+
-
R
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : এই সূরাটি এবং পরবর্তী পাঁচটি সূরা [সূরা ১১, ১২, ১৩, ১৪ এবং ১৫] পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এই সূরাগুলি মক্কার শেষের দিকে অবতীর্ণ হয়; যখন মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরতের সময়কাল প্রায় নিকটবর্তী। অবশ্য হিজরতের সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই।
এই ছয়টি সূরার বিষয়বস্তুর মধ্যে সামঞ্জস্য বিদ্যমান। সূরা ৮ এবং ৯-এ প্রধানতঃ নূতন মুসলমান সম্প্রাদায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নূতন মুসলমান সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান, সংগঠন, আদর্শ এবং সর্বপরি এর প্রচার এবং প্রসার সমসাময়িক আরব মোশরেকদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে। তারা ইসলামকে সমূলে বিনাশ সাধন করতে তৎপর হয়ে ওঠে। সূরাগুলির ভূমিকাতে দেখুন। এই সূরাগুলির বিষয়বস্তু হচ্ছে, বহিঃ শত্রুতাকে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে, আল্লাহর সাথে পৃথিবীর মানব সম্প্রদায়ের সম্পর্কের ভিত্তি। কিভাবে প্রত্যাদেশ কাজ করে? আল্লাহর করুণার অর্থ কি? এবং এই করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থই বা কি?
আল্লাহ্র রসুলরা কিভাবে তাদের প্রতি অর্পিত আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রচারিত করেন। মানব সম্প্রদায় কিভাবে তা গ্রহণ করবে? ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে সূরাগুলিতে। ১৩ নম্বর সূরাটি ব্যতীত অন্যান্য সব সূরারই প্রথমে "আলিফ", "লাম", "রা" এই তিনটি সংক্ষিপ্ত অক্ষর সংযুক্ত করা হয়েছে, যা প্রতীকধর্মী। ১৩ নম্বর সূরাটির উপরে "আলিফ", "লাম" "মিম", "রা' এই চারটি সংক্ষিপ্ত অক্ষর সংযুক্ত করা হয়েছে। এই সূরাটির এই বিভিন্নতা আমরা ১৩ নম্বর সূরার সময়ে আলোচনা করবো।
এই ভূমিকাতে শুধুমাত্র ১০ নম্বর সূরাটি সম্বন্ধেই আলোচনা করা হবে। এই সূরাটির মর্মবাণী হচ্ছে : আল্লাহ এই বিশাল বিশ্বভূবন সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র আমাদের ভোগ বিলাসের জন্য নয়, শুধুমাত্র সৃষ্টি ও ধ্বংসের জন্য নয়। তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি শুধুমাত্র বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর উদ্দেশ্য বহু উর্দ্ধে, মহত্বর কারণের জন্য। সবচেয়ে অত্যাচার্য হচ্ছে আল্লাহ্কে আমরা আমাদের চর্মচক্ষে দেখতে পাই না, কিন্তু তাঁকে আমরা আমাদের আত্মার মধ্যে অনুভব করতে পারি। যুগে যুগে নবী রসুলের মাধ্যমে, কিতাবের মাধ্যমে তাঁর প্রত্যাদেশ আমাদের নিকট প্রকাশিত হয়। এই সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে, কিভাবে রসুলেরা প্রত্যাখাত হয়েছেন যুগে যুগে এবং কিভাবে সাধারণ মানুষ আল্লাহর প্রত্যাদেশকে অবিশ্বাস করেছে এবং শেষ মূহুর্তে অনুতাপের মাধ্যমে ফিরে এসেছে। এই সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে, ইউনুস নবীর ক'থা এবং তার সময়ের লোকদের কথা। এই সব লোকেরা আল্লাহর প্রত্যাদেশকে প্রত্যাখান করেছিলো। কিন্তু যে মূহুর্তে তারা অনুতাপ করেছে, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় নাই। আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা আমাদের ধারণার অতীত যা আমাদের বিধৌত করতে সর্বদা উদগ্রীব।
সারসংক্ষেপ : বিশ্ব-বিধাতা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ মানব কূলের হৃদয়ে অপূর্ব অত্যাচার্যভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আল্লাহর প্রত্যাদেশ ব্যতীতও তাঁর হাতের পরশ সমস্ত সৃষ্টিতে বিদ্যমান। চন্দ্র, সূর্য, তরু-লতা, আকাশ-বাতাস, দিন-রাত্রি, প্রকৃতির পরিবর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন [১০:১-২০]
জীবনের সকল সৌন্দর্য্য এবং ভালো সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু বিশ্ব বিধাতা আল্লাহ। মানুষ অন্ধ, তাই এসব দেখেও সে আল্লাহ্র অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে না [১০:২১-৪০]।
সব কিছুর শুরু আল্লাহ্, এবং তাঁর কাছেই সব কিছু প্রত্যার্পন করবে। তাঁর কাছেই সব কিছুর শেষ। তিনিই একমাত্র সত্য। মানুষ আল্লাহর প্রেরিত সত্যকে গ্রহণ করার পরিবর্তে আল্লাহর সাথে শরীক গ্রহণ করে যা সত্য বিমূখ- কারণ মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। [১০:৪১-৭০]
আল্লাহ্ নূহ্ নবীকে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বকে প্রকাশ করেন, কিন্তু নূহ্ নবীর সমসাময়িক লোকেরা তা প্রত্যাখান করে, পরিণামে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ্ হযরত মুসার (আ) মাধ্যমে ফেরাউনের সাথে কথা বলেন। কিন্তু ফেরাউন তা বিশ্বাস করে না, কারণ সে ছিল অবাধ্য ও একগুয়ে। শেষ মহুর্তে ফেরাউন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো কিন্তু তখন অনুতাপের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল [১০:৭১-৯২]।
আল্লাহ্র প্রতি অবিশ্বাস মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। ইউনুস নবীর সমসাময়িক জনগণ অনুতপ্ত হয়েছিলো। ফলে তারা আল্লাহ্র রহমত ও করণীয় ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে যারা বিশ্বাসী বা ঈমানদার ব্যক্তি, আল্লাহ তাঁদের ধ্বংস থেকে রক্ষা করবেন। যখনই আল্লাহর সত্য (প্রত্যাদেশ) প্রকাশিত হয় যা অনুসরণ করা এবং বিপদে ও দুর্যোগে ধৈর্য্য ধারণ করা কর্তব্য। কারণ আল্লাহ্ সুক্ষ বিচারক [১০:৯৩-১০৯]
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে]
১৩৮২: 'আয়াত' - শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্র নিদর্শন অথবা কুর-আনের পংক্তি বা চরণ। এখানে দুটো অর্থই সমভাবে প্রযোজ্য। কুর-আনের আয়াত জ্ঞানের ভান্ডার স্বরূপ। সে হিসেবে এর প্রতিটি চরণ হিরকখন্ড তুল্য। 'নিদর্শন' এ জন্য যে, আকাশে-বাতাসে পৃথিবী ও নভোমন্ডলে সর্বত্রই সেই স্রষ্টার হাতের স্পর্শ বা নিদর্শন বিদ্যমান। নক্ষত্র খচিত রাতের আকাশ আমাদের মনকে, চিন্তার দিগন্তকে সুদূরে প্রসারিত করে। মহান স্রষ্টার বিরাটত্ব অনুভব করতে সাহায্য করে। এই পৃথিবী ও নভোমন্ডলের সৃষ্টি আল্লাহ্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ক্ষমতা ও মহত্মের উজ্জ্বল "নিদর্শন"। সেই বিশ্ব-বিধাতা সারা নভোমন্ডল, আকাশ, বাতাস, পৃথিবী যার করতলগত, যিনি ক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দি, তিনি তার সৃষ্টির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে প্রাণ তাকেও কখনও অবহেলা করেন না। যে পাপী যে অবহেলিত, তিনি তাদের সাথেও তার রসুলদের মাধ্যমে কথা বলেন, হেদায়েত করেন, আত্মিক মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন। এগুলি সবই তাঁর নিদর্শন।
১৩৮৩ : আরবদের কাছে এই ব্যাপারটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ছিল যে তাদের মধ্যেই একজন নিজেকে আল্লাহ্র প্রেরিত পুরুষ বা রাসুল দাবী করছেন। আল্লাহ্র বাণী যা জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ভরপুর, তা রাসুলের মুখ থেকে নিঃস্বরিত। এই বাণীর ক্ষমতা, অতুলনীয় কারণ, এই বাণী মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে মুক্তির পথ দেখায়। আরও আশ্চর্যের বিষয়, রসুলের (সা) মত একজন নিরক্ষর লোকের মুখ থেকে কিভাবে এরূপ জ্ঞানের বাণী নিঃস্বরিত হতে পারে। এটা তখনই সম্ভব যখন তিনি আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন। এই সহজ সত্যটি আরবের লোকেরা বুঝতে সক্ষম হয় নাই। তারা তাঁকে যাদুকর আখ্যা দেয়, কারণ, আত্মার অন্ধকার, তাদের অনুধাবন ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, ফলে তারা তাদের দূরদর্শিতা, অনুধাবন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ম্যাজিকের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। তারা নিজেদের কুপমন্ডুকতার অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে যায়, যা তাদের অজ্ঞানতার ফল।
১৩৮৪ : "Qddama" শব্দটির অর্থ উচ্চ মর্যদা, অথবা কোনও কাজকে তাঁর প্রভুর নিকট পূর্বেই প্রেরণ করা। বাংলা অনুবাদ হয়েছে "তুমি সুসংবাদ দাও, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট আছে উচ্চ মর্যাদা।" ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে "The good news to the Belivers/ That they have before their Lord/The good actions they have advanced" ইংরেজী অনুবাদে দ্বিতীয় অর্থটির প্রয়োগ করা হয়েছে।
আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সর্বদা সকলের জন্য সুখকর নয়, অনেকের জন্যই তা অপ্রীতিকর। সতর্কবাণী করা হয়ছে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য, সাবধান করা হয়েছে পাপের পরিণতি সম্পর্কে। যদি আমাদের মাঝে বিশ্বাসের দৃঢ়তা থাকে, তবে আমরা আল্লাহ্র সতর্কবাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবো। যে এই বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করেছে, এবং সেই অনুযায়ী জীবনকে পরিচালিত করতে পেরেছেন তাদের জন্য আল্লাহ্ এই আয়াতে উচ্চ মর্যদার সুসংবাদ দিয়েছেন। জীবনকে পরিচালিত বাক্যটি "The good action they have advance" বাক্যটি বোঝানের জন্য অথবা "মোমেনদিগের" শব্দটি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ "Sidq" শব্দটির অর্থ বিশ্বস্ত ও খাঁটি। সুতারাং যে বিশ্বস্ত ও খাঁটি বা সৎ জীবন যাপন করে, তাদের জন্য সুসংবাদ।
১৩৮৫ : দেখুন টিকা ১০৩১ এবং সূরা [৭:৫৪] আয়াত
১৩৮৬ : এই আয়াতে 'আরস' বা সিংহাসন শব্দটি প্রতীকধর্মী। এই শব্দটি নিম্নোক্ত অর্থবোধক : (১) সিংহাসন রাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ অধিষ্ঠানের প্রতীক। এখানে আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট জগতের সবার উপরে, এই ভাবকে বোঝানো হয়েছে। সিংহাসন শব্দটি দ্বারা (২) রাজতন্ত্রে যেরূপ রাজার কর্তৃত্ব সর্বময়, আল্লাহ্র রাজত্বে আল্লাহ্র আইন সেরূপ অলঙ্ঘনীয়। প্রাকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এ কথার সত্যতা মেলে। কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতি, আকাশ-ভূমন্ডল, জীব ও জড় প্রকৃতি সকলের জন্য সুনির্দ্দিষ্ট প্রকৃতিক আইন আছে। এই আইন আল্লাহ্ কর্তৃক প্রণীত। সে লঙ্ঘন করার ক্ষমতা প্রকৃতিতে কারও নাই। (৩) তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। হিন্দু বা প্রাচীন গ্রীকদের বহু দেব- দেবী ছিল, যারা সাধারণ মানুষের ন্যায় আচরণ করতো। তাদের প্রেম-ভালবাসা, হাসি-কান্না, রাগ-অভিমান সবই ছিল সাধারণ পৃথিবীর মানুষের ন্যায়। এখানেই এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্ থেকে তাদের পার্থক্য। (৪) তিনি সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক এবং সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি "সকল বিষয় নিয়ন্ত্রিত করেন।" (৫) নবী, রসুল, স্ব-ইচ্ছায় কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। " তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন সুপারিশকারী পক্ষে আবেদন করতে পারে না।"
১৩৮৭ : দেখুন সূরা [৬:৮০] আয়াত।
১৩৮৮ : "Haqq" অর্থ সত্য, সঠিক, ন্যায়, নিশ্চিত ইত্যাদি বহুবিধ ভাবকে বুঝায়।
১৩৮৯ : দেখুন সূরা [২:১১৭] আয়াত ও টিকা ১২০। আল্লাহর সৃষ্টিকে অনুধাবন করতে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন। মানুষের সৃষ্ট যে কোনও পদার্থের আরম্ভ আছে আবার একদিন তা শেষ হয়ে যায়। সভ্যতার ক্রমবিকাশ একথাই বলে। এখানেই মানুষের সৃষ্টিধর্মী কাজের সাথে আল্লাহ্র কাজের পার্থক্য। সৃষ্টির আদি থেকে প্রাণের সৃষ্টি হয়ে আসছে, কোনও এক সময়ের জন্যও তা থেমে থাকে না। মৃত্যুর সমাধির উপরেই রচিত হয় জীবনের সূচনা। "অতঃপর উহার পুনরাবর্তন ঘটান।" সৃষ্টির এই ধারাবাহিকতা বিভিন্ন ধাপে ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকে। যারা মোমেন তারা আল্লাহ্র সৃষ্টির মাধ্যমে পূণ্য কাজ বা সৎ কাজ করার সুযোগ পান যেনো আল্লাহ্ তাদের পরকালে পুরস্কৃত করতে পারেন।
১৩৯০ : "Hamim" ফুটন্ত পানীয়; সূরা [৩৮:৫৭] আয়াতের "Gassaq" শব্দটির সাথে তুলনীয়। "Gassaq" শব্দটির অর্থ কৃষ্ণবর্ণ, ঘোলা বা অপরিস্কার, প্রচন্ড ঠান্ডা পানীয়। এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে যারা আল্লাহ্র বিধানের প্রতি বিদ্রোহ করে বা কুফ্রী করে তাদের শাস্তিকে রূপকের সাহায্যে বোঝানোর জন্য।
১৩৯১ : সৃষ্টির সৌন্দর্য্য ও রূপকে প্রকাশ করার জন্য সূর্য্য ও চন্দ্রকে রূপক হিসেবে এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্য তার আলোতে ভাষ্মর, সূর্য্যের আলোর তেজ ও উজ্জ্বল্য আমাদের জীবন রক্ষাকারী, অপর পক্ষে চাঁদের আলো মোলায়েম ও স্নিদ্ধ, সুন্দর যা অন্ধকারময় রাত্রিতে রাতের অন্ধকার দূর করতে সাহায্য করে। রাতের পৃথিবীর সৌন্দর্য্যকে বৃদ্ধি করে। এ ব্যতীত সূর্য্য এবং চন্দ্রের সাহায্যে আমরা সময়ের পরিমাপ করি। সৌর ক্যালেন্ডার ও চন্দ্র ক্যালেন্ডার সূর্য্য ও চাঁদের আবর্তনের উপরে ভিত্তি করেই রচিত। মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-আচরণ সব কিছু নির্ধারিত হয় চাঁদের উদয়ের উপরে ভিত্তি করে বা চান্দ্র মাস অনুসারে। অপর পক্ষে কৃষি কাজের পরিকল্পনা মূলতঃ করা হয় সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কারণ ঋতুর পরিবর্তনের সাথে কৃষি কাজের সম্পর্ক বিদ্যমান। সুতারাং সূর্য্য ও চন্দ্র সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ্ জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ নিদর্শন রেখেছেন।
১৩৯২ : পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মহৎ উদ্দেশ্য বিদ্যমান। তাঁর এই উদ্দেশ্য সত্য ও সুন্দরের উপরে প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্ পৃথিবীকে তাঁর খেয়াল-খুশী চরিতার্থ করার জন্য খেলার ছলে সৃষ্টি করেন নাই। দেখুন সূরা (২১:১৬) আয়াত। এই আকাশ, পৃথিবী, ভূমন্ডল সৃষ্টিতে আল্লাহ্র সৃষ্টি নৈপুন্যের কৌশল, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং বৈচিত্র বিদ্যামন। এসব বৈচিত্র থাকা সত্বেও সমস্ত সৃষ্ট পদার্থকে সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা আল্লাহ্র একত্বের কথা অনুভব করতে পারি। কারণ আকাশ-পৃথিবী, নভোমন্ডল, সর্বত্রই একই প্রাকৃতিক নিয়ম বর্তমান, সকলেই একই সূত্র বা নিয়ম মেনে চলে। যদি নভোমন্ডলের বিভিন্ন গ্রহ, বা পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন স্রষ্টা থাকতো, তবে তাদের পরিচালনার সূত্রও বিভিন্ন হতে বাধ্য হতো। বিজ্ঞানের সূত্র সকল কিছুর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হতো না। আল্লাহ্র একত্বের এর থেকে বড় প্রমাণ আর কিছু নাই। আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত নিয়ম বা প্রাকৃতিক নিয়ম বা বিজ্ঞানের সূত্র কখনই লঙ্ঘিত হয় না, আল্লাহ্ শুধুমাত্র মানব সম্প্রদায়কে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়েছেন। মানব সম্প্রদায় এই ইচ্ছা শক্তির অপব্যবহার করে যখন পাপে নিমজ্জিত হয়, আল্লাহ্র ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, প্রাকৃতিক নিয়মেই এক সময়ে পাপীর ধ্বংস ডেকে আনে এবং পৃথিবীতে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। দেখুন সূরা (৩:১৯১) আয়াতে।
১৩৯৩ : দেখুন সূরা (৯:১১) আয়াতে।
১৩৯৪ : দেখুন সূরা (২:১৬৪) আয়াতে।
১৩৯৫ : যারা আল্লাহ্র করুণা ও রহমত বঞ্চিত হবে তাদের প্রতি এই আয়াতে বলা হয়েছে। এদের বৈশিষ্ট্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে : (১) একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ্ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়েছেন, কারণ একমাত্র মানুষের এই নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে আত্মার অস্তিত্ব বিদ্যমান যা পরমাত্মার অংশ [১৫:২৯] [৩২:৯]। তাই পৃথিবীতে মানুষের অবস্থানের একটাই উদ্দেশ্য আর তা হচ্ছে পৃথিবীর জীবনের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি লাভ করা, যেনো মৃত্যুর পরে সে সেই পরমাত্মার সাক্ষাত লাভ করতে পারে। অর্থাৎ একান্ত আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রত্যেক মানব সন্তানকে চেষ্টা করতে হবে তাঁর আত্মিক উন্নতির জন্য। যারা তা না করবে তারা আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত হবে। (২) এই সব লোকেরা বস্তুগত পৃথিবী ও পার্থিব জিনিষ দ্বারা মুগ্ধ ও সম্মোহিত হয়ে যায়। পার্থিব লাভ-লোকসানই তাদের জীবনে একমাত্র মোক্ষলাভ। এতেই তারা সন্তুষ্টঃ, আত্মতৃপ্ত। সুতারাং তাদের আত্মায় পরকালের চিন্তা ঠাঁই পায় না। এরা হবে আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত। (৩) তাঁরা আল্লাহ্র নির্দেশাবলী বুঝতে অক্ষম হবে; কারণ আল্লাহ্র বাণী বোঝার ক্ষমতা তাদের থাকবে না। এর কারণ পূর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে। এদেরকে আল্লাহ্ মূক ও বধিররূপে বর্ণনা করেছেন, দেখুন সূরা (২:১৮) আয়াত। (১) নম্বর ও (২) নম্বর বৈশিষ্ট্যকে বলা যায় ঈমাহীনতার লক্ষণ। এরা পরকালের অস্তিত্বেই বিশ্বাসী নয়। (৩) নম্বর হচ্ছে তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা তাদের কর্মফলের জন্য পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত। এই সব লোক যারা আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত হবে, তাদের সাথে বিশ্বাসী ও ঈমানদার এবং যারা আল্লাহ্র রহমত লাভ করবে তাদের তুলনামুলক আলোচনা করা হয়েছে সূরা (১০:৯) আয়াতে।
১৩৯৬ : এই আয়াতে যারা বিশ্বাসী ঈমানদার তাদের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস বা ঈমানের জন্য তারা তাদের অন্তরের মাঝে আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথের সন্ধান লাভ করবে। যারা এই পথের সন্ধান লাভ করে তাদের অন্তর বেহেশ্তি শান্তিতে ভরে যায়। আনন্দ ও শান্তি তাদের আত্মাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়।
১৩৯৭ : এই আয়াতটি আধ্যাত্মিক জগতের মিষ্টি একটি সংগীত বা সুর। বেহেশতবাসীরা যে সুরে আল্লাহ্কে কৃতজ্ঞতা জানাবে তাকেই কবিতার ছন্দে এখানে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁদের গান, তাঁদের আনন্দচ্ছ্বাস, সবই পরম করুণাময়ের করুণার প্রকাশ। তাঁদের প্রতি যে সম্ভাষণ করা হবে তা হচ্ছে "সালাম" যার আভিধানিক অর্থ শান্তি। অর্থাৎ তাঁদের আত্মা বেহেশ্তি শান্তিতে ভরে যাবে- যা মানব জীবনের চরম এবং পরম পাওয়া। আল্লাহ্র প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা হবে, "প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্র প্রাপ্য।"
১৩৯৮: যারা অপরিণামদর্শী, শুধু তারাই ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। পৃথিবীতে আমরা দেখি, যারা বিজ্ঞ, জ্ঞানী, তারা হন দূরদর্শী, তারা ভবিষ্যৎ সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বর্তমান সময়ে কষ্ট স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু যারা অজ্ঞ, অপরিণামদর্শী, মূর্খ, শুধু তারাই বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং ক্ষণস্থায়ী আরাম, আয়েশের পিছনে নিজেদের সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে। আধ্যাত্মিক জীবনেও যারা পরকালের সুখ শান্তিতে বিশ্বাস করে না, তারা ঐ অপরিণামদর্শী মূর্খ লোকের মতই নির্বোধ। তারা পরকালের সুখ-শান্তির জন্য ইহকালে সামান্য কষ্টও স্বীকার করতে রাজী নয়। তারা ইহকালের ক্ষণস্থায়ী সুখের পিছনে ছুটে বেড়ায়। কারণ তাদের অজ্ঞতা তাদের আধ্যাত্মিক দিক থেকে অন্ধ করে দেয়। তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে বোঝার বা অনুধাবন করার ক্ষমতা থাকবে না। এদেরকেই কোরানের ভাষায় বলা হয়েছে মূক ও বধির। পরকালের অবিশ্বাসের দরুণ এরা আল্লাহ্র প্রতি বিদ্রূপ প্রদর্শন করে, তাৎক্ষণিক শাস্তি দাবী করে দেখুন সূরা [৮:৩২] আয়াতে। আল্লাহকে এরা নির্বোধের মত প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করে কারণ তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। যদি সত্যি সত্যি আল্লাহ তাদের কথা শুনতেন, তবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়তো। কিন্তু পরম করুণাময় তাদের ধ্বংস না করে সময় মঞ্জুর করেন। যেনো তারা ভবিষ্যতে অনুতাপ করার সুযোগ পায়। কিন্তু তারা তাদের এই সময়ের সদ্ব্যবহার না করে পাপে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এদের আধ্যাত্মিক জগত অন্ধকারময়- ফলে এরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে হবে বঞ্চিত। চক্ষু থেকেও এরা হবে অন্ধ ব্যক্তির ন্যায়। অন্ধ ব্যক্তি যেমন হাত্ড়ে হাত্ড়ে পথ চলে, এরাও জীবনের পথে কোন সঠিক দিগ্ নির্দ্দেশনা পাবে না। এরা বিভ্রান্তির মধ্যে বাস করবে। "আমি তাদের অবাধ্যতায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে দেই।"
১৩৯৯ : এই আয়াতে সাধারণ মানুষ যাদের ঈমান দুর্বল তাদের অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে। যখন দুঃখ, দুর্দ্দশা, হতাশা, গ্লানি, এই সব দুর্বল ঈমানের ব্যক্তিদের ঘিরে ধরে, তারা একান্ত অনুগত ভাবে আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করে। " সে শুয়ে, বসে অথবা দাঁড়িয়ে" বাক্যটি দ্বারা একান্ত অনুগত ও আন্তরিক ভাবে আল্লাহকে স্মরণ করা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বিপদে পড়লে এসব লোকেরা জীবনের সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু যখন আল্লাহ্ তাদের সেই বিপদ অতিক্রম করিয়ে দেন, তখন তারা আল্লাহ্র করুণার কথা ভুলে যায। তারা ভুলে যায় যে জীবনের সকল কল্যাণ আল্লাহ্র দান। কারণ তাদর ঈমান দুর্বল। তারা হচ্ছে কবি নজরুলের ভাষায় "সুখে দিনে ভুলে থাকি, বিপদে তোমায় ডাকি"- দলের লোক।
১৪০০: ঈমানের পূর্ব শর্তই হচ্ছে, মানবতা। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে, আত্মত্যাগের মাধ্যমে, আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা নিবেদন। সেই জন্যই বলা হয়ে থাকে, যার দয়া নাই, তার মধ্যে ঈমান নাই। কারণ সাধারণভাবে দেখা যায় ঈমানহীন ব্যক্তিরা হয় অত্যন্ত স্বার্থপর। তারা নিজের স্বার্থ চিন্তায় এতটাই আচ্ছন্ন থাকে যে, সেখানে ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দ, কোনও কিছুই স্থান পায় না। অন্যায়ভাবে মন্দ কাজের মাধ্যমে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করাই হচ্ছে তাদের জীবনের মোক্ষ এবং এই অন্যায় ও অসৎ কাজ পুনঃ পুনঃ করার ফলে, এর মাঝে তারা বিকৃত সৌন্দর্য্য খুঁজে পায়। "তাহাদিগের কর্ম তাহাদিগের নিকট এইভাবে শোভন প্রতীমান হয়।" স্বার্থপর ব্যক্তিরা নিজেদের সাফল্যে দম্ভ ও অহংকার অনুভব করে; তাদের ধারণা জন্মে তাদের সাফল্য তাদেরই একান্ত প্রচেষ্টার ফসল। অন্ধ অহংকার তাদের আত্মাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। তারা স্রষ্টাকে অনুভব করতে পারে না তাদের আত্মার মাঝে।
১৪০১ : তাৎক্ষণিকভাবে এই আয়াতের আবেদনে আরবদের কোরেশদের কথা বলা হয়েছে। কারণ তারাই হচ্ছে ধ্বংস প্রাপ্ত আজ ও সামুদ জাতির উত্তরাধিকারী। কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন, সর্বকালের, সর্বযুগের। খলিফা হারুণ-অর-রশীদের সময়, আব্বাসীয় সম্রাজ্যের বিস্তার, মুসলমানদের সূদুর স্পেন পর্যন্ত বিজয়, অটোম্যান সম্রাজ্যের অধিপত্য কুর-আন শরীফের এ কথারই প্রতিধবনি করে যে, যখন কোনও জাতি আল্লাহ্র প্রদর্শিত ন্যায় ও সত্যের পথে চলে তখন তারা সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে, আবার যখনই তারা সে পথ ত্যাগ করে, তখনই তাদের পতন ঘটে। কুর-আনের এই উপদেশ পৃথিবীর সকল মানুষের, সকল জাতির জন্য সর্বযুগে, সর্বকালে প্রযোজ্য। একথা মুসলমান, অমুলমান সবার জন্য সমভাবে সর্বযুগে প্রযোজ্য ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। উপদেশ : এই আয়াতের প্রেক্ষিতে আজকের মুসলমানদের অনুধাবন করতে হবে তাদের দুরবস্থার কারণ ও অমুলমানদের অভ্যূত্থানের কারণ।
১৪০২: যারা ঈমানহীন তারা আল্লাহ্র আয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করে না। তারা তাদের স্বার্থ অনুযায়ী কুর-আনের আয়াতের নির্দ্দেশের পরিবর্তন চায়। কিন্তু আল্লাহ্র নবী হচ্ছেন আল্লাহ্র বাণীর বাহকমাত্র। এর সামান্যতম পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের ক্ষমতা তাঁরও নাই। কেউ তা পছন্দ করুক বা না করুক, গ্রহণ করুক বা না করুক সেটা নবীর দায়িত্ব নয়। নবীর (সা) দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়। যারা নিজ স্বার্থ ব্যতীত অন্য কিছু অনুধাবনে অক্ষম তারাই সব সময়ে ধর্মকে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে চায়; ধর্মকে তারা নিজস্ব ইচ্ছা বা কল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি করতে চায়। পৃথিবীতে যুগে যুগে কিতাবধারীদের মধ্যে আল্লাহ্র মূল বাণীর বা ধর্মের যে বিকৃতি ঘটেছে তার একমাত্র কারণই হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ধর্মকে বিকৃতি করার প্রবণতা। যুগে যুগে ধর্মের বিকৃতির মূল কারণই হচ্ছে কিছু লোকের স্বার্থপরতা। কিন্তু এ কথা তারা বুঝতে অক্ষম যে ধর্মকে ভাড়া খাটানো যায় না।
১৪০৩ : সমস্ত বিশ্ব-প্রকৃতি, আকাশ নভোমন্ডল সবই আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়। আল্লাহ্ তার ইচ্ছা বা প্রত্যাদেশকে মানুষের কাছে প্রকাশ করতে চান, আর এই প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছেন তাঁর মনোনীত নবী ও রসুলেরা। আল্লাহ্র অপার করুণা যে, তিনি তার ইচ্ছাকে আমাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের কল্যাণের জন্য আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্র নিদর্শন বা প্রত্যাদেশই হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছা বা আমাদের জীবন পথের পথ প্রদর্শক- যা আমাদের জীবনে ক্যলাণ ও শান্তি বয়ে আনবে। তাঁর নির্দ্দেশিত পথ অবলম্বনের ফলে আমাদের আত্মিক উন্নতি ঘটবে যার ফলে আমাদের ইহকাল ও পরকাল শান্তিতে ভরে যাবে। এই 'শান্তি' পাওয়া জীবনের পরম ও চরম পাওয়া। আল্লাহ্র হেদায়েতের জন্য তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
১৪০৪ : হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সা) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে শৈশব থেকে পৌঢ়ত্ব পর্যন্ত কোরেশদের মধ্যে ছিলেন। আরবদের সেই সময়কার কুলষিত জীবন ধারণ প্রণালীর মধ্যে থেকেও মুস্তফার (সা) জীবন ছিল পূত-পবিত্র এবং স্বর্গীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ। সম-সাময়িক কোরেশরা তাঁর চরিত্রের এ দিকটি সম্যকভাবেই অনুধাবন করেছিলো- সে কারণেই তারা তাঁকে "আল-আমীন" বা বিশ্বাসী নামকরণ করেছিলো। কোরেশরা ভালোভাবেই জানতো যে, তিনি তাঁর লোকদের, তাঁর জাতিকে কতটা ভালোবাসেন। তাদের মঙ্গলের জন্য মুহম্মদ (সা) কতটা নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তার পরেও যখন তিনি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত করেন, তাদের পাপ কার্যকে সুনির্দ্দিষ্ট করেন এবং প্রচার করেন "আল্লাহ্র ইচ্ছাকে", কোরেশরা নবীর (সা) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে সম্যক অবহিত হওয়া সত্বেও তাঁকে ও তাঁর প্রতি প্রেরিত আল্লাহ্র বাণীকে অস্বীকার করে। হযরত মুহম্মদ (সা) কোরেশদের নিকট বারে বারে আবেদন করেছেন, "আমি তো এর পূর্বে তোমাদের মাঝে জীবনের দীর্ঘকাল অবস্থান করেছি তবুও কি তোমরা বুঝতে পারবে না।" । - অর্থ্যাৎ আল্লাহ্র বাণী অনুধাবন ও তাঁর নির্দ্দেশিত পথ অবলম্বনের এই সুবর্ণ সুযোগ কোরেশরা বুঝতে পারছে না।
১৪০৫ : যখন কেউ বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কিছুর এবাদত করে এবং বিশ্বাস করে যে, এসব নিষ্প্রাণ বস্তু বা প্রতীক তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে সুপারিশ করবে, তখন তাঁদের আত্মার মাঝে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্র রহমত ও করুণা অনুধাবন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। কিভাবে নিষ্প্রাণ কাঠের টুকরা (তৈরী মূর্তি) বা পাথরের খন্ড (তৈরী প্রতিমা) বা মৃত লোকের মাজার আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম এবং আল্লাহ্র কাছে সুপারিশ করতে সক্ষম? বা কিভাবে মৃত লোকের মাজারে আবেদন নিবেদন করলে তা আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছাবে? মৃত ব্যক্তি, বা যতবড় পূণ্যবান-ই হোন না কেন একমাত্র নবী করিম (সা) ব্যতীত আর কাউকে এমন সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হয় নাই। সাধারণ লোক এ কথা বুঝতে অক্ষম, যে ব্যক্তি (মৃত), সে নিজে আল্লাহ্র করুণার প্রত্যাশী তিনি কিভাবে অন্যের জন্য আল্লাহ্র করুণা বরাদ্দ করতে সক্ষম হবেন? এই সুরা (১০:৩) আয়াতে এই কথাই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর পূণ্যবান ব্যক্তিদেরও সাধ্য নাই বা ক্ষমতা নাই আল্লাহ্র কাছে সুপারিশ করার। যদি কেউ দাবী করে যে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা বিদ্যমান, তাঁর সুপারিশ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য, তবে অবশ্যই সে মিথ্যার কল্পনা করে এবং তার কল্পনার মূর্তি আল্লাহ্র জানা নাই। "পৃথিবীর এমন কিছু সংবাদ দিবে যা তিনি (আল্লাহ্) জানেন না?" কিন্তু আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছুই আল্লাহ্র নখদর্পনে। দৃশ্য -অদৃশ্য, প্রকাশ্য গোপন সবাই তাঁর কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্ট। সুতারাং আল্লাহ্র আগোচরে কিভাবে তাদের এবাদতের বস্তুরা ক্ষমতাবান হতে পারে?
১৪০৬ : দেখুন সূরা [২:২১৩] আয়াত। কবির কথায় বলতে হয়, "জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মানুষ জাতি।" কুর-আনের এই আয়াতে সেই কথাই ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ সকল মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি, সাদা, কালো, আর্য-অনার্য সকলের জন্য সমান। সকল মানুষই তার নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে পরমাত্মার অংশ ধারণ করে। তার আত্মা পরমাত্মার অংশ [১৫:২৯]। এই আত্মার উন্নতি লাভ করা সকল মানুষের জন্য ফরজ, আর আল্লাহর কর্তৃক নির্দ্দেশিত পথও সকল মানুষের জন্য এক। এই পথ সাদা-কালো, সকলের জন্য সমান। আর এই নির্দ্দেশিত পথই হচ্ছে আল্লাহর প্রেরিত বাণী যা যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছে। যুগে যুগে আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ হচ্ছে, এক আল্লাহ্তে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সত্য পথ অবলম্বনের মাধ্যমে জীবন ধারণ করা। কিন্তু যুগে যুগে মানুষের স্বার্থপরতা এবং আত্মম্ভরীতার ফলে আল্লাহ্র বাণীর বিকৃতি ঘটেছে। মানুষে মানুষে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে, মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন জাতি, গোত্রের উদ্ভব ঘটেছে। আল্লাহ্ পরম করুণাময়। মানুষের সৃষ্ট এই জাতিগত পার্থক্য সত্বেও যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মাঝে আল্লাহ তাঁর দূতদের প্রেরণ করেছেন; তাদের সংস্কৃতি, পরিবেশ ও মানসিকতার উপযোগী করে। এসব লোকেরা বা জাতি যেনো আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে, আল্লাহ্র দেয়া নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করে, তাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। তারা যেনো অমূল্য গুণরাজি ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আত্মাকে উন্নত ও উদ্ভাসিত করতে পারে। দেখুন সূরা [৫:৪৮] আয়াত।
উপদেশ : এই আয়াতগুলি [২:২১৩; ৫:৪৮; ১০:১৯] থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীতে আমাদের আগমনের একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন। চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমেই একমাত্র আত্মিক উন্নতি সম্ভব। আর এই গুণাবলী অর্জনের সব নির্দ্দেশ আছে আল্লাহ্র বাণীর মাধ্যমে। এবং যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে তা প্রেরণ করা হয়েছে তাঁর দূতদের মাধ্যমে। যারা তা অনুসরণ করে তারাই ইহলোকে ও পরলোকে সমৃদ্ধশালী হয়, সুখ ও শান্তির অধিকারী হয়।
১৪০৭ : 'কথা' বা 'ঘোষণা' সম্পর্কে দেখুন সূরা : [৬:১১৫], [৯:৪০] এবং সূরা [৪:১৭১]। সমস্ত পৃথিবীব্যাপী আল্লাহ্ মানুষ জাতিকে একটি জাতি হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। [দেখুন টিকা ১৪০৬] তবুও তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতভেদের দরুণ তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রত্যেকেই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। পরম করুণাময় আল্লাহ্ মানুষের এই পার্থক্য দূর করে তাদের মধ্যে সমতা আনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁর এই বিশ্বজনীন ইচ্ছাই হচ্ছে "ঘোষণা" । আল্লাহ্ আদম সন্তানকে ধর্মানুরাগে ও চারিত্রিক গুণাবলীতে গুণান্বিত হতে সাহায্য করেন তার পথ নির্দ্দেশ বা বাণীর মাধ্যমে। একমাত্র ধর্মানুরাগ ও চারিত্রিক গুণাবলীই মানুষকে পরস্পরের সমকক্ষ করতে পারে ও নিকটবর্তী করে। অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, পরস্পরের মধ্যে মতভেদ বৃদ্ধি করে ও দুস্তর ব্যবধানের সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন আত্মিক উন্নতি সাধন করার জন্য, যেনো সে পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। সমস্ত মানুষ জাতির সৃষ্টির এই একটাই উদ্দেশ্য, এখানেই সকল মানুষ সকল জাতি এক সমতলে অবস্থিত। আর এই আত্মিক উন্নতি লাভের একটাই পথ, আর তা হচ্ছে ধর্মানুরাগ ও চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন। মানুষ সৃষ্টির লগ্নেই আল্লাহ্ এই বিশ্বজনীন ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এবং তার জন্য এক নির্দ্দিষ্ট স্থায়িত্ব কাল নির্ধারণ করেছেন। অন্যথায় সাথে সাথেই " তাদের মত পার্থক্যের মীমাংসা হয়ে যেতো।"
১৪০৮: যারা কাফের তারা আfল্লাহ্র অস্তিত্বে বা পরকালে বিশ্বাস করে না। যদিও তারা দাবী করে যে, " কোন নিদর্শন" পেলে তারা তাদের বিশ্বাস বা ঈমান আনবে, এ কথা সত্য নয়। এটা তাদের একটি ভান বা বিশ্বাস না করার একটা কৌশল মাত্র। কারণ সারা বিশ্ব প্রকৃতি জুড়েই আল্লাহর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। আকাশ, বাতাস, তরু-লতা, জীব জগৎ সবই তার জ্ঞান, প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। তারা যা চায় তা হচ্ছে অদৃশ্য জগতের খবর। পার্থিব জগতে যেমন বই এর পৃষ্ঠা খুললেই জ্ঞানের ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া যায় তারাও চায় ভবিষ্যতের ভান্ডারে কি সঞ্চয় আছে, আল্লাহ্র নবী আল্লাহ্র কাছ থেকে তা জেনে তাদের বলুক। তারা মূর্খ, তাই তারা বুঝতে পারে না- এই বিরাট মহাবিশ্ব বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে। বর্তমানের বৈজ্ঞাকি সত্যতা এই যে, দশমাত্রা পর্যন্ত বস্তুর অস্তিত্ব সম্ভব যেখানে আমরা বাস করি ত্রিমাত্রিকি জগতে। এই ত্রি-মাত্রার বাইরের যে জগত তা আমাদের চোখে অদৃশ্য। মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতা খুবই সীমতি। এই সীমিত জ্ঞান ও ক্ষমতা নিয়ে সে আল্লাহ্র অদৃশ্য জগতের সংবাদ চায়। কিন্তু এই পার্থিব দেহ ধারণ করে কিছুতেই তার পক্ষে মানুষের জ্ঞান ও যুক্তির অতীত রহস্য ধারণ করা সম্ভব নয়। সুতারাং তারা অপেক্ষা করুক। এই আয়াতে কাফেরদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে, এবং মোমেন বান্দারাও অপেক্ষা করে। কিন্তু এই দুদলের কোন কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা দুধরণের। দেখুন সূরা [৬:১৫৮] এবং [৯:৫২] আয়াতে।
১৪০৯: পৃথিবীতে মানুষের স্বভাব ধর্মই হচ্ছে, যখন সে বিপদে পড়ে, তখন সে কায়-মনোবাক্যে, একান্ত আন্তরিকভাবে আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করে। কিন্তু যখনই আল্লাহ তাকে অনুগ্রহ করেন, তাঁর থেকে বিপদ-বিপর্যয় দূর করে দেন, সাথে সাথেই সে আল্লাহ্কে ভুলে যায়। শুধুমাত্র সে যে আল্লাহ্কে ভুলে যায় তাই-ই নয়, সে আল্লাহ্র বিধান বা আল্লাহর ইচ্ছার বিরোধিতা করতে থাকে। এসব লোক মূর্খ এবং হতভাগ্য। হতভাগ্য এইজন্য, তারা বুঝতে অক্ষম যে, আল্লাহ্র বিশ্বজনীন পরিকল্পনা রোধের ক্ষমতা এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে কারও নাই। আল্লাহ্র যা ইচ্ছা তা বাস্তবায়িত হবেই। আল্লাহ্র প্রচন্ড ক্ষমতার সম্মুখে আল্লাহর ইচ্ছার বিরোধিতা করার পরিকল্পনা প্রচন্ড স্রোতের মুখে তৃণখন্ডের ন্যায় ভেসে যায়। ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষমতা ও পরিকল্পনা মহাকালের আবর্তে হারিয়ে যায়। আল্লাহ্র ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়। কিন্তু এসব হতভাগ্যদের নথি আল্লাহ্র কাছে হারিয়ে যায় না। তাদের অবাধ্যতার তালিকা আল্লাহ্র কাছে অনন্তকালের জন্য স্থায়ীভাবে রক্ষিত হয়।
১৪১০: মানুষের মেধা, জ্ঞান, প্রতিভা, অধ্যবসায় মানুষকে পৃথিবী জয় করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু মানুষের এসব ক্ষমতা মানুষের নিজস্ব নয়, এসব মহান আল্লাহ্র দান। আল্লাহ্ তার নেয়ামত বিভিন্ন বান্দাকে বিভিন্নভাবে দান করেছেন। এ সবের জন্য আমাদের আল্লাহ্র কাছ সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু মানুষ অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ প্রাণী। মানুষের চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি এই আয়াতে সুন্দর একটি উপমার সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। অকুল সমুদ্রে জাহাজ যখন অনুকূল বায়ুতে তার গন্তব্যস্থানের দিকে অগ্রসর হয়, যাত্রীদের হৃদয় তখন আনন্দে ভরপুর থাকে। তাদের দিনগুলি তখন সোনালী ডানাতে ভর করে উড়ে চলে। আল্লাহ্র করুণায় যে তা সম্ভব হয়েছে তা তারা ভুলে যায়। কিন্তু যদি হঠাৎ করে জাহাজটি সামুদ্রিক ঝড়ের মধ্যে নিপতিত হয়, এই সব আনোন্দচ্ছল যাত্রীরা ভয়ে, আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়ে। বিপদের মুখোমুখি, মৃত্যুকে সম্মুখে প্রত্যক্ষ করে তারা একান্তভাবে অনুগত চিত্তে, আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করে। সাধারণ মানুষের প্রবণতা হচ্ছে এ সময়ে তারা আল্লাহ্র নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, তারা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে জীবনের পরবর্তী সময়টা আল্লাহ্র রাস্তায় চলবে। কোন অন্যায় ও অসত্যের আশ্রয় নেবে না। আল্লাহ্র বিধান মত জীবনকে পরিচালিত করবে। দেখুন সূরা [৬:৬৩] আয়াত।
১৪১১: মানুষকে আল্লাহ্ যখনই বিপদমুক্ত করেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি হচ্ছে, বিপদ মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা । এই কৃতজ্ঞতা শুধুমাত্র মৌখিক হবে না, হতে হবে তাঁর কাজের মাধ্যমে, তার আচরণের মাধ্যমে। পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হবে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সে আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। তার অহংকার তাকে উদ্ধত করে তোলে। দম্ভ, অহংকারে সে ভুলে যায় পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনের কথা। কত শক্তিশালী নৃপাতি মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতা, শক্তি আজকে শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতাতে বন্দী হয়ে আছে। পৃথিবীর ক্ষমতা, শক্তি, অর্থ, সম্পদ ব্যক্তির জীবনে খুবই ক্ষণস্থায়ী যা শ্বাসত সত্য যা অনন্তকাল স্থায়ী, তা হচ্ছে পরকালের জীবন। এই সত্যকে অনুভব করতে পারবো মৃত্যুর পর যখন আমরা সেই মহান আল্লাহ্র দরবারে নীত হব। কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকবে না। উদ্ধত অহংকারে অন্যের উপরে অন্যায়, অত্যাচার দ্বারা আমরা আমাদের আত্মার যে ক্ষতি করে থাকি তা মৃত্যুর পরে আমাদের সামনে ভাস্বর হবে।
১৪১২: এই আয়াতটিতে অপূর্ব সুন্দর উপমার সাহায্যে পার্থিব জীবনের সুখ-শান্তি, আত্মতৃপ্তি, দম্ভ ও অহংকারের ক্ষণস্থায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর রহমত স্বরূপ। আল্লাহ্র রহমত যেরূপ মৃতপ্রায় আত্মাকে আত্মিক সমৃদ্ধিতে সমৃদ্ধশালী করে; বৃষ্টির পানিও সেরূপ শুষ্ক ধরণীকে সিক্ত করে ধরণীকে ফসল, ফুল, ফল ও অরণ্যতে ভরিয়ে তোলে। ধরণী শস্য শ্যামলা হয়ে ফুল ও ফসলে ভরে উঠে। কারণ আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ হচ্ছে ফসলের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশ। কিন্তু ফসলের মালিকের মনে অন্ধ অহংবোধ জন্ম লাভ করে যে, তাঁর পরিশ্রমের ফলেই সে কৃষি কাজে সফলতা লাভ করেছে। ফসলের প্রাচুর্যের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ দেওয়ার পরিবর্তে, "উহার অধিকারীগণ মনে করে উহা তাদের আয়ত্তাধীন।"- অর্থাৎ তার সম্পদ, প্রাচুর্য, সবকিছু তার নিজস্ব ক্ষমতায় অর্জিত হয়েছে। এখানে বিশ্বস্রষ্টার কোনও ভূমিকা নাই। এই অহংকার বা দম্ভকে ধ্বংস করতে স্রষ্টার এক মূহুর্ত সময়ের প্রয়োজন হয় না। এখানে এই ধারণাটিকে বুঝানোর জন্য সুন্দর একটি উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। তা হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ : যেমন, ক্ষরা, শিলাবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, আগ্নেয়পাত ইত্যাদি যেরূপ এক মূহুর্তে শস্য-শ্যামল ভুমিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে ঠিক সেইরূপ মূহুর্তের মধ্যে মানুষের সম্পদের অহংকার, প্রাচুর্যের অহমিকা, ক্ষমতার দম্ভ মাটিতে মিশিয়ে দিতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র মূহুর্ত সময়েরও প্রয়োজন নাই। সুরম্য অট্টালিকা শোভিত জনপদ, মনোরম উদ্যান, সুপক্ক ফসলের ক্ষেত যে সব বস্তু মানুষের মনে অহংকারের জন্ম দেয় যা তাকে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে বাঁধা দেয়, যা তাকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা বৃদ্ধি করে, তা সবই যে মহান আল্লাহ্র দান, আর তা আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে খুবই ক্ষণস্থায়ী ও নগন্য। আল্লাহ্র শক্তির কাছে মানুষের শক্তি, সামর্থ খুবই অকিঞ্চিতকর ও নগন্য। তার প্রচেষ্টাও ক্ষণস্থায়ী। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পৌরানিক সভ্যতা ও জনপদ, যা আজ শুধুমাত্র ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়বস্তু। আমাদের পার্থিব জীবনকে তুলনা করা হয়েছে ঐ সুপক্ক ফসলের ক্ষেতের সাথে, আল্লাহ্র রহমত ব্যতীত যার অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী। তাহলে কেন আমরা স্থায়ী সুখের ঠিকানাকে অবহেলা করে শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের জন্য চেষ্টা করে যাব?
