Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ০ জন
আজকের পাঠক ২০৪ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১২৩৯ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৬৫১ বার
+ - R Print

সূরা মুয্‌যাম্মিল


সূরা মুয্‌যাম্মিল বা বস্ত্রাবৃত - ৭৩

২০ আয়াত, ২ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

ভূমিকা ও সার সংক্ষেপ : এই সূরাটি কোরাণ অবতীর্ণ হওয়ার প্রাথমিক সূরাগুলির অন্যতম। সর্ব প্রথম অবতীর্ণ হয় সূরা ইক্‌রার [ ৯৬ : ১ - ৫ ] আয়াত সমূহ। এর অবতীর্ণ কাল সম্বন্ধে বলা হয় যে, হিজরতের ১২ বৎসর পূর্বে রাসুলের ৪০ তম বৎসরে তা ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এর পর কিছুদিন বিরতি [Fatra] থাকে - যে বিরতিকাল সম্বন্ধে সঠিকভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না, কারণ এ সম্বন্ধে কোন লিখিত ঐতিহাসিক দলিল নাই। কারও মতে এই বিরতি কাল ছিলো ছয় মাস,কারও মতে এক বৎসর আবার কারও মতে দুই বৎসর। সে সময়ে চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আরব দেশের বৎসর গণনা করা হতো। দ্বিতীয় সূরা যা অবতীর্ণ হয়, সম্ভবতঃ ক্রম অনুযায়ী তা ছিলো সূরা আল্‌ - কালামের [ ৬৮নং সূরা ] অধিকাংশ আয়াত ; যা অবতীর্ণ হয় বিরতির [Fatra] পরে। তার পর পরই এই সূরাটি অবতীর্ণ হয় [ ৭৩ নং, তৃতীয় ] ; এবং ৭৪ নং সূরার অবতীর্ণ কাল ছিলো চতুর্থ যার সাথে সাথে অবতীর্ণ হয় ৯৬ নং সূরার অবশিষ্টাংশ। এই সূরাটির [ ৭৩ নং ] অবতীর্ণ কালকে হিজরতের ১০ - ১১ বৎসর পূর্বের সময়রূপে ধারণা করা যেতে পারে।

এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে, আধ্যাত্মিক জগতে প্রার্থনা ও বিনয়ের বৈশিষ্ট্য এবং যারা আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান ও প্রত্যাদেশের সত্যকে অস্বীকার করে তাদের ভয়াবহ পরিণত।


সূরা মুয্‌যাম্মিল বা বস্ত্রাবৃত - ৭৩

২০ আয়াত, ২ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

১। হে বস্ত্রাবৃত ৫৭৫৪

৫৭৫৪। কোন কোন তফসীরকারের মতে 'মুজাম্মিল ' শব্দটি দ্বারা "প্রার্থনার সময়ে সঠিক ভাবে পরিচ্ছদ পরিধানকে " বুঝানো হয়েছে। অথবা বুঝানো হয়েছে পৃথিবীর অস্থায়ী গর্ব অহংকারকে দূরে সরানোর জন্য যার উপমা হচ্ছে নিজেকে আড়াল করা চাদর বিশেষ দ্বারা। আমাদের নবীর অন্যতম উপাধি হচ্ছে মোজাম্মেল। কিন্তু এই সূরা ও পরবর্তী সূরাতে রাসুলকে "মোজাম্মেল " সম্বোধন এক সুগভীর ভাবধারা বহন করে থাকে। পার্থিব জীবনে সাধারণ মানুষ পরিচ্ছদ পরিধান করে শরীরকে শীতের ঠান্ডা, গ্রীষ্মের তাপদাহ বা বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু পার্থিব জীবনের এই আরাম আয়েস আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য অপ্রয়োজনীয়।

প্রতিটি আত্মা প্রতিপালকের সম্মুখে দাঁড়াবে পার্থিব সকল অলংকার ত্যাগ করে পরিশুদ্ধ রূপে। নবীকে সম্বোধনের মাধ্যমে সকল বিশ্বমানবকে সম্বোধন করা হয়েছে যে পার্থিব সকল ভুষণ ত্যাগ করে পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র সম্মুখে দাঁড়াতে নিস্তব্ধ নিশিত রাত্রির নিরবতার মাঝে। তবে এ ব্যাপারে খুব বেশী কঠোরতা অবলম্বন করতে নিষেধ করা হয়েছে, যার উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে।

২। রাত্রিতে [ নামাজে] দাড়াও, কিন্তু সমস্ত রাত্রি নয়, ৫৭৫৫

৫৭৫৫। রাসুল (সা) তার নবুয়ত লাভের পূর্বে এবং পরে হেরা পর্বতের গুহায় কঠোর আধ্যাত্মিক ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। তিনি দিবা রাত্র গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। এভাবেই মধ্যরাত্রি ও মধ্য রাত্রির পরবর্তী প্রার্থনা " তাহাজ্জুতের নামাজ " নামে পরিচিত হয়। দেখুন নীচের ২০ নং আয়াত ও [ ১৭: ৭৯ ] নং আয়াত।

