সূরা বাকারা
সূরা বাকারা - ২
২৮৬ আয়াত, ৪০ রুকু, মাদানী[দয়াময়,পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে]
ভূমিকা : প্রারম্ভিক সূরা ফাতেহায় ৭টি আয়াতকে কোরআন শরীফের সার সংক্ষেপ বলা যায়, ঠিক সে রকম এই সূরায় ২৮৬টি আয়াতে সমগ্র কোরআন শরীফের শিক্ষাকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
সার সংক্ষেপ : এই সূরায় -
১-২৯ আয়াতে গূঢ় অর্থসম্পন্ন উপদেশাবলীর মাধ্যমে তিন রকম লোকের কথা বলা হয়েছে এবং কিভাবে এই তিন শ্রেণীর লোক আল্লাহ্র উপদেশাবলী গ্রহণ করে সে সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্র কাছে হেদায়েত প্রার্থনা করে অবশ্যই আল্লাহ্র বাণী তাদের পথ প্রদর্শন করে। যারা তাঁর বাণী প্রত্যাখ্যান করে তারা চক্ষুষ্মান হয়েও অন্ধ। তাদের আত্মায় সীল-মোহর দেয়া। মুনাফিকদের জন্য করুণা, কারণ তারা নিজেরাও প্রতারিত এবং অন্যকেও প্রতারিত করতে সর্বদা থাকে সচেষ্ট। সুন্দর উপমার সাহায্যে এই কথাটি প্রকাশ করা হয়েছে। বৃষ্টি ফসলের জমিকে ফুল-ফল-ফসলে ভরিয়ে তোলে। আবার সেই বৃষ্টিই আগাছায় ভর্তি জমিতে কাঁটাগাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সেরূপ বিশ্বাসী বা ঈমানদার লোকের জন্য আল্লাহ্র বাণী, তার ঈমানের ভীত আরও মজবুত করে, আবার সেই একই বাণী অবিশ্বাসীদের হৃদয়ের ব্যাধি বৃদ্ধি করে।
আয়াত ৩০-৩৯ এ বলা হয়েছে মানুষের সৃষ্টি সম্বন্ধে, বলা হয়েছে সৃষ্ট জগতে তার উচ্চে অধিষ্ঠান, তার পতন, পৃথিবীতে বিবর্তণের ধারায় তার পথ চলার নির্দেশ সম্বন্ধে।
আয়াত ৪০-৮৬ এ বলা হয়েছে ইসরাইলীদের সম্পর্কে। তাদের কিতাব, তাদের ঐতিহ্য, আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামত এবং কিভাবে তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়েছিলো, উপমা ও সাধারণ কাহিনীর মাধ্যমে তা বর্ণনা করা হয়েছে।
আয়াত ৮৭-১২১ হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) এর সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিভাবে তাঁরা অবাধ্য ও অবিশ্বাসী জনতার সাথে সংগ্রাম করেছিলেন। কিভাবে ঐশী কিতাব প্রাপ্ত লোকেরা তাদের নিজেদের কিতাবের বাণী অস্বীকার করেছিলো। কিভাবে তারা অহংকারের স্ফীত হয়ে হযরত মুহম্মদ (দঃ) কে অস্বীকার করেছিলো; যদিও তারা জানতো যে নবুয়তের ধারাবাহিকতায় তিনিই শেষ নবী।
আয়াত ১২২-১৪১। পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর সম্বন্ধে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম একজন সতিক্যারের পূণ্যবান ইমাম ছিলেন। তিনি আরবে জন্ম গ্রহণকারী হযরত ইসমাঈলের বংশের পূর্বপুরুষ। আবার ইসরাইল সম্প্রদায়েরও পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি। তিনিই হযরত ইসমাঈল সহযোগে কাবা শরীফ নির্মাণ করেন এবং পরিশুদ্ধ করেন। এভাবেই তিনি সকলের জন্য একই ধর্মের অবতারণা করেন। আর তাঁর এই ধর্মের বিশ্বনন্দিত রূপই হচ্ছে ইসলাম।
আয়াত ১৪২-১৬৭। কা'বা শরীফ এখন বিশ্ব মানবের এবাদতের স্থান এবং বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতীক।
আয়াত ১৬৮-২৪২। এভাবেই বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা যার এক নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দু ও প্রতীক আছে - আর তা হচ্ছে কা'বা শরীফ। সারা মুসলিম জাহানের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের প্রবর্তন করা হয়েছে। তাদের সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন সম্পর্কে নিয়ম-নীতি নির্দেশ দান করা হয়েছে। একথা দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কোন ধর্ম নাই, কোনও পূণ্য নাই। পূণ্য আছে এক স্রষ্টায় বিশ্বাসে, জীবে দয়ায়, প্রার্থনায়, দানে এবং দুঃখ দুর্দশায় ধৈর্য্য ধারণের মধ্যে। সামাজিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে যেমন-খাদ্য, পানীয়, উপবাস, বিষয়-সম্পত্তির বন্টন, জিহাদ, মদ, জুয়া, এতিম এবং মেয়েদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কীয় নিয়ম কানুন ইত্যাদি সম্পর্কে নির্দেশ দান করা হয়েছে।
আয়াত ২৪৩-২৫৩। জিহাদকে যেনো ভুল বোঝা না হয়। জিহাদের প্রকৃতরূপকে বোঝানোর জন্য তালুত, গোলিয়াথ ডেভিডের ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে। যুগে-যুগে, কালে-কালে নবী রাসূলদের পৃথিবীকে প্রেরণ করা হয়েছে মিথ্যার বিরুদ্ধে জেহাদ এবং সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য।
আয়াত ২৫৪-২৮৩। এই আয়াতসমূহে বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে সত্যিকারের গুণাবলী বা ধর্মাচারণ মুখের কথা নয়। সত্যিকারের ধর্ম নির্ভর করে-দয়া, মায়া, মহত্ব, স্রষ্টার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও ভালোবাসার মধ্যে।
আয়াত ২৫৫। এই আয়াতটিতে আল্লাহ্র প্রকৃতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে। আয়াতটিকে বলা হয় "আয়তাল কুরশী"। অর্থাৎ তিনি সেই বিশ্ব প্রতিপালক যার আসন ভূলোকে, দ্যুলোকে, সর্বত্র। যার উপস্থিতি বিশ্বব্যাপী।
আয়াত ২৮৪-২৮৬। এই সূরা শেষ করা হয়েছে এক স্রষ্টায় বিশ্বাস (Faith), তাঁর প্রতি আনুগত্য এবং ধর্মের ব্যাপারে ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বের উপরে গুরুত্ব আরোপ করে।
কুরআন শরীফে সূরা বাকারা হচ্ছে সর্ববৃহৎ সূরা। ২৮২ নম্বর আয়াতটি হচ্ছে কুরআন শরীফের সর্ববৃহৎ আয়াত যা এই সূরাতে বিদ্যমান। আয়াত ৬৭-৭১ এ দেয়া উপমা অনুসারে গাভী নাম দেয়া হয়েছে। এই উপমায় দেখানো হয়েছে, যখন বিশ্বাসের ভিত থাকে দুর্বল, তখন আনুগত্য প্রকাশ করা হয় কষ্টসাধ্য। যখন বিশ্বাসের ভিতে চির ধরে মানুষ নানা অজুহাতে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। এমন কি যদিও তারা আক্ষরিক অর্থে, আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে স্রষ্টাকে মান্য করতে চেষ্টা করে কিন্তু তা হয় সম্পূর্ণ বাহ্যিক। যে বিশ্বাস, যে আনুগত্য আত্মার অন্তস্থল থেকে উৎসারিত নয় তা স্রষ্টার কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। এসব লোকেরা নিজেদের ধার্মিক বলে প্রচার করলেও এরা আত্মিক দিক থেকে মৃত। এদের আত্মা মমিতে পরিণত হয়ে যায়। তাদের আত্মম্ভরিতা, স্বার্থপরতা, স্বনির্ভরশীলতা তাদের করে তোলে অহংকারী। ফলে তারা বুঝতে অপারগ যে আত্মিক দিক থেকে তারা মৃত। কারণ স্রষ্টার যে করুণা যা বিশ্বজগতকে বেষ্টন করে আছে, যে অমিয়ধারাতে সারা সৃষ্টি অবগাহন করে ধন্য তারা তা বুঝতে অসমর্থ। স্রষ্টার অস্তিত্ব তারা অনুভব করতে অসমর্থ। জীবন বহমান-গতিশীল, কর্মচঞ্চল। হীন, নীচ, কর্দমাক্ত জীবন থেকে উর্ধ্বলোকে আরোহণের চেষ্টাই হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য। এটাই হচ্ছে এই সূরার মূল ধারা। এ সূরা মদিনায় নাজেল হওয়া সূরাগুলির মধ্যে প্রধান সূরা।
সূরা বাকারা - ২
২৮৬ আয়াত, ৪০ রুকু, মাদানী[দয়াময়,পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে]
২৫। আলিফ্ লাম্ মিম্ -এই তিনটি অক্ষর সূরা বাকারা এবং আরও ৩, ২৯, ৩০, ৩১ এবং ৩২ এই সূরাগুলির (মোট সংখ্যা ৬) প্রারম্ভে স্থাপন করা হয়েছে। সূরা বাকারা এবং সূরা আল-ইমরানে একটা জাতির উত্থান-পতন, ভূত-ভবিষ্যত এবং তাদের সমগ্র ইতিহাস সম্বন্ধে বলা হয়েছে, আবার সেই সাথে নূতন জাগ্রত জাতি মুসলমানদের সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধেও বলা হয়েছে। সূরা ২৯ এ ঠিক একইরকম যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। তবে এখানে জাতি হিসেবে না বলে প্রতিটি আত্মার জীবন-মৃত্যু, জয়-পরাজয়, অতীত-বর্তমান অর্থাৎ এই পৃথিবীতে মানব-আত্মার অস্তিত্বের পূর্ণ ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা ৩০ আমাদের বলে, আল্লাহ্ সকল শক্তির উৎস। সব কিছু তাঁর থেকে উৎপত্তি আবার তাঁর কাছেই সবকিছু ফিরে যাবে। সূরা ৩১ ও ৩২ শে ঐ কথাকেই পুনরায় সঞ্জিবীত করা হয়েছে।
নূতনভাবে, নূতন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ্ই হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা এবং একমাত্র তিনিই শেষ বিচারের মালিক। সূতরাং সে সব সূরা আলিফ্, লাম্, মিম্ এই তিন অক্ষর দ্বারা শুরু হয়েছে তাদের সবার মধ্যেই অন্তর্নিহিত ভাব এক। আর তা হচ্ছে জীবন ও মৃত্যুর রহস্য, সৃষ্টির আরম্ভ ও শেষের রহস্য এবং সব রহস্যের সমাধান এক স্রষ্টার কাছে বিদ্যমান। তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ। এই অক্ষর তিনটি সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে, অনেক আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এর সবটাই অনুমান নির্ভর। প্রকৃত অর্থ জানেন একমাত্র আল্লাহ্। অনেকে মনে করেন এই অক্ষরগুলি প্রতীকধর্মী। সুতরাং এ সম্বন্ধে যুক্তি তর্কের অবকাশ নাই।
২৬। 'আল্লাহ্ ভীরু বা তাকওয়া অবলম্বনকারী'-এ আরবী শব্দটির অর্থ আল্লাহ্ ভীতি। আল্লাহ্ ভীতি অর্থ এই নয় যে অপরাধীরা যেভাবে বিচারককে ভয় পায় সেভাবে শুধুমাত্র শাস্তির ভয়ে ভয় করা। তাকওয়ার মূল ভাব হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসা। আর এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। অর্থাৎ মনের ঐকান্তিক ইচ্ছা আল্লাহ্র আদেশকে মেনে চলার বা যা থেকে আল্লাহ্ বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকা। আল্লাহ্র প্রতি এই ভালবাসাই হচ্ছে সকল কিছুর মূল চালিকাশক্তি। তাকওয়াকে এভাবে প্রকাশ করা যায়। প্রথমতঃ (১) আল্লাহ্কে ভয় করতে হবে ভালবেসে। (২) আল্লাহ্ যা অপছন্দ করেন তা থেকে দূরে থাকতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ্র আইন না ভাঙ্গা, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে না যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আল্লাহ্ বারে বারে বলেছেন-মিথ্যা কথা না বলতে, সত্যি কথা বলতে, অন্যকে না ঠকাতে, ন্যায় ও সত্যের পথে চলতে ইত্যাদি মেনে চলাই হচ্ছে আল্লাহ্র আইন মেনে চলা। আল্লাহ্কে ভালবেসে, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায়, আল্লাহ্র অনুগ্রহের আশায় আমাদের জিহবা (অর্থাৎ কথা বা ভাষা), হাত (অর্থাৎ কাজ, সমাজ ও সংসারের প্রতি),মন ও মেধাকে সংযত করতে হবে। অর্থাৎ নিজেকে কথায়, কাজে, সমস্ত অন্যায় ও অসত্য থেকে শুধুমাত্র আল্লাহ্কে সন্তুষ্টি করার জন্য সংযত রাখতে হবে। (৩) অন্যায়, অসত্য ইত্যাদি থেকে নিজেকে সর্বদা বিরত রাখার ফলে ব্যক্তির চরিত্রে সৎগুণের জন্মলাভ করে, এই গুণাবলীই হচ্ছে ধর্মপরায়ণতার ভিত্তি। এরূপ ব্যক্তি সর্বান্তকরণে অসৎ ও অন্যায় পথ পরিহার করবে এবং নিজের জীবনে ন্যায়, সত্য ও কর্তব্যনিষ্ঠা, ধৈর্য্য প্রভৃতি গুণের প্রতিফলন ঘটাবে। এর জন্য প্রয়োজন সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ-Cause of God is the cause of justice and cause of oppressed। [দেখুন টিকা ৭৪০, আয়াত ৪৭ : ১৭]
২৭। বিশ্বে যা কিছু সুন্দর সবকিছুর মূল চালিকাশক্তি সর্বশক্তিমান এক আল্লাহ্। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে যা কিছু নেয়ামত দান করেছেন তা থেকে সৎকাজে দান করতে বলা হয়েছে। অনেক তফসীরকারগণ মনে করেন অর্থ এবং ধন-সম্পদই একমাত্র দান করার বিষয়বস্তু। কিন্তু আল্লাহ্র নেয়ামতকে শুধুমাত্র অর্থের নিক্তিতে মাপলে ভুল করা হবে। মানুষকে আল্লাহ্ সৃষ্টির সেরা জীব করেছেন সেটা শুধুমাত্র এজন্য নয় যে, সে আর্থিক সাচ্ছন্দ্য সংগ্রহে সক্ষম। মানুষ 'আশরাফুল মাখলুকাত'- সৃষ্টির সেরা জীব, কারণ তার চারিত্রিক গুণাবলী। চারিত্রিক গুণাবলীর কারণেই মানুষ কখনও ফেরেশতার সমতুল্য, আবার এর অভাবে পশুর সমান। এই সব চারিত্রিক গুণাবলী, মেধা, মননশক্তি সবই মহান আল্লাহ্র দান। এ সবই আল্লাহ্র নেয়ামত। আল্লাহ্র নেয়ামতকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি।
প্রথমত : বস্তুগত দান, যথা ধন-সম্পদ, খাদ্য, বাসস্থান, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। অর্থাৎ যা কিছু আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করতে পারি, এ সব কিছুই এই শ্রেণীর নেয়ামতের অন্তর্গত।
দ্বিতীয়ত : স্পর্শাতীত দান অর্থাৎ যে নেয়ামত পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না যথা- উচ্চ মর্যাদা, বংশ মর্যাদা, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপক্তি, সুযোগ-সুবিধা, স্বাস্থ্য, প্রতিভা, মেধা, বিদ্যা, বুদ্ধি ইত্যাদি যা ব্যক্তির চরিত্রের প্রকাশ পায় তা সবই আল্লাহ্র নেয়ামত।
তৃতীয়ত : বিবেক (Spiritual gift),জাগ্রত বিবেক আল্লাহ্র সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। যথা-ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা,ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা, অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা, মানুষকে তার গুণাবলীর দ্বারা বিচার করার ক্ষমতা, ভালোবাসার ক্ষমতা, গুণাবলীর সনাক্ত করার ক্ষমতা,ইত্যাদি ইত্যাদি।
আল্লাহ্ বিভিন্ন ব্যক্তিকে তার এই নেয়ামতের বিভিন্ন অংশ দান করে থাকেন। কেউ হয়তো অর্থ-সম্পদে সম্পদশীল, আবার কেউ উচ্চ পদ মর্যাদার অধিকারী, কেউ মেধা, বুদ্ধিতে কৃতী। আল্লাহ্ বলেছেন যার মধ্যে এই তিন ধরনের যে কোন ধরনের নেয়ামতের প্রকাশ ঘটুক না কেন তা নিয়ে অহংকার করার কিছুই নাই। এ সবই বান্দার জন্য আল্লাহ্র দান। এ দান কখনও একা ভোগ করতে নাই। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধানের জন্য, তার সৃষ্টির সেবার জন্য, মানুষের মঙ্গলার্থে এসব নেয়ামত বা আল্লাহ্র দানকে ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ যার অর্থ আছে তিনি অর্থ দান করবেন জনহিতকর কাজে। যার মেধা আছে তিনি সেই মেধা, যার প্রভাব প্রতিপত্তি আছে তিনি সেই প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি যে নেয়ামতই বান্দার থাকুক না কেন তিনি সেই নেয়ামত আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধানের জন্য মানুষের মঙ্গলের জন্য তার সৃষ্টির সেবার জন্য ব্যয় করবেন। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, সঙ্গীত, শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের যে দক্ষতা বা প্রতিভা যাই-ই থাকুক না কেন তা আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে আল্লাহ্র এবাদত করা। ঠিক সেইভাবে যে ব্যক্তি আত্মিক নেয়ামতে ধন্য বা বিবেকবান, তার উচিত তার সেই জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি সমাজের বিবেককে জাগ্রত করার কাজে নিবেদন করা। জনসাধারণের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য, তারা যাতে ন্যায়কে-অন্যায় থেকে পার্থক্য করতে পারে, ভালকে মন্দ থেকে আলাদা করতে পারে, বিশ্ব মানবতার জন্য তাদের সেই জ্ঞানকে ব্যবহার বা বিতরণ করতে হবে। এর জন্য আমাদের কঠোর তপস্বী হওয়ার প্রয়োজন নাই অথবা অত্যন্ত কৃপণ বা অপচয়ী হওয়ারও প্রয়োজন নাই। এই হচ্ছে দানের সংজ্ঞা।
২৮। ঈমান বা আল্লাহ্তে বিশ্বাস শুধুমাত্র একটি মৌখিক স্বীকারোক্তি মাত্র নয়। এটি এমন এক বিশ্বাস যা উৎসারিত হয় গভীর বোধ, অবিচল আস্থা, সেই আস্থা ও বিশ্বাসে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা থেকে-যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র আদেশ-নির্দেশের প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনের বাস্তব চর্চা এবং নিঃস্বার্থ মানবসেবার মাধ্যমে।
২৯। 'সফলকাম' হবে বা 'উন্নতি' লাভ করবে অর্থাৎ আল্লাহ্র নেয়ামতের অধিকারী হবে। এগুলি সেইসব দুর্লভ চারিত্রিক গুণাবলী যার উল্লেখ পূর্বে করা হয়েছে। অর্থাৎ বান্দা যদি আল্লাহ্র হুকুম বা আল্লাহ্র আইন মেনে চলে (যথা-সত্য কথা বলে, ন্যায়ের জন্য জিহাদ করে, মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে ইত্যাদি) তবে তার চরিত্রে দুর্লভ গুণাবলীর জন্ম নেবে। বোঝানোর জন্য একটি ছোট উদাহরণ দেয়া গেলো। সত্য কথা বলার অভ্যাস করা আল্লাহ্র হুকুম। আমাদের রাসূল (সাঃ) জীবনে কোনওদিন এমনকি নবুয়তের পূর্বেও একটিও মিথ্যা কথা বলেন নাই। এটাই হচ্ছে আমাদের সর্বপ্রথম এবং প্রধান সুন্নত এবং ফরজ। সত্যবাদীতা এক ধরণের অভ্যাস। এর থেকে যে চারিত্রিক গুণাবলীর জন্ম নেয় তা হচ্ছে সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি। আবার মিথ্যা বলাও একধরণের অভ্যাস। এর থেকে চরিত্রে যে সব দোষের সৃষ্টি হয়-তা হচ্ছে দূর্নীতিপরায়ণতা, অবিশ্বস্ততা, স্বার্থপরতা, অন্যকে ঠকানোর প্রবণতা ইত্যাদি। আত্মার উন্নতি লাভই হচ্ছে আধ্যাত্মিক সফলতার মূল কথা। সুতরাং যারা আল্লাহ্র কেতাবে বিশ্বাসী এবং সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করেন আল্লাহ্ তাদের আত্মিক উন্নতি দান করেন। এর ফলে যে সমাজ আল্লাহ্র আইন মেনে চলে সে সমাজ শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। কারণ একটি পাপ অপর একটি পাপকে আকর্ষণ করে, অনুরূপভাবে একটি নেকীর (অর্থাৎ চারিত্রিক গুণাবলীর) বদলায় অপর নেকী বা (চারিত্রিক গুণাবলী) সৃষ্ট হয়।
'নেকী" একটি বিমূর্ত অর্থজ্ঞাপক শব্দ। কিন্তু আমাদের সমাজে নেকী শব্দটিকে বস্তুগতভাবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন-কোন কোন মৌলভী সাহেবেরা বলে থাকেন-অমুক কাজটি করলে আল্লাহ্ ৭০টি নেকী দান করবেন। নেকীকে এরকম বস্তুগতভাবে উপস্থাপন করা যায় না। নেকী হচ্ছে আল্লাহ্র সেই বিশেষ নেয়ামত যা আত্মাকে সমৃদ্ধ করে, ফলে আত্মা দুঃখ-কষ্ট ভরা পৃথিবীতে থেকেও দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পায়; আত্মা অপার শান্তির পরশ অনুভব করে। সেই হিসেবে নেকী হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলী কারণ একমাত্র শুদ্ধ চারিত্রিক গুণাবলীই মানব সন্তানকে লোভ-লালসা ভরা পৃথিবীর উর্ধ্বে স্থাপন করতে পারে। আর ব্যক্তি যখন লোভ-লালসা ভরা পৃথিবীতে থেকেও তার উর্ধ্বে অবস্থান করতে পারে, শুধু তখনই সে বেহেশতি শান্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে। লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ, ঈর্ষা-নীচতা আত্মার ভিতরে যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। এই আয়াতে যে তিন শ্রেণীর লোকের কথা বলা হয়েছে, এরা হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর।
৩১। সমস্ত সত্য ও সুন্দরের উৎস আল্লাহ্। যদি আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে অস্বীকার করি, অন্যায় করি, মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করি, আল্লাহ্র আইন অমান্য করি, তবে আল্লাহ্ আমাদের হৃদয়কে যে পবিত্রভাবে সৃষ্টি করেছেন-অন্তরের সেই পবিত্রতা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমরা আল্লাহ্র অসীম রহমত থেকে বঞ্চিত হতে থাকবো। এর ফলে আমাদের অন্তরে সত্যিকারের ধর্মবোধ জন্মাবে না। আমাদের বিবেক ধীরে ধীরে অন্ধকার নিমজ্জিত হবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের বিবেক (Spiritual Faculty) হয়ে যাবে মৃত। এর ফলে আমাদের অন্তরে সত্যকে ধারণ করার ক্ষমতা লোপ পাবে। সত্যকে অসত্য থেকে, ন্যায়কে অন্যায় থেকে পার্থক্য করার ক্ষমতা রহিত হবে। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় হবে সত্য বিমুখ, সত্যের আলো এবং ভালোর আলো সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। এটাই হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তি। চক্ষুষ্মান ব্যক্তি হয়েও অন্তর্দৃষ্টি বিহীন হবে। শ্রবণশক্তি থাকা সত্ত্বেও সত্য ও ন্যায়ের আহবান তার শ্রবণে পৌঁছাবে না। একেই বলা হয়েছে চক্ষু ও কর্ণে সীল মোহর দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া। [দেখুন টিকা ৬৩১]
৩২। পৃথিবীতে আদম সন্তানের অবস্থান হচ্ছে স্বল্পকালীন। এই স্বল্পকালীন সময় হচ্ছে নিজেকে পরকালের জন্য প্রস্তুত করার শিক্ষানবীশকাল (Probationary Period) আত্মার উন্নতি লাভ করাই হচ্ছে এই পৃথিবীতে অবস্থানের একমাত্র লক্ষ্য। আত্মার উন্নতিকে এখানে সমৃদ্ধি এবং আত্মার অধঃপতনকে এখানে শাস্তিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পাপের পথ পিচ্ছিল ও নিম্নগামী। এই পিচ্ছিল পথে যাত্রা শুরু করলে গতি হয় ক্রমাগত দ্রুত ও ত্বরাণ্বিত। শেষ পর্যন্ত এ পথ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভবপর হয় না। কারণ একটি পাপ বহু পাপের জন্ম দেয়, যেমন-একটি পূণ্য আরও পূণ্যকে আকর্ষণ করে।
রুকু - ২
৩৩। এবারে আল্লাহ্ তৃতীয় শ্রেণীর লোকদের সম্বন্ধে বলেছেন। এরা হচ্ছে মিথ্যুক অর্থাৎ মুনাফিক। এরা নিজেদের কাছে নিজেরা বিশ্বস্ত নয়। এরা মুখে বলে এক কথা কিন্তু এদের অন্তর বলে অন্য কথা। ফলে এদের অন্তরে জন্ম নেয় দুরারোগ্য ব্যাধি (২ : ১০)। সংসারে ভালো অপেক্ষা মন্দের প্রভাব বা বিস্তার ঘটে অত্যন্ত দ্রুত। মুনাফিকদের অন্তরের ব্যাধি সেইরূপ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অবিশ্বস্ততা, স্বার্থপরতা, হিংসা-দ্বেষ প্রভৃতি বিভিন্ন রিপু মুনাফিকের অন্তর ছেয়ে ফেলে। এই সকলই মুনাফিকের অন্তরের ব্যাধি। যদি সময়মত সাবধানতা অবলম্বন করা যায় অন্তরের এই অবস্থা (State of mind) থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘদিন যারা মিথ্যার আশ্রয়ে আত্মাকে কলুষিত করে তাদের আত্মার উপরে কঠিন আবরণ পড়ে। অন্তর হয়ে যায় পাথরের ন্যায় শক্ত। সে শক্ত পর্দা ভেদ করে সত্যের আলো তাদের অন্তরে পৌঁছাতে পারে না।
১০। তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি; এবং আল্লাহ্ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন ৩৪; তারা [ভোগ করবে] নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী।
৩৪। মিথ্যুক বা মুনাফিকেরা সব সময়েই হয় অবিশ্বস্ত (Insincere) এবং নীতিজ্ঞানশূন্য। একজন নীতি জ্ঞানশূন্য লোক হয় লোভী এবং সুবিধাবাদী। সুবিধাবাদীরা সর্বদা মন্দের সাথে ভালোর এবং সত্য ও ন্যায়ের সাথে অন্যায়, অসত্য ও দুর্নীতির সমঝোতা করতে ব্যস্ত থাকে। কপটতাই তাদের ব্যাধি। কারণ এই সমঝোতার ফলে সে তার অবস্থানকে সুবিধাজনক স্থানে নিতে সক্ষম হয়। নিজের অবস্থান ভালো করাই মুনাফিকের একমাত্র উদ্দেশ্য। সুবিধা ভোগ করাই তাদের একমাত্র ধ্যান ধারণা। কোনও ন্যায়-নীতি তাদের চিন্তায় স্থান পায় না। কিন্তু সংসারে কখনও ভাল ও মন্দের, ন্যায় ও অন্যায়ের, সত্য ও মিথ্যার সন্ধি হতে পারে না। যারা তা করতে চায় তার অন্তরে ব্যাধিগ্রস্থ। কারণ তারা তাদের নিজেদের অন্তরের কাছে বিশ্বস্ত নয়। এর ফলে তাদের অন্তর কোন ভাল গ্রহণ করতে পারে না। যদি কোন ভালও তাদের কাছে আসে, তবে তারা তা মন্দে রূপান্তরিত করে ফেলে। এরকম উদাহরণ আমরা অহরহ আমাদের চারপাশে দেখি। এখানে আল্লাহ্ উদাহরণ দিচ্ছেন যে, বৃষ্টি আল্লাহ্র নেয়ামত স্বরূপ। যে বৃষ্টিধারা ধরনীকে ফুল-ফল ও ফসলে ভরিয়ে দেয়। ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য্যে ধরণীকে করে আমোদিত। সেই বৃষ্টির ফলে আগাছার বৃদ্ধিতে সহায়তা হয়। কাঁটাগাছের কাঁটার বৃদ্ধি ত্বরাণ্বিত হয়। শুধু যে ত্বরাণ্বিত হয় তাই-ই নয় কাঁটাকে করে শক্তিশালী। সেইরূপ মুনাফেকের অন্তরের সংস্পর্শে 'ভালো' মন্দরূপ ধারণ করে। মুনাফেকের ব্যাধি তার অন্তরে। ঐ কাঁটা গাছের মত, আল্লাহ্র রহমত এদের জন্য সুফল বয়ে না এনে অন্তরের ব্যাধির ব্যাপ্তি ঘটায়।
১২। নিশ্চয়ই এরাই তারা যারা অশান্তি সৃষ্টি করে, কিন্তু তারা [তা] বুঝতে পারে না ৩৫।
৩৫। যেহেতু মুনাফেকের ব্যাধি তার অন্তরে, তাদের ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা হবে তিরোহিত, ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার অন্তর্দৃষ্টির হবে অভাব। ফলে এ রকম লোক যখন দেশের শাসন ব্যবস্থায় আসে অথবা কোনও দায়িত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করে এমন কি সমাজ-জীবনের যে কোন ক্ষু্দ্রতম কাজেও তারা অংশগ্রহণ করে; তখন সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা হয় বিঘ্নিত। তারা সমাজ-জীবনকে কলুষিত করে, অশান্তির সৃষ্টি করে। কারণ, আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি ব্যতীত সমাজ ও সংসারে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব নয়। আর আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মুনাফিকের অন্তরে অনুপস্থিত। কিন্তু মুনাফিকেরা মনে করে তারা শান্তির জন্যই কাজ করছে-কারণ তাদের দূরদৃষ্টির অভাবে প্রকৃত শান্তি ও শৃঙ্খলার রূপ অনুধাবন করতে তারা হয় অপারগ।
৩৬। মুনাফেকের চরিত্রের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা নিন্দুক হয়ে থাকে। এদের চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আত্মম্ভরিতা ও অহংকার। নিজেকে সর্বদা সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তা করা। যারা বিশ্বাসী ও ধার্মিক, তারা অবশ্যই আল্লাহ্র আইন মেনে চলবে । তারা হবে সত্য ও ন্যায়ের পূজারী। এটা মুনাফেকের চোখে বোকামীর সামিল কিন্তু তারা জানে না যে আল্লাহ্র চোখে মুনাফেকেরা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও বোকা।
৩৭। মুনাফেকী যখন অন্তরের অন্তঃস্থলে গভীরভাবে তার শিকড় বিস্তার করে, তখন তারা হয়ে উঠে অত্যন্ত কপট ও ভণ্ড। মুখে মধু ঢেলে তারা ধার্মিক লোকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে যেনো তাদের প্রকৃতরূপ বিশ্ববাসীরা অনুধাবন করতে না পারে। কিন্তু যখন তারা স্বগোত্রে প্রত্যাবর্তন করে তখন নিজমূর্তি ধারণ করে। কিন্তু কপটতা, ভণ্ডামীর পরিণতি কখনও ভালো হয় না। একে আল্লাহ্ তুলনা করেছেন সেই লোকের সাথে যে তার বাণিজ্যে মুনাফা লাভের পরিবর্তে লোকসান দিয়েছে। কারণ এই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান খুবই ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে আমরা এসেছি বেহেশ্ত লাভের বাণিজ্যে। আত্মা তার মূলধন। এই মূলধনকে যে উন্নত করতে পারবে তারই আছে মুনাফা। অন্যথায় যে আত্মাকে লোভ-লালসা, অন্যায়, অসত্যের কাছে বিক্রি করে সে ঐ ব্যক্তির মত যে বাণিজ্যে লোকসান দেয়।
১৬। এরাই তারা যারা হেদায়েতের বিনিময়ে ভ্রান্তি কিনে নিয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা বাণিজ্য লাভজনক নয়, এবং তারা সত্য পথের নির্দেশ হারিয়ে ফেলেছে।
১৭। তাদের উপমা সেই ব্যক্তির ন্যায় ৩৮, যে আগুন জ্বালালো। যখন তা তার চতুর্দিক আলোকিত করলো, আল্লাহ্ তাদের আলো সরিয়ে নিলেন এবং তাদের ঘোর অন্ধকারে পরিত্যাগ করলেন, যেনো তারা দেখতে না পায়।
১৮। তারা বধির, মূক এবং অন্ধ, তারা [সঠিক পথে] ফিরবে না।
৩৮। মুনাফিকের আত্মা ভণ্ডামী, জুয়াচুরি, অসত্য, অন্যায়ে পরিপূর্ণ। এগুলির সাহায্যে সে খুব সহজেই কোনও কাজে জয়লাভ করে এবং প্রশংসার পাত্রে পরিণত হয়, সেই লোকটির মত যে ক্ষণস্থায়ী আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়ে চারিদিকের গাঢ় অন্ধকার দূর করতে সক্ষম হয়েছিলো এবং সকলের প্রশংসার পাত্রে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু তার জ্বালানো আগুন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এক সময় তা নিভে যায়। ফলে চারিদিক আবার গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। হঠাৎ আলোর ঝলকানির পরে এ গাঢ়তা পূর্বের গাঢ়তার থেকে আরও বেশি প্রতীয়মান হয়। এই উপমার সাহায্যে আল্লাহ বোঝাতে চাচ্ছেন যে, যেসব কাজের ভিত্তি অন্যায়, অসত্য, অবিশ্বাস, ভণ্ডামীর উপর প্রতিষ্ঠিত, তার ফল কখনও স্থায়ী হয় না। ঐ কাজের সাফল্য অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, আগুণের ক্ষণস্থায়ী আলোর মত। যে আলো অন্ধকারকে চিরতরে দূর করতে অপারগ। মুনাফিকেরা ভণ্ডামীর সাহায্যে জয়ী হতে চায়। ফলে তার কাজের নিয়তে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস, সত্যের প্রতি বিশ্বস্ততা, প্রতিপালকের রহমতের আশা সবই থাকে অনুপস্থিত। মুনাফিকের কাজের নিয়ত কখনই মহৎ হয় না। কখনই ভালো হয় না। ফলে সময়ের বৃহত্তর পরিসরে মুনাফিকের কাজের নিয়ত বা অন্তরের উদ্দেশ্য সকলের নিকট পরিস্ফুটিত হয়ে যায়। সত্য প্রকাশিত হয়। ফলে কাজের সব পরিণতি হয় বিফল। সত্যের উদ্ভাসিত আলোতে মুনাফিকের অন্তর ভয়ে ত্রাসে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। অন্তরের ভয় ত্রাস, মুনাফিকদের সুস্থ চিন্তাধারাকে বাধাগ্রস্থ করে, ফলে তারা সত্যকে জানতে, সত্যকে অনুধাবন করতে, শুনতে বা দেখতে অক্ষম হয়। মুনাফিকের আত্মার চারিদিক প্রাচীর বেষ্টিত হয়ে যায়। প্রাচীর বেষ্টিত স্থান যেমন সূর্যের ঝলমলে আলোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ঠিক সেইরূপ মুনাফিকের অন্তরের মিথ্যার আবরণ সত্যের আলোর প্রবেশে বাঁধা সৃষ্টি করে। তাদের আত্মা সত্যের আলো বা আল্লাহ্র হেদায়েতের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, কিন্তু মিথ্যার আবরণ তাদের আত্মায় সত্যের আলো প্রবেশে বাঁধা দেয়। ফলে তারা অন্ধকারে অন্ধের মত পথ হাতড়ে বেড়ায়। তাদের আত্মা চায় মুক্তির আলো, মুক্তির বাতাস। কিন্তু তারা তা পায় না। তারা মিথ্যার অন্ধকারে অন্ধ ও বধির। সত্যকে খুঁজে নেবার ক্ষমতাও তাদের নাই। সুতরাং তারা আর ফিরবে না। অর্থাৎ তাদের অনুভূতিতে সত্য ও ন্যায় বোঝার মত যোগ্যতা রইল না। কারণ তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঈমানকে প্রতিহত করছে।
২০। বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টি শক্তিকে প্রায় কেড়ে নেয়। প্রতিবার [বিদ্যুতের] আলো যখন তাদের [সাহায্য] করে, তারা [তার সাহায্যে] পথ চলতে থাকে। এবং যখন তাদের উপর অন্ধকার নেমে আসে, তারা থমকে দাঁড়ায়। আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করতেন তবে, তাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে পারতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ের উপরে সর্বশক্তিমান।
৩৯। মুনাফিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা অত্যন্ত সুবিধাবাদী। এদের একদল ইসলামের বিজয় দেখে তার প্রতি ধাবিত হয় আবার যখনই স্বার্থে আঘাত লাগে তখনই মত পরিবর্তন করে। এই আয়াতে উপমার সাহায্যে তাদেরই বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সাধারণতঃ এরা তাদের অবস্থার প্রেক্ষিতে সুসময়ে আত্মতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট কিন্তু যখনই কোনও বিপদ আপতিত হয় তখন তাদের যে অবস্থা হয় সেই অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে। বিদ্যুতের আলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়। বজ্র তাদের কানে তালা লাগিয়ে দেয়, শ্রবণশক্তি হরণ করে। মৃত্যুভয় তাদের শঙ্কিত করে তোলে। তারা আল্লাহ্র উপর নির্ভরশীলতা হারিয়ে ফেলে। অথচ আল্লাহ্ সবার উপরে শক্তিমান, কাফেররাও তারই ক্ষমতার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ্ তাদের সময় দেন। ফলে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ ও কানে তালা লাগানো বজ্রের গর্জনের ফাঁকে যখন একটু আলোকিত হয়, তখন তারা পথ চলার চেষ্টা করে। আবার যখন অন্ধকার বিরাজ করে তখন দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ উপমার সাহায্যে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, মুনাফিকদের অন্ধকারাচ্ছন্ন আত্মায় মাঝে মাঝে সত্যের আলোর, হেদায়েতের আলোর চমক খেলে যায়। অর্থাৎ মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে ন্যায় ও সত্য ও বিবেক জাগ্রত হয়-তবে তা হয় অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। সে সময়ে তারা পথ চলতে চেষ্টা করে কিন্তু আবার তারা মিথ্যার অন্ধকারে ডুবে যায়, সম্ভবতঃ ক্ষণস্থায়ী পথ চলার শক্তিতে তারা উজ্জীবিত হয়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তাতে অহংকারে স্ফীত হয়। কিন্তু তা না করে তারা যদি বিনয়ের সাথে আল্লাহ্র অনুগ্রহ কামনা করতো আল্লাহ্র আশ্রয় কামনা করতো তবে অবশ্যই তারা আল্লাহ্র নিরাপদ আশ্রয়ে তাঁর রহমতে ধন্য হত।
রুকু - ৩
৪০। 'তাকওয়া' এর জন্য দেখুন [২:২ টিকা ২৬]। এবাদত কথাটির অর্থ অনেক ব্যাপক। শুধুমাত্র যান্ত্রিকভাবে নামাজ পড়া, রোযা রাখা, যাকাত দেয়া এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যে এবাদতের সাথে আত্মার যোগাযোগ নাই তা এবাদতই নয়। এবাদতের পূর্বশর্ত হচ্ছে আল্লাহ্র সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মনের ঐকান্তিক ইচ্ছা। বিনয়ের সাথে, ভক্তির সাথে, স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত প্রতিটি কাজই হচ্ছে এবাদত। সে কাজ যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, যদি তা নিবেদিত হয় আল্লাহ্র জন্য, আল্লাহ্কে খুশী করার জন্য, তবেই তাই-ই হচ্ছে আসল এবাদত। যখন বান্দার মনের অবস্থা এই পর্যায়ে উন্নীত হয় যে তার সমস্ত ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সবই স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত তখনই বান্দার চরিত্রে মুত্তাকী (Righteousness) হওয়ার মত গুণাবলীর সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসাতে, বিনয়ে নিবেদিত আত্মাই হচ্ছে মুত্তাকী। আল্লাহ্ আমাদের তাঁর কাছে আত্মসমর্পনের এই সুযোগ দিয়েছেন। বান্দাকে 'সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি' (Limited Free Will) এর মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষা করেন। বান্দা যেনো স্ব-ইচ্ছায়, মহান সত্তার কাছে আত্মনিবেদন করে। যদি আমরা তা করতে পারি তবে আমাদের ভিতরে যে পরিবর্তন আসবে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। আমাদের সর্বসত্ত্বা আল্লাহ্র রহমতে বিধৌত হয়ে তা সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়ে উঠবে। আমরা হব এক সুস্থ শৃঙ্খলায় পরিবর্তিত মানুষ।
৪১। এই আয়াতে আল্লাহ্র মাহাত্ম্য, তাঁর অপরিসীম করুণার কথা বলা হয়েছে। আমাদের এই দেহ-মন, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবন সবই স্রষ্টার দান, তারই উপরে সবই নির্ভরশীল। এই আয়াতে আকাশ ও জমিকে প্রতীক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে জমিকে বিছানা অর্থাৎ পার্থিব আরাম-আয়েশ এবং আকাশকে ছাদ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জীবনের নিরাপত্তা বোঝানো হয়েছে। আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহ্র রহমতের প্রতীক। কারণ বৃষ্টির অভাবে শস্য-শ্যামল ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়। আবার বৃক্ষলতা বিহীন ভূমি বৃষ্টির পানিতে সজীবতা ধারণ করে। তাই বৃষ্টিকে এখানে প্রতীকধর্মী শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীতে যে বৃষ্টি হয় তা পৃথিবীর সজীবতার জন্য প্রয়োজন। সেই রকম আল্লাহ্র রহমতের বৃষ্টি আধ্যাত্মিক জগতের বিকাশ ও অন্তর্দৃষ্টি (Spiritual Insight) লাভের জন্য প্রয়োজন। ইহজগত ও পরজগতের সব কিছুই আল্লাহ্র উপরই নির্ভরশীল। এই সত্য জানার পর কেউ যদি অন্য কিছুকে আল্লাহ্র সমকক্ষ মনে করে তা হবে মহাপাপ। এই সমকক্ষ মনে করার প্রবণতা আমাদের জীবনে অত্যন্ত প্রবল। এই সমকক্ষ মনে করাকেই বলা হচ্ছে আল্লাহ্র সাথে অংশীদার করা। এটা শুধুমাত্র মূর্তি পূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করলে তা হবে ভুল। শুধুমাত্র মূর্তি পূজায় আল্লাহ্র সাথে অংশীদার করা হয় এ ধারণার বশবর্তী আমাদের অনেকেই। কিন্তু মূর্তি পূজা ছাড়াও বহু ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের স্রষ্টার সমকক্ষ মনে করতে ভালবাসি। হতে পারে আত্ম-অহংকার, আত্ম-গর্ব, সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি। একটি ছোট উদাহরণ দ্বারা এটাকে উপস্থাপন করা যায় যেমন, রত্ন পাথর ধারণ করা। বিপদ-আপদ, দুঃখ-দুর্দশা এসবের জন্য সর্বশক্তিমানের আশ্রয় প্রার্থনা না করে রত্ন পাথরের আশ্রয় গ্রহণ করা হচ্ছে সর্বশক্তিমানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করা। বিশেষ দিনে যাত্রা করা। শুভ-অশুভ দিন ধার্য করা ইত্যাদি। এর থেকে প্রমাণ হয় আমরা সর্বশক্তিমানের উপর নির্ভরশীল নই। আবার আত্মগর্ব, আত্ম-অহংকার নিজের উপর প্রচণ্ড বিশ্বাসে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা না থাকা ইত্যাদি এসবই আল্লাহ্র সাথে অংশীদারিত্ব কল্পনা করা। আজকে আমরা বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে চমৎকৃত, মুগ্ধ। মানুষ 'জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং' এর সাফল্যে স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত। গ্রহ-গ্রহান্তরে তার যাত্রা। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। এসবের ফলে অনেকের মধ্যে এমন অহংবোধের জন্ম হয়েছে যে তারা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি আনুগত্য ফেলছে হারিয়ে। তারা বিজ্ঞানের জ্ঞানকে স্রষ্টার আসনে বসায়। অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক নিজের সাফল্যে বিমোহিত হয়ে একমাত্র নিজেকেই এই সাফল্যের নিয়ামক মনে করে। তার মেধা বা প্রতিভা যে স্রষ্টার দান, তার সাফল্যের পেছনের এই ছোট্ট অথচ মৌলিক শর্তটি সে ভুলে যায়। প্রতিভা, মেধা, ক্ষমতা, অর্থ-বিত্ত এসব মানুষকে আত্মঅহংকারী করে তোলে। আল্লাহ্র সাথে এও এক ধরণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ও এক ধরনের শেরেকী করা।
৪২। কুরআনের আয়াত যে আল্লাহ্র বাণী, তার প্রমাণ কি? আল্লাহ্ এখানে উপযুক্ত প্রমাণের উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ আমাদের নবীর মাধ্যমে অনেক সূরা নাজিল করেছেন। আল্লাহ্ এখানে বলেছেন, 'তোমরা কি অনুরূপ একটা সূরাও রচনা করতে পারবে?' আল্লাহ্র বাণীর মানুষের সুপ্ত আধ্যাত্মিক শক্তিকে জাগরিত করার যে ক্ষমতা সে ক্ষমতা মানুষের তৈরি বাণীতে নাই। থাকা সম্ভবও নয়। মানুষ নিজের কূপমণ্ডুকতা, হঠকারীতা, বিবেকহীনতা, অজ্ঞনতার ফলে এসব কথা বলে যে, আল্লাহ্র বাণী মানুষের সৃষ্টি। কুরআন এক ঐশী গ্রন্থ। কুরআন যে আলোর ভূবন ও আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান দেয়, তার স্থায়িত্ব, অস্তিত্ব ও প্রভাব, যুগ, কাল অতিক্রান্ত।
৪৩। কুরআনের বাণীর সৌন্দর্য্য, ভাষা, গাম্ভীর্য, নিগূঢ় অর্থ, সর্বোপরি আধ্যাত্মিক জগত ও মনোজগতের উপরে এর যা প্রভাব, তার সমকক্ষ কিছু রচনা করা কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। তবুও কেউ যদি একগুয়ে অবাধ্যভাবে সত্যকে অস্বীকার করে, আল্লাহ্র বাণীকে ঐশী বাণী হিসেবে গ্রহণে অস্বীকার করে, তবে অবশ্যই অস্বীকারকারীর অন্তরে যন্ত্রণার উদ্ভব হয়। সেই যন্ত্রণার আগুনে তার আজীবন লালিত মিথ্যা উপাস্যগুলিই [এটা হতে পারে আত্মগর্ব, আত্মপ্রচার, আত্ম-প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা ও অর্থের প্রতিপত্তি, বিজ্ঞান ইত্যাদি] শুধু শেষ হয়ে যায় না, তার অন্তরের অন্তঃস্থলে সেই আগুন তার লেলিহান শিখা বিস্তার লাভ করে। এরপরেও কি তাদের জ্ঞান ফিরবে না? আত্মার এই যন্ত্রণা তার সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত সত্তাকে অন্তরের অন্তঃস্থলকে তীব্রভাবে দহন করে। এ যন্ত্রণা শারীরিক নয়। এক ভয়াবহ শূন্যতা, ভয়ানক যন্ত্রণা তার আত্মাকে দহন করবে। সংসারের কোন সুখ, অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি কিছুই তাকে সেই জ্বালা ভুলাতে সাহায্য করবে না। অনেকে হয়তো বা মনে করতে পারে যে সে সব যন্ত্রণার উর্ধ্বে, নির্বিকার। কিন্তু আত্মার এ আগুন সেই লৌহ কঠিন আত্মাকেও দহন করবে। এ কথাটাকে কুরআন শরীফে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে দোযখের জ্বালানী হবে পাপিষ্ঠ আত্মা। পাথরের ন্যায় শক্ত আত্মার জন্য দেখুন। [২:২৪, ৭৪, ২৬৪ আয়াত]
৪৪। এই আয়াতটি উপরের আয়াতের বিপরীত ভাব প্রকাশ করে। দোযখের শাস্তির প্রতীক হচ্ছে আগুন, বেহেশ্তের শান্তির প্রতীক হচ্ছে বাগান। এখানে প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে কারণ বেহেশ্তের শান্তি ও দোযখের শাস্তি এই পৃথিবীতে বসে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। যখন কল্পনা বাস্তবকে অতিক্রম করে যায় তখন তা প্রকাশের ভাষা হয় একমাত্র প্রতীক। ছবির মত প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ, অবস্থান, উপভোগ সবই অত্যন্ত আরামদায়ক, শান্তিদায়ক। সেই কারণে বেহেশ্তের বর্ণনায় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর ও সৌন্দর্য্যরে অবতারণা করা হয়েছে। এটা এমন একটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আঁধার যা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। স্বচ্ছ সলিল ধারণ করে স্রোতস্বিনী ছোট নদী বয়ে যাচ্ছে একপাশ দিয়ে। তার পানি স্ফটিকের মত স্বচ্ছ যা সূর্য ও চন্দ্রালোককে প্রতিফলিত করে। সাজানো ফুল ও ফলের বাগান। বনতল ফুলে ফুলে ছাওয়া। ফলভারে গাছ অবনত। আর এসব ফল হবে প্রত্যেকের পছন্দের প্রতীক। এখানে ফল কথাটি প্রতীকধর্মী। পার্থিব জীবনে এই পৃথিবীতে আমরা যেসব ফল খাই, তার স্বাদ আমাদের করে তৃপ্ত। বিভিন্ন ফলের বিভিন্ন স্বাদ, বিভিন্ন গন্ধ। বেহেশ্তী ফলকে এখানে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আত্মত্যাগ ও ভাল কাজের পরে আমাদের আত্মায় এক স্বর্গীয় অনুভূতি বিরাজ করে। যে কাজ যত বেশি নিঃস্বার্থ ও আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত, তার অনুভূতি তত তীব্র শান্তিদায়ক। পৃথিবীর গাছের ফলের যেরূপ স্বাদের, গন্ধের ও রূপের তারতম্য আছে, আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত নিঃস্বার্থ মহৎ কাজের পরে আত্মার ভিতরের অনুভূতিরও সেরূপ তারতম্য ঘটে। এই তারতম্য ঘটে কাজের তারতম্য অনুযায়ী। ভাল কাজের পর আমরা আমাদের আত্মায় যে সুখ ও শান্তির অনুভূতি লাভ করি একেই বেহেশ্তি 'ফলের' প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তার ফলে বেহেশ্তে যে 'ফল' আমরা ভোগ করবো তার রূপ, রস, গন্ধ, অনুভূতি সবই হবে পৃথিবীতে [নিঃস্বার্থ, আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত ভাল কাজের ফল] ভোগ করা সুখ-শান্তির অনুভূতি ফলেরই অনুরূপ। মনে হবে এ ফল তো আমরা আগেও ভোগ করেছি। অর্থাৎ ভাল কাজের পর যে স্বর্গীয় অনুভূতি সেই অনুভূতিরই অনুভব। তবে তার তীব্রতা হবে আরও গভীর, আরও সুন্দর। আত্মার অন্তঃস্থল তার পরশে হবে পুলকিত, শিহরিত, শান্ত। আত্মায় লাভ করবে অপার শান্তি। এর কারণ পূর্বেই পৃথিবীতে আমাদের সেই অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে।
মৃত্যুর সাথে সাথে আমাদের এই মরদেহের বিনাশ ঘটে, কিন্তু এই দেহের মাধ্যমে পৃথিবীতে আমরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করি, মৃত্যুর পরেও আত্মা সেই অভিজ্ঞতা বহন করে পরকালের যাত্রা শুরু করে। অর্থাৎ ভাল কাজের শেষে যে স্বর্গীয় অনুভূতি বা শান্তি আর মন্দ কাজের শেষে আত্মার যন্ত্রণা বা অস্থিরতা এই অভিজ্ঞতা মৃত্যুর পরেও আমরা বহন করে নিয়ে যাব পরলোকে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতা পরকালে বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এই অভিজ্ঞতাকেই 'ফলের' প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়েছে।
বেহেশ্তের বর্ণনায় এর পরে এসেছে সঙ্গীর কথা। অনেকেই এই কথাটাকে স্থুলভাবে যৌনসঙ্গী রূপে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখানে 'মুতাহ্হারাতুন' শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে সেই সব সঙ্গী যারা পূত ও পবিত্র। এই শব্দটির দ্বারা যে পবিত্রতা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে তা হবে সর্বোচ্চ। অনেকে এভাবে তফসীর করেছেন যে তারা হবে পবিত্র কারণ তারা মল-মূত্র ত্যাগ করবে না বা তাদের মাসিক হবে না। অর্থাৎ মাসিক কথাটির দ্বারা তারা বুঝাতে চাচ্ছেন সে সঙ্গীরা সবাই স্ত্রী ধর্মী। কিন্তু সঙ্গী অর্থ শুধু মেয়ে নয়। এখানে সঙ্গী কথাটি দ্বারা 'আত্মার সঙ্গী' এ কথাটাকেই বোঝানো হয়েছে। নশ্বর দেহ-মিলনে যে সঙ্গ-সুখ তা ক্ষণস্থায়ী, তা স্থুল, তা জৈব। এই স্থুল সঙ্গ-সুখ পেতে হলে লিঙ্গের প্রয়োজন। যৌন সঙ্গীর প্রয়োজন। কিন্তু মরদেহ ত্যাগ করে যে অবিনশ্বর ও চিরঞ্জীব আত্মা থাকে তার কোনও লিঙ্গ নাই। সে পুরুষও নয়, মেয়েও নয়। পুত-পবিত্র আত্মারা হবে পরস্পরের সঙ্গী। এই প্রেম হবে দেহাতীত। পৃথিবীর প্রেমের যে অনুভূতি তার থেকে এর অনুভূতি হবে বহুগুণ তীব্র। এর যে শান্তি তা হবে স্থায়ী। পৃথিবীর মত তা ক্ষণস্থায়ী হবে না।
২৭। যারা অনুমোদন করার পরে আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ্ যা সংযুক্ত রাখতে আদেশ দিয়েছেন তা ভঙ্গ করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়, এগুলি [শুধুমাত্র] তাদেরই নিজের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
৪৫। আরবী শব্দের প্রতিশব্দ 'অতিক্ষুদ্র' কথাটির দ্বারা যা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে দুর্বলতম প্রাণী। এটা শুধু যে আয়তনে তাই-ই নয়, সর্ব ব্যাপারেই যে প্রাণী অত্যন্ত নগন্য। সূরা ২৯ : ৪১ তে উপমার জন্য মাকড়সাকে ব্যবহার করা হয়েছে। অনুরূপভাবে সূরা ২২ : ৭৩ তে মাছিকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার উপমার জন্য প্রাকৃতিক, অতি-প্রাকৃতিক শক্তিকেও ব্যবহার করা হয়েছে যেমন ২ : ১৯ তে বজ্র এবং বিদ্যুৎকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ্র কাছে তার প্রতিটি সৃষ্টিই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। তাই আমাদের কাছে যা অত্যন্ত নগণ্য ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আল্লাহ্ তাকেও উপমা হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেন না। আল্লাহ্র সৃষ্টিতে বিশাল সিন্ধু, পর্বত, মহীরুহ, বিশাল প্রাণী ইত্যাদি এ সবে যে সৃষ্টি নৈপুণ্য বা কৌশল বিদ্যমান, ক্ষুদ্র মশা, মাছি বা পিপঁড়া বা মাকড়সাতে সেই পরিমাণ সৃষ্টি কৌশল বিদ্যমান। বিজ্ঞান বলে প্রতিটি ক্ষুদ্র প্রাণী বা বস্তু, তাদের যে ধর্ম ও সৃষ্টি কৌশল তা সবই আল্লাহ্র অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই স্বাক্ষর। এমনকি অনুজীব যাদের অনুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতীত দেখা সম্ভব নয়, তাদেরও অবজ্ঞা করার ক্ষমতা আমাদের নাই। কারণ আমরা জানি এরা আমাদের চর্মচক্ষুর অগোচরে থেকেও মানুষের মত শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। যেমন-প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদির জীবাণু চর্মচক্ষে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এদের ধ্বংস করার ক্ষমতা আমরা সবাই জানি। সাম্প্রতিককালে এইড্স এর আতঙ্ক সকলেরই জানা। সুতরাং স্রষ্টার সৃষ্টিতে ছোট বড় কিছু নাই এই বোধ শুধুমাত্র দূরদর্শী ও চিন্তাশীলরাই অনুধাবন করতে পারে, যারা সত্যিকারের ভাবে মুমিন। মুমিনদের জন্য এসব দৃষ্টান্ত হেদায়েতের উপকরণ। আর যাদের মন মস্তিষ্ক অবিরাম খোদাদ্রোহিতার ফলে সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধি-বিবেচনা ও অনুধাবন শক্তি বিবর্জিত হয়ে পড়েছে, তাদের জন্য উপরিউক্ত উপমা আরও পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই সাথে এটাও লক্ষণীয় যে আয়াত ২৬ ও ২৭ এক সাথে পড়া উচিত। পথভ্রষ্টদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে আয়াত ২ : ২৭-তে। এরা সেই সব পাপী যারা আল্লাহ্র সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। যারা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, পৃথিবীতে হিংসা , বিদ্বেষের আগুন জ্বালায়, সমাজের শান্তির পরিবর্তে হানাহানির সৃষ্টি করে।
২:২৭ এই আয়াতে যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে এটা এখানে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের (ইহুদী) জন্য বলা হলেও এর আবেদন সর্বকালের, সর্বস্থানের জন্য প্রযোজ্য। এখানে ইহুদীদের আচার আচরণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে। আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মুনাজাতের জবাবে বলেছেন যে আল্লাহ্র নির্দেশিত বাণী যুগে যুগে হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) বংশধরদের মাধ্যমেই প্রচারের জন্য পাঠাবেন। বিনিময়ে তারা আল্লাহ্ নির্দেশিত পথে চলবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ইহুদীরা তাদের সেই অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। শুধু তাই-ই নয় তারা আল্লাহ্র প্রেরিত রসুলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তাদের হত্যা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত, ফলে তাদের আত্মার ধ্বংস নিজেরাই ডেকে এনেছে। ইহুদীদের উপমার সাহায্যে আল্লাহ্ সমগ্র মানব সমাজকে এই শিক্ষা দিয়েছেন যে পৃথিবীর প্রতিটি জীবন আল্লাহ্র কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। আল্লাহ্ তাদের ভালবাসেন, দয়া করেন। বিনিময়ে তারা আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে চলবে। এই পথ চলা হবে স্ব-ইচ্ছায়। স্রষ্টার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পনের মাধ্যমে। যারা তা না করে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথকে উপক্ষো করে, তাদের বিবেক (Spiritual Insight) হয় তমসাচ্ছন্ন। বিবেক তমসাচ্ছন্ন হলে মানুষের মধ্যে ভাল-মন্দের, ন্যায়-অন্যায় এর মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে আল্লাহ্র রহমত তাদের অন্তরকে স্পর্শ করে না। পরিণতিতে অন্তরের অন্ধকার দূরীভূত হয় না, বিবেক জাগ্রত হয় না। বিবেকহীন আত্মা পশুর সমান। যার অন্তর প্রদর্শিত পথের আলো গ্রহণে অপারগ, তার মত হতভাগা আর কে আছে? তার জন্য পৃথিবী হাহাকারময় ও অশান্তিময়। তাদের পরকাল দোযখের আগুনের লেলিহান শিখায় আবৃত। আল্লাহ্র পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য এতে ব্যাহত হয় না একবিন্দুও। তাই ক্ষুদ্র বস্তুর উপমা এসব অন্তর বোঝার ক্ষমতা রাখে না। কারণ তাদের আত্মা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শুধুমাত্র তারাই বুঝতে পারবে, যাদের আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো প্রবেশ লাভ করেছে। বরং এইসব উপমাতে তাদের ঈমানের দৃঢ়তা আরও বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ্র রহমত তাদের অন্তরকে বিধৌত করে, ফলে তাদের অন্তর্দৃষ্টি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অনুধাবন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
২৯। তিনিই পৃথিবীর সকল বস্তু তোমাদের [ব্যবহারের] জন্য সৃষ্টি করেছেন। উপরন্তু তার পরিকল্পনা আকাশকেও অন্তর্ভূক্ত করে, তিনি সপ্ত আসমান তৈরির কাজকে সুষম করেন। সকল বিষয় সম্বন্ধে তিনি পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী।
৪৬। এই [২ : ২২]-আয়াতে আল্লাহ্ তার বান্দাকে জানাচ্ছেন তার অসীম করুণার কথা। সন্দেহ বাতিকদের সন্দেহ খণ্ডন করেছেন ২ : ২৩-এ। অন্যায় কাজের শাস্তি বর্ণনা করেছেন ২ : ২৪ আয়াতে এবং যারা পৃথিবীতে ভাল কাজ করে তাদের জন্য আছে সুখবর :২৫ আয়াতে। কোরআনের আয়াতে এসব বর্ণনা করা হয়েছে চমৎকার ভাষা ও যুক্তির মাধ্যমে। আয়াত ২ : ২৬-২৭ আয়াতে বলা হয়েছে যে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভালর পরিবর্তে মন্দকে বেছে নেয়, আল্লাহ্র বাণীকে অস্বীকার করে, আল্লাহ্র দেখানো রাস্তাকে (নৈতিক ও চারিত্রিক গুনাবলীর উন্নতি) পরিহার করে, ফলে আল্লাহ্র সাথে মানুষের যে ওয়াদা তারা তা ভঙ্গ করে। মহাগ্রন্থ কুরআনে বর্ণিত ছোট ছোট উপমার দ্বারা এইসব উদ্ধত ও অবাধ্যজনকেই বিপথগামীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এরা আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং যে সব সম্পর্ক আল্লাহ্ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে। যার পরিণাম স্বরূপ ধরার বুকে অশান্তি বিস্তার করে।
এর পরের আয়াতে ২ : ২৮-২৯ আল্লাহ্ তার বান্দার অন্তরের অনুভূতির কাছে আবেদন রেখেছেন। তিনি বলেছেন এই পৃথিবীতে বান্দার সর্ব অস্তিত্ব, তার ধন-সম্পদ, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি, জ্ঞান-মেধা সবকিছুই তাঁরই দান। জীবন ও মৃত্যুর রহস্য তাঁরই হাতে। মরদেহের মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা নয়। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন। এই পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনকে পরকালের 'শিক্ষানবীশ কাল' (Probationary Period) বলা যায়। পরকালের অনন্ত জীবনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার সময় হচ্ছে পৃথিবীর এই জীবন। এই জীবন শেষে আল্লাহ্র কাছেই ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব করে সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিকে মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আলোচ্য আয়াতে এ তথ্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যে পৃথিবীতে এমন কোন বস্তু নাই যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের উপকার সাধন করে না। পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব থেকে বিরাট মহাবিশ্ব সবই তাঁর সৃষ্টি। মহাবিশ্বের আয়তন ধারণা করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এই মহাকাশকে আল্লাহ্ সপ্ত আকাশে ভাগ করেছেন। ভবিষ্যতের বিজ্ঞানই হয়তো এই সপ্ত আকাশের সন্ধান দেবে। এখানে সপ্ত আকাশ হয়তো আল্লাহ্ সাতটি গ্যালাক্সির বা ছায়াপথের সন্ধান দিচ্ছেন-যেখানে আমাদের বিজ্ঞান বিশ্বজগতের শুধুমাত্র এক আকাশ বা একটি ছায়াপথের সন্ধান দেয়। ভবিষ্যতের বিজ্ঞান আমাদের এই রহস্যের সমাধান দেবে। স্রষ্টার সৃষ্টি বিশাল এবং সুক্ষ্ম কৌশল এবং জ্ঞানে ভরা। তার সৃষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞান আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে ধারণা করাও অসম্ভব। সেই স্রষ্টাকে ইচ্ছাকৃতভাবে যারা অস্বীকার করে তাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি (Spiritual Faculty) আস্তে আস্তে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়।
রুকু - ৪
৪৭। ফেরেশতারা যদিও পূত, পবিত্র এবং ক্ষমতাধর তবুও তারা সম্পূর্ণ নয়। তাদের ক্ষমতা অত্যন্ত শক্তিশালী ও সম্পূর্ণ (Perfect) তবুও তারা অসম্পূর্ণ। কারণ তাদের কার্যপ্রণালীর মধ্যে কোথাও আবেগ ও অনুভূতির স্থান নাই। এখানেই ফেরেশতাদের সাথে মানুষের পার্থক্য। এখানেই ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। যে রকম কম্পিউটার যে কোনও কাজে মানুষের থেকে অত্যন্ত দ্রুত, অত্যন্ত নির্ভুল এবং অত্যন্ত শক্তিশালী,-তবুও মানুষ কম্পিউটার থেকে শ্রেষ্ঠ। ফেরেশতারা আবেগ ও অনুভূতিশূন্য ফলে তারা কম্পিউটারের মত যান্ত্রিক। আবেগ ও অনুভূতির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ হচ্ছে-ভালবাসার ক্ষমতা। সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষেরই ভালবাসার ক্ষমতা আছে। এই আবেগ ও অনুভূতি (Passion and emotion) ঠিকভাবে পরিচালিত করে মানুষ হয় দেবত্বে উন্নীত, আবার অন্ধ আবেগ ও অনুভূতির ফলে মানুষ ন্যায়-অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলে। নিজেকে পশুর স্তরে নামিয়ে ফেলে। কে কিভাবে তার আবেগ ও অনুভূতিকে পরিচালিত করে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" প্রয়োগের উপরে। একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ্ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দান করেছেন। ফলে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্ট জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষই তার নিজস্ব ভাগ্য গড়ার অধিকার লাভ করেছে। যখন এই ইচ্ছা শক্তি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তখন মানুষ নিজের সৌভাগ্য নিজে গড়ে তোলে। প্রকৃতিকে বশ করে, নিজেকে পৃথিবীর 'খলিফা' রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এমন ক্ষমতা আল্লাহ্ একমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন।
অপরপক্ষে ফেরেশতাদের আমরা কল্পনা করতে পারি, যাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি নাই। তাদের আমরা শক্তির (Force) প্রতীক হিসেবে ধরতে পারি। আল্লাহ্র হুকুম যারা নির্ভুলভাবে মেনে চলে। কিন্তু নিজস্ব বিচার বিবেচনা নাই। ফলে আল্লাহ্র প্রতিভূ হওয়ার ক্ষমতা নাই। আল্লাহ্র প্রতিভূ হওয়া যায় তখনই যখন নিজস্ব আবেগ, অনুভূতির সাহায্যে সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টিতে সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে নিয়োজিত করার ক্ষমতা থাকে, ভাল কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে, মন্দ কাজে বাঁধা দান করতে পারে, তখনই মানুষের মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায় এবং মানুষ দেবত্বে উন্নীত হয়। 'খলিফার' গুণাবলী অর্জনে সক্ষম হয়। এই পার্থক্য শেক্সপীয়ার [৯৪ সনেটে] কয়েকটি পংক্তিতে প্রকাশ করেছেন, 'They are the lords and owners of their faces. Others but stewards of their excellence.' যেহেতু ফেরেশতারা আবেগ-অনুভূতিহীন, তাই আবেগ অনুভূতির অপব্যবহারের ফলে পৃথিবীতে যে দুঃখ দুর্দশার উদ্ভব হবে সেটাই তাদের প্রধান শঙ্কার বিষয় ছিল। আসলে মানুষের মাঝে স্রষ্টা তাঁর বৈশিষ্ট্যের রূপ প্রকাশ করেছেন। মানুষ সৃষ্টি করে, মানুষ তার সৃষ্টিকে রক্ষা করে, সর্বোপরি মানুষ ভালবাসে। যেরূপ স্রষ্টা আমাদের এবং বিশ্বচরাচরের তার সমস্ত সৃষ্টিকেই ভালবাসেন। আবেগ-অনুভূতির সর্বোচ্চ ফসল হচ্ছে ভালবাসা। ভালবাসা চাওয়া ও ভালাবাসা দেওয়া। স্রষ্টার করুণা ও দয়া-তাঁর ভালবাসারই প্রকাশ। ফেরেশতারা স্রষ্টার এই বিশেষ দিকটি অনুধাবন করতে অক্ষম। কারণ তারা আবেগ ও অনুভূতি বিহীন। ফেরেশতারা বিনয় ও ভক্তি সহকারে আল্লাহ্র কাছে মানুষ সৃষ্টিতে আপত্তি জানিয়েছেন। ফেরেশতাদের মতামত প্রকাশ কোন প্রতিবাদ ছলে অহংকার প্রদর্শন বা যোগ্যতার দাবী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তাদের অভিমতের অভিব্যক্তি ছিল একান্ত অনুগতের ন্যায় এবং বিনীতভাবে নিজস্ব খেদমত পেশ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এখানে এ কথা ভাবার অবকাশ নাই যে ফেরেশতারা হিংসার বশবর্তী হয়ে এরকম অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ তা সম্ভব নয়। হিংসা বা রাগ, দ্বেষ সবেরই উৎপত্তিস্থল হচ্ছে আবেগ ও অনুভূতি। ফেরেশতারা সর্বপ্রকার আবেগ ও অনুভূতিশূন্য। সুতরাং ভালবাসার আবেগ ও অনুভূতি অনুভব করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই কারণেই সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ তাদের বলেছেন যে তাদের জ্ঞান সীমিত এবং ফেরেশতারা তা স্বীকার করে নেয় [২ : ৩২]।
ফেরেশতাদের এই যে অপূর্ণতা এটা তাদের কোনও ত্রুটি নয়। আল্লাহ্ তাদের সেইভাবেই সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহ্ যখন ফেরেশতাদের নিকট আদমের (আঃ) মানসিক উৎকর্ষতার প্রমাণ দাখিল করলেন তখন ফেরেশতারা তাদের অপূর্ণতা স্বীকার করে নিল।
৪৮। এই আয়াতের তর্জমা এরকম দাঁড়ায় যে, 'বস্তুর প্রকৃতি শিক্ষা দেন' অনুবাদেকরা একে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে বস্তুসামগ্রীর নাম, এদের গুণাগুণ ও লক্ষনাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের যোগ্যতা। অর্থাৎ একমাত্র আদমই সেই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন যার সাহায্যে মানুষ জড় প্রকৃতিকে অতিক্রম করে তার প্রকৃত সত্তাকে উদ্ঘাটনে সক্ষম হবে। এ যোগ্যতা কেবলমাত্র আদম সন্তানকেই দেয়া হয়েছে। ফেরেশতাদের স্বভাব প্রকৃতি মোটেই এর উপযোগী নয়। এসব কিছুই আদমকে তার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ধর্ম হিসেবেই শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে শিক্ষাদানের কোনও আয়োজনই করা হয় নাই। বরং আদম (আঃ) কে সৃষ্টির প্রারম্ভিক পর্যায়ে এসব জ্ঞান স্বভাবগত করেই দেওয়া হয়েছিল। যেমন-সদ্যজাত শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই মায়ের দুধ পান করতে এবং হাঁসের ছানা সাঁতার কাটতে জানে। এ ব্যাপারে কোনও বাহ্যিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় না। হযরত আদমের (আঃ) জন্য জন্মগতভাবে যে বিশেষ গুণাবলী ছিল, তা হচ্ছে তার আবেগ ও অনুভূতি, যার সাহায্যে তিনি বস্তু জগতের উর্ধ্বেও চিন্তা করতে সক্ষম ছিলেন। সমস্ত আয়াতটাই এক বিশেষ অর্থবোধক। যে বিশেষ চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য আদম সন্তানকে ফেরেশতাদের থেকে পৃথক এবং শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে তা হচ্ছে - ১) মানুষ ভালবাসতে পারে, ২) নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে কোনও কাজের পরিকল্পনা করতে পারে, ৩) ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে, ফলে আল্লাহ্র প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা রাখে। মানুষের এই বিশেষ গুণাবলীর জন্যই মানুষ স্রষ্টাকে না দেখেও নিজের সত্ত্বার ভিতরে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। সে বিশ্বাস করে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ আদম সন্তানকে ভালবাসেন। তিনি সর্বজ্ঞ। তিনি সব দেখেন, সব শুনেন। মানুষ তার অন্তরের অন্তঃস্থলের কোনও চিন্তা, কোনও কাজ, কোনও অনুভব, কোনও কিছু তাঁর কাছে গোপন করতে পারে না। সর্বশক্তিমানের উপর বিশ্বাস, তাঁর প্রতি আনুগত্য, ভালবাসা, সবই জন্মলাভ করে মানুষের সেই বিশেষ চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য, আর তা হচ্ছে আবেগ ও অনুভূতি (Feeling)। এই বিশেষ গুণটি অর্থাৎ আবেগ ও অনুভূতি শুধু যে ফেরেশতাদের মধ্যেই অনুপস্থিত তাই নয়, সমগ্র বিশ্ব চরাচরে মানুষ বাদে সমস্ত প্রাণীকূলের মধ্যেও অনুপস্থিত।
৩৩। তিনি বললেন, 'হে আদম! এগুলির প্রকৃতি সম্বন্ধে বল।' যখন সে ফেরেশতাদের তা বলল, আল্লাহ্ বললেন, 'আমি কি তোমাদের বলি নাই যে আমি আকাশ ও পৃথিবীর গোপন রহস্য অবগত, এবং তোমরা যা প্রকাশ কর এবং যা গোপন কর আমি তা [সব] জানি?'
