সূরা ইউসুফ
সূরা ইউসুফ -১২
ভূমিকাঃ- সূরা ১০ থেকে ১৫ পর্যন্ত সূরার সাধারণ মর্মার্থ এবং এই সূরার ক্রম অনুসারে এর অবস্থানের জন্য দেখুন ১০ এর ভূমিকা। এই সূরাতে পিতা ইয়াকুবের ১২টি ছেলের মধ্যে ইউসুফের কাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশকে তুলে ধরা হয়েছে। এই কাহিনীকে আল্লাহ্ অত্যন্ত সুন্দর কাহিনীরূপে উল্লেখ করেছেন [১২:৩] আয়াতে। কারণ হিসেবে বলা যায়; ১) কোরানে বর্ণিত অন্যান্য ঘটনার থেকে ইউসুফের কাহিনী অত্যন্ত বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ২)এই কাহিনীর মাধ্যমে মানুষের উত্থান পতনের বর্ণনা করা হয়েছে; ফলে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে এর আবেদন পৌছায় । ৩) সুন্দর ভাবে অঙ্কিত করা হয়েছে এর আধ্যাত্মিক নিহিতার্থ, জীবনের বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করা হয়েছে, বৃদ্ধ পিতার সন্তানের জন্য আকুতি, পিতা এবং তাঁর আদরের ছোট সন্তানের মধ্যে আস্থা ও ভালোবাসার সম্পর্ক, বড় ভাইদের ছোট ভাই এর প্রতি হিংসা-দ্বেষ, তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাদের পিতার দুঃখ, নামমাত্র মূল্যে পিতার আদরের সন্তানকে দাসত্বের জন্য বিক্রী করা; ভালোবাসার কামজ প্রবৃত্তিকে পবিত্রতা ও সংযমের পটভূমিতে তুলে ধরা, মিথ্যা অভিযোগ, কারাগার, স্বপ্নের অর্থ, সাধারণ জীবন ও অর্থবহ জীবন ইত্যাদি। নিষ্পাপ জীবন সম্মান বয়ে আনে , ক্ষমা ও বদান্যতা প্রকাশ করা হয়েছে মিষ্টি প্রতিশোধ আকারে,প্রশাসনের উচ্চ কার্যাবলী, উচ্চপদে অধিষ্ঠানে থেকেও বিনয়, বাৎসল্য ও সর্বপরি ধর্মানুরাগ ও সত্যানুরাগ ইত্যাদির বর্ণনা এখানে আছে।
এই কাহিনী যদিও বাইবেলে বর্ণিত কাহিনীর অনুরূপ তবুও এই কাহিনী ও বাইবেলে বর্ণিত কাহিনী এক নয়। বাইবেলে বর্ণিত কাহিনী লোকগাঁথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়- যেখানে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের কোনও স্থান নাই। সেখানে ইহুদীদের মিশরবাসীদের উর্দ্ধে স্থাপনের জন্য প্রয়াস পায় এ ভাবে যে ইহুদীরা মিশরবাসী অপেক্ষা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও আর্থিক ব্যাপারে অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিল । সেখানে দেখানো হয়েছে যে ইউসুফ দুভির্ক্ষের সুযোগ গ্রহণ করে গরীব মিশর বাসীদের জমি ও গৃহপালিত পশু হস্তগত করেন রাষ্ট্রের নামে। এভাবেই ইসরাঈলীরা ফেরাউনের পশুসম্পদের অধিকারী হয়, এখানেই বাইবেলের কাহিনীর সাথে কোরানের কাহিনীর পার্থক্য - কোরান কাহিনীর আধ্যাত্মিক দিকটি অল্প বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরেছে। রূপক বর্ণনার মাধ্যমে জীবনের পরস্পর বিরোধী দিক তুলে ধরেছে, বলা হয়েছে অসত্য ও পরিবর্তনশীল পৃথিবীর মাঝে সত্যিকারের গুণাবলী একমাত্র স্থায়ী ভাবে থাকে। ইতিহাসের বিরাট ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে; কিভাবে আল্লাহ্র পরিকল্পনা ধীরে ধীরে কার্যকররূপ গ্রহণ করে। মুসলিম ব্যাখ্যাকারীদের নিকট কাহিনীর এই বিশেষ দিক অত্যন্ত প্রিয় ।
সার সংক্ষেপঃ জীবন একটা স্বপ্ন যা উপমা ও কাহিনীর মাধ্যমে প্রাঞ্জল ভাষায় কোরানে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র নবী হযরত ইউসুফ স্বপ্নে যে সত্যকে প্রত্যক্ষ করেন, তা তার সৎ ভাইদের কাছে অরুচিকর মনে হয়। তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং নামমাত্র মূল্যে তাঁকে বণিকদের কাছে ক্রীতদাসরূপে বিক্রী করে দেয় । [১২:১-২০]
বনীকেরা হযরত ইউসুফকে মিশরে নিয়ে আসে এবং মিশরের প্রধানমন্ত্রীর (আজিজ) সম্মুখে আনায়ন করে, পরবর্তীতে আজিজ হযরত ইউসুফকে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। আজিজের স্ত্রী হযরত ইউসুফকে প্রেমিকরূপে পেতে চান- কিন্তু কামজ প্রেমে হযরত ইউসুফকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। তাঁর প্রত্যাখান তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে। কিন্তু হযরত ইউসুফ কারাগারে থেকেও সত্যকে খুঁজে ফেরেন এবং সেখানে তিনি তার দয়ালু স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁর একজন সঙ্গী -বন্দী, যার কাছে তিনি স্বপ্নের ব্যাখা দান করেছিলেন, মুক্তি পায় এবং রাজ অনুগ্রহ লাভ করে রাজার পানপাত্র বহনকারী হয়। [১২: ২১-৪২]
রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানের সুযোগে ইউসুফ রাজার নিকট নিজের নির্দ্দোষিতা প্রমাণের সুযোগ পেলেন। হযরত ইউসুফ দাবী করলেন যে প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধ থেকে সকল অপবাদ মিথ্যারূপে ঘোষণা করা হোক । তিনি রাজ অনুগ্রহ লাভ করেন এবং উজির পদে মনোনীত হন। তাঁর সৎ ভাইরা দুর্ভিক্ষ পীড়িত হয়ে মিশর আগমন করে এবং ইউসুফ দ্বারা সহৃদয়তার সাথে গৃহিত হয়। তারা ইউসুফের পরিচয় জানতে পারে না । হযরত ইউসুফ তাঁর আপন ভাই বেঞ্জামিনকে মিশরে আনতে বলেন। [১২: ৪৩-৬৮]
হযরত ইউসুফ কৌশলে বেঞ্জামিনকে আটকিয়ে রাখেন এবং তাঁর সৎ - ভাইদের তাদের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করে। পরে তাদের ক্ষমা করে দেয় এবং তাদের ক্যানন থেকে হযরত ইয়াকুব ও তাদের পরিবারদের মিশরে আনার জন্য প্রেরণ করেন । [১২: ৬৯-৯৩]
হযরত ইসরাঈল (ইয়াকুব) মিশরে এসে বসতি স্থাপন করেন ও শান্তি লাভ করেন। আল্লাহ্র নামকে মহিমান্বিত করা হয়। আল্লাহ্র সত্য চিরস্থায়ী হবে এবং আল্লাহ্র ইচ্ছা পরলোকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করা হবে। [ ১২: ৯৪ - ১১১]
সূরা ইউসুফ - ১২
১১১ আয়াত, ১২ রুকু, মক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
১৬২৮: Ayat: আল্লাহ্র নিদর্শন এবং কোরানের স্তবক বা চরণ। হযরত ইউসুফের কাহিনী আল্লাহ্র এক অপূর্ব নিদর্শন , বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা যার মাধ্যমে আল্লাহ্ প্রকাশ করেছেন কিভাবে তাঁর উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা সফল বাস্তবায়ন হয়।
১৬২৯: দেখুন সূরা [৫: ১৫] আয়াত এবং টিকা ৭১৬ । এখানে Mubin শব্দটির প্রধান অর্থ করা হয়েছে, যা কোন কিছুকে স্পষ্ট ভাবে ব্যাখা করে ।
১৬৩০: Qur-an কথাটির অর্থ ১) যা পঠিত হইবে, অথবা ২) আবৃত্তি করা হইবে, অথবা, ৩) ঘোষণা করা হইবে। এই কথাগুলি কোরানের যে কোন স্তবক বা চরণ অথবা সূরা বা , সর্ম্পূণ গ্রন্থ সম্বন্ধে প্রযোজ্য। এই আয়াতে কোরানকে আরবী ভাষাতে নাজেল করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে উপরিউক্ত প্রক্রিয়ায় পাঠক যাতে কোরান পড়ে বুঝতে পারে, সে কারণেই এই মহাগ্রন্থকে আরবী ভাষাতে নাজেল করা হয়েছে [কারণ আরবের লোকের ভাষা আরবী]
১৬৩১ : "সুন্দর কাহিনী" দেখুন এই সূরার ভূমিকাতে । এই কাহিনীর আলঙ্কারিক সুন্দর বর্ণনা তাদের জন্যই ইঙ্গিতময় , যারা আল্লাহ্র ইঙ্গিত বুঝতে চায়, জ্ঞান আহরণ করতে চায়। এই সৌন্দর্য শুধু যে ইউসুফের কাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাই নয়, হযরত ইউসুফ নিজেও ছিলেন সুন্দর - সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপবান যুবক । মিশরের মহিলারা তাঁকে বলতো 'স্বর্গের দেবদূত' বা মহিমান্বিত ফেরেশতা' [১২: ৩১] তিনি ছিলেন ভিতরে ও বাহিরে সমভাবে সুন্দর । তাঁর বাইরের অবয়বের সৌন্দর্য্য ছিলো তাঁর আত্মার সৌন্দর্যের প্রতীক।
১৬৩২: এই আয়াতটিতে উপমার সাহায্যে বোঝানো হয়েছে যে, ইউসুফ ছিলেন আল্লাহ্র মনোনীত ব্যক্তি। কাহিনী বোঝার সুবিধার্থে কিছু পূর্বের ইতিহাস এখানে আলোচনা করা হলো । হযরত ইউসুফের বংশ তালিকা এভাবে প্রকাশ করা যায় : হযরত ইব্রাহিমের কনিষ্ঠ সন্তান হযরত ইসাহাকের পুত্র ছিলেন হযরত ইয়াকুব। যার অপর নাম ছিলো হযরত ইসরাঈল । হযরত ইব্রাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন হযরত ইসমাইল যার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সূরা [২: ১২৪ - ১২৯] আয়াতে পয়গম্বরকুলের বংশ চূরামনিতে হযরত ইব্রাহীমের স্থান। হযরত ইয়াকুবের চার স্ত্রী ছিলো ।তাঁর তিন স্ত্রীর গর্ভে দশটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। বৃদ্ধ বয়েসে তাঁর সুন্দরী চতুর্থ স্ত্রীর [রাহেল] নিকট থেকে তিনি দুটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। তাঁদের নাম ছিলো যথাক্রমে ইউসুফ ও সর্বকনিষ্ঠ বেঞ্জামিন । যে স্থানে হযরত ইয়াকুব তাঁর পরিবারবর্গ নিয়ে বাস করতেন তা ছিলো ক্যানন প্রদেশে, বর্তমান জেরুজালেম থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে বর্তমান Nablus [পুরাতন Shecem ] নামক স্থানে । পুরুষনুক্রমিক ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে এখানেরই একটি কূপে হযরত ইউসুফকে নিক্ষেপ করা হয় । যা এখনও দর্শনীয় বস্তু ।
১৬৩৩ : এই স্বপ্নের কাহিনী যখন বর্ণনা করা হয় , তখন হযরত ইউসুফ ছিলেন বালকমাত্র। কিন্তু সে সময়েই তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়। তিনি ছিলেন সরল, সত্যবাদী ও পূন্যাত্মা । তিনি ছিলেন সচ্চরিত্র ও পৌরুষের প্রতীক। তাঁর পিতা তাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। ফলে তাঁর সৎ ভাইরা তাকে ঈর্ষা এবং ঘৃণা করতো । এই স্বপ্নের মাধ্যমে বলা হয় যে, তাঁর ভাগ্য আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত, তিনি আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত ! তাঁকে আল্লাহ্ তাঁর এগারো ভাই [ একাদশ নক্ষত্র] ও পিতা মাতা [সূর্য এবং চন্দ্র ] অপেক্ষা বহু উর্দ্ধে স্থাপন করবেন - স্বপ্নের মাধ্যমে তাঁকে এই শুভ সংবাদ দান করা হয় । পরবর্তীতে আমরা দেখি; খ্যাতি, সম্মান, অর্থ বিত্ত, সৌন্দর্য সব কিছুর শীর্ষে অবস্থান করেও হযরত ইউসুফ তাঁর চরিত্রের বিনয়কে হারান নাই। অহংকারে আত্মবিস্মৃত হন নাই। তিনি তাঁর পিতা মাতাকে সর্বদা সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত রাখতেন এবং তাঁর সৎ ভাইদের ঘৃণা ও ঈর্ষার প্রতিদানে তিনি তাদের ক্ষমা ও দয়া করেন। এই ছিলো তাঁর মিষ্টি প্রতিশোধ।
১৬৩৪: বালক ইউসুফ ছিলেন সরলতার প্রতীক । তিনি তাঁর ভাইদের তীব্র ঘৃণা ও ঈর্ষার বিষয় অবগত ছিলেন না । কিন্তু তাঁর পিতা তা অবগত ছিলেন এবং তিনি সে সম্বদ্ধে ইউসুফকে সাবধান করেন।
১৬৩৫: কাহিনীর মধ্যবর্তী স্থানে এখানে এসে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানেই কোরানের কাহিনীর সৌন্দর্য। হযরত ইউসুফের ভাইরা শয়তানের হাতের পুতুল ছিলো মাত্র। শয়তান তাদের যে ভাবে পরিচালিত করতো তারা সেভাবেই পরিচালিত হতো । ফলে তারা তাদের মনুষত্বকে, ব্যক্তিত্বকে শয়তানের দুষ্টফন্দির নিকট সমর্পিত করেছিলো। তারা ভুলে গেলো যে, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু । মানুষের চরিত্র, মনুষত্ব ও ব্যক্তিত্ব সব কিছু শয়তান বা পাপ ধ্বংস করে দেয় ।
১৬৩৬: ইউসুফ ছিলেন আল্লাহ্র মনোনীত। আল্লাহ্ ইউসুফ কে "মনোনীত" করবেন। সুতারাং তিনি আল্লাহ্র নিদর্শন ও ঘটনার সঠিক ব্যাখা বোঝার ক্ষমতা রাখবেন। যারা পূণ্যাত্মা তাদের কল্পনায় সত্য ধরা পরে। তারা সত্যকে বুঝতে পারেন। এ একটি বিশেষ ক্ষমতা যা আল্লাহ্র দান। অপর পক্ষে যাদের এই ক্ষমতা নাই তারা তা বুঝতে পারবে না। পূণ্যাত্মারা পূর্বাহ্নেই স্বপ্নে বড় বড় ঘটনার ইঙ্গিত পান। অপর পক্ষে যারা তুচ্ছ তারা এ ক্ষমতা রাখে না , এই ক্ষমতা আল্লাহ্রই দান। হযরত ইউসুফের চরিত্রের মাধ্যমে, আল্লাহ্ বিশ্বের সমস্ত পূন্যাত্মাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। জীবনের পথে আমাদের অনেক চড়াই উৎরাই পথ অতিক্রম করতে হয় । যখন দুর্যোগের কালো মেঘ আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে যারা পূন্যাত্মা তারা সেই বিপদ ও দুর্যোগকে মোকাবিলা করেন ধৈর্য্য, বিনয় ও আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নির্ভরশীলতার মাধ্যমে। আল্লাহ্র প্রতি কোনও অভিযোগ তাঁরা উচ্চারণ করেন না । তাঁরা সর্বদা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে নিবেদিত থাকেন। বিপদে দুঃখে তাঁরা যেমন ধীর স্থির থাকেন, সৌভাগ্য এবং সফলতাতেও তারা উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেন না । তিনি সর্বদা বিনয়াবনত ভাবে শত্রু মিত্র সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন । তাঁর সর্ব কাজ থাকে এক আল্লাহ্র সন্তুষ্টির প্রতি নিবেদিত। হযরত ইউসুফের চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি প্রতিটি পূন্যাত্মাদের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং কোরানের শিক্ষার মাধ্যমে এই বিশেষ দিকটি তুলে ধরা হয়েছে।
১৬৩৭: এই আয়াতটি হযরত ইয়াকুবের উপদেশ তাঁর সন্তান হযরত ইউসুফের প্রতি। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে সব কিছুর নিয়ন্ত্রন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র হাতে । তিনি মঙ্গলময় এবং সর্বজ্ঞানী তাঁর অজ্ঞাত কিছুই নাই। সুতারাং আমরা তাঁর প্রতি আমাদের আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন করবো। ইউসুফকে তার পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহিম, হযরত ইস্হাকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম , হযরত ইসাহাক ছিলেন প্রকৃত ধর্মভীরু, বিশ্বাসী এবং আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত প্রাণ । তাঁদের এই বিশ্বাস ও আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখতে সাহায্য করে, সমস্ত মলিনতা মুক্ত রাখে, সমস্ত বাঁধাকে জয় করতে সাহায্য করে।
১৬৩৮: ইউসুফের কাহিনীর মাধ্যমে ভালো ও মন্দের বিভিন্ন বৈষম্যকে তুলনা করা হয়েছে। যারা আধ্যাত্মিক দ্বীনের অন্বেষণে ব্যপৃত, তাঁদের জন্য এই কাহিনীর বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত সমূহ বিদ্যমান।
১৬৩৯: হযরত ইয়াকুবের দশটি ছেলে, তারা তাদের ছোট ভাই ইউসুফ ও বেঞ্জামিনকে হিংসা ও ঘৃণা করতো । হযরত ইয়াকুব জ্ঞানী ছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মাতৃহারা ছোট দুটি সন্তান ইউসুফ ও বেঞ্জামিনকে বিশেষ নিরাপত্তা দান করা প্রয়োজন । আল্লাহ্র প্রেরিত জ্ঞানে তিনি ইউসুফের ভবিষ্যত সাফল্য, তাঁর প্রতি আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামত বুঝতে পেরেছিলেন। আর বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ইউসুফের নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। কিন্তু হযরত ইয়াকুবের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, তার অন্যান্য দশটি ছেলের নিকট বোধগ্যম ছিল না । তারা তাদের পিতাকে মূর্খ ও অন্ধ বলে পরিগণিত করতো , কারণ তাদের পিতার দ্বীন প্রজ্ঞা ও উপদেশ তাদের আত্মশ্লাঘা, আত্মপ্রেমে আঘাত করতো। "মিথ্যা" সর্বদা "সত্যকে" ঘৃণা করে তার কারণ মিথ্যা আত্মপ্রেমের বাইরে আর কিছুই কল্পনা করতে পারে না । মিথ্যুক ব্যক্তির সর্বচিন্তা , সর্বসত্তা যখন আত্মপ্রেমে নিমগ্ন থাকে তখন সে তার প্রভাব, প্রতিপত্তি বিস্তারে বাঁধার সম্মুখীন হলে পশু শক্তি ব্যতীত আর কিছুই বুঝতে পারে না । "অথচ আমরা একটি উৎকৃষ্ট দল " -এই বাক্যটি এই অর্থ বহন করে যে, হযরত ইয়াকুবের দশ ছেলে আত্নপ্রেমে নিমগ্ন থাকার ফলে নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা প্রাপ্ত হয় । এক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তাদের দৃষ্টিতে পশুশক্তি - ই ছিলো একমাত্র এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র । বৃদ্ধ ইয়াকুব, কিশোর ইউসুফ ও বালক বেঞ্জামিনকে তারা তাদের অপেক্ষা হীনবল মনে করতো । কারণ তারা ছিলো সংখ্যায় অধিক এবং শারিরীক শক্তিতে যুবক। তাদের মানসিকতার মাধ্যমে যুগকাল অতিক্রান্ত উপদেশ হচ্ছে যুগে যুগে এভাবেই আত্ম-প্রেমিকদের সত্যকে বোঝার ক্ষমতা থাকে না, যে কারণে ইয়াকুবের দশ ছেলে তাদের পিতাকে মনে করতো "পিতা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই আছেন"। এ উপদেশ যারা নিজেকে সর্বদা সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে তারা জীবনের সর্বাবস্থায় জ্ঞান ও সত্য অপেক্ষা পশু শক্তিতে অধিক বিশ্বাস করে।
১৬৪০: এই আয়াতের বক্তব্যে দশ ভাই এর চরিত্রের বিশ্ব নিন্দুক ও দয়ামায়াহীন কঠিন দিকটিই ফুটে উঠেছে। আরও ফুটে উঠেছে তাদের পার্থিব ও বৈষয়িক বিষয়ের আসক্তি। পৃথিবীতে অসৎ এবং দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা সৎ এবং ভালো লোককে সহ্য করতে পারবে না । ইউসুফের ভাইদের চরিত্রের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন। এই আয়াতে দশ ভাই যে উক্তি করেছে, সম্ভবতঃ তা ছিলো তাদের পিতার উপদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মনোভাবের প্রকাশ। সম্ভবতঃ তাদের পিতা উপদেশ দিতেন যে, "কেন তোমরা ইউসুফের মত ভালো হয়ে যাও না ?" এসব উপদেশের মর্মার্থ ছিলো তাদের অনুধাবনের বাইরে । ফলে উপদেশ তাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন না করে তাদের অন্তরে হিংসা, বিদ্বেষ ও তিক্ততার জন্ম দিত। সত্যিকারের ভালোর কোনও মূল্যই ছিলো না তাদের কাছে - তা ছিলো শুধুমাত্র কথার কথা বা ভানমাত্র তারা ইউসুফকে হত্যার পরিকল্পনা করে । কারণ তাদের ধারণা ছিলো ইউসুফকে তাদের পিতার দৃষ্টির সম্মুখ থেকে অপসারণ করতে পারলেই তারা তাদের পিতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। শুধুমাত্র পার্থিব জ্ঞান যাদের সহায় তারাই এরূপ ক্ষীনবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের মত নীচ এবং হীন ভাবে চিন্তা করতে পারে। হৃদয়ের ভালোবাসা শুধু যে চর্মচক্ষুর দেখার উপরে নির্ভর করে না এই সহজ সত্যটিও বুঝতে তারা অক্ষম। কারণ তারা হৃদয়ের ভালোবাসাকে লাভ-লোকসানের দাঁড়িপাল্লায় বিচার করে। এ কথা ইউসুফের ভাইদের জন্য যেরূপ প্রযোজ্য ছিলো আজও বৈষয়িক কুটবুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের জন্য তা সমভাবে প্রযোজ্য । যারা শুধুমাত্র বৈষয়িক জ্ঞান ও বুদ্ধিতে সমৃদ্ধ তাদের সর্বদা দূরদৃষ্টির ও অর্ন্তদৃষ্টির অভাব ঘটবে। এই -ই আল্লাহ্র বিধান । অপর পক্ষে ইয়াকুব নবী বোকাও ছিলেন না বা অবিবেচকও ছিলেন না । আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাহায্যে তিনি দশ ভাই ও ইউসুফের চরিত্রের পার্থক্য বুঝতে পারতেন। এ পার্থক্য ছিলো হিরক খন্ড ও কাঁচ খন্ডের মধ্যে যে পার্থক্য তার অনুরূপ । দশ ভাই এর পরবর্তী উক্তি থেকে এই সত্যই প্রকাশিত হয় যে, তাদের বক্তব্যের মাঝে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, অন্তর্দৃষ্টি কিছুই ছিলো না । শুধু ছিলো ব্যক্তিগত লাভ ও তাৎক্ষনিক পাওয়ার আকাঙ্খা।তারা বলেছিলো যে, "ইউসুফকে হত্যা কর --------। তার পর পূণ্যাত্মা হওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে। " অর্থাৎ নিজের স্বার্থ - উদ্ধারের পরে ভালো হওয়ার ভান করা যায় বা কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করা যায় । এতে নিজ স্বার্থ সিদ্ধি হয় ; এবং একই সাথে নিজেকে অন্যের চোখে ভালো প্রমাণিত করা যায় । তারা নির্বোধ তাই তারা বুঝতে অক্ষম যে মোনাফেকী বা ভান দ্বারা কখনও প্রকৃত পূণ্য অর্জন করা যায় না ।
উপদেশঃ স্বার্থপর ও মোনাফেক লোকেরা কোনও দিনও প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাবে না ।
১৬৪১: দশ ভাই এর একজন সম্ভবতঃ কম নিষ্ঠুর ছিল, অথবা,পৃথিবীর দেনা পাওনাতে অন্য নয় জন অপেক্ষা অধিক জ্ঞানী ছিলো; কারণ সে বললো, "কেন আমরা ভাতৃরক্তের দায়ভার বহন করবো? ইউসুফকে একটি কূপের মধ্যে নিক্ষেপ কর, কোনও পথিক তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে, এবং একেবারে চিরতরে দেশের বাইরে সরিয়ে ফেলবে। এতে আমাদের দ্বিবিধ লাভ - ভ্রাতৃহত্যার পাপও হলো না , আবার ইউসুফের উপস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়া গেলো।" যারা পাপী তারা এরকম চাতুরীপূর্ণ বাক্য দ্বারা মোহিত হয় এবং তাদের প্রত্যয় জন্মে যে তারা অন্যায় কিছু করছে না । আসলে তাদের এই ন্যায়-অন্যায় বোধ ছিলো সম্পূর্ণ ভাওতা পূর্ণ । যে কূপে ইউসুফকে নিক্ষেপ করা হয় তা ছিলো একটি শুষ্ক কূপ। যদিও শুষ্ক কিন্তু গভীর ছিলো ,যার ফলে ইউসুফ কূপের অভ্যন্তর থেকে বের হয়ে আসতে অক্ষম হন। আল্লাহ্র পরিকল্পনা ছিলো হযরত ইউসুফের জীবন রক্ষা করা, এবং এই জীবন রক্ষার জন্য তিনি যেনো তাঁর কোনও ভাই এর কাছে ঋণী না থাকেন। সেই পরিকল্পনা এ ভাবেই বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ্র পরিকল্পনা বোঝার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাই , আর তা এভাবেই বিস্ময়কর ভাবে কার্যকর হয়।
১৬৪২: দুষ্ট ভ্রাতারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য অগ্রসর হলো । হযরত ইয়াকুব তাঁর এই দশ ছেলের মন- মানসিকতা সম্বন্ধে সম্যক অবগত ছিলেন, তাই তিনি ইউসুফকে এই দশ ভাই এর দায়িত্বে অর্পন করা পছন্দ করেন নাই। কিন্তু কুচক্রীরা তাদের সুনিপুন অভিনয়ের মাধ্যমে তাদের আপত্তি প্রকাশ করে।
১৬৪৩: কুচক্রীদল জানতো যে তাদের আবেদন অগ্রাহ্য হবে। তাই তারা কৌশলে ভিন্ন আংগিকে তাদের বক্তব্য পেশ করলো । হযরত ইয়াকুবের বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করার জন্য তারা এবারে যে যুক্তির উত্থাপন করলো , তা হযরত ইয়াকুব ও হযরত ইউসুফ উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হলো। তারা বললো তাদের সাথে তাদের ছোট ভাইটির খেলাধূলা ও আনন্দফুর্তিতে ভালো সময় কাটবে যা ইউসুফের মত কিশোরের প্রয়োজন । সুতারাং মনের ও দেহের প্রফুল্লতার জন্য হলেও ইউসুফের প্রাণ ভরে খেলাধূলা ও আমোদ-ফুর্তি করা উচিত।
উপদেশ : এভাবেই শঠ্ ও কুচক্রীরা সর্বদা তাদের চক্রান্তের জাল বোনে।