৩। অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কম,

৪। অথবা, তদপেক্ষা বেশী, এবং কুর-আন আবৃত্তি কর ধীরে ধীরে, সুরেলা কন্ঠে। ৫৭৫৬

৫৭৫৬। যে সময়ে এই সুরাটি অবতীর্ণ হয়, সম্ভবতঃ সে সময়ে শুধুমাত্র ৯৬ নং সূরা ৬৮ নং সূরা সম্ভবতঃ ৭৪ নং সূরা এবং সূরা আল্‌- হামদ্‌ সূরা বিদ্যমান ছিলো। বর্তমানে আমাদের সম্মুখে সম্পূর্ণ কোরাণ মহাগ্রন্থ উপস্থাপন করা হয়েছে। লক্ষ্য করুন সামান্য কয়েকটি সূরা যখন বিদ্যমান তখনই সাবধান করা হয়েছে যে, কোরাণ যেনো কেউ তাড়াহুড়ো করে না পড়ে - যেমন আমাদের অনেকে গর্বের সাথে বলে থাকেন যে, সে রমজানে ৩-৪ বার কোরাণ খতম করেছে। না বুঝে, না অনুধাবন করে, শুধুমাত্র দ্রুত পড়ে যাওয়ার মাঝে কোনও পূণ্য নাই। কোরাণ আবৃত্তি করতে হবে, ধীরে ধীরে,স্পষ্ট ও সুন্দর সুরেলাভাবে যেনো এই বাণীর উপদেশ ও মর্মবাণী আত্মার অন্তঃস্থলে প্রবেশের সুযোগ লাভ করে। দ্রুত ও তাড়াহুড়ো করে অর্থ না বুঝে পড়লে তার কোন প্রতিক্রিয়াই চরিত্রে প্রতিফলিত হয় না। অর্থ না বুঝে কোরাণ তেলাওয়াত মূল্যহীন। কোরাণের আয়াতগুলি ভাষা ও ছন্দে এতই সুন্দর যে তা আবেগের সাথে সুরেলা ধ্বনিতে পড়তে হবে। এতে রয়েছে এক অপূর্ব মাধুর্য এবং বিন্যাসে রয়েছে বিশেষ ধরণের বর্ণাঢ্যতা যা আত্মাকে করে সমৃদ্ধ। এর অভ্যন্তরভাগে সেরূপ রয়েছে আত্মার জন্য সীমাহীন স্নিগ্ধ ফল্গুধারা।

মন্তব্য : সঙ্গীতের সুর মানুষের মনোজগতে বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। সে কারণেই সঙ্গীতের সুরে কুর-আন পড়তে বলা হয়েছে, আজান হবে সুরেলা ভাবে। সে কারণেই আল্লাহ দাউদ নবীকে বিশেষ সঙ্গীত প্রতিভা দান করেছিলেন। তাঁর সঙ্গীতে পাহাড় প্রতিধ্বনি করতো, পাখীরা গান করতো, সঙ্গীত প্রতিভা আল্লাহ্‌র বিশেষ দান। মানুষের মনোজগতকে সমৃদ্ধ করার জন্য- তবে সে সঙ্গীত হতে হবে রুচীসমৃদ্ধ আত্মার জন্য স্নিগ্ধ সীমাহীন স্নিগ্ধ ফাল্গুধারার মত।

অতএব আরবীর সাথে সাথে মাতৃভাষাতে কোরাণ পাঠ করতে হবে যেনো এর উপদেশ স্ব জীবনে প্রতিফলিত করার সুযোগ ঘটে। [২১:৭৯] [৩৪:১০] [৩৮:১৮] [৩৮:১৯]

৫। শীঘ্রই আমি তোমাকে প্রেরণ করবো গুরুভার বাণী [ ওহী ]। ৫৭৫৭

৫৭৫৭। ''প্রেরণ করবো " - অর্থাৎ ধীরে ধীরে কোরাণকে সম্পূর্ণরূপে প্রেরণ করা হবে Fatra  বা বিরতির কালের পর।

৬। প্রকৃত পক্ষে, [ ঘুম থেকে ] রাত্রিতে উত্থান [ আত্মার ] শাসনের জন্য অত্যন্ত ক্ষমতা সম্পন্ন, এবং [ প্রার্থনার ] শব্দ চয়নের জন্য উপযুক্ত [ সময় ]। ৫৭৫৮

৫৭৫৮। আল্লাহ্‌র নিকট প্রার্থনা ও আল্লাহ্‌র নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য নিশিত রাত্রির নিরবতা অপেক্ষা অধিক ভালো আর কোন সময় ? নিশিত রাত্রিতে বিরাজ করে স্তব্ধতা যা মনের উপরে প্রশান্তির প্রলেপ প্রদান করে। সমগ্র বিশ্ব সুপ্তির কোলে ঢলে পড়ে, নগরের কোলাহল হয় স্তব্ধ, শুধু সীমাহীন আকাশের নক্ষত্ররাজি জেগে থাকে মানব আত্মাকে অনন্ত বিশ্বলোকের সীমাহীনতাকে উপলব্ধিতে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু রাত্রির নিদ্রা থেকে এবাদতের উদ্দেশ্যে জাগ্রত হওয়া কঠিন। প্রবৃত্তিকে প্রদমিত করেই তা সম্ভব হয়, তখন যা কিছু বলা হয় বা আবৃত্তি করা হয় তা হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়। আর সে সময় পূর্ণ মনোযোগের সাথে এবাদত করা যায়