১৪১৩: পৃথিবীর জীবন-এর চাকচিক্য, সবই ক্ষণস্থায়ী। পৃথিবীর এই জীবনে আমরা ভোগ-বিলাস, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মত্ত থেকে জীবনের দুর্লভ সময়ের অপব্যবহার করি। পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসের আনন্দ কখনও আত্মাকে তৃপ্তি দেবে না, শান্তি বা প্রশান্তিতে আত্মাকে ভরিয়ে দেবে না। কারণ তা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। অর্থ, সম্পদ, সুখ-শান্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি সব কিছু ব্যক্তির জীবনের ক্ষণস্থায়ী রূপ মাত্র। এসব হারাবার ভয়ে তার চিত্ত সর্বদা থাকে উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। ফলে চিত্তের শান্তি হয় বিঘ্নিত। পার্থিব সম্পদের বা ক্ষমতার যে সুখ তা ক্ষণস্থায়ী সুখ। কারণ তা ঐ ফসলের ক্ষেতের মত সর্বদা হারাবার ভয় থাকে। অপর পক্ষে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের যে সুখ বা শান্তি তা স্থায়ী। উপরে ফসলের ক্ষেতের উপমার সাথে পার্থিব ক্ষণস্থায়ী সুখের তুলনা করে, আল্লাহ্ আমাদের স্থায়ী শান্তির ঠিকানায় আহ্বান করেছেন। আল্লাহর আশ্রয় স্থায়ী আশ্রয়। তা হারাবার ভয় নাই, নষ্ট হওয়ার ভয় নাই। না পাওয়ার হতাশা বা দুঃখ আমাদের উদ্বিগ্ন করতে পারে না। আত্মার সাথে বিরাজ করবে অপার শান্তি। এই শান্তির আলয়ে সবার জন্য-ই আছে আল্লাহ্র তরফ থেকে আমন্ত্রণ। তারাই এই শান্তির আলয়ের সন্ধান লাভ করবে যারা পার্থিব জীবনকে-ই জীবনের সর্বোচ্চ মোক্ষ লাভ মনে করবে না। যারা আল্লাহ্র প্রসন্নতা লাভের জন্য চেষ্টা করবে, শুধু তাঁরাই খুঁজে পাবেন সেই শান্তির আলয়ের ঠিকানা। সেই ঠিকানাতে পৌঁছানোর জন্য যে সরল পথের নিশানা, সেই নিশানার সন্ধান তাঁরা লাভ করবেন। "সালাম" বা শান্তি হচ্ছে ইসলামের অপর নাম। ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম- যা আত্মাকে প্রশান্তির পথে পরিচালিত করে। সেই পথ যা আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাসের মাধ্যমে, আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন করতে শেখার ফলে আত্মা শান্তির পরশে আত্ম নিমগ্ন হয়।
১৪১৪ : যারা মোমেন বা ধার্মিক তারা আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য কাজ করেন। মোমেন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য-ই হচ্ছে তারা অন্যের মঙ্গলাকাঙ্খী। তাঁদের জন্যই আছে আল্লহ্র তরফ থেকে "মংগল" এবং "আরও অধিক" মংগল। অর্থাৎ যারা অপরের মংগলের জন্য কাজ করে তাদের আত্মাকে আল্লাহ্ অপার শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য তারা তাদের আত্মার মাঝে অনুভব করবেন- যার অনুভব ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। ঐ কথাকেই কবি এভাবে বর্ণনা করেছেন।
"পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন প্রাণ সকলই দাও;
তার মত সুখ কোথায় কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।"
১৪১৫ : "মুখন্ডল" কথাটি এখানে ব্যক্তি চরিত্র বা ব্যক্তিত্বকে বুঝানো হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীই প্রাণের অধিকারী। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য হচ্ছে মানুষ এই নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে প্রাণের অস্তিত্ব ব্যতীতও আত্মার অবস্থান অবস্থিত। এই আত্মার চাওয়া-পাওয়াই ব্যক্তির চরিত্রের ব্যক্তিত্বের বহিঃ প্রকাশ। ব্যক্তি যখন স্রষ্টার সান্নিধ্য আত্মার মাঝে অনুভব করে, তখন তার সর্বসত্তা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়ে যায়। বিভিন্ন গুণাবলী ব্যক্তির চরিত্রকে করে মাধুর্য্যমন্ডিত। যে চরিত্র বা ব্যক্তিত্ব গুণে সমৃদ্ধ সেখানে কোনও ভুল-ভ্রান্তি বা পদস্খলনের সম্ভাবনা সামান্য। কারণ আল্লাহ্ তাদের জীবন পথের অন্ধকার দূর করে দেবেন, কোন "কালিমা ও হীনতা তাদের মুখমন্ডলকে আচ্ছন্ন করবে না,"- অর্থাৎ লোভ, হিংসা-দ্বেষ, ইর্ষা, নীচতা, হীনতা, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি জীবনে চলার পথে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে, ফলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যার ফলে তার ব্যক্তিত্ব বা মুখমন্ডলকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। যদি সে ভালো কাজ অর্থাৎ পরের মঙ্গলের জন্য কাজ করে তবে মহান আল্লাহ্ তার দোষ ত্রুটি দূর করে দেবেন; অন্তরের ক্ষোভ, হতাশা সব বিদূরিত করে তাঁর সান্নিধ্যে অন্তরকে উদ্ভাসিত করবেন। যার ফলে চারিত্রিক মাধুর্যে, নৈতিক দিক থেকে ব্যক্তিত্ব হবে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ। তাই যারা অপরের মঙ্গলের জন্য কাজ করে তারা হবে জান্নাতের অধিবাসী।
১৪১৬: এই আয়াতে বলা হয়েছে যে মন্দ কাজের প্রতিফল মন্দ। অর্থাৎ যারা ইচ্ছাকৃতভাবে অসৎ কার্যকলাপ করে, তারা তাদের অনুরূপ কতৃকর্মের ফল ভোগ করবে। তাদের আত্মা আল্লাহ্র নূর থেকে বঞ্চিত হবে, ফলে জীবনের পদে পদে রীপুর তাড়নায় তারা ভুল পথে পরিচালিত হবে। ফলে তাদের আত্মার মাঝে তারা হীনতা, নীচতা অনুভব করবে, যা তাদের আত্মার মাঝে যন্ত্রণার উদ্ভব করবে। সিদ্ধান্তহীনতা তাদের চিত্তকে অস্থির রাখবে। ভয়, আশঙ্কা তাদের ব্যক্তিত্ব করবে আচ্ছন্ন। পৃথিবীতে এভাবেই তাদের চিত্তের শান্তি তিরোহিত হবে, পরকালের শাস্তিতো পাওনাই রইল। এই আয়াতে "অনুরূপ" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ্র ন্যায় বিচার অত্যন্ত সুক্ষ। অন্যায় ও অসৎ কাজের শাস্তি ততটুকুই বা অনুরূপ হবে যতটুকু অসৎ ও অন্যায় কাজ সে করেছে তার বেশী নয়। তার থেকে একচুলও বেশী নয় বা কম নয়। কিন্তু যে সৎ কাজ বা ভালো কাজ করে, মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে তার পুরস্কার তার কাজের "অনুরূপ" না হয়ে, তা তার কাজের পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। আল্লাহ্র করুণা বা দয়া তার প্রাপ্যকে ছাড়িয়ে তাঁকে পরিব্যপ্ত করবে। কারণ আল্লাহ্ মহান ও পরম করুণাময়।
১৪১৭: "অন্ধকারকে" এখানে আলোর বিপরীত অর্থকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। "অন্ধকার" ও "আলো" এই শব্দগুলি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। "আলো" হচ্ছে আনন্দ ও শান্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা আত্মাকে প্রশান্তি ও 'নির্মল আনন্দে" ভরিয়ে দেয় তাই-ই আত্মিক "আলো" অপরপক্ষে যা আত্মার মাঝে অস্থিরতা, শঙ্কা, ভয়, সিদ্ধান্তহীনতা, অশান্তির জন্ম দেয় তাই-ই আত্মার জন্য "অন্ধকার" স্বরূপ। এই অন্ধকারের গভীরতার স্তর সবার জন্য সমান নয়। এই গভীরতার স্তরকে এই আয়াতে "আস্তরণ" শব্দটি এবং ইংরেজী অনুবাদে "Depth of darkness" বাক্যটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।
১৪১৮: মানুষ নানাভাবে নানা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে। এগুলি সবই তার নিজস্ব মনগড়া কল্পনার ফসল। কিন্তু সে তার কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কখনও তার সেই কল্পনাকে নবী রসুলের নামে বা, মহৎ ব্যক্তিত্বের নামে বা আল্লাহ্র নামে চালু করে। এ ব্যাপারে তারা পরস্পর পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। তারা আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পনের পরিবর্তে নিজস্ব মত ও পথের, বা কল্পনাকে পূঁজা করে যা শেরেকী বা আল্লাহ্র সাথে অংশদারিত্ব। যাদেরকে এবাদতের মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা হতো, তারা শেষ বিচারের দিনে তাদের দায় দায়িত্ব অস্বীকার করবে। এই কথাকেই এই আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে "তোমরা তো আমাদের উপাসনা করতে না।" অর্থাৎ এইসব মোশরেকদের এবাদতের বস্তু ছিল তাদের নিজস্ব মনগড়া বস্তু, যা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে উদ্ধার করেছে, যা কুসংস্কার বা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা।
উপদেশ : বাংলাদেশে ও পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশে মুসলমানেরা কুর-আনের আয়াতের নির্দ্দেশকে অনুধাবন না করে, মিথ্যা কুসংস্কার ও নানা ধরণের শেরেকী কার্যকলাপে লিপ্ত। এর কারণ তারা সঠিকভাবে কুর-আন পড়ে না। যেমন বাংলাদেশে ধর্মকে অনুধাবনের জন্য অধিকাংশ লোকে মূল কুর-আনের আয়াতের পরিবর্তে হাদিসের সাহায্য গ্রহণ করে। যেহেতু হাদিস মানুষের রচনা, সেখানে ভুলভ্রান্তি এবং মিথ্যা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা অধিক।
১৪১৯: দেখুন পূর্বতী টিকা। fযাদের মুশরেকরা পূঁজা করতো, তারা জানতো না যে তারা পূজিত হচ্ছে।
১৪২০: দেখুন সূরা [২:৯৫] আয়াত। সূরার [২:৯৫] আয়াতে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে "qaddama" এবং এই সূরাতে [১০:৩০] ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে "aslafa" এই দুটি ক্রিয়াপদই প্রায় সমার্থক।
১৪২১: তারা যাদের আল্লাহ্র সমকক্ষ কল্পনা করে আরাধনা করতো, যাদের সাহায্য কামনা করতো, তাদের সেই উপাস্য বস্তু শেষ বিচারের দিনের তাদের কোনও সাহায্যেই আসবে না। তাদের উপাস্যরা তাদের ত্যাগ করে চলে যাবে এবং তারা হতাশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। দেখুন সূরা [৬:২৪] আয়াতে।
রুকু-৪
১৪২২: "জীবনোপকরণ" বলতে শুধুমাত্র আহার্য্য সামগ্রী বুঝায় না। ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আত্মিক অর্থাৎ তার সর্বসত্তা বিকাশের জন্য যত প্রকার উপকরণ প্রয়োজন এখানে জীবনোপকরণ বলতে তাই-ই বোঝানো হয়েছে। শারীরিক বিকাশের জন্য জীবনোপকরণের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে আকাশ থেকে ঝড়ে পড়া বৃষ্টির পানি ও সূর্য্যের আলো- যার সাহায্যে গাছের বৃদ্ধি হয় এবং পৃথিবীর মাটিতে ফসল উৎপাদন হয়। জলে, স্থলে ও আকাশে চলাচলের মাধ্যমের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে জীবনোপকরণ হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য। আর আধ্যাত্মিক জগতের বিকাশের জন্য যে জীবনোপকরণ, তা হচ্ছে আল্লাহ্ প্রেরিত নবী ও রসুলেরা যারা যুগে যুগে মানুষদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পথ প্রদর্শন করে গেছেন।
১৪২৩: মানুষ বিভিন্ন মানসিক শক্তির আঁধার। একমাত্র মানুষকেই এই বিশেষ মানসিক শক্তি বা faculties of mind দেয়া হয়েছে, অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হয় নাই। এই আয়াতে শুধুমাত্র দুটো মানসিক শক্তি যা অতি সাধারণ, তারই উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি। এই দুটো মাত্র উল্লেখ করা হয়েছে অন্য সকল মানসিক শক্তির প্রতীক বা উদাহরণ হিসেবে। মানুষ তার এই সব মানসিক শক্তির সাহায্যে আল্লাহ্র নেয়ামতকে উপভোগ করতে পারে। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ তার চর্ম চক্ষুর বাইরেও হৃদয় দিয়ে অনুভব করার ক্ষমতা রাখে। সাধারণ শব্দের বাইরেও ভাষার মাধুর্য্য, প্রাণের ভাব প্রকাশের ভঙ্গী উপভোগ করে। এভাবেই তার চিন্তার জগৎ অনুভবের জগৎ তার ক্ষুদ্র শারীরিক অনুভূতির সীমা ছাড়িয়ে অসীমে বিস্তার লাভ করে। এই পৃথিবীর পার্থিব ও অপার্থিব সকল নেয়ামত আমরা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে পারি। এই উপভোগের ক্ষমতা আল্লাহ্রই দান। কিন্তু সাধারণ মানুষ আল্লাহ্র এসব নেয়ামতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, তারা এটাকে কোনও ব্যতিক্রম ভাবতে পারে না।
১৪২৪: দেখুন সূরা [৩:২৭] আয়াত এবং টিকা ৩৭১-এ; সূরা [৬:৯৫] আয়াত এবং টিকা ৯২০; এবং সূরা [৩০:১৯] আয়াতে।
১৪২৫: " যিনি সকল বিষয় শাসন নিয়ন্ত্রিত করেন"- এই বাক্যটি দ্বারা পুরো আয়াতটির ভাবকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। সারা বিশ্ব-ভূবন, আকাশ-নভোমন্ডল, সর্ব কিছুর সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিপালন, বিকাশ, নিরাপত্তা, সব কিছুর নিয়ন্ত্রক আল্লাহ্। এই অতি সাধারণ সত্যকে অবহেলা করে আল্লাহ্র উপাসনা ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করা নিতান্ত অর্থহীন নয় কি?
১৪২৬: উপরের আয়াতের মাধ্যমে বিশ্ব স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্য্য, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দয়াকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যা কিছু মানসিক দক্ষতা সমূহ, যার জন্য মানুষ গর্ববোধ করে, সবই আল্লাহ্র দান। তিনি-ই একমাত্র উপাস্য। এই সহজ সত্যটি ভুলে যেয়ে কেউ যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করে, তবে তা হবে প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করা, প্রকৃত সত্যকে অসম্মান করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা। এর ফলে ব্যক্তির অন্তর্জগতে বা আধ্যাত্মিক জগতে বিরাট বিপর্যয় ঘটে যাবে। মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা শুধু যে ধর্মীয় বিশ্বাসের বা ঈমানের ভিত্তি-ই দুর্বল করে তাই-ই না, এই ভিত্তি দুর্বল হওয়ার ফলে ব্যক্তির চরিত্র বা আচরণেও বিকৃতি দেখা দেবে, যেমন সুউচ্চ ইমারতের ভিত্তি দুর্বল হলে, ইমারতের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় সেরূপ ঈমান থেকে বিচ্যুতির ফলে, আমাদের আধ্যাত্মিক জগতে ধ্বংস নামে, আমরা ভুল করি, আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হই, আমরা "সরল পথের" ঠিকানা ফেলি হারিয়ে। এখানে তাই প্রশ্ন করা হয়েছে, "কিভাবে তোমরা সত্য থেকে ফেরে যাচ্ছ "?
১৪২৭: "Every action there is an equal and opposite reaction". বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক নিউটনের এটি একটি সর্বজন বিদিত বৈজ্ঞানিক সূত্র। পৃথিবীতে প্রতিটি কাজেরই প্রতিফল থাকে। ভালো কাজর প্রতিফল ভালো, মন্দ কাজের প্রতিফল অবশ্যই মন্দ। আল্লাহ্ আমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। সুতারাং একমাত্র উপাস্য। এটাই একমাত্র শ্বাসত সত্য। যে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে সে এই শ্বাসত সত্যকে অস্বীকার করে। যা আমাদের বিধিদত্ত স্বভাব প্রকৃতির বিরুদ্ধে। সুতারাং নিউটনের সূত্রমতে, এর একটি প্রতিফল থাকবে বই কি। যেহেতু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্কে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখানো প্রচন্ড অবাধ্যতা, সুতারাং এই অবাধ্যতার প্রতিফল ভয়াবহ হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এই বিরাট বিশ্ব-সংসার আল্লাহ্র নির্দ্দিষ্ট আইনে চলে। আল্লাহ্র প্রতি অবাধ্যতার জন্য যে আইন সে আইন প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই ব্যক্তির জীবনে তা প্রতিফলিত হবে। যদি আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করি বা আল্লাহ্র সাথে অন্য কাউকে 'শরীক' করি তবে আল্লাহ্র আইন বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে, আমরা হয়ে যাব বিভ্রান্ত, এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাসের দীপশিখাটি নিভে যাবে। এর ফলে আমাদের আত্মিক দিক থেকে মৃত্যু ঘটবে। আমাদের হৃদয়ের যে আধ্যত্মিক শক্তি (Spiritual faculty) তা হবে অন্তহৃত। ফলে, " নিশ্চয়ই তারা ঈমান আনবে না।"
১৪২৮: যারা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে অর্থাৎ 'শেরেকী' করে তাদের বিরুদ্ধে এই আয়াতেও সতর্ক বাণী করা হয়েছে, কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে। এই আয়াতে আল্লাহ্ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে তাদের মিথ্যা উপাস্য কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, প্রতিপালন করতে পারে না, রক্ষা করতে পারে না, সৃষ্টিকে পুনরাবর্তন ঘটাতে পারে না, অর্থাৎ তাদের কোনও সৃষ্টিধর্মী গুণ নাই। শুধু তাই-ই নয়, তারা মানুষকে আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখে না। আত্মিক উৎকর্ষতা হচ্ছে মানুষের মনুষ্য জন্মের শেষ পরিণতি। মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের অস্তিত্বের শেষ হয়ে যায় না। এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করে আত্মার যাত্রা শুরু হয় অনন্তলোকে পরম আত্মার সান্নিধ্য লাভের কামনায়। সেই যাত্রা পথের পাথেয় এই পৃথিবীতেই আমাদের সংগ্রহ করতে হয় আত্মিক উৎকর্ষতার মাধ্যমে। এই সব মিথ্যা উপাস্য সে পথ দেখাতে ব্যর্থ। হতে পারেন তিনি দেবতুল্য ব্যক্তিত্ব [যেমন আমাদের দেশে পীর পূজা করা হয়], যদি তিনি তার অনুগামীদের আত্মিক উৎকর্ষতার পথ প্রদর্শন না করে, ভুল পথ প্রদর্শন করেন; তবে তাঁর নিজেরই আল্লাহর পথ নির্দ্দেশ প্রয়োজন। পরের আয়াতে তাই বলা হয়েছে "যিনি (আল্লাহ), সত্যের পথ নির্দ্দেশ করেন তিনি আনুগত্যের অধিকতর হকদার, না যাকে পথ না দেখালে [দেবতুল্য ব্যক্তি] পথ পায় না- সে?" তাহলে কেন মানুষ আল্লাহ্র সাথে শরীক করবে, মনগড়া উপাস্যের অনুগত থাকবে। যখন আল্লাহ্ সকল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্যপথের মালিক। সুতারাং সকল উপাসনা, সকল আনুগত্য আল্লাহ্র প্রাপ্য- তিনিই একমাত্র সত্য।
১৪২৯: দেখুন সূরা [৩:২৩] আয়াত এবং টিকা ৩৬৬। আল্লাহ্র বাণী বা পথ নির্দ্দেশ হচ্ছে মানুষের চরিত্রের নৈতিক নীতিমালা। আমরা পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাস আলোচনা করলে দেখতে পাই প্রাচীন যুগ থেকে এ পর্যন্ত মানুষের নৈতিক নীতিমালা একই রয়ে গেছে। কারণ আল্লাহ্র প্রণীত নীতি বা আইন কোনও অবস্থাতেই লঙ্ঘন করা যায় না। সে নীতিমালা যদি প্রকৃতির আইন হয়, তবে এর লঙ্ঘনে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। আর নীতিমালা যদি নৈতিক নীতিমালা হয় তবে তার লঙ্ঘনে আত্মিক জীবনের অগ্রগতি ধ্বংস হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে। পার্থিব জীবনের নৈতিক নীতিমালা আল্লাহ্ যুগে যুগে তার প্রেরিত দূতদের মাধ্যমে,, কিতাবের মাধ্যমে মানুষের জন্য প্রেরণ করেছেন। তার কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই। উদাহরণ : যেমন সত্য কথা বলা আত্মাকে সমৃদ্ধ করে, মিথ্যার অভ্যাস আত্মিক উৎকর্ষতার বাঁধা স্বরূপ, ইত্যাদি। এই নৈতিক নীতিমালা সমূহ সর্বযুগে এক রয়ে গেছে। আত্মিক উৎকর্ষতার পথ নির্দ্দেশ সর্বযুগের জন্য অপরিবর্তনীয়। কুর-আন শুধু পূর্ববর্তী গ্রন্থের সত্যায়ন করে। "অনুমোদন" কথাটির দ্বারা এই কথাই বুঝানো হয়েছে। "বিধান সমূহের বিশদ ব্যাখ্যা"- এই লাইনটির অর্থ, পূর্ববর্তী আল্লাহর কিতব সমূহে যে নৈতিক বিধান সমূহের বর্ণনা আছে তার বিশদ ব্যাখ্যা কুর-আনে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কুর-আন কোনও নূতন গ্রন্থ নয়। ইসলাম কোনও নূতন ধর্ম নয়। ইসলাম সর্বকালের সর্বযুগে সত্য ধর্ম। কুর-আন পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থের সত্যায়নকারী মাত্র।
১৪৩০ : দেখুন সূরা [২:২৩] এবং টিকা নং-৪২।
১৪৩১: "Taawil" - শব্দটির আক্ষরিক অর্থ : স্পষ্ট করা বা ব্যাখা করা বা সম্পূর্ণ শেষ করা। আল্লাহ্র নির্দ্দেশ শুধু যে আমাদের প্রতিদিনের জীবন ধারণের পথ চলার নির্দ্দেশ দান করে তাই-ই নয়, আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনে, উচ্চতর জীবনের সন্ধান দান করে। এই আয়াতে এই দ্বিবিধ জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। (১) প্রতিদিনের জীবন যাপনের নৈতিক নীতিমালা যা আমাদের নৈতিক চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। এই নীতিমালার জ্ঞান না থাকার দরুণ তারা তা অস্বীকার করে। (২) আবার তারা জানে না আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন প্রণালী মানুষের চরিত্রকে অমূল্য গুণরাজিতে ভরিয়ে দেয় যা হচ্ছে ইহকাল ও পরকালের সুখ শান্তির চাবিকাঠি। আর আল্লাহ্র বিধানকে অস্বীকার করার পরিণামও তারা বুঝতে পারে না। অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্র আয়াতকে অস্বীকার করে, কারণ তারা তার মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারে না। অনুধাবন করতে পারে না, কারণ তারা তা অনুধাবন করতে ইচ্ছুক নয়। জীবনের শেষ পরিণতি এবং সত্য পথের জ্ঞানকে যদি তারা অনুধাবন করতে চাইত তবে অবশ্যই তা তাদের আয়ত্বাধীন হতো।
১৪৩২ : যারা ভ্রান্ত, যারা পাপী তাদের শেষ পরণতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের এই সত্যের প্রতি সাক্ষ্য দান করে। যারা পথ ভ্রান্ত, যারা জীবনে চলার পথে আল্লাহ্ প্রদত্ত নৈতিক মূল্যবোধ পরিহার করে, ফলে আল্লাহ্র নির্দ্দেশকেই অমান্য করে। আধ্যাত্মিক জগতের আইন অনুযায়ী তাদের দূর দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির অভাব ঘটবে, ফলে তারা হয় একগুয়ে ও অবাধ্য এবং অজ্ঞ। তাদের অজ্ঞতার দরুণ তারা কোনও ব্যাপারেই পূর্বাপর চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অপারগ। তাদের অজ্ঞতার দরুণ তারা 'সত্যকে মিথ্যার অভিযোগ করে।" সুতারাং তারা সিদ্ধান্তহীনতা ও আত্মার অস্থিরতায় ভোগে। তাদের ধ্বংস অনিবার্য। এই হচ্ছে জালিমদের শেষ পরিণতি।
রুকু-৫
১৪৩৩: যারা অবিশ্বাসী তারা আল্লাহর নবী হযরত মুহম্মদের (সা) নিকট প্রেরিত আল্লাহ্র বাণীকে অবিশ্বাস করে এবং নবীকে মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করে। এই আয়াতে এই ঘটনার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের এই অভিযোগের কারণে নবী (সা) তার আল্লাহ্ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ত্যাগ করেন নাই বা কর্তব্যচ্যুত হন নাই। যারা তার কর্তব্যে বাঁধার সৃষ্টি করেছিলো তাদের প্রতি তাঁর উপদেশ ছিল, "আমার কর্মের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কর্মের দায়িত্ব তোমাদের।" আমার কর্মের দায়-দায়িত্বের জন্য আল্লাহ্র কাছে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। অন্য কাউকে নয়। আমি যদি আমার কর্তব্য আন্তরিকভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালন করি তোমাদের প্রত্যাখ্যান বা ভ্রান্তির জন্য আমি দায়ী থাকবো না। তোমাদের কর্মের দায়-দায়িত্বের জন্য তোমাদের আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে- আমার নয়।
উপদেশ : ইসলাম ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বে বিশ্বাসী। একজনের কর্মের প্রতিফলনের জন্য অন্যজন দায়ী থাকবে না।
১৪৩৪: দেখুন সূরা [৬:২৫, ৩৬, ৩৯] আয়াত এং এর টিকা। যারা হিপ্রোক্রাট বা মোনাফেক তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক রসুলের (সা) বাণী শোনার মানসে তাঁর কাছে গমন করতো। কিন্তু তারা তাঁর উপদেশের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পরতো না, তারা তা বুঝতে পারতো না। ফলে তারা রসুলের বাণী দ্বারা তাদের আত্মিক উৎকর্ষতা লাভ করতে অক্ষম হতো। এর কারণ তারা আল্লাহ্র বাণী শোনা বা বোঝার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। তারা আল্লাহ্র একত্বে ও পরকালের ধারণায় বিস্বস্ত নয়। তারা সত্যকে জানতে আগ্রহী নয়। রসুলের (সা) কথা শোনার ভান করে। ভান করে কারণ তারা শোনার জন্য আন্তরিক নয়। তাই তারা শুনতে পারবে না। তাদের উপমা হচ্ছে, অন্ধ, বা বধির বা মূর্খ লোকের মত। অন্ধকে যেমন আলো দেখানো যায় না, বধিরকে যেমন শব্দ শোনান যায় না, মূর্খকে যেমন জ্ঞান দান করা যায় না- মোনাফেকদের অবস্থাও তদ্রূপ। তাদেরকে সত্য পথে পরিচালিত করা অসম্ভব, কারণ তাদের আন্তরিকতার অভাব।
উপদেশ : কুর-আনের উপদেশ সর্বকালের ও সর্বস্থানের জন্য প্রযোজ্য। মোনাফেকদের যে বর্ণনা রসুলের (সা) সময়ে দেয়া আছে, এরই আলোকে মোনাফেকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অদ্যাবধি বিচার করতে হবে।
১৪৩৫: আল্লাহ্ সুক্ষদর্শী বিচারক। তিনি তার কোনও বান্দার প্রতি সামান্যতমও অন্যায় করেন না। আল্লাহ্ মানুষকে বিভিন্ন মানসিক দক্ষতা দিয়েছেন যেমন : বোঝার ক্ষমতা, জানার ক্ষমতা, অনুধাবন ক্ষমতা, ভালোবাসার ক্ষমতা ইত্যাদি। জীবনকে সুস্থ, সুন্দর, শান্তিময় করার জন্য আত্মাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের উপযোগী করার জন্য আল্লাহ্ যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন, তারা আমাদের সৎ পথের সন্ধান দিয়েছেন, পথ প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ্ সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছেন মানুষকে আত্মিক দিক থেকে পবিত্র, নির্মল ও শান্তিময় করার জন্য। কিন্তু তার একটাই শর্ত। মানব সন্তানকে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করতে হবে স্ব-ইচ্ছায়। এখানেই হবে তার "সীমিত ইচ্ছাশক্তির" ব্যবহার ও পরীক্ষা। যদি কেউ আল্লাহর প্রদর্শিত পথ গ্রহণ না করে, তবে সেটা সে করে স্ব-ইচ্ছায়; যা তার আত্মাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। "বরং মানুষই নিজের আত্মার প্রতি অন্যায় করে।"
১৪৩৬: মৃত্যুর পরে যে জীবন তা হবে অন্তকাল। সেই অনন্তকাল জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর জীবনকে মনে হবে ক্ষণস্থায়ী জীবন মাত্র। মনে হবে দিনের মূহুর্তকাল সময় মাত্র। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের যে সময় তা খুবই অকিঞ্চিত মনে হবে শেষ বিচারের দিনে।
১৩৩৭: "তারা তখন পরস্পরকে চিনবেন", অর্থাৎ শেষ বিচারের দিনে এই পৃথিবীর স্মৃতি আমাদের বহন করে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে, আমাদের চেনা জগতের, আমাদের চেনা পরিচিত জনের বিভিন্ন ক্রিয়া কর্মের স্মৃতি আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে শেষ বিচারের দিনে। ফলে আমরা নিজেদের অপরাধকে সনাক্ত করে আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের মর্ম অনুধাবন করতে সক্ষম হব।
১৪৩৮: এই আয়াতে আল্লাহ্ নবীকে (সা) নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, ভালো কাজের পরিণাম ভালো এবং মন্দ কাজের প্রতিফল সব সময়েই মন্দ হবে। এটা চিরন্তন সত্য। এখানে নবীকে বলা হয়েছে যে, এই সত্যকে তাঁর সম্মুখে উপস্থাপন করা হবে তাঁর জীবদ্দশায় অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে। তবে এর জন্য সত্যের মর্মবাণীর কোনও পরিবর্তন হবে না। "তোমার জীবদ্দশায় তোমাকে দেখিয়ে দিই"- অর্থাৎ নবীর (সা) পৃথিবীর কাল পূর্ণ করার কথা বলা হয়েছে এখানে। পৃথিবীর জীবনে আমরা অনেক সময়ে দেখি, যারা মন্দ, যারা দুষ্ট, তারা জীবনে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি লাভ করছে। যারা আল্লাহ্র সাক্ষাত, অর্থাৎ পরকালের জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করে, আল্লাহ্ তাদের জন্য পৃথিবীর ভোগবিলাসের জীবনকে আরও বিস্তৃত করে দেন। এ দেখে মোমেন বান্দা বা পূণ্যাত্মারা যেন হতাশ না হয়। কারণ আল্লাহ্র নির্দ্দেশ অবশ্যই কার্যকর হবে। কারণ ভালো, মন্দ সকলকে আল্লাহ্র কাছে ফিরে যেতে হবে। ভালো ও মন্দের শেষ পরিণাম এই পৃথিবীতেই আংশিক পূরণ হয়, যদি তা নাও হয় তবে মৃত্যুর পরে তা অবশ্যই পূরণ হবে। কারণ "তারা যা করে আল্লাহ তার স্বাক্ষী"।
উপদেশ: যদিও আয়াতটিতে নবীকে (সা) সম্বোধন করা হয়েছে তবে এ বাণী চিরন্তন সত্য। ভালো কাজের পরিণাম ভালো মন্দ কাজের পরিণাম মন্দ।
১৪৩৯: প্রত্যেক যুগে প্রত্যক জাতির জন্য আল্লাহ্ তাঁর দূতদের প্রেরণ করেছেন পথ প্রদর্শক হিসেবে। তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছেন, তাঁর বাণীর সাহায্যে, তাঁর প্রত্যাদেশের সাহায্যে। যদি আল্লাহ্র দূতদের অস্বীকার করা হয়, আল্লাহ্র বাণীকে গ্রহণ না করে তাকে বিকৃত করা হয়, এবং অপব্যবহার করা হয়, তবে তার সুক্ষ সঠিক এবং ন্যায় বিচার অনুষ্ঠিত হবে শেষ বিচারের দিনে। সেদিন তাদের সামনে থেকে মিথ্যার আবরণ উন্মোচিত হবে, সত্য উদ্ভাসিত হবে। অবিশ্বাসকারীরা বিদ্রূপ করে, "যদি শেষ বিচারের দিন সত্যি হয়, তবে তা কবে আসবে?" আল্লাহ্র নবীর উত্তর ছিল, " যে কোনও সময়ে সেই দিন আসতে পারে। তাকে ত্বরান্বিত বা বিলম্ব করার ক্ষমতা কারও নাই। তোমরা যদি ভেবে থাক সেদিন আমি তোমাদের রক্ষা করবো, বা সেদিন আমার প্রতি তোমাদের ব্যবহারের জন্য তোমাদের ক্ষতি করবো, তবে জেনে রাখ সেদিনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবেন একমাত্র আল্লাহ্ , যার ন্যায়-বিচার হবে অত্যন্ত সুক্ষ। "আমার নিজস্ব ভালোমন্দের উপর আমার কোনও অধিকার থাকবে না।"
১৪৪০: দেখুন সূরা [৭:১৮৮] আয়াত।
১৪৪১: এই লাইনটি [১০:৪৯] সূরা [৭:৩৪] আয়াতের পুনরাবৃত্তি; তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এই আয়াতের প্রেক্ষাপট হচ্ছে অবিশ্বাসীদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ [দেখুন টিকা ১৪৩৯] নবীর প্রতি। তারা নবীকে (সা) ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতো এই বলে যে পরকাল বলে কোনও জিনিসের অস্তিত্ব কি বিদ্যমান আছে? যদি থাকে, এবং নবী যদি সত্যি সত্যি আল্লাহ্র দূত হন,তবে আল্লাহ্ এবং পরকালে অবিশ্বাসের দরুণ তাদের এই মূহুর্তে ধ্বংস করে দেয়া হোক। সূরা [৭:৩৪] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে তার দরুণ তাদের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রই আল্লাহ্ বলেছেন যে পাপীদের তৎক্ষণাৎ ধ্বংস করা হয় না। প্রত্যেক জাতি এবং নূতন প্রজন্মকে অনুতাপ করে পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য সময় দেয়া হবে। যখন তাদের সময় শেষ হয়ে যাবে; তখন তাদের ন্যায় ও অন্যায়, ভালো ও মন্দ কাজের পরিণাম তাদের সামনে তুলে ধরা হবে এবং সমন্বয় সাধন করা হবে। "মূহুর্তকালও বিলম্ব বা ত্বরা করতে পারবে না" আল্লাহ্ সব কিছুরই সাক্ষী তিনি-ই সর্ব্বজ্ঞ।
১৪৪২: অবিশ্বাসীদের ঠাট্টা, বিদ্রূপ চিরস্থায়ী হবে না। যখন তারা আল্লাহ্র ক্রোধকে প্রত্যক্ষ করতে পারবে, তারা আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়বে। আল্লাহ্র শাস্তি তাদের উপরে হঠাৎ করেই নিপতিত হবে। দিবসে বা রাত্রিতে যে কোনও সময়ে তা ঘটতে পারে। এটা এমন আকষ্মিক হবে যে, তারা যখন একেবারেই আশঙ্কামুক্ত অবস্থায় থাকবে। এ সময়ে কি তারা বলার সাহস পাবে যে "আল্লাহ্র শাস্তি ত্বরান্বিত হউক।"
১৪৪৩: জালিম অর্থাৎ যারা অন্যায়কারী, তাদের শেষ সময়ের বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। পৃথিবীতে তাদের অন্যায় কর্মফলের প্রতিফল তারা পেতে শুরু করবে। তাদের সে শাস্তি স্থায়ীরূপ লাভ করবে। এই আয়াতগুলিতে অবিশ্বাসীদের মনঃস্ততঃ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে [১০:৪৭] আয়াত থেকে এবং শেষ হয়েছে [১০:৫৩] আয়াতে। আনুপূর্বিক ঘটনা শুরু হয়েছে সার্বজনীন বর্ণনার মাধ্যমে। প্রত্যেক যুগে পৃথিবীতে নবী রসুলদের প্রেরণ করা হয়েছে সাধারণ লোকদের উপদেশ ও সাবধান করে দেওয়ার জন্য। এসব নবী রসুলেরা, আল্লাহ্র শাস্তি, শেষ বিচারের দিন, এবং পৃথিবীর কর্মজগতের, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে শেষ বিচারের দিনে যে সমন্বয় সাধন করা হবে তার সম্বন্ধে লোকদের সাবধান করে দেন। এই সাবধান বাণীর প্রেক্ষিতে উপরের আয়াতগুলিতে কথোপথনের মাধ্যমে অবিশ্বাসীদের মনের ভাবকে প্রকাশ করা হয়েছে। অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্র শাস্তি সম্পর্কে অবিশ্বাস করে এবং এর ফলে তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলে, "এক্ষুণি কেন শাস্তি আমাদের উপরে পতিত হয় না?" উত্তর ছিল আল্লাহ্ তার নির্ধারিত সময়েই শাস্তি দান করবেন। এর পরে বিশ্বাসী বা ঈমানদার ব্যক্তিদের বলা হয়েছে, যখন আল্লাহ্র গজব বা শাস্তি হঠাৎ করে নিপতিত হয় পাপীরা কিভাবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়। তখন কি তারা আবার মনে করে না যে, এই শাস্তি হঠাৎ করে এসেছে? আল্লাহ্র শাস্তি যখন তাদের ঘিরে ধরে, তখন পাপীদের আতঙ্ক অবর্ণনীয়। অন্যায়কারী ও পাপীরা তখন জানতে চায় " এটা কি সত্য?" ইহা অবশ্যই সত্য। এবং তোমরা ইহা ব্যর্থ করতে পারবে না"
রুকু-৬
১৪৪৪: দেখুন সূরা [৩:৯১] আয়াত।
১৪৪৫: ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে "They would declare (their) repentance/when they see the Chastisement." অধিকাংশ বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে, "যখন উহারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন মনস্তাপ গোপন করবে।" এখানে মনস্তাপ অর্থাৎ অনুতাপ। সুতারাং ইংরেজী অনুবাদ অনুযায়ী "গোপন" কথাটি এখানে প্রযোজ্য নয়। আরবীতে যে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হচ্ছে, "asarru" যার অর্থ "declare" (ঘোষণা) বা "reveal" (প্রকাশ) অন্য অর্থ "Conceal" গোপন বা "hide" (লুকানো)। এখানে কোরানের তফসীরকরণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মওলানা ইউসুফ আলী পূর্বের অর্থটি অধিক প্রযোজ্য মনে করেন। সেভাবে আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় "পাপীরা যখন তাদের সম্মুখে শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তারা তা থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। এমন কি তারা তাদের মান-অপমান, লজ্জ্বা-শরম ভুলে তাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এই কথাকেই "declare their repetance" বাক্য দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। যদি শেষ দুটো অর্থ নেয়া হয়, তবে তাহলে বাক্যটির অর্থ "দাড়ায়" শাস্তি থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য পাপীরা সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু তাদের জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন ব্যাপার হবে সর্বসম্মুখে নিজের পাপকে স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার গ্লানি ও লজ্জ্বা। সুতারাং তারা মনস্তাপ বা অনুতাপকে গোপন করবে।
