সূরা আল্-আন্-আম
সূরা আল্-আন্-আম বা পশু - ৬
আয়াত ১৬৫, রুকু ২০, মাক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে]
ভূমিকা : ক্রম অনুযায়ী মক্কার অবতীর্ণ সূরাগুলির মধ্যে এই সূরাটির অবস্থান শেষাংশে। এই সূরার অধিকাংশ মক্কাতেই নাযেল হয়। কোরআন শরীফে এই সূরাটি অবস্থান যক্তিযুক্তভাবে প্রথাগত নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা মানব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ইতিহাস অবলোকন করেছি, পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশের আলোচনা এবং কিভাবে দূর্নীতি রাহুগ্রস্থ হয়ে হায়িয়ে যায় তা বলা হয়েছে। নূতন সম্প্রদায়ের সংঘবদ্ধ জীবন প্রণালী, আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাস যা ইসলামের (হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম) মূল মন্ত্র তা থেকে ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিচ্যুতি এসব বিষযে আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তী ধাপে আরব মোশরেক-দের পৌত্তলিকতাকে এ একত্ববাদের পটভূমিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সার-সংক্ষেপ : আল্লাহ্র প্রকৃতি এবং যে ভাবে বিশ্ব প্রকতির মালিক নিজেকে প্রকাশ করেন তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং সেই সাথে মোশরেকদের বহু-ঈশ্বরাবাদের গুরুত্বহীনতাকে তুলে ধরা হয়েছে। [৬:১-৩০]
এই অপূর্ব সুন্দর পৃথিবী আল্লাহ্র বিষ্ময়কর সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শন। কিন্তু এই সুন্দর পৃথিবীর জীবন পরকালের জীবনের তুলনায় মূল্যহীন। যা কিছু অদৃশ্য,অশ্রুত গোপনীয় সবই আল্লাহ্ জ্ঞাত। [৬:৩১-৬০]
এই পৃথিবীর সৃষ্টিতে, এর রক্ষণাবেক্ষণ, ধারাবাহিকতা সবই সেই স্রষ্টার একাত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। একথা হযরত ইব্রাহীমের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি মুশরিকদের সাথে যুক্তিকে লিপ্ত হয়েছিলেন। [৬:৬১-৮২]
হযরত ইব্রাহীমের বংশধরের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর সত্যকে চিরদিন ভাস্বর রেখেছেন এবং শেষ প্রর্যন্ত তা কোরআন শরীফে এসে শেষ হয়। যদি কেউ আল্লাহ্র সৃষ্টিকে অনুধাবন করেতে চেষ্টা করে এবং সৃষ্টির সমন্বয়, ধারাবাহিকতার শৃঙ্খলা ইত্যাদি সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে, তবে এমন কি কেউ আছে যে আল্লাহর মহিমা, দয়া তার প্রত্যাদেশ অনুধাবনে ব্যার্থ হবে।' [৬:৮৩-১১০]
অবাধ্য ও বিদ্রোহীরাই প্রতারিত হয়। তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। যদিও তারা পরস্পর পরস্পরের সহযোগী তবুও তারা শাস্তি এড়াতে পারবে না। [৬:১১১-১২৯]
বিদ্রোহীদের অপরাধ ও কুসংস্কার সত্বেও আল্লাহ্র হুকুম প্রতিষ্টিত হবেই। [৬:১৩০-১৫০]
সরলপথের অনুসরণ করাই হচ্ছে উত্তম পথ। কোরআনের নিদ্দের্শ অনুযায়ী এই হচ্ছে আল্লাহ্ নির্দ্দেশিত পথ। সুতরাং এই পথকে অনুসরণ করার জন্য আমাদের একতাবদ্ধ ভাবে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। [৬:১৫১-১৬৫]
সূরা আল্-আন্-আম বা পশু - ৬
আয়াত ১৬৫, রুকু ২০, মাক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে]
৮৩৪। 'Adala' এই আরবী শব্দটি বিভিন্ন অর্থবোধক। বিভিন্ন আয়াতে এর বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে (১) কাউকে সমকক্ষ দাঁড় করানো; ভারসাম্য রাখা (২) সকলের সাথে ন্যায়ের আচারণ করা [৮২:১৫], (৩)ক্ষতিপূরণ বা পূণর্বাসন বা সমভাবে বিনিময় [৬:৭০], (৪) সঠিক বিলিবন্দোবস্ত, নিরপেক্ষতা [৮২:৭], (৫) ন্যায়ের ভারসাম্য নষ্ট করা, পক্ষ-পাতিত্ব করা [৬:১৩৫]।
৮৩৫। এখানে তিন ধরনের যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে (১) দ্যুলোকে-ভূলোকে, আসমান যমীনে যা আমাদের দৃষ্টি সীমার মধ্যে সবই আল্লাহ্র সৃষ্টি। তাহলে তাঁরই সৃষ্ট জিনিষ কি ভাবে তাঁর সমকক্ষ হতে পারে? (২) তিনি তোমার অভিভাবক প্রভু। তিনি সস্নেহে তোমাদের প্রতিপালন করেন এবং ভালোবাসেন। তবে কি ভাবে তোমরা এতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে যে তোমরা তাকে ত্যাগ করে শেরেকের পিছনে ছুটে বেড়াও।(৩) আলো এবং অন্ধকার তোমাদের শিক্ষা দেয় সত্য ও মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করার; তাহলে কিভাবে তোমরা এক আল্লাহ্র সাথে মিথ্যা ঈশ্বরের ধারণা মিশ্রিত করে ফেলো এবং অন্ধ কুসংস্কারে বিশ্বাস স্থাপন কর? প্রাচীন পারস্যে ঈশ্বরাবাদে আলো ও আঁধারকে বিপরীতধর্মী শক্তি হিসেবে পূঁজো করা হতো, কিন্তু আলো আঁধার সবই এক সৃষ্টার সৃষ্টি।
৮৩৬। সারা বিশ্ব প্রকৃতি সৃষ্টার আরাধনায় নিমগ্ন । তাঁর অধিষ্ঠান সর্বোচ্চ। এ অনুভব যুক্তির তর্কের উর্দ্ধে। মানব সন্তান,যার উৎপত্তি নিকৃষ্ট কাদা থেকে সে কি ভাবে সুউচ্চ মহান স্রষ্টার বিরোধিতা করে। কি ভাবে সন্দেহ প্রকাশ করে, কিভাবে সে ভুলে যায় যে, পৃথিবীর জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, এ জীবন পরকারের জন্য শিক্ষানবীশকাল মাত্র। এই শিক্ষানবীশ কালের শেষে তাকে পরকালের হিসাব নিকাশের জন্য আল্লাহ্র দরবারে উপস্থিত হতে হবে।
৮৩৭। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন, পরকালের জীবনের জন্য শিক্ষানবীশ কাল মাত্র। একেই বলা হয়েছে নির্দ্দিষ্ট কাল। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের শেষে এই জীবনের হিসাব নিকাশের জন্য উপস্থিত হতে হবে।
৮৩৮। দুলোকে, ভূলোকে, আসমান, যমীনে সর্বত্রই আল্লাহর অস্তিত্ব বর্তমান। যা মাত্র মুর্খরাই ভাবতে পারে যে আল্লাহ্ সপ্ত আশমানের উপরে তাঁর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত আছেন; মাটির পৃথিবীতে তাঁর অধিষ্ঠান নাই। এই পৃথিবীর প্রতেটি ধূলি কণায় তাঁর অস্তিত্ব বিদ্যমান। এমন কি আমাদের অন্তরের গোপন চিন্তা-ভাবনা কিছুই তাঁর কাছে গোপন থাকে না । কাজের নিয়ত সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল। আমাদের কাজ যদি শুধু মাত্র খ্যাতি অর্জনের নিমিত্তে এবং লোকের প্রশংসা অর্জনের জন্য হয়ে থাকে তবে তা স্রষ্টার অগোচরে থাকে না। আল্লাহ্ আমাদের বিচার করবেন কাজের নিয়ত ও কাজ দ্বারা। ভালো ও মন্দ কাজের জন্য তুল্য বিনিময় করবেন।
০৫।এবং যখন সত্য তাদের নিকট পৌঁছেছে, তারা তখন প্রত্যাখান করেছে। কিন্তু শীঘ্রই তারা যা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো তার সত্যতা সম্বন্ধে জানতে পারবে।
০৬। তারা কি দেখে না যে, তাদের পূর্বে কত মানব গোষ্ঠিকে আমি ধ্বংস করেছি? ৮৩৯। আমি তাদের দুনিয়াতে শক্তিতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যেমনটি তোমাদের করি নাই। আমি তাদের উপর আকাশ থেকে বৃষ্টির ধারা বর্ষণ করেছিলাম এবং তাদের [পাদদেশে জমি উর্বর করার জন্য] নদী প্রবাহিত করেছিলাম । এরপরও তাদের পাপের জন্য আমি তাদের ধ্বংস করেছিলাম, এবং তাদের পরে অন্য মানব গোষ্ঠি সৃষ্টি করছি [তাদের উত্তরাধীকারী হওয়ার জন্য।
৮৩৯। এই আয়াতে মানব ইতিহাসের উত্থান ও পতনের মাধ্যমে আমাদের চিরন্তন ইতিহাসের শিক্ষা দান করা হয়েছে। যদি আমরা শক্তি, দম্ভে, অহংকারে মদমত্ত হয়ে এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে যাই, তবে বর্তমান জীবনের চাকচিক্য ও সর্বোচ্চ অধিষ্ঠান আমাদের অন্তর্দৃষ্টি হরণ করে নেবে। আমাদের চোখ থাকতেও দেখতে পারবো না, মন থাকতেও বুঝতে পারবো না, জ্ঞান থাকতেও অবুঝ হয়ে যাব । তাই আল্লাহ্ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে পৃথিবীতে বহু শক্তিশালী জাতি, যারা জ্ঞান, বিজ্ঞান , সভ্যতার আলোকে পৃথিবীকে করেছিল আলোকিত, তারা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে। কারণ তাদের প্রতি আরোপিত কর্তব্য করতে হয়েছিল অপারগ। আমাদের তাদের দেখে শিখতে বলা হয়েছে। যদি আমরা উদাহরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করি, তবে আমাদের অবস্থা ঠিক তাদের মতই হবে। এই সত্য, এই-ই ইতিহাসের শিক্ষা। যাদের মধ্যে থাকবে বিশ্বাসের অপূর্ণতা শুধু তারাই এই শিক্ষা গ্রহণ থেকে হবে বিমুখ।
৮৩৯-ক। 'Qirtas', রসূলের সময়ে যে সামগ্রী লেখার জন্য কাগজের পরিবর্তে ব্যবহার করা হতো তাকেই উপরের শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে। মওলানা ইউসুফ আলী শব্দটি ইংরেজী অনুবাদ করেছেন 'Parchment' বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে 'কাগজ' শব্দটি দ্বারা। পার্চমেন্ট খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে পশ্চিম এশিয়াতে লেখার জন্য ব্যবহৃত করা হতো। বর্তমান যুগে লেখার জন্য যে কাগজ ব্যবহার করা হয়, তা আরবেরা প্রথম ব্যবহার করে ৭৫১ খৃষ্টাব্দে সমরখন্দ বিজয়ের পরে।চীনদেশের লোকেরা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতব্দী থেকেই কাগজের ব্যবহার জানতো। আরবরাই ইউরোপে প্রথম কাগজের ব্যবহার প্রচলন করে। গ্রীসে একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে কাগজের ব্যবহার প্রচলন হয়। দ্বাদশ শতব্দীতে সিসিলির মাধ্যমে ইতালীতে কগজের ব্যবহরের প্রচলন হয়। খৃষ্ট জন্মের ২৫০০বৎসর পূর্বে প্রাচীন মিশরীয়রা নল-খাগরা থেকে প্যাপিরাস তৈরী করে। এই প্যাপিরাসকেই তারা লেখার জন্য ব্যবহার করতো। দশম শতাব্দীতে প্যাপিরাসের স্থান দখল করে নেয় কাগজ।
৮৪০। বস্তু বাদী লোকেরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু ব্যতীত আর কিছুরই অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। যা তারা পঞ্চ ইন্দ্রিয়দ্বারা অনুভব করতে পারবে, শুধু তারই অস্তিত্ব তারা স্বীকার করে। এর বাইরে অদৃশ্য জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা হয় সন্দিহান। তাই এরূপ কোন বস্তু যখন কোনও অপার্থিক উৎস থেকে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়, যা তারা অনুধাবনে অধম, তারা তাকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে। তারা তকে অভিহিত করে ম্যাজিক বা কুসংস্কার বা অন্য কোনও নামে। যা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে মজবুত করার কথা, তার পরিবর্তে তারা তা থেকে বিচ্যুত হয়। কারণ তাদের "অন্তরে ব্যাধি" [২:১০]
৮৪১। দেখুন [২:২১০] আয়াত। ফেরেশতা আল্লাহ্র দূত, তারা আল্লাহ্র হুকুম তামিল করার জন্য সদা নিয়োজিত। আমরা মর্তের সাধারণ মানুষ। এই নশ্বর দেহ যতক্ষণ আমাদের ধারণ করে থাকতে হবে, ততক্ষণ আমরা এসব স্বর্গীয় দূতদের দেখার ক্ষমতা লাভ করবো না। যেহেতু আমরা মাটির পৃথিবীতে নশ্বর দেহকে অবলম্বন করে আমাদের জীবন-যাপন করি- শত দোষ-ত্রুটি, শত পাপ আমাদের কর্মপ্রণালী ও চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এসব থেকে মুক্ত হয়ে পূত পবিত্র জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য, অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খা আত্মার মাঝে সৃষ্টি করার জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ্ আমাদের অবকাশ দান করেন। কিন্তু এই"অবকাশ"- কে কেউ যদি আল্লাহ্র রহমতের সন্ধানে নিয়োজিত না করে, আল্লাহ্র দূত বা ফেরেশতা চর্মচক্ষে দেখে নিজের পঞ্চইন্দ্রিয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে চায়, তবে সেখানে আত্মিক উন্নতির সুযোগ কোথায়? ধর্মের গোড়ায় কথাই হচ্ছে, অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, যদি তারা তাদের নশ্বর দেহ নিয়ে, ইন্দ্রিত দ্বারা আল্লাহ্র দূতদের দেখতে পেতো, তবে তারা সবাই সাথে সাথেই ধ্বংস হয়ে যেতো। আলোর উদয়ে যেমন- অন্ধকার মুহুর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায় ঐ সব অবিশ্বাসীরা মূহুর্তের মধ্যে সেরূপ নিঃশেষ হয়ে যেতো।
৮৪২। আজকের বিজ্ঞান বলে আমরা সাধারণ মানুষ ত্রিমাত্রার বেশী আমাদের এই চর্মচক্ষুতে দেখতে পারব না বা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভবও করতে পারব না। কিন্তু বিজ্ঞান গণিত বিদ্যার প্রমাণ সাহায্যে করেছে যে ত্রিমাত্রার বাইরেও চতুর্মাত্রা, পঞ্চমাত্রার অস্তিত্ব সম্ভব। সুতরাং ফেরেশতারা এমন মাত্রায় বিরাজ করে যা আমাদের পক্ষে কোনও অবস্থাতেই দেখা সম্ভব হবে না। সুতরাং ফেরেশতাকে আমাদের চর্মচক্ষুতে দর্শনীয় করতে হলে অবশ্যই তাঁকে মানুষের আকৃতিতেই পাঠাতে হবে। সে ক্ষেত্রে যারা আত্মিক দিক থেকে সমৃদ্ধ নয়, বিভ্রান্ত, তাদের সে বিভ্রান্তি দূর হবে না। তারা তখন বলবে যে আমরা ফেরেশতা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এতো দেখছি সাধারণ মানুষ।
৮৪৩। "তাই বিদ্রূপকারীদের পরিবেষ্টন করেছিলো।" অথাৎ বিদ্রুপকারীদের অস্ত্র বুমেরাং এর মত ফিরে এসে তাদেরকেই পরিবেষ্টন করেছে। এখানে "পরিবেষ্টন" কথাটি অত্যন্ত গুরুন্তপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন শত্রুসেনা দ্বারা পরিবৃত্ত হয়ে আত্মসমর্পনে বাধ্য হতে হয়, সেইরূপ আল্লাহ্র নবীদের বিদ্রূপকারীরা তাদের কৃতকর্মের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সত্যকে প্রত্যক্ষ করবে। যারা যীশু খৃষ্টকে বিদ্রূপ করতো, তারা তখন কোথায় ছিল যখন টিটাস (Titus) জেরুজালেম ধ্বংস করে দেয়। যারা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদকে (সাঃ) নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতো এবং তাঁকে তাঁর জন্মভূমি মক্কা ত্যাগে বাধ্য করেছিল, তাদের কি অবস্থা হয়েছিল যখন মুহাম্মদ (সা) মক্কা জয় করেন ঐ দিন বিদ্রুপকারীরা তার কছে দয়া ভিক্ষা করে এবং তিনি তাদের দয়া করেন। যা সত্য তা কখনো ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব নয়, সত্যের জয় অবধারিত; বরং ঐ ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, বিদ্রূপকারীরই ধ্বংসের কারণ। ল্যাটিন একটি প্রবাদ বাক্য চালু আছে, তা হচ্ছে, "Great is Truth, and must Prevail."
রুকু - ২
১২। বল,"আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা কার? বল, "আল্লাহ্র।" তিনি নিজের জন্য দয়ার [নীতি] গ্রহণ করেছেন ৮৪৪। শেষ বিচারের দিনে তিনি তোমাদের অবশ্যই একত্র করবেন- এ সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ নাই। যারা নিজের আত্মার [অস্তিত্ব] হারিয়ে ফেলেছে, এরাই তারা যারা ঈমান আনবে না ।
৮৪৪। পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র। সবই তাঁর দয়া। যারা আল্লাহর আইনকে প্রত্যাখান করে সত্য থেকে বিমুখ হয়, তারা নিজেই নিজের আত্মার ক্ষতি করে, পরিণামে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। আল্লাহ্র ব্যাপক অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় নিজের কৃত কর্মেরই কারণে।
৮৪৫। 'Sakana' এই আরবী শব্দটির অর্থ (১) থাকা বা অবস্থান করা, (২) বিশ্রাম নেওয়া, স্থির থাকা, নড়াচড়া না করা বা থামা, গুপ্ত থাকা, (৩) শান্ত বা অনুচ্চারিত।
"রাত্রি ও দিনে যা কিছু বাস করে" এখানে রাত্রি ও দিন-কে যদি দুটি ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা হয় তবে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্য আছে। 'বাস করে' কথাটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে যা কিছু রাত ও দিনে স্থিতি লাভ করে। অর্থাৎ পৃথিবীতে দিবা ও রাত্রিতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র এ সবের মধ্যে কিছু প্রকাশ্য, কিছু গোপনীয়, কিছু চলমান, স্থির,কিছু সশব্দ, কিছু শান্ত, ও অনুচ্চারিত। এ সবই আল্লাহ্ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।
৮৪৬। রুকু (২) তে আমরা দেখি পরোক্ষ কথোপকথনের মাধ্যমে গভীর ভাবের প্রকাশ হয়েছে। শুরুতে আয়াত [৬:১১] তে কাল্পনিক প্রশ্ন হচ্ছে "অতীতে কেমন ভাবে ফিরে যাবে"? যদিও এসব প্রশ্ন এখানে প্রকাশ করা হয় নাই, কিন্তু যে উত্তর দেওয়া আছে , তা থেকেই অপ্রকাশ্য প্রশ্নটিকে অনুধাবন করা যায়। উত্তরটি হচ্ছে, "পৃথিবী ভ্রমণ কর এবং দেখো যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, তাদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো।" সৎ গুণ ও ধর্মের প্রতি অবিচলতাই জাতির বিশ্ব সভায় উন্নতির কারণ। এ থেকে যারা বিপথগামী হয় তারা ধ্বংসের পাদপ্রান্তে নীত হয়। এ কথা অতীতে যেমন সত্য ছিল, বর্তমানে সত্য আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আয়াত [৬:১২]- তে অব্যক্ত প্রশ্নটি হচ্ছে আল্লাহ্র ক্ষমতা সম্বন্ধে। প্রশ্নটি হচ্ছে " আসমান যমীনে যা আছে তা কার ?" এখানে আল্লাহ্র নবীর উত্তর হচ্ছে, রহমত ও করুণা আল্লাহ্রই নামের বিশেষণ তাঁর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সাধারণ মানুষের ধারণারও বাইরে।
৮৪৭। "তিনিই আহার দান করেন কিন্তু তাঁকে কেহ আহার দান করে না।" এই কথাটি আক্ষরিক ও আলংকারিক সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা আমাদের অভাবের জন্য দয়ার মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি সর্ব অভাবমুক্ত।
১৬। "সেদিন যদি কারও থেকে শাস্তি সরিয়ে নেয়া হয় তবে তা হবে আল্লাহর অনুগ্রহ। এবং তাই হবে [আত্মার মুক্তি] সকল আশা- আকাঙ্খার পরিপূর্ণ তৃপ্তি ৮৪৮।
৮৪৮। এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের প্রশ্ন উত্তরের ধারাবাহিকতা। পূর্ববর্তী আয়াতে না বলা প্রশ্ন এবং উত্তর এর মাধ্যমে আধ্যত্মিক জীবনের গভীরতাকে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন [৬:১৪] -তে অপ্রাকশ্য প্রশ্নটি ছিল "আল্লাহ্র নির্দেশ ব্যতীতও আমাদের অন্যান্যদের নির্দ্দেশ মানার প্রয়োজন আছে কি? রসূলের উত্তরটি দেওয়া হয়েছে উপরিউক্ত আয়াতে এভাবে যে, "আমি কি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবো ?........... আমি আদিষ্ট হয়েছি যেন আত্মসমর্পনকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম ব্যক্তি হই।" আয়াত [৬:১৫] এর প্রশ্নটি উপদেশ আকারে :"জীবন ক্ষণস্থায়ী, জীবনকে উপভোগ করে নাও আল্লাহর নির্দেশকে উপেক্ষা কর।" রাসূলের উত্তর ছিল :" আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি আমি যেন ভয় করি, যে মহাদিনের শাস্তি আমার উপর পতিত হবে।" অর্থাৎ ভোগ বিলাস থেকে সুখ ও শান্তি আসে না, এ সবই এই পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ। স্থায়ী সুখের ঠিকানা হচ্ছে আল্লাহ্র আশ্রয়। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা-ই আমাদের স্থায়ী সুখের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। আয়াত [৬:১৯]-তে শেষ প্রশ্ন হচ্ছে "সাক্ষ্য প্রদানে সর্বশ্রেষ্ঠ কি? " উত্তর হচ্ছে "আল্লাহ্ আমার ও তোমাদিগের মধ্যে সাক্ষী এবং এই কুরআন আমার নিকট প্রকাশ করা হয়েছে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে, যেনো
আমি ...........।
৮৪৯। ক্ষতি বা অনিষ্টের ভয়ে অনেকেই মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে তাদের সাহায্য প্রার্থনা করে। যেমন আমাদের দেশে ক্ষতি বা অনিষ্টের ভয়ে জ্যোতিষের স্মরণপন্ন হয়, গ্রহ নক্ষত্রের কুপ্রভাব দূর করার জন্য রত্ন পাথর ধারণ করে, মাজারে মানত করে ইত্যাদি সবই মিথ্যা উপাস্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। এই মিথ্যা উপাস্যের কোনও ক্ষমতাই নাই, সকল ক্ষমতার উৎস আল্লাহ্ তিনিই সবার উপরে পরাক্রান্ত ও শক্তিমান- আর সবই ভ্রান্ত।
১৯। বল, "সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য কি ?" বল, "আল্লাহ্ আমার ও তোমাদের মধ্য সাক্ষী। এই কুরআন আমার নিকট প্রকাশ করা হয়েছে প্রত্যোদেশের মাধ্যমে; যেনো আমি তোমাদের এবং যাদের নিকট ইহা পৌঁছুবে সকলকে সতর্ক করতে পারি। তোমরা কি এই সাক্ষ্য দিতে-পার যে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য আছে?" বল,' কিন্তু [প্রকৃত] সত্য হচ্ছে তিনি তো এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্ এবং তোমরা তাঁর সাথে যে অংশীদার কর, আমি সত্যই তা থেকে নির্দোষ।"
২০। আমি যাদের কিতাব দিয়েছি তারা তাকে জানে যেমন তারা জানে তাদের পুত্রদের ৮৫০ সুতরাং যারা তাদের আত্মার ক্ষতি করেছে তারাই ঈমান আনতে অস্বীকার করবে।
৮৫০। দেখুন আয়াত [২:১৪৬] এবং টিকা ১৫১। এখানে 'তাহাকে' মব্দটি নবী করিম (সাঃ) এর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে।
রুকু - ৩
২২। একদিন আমি তাদের সকলকে একত্রিত করবো। যারা [আমার সাথে] শরীক আরোপ করেছিলো তাদের আমি বলবো," যাদের তোমরা [আবিস্কার এবং] আলোচনার বিষয় করেছিলে , সে সব শরীকেরা কোথায়?"