৩৪। এবং স্মরণ কর, আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম, 'আদমকে সেজ্দা কর।' ইবলীশ ব্যতীত সকলেই সেজ্দা করলো ৪৯। সে অমান্য করলো এবং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলো। [ফলে] সে কাফেরদের অন্তুর্ভূক্ত হল।
৪৯। এই আরবী আয়াতের অনুবাদ দাঁড়ায় যে, 'ইবলীশ ব্যতীত সকলেই সিজ্দা করলো।' এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইব্লিশ একজন ফেরেশ্তা কিন্তু ফেরেশ্তারা পথভ্রষ্ট হবে সে রকম ক্ষমতা তাদের নাই। মুসলিম দর্শনে তা স্বীকারও করে না। সূরা ১৩ এর আয়াত ৫০-এ ইব্লিশকে জ্বীন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা পরে এ সম্বন্ধে আলোচনা করবো।
৫০। প্রশ্ন হচ্ছে বেহেশ্তের বাগানের অবস্থান কি আমাদের পৃথিবীতেই ছিল কি না? অবশ্যই না। কারণ ৩৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, 'পৃথিবী হবে তোমাদের বাসস্থান।' পৃথিবীতে পতনের পূর্বে আদমের অবস্থান এমন এক জায়গায় ছিল যেখানে নির্মল হৃদয়ে বিরাজ করতো অপার শান্তি, নির্মল ভালবাসা, বিশ্বাস, আত্মার ভিতরে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের অপূর্ব আনুগত্য। আর পৃথিবী এমন এক জায়গা যেখানে প্রতি নিয়ত যে পরিবেশ বিরাজ করে তা কখনই বেহেশ্তের উপযোগী নয়। পৃথিবীতে বিরাজ করে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা। এখানে প্রতিনিয়ত স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
সুতরাং যারা বলে আদমের স্বর্গ পৃথিবীরই কোনও এক জায়গা তারা ভুল বলে। কারণ হয়তো স্বর্গ এমন এক জায়গা যেখানে আত্মার অবস্থান হবে স্থান ও কালের (Time & space) এর উর্ধ্বে। খ্রীষ্টানরা বলে আদমের স্বর্গ থেকে পতনের কারণ আদমের 'জ্ঞান বৃক্ষের' নিকট গমন এবং এর ফল ভক্ষণ। কিন্তু তা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। কারণ আল্লাহ্ ফেরেশতাদের বলেছেন [২ : ৩১] যে মানুষকে তিনি জ্ঞান দান করেছেন, যা ফেরেশতাদের নাই। সুতরাং মানুষের মধ্যে যে জ্ঞান ধারণের ক্ষমতা বা বিকাশ তা স্রষ্টা মানুষ সৃষ্টির সময়েই দান করেছেন। তাহলে কুরআন শরীফে যে বৃক্ষের নিকট আদম সন্তানকে অগ্রসর হতে নিষেধ করা হয়েছিল তা কি? তা অবশ্যই পাপ বৃক্ষ [Tree of evil]। আর এটা পাপ বৃক্ষ বলেই আল্লাহ্ শুধু যে এর ফল খেতে নিষেধ করেছেন তা নয়; এমনকি এর ধারে কাছে যেতেও নিষেধ করেছেন।
৫১। 'জুল্ম' আরবী শব্দটি বহুবিদ অর্থ করা যায়। এর দ্বারা ভুল, অন্যায়, ক্ষতি ইত্যাদি বুঝায়। যখন অন্যের প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বা ক্ষতি করা হয় তখন তা অত্যাচার বা নিষ্পেষণে পরিণত হয়, তখন পাপবোধ অত্যাচারীর আত্মাকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সুতরাং পাপী ব্যক্তি তার আত্মাকে 'জুল্ম' করে। আত্মার যা স্বাভাবিক বিকাশ তা বাধাগ্রস্থ হয়। স্বাভাবিকভাবে আত্মা হচ্ছে পূত, পবিত্র ও নিষ্পাপ। সৃষ্টির আদিতে আত্মার পরিচয় হচ্ছে স্বর্গীয়; শান্তিতে আপ্লুত কিন্তু কৃত পাপ তার আত্মাকে অন্ধকারে বা যন্ত্রণায় নিক্ষিপ্ত করে। ফলে আত্মার মধ্যে শান্তির পরিবর্তে যন্ত্রণার উদ্ভব হয় 'জুল্ম' এই শব্দটির দ্বারা আত্মার স্বাভাবিক গতির বিরুদ্ধাচরণ করা বুঝানো হয়েছে।
৫২। [২ : ৩৪]-এ 'ইব্লিশ' এই কথাটির দ্বারা দুষ্টের বা শয়তানের ক্ষমতাকে (Power of Evil) বুঝানো হয়েছে। শয়তানের ক্ষমতা হচ্ছে ভালকে অবদমিত করার চেষ্টা ও শত্রুতা। ভালোর বিরুদ্ধে মন্দের বিদ্রোহ করা ও ভালোকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা, এই-ই হচ্ছে শয়তানের ক্ষমতা ও কার্যপ্রণালী। এখানে বেহেশ্তের বাগান থেকে পতনকে রূপক অর্থে প্রকাশ করলে আমরা আমাদের চারিপাশের পৃথিবীতে এর অসংখ্য উদাহরণই দেখতে পাই। পৃথিবীর মানুষ প্রতিনিয়ত লোভ-প্রলোভন বা শয়তানের কুমন্ত্রণার কাছে পরাজিত হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে সে আত্মার নিষ্পাপ অবস্থা যা সৃষ্টির আদিতে সে স্রষ্টার কাছে থেকে লাভ করেছিল, যার ফলে তার নির্মল আত্মায় অপার বেহেশতি শান্তি বিরাজ করতো সেই মানসিক অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়। লোভ-প্রলোভন, অন্যায় অত্যাচারের ফলে আত্মার শান্তি হয় বিঘ্নিত। আত্মা হয় মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত ও জর্জরিত। রূপক অর্থে আমাদের মানসিক শান্তিময় অবস্থা [State of Felicity] থেকে শয়তানের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করাই হচ্ছে বেহেশ্ত থেকে পৃথিবীতে পতন যা অহরহ-ই আমাদের চারিপাশে ঘটে।
৫৩। মানুষ সৎ কাজের ফলে আত্মায় বেহেশ্তের শান্তি অনুভব করে, অসৎ কাজের ফল হচ্ছে দোযখের যন্ত্রণা। এই যন্ত্রনা হয় আত্মায়। এখানে আদম অর্থ মানব সম্প্রদায়কে বুঝানো হচ্ছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই আদম সন্তান। এখানে আদম, ইভ, শয়তান সবাইকে পরস্পরের শত্রু হিসেবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ শয়তানের প্রলোভনই হচ্ছে মানুষের শত্রু, আত্মার যন্ত্রণা।
৫৪। পৃথিবীর আবাসস্থল মানব সন্তানের জন্য অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে অবস্থানকালে আদম সন্তানকে তার জীবিকার জন্য তার বাঁচার জন্য অহরহ সংগ্রাম করতে হবে-এইই আল্লাহ্র হুকুম। সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে এবং এর মাধ্যমেই ভালোকে গ্রহণ করে, মন্দকে প্রতিহত করে আত্মাকে বেহেশ্তের উপযোগী করতে হবে। পৃথিবীতে তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রাম হচ্ছে আত্মিক এবাদতের এবং আত্মিক উন্নতির এক অপরিহার্য অংশ।
৫৫। ৩১ নং আয়াতে 'আল্লাহ্ সকল জিনিসের প্রকৃতি শিক্ষা দিলেন' বলা হয়েছে। এই 'সকল জিনিষের প্রকৃতি হচ্ছে বস্তুর ধর্ম। ঠিক সেইভাবে এখানে আল্লাহ্র কাছ থেকে 'প্রত্যাদেশের বাণী পেল অর্থাৎ প্রত্যাদেশ বা আধ্যাত্মিক' জ্ঞান লাভ করলো। কারণ কোনও জ্ঞান শিখতে হলে তার নিজস্ব চেষ্টায় শিখতে হয়। কিন্তু প্রত্যাদেশ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান যা আল্লাহ্র অসীম রহমত বা করুণার প্রতীক যা নদীর ফল্গুধারার মত স্বতঃপ্রবাহিত। হযরত আদম (আঃ) আল্লাহ্র কাছ থেকে সেই অসীম রহমতেরই সন্ধান পেয়েছিলেন।
আরবীতে অনুতাপ [তওবা] কথাটির অর্থ ফিরিয়া আসা এবং 'তওয়াফ' কথাটির ব্যবহার হয়েছে আল্লাহ্র কাছে কৃত পাপের ক্ষমা চাওয়া হিসেবে। কারণ আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও দয়ালু (Oft-returning Or Ever returning)। ক্ষমা চাওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে কৃত পাপের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করা। অনুতাপ তিনটি ধাপের সমন্বয়ে গঠিত। প্রথমতঃ পাপী ব্যক্তি তার কৃত পাপকে সনাক্ত করবে। দ্বিতীয়তঃ সেই পাপ কাজকে শুধু সনাক্ত করলেই হবে না তা পরিত্যাগ করতে হবে। তৃতীয়তঃ ভবিষ্যতেও সে সেই মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকবে এই মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা ও দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করা। এই তিনটি ধাপের সমন্বয়ই হচ্ছে অনুতাপ করা। এই তিনটি ধাপের যে কোনও একটির অভাব থাকলে তওবা হবে না। অর্থাৎ অতীতের পাপকে সনাক্ত করা, বর্তমানে তা পরিহার করা এবং ভবিষ্যতে তা না করার সংকল্প গ্রহণ করা-এই তিনটি জিনিসের সমাবেশ না ঘটা পর্যন্ত তওবা হবে না।
এরপরে আসে অতীতের কৃত পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়া। মানুষ অত্যন্ত দুর্বল চরিত্রের। সে বার বার ভুল করে এবং বার বার আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত তার ক্ষমা চাওয়া হয় আন্তরিক এবং সত্যিকারের, আল্লাহ্ অসীম করুণার অধিকারী, রহমানুর রহীম এবং ক্ষমাশীল। একমাত্র তাঁর করুণাই আমাদের দোষত্রুটি মুক্ত হতে সাহায্য করে।
৫৬। লক্ষ্য করুন এই আয়াতটি শুরু হয়েছে বহুবচন 'আমরা' দিয়ে এবং শেষে একবচন 'আমার' ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআন শরীফের বহুস্থানে আল্লাহ্ নিজেকে প্রথম পুরুষ বহুবচন 'আমরা' ব্যবহার করেছেন। কারণ এটা ব্যবহার হয়েছে সম্মানীয় অর্থে। এরকম ব্যবহার জনসাধারণের জন্য রাজকীয় হুকুম জারীর মধ্যেও করা হয়ে থাকে। ঠিক সে রকমভাবেই আদম, ইভ, শয়তানের জন্য যা সাধারণ হুকুম তা প্রকাশ করার জন্য সম্মানীয় আল্লাহ্র হুকুমকে বহুবচনের ব্যবহার করা হয়েছে; যেমন-'আমরা বললাম, তোমরা এখান থেকে নেমে যাও।' কিন্তু স্রষ্টা যখন ব্যক্তিগতভাবে কারও প্রতি করুণা প্রকাশ করেছেন তখন নিজেকে বহুবচনের পরিবর্তে একবচনের ব্যবহার করেছেন। যেমন, 'যারা আমার সৎ পথের নির্দেশ অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নাই।'
এই আয়াতে মানুষের অধঃপতন সত্ত্বেও আদম সন্তানকে আল্লাহ্ সুন্দরতম জীবনের, তাঁর করুণাধারা, তাঁর ক্ষমার আশ্বাস দিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন পথের নিশানার। যদি মানব জাতি তার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে, তবে মহান স্রষ্টা আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন যে আমাদের কোনও ভয় নাই, পৃথিবীর কোন ব্যাথা, গ্লানি আমাদের আত্মাকে স্পর্শ করবে না। আমাদের পার্থিব জীবন হবে শান্তিময় এবং পারলৌকিক জীবন হবে ঐশ্বর্যময়। কারণ আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে চলার ফলে আত্মার যাত্রা শুরু হবে পরমাত্মার দিকে। পরমাত্মার সান্নিধ্যই আত্মার একমাত্র কাম্য। ফলে মহান স্রষ্টার করুণায় আত্মা হয় বিধৌত, আপ্লুত।
৫৭। কিন্তু যখন মানব সন্তান আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ ত্যাগ করে, তখন সে আত্মার জন্য স্বর্গীয় আলো প্রবেশে পথ বন্ধ করে দেয়। এভাবে সে ক্রমাগত আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলে তার আত্মায় আল্লাহ্র রহমত ও হেদায়েতের আলো পৌঁছাতে পারে না। ইচ্ছাকৃতভাবে স্রষ্টার নির্দেশিত পথকে উপক্ষো করার ফলে আত্মা তার পবিত্রতা হারায়, ফলে আত্মা অন্ধকারে আবৃত হয়ে যায় এবং আত্মার মধ্যে যন্ত্রণার উদ্ভব হয়। আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ হচ্ছে সৎ জীবন যাপন করা। সৎ জীবন যাপনের মাধ্যমে আত্মিক শক্তির উদ্ভব হয়। আত্মার মধ্যে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করা যায়। ফলে হৃদয় হয় আলোকিত। অর্থাৎ সৎ জীবন যাপনের ফলে আত্মায় বিভিন্ন গুণরাজির জন্ম নেয়। এই গুণরাজিই হচ্ছে আল্লাহ্র নেয়ামত। ফলে মানুষ আত্মার মধ্যে শান্তি লাভ করে।
কিন্তু যে ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথ পরিহার করে, তার হৃদয় ভয়, ভীতি, আশঙ্কায় পূর্ণ হয়ে যায়। হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহ্র সান্নিধ্য অনুভব করতে সে হয় ব্যর্থ-ফলে তার হৃদয় সর্বদা থাকে শঙ্কিত, ভীত। এর ফলে জন্ম নেয় অনিশ্চয়তা এবং এক ধরণের আত্মিক যন্ত্রণা। আত্মার এই যন্ত্রণাকেই [Spiritual Fire] দোযখের আগুন বলা হয়েছে একং তারা এই আগুনে চিরদিন থাকবে।
রুকু - ৫
৫৮। আল্লাহ্ এখানে ইসরাঈলীদের প্রতি তাঁর অনুকম্পাসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ্ বলেছেন যে তিনি তাদের মিশরীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দুধ ও মধুতে ভরা ক্যানান দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেছেন, 'আমি আমার চুক্তি পালন করেছি, তোমরা তোমাদের চুক্তি পালন কর।'
৫৯। ইহুদীরা পূর্বেই আল্লাহ্র বাণী লাভ করেছে হযরত মুসার মাধ্যমে। সেই বাণীর সমর্থক হিসেবে হযরত মুহম্মদ (দঃ) এর আবির্ভাব। সুতরাং হযরতের (দঃ) কাছে আল্লাহ্ যা নাজিল করেছেন তা ইহুদীদের পূর্ব পরিচিত হওয়ার কথা। তবু ইহুদীরাই প্রথম, যারা আল্লাহ্র বাণীর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্যই তারা তা করে। কিন্তু আল্লাহ্র নির্দেশ তাদের ক্ষুদ্র বিচার-বিবেচনার অনেক উর্ধ্বে। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্র আয়াতসমূহের বিনিময়ে মূল্য গ্রহণ নিষিদ্ধ হওয়ার অর্থ হলো-মানুষের মর্জি ও স্বার্থের তাগিদে আয়াতসমূহের মর্ম বিকৃত ও ভুলভাবে প্রকাশ করে কিংবা তা গোপন রেখে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। এ কাজটি উম্মতের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। তাই সৎ কাজ ও নিজ কর্তব্য সম্বন্ধে নির্দেশ আল্লাহ্র কাছ থেকে নিতে হবে। অর্থাৎ কুরআন শরীফ পড়ে বুঝে সেই অনুযায়ী জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোনও পুরোহিত (পীর-ফকির-মাজার) বা অমনোনীত ফতোয়াবাজ বা সামাজিক রীতিনীতি বা সামাজিক সংস্কার এ সবের অনুগত হওয়া হারাম।
৪৩। এবং তোমরা সালাতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাক; যাকাত আদায় কর; এবং যারা আমার সামনে মাথা নত করে তাদের সাথে মাথা নত কর [এবাদতের জন্য] ৬০।
৬০। সত্য গোপন করা এবং তাতে সংযোজন ও সংমিশ্রণ করা হারাম। যদিও উপরিউক্ত আয়াত ইহুদীদের সম্বোধন করে নাজিল করা হয়েছে তবুও এর আবেদন সর্বকালের সর্বযুগের, সর্ব জাতির জন্য সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। বাঙালি জাতির এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা কর্তব্য। শ্রোতা ও সম্বোধিত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে বা নিজ কার্য সিদ্ধির উদ্দেশ্যে সত্যকে মিথ্যার সাথে উপস্থাপন করা সম্পূর্ণ না-জায়েজ ও হারাম।
৪৫। তোমরা [আল্লাহ্র] সাহায্য প্রার্থনা কর ধৈর্য্য, অধ্যবসায় এবং সালাতের মাধ্যমে। বিনয়ী ব্যক্তি ব্যতীত আর সকলের নিকট ইহা নিশ্চিতভাবে কঠিন কাজ ৬১।
৬১। আল্লাহ্ এখানে ধৈর্য্য, অধ্যবসায় ও প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করতে বলেছেন। বাংলায় আরবী সবর্ কথাটির অনুবাদ করা হয়েছে ধৈর্য্য। কিন্তু সবর্ কথাটির অর্থ এত ব্যাপক যে শুধুমাত্র ধৈর্য্য এই একটি মাত্র শব্দ দ্বারা এর অর্থের ব্যাপকতা বুঝানো সম্ভব নয়। এর দ্বারা বুঝায় -
১) ধৈর্য্য অর্থাৎ তাড়াহুড়া না করে ধীর স্থিরভাবে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা।
২) কোন কাজে দৃঢ়ভাবে এবং অধ্যবসায়ের সাথে লেগে থাকার ক্ষমতা। যে কোনও কাজ করতে গেলে সাফল্য না-ও আসতে পারে, কিন্তু তার দরুন হতাশাগ্রস্থ না হয়ে দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা এবং অধ্যাবসায়ী হওয়ার নামই ধৈর্য্য।
৩) কোনও কাজে ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতাই ধৈর্য্য। কোনও দৈব ক্ষমতায় (Chance action) বিশ্বাসী না হয়ে নিজের যোগ্যতার উপরে এবং আল্লাহ্র উপরে আস্থাশীল হয়ে ধারাবাহিকভাবে ক্রমান্বয়ে কাজ করার ক্ষমতাই হচ্ছে সবর্।
৪) সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই আল্লাহ্র দান হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষমতা এবং সেই কারণে কোনও সাফল্যে বা সুখে উদ্বেলিত না হওয়া এবং ব্যর্থতা বা দুঃখে মানসিক অস্থিরতা প্রকাশ না করা বা ভেঙ্গে না পড়া বা আল্লাহ্কে দোষারোপ না করার নামই হচ্ছে সবর্ বা ধৈর্য্য।
এই চারটি গুণের সমন্বয় করলে চরিত্রের যে দৃঢ়তার অভিব্যক্তি বুঝানো যায় তাকেই এক কথায় সবর্ নামে অভিব্যক্তি করা হয়। এর অর্থ কেউ যেনো এ না বুঝে যে পৃথিবীর সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা সম্পর্কে নিরাসক্ত ভাবই হচ্ছে সবর্। সবর্ হচ্ছে সর্বক্ষণ, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র কাছে শুকরিযা আদায় করা। মনে এই আশা পোষণ করা যে দুঃখ তাঁরই দান। দুঃখের মাঝেও নিশ্চয়ই তাঁর কল্যাণময় ইঙ্গিত আছে। সুতরাং দুঃখের অমানিশা একদিন অতিক্রান্ত হবেই। এই বিশ্বাসের নামই সবর্।
রুকু - ৬
৬২। আয়াত [২ : ৪০]-তে আল্লাহ্ ইসরাঈলীদের বলেছেন যে, তিনি তাদের বিশেষ নেয়ামত দান করেছেন। উপরিউক্ত আয়াতে সামগ্রিকভাবে নেয়ামতসমূহ বা আল্লাহ্র দানসমূহের (Gift) কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে অনেক নেয়ামতের মধ্যে বিশেষভাবে একটি নেয়ামতের কথা বলা হয়েছে। ইহুদীদের ইতিহাস বলে আল্লাহ্ ইহুদীদের বিশেষ ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
এখানে সকলের জন্য এই উপদেশ যে আল্লাহ্র চোখে সবাই সমান। সকলকে তার নিজ নিজ কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ এর মধ্যে কোন ভেদাভেদ নাই।
৬৪। উপরে যে বিশেষ আচরণের কথা বলা হয়েছে এখান থেকে তার বিস্তারিত বর্ণনা আরম্ভ হয়েছে। মিশরের দাসত্ব বন্ধন ছিলো এক ভীষণ পরীক্ষা ইহুদীদের জন্য। দিবা-রাত্র তাদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো, তারপরও তারা পেতো অমানবিক ব্যবহার। কোনও এক গণক ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল যে, ইসরাঈলী বংশে এমন এক ছেলের জন্ম হবে যার হাতে ফেরাউনের পতন হবে। এজন্য ফেরাউন আদেশ দেন ইসরাঈলদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করার জন্য এবং কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখার জন্য। এই হুকুমের প্রেক্ষিতেই হযরত মুসার জন্মের পর তিনমাস পর্যন্ত তাঁকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। যখন আর তা সম্ভব হলো না তখন তাঁর মা তাকে একটি ঝুড়িতে করে নীল নদীতে ভাসিয়ে দেন। পরবর্তীতে ফেরাউনের স্ত্রী ও কন্যা তাঁকে উদ্ধার করে এবং দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন [২৮:৯]। এভাবেই হযরত মুসা তাঁর শত্রুদের দ্বারাই প্রতিপালিত হতে থাকলেন। এ সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা। কারণ হযরত মুসা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তি, যিনি তাঁর জাতিকে মিশরীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত করবেন। আল্লাহ্র অপূর্ব লীলায় হযরত মুসা শুধু যে জীবন রক্ষা পেলেন তাই-ই নয় শত্রুপুরীতে বসবাস করে শত্রুদের সমস্ত জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ আল্লাহ্র ইচ্ছা ছিল মিশরীয়দের জ্ঞান ভান্ডার হযরত মুসার কাছে উন্মুক্ত করা। কারণ তিনি ছিলেন ইসরাঈলীদের মুক্ত করার জন্য আল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তি সেজন্য আল্লাহ্ তাঁকে শত্রু শিবিরের সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন। ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে থেকে তিনি প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন মিশরবাসীর অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ইসরাঈলীদের উপর। এ সবই আল্লাহ্র ইচ্ছায় সংঘটিত হয়। আল্লাহ্র ইচ্ছা হযরত মুসার জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করা। কারণ এ জ্ঞান তাঁকে ইসরাঈলীদের মুক্ত করতে সাহায্য করবে।
সাধারণ উপদেশ হলো, আল্লাহ্র ইচ্ছা কীভাবে প্রতিপালিত হয় তা বোঝার ক্ষমতা বা রদ করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাই। থাকলে ফেরাউনের নিজ পুরীতে সন্তানতুল্য আদরে নিজশত্রু (হযরত মুসা) প্রতিপালিত হতো না।
৬৫। শেষ পর্যন্ত ইসরাঈলীরা যখন মিশর থেকে পলায়ন করতে সক্ষম হলো, তখন ফেরাউন তাদের পশ্চাৎ ধাবন করলো। আল্লাহ্র কুদরতে সমুদ্র দ্বিধাবিভক্ত হলো এবং বনী-ইসরাঈলীরা লোহিত সাগর অতিক্রম করতে সক্ষম হলো। কিন্তু ফেরাউন তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে যেয়ে সমুদ্রে ডুবে মারা গেল।
[উপদেশ : অন্যায়কারীর ধ্বংস অবধারিত।- অনুবাদক]
৬৬। এই আয়াতের ঘটনা ঐ সময়ের পর। হযরত মুসা ৪০ দিন তূর পাহাড়ে অবস্থান করেন এবং আল্লাহ্র এবাদতে মগ্ন থাকেন ফলে তাওরাত কিতাব লাভ করেন। কিন্তু বনী ইসরাঈলীরা হযরত মুসার অনুপস্থিতিতে অধৈর্য্য হয়ে উঠলো এবং সোনা দিয়ে একটি গো-বৎসের প্রতিমূর্তি করে তার পূঁজা শুরু করে দিলো।
৬৭। হযরত মুসা আল্লাহ্র কাছে তাঁর জাতির জন্য ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিলেন। এই হচ্ছে কুরআনের বর্ণনা কিন্তু ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনায় বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। আসলে ইহুদী এবং খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ হযরত মুসা এবং হযরত ঈসার মৃত্যুর বহুপরে সংগৃহীত হয়। সেই সময়ে তা অবিকৃত ছিল না। ফলে বহু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে।
৬৮। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশই হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছার প্রকাশ। যার সাহায্যে আমরা ভাল-মন্দ, সত্য-অসত্য, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। এই প্রত্যাদেশকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি আল্লাহ্র কিতাবে। ইতিহাস থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পাই যে, সেই জাতিই পৃথিবীতে স্থায়িত্ব পেয়েছে যারা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ মেনে চলেছে। আর যারা চলে নাই তারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। এই আয়াতে 'কিতাব' ও 'ফুরকান' শব্দটি অনেক তফসীরকারগণ সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আবার অনেকে এই দুই শব্দকে সম্পূর্ণ আলাদা অর্থবোধক শব্দ হিসেবে ধরেছেন। 'কিতাব' অর্থ লিখিত বই এবং 'ফুরকান' অর্থ তফসীরকারগণ ব্যাখ্যা করেছেন 'আল্লাহ্র নিদর্শন'। মাওলানা ইউসুফ আলী সাহেব শেষোক্তদের সাথে একমত। কারণ ফুরকান শব্দটি [২১ : ৪৮]-আয়াতে হযরত মুসা ও তার ভাই হারূনের বর্ণনায় ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু হারুণ কোনও কিতাব প্রাপ্ত হন নাই সুতরাং ফুরকান আলাদা এবং অন্য অর্থবোধক কোন শব্দ হবে যা আল্লাহ্র নিদর্শনকে প্রকাশ করে। যার সাহায্যে ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। এছাড়াও [২৫ নং] সূরাটির নাম 'ফুরকান' এবং এই সূরার প্রথম আয়াতেই ফুরকান শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'ফুরকান' শব্দটি কিতাবের পরিবর্তে হতে পারে না। এর অর্থ হওয়া উচিত যুগে যুগে আল্লাহ্র নিদর্শন। মুসলমানদের কিতাব ও নিদর্শন দুটোই আছে। ফুরকান হলো ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ড।
৬৯। ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্য অনুযায়, 'Go in and out from gate to gate throughout the camp, and slay every man his brother, and every man his companion, and every man his neighbor.......... and there fell of the people that day 3,000 men.' আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হয় হত্যা ছিল তাদের জন্য মহা পরীক্ষা। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দিলেন। 'আন্ফুসাকুম' শব্দটির অর্থ হচ্ছে 'আত্মা', 'ব্যক্তি' নয়। সেদিক থেকে অর্থ করলে হযরত মুসার নির্দেশের অর্থ দাঁড়ায়, 'গো-বৎস পূজার' দ্বারা তোমরা তোমাদের আত্মাকে কলুষিত করেছ সুতরাং তোমাদের অপবিত্র আত্মাকে বিনাশ কর। আল্লাহ্র চোখে তা-ই হবে তোমাদের জন্য প্রযোজ্য।
৭০। হযরত মুসা (আঃ) তূর পর্বত থেকে তাওরাত নিয়ে এসে বনী ইসরাঈলের সামনে পেশ করে বললেন যে, এটা আল্লাহ্ প্রদত্ত কিতাব। তখন কিছু সংখ্যক উদ্ধত লোক বলল, যদি আল্লাহ্ স্বয়ং বলে দেন যে, এ কিতাব তাঁর প্রদত্ত তবে অবশ্যই আমাদের বিশ্বাস এসে যাবে। মুসা (আঃ) আল্লাহ্র আদেশক্রমে তাদেরকে তূর পর্বতে যেতে বললেন। বনী ইসরাঈলীরা সত্তর জন লোককে মনোনীত করে হযরত মুসা (আঃ) এর সঙ্গে তূর পর্বতে পাঠাল। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহ্র বাণী স্বয়ং শুনতে পেলো। তখন তারা নতুন ভান করে বলল, শুধু কথা শুনে তো তৃপ্তি হচ্ছেনা; আল্লাহ্ই জানেন এ কথা কে বলছে। যদি আল্লাহকে দেখতে পাই, তবে অবশ্যই মেনে নেবো। কিন্তু যেহেতু এ মরজগতে আল্লাহ্কে দেখার ক্ষমতা কারও নাই কাজেই এ ধৃষ্টতার জন্য তাদের উপর বজ্রপাত হল এবং সবাই ধ্বংস হয়ে গেলো।
৫৭। আমি তোমাদের মেঘের ছায়া দিয়েছিলাম, এবং তোমাদের নিকট মান্না ৭১ ও কোয়েল প্রেরণ করেছিলাম এই বলে: 'তোমাদের ভাল যা দান করেছি তা থেকে আহার কর।' [কিন্তু তারা বিদ্রোহ করে]; তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারে নাই, বরং তারা তাদের নিজের আত্মার প্রতি ক্ষতি করেছে।
৭১। ইহুদীরা যে প্রান্তরে থাকতো তা ছিল উন্মুক্ত মরুভূমি প্রান্তর। এখানে কোনও লোকালয় বা গাছ ছিল না যার নীচে শীত-গরম বা সূর্যতাপ থেকে আশ্রয় নেয়া চলে। তেমনিভাবে এখানে পানাহারের উপকরণ বা পরিধানের বস্ত্রসামগ্রীও ছিল না। কিন্তু আল্লাহ্ হযরত মুসার দোয়ার বদৌলতে যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবার বন্দোবস্ত করেন। মেঘ দ্বারা ছায়া দানের এবং ক্ষুধা পেলে 'মান্না ও সালওয়া' এর বন্দোবস্ত করেন। 'মান্না' কি? মান্নাকে বলা হয়েছে বরফের মত স্বচ্ছ, শ্রভ্র এক ধরণের মিষ্ট খাবার যা মাটিতে জমে থাকতো। এগুলিকে পরদিন পর্যন্ত রেখে দিলে পচে যেতো এবং সূর্যতাপে রাখলে গেল যেতো। প্রত্যেক লোকের জন্য প্রয়োজন ছিল এক ওমের (হিব্রু মাপ) যা ২ কোয়ার্টের সমান বর্তমানে সময়ে 'মান্না' বলতে যা বোঝায় তা হচ্চে ঝাউ জাতীয় একরকম চিরহরিৎ বৃক্ষের রস। এই রস মিষ্টি এবং আঠালো। এক রকমের পোকা যখন বৃক্ষকে ছিদ্র করে তখন এই রস নির্গত করে। ভারতে যেমন-লাক্ষা পোকা দ্বারা এক রকম বৃক্ষ থেকে লাক্ষা উৎপন্ন হয়।
সালওয়া হচ্ছে কোয়েল পাখীর মত ছোট ছোট পাখীর ঝাঁক। পাখীর ঝাঁক তাদের কাছে ঝাঁকে ঝাঁকে সমবেত হত, আর তারা সেগুলি সংগ্রহ করে নিত। পাখীর ঝাঁক তাদের দেখে পালাতো না। 'মান্নার' অসাধারণ প্রাচুর্য এবং কোয়েল পাখীর লোকভীতি না থাকাও ছিল অস্বাভাবিক। এ হিসেবে উভয় বস্তুই অদৃশ্য ধনভান্ডার হতে দেওয়া হয়েছিলো বলে প্রকাশ করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে কোয়েল পাখির ঝাঁক বছরের কোনও এক নির্দিষ্ট সময়ে ভূ-মধ্যসাগরের বাতাস দ্বারা পরিচালিত হয়ে এখানে এসে পড়ে। এ ঘটনা ১৯১৪-১৯১৮ সনের বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বহু ভারতীয় সামরিক অফিসার যারা মিশর ও প্যালেষ্টাইনের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন তারা প্রত্যক্ষ করেছেন।
যখন বনী ইসরাঈলীদের একটানা মান্না ও সালওয়া খেতে খেতে বিস্বাদ এসে গেলো এবং স্বাভাবিক খাবারের জন্য প্রার্থনা করলো তখন তাদেরকে এমন এক নগরীতে প্রবেশ করতে হুকুম দেওয়া হলো, যেখানে পানাহারের জন্য সাধারণভাবে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে। যখন তারা নগরীতে প্রবেশ করতে আরম্ভ করবে শহরের দরজা দিয়ে, তখন বিনয়ের সাথে প্রণত মস্তকে প্রবেশ করবে এবং মুখে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু যে শব্দটির (সাংকেতিক) সাহায্যে ক্ষমা চাইতে বলা হলো ইহুদীরা তা পরিবর্তন করে ফেললো। আরবীতে এই শব্দটি ছিল 'হিত্তাতুন' যা বিনয় এবং ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। এই বিশেষ ঘটনা থেকে যে শিক্ষা গ্রহণের ইঙ্গিত আল্লাহ্ তায়ালা দিচ্ছেন তা হচ্ছে কোনও কাজে বিজয়ের মুহূর্তে আমরা বিনয়ী ও নম্র থাকবো যেনো আল্লাহ্র চোখে আমাদের আচরণ পছন্দনীয় হয়। অন্যথায় আমাদের উদ্ধত ও অহংকার আচরণ আমাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে।
আয়াত [২ : ৫৮-৫৯] কে সূরা [৭ : ১৬১-১৬২] সাথে তুলনা করা যায়। দু একটা শব্দ যেমন-[২ : ৫৮] তে ব্যবহার করা হয়েছে, 'শহরে প্রবেশ কর' কিন্তু [৭ ; ১৬১] তে ব্যবহার করা হয়েছে 'বাস কর; আবার [২ : ৫৯] এ ব্যবহার করা হয়েছে 'আদেশ লঙ্ঘন করা' এবং [৭ : ১৬২] তে 'সীমা লঙ্ঘন করা' বলা হয়েছে। কিন্তু এর জন্য আয়াতের অর্থের কোন পরিবর্তন হয় নাই।
রুকু - ৭
৭৩। এই আয়াতে ইহুদীদের বিভিন্ন উপজাতি (Tribe) সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। ইহুদীদের বার (১২)টি উপজাতি হচ্ছে ইয়াকুব নবীর ১২ জন ছেলের বংশধরগণ। ইয়াকুব নবীকে ইহুদীরা নাম দিয়েছে ইসরাঈল। সেই কারণে ইহুদীদের আর এক নাম বনী ইসরাঈল বা ইসরাঈলের বংশধর।
সিনাই পর্বতের কাছে হোরের নামক স্থানে যেখানে মুসা নবীকে প্রত্যাদেশ বা আল্লাহ্র আইন প্রদান করা হয় সেখানে ১২ ফুট উচ্চ এবং ৫০ ফুট পরিধি বিশিষ্ট লাল গ্রানাইট পাথরের স্তুপ থেকে ১২টি ঝর্ণা প্রবাহিত যা ১৫ শতাব্দীতে ইউরোপীয়ান পরিব্রাজক ব্রেভডেনবাচ (Brevdenbach) প্রত্যক্ষ করেন। এই ঝর্ণাগুলির অস্তিত্ব হযরত মুহম্মদের (দঃ) সময়েও ছিলো এবং সম্ভবতঃ এখনও আছে।
এই আয়াতকে আল্লাহ্ উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন আরও মহত্তর কিছু শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এই পৃথিবীতে চলার পথে আমরা আত্মিক দিক থেকে নিঃসঙ্গ। মায়া-মমতাহীন, স্বার্থপর পৃথিবীতে একটু স্নেহ ভালবাসা ও সঙ্গের জন্য তৃষিত হই। পৃথিবীর পথ আদম সন্তানের জন্য পৃথিবীকে করে তোলে বন্ধুর ও কঙ্করময়। আধ্যাত্মিক জগতের বা আত্মার তৃষ্ণা মেটাতে পরম করুণাময় যুগে-যুগে, কালে কালে তাঁর দূত প্রেরণ করেছেন পৃথিবীতে। এমনকি পাথরের মত শক্ত যাদের হৃদয [যেমন-প্যাগান আরবেরা] তাদের মাঝেও আমাদের নবীর মত দূত প্রেরণ করেছেন তাঁর রহমতের ফল্গুধারায় তাদের কঠিন হৃদয়কে সঞ্জীবিত করার জন্য। আর এই সব নবী ও রাসূলগণের চারিপাশে বিভিন্ন জাতি তাদের বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা, নিয়ে বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে ভীড় করেছে, তারা ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে, আত্মিক তৃষ্ণা মিটিয়েছে। যেমন-তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ইসরাঈলীদের ১২টি সম্প্রদায় ১২টি ঝর্ণাধারার চারিপাশে সমবেত হয়েছিল। আল্লাহ্ যুগে যুগে মানুষের জন্য ঐ ঝর্ণাধারার মত নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের অমিয় বাণীর প্রভাবে মানুষের আত্মা তার তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। আত্মার খোরাক আল্লাহ্ এই ভাবেই যুগে যুগে বিশ্ববাসীদের কাছে প্রেরণ করেছেন। আমরা এর জন্য পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। কীভাবে? আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা মৌখিক নয়-তা হবে কার্যাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ। আমরা আমাদের আচরণের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। আমরা নিজেদের অন্যায়, অবিচার ও স্বার্থপরতা নামক রিপু থেকে নিজেকে রক্ষা করবো। সর্বদা মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান ক্ষণস্থায়ী। আর এই ক্ষণস্থায়ী অবস্থানেরই কার্যকলাপ নির্ধারণ করবে আমাদের আগামী দিনের বা পরকালের অবস্থান। এই হচ্ছে বিশ্ব প্রতিপালকের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা। আর এই কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী অবস্থানকালে। যে ক্ষণস্থায়ী অবস্থান কালকে বলা যায় আমাদের 'শিক্ষানবীশকাল' (Probationary Period) অনন্ত পরকালের জন্য।
৭৪। 'মিশরা' কথাটির আরবী শব্দরূপ দাঁড়ায় 'যে কোন শহর'। কথাটির শব্দরূপই সব নয়, এর গূঢ় অর্থ হবে মিশরের যে কোনও শহর। কারন 'তানউইন' আরবী শব্দটির দ্বারা যা প্রকাশ করা হয়েছে তার অর্থ 'মিশরের' কোনও স্থানের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে কোন দেশ যা মিশরের মতই উর্বর। এই আয়াতে ইহুদীদের ভৎর্সনা করা হয়েছে। ইহুদীরা একই খাবার প্রতিদিন খাওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো। কারণ মিশরে তারা যখন কৃতদাস বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, ফেরাউনদের খাবারের প্রাচুর্য ও প্রকারভেদ তাদের প্রলুব্ধ করতো। দাসত্বের বন্ধন, অত্যাচার অপেক্ষা তাদের কাছে খাবারের বিভিন্নতা ও প্রাচুর্য হয়ে উঠলো বেশী লোভনীয়। এ ব্যাপারে হযরত মুসা (আঃ) এর ভৎর্সনা ছিল দু'ভাবে, (১) বিভিন্ন ধরণের সুস্বাদু খাবার যে কোনও শহরেই পাওয়া যায়, কিন্তু তার পরিবর্তে কি স্বাধীনতা বিক্রি করা যায়? সুস্বাদু খাবার অপেক্ষা কি স্বাধীনতা বহু মূল্যবান নয়? (২) সামনেই ইহুদীদের জন্য রয়েছে আল্লাহ্র অঙ্গীকারাবদ্ধ সমৃদ্ধির দেশ, আর পিছনে রয়েছে দাসত্বের দেশ (মিশর)। কোনটা মঙ্গলজনক? তারা কি ভালর প্রতিদানে মন্দকে বেছে নেবে?
৭৫। এখান থেকে এই আয়াতের অর্থ সার্বজনীন। আল্লাহ্ ইহুদীদের দাসত্ব মুক্ত করে আল্লাহ্র মনোনীত স্থানে তাদের বাসস্থান স্থির করলেন। কিন্তু ইহুদীরা আল্লাহ্র এই বিধি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। ফলে তাদের উপর আল্লাহ্র গজব নাজেল হলো। তাদের লাঞ্ছনা গঞ্জনা জাতীয় বিপর্যয়ে পরিণত হলো। এটা আমরা ইহুদীদের ইতিহাস পড়লেই দেখতে পাই। প্রথমতঃ তারা 'আসেরিয়ান'দের দ্বারা পরাজিত ও বন্দী হয়ে তাদের দেশে নীত হয়। পরে পারস্য সম্রাট তাদের আসেরিয়ানদের থেকে মুক্ত করে তাদের দাসে পরিণত করেন এবং এর পরে তারা আবার গ্রীক, রোমান ও আরবদের অধীনে চলে যায়। এর ফলে ইহুদী জাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই থেকে নিজেদের স্বাধীন আবাসস্থল থেকে বঞ্চিত হয় এবং সেই থেকে তারা পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেদের কোনও মাতৃভূমি নাই। এ লাঞ্ছনা এ জন্য হলো যে তারা আল্লাহ্র বিধি বিধানের প্রতি কুফরী করেছিলো এবং নবীদের হত্যা করেছিলো। তারা আল্লাহ্র আনুগত্য প্রকাশ করতো না এবং আনুগত্যের সীমা লঙ্ঘন করতো।
নবী-হত্যা শুরু হয় আবেল হত্যার মধ্য দিয়ে, যে ছিল ইহুদীদের পূর্বপুরুষ। এরপর ইয়াকুব নবীর জ্যোষ্ঠ পুত্ররা ইউসুফ নবীকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। ইউসুফ নবীকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁরা তাকে কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে। যদিও আল্লাহ্র অপার করুণায় তাঁর মৃত্যু ঘটে নাই, তিনি অপরিচিত বণিকদের দ্বারা উদ্ধারপ্রাপ্ত হন এবং মিশরে আনীত হন, কিন্তু তাঁর ভাইরা ভাতৃ হত্যার পাপে অভিযুক্ত। কারণ আল্লাহ্ কর্মকে বিচার করেন তার নিয়ত দ্বারা। ইউসুফ নবীর ভাইদের সংকল্প ছিল তাঁকে হত্যা করার। তিনি নিহত হন নাই সেটা আল্লাহ্র অসীম করুণা ও দয়া। কিন্তু এতে তাঁর ভাইদের মানসিক অবস্থা বা নিয়তের কোন তারতম্য ঘটে নাই। সুতরাং ভাতৃ হত্যার নিয়তের দরুন তাদের উপরে ভাতৃহত্যার পাপই বর্তায়। পরবর্তীতে তারা ঈসা নবীকে হত্যা করে। যদিও তারা সত্যিকারের ঈসা নবীকে হত্যা করতে পারে নাই। তাঁরই সদৃশ একজনকে হত্যা করে। সুতরাং নবী হত্যার নিয়ত বা সংকল্পের দরুণ হত্যার পাপের দায়ভার তাদের উপর বর্তায়। শেষে আমরা দেখি তারা হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কেও হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কুরআনের এই আয়াতের অর্থ যদিও ইহুদীদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে, কিন্তু এর নৈতিক আবেদন সার্বজনীন। এর নৈতিক উপদেশ হচ্ছে, যদি কেউ ব্যক্তিগত বা জাতিগতভাবে উদ্ধত ও অহংকারী হয় এবং নৈতিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক মুক্তি ও স্বাধীনতার চেয়ে পৃথিবীর চাকচিক্যময় জীবন ও ভোগ বিলাস অধিক পছন্দ করে, আল্লাহ্র আইন ভঙ্গ করে অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রদত্ত নৈতিক নিয়মাবলী (যথা সত্যি কথা বলা, চুরি না করা, আমানতের খেয়ানত না করা, ব্যভিচার না করা ইত্যাদি) ভঙ্গ করে, আল্লাহ্র নিয়ামত প্রত্যাখান করে [যেমন করেছিলো ইহুদীরা] তবে তাদের জন্য সে যে ব্যক্তিই বা জাতিই হোক, রয়েছে দুঃখজনক লাঞ্ছনা এই পৃথিবীতে এবং পরকালে।
রুকু - ৮
৭৬। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ইরাকের নিম্নাংশ বসরার সন্নিকটে খুব ছোট এক সম্প্রদায় বাস করে। এদের জনসংখ্যা ২০০০ এর বেশী হবে না। আরবীতে তাদের বলা হয় সুবী (বহুবচনে সুবা)। তাদেরকে বলা হয় সার্বিয়ান এবং নাসোরিয়ান, অথবা সেন্ট জনসের ক্রিশ্চিয়ান। এরা নিজেদের আধ্যাত্মিক রহস্যবাদী খৃষ্টানরূপে বা জীবনের মূল রহস্যভেদী রূপে দাবী করে। তারা সাদা কাপড় পরে এবং ঘন ঘন পানিতে ডুব দিয়ে গোসল করে। তাদের ধর্মপুস্তকের নাম গিন্জা, যা সিরীয় ভাষায় লেখা। তারা অগ্নি উপাসক বা জরাথুষ্ট্র। তারা যে কোন নদীকে ইয়ারডান (জর্দান) নামে অভিহিত করে। তারা তাদের মুসলমান প্রতিবেশীদের সাথে সুখ-শান্তিতে বসবাস করে। এদের সাথেই কুরআন শরীফ বর্ণিত সার্বিয়ানদের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায; কিন্তু আবার কুরআন বর্ণিত সম্প্রদায়ের সাথে সম্পূর্ণ একও নয়।
আর একটি সম্প্রদায় যাদেরকে বলা হতো হারানের নকল সার্বিয়ান। এই সম্প্রদায় তাদের লম্বা চুল ও অদ্ভূত পোষাকের জন্য ৮৩০ খৃষ্টাদে খলিফা হারুন-অর-রশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সম্ভতঃ তারা কুরআনের বর্ণিত সার্বিয়ান নাম গ্রহণ করে কারণ তাহলে তারা কিতাব প্রাপ্ত জাতিসমূহের অন্তর্গত হতে পারবে। এরা সিরিয়াবাসী এবং তারার পূজক (star worshipper) এবং এদের আচার আচরণ সমসাময়িক গ্রীক ভাষাভাষি ইহুদীদের মত। এরা যদিও নিজদের কিতাবপ্রাপ্ত জাতিসমূহের অন্তর্গত বলে দাবী করে তবে তা যৌক্তিক কিনা তা বিবেচ্য। এ ব্যাপারে মাওলানা ইউসুফ আলীর মতামত হচ্ছে (যদিও অনেক লেখক ভিন্নমত পোষণ করেন) সার্বিয়ান কথাটির সঙ্কীর্ণার্থে ব্যবহার না করে ব্যাপক ও সার্বজনীন অর্থে ব্যবহার করা যায়। এদের মধ্যে যুগে যুগে অন্যান্য মহান শিক্ষক যারা পৃথিবীকে নৈতিক শিক্ষা দানে ধন্য করেছেন তাঁদের সবাইকে অন্তুর্ভুক্ত করা যায়। এখানেও ইসলামের মাহাত্ম্য ও সার্বজনীনতা বিদ্যমান।
আর একটি শ্রেণী আছে যাদের সার্বিয়ান নামে অভিহিত করা হয়। এরা প্রাচীন আরবের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। যার সাথে ফিনিশিয়া দেশীয় এবং বেবীলন দেশীয়দের সম্যক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ৮০০-৭০০ খৃঃ পূর্বে আরবের দক্ষিণে ইয়েমেনের কাছে এদের এক সমৃদ্ধশালী রাজ্যের বিস্তার লাভ করে, যদিও এদের সাম্রাজ্যের সূত্রপাত হয় আরবের উত্তরাংশে।এরা তারার পূজক ছিল (সূর্য, চন্দ্র, ভেনাস)। সম্ভবতঃ শেবার রাণী এদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরা ৩৫০ খৃষ্টাব্দে আসোরিয়ানদের কাছে পরাভূত হয়। এদের রাজধানী ছিল সানার নিকটে। এরা পাথরের তৈরি প্রাসাদ তৈরি করেছিল যার বৈশিষ্ট্য ছিল সুদৃশ্য তোরণ।
৭৭। এই কথা বলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলাম ধর্ম কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের একচেটিয়া অন্তর্ভূক্ত নয়। যেমন-ইহুদীরা নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করে, খৃষ্টানেরা নিজেদের মনে করে ইহুদীদের থেকে উদ্ভূদ। অর্থাৎ আল্লাহ্র প্রদত্ত ধর্ম ইহুদীদের মধ্যে ব্যতীত আর কারও কাছে নাজেল হওয়া সম্ভব নয়। কারন তারা বিশ্বাস করে তারা আল্লাহ্র মনোনীত। এমনকি আধুনিক খৃষ্টান সম্প্রদায় সচেতনভাবে যা অযৌক্তিক ভাবে আল্লাহ্র প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে যে পাদ্রী বা পুরোহিতের সাহায্য পাপস্খালনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তারা বিশ্বাস করে যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আল্লাহ্র মনোনীত পাদ্রী বা পুরোহিতের প্রয়োজন। এর অর্থ দাঁড়ায় যে খৃষ্টান বা ইহুদী ব্যতীত আর কেহই আল্লাহ্র সন্নিকটে পৌঁছানোর যোগ্য নয়। কিন্তু উপরের আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হযরত মুহম্মদ (দঃ) এর পূর্বে পৃথিবীতে ইসলাম ছিল। কুরআন শরীফের [৩ : ৬৭] এ পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, হযরত ইব্রাহীম ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলমান। কারণ তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পন করেছিলেন। ইসলামের শিক্ষার মূল নির্যাস হচ্ছে আল্লাহ্র কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন। আর আল্লাহ্র ইচ্ছা হচ্ছে (১) বিশ্বাস করা স্রষ্টা এক এবং অদ্বিতীয়, পরকালে তার কাছেই ইহকালের হিসাব দিতে হবে এবং (২) তাঁরই সন্তুষ্টি বিধানের জন্য সৎ কাজ করতে হবে। এই দুই ধর্ম যে পালন করে, সে-ই প্রকৃত মুসলমান। তাদের কোনও ভয় নাই। ইসলামের এই শিক্ষা সর্বকালের, সর্বযুগের এবং সর্ব মানুষের জন্য।
৬৫। তোমরা তো ভাল করেই জানো তোমাদের মধ্যে যারা সাবাতের [শনিবারের] সম্পর্কে সীমালঙ্ঘন করেছিলো। আমি তাদের বললাম, 'তোমরা ঘৃণিত বানর হয়ে যাও।' ৭৯
৬৬। সুতরাং আমি তা সমসাময়িক ও তাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য করেছিলাম দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহ্ ভীরুদের জন্য করেছিলাম উপদেশ।
৭৯। ইহুদী ধর্ম মতে শনিবার হচ্ছে অত্যন্ত পবিত্র দিন। ঐদিনকে বলে সাবাত। ঐদিন সমস্ত কাজ নিষিদ্ধ, শুধুমাত্র সাপ্তাহিক উপসনার জন্য নির্দিষ্ট। হযরত মুসার আইন অনুযায়ী সাবাতের আইন ভঙ্গ করার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে একদল ইহুদী বাস করতো যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। এই সম্প্রদায় সাবাত আইন লঙ্ঘন করে সেদিনও মাছ ধরতো। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা মৎস্য শিকার করতো। ফলে তারা আল্লাহ্র রোষানলে পতিত হয় এবং তাদের আকৃতির রূপান্তর ঘটে। আয়াত [৭: ১৬৩-১৬৬]-এ বর্ণনা আছে যে, যেহেতু শনিবার বা সাবাত দিনে সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ থাকে মাছেরা নিরাপদ মনে করে ঐ দিন সমুদ্র উপকূলে নির্ভয়ে মাথা উচুঁ করে চলাফেরা করতো। কিন্তু সপ্তাহের অন্য দিন তা করতো না। এটা ছিলো ঐ সম্প্রদায়ের জন্য এক পরীক্ষা। বিভিন্ন রেওয়াত থেকে জানা যায় যে, ইহুদীরা শরীয়তের নির্দেশ অমান্য করার জন্য অপকৌশল অবলম্বন করে। তারা সমুদ্র উপকূলে নির্ভয়ে বিচরণশীল মাছগুলিকে ধরে লেজে লম্বা সুতো বেঁধে দিত এবং তার একটা মাথা ডাঙ্গায় কোন কিছুর সাথে বেঁধে রাখা হতো। রবিবার আসতেই সুতো টেনে মাছ শিকার করে নেওয়া হতো। এ শুধু আল্লাহ্র আইন লঙ্ঘনই নয়, এ এক রকম উপহাসও বটে। হয়তো বা তাদের মধ্যে ধারণা ছিলো যে তারা শনিবারে মাছগুলিকে বধ করছে না সুতরাং আল্লাহ্র আইন ভঙ্গ করছে না। কিন্তু আল্লাহ্র আইন ছিলো যে ঐ দিনটি মাছেদের জন্য নিরাপদ থাকবে। যেহেতু ইহুদীরা অপকৌশল অবলম্বনকারী, সেই কারণে তারা ধর্মের মূল ভিত্তি থেকে সরে এসে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তাদের ধারণা ছিলো তারা শনিবারে মাছ বধ না করে রবিবারে করছে। এটা ধর্মের পরিপন্থি হবে না। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার উপর তারা অত্যাধিক গুরুত্ব দিত। আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কোন ধর্ম নাই। এই সহজ সত্য বোঝা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও অপরিহার্য বটে। কারণ আত্মিক প্রণোদনা ব্যতীত কর্মের গুরুত্ব নাই। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ বিশদ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন মানুষের জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে 'নিয়তের উপরেই কর্মের ফলাফল নির্ভর করে'। একমাত্র আল্লাহ্ই অন্তর্যামী, তিনি সব কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আজকের মুসলিম সম্প্রদায় আল্লাহ্ প্রদত্ত ন্যায় ও সত্য পথকে পরিহার করে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। ফলে ঐ ধীবর ইহুদী সম্প্রদায়ের মতই তাদের আজ বিশ্বব্যাপী লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা।
৮০। এই আয়াতটি [৬৭-৭১] পড়তে হবে [২:৭২-৭৩] সঙ্গে সংযুক্তি করে। এই নীর্তিগর্ভমূলক বিবরণ এই যে, বনী ইসরাঈলীদের মধ্যে একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিলো। হত্যাকারী কে তা জানা কঠিন হয়ে পড়ে। বনী ইসরাঈলরা মুসা (আঃ)'র কাছে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তিনি আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী একটি গরু জবাই করার জন্য আদেশ দেন। তারা চিরাচরিত অভ্যাস ও প্রকৃতি অনুযায়ী এতে নানা প্রকার বাদানুবাদের অবতারণা করতে থাকে ও বলে তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছো? (কোথায় হত্যাকারীর সন্ধান, আর কোথায় গরু জবাই)। উপরের ঘটনার মাধ্যমে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত সহজ। হযরত মুসা কোরবানীর জন্য উপদেশ দিলেন। কিন্তু ইসরাঈলরা তা হাসি ঠাট্টা রূপে পরিগণিত করলো। কিন্তু যখন মুসা আল্লাহ্র নামে হল্ফ করে তাদের কোরবাণী দেয়ার জন্য ক্রমাগত তাগাদা দিতে লাগলেন, তখন তারা বিভিন্ন অজুহাতের অবতারণা করতে লাগলো। এসব অজুহাত ছিল কোরবাণী না দেওয়ার অজুহাত। কারণ যে সব প্রশ্ন তারা হযরত মুসাকে করেছিলো যদি তারা আন্তরিক হতো কোরবাণীর ব্যাপারে তবে তারা নিজেরাই প্রশ্নের সমাধান করতে পারতো। হযরত মুসার নির্দেশ খুব সহজেই বুঝতে পারতো। কিন্তু তারা আল্লাহ্র নির্দেশ বুঝতে চেষ্টা করে নাই মোটেও। তাদের উদ্দেশ্য ছিল খারাপ, দোষত্রুটি খুঁজে সমালোচনা করাই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য। পুরো জিনিষটাই ছিল তাদের এক ধরণের ভাল অপকৌশল, যে তারা সুপথের বা আল্লাহ্র নির্দেশকে বুঝতে চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত যখন তাদের কোনও অজুহাত বা টালবাহানা টিকলো না তখন তারা গরু কোরবানী দিল কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ফলে তাদের নিবেদন (কোরবানী) এর মূল সুর যা হচ্ছে আত্মাকে পাপ থেকে পরিশুদ্ধ করা, তা হারিয়ে যায়। তারা কৌশলে সত্যকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। এই এড়ানোর চেষ্টা স্বরূপ তারা নানা রকম কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। কারণ বিবেককে প্রতারিত করতে অনেক কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়।
৬৯। তারা বলেছিলো, 'আমাদের পক্ষ থেকে তোমার প্রভুর নিকট প্রার্থনা করে স্পষ্টভাবে জেনে নাও উহার রং কি?' সে [মুসা] বলেছিলো, 'আল্লাহ্ বলেছেন, [হরিণ শিশুর ন্যায়] হলুদ বর্ণের গাভী, উজ্জ্বল রং এর আমেজ যা দর্শকদের সন্তুষ্ট করে।'
৭০। তারা বলেছিলো, 'আমাদের পক্ষ থেকে তোমার প্রভুর নিকট বল, তিনি যেনো আমাদের সুস্পষ্ট করে বলেন এটি কেমন হবে; আমাদের নিকট সকল গাভীই এক রকম; যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন তবে নিশ্চয়ই আমরা নির্দেশ পাব।
৭১। সে বলেছিলো, 'আল্লাহা বলেছেন, উহা এমন একটি গাভী যা ক্ষেত চাষ বা পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয় নাই। সুস্থ এবং নিখুঁত।' তারা বলেছিলো, 'এখন তুমি সত্য এনেছ।' অতঃপর তারা গাভীটিকে কোরবাণী দিলো যদিও তারা তা করতে ইচ্ছুক ছিলো না।
রুকু - ৯
৮১। ইহুদী ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মাঠে ফেলে রাখা হয়েছিলো, কেউই জানতো না তার হত্যাকারী কে? আল্লাহ্র নির্দেশ হলো বক্না গাভী কোরবানী দিয়ে তার উপরে নগরের প্রতিটি লোক তার হস্ত প্রক্ষালন করবে এবং নিজেকে নির্দোষ দাবী করবে। এভাবেই তাদেরকে রক্তের ঋণ শোধ করতে হুকুম দেয়া হল। প্রথমে তারা একে অন্যকে দোষারোপ শুরু করলো, তারপরে তারা চেষ্টা করলো যেন বক্না গাভটিকে কোরবানী দেওয়া না হয়, সেজন্য নানা টালবাহানা বের করলো যেমন বর্ণনা করা হয়েছে। যখন গরু জবাই হলো, আল্লাহ্র হুকুমে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে তার হত্যাকারীকে সনাক্ত করলো।
এই আয়াতের উপদেশ হচ্ছে, মানুষ তার পাপ ও অন্যায়কে লুকাতে চায়। এটা হতে পারে ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে। কিন্তু পাপ কখনও লুকায়িত থাকে না। যে কোন ভাবেই হোক পাপ জনসম্মুখে প্রকাশ পাবেই। এ-ই হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান। ইহুদীদের জাতীয় ইতিহাসের মাধ্যমে এই শিক্ষাই আমাদের দেয়া হচ্ছে।
৭৪। এরপরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেলো; কাঠিন্যে পাথরের মত অথবা তদপেক্ষা অধিক। পাথরের মধ্যে এমনও কতক আছে যেগুলি থেকে নদী বেগে উৎসারিত হয়; কতক এমন আছে যেগুলি বিদীর্ণ হলে তা থেকে পানি নির্গত হয়; এবং এমনও কতক আছে যা আল্লাহ্র ভয়ে ধ্বসে পড়ে। এবং তোমরা যা কর আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে অমনোযোগী নন ৮২।
৮২। পাপী লোকের হৃদয় কঠিন থেকে কঠিনতর হয় যত দিন যায়। সুন্দর উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে যে এদের হৃদয় শক্ত পাথরের থেকেও শক্ত। আমাদের ধারণা প্রকৃতিতে পাথরের থেকে শক্ত আর কিছু নাই। কিন্তু এই পাথরের বুক চিরেই ঝর্ণাধারার উৎপত্তি হয়-যা পরবর্তীতে নদীতে রূপান্তরিত হয়। যে নদীপ্রবাহ মানুষের জীবন ফুলে-ফলে ভরিয়ে তোলে। আবার এমন পাথরের স্তর আছে যা ডিনামাইটের সাহায্যে উড়িয়ে দিলে তার নীচে সুমিষ্ট পানিয় জলের স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়। আবার এমন অনেক পাথরের স্তর আছে যা প্রাকৃতিক কারণে বা ভূমির চাপ বা ভূমিকম্পন ইত্যাদিতে মাটির নীচে ডুবে যায় এবং ফলশ্রুতিতে পানির স্তরকে মাটির উপরে এনে দেয়। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে-১৯৩৪ সালে বিহারের ভূমিকম্পে ঠিক এরকমই এক ঘটনা ঘটে। একেই কবিতার ছন্দে উপমার সাহায্যে বলা হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি আল্লাহ্র হুকুম মেনে চলে। এমনকি কঠিন পাথরের বুকেও সুমিষ্ট পানির সন্ধান লাভ করা যায় আল্লাহ্র হুকুমে। ঠিক সেইরকম যে কঠিন হৃদয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ্ ভীতি থাকবে সে হৃদয় যত কঠিনই হোক না কেন একদিন না একদিন তা অনুতাপের আগুনে গলে চোখের পানিতে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। খোদভীতি তার অন্তরের তন্ত্রীগুলোতে অনুতাপের আগুন জ্বেলে দেবে। পাথরের বুকে যেমন সুমিষ্ট ঝর্ণাধারার সৃষ্টি হয়, অনুতাপের আগুনে কঠিন হৃদয়ে আল্লাহ্ প্রেমের অমিয় ধারার সৃষ্টি হবে। কিন্তু জ্ঞান পাপীর হৃদয় ঐ প্রস্তর খন্ডের চেয়েও বেশি শক্ত। পৃথিবীর কোন শক্তিই ঐ হৃদয়কে আল্লাহ্র ভয়ে ভীত করতে পারবে না। পারবে না ঐ কঠিন হৃদয় থেকে উৎসরিত করতে আল্লাহ্ প্রেমের অমিয় ধারা।
৭৬। দেখো! যখন তারা মুমিনদের সংস্পর্শে আসে, তারা বলে, 'আমরা ঈমান এনেছি' ৮৩, কিন্তু যখন তারা একান্তে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়, তখন তারা বলে, 'আল্লাহ্ তোমাদের যে প্রত্যাদেশ দিয়েছেন তোমরা কি তাদের তা বলে দেবে; যেনো ইহার দ্বারা তোমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ্র সামনে যুক্তি পেশ করতে পারে?' তোমরা কি [তাদের উদ্দেশ্য] বুঝতে পার না ?
৮৩। তাৎক্ষণিকভাবে এই আয়াতে মদিনার সমসাময়িক ইহুদী সম্প্রদায়ের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন-সর্বকালের, সর্ব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য-
মদিনার মুসলিমদের ধারণা ছিল ইহুদীরা হযরত মুহম্মদ-কে (সাঃ) নবী হিসেবে সাদরে গ্রহণ করবে। কারণ তাদের ধর্মগ্রন্থে মুহম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে বলা আছে। কিন্তু মুসলমানদের এ ধারণা ছিল ভুল। তাদের ধর্মগ্রন্থে [Deut xviii-১৮] এ বর্ণিত আছে যে, 'I will raise them up a prophet from among their brethen, like unto thee' অর্থাৎ হযরত মুসার মত।
এই লাইনটি ইহুদীদের মধ্যে কিছু গুণী এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) হচ্ছেন আল্লাহ্র অঙ্গীকার করা সেই নবী। ফলে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আরবেরা সেমেটিকদের স্বগোত্রভূক্ত। ইহুদীরা সেমোটিক গোত্রভূক্ত। সুতরাং ইহুদী ধর্মগ্রন্থে সঠিকভাবেই বর্ণিত হয়েছে যে, 'তোমাদের ভ্রাতৃদের মধ্যে থেকেই হযরত মুসার মত নবী প্রেরণ করা হবে'। আর এ কথাও ঠিক যে হযরত মুহম্মদ (দঃ) ব্যতীত আর কোনও নবীই হযরত মুসার মত ছিলেন না। ওল্ড টেস্টামেন্টের পঞ্চম গ্রন্থ 'Deuteronomy' যা হযরত মুসার বহু পরে লেখা হয়েছিলো, তাতে বলা হয়েছে, 'There arose not a prophet since in Israel like unto Moses, whom the lord knew face to face.'