১৬৪৪: যদিও হযরত ইয়াকুব কুচক্রীদের সম্বদ্ধে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন । তবুও তিনি তাদের পরিকল্পনার প্রকৃত রূপটি বুঝতে পারেন নাই। কিন্তু কিভাবে তাঁর পক্ষে তাঁর দশ ছেলেকে এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করা সম্ভব? যদি তিনি প্রকাশ্যে ইউসুফকে তাদের সাথে যেতে বাধা দান করেন তবে তার ফল আরও ভয়াবহ হতে পারে। তখন ইউসুফের প্রতি তাদের শত্রুতা ও আক্রোশ প্রকাশ্য রূপ ধারণ করবে। সুতারাং সম্পূর্ণ ব্যাপারটি বিচক্ষণতা ও সাবধানের সাথে সমাধা করতে হবে। তিনি কুচক্রীদের কাছে আবেদন করলেন যে তিনি বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং ইউসুফের অবর্তমানে তাঁর অভাব তীব্রভাবে অনুভব করবেন , আর সবচেয়ে বড় কথা ইউসুফ এখনও ছোট, তাঁর ভাইদের সাথে খেলার মত ক্ষমতা তাঁর হয় নাই। এরূপ ক্ষেত্রে তাঁর ভাইরা নিজেদের খেলাধূলা নিয়ে মত্ত থাকবে, ফলে ইউসুফ একা থাকবে। এমনও হতে পারে যে তাঁকে একা পেয়ে নেকড়ে-রা তাঁকে আক্রমণ করে তাঁকে খেয়ে ফেললো। এটা ছিলো একটা সম্ভাবনার কথা, কিন্তু এরই সুত্র ধরে পরবর্তীতে কুচক্রী ভাইরা তাদের পিতার নিকট ইউসুফকে নেকড়ে বাঘে খাওয়ার বানোয়াট কাহিনীর বর্ণনা করে, যা বর্ণনা করা হয়েছে [১২:১৭] আয়াতে। পৃথিবীতে কুচক্রীরা মনে করে তাদের চক্রান্ত নিচ্ছিদ্র অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু আল্লাহ্র পরিকল্পনার বেড়াজাল অত্যন্ত শক্তিশালী তা যখন চারিপাশ থেকে ঘিরে ধরে তখন চক্রান্তকারীর পলায়নের পথ থাকে না । ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিলো ইউসুফের দশ ভাই এর বেলায় যার বর্ণনা আছে নীচের [১২:৯১] আয়াতে। সেখানে বলা হয়েছে, কিভাবে দশ ভাই তাদের রচিত মিথ্যা দ্বারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এবং শেষ পর্যন্ত তাদের অপরাধ স্বীকার করে এবং অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করে।
১৬৪৫: কুচক্রী ভাইরা খুব সহজেই হযরত ইয়াকুবের যুক্তিকে খন্ডন করলো। যারা কুচক্রী তারা সর্বদা তাদের কাজের সপক্ষে ভাল এবং গ্রহণযোগ্য যুক্তি পেশে সক্ষম। দশ ভাই এর জন্যও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তাদের যুক্তি ছিল ইউসুফ সহ তারা এগারো জন। এই এগারোজনের মধ্যে দশজনই হচ্ছে সক্ষম সবল যুবা। সুতারাং তাদের শেষ করার আগে নেকড়ে বাঘের ক্ষমতা হবে না ইউসুফকে স্পর্শ করার। এভাবেই তারা তাদের মৌখিক যুক্তি তর্কে বিজয় লাভ করে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাদের অন্তরে দুষ্ট পরিকল্পনার জাল বিস্তার করছিলো যার সাথে তাদের যুক্তি তর্কের কোনও সামঞ্জস্য ছিলো না। এভাবেই যারা কুচক্রী , দুষ্ট, পাপী তারা তাদের কথার চমকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এ আয়াতের এটাই আধ্যাত্মিক উপদেশ।
১৬৪৬ : এই আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে, ইউসুফের দুঃখ-দুর্দশায় আচ্ছন্ন, তিমির অন্ধকারময় দিনগুলিতে-ও আল্লাহ্র করুণা তাঁকে ঘিরে রেখেছিলো। ঠিক সেই একইভাবে যারা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে নিবেদিত বান্দা , তাঁদের সকল দুঃখ কষ্ট, বিপদ-আপদে আল্লাহ্র কল্যাণময় ইচ্ছা তাঁদেরকে ঘিরে থাকে এবং তারা তা বুঝতে পারে। কিশোর ইউসুফকে তাঁর ভাইরা যখন কূপের মাঝে নিক্ষেপ করলো তখন তাদের অন্তরের ইচ্ছা ছিলো কূপের অভ্যন্তরে ইউসুফের মৃত্যু অথবা ক্রীতদাস হিসেবে অন্যত্র গমণ। সুস্থভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে সমগ্র ব্যাপারটি যে কোনও পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির জন্যই ছিলো ভীতিকর; সেখানে ইউসুফ ছিলেন সামান্য একজন কিশোর। কিন্তু আল্লাহ্র রহমত যাকে ঘিরে থাকে তিনি তো পার্থিব কারণে সৃষ্ট ভয়ে ভীত হতে পারেন না । কারণ সে তাঁর আত্মার মাঝে আল্লাহ্র অভয় বাণী শুনতে পায়। এক্ষেত্রে আমরা ইউসুফের ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ্র এই করুণার স্বাক্ষরই প্রত্যক্ষ করি। কূপের মাঝে বালক ইউসুফ ভীত না হয়ে অন্তরে অনুভব করলেন সাহস ও প্রজ্ঞা। তাঁর নির্মল ও বিশুদ্ধ আত্মার দর্পনে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন যে , একদিন তাঁর ভাইরা তাঁর কৃপাপ্রার্থী হবে। সেদিন তিনি তাদের অনুগ্রহ করে তাদের আজকের বিশ্বাসঘাতকতা ও কুকর্মের জন্য লজ্জ্বিত করতে পারবেন।
১৬৪৭: ইউসুফ বালক বয়েসে কূপের অভ্যন্তরে ভবিষ্যত ঘটনা যে ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, পরবর্তীতে ঘঁটনা ঠিক সেভাবেই ঘটেছিলো, যখন ইউসুফ মিশরের উজীর ছিলেন। পরবর্তীতে ইউসুফের ভাইরা ইউসুফের অনুগ্রহ প্রার্থী হয়; কিন্তু তারা জানতো না যে তারা যার অনুগ্রহ প্রার্থী সে তাদের ভাই, যাকে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে কূপে নিক্ষেপ করেছিলো । দেখুন নীচের আয়াত [১২ : ৮৯] এবং [১৩ : ৫৮]
১৬৪৮: ইউসুফের কুচক্রী দশ ভাই সন্ধ্যার পরে রাতে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার নিকট গমন করে তাদের কাল্পনিক কাহিনী বর্ণনা করলো। তারা তাদের ষড়যন্ত্রকে নিঃচ্ছিদ্র ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য রাত্রির প্রথম ভাগকে বেছে নিয়েছিলো, এটা প্রমাণ করার জন্য যে, সারা দিনমান তারা তাদের হারানো ভাইয়ের অনুসন্ধানে ব্যপৃত ছিলো।
১৬৪৯: কুচক্রী ভাইদের রচিত বক্তব্যের বিবরণ এখানে আছে। যেহেতু তারা বাইরে আমোদ-প্রামোদের জন্য গিয়েছিলো, সুতারাং তাদের বক্তব্য ছিলো যে, তারা যখন খেলাধূলায় মত্ত ছিলো , তখন ইউসুফকে নেকড়ে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। যেহেতু ইউসুফ ছিলো ছোট, সে কারণে সে খেলাধূলায় তাদের সাথে অংশগ্রহণ না করে তাদের জিনিষপত্র পাহারা দিচ্ছিলো । তারা খেলাধূলায় মত্ত থাকাতে তারা নেকড়ে বাঘের আগমন বুঝতে পারে নাই । এই আয়াতে ভাইদের যে ধূর্তরূপ ফুটে উঠেছে, তা সর্বকালের হিংসা- দ্বেষে আক্রান্ত ধূর্তব্যক্তিদের চরিত্রের অনুরূপ। তারা কৌশলে নেকড়ে বাঘের গল্পের অবতারণা করেছিলো। কারণ তাদের ধারণায় যেহেতু হযরত ইয়াকুব পূর্বেই নেকড়ে বাঘের উল্লেখ করেছিলেন এ থেকে তাদের ধারণা হয়েছিলো যে, নেকড়ে বাঘের গল্প তাদের পিতার নিকট বিশ্বাসযোগ্যরূপে পরিগণিত হবে।
উপদেশ : অসৎ ব্যক্তিরা সর্বদা সব কিছু বিশ্বাসযোগ্য রূপে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট যেনো সাধারণ মানুষ তাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে না পারে ।
১৬৫০: হযরত ইয়াকুবের দশ ছেলে আশ্চর্যভাবে প্রত্যক্ষ করলো যে, যে কাহিনীকে তারা নিঃচ্ছিদ্র ও বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে করেছিলো, সে কাহিনী হযরত ইয়াকুব অবিশ্বাস ভরে প্রত্যাখান করলেন। এই অবিশ্বাস তাদের আত্মাশ্লাঘাতে আঘাত করে , তারা তাদের নির্দোষিতার প্রমাণ স্বরূপ রক্তমাখা সার্ট উপস্থাপন করে।
১৬৫১: কুচক্রী ভাইদের ধারণা ছিলো যে, যদি তারা রক্তমাখা সার্ট তাদের পিতার নিকট প্রদর্শন করতে পারে; তবে তারা তাদের পিতার নিকট ইউসুফের মৃত্যু সম্বন্ধে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। তাদের ধারণা ছিলো যে, তাদের পিতা বিশ্বাস করবেন যে ইউসুফ বন্য প্রাণী দ্বারা নিহত হয়েছে। রক্তমাখা সার্টের রক্ত ইউসুফের ছিল না ; তা ছিলো একটি ছাগলের রক্ত । ইউসুফের ভাইরা এই উদ্দেশ্যে একটি ছাগল হত্যা করে । কিন্তু তাদের এত চেষ্টা সত্বেও তারা হযরত ইয়াকুবের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হলো না। কোন কোন তফসীরকারের মতে অবিশ্বাসের কারণ হচ্ছে সার্টটি অক্ষত ছিলো । হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ এবং প্রাণী দ্বারা ভক্ষণের পরে নিহত ব্যক্তির পরিধেয় সার্ট কখনও অক্ষত থাকতে পারে না । প্রকৃত সত্য হচ্ছেঃ আল্লাহ্র নবী যারা, তাদের আত্মার দর্পনে সত্যের ছবি সর্বদা প্রতিফলিত হবে - সে ছবি বর্তমান, অতীত বা ভবিষ্যতের যে কোনও সময়ের হতে পারে; যে ভাবে ইউসুফ কূপের মধ্যে থেকে তাঁর অদূর ভবিষ্যতের ছবি দেখতে পেয়েছিলেন।
১৬৫২: হযরত ইয়াকুব তাঁর ছেলেদের দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে আক্ষেপ করে বললেন যে, " হায় ! তোমরা যে কাহিনীর উদ্ভাবন করেছ, তা সত্যিই চমৎকার ! কিন্তু তোমাদের বৃদ্ধ পিতার কি হবে! আমার প্রিয় সন্তানকে হারানোর পরে আমার জীবনে আর কি অবশিষ্ট রইল? আমি আর কি বা করতে পারি ? আমি শুধুমাত্র ধৈর্য্য অবলম্বন করে আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি। আমার আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস আছে। এ বিশ্বাস আছে যে, তিনি যা করেন তা মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন।"
উপদেশ : সকল মোমেন ব্যক্তির জন্য বিপদে ধৈর্য্য ও আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার জ্বলন্ত উদাহরণ হযরত ইয়াকুব ।
১৬৫৩: অচেনা অজানা সওদাগররা তাদের বাণিজ্য সামগ্রী নিয়ে মিশরের পথে চলছিলো । সম্ভবতঃ এসব সওদাগরেরা ছিলো মিদিয়ানবাসী অথবা আরব । সে সময়ের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বাণিজ্যবহর তাদের পূর্বাহ্নে ক্ষুদ্র এক দলকে প্রেরণ করতো পথি মধ্যে পানির সন্ধানে । এই অগ্রগামী দলটি পানির সন্ধান পেলে সেখানে তাঁবু স্থাপন করতো। সেই অনুযায়ী কোন একটি অগ্রগামী বাণিজ্য বহর পানির সন্ধানে যে কূপে ইউসুফ নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, সেখানে পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পানির বালতি নামিয়ে দেয় ।
১৬৫৪: পানি সংগ্রাহক বালতি তুলে আশ্চর্য্য হয়ে গেলো। সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল , দেবদূতের ন্যায় নির্মল, অপূর্ব কান্তিমান এক কিশোর তার বালতিতে । ইউসুফের দর্শনে পানি সংগ্রাহক বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে গেলো ।এই কিশোর দ্বারা সে কি করবে? যাই হোক ইউসুফের দর্শনে সে উৎফুল্ল হয়ে পড়ে এবং সে চীৎকার করে তার আনন্দ প্রকাশ করে, "সুখবর " বলে । "Bushra" এই আরবী শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে "Good news" এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "সুখবর" । কিন্তু কোন কোন ব্যাখাকারীর মতে এই শব্দটি কোনও ব্যক্তির নামকে বোঝানো হয়েছে।
১৬৫৫: সেটা ছিলো একটি বাণিজ্য বহর । সুতারাং তারা প্রতিটি বিষয়কেই লাভ-লোকসান ও পণ্যের প্রেক্ষিতে বিচার করতে অভ্যস্ত । যখন তারা অপূর্ব সুন্দর কিশোরকে হঠাৎ করেই লাভ করলো , যার কোনও দাবীদার নাই। তখন তাদের ব্যবসায়ী মন সেই কিশোরকেও পণ্যের নিক্তিতে ভাবতে শুরু করলো। এই অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরকে ক্রীতদাসের বাজারে প্রভুত অর্থের বিনিময়ে বিক্রী করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তাদের উৎফুল্ল করে তুললো । সে সময়ে মিশরে Hyksos রাজবংশ রাজত্ব করছিলো । মেমফীস ছিল তাদের রাজধানী । মেমফীসের বাজারে এই অপূর্ব সুন্দর কিশোরকে তারা বিক্রীর জন্য মনস্ত করে এবং সেই অনুযায়ী যাত্রা করে। যাত্রা পথে তারা কিশোরকে অতি সংগোপনে লুকিয়ে রাখে। কারণ তাদের ব্যবসায়িক মন ছিল সদা সন্ত্রস্ত । পাছে কেউ তার প্রতি অধিকার প্রয়োগ করে । কেউ তাকে ক্রীতদাসরূপে দাবী করে এজন্য । সেই কারণে তারা যতদূর সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করে।
১৬৫৬: একই পরিবেশে থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির চিন্তাধারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। এই আয়াতটি থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, একই ঘটনা বিভিন্ন ব্যক্তির মনে বিভিন্নভাবে রেখাপাত করে। ইউসুফের মনে তীব্রভাবে তাঁর ভাইদের বিশ্বাসঘতকতা রেখাপাত করছিলো । হযরত ইয়াকুবের মন প্রাণ প্রিয় পুত্র শোকে অধীর হয়েছিলো । ইউসুফের ভাইরা ইউসুফকে বিতারিত করতে পেরে আনন্দে উদ্বেল হয়েছিলো কারণ তারা ইউসুফকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতো, ঠিক সেই একই সময়ে বণিকরা ইউসুফকে বিক্রী করে তাদের যে আর্থিক লাভ হবে সেই চিন্তায় বিভোর ছিলো। প্রত্যেকেই স্ব-স্ব চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ ছিলো - যদিও প্রকৃত ঘটনা ছিলো একটাই । আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, তিনি প্রত্যেকের চিন্তা - ভাবনা, কার্য প্রণালী, উদ্দেশ্য সবই অবগত আছেন। "উহারা যাহা করিতেছিলো সে বিষয়ে আল্লাহ্ সবিশেষ অবহিত ছিলেন।" আমরা আমাদের পরিকল্পনা করি আল্লাহ্ তাঁর পরিকল্পনা করেন। আল্লাহ্র পরিকল্পনা অবশ্যই কার্যকর হবে। আমরা যত পরিকল্পনাই করি না কেন পূণ্যাত্মা বা পাপী আমরা কেউই জানি না ভবিষ্যতে আমাদের ভাগ্যে কি আছে। আল্লাহ্র বৃহত্তর পরিকল্পনায় বিপদ, দুঃখ - দুর্দ্দশা , শত্রুর অনিষ্টকর প্রভাব সবই সময়ের বৃহত্তর পরিসরে মঙ্গলময় রূপ ধারণ করে বান্দার জীবনকে আপ্লুত করে । ইউসুফের জীবনী আমাদের এই শিক্ষাই দান করে।
১৬৫৭: "দিরহাম" এই শব্দটি গ্রীক শব্দ "Drachma" থেকে উদ্ভুদ। এর অর্থ হচ্ছে ছোট রৌপ্য মুদ্রা যার ওজন আয়তন এবং মূল্যমান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে ।
১৬৫৮: ইউসুফের বিক্রীর জন্য তারা নিম্ন মূল্য ধার্য করেছিলো । প্রকৃত সত্য হচ্ছে ইউসুফের বিক্রীর ব্যাপারে উভয় পক্ষই প্রবঞ্চনার আশ্রয় গ্রহণ করে। ইউসুফের ভাইরা আড়াল থেকে লক্ষ্য করেছিলো ইউসুফের কি পরিণতি ঘটে। যখন তারা দেখলো যে বণিকেরা ইউসুফকে নিয়ে যেতে উদ্যত তখন তারা বের হয়ে এসে ইউসুফের জন্য মূল্য দাবী করলো; কারণ তাদের বক্তব্য ছিলো যে, ইউসুফ তাদের পলাতক ক্রীতদাস । তাদের মনে যথেষ্ট ভয় ছিলো যে, যে কোনও মূহুর্তে প্রকৃত সত্য প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে । সে কারণে তারা ইউসুফের মূল্যের ব্যাপারে দরদাম করতে সাহসী হলো না, কারণ তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিলো, ইউসুফকে বিতারিত করা।
অপর পক্ষে বণিকেরাও ছিলো অত্যন্ত ধূর্ত, সে কারণে তারা ভাইদের দাবীকে সন্দেহ করলো না, বা কোনওরূপ অনুসন্ধান করলো না, পাছে তাদের মূল্যবান পণ্য "ইউসুফ" হাতছাড়া হয়ে যায় । এভাবেই সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আত্মা শুধুমাত্র কয়েকটি রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে সামান্য মূল্যে ক্রীতদাসরূপে বিক্রী হয়ে যায়।
১৬৫৯: এভাবেই ইউসুফ তার ভাইদের হিংসার দরুণ নিজ জন্মভূমি ক্যানন দেশ থেকে বিতারিত হন। বণিকেরা তাঁকে মিশরে নিয়ে আসে। সম্ভবতঃ সে সময়ে মিশরের রাজধানী ছিলো মেমফীসে । সেখানে তাঁকে বিক্রীর জন্য প্রদর্শন করা হয় । ইউসুফের ক্রেতার অভাব ছিলো না । তাঁর কান্তিমান রূপ, আকর্ষণীয় আচরণ, নিষ্পাপ চরিত্রের পবিত্রতা, বিশ্বস্ততা, সর্বপরি তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও ভদ্র আচরণ যা তাঁর চরিত্রকে মহত্ত ও মাধুর্য্য দান করেছিলো। তার ফলে সহজেই বহু ক্রেতা ইউসুফের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবৃন্দের মধ্যে তাঁকে ক্রয় করার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তি যাকে আয়াত [১২ : ৩০ ] এ "আজীজ" বলা হয়েছে, তিনি জয়লাভ করেন।
১৬৬০: দেখুন উপরের টিকা । আজীজের উদ্দেশ্য ছিলো সম্ভবতঃ পার্থিব । সম্ভবতঃ তাঁর ধারণা ছিলো এরূপ রূপবান কিশোর যে বুদ্ধিতে ও আচার , আচরণে আকর্ষনীয় তাঁকে যদি পুত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তবে সম্ভবতঃ ভবিষ্যতে এই পুত্র তাঁকে আরও সম্মান, মর্যাদা, শ্রদ্ধা, ক্ষমতা ও সম্পদ লাভে সহায়তা করবে।
১৬৬১: এই সব আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অনুধাবন করা, কিরূপ অভ্রান্ত ভাবে ও বিস্ময়কর ভাবে আল্লাহ্র পরিকল্পনা কার্যকর হয়। আল্লাহ্ ইউসুফকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবেন, তাই তাঁকে বিপদ ও দুর্ভাগ্যের মাধ্যমে জ্ঞানের উপযুক্ত করে নেন। ইউসুফ নিজেকে পূণ্যাত্মারূপে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উপযুক্ত প্রমাণ করতে সক্ষম হন। আল্লাহ্ ইউসুফকে মিশরের "আজীজের " আশ্রয়ে অধিষ্ঠিত করেন,যেনো ভবিষ্যতে ইউসুফ মিশরের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অন্যতম হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন। এভাবেই সময়ের বৃহত্তর পরিসরে ইসরাঈলী সম্প্রদায় ও তার বংশধরদের আল্লাহ্র বাণীকে ধারণ করার উপযুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে হযরত মুসার প্রতি আল্লাহ্র প্রেরিত কর্তব্য সম্পাদনের মাধ্যমে পৃথিবীতে আল্লাহ্র বাণী প্রচারের পথ সুগম হয় । আল্লাহ্র পরিকল্পনা সময়ের বৃহত্তর পরিসরে কার্যকর হবেই হবে। "আল্লাহ্ তার সকল কার্যে পূর্ণ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব রাখেন ।"
১৬৬২: "Ahadith" অর্থ কাল্পনিক বা প্রকৃত জীবন কাহিনী বা কাহিনী যা স্বপ্নে প্রতিভাত হয়। আমাদের এই চেনা পৃথিবীতে যা ঘটে তার সব কিছুর বিচার বাহ্যিকভাবে করা চলে না । সংঘটিত ঘটনার প্রকৃত ব্যাখা অনেক সময়ে আমাদের চর্মচক্ষুর অগোচরে থাকে। একথাকেই মহাকবি সেক্সপীয়ার হেমলেটের ভাষ্যে এভাবে বর্ণনা করেছেন, "There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of your philosophy", চক্ষু, কর্ণ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তার সাহায্যে ঘটনার প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। জীবনে চলার পথে আজকে যে ঘটনাকে মনে হবে দুঃখ দুর্দ্দশার কারণ অনাগত ভবিষ্যতে সেই ঘটনাকে মনে হবে আর্শীবাদ । সময়ের বৃহত্তর পরিসরে ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য ধরা পড়ে। যে ঘটনাকে মনে হবে অতি সাধারণ তার ভিতরেই লুকিয়ে থাকতে পারে বৃহত্তর ও মহত্তর সম্ভাবনার বীজ। সাধারণ ঘটনার সূদূর প্রসারী জ্ঞানকেই বলে তত্বজ্ঞান। কখনও কখনও তত্বজ্ঞান বা প্রজ্ঞা সাধারণ মানুষের মানসপটে উদিত হয় । কিন্তু তা খুব স্বচ্ছ্ব হয় না । কবি, জ্ঞানী ব্যক্তি, বা নবী - রাসুল এরা হলেন সেই শ্রেণীর ব্যক্তি যাদের মানসপটে কোনও ঘটনার গভীর জ্ঞান বা গুঢ়তত্ব উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হয়। সাধারণ ঘটনার গভীরে আল্লাহ্র যে ইচ্ছা কাজ করে তার স্বরূপ যারা উপলব্ধি করতে পারেন তারাই মহাজ্ঞানী। তাদেরকেই দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বলা হয় । হযরত ইউসুফকে আল্লাহ্ বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে এই দিব্যজ্ঞান দান করেন। ভাইদের তীব্র ঘৃণা ও হিংসার কারণে হযরত ইউসুফকে নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে সূদূর মিশরে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি হতে হয়। আপাতঃ দৃষ্টিতে ঘটনাটি ইউসুফের জন্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মাতৃহারা ইউসুফ পিতাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সেই পিতার স্নেহ বঞ্চিত হয়ে ক্রীতদাসের জীবনে প্রবেশ করা, হযরত ইউসুফের সেই দুর্যোগময় দিনগুলি সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কিন্তু সেই বিপদ ও দুর্যোগের মধ্যেই নিহিত ছিলো স্রষ্টার মঙ্গলময় ইচ্ছা । ইউসুফের ধৈর্য্য, আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা ও আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসর্ম্পণের মাধ্যমেই হযরত ইউসুফকে আল্লাহ্ এই দিব্যজ্ঞান দান করেন। যে পিতাকে তিনি প্রাণাধিক ভালোবাসতেন , ভাইদের ষড়যন্ত্রের ফলে সেই পিতৃস্নেহ থেকে কৈশোরেই বঞ্চিত হন। মিশরের জীবনও তার খুব মসৃন ছিল না । নানা প্রতিকূলতা ও বিপদ - বিপর্যয়কে অতিক্রম করে আল্লাহ্ তাকে মিশরের শাসন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করেন। মানুষের মঙ্গল কামনা, মানুষের মঙ্গলের জন্য তাঁর কাজ, তাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। তাঁর কর্মের প্রেরণা ও উদ্যমের দ্বারা মিশরের তথা সমসাময়িক পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মঙ্গল সাধন করতে সক্ষম হন, দেশবাসীর সুখ ও সমৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে পারেন। সূর্য, চন্দ্র, তারা সেজদা করছে, ইউসুফের এই স্বপ্ন এভাবেই সফল হয় । আল্লাহ্র ভবিষ্যত পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ছিলো তাঁর এই স্বপ্ন। ভবিষ্যতে ইউসুফ মিশরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করবেন এবং সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে মানবতার সেবা করবেন আল্লাহ্র এই ছিলো ইচ্ছা। তবে আল্লাহ্র ইচ্ছা পূরণের জন্য বান্দাকে অনেক দুঃখ-দুর্দ্দশা, বিপদ-আপদের পরীক্ষা দিতে হয়। যে ধৈর্য্য, সহিঞ্চুতা , দৃঢ়তা ও প্রার্থনার মাধ্যমে সেই বিপদকে অতিক্রম করতে পারে, সেই পৌঁছাতে পারে নির্দ্দিষ্ট মঞ্জিলে। হযরত ইউসুফের জীবনের উত্থান ও পতনের মাধ্যমে, আল্লাহ্ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন জীবনের গুঢ়তত্ব। আজ যা মনে হবে ভুল, শয়তানের ফাঁদ, ষড়যন্ত্র, ব্যর্থতা বা ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে নিস্পেষণ - ভবিষ্যতের পটভূমিতে তার মূল্যায়ন করতে হবে। আর এই তত্বজ্ঞান ই আল্লাহ্ ইউসুফকে শিক্ষা দিয়েছেন। ইউসুফের এই প্রজ্ঞা ও তত্বজ্ঞান স্বপ্নের ব্যাখা করতে সক্ষম ছিলো।