২৩। [এরপর] তাদের জন্য এ কথা বলা ভিন্ন অন্য কোন অজুহাত থাকবে না:" আমাদের প্রভু আল্লাহ্র শপথ, যারা আল্লাহ্র সাথে অংশীদার করে আমরা তাদের দলভুক্ত ছিলাম না" ৮৫১।
৮৫১। 'Fitnat' আরবী শব্দটি বহুবিধ অর্থ রয়েছে। যথা : চেষ্টা করা, পরীক্ষা করা, প্রলোভিত করা। ফিত্নার বিভিন্ন অর্থগুলির প্রয়োগ বিভিন্ন আয়াতে লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ (১) আয়াত [২:১০২]-এ বিচারে বা প্রলোভনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। (২) [২:১৯১, ১৯৩, ২১৭] এই আয়াতগুলিতে ফিত্নার অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাচারে, নিষ্পেষণ, অশান্তি ইত্যাদি পরিবর্তে। (৩) [৩:৭] এই আয়াতে ফিত্নার অর্থ করা হয়েছে মতভেদ বা লড়াই এর পরিবর্তে। (৪) এখানে আয়াত [৬:২৩] ফিত্নার অর্থ করা হয়েছে এড়ানোর চেষ্টা করা, বা অজুহাত দেওয়া।
যারা আল্লাহর নির্দ্দেশ অমান্য করে, তারা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মিথ্যা উপাস্যের সাহায্য প্রার্থনা করে। এটা করে তাদের মিথ্যা অহংকার বা গর্ব বোধ থেকে। শেষ বিচারে দিনে তারা তাদের এই মিথ্যা অহংকারের স্বরূপ দেখতে পাবে। তাদের এই বিদ্রোহ, মিথ্যা গর্বের কি উত্তর থাকতে পারে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র দরবারে? পরকালেও তারা চেষ্টা করবে মিথ্যা উত্তর যথা : "আমাদিগের প্রতিপালক আল্লাহর শপথ,আমরা তো মুশরীক্ ছিলাম না" এই কথা দ্বারা প্রতারিত করতে। তারা সর্বশক্তি দ্বারা চেষ্টা করবে তাদের মিথ্যা উপসনার দোষ মুক্ত হতে।
৮৫২। এখানে হাশরের ময়দানে মুশরেকদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে তারা অহরহ মিথ্যা বলতো্ সত্যকে অস্বীকার করতো। আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করতো। তারা ছিল মিথ্যা ভাষণে অদ্বিতীয় পটু, যার ফলে হাশরের ময়দানেও তারা মিথ্যা বলতে দ্বিধা বোধ করবে না। কিন্তু আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, এ মিথ্যা ভাষণ তাদের সফলতা এনে দেবার পরিবর্তে তাদের দুঃখ দুর্দ্দশার কারণ হবে। মহান আল্লাহ্র সামনে মিথ্যা বলার সাহস থেকে তারা প্রমাণিত করবে যে তারা সর্ব্বৈব মিথ্যাবাদী।
৮৫২।-ক।'তা'-অর্থাৎ কোরআন।
২৭। তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তারা [দোযখের] আগুনের সম্মুখীন হবে। তারা বলবে, "হায়! যদি আমাদের [পৃথিবীতে] ফেরৎ পাঠানো হতো, তবে আমরা আমাদের প্রভুর নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখান করতাম না। অধিকন্তু আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।
২৮। হ্যাঁ! পূর্বে তারা যা গোপন করেছিলো, তা তাদের [দৃষ্টির] সামনে প্রকাশ পাবে। [এরপরও] যদি তাদের পৃথিবীর জীবনে ফেরৎ পাঠানো হয়, তবে তাদের যা করতে নিষেধ করা হয়েছিলো, সেই বিষয়েরই পূণরাবৃত্তি করবে। প্রকৃতপক্ষে তারা হচ্ছে মিথ্যাবাদী ৮৫৩।
৮৫৩। মিথ্যাবাদীদের মিথ্যা বলার অভ্যাস এটা অজ্ঞানতাপ্রসুত নয়। এটা এক ধরণের মানসিক বিকৃতি যার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে স্বার্থপরতা। পৃথিবীতে নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য লোকে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। মিথ্যা বলা এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধির উৎপত্তিস্থল তাদের অন্তরের [আয়াত ২:১০]। এই ব্যাধির দরুণ তাদের অন্তর আল্লাহ্র নিদর্শন বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বুদ্ধি থাকলেও তারা বুঝতে অক্ষম হবে। বিবেক থাকলেও সে বিবেক হয়ে যাবে অনুভূতিশূণ্য। কান থাকতেও তারা শুনতে পাবে না-আল্লাহ্র বাণীর মর্ম, অনুধাবণ করতে পারবে না। ন্যায় ও সত্যের আহবানে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে না। চোখ থাকতেও তারা দেখতে পাবে না অর্থাৎ তাদের মধ্যে কোনও অন্তর্দৃষ্টির জন্ম নেবে না। এগুলি আল্লাহ্র তরফ থেকে মিথ্যাবাদীদের প্রাপ্য শাস্তি। ফলে তারা যা দেখে, যা শোনে বা যা শেখে সবই বিকৃত হয়ে যায়। তাদের দেখা বা শোনা, বা বোঝা সবই হয় প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে । ফলে তারা ক্রমান্বয়ে পাপের পঙ্কে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে। পৃথিবীর জীবনে অন্যকে প্রতারিত করার জন্য যেসব ছলা-কলা ও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, হাশরের ময়দানে সে সব তাদের চোখে হবে ভাম্বর।
৩০। তুমি যদি দেখতে, যখন তাদেরকে তাদের প্রভুর সামনে দাঁড় করানো হবে! তিনি বলবেন,"ইহা কি প্রকৃত সত্য নয়?" তারা বলবে," আমাদের প্রভুর শপথ, [নিশ্চয়ই] সত্য! তিনি বলবেন,"তোমরা শাস্তির স্বাদ আস্বাদ কর, কারণ তোমরা ঈমানকে প্রত্যাখান করেছিলো।"
রুকু-৪
৮৫৪। পৃথিবীর জীবন যখন পাপে পূর্ণ হয়। দূর্নীতিপরায়ণতা যখন জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ লাভ করে , বিবেক তখন হয় মৃত। যে বিবেকের কারণে মানুষ পশুর থেকে শ্রেষ্ঠ, সেই বিবেক পাপের ভারে অবচেতন হয়ে যায়। কিন্তু শেষ বিচারের দিনে, পাপী ও পুণ্যাত্মা সকলেরই বিবেক হবে জাগ্রত। ফলে পাপীরা পাপের পরিণাম অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। পাপের অনুধাবন ক্ষমতা তাদের উপরে ভারী বোঝার মত চেপে বসবে। কোন কোন তাফসীরকারের মতে, পাপ কাজের পরিণামকে পিচাশরূপে কল্পনা করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে এই পিচাশ পাপী লোকের স্কন্ধে চেপে বসবে। অপর পক্ষে ভালো কাজের পরিণামকে সবল দ্রুতগামী অশ্বের সাথে তুলনা করা হয়েছে যা পুণ্যাত্মাদের বহন করে নেবে। যদি ভালো কাজের সংখ্যা কম এবং মন্দ কাজের সংখ্যা বেশী হয়, তবে ভালো কাজ মন্দ কাজের পরিণামের নীচে চাপা পরে ধ্বংস হয়ে যাবে।
৮৫৫। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সুস্থভাবে বাঁচা এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজকে সুষ্ঠভাবে সম্পাদনের জন্য আনন্দ এবং ফুর্তির প্রয়োজন আছে। যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজের সুষ্ঠ সম্পাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুস্থ মানসিকতা। এই সুস্থ মানসিকতা লাভ করা যায় হাসি আনন্দের মধ্যে। সেইরূপ মানব জীবনের শেষ পরিণতি হচ্ছে পরকালের জীবন। এই পরকালের জীবনকে সুন্দর সুষ্ঠরূপে গঠন করতে হলে, পৃথিবীর জীবনকে সুন্দর ভাবে পরিচালিত করতে হবে। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনকে, হাসি আনন্দকে কেউ যেনো জীবনের শেষ পরিণতি না ভাবে। পৃথিবীর জীবন হচ্ছে পরকালের জীবনের পূর্বশর্ত। পরকালের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে, সফলভাবে লাভ করতে হলে পৃথিবীর জীবনের মাধ্যমেই লাভ করতে হবে।
৩৪। তোমার পূর্বেও রাসূলগণ প্রত্যাখাত হয়েছে। ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে তারা তাদের প্রত্যাখান ও অন্যায় সহ্য করেছিলো; যতক্ষণ না আমার সাহায্য তাদের নিকট পৌঁছেছিলো। আল্লাহ্র আদেশ কেহ পরিবর্তন করতে পারবে না। ইতিমধ্যে সেসব রাসূলগণের কিছু সংবাদ লাভ করেছ।
৩৫। যদি তাদের বিরোধিতা তোমার নিকট কষ্টকর হয় [ধৈর্য্য ধারণ করতে], তবে পারলে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ অথবা আকাশে সোপান অন্বেষণ কর, যেনো তুমি তাদের জন্য কোন নিদর্শন আনতে পার ৮৫৬ [যা অসম্ভব, সুতরাং ধৈর্য ধারণ কর]। যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করতেন তবে তিনি তাদের [সকলকে] সৎপথে একত্রিত করতে পারতেন। সুতরাং তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না যারা অজ্ঞতার দ্বারা প্রভাহিত হয় [এবং ধৈর্য হারায়]
৮৫৬। আমাদের নবী করিমের (সা) জীবন এবং তার নিকট প্রেরিত আল্লাহর নিদর্শন সমূহ হচ্ছে আল্লাহ্র সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন মোমেন বান্দাদের জন্য। যারা অবিশ্বাসী, তারা কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করে না। যদি নবী করিম (সা) তাহাদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য পৃথিবীর অভ্যন্তর পর্যন্ত সুরঙ্গ খনন করতেন এবং আকাশ পর্যন্ত সিঁড়ি অন্বেষণ করতেন তবু-ও এই অবিশ্বাসীদের আল্লাহ্র রাস্তায় বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারতেন না। আমাদের নবী ঐকান্তিক আগ্রহের সাথে চাইতেন যে সকলে আল্লাহ্র নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করুক। কিন্তু তৎপরিবর্তে অবিশ্বাসীরা তার উপরে অত্যাচার ও নির্যাতন চালাত। এখানে আল্লাহ্ বলেছেন, সমস্তই আল্লাহ্র বৃহত্তর পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং রাসূলকে ধৈর্য্যের সাথে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে। এই আয়াতটি নাজেল হয় হিজরতের পূর্বে,যখন মক্কায় রাসূলের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চলছিল। মদিনায় রসূলের হিজরত, সেখানে তার অবস্থান এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ একথাই প্রমাণ করে যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র সত্য জয় লাভ করবেই। যারা আল্লাহ্র নবীকে আন্তরিক ভালোবাসে আয়াত [৬:৩৩-৩৫] পর্যন্ত পড়ার সময়ের অবশ্যই তারা অশ্রু সম্বরণ করতে পারবে না। কারণ তার জীবন ছিল ফুলের মত পবিত্র, জীবনে কোনও দিন যিনি সামান্য মিথ্যা বলেন নাই, অন্যায় করেন নাই। যদিও একথা কাফেররা স্বীকার করতো, কিন্তু তবুও তারা তাঁর নিকট ওহী আসার বিষয়টি অস্বীকার করতো। প্রকারান্তে বলা হয় যে তিনি মিথ্যাবাদী। আমাদের নবীর আন্তরিক প্রচেষ্টার এরূপ জবাব স্বভাবতঃই নবীর মনঃকষ্টের কারণ ছিল।
৮৫৭। এই আয়াতটিকে দু'ভাগে ব্যাখ্যা করা যায়। (১) যদি কেউ সত্যান্বেষী হয় এবং সত্যের প্রতি আন্তরিক হয় এবং আন্তরিক ভাবে সত্যকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করে, তাহলে একদিন অবশ্যই তারা বিশ্বাসী হবে বা ঈমান আনবে। যদি তাদের আধ্যাত্মিক জগত 'Spiritual faculty' মৃত এবং অনুভূতির শূন্য হয়, তবুও সত্য অনুধাবনের ইচ্ছা থেকে, আল্লাহ্র রহমতে তাদের আধ্যাত্মিক জগতে প্রাণ সঞ্চার হবে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছেই সকলের পত্যার্পণ। (২) দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, যারা আন্তরিক তারা অবশ্যই ঈমান আনবে, যাদের হৃদয় মৃত বা বোঝানো ক্ষমতা নাই তারা কখনও ঈমান আনবে না । কিন্তু কেউই শেষ বিচারের দিনে রেহাই পাবে না; এই উভয় দলকে সেই দিনে উপস্থিত করা হবে, বিচারকের কাছে।
৮৫৮। কাফেররা প্রতিপালকের নিকট থেকে নিদর্শন যাঞ্চা করে; কিন্তু যদি তাদের বোঝার ক্ষমতা থাকতো, তবে তারা অনুধাবন করতে পারতো যে আল্লাহ্র নিদর্শন বিশ্বভূবনে ছড়ানো। ছোট্ট তৃণমূল থেকে নভোমন্ডল সবই তাঁর সৃষ্টি, সবই তাঁর হাতের স্বাক্ষর বহন করে। যেহেতু কাফেররা অজ্ঞ, অনুধাবন শক্তি রহিত, সেহেতু তারা এসব নিদর্শন অনুভব করতে পারে না। তারা তাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের সীমানার মধ্যেই আল্লাহর নিদর্শন যাঞ্চা করে।
৮৫৯। "পৃথিবীতে বাস করে এমন কোন বিচরণশীল প্রাণী নাই;" এই বাক্যটির অন্তর্গত সমস্ত প্রাণীকূল - যেমন, যারা পানিতে বাস করে বা মাছ, সরীসৃপ, যারা কঠিন খোলসের মধ্যে বাস করে, কীট পতঙ্গ চতুস্পদ প্রাণী ইত্যাদি সকলেই এর অন্তর্ভূক্ত। যার ডানা আছে তাদের আলাদা উল্লেখ করে বলা হয়েছে। 'Tair' এই আরবী শব্দটি 'পাখি' শব্দটি দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু শব্দটির প্রকৃত অর্থ যা কিছু ওড়ে। সুতরাং বাদুরকে যদি পক্ষীকূল সম্প্রদায়ভূক্ত না করে স্তন্যপায়ীদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। 'Tair' কথাটির দ্বারা বাদুরকেও একই শ্রেণীভূক্ত করা হয়েছে। আমরা আদম সন্তান এই ভেবে গর্বে স্ফীত হই যে আমরা সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু "ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণশীল" জীবদেরও নিজস্ব সমাজ, সামাজিক নিয়ম-কানুন আছে, যা আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত। আয়াত [৬:৫৯]-তে বলা হয়েছে," তাহার অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অংকুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নাই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নাই।" অর্থাৎ বিশ্বহ্মান্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবনও তাঁরই পরিকল্পনা অধীন এবং তাঁর কছেই তাদের জবাবদিহি। অর্থাৎ জীবন, কর্মচাঞ্চল্য,দক্ষতা,পৃথিবীর সব কিছুই আল্লাহর পরিকল্পনা মাফিক চলে।
৮৬০। আদম সন্তানকেই আল্লাহ্ একমাত্র " সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দান করেছেন। এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কারণেই সে পৃথিবীতে আল্লাহ্র প্রতিনিধি। যদি কেউ ইচ্ছাশক্তির অব্যবহার করে, ইচ্ছাকৃতভাবে অল্লাহ্র নিদর্শন সমূহকে দেখতে অস্বীকার করে, শুনতে অস্বীকার করে, এবং বলতে অস্বীকার করে, তবে তারা হবে যেনো" বধির ও মূক" অর্থাৎ মহাবিশ্বকে আল্লাহ্র নিদর্শন পরিব্যপ্ত করে রাখলেও তারা তা দেখতে পাবে না। তারা হবে যেনো অন্ধ, ফলে আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবে না যেনো তারা বধির। ফলে তারা বিবেকের অধিকারী হবে না, বা বিচক্ষণ হবে না, তারা হবে যেনো বোবা পশুর মত। তারা বিভ্রান্তির মধ্যে বাস করবে এবং আত্মিক কষ্ট পাবে। অপরপক্ষে যারা তাদের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" অব্যবহার না করে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে নিজকে সমর্পন করে আল্লাহ্র বিধান মেনে চলে, তারা আল্লাহ্র করুণা ও রহমত লাভ করবে।
৪১। "না, তোমরা শুধু তাঁকেই ডাকবে; এবং তাঁর ইচ্ছা হলে, যে [বিপর্যয়ের] জন্য তাঁকে ডাকছো তিনি তা দূর করবেন। এবং যাকে তোমরা তাঁর শরীক করতে তোমরা তা বিস্মৃত হবে।"
রুকু-৫
৪৩। যখন আমার নিকট থেকে তাদের উপর শাস্তি নিপতিত হলো, কেন তারা বিনয়ী হলো না? ৮৬১। অধিকন্তু তাদের হৃদয় কাঠিন হয়েছিলো, এবং শয়তান তাদের [পাপের ] কাজকে তাদের দৃষ্টিতে প্রলোভনদায়ক করেছিলো।
৮৬১। এই পৃথিবীর জীবন সব সময়ে সুখের নয়, অনেক সময়ে এ জীবনকে কুসমাবৃত্ত মনে না হয়ে মনে হয় যেনো কন্টকাবৃত্ত। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ভরা পৃথিবীর এই জীবন। যখন দুঃখের অমানিশা আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, কষ্টের দীর্ঘ দিনগুলি যেনো শেষ হয় না। যারা মোমেন বান্দা তারা এসব দিনগুলিকে আল্লাহ্রই রহমতরূপে কল্পনা করে, যেমন করে সুখের দিনগুলিকে। কারণ সঠিক ভাবে গ্রহণ করলে দুঃখ-কষ্টের দিনগুলিই বান্দার জীবনকে চারিত্রিক গুণাবলীতে ভরিয়ে দিতে পারে। খৃষ্টানদের প্রার্থনা সঙ্গীত (Psalms XCIV 12)- তে এই কথারই প্রতিধ্বনির শোনা যায়, "Blessed is thou man Chastenest. O Lord" সুখের দিনে, সম্পদের দিনে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রভাবে মানুষ হয়ে ওঠে উদ্ধত ও অহংকারী। এর ফলে আল্লাহ্র রহমত থেকে সে হয় বঞ্চিত। দুঃখ-কষ্টের কষ্টিপাথরে চরিত্রে ধৈর্য্য ও বিনয়ের জন্ম নেয়। বিপদের দিনে, দুঃখের দিনে, কষ্টের দিনে যে ধৈর্য্য ও বিনয়ের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করে, সে পৃথিবীর বহু পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে। স্বয়ং স্রষ্টা তার চরিত্র অমূল্য গুণরাজিতে ভরিয়ে দেন। দুঃখ কষ্টের পথ অতিক্রমের মাধ্যমে চরিত্রে জন্ম নেয়, বিনয় ও সাহসের সাথে বিপদকে অতিক্রমের ক্ষমতা আল্লাহ্র উপর নির্ভরশীলতা, স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের ক্ষমতা, ধৈর্য্য প্রভৃতি বিভিন্ন গুণরাজি । কিন্তু যদি দুঃখ-কষ্টকে আল্লাহ্র দান মনে না করে, এর জন্য আমরা স্রষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ করি, অসন্তুষ্টি প্রকাশ করি, তবে আমরা স্রষ্টার অনুকম্পা লাভে ব্যর্থ হব। শয়তান এ সুযোগ গ্রহণ করে এবং আমাদের শয়তানের পথে নিয়ে যায়। ফলে আমাদের হৃদয় আল্লাহ্ রহমত ধারণে ব্যর্থ হয়। হৃদয় কঠিন হয়ে যায়।
৮৬২। স্নেহ মায়া, মমতা, অপরের জন্য ভালোবাসা, দুঃখির দুঃখ হৃদয় দিয়ে অনুভব করার ক্ষমতা এগুলি হচ্ছে সংবেদনশীল মনের লক্ষণ। হৃদয়ের তন্ত্রী যার অপরের সুখে-দুঃখে উদ্বেলিত হয় সেই তো পারে সত্যকে অনুধাবণ করতে। তারই মাঝে জ্ঞান চক্ষু উম্মীলিত হয়, তার আত্মায় জম্ম নেয় অন্তর্দৃষ্টি। তাঁরই আত্মা আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসরমান। প্রাচুর্যের মাঝে বাস করেও অনেকে দুঃখীর দুঃখ অনুভব করতে চেষ্টা করে। এসব ক্ষেত্রে বলা চলে তাদের হৃদয়ে আল্লাহ্র বাণী খুব সামান্যভাবে হলেও স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু এরা ব্যতীত সংখ্যাগুরু সম্পদশালী লোকেরা সম্পদের অহংকারে স্ফীত হয়ে আল্লাহ্র উপদেশ ভুলে যায়। এদের সস্বন্ধেই এ আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, তাদের জন্য আরও সম্পদ, আরও ভালো কিছু উন্মুক্ত করে দেয়া হলো। এটা তাদের জন্য শুধু যে পরীক্ষা তাই-ই নয় এটা তাদের জন্য এক ধরণের শাস্তিও বটে। শাস্তি এ জন্য যার যত সম্পদ শেষ বিচারের দিনে তার হিসাব হবে তত দীর্ঘতর কঠিন। আল্লাহ্ প্রদত্ত সম্পদ তাদের অহংকারী ও উন্ধত করে তোলে ফলে তারা ধীরে ধীরে পাপের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। আল্লাহ্ বলেছেন, তাদের ভোগ-বিলাসের মাঝে, "অকস্মাৎ তাদের হিসাব গ্রহণের জন্য ডাকি।" অর্থাৎ পৃথিবীর ভোগ-বিলাসের অকস্মাৎ পরিসমাপ্তি ঘটবে। এ সব পাপীরা এর ফলে অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে হতাশা তাদের ঘিরে ধরে।
৮৬৩। অত্যাচারী, অন্যায়কারী, সম্পদ ও ক্ষমতার দম্ভে অন্যের উপরে অত্যাচার করে। মানুষকে মানুষ হিসেবে জ্ঞান করে না। এদের উপরে আল্লাহ্র বিচার,শাস্তির খড়গ হিসেবে নেমে আসে। যুগে যুগে যারা জালিম তারা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যায় এই আল্লাহ্র বিধান। এভাবেই যুগে যুগে মোমেন,সৎ এবং অত্যাচারীতরা আল্লাহ্র এই বিশেষ মঙ্গলময় রূপকেই" জগৎসমূহের প্রতিপালক" বিশেষণটির দ্বারা তুলে ধরেছে।
৮৬৪। দেখুন [২:৭] এবং এর টিকা।
৮৬৫। "অকস্মাৎ" অর্থাৎ হঠাৎ বা কোনও সঙ্কেত বা সাবধানতা ব্যতীত। যারা মোমেন বান্দা, তারা আল্লাহ্র নিদর্শন বুঝতে পারেন এবং তা অনুধাবন করতে পারেন, তারা একথা তাদের অন্তর থেকে জানেন যে মন্দ কাজের পরিণতি অবশ্যই মন্দ হবে, এ কথা দিবালোকের মত সত্য। আল্লাহ্র শাস্তির খঢ়গ অন্যাকারী বা যারা মন্দ কাজের সঙ্গী তাদের উপরে অবশ্যই নেমে আসবে। মোমেন বান্দার এতে কোনও ক্ষতি হবে না। এই-ই হচ্ছে আল্লাহ্র তরফ থেকে ন্যায় বিচার। একে আল্লাহ্র প্রতিশোধ ভাবার কোনও অবকাশ নাই।
৮৬৬। আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব করেছেন। তাকে করেছেন পৃথিবীতে আল্লাহ্র প্রতিনিধি। সে কারণে জীব জগতে একমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি।" সে শক্তি বলে সে ইচ্ছা করলে স্রষ্টার হুকুম পালন করতে পারে বা তা অস্বীকার করতে পারে। এতটুকুই তার স্বাধীনতা। নবী রসূলের পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে আদম সন্তানকে সুপথ প্রদর্শনের জন্য; পাপ থেকে সাবধান করার জন্য। আদম সন্তানের স্বাধীন ইচ্ছাকে খর্ব্ব করার জন্য নয়। ধর্মের ব্যাপারে কোনও বাধ্যবাধকতা নাই। নবী রসূলদের কাজ শুধু সর্তক করে দেওয়া, যেনো পাপীরা তাদের পাপ কাজকে বুঝতে পারে এবং অনুতপ্ত হয়। কারণ আল্লাহ্র শাস্তি অতি ভয়ঙ্কর।
৫০। বল, "আমি তোমাদের বলি নাই যে, আমার নিকট আল্লাহ্র ধনভান্ডার রয়েছে ৮৬৭। আমি অদৃশ্য সম্বন্ধে জানি না। আমি তোমাদের এ কথা বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমার নিকট যে প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে, আমি শুধু তার অনুসরণ করি। বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি এক হতে পারে? তোমরা কি বিবেচনা করবে না? ৮৬৮
৮৬৭। এই আয়াতটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় যে আল্লাহ্র সর্ব নেয়ামতের খবর পয়গম্বরকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর কাছেও নাই। আমাদের দেশে গণকেরা যে দাবী করে তারা ভবিষ্যত জানতে পারে, আবার অনেক নিজেকে ওলী অথবা বুযুর্গ দাবী করে এই ধারণা পোষণ করে যে, তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন, যাকে যা ইচ্ছা দিতে পারেন-এ কথা সুস্পষ্ট মূর্খতা বৈ কিছু নয়। এই আয়াতের সার্বজনীন ব্যাখ্যা হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত নেয়ামতের মালিক আল্লাহ্। আল্লাহ্ যাকে যতটুকু খুশী দান করেন। নবী রসূলদের আল্লাহ্ যাকে যতটুকু সত্য বোঝার বা অনুধাবন করার অন্তর্দৃষ্টি দান করেছেন তিনি ততটুকুই লাভ করেছেন। এ ক্ষমতা তাঁদের আল্লাহ্র নিকট থেকে পাওয়া। তাঁদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা বিবেক অন্তর্দৃষ্টি সবই আল্লাহ্র দান। সব নেয়ামতের মালিক আল্লাহ্, কিছুই তাঁদের নিজস্ব নয়। তারাও আমাদের মত রক্ত মাংসের সাধারণ মানুষ। তাদের আর্দশ, শিক্ষা, বাণী, সবই আল্লাহ্র অশেষ করুণার স্বাক্ষর। আর যারা তাঁদের শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করে তারাও আল্লাহ্র করুণায় বিধৌত।