১৪৪৬: যারা কুফরী ও গুনাহ্ অর্থাৎ অন্যায় ও পাপ করে তাদের অন্তর কলুষিত হয়। ফলে তারা হয় সত্যবিমূখ। আত্মার এই অবস্থাকেই কুর-আন শরীফে "অন্তরে ব্যাধি" শব্দটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। সত্যবিমুখতা ও রীপু দ্বারা তারিত হওয়াই হচ্ছে তাদের আত্মার ব্যাধি যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। কুর-আনের উপদেশ গ্রহণ করলে অন্তর সে ব্যাধিমুক্ত হয়। কারণ কুর-আন হচ্ছে, আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ। পৃথিবীর জীবনে যে জীবন বিধান মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাই আছে কুর-আনের নির্দ্দেশে আর এই বিধান নিজের জীবনে প্রতিফলিত করাই হচ্ছে "আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন" করা। সে জন্য যে কোরানের উপদেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে পারে, সে অন্তরকে ব্যাধিমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। সুস্থ অন্তরে কুর-আনের উপদেশ বা আল্লাহ্র হেদায়েত বা "সত্য" খুব সহজেই অনুপ্রবেশ করে, ফলে তারা আল্লাহ্র করুণা, দয়া ও ক্ষমার যোগ্য হতে পারে। তাই কুর-আন হচ্ছে "মুমীনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত।" আল্লাহ্র হোদেয়ত, রহমত, ক্ষমা এর থেকে বড় পাওয়া মানব জীবনে আর কি থাকতে পারে? পার্থিব সুযোগ-সুবিধা, ধন-ঐশ্বর্য্য সবই আল্লাহ্র রহমত ও ক্ষমার কাছে তুচ্ছ।
১৪৪৭: এই আয়াতে "রিযক" শব্দটি আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে "রিযক" হচ্ছে সেই বস্তু জলে, স্থলে আকাশে, উদ্ভিদ জগতে, প্রাণী জগতে, খনিজ সম্পদে ইত্যাদি বিশ্বভুবনে আল্লাহ্ যা কিছু জীবন ধারণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর যা কিছু সৃষ্টি তা হচ্ছে পার্থিব; এই নশ্বর দেহের পুষ্টি, পরিবর্ধন ও আরাম আয়েশের জন্য প্রয়োজন। মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের নশ্বর দেহের বাইরেও আত্মার পুষ্টি বা আত্মিক উন্নতির প্রয়োজন হয়। আত্মার এই পুষ্টি হচ্ছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান যা আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ ও সমুন্নত রাখে, আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে কলুষমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। যা আমাদের জন্য পার্থিব ও আত্মিকভাবে কল্যাণকর, তা আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ্ থেকে আর কেউ বেশী জানেন না। সুতারাং নিজ নিজ খেয়াল খুশীমত কিছু হালাল, কিছু হারাম বলার অধিকার কারও নাই। বিশেষ কোনও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোন বস্তুর উপরে ক্ষণস্থায়ী 'হালাল', 'হারাম' আরোপ করা যায়, কিন্তু আল্লাহ্র নামে ধর্মের নামে স্থায়ীভাবে হারাম বা হালাল বলা অন্যায়। এই আয়াতে 'হারাম', 'হালাল' প্রতীক অর্থে সামাজিক নিয়ম কানুন ধর্মীয় বিধানকে বোঝানো হয়েছে।
উপদেশ : যুগে যুগে ধর্মের নামে ধর্মীয় বিধানকে লঙ্ঘন করা হয়েছে, ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসের মাঝে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে। আজকের মুসলিম সমাজ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত।
১৪৪৮: "যারা আল্লাহ্ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে"- অর্থাৎ যারা ধর্মের নামে তাদের মনগড়া বিধি-বিধান চালু করতে চায়। যারা তা করে, তারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে শেষ বিচার দিবস সম্বন্ধে তাদের ধারণা কি? তাদেরকে তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৪৪৯: আল্লাহ্ পরম করুণাময় । তাঁর নাম ও অনুগ্রহ অসীম। যা দেহ, মন ও আত্মাকে করে পরিশুদ্ধ সুস্থ ও সুন্দর কিন্তু মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ জীব, সে স্রষ্টার এই অকৃপন দানকে অনুভব করতে পারে না, ফলে তার আত্মার মাঝে স্রষ্টার প্রতি কোনও কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মায় না। উপরন্তু তার ক্ষুদ্র জ্ঞান তাকে অন্ধ অহংকারের পথে পরিচালিত করে; যার ফলে সে মনগড়া মিথ্যার উপরে তার ধ্যান ধারণা স্থাপন করে। তার ধর্মীয় বিশ্বাস পরিণত হয়, মিথ্যা উপাসনায়।
রুকু-৭
১৪৫০: আল্লাহর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, তার সর্ব সৃষ্টিকে ঘিরে থাকে। তা সদা জাগ্রত, চির অম্লান। সৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ্ প্রকৃতিতে যে সব আইন বা বিধান চালু করেছেন [যাকে আমরা বিজ্ঞানের জ্ঞান বলি] তা সৃষ্টির সেই আদি যুগ থেকে অদ্যাবধি একইভাবে চলে আসছে। একইভাবে আধ্যাত্মিক জগতের জন্য যে নৈতিক নীতিমালা তাও যুগ-কাল অতিক্রান্ত তা চির অম্লান। এখানেই মানুষ অনুধাবন করতে পারবে বিশ্ব স্রষ্টার জ্ঞানের পরিধি ও স্থায়িত্ব- যা তার সর্বসৃষ্টিকে সর্বদা ঘিরে থাকে। বৃহৎ, ক্ষুদ্র, সৃষ্টির প্রতিটি জিনিষই তাঁর জ্ঞাত। "অণু-পরমাণুও তাঁর অগোচরে নয়"। মানুষের নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা আছে। কিন্তু সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব কোনও কাজে আত্মনিমগ্ন থাকলে পারিপার্শ্বিকতা ভুলে যায়। সব কিছুতে খেয়াল করতে অক্ষম। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র সত্তা চির জাগ্রত। আবার মানুষের সীমিত ক্ষুদ্রজ্ঞান আজকে যা বিধিসম্মত ও বিচক্ষণ বলে বিশ্বাস করে, সময়ের ব্যবধানে তাকেই আবার বাতিল ঘোষণা করে। অর্থাৎ মানুষের ক্ষুদ্র সীমিত জ্ঞান নির্দ্দিষ্ট সময়ের প্রক্ষিতে, সুস্পষ্ট-সময়ের ব্যবধানে তা অস্পষ্ট বা মূল্যহীন। আল্লাহ্র বিধান, আল্লাহ্র জ্ঞানরই বহিঃপ্রকাশ, তাই তা চির অম্লান, যুগ কাল অতিক্রান্ত। আবার মানুষের জ্ঞান সবার কাছে সমান বোধগম্য হয় না। বুদ্ধির স্তরভেদে বোধগম্যতার স্তর ভেদ ঘটে। আবার সময়ের ব্যবধানে তার কোনও মূল্য থাকে না। যেমনঃ প্রচীন সভ্যতার রীতিনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, যা সে যুগে ছিলো অপ্রতিরোধ্য, বর্তমানে তা শুধুমাত্র ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়। আল্লাহ্র আইন আল্লাহ্র জ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ। সুতারাং সেখানে কোনও অস্পষ্টতা নাই। সময়ের ব্যবধানেও তা অস্পষ্ট হয় না। তা যুগ কাল অতিক্রান্ত, স্থান ও সময়ের উর্দ্ধে, চির অম্লান। 'Mubin' (clear) বাংলা "সুস্পষ্ট" শব্দটি দ্বারা আল্লাহ্র জ্ঞানের এই সুস্পষ্ট রূপকেই প্রকাশ করা হয়েছে। "আল্লাহ্র বাণীর কোনও পরিবর্তন নাই।"
১৪৫১: আল্লাহ্র অস্তিত্ব সর্বত্র বিদ্যমান। জলে-স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর অবস্থান। অণু-পরমাণু জিনিষও তার অজ্ঞাত নয়। কিছুই তাঁর অগোচরে নয়। মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলের অপ্রকাশিত চিন্তাও তার অগোচরে থাকে না। সব কিছুই তাঁর নখদর্পনে। পাপীদের আল্লাহ্কে ভয় করার কারণ এই একটাই। যারা পূণ্যাত্মা বা মোমেন বান্দা তাঁদের এই পৃথিবীতে বা পরলোকে কোথাও ভয় নাই। পূণ্যাত্মা বা মোমেন বান্দা তারাই যারা 'তাকওয়া' অবলম্বন করে। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র সন্তুষিটর জন্য সর্বদা মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে তারাই তাকওয়া অবলম্বনকারী।
১৪৫২: এই আয়াতটিকে যদিও রসুলকে (সা) সম্বোধন করা হয়েছে, তবুও তাঁর আবেদন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। যারা পূণ্যত্মা, কখনও কখনও তাঁরা পাপী ও দুষ্ট লোকের কথা, মন্দ বাক্য, গালাগালি, বা বিদ্রূপে মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের দুঃখিত বা রাগান্বিত হওয়ার কারণ নাই। কারণ দুষ্টদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নাই। সমস্ত ক্ষমতার উৎস আল্লাহ্। সুতারাং তারা পূন্যাত্মাদের সত্যিকারভাবে অসম্মান করার ক্ষমতা রাখে না। মানুষের যা সম্মান তা আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত।
১৪৫৩: এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা এক আল্লাহ্। সূদুর নভোমন্ডলে, পৃথিবীতে, আকাশে-বাতাসে, জলে-স্থলে, অন্তরীক্ষে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র সৃষ্টি। তিনিই তাদের সবার প্রভু ও উপাস্য। যদি কেউ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনা করে তবে তারা তা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে। আল্লাহ্র সাথে অংশীদারিত্ব করে। এই অংশীদারিত্ব তাদের কল্পনাপ্রসূত এবং মিথ্যা আবিস্কারের ফসল।
১৪৫৪: আমাদের পৃথিবীর জীবন পর্যায়ক্রমে দুই পর্বে আবর্তিত হয়। কাজ ও বিশ্রাম। এই দুই পর্বের জন্য আল্লাহ্ আমাদের সময়কেও দুভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। নিরব নিশুতি অন্ধকার রাত্রি হচ্ছে বিশ্রামের জন্য এবং সূর্যালোকিত উজ্বল দিন হচেছ কাজের জন্য নির্ধারিত। "দেখার জন্য" বাক্যটি একটি সুন্দর উপমা। এই বাক্যটির সাহায্যে বুঝানো হয়েছে, দিবাভাগ শুধুমাত্র কাজ করার জন্য নয়, কাজ ব্যতীতও মানসিক দক্ষতা (Faculty of mind) বাড়ানোর জন্যও নির্ধারিত। দেখার প্রয়োজন হয় যেনো আমাদের চিন্তার ক্ষমতা, অনুধাবন ক্ষমতা, সংশ্লেষণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এগুলি হচ্ছে উচ্চতর মানসিক দক্ষতার বিকাশ।
১৪৫৫: কুর-আন শরীফে বহুস্থানে 'সফলকাম' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনধারণে, কর্মক্ষেত্রে, সফলতা ছাড়াও আমাদের জীবনের উচ্চতর পর্যায়ের সফলতা ইঙ্গিত এই শব্দটির দ্বারা করা হয়। বর্তমানে ও ভবিষ্যতে আমাদের স্বাস্থ্য, সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা, সুখ-শান্তি, প্রভাব প্রতিপত্তি, জীবনের সকল ক্ষেত্রের সফলতাকে এই শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়। যে মিথ্যা কথা বলে আল্লাহ্ তাকে পার্থিব ও আধ্যত্মিক জগতের সফলতা থেকে বঞ্চিত করবেন। দেখুন সূরা [৯:৭৭] আয়াত ও সূরা [২৬:২২১, ২২২, ২২৩ আয়াত]। এ সব আয়অতে আল্লাহ্ মিথ্যাবাদীদের পুনঃ পুনঃ সাবধান করেছেন। তারা কখনও সফলতা লাভ করবে না। এই আয়াতে সাধারণ মিথ্যাবাদীদের ছাড়াও বিশেষ মিথ্যাবাদী, যারা আল্লাহ্র নামে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তাদের কথা বলা হয়েছে। মিথ্যাবাদীরা আল্লাহর সকল রহমত, যা জীবনকে সমৃদ্ধশালী করে, তা থেকেই যে শুধু বঞ্চিত হবে, তাই নয়, 'আল্লাহ' কে নিয়ে যে মিথ্যার সে উদ্ভাবন করে সেখানেও সে সফলতা লাভ করবে না আল্লাহ তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে দেবেনই। মিথ্যাবাদীর জীবন থেকে সফলতা শব্দটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কারণ তারা আল্লাহ্র রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।
রুকু-৮
১৪৫৬: হযরত নূহ (আ) এর কাহিনী এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরার জন্য। হযরত নূহ (আ) এর কাহিনীর পূর্ণ বিবরণ আছে সূরা [১১:২৫-৪৮] আয়াতে, এবং অন্যান্য অনেক স্থানেও আছে যেমন সূরা [৭:৫৯-৬৪], সূরা [২৩:২৩-৩২] ; সূরা [২৬:১০৫-১২২] এবং সূরা [৩৭:৭৫-৮২] আয়াতে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাহিনীর ঘটনার মাধ্যমে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : হযরত নূহ এর ধর্ম প্রচার তাঁর সমসাময়িক লোকদের মধ্যে, যারা ছিল অত্যন্ত মন্দ এবং দুষ্ট। তারা নূহের (আ) প্রচারিত ধর্মকে প্রতিহত করে অত্যন্ত মন্দভাবে। কিন্তু হযরত নূহ্ কোনও কিছুকেই ভয় পান নাই। আল্লাহ্র প্রতি একান্ত বিশ্বাস রেখে তিনি আল্লাহ্র বাণী প্রচার করেন; এবং আল্লাহ্ তাঁকে ভয়াবহ বন্যা থেকে রক্ষা করেন। অর্থাৎ যারা আল্লাহর বাণী প্রচারে, বা আল্লাহ্র কাজে অকুতোভয় এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল, আল্লাহ্ তাদের স্বয়ং রক্ষা কর্তা। এই আয়াগুলিতে [১০:৭১-৭৩] এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে।
১৪৫৭: হযরত নূহ (আ) পরিস্কারভাবে ঘোষণা করেন যে, তারা ঐক্যমত্যভাবে তাকে মৃত্যু দন্ডাদেশ দিতে পারে, যদি তারা তাই চায়। তিনি তাদের নিকট অকপটে আল্লাহ্র বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। মৃত্যুকেও তিনি ভয় পান নাই। [উপদেশ : আল্লাহর কাজে সকলেরই হযরত নূহ- এর মত অকুতোভয় হওয়া প্রয়োজন]।
১৪৫৮: আল্লাহ্র নবীরা আল্লাহ্র বাণী বা উপদেশ প্রচার করতেন মানুষের মঙ্গলের জন্য, সমাজের মঙ্গলের জন্য। এর জন্য তাঁরা মানুষের কাছ থেকে কোন প্রতিদান আশা করেন নাই। বরঞ্চ তাঁরা তাঁদের এই নিঃস্বার্থ কাজের জন্য নির্যাতিত, অপমানিত এমন কি স্বদেশ ও জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হয়েছেন। উপদেশ : যুগে যুগে সত্য পথের পথিকরা মন্দ ও দুষ্ট লোকের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে থাকেন।
১৪৫৯: দেখুন সূরা [৭:৬৪] আয়াত।
১৪৬০: "পূর্বে যারা প্রত্যাখান করেছিলো।" এই বাক্যটি ইঙ্গিত পূর্ণ। এই বাক্যটি থেকে মনে হয় আধ্যাত্মিক জগতের বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটোই বংশপরস্পরায় ধারাবাহিকভাবে চলে আসে। পূর্বে যা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো, তা ছিল পূর্ববর্তী পুরুষদের দ্বারা, তাদের সেই প্রত্যাখ্যানের ধারা তারা পরবর্তী পুরুষেও রক্ষা করে চলে। পৃথিবীর ইতিহাস যুগে যুগে এই সত্যের সাক্ষ্য বহন করে। জালিম সম্প্রদায় আল্লাহ্র করুণাকে উপক্ষো করে, আল্লাহর আইনকে ভঙ্গ করে, আল্লাহ্র বাণীকে প্রতিহত করে। এদের হৃদয়কে আল্লাহ্ "শীলমোহর" করে দেন। তখন আল্লাহ্র করুণা, দয়া বা বাণী কোনও কিছুই তাদের হৃদয়ে পৌঁছাবে না। তাঁদের হৃদয় আধ্যাত্মিক জগতের উপদেশ বুঝতে অক্ষম হবে। দেখুন সূরা [২:৭] আয়াতে এবং এর টিকা। এসব লোকেরা তাদের পূর্ব প্রসূত ধ্যান ধারণার দ্বারা এতটাই আপ্লুত থাকে যে, তারা আল্লাহ্র নবী কি বললেন তার মর্মকথা অনুধাবনের চেষ্টা পর্যন্ত করে না।
১৪৬১: হযরত মুসা (আ) হারুণ ও ফেরাউনের কাহিনী কুর-আনের বহুস্থানে বর্ণিত হয়েছে। বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সূরা [৭:১০৩-১৩৭] আয়াতে। এই আয়াতে ফেরাউনের কাহিনীর মাধ্যমে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে তা হচ্ছে : যারা পাপী, যারা দুষ্ট, যারা পাপের পথকে ত্যাগ করতে অপারগ, সত্যকে যারা গোপন করে, তারা আল্লাহ্র নবীকেও মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। আল্লাহ্র নবী, যিনি নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেন, এইসব উদ্ধত অহংকারী অবিশ্বাসী ব্যক্তি তাদের নীচ, হীন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতে দ্বিধা বোধ করে না।
উপদেশ : যে কোনও পূণ্যত্মা লোক, যারা নিঃস্বার্থভাবে অপরের কল্যাণের জন্য আত্মনিবেদন করেন, তারা সব সময়েই মন্দ ব্যক্তিদের দ্বারা একইরকম বাঁধার সম্মুখীন হবেন।
১৪৬২: প্রকৃত সত্য এবং যাদু একে অপরের বিপরীত। যাদু মিথ্যা ও প্রতারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত। যা মিথ্যা যা অশুভ তা প্রতারণার সাহায্যে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। কিন্তু তা কখনও স্থায়ী হতে পারে না। সত্য শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হবেই। আপাতঃ দৃষ্টিতে মিথ্যাকে ন্যায় সঙ্গত মনে হলেও তার স্থায়ীত্ব ক্ষণস্থায়ী। সত্যের আলোয় মিথ্যার অন্ধকার দূরীভূত হতে বাধ্য। এ কথা পৃথিবীতে সর্বকালে সর্বযুগের জন্য সত্য।
১৪৬৩: বাংলাতে একটি প্রবাদ বাক্য আছে, "আপনি ভালো তো জগত ভালো, আপনি কালো (মন্দ) তো জগত কালো।" অর্থাৎ ভালো ও পূন্যবান লোক সব কিছুর মধ্যই শুভ ও কল্যাণ দেখে থাকে। মন্দ লোক সব কিছুর মধ্যেই ষড়যন্ত্র অবিশ্বাস ও অকল্যাণ আবিস্কার করে থাকে। এই আয়াতে আমরা দেখতে পাই ফেরাউন ও তার লোকেরা আল্লাহ্র নবী হযরত মুসাকেও সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকে রেহাই দেয় নাই। তাদের ধারণা হয়েছিল, হযরত মুসা (আ) উচ্চাশা চরিতার্থ করার জন্য, ক্ষমতার লোভে তাদের মাঝে আল্লাহ্র শক্তি সম্বন্ধে প্রচার করছে, এবং নিজেকে আল্লাহ্র প্রতিনিধিরূপে প্রকাশ করছে; যেনো তিনি মিশরের অধিপতি হতে পারেন। কিন্তু হযরত মুসা (আ) তাদের এই অভিযোগ অস্বীকার করলেন। একই রকমভাবে অবিশ্বাসীরা হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সা) কেও অভিযুক্ত করেছিলেন।
উপদেশ : দুষ্ট লোকেরা কখনও কোনও কিছুতেই শুভ বা মঙ্গল দেখতে অপারগ।
১৪৬৪: যখন যাদুকরেরা তাদের লাঠি ভূমিতে নিক্ষেপ করলো, তাদের যাদু বিদ্যার বলে, লাঠি সাপে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। কিন্তু হযরত মুসার (আ) অলৌকিক ক্ষমতার কাছে তাদের যাদুর খেলা ছিলো ছেলে খেলার সামিল। কারণ মুসার (আ) ক্ষমতার পিছনে আল্লাহ্র ক্ষমতা নিহিত ছিল- যা ছিল প্রকৃত সত্য।
১৪৬৫: আল্লাহ্র বাণী এবং হুকুমের মধ্যেই ''প্রকৃত সত্য' নিহিত। যাদুকরের যাদুর প্রভাব এক ধরণের কৌশল যা চক্ষুকে প্রতারণা করে, যার অলৌকিকত্বের পিছনে কোনও "প্রকৃত সত্য" নিহিত নাই।
উপদেশ : বাংলাদেশে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বহু ব্যক্তি নিজেকে দাবী করে- যারা নিজেকে পীররূপে প্রতিষ্ঠিত করে। এদের বহুভক্ত বা মুরীদ আছেন। এই আয়াতে আল্লাহ্ সাবধান করে দিয়েছেন যে, যা কিছু চর্মচক্ষুতে অলৌকিক বলে প্রতীয়মান হয় তাই-ই "প্রকৃত সত্য" নয়। একমাত্র "প্রকৃত সত্য' হচ্ছে আল্লাহ্র "বাণী বা হুকুম"- যার মধ্যেই আধ্যাত্মিক জগতের প্রকৃত ক্ষমতা নিহিত। আর আল্লাহর বাণী বা হুকুম লেখা আছে কুর-আনের পাতায়।
রুকু-৯
১৪৬৬ : এই আয়াতে "তার প্রতি" কথাটি কোনও কোনও তফসীরকারের মতে কথাটি ফেরাউনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। যদি ফেরাউনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে অর্থ দাঁড়াবে যে, অধিকাংশ ফেরাউনের লোকজন হযরত মুসার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলো না। কিন্তু যাদুকরেরা মুসার অলৌকিক ক্ষমতা দেখে আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলো [৭:১২০] ফেরাউনের স্ত্রী করলেন [৬৬:১১] এবং শেষ পর্যন্ত ফেরাউন [১০:৯০] যদিও তা শেষ মূহুর্তে। কোন কোনও তফসীরকারের মতে "তাহার" শব্দটি হযরত মুসার (আ) পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হবে মুসার (আ) লোক অর্থাৎ ইসরাইলীরা ভীষণ কঠিন হৃদয় লোক ছিল [৭:১২৯] আল্লাহ্র কোনও বাণীই তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করতো না। এমন কি হযরত মুসা যখন তাদের মিশরের দাসত্ব থেকে আল্লাহ্র করুণায় মুক্তি দিতে সমর্থ হলেন, তখনও তাদের খুব অল্প সংখ্যকের হৃদয়েই আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ছিল। খুব কম সংখ্যকই আল্লাহর হুকুম বা বিধানকে ভয় করতো বরং তারা ফেরাউনের দ্বারা সম্মোহিত ছিল, তারা আল্লাহ্ অপেক্ষা ফেরাউনকে ভয় করতো বেশী।
১৪৬৭: "Fitnat" শব্দটি আছে সূরা [৮:২৫] আয়াতে, এবং টিকা ১১৯৮-এ এর বিভিন্ন অর্থের ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এই আয়াতটি পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের প্রার্থনা। যেহেতু তারা দুর্বল, তারা তাদের শক্তিশালী শত্রুর অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করছেন। [উপদেশ : আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। তাঁর সাহায্য পূণ্যাত্মাদের সর্বদা কাম্য হওয়া উচিত]।
১৪৬৮: মুসার (আ) প্রতি আল্লাহ্র এই নির্দ্দেশ-সম্ভবতঃ যাদুকরেরা এবং স্বল্প সংখ্যক মিশরী আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পরে দেয়া হয়েছিলো। এ সময়ে হযরত মুসাকে (আ) স্বল্প কিছুদিনের জন্য মিশরে অবস্থান করতে হয়। কারণ তার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল এর কারণ ফেরাউন ইসরাঈলীদের মিশর ত্যাগে অনিচ্ছুক ছিল। বণী ইসরাঈল-এর প্রতি মসজিদে সালাত আদায় করার হুকুম ছিল। কিন্তু ফেরাউনের অত্যাচারের ভয়ে মসজিদে গমন কষ্টসাধ্য হওয়ায় গৃহের নির্দ্দিষ্ট স্থানে সালাত আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহ্র এই হুকুম ছিল স্বল্প সময়ের জন্য, কারণ হযরত মুসার (আ) আগমনের পর থেকে ইসরাঈলীদের মিশরে অবস্থানের মেয়াদ ছিল ক্ষণস্থায়ী
১৪৬৯। এই প্রার্থনাটি ছিল হযরত মুসার (আ), যার সাথে হারুনও মিলিত হয়েছিলেন। কারণ হযরত হারুন সর্বদা হযরত মুসার সহচররূপে, তার সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতেন। তাদের প্রার্থনাকে সহজভাবে প্রকাশ করলে তা দাড়ায়, "হে আল্লাহ্ আমরা বুঝতে পারি মিশরীয়দের সম্পদ, ঐশ্বর্য্য, পার্থিব চাকচিক্য হিংসার বিষয়বস্তু নয়। কারণ -এ সব বস্তু-ই হচ্ছে জীবনের ক্ষণস্থায়ী সম্পদ। এই ক্ষণস্থায়ী সম্পদের চাকচিক্য মানুষকে মোহমুগ্ধ করে ফেলে, দম্ভ অহংকার তার আত্মাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়। ফলে সে বিপথে পরিচালিত হয়। শুধু যে সে নিজেই একমাত্র পরিচালিত হয় তাই-ই নয়, অন্যকেও পরিচালিত করে। তাদের অহংকার ও দম্ভই তাদের সমস্ত কর্মকে নষ্ট করে, তাদের পতনের কারণ ঘটায়। তাদের ঐশ্বর্য্য, সম্পদ তাদের অন্তরের প্রশান্তি নষ্ট করে দেয়। তাদের অন্তরকে পাষাণে পরিণত করে। এই পাষাণ হৃদয়ে আল্লাহ্র বাণীর মাধুর্য্য অনুপ্রবেশ করতে পারে না। ফলে তারা কখনও আল্লাহ্ নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করবে না, আল্লাহ্তে ঈমান আনবে না, যতক্ষণ না তারা স্বচক্ষে আল্লাহ্র শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।
১৪৭০: এটা একটা ভয়াবহ অভিশাপ। সম্পদ, ঐশ্বর্য্য, আত্মার মাঝে দম্ভ ও অহংকারের জন্ম দেয়। ফলে আত্মার সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যায়। আত্মা ধীরে ধীরে সত্যকে গ্রহণের ক্ষমতা হারায় ও পাষাণের ন্যায় কঠিনে পরিণত হয়ে যায়। সে আত্মায় আল্লাহর নূর প্রবেশ লাভ করে না। এই আয়াতের অভিশাপ হচ্ছে- তাদের এই ঐশ্বর্য সম্পদ তাদেরকে পৃথিবীর চোখে ঘৃণ্য বস্তুতে পরিণত করে দিক, যেনো তারা পৃথিবীতে অনুকরণযোগ্য না হয়ে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। মানুষের হৃদয় হচ্ছে আবেগ অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু। যখন হৃদয় থাকে নির্মল, তখন হৃদয় হয়ে উঠে আবেগ অনুভূতির উৎস। আনন্দ উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা প্রভৃতি হৃদয়কে স্বর্গীয় আলোয় ভরিয়ে দেয়। কিন্তু যখন হৃদয় কঠিন পাষাণের ন্যায় পরিণত হয়, সেই হৃদয়ে বিশ্বাসের স্থান থাকে না, ফলে তাদের আত্মা অবিশ্বাস ও ঘৃণাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কারণ, তাদের আত্মা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ঐশ্বরিক অনুগ্রহ তাদের ধন্য করে না। আল্লাহ্র নূরই হৃদয়কে সুখ-শান্তি, প্রশান্তি, আনন্দ ভালোবাসার জগতে পৌঁছে দিয়ে থাকে। যা অনাবিল শান্তির রাজ্য।
১৪৭১: এখানে হযরত মুসা (আ) ও হারুন ইসরাঈলীদের সম্বোধন করে ফেরাউনের বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিশাপ উচ্চারণ করেন। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম ছিল : পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য ও সম্পদের চাকচিক্যে, পার্থিব জীবনের শোভাতে সম্মোহিত না হয়ে, সত্যের প্রতি অবিচল থাকার নির্দ্দেশ। সত্যের প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও অনুসরণই একমাত্র আত্মার মুক্তি আনতে পারে। যারা পার্থিব জীবনে এবং এর শোভাতে বিমোহিত হবে, তাদের হৃদয়ে সত্যের আলোর অনুপ্রবেশ ঘটবে না। ঐশ্বরিক অনুগ্রহ বঞ্চিত এসব আত্মা পাষাণের ন্যায় কঠিনে পরিণত হবে যা কুর-আনের বহু স্থানে "মোহর করিয়া দেয়া" কথাটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
১৪৭২: বনী-ইসরাঈলীদের মিশর ত্যাগের পর থেকে সমুদ্র অতিক্রম এবং ফেরাউন এর পশ্চাৎধাবন ও তার আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ, সম্পূর্ণ ঘটনাকে কবিতার কয়েকটি পংক্তির সাহায্যে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১৪৭৩: মৃত্যুকালে ফেরাউন বললো, "তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নাই" অর্থাৎ মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার পর ফেরাউন এক আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো। অবশ্যই তা ছিলো "death bed repentance" বা মৃত্যুপথযাত্রীর কৃত অনুতাপ। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তের অনুতাপ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, সূরা [৪:১৮] আয়াত। কারণ তা সম্পূর্ণ নয়। সম্পূর্ণ নয় এই কারণে যে : অনুতাপ তিনটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। (১) কৃত পাপকে সনাক্ত করা (২) অতীতের কৃত পাপের জন্য অনুতাপ করা ও (৩) ভব্যিতে নিজের চরিত্রকে এমনভাবে সংশোধিত করা যেনো অতীতের পাপের পুণরাবৃত্তি না ঘটে। অর্থাৎ। Repentance with amendment। মৃত্যু পথযাত্রী ফেরাউন (১) নম্বর ও (২) নম্বর ধাপ অতিক্রম করলেও (৩) নম্বর ধাপ অতিক্রম করা সম্ভব হয় নাই। সুতারাং তার অনুতাপ অসম্পূর্ণ। সুতারাং আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। মিশরের ফেরাউনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, রামাসিস-২ ছিলেন হযরত মুসার সময়কার ফেরাউন। রামাসিস-২ সমুদ্রে ডুবে মারা যান বর্তমানে তার ''মমি" পরীক্ষা করে তার দেহে সমুদ্রের পানির লবনাক্ত কণা সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সমুদ্র থেকে রামাসিসের দেহ উদ্ধার করে তৎকালীন মিশরবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী রামাসিকের-২ এর দেহকে মমী করে সংরক্ষিত করা হয় যা বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতাত্বিকেরা মাটি খুড়ে থিবিসের একটি পিরামিড থেকে উদ্ধার করেন। বর্তমানে তা সকলের দেখার জন কায়রোর জাতীয় যাদুঘরে রক্ষিত আছে। যতদিন এই পৃথিবীর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে, ততদিন পৃথিবীর মানবমন্ডলীর সামনে আল্লাহ্ ফেরাউনকে দৃষ্টান্তস্বরূপ রেখে দেবেন। আমাদের নবীর আগমনের পূর্বে, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সমস্ত পৃথিবী যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলো, ফেরাউনের মমীর অস্তিত্বও কেউ কল্পনা করতে পারতো না, সে সময়েই কুর-আন ঘোষণা করে [১০:৯২] আয়াতে যে অবিশ্বাসীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত হয়ে ফেরাউনের দেহ যুগ যুগ ধরে থাকবে। আল্লাহ্র ইচ্ছা, তাঁর ক্ষমতা সর্বোচ্চ। তাঁর ইচ্ছা কিভাবে পূরণ হবে তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের বোধের অগম্য।
রুকু-১০
১৪৭৪: আল্লাহ্র রোষে পতিত হয়ে বহুদিন ইহুদীরা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, শেষে আল্লাহ্ তাদের জন্য "ক্যানন" দেশকে মনোনীত করে দেন যার বর্ণনা বাইবেলে আছে [Exod iii 8]। দুধ ও মধুর দেশ বা "a land flowing with milk and honey" এ কথার অর্থ হচ্ছে তারা অবশেষে একটি সমৃদ্ধশালী দেশের অধিকারী হলো। আল্লাহ্ তাদের শুধু যে পার্থিব দিকেই সম্পদশালী করেছিলেন তাই নয়, তাদের আত্মিক উন্নতির জন্য তাদের জন্য যুগে যুগে নবীদের প্রেরণ করেছিলেন; যারা আল্লাহ্র বাণীকে তাদের মধ্যে সমুন্নত রাখেন। এর পরেও ইহুদীরা ধর্ম নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাদের ধর্ম গ্রন্থ তাওরাতে মহানবীর আগমন সম্পর্কে বলা হয়েছে মহানবীর আগমনের পূর্বে, এরা শেষ নবীর উপর বিশ্বাস পোষণ করতো, তার নিদর্শন সমূহ ও তাঁর আগমনের সময় নিকটবর্তী হওয়ার সংবাদ লোকদের বলতো, কিন্তু যখন শেষ নবী (সা) তাঁর যাবতীয় প্রমাণাদি ও তওরাতে বাতলানো নিদর্শনসহ আগমন করলেন, তখন এরা পরস্পর মতবিরোধ করতে লাগলো। কিছু লোক ঈমান আনলেও অন্যান্য সবাই অস্বীকার করলো। "অত:পর তাদের দ্বীনের জ্ঞান প্রদান করার পর তারা [ধর্মীয়] মতভেদে বিভক্ত হলো।" অর্থাৎ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক নেয়ামত পাওয়ার পরেও আল্লাহ্র প্রেরিত ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই বিভেদের একটাই কারণ, আর তা হলো স্বার্থপরতা, অবাধ্যতা ও একগুয়েমী। 'কেয়ামতের দিনে আল্লাহ্ উহার ফয়সালা করে দিবেন।"
উপদেশ : কুর-আনের এই আয়াত শুধুমাত্র সে যুগের ইহুদীদের উপরেই প্রযোয্য নয়। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে যে মতবিরোধ তা উপরের বক্তব্যেরই সমর্থন মেলে।
১৪৭৫: আল্লাহ একমাত্র সত্য। তিনি এক ও অবিনশ্বর। প্রকৃত ধর্মের মূল মর্মবাণী এই একটিই। ধর্ম বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ভাবে প্রকাশ হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ধর্মের সত্য সব সময়েই এক ও অভিন্ন। তাই রসুলুল্লাহ্র (সা) কাছে যখন সত্য ধর্মের প্রকাশ ঘটলো, পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের লোকেরা যারা সত্যিকারভাবে ধর্মের মর্মবাণী বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা আল্লাহ্র রসুল (সা) কে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ফলে ধর্মভীরু লোক যেমন : ইহুদীদের মধ্যে "আবদুল্লাহ্ ইবন্ সালম", খৃষ্টানদের মধ্যে 'ওরকা' অথবা ভিক্ষু বাহিরা ইত্যাদি, যারা মুহম্মদের (সা) আগমনকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। এই আয়াতটি নবীকে সম্বোধন করে প্রকৃতপক্ষে সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির সন্দেহ নিরসনের পন্থা বলে দেয়া হয়েছে।
১৪৭৬: দেখুন সূরা [৩:৬০] আয়াতে এবং টিকা ৩৯৯।
১৪৭৭: পাপী এবং অবিশ্বাসীদের আল্লাহ্ সর্বযুগে পাপের বিরুদ্ধে সাবধান করে দিয়েছেন। আল্লাহ্র বাণী বা নিদর্শন প্রতি যুগেই মানুষের কল্যাণের জন্য, মানব সন্তানকে পাপ থেকে বিরত থাকার জন্য সাবধান করেছে। এই আয়াতে 'বাক্য' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। 'বাক্য' শব্দটি এখানে আরও গভীরভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্র সাবধান বাণীকে উপেক্ষা করে, তারা বহু মূল্যের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত তা অনুধাবন করতে বাধ্য হয়। শেষ মূহুর্তে তারা যখন শাস্তিকে তাদের সামনে প্রত্যক্ষ করে; তখন তারা তাদের একগুয়ে অবাধ্যতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাধ্য বাধকতার মাধ্যমে আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পন আল্লাহ্র কাম্য নয়। আদম সন্তানকে আল্লাহ্ "সীমিত" স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। সেই ইচ্ছাশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে স্ব-ইচ্ছায় আদম সন্তান আল্লাহ্র কাছে আত্ম সমর্পন করবে, এই হচ্ছে মানুষের কাছে মহান আল্লাহ্র দাবী। এই দাবীকে যে অস্বীকার করে অবাধ্য ও একগুয়ে ভাবে, তার শেষ মূহুর্তের আত্মসমর্পন গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মানুষ সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্যই এখানে ব্যহত নয়। এক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য শাস্তি তাকে বিশ্বাস আনতে বাধ্য করে। যেমন করেছিলো ফেরাউনকে। কিন্তু তা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে "প্রভুর বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে।"
১৪৭৮: পূর্বের আয়াতগুলিতে ফেরাউনের জীবনীর মাধ্যমে এ সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে, আল্লাহ্র শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পরে ঈমান আনা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ঈমানের ফলে তার শাস্তি রহিত হবে না। এই আয়াতে ইউনুস নবীর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, গোনাহগার যদি, আল্লাহ্র শাস্তি আসার পূর্বে অনুতপ্ত হয় তবে আল্লাহ্র কাছে তা গ্রহণযোগ্য। পাপীদের আল্লাহ্ বারে বারে পাপের পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দেন। নিনেভা দেশের লোকেরা যখন পাপে আসক্ত ছিল তাদের নবী হযরত ইউনুস বারে বারে তাদের আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেন, ইউনুস নবীর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সূরা [৩৭:১৩৯-১৪৮] আয়াতে। ইউনুস নবী সম্পর্কে আলোচনা করা হবে সেই সূরার টিকাতে। এই টিকাতে নিনেভা শহরটি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। নিনেভা একটি অতি প্রাচীন শহরের নাম। যার অবস্থান বর্তমান পৃথিবীর মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে : বর্তমানে ইরাকের সমৃদ্ধশালী নগরী মসুল (Mosul) টাইগ্রীস নদীর দক্ষিণ পাড়ে, বাগদাদ থেকে ২৩০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই মসুল নগরীর উল্টোদিকে টাইগ্রীস নদীর উত্তর পাড়ে নিনেভা নগরীর অবস্থান ছিলো বলে মনে করা হয়। এই অবস্থানে দুইটি মাটির টিলা আছে। এর একটি টিলাকে The tomb of Nabi Yunus" বা "ইউনুস নবীর কবর" বলে অভিহিত করা হয়। প্রত্নতত্ববিদরা এখনও এই প্রাচীন শহরটিকে সম্পূর্ণ আবিস্কার করেন নাই। তবে একথা প্রমাণিত যে, এখানে প্রাচীন 'সুমেরাই' শহর অবস্থিত ছিল। সম্ভবতঃ তা ছিল খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ শতাব্দীরও আগে। এই শহরটি ছিল তখনকার আসেরীয় রাজাদের রাজধানী। আসেরিয়ানদেরকে প্রথম সম্রাট সালমানেসার-১ [Shalmaneser] খৃষ্টপূর্ব ১৩০০ শতাব্দীতে রাজত্ব করে। সে সময়ে তিনি ছিলেন পশ্চিম এশিয়ার প্রধান শক্তিশালী রাজা। সালমানেসারের পূর্বে আসেরিয়ানরা বেবীলনের করদ রাজ্য ছিল, কিন্তু সালমানেসারের সময়ে ক্ষমতার চাকা ঘুরে যায়। এ সময়ে বেবীলন আসেরিয়ানদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। দ্বিতীয় পরাক্রমশালী আসেরিয়ান নৃপতি রাজত্ব করেন খৃষ্টপূর্ব ৭৪৫ শতাব্দীতে। এ সময়ে পশ্চিম এশিয়াতে আসেরিয়ানরা আবার প্রধান রাজশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। এই নৃপতির নাম ছিল সেনাচোরিব [Sennacherib খৃষ্টপূর্ব ৭০৫-৬৮১)], তিনি তার জনহিতকর কাজের দ্বারা শহরটিকে সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত করেন। যদি ইউনুস নবীর আবির্ভাবের সময়কে ধরে নেয়া হয়, খৃষ্টপূর্ব ৮০০ শতাব্দী- তবে সে সময়টা হবে প্রথম ও দ্বিতীয় এই দুই শক্তিশালী আসেরিয়ান নৃপতির মধ্যবর্তী সময়, যখন নিজেদের পাপের ফলে আসেরিয়ানদের সমৃদ্ধ শহর ও সভ্যতা ধ্বংসের পাদপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ্র শাস্তি শুরু হওয়ার পূর্বেই তারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দেন, ফলে দ্বিতীয় সেনাচোরিব সম্রাটের সুবর্ণ যুগের সূত্রপাত হয়। আসেরিয়ানদের এই উন্নত সভ্যতা খৃষ্টপূর্ব ৬১২ শতাব্দীতে Scythians (so called Medes) দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