তাই হযরত মুহম্মদের (দঃ) আগমনে ইহুদীরা অত্যন্ত হিংসা অনুভব করতে থাকলো। কারণ হযরত মুহম্মদকে (দঃ) হযরত মুসার প্রতিদ্বন্দী ভাবতে শুরু করলো। মুসলমানদের সাথে তারা দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে থাকলো। মদিনায় যখন ধীরে ধীরে মুসলিম কমিউনিটি বড় হতে থাকলো এবং শক্তি সংগ্রহ করতে থাকলো, তখন ইহুদীরা এমন ভান করতে থাকলো যে তারা মুসলিমদের উন্নতিতে খুশী এবং তারা তাদেরই একজন। কিন্তু সত্যিকারভাবে তাদের মনোভাব ছিল অন্য। তারা সযত্নে তাদের ধর্মগ্রন্থ বর্ণিত হযরত মুহম্মদের (দঃ) আগমন বার্তা গোপন রাখে যেনো তারা এ ব্যাপারে কখনও প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়।
ইহুদীদের এই দ্বৈত ভূমিকা সমন্বিত এই আয়াতটির সার্বজনীন ব্যাখ্যা হচ্ছে সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বসাধারণের জন্য। আল্লাহ্তে বিশ্বাস হচ্ছে এক ধরণের নৈতিক মূল্যবোধ, এক ধরনের নীতিজ্ঞান, এক ধরণের আদর্শ। যুগে-যুগে, কালে-কালে, বিশ্বাস বা আদর্শকে টিকে থাকার জন্য জিহাদ করা হয়েছে, ক্ষমতা, শক্তি, সামাজিক মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, সংঘটিত সংঘ ও প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষ সুযোগ সুবিধার বিরুদ্ধে। এই জিহাদে বিশ্বাস বা সদ্যনীতি বা আদর্শ যখন জয়লাভ করে তখন দেখা যায় যে, সব প্রতিকূল শক্তি বা অবিশ্বাসীরা যারা এতদিন বাধা দান করেছে তারা বন্ধুর ছদ্মবেশে, মিত্রের ছদ্মবেশে তাদের দিকে সখ্যতার হাত বাড়ায়। কিন্তু অবিশ্বাসীরা কোনও নীতিতেই বিশ্বাসী নয়, তারা সব সময়েই বিশ্বাসীদের অর্থাৎ নীতিজ্ঞান সম্পন্নদের কাফেলার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত। বন্ধুত্ব তাদের একটি ভান মাত্র।
বিশ্বাসীরা তাদের জ্ঞান ও মেধাকে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করে ফলে আল্লাহ্ তাদের জ্ঞান ও মেধাকে [এই জ্ঞান শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান বা ধর্মের ইত্যাদির] আরও বিকশিত করেন। তাদের এই সাফল্য অবিশ্বাসীদের আরও হিংসার কারণ হয়। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, তিনি সবই জানেন। বিশ্বাসীদের সত্যিকারভাবে জ্ঞানার্জন করতে বলা হচ্ছে এবং এর জন্য সর্বপ্রকার দুঃখ কষ্ট স্বীকার করতেও দ্বিধাবোধ না করে, এমনকি প্রয়োজনে বিদ্যা অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যেতেও তাদের অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। এরপর আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে বিশ্বাসীদের এই জ্ঞানকে যদি জনহিতকর কার্যে নিয়োজিত করা হয় তবে অবশ্য ছদ্মবেশধারী অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদের কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হবে। অবিশ্বাসীরা হয় নীতিজ্ঞান শূন্য, কপট ও ভণ্ড। তারা সু-সময়েই বন্ধুর ছদ্মবেশে বিশ্বাসীদের আস্থাভাজন হয়ে তাদের বিপথে চালিত করতে চায়।
৭৮। তাদের মধ্যে কিছু নিরক্ষর লোক আছে, যারা [নিজেদের] আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যতীত কিতাব সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নাই। তারা অনুমান ব্যতীত আর কিছু করে না। ৮৪
৮৪। এই আয়াতটি [২:৭৬] এর বর্ধিত অংশ হিসেবে ধরা হয়েছে। ইহুদীরা তাদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত জ্ঞানকে (অর্থাৎ হযরত মুহম্মদের (দঃ) আর্বিভাবের খবর) গোপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইহুদীদের মধ্যে যারা ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারতো তারাও নিরপেক্ষ ছিল না। অশিক্ষিতদের সাথে তাদের খুব পার্থক্য ছিল না। কারণ তারা তাদের ধর্মগ্রন্থের আসল উপদেশ খুব ভালভাবেই জানতো, কিন্তু তারা তা বিকৃত করে নিজেদের মনগড়া তথ্য যা শুধুমাত্র অনুমানভিত্তিক তা পরিবেশন করতো। তারা মানুষকে প্রতারণা করার জন্য নিজস্ব লেখাকে আল্লাহ্র বাণী বলে প্রচার করতো। এই জঘন্য প্রতারণা তাদের সাময়িক সুবিধা দান করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু এই সুবিধা বা লাভ কখনও সত্যিকারের হতে পারে না। যদি এই সুবিধার পরিবর্তে সমস্ত পৃথিবীও করতলগত হয় তবুও তা জোচ্চুরি, আর তা হচ্ছে আত্মাকে বিক্রি করার সামিল। তারা ক্রয় করলো 'Gained the whole world and lost their own souls.' কারণ নিজের হাতে বাণী লিখে আল্লাহ্র বাণী বলে প্রচারিত করা জঘন্য পাপ। কারণ এর মধ্যে কোনও সত্য নাই।
[সর্বজনীন উপদেশ হচ্ছে, ধর্মহীনতা সব সময়েই নিজস্ব মনগড়া কাল্পনিক স্রষ্টা গড়তে ভালবাসে। ধর্মহীন ব্যক্তির নিজস্ব সুযোগ, সুবিধা, কল্পনা যা তাকে আত্মতৃপ্ত করে তার নিজস্ব কল্পনার জগৎকে। তার নিজস্ব ধর্মকে সে নিজে সৃষ্টি করে, কিন্তু প্রতারিত করে বিশ্বস্রষ্টার নামে। দেখা যায় তারা তাদের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য অন্যায় অবিচার, অপরাধের আশ্রয় নেয়। এ সবই করে শুধুমাত্র জনসাধারণকে প্রভাবিত করার জন্য তাদের স্বপক্ষে, এর সাথে স্রষ্টার তুষ্টির কোন সম্পর্ক নাই। ধর্মের নামে এই অনাচার যুগে যুগে দেশে দেশে সংগঠিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এর থেকে আমরা মুসলমানেরাও বাদ যাচ্ছি না। এর ফল অত্যন্ত বিষদায়ক। তাৎক্ষণিকভাবে কখনও এর কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে তা খুব স্বল্প সময়ের জন্য। এ যেনো সেই সাবানের বুদবুদ যা স্বল্পকালের জন্য রামধনুর বর্ণালী বিচ্ছুরিত করে আকাশে ওড়ে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেটে যায়। সেইরূপ ধর্মের নামে জোচ্চুরী সব সময়েই ধ্বংস ডেকে আনবে।-অনুবাদক]
৮০। এবং তারা বলে, 'দিন কতক ব্যতীত আগুন আমাদের স্পর্শ করবে না।' ৮৫। বল, 'তোমরা কি আল্লাহ্ সম্বন্ধে এমন কিছু বলছো যা তোমরা জান না?
৮৫। উদ্ধত অহংকারী ইহুদীরা দাবী করে যে, যেহেতু তারা হযরত ইব্রাহীমের বংশধর তারা যত গুণাহ্ করুক না কেন তারা বেহেশ্তে যাবেই। যদি তাদের কারও দোযখে যেতেই হয় তবে তা হবে শুধুমাত্র অল্প কয়েকদিনের জন্য। তারপর তাদের বেহেশ্তে পুনর্বাসিত করা হবে। তাদের এই মিথ্যা অহংকারকে বা মিথ্যা দাবীকে আল্লাহ্ [২ : ৮১-৮২] নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মিথ্যার ফানুস সত্যের আঘাতে ফুটো হয়ে গেছে।
সাধারণ উপদেশ হচ্ছে, ধর্মহীনতা উৎপন্ন করে মানসিক অবিশ্বাস, অবিশ্বস্ততা। আর তাই অবিশ্বাসী ব্যক্তিদের দেখা যায় নিজেদের সম্বন্ধে অন্ধ আত্ম অহংকারে মত্ত থাকতে। এরা নিজেদের সম্বন্ধে পদ মর্যাদা, উচ্চ বংশ গৌরব, সভ্যতা, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতা দাবী করে। কারণ এরা মনে করে তারা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তি। এরা জানে না যে, যা কিছুর উপরই তাদের লোভ থাকুক না কেন এর কোন কিছুই তাদের অধিকারে নেই। অসামান্য ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি নিয়েও মানুষ মুহূর্তের মধ্যে নির্মমভাবে লাঞ্ছিত হতে পারে। বাহ্যিকভাবে সুশ্রী হয়েও চিত্তে ধারণ করতে পারে অপরিমেয় অসুখ যন্ত্রণা। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও সাধারণ মানুষের পদদলিত হতে পারে, হতে পারে জীবনের প্রতিকূলে যে কোন বিপর্যয়। আর মানুষের জীবনের এইসব প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তির কোন কিছুই মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। মানুষ চেষ্টা করতে পারে কিন্তু চেষ্টা করার মানসিকতা তৈরি করতে পারে না। যখন আল্লাহ্ কাউকে সে মানসিকতা দেন আর যখন সে তা অবহেলা করে তখন কোন কিছুই আর তার জন্য ভাল অবস্থা তৈরি করতে পারে না। মানুষের মনের উপর সৃষ্টিকর্তার রয়েছে এই রকম সুক্ষ্ণ ও সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু তাদের এই বিপরীতে মানসিক অবস্থা তাদের ধর্মহীনতারই ফসল। এই ধর্মহীনতার কয়েক রকম আছে। কেউ ধর্মের নামে ধর্মহীন, কেউ মানবতার নামে ধর্মহীন, কেউ ব্যক্তিস্বার্থে ধর্মহীন। তবে ধর্মহীনতার বা অবিশ্বাসের মূল কথা হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ। কিন্তু আল্লাহ্ সব জানেন-মানুষের অন্তরের নিয়ত সম্পর্কে। আল্লাহ্র রহমত তারই উপরে বর্ষিত হবে যে লোক দেখানো বা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নয়, শুধুমাত্র আল্লাহ্কে খুশী করার জন্যই চারিত্রিক গুণাবলী (Conduct of life) অর্জন করবে।
৮৬। নিজস্ব স্বার্থ বা লাভের জন্য যারা পাপ করে তারা আল্লাহ্র চোখে অত্যন্ত গুণাহ্গার। তারা সাধারণ পাপীদের থেকে বহুগুণ জঘন্য। কারণ নিজের স্বার্থ-লাভের জন্য যারা পাপ করে তারা চরম স্বার্থপর। স্বার্থপরতা এমন একটি দোষ যা মানুষের ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা লুপ্ত করে দেয়। আর ন্যায়-অন্যায়বোধ লুপ্ত মানুষ হয় সমস্ত নীতিজ্ঞান বা বিবেক বিবর্জিত। এর উদাহরণ আমরা বাংলাদেশীরা আমাদের চারিপাশে ব্যক্তি জীবনে বা জাতীয় জীবনে দেখতে পাই। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কারণ আল্লাহ্ মানুষকে বিবেক দান করেছেন। কিন্তু মানুষ যখন তার নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সেই বিবেককে বিসর্জন দেয়, তখন অন্যায়ের পথ, পাপের পথ তার পক্ষে হয় অনেক সহজ, অনেক মসৃণ। নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য যারা পাপ কাজ করে তাদের মানসিক অবস্থা [State of mind] এমনরূপ ধারণ করে যে, সেখানে কোনও ভালো, কোনও ন্যায়, কোনও সত্য প্রবেশ করতে পারে না। [They are impervious to truth and justice] অর্থাৎ তাদের ন্যায় ও সত্য বোঝার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই আল্লাহ্ বলেছেন যারা শুধুমাত্র জাগতিক লাভ ও নিজস্ব স্বার্থের জন্য পাপ করে তাদের ক্ষতি সাধারণ পাপীদের থেকে অনেক বেশি। কারণ তারা তাদের আত্মাকে বিক্রি করে দেয় স্বার্থপরতার কাছে।
রুকু - ১০
৮৭। উপরের আয়াতে বলা হচ্ছে যে সেই সব নির্দেশের কথা যা তাওরাতে আল্লাহ্ হযরত মুসাকে দিয়েছিলেন। আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, একত্ববাদে ঈমান, পিতা-মাতা, এতিম বালক-বালিকা ও দীন-দরিদ্রের সেবা যত্ন করা, সব মানুষের ভালর জন্য কথা বলা এবং যাকাত দেওয়া ইসলামী শরীয়তসহ পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহেও বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ এইসব নৈতিক অনুশাসন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বজাতির জন্য প্রযোজ্য [Universal]। যদি কেউ আল্লাহ্র এই আইন অমান্য বা লঙ্ঘন করে, তবে আল্লাহ্র শাস্তি সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কারও জন্য তা লাঘব করা হবে না। [২ : ৮৬]।
'মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলবে' বা 'Speak fair to the people' কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। এর আবেদন অনেক গভীর। শুধুমাত্র বাহ্যিক ভালো ব্যবহার চরিত্রের নম্রতা প্রকাশ করে না। এর অর্থ অনেক গভীর, অনেক ব্যাপক। নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত এদের সাথে শুধু ভাল ব্যবহারই যথেষ্ট নয়, এদের অধিকারের জন্য কথা বলা, দুঃখীর সান্তনার জন্য কথা বলা, দুঃখ মোচনের জন্য কাজ করা, সত্য গোপন না করে সত্যর জন্য কথা বলা, এ সবই এই আয়াতটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ যেখানেই মানুষের প্রতি অন্যায় অবিচার হতে দেখা যাবে সেখানেই আল্লাহ্ নির্দেশ অনুযায়ী তার পাশে দাঁড়াতে হবে, তার হয়ে কথা বলতে হবে।
৮৮। [২ : ৮৩] আয়াতটি হচ্ছে সার্বজনীন। পূর্বের আয়াতে যে অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছিল [২:৮৪], আয়াতে তারই পরিশিষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। এই পরিশিষ্টে বলা হচ্ছে যে, মদিনায় হযরত মুহম্মদের (দঃ) নেতৃত্বে যে মুসলিম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের সাথে মদিনার ইহুদীরা চুক্তিতে আসে যার শর্তগুলি আয়াতে [২:৮৪] বর্ণিত হয়েছে। চুক্তিটি ইব্নে হিশামের সিরাত-উর-রসূল এবং আমীর আলীর স্পিরিট অফ ইসলাম গ্রন্থে [পৃষ্ঠা ৫৭-৬১ লন্ডন ১৯২২] বর্ণিত আছে। হিযরতের দ্বিতীয় বর্ষে মদিনায় ইহুদীরা বিশ্বাস ঘাতকতা করে এবং ঐ চুক্তি লঙ্ঘন করে। সে সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে।
৮৯। বনী ইসরাঈলকে তিনটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রথমতঃ খুনোখুনী না করা, দ্বিতীয়তঃ বহিস্কার অর্থাৎ দেশত্যাগে বাধ্য না করা, তৃতীয়তঃ স্বগোত্রের কেউ কারও হাতে বন্দী হলে অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা। এই আয়াতটি অনুবাদের সময়ে কেউ কেউ 'মুক্তিপণ আদায়' করতো আবার কেউ 'মুক্তিপণ দিত' এই অনুবাদ করেছেন। সে সময়ে মদিনায় অনেকগুলি ইহুদী গোত্র বাস করতো। এর মধ্যে আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রায়ই লেগে থাকতো এবং এই সব যুদ্ধ বিগ্রহে উষ্কানী এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজেদের সুযোগ সুবিধা মত মদদ দেওয়াই ছিল অন্যান্য ইহুদী গোত্রদের কাজ। বিনিময়ে তারা যুদ্ধলব্ধ ধন-সম্পদের হিস্সা পেত। তদুপরি তারা পরাজিতদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতো। ইহুদীরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ প্রায়ই করতো ফলে তারা আল্লাহ্র প্রথম ও দ্বিতীয় আদেশ অমান্য করতো। তৃতীয় আদেশ যদি অনুবাদ হয় মুক্তিপণ নিত অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে মুক্ত করতো, তবে তৃতীয় আদেশও অমান্য করতো কিন্তু যদি অনুবাদ হয় 'মুক্তিপণ দিত' অর্থাৎ মুক্ত করার জন্য তারা টাকা পয়সা দিত। সেক্ষেত্রে অনেক অনুবাদকের মতে, ইহুদীরা আল্লাহ্র প্রথম দুটি আদেশ অমান্য করে ধার্মিকতা প্রদর্শনের জন্য যুদ্ধবন্দী ঘটা করে মুক্ত করতো এবং সে জন্য চাঁদা প্রদান করতো। অথচ যুদ্ধ না করার ও অযথা নির্বাসন না দেওয়ার ওয়াদা ভঙ্গ করতে তারা দ্বিধাবোধ করে নাই।
এই আয়াতটির সার্বজনীন উপদেশ হচ্ছে একদিকে আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করা অন্যদিকে ধার্মিকতা প্রদর্শন করা ইহুদীদের এই মানসিকতা সর্বকালে সর্বস্থানে পৃথিবীর বহু জাতির মধ্যে দেখা যায়। যেমন-আমাদের দেশে অসৎ পথে অর্জিত অর্থে দান-ধ্যান করে ধার্মিকতা প্রদর্শন করে। অথচ অসৎ পথে অর্থ উপার্জন আল্লাহ্র নিষেধ। এই নিষেধ ভঙ্গ করতে দ্বিধাবোধ করে না; কিন্তু সে অর্থে ধার্মিকতা প্রদর্শনে আত্মতৃপ্তি পায় এ রকম উদাহরণ পৃথিবীর বহু জাতির মধ্যে বিদ্যমান।
রুকু - ১১
৯০। [১৯:১৬-৩৪] এই আয়াতগুলিতে যীশুখৃষ্টের জন্মের বিবরণ দেয়া হয়েছে। কেন তাঁকে 'মরিয়মের পুত্র' নামে সম্বোধন করা হয়েছে? 'স্পষ্ট প্রমাণ' কি? 'পবিত্র আত্মা' কে যা দ্বারা তাঁকে শক্তিশালী করা হয়েছিলো? আমরা কুরআনের এই উক্তি সম্বন্ধে পরে আলোচনা করবো। দেখুন সূরা ৩, আয়াত ৬২ এবং টিকা ৪০১।
৯১। সেকশন ১১-১৩, আয়াত [২:৮৭-১১২] পর্যন্ত সাধারণভাবে কিতাবী লোকদের সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে বিশেষভাবে ইহুদী ও খৃষ্টানদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে যেসব নৈতিক আইনাবলী বিদ্যমান তা ইহুদীদের কিতাব যা আল্লাহ্ মুসাকে দান করেছেন তারই অনুরূপ। হযরত মুহম্মদের (দঃ) ধর্ম ইসলামের শিক্ষা সেই একই স্রষ্টার কাছ থেকে আগত। সুতরাং খৃষ্টান বা ইহুদীদের তা না বোঝার বা না সনাক্ত করার কথা নয়। কিন্তু তাদের অন্ধ অহংকার ও উদ্ধতপনা তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ উপদেশ হচ্ছে, অহংকার একটি খারাপ রিপু যা সত্যকে দেখতে, অনুধাবন করতে ও গ্রহণ করতে বাধা দেয়।
৯২। অহংকার বা অহংবোধ মানুষকে অন্ধ করে তোলে, এর ফলে স্রষ্টার করুণা ও মানুষের আত্মার মাঝে দেয়ালের সৃষ্টি হয়। ইহুদীদের ঠিক সেই অবস্থা হয়েছিলো। তারা বিশ্বাস করতো যে আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান ও বিবেক দ্বারা একমাত্র তাদের হৃদয়ই পূর্ণ। গর্ব এবং অহংকার তাদের চোখের উপর পর্দা টেনে দিয়েছে-তাই তারা প্রকৃত সত্যকে দেখতে বা অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। তাদের দাবী, যে একমাত্র তারাই আল্লাহ্র বাণীর ধারক, বাহক ও রক্ষক। এ শুধু যে মিথ্যা তা-ই নয়, এ এক ধরণের কুফ্রী। বাস্তব সত্য হচ্ছে তারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারা অবিশ্বাসী, তারা আল্লাহ্কে বিশ্বাস করে না।
সার্বজনীন উপদেশ হচ্ছে যুগে-যুগে, কালে-কালে, দেশে-দেশে বহু ব্যক্তি, বহু জাতি দেখা যায় যারা ক্ষুদ্র জ্ঞানের অধিকারী হয়ে অহংকারে অন্ধ হয়ে যায় এবং এই অন্ধ অহংকার তাদের জ্ঞানের বৃহত্তর পরিসরে প্রবেশে বাঁধা দান করে। ধর্ম সম্বন্ধে ক্ষুদ্র জ্ঞান তাদের করে তোলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, একগুঁয়ে, অহংকারী। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা জন্মায়। এই মনোভাবের কারণেই যুগে যুগে, কালে-কালে, ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ কলহের সৃষ্টি হয়েছে। এই মনোভাব হচ্ছে প্রকৃত কুফরী মনোভাব, অধার্মিকতার বা অবিশ্বাসের মনোভাব। আধ্যাত্মিক জগতে আল্লাহ্র নেয়ামত অফুরন্ত। এই সব মৌলবাদীরা অহংকারের ফলে সেই অফুরন্ত নেয়ামত হৃদয়ে ধারণ করার দরজা বন্ধ করে দেয়। ফলে তারা আল্লাহ্র রোষানলে পতিত হয়।
৯৩। মূল শব্দ 'কাফারা' এর অনেক মানে আছে-
১) আল্লাহ্র রহমতকে অস্বীকার করা এবং অকৃতজ্ঞ হওয়া।
২) ধর্মে বিশ্বাস হারানো এবং প্রত্যাদেশকে আল্লাহ্র প্রেরিত বাণীরূপে বিশ্বাস না করা।
৩) এরা আল্লাহ্র সম্পর্কে বহু মনগড়া কথা বলে। ব্যাখ্যা দান করে যা আল্লাহ্র প্রতি নিন্দারূপে আল্লাহ্র চোখে পরিগণিত।
এই লাইনটিতে এর যে কোনও একটি মানে প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু মনে হয় এই লাইনটিতে এর তিনটি অর্থই সমভাবে প্রযোজ্য।
৯৫। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববোধ, অন্ধ অহংকার, উদ্ধত দৃষ্টিভঙ্গী ইহুদীদের কুরআনের সত্যকে গ্রহণ করতে বাঁধা দান করেছে। কারণ, কুরআন এবং হযরত মুহম্মদ (দঃ) তাদের জাতির বাইরের একজন। তাদের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী একমাত্র তারাই শ্রেষ্ঠ জাতি। সুতরাং আল্লাহ্র কিতাব পাওয়ার অধিকারী একমাত্র তারাই। এখানে সার্বজনীন উপদেশ হচ্ছে, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের (Racial arrogance) দাবী তা কি আজকের পৃথিবীতে অনুপস্থিত? অনুপস্থিত নয়, আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে এই বিকৃত মানসিকতার সন্ধান পাই। বিকৃত এই জন্য যে এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী আল্লাহ্র খুব অপছন্দ। আজকের পৃথিবীতে মৌলবাদী মুসলমানদের আমরা ঐ ইহুদীদের মতই দাবী করতে দেখি যে, মুসলমান নামের দরুণই আমরা বেহেশ্তে যাব। অন্য সব ধর্মের লোকেরা দোযখে যাবে। কিন্তু [২:৬২] আয়াতে আল্লাহ্ পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছেন যে, যে কেউ একত্ববাদে বিশ্বাসী এবং পৃথিবীর কাজকর্মের জন্য পরকালের জবাবদিহিতাতে বিশ্বাস করবে এবং স্রষ্টার সৃষ্টির সেবার জন্য সৎ কাজ করবে সেই বেহেশ্তের অধিকারী হবে। এখানে কোনও নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর কথা বলা হয় নাই।
সুতরাং মানুষ কিভাবে সীমানা নির্ধারণ করে, কে বেহেশ্তে যাবে আর কে যাবে না? আল্লাহ্ এই বিশাল বিশ্বভূবনের মালিক। তিনিই এর নিয়ন্তা, পরিচালক ও পালনকর্তা। বেহেশ্ত দোযখের সীমা নির্ধারণ করার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই। সুতরাং এভাবে যারা আল্লাহ্র আদেশ লঙ্ঘন করে তারা ইহুদী, খৃষ্টান বা মুসলিম যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তারা সবাই আল্লাহ্র রোষানলে পতিত হবে।
৯৬। ইহুদীদের এই জাতিগত আভিজাত্য যা তারা দাবী করে তা তাদের কাজের দ্বারা প্রমাণিত হয় না। কারণ ইহুদীরা তাদের নিজ গোষ্ঠীভূত বহু পয়গম্বরকে হত্যা করেছে। যখনই তাদের নিজেদের মতের সাথে সত্যের বিরোধ হয়েছে তখনই তারা তাদের হত্যা করেছে। অথচ এসব পয়গম্বরেরা বিশেষভাবে তাওরাতের শিক্ষাই প্রচার করতেন। এসব হত্যাকারীদেরই ইহুদীরা নেতা ও পুরোহিত মনে করেছে। এভাবে তারা তাওরাতের সাথে কুফ্রী করেছে। সুতরাং তাওরাতের প্রতি ঈমান আনার দাবী অসার প্রতিপন্ন হয়। মোটকথা তাদের কথা ও কাজ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
[এখানে সর্বজনীন শিক্ষা হচ্ছে, এই মানসিকতা আমরা এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে দেখতে পাই। আমাদের কাজ বিচার বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে কেন মুসলিম জাতি বা সম্প্রদায় আজ পৃথিবীব্যাপী এত লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার। একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই দেখা যায় যে আজ মুসলিম সমাজ প্রকৃত সত্যের আলো থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আজ মুসলিম সমাজ কুরআনের সত্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে তাদের পৃথিবীব্যাপী এত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা।-অনুবাদক।]
৯৩। এবং স্মরণ কর, আমি তোমাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং আমি [উচ্চ সিনাই] পর্বতকে তোমাদের উর্দ্ধে উত্তোলন করেছিলাম, [বলেছিলাম]: "আমি তোমাদের যা দিলাম তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং [আইনের প্রতি] মনোযোগী হও। "৯৭। তারা বলেছিল " আমরা শুনলাম এবং আমরা অমান্য করলাম ৯৮। " [ফলে] কুফরী হেতু তাদের হৃদয়ে গোবৎসের প্রতি প্রীতি সঞ্চিত হয়েছিলো ৯৯।বলঃ" তা কতই না নিকৃষ্ট যা তোমাদের ঈমান তোমাদেরকে নির্দ্দেশ দেয়, [অবশ্য] যদি তোমাদের কোন ঈমান থাকে।"
৯৯। হযরত মুসা তুর পর্বতে কিতাবপ্রাপ্ত হওয়ার পর ফিরে এসে ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থের চুক্তিসমূহ মেনে চলার নির্দেশ দেন এবং ইহুদীরা অঙ্গীকার করেছিল যে তারা তাওরাতের অনুশাসন মেনে চলবে। তার অবর্তমানে ইহুদীরা সোনার গো-বৎস বানিয়ে পূজা করতে থাকে। হযরত মুসা ফিরে এসে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে যান এবং সোনার গো-বৎসকে আগুনে পুড়িয়ে গুড়ো করে পানিতে মিশিয়ে ইহুদীদের খেতে বাধ্য করেন, এই ঘটনাকে কোরআনে উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। সোনার গো-বৎস হচ্ছে আল্লাহ্র হুকুম না মানার, অবাধ্যতার, বিদ্রোহ এবং অবিশ্বাসের প্রতীক। একে তুলনা করা যায় সামান্য পরিমাণ বিষের প্রভূত ক্ষতি সাধন করার ক্ষমতার সাথে। গো-বৎস পূজার শাস্তি ছিলো ঐ বিষবৎ পানীয় পান করা। এই বিষ তারা পান করলো তাদের পাকস্থলীতে নয়; তাদের হৃদয়ে। আল্লাহর চোখে তাদের অপবিত্র, উদ্ধত, অহংকারী আত্মার বিনাশ হতে হবে। তাদের হতে হবে বিনয়ী [:৫৪]
৯৫। কিন্তু তারা কখনও মৃত্যু কামনা করবে না, কারণ হচ্ছে তাদের [পাপ কর্ম] যা তাদের হাতসমূহ তাদের পূর্বেই [আল্লাহ্র নিকট] প্রেরণ করেছে ১০০। আল্লাহ্ পাপীদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন।
১০০। 'Which their hands have sent on before them' মওলানা ইউসুফ আলী লাইনটি এভাবে উপস্থাপন করেছেন "[তাদের পাপ] যা তাদের হাত সমূহ তাদের পূর্বেই আল্লাহ্ নিকট প্রেরণ করেছে।" কথাটার অর্থ অনেক ব্যাপক, মহাকালের গর্ভে কিছুই হারায় না । আমরা মৃত্যুর পরে আল্লাহর দরবারে নীত হব। কিন্তু আমাদের পৃথিবীতে কৃতকর্মগুলি আমাদের মৃত্যুর বহুপূর্বে সাথে সাথেই আল্লাহ্র দরবারে নীত হয়। "তাদের হাত যা পূর্বে প্রেরণ করেছে"- এই কথাটি কুরআন শরীফে বহুবার বলা হয়েছে। আমাদের সু-কর্ম বা কু-কর্ম সবই আল্লাহ্র দরবারে তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছে যায়। এর কিছু উদাহরণ দেওয়া যায় বর্তমানে ইন্টারনেট, ফ্যাক্স ইত্যাদির সাহায্যে পৃথিবীর এক প্রান্তের সংবাদ মূহুর্তের মধ্যে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। সুতরাং আমরা কি করি, আমরা কি ভাবি, কি আমাদের কাজের নিয়ত সব আমাদের চিন্তাধারার সাথে সংম্পৃক্ত। আর এই চিন্তাধারা ঐ ইন্টানেটের মত মূহুর্তের মধ্যে আল্লাহ্র দরবারে নীত হয়, কারণ আল্লাহ্ বারে বারে বলেছেন যে আল্লাহ্ আমাদের কাজের বিচার করবেন তার নিয়ত দ্বারা কাজ দ্বারা নয়। এখানে এবং কুরআনে বহু স্থানে বলা হয়েছে যে মানুষের সুপ্ত এবং গুপ্ত সব পাপ কার্যই আল্লাহ্র দরবারে তার মৃত্যুর পূর্বেই নীত হয়, সূরা [৭:৪০] অথবা [৮:১৪] বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে পৃথিবীতে আমাদের কৃত ভালো কাজ ও মন্দ কাজ আমাদের মৃত্যুর বহু পূর্বেই তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহ্র দরবারে বিচারাধীন হওয়ার জন্য ফাইলবন্দী হয়ে নীত হয়। আমাদের এই কৃতকর্ম হবে আমাদের ব্যক্তিগত দায়িত্ব। আল্লাহ্র দরবারে আমাদের কৃতকর্ম সবই আমাদের মৃত্যুর পূর্বেই আমাদের এই পৃথিবীতে অবস্থান সময়েই মহান আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছে যাবে। আমরা বুঝতে পারি বা নাই পারি এর ফলাফল এই পৃথিবীতেই আমাদের জীবনে পেতে শুরু করি। আমরা দেখি সৎ আল্লাহ ভীরু লোকের জীবন শান্তিতে ভরে যায়। অপরপক্ষে, জাগতিক উন্নতি সত্ত্বেও অসৎ অধার্মিক লোকের শান্তি (Bliss) আসে না কারণ আত্মার শান্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে আত্মিক উন্নতি [Spiritual growth] আবার আত্মার [Spiritual faculty] সমৃদ্ধির পূর্বশর্তই হচ্ছে সততা ও সৎ কাজ। আল্লাহ্র নিয়তে যারা সততা অবলম্বন করে ও সৎ কাজ করে তাদের সেই নিয়ত ও কাজ তার মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহর দরবারে নীত হয় এবং আল্লাহ্ তাদের আত্মিক সমৃদ্ধি দান করেন। ফলশ্রুতিতে তারা আত্মার মাঝে শান্তি খুঁজে পায়। অপর পক্ষে যারা শুধু জাগতিক মোহে অসৎ ও অধার্মিকতার পথ অবলম্বন করে তাদের সেই নিয়ত বা চিন্তাধারাও আল্লাহ্র দরবারে তাদের মৃত্যুর পূর্বেই নীত হয়। ফলে তাদের আত্মিক উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে তারা ধন-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আত্মিক শান্তি থেকে বঞ্চিত হয় এবং এক ধরনের আত্মিক যন্ত্রণাতে ভোগে।
৯৮। যে কেউ আল্লাহ্র, তাঁর ফেরেশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিব্রাইল ও মীকাঈলের শত্রু; সে জেনে রাখুক; যারা ঈমান আনে না আল্লাহ তাদের শত্রু।
১০০। [ঘটনা] কি এই নয় যে, প্রত্যেক সময় তারা অঙ্গীকার করে, [কিন্তু] তাদের মধ্যে একদল তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়? বরং তাদের অধিকাংশই ঈমানহীন।
১০১। যখন তাদের নিকট আল্লাহ্র তরফ থেকে একজন রাসূল এসেছিলো, যে তাদের নিকট যা আছে উহার সমর্থক, কিতাবীদের একদল, আল্লাহ্র কিতাবটিকে পিছনে নিক্ষেপ করলো, যেনো [এটা এমন একটি ঘটনা যা] তারা জানে না ১০২।
১০২। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি ঈমান না আনার ব্যাপারে একটি বিশেষ অঙ্গীকার ভঙ্গের বিষয় বর্ণিত হয়েছে। তাদের কাছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একজন মহান পয়গম্বর আসলেন এবং কুরআন নাজেল হলো যা ইহুদীদের কাছে যে ধর্মগ্রন্থ [তাওরাত] আছে তাকে সত্যায়ন করে। এ অবস্থায় রসূল করিম (সাঃ) এর প্রতি ঈমান আনা তাওরাতের নির্দেশ পালনেরই নামান্তর ছিল। তাওরাতকে তারাও আল্লাহ্র প্রেরিত গ্রন্থ মনে করতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের নিজেদের ধর্ম গ্রন্থের বাণীকে অস্বীকার করলো। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী তার পরিবর্তন করলো। যদি তারা আন্তরিক হতো তবে তারা অবশ্যই দেখতে পেতো তাদের ধর্মগ্রন্থের [তাওরাতের] যে বাণী বা নৈতিক নীতিমালা, সে নীতিমালা আমাদের কুরআনের নৈতিক নীতিমালারই অনুরূপ। কারণ সবই একই স্রষ্টার কাছ থেকে আগত। কিন্তু তারা সে চেষ্টা না করে কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করলো। সবচেয়ে খারাপ কাজ যেটা তারা করলো তা হচ্ছে মিথ্যা কপটতা ও অমঙ্গলের পথ তারা বেছে নিল। মন্দের দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়ে পড়লো। যেমন-তারা [আল্লাহ্র কিতাব অনুসরণ না করে] ম্যাজিক বা যাদুবিদ্যার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লো এবং তারই অনুসরণ করতো। পরবর্তী আয়াতে এ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
১০৩। এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের সংযোজিত অংশ। ইহুদীরা আল্লাহ্র ইচ্ছার প্রতিফলন বা আল্লাহ্র কিতাবের অনুসরণ না করে ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করলো, যা হযরত সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানেরা চর্চা করতো। তা হচ্ছে জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা ও যাদুবিদ্যা। আল্লাহ্ এগুলি থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। জ্যোতিষ বিদ্যা ও যাদু বিদ্যাতে বিশ্বাস স্থাপন করা কুফ্র। কিন্তু ইহুদীরা হযরত সোলায়মান সম্পর্কে অপূর্ব সব যাদুর কাহিনী চালু করেছিলো। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন যে হযরত সোলায়মান যাদুতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি শয়তানের শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের খোদাভীরু নবী। যারা এইসব অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করে তারা আল্লাহ্র আইনের বিরোধিতা করে। তারাই সত্যিকারের স্রষ্টার নিন্দুক বা কাফের।
সার্বজনীন উপদেশ হচ্ছে, যে সব জাতি শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসর এবং সামাজিক জীবনে দারিদ্র এবং অবিচার ও অনাচারের মধ্যে বাস করে, দেখা যায় তাদের মধ্যে স্রষ্টার উপরে নির্ভরশীলতা অপেক্ষা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর নির্ভরশীলতা বেশি হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাংলাদেশীদের জাতীয় জীবনে এ ধরনের প্রভাব অত্যন্ত বেশি।
১০৪। এই আয়াতটিকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রশ্ন জাগে হারূত মারূত কে ছিলেন? তারা কি শিক্ষা দিতেন? মাওলানা ইউসুফ আলী 'তফসীর হাক্কানী' ও 'তফসীর কবীর'- কে অনুসরণ করেছেন। হারূত ও মারূতকে ফেরেশ্তা বলা হয়েছে। ফেরেশ্তা এখানে প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। যার অর্থ করা যায় তারা ছিলেন ভাল মানুষ ও বিভিন্ন জ্ঞানে সমৃদ্ধ। তারা ছিলেন জ্ঞানী এবং বিবেকবান [man of knowledge and wisdom]। তাদের ফেরেশ্তা বলা হচ্ছে এই জন্য যে, প্রাচীনকালে ফেরেশ্তারা ছিলেন পৌরুষের প্রতীক। ফেরেশ্তা সমতুল্য ব্যক্তি হবেন জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ, বিচক্ষণতা, বিবেকে, ক্ষমতায় যারা অপ্রতিদ্বন্ধী। যদি প্রতীকরূপে ধরা হয় তবে হারূত ও মারূত ছিলেন সেইরূপ ব্যক্তি। শঠতা, নীচতা, কপটতার উর্ধ্বে ছিলেন তারা।
হারূত ও মারূত প্রাচীন বেবীলন শহরে বাস করতেন। বেবীলন শহর সেই যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থানরূপে পরিচিত ছিল। ঠিক কখন সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত তথ্য জানা না থাকলেও এক সময়ে পৃথিবীতে বিশেষ করে বাবেল শহরে যাদুবিদ্যার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। যাদুর অত্যাচার্য ক্রিয়া দেখে মূর্খ লোকদের মধ্যে যাদু ও পয়গম্বরদের মো'জেযার স্বরূপ সম্বন্ধে বিভ্রান্তি দেখা যায়। সে কারণে তারা হযরত সোলায়মান (আঃ) কে যাদু বিদ্যার চর্চা করার কথা বলতো। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন হযরত সোলায়মান যাদুর র্চচা করতেন না। তিনি ছিলেন সত্যদ্রষ্টা আল্লাহ্ কর্তৃক মোজেযাপ্রাপ্ত পয়গম্বর। কেউ কেউ যাদুকরদেরও সজ্জন ও অনুসরণযোগ্য মনে করতে থাকে। এই বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তায়ালা বাবেল শহরে হারূত ও মারূত নামে দুজন ফেরেশ্তাকে প্রেরণ করেন। তাদের কাজ ছিল যাদুর স্বরুপ ও ভেল্কিবাজী সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা যাতে বিভ্রান্তি দূর হয় এবং যাদুর আমল, রূপ ও যাদুকরদের অনুসরণ থেকে তারা বিরত থাকতে পারে। মোট কথা ফেরেশ্তাদ্বয় বাবেল শহরে কাজ আরম্ভ করে দিলেন। তারা যাদুর মূল শাখা-প্রশাখার বর্ণনা করে জনগণকে এ কুকর্ম থেকে আত্মরক্ষা ও যাদুকরগণকে ঘৃণা করার উপদেশ দেন। ফেরেশ্তাদ্বয় এ বলে লোকজনদের সাবধান করতেন যে দেখ, আমাদের দ্বারা আল্লাহ্ তায়ালা পরীক্ষা নিতে চান যে, এগুলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কে স্বীয় ধর্মের হেফাজত ও সংরক্ষণ করেন এবং কে এগুলো সম্পর্কে অবগত হয়ে নিজেই সে অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং স্বীয় দ্বীন ঈমান বরবাদ করে দেয়। যে জ্ঞান পৃথিবীকে আলোকিত ও শান্তিতে ভরিয়ে দিতে পারে, সেই জ্ঞান দুষ্ট লোকের হাতে পড়লে ক্ষতি সাধন হয়। উদাহরণ স্বরূপ আমরা আমাদের সাম্প্রতিক পৃথিবীতে দেখতে পাই যে, পারমাণবিক জ্ঞান যখন শান্তির কাজে ব্যবহার করা হয় তা হয় মানুষের কল্যাণের জন্য। এই জ্ঞানই আবার পৃথিবীর ধ্বংস যজ্ঞের কারণ হতে পারে। জ্ঞানই শক্তি-আবার এই জ্ঞানই দুষ্ট লোকের হাতে মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জ্ঞান এরূপ পরীক্ষার সম্মুখীন। আল্লাহ্ আমাদে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। হারূত মারূতের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান আমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। জ্ঞানকে মানুষ লোভ ও ক্ষমতার জন্য অপব্যবহার করবে না। জ্ঞানকে মানুষ আল্লাহ্র রাস্তায় অর্থাৎ মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করবে। আর একটি উপদেশ হচ্ছে এই যে, জীবনের কোনও অবস্থাতেই কোনও বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলেও তা থেকে উদ্ধারের জন্য যাদু-টোনা, ঝাড়-ফুক ও অলৌকিক কিছুর আশ্রয় গ্রহণ করা হারাম ও কুফর। আজ আমাদের বাংলাদেশীদের মধ্যে রত্ন পাথর, ঝাড়-ফুক, মাদুলী - তাবিজ ইত্যাদির অত্যাধিক প্রসার লাভ করেছে। সেই সাথে প্রসার লাভ করেছে পীর-ফকির নামধারী ভন্ড প্রতারকদের, যারা দাবী করে যে তাদের অলৌকিক ক্ষমতাবলে তারা সব মুশকিল আসান করে দিতে পারে। কিন্তু মুসলমাদের কর্তব্য হচ্ছে মুসকিল আসান বা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য শুধুমাত্র সর্বশক্তিমানের কাছে আত্মসমর্পন করা। তিনি সব মুশকিল-আসানের মালিক। যাদু টোনা বা অলৌকিক কিছুর আশ্রয় গ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ বা হারাম।
১০৫। দুষ্ট লোকেরা হারূত ও মারূতের কাছ থেকে যাদুর স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে তা তাদের দুষ্ট অভিসন্ধি চরিতার্থ করার কাজে নিয়োজিত করে। তাদের প্রতারণা, জালিয়াতি, সাধারণ মানুষের চোখে বিভ্রান্তি ঘটায়। এসব যাদুকরেরা সাধারণভাবে স্ত্রী পুরুষের মধ্যে বিভেদ ঘটানোর জন্য তাদের এই যাদুর ব্যবহার করতো। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় এসব অলৌকিক কর্মকাণ্ডকে যাদু বলা হয়। যাদু হচ্ছে সেই জিনিষ বা শয়তানের সন্তুষ্টির জন্য করা হয়; যে কাজ সম্পাদনের জন্য শয়তানের সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু মহান আল্লাহ্ আমাদের আস্বস্ত করেছেন যে ওদের ক্ষমতা আল্লাহ্ খুবই সীমিত করেছেন। শয়তানকে এই সীমিত ক্ষমতা আল্লাহ্ দিয়েছেন বেহেশ্ত থেকে বিতাড়িত করার সময়েই। আর আদমকে দেয়া হয়েছিলো সেই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি যেনো সে স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে, শয়তানের সন্তুষ্টির জন্য কাজ না করে। যারা শয়তানের কু-প্রভাব থেকে সর্বশক্তিমানের আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করে, আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করেন। আল্লাহ্র রহমত ও করুণাধারা তাদের বেষ্টিত করে রাখে। যারা অনুতপ্ত এবং সেই সাথে নিজ কার্যপ্রণালীকে সংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র নির্দেশ অন্বেষণ করে; তারা অবশ্যই সমস্ত ক্ষতি, সমস্ত কু-প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ্র আশ্রয় লাভ করে। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এসব যাদুকর বা ভণ্ড পীরের আশ্রয় প্রার্থনা করার অর্থ হচ্ছে কুফ্র এবং নিজের আত্মার বা আধ্যাত্মিক জীবনের ক্ষতি করা। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন এসব যাদুকর বা ভণ্ড পীরেরা (যারা ধর্মের নামে মানুষকে ঠকায়) তাদের নিজের আত্মাকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা অশুভ শক্তির ক্রীতদাসে পরিণত হয়। এই আয়াতে শুধু যে ব্যক্তিগত দু-একজনের কথাই বলা হয়েছে তা নয় বরং এখানে বলা হয়েছে ইহুদীদের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর কথা, ঠিক একইভাবে পৃথিবীর যে কোনও অধঃপতিত জাতি সমষ্টিগতভাবে রত্ন-পাথর, যাদু-টোনা, পীর-ফকিরের আধিপত্যে বিশ্বাসী হতে পারে। পরিণামে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। কারন তারা আল্লাহ্র করুণা বা রহমত থেকে বঞ্চিত হয়।
রুকু - ১৩
১০৬। কোন কোন ইহুদী রাসুলুল্লাহ্কে (সাঃ) এর নিকট এসে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে তাঁকে, 'রাঈনা' বলে সম্বোধন করত। হিব্রু ভাষায় এর অর্থ একটি বদ দোয়া। তারা এ নিয়তেই তা বলতো কিন্তু আরবী ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে 'আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন' ফলে আরবীভাষীরা তাদের এই দুরভিসন্ধি বুঝতে পারতো না। ভাল অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে কোন কোন মুসলমানও রাসুলুল্লাহ্কে এই শব্দে সম্বোধন করতেন। এতে দুষ্টরা আরও আশ্কারা পেতো ও পরস্পর হাসাহাসি করতো আর বলতো, 'এত দিন আমরা গোপনেই তাকে মন্দ বলতাম। এখন এতে মুসলমানদেরও শরীক হওয়ার কারণে প্রকাশ্যে মন্দ বলার সুযোগ এসেছে'। তাদের এই সুযোগ নষ্ট করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ মুসলমানদের নির্দেশ দিচ্ছেন, 'হে মুমিনগণ তোমরা 'রাঈনা' শব্দটি বলো না। এর পরিবর্তে উনযুরনা বলবে।
সার্বজনীন শিক্ষা হচ্ছে, প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জাতির মধ্যে একশ্রেণীর লোক থাকে যারা ভালো জিনিষকে কথার মাধ্যমে মন্দভাবে উপস্থাপন করতে ভালবাসে। এরা হচ্ছে বিশ্বনিন্দুক। এদের কথার ধুম্রজালে সাধারণ মানুষ হয় বিভ্রান্ত। আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে চিন্তা ও বক্তব্যে সৎ হওয়া। বক্তব্য হবে স্বচ্ছ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। আরও হুকুম হচ্ছে সৎ বিবেকবান নেতার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, যে জাতির চিন্তা ও কথার মধ্যে ব্যবধান থাকে তারা মুনাফিক। কারণ তারা ভাবে এক কথা বলে অন্য কথা এরূপ ব্যক্তি বা জাতির উপর আল্লাহ্র গজব অবশ্যই নিপতিত হবে।
১০৬। আমি কোন আয়াতকে রহিত করলে, বা ভুলে যেতে দিলে, তা থেকে উত্তম কিংবা সমতুল্য কোন আয়াত প্রতিস্থাপন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ্ সকল জিনিষের উপরে ক্ষমতাবান? ১০৭।
১০৭। উপরের আয়াতটির অর্থ সার্বজনীন। এর অর্থ সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার না করাই উচিত। এই আয়াতের অর্থ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় যে, যুগে-যুগে, কালে-কালে, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আল্লাহ্র বাণী সময় ও যুগোপযোগী করা হয়েছে। এর ভাষা, নিয়ম-কানুনের মধ্যে বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে সময়ের দাবী ও সময়ের প্রয়োজনে এবং যুগের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য সেই আদি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত একই রয়ে গেছে। হযরত মুসার ধর্মগ্রন্থের সামাজিক নিয়ম কানুনের সাথে হযরত ঈসার ধর্মগ্রন্থের সামাজিক নিয়ম কানুনের পার্থক্য এবং শেষে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর উম্মতদের সামাজিক নিয়ম কানুনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় কিতাবীদের নৈতিক নীতিমালা যুগে-যুগে, কালে-কালে একই রয়ে গেছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে বাহ্যিক, সামাজিক নিয়ম নীতিমালা যা যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে যুগোপযোগী করা হয়েছে। এটা ভাবা অন্যায় নয় যে মানব সমাজ সময় ও যুগ অতিক্রম করে সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে। যুগে-যুগে আল্লাহ্ ধর্মকে সেই যুগের উপযোগী করার জন্য বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নবী রাসূলকে প্রেরণ করেছেন। [৩ : ৭] আয়াতে আল্লাহ্ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন যে-
'তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন; যাহার কতক আয়াত সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন; এইগুলি কিতাবের মূল অংশ' আর অন্যগুলি রূপক। যাদের অন্তরে সত্য লঙ্ঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিত্না এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যা রূপক তার অনুসরণ করে।'
উদাহরণ স্বরূপ যেমন-অনেকে বলে যে আয়াত [২ : ১১৫] কে [২ : ১৪৪] আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে। আয়াত [২ : ১১৫] এ বলা হয়েছে যে -
'পূর্ব পশ্চিম সর্বত্রই আল্লাহ্ বিদ্যমান; এবং যে দিকেই তোমরা মুখ ফিরাও না কেন সে দিকেই আল্লাহ্র উপস্থিতি বিদ্যমান। আল্লাহ্ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।' এবং আয়াত [২:১৪৪] তে বলা হয়েছে -
'.... তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরাইয়া দিতেছি যা তোমাকে সন্তুষ্ট করবে। অতএব তুমি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাও। তোমরা যেখানেই থাক না কেন উহার দিকে মুখ ফিরাও ....'।
- এর অর্থ এই দাঁড়ায় না যে আয়াত [২:১৪৪] দ্বারা আয়াত [২:১১৫] কে রহিত করা হয়েছে। কারণ এটা ভাবা সংকীর্ণতা ও অন্যায় যে আল্লাহ্ শুধু কোনও নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ। তাঁর অবস্থান সর্বত্র; আয়াত [২:১১৫] দ্বারা এই বুঝানো হয়েছে যে আল্লাহ্র ব্যপ্তি বিশ্বজগৎব্যাপী; তাঁর উপস্থিতি সর্বত্র। আয়াত [২:১৪৪] দ্বারা বুঝনো হয়েছে যে, এবাদতের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সকলে মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাবে।
পৃথিবীর দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে কালের আবর্তে পৃথিবীতে কোনও জিনিস স্থায়ী নয়। কত জনপদ, সভ্যতা, অনুসরণীয় প্রতিষ্ঠান সময়ের আর্বতনে লোপ পেয়ে যায়। বিবর্তনের ধারায় তাদের শিক্ষাও লোকে ভুলে যায়। আজকে যা মনে হবে প্রকৃষ্ট অনুসরণীয় নীতি আগামীকাল তা মনে হবে যুগোপযোগী নয়। কিন্তু আল্লাহ্র শাশ্বত বাণী অপরিবর্তনীয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে, সত্য কথা বলা, চুরি না করা, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হস্তগত না করা, ব্যাভিচার না করা ইত্যাদি এগুলি হচ্ছে আল্লাহ্র শাশ্বত আইন। হযরত মুসার কিতাব থেকে হযরত ঈসা, হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর কুরআন পর্যন্ত একইভাবে অপরিবর্তিত রয়েছে। যে কোনও কিতাবীদের ধর্মের মূল নৈতিক নীতিমালা এক। কিন্তু এমন অনেক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আছে যেখানে খৃষ্টানদের সাথে ইহুদীদের মেলে না, আবার খৃষ্টানদের সাথে মুসলমানদের মেলে না ইত্যাদি। তাই বলে ইহুদী, খৃষ্টান বা ইসলাম এর কোনটাই ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম নয়। কিতাবীরা সবাই হযরত ইব্রাহীমের ধর্মের অনুসারী। সময়ের ব্যবধানে ধর্মের মধ্যে যে অনাচার প্রবেশ করেছিলো, সেগুলি পরিশুদ্ধ করে যুগোপযোগী করার জন্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তন করা হয়েছে। কুরআন হলো সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যুগোপযোগী করার জন্য ইসলামে মেয়েদের অধিকার স্বীকৃত করা হয় - জীবনের সর্ব অবস্থায় যথা : সম্পত্তি, সাক্ষী ইত্যাদিতে যা পূর্বে ছিল না।
১০৮। তোমরা কি তোমাদের রাসূলকে সেইরূপ প্রশ্ন করতে চাও, প্রাচীনকালে মুসাকে যেরূপ করা হয়েছিল? ১০৮। কিন্তু যে বিশ্বাসী থেকে অবিশ্বাসীতে পরিবর্তিত হয়, নিঃসন্দেহে সে সরল পথ থেকে বিপথে যায় ১০৯।
১০৮। ইহুদীরা হযরত মুসা (আঃ) কে অপ্রাসঙ্গিক কুটিল প্রশ্ন দ্বারা অবিরাম হয়রানী করতো। এখানে আল্লাহ্ মুসলমানদের সেই উদাহরণ অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। আধ্যাত্মিক জগতে নিজেকে জাহির করা বা প্রচার করার মাধ্যমে কিছুই পাওয়া যায় না। সত্যিকারের যদি কিছু জানার আকাঙ্ক্ষা থাকে শুধুমাত্র তবেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা উচিত।
১০৯। আরবী শব্দ 'সাওয়াআ' এর অর্থ অনেক ব্যাপক। শুধুমাত্র সরল পথ বা মসৃন পথ-এভাবে এর অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এর দ্বারা বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ পায়। যেমন-এ এমন পথ যা মসৃন [বন্ধুর পথের বিপরীত]; সুসামঞ্জস্যপূর্ণ [এলোমেলো এর বিপরীত]; সঙ্গতিপূর্ণ [অসঙ্গতির বিপরীত]; ন্যায়ের পথ [অন্যায়ের বিপরীত]; মধ্য পথ [চরম পথের বিপরীত] এবং যে পথ আদর্শ বা উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত। অর্থাৎ এটা এমন এক পথ যা মধ্য পথ, ন্যায় ও সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত, পারিপার্শ্বিকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালোর প্রতি, সত্য ও সুন্দরের প্রতি নিবেদিত পরিকল্পিত জীবন। সুতরাং এ পথ অবলম্বন করতে হলে চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। সরল পথ হারায় অর্থাৎ চারিত্রিক গুণাবলীর যে মাধুর্য যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সরল পথকে নির্দেশ করে, তা হারিয়ে ফেলে এবং ঠিক তার বিপরীত ধর্মই তার চরিত্রে প্রকাশ পায়। চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশই হচ্ছে ইসলামের সরল পথের ঠিকানা। 'সাওয়াআ' অর্থ এই সরল পথের ঠিকানা।
১১০। কোরআন শরীফে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ 'ক্ষমা করা'র সমার্থক, তবুও এদের ব্যবহারে এদের বিভিন্নতা দেখা যায়। 'আফা' কে এই আয়াতে ক্ষমা করা অনুবাদ করা হয়েছে কিন্তু আরবী এই শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে ভুলে যাওয়া বা মন থেকে মুছে ফেলা। 'সাফাহা' কে এখানে অনুবাদ করা হয়েছে উপেক্ষা করা। আরবী শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, উপক্ষো করা, এমন ভাব করা যেনো ব্যাপারটি কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নাই ইত্যাদি এই ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে। 'সাফা' শব্দের বাংলা এক কথায় উপেক্ষা করা শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। সুতরাং 'আফা' এবং 'সাফা' এই দুটোই ক্ষমা এই কথাটির সমার্থক বোঝায়। কিন্তু কোরআন শরীফে আর একটি শব্দ 'গাফারা' ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমা করা অর্থে। এই শব্দটি শুধুমাত্র আল্লাহ্র প্রতি প্রযোজ্য, কারণ পাপীর পাপ শুধু ক্ষমা নয়, ক্ষমার পর তাকে রহমতের ধারায় বিধৌত করা এবং বার বার পাপীর পাপ ক্ষমা করা এবং রহমত করার নামই হচ্ছে 'গাফারা'; এই জন্য আল্লাহ্র আর এক নাম 'গফুর'।
১১২। [২:১০৬] আয়াতের এই লাইনটি যে, 'আল্লাহ্ সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান'-এর পূর্বে ও পরে কুরআন শরীফের অনেক জায়গাতেই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকবার এই লাইনটি ব্যবহার করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। [২:১০৬] এ বলা হয়েছে প্রত্যাদেশের ধারাবাহিকতার উপরে। এখানে বক্তব্য হচ্ছে ধর্মের মূলনীতি রয়ে গেছে একই কিন্তু যুগোপযোগী করা হয়েছে যুগে-যুগে, কালে-কালে। বাঁধা এসেছে প্রতিটি যুগেই। কিন্তু আল্লাহ্র ক্ষমতা অসীম, তাঁর ইচ্ছাই জয় লাভ করে শেষ পর্যন্ত, এই ছিল [২:১০৬] এর প্রেক্ষাপট। কিন্তু [২:১০৯] আয়াতে আল্লাহ্ আমাদের বাধা-বিপত্তির মুখে ধৈর্য্যশীল ও ক্ষমাশীল হতে আদেশ দিচ্ছেন অন্যায়কারী ও হিংসুকদের উপরে। প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ্র যা ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত পূরণ হবেই। কারণ তিনি সব কিছুর উপরে শক্তিমান।
১১৩। [২:৯৫] আয়াতে এবং টিকা ১০০ তে দ্রষ্টব্য।
১১২। পক্ষান্তরে, যে কেউ পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পন করে ১১৪, এবং ভালো কাজ করে, সে এর পুরষ্কার তার প্রভুর নিকট পাবে; তাদের কোন ভয় নাই, তারা দুঃখিতও হবে না; ১১৫।
১১৪। এখানে 'ওয়াজহা' আরবী শব্দটির অর্থ হচ্চে মুখমণ্ডল। কিন্তু তর্জমা করা হয়েছে 'আত্ম' কথাটির দ্বারা। এখানে আল্লাহ্ বলেছেন, যে ব্যক্তি স্বীয় মাথা আল্লাহ্র দিকে নত করে দেয় অর্থাৎ আত্মসমর্পন করে বা বিশ্বাস ও কাজকর্মে আনুগত্য অবলম্বন করে এবং তৎসঙ্গে [শুধু বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানই নয়, আন্তরিকভাবে] সৎ কর্ম করে, সে তার আনুগত্যের প্রতিদান প্রতিপালকের কাছে পাবে।
আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তায়ালা ইহুদী ও খৃষ্টানদের পারস্পরিক মত বিরোধ উল্লেখ করে তাদের নিবুর্দ্ধিতা ও মত বিরোধের কুফল বর্ণনা করেছেন। অতঃপর সত্য উদঘাটন করেছেন। এ ঘটনায় মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েত (পথ নির্দেশ) নিহিত আছে।
খৃষ্টান ও ইহুদী উভয় সম্প্রদায়ই ধর্মের প্রকৃত সত্যকে উপক্ষো করে ধর্মের নাম ভিত্তিক জাতীয়তা গড়ে তুলেছিল। তারা প্রত্যেকেই স্ব-জাতিকে জান্নাত ও আল্লাহ্র প্রিয় পাত্র বলে দাবী করতো এবং তারা ব্যতীত জগতের সমস্ত জাতিকে জাহান্নামী ও পথভ্রষ্ট বলে বিশ্বাস করতো। আল্লাহ্ তায়ালা উভয় সম্প্রদায়কে তাদের মূর্খতা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, এরা উভয় সম্প্রদায়ই জান্নাতে যাওয়ার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে উদাসীন। তারা শুধু ধর্মের নামভিত্তিক জাতীয়তার অনুসরণ করে। বস্তুতঃ ইহুদী, খৃষ্টান ও ইসলাম যে কোনও ধর্মেরই প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে দুটি বিষয়।
ক) বান্দা মনে প্রাণে নিজেকে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পন করবে। তাঁর আনুগত্যকেই স্বীয় মত ও পথ বলে মনে করবে। এ উদ্দেশ্যটি যে ধর্মে অর্জিত হয় তাই প্রকৃত ধর্ম। ধর্মের প্রকৃত স্বরূপকে পেছনে ফেলে ইহুদী অথবা খৃষ্টান অথবা ইসলাম জাতীয়তাবাদের ধ্বজা উত্তোলন করা ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক।
খ) দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে সৎকর্ম। পারলৌকিক মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশের জন্য শুধু আনুগত্যের সংকল্পই যথেষ্ট নয় বরং সৎকর্মেরও প্রয়োজন। আল্লাহ্র কাছে ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমানের কোনও মূল্য নাই। গ্রহণীয় বিষয় হচ্ছে ঈমান ও সৎকর্ম। সৎকর্ম কি? যে কাজ আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা হয় তাই-ই সৎকর্ম। কুরআনের বহু স্থানে সমাজ ও জাতির মঙ্গলের জন্য কাজ করার নির্দেশ দান করা হয়েছে। এই জাতীয় কাজই হচ্ছে সৎকাজ।
যে কেউ উপরোক্ত মৌলিক বিষয়াদির মধ্য থেকে যে কোনও একটি ছেড়ে দেয়, অতঃপর শুধুমাত্র নাম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নিজেকে জান্নাতের ইজারাদার মনে করে নেয়; সে আত্মপ্রবঞ্চনা বৈ আর কিছুই করে না। আসল সত্যের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নাই। এসব নামের উপর ভরসা করে কেউ আল্লাহ্র নিকটবর্তী ও মকবুল হতে পারবে না। যে পর্যন্ত না তার মধ্যে ঈমান ও সৎ কর্ম থাকে। সুতরাং এ দাবী যেনো কেউ না করে যে আমরা পুরুষানুক্রমে মুসলমান। প্রত্যেক অফিস ও রেজিস্টারে আমাদের নাম মুসলমানদের কোটায় লিপিবদ্ধ এবং আমরা মুখেও নিজেদের মুসলমান বলি, সুতরাং সকল পুরস্কারের যোগ্য হকদার আমরাই। তাহলে ইহুদী ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য খুব কমই থাকবে। দুনিয়া জুড়ে মুসলমানদের অবনতি ও অস্থিরতার মূল কারণ আমাদের এখানেই খুঁজে দেখতে হবে। আমাদের ঈমান মৌখিক। এর সাথে আন্তরিকতার সম্পর্ক কম। অর্থাৎ আমরা আন্তরিকভাবে আল্লাহ্র হুকুম মান্য করি না। যেমন-আমরা মিথ্যার বেসাতি করি, মানুষকে ঠকাতে দ্বিধাবোধ করি না, অন্যায়-অবিচার, অসত্য আজ আমাদের জীবনের সামাজিক ব্যাধি। অন্যায় আইন আজ আমরা সমাজ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে স্বীকার করে চলছি। এগুলি হচ্ছে আল্লাহ্র আইন অমান্য করা। আল্লাহ্র আইনকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে, মৌখিকভাবে নিজেকে মুসলমান দাবী করলেও অন্তরে আল্লাহ্কে অস্বীকার করা। সে নিজের প্রতি নিজে বিশ্বস্ত নয় এটা মুনাফিকীরই নামান্তর।
দ্বিতীয়তঃ তাঁর সৃষ্টির সেবা করা। এ ব্যাপারে মুসলমানেরা কতটুকু অগ্রগামী তা বিবেচ্য। আমরা কতটুকু আন্তরিক সমাজের মঙ্গলের জন্য, সৎ কাজে আমরা কতটুকু উৎসর্গীকৃত। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীনের ব্যাপারে মুসলিম সমাজ আজ খুব একটা আন্তরিক নয়। এখানেই দুনিয়া জুড়ে মুসলমানদের এত অস্থিরতা ও অবনতির কারণ। মুসলমানদের অবনতি ও অস্থিরতা অপরপক্ষে খৃষ্টান ও ইহুদীদের উন্নতির ও প্রশান্তির মূল বিষয় উপরে বর্ণিত হলো। এতে প্রতীয়মান হয় যে জগতে আমাদের দারিদ্র, পরমুখাপেক্ষিতা, বিপদ-আপদ ও সংকট ইসলামের মূল ধারা থেকে বিচ্যুতির কারণে। যারাই এই মূলধারা বা ধর্মের মূল অন্তর্নিহিত নৈতিক গুণাবলী অর্জন করেছে তারা ইহুদী বা খৃষ্টান যেই হোক না কেন তাদের উপরে আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। আলোচ্য আয়াত থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঈমান ও সৎকর্ম পূর্ণরূপে অবলম্বন না করলে শুধু বংশগতভাবে ইসলামের নাম ব্যবহারের দ্বারা কোনও শুভ ফল আশা করা যায় না [২ :৬২] দেখুন।
১১৫। 'তাদের কোনও ভয় নাই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।'-এই লাইনটি এই সুরায় এবং কুরআনের বহু জায়গাতে এসেছে। যেমন-[২, ৩৮, ৬২, ১১২, ২৬২, ২৭৪ এবং ২৭৭]এ। কুরআন নাজেল হয়েছে কবিতার ছন্দে। এর ভাষা, ছন্দ, বর্ণনার মাধুর্যে অতুলনীয়। এই লাইনটি বার বার ব্যবহৃত হয়েছে সঙ্গীতের মত। যেমন-সঙ্গীতের একটি লাইন 'সোমের' সৃষ্টি করে ঠিক সেরূপ। এছাড়াও এ দ্বারা লাইনটির গূঢ় অর্থের গুরুত্বের প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে।
১১৬। এই আয়াতে কিতাবধারীদের সম্বন্ধে আলোচনা করা হচ্ছে। যদিও তারা ঐশী গ্রন্থপ্রাপ্ত এবং ইব্রাহীমের ধর্মের অনুসারী, তবুও নিজেদের অজ্ঞতা এবং অন্ধ অহংকারে তারা একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। যদিও তারা সকলেই ঐশী গ্রন্থের অধিকারী।
[সার্বজনীন শিক্ষা হচ্ছে অজ্ঞতা, অন্ধ-অহংকার, একগুঁয়েমী আমাদের অন্তরে অন্ধকারের সৃষ্টি করে যা আমাদের সত্য ও সুন্দরকে চিনতে বাঁধা দান করে। ভালো-মন্দ সব একাকার হয়ে যায়, ফলে সত্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা জন্মে।-অনুবাদক।]
১১৭। মক্কা বিজয়ের পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যখন মক্কায় প্রবেশ করে কাবা গৃহে তাওয়াফ ও নামাজ আদায় করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, তখন মক্কার মুশরিকরা তাঁকে বাধা দান করে। ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি নামাজ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। আল্লাহ্ তায়ালা এখানে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করে এ কাজের দোষ প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় জালেম আর কে আছে যে আল্লাহ্র মসজিদসমূহে [মক্কার মসজিদুল হারাম, মদীনার মসজিদে নববী, মসজিদে বায়তুল মোকাদ্দাস প্রভৃতি সব মসজিদই অন্তর্ভূক্ত] তার নাম উচ্চারণ [ও এবাদত] করতে বাধা দেয় এবং পরিত্যক্ত করতে চেষ্টা করে।
হুদায়বিয়ার ঘটনার পর মক্কার মুশরিকরা যখন রাসূলুল্লাহ্কে (সাঃ) কাবা প্রাঙ্গণে প্রবেশ এবং তাঁর তাওয়াফে বাঁধা প্রদান করে, তখন এই আয়াত নাজেল হয়।
এই আয়াতের বর্ণনায় সাধারণ শব্দের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র আইনের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যাতে নির্দেশটি শুধুমাত্র খৃষ্টান ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা না হয়। বরং এ নির্দেশটি সার্বজনীন, সর্বকালের জন্য এবং সকল সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য করা হয়। এ কারণেই আয়াতে বিশেষভাবে বায়তুল মোকাদ্দাসের নামোল্লেখের পরিবর্তে 'আল্লাহ্র মসজিদ সমূহে' সব মসজিদের ক্ষেত্রেই নির্দেশটি ব্যাপক করে দেওয়া হয়েছে।
[সাধারণ জ্ঞাতব্য হচ্ছে-ইসলাম এবাদতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সমস্ত মসজিদই আল্লাহ্র এবাদতের জন্য উন্মুক্ত। ধর্ম সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ থাকতে পারে। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা জাতিগত। ইসলাম বলে সে যেই হোক না কেন এক সম্প্রদায় আর এক সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করতে পারেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সকলের শান্তিপূর্ণ এবাদতের জন্য বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। যতক্ষণ পর্যন্ত যে কেউ এক আল্লাহ্-য় বিশ্বাসী হয় এবং ভক্তিভরে স্রষ্টার কাছে নিজেকে নিবেদনের জন্য মসজিদে উপস্থি হয়, তার জন্য আল্লাহ্র মসজিদের দ্বার উন্মুক্ত। আত্মবিশ্লেষনের মাধ্যমে আমাদের খুঁজে দেখতে হবে আমরা কি কুরআনের এই নির্দেশ অনুসরণ করি না গোষ্ঠীগত বিভক্তিতে আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের চেষ্টা করি।-অনুবাদক।]
১১৮। 'ওয়াজহা' শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে 'মুখমন্ডল' এখানে অনুবাদ করা হয়েছে উপস্থিতি। টিকা ১০৭-দ্রষ্টব্য।