৮৬৮। নবী, রাসূলেরা আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্ত। এই নিয়ামত তাঁদের নিজস্ব নয়-সব নেয়ামতের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। "অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? " এই বাক্যটির অর্থ নবী রাসূল যারা আল্লাহ্র নেয়ামতের ধন্য, তাদের বলা হয়েছে "চক্ষুষ্মান"। সাধারণ লোক যারা আল্লাহ্র নিদর্শন অনুধাবনে অক্ষম, তাদের বলা হয়েছে "অন্ধ"। সাধারণ অজ্ঞ লোক ও নবী রাসূলেরা সমান হতে পারে না। নবী ও রাসূলেরা অবশ্যই আমাদের নিকট সম্মানের দাবীদার।
রুকু-৬
৮৬৯। মানুষের মধ্যে একশ্রেণীর লোক আছে, যারা ঈমানে বিশ্বাস করে, কিন্তু সেই সাথে নিজেকে পাপ কাজেও নিয়োজিত রাখে। এদের সম্পর্কেই এই আয়াতের নির্দ্দেশ। বলা হয়েছে যে এদেরকে সাবধান করে দিতে শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে,ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে, পরকালের সম্বন্ধে। সে দিন আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোনও রক্ষাকর্তা, বা সুপারিশকারী থাকবে না। একমাত্র আল্লাহ্ই পারেন তাদের পাপকে ক্ষমা করে দিতে।
৮৭০। 'Wajh' এটি একটি সংক্ষিপ্ত আরবী শব্দ যার অর্থ ব্যাপক। ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে self দেখুন [২:১১২] আয়াত এবং টিকা ১১৪। বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে মুখমন্ডল যার অর্থ আল্লাহ্র করুনা বা নিজের মাঝে আল্লাহ্র উপস্থিতি অনুভব করা যা আধ্যাত্মিক জগতের জন্য সর্বোচ্চ পাওয়া।
৮৭১। মক্কায় ধনী এবং প্রভাবশালী কোরেশরা মনে করতো হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) বাণী শ্রবণ করা এবং বিশ্বাস করা তাদের পক্ষে সম্মান হানিকর এই জন্য যে, হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) অধিকাংশ শিষ্য সে সময়ে ছিলেন গরীব এবং সমাজে তাদের কোনও প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল না। তারা রসূলুল্লাহ্র (সা) নিকট দাবী করে যে, "আপনার নিকট যে সকল নিম্ন শ্রেণীর লোক (দরিদ্র মুসলিম) ভীড় করে তাদের বহিষ্কার করলে আমরা আপনার কথা শুনতে পারি।" এর পরিপ্রেক্ষিতেই আয়াতটি নাযিল হয়। কাফেরদের এই দাবী রাসূলুল্লাহ্ নাকচ করে দেন। মক্কার যে সব জনগোষ্ঠি রসূলুল্লাহ্র চারিপাশে ভীড় করেছিল, তা ছিল আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা থেকে উৎসারিত । পৃথিবীর দৃষ্টি কোণ থেকে বিচার করলে এসব গরীব লোকদের রসূলুল্লাহ্র কাছে কিছুই চাওয়া পাওয়ার ছিল না। রাসূলূল্লাহ্ নিজেই স্বয়ং ছিলেন দরিদ্র। তাঁর কোন ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা অর্থ সম্পদ ছিল না। যার লোভে দরিদ্র লোকেরা তাঁর চারিপাশে সমবেত হবে। অপর পক্ষে রসূলুল্লাহ্র এইসব দরিদ্র লোকদের থেকে অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুই পাওয়ার ছিল না। এসব দরিদ্র লোকদের রসূলুল্লাহ্র পাশে সমবেত হওয়ার কারণ কোন পার্থিব লাভ নয়। একমাত্র কারণ ছিল আল্লাহ্র প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। রসূলুল্লাহ্র (সা) মাধ্যমেই আল্লাহ্র রহমত ও করুণার সন্ধান লাভ করা যায়, আল্লাহ্র অমীয় বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করা যায়। যদি কেউ আল্লাহ্র বাণী অনুধাবনের ব্যাপারে আন্তরিক না হয়, তবে সে দোষ রসূলের নয়। কারণ সে আন্তরিক নয়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের স্ব-স্ব কর্মফল ভোগ করবে। কারও ভার কেউ বহন করবে না
৮৭২। পূর্ববর্তী আয়াতের অনুসরণে এই আয়াতটি। ধনী ও প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পন্ন লোকেরা, যাদের আল্লাহ্ গরীব মোমেন বান্দাদের উপরে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করেছেন এই কারণে যে, আল্লাহ্ এর মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করতে চান। ধনীদের প্রভাব প্রতিপত্তি, অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, সত্যকে এবং সত্যের সাধককে চিনতে বাঁধা দান করে। কারণ এসব গরীব মোমেন বান্দাদের দেখে তাদের ঘৃণার উর্দ্রেক হয় এবং তাদের অন্তর বলে, "আল্লাহ্ এসব নিম্নশ্রেণীর লোকদের কি তাঁর শিক্ষা গ্রহণের জন্য নির্বাচিত করেছেন?" অর্থাৎ তাদের চোখে পার্থিব জীবনের চাকচিক্য হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ট মাপকাঠি। কিন্তু আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তিনি জানেন কে তাঁকে অনুসরণ করে, কার আচরণ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়।
৮৭৩। যারা বিনয়ী এবং আল্লাহ্র আয়াতে বিশ্বাসী এবং মোমেন বান্দা, তাদের এই আয়াতে বিশেষ ভাবে সম্মানীত করা হয়েছে তাঁদের প্রতি বিশেষ সম্বোধন দ্বারা। সম্বোধনটি হচ্ছে, " তোমাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক।" Salam শব্দটি শান্তি কথাটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছ। এই বাক্যটির দ্বারা আল্লাহ্ মোমেন বান্দাদের জন্য তাঁর বিশেষ করুণা ও দয়া ঘোষণা দিয়েছেন। তোমার উপরে শান্তি বর্ষিত হোক " এই বাক্যটি ইসলামে একে অপরকে সম্বোধনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
৮৭৪। দেখুন [৬:১২]
৮৭৫। উপরের আয়তগুলি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পাপের পথ হিংসা ও অহংকারে পরিপূর্ণ। সত্যিকারের মোমেন বান্দাকে আল্লাহ্ সম্মানীত করেন।
রুকু-৭
৮৭৬। মক্কাবাসী, যারা আল্লাহ্র আয়াতে অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য কয়েকটি যুক্তি এখানে পেশ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি যুক্তির পূর্বে 'বল' কথাটি বলা হয়েছে। প্রথম চারটি যুক্তি হচ্ছে-
(১) তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যাদের আহ্বান কর তাদের ইবাদত করতে নিষেধ করা হয়েছে।" অর্থাৎ আমি আল্লাহ্র নিকট থেকে স্পষ্ট নির্দেশ লাভ করেছি এবং এই নির্দেশ মেনে চলবো, (৫৬) আয়াত।
(২) "আমি তোমাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করি না" (৫৬ আয়াত)।
(৩) অবিশ্বাসীরা সর্বদা বলে যে, "যদি সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র অস্তিত্ব থাকে, তবে তিনি অবিশ্বাসীদের ধ্বংস করে দেন না কেন ?" এরই উত্তরে রাসূল বলেছেন যে, "তোমরা যা তাড়াতাড়ি চাইছ, তা আমার ক্ষমতার বাইরে।" অর্থাৎ শাস্তি দানের ক্ষমতা রাসূলের নাই - আয়াত (৫৭)।
(৪) "যদি আমার নিকট থাকতো তবে আমার ও তোমাদের মধ্যেকার বিষয় তৎক্ষণাত মীমাংসা হয়ে যেতো" - আয়াত (৫৮)।
(৫৮) আয়াতে রাসূল বলেছেন যে, "আল্লাহ্ সবচেয়ে ভালো জানেন যে, কারা পাপ করে।" এ ছাড়াও বিশ্বভূবনের সব কিছুই তিনি অবগত যা আমরা মরণশীল মানুষেরা আমাদের সীমিত জ্ঞান দ্বারা অনুধাবন করতে পারি না। আল্লাহ্র বৃহৎ পরিকল্পনা সময়ের বৃহত্তর পরিসরে। যার ক্ষুদ্র অংশই শুধু আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা বিশ্বাস করি বা নাই করি, আমাদের কাজের হিসাব তাঁকে অবশ্যই দাখিল করতে হবে।
৮৭৭। "তোমরা যা তাড়াতাড়ি চাইছ।" কাফেরেরা আল্লাহ্ সম্পর্কে ঠাট্ট বিদ্রূপ করে বলে যে আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতির মোতাবেক তাদের শীঘ্র শীঘ্র শাস্তি দান করুন। এটা আল্লাহ্কেই অস্বীকার করার নামান্তর।
৮৭৮। আল্লাহ্ পৃথিবীতে দূত প্রেরণ করেন তাঁর বাণী প্রচারের জন্য। পাপীদের শায়েস্তা করার জন্য নয়। তাদের শাস্তি দান করবেন স্বয়ং আল্লাহ। রসূলের দায়িত্ব হচ্ছে পাপীদের সাবধান করে দেওয়া পরকালে আল্লাহ্র শাস্তি সম্বন্ধে। রসূলের দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথের সন্ধান দেখানো যাতে আমরা পাপ কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারি।
৮৭৯। 'Mafatih' বহুবচনে 'Miftah' যার অর্থ চাবী বা 'Maftah'-ধনসম্পদ । এই দুধরনের অর্থকেই বাংলায় "চাবি" কথাটির দ্বারা প্রকাশ কারা হয়েছে।
৮৮০। এই আয়াতটিতে স্রষ্টার সৃষ্টির নিয়ম বা নীতির যে আদি পরিকল্পনা সে সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে সৃষ্টির আদিতেই স্রষ্টা তার সৃষ্ট প্রতিটি জিনিষকেই এক নির্দ্দিষ্ট নিয়ম নীতির অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। এই নিয়ম বা নীতি অলঙ্ঘনীয়। আমাদের চারিপাশে পৃথিবীতে, আকাশ, বাতাস, তরু-লতা, সবই স্রষ্টার নির্ধারিত স্ব-স্ব নিয়মকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে থাকে। ক্ষুদাতিক্ষুদ্র অনু-পরমানু, জড় জিনিষও প্রকৃতির নিয়মকে ভঙ্গ করে না। সজীব-বিবর্ণ, জীবিত-মৃত কেহই তাঁর আইনের বাইরে নয়। প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিষ থেকে বৃহৎ সবই আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া প্রাকৃতিক আইনের অধীন।
৮৮১। এই বিশ্বে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহ্ প্রদত্ত প্রাকৃতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। তার প্রতিটি মুহুর্ত, এমন কি জাগরণ ও নিদ্রা সবই আল্লাহ্ প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হয়। নিদ্রা বা ঘুম আজও মানুষের বিস্ময়। এর সম্পূর্ণ রহস্য আজও মানুষ উদঘাটন করতে সক্ষম নয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে "It is He, who doth take your souls by night." এখানে 'ঘুম'-কে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ কথা বলা হয়েছে যে ঘুম হচ্ছে 'Twin brother of death' অর্থাৎ ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর যমজ ভাই। অর্থাৎ যখন আমরা ঘুমে থাকি, আমাদের আত্মা আমাদের দেহকে ত্যাগ করে যায়। যেমন-মৃত্যুর সময়ে আমাদের আত্মা আমাদের দেহকে ত্যাগ করে চলে যায়। ঘুমের মাঝে আল্লাহ্ আমাদের আত্মাকে গ্রহণ করেন, সেই সাথে আমাদের সারা দিবসের কর্মপ্রণালীর হিসাব। কখনও কখনও স্বপ্নের ঘোরে আমরা আমাদের দিবসের কর্মের উদ্দেশ্য, বিবরণ, হিসাব, ধারা স্বপ্ন-লোকে দেখে থাকি। রাত্রির ঘুম আমাদের নিকট মৃত্যুর সমতুল্য । দিবসে আমরা আমাদের কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পাই-এভাবেই আমাদের জীবন অতিবাহিত হয় যতদিন না আমরা আমাদের পৃথিবীর নির্ধারিত সময় কাল অতিক্রম করি। পৃথিবীর নির্ধারিত সময়ের পরে আসে অনন্ত নিদ্রা বা মৃত্যুর কাল, যখন আমরা সারা জীবনের কর্মের হিসাব বহন করে নিয়ে যাই। এর পরে একদিন আসবে পুণর্জাগরণের সময় সেদিন হবে শেষ বিচারের দিন। যেদিন আমরা আমাদের ফেলে আসা পৃথিবীর প্রতিটি কর্মকে আমাদের চোখের সামনে ভাস্বর দেখতে পাব।
রুকু-৮
৮৮২। 'রক্ষক'- এই শব্দটিকে অনেকে 'রক্ষাকারী' ফেরেশতারূপে ব্যাখ্যা করেছেন। রক্ষক বা অভিভাকত্ব এই শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা উচিত। আল্লাহ্ আমাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন, আমাদের বিপদে-আপদ,থেকে রক্ষা করেন, আমাদের সুন্দর, ভালো ও আরামদায়ক জীবন ধারণের সব উপকরণ সরবরাহ করেন, আমাদের শারীরিক ও আত্মিক উন্নতির জন্য যা প্রয়োজন সবই তিনি আমাদের দান করেন, সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন এবং পৃথিবীর জীবন যাত্রা শেষে নির্দ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেন। তিনিই আমাদের সর্ব্বাপেক্ষা বড় 'রক্ষক'।
৮৮৩। 'Rasul' শব্দটির অনেক বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে 'আমার প্রেরিতরা' ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে 'Our angels'। রসূল শব্দটি আল্লাহ্র প্রেরিত দূত যারা আল্লাহ্র নির্দ্দেশ সমূহ পৃথিবীতে পৌঁছে দেন তাদের সম্বন্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। যে ফেরেশতা মানুষের জান কবচ করে তারা তাদের কর্তব্য কর্ম নির্ভুল ভাবে করে থাকে। জান কবচকারী ফেরেশতা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দ্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে কখনই তাদের কর্ম সম্পাদন করে না। তারা তা করে নির্ভুলভাবে। "তারা কখনও তাদের কর্তব্যে বিচ্যুত হয় না" এই বাক্যটি দ্বারা এ কথাকেই বুঝানো হয়েছে।
৮৮৪। 'Al haqq' এই শব্দটির অর্থ সত্য, বা একমাত্র সত্য। এখানে হাশরের ময়দানের কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন আমাদের চোখে মায়ার অঞ্জন পরিয়ে রাখে। আমরা মৃত্যুর পরের অনন্ত জীবরের কথা ভুলে যাই। মৃত্যুর সাথে সাথে আমাদের চোখের সামনে থেকে মায়া অঞ্জন সরে যাবে। আমরা সেই সর্ব শক্তিমান প্রভুর কাছে নীত হব এবং আমরা প্রকৃত সত্যকে আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাব। এতদিন যারা আল্লাহ্র শাস্তি প্রত্যক্ষ করার জন্য বারে বারে তাগিত দিয়েছিল। এখন তারা বুঝতে পারবে সে শাস্তির ক্ষিপ্রতা, পরিণাম ও তীব্রতা। তাদের বোধদয় হবে যে আল্লাহ্র পরিকল্পনা অবশ্যই কার্যকর হবে, তাদের ব্যঙ্গক্তি বা উপহাস কোনও কাজেই আসবে না।
৮৮৫। টিকা ৮৭৬-এ আমরা দেখেছি যে,"বল" কথাটির দ্বারা চারটির যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। এই আয়াতগুলিতে [৬:৬৩-৬৫] "বল" কথাটির দ্বারা আরও তিনটি যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। (৫) এই যুক্তিতে বলা হয়েছে যে, কঠিন বিপদে আপদে তেমরা "কাতরভাবে এবং নিঃশব্দে ভীতভাবে তাঁকে ডাক।" তাদের এই অনুনয় তখন তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে উত্থিত হয় আয়াত (৬৩)। (৬) আল্লাহ্র সদয় তত্ত্বাবধানে তারা বিপদ থেকে উদ্ধার পায়। কিন্তু উদ্ধার পাওয়ার পরেই তারা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে অকৃতজ্ঞ হয় আয়াত (৬৪) । (৭) যারা অকৃতজ্ঞ আল্লাহ্র শাস্তি তাদের চুতূর্দিক বেষ্টন করে রাখার ক্ষমতা রাখে আয়াত (৬৫), "তোমাদিগের উর্দ্ধদেশ অথবা পাদদেশ থেকে বিপদ বিপর্যয় প্রেরণ করতো, "কথাটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট তাদের চতুর্দিকে বেষ্টন করে ফেলতে পারে। শুধু তাই-ই নয় তাদের পরস্পরের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, প্রতিশোধের আকাঙ্খা,প্রভৃতি তাদের পরস্পরেরে ভিতরে হানাহানির জন্ম দেবে এবং জাতিগত, বংশগত সম্প্রীতি হবে নষ্ট। সমাজের শৃঙ্খলা হবে বিঘ্নিত। "একদলকে অপর দলের প্রতিশোধের আস্বাদ গ্রহণ করাইতে তিনি সক্ষম" এই বাক্যটির দ্বারা উপরোক্ত ভাবধারার প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত, জাতিগত এই বিপর্যয় থেকে রক্ষাকর্তা একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্।
৮৮৬। "Zulumat কথাটির অর্থ জনমানব শূণ্য অন্ধকার নিভূত স্থান, ভয়াবহ বিপদজনক স্থান যেমন মরুভূমি, ঘন জঙ্গল , অথবা সুউচ্চ পর্ব্বত বা গভীর সমুদ্র , যেখানে বিপদের সমূহ সম্ভবনা।
৮৮৭। এই আয়াতের উচ্চারণ দু'ভাবে পড়া যায়, তবে উভয় ক্ষেত্রে এর অর্থের বিশেষ তারতম্য ঘটে না। (১) Khufyatan যখন এই শব্দটি উচ্চারণ করা হয় তখন এর অর্থ হয়, নিঃশব্দে গোপনে, অন্তরের অন্তস্থল তেকে,প্রচন্ড ভয়ে বাক্যহারা হয়ে। (২) Khifatan যখন এই শব্দটি উচ্চারণ করা হয়, তখন এর অর্থে হয়ে যায় আতঙ্কিত ভাবে,অথবা ভীত ভাবে, অথবা ভক্তিভরে আয়াত [৭:২০৫]-এ যেভাবে উল্লেখকরা হয়েছে।
৬৫। বল' তোমাদের উর্দ্ধদেশ অথবা পাদদেশ থেকে বিপদ-বিপর্যয় প্রেরণ করতে ৮৮৮,অথবা দলগত বিবাদের সময়ে বিভ্রন্তিতে আচ্ছাদিত করে, এক দলের অপর দলকে প্রতিশোধের আস্বাদ গ্রহণ করাইতে তিনিই সক্ষম, দেখ, কিভাবে আমি বিভিন্ন [[প্রতীকের] মাধ্যমে আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করি ৮৮৯; যাতে তারা বুঝতে পারে।
৮৮৮। "উর্দ্ধদেশ ও পাদদেশ থেকে বিপদ-বিপর্যয় প্রেরণ করতে" উর্দ্ধদেশ অর্থাৎ যা আকাশ থেকে পতিত, যেমন-তুষার ঝড়, প্রচন্ড হ্যারিকেন (ঝড়),প্রবল বৃষ্টিপাত, প্রভৃতি তলদেশ অর্থাৎ, ভূমিকম্প, বন্যা ভূমিধস ইত্যাদি।
৮৮৯। দেখুন [৬:৪৬] আয়তে সঙ্গীতের ধূয়ার (প্রথম লাইন) মত যা আরম্ভ করা হয়েছিল, এই আয়াতে [৬:৬৫] সেই যুক্তির সমাপ্তি টানা হয়েছে।
৮৯০। এই আয়াতটি যে সময় নাজেল হয় তখন রসূলের প্রচন্ড বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হত। সমবেত ভাবে মক্কার লোকজন তাঁকে বাঁধা দান করে। মক্কাবাসীরা আল্লাহ্র নির্দ্দেশ প্রচারে শুধুমাত্র বাঁধা দান করেই ক্ষান্ত হয় নাই, তারা রসূলের (সা) জীবন নাশের চেষ্টা করে। এখানে আল্লাহ্ বলেছেন নবীর কর্তব্য তো শুধু আল্লাহ্র বাণী ও নির্দ্দেশ পৌঁছে দেওয়া কারও চরিত্র সংশোধনের দায়িত্ব তাঁর নয়। প্রত্যেককেই আল্লাহ্ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দিয়েছেন সেই ইচ্ছা শক্তির ব্যবহার রসূলের নির্দ্দেশিত আল্লাহ্র পথে করবে নিজ নিজ চরিত্রের সংশোধনের জন্য। এ দায়িত্ব প্রত্যেকের ব্যক্তিগত। আল্লাহ্ নবীকে পরিস্কার ভাবে ঘোষণা করতে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্র নির্দ্দেশ যুগে যুগে ও কাল উপযোগী করে প্ররণ করা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রতিটি নির্দেশের জন্য সময় ও কাল বেধে দেয়া হয়েছে । যারা রাসূলকে বাঁধা দান করেছিলো, তারা এ সত্য খুব শীঘ্রই অনুধাবন করেছিলো যে, তাদের ধ্বংসের মাধ্যমে, বাঁধাদানকারীদের সময় ও কাল শেষ। কারণ তাদের মানসিকতা ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল অন্যায়, অসত্য, স্বার্থপরতা, অত্যাচার ও জুলুমের উপরে। সুতরাং রসূলকে বাঁধাদানকারীদের ধ্বংস ছিল অনিবার্য,ইসলাম প্রচারের জন্য তা ছিল অবধারিত।
৬৮। যখন তুমি লোকদের দেখবে আমার আয়াতসমূহের মিথ্যা [উপহাসমূলক] আলোচনা করতে, সেখান থেকে চলে আসবে যতক্ষণ না তারা অন্য প্রসঙ্গে ফিরে আসে ৮৯১। যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর, পাপী সম্প্রদায়ের সাথে বসে থাকবে না।
৮৯১। দেখুন [৪:১৪০]। যদি কোথাও সত্যকে হাস্যস্পদ করা হয়, তবে আমাদের উপরে নির্দ্দেশ আমরা যেনো সেখানে কালক্ষেপন না করি। যদি আমরা এরকম কোনও অবস্থাতে নিজেদের আবিস্কার করি, তবে আমাদের উপরে নির্দ্দেশ যে মূহুর্তে তা হৃদয়ঙ্গম করবো সাথে সাথে প্রতিবাদ হিসেবে সে স্থান ত্যাগ করবো।
৮৯২। প্রত্যেক লোক স্ব-স্ব কর্মের জবাদিহিতার জন্য দায়ী , কিন্তু মোমেন বান্দার দায়িত্ব দ্বিবিধ। মোমেন বান্দাদের দ্বিবিধ কর্তব্য নিম্নরুপ (১) তারা মন্দ থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। (২) প্রতিকূল পরিবেশেও তাদের আল্লাহ্র নির্দেশ প্রচারিত করতে হবে। অবশ্যই তাদের এই চেষ্টা কিছু সুফল বয়ে আনবে। "যেনো তারা আল্লাহ্কে ভয় করতে শেখে"- এই লাইটির দ্বারা উপরোক্ত ভাবধারাটিই বুঝানো হয়েছে।
৮৯৩। আয়াত [৬:৩২]-এ বলা হয়েছে,"পার্থিক জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নয়।" ধর্ম ও পরকালের অঙ্গীকার হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তার প্রতিই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ইহকালের জীবন ক্ষণস্থায়ী, পরকালের জীবন অনন্তকাল। সুতরাং অনন্তকাল জীবনের প্রস্ত্ততির জন্য ধর্মকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু এই আয়াতে [৬:৭০] বলা হয়েছে যে পৃথিবীর মানুষ ব্যাপারটিকে ঠিক উল্টোভাবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ তারা পরকালের জীবন ও ধর্মকে কম গুরুত্বপূর্ণ এবং হাসি আনন্দের বিষয় বস্তুরূপে কল্পনা করে। এর প্রচুর উদাহরণ আমাদের সমাজে বর্তমান, রোজা না করে ঈদের আনন্দ, আত্মাত্যাগের মানসিকতা ব্যতীতই কোরবাণী দেওয়া ও গর্ব অনুভব করা এবং মন্দ ও খারাপ কাজ ত্যাগ না করেই হজ্জ্বের ময়দানে আল্লাহ্র সমীপে হাজির হওয়া, শবেবরাতের নামজকে সংক্ষিপ্ত করে হালুয়া রুটিতে মনোনিবেশ করা, ঈদে-মিলাদুন্নবীতে রসূলের (সা) জীবনীকে অনুধাবন ও নিজের চরিত্রে তার প্রতিফলনের পরিবর্তে আনন্দ ফূর্তিতে গা ভাসিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। ধর্মের অন্তর্নিহিত ভাবকে অনুধাবন না করে, তাকে আনন্দ ফূর্তির খোরাক হিসেবে কল্পনা করার কারণ, এসব লোকেরা পৃথিবীর জীবনের চাকচিক্যতে মুগ্ধ হয়ে তাতেই গা ভাসিয়ে দেয়। তাদের কর্মফল তাদের ভোগ করতে হবে।