১৪৭৯: প্রথম আসেরিয়ান সম্রাটের সময়ে নিনেভা ছিল একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ও প্রশংসা করার মত নগরী। কিন্তু সময়ের আবর্তনে, এক সময়ে তা পাপের পাঁকে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এটা বেবীলন শহরের মত একটা পাপের আখড়াতে পরিণত হয়। আল্লাহ্ ইউনুস নবীকে শহরবাসীর মধ্যে পাঠান তাদের সতর্ক করার জন্য, যেনো তারা পাপের পথ ত্যাগ করে। যদিও সমস্ত লোকই পাপে নিমজ্জিত হয়েছিলো, তবুও মনে হয় স্বল্প সংখ্যক কিছু ন্যায়বান লোক ইউনুস নবীর সতর্কবাণী গ্রহণ করে। তাদের জন্যই আল্লাহ্ নিনেভাবাসীদের ধ্বংস না করে নতুনভাবে সমৃদ্ধশালী জীবন শুরু করার সুযোগ দান করেন। উপরের টিকার কালক্রম অনুযায়ী তাদের এই গৌরবময় ইতিহাস প্রায় দুইশত বৎসর স্থায়ীত্ব লাভ করে। ইতিমধ্যে আসেরিয়ানরা ধীরে ধীরে আবার পাপে নিমজ্জিত হয়ে পড়, ফলে এক সময়ে এই গৌরবময় সভ্যতা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে যায়। যে বিষয়গুলি এখানে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ্ নিনেভাবাসীদের সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ জীবন যাপনের সুযোগ দান করেছিলেন। সামগ্রিক কথাটি এখানে ব্যবহার করা হলো এজন্য যে, এই শব্দটি এখানে জাতির জন্য প্রযোজ্য হয়েছে- বর্তমান জাতীয় জীবনের জন্য। একথার অর্থ হচ্ছে জাতির সকলেই যদিও আল্লাহ্র রহমত ও করুণা লাভ করেছিলো, তবুও ব্যক্তিগত পাপের দায় দায়িত্ব থেকে কেউ রেহাই পাবে না। পাপের শাস্তি হচ্ছে আত্মিক অবনতি- এই-ই আল্লাহ্র আইন বা বিধান। এর থেকে কারোরই রেহাই নাই- শুধুমাত্র অনুতাপের মাধ্যমেই অব্যহতি পাওয়া সম্ভব। আর এই অনুতাপ হতে হবে ব্যক্তিগত। কারণ পৃথিবীতে আমরা সকলেই ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতায় আবদ্ধ। দেখুন সূরা [৬:১৬৪], [৩৯:৭, ৭০], [৩৫:১৮], [৪২:১৫], [৫৩:৩৮], [৭৪:৩৮] ইত্যাদি। শুধুমাত্র অনুতাপের মাধ্যমেই আল্লাহ্র ক্ষমা ও দয়া লাভ করা যায়।
১৪৮০: পৃথিবীতে অসংখ্য জীব-জন্তু, তৃণলতা, গাছ-পালা, অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণী জগত আল্লাহ্র সৃষ্টির স্বাক্ষর বহন করে। মানুষের থেকে এদের পার্থক্য হচ্ছে, এদের কাউকেই আল্লাহ্ মানুষের মত "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দেন নাই। এই সীমতি ইচ্ছা শক্তির জন্যই মানুষ ইচ্ছা করলে ভালোকে গ্রহণ করতে পারে, আবার মন্দকেও বেছে নিতে পারে। কিন্তু প্রাণী বা উদ্ভিদ জগত তা পারে না। স্রষ্টার কাছে এই সীমিত ইচ্ছা শক্তির জবাবদিহিতা সমস্ত প্রাণীকুলের মধ্য একমাত্র মানুষকেই করতে হবে। যদি আল্লাহ্ মানুষকে এই শক্তি দান না করতেন তবে সকল মানুষই ফেরেশতাদের মত কোন পাপ করতো না, কোন মন্দ করার ক্ষমতা তাদের চরিত্রে থাকতো না। সুতারাং কোনও জবাবদিহিতাও থাকতো না। ফেরেশতাদের আল্লাহ্ যেমন কোন পাপ কাজ করার ক্ষমতা দান করেন নাই, মানুষও ঠিক সেরূপ হতো। মানুষের ঈমান বা বিশ্বাস তখন তাদের চরিত্রের একটি বৈশষ্ট্য পরিণত হতো, তাদের ঈমানকে ভালো ও মন্দের কষ্টিপাথরে যাচাই করার প্রশ্ন আসতো না। পৃথিবীর সকল মানুষই তখন ঈমানদার ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হতো। এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে, "তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে, পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনতো।" কিন্তু পৃথিবীতে আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন বিভিন্ন মানসিক দক্ষতা সম্পন্ন করে। সে ভালো মন্দের পার্থক্য করতে পারে, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারে, সে ভালোবাসতে পারে আবার ঘৃণাও করতে পারে। আল্লাহ্র ইচ্ছা : মানুষ তার এই সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশ ঘটাবে তার আত্মিক উন্নতির মাধ্যমে, স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খায়। সুতারাং ঈমানের বা বিশ্বাসের অধিকারী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, নৈতিক চরিত্রের উন্নতি করে আত্মিক উন্নতি লাভ করা। আর এর বিরোধিতা করাই হচ্ছে পাপ। এই আয়াতে আল্লাহ্ মোমেন ব্যক্তিদের সাবধান করে বলেছেন যে, তারা অবিশ্বাসীর অবিশ্বাসের জন্য ক্রুদ্ধ হবে না বা অধৈর্য হবে না বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে না। এখানে গুরত্বপূর্ণ উপদেশ যা আল্লাহ্র মোমেন ব্যক্তিদের দান করেছেন তা হচ্ছে : গায়ের জোড়ে বা শক্তির ভয় দেখিয়ে কারও উপরে ধর্মীয় বিশ্বাস চাপানোর প্রলোভন মোমেন ব্যক্তিদের সংবরণ করতে হবে। কারণ আল্লাহ্র ভালোবাসা হারানোর ভয়ে না হয়ে যদি শুধুমাত্র মানুষের ভয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে পালন করা হয়, তবে তা কখনও সত্যিকারের ঈমান বা বিশ্বাস নয়। তা ঈমান নয়।
১৪৮১: আল্লাহ্ মানুষকে "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করেছেন। এই ইচ্ছাশক্তিকে আল্লাহ্র ইচ্ছাশক্তির সাথে সমন্বিত করে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের নামই হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঈমান। এর জন্য প্রয়োজন ঐকান্তিক আগ্রহ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা। মানুষ চারিত্রিক দিক থেকে দুর্বল। সেই কারণে সাফল্য লাভের জন্য তার সর্বদা আল্লাহ্র সাহায্য ও রহমতের প্রয়োজন। যদি আমাদের প্রচেষ্টা আন্তরিক হয়, যদি আমরা আল্লাহ্র ইচ্ছাকে অনুধাবনের চেষ্টা করি, তবে অবশ্যই আল্লাহ্র সাহায্য অতি নিকটে। ঈমানের প্রথম ধাপই হচ্ছে আল্লাহ্কে বোঝার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা। যদি এই প্রচেষ্টা আন্তরিক না হয়, তবে, তাদের মনে সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে থাকবে এবং তা ধর্মীয় বিশ্বাসের পথে বাঁধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। এই-ই আল্লাহ্র বিধান। এই বিধানকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, "যারা অনুধাবন করবে না, আল্লাহ তাদের উপর সন্দেহের [অন্ধকার] স্থাপন করবেন।"
[উপদেশ : যারা মৌলবাদী, শক্তির মাধ্যমে ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের জন্য এই আয়াতে আছে উপদেশাবলী]
১৪৮৩: মানুষের মধ্যে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য বোধ এবং সত্যের জন্য, ভালোর জন্য, ন্যায়ের জন্য, পূণ্যের জন্য আন্তরিক চেষ্টাই হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল ভিত্তি। মানুষ ভালোর জন্য, ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য আন্তরিক চেষ্টার মাধ্যমে তার নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাবে। এই-ই হচ্ছে স্রষ্টার ইচ্ছা। স্রষ্টার এই ইচ্ছা পূরণের মাধ্যমে স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টার নামই হচ্ছে ঈমান বা ধর্ম। ঈমান শুধুমাত্র কয়েকটি কলেমার উচ্চারণ নয়- এটা হচ্ছে বাস্তব প্রচেষ্টা ও কর্মপদ্ধতি। যদি আমরা তা না করি তবে আমাদের আধ্যাত্মিক জগত বা বিবেক (Spiritual faculty) ধীরে ধীরে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে ও একদিন তা মৃত হবে। যার আধ্যাত্মিক জগত অন্ধকারচ্ছন্ন সে কখনও সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়,পাপ-পূন্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। ফলে তার পক্ষে আল্লাহর নিদর্শন সমূহ অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। আল্লাহ্র নিদর্শন দুধরণের : (১) তাঁর সৃষ্টির মধ্যে :, প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান (২) তাঁর দূতদের মাধ্যমে প্রেরিত প্রত্যাদেশের মধ্যে। বধির ব্যক্তি যেমন সঙ্গীতের মাধুর্য্য উপভোগ করতে পারে না, আধ্যাত্মিকভাবে মৃত ব্যক্তিও সেরূপ আল্লাহ্র নিদর্শন বুঝতে পারবে না, বা এর সৌন্দর্য্যকে আত্মার মাঝে অনুভব করতে সক্ষম হবে না।
১৪৮৪: "তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করবো।" এই লাইনটি এই সূরার [১০:২০] প্রথমে শুরু হয়েছে। দেখুন টিকা ১৪০৮। আল্লাহ্র নিদর্শন বিশ্বব্রহ্মান্ড ব্যাপী ছড়ানো। যার দেখার চোখ আছে সেই দেখতে পায়, যার শোনার কান আছে সেই শুনতে পারে, যার বোঝার মন আছে সেই বুঝতে পারে। অবিশ্বাসীদের সেই চোখ, কান বা মন নাই। সুতারাং সত্যের নিদর্শন অনুধাবনে তারা ব্যর্থ। সূরাটির শেষে এসে একই বাক্য দ্বারা এই বক্তব্যের সমাপ্তি টানা হয়েছে।
রুকু-১১
১৪৮৫: সাধারণ মানুষ গড্ডালিকা প্রবাহে চলতে ভালোবাসে। যদি সাধারণ মানুষ সত্যে ধর্মে বিশ্বাস স্থাপনে ইতঃস্তত করে, সন্দেহ পোষণ করে, বা আশ্চর্য হয়, তবে সে ক্ষেত্রে মোমেন ব্যক্তিদের যা কর্তব্য তাকেই আল্ মুস্তফার (সা) বক্তব্যের মাধ্যমে সমস্ত মোমেন ব্যক্তিদের এই আয়াতে জানানো হয়েছে।
১৪৮৬: এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহ্র উপাসনা শুধুমাত্র কোনও হুকুম বা কবির কল্পনা, বা দার্শনিকের কাল্পনিক ব্যাখ্যা, যুক্তিতর্কের বিষয় নয়। এ হচ্ছে চির সত্য-আত্মার অস্তিত্ব, বিকাশ প্রশান্তি এর সাথে জড়িত। অবিনশ্বর আত্মার অস্থায়ী নিবাস এই নশ্বর দেহ। এই দেহের সৃষ্টি ও ধ্বংস তাঁরই হাতে। জীবন ও মৃত্যু শুধুমাত্র এক আল্লাহ্রই হাতে। জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্ ।
১৪৮৭: "আদিষ্ট হয়েছি" অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র এবাদত করার হুকুম রসুলের (সা) আবিস্কার নয়। এই হুকুম স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁকে দিয়েছেন এবং তাঁর মাধ্যমে এই হুকুম সমস্ত বিশ্ব মানবের জন্য প্রচারিত হয়েছে।
১৪৮৮: ঈমান বা বিশ্বাস প্রত্যেকেরই ব্যাক্তি সত্ত্বার অংশ। যেহেতু, মানুষ সামাজিক জীব; সেহেতু তার বিশ্বাস বা বিশ্বাসের আন্তরিকতা ও একাগ্রতা শতগুণে বৃদ্ধি পায়, যদি সে পূণ্যাত্মাদের সাথে এক সঙ্গে থাকার সুযোগ পায় ও এবাদতের অংশীদার হতে পারে। এখানেই ইসলামের বৈশিষ্ট্য। ইসলাম কোন সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে জীবনের ধর্ম। প্রতিদিনের পূত পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে যারা আল্লাহ্র ইচ্ছাকে পূরণ করে তারাই প্রকৃত মোমেন বান্দা। সমাজ সংসার ত্যাগ করে বনে বা নির্জন স্থানে যেয়ে আল্লাহ্র এবাদত করা ইসলাম অনুমোদন করে না। সমাজ ও সংসারের প্রতি কর্তব্যের সীমারেখা বলে দেয়া আছে ঐশীগ্রন্থে। সেই নির্দ্দেশিত পথে যারা প্রতিদিনের পার্থিব জীবন পরিচালিত করে, সমাজ ও সংসারের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে, এ ব্যাপারে পৃথিবীর ক্লোদাক্ত জীবন যাদের স্পর্শ করে না, তারাই মোমেন। দ্বীন ও দুনিয়া এই দুই-এ মিলেই ইসলাম। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য্য। কারণ 'দ্বীন' ব্যতীত দুনিয়া ও দুনিয়া ব্যতীত 'দ্বীন' দুটোই অসম্পূর্ণ। কারণ প্রকৃত সুন্দর সমাজ বিকাশের মূল চাবিকাঠি আছে আল্লাহ্র দ্বীনে। সেই কারণে এখানে রাসুলকে (সা) আল্লাহ হুকুম দিয়েছে "মুমিনদিগের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য।" অর্থাৎ সেই সমাজ যে সমাজ মোমেন বান্দাদের দ্বারা সংগঠিত। অর্থাৎ মোমেনদের সংগঠিত হওয়ার হুকুম।
১৪৮৯: "আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু"। যখন দুঃখ বিপদ আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অন্ধকারচ্ছন্ন করে ফেলে। বিপর্যয়ের ধুলি ঝড়ে জীবনের আশার আলোকে আড়াল করে ফেলে, সেই বিপদ বিপর্যয়ের মাঝেও পরম করুণাময়ের করুণার ধারা প্রবাহিত হয়। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের আত্মাকে পৃথিবীর চাওয়া-পাওয়ার মলিনতা দ্বারা কুলষিত করে ফেলি, তখন আল্লাহ্ তার পরিশুদ্ধতার ভার গ্রহণ করেন। দুঃখ বিপর্যয়ের সময়ে মানুষ আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করে, তাঁর নৈকট্য অনুসন্ধান করে; নিজের দোষ-ত্রুটির অনুসন্ধান করে তাঁর থেকে পরিশুদ্ধ হতে চেষ্টা করে- স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভের আশায়। দুঃখ যন্ত্রণার মাধ্যমেই ধৈর্য্য ধরে জীবনের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে হয়। জীবনর সার্থকতা সেখানেই । দুঃখ, বিপদ, বিপর্যয়ের মধ্যেও আল্লাহ্র করুণার হাত বর্তমান থাকে। বান্দার বৃহত্তর কল্যাণের জন্য সে হস্ত প্রসারিত। তাই বান্দার যাতে কল্যাণ সেভাবেই দুঃখ, বিপদ, বিপর্যয় আল্লাহ্র তরফ থেতে পতিত হয়, এং তিনি ব্যতীত আর কারও তা দূর করে দেবার ক্ষমতা নাই। তাঁর বৃহত্তর পরিকল্পনা আমাদের জন্য যাতে কল্যাণ নিহিত, তা অনুধাবন করার ক্ষমতা আমাদের সীমিত জ্ঞানের বাইরে। আবার আল্লাহ্র করুণা ও রহমত যার জন্য প্রবাহিত তাও কেড়ে নেবার ক্ষমতা কারও নাই। তাঁর রহমত ও করুণা তারাই লাভ করে যারা তার যোগ্য। এমনকি আমরা সাধারণ মানুষ যারা দোষ-ত্রুটির উর্দ্ধে নয়, তারাও তাঁর রহমত ও করুণায় ধন্য।
১৪৯০: 'Furqan' এই শব্দটির অর্থ সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের সীমানা নির্ধারিত করার মানদন্ড। এই মানদন্ড আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রাপ্ত পথ নির্দেশ বা নৈতিক নীতিমালা। এই মানদন্ডই হচ্ছে শ্বাসত "সত্য" যা যুগকাল অপরিবর্তিত। মানুষের নৈতিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ এই মানদন্ড বা "সত্য" দ্বারাই নির্ধারিত হয়। আমরা যদি আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করি তা আমাদের-ই কল্যাণের জন্য করবো। আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে চলে আমরা কাউকে অনুগ্রহ করছি এ কথা মনে করার কোনও কারণ নাই। আল্লাহ্র নবী রসুলেরা আমাদের যুগে যুগে এই পথের সন্ধান দান করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। এতে তাদের কোনও স্বার্থ নাই। কল্যাণ যা তা আমাদের। কারণ যে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে চলে, সে সত্য পথের সন্ধান পায়; যা তার আত্মায় কল্যাণ বয়ে আনে। যদি আমরা আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথকে অস্বীকার করি তবে সে ক্ষতি নিজের ছাড়া আর কারোরই না। এই অস্বীকার করার দায় বা দায়িত্ব কোন নবী বা রসুলের নয়। কারণ আল্লাহ্ প্রত্যেককে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়েছেন। রসুলের প্রদর্শিত পথ গ্রহণ করা বা ত্যাগ করা তার নিজস্ব ইচ্ছা। এই দায়িত্ব ব্যক্তির নিজস্ব। এই দায়িত্বে জবাবদিহিতা তাকে শেষ বিচারের দিনে করতে হবে। এই দায়িত্ব কোনও নবী রসুলের একক দায়িত্ব না। দেখুন সূরা [৬:১৬৪] [৩৯:৭,৭০] ৩৫:১৮] ৪২:১৫] ৫৩:৩৮] ৭৪:৩৮] ইত্যাদি আয়াতে এবং কোরানের আরও বহুস্থানে।
১৪৯১: যখন আল্লাহ্র নবীর (সা) অক্লান্ত চেষ্টা ও আন্তরিক আগ্রহ সত্ত্বেও কাফেররা সত্য ধর্মে আকৃষ্ট হলো না, তাদের অন্যায়, অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো, আল্লাহ্র হুকুম হলো ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষা করা। নবীর (সা) জীবনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই উপদেশ দিয়েছেন যে, কোন মহৎ কাজে যদি পর্বত প্রমাণ বাঁধাও আসে; সবর করতে হবে। সবর, অর্থাৎ ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের সাথে আল্লাহ্র রহমতের অপেক্ষা করতে হবে। এ কথার অর্থ নিশ্চেষ্টভাবে অপেক্ষা করা নয়- একথাটির অর্থ ধীর স্থিরভাবে অধ্যাবসায়ের সাথে নিজ লক্ষ্যের প্রতি অবিচল ভাবে অগ্রসর হতে হবে, যার প্রধান পাথেয় হবে আল্লাহ্র রহমতের ভরসা। আল্লাহ্র পরিকল্পনা এভাবেই মানুষের মাধ্যমে যুগে যুগে কার্যকর হয়। যারা শত দুঃখ, বিপদ, বিপর্যয়ে আল্লাহ্র পতাকা সমুন্নত রাখতে পারে তারাই ধন্য।
সূরা ইউনুস
সূরা ইউনুস বা জোনাহ্ (Jonah)- ১০
১০৯ আয়াত, ১১ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : এই সূরাটি এবং পরবর্তী পাঁচটি সূরা [সূরা ১১, ১২, ১৩, ১৪ এবং ১৫] পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এই সূরাগুলি মক্কার শেষের দিকে অবতীর্ণ হয়; যখন মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরতের সময়কাল প্রায় নিকটবর্তী। অবশ্য হিজরতের সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই।
এই ছয়টি সূরার বিষয়বস্তুর মধ্যে সামঞ্জস্য বিদ্যমান। সূরা ৮ এবং ৯-এ প্রধানতঃ নূতন মুসলমান সম্প্রাদায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নূতন মুসলমান সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান, সংগঠন, আদর্শ এবং সর্বপরি এর প্রচার এবং প্রসার সমসাময়িক আরব মোশরেকদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে। তারা ইসলামকে সমূলে বিনাশ সাধন করতে তৎপর হয়ে ওঠে। সূরাগুলির ভূমিকাতে দেখুন। এই সূরাগুলির বিষয়বস্তু হচ্ছে, বহিঃ শত্রুতাকে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে, আল্লাহর সাথে পৃথিবীর মানব সম্প্রদায়ের সম্পর্কের ভিত্তি। কিভাবে প্রত্যাদেশ কাজ করে? আল্লাহর করুণার অর্থ কি? এবং এই করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থই বা কি?
আল্লাহ্র রসুলরা কিভাবে তাদের প্রতি অর্পিত আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রচারিত করেন। মানব সম্প্রদায় কিভাবে তা গ্রহণ করবে? ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে সূরাগুলিতে। ১৩ নম্বর সূরাটি ব্যতীত অন্যান্য সব সূরারই প্রথমে "আলিফ", "লাম", "রা" এই তিনটি সংক্ষিপ্ত অক্ষর সংযুক্ত করা হয়েছে, যা প্রতীকধর্মী। ১৩ নম্বর সূরাটির উপরে "আলিফ", "লাম" "মিম", "রা' এই চারটি সংক্ষিপ্ত অক্ষর সংযুক্ত করা হয়েছে। এই সূরাটির এই বিভিন্নতা আমরা ১৩ নম্বর সূরার সময়ে আলোচনা করবো।
এই ভূমিকাতে শুধুমাত্র ১০ নম্বর সূরাটি সম্বন্ধেই আলোচনা করা হবে। এই সূরাটির মর্মবাণী হচ্ছে : আল্লাহ এই বিশাল বিশ্বভূবন সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র আমাদের ভোগ বিলাসের জন্য নয়, শুধুমাত্র সৃষ্টি ও ধ্বংসের জন্য নয়। তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি শুধুমাত্র বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর উদ্দেশ্য বহু উর্দ্ধে, মহত্বর কারণের জন্য। সবচেয়ে অত্যাচার্য হচ্ছে আল্লাহ্কে আমরা আমাদের চর্মচক্ষে দেখতে পাই না, কিন্তু তাঁকে আমরা আমাদের আত্মার মধ্যে অনুভব করতে পারি। যুগে যুগে নবী রসুলের মাধ্যমে, কিতাবের মাধ্যমে তাঁর প্রত্যাদেশ আমাদের নিকট প্রকাশিত হয়। এই সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে, কিভাবে রসুলেরা প্রত্যাখাত হয়েছেন যুগে যুগে এবং কিভাবে সাধারণ মানুষ আল্লাহর প্রত্যাদেশকে অবিশ্বাস করেছে এবং শেষ মূহুর্তে অনুতাপের মাধ্যমে ফিরে এসেছে। এই সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে, ইউনুস নবীর ক'থা এবং তার সময়ের লোকদের কথা। এই সব লোকেরা আল্লাহর প্রত্যাদেশকে প্রত্যাখান করেছিলো। কিন্তু যে মূহুর্তে তারা অনুতাপ করেছে, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় নাই। আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা আমাদের ধারণার অতীত যা আমাদের বিধৌত করতে সর্বদা উদগ্রীব।
সারসংক্ষেপ : বিশ্ব-বিধাতা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ মানব কূলের হৃদয়ে অপূর্ব অত্যাচার্যভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আল্লাহর প্রত্যাদেশ ব্যতীতও তাঁর হাতের পরশ সমস্ত সৃষ্টিতে বিদ্যমান। চন্দ্র, সূর্য, তরু-লতা, আকাশ-বাতাস, দিন-রাত্রি, প্রকৃতির পরিবর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন [১০:১-২০]
জীবনের সকল সৌন্দর্য্য এবং ভালো সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু বিশ্ব বিধাতা আল্লাহ। মানুষ অন্ধ, তাই এসব দেখেও সে আল্লাহ্র অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে না [১০:২১-৪০]।
সব কিছুর শুরু আল্লাহ্, এবং তাঁর কাছেই সব কিছু প্রত্যার্পন করবে। তাঁর কাছেই সব কিছুর শেষ। তিনিই একমাত্র সত্য। মানুষ আল্লাহর প্রেরিত সত্যকে গ্রহণ করার পরিবর্তে আল্লাহর সাথে শরীক গ্রহণ করে যা সত্য বিমূখ- কারণ মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। [১০:৪১-৭০]
আল্লাহ্ নূহ্ নবীকে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বকে প্রকাশ করেন, কিন্তু নূহ্ নবীর সমসাময়িক লোকেরা তা প্রত্যাখান করে, পরিণামে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ্ হযরত মুসার (আ) মাধ্যমে ফেরাউনের সাথে কথা বলেন। কিন্তু ফেরাউন তা বিশ্বাস করে না, কারণ সে ছিল অবাধ্য ও একগুয়ে। শেষ মহুর্তে ফেরাউন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো কিন্তু তখন অনুতাপের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল [১০:৭১-৯২]।
আল্লাহ্র প্রতি অবিশ্বাস মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। ইউনুস নবীর সমসাময়িক জনগণ অনুতপ্ত হয়েছিলো। ফলে তারা আল্লাহ্র রহমত ও করণীয় ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে যারা বিশ্বাসী বা ঈমানদার ব্যক্তি, আল্লাহ তাঁদের ধ্বংস থেকে রক্ষা করবেন। যখনই আল্লাহর সত্য (প্রত্যাদেশ) প্রকাশিত হয় যা অনুসরণ করা এবং বিপদে ও দুর্যোগে ধৈর্য্য ধারণ করা কর্তব্য। কারণ আল্লাহ্ সুক্ষ বিচারক [১০:৯৩-১০৯]
সূরা ইউনুস-১০
১০৯ আয়াত, ১১ রুকু, মক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে]
০১। আলিফ - লাম - রা। এগুলি জ্ঞানগর্ভ কিতাবের আয়াত। ১৩৮২
১৩৮২: 'আয়াত' - শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্র নিদর্শন অথবা কুর-আনের পংক্তি বা চরণ। এখানে দুটো অর্থই সমভাবে প্রযোজ্য। কুর-আনের আয়াত জ্ঞানের ভান্ডার স্বরূপ। সে হিসেবে এর প্রতিটি চরণ হিরকখন্ড তুল্য। 'নিদর্শন' এ জন্য যে, আকাশে-বাতাসে পৃথিবী ও নভোমন্ডলে সর্বত্রই সেই স্রষ্টার হাতের স্পর্শ বা নিদর্শন বিদ্যমান। নক্ষত্র খচিত রাতের আকাশ আমাদের মনকে, চিন্তার দিগন্তকে সুদূরে প্রসারিত করে। মহান স্রষ্টার বিরাটত্ব অনুভব করতে সাহায্য করে। এই পৃথিবী ও নভোমন্ডলের সৃষ্টি আল্লাহ্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ক্ষমতা ও মহত্মের উজ্জ্বল "নিদর্শন"। সেই বিশ্ব-বিধাতা সারা নভোমন্ডল, আকাশ, বাতাস, পৃথিবী যার করতলগত, যিনি ক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দি, তিনি তার সৃষ্টির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে প্রাণ তাকেও কখনও অবহেলা করেন না। যে পাপী যে অবহেলিত, তিনি তাদের সাথেও তার রসুলদের মাধ্যমে কথা বলেন, হেদায়েত করেন, আত্মিক মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন। এগুলি সবই তাঁর নিদর্শন।
০২। এটা কি মানুষের জন্য আশ্চর্য্যের বিষয় যে, আমি তাদেরই একজনের নিকট আমার ওহী প্রেরণ করেছি ১৩৮৩? যেনো সে মনুষ্য সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে (তাদের বিপদ সম্বন্ধে) এবং মুমিনদের সুসংবাদ দিতে পারে যে, তাদের প্রভুর নিকট তাদের জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ১৩৮৪। (কিন্তু) কাফেররা বলে, "এতো এক যাদুকর"।
১৩৮৩ : আরবদের কাছে এই ব্যাপারটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ছিল যে তাদের মধ্যেই একজন নিজেকে আল্লাহ্র প্রেরিত পুরুষ বা রাসুল দাবী করছেন। আল্লাহ্র বাণী যা জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ভরপুর, তা রাসুলের মুখ থেকে নিঃস্বরিত। এই বাণীর ক্ষমতা, অতুলনীয় কারণ, এই বাণী মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে মুক্তির পথ দেখায়। আরও আশ্চর্যের বিষয়, রসুলের (সা) মত একজন নিরক্ষর লোকের মুখ থেকে কিভাবে এরূপ জ্ঞানের বাণী নিঃস্বরিত হতে পারে। এটা তখনই সম্ভব যখন তিনি আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন। এই সহজ সত্যটি আরবের লোকেরা বুঝতে সক্ষম হয় নাই। তারা তাঁকে যাদুকর আখ্যা দেয়, কারণ, আত্মার অন্ধকার, তাদের অনুধাবন ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, ফলে তারা তাদের দূরদর্শিতা, অনুধাবন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ম্যাজিকের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। তারা নিজেদের কুপমন্ডুকতার অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে যায়, যা তাদের অজ্ঞানতার ফল।
১৩৮৪ : "Qddama" শব্দটির অর্থ উচ্চ মর্যদা, অথবা কোনও কাজকে তাঁর প্রভুর নিকট পূর্বেই প্রেরণ করা। বাংলা অনুবাদ হয়েছে "তুমি সুসংবাদ দাও, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট আছে উচ্চ মর্যাদা।" ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে "The good news to the Belivers/ That they have before their Lord/The good actions they have advanced" ইংরেজী অনুবাদে দ্বিতীয় অর্থটির প্রয়োগ করা হয়েছে।
আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সর্বদা সকলের জন্য সুখকর নয়, অনেকের জন্যই তা অপ্রীতিকর। সতর্কবাণী করা হয়ছে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য, সাবধান করা হয়েছে পাপের পরিণতি সম্পর্কে। যদি আমাদের মাঝে বিশ্বাসের দৃঢ়তা থাকে, তবে আমরা আল্লাহ্র সতর্কবাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবো। যে এই বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করেছে, এবং সেই অনুযায়ী জীবনকে পরিচালিত করতে পেরেছেন তাদের জন্য আল্লাহ্ এই আয়াতে উচ্চ মর্যদার সুসংবাদ দিয়েছেন। জীবনকে পরিচালিত বাক্যটি "The good action they have advance" বাক্যটি বোঝানের জন্য অথবা "মোমেনদিগের" শব্দটি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ "Sidq" শব্দটির অর্থ বিশ্বস্ত ও খাঁটি। সুতারাং যে বিশ্বস্ত ও খাঁটি বা সৎ জীবন যাপন করে, তাদের জন্য সুসংবাদ।
০৩। অবশ্যই তোমাদের প্রভু আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন ১৩৮৫। (অতঃপর) দৃঢ়ভাবে (কর্তৃত্বের) সিংহাসনে ১৩৮৬ অধিষ্ঠিত হয়ে, সকল কিছুকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন সুপারিশকারী (পক্ষে আবেদন) করতে পারে না। ইনিই তোমাদের প্রভু, আল্লাহ্। সুতরাং তাঁর এবাদত কর। (তবুও কি) তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? ১৩৮৭।
১৩৮৫ : দেখুন টিকা ১০৩১ এবং সূরা [৭:৫৪] আয়াত
১৩৮৬ : এই আয়াতে 'আরস' বা সিংহাসন শব্দটি প্রতীকধর্মী। এই শব্দটি নিম্নোক্ত অর্থবোধক : (১) সিংহাসন রাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ অধিষ্ঠানের প্রতীক। এখানে আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট জগতের সবার উপরে, এই ভাবকে বোঝানো হয়েছে। সিংহাসন শব্দটি দ্বারা (২) রাজতন্ত্রে যেরূপ রাজার কর্তৃত্ব সর্বময়, আল্লাহ্র রাজত্বে আল্লাহ্র আইন সেরূপ অলঙ্ঘনীয়। প্রাকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এ কথার সত্যতা মেলে। কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতি, আকাশ-ভূমন্ডল, জীব ও জড় প্রকৃতি সকলের জন্য সুনির্দ্দিষ্ট প্রকৃতিক আইন আছে। এই আইন আল্লাহ্ কর্তৃক প্রণীত। সে লঙ্ঘন করার ক্ষমতা প্রকৃতিতে কারও নাই। (৩) তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। হিন্দু বা প্রাচীন গ্রীকদের বহু দেব- দেবী ছিল, যারা সাধারণ মানুষের ন্যায় আচরণ করতো। তাদের প্রেম-ভালবাসা, হাসি-কান্না, রাগ-অভিমান সবই ছিল সাধারণ পৃথিবীর মানুষের ন্যায়। এখানেই এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্ থেকে তাদের পার্থক্য। (৪) তিনি সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক এবং সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি "সকল বিষয় নিয়ন্ত্রিত করেন।" (৫) নবী, রসুল, স্ব-ইচ্ছায় কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। " তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন সুপারিশকারী পক্ষে আবেদন করতে পারে না।"
১৩৮৭ : দেখুন সূরা [৬:৮০] আয়াত।
০৪। তাঁরই নিকট তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য ১৩৮৮। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রারম্ভ তিনি-ই করেন ১৩৮৯, এবং এর পুনরাবৃত্তি ঘটান, যেনো তিনি ন্যায়বিচারের সাথে পুরস্কৃত করতে পারেন তাদের যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে। কিন্তু যারা তাঁকে প্রত্যাখান করে তাদের জন্য রয়েছে ফুটন্ত পানি ১৩৯০ পিপাসা এবং কষ্টকর শাস্তি। কারণ তারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছিলো।
১৩৮৮ : "Haqq" অর্থ সত্য, সঠিক, ন্যায়, নিশ্চিত ইত্যাদি বহুবিধ ভাবকে বুঝায়।
১৩৮৯ : দেখুন সূরা [২:১১৭] আয়াত ও টিকা ১২০। আল্লাহর সৃষ্টিকে অনুধাবন করতে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন। মানুষের সৃষ্ট যে কোনও পদার্থের আরম্ভ আছে আবার একদিন তা শেষ হয়ে যায়। সভ্যতার ক্রমবিকাশ একথাই বলে। এখানেই মানুষের সৃষ্টিধর্মী কাজের সাথে আল্লাহ্র কাজের পার্থক্য। সৃষ্টির আদি থেকে প্রাণের সৃষ্টি হয়ে আসছে, কোনও এক সময়ের জন্যও তা থেমে থাকে না। মৃত্যুর সমাধির উপরেই রচিত হয় জীবনের সূচনা। "অতঃপর উহার পুনরাবর্তন ঘটান।" সৃষ্টির এই ধারাবাহিকতা বিভিন্ন ধাপে ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকে। যারা মোমেন তারা আল্লাহ্র সৃষ্টির মাধ্যমে পূণ্য কাজ বা সৎ কাজ করার সুযোগ পান যেনো আল্লাহ্ তাদের পরকালে পুরস্কৃত করতে পারেন।
১৩৯০ : "Hamim" ফুটন্ত পানীয়; সূরা [৩৮:৫৭] আয়াতের "Gassaq" শব্দটির সাথে তুলনীয়। "Gassaq" শব্দটির অর্থ কৃষ্ণবর্ণ, ঘোলা বা অপরিস্কার, প্রচন্ড ঠান্ডা পানীয়। এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে যারা আল্লাহ্র বিধানের প্রতি বিদ্রোহ করে বা কুফ্রী করে তাদের শাস্তিকে রূপকের সাহায্যে বোঝানোর জন্য।
০৫। তিনিই সূর্য্যকে উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় ১৩৯১ এবং চন্দ্রকে সৌন্দর্য্যের আলোক রূপে সৃষ্টি করেছেন এবং উহার (চাঁদের) জন্য প্রদর্শনী (সময়) নির্দিষ্ট পরিমাণ করেছেন; যেনো তোমরা বৎসরের সংখ্যা এবং (সময়) গণনা করতে পার। আল্লাহ্ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেন নাই। ১৩৯২ (এভাবেই) তিনি তাঁর নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেন তাদের জন্য যারা তা বুঝতে পারে ১৩৯৩।
১৩৯১ : সৃষ্টির সৌন্দর্য্য ও রূপকে প্রকাশ করার জন্য সূর্য্য ও চন্দ্রকে রূপক হিসেবে এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্য তার আলোতে ভাষ্মর, সূর্য্যের আলোর তেজ ও উজ্জ্বল্য আমাদের জীবন রক্ষাকারী, অপর পক্ষে চাঁদের আলো মোলায়েম ও স্নিদ্ধ, সুন্দর যা অন্ধকারময় রাত্রিতে রাতের অন্ধকার দূর করতে সাহায্য করে। রাতের পৃথিবীর সৌন্দর্য্যকে বৃদ্ধি করে। এ ব্যতীত সূর্য্য এবং চন্দ্রের সাহায্যে আমরা সময়ের পরিমাপ করি। সৌর ক্যালেন্ডার ও চন্দ্র ক্যালেন্ডার সূর্য্য ও চাঁদের আবর্তনের উপরে ভিত্তি করেই রচিত। মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-আচরণ সব কিছু নির্ধারিত হয় চাঁদের উদয়ের উপরে ভিত্তি করে বা চান্দ্র মাস অনুসারে। অপর পক্ষে কৃষি কাজের পরিকল্পনা মূলতঃ করা হয় সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কারণ ঋতুর পরিবর্তনের সাথে কৃষি কাজের সম্পর্ক বিদ্যমান। সুতারাং সূর্য্য ও চন্দ্র সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ্ জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ নিদর্শন রেখেছেন।
১৩৯২ : পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মহৎ উদ্দেশ্য বিদ্যমান। তাঁর এই উদ্দেশ্য সত্য ও সুন্দরের উপরে প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্ পৃথিবীকে তাঁর খেয়াল-খুশী চরিতার্থ করার জন্য খেলার ছলে সৃষ্টি করেন নাই। দেখুন সূরা (২১:১৬) আয়াত। এই আকাশ, পৃথিবী, ভূমন্ডল সৃষ্টিতে আল্লাহ্র সৃষ্টি নৈপুন্যের কৌশল, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং বৈচিত্র বিদ্যামন। এসব বৈচিত্র থাকা সত্বেও সমস্ত সৃষ্ট পদার্থকে সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা আল্লাহ্র একত্বের কথা অনুভব করতে পারি। কারণ আকাশ-পৃথিবী, নভোমন্ডল, সর্বত্রই একই প্রাকৃতিক নিয়ম বর্তমান, সকলেই একই সূত্র বা নিয়ম মেনে চলে। যদি নভোমন্ডলের বিভিন্ন গ্রহ, বা পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন স্রষ্টা থাকতো, তবে তাদের পরিচালনার সূত্রও বিভিন্ন হতে বাধ্য হতো। বিজ্ঞানের সূত্র সকল কিছুর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হতো না। আল্লাহ্র একত্বের এর থেকে বড় প্রমাণ আর কিছু নাই। আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত নিয়ম বা প্রাকৃতিক নিয়ম বা বিজ্ঞানের সূত্র কখনই লঙ্ঘিত হয় না, আল্লাহ্ শুধুমাত্র মানব সম্প্রদায়কে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়েছেন। মানব সম্প্রদায় এই ইচ্ছা শক্তির অপব্যবহার করে যখন পাপে নিমজ্জিত হয়, আল্লাহ্র ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, প্রাকৃতিক নিয়মেই এক সময়ে পাপীর ধ্বংস ডেকে আনে এবং পৃথিবীতে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। দেখুন সূরা (৩:১৯১) আয়াতে।
১৩৯৩ : দেখুন সূরা (৯:১১) আয়াতে।
০৬। সত্য-সত্যই, রাত্রি এবং দিনের পরিবর্তনে এবং নভোমন্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন এসবে রয়েছে নিদর্শন তাদের জন্য যারা তাঁকে ভয় করে ১৩৯৪।
১৩৯৪ : দেখুন সূরা (২:১৬৪) আয়াতে।
০৭। যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, কিন্তু বর্তমান জীবনেই যারা সন্তুষ্ট এবং পরিতৃপ্ত, আমার নিদর্শনে যারা মনোযোগ স্থাপন করে না ১৩৯৫
০৮। তাদের আবাস হচ্ছে আগুন, কারণ হচ্ছে তাদের অর্জিত (মন্দ) কাজ।
০৮। তাদের আবাস হচ্ছে আগুন, কারণ হচ্ছে তাদের অর্জিত (মন্দ) কাজ।