১১৯। 'আল্লাহ্ পুত্র সন্তান গ্রহণ ,করেছেন' এ কথাটির দ্বারা আল্লাহ্র মহিমা খর্ব করা হয়। শুধু খর্ব করাই নয়, এ এক ধরণের 'ঈশ্বর নিন্দা' কারণ এ কথার দ্বারা এটাই বোঝানো হয় যে, আল্লাহ্ সাধারণ মানুষের মত যৌন-তাড়িত বস্তুবাদী এক শক্তি। এতে আল্লাহ্র মহিমাকে খর্ব করা হয়। আল্লাহ্র কোন অভাব নাই। তিনি অভাবমুক্ত। মরণশীল মানুষ বা প্রাণীর যে কোনও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মহান আল্লাহ্র জন্য প্রয়োগ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অপরপক্ষে, আধ্যাত্মিক মতবাদ অনুযায়ী সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহ্র সন্তান তুল্য। মা যেভাবে নিজ সন্তানকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করে। স্নেহ ভালবাসায় সন্তানের জীবনকে ভরিয়ে দেয়, আল্লাহ্ তার সৃষ্টিকে মায়ের স্নেহের থেকেও বেশি ভালবাসেন। তাঁর করুণাধারা মায়ের স্নেহ অপেক্ষাও বেশি তাঁর সৃষ্টিকে ঘিরে থাকে। সেই হিসেবে আমরা সবাই আল্লাহ্র সন্তান। তাঁর সৃষ্টির দিকে চোখ ফিরালে দেখতে পাই, সমস্ত সৃষ্টি তাঁর আইন অর্থাৎ হুকুম মেনে চলছে। বৃক্ষকুল, প্রাণীকূল, বিশ্ব-প্রকৃতি সদা-সর্বদা আল্লাহ্র আইন মেনে চলে। উদাহরণ স্বরূপ, বলা যায়-বীজকে উপযুক্ত পরিবেশে রাখলে অঙ্কুরোদগম ঘটে। বৃক্ষ তার নিজস্ব গতিতে বড় হয়, ফল-ফুলে শোভিত হয়ে এক সময়ে মরে যায়। এটা আল্লাহ্র আইন। পাহাড়, নদী, সমুদ্র, আকাশ, বাতাস, পানি, আলো সমস্ত বিশ্বভূবন ও বস্তুজগত সকলেই আল্লাহ্র প্রদত্ত স্ব-স্ব আইন মেনে চলে। সেই হিসেবে বিশ্ব-চরাচরে সকলেই আল্লাহ্র গুণগানে ব্যস্ত। আল্লাহ্র আইন মান্য করা মানেই তাঁর এবাদত করা। বস্তুজগতের ক্ষমতা নাই আল্লাহ্র আইন অমান্য করার। একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ্ সীমিত ইচ্ছা শক্তির স্বাধীনতা দিয়েছেন যেনো সে তা প্রয়োগ করতে পারে আত্মিক উন্নতির জন্য। কিন্তু মানুষের যে দেহ সে দেহের দিকে লক্ষ্য করলেও আমরা দেখতে পাই সে নির্ভুলভাবে আল্লাহ্র আইন মেনে চলে। শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে, বার্ধক্যে তার যে পরিবর্তন তা আল্লাহ্র আইনকেই মেনে চলা। এ পরিবর্তনের ধারাকে রহিত করার ক্ষমতা কারও নাই। তাই আমাদের দেহ আল্লাহ্র আইন মেনে চলে। সুতরাং তাঁর গুণগান করে তাঁরই এবাদত করে। কিন্তু সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি [Limited free will] প্রাপ্ত হওয়ার ফলে মানুষ আল্লাহ্র আইন লঙ্ঘন করার ক্ষমতা রাখে এবং এ শক্তি তার আত্মায় নিহিত। এর সদ্ব্যবহার করলে আত্মিক উন্নতি হয়। অপব্যবহার আত্মিক ক্ষতি হয়।
১১৮। যাদের কোন জ্ঞান নাই, তারা বলে, 'আল্লাহ্ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন? অথবা আমাদের নিকট কোন নিদর্শন আসে না কেন?' এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীরাও অনুরূপ কথা বলতো। তাদের অন্তর একই রকম। যে কেউ দৃঢ়ভাবে [তাদের অন্তরে] ঈমানকে ধরে রাখে, আমি অবশ্যই তাদের জন্য নিদর্শনাবলীকে সুস্পষ্ট করেছি।
১১৯। আমি তোমাকে সত্যসহ শুভ সংবাদ দাতা এবং সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। জাহান্নামের অধিবাসীদের সম্বন্ধে তোমাকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।
১২০। ইহুদী ও খ্রীষ্টানগণ কখনও সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্ম মত অনুসরণ কর। বল, 'আল্লাহ্র পথ নির্দেশই [একমাত্র] পথ নির্দেশ।' তোমার নিকট যে জ্ঞান এসেছে তা প্রাপ্তির পর যদি তুমি তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ কর, তবে আল্লাহ্র বিপক্ষে তোমার কোন রক্ষাকারী থাকবে না এবং কোন সাহায্যকারীও থাকবে না।
১২১। যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি যেভাবে তা পাঠ করা উচিত সেভাবে পাঠ কর। এরাই তারা যারা তাতে বিশ্বাস করে। যারা তাতে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে তারা ক্ষতিগ্রস্থ।
রুকু - ১৫
১২৩। সেই দিন থেকে নিজেকে রক্ষা কর, যেদিন কেউ কারও উপকারে আসবে না। কারও কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা হবে না। কোন সুপারিশ লাভজনক হবে না। এবং [বাইরে থেকে] কেউ কোন সাহায্য পাবে না ১২২।
১২২। [২: ১২২-১২৩] আয়াত দুটি, [২: ৪৭-৪৮] আয়াত দুটির পুনরাবৃত্তি। ১২৩ এর ভাষাতে সামান্য পরিবর্তন হলেও তা আয়াতের অর্থে কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই। এই আয়াতগুলিতে ইহুদীদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহের বর্ণনা সুন্দরভাবে শেষ করা হয়েছে। এরপরে শুরু হতে যাচ্ছে, আধ্যাত্মিক জগতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর হিসেবে [হযরত ইসমাইলের (আঃ) মাধ্যমে] আরবদের উপরে আল্লাহ্র অনুগ্রহ বা করুণার বর্ণনা।
১২৩+১২৪। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, তিনি হযরত ইব্রাহীমের পরীক্ষা নিয়েছিলেন এবং হযরত ইব্রাহীম তাঁর ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে বিলীনকরে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্র ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। হযরত ইব্রাহীমের পরীক্ষা কোন অজ্ঞতা যাচাই এর জন্য ছিল না বরং এর উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁকে আধ্যাত্মিক জগতে পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে দেওয়া। আল্লাহ্র কাছে শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞানের চাইতে চারিত্রিক দৃঢ়তার মূল্য বেশি। এতে বোঝা যায় আল্লাহ্র দরবারে যে বিষয়ের মূল্য বেশি তা শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞান নয়, বরং কার্যগত ও চরিত্রগত শ্রেষ্ঠত্ব। এ ধরনের পরীক্ষার বিষয়-বস্তুর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল-
আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা ছিল হযরত ইব্রাহীমকে স্বীয় বন্ধুত্বের বিশেষ মূল্যবোন পোশাক উপহার দেওয়া। তাই তাঁকে বিভিন্ন রকম কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। সমগ্র জাতি এমন কি তাঁর আপন পরিবারের সবাই মূর্তি পূজায় লিপ্ত ছিল। সবার বিশ্বাস ও রীতিনীতির বিপরীত একটি সনাতন ধর্ম তাকে দেওয়া হয়। জাতিকে এ ধর্মের দিকে আহবান জানানোর গুরু দায়িত্ব তাঁর কাঁধে অর্পন করা হয়। তিনি পয়গম্বর সুলভ দৃঢ়তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে নির্ভয়ে জাতিকে এক আল্লাহ্র দিকে আহবান জানান। বিভিন্ন পন্থায় তিনি মূর্তিপূঁজার নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করেন। প্রকৃত পক্ষে কার্যক্ষেত্রে তিনি মূর্তিসমূহের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ফলে সমগ্র জাতি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়। বাদশাহ নমরুদ ও তার পরিবারবর্গ তাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ্র খলীল (বন্ধু) প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য এসব বিপদ-আপদ সত্ত্বেও হাসিমুখে নিজেকে অগ্নিতে নিক্ষেপের জন্য পেশ করেন।
এ পরীক্ষা সমাপ্ত হলে জন্মভূমি ত্যাগ করে সিরিয়ায় হিজরতের পর দ্বিতীয় পরীক্ষা নেওয়া হয়। ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় স্বগোত্র ও মাতৃভূমিকেও হাসিমুখে ত্যাগ করে পরিবার পরিজনসহ হিজরত করলেন।
মাতৃভূমি ও স্বজাতি ত্যাগ করে সিরিয়ায় অবস্থান করতেই নির্দেশ এরো বিবি হাজেরাকে দুগ্ধপোশ্য শিশু হযরত ইসমাঈলসহ নির্বাসনের। আল্লাহ্র ইচ্ছা মক্কা নগরীর সৃষ্টি ও হযরত ইসমাঈলের বংশে আরবে শেষ নবী প্রেরণ করা। তাই এই পুরো ঘটনার অবতারণা। এখানে অনুধাবনযোগ্য যে, শেষ নবী ও শ্রেষ্ঠ নবী স্বীয় বংশে পাওয়ার সম্মান ও গৌরব আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীমকে দিবেন। কিন্তু আল্লাহ্ দান বহু সাধনার দ্বারা ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। তাই তো আমরা দেখি সৎ ও ঈমানদার ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের মধ্যে বেশি নিপতিত হয়। কারণ দুঃখ কষ্টের আগুনে পুড়ে তাদের আত্মা নিখাদ হয়, খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত হয়, ফলে আল্লাহ্র সান্নিধ্য সেই হৃদয়ে অনুভব করার ক্ষমতা জন্মে। হযরত ইব্রাহীমের চরিত্রের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনই হচ্ছে ইসলাম। দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা এরই মাধ্যমে আত্মা পরিশুদ্ধ এবং সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করে।
এরপর আল্লাহ্র হুকুম হয় হযরত ইসমাঈলকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কোরবানী দিতে। এর পরবর্তী ঘটনা সবারই জানা। এটা ছিল পুত্রবৎসল পিতার চরম আত্মোৎসর্গের পরীক্ষা। এগুলো ছিল শক্ত ও বড় কঠিন পরীক্ষা যার সম্মুখীন হযরত খলীলুল্লাহকে করা হল।
এই আয়াতটিকে [২:১২৪] পরবর্তী আয়াতসমূহের সারাংশ হিসেবে ধরা হয়। 'কালিমাত' এ শব্দটির দ্বারা রহস্যময় ইচ্ছা বা পরীক্ষাসমূহকে ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষাতেই হযরত ইব্রাহীম আল্লাহ্র ইচ্ছা পূরণ করেন। এছাড়াও তিনি আল্লাহ্র ঘরকে পুনঃনির্মাণ করেন। একে পুতঃ পবিত্র করেন। যে কেউ আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে সেই মুসলিম। হযরত ইব্রাহীম ছিলেন খাঁটি মুসলিম। আমাদের যে বিশ্বাস আমরা জন্মসূত্রে মুসলিম-সুতরাং আমরা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এ বিশ্বাস ঠিক নয়। মুসলমানের একমাত্র মানদন্ড হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন, তা কি আজকে বিশ্ব মুসলিম সমাজ পালন করে? আমরা নামেই বা জন্মসূত্রে মুসলিম-কিন্তু প্রতিনিয়ত আমরা আল্লাহ্র ইচ্ছার আইন অমান্য করি-অর্থাৎ আমরা সত্যবাদী হব, সৎ পথে চলবো, মানুষকে ঠকাবো না, ন্যায় ও সত্যের জন্য জেহাদ ঘোষণা করবো ইত্যাদিই হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছা বা আইন যা আমরা অমান্য করি। ভেবে দেখতে হবে আমরা ব্যক্তিগত জীবনে ও জাতীয় জীবনে আল্লাহ্র এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছি কিনা। যদি না পেরে থাকি তবে অবশ্যই আল্লাহ্র রোষানলে আমরা পতিত হবে। এই-ই আল্লাহ্র বিধান।
হযরত ইব্রাহীমের এই চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য আল্লাহ্ তাকে পৃথিবীর আধ্যাত্মিক জগতের নেতৃত্ব দান করেন। হযরত ইব্রাহীম তাঁর বংশধরদের জন্যও এই অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন-কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে। নৈতিক ও কার্যগত গুণে গুণান্বিত হওয়া হচ্ছে নেতৃত্বের প্রধান শর্ত। পাপাচারী ও জালিমকে নেতৃত্ব লাভের সম্মান দেওয়া হবে না-হোক না কেন সে হযরত ইব্রাহীমের বংশধর। এর ব্যাখ্যা এই যে নেতৃত্ব একদিক দিয়ে আল্লাহ্র খেলাফত বা প্রতিনিধি। আল্লাহ্র অবাধ্য বা বিদ্রোহী, যারা উপরিউক্ত নৈতিক ও কর্মগতগুণে গুণান্বিত হয় না, তাদেরকে এ পদ দেয়া যায় না। এ কারণেই যারা নৈতিক চরিত্র ও কর্মগুণে গুণান্বিত নয়, তাদের স্বেচ্ছায় বা ভোট দানের মাধ্যমে নেতা নিযুক্ত না করা মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
১২৫। কাবা শরীফ হচ্ছে আল্লাহ্র ঘর। কাবা শরীফ পুনঃনির্মাণ করেন হযরত ইব্রাহীম, হযরত ইসমাঈলের সহযোগিতায়। আল্লাহ্ কাবা শরীফের চারটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। যেমন-
ক) এই স্থান হবে সকলের সম্মেলন স্থান, তা হতে পারে ব্যবসা বাণিজ্য বা উপাসনা, যে কোন ব্যাপারে।
খ) কাবা গৃহ এবং এর সীমানা অত্যন্ত পবিত্র। শত্রু-মিত্র সবাই এই স্থানকে সম্মান করবে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সীমানার মধ্যে সর্বপ্রকার সহিংসতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোন রকম খেলাধুলা এবং আনুষাঙ্গিক আনন্দ ফূর্তি করাও সীমানার মধ্যে নিষেধ। এই স্থানকে আল্লাহ্ সকলের জন্য নিরাপদ স্থানরূপে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কাবা হচ্ছে শান্তির আবাসস্থল।
গ) কাবা গৃহ হচ্ছে আল্লাহ্র এবাদতের স্থান। এখানে মাকামে ইব্রাহীম অবস্থিত অর্থাৎ ঐ পাথর যাতে মোজেযা হিসেবে হযরত ইব্রাহীমের পদচিহ্ন অঙ্কিত হয়ে আছে।
ঘ) এ গৃহকে অবশ্যই সর্বদা পূত-পবিত্র রাখা কর্তব্য। কাবা গৃহকে যাবতীয় বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। দেহ ও পোষাক পরিচ্ছদকে যাবতীয় অপবিত্রতা ও দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু থেকে পাক-সাফ করে এবং অন্তরকে কুফ্র, শিরক্, দুশ্চরিত্রতা, অহংকার, হিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদি থেকে পবিত্র করে কাবা শরীফে প্রবেশ করা কর্তব্য। অর্থাৎ হজ্বের পূর্বশর্ত হচ্ছে দৈহিক ও আত্মিক পবিত্রতা।
১২৬। এখানে চারটি আচার অনুষ্ঠানের উল্লেখ করা হয়েছে।
ক) তাওয়াফ করা বা কাবা শরীফের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করা
খ) ইতিকাফ করার স্থান হচ্ছে এই স্থান।
গ) রুকু করা।
ঘ) সেজদা করা।
এই পবিত্র স্থানকে পবিত্র রাখার দায়িত্ব সবার। তবে যারা হজ্জ্বযাত্রী, যারা এই আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে তাদের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্রতার উপর। বাহ্যিক অপবিত্রতা ও আবর্জনা এবং আত্মিক অপবিত্রতা উভয়টিই এর অন্তুর্ভূক্ত যেমন-কুফর, শির্ক, দুশ্চরিত্রতা, হিংসা, লোভ-লালসা, কু-প্রবৃত্তি, অহংকার, রিয়া, নাম-যশ ইত্যাদি অন্তরে রেখে আল্লাহ্র গৃহে আগমণ না জায়েয। পৃথিবীর সব লোভ-লালসা, প্রবৃত্তি কামনা সব কিছু ত্যাগ করে শুদ্ধ পবিত্র আত্মাকে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদনের জন্যই তীর্থযাত্রীদের কাবাগৃহে আগমন করা উচিত। আমাদের আচার-অনুষ্ঠান সবই হবে আন্তরিক যেনো শুদ্ধ-পবিত্র আত্মার নিবেদন তাঁর কাছে পৌঁছায়। পৃথিবীর সবকিছুর মোহ ত্যাগ করে পবিত্র আত্মা নিয়ে তার দরবারে হাজির হওয়ার নামই হচ্ছে হজ্বব্রত পালন।
১২৭। মূল শব্দ 'সালাম'। ইসলাম অর্থ 'শান্তি'। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) হেরেমকে শান্তির স্থলরূপে বানানোর জন্য প্রার্থনা করেন। ইসলামে হেরেমকে শান্তির শহর বলা হয়, কারণ এখানে কাবা গৃহ অবস্থিত। ইহুদীরাও জেরুজালেমকে তাদের 'শান্তির শহর' বলে। আয়াত [২:১৩৪, ১৪১] থেকে বোঝা যায় যে পুরনো দিন গত। সুতরাং মক্কা হবে নূতন 'জেরুজালেম' বা বলা যায় হযরত ইব্রাহীমের সেই 'শান্তির আলয়' যার জন্য হযরত ইব্রাহীম প্রার্থনা করেছিলেন। এখন থেকে হেরেম শরীফ ও কাবা ঘর হবে বিশ্ব মানবের মিলন কেন্দ্র। আত্মিক শান্তির আশ্রয়স্থল। হেরেমের শান্তির স্থল হওয়ার বিধান হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর দোয়ারই ফলশ্রুতি যা জাহিলিয়ত যুগ থেকে কার্যকর রয়েছে। ইসলাম ও কুরআন এগুলোকে অধিকতর সুসংহত ও বিকশিত করেছে। মোটকথা হযরত ইব্রাহীমের দোয়া অনুযায়ী আল্লাহ্ তায়ালা শহরটিকে প্রাকৃতিক দিক থেকেও সারা বিশ্বের জন্য শান্তির আলয়ে পরিণত করে দিয়েছেন।
১২৮। হযরত ইব্রাহীমের দোয়া ছিল এই যে, এ শহরের উপজীবিকা হিসেবে যেন ফল-মূল দান করা হয়। মক্কা মুকাররমা ও পার্শ্ববর্তী ভূমি কোনরূপ বাগ-বাগিচার উপযোগী ছিল না। দূর-দূরান্তর পর্যন্ত ছিল না পানির নিশানা। কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা ইব্রাহীমের দোয়া কবুল করেন এবং ফলে মক্কার অদূরে তায়েফ হয়ে উঠে সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা।
এখানে হযরত ইব্রাহীমের দোয়া থেকে মনে হয় তাঁর দোয়ায় সবটুকুই ছিল তাঁর বংশধরদের জাগতিক সুখ ও স্বাচ্ছন্দের নিশ্চয়তার জন্য। আক্ষরিকভাবে এর অর্থ তাই-ই দাঁড়ায়। কিন্তু আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় হযরত ইব্রাহীমের প্রার্থনা ছিল পূণ্যাত্মাদের জন্য যারা খোদভীরু তাদের জন্য আল্লাহ্র নিয়ামত বা [ফল] অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জীবনে আত্মার বিকাশ লাভের জন্য আল্লাহর নিয়ামত প্রার্থনা করা হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে-আল্লাহ্র উত্তর হচ্ছে যারা 'অবিশ্বাসী তাদের জন্যও জীবন উপভোগের সুযোগ দেওয়া হবে'। এর রূপক অর্থ এই যে এই পৃথিবীতে পূণ্যাত্মা ও অবিশ্বাসী সবার জন্যই আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। কারণ আল্লাহ্ রাহমানুর রহিম। কিন্তু আল্লাহ্র রহমতে বিশ্বাসীদের জন্য ইহকালে ও পরকালে সুখ ও শান্তি বয়ে আনে, কিন্তু অবিশ্বাসীদের জন্য শেষ পর্যন্ত এর কোন সুফল নাই।
[আল্লাহ্ আমাদের যে নৈতিক গুণাবলী অর্জন করতে বলেছেন তা না করে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অন্যায়, অসত্যের, মিথ্যা ঘুষ, জোচ্চুরীর আশ্রয় নিয়েছে যার ফলাফল আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ও জাতীয় জীবনে ছাপ ফেলেছে। একথা পৃথিবীর সব মানুষ সব জাতির জন্যই প্রযোজ্য ছিল অতীতে। প্রযোজ্য থাকবে বর্তমানে আরও থাকবে ভবিষ্যতে। কোরআনের এই বাণী শাশ্বত সর্বকালের, সর্বযুগের।
১২৮। 'হে আমাদের প্রভু! আমাদের তোমার [ইচ্ছার] কাছে আত্মসমর্পনকারী মুসলিম কর এবং আমাদের পরবর্তী বংশধরদের তোমার [ইচ্ছার] কাছে আত্ম সমর্পনকারী মুসলিম করো। আমাদের এবাদতের নিয়ম পদ্ধতি শিখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি [অনুগ্রহ] কর। তুমি তো বারে বারে ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু।
১২৯। 'হে আমাদের প্রভু! তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ কর, যে তাদের নিকট তোমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করবে, তাদের কিতাব এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। তুমি তো শক্তিতে পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়।' ১২৯
১২৯। আয়াত [২:১২৫]-এ কাবা গৃহের ইতিহাস, হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) কর্তৃক কাবা গৃহ পুনঃনির্মাণ, কাবা ও মক্কার কতিপয় বৈশিষ্ট্য এবং কাবা গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধি বিধান উল্লেখিত হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল কাবাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একে পাক-সাফ করেন মুমিনদের জন্য। এই হিসেবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) হচ্ছেন ইসলামের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। কাবা শরীফ হচ্ছে ইসলামের প্রতীক।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ্র নির্দেশে সিরিয়ার সুজলা-সুফলা ভূখণ্ড ছেড়ে মক্কার বিশুষ্ক পাহাড় সমূহের মাঝখানে স্বীয় পরিবার পরিজন এনে ফেলে রাখেন এবং কাবাগৃহ নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য কোন আত্মত্যাগী সাধকের অন্তরে অহংকার দানা বাঁধতে পারতো এবং সে তাঁর ক্রিয়া কর্মকে অনেক মূল্যবান মনে করতে পারতো। কিন্তু তিনি জানতেন আল্লাহ্র উপযুক্ত ইবাদত ও আনুগত্য কোন মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তি সামর্থ অনুযায়ী কাজ করে। তাই আমল যত বড়ই হোক সেজন্য অহংকার না করে কেঁদে কেঁদে এমনি দোয়া করা প্রয়োজন যে, হে পরওয়ারদেগার! আমার এ আমল কবুল হোক।
আয়াত [১২৭, ১২৮, ১২৯]-এ হযরত ইব্রাহীমের মোনাজাত কত সুন্দর। বিনয়ের সাথে তিনি তাঁর সমস্ত এবাদত আল্লাহ্কে সমর্পন করছেন এবং আল্লাহ্কে শ্রবণকারী ও সর্বজ্ঞ বলে সম্বোধন করছেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ভবিষ্যৎ বংশধরদের ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মঙ্গরের জন্য আল্লাহ্র কাছে দোয়া করেছেন। তিনি তাঁর পয়গম্বর সুলভ অন্তর্দৃষ্টি থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে ভবিষ্যতে তাঁর বংশধরদের মধ্যে মোশরেকী প্রবেশ করবে। মক্কা হবে ৩৬০টি মূর্তির আবাসস্থল। পবিত্র নগরী জেরুজালেম হবে বেশ্যাদের দ্বারা কলুষিত। তাই তিনি আল্লাহ্র অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছেন, আল্লাহ্র ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। এবং মোনাজাতের শেষ আয়াতে [২:১২৯] দেখা যায় তিনি অন্তর্দৃষ্টিতে তার বংশে আমাদের শেষ নবীর আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তার জন্য আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করেছেন।
হযরত ইব্রাহীমের মোনাজাত আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে আল্লাহ্র কাছে নিজের সু-কর্মকে বিনয়ের সাথে নিবেদন করতে হয়। আত্ম-অহংকার যেনো আমাদের সুকৃতি নষ্ট করে না দেয়।
১৩০। আয়াত [২:১৩০-১৩১]-তে বলা হয়েছে ইব্রাহীমের ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, যার বিন্দুমাত্র বোধ শক্তি নাই। কারণ এই ধর্মটি হুবহু স্বভাব ধর্ম। কোন সুস্থ স্বভাব ব্যক্তি এই ধর্মকে অস্বীকার করতে পারে না। এ ধর্মের বদৌলতেই হযরত ইব্রাহীমকে আল্লাহ্ ইহকালে সম্মান ও মাহাত্ম্য দান করেছেন এবং পরকালেও। ইব্রাহীমি ধর্মের মূলনীতি হচ্ছে আল্লাহ্র আনুগত্য, যার অপর নাম ইসলাম। জগতে পয়গম্বরগণ যত ধর্মই এনেছেন নিজ নিজ সময়ে সে সবই ছিল আল্লাহ্র মনোনীত ধর্ম। সুতরাং নিঃসন্দেহে সে সব ধর্মও ছিল ইসলাম। যদিও সেগুলো এখন আমাদের কাছে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন-ইহুদী ধর্ম, খৃষ্ট ধর্ম ইত্যাদি। এসব ধর্মের মূল স্বরূপ ছিল ইসলাম বা এক আল্লাহ্র আনুগত্য। তবে এ ব্যাপারে হযরত ইব্রাহীমের ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে তিনি নিজ ধর্মের নাম 'ইসলাম' রেখেছিলেন। মোট কথা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যত পয়গম্বর আগমন করেছেন এবং যত আসমানী গ্রন্থ ও শরীয়ত অবতীর্ণ হয়েছে, সে সবগুলোর প্রাণ হচ্ছে ইসলাম তথা আল্লাহ্র আনুগত্য। এ আনুগত্যের সারমর্ম হলো রিপুর কামনা-বাসনা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী আনুগত্য প্রকাশ করা। এই পৃথিবীতে হিংসা, লোভ-লালসা, কাম, ক্রোধ ইত্যাদি বিভিন্ন রিপু আমাদের কামনা-বাসনাকে ভোগ বিলাসের জীবনে আকর্ষণ করে। ফলে আমরা বিভিন্ন পাপ কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ি। আল্লাহ্র নির্দেশ হচ্ছে পাপ থেকে বিরত থাকা, সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা, সর্ব অবস্থায় আল্লাহ্র কাছে আনুগত্য প্রকাশ করা হচ্ছে ইসলামের মর্মবাণী। পরিতাপের বিষয়, আজ ইসলামের নাম উচ্চারণকারী লক্ষ লক্ষ মুসলমান এ সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা ইসলামের মূল অর্থ হৃদয়ঙ্গম না করে এর আচার ও আনুষ্ঠানিকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং একেই ইসলাম ধর্ম নামে অভিহিত করে। তারা ধর্মের নামে স্বীয় কামনা-বাসনারই অনুসরণ করে। কুরআন ও হাদিসের এমন ব্যাখ্যাই তাদের কাছে পছন্দ যা তাদের কামনা বাসনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা জানে না যে এসব অপব্যাখ্যার দ্বারা সৃষ্টিকে প্রতারিত করা গেলেও স্রষ্টাকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর জ্ঞান প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পরিব্যপ্ত। তিনি মনের গোপন ইচ্ছা বা কল্পনা সবই দেখেন ও জানেন। তাঁর কাছে পবিত্র আত্মার আনুগত্য কাম্য। পবিত্র সেই আত্মা যে আত্মা হিংসা-দ্বেষ, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি ইত্যাদি কলুষতা থেকে মুক্ত। আত্মাকে পূত পবিত্র রাখা স্রষ্টার নির্দেশ। ন্যায় ও সত্যের পথে চলাও স্রষ্টার নির্দেশ। পৃথিবীর সমস্ত ক্রিয়া কর্ম শুধুমাত্র স্রষ্টার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য করাই হচ্ছে স্রষ্টার নির্দেশ। স্রষ্টার নির্দেশ মানাই হচ্ছে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা।
১৩২। এবং ইব্রাহীম ও ইয়াকুবও এই সম্বন্ধে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলো, 'হে আমার পুত্রগণ! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য [এই] দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং ইসলামে বিশ্বাসী না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।'
১৩৩। ইয়াকুবের নিকট যখন মৃত্যু উপস্থিত হলো, তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে ১৩১? দেখো! সে তাঁর পুত্রগণকে বলেছিলো, 'আমার পরে তোমরা কার এবাদত করবে?' তারা বলেছিলো, 'আমরা আপনার ইলাহ্ এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ্ এরই এবাদত করবো ১৩২। আল্লাহ্-ই [প্রকৃত পক্ষে] একমাত্র ইলাহ্। আমরা তাঁর নিকট আত্মসমর্পন করি [ইসলাম]'।
১৩২। উপরের আয়াত দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে আল্লাহ্ এক এবং চিরন্তন। হযরত ইব্রাহীম, হযরত ইসহাক, হযরত ইসমাঈলের যে স্রষ্টা, আজও সেই একই স্রষ্টা বিরাজমান। ইব্রাহীমের ধর্মই হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। এই ধর্ম হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব মানবের ধর্ম, এই ধর্ম সমগ্র বিশ্ব মানবের এক অনন্য নির্দেশ নামা। ইসলাম ধর্ম কোনও এক যুগের ধর্ম নয়। তা সর্বকালের সর্বযুগের এবং সর্বসাধারণের। ইসলাম ধর্মের নির্যাস হচ্ছে এক স্রষ্টার কাছে আনুগত্য প্রকাশ। এখানে হযরত ইয়াকুবের মৃত্যুর সময়কার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।
১৩৩। শেষ বিচারের দিনে প্রত্যেককেই তার নিজ নিজ কর্মফল সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হবে। ব্যক্তিগত কর্মের এবং কর্মের নিয়ত দ্বারাই তাকে বিচার করা হবে। প্রত্যেক আত্মাকে তার ব্যক্তিগত দায় দায়িত্ব স্বীকার করতে হয়। অন্যজনের পাপ আর একজনকে স্পর্শ করবে না। সেইরূপ অন্যজনের কৃত পূণ্যও আর একজনকে স্পর্শ করবে না। কোনও সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না। হোক সে খৃষ্টানদের বড় পাদ্রী বা মুসলমানদের বড় পীর, কারও সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না।
ইহুদী এবং খৃষ্টানরা বলে তারা হযরত ইব্রাহীমের সন্তান। সুতরাং তারা পরকালে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে। তাদের বিশ্বাস তাদের পূর্ব পুরুষের সুকৃতি তাদের পরকালে মুক্তি দেবে। কিন্তু এই আয়াত [২:১৩৪] থেকে বোঝা যায় যে বাপ-দাদার সৎকর্ম সন্তানের উপকারে আসবে না; যতক্ষণ না তারা নিজে সৎকর্ম সম্পাদন করে। এমনিভাবে বাপ-দাদাদের কুকর্মের শাস্তিও সন্তানেরা ভোগ করবে না; যদি তারা সৎ কর্মশীল হয়। এতে ইহুদীদের যে দাবী-তারা যা খুশী তাই করবে, শুধুমাত্র তারা ইহুদী এবং বাপ-দাদার সৎকর্মের উত্তরাধিকার সেই কারণে তারা বেহেশ্তে যাবে, কুরআনের আলোকে তা ভুল প্রমাণিত। আমাদের মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোকের ভ্রান্ত ধারণা আছে যে যারা সৈয়দ পরিবারের, রাসূলের বংশধর দেখে তারা পরকালে বিচারের সম্মুখীন হবে না। কুরআনে এ বিষয়টি বার বার বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, 'প্রত্যেকের আমলের [কাজের] দায়িত্ব তার নিজেকে বহন করতে হবে'। আরও আছে, 'কিয়ামতের দিন একজনের বোঝা অন্যজন বহন করবে না'। হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, 'হে বনী হাশেম! এমন যেন না হয় যে, কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোক নিজ নিজ সৎকর্ম নিয়ে আসবে আর তোমরা আসবে সৎকর্ম থেকে উদাসীন হয়ে শুধু বংশ গৌরব নিয়ে এবং আমি বলবো যে, আল্লাহ্র আযাব থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারবো না।'
১৩৪। ইহুদী ও খৃষ্টানেরা উপদেশ দিত যে তোমরা ইহুদী হয়ে যাও [এটা ইহুদীদের কথা] অথবা খৃষ্টান হয়ে যাও [এটা খৃষ্টানদের কথা], তবে তোমরা পরকালে মুক্তি পাবে। কারণ ইহুদীদের ধারণা তারাই একমাত্র আল্লাহ্র বরপুত্র। যদিও তাদের এক আল্লাহ্র উপসনা শিক্ষা দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু বাস্তবে তারা এই এক আল্লাহ্র পথ থেকে বিপথে চালিত হয়েছিল। খৃষ্টানেরা আরব পৌত্তলিকদের মত আল্লাহ্র তিনরূপে বিশ্বাস করে আর তা হচ্ছে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। কিন্তু আল্লাহ্ মুসলমানদের নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের হযরত ইব্রাহীমের ধর্মের উপর স্থির থাকতে। হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম কি? একেশ্বরবাদ এবং আল্লাহ্র কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন-এই হচ্ছে হযরত ইব্রাহীমের ধর্মের মূল কথা, যার অপর নাম হচ্ছে ইসলাম।
১৩৫। এই আয়াতটিতে ইসলামের সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে -
১) স্রষ্টা একজনই। ক্ষুদ্র প্রাণী থেকে মানুষ পর্যন্ত সবকিছুরই স্রষ্টা তিনিই। গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, আকাশ-পৃথিবী, মহাকাশ, নভোমন্ডল, দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছুরই স্রষ্টা একজনই তিনি পরম করুণাময় আল্লাহ্।
২) আল্লাহ্র নির্দেশসমূহ হযরত মুহম্মদের (সাঃ) মাধ্যমে আমাদের দান করা হয়েছে। এই নির্দেশ মানার দায়িত্ব প্রত্যেকের নিজের। কেউ এই নির্দেশ না মানলে সে দায়-দায়িত্ব তারই। অন্য কেউ তার দায়-দায়িত্ব বহন করবে না। কিংবা কোনও নির্দিষ্ট গোত্র বা বংশ বা ধর্মে জন্মগ্রহণ সূত্রেও কেউ নিজ কর্মের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবে না।
৩) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে :
ক) ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তাদের গোত্রের অন্যান্য নবী। এদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম আল্লাহ্র নিকট থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত। অন্যান্যরা তাকে সঠিকভাবে অনুসরণকারী এবং সত্যের প্রচারক।
খ) হযরত মুসা এবং হযরত ঈসা-এঁরা ঐশীগ্রন্থপ্রাপ্ত। তাঁদের এই গ্রন্থ অদ্যাপি বর্তমান যদিও এই গ্রন্থদ্বয় আল্লাহ্ প্রেরিত গ্রন্থদ্বয় থেকে বহু পরিবর্তিত হয়েছে। যুগের এবং কালের প্রবাহে বহুজন বহুভাবে এতে পরিবর্তন সাধন করেছে। আল্লাহ্ প্রেরিত এই গ্রন্থদ্বয় ঠিক আদি এবং অকৃত্রিমরূপে নাই।
গ) এছাড়াও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম প্রচারক, নবী, রাসূল যাদের নাম কুরআন শরীফে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় নাই আমরা মুসলমানেরা তাদের সবাইকে আল্লাহ্র দূত হিসেবে বিশ্বাস করি। আমরা তাদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করি না-এইই হচ্ছে আমাদের উপর আল্লাহ্র নির্দেশ। সর্বকালে, সর্বযুগে আল্লাহ্র দূতদের যে বাণী, তা ইসলামের মূল কথারই প্রতিধ্বনি। সুতরাং ধর্মের যে নৈতিক শিক্ষা তা যুগে-যুগে, কালে-কালে একই রয়ে গেছে। কারণ এই শিক্ষাই হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দেশ। আর আল্লাহ্র নির্দেশই হচ্ছে ইসলাম। নৈতিক মূল্যবোধ সর্বকালে, সর্বযুগে, সর্ব-সাধারণের জন্য অপরিবর্তনীয়। সুতরাং এই অপরিবর্তনীয় বাণী যেই প্রচার করুন না কেন বুঝতে হবে তিনি আল্লাহ্র দূত। আল্লাহ্র নির্দেশ তিনি সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য প্রচার করেছেন। এই বিশ্বাস করা মুসলমানের কর্তব্য। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য্য, এখানেই ইসলামের মহানুভবতা, এইখানেই ইসলামের সার্বজনীনতা। (১), (২) এবং (৩) এই তিনের সমষ্টিই হচ্ছে ইসলামের সার সংক্ষেপ বা ধর্ম বিশ্বাস।
১৩৬। ইব্রাহীমের ধর্ম হচ্ছে সহজ সরল পথ, তার বর্ণনা শেষে বলা হচ্ছে যে, যে কেউ এ পথে চলে বা বিশ্বাস করে তারাই সঠিক পথের দিশারী। অর্থাৎ যারা ইব্রাহীমের ধর্মের উপর বিশ্বাসী তারাই সঠিক পথ প্রাপ্ত। কিন্তু যারা সহজ সরল পথ ত্যাগ করে, বিভিন্ন মাসায়ালার সাহায্যে ধর্মীয় ব্যাখ্যায় ব্যস্ত, এসব লোকের মস্তিষ্ক ও চিন্তাধারা শুধু বস্তু বা বস্তুবাচক বিষয়াদির মধ্যেই নিমজ্জিত। তারা এসব ব্যাপারে নিজ থেকে নানবিধ ব্যাখ্যা করতে প্রবৃত্ত হয় এবং একে দ্বীনের খেদমত বলে মনে করে। আজকাল মুসলমানদের মধ্যেও এ প্রবৃত্তি দেখা যায়। সহজ সরল দ্বীনকে তারা তাদের ব্যাখ্যার মাধ্যমে অত্যন্ত জটিল আচার-আচরণ ও শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে। এই বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা বা পোষাকী আচরণসিদ্ধতা বা বস্তুকেন্দ্রীকতা ইহুদী, খৃষ্টান, মুসলমান সবার মধ্যেই জন্মাতে পারি যদি তারা হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম থেকে চ্যুত হয়। মুসলমানদের মধ্যে এই গর্ব দেখা যায় যে তারা শেষ নবীর উম্মত, সুতরাং তারাই একমাত্র আল্লাহ্র রাস্তায় আছে। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন মৌখিক ঈমানের কোনও মূল্য নাই আল্লাহ্র কাছে। আত্মিক সংবেদন দ্বারা যে কেউ হযরত ইব্রাহীমের ধর্মের উপরে স্থির আছে সেই মুসলমান। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এটার সবার জন্যই প্রযোজ্য। যারাই ইব্রাহীমের ধর্ম থেকে চ্যুত হয়েছে তারাই ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক হয়েছে এবং উগ্র মৌলবাদীতে পরিণত হয়েছে।
১৩৭। খ্রষ্টানেরা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে তারা সপ্তম দিনে তাকে গীর্জায় নিয়ে পবিত্র পানিতে গোসল করায় এবং খৃষ্ট ধর্মের গভীর রঙে রাঙানো বলে মনে করে। এটাকে তারা ব্যাপ্টিজম বলে। ব্যাপ্টিজম খৃষ্টানদের একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, যার সাহায্যে প্রকাশ করে যে শিশুর জীবনে খৃষ্টান ধর্মের ছোপ লাগানো হলো, তার অনাগত ভবিষ্যতকে ধর্মের গভীর রং-এ রাঙানো হলো।
কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন বাহিরের এই আনুষ্ঠানিকতার কোনও মূল্য নাই। যে আত্মাকে আল্লাহ্র ভালবাসায় নিমজ্জিত করতে পারে সেই তো আল্লাহ্র রংয়ে নিজেকে রাঙাতে পারে। এখানে রং কথাটি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসার যে রূপ তাকেই 'আল্লাহ্র রং' এই প্রতীক শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহ্র রং-ই হচ্ছে সবচেয়ে স্থায়ী, সর্বোৎকৃষ্ট। বাহিরের রং এর কোনও মূল্য নাই। অন্তরের এই রং-ই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট।
১৪০। অথবা ১৩৮, তোমরা কি বল, 'ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসাহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরগণ ইহুদী অথবা খৃষ্টান ছিলো' ? বল, 'তোমরা কি আল্লাহ্ অপেক্ষা বেশি জান ? আঃ! আল্লাহ্র নিকট থেকে যে প্রমাণ তারা পেয়েছে তা যারা গোপন করে তার থেকে বড় অন্যায়কারী আর কে আছে? তোমরা যা কর আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে অমনোযোগী নন।'
১৩৯। এই আয়াতের শুরু [২:১৩৪] আয়াত থেকে। আল্লাহ্ বিভিন্নভাবে আমাদের এই উপদেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র সত্য ধর্ম হচ্ছে ইব্রাহীমের (আঃ) ধর্ম, যা যুগে যুগে প্রচার করেছেন বিভিন্ন নবী ও রাসূলগণ। যার সারমর্ম হচ্ছে এক স্রষ্টার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাঁর সৃষ্টির সেবা করা। যার কর্মফল সে-ই ভোগ করবে। কারও পাপের জন্য অন্য কাউকে দায়ী করা হবে না; বা কারও পূণ্যও কেউ ভোগ করতে পারবে না। সঙ্গীত যেমন প্রতিটি অনুচ্ছেদের শেষে প্রথম পংক্তিটির বার বার পুনরাবৃত্তি করা হয়। কোরআন শরীফ কবিতার ছন্দে নাজেল হয়েছে। সঙ্গীতের সেই সৌন্দর্য্য এখানেও ধরে রাখা হয়েছে এবং পূর্বের আয়াতের [২:১৩৪] পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কুরআন শরীফ নাজেল হয়েছে কবিতার মাধ্যমে এবং পড়তেও হয় সুরেলাভাবে। এর ভাষা, ছন্দ, মাধুর্য্য অতুলনীয়। এই লাইনটি শেষে বার বার ব্যবহার করা হয়েছে' সঙ্গীতের একটি লাইন যেরূপ বার বার ব্যবহার করা হয় সেরূপ এই বিষয়টির গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য।
রুকু - ১৭
১৪০। যারা নির্বোধ তারা স্রষ্টার নির্দেশের অপেক্ষা তাদের পুরনো অভ্যাসের দিকেই বেশি ঝুঁকে থাকে, দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে। কোন কিছুতেই তাদের অবিচল আস্থা থাকে না। এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে মূর্তি পূজারী, মুশরিক এবং ইহুদীদের একটা অংশকে যারা সবসময়ই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর সাথীকে তাদের বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে পেরেশান করতে সচেষ্ট থাকতো। এমনকি এ ধরণের লোকেরা হযরত ঈসা (আঃ) এর সময়ে তাঁকেও এভাবে বিরক্ত করতো (Matt. xxii, ১৫, ২৩)।
১৪১। আলোচ্য আয়াতে কিবলা পরিবর্তন সম্পর্কে বিরোধীতাকারীদের আপত্তি বর্ণনা করে তার জওয়াব দেওয়া হয়েছে। আয়াতটি বোঝার জন্য কিবলার স্বরূপ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। [কিবলার শাব্দিক অর্থ মুখ করার দিক। প্রত্যেক এবাদতে মুমিনদের মুখ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র দিকেই থাকে। আল্লাহ্ পবিত্র সত্তা পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ বন্ধন থেকে মুক্ত, তিনি কোনও বিশেষ দিকে অবস্থান করেন না। ফলে কোনও এবাদতকারী যদি যে দিকে ইচ্ছা সেদিকেই মুখ করতো কিংবা একই ব্যক্তি এক সময়ে একদিকে, অন্য সময়ে অন্যদিকে মুখ করতো, তবে তাও স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থি হতো না।]
কিন্তু অপর একটি রহস্যের কারণে সমস্ত ইবাদতকারীর মুখ একদিকেই যাওয়া উচিত। রহস্যটি এই, ইবাদত বিভিন্ন প্রকার। কিছু ইবাদত ব্যক্তিগত, আর কিছু ইবাদত সমষ্টিগত। আল্লাহ্র যিকির, রোযা প্রভৃতি ব্যক্তিগত ইবাদত। এগুলো নির্জনে ও গোপনভাবে সম্পাদন করতে হয়। নামাজ ও হজ্ব সমষ্টিগত ইবাদত। এগুলো সংঘবদ্ধভাবে ও প্রকাশ্যে সম্পাদন করতে হয়। সমষ্টিগত ইবাদতের বেলায় ইবাদতের সাথে সাথে মুসলমানদের সংঘবদ্ধ জীবনের রীতি-নীতিও শিক্ষা দেওয়া লক্ষ্য থাকে। এটা সবারই জানা যে, সংঘবদ্ধ জীবন-ব্যবস্তার প্রধান মূলনীতি হচ্ছে বহু ব্যক্তিভিত্তিক ঐক্য ও একাত্মতা। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও বিচ্ছিন্নতা, সংঘবদ্ধ জীবন ব্যবস্থার পক্ষে বিষতুল্য। এরপর ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু কি হবে; তা নির্ধারণ করার ব্যাপারে বিভিন্ন যুগের মানুষ বিভিন্ন মত পোষণ করেছে। কোন কোন সম্প্রদায় বংশকে কেন্দ্র বিন্দু সাব্যস্ত করেছে, কেউ দেশ ও ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যকে এবং কেউ বর্ণ ও ভাষাকে ঐক্যের কেন্দ্র বিন্দু হিসাবে সাব্যস্ত করেছে। প্রকৃতপক্ষে এসব বিষয় সমগ্র জাতিকে একই কেন্দ্রে সমবেত করতে সমর্থও নয়। বরং চিন্তা করলে দেখা যায় এ জাতীয় ঐক্য প্রকৃতপক্ষে মানব জাতিকে বেহুদা বিভক্ত করে দেয় এবং পারস্পরিক সংঘর্ষ ও মতানৈক্যই সৃষ্টি করে বেশী।
বিশ্বের সকল পয়গম্বরের ধর্ম ইসলাম অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীমের দ্বারা যার নামকরণ হয়েছিল। যার মূল কথা হচ্ছে কোটি কোটির প্রভুর এবাদতে বিভক্ত বিশ্বকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র এবাদত ও আনুগত্যের প্রতি আহবান।
এই আয়াতের তাৎপর্য এই যে বায়তুল মোকাদ্দাস বা কাবা শরীফ এসব স্থানের নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নাই। কিবলা হিসেবে আল্লাহ্ তায়ালা যে এগুলোকে মনোনীত করেছেন, এটাই সে স্থানের শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র কারণ। মহানবী (সাঃ) এর বেলায় কেবলা পরিবর্তনের রহস্য সম্ভবত এই যে, কার্যক্ষেত্রে মানুষ জেনে নিক যে, কিবলা কোন পূজনীয় মূর্তি বা বিগ্রহ নয় বরং আসল বিষয় হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দেশ ও নির্দেশ মানার আনুগত্য।
১৪২। মানবমণ্ডলীর ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সমগ্র বিশ্বের কেবলার মুখ করার দিক কোনটি হবে এর মীমাংসা মানুষের হাতে ছেড়ে দিলে তা বিরাট মতানৈক্য ও কলহের কারণ হয়ে যাবে। সুতরাং এর মীমাংসা আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই হওয়া উচিত। হযরত আদম (আঃ) এর পৃথিবীতে অবতরণের পূর্বেই ফেরেশ্তাদের দ্বারা কাবা গৃহের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। আদম ও আদম সন্তানদের জন্য সর্বপ্রথম কেবলারূপে কাবা গৃহকেই সাব্যস্ত করা হয়। আল্লাহ্ সেই ঐতিহ্যবাহী স্থানকে মুসলমানদের জন্য কিবলার জন্য নির্দিষ্ট করে মুসলমানদের ইহুদী ও খৃষ্টানদের থেকে আলাদা উম্মত হিসেবে চিহ্নিত করে সম্মানিত করেছেন। কাবা শরীফ হচ্ছে তারই প্রতীক।
১৪৩। 'মধ্যপথ অবলম্বী' এই হচ্ছে ইসলামের মূল চেতনা। যেকোন কাজে বা ধর্মের ব্যাপারে ইসলাম বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। যারা ধর্মের ব্যাপারে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, ধর্মের খুঁটি-নাটি, নিয়ম-নীতি ইত্যাদি নিয়ে মাতামাতি করে, ফলে তারা ধর্মের যে মূল চেতনা বা ভিত্তি তা থেকে দূরে সরে যায়। মানুষের কল্যাণের দিকটি তাদের ভিতর থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। আবার যারা ধর্মকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে শুধু পৃথিবীর সুখ, শান্তি, অর্থ, ক্ষমতা ইত্যাদির পিছনে ধাওয়া করে তারাও এক ধরণের মৌলবাদী (থেমে থাকা মানুষ)। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য খুব কম। কারণ এই দুইশ্রেণীই মানুষের কল্যাণের প্রকৃত দিকটি সম্বন্ধে অন্ধ; এবং আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য সম্পর্কে বৈরী। এটা এক ধরণের স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা। কারণ নিজস্ব মনগড়া মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা মানব কল্যাণের দিকটি পরিত্যাগ করে, ফলে তারা আল্লাহ্র আইন লঙ্ঘন করে, যা ইসলামের মূলকথা তাকেই অস্বীকার করে। কিন্তু ইসলাম এই দুই চরম পন্থীতের পরিত্যাগ করতে বলে।
'মধ্যপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায়' এই কথাটির মধ্যে ইসলাম ধর্মের সারমর্ম ও সৌন্দর্য নিহিত। এই ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায়ের মানদণ্ড কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা আল-ইমরানে [৩:১০] বলা হয়েছে, তোমরাই সে শ্রেষ্ঠ উম্মত মানবজাতির কল্যাণের জন্য যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। (১) তোমরা ভাল কাজে আদেশ করবে; (২) মন্দ কাজে নিষেধ করবে এবং (৩) আল্লাহ্র উপর ঈমান আনবে।' সূরা আরাফের শেষভাগে এই সম্প্রদায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে 'আমি যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় রয়েছে যারা সৎ পথ প্রদর্শন করে এবং তদানুযায়ী ন্যায় বিচার করে।' অর্থাৎ এ সম্প্রদায়টি অন্যের হিতাকাঙ্ক্ষা ও উপকারের নিমিত্তে সৃষ্টি। তাদের অভীষ্ট কর্তব্য ও জাতীয় পরিচয় এই যে, তারা মানুষকে সৎ কাজের দিকে পথ দেখাবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। এবং এই হচ্ছে মধ্যপথ। ধর্ম সম্বন্ধে উন্মাদনা ইসলাম অনুমোদন করে না। মধ্যপন্থী হচ্ছে তারাই যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেহাদে তারা হচ্ছে নিঃস্বার্থ। তারা কোনও বিশেষ দেশ ও ভৌগলিক সীমার বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে না। তাদের কর্মক্ষেত্র হবে সমগ্র বিশ্ব এবং জীবনের সকল শাখায় পরিব্যপ্ত। এরাই প্রকৃত মুসলমান।
১৪৪। যখন দু'পক্ষ আত্ম কলহে মগ্ন হয়, তখন তাদের মধ্যে সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয়। এসময়ে একজন নিরপেক্ষ ও ন্যায়বান ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এখানে বলা হয়েছে ইহুদী জাতির কথা। যারা মুসার ধর্মের আচরণবিধি কঠোরভাবে অনুশীলন করতো ফলে ধর্ম রূপান্তরিত হয়ে গেলো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে। ধর্মের যে প্রাণ তা গেলো হারিয়ে। আবার খৃষ্টানেরা বলে ধর্মের নামে পৃথিবীর সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করতে। তাদের কাছে পরকালের জন্য পৃথিবীর সমস্ত ক্রিয়া-কর্ম পরিতাজ্য। তাহলে তো সভ্যতা থমকে যাবে। মানব সভ্যতার যে অগ্রগতি তা হবে ব্যাহত। কিন্তু কর্মহীন দ্বীন আল্লাহ্র কাছে মনোনীত নয়। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে বলা হয়েছে দ্বীন ও দুনিয়া উভয়েরই প্রয়োজন পরকালের মুক্তির জন্য। মুসলমান চলমান পৃথিবীর সমস্ত ক্রিয়াকর্মে অংশ গ্রহণ করবে। আমরা এর প্রকৃত উদাহরণ দেখি ৭ম ও ৮ম শতাব্দীতে মুসলিম সভ্যতার আমলে। তারা হয়েছেন বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, শিল্পী, সাহিত্যিক। পৃথিবীর সভ্যতাকে তারা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু একই সাথের তাদের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম ছিল আল্লাহ্র কাছে নিবেদিত। আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের সাথে সাথেই ছিল তাদের দুনিয়া। দ্বীন ও দুনিয়া এই দুয়ে মিলেই ইসলাম। দুনিয়ার প্রলোভন দুনিয়াতে থেকেই আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসায় আল্লাহ্র জন্য ত্যাগ করাই হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। সুতরাং ইসলামে ঈমানদারগণকে এই মধ্যপন্থী ন্যায়বান সাক্ষী হিসেবে বলা হচ্ছে।
১৪৫। জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে কিব্লা পরিবর্তন করে কাবাকে কিব্লা নির্দেশ করার পর ইহুদী ও আরবের মুশরিক ও মুনাফিকরা প্রশ্ন তুলতে থাকে যে এ ধর্মের কোনও স্থিতিশীলতা নাই। রোজ কিব্লা পরিবর্তন করে। কিন্তু আল্লাহ্র অস্তিত্ব পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সর্বত্রই। কিব্লার কোনও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নাই।
আল্লাহ্ মনোনীত করেছেন এটাই এ স্থানের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। কোনটা কিব্লা হলো সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো কে আল্লাহ্র হুকুম বিশ্বাস ও আনুগত্যের সাথে পালন করলো। আল্লাহ্ কিব্লা পরিবর্তনের ঘটনাকে অনুসারী মুসলমানদের জন্য একটি পরীক্ষা সাব্যস্ত করেছিলেন যাতে প্রকাশ্যভাবে জানা যায় যে কে রাসূলের খাঁটি অনুসারী এবং কে নিজ মতের অনুসারী।
১৪৬। কিব্লা পরিবর্তনের পূর্বে যারা ইন্তেকাল করেছিলেন তারা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে সালাত কায়েম করেছিলেন। তাদের ঈমান ও সালাত কবুল হয়েছে কিনা এ নিয়ে কারও কারও মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এই আয়াতটি-তখন ইরশাদ হয়। আল্লাহ্র কাছে বিশ্বাসের গভীরতা ও আন্তরিকতাই আসল কাম্য। এক স্রষ্টায় বিশ্বাস, তাঁর প্রতি আনুগত্য এবং অকৃত্রিম ভালবাসা-এটাই আল্লাহ্ আমাদের কাছে চান। আল্লাহ্ তাঁর বান্দার কাছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা হাদীস ফেকার চুলচেরা বিশ্লেষণের পাণ্ডিত্য চান না। বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান, ধর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণ, ধর্মের পাণ্ডিত্যে বাইরের পৃথিবীকে চমকিত করতে পারে, সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার অনুসারী হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্র কাছে এসব আনুষ্ঠানিকতার কোনও মূল্য নাই। আল্লাহ্ আমাদের পরিশুদ্ধ আত্মা চান। যে আত্মা থাকবে শুধু আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসা, আনুগত্য ও বিশ্বাসে ভরপুর। এখানে আনুষ্ঠানিকতা বা তার ত্রুটিতে কিছুই যাবে বা আসবে না। সুতরাং যারা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে কিব্লা করে নামায পড়ে গত হয়েছেন তাদের নামাজ যদি আন্তরিক ও আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসাতে ভরপুর হয় তবে অবশ্যই তা আল্লাহ্র কাছে গৃহীত। ইসলাম বাহুল্য আনুষ্ঠানিকতাকে সবসময়ে পরিত্যাগ করতে বলেছে।
১৪৭। এই আয়াত [২:১৪৪] থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় আমাদের নবীর (সাঃ) কিব্লার দিক সম্পর্কে স্বর্গীয় নির্দেশের জন্য আন্তরিকতা, আকুলতা। যতদিন পর্যন্ত মুসলমানেরা তাদের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী এক বিশেষ সম্প্রদায়ে পরিণত না হয়েছে ততদিন আমাদের রাসূল (সাঃ) ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের কিব্লা জেরুজালেমের অনুসরণ করতেন। কিন্তু সমস্ত ইহুদী ও খৃষ্টানেরা একই কিব্লা অনুসরণ করতো না। কিছু কিছু ইহুদী বিশেষভাবে যখন তারা বন্দী হতো তারা জেরুজালেমের দিতে মুখ করে উপাসনা করতো। কারণ আমাদের নবীর আমলে জেরুজালেম বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল-আর বাইজানটাইন সম্রাট ছিলেন খৃষ্টান। কিন্তু খৃষ্টানেরা তাদের চার্চের মুখ পূর্বদিকে পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তন কোন বিশেষ কেব্লার জন্য তারা করে নাই। তারা কম্পাসের পূর্বদিক হিসেবে শুধুমাত্র একটি দিক নির্দেশনা হিসেবে এটা করে। কারণ বর্তমানেও দেখা যায় বিভিন্ন চার্চের বেদী ও বসার স্থান বিভিন্ন দিকে। তার মানে এই, তারা কোনও বিশেষ কিব্লার দিকে মুখ করে না। কিন্তু আমাদের নবী এক আল্লাহ্ বিশ্বাসীদের এক সত্যে, এক বিশ্বাসে, এক নীতিতে একতাবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাই যখন আল্লাহ্ কর্তৃক কাবাকে মুসলমানদের জন্য কিব্লা নির্ধারিত করা হয়; আমাদের নবীর হৃদয় স্বাভাবিকভাবে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। এই সেই স্থান যে স্থানের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দ্বারা কাবা গৃহ নির্মাণের মাধ্যমে। এই সেই কাবা গৃহ যার ভিত্তিপ্রস্তর প্রথম স্থাপিত হয় ফেরেশ্তাদের দ্বারা হযরত আদম (আঃ) এর পূর্বে। সুতরাং আরবদের মাঝে প্রেরিত নবীর জন্য সেই ঐতিহ্যবাহী স্থানকে কিব্লা হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা খুবই স্বাভাবিক এবং আল্লাহ্ তাঁর নবীর সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন; যেনো সমস্ত আরব এবং বিশ্ববাসী এক কিব্লার দিকে মুখ করে আল্লাহ্র এবাদত করতে পারে এবং নিজেদের মধ্যে তাওহীদের সত্যকে অনুভব করে একাত্মতা বোধ করে। কিন্তু যখন আল্লাহ্র তরফ থেকে কাবা গৃহকে কিব্লা মনোনীত করা হয় তখন মুসলিম সম্প্রদায় ছিল অত্যন্ত ছোট এবং মদীনায় নির্বাসিত। কিন্তু আল্লাহ্ কর্তৃক কাবাকে কিব্লা মনোনীত করার ফলে মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড অনুপ্রেরণার জন্ম নেয়। তারা বিশ্বাস করে যে তাদের জয় সুনিশ্চিত। পরবর্তীতে মুসলমানদের মক্কা জয়ই তার প্রমাণ এবং আজ সমস্ত মুসলিম জগতের একমাত্র কিব্লা হচ্ছে কাবা। সারা মুসলিম জগত যখন কাবা শরীফের দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে তখন তারা একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
১৪৮। 'মসজিদুল হারাম বা পবিত্র মসজিদ' পবিত্র মক্কা নগরীতে কাবা গৃহের অবস্থান। এটা ঠিক নয় যে কাবাকে কিব্লা মনোনীত করার ফলে আয়াত [২:১১৫] রহিত হয়ে গেলো। বলা হয়েছে পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই আল্লাহ্ বিরাজমান। অর্থাৎ আল্লাহ্র সত্তা কোনও বিশেষ স্থানে সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহ্র অস্তিত্ব পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, আকাশ, পাতাল, নভোমন্ডল সর্বত্র বিদ্যমান। এই সত্য কাবা গৃহ কিব্লা হিসেবে মনোনীত হওয়ার পূর্বেও ছিল পরেও আছে। এই সত্যকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য এই সত্যের প্রতিধ্বনি করা হয়েছে [২:১৪২] আয়াতে।
১৪৯। একটি নির্দিষ্ট কিব্লা অনুসরণের সৌন্দর্য্য এর পূর্বেও ইহুদী ও খ্রষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তবে তা এত সুদূঢ় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কিব্লার আন্তর্জাতিক রূপায়ন ও স্বীকৃতি শুধুমাত্র ইসলামই প্রবর্তন করে।
১৫১। কিতাবধারী জাতিরা এই সত্যকে এমনভাবে চেনে যেমন তারা তাদের সন্তানদের চেনে। কারণ তাদের ধর্মগ্রন্থ, তাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য সবই সেই এক সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত যা তাদের ধর্মের নূতন রূপকে স্বাগতম জানাতে সাহায্য করে। (কারণ এই রূপ সেই একই আল্লাহ্র নির্দেশে পরিবর্তিত ও সময়োপযোগী করে সংশোধিত। এরপরে আর কোনও জীবন-দর্শনের প্রয়োজন নেই-এটি সর্বকালের মানুষের জন্য একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ)। কোন কোন অনুবাদকের মতে 'this' বা এই শব্দটি আমাদের নবীকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। তাহলে এ আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় যে কিতাবধারী জাতিরা মুহম্মদকে সেরকম ভালভাবে জানে যেমন তারা তাদের সন্তানদের জানে। তারা জানে তিনি সত্যের প্রচারক, তারা জানে তিনি ইব্রাহীমের ধর্ম প্রচার করেছেন। তারা এও জানে যে তার বর্ণনাই তাদের ধর্মগ্রন্থে পূর্বেই বলা হয়েছে। কিন্তু অন্ধকার ও স্বার্থপরতা তাদের সত্য গোপন করতে এবং তাদের ধর্মগ্রন্থের বিপরীত কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
১৫২। 'সত্য' হেদায়েতের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্র। মানুষ যত চেষ্টাই করুক সত্যকে গোপন রাখতে পারে না। মানুষের সন্দেহ, স্বার্থপরতা, বিকৃতি সবকিছুর উর্ধ্বে আল্লাহ্র অস্তিত্ব। পৃথিবীতে আল্লাহ্ই একমাত্র সত্য। তিনিই আদি এবং অন্ত। সুতরাং সত্য হেদায়েতের ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই।
আল্লাহ্ প্রতিটি মানুষকে পাঠিয়েছেন তার বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করে। তাঁর নেয়ামত-ই হচ্ছে মানুষের জন্য বিশেষ গুণাবলী যা মানবকে করে গৌরবান্বিত, ধন্য। একেই আমরা আখ্যায়িত করি প্রতিভারূপে। তবে সবাই প্রতিভাবান না হলেও সকলের মধ্যেই আল্লাহ্র কিছু না কিছু নেয়ামত আছে। বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদি বিভিন্ন গুণাবলী বিভিন্ন মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে জন্ম নেয়। এই জন্মগতভাবে পাওয়া ক্ষমতাই হচ্ছে আল্লাহ্র বিশেষ দান। এই দানকে সম্পূর্ণ করায়ত্ব করতে হলে প্রত্যেককে তার সমস্ত সত্ত্বা ও আন্তরিকতা দিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা ব্যতীত আল্লাহ্ প্রদত্ত এই নেয়ামতকে করায়ত্ব করা সম্ভব নয়। আপাতঃদৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিকের লক্ষ্য এক, শিল্পীর লক্ষ্য অন্য, সাহিত্যিকের লক্ষ্য আলাদা কিন্তু সামগ্রিকভাবে সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক, আর তা হচ্ছে পৃথিবীতে সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা ও সৃষ্টির সেবা করা ও মন্দকে প্রতিহত করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামত দ্বারা আল্লাহ্ প্রত্যেকের জন্য তার লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছেন যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে চেষ্টা ব্যক্তিগত হতে পারে আবার সমষ্টিগতও হতে পারে। এই চেষ্টার শেষ পরিণতি হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতকে আয়ত্ব করে তার সৃষ্টির সেবার জন্য তা নিবেদন করা। এখানে লক্ষ্য এক কিন্তু পথ প্রত্যেকের জন্য আলাদা।
১৫৪। এই আয়াতে প্রতিযোগিতাপূর্ণ দৌড়ের উপমাটির [২:১৪৮] ধারাবাহিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্বে বলা হয়েছে এই দৌড়ের প্রতিযোগিতার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য এক। এখানে কিব্লাকে এর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াত [২:১৪৪] এ বলা হয়েছে নূতন মুসলমানদের জন্য কাবা হচ্ছে একতার প্রতীক। এখানে কাবাকে বলা হচ্ছে সত্য, সুন্দর ও ভালোর প্রতীক-যে প্রতীক সকলেরই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এখানে খৃষ্টান বা ইহুদী বা মুসলমানদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। যে যেখানে থেকেই শুরু করুক না কেন সকলেরই শেষ লক্ষ্য একটাই। আর তা হচ্ছে পৃথিবীতে সত্য ও সুন্দরের এবং ভালোর প্রতিষ্ঠা। এই এক লক্ষ্যে একত্রিত করার প্রতীক হচ্ছে কিব্লা। আয়াত [২:১৫০] এ এই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আয়াতে [২:১৫০] 'Where soever' কথাটি আরবীতে অনেক ব্যাপক অর্থ বহন করে। এর মানে তিনটি বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে, (১) যে কোনও পরিবেশে, (২) যে কোনও যুগে, সময়ে (৩) যে কোনও স্থানে। অর্থাৎ এর যে কোনও অবস্থানেই ব্যক্তি বা সমষ্টি থাকুক না কেন সকলের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য এক কিব্লার দিকে মুখ যা সত্য, সুন্দর ও ভালর প্রতীক।
১৫১। যেমন [অনুগ্রহ তোমরা ইতিমধ্যে পেয়েছ যে], তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের প্রতি রাসূল প্রেরণ করেছি ১৫৫। যে তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে, তোমাদের পরিশুদ্ধ করে, এবং তোমাদের কিতাব ও প্রজ্ঞা এবং নূতন জ্ঞান শিক্ষা দেয়।
১৫৫। এই [২:২৫১] আয়াতটি [২:১৫০] আয়াতের শেষ অংশরূপে পরিগণিত করা যায়। সুতরাং সম্পূর্ণ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে দুটো [১৫০ ও ১৫১] আয়াত এক সাথে পড়া প্রয়োজন। এখানে কাবাকে কিব্লা করার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা হচ্ছে, কাবাকে কিব্লা করার মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের ধর্মকে সম্পূর্ণ করে দিচ্ছেন এবং সেই সাথে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রার্থনাও মঞ্জুর করে দিচ্ছেন। হযরত ইব্রাহীমের প্রার্থনা ছিল তিনটি। প্রথমটি ছিল মক্কা হবে পবিত্র নগরী [২:১২৬], দ্বিতীয়টি হচ্ছে সেখানে সত্যিকারের মুসলমানদের উদ্ভব হবে এবং কাবা শরীফ হচ্ছে পরহেযগারদের জন্য Sanctuary [২:১২৮] এবং তৃতীয়টি হচ্ছে আরবদের মধ্যে যেনো নবী প্রেরণ করা হয় যার গুণাবলী পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করবে [২:১২৯]। এই আয়াতটিতে উপরিউক্ত কথাগুলিরই পুনরাবৃত্তি করে শেষ করা হয়েছে।
১৫৬। 'জিকির' কথাটির অনুবাদ করা হয়েছে স্মরণ করা। স্মরণ কর কথাটির দ্বারা জিকির শব্দটির পূর্ণাঙ্গভাব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আরবী জিকির শব্দটি বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ করে। আমাদের ধর্মে জিকির শব্দটি ব্যবহার হয় (১) স্মরণ অর্থে (২) প্রশংসা অর্থে (৩) অনুশীলন অর্থে (৪) [To celebrate or commemorate] উদ্যাপন অর্থে (৫) গুরুত্ব দেওয়া অর্থে ও (৬) ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আনন্দ লাভ করা অর্থে ইত্যাদি। অর্থাৎ আল্লাহ্র নামকে ভক্তির সাথে, শ্রদ্ধার সাথে, কৃতজ্ঞতার সাথে, জীবনের প্রতিটি অবস্থায় স্মরণ করার নামই হচ্ছে জিকির করা। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-ব্যাথা, সাফল্য-ব্যর্থতা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নাম স্মরণে আনন্দ পাওয়ার নামই হচ্ছে জিকির।
রুকু - ১৯
১৫৮। 'ধৈর্য্য, অধ্যবসায় এবং প্রার্থনা' যা পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে জীবন বিমুখতা। বরং এর অর্থ ঠিক উল্টো। এর অর্থ হচ্ছে সোচ্চার ভাবে শক্তভাবে হাল ধরে মিথ্যার বিরুদ্ধে, সত্যের জন্য যুদ্ধ করা। কারণ সত্যের জন্য যুদ্ধ করাই হচ্ছে আল্লাহ্র জন্য যুদ্ধ করা। আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করার অর্থ ধন-সম্পদ, আপন-জন, সুখ-সুবিধা, সর্বস্ব ত্যাগ করা, সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা। সত্যের জন্য সংগ্রামে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এমনও হয় যে সারা জীবনের কর্মফলকে ত্যাগ করতে হয়। ত্যাগ করতে হয় অর্থ-সম্পদ, মান-সম্মান, যশ-প্রতিপত্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা এমনকি অনেক সময় সমাজের চোখে, সাধারণ মানুষের চোখে নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। তবুও সবকিছুর পরিবর্তে বান্দা যখন আনন্দ চিত্তে, সন্তুষ্টির সাথে শুধুমাত্র সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, তখন তার এই আপাতঃ ক্ষতি আর ক্ষতি থাকে না। আধ্যাত্মিক জগতে বান্দা পায় আসল পুরস্কার। যারা সত্যের জন্য সংগ্রাম করে এই সংগ্রামে যদি তারা নিজেদের জীবন বিসর্জন দেয় তবুও তা বৃথা যায় না। তারা মানুষের ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকে। তারা হয় অমর। আর এই সংগ্রামে বান্দা অর্থ-সম্পদ, মান-সম্মান যা তারা হারায়-সত্যিকার অর্থে তারা তা হারায় না। পৃথিবীর আর্থিক ক্ষতির বিনিময়ে আল্লাহ্ বান্দার সম্মুখে আধ্যাত্মিক জগতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। আমরা মহামানবদের জীবন থেকে এই শিক্ষা পাই-তাদের সংগ্রাম তাদের মৃত্যুর পরও অমর হয়ে আছে। তারা মৃত নন। আবার সত্যের জন্য আত্মত্যাগ মানব সমাজের একটি বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকতে পারে, যে আত্মত্যাগের দ্বারা মানুষ যুগে যুগে উপকৃত হয়। ইসলাম এই আত্মনিবেদনকে উৎসাহিত করে।
