Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ৩ জন
আজকের পাঠক ১১ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩০৪২৩ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬১৫৪ বার
+ - R Print

সূরা রাদ


সূরা রাদ অথবা বজ্র - ১৩

৪৩ আয়াত, ৬ রুকু, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকাঃ সূরা ১০ - ১৫ পর্যন্ত সূরাগুলিকে একই গোত্রভুক্ত করার কারণ সূরা ১০ এর ভূমিকাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এই সূরাতে যে বিশেষ যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ সমূহের প্রতি ইঙ্গিত; যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর ইচ্ছা সমূহকে প্রকাশ করেছেন। মানুষের প্রতি তাঁর করুণার অভিব্যক্তি রয়েছে এই সূরাতে। পয়গম্বরদের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশ সমূহ মানুষের ভাষাতে রূপান্তরিত হয়। যা পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষাতে রূপান্তরিত হয় । আল্লাহ্‌র বাণী যেমন মানুষের ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, আমরা যদি বিশ্ব প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করি, সেখানেও দৃষ্টিগোচর হবে প্রকৃতির বিভিন্ন আইন সমূহ যা আল্লাহ্‌র আইনেরই প্রকাশ মাত্র। পৃথিবীর জীবনে প্রতিনিয়ত নূতন জীবন সৃষ্টি ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এই সত্যই প্রতিভাত হয় যে মৃত্যুই শেষ কথা নয় । তবে কেন সাধারণ মানুষ মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে অবিশ্বাস করে? তারা পরকালের শাস্তির কথাকে উপহাসের বিষয় বস্তুতে পরিণত করে - কারণ পরকালের শাস্তি তাৎক্ষণিক নয়। কিন্তু তারা এত নির্বোধ কেন? তারা কি বজ্র, বিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্য অনুধাবন করে না?

গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলেই অনুধাবন করা যায় যে, বিশ্বপ্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, সকলেই তাঁরই মাহাত্য ঘোষণা করছে। সর্বসৃষ্টির মাঝে তাঁর হাতের পরশ বিদ্যমান। যা সত্য, যা সুন্দর সব তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করে। পৃথিবীতে একমাত্র সত্য, সুন্দর ও ভালো চিরকালের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করে, যা অসুন্দর, মন্দ তা সময়ের আবর্তনে ধবংস প্রাপ্ত হয় - যেমন ভাবে বুদ্‌বুদ বাতাসে মিশে যায় । আল্লাহ্‌ হচ্ছেন সত্য ও সুন্দরের প্রতীক। বিস্ময়কর বা অলৌকিক কিছুর মধ্যে আল্লাহ্‌কে অনুসন্ধান না করে আমাদের চারিপাশের প্রকৃতির মাঝে, তাঁর সৃষ্টির মাঝে, চেনা পৃথিবীর মাঝে, আল্লাহ্‌র সৃষ্টি নৈপুণ্যের মাঝে তাঁর ক্ষমতা ও দয়াকে অনুধাবন করতে বলা হয়েছে। প্রকৃতির আইনের মাঝে তাঁর ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। মানুষ তার পরিকল্পনা করতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা বা ইচ্ছাই স্থায়ীত্ব লাভ করবে। পূর্বের সূরা ইউসুফের কাহিনীতে আল্লাহ্‌ এই সত্যকেই প্রকাশ করেছেন।

সার সংক্ষেপঃ আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ সত্য এবং বিশ্ব প্রকৃতির মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নিদর্শন সমূহ প্রদর্শিত হয়। আল্লাহ্‌ , যিনি শক্তিশালী প্রাকৃতিক শক্তি সমূহের স্রষ্টা, তিনি ক্ষমতা রাখেন মৃত্যুর পরে পুণর্জীবিত করার । আল্লাহ্‌র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সকল কিছুর মধ্যে বিদ্যমান । তাঁর ক্ষমতা , কল্যাণ আমাদের সর্বদা ঘিরে থাকে [১৩:১ -১৮]

পূণ্যাত্মাদের সব কাজ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়, ফলে তাঁরা আত্মার মাঝে প্রশান্তি লাভ করে। যারা মন্দ তারা আল্লাহ্‌র বিধান বা আইন অমান্য করে, ফলে তারা তুচ্ছ ব্যাপারে বিবাদ বিসংবাদে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ করে। সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় এদের উপরেই আল্লাহ্‌র অভিসম্পাত বর্ষিত হয় । [১৩: ১৯ - ৩১]

ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটে পূর্ববর্তী নবীদের জীবনে; তাদের যারা প্রথমে উপহাস করতো, পরবর্তীতে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। অপর পক্ষে ধার্মিক ও পূণ্যাত্মারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে । [ ১৩: ৩২: ৪৩]

সূরা রাদ -১৩ অথবা বজ্র - ১৩

৪৩ আয়াত, ৬ রুকু, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


১। আলিফ-লাম-মীম রা এই গুলি কিতাবের আয়াত তোমার প্রভুর নিকট থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনে না।

২। তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আকাশকে সৃষ্টি করেছেন কোন স্তম্ভ ব্যতীত ১৮০০। [অতঃপর] তিনি দৃঢ়ভাবে [কর্তৃত্বের] সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত করলেন ১৮০১। তিনি সুর্য এবং চন্দ্রকে তার [আইনের আওতায়] নিয়মাধীন করলেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত [স্ব স্ব কক্ষ পথে] আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন ১৮০২ নিদর্শন সমুহ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন যেনো তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত সমন্ধে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে পার ১৮০৩।

১৮০০: এখানে তোমাদের "দৃষ্টিসীমার মধ্যে" বাক্যটি "স্তম্ভ" বা "আকাশমন্ডলী" কোন শব্দটি বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হবে ? এখানে দুটি শব্দকে বুঝানোর জন্যই ব্যবহৃত হতে পারে। মাওলানা ইউসুফ আলী পূর্বের শব্দটি অধিক পছন্দ করেন। কারণ আকাশ মন্ডলী কোনও স্তম্ভ ব্যতীতই শুন্যে ভাসমান এ সত্য আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করি। আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে সুনীল আকাশকে ভাসমান দেখি, কিন্তু এই দৃশ্যমান সুনীল গগন সৃষ্টির পিছনে আল্লাহর যে শক্তি কাজ করে তার ব্যাখ্যা দিতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান, আর বিজ্ঞানের এই ব্যাখ্যা আমাদের করে বিস্মিত ও স্তম্ভিত। আল্লাহ্‌র এই বিশাল ক্ষমতা ও মাহাত্ম্য আমাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৮০১: দেখুন [১০:৩] আয়াত। বিজ্ঞান বলে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড এক সু-নিয়ন্ত্রিত অমোঘ নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। প্রকৃতির এই ব্যবস্থাপনা উচ্চস্বরে ডেকে বলছে যে, এর পিছনে এমন একজন স্রষ্টা ও পরিচালক রয়েছেন, যিনি মানুষের অনুভুতি ও চেতনার বহু উর্দ্ধে। তিনিই সকল কিছুর স্রষ্টা সকল কিছুর পরিচালক, রক্ষক প্রতিপালক। সকল কিছু পরিচালনার জন্য তিনি নির্দিষ্ট আইন করে দিয়েছেন। আরশে বা সিংহাসনে সমাসীন কথাটি দ্বারা এই ভাবকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সব কিছুকেই তিনি তার নিয়মের আজ্ঞাবহ করে দেন। এই নিয়ম এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত কার্যকর হবে। সমস্ত সৃষ্টির শেষ গন্তব্যস্থল আল্লাহ, যেমন সৃষ্টির প্রথম শুরু হয়েছিলো আল্লাহ্‌র থেকে।

১৮০২: দেখুন [১০:৩১] আয়াত ও টিকা ১৪২৫। "তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন" অর্থাৎ বিশ্ব প্রকৃতির জন্য যে প্রাকৃতিক আইন তা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা অপরিবর্তনীয়। আমাদের চারিপাশের প্রকৃতি, পরিবেশ, বিশ্ব ব্রহ্মান্ড, গ্রহ, নক্ষত্র সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আল্লাহর প্রদত্ত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী, আর এই নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী হবে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। যে সময় কালও আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট। সারা বিশ্ব প্রকৃতির সাধ্য নাই, প্রাকৃতিক আইনকে একচুল অমান্য করার। শুধু মানুষকে আল্লাহ খুব সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন ভালোকে গ্রহণ করা ও মন্দকে বর্জন করার। কিন্তু তা সত্বেও মানুষের মানসিক দক্ষতা বা ক্ষমতা [Faculties of mind] তা আল্লাহ প্রদত্ত জন্মগত। এখানে মানুষের ইচ্ছাশক্তির কোন প্রভাব নাই। আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে ভালোবাসেন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করেন।

