Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ০ জন
আজকের পাঠক ৫৬ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৭০৩ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৯২৭ বার
+ - R Print

সূরা নিসা


সূরা নিসা বা নারী - ৪

আয়াত ১৭৬, রুকু ২৪, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে]


ভূমিকাঃ এ সূরা ধারাবাহিকতায় সূরা ৩ এর সাথে সংযুক্ত। এর আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে, ওহুদের যুদ্ধের পর পরই নূতন মুসলিম সমাজে যে সমস্যা সমূহের উদ্ভব হয় তারই উপর। যদিও ঐ বিশেষ ঘটনার সময়ের প্রেক্ষিতে সূরাটি নাজেল হয়, কিন্তু এর বিধি-বিধান মুসলিম সমাজের জন্য স্থায়ীভাবে বিধিবদ্ধ হয়।
এই সূরাকে মূলতঃ দুটি অংশে বিভক্ত করা যায় : (১) একটি অংশ মহিলা, এতিম, উত্তরাধিকার, বিয়ে এবং পারিবারিক অধিকারের আইন নিয়ে আলোচিত। (২) অপর অংশ মদিনায় অবস্থিত মোনাফেকদের সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে, যারা মদিনার একটি বড় অংশ ছিল এবং যারা ছিল অবাধ্য এবং দুষ্কর্মের সহযোগী।
সারসংক্ষেপঃ সূরাটি শুরু করা হয়েছে পৃথিবীর মানুষের ঐক্য ও সংহতি দিয়ে। স্ত্রীলোক ও মহিলাদের অধিকার; এতিমদের অধিকার, পারিবারিক সম্পর্কের অর্থ, এবং মৃত্যুর পরে মৃতের সম্পত্তির সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে [৪ : ১ - ১৪]।
ইসলামে পারিবারিক জীবন এবং এই জীবনের সৌন্দর্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। অত্যান্ত বিচক্ষণতার সাথে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে পারিবারিক জীবনে মহিলাদের সম্মানীয় অধিষ্ঠানের উপরে। কারণ পারিবারিক জীবনের সৌন্দর্য্য মহিলাদের সম্মানের উপরে নির্ভরশীল। মহিলাদের অধিকার, বিয়ে, সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকারের উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ নীতিগুলি সমাজের গরীব ধনী সবার জন্য প্রযোজ্য [৪ : ১৫ - ৪২]।
মদিনার যে সব ব্যক্তি তখনও ইসলাম গ্রহণ করে নাই, তাদের মিথ্যা উপাসকের উপাসনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। অবশ্যই তারা আল্লাহ্‌র নবীকে গ্রহণ করবে এবং তার প্রচারিত বাণীকে মেনে চলবে। তবে তাই হবে তাদের জন্য বিরাট লাভের বিষয়। কারণ তারা তখন মহান সম্প্রদায়ভুক্ত [৪ : ৪৩ - ৭০]।
যারা বিশ্বাসী তারা অবশ্যই শত্রু থেকে আত্ম রক্ষার্থে নিজেদের সংগঠিত করবে। তারা মোনাফেকদের সম্বন্ধে সাবধান থাকবে। যারা দলত্যাগী তাদের প্রতি কিরূপ আচরণ করা প্রয়োজন; সে সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে [৪ : ৭১ - ৯১]।
হত্যার বিরুদ্ধে সাবধান করা হয়েছে। যারা ইসলামের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন তাদের সংশ্রব ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ধর্মীয় কর্তব্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে [৪ : ৯২-১০৪]।
বিশ্বাস ঘাতকতা এবং প্রলোভন সব অনিষ্টের বা মন্দের মূল কারণ [৪ : ১০৫ - ১২৬]।
মহিলা ও শিশুদের ন্যায়নীতির সাথে আচরণ করতে হবে। বিশ্বাসীরা হবে ন্যায়বান ও বিশ্বস্ত এবং কথাবার্তায় সংযত [৪ : ১২৭ - ১৫২]।
কিছুসংখ্যক ব্যতিক্রম ব্যক্তি বাদে কিতাবীদের মধ্যে যারা বিপথে চালিত হয়েছে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে [৪ : ১৫৩ - ১৭৬]।

সূরা নিসা বা নারী - ৪

আয়াত ১৭৬, রুকু ২৪, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে]


১। হে মানব সম্প্রদায় ! তোমার অভিভাবক প্রভুকে ভয় কর, যিনি তোমাকে এক ব্যক্তি সত্ত্বা থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তা থেকে তিনি তাঁর সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁদের দুজন থেকে [বৃক্ষের বীজের ন্যায়] অসংখ্য নর-নারী ইতস্ততঃ ছড়িয়ে দিয়েছেন। আল্লাহকে ভয় কর যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে [অধিকার] ৫০৫ দাবী কর। এবং যে গর্ভ [তোমাকে ধারণ করে] তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও ৫০৬। কারণ আল্লাহ্‌ সর্বদা তোমাদের পর্যবেক্ষণ করছেন।

৫০৫। জীবনের সকল কর্মকান্ড আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে নিবেদিত। "Ye demand your mutual (right)" যার বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে "তোমরা একে অপরের কাছে [অধিকার] দাবী কর।" পরস্পরের প্রতি আমাদের কর্তব্য ও অধিকার সবই আল্লাহ্‌র ইচ্ছা বা আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। আমরা তার দাস বা বান্দা। তার ইচ্ছাই তার বিধান আমাদের জন্য। আমরা আমাদের জীবন কতটুকু তার ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পেরেছি তাই-ই হবে মূল্যায়নের বিষয়। বিখ্যাত ইংরেজ কবি টেনিসন বলেছেন "Our wills are ours, to make them Thine." (In Memorium). আমাদের পরস্পরের প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ব সবই আল্লাহ্‌র বিধান এবং আমাদের চরিত্রের এই কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ আল্লাহ্‌রই দান।

৫০৬। মওলানা ইউসুফ আলী সাহেব লিখেছেন - "And (reverence) the wombs (that bore you)" যার বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত "যে গর্ভ তোমাকে ধারণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও।" কিন্তু অনেক বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে, "সতর্ক থাক জ্ঞাতি বন্ধন সম্পর্কে।"

আমি (অনুবাদক) মওলানা ইউসুফ আলী সাহেবের ব্যাখ্যা এখানে প্রদান করলাম।
পৃথিবীতে যতগুলি অত্যাচার্য রহস্য আছে তার মধ্যে নারী ও পুরুষের মিলনের রহস্য অন্যতম। এই মিলনের ফলেই সন্তানের জন্ম। এই মিলনের ফলেই সাংসারিক বন্ধন, প্রেম, ভালোবাসা। পুরুষ তার শারীরিক শক্তির আধিক্যে, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বোধে, অহংকারে ভুলে যায় সৃষ্টির এই আশ্চর্য রহস্যে মেয়েদের ভূমিকা তাদের থেকে কোন অংশে কম নয়। তার যুগল জীবনের সুখ শান্তি তার ভবিষ্যত জীবনের বংশধর, এ সব কিছুর জন্য সে মেয়েদের ভূমিকার কাছে ঋণী। যে গর্ভে ধারণ করে তিনি অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্রী। স্ত্রীর কারণেই পুরুষ পিতৃত্বের গৌরব অনুভব করে। এ কারণেই পুরুষ জাতির মেয়েদের সম্মান করা উচিত। পুরুষ ও নারীর মিলিত জীবনই হচ্ছে সংসার জীবনের মূল সেতুবন্ধ। সুতরাং যৌন জীবনকে কখনও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। কারণ এই মিলিত জীবনই হচ্ছে সংসারের কেন্দ্র বিন্দু। আর প্রতিটি সংসারই হচ্ছে সমাজের মূল একক। সংসারের বিশৃঙ্খলা বা মূল্যবোধের অবক্ষয়- এর অর্থই হচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। যে যৌন জীবন আমাদের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়, যা আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে পরিচালিত করে, যার সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিচালনায় আমাদের জীবন হয় ঐশ্বর্যমন্ডিত ও সমৃদ্ধ সেই যৌন জীবন সম্বন্ধে আমাদের লজ্জা, ভয় বা ঘৃণা থাকা উচিত নয়। অথবা এ জীবনকে শুধুমাত্র উপভোগের সামগ্রীতেও পরিণত করা উচিত নয়। এ জীবনকে শ্রদ্ধার সাথে, সম্মানের সাথে, সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে হবে। যে গর্ভ তোমাকে ধারণ করে অর্থাৎ স্ত্রী জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।

যারা অনুবাদ করেছেন "সতর্ক থাক জ্ঞাতি বন্ধন সম্বন্ধে" তাদের বক্তব্য নিম্নরূপ :
এই আয়াতে 'আরহাম' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা মূলতঃ একটি বহুবচনবোধক শব্দ। এর একবচন হচ্ছে 'রেহম'। আর 'রেহম' অর্থ জরায়ু বা গর্ভাশয়। অর্থাৎ জন্মের প্রাক্কালে মায়ের উদরে যে স্থানে সন্তান জন্ম লাভ করে। জন্ম সূত্রেই মানুষ পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, আত্মীয়তার ক্ষেত্রে, জ্ঞাতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপণীত হয়। সেই জন্য এখানে অনুবাদ করা হয়েছে জন্মসূত্রে জ্ঞাতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্ক বা মনোযোগী হতে।

২। এতিমদের তাদের সম্পত্তি প্রত্যার্পন করবে [যখন তারা প্রাপ্ত বয়স্ক হবে]। [তাদের] ভালোর সাথে [তোমাদের] মন্দ প্রতিস্থাপিত করো না। এবং তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ [মিশিয়ে] গ্রাস করো না কারণ নিশ্চয়ই তা মহাপাপ ৫০৭।

৫০৭। এতিমের প্রতি অন্যায় না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতিমের প্রতি ন্যায়ের বিধানকে তিনটি উপায়ে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই বিধানগুলি এতিমের যে বা যারা অভিভাবক তাদের জন্য প্রযোজ্য। (১) এতিম শিশুরা যখন সাবালক হবে, তখন অভিভাবকদের উপর অর্পিত সম্পদ বা সম্পত্তি তারা যথা সম্ভব শীঘ্র ফেরৎ দান করবে। অবশ্য [৪ : ৫] আয়াতে বর্ণিত অবস্থা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। (২) "ভালোর সহিত মন্দ প্রতিস্থাপিত করিবে না।" অর্থাৎ আইন বাঁচিয়ে শুধুমাত্র তালিকা অনুযায়ী জিনিসের হিসাব মিলালেই হবে না। উদাহরণ স্বরূপঃ একখন্ড উচ্চ ফলনশীল উর্বর জমির পরিবর্তে যদি সমপরিমাণ অনুর্বর, মরুভূমি সদৃশ্য জমি ফেরৎ দেওয়া হয়। সেইরূপ এতিমের সম্পত্তির তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি জিনিসের হিসাব মিলানোই যথেষ্ট নয়। আইনকে বা লোকচক্ষুকে ফাঁকি দেওয়াই সর্বোচ্চ বুদ্ধিমানের কাজ নয়, আমানতকারীর বিশ্বস্ততাই আল্লাহ্‌র কাছে কাম্য। যে সম্পত্তি তার কাছে গচ্ছিত ছিল ফেরত দেওয়ার সময়ে সেই সম্পত্তির মূল্য গচ্ছিত সম্পত্তির সমমান হতে হবে। গচ্ছিত সম্পত্তির তালিকা থাকুক বা না থাকুক এই নীতি সব গচ্ছিত সম্পত্তির বেলায় প্রযোজ্য। (৩) যদি আমানতকারী নিজের সম্পত্তির সাথে এতিমের সম্পত্তি মিশিয়ে সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় [যেমন- ব্যবসা-বাণিজ্য]; তবে এখানে আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে কঠোরভাবে ন্যায়নীতি মেনে চলতে হবে। এতিমের সম্পত্তি যেনো কোন অবস্থায়ই গ্রাস করা না হয়। আরও দেখুন [২ : ২২০] এবং এর টিকা।

৩। যদি তোমরা আশংকা কর যে এতিমদের প্রতি ন্যায় বিচার করতে পারবে না, ৫০৮, তবে [এতিমদের মধ্যে থেকে] দুই, তিন, অথবা চার জনকে বিবাহ করবে তোমার পছন্দমত। কিন্তু যদি আশাংকা কর তুমি [তাদের সকলের] সাথে সুবিচার করতে পারবে না, তবে শুধুমাত্র একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে [বিবাহ করবে]। ইহা তোমাদের জন্য অন্যায় রোধের অধিকতর উপযুক্ত ৫০৯।

৫০৮। এতিম মেয়েদের বিবাহের ব্যাপারে এখানে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে এই আয়াতটি নাজেল হয় ওহুদের যুদ্ধের পটভূমিতে। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বহু পরিজন শাহাদাৎ লাভ করেন। বহু নারী বিধবা হন। বহু মেয়ে এতিম হয়। এই বিধবা, এতিম নারীদের সমাজে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যেই আয়াতটি নাজেল হয়েছে। এদের প্রতি আচরণ যেন মানবিক এবং ন্যায়সঙ্গত হয়, এই আয়াতটি তারই বার্তা বহন করে। সমাজে যেনো এতিম বা বিধবারা সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে তাই-ই এই ব্যবস্থা। ওহুদের যুদ্ধ গত হয়েছে, কিন্তু এর যে নীতি তা এখনও বলবৎ আছে। এতিম মেয়েদের বিয়ের অনুমতি তখনই দেওয়া হয়েছে, যখন তাদের বিষয় সম্পত্তি ইত্যাদি ব্যাপারে পুরোপুরি স্বার্থ রক্ষা করা এবং এতিম ও নিজ পরিবারের সবার সাথে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আচরণ করা সম্ভব হবে। অন্যথায় বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এতিমের জন্য।

ঠিক এরকম পরিবেশ বা অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে। পাশ্চাত্য দেশ সমূহে সক্ষম যুব সমাজ যুদ্ধে নিহত হওয়ার ফলে দেশে বিবাহযোগ্য অবিবাহিত নারীর সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু যেহেতু তাদের ধর্মে পুরুষের এক বিয়ের রীতি, সেই কারণে বহু মেয়েকে চির জীবন কুমারী জীবন যাপন করতে হয়। যদিও এদের গ্রাচ্ছাস্বদনের অভাব ছিল না, রাষ্ট্রই তাদের সে ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু মানুষ মাত্রই কামনা বাসনা থাকবে। এই কামনা পীড়িত হয়ে বহু মেয়েকেই অবৈধ জীবন যাপন করতে হয়। মেয়েদের ঘর-সংসার করার, বা মা হওয়ার জন্মগত যে আকাঙ্খা তা পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল না। এরকম অবস্থাতেই শুধুমাত্র চার-বিয়ের সুফল ভোগ করা যায়। যারা চার বিয়ের পক্ষপাতি তাদের মনে রাখতে হবে চার বিয়ের আয়াতটি নাজেল হয়েছিল ওহদের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। শান্তির সময়ে বা সুস্থ সময়ে তা প্রযোজ্য নয়।

৫০৯। ইসলাম পূর্ব যুগে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বহু বিবাহ প্রথা চালু ছিল। পবিত্র কোরানে বহু বিবাহ রোধ করে এর সংখ্যা চারে সীমিত করে দেওয়া হয়। কোরানে চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, যদি তাদের মধ্যে সমতা ও ন্যায়ের বিধান না করতে পারে তবে এক স্ত্রীর উপরেই নির্ভর কর। সূরা নিসার এ আয়াতে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে না পারার আশঙ্কার ক্ষেত্রে এক বিয়েতেই তৃপ্ত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা শরীয়তের দোহাই দিয়ে একের অধিক বিয়ে করতে চান, তাদের চিন্তা করা উচিত আর্থিক দিক থেকে বহু-স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করলেও; মানসিক বা আবেগ বা ভালোবাসার ক্ষেত্রে তা রক্ষা করা কতটুকু সম্ভব ? এই শর্তটি এমন এক কঠিন শর্ত যা সাধারণ মানুষের পক্ষে মেনে চলা অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। এই আয়াতটির দ্বারা এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, যুদ্ধ বা এরকম বিশেষ জরুরী অবস্থায় সামাজিক শৃঙ্খলা ও মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার জন্য চার বিয়ে প্রযোজ্য।

৪। আর তোমরা [বিবাহের সময়ে] নারীদের মোহর দান করবে, নৈতিক ও [আইনগত] বাধ্যবাধকতা হিসেবে। কিন্তু যদি তারা সন্তুষ্ট চিত্তে মোহরের কিছু অংশ মাপ করে দেয় তবে তোমরা তা গ্রহণ কর এবং আনন্দচিত্তে ভোগ কর।

৫। তোমাদের সম্পদ যা আল্লাহ্‌ তোমাদের পরিচালনার জন্য দিয়েছেন তা [মানসিক] প্রতিবন্ধি ৫১০ মালিকদের হাতে অর্পণ করো না ৫১১। কিন্তু তা থেকে তাদের জন্য গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে এবং তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গতভাবে দয়ার সাথে ব্যবহার করো।

৫১০। এই আয়াতটি এতিমদের উদ্দেশ্যে নাজেল হয়েছিলো। কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন। এই আয়াতে মওলানা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন "Which Allah has assigned to you to manage" যার বাংলা অনুবাদ হয়েছে "যাহা আল্লাহ্‌ তোমাদের পরিচালনার জন্য দিয়েছেন।" পরিচালনা ও "Manage" কথাটি সমার্থক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। এর মূলনীতি ইংরেজদের বিচার বিভাগের (Chancery in English Law) এবং ভারতীয় বিচার বিভাগের আইন (Court of Wards in India) এর অনুরূপ। এখানে মনে রাখতে হবে ভারতীয় বা ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগ কোরান অবতীর্ণ হওয়ার বহু পরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিষয় সম্পদ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানার প্রশ্নই নয়, এর নিজস্ব দায় দায়িত্ব আছে। যার সম্পদ আছে সে যদি তা পরিচালনায় ব্যর্থ হয়। যদি তার সে যোগ্যতা না থাকে, তবে তার অধিকার হনন করা হবে। এর অর্থ এই নয় যে, তাকে দুঃখ দুর্দশার মধ্যে নিপতিত করা হবে। বরং তার সম্পদ ও সম্পত্তির সুষ্ঠু পরিচালনা ভার গ্রহণ করা হবে যেনো সে ও তার পরিবারের সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা হয়। এক্ষেত্রে তার প্রতি বিশেষ সহানুভূতির সাথে ব্যবহার করতে হবে। কারণ যেহেতু সে অক্ষম। তার এই অক্ষমতা যেনো তাকে আঘাত না দেয়।

৫১১। "তোমাদের সম্পদ" : এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সব কিছুর মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। সারা জাহানের অর্থ সম্পদের মালিকও আল্লাহ্‌। তবে আল্লাহ্‌ তার এই নেয়ামতের জন্য কোনও কোনও বান্দাকে আমানতকারী হিসেবে নিয়োগ করেন। যদি সে অক্ষম হয় তবে তাকে সহৃদয়তার সাথে অপসারণ করতে হবে। যতদিন সে সক্ষমতা অর্জন না করে ততদিন তার অভিভাবক তাদের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। অভিভাবক যদি সচ্ছল হয় তবে এর জন্য সে কোনও পারিতোষিক গ্রহণ করতে পারবে না। যদি অভিভাবক গরীব হয়, তবে তিনি বেতন হিসেবে কিছু গ্রহণ করতে পারবেন। অন্যথায় এই সম্পদ থেকে কোনওরূপ লাভ গ্রহণ করা তার জন্য হারাম। "Speak to them words of kindness & justice". অর্থাৎ অক্ষম ব্যক্তিদের সাথে দয়া-মায়া ও ন্যায় সঙ্গত ব্যবহার করবে।

৬। বিবাহযোগ্য [প্রাপ্ত বয়স্ক] হলে এতিমদের যাচাই করবে ৫১২। যদি তাদের মাঝে পূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেখ; তবে তাদের সম্পদ তাদের নিকট হস্তান্তর করবে। তারা বড় হয়ে যাবে বলে অপচয় করে তাড়াতাড়ি [তাদের সম্পত্তি] শেষ করে ফেল না। যদি অভিভাবক বিত্তবান হয়, তবে সে যেনো কোন পারিশ্রমিক দাবী না করে এবং যদি সে গরীব হয়, তবে সে যেনো ন্যায়সঙ্গত পরিমাণ ভোগ করে। তোমরা যখন তাদের সম্পত্তি তাদের নিকট হস্তান্তর করবে, তখন সাক্ষী রেখো। হিসাব গ্রহণে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট ৫১৩।

৫১২। বিবাহযোগ্য অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক হয়।

৫১৩। যখন কেহ তার আমানত বিশ্বস্ততার সাথে হস্তান্তর করবে, আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে তখন সাক্ষী রাখা। এখানে যে বিষয়টির উপরে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে, সমাজের চোখে বিশ্বস্ত ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণিত হওয়াই সবচেয়ে বড় কথা নয়। সবচেয়ে বড় সাক্ষী হচ্ছেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। তাঁর অবস্থান দ্যুলোকে, ভূলোকে, দৃশ্যে-অদৃশ্যে, মানুষের অন্তরে, সর্বত্র। যদি আল্লাহ্‌র কাছে বিশ্বস্ততা প্রমাণিত হয়, মনে রাখতে হবে তাহলেই একমাত্র মোমেন বান্দা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব। সুতরাং লোকচক্ষে নয় নিজের বিবেককে জাগ্রত রেখে কঠোর সাবধানতার সাথে, বিশ্বস্ততার সাথে আমানত হেফাজত ও হস্তান্তর করতে হবে। মনে রাখতে হবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র কাছে আমাদের অন্তরের গোপন ইচ্ছাটিও গোপন থাকে না। সুতরাং তাঁর কাছে মোমেন হতে হলে আমাদের অবশ্যই নিজের সম্বন্ধে সচেতন ও বিবেককে কঠোরভাবে জাগ্রত রেখে আমানতের হেফাজত ও হস্তান্তর করতে হবে।

৭। পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়রা যা [সম্পত্তি] রেখে যায় ৫১৪ তাতে পুরুষের অংশ আছে এবং নারীর অংশ আছে। সম্পত্তি অল্পই হোক বা বেশীই হোক এক অংশ নির্ধারিত।

৫১৪। এখানে বিষয় সম্পত্তি উত্তরাধীদের মধ্যে বণ্টনের সাধারণ নিয়ম বিবৃত করা হয়েছে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে সম্পত্তিতে পুরুষ উত্তরাধীকারদের যেমন অধিকার আছে, মেয়েদেরও অধিকার আছে। বিষয় সম্পত্তি বা ধন-সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের সময়ে উত্তরাধীকারীরা ব্যতীত আর যে সব আত্মীয়, এতিম ও অভাবগ্রস্থ লোকজন সেখানে উপস্থিত থাকবে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।

৮। কিন্তু যদি [সম্পত্তি] বণ্টনকালে অন্যান্য আত্মীয় অথবা এতিম অথবা দরিদ্র ব্যক্তি উপস্থিত থাকে, [সম্পত্তি থেকে] তাদের কিছু দেবে এবং তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত ও দয়ার সাথে ব্যবহার কর।

৯। তারা [সম্পত্তির বিলিবণ্টনকারী] যেনো তাদের মনে সেরূপ ভয় রাখে, অসহায় সন্তানদের পিছনে ফেলে [মৃত্যুবরণ করলে] তারা তাদের সম্বন্ধে যেরূপ উদ্বিগ্ন হতো। তারা যেনো আল্লাহ্‌কে ভয় করে এবং যথোচিত কথা বলে ৫১৫।

৫১৫। এতিমের তত্ত্বাবধায়কদের এখানে সতর্ক করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে অন্যদেরও বলা হয়েছে যে- তোমরা মৃত্যুর পর তোমার সন্তান অসহায় অবস্থায় পড়লে তুমি যেমন উদ্বিগ্ন হবে, তা ভেবে দেখো।" অর্থাৎ আমাদের যে কারও সন্তান সন্ততির অবস্থা ঐ এতিমদের ন্যায় যে কোনও সময়ে হতে পারে। কারণ হায়াত ও মউতের মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌।

১০। যারা অন্যায়ভাবে এতিমদের সম্পত্তি গ্রাস করে, তারা তাদের উদরে আগুন ভক্ষণ করে। তারা অচিরেই জলন্ত আগুনকে সহ্য করবে।

রুকু - ২

১১। [এরূপে] আল্লাহ্‌ তোমাদের সন্তানদের [উত্তরাধিকার] সম্বন্ধে নির্দেশ দিতেছেন ৫১৬। এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান। শুধুমাত্র কন্যা সন্তান দুই অথবা অধিক থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ আর মাত্র এক কন্যা থাকলে তাঁর জন্য [সম্পত্তির] অর্ধাংশ। মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে, পিতা-মাতা [জীবিত থাকলে] প্রত্যেকের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক ষষ্ঠাংশ। সে নিঃসন্তান হলে, এবং যদি পিতা-মাতাই একমাত্র উত্তরাধিকার হয় তবে, মায়ের জন্য এক তৃতীয়াংশ। যদি তার [মৃত ব্যক্তির] ভাই [অথবা বোন] থাকে তবে মায়ের জন্য এক ষষ্ঠাংশ। [সকল ক্ষেত্রে এই বণ্টন প্রণালী কার্যকর হবে] সকল পাওনা ও ঋণ পরিশোধের পরে। তোমার পিতা-মাতা অথবা সন্তানদের মধ্যে কে উপকারে তোমাদের অধিক নিকটতর হবে তা তোমরা জান না। এটাই আল্লাহ্‌ কর্তৃক ধার্য করা অংশ। আল্লাহ্‌ সব জানেন এবং প্রজ্ঞাময় ৫১৮।

৫১৬। বিষয়-সম্পত্তি বিলি বণ্টনের মূল নীতিমালা এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। বিলি বণ্টনের প্রধান সীমারেখা এখানে বলে দেয়া হয়েছে এবং এর বিষদ ব্যাখ্যা আল্লাহ্‌র নবীর জীবন ও চরিত্রে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ব্যতীত মুসলিম পন্ডিতগণ এ ব্যাপারে বহু গবেষণা করেছেন এবং তাদের সুচিন্তিত মতবাদ সুক্ষাতিসুক্ষ বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা ফিকাহ্‌ শাস্ত্র নামে পরিচিত। এই আয়াতে বিলি বণ্টন ব্যবস্থার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলিই শুধুমাত্র বর্ণনা করা হয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলি হচ্ছে : (১) মূল সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ শুধুমাত্র হস্তান্তর হয় পিতা-মাতার নিকট। অবশিষ্ট দুই তৃতীয়াংশ উত্তরাধীকারীদের মধ্যে বিলি বণ্টন হবে। (২) সমস্ত বিলি বণ্টন হবে মৃত ব্যক্তির ঋণ শোধ করার পর এবং তার অন্তোষ্টিক্রিয়ার যাবতীয় খরচ বহনের পরে যা থাকবে তার উপর। (৩) কোনও অবস্থাতেই মৃত ব্যক্তির ঋণ সহ তার সম্পত্তির বণ্টন করা চলবে না। অর্থাৎ ঋণকে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তির সাথে বণ্টন করা চলবে না। তাহলে একজন অন্যজনের থেকে সুবিধা আদায় করতে চেষ্টা করবে। (৪) সাধারণভাবে বলা হয়েছে একজন পুরুষ একজন মেয়ের থেকে দ্বিগুণ সম্পত্তি পাবে। তবে এ আইন সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়।

৫১৮। এই আয়াতটি (১) সন্তান এবং (২) পিতামাতার মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের উপরে নির্দেশ দান করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে নির্দেশ দান করা হয়েছে (৩) স্বামী বা স্ত্রীর অথবা (৪) জ্ঞাতি গোষ্ঠির প্রাপ্য অংশের উপরে। সন্তানদের অংশ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে অবশ্য তার পরিমাণ নির্ভর করবে পিতামাতার প্রাপ্য অংশের উপরে। যদি পিতা এবং মাতা উভয়েই জীবিত থাকে, তবে প্রত্যেকে মোট সম্পত্তির এক ষষ্ঠাংশ গ্রহণ করবেন। কিন্তু যদি পিতা বা মাতা যে কোনও একজন শুধুমাত্র জীবিত থাকেন তবে তিনি মোট সম্পত্তির এক ষষ্ঠাংশ পাবেন এবং বাকী অংশ সন্তানদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। যদি সন্তান না থাকে এবং অন্য কোনও উত্তরাধীকারী না থাকে, তবে মাতা পাবে মোট সম্পত্তির এক তৃতীয়ায়শ [এবং পিতা পাবেন অবশিষ্ট দুই তৃতীয়াংশ]। কিন্তু যদি মৃতের কোনও সন্তান না থাকে, ভাই এবং বোন থাকে [ভাই এবং বোন এর সংখ্যা বহুবচনে ব্যবহার করা হয়েছে] তবে মাতা পাবেন এক ষষ্ঠাংশ এবং পিতা অবশিষ্টাংশ। সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যাপারে বহু খুঁটিনাটি বিষয় পন্ডিত জনেরা আলোচনা করেছেন। এখানে শুধু মূল কাঠামোর কথাই বলা হলো। তবে মূল বক্তব্য হলো সম্পত্তি বণ্টনের ব্যাপারে সন্তান ও পিতামাতা-ই হচ্ছে প্রধান আলোচ্য ব্যক্তি। যদি এরা বেঁচে থাকেন তবে এদের মধ্যে মৃতের সম্পত্তি বণ্টন করা হবে। অবশ্য কে কতটুকু পাবেন তা নির্ভর করবে উত্তরাধীকারীদের সংখ্যার উপরে।

১২। তোমাদের স্ত্রীরা যে সম্পত্তি রেখে যাবে তার অর্ধাংশ তোমাদের জন্য, যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি তাদের সন্তান থাকে তবে তাদের সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ তোমাদের জন্য। [এ সকল] পাওনা ও ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের কোন সন্তান না থাকলে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ, আর তোমাদের সন্তান থাকলে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-অষ্টমাংশ। [এ সকল] পাওনা ও ঋণ পরিশোধের পর ৫১৯।

যদি পিতামাতা ও সন্তানহীন ৫২০ কোন পুরুষ অথবা নারীর উত্তরাধীকারী থাকে তার এক বৈপিতৃয় ভাই অথবা, ভগ্নী ৫২১ প্রত্যেকের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক ষষ্ঠাংশ। কিন্তু যদি তাদের সংখ্যা দুয়ের অধিক হয়, তবে তারা [সকলে] পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের সম-অধিকার লাভ করবে; [এ সকল] পাওনা ও ঋণ পরিশোধের পরে; যেনো [কারও] কোনরূপ ক্ষতি সাধিত না হয়। ইহা আল্লাহ্‌র নির্দেশ, আল্লাহ্‌ সব জানেন এবং তিনি ধৈর্য্যশীল ৫২২।

৫১৯। স্ত্রীর যদি কোনও সন্তান না থাকে, তবে মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির অর্ধেক পাবেন তার স্বামী, বাকী অর্ধেক পাবেন অন্যান্যরা। কিন্তু যদি স্ত্রীর সন্তান-সন্ততি থাকে তবে, স্বামী পাবেন মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ। মেয়েরা পুরুষের সম্পত্তি পাবে এই আইন অনুসরণ করে একইভাবে, যদি স্বামীর যদি কোনও সন্তান না থাকে, তবে স্ত্রী পাবে স্বামীর সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ এবং যদি স্বামীর সন্তান-সন্ততি থাকে, তবে স্ত্রী পাবেন এক অষ্টমাংশ। মৃতের যদি একাধিক বিধবা বর্তমান থাকে, তবে সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ বা এক অষ্টমাংশ বিধবাদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন হবে।

৫২০। আরবীতে "Kalalat" কথাটি নিম্নোক্ত ভাবে ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। সম্পত্তি বণ্টনের ব্যাপারে যে নির্দেশ নামা তার মধ্যে এই অংশটির ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট নয়। হযরত ওমর যে তিনটি বিষয় বস্তুর ব্যাখ্যার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, তার মধ্যে এটি অন্যতম। আর দুটি হচ্ছে, (১) দাদা-দাদীর অংশ সম্বন্ধে এবং আর একটি হচ্ছে (২) সুদ সম্পর্কীয় ব্যাখ্যা। বর্তমানে যে ব্যাখ্যাকে সর্বজন সম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে যদি পরলোকগত ব্যক্তির কোনও পিতা বা মাতা না থাকে, বা সন্তান সন্ততি না থাকে সে ক্ষেত্রে জ্ঞাতিরাই (বৈপিত্রেয়) হবে সম্পত্তির উত্তরাধীকার উপরে বির্ণত ব্যাখ্যা অনুযায়ী।

৫২১। এখানে বৈপিত্রেয় ভাই ও বোনের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ 'মা' এক কিন্তু পিতার পরিচয় আলাদা। যদি বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন একজন হয় এবং সম্পত্তির অন্যকোনও অংশীদার না থাকে, তবে সে সম্পত্তির এক ষষ্ঠাংশ পাবে, যদি একের অধিক থাকে, তবে সমষ্টিগত ভাবে তারা এক তৃতীয়াংশের অধিকারী। এই অধিকার তখনই প্রযোজ্য হবে যখন পরলোকগত ব্যক্তির রক্তের সম্পর্কের কোনও উত্তরাধীকার থাকবে না। যদি কোনও বিধবাও বেঁচে থাকেন তবে তিনি তার ন্যায্য অংশ পাবেন।

নিকটতম উত্তরাধীকারী ব্যতীত, দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি-গোষ্ঠি যাদের কথা বলা হয়েছে, তা অত্যন্ত জটিল। এই স্বল্প পরিসর টিকাতে তার ব্যাখ্যা দান করা অসম্ভব। এ রকম অবস্থায় জ্ঞাতি-গোষ্ঠিদের মধ্যে তাদের অংশ বণ্টনের পরে অবশিষ্টাংশের (Asaba) জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

৫২২। 'ঋণ' পরিশোধের ব্যাপারে মৃতের 'অন্তোষ্টিক্রিয়ার' খরচ প্রথমে স্থান লাভ করবে। এই খরচ মেটার পরে সম্পত্তি বিলি-বণ্টনের প্রশ্ন আসবে। বিলি বণ্টনের সমস্ত প্রক্রিয়ায় আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুযায়ী ন্যায়ের পথে থাকতে হবে যাতে অন্যায়ভাবে কেউ তার নেয্য পাওনা থেকে বঞ্চিত না হয়। এ ব্যাপারে স্মরণ রাখতে হবে যে, অন্তোষ্টিক্রিয়ার খরচ যেনো ন্যায় সঙ্গত হয় এবং ঋণের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে যেনো তা প্রকৃত হয়, জাল বা জুয়াচুরি না হয় এবং যার যা প্রাপ্য অংশ তা ন্যায় সঙ্গত ও যুক্তি সঙ্গত ভাবে হিসেব করে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে হবে।

১৩। এসব আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা। যারা আল্লাহ্‌ ও রাসূলের আনুগত্য করে তাদের জন্য আছে [বেহেশতের] বাগান যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে এবং ইহা হবে [তাদের জন্য] সর্বোচ্চ সাফল্য ৫২২-ক।

৫২২-ক। দেখুন সূরা [৪৪ : ৫৭] আয়াতে এবং টিকা নং ৪৭৩৩।

১৪। কিন্তু যারা আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয় এবং আল্লাহ্‌র [দেয়া] সীমালংঘন করে তাদের নিক্ষেপ করা হবে আগুনে, সেখানে তারা বাস করবে। তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।

রুকু - ৩

১৫। যদি তোমাদের কোন নারী ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয় ৫২৩, তবে তোমাদের মধ্যে থেকে চারজন [বিশ্বাসযোগ্য] সাক্ষীর ৫২৪ তাদের বিরুদ্ধে দেয়া প্রামাণিক তথ্য গ্রহণ কর। যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তবে তাদের গৃহে অবরুদ্ধ করে রাখ, যতদিন না তাদের মৃত্যু হয়, অথবা আল্লাহ্‌ তাদের জন্য অন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ৫২৫।

৫২৩। অধিকাংশ সমালোচক 'Lewdness' বা অপবিত্র কথাটির অর্থ করেছেন ব্যভিচার রূপে, সে ক্ষেত্রে এই আয়াতে যে শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা পরিবর্তন করা হয়েছে [২৪ : ২] আয়াতে।

৫২৪। ইসলাম মেয়েদের সম্মানের চোখে দেখে। তাই মেয়েদের সম্মান রক্ষার জন্য তাদের যেনো মিথ্যা অপবাদে কলঙ্কিত করা না হয় সে জন্য মেয়েদের বিরুদ্ধে সাক্ষীর ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা এবং সাক্ষীর সংখ্যাও দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই বিধানকে আয়াত [২৪ : ২] তেও পুনরায় নির্দেশ দান করা হয়েছে।

৫২৫। ব্যভিচারী নারীকে জেলখানাতে রাখার নির্দেশ দান করা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ দান না করা পর্যন্ত। পরবর্তী নির্দেশ অর্থাৎ আল্লাহ্‌র নবী পরবর্তী প্রত্যাদেশ না পাওয়া পর্যন্ত। পরবর্তী প্রত্যাদেশ হচ্ছে [২৪ : ২] আয়াতে বেত্রাঘাত অথবা আল্লাহ্‌র নবীর হুকুম পাথর মেরে হত্যা।

১৬। তোমাদের মধ্যে যে দুজন ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী, তাদের উভয়কে শাস্তি দিবে। যদি তারা অনুতপ্ত হয় [তওবা] এবং নিজেদের [চিরত্র] সংশোধন করে, তবে তাদের [শাস্তি দান] থেকে বিরত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।

১৭। যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে, এবং পরবর্তীতে শীঘ্র শীঘ্র অনুতপ্ত হয় [তওবা], এরাই তারা যাদের অনুতাপ [তওবা] আল্লাহ্‌ গ্রহণ করেন; আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি করুণা করবেন। যেহেতু আল্লাহ্‌ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ।

১৮। তাদের অনুতাপের [তওবা] কোন কার্যকারিতা নাই, যারা অবিরাম মন্দ কাজ চালিয়ে যায়, ৫২৬ যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃত্যু এসে তাদের সামনে উপস্থিত হয়, [তখন] সে বলে, "এখন আমি প্রকৃতই অনুতপ্ত।" তাদের জন্যও [তওবা কার্যকর নয়] যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে মৃত্যুবরণ করেছে। এদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।

৫২৬। পাপ কাজ অনেক সময়েই সংস্কৃতির নামে চলে আসে, এর ফলে দেখা যায় সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠি এই পাপকে পাপ মনে করে না। বিবেকের যন্ত্রণা তারা অনুভব করে না, কিন্তু যখন তাদের মধ্যে একজন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যায়, সে তখন তার পাপকে অনুধাবন করতে পারে এবং অনুতপ্ত হয় কিন্তু সে অনুতাপ অর্থহীন। আল্লাহ্‌র কাছে তা গ্রহণ যোগ্য নয়।

১৯। হে ঈমানদারগণ ! নারীদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাদের উত্তরাধিকার গণ্য করা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ ৫২৭। তোমরা তাদের যে মোহর দিয়েছ তার কিছু অংশ ফেরত পাওয়ার জন্য তোমরা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না; ৫২৮ যদি না তারা প্রকাশ্য ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী হয়। পক্ষান্তরে তোমরা তাদের সাথে সহমর্মিতা ও ন্যায়ের সাথে বসবাস করবে। যদি তোমরা তাদের অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ্‌ যার মাধ্যমে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছো।

৫২৭। সেই সময়ে পৃথিবীর বহু জাতির মত আরবদের মধ্যেও এক জঘন্য রীতি চালু ছিল। সৎ ছেলেরা পরলোকগত ব্যক্তির বিধবাদের সম্পত্তির সাথে ভোগ করার উদ্দেশ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিত। এই জঘন্য এবং লজ্জাজনক প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করে ইসলাম। আরও দেখুন নীচের [৪ : ২২] আয়াতে।

৫২৮। মেয়েদের তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার আর একটি উপায় ছিল তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা যেনো তারা 'খুলা' তালাকে বাধ্য হয়, [দেখুন ২ : ২২৯ এবং টীকা ২৫৮] তাদের দেন মোহর মাপ করে দিতে বাধ্য করা হয়। মেয়েদের বঞ্চিত করার এই প্রতারণাপূর্ণ কৌশল ইসলাম পূর্ব আরব সমাজে বিদ্যমান ছিল। এর যে কোনও কৌশলই ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর একটি কৌশল ছিল- যারা তালাক প্রাপ্ত মহিলাদের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতো, তারা মহিলাদের পুনরায় বিয়েতে বাঁধা দান করতো, যে পর্যন্ত না তারা তাদের মোহর পূর্বের স্বামীর জন্য মাপ করে দিত। সমস্ত অপকৌশল ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

২০। কিন্তু যদি তোমরা এক স্ত্রীর বদলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর, এবং তাদের একজনকে মোহর হিসেবে প্রভুত অর্থ ৫২৯ দিয়ে থাকলেও তার কোন অংশ তোমরা তার কাছ থেকে ফেরত নিও না। তোমরা কি [তাদের উপর] মিথ্যা অপবাদ এবং সুস্পষ্ট পাপাচরণ দ্বারা উহা ফেরত নিতে চাচ্ছ ?

৫২৯। অগাধ অর্থঃ "Quintar" যার অর্থ সোনার মুদ্রার প্রাচীন মাপ বিশেষ [দেখুন ৩ : ১৪ এবং এর টিকা]।

২১। আর কিরূপে তোমরা তা গ্রহণ করবে যখন তোমরা একে অপরের সাথে সংগত হয়েছ ? এবং তারা তোমাদের নিকট থেকে [ধর্মীয়] অনুষ্ঠান সম্বলিত প্রতিশ্রুতি নিয়েছে ?