৮৯৪। যেহেতু ইসলামে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের স্থান অত্যন্ত উর্দ্ধে এখানে কোনও মধ্যবর্তী ব্যক্তির স্থান নাই। "ইহা দ্বারা তাদের উপদেশ দাও।" "ইহা" অর্থাৎ কোর-আন। কোরানের নির্দ্দেশিত পথে জীবনকে পরিচালিত করার উপদেশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এই আয়াতটিতে [৬:৭০] পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে প্রত্যেকের দায়-দায়িত্ব তার নিজস্ব, এখানে কোনও মধ্যবর্তী ব্যক্তির স্থান নাই। জীবন দর্শনের নির্দ্দেশ নিতে হবে পবিত্র কোরান থেকে।
[অনুবাদকের মন্তব্যঃ কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ জীবনের চিত্র ভিন্ন। যদিও আমরা নিজেদের মুসলিম বলে প্রচার করি, কিন্তু এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠি আল্লাহ্র হুকুম প্রতি মূহুর্তে অমান্য করে চলেছে। প্রথমতঃ এদেশের জনগোষ্ঠি পীর এবং মুরীদানে বিশ্বাসী এসব পীররাই মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করে থাকে মুরীদদের জন্য -যা ইসলামের নিষিদ্ধ। মুরীদরা নিজস্ব চরিত্র সংশোধন অপেক্ষা পীর পূঁজাতে অধিক আগ্রহী। পরকালে চরিত্রের উন্নতি বা আত্মিক পরিশুদ্ধতাই জবাবদিহিতার মানদন্ড। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ্ পরিস্কার ভাবে বলেছেন যে জীবন দর্শনের নির্দ্দেশ নিতে হবে পবিত্র কোরান থেকে-অন্য কোথাও থেকে নয়। এটাও বান্দার নিজস্ব দায় ও দায়িত্ব। তবে অবশ্যই প্রত্যেকের কোরান পড়ে বুঝতে হবে-তবেই কোর-আন থেকে জীবন দর্শনের নির্দেশ আহরণ করা সম্ভব।]
রুকু-৯
বল, "আল্লাহ্র পথ নির্দ্দেশই [একমাত্র] পথ নির্দ্দেশ। এবং আমরা আদিষ্ট হয়েছি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পন করতে;-
৮৯৫। টিকা ৮৭৬ এবং টিকা ৮৮৫এই দুটি ক্ষেত্রে "বল" শব্দটির দ্বারা সাতটি যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। এই আয়াতে [৬:৭১] আরও দুটি যুক্তির অবতারণ করা হয়েছে। (৮) এমন কে আছে যে চিরঞ্জীব, অনাদি ও অনন্ত আল্লাহ্র নিকট থেকে পথের নিশানা পাওয়ার পরেও জীবনহীন এবং ক্ষমতাহীন বস্তুর পূঁজা করবে? (৯) সুতরাং কেবলমাত্র আল্লাহ্র দেখানো সৎ পথের অনুসরণ করা এবং তাঁর নিয়ম নীতি ও আইনের অনুসরণ করা এবং শেষ বিচারে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করাই হচ্ছে আল্লাহ্র একমাত্র নির্দ্দেশ।
৭৩। তিনিই সৃষ্টি করেছেন আকাশ ও পৃথিবী যথার্থ [অনুপাতে] ৮৯৬। যখন তিনি বলেন, "হও" ,দেখ [সাথে সাথে তা ]হয়ে যায়। তাঁর কথাই সত্য। যেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে সেদিনের কর্তৃত্ব তো তাঁহারই। দৃশ্য ও অদৃশ্য সব কিছুর সম্বদ্ধে তিনি ভালভাবে জ্ঞাত। নিশ্চয়ই তিনি প্রজ্ঞাময় এবং [সকল জিনিষ সম্বদ্ধে] সবিশেষ অবহিত।
৮৯৬। আল্লাহ্ বিশ্বভূবনের সৃষ্টি কর্তা। বিশ্বের অণু-পরমাণু সৃষ্টির মধ্যেও তাঁর জ্ঞানের প্রকাশ অনুভব করা যায়। অনন্ত জ্ঞানের আধাঁর তিনি- তাঁর সৃষ্টির নৈপুণ্য এবং পুর্ণাঙ্গরূপই তাঁর জ্ঞানের সাক্ষর বহন করে।সৃষ্ট জীব ক্ষণস্থয়ী, তার ধ্বংস আছে। কিন্তু স্রষ্টা চিরঞ্জীব এবং অনাদি। তিনি স্থান ও কালের উর্দ্ধে। তাঁর কথাই সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। শুধু যে কেন্দ্রবিন্দু তাই-ই নয়, তাঁর হুকুম শ্বাসত সত্য এবং তাঁর হুকুমই শেষ পর্যন্ত বিরাজ করবে। অনেক সময়ে নীতিভ্রষ্টতা আমাদের চমৎকৃত করতে পারে, কিন্তু যে মূহুর্তে শিঙ্গা ফুকানো হবে, রোজ কেয়ামত সংঘঠিত হবে। শেষ বিচারে অনুষ্ঠিত হবে এবং যা ন্যায় ও সত্য তাই প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সব কিছুই আচ্ছন্ন করে দেবে।
৭৫। এইভাবে আমি ইব্রাহিমকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালনা ব্যবস্থা দেখাই , যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয় ৮৯৭।
৮৯৭। এখান থেকে হযরত ইব্রাহিমের কাহিনী শুরু। তিনি যে গোত্রে বাস করতেন তারা গ্রহ তারকার জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন। হযরত ইব্রাহিমকে আল্লাহ্, পার্থিব পৃথিবীর বাইরের জ্ঞানে ধন্য করেছিলেন। সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি স্রষ্টার জ্ঞান লাভ করেন। পূর্বপুরুষদের মূর্তি তাঁর কাছে পূঁজনীয় ছিল না। পূর্বপুরুষদের পূঁজনীয় মূর্তিকে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় তার একত্ববাদের প্রথম পদক্ষেপ। সেখানে থেকে আল্লাহ্ তাঁকে বহু উর্দ্ধে স্থাপন করেন। আল্লাহ্ তাঁকে প্রাকৃতিক পৃথিবীর নিয়ম-কানুন এর চাকচিক্য, ক্ষমতা সব কিছুর উর্দ্ধে স্রষ্টার সন্নিকটে স্থাপন করেন।
৮৯৮। এই আয়াতটি ইঙ্গিত করে হযরত ইব্রাহিমের আত্মিক উন্নতির ধাপগুলির দিকে। ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে তিনি আত্মিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হন। স্বাভাবিকভাবেই পূর্বপুরুষদের রীতি অনুযায়ী দূর দিগন্তের উজ্জ্বল তারকারাজি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। তিনি তার পূঁজা শুরু করেন। কিন্তু তিনি আশাহত হন যখন দিনের আগমনে তারকারা অন্তর্হিত হয়। তিনি বুঝতে পারলেন উজ্জ্বল তারকারাজির রাত্রির আকাশে আগমন এবং দিনে অন্তর্ধান সবই প্রাকৃতিক আইনের অধীনে। আর এই প্রাকৃতিক আইনের ধারক আল্লাহ্। সুতরাং তারকারাজিকে পূঁজার কোন অর্থই নাই। এদের কোনও শক্তি-ই নাই। এরা কোনও বৃহৎ শক্তি দ্বারা চালিত। যে বস্তু পরিবর্তনশীল, যার অবস্থা নিয়তই পরিবর্তিত হতে থাকে এবং স্বীয় গতিশীলতায় অন্য শক্তির অধীনে, সে কিছুতেই পালনকর্তা হওয়ার যোগ্য নয়।
কোন কোন সমালোচক মন্তব্য করেন যে, [৬:৭৬-৭৮]-এ হযরত ইব্রাহিম পয়গম্বসুলভ প্রজ্ঞা ও উপদেশ প্রয়োগ করে প্রথমবারেই তাদের নক্ষত্র পূঁজাকে ভ্রান্ত পথভ্রষ্টতা বলে অ্যাখ্যা দেন নাই। বরং তাদেরকে ধীরে ধীরে অনুপ্রাণীত করেন নক্ষত্র পূঁজার অসারতা ও কুসংস্কার সম্বদ্ধে।
৮৯৯। চাঁদকে যদিও তারা অপেক্ষা অনেক বড় ও উজ্জ্বল দেখা যায়, তবুও চাঁদের ক্ষয় আছে, নির্দিষ্ট সময় অন্তে অস্ত যায়, সর্বপরি চাঁদের কোনও নিজস্ব আলো নাই। চাঁদ আলোর জন্য সূর্যের উপরে নিভর্রশীল। সুতরাং যায় উজ্জ্বলতা এবং সৌন্দর্য্যের জন্য যে অন্যের উপরে নির্ভশীল তা কখনও স্রষ্টা হতে পারে না। অন্ধকারময় রাত্রি, চাঁদের উদয়ে আলোর বন্যায় ভেসে যায়; কিন্তু সে আলোর উৎস তার নিজস্ব নয়। সেরূপ পৃথিবীর সাময়িক চাকচিক্য,বা কারও বিশেষ ক্ষমতায় (পার্থিব বা আধ্যাত্মিক) মোহিত না হয়ে, সব ক্ষমতার উৎস, জগৎ সংসারের মালিক আল্লাহ্র অনুসন্ধান করা উচিত।
৯০০। ধারাবাহিকতায় তারার আলোর থেকে চাঁদের আলো অধিক উজ্জ্বল, আবার সূর্যের আবির্ভাবে চাঁদের আলোয় ম্লান হয়ে যায়। হযরত ইব্রাহীম এভাবেই ধীরে ধীরে স্রষ্টার অন্বেষণ করেন। কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে সূর্য স্থায়ী নয়, তা উদয় হয় এবং অস্থ যায়-তখন তিনি বুঝতে পারলেন সূর্য স্রষ্টা হতে পারে না। স্রষ্টা এক, অদ্বিতীয় এবং স্থির। হযরত ইব্রাহীমের আধ্যাত্মিক জগতের বিকাশের ধারাবাহিকতাই এখানে প্রকাশ করা হয়েছে। বিকাশের এই ধারাবাহিকতা যেমন-হযরত ইব্রাহীমের জন্য প্রযোজ্য ঠিক সমভাবে তা সবার জন্য প্রযোজ্য। যারা আধ্যাত্মিক জগতের পথিক, যারা সাধারণ মানুষ, তাদেরও ঠিক হযরত ইব্রাহীমের মত আধ্যাত্মিক জগতে ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটে।
৮০। তাঁর সম্প্রদায় তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো ৯০১। সে বলেছিলো," [এসো] তোমরা কি আল্লাহ্ সম্বন্ধে আমরা সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও-যখন তিনি [নিজে] আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন? তোমরা যাদের আল্লাহ্র সাথে শরীক কর, আমি তাদের ভয় করি না; যতক্ষণ না আমার প্রভু ইচ্ছ করেন [ততক্ষণ কিছুই ঘটবে না]। আমার প্রভুর জ্ঞান সব কিছুকে ঘিরে থাকে। তবুও তোমরা কি [নিজেদের] সতর্ক করবে না ?
৯০১। যারা সত্যের সন্ধানী,হযরত ইব্রাহীমের কাহিনী তাদের জন্য এক দিগ-নির্দেশনা। যদি কেউ সত্য সাধনায় সফল হয়, যদি কেউ তার আত্মায় আল্লাহ্র নূরকে ধারণ করতে সক্ষম হয়, তবে অবশ্যই তার মধ্যে থেকে পূর্বপুরুষদের সকল কুসংস্কার দূর হয়ে যাবে। যদি তাকে এ জন্য বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, তবে যে সত্যের সন্ধান পায়, তার জন্য এসব বাঁধা তুচ্ছ। যারা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র করুণা ও ক্ষমার সন্ধান পায় না , তারা বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়, বিভিন্ন জিনিষ যেমন-শুভ-অশুভ,রত্ন-পাথর,পীর ফকিরদের কেরামতি,সাধু সন্ন্যাসী ইত্যাদিকে বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা সকলকেই ভয় করে চলে। কারণ তারা সবর্দা ভীত থাকে সকলের ক্ষমতা ও শক্তি সম্পর্কে। যেমন হযরত ইব্রাহীম তারার আলো, চাঁদের আলো, সূর্যের আলো, প্রত্যেককে ক্ষমতাধর বলে বিভ্রান্ত হয়েছিলো। যে ব্যক্তি এক আল্লাহ্তে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহ্র সান্নিধ্য আত্মার মধ্যে অনুভব করে, তার পক্ষে অন্য কারও ক্ষমতা বা শক্তিকে মান্য করা বা তার অনুগত হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্র প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাস ,তার সব ভয়-ভীতি দূর করে দেবে। অপর পক্ষে যারা এক আল্লাহ্র প্রতি আস্থা স্থাপনের পরিবর্তে বিক্ষিপ্তভাবে বহুশক্তিকে সন্তুষ্টি করতে চায়, তারা সর্বদা আতঙ্কিত থাকে। ঈমানের দৃঢ়তা ব্যক্তিকে করে ভয়শূন্য। অপরপক্ষে দূর্বল ঈমান, ব্যক্তিকে কুসংস্কারপূর্ণ ও ভীত করে তোলে।"তোমরা যাদের আল্লাহ্র শরীক কর তাদের আমি ভয় করিনা।" একথাটি দ্বারা উপরের ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে।
৮২। এরাই তারা যারা ঈমান এনেছে এবং "জুলুম" দ্বারা তাদের বিশ্বাসকে কলুষিত করে নাই, তারাই [প্রকৃত পক্ষে] নিরাপদ, তারাই [সঠিক] পথে পরিচালিত। ৯০১-ক।
৯০১-ক। এখানে 'জুলুম' কথাটির অর্থ শিরক্। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র সাথে অংশীদারিত্ব করে। এই আয়াতটি ব্যাখ্যা রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এভাবেই করেছেন।
রুকু-১০
৯০২। হযরত ইব্রাহীমের কাহিনী থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে আধ্যাত্মিক জগতের পথ ধীরে ধীরে অতিক্রম করতে হয়। এর সাফল্য একদিনে অর্জিত হয় না। বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "যাকে ইচ্ছা আমি স্তর থেকে স্তরে সর্বদা উন্নীত করি।" ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, "We raise whom we will degree after degree." হযরত ইব্রাহীমকে আল্লাহ্র আধ্যত্মিক জ্ঞানে ও মর্যাদায় সমসাময়িক সকলের থেকে উন্নত করেছিলো। আল্লাহ্র হুকুম ছিল, এই জ্ঞান তিনি মানুষের মধ্যে প্রচার করবেন।
৯০৩। এ পর্যন্ত আঠারো জন নবী রাসূলের উল্লেখ করা হয়েছে যাদের চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এই শ্রেণী বিভাগের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকগণও অন্তর্ভূক্ত যারা তিনটি প্রধান ধর্মের প্রচারক এরা হলেন, হযরত মুসা, হযরত ঈসা, এবং মুহম্মদ (সাঃ)। বিভাগের প্রথম শ্রেণীতে আছে হযরত ইব্রাহীম, তাঁর ছেলে ঈসাহাক, হযরত ঈসাহাকের ছেলে ইয়াকুব। হযরত ইব্রাহীমের হচ্ছেন প্রথম যিনি আল্লাহ কর্তৃক কিতাব প্রাপ্ত হন। তার কিতাবের কথা কোরানের [৮৭:১৯] আয়াতে উল্লেখ করা আছে; অবশ্য তাঁর এই কিতাবের অস্তিত্ব এখন নাই। কিতাব প্রাপ্ত জাতিদের মধ্যে তারাই হলেন প্রথম।
৯০৪। শ্রেণী বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণীতে আছেন, নূহ(আ) যার সময়ে পৃথিবী বন্যাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনি পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতিকে পুনরায় পৃথিবীতে পুনঃস্থপিত করেন। আরও বলেছেন,দাউদ, সুলায়মান, আইউব, ইউসুফ, মুসা এবং হারুন। দাউদ ও সোলায়মান নবী দ্বারা ইহুদীদের বিরাট রাজত্বের পতন হয়। আইউব নবী ১০৪বছর বাঁচেন এবং তিনি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর চতুর্থ বংশধরের দেখে যেতে পারেন; এবং আল্লাহ্ তাঁকে প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেন। ইউসুফ নবী মিশরে প্রধান মন্ত্রীত্ব লাভ করেন এবং দুটি গোত্রের তিনিই ছিলেন পূর্বপুরুষ। মুসা এবং হারুন ছিলেন মিশর ত্যাগকারী ইহুদীদের নেতা। এরা সবাই সৎ কাজের অংশীদার ছিলেন এদের আল্লাহ্ বলেছেন "সৎ-কর্মপরায়ণ।"
৯০৫। শ্রেণী বিভক্তির তৃতীয় শ্রেণীতে আছেন কর্মীর দল, যারা সত্য প্রচারে সহায়তা করেছেন। এদের একমাত্র বিশেষণ হচ্ছে পূণাত্মা ব্যাক্তি। এসব পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরা হযরত ঈসার আগমন এবং তার সত্য প্রচারের সাথে সম্পৃক্ত। জাকারিয়া ছিলেন ইয়াহিয়ার পিতা। ইয়াহিয়াকে [আয়াত ৩:৩৭-৪১] বলা যায় হযরত ঈসার আগমনের অগ্রদূত।
৯০৬। শ্রেণী বিভক্তির চতুর্থ শ্রেণীতে আছেন ইসমাঈল , আল্-আয়সা, ইউনুস ও লূত নবী। এদেরকে আল্লাহ্ পৃথিবীর সকল জাতির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এর কারণ এই চারজনই তাদের জীবদ্দশায় প্রচন্ড দুঃখ কষ্টের পথ অতিক্রম করেছেন। কিন্তু তারা আল্লাহ্র উপরে ভরসা হারান নাই। হযরত ইসমাঈলের কাহিনী সকলের জানা। শিশু অবস্থায় তিনি নির্বাসিত হন জনমানবশূণ্য মরুভূমিতে। তিনি এবং তার মা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে জীবন ফিরে পান আল্লাহ্র রহমত জম্জম্ কুপের মাধ্যমে এবং পরিণত বয়সে আরবদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্মান লাভ করেন। আল্ আয়সা ছিলেন ইলিয়াস নবীর উত্তরাধিকারী। তাঁকে জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়। কারণ তিনি এক দূর্যোগপূর্ণ অত্যাচারী ইহুদী রাজার রাজত্বে বাস করতেন। ইউনুস নবীর মাছের পেটে থাকার কাহিনী এবং আল্লাহ্র রহমতে সেখান থেকে উদ্ধার লাভ এবং নিনেভা নগরে সত্য প্রচারের কাহিনী [১০:৯৮] সকলেরই জানা। লূত ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের ভ্রাতুস্পুত্র। যখন 'সদম' নগরী সমকামিতার জন্য ধ্বংস হয়, আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা করেন। [৭:৮০-৮৪]
৯০৭। এই আয়াতে তাদের শব্দটি দ্বারা উপরের চার শ্রেণীর পূণ্যাত্মাদের কথা বলা হয়েছে।
৮৯। এরাই তারা যাদের আমি কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবুওয়াত দান করেছিলাম। যদি তারা [তাদের বংশধরেরা] এগুলি প্রত্যাখান করে ৯০৮, দেখ, আমি তাদের দায়িত্ব নূতন সম্প্রদায়ের উপর অর্পণ করবো, যারা তা প্রত্যাখান করবে না।
৯০৮। "এইগুলিকে" দ্বারা 'কিতাব', 'কর্তৃত্ব' এবং 'নবূয়ত' - ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। এইগুলি পূর্ববর্তী কিতাবধারিদের নিকট থেকে হযরত মুহম্মদের (সাঃ) এবং তাঁর উপরে যারা ঈমান এনেছেন তাদের উপরে ভার অর্পণ করা হয়।
রুকু-১১
৯০৯। "Qadara" এই আরবী শব্দটির অর্থ ওজন করা, বিচার করা, মূল্য নির্ধারণ করা, মর্যাদা উপলব্ধি করা। দেখুন আয়াত [৪:১৪৯] এবং টিকা ৬৫৫। ইহুদীরা রসুলুল্লাহর আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রাপ্তি সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করেছিলো। তার উত্তরে এ কথা বলা হয়েছে যে, তাদের কিতাব হযরত মুসার নিকট প্রেরিত ঐশি গ্রন্থ-ই এর বড় প্রমাণ। যারা হযরত মুসার প্রাপ্ত প্রত্যাদেশ ও তার আল্লাহ্র ঐশিগ্রন্থ প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী নয়। তাদের জন্য উত্তর হচ্ছে, " তারা আল্লাহ্র মর্যাদা যথার্থ উপলব্ধি করে নাই।" যদি আমরা আল্লাহকে সর্বশক্তিমান ও বিশ্বের প্রভু এবং স্রষ্টা রূপে স্বীকার করি, তবে সকল সুন্দর ও ভালোর উৎসও সেই মহিমান্বিত প্রভু এ কথা স্বীকার করতে হয়। এর পরে যদি কেউ বলে যে পৃথিবীতে সুস্থ সুন্দররূপে জীবনে চলার পথ নির্দ্দেশ আল্লাহ্র নিকট থেকে আসে না; "কিতাব আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রাপ্ত নয়, তারা তাদের বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সত্য ও সুন্দরকে খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে; এটা তাদের অহমিকা ও দাম্ভিকতার প্রকাশ মাত্র। কারণ আল্লাহ্ এখানে তাদের লক্ষ্য করতে বলেছেন, তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি, বলা হয়েছে, "তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষেরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো।" পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে কিভাবে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর আধ্যাত্মিক জগৎ তমসাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল।
৯১০। দেখুন [৫:৪৪,৪৬] আয়াত এবং টিকা ৫৭০। এই আয়াতেগুলিতে বলা হয়েছে "পথ-নির্দ্দেশ ও আলো" এই দুটি আয়াতেই পথ -নির্দ্দেশকে আলোর পূর্ব্বে স্থাপন করা হয়েছে। কারণ তা হচ্ছে সাধারণ লোকের জন্য- যাদের আত্মা আলোকিত হয় আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথে জীবন যাত্রার ফলে। সুতরাং পথ- নির্দ্দেশ আলোর পূর্বে স্থাপন করা হয়েছে। এই আয়াতে [৬:৯১] 'আলোকে' 'পথ-নির্দ্দেশের, পূর্বে স্থাপন করা হয়েছে। কারণ "তারা বলে আল্লাহ্ কিছুই নাযিল করেন নাই।" 'কিছু অর্থাৎ আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ। এখানে 'আলো, হচ্ছে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ যার মাধ্যমে পথ নির্দ্দেশ আছে।
৯১১। হযরত মুসার কিতাব ছিল একটাই এবং তা ছিল বিভিন্ন নবী রাসূলদের বাণীর ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু কালক্রমে তা "ওল্ড টেষ্টামেন্ট" নামে বিভিন্ন বইএর (পৃষ্ঠার) সমষ্টিতে পরিণত হয়। এর ফলে মূল বই এর বিভিন্ন অংশ গোপন করা হয়েছে, যা আংশিক প্রকাশ করা হয়েছে। পরিণতিতে মূল কিতাবের যা মূলনীতি তা থেকে বিচ্যুত হয়ে শুধু মাত্র বাহ্যিক লোক দেখানো বস্তুতে পরিণত হয়েছে। একই কথা "নিউ টেষ্টামেন্ট" সম্পর্কে প্রযোজ্য।
৯১২। "Mubarak" এই কথাটির অর্থ আশীর্বাদ পুষ্ট, বা "কল্যাণময়" অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র আশীর্বাদ লাভ করেছে। যারা আল্লাহ্র করুণায় সিক্ত হয়ে অপরের জন্য আল্লাহ্র রহমতের পথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ্র সর্বোচ্চ আশীর্বাদ বা রহমত হচ্ছে পথ-নির্দ্দেশ ও আলো। আল্লাহ্র 'কিতাব' - আমাদের এই পথের নির্দ্দেশ দান করে, যে পথে জীবন যাপন করলে আমাদের আত্মা উন্নতি লাভ করবে এবং আল্লাহ্র নূরে আত্মা আলোকিত হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। আলোকিত আত্মা হচ্ছে গুণে সমৃদ্ধ আত্মা। এই আত্মা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করে।
৯১৩। বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "মক্কা ও তার চতুর্পার্শ্বের" এবং ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, 'Mother of cities and around her, এখানে মক্কাকে শহর সমূহের মাতা বলা হয়, কারণ তা হচ্ছে আদি শহর। কারণ হযরত ইব্রাহীমের সময় থেকেই মক্কা পরিচিত [দেখুন ২:১২৫,১৯৭এবং টিকা ২১৭] "মক্কা ও উহার চতুর্পার্শ্বে বা "All round Makkah" কথাটির অর্থ মক্কাকে কেন্দ্র বিন্দু সাব্যস্ত করে সারা পৃথিবীকেই বোঝানো হয়েছে।
৯১৪। এই আয়াতে আল্লাহ্র এবাদত সমূহের বিবরণ দেয়া হয়েছে। পরকালের বিশ্বাসের সাথে যুক্ত করা হয়েছে কোর-আনে বিশ্বাসকে। এই আয়াতে "এই" কথাটির দ্বরা "কল্যাণময় কিতাব" অর্থাৎ "কোর-আন" এর কথা বলা হয়েছে। আন্তরিকতা এবং একাগ্রতা নিয়ে 'কোর-আন' পাঠ হচ্ছে আল্লাহ্র এবাদত করা; এবং প্রার্থনা বা নামজও এর অন্তর্ভূক্ত। সমস্ত ভালো কাজ ও দান ও হচ্ছে আল্লাহ্র এবাদতের অংশ।
৯১৫। "তোমাদিগের আত্মাকে বের কর"। এখানে 'আত্মা' অর্থাৎ প্রাণকে বোঝানো হয়েছে। যারা পাপী, তারা পৃথিবীর জীবন সম্বন্ধে এত মোহবিষ্ট হয়ে থাকে যে, তারা কল্পনাও করতে পারে না যে এই দেহ একদিন বিনাশ হবে এবং আত্মাকে তার কর্মের জন্য জবাবদিহিতার জন্য দাঁড়াতে হবে।