১৮০৩: বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্‌ মানুষকে ভালো ও মন্দকে গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেয়া সত্বেও তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহের বর্ণনা করেছেন। আকাশে বাতাসে বিশ্বভুবনে তাঁর সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার হাতের পরশ বিদ্যমান, -এই সত্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । স্রষ্টাকে দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করে নিরাকার স্রষ্টাকে হৃদয়ের মাঝে অনুধাবন করা যায়। পৃথিবীর জীবনের শেষে পরকালের জীবনের হিসাব নিকাশের জন্য আমাদের প্রস্তুতি যেনো আমরা ভুলে না যাই। আমাদের মনে যেনো আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ না থাকে সে কারণেই বিশ্ব স্রষ্টা তাঁর অস্তিত্বের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন তাঁর সৃষ্টিকে হৃদয়ের মাঝে অনুভবের মাধ্যমে।


৩। তিনিই পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন এবং তার উপরে পর্বতকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়েছেন এবং নদীকে [প্রবাহিত] করেছেন এবং প্রত্যেক প্রকারের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় ১৮০৪। তিনি দিনের উপর রাত্রির অবগুন্ঠন টেনে দেন। দেখো যারা চিন্তাশীল, তাদের জন্য এসবের মধ্যে নিদর্শন নিহিত রয়েছে। ১৮০৫।

১৮০৪: আল্লাহ্‌র বাণী প্রকৃতির মাঝে লেখা আছে। ফুল, নদী, আকাশ, তারা, এদের মধ্যে দিয়ে আল্লাহর হাতের পরশ অনুভুত হয়। এই আয়াতে আল্লাহ মানব সন্তানকে তাঁর কয়েকটি নিদর্শনের সন্ধান দিয়েছেন যার অর্থ হলো, প্রকৃতিকে ভালবাসতে হবে অনুভবের মাধ্যমে। প্রকৃতিকে ভালবেসে সেই প্রকৃতিরই সাহায্যে প্রকৃতির স্রষ্টা সেই মহান শক্তির কাছে পৌছানোর নির্দেশ আছে এই সব আয়াতে। চোখ খুলে তাঁকে দেখতে হবে, মন দিয়ে তাঁকে অনুভব করতে হবে। এই তাঁর নির্দেশ। এই আয়াতে নির্দেশ দান করা হয়েছে প্রকৃতির বিন্যাসের দিকে সর্বপরি বিশাল উদ্ভিদ জগতের প্রতি। স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি কৌশল সেখানে বিদ্যমান । একই ফুলের মাঝে পরাগ রেণু ও স্ত্রী-ডিম্বাশ্বয় বিদ্যমান আবার কখনও কখনও খেজুর গাছ ও পেঁপে, তাল গাছের মত স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আলাদা আলাদা ভাবে অবস্থান করে। এও স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি কৌশল উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধির জন্য । দেখুন [২০:৫৩] এবং [৩১:১০]।

১৮০৫: দেখুন [৭:৫৪] আয়াত ও টিকা ১০৩২। পুর্বোক্ত আয়াতটি বর্তমান সূরার আয়াতটির সমতুল্য।
[মন্তব্য : উদ্ভিদ বিজ্ঞান আমাদের উদ্ভিদ সম্বদ্ধে স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যের জ্ঞান দান করে । সুতারাং বিজ্ঞানের জ্ঞানের মাধ্যমে স্রষ্টাকে হৃদয়ের মাঝে অনুধাবন করা সম্ভব। ]

৪। পৃথিবীতে রয়েছে [বৈচিত্র্যে ভরা] ভুভাগ [যদিও তারা] পরস্পর সংলগ্ন, তাতে আছে আঙ্গুরের বাগান, শষ্যে ভরা মাঠ, এবং পাম [জাতীয়] বৃক্ষগুলি-১৮০৬ যারা একই শিকর থেকে উৎপন্ন হয় অথবা ভিন্ন প্রকারে। একই পানি সিঞ্চিত হওয়া সত্বেও, তাদের কতককে অপর গুলির তুলনায় স্বাদে উৎকৃষ্ট করেছি। ১৮০৭। দেখো যারা উপলদ্ধি করতে পারে তাদের জন্য অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন।