১৫৯। এখানে সুসংবাদ যার অর্থ আল্লাহ্র রহমত। ঠিক এই একই কথা অন্য ভাষায় বলা হয়েছে [২:১৫৩] আয়াতে। সেখানে বলা হয়েছে আল্লাহ্ তাদের সাথে থাকবেন। এর থেকে বড় পুরস্কার পরহেজগার বান্দার জন্য আর কী হতে পারে।
১৫৭। এরাই তারা যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ বর্ষিত হয়। এবং এরাই তারা যারা সৎপথের নির্দেশ লাভ করে।
১৫৮। দেখো! সাফা ও মারওয়া আল্লাহ্র [প্রতীক] নিদর্শনসমূহের অন্তর্গত ১৬০। সুতরাং যে কেহ কাবা গৃহে ১৬১ হজ্ব ও ওমরা সম্পন্ন করে, তারা এ দুটিকে প্রদক্ষিণ করবে, এতে কোন পাপ নাই। যদি কেহ সৎ কাজের আবেগকে মেনে চলে, তবে নিশ্চিত হও, আল্লাহ্ [সৎ কাজকে] চিনতে পারেন ও সব জানেন ১৬২।
১৬০। আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের সাথে ধৈর্য্য ও অধ্যবসায় গুণ দু'টি আল্লাহ্ প্রতীকের মাধ্যমে এখানে বর্ণনা করেছেন সাফা ও মারওয়া দুটি ছোট ছোট পাহাড় যা মক্কা নগরীর অন্তর্ভূক্ত এবং যার খুব নিকটেই যম্যম্ কূপ অবস্থিত এই পাহাড় দুটি ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়ের প্রতীক। এর সম্বন্ধে পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে। টিকা ১২৩-এ।
প্যাগান আরবেরা এখান মূর্তি স্থাপন করেছিল। ফলে নওমুসলিমরা হজ্বের সময়ে এখানে দৌড়াদৌড়ি করতে ইতঃস্তত করছিল। অবশ্য তাদের একটা কথা অনুধাবন করা উচিত ছিল যে পবিত্র কাবা ঘর [আল্লাহ্র ঘর] মূর্তি দ্বারা ভর্তি ছিল এবং আল্লাহর রাসূল তা পরিষ্কার করে সেখানে আল্লাহ্র ইবাদতের প্রতিষ্ঠা করেন।
এখানে শিক্ষণীয় হচ্ছে, পবিত্র জিনিষের অপবিত্র ব্যবহার হয়ে যেতে পারে। তাই বলে, আমরা সেই পবিত্র জিনিষকে ত্যাগ করতে পারি না। যা পারি তা হচ্ছে তাকে শুদ্ধ করে তার স্বস্থানে স্থাপন করতে। অর্থাৎ সত্য মিথ্যা দ্বারা আবৃত হতে পারে। যেমন-সূর্য মেঘে ঢেকে গেলে সূর্য সূর্যই থাকে। সেরকম সত্য মিথ্যা দ্বারা আবৃত্ত হলেও সত্য প্রকাশ পাবেই। সে রকম যদি আমাদের কাজের উদ্দেশ্য এবং আমাদের জীবন যদি পবিত্র হয়, পৃথিবীর আর কেউই তার মূল্য দিক বা না দিক আল্লাহ্ তার মূল্য দেবেনই।
১৬১। 'The House' পবিত্র মসজিদ বলতে কাবা ঘরকেই বোঝানো হয়েছে। পবিত্র হজ্বব্রত পালনের সময়ে যিলহজ্ব মাসের ৯ম দিনে আরাফাতের ময়দানে যেতে হয় এবং তারপর কাবা ঘরকে প্রদক্ষিণ করতে হয়। হজ্বের সময় ব্যতীত অন্য সময়ে কাবা ঘর প্রদক্ষিণ করাকে বলে ওমরা করা। ওমরা করার নিয়মাবলী ও হজ্বের নিয়মাবলী প্রায় একই শুধু ওমরার সময়ে আরাফাতের ময়দানে যেতে হয় না। তবে সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। সাফা মারওয়া মুসলিম ধর্মে এক মাইলফলক। এর দ্বারা আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীলার সাথে যে গুণ দুটির জন্য সাফা ও মারওয়া প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো ধৈর্য্য, অধ্যাবসায়। আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীলতা, ধৈর্য্য ও অধ্যবসায় এই হচ্ছে প্রকৃত মোমেন বান্দাদের চরিত্রের প্রধান ও অন্যতম গুণাবলী।
১৬২। আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনও কাজ করা উচিত নয়। তীব্র আবেগে মানুষের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচারের ক্ষমতা লোপ পায়। সুতরাং তীব্র আবেগের বশবর্তী হয়ে কারও ক্ষতি করা বা কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। কিন্তু এখানে আল্লাহ্ বলেছেন যদি তীব্র আবেগ ভালর জন্য হয়, মানুষের মঙ্গলের জন্য হয়, তবে তা করা উচিত। সমাজ বা মানুষের ভয়ে তা ত্যাগ করা উচিত নয়। আমরা যদি নিশ্চিতভাবে জানি যে আবেগ ও অনুভূতি আমাদের সুপথে চালিত করছে-আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে মানুষের বা সমাজের ভয়ে তা ত্যাগ না করে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে তার সন্তুষ্টির জন্য তা সম্পাদন করা। একেই বলা হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
১৬৩। 'Those entitled to curse' অভিশাপকারীগণ অর্থাৎ ফেরেশ্তা ও মানব গোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে যারা অভিশাপ দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। [২:১৬১] এই আয়াতে বলা হয়েছে যারা অভিশপ্ত তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। সেই সাথে বঞ্চিত হবে ফেরেশ্তা ও বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর শুভাশীষ থেকে। কারণ তারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করার ফলে নিজের আত্মার উপরে অত্যাচার করে। আল্লাহ্ মানুষের আত্মাকে পুতঃ এবং পবিত্র করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের আত্মা আল্লাহ্র রুহুর অংশবিশেষ [১৫:২৯]। অবিশ্বাসের দ্বারা আত্মার পবিত্রতা কলুষিত হয়ে যায়। কলুষিত আত্মা মহান স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হয় ফলে অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়। আল্লাহ্র সান্নিধ্য আত্মাকে করে আলোকিত, পরিতৃপ্ত, শান্ত এবং জ্ঞানী। অপর পক্ষে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে, তাদের আত্মা হয় পথভ্রান্ত, উদভ্রান্ত, অন্ধকারে আচ্ছন্ন ও বিচলিত। পৃথিবীর জ্ঞান, বিজ্ঞান তাদের মানসিক এই অবস্থার [State of mind] পরিবর্তন করতে পারে না। এই অবস্থায়ই হচ্ছে অভিশপ্ত অবস্থা।
১৬১। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং কাফিররূপে মারা যায়, তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত এবং ফেরেশ্তাগণ ও সকল মানুষের অভিসম্পাত।
১৬২। তারা সে অবস্থায় স্থায়ী হবে ১৬৪, তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না, তাদের [ভাগ্যে] কোন অবসরও দেয়া হবে না।
১৬৪। 'অভিশাপ' এটা শুধুমাত্র মুখের কথা নয়। অভিশপ্ত হচ্ছে আত্মার এক বিশেষ অবস্থা। [State of mind] এই অবস্থা আল্লাহ্র অনুগ্রহের ঠিক উল্টো। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও রহমত আত্মাকে অন্ধকার থেকে আলোর ভূবনে নিয়ে আসে। ফলে আত্মার মধ্যে জন্ম নেয় শান্তি, অন্তর্দৃষ্টি [Spiritual insight] এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা (Wisdom) এরকম অবস্থায় বান্দার মধ্যে জন্ম নেয় ন্যায়-অন্যায় বোঝার ক্ষমতা, ভালকে মন্দ থেকে পার্থক্য করার ক্ষমতা, ফলে তিনি হন বিবেকবান এবং আল্লাহ্র রহমতের ফলে তার সমস্ত সত্তা শান্তিতে ভরে যায়। পৃথিবীর দুঃখ ব্যাথা, লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। অনাবিল শান্তি এবং আলোর ভূবনে হয় আত্মার অগ্রযাত্রা।
অভিশাপ প্রাপ্ত অবস্থা ঠিক এর বিপরীত। অনেকে মনে করে মুখে উচ্চারণ করলেই অভিশাপগ্রস্থ করা যায় কোনও ব্যক্তিকে, কিন্তু তা ঠিক নয়। তাই ইংরেজী প্রবাদ আছে, 'Causeless curse will not come.' কিন্তু যদি অত্যাচারী নিপীড়িত ব্যক্তি আল্লাহ্র কাছে এর প্রতিকার চায় তাহলে তার কান্না আল্লাহ্র আরসকে কাঁপিয়ে দেয়, ফলে অত্যাচারিত ব্যক্তির অভিশাপের ফলে অন্যায়কারী, অত্যাচারী ব্যক্তির উপর আল্লাহ্র রোষানল পতিত হয়। তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যায়কারী বা অত্যাচারী তার নিজের আত্মার উপরে অত্যাচার করে। ফলে আত্মার শান্তি হয় বিঘ্নিত। ঐ ব্যক্তি সর্বদা থাকে ভীত, সন্ত্রস্ত, বিচলিত, পৃথিবীর উপর সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এরাই হচ্ছে অভিশপ্ত আত্মা। এটা হচ্ছে এক ধরনের (State of mind) মানসিক অবস্থা।
১৬৫। এই আয়াতটির মর্মার্থ হচ্ছে, যখনই ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্কে অস্বীকারকারী এবং অন্যায় অত্যাচারকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ্র রোষানলের কথা বলা হয়েছে, তখনই আবার বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে আল্লাহ্র রহমত (Grace) এবং করুণার (Mercy) কথা। এই আয়াতে আল্লাহ্র একত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আয়াতটি শেষ করা হয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতি, আকাশ-নভোমন্ডল সবই আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হবে বিভিন্ন। কিন্তু যারা বিজ্ঞানের সাধক তারা জানেন বিশ্ব-প্রকৃতি, নভোমন্ডল সবই প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে। সে নিয়ম সবার জন্যই এক। যেমন-উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিজ্ঞান বলে মানুষ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে বুদ্ধি জগতের দিক থেকে বিভিন্নতা থাকলেও শারীরিক (Physiology) কলাকৌশল এক। রক্ত সঞ্চালন প্রণালী, Digestive System ইত্যাদি মানুষ ও প্রাণীর একই প্রক্রিয়ায় কাজ করে। তাইতো বিজ্ঞানীরা কোনও নতুন ঔষধ মানুষের পূর্বে কোনও প্রাণীর উপরে পরীক্ষা করে নেয়। একই নিয়ম বিশ্ব চরাচরের সবার জন্য প্রযোজ্য। একই নিয়মের আওতায় পৃথিবী, শুক্র, বৃহস্পতি, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি। এ সমস্তই একটি তত্ত্বের প্রতিই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে সব কিছুই এক জনের দ্বারা সৃষ্টি। বিভিন্ন স্রষ্টা বিভিন্ন জিনিস সৃষ্টি করলে বিশ্বজগতের বিজ্ঞান এক সূত্রে গাঁথা হতো না। বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন নিয়মের সূত্রে গাঁথা হতো। ফলে প্রকৃতিতে অনিয়ম ও সংঘর্ষ ঘটতো প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমরা দেখি আমাদের চারিপার্শ্বের বিশ্ব এক সূত্রে গাঁথা যা নির্দেশ করে স্রষ্টার একত্ব।
১৬৬। এই সুন্দর আয়াতটি হিমালয় পর্বতের মত। সৌন্দর্যমন্ডিত কিন্তু সুউচ্চ ও দৃপ্ত। আয়াতটির বর্ণনা শুধু সৌন্দর্য্যমন্ডিতই নয়, আয়াতটি আমাদের পরিচালিত করে বৃহত্তর, সুন্দরতম জীবনের প্রতি। আয়াতটির উপমাগুলি অনুধাবনযোগ্য এবং সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ। এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। প্রকৃতির বিভিন্নতার মধ্যে তার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। তার নির্দশন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র-সৌন্দর্য্য, শক্তিতে এবং মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিষে। এই সব নির্দশন দ্বারা আল্লাহ্ মানুষের বুদ্ধি এবং জ্ঞানকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন। প্রথমে আয়াতটি আরম্ভ হয়েছে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির মাহাত্ম্য দিয়ে। বিশাল আকাশ ও নভোমন্ডল মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে কিন্তু মানুষের চিন্তায় কল্পনায় সে অত্যন্ত কাছে। সৌন্দর্য্যমন্ডিত তারায় খচিত, চন্দ্রালোক শোভিত, প্রদীপ্ত সূর্যালোকিত মেঘে ঢাকা নীলাম্বর, আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋতুতে পৃথিবীর রং রূপের পরিবর্তন, সবই মানুষের চিন্তার দিগন্ত কল্পনার সীমানাকে ছাড়িয়ে যায়। আকাশ ও পৃথিবীর কি নিগূঢ় সম্পর্ক। কতদূরে সূর্যের অবস্থান তবুও পৃথিবীর দিনরাত্রির পরিবর্তনের সাথে তার কতই না নিবিড় সম্পর্ক। সৃষ্টির কি অপার রহস্য-দিন রাত্রির হ্রাস বৃদ্ধির সাথে সাথে পৃথিবীতে ঋতুর পরিবর্তন হয়। এক এক ঋতুতে প্রকৃতি এক এক সাজে সেজে ওঠে। আবার এই পরিবর্তনের ধারা সমগ্র পৃথিবীব্যাপী এক নয়। দ্রাঘিমাংশ পরিবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান বিভিন্ন আবহাওয়া ধারণ করে। ফলে সে দেশের প্রকৃতিও বিভিন্ন হয়। স্রষ্টার সুনিপুণ কৌশলের জন্যই একই পৃথিবীতে আমরা হাজারো বৈচিত্র্যের সন্ধান পাই। 'দিন ও রাত্রির পরিবর্তন, যা মানুষের হিত সাধন করে'-আল্লাহ্ দিনকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের রুজী রোজগারের জন্য আর রাতকে সৃষ্টি করেছেন বিশ্রামের জন্য। এই আয়াতে কাজ এবং রুজী রোজগারের বর্ণনার মধ্যে একটি সুন্দর উপমার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। যেমন অসীম সমুদ্রে হেলে দুলে চলেছে নৌযান সম্পূর্ণ এক দেশ থেকে আর এক দেশে। বাণিজ্য জাহাজ দেশে দেশে, মানুষে-মানুষে বন্ধনের প্রতীক, যোগাযোগের মাধ্যম। এভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীর সমুদ্র বা জলভাগ, স্থলভাগ থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার এই আয়াতে আল্লাহ্ বৃষ্টিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন দেয়া-নেয়ার সম্পর্কের সাথে। আকাশ সমুদ্রের পানিকে গ্রহণ করে মেঘরূপে, আবার পৃথিবী সেই পানি গ্রহণ করে বৃষ্টিরূপে আবার সেই বৃষ্টির পানি পৃথিবী সমুদ্রকে ফিরিয়ে দেয় নদীর মাধ্যমে। এটাকে বিজ্ঞানীরা 'পানি চক্র' নামে অভিহিত করে। তবে এটা কি স্রষ্টার সৃষ্টির এক অপূর্ব কৌশল নয়? একই পানি চক্রাকারে প্রবাহিত হচ্ছে কিন্তু পরিণতিতে পৃথিবী ফুলে, ফলে ফসলে সমৃদ্ধ হচ্ছে-নদী সকল নাব্যতা রক্ষা করছে। শীতের শুষ্কতায় বৃক্ষ তরুলতা মৃত প্রায় হয়ে গেলে বৃষ্টির পানিতে মৃত প্রায় পৃথিবী আবার সজীব হয়ে উঠে। নদী সকল ব্যবসা বাণিজ্য ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। আল্লাহ্ পৃথিবীব্যাপী ছড়ানো তার নির্দশন সমূহের প্রতি ইঙ্গিত করতে যেয়ে বলেছেন, 'আল্লাহ্ পৃথিবীব্যাপী বহুধরণের জীব জন্তু সৃষ্টি করেছেন। বিশাল ডাইনোসর থেকে অনুজীব এবং ভাইরাস যা অনুবীক্ষণ যন্ত্রেও দেখা সম্ভব নয়। সবই আল্লাহ্র সৃষ্টি। এর প্রতিটিতেই স্রষ্টার সৃষ্টি কৌশল বিদ্যমান। আল্লাহ্ মানুষকে চিন্তা করতে বলেছেন তাকে অনুধাবন করতে বলেছেন তার সৃষ্টির রহস্য কৌশলের মধ্য দিয়ে। তিনি যে কত বড় কর্মকার, কত বড় শিল্পী, কত বড় বিজ্ঞানী তার অনুধাবন করতে হলে অবশ্যই প্রত্যেককে বিজ্ঞান জানতে হবে। জ্ঞানী হতে হবে। আল্লাহ্ বলেছেন তাকিয়ে দেখ-কিভাবে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বাতাসের গতিবেগের পরিবর্তন হয়। কখনও বাতাস উত্তর দিক থেকে কখনও দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এর ফলে সমুদ্রের জলরাশি মেঘ হয়ে ভেসে ভেসে কোনও দেশে শীতে কোনও দেশে গ্রীষ্মে বৃষ্টিপাত ঘটায়। পৃথিবীকে সজীব রাখার আল্লাহ্র এ এক অপূর্ব কৌশল। প্রাচীনকালে যখন কলের জাহাজ আবিষ্কার হয় নাই, নাবিকেরা এই বাতাসের উপর নির্ভর করে সমুদ্র যাত্রা করতো, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতো, এক দেশের সভ্যতা অন্য দেশে প্রসার লাভ করতো। এখানে আল্লাহ্ বলেছেন মেঘ যেনো আকাশ, পৃথিবী ও বাতাসের দাস হিসেবে কাজ করে। শুধু তাই-ই নয় মেঘকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র বৃষ্টির জন্য নয়। প্রচণ্ড দাব-দাহে মেঘ আমাদের ছায়া দান করে, সূর্যাস্তের সময়ে পশ্চিম আকাশে মেঘের রংয়ের খেলা কাকে না মুগ্ধ করে? আল্লাহ্ বলেছেন তাঁকে অনুধাবন করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকে জানতে হবে। তবেই তার অপার জ্ঞানের, করুণার নিদর্শনের একটু মাত্র কণা আমরা অনুধাবন করতে পারবো। ফলে আমাদের হৃদয়ে তাঁর করুণার জন্য ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জন্মাবে। শুধুমাত্র মৌখিকভাবে তাঁকে স্মরণ করে তাকে ভালবাসা যায় না, তার যোগ্য সম্মান জানানো যায় না। নিরাকার আল্লাহ্কে হৃদয়ে অনুভব করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকে অনুধাবনের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।
১৬৭। আমাদের চারিপাশের বিশ্ব-জগতের দিকে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলেই আমরা বুঝতে পারবো সমস্ত সৃষ্টিই এক স্রষ্টার সৃষ্টি। বিজ্ঞানের একই নিয়ম বা তত্ত্ব সকলেই অনুসরণ করে। তার করুণা ধারায় সকলেই সঞ্জীবিত। যারা বিশ্বাসী এবং পরহেজগার তারা সৃষ্টির সমস্ত কিছুর মধ্যেই স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তারা এই সহজ সত্যটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। অবিশ্বাসী এই অর্থে যে, তারা অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, অনেকে মুখে মুখে আল্লাহ্কে স্বীকার করে কিন্তু তাদের অন্তর অন্য জিনিষের বন্দনা করে, এরাও অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত। বিশ্বাসীদের অন্তর সর্বদা আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসায় পরিপূর্ণ থাকে। তারা এই বিশ্বজগতের সব কিছুতেই আল্লাহ্র হাতের স্পর্শ অনুভব করে, তাঁর রহমতের সন্ধান পায়। কিন্তু অবিশ্বাসীদের অন্তরে বিভিন্ন জিনিষ পূজনীয় বিষয় হিসেবে স্থান পায়। এইসব পূজনীয় বিষয় যে সবসমযে মূর্তি বা বিগ্রহ হবে এমন কোনও কথা নাই। মূর্তি বা বিগ্রহকে যারা পূঁজা করে তাদের সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এছাড়াও যে সব বস্তুকে অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্র সমকক্ষরূপে পরিগণিত করে তাকে এভাবে বর্ণনা করা যায় -
(১) নিজের কাল্পনিক সৃষ্টিকে সে স্রষ্টার উপরে স্থান দেয়। যেমন-অনেক উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিমান ব্যক্তি আছেন যারা নাস্তিক, তাদের উপাস্য হচ্ছে বিজ্ঞান বা শিল্প বা সাহিত্য। এর মাঝেই তারা আত্মার পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে চায়। তাদের ধ্যান ধারণা সবই নিজেকে ঘিরে, নিজের সৃষ্টিকে ঘিরে আবর্তিত হয়। সেখানে বিশ্ব স্রষ্টার কোনও স্থান নাই। তারা ভুলে যায় যে আল্লাহ্ তাকে বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেছেন মানুষের সেবা করার জন্য। এখানে আত্ম অহংকার বা আত্মপূঁজার কোনও স্থান নাই।
(২) আর এক ধরনের লোক আছে যারা আল্লাহ্র আসনে বসায় তাদের নেতাকে। এই নেতা রাজনৈতিক হতে পারে [যেমন-লেলিন ছিলেন কমুনিষ্ট সোভিয়েত রাশিয়ায়] আবার ধর্মীয় হতে পারে। এখানে ধর্মীয় নেতা অর্থাৎ আমাদের দেশের পীর পূঁজার সংস্কৃতির কথা বলতে চাচ্ছি। এই সব পীর তাদের ভক্তদের এক আল্লাহ্র আসন থেকে নিজেদের সেই আসনে অধিষ্ঠিত করেছে এবং ভক্তদের সব মুশকিল আসানের মালিক বলে দাবী করে। আবার আর এক ধরণের পৌত্তলিকতা আমাদের সমাজে আসন গেড়ে বসেছে তা হচ্ছে 'মাজার পূঁজা' আল্লাহ্র কাছে কোনও শুভকাজে অনুমতি না চেয়ে কোন বিপদে সাহায্য না চেয়ে মাজারে যেয়ে জিয়ারত করে শুভ কাজ শুরু করা হয় বা বিপদে সাহায্য চাওয়া হয়।
(৩) তৃতীয় আর এক ধরনের লোক আছে যারা শয়তানের পূঁজারী। এরা মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে। ফলে এরা অন্যায়, অসত্যকে আকড়ে ধরে এবং এর দ্বারা ইহলৌকিক উন্নতিকে জীবনের পরম পাওয়া বলে গণ্য করে। কিন্তু আল্লাহ্ পরিষ্কার ভাবে বলেছেন যে মৃত্যুর পর প্রতিটি মানুষের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলন করা হবে। তারা যাদের পূঁজা করতো সেই পূঁজনীয় বস্তু তার ভক্তদের ত্যাগ করবে।
১৬৭। যারা অনুসরণ করেছিলো, তারা বলবে, 'যদি আমাদের আর একবার সুযোগ দেয়া হতো আমরা তাদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, তারা যেরূপ আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।' এরূপেই আল্লাহ্ তাদের কাজের [পরিণামকে] আক্ষেপের বিষয়রূপে দেখাবেন। তাদের জন্য আগুন থেকে বের হওয়ার কোন উপায় থাকবে না ১৬৮।
১৬৮। দেখুন [৩:১৫৬], [৮:৩৬], [১৯:৩৯], [৬৯:৫০], [২৫:২৩]। মৃত্যুর পরে আমাদের কৃতকর্মের ফলাফল হবে অপরিবর্তনীয়। অবিশ্বাসীরা পরলোকে অনুতাপের অনলে দগ্ধ হতে থাকবে যা থেকে তাদের মুক্তি ঘটবে না।
রুকু - ২১
১৬৯। এই আয়াতটি খাদ্য বস্তুর হালাল সম্পর্কে সতর্ক করে আরম্ভ করা হয়েছে। প্রথমে [২: ১৬৮-৭১] বিশ্ববাসীকে সম্বোধন করা হয়েছে। হতে পারে তারা মুসলিম বা পৌত্তলিক বা কিতাবধারী জাতি। আল্লাহ্র এ আহবান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য। আয়াত [২:১৭২-৭৩]এ বিশেষভাবে মুসলমানদের আহবান করা হয়েছে। তারপর [২:১৭৪-৭৬] তাদেরই সম্বোধন করা হয়েছে যারা ধর্মে আনুষ্ঠানিকতার উপরে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় এবং ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এরাই আমাদের সমাজের মৌলবাদীরূপে পরিচিত। এরা প্রকৃত ধর্মের প্রাণ থেকে বহুদূরে। আবার আর এক শ্রেণীর কথা বলা হয়েছে যারা কোনও নিয়ম কানুনে বিশ্বাস করে না, এরা আমাদের সমাজে প্রগতিশীল বলে দাবী করে। কিন্তু ইসলাম হচ্ছে মধ্যপথ অবলম্বী। সুন্দর, সুস্থ সমাজে অবশ্যই কিছু ধরা বাঁধা নিয়ম-কানুন থাকবে। এই নিয়ম কানুন সমাজের সকল সদস্য-সদস্যাদের মঙ্গলার্থে সৃষ্টি এবং এই নিয়ম কানুন সম্পর্কে সমাজের সকল সদস্য-সদস্যাদের আন্তরিকতা থাকবে তা মানার জন্য। তবেই একটা Homogeneous (সমপ্রকৃতি) সমাজ হওয়া সম্ভব। তবে এখানে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যে, এই সব নিয়ম-কানুন যেনো বাড়াবাড়িতে না পৌছাঁয় [২:১৭৬]। [পবিত্র বা Good : Taiyib=Pure, Clean, Wholesome, nourishing, pleasing to taste] সুতরাং নিয়ম-কানুন বা ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা বা আইন তা যদি সুস্থ, সুন্দর ও সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য হয় তবে তাই-ই হচ্ছে ধর্মের আসল আনুষ্ঠানিকতা। কারণ ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা মানব গোষ্ঠীর বৃহত্তর কল্যাণের জন্য। তবে আনুষ্ঠানিকতা কখনও ধর্ম নয়। যে আনুষ্ঠানিকতা বা নিয়ম-কানুন সমাজকে এগিয়ে নেয়, মানব সভ্যতায় স্রষ্টার কাছাকাছি হতে সাহায্য করে এবং সমাজের মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি তাই-ই স্রষ্টার মনোনীত। সুতরাং সাধারণ নীতি হচ্ছে, যা ইসলামী আইন দ্বারা সিক্ত করেছে এবং যা ভালো এবং সমাজ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য তা অনুসরণ যোগ্য এবং যা মন্দ, লজ্জ্বাজনক, যা সমাজের মঙ্গল বিধান করে না তা পরিহার করতে হবে। ধর্মের নামে অনেক অপব্যাখ্যা চালু হয়েছে আমাদের সমাজে, উদ্ভব হয়েছে মৌলবাদীদের; ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের সমাজের মৌলবাদী মুসলিমদের যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, 'মেয়েদের ঘরে আবদ্ধ রাখলেই ইসলাম রক্ষিত হবে।' আবার সমাজের অনেককে দেখা যায় বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বাসী যার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই যেমন মাজার পূঁজা ও ভাগ্য গণনায় বিশ্বাস করা ও পাথর ধারণ করা, বিশেষ ধরণের পোষাক পরিধান করা ইত্যাদি।
১৭০। যখন তাদের বলা হয়, 'আল্লাহ্ যে প্রত্যাদেশ দিয়েছেন তা অনুসরণ কর'; তারা বলে, 'না! আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের পথ অনুসরণ করবো।' কি! যদিও তাদের পিতৃপুরুষগণ ছিলো প্রজ্ঞাবিহীন এবং তারা সঠিক পথে পরিচালিত ছিলো না তথাপিও ?
১৭১। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের উপমা হচ্ছে ভেড়ার পালের ন্যায়-যারা শুধু হাঁকডাক ও চিৎকার ব্যতীত কিছুই শোনে না ১৭০। [এরা হচ্ছে] বধির, বোবা ও অন্ধ ১৭১। [সুতরাং] তারা হচ্ছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাবিহীন।
১৭০। যারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়, তাদের আত্মায় স্বর্গীয় আলো প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এ সেই আলো যা মানুষের আত্মাকে বিবেক, জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ করে। এ জ্ঞান দানের ক্ষমতা একমাত্র সর্বশক্তিমান ব্যতীত আর কারও নাই বিশ্বজগতে। ফলে অবিশ্বাসী ব্যক্তি ধর্মীয় জীবন যাপন পদ্ধতির মাধ্যমে অমিয় শান্তির বাণী হৃদয়ঙ্গম করতে অক্ষম হয়। এই ব্যক্তির উপমা হচ্ছে গরু ও ভেড়ার পালের মত। যেমন-গরুর পাল বা ভেড়ার পাল কিছুই বোঝে না, দেখে না, শোনে না। দেখে না শোনে না এই অর্থে যে তারা শুধু মাত্র রাখালের চিৎকার দ্বারা পরিচালিত হয়। রাস্তার বা পথের ভাল-মন্দ বা চিৎকার বা শব্দের বিভিন্ন ধ্বনি (অর্থাৎ আদর বা রাগ) কিছুরই পার্থক্য করতে এরা অপারগ। সেই রকম যে ব্যক্তি আল্লাহ্তে বিশ্বাসী নয়, তার হৃদয় বিবেকের আলো বা অন্তর্দৃষ্টি লাভে অক্ষম। অন্তর্দৃষ্টি না থাকার দরুণ চক্ষু থাকলেও কোনও ঘটনার গূঢ় অর্থ অনুধাবনে হবে ব্যর্থ, কান থাকলেও স্রষ্টার বাণীর গূঢ় অর্থ সে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে ব্যর্থ। 'They are void of wisdom'.
১৭১। আয়াত [২:১৮] তে বলা হয়েছে যে যারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে 'তারা হবে বধির, বোবা এবং অন্ধ'। তারা আর কখনও সুপথে আসবে না। যেহেতু তারা স্রষ্টাকে অস্বীকার করে, সুতরাং তারা আত্মার মূল উৎপত্তিকে অস্বীকার করে। স্রষ্টাকে বিশ্বাস করার ফলে, তার উপরে নির্ভর করার ফলে আত্মার ভিতরে জন্ম নেয় এক বিশেষ স্বর্গীয় অনুভূতি [State of mind]। এই অনুভূতির ব্যবহারের ফলে ব্যক্তির জীবনে অন্তর্দৃষ্টি জন্ম নেয়। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোঝার ক্ষমতা জন্মে। আত্মার ভিতরে জন্ম নেয় বিবেকের আলো-যে আলোর উৎপত্তি স্বর্গীয়। এই আলো তাকে পথ দেখায়। এই আলোই তাকে আল্লাহ্র বাণীর অর্থ বুঝতে সাহায্য করে। এই আলোই তাকে সন্ধান দেয় শান্তির অমিয় ধারার। তারা চর্ম চক্ষুর বাইরেও দেখেন, শ্রবণেন্দ্রীয়ের বাইরেও শোনেন। এরা জ্ঞানী ও বিবেকবান। কিন্তু আল্লাহ্কে অস্বীকার করা ব্যক্তি গরু-ছাগলের পালের মত যারা চক্ষু থেকেও পথের নিশানা চেনে না, কান থাকতেও ধ্বনির পার্থক্য করতে পারেনা।
১৭২। আল্লাহ্র নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও আল্লাহ্র এবাদতের অংশ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এক ধরণের অভ্যাস। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে আসি। মানুষের সমাজ সব সময়েই পরস্পরের উপরে নির্ভরশীল। এ ব্যতীত কোনও সমাজ চলতে পারে না। এই নির্ভরশীলতা স্বীকার করে নিলেই আত্মায় কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মায়। এটা একটা স্বর্গীয় গুণ। যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি প্রথমে কৃতজ্ঞ হবে অবশ্যই সে আল্লাহ্র নেয়ামতের প্রতিও কৃতজ্ঞ হবে। আল্লাহ্ কৃতজ্ঞ হতে বলেছেন কারণ কৃতজ্ঞতা মানুষের আত্মায় শান্তি আনে। অকৃতজ্ঞ আত্মায় সর্বদা হাহাকার বিরাজ করে ফলে শান্তি হয় তিরোহিত। অশান্ত আত্মা আল্লাহ্র বাণী ধারণে অক্ষম, আল্লাহ্র নেয়ামত সনাক্ত করতে অক্ষম। ফলে অকৃতজ্ঞ আত্মা হিংসা দ্বেষে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং আত্মার শান্তি হয় তিরোহিত। এই কারণে বলা হয় Gratitude for Allash's gift is one form of worship. তবে এই কৃতজ্ঞতা বোধের প্রথম পাঠ শুরু হয় জীবনের শৈশবে-সমাজে দেয়া নেয়ার মাধ্যমে।
১৭৩। 'মৃত প্রাণীর মাংস'-এ কথাটির দ্বারা বোঝানো হচ্ছে সেই প্রাণী যা নিজে নিজেই মৃত্যু বরণ করেছে, তাকে খাবার জন্য আল্লাহ্র নামে মারা হয় নাই। তবে এর মধ্যে অবশ্য মাছ এবং চিংড়ি জাতীয় প্রাণী পড়ে না।
১৭৪। খাদ্য সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ আছে [৫:৩-৪]; [৬:১২৪, ১৩৮-১৪৬] ইত্যাদি। যারা ফিকা শাস্ত্র অধ্যায়ন করেন তারা এ সম্বন্ধে বিশদ ব্যাখ্যা দান করেছেন। এখানে মাওলানা ইউসুফ আলী সাহেবের খাদ্য সম্পর্কীয় সাধারণ নিয়ম নীতি আলোচনা করাই উদ্দেশ্য-বিশদ ব্যাখ্যায় তিনি অংশ গ্রহণ করেন নাই।
মৃত জন্তুর মাংস এবং রক্ত যে কোনও সভ্য ব্যক্তির ঘৃণার উদ্রেক করবে। ঠিক সেই রকম শুকরের মাংসও করবে, কারণ শুকর অত্যন্ত নোংরা জায়গায় থাকতে ভালবাসে। যদিও বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব শুকরকে অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে তবু নিম্নলিখিত যুক্তিগুলির জন্য শুকরের মাংস অপবিত্র।
(১) যেহেতু শুকর জন্মগতভাবে অত্যন্ত নোংরা। সুতরাং নোংরা প্রাণীর মাংস ভক্ষকের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
(২) শুকরের মাংসে চর্বির পরিমান অত্যন্ত বেশি গরু এবং ছাগল অপেক্ষা যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
(৩) শুকরের মাংসের সাহায্যে বিভিন্ন রকম কৃমির রোগের বিস্তার লাভ করতে পারে। যেমন-Trichinosis.
(৪) দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রাণীর মাংস খাওয়া অবশ্যই যে কোনও কিতাবধারী জাতির জন্য হারাম।
১৭৫। 'They eat nothing but fire into their bellies' আক্ষরিক অনুবাদ শুনতে কিছুটা কঠোর এবং রসশূন্য মনে হয়। কিন্তু মূল আরবী শব্দের ভাব ঠিক তা নয়। ইসলাম সব সময়েই মধ্যপথ অবলম্বী, এমন কি খাদ্য ও পানীয়ের ব্যাপারেও ইসলাম মধ্যপথ অবলম্বী। ইসলাম, ধর্মের ব্যাপারে লাগাম ছাড়া স্বাধীনতার বিপক্ষে আবার অতিরিক্ত নিয়ম কানুন এবং আনুষ্ঠানিকতার বিপক্ষে। এ ব্যাপারে ইসলাম খুব সাধারণ এবং যুক্তিযুক্ত কয়েকটি নিয়ম নীতির কথা বলে। এসব নিয়ম-নীতি ভঙ্গ শুধু যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্ভাবনা তাই নয় আত্মার বিকাশের প্রভূত ক্ষতির সম্ভাবনা।
কেউ যদি আল্লাহ্র নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বা উদ্দেশ্য মূলকভাবে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ধর্মের নামে জাল-জুয়াচুরি করে, তার পরিণতি ভয়াবহ, নৈতিক ও আত্মিক অধঃপতন অনিবার্য। কারণ এ হচ্ছে পাপ, বিশ্বাস এবং নৈতিকতার বিরুদ্ধে। এই নৈতিক অধঃপতনকে উপমার সাহায্যে উত্থাপন করতে যেয়ে বলা হয়েছে, এ যেনো আগুন ভক্ষণ করার সামিল। আমাদের এই নশ্বর দেহে আগুন ভক্ষণ করা যে কী দুঃসহ যন্ত্রণা তা অনুধাবন করার জন্যই এই উপমার অবতারণা। আসলে হাশরের ময়দানে আত্মার যে যন্ত্রণা তা হবে নশ্বর দেহে আগুন ভক্ষণ করার যন্ত্রনার থেকেও বেশী। দৈহিক যন্ত্রণা সে যন্ত্রণার কাছে ম্লান হয়ে যাবে। সে যন্ত্রণা আরও বেড়ে যাবে কারণ বিচারক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্, তার সমস্ত রহমত ও করুণা থেকে তাদের বঞ্চিত করবেন। এমনকি সামান্য প্রশ্নও তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে না।
১৭৬। [তাদের ধ্বংসের] কারণ আল্লাহ্ সত্যসহ কিতাব [কোরআন] প্রেরণ করেছেন, কিন্তু যারা কিতাবের মাঝে মতভেদ অনুসন্ধান করে, তারা [মতভেদের জন্য] ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে [যা প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বহুদূরে] ১৭৬।
১৭৬। এতক্ষণ আলোচনার বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ ছিল জীবন ধারণের, বিশেষভাবে খাদ্য বস্তু সম্পর্কীয় আলোচনার মধ্যে। দেহ এবং আত্মা এই দুই-ই মিলেই পৃথিবীর জীবন। দেহের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আত্মার বিকাশ ঘটানোই হচ্ছে পৃথিবীতে আমাদের বাসস্থানের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। দেহ ব্যতীত আত্মার বিকাশ অসম্ভব। তাই দেহের প্রকৃত পরিচর্যার নিয়মাবলী এখানে আলোচিত হয়েছে। খাদ্য, পানীয়, যৌনসংযম ইত্যাদি বিধি নিষেধ না মানলে শুধু যে দেহ ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা নয়, দেহের ভিতরে যে আত্মার বাস সে আত্মার বিকাশেরও অবনতি ঘটে। তাই এই আয়াতটিতে [২:১৭৬] দৈহিক নিয়মাবলী থেকে নৈতিকতা এবং বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। যেমন-যে প্রচণ্ড মদ খায় এবং ব্যাভিচারে অভ্যস্ত তার আত্মার সুস্থ বিকাশ অসম্ভব। যে ব্যক্তি ঘুষ খেয়ে বা হারাম পয়সায়, বা জাল-জুয়াচুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে তার আত্মায় আল্লাহ্র নূর প্রবেশে বাঁধা পায় ইত্যাদি। সুতরাং ধর্মের সাথে জীবন ধারণের রীতিনীতি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত।
এই আয়াতটিতে আল্লাহ্ বলেছেন যে এই পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য যে নিয়মাবলী তিনি প্রেরণ করেছেন তা মানা কর্তব্য। কিন্তু এ নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে তারা ধর্মের মূল সুর থেকে সরে যায়। যারা ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা ও নিয়ম-নীতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তারাই সাম্প্রদায়িকতায় পরিণত হয় এবং পরিণতিতে ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। ফলে এরা মৌলবাদীতে পরিণত হয়। সুতরাং জীবন ধারণের রীতিনীতিই [খাদ্য, পানীয়, পর্দ্দা, বিয়ে ইত্যাদি] যেনো ধর্মে পরিণত না নয়। তাহলে ধর্মের মূল সূর হচ্ছে আত্মার বিকাশ, সেই পরম করুণাময়ের সান্নিধ্যলাভ, সেই বিশ্বাস, সেই মানসিকতা, সেই অনুভব ক্ষমতা আমাদের আত্মাকে আলোকিত করতে পারবে না। আমরা অন্ধকারে হারিয়ে যেয়ে নিজেদের মধ্যে শুধু বিভেদই সৃষ্টি করতে পারবো। এ কথাটাই এই আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
রুকু - ২২
১৭৭। 'পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ ফিরানোতে কোন পূণ্য নাই।' এ কথাটির অর্থ পশ্চিমা বিশ্ব পূর্বদিকে নামাজ পড়ে কারণ তাদের কাবা পূর্বদিকে আবার কাবার পূর্বদিকে যারা অবস্থিত তারা পশ্চিমদিকে নামাজ পড়ে। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক নামাজ পড়ার মধ্যে ধর্ম নাই। এই আয়াতটিকে [২:১৭৭] পূর্বের আয়াতের সম্প্রসারণ বলা চলে। কারণ এখানে আল্লাহ্ বিশেষ গুরুত্বের সাথে সাবধান করে দিচ্ছেন আনুষ্ঠানিকতাকে যারা ধর্ম বলে বিবেচনা করে তাদের। শুধুমাত্র নামাজ, রোযা, পানাহার, চলাফেরা, পোষাক-পরিচ্ছদ এগুলো ধর্ম নয়। এগুলো কতগুলো নিয়ম যা শরীর ও মনের জন্য ভাল যা মানলে ধর্মের অন্তরে প্রবেশ করতে সুবিধা হয়। আল্লাহ্ এখানে পরিষ্কার ভাষায় আল্লাহ্ প্রেমিকদের মানদন্ড বর্ণনা করেছেন। এ মানদণ্ডে কিন্তু পোষাক-পরিচ্ছদ, (নারী বা পুরুষ) খাদ্য, চলাফেরা, আচার আচরণ কিছুই উল্লেখ করা হয় নাই।
(১) যাদের বিশ্বাসে আছে আন্তরিকতা। অর্থাৎ যারা সুখে-স্বাচ্ছন্দে, বিপদে-আপদে, ভাল-মন্দে, দুঃখে-কষ্টে জীবনে সর্বাবস্থায় শুধু এক আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল, এক আল্লাহ্তে আস্থাশীল এক আল্লাহ্তে বিশ্বাসী। তিনিই একমাত্র ইহকালের ও পরকালের মালিক এই বিশ্বাস অন্তরে রাখা।
(২) এই বিশ্বাসকে কর্মে পরিণত করতে হবে। আল্লাহ্র কাছে আল্লাহ্ ভীরুরূপে উপস্থাপন করার উপায় হচ্ছে আল্লাহ্কে খুশী করার জন্য জনহিতকর কাজে দান করা। এ দান শুধু মাত্র টাকা পয়সা দান নয়। আল্লাহ্ যাকে যা নেয়ামত দান করেছেন সেই নেয়ামত জনহিতার্থে ব্যবহার করার নামই হচ্ছে দান।
(৩) সালাত কায়েম করলে
(৪) প্রকৃত এবং ভাল নাগরিক হতে হলে প্রত্যেককে যাকাত দিতে হবে।
(৫) মুসলমানের প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সামাজিক বাধ্যবাধকতা (Social Obligation) আছে এবং তা তাকে পালন করতে হবে। প্রতিশ্রুতি পালনই হচ্ছে মুসলমানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(৬) আমাদের প্রত্যেককে বিপদে দুঃখে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে এবং সর্বশক্তিমান দয়াময়ের করুণা প্রত্যাশা করে দৃঢ়তার সাথে বিপদকে অতিক্রম করতে হবে।
এই ছয়টি মানদন্ড (Criteria) যার চরিত্রে দেখা যাবে তিনিই মুসলমান; তিনিই বিশ্বাসী। শুধুমাত্র পোষাক-পরিচ্ছদ (টুপি, দাড়ি, বোরখা ইত্যাদি) বা খাদ্য দ্রব্য, বাছ বিচার, পূর্ব বা পশ্চিমে মুখ ফিরানো [অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে নামাজ আদায় করার মধ্যে কোনও ধর্ম নাই] ধর্ম আছে উপরের ছয়টি মানদণ্ডে। যদিও মনে হয় এগুলি প্রত্যেকটি পৃথক পৃথক গুণাবলী কিন্তু তা নয় এরা এক সূতোয় গাঁথা। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে একটি আর একটির সম্পূরক।
যে বিশ্বাস, যে আনুগত্য আত্মার অন্তস্থল থেকে উৎসারিত নয় তা স্রষ্টার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
১৭৮। (১) 'বিশ্বাস' বা ঈমান কোনও মুখের কথা নয়। শুধুমাত্র মৌখিকভাবে আল্লাহ্র প্রতি যে বিশ্বাস স্থাপন করা হয়, তা কোনও বিশ্বাসই নয়। বিশ্বাস হল অন্তরের এক বিশেষ অবস্থা [State of mind] এটা শুধুমাত্র মুখের কথা নয়। বিশ্বাস হল সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র উপর নির্ভরশীলতা, সর্বাবস্থায় সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে তার মঙ্গলময় উপস্থিতি আত্মার ভিতরে অনুভব করা, এই বিশ্বাস সর্বান্তকরণে করা যে, মঙ্গলময় প্রভু, ব্যক্তির সর্বসত্তা ঘিরে আছেন। তারই করুণার প্রত্যাশা করা, তারই ভালবাসা অনুভব করা, তার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করা। যখন বিশ্বাসের ভিত্তিমুল আন্তরিক হয় তখন এই চাকচিক্যময় পৃথিবীর রূপ আমাদের চোখে বদলে যাবে। আমাদের মাঝে অন্তর্দৃষ্টির উদ্ভব হয় [Spiritual insight]। আমরা পৃথিবীর ভোগ-লালসা, আনন্দ-উল্লাস, প্রভাব-প্রতিপত্তি সব কিছুই যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বেষ্টন করে থাকে, যার জন্য আমরা প্রাণপণে যত্নসহকারে পরিশ্রম করি, যার জন্য আমরা লালায়িত, তার রূপ যাবে বদলে। এসবই মনে হবে অর্থহীন। শুধু তখনই আমরা বুঝতে পারবো পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী। এটা হচ্ছে শিক্ষানবীসকাল পরকালের জন্য। আমরা বুঝতে পারবো আল্লাহ্র কিতাব, তার প্রেরিত রাসূল, ফেরেশ্তা সবই আমাদের পরলৌকিক মঙ্গলের জন্য। পৃথিবীর শিক্ষানবীসকাল নিরাপদে অতিক্রম করার জন্য মহান আল্লাহ্র করুণার স্পর্শ আমরা অনুভব করতে পারবো। আমাদের আত্মার ভিতরে অন্তর্দৃষ্টির উদ্ভব হবে [Spiritual insight]। একেই বলা হচ্ছে বিশ্বাসের আন্তরিকতা [টিকা: ১৭৭ দেখুন]।
১৭৯। (২) 'দান'বা 'ব্যয়' আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসা থেকে, মানুষের মঙ্গলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য যা কিছু করা হয় তাই 'দান' কিন্তু এই দানের পিছনে ব্যক্তির নিয়ত যদি আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসা না হয়, যদি আল্লাহ্কে খুশী করার ইচ্ছা না হয়ে নাম, যশঃ ও সুখ্যাতি অর্জনই মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তবে তা আল্লাহ্র কাছে দান বলে পরিগণিত হবে না। এখানে কাদের দান বা দয়া করা যায় তাদের কথা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। (১) নিকট আত্মীয়, (২) এতিম এই শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। এতিম বলতে আমরা শুধুমাত্র পিতৃ-মাতৃহীন বালক-বালিকাকে বুঝি। কিন্তু ব্যাপক অর্থে এতিম বলতে বুঝায় সেই ব্যক্তি সমাজে যার কোন সহায় (Support) বা সম্বল (Wealth) নাই। (৩) সেই ব্যক্তি অভাবগ্রস্থ যার সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিন্তু কারও কাছে সে সাহায্য প্রার্থনা করে না। এই সাহায্য শুধুমাত্র অর্থের নিক্তিতে মাপা যাবে না, এ সাহায্যে যে কোনও ধরণের হতে পারে যেমন অশিক্ষিত ব্যক্তির শিক্ষার প্রয়োজন, অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার প্রয়োজন। এখানে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এদের খুঁজে বের করা এবং যারা সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের উপরে এদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। (৪) পথচারী, অর্থাৎ আজকের যুগে একদেশের লোক অন্যদেশে হর-হামেশা যাতায়াত করে। নূতন দেশে, নূতন পরিবেশে নূতন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে যে কষ্ট ও পরিশ্রম তা লাঘব করার জন্য সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করা। (৫) সাহায্য প্রার্থী, অর্থাৎ আর্থিক সাহায্যে ছাড়াও সমাজে আমরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আর্থিক সাহায্য ছাড়াও যে সাহায্যের প্রয়োজন একে অপরের, সে সাহায্য করা প্রয়োজন। যেমন-সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে-শাদী ইত্যাদি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে দুর্গত এলাকায় কাজ করা ইত্যাদি। (৬) ক্রীতদাসের মুক্ত করা। আজকের যুগে ক্রীতদাস প্রথা নাই। কিন্তু ঠিক সেভাবে ক্রীতদাস প্রথা বিরাজ না করলেও সময়ের ব্যবধানে এর ধরণ পাল্টে গেছে। মানুষ মানুষের উপরে যে নির্যাতন করে সেও এক ধরণের ক্রীতদাস প্রথা। যেমন-আমরা দেখছি বসনিয়াতে মানুষের নির্যাতন। ঠিক একইভাবে বলা যায় বাংলাদেশে বর্তমানে নারী নির্যাতন 'আইয়ামে জাহেলিয়াতের' স্তরে প্রায় পৌঁছে গেছে। আত্মার স্বাধীনতা যেখানে ব্যাহত হয় তাই-ই হচ্ছে দাস প্রথা। কুরআনের বাণী সর্বকালের, সর্বযুগের। তাই আক্ষরিক অর্থে দাস প্রথার মধ্যে একে সীমাবদ্ধ রাখলে আল্লাহ্র বাণীর অবমাননা করা হয়। যেখানেই মানবতার অবমাননা সেখানেই মানবতার মুক্তির জন্য দান করা কুরআনের নির্দেশ। মানবতার অবমাননাই হচ্ছে ক্রীতদাস প্রথা' যা আজকের যুগেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরূপে বিরাজমান।
১৮০। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপরায়ণ এবং ব্যক্তিগত দান করেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। ধর্ম-কর্ম পালন এবং দান এসবই ব্যক্তিগত না হয়ে হতে হবে সমষ্টিগতভাবে, সুশৃঙ্খলভাবে যেনো সমাজে এর প্রতিফলন ঘটে। মুসলিম প্রজাতন্ত্রে অবশ্যই নামাজ, রোজা, যাকাত অর্থাৎ আল্লাহ্র ইবাদত সমষ্টিগতভাবে হওয়া প্রয়োজন শুধু তাই-ই নয়, প্রজাতন্ত্রের সমস্ত কার্যপ্রণালী হবে কল্যাণমুখী; এবং এই কল্যাণমুখী কাজে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের (নারী, পুরুষ, নির্বিশেষে) অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকেই যেনো সমাজের কাছে দেয় তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করে। মুসলমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে দেয় প্রতিশ্রুতি পালন।
১৮১। মুসলমানদের চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। তা হচ্ছে ধৈর্য্য এবং চরিত্রের দৃঢ়তা। একে এভাবে বর্ণনা করা যায়, 'Preserve the dignity of man, with soul ercet'-Burns. এই গুণটির বর্ণনা করতে যেয়ে কুরআন শরীফে তিনটি বিশেষ অবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে।
(১) শারীরিক কষ্ট এবং যন্ত্রণা।
(২) যে কোনও প্রতিকূল রোগ-শোক, অর্থ-কষ্ট, অভাব-অনটন ইত্যাদি অবস্থা। জীবনের চলার পথ সব সময়ে মসৃণ নয়। নানা প্রকার দুঃখ-ব্যাথা, ঘাত-প্রতিঘাতে জীবনের চলার পথকে করে কণ্টকাকীর্ণ। অন্যায়-অবিচার আমাদের করে দিশাহারা। সব সময়েই আল্লাহ্র উপরে অবিচল আস্থা রেখে দৃঢ়তার সাথে দুঃখের রাস্তা অতিক্রম করা।
(৩) যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি সময়ে আল্লাহ্র উপরে আস্থা রেখে ধৈর্য্য ধারণ করা।
১৮২। লক্ষ্য করুণ এই আয়াতটিতে এবং এর পরবর্তী আয়াতটিতে ইসলাম পূর্বাবস্থায় প্রতিহিংসার যে ব্যাপকতা তার ভয়াবহতা অনেকটা হ্রাস করা হয়েছে। এই আয়াতটিতে ন্যায় এর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সমতার ভিত্তিতে তবে কেউ যদি ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারে সেটা হচ্ছে সর্বোত্তম। 'কিসাস' শব্দটির অর্থ হচ্ছে 'জানের বদলে জান' এ ধরণের হত্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইসলামের পূর্বে আরবে গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী বদলা বংশ পরম্পরায় চলতো। তাতে অনেক নিরাপরাধ লোকও মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। ইসলাম তা অনুমোদন করে না। ইসলামের নিয়ম হচ্ছে 'জানের বদলে জান'। তবে সর্ব সম্মতিক্রমে দয়া প্রদর্শন হচ্ছে সর্বোত্তম, এমনকি জানের পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ দানও আল্লাহ্র কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য।
ইসলামে সমতার আইনে [Law of equality] তিন ধরণের লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তি, এখানে মেয়ে বা পুরুষ, ধনী বা দরিদ্রের কোন পার্থক্য নাই। একজন ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিবর্তে দু'জন গরীব স্বাধীন ব্যক্তি হতে পারে না। একজন ক্রীতদাসের পরিবর্তে একজন ক্রীতদাস, একজন মহিলার পরিবর্তে একজন মহিলা। স্বাধীন মেয়েদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এর কারণ এটা নয় তারা সমাজে ছোট বা হেয়। তারা সন্তানের মা। এই হিসেবে সমাজে তাদের অন্য আর এক অবস্থান আছে। ইসলামে ন্যায়-নীতি এরকম সুশৃঙ্খল যে, একজনের হত্যার পরিবর্তে বহু জানের সমাপ্তি হতে পারে না-যা সে সময়ে আরবদের মধ্যে গোত্রগত বিবাদের ফলে ঘটতো। কিন্তু যদি ক্ষতিগ্রস্থ দল ক্ষমা প্রদর্শন করে সেটাই সর্বোত্তম।
১৮৩। 'কিসাস' প্রযোজ্য শুধুমাত্র বিবাদ বিসংবাদ, ঝগড়া-ঝাটির সময়ে। ভুলক্রমে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ব্যাপারে 'কিসাস' প্রযোজ্য নয়।
১৮৪। 'ভাই' এই আয়াতের এই শব্দটির অর্থ অনেক ব্যাপক ইসলামে সবাই ভাতৃবন্ধনে আবদ্ধ।
১৮৫। যদি ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ ক্ষমা করে দেয়, তবে অন্য পক্ষের সব শাস্তি মাফ হতে পারে।
১৮০। তোমাদের মধ্যে কারও মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে, যদি তার বিষয় সম্পত্তি থাকে, তবে ন্যায় সঙ্গত প্রথামত তার পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের জন্য ওসিয়াত করার বিধান তোমাদের দেয়া হলো। এটি আল্লাহ্ ভীরুদের জন্য একটি কর্তব্য ১৮৬।
১৮৬। মৃতব্যক্তির সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু এটি একটি ভাল পদ্ধতি যে, মৃত্যুপথযাত্রী পুরুষ বা মহিলা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় তার পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারও সম্বন্ধে ওসিয়ত করে যেতে পারে। এটি হতে হবে তার কাছের লোকদের প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশস্বরূপ এবং একান্ত আন্তরিকতার সাথে, কারও প্রতি অন্যায় করার নিয়ত যেনো তাতে না থাকে। এই ওসিয়ত অবশ্যই ন্যায়ের ভিত্তিতে হতে হবে।
১৮২। কিন্তু কেউ যদি ওসিয়াতকারীর পক্ষপাতিত্বের কিংবা অন্যায়ের আশঙ্কা করে ১৮৭, অতঃপর সে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দেয়, এতে তার কোন পাপ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বার বার ক্ষমাশীল এবং পরম করুণাময়।
১৮৭। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যতদিন পর্যন্ত ওয়ারিশগণের অংশ কুরআনের আয়াত দ্বারা [৪:১১] নির্ধারিত হয় নাই ততদিন পর্যন্ত নিয়ম ছিল মৃত্যুপথযাত্রী তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য ওসিয়ত করে যেতেন। অবশিষ্ট সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে বণ্টিত হত। সে নির্দেশটিই এ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।
১৮৮। 'যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিলো' এই কথাটির অর্থ এই নয় যে মুসলমানদের রোজা ও পুর্ববর্তী জাতিসমূহের রোজার নিয়মকানুন বা দিন একই রকম। এ কথাটির দ্বারা এই বোঝানো হচ্ছে যে, রোজা মানে আত্ম সংযম যা পূর্ববর্তী জাতিসমূহের প্রতিও নাজিল হয়েছিল। রোজার মূল সুর বা উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মসংযম। জীবনের প্রতিটি ব্যাপারেই আত্মসংযমই হচ্ছে রোজার মূল বিয়ষবস্তু।
১৮৯। আয়াত [২:১৮৪] পড়ার সময়ে আয়াত [২:১৮৫-১৮৮] গুলিও পড়তে হবে যেনো রোজা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা করা যায়। মুসলমানদের কাছে রোজা আত্মবঞ্চনা বা অত্যাচার নয়। মুসলমানদের রোজা অন্য ধর্মের লোকদের থেকে অনেক বেশী কঠোরভাবে পালন করতে হয়। রোজার সময়ে দিনের বেলা আহার, পানীয়, যৌন প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকতে হয়। যারা অত্যধিক ভোজন বিলাসী, রোজার নিযম তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কারণ দেখা যায় অতিভোজনের ফলে তারা বেশির ভাগ সময়ে মেদবহুলতায় ভোগেন। তবে রোজার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আধ্যাত্মিক দিক। খাদ্য, পানীয় এবং যৌনপ্রবৃত্তি মানুষের ধর্ম, যা পশুর প্রবৃত্তির সমান। এই প্রবৃত্তির দাস যারা তাদের মধ্যে আত্মিক চেতনার জন্ম লাভ করে না। তাই যখন রোজার মাধ্যমে খাদ্য, পানীয় এবং যৌন প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে সংযত রাখা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে আত্মার মধ্যে অন্যান্য রিপু দমন করাও সহজ হয়ে ওঠে। যখন রিপুসমূহ আমাদের করায়ত্ব হয় তখনই আত্মার ভিতরে জন্মলাভ করে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা। এই সান্নিধ্য লাভ সম্ভব হয় প্রার্থনা (নামাজ) রোজা, আল্লাহ্র ধ্যান এবং দানের মাধ্যমে। অর্থাৎ আল্লাহ্র এবাদতের মাধ্যমে। এই এবাদত হতে হবে আন্তরিক। শুধুমাত্র লোক দেখানো বা আনুষ্ঠানিক হলে চলবে না।
১৯০। পর্যটন বা সফর কতটুকু হবে সে সীমারেখা কুরআনে উল্লেখিত নাই। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর হাদীস এবং সাহাবীগণের আমলের উপর ভিত্তি করে ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) এবং অন্যান্য কিছু সংখ্যক ফিকহ্বিদের মতে এ সফর কমপক্ষে তিন মনজিল দূরত্বের হতে হবে। অর্থাৎ একজন লোক স্বাভাবিকভাবে পায়ে হেঁটে তিনদিন যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ততটুকু দূরত্বের সফরকে সফর বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগের আলেমগণ 'মাইল' হিসেবে এ দূরত্ব আটচল্লিশ মাইল নির্ধারণ করেছেন। অবশ্য শুধু মাইল হিসেবে এটাকে ধার্য করলে ঠিক হবে না। কারণ গরুর গাড়ীতে ৮-৯ মাইল অতিক্রম করা অপেক্ষা পায়ে হেঁটে ৮-৯ মাইল অতিক্রম করা অনেক বেশী কষ্টকর। আবার ঘোড়ায় চড়ে ৮-৯ মাইল যাওয়া কিছুই নয়, তার থেকে সহজ মটর গাড়ীতে যাওয়া বা এরোপ্লেনে যাওয়া। সুতরাং বর্তমান যুগে সফরের কষ্ট নির্ভর করে যানবাহনের উপরে, সেখানে হোটেল ব্যবস্থাপনার উপরে। মওলানা ইউসুফ আলীর মতে সফরের মান বা নীতি নির্ধারণ করা উচিত পরিবেশ অনুযায়ী।
১৯১। যাদের রোজা রাখতে কষ্ট হয়, যেমন-বৃদ্ধ বা অসুস্থ লোক। এর মধ্যে সন্তান সম্ভবা মহিলা বা যারা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান তারাও হতে পারেন। এদের জন্য এই আয়াতটি প্রযোজ্য, কিন্তু এ ব্যাপারে সবাই একমত নয়। অনেকে মনে করেন পরবর্তীতে তাদের সমসংখ্যক দিন রোজা রাখতে হবে যখন তারা সুস্থ বোধ করবেন।
১৯২। 'ফোরকান' অর্থাৎ মানদণ্ড। ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী পথনির্দেশ। ন্যায়ের মানদণ্ড ও অন্যায়ের মানদণ্ড [দেখুন ২:৫৩ এবং এর টিকা]।
১৯৩। রমজানের রোজার নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে যতবার বলা হয়েছে ততবার এর সাথে আর একটি উপদেশ সংযুক্ত হয়েছে আর তা হচ্ছে রোজার আধ্যাত্মিক দিক অনুধাবন করা। অর্থাৎ যদিও রোজা একটি কষ্টসাধ্য এবাদত কিন্তু আল্লাহ্ রোজাকে ফরজ করা সত্ত্বেও এর সাথে আমাদের জন্য (১) বিশেষ সুযোগ সুবিধা দান করেছেন বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে এবং (২) বারে বারে উল্লেখ করেছেন রোজার আধ্যাত্মিক দিকটির প্রতি। আল্লাহ্র ওয়াস্তে রোজা রাখা হচ্ছে ব্যক্তির নিজের আত্মা পরিশুদ্ধ করার উপায়। পৃথিবীর চলার পথ, জীবন ধারণের পথ কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। লোভ লালসা, আসক্তি আমাদের চালিত করতে চায় পাপের পথে। রিপুসমূহ আমাদের ভোগের কর্দমাক্ত পথে চালিত করে। ফলে আত্মা তার মঞ্জিল থেকে দূরে সরে যায়। আত্মা চালিত হয় অন্ধকার পথে। একমাত্র আল্লাহ্র নিয়তে, আল্লাহ্কে খুশী করার জন্য যখন আমরা রোজা রাখি, তখনই শুধুমাত্র আত্মা এইসব পাপের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারে। রিপু সকল হয় অবদমিত, ফলে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ চলা শুরু হয়। আত্মা প্রবেশ করে অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে। রোজার এই বিশেষ নিহিতার্থ ব্যতীত রোজার কোন মূল্য নাই। শুধুমাত্র উপবাস হচ্ছে সেই মৃত ঝিনুকের মত যার মধ্যে কোনও শাঁস নাই। সুতরাং এই পবিত্র মাস কোনও কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। এ হচ্ছে আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামত তাঁর বান্দাদের প্রতি। আমাদের এই বিশেষ নেয়ামতের জন্য আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। তাঁর মহিমা প্রচার করা উচিত।
১৮৭। সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ করা হলো। তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ [স্বরূপ], তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ [স্বরূপ] ১৯৫। আল্লাহ্ জানেন তোমরা পরস্পরের সঙ্গে গোপনে যা করতে। কিন্তু তিনি তোমাদের দিকে ফিরেছেন এবং ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তাদের সাথে সঙ্গত হও, এবং আল্লাহ্ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা কর ১৯৬। এবং আহার কর এবং পান কর যতক্ষণ না ঊষার শুভ্র রেখা রাত্রির কৃষ্ণরেখা থেকে স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত হয় ১৯৭। অতঃপর নিশাগম পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর ১৯৮। কিন্তু মসজিদে ই'তিকাফের সময়ে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সঙ্গত হয়ো না ১৯৯। এগুলি আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা। সুতরাং এগুলির নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ্ মানব জাতির নিকট তাঁর নিদর্শনাবলী সুস্পষ্ট করেন; যেনো তারা আত্মসংযম শিক্ষা লাভ করে।
১৯৪। আয়াত [২:১৮৬] এবং আয়াত [২:১৮৮] দু'টি রমজানের রোজার সাথে সংশ্লিষ্ট, ১৮৬ তে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে রমজানের আধ্যাত্মিক দিকটির প্রতি। রোজা সংক্রান্ত ইবাদতে অবস্থা বিশেষে অব্যহতি দান এবং বিভিন্ন সহজতা সত্ত্বেও কিছু কষ্ট বিদ্যমান রয়েছে। এ কষ্টকে সহজ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, আমি বান্দাদের সন্নিকটে রয়েছি। আল্লাহ্ আমাদের প্রার্থনার জবাবে তাঁর সান্নিধ্যের আশ্বাস দিচ্ছেন। এর থেকে বড় পাওয়া আর বান্দার জীবনে কি হতে পারে? আয়াত [২:১৮৮] তে বলা হচ্ছে যে, অন্যায়ভাবে যেন অন্যের সম্পত্তি গ্রাস না করি অর্থাৎ হারাম খাবার না খাই।
১৯৫। এই আয়াতটি থেকে বোঝা যায় ইসলামে নারী ও পুরুষকে আল্লাহ্ সমান মর্যাদা দিয়েছেন। নারী ও পুরুষ একে অপরের ভূষণ। অর্থাৎ পরস্পরের বন্ধু, সুখে-দুঃখে পরস্পরের অংশীদার, বিপদে-আপদে পরস্পরের সান্ত্বনা ও অবলম্বন। অর্থাৎ একে অপরের সম্পূরক বা অংশ। পোষাক যেরূপ শরীরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্কও তাই, একে অপরের পোষাকের ন্যায়। কেউই বড় নয় বা কেউই ছোট নয়। এখানে পোষাকের উপমা দেয়া হয়েছে কারণ পোষাকের ব্যবহার হচ্ছে লজ্জা নিবারণ ও সৌন্দর্য্যবৃদ্ধির জন্য। ঠিক সেরকম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ সবকিছুতে পরস্পর সমতার ভিত্তিতে জীবনের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও বাহিরের নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে আত্মরক্ষা করা। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে সমঝোতার (Mutuality) ভিত্তিতে।
স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে সহবাসের প্রশ্নটিও এসে যায়। এটা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার, তাই আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে এ ব্যাপারে সততা এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গীর (Openness) আশ্রয় নিতে। মিথ্যা এবং আত্মবঞ্চনাকে পরিহার করতে বলা হয়েছে। যৌন অনুভূতিকে খাদ্য এবং পানীয় এর সাথে এক শ্রেণীভূক্ত করা হয়েছে। কারণ খাদ্য, পানীয় এবং যৌন অনুভূতি এ তিনটিই পশু এবং মানুষ উভয়েরই মধ্যে সমভাবে বর্তমান। সুতরাং এ তিনটি প্রবৃত্তিকে পশু প্রবৃত্তি বলা চলে। সুতরাং রমজান মাসে দিনের বেলায় এই প্রবৃত্তিগুলিকে অবদমিত রাখতে হবে, তবে রাতের বেলায় এসবে নিষেধ নাই এবং এর জন্য লজ্জিত হওয়ার কোন কারণ নাই। কারণ প্রবৃত্তির জন্য আমরা দায়ী নই। এটা আল্লাহ্ প্রদত্ত। আমাদের প্রতি আল্লাহ্ আদেশ দিয়েছেন প্রবৃত্তি ও রিপুসমূহকে নিজের আয়ত্বে আনতে। আমরা যেনো প্রবৃত্তি ও রিপুর দাস না হই। তাই রমজানের একমাস এর চর্চা হয়।
১৯৬। 'এবং আল্লাহ্ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা কর'। এই লাইনটি সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ আছে। বিভিন্ন অনুবাদক একে বিভিন্ন ভাবে অনুবাদ করেছেন। কেহ কেহ বলেন এর অর্থ এই যে ঊষা সমাগমের পূর্ব পর্যন্ত পানাহার এবং যৌনসঙ্গম বৈধ। আবার অনেকের মতে এর অর্থ হচ্ছে তোমাদের জন্য যা বৈধ করা হয়েছে তা ভোগ কর এবং রোজার যা মূল উদ্দেশ্য তার অনুসন্ধান কর। রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রিপুর দমন করা যাতে আত্মার উন্নতি লাভ ঘটে, ফলে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ সহজ হয়। অর্থাৎ আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের চেষ্টা করাই হচ্ছে রোজার মূল উদ্দেশ্য।
১৯৭। যারা প্রকৃতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত তারা জানে, প্রতুষ্যের রূপমাধুর্য কী মনোহর। প্রথমে দেখা দেয় পূর্বদিগন্তে সাদা অনির্দিষ্ট আলোকের চিকন চিকন রেখা তারপর একটি অন্ধকার সবকিছু গ্রাস করে ফেলে, পরে এই অন্ধকারের বুক চিরে ধীরে ধীরে দেখা দেয় একটি রক্তিমাভ সাদা সুনির্দিষ্ট আলোক রেখা। এটিই হচ্ছে সত্যিকার প্রভাত বা 'সুবহ্ সাদিক'। এরপর থেকেই রোজার সময় শুরু হয়।
১৯৮। 'নিশাগম' আরবীতে এই অর্থই হয়। তবে রাসূলের (সাঃ) শিক্ষা ও প্রত্যক্ষ রোজা রাখার নিয়ম থেকে জানা যায় যে এর সঠিক অর্থ হবে, 'সূর্যাস্ত পর্যন্ত'।
১৯৯। এই আয়াতটি দ্বারা 'ইহ্তিকাফ' এর উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে মসজিদে অবস্থান করে এবাদত বন্দেগীতে মশগুল হওয়া। আমাদের নবী (সাঃ) রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদেই অবস্থান করতেন।
২০১। জৈবিক প্রয়োজন তিনটি খাদ্য, পানীয় এবং যৌন অনুভূতি। এই তিনটি প্রয়োজন পশু, মানুষ সকলেরই সামন কিন্তু মানুষের পশু অপেক্ষা আর একটি কামনা প্রবল তা হচ্ছে অর্থ ও সম্পদের আকাঙ্ক্ষা। সৎ পথে অর্থ উপার্জন ইসলাম অনুমোদন করে। শুধু অনুমোদনই করে না উৎসাহিত করে। কিন্তু যখন এই অর্থ সম্পদ উপার্জন অসৎ পথে হয় তখনই তা পাপের পথ বা পাপে পর্যবসিত হয়। সাধারণভাবে আমরা সৎপথ বলতে বুঝি চুরি, ডাকাতি না করা, এবং তহবিল তসরুফ না করা। একজন সৎ মানুষ এই তিনটি থেকে বিরত থাকাকেই মোটামুটিভাবে সৎ পথ বলে ধারণা করেন। কারণ মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য এই তিনটি উপায়েরই আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনটি উপায়ই হচ্ছে অর্থলোভ চরিতার্থ করার উপায়। কিন্তু এখানে আরও দুটি সুক্ষ্ণ লোভের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলির একটা হচ্ছে ঘুষ দেওয়া। অর্থাৎ অন্যের সম্পদ গ্রাস না করে নিজের সম্পদ বিচারক বা কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ঘুষ প্রদান করা যেনো অন্যায়ভাবে সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে বা আর্থিক সুবিধা লাভ করতে পারে কিন্তু আইন তাকে ধরতে পারে না। এরকম উদাহরণ আমাদের সমাজে অজস্র। দ্বিতীয়টি অনুবাদ করা হয়েছে 'একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করো না'। একথাটির অর্থ এই দাঁড়ায় যে, জনগণের সম্পদ (Public Property) অন্যায়ভাবে গ্রাস না করা। কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দেওয়া, ঘুষ খাওয়া, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এগুলি সবই অসৎপথে উপার্জিত অর্থ। অসৎ পথে উপার্জিত অর্থ হারাম।