১৬৬৩: "আল্লাহ্ তাঁহার কার্যে পূর্ণ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব রাখেন।" আমরা আমাদের চেষ্টা ও ক্ষমতা অনুযায়ী আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করি, কিন্তু সে নিয়ন্ত্রণ হবে ক্ষণস্থায়ী । আমাদের সকল কর্মপ্রচেষ্টার শেষ পরিণতি আল্লাহ্র হাতে। আমাদের ভবিষ্যত পরিণতি ঐশ্বরিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রনে । মানুষের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা আল্লাহ্র পরিকল্পনা প্রতিহত করতে পারে না । আল্লাহ্ স্বীয় কর্মে প্রবল ও শক্তিমান। যাবতীয় বাহ্যিক কারণ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সংঘটিত হয়। কিন্তু অধিকাংশ লোক এ সত্য বোঝে না । তারা বাহ্যিক উপকরণকেই সব কিছু মনে করে , এগুলোর চিন্তায় ব্যপৃত থাকে এবং উপকরণ সৃষ্টিকারী সর্বশক্তিমানের কথা ভুলে যায়। ফলে মানুষের চেষ্টা, চিন্তা, কর্ম সবই হয় অসম্পূর্ণ । এ কথাই সেক্সপীয়ার বলেছেন, [Hamlet V-2] "This too, too solid flesh!" ইউসুফের কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই সত্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। ইউসুফের আল্লাহ্র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁকে পার্থিব লোভ-লালসার উর্দ্ধে স্থাপন করেছিলো । অর্থ, সম্পদ, সুন্দরী তরুণী সব কিছুর প্রলোভনের তিনি ছিলেন উর্দ্ধে। তার ফলে আল্লাহ্ তাঁর মাঝে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্ম দেন, এবং মানুষের সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। এভাবেই আল্লাহ্র রহমত ও করুণার প্রকাশ ঘটেছে যুগে যুগে। কারণ আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান ।
উপদেশ : আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও তার বিধান মানার মাধ্যমেই আত্মিক উন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানে উন্নত ব্যক্তির হৃদয়কে আল্লাহ্ তত্বজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন, যেমন করেছিলেন ইউসুফকে।
১৬৬৪: ইউসুফ যখন ক্যানন দেশ থেকে মিশরে আনীত হন, তিনি ছিলেন একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর মাত্র। কিন্তু সেই বয়সেও তাঁর চরিত্র ছিলো ফুলের মত নির্মল ও সুন্দর । সব অসুন্দর ও পাপ থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতেন। মিশরে তাঁর ভাগ্যের উত্থান -পতনের মধ্য দিয়ে তিনি যৌবনে পদার্পন করেন এবং আল্লাহ্ তাকে জ্ঞান, বিবেক ও ক্ষমতা দ্বারা অভিষিক্ত করেন।
১৬৬৫: "Muhsinin" এই শব্দটির অর্থ যারা ন্যায়ের পথে থাকে এবং যারা ভালো কাজ করে। এই আয়াতে সৎ কর্মপরায়ণরূপে অনুবাদ করা হয়েছে। কারণ সৎকর্মপরায়ণ বলতে উপরের দ্বিবিধ অর্থকেই বোঝায়। ন্যায় কথাটির গুঢ় অর্থ হচ্ছে অন্যের প্রতি তার প্রাপ্য অনুযায়ী সঠিক আচরণ করা। ন্যায় এবং ভালো কাজ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ন্যায় ব্যতীত ভালোকাজ সম্ভব নয়। আবার ভালোকাজ করতে হলে অবশ্যই ন্যায়বান হতে হবে। ন্যায় এবং সৎকাজ মানুষকে পূণ্যাত্মা ব্যক্তিতে পরিণত করে। আর পূণ্যাত্না ব্যক্তিই হচ্ছে আল্লাহ্র রহমতের যোগ্য । যেমন - ইউসুফকে আল্লাহ্ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন।
উপদেশ : সর্বকালে সর্বযুগে পূণ্যবান ব্যক্তিরা আল্লাহ্র হিক্মত ও জ্ঞান লাভ করেন।
১৬৬৬: "আজীজ" ইউসুফকে কখনও ক্রীতদাসের ন্যায় ব্যবহার করেন নাই । তাঁর আচরণ ইউসুফের প্রতি পুত্র বা অতিথি অপেক্ষাও অধিক সম্মানীয় ছিলো। আজিজের গৃহে ইউসুফের যখন এরূপ উচ্চাসনে অধিষ্ঠান ছিলো, সে সময়ে জোলেখা (আজিজের স্ত্রী) তাঁকে তাঁর প্রেমের ফাঁদে প্রলোভিত করে। এর দ্বারা সে শুধু ইউসুফের সম্মান ও মর্যাদাকেই ভূলুন্ঠিত করে নাই তৃতীয় যে অন্যায় সে ইউসুফের প্রতি করেছিলো তা ছিলো জোলেখার কামজ প্রেমের পরিণতি যা ইউসুফের সম্মান ও মর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করে। কামজ প্রেমের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মতুষ্টি । সত্যিকারের ভালোবাসার উদ্দেশ্য হবে ভালোবাসার জনের কল্যাণ কামনা, আত্মতুষ্টি সেখানে শেষ কথা নয়। নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেবার মধ্যেই প্রকৃত প্রেমের সার্থকতা । কিন্তু এই কাহিনীতে জোলেখা যে মূহুর্তে ধৃত হলো সঙ্গে সঙ্গে সে সমস্ত অপরাধ ইউসুফের উপর ন্যস্ত করতে দ্বিধা বোধ করলো না। একবারও চিন্তা করলো না নিরাপরাধ, নিষ্পাপ ও সম্মানীয় ব্যক্তির জন্য তা কতখানি ভয়াবহ ও মর্মান্তিক হতে পারে । ইউসুফের ন্যায় নিষ্পাপ ও পূণ্যাত্মা লোক অবশ্যই জোলেখার প্ররোচনাকে প্রতিহত করবে - এবং তাই - ই ছিলো ইউসুফের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু জোলেখার কামজ প্রেম এই বাঁধাতে প্রতিহিংসায় উম্মত্ত হয়ে ওঠে। ফলে ইউসুফের মান সম্মান , সামাজিক মর্যাদা সব কিছুই ভূলুন্ঠিত করতে জোলেখা দ্বিধা বোধ করে নাই ।
১৬৬৭। জোলেখাকে প্রতিরোধ করার জন্য ইউসুফের আবেদন ছিলো ত্রিবিধ। ১) আমি আমার প্রভুর কর্তব্যের কাছে দায়বদ্ধ, ঠিক সেইরূপ তুমিও তোমার স্বামীর কর্তব্যের কাছে। ২) আজীজ যেভাবে দয়া মহানুভবতা ও সম্মানের সাথে আমার প্রতি আচরণ করেছেন, তার প্রতিদান শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমেই শোধ হবার নয় ৩) তুমি কি দেখ না যে তুমি পাপের তীব্র আসক্তি দ্বারা আকর্ষিত? পাপের দ্বারা কোনও মঙ্গল অর্জন করা যায় না ? আমাদের সকলেরই আল্লাহ্র আইন ও মানুষের তৈরী আইন মেনে চলা উচিত। সীমা লংঘনকারিগণ সফলকাম হয় না। "
১৬৬৮: জোলেখা কাম রীপুর তাড়নায় দ্বিগ্বিদিগ জ্ঞানশুন্য ছিলো। সে কারণেই ইউসুফের আবেদন তাঁকে স্পর্শ করলো না । জোলেখার সৌন্দর্য্য, প্রেম, ইউসুফকে পাওয়ার আকুলতা, ইউসূফকে প্রলোভিত করেছিলো সত্য, কিন্তু সেই মহা প্রলোভনের মুখেও তিনি আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করতে ভোলেন নাই । বিশ্বাসীদের প্রার্থনার উত্তর আল্লাহ্ দিয়ে থাকেন। তাই সেই সুন্দরী রমনীর তীব্র আবেগ ও কামনার মুখেও তিনি প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা জোলেখা অনুধাবন করতে পারে নাই । কারণ জোলেখার জগৎ কামনার বিষ-বাষ্পে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলো। সে অন্ধকার ভেদ করে সত্যের আলো প্রত্যক্ষ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাঁর ধারণা ছিলো বন্ধ দরজার আড়ালে কেহ তাঁকে দেখতে পারবে না। কিন্তু হযরত ইউসুফ জানতেন আল্লাহ্র উপস্থিতি সর্বত্র । এই উপলব্ধিই তাঁকে সর্বপ্রকার প্রলোভন থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েছিলো ।
উপদেশ : পৃথিবীর জীবন নানা প্রলোভনে ভরা । একমাত্র আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমেই এই প্রলোভনের বেড়াজালকে ছিন্নভিন্ন করা সম্ভব । এই আয়াতে বিশ্ববাসীকে সেই আশ্রয় প্রার্থনার জন্যই বলা হয়েছে।
১৬৭০: কামোন্মত্ত প্রভুপত্নীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইউসুফ দরজার দিকে ধাবিত হলেন। জোলেখাও তাঁর পিছনে পিছনে ধাওয়া করলেন। জোলেখা পিছন থেকে তাঁর পোষাক টেনে ধরলো । ইউসুফ ছিলেন সামনে ধাবমান এবং জোলেখা তাঁর সার্টের পিছন থেকে টেনে ধরে তাঁর অগ্রগতি রুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ইউসুফ জোলেখার অন্ধ কামনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। ফলে তিনি দৃঢ়তার সাথে সম্মুখে অগ্রসর হলেন এবং দরজা খুলে দিলেন। টানা হেচড়ার ফলে ইউসুফের সার্ট পিছন থেকে ছিঁড়ে গেলো। যখন দরজা খোলা হলো, আজিজ কালক্রমে দরজার সম্মুখেই ছিলেন। এ কথা ভাবার অবকাশ নাই যে, আজিজ তাঁর স্ত্রীর উপরে গোয়েন্দাগিরি করছিলেন । তিনি তা করেন নাই । ঘটনাচক্রেই সেখানে ছিলো তার অবস্থান । তবে তিনি ছিলেন একজন ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তি । জোলেখা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর আতঙ্ক সহজেই অনুমেয় । একটি পাপ আর একটি পাপের জন্ম দেয়। তাঁর পাপকে গোপন করার জন্য এবং নিজেকে নিরাপরাধ প্রমাণ করার জন্য জোলেখা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। জোলেখা ধারণা করেছিলো এই মিথ্যার ফলে সে যে শুধু নিজেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবে তাই নয়; ইউসুফের উপরেও প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হবে। তাঁর প্রেমের প্রত্যাখানের প্রতিশোধ। পার্থিব ভালোবাসা যা কামোন্মক্ততা থেকে উৎপন্ন , জোলেখাকে হিংস্র করে তুলে , প্রতিশোধ স্পৃহাতে তাঁর মধ্যে ন্যায় অন্যায় বোধ লুপ্ত হয়ে যায় ।
১৬৭১: জোলেখার মিথ্যা অভিযোগ আপতঃদৃষ্টিতে ন্যায় সঙ্গত মনে হয়। ইউসুফকে দেখা যায় বিধ্বস্ত পোষাক - পরিচ্ছদে। সুতারাং জোলেখা সমগ্র ঘটনাকে এভাবে চিত্রিত করতে প্রয়াস পায় যে, ইউসুফ হঠাৎ তাঁকে আক্রমণ করেন এবং তিনি আত্মরক্ষার জন্য চেষ্টা করেন যার ফলে ইউসুফের পোষাক পরিচ্ছদ বিপর্যস্ত । একজন ক্রীতদাসের পক্ষে এরূপ চেষ্টা কত বড় অপরাধ তা সহজেই অনুমেয় । শাস্তি হিসেবে হয়তো তাঁকে অন্ধকার কারাকক্ষে নিক্ষিপ্ত করা হবে, নতুবা চাবুক মারা হবে। উভয় ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে ইউসুফকে জোলেখা স্বঅধিকারে আনার সুযোগ লাভ করবে।
১৬৭২: সমস্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেও ইউসুফ তাঁর সম্মান, গাম্ভীর্য ও বিবেক বুদ্ধি হারান নাই। তিনি চিৎকার করে প্রতিবাদ করেন নাই, কিন্তু দৃঢ় ও প্রত্যয়ী কন্ঠে সত্যকে প্রকাশ করতে কুন্ঠিত হন নাই । সত্যকে সহজভাবে তিনি প্রকাশ করেছিলেন।
১৬৭৩: জোলেখা ও ইউসুফের মধ্যে ঘটনার কোন সাক্ষী ছিলো না। সত্যিকার ভাবে তাঁদের দুজনার মধ্যে বদ্ধ দরজার আড়ালে কি ঘটেছিলো তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আমরা অনুমান করতে পারি যে, সেখানে ইউসুফ জোলেখাকে কেন্দ্র করে বিরাট জটলার সৃষ্টি হয়েছিলো । সমস্ত ভৃত্যরা এবং প্রাসাদের সকলেই সেখানে সমবেত হয়েছিলো । সকলেই প্রকৃত ঘটনা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিলো । কিন্তু অতি সাধারণ একজন যে এই ব্যাপারের সাথে জড়িত নয়, তার মাধ্যমে আল্লাহ্ প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটিত করেন । এ কথা থেকে এই সত্যই প্রতিভাত হয় যে, মানুষ যখন উত্তেজিত থাকে তখন অতি সাধারণ সত্যও সে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয় না, যা একজন ধীর স্থির সাধারণ ব্যক্তির কাছে প্রতিভাত হয়, উত্তেজিত ব্যক্তির অনুধাবন ক্ষমতা অন্তর্হিত হয় । When anger appears, wisdom disappears.
১৬৭৪: যদি ইউসুফের সার্ট পিছন থেকে ছেড়া হয়, তবে অবশ্যই ইউসুফ জোলেখার দিকে পিঠ দিয়ে দরজার দিকে দৌড়াচ্ছিলেন। সেই সময় আজীজের স্ত্রী তার সার্ট পিছন থেকে টেনে ধরে। সার্টের পিছন দিক ছেড়া প্রকৃত ঘটনার এই সত্যের দিকেই ইঙ্গিত করে। দোষী সম্বন্ধে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না এবং এই যুক্তি আজিজের মনেও দৃঢ় প্রত্যয় উৎপন্ন করে।
১৬৭৫: প্রকৃত ঘটনায় কে দোষী এ কথা সকলের নিকট দিবালোকের মত ভাস্বর হয়ে উঠলো। গৃহের কর্তা হিসেবে দোষীকে শাস্তি দানের সিদ্ধান্ত আজীজের নেওয়া কর্তব্য । সম্পূর্ণ ঘটনা তাঁকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছিলো । কারণ আজিজ ছিলেন রাজ-আমত্য , সম্মানীয় ব্যক্তি । তাঁর স্ত্রী একজন ক্রীতদাসের প্রেমে কাঙ্গালিনী হয়ে দৌড়াবে , এ কথা তাঁর মত একজন উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীর জন্য কতটা সম্মান হানিকর তা সহজেই অনুমেয় । তা সত্বেও আজীজ তাঁর স্ত্রীকে তিরষ্কার ব্যতীত অন্য কোনও শাস্তি দান করেন নাই। সম্ভবতঃ তিনি জোলেখাকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন । তাই তিনি সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ ঘটনাটিকে মেয়েদের রঙ্গকৌতুক, বা ছলাকলা বা ভালোবাসার পাগলামি এভাবেই গ্রহণ করেন। কিন্তু আজীজ ছিলেন ন্যায় বিচারক । তিনি ইউসুফের অপরাধ শুন্য, নিষ্পাপ চরিত্র, মনিবের প্রতি আনুগত্য, নিখাদ চরিত্রকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, এবং তাঁর প্রতি ন্যায় বিচারই করেছিলেন।
১৬৭৬: সম্পূর্ণ ঘটনাটিতে ইউসুফের প্রতি ন্যায় বিচার করা হয় নাই। আজীজ শুধুমাত্র ইউসুফের কাছে ক্ষমা চেয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বিবেচনায় আনেন নাই যে, সম্পূর্ণ ঘটনা ইউসুফের মনে কি ব্যাথা ও বেদনার সৃষ্টি করেছিলো। প্রথমতঃ তাঁর স্ত্রীর প্রেমের ফাঁদ তাকে মানসিক আঘাত দান করে । দ্বিতীয়তঃ আজিজের স্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগের উত্থাপন করে। তৃতীয়তঃ ইউসুফের মত নির্মল চরিত্রের ব্যক্তির পক্ষে সকলের উপস্থিতিতে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো তা সহ্য করা সত্যিই কঠিন ছিলো । আজীজের উচিত ছিলো, জোলেখাকে বলা ইউসুফের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য এবং তার পরে তার বলা উচিত ছিলো, অপরাধের জন্য তার নিকট ক্ষমা চাওয়া ।
রুকু - ৪
১৬৭৭: "আজীজ" হচ্ছে উচ্চ পদস্থ রাজন্য বর্গের উপাধি।
১৬৭৮: আজীজের ন্যায়পরায়ণতা, জ্ঞান, সূবিবেচনা জোলেখা - ইউসুফের ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারতো, যদি না শহরের কুৎসা রটনাকারী মহিলারা এই ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামাতো। আজীজ জোলেখাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন এবং সে ক্ষমতা ও অধিকার তার ছিলো । সম্ভবতঃ তিনি জোলেখার আচরণ বুঝতে পেরেছিলেন । সম্পূর্ণ ঘটনাতে
ইউসুফের ইস্পাত দৃঢ় মনোবলে ও চরিত্রের দৃঢ়তা -ই প্রকাশ পেয়েছে।
১৬৭৯: আজীজের স্ত্রী জোলেখার বদনাম যখন শহরের প্রধান গল্পের বিষয় বস্তু , জোলেখার মান-সম্মান ধূলায় লুন্ঠিত। তখন আজীজের স্ত্রী শহরের মহিলাদের ভোজ সভায় আমন্ত্রন করলো । ভোজ সভার দৃশ্যটি কল্পনা করতে পারি এভাবে শহরের অভিজাত মহিলারা আরামদায়ক চেয়ারে আরাম করে বসে ভোজ সভা উপভোগ করছে। মূল ভোজ শেষে মিষ্টান্ন খাবার সময় উপস্থিত । ভোজ শেষে সকলেই অলসভাবে আলাপচারিতায় নিমগ্ন। সেই সময়ে আজিজের স্ত্রী আপেল কাটার জন্য প্রত্যেকের হাতে একটি করে ছুরি দিলেন। সকলেই যখন আপেল কাটতে উদ্যত সে সময়ে জোলেখা ইউসুফকে সভাস্থলে উপস্থিত হতে আদেশ দান করেন। ইউসুফের উপস্থিতি তাদের মাঝে যে হতবিহ্বল ও আত্মবিস্তৃতি এনে দেয় তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। ইউসুফের রূপের ছটায় মুগ্ধ হয়ে মহিলারা আপেল কাটার পরিবর্তে নিজেদের হাত কেটে ফেললো । তাদের বক্তব্য ছিলো, "এতো মানুষ নয়, এতো মহিমান্বিত ফেরেশতা।" আজীজের স্ত্রী এবারে মহিলাদের দোষারোপের উত্তর দিতে সক্ষম হলেন।
১৬৮০: জোলেখাfর বক্তব্য ছিলো সুক্ষ চাতুর্যপূর্ণ । আজীজের ভর্ৎসনাতে তাঁর মধ্যে যেটুকু অনুতাপের সৃষ্টি হয়েছিলো, সেই বিবেককে অন্যায়ের আড়ালে চাপা দেওয়ার জন্য তাঁর অন্যের সহযোগীতার প্রয়োজন ছিলো । সেই সহযোগীতা ও সহমর্মিতা সে লাভ করতে সচেষ্ট ছিলো কৌশলে শহরের অভিজাত মহিলাবৃন্দ দ্বারা। জোলেখার বক্তব্যকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম অংশে তাঁর কন্ঠে বিজয়ের সূর ধ্বনিত হয়েছে। "এই তো যার সম্বন্ধে তোমরা নিন্দা করেছ।" অর্থাৎ সামান্য দেখা মাত্র তোমাদেরও ঐ একই অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে। সুতারাং আমার দোষ কোথায়? যে আচরণের জন্য জোলেখার লজ্জ্বিত হওয়া উচিত ছিলো, মহিলাদের সহানুভূতি ও সমর্থনে লজ্জার পরিবর্তে তার বিবেক তিরোহিত হলো। সে তার কৃতকর্ম সঙ্গত হয়েছে বলে শপথ করলো । এভাবেই সে তাঁর পাপকে সমর্থন করে এবং তাঁর সম্বন্ধে গর্ববোধ করে। তার বক্তব্য দ্বারা সে এক ধাপ নিম্নগামী হয়ে যায়। কারণ সে ইউসুফের অপাপবিদ্ধ, নিষ্কলুষ চরিত্রের দৃঢ়তা এবং নিজেকে পাপ থেকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ়তা প্রকাশ করাকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করলো। এসবের কোনও মূল্যই ছিল না তাঁর কাছে। জোলেখা এ সময়ে সামান্য বিরতি নেন - যেনো তাঁর বক্তব্য শ্রোতাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করতে পারে। এর পরে সে তাঁর বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ শুরু করে । তাঁর এই বক্তব্যে মহিলাদের মধ্যে কামোন্মত্তার তীব্র আবেগের সৃষ্টি হয় এবং সকলের মাঝে তা সংক্রমিত হয়। জোলেখার একার বক্তব্য সকল মহিলাদের বক্তব্য আকারে প্রকাশ পেতে থাকে। সকলেই জোলেখার বক্তব্যের প্রতি একাত্বতা প্রকাশ করে। সকল মহিলারা ঐকমত্যে পৌঁছায় যে, কোনও সুন্দরী নারীর আত্মনিবেদন প্রত্যাখান করার অধিকার কোনও পুরুষের নাই । তাতে নারীর সৌন্দর্যের অবমাননা করা হয়, যা মহিলাদের মতে সর্বোচ্চ অপরাধের সামিল। কামোন্মত্ত জোলেখার ন্যায়, অন্যায় বোধ বিলুপ্ত হয়ে যায় । জোলেখার মনে এভাবও বিরাজ করছিলো যে, ইউসুফ সামান্য একজন ক্রীতদাস । অবশ্যই সে তাঁর মনিবের হুকুম মান্য করতে বাধ্য । আর তা যদি না করে তবে তাকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হবে যেখানে দুষ্কৃতিকারীদের রাখা হয় । দুর্ভাগ্য ইউসুফের। জোলেখা তাঁর অপকর্মের সমর্থনের জন্য সম্পূর্ণ ঘটনার আয়োজন করেছিলো ।এভাবেই সে তাঁর পাপ লিপ্সা পূরণের জন্য ক্রমাগত অধঃপাতিত হয়েছিলো । জোলেখার অসৎ কর্মের দরুণ ইউসুফকে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রনা ও দুঃখ কষ্টের পথ অতিক্রম করতে হয়।
১৬৮১: এরা আমাকে যার প্রতি আহ্বান করছে ...... । লক্ষ্য করুণ এখানে বহুবচন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। "সে" একবচন শব্দ ব্যবহার করা হয় নাই । পূর্বে শুধুমাত্র একজন নারী জোলেখার ফাঁদ ছিলো । বর্তমানে তা বহু নারীতে রূপান্তর হয়েছে।
১৬৮২: ইউসুফের বক্তব্য এখানে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নবী ও রসুলদের যে বৈশিষ্ট্য সেই বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায় ইউসুফের বক্তব্যে। জীবনের সর্ব অবস্থায় আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করা নবী ও রসুলদের বৈশিষ্ট্য । ইউসুফ জানতেন মানুষকে দুর্বল ভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। নিজস্ব ক্ষমতার জন্য গর্ব করার কিছুই নাই । নিজস্ব একক প্রচেষ্টায় পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। একমাত্র আল্লাহ্র সাহায্যই পারে সকল পাপ থেকে বান্দাকে রক্ষা করতে। তাই ইউসুফ পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করেছিলেন । আল্লাহ্র সাহায্যই একমাত্র সকল বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে সফলতা এনে দিতে পারে। যারা অন্ধ এবং মূর্খ তারা জানে না তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা । তারা জানে না তাঁদের দুর্বলতা, তারা জানে না তাদের জয় পরাজয়ের সীমানা। অশেষ ক্ষমতার অধিকারী সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ ।
১৬৮৩: এভাবেই ইউসুফ মহিলাদের ছলা কলা থেকে রক্ষা পেলেন । আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা না করলে অবশ্যাম্ভবীভাবে তাঁর অধঃপতন ঘটতো । আল্লাহ্র করুণায় তাঁর চরিত্রের নির্মল দিকটি সকলের চোখে উজ্জ্বল ভাবে প্রতিভাত হলো।
১৬৮৪: যখন ইউসুফের চরিত্রের নির্দ্দোষিতা ও নির্মলতা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হলো, সম্পূর্ণ ঘটনার জন্যে দোষারোপ করা হলো নগরীর মহিলাদের উপরে। এর পরে কারাগারে যাওয়ার মধ্যে ইউসুফের কোনও অগৌরব ছিলো না। সম্পূর্ণ নাটকটি ধীরে ধীরে শেষ পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল । পূত পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ইউসুফের নিকট মহিলাদের কাম প্রবৃত্তির কাছে আত্নসমর্পণ অপেক্ষা কারাগার ছিলো শ্রেয়ঃ। ঘটনার প্রেক্ষাপট এমন হলো যে ইউসুফ এখন শুধুমাত্র একজন স্ত্রীলোকের কামনার বস্তু নয়, সে এখন শহরের অভিজাত সুন্দরী সকল মহিলার কামনার বস্তু। মহিলাদের ধারণা ছিলো , তারা ইউসুফকে কারাগারের ভয়ে ভীত করে তাদের কামের ইচ্ছা পূরণ করবে। কিন্তু হায় পথভ্রান্ত জীব! তারা জানে না , যারা আল্লাহ্র রাস্তায় থাকে! আল্লাহ্কে ভালোবেসে জীবন উৎসর্গ করতে চায়, তাদের ভয় বা প্রলোভনের দ্বারা পাপের পথে টেনে নামানো সম্ভব নয়। ইউসুফকে কারাগারে প্রেরণের বিষয়টি আজীজের মনঃপুত ছিলো। কারণ তিনি ধারণা করেছিলেন যে ইউসুফকে দৃষ্টি সীমার বাইরে রাখলে জোলেখা ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি আকর্ষণ হারাবে। এই ধারণা শুধুমাত্র যে আজীজেরই ছিলো তা নয়, শহরের অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাও তাদের স্ত্রীদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হয়ে ওঠে । তাই তারাও আজীজের মতানুযায়ী এই ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলো । তারা জানতো যে ইউসুফ নিরাপরাধ এবং তারা ইউসুফের মধ্যে পূণ্যাত্মা লোকের প্রতিফলন দেখেছিলো। কিন্তু তারা মহিলাদের ইউসুফের প্রতি আকর্ষণে চিন্তিত আতঙ্কিত হয়ে যায়। তারা সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্তে আসে যে সমাজের বিশৃঙ্খলা এবং বহুলোকের যন্ত্রনা ভোগের পরিবর্তে একজনের কারাগার ভোগ করা উত্তম। যদিও সে ব্যক্তি নিরাপরাধ ও পূণ্যাত্মা হয়। যুগে যুগে পৃথিবীতে এ ভাবেই যারা পূণ্যাত্মা, ভালো লোক তারা অন্যায়কারীর হাতে শাস্তি পেয়ে থাকে, ইউসুফও তার ব্যতিক্রম ছিলো না ।
রুকু - ৫