৭। প্রকৃত পক্ষে, দিবাভাগে তোমার জন্য রয়েছে কর্তব্য এবং দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। ৫৭৫৯

৫৭৫৯। বিশ্ব নবীকেও (সা) সাধারণ মানুষের মতন সকল কর্তব্য ও দায়িত্ব সমাধা করতে হতো। একাধারে তিনি ছিলেন সাধক, প্রচারক, গৃহী, সংগঠক,সামাজিক কর্তব্যজ্ঞান সম্পন্ন নাগরিক, ইত্যাদি ফলে বহুবিধ দায়িত্ব প্রতিদিন তাঁকে সমাধা করতে হতো। সর্বাপেক্ষা কঠিন দায়িত্ব ছিলো তাঁর অনুসারীদের প্রতি যারা তাঁর ধর্মের বাণী অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের বিধর্মীদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার কর্তব্য। দিবাভাগের এই দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার পরে, রাতের নীরবতা হবে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়ানোর জন্য সুরক্ষিত। তবে এ কথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, দিন রাত্রির কোনও সময়েই যেনো আত্মা আল্লাহ্‌র স্মরণ বিমুখ না হয়। দিবসের সকল কর্তব্যের অবসানের পরে রাত্রির নিস্তব্ধতার মাঝে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করতে হবে, একনিষ্ঠভাবে ও একান্ত নিমগ্ন ভাবে। এই আদেশ মহাপ্রভুর নিকট থেকে বিশ্ব মানবের জন্য। তা রাসুলের (সা) জন্য যেরূপ প্রযোজ্য, বিশ্ব মানবের জন্য তা সমভাবে প্রযোজ্য।

৮। সুতারাং তুমি তোমার প্রভুর নাম স্মরণ কর এবং তাঁর প্রতি সর্বান্তঃকরণে নিজেকে উৎসর্গ কর।

৯। [ তিনিই ] পূর্ব ও পশ্চিমের প্রভু ; তিনি ব্যতীত অন্য উপাস্য নাই। সুতারাং তাঁকেই গ্রহণ কর, [ তোমার ] কর্মবিধায়ক হিসেবে। ৫৭৬০।

১০। লোকে যা বলে, তাতে তুমি ধৈর্যধারণ কর, এবং সৌজন্য সহকারে তাদের পরিহার কর।

৫৭৬০। এই বিশাল বিশ্বভূবনের মালিক একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। তিনি এই মহাবিশ্বের শাসনকর্তা। তাঁর হুকুমেই সকল কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতারাং দুষ্ট লোকদের চক্রান্তে কেউ যেনো, বিভ্রান্ত না হয়। আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভর কর, তাঁর ক্ষমতাতে বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারক। অন্যায় অবিচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, আর তা হবে ধৈর্য্য ও সৌজন্য সহকারে। অর্থাৎ অন্যায়কারীকে বুঝতে দেবে যে, তুমি তাদের কর্মে ভীত নও, কারণ তোমার সকল নির্ভরশীলতা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র উপরে। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, পূর্ব ও পশ্চিমের অধিকর্তা আল্লাহ্‌। বাক্যটিকে সঙ্কীনার্থে চিন্তা করার সুযোগ নাই। এখানে পূর্ব পশ্চিম দ্বারা সমগ্র পৃথিবীকে বুঝানো হয়েছে। যদি আমরা উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু থেকে রেখা টেনে পৃথিবীটাকে পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধ রূপে দু অংশে বিভক্ত করি তবে এই দুই অংশে সম্পূর্ণ পৃথিবী এসে যায়। দেখুন আয়াত [ ২ : ১১৫ ]।

১১। যারা বিলাস সামগ্রীর অধিকারী কিন্তু [ তবুও ] সত্য প্রত্যাখানকারী [ তাদের সাথে বোঝা পড়ার] ব্যাপারটি তুমি আমার উপরেই ছেড়ে দাও ৫৭৬১। কিছুকালের জন্য তাদের সাথে ধৈর্য ধারণ কর।

৫৭৬১। পৃথিবীতে সকলে সমান ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কেউ জন্মসূত্রে ভাগ্যবান, কেউ কর্মসূত্রে ভাগ্যবান। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, পার্থিব জীবনে, সম্পদ, ক্ষমতা, মেধা, প্রতিভা ইত্যাদি যে যাই-ই ভোগ করুক না কেন, সকল সময়ে স্মরণ রাখতে হবে যে, এ সকলই পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র দান। এ জন্য সর্বদা আল্লাহ্‌র নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। যদি কেউ অকৃতজ্ঞ হয় এবং আল্লাহ্‌র শত্রুরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, তবে তার মোকাবিলা করবেন স্বয়ং আল্লাহ্‌।