১৩৯৫ : যারা আল্লাহ্র করুণা ও রহমত বঞ্চিত হবে তাদের প্রতি এই আয়াতে বলা হয়েছে। এদের বৈশিষ্ট্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে : (১) একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ্ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়েছেন, কারণ একমাত্র মানুষের এই নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে আত্মার অস্তিত্ব বিদ্যমান যা পরমাত্মার অংশ [১৫:২৯] [৩২:৯]। তাই পৃথিবীতে মানুষের অবস্থানের একটাই উদ্দেশ্য আর তা হচ্ছে পৃথিবীর জীবনের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি লাভ করা, যেনো মৃত্যুর পরে সে সেই পরমাত্মার সাক্ষাত লাভ করতে পারে। অর্থাৎ একান্ত আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রত্যেক মানব সন্তানকে চেষ্টা করতে হবে তাঁর আত্মিক উন্নতির জন্য। যারা তা না করবে তারা আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত হবে। (২) এই সব লোকেরা বস্তুগত পৃথিবী ও পার্থিব জিনিষ দ্বারা মুগ্ধ ও সম্মোহিত হয়ে যায়। পার্থিব লাভ-লোকসানই তাদের জীবনে একমাত্র মোক্ষলাভ। এতেই তারা সন্তুষ্টঃ, আত্মতৃপ্ত। সুতারাং তাদের আত্মায় পরকালের চিন্তা ঠাঁই পায় না। এরা হবে আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত। (৩) তাঁরা আল্লাহ্র নির্দেশাবলী বুঝতে অক্ষম হবে; কারণ আল্লাহ্র বাণী বোঝার ক্ষমতা তাদের থাকবে না। এর কারণ পূর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে। এদেরকে আল্লাহ্ মূক ও বধিররূপে বর্ণনা করেছেন, দেখুন সূরা (২:১৮) আয়াত। (১) নম্বর ও (২) নম্বর বৈশিষ্ট্যকে বলা যায় ঈমাহীনতার লক্ষণ। এরা পরকালের অস্তিত্বেই বিশ্বাসী নয়। (৩) নম্বর হচ্ছে তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা তাদের কর্মফলের জন্য পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত। এই সব লোক যারা আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত হবে, তাদের সাথে বিশ্বাসী ও ঈমানদার এবং যারা আল্লাহ্র রহমত লাভ করবে তাদের তুলনামুলক আলোচনা করা হয়েছে সূরা (১০:৯) আয়াতে।
০৯। যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, তাদের ঈমানের জন্য তাদের প্রভু তাদেরকে (সৎ) পথ প্রদর্শন করবেন ১৩৯৬। পরম সুখের কাননে যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে।
১৩৯৬ : এই আয়াতে যারা বিশ্বাসী ঈমানদার তাদের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস বা ঈমানের জন্য তারা তাদের অন্তরের মাঝে আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথের সন্ধান লাভ করবে। যারা এই পথের সন্ধান লাভ করে তাদের অন্তর বেহেশ্তি শান্তিতে ভরে যায়। আনন্দ ও শান্তি তাদের আত্মাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়।
১০। (এই হবে উচ্চস্বরে) তাদের ক্রন্দন: "হে আল্লাহ্! তুমি (কত) মহান!" এবং সেখানে তাদের জন্য অভিবাদন হবে "শান্তি" এবং তাদের শেষ ধ্বনি হবে "সকল প্রশংসা জগত সমূহের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য" ১৩৯৭।
১৩৯৭ : এই আয়াতটি আধ্যাত্মিক জগতের মিষ্টি একটি সংগীত বা সুর। বেহেশতবাসীরা যে সুরে আল্লাহ্কে কৃতজ্ঞতা জানাবে তাকেই কবিতার ছন্দে এখানে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁদের গান, তাঁদের আনন্দচ্ছ্বাস, সবই পরম করুণাময়ের করুণার প্রকাশ। তাঁদের প্রতি যে সম্ভাষণ করা হবে তা হচ্ছে "সালাম" যার আভিধানিক অর্থ শান্তি। অর্থাৎ তাঁদের আত্মা বেহেশ্তি শান্তিতে ভরে যাবে- যা মানব জীবনের চরম এবং পরম পাওয়া। আল্লাহ্র প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা হবে, "প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্র প্রাপ্য।"
১১। মানুষ যেভাবে তাদের কল্যাণকে ত্বরান্বিত করতে চায় আল্লাহ্ যদি সেভাবে মানুষের (অর্জিত) অকল্যাণকে ত্বরান্বিত করতেন, তবে তাদেরকে দেয় অবকাশের সময় সাথে সাথেই মীমাংসা হয়ে যেতো ১৩৯৮। সুতরাং যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, আমি তাদের অবাধ্যতায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে দিই।
১৩৯৮: যারা অপরিণামদর্শী, শুধু তারাই ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। পৃথিবীতে আমরা দেখি, যারা বিজ্ঞ, জ্ঞানী, তারা হন দূরদর্শী, তারা ভবিষ্যৎ সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বর্তমান সময়ে কষ্ট স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু যারা অজ্ঞ, অপরিণামদর্শী, মূর্খ, শুধু তারাই বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং ক্ষণস্থায়ী আরাম, আয়েশের পিছনে নিজেদের সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে। আধ্যাত্মিক জীবনেও যারা পরকালের সুখ শান্তিতে বিশ্বাস করে না, তারা ঐ অপরিণামদর্শী মূর্খ লোকের মতই নির্বোধ। তারা পরকালের সুখ-শান্তির জন্য ইহকালে সামান্য কষ্টও স্বীকার করতে রাজী নয়। তারা ইহকালের ক্ষণস্থায়ী সুখের পিছনে ছুটে বেড়ায়। কারণ তাদের অজ্ঞতা তাদের আধ্যাত্মিক দিক থেকে অন্ধ করে দেয়। তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে বোঝার বা অনুধাবন করার ক্ষমতা থাকবে না। এদেরকেই কোরানের ভাষায় বলা হয়েছে মূক ও বধির। পরকালের অবিশ্বাসের দরুণ এরা আল্লাহ্র প্রতি বিদ্রূপ প্রদর্শন করে, তাৎক্ষণিক শাস্তি দাবী করে দেখুন সূরা [৮:৩২] আয়াতে। আল্লাহকে এরা নির্বোধের মত প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করে কারণ তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। যদি সত্যি সত্যি আল্লাহ তাদের কথা শুনতেন, তবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়তো। কিন্তু পরম করুণাময় তাদের ধ্বংস না করে সময় মঞ্জুর করেন। যেনো তারা ভবিষ্যতে অনুতাপ করার সুযোগ পায়। কিন্তু তারা তাদের এই সময়ের সদ্ব্যবহার না করে পাপে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এদের আধ্যাত্মিক জগত অন্ধকারময়- ফলে এরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে হবে বঞ্চিত। চক্ষু থেকেও এরা হবে অন্ধ ব্যক্তির ন্যায়। অন্ধ ব্যক্তি যেমন হাত্ড়ে হাত্ড়ে পথ চলে, এরাও জীবনের পথে কোন সঠিক দিগ্ নির্দ্দেশনা পাবে না। এরা বিভ্রান্তির মধ্যে বাস করবে। "আমি তাদের অবাধ্যতায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে দেই।"
১২। আর যখন মানুষকে দুঃখ বিপর্যয় স্পর্শ করে, সে শুয়ে, বসে, অথবা দাড়িয় (সর্বাবস্থায়) আমাকে ডাকে ১৩৯৯। কিন্তু যখন আমি তার দুঃখ -বিপর্যয়ের সমাধান করে দেই, তখন সে এমন পথ অবলম্বন করে, যেনো তাকে যে দুঃখ-দুর্দ্দশা স্পর্শ করেছিলো, তার জন্য সে আমাকে ডাকেই নাই। এভাবেই সীমা লংঘনকারীদের চোখে তাদের কর্মকে শোভন করা হয়েছে ১৪০০।
১৩৯৯ : এই আয়াতে সাধারণ মানুষ যাদের ঈমান দুর্বল তাদের অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে। যখন দুঃখ, দুর্দ্দশা, হতাশা, গ্লানি, এই সব দুর্বল ঈমানের ব্যক্তিদের ঘিরে ধরে, তারা একান্ত অনুগত ভাবে আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করে। " সে শুয়ে, বসে অথবা দাঁড়িয়ে" বাক্যটি দ্বারা একান্ত অনুগত ও আন্তরিক ভাবে আল্লাহকে স্মরণ করা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বিপদে পড়লে এসব লোকেরা জীবনের সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু যখন আল্লাহ্ তাদের সেই বিপদ অতিক্রম করিয়ে দেন, তখন তারা আল্লাহ্র করুণার কথা ভুলে যায। তারা ভুলে যায় যে জীবনের সকল কল্যাণ আল্লাহ্র দান। কারণ তাদর ঈমান দুর্বল। তারা হচ্ছে কবি নজরুলের ভাষায় "সুখে দিনে ভুলে থাকি, বিপদে তোমায় ডাকি"- দলের লোক।
১৪০০: ঈমানের পূর্ব শর্তই হচ্ছে, মানবতা। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে, আত্মত্যাগের মাধ্যমে, আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা নিবেদন। সেই জন্যই বলা হয়ে থাকে, যার দয়া নাই, তার মধ্যে ঈমান নাই। কারণ সাধারণভাবে দেখা যায় ঈমানহীন ব্যক্তিরা হয় অত্যন্ত স্বার্থপর। তারা নিজের স্বার্থ চিন্তায় এতটাই আচ্ছন্ন থাকে যে, সেখানে ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দ, কোনও কিছুই স্থান পায় না। অন্যায়ভাবে মন্দ কাজের মাধ্যমে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করাই হচ্ছে তাদের জীবনের মোক্ষ এবং এই অন্যায় ও অসৎ কাজ পুনঃ পুনঃ করার ফলে, এর মাঝে তারা বিকৃত সৌন্দর্য্য খুঁজে পায়। "তাহাদিগের কর্ম তাহাদিগের নিকট এইভাবে শোভন প্রতীমান হয়।" স্বার্থপর ব্যক্তিরা নিজেদের সাফল্যে দম্ভ ও অহংকার অনুভব করে; তাদের ধারণা জন্মে তাদের সাফল্য তাদেরই একান্ত প্রচেষ্টার ফসল। অন্ধ অহংকার তাদের আত্মাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। তারা স্রষ্টাকে অনুভব করতে পারে না তাদের আত্মার মাঝে।
১৩। তোমাদের পুর্বে বহু মানবগোষ্ঠিকে তাদের পাপের দরুণ ধ্বংস করেছি। রসুলগণ তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ আগমন করেছিলো। কিন্তু তারা ঈমান আনে নাই। যারা পাপ করে এভাবেই আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নিই।
১৪। অতঃপর ওদের পরে তোমাদের তাদের উত্তরাধিকার করেছি- দেখার জন্য যে তোমরা কিরূপ কর্ম কর ১৪০১।
১৪। অতঃপর ওদের পরে তোমাদের তাদের উত্তরাধিকার করেছি- দেখার জন্য যে তোমরা কিরূপ কর্ম কর ১৪০১।
১৪০১ : তাৎক্ষণিকভাবে এই আয়াতের আবেদনে আরবদের কোরেশদের কথা বলা হয়েছে। কারণ তারাই হচ্ছে ধ্বংস প্রাপ্ত আজ ও সামুদ জাতির উত্তরাধিকারী। কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন, সর্বকালের, সর্বযুগের। খলিফা হারুণ-অর-রশীদের সময়, আব্বাসীয় সম্রাজ্যের বিস্তার, মুসলমানদের সূদুর স্পেন পর্যন্ত বিজয়, অটোম্যান সম্রাজ্যের অধিপত্য কুর-আন শরীফের এ কথারই প্রতিধবনি করে যে, যখন কোনও জাতি আল্লাহ্র প্রদর্শিত ন্যায় ও সত্যের পথে চলে তখন তারা সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে, আবার যখনই তারা সে পথ ত্যাগ করে, তখনই তাদের পতন ঘটে। কুর-আনের এই উপদেশ পৃথিবীর সকল মানুষের, সকল জাতির জন্য সর্বযুগে, সর্বকালে প্রযোজ্য। একথা মুসলমান, অমুলমান সবার জন্য সমভাবে সর্বযুগে প্রযোজ্য ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। উপদেশ : এই আয়াতের প্রেক্ষিতে আজকের মুসলমানদের অনুধাবন করতে হবে তাদের দুরবস্থার কারণ ও অমুলমানদের অভ্যূত্থানের কারণ।
১৫। কিন্তু যখন আমার সুস্পষ্ট নিদর্শন [আয়াত] তাদের নিকট পাঠ করা হয়, (তখন) যারা (পরলোকে) আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, তারা বলে, "ইহা (কুরআন) ব্যতীত পাঠের জন্য অন্য কিছু আন অথবা একে পরিবর্তন কর ১৪০২।" বল: "ইহা বদলানোর কোন ক্ষমতা আমার নাই। আমার প্রতি যে প্রত্যাদেশ হয় তা ব্যতীত অন্য কিছু আমি অনুসরণ করি না। যদি আমি আমার প্রভুকে অমান্য করি, তবে আমি (অনাগত) মহাদিবসের শাস্তির ভয় করি।
১৪০২: যারা ঈমানহীন তারা আল্লাহ্র আয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করে না। তারা তাদের স্বার্থ অনুযায়ী কুর-আনের আয়াতের নির্দ্দেশের পরিবর্তন চায়। কিন্তু আল্লাহ্র নবী হচ্ছেন আল্লাহ্র বাণীর বাহকমাত্র। এর সামান্যতম পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের ক্ষমতা তাঁরও নাই। কেউ তা পছন্দ করুক বা না করুক, গ্রহণ করুক বা না করুক সেটা নবীর দায়িত্ব নয়। নবীর (সা) দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়। যারা নিজ স্বার্থ ব্যতীত অন্য কিছু অনুধাবনে অক্ষম তারাই সব সময়ে ধর্মকে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে চায়; ধর্মকে তারা নিজস্ব ইচ্ছা বা কল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি করতে চায়। পৃথিবীতে যুগে যুগে কিতাবধারীদের মধ্যে আল্লাহ্র মূল বাণীর বা ধর্মের যে বিকৃতি ঘটেছে তার একমাত্র কারণই হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ধর্মকে বিকৃতি করার প্রবণতা। যুগে যুগে ধর্মের বিকৃতির মূল কারণই হচ্ছে কিছু লোকের স্বার্থপরতা। কিন্তু এ কথা তারা বুঝতে অক্ষম যে ধর্মকে ভাড়া খাটানো যায় না।
১৬। বল, : "যদি আল্লাহ্র ইচ্ছা হতো, আমি ইহা তোমাদের নিকট আবৃত্তি করতাম না, এবং তিনি তোমাদের এ সম্বন্ধে কোন কিছু জানাতেন না ১৪০৩। এর পূর্বে আমিতো সুদীর্ঘ জীবন কাল তোমাদের মাঝে কাটিয়েছি। (তবুও কি) তোমরা বুঝতে পারবে না ১৪০৪?"
১৪০৩ : সমস্ত বিশ্ব-প্রকৃতি, আকাশ নভোমন্ডল সবই আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়। আল্লাহ্ তার ইচ্ছা বা প্রত্যাদেশকে মানুষের কাছে প্রকাশ করতে চান, আর এই প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছেন তাঁর মনোনীত নবী ও রসুলেরা। আল্লাহ্র অপার করুণা যে, তিনি তার ইচ্ছাকে আমাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের কল্যাণের জন্য আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্র নিদর্শন বা প্রত্যাদেশই হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছা বা আমাদের জীবন পথের পথ প্রদর্শক- যা আমাদের জীবনে ক্যলাণ ও শান্তি বয়ে আনবে। তাঁর নির্দ্দেশিত পথ অবলম্বনের ফলে আমাদের আত্মিক উন্নতি ঘটবে যার ফলে আমাদের ইহকাল ও পরকাল শান্তিতে ভরে যাবে। এই 'শান্তি' পাওয়া জীবনের পরম ও চরম পাওয়া। আল্লাহ্র হেদায়েতের জন্য তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
১৪০৪ : হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সা) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে শৈশব থেকে পৌঢ়ত্ব পর্যন্ত কোরেশদের মধ্যে ছিলেন। আরবদের সেই সময়কার কুলষিত জীবন ধারণ প্রণালীর মধ্যে থেকেও মুস্তফার (সা) জীবন ছিল পূত-পবিত্র এবং স্বর্গীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ। সম-সাময়িক কোরেশরা তাঁর চরিত্রের এ দিকটি সম্যকভাবেই অনুধাবন করেছিলো- সে কারণেই তারা তাঁকে "আল-আমীন" বা বিশ্বাসী নামকরণ করেছিলো। কোরেশরা ভালোভাবেই জানতো যে, তিনি তাঁর লোকদের, তাঁর জাতিকে কতটা ভালোবাসেন। তাদের মঙ্গলের জন্য মুহম্মদ (সা) কতটা নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তার পরেও যখন তিনি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত করেন, তাদের পাপ কার্যকে সুনির্দ্দিষ্ট করেন এবং প্রচার করেন "আল্লাহ্র ইচ্ছাকে", কোরেশরা নবীর (সা) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে সম্যক অবহিত হওয়া সত্বেও তাঁকে ও তাঁর প্রতি প্রেরিত আল্লাহ্র বাণীকে অস্বীকার করে। হযরত মুহম্মদ (সা) কোরেশদের নিকট বারে বারে আবেদন করেছেন, "আমি তো এর পূর্বে তোমাদের মাঝে জীবনের দীর্ঘকাল অবস্থান করেছি তবুও কি তোমরা বুঝতে পারবে না।" । - অর্থ্যাৎ আল্লাহ্র বাণী অনুধাবন ও তাঁর নির্দ্দেশিত পথ অবলম্বনের এই সুবর্ণ সুযোগ কোরেশরা বুঝতে পারছে না।
১৭। যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা আরোপ করে, অথবা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, তাঁর থেকে বেশী পাপ আর কে করে? কিন্তু যারা পাপ করে তারা কখনই (আধ্যাত্মিক) সফলতা লাভ করবে না।
১৮। আল্লাহ ব্যতীত তারা তাদেরই আনুগত্য করে যারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, অথবা কোন উপকারও করতে পারে না, এবং তারা বলে, "এরা হচ্ছে আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সুপারিশকারী"। বল, "তোমরা কি আল্লাহকে নভোমন্ডল ও পৃথিবী সম্বন্ধে এমন কিছু জানাতে চাও যা তিনি জানেন না? ১৪০৫। তিনি মহান, পবিত্র। ওরা [তাঁর সম্বন্ধে] যাকে শরীক করে তা থেকে তাঁর অবস্থান বহু উর্দ্ধে"।
১৮। আল্লাহ ব্যতীত তারা তাদেরই আনুগত্য করে যারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, অথবা কোন উপকারও করতে পারে না, এবং তারা বলে, "এরা হচ্ছে আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সুপারিশকারী"। বল, "তোমরা কি আল্লাহকে নভোমন্ডল ও পৃথিবী সম্বন্ধে এমন কিছু জানাতে চাও যা তিনি জানেন না? ১৪০৫। তিনি মহান, পবিত্র। ওরা [তাঁর সম্বন্ধে] যাকে শরীক করে তা থেকে তাঁর অবস্থান বহু উর্দ্ধে"।
১৪০৫ : যখন কেউ বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কিছুর এবাদত করে এবং বিশ্বাস করে যে, এসব নিষ্প্রাণ বস্তু বা প্রতীক তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে সুপারিশ করবে, তখন তাঁদের আত্মার মাঝে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্র রহমত ও করুণা অনুধাবন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। কিভাবে নিষ্প্রাণ কাঠের টুকরা (তৈরী মূর্তি) বা পাথরের খন্ড (তৈরী প্রতিমা) বা মৃত লোকের মাজার আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম এবং আল্লাহ্র কাছে সুপারিশ করতে সক্ষম? বা কিভাবে মৃত লোকের মাজারে আবেদন নিবেদন করলে তা আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছাবে? মৃত ব্যক্তি, বা যতবড় পূণ্যবান-ই হোন না কেন একমাত্র নবী করিম (সা) ব্যতীত আর কাউকে এমন সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হয় নাই। সাধারণ লোক এ কথা বুঝতে অক্ষম, যে ব্যক্তি (মৃত), সে নিজে আল্লাহ্র করুণার প্রত্যাশী তিনি কিভাবে অন্যের জন্য আল্লাহ্র করুণা বরাদ্দ করতে সক্ষম হবেন? এই সুরা (১০:৩) আয়াতে এই কথাই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর পূণ্যবান ব্যক্তিদেরও সাধ্য নাই বা ক্ষমতা নাই আল্লাহ্র কাছে সুপারিশ করার। যদি কেউ দাবী করে যে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা বিদ্যমান, তাঁর সুপারিশ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য, তবে অবশ্যই সে মিথ্যার কল্পনা করে এবং তার কল্পনার মূর্তি আল্লাহ্র জানা নাই। "পৃথিবীর এমন কিছু সংবাদ দিবে যা তিনি (আল্লাহ্) জানেন না?" কিন্তু আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছুই আল্লাহ্র নখদর্পনে। দৃশ্য -অদৃশ্য, প্রকাশ্য গোপন সবাই তাঁর কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্ট। সুতারাং আল্লাহ্র আগোচরে কিভাবে তাদের এবাদতের বস্তুরা ক্ষমতাবান হতে পারে?
১৯। মনুষ্য সম্প্রদায় ছিলো একই জাতি ১৪০৬। কিন্তু (পরবর্তীতে) মতভেদের সৃষ্টি হয়। তোমরা প্রভুর পূর্ব ঘোষণা না থাকলে, তাদের মত পার্থক্যের মীমাংসা হয় যেতো ১৪০৭।
১৪০৬ : দেখুন সূরা [২:২১৩] আয়াত। কবির কথায় বলতে হয়, "জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মানুষ জাতি।" কুর-আনের এই আয়াতে সেই কথাই ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ সকল মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি, সাদা, কালো, আর্য-অনার্য সকলের জন্য সমান। সকল মানুষই তার নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে পরমাত্মার অংশ ধারণ করে। তার আত্মা পরমাত্মার অংশ [১৫:২৯]। এই আত্মার উন্নতি লাভ করা সকল মানুষের জন্য ফরজ, আর আল্লাহর কর্তৃক নির্দ্দেশিত পথও সকল মানুষের জন্য এক। এই পথ সাদা-কালো, সকলের জন্য সমান। আর এই নির্দ্দেশিত পথই হচ্ছে আল্লাহর প্রেরিত বাণী যা যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছে। যুগে যুগে আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ হচ্ছে, এক আল্লাহ্তে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সত্য পথ অবলম্বনের মাধ্যমে জীবন ধারণ করা। কিন্তু যুগে যুগে মানুষের স্বার্থপরতা এবং আত্মম্ভরীতার ফলে আল্লাহ্র বাণীর বিকৃতি ঘটেছে। মানুষে মানুষে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে, মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন জাতি, গোত্রের উদ্ভব ঘটেছে। আল্লাহ্ পরম করুণাময়। মানুষের সৃষ্ট এই জাতিগত পার্থক্য সত্বেও যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মাঝে আল্লাহ তাঁর দূতদের প্রেরণ করেছেন; তাদের সংস্কৃতি, পরিবেশ ও মানসিকতার উপযোগী করে। এসব লোকেরা বা জাতি যেনো আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে, আল্লাহ্র দেয়া নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করে, তাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। তারা যেনো অমূল্য গুণরাজি ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আত্মাকে উন্নত ও উদ্ভাসিত করতে পারে। দেখুন সূরা [৫:৪৮] আয়াত।
উপদেশ : এই আয়াতগুলি [২:২১৩; ৫:৪৮; ১০:১৯] থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীতে আমাদের আগমনের একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন। চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমেই একমাত্র আত্মিক উন্নতি সম্ভব। আর এই গুণাবলী অর্জনের সব নির্দ্দেশ আছে আল্লাহ্র বাণীর মাধ্যমে। এবং যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে তা প্রেরণ করা হয়েছে তাঁর দূতদের মাধ্যমে। যারা তা অনুসরণ করে তারাই ইহলোকে ও পরলোকে সমৃদ্ধশালী হয়, সুখ ও শান্তির অধিকারী হয়।
১৪০৭ : 'কথা' বা 'ঘোষণা' সম্পর্কে দেখুন সূরা : [৬:১১৫], [৯:৪০] এবং সূরা [৪:১৭১]। সমস্ত পৃথিবীব্যাপী আল্লাহ্ মানুষ জাতিকে একটি জাতি হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। [দেখুন টিকা ১৪০৬] তবুও তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতভেদের দরুণ তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রত্যেকেই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। পরম করুণাময় আল্লাহ্ মানুষের এই পার্থক্য দূর করে তাদের মধ্যে সমতা আনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁর এই বিশ্বজনীন ইচ্ছাই হচ্ছে "ঘোষণা" । আল্লাহ্ আদম সন্তানকে ধর্মানুরাগে ও চারিত্রিক গুণাবলীতে গুণান্বিত হতে সাহায্য করেন তার পথ নির্দ্দেশ বা বাণীর মাধ্যমে। একমাত্র ধর্মানুরাগ ও চারিত্রিক গুণাবলীই মানুষকে পরস্পরের সমকক্ষ করতে পারে ও নিকটবর্তী করে। অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, পরস্পরের মধ্যে মতভেদ বৃদ্ধি করে ও দুস্তর ব্যবধানের সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন আত্মিক উন্নতি সাধন করার জন্য, যেনো সে পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। সমস্ত মানুষ জাতির সৃষ্টির এই একটাই উদ্দেশ্য, এখানেই সকল মানুষ সকল জাতি এক সমতলে অবস্থিত। আর এই আত্মিক উন্নতি লাভের একটাই পথ, আর তা হচ্ছে ধর্মানুরাগ ও চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন। মানুষ সৃষ্টির লগ্নেই আল্লাহ্ এই বিশ্বজনীন ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এবং তার জন্য এক নির্দ্দিষ্ট স্থায়িত্ব কাল নির্ধারণ করেছেন। অন্যথায় সাথে সাথেই " তাদের মত পার্থক্যের মীমাংসা হয়ে যেতো।"
২০। তারা বলে, "তার প্রভুর নিকট থেকে তার নিকট কোন নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন?" বল, "কেবলমাত্র আল্লাহ-ই অদৃশ্যের সংবাদ অবগত। তাহলে তোমরা অপেক্ষা কর: আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করবো'' ১৪০৮।
১৪০৮: যারা কাফের তারা আfল্লাহ্র অস্তিত্বে বা পরকালে বিশ্বাস করে না। যদিও তারা দাবী করে যে, " কোন নিদর্শন" পেলে তারা তাদের বিশ্বাস বা ঈমান আনবে, এ কথা সত্য নয়। এটা তাদের একটি ভান বা বিশ্বাস না করার একটা কৌশল মাত্র। কারণ সারা বিশ্ব প্রকৃতি জুড়েই আল্লাহর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। আকাশ, বাতাস, তরু-লতা, জীব জগৎ সবই তার জ্ঞান, প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। তারা যা চায় তা হচ্ছে অদৃশ্য জগতের খবর। পার্থিব জগতে যেমন বই এর পৃষ্ঠা খুললেই জ্ঞানের ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া যায় তারাও চায় ভবিষ্যতের ভান্ডারে কি সঞ্চয় আছে, আল্লাহ্র নবী আল্লাহ্র কাছ থেকে তা জেনে তাদের বলুক। তারা মূর্খ, তাই তারা বুঝতে পারে না- এই বিরাট মহাবিশ্ব বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে। বর্তমানের বৈজ্ঞাকি সত্যতা এই যে, দশমাত্রা পর্যন্ত বস্তুর অস্তিত্ব সম্ভব যেখানে আমরা বাস করি ত্রিমাত্রিকি জগতে। এই ত্রি-মাত্রার বাইরের যে জগত তা আমাদের চোখে অদৃশ্য। মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতা খুবই সীমতি। এই সীমিত জ্ঞান ও ক্ষমতা নিয়ে সে আল্লাহ্র অদৃশ্য জগতের সংবাদ চায়। কিন্তু এই পার্থিব দেহ ধারণ করে কিছুতেই তার পক্ষে মানুষের জ্ঞান ও যুক্তির অতীত রহস্য ধারণ করা সম্ভব নয়। সুতারাং তারা অপেক্ষা করুক। এই আয়াতে কাফেরদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে, এবং মোমেন বান্দারাও অপেক্ষা করে। কিন্তু এই দুদলের কোন কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা দুধরণের। দেখুন সূরা [৬:১৫৮] এবং [৯:৫২] আয়াতে।
২১। দুঃখ দুর্দ্দশা মানুষকে স্পর্শ করার পরে যখন আমি তাদের কিছু অনুগ্রহের আস্বাদন করাই, দেখ (তখন) তারা আমার নিদর্শনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে! বলঃ "পরিকল্পনায় আল্লাহ্ অধিক দ্রুততর!" অবশ্যই আমার বার্তাবাহকেরা, তোমরা যে চক্রান্ত কর তা সংরক্ষণ করে ১৪০৯।
১৪০৯: পৃথিবীতে মানুষের স্বভাব ধর্মই হচ্ছে, যখন সে বিপদে পড়ে, তখন সে কায়-মনোবাক্যে, একান্ত আন্তরিকভাবে আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করে। কিন্তু যখনই আল্লাহ তাকে অনুগ্রহ করেন, তাঁর থেকে বিপদ-বিপর্যয় দূর করে দেন, সাথে সাথেই সে আল্লাহ্কে ভুলে যায়। শুধুমাত্র সে যে আল্লাহ্কে ভুলে যায় তাই-ই নয়, সে আল্লাহ্র বিধান বা আল্লাহর ইচ্ছার বিরোধিতা করতে থাকে। এসব লোক মূর্খ এবং হতভাগ্য। হতভাগ্য এইজন্য, তারা বুঝতে অক্ষম যে, আল্লাহ্র বিশ্বজনীন পরিকল্পনা রোধের ক্ষমতা এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে কারও নাই। আল্লাহ্র যা ইচ্ছা তা বাস্তবায়িত হবেই। আল্লাহ্র প্রচন্ড ক্ষমতার সম্মুখে আল্লাহর ইচ্ছার বিরোধিতা করার পরিকল্পনা প্রচন্ড স্রোতের মুখে তৃণখন্ডের ন্যায় ভেসে যায়। ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষমতা ও পরিকল্পনা মহাকালের আবর্তে হারিয়ে যায়। আল্লাহ্র ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়। কিন্তু এসব হতভাগ্যদের নথি আল্লাহ্র কাছে হারিয়ে যায় না। তাদের অবাধ্যতার তালিকা আল্লাহ্র কাছে অনন্তকালের জন্য স্থায়ীভাবে রক্ষিত হয়।
২২। তিনিই তোমাদের স্থলে এবং সমুদ্রে ভ্রমণ করাতে সক্ষম; যেনো তোমরা জাহাজে আরোহণ করলেও; এগুলি আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাসে সহজ স্বচ্ছন্দ গতিতে বয়ে যায় এবং তারা তাতে আনন্দিত হয়। অতঃপর ঝোড়ো হাওয়া এলো এবং চারিদিক থেকে তরঙ্গ (ধেয়ে) আসে, এবং তারা মনে করে তারা উহার দ্বারা পরিবেষ্ঠিত হয়ে পড়েছে, (তখন) তারা আন্তরিক ভাবে আল্লাহ্র প্রতি (তাদের) কর্তব্য নিবেদন করে এবং কেঁদে বলে, "যদি তুমি আমাদের এর থেকে রক্ষা কর তবে আমরা অবশ্যই আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো" ১৪১০।
১৪১০: মানুষের মেধা, জ্ঞান, প্রতিভা, অধ্যবসায় মানুষকে পৃথিবী জয় করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু মানুষের এসব ক্ষমতা মানুষের নিজস্ব নয়, এসব মহান আল্লাহ্র দান। আল্লাহ্ তার নেয়ামত বিভিন্ন বান্দাকে বিভিন্নভাবে দান করেছেন। এ সবের জন্য আমাদের আল্লাহ্র কাছ সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু মানুষ অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ প্রাণী। মানুষের চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি এই আয়াতে সুন্দর একটি উপমার সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। অকুল সমুদ্রে জাহাজ যখন অনুকূল বায়ুতে তার গন্তব্যস্থানের দিকে অগ্রসর হয়, যাত্রীদের হৃদয় তখন আনন্দে ভরপুর থাকে। তাদের দিনগুলি তখন সোনালী ডানাতে ভর করে উড়ে চলে। আল্লাহ্র করুণায় যে তা সম্ভব হয়েছে তা তারা ভুলে যায়। কিন্তু যদি হঠাৎ করে জাহাজটি সামুদ্রিক ঝড়ের মধ্যে নিপতিত হয়, এই সব আনোন্দচ্ছল যাত্রীরা ভয়ে, আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়ে। বিপদের মুখোমুখি, মৃত্যুকে সম্মুখে প্রত্যক্ষ করে তারা একান্তভাবে অনুগত চিত্তে, আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করে। সাধারণ মানুষের প্রবণতা হচ্ছে এ সময়ে তারা আল্লাহ্র নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, তারা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে জীবনের পরবর্তী সময়টা আল্লাহ্র রাস্তায় চলবে। কোন অন্যায় ও অসত্যের আশ্রয় নেবে না। আল্লাহ্র বিধান মত জীবনকে পরিচালিত করবে। দেখুন সূরা [৬:৬৩] আয়াত।
২৩। কিন্তু যখন তিনি তাদের (বিপর্যয় থেকে) রক্ষা করেন, দেখো! তারা উদ্ধতভাবে ন্যায়-কে অস্বীকারের মাধ্যমে পৃথিবীতে সীমালংঘন করে। হে মানব সম্প্রদায়! তোমাদের উদ্ধত্য তোমাদের নিজের আত্মার বিরুদ্ধে (ক্ষতিকারক) হয়ে থাকে ১৪১১ (মূলত এ হচ্ছে) বর্তমানের জীবনকে উপভোগ করা। শেষ পর্যন্ত আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন তোমরা যা করতে সে সত্যকে তোমাদের নিকট প্রকাশ করে দেবো।
১৪১১: মানুষকে আল্লাহ্ যখনই বিপদমুক্ত করেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি হচ্ছে, বিপদ মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা । এই কৃতজ্ঞতা শুধুমাত্র মৌখিক হবে না, হতে হবে তাঁর কাজের মাধ্যমে, তার আচরণের মাধ্যমে। পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হবে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সে আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। তার অহংকার তাকে উদ্ধত করে তোলে। দম্ভ, অহংকারে সে ভুলে যায় পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনের কথা। কত শক্তিশালী নৃপাতি মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতা, শক্তি আজকে শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতাতে বন্দী হয়ে আছে। পৃথিবীর ক্ষমতা, শক্তি, অর্থ, সম্পদ ব্যক্তির জীবনে খুবই ক্ষণস্থায়ী যা শ্বাসত সত্য যা অনন্তকাল স্থায়ী, তা হচ্ছে পরকালের জীবন। এই সত্যকে অনুভব করতে পারবো মৃত্যুর পর যখন আমরা সেই মহান আল্লাহ্র দরবারে নীত হব। কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকবে না। উদ্ধত অহংকারে অন্যের উপরে অন্যায়, অত্যাচার দ্বারা আমরা আমাদের আত্মার যে ক্ষতি করে থাকি তা মৃত্যুর পরে আমাদের সামনে ভাস্বর হবে।
২৪। বর্তমান জীবনের সাদৃশ্য (হচ্ছে) : বৃষ্টি যা আমি আকাশ থেকে প্রেরণ করি ১৪১২। যার ফলে পৃথিবীর গাছপালা ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদগত হয়, যা থেকে মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য আহার প্রস্তুত রাখা হয়। (ইহা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়) যতক্ষণ না ভূমি সোনালী অলংকারে শোভিত হয়ে (সৌন্দর্যে) নয়নাভিরাম হয়। এ সব যাদের করতলগত, তারা মনে করে এগুলির ব্যবস্থাপনার সকল ক্ষমতা তাদের আয়ত্তধীন। (যখন) দিনে অথবা রাতে আমার আদেশ এসে পৌঁছায় (তখন) আমি এমনভাবে তা নির্মূল করি যেনো একদিন পূর্বেও তার (ঘন সন্নিবিষ্ট) অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলো না। এভাবেই আমি আমার নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি যারা চিন্তাশীল তাদের জন্য।
১৪১২: এই আয়াতটিতে অপূর্ব সুন্দর উপমার সাহায্যে পার্থিব জীবনের সুখ-শান্তি, আত্মতৃপ্তি, দম্ভ ও অহংকারের ক্ষণস্থায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর রহমত স্বরূপ। আল্লাহ্র রহমত যেরূপ মৃতপ্রায় আত্মাকে আত্মিক সমৃদ্ধিতে সমৃদ্ধশালী করে; বৃষ্টির পানিও সেরূপ শুষ্ক ধরণীকে সিক্ত করে ধরণীকে ফসল, ফুল, ফল ও অরণ্যতে ভরিয়ে তোলে। ধরণী শস্য শ্যামলা হয়ে ফুল ও ফসলে ভরে উঠে। কারণ আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ হচ্ছে ফসলের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশ। কিন্তু ফসলের মালিকের মনে অন্ধ অহংবোধ জন্ম লাভ করে যে, তাঁর পরিশ্রমের ফলেই সে কৃষি কাজে সফলতা লাভ করেছে। ফসলের প্রাচুর্যের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ দেওয়ার পরিবর্তে, "উহার অধিকারীগণ মনে করে উহা তাদের আয়ত্তাধীন।"- অর্থাৎ তার সম্পদ, প্রাচুর্য, সবকিছু তার নিজস্ব ক্ষমতায় অর্জিত হয়েছে। এখানে বিশ্বস্রষ্টার কোনও ভূমিকা নাই। এই অহংকার বা দম্ভকে ধ্বংস করতে স্রষ্টার এক মূহুর্ত সময়ের প্রয়োজন হয় না। এখানে এই ধারণাটিকে বুঝানোর জন্য সুন্দর একটি উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। তা হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ : যেমন, ক্ষরা, শিলাবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, আগ্নেয়পাত ইত্যাদি যেরূপ এক মূহুর্তে শস্য-শ্যামল ভুমিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে ঠিক সেইরূপ মূহুর্তের মধ্যে মানুষের সম্পদের অহংকার, প্রাচুর্যের অহমিকা, ক্ষমতার দম্ভ মাটিতে মিশিয়ে দিতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র মূহুর্ত সময়েরও প্রয়োজন নাই। সুরম্য অট্টালিকা শোভিত জনপদ, মনোরম উদ্যান, সুপক্ক ফসলের ক্ষেত যে সব বস্তু মানুষের মনে অহংকারের জন্ম দেয় যা তাকে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে বাঁধা দেয়, যা তাকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা বৃদ্ধি করে, তা সবই যে মহান আল্লাহ্র দান, আর তা আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে খুবই ক্ষণস্থায়ী ও নগন্য। আল্লাহ্র শক্তির কাছে মানুষের শক্তি, সামর্থ খুবই অকিঞ্চিতকর ও নগন্য। তার প্রচেষ্টাও ক্ষণস্থায়ী। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পৌরানিক সভ্যতা ও জনপদ, যা আজ শুধুমাত্র ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়বস্তু। আমাদের পার্থিব জীবনকে তুলনা করা হয়েছে ঐ সুপক্ক ফসলের ক্ষেতের সাথে, আল্লাহ্র রহমত ব্যতীত যার অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী। তাহলে কেন আমরা স্থায়ী সুখের ঠিকানাকে অবহেলা করে শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের জন্য চেষ্টা করে যাব?