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, 'যখন কোন বান্দা হারাম মাল খায় এবং সদ্কা খয়রাত করে, তা কবুল হয় না। যদি তা থেকে ব্যয় করে, তবে তাতে বরকত হয় না। যদি তা উত্তরাধিকারী ওয়ারিশানের জন্য রেখে যায় তবে তা জাহান্নামে যাওয়ার পক্ষে তার জন্য পাথেয় হয়।' নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মন্দ বস্তু দ্বারা মন্দ আমলকে বিধৌত করেন না। অবশ্য সৎ কর্ম দ্বারা অসৎ কর্মকে ধুয়ে দেন। আমাদের সমাজে হারাম খাওয়ার সম্বন্ধে সাধারণ ব্যক্তিদের যা ধারণা তা হচ্ছে শুকরের মাংস, মদ এবং আল্লাহ্র নাম ব্যতীত জবাই করা পশুর গোশ্ত খাওয়া হারাম। এ ব্যাপারে সবাই কঠোরভাবে অনুশীলন করতে চেষ্টা করে। কিন্তু অসৎপথে [ঘুষ, চোরাকারবারী, জনগেণর সম্পদ] অর্জিত অর্থকে হারাম বলে গণ্য করা হয়না। অসৎ পথে অর্জিত অর্থ সমাজের শৃঙ্খলা ও শান্তি বিঘ্নিত করে। শুকরের মাংস, মদ ও বেহালাল পশুর মাংস অপেক্ষাও অসৎ পথের উপার্জিত অর্থে কেনা খাদ্য অনেক বেশী ক্ষতিকর এবং হারাম। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, 'আর সে সত্তার কসম করে বলছি, যাঁর হাতে মুহম্মদের প্রাণ, বান্দা যখন নিজের পেটে হারাম লোকমা ঢোকায়, তখন চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার কোন আমল কবুল হয় না। আর যার শরীরের মাংস হারাম মাল দ্বারা গঠিত হয়, সে মাংসের জন্য তো জাহান্নামের আগুনই যোগ্য স্থান।'
এই আয়াতের শিক্ষা সর্বযুগের সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। এ কারণেই আজ বহু মুসলিম দেশ অনুন্নত ও সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের শিকার। সুতরাং রোজার সংযম হচ্ছে খাদ্য, পানীয়, যৌন অনুভূতি ও অর্থ সম্পদের অন্যায় লোভ থেকে নিজেকে রক্ষা করা ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য রীপু সমূহের সংযমের চেষ্টা করা।
রুকু - ২৪
২০২। নূতন চাঁদ দেখা সম্বন্ধে অনেক ধরণের কুসংস্কার তখনকার আরব সমাজে চালু ছিল। এখানে আমাদের ঐসব কুসংস্কারকে পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে। মুসলমান সমাজে নূতন চাঁদের গুরুত্ব সমধিক। নূতন চাঁদ অনুযায়ী রোজা শুরু হয়, হজ্ব হয়, ঈদ হয় ইত্যাদি। সে যুগে আরবেরা নূতন চাঁদ দেখে তীর্থ যাত্রার আগে ও পরে বাড়ীর সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে পিছনের দরজা দিয়ে করতো। এগুলিকে ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলাম ধর্মে কুসংস্কারের স্থান নাই। কুসংস্কার দ্বারা আত্মিক উন্নতি লাভ হয় না। আত্মিক উন্নতির চাবিকাঠি হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন। আর এই গুণাবলীর ভিত্তি হবে আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসা, আল্লাহ্ ভীতি বা 'তাকওয়া'।
২০৩। 'তোমরা [উপযুক্ত] দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ কর।' এই লাইনটির বহুজন বহু অর্থ করেছেন। এর কয়েকটি নিম্নরূপ (১) তোমরা যখন কোনও নূতন সমাজে প্রবেশ লাভ করবে এর আচার, আচরণ ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করবে। (২) যদি কোনও উদ্দেশ্য সফল করতে চাও সম্মানজনকভাবে এবং সৎ পথে, তবে তার জন্য আইন অনুযায়ী অগ্রসর হবে, সুবিধা লাভের জন্য 'পিছনের দরজার [Back Door] আশ্রয় নেবে না। (৩) কোনও বক্তব্য উপস্থাপনের সময়ে সোজাসুজি উপস্থাপন করবে 'Do not beat around the bush'। (৪) যদি কোনও কাজে বা মিশনে সাফল্য চাও তবে তার জন্য যত রকম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব তা গ্রহণ করবে।
২০৪। ইসলাম আত্মরক্ষা এবং আল্লাহ্র জন্য জিহাদকে অনুমোদন করে। যুদ্ধের সময়ে সর্বশক্তি দিয়ে বিপক্ষ দলকে প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে কিন্তু কোনও অবস্থাতেই আল্লাহ্ প্রদত্ত সীমারেখা অতিক্রম করতে নিষেধ করা হয়েছে। যুদ্ধ জয়ের পরে শত্রুপক্ষের ফসল, গাছ কাটার অনুমতি নাই। যদি শত্রুপক্ষ বশ্যতা স্বীকার করে তবে তাদের জন্য শান্তি স্থাপন করার হুকুম হয়েছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে।
২০৫। ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়াতে যে ঘটনা ঘটে তারই প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজেল হয়। যদিও এটার সময়কাল সম্বন্ধে অনেকের সন্দেহ আছে। সেই সময়ে নও-মুসলিমরা একটি সুসংগঠিত প্রভাবশালী গোত্র বা জাতিতে পরিণত। সেই সময়ে মক্কায় মুসলিমদের প্রতি অবর্ণনীয় অত্যাচার চলছে ফলে বহু মুসলিম মদিনায় হিজরত করেছেন। মক্কার কোরাইশরা এসব নও-মুসলিমদের তাদের বাড়ী ঘরে যেতে বাঁধা প্রদান করতো এমনকি নও-মুসলিমরা যখন হজ্বব্রত পালন করতে গেলেন তখনও তাদের পবিত্র মক্কা নগরী যা বিশ্বমানবের সঙ্গম স্থল, সেখানে প্রবেশে বাঁধা প্রদান করা হয়। আরব প্যাগানদের মুসলমানদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, ঔদ্ধত্য, সীমা ছাড়িয়ে যায়। নও-মুসলমান, যারা জন্মসূত্রে আরবের নাগরিক তাদের থেকে সে নাগরিক অধিকার হরণ করে নেয়া হয়। যখন হুদায়বিয়ার প্রান্তরে মুসলমানদের পবিত্র হজ্বব্রত পালনে বাঁধাদান এবং অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করা হয়, তখন মুসলমান ও কোরাইশদের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বন্ধ করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কাবাসীরা যে শর্ত আরোপ করতে চায় তাতেই তিনি সম্মত হতে রাজী হলেন। অনেক অসুবিধার পর একটি সন্ধি চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। উভয় পক্ষের স্বাক্ষরিত এই চুক্তিই 'হুদায়বিয়ার সন্ধি' নামে খ্যাত। হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি শর্ত মোতাবেক হযরত (সাঃ) তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) সহ ওমরাহ আদায়ের উদ্দেশ্যে যাত্রার নিয়ত করেন। আগের বছর মক্কার কাফিররা ওমরাহ্ উদ্যাপনে বাধা প্রদান করেছিল। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, কাফিররা হয়তো তাদের সন্ধি ও চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করবে না। যদি তারা এ বছরও বাঁধা দেয় তবে তাঁরা কী করবেন? এ প্রসঙ্গেই উল্লেখিত আয়াতে অনুমতি প্রদান করা হলো যে, যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, তবে তোমাদেরও তার সমুচিত জবাব দেওয়ার অনুমতি থাকলো, "তাদের যেখানেই পাবে হত্যা করবে, যে স্থান থেকে তারা তোমাদের বের করেছিলো, তোমরাও তাদের সে স্থান থেকে বের করে দাও।"
কিন্তু সাধারণভাবে ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম যা সর্বদা ক্ষমা ও উদারতা শিক্ষা দেয়। পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছা, সমঝোতা ও বিশ্বস্ততায় ইসলাম বিশ্বাসী। কিন্তু তাই বলে ইসলামে অন্যায়, অত্যাচার সহ্য করার বিধান নাই। যখন ধর্ম হয় বিপন্ন, অন্যায়, অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন মুসলমানেরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এসবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। মুসলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে, ধর্মের জন্য, ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা, এমনকি জীবন ত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ না করা। আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ কাজ, দুঃস্থের প্রতি, নিপীড়িতের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন ইত্যাদি হচ্ছে মুসলমানদের আদর্শ। যেমন আমরা দেখেছি মহানবী (সাঃ) এর জীবনে। আমরা এসবের প্রতিফলন দেখি সাহাবাদের জীবনে। তারা ছিলেন সাহসী, কর্তব্যপরায়ণ, বিশ্বস্ত। কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও একাগ্রতা ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য। তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সর্বশক্তি দিয়ে সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করা যা 'জেহাদ' নামে খ্যাত। এই আয়াতে এই উপদেশই দেওয়া হয়েছে সর্বকালের সর্বযুগের মুসলমানদের জন্য।
১৯৩। যতক্ষণ [তাদের] দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও উৎপীড়ন বন্ধ না হয়; এবং ন্যায় নীতি ও আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ২০৭। কিন্তু যদি তারা বিরত হয়, তবে যারা অত্যাচারী তারা ব্যতীত অন্যদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করা চলবে না ২০৮।
২০৭। আরবী শব্দ 'দ্বীন' এই কথাটির সংক্ষিপ্ত একটি শব্দ যার অর্থ অনেক ব্যাপক। দ্বীন শব্দটির দ্বারা যে ভাব প্রকাশ করে সেগুলি হচ্ছে কর্তব্যে অবিচল, ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা, ন্যায় বোধ, বিশ্বাস, আনুগত্য, কৃতজ্ঞতা বোধ, প্রথাগত আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি। যদি কোন রাষ্ট্র উপরোক্ত গুণাবলীর দ্বারা পরিচালিত হয় তবেই বলা যাবে সেখানে আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠিত। শুধুমাত্র নাম সর্বস্ব ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয় না।
২০৮। কিন্তু যদি কাফিররা তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং যুদ্ধ করে তবে তোমরাও যুদ্ধ কর জালিমদের সাথে।
২০৯। আশহুরে-হারাম বা সম্মানিত মাস চারটি-(১) যিলকদ্ব, (২) যিলহজ্ব, (৩) মহরম, (৪) রজব। ইসলাম পূর্ব যুগেও এ চার মাস যুদ্ধ বিগ্রহকে হারাম মনে করা হতো; মক্কার মুশরিকরাও এ বিধি মেনে চলতো। এখানে আল্লাহ্ বলেছেন, হে মুসলমানগণ! মক্কার কাফিররা যদি তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তবে হারাম মাসে অর্থাৎ যিলকদ মাসে যুদ্ধ করতে হবে বলে তোমরা যে আশঙ্কা করছো সে সম্পর্কেও নিশ্চিত থাক। হারাম মাসে কেবল সে ক্ষেত্রেই তোমাদের জন্য যুদ্ধ নিষিদ্ধ, যে ক্ষেত্রে কাফিররা তোমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। অতএব যারা তোমাদের এই নিষিদ্ধতা মেনে চলে, তোমরাও তাদের বিপক্ষে এই নিষেধাজ্ঞা মেনে চল। আর যদি তারা তোমাদের সঙ্গে এই নিষিদ্ধতা মেনে না চলে, তোমাদের বিপক্ষে সীমা অতিক্রম করে, তবে তোমরাও তাদের প্রতি ততটুকুই সীমা অতিক্রম কর, যতটুকু তারা করেছে। আর এসব নির্দেশাবলী পালনে আল্লাহ্কে ভয় কর, যাতে সমতার ভিত্তিতে (Law of equality) সবকিছু হয়। আল্লাহ্ তায়ালার দান ও রহমত ঐসব আল্লাহ্ ভীরুদের সঙ্গে থাকে, যারা কোন ক্ষেত্রেই আইনের সীমা অতিক্রম করে না।
২১০। যদিও আল্লাহ্ মুসলমানদের যুদ্ধের হুকুম দিয়েছেন কিন্তু একই সাথে আত্মসংযমের আদেশ দিচ্ছেন। শক্তি প্রয়োগের এক ধরণের মাদকতা আছে। কিন্তু ধ্বংসের জন্য এ শক্তি প্রয়োগ নিষেধ। শুধুমাত্র আত্মরক্ষা ও অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করা চলবে। মানুষের স্বভাবধর্ম এই যে শক্তির স্বাদ একবার পেলে সে শক্তি মদমত্ত হয়ে যায়। তাই আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে প্রয়োজনে অস্ত্র ধরবে কিন্তু সর্বদা নিজেকে সংযত রাখবে। যারা শক্তিধর হয়েও আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে সংযত রাখে আল্লাহ্র কাছে তারা মুত্তাকী। আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে যুদ্ধ করবে নীতিগত কারণে অন্ধ আবেগ ত্বারিত হয়ে নয়। নীতির জন্য প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেবে এবং শহীদ হবে। আবেগ ত্বারিত এবং আক্রোশ দ্বেষ বা হিংসা চরিতার্থ করার জন্য যুদ্ধ করা না জায়েজ।
২১১। প্রতিটি যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের প্রয়োজন। যদি যুদ্ধ ন্যায় সঙ্গত কারণে, অন্যায়কে প্রতিরোধের জন্য আল্লাহ্র দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য হয়, তবেই সে যুদ্ধ হবে আল্লাহ্র কারণে যুদ্ধ করা বা 'নীতির' জন্য যুদ্ধ করা। এসব যুদ্ধের সময়ে, আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে যার অর্থ-সম্পদ আছে তা যুদ্ধের জন্য মুক্ত হস্তে দান করা। শুধু অর্থ সম্পদ দান করেই দায়িত্ব পালন শেষ হয় না। সবচেয়ে বড় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন হচ্ছে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা সর্বান্তকরণে নিয়োগ করা। অর্থাৎ 'আল্লাহ্র পথে' ব্যয়ের সময়ে প্রত্যেকে স্ব-স্ব ক্ষমতা অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ, মেধা, বুদ্ধি, শারীরিক সামর্থ এক কথায় সব কিছুই আল্লাহ্র রাস্তায় খরচ করবে। যদি কেউ এ সময়ে আল্লাহ্র রাস্তায় খরচ না করে অর্থ সম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখে তবে সে তার নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে। যদি কেউ তার অর্থ সম্পদকে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় না করে নিজস্ব ভোগ বিলাসের জন্য ব্যয় করে, তবে সে প্রকারান্তে শত্রুকেই সাহায্য করে। এবং ফলস্বরূপ নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে। তাদের বোঝা উচিত স্বার্থপরতা কখনও ভাল কিছু করতে সমর্থ হয় না। নিঃস্বার্থভাবে সমাজের জন্য যা কিছুই করা হয় তাই আল্লাহ্কে খুশী করে। এই উপদেশ সর্বকালের সর্বযুগের। যে সমাজে ধনীদের ধন-সম্পদ, কুক্ষিগত নয়, যে সমাজে ধন-সম্পদ শুধুমাত্র তাদের বিলাস-ব্যসনে ব্যয় হয় না। তাদের সম্পদে গরীবের হক থাকে, আমরা দেখি সে সমাজ উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহ্র রহমত সে সমাজের উপর বর্ষিত হয়। এই ব্যয়কেই 'আল্লাহ্র পথে' ব্যয় বলা হয়েছে।
২১২। দেখুন সুরা ২, আয়াত ১৫০ ও টিকা ১৬১। হজ্জ্ব প্রক্রিয়া হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ ইবাদত যা জুলহজ্জ্ব মাসের প্রথম ১২/১৩ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। উমরাহ্ হচ্ছে সংক্ষিপ্ত হজ্জ্ব যা বৎসরের যে কোন সময়েই করা সম্ভব। হজ্জ্ব ও উমরাহ্ উভয় ক্ষেত্রেই ইহ্রাম পরিধান করতে হয়, যা শুধুমাত্র কাফনের কাপড়ের ন্যায় সেলাইবিহীন দু'টুকরো কাপড়। ইহ্রাম হচ্ছে পৃথিবীর দম্ভ, অহংকার, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ইত্যাকার সর্ব রিপুর ত্যাগের প্রতীক স্বরূপ। ইহ্রাম পরিধানের পর থেকে হজ্জ্ব বা উমরাহ্র সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ না করা পর্যন্ত অন্য কাপড়, গহনা বা চুলের পরিচর্যা অথবা সুগন্ধি ব্যবহার করা, শিকার করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে পুরুষ লোকদের মাথার চুল চেঁছে ফেলা এবং মহিলাদের এক গোছা চুল কাটা বিধেয়। এরপরে ইহ্রাম খুলে ফেলে পোষাক পরিবর্তন করা জায়েজ।
বলা হয়েছে যে, (১) একবার ইহ্রাম পরিধান করার পর হজ্জ্ব বা উমরাহ্র সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। (২) এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে দুনিয়াবী হবে না, তা হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত। (৩) যদি কোন কারণে আমরা তা সম্পন্ন করতে সক্ষম না হই, তবে তার উপরে কুরবানী করা অত্যাবশকীয় হয়ে যাবে।
২১৩। যদি কেউ সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পূর্বে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, যার দরুন তাকে ইহ্রাম খুলে অন্য কাপড় পড়তে হবে, সেক্ষেত্রে অথবা তার মাথাতে চর্মরোগের জন্য বা অন্য কারণে তার পক্ষে চুল কামানো সম্ভব নয়, এসব ক্ষেত্রে যদি তাকে ইহ্রাম খুলে ফেলতে হয় তবে সে তিনদিন রোজা রাখবে এবং গরীবদের খাদ্য দান করবে বা পশু কুরবানী দেবে।
২১৪। এই আয়াতটি যখন অবতীর্ণ হয়, তখন মক্কা নগরী ছিলো ইসলামের শত্রুদের অধীন। সে কারণে যুদ্ধাবস্থা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থার কথা একই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্র আয়াতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হলেও তার প্রয়োগ হবে সর্বজনীন। কারণ শীঘ্রই মক্কা নগরী শত্রুমুক্ত হয়েছিলো। দূর-দূরান্ত থেকে হজ্জ্বযাত্রীরা হজ্জ্ব ক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে হজ্জ্বের সময়ের পূর্বেই মক্কা নগরীতে আগমন করতো। এসব হজ্জ্বযাত্রীরা উমরাহ্ সম্পন্ন করে ইহ্রাম খুলে ফেলতো এবং আনুষ্ঠানিক হজ্জ্বের জন্য অপেক্ষা করতো [হজ্জ্বে তামাত্তু অথবা আল্ কিরান]।
২১৬। এখানেই যুদ্ধ সম্পর্কিত কর্তব্য বা বিধান সম্বন্ধে বর্ণনা শেষ করে হজ্জ্বের সময়কার পালনীয় ও করণীয় বিধান সম্বন্ধে আলোচনা শুরু হয়েছে। যুদ্ধের সাথে সর্বদাই জীবনের ভয় জড়িত থাকে। কিন্তু আমাদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, আমরা যেন আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তীব্র আবেগে অন্ধ না হয়ে যাই। কারণ ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করা অপেক্ষা আল্লাহ্র হুকুম মান্য করে জিহাদে অংশ গ্রহণ করা উত্তম। জিহাদ এমন একটি কঠিন সময় যখন ব্যক্তির চরিত্রের প্রকৃত তেজস্বীতা ও গুণাবলী পরিলক্ষিত হয় এবং এভাবেই আল্লাহ্ আমাদের ঈমানের পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ্র রাস্তায় যারা সৎ কাজ করে এবং আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে যারা আত্মসমর্পন করে তাদের প্রতি আল্লাহ্র করুণার কথা বলে শেষ করা হয়েছে ১৯৫ আয়াতটি। এই [২:১৯৬] আয়াতটি শেষ করা হয়েছে সেইসব লোকদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণের মাধ্যমে যারা আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করার দোহাই দিয়ে সীমা লঙ্ঘন করে থাকে। তাদের শাস্তি যে অবধারিত তাও এখানে নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে আমাদের বলা হয়েছে হজ্জ্বের মত কোন বৃহৎ লোকসমাবেশে কোন কোন কাজ আমাদেরকে পরিহার করে চলতে হবে।
রুকু - ২৫
২১৭। 'সুবিদিত মাস' বলতে শাওয়াল, যিলক্বদ, যিলহজ্জ্ব মাস [১০ অথবা ১৩ পর্যন্ত] বুঝায়; যখন হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অর্থাৎ হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা শাওয়াল মাসের প্রথম থেকেই শুরু করা যেতে পারে, যখন থেকে হজ্জ্বযাত্রীরা মক্কার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তবে হজ্জ্বের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় যিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম দশ দিনে। বিশেষভাবে তা করা হয় ৮ম, ৯ম ও ১০ম যিলহজ্জ্ব তারিখে যখন হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। হজ্জ্বের সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা নিম্নরূপ :
(১) নির্দিষ্ট স্থান থেকে ইহ্রাম পরিধান করে মক্কার দিকে অগ্রসর হতে হয়। এরপরে হজ্জ্বের বিধি নিষেধ তার উপরে আরোপিত হয়। এখান থেকেই হজ্জ্বযাত্রীরা আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েন এবং পৃথিবীর সকল আকর্ষণকে পরিত্যাগ করেন। (২) সাত বার কাবা ঘরকে প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করতে হয়। এ সময়ে কাবার দেয়াল সংলগ্ন কালো পাথরকে চুম্বন করতে হয়-যা আল্লাহ্র প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালবাসার প্রতীক। (৩) মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে [২:১২৫] দু'রাকায়াত নামাজ পড়ার পরে যমযম কূপের পানি পান করে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের উদ্দেশ্যে গমন করতে হয় [২:১৫৮]। এই পাহাড়দ্বয় ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের প্রতীকস্বরূপ। (৪) ৭ই যিলহজ্জ্ব হজ্জ্ব সম্পর্কীয় খুৎবাহ্ পাঠ করা হয় যা সকলে শ্রবণ করে (৫) ৮ই যিলহজ্জ্ব সকল হজ্জ্বযাত্রীগণ মক্কা থেকে ৬ মাইল উত্তরে মীনাতে গমণ করেন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। সেখান থেকে ৯ই যিলহজ্জ্ব আরাফাতের পাহাড়ে গমণ করেন। আরাফাত মীনা থেকে আরও ৫ মাইল উত্তরে যা 'রহমতের পাহাড়' নামে খ্যাত। এখানেই হযরত আদম ও বিবি হাওয়া দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে পুণরায় মিলিত হন এবং আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করেন। এখানেই বিশ্বনবী তাঁর বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ দান করেছিলেন। এখানে প্রচারিত ভাষণ সকলেই শুনে থাকেন। (৬) ১০ যিলহজ্জ্ব হচ্ছে ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানীর দিন। কুরবানী দেয়া হয় মীনার প্রান্তরে। এরপরে মাথার চুল কামিয়ে ফেলে হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয় 'তওয়াফ-আল-ইফাদা' এবং প্রতীকধর্মী শয়তানকে পাথর ছোঁড়ার মাধ্যমে। পরবর্তী দু'দিনও পাথর ছোঁড়া হয়। এই পাথর নিক্ষেপের অনুষ্ঠানটি প্রতীকধর্মী, যা মানুষের কুচিন্তা, কুকথা ও কু-কাজকে প্রত্যাখ্যানের সাথে সম্পৃক্ত। কুরবাণীর পরে আরও ২/৩ দিন মীনাতে অবস্থান করতে বলা হয়। এই দিনকে বলা হয় 'তাশরিক' দিন।
২১৮। বলা হয়েছে প্রতিটি হজ্জ্বযাত্রী হজ্জ্বের দিনগুলি সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করার মত অর্থ নিয়ে আসবেন যেনো বিদেশ বিভূঁয়ে অর্থাভাবে ভিক্ষার মত অসম্মানজনক কাজ করতে না হয়। কুরআনের চিরাচরিত প্রথায় এখানেও আমাদের পার্থিব থেকে আধ্যাত্মিক দর্শনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যদি এই পৃথিবীতে স্বল্পকালীন [হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে] ভ্রমণের জন্য পাথেয় প্রয়োজন হয়, তবে পৃথিবী থেকে পরলোকের যে সুদীর্ঘ যাত্রাপথ, সে পথের জন্য পাথেয় কতটা প্রয়োজনীয় তা সহজেই অনুমেয়। সে যাত্রা হবে অনন্তযাত্রা। এই পৃথিবী থেকে অন্যভূবনে যাত্রা। ভবিষ্যত পৃথিবীর এই যাত্রাপথে সর্বাপেক্ষা উত্তম যে পাথেয় তা আত্মসংযম বা সঠিক চারিত্রিক গুণাবলী বা তাকওয়া। তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ্ ভীতি-যার ফলে আত্ম সংযমের মাধ্যমে চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে।
২১৯। সৎ ব্যবসা-বাণিজ্য হজ্জ্বের সময়ে অনুমোদন করা হয়েছে। এ থেকে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন ঠিক সেরূপ সুবিধা ভোগ করবেন হজ্জ্বযাত্রীরা। অন্যথায় এই বিপুল সংখ্যক হজ্জ্বযাত্রী প্রয়োজনীয় জিনিষের অভাবে জীবন যাত্রায় বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতেন। এখানে আল্লাহ্ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাদের ব্যবসায় লাভ হচ্ছে আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্বরূপ। সুতরাং ব্যবসা যেনো কোন প্রকার ছলচাতুরী ও অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হয়। সৎ ব্যবসা সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনে। সুতরাং তা হবে আল্লাহ্র সেবা বা আল্লাহ্র রাস্তায় কাজের সমতুল্য।
[উপদেশ : সমাজ জীবনের প্রতিটি কাজ, যদি তা হয় সৎ ও সমাজের জন্য উপকারী, তবে তাই-ই হচ্ছে আল্লাহ্র ইবাদতের সমতুল্য। এখানেই ইসলামের মাহাত্ম্য অন্যান্য ধর্ম অপেক্ষা। দ্বীন ও দুনিয়ার এমন অপূর্ব সমন্বয় সত্যিই বিরল। কবির ভাষায় বলা যায়-
সে আমার নয়;
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।']
২২০। দেখুন সূরা ২, আয়াত ১৯৭ ও টীকা ২১৭। আরাফাত ও মীনার মধ্যবর্তী মুজ্দালিফা নামক স্থানে রাসূল (সাঃ) হজ্জ্বের দিনসমূহে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতেন-সালাত কায়েমে। আরাফাত থেকে মীনাতে প্রত্যাবর্তনকালে এ জায়গাতেই সকল হজ্জ্বযাত্রীদের রাত্রিযাপন করতে হয় ও ইবাদাতে মশগুল হতে হয়। এখান থেকেই হজ্জ্বযাত্রীগণ শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য পাথর সংগ্রহ করে থাকেন। এভাবেই এ স্থান হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতায় পবিত্র স্থান রূপে পরিগণিত হয়।
২২১। মক্কার কোন কোন গোত্র ছিলো উদ্ধত এবং একগুঁয়ে। তারা আরাফাতে গমন না করে মুজ্দালিফাতে অবস্থান করতো। এদেরকেই তিরস্কার করা হয়েছে তাদের একঁগুয়েমির জন্য এবং অন্য সকলের ন্যায় একই কাতারে হজ্জ্বের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে নির্দেশ দান করা হয়েছে। কারণ ইসলাম সমতায় বিশ্বাসী।
২২২। দেখুন উপরের টিকা। আরাফাতে সকল হজ্জ্বযাত্রীগণ সমবেত হন। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রচণ্ড ভীড়ে সেখানে যানজটের সৃষ্টি হতে পারে; যার ফলে হজ্জ্বযাত্রীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সুতরাং আরাফাতে প্রয়োজনীয় সময়ের অধিক সময় ব্যয় না করে বা অপেক্ষা না করে সেখান থেকে দ্রুত প্রত্যাবর্তন করতে বলা হয়েছে। হজ্জ্বযাত্রীদের উচিত প্রত্যেকে পরস্পরের সুখ-সুবিধার প্রতি দৃষ্টি দেয়া।
২২৩। ইসলাম পূর্ব দিনগুলিতে মুনাফিকেরা হজ্জ্বযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মিনার ময়দানে সকলে সমবেত হতো এবং তাদের পূর্বপুরুষদের গুণগানে লিপ্ত হতো। ইসলাম হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতাকে শেরেকীর পাপমুক্ত করে তা পরিশুদ্ধ করে এবং সেই সাথে হজ্জ্ব শেষের আনুষ্ঠানিকতাকেও পরিশুদ্ধ করা হয়। প্রত্যেক হজ্জ্বযাত্রীকে কুরবানী শেষে ২/৩ দিন মীনাতে অবস্থান করতে হয়। বলা হয়েছে এই ২/৩ দিন তারা আল্লাহ্র গুণগানে ব্যয় করবে। দেখুন নীচের আয়াত [২:২০৩]।
২২৪। যদি কেউ শুধুমাত্র পৃথিবীর ভোগ বিলাসের জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে এবং সর্বক্ষণ শুধুমাত্র পৃথিবীর ভোগ বিলাসের কথা চিন্তা করে তবে তার আধ্যাত্মিক জীবনের পথ অবশ্যই রুদ্ধ হয়ে যাবে। কোন কোন লোক হজ্জ্বের সময়ে দোয়া করে বটে, তা একান্তভাবে দুনিয়ার উন্নতির জন্য, পরকালের কোন চিন্তাই তাদের থাকে না। তারা পরকালে কিছুই পাবে না। কেননা তাদের কার্য পদ্ধতিতে বুঝা যায় যে, তারা হজ্জ্বের ফরজ প্রথাগতভাবে আদায় করে এবং তা করে দুনিয়াতে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য। আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা বা পরকালে মুক্তি পাওয়ার কোনও ধ্যান ধারণাই তাদের থাকে না। এই আয়াতে এদের বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, জাগতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা এমনিভাবে নিমগ্ন যে, কোন প্রকারে শুধু নিজের চাহিদা পূরণ হোক, এটাই তাদের কাম্য-চাই তা ভাল হোক বা মন্দ হোক, সৎ পথে অর্জিত হোক বা অসৎ পথে, মানুষ একে পছন্দ করুক বা নাই করুক।
আমাদের অবস্থাও একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, অনেক মুসলমান ধনী ব্যক্তি যেসব দোয়া কালাম পাঠ করে বা বুযুর্গ লোকদের দ্বারা করায় তাতে দুনিয়ার সমৃদ্ধি এবং ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি অগ্রগতির জন্যই করে বা করায়। তারা অনেক দোয়া কালাম পাঠ করে এবং নফল এবাদত করে ভাবে যে, আমরা অনেক এবাদত করে ফেলেছি। কিন্তু বাস্তবে এটা এক প্রকার দুনিয়াদারী পূজায় পরিণত হয়। এও এক ধরণের শেরেকী। আবার অনেক লোক জীবিত বুযুর্গান বা মৃত বুযুর্গানের (মাজারে যেয়ে কান্নাকাটি) সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এতেও তাদের উদ্দেশ্য থাকে তাদের দোয়া-তাবিজের সাহায্য নিজের উদ্দেশ্য সফল করা, দুনিয়ার বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকা। এই আয়াতে তাদের জন্য উপদেশ আছে। সত্যিকারের মোমেন ব্যক্তিও ইহকালকেও অস্বীকার করে না পরকালকেও অস্বীকার করে না। তারা দুনিয়ার কল্যাণের মাধ্যমে পরকাল অর্জন করতে চায়। দুনিয়ার কল্যাণ যেমন-শারীরিক সুস্থতা, পরিবার-পরিজনের সুস্থতা, হালাল-রুজীর প্রাচুর্য্য, পার্থিব যাবতীয় প্রয়োজনের পূর্ণতা, নেক আমল, সচ্চরিত্র, উপকারী বিদ্যা, মান-সম্মান, সামাজিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা, আকীদার সংশোধন, সিরাতে-মুস্তাকীমের হেদায়েত, এবাদতে একাগ্রতা প্রভৃতিসহ অসংখ্য স্থায়ী নেয়ামত এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও সাক্ষাত লাভ প্রভৃতি সবই এর অন্তর্ভূক্ত।
২০২। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদেরই বণ্টন করা হবে ২২৫। বস্তুতঃ হিসাব গ্রহণে আল্লাহ্ অত্যন্ত তৎপর।
২২৫। আল্লাহ্র কাছে আমাদের সমস্ত কাজ কর্মের হিসাব পূণ্য এবং পাপের হিসাব অনুযায়ী জমা এবং খরচের খাতায় লেখা হয়ে যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে মুহুর্তের মধ্যে। কারণ আল্লাহ্ আয়াতে [২:৯৫] বলেছেন যে, আমাদের কাজের হিসাব আমাদের মৃত্যুর বহু আগে তার দরবারে জমা হয়। আজকের কম্পিউটার যুগে দেখি পৃথিবীর একপ্রান্তের সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে অন্য প্রান্তে চলে যায়। সুতরাং আমাদের হাত যা করে তার হিসাব মুহূর্তের মধ্যে আল্লাহ্র কাছে পৌঁছে যাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নাই।
২২৬। 'নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনসমুহে'-১০ যিলহজ্জ্বের পরে মীনাতে তিনদিন থেকে হজ্জ্বযাত্রীদের নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্কে স্মরণ করতে বলা হয়েছে। এই দিনগুলিকে বলা হয়েছে 'তাশরীক' [দেখুন আয়াত ২:২০০ ও টিকা ২২৩]। হজ্জ্বযাত্রী দুইদিন পর না তিনদিন পর চলে যাবে তা করা হয়েছে ঐচ্ছিক।
২০৫। যখন সে ফিরে যায়, তার উদ্দেশ্য হয় পৃথিবীর সর্বত্র অশান্তির সৃষ্টি করা এবং শস্য ও গৃহপালিত পশুর ধ্বংস সাধন করা। আর অশান্তি সৃষ্টিকারীকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না।
২০৬। যখন তাদের বলা হয়, 'আল্লাহ্কে ভয় কর', তখন সে তার ঔদ্ধত্য [রিপুর] দ্বারা পরিচালিত হয় [আরও] অপরাধের প্রতি। এদের জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট; [শোওয়ার জন্য] কত নিকৃষ্ট সে বিছানা।
২২৭। আয়াত [২:২০০] এবং আয়াত [২:২০১] এ দু'ধরণের লোকের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে [২:২০৪] তৃতীয় আর এক ধরণের লোকের কথা বলা হয়েছে। এরা হচ্ছে ধূর্ত চালাক এবং কথা বার্তায় সাবলীল মোনাফেক। সাধারণ মানুষ এদের মনে করে, দুনিয়াদারী সম্বন্ধে অত্যন্ত অভিজ্ঞ। চমকপ্রদ কথা বার্তার ফলে এদের কথা দ্বারা তারা মোহবিষ্ট হয়ে পড়ে। নিষ্ঠাবান মুমিন মুসলমান, যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য আত্ম বিসর্জন দিকে কুণ্ঠাবোধ করেন না, এদের ক্ষতি সাধন করা, তাদের বিপথে চালিত করাই এই সব মোনাফেকদের উদ্দেশ্য। এদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেছেন (১) এরা মুখে অত্যন্ত মিষ্টি কিন্তু পিছনে এরা অঘটন ঘটনে পটিয়সী। (২) বিবাদ-বিসংবাদ ঘটানো, ঘৃণা-দ্বেষ, ঈর্ষা ছড়াতে এরা ওস্তাদ। (৩) এদের বাক্চাতুর্য্য আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হবে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিসঙ্গত। (৪) এরা কথায় কথায় প্রতিজ্ঞা করে। সাধারণ ব্যক্তিদের পক্ষে এদের জাল জুয়াচুরি ধরা প্রায় অসম্ভব। (৫) এরা পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তা থেকে ফায়দা লুটতে আগ্রহী, এরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত।
২২৯। আয়াত [২:২০৭] এ যে ধরণের লোকের বর্ণনা করা হয়েছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নিজের জীবন ত্যাগ করতে কুণ্ঠিত নয়। এরা আল্লাহ্র প্রতি অনুগত, আল্লাহ্র রাস্তায় উৎসর্গিত প্রাণ, দৃঢ় এবং বিশ্বস্ত। আমরা এ ধরণের বহু ব্যক্তির সন্ধান পাই। ইসলামের প্রথম যুগে, এরাই হচ্ছেন ইসলামের প্রকৃত স্তম্ভ (Pillar) বা থাম। শত অত্যাচার, হত্যা, অন্যায় অবিচারে তারা নতি স্বীকার করেন নাই। নিজের জীবনের এমনকি নিজের ভালবাসার জনের বিনিময়েও তারা ইসলামের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হন নাই। সবকিছুর পরিবর্তে তারা তাদের নবী (সাঃ) এর পাশে পাহাড়ের মত অটল, অনড় থেকেছেন। আর এদের কারণেই ইসলামের বিস্তার লাভ। আয়াত [২:২০৮] এ আল্লাহ্ এই দ্বিতীয় ধরণের বান্দাকে অনুসরণ করার জন্য সবাইকে আদেশ দিচ্ছেন এবং অন্য দু'ধরণের লোক যাদের এক ধরন শুধু পৃথিবীর অর্থ সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি যাদের কাম্য পরকাল যাদের কাছে অর্থহীন আয়াত [২:২০০] এবং অন্য ধরণ [২:২০৪] যারা ধূর্ত এবং মোনাফেক, যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। যদি আমরা তা করতে পারি তবেই আমরা মুক্তি পাব, আমরা মুত্তাকী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবো।
২০৯। যদি তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট [নিদর্শন] আসার পরেও তোমাদের পদস্খলন ঘটে, তবে জেনে রাখ আল্লাহ্ মহাশক্তিশালী ও প্রজ্ঞাময় ২৩০।
২৩০। আল্লাহ্র আদেশাবলী জানার পরেও কেউ যদি তা না মানে, তবে ক্ষতি আল্লাহ্র নয়, ক্ষতি তারই। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে আল্লাহ্র পরিকল্পনা কার্যকর হবেই। কেউ যদি আল্লাহ্কে অস্বীকার করে তার পথ থেকে দূরে সরে যায় তা হয়তো ক্ষণকালের জন্য সমাজে কিছু অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র তাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। ক্ষতি হবে তারই যে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে তার পথ থেকে দূরে সরে যাবে। আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী, তার পরিকল্পনা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
২৩১। যদি বিশ্বাসের অভাব থাকে, যদি ঈমানের দৃঢ়তা না থাকে, তখনই আল্লাহ্র হুকুম মানার ক্ষেত্রে গড়িমসি দেখা যায়। তখনই তারা এ রকম বাক্য ব্যবহার করবে, 'হ্যাঁ আমরা তখনই বিশ্বাস করবো যখন আল্লাহ্ তার ফেরেশ্তাদের সমবিভরে আমাদের সামনে তাঁর মহিমা উপস্থাপন করবেন।' অর্থাৎ তারা তাদের মত করে আল্লাহ্কে বিশ্বাস করতে চায়; আল্লাহ্র মনোনীত পন্থায় নয়। কিন্তু তা তো হবার নয়। সব সিদ্ধান্তের একমাত্র মালিক আল্লাহ্। তার হুকুমই একমাত্র হুকুম, তার সিদ্ধান্তই একমাত্র সিদ্ধান্ত।
২৩২। উপরের আয়াতের উদাহরণ আমরা দেখি হযরত মুসার সময়ে। আল্লাহ্ ইসরাঈলীদের তার মহিমা এবং নিদর্শন দেখান, তারপরও ইসরাঈলীরা আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ ত্যাগ করে নিজেদের কল্পনায় গড়া মূর্তিপূজা এবং খেয়ালখুশী মত চলতে থাকে। এ কথাটা শুধুমাত্র ইসরাঈলীদের বেলায প্রযোজ্য তাই নয়। এ কথা সর্বকালের সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্র পরিবর্তে নিজেদের কল্পনা প্রসূত শক্তির পূঁজা করে। প্রাচীন ইসরাঈলীরা সোনার গো-বৎস্য পঁজা করেছে, আজকের যুগে আমরা দেখি এর ধরণ পাল্টে গেছে। কেউ বিশ্বমানবতার নামে নাস্তিক, কেউ কমুনিজমের নামে নাস্তিক। আবার কেউ আল্লাহ্র নামে Trinity তে বিশ্বাসী ইত্যাদি। অর্থাৎ সবাই স্ব-স্ব মত অনুসারে আল্লাহ্কে বিশ্বাস করতে চায়। আজ মুসলমানদের মধ্যে এত বিভক্তির কারণও এই একটাই। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন এর দ্বারা তারা নিজেদেরই প্রতারিত করবে, কারণ আল্লাহ্র ন্যায় বিচার অবশ্যই আসবে। যারা তার রহমত ও করুণা অস্বীকার করে তাদের জন্য এই ন্যায় বিচার অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রযোজ্য হবে।
২৩৩। আয়াত [২:১৯৬] এর শেষাংশে আল্লাহ্কে ভয় করতে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ্কে ভয় করে না তাদের কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আয়াত [২:২১১] এর শেষাংশে তাদের কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহ্র নিদর্শন অস্বীকার করে এবং পরিবর্তন করে তাদের শাস্তি হবে কঠোর।
২৩৪। এই আয়াতে বলা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুনিয়ার প্রতি আসক্তি হচ্ছে, সত্যের প্রতি, আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি অনীহার প্রকৃত কারণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যার নিদর্শন হলো ধর্মভীরুদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন। মানুষের পক্ষে শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের উন্নতিতে অহংকারী হওয়া উচিত নয়। কারণ আল্লাহ্ সবাইকে সমান রিযিক দান করেন না। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা প্রচুর পরিমাণে দিয়ে থাকেন এবং দেখা যায় আমাদের ধারণায় যাদের পাওয়া উচিত নয়, তাদেরই অর্থবিত্ত বেশী। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে, পৃথিবীর অগ্রযাত্রায়, আল্লাহ্র পরিকল্পনা বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যে কেউ আল্লাহ্র নেয়ামতের অধিকারী হলে, কেন তাকে সে নেয়ামত দেওয়া হলো তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নাই। তবে এটা নিশ্চিত যে, আল্লাহ্ যাকে যে নেয়ামত দিয়েছেন তার সদ্ব্যবহার সম্বন্ধে হিসাব নেবেন পরকালে। যেমন-আমরা দিন শেষে আমাদের ব্যবসায়ের হিসাব মিলাই।
২১৪। তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা [পরীক্ষা ব্যতীত] জান্নাতে প্রবেশ করবে, যেরূপ পরীক্ষা পূর্ববর্তীগণ, যারা গত হয়েছে, তাদের করা হয়েছিলো? দুঃখ, কষ্ট এবং দুর্ভাগ্য তাদের স্পর্শ করেছিলো এবং তারা এতটাই ভীত ও কম্পিত হয়েছিলো যে, এমনকি রাসূল এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছিলো, তারা [সকলেই] কেঁদে বলেছিলো, 'কখন আল্লাহ্র সাহায্য আসবে?' আঃ! অবশ্যই আল্লাহ্র সাহায্য [সর্বদা] অতি নিকটে।
২১৫। তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, [দান হিসেবে] কি তারা ব্যয় করবে। বল, যা ভাল ২৩৫ তাই-ই ব্যয় কর, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্থ এবং পর্যটকদের জন্য। এবং তোমরা যা ভাল কাজ কর আল্লাহ্ তা খুব ভালভাবে জানেন।
২৩৫। দান বা Charity সম্পর্কে এখানে তিনটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। (১) কি দান করবে? (২) কাকে দান করবে? এবং (৩) কীভাবে দান করবে? এর উত্তরে বলা হয়েছে, যা কিছু ভাল, মানুষের জন্য মঙ্গলজনক, তাই-ই দানের বস্তু। অনেকের ধারণা শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদই দানের বস্তু। অর্থ দান করা পৃথিবী সর্বাপেক্ষা সহজ কাজ। আল্লাহ্ প্রতিটি মানুষকে কোন না কোন নেয়ামতে ধন্য করেছেন। কাউকে দিয়েছেন মেধা, কাউকে শিল্পীমন, কাউকে প্রভাব প্রতিপত্তি, কাউকে ক্ষমতা, কাউকে অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি। যাকে যে নেয়ামত দিন না কেন সে সেই নেয়ামত আল্লাহ্র রাস্তায় খরচ করবে। এখানে বলা হয়েছে, "যা ভাল তাই-ই ব্যয় কর।" অর্থাৎ ফেলে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় বা যা মানুষের জন্য কল্যাণকর নয় তা দানের যোগ্যতা রাখে না। এ ব্যাপারে দুঃখী ব্যক্তিকে সান্ত্বনার বাণীও দান হিসেবে গ্রহণযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে অর্থ সাহায্য দান নয় কারণ এই অর্থ সাহায্য তার জন্য কোনও কল্যাণ বয়ে আনবে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে কাকে দেওয়া হবে বা কার জন্য ব্যয় করবে? এ দানে পিতামাতাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সুতরাং এ দান যে যাকাত নয় তা বোঝা যায় এ কারণে যে, পিতা-মাতাকে যাকাত দেওয়া যায় না এবং যাকাতে সব সময়ে পরিমাণ ধার্য করা থাকে। এখানে তা নাই। সুতরাং পিতা-মাতার পর যাদের কথা বলা হয়েছে তারা হচ্ছে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্থ এবং মুসাফির। এদের মধ্যে বিচার করতে হবে কার প্রয়োজন অধিক। যার অধিক তার দাবী অগ্রগণ্য। এ ব্যাপারে কেউ যদি পৃথিবীতে প্রশংসিত হওয়ার জন্য [যা স্বভাবধর্ম] যে অগ্রগণ্য দাবীদার তার দাবীকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এবং এমন লোককে দান করে যাতে সে পৃথিবীতে সবার কাছে প্রশংসা পেতে পারে, তবে তার সে দান, দান বলে গণ্য হবে না। এটা আল্লাহ্র চোখে জালিয়াতির সমান। যে কোনও দানকে আল্লাহ্ বিচার করবেন তার নিয়ত দ্বারা। দানের উদ্দেশ্য হবে দুটি (১) দান হতে হবে নিঃস্বার্থ এবং (২) গ্রহীতার প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থাৎ যার প্রয়োজন অধিক তার দাবী অগ্রগণ্য এই ভিত্তিতে দান করা। যদি কেউ দান করার ব্যাপারে এই দু'টি মূলনীতি অস্বীকার করে তবে অবশ্যই তার দানের পিছনে নিজস্ব কোনও স্বার্থ বিদ্যমান থাকে।
তৃতীয় প্রশ্ন কীভাবে দান করা হবে। এর উত্তরে বলা হয়েছে এমনভাবে দান করতে হবে যেন আমাদের অবস্থান আল্লাহ্র দৃষ্টির সম্মুখে, কারণ "আল্লাহ্ তা খুব ভালোভাবে জানেন।" আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, তিনি আমাদের নিয়ত সম্বন্ধে আমাদের চেয়েও বেশি ওয়াকিবহাল। সুতরাং তার হুকুম মেনে, তাকে খুশী করাই হচ্ছে দানের একমাত্র উদ্দেশ্য। যদি কেউ মনে করে বাহিরের প্রদর্শনী, বা ভান বা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বস্ত না হয়ে দান খয়রাত করে পূণ্য বা সওয়াব হাসিল করবে, তবে তারা মূর্খ। কারণ মানুষের কোনও শঠতা বা ভান বা বাহিরের প্রদর্শনী কিছুই বিশ্ব স্রষ্টার কাছে গোপন থাকে না।
২৩৬। সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ হচ্ছে জিহাদ। কারন আল্লাহ্র আইন রয়েছে সত্য ও ন্যায়ের মধ্যে। তাই সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা মানেই হচ্ছে আল্লাহ্র আইনের প্রতিষ্ঠা। আর সত্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করা হচ্ছে সর্বোচ্চ দান। পৃথিবীতে নিজের জীবনের চেয়ে বড় আর কি আছে? সেই জীবনকে যে দান করতে পারে তার থেকে বড় দাতা আর কে আছে? জেহাদ বা আল্লাহ্র জন্য সেই জীবনকে নিবেদন করা হয়। একথা স্মরণযোগ্য যে জেহাদ শুধুমাত্র অস্ত্রের সাহায্যেই হয় না লেখনীর সাহায্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, জনমত গঠন করা জেহাদ। সেই রকম বক্তৃতার মাধ্যমে, নেতৃত্বের মাধ্যমে যদি সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য ও অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা হয় তাও আল্লাহ্র চোখে জেহাদ। যদি কেউ নিজের দম্ভ প্রকাশের জন্য অন্যায় জুলুম বা অত্যাচার করে, নিজের নাম প্রকাশের জন্য কূট-তর্কে অবতীর্ণ হয়, নিজের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য জনমত তৈরির চেষ্টা করে তবে তারা আল্লাহ্র চোখে নিন্দনীয়। আল্লাহ্ সবকিছুই জানেন।
রুকু - ২৭
২৩৭। পবিত্র মাস দেখুন [২:১৯৪] ও টিকা ২০৯।
২৩৮। রাসূল (সাঃ) এর কয়েকজন সাহাবা কোন এক সফরে ঘটনাচক্রে কাফিরদের সাথে একটি খণ্ডযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সে যুদ্ধে একজন কাফির নিহত হয়। দিনটি ছিল রজব মাসের পহেলা তারিখ। যেহেতু ঘটনাটি নিষিদ্ধ মাসে সংঘটিত হয়েছিল, তাই কাফিররা মুসলমানদের দোষারোপ করতে লাগল যে, মুসলমানেরা নিষিদ্ধ মাসের সম্মান পর্যন্ত করে না। তাতে মুসলমানগণ চিন্তিত হয়ে রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন। এখানে তারই উত্তরে ইরশাদ হচ্ছে উপরের আয়াত। হিজরতের পূর্বে মক্কার সেই দুর্বিসহ দিনগুলিতে নও মুসলমানদের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হতো। তারা এই নির্যাতন দীর্ঘকাল ভোগ করেন যতদিন না আল্লাহ্ তাদের আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার হুকুম দান করেন। তারা নিষিদ্ধ মাসে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তা ছিল তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফলে তারা বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়েছিলেন। শত্রুরা শুধু যে তাদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করে তাদের বিবেককে ক্ষত বিক্ষত করেছিল তাই-ই নয় তারা তাদের উপরে অপমান, অত্যাচারের ঝড় বইয়ে দিয়েছিলো। তারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করতো, মুসলমানদেরকে কাবা ঘর থেকে বের করে দিত, মুসলমানদের নির্বাসনে যেতে বাধ্য করতো ইত্যাদি। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, ফিৎনা বা সন্ত্রাস হত্যার চেয়ে বেশী অপরাধ।
২৩৯। আয়াত [২:১৯১, ১৯৩]-টি, আয়াত [২:২১৭] এরই অনুরূপ। ফিৎনা কথাটির অর্থ করা হয়েছে দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ, শিরক্, কুফর, ধর্মীয় নির্যাতন ইত্যাদি।
২১৯। তারা তোমাকে মদ ২৪০ ও জুয়া ২৪১ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, 'এগুলির মধ্যে রয়েছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য কিছু লাভ। কিন্তু লাভ অপেক্ষা পাপ অনেক বেশী।' তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে কি পরিমাণ তারা [দানে] ব্যয় করবে? বল, 'তোমার প্রয়োজনের পরে যা উদ্বৃত্ত থাকে ২৪২।' এভাবেই আল্লাহ্ তাঁর বিধান সমূহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট রূপে ব্যক্ত করেন-যেনো তোমরা চিন্তা করতে পার;-
২৪০। 'Khamr' শব্দটির অর্থ হচ্ছে 'গাঁজানো'। হতে পারে তা আঙ্গুরের রস বা মদ। যদি একে বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগ করা হয় তবে যে কোনও 'গাঁজানো' পানীয় এর জন্য তা প্রযোজ্য। সাধারণ অর্থে যে কোনও মাদক দ্রব্যের জন্য তা প্রযোজ্য।
২৪১। 'Maisir' শব্দটির অর্থ হচ্ছে পরিশ্রম ব্যতিরেকে খুব সহজে যা লাভ করা যায়, তাই হচ্ছে জুয়া বা Gambling। জাহিলিয়াতের যুগে নানা রকম জুয়ার প্রচলন ছিল। তার মধ্যে এক প্রকার জুয়া ছিল তীরের সাহায্যে ভাগ্য নির্ধারণ করতো। আজকের যুগে যাকে আমরা লটারী নামে অভিহিত করি। উট জবাই করে তার মাংস বন্টন করার সময়ে জুয়ার আশ্রয় নেয়া হতো, কেউ একাধিক অংশ পেতো, আবার কেউ বঞ্চিত হত। যে নীতির উপরে জুয়াকে নিন্দনীয় করা হয়েছে তা হচ্ছে এমন কিছু লাভ করা যা তার প্রাপ্য নয় অথবা সর্বস্ব হারানো। সমস্ত ব্যাপারটি হচ্ছে সম্পূর্ণ লটারী ও 'মায়সারের' অন্তর্ভূক্ত।
২৪২। কারও কোনও জিনিস প্রয়োজনের অতিরিক্ত মজুত করা উচিত নয়। সম্পদ যতটুকু আমাদের প্রয়োজন তা ব্যবহারের অনুমতি আছে কিন্তু বাড়তি সম্পদ জনহিতকর কাজে বা দান-ধ্যানে ব্যয় করবে।
২৪৩। মাদকদ্রব্য ও জুয়া পাপ। এ পাপের জন্য শুধু যে ব্যক্তিগত ক্ষতি হয় তাই নয়, সামাজিক ভাবেও এর ক্ষতি প্রভূত। উপকারের চেয়ে অপকারিতা বেশী। তাই এ সম্বন্ধে আল্লাহ্ আমাদের চিন্তা করতে বলেছেন, ব্যক্তির জীবনে এর প্রভাব, সমাজ জীবনে এর প্রভাব এবং সর্বোপরি আধ্যাত্মিক জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কে।
২৪৪। এতিমদের সম্পত্তি সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থা হচ্ছে তাদের হিসাব নিকাশ সম্পূর্ণ আলাদা রাখা। কোনও অভিভাবক যেনো এতিমের সম্পত্তির সাথে নিজের সম্পত্তি মিশ্রিত না করে ফেলে, যাতে তার মনে এতিমের সম্পত্তি থেকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য লোভ জন্মাতে পারে। এমনকি ব্যক্তিগত লাভের জন্য এতিম মেয়েকে বিয়ে করাও উচিত নয়। অধিকন্তু আয়াত [৬:১৫২]-এ সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, অভিভাবকেরা তাদের সম্পদ এতিমের সম্পদ থেকে আলাদা রাখবে। এতিমের মাল আলাদা করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের সম্পদ যেনো নষ্ট করা না হয়। আর যদি ব্যয় যৌথ রাখলে তাদের মঙ্গল হয়, তবে তাদের মঙ্গলের খেয়াল করা অতি উত্তম। অর্থাৎ এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে এতিমের ক্ষতি হয়। অভিভাবক যদি এমন কিছু করেন যা এতিমের জন্য ক্ষতিকারক কিন্তু আইন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না সেক্ষেত্রে আল্লাহ্কে ভয় করতে বলা হয়েছে।
২৪৫। ইসলামে আল্লাহ্র আইনকে এত কঠোর করা হয় নাই যাতে তা মানুষের কাছে দুরূহ বা ভারী মনে হয়। বরং আল্লাহ্ বারে বারে ক্ষমা প্রদর্শন এবং মানুষের প্রতি তার আস্থা প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ্র চোখে আত্মিক ও চারিত্রিক পরাকাষ্ঠাই হচ্ছে মানুষের সম্মানের চাবিকাঠি। তবু মানুষ বারে বারে এই মাপকাঠি থেকে পদস্খলিত হয়। মানুষের কাছে আল্লাহ্ এই নৈতিক দৃঢ়তা আশা করেন যেনো সে সততার ব্যাপারে [তা এতিমের সম্পত্তিই হোক বা অন্য কারও আমানত হোক] অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও কঠোর হতে পারে। যদি সে তা না হয়, তবে অবশ্যই তাকে আল্লাহ্র শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ছলনা বা কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে সে হয়তো সমাজের চোখে সম্মানীয় হতে পারবে এবং মানুষের সৃষ্ট আইনকে ফাঁকি দিতে সম্ভব হবে। কিন্তু আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, তাঁর শাস্তি অলঙ্ঘনীয়।
২৪৬। 'বিবাহ' হচ্ছে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের চাবিকাঠি। দু'জন ব্যক্তি একই বন্ধনে আবদ্ধ হয় চিন্তায়, কর্মে, প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। বিবাহ সম্পর্ক হচ্ছে একে অপরের সম্পূরক বা ভূষণ স্বরূপ। পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী, পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহের জন্যই এখানে আমাদের আগমণ। পৃথিবীর জীবনকে বলা হয় 'শিক্ষানবীশকাল' (Probationary Period) পরকালের জন্য। এই জীবনের সাফল্যই পরকালের সাফল্য। আর এ সাফল্য হচ্ছে আত্মিক, চারিত্রিক ও নৈতিক উন্নতি। পৃথিবীর এই দুস্তর, দুর্গম পথে আছে নানা প্রলোভন, একে সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সহযোগিতার ভূমিকা পালন করে। বৈবাহিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এত নিবিড় ও একান্ত যে একে অন্যের ভাবধারায় বা চিন্তাধারায় সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ধর্মীয় বা নৈতিক জীবনে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যবধান থাকে তবে তার প্রভাব তাদের জীবনে পড়তে বাধ্য। সুতরাং যারা পরস্পরের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে তাদের ধর্মীয় চেতনা একই প্রকার হওয়া উচিত। যেহেতু বৈবাহিক জীবন পরস্পরের প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস, নির্ভরশীলতা ও একাত্মতার উপর প্রতিষ্ঠিত সেই কারণে ধর্মীয় ও নৈতিক জীবন যদি দু'জনের দু'রকম হয় তবে তাদের মধ্যে মত পার্থক্য থেকে জন্ম নেবে অবিশ্বাস ফলে বৈবাহিক জীবনের অন্যান্য গুণাবলী যথা নির্ভরশীলতা ও একাত্মতা কমে যাবে। ফলশ্রুতিতে বৈবাহিক জীবনের মূল ভিত্তি, ভালবাসার ভিত্তি হয়ে যাবে দুর্বল। যদি দু'জন দু'জনকে ভালবাসে তবে তাদের ধর্মের ভিত্তি এক হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এখানে ধর্মের অর্থ যেনো কেউ ধর্মের লেবেল মনে না করেন। আজকে বাংলাদেশে জন্মসূত্রে মুসলমান লেবেল সর্বস্ব বহু নারী-পুরুষের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব নারী পুরুষের মধ্যে ধর্মের ন্যূনতম মূল্যবোধও অনুপস্থিত। ইসলামের স্বরূপ ও অর্থ হচ্ছে ইসলামের আনুগত্য। এ আনুগত্যের সারমর্ম হলো রিপুর কামনা-বাসনার বিপরীতে আল্লাহ্র নির্দেশের আনুগত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করে হেদায়েতের অনুসরণ। আজকে বাংলাদেশীদের মধ্যে অনেকের ধারণা মসজিদে গমন এবং নামায রোজার মধ্যেই ধর্ম নিহিত। এ কথা বলার কারণ হচ্ছে আজকে আমাদের সমাজের বহু লোক দেখা যায়, যারা নামায রোজার ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী ও সতর্ক। কিন্তু এদের মধ্য ইসলামী মূল্যবোধ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মূল্যবোধ এই অর্থে তারা আল্লাহ্ যে সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা অহরহই করছেন। যেমন-ঘুষ খাচ্ছেন, জনগণের মাল (সরকারী সম্পত্তি) বে-আইনীভাবে ব্যবহার করছেন, জনগণের আমানতের খেয়ানত করছেন, জীবনের প্রতিটি পদে (কথায় ও কাজে) মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করছেন, অন্যকে ঠকাচ্ছেন ইত্যাদি। সুতরাং এদেরকে ইসলামের লেবেল ভূষিত ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। দু'জন লোক ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হতে পারে কিন্তু তাদের মূল্যবোধ যদি একই হয় তবে তারা ধর্মের যে মূল সত্য তা অনুধাবন করতে বাধ্য। কারণ জগতে পয়গম্বরগণ যত ধর্ম এনেছেন, নিজ নিজ সময়ে সে সবই আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। সুতরাং সেসব ধর্মও ছিল ইসলাম যদিও সেগুলি বিভিন্ন নামে অভিহিত হত। যেমন-মুসা (আঃ) এর ধর্ম তথা ইহুদী ধর্ম, ঈসা (আঃ) এর ধর্ম তথা খৃষ্ট ধর্ম ইত্যাদি। এসব ধর্মের স্বরূপ ছিল ইসলাম, যার মর্ম হচ্ছে আল্লাহ্র হুকুমের প্রতি আনুগত্য। যেহেতু স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার করে সেই কারণে তাদের একই ধর্মে একই মূল্যবোধে বিশ্বাসী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। না হলে তাদের মধ্যে বক্তিগত ও সামাজিক কোন্দল হতে বাধ্য। এখানে ধর্ম অর্থ যারা আল্লাহ্র আনুগত্যে বিশ্বাসী এবং অনুসরণকারী।
২৪৭। 'Azan' অর্থ কষ্টকর, অপবিত্র। মওলানা ইউসুফ আলী মেয়েদের রজঃস্রাব সম্বন্ধে এই দুইটি অবস্থার কথাই উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এটা মেয়েদের জন্য কষ্টকর এবং অপবিত্র অবস্থা। কিন্তু বেশীরভাগ অনুবাদক শুধুমাত্র অপবিত্রতার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মহান আল্লাহ্ বলেছেন বিষয়টি মেয়েদের দিক থেকে এবং পুরুষের দিক থেকেও দেখা কর্তব্য। মেয়েরা মাত্রই জানেন এই অবস্থা তাদের জন্য কতটা কষ্টদায়ক, সেটা যাতে পুরুষেরা মনে রাখেন এবং যেহেতু অবস্থাটা হচ্ছে অপবিত্র অবস্থা সে জন্য পবিত্র না হওযা পর্যন্ত সহবাস থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মানুষকে আল্লাহ্ 'সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি' দিয়েছেন যা পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণীকে দান করা হয় নাই। প্রাণীরা চলে তাদের সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, বন্য প্রাণীরা কত সাবধানতায়, কত সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের বড় করে কারণ এই হচ্ছে আল্লাহ্র হুকুম। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে যে সন্তানকে বড় করে, তারপরে একদিন তারা সে সন্তানের কথা ভুলে যায়। কারণ এই হচ্ছে তাদের উপর আল্লাহ্র হুকুম। আবার যখন সন্তান ধারণ করার সময় হয় শুধুমাত্র তখনই তারা জোড়া বাঁধে, সহবাস করে অন্য সময়ে নয়। কারণ এই-ই হচ্ছে তাদের উপর আল্লাহ্র হুকুম। তারা তা কখনও লঙ্ঘন করে না বা করার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয় নাই। মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের আল্লাহ্ সীমিত আকারে 'স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি' দিয়েছেন। ইচ্ছা করলে তারা আল্লাহ্র আইন ভঙ্গ করতে পারে। তাই শুধুমাত্র মানুষকেই এই 'ইচ্ছাশক্তির' ব্যবহার সম্বন্ধে হিসাব দাখিল করতে হবে পরকালে। পৃথিবীর আর কোনও প্রাণীকে তা করতে হবে না। মেয়েদের রজঃস্রাব সম্বন্ধে আল্লাহ্র এই বিধান পুরুষ মেনে চলবে এই আল্লাহ্র বিধান। যেনো কেউ তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অপব্যবহার না করে।
২৪৮। 'Haithu' এই সংক্ষিপ্ত শব্দটির অর্থ আচরণ, সময় এবং স্থানকে নির্দেশ করা হচ্ছে। সহবাসের ব্যাপারে নৈতিকতা, আচরণ, সময় এবং স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য আল্লাহ্ আমাদের জন্য সামাজিক এবং নৈতিক নীতিমালা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। যা স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির উপরে নির্ভরশীল এবং মহানবী (সাঃ) এর জীবনধারা থেকে আমরা যার অনুপ্রেরণা পাই। আল্লাহ্ পবিত্রতা ভালবাসেন। এই পবিত্রতার শুরু প্রথমতঃ শারীরিক পবিত্রতা থেকে যা শরীরকে পরিশুদ্ধ করে, স্বাস্থ্যকে সমৃদ্ধ করে সর্বোপরি আত্মিক উন্নতিতে সহায়ক হয়। পবিত্রতা হতে হবে শারীরিক, খাদ্য, মানসিক এবং আত্মিক।
২৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে যৌনজীবন অত্যন্ত পবিত্র। এই জীবন সম্বন্ধে লজ্জিত হওয়ারও কিছু নাই বা একে হালকাভাবে গ্রহণ করা উচিত নয় বা এ নিয়ে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করারও প্রয়োজন নাই। মানব জীবন চক্রের এ এক অপরিহার্য অংশ। এই জীবনকে আল্লাহ্ এভাবে বর্ণনা করেছেন স্ত্রীরা হচ্ছে শস্য ক্ষেত্র স্বরূপ। স্বামীরা সেই শস্য ক্ষেত্রে বীজ বপন (শুক্র) করবে এবং ফসল ঘরে তুলবে, এখানে সন্তান তার ফসলস্বরূপ। সুতরাং স্বীয় জমি যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। অর্থাৎ কৃষিকাজে যেমন জমি চাষ করা এবং ফসল বোনার নির্দিষ্ট সময় ও নিয়ম আছে; সেইরূপ আল্লাহ্ মানুষকে বলেছেন তার সময়, সুযোগ ও ইচ্ছা অনুযায়ী তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হবে। সে এমনভাবে তার ফসল বুনবে না যাতে তার জমির ক্ষতি হয় বা তার ফসল পরিপক্কতা লাভ করতে না পারে। এই উক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অল্প বয়সে ঘন ঘন সন্তান ধারণের ফলে বহু নারীই অকালে বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং ফলে স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। স্ত্রীকে বলা হচ্ছে 'ফসলের জমি' যা আল্লাহ্ তাকে ইচ্ছা বা বিবেক অনুযায়ী কর্ষণ করার অনুমতি দিয়েছেন, তার অপব্যবহার না করতে বলা হয়েছে। যেনো 'ভূমি' অর্থাৎ স্ত্রীর কোনও ক্ষতি না হয়। শুধু যে স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় তাই নয় ঘন ঘন সন্তান জন্মের ফলে তারা উপযুক্ত যত্ন পায় না, ফলে ভগ্ন স্বাস্থ্য এবং যত্নের অভাবে দেশের উপযুক্ত নাগরিকরূপে গড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং ভুল কর্ষণ ও ভুল বপনের ফলে শুধু যে জমিরই ক্ষতি হয় তাই নয় উপযুক্ত পরিপুষ্ঠ ফসল লাভ থেকেও জমির মালিক বঞ্চিত হয়। এখানে ইচ্ছামত কর্ষণ করার অর্থ এই যে, স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে সহানুভূতি সম্পন্ন হবে এবং নিজের বিবেক ও বুদ্ধির ব্যবহার করবে। নিজের বিবেক ও বুদ্ধির ব্যবহারকেই আল্লাহ্ বলেছেন 'তোমাদের শস্য ক্ষেত্রে যখন যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পার'। অর্থাৎ বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হলো। বৈবাহিক সম্পর্ক শুধুমাত্র ভোগ-উপভোগের জন্য নয়। সুন্দর শান্তিপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, সৎ সন্তানের জন্ম দেওয়া ও তাদের সুষ্ঠু লালন পালন এর অত্যতম উদ্দেশ্য।
[অনুবাদকের মন্তব্যঃ এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, সঙ্গতি না থাকলে অধিক সন্তানের জন্ম না দেওয়াই উচিত। সে হিসেবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বৈধ হওয়া উচিত।]
খৃষ্টান ধর্মে যেমন সংসার ধর্ম পালনকে পাপ বলে মনে করে এবং চিরকুমার থাকাকে ধার্মিকতার মাপকাঠি গণনা করে, ইসলাম ধর্ম এই মতবাদে বিশ্বাস করে না।(অস্বাভাবিক জীবনযাপন মানসিক ভারসাম্যতা নষ্ট করে) ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতার আসন সর্বোচ্চ এবং বিবাহের ফসল প্রতিটি সন্তানই হচ্ছে পবিত্র।