১২। আমার নিকট আছে শৃঙ্খল ৫৭৬২ [ বাঁধার জন্য ] এবং আগুন [ পোড়ানোর জন্য ] ৫৭৬৩।

৫৭৬২। শৃঙ্খল হচ্ছে বন্দীত্বের প্রতীক। কারারুদ্ধ বন্দীদের যখন কারাগারের বাইরে আনা হয়, তখন তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, সে কারণে শৃঙ্খল দ্বারা তাদের হস্ত ও পদযুগল বেধে তাদের চলাচলের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এই উপমার সাহায্যে পাপীদের আত্মিক অবস্থানকে প্রকাশ করা হয়েছে। পাপ কাজ ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে পাপীদের বিবেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফলে তারা বিবেকের স্বাধীনতা হারায় ও এক সময়ে তাদের বিবেক অসাড় হয়ে পড়ে। শৃঙ্খলের জন্য দেখুন নিম্নলিখিত আয়াত সমূহ [ ১৩ : ৫ ] ; [ ৩৪ : ৩৩ ] ; [ ৪০ : ৭১ ] ; এবং [ ৬৯: ৩০-৩২ ] ও এদের টিকা সমূহ।

৫৭৬৩। পাপের আর একটি উপমা দান করা হয়েছে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি। যে আগুন তাদের আত্মার অন্তঃস্থল পর্যন্ত দহন করে ফেলবে। পাপের বিকৃতি তাদের চোখে মনে হবে মনোহর। ফলে পাপ কাজের প্রতি তাদের গভীর আসক্তি জন্মাবে। কিন্তু এ কাজ তার মনে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি নিয়ে আসবে। যার ফলে তার মনের সকল সুক্ষ অনুভূতি ও কোমল প্রবৃত্তি লোপ পেতে থাকবে। তার সকল মানসিক দক্ষতা সমূহ, সৃজনশীল ক্ষমতা সমূহ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে পড়বে। কাঠ যেরূপ আগুনে পুড়ে ছাইতে পরিণত হয়। পাপ কাজও সেরূপ আত্মার সকল গুণাবলী ধ্বংস করে বিকৃত করে ফেলে। আত্মার এই পরিণতিকেই আগুনের উপমার সাহায্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। দেখুন [ ৪৪ : ৪৭ ] এবং [ ৫৬ : ৯৪ ] আয়াত সমূহ।

১৩। আর আছে এমন খাদ্য, যা গলায় আটকিয়ে যায় ৫৭৬৪, এবং ভয়াবহ শাস্তি। ৫৭৬৫।

৫৭৬৪। পাপ কাজের ক্ষুধা অগ্নির ন্যায়। তা বাধাগ্রস্থ না হলে অগ্নির ন্যায় তার উত্তোরোতর বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। পুষ্টিকর খাfদ্য একজন সাধারণ মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি সাধন করে থাকে। সুখাদ্য,খাদ্যনালী দিয়ে খুব সহজেই নেমে যায় পরিপাক যন্ত্রের দ্বারা হজম হয়ে শরীরকে সতেজ করে। ঠিক সেরূপ হচ্ছে পূণ্যাত্মাদের কর্ম যা আত্মাকে করে সতেজ ও সবল। অপরপক্ষে পাপীদের কর্মকে তুলনা করা যায় অখাদ্য ও কুখাদ্যের সাথে। তাদের কর্মের পরিণাম তাদের অবস্থা হবে শ্বাসরুদ্ধকর। আত্মাকে সজীব, সতেজ করার পরিবর্তে তাদের শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলবে। পরিতৃপ্তির পরিবর্তে তাদের মাঝে পাপের ক্ষুধা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। দেখুন সূরা [ ৪৪ : ৪৩ ] ; [ ৫৬ : ৫২ ] ; [ ৬৯ : ৩৬ - ৩৭] এবং [ ৮৮ : ৫ ] আয়াত সমূহ।

৫৭৬৫। "ভয়াবহ শাস্তি " শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে সকল শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। পাপের শাস্তি হবে ভয়াবহ - সেই নিদারুন যন্ত্রণা হবে তুলনাহীন। এই যন্ত্রণা অনেক সময়েই এই পৃথিবীতেই শুরু হয়ে যায়। যদি তা নাও হয়, তবে পরলোকের শাস্তি হবে অবশ্যাম্ভবী।