২২। অতীতে যা ঘটেছে তা ব্যতীত, [এখন থেকে] তোমাদের পিতাদের বিবাহিত নারীদের তোমরা বিবাহ করো না। নিশ্চয়ই ইহা লজ্জাকর ও ঘৃণ্য এবং জঘণ্য এক প্রথা ৫৩০।

৫৩০। দেখুন আয়াত [৪ : ১৯] এবং টীকা ৫২৭।

রুকু - ৪

২৩। তোমাদের [জন্য বিবাহে] নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৫৩১, তোমাদের মাতা, কন্যা, ৫৩২ ভগ্নী, ফুপু, খালা, ভ্রাতুষ্পুত্রী, বোনের মেয়ে, দুগ্ধ মাতা, ৫৩৩ দুগ্ধ-বোন, শ্বাশুরী, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সংগত হয়েছ তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত সৎ কন্যা ৫৩৪ যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে। তবে যদি তাদের সাথে সংগত না হয়ে থাক, তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নাই। এবং তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী ৫৩৫ এবং একই সময়ে দুই ভগ্নীকে বিবাহ করা ৫৩৬। অতীতে যা ঘটেছে তা ব্যতীত। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।

৫৩১। এই নিষিদ্ধের তালিকা পৃথিবীর সমস্ত জাতির মধ্যে বিয়ে সম্পর্কে যে বিধি-নিষেধ বিদ্যমান তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই নিষিদ্ধের তালিকার শুরু পূর্বের আয়াতে [৪ : ২২] যেখানে বলা হয়েছে "পিতা যাহাদের বিবাহ করিয়াছে।" এর অর্থাৎ পিতার বিবাহিত বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত। এই আয়াতে [৪ : ২৩] নিষিদ্ধের যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে তা পুরুষের দিক হতে কিন্তু একই নীতি মহিলাদের দিক থেকেও প্রযোজ্য।

৫৩২। 'মাতা' কথাটির দ্বারা নিজের মা ব্যতীত grand mother অর্থাৎ দাদী, নানী great grand mother সকলকেই বুঝানো হচ্ছে, কন্যা দ্বারা grand daughter অর্থাৎ নাতী, নাত্‌নী [মেয়ের দিক থেকে বা ছেলের দিক থেকে] সকলকেই বুঝানো হয়েছে। 'বোন' কথাটির মধ্যে আপন বোন, সৎ বোন, সকলেই অন্তর্ভুক্ত ইত্যাদি।

৫৩৩। 'দুগ্ধ মাতা' - শিশু জন্মের পরে নিজ মাতার দুগ্ধ পান করে। কিন্তু নিজ মাতা ব্যতীত অন্য কারও দুগ্ধ পান করলে ইসলামের দৃষ্টিতে এই সম্পর্ককে অত্যন্ত সম্মান করা হয়েছে। এই সম্পর্ককে রক্তের সম্পর্কের মত সম্মান দেয়া হয়েছে। সুতরাং রক্তের সম্পর্কে যাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম করা হয়েছে দুগ্ধ মাতার বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

৫৩৪। অভিভাবকত্বে না থাকলেও এই কন্যার সাথে বিয়ে অবৈধ। 'অভিভাবকত্ব' কথাটি প্রসঙ্গক্রমে প্রচলিত প্রথার একটি উল্লেখ মাত্র। এটা কোনও শর্ত নয়।

৫৩৫। 'ঔরসজাত পুত্র' কথাটির মধ্যে নারীরাও অন্তর্ভূক্ত।

৫৩৬। দুই ভগ্নীকে একত্রে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।

পঞ্চম পারা

২৪। তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত ৫৩৭ আরও [নিষিদ্ধ করা হয়েছে] সকল বিবাহিত নারী। এভাবেই আল্লাহ্‌ [নিষেধ সমূহের] বিধান স্থাপন করেছেন। উল্লেখিত নারীগণ ব্যতীত অন্য নারীকে তোমাদের সম্পত্তি থেকে উপহার দান করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ করা হলো - [যা] ব্যভিচারের জন্য নয় [বরং চরিত্রের] পবিত্রতার জন্য ৫৩৮। তাদের মাধ্যমে যে সুখ ও আনন্দ তোমরা ভোগ করেছ তার দরুণ তাদের মোহর পরিশোধ করা কর্তব্য। ৫৩৯ মোহর নির্ধারণের পরে, কোন বিষয়ে [পরিবর্তনের জন্য] পরস্পর রাযী হলে তাতে তোমাদের কোন দোষ নাই। এবং আল্লাহ্‌ সব জানেন এবং সর্ব বিষয়ে প্রজ্ঞাময়।

৫৩৭। 'অধিকার ভুক্ত দাসী' - এই কথাটি 'বন্দী' বা ক্রীতদাসীদের বেলায় প্রযোজ্য। যেহেতু এখন ক্রীতদাস প্রথা চালু নাই সুতরাং কথাটি এখন প্রযোজ্য নয়।

৫৩৮। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে নিষিদ্ধ করণের তালিকা প্রকাশের পরে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে উপরিউক্ত ঐ নিষিদ্ধ ব্যক্তি ব্যতীত আর সবার জন্য বিবাহ জায়েয। কিন্তু এখানে শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন। শুধুমাত্র কামনা বাসনা চরিতার্থ করার মানসে যেনো বিয়ে করা না হয়। 'Hisn' আরবী শব্দটির দ্বারা বিয়ে বুঝানো হয় যার প্রকৃত অর্থ দূর্গ। সুতরাং বিয়ের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে যৌন জীবনের পবিত্রতার দূর্গ স্বরূপ।

৫৩৯। বিয়ের পরে মেয়েদের আজন্ম পরিচিত বাপ-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সকলকে ত্যাগ করে স্বামীর সংসারে আত্মসমর্পণ করতে হয়। মেয়েদের এই ত্যাগ একতরফা হওয়া উচিত নয়, পুরুষকেও এই যুগল জীবনের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করা উচিত। তাই ইসলামের বিধান হচ্ছে পুরুষ তার অর্জিত অর্থের কিছু পরিমাণ আত্মসমর্পণ করবে, নারীর কাছে। এই সমর্পণ হবে তার ক্ষমতা অনুযায়ী যা দেন মোহর নামে পরিচিত। সর্বনিম্ন দেনমোহর ধার্য করা অনুমোদন করা হয়, কিন্তু তাই বলে সর্বনিম্ন দেনমোহরই নির্দিষ্ট এটা যেনো কেউ না মনে করেন। সর্বনিম্নের নীচে মোহর গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু সর্বোচ্চ সীমার কোনও বাধা ধরা নিয়ম নাই।

২৫। তোমাদের মধ্যে কারও যদি স্বাধীন ঈমানদার নারী বিবাহের সামর্থ না থাকে, তবে তোমরা অধিকারভুক্ত ঈমানদার দাসী বিবাহ করবে ৫৪০। তোমাদের ঈমান সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তোমরা একে অপরের সমান। সুতরাং তাদের বিয়ে করবে তাদের অনুমতিক্রমে, এবং যা ন্যায়সঙ্গত সেভাবেই তাদের মাহ্‌র প্রদান করবে। তারা হবে পূত পবিত্র চরিত্রের, অসংগত যৌন অপরাধী বা ব্যভিচারীনি হবে না। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর যদি তারা অশ্লীলতা করে, তবে তাদের শাস্তি স্বাধীন নারীর অর্ধেক। তোমাদের মধ্যে যারা পাপকে ভয় করে এই [অনুমতি] তাদের জন্য। তবে যদি তোমরা আত্মসংযম অনুশীলন কর তা তোমাদের জন্য অধিকতর মঙ্গলজনক। আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।

৫৪০। 'অধিকারভুক্ত' কথাটির দ্বারা যুদ্ধে প্রাপ্ত দাসীকে বোঝানো হয়েছে। পূর্বে যুদ্ধ বন্দীদের বিজিতেরা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিত - দাস-দাসী হিসেবে। এখানে এসব ক্রীতদাসীদের বিবাহের মাধ্যমে কামনা করতে বলা হয়েছে, অন্য কোন কুলষিত উদ্দেশ্য যেনো না থাকে। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য্য। ইসলাম বিশ্ব ভাতৃত্বে বিশ্বাসী। হতে পারে সে ক্রীতদাসী, কিন্তু সেও রক্ত মাংসের মানুষ। ঘটনাক্রমে সে আজ ক্রীতদাসী - সেটা তার অপরাধ নয়। যদি কোনও ক্রীতদাসী তার প্রভুর সন্তানের জন্ম দেয়, তবে সেই সন্তান হবে মুক্ত মানুষ।

২৬। আল্লাহ্‌ তোমাদের সুস্পষ্টভাবে বলতে চান, এবং পূর্ববর্তীদের পথে তোমাদের পরিচালিত করতে চান। [তাঁর ইচ্ছা] তোমাদের প্রতি [অনুগ্রহ করা]। আল্লাহ্‌ সব জানেন এবং সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাময়।

২৭। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা তোমরা তাঁকে অবলম্বন কর। কিন্তু যারা নিজ কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে তাদের ইচ্ছা যে তোমরা [আল্লাহ্‌র থেকে] ফিরে যাও দূরে, বহুদূরে।

২৮। আল্লাহ্‌ তোমাদের [ভার] হালকা করতে চান। যেহেতু মানুষকে দুর্বল [চিত্ত] করে সৃষ্টি করা হয়েছে।

২৯। "হে মুমিনগণ ! দম্ভভরে তোমরা একে অপরের সম্পত্তি গ্রাস করো না। কিন্তু পরস্পর শুভেচ্ছার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ। পরস্পরকে হত্যা [বা ধ্বংস] করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি অতি দয়ালু; ৫৪১।

৫৪১। এই আয়াতটিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন, কারণ এর অর্থ অনেক ব্যাপক। এই আয়াতটিতে যে ভাব প্রকাশ করা হয়েছে, তা নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যায়। (১) আমাদের যা কিছু অর্থ সম্পদ, যা আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে পরিগণিত করি, তা হচ্ছে আল্লাহ্‌ কর্তৃক গচ্ছিত ধন-সম্পদ। হতে পারে তা ব্যক্তিগত নামে বা রাষ্ট্রের নামে বা গচ্ছিত সম্পত্তি বা সমাজ বা রাষ্ট্র কর্তৃক গচ্ছিত সম্পত্তি। এই পৃথিবীর জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই পৃথিবীর জীবন হচ্ছে পরকালের শিক্ষানবীশ কাল। ধন-সম্পদ, বিষয়-আশয় সব ত্যাগ করে পরকালে যাত্রা করতে হয়। কিছুই সাথে করে নেয়া যায় না। অর্থ-সম্পদ, সবই আল্লাহ্‌র এবং তার কাছ থেকে পাওয়া এবং গচ্ছিত। যেহেতু গচ্ছিত সুতরাং তার হিসাব আমাদের দাখিল করতে হবে। এর অপব্যয় হবে অন্যায়। (২) [২ : ১৮৮] আয়াতে ঐ একই কথার পুণরাবৃত্তি করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে আমাদের সাবধান করে দেয়া হয়েছিল লোভের হাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য। এখানে এই আয়াতে [৪ : ২৯] বিষয় সম্পত্তিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে তা হতে হবে সৎ ব্যবসা। এখানে যীশু খৃষ্টের নীতিগর্ভ বাণীর [Matt. xxv. 13-30] উল্লেখ করা যায়। "Where the servants who had increased their master's wealth were promoted and the servants who had hoarded was cast into darkness." (৩) এই আয়াতে আমাদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে আমাদের অপব্যয় আমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে, ["পরস্পরকে বা নিজদিগকে হত্যা করো না"] এই লাইনটির অর্থ অনেক ব্যাপক। এখানে আল্লাহ্‌ আমাদের বলছেন যে আমরা নিজের জীবনের জন্যও যেমন সাবধানতা অবলম্বন করি অন্যলোকের জীবনের জন্যও সেরূপ মানসিকতা প্রদর্শন করবো। নিজের লোভ-লালসা চরিতার্থ করার জন্য সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা বা অন্যের জীবনের জন্য হুমকী স্বরূপ হওয়া চলবে না। সম্পদ বাড়ানোর জন্য সন্ত্রাস করা অন্যায়। অর্থাৎ সন্ত্রাস হচ্ছে সুস্থ ব্যবসায়ের বিপরীত। সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা যে সমাজে বিরাজ করে, সে সমাজে সুস্থ ব্যবসা-বাণিজ্য চলতে পারে না। [যেমন বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা]। (৪) সমাজে বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে নিজের ভাই এর বিরুদ্ধে অন্যায় করার সামিল। কারণ সমাজে আমরা একে অপরের উপরে নির্ভরশীল। সমাজের সকলেই ভাতৃসুলভ। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে বিশ্ব বিধাতা ধনী, গরীব সকলের জন্য সমান দয়ালু। সুতরাং কারও প্রতি আমরা যদি অন্যায় করি তা বিশ্ব বিধাতার প্রতি তার আদেশ অমান্য করার সামিল। তার স্থান হবে অগ্নিতে।

৩০। যদি কেহ অন্যায় ও বিদ্বেষবশে তা করবে, আমি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবো। আল্লাহ্‌র পক্ষে ইহা অতি সহজ।

৩১। [কিন্তু] তোমরা যদি চরম অসৎ কাজ, যা তোমাদের করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখ, [তবে] আমি তোমাদের মন্দ কাজগুলির [পাপ] হ্রাস করে দেব এবং তোমাদের বিশিষ্ট সম্মানের তোরণে প্রবেশ করাইব।

৩২। আল্লাহ্‌ তোমাদের কতককে তাঁর দানে [সম্পদ ও সহজাত গুণে] অপরের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি [তার যা নাই], তা কামনা করবে না। পুরুষ যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ, নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহ্‌র নিকট তাঁর অনুগ্রহের [সহজাত গুণের] জন্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ের পূর্ণ জ্ঞান রাখেন; ৫৪২।

৫৪২। এই পৃথিবীর জীবন নারী-পুরুষের সম্মিলিত জীবন। পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় নারী ও পুরুষের উভয়েরই অবদান স্বীকৃত। আল্লাহ্‌র 'নেয়ামতের' সঠিক ব্যবহারের ফলেই এই অগ্রযাত্রা সম্ভব। আল্লাহ্‌র নেয়ামত হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিশেষ দান-ব্যক্তির জন্য তা হতে পারে ধন-সম্পদ, বা মেধা, মনন শক্তি বা প্রতিভা, সৃজন ক্ষমতা ইত্যাদি। অথবা শারীরিক মানসিক শক্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আল্লাহ্‌র এই নেয়ামত সকলের মধ্যে সমভাবে বণ্টিত নয়। মানুষে মানুষে, নারী-পুরুষে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। এখানে আল্লাহ্‌ বলছেন এই বৈষম্য আল্লাহ্‌র বৃহত্তর পরিকল্পনা কার্যকর করার এক অংশ বিশেষ। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের জ্ঞান ও ধারণ ক্ষমতা সীমিত। এই সীমিত জ্ঞান ও ধারণ ক্ষমতায় আল্লাহ্‌র বৃহত্তর পরিকল্পনা ধারণ করা বা অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আল্লাহ্‌ বলছেন পুরুষ-নারী প্রত্যেককে নিজ নিজ যোগ্যতা বা আল্লাহ্‌র নেয়ামত, নিজের কর্মফল দ্বারা অর্জন করতে হবে [পুরুষ যা অর্জন করে তাহা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তাহা তার প্রাপ্য অংশ]। অদৃষ্টে অন্ধ বিশ্বাসে ইসলাম বিশ্বাসী নয়। কর্মফল দ্বারা অদৃষ্ট সৃষ্টিতে ইসলাম বিশ্বাসী।

মানুষে-মানুষে, পুরুষ-নারীতে কর্মক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র নেয়ামত প্রাপ্তির বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তার জন্য মনে হিংসার ভাব উর্দ্রেক হওয়া উচিত নয়। কারও অর্থ-সম্পদ, মান-মর্যাদা, শক্তি-সামর্থ্য, প্রতিভা-সৃজন ক্ষমতা, সুখ-শান্তি ইত্যাদি যদি অন্যদের আমাদের থেকে বেশী হয়, তবে তার জন্য আমরা ঈর্ষান্বিত হব না। এ আয়াতে অন্যের এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি আকাঙ্খা পোষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে যা তার সাধ্যায়ত্ত নয়। কারণ মানুষ যখন নিজেকে অন্যের চাইতে ধন-দৌলত, আরাম-আয়েশ, বিদ্যা-বুদ্ধি, শারীরিক সৌন্দর্য্য-সৌষ্ঠবে নিকৃষ্ট অনুভব করে, তখন স্বভাবগত ভাবেই তার অন্তরে হিংসার বীজ উত্তপ্ত হতে শুরু করে। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা। আজকে যা ঈর্ষার বস্তু হয়তো সময়ের বৃহত্তর পরিসরে তার সমতা বিধান হবে। এখানে বলা হয়েছে আমাদের যদি কিছুর প্রয়োজন থাকে তার জন্য ঈর্ষান্বিত না হয়ে মহান আল্লাহ্‌র দরবারে প্রার্থনার মাধ্যমে যাঞ্চা করতে হবে ইস্পিত বস্তুর জন্য। যদিও সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ আমাদের আশা-আকাঙ্খা, দোষ-ত্রুটি সবই জ্ঞাত। কারণ এই বিশ্ব ভূবনের কোনও কিছুই তার অজ্ঞাত নয়। আমাদের প্রয়োজন আমাদের অপেক্ষা তিনি-ই বেশী জানেন। তাহলে প্রশ্ন হলো আমাদের তাঁর কাছে আমাদের প্রয়োজন নিবেদন করতে হবে কেন ? কারণ আমাদের "সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করা হয়েছে। এই ইচ্ছা শক্তির প্রভাবে মানুষ তার আশা-আকাঙ্খাকে সনাক্ত করতে পারে এবং স্রষ্টার কাছে তা পূরণের জন্য প্রার্থনার মাধ্যমে যাঞ্চা করতে পারে। এই প্রার্থনার ফলে তার আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, নিজের দোষ-ত্রুটি সনাক্ত করতে পারে এবং নিজেকে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের উপযুক্ত করে তুলতে পারে। ফলে আল্লাহ্‌র নেয়ামত পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।

৩৩। প্রত্যেকের [উপকারের] জন্য, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অংশীদার ও উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেছি ৫৪৩। এবং যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারবদ্ধ তাদের প্রাপ্য অংশ দিয়ে দেবে ৫৪৪। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্‌ সর্ব বিষয়ের সাক্ষী।

৫৪৩। 'Mawali' বহুবচনে 'Maula' যা মূল শব্দ 'Wala' থেকে উদ্ভূদ। মূল শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে নিকট সম্বন্ধকে। সুতরাং 'Maula' শব্দটির অর্থ হবে (১) নিকট আত্মীয় (২) উত্তরাধীকার (৩) অংশীদার। এই আয়াতটিতে 'Maula' শব্দটির দ্বারা এই তিনটি শব্দ অর্থকেই বুঝানো হয়েছে। এ ব্যতীত সূরা [৪৪ : ৪৪] তে এই শব্দটির অর্থ করা হয়েছে (৪) প্রতিবেশী বা বন্ধু বা রক্ষাকর্তা বা মক্কেল এবং সূরা [১৬ : ৭৬] তে এর অর্থ করা হয়েছে (৫) প্রভু। এই আয়াতে অনুবাদ করা হয়েছে "পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন।"

৫৪৪। "যাদের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ।" এই লাইনটির ব্যাখ্যা নিম্নরূপ :
যখন নওমুসলিমরা মক্কা থেকে মদিনাতে দেশান্তরি হন, তখন মদিনাবাসীরা মক্কার নওমুসলিমদের ভাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেন। আনসার ও মোহজেরদের মধ্যে ভাতৃত্ববন্ধনের সূত্র হিসেবে উত্তরাধীকার প্রশ্নেও আনসাররা মোহাজেরদের অংশীদার করতেন। পরবর্তীতে যখন মুসলিম সম্প্রদায় আরবের মাটিতে সুদৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপিত হয়। মক্কাবাসী আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন মুসলিম সম্প্রদায়ে রক্তের সম্পর্কে ও আনসার ভাইদের অধিকারের ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াতটি নাজেল হয় অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক ও আনসার ভাই সকলেই রক্তের সম্পর্কে উত্তরাধীকার সূত্রে গ্রথিত। কিন্তু এই আয়াতটি ব্যাপক অর্থবোধক। সাধারণভাবে এর অর্থ হচ্ছে, রক্তের সম্পর্ক, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সবার স্বার্থে ন্যায়ের মাপকাঠিতে আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে, এর প্রতিটি বন্ধনকে সম্মান করতে বলা হয়েছে। রক্তের সম্পর্ক ব্যতীত আর যে সব সম্পর্ক তাদের কথাই বলা হয়েছে "অঙ্গীকার বদ্ধ" শব্দটির দ্বারা।

রুকু - ৬

৩৪। পুরুষ নারীর অভিভাবক ৫৪৫ এবং ভরণপোষণকারী, কারণ আল্লাহ্‌ এককে [পুরুষকে] অন্য [নারী] অপেক্ষা অধিক [শক্তি] দান করেছেন, এবং এ কারণে যে তারা [পুরুষ] তাদের অর্থ সম্পদ দ্বারা তাদের [নারীদের] ভরণপোষণ করে। সুতরাং পূণ্যবতী নারীরা ভক্তিভরে তাদের [স্বামীদের] বাধ্য থাকবে এবং [স্বামীদের] অনুপস্থিতিতে আল্লাহ্‌ তাদের যা হেফাজত করতে বলেছেন তার হেফাজত করবে ৫৪৬। যেসব নারীদের থেকে তোমরা অবাধ্যতার এবং অসৎ আচরণের আশংকা কর [প্রথমে] তাদের সদুপদেশ দাও। [তারপর] তাদের সাথে শয্যা বর্জন কর, এবং [সর্বশেষে হালকা ভাবে] তাদের প্রহার কর ৫৪৭। কিন্তু তারা যদি আনুগত্যে ফিরে আসে তবে তাদের বিরুদ্ধে [বিরক্ত করার] কোন পথ অন্বেষণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মহান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ৫৪৮।

৫৪৫। "Qawwam" এই আরবী শব্দটির বঙ্গানুবাদ দাড়ায়, যে অন্যের স্বার্থ রক্ষার্থে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়, তার স্বার্থ রক্ষা করে, তার বিষয় সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করে, সকল অবস্থায় তার রক্ষণাবেক্ষণ করে ইত্যাদি। এই আয়াতে পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে শর্ত সাপেক্ষে, কারণ পুরুষ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে এবং নারীদের ভরণ পোষণের ব্যয়ভার বহন করে। শর্ত সাপেক্ষে, কারণ কোরান শরীফে বহু জায়গায় আধ্যাত্মিক জগতে পুরুষ ও নারীকে সমান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পরলৌকিক জীবনে নারী-পুরুষ উভয়কে নিজ নিজ কর্মফলের দায়িত্ব বহন করতে হবে। এই দায়িত্ব পুরুষ ও নারীর সমান। কেউ কারও দায়িত্ব বহন করবে না। মেয়েদের পরকালের শাস্তি বা বেহেস্তর সুখ পুরুষের অর্ধেক করা হয় নাই। দেখুন আয়াত [৩ : ১৯৫], [৪:১২৪/২:২২৮, ১৮৭]। পরকালের জীবনের জন্য নারী-পুরুষ সমান অধিকারী। ইহকালের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য পুরুষকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে অবশ্য তা শর্তসাপেক্ষে। পুরুষ অর্থনৈতিক সব দায়-দায়িত্ব বহন করবে এই শর্ত সাপেক্ষে পুরুষ-নারীর উপরে আধিপত্যের অধিকার পায়। অন্যথায় "নারী ও পুরুষ একে অপরের ভূষণ স্বরূপ।" [২ : ১৮৭] কেউ কারও থেকে শ্রেষ্ঠ নয়।

৫৪৬। "সুতরাং পূণ্যবতী নারীরা ভক্তিভরে তাদের স্বামীদের বাধ্য থাকবে এবং স্বামীদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহ্‌ তাদের যা হেফাজত করতে বলেছেন তার হেফাজত করবে।" এই লাইনটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, সেই পূণ্যবতী স্ত্রী যে স্বামীর বর্তমানে বা অবর্তমানে তার স্বামীর মান, সম্মান, বিষয় সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করে, নিজের সতীত্ব রক্ষা করে এবং স্বামীর লাভ লোকসানের সাথে তার নিজের লাভ-লোকসানকে একীভূত করতে সক্ষম হয়, যেনো সংসারে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করে।

৫৪৭। সংসারে স্ত্রীদের অবাধ্যতার বেলায় নিম্নোক্ত চারটি ধাপ বর্ণনা করা হয়েছে। (১) প্রথমতঃ মৌখিক উপদেশ ও মৌখিক শাসন প্রযোজ্য। (২) যদি এতেও কোন কাজ না হয় তবে যৌন সম্পর্ক নিষেধ করা হয়েছে (৩) যদি তাতেও কাজ না হয় তবে হালকা শারীরিক শাস্তি প্রযোজ্য। কিন্তু ইমাম শফী মনে করেন যে, যদিও হালকা শারীরিক শাস্তি বৈধ, তবুও তা প্রয়োগ করা উচিত নয়। (৪) যদি উপরের তিনটি পন্থায়েও স্ত্রীর ব্যবহারে পরিবর্তন আনা সম্ভব না হয়, তবে এর অন্য উপায় অনুসন্ধান করতে হবে পারিবারিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে, যেমন বলা হয়েছে- [৪ : ৩৫] আয়াতে।

৫৪৮। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে স্বামী স্ত্রীর দু'জনের মধ্যে যখন বিরোধ হয়, তখন রাগারাগি, দোষারোপ, কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা, কুৎসা প্রচার করা, দোষ অন্বেষণ থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সমস্তই ইসলামে নিষিদ্ধ। এখানেই ইসলামের বৈশিষ্ট্য এবং এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য্য। মুসলমান তার অন্তরে সব সময়ে এই বিশ্বাস রাখে যে, পৃথিবীতে তার কৃত সমস্ত কর্মকান্ড আল্লাহ্‌ জ্ঞাত। আমাদের চিন্তা ভাবনা ক্রিয়া-কর্ম সবই খোলা বই এর মত তিনি পাঠ করতে পারেন। আমরা যাই-ই কিছু করি না কেন সবই তার সম্মুখে অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি-ই সুউচ্চ। তার অনুভব আমাদের সর্বসত্তা ঘিরে আছে। সেই বিরাট মহান ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে আমরা কত অকিঞ্চিতকর। এই অনুভব বা অনুভূতি মুসলমানকে কুৎসিত ব্যবহার বা পরিস্থিতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।

৩৫। তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধের আশংকা করলে তোমরা [দুজন] সালিস নিযুক্ত করবে; একজন পুরুষের পক্ষ থেকে একজন নারীর পক্ষ থেকে ৫৪৯। যদি তারা উভয়েই মীমাংসা চায় তবে আল্লাহ্‌ তাদের মিলন সাধনের [অনুকূল] পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ এবং সকল বিষয়ে অবহিত।

৫৪৯। পারিবারিক কলহ মীমাংসার এক সুন্দর পন্থা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। বেশী লোক জানাজানি বা প্রচার উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর। অপপ্রচার, বা কাঁদা ছোড়াছুড়ি বা আইনের আশ্রয়ে প্রতারণার কৌশল অবলম্বন এগুলি রোধকল্পে আপোষ মীমাংসার পথ বাতলে দেয়া হয়েছে। ঘরের বিবাদ ঘরে মীমাংসা না হতে পারলেও অন্ততঃ পরিবারের মধ্যেই যেনো তা হয়ে যায়। আদালতে মামলা-মোকদ্দমা বন্ধ করার ফলে যেনো বিষয়টি হাটে-ঘাটে বিস্তার লাভ না করে। এই কার্যকর ব্যবস্থা হলো : সরকার উভয়পক্ষের মুরুব্বী-অভিভাবক অথবা মুসলমানদের কোন শক্তিশালী সংস্থা, তাদের (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে আপোষ করিয়ে দেয়ার জন্য দু'জন সালিস নির্ধারণ করে দেবেন। একজন পুরুষ পরিবার থেকে, একজন স্ত্রীর পরিবার থেকে। স্ব-স্ব পরিবার থেকে নির্বাচনের ফলে সালিস ব্যক্তিগণ তাদের মক্কেলদের দোষ-ত্রুটি, মেজাজ-মর্জি সম্বন্ধে সম্যক ওয়াকেবহাল। সুতরাং তাদের জন্য ন্যায় বিচার করা সহজতর হয়। ল্যাটিন দেশ সমূহ তাদের লিগ্যাল সিস্টেমে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে থাকে।

৩৬। তোমরা আল্লাহ্‌র ইবাদত কর, এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার করো না ৫৫০। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্থ নিকট প্রতিবেশী ৫৫১, দূর প্রতিবেশী, সংগী-সাথী ৫৫২, পথচারী [যাদের সাক্ষাৎ লাভ কর] এবং তোমার অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি ৫৫৩ সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালোবাসেন না, ৫৫৪।

৫৫০। এই আয়াতে ইসলামের মূল নির্যাসকে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামের মূল কথা হচ্ছে আল্লাহ্‌র ইবাদত করা ও তার সৃষ্টির সেবা করা। 'সৃষ্টির সেবা' কথাটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তা ব্যাপক অর্থ বহন করে। দুঃখী আর্ত মানুষ ছাড়াও, পশু-পাখী, এমনকি গাছপালাও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। সবই সেই বিশ্ব স্রষ্টার সৃষ্টি। এর সেবাই হচ্ছে ধর্ম। এই আয়াতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আবেগ অপেক্ষা বাস্তব কাজের প্রতি এখানে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
"জীবে দয়া করে যেই জন,
সেই জনে সেবিছে ঈশ্বর। (আল্লাহ্‌)।"
৫৫১।"নিকট প্রতিবেশী" কথাটির দ্বারা প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধব যারা অন্তরঙ্গ তাদের বুঝানো হয়েছে, "দূর প্রতিবেশী কথাটির দ্বারা তাদেরই বুঝানো হয়েছে যারা আমাদের নিকট থাকেন না কিন্তু যারা আমাদের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। যেমন - বাংলাদেশীরা যেখানেই থাকুন তারা এক জাতি। সুতরাং চেনা বা অচেনা বাংলাদেশী হিসেবে একজন বাংলাদেশী অন্য বাংলাদেশীর সেবার হক্‌দার। সেভাবে বৃহত্তর পরিসরে মুসলিম উম্মার জন্য সেবা করা যে কোনও মুসলিমের কর্তব্য।

৫৫২। "সংগী-সাথী" কথাটির দ্বারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবদের বুঝানো হয়েছে। "পথচারী" কথাটির দ্বারা পথ চলতে চলতে যাদের সাথে আমরা পরিচিত হই, যাদের আমরা পূর্বে চিনতাম না, তারা যদি কেউ পথে কোনও বিপদে পরে, তবে সাধ্য অনুযায়ী তার সাহায্য করা মুসলমান হিসেবে কর্তব্য, এই-ই কোরানের বিধান। অর্থাৎ যে কোনও লোকই যদি সাহায্য প্রার্থী হয়, তবে মুসলমান হিসেবে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য। এখানে চেনা-জানা প্রশ্নটি অবান্তর।
৫৫৩। "অধিকার ভূক্ত দাস-দাসী" অর্থ 'বন্দী' বা 'ক্রীতদাস' দেখুন টিকা ৫৩৭।

৫৫৪। সত্যিকারের পরোপকার ও দয়া একটা স্বর্গীয় গুণ। এই গুণের উৎপত্তি আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা থেকে উৎসারিত। আল্লাহ্‌কে ভালোবেসে তার সন্তুষ্টির জন্য যে পরোপকার বা জীবে দয়া প্রদর্শন করে সে অবশ্যই বিনয়ের মাধ্যমে তা করবে। কারণ মহান আল্লাহ্‌র সম্মুখে উদ্ধতপনা ও অহংকারের স্থান নাই। যারা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির পরিবর্তে আত্ম সন্তুষ্টির জন্য পরোপকার করে, তারা হয় অহংকারী ও উদ্ধত। কারণ তারা ভুলে যায় আল্লাহ্‌র চোখে ধনী-দরিদ্র, বিদ্বান-মূর্খ, সবাই সমান। এই পৃথিবীতে কেহ তার ভালো অবস্থানের জন্য অন্যকে করুণা করতে পারে না। তার ভালো অবস্থান আল্লাহ্‌রই দান। সুতরাং পৃথিবীর যোগ্যতায় যারা উচ্চাসীন এবং এই কারণে যারা উদ্ধত অহংকারী আল্লাহ্‌ তাদের অপছন্দ করেন। আমরা পৃথিবীর মান সম্মানের মানদন্ডে সব কিছু বিচার করি। কিন্তু আল্লাহ্‌র মানদন্ড হচ্ছে বান্দার আত্মার আত্মনিবেদন ও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আকুলতা। সুতরাং যে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রদর্শনের নিমিত্তে অন্যকে করুণা বা দয়া করে পৃথিবীর মানদন্ডে তাকে উচ্চাসনে স্থাপন করলেও আল্লাহ্‌ সে সব অহংকারীকে অপছন্দ করেন।

৩৭। [আরও ভালোবাসেন না] যারা কৃপণতা করে এবং অন্যকে কৃপণতার নির্দেশ দেয়; আল্লাহ্‌ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দান [অর্থ সম্পদ ও সহজাত গুণাবলী] করেছেন তা গোপন করে ৫৫৫। যারা ঈমানকে প্রতিহত করে তাদের জন্য আছে ঘৃণাদায়ক শাস্তি, ৫৫৬।

৫৫৫। দয়া ও পরোপকার একটি মহৎ গুণ যাকে দানরূপে অভিহিত করা হয়। এই মহৎ গুণ বান্দাকে স্রষ্টার নৈকট্য লাভে সাহায্য করে। তবে তা হচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে। জীবে দয়া বা সেবার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ। এখানেই জীবে দয়া বা সেবার মূল সাফল্য নিহিত। মানুষ তার দানের জন্য সাফল্য লাভ করতে পারে না মূলতঃ দুটি কারণে। (১) আত্ম অহংকার ও গর্ব তাকে উদ্ধত ও অহংকারী করে তোলে। নিজেকে সে দাতার আসনে কল্পনা করে। সে ভুলে যায় তার যা কিছু নেয়ামত তা সবই আল্লাহ্‌র দান। সে শুধু তার জিম্মাদার। এ কথা ভুলে যাওয়ার ফলে সে আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পদ রূপে কল্পনা করে এবং একে কুক্ষিগত করে রাখে। এই নেয়ামতকে অন্যের সাথে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ফলে সে হয়ে ওঠে উদ্ধত ও অহংকারী। অহংকার এমন একটি খারাপ রীপু যা বান্দাকে সত্যিকারের দয়া ও পরোপকার থেকে বিরত রাখে। কারণ অহংকারী ও দাম্ভিক ব্যক্তি যাই-ই করুক না কেন তা হয় শুধুমাত্র আত্ম প্রচারের নিমিত্তে। আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য সেখানে অনুপস্থিত। (২) কৃপণতা - যার উদ্ভব হচ্ছে কোনও সম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখার মানসিকতা থেকে। কৃপণতার-ই অন্যরূপ হচ্ছে স্বার্থপরতা। স্বার্থপর ব্যক্তি শুধুমাত্র আত্মসুখ ব্যতীত আর কিছুই অনুধাবনে সক্ষম নয়। অহংকারী ও কৃপণ ব্যক্তির মানসিকতা একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ। কারণ অহংকারী আত্মপ্রচারে এবং কৃপণ আত্মসুখ ও স্বাচ্ছন্দে ব্যস্ত থাকে। যারা কৃপণ তারা পৃথিবীর মানদন্ডে হয়তো বা দূরদর্শীরূপে পরিচিত হতে পারবেন। কারণ তারা তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা শুধু আত্ম উন্নতির জন্য ব্যয় করে। আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয়কে তারা অপব্যয় মনে করে। তাদের কৃপণতার এই উদাহরণ অন্যকেও প্রভাবিত করে এবং অন্যকেও আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করা থেকে বিরত রাখতে উদ্ভুদ্ধ করে। আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে কুক্ষিগত করে রাখার পক্ষে সে যুক্তি উপস্থাপন করে যেনো সমাজের চোখে সে একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিরূপে পরিচিত হতে পারে। অথবা আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে সে তা গোপন করে, লুকিয়ে রাখে, যেনো তাতে কাউকে অংশীদার করতে না হয়। সৎ কাজ ও দান ও পরোপকার সব কিছুরই একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ। আল্লাহ্‌ বান্দাকে বিচার করবেন কর্মের নিয়ত দ্বারা কর্ম দ্বারা নয়। যে সৎ কাজ, বা দান, বা পরোপকার বা সেবার নিয়ত, আল্লা প্রেম নয় আত্মপ্রেম, সে সব কর্ম আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এসব উদ্ধত অহংকারী ও কৃপণ ব্যক্তিদের আল্লাহ্‌র না পছন্দ।

৫৫৬। লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করা এবং সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা দুই-ই নিতান্ত মন্দ কাজ। যারা একান্তভাবে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে ব্যয় না করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে তাদের আমল আল্লাহ্‌র দরবারে গৃহীত হয় না। এদেরকে আল্লাহ্‌ কাফেরদের সমতুল্য জ্ঞান করেন।

৩৮। আরও [ভালোবাসেন না] যারা মানুষকে দেখানোর জন্য তাদের ধন সম্পদ ব্যয় করে ৫৬৭ এবং আল্লাহ্‌ এবং আখিরাতে বিশ্বাস করে না। যদি কেহ শয়তানকে অন্তরঙ্গ [সঙ্গী] রূপে গ্রহণ করে, তবে কত মন্দ সে অন্তরঙ্গতা।

৫৫৭। কৃপণতা বা আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে কুক্ষিগত করে রাখা যে পরিমাণ ক্ষতিকর বা দোষের, ঠিক সমপরিমাণ ক্ষতিকর হচ্ছে, লোক চক্ষে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ধন সম্পদ ব্যয় করা বা আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে দান করা। এটা এক ধরণের মোনাফেকী। কারণ তাদের অন্তরের বাসনা ও কার্যের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। তাদের অন্তর দয়া, দান ও পরোপকার করে লোক চক্ষে দানশীল হিসেবে সুখ্যাতি অর্জনের জন্য। এ দান শুধুমাত্র আত্মতুষ্টি ও আত্মপ্রচারের জন্য করা হয়। কিন্তু বাইরে তারা অন্তরের কথা প্রচার করে না - তারা প্রচার করে যে আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতিই তাদের এই মহৎ কাজে উজ্জীবিত করেছে। তাদের অন্তরের বাসনা ও কাজের মধ্যে মিল নাই। সুতরাং তারা মোনাফেকরই রূপান্তর। দানের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ ও মানুষের কল্যাণ কামনা। যাদের অন্তরে পরোপকারের এই উদ্দেশ্য অনুপস্থিত তারা মোনাফেকেরই সামিল। তারা শয়তানের সঙ্গী। কারণ লোক দেখানোর জন্য উদ্দেশ্য বিহীন ব্যয় করা নিতান্ত মন্দ কাজ।

৩৯। তারা যদি আল্লাহ্‌ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান আনতো এবং আল্লাহ্‌ তাদের যে জীবনোপকরণ দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করতো; তা হলে তাদের কি ক্ষতি হতো ? ৫৫৮ তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ পূর্ণ জ্ঞান রাখেন।

৫৫৮। "Out of what Allah hath given them for sustenance" যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় "আল্লাহ্‌ তাদের যে জীবনোপকরণ প্রদান করেছেন"। "Sustenance" বা "জীবনোপকরণ" কথাটি অত্যন্ত অর্থবোধক। মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান, প্রতিভা, উচ্চ বংশ, মর্যাদা, অর্থ-সম্পদ, বিষয়-সম্পত্তি সবই আল্লাহ্‌র দান বা নেয়ামত বা জীবনোপকরণ। পৃথিবীর অগ্রযাত্রায়, সভ্যতার ক্রমবিকাশে আল্লাহ্‌র এসব নেয়ামত বিভিন্ন জনের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়। এ সবেরই মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। বান্দা শুধুমাত্র এসব নেয়ামতের জিম্মাদার, মালিক নয়। সুতরাং আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে আল্লাহ্‌র সেবায় নিয়োজিত করাই মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটাকে কেউ যেনো ক্ষতিরূপে কল্পনা না করে। বরং আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে কুক্ষিগত করার মধ্যে আছে পাপ ও আত্মার জন্য ক্ষতি। জনগণের খেদমতে এর বিতরণের মধ্যে আছে আত্মিক উন্নতির চাবিকাঠি।

৪০। আল্লাহ্‌ কখনও অণু পরিমাণও অন্যায় করেন না; কোন ভালো কাজ [করলে] তিনি তা দ্বিগুণ করে দেন এবং তাঁর নিজের নিকট থেকে মহাপুরস্কার প্রদান করেন ৫৫৯।

৫৫৯। অণু পরমাণু সৎ কাজও আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আত্মাকে পবিত্র করে। সৎ কাজের পূণ্য এই পৃথিবীতেই লোকে ভোগ করে, কারণ আল্লাহ্‌র রহমত ও করুণা তার উপরে বর্ষিত হয়। ফলে বান্দার জীবন সুখ ও শান্তিতে ভরে যায়। সর্বাপেক্ষা বড় যা পাওয়া, যার জন্য এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর জীবন, যার জন্য মহাসাধকদের সারা জীবনের সাধনা, তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ। আল্লাহ্‌ বান্দার অন্তরে মহান আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য অনুভবের ক্ষমতা দান করেন। স্রষ্টার সান্নিধ্যের থেকে বড় পাওয়া বান্দার জীবনে আর কি আছে ?