৯১৬। মানুষের আত্মা অমর। মৃত্যু আমাদের ক্ষণস্থায়ী দেহকে ধ্বংস করে দেবে। এই দেহ মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি; যা মৃত্যুর পরে আবার মৃত্তিকাতেই মিশে যাবে। এই আয়াতে আল্লাহ্ আমাদের আত্মাকে সম্বোধন করেছেন। আত্মা এই পৃথিবীর জীবনে অনেক ধাপ অতিক্রম করে। পরিবেশগত কারণে এই পৃথিবীতে আমাদের সকলের অবস্থান এক স্থানে নয়। কেউ জন্মে ধনীর ঘরে, কেউ গরীবের ঘরে,। কেউ জীবনকে গড়ার সুযোগ পায়, কেউ পায় না। ফলে আমাদের কর্মস্থল হয় বিভিন্ন। সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থানের বিভিন্নতার জন্য, শৈশবে, কৈশরে, যৌবনে, বার্ধক্যে সমাজে আমাদের অবস্থান বিভিন্ন হয়। আয়াত [৩২:৭-৯]-এ বিবরণ আছে কিভবে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি, কিভাবে আত্মাকে নিকৃষ্ট মৃত্তিকার তৈরী দেহের সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। মৃত্যুতে প্রত্যেকের দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্টির প্রথমে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় স্রষ্টার কাছে নীত হবে। শুধু তার সাথে থাকবে তার কাজের বা অভিজ্ঞতার ইতিহাস। " উহাদিগের কার্যকলাপ আছে আমল নামায়। আছে ক্ষুদ্র ও বুহৎ সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ" [৫৪:৫২-৫৩] আয়াত। এই পৃথিবীতে বিভিন্ন জন আল্লাহ্র বিভিন্ন নেয়ামতে ধন্য। কেউ শিল্পী, কেউ বিজ্ঞানী, কেউ শিল্পপতি, কেউ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ইত্যাদি , সবই আল্লাহ্র নেয়ামত। পৃথিবীর অগ্রগতির জন্য আল্লাহ বিভিন্ন ব্যক্তিও বিভিন্ন নেয়ামতে ধন্য করেছেন। মৃত্যুতে নশ্বর দেহ ত্যাগের সাথে সাথে এসব নেয়ামতকেও ত্যাগ করে সৃষ্টির প্রথমে আত্মার সেই অবস্থানে স্রষ্টার কাছে যেতে হবে। অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, আত্মীয়-স্বজন, পুত্র-কন্যা, বন্ধু-বান্ধব, মেধা,মনন শক্তি, প্রতিভা, অর্থাৎ পার্থিব জীবনের কোন কিছুই সাথে করে নেয়া যাবে না। সাথে যাবে শুধু পৃথিবীর জীবনের কর্মফল।
৯১৭। সুখে, দুঃখে, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন, আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার নামই হচ্ছে ইসলাম। কিন্তু মানুষ সর্বদা আল্লাহ্র সাথে শরীক করতে ভালোবাসে। সে আল্লাহ্র প্রতিনিধিরূপে ব্যক্তিপূঁজা করে (demi god) যা আমাদের দেশে দেখা যায় পীর পূঁজারূপে। কোনও বিপদ আপদে এসব পীরের মুরীদরা ছুটে যায় পীরের দরগায়। ইসলামে মধ্যবর্তীর স্থান নাই। বিপদে আপদে সর্বাবস্থায় বান্দা সরাসরি আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করবে। এছাড়াও বীর পূঁজা, বরণ্য ব্যক্তি পূঁজা, বিজ্ঞানকে আল্লাহ্র উপরে স্থান দেওয়া ইত্যাদি শেরেকের নামান্তর। মৃত্যুর সাথে সাথে এ সবই অন্তর্হিত হবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত হবে; কেউ কারোও দায়-দায়িত্ব বহন করবে না।
রুকু-১২
৯১৮। স্রষ্টার শিল্প-দক্ষতা ও তাঁর নৈপুর্ণ প্রকাশ পায় তার সৃষ্টির মাধ্যমে। এই আয়াতে সুন্দর ভাবে তা বর্ণনা করা হয়েছে। শব্দ চয়নে অতি সাধারণ, কিন্তু তারই মাধ্যমে সৃষ্টির মুল ধারাকে অপূর্ব ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবন জৈবিক জীবন। খাওয়া-পরা প্রজনন এতো পশুর জীবন। এই জীবনের জন্যেই মানুষ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে। এই সাধারণ জীবনে সাধারণ চাওয়া-পাওয়ার জন্য আমরা সম্পূর্ণরূপে পৃথিবীর উদ্ভিদ জগতের উপর নির্ভরশীল। তাই উদ্ভিত জগতের উপমার সাহায্যে আল্লাহ্ আমাদের বৃহত্তর মহত্তর জীবনের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। যে জীবন হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবন। পার্থিব জীবনের বাইরে মানুষের আছে উচ্চতর জীবন যা পশুদের নাই। পার্থিব জীবনের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের সেই উচ্চতর জীবনের সন্ধান দিয়েছেন এই আয়াতে। এই শিক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয় জাতিগত ভাবে সবার জন্যই প্রযোজ্য। সকালের সূর্য্য, রাতের তারা, আকাশের চাঁদ এসব বিরাট বিশাল সৃষ্টি থেকে ক্ষুদ্র বীজ ও তার অঙ্কুরোদগম সবই আল্লাহ্র শিল্প দক্ষতা ও তাঁর সৃষ্টি শৈলি নৈপুর্ণ্যের দিকে ইঙ্গিত করে এবং আমাদের মহান আল্লাহ্র সম্বন্ধে চিন্তা বা ধ্যান করার সুযোগ দান করে যা আমাদের আত্মাকে করবে উন্নত সমৃদ্ধ এবং আত্মার অন্ধকার দূর করে আত্মিক জীবনের উন্মেষ ঘটাবে।
৯১৯। এখানে উপমা হিসেবে শষ্য বীজ ও খেজুরের বীচিকে ব্যবহার করা হয়েছে পুরো উদ্ভিদ জগৎকে উপস্থাপন করার জন্য। দেখানো হয়েছে আমাদের পার্থিব জীবন কিভাবে এই উদ্ভিদ জগতের উপরে নির্ভরশীল। উদ্ভিদতত্ব বলে যে, বীজ দুধরনের-একবীজ পত্রী ও দ্বিবীজপত্রী। এর মধ্যে শষ্য যেমন- ধান, গম, বার্লি এরা একবীজপত্রী এবং ডাল জাতীয় যথাঃ সিম, মটরশুটি, ছোলা ইত্যাদি দ্বিবীজপত্রী। মোটামুটি পৃথিবীর সমস্ত বীজকেই এই দুই শ্রেণীতে বিভক্তি করা যায়। এই আয়াতে খেজুরের বীচিকে ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ সে সময়ে আরব দেশে খেজুর ছিল বেঁচে থাকার মূল কৃষি পণ্য। আরবের লোকদের মূল খাদ্য শষ্য ছিল খেজুর-এই খেজুর ছিল তাদের মূল শষ্যকণা, খেজুর তাদের ফলের অভাব পূরণ করতো, মিষ্টির পবির্তে ব্যবহৃত হতো,খেজুর গাছ ঘরের খুটি, খেজুর পাতা ঘরের ছাউনীরূপে ব্যবহৃত হতো। মরুদ্যানে খেজুর গাছই একমাত্র ছায়াদানের উপকরণ। সে সময়ে খেজুর গাছের সংখ্যা দ্বারা ব্যক্তির সম্পদের হিসাব নিরূপন করা হতো। অর্থাৎ একে বলা চলে সে সময়ে আরববাসীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে খেজুর গাছের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সেই কারণে এখানে উপমার জন্য খেজুরের বীচিকে ব্যবহার করা হয়েছে। 'Falaqa' আরবী শব্দটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে "অঙ্কুরিত" ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে "Split & sprout" অর্থাৎ দ্বিধা বিভক্ত হয় এবং অঙ্কুরিত হয়। এ কথা আমরা সবাই জানি যে বীজ অঙ্কুরিত হতে প্রথমে (১) বীজকে দ্বিধা বিভক্ত হতে হয় (২) পরে এক অংশ শিকড়রূপে মাটির অন্ধকারে প্রবেশ করে এবং অন্য অংশ কান্ডরূপে আলোতে মুক্ত প্রকৃতিতে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে পাতা, ফুল, ও ফলে সুশোভিত হয়। শিকড়ের কাজ হচ্ছে গাছকে মাটির সাথে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা ও মাটি থেকে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় রস আহরণ করা এবং কান্ডের কাজ হচ্ছে সেই রসে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করা এবং সেই খাদ্য সুসম বন্টনের মাধ্যমে গাছকে পাতা, ফুল ও ফলে শোভিত করা। এই দুয়ের সমতায় মাধমে একটি গাছের সম্পূর্ণতা ঘটে। একটি অতি ছোট ও সাধারণ উদাহরণের মাধ্যমে সমতাকে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীতে আমাদের জীবনও দুভাগে বিভক্তঃ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবনেও আল্লাহ্র দেয়া নীতিমালা ঠিক ঐ উদ্ভিদের মত একই ভাবে কাজ করে। পার্থিব জীবন গাছের কান্ডের মত চাকচিক্যময় সুশোভিত এবং বাহ্যিক ভাবে দ্রষ্টব্য। আর আধ্যাত্মিক জীবন গাছের শিকড়ের মত লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে, কিন্তু জীবনের মূল রস আহরিত হয় সেই জীবন থেকেই। কারণ আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য মানুষ, মানুষ হিসেবে পরিচিত। পশু হিসেবে নয়।
(১) প্রথমটি হচ্ছে উদ্ভিদ জগৎ। উদ্ভিদ জগতের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই গাছের জীবন চক্রে শীত কালে শীত প্রধান দেশে গাছ পত্র শূন্য হয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যায়। বসন্তে এই সব মৃতপ্রায় গাছ আবার নূতন পাতা ও কুড়িতে সুশোভিত হয়ে ওঠে, গ্রীষ্মে ডাল পালা মেলে তা বেড়ে ওঠে আবার শরতের আগমনে গাছের সব পাতাগুলি লাল হয়ে ঝড়ে পড়তে শুরু করে, শীতের প্রস্তুতির জন্য তখন গাছগুলি পত্রশূন্য অবস্থায় মৃতপ্রায় রূপে দাঁড়িয়ে থাকে। গাছদের এই জীবন চক্র আমাদের দেশে এতটা তীব্র ভাবে অনুভূত হয় না। কিন্তু শীতপ্রধান দেশে বৃক্ষের এই জীবন চক্র এত তীব্রভাবে দৃষ্টিগোচর হয় যে, তা প্রকৃতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের দেশে শীতের তীব্রতা না থাকাতে শীতকালে গাছগুলি পত্রশূন্য হয় না। বৃক্ষের এই জীবন চক্র - শীতে মৃত্যু, বসন্তে জীবন লাভ, গ্রীষ্মে বৃদ্ধি এবং শরতে মৃত্যুর প্রস্তুতি ও আবার শীতে মৃত্যুসম অবস্থা; এই আয়াতটিকে বোঝার জন্য প্রযোজ্য। আবার মরুভূমি সাদৃশ্য মাটি বৃষ্টিতে সজীব হয়ে জীবনের স্পর্শে ভরে যায়, আবার বৃষ্টির অভাবে সুজলা-সুফলা ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়। এও এক ধরণের মৃত থেকে জীবন্ত ও জীবন্ত থেকে মৃতের আবির্ভাব ঘটানো।
(২) দ্বিতীয়তঃ আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে, তখন আল্লাহ্র করুণায় তা দীপ্তমান হয়ে ওঠে। যদি আমরা আল্লাহ্র দেয়া নৈতিক আইন মেনে না চলি, তবে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন আবার অন্ধকারে ঢেকে যাবে, অর্থাৎ আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের মৃত্যু ঘটবে। এভাবে বহুবার আমাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে। নশ্বর জীবন ও মৃত্যুর মালিক আল্লাহ্। জীবন ও মৃত্যু আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত হতে পারে না।
৯২১। পৃথিবী ও নভোমন্ডল আল্লাহ্র সৃষ্টির বিশালত্বের নিদর্শন। দিনের সূর্য্য, রাতের চন্দ্র, অসীম নিলীমার অসংখ্যা তারকারাজি সেই বিশালত্বেরই ইঙ্গিত দান করে। চাঁদ, সূর্য্য তারা, কত দূরে তাদের অবস্থান, বিশাল নভোমন্ডলের বিশালত্বের ধারণা করা আমাদের কল্পনারও বাইরে, তবুও মনে হয় এরা আমাদের কত কাছের। কারণ আমাদের দিন-রাত্রির হিসাব, বৎসর অতিক্রান্তের সময়, অর্থাৎ আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ নভোমন্ডলের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পরাক্রম আমাদের ধারণারও বাইরে। তবুও নভোমন্ডলের সৃষ্টির মধ্যে তার কিছু আভাষ লাভ করা যায়। "পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের" - বাক্যটির দ্বারা এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে। দেখুন আয়াত [৬ : ৯১] ও টীকা ৯০৯। যেখানে বলা হয়েছে "তাহারা আল্লাহ্র মর্যাদা যথার্থ উপলব্ধি করে নাই।" আরও দেখুন আয়াত [৪ : ১৪৯] এবং টীকা ৬৫৫।
৯২২। পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে, সূর্য্য ও চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন বিধাতা মানুষের সময়ের হিসাব রাখার জন্য। এই আয়াতে বলা হয়েছে তারাকে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্ধকার রাতে মানুষ যেনো পথের নিশানা ঠিক করতে পারে। আমরা জানি কম্পাস আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ ধ্রুব তারার সাহায্যে গভীর সমুদ্র পাড়ি দিত।
৯২৩। Ansha'a এই আরবী শব্দ বহুবিধ অর্থবোধক। এর অর্থ হয় 'বৃদ্ধি পাওয়া' (grow) আয়তনে বা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়া (increase), সম্প্রসারিত হওয়া (develop), পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়া (reach maturity)। এর সবগুলি অর্থই সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রজনন প্রক্রিয়া পৃথিবীর এক অত্যাচার্য প্রক্রিয়া। এক ব্যক্তি থেকে পৃথিবী আজ কোটি কোটি মানুষে পরিপূর্ণ। এই কোটি কোটি মানুষ প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র, প্রত্যেকেই নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য, মৌলিক মানসিক শক্তিতে (faculty of mind) ধন্য। আমরা সকলেই বর্ণে, শারীরিক গঠনে, মানসিক শক্তিতে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র, তবুও আমরা সকলেই একই আদম সন্তান - মানব সম্প্রদায়। পরের আয়াতে আঙ্গুর, দাড়িম্ব ইত্যাদি ফলের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। সমস্ত আঙ্গুরই প্রায় একই রকম, তবুও এদের স্বাদে, গন্ধে, রসে কতই না পার্থক্য। আবার একই গুচ্ছের আঙ্গুরের প্রত্যেকটির মধ্যে স্বাদে কতই না পার্থক্য। সেইরূপ মানব সম্প্রদায় এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি হলেও তাদের বৈশিষ্ট্যে কতই না পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
৯২৪। মানব আত্মার জন্য পৃথিবীর বাসস্থান হচ্ছে "স্বল্পকালীন" বাসস্থান এবং পরকালের জীবন হচ্ছে অনন্ত জীবন যা "দীর্ঘ বাসস্থান।" পৃথিবীর এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করার জন্য আল্লাহ্ আমাদের বিভিন্ন মানসিক ক্ষমতা দিয়েছে। আমাদের বিভিন্ন গুণাবলী দ্বারা ভূষিত করেছেন, যেন আমরা তার সদ্ব্যবহার দ্বারা পরকালের শান্তিময় অনন্ত জীবন লাভ করতে পারি।
৯২৫। এই আয়াতে রূপক বর্ণনার মাধ্যমে আমাদের আত্মার বিকাশের ধারাবাহিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। বারি বর্ষণ শুষ্ক মাটিকে সিক্ত করে, ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে এবং সময়ের ব্যবধানে চারা গাছ পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে ও ফুলে ফলে সুশোভিত হয়। তারপর একদিন আসে ফসল ঘরে তোলার সময়। ঠিক একই রকম ভাবে আমরা আমাদের পৃথিবীর জীবন উপভোগ করি, কর্মে, সাফল্যে সময়ের ভাড়া পূর্ণ করি। এই পৃথিবীর জীবনকে অতিক্রমকালে আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান লাভ করি। ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ আধ্যাত্মিক জগতের পথের নির্দেশ দান করে। এই পৃথিবীর জীবনের মাধ্যমে পরকালের মুক্তি বা আধ্যাত্মিক জীবনের ফসল "পরিপক্কতা লাভ করে" ও ফসল ঘরে তোলা যায় এ ফসল হচ্ছে ঈমানের ফসল।
৯২৬। আঙ্গুর, দাড়িম্ব বা যয়তুন ইত্যাদি বিভিন্ন ফল আল্লাহ্ মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন। একই প্রজাতির ফল হওয়া সত্বেও এরা প্রত্যেকেই স্বাদে ও গন্ধে, আলাদা। যেমন- আঙ্গুর একই প্রজাতির হওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকার আঙ্গুরের মধ্যে প্রভূত মিল। আবার রং, আকার, আকৃতি, গন্ধ, স্বাদে, রসে এদের মধ্যে অমিলও কম নয়। আবার একই গুচ্ছ আঙ্গুরের মধ্যে প্রতিটি আঙ্গুরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। এই উপমার সাহায্যে আল্লাহ্ আমাদের বলেছেন যে, যদিও "পৃথিবী জুড়ে আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মানুষ জাতি" যদিও মানুষ এক-ই প্রজাতি, তবুও জগত জুড়ে প্রতিটি মানুষ আলাদা। শুধু যে বাহ্যিক আলাদা তাই-ই নয়; প্রতিটি মানুষেরই আত্মিক বিকাশ বিভিন্ন হয়। এই বিভিন্নতা সত্বেও তা সমভাবে মূল্যবান।
৯২৭। এখানেই এই সুন্দর রূপক বা উপমার সমাপ্তি টানা হচ্ছে। বীজের অঙ্কুরোদগম থেকে ফুল ও ফল এবং ফসলের পরিপক্কতা লাভ, এই পরিবর্তন আমরা প্রতিদিন আমাদের চারিপাশে দেখতে পাই। কিন্তু প্রকৃতির এই পরিবর্তনকে মানুষের জীবনের সঙ্গে তুলনা ও রূপকের ব্যবহারে এই আয়াতটি হয়েছে অনবদ্য। বিশ্ব সাহিত্যে এমন গুঢ় অর্থবোধক প্রার্থনা সঙ্গীত যা ভাষা ও ভাবে সমৃদ্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৯২৮। এই অপূর্ব সুন্দর আয়াতগুলির শেষে সঙ্গীতের ধূয়ার মত ধূয়া আছে। সঙ্গীতের প্রথম লাইনটি যেমন বারে বারে গাওয়া হয়। এখানেও ছোট্ট একটি লাইন প্রতিটি আয়াতের শেষে যোগ করা হয়েছে। আয়াত [৬:৯৭]-তে বলা হয়েছে "জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আমি নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করিয়াছি।" ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে,"We detail Our Sign for people who know." জ্ঞানই শক্তি; আমাদের এই পার্থিব পৃথিবী ও নভোমন্ডল সবই আল্লাহ্র জ্ঞানের স্বাক্ষর বহন করে। আয়াত [৬ : ৯৮]-তে বলা হয়েছে "অনুধাবন কারী সম্প্রদায়ের জন্য আমি নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেছি"; ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে, "We detail Our Sign for people who understand."। "Understand" বা অনুধাবন করা তা হচ্ছে আমাদের আত্মার উচ্চতর ক্ষমতার বিকাশ। জ্ঞান লাভ করা এক প্রকার মানসিক ক্ষমতাকে বোঝায়, কিন্তু অনুধাবন করার ক্ষমতা তার থেকেও উচ্চতর মানসিক ক্ষমতা (higher faculty of mind). শুধু জ্ঞান আহরণ করে মানুষ কখনও প্রকৃত জ্ঞানী হয় না, তখন মানুষ হয় learned। জ্ঞানের সাথে যখন অনুধাবন ক্ষমতার জন্ম লাভ করে তখন মানুষ হয় জ্ঞানী বা Wise। সে তখন জীবনের উচ্চতর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়। তার ভিতরে জন্ম লাভ করে অন্তর্দৃষ্টি ও বিবেক। চোখে যা দেখা যায় তার বাইরেও তিনি তখন দেখতে পান। আয়াত [৬ : ৯৯] এর শেষে আছে "মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য উহাতে নিদর্শন রয়েছে," যার ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে "There are sign for people who believe." এই আয়াতে এসে মানুষের জীবনের শেষ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ঈমান বা বিশ্বাসই হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তারাই মোমেন বান্দা যাদের আছে বিশ্বাস বা ঈমান। আর এই ঈমানই বান্দাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়। ঈমানের বিভিন্ন ধাপকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে ১) জ্ঞান ২) অনুধাবন ৩) বিশ্বাস বা ঈমান।
৯২৯। 'জ্বিন' - তারা কে ? আয়াত [১৮ : ৫০]-এ বর্ণনা করা হয়েছে যে ইবলিস্ জ্বিনদের একজন ছিলেন। আবার এ কথাও বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ ফেরেশতাদের আদমকে সেজদা করতে বললেন, ইবলিস্ ব্যতীত সকলেই সেজদা করলো। এই বর্ণনা থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, ইবলীস ফেরেশতাদের সঙ্গী ছিল। কিন্তু কোন ফেরেশতা ছিল না। কোরান শরীফের বহু স্থানে আল্লাহ্ মানুষ ও ফেরেশতাকে যুগ্মভাবে সম্বোধন করেছেন। আয়াত [৫৫ : ১৪-১৫]-এ উল্লেখ আছে আল্লাহ্ মানুষকে কাদা থেকে এবং জ্বিনদের আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন। কোরান এবং হাদীস উভয় স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে জ্বিনেরা এক আলাদা প্রজাতি। জ্বিনদের আগুন থেকে সৃষ্টির করা হয়েছে এবং মানুষের মত তাদের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করা হয়েছে। ফলে ইচ্ছা করলে তারা ঈমান আনতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে তারা অবিশ্বাসীতে পরিণত হতে পারে, ইচ্ছা করলে তারা আল্লাহ্র নির্দেশনামা বা হেদায়েত গ্রহণ করতে পারে বা তা পরিত্যাগ করতে পারে। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, জ্বিনেরা কোন অদৃশ্য শক্তি নয়। তারা হচ্ছে এক বিশেষ প্রজাতি, যাকে আল্লাহ্ নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন, যার হিসাব বা জবাবদিহি তাকে দাখিল করতে হবে, আল্লাহ্র দরবারে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক আছে যারা জ্বিনকে ক্ষমতায় আল্লাহ্র কমকক্ষ মনে করে।
রুকু - ১৩
৯৩০। দেখুন [২ : ১১৭] এবং টীকা ১২০।
১০৩। দৃষ্টি তাঁকে ধারণ করতে পারে না। কিন্তু তিনি ধারণ করতে পারেন সকল দৃষ্ট বস্তু। সকল উপলব্ধির উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান এবং তথাপি তিনি সবকিছুর সাথেই পরিচিত ৯৩১।
৯৩১। 'Latif' এই শব্দটির অর্থ, সুক্ষ, এত সূক্ষ যে ইন্দ্রিয়ের অগোচর। দেখুন আয়াত [২২ : ৬৩] এবং টীকা ২৮৪৪।
৯৩২। মওলানা ইউসুফ আলীর মতে এই আয়াতে আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে সম্বোধন করেছেন। তাঁর মতে আয়াতটির প্রথমে "বল" কথাটি প্রযোজ্য। তাহলে পুরো আয়াতটি হবে আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দেশিক কিন্তু রাসূল কর্তৃক প্রচারিত বাণী।
৯৩৩। দেখুন আয়াত [৬ : ৬৫] এবং টীকা ৮৮৯।
৯৩৪। আল্লাহ্ কোরানের বাণীকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য অনেক উপমা, প্রতীক, বর্ণনা ব্যবহার করেছেন যার অধিকাংশ আমাদের চারিদিকের প্রকৃতি, আমাদের চেনা পরিবেশ থেকে নেয়া, যাতে আল্লাহ্র বাণীকে অনুধাবনে সুবিধা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে মনের দিগন্তকে প্রসারিত করা হয়েছে নূতন নূতন ক্ষেত্রে। যে কোন অধ্যবসায়ী এবং আন্তরিক শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জন্য এরূপ ভাবেই শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অগ্রসর হবেন, যেমনটি হয়েছিলেন আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)। যারা প্রাকৃতিক জ্ঞানের সন্ধানে ব্যপৃত তাদের মাঝে যদি সামান্যতমও আধ্যাত্মিক জ্ঞান থাকে তবে তারা এসব উপমা, রূপক, প্রতীক ও বর্ণনা দ্বারা তাদের আধ্যাত্মিক জগতের জ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হবেন। তাদের পার্থিব জ্ঞান ছিল একমুখী। এখন এই জ্ঞানের মাধ্যমে অতিন্দ্রিয় জগতের জ্ঞান, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সন্ধান লাভে তারা সক্ষম হবেন।