২৫। কিন্তু আল্লাহ (সর্বদা) শান্তির আলয়ের দিকে আহ্বান করেন ১৪১৩। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথে পরিচালিত করেন।
১৪১৩: পৃথিবীর জীবন-এর চাকচিক্য, সবই ক্ষণস্থায়ী। পৃথিবীর এই জীবনে আমরা ভোগ-বিলাস, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মত্ত থেকে জীবনের দুর্লভ সময়ের অপব্যবহার করি। পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসের আনন্দ কখনও আত্মাকে তৃপ্তি দেবে না, শান্তি বা প্রশান্তিতে আত্মাকে ভরিয়ে দেবে না। কারণ তা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। অর্থ, সম্পদ, সুখ-শান্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি সব কিছু ব্যক্তির জীবনের ক্ষণস্থায়ী রূপ মাত্র। এসব হারাবার ভয়ে তার চিত্ত সর্বদা থাকে উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। ফলে চিত্তের শান্তি হয় বিঘ্নিত। পার্থিব সম্পদের বা ক্ষমতার যে সুখ তা ক্ষণস্থায়ী সুখ। কারণ তা ঐ ফসলের ক্ষেতের মত সর্বদা হারাবার ভয় থাকে। অপর পক্ষে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের যে সুখ বা শান্তি তা স্থায়ী। উপরে ফসলের ক্ষেতের উপমার সাথে পার্থিব ক্ষণস্থায়ী সুখের তুলনা করে, আল্লাহ্ আমাদের স্থায়ী শান্তির ঠিকানায় আহ্বান করেছেন। আল্লাহর আশ্রয় স্থায়ী আশ্রয়। তা হারাবার ভয় নাই, নষ্ট হওয়ার ভয় নাই। না পাওয়ার হতাশা বা দুঃখ আমাদের উদ্বিগ্ন করতে পারে না। আত্মার সাথে বিরাজ করবে অপার শান্তি। এই শান্তির আলয়ে সবার জন্য-ই আছে আল্লাহ্র তরফ থেকে আমন্ত্রণ। তারাই এই শান্তির আলয়ের সন্ধান লাভ করবে যারা পার্থিব জীবনকে-ই জীবনের সর্বোচ্চ মোক্ষ লাভ মনে করবে না। যারা আল্লাহ্র প্রসন্নতা লাভের জন্য চেষ্টা করবে, শুধু তাঁরাই খুঁজে পাবেন সেই শান্তির আলয়ের ঠিকানা। সেই ঠিকানাতে পৌঁছানোর জন্য যে সরল পথের নিশানা, সেই নিশানার সন্ধান তাঁরা লাভ করবেন। "সালাম" বা শান্তি হচ্ছে ইসলামের অপর নাম। ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম- যা আত্মাকে প্রশান্তির পথে পরিচালিত করে। সেই পথ যা আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাসের মাধ্যমে, আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন করতে শেখার ফলে আত্মা শান্তির পরশে আত্ম নিমগ্ন হয়।
২৬। যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য আছে মঙ্গল (পুরস্কার), হ্যাঁ আরও অধিক (অপরিমিত) ১৪১৪। কোন কালিমা বা হীনতা তাদের মুখমন্ডলকে আচ্ছন্ন করবে না ১৪১৫। তারাই হবে জান্নাতের অধিবাসী। (হ্যাঁ) সেথায় তারা চিরদিন থাকবে।
১৪১৪ : যারা মোমেন বা ধার্মিক তারা আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য কাজ করেন। মোমেন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য-ই হচ্ছে তারা অন্যের মঙ্গলাকাঙ্খী। তাঁদের জন্যই আছে আল্লহ্র তরফ থেকে "মংগল" এবং "আরও অধিক" মংগল। অর্থাৎ যারা অপরের মংগলের জন্য কাজ করে তাদের আত্মাকে আল্লাহ্ অপার শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য তারা তাদের আত্মার মাঝে অনুভব করবেন- যার অনুভব ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। ঐ কথাকেই কবি এভাবে বর্ণনা করেছেন।
"পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন প্রাণ সকলই দাও;
তার মত সুখ কোথায় কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।"
১৪১৫ : "মুখন্ডল" কথাটি এখানে ব্যক্তি চরিত্র বা ব্যক্তিত্বকে বুঝানো হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীই প্রাণের অধিকারী। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য হচ্ছে মানুষ এই নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে প্রাণের অস্তিত্ব ব্যতীতও আত্মার অবস্থান অবস্থিত। এই আত্মার চাওয়া-পাওয়াই ব্যক্তির চরিত্রের ব্যক্তিত্বের বহিঃ প্রকাশ। ব্যক্তি যখন স্রষ্টার সান্নিধ্য আত্মার মাঝে অনুভব করে, তখন তার সর্বসত্তা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়ে যায়। বিভিন্ন গুণাবলী ব্যক্তির চরিত্রকে করে মাধুর্য্যমন্ডিত। যে চরিত্র বা ব্যক্তিত্ব গুণে সমৃদ্ধ সেখানে কোনও ভুল-ভ্রান্তি বা পদস্খলনের সম্ভাবনা সামান্য। কারণ আল্লাহ্ তাদের জীবন পথের অন্ধকার দূর করে দেবেন, কোন "কালিমা ও হীনতা তাদের মুখমন্ডলকে আচ্ছন্ন করবে না,"- অর্থাৎ লোভ, হিংসা-দ্বেষ, ইর্ষা, নীচতা, হীনতা, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি জীবনে চলার পথে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে, ফলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যার ফলে তার ব্যক্তিত্ব বা মুখমন্ডলকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। যদি সে ভালো কাজ অর্থাৎ পরের মঙ্গলের জন্য কাজ করে তবে মহান আল্লাহ্ তার দোষ ত্রুটি দূর করে দেবেন; অন্তরের ক্ষোভ, হতাশা সব বিদূরিত করে তাঁর সান্নিধ্যে অন্তরকে উদ্ভাসিত করবেন। যার ফলে চারিত্রিক মাধুর্যে, নৈতিক দিক থেকে ব্যক্তিত্ব হবে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ। তাই যারা অপরের মঙ্গলের জন্য কাজ করে তারা হবে জান্নাতের অধিবাসী।
২৭। কিন্তু যারা মন্দ কাজ করে তাদের পুরস্কার হবে অনুরূপ মন্দ ১৪১৬। অপমান তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলবে। আল্লাহ্র (ক্রোধ) থেকে তাদের রক্ষাকারী কেউই থাকবে না। তাদের মুখ মন্ডল মনে হবে রাত্রির ঘন অন্ধকারের আস্তরণ দ্বারা আবৃত। এরা হলো অগ্নির অধিবাসী; [হ্যাঁ] সেথায় তারা চিরদিন থাকবে ১৪১৭।
১৪১৬: এই আয়াতে বলা হয়েছে যে মন্দ কাজের প্রতিফল মন্দ। অর্থাৎ যারা ইচ্ছাকৃতভাবে অসৎ কার্যকলাপ করে, তারা তাদের অনুরূপ কতৃকর্মের ফল ভোগ করবে। তাদের আত্মা আল্লাহ্র নূর থেকে বঞ্চিত হবে, ফলে জীবনের পদে পদে রীপুর তাড়নায় তারা ভুল পথে পরিচালিত হবে। ফলে তাদের আত্মার মাঝে তারা হীনতা, নীচতা অনুভব করবে, যা তাদের আত্মার মাঝে যন্ত্রণার উদ্ভব করবে। সিদ্ধান্তহীনতা তাদের চিত্তকে অস্থির রাখবে। ভয়, আশঙ্কা তাদের ব্যক্তিত্ব করবে আচ্ছন্ন। পৃথিবীতে এভাবেই তাদের চিত্তের শান্তি তিরোহিত হবে, পরকালের শাস্তিতো পাওনাই রইল। এই আয়াতে "অনুরূপ" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ্র ন্যায় বিচার অত্যন্ত সুক্ষ। অন্যায় ও অসৎ কাজের শাস্তি ততটুকুই বা অনুরূপ হবে যতটুকু অসৎ ও অন্যায় কাজ সে করেছে তার বেশী নয়। তার থেকে একচুলও বেশী নয় বা কম নয়। কিন্তু যে সৎ কাজ বা ভালো কাজ করে, মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে তার পুরস্কার তার কাজের "অনুরূপ" না হয়ে, তা তার কাজের পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। আল্লাহ্র করুণা বা দয়া তার প্রাপ্যকে ছাড়িয়ে তাঁকে পরিব্যপ্ত করবে। কারণ আল্লাহ্ মহান ও পরম করুণাময়।
১৪১৭: "অন্ধকারকে" এখানে আলোর বিপরীত অর্থকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। "অন্ধকার" ও "আলো" এই শব্দগুলি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। "আলো" হচ্ছে আনন্দ ও শান্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা আত্মাকে প্রশান্তি ও 'নির্মল আনন্দে" ভরিয়ে দেয় তাই-ই আত্মিক "আলো" অপরপক্ষে যা আত্মার মাঝে অস্থিরতা, শঙ্কা, ভয়, সিদ্ধান্তহীনতা, অশান্তির জন্ম দেয় তাই-ই আত্মার জন্য "অন্ধকার" স্বরূপ। এই অন্ধকারের গভীরতার স্তর সবার জন্য সমান নয়। এই গভীরতার স্তরকে এই আয়াতে "আস্তরণ" শব্দটি এবং ইংরেজী অনুবাদে "Depth of darkness" বাক্যটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।
২৮। একদিন আমি তাদের সকলকে একত্রিত করবো। অতঃপর যারা (আমার সাথে) শরীক করতো তাদের বলবো, "তোমরা এবং যাদের তোমরা শরীক করেছ, স্ব স্ব স্থানে অবস্থান কর"। আমি তাদের [পরস্পর থেকে] পৃথক করে দেবো। এবং তারা যাদের শরীক করেছিলো তারা বলবে, "তোমরা তো আমাদর উপাসনা করতে না" ১৪১৮।
১৪১৮: মানুষ নানাভাবে নানা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে। এগুলি সবই তার নিজস্ব মনগড়া কল্পনার ফসল। কিন্তু সে তার কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কখনও তার সেই কল্পনাকে নবী রসুলের নামে বা, মহৎ ব্যক্তিত্বের নামে বা আল্লাহ্র নামে চালু করে। এ ব্যাপারে তারা পরস্পর পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। তারা আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পনের পরিবর্তে নিজস্ব মত ও পথের, বা কল্পনাকে পূঁজা করে যা শেরেকী বা আল্লাহ্র সাথে অংশদারিত্ব। যাদেরকে এবাদতের মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা হতো, তারা শেষ বিচারের দিনে তাদের দায় দায়িত্ব অস্বীকার করবে। এই কথাকেই এই আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে "তোমরা তো আমাদের উপাসনা করতে না।" অর্থাৎ এইসব মোশরেকদের এবাদতের বস্তু ছিল তাদের নিজস্ব মনগড়া বস্তু, যা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে উদ্ধার করেছে, যা কুসংস্কার বা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা।
উপদেশ : বাংলাদেশে ও পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশে মুসলমানেরা কুর-আনের আয়াতের নির্দ্দেশকে অনুধাবন না করে, মিথ্যা কুসংস্কার ও নানা ধরণের শেরেকী কার্যকলাপে লিপ্ত। এর কারণ তারা সঠিকভাবে কুর-আন পড়ে না। যেমন বাংলাদেশে ধর্মকে অনুধাবনের জন্য অধিকাংশ লোকে মূল কুর-আনের আয়াতের পরিবর্তে হাদিসের সাহায্য গ্রহণ করে। যেহেতু হাদিস মানুষের রচনা, সেখানে ভুলভ্রান্তি এবং মিথ্যা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা অধিক।
২৯। আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে স্বাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্-ই যথেষ্ট। তোমরা আমাদের যে উপাসনা করতে, অবশ্যই সে সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতাম না ১৪১৯।
১৪১৯: দেখুন পূর্বতী টিকা। fযাদের মুশরেকরা পূঁজা করতো, তারা জানতো না যে তারা পূজিত হচ্ছে।
৩০। (এভাবেই) প্রতিটি আত্মাই যে কর্ম সে (মৃত্যুর) পূর্বে প্রেরণ করেছিলো, তার [ফলাফল] প্রমাণ করে নেবে ১৪২০। তাদেরকে তাদের প্রকৃত অভিভাবক আল্লাহর নিকট ফিরিয়ে আনা হবে এবং তাদের উদ্ভাবিত মিথ্যা তাদেরকে হতাশার মাঝে ত্যাগ করে যাবে ১৪২১।
১৪২০: দেখুন সূরা [২:৯৫] আয়াত। সূরার [২:৯৫] আয়াতে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে "qaddama" এবং এই সূরাতে [১০:৩০] ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে "aslafa" এই দুটি ক্রিয়াপদই প্রায় সমার্থক।
১৪২১: তারা যাদের আল্লাহ্র সমকক্ষ কল্পনা করে আরাধনা করতো, যাদের সাহায্য কামনা করতো, তাদের সেই উপাস্য বস্তু শেষ বিচারের দিনের তাদের কোনও সাহায্যেই আসবে না। তাদের উপাস্যরা তাদের ত্যাগ করে চলে যাবে এবং তারা হতাশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। দেখুন সূরা [৬:২৪] আয়াতে।
রুকু-৪
৩১। (হে নবী) বল : " কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করেন ১৪২২? অথবা কে তিনি যিনি শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তির উপরে ক্ষমতাবান ১৪২৩ ? এবং কে তিনি যিনি মৃত থেকে জীবীতকে এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করে আনেন ১৪২৪? এবং কে তিনি যিনি সকল বিষয়ে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করেন ১৪২৫? তারা শ্রীঘ্রই বলে উঠবে, "আল্লাহ্"। (তাদের) বল, "তবুও কি তোমরা [আল্লাহ্র প্রতি] ধর্মানুরাগ দেখাবে না?"
১৪২২: "জীবনোপকরণ" বলতে শুধুমাত্র আহার্য্য সামগ্রী বুঝায় না। ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আত্মিক অর্থাৎ তার সর্বসত্তা বিকাশের জন্য যত প্রকার উপকরণ প্রয়োজন এখানে জীবনোপকরণ বলতে তাই-ই বোঝানো হয়েছে। শারীরিক বিকাশের জন্য জীবনোপকরণের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে আকাশ থেকে ঝড়ে পড়া বৃষ্টির পানি ও সূর্য্যের আলো- যার সাহায্যে গাছের বৃদ্ধি হয় এবং পৃথিবীর মাটিতে ফসল উৎপাদন হয়। জলে, স্থলে ও আকাশে চলাচলের মাধ্যমের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে জীবনোপকরণ হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য। আর আধ্যাত্মিক জগতের বিকাশের জন্য যে জীবনোপকরণ, তা হচ্ছে আল্লাহ্ প্রেরিত নবী ও রসুলেরা যারা যুগে যুগে মানুষদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পথ প্রদর্শন করে গেছেন।
১৪২৩: মানুষ বিভিন্ন মানসিক শক্তির আঁধার। একমাত্র মানুষকেই এই বিশেষ মানসিক শক্তি বা faculties of mind দেয়া হয়েছে, অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হয় নাই। এই আয়াতে শুধুমাত্র দুটো মানসিক শক্তি যা অতি সাধারণ, তারই উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি। এই দুটো মাত্র উল্লেখ করা হয়েছে অন্য সকল মানসিক শক্তির প্রতীক বা উদাহরণ হিসেবে। মানুষ তার এই সব মানসিক শক্তির সাহায্যে আল্লাহ্র নেয়ামতকে উপভোগ করতে পারে। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ তার চর্ম চক্ষুর বাইরেও হৃদয় দিয়ে অনুভব করার ক্ষমতা রাখে। সাধারণ শব্দের বাইরেও ভাষার মাধুর্য্য, প্রাণের ভাব প্রকাশের ভঙ্গী উপভোগ করে। এভাবেই তার চিন্তার জগৎ অনুভবের জগৎ তার ক্ষুদ্র শারীরিক অনুভূতির সীমা ছাড়িয়ে অসীমে বিস্তার লাভ করে। এই পৃথিবীর পার্থিব ও অপার্থিব সকল নেয়ামত আমরা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে পারি। এই উপভোগের ক্ষমতা আল্লাহ্রই দান। কিন্তু সাধারণ মানুষ আল্লাহ্র এসব নেয়ামতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, তারা এটাকে কোনও ব্যতিক্রম ভাবতে পারে না।
১৪২৪: দেখুন সূরা [৩:২৭] আয়াত এবং টিকা ৩৭১-এ; সূরা [৬:৯৫] আয়াত এবং টিকা ৯২০; এবং সূরা [৩০:১৯] আয়াতে।
১৪২৫: " যিনি সকল বিষয় শাসন নিয়ন্ত্রিত করেন"- এই বাক্যটি দ্বারা পুরো আয়াতটির ভাবকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। সারা বিশ্ব-ভূবন, আকাশ-নভোমন্ডল, সর্ব কিছুর সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিপালন, বিকাশ, নিরাপত্তা, সব কিছুর নিয়ন্ত্রক আল্লাহ্। এই অতি সাধারণ সত্যকে অবহেলা করে আল্লাহ্র উপাসনা ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করা নিতান্ত অর্থহীন নয় কি?
৩২। তিনিই আল্লাহ্, (যিনি) তোমাদের প্রকৃত লালন-পালনকারী। সত্যকে ত্যাগ করার পরে বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কি থাকে ১৪২৬? (তাহলে) কিভাবে তোমরা (সত্য থেকে) ফিরে যাচ্ছ?
১৪২৬: উপরের আয়াতের মাধ্যমে বিশ্ব স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্য্য, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দয়াকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যা কিছু মানসিক দক্ষতা সমূহ, যার জন্য মানুষ গর্ববোধ করে, সবই আল্লাহ্র দান। তিনি-ই একমাত্র উপাস্য। এই সহজ সত্যটি ভুলে যেয়ে কেউ যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করে, তবে তা হবে প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করা, প্রকৃত সত্যকে অসম্মান করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা। এর ফলে ব্যক্তির অন্তর্জগতে বা আধ্যাত্মিক জগতে বিরাট বিপর্যয় ঘটে যাবে। মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা শুধু যে ধর্মীয় বিশ্বাসের বা ঈমানের ভিত্তি-ই দুর্বল করে তাই-ই না, এই ভিত্তি দুর্বল হওয়ার ফলে ব্যক্তির চরিত্র বা আচরণেও বিকৃতি দেখা দেবে, যেমন সুউচ্চ ইমারতের ভিত্তি দুর্বল হলে, ইমারতের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় সেরূপ ঈমান থেকে বিচ্যুতির ফলে, আমাদের আধ্যাত্মিক জগতে ধ্বংস নামে, আমরা ভুল করি, আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হই, আমরা "সরল পথের" ঠিকানা ফেলি হারিয়ে। এখানে তাই প্রশ্ন করা হয়েছে, "কিভাবে তোমরা সত্য থেকে ফেরে যাচ্ছ "?
৩৩। যারা বিদ্রোহী তাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রভুর এই বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, নিশ্চয়ই তারা ঈমান আনবে না ১৪২৭।
১৪২৭: "Every action there is an equal and opposite reaction". বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক নিউটনের এটি একটি সর্বজন বিদিত বৈজ্ঞানিক সূত্র। পৃথিবীতে প্রতিটি কাজেরই প্রতিফল থাকে। ভালো কাজর প্রতিফল ভালো, মন্দ কাজের প্রতিফল অবশ্যই মন্দ। আল্লাহ্ আমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। সুতারাং একমাত্র উপাস্য। এটাই একমাত্র শ্বাসত সত্য। যে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে সে এই শ্বাসত সত্যকে অস্বীকার করে। যা আমাদের বিধিদত্ত স্বভাব প্রকৃতির বিরুদ্ধে। সুতারাং নিউটনের সূত্রমতে, এর একটি প্রতিফল থাকবে বই কি। যেহেতু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্কে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখানো প্রচন্ড অবাধ্যতা, সুতারাং এই অবাধ্যতার প্রতিফল ভয়াবহ হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এই বিরাট বিশ্ব-সংসার আল্লাহ্র নির্দ্দিষ্ট আইনে চলে। আল্লাহ্র প্রতি অবাধ্যতার জন্য যে আইন সে আইন প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই ব্যক্তির জীবনে তা প্রতিফলিত হবে। যদি আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করি বা আল্লাহ্র সাথে অন্য কাউকে 'শরীক' করি তবে আল্লাহ্র আইন বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে, আমরা হয়ে যাব বিভ্রান্ত, এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাসের দীপশিখাটি নিভে যাবে। এর ফলে আমাদের আত্মিক দিক থেকে মৃত্যু ঘটবে। আমাদের হৃদয়ের যে আধ্যত্মিক শক্তি (Spiritual faculty) তা হবে অন্তহৃত। ফলে, " নিশ্চয়ই তারা ঈমান আনবে না।"
৩৪। বলঃ "তোমরা যাদের শরীক কর, তাদের মধ্য কেউ কি আছে যে সৃষ্টি প্রথম আরম্ভ করে এবং পরে তার পুনরাবৃত্তি ঘটায় ১৪২৮। বল : "আল্লাহ্-ই সৃষ্টিকে অস্তিতে আনেন ও পরে পুনরাবৃত্তি ঘটান"। সুতরাং কিভাবে তোমরা [সত্য] বিচ্যুত হয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছ?
৩৫। বল : "তোমরা যাদের শরীক কর, তাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে সত্য পথ প্রদর্শন করতে পারবে?" বলঃ "(একমাত্র) আল্লাহ্-ই সত্য পথ প্রদর্শন করেন। যিনি সত্য পথ দেখান তিনি আনুগত্য অনুসরণে বেশী দাবীদার, না, যাকে পথ না দেখালে পথ পায় না-সে? তোমাদের কি হয়েছে? কিভাবে তোমরা বিচার-বিবেচনা কর?"
৩৫। বল : "তোমরা যাদের শরীক কর, তাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে সত্য পথ প্রদর্শন করতে পারবে?" বলঃ "(একমাত্র) আল্লাহ্-ই সত্য পথ প্রদর্শন করেন। যিনি সত্য পথ দেখান তিনি আনুগত্য অনুসরণে বেশী দাবীদার, না, যাকে পথ না দেখালে পথ পায় না-সে? তোমাদের কি হয়েছে? কিভাবে তোমরা বিচার-বিবেচনা কর?"
১৪২৮: যারা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে অর্থাৎ 'শেরেকী' করে তাদের বিরুদ্ধে এই আয়াতেও সতর্ক বাণী করা হয়েছে, কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে। এই আয়াতে আল্লাহ্ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে তাদের মিথ্যা উপাস্য কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, প্রতিপালন করতে পারে না, রক্ষা করতে পারে না, সৃষ্টিকে পুনরাবর্তন ঘটাতে পারে না, অর্থাৎ তাদের কোনও সৃষ্টিধর্মী গুণ নাই। শুধু তাই-ই নয়, তারা মানুষকে আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখে না। আত্মিক উৎকর্ষতা হচ্ছে মানুষের মনুষ্য জন্মের শেষ পরিণতি। মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের অস্তিত্বের শেষ হয়ে যায় না। এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করে আত্মার যাত্রা শুরু হয় অনন্তলোকে পরম আত্মার সান্নিধ্য লাভের কামনায়। সেই যাত্রা পথের পাথেয় এই পৃথিবীতেই আমাদের সংগ্রহ করতে হয় আত্মিক উৎকর্ষতার মাধ্যমে। এই সব মিথ্যা উপাস্য সে পথ দেখাতে ব্যর্থ। হতে পারেন তিনি দেবতুল্য ব্যক্তিত্ব [যেমন আমাদের দেশে পীর পূজা করা হয়], যদি তিনি তার অনুগামীদের আত্মিক উৎকর্ষতার পথ প্রদর্শন না করে, ভুল পথ প্রদর্শন করেন; তবে তাঁর নিজেরই আল্লাহর পথ নির্দ্দেশ প্রয়োজন। পরের আয়াতে তাই বলা হয়েছে "যিনি (আল্লাহ), সত্যের পথ নির্দ্দেশ করেন তিনি আনুগত্যের অধিকতর হকদার, না যাকে পথ না দেখালে [দেবতুল্য ব্যক্তি] পথ পায় না- সে?" তাহলে কেন মানুষ আল্লাহ্র সাথে শরীক করবে, মনগড়া উপাস্যের অনুগত থাকবে। যখন আল্লাহ্ সকল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্যপথের মালিক। সুতারাং সকল উপাসনা, সকল আনুগত্য আল্লাহ্র প্রাপ্য- তিনিই একমাত্র সত্য।
৩৬। ওদের অধিকাংশই অনুমান ব্যতীত আর কিছুর অনুসরণ করে না। সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না। ওরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ্ অবশ্যই ভালোভাবে অবগত।
৩৭। এই কুর-আন আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, ইহা [কুর-আন] পূর্ববর্তী [প্রত্যাদেশের] অনুমোদন এবং বিধানসমূহের বিশদ ব্যাখ্যা ১৪২৯। এতে কোন সন্দেহ নাই যে এটি বিশ্বভূবনের মালিক আল্লাহ্র নিকট থেকে (অবতীর্ণ গ্রন্থ)।
৩৭। এই কুর-আন আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, ইহা [কুর-আন] পূর্ববর্তী [প্রত্যাদেশের] অনুমোদন এবং বিধানসমূহের বিশদ ব্যাখ্যা ১৪২৯। এতে কোন সন্দেহ নাই যে এটি বিশ্বভূবনের মালিক আল্লাহ্র নিকট থেকে (অবতীর্ণ গ্রন্থ)।
১৪২৯: দেখুন সূরা [৩:২৩] আয়াত এবং টিকা ৩৬৬। আল্লাহ্র বাণী বা পথ নির্দ্দেশ হচ্ছে মানুষের চরিত্রের নৈতিক নীতিমালা। আমরা পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাস আলোচনা করলে দেখতে পাই প্রাচীন যুগ থেকে এ পর্যন্ত মানুষের নৈতিক নীতিমালা একই রয়ে গেছে। কারণ আল্লাহ্র প্রণীত নীতি বা আইন কোনও অবস্থাতেই লঙ্ঘন করা যায় না। সে নীতিমালা যদি প্রকৃতির আইন হয়, তবে এর লঙ্ঘনে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। আর নীতিমালা যদি নৈতিক নীতিমালা হয় তবে তার লঙ্ঘনে আত্মিক জীবনের অগ্রগতি ধ্বংস হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে। পার্থিব জীবনের নৈতিক নীতিমালা আল্লাহ্ যুগে যুগে তার প্রেরিত দূতদের মাধ্যমে,, কিতাবের মাধ্যমে মানুষের জন্য প্রেরণ করেছেন। তার কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই। উদাহরণ : যেমন সত্য কথা বলা আত্মাকে সমৃদ্ধ করে, মিথ্যার অভ্যাস আত্মিক উৎকর্ষতার বাঁধা স্বরূপ, ইত্যাদি। এই নৈতিক নীতিমালা সমূহ সর্বযুগে এক রয়ে গেছে। আত্মিক উৎকর্ষতার পথ নির্দ্দেশ সর্বযুগের জন্য অপরিবর্তনীয়। কুর-আন শুধু পূর্ববর্তী গ্রন্থের সত্যায়ন করে। "অনুমোদন" কথাটির দ্বারা এই কথাই বুঝানো হয়েছে। "বিধান সমূহের বিশদ ব্যাখ্যা"- এই লাইনটির অর্থ, পূর্ববর্তী আল্লাহর কিতব সমূহে যে নৈতিক বিধান সমূহের বর্ণনা আছে তার বিশদ ব্যাখ্যা কুর-আনে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কুর-আন কোনও নূতন গ্রন্থ নয়। ইসলাম কোনও নূতন ধর্ম নয়। ইসলাম সর্বকালের সর্বযুগে সত্য ধর্ম। কুর-আন পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থের সত্যায়নকারী মাত্র।
৩৮। অথবা তারা কি বলে যে, "সে এটা জাল করেছে?" বলঃ "যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে এসো, এবং [তোমাদের সাহায্যের জন্য] আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাকে পার আহ্বান কর ১৪৩০।
১৪৩০ : দেখুন সূরা [২:২৩] এবং টিকা নং-৪২।
৩৯। কেবল তাই নয়, যে জ্ঞান তারা আয়ত্ব করতে পারে নাই, এমনকি যার ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত তাদের নিকট পৌঁছায় নাই, তাকেই তারা মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করলো ১৪৩১। এভাবেই ওদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যার অভিযোগ করেছিলো। কিন্তু দেখো যারা পাপ করে তাদের শেষ পরিণতি কি হয় ১৪৩২।
৪০। ওদের মধ্যে কতক ইহাতে [কুরআনে] বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কতকে করে না। এবং তোমার প্রভু ভালো ভাবেই জানেন কারা অশান্তি সৃষ্টিকারী।
৪০। ওদের মধ্যে কতক ইহাতে [কুরআনে] বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কতকে করে না। এবং তোমার প্রভু ভালো ভাবেই জানেন কারা অশান্তি সৃষ্টিকারী।
১৪৩১: "Taawil" - শব্দটির আক্ষরিক অর্থ : স্পষ্ট করা বা ব্যাখা করা বা সম্পূর্ণ শেষ করা। আল্লাহ্র নির্দ্দেশ শুধু যে আমাদের প্রতিদিনের জীবন ধারণের পথ চলার নির্দ্দেশ দান করে তাই-ই নয়, আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনে, উচ্চতর জীবনের সন্ধান দান করে। এই আয়াতে এই দ্বিবিধ জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। (১) প্রতিদিনের জীবন যাপনের নৈতিক নীতিমালা যা আমাদের নৈতিক চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। এই নীতিমালার জ্ঞান না থাকার দরুণ তারা তা অস্বীকার করে। (২) আবার তারা জানে না আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন প্রণালী মানুষের চরিত্রকে অমূল্য গুণরাজিতে ভরিয়ে দেয় যা হচ্ছে ইহকাল ও পরকালের সুখ শান্তির চাবিকাঠি। আর আল্লাহ্র বিধানকে অস্বীকার করার পরিণামও তারা বুঝতে পারে না। অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্র আয়াতকে অস্বীকার করে, কারণ তারা তার মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারে না। অনুধাবন করতে পারে না, কারণ তারা তা অনুধাবন করতে ইচ্ছুক নয়। জীবনের শেষ পরিণতি এবং সত্য পথের জ্ঞানকে যদি তারা অনুধাবন করতে চাইত তবে অবশ্যই তা তাদের আয়ত্বাধীন হতো।
১৪৩২ : যারা ভ্রান্ত, যারা পাপী তাদের শেষ পরণতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের এই সত্যের প্রতি সাক্ষ্য দান করে। যারা পথ ভ্রান্ত, যারা জীবনে চলার পথে আল্লাহ্ প্রদত্ত নৈতিক মূল্যবোধ পরিহার করে, ফলে আল্লাহ্র নির্দ্দেশকেই অমান্য করে। আধ্যাত্মিক জগতের আইন অনুযায়ী তাদের দূর দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির অভাব ঘটবে, ফলে তারা হয় একগুয়ে ও অবাধ্য এবং অজ্ঞ। তাদের অজ্ঞতার দরুণ তারা কোনও ব্যাপারেই পূর্বাপর চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অপারগ। তাদের অজ্ঞতার দরুণ তারা 'সত্যকে মিথ্যার অভিযোগ করে।" সুতারাং তারা সিদ্ধান্তহীনতা ও আত্মার অস্থিরতায় ভোগে। তাদের ধ্বংস অনিবার্য। এই হচ্ছে জালিমদের শেষ পরিণতি।
রুকু-৫
৪১। যদি তারা তোমাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে, (তবে তুমি) বল : "আমার কাজের দায়িত্ব আমার, এবং তোমাদের কাজের দায়িত্ব তোমাদের ১৪৩৩। আমি যা করি সে বিষয়ে তোমাদের কোন দায়িত্ব নাই, এবং তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমিও দায়মুক্ত।"
১৪৩৩: যারা অবিশ্বাসী তারা আল্লাহর নবী হযরত মুহম্মদের (সা) নিকট প্রেরিত আল্লাহ্র বাণীকে অবিশ্বাস করে এবং নবীকে মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করে। এই আয়াতে এই ঘটনার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের এই অভিযোগের কারণে নবী (সা) তার আল্লাহ্ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ত্যাগ করেন নাই বা কর্তব্যচ্যুত হন নাই। যারা তার কর্তব্যে বাঁধার সৃষ্টি করেছিলো তাদের প্রতি তাঁর উপদেশ ছিল, "আমার কর্মের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কর্মের দায়িত্ব তোমাদের।" আমার কর্মের দায়-দায়িত্বের জন্য আল্লাহ্র কাছে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। অন্য কাউকে নয়। আমি যদি আমার কর্তব্য আন্তরিকভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালন করি তোমাদের প্রত্যাখ্যান বা ভ্রান্তির জন্য আমি দায়ী থাকবো না। তোমাদের কর্মের দায়-দায়িত্বের জন্য তোমাদের আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে- আমার নয়।
উপদেশ : ইসলাম ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বে বিশ্বাসী। একজনের কর্মের প্রতিফলনের জন্য অন্যজন দায়ী থাকবে না।
৪২। তাদের মধ্যে কেহ কেহ তোমার কথা শোনার (ভান করে)। কিন্তু তুমি কি বধিরকে শোনাতে পারবে, যদিও তাদের বোঝার ক্ষমতা না থাকে ১৪৩৪?
৪৩। এবং তাদের কেহ কেহ আছে যারা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তুমি কি অন্ধকে পথ দেখাতে পারবে, যদিও তারা দেখতে না পায়?
৪৩। এবং তাদের কেহ কেহ আছে যারা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তুমি কি অন্ধকে পথ দেখাতে পারবে, যদিও তারা দেখতে না পায়?
১৪৩৪: দেখুন সূরা [৬:২৫, ৩৬, ৩৯] আয়াত এং এর টিকা। যারা হিপ্রোক্রাট বা মোনাফেক তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক রসুলের (সা) বাণী শোনার মানসে তাঁর কাছে গমন করতো। কিন্তু তারা তাঁর উপদেশের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পরতো না, তারা তা বুঝতে পারতো না। ফলে তারা রসুলের বাণী দ্বারা তাদের আত্মিক উৎকর্ষতা লাভ করতে অক্ষম হতো। এর কারণ তারা আল্লাহ্র বাণী শোনা বা বোঝার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। তারা আল্লাহ্র একত্বে ও পরকালের ধারণায় বিস্বস্ত নয়। তারা সত্যকে জানতে আগ্রহী নয়। রসুলের (সা) কথা শোনার ভান করে। ভান করে কারণ তারা শোনার জন্য আন্তরিক নয়। তাই তারা শুনতে পারবে না। তাদের উপমা হচ্ছে, অন্ধ, বা বধির বা মূর্খ লোকের মত। অন্ধকে যেমন আলো দেখানো যায় না, বধিরকে যেমন শব্দ শোনান যায় না, মূর্খকে যেমন জ্ঞান দান করা যায় না- মোনাফেকদের অবস্থাও তদ্রূপ। তাদেরকে সত্য পথে পরিচালিত করা অসম্ভব, কারণ তাদের আন্তরিকতার অভাব।
উপদেশ : কুর-আনের উপদেশ সর্বকালের ও সর্বস্থানের জন্য প্রযোজ্য। মোনাফেকদের যে বর্ণনা রসুলের (সা) সময়ে দেয়া আছে, এরই আলোকে মোনাফেকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অদ্যাবধি বিচার করতে হবে।
৪৪। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মানুষের প্রতি অন্যায় করেন না। বরং মানুষই নিজের আত্মার প্রতি অন্যায় করে ১৪৩৫।
৪৫। একদিন তিনি তাদের সকলকে একত্রিত করবেন। [সেদিন তাদের মনে হবে] দুনিয়ায় তারা যেনো দিনের একটি ক্ষণ মাত্র কাটিয়ে এসেছে ১৪৩৬। তারা (তখন) পরস্পরকে চিনতে পারবে ১৪৩৭। যারা (পরলোকে) আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাত হওয়াকে অসত্য বলেছিলো এবং সৎপথ গ্রহণে অস্বীকার করেছিলো, নিশ্চয়ই তারা হবে ক্ষতিগ্রস্থ।
৪৫। একদিন তিনি তাদের সকলকে একত্রিত করবেন। [সেদিন তাদের মনে হবে] দুনিয়ায় তারা যেনো দিনের একটি ক্ষণ মাত্র কাটিয়ে এসেছে ১৪৩৬। তারা (তখন) পরস্পরকে চিনতে পারবে ১৪৩৭। যারা (পরলোকে) আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাত হওয়াকে অসত্য বলেছিলো এবং সৎপথ গ্রহণে অস্বীকার করেছিলো, নিশ্চয়ই তারা হবে ক্ষতিগ্রস্থ।
১৪৩৫: আল্লাহ্ সুক্ষদর্শী বিচারক। তিনি তার কোনও বান্দার প্রতি সামান্যতমও অন্যায় করেন না। আল্লাহ্ মানুষকে বিভিন্ন মানসিক দক্ষতা দিয়েছেন যেমন : বোঝার ক্ষমতা, জানার ক্ষমতা, অনুধাবন ক্ষমতা, ভালোবাসার ক্ষমতা ইত্যাদি। জীবনকে সুস্থ, সুন্দর, শান্তিময় করার জন্য আত্মাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের উপযোগী করার জন্য আল্লাহ্ যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন, তারা আমাদের সৎ পথের সন্ধান দিয়েছেন, পথ প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ্ সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছেন মানুষকে আত্মিক দিক থেকে পবিত্র, নির্মল ও শান্তিময় করার জন্য। কিন্তু তার একটাই শর্ত। মানব সন্তানকে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করতে হবে স্ব-ইচ্ছায়। এখানেই হবে তার "সীমিত ইচ্ছাশক্তির" ব্যবহার ও পরীক্ষা। যদি কেউ আল্লাহর প্রদর্শিত পথ গ্রহণ না করে, তবে সেটা সে করে স্ব-ইচ্ছায়; যা তার আত্মাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। "বরং মানুষই নিজের আত্মার প্রতি অন্যায় করে।"
১৪৩৬: মৃত্যুর পরে যে জীবন তা হবে অন্তকাল। সেই অনন্তকাল জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর জীবনকে মনে হবে ক্ষণস্থায়ী জীবন মাত্র। মনে হবে দিনের মূহুর্তকাল সময় মাত্র। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের যে সময় তা খুবই অকিঞ্চিত মনে হবে শেষ বিচারের দিনে।
১৩৩৭: "তারা তখন পরস্পরকে চিনবেন", অর্থাৎ শেষ বিচারের দিনে এই পৃথিবীর স্মৃতি আমাদের বহন করে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে, আমাদের চেনা জগতের, আমাদের চেনা পরিচিত জনের বিভিন্ন ক্রিয়া কর্মের স্মৃতি আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে শেষ বিচারের দিনে। ফলে আমরা নিজেদের অপরাধকে সনাক্ত করে আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের মর্ম অনুধাবন করতে সক্ষম হব।
৪৬। আমি যদি ওদের কাছে [দেয়] আমার প্রতিশ্রুতির কিছু অংশ [তোমার জীবদ্দশায়] তোমাকে দেখিয়ে দেই, অথবা [এর আগেই] তোমার আত্মাকে [আমার কাছে] নিয়ে আসি, যে কোন অবস্থায় তাদের প্রত্যাবর্তন হবে আমার কাছে। শেষ পর্যন্ত, তারা যা করে তার সাক্ষী থাকবেন আল্লাহ্ ১৪৩৮।
১৪৩৮: এই আয়াতে আল্লাহ্ নবীকে (সা) নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, ভালো কাজের পরিণাম ভালো এবং মন্দ কাজের প্রতিফল সব সময়েই মন্দ হবে। এটা চিরন্তন সত্য। এখানে নবীকে বলা হয়েছে যে, এই সত্যকে তাঁর সম্মুখে উপস্থাপন করা হবে তাঁর জীবদ্দশায় অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে। তবে এর জন্য সত্যের মর্মবাণীর কোনও পরিবর্তন হবে না। "তোমার জীবদ্দশায় তোমাকে দেখিয়ে দিই"- অর্থাৎ নবীর (সা) পৃথিবীর কাল পূর্ণ করার কথা বলা হয়েছে এখানে। পৃথিবীর জীবনে আমরা অনেক সময়ে দেখি, যারা মন্দ, যারা দুষ্ট, তারা জীবনে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি লাভ করছে। যারা আল্লাহ্র সাক্ষাত, অর্থাৎ পরকালের জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করে, আল্লাহ্ তাদের জন্য পৃথিবীর ভোগবিলাসের জীবনকে আরও বিস্তৃত করে দেন। এ দেখে মোমেন বান্দা বা পূণ্যাত্মারা যেন হতাশ না হয়। কারণ আল্লাহ্র নির্দ্দেশ অবশ্যই কার্যকর হবে। কারণ ভালো, মন্দ সকলকে আল্লাহ্র কাছে ফিরে যেতে হবে। ভালো ও মন্দের শেষ পরিণাম এই পৃথিবীতেই আংশিক পূরণ হয়, যদি তা নাও হয় তবে মৃত্যুর পরে তা অবশ্যই পূরণ হবে। কারণ "তারা যা করে আল্লাহ তার স্বাক্ষী"।
উপদেশ: যদিও আয়াতটিতে নবীকে (সা) সম্বোধন করা হয়েছে তবে এ বাণী চিরন্তন সত্য। ভালো কাজের পরিণাম ভালো মন্দ কাজের পরিণাম মন্দ।
৪৭। প্রত্যেক জাতির জন্য একজন রাসুল [প্রেরণ করা হয়েছে]। যখন তাদের রাসুল আসে, তখন বিষয়টি ন্যায়ের সাথে তাদের মাঝে মীমাংসা হবে এবং তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না ১৪৩৯।
৪৮। তারা বলে, "যদি তুমি সত্য বলে থাক, তবে বল, এই প্রতিশ্রুতি কবে পূর্ণ হবে?"
৪৮। তারা বলে, "যদি তুমি সত্য বলে থাক, তবে বল, এই প্রতিশ্রুতি কবে পূর্ণ হবে?"
১৪৩৯: প্রত্যেক যুগে প্রত্যক জাতির জন্য আল্লাহ্ তাঁর দূতদের প্রেরণ করেছেন পথ প্রদর্শক হিসেবে। তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছেন, তাঁর বাণীর সাহায্যে, তাঁর প্রত্যাদেশের সাহায্যে। যদি আল্লাহ্র দূতদের অস্বীকার করা হয়, আল্লাহ্র বাণীকে গ্রহণ না করে তাকে বিকৃত করা হয়, এবং অপব্যবহার করা হয়, তবে তার সুক্ষ সঠিক এবং ন্যায় বিচার অনুষ্ঠিত হবে শেষ বিচারের দিনে। সেদিন তাদের সামনে থেকে মিথ্যার আবরণ উন্মোচিত হবে, সত্য উদ্ভাসিত হবে। অবিশ্বাসকারীরা বিদ্রূপ করে, "যদি শেষ বিচারের দিন সত্যি হয়, তবে তা কবে আসবে?" আল্লাহ্র নবীর উত্তর ছিল, " যে কোনও সময়ে সেই দিন আসতে পারে। তাকে ত্বরান্বিত বা বিলম্ব করার ক্ষমতা কারও নাই। তোমরা যদি ভেবে থাক সেদিন আমি তোমাদের রক্ষা করবো, বা সেদিন আমার প্রতি তোমাদের ব্যবহারের জন্য তোমাদের ক্ষতি করবো, তবে জেনে রাখ সেদিনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবেন একমাত্র আল্লাহ্ , যার ন্যায়-বিচার হবে অত্যন্ত সুক্ষ। "আমার নিজস্ব ভালোমন্দের উপর আমার কোনও অধিকার থাকবে না।"
৪৯। বল : ''আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন, তা ব্যতীত আমার নিজের ভালো মন্দের উপর আমার কোন অধিকার নাই ১৪৪০। প্রত্যেক জাতির জন্য সময়কে নির্দ্দিষ্ট করা হয়েছে ১৪৪১। যখন তাদের নির্ধারিত সময় আসবে তখন তারা মূহুর্তকালও বিলম্ব বা ত্বরা করতে পারবে না। "
১৪৪০: দেখুন সূরা [৭:১৮৮] আয়াত।
১৪৪১: এই লাইনটি [১০:৪৯] সূরা [৭:৩৪] আয়াতের পুনরাবৃত্তি; তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এই আয়াতের প্রেক্ষাপট হচ্ছে অবিশ্বাসীদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ [দেখুন টিকা ১৪৩৯] নবীর প্রতি। তারা নবীকে (সা) ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতো এই বলে যে পরকাল বলে কোনও জিনিসের অস্তিত্ব কি বিদ্যমান আছে? যদি থাকে, এবং নবী যদি সত্যি সত্যি আল্লাহ্র দূত হন,তবে আল্লাহ্ এবং পরকালে অবিশ্বাসের দরুণ তাদের এই মূহুর্তে ধ্বংস করে দেয়া হোক। সূরা [৭:৩৪] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে তার দরুণ তাদের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রই আল্লাহ্ বলেছেন যে পাপীদের তৎক্ষণাৎ ধ্বংস করা হয় না। প্রত্যেক জাতি এবং নূতন প্রজন্মকে অনুতাপ করে পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য সময় দেয়া হবে। যখন তাদের সময় শেষ হয়ে যাবে; তখন তাদের ন্যায় ও অন্যায়, ভালো ও মন্দ কাজের পরিণাম তাদের সামনে তুলে ধরা হবে এবং সমন্বয় সাধন করা হবে। "মূহুর্তকালও বিলম্ব বা ত্বরা করতে পারবে না" আল্লাহ্ সব কিছুরই সাক্ষী তিনি-ই সর্ব্বজ্ঞ।
৫০। বল : "তোমরা কি ভেবে দেখেছ, - যদি তাঁর শাস্তি, দিবসে বা রজনীতে তোমাদের উপরে আসে ১৪৪২, ইহার কোন অংশ কী পাপীরা ত্বরান্বিত করতে চাইবে?"
৫১। যখন তা প্রকৃতই এসে পড়বে তখন কি তোমরা তা বিশ্বাস করবে? [তখন বলা হবে] : আঃ এখন? এবং [পূর্বে] তোমরা তো ইহাই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে।
৫১। যখন তা প্রকৃতই এসে পড়বে তখন কি তোমরা তা বিশ্বাস করবে? [তখন বলা হবে] : আঃ এখন? এবং [পূর্বে] তোমরা তো ইহাই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে।
১৪৪২: অবিশ্বাসীদের ঠাট্টা, বিদ্রূপ চিরস্থায়ী হবে না। যখন তারা আল্লাহ্র ক্রোধকে প্রত্যক্ষ করতে পারবে, তারা আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়বে। আল্লাহ্র শাস্তি তাদের উপরে হঠাৎ করেই নিপতিত হবে। দিবসে বা রাত্রিতে যে কোনও সময়ে তা ঘটতে পারে। এটা এমন আকষ্মিক হবে যে, তারা যখন একেবারেই আশঙ্কামুক্ত অবস্থায় থাকবে। এ সময়ে কি তারা বলার সাহস পাবে যে "আল্লাহ্র শাস্তি ত্বরান্বিত হউক।"
৫২। অতঃপর পাপীদের বলা হবে : "স্থায়ী শাস্তি আস্বাদন কর ১৪৪৩। তোমরা যা অর্জন করেছ (এখন) তারই বিনিময় দেয়া হচ্ছে মাত্র।"
৫৩। ওরা তোমার নিকট জানতে চায়; এটা কি সত্য?" বল : "হ্যাঁ, আমার প্রতিপালকের শপথ। ইহা অবশ্যই সত্য! তোমরা ইহা ব্যর্থ করতে পারবে না!"
৫৩। ওরা তোমার নিকট জানতে চায়; এটা কি সত্য?" বল : "হ্যাঁ, আমার প্রতিপালকের শপথ। ইহা অবশ্যই সত্য! তোমরা ইহা ব্যর্থ করতে পারবে না!"