৪১। যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো এবং তোমাকে উহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করবো তখন কি অবস্থা হবে ? ৫৬০

৫৬০। এতে বলা হয়েছে যে বিগত উম্মতসমূহের নবী-রাসূলগণ নিজ নিজ উম্মতের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হবেন কেয়ামতের দিনে। সাক্ষী হবেন, কারা ছিল 'বিশ্বাসী' ও কারা 'বিশ্বাস'-কে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের সনাক্ত করণ্যের জন্য।

৪২। যারা ঈমানকে প্রত্যখ্যান করেছে এবং রাসূলের অবাধ্য হয়েছে, সেদিন তারা কামনা করবে যে, যদি তারা মাটির সাথে মিশে যেতে পারতো ৫৬১। কিন্তু তারা আল্লাহ্‌র নিকট থেকে কোন কথাই গোপন করতে পারবে না।

৫৬১। শেষ বিচারের দিনে হাশরের ময়দানে দুনিয়ায় কৃত প্রত্যেকটি আমল দৃশ্যমান হবে, কিছুই গোপন থাকবে না। প্রত্যেকের চোখ খুলে যাবে। ভালো মন্দ সব আমল এবং আমলের নিয়ত হবে দৃশ্যমান। যারা আল্লাহ্‌র বাণীকে অস্বীকার করেছিল, শেষ বিচারের দিনে তাদেরকে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরবে। তারা ধূলায় মিশে যতে চাইবে আত্মগোপন করার আশায়। কিন্তু সেই মহাদিবসে কেহ কিছুই আত্মগোপন করতে পারবে না। তাদের অতীত কার্যকলাপ তাদের সামনে হবে ভাস্বর এবং তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী।

৪৩। হে মুমিনগণ ! নেশাগ্রস্থ অবস্থায় সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না ৫৬২, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা [সালাতের সময়ে] যা বল তা [অর্থ] বুঝতে পার। [আবার] অপবিত্র অবস্থায় [সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না], যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা গোসল কর, তবে পথচারী এ ব্যবস্থার ব্যতিক্রম। আর যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেহ শৌচগার থেকে আসে; অথবা তোমরা নারী সম্ভোগ কর এবং পানি না পাও ৫৬৩ তবে পবিত্র বালি বা [মাটির] দ্বারা তায়াম্মুম করবে, এবং মুখমন্ডল এবং হাত [মাটি দ্বারা] ঘষবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ পাপ মোচনকারী এবং বারে বারে ক্ষমা করে দেন।

৫৬২। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজ পড়া যেমন হারাম, সেইরূপ তন্দ্রাযুক্ত অবস্থা বা হতবুদ্ধি অবস্থায়ও নামাজ পড়া যায়েজ নয়। কারণ নামাজের সময়ে নামাজের প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ আবশ্যক যা উপরের মানসিক অবস্থায় সম্ভব নয়। উপরন্তু আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়কে মদ্যপানের অভিশাপ থেকে রক্ষা করা। ইসলাম পূর্ব আরববাসীরা মদ্যপানে অত্যন্ত আসক্ত ছিল। কিন্তু সহসা একে হারাম করে দেয়া হলে, মানুষের পক্ষে এ আদেশ পালন করা একান্তই কঠিন হতো। কাজেই প্রথমে এর উপরে আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। সুতরাং আলোচ্য আয়াতে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজ পড়া হারাম করা হয়েছে। এই আয়াতের আর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে যে নামাজের মাধ্যমে একাগ্রভাবে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য কামনা করতে হবে। নামাজের মাধ্যমে বান্দাকে একাগ্রভাবে, সজ্ঞানে, ভক্তিভরে আত্ম নিবেদন করতে হবে। এই হচ্ছে নামাজের পূর্বশর্ত যা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় সম্ভব নয়।

৫৬৩। নামাজের সময়ে শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতা অত্যন্ত জরুরী; কিন্তু ইসলামের সব বিধানই জীবনের প্রয়োজনের জন্য। তাই নামাজের সময়ে দৈহিক পবিত্রতার জন্য পানির প্রয়োজন অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও তাতে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয় নাই। পানির অভাবে জরুরী অবস্থায়, পরিষ্কার বালি ও মাটি দ্বারাও দৈহিক পবিত্রতার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে চারটি জরুরী অবস্থার বর্ণনা করা করা হয়েছে, প্রথম দুটি অবস্থা হচ্ছে সফরকাল ও অসুস্থকাল। সফরকালে কোনও ব্যক্তির পানির উৎস বা প্রাপ্তি স্থান সম্বন্ধে কোনও ধারণ থাকে না আবার অসুস্থ ব্যক্তির চলাফেরার ক্ষমতা না থাকার দরুণ পবিত্রতার জন্য পানির ব্যবহার তার জন্য সহজসাধ্য নয়। এই দুই ক্ষেত্রে পানির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরী নয়। কিন্তু শেষের দুটি ক্ষেত্রে একটি শৌচস্থানে অপরটি স্ত্রী সম্ভোগের পরে পানির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরী। উপরের চারটি অবস্থাতেই পানির অভাবে প্রয়োজনে 'তাইয়্যেমুম' বা পরিষ্কার বালি ও মাটির ব্যবহারকে অনুমোদন করা হয়েছে।

৪৪। তুমি কি চিন্তা করে দেখ নাই যাদের কিতাবের একাংশ দেয়া হয়েছিলো ৫৬৪; তাদের পথ চলা ছিলো ভুল, এবং তারা ইচ্ছা করে যে তোমরাও সঠিক পথ থেকে ভ্রষ্ট হও।

৫৬৪। দেখুন [৩ : ২৩] আয়াতে এবং টিকা ৩৬৬।

৪৫। কিন্তু তোমাদের শত্রুদের সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ পূর্ণভাবে জানেন। অভিভাবক হিসেবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট এবং সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট।

৪৬। ইহুদীদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা শব্দগুলির [সঠিক] স্থানচ্যুত করে, এবং বলে; "আমরা শুনলাম এবং আমরা অমান্য করলাম, ৫৬৫ এবং শোন, না শোনার মত"। এবং তাদের জিহবা কুঞ্চিত করে এবং দ্বীনের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে বলে, "রাইনা" ৫৬৬। কিন্তু তারা যদি বলতো, "শুনলাম ও মান্য করলাম; এবং শোন এবং আমাদের প্রতি লক্ষ্য কর" তবে তা তাদের জন্য ভালো এবং অধিক যথাযথ হতো। কিন্তু তাদের অবিশ্বাসের দরুণ আল্লাহ্‌ তাদের অভিশপ্ত করেছেন। তাদের অল্প সংখ্যকই বিশ্বাস করবে।

৫৬৫। দেখুন [২ : ৯৩] আয়াত এবং টিকা ৯৮। ইহুদীদের একটি খারাপ কৌশল ছিল যে তারা উপযুক্ত শব্দকে বিকৃত করে প্রকাশ করতো, যার ফলে নবীর শিক্ষাকে বিকৃত করে তারা হাস্যষ্কর ভাবে উপস্থাপন করতো। যেখানে বলা প্রয়োজন ছিল, "আমরা শুনলাম ও বিশ্বাস স্থাপন করলাম।" সেখানে তারা চিৎকার করে বলে 'আমরা শুনলাম' এবং নিম্নস্বরে ফিস্‌ফিস্‌ করে বলতো "ও অমান্য করলাম।" তারা সজোরে বলে "শুনলাম" এবং ফিস্‌ফিস্‌ করে বলে "না শোনার মত" যাতে পুরো বক্তব্যটাই হাস্যষ্কর ভাবে উপস্থাপিত হতো। যখনই তারা নবী করিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইত, তখনই তারা দ্ব্যর্থক শব্দ ব্যবহার করতো যা বাহ্যতঃ খারাপ প্রতীয়মান হয় না, কিন্তু যার উদ্দেশ্য জঘন্য।

[উপদেশঃ সর্বকালে সর্বযুগে যারা মন্দ তারা সত্যকে বিকৃত করে পরিবেশন করতে ভালোবাসে। সুতরাং মন্দ লোকের কথা বিশ্বাস করার পূর্বে তা ভালোভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

৫৬৬। দেখুন [২ : ১০৪] আয়াত ও টিকা ১০৬। 'রাইনা' আরবী শব্দটির অর্থ "আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুণ।" কিন্তু ইহুদীরা তাদের জিহবাকে কুঞ্চিত করে যা উচ্চারণ করতো তার অর্থ, হীব্রু ভাষায় 'আমাদের খারাপ সঙ্গী।"

৪৭। হে কিতাবীগণ ! তোমাদের মুখমন্ডল ও খ্যাতিকে চিনতে না পারার মত বিকৃত করার পূর্বে এবং সেগুলিকে পশ্চাৎদিকে ফিরিয়ে দেয়ার পূর্বে ৫৬৭ অথবা সাবাত ৫৬৮ ভঙ্গকারীদের যেরূপ অভিশাপ করেছিলাম, সেইরূপ তাদের অভিশাপ করার পূর্বে তোমাদের নিকট [ইতিপূর্বেই] যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার সমর্থকরূপে আমি যা [এখন] অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা ঈমান আন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েই থাকবে।

৫৬৭। "মুখমন্ডল সমূহকে বিকৃত করার পূর্বে অতঃপর সেইগুলিকে পিছনের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া", এটি একটি আরবী প্রবাদ বাক্য। এখানে মুখমন্ডল কথাটির দ্বারা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও সত্ত্বাকে বুঝানো হয়েছে। এর দ্বারা ব্যক্তির কর্মতৎপরতা ও খ্যাতিকেও বুঝানো হয়। কিতাবী জাতিদের আল্লাহ্‌ তার বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেছেন। কিন্তু যখন তারা আল্লাহ্‌র বাণীর উপযুক্ত না হয় এবং আল্লাহ্‌র বাণীকে অমান্য করে, বলা হচ্ছে তখন তাদের "মুখমন্ডলকে" বিকৃত করা হয়। অর্থাৎ তাদের ব্যক্তিসত্ত্বা, মান-সম্মান, খ্যাতি, কর্মতৎপরতা সব ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের যে মহত্ব বা বৈশিষ্ট্য যা ছিল তাদের চরিত্রের বা সত্বার অংশ, তার এই সত্বার ধ্বংস অর্থাৎ পতন। যে জাতির চারিত্রিক গুণাবলী ধ্বংস হয় সে জাতির পতন অবশ্যাম্ভাবী। তার স্থান অন্য জাতি অধিকার করবে। পৃথিবীতে সমস্ত জাতিরই পতনের ইতিহাস এই সত্যকে প্রকাশ করে। এ কথা জাতির জন্য যেমন প্রযোজ্য ব্যক্তির জীবনেও সমভাবে প্রযোজ্য।

৫৬৮। দেখুন [২ : ৬৫] আয়াত ও টীকা ৭৯।

৪৮। আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে অংশীদারিত্বকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে খুশী তিনি ক্ষমা করে দেন; আল্লাহ্‌র সাথে শরীক উদ্ভাবন করা এক জঘন্য পাপ ৫৬৯।

৫৬৯। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাকতা করা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ। পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গীতে এ অত্যন্ত জঘন্য কাজ। তারও থেকে জঘন্য কাজ হচ্ছে আল্লাহ্‌র সাথে শরীক কল্পনা করা। স্রষ্টার রজত্বে এ এক অমার্জনীয় অপরাধ। যদি সজ্ঞানে এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্‌র অংশীদার সৃষ্টি করা হয়, তাঁর প্রতিযোগী সৃষ্টি করা হয়, তবে তা হবে স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সামিল। এই কথাটিকে বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো এভাবে উপস্থাপন করেছেন, "Lie in the soul". অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "আত্মাকে মিথ্যায় কলুষিত করা।" আল্লাহ্‌ পরম করুণাময়। এত কিছুর পরেও যদি কেউ অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহ্‌র সাথে শরীক কল্পনা করে এবং পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয় এবং নিজেকে সংশোধন করে, তবে অপার করুণার আঁধার মহান আল্লাহ্‌র করুণা ও রহমত তার জন্য সর্বদা উন্মুক্ত। দেখুন [৪ : ১৭] আয়াতে।
শেরকের সংজ্ঞা কি ?
এ ক্ষেত্রে হযরত মাওলানা মুফতী মুহম্মদ শাফীর উদ্বৃতি দেওয়া হলো :
জ্ঞানের ক্ষেত্রে শরীক সাব্যস্ত করাঃ (১) কোন বুযুর্গ বা পীরের ব্যাপারে এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, আমাদের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে তিনি সর্বদা অবহিত। (২) কোন জ্যোতিষ-পন্ডিতের কাছে গায়েবের সংবাদ জিজ্ঞাসা করা। (৩) কোন বুযুর্গের বাক্যে মঙ্গল দেখে তাকে অনিবার্য মনে করে নেওয়া। (৪) কারো নামে রোজা রাখা।

ক্ষমতার ক্ষেত্রে শরীক সাব্যস্ত করাঃ কাউকে হিত বা অহিত, তথা ক্ষতি, বৃদ্ধি সাধনের অধিকারী মনে করা। এই ধারণা ব্যক্তি পূঁজার প্রতি হতে পারে বা নৈর্ব্যক্তিকও হতে পারে। যেমন- বিজ্ঞান, সাহিত্য সংস্কৃতিকেও অনেকে নিজস্ব পরিমন্ডলে পূঁজনীয় মনে করে। কারও কাছে সন্তান কামনা করা উত্যাদি। এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন সব শক্তির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে আল্লাহ্‌।

এবাদতে শরীক সাব্যস্তঃ কাউকে সেজদা করা, কারো নামে কোন পশু মুক্ত করা, কারো নামে মানত করা, কারো কবর বা বাড়ী-ঘরের তওয়াফ করা, আল্লাহ্‌ তায়াতলার হুকুমের তুলনায় অপর কারো কথা কিংবা কোন প্রথাকে প্রাধান্য দেওয়া, কারো সামনে রুকু করার মত মাথা অবনত করা [যেমন- বাংলাদেশীদের মধ্যে পা ছুঁয়ে সালাম করার প্রথা চালু আছে।] কারো নামে জীব উৎসর্গ করা, পার্থিব কাজ কারবার কিংবা বিবর্তনকে নক্ষত্রের প্রভাব বলে বিশ্বাস করা এবং কোন কোন মাস বা দিনকে অশুভ মনে করা প্রভৃতি।

৪৯। তুমি কি তাদের কথা চিন্তা কর নাই, যারা নিজেদের জন্য পবিত্রতার দাবী করে ? ৫৭০। বরং আল্লাহ্‌ যাকে খুশী পবিত্র করেন, এবং তাদের প্রতি কণামাত্রও অন্যায় করা হবে না ৫৭১।

২৭০। 'পবিত্র' - এই কথাটির দ্বারা রিপুর কামান বাসনা বা পাপ থেকে পবিত্র থাকাকেই বুঝানো হয়েছে। রিপুর কামনা বাসনা থেকে যে পবিত্র থাকতে পারে সে কামেল ব্যক্তি। কে পবিত্র বা কামেল তা জানেন একমাত্র আল্লাহ্‌ - কারণ সৎ পথে বা পবিত্র পথে পরিচালনার মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌। যারা নিজেদের পবিত্র বা কামেল রূপে আখ্যায়িত করে তারা সত্যিকারের পবিত্রতার থেকে বহুদূরে। কারণ তাদের আত্মা মিথ্যা ভান, আত্মগর্ব ও আত্ম অহংকারে আচ্ছাদিত। এসব আত্মায় আল্লাহ্‌র নূর প্রবেশে বাঁধা পায়। যদিও আয়াতটি ইহুদীদের উপলক্ষে নাজেল, তবুও এর আবেদন সর্বযুগের জন্য। আজ আমাদের বাংলাদেশী সংস্কৃতিতে বহু কামেল নামধারী পীরের আবির্ভাব ঘটেছে যারা ধর্মের নামে নিজেদের পবিত্র বলে বা কামেল বলে দাবী করে। এরা নিজেরাই নিজেদের পবিত্র বলে বা কামেল বলে দাবী করে। এরা নিজেরাই নিজেদের পীররূপে সাব্যস্ত করেন। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই পীর-পেশা বংশ পরস্পরায় চলে। পিতার মৃত্যুর পরে ছেলে গদিনসীন হয়ে থাকে। যেখানে আল্লাহ্‌ বলেছেন, 'আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করেন।' সেখানে কামেল হওয়া বংশ পরস্পরায় কিভাবে চলতে পারে ? যেহেতু এরা ধর্মের নামে, ধর্মের আচ্ছাদানে নিজেদের পবিত্র বা কামেলরূপে পরিচিত করেন। সেহেতু তাদের দ্বারা সমাজের কোনও বৃহত্তর কল্যাণ বা মঙ্গল সাধন হয় না। বাংলাদেশের সমাজের মূল ব্যাধি বা ঈমানের মূল অন্তরায় হচ্ছে দূর্নীতি, অন্যায় ও অসত্য। এসব পীরেরা মানুষের কল্যাণের জন্য, সমাজের কল্যাণের জন্য, মানব জীবনের মহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য কখনও তার মুরীদদের প্ররোচিত বা উদ্ভুদ্ধ করেন না। সুতরাং যারা স্বঘোষিত 'পবিত্র' তারা আল্লাহ্‌র রহমত ও করুণা থেকে বহু দূরে। কারণ তারা আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যাচার করে।

৫৭১। 'Fatil' - এই আরবী শব্দটির প্রকৃত অর্থ হচ্ছে খেজুরের বীচির খাঁজের মধ্যে যে সামান্য চামড়া থাকে তাকেই বুঝানো হচ্ছে যা মূল্যহীন। অর্থাৎ খেজুরের মূল্য খেজুরের মাংসল অংশ বা শাঁসের জন্য। খেজুর ভক্ষণের পরে খেজুর বীচির খাঁজের মধ্যে যে সামান্য পাতলা চামড়ার মত থাকে তা ভক্ষকের নিকট অতি নগণ্য মনে হয়। এই কথাটির দ্বারা পরিমাণের সামান্যতমকে বুঝানো হয়েছে যা মূল্যহীন। ইউসুফ আলী সাহেব অনুবাদ করেছেন 'Whit' এই ইংরেজী শব্দ দ্বারা।

৫০। চিন্তা কর ! তারা কিভাবে আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করে। সন্দেহাতীত পাপ হিসেবে ইহাই যথেষ্ট।

৫১। তুমি কি চিন্তা করে দেখ নাই যাদের [আল্লাহ্‌র] কিতাবের অংশ বিশেষ দেয়া হয়েছিলো, ৫৭২; তারা [এখন] যাদুবিদ্যা ও তাগুতে বিশ্বাস করে ? ৫৭৩। এবং তারা অবিশ্বাসীদের বলে যে, তারা মুমিনদের অপেক্ষা অধিক [সঠিক] পথে পরিচালিত।

৫৭২। দেখুন [৩ : ২৩] আয়াত ও টীকা ৩৬৬ নং। একই উদ্বৃতি আছে - [৪ : ৪৪] আয়াতে।

৫৭৩। 'জিব্‌ত' আরবী শব্দটির অনুবাদ মাওলানা ইউসুফ আলী করেছেন- যাদু বিদ্যা, মূর্তিপূজা, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কাউকে পূঁজা করা ইত্যাদি। মাওলানা ইউসুফ আলী 'তাগুত' কথাটির অনুবাদ করেছেন এভাবে- শয়তানের অনুসারী। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আবিসিনীয় ভাষায়, তাণ্ডত অর্থ গণক বা জ্যেতিষীকে বুঝায়। এই আয়াতটি তখনই নাজেল হয়, যখন কিতাব প্রাপ্ত জাতি ইহুদীরা হযরত মুহম্মদের (সাঃ) বিরুদ্ধাচারণ করার মানসে মক্কার প্যাগানদের সাথে ঐক্যজোটের সৃষ্টি করে এবং প্যাগানদের 'জিব্‌ত' ও 'তাগুত' মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করে।

উপদেশঃ বর্তমান বিশ্বেও এই উদাহরণ বিরাজমান। সামান্য স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ন্যায় ও সত্যকে [আল্লাহ্‌র কিতাব] অস্বীকার করা ও অন্যায় অসত্যের সাথে হাত মিলানো যা ঐ জ্বিবত্‌ ও তাগুতে বিশ্বাসেরই নামান্তর।

৫২। এরাই তারা যাদের আল্লাহ্‌ অভিশাপ দিয়েছেন; এবং আল্লাহ্‌ যাদের অভিশাপ দেন তুমি কখনও তাদের কোনও সাহায্যকারী পাবে না ৫৭৪।

৫৭৪। হযরত মুহম্মদের (সাঃ) বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য ইহুদীরা মক্কার প্যাগানদের সাহায্য প্রার্থনা করেছিল এবং কিতাবী জাতি হওয়া সত্বেও তারা প্যাগানদের দেব-দেবী, যাদু বিদ্যাকে মেনে নিয়েছিল এই কারণে যে প্যাগানরা হযরতের বিরুদ্ধে ইহুদীদের সাহায্য করবে। কিন্তু আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান। শেষ পর্যন্ত মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইহুদী ও প্যাগানেরা পরাজয় বরণ করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজেল হয়। কিন্তু এর আবেদন সর্বকালের, সর্বযুগের ও সর্বসাধারণের জন্য।

উপদেশঃ অন্যায় ও অসত্য সব সময়ে একজোট হয়ে সত্য ও ন্যায়কে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের রক্ষাকর্তা স্বয়ং আল্লাহ্‌। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় অন্যায় ও অসত্যের কালো মেঘ সত্য ও ন্যায়ের আলোকে ক্ষণকালের জন্যে আচ্ছাদিত করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের জয় অবধারিত। সত্য ও ন্যায়ের আলো পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করবেই।

৫৩। তবে কি রাজ-শক্তিতে তাদের কোন অংশ আছে ? মনে রেখো [সে ক্ষেত্রে] তারা মানবতার জন্য এক কপর্দকও দিবে না ৫৭৫।

৫৭৫। 'Naqir' এই আরবী শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে 'farthing' শব্দটির দ্বারা এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে 'কপর্দক' দ্বারা। অর্থাৎ অত্যন্ত নগন্য যার মূল্য খেজুরের বীচির খাঁজের মধ্যে যে সামান্য শাঁস থাকে তার থেকেও কম। এখানে মানুষের সহজাত একটি জঘণ্য রীপুর উল্লেখ করা হয়েছে। হিংসা একটি জঘণ্য রীপু। এই রীপু তারিত ব্যক্তি হয় স্বার্থপর এবং অন্যকে দান-ধ্যানের ব্যাপারে অত্যন্ত কৃপণ। অন্যের সুখ-শান্তি ও ঐশ্বর্যে হয় ঈর্ষান্বিত। বিশেষতঃ ঈর্ষাপীড়িত ব্যক্তি যখন জনগণের ক্ষমতার অধিকারী হয়, তখনও তারা বেমানান ভাবে সব কিছু নিজের কুক্ষিগত করে রাখে। জনগণের সমৃদ্ধি বা সুখ-শান্তি কামনা করার বা তাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করার মহানুভবতা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকে।

৫৪। মানব জাতিকে আল্লাহ্‌ নিজ অনুগ্রহে যা [সহজাত গুণাবলী ও সম্পদ] দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে ? কিন্তু আমি ইব্রাহিমের বংশধরদের ইতিপূর্বে কিতাব ও হিক্‌মত [জ্ঞান ও প্রজ্ঞা] দিয়েছি এবং তাদের বিশাল রাজ্য প্রদান করেছি ৫৭৬।

৫৭৬। দাউদ নবী ও সলেমান নবীকে আল্লাহ্‌ বিশাল রাজত্ব দান করেছিলেন যার উল্লেখ এখানে করা হয়েছে।

৫৫। তাদের কতক বিশ্বাস করেছিলো, এবং কতক তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো, জ্বলন্ত আগুনের জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট ৫৭৭।

৫৭৭। দেখুন [৪ : ৯৭], [৮ : ৩৭], [৮ : ৯৫] আয়াতগুলি যেখানে দোযখের এবং যারা দোযখবাসী হবে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে। [৪ : ৫৪-৫৫] আয়াতে বলা হয়েছে হিংসুকের কথা ! হিংসা একটি রীপু যা আত্মার শান্তি বিঘ্নিত করে; যা দোযখের আগুনের ন্যায়।

৫৬। যারা আমার নিদর্শন সমূহ প্রত্যাখ্যান করে, আমি শীঘ্রই তাদের অগ্নিতে নিক্ষেপ করবো। যতবারই তাদের চর্ম আগুনে ঝলসে যাবে, আমি তার স্থলে নূতন চর্ম সৃষ্টি করবো, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ শক্তিতে ক্ষমতাশীল এবং প্রজ্ঞাময়।

৫৭। কিন্তু যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে, শীঘ্রই আমি তাদের বেহেশতে স্থান করে দেবো, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, [যা হবে তাদের] চিরস্থায়ী বাসস্থান। সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গী থাকবে ৫৭৮। এবং তাদের স্থান করে দেবো সুশীতল ছায়াতলে ৫৭৯।

৫৭৮। দেখুন [২ : ২৫] আয়াত এবং টিকা ৪৪।

৫৭৯। বেহেশতের সুখ শান্তিকে কোনও মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা বা একে ভাষায় প্রকাশ করাও সম্ভব নয়। কোরান শরীফে বেহেশতের সুখ শান্তিকে প্রকাশের জন্য রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ যখন ভাষা কোনও অনুভূতিকে প্রকাশে সমর্থ না হয়, তখন রূপকের আশ্রয় ব্যতীত তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ছায়া ঘেরা নয়নাভিরাম বাগান, যার পাদদেশে ছোট নদী প্রবাহিত এই বাগানকে বেহেশতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অপর পক্ষে নরক যন্ত্রণাকে আগুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বেহেশ্‌ত ও দোযখের বৈষম্য তুলনা করার জন্য বেহেশ্‌তের সুখ শান্তিকে স্নিগ্ধ ছায়া ঘেরা নদীকূলের প্রশান্তি স্বরূপ বলা হয়েছে, অপর পক্ষে দোযখের যন্ত্রণা হচ্ছে জীবন্ত অগ্নিতে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণার স্বরূপ। আয়াত [৪ : ৫৬] এবং [৪ : ৫৭] এর বক্তব্য হচ্ছে - মন্দ কাজ আত্মার মাঝে যন্ত্রণার সৃষ্টি করে যার যন্ত্রণা জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা থেকেও অধিক। মৃত্যু শারীরিক যন্ত্রণার অবসান করে, কিন্তু আত্মা অমর। দৈহিক মৃত্যুর পরও আত্মার যন্ত্রণা অনন্তকাল ব্যাপী বিরাজ করে। এই হচ্ছে নরকাগ্নি। এই যন্ত্রণার শেষ নাই। মন্দ কাজই হচ্ছে এর মূল কেন্দ্র বিন্দু। অপর পক্ষে ভালো কাজ বা সৎ কাজ আত্মাকে স্বর্গীয় সুখ ও শান্তিতে ভরিয়ে ভরিয়ে দেয়, যাকে বেহেস্তের প্রবাহিত নদী, ফুলে শোভিত স্নিগ্ধ ছায়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে।

৫৮। আল্লাহ্‌ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন আমানত উহার হক্‌দারের প্রত্যার্পণ করার জন্য। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়ের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ্‌ তোমাদের যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সব শোনেন এবং সব দেখেন।

৫৯। হে বিশ্বাসীগণ ! যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাস কর, তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌র এবং আনুগত্য কর রাসূলের এবং [আনুগত্য কর] তাদের, তোমাদের মধ্যে যারা [আইনসঙ্গত] ক্ষমতার অধিকারী ৫৮০। এবং যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মতভেদ ঘটে তবে তা পেশ কর আল্লাহ্‌ ও রাসূলের নিকট। ইহাই সর্বোত্তম এবং পরিণাম নির্ধারণের জন্য ইহাই যথাযোগ্য।

৫৮০। 'Ulu-L-amr' এই আরবী শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, Those charged with authority or responsibility or decision or the Settlement of the affair, এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "যাহারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী।" হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ও প্রথম সাহাবীদের মতে 'উলিল আমর' - এর অর্থ হচ্ছে সে সমস্ত লোক যাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। এই পৃথিবীতে আল্লাহ্‌ বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন নেয়ামত দান করেছেন। এই নেয়ামতই হচ্ছে তার ক্ষমতার উৎস। নবী রাসূলদের আল্লাহ্‌র বাণী প্রচারের ক্ষমতা দিয়েছেন- এ হচ্ছে আল্লাহ্‌ প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নেয়ামত বা ক্ষমতা প্রাপ্ত। প্রশাসনিক, কারিগরী, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন দক্ষতা ব্যক্তির চরিত্রে বিভিন্ন ক্ষমতার জন্ম দেয়। কেউ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক্ষমতাধর, কেউ প্রকৌশল বিজ্ঞানে ক্ষমতাধর, কেউ প্রশাসনে ক্ষমতাধর। আল্লাহ্‌র নেয়ামতের কারণেই ব্যক্তি বিশেষ গুণাবলী অর্জন করে ক্ষমতাবান হয়। এরাই হন দেশের শাসন ক্ষমতার অধিকারী। এখানে আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা হবেন পক্ষপাতিত্বহীন এবং ধর্ম নিরপেক্ষ। তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটাই মানদন্ড থাকবে, আর তা হচ্ছে আল্লাহ্‌ ও রাসূলের দেখানো ন্যায় ও সত্য পথ অবলম্বন করা। ক্ষমতার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান ব্যক্তি হবেন ন্যায়বান, পক্ষপাতিত্বহীন, ধর্মনিরপেক্ষ। তারা তাদের ক্ষমতার ব্যবহার করবেন জনগণের কল্যাণের জন্য, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য, সত্যকে প্রকাশ করার জন্য। এখানে পক্ষপাতিত্বের কোনও স্থান নাই। জনসাধারণের উপর আল্লাহ্‌র আদেশ হচ্ছে, তারা যেনো সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সাথে সহযোগীতা করে, অন্যথায় সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা হবে বিঘ্নিত।

আয়াত [৪ : ৫৮] তে প্রথম বাক্যটিতে আমানত পরিশোধ এবং দ্বিতীয় বাক্যটিতে ন্যায় বিচারের নির্দেশ দান করা হয়েছে। আমানত পরিশোধের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়ার কারণ হচ্ছে, এর অবর্তমানে কোথাও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কাজেই যারা ক্ষমতাধর বা যাদের হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা থাকবে, তাদেরকে প্রথমে এই গচ্ছিত আমানতের দায়িত্ব যথাযতভাবে পালন করতে হবে। এ আয়াতে বিশেষভাবে একটি কথা স্মরণযোগ্য যে, এতে মহান আল্লাহ্‌ সরকারী পদসমূহকেও আমানত বলে সাব্যস্ত করে প্রথমেই এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আমানত যেন শুধুমাত্র তাদেরকে প্রত্যার্পণ করা হয় যারা তার প্রকৃত মালিক। কোন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের জন্য স্বজনপ্রীতি করতে যেয়ে অন্য কারও আমানত দিয়ে দেওয়া জায়েয নয়। সরকারী পদ, যার সাথে সর্বসাধারণের অধিকার জড়িত, তাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। একমাত্র সে সমস্ত লোকই এ সব আমানতের অধিকারী, যারা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সামর্থের দিক দিয়ে এসব পদের জন্য উপযোগী এবং উপস্থিত লোকদের মধ্যে উত্তম। আর বিশ্বস্ততা ও আমানতকারীর দিক দিয়েও যারা অন্যান্যদের তুলনায় অগ্রগণ্য। এদের ছাড়া অন্য কাউকে এসব পদ অর্পণ করা হলে আমানতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না।

এই প্রেক্ষিতে [৪:৫৯] আয়াতে প্রতীয়মান হয় ক্ষমতাধর বা রাষ্ট্রীয় পদ মর্যাদাসমূহ আল্লাহ্‌ তায়ালার আমানত। যাদের হাতে নিয়োগ ও বরখাস্তের অধিকার অথবা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের অধিকার রয়েছে সে সমস্ত কর্মকর্তা ও অফিসারবৃন্দ হলেন সে পদের আমানতদার। [বাংলাদেশে সরকারী অফিসে বহু ব্যক্তিকে দেখা যায়, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন ঠিকই, কিন্তু জনগণের অধিকার ও সম্পদ যা তাদের কাছে আমানত স্বরূপ তা খেয়ানত করেন। এদের ইসলামের সংজ্ঞা অনুযায়ী ধার্মিক বলা যাবে না, কারণ এরা ক্ষমতাধর, কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করেন]। সত্যিকারের যোগ্য লোক যোগ্য পদে অধিষ্ঠিত হলে সাধারণ লোকের জন্য হুকুম হলো "তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌র, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতাধর।" "ক্ষমতাধর" অর্থাৎ সচেতন নেতৃবর্গ।

রুকু - ৯

৬০। তুমি কি চিন্তা করে দেখ নাই তাদের সম্বন্ধে, যারা ঘোষণা করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে ? ৫৮১। অথচ তাদের [প্রকৃত] ইচ্ছা হচ্ছে তারা সকলে [তাদের বিতর্কের] মীমাংসার জন্য তাগুতের বিচারপ্রার্থী হবে। যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদের আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শয়তানের ইচ্ছা হচ্ছে তাদের বিপথে চালিত করা, যা [সঠিক পথ থেকে] অনেক দূরে।

৫৮১। এই আয়াতটি নাজেল হয়েছে মুনাফেকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার প্রসঙ্গে। একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজেল হয়। কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন। মুনাফেকদের দূরভিসন্ধি সর্বকালের, সর্বযুগে বর্তমান। সাধারণভাবে মোনাফেকেরা কথায় এমন চমক সৃষ্টি করবে যাতে মনে হবে তারা সত্য ও ন্যায়ের পথে আছে, কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, তারা মানসিকভাবে সর্বদা অন্যায় ও অসত্যের প্রতি আকৃষ্ট। যেখানেই ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত সেখানেই তারা সত্য ও ন্যায়কে পদদলিত করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সেজন্য আয়াতের শেষ অংশে হেদায়েত দান করা হয়েছে যে, যে লোক শয়তানের অনুসরণ করবে, শয়তান তাকে পথভ্রষ্টতার সুদূর প্রান্তে নিয়ে যাবে।

৬১। যখন তাদের বলা হয়, " আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের দিকে এসো, এবং রাসূলকে অনুসরণ কর।" তুমি দেখবে যে, মুনাফিকরা বিতৃষ্ণায় মুখ তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

৬২। তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন কোন বিপদ-বিপর্যয় তাদের ঘিরে ধরবে, তখন কি হবে ? তখন তারা তোমার নিকট এসে আল্লাহ্‌র নামে প্রতিজ্ঞা করবে "আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ব্যতীত অন্য কিছু বুঝি না।"

৬৩। এরাই তারা, - আল্লাহ্‌ যাদের অন্তরের [কথা] সম্যক অবগত। সুতরাং তাদের থেকে দূরে থাক ৫৮২। কিন্তু তাদের সদুপদেশ দাও এবং এমনভাবে কথা বল যেনো তা তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।

৫৮২। "দূরে থাক" বা ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে "Keep clear of them". এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে মোনাফেকদের সঙ্গ থেকে দূরে থাকার জন্য। যদিও এই উপদেশটি ছিল আল্লাহ্‌র নবীর জন্য, কিন্তু কোরানের বাণী সার্বজনীন এবং সর্বকালের। এখানে উপদেশ হচ্ছে মোনাফেকদের সংস্পর্শ ও তাদের বাক্‌চাতুর্য্য ও ছলা-কলা থেকে নিজেকে দূরে রাখা। তাদেরকে বিশ্বাস করতে নিষেধ করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তাদের বিরুদ্ধে এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। বরং আল্লাহ্‌র নবীর উপর হুকুম হচ্ছে এদের দোষত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করা; যেনো তারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় ফিরে আসে।

৬৪। আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর আনুগত্য করা হবে, এই উদ্দেশ্য ব্যতীত আমি কোন রাসূল প্রেরণ করি নাই। যখন তারা নিজের [আত্মার] প্রতি অন্যায় করে তখন তারা [যদি] তোমার কাছে আসে এবং আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে তারা অবশ্যই আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালুরূপে পাবে।

৬৫। কিন্তু না তোমার প্রভুর শপথ ! যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের বিবাদ-বিতর্কের বিচারক হিসেবে তোমাকে মান্য করে এবং তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনের মাঝে কোন দ্বিধা - দ্বন্দ্ব না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা [প্রকৃত] বিশ্বাস [ঈমান] লাভ করবে না ৫৮৩।

৫৮৩। আনুষ্ঠানিকাতর মধ্যে কোনও ধর্ম নাই। শুধু মাত্র মৌখিক ও আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া কর্ম আল্লাহ্‌র দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাস - যা বান্দার প্রতিদিনের জীবন-যাপন ও কর্মপ্রণালীর মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে। Lip profession বা মুখের কথায় ধার্মিক বলে বহির্বিশ্বে প্রমাণিত হলেও আল্লাহ্‌ সর্ব জ্ঞাত। তিনি বান্দার মনের সব খবরই জানেন। প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসীরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোরান ও রাসূলের অনুসারী। কোরানের হুকুম ও রাসূলের সিদ্ধান্ত তারা সন্দেহাতীত ভাবে পালন করবে। শুধু পালন করবে বললে যথার্থ বলা হবে না- "উহা সর্বান্তকরণে মেনে নেয়"। অর্থাৎ তাদের অন্তর কোরানের নির্দশ মানার ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করে; অন্তর হয় উৎফুল্ল; কোনও সন্দেহ বা অভিযোগ তাদের আত্মাকে ভারাক্রান্ত করে না। এরাই হচ্ছেন প্রকৃত মোমেন।

৬৬। যদি তাদের নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে আদেশ দিতাম, অথবা গৃহত্যাগের নির্দেশ দিতাম তবে তাদের মাঝে খুব অল্প সংখ্যকই তা করতো ৫৮৪। তাদের [প্রকৃত পক্ষে] যা করতে বলা হয়েছিলো যদি তারা তা করতো, তবে তা তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হতো এবং তাদের [ঈমানকে] শক্তিশালী করতে সর্বাধিক সাহায্য করতো।

৫৮৪। প্রতিটি মহৎ কাজকেই পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হতে হয়। আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাসকেও সেইরূপ পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হতে হয়। তারাই সুদৃঢ় ঈমানের উপরে অধিষ্ঠিত যারা আল্লাহ্‌র আইন বা বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে দ্বিধা বোধ করে না, একেই জেহাদ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মানুষের নিকট তার জীবন বা অস্তিত্ব হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু। এই জীবনকে, জীবনের আরাম আয়েশকে, জীবনের প্রিয় বস্তু বা প্রিয়জনকে যারা আল্লাহ্‌র জন্য উৎসর্গ করে, তারাই তো সত্যিকারের মোমেন বা বিশ্বাসী। সত্যিকারের মোমেন ব্যক্তি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে অকুতভয়; এই সংগ্রামে নেতার হুকুম পালনে সে কখনও দ্বিধাগ্রস্থ হয় না। কারণ সে জানে তার এই সংগ্রাম মহত্তর উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম। আল্লাহ্‌র কাছে সে গ্রহণযোগ্য। তার কোনও ভয় নাই- ইহকালে বা পরকালে। ফলে তার চিন্তা ভাবনা হয় সুসংহত ও দৃঢ়। চিত্ত হয় বিশ্বাসে স্থির ও প্রশান্ত। কারণ সে জানে "উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।" এখানেই মোনাফেকদের সাথে মোমেন বান্দার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মোনাফেক নিজ স্বার্থ ব্যতীত কোনও মহৎ উদ্দেশ্য বা বৃহত্তর স্বার্থের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারে না। সর্বদা তার চিত্তে একটাই ভাবনা ও চিন্তা স্থান দখল করে থাকে - আর তা হচ্ছে ব্যক্তিগত লাভ লোকসান। এর জন্য সে মিথ্যার, অন্যায়, অত্যাচার, অসত্যের আশ্রয় নিতে দ্বিধা বোধ করে না। ফলে সে তার অন্তরের অন্তস্থলে সম্যক অবগত যে, তার কার্যপ্রণালী আল্লাহ্‌ কর্তৃক অনুমোদিত নয়। লাভ-লোকসানের চিন্তা, হারাবার ভয়, লোক সম্মুখে তার নীচ কার্যপ্রণালী প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়, এসব মিলে তার আত্মাকে করে তোলে অশান্ত ও অস্থির। এর ফলে মোনাফেকের অন্তরের শান্তি হয় বিনষ্ট। অপরপক্ষে মোমেন বান্দার অন্তর বেহেশ্‌তি শান্তিতে ভরে যায়।

৬৭। এবং তখন আমি আমার পক্ষ থেকে তাদের মহা পুরস্কার প্রদান করতাম।

৬৮। এবং আমি তাদের নিশ্চয়ই সরল পথে পরিচালিত করতাম ৫৮৫।

৫৮৫। আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য আত্মাকে করে পরিশুদ্ধ ও নির্মল। প্রারম্ভিক ক্ষেত্রে আনুগত্যের ফলে যে সুবিধা বিশ্বাসীরা ভোগ করে, সংক্ষেপে এই আয়াতটিতে ও পূর্ববর্তী আয়াতে তা বর্ণনা করা হয়েছে। সুবিধাগুলি নিম্নরূপ : (১) এই আনুগত্য তার নিজের আত্মার মঙ্গলের জন্য ("তাদের জন্য ভালো হতো"); (২) এর ফলে তাদের বিশ্বাসের ঈমানের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হতো "ঈমানকে শক্তিশালী করতে সর্বাধিক সাহায্য করতো।" (৩) আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য অর্থাৎ তাঁর বিধান বা সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য যেই-ই সংগ্রাম করবে উপরে উল্লেখিত নিয়ামত সমূহ আল্লাহ্‌ তাকে প্রদান করবেন এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নাই।

৬৯। যারা আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে এবং রাসূলের [আনুগত্য করে] তারা তাদের সঙ্গী হিসেবে পাবে, যাদের উপরে আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন- [তারা হচ্ছেন] নবী [যারা সত্য প্রচার করেন] সত্যনিষ্ঠ [যারা অকৃত্রিমভাবে সত্যকে ভালোবাসেন], শহীদ এবং পূণ্যাত্মা [যারা ভালো কাজ করে]। আঃ কত সুন্দর তাদের সাহচার্য ৫৮৬।