আয়াত ১২ এবং ১৩ তে শাস্তির বর্ণনা করা হয়েছে। শাস্তি শব্দটিকে ব্যপক অর্থে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, শৃঙ্খল শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র লৌহ শৃঙ্খল কল্পনা করা নিবুর্দ্ধিতা। এই শৃঙ্খল হচ্ছে আত্মার শৃঙ্খল যা পাপে ও কুসংস্কারে অভ্যস্থ হওয়ার দরুণ আত্মা তার বিশ্বাসের ও বিবেকের স্বাধীনতা হারায়। এ হচ্ছে আত্মার এক ধরণের যন্ত্রনা। দেখুন ৫৭৬২ টিকাতে উল্লেখিত টিকাসমূহ। একই ভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে অগ্নিকে ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে শাস্তির প্রথম ধাপে অত্যাচারিতকে রক্ষা করতে হবে অত্যাচারীর হাত থেকে। পৃথিবীর জীবনে আমরা অপরাধীকে বন্দী করে রাখি জেলখানাতে পরলোকের জীবনেও অপরাধীরা পাপ কাজ করার ক্ষমতা হারাবে। পরবর্তী ধাপে অপরাধীর মনে তার অপরাধ সম্বন্ধে অনুতাপের আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হবে, যেনো তার হৃদয় থেকে অপরাধ করার স্বাভাবিক প্রবণতা অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং অপরাধীর সুস্থ বিবেক জাগরিত হয়। যে বিবেক এতদিন পাপের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিলো। আর একটি শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, খাদ্য গলায় আটকে যাবে। সাধারণভাবে খাদ্য ও পানীয় মানুষের মনে তৃপ্তি ও সুখের অনুভূতির সৃষ্টি করে থাকে এবং শারীরিক প্রয়োজন মিটিয়ে শরীরকে শান্তি দান করে। সুতারাং খাদ্য ও খাদ্য গ্রহণের অনুভূতি সাধারণ মানুষের মনে সুখের অনুভূতির সৃষ্টি করে থাকে। পাপীদের শাস্তিকে অনুধাবন যোগ্য করার জন্য বলা হয়েছে যে, সুখাদ্য গ্রহণের তৃপ্তিকর ও সুখময় অনুভূতিকেও ভীতিজনক করে তোলা হবে। অর্থাৎ যে পাপ ও পাপের পরিণাম অপরাধীর নিকট সুখময় স্মৃতি ছিলো পার্থিব জীবনে সেই কার্য ও কার্যের পরিণাম তার নিকট হবে ভীতিজনক। গলাতে খাদ্য আটকে শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপমার মাধ্যমে এই শাস্তিকে প্রকাশ করা হয়েছে। যাদের আধ্যাত্মিক জীবন অন্ধকারময়, আত্মা মৃতবৎ, তাদের মৃত আত্মাকে উজ্জ্বীবিত করার জন্য পার্থিব জীবনের উপমা সমূহ ব্যবহার করা হয়েছে। সম্ভবতঃ অভিজ্ঞতার আলোকে এই উপমা তাদের অন্ধকারময়, মৃতবৎ আত্মিক জগতে হঠাৎ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। যদি এই বর্ণনার কিছুই তাদের চিন্তা ও চেতনাকে জাগাতে সক্ষম না হয়, তবে তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি " যে শাস্তির ভয়াবহতা কল্পনা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, যার বর্ণনা করা কোন লেখনীর পক্ষেও অসাধ্য।

১৪। যে দিন পৃথিবী ও পর্বতমালা ভীষণ ভাবে প্রকম্পিত হবে এবং পর্বত সমূহ বহমান বালুকাস্তুপে পরিণত হবে ৫৭৬৬

৫৭৬৬। কেয়ামত দিবসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। সেদিন সমগ্র বিশ্বজগত প্রকম্পিত হতে থাকবে, যার ফলে সারা বিশ্বের রূপ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আমাদের এই চেনা পৃথিবী সম্পূর্ণ অচেনা পৃথিবীতে রূপান্তরিত হয়ে পড়বে। এই রূপান্তর সংক্ষিপ্ত একটি উপমার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সুউচ্চ পর্বত হচ্ছে কাঠিন্য ও স্থায়ীত্বের প্রতীক। কঠিন শিলার স্তুপ, পর্বতকে করে তোলে দুর্গম ও চিরস্থায়ী। কেয়ামত দিবসে এসব সুউচ্চ, দুর্ভেদ্য,চিরস্থায়ী,কঠিন শিলাস্তুপের সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যাবে। তারা পরিবর্তিত হয়ে যাবে বহমান বালুকারাশির ন্যায় - আকৃতিহীন, কাঠিন্যহীন বস্তুতে।

১৫। [ হে মানব কুল ] আমি তোমাদের নিকটে একজন রসুল প্রেরণ করেছি, যে তোমদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ, ৫৭৬৭, যে রূপ রসুল পাঠিয়েছিলাম ফেরাউনের নিকট।

৫৭৬৭। আমাদের রাসুলকে (সা) প্রেরণ করা হয়েছিলো তাঁর যুগ অর্থাৎ বর্তমান যুগের মানব সম্প্রদায়কে সাবধান করার জন্য। কারণ তিনি হচ্ছেন সর্বশেষ নবী পৃথিবীর জন্য। তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছিলো মানুষকে পাপ থেকে সাবধান করার জন্য সাক্ষীস্বরূপ। এই আয়াতে রাসুলের (সা) দায়িত্বকে তুলনা করা হয়েছে হযরত মুসার সাথে। ফেরাউনের উদ্ধতপনার শাস্তির বর্ণনা আছে সূরা [ ১০: ৭৫- ৯২ ] আয়াতে।

১৬। কিন্তু ফেরাউন রসুলকে অমান্য করেছিলো ৫৭৬৮; সুতারাং আমি তাকে কঠিন শাস্তি দ্বারা আক্রান্ত করেছিলাম।