২৫০। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য পরকালে মহান আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ। যারা বিশ্বাসী, ঈমানদার, তাদের জন্য আল্লাহ্ তার সান্নিধ্যের আশ্বাস দিয়েছেন। এর থেকে বড় সুসংবাদ পরহেজগারদের জন্য আর কিছুই নাই। পৃথিবীর সব চাওয়া পাওয়া, লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ থেকে মুক্তি লাভ করার ফলে আত্মা সেই ক্ষমতা লাভ করে, যে ক্ষমতার ফলে সে মহান আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করবে। পরহেজগার ব্যক্তিরা সেই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন যখন তাদের আত্মা পরম আত্মার সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাবে। যারা পাপী তারা এই দিনটিকে ভয় পাবে। এই আয়াতটির সৌন্দর্য্য হচ্ছে মানব জীবনের ইন্দ্রিয়গত দিগটিকেও মহিমান্বিত করা হয়েছে, যুক্ত করা হয়েছে আত্মিক উন্নতির সোপান স্বরূপ।
২৫১। কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব সমাজে বহুবিধ নিয়মনীতি চালু ছিল যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। সে সময়ে আরবদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার শপথ বাক্য চালু ছিল যা তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় ব্যবহার করতো। এর মধ্যে কিছু ছিল দাম্পত্য জীবন সম্পর্কিত। তারা শপথ বাক্য উচ্চারণ করতো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, ভুল বোঝাবুঝি বা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে। এই আয়াত ও পরবর্তী তিন আয়াতে এদের সম্পর্কেই বলা হয়েছে। আয়াতে [২:২২৪] এর বক্তব্য সার্বজনীন; বলা হয়েছে সাধারণ লোকদের সম্পর্কে যারা আল্লাহ্র নামে শপথ করে সৎকর্ম, আত্মসংযম ও মানুষের মাঝে শান্তি স্থাপন থেকে বিরত থাকে। যদি এই সংকল্প হয়ে শুধুমাত্র রাগের বশে এবং তা যদি অন্তরের কথা না হয়, তবে আল্লাহ্র আশ্বাস, তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি সব শোনেন, সব জানেন। তিনি তো চান বান্দার অন্তরের সঠিক আচরণ। বান্দার আচরণে অবাধ্যতা ও বাকচাতুর্য্য, ছলনা, আল্লাহ্র কাম্য নয়।
২৫২। এখানে বলা হয়েছে, যে শপথের পিছনে কোন উদ্দেশ্য নাই; রাগ, অভিমান বা আবেগ দ্বারা পরিচালিত কোনও শপথের জন্য আল্লাহ্ বান্দাকে দায়ী করবেন না। আল্লাহ্ বান্দাকে তার নিয়ত দ্বারা বিচার করবেন। যদি শপথ হয় তার অন্তরের ইচ্ছা তবেই আল্লাহ্র কাছে তা বিচার্য্য। উদ্দেশ্যবিহীন শপথের জন্য প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ কিছু দান করা প্রয়োজন।
২২৭। কিন্তু যদি তারা তালাকের ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব সম্পন্ন হয়, তবে আল্লাহ্ সব শোনেন এবং সব জানেন ২৫৩।
২৫৩। আয়াত [২:২২৫, ২২৬, ২২৭] তিনটি আয়াত [২:২২৪] এর সাথে এক সঙ্গে পাঠ করা প্রয়োজন। যদিও আয়াত [২:২২৪] এর বক্তব্য সার্বজনীন তবুও এর সাথে পরের তিনটি আয়াতকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে।
সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে আরবেরা মেয়েদের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করতো। এর একটা অন্যতম উপায় ছিল বিয়ের মাধ্যমে, যা ইসলাম রহিত করে। ইসলাম পূর্ব আরবের লোকেরা রাগের বশে বা খেয়াল খুশীমত আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলতো যে তারা তাদের স্ত্রীদের নিকট গমন করবে না। এর ফলে মহিলাদের কোনও দাম্পত্য জীবন থাকতো না, কিন্তু তাকে অন্য কোথাও বিয়ে করার অধিকারও দেওয়া হতো না। ফলে মেয়েটির জীবন নষ্ট হয়ে যেতো। এর কেউ প্রতিবাদ করলে বলা হতো যে এটা আল্লাহ্র নামে শপথ। সুতরাং এটা মানতে বাধ্য। ইসলামের বিধান হচ্ছে যদি ঐ শপথ ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বা হঠাৎ খেয়ালের বশে করা হয়, কিন্তু সত্যিকারের নিয়ত না হয়; তবে সেই উদ্দেশ্যবিহীন শপথের কোনও মূল্য নাই আল্লাহ্র কাছে। উদ্দেশ্য বিহীন শপথের জন্য কোনও মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া ইসলাম অনুমোদন করে না। শপথ হতে হবে আন্তরিক যা সে সত্যিকারভাবে করতে চায় বা বিশ্বাস করে। আল্লাহ্ বিচার করবেন নিয়ত দ্বারা, চিন্তাবিহীন, উদ্দেশ্যবিহীন শপথ দ্বারা নয়। যদি কেউ সত্যিকারভাবে স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছেদ করতে চায়, তবে ইসলামের মতে তাকে চার মাস কাল অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে যদি তারা পরস্পর মিলিত হতে চায় তবে তা গ্রহণযোগ্য। চার মাস অপেক্ষার পরেও যদি মতের পরিবর্তন না হয় তবে তা তালাক হয়ে যাবে।
আমাদের দেশে গ্রামে কোথাও কোথাও এখনও রাগের বশবর্তী হয়ে তালাক উচ্চারণ করলেই মোল্লাদের বিচারে তা তালাক হয়ে যায়। স্বামী বা স্ত্রীকে এই চার মাসের সুযোগ দেওয়া হয় না বা আল্লাহ্ বলেছেন উদ্দেশ্য বিহীন নিয়তহীন অন্তরের শপথ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয় আয়াত [২:২২৪] কোরআনের এই আদেশকে তারা লঙ্ঘন করে ধর্মের নামে।
২৫৪। ইসলামের চোখে 'তালাক' ঘৃণ্য। ইসলাম চেষ্টা করে যতদূর সম্ভব বিবাহ বন্ধনকে অটুট রাখতে। কারণ বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সন্তানেরা। তাই ইসলামের চোখে তালাক কাম্য নয়। ইসলাম হচ্ছে সাম্যের ধর্ম। নারী-পুরুষের সমতায় ইসলাম বিশ্বাসী। তাই দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কের যদি চির ধরে, যদি দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ভালবাসার অভাব, অপমান, হীনমন্যতা প্রবেশ করে তবে তালাকের ব্যাপারে নারী-পুরুষের সম-অধিকার 'নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন আছে তাহাদের উপর পুরুষদের।' কিন্তু এই ব্যাপারটি যাতে আবেগ তাড়িত না হয়ে যায়, তাড়াহুড়ো না হয় সেজন্য সমঝোতার দ্বার উন্মুক্ত রাখা হয়েছে অনেক ভাবে। আয়াতে [২:২২৮] বলা হয়েছে এবং [২:২২৬, ২২৭] আয়াতে বলা হয়েছে তালাক হয়ে যাওয়ার পরও মহিলাদের জন্য রয়েছে তিনমাস 'ইদ্দত কাল'। এই ইদ্দত কাল স্বামী-স্ত্রীর যদি সমঝোতা হয় তবে বিবাহ বন্ধন অটুট থাকে।
এই আয়াতের বৈশিষ্ট্য এই যে, এই আয়াতে নারী-পুরুষের সম-অধিকারের কথাটি পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যারা বলে ইসলামে নারী ও পুরুষের সম-অধিকার নাই তাদের জন্য এই আয়াতটি একটি প্রামাণ্য দলিল।
২৫৫। 'কিন্তু নারীদের উপর পুরুষদের কিছুটা প্রাধান্য আছে' সমাজের পুরুষ, পরিবার পরিজনদের রুটি-রুজীর অর্জনের জন্য দাবীদার। আরবের সেই অন্ধকারময় যুগে যখন নারীদের পণ্য হিসেবে গণ্য করা হতো, তখন ইসলাম নারীদের জন্য সম-অধিকারের দলিল নিয়ে আবির্ভূত হয়। সে যুগে মেয়েরা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন ছিল না। যেহেতু পুরুষ পরিবারের ভরণ-পোষণ, অর্থ উপার্জনের জন্য দায়ী সেই কারণে পুরুষদের মেয়েদের অপেক্ষা সামান্য অধিক মর্যাদা দান করা হয়েছে। আয়াত [৪:৩৪] এ এই কথাই বলা হয়েছে যে, পুরুষ তার পরিবারের জন্য ধন-সম্পদ ব্যয় করে সেই কারণে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। অন্যথায় আধ্যাত্মিক জীবনে ও দাম্পত্য জীবনে পুরুষ নারীর অধিকার সমান।
[অনুবাদকের মন্তব্যঃ আজকের যুগে নারীরা যেখানে সমভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে সেখানে মর্যাদার দিক থেকে নারীরা পুরুষের সমকক্ষ। কারণ আল্লাহ্ অর্থনৈতিক কারণেই পুরুষদের মেয়েদের থেকে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন করেছেন। আধ্যাত্মিক কারণে নয়। আধ্যাত্মিক জগতে পাপ-পূণ্যের হিসাব নিকাশের ক্ষেত্রে পরকালে আল্লাহ্র পুরস্কার ও শাস্তির ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীকে সমভাবে বিচার করা হবে। যার যার কর্মফল অনুযায়ী তাকে পুরস্কৃত ও শাস্তি দান করা হবে। যে মর্যাদা সম্পন্ন তার পুরস্কার বেশি ও শাস্তি কম, পরকালের জন্য এই বিধান নাই। আয়াত [৩:১৯৫] এ বলা হয়েছে, 'কখনোই আমি তোমাদের কোনও একজনের কাজকেও বিনষ্ট হতে দেব না, তা সে নারীই হোক আর পুরুষই হোক। তোমরা তো সমগোত্রীয় লোক।' আবার আয়াত [৯:৭১] এ বলা হয়েছে 'মুমিন নারী ও পুরুষেরা একে অপরের সংরক্ষক ও সাহায্যকারী, তারা ন্যায়ের আদেশ করে ও অন্যায়ের বাধা প্রদান করে। তারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূরের আনুগত্য করে। তাদেরই উপর আল্লাহ্ রহমত বর্ষণ করবেন। আর আল্লাহ্তো ক্ষমতা ও প্রজ্ঞায় এক সত্ত্বা।' সুতরাং ইসলামের নারীর সম অধিকার স্বীকৃত। যে মর্যাদার জন্য পুরুষ দাবীদার তা হচ্ছে তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশীদার এবং শারীরিক দিক থেকেও তারা শক্তিশালী। সুতরাং আজকের বিংশ শতাব্দীতে মেয়েরা যেখানে সমভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশীদার সেখানে মর্যাদার প্রশ্নটি নূতনভাবে মূল্যায়নের দাবীদার বৈকি। কারণ ইসলাম নারী ও পুরুষের সম-অধিকারে বিশ্বাসী। ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানেরা দৈহিক, আধ্যাত্মিক ও মানসিকভাবে কেউ কারো তুলনায় নিকৃষ্টতর নয়; যদিও কোন কোন বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে একজন নারী বা পুরুষের কিছু কিছু দক্ষতা বা দূর্বলতা থাকতে পারে। কিন্তু মুসলমান হিসাবে ইসলামী সংগ্রামে তারা সমান অংশীদার।]
২৫৬। যদি স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য এমন পর্যায়ে পরিণত হয় যে একসাথে বসবাস করা অসম্ভব সেক্ষেত্রে তালাক বা বিচ্ছেদ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় আবেগ তাড়িত হয়ে বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে, স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেলো কিন্তু পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়ে আবার একত্রে তারা সংসার ধর্ম পালন করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। এরকম ক্ষেত্রে দুবার এরকম করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে হঠকারিতার মাধ্যমে যেনো কোন বিবাহ বিচ্ছেদ না হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ হচ্ছে একটি পবিত্র অঙ্গীকার। সুতরাং বিবাহ-বিচ্ছেদ যাতে হঠকারিতা বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে না হয় সেই কারণেই এত সাবধানতা। দুবার আলাদা থাকা এবং পুনরায় মিলনের পরে অবশ্যই দুপক্ষ ন্যায় সঙ্গত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হবে যে, তাদের পক্ষে এক সঙ্গে থাকা সম্ভব কি না। তৃতীয় বারে তারা অবশ্যই মনস্থির করবে হয় তারা সম্মানজনকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ করবে নয়তো এক সাথে সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করবে। তালাক প্রত্যাহারের অধিকার শুধু এক বা দুই তালাক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, যাতে কোন অত্যাচারী স্বামী এমন করতে না পারে যে, কথায় কথায় তালাক দেবে এবং তা প্রত্যাহার করে পুনরায় স্বীয় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখবে। দুই তালাকের মধ্যে শর্ত রাখা হেয়ছে যে এতে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায় না বরং ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তালাক প্রত্যাহার করে স্ত্রীকে স্বীয় বিবাহ বন্ধনে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা স্বামীর থাকে। বস্তুতঃ ইদ্দত শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত যদি তালাক প্রত্যাহার করা না হয়, তবেই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়। এই দুই তালাক হতে হবে পৃথক পৃথকভাবে, সময়ের ব্যবধানে।
২৫৭। যদি বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাক অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তবে ইসলামের বিধান হচ্ছে তা যেনো কাদা ছোঁড়াছুড়ির পর্যায়ে চলে না যায়। বিচ্ছেদ হবে সম্মানজনকভাবে, পরস্পরের সমঝোতার মাধ্যমে। ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম শর্ত হচ্ছে স্ত্রীকে দেয়া উপহার সামগ্রী ও দেন মোহরানা বা সম্পত্তি যা সে তার স্ত্রীকে দান করেছিল তা সে ফেরত নিতে পারবে না। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে রক্ষা করার এই সনদ একমাত্র ইসলামই দেয়।
[অনুবাদকের মন্তব্যঃ আজকের বাংলাদেশে ৫০% উপরে জনসংখ্যা দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অত্যন্ত বেশী। এদের পুরুষেরা বিবাহের সময়ে যৌতুক গ্রহণ করে যা ইসলাম বিরোধী এবং বিচ্ছেদের সময়ে সন্তানসহ স্ত্রীদের ত্যাগ করে এবং কোন রকম মোহরানা শোধ করা ব্যতীত তারা এই কাজ করে। এরা সমাজে নিন্দনীয় নয়। এও কুরআনের হুকুমের বরখেলাপ বা ইসলামের দৃষ্টিতে বেআইনী। যেখানে ইসলাম নারীদের অধিকার রক্ষায় এত সচেতন, সেখানে কুরআনের আইন বহির্ভূতভাবে নারীদের তাদের মোহরানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।]
২৫৮। তালাক সম্পর্কে যত আইন-কানুন করা হয়েছে তা দু'পক্ষেরই মঙ্গলের জন্য যাতে তারা সমাজে সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে। তালাক হচ্ছে একটি পবিত্র বন্ধনকে ছিন্ন করা। আর সৎ লোকের কর্ম পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, কোন কাজ বা চুক্তি হলে তারা উত্তম পন্থায় করে থাকেন। এমনিভাবে যদি বিবাহ-বন্ধনও ছিন্ন করার পর্যায়ে এসে যায় তবে তা রাগান্বিত হয়ে বা ঝগড়া-বিবাদের মাধ্যমে করা উচিত নয়। ন্যায় ও ভদ্রতার সাথেই তা করা উচিত। এই-ই হচ্ছে ইসলামের বিধান। এই আয়াতে স্ত্রী জাতিকেও এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। স্বামীর যুলুম অত্যাচার হতে আত্মরক্ষা করার ব্যবস্থা তাদের জন্যও রয়েছে। তারা কাজীর দরবারে নিজেদের অসুবিধার বিষয় উপস্থাপন করে স্বামীর দোষ প্রমাণ করে বিবাহ-বিচ্ছেদ করিয়ে নিতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে বিচারকের সিন্ধান্ত অনুযায়ী স্বামী স্ত্রীর নিকট থেকে আর্থিক সুবিধা পেতে পারে [দেনমোহরানা মাপ করে দেওয়া] এরকম তালাককে 'খুলা' তালাক বলে।
২৫৯। 'জুলুম' করে [নিজেদের প্রতি এবং অন্যদের প্রতি]। 'জালিমুন' এর মূল অর্থের জন্য দেখুন সূরা ২, আয়াত ৩৫, টিকা ৫১।
২৬০। এই আয়াতটিকে পূর্ববর্তী আয়াতের অংশ হিসেবে ধরা যেতে পারে। পূর্ববর্তী আয়াতের [২:২২৯] প্রথম বাক্যে বলা হয়েছে দুই তালাকের পর পুনঃর্মিলন সম্ভব, কিন্তু তিন তালাকের পরে তা আর সম্ভব নয়। যদি তিন তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে কেউ আবার ফিরে পেতে চায় তবে সেই স্ত্রীর অন্য লোকের সাথে বিবাহ হতে হবে। সেই লোক তালাক দিলেই তবে প্রথম স্বামী আবার তাকে পুনঃর্বিবাহ করতে পারবে। এখানে আল্লাহ্ আমাদের এই উপদেশ দিচ্ছেন যে বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। একে সব সময়ে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বা আবেগ দ্বারা অন্ধ হয়ে বা হঠকারিতার দ্বারা বার বার এ কাজ করার সুযোগ থাকলে বিয়ের পবিত্রতা ও গাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে ছেলে খেলাতে পরিণত হবে। এই বাধা বা শাস্তি দ্বারা পুরুষদের আত্মসংযম করতে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যেন 'তালাক' দেয়াকে তারা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে পারে।
২৬১। যদি কোন লোক দুই তালাকের পরে স্ত্রীকে ফিরে পেতে চায় তবে তা সে করতে পারে শর্ত সাপেক্ষে, যেনো অত্যাচার করার জন্য তাদের ফেরত নেয়া না হয়। স্ত্রীকে ফেরত নেওয়ার প্রধান শর্ত হবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ন্যায় ও সমতার ভিত্তি, সম্মানের ভিত্তি যেনো স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করতে পারে। এই আয়াতে দুইটি শর্ত সাপেক্ষে চুক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। (১) যখন তোমরা স্ত্রীকে তালাক দাও; (২) তাহারা ইদ্দত পূর্তীর নিকটবর্তী হয়; এই দুই শর্তের সাথে আর দুটো অংশ যোগ করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে, (৩) যথাবিধি বা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের ফিরিয়ে নেবে বা (৪) বিধিমত বা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের মুক্ত করবে। প্রথম (১) শর্তটি যুক্ত হয়েছে তিন (৩) নম্বরের সাথে এবং দুই (২) নম্বর শর্তটি যোগ হয়েছে চার (৪) নম্বরের সাথে। অর্থাৎ স্বামী যদি পুনরায় স্ত্রীকে গ্রহণ করতে চায় তবে ইদ্দত কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নাই আর যদি তা না হয় তবে ইদ্দত কাল পূর্ণ হওয়ার পর স্ত্রীগণের পুনরায় বিবাহ করায় কোনও বাধা নাই।
২৬২। পুরুষকে তালাক দেবার অধিকার দিয়ে আল্লাহ্ তাকে অধিক মর্যাদাবান করেছেন। কিন্তু তাকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে সে যেনো এর অমর্যাদা না করে। যদি সে দুর্বল নারীকে অত্যাচার করার জন্য এই অধিকারের অপপ্রয়োগ করে, তবে তার নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী ধ্বংস হতে বাধ্য।
২৬৩। কখনও কখনও দাম্পত্য সম্পর্ককে অনেকে হাল্কাভাবে গ্রহণ করে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে এই সম্পর্কই হচ্ছে একটি সমাজের মৌলিক উপাদান। এই সম্পর্কে ফাটল ধরলে সংসারে অশান্তি নেমে আসে, স্বামী-স্ত্রীর মানসিক যন্ত্রণা ব্যতীতও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সন্তান-সন্ততিরা। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। এদের নিরাপত্তা, সুখ-শান্তি বিঘ্নিত হলে পরবর্তীতে এরা সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন ও বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। ফলে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা হবে বিঘ্নিত। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাশ্চাত্য সমাজ। সেখানে যে সব শিশু ভগ্ন পরিবার থেকে আগত তাদের মানসিক বিকৃতি সমাজবিদদের চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন করে। উচ্ছৃঙ্খল সমাজ কোনও দিন শান্তি পেতে পারে না।
২৬৪। 'জিকির'-[এ শব্দটির অর্থ দেখুন ২:২৫১ এবং টিকা ১৫৬] জিকির করার অর্থ এই নয় যে সশব্দে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করতে হবে, জিকিরের অর্থ হচ্ছে সমস্ত হৃদয় মন জুড়ে আল্লাহ্র নাম অনুরণিত হতে থাকবে, তা সশব্দে হতে পারে নিঃশব্দেও হতে পারে। এই নাম স্মরণ শুধু শব্দ উচ্চারণেই শেষ হবে না, আল্লাহ্কে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে, আল্লাহ্র নেয়ামতের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ হতে হবে। অর্থাৎ এ শব্দটির গূঢ় অর্থ হচ্ছে সর্ব সত্তায়, সর্বান্তকরণে, আল্লাহ্র চিন্তা, আল্লাহ্র ধ্যান করা এবং অন্তরে তার সান্নিধ্য অনুভব করা যার প্রকাশ ঘটবে কয়েকটি শব্দ দ্বারা। অন্যথায় শুধু মৌখিক 'জিকির' জিকিরের সম-মর্যাদা সম্পন্ন নয়।
রুকু - ৩০
২৬৫। বিবাহ বিচ্ছেদ ইসলামের চোখে অত্যন্ত ঘৃণ্য ব্যাপার। কারণ দাম্পত্য জীবন হচ্ছে সমাজের মূলভিত্তি। এই ভিত্তি দুর্বল হলে পুরো সমাজটাই দুর্বল হয়ে যাবে। সুতরাং বিবাহের বন্ধনকে বহাল রাখার ব্যাপারে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অত্যন্ত যত্নশীল। কিন্তু তাই বলে এমন কথা বলে না যে, স্নেহ, মায়া, ভালবাসা ও সম্মান ছাড়া যে বৈবাহিক জীবন তা যাপন করতেই হবে। তবে ভালবাসা ও সম্মানের উপর ভিত্তি করে যদি সমঝোতা হয় তবে সে বিয়ে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ইসলাম ধর্মে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। রাসূলের জীবনকালে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই আয়াত নাজেল হয়। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে পুনঃর্বিবাহে বাঁধা দেওয়া হারাম।
২৬৬। এ আয়াতে স্তন্যদান সম্পর্কিত নির্দেশাবলী বর্ণিত হয়েছে। এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আয়াতে তালাক সংক্রান্ত আদেশাবলীর আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে শিশুকে স্তন্যদান সংক্রান্ত আলোচনা এজন্য করা হয়েছে যে, সাধারণতঃ তালাকের পর শিশুর লালন-পালন ও দুধ পান নিয়ে বিবাদের সৃষ্টি হয়। কাজেই এই আয়াতে এমন ন্যায়সঙ্গত নিয়ম বাত্লে দেওয়া হয়েছে যা স্ত্রী পুরুষ উভয়ের জন্যই সহজ ও যুক্তিযুক্ত। এই আয়াতে স্তন্যদান সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা সার্বজনীন। অর্থাৎ শিশুদের স্তন্যদান মায়ের উপর ওয়াজিব, বিবাহ বন্ধনে থাকা বা তালাক অবস্থায়। স্তন্যদানের পূর্ণ সময় দুই বছর। নিয়ম অনুযায়ী এ সময়ে মাতার খাওয়া-পরা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা সন্তানের পিতার দায়িত্ব। আল্লাহ্ কাকেও কারও সামর্থের উর্ধ্বে কোন আদেশ দান করেন না। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় এ ব্যাপারে কোনও ঝগড়া ফ্যাসাদের অবকাশ নাই। কারণ বিবাহিত স্ত্রীর ভরণ পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। কিন্তু তালাক প্রাপ্ত অবস্থায় যাতে এ ব্যাপারে কোনও পক্ষের উপর কোন জুলুম না হয় সে জন্য এ নির্দেশ।
২৬৭। বিধবাদের জন্য ইদ্দত কাল ৪ মাস ১০ দিন। বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ইদ্দত কাল ৩ মাস এবং বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে কিন্তু কুমারী তার ইদ্দত কালের প্রয়োজন নাই [৩৩:৪৯] আয়াত।
২৬৮। বিধবাদের ইদ্দত পালন করা অবস্থায় বিবাহ নিষেধ করা হয়েছে। এমন কি এ ব্যাপারে গোপনে কোনও অঙ্গীকার করাও জায়েয নয়। এর কারণ এই যে ঐ শোকাবস্থায় নারীরা ভাল-মন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অনিশ্চয়তা এবং শোক তাদের এত অভিভূত করে যে এ সময়ে তাদের বিচার বুদ্ধি স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকারই কথা। সুতরাং সেই অবস্থায় বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সে ভুল করে। এ জন্যই এই নিয়ম। কিন্তু কেউ যদি প্রস্তাব দেয় বিবেচনার করার জন্য তবে তা জায়েজ।
রুকু - ৩১
২৩৭। যদি তোমরা [স্ত্রীদের] স্পর্শ করা পূর্বে তালাক দাও অথচ মোহর ধার্য করা হয়েছে [সেক্ষেত্রে স্ত্রীরা] অর্ধেক মোহর পাবে যদি সে তা মাফ করে না দেয় অথবা সে [স্বামী], যার হাতে বিবাহ বন্ধন রয়েছে ২৬৯, [স্বামীর অর্ধেক প্রাপ্য] মাফ করে দিলে [সেক্ষেত্রে স্বামী] স্ত্রীকে পূর্ণ মোহর দেবে ২৭০। [স্বামীর প্রাপ্য অর্ধেক] মাফ করে দেওয়াই হচ্ছে পুণ্যাত্মার নিকটবর্তী কাজ। এবং নিজেদের মধ্যে বদান্যতার কথা ভুলে যেও না। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ্ তা সব দেখেন।
২৬৯। স্ত্রী গমণের পূর্বে যদি তালাক অনুষ্ঠিত হয়, এর দুটি দিক আছে। যে বিয়ের মোহর নির্ধারিত করা হয় নাই কিংবা মোহর নির্ধারিত হয়ে থাকবে। প্রথম অবস্থায় তোমার উপর মোহরের দায়িত্ব আছে বলে মনে করো না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তির সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীকে উপঢৌকন দেওয়া উচিত।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মোহরের অর্ধেক শোধ করতে হবে। কিন্তু স্ত্রী ইচ্ছা করলে তার অংশ মাফ করে দিতে পারে অথবা স্বামী তার প্রাপ্য অংশ মাফ করে দিতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে স্ত্রী পূর্ণ মোহর পাবে। যদি সে বদান্যতার প্রেক্ষিতে অর্ধেক না নেয়, তবে তাও ক্ষমার পর্যায়ে পড়ে এবং ক্ষমা করাকে উত্তম ও তাকওয়ার পক্ষে অনুকূলে বলা হয়েছে।
২৭০। এই অবস্থায় নির্ধারিত মোহরের অর্ধেক দেওয়াই বিধেয়। 'যাহার হাতে বিবাহ বন্ধন রয়েছে'-কথাটির অর্থ স্বামীর হাতে [হানাফী মত অনুসারে] বিবাহ বন্ধন ন্যস্ত। কারণ তালাক দেওয়ার ক্ষমতাও তার হাতে। সুতরাং মোহরের অর্ধেক যেটা তার প্রাপ্য সেটাও ইচ্ছা করলে সে মাফ করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে স্ত্রী পূর্ণ মোহর পাবে।
২৭১। আগে ও পরে সালাত সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে নামাজের হুকুম বর্ণনা করার ইঙ্গিত করে যে, আল্লাহ্র আনুগত্যই হচ্ছে প্রকৃত উদ্দেশ্য। সামাজিকতা ও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের দ্বারা অন্যান্য কল্যাণ লাভ ছাড়াও সেই লক্ষ্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন একটা স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য। এখানে সর্ব প্রকার সালাতের বিশেষত আসরের সালাতের প্রতি যত্নবান হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াতে বলা হয়েছে।
২৭২। আয়াত ২৩৮-২৩৯ সমজাতীয়, দুটিই বিপদের সময় আল্লাহ্কে স্মরণ করার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। ৪:১০১-১০৩ এ এটি আরো বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত হয়েছে।
২৭৩। এখানে বিভিন্ন তফসীরকারদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে। অনেকের মতে [৪:১২] দ্বারা বিধবাকে সম্পত্তির অংশ প্রদান করা হয় উত্তরাধিকারী সূত্রে। সুতরাং বিধবার এক বছরের ভরণ পোষণের যে আয়াতটি এখানে নাজিল হয়েছিল তা উক্ত আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে গেলো। কিন্তু মওলানা ইউসুফ আলী তা মনে করেন না। উক্ত আয়াতটি সম্পত্তির ব্যাপারে প্রযোজ্য। কিন্তু বিধবা যদি ইচ্ছা করে এক বছরের পূর্বেই স্বামী গৃহ ত্যাগ করতে পারে। সেক্ষেত্রে তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায়।
২৪২। এভাবেই আল্লাহ্ তাঁর বিধান সমূহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট করেছেনে যেনো তোমরা বুঝতে পার।
রুকু - ৩২
২৭৪। এই আয়াতে আমরা আবার জিহাদের কথায় ফিরে এলাম যা পূর্বে [২:২১৪-২১৬] বর্ণনা করা হয়েছে। জিহাদ সম্পর্কে আমাদের কোনও রকম ভ্রান্ত ধারণা থাকা উচিত নয়। একথা সর্বদা বিশ্বাস রাখা কর্তব্য যে জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্। যদি আমরা আমাদের ঈমান বা বিশ্বাসের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত না থাকি; যদি আমরা আমাদের বিশ্বাসের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য আমাদের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি, সহায়-সম্বল, আমাদের সর্ব প্রচেষ্টা নিয়োগ না করি, তবে অচিরেই আমাদের সযত্নে রক্ষিত অর্থ-সম্পদ, সহায়-সম্বল শত্রু কবলিত হয়ে যাবে। জীবন ও মৃত্যুর মালিক আল্লাহ্। ভীতুরা মনে করে সযত্নে রক্ষা করায় তারা হয়তো মৃত্যুকে এড়াতে সক্ষম হবে, কিম্বা শত্রুর কাছে আত্ম নিবেদন করে নিজেকে এবং অর্থ সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ইতিহাসই এর প্রমাণ বহন করে। যারা মৃত্যুকে বা ক্ষতিকে এড়ানোর জন্য ধর্ম যুদ্ধকে পরিহার করে এবং শত্রুর কাছে ভীতুর ন্যায় আত্মসমর্পন করে, তারা এর কোনটা থেকেই রেহাই পায় না। সংখ্যায় অধিক থাকলেও তাদের ভাগ্যে থাকে অপমানজনক মৃত্যু। এই উপদেশটি সর্বকালের এবং সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। অবশ্য কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজেল হয় তফসীরকারদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু এর যে উপদেশ বা শিক্ষা তা সার্বজনীন।
২৭৫। এই আয়াতে পূর্বের আয়াতের বক্তব্যকে সমর্থন করা হচ্ছে। জেহাদ করতে হবে আল্লাহ্র আইনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যে যুদ্ধ স্বার্থ বা লোভের জন্য সংগঠিত হয় তা জেহাদ বা আল্লাহ্র জন্য যুদ্ধ নয়। আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। অর্থাৎ আমাদের সব কাজ, সব কথা, চিন্তা-ভাবনা, নিয়ত সবকিছু আমাদের থেকে আল্লাহ্ই বেশী জানেন। আমরা আমাদের অন্তরের গোপন চিন্তা-ভাবনা বা ইচ্ছা মানুষের কাছে গোপন করতে পারি। আমাদের পাপ বাহিরের পৃথিবীর কাছে লুকিয়ে রাখতে পারি, কিন্তু আল্লাহ্র কাছে কিছুই গোপন থাকে না। [দেখুন ২ : ২১৬ এবং টীকা ২৩৬]
২৭৬। আল্লাহ্র রাস্তায় বা সৎ কাজে খরচ করাকে রূপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে "উত্তম ঋণ"। বহু কারণেই এই ঋণকে উত্তম বলা যায়। (১) এর মাধ্যমে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের প্রেরণা জন্মলাভ করে। (২) সাধারণভাবে অর্থ ঋণদানের ব্যাপারে অর্থ ফেরৎ পাওয়া বা না পাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এখানে আমরা সৎ কাজের মাধ্যমে যে ব্যয় করি তা আল্লাহ্র জন্য, আল্লাহ্কে পাওয়ার সাধনা। এ জীবন হচ্ছে পরকালের জন্য শিক্ষানবীশ কাল [Probationary Period] তবে কি আমরা আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠার নিয়তে সৎ কাজে অর্থ ব্যয় করতে পিছিয়ে যেতে পারি?
২৭৭। মুসা এবং হারুণের পরে ইসরাঈলীদের শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত হয় জোসুয়ার উপরে। জোসুয়া জর্দান অতিক্রম করে ইসরাঈলীদের নিয়ে প্যালেষ্টাইনে বসতি স্থাপন করেন। তার রাজত্বকাল ২৫ বৎসর স্থায়ী হয়। এরপর পরবর্তী ৩৫০ বৎসরের ইতিহাস ইসরাঈলীদের উত্থান পতনের বিচিত্র ইতিহাস। তাদের নিজেদের মধ্যে একতা ছিল না ফলে তারা প্যালেষ্টাইনের বিভিন্ন উপজাতি যেমন-মিডিয়ানাইটস, আমালেকাইটস এবং অন্যান্য উপজাতিদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে। তারা প্রায়ই মূর্তি পূঁজার আশ্রয় গ্রহণ করতো। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে নেতার জন্ম হতো, যারা তাদের একতাবদ্ধ করে ইসরাঈলীদের পুরনো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতো। এই সব একনায়কদের সে সময়ে বলা হতো বিচারক (ওল্ড টেষ্টামেণ্টের ভাষ্য অনুযায়ী)। তাদের মধ্যে শেষ যিনি রাজত্ব করেছেন তার নাম ছিল স্যামুয়েল, তাকে রাজাও বলা চলে আবার নবীও বলা চলে।
২৭৮। উল্লেখিত নবীর নাম হচ্ছে স্যামুয়েল। এ সময়ে ইসরাঈলীদের মধ্যে দুর্নীতি ছেয়ে যায়। ফিলস্তিনীরা তাদের আক্রমণ করে এবং ইসরাঈলীদের পরাজিত করে। ফলে সেখানে প্রচুর নরহত্যা সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের সময়ে ইসরাঈলীরা একতাবদ্ধ থেকে সাহসের সাথে যুদ্ধ করার পরিবর্তে তারা তাদের পবিত্র সিন্ধুকটি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের সম্মুখে হাজির করলো। এই সিন্ধুকটি হলো সেই সিন্ধুক, যার মধ্যে আল্লাহ্র প্রেরিত ইসরাঈলীদের সাথে করা পবিত্র চুক্তিপত্র সংরক্ষিত ছিল (Ark of covenant)। তাদের আশা ছিল যেহেতু এর মধ্যে আল্লাহ্র পবিত্র বাণী রক্ষিত আছে সুতরাং তারা যুদ্ধ করুক বা নাই করুক সিন্ধুকটির গুণেই তারা বিজয় লাভ করবে। যারা নিজেরা চেষ্টা না করে দৈব বা অলৌকিকের বা ভাগ্যের উপরে নিজেদের বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের পরিণাম ঐ ইসরাঈলীদের মতই হয়। এই হচ্ছে কুরআনের শিক্ষা। শত্রুরা ইসরাঈলীদের পরাজিত করে তাদের সিন্ধুকটি নিয়ে যায় এবং সাত মাস তাদের দখলে রাখে। ইসরাঈলীরা ভুলে গিয়েছিল যে পাপ বা দুর্নীতি পরায়ণতা করলে তার থেকে রেহাই কোনও পবিত্র জিনিষ করতে পারে না এই হচ্ছে আল্লাহ্র আইন। [আমাদের দেশে যেমন অনেকে বিশ্বাস করে পাপ করে পীর ফকির ধরেই রেহাই পাওয়া যেতে পারে। পাপ থেকেই রেহাই পাওয়ার একটাই উপায়, অনুতাপ করা এবং নিজের চরিত্র সংশোধন করা তবেই সর্বশক্তিমানের সাহায্য পাওয়া যায়। অন্যথায় কোনও পবিত্র বস্তুই তাকে রক্ষা করতে পারবে না।] অপরপক্ষে পবিত্র সিন্ধুক শত্রুদেরও কোন উপকারে আসে নাই। শত্রুরা দেখলো পবিত্র সিন্ধুক তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন না করে বরং আরও দুঃখ দুদর্শার কারণ হলো। সুতরাং তারা এটা পরিত্যাগ করে চলে গেলো। এই পবিত্র সিন্ধুকটি Ya'arim [Kirjath Jearim] এর Qarya গ্রামে প্রায় বিশ বৎসর ছিল। ইতিমধ্যে ইহুদীরা স্যামুয়েলকে একজন রাজা নিযুক্ত করার জন্য অনুরোধ করতে থাকলো। তাদের ধারণা হলো একজন রাজা হলেই তাদের সমস্ত দুঃখ দুর্দশা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারলো না দুঃখ দুর্দশা দূর করতে হলে আল্লাহ্র আইন মানতে হবে। আল্লাহ্র আইন হচ্ছে একতা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় অর্থাৎ ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করার মানসিকতা অর্জন করা। এই মানসিকতা ব্যতীত পবিত্র বস্তু বা ভালো রাজা কেহই কিছু করতে সক্ষম হবে না।
২৭৯। জালুতের নিকট পরাজয়ের পর ইহুদীদের ধারণা হলো একজন রাজার অভাবে তাদের এই পরাজয়। তাদের একজন রাজা থাকলে তারা একতাবদ্ধভাবে দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করতে পারতো। তাই তারা তাদের পয়গম্বর স্যামুয়েলকে তাদের জন্য একজন রাজা নির্বাচন করে দিতে অনুরোধ করলো। স্যামুয়েল অবশ্য পয়গম্বর সুলভ অন্তর্দৃষ্টির কারণে বুঝতে পেরেছিলেন যে ইহুদীদের এই সিদ্ধান্তের কোনও দৃঢ়তা নাই। যুদ্ধের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই শুধুমাত্র এই সিদ্ধান্ত। যুদ্ধ জয়ের জন্য যে দৃঢ়তার প্রয়োজন তা তাদের মধ্যে নাই। চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব থাকলেও তারা ছিল বাক্ সর্বস্ব। কথায় এবং বাক্যে তারা ছিলো অত্যন্ত সাহসী ও দৃঢ়। কিন্তু সত্যিকারের প্রয়োজনের সময়ে তাদের বাক্সর্বস্ব সাহস হলো অস্থায়ী এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করলো।
উপদেশ হচ্ছে যাদের মধ্যে ঈমানের দৃঢ়তা নাই তারা হয় বাক্সর্বস্ব। কর্মক্ষেত্রে তাদের কথা ও কাজের মিল থাকে না।
২৮০। Saul এই নামটি বাইবেলে ব্যবহার করা হয়েছে যার আরবী ভাষান্তর হচ্ছে তালূত। তালূত ছিলেন বেনজামিনের গোত্রভূক্ত। বেনজামিনের গোত্র ছিল ইসরাঈলীদের একটি ছোট গোত্র। তালূত ছিলেন লম্বা এবং সুন্দর কিন্তু অত্যন্ত দরিদ্র। একদিন তিনি যখন তার পিতার হারানো গাধার সন্ধান করেছিলেন সে সময়ে তার সাথে স্যামুয়েলের সাক্ষাত হয়। স্যামুয়েল তাকে ইসরাঈলী সম্প্রদায়ের রাজা নিযুক্ত করেন। তার নাম ঘোষণার সাথে সাথে ইহুদীদের মধ্যে মতভেদের শুরু হয়ে যায়। তারা নানাভাবে এর বাধা দান করে। তাদের নানা ওজর আপত্তি ছিল বাইরে লোক দেখানো। তাদের প্রত্যেকের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তা ছিল তাদের স্বার্থপরতা। প্রত্যেকেরই মনের গোপন ইচ্ছা ছিল রাজা হওয়ার। তাদের এই রাজা হওয়ার ইচ্ছার পিছনে কোনও মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল শুধু নিজস্ব ভোগ বিলাস এবং আত্মপ্রচার ও অহংকার।
[উপদেশ হচ্ছে যুগে যুগে খারাপ লোকের মধ্যে এই মানসিকতার সন্ধান পাওয়া যায়। যে দেশের জনগণের নৈতিক চরিত্র যত খারাপ তাদের মধ্যে প্রভাব প্রতিপত্তির মোহ তত বেশী দেখা যায়। এসব লোক জনগণের নামে ক্ষমতা দখল করতে চায়। কিন্তু জনগণের কল্যাণ চায় না। [বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একই অবস্থা বিরাজমান।]
২৮১। তাবুক বা 'Ark of Covenant'- বা পবিত্র সিন্ধুক। এই সিন্ধুকটি ছিল আকাশিয়া কাঠের তৈরি। এর মাপ ছিল ৫'´৩'´৩'। এর পুরোটা সোনার পাত দ্বারা আবৃত [see Exad xxv ১০-১২] এর ভিতরে আল্লাহ্র কাছ থেকে হযরত মুসার পাওয়া আল্লাহ্র বাণীসমূহ সংরক্ষিত ছিল। অর্থাৎ হযরত মুসার পাওয়া পাথরের উপরে খোদাই করা আল্লাহ্র বাণী সমূহ সংরক্ষিত থাকতো। এই সিন্ধুকটি ছিল ইহুদীদের অত্যন্ত পবিত্র আমানত। পয়গম্বর স্যামুয়েলের জীবনের প্রথম ভাগে ইসরাঈলীরা এই পবিত্র সিন্ধুকটির অভিভাবকত্ব হারায় [টিকা ২৭৮ আয়াত ২:২৪৬] যখন এই সিন্ধুকটি পরিত্যক্ত হয়ে বিশ বছর সিন্ধুকটি একটি গ্রামে পতিত অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরে সিন্ধুকটি রাজধানীতে আনা হয়। এই সিন্ধুকটি পরবর্তীতে একতা এবং শাসন ক্ষমতার প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়।
[উপদেশঃ আল্লাহ্র বাণী অনুযায়ী জীবন যাপন করাই হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা এবং তা হচ্ছে জীবনের সাফল্যের চাবিকাটি। তা না করে আল্লাহ্র বাণীকে বাক্সবন্দী করে রেখে, খুশীমত জীবন যাপন করা এবং আল্লাহ্র করুণার প্রত্যাশা করা মূর্খতা। আজকে মুসলিম সমাজে অনেকেই কুরআনের অর্থ না বুঝে কুরআন তেলওয়াত করে এবং শ্রদ্ধার সাথে ধর্মপুস্তক বাক্সবন্দী করে রাখে। কিন্তু বাস্তব জীবনে কুরআনের শিক্ষার কোনও প্রতিফলন নাই। ফলে মুসলমান সমাজ আল্লাহ্র করুণা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।]
২৮২। 'Sakina' ব নিরাপত্তা, শান্তি, প্রশান্তকারী। রাজা সোলাইমান যখন মসজিদ তৈয়ার করলেন সেখানে এই পবিত্র সিন্ধুকটি রক্ষিত ছিল এবং এই কথাটি 'Sakina'-লেখা ছিল আল্লাহ্র মহিমার প্রতীক স্বরূপ।
২৮৩। "ফেরেশতারা ইহা বহন করিয়া আনিবে" - ইহা অর্থাৎ পবিত্র সিন্ধুকটি।
২৮৪। যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে সৈনিকের শৃঙ্খলার। সেনাপতির আদেশ হবে শিরোধার্য। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণ সৈনিকেরা সেনাপতির আদেশ লঙ্ঘন করে এবং খেয়াল খুশীমত চলে; তবে সৈন্য সংখ্যা যত বেশীই হোক না কেন সে যুদ্ধ জয়ের আশা সুদূর পরাহত। এ রকম উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক থাকার থেকে না থাকাই ভালো। এরা পারে শুধু বিশৃঙ্খলা ও ত্রাসের সৃষ্টি করতে। তালুত ছিলেন আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ। উত্তপ্ত গরমে পদব্রজে দুর্গম পথ অতিক্রমের পরে স্বাভাবিকভাবে সবাই পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। সে সময়ে ছোট নদী অতিক্রান্ত করার সময়ে স্বাভাবিকভাবে সবাই পানি পান করতে চাইবে। সত্যিকার ভাবে ইহুদীরা তালুতের (সেনাপতি) অনুগত কিনা এটা পরীক্ষা করার জন্য তালুত হুকুম জারী করলেন যে, কেউ যেনো নদী থেকে পানি পান না করে। এটা আল্লাহ্র পরীক্ষা। যারা পানি পান করবে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এবং অধিকাংশ ইহুদী এই পরীক্ষায় ব্যর্থতার পরিচয় দিল। স্বল্প সংখ্যাক এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়েছিল।
[উপদেশঃ প্রয়োজনের সময়ে খুব নগন্য সংখ্যক লোকই এগিয়ে আসে। উপরন্তু তখন কিছু লোকের অসহযোগ অন্যান্য লোককেও বিচলিত করে।]
২৮৫। যদিও নগণ্যসংখ্যক লোক বিশ্বস্ত ছিল তালুতের নেতৃত্বে। কিন্তু তাদের মধ্যেও বিভক্তি ছিল। তালুতের সেনাবাহিনীর মধ্যে একদল ছিল অসম্পূর্ণ ঈমানদার, যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে নাই। দ্বিতীয় দল : ঈমানদার যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু যখন জালুতের (Goliath) বিরাট বাহিনীর সম্মুখীন হলো, তখন নিজেদের সংখ্যা কম বলে চিন্তা করেছিলো এবং তৃতীয় দল ছিল পূর্ণ ঈমানদার, যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং নিজেদের সংখ্যা লঘুষ্টতার কথাও চিন্তা করেন নাই। কারণ তাদের ভরসা ছিল একমাত্র আল্লাহ। কারণ তারা জানে যে তারা ন্যায় ও সত্যের জন্য যুদ্ধ করছে। এবং যারা ন্যায় ও সত্যের জন্য যুদ্ধ করে তাদের পক্ষে আল্লাহ্ যুদ্ধ করেন। সুতরাং তাদের কোনও ভয় নাই।
উপদেশঃ সংসারের যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রতিকূল শক্তি দেখে ভয় না পেয়ে আল্লাহ্র উপরে ভরসা স্থাপন করা পূর্ণ ঈমানের লক্ষণ। এখানে প্রতিকূল অর্থাৎ অন্যায় অবিচারের শক্তি ও ক্ষমতা দেখে ভয় না পেয়ে ন্যায় ও সত্য পথে আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে অগ্রসর হলে আল্লাহ্র সাহায্য সুনিশ্চিত।
২৫১। আল্লাহ্র ইচ্ছায় তারা তাদের ছত্রভঙ্গ করলো। এবং দাউদ জালুতকে সংহার করলো ২৮৬। আল্লাহ্ তাঁকে দান করেছিলেন ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা এবং আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করলেন তাই তাঁকে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ্ যদি মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা ২৮৭ প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ্ পৃথিবীর সকল কিছুর প্রতি অনুগ্রহে পূর্ণ ২৮৮।
২৮৬। কোরান শরীফে অনেক বর্ণনামূলক ঘটনাকে অল্প দুই এক লাইনে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমনটি করা হয়েছে এখানে। ওল্ড টেস্টামেন্টে ঘটনাটির পূর্ণ বিবরণ আছে, কিন্তু এর যে মূল আবেদন মানুষের আত্মিক উন্নতির দিক, সে দিকটি ওল্ড টেস্টামেন্টে অনুপস্থিত। কুরআনে ঘটনাকে বর্ণনা করা হয়েছে রূপক হিসাবে যেনো আমরা এর থেকে মহত্তর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
ডেভিড যার আরবী ভাষান্তর হচ্ছে দাউদ। তিনি ছিলেন একজন দরিদ্র যুবক, যার না ছিলো কোনও অস্ত্র, না ছিলো কোনও যুদ্ধ অভিজ্ঞতা। তিনি ছিলেন একজন সামান্য মেষপালক। তিনি তার গোত্রে এমনই একজন নগন্য ব্যক্তি ছিলেন যে ইসরাঈলদের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাকে চিনতো না। মেষ পালক ডেভিড বা দাউদ যখন যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অগ্রসর হলেন তার উপস্থিতি সকলের কাছে এত হাস্যকর মনে হলো যে, এমনকি তার বড় ভাই তাকে তিরষ্কার করেছিলো, কারণ মেষদের পরিত্যাগ করে আসার জন্য। একজন গরীব মেষপালক জালুতের মত শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে সেটা ইহুদীদের কাছেও একটা হাস্যকর প্রচেষ্টা বৈকি। এমনকি জালুত পর্যন্ত দাউদের উপস্থিতিকে হাস্যকর মনে করেছিলো। হত দরিদ্র, অস্ত্রবিহীন, মেষপালক দাউদের বাইরের রুপ সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে নাই, কিন্তু তার বিশ্বাস এবং ঈমানের দৃঢ়তা তাকে আল্লাহ্র চোখে বহুগুণ শক্তিশালী করেছিলো। দাউদ যখন জালুতকে সম্মুখ সমরে আহবান করলো, অস্ত্রবিহীন দাউদের উপস্থিতি জালুতের মনে হাসির উদ্রেক করলো। এ সময়ে জালুত অস্ত্রবিহীন দাউদকে তার নিজ অস্ত্র দ্বারা সাহায্য করতে চাইলেন। কিন্তু দাউদ তা গ্রহণ না করে, নদী থেকে কয়েকটি নুড়ি কুড়িয়ে নিলেন এবং নিজের গুলতীর সাহায্যে জালুতকে নুড়ি পাথর দ্বারা মস্তকে আঘাত করলেন। এতে জালুত ভীষণভাবে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং দাউদ জালুতেরই তরবারী দ্বারা জালুতকে হত্যা করেন। জালুতের মৃত্যুর পরে জালুতের বাহিনীর মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে । ইহুদীরা তাদের পশ্চাদধাবন করে এবং হত্যা করে। কাহিনীর এখানেই শেষ।
[উপদেশঃ এই আয়াতের কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের অনেকগুলি নৈতিক উপদেশ দিচ্ছেন। এর প্রধান উপদেশ হচ্ছে, যদি আমরা আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব এবং সংহতি রক্ষা করতে চাই, যদি আমরা আমাদের ধর্মকে নিরাপদ করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে সাহস, দৃঢ়তা এবং আল্লাহ্র প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাসের সাথে শত্রুর মোকাবেলা করা। অন্যান্য যে সব উপদেশের কথা বলা হচ্ছে, তা হলো :
(১) যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষদলের সৈন্য সংখ্যা বা অস্ত্র সজ্জার আধিক্যই শেষ কথা নয়, যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে নৈতিক মনোবল, বিশ্বাস, দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি আল্লাহ্র উপরে আস্থা স্থাপন।
(২) যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিক মনোবলই প্রধান অস্ত্র। শত্রুপক্ষের সমরসজ্জা বা আয়তন দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আর এই নৈতিক মনোবল তখনই পাওয়া যায় যখন অস্ত্র ধারণ করা যায় অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে। সত্যের জন্য যুদ্ধ করার নৈতিকতা, সাহস এবং বিচক্ষণতার সাথে পরিকল্পনা করা [যেমন করেছিলেন দাউদ]।
(৩) বীর যোদ্ধা সব সময়ে নিজের শক্তি ও অস্ত্রের উপরে ভরসা রাখে, যেখানে যা সহজলভ্য তা-ই তার অস্ত্র হতে পারে [যেমন দাউদ ব্যবহার করেছিলেন নুড়ি পাথর]। আজকের পৃথিবীতে যে গেরিলা যুদ্ধ হচ্ছে তারা এই পথই অবলম্বন করে। পরিবেশকে তারা শত্রুনিধনের কাজে লাগায়।
(৪) যদি আল্লাহ্র রহমত আমরা পেতে পারি তবে শত্রুর অস্ত্র বুমেরাং এর মত তার নিজেরই ধ্বংসের কারণ হবে [জালুতকে, জালুতের তরবারী দ্বারা হত্যা করা হয়]।
(৫) নেতার ব্যক্তিত্ব, অধীনস্তদের দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করতে সাহায্য করে এবং শত্রুপক্ষের অন্তরে ত্রাসের সঞ্চার করে [যেমন দাউদের বীরত্ব বিপক্ষ দলের মনে ত্রাস এবং ইহুহীদের শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করতে উৎসাহিত করে।]
(৬) বিশুদ্ধ ঈমান আল্লাহ্র সন্তুষ্টির কারণ, আল্লাহ্র রহমতের কারণ। এই রহমত বান্দার জীবনে বিভিন্নভাবে প্রবাহিত হতে পারে। যেমন - দাউদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্র পুরস্কার বা রহমত ছিল; ক্ষমতা, জ্ঞান এবং আরও অন্যান্য চারিত্রিক গুণাবলী। [নীচের টিকা দেখুন।]
২৮৭। মেষপালক দাউদকে আল্লাহ্ যেসব গুণাবলীতে ভূষিত করেছিলেন সেগুলি হচ্ছে, বড় যোদ্ধা, রাজা, জ্ঞানী ব্যক্তি, পয়গম্বর ইত্যাদি। এ ব্যতীত দাউদ নবীকে আল্লাহ্ আর যে নেয়ামতে ধন্য করেছিলেন তা হচ্ছে তার কাব্য প্রতিভা ও সঙ্গীতে অসাধারণ দক্ষতা। অর্থাৎ একাধারে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ।
[উপদেশঃ ব্যক্তির চরিত্রের গুণাবলী বা Talent-ই হচ্ছে আল্লাহ্র সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত বা পুরস্কার।
২৮৮। আল্লাহ্র অস্তিত্ব বিশ্বব্রহ্মান্ড ব্যাপী। তিনি সর্বত্র বিদ্যমান। তিনি তার সৃষ্টিকে ভালোবাসেন, করুণা করেন, রক্ষা করেন [১ : ২] এবং পালন করেন। পৃথিবীর জীবনযাত্রায় আমরা দেখি প্রকৃতিতে শান্তি-শৃঙ্খলার মধ্যে (Peace harmony) এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। প্রাণীকূলের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখি কেউ শক্তিশালী কেউ দুর্বল। কিন্তু প্রকৃতিতে আল্লাহ এমন বিধিবদ্ধ আইন করে দিয়েছেন যে, সবল ও দুর্বল সেই সৃষ্টির আদি থেকে শান্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে সমন্বয় করে বেঁচে আছে। তা না হলে দুর্বল পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। মানুষের বেলাতেও আল্লাহ্ একদল দ্বারা অন্য দলের ক্ষমতাকে সীমিত করেন, কারণ তাঁর সৃষ্টিতে সমতা রক্ষা করার জন্য এর প্রয়োজন আছে। বিশ্বব্যাপী আল্লাহ্র পরিকল্পনা বোঝার বা হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষের নাই। তার জ্ঞান এবং পরিকল্পনা স্থান, কাল ও সময়ের উর্ধ্বে। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সর্বশক্তিশানের প্রতি অটল বিশ্বাস রাখা যে, তিনি আমাদের ভালোবাসেন এবং তার নেয়ামত সীমাহীন এবং তিনি আমাদের মঙ্গলাকাঙ্খী।
২৮৯। যুগে যুগে আল্লাহ্ নবী-রাসূলদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাদের বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন নেয়ামতে ধন্য করেছেন। সম্ভবতঃ আল্লাহ্র কাছে তাদের মর্যাদাও ছিল বিভিন্ন। কিন্তু আমরা ক্ষুদ্র মানুষ সীমিত জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ্র নবী রাসূলদের [২ : ১৩৬] মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা রাখি না। এই নবী রাসূলরা যদিও আল্লাহ্র মনোনীত তবুও যুদ্ধের বিভিষিকা থেকে মুক্তি পান নাই। এখানে তিনটি উপমার সাহায্যে তা তুলে ধরা হয়েছে। হযরত মুসা (আঃ) এর সাথে আল্লাহ্ সরাসরি কথা বলেছেন। তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে চল্লিশ বছর উষর ও নির্জন প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কারণ ছিল তার নিজের লোকদের ধর্মে অবিশ্বাস। তিনি প্যালেষ্টাইনদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধ পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার পূর্বেই আল্লাহ্ তাকে তুলে নেন এবং এর দায়িত্ব বর্তায় যেয়ে জোসুয়ার উপরে। দাউদ নবী ছিলেন আল্লাহ্র মনোনীত। তিনি তার সময়কালের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাকে পরাজিত করেন। তিনি রাজা হিসেবে, পয়গম্বর হিসেবে সফল যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যীশুখৃষ্টকে আল্লাহ্ পবিত্র আত্মা দ্বারা শক্তিশালী করেন। তাকে আল্লাহ্ যুদ্ধের জন্য কোনও অস্ত্র দেন নাই। তার নবুওয়াতকাল ছিল খুবই সীমিত। আমাদের নবী মুহম্মদ (সাঃ) জীবনে দেখি, আল্লাহ্ সব নবী রাসূলদের উপরে নির্ধারিত দায়িত্ব সমন্বিত করে তাকে সে দায়িত্ব দেন। তিনি ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ) ন্যায় কোমল হৃদয়, আবার হযরত মুসা (আঃ) অপেক্ষা তিনি বড় সংগঠক ছিলেন। হযরত মুসা ইহুদীদের সংগঠিত করেছিলেন, কিন্তু মুহম্মদ (সাঃ) মদিনা থেকে বিশাল আরব গোষ্ঠীকে সংগঠিত করেছিলেন কোরানের আইনের আলোকে। তার সাফল্য হচ্ছে তার উপরে আল্লাহ্র অর্পিত দায়িত্ব তিনি তার জীবদ্দশায় সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।
২৯০। হযরত মুসার জন্য উপরের টিকা দেখুন।
২৯১। এর অর্থ দ্বিবিধ। প্রথমতঃ তাদের উচ্চ পদে সম্মানিত করা হয় এবং দ্বিতীয়তঃ এ মর্যাদার ক্রমধাপ বিদ্যমান।
২৯২। দেখুন [২ : ৮৭] আয়াত এবং [৩ : ৬২] এর টিকা নং ৪০১।
২৯৩। আদম সন্তানকে আল্লাহ্ গুণাবলীতে ফেরেশতাদের উপরে স্থাপন করেছেন; আবার শয়তানের প্ররোচণাতে সে পশুরও অধম। সাধারণ মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অত্যন্ত স্বার্থপর। ব্যক্তিস্বার্থ তার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রাধাণ্য পায়। সারাটা জীবন সে শুধুমাত্র "জান এবং মাল" এরই রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করে। আল্লাহ্ মানুষকে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়েছেন। এই সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অপব্যবহার মানুষ করে। কারণ মানুষ অত্যন্ত স্বার্থপর জীব। কিন্তু মানুষের এই স্বার্থপরতা আল্লাহ্র সুদূর প্রসারিত পরিকল্পনা ব্যহত করতে পারে না। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। আল্লাহ যদি মানুষকে এই সীমিত ইচ্ছাশক্তি না দিতেন হয়তো সেক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যসব প্রাণীর মতই কোন জটিল দ্বন্দ্বে মানুষ জড়িয়ে পড়তো না এবং পাপ-পূণ্যের জন্য দুঃখ-সুখ ভোগের আশংকা থাকতো না।
রুকু - ৩৪
২৯৪। 'Spend' বা 'ব্যয় কর'। অর্থাৎ দান কর বা সৎ কাজে নিয়োজিত কর। আল্লাহ্র যা কিছু দান, তা সবকিছু একা ভোগ করবে বলে মজুদ করে রাখা হারাম। আল্লাহ্র এই দানকে শুধুমাত্র টাকা পয়সার নিক্তিতে মাপা যায় না। সভ্যতার বিকাশের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে যা কিছু দান করেছেন সবই আল্লাহ্র নেয়ামত [দেখুন টিকা ২৭]। সৎ কাজ করাও হচ্ছে দান করা। সৎ কাজ কি ? সৎ কাজ হচ্ছে সেই কাজ যা আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য করা হয়। হতে পারে তা প্রতিবেশীর জন্য, হতে পারে তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য, হতে পারে তা অপরিচিত আগন্তুকের জন্য, হতে পারে তা সমাজের জন্য। এমন কি হতে পারে তা পশু, পাখী, বা গাছপালা বা প্রকৃতি। যা-ই আল্লাহ্র সৃষ্ট তার রক্ষণাবেক্ষণ, তার মঙ্গলের জন্য, নিজের মেধা, মনন শক্তি, শ্রম, উৎসর্গ করার নামই হচ্ছে দান করা। শুধু অর্থ সম্পদ গরীবের মধ্যে বিতরণকে সঙ্কীর্ণার্থে দান পরিগণিত করা যায়, কিন্তু ইসলামের চোখে দানের সংজ্ঞা বা পরিধি অনেক ব্যাপক। আল্লাহ্ যাকে যে নেয়ামত [অর্থ-সম্পদ, মেধা-মননশক্তি, সাহিত্য প্রতিভা, শিল্পী মন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সমাজে উচ্চ অধিষ্ঠান, উচ্চ বংশে জন্ম ইত্যাদি] দিয়েছেন; সেই নেয়ামতকে নিঃস্বার্থভাবে জনগণের কল্যাণের জন্য নিয়োজিত করাই হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে বৃহত্তর পরিসরে দান করা বা Charity। এখানে নিঃস্বার্থ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এই দানের পিছনে যেনো দম্ভ, আত্ম অহংকার বা সমাজের চোখে সুনামের মোহ বা কোনও বিশেষ সুবিধা লাভের আকাঙ্খা থাকে না। এই দানের হবে একটাই উদ্দেশ্য - আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র নেয়ামতকে আল্লাহ্র সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত করা যেনো স্রষ্টাকে খুশী করা যায়, পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টিই হবে দানের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর এ কথাটা অনুধাবনযোগ্য যে আল্লাহ্র নেয়ামত বলতে অর্থ-সম্পদ ব্যতীতও মানসিক এবং আত্মিক নেয়ামতকেও বোঝায় [টিকা ২৭]। আল্লাহ্র সৃষ্ট সকল প্রাণী নিয়ে তাঁর পরিবার। "তিনিই আল্লাহ্র সর্বাধিক প্রিয় যিনি আল্লাহ্র সৃষ্ট প্রাণীগণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করেন।" - হাদীস।
২৯৫। আরও দেখুন ২ : ৪৮, ১২৩।
২৯৬। এই সেই আয়াত যার নাম 'আয়তাল কুরসী' বা "Verse of the Throne" বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় আল্লাহ্র "সিংহাসনের ছন্দ গ্রহণ।" অবশ্য পৃথিবীতে এমন কেউই নাই যার পক্ষে আয়তাল কুরসীর প্রকৃত অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করা সম্ভব। এই আয়াতটির ভাব-গাম্ভীর্য, মহিমা প্রকাশের ভাষা এবং গভীরতা, ছন্দের চমৎকারীত্ব, রচনাশৈলী, শব্দ চয়ন, ভাবের প্রকাশ এত গভীর এবং ব্যঞ্ছণাময় যে আরবী ভাষাতেও এর ব্যাখ্যা দান করে মূলভাব প্রকাশ করা মানুষের সাধ্যাতীত। আর এখানে আরবী নয় অন্য ভাষাতে এর ভাষান্তরিত করা হচ্ছে, সুতরাং আয়তাল কুরসীর মূল ভাবের সম্পূর্ণ প্রকাশ না হওয়াই স্বাভাবিক। আর এই অক্ষমতার জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।
এই আয়াতে আল্লাহ্র বিশেষ গুণাবলীর স্তুতি করা হয়েছে। এসব বিশেষণ শুধুমাত্র আল্লাহ্র। পৃথিবীর আর কোনও কিছুর জন্যই এগুলি প্রযোজ্য নয়। তিনি চিরঞ্জীব, স্বাধিষ্ঠ বিশ্ববিধাতা সৃষ্টির তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে সত্তা অনাদি ও অনন্তকাল ব্যাপী বিরাজমান, আপন সত্তার জন্য যিনি কারও মুখাপেক্ষী নন, অথচ সর্বসত্তার যিনি ধারক, তাঁকেই 'কাইয়ুম' বলা হয়]। পৃথিবীতে আমাদের জীবন অসম্পূর্ণ, তাই পৃথিবীর জীবনে প্রতিনিয়ত নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন ভাবে। আমাদের কর্মক্ষেত্রে আমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, দুঃখে সান্ত্বনার প্রয়োজন হয়, সুখে অংশীদার প্রয়োজন হয়, বিশাল কর্মকাণ্ডে সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়। আমাদের পক্ষে 'কাইয়ুম' (self subsisting) কথাটির গুঢ় অর্থ অনুধাবন করাও সম্ভব নয়। একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন 'কাইয়ুম'। তার জন্য বিশ্রাম বা তন্দ্রার প্রয়োজন নাই। মানুষের জাগতিক প্রয়োজনের মাপকাঠিতে তাঁকে বিচার করা যাবে না। এটাই স্বাভাবিক।
২৯৭। বিশ্ববিধাতা আল্লাহ্ সয়ম্ভু। তিনি অসীম। সীমার বাঁধনে তাকে বাঁধা যায় না। তিনি স্থান-কাল ও সময়ের উর্ধ্বে। তিনি সর্বস্থান ও সর্বকালব্যাপী। একমাত্র বিশ্ববিধাতার এই রূপ অনুধাবন করলেই স্বর্গ-মর্ত্য সম্বন্ধে বস্তুবাদী ধারণা আমাদের ভিতর থেকে অন্তর্হিত হবে। প্রকৃতিবাদীরা ভুলভাবে একে উপস্থাপন করে যে বিশ্ব প্রকৃতি-ই হচ্ছে স্রষ্টার একটি রূপ। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি-ই তাঁর দ্বারা সৃষ্ট এবং পদানত। আকাশ ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সে সবই আল্লাহ্র মালিকাধীন। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইচ্ছা শক্তির মালিক। যেভাবে যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। আল্লাহ্ যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর মালিক এবং কোনও বস্তু তাঁর চাইতে বড় নয়, তাই কেউ তাঁর কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকারী নয়। কেউ কারও জন্য সুপারিশ করারও অধিকারী নয়। এ ক্ষমতা কারো নাই। তবে তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে সুপারিশ করতে পারবেন। হাদীসে আছে আল্লাহ্ হাশরের ময়দানে একমাত্র আমাদের রাসূলকে (সাঃ) এই ক্ষমতা দান করবেন অন্য কাউকে নয়। আল্লাহ্র জ্ঞান, স্থান, কাল ও সময়ের উর্ধ্বে। আমাদের পৃথিবীর মানুষেরা সীমিত জ্ঞানে যে কোনও জ্ঞানকে বিচার করি সময়ের প্রেক্ষিতে। আজকে বিজ্ঞান যা অমোঘ সত্যরূপে আত্মপ্রকাশ করছে, কাল তা ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এ রকম অহরহই ঘটে থাকে। এখানেই আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতা। এখানেই তাঁর জ্ঞানের সাথে আমাদের জ্ঞানের পার্থক্য। যদি আমরা সর্বান্তকরণে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারি, তবেই আমাদের জ্ঞানের এই অপূর্ণতা দূরীভূত হয়ে তার জ্ঞানের বৃহত্তর অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পাবো অর্থাৎ আমাদের অন্তর্দৃষ্টির [spiritual insight] জন্ম নেবে।
২৯৮। [Throne] সিংহাসন বা আসন : আল্লাহ্র আসন সর্বব্যাপী। আকাশ, পৃথিবী, ভূমন্ডল, সর্বত্র তার হাতের স্পর্শ বিদ্যমান। এই ভুমণ্ডল, নভোমন্ডল সবই তাঁর নির্দেশে চলে। আসমান ও যমীনের যাবতীয় বস্তুর নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছেন আল্লাহ্তায়ালা। সমস্ত সৃষ্টি তাঁর আশ্রয়ে বিদ্যমান।
২৯৯। আমাদের অপূর্ণ পার্থিব জীবনে কর্ম এবং বিশ্রাম দুটোই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কর্মের পরে বিশ্রাম দ্বারা ক্লান্তি দূর না করলে আমরা নূতনভাবে কর্ম শুরু করার ক্ষমতা রাখি না। আমাদের সীমিত এবং অপূর্ণ জ্ঞান দ্বারা আমরা বুঝতে অক্ষম অনাদি অনন্তকাল ধরে বিশ্রাম না করে কীভাবে কাজ করা যায়। কিন্তু পৃথিবী, আকাশ ও নভোমন্ডলের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই স্রষ্টার সৃষ্টি কাজ সেই আবহমান কাল থেকে বিরতিহীন, একভাবে চলে আসছে। সৃষ্টি এক মূহুর্তের জন্যও থেমে থাকেনি, থেমে থাকছে না। এই পৃথিবীতে জন্ম মৃত্যু আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। পুরানোরা মৃত্যুর মাধ্যমে নূতনদের স্থান করে দিচ্ছে। আবার এই নূতনদের সৃষ্টিকে স্রষ্টা আবহমান কাল থেকে রক্ষা করে আসছেন। এই সৃষ্টি এবং সৃষ্টির রক্ষা করা যতিহীনভাবে চলছে। তার পরিপূর্ণ ক্ষমতার পক্ষে এসব কাজ করা কঠিন নয়। আবার মানুষের মত তাঁর ক্লান্তিরও কোনও কারণ নাই। কারণ তার সত্তা যাবতীয় ক্লান্তি, তন্দ্রা ও নিদ্রার প্রভাব থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
৩০০। ধর্মের ব্যাপারে বাধ্যাবাধকতার স্থান নাই। কারণ-
(১) ধর্ম হচ্ছে অন্তরের ব্যাপার। আমাদের সমস্ত সত্তা যখন পরম করুণাময়ের পরশ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়, একমাত্র তারই উপর নির্ভরশীল হয়, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে, তখনই ঈমান বা ধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়। জোরপূর্বক বাধ্যাবাধকতার মাধ্যমে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা করানো সম্ভব কিন্তু আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা জন্মানো সম্ভব নয়। কারণ ঈমানের সম্পর্ক বাহ্যিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে নয়। এ হচ্ছে অন্তরের ব্যাপার, আত্মার ব্যাপার।
(২) সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং সত্যের রূপ সম্বন্ধে বিশ্বাসীদের মধ্যে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
(৩) আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকারী। তাঁর শুভাকাঙ্খা আমাদের সর্ব অবয়বকে ঘিরে আছে। তিনি আমাদের মঙ্গল চান। আমাদের আত্মাকে অন্ধকার থেকে আলোর যাত্রা পথে পরিচালিত করাই তার কাম্য।