৫৮৬। এই আয়াতটি এক অপূর্ব অর্থবোধক, গভীর এবং আত্ম নিবেদিত। এখানে আল্লাহ্‌ বলছেন যে অতি সাধারণ ব্যক্তিও যদি আল্লাহ্‌ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তবে পরকালে তাদের কোনও ভয় নাই। পরকালে তারা এক মহৎ সম্প্রদায়ের সদস্য হতে যাচ্ছেন যে সম্প্রদায় আল্লাহ্‌র আশীর্বাদে ধন্য; যে সম্প্রদায় চিরস্থায়ী ভাবে আল্লাহ্‌র রহমতে বিধৌত হবে। শীতের প্রভাতের নরম সোনালী রৌদ্রে সর্ব অঙ্গ যেমন উষ্ণতার আরামে ডুবে যায়, বিশ্ব চরাচর সূর্যস্নাত হয়ে বিকশিত হয়ে ওঠে, ঠিক সেই ভাবে আল্লাহ্‌র রহমতে ধন্য সম্প্রদায় পরকালে বিকশিত, প্রস্ফুটিত হবে। কত না মহৎ, কত না সুন্দর সেই সম্প্রদায়। এই মহৎ সম্প্রদায়ের ক্রমোচ্চ শ্রেণী বিভাগের বর্ণনা এই আয়াতে আছে। ধারাবাহিক ভাবে সর্বোচ্চ স্থানে আছেন : (১) নবী ও রাসূলেরা যাদের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তার বাণী এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। যাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি আল্লাহ্‌র বিধান সমূহ, ইসলাম ধর্মে সেই শ্রেণীবিন্যাসের সর্বোচ্চ স্থানে আছেন আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ মোস্তফা (সাঃ)। (২) এর পরবর্তী ধাপে আছেন তাঁরাই যারা সত্য, ন্যায় ও বিশ্বস্ততায় অগ্রগণ্য পথিক। যারা সত্যকে ভালোবাসেন, সত্যকে সমর্থন করেন এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা তাদের জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেও সর্বদা প্রস্তুত। এরা হলেন হযরত মুহম্মদের সহচরবৃন্দ, তাঁর সাহাবীবৃন্দ, যারা ইসলামের সেই প্রাথমিক যুগে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার জন্য শত অত্যাচারেও সত্য পথ থেকে, রাসূলের পক্ষ থেকে বিচ্যুত হন নাই। হযরত আবু বকর এর মধ্যে তালিকার শীর্ষে যে জন্য তিনি সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত হন। (৩) এর পরবর্তী ধাপে আছেন সত্যের সাধকবৃন্দ, যারা সত্যের জন্য, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেন। প্রয়োজনে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শাহাদাৎ বরণ করতেও দ্বিধা বোধ করে না। সমাজে এদের আবির্ভাব নানাভাবে দেখা যায়। মহৎ ব্যক্তি যাদের বাণীতে বা প্রচারে বা জ্ঞানে পৃথিবী ধন্য হয়, অথবা জ্ঞানী ব্যক্তির 'কলম' যা অজ্ঞানতার আঁধার দূর করতে সক্ষম, অথবা সমাজের মঙ্গলের জন্য বা জনগণের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মী। (৪) শেষ ধাপে আছে বিশাল জনগোষ্ঠি যারা সৎ জীবন যাপনের মাধ্যমে, আল্লাহ্‌র বিধান অনুসরণের মাধ্যমে নিজেদের আল্লাহ্‌র দরবারে মোমেন বান্দারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এরা হচ্ছেন তারাই যারা অতি সাধারণ মানুষ এবং তাদের জীবন যাত্রা প্রণালীও অতি সাধারণ, কিন্তু তাদের অতি সাধারণ জীবন যাপন অসাধারণ হয়ে ওঠে, যখন তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন প্রণালী যথা- ব্যবসা-বাণিজ্যে, অফিস-আদালতে অর্থাৎ তাদের কর্মক্ষেত্রে তারা ন্যায় ও সত্যের পথ অবলম্বন করেন; প্রকাশ্য ও গোপন সব ক্ষেত্রেই সৎ কর্মসমূহে যথাযথভাবে অনুসরণ করেন; আল্লাহ্‌ ও রাসূলের আনুগত্যের ফলে পরকালে আমরা এই মহান সম্প্রদায়ের সদস্য লাভের যোগ্যতা অর্জনের ক্ষমতা লাভ করবো "আঃ কত সুন্দর তাদের সাহচর্য।" এই কথাটি দ্বারা এই যোগ্যতাকেই বুঝানো হয়েছে।

৭০। এরূপই [হয়ে থাকে] আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ। জ্ঞানে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট ৫৮৭।

৫৮৭। এই আয়াতটি প্রাণিধানযোগ্য। এই আয়াতটির অর্থ অনুধাবনের জন্য নিম্নোক্ত উপমাটি ব্যবহার করা হলো। মনে করুণ সামরিক বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ জেনারেল, তিনি একজন সাধারণ সৈনিক এবং ছোট বড় সব অফিসারকে একই টেবিলে একই সারিতে বসার এবং অংশ গ্রহণের সম্মান প্রদর্শন করলেন। তাঁর এই মহত্ব ছোট-বড় সবাইকে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। ঠিক সেইরূপ মহান আল্লাহ্‌ আমাদের ক্ষুদ্রতা, দীনতা, সীমাবদ্ধতা সত্বেও আমাদের যোগ্যতা না থাকা সত্বেও সেই মহান গৌরবময় সম্প্রদায়ের সদস্য পদ দান করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন, আমাদের সম্মানীত করেছেন। কারণ "জ্ঞানে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট।"

রুকু - ১০

৭১। হে মুমিনগণ ! সাবধানতা অবলম্বন করবে। দলে দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হবে অথবা এক সাথে অগ্রসর হবে ৫৮৮।

৫৮৮। আল্লাহ্‌র জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়া বা ত্যাগ স্বীকার করার নাম জেহাদ। পূর্ববর্তী আয়াতে জেহাদের কথা বলা হয়েছে, [৪ : ৬৬]; এই আয়াতের [৪ : ৭১] প্রথমাংশে জেহাদের জন্য প্রস্তুতির এবং অতঃপর আয়াতের দ্বিতীয় অংশে জেহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোনও যুদ্ধই উপযুক্ত প্রস্তুতি ব্যতীত জয়লাভ করা যায় না। এই বাহ্যিক প্রস্তুতি গ্রহণ আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতার পরিপন্থি নয়। সুতরাং 'জেহাদ' বা সত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ বা যে কোনও মহৎ কাজই শুরু করার পূর্বে উপযুক্ত প্রস্তুতি ও "সতর্কতা অবলম্বন" অবশ্য করণীয়। আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণের পরে- আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভর করে, সাহসের সাথে এগিয়ে যাওয়া। "সতর্কতা অবলম্বন কর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হও অথবা এক সাথে অগ্রসর হও।" এই লাইনটি দ্বারা উপরের ভাবধারার প্রকাশ করা হয়েছে। এই "দলে দলে" - কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেহাদে অংশগ্রহণকারীরা সকলেই আল্লাহ্‌র সৈনিক। তাদের বিশ্বাস, চিন্তাধারা, কর্মপদ্ধতি, মূল নীতি সবই হতে হবে একই উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত। ব্যক্তিগত সুখ, সুবিধা, বা স্বার্থপরতা জেহাদের পরিপন্থি। ছোট দল বা বড় দল বিভক্ত করে যেভাবে নেতা যুদ্ধের কৌশল নির্ধারিত করেন এবং সৈন্য পরিচালনা করেন, সাধারণ সৈনিক বা কর্মীরা তা অকপটে মেনে চলবে। কোন দ্বিধা, দ্বন্দ যেনো তাদের অন্তরে স্থান না পায়। এই-ই হচ্ছে আল্লাহ্‌র নির্দেশ।

৭২। নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে এমন লোক আছে যারা পিছনে বিলম্ব করবে ৫৮৯। যদি কোন বিপর্যয় তোমাদের উপরে পতিত হয়, তারা বলে, "আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, [কারণ] আমরা তাদের মাঝে উপস্থিত ছিলাম না।"

৫৮৯। এই আয়াতে মোনাফেকের আর একটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। মোনাফেকেরা হয় অত্যন্ত স্বার্থপর। ব্যক্তিস্বার্থ ব্যতীত তার চিন্তাধারাতে আর কিছুই স্থান পায় না। তাই মোনাফেকেরা হয় সন্দেহবাহিক। এই সন্দেহ বাতিকতা মোনাফেকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বাতিকতার ফলে সে সমাজের কাউকে বিশ্বাস করে না। সব কিছুকেই সে মনে করে তার স্বার্থ বিরুদ্ধ। ফলে সে সমাজের বৃহত্তর কর্মসূচী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাতীয় বা সামাজিক জীবনের মঙ্গলের জন্য যে সব কর্মসূচী তাতে অংশগ্রহণ থেকে সে হয় বিরত। যদি এই কর্মসূচীর দরুন জাতি বা গোষ্ঠির লোকজন কোনও বিপদে পড়ে বা পরাজয় বরণ করে মোনাফেক ব্যক্তিরা দুঃখ বোধ বা অংশ না গ্রহণের জন্য লজ্জ্বিত বোধ করে না বরং সে নিজেকে আল্লাহ্‌র আশীর্বাদ প্রাপ্ত ব্যক্তি মনে করে। অপর পক্ষে, যদি সাফল্য বা জয় দ্বারা জাতি বা গোষ্ঠিকে আল্লাহ্‌ ধন্য করেন, তবে মোনাফেক ব্যক্তি তাদের ঐ সাফল্য বা জয়ের আনন্দে অংশ গ্রহণ করতে অপারগ, তার সমস্ত সত্তা হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়। কারণ বীরোচিত কাজের গৌরব থেকে সে বঞ্চিত, সেই ক্ষোভে তার অন্তর আত্মা দহিত হয়।

৭৩। কিন্তু তোমরা যদি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সাফল্য লাভ কর, তবে তারা নিশ্চয়ই বলবে, যেনো তোমাদের ও তাদের মধ্যে কোন ভালোবাসার বন্ধন নাই- এভাবে বলবে যে, "হায়! যদি তাদের সাথে থাকতাম, তবে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম" ৫৯০।

৫৯০। এই আয়াতের এই উক্তিটি মোনাফেক ব্যক্তির। এই উক্তি দ্বারা প্রকাশ পায়, মোনফেকদের আচরণ। স্বার্থপর ব্যক্তির চিন্তাধারার অকপট প্রকাশ উপরের উক্তি। এরূপ ব্যক্তিরা কখনও সমাজ সংসারের বা জাতির সম্পদ বা শক্তিরূপে পরিগণিত হতে পারে না। এরূপ ব্যক্তিরা জাতীয় বিপর্যয় বা অস্তিত্বের, সংহতির প্রশ্নে কখনও কোনও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না।

৭৪। যারা পারলৌকিক জীবনের বিনিময়ে পার্থিব জীবনকে বিক্রয় করে। তারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম করুক ৫৯১। যে কেহ আল্লাহ্‌র পথে সংগ্রাম করবে, সে নিহত হোক বা বিজয়ী হোক, আমি তাঁকে মহাপুরস্কার দান করবো।

৫৯১। এই আয়াতটি ও পরবর্তী আয়াতটি মক্কার নির্যাতিত, দুর্বল, নিপীড়িত মুসলমান যারা হিযরত করতে অসমর্থ ছিল, জেহাদের মাধ্যমে সেই নিপীড়িতদের মুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উৎপীড়িতদের সাহায্য করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। আর এই ফরজ বা আল্লাহ্‌র হুকুম সর্বকালের ও সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। যারা মোমেন, তারা আল্লাহ্‌র এই হুকুম মান্য করার মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহ্‌র রহমতে ধন্য মনে করে, নিজেকে বিশেষে সুবিধাভোগী মনে করে। কারণ তারা আল্লাহ্‌র রাস্তায়, তার সেবার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে যাচ্ছে। পৃথিবীতে সব যুগেই সবখানেই মানবতা হয়েছে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত। একথা যেমন সেই যুগেও বিদ্যমান ছিল, আজকেও বিদ্যমান। বিশেষভাবে বাংলাদেশে। এদেশে যারা দুর্বল অর্থ এবং সম্পদে, তারা প্রতি মূহুর্তে হচ্ছে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত। এদেশের মহিলারা প্রতি মূহুর্তে যৌতুক ও সন্ত্রাসের দ্বারা হচ্ছে নির্যাতিত। তারা পুরুষের লোভ লালসার শিকারে পরিণত হচ্ছে। মানবতা হচ্ছে লঙ্ঘিত, লাঞ্ছিত। আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে- যেখানেই মানবতা লাঞ্ছিত হবে সেখানেই জেহাদের হুকুম। মুসলমানদের জন্য জেহাদ এক বিশেষ নেয়ামত বহন করে। কারণ জেহাদে কিছুই হারাবার নাই। বরং যারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করে তারা আল্লাহ্‌র বিশেষ নেয়ামতে ধন্য। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনের, ক্ষণস্থায়ী সুখ-সুবিধার পরিবর্তে সে লাভ করে চিরস্থায়ী জীবন। যদি সে জেহাদে জয়লাভ করে, তবে এই পৃথিবীতেই সে হবে সম্মানিত আর যদি জেহাদে তার মৃত্যুও ঘটে, মৃত্যুর পরে সে হবে আল্লাহ্‌ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত। অর্থাৎ তাদের জয় বা পরাজয় - এই দুয়ের মধ্যে আল্লাহ্‌র কাছে কোনও পার্থক্য নাই। তাদের মহৎ নিয়তের জন্য আল্লাহ্‌ তাদের বিশেষ 'সম্মানে' ভূষিত করবেন তাঁর নিজের পক্ষ থেকে। এর থেকে বড় পাওয়া মোমেন বান্দার জীবনে আর কি হতে পারে ? জীবন ও মৃত্যু দুই-ই তার কাছে সমান। সত্যিকার অর্থে আল্লাহ্‌র যোদ্ধাদের মৃত্যু নাই। দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তারা মানুষের অন্তরের রাজ্যে অমর হয়ে থাকেন। তাদের যেমন- মৃত্যু নাই, সেরূপ ন্যায়ের পথে সত্যের পথে, নিপীড়িতদের পক্ষে জেহাদেরও পরাজয় নাই। একদিন না একদিন জয় তাদের হবেই। আল্লাহ্‌র রাস্তায় যারা যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেন তারা হচ্ছেন শহীদ। শহীদের মৃত্যু নাই। তাই এদের নিকট "জীবন মৃত্যু ভৃত্য সম, চিত্ত ভাবনাহীন।"

৭৫। এবং কেন তোমরা আল্লাহ্‌র পথে এবং তাদের জন্য যারা দুর্বল, অত্যাচারিত, [নিষ্পোষিত] নর-নারী এবং শিশুগণের জন্য সংগ্রাম করবে না ৫৯২ ?

যাদের আর্ত কান্না হচ্ছে, "আমাদের প্রভু " এই জনপদ, যার অধিবাসীরা অত্যাচারী, সেখান থেকে আমাদের উদ্ধার কর। এবং তোমার নিকট থেকে কাহাকেও আমাদের অভিভাবক কর; এবং তোমার নিকট থেকে কাহাকেও প্রতিষ্ঠিত কর যে আমাদের সাহায্য করবে" ৫৯৩।

৫৯২। 'Mustadh'af' = অর্থ দুর্বল, যার দরুন তার সাথে অন্যায় ব্যবহার করা হয়। দেখুন [৪:৯৮] আয়াত।

৫৯৩। উৎপীড়িতদের সাহায্য করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে " আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম করার" অর্থ হচ্ছে, ন্যায় ও সত্যের জন্য, নিপীড়িত, শোষিত জনগণের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করাকে বুঝায়। আয়াতটি নাজেল হওয়ার শানে নাজুল হচ্ছে- মক্কা নগরীতে এমন কিছু দুর্বল মুসলমান রয়ে গিয়েছিলেন, যারা দৈহিক দুর্বলতা এবং আর্থিক কারণে হিজরত করতে পারছিলেন না। পরে কাফেররাও তাদের হিজরত করতে বাধাদান করছিল এবং তাদের উপরে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন শুরু করছিল, যেনো তারা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এই উৎপীড়িত নব্য মুসলিমরা নিজেদের ঈমানী বলিষ্টতার দরুণ কাফেরদের অসহনীয় অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করেও ঈমানের উপরে স্থির থাকেন। তাঁরা এই অত্যাচার উৎপীড়ন থেকে অব্যহতি লাভের জন্য বরাবরই আল্লাহ্‌র দরবারে প্রার্থনা করতেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্‌ তাঁদের সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেন এবং এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ জেহাদের নির্দেশ দেন- অত্যাচারিতদের সাহায্য করতে, তাদের কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সেই মুক্তি অর্জিত হয়।

এই আয়াতটির উপদেশ সার্বজনীন। রাসূলে করিমের যুগ বহু আগে শেষ হয়েছে, কিন্তু তার প্রতি দেয় আল্লাহ্‌র বাণী বা উপদেশ সর্বকালের জন্য। যেখানেই উৎপীড়িত, মজলুম জনতা, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ফরজ। তাই যে কোনও ঈমানদার মুসলমান ন্যায় ও সত্যর জন্য সংগ্রামে সর্বদা সাহসী ভূমিকা অবলম্বন করবে। এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র হুকুম।

৭৬। যারা মুমিন, তারা আল্লাহ্‌র পথে সংগ্রাম করে, এবং যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে তারা অশুভ শক্তির [তাগুতের সাহায্যের] জন্য সংগ্রাম করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের ৫৯৪ বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল।

৫৯৪। যারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম করে, এই আয়াতে তাদের বলা হয়েছে 'মোমেন' বা 'বিশ্বাসী' বলে। 'Auliyaa' বহুবচনে 'Wali' - যার অর্থ হচ্ছে বন্ধু, সমর্থক, রক্ষাকর্তা। এই শব্দটি সমার্থক 'maule' শব্দটির জন্য দেখুন [৪ : ৩৩] আয়াত এবং টিকা ৫৪৩।

৭৭। তুমি কি চিন্তা করে দেখ নাই, যাদের [যুদ্ধ থেকে] তাদের ৫৯৫ হাতকে বিরত রাখতে বলা হয়েছিলো, নিয়মত সালাত প্রতিষ্ঠিত করতে এবং যাকাতের জন্য ব্যয় করতে বলা হয়েছিলো ? [শেষ পর্যন্ত] যখন তাদের জন্য যুদ্ধের আদেশ প্রেরণ করা হলো, দেখো ! তাদের একদল মানুষকে ভয় করেছিলো আল্লাহ্‌কে ভয় করার মত অথবা তদপেক্ষা বেশী। তারা বলেছিলো, "হে প্রভু আমাদের জন্য যুদ্ধের আদেশ কেন দিলে ? আমাদের কিছু দিনের জন্য অবকাশ দাও না?" ৫৯৬ বল, "পার্থিব ভোগ বিলাস [অতি] সামান্য এবং যে সঠিক ভাবে চলে [জীবন ধারণ করে], তার জন্য পরকাল সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও অন্যায় করা হবে না।

৫৯৫। জেহাদের হুকুম নাজেল হওয়ার পূর্বে একদল মুসলিম যুদ্ধ করার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত, প্রতিশোধ, ঝগড়া প্রিয়তা, ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান। আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হতে হবে মহান, তবেই তা জেহাদ নামে আখ্যায়িত করা যাবে। মহত্তর উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত সংগ্রামই হচ্ছে জেহাদ। আর এই জেহাদে যারা প্রাণ বিসর্জন দেন তারা হচ্ছেন শহীদ। সুতরাং মহত্তর উদ্দেশ্য ব্যতীত যুদ্ধ করা সব সময়েই ইসলামে নিষিদ্ধ। এই আয়াতে বলা হয়েছে, যখন সত্যিকারের জেহাদের জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দান করা হলো, অর্থাৎ মহত্তর কারণের জন্য, উৎপীড়িতের মুক্তির জন্য জেহাদের হুকুম দান করা হলো, যারা ব্যক্তিগত কারণে যুদ্ধের জন্য ব্যাকুল ছিল, তাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভাব পরিলক্ষিত হলো। কারণ জেহাদের উদ্দেশ্য পরের মঙ্গল সাধন, ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান এখানে অনুপস্থিত। যারা মোনাফেক শুধু তারাই বৃহত্তর কারণের জন্য আল্লাহ্‌র রাস্তায় জেহাদে দ্বিধা দ্বন্দ্ব করে, ব্যক্তিগত লাভ ব্যতীত মোনাফেকেরা যুদ্ধে ভীত হয়।

৫৯৬। তাদের মনের কথা হচ্ছে, "পৃথিবীর জীবন খুবই ছোট ও ক্ষণস্থায়ী, সেই জীবনকে পরের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করে কি লাভ ? যদি ব্যক্তিগত লাভ না হয় ?" তাদের এই মানসিক চিন্তাধারার প্রেক্ষিতেই এই আয়াতটি নাজেল হয়। সংক্ষেপে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাদের জন্য নিম্নোক্ত বক্তব্যগুলি পেশ করা হয়েছে : [৪ : ৭৪-৭৮] আয়াতের মাধ্যমে।

(১) পৃথিবীর ভোগ বিলাসের জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, "আয়ু যেনো পদ্মপত্রে নীড়।" এ জীবনের বিশ্বাস নাই একমূহুর্তের। তাই মোমেন বান্দাদের উচিত এই পৃথিবীর মোহ পরিত্যাগ করে পরকালের জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়া।

(২) পৃথিবীতে তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়ের পথ অবলম্বন করা। তারাই মুত্তাকী যারা ন্যায়ের পক্ষে অটল থাকে সুতরাং মুত্তাকী লাভের জন্য প্রত্যেকে প্রত্যেকের কর্তব্যে অটল থাকবে।

(৩) যখন তোমাদের আল্লাহ্‌ আত্মোৎসর্গের জন্য নির্দেশ দান করেন, মনে রেখো আল্লাহ্‌ কারও প্রতি সামান্য অন্যায় বা জুলুম করেন না। প্রত্যেককেই তার সাধ্য অনুযায়ী বিচার করবেন।

(৪) মৃত্যুকে ভয় করেও মৃত্যুকে এড়াতে পারবে না। যেখানেই থাক না কেন; সময় হলে মৃত্যু তোমাকে ঠিক খুঁজে নেবে। মৃত্যুভয়ে জেহাদ থেকে বিরত না থেকে সাহসের সাথে তার মোকাবেলা কর। সুতরাং যখন কর্তব্য তোমাকে ডাক দেবে অকুতোভয়ে মৃত্যুর পরোয়া না করে তার সম্মুখীন হও।

৭৮। "তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের খুঁজে বের করবেই, এমনকি সুউচ্চ, মজবুত দুর্গে অবস্থান করলেও।" যদি তাদের কোন কল্যাণ হয়; তবে তারা বলে, "এ তো আল্লাহ্‌র নিকট থেকে।" কিন্তু যদি তাদের অকল্যাণ হয়, তবে তারা বলে, "এতো তোমার নিকট থেকে।" [হে নবী] ৫৯৭ বল, 'সব কিছু আসে আল্লাহ্‌র নিকট থেকে। কিন্তু তাদের কি হয়েছে যে, তারা কোন কথা বোঝে না।

৫৯৭। এখানে এই আয়াতে মোনাফেকদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে- মোনাফেকদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের কথা ও কাজে মিল নাই। তাদের চিন্তাধারা অসঙ্গত। যদি কোনও বিপদ তাদের উপরে পতিত হয়, যার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী, তারা তখনও তার দায় দায়িত্ব স্বীকার করবে না। তারা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্যের ঘাড়ে দোষারোপের জন্য। কিন্তু যদি ভাগ্য তাদের উপরে সুপ্রসন্ন হয়, তবে সাথে সাথে তারা সব কিছুর জন্য নিজেকে কৃতিত্বের দাবীদার মনে করে। তারা নিজের মেধা, ক্ষমতার গর্বে অহংকারে স্ফীত হয়ে ওঠে এবং নিজেকে আল্লাহ্‌র বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট বলে ভাবতে শুরু করে; তারা স্বতন্ত্র, এই চিন্তাধারা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। বর্তমান যুগে মোনাফেকদের বৈশিষ্ট্য আর একধাপ অগ্রগতি হয়েছে। তারা তাদের কৃতিত্বের দাবীদার হিসেবে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সেখানে স্রষ্টার কোনও স্থান নাই। সমস্ত কৃতিত্ব, সমস্ত সাফল্য, সমস্ত দক্ষতা, সব কিছুর সাফল্য তার নিজের। মোনাফেকেরা ভুলে যায়, শিল্প, সাহিত্য, মেধা, সৃজন ক্ষমতা, বিজ্ঞান, সব ক্ষমতাই হচ্ছে আল্লাহ্‌র নেয়ামত। পরিশ্রমের মাধ্যমে সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এই নেয়ামতকে করায়ত্ব করতে হয়। কিন্তু মোনাফেকেরা ভুলে যায় সর্বক্ষমতার, সর্ব নেয়ামতের উৎস সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। আমরা শুধুমাত্র তার নেয়ামতের ধারক। তিনি দান করেছেন বলেই বিশেষ নেয়ামতে আমরা ধন্য হই। সমস্ত মঙ্গলের মালিক আল্লাহ্‌ [৩ : ২৬]। কিন্তু যা কিছু অমঙ্গল বা বিপদ তা আমাদের নিজেদেরই কর্মফল। আল্লাহ্‌ কখনও সামান্যতম অবিচার বা জুলুম করেন না [৪ : ৭৭]। বিপদ বা পরাজয়কে মোনাফেকেরা চিহ্নিত করে দুর্ভাগ্য বলে। যেনো দুর্ভাগ্য আল্লাহ্‌ কর্তৃক প্রদত্ত।

৭৯। হে মানব সম্প্রদায়] তোমার যা কিছু কল্যাণ হয় তা আল্লাহ্‌র নিকট থেকে [প্রেরিত], কিন্তু তোমার যা কিছু অকল্যাণ ঘটে, তা তোমার নিজের কারণে এবং আমি তোমাকে মানুষকে [শিক্ষা দিবার জন্য] রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি, সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট ৫৯৮।

৫৯৮। সাধারণ মানুষ সব সময়ে দুর্ভাগ্যকে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত জ্ঞানে- আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে দোষারোপ করে। তারা সৌভাগ্যকে স্ব-অর্জিত বলে অহংকারে স্ফীত হয়। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, আল্লাহ্‌র রহমত তাঁর সৃষ্টিকে বেষ্টন করে আছে। আমরা চাই বা না চাই তার রহমত, করুণা আমাদের বিধৌত করতে সর্বদা বিরাজমান। শুধু আমাদের অন্তরের মাঝে, আত্মার মাঝে তার রহমতকে, করুণাকে ধারণ করার আকাঙ্খা প্রকাশ করতে হবে। এই ধারণ করার আকাঙ্খার অর্থ, আল্লাহ্‌র বিধান অনুযায়ী জীবন প্রণালীকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদি আমরা আমাদের জীবন যাপন প্রণালী স্রষ্টার বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতে পারি, তবে আমাদের চরিত্রে জন্ম নেবে দুর্লভ গুণাবলীর। এই গুণাবলীই হচ্ছে আল্লাহ্‌র রহমত। আল্লাহ্‌র রহমতে ধন্য ব্যক্তির চরিত্রে জন্ম নেয়, দূরদর্শিতা, জ্ঞান (wisdom), প্রজ্ঞা, সর্বপরি বিবেক (spiritual insight)। ফলে তার জীবন স্বর্গীয় শান্তিতে ভরে যায়। পৃথিবীর মলিনতার উর্ধ্বে হয় তার অবস্থান। ব্যক্তির সমষ্টি থেকেই জাতির জন্ম। যে জাতির জাতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান মেনে চলা [অর্থাৎ সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন প্রণালী পরিচালনা করা এবং সৎ কাজ করা] সে জাতির নাগরিকদের চরিত্রেও দুর্লভ গুণাবলীর জন্ম নেবে। ফলে তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হবে (দেখুন আয়াত [২৪ : ৫৫]। "কল্যাণ যা তোমার হয় তা আল্লাহ্‌র নিকট থেকে", কথাটির অর্থ হচ্ছে উপরের বর্ণনা। অপরপক্ষে যারা অসৎ পথে জীবন যাপন করে তাদের আত্মায় আল্লাহ্‌র নূর প্রবেশে বাঁধা পায়, ফলে তাদের আত্মা অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। এই আত্মায় কখনও গুণাবলীর প্রকাশ ঘটবে না। তাদের মধ্যে দূরদর্শিতা, জ্ঞান (wisdom) প্রজ্ঞা, সর্বপরি বিবেক (spiritual insight) থাকবে অনুপস্থিত। বিবেকহীন ব্যক্তি যেমন সমাজের উপকারের পরিবর্তে অপকার করে, সেরূপ যে জাতি বিবেকহীন তারা পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় হবে পশ্চাদপদ। তাদের জীবনে জাতীয় বিপর্যয় লেগেই থাকবে, কারণ তাদের জীবন প্রণালীই তাদের আল্লাহ্‌র প্রদত্ত গুণাবলী থেকে বঞ্চিত করেছে। এ কথাকেই এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, "অকল্যাণ যা তোমার হয় তা তোমার নিজের কারণে।" এই জীবন যাপন প্রণালীকে আল্লাহ্‌র ইচ্ছানুযায়ী পরিচালনার জন্য আল্লাহ্‌ তাঁর বিধান সমূহকে তাঁর দূতদের মাধ্যমে যুগে যুগে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সেইরূপ আল্লাহ্‌র প্রেরিত দূত। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন সামাজিক ও নৈতিক চরিত্রের উন্নতি সাধনের পন্থা। তিনি আমাদের জন্য আল্লাহ্‌ প্রেরিত রহমত স্বরূপ। আমাদের জীবনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ নির্দেশ করার জন্য আল্লাহ্‌ তাঁকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং আল্লাহ্‌র রাসূলের প্রদর্শিত পথ পরিত্যাগের অর্থই হচ্ছে নিজের প্রতি বিপর্যয় বা দুর্ভাগ্য ডেকে আনা।

উপদেশঃ আজ বাংলাদেশীদের জাতীয় বিপর্যয়কে এরই আলোকে খুঁজে দেখতে হবে। আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কোনও ধর্ম নাই, কোনও পূণ্য নাই। পূণ্য আছে এক স্রষ্টায় বিশ্বাসে, জীবে দয়ায়, প্রার্থনায়, দানে এবং দুঃখ-দুর্দশায় ধৈর্য্য ধারণের মাধ্যমে। আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ আল্লাহ্‌র অন্যসব হুকুম অমান্য করে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে নামাজ, রোজা ইত্যাদি যখন কায়েম করা হয় তাকেই বুঝানো হয়েছে আনুষ্ঠানিকতা। আজ বিশ্ব মুসলিম জাহানের যে বিপর্যয় তাঁর অনুসন্ধানও এরই আলোকে করতে হবে। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মুসলমান মানেই তো আল্লাহ্‌র বিশ্বাসী, তবুও কেন দুনিয়াভর মুসলমানদের এত ব্যর্থতা এত জিল্লাতি। এর উত্তর আমরা আল্লায় বিশ্বাসী বটে, তবে আমাদের এ ঈমান ও বিশ্বাসে রয়েছে হাজারো ত্রুটি। কারণ এ ঈমান আমাদের কাছ থেকে যা দাবী করে সে সম্বন্ধে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই উদাসীন। আমরা অনেক সময় এটা ধারণায়ই আনতে পারি না যে, আল্লাহ্‌ যেমন আমাদের বাহ্যিক আচরণ দেখছেন, তেমনি জানছেন আমাদের অন্তরের খবর। আমাদের ঈমান দুর্বল বলেই, আমাদের বিশ্বাসের সাথে বাস্তব কর্মাচরণের মিল থাকে না। আর আমরা যে ত্রুটিপূর্ণ ঈমানের কারণেই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হই তাও তো সুস্পষ্ট।

৮০। যে রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহ্‌রই আনুগত্য করে। কিন্তু কেহ যদি ফিরে যায় আমি তোমাকে তাদের উপর পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করি নাই ৫৯৯।

৫৯৯। "মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত।" কারণ সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ্‌ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করেছেন। সৃষ্টির আর কোনও প্রাণীকেই এই ক্ষমতা দান করা হয় নাই। আল্লাহ্‌র বিধান মেনে চলার জন্য এই স্বাধীন ইচ্ছা শক্তিকে ব্যবহার করার ক্ষমতা আল্লাহ্‌ মানুষকে দিয়েছেন। সে আল্লাহ্‌র বিধান মেনে চলবে, না বিধান থেকে সরে যাবে বা বিদ্রোহ করবে, তা নির্ভর করবে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির উপরে। এই ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগে সে হতে পারে ফেরেশতার সমতুল্য, অথবা বিদ্রোহ করে হতে পারে পশুর থেকেও অধম। আল্লাহ্‌ রাসূলকে প্রেরণ করেছেন তাঁর বিধান সমূহ প্রচারের জন্য, নির্দেশ দান করার জন্য এবং পথ প্রদর্শন করার জন্য। কাউকে জোর পূর্বক ভালো করার দায়িত্ব তার নয়। সেটা আল্লাহ্‌র ইচ্ছাও নয় যে জোর পূর্বক কাউকে অনুশীলনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র রাস্তায় ফিরিয়ে আনা। কেউ যদি রাসূলের নির্দেশ না মানে সে দায়িত্ব রাসূলের নয়, যে অস্বীকার করে তার। যে রাসূলের নির্দেশ মানে সে আল্লাহ্‌রই নির্দেশ মানে- কারণ আল্লাহ্‌ রাসূলের মাধ্যমে তাঁর নির্দেশ সমূহকে আমাদের জন্য প্রেরণ করেছেন। আর যে রাসূলের নির্দেশ অমান্য করে - সে আল্লাহ্‌কেই অমান্য করে।

৮১। কথায় তাদের আনুগত্য আছে। কিন্তু যখন তারা তোমার নিকট থেকে চলে যায়, তাদের একদল সারা রাত্রি [ব্যাপি] চিন্তা করে; তুমি যা [তাদের] বলেছ তার বিপরীত [কথা]। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাদের রাত্রির [ষড়যন্ত্র] লিপিবদ্ধ করে রাখেন। সুতরাং তাদের থেকে দূরে থাক এবং আল্লাহ্‌র উপর আস্থা স্থাপন কর। এবং ব্যবস্থাপক হিসেবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট ৬০০।

৬০০। এই আয়াতে যারা চিন্তা, কথা ও কাজে সত্যবাদী নয়, তাদের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে। বিশ্বাসের সততা থেকে, মানুষের মাঝে সত্য বলার প্রবণতা, সততা, বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার জন্ম হয়। যারা মিথ্যা কথা বলে, তারা হয় মোনাফেক। তাদের চিন্তা, কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। এই আয়াতে এসব লোকদের থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। "তাদের থেকে দূরে থাক", ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে "So keep clear of them." কারণ এরা সাহায্যের পরিবর্তে আরও বিপদ ডেকে আনে। সুতরাং এরা যত শক্তিধরই হোক না কেন এদের উপরে নির্ভর করতে বা এদের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ মিথ্যাবাদী লোকের কোনও ওয়াদা বা কথাকে বিশ্বাস না করা আল্লাহ্‌র হুকুম। নির্ভর করতে হবে আল্লাহ্‌র উপরে। আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান, আল্লাহ্‌র ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। তিনি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অভিভাবক।

এই আয়াতে সাবধান করা হয়েছে- যে মিথ্যাবাদীদের মৌখিক অঙ্গীকারে আমরা যেনো বিভ্রান্ত না হই। আমরা যেনো তাদের শক্তি ও ক্ষমতায় ভীত না হই। আমাদের উপরে নির্দেশ হচ্ছে, মানুষের পক্ষে যতটুকু সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ সম্ভব তা করতে হবে। উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণের পরে, [আয়াত ৪ : ৭১] শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভর করতে বলা হয়েছে, সাফল্যের জন্য। আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞাত, তিনি কার্যকরণ পদ্ধতি এবং মানুষের অন্তরের অন্তস্থলের খবর আমাদের থেকে অনেক বেশী জানেন।

৮২। তারা কি কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা করে না ? ইহা যদি আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারও নিকট থেকে অবতীর্ণ হতো তবে তারা এর মাঝে অনেক অসামঞ্জস্য দেখতে পেতো ৬০১।

৬০১। "কোরান সম্বন্ধে চিন্তা করে না।" - এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ্‌ তায়ালা কোরান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা করার জন্য মানব সমাজকে আহবান করেছেন। এই আয়াত দ্বারা এই সত্যর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, কোরান নাজেল হয়েছে এক মহা শক্তিধর, প্রভুর কাছ থেকে। তিনি এক এবং অনাদি, সেই কারণে এত বড় গ্রন্থ কোরানের কোথাও অসামাঞ্জস্যপূর্ণ উক্তি লক্ষ্য করা যায় না। যে গ্রন্থ সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর ধরে নাজেল হয়েছে যদি তা মরণশীল মানুষের কল্পনার সৃষ্টি হত, তবে অবশ্যই এর বহুস্থানে সামঞ্জস্যের অভাব পরিলক্ষিত হত। আর এ বিষয়টি একমাত্র চিন্তা এবং গবেষণার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। এ ব্যতীত এ আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয়েছে যে, প্রতিটি মানুষ কোরানের উপরে গভীর চিন্তা করুক আল্লাহ্‌র তাই-ই ইচ্ছা। কাজেই কোরাণ সম্পর্কিত চিন্তা-গবেষণা কিংবা পর্যালোচনা করা শুধুমাত্র ইমাম-মুজতাহিদগণের একক দায়িত্ব মনে করা যথার্থ নয়। উল্লেখিত আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, কোরান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা পর্যালোচনা করার অধিকার প্রতিটি লোকেরই রয়েছে। অধিকার বলা ভুল হবে, এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র হুকুম তাঁর বান্দাদের উপর। শুধুমাত্র তেলাওয়াত বা আবৃত্তির দ্বারা - যাতে চিন্তা-গবেষণা অনুপস্থিত থাকবে- আল্লাহ্‌র এ হুকুম মান্য করা হয় না। সাধারণ মানুষ যখন নিজের ভাষায় কোরানের তর্জমা - অনুবাদ পড়ে, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে, তখন তাদের হৃদয়ে আল্লাহ্‌র হুকুম সমূহ অনুধাবনের ক্ষমতার জন্ম নেয়, তাদের মনে সৃষ্টি হবে আল্লাহ্‌ তায়ালার মহত্বের ধারণা; ফলে তারা আল্লাহ্‌কে ভালোবাসতে পারবে। আল্লাহ্‌র ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে, আর এটাই হচ্ছে আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। কোরান যে ঐশি মহাগ্রন্থ তার প্রমাণ নিম্নরূপ :
(১) এই কোরান নাজেল হয় সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর ধরে। এই সুদীর্ঘ সময় ধরে নাজেল হওয়া সত্বেও এর কোনও একটি বিষয়ের মধ্যেও কোনওরূপ মত পার্থক্য নাই। মানুষের সৃষ্ট কোনও কিছুতেই এত সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে এমন অপূর্ব সামঞ্জস্য থাকতেই পারে না।

(২) যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র বাণী এই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে, আমাদের নবী, হযরত মুহম্মদ (সাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর ব্যক্তি। তিনি কোনও শিক্ষিত বা দার্শনিক ছিলেন না- কিভাবে এমন একজন নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে কোরানের মত মহাগ্রন্হ রচনা সম্ভব ?