১৬৮৫: ইউসুফের জীবন সময়ের কালস্রোতে বিচিত্র ভাবে বহমান হচ্ছিল। শৈশবে, কৈশরে , যৌবনে - জীবনের বিভিন্ন সময়ে জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছে বিভিন্ন ঘটনার সমারোহ । কারাগারে নিক্ষেপের পর থেকে ইউসুফের জীবনে আর এক নূতন অধ্যায় শুরু হলো। ইউসুফের জীবন সম্পর্কে আল্লাহ্র বৃহত্তর পরিকল্পনা এবারে নূতন খাতে প্রবাহিত হতে থাকলো। মন্দ ও খারাপ যারা তারা ভালোর বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে পারে, জগৎ সংসার তাদের মতে প্রভাবিত করতে পারে, কিন্তু জগৎ সংসারের যিনি মালিক , তিনি মন্দের সকল কুপ্রভাবকে সময়ের বৃহত্তর অঙ্গনে মঙ্গলময়রুপে পরিবর্তন করে দেবার ক্ষমতা রাখেন। আর এই পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন বান্দা অবিচলভাবে মঙ্গলময় আল্লাহ্র উপরে আস্থা রেখে সকল পাপ থেকে ধৈর্য্যের সাথে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। একজন নিরপরাধ ব্যক্তির পক্ষে কারাগারকে বরণ করে নেয়ার মধ্যে ইউসুফের চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি দৃশ্যমান। এভাবেই আল্লাহ্ দুঃখ দুর্দ্দশার মধ্যে দিয়ে বান্দার চরিত্রের গুণাবলীকে প্রস্ফুষ্টিত করতে সাহায্য করেন। যেমন আগুনে পুড়ে সোনা খাঁটি হয়, সেরূপ দুঃখের আগুনে পুড়ে চরিত্রের গুণাবলী উজ্জ্বল ভাস্বর হয়। ইউসূফকে আল্লাহ্ মিশরের আপামর জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দ্দশা থেকে মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেত চান - আর সে জন্যই এই প্রস্তুতি। কিন্তু অপূর্ব আল্লাহ্র কর্মপদ্ধতি । ইউসুফকে ফেরাউনের সম্মুখে উপস্থিত করা প্রয়োজন, কিন্তু সেটা যেনো কারও অনুগ্রহে না হয় সে ব্যবস্থাই কৌশলে আল্লাহ্ করে দিলেন। আর সে কারণেই যে ব্যক্তি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ফেরাউনের ব্যক্তিগত ভৃত্য নিযুক্ত হয়েছিলো; সে ইউসুফের নির্দোষিতার কথা, মুক্তির কথা ফেরাউনের নিকট পেশ করার শপথ করা সত্বেও ভুলে গেলো। অপরপক্ষে নির্দোষ ইউসুফ কারাগারে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য একান্ত নিষ্ঠার সাথে করে গেছেন। কারাগারের সবার মাঝে সত্যের প্রচার করে গেছেন। কি অবিচল নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আল্লাহ্র প্রতি।
১৬৮৬: ইউসুফের সমসাময়িক সময়ে আরও দুজন লোক ফেরাউনের রোষে পতিত হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। এরা ছিলেন রাজকর্মচারী। এদের মধ্যে একজন ছিলেন, পান-পাত্র বাহক (বাটলার বা প্রধান স্টুয়ার্ড) যার প্রধান কাজ ছিলো রাজার পানীয় দ্রব্য প্রস্তুত ও পরিবেশন করা। অন্যজনের কর্তব্য কর্ম ছিলো রাজার জন্য রুটি তৈরী করা। এদের দুজনকেই কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। প্রথম জন স্বপ্ন দেখলো যে, সে তার পুরাণো চাকুরীতে বহাল হয়েছে, এবং মদ তৈরী করছে, দ্বিতীয় জন স্বপ্ন দেখলো, সে মাথায় করে রুটি তাঁর প্রভুর কাছে নেবার পূর্বেই পাখীরা তা খেয়ে ফেলছে।
১৬৮৭: "আমরাতো তোমাকে সকলের জন্য ভালো কাজ করতে দেখেছি।" উপরিউক্ত দুই ব্যক্তিই ইউসুফের মধ্যে আল্লাহ্র নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলো। তারা বুঝতে পেরেছিলো যে, ইউসুফ আল্লাহ্ প্রেরিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী । কারণ ইউসুফ দয়ালু, পরোপকারী ও সৎকর্মপরায়ণ । এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যদিও তারা দুজন ছিলো সাধারণ মানুষ, কিন্তু তারাও বুঝতে পেরেছিলো, সৎকর্মপরায়ণ দিগের উপরে আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। এ হচ্ছে অদৃশ্য জগতের নৈতিকতার এক অমোঘ আইন। এ কারণেই তারা অপরিচিত হয়েও ইউসুফের কাছে তাদের স্বপ্নের ব্যাখা বলার জন্য অনুরোধ করে।
১৬৮৮: দুজনের মধে এজনের স্বপ্নের অর্থ ছিলো ভালো অন্যজনের অর্থ ছিলো ভয়াবহ। এখানে লক্ষনীয় এই যে, হযরত ইউসুফ জানতেন যে তাঁর জ্ঞান , প্রজ্ঞা যা তিনি পরম করুণাময়ের কল্যাণে লাভ করেছেন তা শুধুমাত্র স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার জন্য নয় ; আল্লাহ্ তাঁকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন বৃহত্তর ও মহত্তর কল্যাণ সাধনের জন্য । এই দুজন ব্যক্তিকে তিনি মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র কথা, শেষ বিচারের কথা ব্যক্ত করেন। স্বপ্নের অর্থ প্রকাশ করার পূর্বেই তিনি তা করেন। কিন্তু তিনি তাদের হেদায়েত করেন অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে । এ কথা তারা যেনো ভাবার অবকাশ না পায় যে, স্বপ্নের অর্থ জানতে হলে, আল্লাহ্র কথা তাদের শুনতে হবে। তাদের মনে যেনো কোনও বিরূপ ধারণা না জন্মে । বরং তিনি বলেছিলেন যে, "খাদ্য আসার পূর্বে আমি তোমাদের স্বপ্নের তাৎপর্য জানিয়ে দিব। আমার প্রভু আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন এটা তারই অংশ।"
১৬৮৯: ইউসুফের বক্তব্য এখানে অনুধাবনযোগ্য । স্বপ্নের অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা তাকে অহংকারে স্ফীত করে নাই, বা তিনি এর জন্য নিজস্ব কোনও কৃতিত্বও দাবী করেন নাই বা পরোপকার করার মহত্বও দাবী করেন নাই। ইউসুফের বক্তব্য থেকে এ সত্যই প্রতিভাত হয় যে, তিনি জানতেন আল্লাহ্র জ্ঞান তাঁর মাধ্যমেই প্রকাশ হচ্ছে । তিনি শুধু তাঁর কর্তব্য করে যাচ্ছেন - আর তা হচ্ছে মানুষকে প্রকৃত ঈমান শিক্ষা দেয়া।
১৬৯০: এই আয়াতে হযরত ইউসুফ যাদের কথা উল্লেখ করেছেন, তারা হচ্ছে মিশরবাসী। তারা ছিলো মূর্ত্তিপূজক এবং শুধুমাত্র পার্থিব জীবনকেই জীবনের আরাধ্য বলে বিচেনা করতো, ইউসুফের দায়িত্ব ছিলো তাদের আল্লাহ্র একত্ব সম্বদ্ধে জ্ঞান দান করা । তিনি তা করেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। তাঁর বক্তব্য ছিলো নিম্নরূপঃ সুখে, দুঃখে আল্লাহ্র প্রতি একান্ত বিশ্বাসই আমার শক্তির উৎস। মন্দ কখনও চিরস্থায়ী হয় না। সম্ভবতঃ তোমাদের মাঝে কোনও একজন পাপে লিপ্ত, সে কারণেই তাঁর এখানে আগমন; সম্ভবতঃ তোমাদের একজন নির্দোষ । সে যাই -ই হোক তোমরা কি সত্যকে গ্রহণ করবে না বা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনবে না ? ঈমানের আলো মানুষকে চিরঞ্জীব করে।
১৬৯১: হযরত ইউসুফ পয়গম্বরসূলভ ভঙ্গিতে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানের পূর্বে ঈমানের দাওয়াত ও ধর্ম প্রচারের কাজ করেছেন। প্রথমে তিনি কুফরের নিন্দা ও কাফেরদের ধর্মের প্রতি স্বীয় বিমুখতা বর্ণনা করেছেন । এর পরে তাঁর প্রতি আস্থা অর্জনের জন্য তিনি বলেছেন যে, যদিও আমি তোমাদের থেকে ছোট হব, কিন্তু আমি নবী পরিবারেরই একজন এবং তাঁদেরই সত্য ধর্মের অনুসারী। আমার পিতৃপুরুষ হচ্ছেন ইব্রাহীম, ইসহাক, ও ইয়াকুব । যারা পৃথিবীতে সম্মানীয় ও শ্রদ্ধেয় । এরা আল্লাহ্র একত্বের ধারণা থেকে একচুলও বিচ্যুত হন নাই। এই সত্য ধর্মের তওফীক আল্লাহ্ সমস্ত পয়গম্বরকুলের মাধ্যমে সমস্ত মানুষ জাতির জন্য প্রেরণ করে তাদের অনুগ্রহ করেছেন।
১৬৯২: এখানে লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছেঃ যদিও হযরত ইউসুফ নিজেকে নবী বংশের অধঃস্তন পুরুষরূপে বর্ণনা করেছেন , কিন্তু কয়েদীদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে নিজেকে তাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেছেন। তিনি তাদের "কারা সংগীদ্বয় " রূপে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ কারাগারের সকল দুর্ভাগ্যের সংগী। সে ক্ষেত্রে আমরা সমতার ভিত্তিতে কথা বলতে পারি। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, "ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রভু শ্রেয়, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ্, যার ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য যিনি সবার উপরে পরাক্রমশালী শ্রেয়? "।
১৬৯৪: এভাবেই ইউসুফ তার কারা সঙ্গীদের নিকট আল্লাহ্র একত্ব সম্পর্কে উপদেশ দান করেন্। বিশ্ব স্রষ্টার আনুগত্যের প্রতি আহ্বান করে তিনি তার কর্তব্য কর্ম শেষ করেন, যদিও তা তাঁর সঙ্গীদের স্বপ্নের ব্যাখ্যার অর্ন্তভূক্ত ছিল না । স্রষ্টার প্রতি মানুষের কর্তব্যের অঙ্গীকার, এর মধ্যে দিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করে তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করার ক্ষমতা যে স্রষ্টার দান সেই স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতারই প্রকাশ ছিলো ইউসুফের বক্তব্যে । এর পরে তিনি সহজ সরল ভাষাতে তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করেন। এখানেও লক্ষ্যনীয় যে ব্যাখ্যা দানের পূর্বে ইউসুফ তাঁর কারাসঙ্গীদের সাথে একত্মতা ঘোষণা করেন এভাবেঃ "হে আমার কারা সঙ্গী দুজন ।" এই সম্বোধনের মাঝে ইউসুফের সহানুভুতিশীল মনেরই পরিচয় পাওয়া যায় এখানে। তাঁর বক্তব্য ছিলো সহজ, বাহুল্য বর্জিত - সুসংবাদ ও দুঃসংবাদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সত্যকে তিনি বাহুল্য বর্জিত ও সহজভাবে প্রকাশ করেছেন; এজন্য যে, তাঁর সঙ্গীদ্বয় যেনো প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে পারে।কারণ প্রকৃত সত্য পৃথিবীর জয় পরাজয়ের উর্দ্ধে , - আল্লাহ্র দরবারে তা নির্ধারিত, বা অটল ফয়সালা। এ কথাকেই বলা হয়েছে "তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।"
১৬৯৫: সম্ভবতঃ পান-পাত্র বাহক নিরাপরাধ ছিলো, যার ফলে ফেরাউন তাকে তার পূর্ব পদে বহাল করলেন । সে পুণরায় রাজার পান-পাত্র বাহকরূপে নিয়োজিত হলো এবং সময়ের ব্যবধানে রাজার প্রিয়পাত্ররূপে পরিগণিত হলো। রাজার প্রিয়পাত্র হওয়া ছিলো তার পার্থিব লাভ, কিন্তু আল্লাহ্র নবী হযরত ইউসুফের সংস্পর্শে তার আধ্যাত্মিক জীবনকে যে ভাবে ধন্য করেছিলো পার্থিব লাভ তার তুলনায় কিছুই নয়। সেদিক থেকে সে ছিলো সত্যিই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি । সে ইচ্ছা করলে তার এই সৌভাগ্যকে মঙ্গলময় কাজে ব্যবহার করতে পারতো। কিন্তু হায়! মানুষকে আল্লাহ্ অসম্পূর্ণরূপেই সৃষ্টি করেছেন।
১৬৯৬: হায়! রুটি প্রস্তুতশারকের জন্য ছিলো দুঃসংবাদ। আশা-নিরাশার মাঝে দোদুল্যমানভাবে না রেখে ইউসুফ তাকে এই দুঃসংবাদ দিলেন অকপটভাবে । হয়তো সেই ব্যক্তি কোনরূপ প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, বা অন্য কোনও অপরাধে জড়িত ছিলো যা প্রমাণ হলে তার ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড ছিলো একমাত্র শাস্তি । ক্রুশে মৃত্যুর পরে শকুন ও পাখীরা তার চোখ, মুখ খুবলে খাবে। এই ছিলো স্বপ্নের তাৎপর্য বা তার নিয়তি। হতভাগ্য লোক! তবুও সে ভাগ্যবান । সম্ভবতঃ ইউসুফ তাকে তার কৃতকর্মের জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে অনুতাপ শিক্ষা দেন। যেন সে পরকালে আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করতে পারে। অপরপক্ষে , যদি সে নির্দোষ হয়, নিষ্ঠুর মুত্যু তাকে শাস্তি দানে অক্ষম। কারণ ইউসুফ তাঁকে যে আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান দান করেছেন সেখানের নিরবিচ্ছিন্ন সুখ শান্তির শুভ সংবাদ তাকে আত্মিক দিক থেকে করে তুলবে মৃত্যুঞ্জয়ী ।
১৬৯৭: ইউসুফ যে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন সে সম্বন্ধে তার কোন মিথ্যা অহমিকা বা নিজেকে অত্যন্ত দয়ালু বা নিজের সম্বন্ধে কোনও বিশেষ শ্রেষ্টত্ব বোধ ছিলো না। নবী সূলভ আচরণ ছিলো তার চরিত্রে। নিরহংকার, পরোপকারী, অন্যের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্ব স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও নির্ভরশীলতা এ সব চারিত্রিক গুনাবলীই তাঁর চরিত্রে ছিল ভাস্বর। যখন পান-পাত্র বাহকের স্বপ্নের ব্যাখ্যা সত্যে পরিণত হলো, সে যখন মুক্তি পেয়ে রাজঅনুগ্রহে স্বপদে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে , সে সময়েই সম্ভবতঃ পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময়ে পান-পাত্র বাহক উল্লাসে, আনন্দে, গর্বে স্ফীত হয়ে ইউসুফকে জিজ্ঞাসা করেছিলো সে কি বন্দী ইউসুফের জন্য কিছু করতে পারে? পৃথিবীর কোনও অনুগ্রহ ইউসুফের জন্য প্রয়োজন নাই। তা তিনি রাজা হোন বা রাজন্যবর্গই হোন। তাঁর একমাত্র সাহায্য কর্তা বিশ্বস্রষ্টা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। আল্লাহ্র সাহায্যেই তার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তিনি জানতেন পৃথিবীতে তাঁকে আল্লাহ্ কর্তৃক অর্পিত বহু দায়িত্ব ও কর্তব্য করতে হবে, যা কারাগারে থেকে করা সম্ভব নয় । পান-পাত্র বাহককে রাজার কাছে তাঁর কথা উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। কোনও অনুগ্রহ লাভের আশায় নয় । তা এই জন্য যে রাজার গোচরে আনা যে একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজার ন্যায় বিচার ব্যহত হচ্ছে। সেই কারণে ইউসুফের বক্তব্য ছিলো, "তোমার প্রভুর নিকট আমার কথা বলিও।" কোনও অনুগ্রহ বা কৃপা প্রার্থনা নয়। শুধুমাত্র স্মরণে আনা । কারণ আল্লাহ্র নবী যিনি তিনি শুধুমাত্র আল্লাহ্রই অনুগ্রহ ও কৃপাপ্রার্থী।
১৬৯৮: "Bidh" অর্থাৎ "কয়েক বৎসর " বা "A few (more) years" এর অর্থ অনির্দ্দিষ্ট কিন্তু স্বল্প সংখ্যক যথাঃ ৩, ৫, ৭, বা ৯ বৎসর।
রুকু - ৬
১৭০০: ফেরাউন স্বপ্নে দেখলেন সাতটি কৃষকায় গাভী সাতটি হৃষ্টপুষ্ট গাভীকে ভক্ষণ করছে আবার সাতটি সুপুষ্ট সবুজ শষ্যের শীষ সাতটি শুষ্ক শীষে পরিণত হলো। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য তিনি গোপন সভার আহ্বান করলেন। যেখানে পান-পাত্র বাহকও উপস্থিত ছিলো । ইউসুফের মুক্তির এই ছিলো পূর্বাভাষ । কি বিস্ময়কর ভাবেই না আল্লাহ্র পরিকল্পনা কার্যকর হয়।
১৭০১: সভাষদগণ কেহই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানে সক্ষম ছিলো না । প্রথমতঃ তারা এ ব্যাপারে ছিলো অনভিজ্ঞ। দ্বিতীয়তঃ তারা এর ফলাফল সম্বন্ধে কোনও দায়িত্ব নিতে ছিলো অপারগ।
১৭০২: এবারে পান-পাত্র বাহকের ইউসুফের কথা স্মরণ হলো। লোকটি জানতো যে ইউসুফ একজন সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তি এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যাদানে তিনি অত্যন্ত দক্ষ। লোকটি সহজ সরল ছিলো না। এ সময়ে সে ইচ্ছা করলে ইউসুফের কথা রাজার কাছে উল্লেখ করতে পারতো , যা হয়তো ইউসুফের মুক্তির সহায়ক হতো। কিন্তু সে সুচতুরভাবে স্বপ্নের ব্যাখ্যার পুরো কৃতিত্ব নিজে ভোগ করার মানসে ইউসুফের উল্লেখ পর্যন্ত করে নাই । এভাবে সে রাজ দরবারে বিশেষ আনুকুল্য লাভ করতে চেয়েছিলো এবং সম্ভব হলে ইউসুফের মুক্তির বন্দোবস্ত করে তার বিবেকের কাছে মুক্ত হতে পারতো । তবে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো রাজ দরবারে বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করা। ইউসুফের সাহায্যে সে যে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করবে সেটা সে প্রকাশ পর্যন্ত করে নাই। সে রাজার কাছে ছুটি প্রার্থনা করলো স্বপ্নের ব্যাখ্যা সংগ্রহ করার জন্য। রাজ দরবার থেকে সোজা সে কারাগারে ইউসুফের কাছে চলে গেলো এবং ইউসুফকে সম্বোধন করলো যা, পরবর্তী আয়াতে দ্রষ্টব্য । [লোকটির চরিত্রের মাধ্যমে সাধারণ লোকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। ]
১৭০৩: পান-পাত্র বাহকের আবেদন অবশ্যই অনেক দীর্ঘ ছিলো, কারণ সম্পূর্ণ ঘটনাকে তার ব্যাখ্যা করতে হয়েছিলো । এই আয়াতে সংক্ষিপ্ত আকারে মূল বিষয় গুলিকে তুলে ধরা হয়েছে। ইউসুফের কাছে সে কিছুই গোপন না করে সকল বিষয় বর্ণনা করলো। সে বললো যে সে যদি স্বপ্নের ব্যাখ্যা লাভ করে তবে সে তা রাজসভাতে প্রকাশ করতে পারবে। এখানে একটি বিষয় দ্রষ্টব্য যে, লোকটি তার প্রয়োজন ও বক্তব্য সম্বদ্ধে সরাসরি প্রকাশ করেছিলো , আল্লাহ্র নবীকে মুক্ত করে দেবার কথা বলে প্রলোভিত করে নাই, বা এতদিন ইউসুফের সাথে কোনও যোগাযোগ না করার জন্যও কোনও কৈফিয়ত দেয় নাই । ইউসুফের চরিত্রের মহানুভবতা এখানে অনুধাবনযোগ্য । সে যে নিরাপরাধের কথা উল্লেখ পর্যন্ত করে নাই। সে কারণে ইউসুফ তাকে ভর্ৎসনা করেন নাই। তিনি সরাসরি তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করেন। কারণ আল্লাহ্র নবী জানেন যা কিছু ঘটে আল্লাহ্র ইচ্ছায় । হয়তো সাধারণ একজন মানুষের কাছে আল্লাহ্র নবী তাঁর মুক্তির জন্য ঋণী থাকবেন তা আল্লাহ্র ইচ্ছা নয়। আল্লাহ্র ইচ্ছা ইউসুফকে সম্মানের সাথে কারাগার থেকে মুক্ত করা।
১৭০৪: এই আয়াত থেকে বোঝা যায় ইউসুফ শুধুমাত্র স্বপ্নের ব্যাখ্যাই দান করেন নাই, স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী যখন সেই দুঃসময় আসবে তখনকার প্রতিকারও বাতলে দেন। প্রথম সাত বছর অনুকুল পরিবেশে ও কৃষকদের পরিশ্রমে প্রচুর শস্য উৎপাদন হবে, সেই শস্যের উদ্বৃত্ত শস্য জমিয়ে রাখতে হবে, বিশেষভাবে পোকা, মাকড় কীট পতঙ্গ তা যেনো নষ্ট না করে।
১৭০৫: সমৃদ্ধশালী সাতটি বছরের পরে আসবে সাতটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বৎসর। পূর্বে যা সঞ্চয় করে রাখা হয়েছিলো পরবর্তী সাত বৎসর তা হবে তাদের আহারের একমাত্র সম্বল। এখানে সাবধান করা হয়েছে যে,তারা যেনো কোনও অবস্থাতেই শস্য বীজ খেয়ে না ফেলে কারণ তাহলে পরবর্তীতে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে,নীলনদীর পানি ফুলে ফেঁপে উঠবে, মাটি আবার ফসল বোনার উপযোগী হবে, তখন বীজের অভাবে তাদের কৃষিকাজ ব্যহত হবে। এই উপদেশ ইউসুফের জ্ঞান, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞারই সাক্ষর ।
১৭০৬: "প্রচুর (ফলের রস ও তেল) নিংড়াবে" এই বাক্যটি প্রচুর শস্য উৎপাদনের প্রতীক স্বরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। নীল নদীর উৎস মুখে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে ,নীল নদী ফুলে ফেঁপে উঠবে, এবং নদী বাহিত পলিমাটি দ্বারা মিশরের নদী উপকূল উর্বর হয়ে উঠবে। এ ছাড়াও মিশরে বৃষ্টিপাত হবে যা খরার ফলে মৃতপ্রায় আঙ্গুর বাগান ও জলপাই ক্ষেতকে পুনঃর্জিবীত করতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ শস্যের প্রাচুর্য খাদ্যাভাব মেটাবে ; ফলের প্রাচুর্য ফলের রসের অভাব মেটাবে । তেলের অভাব মেটাবে। অর্থাৎ মিশর আবার ধনধান্য , পুষ্পে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠবে।
১৭০৭: পান-পাত্র বাহক ইউসূফের ব্যাখ্যা রাজাকে ব্যক্ত করেছিলো যার দরুণ রাজা ইউসুফের সাথে সাক্ষাত করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন । তিনি কারাগার থেকে ইউসুফকে নিয়ে আসার জন্য লোক প্রেরণ করলেন।
১৭০৮: সাধারণ মানুষ রাজ আনুকুল্য লাভ করলে নিজেকে ধন্য মনে করে। সেভাবেই রাজার প্রেরিত অনুচর আশা করেছিলো ইউসুফ রাজ দর্শনের সংবাদে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে। কিন্তু ইউসুফ ছিলেন আল্লাহ্র নবী, তিনি তো মরণশীল মানুষের দয়ার উপরে নির্ভরশীল নন। তিনি তাঁর সর্বসত্তা সর্ব অবস্থার জন্য আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল। তাই তিনি রাজদর্শনের পূর্বে মহিলাদের ব্যাপারে এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। আয়াত [১২:৩৩] এ আমরা দেখি ইউসুফ সুন্দরী মহিলাদের আমন্ত্রণ অপেক্ষা, কারাভোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সুতারাং কারামুক্তির আগে তাঁর জানা প্রয়োজন মহিলাদের তাঁর সম্বদ্ধে বর্তমান মানসিক অবস্থা কিরূপ।
১৭০৯: মহিলাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে রাজা হয়তো অবগত নাও থাকতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের গোপন চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র সম্বদ্ধে সম্যক অবগত।
১৭১০: ইউসুফের বক্তব্য রাজ অনুচর রাজার কাছে বহন করে নিল। বক্তব্যের আবেদন অনুযায়ী রাজা মহিলাদের রাজসভাতে ডেকে পাঠালেন। অন্যান্য মহিলাদের সাথে আজিজের স্ত্রী জোলেখাও উপস্থিত ছিলেন। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন "তোমাদের কি হয়েছিলো ?" রাজা সত্য ঘটনা জানতে চাইলেন।
১৭১১: আজিজের স্ত্রীর উপস্থিতিতে অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা বলেছিলো যে, "ইউসুফ নিরাপরাধ ও নিষ্পাপ। তাদের বক্তব্য ছিলো, " আমরা ওর মধ্যে কোন দোষ দেখি নাই ।" তারা অকপটে ইউসুফের চরিত্রের নির্মলতা স্বীকার করেছিলো । যখন মহিলারা তাদের বক্তব্য শেষ করলো এবারে জোলেখা তার বক্তব্যকে সহজ সরলভাবে সত্যকে বিকৃত না করে উত্থাপন করলো। সে তাঁর নিজ দোষ স্বীকার করলো অকপটে।
১৭১২: জনাব ইউসুফ আলীর মতে আয়াত ৫২ ও ৫৩ আজীজের স্ত্রী জোলেখার বক্তব্যের ধারাবাহিকতা এবং সে ভাবেই তিনি ইংরেজীতে আয়াতটি অনুবাদ করেছেন। ইব্নে খতির (Ibn Khotir) এভাবেই আয়াতটির ব্যাখ্যা দান করেন। তবে অধিকাংশ তফসীরকারের মতে আয়াত ৫২ এবং ৫৩ হচ্ছে ইউসুফের বক্তব্য। তাঁদের মতে এখানে ইউসুফ আজীজের নিকট তার আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা বর্ণনা করেছেন "আমি তার অবর্তমানে বিশ্বাসঘাতকতা করি নাই।" তাঁর বক্তব্য হচ্ছে তিনি কখনও তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রীর সাথে কোন অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলেন নাই। যদিও এ কথা ভাবা স্বাভাবিক ছিলো যে, ইউসুফ ছিলেন একজন সাধারণ রক্ত মাংসের মানুষ এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে ভুল করা খুবই স্বাভাবিক ।
জনাব ইউসুফ আলীর মতে, "আজীজের স্ত্রী তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং নিরাপরাধ লোককে কারাগারে নিক্ষেপের কারণে অপরাধবোধ তাঁকে অস্থির করে তোলে । তাঁর অনুতাপ তাকে সত্যের প্রতি অবিচলিত থাকতে সাহায্য করে; এবং সর্ব সমক্ষে দয়া ও ক্ষমা ভিক্ষা করার মত মানসিক শক্তিতে উজ্জীবিত করে "আমি তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করি নাই।" কথাটি এরই প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে। এই অনুতাপ , সত্য প্রকাশের সাহস তাকে অন্তর্দৃষ্টি দান করে । সে প্রকৃত ভালোবাসা ও কামজ প্রেমের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হয়।
ইউসুফের প্রতি মিথ্যা অভিযোগের কারণ ছিলো জোলেখার ইউসুফের প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণ ও কামোন্মত্ততা। আবেগের তীব্রতায় ক্ষণেকের জন্য হলেও সে নিজেকে বিস্মৃত হয়েছিলো । সুতারাং তাঁর এই অভিযোগ ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা প্রসূত ছিলো না।