১০৭। যদি আল্লাহ্র পরিকল্পনা থাকতো তবে তারা মিথ্যা উপাস্য গ্রহণ করতো না ৯৩৫। আমি তোমাকে তাদের কার্যকলাপের পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করি নাই। আর তুমি তাদের অভিভাবকও নও।
৯৩৫। আল্লাহ্ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, যদিও তা সীমিত আকারে, আর নির্দেশ দান করেছেন যে এই ইচ্ছা শক্তিকে আল্লাহ্র আইন মানার মাধ্যমে, আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করার জন্য। মানুষের সাথে আল্লাহ্র সম্পর্কই হচ্ছে ঈমান ও নৈতিক মূল্যবোধের অঙ্গীকার, আর এই অঙ্গীকার আদম সন্তানকে পূর্ণ করতে হবে স্ব-ইচ্ছায়। অবিশ্বাসীরা বলে যে, যদি আল্লাহ্ এতই শক্তিশালী তবে কেন পাপী ও মন্দদের ধ্বংস করে দেন না ? কেন তাদের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিলীন করে দেয়া হয় না ? উত্তর হচ্ছে আল্লাহ্ তা পারেন; "আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করতেন" কিন্তু তা আল্লাহ্র পরিকল্পনা নয়। আল্লাহ্র পরিকল্পনা আলাদা। আদম সন্তানকে দেয় স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির ব্যবহারে আত্মিক উন্নতি ঘটানোই তার ইচ্ছা। সুতরাং রাসূলকে বলা হয়েছে "তোমাকে তাদের পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করি নাই; আর তুমি তাদের অভিভাবক নও।" রাসূলের উপরে নির্দেশ শুধু তাঁর কাছে অবতীর্ণ সত্যের প্রচার করা।
৯৩৬। ধর্ম বিশ্বাসের জিনিস, ধর্ম অন্তরের ধন - যার প্রকাশ পায় ধার্মিক লোকের আচার আচরণে, তার ব্যক্তিত্বে। মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের মূলে অনেক শক্তি কাজ করে। তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য অনুভূতি, মনঃস্তত্ব, প্রবণতা, জীবন ধারণের ইতিহাস (যা মনঃস্তত্ববিদেরা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেন), বংশগতি, শিক্ষা এবং আরও সব সুক্ষ শক্তি যা তার চরিত্রের উপরে প্রভাব ফেলে তার ব্যক্তিত্ব গঠন করে। মোমেন বান্দা যারা, তারা আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত, তাদের কর্তব্য হচ্ছে (১) মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের মূলে যে সব শক্তি কাজ করে, তার যে কোনটি কাজে লাগাতে যেনো তা ব্যক্তির চরিত্রকে সংশোধন করতে পারে। (২) যা কিছু অপবিত্র ও অপব্যবহার হয়েছে তা পবিত্র করা। (৩) জীবনের প্রতি এবং প্রতিটি জিনিসের প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গীর পরিবর্তন করা এবং নূতন ধারণার সৃষ্টি করা। (৪) যা কিছু মন্দ তার বিরুদ্ধে লড়াই করা। এ সবই করার একটি উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে সত্যকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি লাভ করা। আত্মাকে অন্ধকার থেকে আলোতে অগ্রসর করা। যদি এই কাজে শিক্ষকের বিচক্ষণতা ও দক্ষতা না থাকে, তবে ফল হবে বিপরীত। সত্যের প্রতি, আল্লাহ্র প্রতি মানুষের আকর্ষণ বা শ্রদ্ধাবোধের পরিবর্তে, সাধারণ মানুষ অশ্রদ্ধা বোধ করবে এবং একগুয়ে ভাবে সত্যকে বা আল্লাহ্র বাণীকে প্রতিরোধ করবে। ফলে যারা বিশ্বাসে দুর্বল ছিল, তাদের মধ্যেও সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকবে। এই প্রতিরোধ ও জেদের ফলে তারা মুক্ত চিন্তাধারার পরিবর্তে বদ্ধ সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে যায়। নিজেদের সংস্কার বা ধ্যান ধারণাকে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করতে থাকে। এ কথা ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য, জাতির জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ্ তাঁর অসীম করুণায় এসব বিপথগামীদের সহ্য করে থাকেন এবং যারা সত্য পথের পথিক, মোমেন বান্দা আল্লাহ্ তাদের বলেছেন যে তারা যেনো এসব কুসংস্কারচ্ছন্ন ব্যক্তিদের ধ্যান ধারণাকে অবজ্ঞাভরে গালি না দেয়। কারণ তার ফলে এসব অবোধ লোকেরা সত্যের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার পরিবর্তে বিতশ্রদ্ধ হবে এবং আল্লাহ্ ও তার নির্দেশকেও গালাগালি করবে। "অজ্ঞানতা বশতঃ অন্ধ আক্রোশে তারাও আল্লাহকে গালি দিবে। এইভাবে, প্রত্যেক ব্যক্তির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি।" এই লাইনটি দ্বারা উপরের ভাবকেই বোঝানো হয়েছে। তবে তাই বলে মোমেন বান্দারা তাদের যোগ্যতা ও গুণাবলী সম্বন্ধে এত বিনীত হবে না যাতে তাদের চরিত্রের অমূল্য গুণরাজী ঢাকা পড়ে যায়। অথবা অন্যায় ও মন্দর সাথে সন্ধি করে, অথবা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে অস্বীকার করবে।
[অনুবাদকের মন্তব্য : আজকে বাংলাদেশের ধর্মীয় আকাশে যে কালোমেঘের সৃষ্টি হয়েছে - সেই পরিপ্রেক্ষিতে উপরের আয়াতের উপদেশ অত্যন্ত কার্যকর।]
৯৩৭। যারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে, আল্লাহ্র বাণীতে বিশ্বাস করে না তারা হয় একগুয়ে ও জেদী। তাদের একগুয়েমী ও জেদ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, তারা সত্যকে অস্বীকার করতে পারলেই সুখী, কোনও যুক্তি তর্কই তাদের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করতে পারে না। কারণ যীশু খৃষ্টের জীবনের মত অত্যাশ্চার্য জীবন আর পৃথিবীতে নাই। অলৌকিক ঘটনায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন পরিপূর্ণ। তবুও লোকে তাঁকে অবিশ্বাস করেছিল। আমাদের এই পৃথিবী, আমাদের প্রতিদিনের জীবনের দিকে আমরা যদি বিচক্ষণতার সাথে দৃষ্টিপাত করি, তবে দেখবো আল্লাহ্র নিদর্শনে তা ভরপুর। যারা ঈমানদার বা বিশ্বাসী শুধু তারাই তা দেখতে পারে। নির্দিষ্ট কোনও অলৌকিক কর্মকান্ডের প্রতি বিশ্বাস যদি ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি হয় তবে তা প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাস নয়। আল্লাহ্ বলেছেন "যদিও [বিশেষ] নিদর্শন আসতো, তারা ঈমান আনতো না।" অর্থাৎ নিদর্শন তাঁদের মনমত হতে হবে। সমস্ত সৃষ্টি ব্যাপী আল্লাহ্র নিদর্শন ছড়ানো - যথাঃ প্রাণীর দেহভ্যন্তরের যে জৈবিক প্রক্রিয়া, প্রাণী জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ। পৃথিবীর আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, সমুদ্রস্রোত - সবই ইঙ্গিত করে সেই মহান স্রষ্টার অগাধ জ্ঞানের ও সৃষ্টির শৈলীর দিকে। এসব নিদর্শনকে অনুধাবনের মাধ্যমেই স্রষ্টাকে অনুধাবন করা যায়। যারা সে চেষ্টা না করে তাদের মনগড়া বিশেষ অলৌকিক ক্রিয়াকর্মকে ধর্মের ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করে, তারা তা করে তাদের বিভ্রান্তি, জেদ ও একগুয়েমীর জন্য। এর সাথে ধর্মের বা আল্লাহ্র কোনও সম্পর্ক নাই।
[মন্তব্য : বাংলাদেশীরা পৌত্তলিকদের মত অলৌকিক ক্রিয়াকর্মে অত্যন্ত বিশ্বাসী। সেই কারণে তারা সর্বদা 'পীর' নামে এমন ব্যক্তির অনুসন্ধান করে যার সম্বন্ধে অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের কাহিনী বাজারে প্রচলিত। বাংলাদেশীরা সেই পীর নামক ব্যক্তির মনোরঞ্জন করে পার্থিব লাভের আশায়, আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়। ফলে আমাদের দেশে "পীর ব্যবসা" অত্যন্ত জমজমাট যা ইসলামিক নীতির বিরুদ্ধ।]
৯৩৮। যারা আল্লাহ্র নিদর্শনকে এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে অনুধাবনের চেষ্টা না করে এবং একগুয়েমী ও জেদের বশবর্তী হয়ে অলৌকিক কর্মকান্ডকে ধর্মের ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করে, এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ্ তাদের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধিও বিলোপ করে দেবেন। "তাদের অন্তর ও দৃষ্টি [বিভ্রান্তির দ্বারা] পরিবর্তন করে দেব।" ফলে তাদের অন্তঃকরণ শক্ত পাথরের মত হয়ে যাবে, তাদের হৃদয়ে সিলমোহর দিয়ে দেয়া হবে। যার ফলে এসব লোকেরা সাধারণ সত্যকেও অনুধাবণ করতে পারবে না। তারা সত্য থেকে যত দূরে সরে যাবে তত তাদের মধ্যে মন্দ ও পাপকে গ্রহণ করার প্রবণতা, পাপের পিচ্ছিল পথে অবতরণের গতি বৃদ্ধি পাবে।
৯৩৯। আল্লাহ্র করুণা পাপী, পূণ্যাত্মা, দুর্বল, অজ্ঞ, সবার জন্য সমভাবে বহমান। তিনি পাপী-তাপী সকলের অনুতাপ গ্রহণ করে ক্ষমা করার জন্য দু'হাত বাড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে আছেন। কিন্তু যাদের হৃদয় তালাবদ্ধ, চক্ষু থেকেও অন্ধ, তারা আল্লাহ্র রহমতের সন্ধান লাভ করবে না। তাদের অবাধ্যতা, একগুয়েমী, জেদ, বিদ্রোহ, তাদের আল্লাহ্র রহমত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রেই আল্লাহ্ "তাদের অন্তরে ও নয়নে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন।" আয়াত [২:১৫]-এ এদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, "তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দেন।"
রুকু - ১৪
৯৪০। প্রচন্ডভাবে বিস্ময়কর অলৌকিক বস্তু তাদের সামনে হাজির করলেও তারা আল্লাহ্র অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করবে না। এমন কি আধ্যাত্মিক জগতের সমস্ত শক্তিকেও যদি তাদের সম্মুখে হাজির করা হয় তবুও তারা আল্লাহ্র শক্তিতে বিশ্বাস করবে না। কারণ তারা স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্র নিদর্শনকে অস্বীকার করেছে এবং অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়েছে। এই হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান বা আইন।
৯৪১। আমাদের নবীর জীবনে দুষ্টলোকেরা ঈমান আনার পরিবর্তে নবীর জীবনের দুঃখ দুর্দশার কারণ। এই ঘটনা শুধুমাত্র যে আমাদের নবীর জীবনে ঘটেছে তা নয়, পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সত্যতার সন্ধান মেলে যে, পৃথিবীতে পূণ্যাত্মা লোকেরা, যারাই আল্লাহ্র আইন বা হুকুমকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, তারাই এভাবে শয়তান লোক এবং জ্বিনদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন। অশুভ ও অসৎ লোকেরা সব সময়ে তাদের মিষ্টি কথা ও বাক্চাতুর্যের দ্বারা সাধারণ লোকদের প্রতারিত করে, প্রভাবিত করে অসৎ পথের দিকে। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাদের ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা করেন না। তিনি এসব অশুভ শক্তিকে তাদের প্রতারণার ফাঁদ বিস্তার করতে বাধা দেন না। কারণ আল্লাহ্র ইচ্ছা মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির" পরীক্ষা নেওয়া। মানুষ যাতে স্ব-ইচ্ছায় শয়তানের প্রলোভন থেকে মুক্ত হয়ে সর্বশক্তিমানের আশ্রয় প্রার্থনা করে এই-ই আল্লাহ্র ইচ্ছা - এই বিশ্বনিয়ন্তার পরিকল্পনা। এই কথাকেই বলা হয়েছে যে, "যদি না তোমার প্রতিপালক পরিকল্পনা করতেন তবে তারা তা করতে না।" অর্থাৎ আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে এই সব অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। তাহলে অশুভ শক্তির অনুপস্থিতিতে সকলেই বিশ্বাসীতে পরিণত হতো। কিন্তু আল্লাহ্র সামগ্রিক পরিকল্পনা অন্যরূপ। আল্লাহ্ মানুষের "ইচ্ছাশক্তির" পরীক্ষা নিতে চান, শয়তানের প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে।
৯৪২। শয়তানের প্রলোভন ও প্রতারণার শিকার তারাই যাদের পরকালের বিচার এবং আত্মার শেষ গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে বিশ্বাস নাই। পৃথিবীর লোভ-লালসা, শয়তানের বাক্চাতুর্যে তারা মোহিত হয়ে যায়। এরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র পরিবর্তে অসৎ ও অশুভ শক্তির পূঁজা করে। "অনুরক্ত হয়" অর্থাৎ শয়তানের প্ররোচনার প্রতি অনুরাগী হয়। তারা এর মধ্যে তাদের আনন্দ, তৃপ্তি ও পরিতুষ্টি খুঁজে পেতে চেষ্টা করবে। কিন্তু তা হবে প্রতারণামূলক। কারণ মন্দ ও অসৎ জিনিসের ফলাফলও অসৎ ও মন্দ।
৯৪৩। পূণ্যাত্মা লোকদের নিকট আল্লাহ্র প্রদর্শিত জীবনাদর্শই হচ্ছে একমাত্র সত্য। এই সত্য তাঁদের জীবনের ধ্রুবতারা। আল্-কোরান হচ্ছে আল্লাহ্র প্রদর্শিত জীবনাদর্শের লিখিত দলিল। বান্দার জন্য স্রষ্টার ইচ্ছার রূপই হচ্ছে কোরআনের বাণী। কোরানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : সাধারণ মানুষের জন্য, আদর্শ জীবন-যাপন প্রণালীর মূলনীতি সমূহ, সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষাতে এই গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। যা থেকে বিনয়ী ও আল্লাহ্ প্রদর্শিত পথ গ্রহণে আগ্রহী অতি সাধারণ লোকও জীবনাদর্শন খুঁজে পাবে। আবার যারা আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সমৃদ্ধ, তাঁদের জন্য এই কিতাব সমৃদ্ধিতে ভরপুর। উপমা, রূপক, উদাহরণের সাহায্যে আল্লাহ্ বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন তাঁদের জন্য আত্মিক সমৃদ্ধির পথ।
১১৬। যদি তুমি পৃথিবীর প্রচলিত ধারা অনুযায়ী চলতে চাও, তবে তারা তোমাকে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করবে, তারা তো শুধু অনুমান করে, তারা তো শুধু মিথ্যা বলে।
১১৭। কারা তাঁর পথ থেকে বিপথগামী হয়, তোমার প্রভু তা ভালোভাবে জানেন। কারা তাঁর পথ নির্দেশ গ্রহণ করেছে তিনি তাও ভালোভাবে জানেন।
১১৮। যদি তোমাদের তাঁর নিদর্শনে ঈমান থাকে, তবে যাতে আল্লাহ্র নাম নেয়া হয়েছে তা [সেই মাংস] থেকে আহার কর।
১১৯। যাতে [যে মাংসে] আল্লাহ্র নাম নেয়া হয়েছে কেন তোমরা তা থেকে আহার করবে না ? যখন তোমাদের জন্য যা হারাম করা হয়েছে তিনি তা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন ? [অবশ্য] ব্যতিক্রম হবে নিরূপায় হলে ৯৪৪। অনেকেই প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে অন্যকে [লোককে] নিজেদের প্রবৃত্তি দ্বারা বিপথগামী করে। তোমার প্রভু খুব ভালোভাবেই জানেন কারা সীমালংঘন করে।
৯৪৪। এ সম্পর্কে দেখুন আয়াত [৫ : ৩]। যখন খাদ্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোনটি হারাম, কোনটি হালাল বলে দেওয়া হয়েছে তখন এ সম্বন্ধে নূতনভাবে সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়, কারণ তা অজ্ঞ লোকদের আরও বিপথগামী করবে।
১২১। সে [মাংস] আহার করো না যার উপরে আল্লাহ্র নাম নেয়া হয় নাই। তা হবে ধর্মহীনতা। শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের তোমাদের সাথে তর্ক করতে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু তোমরা যদি তাদের মান্য কর, তবে অবশ্যই তোমরা মুশরিক বলে গণ্য হবে।
৯৪৫। এই আয়াতে এক অনুপম রূপকের সাহায্যে পূণ্যাত্মা ও পাপীর মধ্যে তুলনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এই নশ্বর দেহের জীবন মৃত্যুর কথা এখানে বলা হয় নাই। নশ্বর দেহের ভিতরে যে আত্মা তার কথাই এখানে রূপকের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। এই আত্মা দেহভ্যন্তরে থাকে সুপ্ত, যা মৃত্যুরই সামিল। একেই রূপকের সাহায্যে বলা হয়েছে "যে ব্যক্তি মৃত" আল্লাহ্র নূর যখন তার আত্মিক সত্তাকে আলোকিত করে, তখন সে হয় আধ্যাত্মিক ভাবে জীবিত। এটা আল্লাহ্র রহমত ও অসীম করুণা যে সে আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করে, যে জীবন তাকে আল্লাহ্র নূরে বিধৌত করে, যে আলোতে সে তার জীবনে চলার পথের নিশানা খুঁজে পায়। এই আধ্যাত্মিক জীবন যে শুধু তারই জীবনের আলোক বর্তিকারূপে কাজ করে তাই নয়, তার অনুসারীরা এ আলোকে তাদের জীবনের পথ খুঁজে পায়। অর্থাৎ তার জ্ঞান, বিবেক, অন্তর্দৃষ্টি, ন্যায়বোধ, সত্যনিষ্ঠা ইত্যাদি শুধু যে তাঁরই চলার পথের সঙ্গী হয় তা নয়, তার সঙ্গী-সাথীরাও আল্লাহ্র হেদায়েত বা নূর দ্বারা উপকৃত হয়। ভালো কাজে হেদায়েত পূণ্যাত্মাদের জন্য আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব। এর বিপরীতে আছে আর এক দল লোক, যারা পাপী, যারা আল্লাহ্র হেদায়েতকে ঘৃণা করে। যাদের আত্মা অন্ধকারের অতলে বাস করে। যদিও শারীরিকভাবে এসব লোকেরা জীবিত বলে আখ্যায়িত হয়, কিন্তু আত্মিক দিক থেকে এসব লোকেরা মৃত। এসব লোকেরা সর্বদা যা কিছু ভালো, যা কিছু পূত ও পবিত্র যা কিছু ন্যায় ও সত্য তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। কিন্তু তাদের চক্রান্ত পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। কারণ আল্লাহ্র শক্তির কাছে তাদের শক্তি তুচ্ছ। আলোকিত আত্মা ও অন্ধকার মৃত আত্মা, এই দু'ধরণের লোক কি এক হতে পারে ? যদিও দু'শ্রেণীর লোক এক নয়, যদিও অলোকিত আত্মার লোকদের কর্তব্য কর্ম হচ্ছে পৃথিবীর কল্যাণ সাধন। তারাই পৃথিবীর নেতা হওয়ার যোগ্য তবুও সমসাময়িক পৃথিবীতে দেখা যায় যে, যারা মন্দ তারাই পৃথিবীর নেতার দায়িত্বে নিয়োজিত। কিন্তু তাই বলে পূণ্যাত্মা লোকদের হতাশ হওয়া উচিত নয়। তাঁরা তাদের কর্তব্যে অবিচল থেকে তাঁদের কর্তব্য কর্ম করে যাবে।
১২৪। যখন তাদের নিকট [আল্লাহ্র নিকট থেকে] নিদর্শন আসে; তারা বলে, "আল্লাহ্র রাসূলগণকে যা দেয়া হয়েছিলো, [ঠিক] সেরূপ কিছু না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ঈমান আনবো না ৯৪৬।" কোথায় [এবং কিভাবে] আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদিত হবে তা আল্লাহ্-ই সবচেয়ে ভালো জানেন। শীঘ্রই দুষ্টরা লাঞ্ছনা দ্বারা অতর্কিতে পাকড়াও হয়ে আল্লাহ্র সম্মুখে নীত হবে এবং তাদের সকল চক্রান্তের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
৯৪৬। পৃথিবীময় আল্লাহ্র নির্দশন ছড়ানো। আকাশ, প্রকৃতি, জীব-জন্তু, মানুষ, সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহ্র নিদর্শন স্বরূপ সাধারণ লোকের কাছে। নবী রাসূলদের নিকট আল্লাহ্র বাণী প্রেরিত হয়, এছাড়াও আল্লাহ্ তাদের অনেক বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেন। অনেকেই আল্লাহ্ কর্তৃক বিশেষ মোজেযা প্রাপ্ত হয়েছেন। এগুলিই আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত তার রাসূলদের জন্য বিশেষ নিদর্শন। অপরপক্ষে যারা পাপী, যারা অবিশ্বাসী,. তাদের জন্যও আল্লাহ্র নিদর্শন আসে, তবে তা সতর্কীকরণ সঙ্কেতরূপে। তবে যারা মন্দ, যারা অবিশ্বাসী তারা সতর্কীকরণ নিদর্শনে কর্ণপাত করে না। ইচ্ছাকৃত ভাবে তা অস্বীকার করে। আল্লাহ্র দূতদের প্রতি প্রেরিত নিদর্শন ও মন্দ লোকদের প্রতি প্রেরিত নিদর্শন কখনও এক হতে পারে না। রাসূলদের নিকট প্রেরিত নিদর্শনের অনুরূপ নিদর্শনের জন্য এই সব অবিশ্বাসীরা আবদার করে। এটা করা তাদের পক্ষেই সম্ভব কারণ তাদের বিশ্বাস বা ঈমান নাই। এসব অবিশ্বাসীদের ইচ্ছা বা খেয়ালের বশবর্তী আল্লাহ্ নন। আল্লাহ্ তাঁর রিসালতের (রাসূলের পদ ও দায়িত্ব) ভার কাহার উপরে অর্পণ করবেন তা তিনিই ভাল জানেন।
৯৪৭। 'Qadha wa Qadr' এই আরবী শব্দটির দ্বারা আল্লাহ্র ইচ্ছাকে বুঝানো হয়। এই শব্দটির অর্থ অনেকে ভুল অর্থ করে থাকেন। এর অর্থ যেনো কেহ স্বেচ্ছাচার না বোঝে। আল্লাহ্র আদর্শই হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছা বা পরিকল্পনা। আমাদের চারিপাশের যে পৃথিবী, এই নভোমন্ডল, প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, বিশ্ব প্রকৃতি সবই আল্লাহ্র আদেশ অনুসারে পরিচালিত হয়। আল্লাহ্র আদেশ-ই বিশ্বপ্রকৃতির জন্য প্রাকৃতিক আইনরূপে পরিচিত। এই আইন বিশ্ব প্রকৃতির জন্য অলঙ্ঘনীয়। সেইরূপ আধ্যাত্মিক জগতের জন্যও আছে আল্লাহ্র আইন। যেমনঃ আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে যারা চলবে তাদের জন্য আছে দয়া, অনুগ্রহ, আবার যারা এ পথ পরিত্যাগ করে বিদ্রোহী হবে, তাদের জন্য আছে শাস্তি। আল্লাহ্ ন্যায় বিচারক। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ পরিত্যাগ করে এবং আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়, তবে তার পতন অবশ্যাম্ভাবী। এ পতন হচ্ছে তার আধ্যাত্মিক পতন। পতনের প্রতিটি পদক্ষেপে তার গতি হবে ত্বরান্বিত, তার আধ্যাত্মিক জগত হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন। আল্লাহ্র অনুগ্রহ, দয়া, পাপী, পূণ্যবান সবার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু এইসব অধঃপতিত ব্যক্তিরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ধারণ করতে অক্ষম, ফলে তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি, আকাশে আরোহনের মতই দুরূহ। অপরপক্ষে যারা পূণ্যাত্মা, তারা তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে যত অগ্রসর হয়, আল্লাহ্র করুণায় সে পথ ক্রমান্বয়ে সহজ থেকে সহজতর হয়। হযরত ঈসা এই কথাকে এভাবে প্রকাশ করেছেন, "He that hath, to him shall be given; but he that hath no, from him shall be taken away even that which he hath."