(৩) কোরান নাজেল হয় বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ঘটনা ও বিভিন্ন পরিবেশের প্রেক্ষিতে, কিন্তু এর মধ্যে সামঞ্জস্য এত অধিক যে সময়ের ধারাবাহিকতা না রেখেও এর যে কোনও স্থান বা আয়াত অন্য যে কোনও আয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসবই সেই স্রষ্টার একত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে।

৮৩। যখন [জন সাধারণের] নিরাপত্তা অথবা আশঙ্কার কোন সংবাদ তাদের নিকট পৌঁছায়, তারা তা প্রচার করে দেয়। [কিন্তু] যদি তারা তা রাসূলের কিংবা তাদের মাঝে যারা শাসক গোষ্ঠি তাদের গোচরে আনতো, তবে [সরাসরি] তাদের নিকট থেকে প্রকৃত তদন্ত দ্বারা উহার যথার্থতা নির্ণয় করা যেতো। যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো, তবে তোমাদের অল্প সংখ্যক ব্যতীত সকলেই শয়তানের অনুসরণ করতো ৬০২।

৬০২। রাষ্ট্রীয় কর্ম-কান্ডে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। হতে পারে তা যুদ্ধ, হতে পারে তা প্রাকৃতিক বিপর্যয়; হতে পারে তা এমন ঘটনা প্রবাহ যা জনসাধারণের জন্য আতংকজনক বা উদ্বিগ্নজনক। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র নির্দেশ সুস্পষ্ট। রাষ্ট্র পরিচালনাধীন শাসকবর্গের উপরে নির্দেশ, এরূপ গুজব বা চিন্তাহীন উক্তি যা জনসাধারণের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি করবে তাকে প্রতিহত করা। আর সাধারণ লোকের উপরে নির্দেশ তারা যেনো গুজব রটনায় অংশ গ্রহণ না করে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে 'রটনা কথা' শাসক শ্রেণীর নিকট পৌঁছে দেওয়া যেনো তার প্রতিবিধান করা যায়। কারণ বিপদ ও বিপর্যয়ের মাঝে মিথ্যা 'গুজব' মানুষের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করতে সহায়তা করে। ফলে সে হয় বিপদের মোকাবিলা করতে অসমর্থ। আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন মানুষ জীবনের বহু প্রতিকূল অবস্থাকে অতিক্রম করতে সক্ষম। মিথ্যা গুজব তার সেই ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়। অপরপক্ষে যদি 'গুজব' সত্যি বলেও প্রতীয়মান হয়, তবেও তার রটনা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। কারণ তা ভীতু এবং দুর্বলদের আরও ভীত এবং দুর্বল করে তোলে। এমনকি অত্যন্ত সাহসী ব্যক্তিকেও এসব গুজব বিচলিত করে। কারণ বিপদ বা বিপর্যয়কে মোকাবেলার উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাব তাদের আতংকগ্রস্থ করে তোলে। যুদ্ধের সময়ে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে চিন্তাহীন উক্তি, গুজব ইত্যাদি শুধু যে জনমনে আতংকের সৃষ্টি করে তাই-ই নয়, তা শত্রুদের জন্য অত্যন্ত শুভ ফল বহন করে। কারণ গুজব মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেই কারণে আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে, এসব বিপর্যয়ের সময়ে যে কোনও সংবাদ শুভ বা অশুভ যাই-ই হোক না কেন তা রটনা না করে নিঃশব্দে তাদের গোচরে আনতে হবে যারা তা অনুসন্ধান করার ক্ষমতা রাখেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। কারণ যদি গুজবের কথা সত্যি হয়, তবে তারা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন, যেনো শত্রু পরাভূত হয়। আর যদি মিথ্যা হয় তবুও তার প্রতিশোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। সুতরাং আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে এসব বিপর্যয়ের সময়ে যে কোনও ধরণের সংবাদ তা শুভই হোক বা অশুভই হোক তা রটনা না করে পৌঁছে দিতে হবে শাসনকার্যে যারা নিয়োজিত আছেন বা স্ব স্ব দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে। তা না করে যদি কেউ তা রটনা দ্বারা সমাজ বা জাতিকে আতংকগ্রস্থ করে তোলে তবে তা হবে শত্রুদের দ্বারা পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার সামিল।

৮৪। সুতরাং আল্লাহ্‌র পথে যুদ্ধ কর। তোমাকেই শুধু তোমার [কর্মের] জন্য দায়ী করা হবে। এবং মুমিনদের উদ্বুদ্ধ কর। এমন হতে পারে যে, আল্লাহ্‌ কাফেরদের প্রচণ্ড ক্রোধকে দমন করবেন। কারণ আল্লাহ্‌ শক্তিতে প্রবলতম এবং শাস্তিতে কঠোরতম ৬০৩।

৬০৩। এই আয়াতটি রাসূলকে উদ্দেশ্য করে নাজেল। আল্লাহ্‌র নবীর সাহস, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, কমনীয়তা সর্বোপরি আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা সকলের জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছিল। যে কোন বিপদের সম্মুখীন তিনি একাকী হতে দ্বিধা বোধ করতেন না। যে কোনও কাজের বিপদ বাধা সব স্ব-ইচ্ছায়, একা কাঁধে তুলে নিতে তিনি কখনও পিছ পা হতেন না। কর্তব্য যতই কঠোর হোক, যতই বিপদ সংকুল হোক তা থেকে তিনি কখনই সরে আসতেন না। যে কোনও বিপদ বাঁধার মুখোমুখি তিনি একা হতেও দ্বিধা বোধ করতেন না। সর্বপরি কর্তব্যকর্মে আল্লাহ্‌র প্রতি তার নির্ভরশীলতা অন্য আর দশজনকে অনুপ্রাণিত করতো। যারা বিবেকবান তারা এই নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগী, পরোপকারী, সত্যবাদী, নিবেদিত প্রাণ মানুষটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিত। এখানে আল্লাহ্‌ বলেছেন, "তোমাকে শুধু তোমার নিজের জন্য দায়ী করা হবে।" এই লাইনটি আমাদের নবীর জন্য যেমন প্রযোজ্য ঠিক সমভাবে সকলের জন্যই প্রযোজ্য। প্রত্যেকে আমরা আমাদের নিজ নিজ কর্মফলের জন্য দায়ী থাকবো। একের দায়ভার অন্যকে বহন করতে হবে না। ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমাদের কর্তব্য শুধু আমাদের চরিত্রের দ্বারা, কর্মের দ্বারা এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাতে বিবেকবান ব্যক্তিরা অনুপ্রাণিত হয় - আল্লাহ্‌র রাস্থায় সংগ্রাম করার জন্য। আল্লাহ্‌ বলেছেন যারা কাফের বা অন্যায়কারী তাদের ক্ষমতা খর্ব করার মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌। কাফের ও অন্যায়কারীর শক্তি ও ক্ষমতা যত বেশীই হোক, তারা যত নিষ্ছিদ্র পরিকল্পনাই করুক না কেন আল্লাহ্‌র ক্ষমতা বা পরিকল্পনার কাছে তা তুচ্ছ। আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই। আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান।

৮৫। কল্যাণের জন্য যে কেহ মধ্যস্থতা করলে, সে তার অংশীদার হবে। এবং যে কেহ মন্দ কাজের জন্য সুপারিশ বা সাহায্য করলে সে তার [শাস্তির] ভারের অংশীদার হবে। আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ের উপরে ক্ষমতাবান ৬০৪।

৬০৪। জীবন চলমান, এই চলমান জীবন স্রোতে আমাদের বিচক্ষণতার অভাবে, আমরা সব সময়ে সৃষ্টিকর্তার মঙ্গলময় উপস্থিতি অনুভব করতে পারি না। তাঁর ন্যায়ের সূক্ষ্ণ দন্ড অনেক সময়েই আমাদের অনুভবের ক্ষমতার বাইরে থাকে। কারণ আমরা সাধারণ মানুষ প্রাত্যাহিক জীবন যাপনে এত ব্যস্ত থাকি, পার্থিব জীবন আমাদের এত মোহবিষ্ট করে রাখে যে আমরা মহান স্রষ্টার মঙ্গল ইচ্ছা ও ন্যায় নীতি অনুধাবনে অক্ষম হই। কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, ভালো এবং মন্দ প্রত্যেকে তার স্ব-স্ব কর্মের অংশীদার। যদি কেউ ভালো কাজকে শুধুমাত্র সমর্থন করে, তবুও সে ঐ ভালো কাজের সওয়াবের অংশীদার। অপরপক্ষে কেউ যদি মন্দ কাজের সাহায্য ও সমর্থন করে, তবে সে ঐ মন্দ কাজের অংশীদার। অর্থাৎ ভালো কাজের সমর্থন দানকারী ঐ কাজের কৃতিত্ব, সাফল্য এবং সওয়াবের অংশীদার আল্লাহ্‌র চোখে, মন্দ কাজের সমর্থনদানকারী সমভাবে মন্দ কাজের পরিণতির জন্য আল্লাহ্‌র চোখে দায়ী। এখানে 'সমর্থন' বা 'সুপারিশ' কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। সমর্থন বা সুপারিশ হচ্ছে হাতে-কলমে কোনও কাজ না করে নৈতিকভাবে বা মানসিকভাবে সেই কাজের সাথে একাত্মতা বোধ করা। আমাদের এই নৈতিকতা বা মানসিক অবস্থা যাকে কাজের 'নিয়ত' বলা যায়- তাই-ই আল্লাহ্‌র কাছে বিচার্য। সৎ বা ভালো নিয়ত আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য এবং কাম্য। অসৎ বা মন্দ কাজের 'নিয়ত' আল্লাহ্‌র দরবারে শাস্তিযোগ্য। আল্লাহ্‌ সব কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান।

"যে ব্যক্তি কোন সৎ কাজে অপরকে উদ্বুদ্ধ করে, সেও ততটুকু সওয়াব পায়, যতটুকু সৎকর্মী পায়" হাদীস।

৮৬। যখন তোমাকে [সৌজন্যমূলক] অভিবাদন অর্পণ করা হয়, তোমরা উহা অপেক্ষা আরও সৌজন্যমূলক অভিবাদন অথবা [কম পক্ষে] সমপরিমাণ সৌজন্যের সাথে তাদের অভ্যর্থনা কর। আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ের হিসেব সতর্কতার সাথে গ্রহণ করে থাকেন ৬০৫।

৬০৫। ভালো কাজের জন্য যুদ্ধ করা আল্লাহ্‌র আদেশ। এই আদেশকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে ভালো ব্যবহার বা চরিত্রের মাধুর্য্য, ভদ্র আচরণের সাথে। আমাদের জীবনে যুদ্ধবস্থা হচ্ছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা- এ অবস্থা চিরদিন বিরাজ করতে পারে না- সমাজের এ অবস্থা অত্যন্ত অস্থায়ী ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিক জীবনে ভদ্র ও মিষ্টি আচরণ, চরিত্রের মাধুর্য্য, অন্যের সাথে ব্যবহার এসব হচ্ছে প্রতিদিনের জীবন এবং এর প্রভাব সমাজ জীবনে স্থায়ী। ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় সৌজন্য ও ভদ্র আচরণের উপরে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সৌজন্য, ভালো ব্যবহার, দয়া, মহানুভবতা ইত্যাদি অন্যের জন্য প্রদর্শন করা আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করা। এখানে বলা হয়েছে কেউ যদি এসব প্রদর্শন করে আমাদের, তবে আমাদের উপরে হুকুম হচ্ছে, তদপেক্ষা উত্তম সৌজন্য প্রকাশ করা। উত্তম না হলেও সমতার ভিত্তিতে তা প্রকাশ করতে হবে। আমরা সকলেই আল্লাহ্‌র সৃষ্ট জীব। তার কাছেই আমাদের সকলকে হিসাব দাখিল করতে হবে।

৮৭। আল্লাহ্‌ ! তিনি ব্যতীত আর কোনও উপাস্য নাই। অবশ্যই তিনি শেষ বিচারের দিনে তোমাদের একত্রিত করবেন; যাতে কোনও সন্দেহ নাই। আল্লাহ্‌র বাণী অপেক্ষা কার কথা বেশী সত্য হতে পারে ?

রুকু - ১২

৮৮। তোমরা কেন মোনাফেকদের সম্বন্ধে দু'দলে বিভক্ত হয়ে গেলে ৬০৬ ? তাদের [মন্দ] কর্মের জন্য আল্লাহ্‌ তাদের পরিত্যাগ করেছেন। আল্লাহ্‌ যাদের [সৎ] পথ থেকে বহিষ্কৃত করে দেন, তুমি কি তাদের [সৎ পথে] পরিচালিত করতে পারবে ? আল্লাহ্‌ কাহাকেও পথভ্রষ্ট করলে, তুমি তাদের জন্য কখনও কোন সুপথ পাবে না।

৬০৬। ওহুদের যুদ্ধে মোনাফেকেরা শেষ মূহুর্তে মুসলমানদের পক্ষ ত্যাগ করে। ওহুদের যুদ্ধের বিপর্যয়ের পরে মদিনার মুসলমানদের মধ্যে এসব মোনাফেকদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। একদল মুসলমান তাদের নিশ্চিহ্ন করার পক্ষে মত প্রকাশ করে, অন্যদল তাদের সম্পূর্ণ ছেড়ে দেবার পক্ষে মত প্রকাশ করে। এই আয়াতে এই দুই চরম মত পার্থক্যের বিরুদ্ধে এবং মধ্যপথ অবলম্বনের পক্ষে নির্দেশ দান করা হয়েছে। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে তারা ছিল মদিনার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিপদের দিনে পরীক্ষিত যে, তারা বিপদে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য বন্ধু নয়। তারা ছিল সাধারণ লোকদের বিপথের চালিকা শক্তি। সুতরাং কোনও চরম ব্যবস্থার পক্ষে কেউ মত প্রকাশ করলেও তা ছিল স্বাভাবিক। তা সত্বেও আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে প্রথমবারের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্য। তাদের সম্পর্কে সব রকম সতর্কতা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তাদের যেনো অনুতাপ করার সুযোগ দেওয়া হয়; যেনো ভবিষ্যতের পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হতে পারে। তারা যেনো মোনাফেকীর পথ পরিত্যাগ করে ভালো পথে নিজেকে পরিচালিত করতে পারে। আল্লাহ্‌র ক্ষমার দুয়ার অনুতাপকারীদের জন্য সব সময়েই খোলা। যদি তারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়, তবে আল্লাহ্‌ তাদের চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করেন, তাদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি, নীচতা, হীনতা, স্বার্থপরতা দূর করে দেন। ফলে তাদের চরিত্রে আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার জন্ম নেয়। পরবর্তী আয়াতে [৪ : ৮৯] এই কথাটি নিম্নোক্ত লাইনটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে : "সুতরাং আল্লাহ্‌র পথে হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের মধ্যে কাউকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না।" অর্থাৎ তাদের আল্লাহ্‌র পথে হিজরত করার সুযোগ দেওয়া হলো। কিন্তু এর পরেও যদি কেহ মুসলমানদের ত্যাগ করে, তবে তারা হবে মুসলমানদের শত্রু। এ জন্য যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের যা প্রাপ্য শাস্তি, তাই-ই তাদের প্রাপ্য - যা সর্বকালে, সর্বদেশে প্রযোজ্য। এত কিছু পরেও আল্লাহ্‌ দুইটি বিশেষ অবস্থাকে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করেছেন [দেখুন আয়াত ৪ : ৯০]।

৮৯। তারা কিন্তু ইহা ইচ্ছা করে যে, তোমরা তাদের মত ঈমানকে ত্যাগ কর এবং এরূপে তোমরা তাদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাও। সুতরাং [যা নিষিদ্ধ] আল্লাহ্‌র পথে [তা ত্যাগ] বা হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। কিন্তু যদি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে দল ত্যাগ করে, তবে তাদের যেখানে পাবে গ্রেফতার করবে এবং হত্যা করবে। এবং [এরূপ ক্ষেত্রে] তাদের মধ্যে থেকে কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী গ্রহণ করবে না ৬০৭।

৬০৭। " আল্লাহ্‌র পথে হিজরত" কথাটি অনেক বৃহত্তর অর্থে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যে কেউ স্ব-ইচ্ছায় যুদ্ধের আইন কানুন মেনে চলে এবং কোনও অবস্থাতেই বা কোনও দুর্যোগের মাঝেও তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব যদি সে পরিত্যাগ না করে, তবেই তা হবে তার বিশ্বস্ততা বা আন্তরিকতার প্রমাণ। আন্তরিকতার প্রমাণ সাপেক্ষে সেই সেনাদলের সদস্য হিসেবে সে অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। কারণ সে তার বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দাখিল করেছে। এই বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতাকেই " আল্লাহ্‌র পথে হিজরত" কথাটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। এ হিজরত সম্পর্কে বোখারীর টিকাকার আল্লামা আইনী লিখেছেন : "স্থায়ী হিজরতের অর্থ পাপকর্ম পরিত্যাগ করা।" কিন্তু অপরপক্ষে, সে যদি নিজেকে আন্তরিক ও বিশ্বস্ত বলে প্রচার করে এবং ছলা-কলার দ্বারা যুদ্ধক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদের গোপন বৈঠকের অন্তর্ভূক্ত হয় এজন্য যে সময় সুযোগের ব্যবহার করে সে বিশ্বাসঘাকতা করবে তবে সে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিশ্বাস ঘাতক বা দলত্যাগকারী হিসেবে চিহ্নিত হবে। যদি সে পালিয়েও যায় তবুও সে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। বিশ্বাস ঘাতক ও শত্রুর ব্যাপারে যে শাস্তি প্রাপ্য, তার জন্যও সেই একই শাস্তি প্রাপ্য। অবশ্য সে শত্রু অপেক্ষা জঘন্য চরিত্রের। কারণ শত্রুকে সাক্ষাতেই চেনা যায়। তার মধ্যে কোনওরূপ 'ভান' বা লুকোচুরি নাই। কিন্তু এসব বর্ণচোরা নিজদলে থেকে দলের শেকড় কেটে দেয় - এদের চেনা যায় না। এরা আরও ভয়ঙ্কর। সুতরাং আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে এ সব বিশ্বাস ঘাতকদের কোনওরূপ দয়া বা ক্ষমা প্রদর্শন না করা।

৯০। ইহা প্রযোজ্য নয়, তাদের জন্য যারা এমন এক দলের সাথে যুক্ত যাদের সাথে তোমরা [শান্তি চুক্তিতে] অঙ্গীকারবদ্ধ ৬০৮। অথবা [প্রযোজ্য নয়] তাদের জন্য যারা তোমাদের নিকট এমন অবস্থায় আগমন করে যে তাদের হৃদয় তোমাদের সাথে অথবা তাদের [নিজ] সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করতে সংকুচিত হয় ৬০৯। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা হলে, তিনি তাদের তোমাদের উপরে ক্ষমতাবান করতেন, এবং তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতো। সুতরাং যদি তারা তোমাদের নিকট থেকে প্রত্যাহার করে ও যুদ্ধ না করে এবং [তার পরিবর্তে] তোমাদের নিকট শান্তি [প্রস্তাবের জামানত] প্রেরণ করে, সেরূপ ক্ষেত্রে [তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার] কোন পথ আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য খোলা রাখেন না।

৬০৮। যারা বারে বারে নিজ গোত্র ও দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে এই আয়াতে দুটি শ্রেণীকে এই শাস্তির আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এদের একদল যারা নিজদল ত্যাগ করছে- সত্য, তবে তারা এমন এক গোষ্ঠির আশ্রয় গ্রহণ করেছে যারা মুসলমানদের সাথে শান্তির বা বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ। যদিও সে সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করে নাই, তবুও যেহেতু তারা মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ, এদের নিকট আশ্রয় গ্রহণকারীর জন্যও শাস্তির দন্ডাজ্ঞা রহিত করা হয়েছে। এই আয়াতের প্রভাব সুদূর প্রসারী। কারণ যে ব্যক্তি মুসলমানদের শত্রু, সে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার সুযোগ পাবে না। কারণ তার আশ্রয়দানকারী দেশ মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বের বা শান্তির চুক্তিতে আবদ্ধ। সেই কারণে সেও অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য। বর্তমান যুগে যাকে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি নামে আখ্যায়িত করা হয় এ হচ্ছে তারই রূপ। দ্বিতীয় দল যাদের জন্য দন্ডাজ্ঞা রহিত করা হয়েছে, তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যারা আন্তরিক ভাবেই ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণে অনিচ্ছুক, যদিও তারা প্রত্যক্ষভাবে মুসলমানদের সাথে যোগদানের বিরোধী। এর কারণ এ হতে পারে যে মুসলমানদের সাথে যোগদান করলে তাদের হয়তো নিজ গোষ্ঠির বিরুদ্ধে, বা অন্য কোন মিত্র গোষ্ঠির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, নীতিগতভাবে যা তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, এ ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি বা দলকে প্রমাণ করতে হবে যে, কোনও অবস্থাতেই তারা ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে না। এ ক্ষেত্রে তার আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার জামিনদার প্রয়োজন। বর্তমানে যাকে আমরা 'প্যারোলে' মুক্তি বা শর্তাধীনে মুক্তি বলি, এটা তারই এক রূপ। বর্তমান পৃথিবীতে যে সামরিক নিয়মাবলী প্রচলিত আছে তা থেকে ইসলামের যে শর্তাধীনে মুক্তি বা 'প্যারোলের' ব্যবস্থা আছে তা অনেক নমনীয়। বর্তমান সামরিক নিয়মাবলীতে শুধুমাত্র যুদ্ধ বন্দীরা প্যারোলের সুবিধা ভোগ করতে পারে; নিজ সম্প্রদায়ের লোক যারা স্ব-ইচ্ছায় সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছে তারা এই সুবিধা পেতে পারে না। মোনাফেকেরা নিজ দলে থেকেও বিশ্বাসঘাতকতা করে ও সুযোগ বুঝে দল ত্যাগ করে। যদিও তা ক্ষমার যোগ্য নয়, বর্তমান সভ্য পৃথিবীর কোনও সামরিক নিয়মাবলীতে। তবুও ইসলাম এই সব বিশ্বাসঘাতকদের শর্তাধীনে মুক্তির অনুমোদন করে। কারণ ইসলাম মানবতার ধর্ম। এই ক্ষমাশীলতার দ্বারা এ কথাই প্রমাণ হয় যে, মানবতাকে ইসলাম সর্বোচ্চ স্থানে স্থান দেয়।

৬০৯। "এমন অবস্থায় আগমন করে" - এই আগমন শারীরিক নয়, এই আগমন শব্দটির দ্বারা বুঝানো হচ্ছে সর্বান্তকরণে সমর্থন করা। 'হৃদয়' কথাটির দ্বারা এই ভাবেরই প্রকাশ করা হয়েছে। যখন কেহ আন্তরিক ভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না চায়, যদি সে বিশ্বস্ততার সাথে এই ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করে তবে তাদের জন্য ঐ দন্ডাজ্ঞা রহিত। এখানে ইসলামের এই বিধান বিচক্ষণতারই স্বাক্ষর দেয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো, তবে তোমাদের ক্ষতি এবং অসুবিধা আরও বৃদ্ধি পেতো। তাদের নিরপেক্ষতা তোমাদের জন্য বিরাট সুবিধার ব্যাপার। তারা নিরপেক্ষ না থাকলে বিপদ হতো দ্বিমুখী। [ঠিক এমনই ব্যাপার ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যখন হিটলার সোভিয়েট রাশিয়াকে আক্রমণ করে।] যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাদের আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে সন্তুষ্ট, ততক্ষণ তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যাবে না বা তাদেরকে আক্রমণ করবে না। এই-ই ইসলামের বিধান।

৯১। তোমরা কিছু লোককে পাবে যারা তোমাদের ও তাদের নিজ সম্প্রদায়ের নিকট থেকে নিরাপত্তা চাইবে। যখনই তাদের পুনরায় প্রলোভিত করা হবে তারা তাতে বশীভূত হয়ে পড়বে ৬১০। যদি তারা তোমাদের নিকট থেকে ফিরে না যায় অথবা শান্তি [প্রস্তাবের জামানত] প্রেরণ না করে, তাছাড়া তাদের হাতকে সম্বরণ না করে, তবে তাদের যেখানেই পাবে গ্রেফতার করবে ও হত্যা করবে। আমি তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট যুক্তি সরবরাহ করছি।

৬১০। পূর্বের আয়াতে দুই শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যাদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করা হয়েছে। এই আয়াতে আর এক শ্রেণীর উল্লেখ করা হয়েছে, যারা বিশ্বাস ঘাতক এবং সেই সাথে অত্যন্ত বিপদজনকও বটে সমাজের জন্য। সুতরাং কোনও অবস্থাতেই তাদের মুক্ত করে দেওয়া উচিত নয়। এই সব মোনাফেকদের বৈশিষ্ট্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এরা তোমাদের বিশ্বাস ভাজন হতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সেই সাথে সে তোমার শত্রুদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করতে চেষ্টা করবে। সে সর্বদা এই দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করবে। ফলে সে লোভের বশবর্তী হয়ে যে কোনও দলের বশ্যতা স্বীকার করে। এখানে আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে এদের কখনও বিশ্বাস না করা, এবং এদের প্রকাশ্যে শত্রুরূপে পরিগণিত করা। আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে এসব দ্বিমুখী মোনাফেকদের কখনও বিশ্বাস না করা বন্ধুরূপে নিজদলে স্থান না দেওয়া। কারণ এরা খুবই বিপদজনক। তবে এরা যদি শান্তি ও মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করার অঙ্গীকার করে এবং অঙ্গীকার করে যে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না, তবে তাদের জন্য আল্লাহ্‌র দন্ডাজ্ঞা রহিত। কিন্তু তারা যদি ক্রমাগত দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করে, এবং বারে বারে মুসলমানদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, আল্লাহ্‌ নির্দেশ হচ্ছে, তাদের প্রকাশ্য শত্রুরূপে ঘোষণা করা। যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু সেনাকে যেভাবে নিধন করা উচিত এ সব মোনাফেকদেরও তাই-ই প্রাপ্য। অর্থাৎ যেখানেই শত্রু এবং এসব দলত্যাগকারীদের পাবে সেখানেই তাদের হত্যা করবে।

রুকু - ১৩

৯২। কোন অবস্থায় একজন মুমিন অন্য মুমিনকে হত্যা করবে না। তবে ভুলবশতঃ করলে তা স্বতন্ত্র ৬১১। ভুলবশতঃ কেহ কোন মুমিনকে হত্যা করলে, আদেশ হলো, একজন মুমিন দাস মুক্ত করা, এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ করা, যদি না তারা ক্ষমা করে। যদি মৃত ব্যক্তি শত্রু পক্ষের লোক হয় এবং মুমিন হয়, তবে একজন মুমিন দাস মুক্ত করা [যথেষ্ট]। যদি সে এমন এক সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, যাদের সাথে তোমরা [শান্তি চুক্তিতে] অঙ্গীকারবদ্ধ তবে তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ এবং মুমিন দাস মুক্ত করা বিধেয়। যে, সঙ্গতিহীন সে আল্লাহ্‌র নিকট অনুতাপ [তওবা] প্রকাশের জন্য দুই মাস একাদিক্রমে সিয়াম পালন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সর্ব জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনি প্রজ্ঞাময়।

৬১১। মুসলিম ভাতৃত্বে মানুষের জীবন অত্যন্ত মূল্যবান এবং পবিত্র। কেউ কারও জীবন নেওয়ার অধিকারী নয়। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ভুল ভ্রান্তি খুবই স্বাভাবিক। যেমনটি ঘটেছিল ওহুদের যুদ্ধের বিপর্যয়ের সময়ে। ভুলক্রমে মুসলমানের দ্বারা মুসলমান নিহত হয়। এ ভুলের কারণ ছিল চিনতে না পারা এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রের বিপর্যয়। মুসলমানকে মুসলমান দ্বারা হত্যা সংঘটিত হয় শুধুমাত্র ভুলবশতঃ, এ হত্যা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। এরূপ হত্যা সংঘটিত হতে পারে তিন রকম অবস্থার প্রেক্ষিতে। (১) নিহত ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। শুধু যে মুসলিম তাই-ই নয়, সে এবং হত্যাকারী একই গোত্রভুক্ত। (২) সে মোমেন কিন্তু সে এমন এক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। (৩) যদি নিহত ব্যক্তি এমন এক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত যারা মুসলমানদের সাথে শান্তি ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ।

যদিও এই হত্যার পিছনে কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে এই হত্যা সংঘটিত করা হয় নাই, তবুও আল্লাহ্‌র নির্দেশ, সে এই হত্যার অপরাধ থেকে রেহাই পাবে না। মুসলিম আইন অনুযায়ী (১) ও (৩) নম্বর ক্ষেত্রে নিহতের পরিবার বর্গ হত্যাকারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারে। হত্যাকারী ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে, যদি না নিহতের পরিবার বর্গ তা ক্ষমা করে দেয়। এ ক্ষেত্রে হত্যাকারীকে তার ভুলের জন্য নিহতের পরিবার বর্গকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া ব্যতীতও একজন মোমেন ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিতে হবে। আর (২) নম্বরের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রয়োজন নাই। শুধুমাত্র একজন মোমেন ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিলেই তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিষেধ করা হয়েছে। কারণ (২) নম্বরের বেলায় নিহত মোমেন ব্যক্তি এমন এক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। সুতরাং তার পরিবার বর্গকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া মানে শত্রু পক্ষকে অর্থ-বিত্ত দ্বারা সহযোগীতা করার সামিল। কারণ নিহত ব্যক্তির সম্প্রদায় মুসলমানদের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত। অপরপক্ষে নিহত ব্যক্তি যদি সক্রিয় যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভূমিকা অবলম্বন করে থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী এ হত্যা পৃথিবীর সব দেশেই বৈধ। সুতরাং আর্থিক ক্ষতিপূরণ (২) নম্বর ক্ষেত্রে বৈধ নয়। তবে যেহেতু ভুলক্রমে সে একজন মোমেন বান্দার হত্যাকারী, সে কারণে তার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তাকে একজন মোমেন ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিতে হবে। এখানে লক্ষ্যণীয় যে (১), (২) ও (৩) নম্বর প্রতিটি ক্ষেত্রে মোমেন ক্রীতদাসদের মুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রষ্টব্য যে মোমেন বান্দা দ্বারা মোমেন বান্দাকে হত্যার যে জঘন্য অপরাধ, সেই অপরাধকে মার্জনার প্রয়াস করা হয়েছে ক্রীতদাস মুক্তির মাধ্যমে। ইসলাম ক্রীতদাস প্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছে- এই আয়াত দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয়। এর পরে আর একটি প্রায়শ্চিত্তের কথা বলা হয়েছে। যদি হত্যাকারীর আর্থিক সচ্ছলতা না থাকে যাতে সে নিহতের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও ক্রীতদাস মুক্ত করতে না পারে, তবে তার বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে, একাদিক্রমে দুই মাস রোজার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। আল্লাহ্‌র কাছে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে সত্যিকারের অনুতাপকারী।

৯৩। যদি কেহ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করে, তবে তার তুল্য বিনিময় হবে জাহান্নামে ৬১২ [অনন্তকাল] অবস্থান। এবং আল্লাহ্‌র ক্রোধ এবং অভিশাপ তার উপরে থাকবে। এবং তার জন্য ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

৬১২। সজ্ঞানে ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মূলকভাবে হত্যাকে ইসলামে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এই আয়াতে [৪ : ৯৩] যে শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে, তা ইহকালের নয়, তা পরকালের জন্য; আল্লাহ্‌র কাছে প্রাপ্য শাস্তি। উদ্দেশ্যমূলক হত্যার শাস্তি দেশের আইন অনুযায়ী [২:১৭৮ এ দ্রষ্টব্য] যা 'কিসাসে' উল্লেখ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রাপ্য। 'কিসাসে' উল্লেখ আছে - জীবনের পরিবর্তে জীবন - অবশ্য তা হতে হবে সমতার ভিত্তিতে। পূর্বে আরবদের মাঝে যে প্রথা প্রচলিত ছিল যে একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গোত্রে গোত্রে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো এবং একটি মৃত্যুর পরিবর্তে বহু জীবনের অবসান ঘটতো, ইসলাম পূর্ব এই জঘন্য বিধি বিধানের অবসান ইসলাম 'কিসাস' দ্বারা রহিত করে। কিন্তু যদি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধীকারীরা 'হত্যার পরিবর্তে হত্যা' - এর পরিবর্তে আর্থিক ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করে এবং হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয় তবে তা গ্রহণযোগ্য। ইসলামের এই বিধান অনুযায়ী ইসলামপূর্ব আরবদের মাঝে যে গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী প্রতিশোধ প্রথা চালু ছিল তা দূরীভূত হয় এবং বহু জীবন রক্ষা পায় ও সমাজে শান্তি স্থাপিত হয়।

৯৪। হে মুমিনগণ ! যখন তোমরা আল্লাহ্‌র পথে যাত্রা শুরু করবে ৬১৩, তখন সযত্নে সাবধানতার সাথে অনুসন্ধান করে নেবে এবং কেহ তোমাদের সালাম করলে ইহজীবনের নশ্বর সম্পদের লোভে তাকে বলো না, "তুমি মুমিন নও।" [কারণ] আল্লাহ্‌র নিকট অনায়াসলভ্য সম্পদ রয়েছে প্রচুর। যতদিন না আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন তার পূর্বে তোমরা তো এরূপই ছিলে। সুতরাং অনুসন্ধানে সাবধানতা অবলম্বন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমরা যা কর সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।

৬১৩। উল্লেখিত আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, কেউ মুসলিম বলে নিজেকে পরিচয় দিলে অনুসন্ধান ব্যতিরেকে তার উক্তিকে কপটতা মনে করা কোন মুসলমানের জন্যই বৈধ নয়। এ ব্যাপারে কোন কোন সাহাবী থেকে ভুল সংঘটিত হওয়ার কারণে আলোচ্য আয়াতটি নাজেল হয়। হযরত (সাঃ) কতিপয় সাহাবীকে এক গোত্রের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। সে গোত্রের এক ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেছিল, কিন্তু তাঁর ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি সাহাবীদের জানা ছিল না বলে সে ইসলামী রীতিতে সালাম করা সত্বেও তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। আয়াতটি এই প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়।

আলোচ্য আয়াতে প্রথমেই নির্দেশ দান করা হয়েছে যে, মুসলমানেরা কোন কাজ সত্যাসত্য যাচাই না করে শুধুমাত্র ধারণার বশবর্তী হয়ে কিছু করবে না। ঘটনার তদন্ত না করে সিদ্ধান্ত নেয়া বৈধ নয়। "অনুসন্ধান করে নেবে" - এই বাক্যটি দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে। মুসলমানদের উপরে আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে, তোমরা যখন আল্লাহ্‌র পথে সফর কর তখন সত্যাসত্য অনুসন্ধান করে সব কাজ করো। শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করলে প্রায়ই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। " আল্লাহ্‌র পথে যাত্রা" - অর্থাৎ আল্লাহ্‌র বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করা। এর অর্থ শুধুমাত্র যুদ্ধকেই বুঝায় না। যে কোনও সৎ নিয়তে, সৎ কাজ সমাধানের জন্য বিদেশে গমনকেই এখানে আল্লাহ্‌র পথে যাত্রা এই কথাটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে। এই সৎ কাজ হতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্য যা সততার উপরে প্রতিষ্ঠিত, কিংবা অন্য কোনও কাজ যা সততা ও আন্তরিকভাবে সম্পন্ন করা হয় এই জন্য, যে তা আল্লাহ্‌র আইনকে মানার প্রবণতা থেকে উৎপত্তি হয়। উপরোক্ত আয়াতটি যদিও জেহাদের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ তবুও এর আবেদন সার্বজনীন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রবণতা কাজ করে তা হচ্ছে যুদ্ধই হোক বা শান্তিবস্থাই হোক এক শ্রেণীর লোক ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা এবং অন্যের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য ধর্মের নামে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে। যুদ্ধের সময়ে এই শ্রেষ্ঠত্ব লাভের প্রকাশ ঘটে প্রশংসা পাওয়ার আকাঙ্খা বা পার্থিব বস্তু সামগ্রী পাওয়ার লোভ। সব ক্ষেত্রেই "লোভ" রীপুই তাকে জেহাদের নিয়ত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু মোমেন বান্দারা পৃথিবীর কোনও লাভের জন্যই জেহাদ করে না, তারা করে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আশায়। আল্লাহ্‌র সেবাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কোনও লোভ-লালসা, বা ক্ষমতা দম্ভ কোনও কিছুই তাদের কাম্য নয়। সুতরাং দম্ভে বা অহংকারে স্ফীত হয়ে অনুসন্ধান ব্যতীরেকে কোন মুসলমান কাউকে বলবে না যে, "তুমি মোমেন নও।"

উপদেশঃ অনুসন্ধান ব্যতীরেকে সত্যাসত্যা নির্ধারণ করা মুসলমানদের জন্য বৈধ নহে।

৯৫। অক্ষম ব্যতীত যে সব [সক্ষম] মুমিন ঘরে বসে থাকে তারা এবং যারা আল্লাহ্‌র পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা সংগ্রাম এবং যুদ্ধ করে তারা সকলে সমশ্রেণীভুক্ত নয়। যারা স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে আল্লাহ্‌ তাদের, যারা [ঘরে] বসে থাকে তাদের উপর মর্যদা দান করেছেন। আল্লাহ্‌ সকল [বিশ্বাসীদের] কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিতেছেন ৬১৪। কিন্তু যারা [আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম] ও যুদ্ধ করে আল্লাহ্‌ তাদের বিশেষ পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত করেছেন তাদের উপর যারা [ঘরে] বসে থাকে।

৬১৪। আল্লাহ্‌র রহমত সবার জন্য সমভাবে বহমান। যারা আল্লাহ্‌র উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে, যারা বিশ্বাসী, অর্থাৎ যারা আল্লাহ্‌র বিধানে বিশ্বাসী, তাদের জন্য আল্লাহ্‌র তরফ থেকে কল্যাণের বার্তা দেয়া হয়েছে। বিশ্বাসীদের জন্য এই কল্যাণ সবার জন্য সমান নয়। এর মধ্যে পার্থক্যের কথা আল্লাহ্‌ ঘোষণা করছেন। অনেকে ঘরে বসে সব বিপদ মুক্তভাবে নিরিবিলিতে আল্লাহ্‌র ইবাদত করে। এরা বাইরের পৃথিবীর ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে চায় না। এর কারণ এদের মধ্যে অনেকে শারীরিক ভাবে দুর্বল। এই 'অক্ষম' ব্যক্তিদের আল্লাহ্‌ ক্ষমা করে দেবেন তাদের শারীরিক অক্ষমতার দরুণ। কিন্তু আর এক শ্রেণীর লোক আছেন, যারা শারীরিক সুস্থতা থাকা সত্বেও মনের দিক থেকে, চিন্তার দিক থেকে দুর্বল। আল্লাহ্‌র রাস্তায় যুদ্ধ করার মত দৃঢ় মনোবল তাদের নাই। তারা সমস্ত কাজ কর্মেই সাধারণভাবে নিষ্কৃয়তা প্রদর্শন করে। এরা আল্লাহ্‌র রাস্তায়, আল্লাহ্‌র বিধান প্রতিষ্ঠাকল্পে কোন বাঁধার সম্মুখীন হতে প্রস্তুত নয়।

এদের পরহেজগারী নির্ভর করে বাধা-বিপত্তিহীন, নিরিবিলি জীবন, ঘরের কোণে বসে আল্লাহ্‌র ইবাদত করার মাধ্যমে। কিন্তু ইসলামে এই ইবাদতের মুল্য অনেক কম। অপরপক্ষে যারা মানুষের মঙ্গলের জন্য, সমাজ জীবনে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, তারা আল্লাহ্‌র নিকট অধিক মর্যাদাবান। কারণ তাদের এই সংগ্রাম হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম। এই আয়াত দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে শুধু মাত্র ঘরে বসে নামাজ রোজার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রসন্নতা লাভ করা যায় না। এই নিষ্কৃয় ইবাদাত আল্লাহ্‌র কাম্য নয়। আল্লাহ্‌ ঐ ইবাদতকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন যে ইবাদতে আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম করা হয়। আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম কি ? যে সংগ্রাম অশুভ শক্তির (evil) বিরুদ্ধে, যে সংগ্রাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যে সংগ্রাম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য - সেই সংগ্রামই হচ্ছে আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম। যারা এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এবং অনমনীয় দৃঢ়তার সাথে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করার প্রয়াস পায় তারাই আল্লাহ্‌র প্রিয় পাত্র। এই বাধা-বিপত্তি হতে পারে শারীরিক, হতে পারে পরিবারের, হতে পারে সামাজিক, হতে পারে বাইরের পৃথিবীর। সব বাধা-বিপত্তিকে এসব লোকেরা, অনমনীয় দৃঢ়তার সাথে অমিত বিক্রম, সাহসের সাথে, ইস্পাত কঠিন মনোবলের সাথে অতিক্রম করে, শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য, আল্লাহ্‌র রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য। এও এক ধরণের জেহাদ বা ধর্ম যুদ্ধ। জেহাদের সময়ে মোমেন বান্দা সবকিছু আত্মত্যাগ করে, এমন কি নিজের জীবনকেও বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তাদের এই আত্মত্যাগ, মহৎ মৃত্যু আল্লাহ্‌র চোখে অত্যন্ত গৌরবান্বিত। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ আমাদের সেই সংবাদই দিচ্ছেন যে শুধুমাত্র ঘরে বসে যারা ধর্ম-কর্ম করে তাদের তুলনায় যারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় জেহাদ করে তাদের সম্মান আল্লাহ্‌র চোখে অনেক বেশী। যারা আল্লাহ্‌র বিধান প্রতিষ্ঠাকল্পে আত্মত্যাগ করে, জেহাদ করে, তাদের জন্য আল্লাহ্‌ বিশেষ মর্যাদার ঘোষণা দিয়েছেন এই আয়াতে।

৯৬। এই পদমর্যাদা তিনিই প্রদান করেন এবং [সেই সাথে] ক্ষমা ও দয়া। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।

রুকু - ১৪

৯৭। যারা আত্মার [পবিত্রতার] বিরুদ্ধে পাপ করে, তাদের আত্মাকে [প্রাণ] হরণের সময়ে ফিরিশতারা বলে, "তোমরা কি [দুর্দশায়] ছিলে ?" তাদের উত্তর হবে, "পৃথিবীতে আমরা দুর্বল এবং নিষ্পেষিত ছিলাম।" তারা বলবে, " আল্লাহ্‌র দুনিয়া কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত ছিলো না, যাতে তোমরা [মন্দ থেকে বাঁচার জন্য] হিজরত করতে পার?" এসব লোকই জাহান্নামকে তাদের আবাসস্থল হিসেবে পাবে - কত মন্দ সেই আবাস ! ৬১৫

৬১৫। এই আয়াতে হিযরতের বা দেশ ত্যাগের জন্য নির্দেশ হয়েছে। হিযরত মুসলমানদের জন্য তখনই ফরয যখন প্রকাশ্যে ইসলামের কর্তব্যাদি পালন যে দেশে সম্ভব নয়। এখানে হিযরতের শর্তাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। হিযরত হতে হবে আল্লাহ্‌র রাস্তায়। হিযরতের উদ্দেশ্য হবে, নিজের দেশ, জাতি, আত্মীয়-স্বজন, বিষয়-সম্পত্তি ত্যাগ করা, মুসলিম জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য। উদ্দেশ্য হবে বৃহত্তর মুসলিম গোষ্ঠিতে সংযুক্তি যেখানে সে তার ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে পারে, সুখ ও শান্তির সাথে বসবাস করতে পারে এবং ইসলামের বিকাশের জন্য সমষ্টিগতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে পারে। হিযরত বা দেশ ত্যাগের নিয়ত বা মূলমন্ত্র এখানেই নিহিত। যখন কোথাও ইসলাম বিপন্ন হয়, নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস সমুন্নত রাখার জন্য সে স্থান থেকে পলায়ন করাই হিযরতের উদ্দেশ্য নয়। হিযরতের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হবে মন্দকে বা দুষ্টকে প্রতিহত করা। এর জন্য প্রয়োজন নিরলস ও অক্লান্তভাবে, ঐকান্তিক ভাবে 'মন্দ' বা 'খারাপের' বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। এই সংগ্রামেরই আর এক নাম 'জেহাদ'। এই সংগ্রামের জন্য প্রয়োজনে মোমেন বান্দাদের তাদের বাড়ী, ঘর, আত্মীয়, পরিজন ত্যাগ করে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদের সংগঠিত হতে হবে, একতাবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম করতে হবে। হিযরতের মূলমন্ত্র হচ্ছে- "মন্দকে বাধা দান করা।" মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শুধুমাত্র ভালো কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার অন্যতম প্রধান কর্তব্য হচ্ছে মন্দকে বা অন্যায়কে বা খারাপকে বাঁধা দান করা।

'মন্দকে' বা অন্যায়কে বাধাদান করতে হবে সমষ্টিগতভাবে। আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে মুসলমানরা হিযরতের মাধ্যমে নিজেদের সুসংগঠিত করে, সমষ্টিগতভাবে মন্দকে প্রতিহত করবে। আল্লাহ্‌র দুনিয়া অনেক বড়। এই মন্দকে প্রতিহত করার জন্য সংগঠিত হওয়ার ইচ্ছায় হিযরত করার জন্য এই দুনিয়া অত্যন্ত প্রশস্ত। পার্থিব ধন-সম্পদ, রাজত্ব, সম্মান, অথবা প্রভাব-প্রতিপত্তির অন্বেষায় দেশত্যাগ করা হিযরত নয়। আল্লাহ্‌র পথে অর্থাৎ মন্দকে প্রতিহত করার মানসে দেশত্যাগ করার নামই হচ্ছে হিযরত। যে ব্যক্তি অর্থের বা কোন পার্থিব বস্তুর বিনিময়ে দেশত্যাগ করে তা আল্লাহ্‌র কাছে হিযরত বলে গণ্য নয়। অর্থাৎ হিযরতের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে 'মন্দকে' প্রতিহত করা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যদি আমরা মন্দকে প্রতিহত করতে না পারি, তবে নিদেনপক্ষে ঐ মন্দ সঙ্গকে পরিত্যাগ করবো। তবে সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থা হচ্ছে নিজেদের সুসংগঠিত করা, যেনো একতাবদ্ধভাবে মন্দকে প্রতিহত করা যায়।