ইউসুফের বক্তব্য ছিলো, "আল্লাহ্ বিশ্বাসঘাতকদিগের সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।"
ত্রয়োদশ পারা
১৭১২ -ক : Ammara : অর্থ আসক্তি বা প্রবণতা, অনুপ্রাণীত, একগুয়ে আবেগপ্রবণ। দেখুন আয়াত [৭৫:২] এবং এর টিকা ৫৮১০।
১৭১৩: দেখুন টিকা ১৭১২ । জনাব ইউসূফ আলীর মতে, এই আয়াতটি আজিজের স্ত্রীর বক্তব্যের ধারাবাহিকতা। কারণ এর বক্তব্য ইউসুফ অপেক্ষা জোলেখার প্রতি অধিক প্রযোজ্য ।
১৭১৪: এই আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী ইউসুফকে তখনও রাজার সামনে উপস্থিত করা হয় নাই। আয়াত [১২:৫০] তে একই আদেশ রাজা দিয়েছিলেন; কিন্তু ইউসুফ তার মুক্তির পূর্বে আইনের সাহায্যে নিজেকে অপরাধমুক্ত প্রমাণের জন্য প্রতিবিধানের আবেদন করেন। এবারে ইউসুফের নির্দ্দোষিতা , প্রজ্ঞা, জ্ঞান , সত্যবাদিতা এবং বিশ্বস্ততা সুনির্দ্দিষ্ট ভাবে প্রমাণিত হলো। শুধু তাই নয় আজীজের স্ত্রীর বক্তব্যে তা আরও দৃঢ়ভাবে সমর্থিত ও সত্যায়িত হলো। রাজা ইউসুফের সত্যদৃপ্ত চরিত্রের প্রকাশ ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তাঁর বিশেষ বিশ্বস্ত উজীর নিয়োগ করলেন।
সম্ভবতঃ এ সময়ে আজীজের মৃত্যু হয়েছিলো, [কারণ এর পরে কোথাও তাঁর কোনও উল্লেখ নাই।] এবং ইউসুফকে রাজা তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। কিন্তু ইউসুফ পূর্বোক্ত আজীজ অপেক্ষা আরও বেশী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কারণ রাজা তাঁকে দুঃসময়ে জরুরী অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য আজীজের নির্ধারিত ক্ষমতা ব্যতীতও বিশেষ ক্ষমতা দান করেন। রাজার সবচেয়ে বিশ্বস্ত উজীরকে যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া সম্ভব রাজা তাঁকে সেই ক্ষমতা দান করেন । রাজার নিকট তাঁর ছিলো বিশেষ মর্যাদা ও অবাধ যাতায়াত।
১৭১৫: এই ফেরাউন কে ছিলেন? ফেরাউন কোনও ব্যক্তি বিশেষ নয়। মিশরের নৃপতিদের উপাধি ফেরাউন। সম্ভবতঃ এই ফেরাউন ছিলেন হিকসস্ রাজতন্ত্রের [ Hyksos Dynasty] ফেরাউন। হিকসস্রা মিশরে রাজত্ব করে খৃষ্টপূর্ব ১৯ থেকে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত ।
১৭১৬: ইউসুফকে রাজা অশেষ ক্ষমতার অধিকারী করেন। ইউসুফ ইচ্ছা করলেই এই ক্ষমতা , সম্মান ও অর্থ সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারতেন। নিজে ভোগ বিলাসে মত্ত থেকে অপরের কাঁধে গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু যারা সৎ ও কর্তব্য পরায়ণ তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। ইউসুফ ছিলেন সেইরূপ সৎ ও কর্তব্যপরায়ন চরিত্রের অধিকারী । সে কারণেই তিনি স্ব ইচ্ছায় যাঞ্চা করে সবচেয়ে কঠিন এবং অপ্রিয় কাজের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন । কারণ তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো মানুষের সেবা । কি কঠিন ও গুরু দায়িত্ব ছিলো তা সহজেই অনুমেয় । প্রাচুর্যের সময়ে উদ্বৃত্ত ফসলকে সুশৃঙ্খলভাবে এবং সফলভাবে মজুত করে রাখা এবং দুর্ভিক্ষের সময়ে সেই ফসলকে প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যায়ের ভিত্তিতে বন্টন করা সত্যিকারেরই ছিলো অতি কঠিন ও গুরু দায়িত্ব । শস্য ভান্ডারের দায়িত্ব শস্য গুদামজাত করা, পোকামাকড় থেকে তা রক্ষা করা ইত্যাদি একঘেয়ে কাজের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেবার কারণ, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আল্লাহ্র কৃপায় বুঝতে পেরেছিলেন প্রকৃত ঘটনার গুরুত্ব ।
১৭১৭: আল্লাহ্র কি অপূর্ব লীলাখেলা । তাঁর পরিকল্পনা কত বিস্ময়কর ভাবে কার্যকর হয় তারই এক অপূর্ব নিদর্শন ইউসুফকে মিশরে সম্মানের সাথে অধিষ্ঠিত করা । যে বালককে তাঁর হিংসুক ভাইএরা সামান্য মূল্যের বিনিময়ে বিক্রী করে দিয়েছিলো - মনে হয়েছিলো সেখানেই ইউসুফের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে । কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র পরিকল্পনাকেই কার্যকর করতে সাহায্য করেছে তাঁর ভাইরা। তাঁকে বিক্রি করার ফলেই তিনি মিশরে নীত হন। সময়ের ব্যবধানে ক্রীতদাস ইউসুফ নানা ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে একদিন মিশরের প্রধান উজীরের পদে অধিষ্ঠিত হন। সে সময়ে মিশরের অধিপতি ছিলেন সমসাময়িক পৃথিবীর শক্তিশালী নৃপতি আর ইউসুফ সেই নৃপতির সর্বাপেক্ষা বিশ্বাসভাজন ও ক্ষমতাধর প্রধান উজীর নিযুক্ত হন। তিনি যে শুধু এই বিরল সম্মানের অধিকারী হন তাই - ই নয় । তার পরিবার পরিজনও এর অংশীদার হন। ইউসুফের জীবনী হচ্ছে সৎকর্মশীলতা ও আল্লাহ্র রাস্তায় শ্রমসাধ্য পরিশ্রমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যারা আল্লাহ্র রাস্তায়, সৎকর্মে নিজের মেধা, শ্রম, পরিশ্রম সব কিছু ব্যয় করে তাদের জন্য ইউসুফের চরিত্র এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে সকল যুগের জন্য। আল্লাহ্র পরিকল্পনার বাস্তবায়নের বিস্ময়কর দিক হচ্ছে , ইউসুফ যখন শক্তিধর রাজন্যবর্গে পরিণত হন, তখন তাঁর বয়েস মাত্র ত্রিশ বৎসর ছিলো । "সে সেদেশে যথা ইচ্ছা অবস্থান করতে পারতো" এ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া ।
১৭১৮: যারা মুমিন ও পূণ্যাত্না তাঁরা এই পৃথিবীতে যা কিছু ভোগ করুক না কেন সেটাই শেষ কথা নয়, তাঁদের আসল পুরষ্কার আছে পরলোকে।
১৭১৯: সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। একসময়ে মিশরের ফসলের প্রাচুর্যের সময় শেষ হয়ে, দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসের ছায়া ফেলে । দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া শুধু মাত্র মিশরকেই গ্রাস করে না, তা পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমূহেও বিস্তার লাভ করে । বিজ্ঞ ইউসুফ উদ্বৃত্ত শস্য এমনভাবে সংরক্ষিত ও গুদামজাত করেন যে তা পার্শ্ববর্তী রাজ্যের খাদ্যাভাব পূরণ করতে সক্ষম ছিলো । ফলে পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমূহ থেকেও খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য লোকের মিশরে আগমন ঘটতো । ইউসুফ তাদের সাদরে গ্রহণ করতেন এবং ন্যায্য দামে তাদের কাছে খাদ্য শস্য বিক্রয় করতেন।
এই মহা দুর্যোগের দিনগুলোতে আপামর জনসাধারণ যখন ইউসুফের বিজ্ঞ পরিকল্পনা ও পরিচালনায়, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো , ইউসুফের অন্তর তখন তাঁর পিতা ও ছোট ভাই বেঞ্জামিনের দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে থাকতো । বেঞ্জামিন ছিলেন ইউসুফের আপন ছোট ভাই এবং অপর দশভাই ছিলেন, বৈমাতৃয় । ইউসুফ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর বৈমাতৃয় ভাইরা তাঁর সাথে যে ব্যবহার করেছিলো , বেঞ্জামিনের সাথেও কি সেই একই ব্যবহার করছে? বৃদ্ধ পিতা স্নেহময় ছোট ভাই , সমগ্র পরিবার এই দুঃসময়ে কিভাবে আত্মরক্ষা করছে? এ সব দুঃচিন্তায় ইউসুফের মন ভারাক্রান্ত হয়ে যেতো । ইউসুফের এসব দুঃশ্চিন্তার প্রত্যুত্তর স্বরূপ একদিন দেখা গেলো তাঁর বৈমাতৃয় দশ ভাই ক্যানন দেশ থেকে শস্য ক্রয়ের জন্য মিশরে উপস্থিত হয়েছে। দুর্ভিক্ষাবস্থাতে খাদ্য শস্যের বিতরণ ও অন্যান্য সকল ব্যবস্থা ইউসুফ স্বহস্তে রেখেছিলেন কারণ বিতরণের অব্যবস্থা ও অপচয় রোধ করার জন্য তিনি এ ব্যাপারে কারুর উপরেই নির্ভর করেন নাই। তাঁর ভাইরা যখন মিশরে পৌঁছালো তারা ইউসুফের রাজকীয় পদ মর্যাদা , ক্ষমতা মহার্ঘ পোষাক পরিচ্ছেদের আড়ালে ইউসূফকে সনাক্ত করতে পারলো না । ইউসুফ কিন্তু ঠিকই তাদের সনাক্ত করেছিলেন। ইউসুফের ভাইদের ধারণারও অতীত ছিলো যে, যাকে তারা ক্রীতদাস স্বরূপ বিক্রী করে দিয়েছে, তাঁর তো দাস হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করার কথা; অথবা এই প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের মাঝে হয়তো বা ইউসুফ মৃত্যু বরণ করে থাকতে পারে। সে স্থলে বর্তমান ক্ষমতাবান, ধনরত্নের অধিকারী রাজার একান্ত বিশ্বাসভাজন উজীররূপে ইউসুফকে কল্পনা করা তাদের ধারণারও বাইরে ছিলো।
১৭২০: ইউসুফ তাঁর ভাইদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন। তাঁর মনে চিন্তা আনাগোনা করতে লাগলো । ইউসুফের মনে হলো,তাঁর ভাইরা কি তাদের বৃদ্ধ পিতাকে ত্যাগ করেছে? এখন তাঁর পিতার কি অবস্থা? বার্দ্ধক্য কি তাঁকে অসহায় করে ফেলেছে ? সম্ভবতঃ সেই কারণেই তিনি দশ ভাইয়ের সাথে মিশর আসতে পারেন নাই। তাদের অন্য ভাই বেঞ্জামিনের খবর কি? ইত্যাদি বিভিন্ন জিজ্ঞাসা তার অন্তরকে আন্দোলিত করে তুললো সম্ভবতঃ তিনি তাঁর উচ্চাসন থেকে নেমে আগন্তুকদের সাথে কথোপকথন করেছিলেন, হৃদ্যতাপূর্ণভাবে তাদের পারিবারিক খোঁজ খবর নিয়েছিলেন নিঃসন্দেহে দশ ভাই পারিবারিক খোঁজ খবরের সময়ে ইউসুফের কথা প্রকাশ করে নাই। কারণ নিজের পাপের কথা কেই বা সর্ব সমক্ষে প্রকাশ করতে চায়? তবে সম্ভবতঃ ইউসুফের সহৃদয় জেরার মুখে তারা বেঞ্জামিনের কথা প্রকাশ করেছিলো। বেঞ্জামিনের উল্লেখে ইউসুফের চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো। ছোট ভাইটি কত বড় হয়েছে? কেন তারা তাঁকে মিশরে আনলো না ? তারা কি পরের বারে শস্য সংগ্রহের সময়ে তাঁকে মিশরে নিয়ে আসবে? তাঁর উদ্বেগ আকুল চিত্ত ভাতৃ মিলনে অস্থির হয়েছিলো। তিনি স্থির করলেন পরের বারে অবশ্যই বেঞ্জামিনকে তাদের মিশরে আনতে হবে। নতুবা তাদের আর কোন শস্য দেয়া হবে না । এমনকি মিশরের মহা ক্ষমতাধর উজীর তাদের সাথে সাক্ষাত পর্যন্ত করবেন না।
৬১। তারা বলেছিলো, "আমরা তাঁর পিতাকে এ বিষয়ে সম্মত করবার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করবো ১৭২১ । অবশ্যই আমরা তা করবো।"
১৭২১: ইউসুফের বক্তব্যের জবাবে দশ ভাই বললো যে, তারা তাদের পিতাকে এ ব্যাপারে সম্মত করতে চেষ্টা করবে। অবশ্যই তারা উজীরের ইচ্ছার পূরণ করবে। তাদের এই বক্তব্য থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের পিতার প্রতি বা ভাই বেঞ্জামিনের জন্য এতটুকু ভালোবাসাও ছিলো না । তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো খাদ্য শস্য সংগ্রহ করা, বৃদ্ধ পিতা বা ভাই বেঞ্জামিন সম্পর্কে তাদের কোনও আকর্ষণ বা ভালোবাসা ছিলো না । তাই তারা মিশরের উজীর ইউসুফের নিকট হযরত ইয়াকুবের বিষয়ে ব্যঙ্গক্তি করে প্রকাশ করে "তার পিতাকে" । কিন্তু কথাটি হওয়া উচিত ছিলো , "আমাদের পিতাকে " । আবার বেঞ্জামিন সম্পর্কে বলে "এ বিষয়ে" কিন্তু বাক্যটি হওয়া উচিত ছিলো "ভাইয়ের বিষয়ে" । এ থেকেই অনুধাবন করা যায় তারা তাদের পিতা ও ভাইকে এতটুকুও ভালোবাসতো না । কিন্তু অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস। তাদের ভাগ্য এখন ইউসুফের হাতে নির্ধারিত হবে।
১৭২২: Bidha'at অর্থ পণ্যমূল্য বা ব্যবসার মূলধন যা বহন যোগ্য; টাকা পয়সা যা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করা হয়। এই আয়াত থেকে অনুমিত হয় যে তারা পণ্যের বিনিময়ে শস্য ক্রয় করেছিলো । দেখুন [১২:১৯] আয়াত যেখানে কিশোর ইউসুফকে পণ্য বলা হয়েছে।
১৭২৩: ভাতৃমিলনের জন্য ইউসুফ উদ্বেল হয়ে উঠেছিলো । সুতারাং তিনি মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন যে, তাঁর ভাইয়েরা বেঞ্জামিন সহযোগে তাঁর কাছে ফিরে আসুক । সেই কারণে তিনি তাদের পূর্ণবার আসার উপরে শর্ত আরোপ করেছিলেন। উপরন্তু তাদের উৎসাহ দানের জন্য তিনি তাদের শস্যের জন্য পরিশোধিত মূল্য ফেরত দান করেন। এই ফেরত দান করাটি ছিলো অত্যন্ত সুকৌশলে যেনো দশ ভাই দেশে ফিরে তার সন্ধান লাভ করে।
১৭২৪: দশ ভাই প্রত্যাবর্তনের পরে ইয়াকুবকে সবিস্তারে সব বর্ণনা করলো । কিন্তু ইয়াকুবের নিকট থেকে বেঞ্জামিনকে মিশরে নেওয়ার অনুমতি খুব সহজসাধ্য ছিল না । কারণ ইয়াকুব কোন দিনই তাদের কথা বিশ্বাস করতো না, উপরন্তু ইউসুফের ঘটনার পরে ইয়াকুবের পক্ষে তাদের বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। সুতারাং তারা সমগ্র পরিবারের প্রয়োজনীয়তার দিকটি সুকৌশলে উত্থাপন করলো, " যেনো আমরা শস্যের বরাদ্দ পেতে পারি।" অর্থাৎ পরিবারের জন্য খাদ্য শস্য সংগ্রহ করতে পারে।
১৭২৫: হযরত ইয়াকুব বেঞ্জামিনের মিশর যাওয়ার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তার কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতায় ইউসুফের সময়ে তিনি তাদের বিশ্বাস করে প্রতারিত হন। সে সময়েও তাঁরা ইউসুফের রক্ষণাবেক্ষনের জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলো । সুতারাং তাদের প্রতিজ্ঞা মূল্যহীন । তিনি তাদের প্রতিজ্ঞা বিশ্বাস করেন না । তাঁর একমাত্র বিশ্বাস ও ভরসা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র উপরে। রক্ষণাবেক্ষনে আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ । তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র দয়া রহমত এই বৃদ্ধ ও তার সন্তানকে ধন্য করে।
১৭২৬: দশ ভাই হযরত ইয়াকুবের প্রত্যাখ্যানে নিরাশ হলো না, ইতিমধ্যে তারা মাল পত্র খুলে দেখতে পেলো যে, তার মধ্যে তাদের পণ্যমূল্য যা তারা খাদ্য সামগ্রীর মূল্য হিসেবে শোধ করেছিলো, তা তাদের ফেরত দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা বিনা মূল্যে খাদ্য শস্য লাভ করেছে। যারা পাপী তাদের মধ্যে লোভ রীপু অত্যন্ত প্রবলরূপ ধারণ করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। বিনা মূল্যে খাদ্য শস্য লাভ করার ফলে তাদের মধ্যে এরূপ ধারণা হলো যে তারা যদি উজীরকে সন্তুষ্ট করতে পারে,তার মনঃষ্কামনা পূর্ণ করতে পারে , তবে তারা অঢেল খাদ্য শস্য লাভ করতে পারবে। আর উজীরকে সন্তুষ্ট করার একটাই পথ আর তা হচ্ছে তাদের ছোট ভাই বেঞ্জামিনকে উজীরের নিকট নিয়ে যাওয়া। আর বেঞ্জামিনকে সঙ্গে নিতে তাদের কোনও পয়সা খরচ হবে না। বরং অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে উজীরের সন্তুষ্টির বিনিময়ে তারা প্রচুর খাদ্য শস্য লাভ করবে। সুতারাং তারা তাদের দাবী অত্যন্ত জোড়ালো ভাবে তাদের পিতার কাছে উপস্থাপন করলো।
১৭২৭: ভাইদের বক্তব্য ছিলো! : যদি আমরা উজীরকে সন্তুষ্ট করতে পারি, তবে যে পরিমাণ খাদ্য শস্য আনতে পারবো, তার তুলনায় বর্তমানের পরিমাণ অতি অল্প বোধ হবে। কারণ মিশরের শস্য ভান্ডার শস্যে ভরপুর । সুতারাং উজীরের পক্ষে উট বোঝাই শস্য দান করা কোনও সমস্যাই নয়।
১৭২৮: দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস শেষ পর্যন্ত হযরত ইয়াকুবকে বাধ্য করেছিলো বেঞ্জামিনকে ভাইদের সাথে মিশরে যাওয়ার অনুমতি দানে। কিন্তু তিনি আল্লাহ্র নামে তাদের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন বেঞ্জামিনকে ফেরত আনার জন্য অবশ্য যদি তারা একান্তভাবে অসহায় হয়ে না পড়ে । এ ব্যাপারে ইয়াকুব আল্লাহ্কে সর্বোচ্চ সাক্ষী হিসেবে মনোনীত করেন।
১৭২৯: হযরত ইয়াকুব আল্লাহ্কে মিনতি পূর্ণ ভাবে সাক্ষী হতে বলেছিলেন বর্তমানের কথোপকথনের জন্য , তাঁর দশ ছেলের সাথে চুক্তির ব্যাপারে । আল্লাহ্ উভয় পক্ষের অভিভাবক ও সাক্ষী।
১৭৩০: কোন কোন ব্যাখ্যাকারীর মতে, ইহুদী বা প্রাচ্যদেশের প্রথা বা কুসংস্কার ছিলো যে, একই পরিবারের সদস্য সংখ্যা যখন বেশী হয়, তখন সকলে এক সাথে সমষ্টিগতভাবে কোথাও যাওয়া উচিত নয় । কারণ তাতে কুদৃষ্টির প্রভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । এই প্রথা অনুযায়ী হযরত ইয়াকুব তাঁর ছেলেদের উপরিউক্ত উপদেশ দেন। এসব প্রথা বা কুসংস্কারের কথা বাদ দিলেও ব্যাপারটি কি খুব হাস্যকর নয় যে দশ এগারো জনের একটি দল অজানা দেশে অচেনা পরিবেশে মিছিল সহকারে অগ্রসর হচ্ছে। ইয়াকুব ছিলেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ব্যক্তি, তাই ইয়াকুবের এই উপদেশের মধ্যে কুসংস্কার , দেশীয় প্রথা ইত্যাদির উর্দ্ধে বৃহৎ কারণ বিদ্যমান ছিলো । সমগ্র ঘটনাটিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে আমাদের সম্মুখে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে এগারো জনের একটি ভিনদেশী আগন্তুকের দল, যাদের পোষাক, ভাষা ব্যবহার সবই অপরিচিত, সে দেশের লোকের কাছে। দেশের কঠিন সময়ে এরূপ একটি আগন্তুক দলের আগমন, যাদের পরিচয় তাদের জানা নাই। সে ক্ষেত্রে তাদের মনে শুধুমাত্র যে কৌতুহল সৃষ্টি করবে তাই নয়, সন্দেহেরও সৃষ্টি করতে পারে যদি তারা দলবদ্ধভাবে সে দেশে প্রবেশ করে। বিদেশীদের তারা গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ করতে পারে, অথবা দলবদ্ধ অপরাধী হিসেবে ধারণা করতে পারে। এরূপ সন্দেহের কথাই আয়াত [১২:৭৩] এ বর্ণনা করা হয়েছে। যদি এগারো ভাই দলবদ্ধভাবে শহরে প্রবেশ না করে পৃথক পৃথক ভাবে প্রবেশ করে, তবে তারা শহরবাসীর খুব কমই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। হযরত ইয়াকুব ছিলেন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি পার্থিব দিক থেকে মানুষের পক্ষে যতদুর সাবধানতা অবলম্বন করা সম্ভব তা করার জন্য উপদেশ দান করেন। ইয়াকুব ছিলেন আল্লাহ্র নবী, সুতারাং তার সর্ব নির্ভরশীলতা ছিলো সেই সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্র উপরে। তাঁর সাবধান বাণী ছিলো যে, যদি তারা আল্লাহ্র বিধানকে অবহেলা বা অমান্য করে তবে মানুষের হাজার সাবধানতা সত্বেও তাঁকে বিপদ থেকে কেহ রক্ষা করতে পারবে না । মানুষের তৈরী আইন কানুন , রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠান, সাবধানতা, যত ভালো এবং যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সর্ব নিরাপত্তার মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ । সুতারাং তাঁর ছেলেরা আল্লাহ্র এই অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা অনুধাবনের চেষ্টা করবে । মানুষের ক্ষমতার উপরে নির্ভরশীলতা থেকে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা বহুগুণে শ্রেয় । এই হচ্ছে এই আয়াতের উপদেশ।
১৭৩১: দেখুন পূর্বের আয়াত এবং এর টিকা নং ১৭৩০ । ইউসুফের ভাইরা যদিও দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে তাদের পিতা প্রদত্ত বিধিনিষেধ মেনে চলেছিলো। কিন্তু তাদের আত্মা কলুষমুক্ত ছিলো না । তাদের পিতার উপদেশ তাদের আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে বিঘ্নিত করতে পারলো না। আল্লাহ্র সূদূর প্রসারী পরিকল্পনা ছিলো যে তারা বেঞ্জামিনকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না । ইউসুফের ভাইরা ইউসুফের বিরুদ্ধে যে অন্যায় করেছে সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকলেও তাদের ধারণারও বাইরে ছিলো যে তারা বর্তমানে ইউসুফের ক্ষমতার মধ্যে। ইউসুফ তাদের প্রতি মিষ্টি প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। তিনি সমস্ত পরিবারকে একত্রিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি দশ ভাই এর মনে অনুতাপের অনল জ্বালাতে সক্ষম হন। এভাবেই দশ ভাই এর আত্মা অনুতাপের আগুনে পরিশুদ্ধ হয়; পারিবারিক মিলন ঘটে, এবং আল্লাহ্র বৃহত্তর পরিকল্পনা সাফল্য লাভ করে। হযরত ইউসুফ আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যন্ত্রতুল্য ছিলেন মাত্র।
১৭৩২: নবী ও রসুলদের কর্তব্য হচ্ছে তাঁরা সর্বসাধারণকে সমভাবে শিক্ষা দান করবেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাঁরা ভালো লোক বা মন্দ লোকের মধ্যে কোনও পার্থক্য করবেন না। হযরত ইয়াকুবের ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ্ এই শিক্ষাই পৃথিবীর সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। ইয়াকুব নবী তাঁর প্রিয় গুণবান ছেলেকে যেভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন ঠিক সেই একইভাবে তাঁর দশজন অপদার্থ ছেলেকেও উপদেশ দান করেন। এ ব্যাপারে ছেলেদের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে নবী হিসেবে তিনি নিশ্চয়তা দান করতে পারেন নাই। তিনি তার ছেলেদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন নাই । যদিও তারা তাদের পিতার উপদেশ আক্ষরিক ভাবে মেনে চলেছিলো । এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে নবী রসুলেরা উপদেশ দিতে পারেন, সাবধান করতে পারেন, কিন্তু ফলাফল আল্লাহ্র হাতে। কারণ ইয়াকুব নবীর উপদেশ অনুসরণ করা সত্বেও তাঁর ছেলেরা বিপদ থেকে রক্ষা পায় নাই। এখানে দ্রষ্টব্য বিষয় হচ্ছে, তাঁর ছেলেরা এক্ষেত্রে পিতার উপদেশ গ্রহণ করেছিলো সত্য কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারা তা পালন করে নাই। তাদের আত্মা ছিলো পাপে পূর্ণ । সুতারাং ইয়াকুব নবীর সাবধানতা তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে নাই । ইয়াকুব নবী মিশরে ঢোকার পথে বিপদ সম্বন্ধে যে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছিলেন, তা ছিলো সীমিত আকারে। সুতারাং সেই সীমিত উপদেশ অনুসরণ করেও দশ ভাই বৃহত্তর বিপদকে এড়াতে সক্ষম হয় নাই । আল্লাহ্র এই বাণী সার্বজনীন । এই বক্তব্য ইয়াকুব নবী থেকেও যারা আরও বড় মাপের মানুষ তাদের উপদেশ সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। আমাদের নবী হযরত মুহম্মদের (সা) শিক্ষা সম্বন্ধেও এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য । যারা রসুলের (সা) প্রচার ও শিক্ষা সম্বন্ধে , আল্লাহ্র বাণী অনুসরণের ক্ষেত্রে আন্তরিক ও বিশ্বস্ত নয়। শুধুমাত্র রসুল মুহম্মদের (সা) কিছু আনুষ্ঠানিকতা ও বক্তব্যকে সীমিত আকারে মেনে চলে তারা সমাজ জীবনের বৃহত্তর বিপর্যয়কে কখনও প্রতিহত করতে পারবে না । কারণ মানুষের দুঃখ, বিপদ, বিপর্যয় সবই তার নিজস্ব কর্মফল। আল্লাহ্র রাস্তা থেকে বিচ্যুতির ফলেই তাদের এই পরিণতি। কিন্তু এসব সাধারণ লোকেরা ভেবে পায় না , তারা রসুলের (সা) আদেশ আক্ষরিকভাবে মান্য করা সত্বেও কেন তাদের বিপদ বিপর্যয়। ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো ইয়াকুব নবীর দশ ছেলের। এসব লোকেরা মহানবী মুহম্মদের (সা) আদেশকে সংকীণার্থে পালন করে থাকে, কিন্তু ধর্মের বৃহত্তর ও মহত্তর মূলনীতিগুলি অবহেলা করে থাকে । ফলে তাদের বিপদ বিপর্যয়ের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। আমাদের দেশে অনেকে মনে করে টুপি, দাড়ি, বোরখা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই ধর্মের শেষ কথা। এসব ধর্মের সীমিত রূপ। একজন প্রকৃত মুসলিমের প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে সে একজন প্রকৃত ভালোমানুষ - চরিত্রে, ব্যবহারে, কথায় , কাজে , দায়িত্বে, কর্তব্যে, বিবেকে, বিচার , বুদ্ধিতে। শুধুমাত্র ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা মেনে প্রকৃত বিপর্যয় থেকে সে রক্ষা পেতে পারবে না। কোরানের আলোতে জীবনের পথ খুঁজতে হবে, সেই পথের দিশারী হবে রসুলের (সা) জীবনী । আজকে মুসলিমদের বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ের কারণ উপরের আয়াতে খুঁজে পাওয়া যায়।