[Mark iv 25]
১২৭। তাদের জন্য তাদের প্রভুর নিকট রয়েছে শান্তির আলয়। তিনি তাদের বন্ধু হবেন, কারণ তারা [ধর্মানুরাগ] চর্চা করতো।
৯৪৮। দেখুন আয়াত [৬ : ১০০] এবং টীকা ৯২৯।
৯৪৯। "অনেক লোককে তোমাদের অনুগামী করিয়াছিলে।" - অর্থাৎ বহু মানব সন্তানকে বিপথগামী করিয়াছিলে।
৯৫০। এই পৃথিবীতে সাধারণতঃ অসৎ ও অশুভ শক্তি পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। তাদের এই বন্ধুত্বের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে এর দ্বারা তারা পার্থিব লাভ করে। কিন্তু যখন তাদের পৃথিবীর এই স্বল্প মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, মৃত্যুর পরে তাদের এই অশুভ তৎপরতা তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে যাবে, তখন এসবের জন্য অনুতাপ করে কোন লাভ হবে না।
৯৫১। মুশরেকদের চিরস্থায়ী বাসস্থান হবে জাহান্নাম। এ কথা নবী রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের গোচরীভূত করেছেন। 'চিরস্থায়ী' অর্থাৎ, 'অনন্ত', এই শব্দগুলির সম্যক অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা মানব সন্তানের জন্য খুব একটা সহজ নয়। অসীম, অনন্তের ধারণা মানুষের ধারণার বাইরে। "যদি না আল্লাহ্ অন্য রকম ইচ্ছা করেন" এই বাক্যটি সংযুক্ত হওয়ার ফলে 'অসীমের' ধারণা সসীমে আবদ্ধ হয়। কারণ দয়াময় আল্লাহ্ হয়তো কোনওদিন তাদের ক্ষমা করবেন। কারণ পরম করুণাময় ও ন্যায়বিচারক তো আল্লাহ্রই উপাধি।
৯৫২। দেখুন উপরের টিকা নং ৯৫০। অসৎ ও অশুভ শক্তি সমূহ সব সময়েই পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। কারণ এর দ্বারা তারা পরস্পর লাভবান হয়। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। যারা অসৎ, দুষ্ট, দূর্নীতিপরায়ণ, তারা সমাজে একতাবদ্ধভাবে কাজ করে যেনো তারা, যা ভালো, সৎ, সুন্দর তাকে বাঁধা দান করতে পারে। এর ফলে তারা পরস্পর আর্থিক ভাবে লাভবান হয়।
রুকু - ১৬
৯৫৩। "তোমাদের মধ্যে থেকে কি রাসূলগণ তোমাদের নিকট আসে নাই" - এই আয়াতে সমগ্র মানব গোষ্ঠী ও জ্বিনদের সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে যত নবী ও রাসূল এসেছেন তাদের সবার কথাই এখানে বলা হয়েছে।
১৩২। প্রত্যেকের তার কর্মের [ফল] অনুযায়ী ধাপ [বা ক্রম মাত্রা] রয়েছে। তারা যাই করুক না কেন, সে সম্বন্ধে তোমার প্রভু অমনোযোগী নন ৯৫৪।
৯৫৪। ভালো এবং মন্দের কোনও সর্বোচ্চ সীমারেখা নাই। ভালো ও মন্দ নির্ভর করে কৃতকর্ম ও কর্মের নিয়তের উপরে। সুকর্ম অতি ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে বৃহৎ পরিসরে, বৃহৎ অঙ্গনে হতে পারে। এর কোন সীমানা টানা যায় না, এর কোনও শেষ নাই। সেইরূপ আধ্যাত্মিক জগতের যাত্রাপথে আধ্যাত্মিক উন্নতির কোন শেষ পরিসীমা নাই। মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির বিভিন্ন ধাপ বর্তমান, আর তা নির্ধারিত হয় তার কর্মের ও নিয়তের ফলাফল অনুযায়ী। আল্লাহ্ আমাদের থেকেও আমাদের কর্ম ও কর্মের নিয়ত সম্বন্ধে জ্ঞাত। তিনি সর্বজ্ঞ।
৯৫৫। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত। আমাদের প্রার্থনা, বা ইবাদত কিছুরই তাঁর প্রয়োজন নাই। তাঁকে আমাদের ইবাদত করা প্রয়োজন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের মঙ্গলের প্রয়োজনে। আমাদের আত্মিক মুক্তির জন্য, আমাদের আত্মার উন্নতির জন্য আমরা তাঁর ইবাদত করি। এতে আল্লাহ্র কোনও লাভ বা ক্ষতি নাই। যারা পৃথিবীতে নিজেদের উন্নতি (আত্মিক বা পার্থিব) সাধন করতে পেরেছে, একথা তাদের সব সময়েই মনে রাখা প্রয়োজন যে তা সম্ভব হয়েছে আল্লাহ্র করুণার জন্য। যদি কেউ ধ্বংস হয়ে যায় তা আল্লাহ্র কোনও ক্ষতির কারণ হয় না। তিনি সে স্থানে অন্যদের স্থান করে দেন। পৃথিবীর অতীত ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। যদি আমাদের অন্তর্দৃষ্টি থাকে তবে আমরা দেখবো যুগে যুগে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে বর্তমানও এর থেকে মুক্ত নয়।
৯৫৬। নবী রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ্ মোমেনদের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং পাপীদের সাবধান করেছেন, তা অবশ্যই প্রতিপালিত হবেই। আল্লাহ্র ইচ্ছাকে কেহই থামিয়ে রাখতে পারবে না। দেখুন আয়াত [৬ : ১২৫] এবং টীকা ৯৪৭।
৯৫৭। এই আয়াতে যারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসী নয় সেই মুশরেকদের সম্বোধন করে আল্লাহ্ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে রাসূলুল্লাহ্ বলেছেন যে, অবিশ্বাসীদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও তাদের চেষ্টা ফলপ্রসু হবে না কারণ তাদের কোনও চেষ্টাই নবীকে তার কর্তব্যচ্যুত করতে পারবে না; এবং শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবেই। এই বাণী সর্বকালের সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। অশুভ শক্তি তার সর্বশক্তি দিয়ে সত্য, ন্যায় ও ভালোকে অবদমিত করতে চাইবে। যারা আল্লাহ্তে বিশ্বাসী, আল্লাহ্র সত্যে বিশ্বাসী তারা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করতে চেষ্টা করবে। তারা তাদের প্রতি আল্লাহ্ যে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তারা আন্তরিক ভাবে তা পালন করবে। একথা মনে রাখতে হবে সকল কাজের মূল্যায়ন করবেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। তাঁর মূল্যায়ন, কর্মের বিচার ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত। "পাপীরা কখনও সফলকাম হবে না।"
৯৫৮। এই আয়াতে অন্ধকার যুগের মুশরিকদের একটি বিশেষ পথভ্রষ্টতা ব্যক্ত করা হয়েছে। আরবদের অভ্যাস ছিল যে, শস্যক্ষেত্র, বাগান এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে যা কিছু আমদানী হত, তার এক অংশ আল্লাহ্র জন্য এবং এক অংশ উপাস্য দেব-দেবীর নামে পৃথক করে রাখত। আল্লাহ্র নামের অংশ থেকে গরীব-মিসকীনদের দান করা হত এবং দেব-দেবীর অংশ মন্দিরের পূজারী, সেবায়েত ও রক্ষকদের জন্য ব্যয় করত। তারা ভাল ভাল বস্তু দেবতাদিগের ভাগে দিত, অধিকন্তু আল্লাহ্র ভাগ হতে দেবতাদের ভাগে মিশিয়ে দিত, এই বলে যে, "আল্লাহ্ মুখাপেক্ষী নন, তাঁহার প্রয়োজন নাই, দেবতাগণ মুখাপেক্ষী, তাদের প্রয়োজন আছে।" অথচ তারা এতটুকু বুঝতে চেষ্টা করতো না যে মুখাপেক্ষী দেবতা কিভাবে মাবুদ হতে পারে ? পুরো ব্যাপারটিই ছিল আল্লাহ্কে হাস্যস্পদ করার সামিল। যে আল্লাহ্ সমগ্র বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা সব কিছুর মালিক তাঁর কিভাবে দেবতাদের সমকক্ষ অংশ থাকতে পারে ?
[মন্তব্য : মাজারে মানত করা, মাজারে দান করা বর্তমানে বাংলাদেশের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশরূপে বিরাজমান। উপরের আয়াতের অনুরূপ দেবতাদের পরিবর্তে মাজারকে আল্লাহ্ সমকক্ষ অংশীদার কল্পনা করা হয়]।
৯৫৯। পৃথিবীতে যেখানেই পৌত্তলিক ধর্ম বিদ্যমান, সেখানেই দেখা যায় নরবলির প্রথা বিরাজমান। এ প্রথা যে শুধুমাত্র ভারতে আছে, তাই-ই নয়, পৌত্তলিক আরবদের মধ্যেও এই প্রথা বিরাজ ছিল। এরকম একটি জঘন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণা ও বিদ্রোহের ভাব সৃষ্টি করা স্বাভাবিক। কিন্তু যারা পৌত্তলিক তাদের মনে তাদের এই নৃশংস অনুষ্ঠান ঘৃণার পরিবর্তে অত্যন্ত সুশোভনরূপে দেখা দেয়। তাদের দৃষ্টিতে এই প্রথাকে সুশোভন দেখায় বলেই তারা সন্তান হত্যার মত পাপকেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানরূপে গ্রহণ করে এবং তা তাদের চক্ষে সুশোভন ও হৃদয় গ্রাহী হয়। এর ফলে তারা নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনে। তাদের ধর্মবিশ্বাস দৃঢ়ভিত্তির পরিবর্তে সন্দেহ, অবিশ্বাস, সংশয় এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়।
৯৬০। পৌরহিত্য প্রথা মানুষের উপরে প্রভাব প্রতিপত্তি প্রয়োগ করার এক বিশেষ পদ্ধতি স্বরূপ। তারা নিজেদের ধারণা অনুযায়ী কোন কোন খাদ্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তারা এই ধারণা লোকদের দেয় যে তারা এই ঘোষণা করার ক্ষমতা আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রাপ্ত। তারা আল্লাহ্র ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। কিন্তু এ সবই সর্ব্বৈব মিথ্যা। আল্লাহ্ সম্বন্ধে মিথ্যা প্রচারণার উদ্দেশ্যে তারা তা করে। ফলে এদেরকে বিশ্বাসের ফলে সাধারণ মানুষও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, হয়ে পড়ে পথভ্রষ্ট।
[মন্তব্য : বাংলাদেশে আজ সাধারণ মানুষ কোরআন পাঠ করে কিন্তু তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম না করার ফলে, ধর্মের অনুশাসনের জন্য ধর্মব্যবসায়ীদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা অনেক মনগড়া কথা বলে। ফলে তারা আল্লাহ্র হুকুম মানার পরিবর্তে, মানুষের মনগড়া ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি ঝুকে পড়েছে এবং কুসংস্কারের নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।]
৯৬১। আবার মুশরিকদের মধ্যে এমন সংস্কার চালু ছিল যে তারা দেবতার নামে পশু উৎসর্গ করে মুক্ত করে দিত [যেমন- এখনও দেখা যায় ভারতে হিন্দুদের মধ্যে]। এই সব উৎসর্গীত পশুকে সমাজের কোনও রকম প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় না। তাকে দিয়ে কোনও কাজ করানো হয় না বা তাঁর মাংসও ভক্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বিরাট পশু সম্পদ ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে, যা সমাজের জন্য বিরাট ক্ষতি স্বরূপ।
৯৬২। যদি কোনও পশুকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দান করা হয়, তবে যেহেতু জবেহ্ করার সময়ে তার উপরে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করা হয় নাই, সুতরাং খাদ্য হিসেবে তা মুসলমানদের জন্য হালাল থাকে না। দেখুন আয়াত [৫ : ৪] এবং টিকা ৬৯৮।
৯৬৩। এই আয়াতটি দ্বারা এই সত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, যুগে যুগে মানুষ যখন সত্য ধর্ম থেকে পথভ্রষ্ট হয়, তখন নিজেদের মনগড়া অনেক রকম কুসংস্কারের প্রচলন করে। এই আয়াতের এই অংশে গৃহপালিত পশুর সম্বন্ধে সে সময়ের আরব মুশরিকদের যে সব কুসংস্কার প্রচলিত ছিল তারই কিছুটা নমুনা বিবৃত করা হয়েছে। এসব কুসংস্কারের আরও কিছু বর্ণনা আছে আয়াত [৫ : ১০৩]-এ এবং এর টিকাতে।
উপদেশ : যুগে যুগে মানুষ যখন সত্য ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, তখন নানা কুসংস্কার তাদের রীতিনীতিকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। এই উপদেশ সর্বকালের সকল জাতির জন্য প্রযোজ্য।
রুকু - ১৭
৯৬৪। "Ansha-a" - এই আরবী শব্দটির অর্থের জন্য দেখুন আয়াত [৬ : ৯৮] ও টীকা ৯২৩।
৯৬৫। সঙ্গীতের মাধূর্যের মত, কবিতার ছন্দের মত এক অপূর্ব বাচনভঙ্গী সমৃদ্ধ আয়াত। দেখুন আয়াত [৬ : ৯৯] এবং এর টীকা।
৯৬৬। "অপচয় করিবে না" - ইংরেজীতে প্রচলিত এক নীতিবাক্য আছে যে, "Waste not, want not"। অর্থাৎ অপচয় করো না, অভাব মুক্ত থাক। এই কথাকেই এখানে "অপচয় করিবে না, কারণ আল্লাহ্ অপচয়কারীকে ভালোবাসে না" এভাবে বলা হয়েছে। তবে এ লাইনটিতে আল্লাহ্র উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে, এর গুঢ় অর্থ শুধুমাত্র পৃথিবীর চাওয়া পাওয়ার সাথেই সম্পৃক্ত নয়। এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে জীবনের আধ্যাত্মিক দিককে। আল্লাহ্ পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্ট পদার্থকে ভালোবাসেন, তাদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবন ধারণের সব উপকরণের প্রয়োজন মেটান। আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে যতটুকু প্রয়োজন তা উপভোগ কর, এবং অপচয়ে বাড়াবাড়ি করো না। যদি কেউ তা করে তার অর্থ শুধু এই নয় যে, সে অপচয়ের ফলে দরিদ্রতায় নিপতিত হতে পারে। এই অপচয়ের আর একটি আধ্যাত্মিক দিক বর্তমান। তা হচ্ছে, যে অপচয় করে ও নিজ প্রয়োজনের বাইরে খরচ করে; তার এই খরচ অবশ্যই অন্যকে বঞ্চিত করে সে আহরণ করে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে আর আত্মার স্বার্থপরতার দিকটি উন্মোচিত হয়। আর স্বার্থপর আত্মার আত্মিক উন্নতি ঘটে না, তার চরিত্রে কোনও গুণাবলীর প্রকাশ ঘটে না। এদের আল্লাহ্ পছন্দ করেন না, ফলে এরা আল্লাহ্র রহমত থেকে বঞ্চিত হয়।
৯৬৭। এই আয়াতগুলিতে কুসংস্কারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তা বর্ণনা করা হয়েছে। কুসংস্কার ধর্মের আমূল বা আত্মাকে ধ্বংস করে ফেলে। মানুষকে ধর্মের নামে মুশরেকে পরিণত করে। তাই ইসলামে বারে বারে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। এখানে আরব মোশরেকদের কথা বলা হয়েছে; যারা খাদ্য হিসেবে পশু সম্বন্ধে অনেক ধরণের কুসংস্কারের বিশ্বাসী ছিল। এই আয়াতে যে সব জন্তুকে আল্লাহ্ রিয্করূপে আমাদের জন্য ধার্য্য করেছেন তা গ্রহণ করতে বলেছেন। পরের আয়াতে [৬ : ১৪৩] ঘোড়ার কথাা উল্লেখ করা হয় নাই, কারণ ঘোড়ার মাংস সব সময়েই নিষিদ্ধ এবং এই নিষিদ্ধকরণ কোনরূপ কুসংস্কার নয়। ছাগল, ভেড়া, উট, গরু, এগুলি সাধারণ ভাবেই আমাদের খাদ্য হিসেবে মাংসের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। ছাগল ও ভেড়া কখনও ভার বহনের জন্য ব্যবহার করা হয় না, কিন্তু উট (পুরুষ এবং মাদী উভয়েই) ভারবহন ও মাংসের জন্য ব্যবহার করা হয়। ষাড় গরু চাষের জন্য এবং গাভী সাধারণতঃ দুধের জন্য এবং সাধারণভাবে গরু (ষাঁড় ও গাভী) মাংসের উৎস হিসেবে পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবহার করা হয়।
৯৬৮। এই আয়াতে যে সকল পশুকে তোমরা খেয়ালখুশী মত হালাল হারাম করে থাক তার চার জোড়া বা পুরুষ মাদী মিলিয়ে তাদের সংখ্যা আট। পূর্ববর্তী আয়াত সমূহে [৬ : ১৩৯] ও [৫ : ১০৩] মানুষের মনগড়া কুসংস্কারের সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এই আয়াতেও মানুষের বিভিন্ন কুপ্রথাকে হাস্যকরভাবে বিদ্রুপ করা হয়েছে; এবং পরের আয়াতেও তাই-ই করা হয়েছে।
উপদেশ : ইসলাম মুক্ত চিন্তাধারার ধর্ম। কুসংস্কার, কুপ্রথা এবং আনুষ্ঠানিকতা ধর্মের মূল ধারাকে ব্যহত করে। তাই ইসলামে এ সব নিষিদ্ধ।
৯৬৯। "বহমান রক্ত" - অর্থাৎ রক্ত প্রবাহ যা দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পরিশুদ্ধ করে। অর্থাৎ মূল রক্ত স্রোত। এই রক্ত স্রোত মাংসের ভিতরে, বা কলিজার অভ্যন্তরে বা এরকম বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে যে রক্ত লেগে থাকে তা থেকে আলাদা।
৯৭০। 'Zufur' এই আরবী শব্দটির অর্থ 'নখ' বা খুড়। মওলানা ইউসুফ আলী "We forbade every (animal) with undivided hoof" বাক্যটি ব্যবহার করেছেন এবং অনেক বাংলা অনুবাদে 'নখর' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। 'Zufur' শব্দটি এক বচন। কিন্তু এমন কোনও প্রাণী নাই যার একটি মাত্র 'নখ' আছে। আবার 'নখ' কখনও দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে না। সুতরাং সে হিসেবে 'খুর' কথাটিই হবে 'Zufur' শব্দটির প্রকৃত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে আছে, [Leviticus. xi 3-6. “Whatsoever parteth the hoof, and is cloven – footed, and cheweth the end, among the beasts. - তাই-ই হালাল। তাদের ধর্মে উপরের বৈশিষ্ট্য থাকার দরুণ উট, খরগোশ হালাল খাদ্য নয়, কারণ এদের 'খুর' দ্বিধাবিভক্ত নয়। সুতরাং "অবিভক্ত খুর" অনুবাদ-ই হবে উপযুক্ত অনুবাদ। অপরপক্ষে উট ও খরগোশ ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল।
৯৭১। Leviticus (vii 23) এর বর্ণনা অনুযায়ী "Ye shall eat no manner of fat, of OX, or of sheep, or of goat." এই বাণীর ব্যতিক্রম দেখা যায় পুরোহিতদের বেলায় [Leviticus vii 6] তাদের জন্য নিবেদিত প্রাণীর চর্বি ছিল বৈধ।
১৪৮। যারা [আল্লাহ্র সাথে] অংশীদার করে তারা বলবে' "যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করতেন, তবে আমরা এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁর সাথে কোন অংশীদার করতাম না, এবং কোন কিছুই হারাম করতাম না ৯৭২।" এভাবেই তাদের পূর্বপুরুষেরাও মিথ্যা তর্ক করতো, যতক্ষণ না তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছিলো। বল, "তোমাদের কি কোন [নিশ্চিত] জ্ঞান আছে ? যদি থাকে তবে আমার নিকট তা উপস্থাপন কর। তোমরা অনুমান ব্যতীত আর কিছুই অনুকরণ কর না, তোমরা মিথ্যা ব্যতীত আর কিছুই বল না।"
৯৭২। যথারীতি আরব মোশরেকরা তাদের কর্মের পক্ষে যে সব যুক্তি প্রদর্শন করতো তাই-ই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এসব যুক্তি অন্তঃসারশূন্য। "আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করতেন" - বাক্যটি দ্বারা তারা বুঝাতে চেয়েছে, (১) তারা ব্যক্তিগত দায় দায়িত্ব মুক্ত, (২) তারা অদৃশ্য নিয়তির হাতের ক্রীড়নক মাত্র; (৩) সুতরাং তারা যে শিরক কার্যে নিয়োজিত তা তারা ইচ্ছামত করার দাবীদার। এই উক্তিগুলি পরস্পর অসংলগ্ন। কারণ যদি (২) নম্বর উক্তি সঠিক হয় তবে (৩) নম্বর উক্তির যথার্থতা মেলেনা। কারণ যারা অন্ধ নিয়তির শিকার তাদের স্বাধীন ইচ্ছার কোনও মূল্য নাই। সুতরাং মোশরেকদের উক্তির কোনও গুরুত্ব নাই।
৯৭৩। "আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে সৎপথে পরিচালিত করিতেন।" এ বাক্যটির অনেকেই কদর্থ করে থাকেন। তারা মোশরেকদের মত বলে থাকে আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তারা সৎ পথে জীবন-যাপন করতো, যেহেতু আল্লাহ্র ইচ্ছা নাই, সেই কারণে তারা অসৎ জীবন যাপন করছে। এ কথা ঠিক যে আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, সব কিছুর উপরে তিনি শক্তিমান। একমাত্র মানব সন্তানকে তিনি "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করেছেন, যার জন্য তাঁকে ফেরেশতাদের উপরে স্থান দেয়া হয়েছে, এবং আদম সন্তানকে "আশরাফুল মাখলুকাত" নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই ইচ্ছা শক্তির স্বাধীনতার জন্য তার কিছু দায়-দায়িত্ব আছে - এই দায়-দায়িত্ব হচ্ছে তার এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা। আল্লাহ্র ইচ্ছা সমূহ আল্লাহ্র কিতাবে আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত আইন হিসেবে বর্ণিত আছে। যখন মানুষ আল্লাহ্র আইনের সাথে তার ইচ্ছাশক্তিকে সমন্বিত করে তখন তার উপরে আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। যারা ভুলপথে যায়, এই ইচ্ছাশক্তির অপব্যবহার করে তখনও আল্লাহ্র করুণাধারা তাকে নানাভাবে সেই ভ্রান্ত পথ থেকে সুপথে আনার প্রয়াস পায়। তবুও যদি কেউ পাপের পথে চলতেই থাকে তবে তার জন্য আল্লাহ্র শাস্তি অবধারিত [৬ : ১৪৭] আয়াতে দেখুন।
এই "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির" জবাবদিহিতার জন্যই পাপ ও পূণ্যের বিচার। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য জীব-জন্তু, তরু-লতা, কারও এই ইচ্ছাশক্তি নাই। সকলেই আল্লাহ্র হুকুম অনুযায়ী জন্মে, বড় হয়, আবার একদিন মৃত্যুবরণ করে। তারা কোনও অবস্থাতেই তাদের প্রতি দেয়া আল্লাহ্র আইনকে প্রতিহত করা বা একে লঙ্ঘন করার ক্ষমতা রাখে না। সেহেতু তাদের পাপ বা পূণ্য কিছুই নাই। যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করতেন তবে মানুষকেও আল্লাহ্ ফেরেশতাদের মত ইচ্ছা বিহীন রূপে সৃষ্টি করতে পারতেন, যারা সকলেই সব সময়েই সৎ পথে চালিত হত। কখনও কোনও পাপ কাজ করতো না। এই কাথাকেই বলা হয়েছে "যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারতেন।" অর্থাৎ পৃথিবীতে পাপ বলে কিছু থাকতো না।