৯৮। [প্রকৃত] দুর্বল, অত্যাচারিত পুরুষ, নারী ও শিশু [এর] ব্যতিক্রম হবে; যাদের আর্থিক সংস্থান তাদের ক্ষমতার বাইরে এবং [নিষ্কৃতি] লাভের কোন পথও তারা পায় না ৬১৬।

৬১৬। যদি আমরা আমাদের দৈহিক ও মানসিক, অক্ষমতার দরুণ আল্লাহ্‌র রাস্তায়, 'ভালোর' জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করতে না পারি তবুও আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য হচ্ছে মন্দ থেকে, মন্দের প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। যদি আমাদের অক্ষমতা সত্যিকারের হয়, যদি তা লোক দেখানো ওজর আপত্তি না হয়, তবে আল্লাহ্‌ পরম করুণাময়, অসীম দয়ার আঁধার; তিনি আমাদের অক্ষমতা মাপ করে দেবেন।

৯৯। এদের জন্য আশা আছে যে, আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ [পাপ] মোচন করেন এবং বারে বারে ক্ষমা করেন।

১০০। আল্লাহ্‌র রাস্তায় যারা হিজরত করে, দুনিয়াতে তারা বহু প্রশস্ত আশ্রয়স্থল লাভ করবে। যারা আল্লাহ্‌ ও রাসূলের জন্য উদ্বাস্তু হয় তারা মৃত্যুবরণ করলে অবশ্যই আল্লাহ্‌র কাছে তাদের পুরস্কার পাওনা হয়। এবং আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

রুকু - ১৫

১০১। যখন তোমরা দেশবিদেশে ভ্রমণ করবে, তখন কাফিরদের আক্রমণের ভয়ে তোমরা সালাত সংক্ষিপ্ত করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না ৬১৭। অবশ্যই কাফিরগণ তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

৬১৭। দেশ ভ্রমণ, যুদ্ধক্ষেত্রে নামাজ, সংক্রান্ত নির্দেশাবলী আয়াত [৪ : ১০১-১০৪]-এ আছে। এই দুটি বিশেষ অবস্থায় নামাজকে সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দান করা হয়েছে। আয়াত [৪ : ১০১]-এ নামাজ সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ আছে ভ্রমণের বেলায় এবং আয়াত [৪ : ১০২-১০৪]-এ নামাজ সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ আছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সেনার মুখোমুখি বিপদ সংকুল অবস্থায়। কোরানের এই নির্দেশকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে রাসূলের জীবনীর মাধ্যমে। তিনি যেভাবে তা অনুশীলন করতেন তাঁর মাধ্যমেই এর ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। যেমন ভ্রমণের বা সফরের বেলায় সফর-কে সময় ও যুগের পটভূমিতে তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আয়াত [২ : ১৮৪] এবং টিকা ১৯০-এ দ্রষ্টব্য। নামাজকে কতটুকু সংক্ষিপ্ত করতে হবে সে সম্বন্ধে আমরা ধারণা করতে পারি রাসূলের পথ অনুসরণ করে। সাধারণতঃ আমাদের নবী জোহর, আছর এবং এশার নামাজকে চারি রাকাতের স্থলে দু'রাকাত পড়তেন এবং ফজর এবং মাগরিবের নামাজ পূর্বেই দু'রাকাত এবং তিন রাকাত ছিল এবং তা অপরিবর্তিত থাকতো।

১০২। [হে নবী] তুমি যখন তাদের মাঝে থাকবে এবং সালাত পরিচালনার জন্য দাঁড়াবে, তখন একদলকে তোমার সাথে [সালাতে] দাঁড়াতে বল এবং তারা যেনো সশস্ত্র থাকে। এবং সালাত শেষে তারা যেনো তোমাদের পিছনে অবস্থান গ্রহণ করে। এবং যে দল এখনও সালাতে শরীক হয় নাই, তারা যেনো তোমার সাথে সালাতে শরীক হয়, এবং সকল সতর্কতা অবলম্বন করে ও সশস্ত্র থাকে। কাফিরদের কামনা যে যদি তোমরা অস্ত্র-শস্ত্র এবং তোমাদের [সৈনিকের] মালপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও, তবে তারা যেনো তোমাদের উপর অতর্কিত ঝাপিয়ে পড়তে পারে ৬১৮। যদি বৃষ্টির অসুবিধার জন্য অথবা অসুস্থতার জন্য তোমরা অস্ত্র রেখে দাও তবে তোমাদের কোন দোষ নাই। কিন্তু তোমাদের জন্য তোমরা [সকল] সতর্কতা অবলম্বন করবে। কাফিরদের জন্য আল্লাহ্‌ লাঞ্জনাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন।

৬১৮। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মুখোমুখি অবস্থানে জামাতে নামাজ পড়ার ব্যাপারে এখানে নির্দেশ দান করা হয়েছে। সকলে এক সাথে জামাতে না দাঁড়িয়ে দু'দলে বিভক্ত হয়ে নামাজ আদায় করবে। একদল নামাজ আদায় করবে, অন্যদল পাহাড়া দেবে। আবার নামাজ শেষে পূর্বোক্ত দল পাহাড়া দেবে এবং অপর দল নামাজ পড়বে। অর্থাৎ শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে সর্ব প্রকার ব্যবস্থা নেবার কথা এখানে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা রাসূলের জীবনী এবং বিভিন্ন সময়ে অনুশীলনের মাধ্যমে করা হয়েছে।

১০৩। যখন তোমরা [সংঘবদ্ধভাবে] সালাত শেষ করবে ৬১৯, তখন দাঁড়িয়ে, বসে এবং পাশ ফিরে শুয়ে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করবে। কিন্তু যখন তোমরা বিপদ থেকে আশঙ্কা মুক্ত হবে, তখন নিয়মিত সালাত কায়েম করবে। নিয়মিত সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য নির্দেশ দান করা হলো।

৬১৯। এখানে বলা হয়েছে যে বিপদ জনক অবস্থায় সংক্ষিপ্ত নামাজ জামাতে শেষ করার পরেও প্রত্যেকে ব্যক্তিগত ভাবে যে যেমন আছে সেই ভাবেই আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবে। তারপরে যখন বিপদ শেষ হয়ে যাবে, বিপদমুক্ত অবস্থায় সকলে পূর্ণাঙ্গ নামাজ আদায় করবে।

১০৪। শত্রুর অনুসরণে কখনও শিথিল হয়ে না। যদি তোমরা কষ্ট ভোগ করে থাক, তারাও তো অনুরূপ কষ্ট ভোগ করে থাকে। কিন্তু তোমাদের তো আল্লাহ্‌র [অনুগ্রহের] আশা আছে, যখন তাদের সে আশা নাই ৬২০। এবং আল্লাহ্‌ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ।

৬২০। এখানে উপদেশ দেয়া হয়েছে যুদ্ধ ক্ষেত্রের পটভূমিতে, কিন্তু এর উপদেশ সার্বজনীন। ইসলাম অর্থই হচ্ছে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ, আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা। এই নির্ভরশীলতা নৈতিক মনোবল বৃদ্ধি করে। জীবনে চলার পথে বহু বিপদ বাঁধার সম্মুখীন আমাদের হতে হয়। আমাদের অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবনের পথ অতিক্রম করতে হয়। এই দুঃখ কষ্টের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা। এ বিশ্বাস আমাদের সান্ত্বনা দেয়, সাহস যোগায়, আশার সঞ্চার করে যে আমরা সেই পরম করুণাময়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছি। অপরপক্ষে যারা অবিশ্বাসী, তারা সেই একই দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়ে পথ অতিক্রমের সময় স্রষ্টার প্রতি নির্ভরশীলতা না থাকার কারণে তাদের অন্তর আশঙ্কায় পূর্ণ হয়ে যায়, তারা ভরসা ফেলে হারিয়ে। ধার্মিক লোকের জীবনে আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা পাওয়া সর্বাপেক্ষা বড় পাওয়া।

রুকু - ১৬

১০৫। আমি তো তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যেনো তুমি আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুযায়ী মানুষের মাঝে বিচার মীমাংসা করতে পার। সুতরাং যারা বিশ্বাস ভংগকারী তাদের ওকালতির জন্য [ব্যবহৃত] হয়ো না ৬২১।

৬২১। এই আয়াতটি তায়েমা-ইবন-উবাইরাকের ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজেল হয়েছে। ঘটনাটি ছিল এরূপঃ তাকে কিছু অস্ত্র-শস্ত্র চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। যখন এই চুরির ব্যাপারে তল্লাশী শুরু হয়, তখন তায়েমা অস্ত্রগুলি এক ইহুদীর বাড়ীতে রেখে আসে। ফলে তল্লাসী চলাকালে অস্ত্রগুলি ইহুদীর বাড়ী থেকে উদ্ধার করা হয় এবং ইহুদীকে চুরির অপারাধে অভিযুক্ত করা হয়। তায়েমা নিজেকে মুসলমান বলে ঘোষণা করলেও তাঁর অন্তরে আল্লাহ্‌র জন্য কোনও ভয় বা ভীতি ছিল না। আল্লাহ্‌র আইন মানার প্রতি শ্রদ্ধা' ছিল না। স্বাভাবিক ভাবে মোনাফেকেরা যে রকম ধূর্ত হয় সেও তাই ছিল। সেই কারণে সে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি ও ভাতৃত্ববোধের সুযোগ গ্রহণের জন্য চোরাই মাল অন্য কোনও মুসলমানের বাড়ীতে না রেখে ইহুদীর বাড়ীতে রেখে দিয়েছিল; যাতে মুসলমানেরা মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধনে উজ্জীবিত হয়ে ইহুদীকে অভিযুক্ত করে এবং তার দিকে মনোযোগ না দেয়। এ ব্যাপারে তায়েমার পরিকল্পনা সফল হয়েছিল বলা চলে। ইহুদী যখন তার চুরির অপরাধ অস্বীকার করে তায়েমাকে পাল্টা অভিযুক্ত করলো; তখন সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের সহানুভূতি তায়েমার জন্য প্রকাশিত হলো। কারণ তায়েমা মুসলমান- যদিও তা ছিল নাম মাত্র। পুরো ঘটনাটি রাসুলুল্লার (সাঃ) গোচরীভূত করা হলো ন্যায় বিচারের স্বার্থে। যদিও মুসলিম সম্প্রদায় রাসুলুল্লাহকে (সাঃ) তায়েমার এর পক্ষে সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য প্রভাবিত করেছিল। এমন একটা সময় এসেছিল যে আল্লাহ্‌র রাসূল তায়েমার পক্ষে রায় দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে সত্য প্রতিভাত হয়। আল্লাহ্‌র রাসূল আল্লাহ্‌র রহমতে কোরানের বিধি মোতাবেক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করলেন। ফলে তায়েমা যখন দেখলো যে তার শাস্তি অবধারিত তখন সে মক্কায় পলায়ন করলো এবং ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় কাফেরে পরিণত হলো।

সাধারণ উপদেশ হচ্ছেঃ মোমেন বান্দাদের জন্য এই পৃথিবীতে প্রতিটি পদে, ছলনা ও কৌশলের জাল প্রসারিত। মন্দ সর্বদা ভালোকে প্রতিহত করতে চায়। ছলে-বলে, কৌশলে মন্দ সর্বদা তার জালকে প্রসারিত করে। এর অন্যতম কৌশল হচ্ছে যখন 'মন্দ' বা 'অন্যায়' তার শক্তি দ্বারা 'ন্যায়কে' বা 'ভালো'কে প্রতিহত করতে পারে না তখন সে প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করে। 'মন্দ' বা 'অন্যায়' তখন আবেদন করে মানুষের সহানুভূতি ও দয়ার কাছে। তখন দয়া, সহানুভূতি, করুণা ইত্যাদি হয় 'ন্যায়; ও 'সত্যকে' প্রতিহত করার অন্যতম হাতিয়ার। এখানে আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে সাধারণ মানুষ অনেক সময়ে দয়া ও করুণায় বিগলিত হয়ে, ভাতৃত্ববোধে উদ্বেলিত হয়ে অন্যায়কে অনুধাবন করতে পারে না। ফলে সে অন্যায় প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে পরিণত হয়। ভালোকে, মন্দ থেকে চেনা, অন্যায়কে, ন্যায় থেকে পার্থক্য করা, সত্যকে, অসত্য থেকে খুঁজে বের করতে পারার ক্ষমতাই হচ্ছে বিবেক (spirittual insight) যা আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে এই নেয়ামত লাভ করার জন্য সর্বদা আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা করবে। সে সর্বদা সতর্ক ও সাবধান থাকবে যেনো অন্যায়কারীর ছলা-কলায় বিভ্রান্ত না হয়। আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা করবে যেনো ন্যায়ের সংগ্রামে, অন্যায়কে প্রতিরোধের সংগ্রামে, সত্যকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সে আল্লাহ্‌র সাহায্য লাভ করতে পারে। অন্যথায় সে আল্লাহ্‌র হুকুম লঙ্ঘনকারীদের সামিল বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ্‌র পবিত্র বিধান যা তার কাছে আমানত স্বরূপ, তা পালনে সে হবে ব্যর্থ। ফলে সে খেয়ানতকারীদের সামিল বলে গণ্য হবে। তাই পরবর্তী আয়াতে, ভুল-ভ্রান্তির জন্য পরম করুণাময়ের ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে।

১০৬। আর আল্লাহ্‌র ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

১০৭। যারা তাদের নিজ আত্মাকে প্রতারিত করে তাদের সমর্থনে তর্ক করো না ৬২২। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ বিশ্বাসঘাতক এবং অপরাধকারীদের পছন্দ করেন না।

৬২২। মানব সন্তান জন্ম লাভ করে পূত পবিত্র আত্মা নিয়ে। সংসারের যাত্রাপথে পৃথিবীর লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ, স্বার্থপরতা এই পূত পবিত্র আত্মাকে কলুষিত করে তোলে। আমাদের আত্মা সেই পরমাত্মার অংশ। তাই এই আত্মা আমাদের নিকট আমানত স্বরূপ। স্রষ্টার নির্দেশ হচ্ছে একে পূত পবিত্র রাখা এবং এই নশ্বর দেহ অবসানে এই আত্মাকে পূত পবিত্র ভাবে সেই পরমাত্মার নিকট সমর্পণ করা। সুতরাং সকল অন্যায়, অপরাধ, মন্দ কাজ, লোভ-লালসা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে তায়েমার ঘটনার মাধ্যমে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, "তাদের সমর্থনে তর্ক করো না।" অর্থাৎ যারা ছলে, বলে কৌশলে ভালোকে প্রতিহত করতে চায়, ন্যায়ের আবরণে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়; ভাতৃত্ববোধের আড়ালে পক্ষ পাতিত্বের প্রভাব বিস্তার করে, তাদের সম্পর্কে তায়েমার ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন। পক্ষপাতিত্ব এমন একটা মন্দ কাজ যা বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে, ভাতৃত্বের আবরণে, গোষ্টিগত একাত্বতার মাধ্যমে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে উদ্ভূদ্ধ করে। এসব ক্ষেত্রে ন্যায়ের দন্ড হয় পদদলিত। আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে যে কোনও অবস্থায় ন্যায়ের দন্ড সমুন্নত রাখতে হবে। [অনুবাদকের মন্তব্যঃ বাংলাদেশে ধর্মের নামে, দলের নামে, প্রতিদিন ন্যায়ের দন্ডকে ধূলিসাৎ করা হচ্ছে। ফলে আল্লাহ্‌র গজব আমাদের উপরে পতিত হচ্ছে]। ইসলামের দৃষ্টিতে 'ন্যায়' ও 'সত্য' হচ্ছে বিবেক যা আল্লাহ্‌র সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত বান্দার জন্য।

১০৮। আঃ এরাই তারা যারা [তাদের নিজ অপরাধ] মানুষের নিকট গোপন রাখে, কিন্তু আল্লাহ্‌র নিকট থেকে গোপন রাখতে পারে না। রাত্রে তারা যখন ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে, যা আল্লাহ্‌ অনুমোদন করেন না- তিনি [আল্লাহ্‌] তাদের ঘিরে থাকেন এবং তারা যা করে আল্লাহ্‌র [জ্ঞান] তার সব কিছুকেই ঘিরে থাকে ৬২৩।

৬২৩। মোনাফেক ও পাপীরা প্রকাশ্যে এক কথা বলে আবার গোপনে তারা ষড়যন্ত্র করে। তাদের প্রকাশ্য কথা ও অন্তরের চিন্তায় কোনও মিল নাই। এরাই মিথ্যাবাদী, এরাই মোনাফেক। বাইরের পৃথিবী তাদের এই দ্বিমুখী নীতি ও অন্তরের খবর না জানতে পারলেও আল্লাহ্‌ সব জানেন তিনি সর্বজ্ঞ। তিনি তাদের অন্তরের সব খবর রাখেন। তারা যা করে, যা বলে সবই তাঁর জ্ঞাত। 'Muhit' কথাটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে তিনি সব কিছুকেই বেষ্টন করে আছেন "Compass them round" যার বাংলা তর্জমা করা হয়েছে, "তিনি তাদের ঘিরে আছেন।" আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করলেই এ সব পাপীদের স্তব্ধ করে দিতে পারেন। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ তার বৃহত্তর পরিকল্পনা অনুধাবন করতে পারি না। যা কিছু সবই তার আয়ত্বাধীন।

১০৯। আঃ এরাই তারা যাদের পক্ষ নিয়ে এই পৃথিবীতে তোমরা তর্ক করে থাক। কিন্তু শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্‌র সাথে কে তাদের পক্ষে তর্ক করবে ? অথবা কে তাদের উকিল হবে ?

১১০। যদি কেহ মন্দ কাজ করে অথবা নিজ আত্মার প্রতি যুলুম করে, কিন্তু পরে আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে, আল্লাহ্‌কে সে বার বার ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু রূপে পাবে।

১১১। এবং যদি কেহ পাপ করে, সে তা করে নিজের আত্মার ক্ষতির জন্য। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাময় ৬২৪।

৬২৪। 'Kasaba'- অর্থাৎ অর্জন করা, লাভ করা, মূল্যবান কিছু পাওয়ার জন্য কাজ করা, ভবিষ্যত সঞ্চয়ের জন্য চেষ্টা করা ইত্যাদি। প্রাত্যহিক জীবন যাপনে পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবিকা সংগ্রহ করি। যে কঠোর পরিশ্রমী, তার জীবিকার অভাব হয় না। কঠোর পরিশ্রমীর জন্য আয় উন্নতি অবধারিত। আবার যে পরিশ্রম বিমুখ, অলস, তার উন্নতি সম্ভব নয়। ঠিক সেইরূপ আধ্যাত্মিক জীবনে ভালো-কাজের ফল স্বরূপ আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি লাভ করা যায়। অপরপক্ষে মন্দ কাজের ফলে আধ্যাত্মিক জীবন হয় কলুষিত, পরকালের জীবনের সুখ শান্তি হয় বিঘ্নিত। আয়াত [৪ : ১১০-১১২]-তে তিনটি অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে (১) আমরা যদি অন্যায় বা মন্দ কাজ করে অনুতাপ করি- আল্লাহ্‌র ক্ষমার হাত প্রসারিত বান্দার জন্য। (২) যদি আমরা 'অন্যায়' বা মন্দ কাজ করি এবং মনে করি যেহেতু লোক সমক্ষে তা গোপন করা সম্ভব হয়েছে, সুতরাং আল্লাহ্‌র কাছেও তা গোপনে রাখা সম্ভব, তবে তা হবে মারাত্মক ভুল। আল্লাহ্‌র কাছে কিছুই গোপন থাকে না। মন্দ কাজের যে পরিণাম তা আমাদের পূর্ণ মাত্রায় ভোগ করতে হবে। প্রত্যেককে স্ব-স্ব কাজের জবাবদিহি করতে হবে। (৩) যদি আমরা অন্যায় কাজ করে তা অপরের ঘাড়ে চাপাতে চাই, (যেমন তায়েমা নিজে চুরি করে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছিল) তার শাস্তি দ্বিবিধ। অন্যায় কাজের অপরাধে সে তো অপরাধী হবেই, উপরন্তু অন্যের ঘাড়ে সেই অন্যায় কাজের অপবাদ চাপানোর কারণেও সে অপরাধী হবে। কারণ সে ক্ষেত্রে অন্যায় কাজের সাথে মিথ্যার বেসাতী আমারের গলায় বেড়ীর মত বেষ্টন করে থাকে। এই মিথ্যার বেসাতী করা এক জঘন্য পাপ; যা আমাদের চরিত্রের ছোট ছোট ভুলত্রুটি, দোষকে পরিশুদ্ধ না করে বড় পাপের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এ হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান। তাই তো দেখি মিথ্যুক ব্যক্তি প্রথমে সাফল্য লাভ করলেও পরিণামে সে সাফল্য স্থায়ী হয় না। স্থায়ী যা হয় তা হচ্ছে লাঞ্জনা, অপমান। একথা ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য ঠিক সমভাবে প্রযোজ্য জাতির প্রতি। যে জাতির নাগরিকেরা সত্যবন্ধ নয়, তারা কোনও দিন আল্লাহ্‌র রহমত পেতে পারে না। তাদের শেষ পরিণতি লাঞ্ছনা ও অপমান।
[অনুবাদকঃ বাংলাদেশীদের বিশ্ব সভায় এত লাঞ্ছনা ও অপমানের কারণ জাতি হিসেবে আমরা মিথ্যুক ও মোনাফেক]।

১১২। যদি কেহ দোষ বা পাপ করার পর তা নির্দোষ ব্যক্তির উপর আরোপ করে তবে সে [অন্যকে] মিথ্যা অপবাদ ও অতি অসৎ পাপের [উভয়] বোঝা [নিজের] উপর বহন করে।

রুকু - ১৭

১১৩। তোমার প্রতি যদি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো তবে তাদের একদল তোমাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্র করতো। কিন্তু [প্রকৃত পক্ষে] তারা কেবলমাত্র তাদের নিজের আত্মাকেই পথভ্রষ্ট করবে। এবং তারা তোমার সামান্য ক্ষতিও করতে পারবে না। কারণ আল্লাহ্‌ তোমার প্রতি কিতাব ও প্রজ্ঞা [হিক্‌মত] প্রেরণ করেছেন এবং [পূর্বে] তুমি যা জানতে না তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং তোমার প্রতি আল্লাহ্‌র মহা অনুগ্রহ রয়েছে।

১১৪। তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোনও কল্যাণ নাই। কিন্তু যদি কেউ পরপোকার অথবা ন্যায় বিচার অথবা মানুষের মাঝে বিরোধ দূর করার উদ্দেশ্যে ৬২৫ [গোপনতা অবলম্বন করে] অন্যকে উদ্বুদ্ধ করে; তবে যে তা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে, তাকে অবশ্যই আমি সর্বোচ্চ [মূল্যবান] পুরস্কার দান করবো।

৬২৫। সাধারণতঃ নিন্দনীয় কাজ এবং মন্দ উদ্দেশ্যকে লোক সমাজে গোপনীয় রাখা হয়। অথবা কোন ব্যক্তি যখন জানে তার কীর্তি-কাহিনী লোক সমাজে প্রকাশ পেলে সে সমাজের চোখে ঘৃণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হবে, সে সব ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। এ রকম গোপনীয়তা সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। তাই এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলছেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবাধ ও মুক্ত চিন্তাধারা এবং আলোচনার প্রকাশ হতে হবে। অবাধ ও মুক্ত চিন্তাধারাই একমাত্র সমাজ জীবনের ক্লেদ দূর করে, সমাজের সাম্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। ইসলাম সে কারণে গোপনীয়তাকে সমর্থন করে না। তবে তিনটি বিশেষ ক্ষেত্রে গোপনীয়তাকে সমর্থন দান করা হয়েছে। শুধু সমর্থন দান বললে সঠিক বলা হবে না, বরং প্রশংসা করা হয়েছে; যদি এই গোপনীয়তা হয় নিঃস্বার্থ পরোপকারের জন্য এবং আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিবেদন। (১) যদি কেউ পরোপকারের জন্য দান ধ্যান করে এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য, হিতসাধনের জন্য কাজ করে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে চায় না এই জন্য যে প্রকাশ্য সে দান গ্রহণের ফলে গ্রহীতাকে লোক সমাজে হীনমন্যতায় ভুগতে হবে। সমাজের চোখে সে করুণার পাত্র হবে, সে সব ক্ষেত্রে গোপনীয়তা গ্রহণ করা শ্রেয়। অথবা উপদেশ দ্বারা, বা পরামর্শ দ্বারা, কাউকে সাহায্য করা এবং তা গোপন রাখা এই জন্য যে তা প্রকাশ পেলে গ্রহীতার মনে হীনমন্যতার জন্ম নিতে পারে, তার আবেগ অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। (২) যখন ন্যায়ের খাতিরে বা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও অপ্রীতিকর কাজ করতে হয়, তা অবশ্যই করণীয় কর্তব্য। কিন্তু সে কাজ প্রকাশ পেলে যদি কাউকে লজ্জা ও অপমানের মধ্যে পড়তে হয় তবে সে ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করাই উত্তম। সৎ কাজে গোপনীয়তা উত্তম। (৩) যদি দু'পক্ষের ঝগড়া ও বিবাদ বিসংবাদ মেটানোর জন্য কোন ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়, অর্থাৎ শান্তি স্থাপনের জন্য গোপনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তবে সে ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করাই উত্তম। কারণ ঝগড়া ফ্যাসাদের সময়ে দু'পক্ষই অত্যন্ত স্পর্শ কাতর হয়ে যায়। সামান্য কথাও তখন দু'পক্ষকে উত্তেজিত করার জন্য যথেষ্ট। এসব ক্ষেত্রে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে গোপনীয়তা অবলম্বন করা উত্তম। গোপনে দু'পক্ষের মধ্যে আলোচনা করা যাতে কোনও পক্ষেরই সম্মানে আঘাত না লাগে। অর্থাৎ যে কেউ শুধুমাত্র আল্লাহ্‌কে খুশী করার জন্য দান-খয়রাত করে, সৎ কাজ করে এবং মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করে এবং গ্রহীতার অনুভূতিতে যাতে আঘাত না লাগে সে কারণে তা গোপন রাখে, আল্লাহ্‌ পক্ষ থেকে তাদের জন্য আছে মহা পুরস্কার।

১১৫। কারো নিকট সৎপথ প্রদর্শনের পরও সে যদি রাসূলের সাথে তর্ক করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথের অনুসরণ করে, তবে যে পথ সে মনোনীত করেছে আমি তাকে সেই পথেই থাকতে দেবো, এবং [শেষ পর্যন্ত] জাহান্নামে অবতরণ করাবো। কত নিকৃষ্ট সেই আবাস।

রুকু - ১৮

১১৬। আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে শরীক করার [গুনাহ্‌] ক্ষমা করেন না ৬২৬। এছাড়া অন্য পাপ যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি ক্ষমা করেন। এবং যে আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করে সে [সঠিক পথ থেকে] বহুদূরে পথভ্রষ্ট হয়।

৬২৬। দেখুন আয়াত [৪ : ৪৮] এবং টিকা ৫৬৯। আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করা হচ্ছে নিজের আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা, যাকে তুলনা করা চলে ঐ ব্যক্তির সাথে যে নিজ মাতৃভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে; নিজ রাষ্ট্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করার পাপের ক্ষমা নাই।

১১৭। [পৌত্তলিকেরা] তাঁকে ত্যাগ করে দেবীর পূঁজা করে ৬২৭। তারা [আল্লাহ্‌র প্রতি] বিদ্রোহে অটল থেকে শয়তানকে আমন্ত্রণ করে ৬২৭।

৬২৭। আল্লাহ্‌র ক্ষমতা, মমতা, নিদর্শন তার সমস্ত সৃষ্টিকে ব্যপ্ত করে আছে। তার সৃষ্টি তার একত্বের দিকেই নির্দেশ দেয়। তার সৃষ্টির প্রতিটি ধূলিকণা, তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মহত্বের প্রতি ইঙ্গিত দান করে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সব কিছুই স্রষ্টার বিশালত্বের এবং একত্বের নিদর্শন। যদি কেউ স্রষ্টার একত্ববাদ থেকে বিচ্যুত হয়, তবে সে তা করে তার আত্মিক ও মানসিক বিকৃতির কারণে। বিশেষতঃ এই বিকৃতির মূল অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তার উৎপত্তি যৌন আবেদন বা আত্ম অহংকার থেকে। বিকৃত যৌন আবেদন বলতে এই বোঝায় যে অনেক ধর্মে মনে করা হয় যে, যৌনতা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পক্ষে অপরিহার্য। যেমন হিন্দু ধর্মে কালী মুর্তিকে কল্পনা করা হয় রক্ত পিপাসু উলঙ্গ নারীরূপে। এমন কি বিদ্যার দেবী সরস্বতী, বা শিল্প সাহিত্য ও খেলাধূলার কুমারী দেবী মিনার্ভা, বা কামদেবী ভেনাস এদের সবার বেলাই ঐ একই কথা প্রযোজ্য। কল্পনার জগতে যখন এদের সৃষ্টি করা হয়, তখন কাম রীপুটির প্রাধান্য অধিক দেখা যায়। এমন কি হিন্দু ধর্মে যে দেবদাসী প্রথা চালু আছে তাও ঐ কাম রীপুরই অন্য একটি রূপ। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানসে স্রষ্টার একত্বের ধারণা অনুধাবন ক্ষমতা লোপ পায়। কারণ বিকৃত চিন্তাধারা তাদের সমস্ত সত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফলে সত্যিকারের যে ধর্মীয় মুল্যবোধ তা তাদের মধ্যে থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। "তারা দেবীরই পূজা করে।" দ্বিতীয় আর একটি কারণ, যে কারণে সাধারণ লোকে আল্লাহ্‌র নিকট অনুগত হয় না তা হচ্ছে আত্মগর্ব ও অহংকার। নিজের সম্বন্ধে অন্ধ এবং বিকৃত অহংকার কি রূপ নিতে পারে, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ শয়তানের বেহেস্ত থেকে পতন। নিজ সম্বন্ধে অন্ধ অহংকারে, বিকৃত আত্মগর্বে, শয়তান আল্লাহ্‌র হুকুমকে অস্বীকার করে। ফলে আল্লাহ্‌র অভিশাপ তার উপরে বর্ষিত হয়। এই দু'ধরণের বিকৃতি অর্থাৎ দেবদেবী ও অহংকার, এদের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি এদের সামান্যতমও প্রশ্রয় দেয়া হয় তবে অচিরেই তা আমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। আমাদের সর্বসত্ত্বায় বিকৃতি এমন ভাবে প্রবেশ করবে যে তা আল্লাহ্‌র নিদর্শন অনুধাবনের ক্ষমতা রহিত করে দেবে।

১১৮। আল্লাহ্‌ তাকে [শয়তানকে] অভিশাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে বলেছিলো, "আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের এক অংশকে আমার অনুসারী করে নেব" ৬২৮।

৬২৮। বেহেশত থেকে পতনের পরে শয়তান আল্লাহ্‌র কাছে অনুরোধ করলো, যে আদমের কারণে তার পতন এবং অপমান, সেই আদমকে প্রলোভিত করে অসৎপথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাকে দেয়া হোক। আল্লাহ্‌ শয়তানকে সেই ক্ষমতা দান করলেন- আর মানুষকে দান করলেন স্বল্প পরিমাণে 'স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি' (Limited free will)। শয়তান মানুষের এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে যথেচ্ছ ব্যবহার দ্বারা তাকে কুপথে প্রলোভিত করতে পারে। এই 'স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি'-কে আদম সন্তান ইচ্ছা করলে সুপথে পরিচালিত করতে পারে, আবার কুপথে বা শয়তানদের পথেও পরিচালিত করতে পারে। এই ইচ্ছা শক্তির জন্যই আদম সন্তান সৃষ্টির সেরা জীব। এই ইচ্ছা শক্তির ব্যবহারকে সংযত ও সুসংহত করে নিজেকে স্রষ্টার কাছে প্রমাণিত করতে হবে, তার করুণার যোগ্য হতে হবে; পরকালে এর হিসাব দাখিল করতে হবে। এই আয়াতে শয়তান অহংকার প্রদর্শন করছে এই বলে যে, সে অবশ্যই আদম সন্তানের এক অংশকে তার রাস্তায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আল্লাহ্‌ আদম সন্তানকে যে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দান করেছেন তার উপযুক্ত ব্যবহারে সে হতে পারে ফেরেশতাদের সমকক্ষ আবার তার অপব্যবহারে সে হবে পশুরও অধম। সবই আদাম সন্তানের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। এখানেই মানুষের স্বাধীনতা। সে ভালো হতে চায়, না মন্দ হতে চায়- সবই নির্ভর করবে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপরে। এখানেই শয়তানদের ক্ষমতা। শয়তান আদম সন্তানকে কুপথে চালিত করে এমন অবস্থায় নিয়ে আসে যে, তার সমস্ত সু-প্রবৃত্তি নষ্ট হয়ে যায়, সকল সুকোমল বৃত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। তার প্রকৃতি বা চরিত্র পশু প্রবৃত্তি ধারণ করে। তারা তখন শয়তানের প্রতিনিধি হিসেবেই কাজ করে।

১১৯। "আমি তাদের পথভ্রষ্ট করবোই ৬২৯ এবং তাদের মাঝে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করবোই। আমি তাদের পশুর কর্ণচ্ছেদ করার ৬৩০ এবং আল্লাহ্‌র [সুন্দর] সৃষ্ট প্রকৃতিকে বিকৃত করতে আদেশ দেবোই ৬৩১।" আল্লাহ্‌কে পরিত্যাগ করে যে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে সে স্পষ্টতঃই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

৬২৯। শয়তান যে সব প্রলোভন দ্বারা মানুষকে কুপথে পরিচালিত করবে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রলোভন বা মিথ্যা বাসনা। শয়তান দ্বারা পরিচালিত মানুষ প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় গ্রহণ করবে। 'মিথ্যা বাসনা' দ্বারা এ কথাকেই বুঝানো হয়েছে। এসব আদম সন্তানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে তারা হবে অত্যন্ত কুসংস্কারচ্ছন্ন। তারা সব সময়ে বিভিন্ন ভয়ে মানসিকভাবে আক্রান্ত থাকবে। ত্রাস বা অমূলক ভয়-ভীতি হবে তাদের নিত্য সঙ্গী- যার থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন ঈশ্বরের আশ্রয় ভিক্ষা করবে। অর্থাৎ শয়তানের অস্ত্র হচ্ছে, প্রতারণা, মিথ্যা ছলনা, প্রবঞ্চনা, কুসংস্কার ও অমূলক ভয়-ভীতি।

৬৩০। নানা জাতির মধ্যে নানা ধরণের কুসংস্কার বিদ্যমান। প্রাচীন আরব জাতির মধ্যে এরকম কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল যে কোনও অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য পশুর কান ছিদ্র করা প্রয়োজন। এরকম বহু ধরণের কুসংস্কার বিভিন্ন জাতির মধ্যে দেখা যায়। যেমন মাজার পূঁজা, পীর পূঁজা, রত্নপাথর ধারণ করা, শুভদিনে যাত্রা ইত্যাদি সবই কুসংস্কারের মধ্যে অন্তর্গত। এই আয়াতে পশুর কর্ণচ্ছেদ একটি উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে। এ থেকে কেউ যেনো মনে না করেন যে সেটাই একমাত্র কুসংস্কার। কুসংস্কার বহু ধরণের এবং বহুভাবে বিদ্যমান। কুসংস্কার এমন একটি রোগ যা মানুষের সকল স্বাধীন সত্ত্বাকে পরিব্যপ্ত করে ফেলে। যে সত্ত্বা পরমাত্মার অংশ তার অস্তিত্ব হয় বিপন্ন, নৈতিক স্বাধীনতা হয় ব্যহত। মানুষ কুসংস্কারের দাসে পরিণত হয়। সে তখন ভুলে যায় যে, সমস্ত শুভ বা কল্যাণের মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌। বিপদ বা বাঁধাতে একমাত্র তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করা এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা করাই সঙ্গত। পরিবর্তে কুসংস্কারচ্ছন্ন ব্যক্তি এমন সব জিনিসকে তার বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য গ্রহণ করে; সত্যিকার অর্থে যাদের কোনও ক্ষমতাই নাই। যেমন- সাধারণ মানুষ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য বা ভবিষ্যত জানার জন্য বা শুভ অশুভ দিন ধার্য করার জন্য জ্যোতিষ, গণক বা গ্রহ-নক্ষত্রে বিশ্বাস স্থাপন করে, তাবিজ-মাদুলি ধারণ করে। পরিণতিতে এসব তাদের এক আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস, তাঁর করুণা ও রহমত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। তারা শয়তানের অভিভাবকত্বে আশ্রয় গ্রহণ করে।

৬৩১। 'আল্লাহ্‌র [সুন্দর] সৃষ্ট প্রকৃতিকে বিকৃত করতে আদেশ দেবই' এ বাক্যটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে- সমস্ত সত্য ও সুন্দরের উৎস আল্লাহ্‌। বিশ্ব ভূবন, পৃথিবী, প্রকৃতি, আকাশ, মাটি, সমুদ্র, নদী, গাছপালা সব কিছুই সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি। বিশ্ব প্রকৃতির সব কিছুই সমন্বয়পূর্ণ। কিন্তু মানুষের লোভ-লালসা বিশ্ব-প্রকৃতির এই সমন্বয়কে বিনষ্ট করে। আজকের পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এর সত্যতা অনুধাবন করা যায়। মানুষের লোভ-লালসার দরুণ পৃথিবীর অস্তিত্ব হয়ে পড়েছে বিপন্ন। পৃথিবীর মানুষ প্রতি নিয়ত লোভ, প্রলোভনের বা শয়তানের কুমন্ত্রণার কাছে পরাজিত হচ্ছে। আমরা আমাদের চারিপাশে অহরহই দেখি বিভিন্ন ভাবে প্রকৃতির নিয়মকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হচ্ছে নষ্ট। এই ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মূলে আছে মানুষের লোভ এবং স্বার্থপরতা যা শয়তানের প্ররোচনা। তাই প্রকৃতির নিয়মকে লঙ্ঘন করাকেই এখানে বলা হচ্ছে " আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকে বিকৃত করতে আদেশ দেবই।" মানুষের লোভ এবং স্বার্থপরতার কাছে সত্য ও সুন্দর পরাজিত হচ্ছে প্রতি মূহুর্তে। আধ্যাত্মিক জগতের জন্য এ পরাজয় আরও মর্মান্তিক। মানুষের কুসংস্কার ও নিষ্ঠুর সংস্কৃতি মানুষের যা স্বাভাবিক ধর্ম, প্রকৃতিগত ভাবে আল্লাহ্‌ তাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, সেই ধর্ম থেকে তাকে বিচ্যুত করে। সৃষ্টির প্রথমে আল্লাহ্‌ মানুষকে পূত ও পবিত্র করে সৃষ্টি করেন। মানুষের আত্মা, পরমাত্মার অংশ [১৫:২৯]। তা হচ্ছে নির্মল ও পবিত্র। এই তার আদি এবং অকৃত্রিম ধর্ম। শয়তানের কুমন্ত্রণা ও লোভে এই আত্মা হয়ে যায় কলুষিত ও পাপের দ্বারা পূর্ণ- যা তার স্বাভাবিক ধর্ম নয়। 'বিকৃত' কথাটির দ্বারা এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে।

১২০। শয়তান তাদের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের মাঝে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। শয়তানের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা ব্যতীত আর কিছু নয়।

১২১। তাদের [প্রতারিত ব্যক্তি] বাসস্থান হবে জাহান্নামে, এবং সেখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন পথ তারা পাবে না।

১২২। কিন্তু যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে, আমি শীঘ্রই তাদের [বেহেশতের] বাগানে প্রবেশ করাবো যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী রূপে বাস করবে। আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সত্য। কার কথা আল্লাহ্‌ অপেক্ষা অধিক সত্য হবে ?