১৭৩৩: আল্লাহ্র নবীরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ । তারা তাদের এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করেন আল্লাহ্র তরফ থেকে । আল্লাহ্র করুণা ও রহমতই তাদের এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী করে। আর সাধারণ মানুষ এ সম্বদ্ধে অজ্ঞ - যেমন কার্লাইল বলেছেন, "For men, as such, are mostly fools, - devoid of Knowledge and understanding"
রুকু - ৯
১৭৩৪: দশ ভাই বেঞ্জামিন সহ মিশরে উপস্থিত হয়ে মহান উজীরের দর্শনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । ইউসুফ তাঁর ভাইদের অত্যন্ত আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা করে নিলেন। মনে হয় এবারে তাদের সম্বর্ধনা পূর্বের চেয়েও বেশী ছিলো কারণ তারা ইউসুফের অনুরোধক্রমে তাঁর ভাই বেঞ্জামীনকেও সঙ্গে করে এনেছে। নানা প্রশ্ন ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে ইউসুফ নিশ্চিত হয়েছিলেন যে আগন্তুক বেঞ্জামিনই তাঁর সেই ছোট ভাইটি । সম্পূর্ণ ছবিটি ছিলো এরূপ, ভাইদের সম্মানার্থে ইউসুফ ভোজসভার আয়োজন করেন। ভোজের টেবিলে দুজন দুজন করে প্রতিটি টেবিলে সবাই বসেছে। শুধু বেঞ্জামিন একা পড়ে যাওয়াতে ইউসুফ বেঞ্জামিনকে নিজের টেবিলে গ্রহণ করেন।
১৭৩৫: ভোজের পরে থাকার প্রশ্ন এলো । দুজন দুজন করে থাকার বন্দোবস্ত করা হলো, আবারও বাদ পড়ে গেলো বেঞ্জামীন - কারণ বেঞ্জামিন ছিলো বেজোড় সংখ্যা, সুতারাং উজীর তাকে নিজের কাছে রাখলেন। এভাবেই ইউসুফ বেঞ্জামীনকে নিভৃতে কাছে পাওয়ার সুযোগ করে নেন। ইউসুফ এবারে বেঞ্জামীনের কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেন, এবং তা অন্য ভাইদের কাছে গোপন রাখতে বলেন। তিনি আরও বলেন যে অনেক কিছু অদ্ভুদ ব্যাপার ঘটতে পারে, সে যেনো তাতে কিছু মনে না করে। ইউসুফ বেঞ্জামীনের নিকট থেকে তার পিতার খবর , পরিবারের সকল খবর সংগ্রহ করেছিলেন। পরিবারের সকল সদস্যদের নিজের কাছে আনার জন্য তাঁর মধ্যে ব্যগ্রতার সৃষ্টি হয় । তিনি তাদের সবাইকে মিশরে আনার জন্য পরিকল্পনা করেন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১৭৩৬: "Kanu" আরবী শব্দটির অতীত কালের সাথে যখন Ta'malun শব্দটিকে সমন্বিত করা হয়েছে তখন তা নির্দ্দেশ করে তার ভাইদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কার্যাবলীকে । বেঞ্জামিন তাঁর ভাইদের অতীতের দুর্ব্যবহারে, বর্তমানের ব্যবহারে বা ভবিষ্যতের কার্যপ্রণালীতে একটুকুও বিচলিত ছিলেন না। সুতারাং ইউসুফের পরিকল্পনায় বেঞ্জামিন সানন্দে সম্মতি দান করেন এবং নিশ্চুপ থাকেন।
১৭৩৭: ইউসুফ যে সুক্ষ কৌশলের আশ্রয় অবলম্বন করেছিলেন, তাতে তার দুটো উদ্দেশ্য সফল হয়েছিলো । তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তার ভাইদের উপরে চাপ সৃষ্টি করে তাদের মনে আতংক সৃষ্টি করেছিলেন। তবে তাঁর ভাইএরা তার প্রতি যে অবিচার ও অত্যাচার করেছিলো, তার তুলনায় ইউসুফের এই ব্যবহার ছিলো খুবই নগণ্য । তাই যখন সম্পূর্ণ ঘটনা উদ্ঘাটিত হলো তখন ইউসুফের ভাইরা প্রচন্ড লজ্জিত বোধ করলো । এই লজ্জা তাদের পাপবোধকে জাগ্রত করে এবং অনুতাপের পথ সুগম করে তোলে । দ্বিতীয়তঃ এই কৌশল অবলম্বনের ফলে ইউসুফ বেঞ্জামিনকে তাঁর নিজের কাছে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো এবং তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে মিশরে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পরিকল্পিত কৌশলটি ছিলো এরূপঃ মূল্যবান একটি কাপ বেঞ্জামিনের পণ্য ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো এবং অনুসন্ধানের পরে যখন তা আবিষ্কৃত হয় তখন অপরাধের শাস্তি স্বরূপ তাকে আটকে রাখা হয় । এভাবেই ইউসুফের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন লাভ করে।
উপদেশ : আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে ইউসুফ একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে চোর হিসেবে সাব্যাস্ত করে অন্যায় করেছেন। কিন্তু ইউসুফের নিয়ত ছিলো মহৎ। আল্লাহ মানুষকে কাজ নয়, কাজের নিয়ত দ্বারা বিচার করবেন।
৭২। তারা বলেছিলো, "আমরা রাজার পানপাত্র হারিয়েছি। যে তা আনতে পারবে, সে এক উট বোঝাই [পুরষ্কার ] লাভ করবে। আমি তার জামিন । "
৭৩। [ভাই এরা] বলেছিলো, "আল্লাহ্র শপথ! তোমরা ভালো করেই জানো, আমরা এদেশে গন্ডগোল সৃষ্টি করতে আসি নাই । এবং আমরা চোরও নই " ১৭৩৮ ।
১৭৩৮: সাধারণ বিদেশীরা সে দেশের জনসাধারণের বিশ্বাসভাজন হয় না। অনেক সময়েই দেখা যায় তারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার ষড়যন্ত্র বা চোরাচালানী বা আনুষঙ্গীক অপরাধের সাথে সংযুক্ত থাকে। অচেনা দেশে বিদেশীরা সভাবতঃই এরূপ সন্দেহের আওতাভুক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষতঃ যদি সে সময়টা হয়, দেশের জন্য অত্যন্ত দুর্যোগের সময়। ইউসুফের ভাইদের এরূপ রাজকীয় আতিথেয়তার পরে তাদের যখন চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করা হলো, তারা হতভম্ব হয়ে পড়লো। তারা প্রবলভাবে চুরির দায় দায়িত্ব অস্বীকার করলো।
১৭৩৯: তাদের অস্বীকৃতির উত্তরে মিশরের প্রহরীরা বললো, "ঠিক আছে, তোমরা যদি চুরি না করে থাক , ভাল কথা কিন্তু মিশরের উজীরের আন্তরিক আতিথেয়তার প্রতিদানে তোমাদের ব্যাগ থেকে যদি মূল্যবান কাপটি বের হয় তাহলে কি হবে?" এভাবে ইউসুফ ভ্রাতাদের কাছ থেকে ইয়াকুবী শরীয়ত অনুযায়ী চোরের বিধান জেনে নিয়েছিলেন।
১৭৪১: অবশ্য তাদের পারিবারিক রীতি অনুযায়ী এই ছিলো চৌর্যবৃত্তির শাস্তি । পরবর্তীতে মুসার যে আইন [Exod xxii3] তা হচ্ছে অপরাধীকে তার সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যদি সে সেই ক্ষতিপূরণ দিতে অসমর্থ হয়, তবে সে ক্রীতদাস হিসেবে থাকবে। এক্ষেত্রে অপরাধ শুধুমাত্র চুরিই ছিলো না, তা ছিলো চুরি এবং অতিথিসেবকের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা স্বরূপ। দশ ভাই এরূপ শাস্তির ঘোষণা দ্বারা পরিতৃপ্তি লাভ করেছিলো - কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেরও টের পায় নাই যে, তারা তাদের অজান্তেই ইউসুফের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে। আল্লাহ্র অপার ক্ষমতায় এ ভাবেই অতি জঘন্য পরিকল্পনা সময়ের আবর্তনে ভবিষ্যতে কল্যাণকর ও মঙ্গলময়রূপে বান্দার জীবনকে ধন্য করে।
উপদেশ : আপাতঃদৃষ্টিতে যা দুর্যোগময় ও বিপদ সঙ্কুল মনে হয় ভবিষ্যতে তা কল্যাণকর ও মঙ্গলময় হতেও পারে। সুতারাং বিপদে দুর্যোগে সাহস না হারিয়ে আল্লাহ্র উপরে ভরসা রাখা ও ধৈর্য্য অবলম্বন করা প্রয়োজন।
১৭৪২: এই আয়াতে "সে" কথাটি ইউসুফের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে । যেহেতু পান-পাত্রটি রাজার ছিলো [১২:৭২], সে কারণে ঘটনাটি ছিলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধারণা করা হয়, তল্লাসীর সময়ে ইউসুফ স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন কারণ ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুসারে তার ব্যক্তিগত উপস্থিতি অত্যাবশ্যক ছিলো। তল্লাসীর কাজ হুকুম অনুযায়ী তার কর্মচারীবৃন্দই করেছিলো সন্দেহ নেই কিন্তু তাঁর উপস্থিতির জন্যই এই আয়াতে "সে" শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ তল্লাশীর কাজটি তাঁরই হুকুমে হয়েছে। আইনের ভাষাতে বলা হয়, "Qui facit per alium, facit per se" অর্থাৎ "Whoever does anything through another, does it himself"।
১৭৪৩: Wiaum আরবী শব্দ বহুবচনে Auiya, অর্থ ব্যাগসমূহ, বাক্সসমূহ, তালাবদ্ধ ড্রয়ার সমূহ ইত্যাদি যাতে জিনিষ পত্র সংগ্রহ করে রাখা যায়। আরবী শব্দটির উল্লেখ করা হলো এই জন্য , এখানে ছোট্ট একটি উদাহরণ দেয়া গেলো কোরানের বর্ণনায় শব্দ চয়নের মাধুর্য্যকে তুলে ধরার জন্য । লক্ষ্য করুণ শব্দটির প্রয়োগের যর্থাথতা । আয়াত [১২:৭০] অনুযায়ী কাপটি লুকানো ছিলো ঘোড়ার পিঠের জিনের পার্শ্বের ব্যাগের (Rahl) মধ্যে। যখন কর্মচারীরা তল্লাশী শুরু করলো, তারা দশ ভাই এর ছোট বড় সকল মালপত্রের মধ্যে তল্লাশী চালালো । এই সকল প্রকার মাল পত্র বোঝানোর জন্য শব্দটির ব্যবহার হয়েছে।
১৭৪৪: পাত্রটি অর্থাৎ এক্ষেত্রে পান-পাত্রটি ।
১৭৪৫: ইউসুফ মিশরের বাদশাহের আইন অনুযায়ী ভাইকে গ্রেফতার করতে পারতেন না । কেননা মিশরের আইনে চোরকে মারপিট করে এবং চোরাই মালের দ্বিগুণ মূল্য আদায় করে ছেড়ে দেয়ার বিধান ছিলো। কিন্তু তারা এখানে ইউসুফ ভ্রাতাদের কাছ থেকে ইয়াকুবী শরীয়ত অনুযায়ী চোরের বিধান জেনে নেয়। এভাবে বেঞ্জামিনকে আটক রাখা ইউসুফের জন্য বৈধ হয়ে যায়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় সমস্ত কৌশলটি একটি জঘন্য প্রতারণামূলক কৌশল, যেমন আমাদের দেশে দেখা যায় শত্রুকে বিপদে ফেলার জন্য চোরাই মাল তার বাড়ীতে লুকিয়ে রেখে পুলিশে খবর দেয়া হয়। এরকম একটি কৌশল আল্লাহ্র নবী ইউসুফ করবেন কেন? আপাতঃদৃষ্টিতে কৌশলটি নিম্নমানের ও বেঞ্জামিনের জন্য অপমানজনক মনে হলেও এর উদ্দেশ্য ছিলো মহৎ । সময়ের বৃহত্তর পরিসরে তা ছিলো বেঞ্জামিনের জন্য কল্যাণজনক। আল্লাহ্ মানুষকে বিচার করেন তার কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্য দ্বারা কাজের দ্বারা, বা কাজের সাফল্য বা ব্যর্থতার দ্বারা নয়। মুসা ও খিজিরের ঘটনায় নৌকা ভাঙ্গা, বালককে হত্যা করা ইত্যাদি আপাতঃদৃষ্টিতে গোনাহ্র কাজ বলে মনে হলেও ভবিষ্যতের পটভূমিতে তা ছিলো মঙ্গলজনক কাজ। এভাবেই আল্লাহ্র মঙ্গলময় ইচ্ছা কার্যকর হয়। এই কৌশলের মাধ্যমে আল্লাহ্ প্রকৃত অপরাধীদের তাদের অপরাধকে অনুধাবন করার সুযোগ করে দেন যেনো তারা অনুতপ্ত হতে পারে, পরিবারটি যাতে পুনরায় মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়, এবং সন্তানের বিরহে কাতর শোকার্ত ইয়াকুবের হৃদয়কে শান্ত করতে পারেন। আল্লাহ্র কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যম ছিলেন হযরত ইউসুফ। তবে এখানে লক্ষনীয় ইউসুফের মনেও তাঁর কাজের নিয়ত ও উদ্দেশ্য ছিলো মহৎ। আল্লাহ্র হুকুম বা ইচ্ছা ব্যতীত ইউসুফ তাঁর ভাইকে বন্দী করতে পারতেন না । আল্লাহ্র পরিকল্পনা অপ্রতিরোধ্য এবং বিশ্বব্যাপী তার ক্ষমতার হস্ত প্রসারিত।
১৭৪৬: কর্মই মানুষের জীবন । এই কর্মময় পৃথিবীতে প্রতি মূহুর্তে মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়। অতীতকে পিছনে ফেলে ভবিষ্যতে তার যাত্রা । এই যাত্রা পথে আমরা প্রতি মূহুর্তে আমাদের কার্য প্রণালীর পরিকল্পনা করি। কোনও পরিকল্পনা হয় বোকামীতে ভরা, কোনটা ভন্ডামীতে ভরা, অথবা কোনটা হয় বিচক্ষণ । যে পাপী , দুষ্ট সে এক রকম পরিকল্পনা করে, যে বোকা সে অন্য রকম পরিকল্পনা করে, যে সরল সেও আর এক ধরনের পরিকল্পনা করে। আবার জগৎ সংসারে এক ধরনের লোক আছে যারা নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী মনে করে, কিন্তু তারা জানে না তাদের নিজস্ব জ্ঞান বা বিচার বুদ্ধির দরুণ তারা কখনও প্রকৃত জ্ঞানী হতে পারবে না । আবার প্রকৃত জ্ঞানী লোকের মধ্যেও তারতম্য বিদ্যমান । কারণ সকল জ্ঞানের উৎস আল্লাহ্ । মানুষের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞান ও বিচক্ষণতার যে স্ফুরণ দেখা যায় তা আল্লাহ্র জ্ঞানের সামান্য প্রকাশ মাত্র। এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে, "আমি যাকে ইচ্ছা জ্ঞান ও প্রজ্ঞাতে উন্নীত করি।" আল্লাহ্র অসীম জ্ঞান ও ক্ষমতায় বিপদ, বিপর্যয়, মূর্খতা সব অকল্যাণ অবশেষে কল্যাণে রূপান্তরিত হতে পারে। এই হচ্ছে এই আয়াতের উপদেশ।
১৭৪৭: দশ ভাই এর বেঞ্জামীন ও ইউসুফের প্রতি ঘৃণা এবারে ভাষায় প্রকাশ হলো। তাদের ঘৃণার তীব্রতা এতটাই ছিলো যে, তারা শুধুমাত্র বেঞ্জামীনকেই যে চোর বলে বিশ্বাস করলো তাই নয়, বহুদিন পূর্বে হারিয়ে যাওয়া বেঞ্জামীনের সহোদর ইউসুফের প্রতিও মিথ্যা দোষারোপ করতে দ্বিধা করলো না। তারা জানতেও পারলো না যে এই মিথ্যা দোষারোপ ইউসুফের হৃদয়ের তন্ত্রীতে কতটা আঘাত করেছিলো। তাদের ধারণারও বাইরে ছিলো যে তাদের সামনে মিশরের ক্ষমতাশালী যে উজীর দন্ডায়মান তিনি আর কেহ নন, তিনি তাদের ক্রীতদাসরূপে বিক্রি করে দেয়া ভাই ইউসুফ। হায়! তারা যদি জানতো যে তাদের মিথ্যা এবং বিশ্বাসঘাতকতা খুব শীঘ্রই আল্লাহ্ সর্ব সমক্ষে প্রকাশ করে দেবেন।
১৭৪৮: "প্রকাশ করলো না" অর্থাৎ গোপন রাখলো। ইউসুফের বহু গোপন তথ্য ছিলো । ১) তিনিই যে ইউসুফ সে তথ্য গোপন করা; ২) সহোদর বেঞ্জামীন জানে যে তিনি ইউসুফ; ৩) তিনি জানেন যে বেঞ্জামীন নিরাপরাধ এবং সম্পূর্ণ সাজানো ঘটনাটি একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ মাত্র। [দেখুন টিকা ১৭৪৫]; ৪) দশ ভাই তাদের অজান্তেই পরিকল্পনায় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে এবং দ্রুত বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে যদিও তাদের নিয়ত ও উদ্দেশ্য ছিলো খারাপ।
১৭৪৯: এই লাইনটিতে ইউসুফের মনের অবস্থার বিবরণ আছে। ইউসুফের তাঁর ভাইদের সম্বদ্ধে চিন্তাধারা ছিলো এরূপ, "আঃ! তোমরা ভাবছো যে কত সহজে তোমরা বেঞ্জামীনের থেকে নিষ্কৃতি পেতে যাচ্ছ, যেমন ভাবে তোমরা বহু পূর্বে ইউসুফ থেকে পেয়েছিলে । সত্যিকারের ঘটনা প্রবাহ জানলে তোমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকবে না। কারণ তোমরা এখন ইউসুফের ক্ষমতার ও কৃপার পাত্র।" তবে এ কথা ইউসুফ "সবিশেষ অবহিত" ছিলেন যে মহাজ্ঞানী আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তিনি একটি যন্ত্র বই আর কিছুই নয়।
উপদেশঃ পৃথিবীতে আমাদের দুঃখ, ব্যাথা, বেদনা, বিপদ, বিপর্যয় সব কিছুই আল্লাহ্র পরিকল্পনার অধীন। তিনি যন্ত্রী আমরা যন্ত্র; তিনি যেমন বাজান আমরা তেমনই বাজি।"
১৭৫০: ইউসুফের ভাইরা ইউসুফকে হে আজীজ বলে সম্বোধন করলো। এখানে কেহ যেনো বিভ্রান্তিতে না পড়েন সেই আজীজের সাথে যে আজীজ ইউসুফকে ক্রয় করেন, তাঁর সাথে । আজীজ ছিলো মিশরের উজীরের উপাধি। দেখুন আয়াত [১২:৩০] এবং টিকা ১৬৭৭ এবং ১৭১৪ । ]
১৭৫১: এ সময়ে ইউসুফের সাথে দশ ভাই এর সামান্য তর্কবির্তক হয়। বেঞ্জামীনকে হারানোর পরে তারা তাদের পিতার যে ক্রোধের সম্মুখীন হবে তা অনুধাবন করতে পেরেছিলো । তাই তাদের একজন বেঞ্জামীনের পরিবর্তে থেকে যেতে চেয়েছিলো । কিন্তু দশ ভাই নিজ থেকে যে চুক্তি ইউসুফের সাথে করেছিলো, ইউসুফ সেই চুক্তিতে অনড় ছিলেন।
১৭৫২: 'Kabir' এই শব্দটির অর্থ বয়োজ্যেষ্ঠ। কিন্তু আয়াত [১২:৭৮] এ 'Kabir ' ও 'Shaikh' এই দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে দু রকম অর্থে। ইউসুফ আলী সাহেব প্রথমটি "শ্রদ্ধেয়" এবং দ্বিতীয়টি "প্রবীণ" হিসেবে অনুবাদ করেছেন। আয়াত [২০:৭১] এ 'Kabir' শব্দটি অবশ্যই দলপতি বা নেতার পরিবর্তে ব্যবহার হয়েছে। সেখানে কোন প্রবীণের বা বয়েসের কথা বলা হয় নাই । ইউসুফ আলী সাহেব এই আয়াতে [১২:৮০] দলনেতা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। 'দলনেতা' অর্থাৎ পুরো দলে যিনি নেতৃত্ব দিতেন বিভিন্ন বিষয়ে তিনি। কোরানে তার নামের উল্লেখ নাই। বাইবেলের ভাষ্য নিম্নরূপঃ সর্বজ্যেষ্ঠ ভাইএর নাম ছিলো রুবেন (Reuben) বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী যে ভাই দলের নেতৃত্বে ছিলেন তার নাম ছিলো (Judah) যুধা । তিনি ছিলেন দশ ভাই এর মধ্যে জ্যেষ্ঠতার ক্রমঅনুসারে চতুর্থ। জ্যেষ্ঠতার ক্রম ছিলো এরূপ : Reuben, Simeon, Levi এবং. এরা সকলেই ছিলেন একই মায়ের সন্তান । বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী Judah বেঞ্জামীনের পরিবর্তে জামানত থাকতে চেয়েছিলেন [ Gen Xliii 9] , কারণ যেহেতু তিনিই ছিলেন দলনেতা আর সেটাই ছিলো স্বাভাবিক ।
১৭৫৩: দলনেতা তার পিতার কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আল্লাহ্র নামে শপথ করে। সুতারাং সে পিতার কাছে এবং আল্লাহ্র কাছে দায়বদ্ধ ছিলো । তার পিতা হুকুম না দেওয়া পর্যন্ত সে এখানে বেঞ্জামীনের জামানত হিসেবে থেকে যাবে। কিংবা এমনও হতে পারে যে আল্লাহ্ তাঁর জন্য অন্য কোন রাস্তা খুলে দেবেন । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হয়তো বা আল্লাহ্র দয়ায় মিশরের উজীরের মনে দয়ার উর্দ্রেক হতে পারে, ভবিষ্যতে তিনি হয়তো বা বেঞ্জামীনসহ তাদের মিশরে ত্যাগের অনুমতিও দিতে পারেন। তাহলে তিনি তার পিতার কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারবেন।
১৭৫৪: "সে আমাদের অগোচরে চুরি করেছে। সে ব্যাপারে আমাদের কি করণীয় ছিলো?" দলনেতা ব্যতীত অন্য নয় জনের কাছে দলনেতার এই বিবৃতি অত্যান্ত হৃদয়গ্রাহী ছিলো। কিন্তু দলনেতা ব্যক্তিগতভাবে এবং বিশেষভাবে পিতার নিকট আল্লাহ্র নামে শপথ করার ফলে সে অপরাধবোধে ভুগছিলো।
১৭৫৫: দলনেতা জুধার নির্দ্দেশ ছিলো অন্য নয় ভাই যেনো তাদের পিতাকে ঘটনার সত্যতা সম্বদ্ধে সেই জনপদের অধিবাসী (যেখানে তারা ছিলো) এবং তাদের সাথের যাত্রীদলের মধ্যে অনুসন্ধান করতে বলে, তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। নয় ভাই ফিরে এসে জুধার নির্দ্দেশ অনুযায়ী তাদের পিতার কাছে ঘটনার বর্ণনা করে।
১৭৫৬: নয় ভাই এর বিবরণ হযরত ইয়াকুবকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছিলো । কারণ ইয়াকুব তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান বেঞ্জামীনের চরিত্র খুব ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। বেঞ্জামীন যে এরূপ কোন কাজ করতে পারে না সে সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। তাই তিনি নয় ভাই এর বক্তব্য পুরোপুরি অবিশ্বাস করলেন। বেঞ্জামীনকে চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করা আর আষাঢ়ে গল্পের বয়ান করা একই কথা, এই ছিলো ইয়াকুবের অভিমত । যদিও এই অভিমত সত্য, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বাস্তবে ভাইরা বিন্দুমাত্র মিথ্যা বলে নাই, এবং ইয়াকুবের ধারণাও সত্য ছিল। হযরত ইয়াকুব তাঁর নবীসুলভ অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন যে বেঞ্জামীন নির্দ্দোষ, কিন্তু তিনি সঠিকভাবে ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে পারেন নাই।
১৭৫৭: হযরত ইয়াকুব আল্লাহ্র করুণা ও দয়ার উপরে দৃঢ়ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আল্লাহ্ তাঁর তিন সন্তানকে তাঁর নিকট ফিরিয়ে দেবেন। যদিও বর্তমান সময় তাঁকে দুঃখের অথৈ সাগরে নিক্ষেপ করেছে, কিন্তু তা তাকে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করতে পারে নাই।
১৭৫৮: হযরত ইয়াকুব , সন্তান শোকে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট এক বৃদ্ধ পিতা, যার কষ্ট ভাষায় বর্ণনাতীত । এই অসহনীয় কষ্টকে সামান্য এক লাইনে কোরানের আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। বেঞ্জামীনকে হারিয়ে ইয়াকুবের মনে ইউসুফকে হারানোর শোককে স্মরণ করিয়ে দেয়। ইউসুফ তাঁর সোনার টুকরা ছেলে, যার মাঝে ভবিষ্যতে নবী হওয়ার লক্ষণ বিদ্যমান ছিলো , যার উপরে আল্লাহ্র করুণাধারা তিনি নবীসুলভ অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইউসুফের মহত্ব, সকল কিছু তাঁর স্মৃতিপটে উদিত হলো, এবং বেঞ্জামীনের সাথে সাথে তিনি ইউসুফের শোকেও অধীর হয়ে উঠলেন। শোকের ভার তাঁর বুকে পাহাড়ের মত চেপে বসলো। যদি তিনি মন খুলে কাঁদতে পারতেন তবে হয়তো তার এই শোক কিছুটা লাঘব হতো। কিন্তু শোকের পাষাণ ভার এত তীব্র ছিলো যে, তাঁর চোখে পানি ছিল না। শোকের অশ্রুতে তার চক্ষু হয়তো লাল হয়ে ফুলে যেতো কিন্তু অন্তরের পাষাণভার কিছুটা হলেও লাঘব ঘটতো, ফলে তার চোখের স্বাভাবিক উজ্জ্বল্য বিদ্যমান থাকতো । কাঁদতে না পারার ফলে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার অবয়বে। তাঁর চক্ষুর বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায় । চক্ষু তার স্বাভাবিক দীপ্তি হারিয়ে নিষ্প্রভ ও সাদা হয়ে যায়। তাঁর চোখের সামনে থেকে পৃথিবীর আলো নিভে যায় । তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান, পৃথিবী তাঁর কাছে অন্ধকারময় হয়ে ওঠে। অন্তরলোকও শোকের তীব্রতায় পাথর হয়ে যায়। তিনি তাঁর শোকের অধীরতা একাই সহ্য করেছেন। শোকের কোনও প্রকাশ ছিলো না, কারও বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিলো না । পৃথিবীতে এমন কেউ কি আছে যে তাঁর এই দুই সুযোগ্য পুত্র হারানোর শোকে সমব্যথী হতে পারবে? বুঝতে পারবে? তিনি একমাত্র আল্লাহ্র উপরে অবিচলিত বিশ্বাস রেখে এই শোকে নীরবে ধৈর্য্য ধারণ করেন। আল্লাহ্র প্রতি অবিচল বিশ্বাসই তাঁকে ধৈর্য্যের দীপ শিক্ষা জ্বালিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এই আয়াতের প্রধাণ শিক্ষা হচ্ছে মোমেন বান্দার অন্যতম প্রধান গুণ হবে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস রেখে অবিচলিত ধৈর্য্য। যারা প্রকৃত মোমেন বিপদে ধৈর্য্য ধারণ হচ্ছে তাদের জন্য পরীক্ষা।