৫৭৬৮। পৃথিবীর ক্ষমতাশালী নৃপতি ফেরাউন হযরত মুসাকে কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন তারই বর্ণনা দেয়া হয়েছে এখানে। একই ঘটনা দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যের দরুন ঘটনার নৈতিক শিক্ষার পার্থক্য ঘটে থাকে। যেমন এখানে হযরত মুসার সাথে ফেরাউনের সাক্ষাৎকারের সময়ে ফেরাউনের ধারণা হলো যে, হযরত মুসা তার অবাধ্য হয়েছেন। কারণ পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতা তাঁকে গর্বিত ও অহংকারী করে তুলেছিলো। আবার সেই একই সাক্ষাৎকারকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহ্‌ বর্ণনা করেছেন যে ফেরাউন হযরত মুসাকে অমান্য করেছেন। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতায় ফেরাউনের রাজত্বকাল এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তাদের শক্তিশালী রাজত্ব ছিলো জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংগঠন, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু যা গর্ব ও অহংকার করার অধিকার রাখে। কিন্তু মুসার ফেরাউন ভুলে গিয়েছিলো যে, এ সকলের পিছনে রয়েছে একজন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র অবদান। অপরপক্ষে হযরত মুসা যাদের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তারা ছিলো অত্যাচারিত, অবদমিত, ক্রীতদাস শ্রেণীর লোক, যারা ফেরাউনের অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং দাসোচিত কাজ করতো। যদিও এসব লোকের কোনও সম্পদ ও ক্ষমতা ছিলো না, কিন্তু এদের পিছনে ছিলো আল্লাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহ। ফেরাউনের জ্ঞান, ক্ষমতা, বিশাল সেনাদল যা ক্ষমতার প্রতীক, যা পৃথিবীকে ভয়ে ও শ্রদ্ধায় প্রকম্পিত করে তুলতো তা তুচ্ছ হয়ে গেলো আল্লাহ্‌র ক্ষমতার নিকট। আল্লাহ্‌র ক্ষমতা দর্শনে মানুষের মনে যে, বিষ্ময়, শ্রদ্ধা ভয়, উৎপাদন করবে তা তুলে ধরা হয়েছে একটি উপমার মাধ্যমে। সে ভয়ের তীব্রতা হবে এতটাই ভয়ংকর যে কিশোরের মাথার সকল চুল বৃদ্ধ ব্যক্তির ন্যায় সাদা হয়ে যাবে। অপরপক্ষে অন্য ভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা যায়, যে জাতি আল্লাহ্‌র বিধান সমূহ অমান্য করে থাকে শিশুর ন্যায় আচরণ করে সেই জাতি আল্লাহ্‌র রোষে পতিত হয়ে ধ্বংসের পূর্ব মূহুর্তে নিজ অবস্থান উপলব্ধিতে সক্ষম হয়ে পক্ককেশ জ্ঞানীর ন্যায় আচরণ করবে। আল্লাহ্‌র বিধান সমূহ চিরস্থায়ী এবং পরিপূর্ণতা লাভ করবে এবং অন্য সকল কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। " আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।"

১৭। যদি তুমি [আল্লাহ্‌কে ] অস্বীকার কর, তবে তুমি কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে সেদিন, যেদিন কিশোরকে পরিণত করবে বৃদ্ধে ? ৫৭৬৯

১৮। যে দিন আকাশ বিদীর্ণ হবে ? তাঁর [ সেদিনের ] প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।

৫৭৬৯। যদি তোমরা এই পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত শিক্ষানবীশকালে আল্লাহ্‌র হুকুমকে অমান্য কর,তবে কিভাবে পরলোকের জীবনের শাস্তিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে ? শেষ বিচারের দিনের ভয়াবহ শাস্তিকে দুইটি উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা হয়েছে : ১) সেদিনের শাস্তির ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ও সুতীক্ষ্ণ হবে যে, তা দর্শনে আতঙ্কিত কিশোরদেরও সকল চুল বৃদ্ধদের মত সাদাতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। ২) যে নিঃসীম নীল আকাশকে আমরা চিরদিন উদার ও মুক্তরূপে দেখে থাকি, সেদিন এই নীল আকাশও চৌচির হয়ে ফেটে যাবে। দেখুন সূরা [ ৮২: ১ ] আয়াত। সম্পূর্ণ বর্ণনাটিকে সংক্ষেপে এভাবে প্রকাশ করা যায় যে, মানুষের ভিতরের প্রকৃতি এবং বাইরের চেহারা বা রূপ সেদিন সম্পূর্ণরূপে বদলে যাবে, রূপান্তরিত হয়ে পড়বে। সেদিন জীবনের প্রকৃত মুল্যবোধকে সে অনুধাবনে সক্ষম হবে। "আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।"

১৯। অবশ্যই ইহা এক সতর্কবাণী ৫৭৭০; অতএব,যার ইচ্ছা, সে তার প্রভুর দিকের [ সরল ] পথ অবলম্বন করুক।

৫৭৭০। যে বর্ণনা এতক্ষণ করা হলো তা কোন মিথ্যা বা অসাড় বাগাড়ম্বর নয়। এই বর্ণনা হচ্ছে সতর্কবাণী - মানুষের কল্যাণের জন্য। যদি কেউ আল্লাহ্‌র নিকট প্রকৃত ক্ষমাপ্রার্থী হয় এবং আল্লাহ্‌র হেদায়েতের সুশীতল ছায়াতে আশ্রয় গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তবে সে তৎক্ষণাত আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভে সক্ষম হবে। এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান বা আইন। অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা "সরল পথের" সন্ধান লাভ করা যায়, যা খুব দ্রুত আদম সন্তানকে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে উপনীত করতে সক্ষম।