১২৩। তোমাদের [মুসলিম] ও কিতাবধারীদের [ইহুদী ও খৃষ্টান] আকাঙ্খা অনুযায়ী কাজ হবে না ৬৩২। কেহ মন্দ কাজ করলে সেই অনুযায়ী প্রতিশোধ নেয়া হবে। আল্লাহ্‌ ব্যতীত সে কোনও অভিভাবক বা সাহায্যকারী পাবে না।

৬৩২। একবার কিছু মুসলমান ও আহলে কিতাবীর মধ্যে গর্ব সূচক কথা বার্তা শুরু হলো। আহলে কিতাবীরা বললো : আমরা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্ভ্রান্ত। কারণ আমাদের নবী ও আমাদের গ্রন্থ তোমাদের নবী ও তোমাদের গ্রন্থের পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলমানেরা বললো : আমরা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ আমাদের নবী সর্বশেষ নবী এবং আমাদের গ্রন্থ সর্বশেষ গ্রন্থ। এ গ্রন্থ পূর্ববর্তী সব গ্রন্থকে রহিত করে দিয়েছে। এ কথোপকথনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতটি নাজেল হয়।

এই আয়াতটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শুধু কল্পনা, বাসনা ও দাবী দ্বারা কারও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না, বরং প্রত্যেকের কাজ কর্মই শ্রেষ্ঠতার ভিত্তি। ব্যক্তিগত দায় ও দায়িত্বই হচ্ছে ইসলামের প্রধান্য বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত বিশ্বাস ও চরিত্রের পবিত্রতাই হচ্ছে ধর্মের মূল কথা। আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস কোনও কথার কথা নয়। এটা কোনও বাহ্যিক আচার বা অনুষ্ঠান নয়- এ হচ্ছে এমন এক বিশ্বাস যা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসরিত। যা একান্ত, অনুগত ও অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। বান্দা তখন তার সর্ব ইচ্ছাকে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে স্ব-ইচ্ছায়। যদি এই আত্মসমর্পণ হয় আন্তরিক ও আত্মার অন্তঃস্থল থেকে তা উত্থিত হয়, তবে তা আমাদের সর্ব সত্তাকে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার সাথে বিলীন করে দেয়। এরই নাম 'বিশ্বাস' এই বিশ্বাসই বান্দার চরিত্রকে পূত পবিত্র হতে সাহায্য করে। বিশ্বাস ও পূত পবিত্র চারিত্রিক গুণাবলীই হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য্য যা অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে আলাদা। এমন অনেক ধর্ম আছে যারা বিশ্বাস করে আত্মার মুক্তির জন্য অপরের সাহায্য প্রয়োজন অর্থাৎ পাদ্রী বা পুরোহিত শ্রেণীর মাধ্যম প্রয়োজন; অর্থাৎ পাদ্রীরা অন্যদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আবার অনেকে বিশ্বাস করে যেহেতু তারা "ইব্রাহীমের সন্তান" বা তারা কোনও নির্দিষ্ট জাতিতে জন্মগ্রহণ করেছে সেই কারণে তারা শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আল্লাহ্‌ বলেছেন জাতি বা ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দ্বারা মানব সন্তানকে বিচার করা হবে না। তার শ্রেষ্ঠত্বের বিচার হবে তার কাজের দ্বারা, এবং যে মন্দ কাজ করবে, সে যেখানেই জন্ম গ্রহণ করুক না কেন তাকে তার ফল ভোগ করতে হবে। পাদ্রী বা পুরোহিত বা হযরত ইব্রাহীমের বংশধর বা শ্রেষ্ঠ জাতি সকলকেই আল্লাহ্‌ তার কাজের দ্বারা বিচার করবেন, বংশ গৌরব বা অন্য কিছু দ্বারা নয়। সৎ কাজের আছে পুরস্কার, মন্দ কাজের শাস্তি। এই-ই আল্লাহ্‌র বিধান।

১২৪। পুরুষ অথবা নারী যে কেউ সৎ কাজ করলে, ও ঈমান থাকলে, তারা বেহেশতে প্রবেশ লাভ করবে। এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও অন্যায় করা হবে না ৬৩৩।

৬৩৩। 'Naqir' - খেজুরের বীচির খাঁজের মধ্যে যে যৎ সামান্য শাঁস থাকে সেই পরিমাণ। অর্থাৎ পরিমাণের সামান্যতা বোঝানোর জন্য এই উপমাটি ব্যবহার করা হয়েছে। দেখুন টিকা নং ৫৭৫ এবং [আয়াত ৪ : ৫৩]।

১২৫। তার থেকে বেশী ধর্মপরায়ণ কে আছে, যে নিজেকে আল্লাহ্‌র [ইচ্ছার] নিকট সমর্পণ করে, ভালো কাজ করে, এবং প্রকৃত ধর্মনিষ্ঠ ইব্রাহীমের অনুসরণ করে ? আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন ৬৩৪।

৬৩৪। মুসলিম দর্শনে হযরত ইব্রাহীমের স্থান অত্যন্ত উচ্চে। ধর্ম হিসেবে ইসলাম নামকরণ হযরত ইব্রাহীমের দ্বারা। তাঁর উপাধি হচ্ছে " আল্লাহ্‌র বন্ধু।" এর অর্থ এই নয় যে তিনি সাধারণ মরণশীল মানুষ ছিলেন না। তিনিও ছিলেন সাধারণ মানুষের মতই মরণশীল। কিন্তু ধর্মের বিশ্বাসে, তিনি ছিলেন অটল, চরিত্রে এবং কর্মে তিনি ছিলেন আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত অনুগত, জীবনের সর্ব অবস্থায় তিনি আল্লাহ্‌র প্রতি ছিলেন একান্ত অনুগত এবং অটল। এক আল্লাহ্‌তে বিশ্বাসীদের মধ্যে তিনি ছিলেন পুরোধায়। তারই বংশে জন্মগ্রহণ করেন বিভিন্ন নবী এবং রাসূলেরা। হযরত মূসা, হযরত ঈসা এবং শেষ নবী হযরত মুহম্মদ তারই অধঃস্তন বংশধর। ইহুদী, খ্রষ্টান এবং মুসলমান সবার জন্য তিনি সমভাবে সম্মানীয়।

১২৬। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহ্‌রই। এবং সব কিছুকে আল্লাহ্‌ পরিবেষ্টন করে আছেন ৬৩৫।

৬৩৫। 'Muhit'- দেখুন আয়াত [৪ : ১০৮] এবং টিকা নং ৬২৩।

রুকু - ১৯

১২৭। তাহারা তোমার নিকট নারীদের সম্বন্ধে [আল্লাহ্‌র] নির্দেশ জানতে চায়। বলঃ আল্লাহ্‌ তোমাদের তাদের সম্বন্ধে নির্দেশ দিতেছেন ৬৩৬। এবং [স্মরণ কর] ইয়াতীম নারীদের সম্বন্ধে যাদের প্রাপ্য তোমরা প্রদান কর না, অথচ তাদের তোমরা বিয়ে করতে চাও, এবং দুর্বল অসহায় শিশুদের সম্বন্ধে [নির্দেশ] যা কিতাবে তোমার নিকট পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে ৬৩৭। যেনো ইয়াতীমদের প্রতি ন্যায় বিচারে তোমরা দৃঢ়তা অবলম্বন কর। এমন কোন ভালো কাজ নাই যা তোমরা কর, কিন্তু আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন।

৬৩৬। নারী, শিশু, এতিমদের এবং যারা দুর্বল তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহারের জন্য ইসলাম পুনঃ পুনঃ নির্দেশ দান করে। এদের জন্য ইসলামে বিশেষ ভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিধবা ও এতিম মেয়েদের জন্য উত্তরাধীকার আইন, দেনমোহর এবং বিয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন নির্দেশ পূর্বেই দান করা হয়েছে [৪ : ২-৩৫]। এখানে আরও কিছু নূতন নির্দেশ সংযোজন করা হয়েছে। ইসলামের চোখে অসহায় মেয়েদের উপরে তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহণ করা ও তাদের দেনমোহর ও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ ও মহাপাপ।

৬৩৭। দেখুন আয়াত [৪ : ৭৫] এবং টীকা নং ৫৯২।

সমাজে বিধবা ও এতিম শিশুরা অত্যন্ত অসহায়। তারা সমাজের চোখে বোঝা স্বরূপ, তাদের ঠকাবার জন্য যারা সবল, সক্ষম ও চতুর তারা তাদের মুখ ব্যাদান করে থাকে। প্রাচীন হিন্দু সমাজের বিধবাদের এতটাই বোঝা মনে করা হোত যে সতীদাহের নামে তাদের পুড়িয়ে মারা হতো। যদি কোনও সমাজ অসহায়, নির্যাতিত ও এতিম শিশুদের অধিকার রক্ষা না করতে পারে, তবে সে সমাজ সভ্য সমাজ বলে দাবী করতে পারে না। ইসলাম সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। কোনও সভ্য সমাজেই "জোড় যার মুলুক তার" এই নীতি চলতে পারে না। পৃথিবীতে ইসলামিক চিন্তাধারাই প্রথম পথ দেখালো যে, সমাজে দুর্বল, অসহায়, নির্যাতিত ও এতিমদের সম অধিকার আছে অন্যান্যদের মত। তাদের অধিকার আছে, সম্পত্তির, সামাজিক ও উন্নতি লাভ করার। এদের প্রতি ন্যায় বিচার করা আল্লাহ্‌র হুকুম।

১২৮। যদি কোন স্ত্রী তার স্বামীর নিকট থেকে নিষ্ঠুরতা অথবা পরিত্যাগের আশংকা করে, তবে তারা নিজেদের মধ্যে আপোষ-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাতে কোন দোষ নাই। এবং আপোষ-নিষ্পত্তিই শ্রেয়; যদিও মানুষের আত্মা লোভ দ্বারা প্রভাবিত হয় ৬৩৮। কিন্তু তোমরা যদি সৎ কাজ কর এবং আত্মসংযম অনুশীলন কর, তবে তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত।

৬৩৮। ইসলামে মেয়েদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বহু আইনের প্রবর্তন করেছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিবাহ সংক্রান্ত আইন। মেয়েরা অসহায় ও দুর্বল। তাদের রক্ষার জন্য তাদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য উত্তরাধীকার আইন, মোহরানা ইত্যাদির নির্দেশ দান করা হয়। বিয়ে একটি পবিত্র অঙ্গীকার এর পবিত্রতা আল্লাহ্‌র কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এই অঙ্গীকারকে অর্থের মাপকাঠিতে মাপা যায় না। তবুও সমাজে বাঁচার জন্য অর্থের বা টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে বৈকি। তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ আল্লাহ্‌র অত্যন্ত অপছন্দ। [৪ : ১২৮] আয়াতে বলা হয়েছে সেই অবস্থার কথা যখন অনিচ্ছাকৃত ভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়। যেমন স্বামী আবার বিয়ে করলেন, যদি স্ত্রী সেই কারণে স্বামীর নিকট থেকে ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করে, তবে আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে সে ক্ষেত্রে পরস্পর সমঝোতার মাধ্যমে উক্ত স্ত্রীর যাবতীয় নেয্য অধিকার পূরণ করে তাকে স্ত্রী হিসেবে রাখতে হবে। যদি এভাবেও তাদের বিবাহ টিকিয়ে রাখা যায়, তবে তাও বিবাহ বিচ্ছেদ অপেক্ষা শ্রেয়। কারণ এর দ্বারা হতভাগ্য নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিধান হয়। অর্থের লোভ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কেহ যাতে নারীর উপরে কোনও অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দেয়, সে কারণে আল্লাহ্‌ পুরুষদের আত্মসংযমের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং সেই সাথে নির্দেশ দান করা হয়েছে যে পরস্পর সমঝোতার মাধ্যমে যদিও বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মেয়েরা যাতে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।

১২৯। তোমাদের তীব্র আকাংখা থাকা সত্বেও তোমরা কখনই স্ত্রীদের সকলের সাথে [সমান] নিরপেক্ষ ও ন্যায্য হতে পারবে না। কিন্তু কোন একজন [স্ত্রী] থেকে সম্পূর্ণ [মুখ] ফিরিয়ে নিও না' যেনো সে ঝুলন্ত অবস্থায় না থাকে ৬৩৯। যদি তোমরা বন্ধুত্বমূলক সমঝোতায় আসতে পার আত্মসংযম অনুশীলন কর, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৬৩৯। এই পৃথিবীতে দাম্পত্য জীবনে সংঘাত ও অশান্তির সৃষ্টি হয় দুটো কারণে। হয় টাকা পয়সার কারণে নয়তো 'অন্য নারীর' উপস্থিতির কারণে। টাকা পয়সার সম্পর্কে পূর্বোক্ত আয়াতে নির্দেশ দান করা হয়েছে। এই আয়াতে 'অন্য নারী সম্বন্ধে' নির্দেশ দান করা হয়েছে। অবশ্য ইসলামে চার বিয়ে অনুমোদন দান করে শর্ত সাপেক্ষ, যে সব স্ত্রীদের প্রতিই সমান ব্যবহার ও ন্যায়নীতি অনুসরণ করা হবে।

১৩০। কিন্তু যদি তারা সম্মত না হয় [এবং পৃথক হয়], তবে আল্লাহ্‌ তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা সকলকে অভাবমুক্ত করবেন। তিনিই আল্লাহ্‌ যিনি সকলের তত্বাবধান করেন এবং তিনি প্রজ্ঞাময়।

১৩১। আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তু আল্লাহ্‌র অধীনে ৬৪০। তোমাদের পূর্বে যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদের এবং [হে মুসলমান] তোমাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় করবে। কিন্তু যদি তোমরা তা অস্বীকার কর তবে দেখ ! আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্‌র অধীনে, এবং আল্লাহ্‌ সকল অভাবমুক্ত এবং সকল প্রশংসার পাত্র ৬৪১।

৬৪০। "আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তু আল্লাহ্‌র অধীনে"- এই লাইনটিকে আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকে অনুধাবন করার জন্য বারে বারে ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র তিনটি বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশের পেক্ষাপটে লাইনটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমতঃ এই লাইনটিকে ব্যবহার করা হয়েছে সৃষ্টির প্রতি তার ভালোবাসা ও বিচক্ষণতা প্রকাশের জন্য। এই আয়াতে [৪ : ১৩১] বলা হয়েছে আল্লাহ্‌ অভাব মুক্ত। তাকে ভয় করলে বান্দারই লাভ। আল্লাহ্‌র কিছু লাভ নাই। দ্বিতীয় বারে এই লাইনটিকে ব্যবহার করা হয়েছে আল্লাহ্‌র কৃতিত্ব ও বিশ্বের সৃষ্টিতে স্বয়ং সম্পূর্ণতা প্রকাশের জন্য। এই আয়াত [৪ : ১৩২] দ্বারা বুঝানো হয়েছে তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন এবং সমস্ত কর্ম-বিধানে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট। আয়াত [৪ : ১৩৩-১৩৪] কে সংযুক্ত করা হয়েছে উপরের লাইনটির সাথে। উপরের লাইনটির প্রেক্ষাপটে এই আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে আল্লাহ্‌র সর্বময় ক্ষমতা প্রকাশের জন্য। তিনি ইচ্ছা করলে ব্যক্তিকে বা জাতিকে এক মূহুর্তে ধ্বংস করে সে জায়গায় নূতন ব্যক্তির বা জাতির সৃষ্টি করতে পারেন। ক্ষতি যা আমাদের, তাঁর এতে কোনও ক্ষতি নাই। তবুও তিনি বারে বারে পাপীদের অনুতাপ করার সুযোগ দেন।

৬৪১। আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব বিশ্বব্যাপী ও তিনি সার্বভৌম। তিনি কারও উপরে নির্ভরশীল নন। তিনি সকল অভাবমুক্ত। সকল কৃতিত্বের দাবীদার একমাত্র তিনিই। সুতরাং সকল প্রশংসার দাবীদার একমাত্র তিনিই। আমাদের সকল কৃতিত্ব, সকল কর্মযজ্ঞ, সকল সফলতা সবই সেই বিশ্ব স্রষ্টার দান। সুতরাং আমাদের উচিত কোনও সফলতা বা কৃতিত্বের জন্য গর্ব বা অহংকার প্রকাশ না করে সেই সর্বশক্তিমান - যার দানে এই সফলতা বা কৃতিত্ব, তারই প্রশংসা করা। এই বক্তব্যটি মুসলিম দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা কেউ যেনো মনে না করে যে এ একটি সাধারণ নৈতিক উপদেশ মাত্র। আল্লাহ্‌র এই নির্দেশ আদম সন্তানের আত্মার বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খা অর্জিত হয় আল্লাহ্‌কে প্রশংসা করার মানসিকতা থেকে। যদি আমরা আল্লাহ্‌কে ভালোবাসতে পারি, ভক্তি করতে পারি, তার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারি, তবেই শুধুমাত্র তখনই আমরা সর্বান্তকরণে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে পারবো। ভক্তি, ভালোবাসা ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জন্ম লাভ করবে আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ সর্বোপরি আল্লাহ্‌কে প্রশংসা করার ইচ্ছা যা মানব আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম। দেখুন টীকা নং ১৮।

১৩২। হ্যাঁ, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু সবই আল্লাহ্‌র অধীনে, সকল কাজের ব্যবস্থাপক হিসেবে আল্লাহ্‌-ই যথেষ্ট ৬৪২।

৬৪২। এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সংযুক্ত। আল্লাহ্‌ অভাবমুক্ত। আমাদের প্রশংসা, আমাদের সহযোগীতা, কিছুই তার প্রয়োজন নাই, কিন্তু আমাদের তাঁকে প্রয়োজন আছে। আমাদের আশা, আকাঙ্খা, সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, চাওয়া-পাওয়া সবেরই কেন্দ্রবিন্দু সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ- সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের উপরে তাঁর ক্ষমতা অপ্রতিহত। আমরা সাধারণ মানুষ দুর্বল চিত্ত। প্রতি মূহুর্তে প্রলোভনের শিকার হয়ে পাপের পথে পা দেই। কিন্তু তারপরেও সেই সর্বশক্তিমানের অসীম করুণা আমাদের ঘিরে থাকে। সব কিছুর পরেও তিনি পাপীদের সর্বোতভাবে সুযোগ দেন ইহকাল ও পরকালের মঙ্গলের জন্য, তাঁর আশ্রয়ের অঙ্গীকারে।

১৩৩। হে মানুষ ! তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের ধ্বংস করতে পারতেন এবং অন্য প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারতেন। নিশ্চয়ই তিনি ইহা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম।

১৩৪। যদি কেহ এই [পৃথিবীর] জীবনে পুরস্কার চায়, আল্লাহ্‌র নিকট ইহকাল ও পরকালের [উভয়কালের] পুরস্কার রয়েছে। তিনিই আল্লাহ্‌ যিনি [সবকিছু] শোনেন ও দেখেন ৬৪৩।

৬৪৩। পৃথিবীর জীবন সীমাবদ্ধ। আমাদের সীমাবদ্ধ পৃথিবীর জীবনে আমাদের চিন্তার দিগন্তও এই পৃথিবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমাদের চাওয়া-পাওয়া সবই এই পৃথিবীর চাওয়া ও পাওয়াকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এই দেহ ও দেহ কেন্দ্রিক জীবন শুধু পার্থিব জীবন। তাই এই পৃথিবীতে আমরা যাই-ই চাই না কেন সবই আবর্তিত হয় এই পৃথিবীর অভিজ্ঞতার আলোকে। আল্লাহ্‌ অসীম রহমত ও নেয়ামতের আঁধার। তাঁর কাছে ইহকাল ও পরকালের সব চাওয়া-পাওয়ার পরিসমাপ্তি। পরকালের সুখ ও সমৃদ্ধি আমাদের চাওয়া-পাওয়া ও ধারণারও বাইরে।

রুকু - ২০

১৩৫। হে মুমিনগণ ! আল্লাহ্‌কে সাক্ষী রেখে তোমরা ন্যায়ের জন্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাক ৬৪৪। যদিও ইহা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা, এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন হোক, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ উভয়েরই শ্রেষ্ঠ রক্ষাকারী ৬৪৫। সুতরাং তোমরা প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ে [ন্যায় বিচারে] বিরত হয়ো না; কিন্তু যদি তোমরা ন্যায়কে বিকৃত কর এবং ন্যায় বিচারকে অস্বীকার কর, অবশ্যই তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ সম্যক অবগত।

৬৪৪। আল্লাহ্‌ সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারকের প্রতীক। তাঁর বান্দাদের প্রতি নির্দেশ হচ্ছে ন্যায় বিচারে তারা যেনো অটল থাকে। আর সেটাই হবে বান্দার জন্য আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষী স্বরূপ। যা ন্যায় তাই-ই সত্য আবার যা সত্য তাই-ই ন্যায়। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জেহাদ করা। কারণ যে ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করে সে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধিরূপে সাক্ষ্য দান করে। তাই ন্যায়ে অটল থাকাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জিহাদ। আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে, ন্যায় বিচার যদি নিজ স্বার্থ বা নিজ পরিবারের স্বার্থের বিরোধী হয় তবুও তাতে বান্দার অটল থাকা, এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র নির্দেশ।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীতে ন্যায়ের যে সংজ্ঞা তা রোমান আইন থেকে আলাদা। আলাদা এই কারণে যে ইসলামের ন্যায় নীতি শুধুমাত্র বাহ্যিক ভাবে আরোপিত ন্যায় নীতি নয়। ন্যায়বোধ হচ্ছে বান্দার অন্তরের অন্তঃস্থলের মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। কারণ মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করে যে তার সকল কর্মকাণ্ড, সকল চিন্তাভাবনা, সকল নিয়ত সব কিছু আল্লাহ্‌ খোলা বই এর মত পাঠ করতে পারেন। তাঁর অগোচরে কিছুই নাই, কিছু থাকেও না। আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের সাক্ষী সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। শুধু কর্মকাণ্ড নয় অন্তরের
অন্তঃস্থলের চিন্তা-ভাবনাও তাঁর অগোচরে থাকে না। শুধু বাহ্যিক ভাবে যদি কোনও বিচার ন্যায় বিচার বলে প্রতিভাত হয়ও, বিচারকের অন্তরের নিয়ত বা চিন্তার খবর আল্লাহ্‌ জ্ঞাত। নিয়ত দ্বারাই আল্লাহ্‌ কর্মের বিচার করবেন। সুতরাং ন্যায় বিচারের সাক্ষী হতে হলে বান্দাকে সর্বাগ্রে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানতে হবে, বুঝতে হবে যে সে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক। অর্থাৎ চিন্তায় বাক্যে ও কর্মে সে হবে সৎ ও আন্তরিক এবং সর্বদা মনে রাখা যে সে সর্বশক্তিমান " আল্লাহ্‌র সাক্ষীস্বরূপ।" এখানেই ইসলামের ন্যায়নীতির সাথে গ্রীক দার্শনিক ও রোমানদের ন্যায় নীতির পার্থক্য। গ্রীক ও রোমানদের ন্যায় বিচার সরকার ও বিচারকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, স্রষ্টার কাছে কোনও দায়বদ্ধতা নাই। ইসলামে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে নির্দেশ দান করছে। সেখানে ধনী-গরীব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত কোনও ভেদাভেদ নাই। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষমতার ও গন্ডির মধ্যে ন্যায়ের নীতিতে অটল থাকবে - এই-ই আল্লাহ্‌র নির্দেশ। এটা শুধু সরকার বা বিচার বিভাগের একারই দায়িত্ব নয় বরং প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দান করা হয়েছে।

৬৪৫। "সে বিত্তবান হউক বা বিত্তহীন হউক।" পক্ষপাতিত্ব মহা অন্যায়। দেখা যায় বহু ব্যক্তি সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির পক্ষ অবলম্বন করে। সেখানে সে ন্যায়ের ধার ধারে না। কারণ তার চেতন ও অবচেতন মনে কিছু প্রাপ্তির লোভ তাকে এই অন্যায় পক্ষপাতিত্বে প্রলুব্ধ করে। আবার কিছু লোক গরীবের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করে। কারণ তারা অসহায়। আল্লাহ্‌ বলছেন পক্ষপাতিত্ব মানেই হচ্ছে অন্যায়। সে বিত্তবানই হোক বা বিত্তহীনই হোক তাতে কিছু আসে যায় না। যার যতটুকু প্রাপ্য সে ততটুকুই পাবে। কাউকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, অন্যকে সাহায্য করার নাম অন্যায় করা। আল্লাহ্‌ ধনী দরিদ্র সকলেরই সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষাকর্তা। সুতরাং এ কথা যেনো কেউ মনে না করে যে গরীবকে সাহায্য করা মনেই সৎ কাজ বা ন্যায় কাজ। মনে রাখা প্রয়োজন যে গরীবের হক্‌ এর জন্য আল্লাহ্‌ই সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকর্তা। ন্যায় এর দন্ড সবার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। "রবীনহুডের" মত ধনীদের লুণ্ঠন করে গরীবদের সাহায্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায় নয়; এ অন্যায়।

১৩৬। হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহ্‌তে, তাঁর রাসূলে, তিনি যে কিতাব তাঁর রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তাতে, এবং যে কিতাব তিনি [রাসূলের] পূর্বে প্রেরণ করেছেন তাতে ঈমান আন ৬৪৬। কেউ আল্লাহ্‌কে, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল এবং শেষ বিচারের দিনকে অস্বীকার করলে, তারা [সৎপথ থেকে] বহুদূরে পথভ্রষ্ট হবে।

৬৪৬। এখানে ঈমানের বা বিশ্বাসের একাগ্রতার কথা বলা হয়েছে। এখানে বিশ্বাস অর্থ এক আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় বিশ্বাস বা অন্যের অনুকরণে বিশ্বাস বা প্রশংসাভাজন বা সম্মানীয় ব্যক্তির অনুকরণ করে বিশ্বাস করা, এসবের সাথে সত্যিকারের অন্তরের অন্তঃস্থলের বিশ্বাসের পার্থক্য বিদ্যমান। বিশ্বাস বা ঈমান হবে একান্ত, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসরিত। বাহিরের কোনও প্রভাব ব্যতীত শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র প্রতি নিবেদিত। বিশ্বাসের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রতি নিবেদন। তারপরে বিশ্বাস রাখতে হবে তার প্রেরিত রাসূলদের প্রতি। তারপরে বিশ্বাস রাখতে হবে ফেরেশতাদের উপর। সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। তার অস্তিত্ব আমাদের সর্বঅবয়বকে ঘিরে থাকে। আমাদের দেহের রক্ত স্রোতের ধমনী থেকেও নিকটে তাঁর অবস্থান; এ বিশ্বাস সর্বদা রাখতে হবে দেখুন আয়াত [৫০ : ১৬]। পরকালে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস, বিশ্বাসের অঙ্গ। আল্লাহ্‌ আমাদের স্রষ্টা, আমাদের সর্ব অবয়বকে ঘিরে তার অবস্থান, তিনি শেষ বিচার দিবসের মালিক এই বিশ্বাস হচ্ছে সব বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু। এই বিশ্বাস থেকে উৎসারিত তার প্রেরিত নবীদের উপরে বিশ্বাস, কিতাবে বিশ্বাস, ফেরেশতাদের বিশ্বাস, পরকালে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস। কেউ যদি এর কোনটার বিশ্বাস থেকে চ্যুত হয়, তবে সে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই 'পথভ্রষ্ট'।

১৩৭। যারা ঈমান আনে এবং তারপর প্রত্যাখ্যান করে, এবং পুনরায় ঈমান আনে ও [পুনরায়] ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং [অন্তরের] অবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষমা করবেন না, এবং তাদের [সৎ] পথ প্রদর্শন করবেন না ৬৪৭।

৬৪৭। কিছু লোক ঈমান এবং কুফরীর মধ্যে দোদুল্যমান। এরা সুবিধাবাদী। সুবিধা অনুযায়ী এরা ঈমান আনে আবার অসুবিধায় পড়লে ধর্মীয় বিশ্বাস বা ঈমান ত্যাগ করে। এদের একটাই উদ্দেশ্য আর তা হচ্ছে পার্থিব উন্নতি লাভ করা। যাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহকাল, তারা কিভাবে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ পেতে পারে ? আল্লাহ্‌র ক্ষমা পেতে পারে ?

যারা এরূপ সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর - যারা আত্ম সুখ ও সুবিধার জন্য ধর্মকে পণ্য হিসাবে ব্যবহার করে, যারা পার্থিব লাভের আশায় বিশ্বাসকে জলাঞ্জলী দেয় তাদের সত্যিকার ভাবে কোনও ঈমান নাই। তারা ধর্মের নামে ভাওতাবাজি করে। তাদের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ নয়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য পার্থিব লাভ-লোকসান। এসব লোক কখনও আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করতে পারবে না। যারা পার্থিব লাভের আশায় ধর্মকে ব্যবহার করে, এই আয়াতে তাদের জন্য সতর্কবাণী করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ তাদের হেদায়েত বা তার পথে পরিচালিত করবেন না। আল্লাহ্‌ তাদেরই হেদায়েত করেন, যারা ধর্মীয় বিশ্বাসে বা ঈমানে অটল। আল্লাহ্‌র হেদায়েত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্ত্বার আমূল পরিবর্তন করে দেয়। তার সর্বসত্তা তখন আল্লাহ্‌ প্রেমে সিক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ্‌র রহমতের ধারায় সে অবগাহনে সমর্থ হয়। আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য তার সর্বসত্তাকে করে আলোকিত। আর কখনই সে সেই আলোকিত পথ ফেলে অন্ধকারের বাসিন্দা হবে না।

১৩৮। মুনাফিকদের শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।

১৩৯। হ্যাঁ, যারা মুমিনদের পরিবর্তে অবিশ্বাসীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি ওদের নিকট থেকে সম্মান আশা করে ? না, সকল সম্মানের মালিক আল্লাহ্‌ ৬৪৮।

৬৪৮। যারা মোনাফেক তারা নামে মুসলমান হলেও তারা সত্যিকারভাবে মুসলমান নয়, কারণ তারা প্রতিমূহুর্তে আল্লাহ্‌র আইনকে অস্বীকার করে। তারা সফলতা লাভের জন্য মিথ্যা, অন্যায় ও অত্যাচারের আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের এই ভন্ডতাকে যদি কেউ 'শক্তির' উৎস মনে করে অবিশ্বাসীদের আশ্রয় প্রার্থনা করে- তবে তা হবে মূর্খতার সামিল। কারণ সকল শক্তির উৎস সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। পৃথিবীতে যারা অসৎ, প্রতারক, ভন্ড, মিথ্যুক এরাই হচ্ছে আল্লাহ্‌র আইন ভঙ্গকারী - এরাই হচ্ছে অবিশ্বাসী। এদের যে সাফল্য তা পার্থিব এবং সে সাফল্য খুবই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু সময়ের বৃহত্তর পরিসরে সে সাফল্য স্থায়িত্ব লাভ করে না। অবিশ্বাসীদের শক্তি-সামর্থ্য ধনবলে প্রভাবিত হয়ে ওদের সাহায্য সহযোগীতা কামনা করা উচিত নয়।

১৪০। এবং ইতিপূর্বে তিনি কিতাবে [কোরআনে] তোমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যে ৬৪৯ যখন তোমরা আল্লাহ্‌র আয়াত প্রত্যাখ্যাত হতে এবং বিদ্রুপ করতে শুনবে, তোমরা তাদের সাথে বসে থাকবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের মত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মোনাফেক ও যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে সকলকে জাহান্নামে একত্রিত করবেন।

৬৪৯। দেখুন আয়াত [৬ : ৬৮]। যেখানে আল্লাহ্‌র বাণীকে প্রত্যাখ্যান করা হয় বা হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে হালকা ভাবে গ্রহণ করা হয়, সেখানে বিশ্বাসীরা অবস্থান করতে পারে না। আল্লাহ্‌র বাণী হচ্ছে চরম সত্য যা যুগ ও কাল অতিক্রান্ত। যদি কেউ এই সত্যকে অস্বীকার করে বা গুরুত্ব না দেয় তবে সে ব্যাপারে বিশ্বাসীদের কর্তব্য হচ্ছে আপত্তি স্বরূপ সে স্থান ত্যাগ করা। এই স্থান ত্যাগের মানসিকতায় যেনো কোনও অহংকার বোধ বা নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা না থাকে। এই স্থান ত্যাগের উদ্দেশ্য হবে অপরপক্ষকে হৃদয়ঙ্গম করানো যে তারা যা বলে বা করে তা সত্য নয়। তা আল্লাহ্‌ কর্তৃক গৃহীত নয় এবং তারই প্রতিবাদ স্বরূপ বিনয়ের সাথে বিশ্বাসীরা তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবে। এই 'সঙ্গ' ত্যাগের উদ্দেশ্য হচ্ছে অসত্য ও অন্যায় শ্রবণের পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এর ফলে যারা সত্যাশ্রয়ী, তাদের সম্মুখে আল্লাহ্‌র বাণীকে অপদস্ত করার পাপ থেকে তারা নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়।

১৪১। [এরাই তারা] যারা তোমাদের সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং [অমঙ্গলের] প্রতীক্ষা করে। যদি তোমরা, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে জয় লাভ কর তারা বলে : "আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না ?" কিন্তু যদি অবিশ্বাসীরা বিজয়ী হয়, তারা [তাদের] বলে, "আমরা কি তোমাদের জন্য সুবিধা অর্জন করি নাই ? এবং আমরা কি তোমাদের মুমিনদের বিরুদ্ধে পাহারা দিই নাই ?" কিন্তু শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্‌ আমাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করবেন। এবং আল্লাহ্‌ কখনই মুমিনদের উপরে কাফিরদের [বিজয়ের] পথ রাখবেন না ৬৫০।

৬৫০। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ মোনাফেকদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, সেই ব্যক্তি মোনাফেক যার কোনও নীতি নাই, যার কোনও আদর্শ নাই। মোনাফেকের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করা এবং জাগতিক যা পার্থিব ভাবে লাভবান হওয়া। যে কোনও সুযোগ সুবিধা যা তার পার্থিব লাভের অনুকূলে যাবে, সে রকম যে কোনও সুযোগ গ্রহণে সে সর্বদা তৎপর। এর জন্য সে কোনও ন্যায় নীতির তোয়াক্কা করে না। সে হবে সুযোগ সন্ধানী। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, যদি দুই বিপরীতমুখী, বিপরীত নীতির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে; মোনাফেকেরা এসব ক্ষেত্রে অতি সতর্কতার সাথে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করে। যাদের জয়ের সম্ভাবনা বা জয় লাভ ঘটে মোনাফেকেরা সর্বদা তাদের পক্ষ অবলম্বন করে। তারা কখনও নীতির জন্য কোনও পক্ষ অবলম্বন করবে না। কারণ তারা নীতি বিবর্জিত। পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির আদি থেকে ভালো ও মন্দের মধ্যে সর্বদা সংঘর্ষ হচ্ছে। এ সংঘর্ষ বিরামহীন। মোনাফেকদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যদি তারা দেখে 'ভালো' জয়ী হতে যাচ্ছে, সাথে সাথে তারা নিজেকে 'ভালো'-র দলে অন্তর্ভূক্ত করে ফেলে। যেখানে ক্ষমতা সেখানেই মোনাফেকদের দলভুক্ত হবার প্রবণতা দেখা যাবে। আর একটি বৈশিষ্ট্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে- তা হচ্ছে, চাটুকারিতার দ্বারা ক্ষমতাবানদের তৈলাক্ত করার প্রবণতা দেখা যাবে মোনাফেকদের মধ্যে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় মোনাফেকেরা জয়ী পক্ষ যদি "ভালো" হয় তাদের তুষ্টির জন্য বিরামহীন চাটুকারিতার আশ্রয় নেবে। আবার যখন 'মন্দ' ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন সে এই বলে তাদের দলে আশ্রয় গ্রহণ করে যে, "আমরা কি তোমাদের মুমিনদের বিরুদ্ধে পাহারা দিই নাই।" এখানে মুমিন অর্থাৎ যা ন্যায় এবং সত্য এবং ভালো অর্থাৎ যখন ন্যায় ও সত্য জয়লাভ করেছিল তখন তাদের হাত থেকে মন্দকে রক্ষা করার জন্যই তারা ন্যায়ের দলে যোগদান করে। যেনো তারা মুমিনদের বা ন্যায়বানদের অভ্যন্তরে থেকে মুমিনদের অর্থাৎ ভালোদের প্রতিহত করতে পারে ও মন্দ বা অন্যায়কারীকে রক্ষা করতে পারে। অর্থাৎ মোনাফেকদের বৈশিষ্ট্য হবে : (১) তারা হবে নীতি বিবর্জিত শুধু পার্থিব লাভই হবে তাদের একমাত্র কাম্য। (২) তাদের অবস্থান হবে সর্বদা ক্ষমতার চারিপাশে (৩) তারা হবে চাটুকার। ক্ষমতাসীনকে চাটুকারীতার দ্বারা তৈলাক্ত করার প্রবণতা থাকবে। (৪) তারা সর্বদা সুবিধামত দলত্যাগ করবে। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে মোনাফেকীর দ্বারা পার্থিব সুযোগ সুবিধা অর্জন করা যায়; তবে তা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহ্‌র দুনিয়ায় শেষ পর্যন্ত মুমিন অর্থাৎ ভালোর জয় অবশ্যাম্ভবী।

উপদেশঃ বাংলাদেশের পটভূমিতে এই আয়াতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশীদের মধ্যে মোনাফেকদের যে সব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে তার সবই বিদ্যমান। তাই জাতি হিসেবে আমাদের এত লাঞ্ছনা।

রুকু - ২১

১৪২। মোনাফেকেরা মনে করে তারা আল্লাহ্‌কে [বুদ্ধির খেলায়] পরাজিত করছে, কিন্তু তিনি [আল্লাহ্‌] তাদের পরাজিত করবেন। যখন তারা সালাতে দাঁড়ায়, তারা আন্তরিক ভাবে দাঁড়ায় না; লোক দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহ্‌কে তারা অল্পই স্মরণ করে।

১৪৩। মনের দিক থেকে [তারা] হয় বিক্ষিপ্ত দোদুল্যমান, না ইহাদের দিকে না উহাদের দিকে। আল্লাহ্‌ যাকে বিপথে ছেড়ে দেন, তুমি তার জন্য কখনও কোন [সু] পথ পাবে না ৬৫১।

৬৫১। যদি আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে 'মন্দকে' গ্রহণ করি এবং প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় গ্রহণ করি এবং মনে করি যে আমাদের প্রতারণা কেউ জানতে পারবে না। তবে তা হবে মহা মূর্খতা। সবাইকে প্রতারিত করা গেলেও আল্লাহ্‌কে প্রতারিত করা যায় না। বরং এই জুয়াচুরি ও প্রতারণার ফলে আমরা আল্লাহ্‌র রহমত থেকে বঞ্চিত হই। কারণ মোনাফেকের সমস্ত ক্রিয়া কর্মই লোক দেখানো। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র রহমত বঞ্চিত সে 'পথভ্রষ্ট'। সৎপথের সন্ধান লাভ করা তার পক্ষে অসম্ভব। "আল্লাহ্‌ যাহাকে বিপথে ছেড়ে দেন," - এ কথাটি অত্যন্ত গুঢ় অর্থ সম্পন্ন। মোনাফেকীর ফলে, ইচ্ছাকৃতভাবে 'মন্দ'-কে বেছে নেবার ফলে, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার ফলে আত্মার স্বচ্ছতা হ্রাস পায়। আল্লাহ্‌র নূরকে আত্মায় ধারণ করার ক্ষমতা লোপ পায়। ফলে আত্মা তার সহজাত প্রবৃত্তি (instinct) হারায়। পূণ্যবান আত্মায় থাকে ঈমানের আলো। সে হয় নীতিবান, নির্ভিক, সত্যাশ্রয়ী, স্থিরচিত্ত, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দূরদর্শী ও অটল। অপরপক্ষে মোনফেকেরা হয় অস্থির, ভীতু- অদূরদর্শী। তারা সর্বদা দোটানায় থাকে। এই অবস্থা তাদের চরিত্রেকে অস্থির, অদূরদর্শী ও ভীতু করে তোলে। তারা অস্থির থাকে, কারণ তাদের কোনও নীতি না থাকার কারণে তাদের চিন্তাধারা থাকে দোদুল্যমান। কারণ তারা সর্বদা সুবিধাজনক অবস্থানের খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তারা থাকে ভীতু কারণ তাদের প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে তাদের আত্মা সর্বদা থাকে শঙ্কিত। ফলে আত্মার যা স্বাভাবিক প্রকাশ তা হয় বিঘ্নিত। ফলে চিন্তাধারার দিক থেকে তারা হয় অপূর্ণ এবং পঙ্গু।

১৪৪। হে মুমিনগণ ! বিশ্বাসীদের পরিবর্তে অবিশ্বাসীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি নিজেদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ আল্লাহ্‌র নিকট প্রদান করতে চাও ?