১৭৫৯: এই উক্তিটি ছিলো ইউসুফের প্রতি হিংসা -দ্বেষে জর্জরিত বৈমাতৃয় ভাইদের । উক্তিটি ছিলো হিংসা-দ্বেষে ও বিদ্রুপে পরিপূর্ণ এবং স্বভাবতঃই তা ছিলো নির্বোধ ও মূর্খ ব্যক্তিরা যখন পাগলের ন্যায় ব্যবহার করে সেরূপ। এই উক্তি প্রমাণ করে যে ইয়াকুবের ছেলেরা তাদের পাপের জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জ্বিত বা অনুতপ্ত ছিলো না । যদি তাদের মধ্যে সামান্যতম বিবেকও জাগ্রত হতো, তবে তারা এরূপ উক্তি করতে পারতো না ।ইউসুফ ও বেঞ্জামীনের শোকে যখন ইয়াকুব নবী পাগল প্রায় , সে সময় এরূপ কটুক্তি হৃদয়হীনতারই নামান্তর । ইয়াকুব নবী তার ব্যাথা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে যাওয়া হৃদয়ের আকুতি পৃথিবীর কারও কাছে জানান নাই, তার আবেদন ছিলো একমাত্র পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র দরবারে। যা পরের আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
১৭৬০: ইয়াকুবের একমাত্র আবেদন ছিলো আল্লাহ্র কাছে। তাঁর এই আবেদন ছিলো তাঁর হৃদয়ের অসহনীয় দুঃখ ব্যাথার ভার সহনশীল করার আবেদন পরম করুণাময়ের দরবারে। এই আবেদন ছিলো পরম করুনাময়ের কাছে নিবেদন স্বরূপ, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়। পুত্রশোকে তিনি যেনো কখনও তাঁর ধৈর্য্যের বাঁধ অতিক্রম না করেন, মনের সংযম স্থিতধী স্থির রাখতে পারেন এই ছিলো তাঁর নিবেদন।
উপদেশঃ এই আয়াতের মাধ্যমে এই উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, বিপদে মনের সংযম না হারিয়ে আল্লাহ্র কাছে বিপদকে নিবেদন করতে হবে । যেখানে ইয়াকুব নবী দুই পুত্র শোকেও আল্লাহ্র বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন নাই, সেখানে সামান্য ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতিতে আমাদের ধৈর্য্যহারা হওয়া উচিত নয়। কারণ সর্ব কাজের শেষ ফলাফল তো আল্লাহ্রই হাতে। তিনি তো মঙ্গলময় - সকল কল্যাণের তিনিই মালিক ।
১৭৬১। ইয়াকুব নবী জানতেন যে সেই পরম মঙ্গলময় প্রভুর হাতে সর্ব কল্যাণ নিহিত । দুঃখ কষ্টের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে তার কল্যাণের উপযুক্ত করে নেন। তিনি অন্তরে অনুভব করেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত সব কিছুরই সফল ও সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটবে। তার এই অনুভবের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলো তার আল্লাহ্র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস । তাই তিনি ইউসুফের বা বেঞ্জামীনের আশা ত্যাগ করেন নাই । পরবর্তী আয়াতে তিনি তার পুত্র গণকে সেই নির্দ্দেশই দান করেন।
১৭৬২: আরবী শব্দটির উচ্চারণ হবে 'Rauh' । কোন কোন অনুবাদক ভুলবশতঃ এই শব্দটিকে Ruh হিসেবে অনুবাদ করেছেন। 'Rauh' এই শব্দটির ভাবানুবাদ হবে আল্লাহ্র করুণা যা অবারিতভাবে প্রবাহিত, অথবা যা আমাদের বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থাকে শান্ত করে। সুতারাং এই ভাবটিই এখানে ইয়াকুব নবীর মুখনিঃসৃত বক্তব্যের উপযুক্ত।
১৭৬৩: এই আয়াতের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, ইয়াকুব নবী তাঁর নবীসুলভ জ্ঞান, প্রজ্ঞার ফলে তাঁর অর্বাচীন ও মূর্খ ছেলেদের ইর্ষা ও বিদ্বেষপূর্ণ অভিযোগের উত্তরে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দান করলেন, যা তাদের জন্য মঙ্গলজনক । আল্লাহ্র করুণা ও সদয় তত্বাবধানের প্রতি তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন; যা তার শোকে বিধ্বস্ত হৃদয়কে সান্তনার প্রলেপ দিতে সক্ষম হয়েছিলো । তিনি তাঁর ছেলেদের ইউসুফ ও বেঞ্জামীনের অনুসন্ধানের জন্য এতদিন পর হুকুম দিলেন। সম্ভবতঃ তিনি তাঁর নবীসুলভ দূরদৃষ্টির সাহায্যে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁরা সকলে মিশরে পুনর্মিলিত হতে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের শস্যের ভান্ডার কমে আসে এবং নূতনভাবে শস্য সংগ্রহের জন্য তাদের মিশর যাওয়া প্রয়োজন।
১৭৬৫: এবারে ইউসুফ আত্মপরিচয় প্রকাশ করলেন। তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তোমরা তোমাদের হারানো ভাই ইউসুফের সাথে কিরূপ অন্যায় ব্যবহার করেছিলো? ইতিমধ্যে ইউসুফ বেঞ্জামীনের নিকট থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, ইউসুফের তত্বাবধানের অবর্তমানে দশ ভাই ছোট্ট মাতৃহারা ভাইটির সাথে কি দুর্ব্যবহার করতো। ইউসুফ চেয়েছিলেন তাঁর ভাইদের বিবেককে জাগ্রত করতে। প্রতিশোধ নয়, ক্ষমা, দয়া ও মহানুভবতার মাধ্যমে ভাইদের বিবেকের কাছে আবেদন। সে জন্য তিনি বেঞ্জামীনের প্রতি যে অবিচার অত্যাচার করা হয়েছিলো তারও উল্লেখ করলেন। ইউসুফের ভাইরা খাদ্যশস্য দানের অনুরোধ করেছিলো, কারণ তাদের কাছে পণ্যমূল্য ছিলো না। তারা খাদ্য শস্যের বিনিময়ে তুচ্ছ পণ্য নিয়ে এসেছিলো - অর্থাৎ তারা ইউসুফের দয়ার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলো, শস্য দান করা খুবই সামান্য দান, কিন্তু ইউসুফের তাঁর ভ্রাতাদের জন্য দান ছিলো আরও মহৎ আরও বৃহৎ। তা ছিলো তাদের বিবেকের কাছে আবেদন, যেনো তারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করতে পারে।
উপদেশ : আল্লাহ্র পরিকল্পনা কত আশ্চর্যজনক ভাবে কার্যকর হয়। এই আয়াতগুলি সেই সাক্ষ্যই দেয়। ইর্ষায় অন্ধ হয়ে ইউসুফ ভ্রাতারা তাঁকে হেয় করার জন্য ক্রীতদাস রূপে বিক্রী করেছিলো । কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই ইউসুফের দয়া ভিক্ষার জন্য তাদের ইউসুফের করুণা প্রার্থী হতে হলো। ইউসুফের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, অর্থ, বিত্ত, সব কিছুই তার ভাইদের ধারণারও বাইরে ছিলো।
১৭৬৬: ইউসুফ ভ্রাতারা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলো বেঞ্জামীনের অবস্থান ক্রীতদাসের ন্যায় নয়। বেঞ্জামীন ইউসুফের পরম স্নেহাস্পদ। উজীর কেন তাদের ইউসুফ ও বেঞ্জামীনের প্রতি তাদের দুর্ব্যবহারের ব্যাপারে প্রশ্ন করলো ? সম্ভবতঃ এসব ঘটনা তাদের ইউসুফের ছোটবেলার স্বপ্নের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হয়তো বা উজীর নিজেই ইউসুফ হবেন, নতুবা এসব অসংলগ্ন ঘটনার কোনও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন। ফলে তারা ইউসুফকে সরাসরি প্রশ্ন করলো, উজির নিজে ইউসুফ কি না? ইউসুফের উত্তরও ছিলো সরাসরি। তিনি বললেন যে, তিনিই ইউসুফ, বিশ্বাস না হয় বেঞ্জামিনকে জিজ্ঞাসা কর, "সে আমার সহোদর । আমরা বহু কষ্ট ও বিপর্যয় সহ্য করেছি এখন আল্লাহ্ আমাদিগের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।" এই আয়াতের উপদেশ ইউসুফের উক্তির মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত আকারে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। "যারা মুত্তাকী অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্র আসন সর্বোচ্চ বলে জানে, যারা ধৈর্য্যশীল ও সৎকর্মপরায়ণ তাদের পুরষ্কার দাতা স্বয়ং আল্লাহ্। "আল্লাহ্ তাদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।" এই বাক্যটি দ্বারা এই ভাবকেই বোঝানো হয়েছে। এ কথা সর্বকালে সর্ব যুগে সর্বমানুষের জন্য প্রযোজ্য।
১৭৬৭: ঘটনার নাটকীয়তা ও আকস্মীকতায় ইউসুফ ভ্রাতাদের সমস্ত চেতনা অবলুপ্ত হওয়ার অবস্থায় উপনীত করলো। ঘটনার অবিশ্বাস্য প্রবাহ তাদের সমস্ত অন্তরাত্মাকে প্রবল ভাবে আন্দোলিত করে, তাদের পুরানো বিশ্বাস মূল্যবোধকে ঝড়া পাতার মত সজোরে ঝেড়ে ফেলে দেয়। এ বোধ তাদের মধ্যে জন্মায় যে, আল্লাহ্র পরিকল্পনা ধূলিস্যাৎ করার ক্ষমতা কোনও মানুষের-ই নাই। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। এ ভাবেই ইউসুফের ভাইদের নৈতিক জীবন অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে। অন্ধকার আত্মার মাঝে আল্লাহ্র নূর প্রবেশের পথ পায়। অনুতাপের আগুন তাদের আত্মার উপরের অন্ধকারের আবরণ উন্মোচনে সাহায্য করে। সম্ভবতঃ তাদের যে দলনেতা জুদা সেখানে একা থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেও তার ভ্রাতাদের অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। অনুতপ্ত ইউসুফ ভ্রাতারা নিজ মুখে স্ব-স্ব পাপের স্বীকারোক্তি করে, এবং ইউসুফের উচ্চ পদে অবস্থানকে আল্লাহ্র ইচ্ছারূপে স্বীকার করে নিতে তাদের মাঝে আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো না। "আল্লাহ্ নিশ্চয় তোমাকে আমাদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। "
১৭৬৮: ইউসুফ ছিলেন নবী পদমর্যাদার অধিকারী। তাঁর মধ্যে নবীসুলভ মহানুভবতা, দয়া, ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি সকল গুণ বিদ্যমান ছিল। তিনি সুখী হয়েছিলেন এ জন্য যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর ভ্রাতারা তাদের পাপকে অন্তরের মাঝে অনুধাবনে সক্ষম হয়েছে এবং অনুতপ্ত হয়েছে। পুণর্মিলনের সেই মহাক্ষণে সবচেয়ে বেশী মনে পড়েছে তাঁর বৃদ্ধ স্নেহবৎসল পিতার কথা। পুণর্মিলনের নির্মল আনন্দ ধারা যাতে পরস্পরের উপরে দোষারোপের তিক্ততার কালিমা লেপনে অনুজ্জ্বল হয়ে না পড়ে, সে কারণে বিচক্ষণ ইউসুফ তৎক্ষণাৎ তাঁর ভ্রাতাদের সূদূর কেনান দেশে প্রেরণ করেন তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে সপরিবারে মিশরে নিয়ে আসার জন্য । স্নেহ পরায়ণ বৃদ্ধ পিতা - যার অন্তর সর্বক্ষণ ইউসুফকে হারানোর ব্যাথায় ভারাক্রান্ত থাকতো - তাঁকে সেই ব্যাথার ভার থেকে মুক্ত করা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা প্রয়োজন। সন্তান মৃত্যুর বিয়োগ ব্যাথা মানুষের একসময়ে সহনীয় হয়ে আসে। এজন্য যে, আল্লাহ্র বান্দা আবার আল্লাহ্র কাছেই ফিরে গেছে। কিন্তু নেকড়ে বাঘে ইউসুফকে খেয়ে ফেলেছে এ বানোয়াট কাহিনী সত্বেও ইয়াকুব তার নবী সূলভ দূরদৃষ্টির সাহায্যে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইউসুফ জীবিত আছে। কিন্তু কোথায় কিভাবে - সে কি মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে? যেখানে পিতা হিসেবে তিনি আরামে আছেন এ কষ্ট কোনও পিতা-মাতার পক্ষেই কোনও সময়েই সহনীয় করা সম্ভব হয় না। সে কারণেই ইউসুফ তাঁর ভাইদের দ্রুত প্রস্থান করতে বললেন এবং তার পিতার দেহ, মন, আত্মাতে শান্তি আনয়ন করার জন্য তার উপস্থিতির প্রমাণ স্বরূপ তাঁর সার্ট তাদের দিলেন। তাঁর পিতা যেনো বুঝতে পারে যে এ কোনও ছলনা নয়। এ হচ্ছে পুণর্মিলনের পূর্বপ্রস্তুতি - যার স্বপ্ন ইয়াকুব নবী বহু বছর থেকেই দেখে এসেছেন এবং যার জন্য তিনি কখনও আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা হারান নাই।
১৭৬৯: ইউসুফের কাহিনীর প্রারম্ভে সার্টের ব্যাপারটি সকলেরই স্মরণ আছে। দশ ভাই ইউসুফের রক্তমাখা জামা উপস্থাপনের মাধ্যমে নেকড়ের কাহিনীর অবতারণা করেছিলো । দেখুন আয়াত [১২:১৭ - ১৮]। এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন । অনুতপ্ত দশ ভাই তাদের পাপকে নিজ মুখে স্বীকার করে এবং ইউসুফ তাদের ক্ষমা করে দেন। প্রতিবার তারা তাদের পিতার নিকট ছিলো দুঃসংবাদের বাহক মাত্র - কিন্তু এবারে তারা ইউসুফের সুসংবাদ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের পিতার কাছে । এ কাহিনীর শুরু হয়েছিলো একটি জামার মাধ্যমে এবং শেষও হতে যাচ্ছে একটি জামার মাধ্যমে । প্রথম জামাটি ছিলো রক্তমাখা অতি সাধারণ একটি জামা । এবারের জামাটি হচ্ছে সমৃদ্ধশালী মিশরের প্রচন্ড ক্ষমতাধর উজীরের বহুমূল্যবান কারুকার্যখচিত জামা যাতে ইউসুফের বর্তমান অবস্থানকে ইয়াকুব নবী অনুধাবন করতে পারেন এবং অন্ধ ইয়াকুব ইউসুফের উপস্থিতি অনুভব করতে পারেন। কাহিনীর প্রথমে যে জামার উল্লেখ আছে, তা ইয়াকুবকে দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত করে এবং কাহিনীর শেষে যে জামার উল্লেখ আছে তা ইয়াকুব নবীকে তাঁর অন্তহীন দুঃখের সাগর অতিক্রমে সাহায্য করে। দেখুন পরবর্তী আয়াতে।
রুকু - ১১
১৭৭০: 'Rih' এই আরবী শব্দটির অর্থঃ ঘ্রাণ, বা বাতাস বা পরিবেশ বা নিঃশ্বাস ইত্যাদি অনুভব করা। বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ইউসুফের উপস্থিতির ঘ্রাণ পাচ্ছি।" ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে "I do indeed scent the presence of Joseph" আরবী শব্দটির বিভিন্ন অর্থ অনুযায়ী অনুবাদ হতে পারতো, "I feel the presecnce of Joseph in the air" এই পৃথিবীতে বর্তমান কালেও অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে দেখা যায় । প্রিয়জনের অনেক সংবাদ বহুদূরে থেকেও প্রিয়জনেরা অনুভব করতে পারে। এই অতীন্দ্রিয় ঘটনাকে আমরা "টেলিপ্যাথি" নামে অভিহিত করি। বিশেষতঃ মা ও সন্তানের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি খুবই সচারচর ঘটে থাকে। যেহেতু ইয়াকুব ছিলেন নবী শ্রেণীভূক্ত, সুতারাং তার বেলাতেও এই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা ছিলো আরও সুক্ষ ও নির্ভুল। তাঁর জ্ঞানের সীমায় আল্লাহ্ তাকে সাধারণ মানুষের উর্দ্ধে স্থাপন করেছিলেন। আল্লাহ্র প্রাপ্ত সেই জ্ঞানের দ্বারাই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইউসুফ জীবিত আছে - এবং একদিন তিনি ইউসুফকে তার পিতৃবক্ষে ফিরে পাবেন। তাঁর যে ছেলেরা তাঁর এই দুঃখের কারণ ছিলো, আল্লাহ্র কি অপূর্ব কৌশল, তাদের মাধ্যমেই সমস্ত ঘটনার পরিসমাপ্তি এক নির্দ্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে ঘটতে যাচ্ছে। ইয়াকুব নবীর বিশুদ্ধ আত্মায় প্রকৃত ঘটনার ছবি তার ছেলেরা দেশে ফেরার পূর্বেই ধরা পরে; যদিও তিনি ছিলেন দৃষ্টিশক্তিহীন।
১৭৭১: 'তারা ' অর্থাৎ ভাইরা দেশে পৌঁছানোর পূর্বে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ। ইউসুফের জন্য শোকাকুল পিতাকে ভাইরা রোগগ্রস্থ মুমূর্ষ বলে অভিহিত করেছিলো, [১২:৮৫] তাঁকে অভিযুক্ত করেছিলো বিভ্রান্ত বলে,এবং জনসাধারণ তা বিশ্বাসও করেছিলো। সেই ভাইদের দ্বারাই আল্লাহ্ ইউসুফের উপস্থিতি ও সমৃদ্ধির ঘোষণা দিলেন। এভাবেই যুগে যুগে শেষ পর্যন্ত মিথ্যার ধ্বংস ঘটে।
উপদেশঃ মিথ্যার শুরু হয়, কিছুদিন সে অপ্রতিহত গতিতে পথ চলে, শেষে সত্যের আলোতে তার অপসারণ ঘটে যেরূপ আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকার দূরীভূত হয়। এ কথা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সর্ব কালে প্রযোজ্য।
১৭৭২: এই আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী অনুমান করা যায় যে, সুসংবাদ বাহকটি ছিলেন জুধা [দেখুন টিকা ১৭৫২ এবং ১৭৫৩] যিনি তাঁর পিতার কাছে বেঞ্জামীনের নিরাপত্তার জন্য জামানত হয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি শুধু বেঞ্জামীনের মুক্তির সুসংবাদ নয়, ইউসুফের সমাচারও পিতার গোচরীভূত করার জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি - ই প্রথম দ্রুত অগ্রসর হয়ে পিতাকে শুভ সংবাদ দিয়েছিলেন, সেই কারণে বাক্যটিতে একবচনে সুসংবাদ বাহক কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীতে ইয়াকুব নবীর সম্বোধন থেকে বোঝা যায় তিনি তাঁর সকল ছেলেদের এই আয়াতে সম্ভাষণ করেছেন। শুধুমাত্র সুসংবাদ বাহককে নয়। "তোমাদের বলি নাই" কথাটি দ্বারা বহুবচনই বোঝায়। পরের আয়াত থেকেও এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, সে সময়ে সকল ভ্রাতারাই উপস্থিত ছিল।
১৭৭৩: 'Fa' অর্থ তখন। অর্থাৎ এখানে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।
১৭৭৪: ইয়াকুবের দৃষ্টিশক্তি পুত্রশোকে ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিলো, এবং চক্ষুদ্বয় নিষ্প্রভ ও সাদা হয়ে গিয়েছিলো [দেখুন ১২:৮৪] । এবারে তাঁর চক্ষুর দীপ্তি ও মনের শক্তি পূর্ববৎ ধারণ করলো।
৯৮। সে বলেছিলো, "শীঘ্রই আমি আমার প্রভুর নিকট তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবো ১৭৭৬ । তিনি তো বারে বারে ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু ।"
১৭৭৬: পুত্রেরা তাদের কৃতকর্মের জন্য পিতার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী ছিলো। কিন্তু পুত্রদের অপরাধ, তাদের পিতার থেকে ইউসুফের কাছে ছিলো অধিক। এ কথা সত্য যে তাদের অপরাধে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন ইউসুফ। সুতারাং ক্ষমা করার এখতিয়ার ইউসুফের । তবে পূর্বাহ্নেই ইউসুফ তাঁর ভ্রাতাদের ক্ষমা করে দেন। ইয়াকুব সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ইউসুফের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য, আল্লাহ্র ক্ষমার মাধ্যমে । আল্লাহ্র ক্ষমার মাধ্যমেই তিনি তাঁর সব সন্তানদের একত্র মিলন দেখতে চেয়েছিলেন।
১৭৭৭: শেষ পর্যন্ত পুরো পরিবার মিশরে প্রবেশ লাভ করলো, এবং পারিবারিক মিলন ঘটলো। ইউসুফ তাঁর ভাইদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দের বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিনি তাঁর পিতা-মাতার জন্য বিশেষ সম্মানজনক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর নিজের মা 'র্যাবেল' বহুপূর্বেই গত হয়েছিলেন। তাঁর খালা 'লীহা' যাকে তাঁর পিতা পরে বিবাহ করেন, তিনি ইউসুফ ও বেঞ্জামীনকে লালন-পালন করেন, তাঁর বিমাতা ও পিতাকে তিনি বিশেষ সম্মানের সাথে ইউসুফ তাঁর সাথে রাখেন।
১৭৭৮: "আপনারা আল্লাহ্র ইচ্ছায় নিরাপদে মিশরে প্রবেশ করুণ" - এবাক্যটি ছিলো ইউসুফের অর্থাৎ মিশরের ক্ষমতাশালী উজীরের সাদর সম্ভাষণ। এই উক্তিটির বৈশিষ্ট্য এখানে লক্ষনীয় । ইউসুফ নিজের সম্ভাষণের পূর্বে আল্লাহ্র ইচ্ছায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। তাঁর পরিবারের জন্য দ্বিমুখী নিরাপত্তার কথা প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্র ইচ্ছায় মিশর পার্শ্ববর্তী দেশের ন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ নয়, নিরাপদে সুরক্ষিত, সেই মিশরে তাঁরা সাদরে আমন্ত্রিত এবং তারা মিশরে সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হবেন।
১৭৭৯: 'উচ্চাসন' কথাটি এখানে রূপক ভাবে বলা হয়েছে, আবার আক্ষরিক ভাবেও এই বাক্যটি এখানে প্রযোজ্য । প্রাচ্য দেশীয় রীতি অনুযায়ী যে কোন অনুষ্ঠানে বা সম্বর্ধনাতে প্রধান অতিথিকে সুউচ্চ মঞ্চে বসানো হয়। সেখানে তার জন্য জাঁকজমকপূর্ণ গদি ও চেয়ারের বন্দোবস্ত করা হয়। সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের এটাই রীতি । ইউসুফও তাঁর পিতা-মাতার প্রতি সেই রীতিই অনুসরণ করেন। তিনি তাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেন। অপরপক্ষে ইউসুফের পিতা-মাতা ও ভাইরা মিশরের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী উজীর, যিনি ফেরাউনের পরেই মিশরের সর্বক্ষমতার অধিকারী, তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মান জাননোর জন্য সেজদা করেন। এ ভাবেই ইউসুফের কৈশরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় [ ১২:৪ আয়াত এবং টিকা ১৬৩৩] ।
১৭৭৯-কঃ হযরত মুহম্মদের (সা)আগমনের পুর্বে কাউকে সম্মান দেখানোর জন্য সেজদার প্রচলন ছিলো। কিন্তু সময়ের ও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে, আল্লাহ্ প্রত্যাদেশকে, যুগে যুগে নবী রসুল প্রেরণ করে যুগোপযোগী করেছেন। শেষ নবীর সাথে সাথে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ পৃথিবীর মানুষের জন্য শেষ প্রত্যাদেশ রূপে গণ্য হয়। এসময় থেকেই চালু হয় যে, আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও সামনে মাথা নত করা চলবে না । আর এই মাথা নত করাকে ভয়ানক পাপ হিসেবে গণ্য করা হবে।
১৭৮০: ইউসুফের চরিত্রের মাধ্যমে আল্লাহ্ মানব চরিত্রের এক অমূল্য গুণরাজি শিক্ষা দিয়েছেন। প্রাচীন কালে মিশর ছিলো, সভ্যতায়, সমৃদ্ধিতে পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ। আজ পর্যন্ত তাদের সভ্যতার নিদর্শন মানুষের মনে বিস্ময়ের উর্দ্রেক করে। সেই মিশরের সর্বময় ক্ষমতার অধিপতি হয়েও এই আয়াতে ইউসুফের বক্তব্যে বিনয়ের যে প্রকাশ ঘটেছে তা অনুধাবন যোগ্য । ক্ষমতা মানুষের বিনয়ী হওয়ার ক্ষমতাকে নষ্ট করে। তাঁর বক্তব্যে প্রথমতঃ তিনি সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন আল্লাহ্র অসীম করুণাকে যার দয়ায় তাঁর আজকের এই অবস্থান । আল্লাহ্র করুণাকে তিনি দুভাবে উপস্থাপন করেছেনঃ ১) আল্লাহ্ তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন, শুধু মুক্তই করেন নাই তাঁকে জনসমক্ষে সৎ, গুণান্বিত ও সম্মানীয় নাগরিকরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২) তাঁর স্নেহময় পিতাকে তিনি ফিরে পেয়েছেন, এ তাঁর পরম সৌভাগ্য। সেই সাথে ভাইদের কথাও স্মরণ করেছেন, যে ভাইরা তাকে অত্যাচারে, অবহেলায় জর্জরিত করেছিলো । তার মহানুভবতার পরিচয় মেলে এখানেই যে, তিনি ভাইদের এই মানসিকতাকে শয়তানের ফাঁদরূপে আখ্যায়িত করেন এবং এই ফাঁদ থেকে মুক্ত করে তাঁর ভাইদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগের জন্য তিনি আল্লাহ্কে ধন্যবাদ দেন। তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও অভিযোগ উত্থাপন করেন নাই । তাঁর স্বভাবকে Husn-i-zann রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। Husn-i-zann শব্দটির অর্থ যার অভ্যাসই হচ্ছে সব কিছুকে সবার জন্য সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা। সে কারণেই তিনি তাঁর ভাইদের দুষ্ট স্বভাবকে দোষারোপ না করে শয়তানের ফাঁদরূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিলো যে, শয়তানই তাঁর ভাইদের তাঁর বিরুদ্ধে চালিত করেছে। আল্লাহ্র অশেষ করুণা যে সব কিছুর শেষ পরিণতিকে তিনি স্বার্থক সুন্দর করেছেন । এজন্য তিনি আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞ। এখানে লক্ষনীয় বিষয় যে, পুরো বক্তব্যের মধ্যে কোথাও তাঁর দুঃখ কষ্ট ভোগের জন্য কোনরূপ অভিযোগ নাই, বা fতাঁর বিশেষ গুণাবলীর জন্য আত্ম-গরিমা নাই, বা ক্ষমতার দম্ভে অহংকারে ষ্ফীত হন নাই। যারা সংসারে সফলতার শীর্ষ বিন্দুতে অবস্থিত, তাদের এরূপ বিনয়ী ও আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার উদাহরণ হচ্ছে এই আয়াত । অবশ্য আমরা সাধারণ মানুষ, তবুও সবার জন্যই বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ হওয়া আল্লাহ্র আদেশ।