৯৭৪। মোশরেকদের বিভিন্ন ধ্যান-ধ্যারণা, কুসংস্কারের সত্যিকারের কোনও ভিত্তি নাই। যারা আল্লাহ্র আইন মানে না তারাই মোশরেক। এরা অনেক কুসংস্কারের চালু করে আল্লাহ্র নামে, যা সমাজ ও জীবনের জন্য ক্ষতিকর এবং সত্যকে বিকৃত করে দেয়, সত্যের আলোকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়। এই আয়াতে আল্লাহ্র নির্দেশ হচ্ছে, আল্লাহ্র নামে যদিও এসব মোশরেকী কান্ড কারখানা চালু করা হয়, যারা সত্যিকারের মোমেন বান্দা তাদের নিষেধ করা হয়েছে তারা যেনো তাদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত না করে। "তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না।" এ কথাটির দ্বারা এই উপদেশকেই ব্যক্ত করা হয়েছে।
[মন্তব্য : এই উপদেশ সর্বকালের সর্বযুগের। বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই উপদেশ অত্যন্ত কার্যকর ভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশীরা প্রতিনিয়ত আল্লাহ্র আইনকে লঙ্ঘন করছে। তারা ঘুষ খায়, অন্যকে প্রতারিত করে, মিথ্যা কথা বলে, ভন্ডামি করে ইত্যাদি। অপরপক্ষে পীর পূঁজা, মাজার পূঁজা, জ্যেতিষের স্মরণাপন্ন হওয়া, রত্নপাথর ধারণ করা ইত্যাদি কাজ সমূহ করে আল্লাহ্র নামে - যা শেরেক। সমাজের বহু কুসংস্কার চালু আছে - যা সবই করা হয় আল্লাহ্র নামে। আল্লাহ্ এসব থেকে মুক্ত এবং তাঁর বান্দাকেও মুক্ত থাকতে বলেছেন।]
৯৭৫। দেখুন আয়াত [৬ : ১]। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। তিনি সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালন কর্তা। সুতরাং তিনি আমাদের একমাত্র আরাধ্য, একমাত্র ইবাদতের লক্ষ্য হওয়া উচিত। যারা আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কাউকে বিপদে রক্ষাকর্তা হিসেবে বা অন্য কোনও কারণে সেই শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, তারা আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ব, করুণা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। ফলে এরা পৃথিবীর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকেও অনুধাবন করতে পারে না। তারা বুঝতে অক্ষম হয়, তাদের জীবনের শেষ পরিণতি। অক্ষয়, চিরঞ্জীব আত্মার শেষ গন্তব্যস্থল যে পরকালের জীবনের সুখ ও শান্তি, এই সহজ সত্যকে তারা কখনও অনুধাবন করতে পারবে না। এদেরকেও অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই নির্দেশ সর্বকালের সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য।
রুকু - ১৯
৯৭৬। যারা আল্লাহ্র আইনের পরিবর্তে কুসংষ্কারে ও আনুষ্ঠানিকতাতে বিশ্বাসী তাদের মন সর্বদা শঙ্কা, ভয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সন্দেহে ভরপুর থাকে। তারা প্রথা অনুযায়ী পবিত্র অপবিত্র ব্যাপারে অত্যন্ত বাতিকগ্রস্থ হয়, হালাল-হারাম সম্বন্ধে স্পর্শকাতর হয়। এদেরকে আহ্বান করা হয়েছে আল্লাহ্র আইনকে পাঠ করার জন্য। আল্লাহ্র আইনই হচ্ছে নৈতিক জীবনের চাবিকাঠি। আল্লাহ্র আইনের (১) প্রথম কথাই হচ্ছে, আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। এই অদ্বিতীয়বাদই হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। এর পরেই আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে (২) পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য করা ও যত্ন নেওয়া। পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। কারণঃ ভালোবাসা শব্দটি একটি বিমূর্ত ধারণা। এই ধারণার পূর্ণাঙ্গরূপ আমরা অনুভব করি পিতা-মাতার ভালোবাসার মাধ্যমে। পিতা-মাতার ভালোবাসাই আমাদের অনুভব করতে সাহায্য করে নিঃস্বার্থ প্রকৃত ভালোবাসার রূপকে অনুধাবন করতে। পিতা-মাতার ভালোবাসা, সন্তানের জীবনে অনুভবের মাধ্যমে ভালোবাসা শব্দটি মূর্তরূপ ধারণ করে। ভালোবাসার এই ধারণা থেকেই আমাদের প্রতি আল্লাহ্র ভালোবাসাকে অনুভব করার ক্ষমতা জন্মাবে। তবে আমাদের প্রতি আল্লাহ্র ভালোবাসা পিতা-মাতার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থেকে আরও গভীর, আরও ব্যপ্ত, আরও সীমাহীন। আল্লাহ্র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তার সৃষ্টিকে ঘিরে থাকে ইহকালে ও পরকালেও। এটা অনুভবের জিনিস। মুখের কথায় বা লেখার মাধ্যমে এর প্রকাশ অসম্ভব। দ্বিতীয়তঃ মানুষের প্রতি মানুষের আছে কর্তব্য ও দায়িত্ব। এসব কর্তব্য ও দায়িত্বের পুরোধায় আছে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য। কারণ পিতামাতার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অনুভবের মাধ্যমেই আমাদের আল্লাহ্র নিঃস্বার্থ স্বর্গীয় ভালোবাসা অনুভবের ক্ষমতা জন্মাবে এবং আল্লাহ্র প্রতিও কর্তব্যবোধ জন্মাবে। অপরপক্ষে (৩) পিতা-মাতাকে তাদের সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং আরব মোশরেকদের নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে সন্তান হত্যার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ তাদের ও আমাদের সবারই প্রতিপালক। (৪) এর পর নিষেধ করা হয়েছে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোন রকম অশ্লীলতা যেনো না করা হয়। আল্লাহ্রা আইন বহির্ভূত যে কোনও যৌন জীবন নিষিদ্ধ। (৫) এর পরে নিষেধ করা হয়েছে 'হত্যা'-কে। এইগুলিই হচ্ছে আল্লাহ্র আইন, যা আল্লাহ্র ইচ্ছার সাথে সমন্বিত, তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন। এসব আইন করা হয়েছে, আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য। আল্লাহ্র আইন মানার মধ্যে দিয়ে আত্মার অগ্রযাত্রা শুরু হয় অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে, আত্মা হয় আত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ, লাভ করে অন্তর্দৃষ্টি। বান্দার চরিত্রে জন্মলাভ করে দুর্লভ গুণরাজি।
৯৭৭। এই আয়াতে 'Haqq' কথাটির ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে "By the way of justice & law" এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "আইনতঃ এবং ন্যায়ের ভিত্তি ব্যতীত।" অর্থাৎ ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে বিচারের পরে যদি কেউ প্রাণদন্ডে দন্ডনীয় হয় শুধু তখনই হত্যাকে বৈধ করা হয়েছে। একথা কেউ যেনো মনে না করে যে শুধুমাত্র মানব সন্তানের জীবনকেই পবিত্র জ্ঞানে হত্যা নিষেধ করা হয়েছে। বিনা কারণে যে কোন জীবনকে ধ্বংস করা অন্যায়। এমন কি খাদ্যের জন্য প্রাণী হত্যার ব্যাপারেও আল্লাহ্র আইন রয়েছে। দেখুন আয়াত [৫ : ৪] এবং টীকা ৬৯৮ ও আয়াত [৬ : ১৩৮] এবং এর টীকা ৯৬২।
৯৭৮। দেখুন [৫ : ১] আয়াত এবং টীকা ৬৮২।
৯৭৯। আয়াত [৬ : ১৫১, ১৫২ এবং ১৫৩]-এ নৈতিকতার আইনসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে যা অমান্য করা আত্মিক উন্নতির জন্য ক্ষতিকর। আয়াত [৬ : ১৫১]-এ বর্ণনা করা হয়েছে আল্লাহ্র সেই সব আইন যা আমাদের নৈতিক চরিত্রকে অনুভবের মাধ্যমে উন্নত করতে সাহায্য করে। আমাদের এই বস্তুগত পৃথিবীর বাইরেও অনুভবের এক জগত আছে, যে জগত ভালোবাসার, যে জগতকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না বা ইন্দ্রিয় জগতের ধরা, ছোঁয়া, স্পর্শের বাইরে যে জগত, যাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয়। আয়াত [৬ : ১৫১]-এ যে সব ব্যাপারে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা অনুসরণের মাধ্যমে আত্মার এই অনুভবের জগত সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত হয়। আত্মা উন্নত হয়, ফলে তার অনুধাবন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই এই আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, "তোমাদিগকে তিনি এই নির্দেশ দিলেন যেনো তোমরা প্রজ্ঞা সম্পন্ন হতে পার।" ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে "Thus doth he command you that ye may learn wisdom." অর্থাৎ অনুধাবনের মাধ্যমেই আত্মা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবে। এই অন্তর্দষ্টিই হচ্ছে "Wisdom"।
আয়াত [৬ : ১৫২]-এ সমাজ জীবনের নৈতিক আইন সম্বন্ধে বলা হয়েছে। সমাজে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপরে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা হবে ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে। পরস্পর পরস্পেরের সাথে আদান-প্রদান করবে ন্যায়ের ভিত্তিতে। এই আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, "এইভাবে আল্লাহ্ তোমাদিগকে নির্দেশ দিলেন যেন, তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।" ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে "Thus doth he command you, that ye may remember"। উপদেশ গ্রহণ করা অর্থই হচ্ছে উপদেশকে প্রয়োজনে স্মরণ করা। জীবনে সহজ সরল পথে চলার নিশানা উপরের দুটি আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে [৬ : ১৫৩]-এ এই সহজ সরল পথে চলার আহ্বান করা হয়েছে। বলা হয়েছে এই পথই হচ্ছে আল্লাহ্র পথ যা ব্যক্তিকে মোমেন বান্দাতে পরিণত করে। এই আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, "এইভাবে আল্লাহ্ তোমাদিগকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা পূণ্যাত্মা হও।" ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, "Thus doth he commanded you, that ye may be righteous."
৯৮০। হযরত মুসাকে দেয়া আল্লাহ্র কিতাব ছিল সৎ কর্মপরায়ণের জন্য সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ফলে তা ছিল ইহুদীদের জন্য জীবন পথের নির্দেশ। এর পরে খৃষ্টানদের জন্যও তা ছিল জীবন পথের নির্দেশ স্বরূপ। এ কথা সত্য যে হযরত ঈসার নবুওয়াতের কাল ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থার মূল নীতিসমূহ তিনি বর্ণনা করেন কিন্তু তার বিশদ ব্যাখ্যা দান করে যেতে পারেন নাই। হযরত মুসার পরে ইসলামের বাণী কোরানই হচ্ছে আল্লাহ্র কিতাব যাতে বিশদভাবে সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থার পথ নির্দেশ দান করা হয়েছে।
রুকু - ২০
১৫৬। পাছে তোমরা বল, " কিতাব তো শুধু আমাদের পূর্বেই দুই সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয়েছিলো' তারা অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে তা পাঠ করে যে জ্ঞান লাভ করেছে আমাদের দিক থেকে আমরা সে সম্বন্ধে অপরিচিত ছিলাম ৯৮১।
৯৮১। পূর্ববর্তী কিতাব সমূহ যা ইহুদী ও খৃষ্টানদের কাছে নাযেল হয়েছিল সেগুলি নব্য মুসলমানেরা পাঠ না করার কারণ এ নয় যে তওরাত ও ইঞ্জিল আরবী ভাষায় ছিল না। অনুবাদের মাধ্যমে বিষয়বস্তু জানা সম্ভবপর ও বাস্তব সম্মত, বরং প্রকৃত কারণ এই যে আহ্লে কিতাবীরা আরবদের শিক্ষা ও একত্ববাদের ব্যাপারে কখনও যত্নবান হয়নি।
৯৮২। আল্লাহ্র কিতাব কোরান এবং রাসুলুল্লাহ্র শিক্ষা ও জীবনী আল্লাহ্র তরফ থেকে দেয় স্পষ্ট প্রমাণ ও পথ নির্দেশ।
৯৮৩। ঈমান বা বিশ্বাস হচ্ছে অন্তরের ধন। অদৃশ্যকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে না দেখে আত্মার মাঝে অনুভব করার নামই হচ্ছে ঈমান বা বিশ্বাস। যেমন- আল্লাহ্র সম্বন্ধে ধারণা, পরকালের ধারণা, ফেরেশতাদের ধারণা, এগুলির কোনটাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, কিন্তু এগুলির প্রতি বিশ্বাস আমাদের অন্তরের বিশ্বাস, বা অন্তরের ধন। ঈমান বা বিশ্বাস হচ্ছে চোখে না দেখে অনুধাবনের মাধ্যমে, বুদ্ধির সাহায্যে, অদৃশ্যে বিশ্বাস করার ইচ্ছা। অদৃশ্যে বিশ্বাসের ফলে স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্র অনুশাসন মানার ইচ্ছা হয়। এরই ফলে চরিত্রে দুর্লভ গুণরাজির জন্ম নেয়। চোখে দেখে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করার নাম ঈমান নয়। সুতরাং সে বিশ্বাসের ফলে মোমেন বান্দা হওয়ার গৌরব অর্জন করা যাবে না। কিয়ামতের সুস্পষ্ট নির্দশন প্রকাশিত হওয়ার পরে কাফেরের ঈমান, গুণাহ্গারের তওবা কবুল হবে না। এই কথাকেই এভাবে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি পূর্বে ঈমান আনে নাই কিংবা ঈমানের মাধ্যমে ধর্মানুরাগ অর্জন করে নাই। অর্থাৎ ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্থাৎ ঈমানের মাধ্যমে চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করে নাই।
৯৮৪। এখানে দু'ধরণের প্রতীক্ষার কথা বলা হয়েছে। যারা ঈমানহীন বা অবিশ্বাসী তাদের প্রতীক্ষা। তারা চোখে দেখে সব কিছুকে বিশ্বাস করতে চায় - আর তা হচ্ছে বুদ্ধিহীনের বিশ্বাসের ন্যায়। বুদ্ধিহীন লোকেরা যেমন কোনও দুর্ঘটনা পূর্বে অনুধাবন করতে পারে না, যখন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তখন আশ্চর্য্য হয়ে যায়। কিন্তু তখন আর দুর্ঘটনা থেকে সে রেহাই পায় না। ঈমানহীন লোকদের ব্যাপারটিও ঠিক সেইরূপ। পরকালকে স্বচক্ষে দেখার জন্য তারা অপেক্ষা করবে, কিন্তু সে দেখা তাদের কোন উপকারে আসবে না। অপরপক্ষে মোমেন বান্দারা পরকালে তাদের সৎ কাজের ফলকে দেখার বা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে - আর সে সম্বন্ধে তাদের ইহকালেই নিশ্চিত আশ্বাস দান করা হয়েছে।
৯৮৫। 'Farraqu' এই শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, "Divide their religion" এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে, 'ধর্মকে [নানা মতে] বিভক্ত করে।' এই লাইনটির ব্যাখ্যা দাঁড়ায় এরূপ : (১) এক শ্রেণীর লোক আছে যারা ধর্মের নামে নিজেদের লাভ-লোকসান সাব্যস্ত করে। তারা ধর্মের বিভিন্ন অংশকে বিভিন্নভাবে গ্রহণ করে। ধর্মের যে অংশ তাদের জন্য উপযোগী সেই অংশ গ্রহণ করে এবং যে অংশ তাদের স্বার্থের বিরোধী হয়, সে অংশ ত্যাগ করে। এই মনোভাবের ফলেই যুগে যুগে একই ধর্মের মধ্যে বিভক্তিকরণ ঘটেছে। খৃষ্টান ধর্মই এর প্রমাণ। আজকের যুগে মুসলমানেরাও এর ব্যতিক্রম নয়। যেখানে ইসলাম একটি সহজ সরল জীবনের অঙ্গীকার - সেখানে ইতিমধ্যেই মুসলমানদের বহু বিভক্তি বিদ্যমান। অথবা (২) বহু লোক আছে যারা ধর্মকে আনুষ্ঠানিক হিসেবে গ্রহণ করেছে। সপ্তাহে একদিন তারা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে, অন্যান্য ছয় দিন তারা দুনিয়ার কাজকর্ম নিয়ে মত্ত থাকে। ইসলাম ধর্ম দ্বীন ও দুনিয়া এই দুই নিয়েই গঠিত। দ্বীন বা ধর্ম ব্যতীত যে দুনিয়ার কাজ-কর্ম তা ইসলাম অনুমোদন করে না। সপ্তাহে ছয় দিনের যে জীবন যথাঃ ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী ইত্যাদি যা জীবন ধারণের নিমিত্তে করা হয় তা হতে হবে আল্লাহ্র নির্দেশ মাফিক - ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত। যদি তা না করে শুধু সপ্তাহে একদিন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় তা ধর্ম নয়। অথবা (৩) আর এক ধরণের লোক আছে যারা ধর্ম সম্বন্ধে মাথা ঘামায় না। ধর্মকে তারা পোষাকী রূপে ব্যবহার করে, শুধুমাত্র একটি গোষ্ঠিতে নিজেদের অন্তর্ভূক্তি ব্যতীত ধর্ম সম্বন্ধে তাদের কোনও মাথা ব্যাথা নাই। এরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষরূপে দাবী করে ধর্মকে নিজেদের জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। ধর্মের কোনও প্রভাব এদের উপরে নাই। অথবা (৪) ধর্মের নামে নিজেদের বিভিন্ন গোষ্ঠিতে বিভক্ত করে ফেলে এবং প্রত্যেক গোষ্ঠি নিজস্ব চিন্তাধারাকে অভ্রান্ত সত্য বলে বিশ্বাস করে, ফলে ধর্মের মূল ঐক্য বিনষ্ট হয়।
[মন্তব্য : আজ ইসলাম ধর্মে ঐক্য বিনষ্টকারী ব্যক্তিবর্গ সারা পৃথিবী জুড়ে বিরাজ করছে।]
৯৮৬। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ ন্যায় বিচারক এবং সেই সাথে বান্দার জন্য উদারও। যারা ভালো কাজ করবে তাদের জন্য একটি কাজের পুরস্কার ঐ কাজের দশগুণ দেয়া হবে। কিন্তু কেউ একটি মন্দ কাজ করলে তার শাস্তি দশগুণ হবে না। একটি মন্দ কাজের শাস্তি সেই কাজের যে পরিমাণ সেই পরিমাণই হবে। তাদের প্রতি কোনও অবিচার করা হবে না। সর্বাপেক্ষা বড় কথা সকল পাপী ব্যক্তির জন্য অনুতাপের দরজা সর্বদা আল্লাহ্র নিকট উন্মুক্ত।
১৬২। বল, "প্রকৃতই আমার সালাত, আমার আত্মোৎসর্গ, আমার জীবন এবং আমার মরণ [সবই] জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্র জন্য।"
১৬৩। "তাঁর কোন শরীক নাই; আমাকে এই আদেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি তাদের মধ্যে প্রথম, যারা তাঁর ইচ্ছার নিকট অবনত হয়।"
১৬৪। বল, "আমি কি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন প্রতিপালক খুঁজবো ? অথচ, তিনিই সকল কিছুর প্রতিপালক। প্রতিটি আত্মা তার নিজ কর্মের প্রতিফলের জন্য দায়ী ৯৮৭। কেউ অন্য কারও ভার বহন করবে না। তোমাদের সর্বশেষ লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ্র দিকে প্রত্যাবর্তন। অতঃপর যে বিষয়ে তোমরা মতভেদ করতে তার সত্যতা সম্বন্ধে তিনি তোমাদের অবহিত করবেন।
৯৮৭। এই আয়াতে পুনরায় বলা হয়েছে ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বের কথা। শেষ বিচারের দিনে আমরা প্রত্যেকে স্ব-স্ব কর্মফলের জন্য দায়ী থাকবো। পৃথিবীতে সফল হলেও পরকালে আমরা আমাদের কাজের পরিণতি অন্যের উপরে দোষারোপ করে সফল হব না। কারও পাপ মুক্তির জন্যও কেউ কোন সুপারিশ করতে পারবে না। খৃষ্টান ধর্মে, হিন্দু ধর্মে ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে দেখা যায় পুরোহিত বা যাযক শ্রেণী অন্যের পাপ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে। বিশ্বাস করা হয় যে যাযক শ্রেণী সাধারণ মানুষের থেকে আত্মিক দিক থেকে উন্নত, সুতরাং সে মুক্তি চাইলে আল্লাহ্ মাপ করে দেবেন - এই বিশ্বাস সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে "প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য দায়ী, এবং কেউ অন্য কারও ভার বহন করবে না।" এই আয়াতে আর একটি ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে, তা হচ্ছে ধর্মের ব্যাপারে কারও যদি কোনও মতান্তর ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে, আর তা যদি সত্যিকারের আন্তরিক হয়, তবে তা নিয়ে প্রকাশ্যে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। এই তর্ক-বিতর্ক অনর্থক, তা শুধু বিভেদই সৃষ্টি করবে। আল্লাহ্ আমাদের বলেছেন যে জীবনের শেষে স্রষ্টার কাছে প্রত্যাবর্তনের পরে আল্লাহ্ তাদের সে সন্দেহ নিরসন করবেন। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কে না যেয়ে, ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি না করে, একতা ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং আমাদের যা কর্তব্য কর্ম তা দৃঢ় ভাবে সম্পন্ন করা।
৯৮৮। দেখুন [২ : ৩০] এবং এর টীকা। 'Khalifa' শব্দটির অর্থ বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। আয়াত [২ : ৩০]-তে 'Khalifa' শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে "Vicegerent" বা পৃথিবীতে আল্লাহ্র 'প্রতিনিধি'।