১৪৫। মোনাফেকরা জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে অবস্থান করবে। তুমি তাদের জন্য কোনও সাহায্যকারী পাবে না;

১৪৬। ব্যতিক্রম হবে তারা যারা [মোনাফেকীর জন্য] অনুতাপ করে, নিজেদের [জীবনধারা] সংশোধন করে, আল্লাহ্‌কে দৃঢ়ভাবে ধারণ এবং আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে তাদের ধর্মে একনিষ্ঠ থাকে। যদি তা করে, তবে তাদের [চিহ্নিত] করা হবে মুমিনদের সাথে ৬৫২। এবং শীঘ্রই আল্লাহ্‌ মুমিনদের মহামূল্যবান পুরষ্কার দ্বারা ভূষিত করবেন।

৬৫২। আল্লাহ্‌ অসীম করুণার আঁধার। তাই মোনাফেকদের পথভ্রষ্ট আত্মার জন্যও এই আয়াতে রয়েছে সুসংবাদ। মোনাফেকেরা নিম্নোক্ত চারটি শর্ত সাপেক্ষে আল্লাহ্‌র ক্ষমা পেতে পারে। (১) যদি তারা তওবা বা অনুতাপ করে। কারণ আন্তরিক অনুতাপ আত্মাকে পরিশুদ্ধ ও নির্মল করে। (২) তারা তাদের চরিত্রকে সংশোধন করবে, ফলে তাদের বাহ্যিক জীবন যাত্রা প্রণালী হবে নির্মল। (৩) আল্লাহ্‌র প্রতি আত্মনিবেদনে তারা হবে একাগ্র। ফলে তাদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বাসের দৃঢ়তা হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তি স্বরূপ। আল্লাহ্‌র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে তারা পৃথিবীর লোভ-লালসা, অন্যায়, অসত্য থেকে রক্ষা পেতে পারে। কারণ এই বিশ্বাসই তাদের 'ধর্মে একনিষ্ট' রাখে। (৪) উপরিউক্ত গুণাবলীর কারণে তারা পূণ্যাত্মাদের গোত্রভূক্ত হওয়ার মর্যাদা লাভ করবে, এই আশ্বাস আল্লাহ্‌ দিয়েছেন এই আয়াতে।

১৪৭। যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান আন, তবে তোমাদের শাস্তি দানে আল্লাহ্‌র কি লাভ ? অধিকন্তু [একমাত্র] আল্লাহ্‌-ই [সকল ভালো] সনাক্ত করতে পারেন এবং সকল কিছু জানেন ৬৫৩।

৬৫৩। আমাদের দেশে (বাংলাদেশে) যারা ধর্মীয় ব্যাপারে নেতার দায়িত্ব পালন করে থাকেন ও উপদেশ দিয়ে থাকেন, তারা সর্বদা আল্লাহ্‌কে কঠোর শাস্তি দাতারূপে উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর সৃষ্টিকে তাঁর ভালোবাসা ও করুণা দ্বারা পরিবৃত করে রেখেছেন। তিনি তো আমাদের শাস্তি দান করতে চান না। তার ভালোবাসার ও করুণার ফল্গুধারা সর্বদা আমাদের সঞ্জিবীত করার জন্য ব্যাকুল। তিনি সর্বজ্ঞ আমাদের সামান্য ভালোও তাঁর দৃষ্টি-গোচর হয়। আমাদের সেই সামান্য 'ভালো'কেও আল্লাহ্‌ পুরস্কৃত করেন।

ষষ্ঠ পারা

১৪৮। প্রকাশ্যভাবে মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ্‌ পছন্দ করেন না, ব্যতিক্রম হবে [শুধু] যেখানে অন্যায় করা হয় ৬৫৪। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সব কিছু শোনেন এবং সবকিছু জানেন।

৬৫৪। মন্দ কথা আল্লাহ্‌ পছন্দ করেন না। মন্দ কথার প্রচার বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। (১) শ্রোতাদের মধ্যে রোমাঞ্চ বা উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মন্দ কথার প্রচারণা হতে পারে। যেমনটি দেখা যায়, সিনেমাতে অপরাধীদের কার্যকলাপকে মহিমান্বিত করা হয়, ফলে তরুণ বা যুব সমাজের মাঝে তাদের অনুকরণ করার প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়- যেমনটি ঘটেছে আমাদের বাংলাদেশীদের সমাজে। দূরদর্শনের মাধ্যমে বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আমাদের সামাজিক জীবনকে কলুষিত করে ফেলছে। (২) পরচর্চার মাধ্যমে মন্দ কথার চর্চা হয়, কারণ এর মাধ্যমে যে প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয় তা অত্যন্ত মন্দ এবং গর্হিত বিষয়বস্তু, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর। (৩) উদ্দেশ্য মূলকভাবে পরের কুৎসা গাওয়া যা মন্দ কথার প্রচারণা। এই কুৎসার ফলে ব্যক্তির সম্মানের হানি হয়, তার অনুভূতিতে আঘাত লাঘে। (৪) আর এক ধরণের তিরষ্কার হতে পারে যা হবে প্রকাশ্যে এবং হবে ব্যক্তির চরিত্রের সংশোধনের জন্য। (১), (২) এবং (৩) এই তিন প্রক্রিয়ার কথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। (৪) এর বেলায় এটা প্রযোজ্য হবে তখনই যখন কারও জুলুমবাজের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার থাকে। তিনি অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন, জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন। তবে তা হতে হবে প্রকাশ্যে যেনো সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়। অথবা (৪) এর বেলায় এটাও হতে পারে যে যিনি বক্তব্য রাখছেন তার তিরষ্কার করার অধিকার নাই, কিন্তু অত্যাচারিতের স্বার্থে তিনি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে পারেন। (৪) এর বেলায় সম্পূর্ণ নির্ভর করবে নিয়তের উপরে। ন্যায়ের স্বার্থে বা অন্যায়ের প্রতিবাদে, জুলুমবাজের বিরুদ্ধে কথা বলা বা এর প্রতিবাদ করা আল্লাহ্‌র হুকুম। যারা অত্যাচারিত বা শোষিত বা অবদমিত তাদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে প্রতিবাদ করার। (৪) এ এদের কথা বলা হয়েছে; এবং এদের সাহায্যে যারা এগিয়ে আসেন তাদের কথাও বলা হয়েছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে মজলুম ব্যক্তি যদি অত্যাচারীর অন্যায় অত্যাচারের কাহিনী লোকের কাছে প্রকাশ করে বা আদালাতে অভিযোগ, ফরিয়াদ জানায়, তবে তা গীবতের পর্যায়ে পড়ে না; এবং এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যারা শরীক হয় তারাও আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য। তাদের বিচার হবে তাদের কর্মের নিয়ত দ্বারা। আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ।

১৪৯। তোমরা সৎ কাজ প্রকাশ কর, অথবা গোপন কর, কিংবা মন্দকে ক্ষমা করে দিলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ [পাপ] মোচন করে দেবেন এবং তিনি [মূল্যমান বিচারের] ক্ষমতা রাখেন।

১৫০। যারা আল্লাহ্‌কে এবং তাঁর রাসূলদের অস্বীকার করে, এবং [যারা] আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের মধ্যে তারতম্য করতে চায় [আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান এনে এবং রাসূলদের অবিশ্বাস করে], বলে, "আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি।" এবং [যারা] মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায় ৬৫৬;-

৬৫৬। আল্লাহ্‌র প্রতি অবিশ্বাসকে নানাভাবে ব্যক্ত করা যায়। এখানে তিনটি উপায়ের বর্ণনা করা হয়েছে : (১) আল্লাহ্‌ ও রাসূলকে অস্বীকার করা; (২) আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে সে বিশ্বাস তাদের নিজস্ব জাতিগত অহংকারের উপর ভিত্তি করে গঠিত। কারণ তারা আল্লাহ্‌তে বিশ্বাস করে, কিন্তু তার প্রেরিত শেষ নবীকে বিশ্বাস করে না। তাদের বিশ্বাস তাদের গোষ্ঠি ব্যতীত অন্য কোথাও আল্লাহ্‌র দূত প্রেরিত হতে পারে না। তাদের এই আংশিক বিশ্বাস আল্লাহ্‌র প্রতি অবিশ্বাসেরই অন্য একরূপ। তারা " আল্লাহ্‌র রাসূলে ঈমানের ব্যাপারে তারতম্য করতে চায়।" (৩) আর এক দল আছে যারা নামমাত্র আল্লাহ্‌ বিশ্বাসী এরা সুবিধাবাদী। এই তিনদলই অবিশ্বাসীর পর্যায়ে পড়ে।

১৫১। প্রকৃত পক্ষে এরাও [সম পরিমাণ] অবিশ্বাসী। এবং আমরা অবিশ্বাসীদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।

১৫২। যারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান আনে এবং রাসূলদের মধ্যে [ঈমানের ব্যাপারে] কোনও তারতম্য করে না। শীঘ্রই আমি তাদের [প্রাপ্য] পুরস্কার প্রদান করবো। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

রুকু - ২২

১৫৩। কিতাবীগণ তোমাকে তাদের জন্য আকাশ থেকে কিতাব অবতীর্ণ করতে বলে। প্রকৃত পক্ষে তারা মুসার নিকট থেকে এর চেয়েও বড় [অলৌকিক] ঘটনার দাবী করেছিলো। তারা বলেছিলো, "আমাদের প্রকাশ্যে আল্লাহ্‌কে দেখাও ৬৫৭।" তাদের অসঙ্গত আচরণের জন্য তারা বজ্রাহত হয়েছিলো। তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও তারা গো-বৎসের পূঁজা করেছিলো। এর পরও আমি তাদের ক্ষমা করে দিই। এবং মুসাকে কর্তৃত্বের স্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করেছিলাম।

৬৫৭। দেখুন [২ : ৫৫] আয়াত। বজ্র ও বিদ্যুৎ তাদের বজ্রাহত করেছিল কারণ তারা এতটাই উদ্ধত ছিল যে তারা স্বচক্ষে মুখোমুখি আল্লাহ্‌কে দেখতে চেয়েছিল। আয়াত [২ : ৫১]-তে এবং টিকা ৬৬ তে দ্রষ্টব্য, যে তারা কিভাবে আল্লাহ্‌র পরিবর্তে সোনার তৈরী বাছুরকে পূঁজা করতো।

উপদেশঃ
এই আয়াতে আল্লাহ্‌ আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে যারা যুক্তিবাদী তারা আধ্যাত্মিক জীবনকেও পার্থিব দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করতে চায়। যেমন আজকের যুগে অনেকে বিজ্ঞান যা বলে তার বাইরে আর কিছুরই অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। যেমন ইহুদীরা স্বচক্ষে দেখা ব্যতীত ' আল্লাহ্‌র' অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। এ সব মূর্খ লোকেরা জানে না যে আল্লাহ্‌ সময় ও কাল ও স্থানের অনেক উর্ধ্বে।

১৫৪। এবং তাদের অঙ্গীকারের জন্য আমি [সুউচ্চ তুর] পর্বতকে ৬৫৮ তাদের উর্ধ্বে স্থাপন করেছিলাম। এবং [অন্য উপলক্ষে] আমি বলেছিলাম, "বিনয়ের সাথে এই দ্বার দিয়ে প্রবশে কর।' এবং [পুনরায়] আমি তাদের আদেশ দিয়েছিলাম, "সাবাতের ব্যাপারে সীমালংঘন করো না।" এবং আমি তাদের নিকট থেকে আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম।

৬৫৮। এই আয়াতে ইহুদীদের তিনটি চুক্তির কথা পুনঃরালোচনা করা হয়েছে যা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। (১) সিনাই পর্বতের নীচে ইহুদীরা আল্লাহ্‌র সাথে বিশ্বাসের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল দেখুন [২ : ৬৩] আয়াতে। (২) তাদের হুকুম দেওয়া হয়েছিল যে বিনয়ের মাধ্যমে শহরে প্রবেশ করতে, পরিবর্তে তারা উদ্ধত্য প্রকাশ করে, দেখুন আয়াত [২ : ৫৮]। (৩) তারা সাবাত দিনকে লঙ্ঘন করে; দেখুন আয়াত [২ : ৬৫]।

১৫৫। তারা স্বর্গীয় অভিশাপগ্রস্থ হয়েছিলো [কারণ তারা দায়ী ছিলো] ৬৫৯ তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য; আল্লাহ্‌র আয়াতকে অস্বীকার করার জন্য; এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা ৬৬০ করার জন্য। তারা বলে, "আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত ৬৬১ [আল্লাহ্‌র বাণী দ্বারা, আর আমাদের প্রয়োজন নাই]" - শুধু তাই নয়, তাদের এই [অধার্মিকের ন্যায়] উক্তির জন্য আল্লাহ্‌ তাদের হৃদয়কে মোহর করে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই ঈমান আনবে।

৬৫৯। আয়াত ১৫৫-১৬১-তে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ইহুদীদের অন্যায় আচরণ সম্বন্ধে।

৬৬০। দেখুন [৩ : ২১] আয়াত এবং টীকা নং ৩৬৩ এবং ৩৬৪।

৬৬১। দেখুন [২ : ৮৮] আয়াত এবং টীকা নং ৯২। আয়াত [৪ : ১৫৫]-এ ধারাবাহিক ভাবে ইহুদীদের অন্যায় কাজগুলির বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছেঃ (১) তারা আল্লাহ্‌র সাথে যে চুক্তি করেছিল তা লঙ্ঘন করে অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। (২) তারা আল্লাহ্‌ প্রদত্ত পথ নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করে, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কিতাব বা আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। (৩) নবীদিগকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। এখানে তাদের অপরাধ দ্বিবিধ, প্রথমতঃ হত্যার অপরাধ, দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ্‌র বাণীকে স্তদ্ধ করার জন্য হত্যা করা অর্থাৎ আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল মনে না করে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করার দরুণ যে পাপ তা আল্লাহ্‌কে অস্বীকার করারই অন্যরূপ। "আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত" - এ কথাটির দ্বারা তারা বুঝাতে চেয়েছে যে হযরত মুসার বাণী ব্যতীত আর কারও অর্থাৎ হযরত মুহম্মদের (সাঃ) নিকট প্রেরিত আল্লাহ্‌র বাণী গ্রহণে তারা অসমর্থ কারণ তাদের হৃদয় তাদের ধর্মগ্রন্থের বাণী দ্বারা আচ্ছাদিত। এটা আল্লাহ্‌কেই অস্বীকার করা। আয়াত [৪ : ১৫৬] থেকে ইহুদীদের কৃত আর এক ধরণের অন্যায়ের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলি হোল- (১) তারা তাদের ঈমান বা বিশ্বাসকে ত্যাগ করেছিল অর্থাৎ তারা 'কুফরী' করেছিল। (২) তারা পবিত্র রমণী মরিয়ম এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ উত্থাপন করেছিল। হযরত মরিয়মকে আল্লাহ্‌ পূত পবিত্র করেছিলেন কারণ তিনি হবেন হযরত ঈসার মাতা। (৩) তারা হযরত ঈসাকে হত্যার জন্য গর্ব প্রকাশ করেছিল। আসলে এই হত্যাটি পুরোপুরিই ছিল তাদের দৃষ্টি বিভ্রম [৪ : ১৫৭]। (৪) তারা আল্লাহ্‌র পথে বাঁধার সৃষ্টি করতো [৪ : ১৬০]। এবং (৫) তারা সুদ ও জুয়াচুরির মাধ্যমে মানুষের উপরে অত্যাচার করতো।

১৫৬। [তারা অভিশপ্ত হয়েছিলো] ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য এবং মারইয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর মিথ্যা অপবাদের জন্য, ৬৬২-

৬৬২। হযরত মরিয়মের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছিল যে তিনি দুঃশ্চরিত্রা। দেখুন [১৯ : ২৭-২৮]। যে কোনও মহিলার সম্পর্কেই চরিত্রহীনার অপবাদ মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতার পরিচয়। সেখানে মেরীর ন্যায় পূত পবিত্র চরিত্রের নারী যিনি আল্লাহ্‌ কর্তৃক মনোনীতা, হযরত ঈসার (আঃ) মাতারূপে, তার বিরুদ্ধে উপরের মিথ্যা অপবাদ, আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকেই অস্বীকার করার সামিল। এই ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত কঠোর। ইসলামে নারীর মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। যদি কেউ কোনও নারী সম্পর্কে অবমাননাকর উক্তি করে বা অপবাদ দেয়, তবে তাকে তার যুক্তির পক্ষে চার জন স্বাক্ষী হাজির করতে হবে, অন্যথায় অভিযুক্তকারীকে ৮০ (আশিটি) বেত্রাঘাত করা হবে এবং চির জীবনের জন্য তাকে কোনও ব্যাপারেই সাক্ষী দেওয়ার অনুপযুক্ত বলে ঘোষণা করা হবে দেখুন [২৪ : ৪]।

১৫৭। আর, "আমরা মারইয়ামের পুত্র, আল্লাহ্‌র রাসূল যীশু খৃষ্টকে হত্যা করেছি" তাহাদের এই উক্তির জন্য। কিন্তু তারা তাকে হত্যাও করে নাই. ক্রুশবিদ্ধও করে নাই ৬৬৩। কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিলো। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিলো, তারা ছিলো সন্দেহে পরিপূর্ণ। এই সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন [নিশ্চিত] জ্ঞান ছিলো না। এটা নিশ্চিত যে তারা তাঁকে হত্যা করে নাই।

৬৬৩। হযরত ঈসার (আঃ) জন্ম ও মৃত্যু উভয়ই অলৌকিক রহস্যে আবৃত। শুধু জন্ম ও মৃত্যু-ই নয়. তার পুরোটা জীবনই অলৌকিক রহস্যাবৃত। গোঁড়া খৃষ্টানদের প্রধান দাবী হচ্ছে, হযরত ঈসাকে ক্রুশে হত্যা করার পরে তাঁকে সমাহিত করা হয় এবং সমাহিতের তৃতীয় দিনে তাঁর পুনরুত্থান ঘটে। এই পুনরুত্থান ঘটে স্ব-শরীরে এমন কি তাঁর যে শারীরিক ক্ষত তাও ছিল দৃশ্যমান। তিনি সেই অবস্থায় হাঁটাচলা করেন শিষ্যদের সাথে কথা বলেন এবং খাবার গ্রহণ করেন, এবং শেষ পর্যন্ত স্ব-শরীরে স্বর্গে নীত হন। খৃষ্টানদের দাবী অনুযায়ী পৃথিবীর পাপ হযরত ঈসা (আঃ) নিজ অঙ্গে ধারণ করে নিজ রক্তের দ্বারা তার ঋণ শোধ করেছেন। এখানেই খৃষ্টান ধর্মে, পৌরহিত্য বা পাপঙ্খলনের জন্য মাধ্যম বা যাজক শ্রেণীর প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত স্বচ্ছ। তারা কোনও পৌরহিত্যে বা পাপস্খলনের জন্য কোনও মাধ্যমের উপস্থিতিতে বিশ্বাসী নয়। ইসলাম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বের প্রতি বিশ্বাসী। সরাসরি আল্লাহ্‌র কাছে স্ব-স্ব পাপস্খলনের জন্য প্রত্যেকের প্রতি আছে নির্দেশ- কেউ কারও পাপের বা কর্মফলের অংশ গ্রহণ করবে না।

খৃষ্টানদের বিভিন্ন গোত্রের খৃষ্টের মৃত্যু সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ আছে। কিছু কিছু পুরানো গোত্র বিশ্বাস করতো যে খৃষ্ট ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে মারা যান নাই। যেমন- Basilidans-রা বিশ্বাস করতো ক্রুশে যীশুর মৃত্যু ঘটে নাই। মৃত্যু ঘটেছিল তার পরিবর্তে অন্য কোন ব্যক্তির। Docetae-রা বিশ্বাস করতো যে যীশুর (আঃ) সত্যিকার অর্থে কোনও পার্থিব শরীর ছিল না। যা দৃশ্যতঃ ছিল তা হচ্ছে অলীক বা মায়া। সুতরাং যা ক্রুশ বিদ্ধ বলে ধারণা করা হয়, তা হচ্ছে দৃষ্টি বিভ্রম; তা বাস্তব সত্য নয়। Marcionite Gospel (১৩৮ খৃস্টাব্দে) যীশুর জন্ম বৃত্তান্তকেই অস্বীকার করে। তারা বলে যীশু মানুষের মূর্তিতে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। Gospel of St Barnabas যীশুর পরিবর্তে অন্যজনকে ক্রুশবিদ্ধ করার মতবাদকে সমর্থন করে। কোরানের বক্তব্য অত্যন্ত স্বচ্ছ। যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় নাই, বা কোনও ইহুদী তাঁকে হত্যা করে নাই। এসবই ছিল শত্রুদের দৃষ্টিভ্রম, সন্দেহ এবং অনুমান। কোরানে স্পষ্ট বলা হয়েছে তাঁকে আল্লাহ্‌ স্ব-শরীরে তুলে নেন। [দেখুন পরের আয়াত এবং এর টিকাতে]।

১৫৮। বস্তুতঃ আল্লাহ্‌ তাঁকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন। এবং আল্লাহ্‌ মহা পরাক্রশশালী, প্রজ্ঞাময় ৬৬৪।

৬৬৪। এই আয়াতের ব্যাখ্যা দানে সমস্ত তফসীরকারগণ একমত নন। এই আয়াতের বাণী হচ্ছে, "তারা তাকে হত্যা করে নাই। আল্লাহ্‌ তাঁকে তার নিকট তুলে নিয়েছেন।" কিছু কিছু খৃষ্টান স্কুল মুসলিমদের মত বিশ্বাস করে যে সাধারণ মানুষের মত যীশুর মৃত্যু ঘটে নাই। তিনি এখন স্বর্গে স্ব-শরীরে বাস করেন।

১৫৯। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবেই ৬৬৫। এবং শেষ বিচারের দিনে সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে ৬৬৬।

৬৬৫। "তার মৃত্যুর পূর্বে।" এই লাইনটির সঠিক অর্থ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সকলেই একমত নন। কিছু কিছু ব্যাখ্যাদানকারীর মতে "তার" বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে যীশুখৃষ্টের পরিবর্তে। তাদের মতে যীশুখৃষ্ট এখনও স্ব-শরীরে জীবিত- এবং রোজ কেয়ামতের পূর্বে ইমাম মেহেদীরূপে তাঁর পুনঃ আবির্ভাভ ঘটবে পৃথিবীকে পাপ থেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। সমস্ত পৃথিবীকে ঈমানে দীক্ষিত করার পরে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। সেটাই হবে তাঁর আসল মৃত্যু। অর্থাৎ তাঁর আসল মৃত্যুর পূর্বে বিশ্ববাসী ঈমানে বিশ্বাসীতে পরিণত হবে। অপরদল মনে করেন যে, 'তার' বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে কিতাবধারীদের পরিবর্তে। অর্থাৎ যারা কিতাবধারী, তারা মৃত্যুর পূর্বে যীশুখৃষ্ট বা হযরত ঈসাকে বিশ্বাস করবেই। এখানে আরবী শব্দ 'La-yu minanna' যার বাংলা তর্জমা করা হয়েছে বিশ্বাস করবেই। একথাটির গুঢ় অর্থ এই হতে পারে যে এই বিশ্বাস করাটা প্রত্যেকের কর্তব্য।

৬৬৬। দেখুন আয়াত [৪ : ৪১]।

১৬০। ভালো এবং স্বাস্থ্যকর [খাবার] যা ইহুদীদের জন্য বৈধ ছিলো; তাদের অন্যায়পরায়ণতার জন্য এবং আল্লাহ্‌র পথে অনেককে বাঁধা দেয়ার জন্য তা অবৈধ করেছি ৬৬৭;-

৬৬৭। দেখুন আয়াত [৬ : ১৪৬]। খাদ্যের ব্যাপারে ইহুদীদের নিয়ম কানুন অত্যন্ত কঠোর। তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে উটের মাংস, খরগোসের মাংস, গরু, ছাগল ও ভেড়ার চর্বি।


১৬১। এবং সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ থাকা সত্বেও তারা তা গ্রহণ করার জন্য এবং অন্যায়ভাবে মানুষের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য। তাদের মধ্যে যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের জন্য নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।

১৬২। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা এবং মুমিনগণ, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, এবং [বিশেষ ভাবে] যারা নিয়মত সালাত কায়েম করে, এবং যাকাত দেয়, এবং আল্লাহ্‌ ও পরকালে বিশ্বাস করে; তাদের আমি শীঘ্রই মহা পুরস্কারে ভূষিত করবই।

১৬৩। আমি তো তোমর প্রতি "ওহী" প্রেরণ করেছি, যেমন আমি করেছিলাম নূহ্‌ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের ৬৬৮ প্রতি। আমি "ওহী" প্রেরণ করেছিলাম ইব্রাহীম, ৬৬৯ ইসমাঈল, ঈসাহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরগণ এবং ঈসা, আইউব, ইউনুস, হারুণ ও সুলাইমানের প্রতি। এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছিলাম।

৬৬৮। এই আয়াতের শুরু হয়েছে একটা সাধারণ ভাষণের মাধ্যমে। এই ভাষণে বলা হয়েছে যে, সমস্ত আল্লাহ্‌র দূতেরা আল্লাহ্‌র তরফ থেকে প্রত্যাদেশ বা 'ওহী' প্রাপ্ত। এর পরেই উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের নবী হযরত মুহম্মদের কথা যাকে আল্লাহ্‌ অন্যান্য নবীদের মতই প্রত্যাদেশ বা 'ওহী' প্রেরণ করেন। কারণ আল্লাহ্‌র বাণী বা প্রত্যাদেশ হচ্ছে চিরন্তন, তা যুগ ও কাল অতিক্রান্ত এবং এই বাণীর বক্তব্যও যুগ ও কাল অতিক্রম করে একই রয়ে গেছে। এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে যে, এখানে বলা হয়েছে প্রত্যাদেশ বা 'ওহী' - 'বই' বলা হয় নাই। প্রত্যেক জাতির জন্য আল্লাহ্‌ তাঁর দূত প্রেরণ করেছেন [১০ : ৪৭] আয়াত। কোরান শরীফে তাঁদের কারও কারও কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আবার অনেকের কথাই উল্লেখ করা হয় নাই [৪ : ১৬৪]।

৬৬৯। দেখুন [২ : ১৩৬] এবং [৩ : ৮৪]। এই আয়াতে নবীদের তালিকা পেশ করা হয়েছে, তাঁদেরকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। (১) [২ : ১৩৬] আয়াতে এবং এর টিকাতে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ঠিক সেই একই ভাবে প্রথম শ্রেণীতে হযরত ইব্রাহীমের পরিবারকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে দেখুন আয়াত [৩ : ৮৪] (২) দ্বিতীয় শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে হযরত ঈসা (আঃ), হযরত আইউব, হযরত ইউনুস যাদেরকে ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়ের প্রতীক স্বরূপ কল্পনা করা হয়। (৩) তৃতীয় শ্রেণীতে রয়েছে ধর্মযাজক হারুন, রাজা সলেমান। এরা প্রত্যেকেই পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাসে মহৎ ব্যক্তিত্ব। হারুন ছিলেন হযরত মুসার অনুগত, সেইভাবে রাজা সোলাইমান ছিলেন হযরত দাউদের অনুগত। হযরত দাউদ তার প্রার্থনা সঙ্গীদের জন্য স্বতন্ত্র ও ভাস্বর। তাঁর কিছু কিছু প্রার্থনা সঙ্গীত (Paslms) এখনও বিদ্যমান। যদিও বর্তমানে যে সব প্রার্থনা সঙ্গীত (Paslms) বিদ্যমান সেগুলি অবশ্যই দাউদ নবীর রচনা নয়, অনেক পার্থক্য থাকা সত্বেও এগুলির মধ্যে যে ভাব, আন্তরিকতা ও আল্লাহ্‌র প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ করে তা সত্যিই তুলনাহীন।
১৬৪। অনেক রাসূলের কাহিনী পূর্বে আমি তোমাকে বলেছি, অনেক রাসূলের কথা বলা হয় নাই; - এবং মুসার সাথে আল্লাহ্‌ সরাসরি কথা বলেছেন ৬৭০।

৬৭০। আল্লাহ্‌ সিনাই পর্বতে হযরত মুসার সাথে কথা বলেন। মুসলিম ধর্মে এই কারণে হযরত মুসার অপর নাম "Kalim-Ullah" বা যার সাথে আল্লাহ্‌ কথা বলেছেন।

১৬৫। রাসূলগণ সুসংবাদ ও সাবধান বাণী বহনকারী, যেনো মানুষ আত্মপক্ষ সমর্থনে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে কৈফিয়ত না দিতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। ৬৭১

৬৭১। প্রত্যেক নবী ও রাসূল আল্লাহ্‌র মহত্ব ও দয়ার কথা ঘোষণা করেছেন তাদের জন্য, যারা কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। যারা ঈমানে অবিশ্বাসী এবং অন্যায়কারী তাঁদের জন্য রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে এসেছে সতর্কবাণী। তাঁদের প্রচারিত সুসংবাদ (মোমেন বান্দাদের জন্য) এবং সতর্কবাণী (পাপীদের জন্য) সমভাবে প্রচারিত। এ কথা যেন কেউ না বলতে পারে যে তারা তাদের অন্যায় কর্মের প্রতিফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না।

১৬৬। অধিকন্তু [হে মুহম্মদ] তোমার প্রতি যা [কোরআন] অবতীর্ণ করা হয়েছে আল্লাহ্‌ তার সাক্ষী। তিনি তা অবতীর্ণ করেছেন নিজ জ্ঞানে এবং ফেরেশতাগণ সাক্ষী দেয়। এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্‌-ই যথেষ্ট ৬৭২।

৬৭২। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ রাসূলদের অন্তরে অর্পিত হয়। অন্তরে তার প্রকাশ ঘটে বোধদয় এর মাধ্যমে - অন্তর হয় আলোকিত, চেতনা হয় সমৃদ্ধ। এর কোনও ভাষা নাই। মানুষের বোধগম্যতার জন্য তাকে প্রকাশ করা হয় ভাষার মাধ্যমে। যার মাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়, তার ব্যক্তিত্ব চরিত্রের সাথে তা করা হয় সামঞ্জস্যপূর্ণ - কিন্তু সমস্ত জ্ঞানের কেন্দ্র বিন্দু পরমজ্ঞানী আল্লাহ্‌। তাঁর কাছ থেকেই সবকিছু উৎসারিত।

১৬৭। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং [মানুষকে] আল্লাহ্‌র রাস্তায় বাঁধা দেয়, তারা [সুপথ] থেকে বহু-বহু দূরে পথভ্রষ্ট।

১৬৮। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং পাপ কাজ করে, আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষমা করবেন না এবং তাদের কোন [সু] পথও দেখাবেন না;-

১৬৯। জাহান্নামের পথ ব্যতীত। সেখানে তারা চিরদিন বাস করবে এবং আল্লাহ্‌র জন্য এটা [করা] সহজ ৬৭৩।

৬৭৩। " আল্লাহ্‌র পক্ষে সহজ।" এই লাইনটির অর্থ এই নয় যে পরম করুণার আঁধার আল্লাহ্‌ তাঁরই সৃষ্ট জীবকে শাস্তি দান করে আনন্দ লাভ করেন। ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে এর বিপরীত। আয়াত [৪ : ১৪৭] এবং টীকা ৬৫৩-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে আমাদের অন্তরের সামান্যতম ভালো এবং সুন্দরও আল্লাহ্‌র দৃষ্টিগোচর হয়; আল্লাহ্‌ তাকে পুরস্কৃত করেন। এই আয়াতে আমাদের বলা হচ্ছে যে আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান- ক্ষমতা এবং জ্ঞানে। যদি কেউ নির্বোধের মত আল্লাহ্‌র শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ধারণা করে যে বিদ্রোহের শাস্তি তারা এড়াতে সক্ষম তবে তারা নির্বোধ। আল্লাহ্‌র পক্ষে শাস্তি দান অত্যন্ত সহজ। উপরের আয়াতটি এই মনোভাবের প্রকাশ স্বরূপ বলা হয়েছে " আল্লাহ্‌র জন্য এটা করা সহজ।"

১৭০। হে মানব সম্প্রদায় ! রাসূল আল্লাহ্‌র নিকট থেকে সত্য এনেছে। সুতরাং তোমরা তাকে বিশ্বাস কর। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ ৬৭৪। কিন্তু তোমরা যদি ঈমানকে প্রত্যাখ্যান কর; আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব আল্লাহ্‌রই এবং আল্লাহ্‌ সব জানেন এবং প্রজ্ঞাময়।

৬৭৪। যুগে যুগে নবী ও রাসূলদের প্রেরণ করে আল্লাহ্‌ মানুষকে হেদায়েত করতে চেয়েছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য। এতে আল্লাহ্‌র কোনও লাভ নাই। তিনি সকল অভাবমুক্ত। সমস্ত বিশ্ব চরাচর তারই প্রশংসায় আপ্লুত।

১৭১। হে কিতাবীগণ ! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না ৬৭৫। আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত সামান্যমাত্র [অন্য] কিছু বলো না। মারইয়ামের পুত্র যীশু খৃষ্ট আল্লাহ্‌র রাসূল [ব্যতীত আর কিছু নয়], এবং তাঁর [আল্লাহ্‌র] বাণী [হও] যা তিনি মারইয়ামকে প্রদান করেছিলেন এবং তিনি আত্মার [রূহ] সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। বলো না, "তিন" [ট্রিনিটি]। নিবৃত্ত হও ৬৭৬। ইহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ এক ও অদ্বিতীয়।

৬৭৫। যে কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি বা আধিক্য আল্লাহ্‌ পছন্দ করেন না। নির্বোধ দাস যেমন অনেক সময়ে প্রভুকে খুশী করার জন্য মাত্রাধিক উৎসাহ উদ্দীপনা প্রকাশ করে প্রভুর সম্মানের ক্ষতিই করে। সেইরূপ ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি বা মাত্রাধিক্য ধর্মের মূল সূর বা আত্মার অনুভূতি থেকে ব্যক্তিকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ির ফলে ধর্ম শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব ধর্মে পরিণত হয়। এর প্রচুর উদাহরণ ইহুদীদের ধর্মাচরণ থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। ইহুদীরা তাদের বাড়াবাড়ির ফলে ধর্মকে আনুষ্ঠানিক সর্বস্ব করে তোলে। আনুষ্ঠানিকতা, জাতিগত বংশ মর্যাদার অহংকার, স্বতন্ত্র-বোধ এসব ইহুদীদের তাদের ধর্ম থেকে বিমুখ করে তোলে। ফলে তারা ধর্মের মূল চেতনা অনুধাবনে অক্ষম হয়। ফলে তারা আল্লাহ্‌র প্রেরিত দূত হযরত ঈসাকে সনাক্ত করতে অক্ষম হয় এবং তাকে অস্বীকার করে। এই আয়াতে ক্রীশ্চিয়ানদের ধর্মীয় আচরণ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তারা হযরত ঈসাকে আল্লাহ্‌র সমকক্ষরূপে পূঁজা করে। তারা মেরীকে ঐশ্বরিক দেবী হিসেবে পূঁজা করে; হযরত ঈসাকে আল্লাহ্‌র পুত্র হিসেবে গণ্য করে। খৃষ্টানেরা 'তিন' তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই 'তিন' তত্ত্ব হচ্ছে- পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। এক আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এই যে 'আল্লাহ্‌র' প্রতিভূ বা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুকে পূঁজা করার প্রবণতা এসবই হচ্ছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার প্রতিফল। এসব থেকে মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে ধর্মের মূল বক্তব্য থেকে সরে যেয়ে আনুষ্ঠানিকতাকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা যা আল্লাহ্‌কে অস্বীকার (Blaspheming) করারই সমতুল্য।
৬৭৬। খৃষ্টানেরা হযরত ঈসা মসীহ (আঃ) কে তিনের এক খোদা মনে করতো। তাদের ভ্রান্তি অপনোদনের জন্য কোরানে পত্যেকটি উপদলকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সম্বোধন করা হয়েছে এবং সম্মিলিতভাবেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাদের সামনে স্পষ্ট ও জোড়ালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, (১) ঈসা মসীহ্‌ (আঃ) তার মাতা হযরত মরিয়মের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী একজন মানুষ (২) তিনি আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্বাচিত সত্য রাসূল। (৩) " "আল্লাহ্‌র বাণী যাহা তিনি মরিয়মকে প্রদান করেছিলেন।" আল্লাহ্‌র বাণীর প্রেক্ষিতে হযরত ঈসার (আঃ) জন্ম। আল্লাহ্‌র বাণী ছিল কুন্‌ বা হও এবং এরই প্রেক্ষিতে হযরত ঈসা (আঃ) এর সৃষ্টি দেখুন আয়াত [৩ : ৫৯]। (৪) এখানে 'রূহু' অর্থ আত্মা বা আদেশ। হযরত ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ্‌ প্রেরিত 'রূহু' বলা হয়েছে- কিন্তু আল্লাহ্‌ নয়। হযরত ঈসার (আঃ) আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্দিষ্ট কাজ করার মেয়াদ কাল ছিল মাত্র তিন বৎসর। যদিও তার সময়কাল ছিল অত্যন্ত সীমিত তবুও তাঁর সম্মান অন্যান্য রাসূলদের সমকক্ষ, এর অতিরিক্ত তাঁর সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় তা ভিত্তিহীন ও বাতিল। খৃষ্টানেরা হযরত ঈসা (আঃ) কে ভক্তি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। আল্লাহ্‌র নবী হিসেবে স্বীকার করেনি। তারা তাঁকে স্বয়ং খোদা, খোদার পুত্র বলে ধারণা করে। তাদের মতে পিতা, পুত্র ও মরিয়ম (পবিত্র আত্মা) এ তিনের সম্বনয়ে এক খোদা। একে বলে 'তিন তত্ত্ব'। অন্য একদলের মতে রূহল কুদ্দুস বা পবিত্র আত্মা হচ্ছেন হযরত জিব্রাইল (আঃ) যাকে তারা মরিয়মের পরিবর্তে উল্লেখ করে। এই 'তিন তত্ত্ব' আল্লাহ্‌কে অস্বীকার করারই নামান্তর। আল্লাহ্‌ অভাবমুক্ত। আল্লাহ্‌ একাই সর্ব কর্ম সম্পাদনকারী এবং সকলের কার্য সম্পাদনের জন্য তিনি একাই যথেষ্ট। অন্য কারো সাহায্য-সহায়তার প্রয়োজন নাই। তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার বা পুত্র পরিজন থাকতে পারে না।
রুকু - ২৪

১৭২। মসীহ্‌ আল্লাহ্‌র সেবা ও উপাসনা করাকে হেয় জ্ঞান করে না ৬৭৭ এবং [আল্লাহ্‌র] ঘনিষ্ঠ ফেরেশতারাও করে না। যারা তাঁর এবাদতকে হেয় জ্ঞান করে এবং অহংকার করে, - তিনি তাদের সকলকে তাঁর নিকট একত্রিত করবেন [উত্তর দেবার জন্য] ৬৭৮।

৬৭৭। এখানে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে হযরত ঈসা (আঃ) নিজেকে আল্লাহ্‌র বান্দারূপে প্রচার করতেন। এই প্রচারে তিনি নিজেকে হেয় জ্ঞান করতেন না।

৬৭৮। যারা নিজেকে আল্লাহ্‌র বান্দারূপে প্রচারে হেয় জ্ঞান করে তারা অহংকারের বশীভূত হয়েই তা করে। অবজ্ঞা ও অহংকার হচ্ছে শয়তানের অস্ত্র মানুষকে বিপথে নেওয়ার। এদের সবাইকে সর্বশক্তিমানের আরসের নীচে জমায়েত করা হবে শাস্তির জন্য।

১৭৩। কিন্তু যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, তিনি তাদের [প্রাপ্য] পুরস্কার প্রদান করবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশী দেবেন। কিন্তু যারা হেয় জ্ঞান করে ও অহংকার করে তিনি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দান করবেন। তাদের রক্ষা করা এবং সাহায্য করার জন্য আল্লাহ্‌ ব্যতীত তারা আর কাউকে পাবে না।

১৭৪। হে মানব সম্প্রদায় ! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে দৃঢ় প্রত্যয়ন উৎপাদনকারী প্রমাণ এসেছে। এবং আমি তোমাদের প্রতি স্পষ্ট জ্যোতি অবতীর্ণ করেছি ৬৪৯।

৬৭৯। 'প্রমাণ' ও 'স্পষ্ট জ্যোতি' বা আলো। এ কথাগুলির অর্থ হচ্ছে "কোরান ও রাসূলের" জীবন, ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষা। মহাগ্রন্থ কোরান হচ্ছে আল্লাহ্‌র তরফ থেকে অকাট্য "প্রমাণ"। রাসূলের জীবন, ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষা হচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের জীবন যাত্রার পথের আলোস্বরূপ। তাঁর জীবন যাত্রা ছিল কোরানের আলোতে জীবনের পথ চলা। কোরানের শিক্ষা তাঁর জীবনে প্রতিফলিত করে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন ভবিষ্যত মানুষের জন্য - যা আমাদের জন্য "স্পষ্ট জ্যোতি।"

১৭৫। এরপর যারা আল্লাহ্‌তে ঈমান আনে এবং তাঁকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে, শীঘ্রই তাদের তিনি তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ লাভের অধিকার দেবেন এবং তাদের সরল পথে তাঁর দিকে পরিচালিত করবেন ৬৮০।

৬৮০। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্‌র রহমত ও করুণা তাঁদের উপরে বিশেষভাবে বর্ষিত হবে।

১৭৬। তারা তোমার নিকট আইনসম্মত ব্যবস্থা জানতে চায়। বল, "যারা উত্তরাধীকারী হিসেবে সন্তান অথবা পিতা-মাতা রেখে যায় না, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ [এভাবে] তোমাদের ব্যবস্থা দিতেছেন। যদি সে সন্তানহীন পুরুষ হয় এবং তার এক বোন থাকে, তবে তার জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধাংশ এবং যদি [মৃত ব্যক্তি] সন্তানহীনা নারী হয়, তবে তার ভাই তার উত্তরাধীকার হবে। আর দুই বোন থাকলে তাদের জন্য তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ। আর যদি ভাই বোন উভয়ে থাকে তবে এক পুরুষের অংশ দুই নারীর সমান। যাতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও- এ জন্য আল্লাহ্‌ [তাঁর আইন] পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছেন। এবং আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখেন ৬৮১।

৬৮১। এই আয়াতটি উত্তরাধীকার আইনের সংযোজিত অংশ বিশেষ। যদি মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা বা সন্তান-সন্ততি না থাকে, তবে তার সম্পত্তির বিলি-বণ্টনের নিয়ম এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। যদি আমরা এ রকম ব্যক্তির নাম '১ক' ধরে নিই 'ক' পুরুষ বা নারী যে কেউ একজন হতে পারে- সে ক্ষেত্রে 'ক' এর বেলায় নিয়ম নিম্নরূপ :
এক্ষেত্রে দু'রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। 'ক' এর পিতামাতা বা সন্তান সন্ততি নাই, কিন্তু তার ভাই বোন আছে। (১) প্রথমতঃ তার এই ভাই বোন হতে পারে একই মায়ের গর্ভজাত, কিন্তু পিতার পরিচয় আলাদা। অর্থাৎ বৈপিতৃ পরিচয়ে ভাই অথবা বোন। (২) দ্বিতীয়তঃ পিতা এক কিন্তু মাতা আলাদা অর্থাৎ বৈমাতৃক বা সৎ ভাই-বোন। আয়াত [৪ : ১২] এর দ্বিতীয়াংশে প্রথম শ্রেণীভুক্ত অর্থাৎ বৈপিতৃ পরিচয়ের ভাই-বোনদের প্রাপ্য অংশের বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে [৪ : ১৭৬] যে ভাই-বোনদের উল্লেখ করা হয়েছে তা ঐ দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। তারা 'ক' এর আপন সহোদর-সহোদরা এবং বিমাতার সন্তান অর্থাৎ এই উভয় ক্ষেত্রে পিতার পরিচয় অভিন্ন। একই পিতার সন্তানদের বেলায়- 'ক' এর সম্পত্তিকে বিলি-বণ্টনের শর্ত হচ্ছে প্রথমতঃ যদি 'ক' এর কোন পত্নী বা পতি থাকে তবে তারা ইসলামী মতে তাঁদের অংশ পাবেন। এর পরে অবশিষ্টাংশ নিম্নরূপে বণ্টিত হবে। আর যদি 'ক' এর কোন পত্নী বা পতি না থাকে তবে তাঁদের অংশ বণ্টনের প্রশ্ন ওঠে না। এর পরে 'ক' এর যদি শুধুমাত্র একটি বোন থাকে [একই পিতা] তবে সে পাবে অর্ধেক অংশ এবং বাকী অংশ দূরের উত্তরাধীকারদের মাঝে বণ্টিত হবে। যদি 'ক' এর একটি মাত্র ভাই থাকে [একই পিতা] তবে সে পুরো সম্পত্তির অংশীদার হবে (পত্নী বা পতির অংশ বণ্টনের পরে।) যদি 'দুই ভাই' থাকে তবে সম্পত্তি সমান দুই ভাগে বিভক্ত হবে (পত্নী বা পতির অংশ বণ্টনের পরে)। যদি একের অধিক বোন থাকে তবে পত্নী বা পতির অংশ বণ্টনের পরে যা থাকে তার দুই তৃতীয়াংশ পাবে বোনেরা। যদি 'ক' এর ভাই এবং বোন উভয়ই থাকে তবে 'ক' এর পত্নী এবং পতির অংশ বণ্টনের পরে যা থাকে তা থেকে ভাই পাবে দুই ভাগ এবং বোন পাবে এক ভাগ। এখানে প্রধান শর্ত হচ্ছে 'ক' এর সমস্ত ঋণ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়ভার, রক্তের ঋণ প্রভৃতি পরিশোধের পরে যে সম্পত্তি থাকবে তাই-ই বিলি-বণ্টনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। টীকা ৫২২-এ দেখুন।