"Latif" দেখুন আয়াত [২২:৬৩] এবং এর টিকা নং ২৮৪৪। সেখানে "লতিফের " ৫ টি অর্থ দেয়া আছে, এর মধ্যে চতুর্থ অর্থটি এই আয়াতে প্রযোজ্য।
১৭৮১: সম্পূর্ণ ঘটনার পরে, ইউসুফ আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতায় সেজদায় অবনত হলেন। তার প্রার্থনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই কৃতজ্ঞতার কি অপূর্ব বহিঃপ্রকাশ । 'ক্ষমতা দান' অর্থাৎ রাজ্য ক্ষমতা দান করেছেন। এই ক্ষমতা ছিল মিশরের রাজার পরেই রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা এ কথাকে মওলানা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন, "Some power"। "Some power" কথাটি বিনয়ের অভিব্যক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে যে সর্বক্ষমতা তুচ্ছ এই বাক্যটি সেই ভাবকে সার্থক সুন্দর ভাবে প্রকাশ করে। আবার, তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যাদানের ফলে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন রক্ষা পায়। তার জন্য তার কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা ছিলো, স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ।" সাধারণ মানুষ এ সব ক্ষেত্রে নিজেকে বিজ্ঞজন মনে করে এবং সর্ব কৃতিত্বের অধিকারী মনে করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। কিন্তু ইউসুফ এ সবের জন্য নিজেকে কৃতিত্বের দাবিদার মনে করেন নাই। তাঁর ভাষ্য ছিলো এ সমস্তই আল্লাহ্র দান; কারণ আকাশ - মন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ্ ।
উপদেশ : বিনয়ী হওয়া মুত্তাকী ব্যক্তির অন্যতম গুণ।
১৭৮২: আল্লাহ্ সর্ব ক্ষমতার উৎস। মানুষের সর্ব কাজের ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শিতা, পরিকল্পনা, সব কিছু, আকাশ ও ভূ-মন্ডলের সর্ব বিষয় আল্লাহ্র আয়ত্তাধীন এ কথা সর্বান্তঃকরণে স্মরণ রাখতে হবে। তিনিই বিশ্বপ্রভু, তিনিই মঙ্গলময় অভিভাবক । যদি আমাদের কর্মকান্ডে আমরা এ কথা ভুলে যাই, তবে আমাদের সকল কর্মই বৃথা।
১৭৮৩: এই আয়াতটি ইউসুফের প্রার্থনা । ইউসুফের বক্তব্য ছিলো নিম্নরূপঃ ১) আমি ক্ষুদ্র মানব সন্তান, আমার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি আমার নিজস্ব কিছু নয় এ সবই তোমার দান। ২) সমস্ত ক্ষমতা প্রতিপত্তি, সুন্দর, কল্যাণ, মঙ্গল, শুধুমাত্র তোমার কাছ থেকেই আসতে পারে। কারণ তুমি এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা । ৩) বিপদ ও দুর্যোগ থেকে তুমি ব্যতীত আর কেহ রক্ষা করতে পারে না। ৪) তুমি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অভিভাবক। ইহকাল ও পরকাল সর্ব অবস্থায় তোমার অভিভাবকত্ব চাই। ৫) আমৃত্যু তোমার প্রতি বিশ্বাসে স্থির রেখো। ৬) স্বতঃস্ফুর্ত হিসেবে আমি যেনো মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করি অর্থাৎ স্বতঃষ্ফুর্তভাবে আমার ইচ্ছাকে তোমার ইচ্ছার কাছে বিলিন করতে পারি। ৭) দীর্ঘ বিরহের পরে নিজ পরিবারের সাথে মিলনের এই সময়ে , আমি যেনো পরকালে সৎকর্মপরায়ণদের পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মহৎ চিন্তা করতে পারি। কত সুন্দর ও অপূর্ব হবে সে মিলন।
১৭৮৪: এখানেই ইউসুফের কাহিনীর শেষ। কিন্তু একি শুধুমাত্র রূপকথার এক কাহিনী? এই কাহিনীর মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে মানব জীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তিকেঃ তাদের অনুভূতি, কর্মের নিয়ত , চিন্তাধারা, জীবন প্রবাহের বিভিন্ন জটিলতা, এবং এর শেষ পরিণতি, যা সাধারণ মানুষ অনুধাবনে ব্যর্থ। ইউসুফের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও এর পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে, বিশ্ব বিধাতা আমাদের এই সত্যের দিকে ইঙ্গিত দান করেছেন যে, মানুষের সকল অশুভ পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্মিলিত শক্তি, সামর্থ, আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে রোধ করার ক্ষমতা রাখে না । সকল ষড়যন্ত্র, বাধা বিপদ সত্বেও আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবেই। সত্যের এবং ন্যায়ের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই; তবে তা মানুষের পরিকল্পনা অনুযায়ী নাও হতে পারে। মিথ্যা ও অন্যায় শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করবেই। এই কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ এই উপদেশ দিয়েছেন যে, "মিথ্যার " ষড়যন্ত্র অনেক সময়েই আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে সাহায্য করে । ইউসুফ ভ্রাতারা ইউসুফকে চিরতরে বিতারিত করতে চেয়েছিলেন, আর তাদর সেই চক্রান্তের শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো? তাদের চক্রান্তের ফলেই ইউসুফ মিশরে আনীত হন; যে মিশর সমসাময়িক বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলোঃ সম্পদে, ক্ষমতায়, প্রাচুর্যে। কিভাবে আজীজের স্ত্রী ও অসৎ স্ত্রীলোকেরা ইউসুফকে অসৎ কাজে কামনা করেছিলো, প্ররোচিত করেছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়। কারণ আল্লাহ্ ইউসুফের প্রার্থনা শোনেন, এবং এই চক্রান্ত থেকে নিরাপদ দূরত্বে কারাগারে প্রেরণ করেন। অন্যথায় এসব কামাসিক্ত রমণী থেকে তিনি নিরাপদে থাকতে পারতেন না । এটাও আল্লাহ্র পরিকল্পনার অংশ যে, ইউসুফ কারা অভ্যন্তরে নিরাপদে এবং মনের প্রশান্তি নিয়ে থাকুন। যে জন্য পান-পাত্র বাহক তার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গিয়েছিলো । যদিও ইউসুফকে দেয়া প্রতিজ্ঞা ভুলে যাওয়া পান-পাত্র বাহকের অন্যায় হয়েছিলো, কিন্তু আল্লাহ্র পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন নির্দ্দিষ্ট সময় উপস্থিত হলো, তখন সে ইউসুফের কথা স্মরণ করতে পারলো। ইতিমধ্যে সময়ের ব্যবধানে আল্লাহ্ ইউসুফকে জ্ঞান, বিবেক, বিচক্ষণতা ও চারিত্রিক গুণাবলীতে ধন্য করেছেন, যেনো সে ভবিষ্যতে ফেরাউনের বিশাল সাম্রাজ্যের বিপদ ও বিপর্যয়ের উপযুক্ত তত্বাবধান করতে পারেন। এই কাহিনীর প্রতিটি চরিত্রকে নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে জীবনের পথকে অতিক্রম করতে হয়েছে। তাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে আল্লাহ্র দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতার এক অপূর্ব ছবি সৃষ্টি হয়েছে যা সুষম এবং বৈচিত্রময় ।
উপদেশঃ মানুষের জীবনের শেষ পরিণতি বা ভাগ্য বিশ্বস্রষ্টার বৈচিত্রময় পরিকল্পনার অংশ যা দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার এক অপূর্ব শেষ পরিণতি।
১৭৮৫: ইউসুফের কাহিনীর যখন সুত্রপাত হয়, যখন কাহিনীর অগ্রগতি হয়, এবং কাহিনীর যবনিকাপাত হয়, তখন রসুলুল্লাহ্ (সা) সেখানে উপস্থিত ছিলেন না । কারণ কাহিনীর সময়কাল ছিল তাঁর জন্মের বহুপূর্বে।কিন্তু আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তাঁকে ইউসুফের কাহিনী অবগত করান। যেহেতু আল্লাহ্ স্বয়ং কাহিনীর বয়ানকারী সুতারাং তা হচেছ স্বর্গীয় আলোকে উদ্ভাসিত। অর্থাৎ প্রতিটি ঘটনার পিছনে আল্লাহ্র মহানুভবতা, বিচক্ষণতা, দয়া, দূরদর্শিতা ইত্যাদিকে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ সমূহে করা হয় নাই । বরং সে সব ধর্মগ্রন্থে ইউসুফের জীবনের ঘটনাকে বিশেষ প্রশংসার বিষয়বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে, ফলে সেখানে আল্লাহ্র বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার বিষয়টি অনুল্লেখ থেকেছে।
১৭৮৬: ইউসুফের কাহিনীর বিশদ বর্ণনার মধ্যে আছে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদনকারী যুক্তি, তবুও তা থেকে খুব অল্প লোকই ঈমান আনায়ন করে। এই ঈমান সে রকম ঈমান বা বিশ্বাস যা আমরা পুরনো যুগে প্রত্যক্ষ করেছিলাম হযরত ইয়াকুবের চরিত্রে। এ যুগে আমাদের নবী মুহম্মদের (সা) চরিত্রে প্রত্যক্ষ করি। এই সূরাটি অবতীর্ণ হয় হিযরতের সামান্য কিছু পূর্বে। এর কাহিনীর মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপ বর্ণনা করা হয়েছে। আল-মুস্তফার (সা) ঐকান্তিক আগ্রহ ও ইচ্ছা ছিলো যেনো মানবতা তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়। মানব সন্তানকে ঈমানহীনতার যে পাপ তা থেকে রক্ষা করা। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টা অবিশ্বাসীদের বিদ্রূপের কষাঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় । তিনি তার জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। হযরত ইউসুফকে নির্যাতন ও নীপিড়নের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁকে বৃহৎ ও মহৎ কাজের যোগ্যরূপে গড়ে তোলেন। ঠিক সে ভাবেই , বা হযরত ইউসুফের থেকেও বেশী নির্যাতন রসুলুল্লাহ্কে (সা) সহ্য করতে হয়েছে - কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত পৃথিবীর বৃহৎ কাজের জন্য । আর শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর কাজে সাফল্যও অর্জন করেছিলেন।
১৭৮৭: ঐশ্বরিক বাণী আধ্যাত্মিক জগতের জন্য এক অমূল্য সম্পদ । এর জন্য এই বাণীর যিনি ধারক ও বাহক তিনি কোন পারিশ্রমিক দাবী করেন না বা কোনও পুরষ্কারেরও তিনি প্রত্যাশী নন। এই বাণীর প্রচার করা হয় শুধুমাত্র পৃথিবীর সকল মানব সম্প্রদায়ের মঙ্গলে জন্য , কল্যাণের জন্য । এই কথাটিকে আরও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে [১:২] আয়াত টিকা নং ২০ তে ।
১৭৮৮: যে বিচক্ষণতা, দয়া ও অনুগ্রহের কথা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশে বর্ণনা করা হয়েছে, তা শুধু যে আল্লাহ্র প্রেরিত গ্রন্থ পাঠেই অনুধাবন করা যায় তা নয় । আল্লাহ্র নিদর্শন সারা পৃথিবীতেই ছড়ানো আছে। আকাশ, বাতাস,তরুলতা, পৃথিবীর বিস্তির্ণ অঙ্গনে তাঁর সর্ব সৃষ্টিতেই তা বিদ্যমান। শুধু আমাদের তা দেখার জন্য মনের চোখের প্রয়োজন। অনুধাবন করার মনের প্রয়োজন , তবে যে কেউ তা দেখতে পারবে, অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু মানুষ এত উদ্ধত, অহংকারী ও একগুয়ে যে সে কিছুই অনুভব করে না, করতে পারে না, কারণ তার এই উদ্ধত ও অহংকারী স্বভাব তার দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
১৭৮৯: যদিও অধিকাংশ লোকে মৌখিকভাবে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের কথা স্বীকার করে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাসী নয় [দেখুন ২৩:৮৪-৮৯ (৩১:২৫), (২৯:৬১), (৩৯:৩৮), (৪৩:৯, ৮৭)] । কারণ তারা তাদের সর্ব কাজে আল্লাহ্র সাথে অংশীদারিত্ব কল্পনা করে। তারা মনে করে পৃথিবীর পরিচালনায় আল্লাহ্ ব্যতীত আরও অনেক শক্তি বিদ্যমান । এসব অংশী - বাদীরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নরূপে বিরাজমান। যারা পৌত্তলিক বা মূর্তিপূজায় অংশগ্রহণ করে তাদের সহজেই সনাক্ত করা যায়, কিন্তু যারা মুখে এক আল্লাহ্র অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু বিশ্বাসে, চিন্তায় ও কাজে প্রমাণ করে অংশীবাদীত্ব তাদের সনাক্ত করা খুব সহজ নয়। যেমন বিপদে, দুর্যোগে পড়লে অনেকেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র সাহায্য ব্যতীতও রত্নপাথর, পীর-ফকির, ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করে । আবার ব্যক্তিপূজা,অংশীদারিত্বের অন্য আর একরূপ, যেমন - যীশুখৃষ্টের পূজা, মাতা মেরীর পূজা। আবার দেখা যায় বীর পূজা, বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ কখনও ব্যক্তিপূজার রূপ ধারণ করে, আবার অনেকে প্রতিভার পূজারী, অনেকে বিজ্ঞান অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধিমত্তার পূজারী। এসব ক্ষেত্রে তারা ভুলে যায় যে, মেধা, প্রতিভা, বীরত্ব,সাহস; সব কিছুই সেই সর্বশক্তিমানের বিশেষ নেয়ামত তাঁর বান্দার জন্য । পৃথিবীর সভ্যতার অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিশেষ বান্দাকে আল্লাহ্ এই সব নেয়ামত দান করেন । বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। জ্ঞান, বিজ্ঞানকে আমাদের একমাত্র নিয়ামক শক্তিরূপে কল্পনা করা, যা আল্লাহ্র সাথে অংশীদার কল্পনা করার সামিল । বর্তমান যুগে মূর্তিপূজার পরিবর্তে আল্লাহ্র সাথে এ ধরনের অংশীদারিত্ব খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এবং অনেকে একে প্রগতিশীল মনোভাব আখ্যা দিয়ে থাকেন। আবার, অনেকে রহস্যময় অলৌকিক কিছুর কাছে আত্মনিবেদন করতে ভালোবাসে, অনেকে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথ ত্যাগ করে তাদের কাল্পনিক "সত্য ও সুন্দরের" পূজা করে। এসব ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য হচ্ছে তারা "সত্য ও সুন্দরকে" ত্যাগ করে অংশীবাদের পথে পা বাড়ায় । সাধারণতঃ এসব ক্ষেত্রে মানুষের লোভ, ভয় ইত্যাদি পরিচালিত করে এই অংশীদারিত্বের পথে। বিপদ ও বিপর্যয় তাদের বিপর্যস্ত করে ফলে ভয় তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধির বিলুপ্তি ঘটায়, কারণ লোভ তাদের বাতলে দেয় সহজে বিপদ থেকে ত্রাণ পাওয়ার পথ। আবার যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে তাদের অহংকার , গর্ব তাদের আল্লাহ্র পরিবর্তে মানুষের বুদ্ধিমত্তার কাছে নিবেদন করতে শেখায়। এ কথাকেই বলা হয়েছে, "শরীক করা ব্যতীত আল্লাহ্কে বিশ্বাস করে না। "
১৭৯০: "Gashiyat " অর্থ আবরণ,আচ্ছাদন বস্ত্র। প্রতীক্ষা করা , যারা পাপাত্মা, তাদের জন্য শেষ বিচার হবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তাদের সর্বস্বত্তা আচ্ছাদিত হবে, আতঙ্কিত হবে সে দিন।
[মন্তব্যঃ বাংলাদেশীরা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মে বিশ্বাসী, আগ্রহী যেমন কিছুদিন পুর্বে সিলেটে বিমান দূর্ঘটনায় সকল যাত্রীর অলৌকিকভাবে প্রাণরক্ষা পাওয়ার ব্যাপারটিকে আখ্যা দেয়া হলো যে, যেহেতু সিলেট হযরত শাহ্জালালের পূণ্যভূমি, সেকারণেই প্লেন দুর্ঘটনায় সকল যাত্রী রক্ষা পায়। কিন্তু বিপদে, দুর্যোগে একমাত্র রক্ষাকর্তা আল্লাহ্ কোনও ব্যক্তি বিশেষ কখনও আল্লাহ্র উপরে শক্তিশালী নয় । এ সবই আল্লাহ্র সাথে অংশীদারিত্ব। দেখুন [৪৫:২৩] আয়াত যেখানে বলা হয়েছে, "তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে তার খেয়াল খুশীকে নিজ ইলাহ্ বানিয়ে নিয়েছে।" অর্থাৎ অধিকাংশ লোক ঈমানের সাথে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শেরেকও যুক্ত করে। ]
১৭৯১: এই আয়াতের হঠাৎ করেই রূপকালঙ্কারের পরিবর্তন করা হয়েছে । এর পূর্ববর্তী আয়াত সমূহে অবিশ্বাসের ধরণ এবং এর ফলে তাদের আত্মিক অন্ধকারের বর্ণনা করা হয়েছে। হঠাৎ করেই এই আয়াতে শাস্তির সময়ের কথা বলা হয়েছে। কেয়ামতের শাস্তি হঠাৎ করেই কোন কিছু বোঝার আগেই আপতিত হবে। সুতারাং কেয়ামত আসার পূর্বেই প্রত্যেককে পাপের শাস্তি থেকে সাবধান হওয়া উচিত।
১৭৯২: ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্মিক জগত আল্লাহ্র একত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্র একত্ব হচ্ছে ইসলামি দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। ইসলাম দর্শনের সকল বাস্তবতা, সকল সত্যের উৎস হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি একত্ববাদে বিশ্বাস। এই হচ্ছে ইসলামের মূলমন্ত্র - এর থেকে বিচ্যুতি বা কোন ভাবার্দশ বা ধারণা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামে ব্যক্তিগত সত্তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং তার স্বতন্ত্র প্রকাশ গ্রহণযোগ্য নয়। সেই একক সত্তার কাছে পরিপূর্ণ আত্মনিবেদনই হচ্ছে ইসলামের সৌন্দর্য্য। মানুষ যখন কৃতিত্বের দাবীদার হয়, তাঁর নিজস্ব সৃষ্টিকর্ম তাকে বিমুগ্ধ করে। শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষ বিভিন্ন প্রতিভার অধিকারী হয়। এ সবের প্রকাশ হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টার বিশেষ অবদানের প্রকাশ মাত্র । স্রষ্টার বিশেষ দানকেই সে প্রকাশ করেছে মাত্র। তার নিজস্ব কোন কৃতিত্ব এতে নাই। যারা পরিপূর্ণভাবে স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে, তাদের কাছে এই সত্য বা অনুভব দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়; এটা তাদের কোনও ধারণা নয়। যারা পরিপূর্ণভাবে তাদের সকল বিশ্বাস, সকল কৃতিত্ব,ভালো, মন্দ, সব কিছু শুধুমাত্র এক আল্লাহ্র কাছে নিবেদন করে, তাদের আধ্যাত্মিক জগতে এই সত্য তেমনিই উজ্জ্বলভাবে ভাস্বর হয়, যেমনভাবে সাধারণ লোক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বস্তুগত পৃথিবীকে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ দেখে, শুনে বিশ্বাস করে। আধ্যাত্মিক জগতকে বলা হয় অদৃশ্য জগত একে দেখা বা শুনা যায় না । শুধু তারাই এর সন্ধান পান যারা শুধুমাত্র আল্লাহ্র কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করেন। তাদের নিজস্ব, সত্তা বলে কোনও স্বাতন্ত্রবোধ থাকে না । আল্ মোস্তফা (সা) এবং তাঁর যারা অনুসারী তারা পৃথিবীর মানব সম্প্রদায়কে ইসলামের এই দর্শন বা সত্যকে অনুধাবন ও অনুসরণ করার জন্য আহ্বান করেছেন । এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ্র একত্ববোধ সম্বন্ধে যারা নিশ্চিন্ত হয়েছেন, যারা বিশ্বস্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পেরেছেন,তাঁরা নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে পৃথিবীর পথ অতিক্রম করতে পারবেন। কোনও মতবাদ বা দর্শন তাদের প্রকৃত সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না । কোনও সন্দেহ বা বিভ্রান্তি তাদের বিপথে চালিত করতে পারবে না ।
১৭৯৩: পৃথিবীতে আল্লাহ্র বাণী প্রচারের জন্য আল্লাহ্ মানুষকেই প্রেরণ করেছেন । কোনও ফেরেশতা বা দেবতা প্রেরণ করেন নাই। তাঁর বাণী প্রচারের জন্য তিনি যাকে মনোনীত করেন তিনি তার মনে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেন। এরা হলেন নবী ও রসুল। এরা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশী সত্যকে অনুধাবন করতে পারেন। তাঁদের আধ্যাত্মিক জগৎ আল্লাহ্র বাণীর সৌন্দর্য্যে, সত্যের আলোতে উদ্ভাসিত । যদিও তাঁদের মনোজগত সাধারণ লোকের মনোজগত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, তবুও তাদের আত্মার বাহন যে দেহ তা সাধারণ মানুষের মতই মৃত্তিকার তৈরী এবং জনপদবাসী । সুতারাং তাদের প্রতিদিনের জীবন সাধারণ মানুষের মতই আহার, বাসস্থান,রোগ, শোক, দুঃখ বেদনার দ্বারা ভারাক্রান্ত। কারণ তারা যদি জনপদবাসী না হয়ে গুহাবাসী বা মঠবাসী সন্ন্যাসী বা নিঃসঙ্গ বসবাসকারী হতেন, তবে তারা সাধারণ মানুষের অভাব, অভিযোগ, দুঃখ, বেদনা অনুভব করতে পারতেন না। কারণ তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না থাকাতে তাদের পক্ষে সাধারণ মানুষের অনুভুতি অনুভব করা সম্ভব হতো না।
১৭৯৪: ইউসুফের জীবন কাহিনীর মত, এই পৃথিবীর জীবনে যারা পূণ্যাত্মা, যারা আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত প্রাণ, তাদের জন্য থাকে আল্লাহ্র বিচক্ষণ পরিচালনা, নানাবিধ অসম্পূর্ণতা সত্বেও তা হয়ে ওঠে সাফল্যমন্ডিত । কিন্তু পূণ্যাত্মাদের জন্য এই পৃথিবীর জীবন-ই শেষ পরিণতি নয়। তাদের শেষ এবং স্থায়ী সুখ শান্তির আবাসভূমি হচ্ছে পরকালের জীবন। ইউসুফের কাহিনীতে দেখানো হয়েছে ইউসুফের মাতৃভূমি ছিলো ক্যানন প্রদেশে, কিন্তু আল্লাহ্ তাঁকে সম্মান দান করেন অনত্র এবং তাঁর পরকালের জীবনে আছে পূণ্যাত্মাদের সঙ্গ। দেখুন [৩:৩৯] আয়াত।
১৭৯৫: আল্লাহ্ পাপীদের প্রচুর সুযোগ দিয়ে থাকেন [ইউসুফের কাহিনীতে যেরূপ তার ভাইদের দিয়েছিলেন] । কিন্তু যখন তাদের নবী সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়েন এবং মনে করেন যে প্রচার কর্ম নিষ্ফল এবং সমাজে মিথ্যাবাদীরূপে চিহ্নিত হন, তখন পাপীদের সুযোগের সময় শেষ হয়ে যায়। সে সময় পৌঁছালেই আল্লাহ্র সাহায্য তাঁর নবীদের কাছে দ্রুত পৌঁছায় এবং তাদের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে উদ্ধার করা হয় , এবং পাপীদের উপরে আল্লাহ্র ক্রোধ আপতিত হয়।
১৭৯৭: ইউসুফের কাহিনী কোন কল্প কাহিনী নয়। আল্লাহ্র ঐশী গ্রন্থ প্রাপ্ত সকল জাতির কিতাবেই এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কোরানেও সেই একই কাহিনী সত্যায়িত করা হয়েছে, তবে তা ভিন্ন আঙ্গিকে । কোরানের কাহিনীর আধ্যাত্মিক দিকটির উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যা অন্য সব ধর্ম গ্রন্থে অনুপস্থিত। কোরাণের বর্ণনাতে মানুষের জীবনের সর্ব দিককে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করা হয় ,তবে ইউসুফের কাহিনী আমাদের জীবন পথের এক সঠিক নির্দ্দেশনা স্বরূপ। ইউসুফের কাহিনীর সার সংক্ষেপ এক কথায় এ ভাবেই প্রকাশ করা যায় যে, যাদের বিশ্বাসে থাকে আন্তরিকতা, ঈমান থাকে খাঁটি, সর্বাবস্থায় যারা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে স্ব ইচ্ছায় আত্মসর্ম্পনকারী, সব কাজের শেষ ফলকে যারা আল্লাহ্র ইচছার কাছে সমর্পন করে, তাঁদের জন্য আছে আল্লাহ্র অসীম রহমত ও করুণা।