৩০০-ক 'Tagut' 'তাগুত'-এর আভিধানিক অর্থ সীমালঙ্ঘনকারী; দুষ্কৃতির মূল বস্তু। যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে ইত্যাদি। শয়তান, কল্পিত দেবদেবী, যাবতীয় উপায় যাকে আল্লাহ্র সমকক্ষ মনে করা হয় সবই তাগুতের অন্তর্গত।
৩০১। "Hand hold" - 'মজবুত হাতল' ধরিবে। আমরা যখন পড়ে যাই বা পদস্খালিত হই, তখন আমরা কোনও কিছু ধরতে চেষ্টা করি যেনো পতন থেকে রক্ষা পেতে পারি। এটা হতে পারে দড়ি বা এই জাতীয় কিছু, বা কোনও কিছুর হাতল বা নোঙ্গর। আমরা আমাদের পতন রোধ করার জন্য যাই-ই অবলম্বন করি না কেন, যদি তা মজবুত হয় এবং ভাঙ্গার বা ছেঁড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তবে আমাদের নিরাপত্তার ভিত্ হয় মজবুত। ততক্ষণ পর্যন্ত-ই হবে মজবুত যতক্ষণ আমরা তা শক্ত করে ধরে থাকতে পারবো। যেমন- লোক ভর্তি বাসে যখন লোকে হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে, তখন ঐ ব্যক্তির নিরাপত্তা নির্ভর করে দুটো জিনিসের উপর। প্রথমতঃ বাসের হাতলের অবস্থার (condition) উপরে, দ্বিতীয়, ব্যক্তির হাতল ধরে থাকার শক্তির বা ইচ্ছার উপরে। যদি হাতলের অবস্থা মজবুত হয় তবে বাসে ঝুলন্ত ঐ ব্যক্তির নিরাপত্তা নির্ভর করবে সম্পূর্ণরূপে মজবুত ভাবে হাতল ধরে রাখার ক্ষমতার বা ইচ্ছার উপরে। অর্থাৎ ব্যক্তির দৃঢ়ভাবে হাতল ধরে রাখার ইচ্ছার উপরেই তার পতনের কারণ নির্ধারিত হবে। এই উপমার সাহায্যে আল্লাহ্ আমাদের উপদেশ দিচ্ছেন- সংসার জীবনের পথ নানা লোভ ও প্রলোভনে ভরা। এ পথে প্রতি মূহুর্তে পদস্খলনের সম্ভাবনা। যদি আমরা তাগুতকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র আল্লাহ্র উপরই আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করি, তবে আমাদের অবস্থান ঐ লোকটির মত যে মজবুত হাতলকে ধরে রাখলো। ফলে সে পতন থেকে রক্ষা পেলো। ধরে রাখা বা না রাখা তার ইচ্ছা। সেই রকম আমরা যদি স্বইচ্ছায় আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করি এবং শুধুমাত্র তার উপরেই আস্থা স্থাপন করি, এবং তার কাছেই আমাদের নিরাপত্তা চাই তবে সে এমন এক মজবুত হাতলকে অবলম্বন করলো যা কখনও ভাঙ্গবে না। অর্থাৎ সংসার জীবনে তার পদস্খলন হবে না।
রুকু - ৩৫
৩০২। আয়াত [২ : ২৫৮ - ২৬০] এই আয়াত তিনটি সম্পর্কে নানা রকম মতবাদ আছে। বিশেষ করে কে সেই ব্যক্তি যে হযরত ইব্রাহীমের সাথে তর্কে প্রবৃত্ত হয়েছিলো ? কুরআন শরীফে যেহেতু তার নাম উল্লেখ করা হয় নাই, এবং আমাদের প্রিয় নবীও এ সম্বন্ধে কোনও বক্তব্য রাখেন নাই, সুতরাং এই ব্যক্তির নামের অনুসন্ধান করা বৃথা এবং এ সম্বন্ধে নিজস্ব কোনও অনুমান করাও উচিত নয়। গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সময়ে অনুমান অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়। কিন্তু কুরআন শরীফ এমন এক গ্রন্থ যার বক্তব্য, যার শিক্ষা, সার্বজনীন এবং যুগ কাল অতিক্রান্ত। সুতরাং এখানে সামান্য একটা নামের ব্যাপারে অনুমান করে কূটতর্কে জড়িয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। ফলে কুরআনের যে মূল শিক্ষা বা যে উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখা হয়েছে তার থেকে আমরা বহু দূরে চলে যেতে পারি। কুরআনের সার্বজনীন ও বৃহত্তর রূপ হৃদয়ঙ্গম করার পরিবর্তে আমরা ক্ষুদ্র পরিবেশে কুটতর্কের ফলে আল্লাহ্র বাণীর মহিমা থেকে বঞ্চিত হব। এ যেনো সমুদ্র দর্শনের পরিবর্তে ক্ষুদ্র 'ডোবা' দর্শন এবং এর মহিমা কীর্তন। উপরের আয়াত তিনটি [২ : ২৫৮, ২৫৯, ২৬০] যে কোনও পয়গম্বরের জীবনেই ঘটতে পারে, তবে আয়াত [২ : ২৫৮]-এ আল্লাহ্, নবী মুহম্মদ মুস্তফাকে (সাঃ) সম্বোধন করেছেন।
৩০৩। আয়াতের [২ : ২৫৮] লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মানুষের ক্ষমতার দম্ভ ও অহংকার আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে তুচ্ছ। যে ব্যক্তির সাথে হযরত ইব্রাহীমের তর্কবিতর্ক হচ্ছিল, সম্ভবতঃ তিনি ছিলেন বেবীলনের রাজা নমরুদ। মাওলানা ইউসুফ আলী এখানে নমরুদের উল্লেখ করেছেন এ জন্য যে হযরত ইব্রাহীমের আদি বাসস্থান ছিল বেবীলনে। সে সময়ে বেবীলন শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে পৃথিবীর শীর্ষ স্থানীয় ছিল। বিজ্ঞান পৃথিবীতে বহু আশ্চর্য্য ঘটনার জন্ম দিতে সক্ষম। একথা সে সময়ের বেবীলনের জন্যও প্রযোজ্য ছিল, বর্তমান সময়ের জন্যও প্রযোজ্য আছে। বিজ্ঞান যত কিছুই আবিষ্কার করুক না কেন জীবনের বা প্রাণের রহস্য আজও তার কাছে অজানা। এই রহস্য সে সময়েও বিজ্ঞানীদের হতবুদ্ধি করতো, আজ এত বছর পরেও বিজ্ঞানীদের প্রাণের রহস্য সেই একইভাবে বিস্মিত ও হতবুদ্ধি করে। আজকের যুগে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাহায্যে মানুষ সৃষ্টির কলা-কৌশল উদঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইব্রাহীমের (আঃ) পরে কত যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। বিজ্ঞানের জ্ঞান কত সমৃদ্ধ হয়েছে, তবুও নিউটনের মত বলতে হয়, "আমরা জ্ঞান সমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়াচ্ছি।" অসীম জ্ঞানের আঁধার একমাত্র সর্বশক্তিমান। যখন লোকে অহংকারে স্ফীত হয়ে দম্ভ প্রকাশ করে তখন সে এই সত্যকে ভুলে যায় বা দেখতে অপারগ হয়। নিজেকে সে স্রষ্টার সমকক্ষ মনে করে। আজকের যুগেও আমরা এসব লোকের সন্ধান পাই যারা বিজ্ঞান পড়ে আল্লাহ্র অস্তিত্ব অস্বীকার করে। তাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানের দম্ভে ভুলে যায় যে, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাকৃতিক বিধান বা বিজ্ঞান সবই আল্লাহ্র অসীম জ্ঞানের সামান্য অংশ মাত্র। নৃপতি বা রাজা এবং বিজ্ঞানী এরা উভয়েই সাধারণ মানুষের তুলনায় ক্ষমতাধর সন্দেহ নাই। কিন্তু আল্লাহ্র তুলনায় তা অত্যন্ত সীমিত। হযরত ইব্রাহীম নমরুদকে সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, যদি সে আল্লাহ্র মতই ক্ষমতাধর হয়, তবে সূর্যকে বলুক পশ্চিম দিক থেকে উঠতে।
৩০৪। এই ঘটনাকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়; (১) Ezekiel-এর শুষ্ক হাড়ের দর্শন [Ezekiel. xxxvii ১-১০] (২) জেরুজালেম পরাজিত ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পরে Nehemiah এর জেরুজালেম পরিদর্শন এবং এর পুনঃনির্মাণ [Nehemia ১. ১২-২০]; এবং (৩) ইহুদীদের ধর্মগুরু ও লেখক, সংস্কারকের নাম 'Uzair or Ezra or Esdras' যাকে পারস্য সম্রাট জেরুজালেম পরাজয়ের পরে জেরুজালেমে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর বহু নীতিবাক্য ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত। এর মধ্যে নম্বর (১) এ এই শুষ্ক হাড় সম্বন্ধে শুধুমাত্র অল্প কয়েকটি লাইনে ৪টি শব্দ পাওয়া যায়। (২) এবং (৩) নম্বরে নির্দিষ্টভাবে এ সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ নাই। কুরআন শরীফের বাণী সর্বকালের সর্বযুগের, সর্ব সাধারণের জন্য। কোনও বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে এই সার্বজনীন উপদেশ বা বাণী প্রচার করা হয়েছে। এখানেও গল্পছন্দে যে নীতিপূর্ণ উপদেশ (similitude) দেওয়া হচ্ছে তা যুগ-কাল অতিক্রান্ত, সর্বজীন; এবং আমাদের সেভাবেই তা গ্রহণ করা উচিত। এখানে মাওলানা ইউসুফ আলীর মতে এই উপদেশ কোনও ব্যক্তিগত নয়, এই গল্পের মাধ্যমে যুগে যুগে এক এক জাতির মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।
৩০৫। এই আয়াতের গল্পটি এরূপ যে, এক লোক ছিল। এক বার চলতে চলতে সে এমন এক জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করলো যে সে শহর এবং তার সভ্যতা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই দেখে তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো, এই ভেবে যে, কীভাবে এই শহর পূণঃর্জীবিত হবে ? কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যুগে যুগে আল্লাহ্ বহু জাতি বহু সভ্যতা ধ্বংস করেছেন, আবার পুনঃর্জীবিত করেছেন। শেষ বিচারের দিনেও ঠিক সেভাবেই প্রত্যেক মানুষকে পুনঃর্জীবিত করবেন। ঐ ব্যক্তি ১০০ বছর মৃত থেকে পুনরায় জীবিত হলো, কিন্তু তার কাছে ব্যাপারটি মনে হলো ক্ষণিক মাত্র। তার খাদ্য ও পানীয় আল্লাহ্র হুকুমে একশত বছর অবিকৃত ছিল কিন্তু তার গাধাটি, শুধুমাত্র যে মারাই গিয়েছিল তাই-ই নয়, তার শুধুমাত্র কয়েকটি শুকনা হাড় অবশিষ্ট ছিল। ঐ লোকটির চোখের সামনেই আল্লাহ্ গাধাটিকে মাংস রক্তে আবৃত করে পুনঃর্জীবিত করলেন।
[সর্বজনীন উপদেশ হচ্ছেঃ (১) আল্লাহ্ হচ্ছেন সময়ের উর্ধ্বে। বর্তমান যুগে বিজ্ঞানীরাও এ কথা বলেন যে, সময়ের ধারণা আপেক্ষিক মাত্র। কসমিক ক্যালেন্ডারের বছরের ধারণা আমাদের দৈনন্দিক জীবনের বছরের ধারণা এক নয়। (২) সময়ের ব্যাপার বিভিন্ন বস্তুকে বিভিন্নভাবে প্রভাবান্বিত করে। (৩) জীবন মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। (৪) মানুষের ক্ষমতার দম্ভের কোনও মূল্য নাই আল্লাহ্র চোখে। আল্লাহ্ মানুষের ঈমান বা তার প্রতি আন্তরিক বিশ্বাসের মূল্য দেন।]
৩০৬। আয়াতে [২ : ২৫৮] বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ সর্বময় ক্ষমতার মালিক। মানুষের মিথ্যা দম্ভ ও অহংকার এক মূহুর্তে ধূলিস্মাৎ হতে পারে। আয়াতে [২ : ২৫৯] বলা হয়েছে আল্লাহ্ সময়ের সীমার উর্ধ্বে। ব্যক্তিগত, জাতিগত জীবনের উত্থান পতন, জীবন-মৃত্যু সবই আল্লাহ্র আইনের কর্তৃত্বাধীন। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র বিচার-বুদ্ধি দ্বারা অনেক সময়ে ভুল করে বসি বা কৌতুহল বা সন্দেহ প্রকাশ করে থাকি। হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) কৌতুহলের উত্তরে আল্লাহ্ দেখালেন যে, মৃত্যুকে জীবিত করা তাঁর জন্য কিছুই নয়।
৩০৭। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ্র উপরে এবং মৃত্যুর পরে পুনঃর্জীবন সম্পর্কে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী; প্রশ্নটি ছিল শুধু মৃত্যুর পরে পুনর্জীবন লাভের যে স্বরূপ তা জানার কৌতুহল। পুনর্জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে কোনরূপ সন্দেহ ছিল না।
৩০৮। 'Juz-an' : A portion of them: তফসীর কারকগণ বলেন যে, পাখীগুলিকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে বিভক্ত অংশগুলিকে পাহাড়ের উপর স্থাপন করা হয়েছিল। পাখীগুলিকে মারা বা টুকরো অংশে বিভক্ত করার কথা এখানে উল্লেখ নাই কিন্তু অধিকাংশ তফসীরকারগণের মতে টুকরো করা শব্দটি উহ্য আছে, কারণ যেহেতু মৃত পাখীকে জীবনদান প্রসঙ্গটি এখানে এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
রুকু - ৩৬
২৬২। যারা আল্লাহ্র রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে, এবং তাদের উদারতার কথা [দান গ্রহীতাকে] স্মরণ করিয়ে দেয় না বা ক্লেশ দেয় না, তাদের পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রভুর নিকটে। তাদের কোন ভয় নাই, তারা দুঃখিতও হবে না।
২৬৩। যে দানের পরে ক্লেশ দেয়া হয়, তা অপেক্ষা সান্ত্বনা বাণী ও ক্ষমা প্রদর্শন শ্রেয় ৩০৯। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত এবং তিনি পরম সহনশীল।
৩০৯। আয়াতে [২ : ২৬২ - ২৬৪] দানের মান দন্ড বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে-
(১) যাই-ই দান করা হোক না কেন তা হালাল রুজী হতে হবে, এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য আল্লাহ্র রাস্তায় [অর্থাৎ তার সৃষ্ট জীবের সেবায়] তা ব্যয় করতে হবে। [২:২৬৭]
(২) দান করে দানের প্রতিদান চাওয়া উচিত নয়, গ্রহীতার কাছ থেকে। দানের প্রতিদান এ পৃথিবীতে চাওয়া অনুচিত। প্রতিদান শুধুমাত্র চাওয়া যেতে পারে সর্বশক্তিমানের কাছে; যার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দান করা।
(৩) দানের পরে গ্রহীতার অনুগ্রহ প্রকাশ না করা এবং যাকে দান করা হলো তাকে কষ্ট না দেওয়া বা দানের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে মানসিক কষ্ট বা লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থাৎ যাকে দান করা হবে তার সাথে এমন কোন ব্যবহার করা যাবে না যাতে সে নিজেকে ঘৃণিত ও হেয় অনুভব করে বা মানসিক কষ্ট পায়।
(৪) দান করতে হবে বিনয়ের সাথে। নাম যশঃ ইত্যাদির আশায় বা কোনও গোপন উদ্দেশ্য সিদ্ধির [যেমন ভোট পাওয়ার জন্য আমাদের দেশের লোক সৎ কাজ বা দান করে] আশায় দান করাকে আল্লাহ্র চোখে দান বলে গণ্য হবে না। এমন কোনও দম্ভ বা অহংকার যদি দাতার মনে থাকে যে সে বিপদের সময়ে গ্রহীতার উপকার করেছে তাতেও দাতার দানের কোনও মূল্য থাকবে না। কারণ কাকে দান করলাম বা কী দান করলাম সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, অহংকার ও দম্ভমুক্তভাবে, বিনয়ের সাথে দান করাই হচ্ছে আসল কথা। মনে এই চিন্তা রাখা যে আমরা যাই দান করি না কেন তা শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য করা হচ্ছে। আমরা আল্লাহকেই দান করছি; তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য। বিশ্ব প্রতিপালক, সর্বশক্তিমানকে ক্ষুদ্র মানুষ যখন দান করবে, তখন কতটা বিনয়ের সাথে এবং অহংকার মুক্ত মানসিকতা থাকতে হবে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ তিনি তো সর্বজ্ঞ, আমাদের ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র চিন্তাধারাও তার অজ্ঞাত নয়। নিরহংকার ও বিনয়ী চিত্তের দান আল্লাহ্ গ্রহণ করেন ও সন্তুষ্ট হন। দানের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ।
দানের মূল নির্যাস হচ্ছে; গ্রহীতার দোষত্রুটি ক্ষমা করে, দয়ার সাথে, বিনয়ের সাথে সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। দুর্ব্যবহারের সাথে দান করা অপেক্ষা ভালো ব্যবহারের সাথে প্রত্যাখ্যান করা শ্রেয়। দানে কোনও প্রতিদান চাওয়া চলবে না গ্রহীতার কাছ থেকে। একমাত্র আল্লাহ্র কাছে প্রতিদান চাওয়া যেতে পারে। আল্লাহ্ সম্পদশালী ও সহিষ্ণু। তিনি কারও অর্থের বা সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্যয় করে, সে নিজের উপকারের জন্যই করে। এই পৃথিবীতে মানব সন্তান প্রতিমূহুর্তে নানা প্রলোভনের শিকার। আমাদের অন্তরের লুকায়িত পাপ, বা লোভ-লালসা বাইরের দৃষ্টিগোচর না হতে পারে, কিন্তু সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ সবই জানেন। এই দোষত্রুটির উর্ধ্বে ওঠা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। পরম করুণাময় আল্লাহ্ আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করেন বলেই তার দরবারে আমাদের কাজের পুরস্কারের আশা করি। আমরা ক্ষুদ্র ও নগণ্য এবং সর্বোপরি আমাদের আশা-আকাঙ্খা বা কর্মের নিয়ত কখনই সম্পূর্ণ পাপমুক্ত হতে পারে না। কারণ মানুষ অত্যন্ত দুর্বলচিত্ত। তাই আল্লাহ্র রহমতই আমাদের ভরসা।
৩১০। মূল্যহীন দান হচ্ছে সেই দান যা লোক দেখানো দান। যা নাম ও খ্যাতির জন্য করা হয়। সে দান আল্লাহ্র জন্য নয়, শুধুমাত্র খ্যাতির জন্য। যে দান নাম ও যশের জন্য, সে দান হচ্ছে মোনাফেকীর সমান। কারণ তারা আল্লাহ্ এবং পরকালে বিশ্বাস করে না। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, তিনি সব দেখেন, সব শোনেন [২ : ২৬৫]। তাদের এই দানকে আল্লাহ্ সুন্দর উপমার সাহায্যে তুলে ধরেছেন। তাদের হৃদয়কে পাথরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মসৃণ পাথরের উপরে পাতলা মাটির প্রলেপ জমা থাকে। অতঃপর এর উপরে মুষলধারে বারিপাত হয়। ফলে যে মাটিতে ফসল ফলতে পারতো তা ধুয়ে যেয়ে মসৃণ পাথরটি বের হয়ে আসে। যে বারিধারা উর্বর জমিকে আরও উর্বর করে, সেই একই বারিধারা মাটি দ্বারা আবৃত পাথরকে আরও উর্বর করার পরিবর্তে বৃষ্টির ফলে মাটিমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ অনুর্বর এক প্রস্তরখণ্ডে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং যার অন্তরে মোনাফেকী, সে অন্তর দানের দ্বারা সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে না বরং তার অন্তরে মোনাফেকীর শিকড় আরও বিস্তার লাভ করে ঐ মাটিমুক্ত শক্ত প্রস্তরখণ্ডের মত হয়ে যায়।
৩১১। এখানে উপমার সাহায্যে সত্যিকারের দানের প্রকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। সত্যিকারের দান অর্থাৎ যে দান আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। এই দানকে তুলনা করা হয়েছে উঁচু একখণ্ড উর্বর জমির সাথে, যে জমিতে বৃষ্টিপাতের ফলে বৃষ্টির পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ লাভ করে মাটিকে আরও উর্বর করে, কিন্তু জমিখন্ড উঁচু হওয়ার দরুণ মাটিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে না। ফলে ফসলের ফলন দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই জমির উর্বরাশক্তি এত বেশী যে যদি বৃষ্টির পরিমাণ কমও হয় তবুও শিশিরের সিক্ততাও ধারণ করার ক্ষমতা এই মাটির আছে। মাটির উর্বরাশক্তি অত্যন্ত বেশী হওয়ার দরুন এই সামান্য সিক্ততাও ফসলের প্রভূত উপকার সাধন করে। সেইরূপ যে লোক শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য দান করে সেই প্রকৃত দান করে। আর এই প্রকৃত দানের দরুন তার আধ্যাত্মিক জীবন হয় সমৃদ্ধ। তার আত্মা আল্লাহ্র নিয়ামত ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করে, যেরূপ ঐ উর্বর মাটি বৃষ্টির পানি এবং শিশির কণা ধারণ করে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছিল। আল্লাহ্র নেয়ামত হচ্ছে ঐ জমির ফসলের মত। এই নেয়ামতকে সে স্বার্থপরের মত শুধু নিজের ভোগে ব্যয় করবে না। সে এই নেয়ামতকে ব্যবহার করবে আল্লাহ্র সৃষ্টির সেবার জন্য বা দানের জন্য। দাতার জীবনে অসময় আসতে পারে, সে সময়েও সে তার সৎ কাজ থেকে বিরত হয় না। সে হচ্ছে ঐ জমিখণ্ডের মত, যখন বৃষ্টির অভাব হয় শিশিরের সিক্ততার সাহায্যে ফসল ফলাতে সক্ষম। অর্থাৎ প্রকৃত দাতা ব্যক্তির হৃদয় প্রাচুর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। তার যা আছে তাতেই সে সর্বদা সুখী এবং সন্তুষ্ট এবং তা থেকেই সে তার সাধ্যমত সৎকাজ করে বা দান করে। তার জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করা ও পরিণামে তার নিজের আত্মার উন্নতি লাভ।
৩১২। দান-ধ্যানের প্রকৃতরূপকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আয়াতে [২ : ২৬১, ২৬৪, ২৬৫]। এখানে চতুর্থ উপমার সংযোজন করা হয়েছে। এই উপমাটির সাথে মানুষের জীবনকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। মনে করুন আপনার একটি সুন্দর বাগান আছে। বাগানটি শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তাই-ই নয় বাগানটি সংসারের আর্থিক সংস্থানের জন্য প্রচুর ফসলও উৎপন্ন করে। এখানে আঙ্গুর ও খেজুরের কথা বলা হয়েছে। আঙ্গুর ও খেজুরকে এখানে ফসলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, [কারণ সব দেশে আঙ্গুর ও খেজুর জন্মায় না। কিন্তু কুরআনের আয়াত সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বসাধারণের জন্য]। আপনার বৃদ্ধ বয়সে সমাগত, কিন্তু আপনার সন্তানেরা এখনও উপযুক্ত হয় নাই। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত, কারণ আপনার তৈরী বাগানটি আপনাকে বৃদ্ধ বয়সের জন্য যথেষ্ট নিশ্চয়তা প্রদান করবে। কিন্তু হঠাৎ করে যদি কোনও দৈব দুর্ঘটনা ঘটে, যেমন- প্রচণ্ড কালবৈশাখী, বা আগুন লেগে বা বন্যায় আপনার এতদিনের পরিশ্রমে তৈরী বাগানটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলো- তখন আপনার মানসিক অবস্থা কিরূপ হবে ? যৌবনের পরিশ্রমের ফসল বাগানটি ছিল আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যতের আশ্রয়স্থল। এক মূহুর্তের প্রাকৃতিক দুর্যোগে তা শেষ হয়ে গেলে বর্তমানের সাথে অতীতের পরিশ্রম ও ভবিষ্যতও শেষ হয়ে যায়। এই পৃথিবীর জীবন পরকালের জীবনের জন্য 'শিক্ষানবীশকাল' (probationary period)। আমরা পৃথিবীর জীবনকে স্বাচ্ছ্বন্দময় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করি। ফলে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি আমাদের হাতের মুঠোয় ধরা দেয়। আমাদের ধারণা জন্মায় আমরা নিজের এবং আমাদের সন্তান সন্তুতিদের ভবিষ্যত নিরাপদ করতে পেরেছি। কিন্তু মানুষের ভবিষ্যতকে দেখার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। এমনও হতে পারে ঐ বাগানের উপর পতিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত আমাদের সারা জীবনে গড়া পরিশ্রমের ফসল একমূহুর্তে লণ্ডভন্ড হয়ে যেতে পারে। নূতন করে জীবন শুরু করার ক্ষমতা আমাদের থাকবে না- আবার সন্তানেরাও অনুপযুক্ত হতে পারে। সুসময়ে এই দুঃসময়ের কথা চিন্তা করে তার বিরুদ্ধে কোনও বিকল্প ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে সেই লোকটির মত বর্তমানের সাথে সাথে অতীতের কাজ ও ভবিষ্যতের আশা সবই পন্ডশ্রম হবে। যদি সে এই দুর্যোগের কথা পূর্বেই চিন্তা করে তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখতো, তবে তার সারাটা জীবনের পরিশ্রম এবং ভবিষ্যতের আশা নষ্ট হয়ে যেতো না। এখানে দুর্যোগটাকে আল্লাহ্র ক্রোধ (Wrath of God) এর প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর বিকল্প হচ্ছে সৎ কার্যে দান করা এবং পরহেজগারী অর্জন করা। দুদিনের ক্ষণস্থায়ী জীবন, চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। স্থায়ী যা তা হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করা। ইহকাল ও পরকালের স্থায়ী সুখের ঠিকানা। কিন্তু সৎ কাজে দান বা আল্লাহ্র রাস্তায় দানের ফলাফলকে আমরা যেনো নষ্ট না করি এভাবে যে গ্রহীতা আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে তাদেরকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। কারণ সে ক্ষেত্রে দানের প্রকৃত উদ্দেশ্য হবে ব্যহত। দান যেনো নাম, যশ, খ্যাতি বা আনুগত্যের উদ্দেশ্যে না হয়। আল্লাহ্ আমাদের কাজকে বিচার করবেন তার নিয়ত দ্বারা। লোক দেখানোর জন্য দান করে গঞ্জনা ও শ্লেষ দিলে সেই দানে কোনও পূণ্য নাই বা উদ্দেশ্য হাসেলের নিয়তে দান করলে কোন পূণ্য নাই।
৩১৩। 'সন্তান-সন্তুতি দুর্বল' - এ কথাটির অর্থ হতে পারে শারীরিকভাবে দুর্বল বা চরিত্রগত দুর্বলতা। অর্থাৎ পিতামাতার ভার নিতে অক্ষম।
৩১৪। ইংরেজী একটি প্রবাদ বাক্য আছে, "Charity covers a multitude of sins." কিন্তু ইসলাম এই মতবাদে বিশ্বাসী নয়। প্রকৃত দানের মূল্য তখনই থাকবে যখন, (১) দাতার নিকট মূল্যবান, এমন কিছু দান করা হয়, (২) যাহা সৎপথে উপার্জিত হয় অর্থাৎ হালাল রুজী কিংবা (৩) আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ [টিকা ২৭ দেখুন] জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করা হয়।
নম্বর (১) সম্পর্কে বলা যায় যে, এরকম দানের জিনিস এমন হতে পারে যা দাতা ব্যবহার করেন না বা দাতার তার প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত আছে। যেমন- ব্যবহৃত কাপড়। অনেক সময়ে ধনী ব্যক্তিরা ফ্যাশনের পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যবহার্য কাপড়-চোপড় নষ্ট হওয়ার পূর্বেই পরিত্যাগ করে এবং নূতন কাপড় ক্রয় করে। এরূপ ক্ষেত্রে ঐ পরিত্যক্ত কাপড় গরীবদের দান করা যায়। কিন্তু এমন কিছু দান করা উচিত নয় যা গ্রহীতা ব্যবহার করলে বিপদের সম্মুখীন হবে। উদাহরণ : যেমন ব্যবহৃত পুরানো সাইকেল কোনও গরীব ছাত্রকে দান করা হলো তার কলেজে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। সাইকেলটির ব্রেকের এবং হ্যান্ডেলের অসুবিধার জন্য ঐ ছাত্রটি পথ চলার সময়ে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলো। এ ক্ষেত্রে ঐ সাইকেলটি দেয়া দান হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ যে দান গ্রহীতার উপকার অপেক্ষা অপকার করে তা সর্বশক্তিমানের কাছে দান হিসেবে গণ্য নয়। আবার মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে নেশার দ্রব্য ক্রয়ের জন্য সাহায্য করা দান নয়।
(২) 'হালাল রুজী' - সৎ পথে অর্জিত সম্পদ ব্যতীত যে অর্থ সম্পদ তা দানের অযোগ্য। আমাদের সামজে অনেক লোক আছে যারা ঘুষ, কলোবাজারী ইত্যাদি অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে এবং রোজার মাসে দান-ধ্যানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। আবার অনেকে মনে করে যে বড় লোকদের অর্থকড়ি ডাকাতি বা জোরপূর্বক অপহরণ করে যদি তা গরীবের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করা হয় তবে তাতে কোনও অন্যায় নাই। এমন কি বিশ্বসাহিত্যের 'রবীনহুডের' মত, আমাদের দেশে 'দস্যু মোহনের' মত চরিত্র কিশোর সাহিত্যে সমাধিক জনপ্রিয়। কারণ তারা, "Rob Peter to pay Paul" কিন্তু ইসলাম এই দৃষ্টিভঙ্গী সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে উপার্জিত অর্থের প্রতিটি পাই পয়সা হতে হবে সৎ পথে অর্জিত এবং হালাল। এই-ই হচ্ছে ইসলামের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী বা নিয়ম-কানুন (Code)। ইসলামের চোখে যে অর্থ সৎ পথে অর্জিত নয় সে অর্থ কোনভাবেই আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই হচ্ছে কোরানের হুকুম। অসৎ পথের অর্জিত অর্থ দ্বারা দান-ধ্যান বা সৎ কাজে ব্যয় করার মধ্যে কোনও পূণ্য নাই। কারণ তা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একথা যেনো কেউ মনে না করে দানের পূণ্য তার অসৎ পথে অর্জিত পাপকে মুছে দেবে। তা কখনই দেবে না। কারণ যারা অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে তারা সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা (peace & harmony) বিঘ্নিত করে এবং পুরো সমাজের সম্মুখে তারা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তা সমাজের বহু নবীন যুবককে পথভ্রষ্ট করে। তাই তাদের দান তাদের কৃতকর্মের পাপকে মুছে ফেলতে পারবে না।
নম্বর (৩) প্রতিটি মানুষের মধ্যে আল্লাহ্ কিছু না কিছু গুণাবলীর সৃষ্টি করেছেন। এই গুণাবলীই হচ্ছে আল্লাহ্র নেয়ামত [টিকা ২৭]। যদি এই নেয়ামত বান্দা জীবনে সৎ কাজের সন্ধানে ব্যয় করে তবেই তা সার্থক ও দান। কিন্তু তা না হয়ে যদি এই নেয়ামতকে অসৎ কাজে ব্যবহার করা হয় তবে তা পাপ। আল্লাহ্ মানব সন্তানকে বহু ধরণের নেয়ামত দিয়েছেন : শিল্প, সাহিত্য, প্রশাসনিক দক্ষতা, সঙ্গীত, বিজ্ঞান, বাণিজ্য ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন প্রতিভাধর ব্যক্তির জন্ম হয়, সেই কারণে মানব সভ্যতা ক্রমাগত অগ্রসরমান। আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে, সর্বোচ্চ দান হচ্ছে সেই দান যে তার প্রতিভা বা দক্ষতা অন্যকে শিক্ষা দেয় অথবা এই দক্ষতা বা প্রতিভার যা ফসল তা সে অন্য সবার সাথে ভাগ করে নেয়। সেই রকমভাবে যে দক্ষতা বা প্রতিভা অন্যায় কাজে ব্যবহৃত হয়, যেমন- বাণিজ্য প্রতিভাকে কালোবাজারীতে ব্যবহার করা, ঋণ-খেলাপী হওয়া ইত্যাদি বা প্রশাসনিক ক্ষমতাকে জনগণের খেদমতের পরিবর্তে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা পাপ, তখন আল্লাহ্র এই নেয়ামতের ব্যবহার দ্বারা বান্দা জীবনে দানের পূণ্য অর্জন করতে সক্ষম হয় না। কারণ আল্লাহ্র এইসব নেয়ামতের অপব্যবহার দ্বারা তারা সমাজের নৈতিকতা ধ্বংস করলো। ফলে তা কলঙ্কিত হলো, তা পাপে পরিণত হলো।
[অনুবাদকের মন্তব্যঃ বাংলাদেশ, যে দেশে অশিক্ষিতের হার এবং দরিদ্রের হার এত বেশী সেখানে শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, যথা- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি এরা আল্লাহ্র নেয়ামতে ধন্য। এদের উপরে আল্লাহ্ কর্তৃক দায়িত্ব হচ্ছে যাকে আল্লাহ্ যে স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন, সেখান থেকেই তার মেধা ও দক্ষতা দ্বারা সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করা। অর্থাৎ বিবেকের সাথে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করা। তবেই সেটা হবে তার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দান। আর তা না করে যদি তারা এই দক্ষতার দ্বারা অন্যায়ভাবে টাকা উপার্জন করতে চায় নিজস্ব সুখ ও সুবিধা ভোগ করার জন্য, তবে তা হবে পাপ। যেমন : ডাক্তার যদি তার কর্তব্য না করে, ইঞ্জিনিয়ার যদি তার কর্তব্য না করে, শিক্ষক যদি তার কর্তব্য না করে তবে তা পাপ। আর স্ব স্ব কর্তব্য যদি নিষ্ঠার সাথে পালন করে তবে তা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ দান এবং আল্লাহ্র এবাদত।
৩১৫। উপরের টিকাতে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি সম্বন্ধে যেগুলি ব্যয় করার মধ্যে কোনও দানের পূণ্য নাই। কারণ ঐ বস্তুগুলি হচ্ছে খারাপ পথে অর্জিত সম্পদ। এখানে সাবধান করা হচ্ছে আমরা ঐ সব খারাপ পথে অর্থ সম্পদ উপার্জন করা থেকে দূরে থাকবো। কারণ তা পাপ, আর ঐ পাপ পথে অর্জিত অর্থ দান দ্বারা অর্জিত পাপকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ হালাল রুজীর দান ব্যতীত আল্লাহ্র কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা হয়তো আমাদের বিবেককে সান্ত্বনা দিতে পারি যে, আমরা সৎ কাজে প্রচুর দান করেছি সুতরাং অসৎ অর্জিত সম্পদের যে পাপ তা ঐ দানের পূণ্য দ্বারা ক্ষয় বা শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে হারাম উপায়ে অর্জিত বস্তু আল্লাহ্ কবুল করেন না।
৩১৬। 'চক্ষু-বন্ধ করে থাকা' - এ কথাটির দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, সেই সব নৈতিকতা বর্জিত কাজ যা বিবেক সম্পন্ন লোক গ্রহণ করতে পারে না। 'চক্ষু-বন্ধ' অর্থাৎ বিবেককে বাদ দিয়ে যা করা হয়।
৩১৭। অসৎ পথে উপার্জিত অর্থ আল্লাহ্র নিয়তে দান করার অর্থ আল্লাহকে অসম্মান করা। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত। তিনি বান্দার অর্থ সম্পদ চান না। তিনি চান বান্দার সমর্পিত হৃদয়। পূত পবিত্র হৃদয়ের দান, যে দান নির্মল হৃদয় থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত। সমস্ত প্রশংসার মালিক আল্লাহ্।
৩১৮। ভালো মন্দের অবস্থান পরস্পর বিপরীত মেরুতে। কারণ ভালো এবং মন্দের নিয়ত সম্পূর্ণ বিপরীত। ভালো এবং মন্দের এই যে বৈষম্য তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় দানের নিয়তের মাধ্যমে। মন্দ সব সময়েই ভালো কাজে বাধা দান করবে। তাই যখন কোনও সৎ কাজের সংকল্প নেয়া হয়, তা শয়তানের দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয়। মনের কোণে ভীড় করে যদি এই অর্থ ব্যয় তাকে দারিদ্রের মধ্যে টেনে আনে ? আবার অনেকে সৎ কাজে দান করার মত অর্থের সঙ্গতি করতে পারে না কারণ তাদের স্বার্থপরতা, লোভ, তাদের উচ্চ জীবন যাত্রার মান এবং জীবন যাত্রার মানের মানদণ্ড বজায় রাখার জন্য প্রচুর অপব্যয় এবং পরস্পরের মধ্যে এই অপচয়ের প্রতিযোগিতা, তাদের সৎ কাজে ব্যয় থেকে নিবৃত রাখে। অর্থাৎ স্বার্থপরতা, লোভ, অপচয়, ভোগ-বিলাস তাদের সৎ কার্যে এবং দানের মানসিকতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। অপরপক্ষে, আল্লাহ্ সর্বদা আমাদের ভালোর দিকে আহবান করেন। তিনিই গোনাহ্ মাফকারী, তিনি প্রাচুর্যময়, তিনি সব কিছু দিতে পারেন, তিনিই একমাত্র প্রশান্তি দানকারী। আল্লাহ্ কারও সৎ কাজ ধ্বংস বা নষ্ট হতে দেন না। তিনি সুবিজ্ঞ অর্থাৎ নিয়ত অনুযায়ী ফল দান করেন। যদি কারও সৎ কাজ নষ্ট হয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে তার নিয়ত খাঁটি ছিল না। কারণ আল্লাহ্ আমাদের অন্তরের নিশানা জানেন। তাঁর কাছে কিছুই গোপন থাকে না। তাঁর কল্যাণের হাত সবার জন্য প্রসারিত কিন্তু যারা জ্ঞানী শুধু তারাই পারে সেই কল্যাণের হাত ধরতে। সত্য কথা হলো এই যে, যাকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান দান করা হয়েছে। বিরাট কল্যাণকর বস্তু সে প্রাপ্ত হয়। বস্তুতঃ উপদেশ তারাই গ্রহণ করে যারা জ্ঞানবান।
২৭০। যা কিছু তোমরা দানে অথবা মানতে ব্যয় কর, নিশ্চিত থেকো আল্লাহ্ তা জানেন। আর পাপীদের জন্য কোন সাহায্যকারী নাই।
২৭১। তোমরা যদি দানের কথা প্রকাশ কর ৩১৯, তাহলেও তা ভালো। কিন্তু তোমরা যদি তা গোপন রাখ এবং [প্রকৃত] অভাবগ্রস্থকে দাও তবে তা তোমাদের জন্য সর্বোত্তম। ইহা তোমাদের [আত্মার] পাপের কিছু [দাগ] মোচন করে দেবে। তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ্ সবিশেষ অবহিত।
৩১৯। দান গোপনে করাই সর্বশ্রেষ্ঠ। অবশ্য প্রকাশ্য হলেও ক্ষতি নাই। যদি তা জনসাধারণের উপকারার্থে হয়। দানের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত নিঃশব্দে, গোপনে, নিঃস্বার্থভাবে অভাবী মানুষের কাছে দান পৌঁছে দেয়া। কারণ দানের নিয়ত দ্বারা আল্লাহ্ এর বিচার করবেন। সৎ কর্মে দানের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ। যদি দানের উদ্দেশ্য হয় লোক দেখানো এবং খ্যাতি এবং যশঃ তবে সে উদ্দেশ্য গ্রহীতার কাছে যতই গোপন থাকুক না কেন আল্লাহ্র কাছে তা প্রকাশ হয়ে যাবেই। ফলে দানের দ্বারা আমাদের আত্মিক উন্নতির পথ হয়ে যাবে রুদ্ধ। আমাদের আত্মার উন্নতির জন্য প্রয়োজন নিঃস্বার্থ দানের নিয়ত ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ। একমাত্র খাঁটি নিয়তই আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভে সক্ষম। যাকে দান করা হবে তাকে হতে হবে 'অভাবগ্রস্থ'।
৩২০। অনেক সাহাবী, কাফিরদেরকে এ উদ্দেশ্যে দান খয়রাত দিতেন যে, সম্ভবতঃ এ কৌশলে কিছু লোক মুসলমান হয়ে যাবে; এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও এ মতই প্রকাশ করেছিলেন। তাই এই আয়াতে আল্লাহ্ রাসূল (সাঃ) কে সম্বোধন করে বলেছেন যে, তাদেরকে সৎ পথে নিয়ে আসা আপনার দায়িত্ব নয়, যে কারণে এত সূক্ষ্ণ আয়োজন করতে হবে। কিন্তু এটি তো আল্লাহ্ তায়ালার কাজ, যাকে ইচ্ছা সৎ পথে নিয়ে আসবেন। আপনার কাজ শুধু হেদায়েত পৌঁছে দেওয়া। দানের সাথে হেদায়েতের কোনও সম্পর্ক নাই। দানের প্রধান শর্ত হচ্ছে অভাবী মানুষের অভাব মোচন। এ অভাব হতে পারে বিদ্যার, অর্থের, শক্তির ইত্যাদি। আয়াত [২ : ২৭১]-এ 'অভাবগ্রস্থ' কথাটির দ্বারা এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে। এই অভাবগ্রস্থ মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করা চলবে না। তাদের একটাই পরিচয় তারা অভাবগ্রস্থ। কাজেই এ চিন্তা করা উচিত নয় যে দান শুধু মুসলমানেরাই পাবে- কাফিররা পাবে না। কে দানের যোগ্য সে বিচারের ভার আমাদের আল্লাহ্ দেন নাই। আমাদের উপরে হুকুম হচ্ছে অভাবগ্রস্থের অভাব মোচন; সে ভালো হোক মন্দ হোক কাফির হোক, মুসলমান হোক সকলেই সমান হকদার। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় এই আয়াতটি [২ : ২৫৬] "ধর্মের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা নাই" উপরের বক্তব্যটি সমর্থন করে। বাধ্যবাধকতার অর্থ শুধু এই নয় যে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করা যায়। বাধ্যবাধকতার অর্থ এই হতে পারে যে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। অর্থাৎ দানের মাধ্যমে কাউকে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল করা এবং তার প্রতিদানে তাকে ধর্মান্তরিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা। দান বা ঘুষ বা সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি কোনও কিছুই যেনো ধর্মান্তরিতদের জন্য প্রযোজ্য না হয়। দানের উদ্দেশ্য হবে একটাই আর তা হচ্ছে, অভাবগ্রস্থের অভাব মোচন করা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভই হচ্ছে দানের প্রধান উদ্দেশ্য। আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করলেই পরিণামে তা নিজের জন্য কল্যাণকর হবে। যদিও এই আয়াতটি আল-মুস্তফা (সাঃ) কে সম্বোধন করে বলা, কিন্তু এর প্রয়োগ সর্বকালের, সর্বযুগের এবং সর্বসাধারণের জন্য।
৩২১। দেখুন [২ : ১১২] আয়াতে টিকা। 'Wajh' এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে 'মুখ' বা 'প্রসন্নতা' অর্থ অনুগ্রহ, করুণা বা সান্নিধ্য অর্থে। [আরও দেখুন টিকা ৩১৯]।
৩২২। তারতম্যহীনভাবে দান করাকে ইসলাম অনুমোদন করে না। অর্থাৎ যার প্রয়োজন নাই তাকেও দান করলাম, এরূপ দানকে দান বলে গণ্য করা যাবে না। দান করতে হবে অভাবগ্রস্থকে। এখানে এই 'অভাবগ্রস্থ' কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা মহত্তর আদর্শের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন এবং এই কারণে অর্থাভাবে কষ্ট বোধ করেন তাদেরকেই অভাবগ্রস্থ বলা হচ্ছে। যেমন- আয়াতে [২ : ২৬২]-এ বলা হয়েছে "যারা আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয় করে"। এখানে আল্লাহ্র পথ এবং অভাবগ্রস্থ এক সূত্রে গাঁথা। আল্লাহ্র পথকে সংঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। মানুষের মঙ্গলের জন্য যে কোনও সৎ কাজই হচ্ছে আল্লাহ্র পথে খরচ করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; কেউ যদি বিনা বেতনে বিদ্যা দান করেন বা জ্ঞান অর্জনের জন্য অর্থ উপার্জনের দিকে মনোযোগ দিতে না পারেন বা কোনও বিশেষ নীতির কারণে নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন, সে কারণে অর্থাভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে এরা পথপার্শ্বের ভিক্ষুকদের মত দোরে দোরে ভিক্ষা করতে পারেন না কিন্তু এদের অর্থাভাব হচ্ছে জীবনের মহত্বর বিকাশের কারণের জন্য। আবার অনেক মহৎ ব্যক্তি দেখা যায় যারা দুঃখী মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। যেমন- মাদাম তেরেসা। এরা দোরে দোরে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন না। এখানে অভাবগ্রস্থ বলতে এদেরকেই বোঝানো হচ্ছে। কারণ এরা মানুষের মঙ্গলের জন্য, সমাজের উন্নতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এদের পিছনে অর্থ খরচ করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করা। সমাজের যারা সম্পদশালী - তাদের এবং সরকারের উচিত এদের সনাক্ত করে এদের অর্থ সাহায্য করা যেনো এরা সমাজের কল্যাণের জন্য অধিকতর কাজ করতে পারেন।
রুকু - ৩৮
৩২৩। দানের বৈশিষ্ট্যের প্রধান প্রধান অংশগুলি এখানে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে [নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে নিয়োজিত করা, নিজের অর্থ সম্পদ দান করা]। কারণ এর পরের আয়াতেই দানের বিপরীত ধর্মের সমালোচনা করা হয়েছে। নিঃস্বার্থ দানের বিপরীত হচ্ছে, লোভ, স্বার্থপরতা, সুদ খাওয়া ইত্যাদি যারা দুঃস্থদের শোষণ করতে দ্বিধা বোধ করে না। এই আয়াতে বলা হয়েছে যারা নিঃস্বার্থভাবে দান করতে পারে, তাদের আত্মা সমৃদ্ধ হয়। এই সমৃদ্ধি আর্থিক নয়। এই সমৃদ্ধি আত্মিক। এদের জীবন (আত্মা), সুখ ও শান্তিতে ভরে যায়। জীবন থেকে অস্থিরতা, জীবন যাপনের ক্লেশ, প্রাত্যাহিক দিন যাপনের মানসিক চাপ, ভীতি সব দূর হয়ে যায়। আত্মায় নেমে আসে এক অনাবিল শান্তি। একেই বলা হচ্ছে, যে দান করে সে নিজের কল্যাণের জন্যই করে। অপরপক্ষে যে আর্ত মানবতাকে সাহায্যের পরিবর্তে শোষণ করে তার আত্মার অবনতি হয়।
৩২৪। সুদ খাওয়াকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনও দ্বিমতের অবকাশ নাই। অবতরণের দিক থেকে এটি সর্বশেষ আয়াত। এরপর কোন আয়াত অবতীর্ণ হয় নাই। এর একত্রিশ দিন পর হুযুর (সাঃ) ওফাত পান। কোন কোন রেওয়ায়েতে নয় দিন পর হযরত রাসূলে করীমের (সাঃ) ওফাতের কথা বর্ণিত আছে। ইবনে খাতিবের ভাষ্য অনুযায়ী হযরত ওমর তার খেলাফতের সময়ে সুদের ব্যাপারে বেশ কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হন। কারণ এ ব্যাপারে বিশদ কিছু ব্যাখ্যার পূর্বেই হযরত (সাঃ) পরলোক গমন করেন। হযরত ওমর যে তিনটি প্রশ্নের সমাধানের জন্য আল্লাহ্র রাসূলের ব্যাখ্যার অভাব অনুভব করেছিলেন, সূদের ব্যাপারটি ছিল তার অন্যতম। কারণ ইসলাম সে সময়ে এক বিরাট শক্তি হিসাবে পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল বৈকি। আমাদের প্রাচীন ও বর্তমান ওলেমাগণ সুদের উপর বহু গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণার মূল ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিলো ইসলামের অভ্যুত্থানের সময়ের আর্থ-সামাজিক পটভূমি। যেহেতু বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং বিতর্কমূলক, সুতরাং ইউসুফ আলী সাহেব বিষয়বস্তুটি অন্য সময়ে যথাযোগ্য পরিবেশে উপস্থাপন করতে মনস্ত করেন। ইউসুফ আলী সাহেবের মতে এর সংজ্ঞা হওয়া উচিত নিম্নরূপ : সোনা, রূপা, প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী [যথা : গম, যব, বার্লি, খেজুর, ধান ইত্যাদি] ধার দেয়ার পরিবর্তে যে মুনাফা অর্জন করা হয় তাই সুদের আওতায় পরে। ইউসুফ আলী সাহেবের সংজ্ঞা অনুযায়ী যে কোনও প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ধারের বিনিময়ে মুনাফা অর্জনই সুদ। এ ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের ব্যাংকের হিসাব নিকাশ অন্তর্ভূক্ত কি না তা গবেষণার বিষয়।
৩২৫। সুদখোরেরা অনেকে এই প্রশ্ন তুলেছিল যে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদেরই অনুরূপ এবং সুদের মাধ্যমে যেমন মুনাফা অর্জিত হয়, তেমনি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমেও মুনাফা অর্জনই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এই উক্তির জবাবে আল্লাহ্ বলেছেন যে, এরা ক্রয়-বিক্রয়কে সুদের অনুরূপ বা সমতুল্য বলেছে, কিন্তু আল্লাহ্র নির্দেশের ফলে এ দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য বিরাজমান। সৎ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প কারখানার প্রসার ব্যক্তিগত এবং জাতিগত উন্নতির চাবিকাঠি। অন্যদিকে মহাজনি সুদখোর টাকা পয়সার লালসায় এমন বিভোর হয়ে পড়ে যে, কোন দরিদ্রের প্রতি তার সামান্য দয়ারও উদ্রেক হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানার প্রসারের ফলে বহু বেকারের কর্মসংস্থান হয় একদিকে, অন্যদিকে জাতীয় আয় এবং মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে মহাজনি সুদখোরের ব্যবসাতে গরীব আরও গরীবে পরিণত হয় এবং জাতীয় জীবনে এর কোন সু-প্রভাব নাই। সুদখোর রক্তচোষা ছারপোকার ন্যায়। এখানেই ব্যাংকের সুদ ও মহাজনি সুদের মধ্যে পার্থক্য।
৩২৬। বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সুদের মধ্যে যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান, তা ইউসুফ আলী সাহেবের পূর্ববর্তী টিকাতে আলোচনা করা হয়েছে। Bai [আক্ষরিকভাবে বিক্রয় বা বাণিজ্য] শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন কাজ-কারবারের জন্য ব্যবহৃত হয়। এ ব্যাপারে ইসলামি বিশ্বকে গবেষণা করে এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।
২৭৭। যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং নিয়মিত সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাদের প্রভুর নিকট তাদের পুরস্কার রয়েছে। তাদের কোন ভয় নাই, তারা দুঃখিতও হবে না ৩২৭।
৩২৭। আয়াত [২:২৭৪] থেকে শুরু হয়েছে দান-ধ্যান ও সুদের মধ্যে তুলনা করা। আয়াত [২:২৭৪] এ এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে, "তাহাদের পুরস্কার তাহাদের প্রতিপালকের নিকট আছে। তাহাদের কোন ভয় নাই, এবং তাহারা দুঃখিতও হবে না;" - যার বিষয়বস্তু ছিল দানের উপকার বর্ণনা প্রসঙ্গে। এই আয়াতে [২ : ২৭৭] সেই একই লাইন ব্যবহার করা হয়েছে, এর পরবর্তী আয়াতসমূহতে উত্তমর্ণকে অধমর্ণের সাহায্যের জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশসমূহ করা হয়েছে। (ক) অধমর্ণের সুদ মাপ করে দিতে, (খ) অধমর্ণকে আসল শোধ করার জন্য সময় দিতে; (গ) যদি সম্ভব হয় অধমর্ণের সব ঋণ মাপ করে দিতে যাতে উত্তমর্ণ দাতার সওয়াব লাভ করতে পারে। [তবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে অথবা পারিবারিক বিশৃঙ্খলা তৈরী করে শুধুমাত্র সওয়াবের জন্য তা করা যাবে না। এখানে সম্ভব হলে তবেই ক্ষমা করতে হবে।]
২৭৯। যদি তোমরা তা না কর, তবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও ৩২৮। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। অন্যায়ভাবে [মূলধনের বেশী চেয়ে] অত্যাচার করো না, এবং তোমরাও [মূলধনের কম গ্রহণ করে] অন্যায়ভাবে অত্যাচারিত হবে না।
৩২৮। 'যুদ্ধ' এখানে যে যুদ্ধের উল্লেখ করা হয়েছে, সে যুদ্ধ মতপার্থক্যের যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধের ঘোষণা আল্লাহ্ ও রাসূলের পক্ষ থেকে করা হয়েছে নিপীড়িত ও শোষিত অধমর্ণদের পক্ষ থেকে।
২৮১। সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমাদের [সবাইকে] আল্লাহ্র নিকট ফিরিয়ে আনা হবে। অতঃপর প্রতিটি আত্মাকে যা সে [পৃথিবীতে] উপার্জন করেছে তার [মূল্য] পরিশোধ করা হবে। এবং কারও প্রতি [এতটুকু] অন্যায় করা হবে না।
রুকু - ৩৯
৩২৯। এই আয়াতে ব্যবসায়িক লেনদেনের শর্তাবলী আলোচনা করা হয়েছে। আয়াতটিতে লেনদেনের দুটো পর্যায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এক হতে পারে ধারে মাল খরিদ করা এবং পরবর্তীতে দাম শোধ করা, অন্যটি হতে পারে অগ্রিম অর্থ প্রদান করা এবং পরবর্তীতে নির্দিষ্ট স্থানে মাল সরবরাহ করা। কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে এসব ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে অবশ্যই লিখিত দলিলের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং সাক্ষী রাখা উত্তম।
৩৩০। দলিল লেখকদের সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে, যিনি লিখবেন, তাকে অবশ্যই ন্যায়বান হতে হবে, যেনো কোনও পক্ষের হয়ে অন্যপক্ষের জন্য অন্যায় দলিল রচনা না করেন। এ কথা সর্বদা মনে রাখতে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সব জানেন ও দেখেন। এ কথা যারা দলিল লিখবেন তারা অবশ্যই মনে রাখবেন যে লেখাপড়া করতে পারা, খুব বড় নেয়ামতপ্রাপ্ত হওয়ার সামিল। আল্লাহ্র এই নেয়ামতকে মানুষের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করা উচিত। যাকে আল্লাহ্ পড়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, লেখার ক্ষমতা দিয়েছেন, তাকে আল্লাহ্ অশেষ নেয়ামত দান করেছেন। কারণ লেখাপড়া করতে পারাই হচ্ছে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের চাবিকাঠি। বিশেষতঃ আমাদের মত দেশে যেখানে অশিক্ষিতের হার অত্যন্ত বেশী, সেখানে শিক্ষিত লোকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত বেশী এবং সে সম্বন্ধে আল্লাহ্র হুকুম এখানে বর্ণিত হয়েছে।
৩৩১। "ঋণ গ্রহীতা যদি নির্বোধ অথবা দুর্বল হয়, অথবা লিখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে" - সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি চুক্তির বিষয়বস্তু বর্ণনা করতে অক্ষম। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক অবশ্যই ন্যায়ের সাথে এবং বিশ্বস্ততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করবেন।
৩৩২। সাক্ষী নির্বাচনের ব্যাপারে পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন তাকে নিজস্ব চেনা পরিচিত মন্ডল থেকে নির্বাচন করাই শ্রেয়ঃ। কারণ লেনদেনের পুরো প্রক্রিয়ার সাথে সে পরিচিত থাকায়, তার পক্ষে ঘটনাটি অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে, সাক্ষ্যদাতাকে সহজেই হাজির করানো সম্ভব হবে।
৩৩৩। উপরের আয়াতটিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে যাতে শৃঙ্খলা রক্ষা হয় এবং অন্যায় সংঘটিত না হয় সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। আয়াতটিতে নৈতিক মূল্যবোধের উপরে যেরূপ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সমগুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে নিজেদের মধ্যে দরদস্তুরের উপরে, লেনদেনের ব্যাপারে, সাক্ষীর ব্যাপারে, উপযুক্ত লিখিত দলিলের ব্যাপারে। শুধু তাই-ই নয় নৈতিকতার প্রশ্নে সকলেই সমান দায়ী। এমন কি যে দলিল লেখক তাকেও এখানে নৈতিকতার প্রশ্নে আল্লাহ্র কাছে দায়ী করা হয়েছে। ন্যায়পরায়ণতা বা সততাকে পৃথিবীর লাভ ও ক্ষতির মাপকাঠিতে, নিজের সুযোগ সুবিধার্থে যেনো প্রয়োগ করা না হয়। ন্যায়, সত্য ও সততা হবে সব কিছুর উর্ধ্বে, এই হচ্ছে ধার্মিক লোকের বিবেক। এ কথা সকলকেই স্মরণ রাখতে হবে যে প্রাত্যাহিক জীবন ও ধর্মীয় জীবন কোন আলাদা ব্যবস্থা বা দফতর নয়। ইসলামের চোখে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্য হবে প্রধান চালিকা শক্তি। এমন কি প্রাত্যাহিক জীবনে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, লেনদেনের ক্ষেত্রে এ কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে আমাদের সব নেওয়া-দেওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমরা করছি আল্লাহ্র চোখের সম্মুখে। সামান্যতম অন্যায়ও তার চক্ষুকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। এই জীবনবোধই হচ্ছে ইসলামিক জীবনবোধ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্র উপস্থিতি অনুভব করা ও তার হুকুম মত জীবন অতিবাহিত করা, এই হচ্ছে ইসলামের মূল দর্শন।
৩৩৪। যদি কেউ সফরে থাকে এবং বাকীর ব্যাপারে যদি কেউ বিশ্বস্ততার জন্য কোন বস্তু বন্ধক নিতে চায়, তাও করতে পারে। কিন্তু বন্ধকী বস্তু দ্বারা উপকৃত হওয়া তার জন্য জায়েয নয়। সে শুধু ঋণ পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত একে নিজের অধিকারে রাখবে। এর যাবতীয় মুনাফা আসল মালিকের প্রাপ্য।
৩৩৫। বন্ধকীর ব্যাপারে যিনি গচ্ছিত রাখেন তার উপর বিশ্বস্ততার এবং ন্যায় পরায়ণতার অঙ্গীকার করা হয়েছে। বন্ধকী জিনিস গচ্ছিত রাখা হচ্ছে আমানত রক্ষা করা। আমানতকারীর কর্তব্য হচ্ছে আমানতকৃত জিনিসের প্রকৃত তত্ত্বাবধান করা এবং ঋণ শোধের পরে তা মালিকের নিকট প্রত্যার্পন করা। আর এই কাজকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার জন্য আল্লাহকে ভয় করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ- এটা একটা ধর্মীয় বিধান যে, কোনও অবস্থায়েই আমানত খেয়ানত করা চলবে না। এই আমানত শুধুমাত্র টাকা পয়সা বা মূল্যবান বস্তুসামগ্রীই নয়। আমানত বহু প্রকার। উদাহরণঃ যিনি প্রশাসনে সরকারী চাকুরী করেন জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা তার জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত আমানত। যিনি ডাক্তারী করেন তার জ্ঞান ও সেবা জনগণের জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত আমানত, যিনি শিক্ষকতা করেন তার মেধা ও জ্ঞান শিক্ষার্থীর জন্য আল্লাহ্ কর্তৃক তার আমানত ইত্যাদি। একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায় সমাজে আমরা প্রত্যেকেই আল্লাহ্র কাছে 'আমানতের' অঙ্গীকারে আবদ্ধ, আল্লাহ্ প্রদত্ত সামর্থ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে আমাদের পরীক্ষা করা হয় আমরা এর খেয়ানত করি কিনা, এই হচ্ছে ধর্মীয় বিধান বা আল্লাহ্র আইন। সাধারণ আইনের সাথে আমরা একে যেনো এক করে না দেখি। কারণ সাধারণ আইন প্রণীত হয় মানুষ দ্বারা। আর ধর্মীয় আইনের প্রণেতা স্বয়ং আল্লাহ্। বাংলাদেশীদের বিবেচ্য তারা এই ধর্মীয় বিধান কতটুকু মানেন।
৩৩৬। লোভ-লালসায় ভরা এই পৃথিবী। এই লোভের বশবর্তী হয়েই আদম (আঃ) কে বেহেশত থেকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। প্রাত্যাহিক জীবনে চলার পথে আমরা অনেক সময়েই লোভের শিকার হই ঐ হযরত আদমের (আঃ) মত। দেখা যায় সত্যকে সামান্য বিকৃত করলে বা গোপন করলে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দান করলে বিরাট জাগতিক লাভ হয়। হতে পারে তা আর্থিক বা সামাজিক। এখানে আল্লাহ্ এই প্রলোভনের বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন, সত্যকে গোপন করে মিথ্যা সাক্ষীর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। মিথ্যা সাক্ষীর পরিণামে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিক জীবন বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কারণ এর ফলে আমাদের নৈতিক অধঃপতন হয়, ফলে আমাদের আধ্যত্মিক জীবনের শুভ্রতা নষ্ট হয়ে কালিমার দাগ পড়ে। আমাদের হৃদয় হয়ে পড়বে তমসাবৃত। এখানে আয়াতে বলা হয়েছে "হৃদয় পাপ দ্বার রঞ্জিত হয়"। এই অন্তর বা হৃদয় কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সকল গোপন ইচ্ছার প্রথম সৃষ্টি হয় এই অন্তরে। পাপ ও পূণ্য সবই অন্তরের ইচ্ছার প্রতিফলন। মিথ্যা সাক্ষীর অপরাধে এই অন্তর পাপের অন্ধকারে ঢেকে যায়। যদিও তা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টিগোচর নয়। ফলে তার আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতির পথ হয়ে যায় রুদ্ধ। কারণ অন্তর বা হৃদয়ই হচ্ছে প্রেম ও ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহ্-প্রেম হচ্ছে জীবনের সর্বোচ্চ প্রেমের পরিণতি। আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে ভালোবাসার শীর্ষবিন্দু। মিথ্যার বেসাতি, প্রেম ভালোবাসার এই কেন্দ্রবিন্দুকে নষ্ট করে দেয় ফলে তার পক্ষে উন্নততর আধ্যাত্মিক জীবনের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।
[উপদেশঃ মিথ্যা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য।]
রুকু - ৪০
২৮৫। রাসূল তাঁর প্রভুর নিকট থেকে তাঁর প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে এবং মুমিনগণও ! এরা প্রত্যেকে আল্লাহতে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর কিতাবে, তাঁর রাসূলগণে বিশ্বাস স্থাপন করে ৩৩৭। [তারা বলে] "আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোন তারতম্য করি না ৩৩৮।" এবং তারা বলে, "আমরা শুনলাম এবং আমরা মান্য করলাম। হে আমাদের প্রভু, [আমরা] তোমার ক্ষমা চাই ৩৩৯। [জীবনের] সকল যাত্রা পথের সমাপ্তি তো তোমার কাছে এসে।"
৩৩৭। এই সূরার আরম্ভ বিশ্বাস (faith) বা ঈমান এর পূর্ণ বিবরণ দিয়ে [২ : ৩-৪] ঈমান বলতে কি বুঝায় তাই বর্ণনা করা হয়েছে উপরিউক্ত আয়াতে। সূরা বাকারা কুরআন শরীফের সর্বাপেক্ষা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সূরা। আল্লাহ্র বিধি বিধানের বিরাট অংশ এতে বিবৃত হয়েছে। এ সূরায় গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ও আনুষাঙ্গিক এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নির্দেশাবলী যথা- নামাজ, যাকাত, রোজা, হজ্ব, জিহাদ, পবিত্রতা, তালাক, ইদ্দত, খুলা তামাক এবং শিশুকে দুগ্ধ পান করানো, মদ ও সুদের অবৈধতা, ঋণ, লেনদেনের বৈধ পন্থা ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এখন আমরা এই সূরায় শেষ অংশে এসে পৌঁছেছি। ঈমানের প্রতি মোমেন বান্দাদের স্বীকারোক্তি এবং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আল্লাহ্র আইন মানার অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে সূরাটি শেষ হতে যাচ্ছে। শেষ অংশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহ্র হুকুম মানার অঙ্গীকারের সাথে সাথে বান্দা তার জানা, অজানা কৃত সব পাপের জন্য আল্লাহ্র কাছে বিনয়ের সাথে ক্ষমা প্রার্থী। অর্থাৎ মোমেন বান্দার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে বিনয়। আমাদের পৃথিবীর যাত্রাপথে, জীবনের যাত্রাপথ শেষ করবো সেই সর্বশক্তিমানের কাছে পৌঁছে। তিনিই আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল। এই শেষ গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য আমাদের আল্লাহ্র সাহায্য প্রয়োজন, আমরা বিনয়ের সাথে তার সাহায্য ও ক্ষমাপ্রার্থী। সূরাটি শুরু করা হয়েছে ঈমানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দ্বারা, শেষ করা হয়েছে ঈমান মানার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে।
৩৩৮। দেখুন আয়াত [২ : ২৫৩ ও টিকা ২৮৯]। আল্লাহ্র দূতদের মধ্যে (রাসূল) কোনও প্রকার ভেদাভেদ করা নিষিদ্ধ। আমরা তাদের সকলকে সমানভাবে সম্মান করবো। যদিও আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দিষ্ট কাজের জন্য তাদেরকে প্রেরণ করা হয় বিভিন্ন যুগের প্রেক্ষাপটে। যুগের প্রেক্ষিতে তাদের কাজে ছিল বিভিন্নতা এবং আল্লাহ্ তাদের সমমর্যাদা দান করেন নাই। আল্লাহ্র কাছে তাদের মর্যাদাক্রমও ছিল বিভিন্ন। কিন্তু আমাদের উপর মুসলিম হিসেবে হুকুম হচ্ছে সকলকে সমভাবে সম্মান করা।
৩৩৯। যখন আমাদের ঈমান বা বিশ্বাস এবং আচরণ হয় আন্তরিক শুধু তখনই আমরা আমাদের চরিত্রের দোষত্রুটি অনুধাবন করতে সক্ষম হব। এই অনুধাবনের ফলে আমরা বিনয়ের সাথে, অনুনয়ের সাথে আমাদের কৃত অপরাধ, দোষত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হব মহান আল্লাহ্র দরবারে। আমরা জানি আমরা সাধারণ মানুষ। প্রতি মূহুর্তে অন্যায় ও ভুলের দ্বারা বিপথে চালিত হই। আল্লাহ্ পরম করুণাময় ও ক্ষমাশালী। যত দোষই করা হোক না কেন প্রকৃত অনুতাপকারীকে আল্লাহ্ ক্ষমা করে দেবেন কারণ আমাদের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। যা আমাদের ক্ষমতার বাইরে আল্লাহ্ সে ভারে আমাদের ভারাক্রান্ত করেন না। আমাদের হৃদয়ের এই অনুভব থেকেই আমাদের অন্তরে সেই সর্বশক্তিমানের কাছে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা জাগ্রত হয়। তখনই আমরা তাঁর কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হই এবং আমাদের পরিচালনার জন্য তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি।
৩৪০। দেখুন [২ : ২৩৩] "আল্লাহ্ কোন আত্মাকে তার সাধ্যের অতীত ভার অর্পণ করেন না।" [২ : ২৮৬] আয়াতের এই লাইনটি আয়াত [২ : ২৩৩] এর পুনরাবৃত্তি। [২ : ২৩৩] আয়াতে এই কার্যাভারকে আর্থিক সঙ্গতির প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করা হয় এবং এখানে আধ্যাত্মিক শক্তির প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে আল্লাহ্ আমাদের আশ্বস্ত করছেন যে, আমাদের আত্মার যার যতটুকু ক্ষমতা, আল্লাহ্ তার কাছে ততটুকুই আনুগত্য দাবী করবেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, আমাদের ক্ষমতার যেনো পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারি, এই প্রার্থনা আল্লাহ্র কাছে করা।
৩৪১। "আমাদের উপরে সেরূপ ভার অর্পণ করে না, যেরূপ তুমি আমাদের পূর্ববর্তীদের উপরে অর্পণ করেছিলে।" এর অর্থ বনী ইসরাঈলের উপর যে সেব কঠিন কাজ-কর্ম আরোপিত ছিল। আমাদের মনে যেনো কোনও উদ্ধতপনা বা অহংকার থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করার প্রবণতা না জন্মে। বরং আমাদের এই কথা মনে রাখতে হবে যে, তারা তাদের বোঝা বা ভার (আল্লাহ্ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব) বহনে অক্ষম হয়েছিল। আল্লাহ্ আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক হালকা করে দিয়েছেন। সুতরাং এই বোধ থেকে আমরা আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণের জন্য এবং তার ক্ষমা পাওয়ার জন্য আকুতি প্রকাশ করবো। আল্লাহ্র রাস্তায় চলার জন্য একমাত্র সম্বল হচ্ছে আল্লাহ্র ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা।
এখানেই সূরা বাকারার শেষ। এই সূরায় সামাজিক বিধি-বিধান বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে। শেষ করা হয়েছে আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে। এই সাহায্য ব্যক্তিস্বার্থে নয় বরং সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে। এই সাহায্য চাওয়া হয়েছে কাফিরদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসীদের জয়ের মাধ্যমে অর্থাৎ অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের ও বিশ্বাসের জয়ের মাধ্যমে।