১৪৪৩: জালিম অর্থাৎ যারা অন্যায়কারী, তাদের শেষ সময়ের বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। পৃথিবীতে তাদের অন্যায় কর্মফলের প্রতিফল তারা পেতে শুরু করবে। তাদের সে শাস্তি স্থায়ীরূপ লাভ করবে। এই আয়াতগুলিতে অবিশ্বাসীদের মনঃস্ততঃ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে [১০:৪৭] আয়াত থেকে এবং শেষ হয়েছে [১০:৫৩] আয়াতে। আনুপূর্বিক ঘটনা শুরু হয়েছে সার্বজনীন বর্ণনার মাধ্যমে। প্রত্যেক যুগে পৃথিবীতে নবী রসুলদের প্রেরণ করা হয়েছে সাধারণ লোকদের উপদেশ ও সাবধান করে দেওয়ার জন্য। এসব নবী রসুলেরা, আল্লাহ্র শাস্তি, শেষ বিচারের দিন, এবং পৃথিবীর কর্মজগতের, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে শেষ বিচারের দিনে যে সমন্বয় সাধন করা হবে তার সম্বন্ধে লোকদের সাবধান করে দেন। এই সাবধান বাণীর প্রেক্ষিতে উপরের আয়াতগুলিতে কথোপথনের মাধ্যমে অবিশ্বাসীদের মনের ভাবকে প্রকাশ করা হয়েছে। অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্র শাস্তি সম্পর্কে অবিশ্বাস করে এবং এর ফলে তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলে, "এক্ষুণি কেন শাস্তি আমাদের উপরে পতিত হয় না?" উত্তর ছিল আল্লাহ্ তার নির্ধারিত সময়েই শাস্তি দান করবেন। এর পরে বিশ্বাসী বা ঈমানদার ব্যক্তিদের বলা হয়েছে, যখন আল্লাহ্র গজব বা শাস্তি হঠাৎ করে নিপতিত হয় পাপীরা কিভাবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়। তখন কি তারা আবার মনে করে না যে, এই শাস্তি হঠাৎ করে এসেছে? আল্লাহ্র শাস্তি যখন তাদের ঘিরে ধরে, তখন পাপীদের আতঙ্ক অবর্ণনীয়। অন্যায়কারী ও পাপীরা তখন জানতে চায় " এটা কি সত্য?" ইহা অবশ্যই সত্য। এবং তোমরা ইহা ব্যর্থ করতে পারবে না"
রুকু-৬
৫৪। [সেদিন] প্রত্যেকটি পাপ-আত্মা, পৃথিবীর সকল সম্পদ যদি তার হতো, তবে সে সানন্দে তা মুক্তিপণ হিসেবে দিত ১৪৪৪। তারা যখন শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করবে তারা (তাদের) অনুতাপ ঘোষণা করবে ১৪৪৫। কিন্তু তাদের মধ্যে মীমাংসা ন্যায় বিচারের সাথে করা হবে এবং তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না।
১৪৪৪: দেখুন সূরা [৩:৯১] আয়াত।
১৪৪৫: ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে "They would declare (their) repentance/when they see the Chastisement." অধিকাংশ বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে, "যখন উহারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন মনস্তাপ গোপন করবে।" এখানে মনস্তাপ অর্থাৎ অনুতাপ। সুতারাং ইংরেজী অনুবাদ অনুযায়ী "গোপন" কথাটি এখানে প্রযোজ্য নয়। আরবীতে যে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হচ্ছে, "asarru" যার অর্থ "declare" (ঘোষণা) বা "reveal" (প্রকাশ) অন্য অর্থ "Conceal" গোপন বা "hide" (লুকানো)। এখানে কোরানের তফসীরকরণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মওলানা ইউসুফ আলী পূর্বের অর্থটি অধিক প্রযোজ্য মনে করেন। সেভাবে আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় "পাপীরা যখন তাদের সম্মুখে শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তারা তা থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। এমন কি তারা তাদের মান-অপমান, লজ্জ্বা-শরম ভুলে তাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এই কথাকেই "declare their repetance" বাক্য দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। যদি শেষ দুটো অর্থ নেয়া হয়, তবে তাহলে বাক্যটির অর্থ "দাড়ায়" শাস্তি থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য পাপীরা সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু তাদের জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন ব্যাপার হবে সর্বসম্মুখে নিজের পাপকে স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার গ্লানি ও লজ্জ্বা। সুতারাং তারা মনস্তাপ বা অনুতাপকে গোপন করবে।
৫৫। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কি আল্লাহ্র অধিকারভূক্ত নয়? আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি কি নিশ্চিত সত্য নয়? তবুও তাদের অধিকাংশ তা বুঝতে পারে না।
৫৬। তিনিই জীবন দান করেন এবং (জীবন) হরণ করেন। তোমাদের সকলেই তার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।
৫৭। হে মানব সম্প্রদায়। তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে এসেছে উপদেশ এবং তোমাদের অন্তরের [ব্যাধির] ১৪৪৬ উপশম এবং মুমিনদের জন্য পথ নিদ্দের্শ ও রহমত।
৫৬। তিনিই জীবন দান করেন এবং (জীবন) হরণ করেন। তোমাদের সকলেই তার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।
৫৭। হে মানব সম্প্রদায়। তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে এসেছে উপদেশ এবং তোমাদের অন্তরের [ব্যাধির] ১৪৪৬ উপশম এবং মুমিনদের জন্য পথ নিদ্দের্শ ও রহমত।
১৪৪৬: যারা কুফরী ও গুনাহ্ অর্থাৎ অন্যায় ও পাপ করে তাদের অন্তর কলুষিত হয়। ফলে তারা হয় সত্যবিমূখ। আত্মার এই অবস্থাকেই কুর-আন শরীফে "অন্তরে ব্যাধি" শব্দটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। সত্যবিমুখতা ও রীপু দ্বারা তারিত হওয়াই হচ্ছে তাদের আত্মার ব্যাধি যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। কুর-আনের উপদেশ গ্রহণ করলে অন্তর সে ব্যাধিমুক্ত হয়। কারণ কুর-আন হচ্ছে, আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ। পৃথিবীর জীবনে যে জীবন বিধান মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাই আছে কুর-আনের নির্দ্দেশে আর এই বিধান নিজের জীবনে প্রতিফলিত করাই হচ্ছে "আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন" করা। সে জন্য যে কোরানের উপদেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে পারে, সে অন্তরকে ব্যাধিমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। সুস্থ অন্তরে কুর-আনের উপদেশ বা আল্লাহ্র হেদায়েত বা "সত্য" খুব সহজেই অনুপ্রবেশ করে, ফলে তারা আল্লাহ্র করুণা, দয়া ও ক্ষমার যোগ্য হতে পারে। তাই কুর-আন হচ্ছে "মুমীনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত।" আল্লাহ্র হোদেয়ত, রহমত, ক্ষমা এর থেকে বড় পাওয়া মানব জীবনে আর কি থাকতে পারে? পার্থিব সুযোগ-সুবিধা, ধন-ঐশ্বর্য্য সবই আল্লাহ্র রহমত ও ক্ষমার কাছে তুচ্ছ।
৫৮। বল : "ইহা (কুরআন) আল্লাহ্র অনুগ্রহে এবং তাঁর দয়ায় এসেছে, সুতরাং এতে ওরা আনন্দিত হোক" তা হবে তাদের সঞ্চিত (ধন-সম্পদ) অপেক্ষা উত্তম।
৫৯। বল : তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ্ তোমাদের কি জীবনোপকরণ দিয়েছেন? ১৪৪৭, তথাপি তোমরা তার কিছু [জিনিস] হালাল ও কিছু হারাম করেছ।" বল, "আল্লাহ কি সত্যিই তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন না তোমরা আল্লাহ্র প্রতি মিথ্যা আরোপ কর?"
৫৯। বল : তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ্ তোমাদের কি জীবনোপকরণ দিয়েছেন? ১৪৪৭, তথাপি তোমরা তার কিছু [জিনিস] হালাল ও কিছু হারাম করেছ।" বল, "আল্লাহ কি সত্যিই তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন না তোমরা আল্লাহ্র প্রতি মিথ্যা আরোপ কর?"
১৪৪৭: এই আয়াতে "রিযক" শব্দটি আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে "রিযক" হচ্ছে সেই বস্তু জলে, স্থলে আকাশে, উদ্ভিদ জগতে, প্রাণী জগতে, খনিজ সম্পদে ইত্যাদি বিশ্বভুবনে আল্লাহ্ যা কিছু জীবন ধারণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর যা কিছু সৃষ্টি তা হচ্ছে পার্থিব; এই নশ্বর দেহের পুষ্টি, পরিবর্ধন ও আরাম আয়েশের জন্য প্রয়োজন। মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের নশ্বর দেহের বাইরেও আত্মার পুষ্টি বা আত্মিক উন্নতির প্রয়োজন হয়। আত্মার এই পুষ্টি হচ্ছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান যা আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ ও সমুন্নত রাখে, আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে কলুষমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। যা আমাদের জন্য পার্থিব ও আত্মিকভাবে কল্যাণকর, তা আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ্ থেকে আর কেউ বেশী জানেন না। সুতারাং নিজ নিজ খেয়াল খুশীমত কিছু হালাল, কিছু হারাম বলার অধিকার কারও নাই। বিশেষ কোনও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোন বস্তুর উপরে ক্ষণস্থায়ী 'হালাল', 'হারাম' আরোপ করা যায়, কিন্তু আল্লাহ্র নামে ধর্মের নামে স্থায়ীভাবে হারাম বা হালাল বলা অন্যায়। এই আয়াতে 'হারাম', 'হালাল' প্রতীক অর্থে সামাজিক নিয়ম কানুন ধর্মীয় বিধানকে বোঝানো হয়েছে।
উপদেশ : যুগে যুগে ধর্মের নামে ধর্মীয় বিধানকে লঙ্ঘন করা হয়েছে, ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসের মাঝে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে। আজকের মুসলিম সমাজ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত।
৬০। যারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করে, তারা শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে কি চিন্তা করে? ১৪৪৮। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের প্রতি অনুগ্রহে পরিপূর্ণ, কিন্তু তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ ১৪৪৯।
১৪৪৮: "যারা আল্লাহ্ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে"- অর্থাৎ যারা ধর্মের নামে তাদের মনগড়া বিধি-বিধান চালু করতে চায়। যারা তা করে, তারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে শেষ বিচার দিবস সম্বন্ধে তাদের ধারণা কি? তাদেরকে তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৪৪৯: আল্লাহ্ পরম করুণাময় । তাঁর নাম ও অনুগ্রহ অসীম। যা দেহ, মন ও আত্মাকে করে পরিশুদ্ধ সুস্থ ও সুন্দর কিন্তু মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ জীব, সে স্রষ্টার এই অকৃপন দানকে অনুভব করতে পারে না, ফলে তার আত্মার মাঝে স্রষ্টার প্রতি কোনও কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মায় না। উপরন্তু তার ক্ষুদ্র জ্ঞান তাকে অন্ধ অহংকারের পথে পরিচালিত করে; যার ফলে সে মনগড়া মিথ্যার উপরে তার ধ্যান ধারণা স্থাপন করে। তার ধর্মীয় বিশ্বাস পরিণত হয়, মিথ্যা উপাসনায়।
রুকু-৭
৬১। তুমি যে কোন অবস্থায় থাক, এবং তুমি কোরআন থেকে যে কোন অংশ-ই আবৃত্তি কর এবং তোমরা [মনুষ্য সম্প্রদায়] যে কোন কাজ কর, এবং যখন [সে কাজে] সম্পূর্ণ আত্মনিমগ্ন থাক, আমি তোমাদের সাক্ষী থাকি। আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর অণু পরিমাণও তোমার প্রভুর অগোচরে নয়। এবং এসব থেকে ক্ষুদ্রতর অথবা বৃহত্তর কিছুই নাই যা সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা নাই ১৪৫০।
১৪৫০: আল্লাহর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, তার সর্ব সৃষ্টিকে ঘিরে থাকে। তা সদা জাগ্রত, চির অম্লান। সৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ্ প্রকৃতিতে যে সব আইন বা বিধান চালু করেছেন [যাকে আমরা বিজ্ঞানের জ্ঞান বলি] তা সৃষ্টির সেই আদি যুগ থেকে অদ্যাবধি একইভাবে চলে আসছে। একইভাবে আধ্যাত্মিক জগতের জন্য যে নৈতিক নীতিমালা তাও যুগ-কাল অতিক্রান্ত তা চির অম্লান। এখানেই মানুষ অনুধাবন করতে পারবে বিশ্ব স্রষ্টার জ্ঞানের পরিধি ও স্থায়িত্ব- যা তার সর্বসৃষ্টিকে সর্বদা ঘিরে থাকে। বৃহৎ, ক্ষুদ্র, সৃষ্টির প্রতিটি জিনিষই তাঁর জ্ঞাত। "অণু-পরমাণুও তাঁর অগোচরে নয়"। মানুষের নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা আছে। কিন্তু সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব কোনও কাজে আত্মনিমগ্ন থাকলে পারিপার্শ্বিকতা ভুলে যায়। সব কিছুতে খেয়াল করতে অক্ষম। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র সত্তা চির জাগ্রত। আবার মানুষের সীমিত ক্ষুদ্রজ্ঞান আজকে যা বিধিসম্মত ও বিচক্ষণ বলে বিশ্বাস করে, সময়ের ব্যবধানে তাকেই আবার বাতিল ঘোষণা করে। অর্থাৎ মানুষের ক্ষুদ্র সীমিত জ্ঞান নির্দ্দিষ্ট সময়ের প্রক্ষিতে, সুস্পষ্ট-সময়ের ব্যবধানে তা অস্পষ্ট বা মূল্যহীন। আল্লাহ্র বিধান, আল্লাহ্র জ্ঞানরই বহিঃপ্রকাশ, তাই তা চির অম্লান, যুগ কাল অতিক্রান্ত। আবার মানুষের জ্ঞান সবার কাছে সমান বোধগম্য হয় না। বুদ্ধির স্তরভেদে বোধগম্যতার স্তর ভেদ ঘটে। আবার সময়ের ব্যবধানে তার কোনও মূল্য থাকে না। যেমনঃ প্রচীন সভ্যতার রীতিনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, যা সে যুগে ছিলো অপ্রতিরোধ্য, বর্তমানে তা শুধুমাত্র ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়। আল্লাহ্র আইন আল্লাহ্র জ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ। সুতারাং সেখানে কোনও অস্পষ্টতা নাই। সময়ের ব্যবধানেও তা অস্পষ্ট হয় না। তা যুগ কাল অতিক্রান্ত, স্থান ও সময়ের উর্দ্ধে, চির অম্লান। 'Mubin' (clear) বাংলা "সুস্পষ্ট" শব্দটি দ্বারা আল্লাহ্র জ্ঞানের এই সুস্পষ্ট রূপকেই প্রকাশ করা হয়েছে। "আল্লাহ্র বাণীর কোনও পরিবর্তন নাই।"
৬২। জেনে রাখ; আল্লাহ্র বন্ধুদের কোন ভয় নাই ১৪৫১। তারা দুঃখিতও হবে না।
৬৩। যারা ঈমান আনে এবং (সর্বদা) অসৎ কাজের বিরুদ্ধে সতর্ক হয়;
৬৪। তাদের জন্য ইহ জীবনে এবং পরলোক আছে শুভ সংবাদ। আল্লাহ্র বাণীর কোন পরিবর্তন নাই, প্রকৃতপক্ষেই তা হচ্ছে [আধ্যাত্মিক] মহা সাফল্য।
৬৩। যারা ঈমান আনে এবং (সর্বদা) অসৎ কাজের বিরুদ্ধে সতর্ক হয়;
৬৪। তাদের জন্য ইহ জীবনে এবং পরলোক আছে শুভ সংবাদ। আল্লাহ্র বাণীর কোন পরিবর্তন নাই, প্রকৃতপক্ষেই তা হচ্ছে [আধ্যাত্মিক] মহা সাফল্য।
১৪৫১: আল্লাহ্র অস্তিত্ব সর্বত্র বিদ্যমান। জলে-স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর অবস্থান। অণু-পরমাণু জিনিষও তার অজ্ঞাত নয়। কিছুই তাঁর অগোচরে নয়। মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলের অপ্রকাশিত চিন্তাও তার অগোচরে থাকে না। সব কিছুই তাঁর নখদর্পনে। পাপীদের আল্লাহ্কে ভয় করার কারণ এই একটাই। যারা পূণ্যাত্মা বা মোমেন বান্দা তাঁদের এই পৃথিবীতে বা পরলোকে কোথাও ভয় নাই। পূণ্যাত্মা বা মোমেন বান্দা তারাই যারা 'তাকওয়া' অবলম্বন করে। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র সন্তুষিটর জন্য সর্বদা মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে তারাই তাকওয়া অবলম্বনকারী।
৬৫। তাদের কথা তোমাকে যেনো দুঃখ না দেয় ১৪৫২। সকল ক্ষমতা ও সম্মান আল্লাহ্র অধিকারভূক্ত। তিনিই (সব কিছু) শোনেন এবং জানেন।
১৪৫২: এই আয়াতটিকে যদিও রসুলকে (সা) সম্বোধন করা হয়েছে, তবুও তাঁর আবেদন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। যারা পূণ্যত্মা, কখনও কখনও তাঁরা পাপী ও দুষ্ট লোকের কথা, মন্দ বাক্য, গালাগালি, বা বিদ্রূপে মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের দুঃখিত বা রাগান্বিত হওয়ার কারণ নাই। কারণ দুষ্টদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নাই। সমস্ত ক্ষমতার উৎস আল্লাহ্। সুতারাং তারা পূন্যাত্মাদের সত্যিকারভাবে অসম্মান করার ক্ষমতা রাখে না। মানুষের যা সম্মান তা আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত।
৬৬। দেখো, অবশ্যই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যত সৃষ্ট বস্তু আছে সবই আল্লাহ্র অধিকারভূক্ত। যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে "শরীকরূপে" উপাসনা করে, তারা কিসের অনুসরণ করে? তারা তো শুধু কল্পনারই অনুসরণ করে এবং মিথ্যা ব্যতীত আর কিছু বলে না ১৪৫৩।
১৪৫৩: এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা এক আল্লাহ্। সূদুর নভোমন্ডলে, পৃথিবীতে, আকাশে-বাতাসে, জলে-স্থলে, অন্তরীক্ষে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র সৃষ্টি। তিনিই তাদের সবার প্রভু ও উপাস্য। যদি কেউ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনা করে তবে তারা তা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে। আল্লাহ্র সাথে অংশীদারিত্ব করে। এই অংশীদারিত্ব তাদের কল্পনাপ্রসূত এবং মিথ্যা আবিস্কারের ফসল।
৬৭। তোমরা যাতে বিশ্রাম করতে পার [সেজন্য] তিনি তোমাদের জন্য রাত্রি সৃষ্টি করেছেন। এবং [তোমাদের] দেখার জন্য দিনকে সৃষ্টি করেছেন ১৪৫৪। যারা [আল্লাহ্র হেদায়েত] শোনে, অবশ্যই তাদের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।
১৪৫৪: আমাদের পৃথিবীর জীবন পর্যায়ক্রমে দুই পর্বে আবর্তিত হয়। কাজ ও বিশ্রাম। এই দুই পর্বের জন্য আল্লাহ্ আমাদের সময়কেও দুভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। নিরব নিশুতি অন্ধকার রাত্রি হচ্ছে বিশ্রামের জন্য এবং সূর্যালোকিত উজ্বল দিন হচেছ কাজের জন্য নির্ধারিত। "দেখার জন্য" বাক্যটি একটি সুন্দর উপমা। এই বাক্যটির সাহায্যে বুঝানো হয়েছে, দিবাভাগ শুধুমাত্র কাজ করার জন্য নয়, কাজ ব্যতীতও মানসিক দক্ষতা (Faculty of mind) বাড়ানোর জন্যও নির্ধারিত। দেখার প্রয়োজন হয় যেনো আমাদের চিন্তার ক্ষমতা, অনুধাবন ক্ষমতা, সংশ্লেষণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এগুলি হচ্ছে উচ্চতর মানসিক দক্ষতার বিকাশ।
৬৮। তারা বলে : "আল্লাহ্ পুত্র সন্তান গ্রহণ করেছেন!" তিনি মহান পবিত্র। তিনি অভাবমুক্ত। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তারই। এ বিষয়ে তোমাদের কোন সনদ নাই। তোমরা কি আল্লাহ্ সম্বন্ধে এমন কিছু বল যা তোমরা জান না?
৬৯। বল : " যারা আল্লাহ্র সম্বন্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করে, তারা কখনও সফলকাম হবে না ১৪৫৫।"
৭০। এই পৃথিবীর ক্ষুদ্র সুখ-সম্ভোগ এবং তারপরে আমার নিকট হবে তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর কুফরী হেতু আমি তাদের কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাবো।
৬৯। বল : " যারা আল্লাহ্র সম্বন্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করে, তারা কখনও সফলকাম হবে না ১৪৫৫।"
৭০। এই পৃথিবীর ক্ষুদ্র সুখ-সম্ভোগ এবং তারপরে আমার নিকট হবে তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর কুফরী হেতু আমি তাদের কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাবো।
১৪৫৫: কুর-আন শরীফে বহুস্থানে 'সফলকাম' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনধারণে, কর্মক্ষেত্রে, সফলতা ছাড়াও আমাদের জীবনের উচ্চতর পর্যায়ের সফলতা ইঙ্গিত এই শব্দটির দ্বারা করা হয়। বর্তমানে ও ভবিষ্যতে আমাদের স্বাস্থ্য, সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা, সুখ-শান্তি, প্রভাব প্রতিপত্তি, জীবনের সকল ক্ষেত্রের সফলতাকে এই শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়। যে মিথ্যা কথা বলে আল্লাহ্ তাকে পার্থিব ও আধ্যত্মিক জগতের সফলতা থেকে বঞ্চিত করবেন। দেখুন সূরা [৯:৭৭] আয়াত ও সূরা [২৬:২২১, ২২২, ২২৩ আয়াত]। এ সব আয়অতে আল্লাহ্ মিথ্যাবাদীদের পুনঃ পুনঃ সাবধান করেছেন। তারা কখনও সফলতা লাভ করবে না। এই আয়াতে সাধারণ মিথ্যাবাদীদের ছাড়াও বিশেষ মিথ্যাবাদী, যারা আল্লাহ্র নামে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তাদের কথা বলা হয়েছে। মিথ্যাবাদীরা আল্লাহর সকল রহমত, যা জীবনকে সমৃদ্ধশালী করে, তা থেকেই যে শুধু বঞ্চিত হবে, তাই নয়, 'আল্লাহ' কে নিয়ে যে মিথ্যার সে উদ্ভাবন করে সেখানেও সে সফলতা লাভ করবে না আল্লাহ তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে দেবেনই। মিথ্যাবাদীর জীবন থেকে সফলতা শব্দটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কারণ তারা আল্লাহ্র রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।
রুকু-৮
৭১। ওদের নূহ্- এর বৃত্তান্ত শোনাও ১৪৫৬। দেখো! সে তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিল, " হে আমার সম্প্রদায়! আমার [তোমাদের মাঝে] অবস্থান এবং আল্লাহ্ নিদর্শনকে স্মরণ করা যদি তোমাদের নিকট দুঃসহ মনে হয়, তবুও আমি আমার নির্ভরতা আল্লাহ্র উপর স্থাপন করবো। তাহলে, তোমাদের শরীকদের সাথে তোমাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে চুক্তি স্থির করে নাও ১৪৫৭। পরে যেনো পরিকল্পনা বিষয়ে তোমাদের মনে কোন সংশয় না থাকে। অতঃপর আমার উপরে তোমাদের দন্ডাদেশ দান কর এবং আমাকে কোন অবকাশ দিও না।"
১৪৫৬: হযরত নূহ (আ) এর কাহিনী এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরার জন্য। হযরত নূহ (আ) এর কাহিনীর পূর্ণ বিবরণ আছে সূরা [১১:২৫-৪৮] আয়াতে, এবং অন্যান্য অনেক স্থানেও আছে যেমন সূরা [৭:৫৯-৬৪], সূরা [২৩:২৩-৩২] ; সূরা [২৬:১০৫-১২২] এবং সূরা [৩৭:৭৫-৮২] আয়াতে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাহিনীর ঘটনার মাধ্যমে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : হযরত নূহ এর ধর্ম প্রচার তাঁর সমসাময়িক লোকদের মধ্যে, যারা ছিল অত্যন্ত মন্দ এবং দুষ্ট। তারা নূহের (আ) প্রচারিত ধর্মকে প্রতিহত করে অত্যন্ত মন্দভাবে। কিন্তু হযরত নূহ্ কোনও কিছুকেই ভয় পান নাই। আল্লাহ্র প্রতি একান্ত বিশ্বাস রেখে তিনি আল্লাহ্র বাণী প্রচার করেন; এবং আল্লাহ্ তাঁকে ভয়াবহ বন্যা থেকে রক্ষা করেন। অর্থাৎ যারা আল্লাহর বাণী প্রচারে, বা আল্লাহ্র কাজে অকুতোভয় এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল, আল্লাহ্ তাদের স্বয়ং রক্ষা কর্তা। এই আয়াগুলিতে [১০:৭১-৭৩] এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে।
১৪৫৭: হযরত নূহ (আ) পরিস্কারভাবে ঘোষণা করেন যে, তারা ঐক্যমত্যভাবে তাকে মৃত্যু দন্ডাদেশ দিতে পারে, যদি তারা তাই চায়। তিনি তাদের নিকট অকপটে আল্লাহ্র বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। মৃত্যুকেও তিনি ভয় পান নাই। [উপদেশ : আল্লাহর কাজে সকলেরই হযরত নূহ- এর মত অকুতোভয় হওয়া প্রয়োজন]।
৭২। "কিন্তু তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, [বিবেচনা কর]: আমি তো তোমাদের নিকট কোন পুরস্কার চাই না ১৪৫৮। আমার পুরস্কার আছে শুধুমাত্র আল্লাহ্র নিকট। এবং আমি তো আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনকারীদের (ইসলামে) অন্তর্ভূক্ত হতে আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি।
১৪৫৮: আল্লাহ্র নবীরা আল্লাহ্র বাণী বা উপদেশ প্রচার করতেন মানুষের মঙ্গলের জন্য, সমাজের মঙ্গলের জন্য। এর জন্য তাঁরা মানুষের কাছ থেকে কোন প্রতিদান আশা করেন নাই। বরঞ্চ তাঁরা তাঁদের এই নিঃস্বার্থ কাজের জন্য নির্যাতিত, অপমানিত এমন কি স্বদেশ ও জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হয়েছেন। উপদেশ : যুগে যুগে সত্য পথের পথিকরা মন্দ ও দুষ্ট লোকের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে থাকেন।
৭৩। তারা তাঁকে প্রত্যাখান করে। কিন্তু আমি তাঁকে এবং যারা তাঁর সাথে নৌকাতে ছিলো তাদের উদ্ধার করি এবং তাদের [পৃথিবীর] উত্তরাধীকারী করি পক্ষান্তরে আমার নিদর্শনকে যারা প্রত্যাখান করেছিলো, তাদের নিমজ্জিত করি, ১৪৫৯ তাহলে দেখ, যাদের সতর্ক করা হয়েছিলো [কিন্তু মনোযোগ দেয় নাই] তাদের কি পরিণতি হয়েছিলো।
১৪৫৯: দেখুন সূরা [৭:৬৪] আয়াত।
৭৪। তাঁর [অন্তর্ধানের] পরে তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট [বহু] রাসুল প্রেরণ করি। তাঁরা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এনেছিলো। কিন্তু যারা পূর্বে ইতিমধ্যে প্রত্যাখান করেছিলো, তারা ঈমান আনবে না ১৪৬০। এভাবে আমি সীমা লংঘনকারীদের হৃদয়কে মোহর করে দিই।
১৪৬০: "পূর্বে যারা প্রত্যাখান করেছিলো।" এই বাক্যটি ইঙ্গিত পূর্ণ। এই বাক্যটি থেকে মনে হয় আধ্যাত্মিক জগতের বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটোই বংশপরস্পরায় ধারাবাহিকভাবে চলে আসে। পূর্বে যা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো, তা ছিল পূর্ববর্তী পুরুষদের দ্বারা, তাদের সেই প্রত্যাখ্যানের ধারা তারা পরবর্তী পুরুষেও রক্ষা করে চলে। পৃথিবীর ইতিহাস যুগে যুগে এই সত্যের সাক্ষ্য বহন করে। জালিম সম্প্রদায় আল্লাহ্র করুণাকে উপক্ষো করে, আল্লাহর আইনকে ভঙ্গ করে, আল্লাহ্র বাণীকে প্রতিহত করে। এদের হৃদয়কে আল্লাহ্ "শীলমোহর" করে দেন। তখন আল্লাহ্র করুণা, দয়া বা বাণী কোনও কিছুই তাদের হৃদয়ে পৌঁছাবে না। তাঁদের হৃদয় আধ্যাত্মিক জগতের উপদেশ বুঝতে অক্ষম হবে। দেখুন সূরা [২:৭] আয়াতে এবং এর টিকা। এসব লোকেরা তাদের পূর্ব প্রসূত ধ্যান ধারণার দ্বারা এতটাই আপ্লুত থাকে যে, তারা আল্লাহ্র নবী কি বললেন তার মর্মকথা অনুধাবনের চেষ্টা পর্যন্ত করে না।
৭৫। এরপরে আমি মুসা ও হারূণকে আমার নিদর্শনসহ ফেরাউন এবং তার পরিষদবর্গের নিকট প্রেরণ করি। কিন্তু তারা ছিলো উদ্ধত এবং পাপে নিমগ্ন এবং সম্প্রদায় ১৪৬১।
১৪৬১: হযরত মুসা (আ) হারুণ ও ফেরাউনের কাহিনী কুর-আনের বহুস্থানে বর্ণিত হয়েছে। বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সূরা [৭:১০৩-১৩৭] আয়াতে। এই আয়াতে ফেরাউনের কাহিনীর মাধ্যমে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে তা হচ্ছে : যারা পাপী, যারা দুষ্ট, যারা পাপের পথকে ত্যাগ করতে অপারগ, সত্যকে যারা গোপন করে, তারা আল্লাহ্র নবীকেও মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। আল্লাহ্র নবী, যিনি নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেন, এইসব উদ্ধত অহংকারী অবিশ্বাসী ব্যক্তি তাদের নীচ, হীন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতে দ্বিধা বোধ করে না।
উপদেশ : যে কোনও পূণ্যত্মা লোক, যারা নিঃস্বার্থভাবে অপরের কল্যাণের জন্য আত্মনিবেদন করেন, তারা সব সময়েই মন্দ ব্যক্তিদের দ্বারা একইরকম বাঁধার সম্মুখীন হবেন।
৭৬। যখন আমার নিকট থেকে তাদের কাছে সত্য এলো, তারা বলেছিলো, "অবশ্যই এটা সুস্পষ্ট যাদু।"
৭৭। মুসা বলেছিলো, "সত্য যখন [প্রকৃতই] তোমাদের নিকট পৌঁছালো, তখন সে সম্বন্ধে তোমরা (এরূপ) বললে? যাদু কি এরূপ? যাদুকরো তো [আধ্যাত্মিক] সফলতা লাভ করবে না ১৪৬২।"
৭৭। মুসা বলেছিলো, "সত্য যখন [প্রকৃতই] তোমাদের নিকট পৌঁছালো, তখন সে সম্বন্ধে তোমরা (এরূপ) বললে? যাদু কি এরূপ? যাদুকরো তো [আধ্যাত্মিক] সফলতা লাভ করবে না ১৪৬২।"
১৪৬২: প্রকৃত সত্য এবং যাদু একে অপরের বিপরীত। যাদু মিথ্যা ও প্রতারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত। যা মিথ্যা যা অশুভ তা প্রতারণার সাহায্যে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। কিন্তু তা কখনও স্থায়ী হতে পারে না। সত্য শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হবেই। আপাতঃ দৃষ্টিতে মিথ্যাকে ন্যায় সঙ্গত মনে হলেও তার স্থায়ীত্ব ক্ষণস্থায়ী। সত্যের আলোয় মিথ্যার অন্ধকার দূরীভূত হতে বাধ্য। এ কথা পৃথিবীতে সর্বকালে সর্বযুগের জন্য সত্য।
৭৮। তারা বলেছিলো, "আমাদের পিতৃ পুরুষগণ যা অনুসরণ করতো তুমি কি সে পথ থেকে আমাদের বিচ্যুত করতে এসেছ, যেনো তুমি এবং তোমার ভাই এদেশে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পার? ১৪৬৩। কিন্তু আমরা তোমাদের বিশ্বাস করি না।"
১৪৬৩: বাংলাতে একটি প্রবাদ বাক্য আছে, "আপনি ভালো তো জগত ভালো, আপনি কালো (মন্দ) তো জগত কালো।" অর্থাৎ ভালো ও পূন্যবান লোক সব কিছুর মধ্যই শুভ ও কল্যাণ দেখে থাকে। মন্দ লোক সব কিছুর মধ্যেই ষড়যন্ত্র অবিশ্বাস ও অকল্যাণ আবিস্কার করে থাকে। এই আয়াতে আমরা দেখতে পাই ফেরাউন ও তার লোকেরা আল্লাহ্র নবী হযরত মুসাকেও সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকে রেহাই দেয় নাই। তাদের ধারণা হয়েছিল, হযরত মুসা (আ) উচ্চাশা চরিতার্থ করার জন্য, ক্ষমতার লোভে তাদের মাঝে আল্লাহ্র শক্তি সম্বন্ধে প্রচার করছে, এবং নিজেকে আল্লাহ্র প্রতিনিধিরূপে প্রকাশ করছে; যেনো তিনি মিশরের অধিপতি হতে পারেন। কিন্তু হযরত মুসা (আ) তাদের এই অভিযোগ অস্বীকার করলেন। একই রকমভাবে অবিশ্বাসীরা হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সা) কেও অভিযুক্ত করেছিলেন।
উপদেশ : দুষ্ট লোকেরা কখনও কোনও কিছুতেই শুভ বা মঙ্গল দেখতে অপারগ।
৭৯। ফেরাউন বলেছিলো, "তোমরা আমার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ যাদুকরকে নিয়ে এসো।"
৮০। যখন যাদুকরেরা উপস্থিত হলো, মুসা তাদের বলেছিলো, "তোমরা যা নিক্ষেপ করতে চাও, নিক্ষেপ কর।''
৮১। যখন তারা নিক্ষেপ করেছিলো ১৪৬৪ মুসা বলেছিলো, "তোমরা যা এনেছ, তা যাদু। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা অকার্যকর করে দেবেন। যারা অশান্তি সৃষ্টি করে, আল্লাহ্ তাদের কাজকে সফল করেন না।"
৮০। যখন যাদুকরেরা উপস্থিত হলো, মুসা তাদের বলেছিলো, "তোমরা যা নিক্ষেপ করতে চাও, নিক্ষেপ কর।''
৮১। যখন তারা নিক্ষেপ করেছিলো ১৪৬৪ মুসা বলেছিলো, "তোমরা যা এনেছ, তা যাদু। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা অকার্যকর করে দেবেন। যারা অশান্তি সৃষ্টি করে, আল্লাহ্ তাদের কাজকে সফল করেন না।"
১৪৬৪: যখন যাদুকরেরা তাদের লাঠি ভূমিতে নিক্ষেপ করলো, তাদের যাদু বিদ্যার বলে, লাঠি সাপে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। কিন্তু হযরত মুসার (আ) অলৌকিক ক্ষমতার কাছে তাদের যাদুর খেলা ছিলো ছেলে খেলার সামিল। কারণ মুসার (আ) ক্ষমতার পিছনে আল্লাহ্র ক্ষমতা নিহিত ছিল- যা ছিল প্রকৃত সত্য।
৮২। "পাপীরা যতই ঘৃণা করুক, আল্লাহ্ তাঁর বাণী অনুযায়ী সত্যকে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠিত করবেন।" ১৪৬৫
১৪৬৫: আল্লাহ্র বাণী এবং হুকুমের মধ্যেই ''প্রকৃত সত্য' নিহিত। যাদুকরের যাদুর প্রভাব এক ধরণের কৌশল যা চক্ষুকে প্রতারণা করে, যার অলৌকিকত্বের পিছনে কোনও "প্রকৃত সত্য" নিহিত নাই।
উপদেশ : বাংলাদেশে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বহু ব্যক্তি নিজেকে দাবী করে- যারা নিজেকে পীররূপে প্রতিষ্ঠিত করে। এদের বহুভক্ত বা মুরীদ আছেন। এই আয়াতে আল্লাহ্ সাবধান করে দিয়েছেন যে, যা কিছু চর্মচক্ষুতে অলৌকিক বলে প্রতীয়মান হয় তাই-ই "প্রকৃত সত্য" নয়। একমাত্র "প্রকৃত সত্য' হচ্ছে আল্লাহ্র "বাণী বা হুকুম"- যার মধ্যেই আধ্যাত্মিক জগতের প্রকৃত ক্ষমতা নিহিত। আর আল্লাহর বাণী বা হুকুম লেখা আছে কুর-আনের পাতায়।
রুকু-৯
৮৩। ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গ নির্যাতন করবে এই আশংকায় মুসার সম্প্রদায়ের এক দল ব্যতীত আর কেহ তাঁর প্রতি ঈমান আনে নাই ১৪৬৬। নিশ্চিতই পৃথিবীতে ফেরাউন ছিলো শক্তিশালী এবং যে সকল সীমাকেই লংঘন করতো।
১৪৬৬ : এই আয়াতে "তার প্রতি" কথাটি কোনও কোনও তফসীরকারের মতে কথাটি ফেরাউনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। যদি ফেরাউনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে অর্থ দাঁড়াবে যে, অধিকাংশ ফেরাউনের লোকজন হযরত মুসার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলো না। কিন্তু যাদুকরেরা মুসার অলৌকিক ক্ষমতা দেখে আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলো [৭:১২০] ফেরাউনের স্ত্রী করলেন [৬৬:১১] এবং শেষ পর্যন্ত ফেরাউন [১০:৯০] যদিও তা শেষ মূহুর্তে। কোন কোনও তফসীরকারের মতে "তাহার" শব্দটি হযরত মুসার (আ) পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হবে মুসার (আ) লোক অর্থাৎ ইসরাইলীরা ভীষণ কঠিন হৃদয় লোক ছিল [৭:১২৯] আল্লাহ্র কোনও বাণীই তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করতো না। এমন কি হযরত মুসা যখন তাদের মিশরের দাসত্ব থেকে আল্লাহ্র করুণায় মুক্তি দিতে সমর্থ হলেন, তখনও তাদের খুব অল্প সংখ্যকের হৃদয়েই আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ছিল। খুব কম সংখ্যকই আল্লাহর হুকুম বা বিধানকে ভয় করতো বরং তারা ফেরাউনের দ্বারা সম্মোহিত ছিল, তারা আল্লাহ্ অপেক্ষা ফেরাউনকে ভয় করতো বেশী।
৮৪। মুসা বলেছিলো, " হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি (প্রকৃতপক্ষেই) আল্লাহ্কে বিশ্বাস কর, যদি তোমরা আত্মসমর্পনকারী হও, তবে তাঁর [আল্লাহ্র] উপরে নির্ভর কর।"
৮৫। তারা বলেছিলো, "আমরা আল্লাহ্র উপরে আমাদের নির্ভরতা স্থাপন করলাম। হে আমাদের প্রভু! যারা অত্যাচারী তাদের জন্য আমাদের উৎপীড়নের (শিকার) করো না ১৪৬৭।
৮৬। "এবং তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাদের কাফের সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার কর।"
৮৫। তারা বলেছিলো, "আমরা আল্লাহ্র উপরে আমাদের নির্ভরতা স্থাপন করলাম। হে আমাদের প্রভু! যারা অত্যাচারী তাদের জন্য আমাদের উৎপীড়নের (শিকার) করো না ১৪৬৭।
৮৬। "এবং তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাদের কাফের সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার কর।"
১৪৬৭: "Fitnat" শব্দটি আছে সূরা [৮:২৫] আয়াতে, এবং টিকা ১১৯৮-এ এর বিভিন্ন অর্থের ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এই আয়াতটি পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের প্রার্থনা। যেহেতু তারা দুর্বল, তারা তাদের শক্তিশালী শত্রুর অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করছেন। [উপদেশ : আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। তাঁর সাহায্য পূণ্যাত্মাদের সর্বদা কাম্য হওয়া উচিত]।
৮৭। আমি মুসা ও তাঁর ভাইকে এই প্রত্যাদেশ দ্বারা উজ্জীবিত করলাম, ১৪৬৮ " তোমার সম্প্রদায়ের জন্য মিশরে গৃহ স্থাপন কর এবং তোমাদের গৃহগুলিকে এবাদত গৃহে পরিণত কর এবং নিয়মিত সালাত কায়েম কর এবং যারা বিশ্বাসী তাদের সুসংবাদ দাও।
১৪৬৮: মুসার (আ) প্রতি আল্লাহ্র এই নির্দ্দেশ-সম্ভবতঃ যাদুকরেরা এবং স্বল্প সংখ্যক মিশরী আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পরে দেয়া হয়েছিলো। এ সময়ে হযরত মুসাকে (আ) স্বল্প কিছুদিনের জন্য মিশরে অবস্থান করতে হয়। কারণ তার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল এর কারণ ফেরাউন ইসরাঈলীদের মিশর ত্যাগে অনিচ্ছুক ছিল। বণী ইসরাঈল-এর প্রতি মসজিদে সালাত আদায় করার হুকুম ছিল। কিন্তু ফেরাউনের অত্যাচারের ভয়ে মসজিদে গমন কষ্টসাধ্য হওয়ায় গৃহের নির্দ্দিষ্ট স্থানে সালাত আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহ্র এই হুকুম ছিল স্বল্প সময়ের জন্য, কারণ হযরত মুসার (আ) আগমনের পর থেকে ইসরাঈলীদের মিশরে অবস্থানের মেয়াদ ছিল ক্ষণস্থায়ী
৮৮। মুসা প্রার্থনা করেছিলেন, " হে আমাদের প্রভু! প্রকৃতপক্ষেই তুমি ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গকে পার্থিব জীবনে জাঁকজমক ও সম্পদ দান করেছ ১৪৬৯। সুতরাং হে আমাদের প্রভু সে (মানুষকে) তোমার পথ থেকে ভ্রষ্ট করে। ওদের সম্পদ বিনষ্ট কর ১৪৭০ এবং ওদের হৃদয়কে কঠিন করে দাও, যেনো কঠিন শাস্তি না দেখা পর্যন্ত তারা ঈমান না আনে।"
১৪৬৯। এই প্রার্থনাটি ছিল হযরত মুসার (আ), যার সাথে হারুনও মিলিত হয়েছিলেন। কারণ হযরত হারুন সর্বদা হযরত মুসার সহচররূপে, তার সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতেন। তাদের প্রার্থনাকে সহজভাবে প্রকাশ করলে তা দাড়ায়, "হে আল্লাহ্ আমরা বুঝতে পারি মিশরীয়দের সম্পদ, ঐশ্বর্য্য, পার্থিব চাকচিক্য হিংসার বিষয়বস্তু নয়। কারণ -এ সব বস্তু-ই হচ্ছে জীবনের ক্ষণস্থায়ী সম্পদ। এই ক্ষণস্থায়ী সম্পদের চাকচিক্য মানুষকে মোহমুগ্ধ করে ফেলে, দম্ভ অহংকার তার আত্মাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়। ফলে সে বিপথে পরিচালিত হয়। শুধু যে সে নিজেই একমাত্র পরিচালিত হয় তাই-ই নয়, অন্যকেও পরিচালিত করে। তাদের অহংকার ও দম্ভই তাদের সমস্ত কর্মকে নষ্ট করে, তাদের পতনের কারণ ঘটায়। তাদের ঐশ্বর্য্য, সম্পদ তাদের অন্তরের প্রশান্তি নষ্ট করে দেয়। তাদের অন্তরকে পাষাণে পরিণত করে। এই পাষাণ হৃদয়ে আল্লাহ্র বাণীর মাধুর্য্য অনুপ্রবেশ করতে পারে না। ফলে তারা কখনও আল্লাহ্ নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করবে না, আল্লাহ্তে ঈমান আনবে না, যতক্ষণ না তারা স্বচক্ষে আল্লাহ্র শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।
১৪৭০: এটা একটা ভয়াবহ অভিশাপ। সম্পদ, ঐশ্বর্য্য, আত্মার মাঝে দম্ভ ও অহংকারের জন্ম দেয়। ফলে আত্মার সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যায়। আত্মা ধীরে ধীরে সত্যকে গ্রহণের ক্ষমতা হারায় ও পাষাণের ন্যায় কঠিনে পরিণত হয়ে যায়। সে আত্মায় আল্লাহর নূর প্রবেশ লাভ করে না। এই আয়াতের অভিশাপ হচ্ছে- তাদের এই ঐশ্বর্য সম্পদ তাদেরকে পৃথিবীর চোখে ঘৃণ্য বস্তুতে পরিণত করে দিক, যেনো তারা পৃথিবীতে অনুকরণযোগ্য না হয়ে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। মানুষের হৃদয় হচ্ছে আবেগ অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু। যখন হৃদয় থাকে নির্মল, তখন হৃদয় হয়ে উঠে আবেগ অনুভূতির উৎস। আনন্দ উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা প্রভৃতি হৃদয়কে স্বর্গীয় আলোয় ভরিয়ে দেয়। কিন্তু যখন হৃদয় কঠিন পাষাণের ন্যায় পরিণত হয়, সেই হৃদয়ে বিশ্বাসের স্থান থাকে না, ফলে তাদের আত্মা অবিশ্বাস ও ঘৃণাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কারণ, তাদের আত্মা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ঐশ্বরিক অনুগ্রহ তাদের ধন্য করে না। আল্লাহ্র নূরই হৃদয়কে সুখ-শান্তি, প্রশান্তি, আনন্দ ভালোবাসার জগতে পৌঁছে দিয়ে থাকে। যা অনাবিল শান্তির রাজ্য।
৮৯। আল্লাহ্ বললেন, (হে মুসা ও হারুন) তোমাদের প্রার্থনা কবুল হলো। সুতরাং তোমরা ন্যায় পথে দৃঢ় থাক এবং কখনও অজ্ঞদের পথ অনুসরণ করো না ১৪৭১।
১৪৭১: এখানে হযরত মুসা (আ) ও হারুন ইসরাঈলীদের সম্বোধন করে ফেরাউনের বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিশাপ উচ্চারণ করেন। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম ছিল : পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য ও সম্পদের চাকচিক্যে, পার্থিব জীবনের শোভাতে সম্মোহিত না হয়ে, সত্যের প্রতি অবিচল থাকার নির্দ্দেশ। সত্যের প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও অনুসরণই একমাত্র আত্মার মুক্তি আনতে পারে। যারা পার্থিব জীবনে এবং এর শোভাতে বিমোহিত হবে, তাদের হৃদয়ে সত্যের আলোর অনুপ্রবেশ ঘটবে না। ঐশ্বরিক অনুগ্রহ বঞ্চিত এসব আত্মা পাষাণের ন্যায় কঠিনে পরিণত হবে যা কুর-আনের বহু স্থানে "মোহর করিয়া দেয়া" কথাটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
৯০। আমি ইসরাঈল সম্প্রদায়কে সমুদ্রের ওপারে নিয়ে গিয়েছিলাম। ফেরাউন ও তার সৈন্যদল ঔদ্ধত্য ও আক্রোশের সাথে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলো ১৪৭২। শেষ পর্যন্ত যখন জলপ্লাবনে নিমজ্জিত হলো, সে বলেছিলো, "আমি বিশ্বাস করলাম বনি ইসরাঈলরা যাকে বিশ্বাস করে। নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই ১৪৭৩। আমি [ইসলামের ] আল্লাহ্র আত্মসমর্পনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হলাম।"
১৪৭২: বনী-ইসরাঈলীদের মিশর ত্যাগের পর থেকে সমুদ্র অতিক্রম এবং ফেরাউন এর পশ্চাৎধাবন ও তার আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ, সম্পূর্ণ ঘটনাকে কবিতার কয়েকটি পংক্তির সাহায্যে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১৪৭৩: মৃত্যুকালে ফেরাউন বললো, "তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নাই" অর্থাৎ মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার পর ফেরাউন এক আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো। অবশ্যই তা ছিলো "death bed repentance" বা মৃত্যুপথযাত্রীর কৃত অনুতাপ। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তের অনুতাপ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, সূরা [৪:১৮] আয়াত। কারণ তা সম্পূর্ণ নয়। সম্পূর্ণ নয় এই কারণে যে : অনুতাপ তিনটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। (১) কৃত পাপকে সনাক্ত করা (২) অতীতের কৃত পাপের জন্য অনুতাপ করা ও (৩) ভব্যিতে নিজের চরিত্রকে এমনভাবে সংশোধিত করা যেনো অতীতের পাপের পুণরাবৃত্তি না ঘটে। অর্থাৎ। Repentance with amendment। মৃত্যু পথযাত্রী ফেরাউন (১) নম্বর ও (২) নম্বর ধাপ অতিক্রম করলেও (৩) নম্বর ধাপ অতিক্রম করা সম্ভব হয় নাই। সুতারাং তার অনুতাপ অসম্পূর্ণ। সুতারাং আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। মিশরের ফেরাউনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, রামাসিস-২ ছিলেন হযরত মুসার সময়কার ফেরাউন। রামাসিস-২ সমুদ্রে ডুবে মারা যান বর্তমানে তার ''মমি" পরীক্ষা করে তার দেহে সমুদ্রের পানির লবনাক্ত কণা সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সমুদ্র থেকে রামাসিসের দেহ উদ্ধার করে তৎকালীন মিশরবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী রামাসিকের-২ এর দেহকে মমী করে সংরক্ষিত করা হয় যা বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতাত্বিকেরা মাটি খুড়ে থিবিসের একটি পিরামিড থেকে উদ্ধার করেন। বর্তমানে তা সকলের দেখার জন কায়রোর জাতীয় যাদুঘরে রক্ষিত আছে। যতদিন এই পৃথিবীর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে, ততদিন পৃথিবীর মানবমন্ডলীর সামনে আল্লাহ্ ফেরাউনকে দৃষ্টান্তস্বরূপ রেখে দেবেন। আমাদের নবীর আগমনের পূর্বে, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সমস্ত পৃথিবী যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলো, ফেরাউনের মমীর অস্তিত্বও কেউ কল্পনা করতে পারতো না, সে সময়েই কুর-আন ঘোষণা করে [১০:৯২] আয়াতে যে অবিশ্বাসীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত হয়ে ফেরাউনের দেহ যুগ যুগ ধরে থাকবে। আল্লাহ্র ইচ্ছা, তাঁর ক্ষমতা সর্বোচ্চ। তাঁর ইচ্ছা কিভাবে পূরণ হবে তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের বোধের অগম্য।
৯১। [তাকে বলা হলোঃ] এখন! কিছুক্ষণ পূর্বেও তো তুমি বিদ্রোহী ছিলে! এবং তুমি [উৎপীড়ক এবং] অশান্তি সৃষ্টিকারী ছিলে!