রুকু - ২

২০। তোমার প্রভু জানেন, যে তুমি কখনও রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনও অর্দ্ধেক এবং কখনও রাতের এক তৃতীয়াংশ নামাজে দাঁড়িয়ে থাক ৫৭৭১, এবং যারা তোমার সাথে আছে তাদের একদলও [ দাঁড়িয়ে থাকে ]। কিন্তু আল্লাহ্‌-ই রাত্রি ও দিনকে উপযুক্ত পরিমাণে করেছেন। তিনি জানেন যে, তোমরা ইহা পুরোপুরি পালন করতে পারবে না ৫৭৭২। সুতারাং তিনি তোমাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়েছেন কাজেই কুর-আনের যতটুকু আবৃত্তি করা সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর ৫৭৭৩। তিনি জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেহ কেহ অসুস্থ থাকবে, কেহ কেহ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে এবং কেহ কেহ আল্লাহ্‌র পথে সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে ৫৭৭৪। কাজেই তোমরা কুর-আন থেকে যতটুকু সহজবোধ্য ততটুকু আবৃত্তি কর। এবং নিয়মিত নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, এবং যাকাত প্রদান কর। এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর ৫৭৭৫। তোমাদের আত্মার [ কল্যাণের ] জন্য ৫৭৭৬ যা কিছু ভালো কাজ অগ্রে প্রেরণ করবে, তোমরা তা আল্লাহ্‌র নিকটে পাবে। হ্যাঁ, তা হবে উৎকৃষ্টতর এবং পুরষ্কার হিসেবে মহত্তর। আল্লাহ্‌র করুণা ভিক্ষা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ বারে বারে ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়। ৫৭৭৭

৫৭৭১। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৭৩ : ২ - ৪ ]। রাসুল (সা) ও তাঁর একান্ত অনুগত অনুসারীবৃন্দ অনেক সময়েই রাত্রির ঘুম ত্যাগ করে রাত্রির দুই তৃতীয়াংশ, অথবা অর্ধাংশ বা এক তৃতীয়াংশ প্রার্থনা এবং কোরাণ তেলাওয়াতে ব্যয় করতেন। অধিকাংশ রাত্রি তাহাজ্জুতের নামাজে ব্যয় করার দরুণ তাদের পদদ্বয় ফুলে যেতো এবং আদেশটি কষ্টসাধ্য প্রতীয়মান হয়। পূর্ণ এক বছর পর এই সূরার শেষাংশ অবতীর্ণ হলে দীর্ঘক্ষণ নামাজে দন্ডায়মান থাকার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায়। যতক্ষণ নামাজ পড়া সহজ মনে হয়, ততক্ষণ নামাজ পড়াই তাহাজ্জুদের জন্য যথেষ্ট। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যারা অসুস্থ, বা কেহ কার্য উপলক্ষে বিদেশে অবস্থান করলে বা কেহ আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রামে ব্যস্ত থাকলে তাদের জন্য দীর্ঘক্ষণ তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সুতারাং তাহাজ্জুদের নামাজকে 'ফরজ' নামাজ না করে ব্যক্তির ইচ্ছার উপরে ন্যস্ত করা হয়।

৫৭৭২। " তিনি জানেন যে তোমরা ইহা পুরোপুরি পালন করতে পারবে না।" আক্ষরিক অর্থে বলা যায় যে সাধারণ মানুষের পক্ষে রাত্রির বিভিন্ন অংশের সঠিক হিসাব রাখা সম্ভব নয়। কারণ দিন ও রাত্রির দৈর্ঘ্য বৎসরের বিভিন্ন সময়ে দিন ও রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। এই হ্রাস-বৃদ্ধির সঠিক হিসাব রাখা শুধুমাত্র জ্যোতির্বিদদের পক্ষেই সম্ভব, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। সুতারাং আল্লাহ্‌ তা রহিত করে দেন। কিন্তু মওলানা ইউসুফ আলী মনে করেন আয়াতটির অর্থ অত্যন্ত ব্যপক ও গভীর। আল্লাহ্‌ দিন ও রাত্রিকে সৃষ্টি করেছেন, কাজ ও বিশ্রামের জন্য, যদিও ঋতু চক্রের বিভিন্ন সময়ে দিন ও রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। নামাজ ও প্রার্থনার জন্য রাত্রির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন লক্ষ্য করার প্রয়োজন নাই বা তা করা সম্ভবও নয়। আল্লাহ্‌র এবাদত বহুভাবেই করা সম্ভব যার বর্ণনা নিম্নে করা হয়েছে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আল্লাহ্‌র এবাদতের জন্য আমরা কিছুটা সময় ব্যয় করবো যা হবে আন্তরিক এবং আল্লাহ্‌র প্রতি একান্তভাবে অনুগত এবং সে সময়টি ব্যয় করা আমাদের জন্য হবে সহজ,সুবিধাজনক এবং বিভিন্ন পরিবেশগত সময়ে যেমন স্বাস্থ্যগত কারণে, দেশভ্রমণের সময়ে, বা বিভিন্ন কর্তব্য কর্মে লিপ্ত থাকার সময়ে সে সময় ব্যয় করা মানুষের পক্ষে দুঃসহ বলে মনে না হয়।