৯২। "আজ থেকে আমি তোমার দেহকে রক্ষা করবো, যেনো তুমি তোমার পরে যারা আসবে তাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ হয়ে থাক। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই আছে যারা আমার নিদর্শন সম্পর্কে অমনোযোগী।"
৯২। "আজ থেকে আমি তোমার দেহকে রক্ষা করবো, যেনো তুমি তোমার পরে যারা আসবে তাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ হয়ে থাক। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই আছে যারা আমার নিদর্শন সম্পর্কে অমনোযোগী।"
রুকু-১০
৯৩। আমি বনী ইসরাঈলীদের মনোরম আবাসস্থলে উপনিবেশ স্থাপন করাইলাম ১৪৭৪। এবং আমি তাদের উত্তম জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে দিলাম। অতঃপর তাদের [দ্বীনের] জ্ঞান প্রদান করার পর তারা [ধর্মীয়] মতভেদে বিভক্ত হলো। তারা যে বিষয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেছিলো, আল্লাহ্ কেয়ামত দিনে অবশ্যই তার ফয়সালা করে দেবেন।
১৪৭৪: আল্লাহ্র রোষে পতিত হয়ে বহুদিন ইহুদীরা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, শেষে আল্লাহ্ তাদের জন্য "ক্যানন" দেশকে মনোনীত করে দেন যার বর্ণনা বাইবেলে আছে [Exod iii 8]। দুধ ও মধুর দেশ বা "a land flowing with milk and honey" এ কথার অর্থ হচ্ছে তারা অবশেষে একটি সমৃদ্ধশালী দেশের অধিকারী হলো। আল্লাহ্ তাদের শুধু যে পার্থিব দিকেই সম্পদশালী করেছিলেন তাই নয়, তাদের আত্মিক উন্নতির জন্য তাদের জন্য যুগে যুগে নবীদের প্রেরণ করেছিলেন; যারা আল্লাহ্র বাণীকে তাদের মধ্যে সমুন্নত রাখেন। এর পরেও ইহুদীরা ধর্ম নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাদের ধর্ম গ্রন্থ তাওরাতে মহানবীর আগমন সম্পর্কে বলা হয়েছে মহানবীর আগমনের পূর্বে, এরা শেষ নবীর উপর বিশ্বাস পোষণ করতো, তার নিদর্শন সমূহ ও তাঁর আগমনের সময় নিকটবর্তী হওয়ার সংবাদ লোকদের বলতো, কিন্তু যখন শেষ নবী (সা) তাঁর যাবতীয় প্রমাণাদি ও তওরাতে বাতলানো নিদর্শনসহ আগমন করলেন, তখন এরা পরস্পর মতবিরোধ করতে লাগলো। কিছু লোক ঈমান আনলেও অন্যান্য সবাই অস্বীকার করলো। "অত:পর তাদের দ্বীনের জ্ঞান প্রদান করার পর তারা [ধর্মীয়] মতভেদে বিভক্ত হলো।" অর্থাৎ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক নেয়ামত পাওয়ার পরেও আল্লাহ্র প্রেরিত ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই বিভেদের একটাই কারণ, আর তা হলো স্বার্থপরতা, অবাধ্যতা ও একগুয়েমী। 'কেয়ামতের দিনে আল্লাহ্ উহার ফয়সালা করে দিবেন।"
উপদেশ : কুর-আনের এই আয়াত শুধুমাত্র সে যুগের ইহুদীদের উপরেই প্রযোয্য নয়। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে যে মতবিরোধ তা উপরের বক্তব্যেরই সমর্থন মেলে।
৯৪। আমি তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, যদি তুমি তাতে সন্দেহ পোষণ কর, তবে তোমার পূর্বের কিতাব যারা পড়েছে তাদের জিজ্ঞাসা কর ১৪৭৫। তোমার প্রভুর নিকট থেকে তোমার কাছে সত্য অবশ্যই এসেছে। সুতরাং যারা সন্দেহচিত্ত তাদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না ১৪৭৬।
৯৫। তাদেরও অন্তর্ভূক্ত হয়ো না যারা আল্লাহ্র নিদর্শনকে প্রত্যাখান করে, তা হলে তুমিও ধ্বংস হয়ে যাবে।
৯৫। তাদেরও অন্তর্ভূক্ত হয়ো না যারা আল্লাহ্র নিদর্শনকে প্রত্যাখান করে, তা হলে তুমিও ধ্বংস হয়ে যাবে।
১৪৭৫: আল্লাহ একমাত্র সত্য। তিনি এক ও অবিনশ্বর। প্রকৃত ধর্মের মূল মর্মবাণী এই একটিই। ধর্ম বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ভাবে প্রকাশ হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ধর্মের সত্য সব সময়েই এক ও অভিন্ন। তাই রসুলুল্লাহ্র (সা) কাছে যখন সত্য ধর্মের প্রকাশ ঘটলো, পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের লোকেরা যারা সত্যিকারভাবে ধর্মের মর্মবাণী বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা আল্লাহ্র রসুল (সা) কে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ফলে ধর্মভীরু লোক যেমন : ইহুদীদের মধ্যে "আবদুল্লাহ্ ইবন্ সালম", খৃষ্টানদের মধ্যে 'ওরকা' অথবা ভিক্ষু বাহিরা ইত্যাদি, যারা মুহম্মদের (সা) আগমনকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। এই আয়াতটি নবীকে সম্বোধন করে প্রকৃতপক্ষে সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির সন্দেহ নিরসনের পন্থা বলে দেয়া হয়েছে।
১৪৭৬: দেখুন সূরা [৩:৬০] আয়াতে এবং টিকা ৩৯৯।
৯৬। নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রভুর বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না ১৪৭৭।
৯৭। যতক্ষণ না তারা তাদের জন্য [নির্ধারিত] ভয়াবহ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, যদিও তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শনকে নিয়ে আসা হয়েছিলো।
৯৭। যতক্ষণ না তারা তাদের জন্য [নির্ধারিত] ভয়াবহ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, যদিও তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শনকে নিয়ে আসা হয়েছিলো।
১৪৭৭: পাপী এবং অবিশ্বাসীদের আল্লাহ্ সর্বযুগে পাপের বিরুদ্ধে সাবধান করে দিয়েছেন। আল্লাহ্র বাণী বা নিদর্শন প্রতি যুগেই মানুষের কল্যাণের জন্য, মানব সন্তানকে পাপ থেকে বিরত থাকার জন্য সাবধান করেছে। এই আয়াতে 'বাক্য' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। 'বাক্য' শব্দটি এখানে আরও গভীরভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্র সাবধান বাণীকে উপেক্ষা করে, তারা বহু মূল্যের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত তা অনুধাবন করতে বাধ্য হয়। শেষ মূহুর্তে তারা যখন শাস্তিকে তাদের সামনে প্রত্যক্ষ করে; তখন তারা তাদের একগুয়ে অবাধ্যতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাধ্য বাধকতার মাধ্যমে আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পন আল্লাহ্র কাম্য নয়। আদম সন্তানকে আল্লাহ্ "সীমিত" স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। সেই ইচ্ছাশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে স্ব-ইচ্ছায় আদম সন্তান আল্লাহ্র কাছে আত্ম সমর্পন করবে, এই হচ্ছে মানুষের কাছে মহান আল্লাহ্র দাবী। এই দাবীকে যে অস্বীকার করে অবাধ্য ও একগুয়ে ভাবে, তার শেষ মূহুর্তের আত্মসমর্পন গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মানুষ সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্যই এখানে ব্যহত নয়। এক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য শাস্তি তাকে বিশ্বাস আনতে বাধ্য করে। যেমন করেছিলো ফেরাউনকে। কিন্তু তা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে "প্রভুর বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে।"
৯৮। [যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিলো] ; ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতীত তাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায়ও কেন হলো না যারা ঈমান আনতো, যেনো তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসতো? ১৪৭৮। যখন তারা ঈমান আনলো, আমি তাদের উপর থেকে বর্তমান জীবনের হীনতাজনিত শাস্তি দূর করে দিলাম, এবং কিছুকালের জন্য [তাদের জীবন] উপভোগ করতে দিলাম ১৪৭৯।
১৪৭৮: পূর্বের আয়াতগুলিতে ফেরাউনের জীবনীর মাধ্যমে এ সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে, আল্লাহ্র শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পরে ঈমান আনা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ঈমানের ফলে তার শাস্তি রহিত হবে না। এই আয়াতে ইউনুস নবীর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, গোনাহগার যদি, আল্লাহ্র শাস্তি আসার পূর্বে অনুতপ্ত হয় তবে আল্লাহ্র কাছে তা গ্রহণযোগ্য। পাপীদের আল্লাহ্ বারে বারে পাপের পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দেন। নিনেভা দেশের লোকেরা যখন পাপে আসক্ত ছিল তাদের নবী হযরত ইউনুস বারে বারে তাদের আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেন, ইউনুস নবীর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সূরা [৩৭:১৩৯-১৪৮] আয়াতে। ইউনুস নবী সম্পর্কে আলোচনা করা হবে সেই সূরার টিকাতে। এই টিকাতে নিনেভা শহরটি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। নিনেভা একটি অতি প্রাচীন শহরের নাম। যার অবস্থান বর্তমান পৃথিবীর মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে : বর্তমানে ইরাকের সমৃদ্ধশালী নগরী মসুল (Mosul) টাইগ্রীস নদীর দক্ষিণ পাড়ে, বাগদাদ থেকে ২৩০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই মসুল নগরীর উল্টোদিকে টাইগ্রীস নদীর উত্তর পাড়ে নিনেভা নগরীর অবস্থান ছিলো বলে মনে করা হয়। এই অবস্থানে দুইটি মাটির টিলা আছে। এর একটি টিলাকে The tomb of Nabi Yunus" বা "ইউনুস নবীর কবর" বলে অভিহিত করা হয়। প্রত্নতত্ববিদরা এখনও এই প্রাচীন শহরটিকে সম্পূর্ণ আবিস্কার করেন নাই। তবে একথা প্রমাণিত যে, এখানে প্রাচীন 'সুমেরাই' শহর অবস্থিত ছিল। সম্ভবতঃ তা ছিল খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ শতাব্দীরও আগে। এই শহরটি ছিল তখনকার আসেরীয় রাজাদের রাজধানী। আসেরিয়ানদেরকে প্রথম সম্রাট সালমানেসার-১ [Shalmaneser] খৃষ্টপূর্ব ১৩০০ শতাব্দীতে রাজত্ব করে। সে সময়ে তিনি ছিলেন পশ্চিম এশিয়ার প্রধান শক্তিশালী রাজা। সালমানেসারের পূর্বে আসেরিয়ানরা বেবীলনের করদ রাজ্য ছিল, কিন্তু সালমানেসারের সময়ে ক্ষমতার চাকা ঘুরে যায়। এ সময়ে বেবীলন আসেরিয়ানদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। দ্বিতীয় পরাক্রমশালী আসেরিয়ান নৃপতি রাজত্ব করেন খৃষ্টপূর্ব ৭৪৫ শতাব্দীতে। এ সময়ে পশ্চিম এশিয়াতে আসেরিয়ানরা আবার প্রধান রাজশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। এই নৃপতির নাম ছিল সেনাচোরিব [Sennacherib খৃষ্টপূর্ব ৭০৫-৬৮১)], তিনি তার জনহিতকর কাজের দ্বারা শহরটিকে সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত করেন। যদি ইউনুস নবীর আবির্ভাবের সময়কে ধরে নেয়া হয়, খৃষ্টপূর্ব ৮০০ শতাব্দী- তবে সে সময়টা হবে প্রথম ও দ্বিতীয় এই দুই শক্তিশালী আসেরিয়ান নৃপতির মধ্যবর্তী সময়, যখন নিজেদের পাপের ফলে আসেরিয়ানদের সমৃদ্ধ শহর ও সভ্যতা ধ্বংসের পাদপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ্র শাস্তি শুরু হওয়ার পূর্বেই তারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দেন, ফলে দ্বিতীয় সেনাচোরিব সম্রাটের সুবর্ণ যুগের সূত্রপাত হয়। আসেরিয়ানদের এই উন্নত সভ্যতা খৃষ্টপূর্ব ৬১২ শতাব্দীতে Scythians (so called Medes) দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
১৪৭৯: প্রথম আসেরিয়ান সম্রাটের সময়ে নিনেভা ছিল একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ও প্রশংসা করার মত নগরী। কিন্তু সময়ের আবর্তনে, এক সময়ে তা পাপের পাঁকে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এটা বেবীলন শহরের মত একটা পাপের আখড়াতে পরিণত হয়। আল্লাহ্ ইউনুস নবীকে শহরবাসীর মধ্যে পাঠান তাদের সতর্ক করার জন্য, যেনো তারা পাপের পথ ত্যাগ করে। যদিও সমস্ত লোকই পাপে নিমজ্জিত হয়েছিলো, তবুও মনে হয় স্বল্প সংখ্যক কিছু ন্যায়বান লোক ইউনুস নবীর সতর্কবাণী গ্রহণ করে। তাদের জন্যই আল্লাহ্ নিনেভাবাসীদের ধ্বংস না করে নতুনভাবে সমৃদ্ধশালী জীবন শুরু করার সুযোগ দান করেন। উপরের টিকার কালক্রম অনুযায়ী তাদের এই গৌরবময় ইতিহাস প্রায় দুইশত বৎসর স্থায়ীত্ব লাভ করে। ইতিমধ্যে আসেরিয়ানরা ধীরে ধীরে আবার পাপে নিমজ্জিত হয়ে পড়, ফলে এক সময়ে এই গৌরবময় সভ্যতা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে যায়। যে বিষয়গুলি এখানে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ্ নিনেভাবাসীদের সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ জীবন যাপনের সুযোগ দান করেছিলেন। সামগ্রিক কথাটি এখানে ব্যবহার করা হলো এজন্য যে, এই শব্দটি এখানে জাতির জন্য প্রযোজ্য হয়েছে- বর্তমান জাতীয় জীবনের জন্য। একথার অর্থ হচ্ছে জাতির সকলেই যদিও আল্লাহ্র রহমত ও করুণা লাভ করেছিলো, তবুও ব্যক্তিগত পাপের দায় দায়িত্ব থেকে কেউ রেহাই পাবে না। পাপের শাস্তি হচ্ছে আত্মিক অবনতি- এই-ই আল্লাহ্র আইন বা বিধান। এর থেকে কারোরই রেহাই নাই- শুধুমাত্র অনুতাপের মাধ্যমেই অব্যহতি পাওয়া সম্ভব। আর এই অনুতাপ হতে হবে ব্যক্তিগত। কারণ পৃথিবীতে আমরা সকলেই ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতায় আবদ্ধ। দেখুন সূরা [৬:১৬৪], [৩৯:৭, ৭০], [৩৫:১৮], [৪২:১৫], [৫৩:৩৮], [৭৪:৩৮] ইত্যাদি। শুধুমাত্র অনুতাপের মাধ্যমেই আল্লাহ্র ক্ষমা ও দয়া লাভ করা যায়।
৯৯। যদি তা তোমার প্রভুর ইচ্ছা হতো তবে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনতো। তবেf কি তুমি ঈমান আনবার জন্য মানুষকে বাধ্য করবে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে? ১৪৮০।
১৪৮০: পৃথিবীতে অসংখ্য জীব-জন্তু, তৃণলতা, গাছ-পালা, অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণী জগত আল্লাহ্র সৃষ্টির স্বাক্ষর বহন করে। মানুষের থেকে এদের পার্থক্য হচ্ছে, এদের কাউকেই আল্লাহ্ মানুষের মত "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দেন নাই। এই সীমতি ইচ্ছা শক্তির জন্যই মানুষ ইচ্ছা করলে ভালোকে গ্রহণ করতে পারে, আবার মন্দকেও বেছে নিতে পারে। কিন্তু প্রাণী বা উদ্ভিদ জগত তা পারে না। স্রষ্টার কাছে এই সীমিত ইচ্ছা শক্তির জবাবদিহিতা সমস্ত প্রাণীকুলের মধ্য একমাত্র মানুষকেই করতে হবে। যদি আল্লাহ্ মানুষকে এই শক্তি দান না করতেন তবে সকল মানুষই ফেরেশতাদের মত কোন পাপ করতো না, কোন মন্দ করার ক্ষমতা তাদের চরিত্রে থাকতো না। সুতারাং কোনও জবাবদিহিতাও থাকতো না। ফেরেশতাদের আল্লাহ্ যেমন কোন পাপ কাজ করার ক্ষমতা দান করেন নাই, মানুষও ঠিক সেরূপ হতো। মানুষের ঈমান বা বিশ্বাস তখন তাদের চরিত্রের একটি বৈশষ্ট্য পরিণত হতো, তাদের ঈমানকে ভালো ও মন্দের কষ্টিপাথরে যাচাই করার প্রশ্ন আসতো না। পৃথিবীর সকল মানুষই তখন ঈমানদার ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হতো। এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে, "তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে, পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনতো।" কিন্তু পৃথিবীতে আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন বিভিন্ন মানসিক দক্ষতা সম্পন্ন করে। সে ভালো মন্দের পার্থক্য করতে পারে, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারে, সে ভালোবাসতে পারে আবার ঘৃণাও করতে পারে। আল্লাহ্র ইচ্ছা : মানুষ তার এই সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশ ঘটাবে তার আত্মিক উন্নতির মাধ্যমে, স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খায়। সুতারাং ঈমানের বা বিশ্বাসের অধিকারী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, নৈতিক চরিত্রের উন্নতি করে আত্মিক উন্নতি লাভ করা। আর এর বিরোধিতা করাই হচ্ছে পাপ। এই আয়াতে আল্লাহ্ মোমেন ব্যক্তিদের সাবধান করে বলেছেন যে, তারা অবিশ্বাসীর অবিশ্বাসের জন্য ক্রুদ্ধ হবে না বা অধৈর্য হবে না বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে না। এখানে গুরত্বপূর্ণ উপদেশ যা আল্লাহ্র মোমেন ব্যক্তিদের দান করেছেন তা হচ্ছে : গায়ের জোড়ে বা শক্তির ভয় দেখিয়ে কারও উপরে ধর্মীয় বিশ্বাস চাপানোর প্রলোভন মোমেন ব্যক্তিদের সংবরণ করতে হবে। কারণ আল্লাহ্র ভালোবাসা হারানোর ভয়ে না হয়ে যদি শুধুমাত্র মানুষের ভয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে পালন করা হয়, তবে তা কখনও সত্যিকারের ঈমান বা বিশ্বাস নয়। তা ঈমান নয়।
১০০। আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত কোন আত্মা ঈমান আনবে না। এবং যারা অনুধাবন করবে না, আল্লাহ্ তাদের উপর সন্দেহের [অন্ধকার] স্থাপন করবেন। ১৪৮১
১৪৮১: আল্লাহ্ মানুষকে "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করেছেন। এই ইচ্ছাশক্তিকে আল্লাহ্র ইচ্ছাশক্তির সাথে সমন্বিত করে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের নামই হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঈমান। এর জন্য প্রয়োজন ঐকান্তিক আগ্রহ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা। মানুষ চারিত্রিক দিক থেকে দুর্বল। সেই কারণে সাফল্য লাভের জন্য তার সর্বদা আল্লাহ্র সাহায্য ও রহমতের প্রয়োজন। যদি আমাদের প্রচেষ্টা আন্তরিক হয়, যদি আমরা আল্লাহ্র ইচ্ছাকে অনুধাবনের চেষ্টা করি, তবে অবশ্যই আল্লাহ্র সাহায্য অতি নিকটে। ঈমানের প্রথম ধাপই হচ্ছে আল্লাহ্কে বোঝার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা। যদি এই প্রচেষ্টা আন্তরিক না হয়, তবে, তাদের মনে সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে থাকবে এবং তা ধর্মীয় বিশ্বাসের পথে বাঁধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। এই-ই আল্লাহ্র বিধান। এই বিধানকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, "যারা অনুধাবন করবে না, আল্লাহ তাদের উপর সন্দেহের [অন্ধকার] স্থাপন করবেন।"
[উপদেশ : যারা মৌলবাদী, শক্তির মাধ্যমে ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের জন্য এই আয়াতে আছে উপদেশাবলী]
১০১। বল, "আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সে সব [নিদর্শন] লক্ষ কর" কিন্তু যারা অবিশ্বাসী, নিদর্শন অথবা সতর্কবাণী কিছুই তাদের উপকারে আসে না ১৪৮৩।
১৪৮৩: মানুষের মধ্যে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য বোধ এবং সত্যের জন্য, ভালোর জন্য, ন্যায়ের জন্য, পূণ্যের জন্য আন্তরিক চেষ্টাই হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল ভিত্তি। মানুষ ভালোর জন্য, ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য আন্তরিক চেষ্টার মাধ্যমে তার নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাবে। এই-ই হচ্ছে স্রষ্টার ইচ্ছা। স্রষ্টার এই ইচ্ছা পূরণের মাধ্যমে স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টার নামই হচ্ছে ঈমান বা ধর্ম। ঈমান শুধুমাত্র কয়েকটি কলেমার উচ্চারণ নয়- এটা হচ্ছে বাস্তব প্রচেষ্টা ও কর্মপদ্ধতি। যদি আমরা তা না করি তবে আমাদের আধ্যাত্মিক জগত বা বিবেক (Spiritual faculty) ধীরে ধীরে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে ও একদিন তা মৃত হবে। যার আধ্যাত্মিক জগত অন্ধকারচ্ছন্ন সে কখনও সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়,পাপ-পূন্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। ফলে তার পক্ষে আল্লাহর নিদর্শন সমূহ অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। আল্লাহ্র নিদর্শন দুধরণের : (১) তাঁর সৃষ্টির মধ্যে :, প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান (২) তাঁর দূতদের মাধ্যমে প্রেরিত প্রত্যাদেশের মধ্যে। বধির ব্যক্তি যেমন সঙ্গীতের মাধুর্য্য উপভোগ করতে পারে না, আধ্যাত্মিকভাবে মৃত ব্যক্তিও সেরূপ আল্লাহ্র নিদর্শন বুঝতে পারবে না, বা এর সৌন্দর্য্যকে আত্মার মাঝে অনুভব করতে সক্ষম হবে না।
১০২। তারা কি তাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে সে সম্প্রদায়ের [জন্য যা ঘটেছে] অনুরূপ ঘটনারই আশা করে? বল, "প্রতীক্ষা করঃ আমিও তোমার সাথে প্রতীক্ষা করবো।" ১৪৮৪
১৪৮৪: "তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করবো।" এই লাইনটি এই সূরার [১০:২০] প্রথমে শুরু হয়েছে। দেখুন টিকা ১৪০৮। আল্লাহ্র নিদর্শন বিশ্বব্রহ্মান্ড ব্যাপী ছড়ানো। যার দেখার চোখ আছে সেই দেখতে পায়, যার শোনার কান আছে সেই শুনতে পারে, যার বোঝার মন আছে সেই বুঝতে পারে। অবিশ্বাসীদের সেই চোখ, কান বা মন নাই। সুতারাং সত্যের নিদর্শন অনুধাবনে তারা ব্যর্থ। সূরাটির শেষে এসে একই বাক্য দ্বারা এই বক্তব্যের সমাপ্তি টানা হয়েছে।
১০৩। শেষ পর্যন্ত আমি আমার রাসুলদের ও মুমিনদেরও উদ্ধার করি। এভাবে আমার দায়িত্ব মুমিনদের উদ্ধার করা।
রুকু-১১
১০৪। বলঃ " হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা যদি আমার দ্বীনের প্রতি সন্দেহ প্রবণ হও, [তবে দেখো] ১৪৮৫ আল্লাহ্ ব্যতীত তোমরা যার এবাদত কর আমি তাদের এবাদত করি না। কিন্তু আমি এবাদত করি আল্লাহর যিনি [মৃত্যুর মধ্য দিয়ে] তোমাদের আত্মাকে হরণ করবেন ১৪৮৬। আমি মুমিনদের [সারিতে] অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। ১৪৮৭, ১৪৮৮
১৪৮৫: সাধারণ মানুষ গড্ডালিকা প্রবাহে চলতে ভালোবাসে। যদি সাধারণ মানুষ সত্যে ধর্মে বিশ্বাস স্থাপনে ইতঃস্তত করে, সন্দেহ পোষণ করে, বা আশ্চর্য হয়, তবে সে ক্ষেত্রে মোমেন ব্যক্তিদের যা কর্তব্য তাকেই আল্ মুস্তফার (সা) বক্তব্যের মাধ্যমে সমস্ত মোমেন ব্যক্তিদের এই আয়াতে জানানো হয়েছে।
১৪৮৬: এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহ্র উপাসনা শুধুমাত্র কোনও হুকুম বা কবির কল্পনা, বা দার্শনিকের কাল্পনিক ব্যাখ্যা, যুক্তিতর্কের বিষয় নয়। এ হচ্ছে চির সত্য-আত্মার অস্তিত্ব, বিকাশ প্রশান্তি এর সাথে জড়িত। অবিনশ্বর আত্মার অস্থায়ী নিবাস এই নশ্বর দেহ। এই দেহের সৃষ্টি ও ধ্বংস তাঁরই হাতে। জীবন ও মৃত্যু শুধুমাত্র এক আল্লাহ্রই হাতে। জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্ ।
১৪৮৭: "আদিষ্ট হয়েছি" অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র এবাদত করার হুকুম রসুলের (সা) আবিস্কার নয়। এই হুকুম স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁকে দিয়েছেন এবং তাঁর মাধ্যমে এই হুকুম সমস্ত বিশ্ব মানবের জন্য প্রচারিত হয়েছে।
১৪৮৮: ঈমান বা বিশ্বাস প্রত্যেকেরই ব্যাক্তি সত্ত্বার অংশ। যেহেতু, মানুষ সামাজিক জীব; সেহেতু তার বিশ্বাস বা বিশ্বাসের আন্তরিকতা ও একাগ্রতা শতগুণে বৃদ্ধি পায়, যদি সে পূণ্যাত্মাদের সাথে এক সঙ্গে থাকার সুযোগ পায় ও এবাদতের অংশীদার হতে পারে। এখানেই ইসলামের বৈশিষ্ট্য। ইসলাম কোন সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে জীবনের ধর্ম। প্রতিদিনের পূত পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে যারা আল্লাহ্র ইচ্ছাকে পূরণ করে তারাই প্রকৃত মোমেন বান্দা। সমাজ সংসার ত্যাগ করে বনে বা নির্জন স্থানে যেয়ে আল্লাহ্র এবাদত করা ইসলাম অনুমোদন করে না। সমাজ ও সংসারের প্রতি কর্তব্যের সীমারেখা বলে দেয়া আছে ঐশীগ্রন্থে। সেই নির্দ্দেশিত পথে যারা প্রতিদিনের পার্থিব জীবন পরিচালিত করে, সমাজ ও সংসারের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে, এ ব্যাপারে পৃথিবীর ক্লোদাক্ত জীবন যাদের স্পর্শ করে না, তারাই মোমেন। দ্বীন ও দুনিয়া এই দুই-এ মিলেই ইসলাম। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য্য। কারণ 'দ্বীন' ব্যতীত দুনিয়া ও দুনিয়া ব্যতীত 'দ্বীন' দুটোই অসম্পূর্ণ। কারণ প্রকৃত সুন্দর সমাজ বিকাশের মূল চাবিকাঠি আছে আল্লাহ্র দ্বীনে। সেই কারণে এখানে রাসুলকে (সা) আল্লাহ হুকুম দিয়েছে "মুমিনদিগের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য।" অর্থাৎ সেই সমাজ যে সমাজ মোমেন বান্দাদের দ্বারা সংগঠিত। অর্থাৎ মোমেনদের সংগঠিত হওয়ার হুকুম।
১০৫। "অধিকন্তু [এভাবে] : ধর্মের প্রতি প্রকৃত ভক্তির সাথে মুখ ফিরাও, এবং কখনও অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না।"
১০৬। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাকেও ডাকবে না; এরা তোমার উপকারও করতে পারবে না, অথবা ক্ষতিও করতে পারবে না। যদি তুমি তা কর, দেখো তবে তুমি অবশ্যই পাপীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
১০৭। যদি আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষতির দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা দূর করতে পারবে না। যদি তিনি তোমার কল্যাণ চান, তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নাই। তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি কল্যাণ দান করেন। তিনি বার বার ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ১৪৮৯
১০৬। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাকেও ডাকবে না; এরা তোমার উপকারও করতে পারবে না, অথবা ক্ষতিও করতে পারবে না। যদি তুমি তা কর, দেখো তবে তুমি অবশ্যই পাপীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
১০৭। যদি আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষতির দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা দূর করতে পারবে না। যদি তিনি তোমার কল্যাণ চান, তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নাই। তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি কল্যাণ দান করেন। তিনি বার বার ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ১৪৮৯
১৪৮৯: "আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু"। যখন দুঃখ বিপদ আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অন্ধকারচ্ছন্ন করে ফেলে। বিপর্যয়ের ধুলি ঝড়ে জীবনের আশার আলোকে আড়াল করে ফেলে, সেই বিপদ বিপর্যয়ের মাঝেও পরম করুণাময়ের করুণার ধারা প্রবাহিত হয়। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের আত্মাকে পৃথিবীর চাওয়া-পাওয়ার মলিনতা দ্বারা কুলষিত করে ফেলি, তখন আল্লাহ্ তার পরিশুদ্ধতার ভার গ্রহণ করেন। দুঃখ বিপর্যয়ের সময়ে মানুষ আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করে, তাঁর নৈকট্য অনুসন্ধান করে; নিজের দোষ-ত্রুটির অনুসন্ধান করে তাঁর থেকে পরিশুদ্ধ হতে চেষ্টা করে- স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভের আশায়। দুঃখ যন্ত্রণার মাধ্যমেই ধৈর্য্য ধরে জীবনের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে হয়। জীবনর সার্থকতা সেখানেই । দুঃখ, বিপদ, বিপর্যয়ের মধ্যেও আল্লাহ্র করুণার হাত বর্তমান থাকে। বান্দার বৃহত্তর কল্যাণের জন্য সে হস্ত প্রসারিত। তাই বান্দার যাতে কল্যাণ সেভাবেই দুঃখ, বিপদ, বিপর্যয় আল্লাহ্র তরফ থেতে পতিত হয়, এং তিনি ব্যতীত আর কারও তা দূর করে দেবার ক্ষমতা নাই। তাঁর বৃহত্তর পরিকল্পনা আমাদের জন্য যাতে কল্যাণ নিহিত, তা অনুধাবন করার ক্ষমতা আমাদের সীমিত জ্ঞানের বাইরে। আবার আল্লাহ্র করুণা ও রহমত যার জন্য প্রবাহিত তাও কেড়ে নেবার ক্ষমতা কারও নাই। তাঁর রহমত ও করুণা তারাই লাভ করে যারা তার যোগ্য। এমনকি আমরা সাধারণ মানুষ যারা দোষ-ত্রুটির উর্দ্ধে নয়, তারাও তাঁর রহমত ও করুণায় ধন্য।
১০৮। বল, " হে মানব সম্প্রদায়! তোমার প্রভুর নিকট থেকে সত্য পৌঁছেছে! যারা পথ নির্দ্দেশ গ্রহণ করবে, তারা তা করবে তাদের নিজের আত্মার কল্যাণের জন্য। যারা পথভ্রষ্ট হবে তারা তা করবে নিজের [আত্মার] ক্ষতির জন্য। তোমাদের কাজের পরিকল্পনার জন্য আমি [নিযুক্ত] নই।" ১৪৯০
১৪৯০: 'Furqan' এই শব্দটির অর্থ সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের সীমানা নির্ধারিত করার মানদন্ড। এই মানদন্ড আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রাপ্ত পথ নির্দেশ বা নৈতিক নীতিমালা। এই মানদন্ডই হচ্ছে শ্বাসত "সত্য" যা যুগকাল অপরিবর্তিত। মানুষের নৈতিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ এই মানদন্ড বা "সত্য" দ্বারাই নির্ধারিত হয়। আমরা যদি আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করি তা আমাদের-ই কল্যাণের জন্য করবো। আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে চলে আমরা কাউকে অনুগ্রহ করছি এ কথা মনে করার কোনও কারণ নাই। আল্লাহ্র নবী রসুলেরা আমাদের যুগে যুগে এই পথের সন্ধান দান করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। এতে তাদের কোনও স্বার্থ নাই। কল্যাণ যা তা আমাদের। কারণ যে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে চলে, সে সত্য পথের সন্ধান পায়; যা তার আত্মায় কল্যাণ বয়ে আনে। যদি আমরা আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথকে অস্বীকার করি তবে সে ক্ষতি নিজের ছাড়া আর কারোরই না। এই অস্বীকার করার দায় বা দায়িত্ব কোন নবী বা রসুলের নয়। কারণ আল্লাহ্ প্রত্যেককে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়েছেন। রসুলের প্রদর্শিত পথ গ্রহণ করা বা ত্যাগ করা তার নিজস্ব ইচ্ছা। এই দায়িত্ব ব্যক্তির নিজস্ব। এই দায়িত্বে জবাবদিহিতা তাকে শেষ বিচারের দিনে করতে হবে। এই দায়িত্ব কোনও নবী রসুলের একক দায়িত্ব না। দেখুন সূরা [৬:১৬৪] [৩৯:৭,৭০] ৩৫:১৮] ৪২:১৫] ৫৩:৩৮] ৭৪:৩৮] ইত্যাদি আয়াতে এবং কোরানের আরও বহুস্থানে।
১০৯। তোমার প্রতি যে ওহী অবতীর্ণ হয়েছে তুমি তার অনুসরণ কর এবং ধৈর্যশীল ও দৃঢ় হও, যে পর্যন্ত না আল্লাহ্ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন; কারণ তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ১৪৯১।
১৪৯১: যখন আল্লাহ্র নবীর (সা) অক্লান্ত চেষ্টা ও আন্তরিক আগ্রহ সত্ত্বেও কাফেররা সত্য ধর্মে আকৃষ্ট হলো না, তাদের অন্যায়, অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো, আল্লাহ্র হুকুম হলো ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষা করা। নবীর (সা) জীবনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই উপদেশ দিয়েছেন যে, কোন মহৎ কাজে যদি পর্বত প্রমাণ বাঁধাও আসে; সবর করতে হবে। সবর, অর্থাৎ ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের সাথে আল্লাহ্র রহমতের অপেক্ষা করতে হবে। এ কথার অর্থ নিশ্চেষ্টভাবে অপেক্ষা করা নয়- একথাটির অর্থ ধীর স্থিরভাবে অধ্যাবসায়ের সাথে নিজ লক্ষ্যের প্রতি অবিচল ভাবে অগ্রসর হতে হবে, যার প্রধান পাথেয় হবে আল্লাহ্র রহমতের ভরসা। আল্লাহ্র পরিকল্পনা এভাবেই মানুষের মাধ্যমে যুগে যুগে কার্যকর হয়। যারা শত দুঃখ, বিপদ, বিপর্যয়ে আল্লাহ্র পতাকা সমুন্নত রাখতে পারে তারাই ধন্য।