৫৭৭৩। ততটুকু আবৃত্তি কর।" কোরাণ পাঠ ধর্মীয় এবাদতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পাঠ যেনো হয় আনন্দদায়ক, সহজ এবং আনুগত্যের মাধ্যমে। দেখুন সূরা [ ২০ : ২ ] আয়াত যেখানে বলা হয়েছে, " আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরাণ অবতীর্ণ করি নাই।" সুতারাং কোরাণ পাঠ করতে হবে অর্থ বুঝে, আন্তরিক ভাবে,গভীর আবেগে, একাগ্রভাবে যেনো কোরাণের বাণীর উপদেশ বা হেদায়েত গ্রহণের ক্ষমতা আত্মার মাঝে জন্ম গ্রহণ করে এবং এই বাণীর পরশে হৃদয় হয় আপ্লুত, আলোকিত ও পুলকিত। অর্থ না বুঝে যান্ত্রিক ভাবে শুধুমাত্র আরবী ভাষাতে কোরাণ পাঠে আত্মার মাঝে এই অনুভব লাভ সম্ভব নয়।

৫৭৭৪। " জিহাদ বা আল্লাহ্‌র পথে সংগ্রাম " অধিকাংশের মতামত হচ্ছে যে সূরাটির এই অংশ মুল সূরা অবতীর্ণ হওয়ার বহু পরে মদিনাতে অবতীর্ণ হয়। এই অংশে আনুশাসনিকভাবে সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে যার থেকে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে সূরাটির এই অংশ মূল সূরার বহু পরে অবতীর্ণ হয়।

৫৭৭৫। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২ : ২৪৫ ] ও টিকা ২৭৬ যেখানে উত্তম ঋণের অংশটির ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। আরও দেখুন সূরা [ ৫৭ : ১৮ ] আয়াত। " উত্তম ঋণ " একটি প্রতীক ধর্মী বাক্য। এই বাক্যটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাহ্‌র রাস্তায় কাজ বা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টিলাভের জন্য কাজ করা। আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে হবে আমাদেরই আত্মিক কল্যাণের জন্য। আল্লাহ্‌র তাতে কোনও লাভ নাই। এই ঋণের পরিবর্তে আমরা আল্লাহ্‌র নিকট থেকে পার্থিব বস্তু পুরষ্কার হিসেবে কামনা করতে পারি না। আল্লাহ্‌ আমাদের যা পুরষ্কার দিবেন তা হবে পার্থিব বস্তু থেকে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত। বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী, "Hay up for yourselves treasures in heaven." [ Matt vi 20]।

৫৭৭৬। পৃথিবীতে আমরা ভালো কাজ যাই-ই করি না কেন সে কাজের ধারাবাহিকতা, আমাদের আল্লাহ্‌র সম্মুখে জবাবদিহিতার জন্য দাড়াবার পূর্বেই আল্লাহ্‌র নিকট পৌঁছে যায়। আমরা যা কিছু ভালো কাজ করি তা আমাদের আধ্যাত্মিক মঙ্গল ও সম্মানকে বৃদ্ধি করে থাকে আল্লাহ্‌র কাছে। এ কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয়কৃত আমাদের পরিশ্রম, প্রতিভা, মেধা, মননশক্তি, সৃজন ক্ষমতা,সম্পদ, ক্ষমতা, অর্থাৎ এক কথায় আমরা যাই ব্যয় করি না কেন তার জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের মুখাপেক্ষী নন। কারণ আল্লাহ্‌ অভাব মুক্ত। আমরা সৎ কাজ বা আল্লাহ্‌র রাস্তায় কাজ করবো আমাদের আত্মিক উন্নতির জন্য, আধ্যাত্মিক কল্যাণের জন্য যা আমাদের অন্তরকে হৃদয়কে বেহেশতি শান্তিতে ভরিয়ে দেবে।

৫৭৭৭। এই আয়াতটি শেষ করা হয়েছে আল্লাহ্‌র ক্ষমা ও করুণার উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। আমরা যে সৎ কাজই করি না কেন তাতে আমাদের যোগ্যতা খুব কমই থাকে। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহই আমাদের ক্ষুদ্রতা ও অযোগ্যতা অতিক্রম করে আমাদের কাজকে সার্থকতার পথে পরিচালিত করে থাকে। ফলে আমাদের হৃদয়ের গুণরাজি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে যা শুধুমাত্র পরম করুণাময়েরই অনুগ্রহ ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তিনি আমাদের দোষত্রুটি অপসারণ করে আমাদের সকল কর্মকে বৃহত্তর সাফল্যের দিকে অগ্রসর করিয়ে দেন। এমন কি যখন কোনও মুত্তাকী ব্যক্তি তার খোদাভক্তি সম্বন্ধে গর্বিত হয় সে সেই মূহুর্তে আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা হারিয়ে আত্মপূঁজায় নিমগ্ন হয় যা গর্হিত পাপ। জীবনের সকল অবস্থায়, সুখে, দুঃখে, বিপদে, বিপর্যয়ে, সম্মান, অসম্মানে সেই সর্বশক্তিমানের চরণ তলে বিনয়ের সাথে আত্মনিবেদনই হচ্ছে প্রকৃত ঈমানদারের লক্ষণ।