১৮০৬: একাধিক শির বিশিষ্ট অর্থাৎ মুল এক কিন্তু উপরে বহু কান্ড বিশিষ্ট গাছ যেমন 'পাম' গাছ আঙ্গুর বা ধান-গাছ এ সব গাছ একই মুল থেকে, থোকা বা গুচ্ছ বেঁধে উৎপন্ন হয়। আবার খেজুর, কচু জাতীয় বৃক্ষ শিকড় থেকে নতুন চারা উৎপন্ন করে। মাটি ও আবহাওয়ার উপরে নির্ভর করে বিভিন্ন গাছের বংশ বিস্তার বিভিন্নভাবে ঘটে থাকে। স্রষ্টার সৃষ্টির এই অপুর্ব কৌশলের প্রতি এই আয়াতের মাধ্যমে এই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অরণ্যভুমি, গাছপালা প্রকৃতির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে, এর শোভা আমাদের অন্তরে প্রশান্তি আনে, আর এর সৃষ্টি কৌশল অনুধাবনের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মায়।

১৮০৭: স্রষ্টার সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শনকে আবারও তুলে ধরা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। একই আলো, একই বাতাস একই পানিতে সঞ্জিবীত হয়ে বিভিন্ন বৃক্ষলতা বিভিন্ন স্বাদের ফল উৎপন্ন করে। কোনটিকে আমরা বলি খেজুর। কোনটি আঙ্গুর, কোনটি আপেল, কি বৈচিত্র এদের আকৃতিতে স্বাদে, গন্ধে, রং এর বাহারে । এই বৈচিত্র সমস্ত উদ্ভিদ জগতের জন্য প্রযোজ্য। ফলে, ফুলে রং এর বাহারে সমস্ত উদ্ভিদ জগত প্রত্যেকেই অনন্য। এর মাঝে স্রষ্টাকে হৃদয়ে অনুভব করার পাঠ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডব্যপী লিখে রেখেছেন আল্লাহ

৫। [তাদের অবিশ্বাস] যদি তোমাকে বিস্মিত করে, তবে [শোন] অদ্ভুদ তাদের কথা ''যখন আমরা [প্রকৃতই] ধুলিতে পরিণত হব সত্যিই কি তখন আমাদের পুনঃসৃষ্টি করা হবে" ১৮০৮? এরাই তারা যারা তাদের প্রভুকে অস্বীকার করে। এরাই তারা যাদের গলার চার পার্শ্বে [দাসত্বের] শৃঙ্খল বেষ্টন করে থাকবে ১৮০৯। এরা হবে আগুনের অধিবাসী ও সেখানে [তারা চিরদিন] থাকবে।

১৮০৮: বিশ্বভুবন ব্যাপী আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে, আকাশে বাতাসে প্রকৃতির লীলাভুমিতে আল্লাহর হাতের পরশ, তাঁর জ্ঞানের, প্রজ্ঞার, দুরদৃষ্টি, করুণা, দয়ার স্বাক্ষর বিদ্যমান। চক্ষুস্মান হয়েও যারা বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভবে ব্যর্থ, তাদের মানসিক অবস্থা সত্যিই বিস্ময়কর। বিশ্ব প্রকৃতিতে প্রতি নিয়ত জন্ম মৃত্যুর খেলা চলছে। নতুন জন্ম নেয় পুরাতন মৃত্যুর মাঝে বিদায় নেয়। এ সত্য বিশ্ব প্রকৃতির উদ্ভিদ, প্রাণী জগত, সবার জন্য প্রযোজ্য। যদি আল্লাহ্‌ প্রতি নিয়ত নতুন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, তবে কিভাবে এ সব লোকেরা মৃত্যুর পরের পুনরুত্থানে অবিশ্বাসী। স্রষ্টার জন্য এটা কি খুবই কঠিন কাজ? যিনি প্রথম সৃষ্টি করেছেন তিনি কি দ্বিতীয় সৃষ্টি করতে অক্ষম? অবিশ্বাসী যারা তাদের বিকৃত মানসিকতা, তাদের পুনরুত্থানে ও পরকালের হিসাব নিকাশে বিদ্রোহী করে তোলে, আর এই বিদ্রোহী মনোভাবেই তাদের শাস্তির পথ সুগম করে তোলে।

১৮০৯: "Aglal " এই আরবী শব্দটির অর্থ জোয়াল [ক্রীতদাসত্বের] দেখুন আয়াত [৭:১৫৭] ও টিকা ১১২৮। জোয়াল শব্দটি প্রতীক স্বরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রবাদ বাক্য বলে মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস মানুষের দ্বিতীয় ধর্ম। যে মানুষ পরলোকে অবিশ্বাসী এবং আল্লাহর বিধান বা নিদর্শনে অবিশ্বাসী সে তাতেই অভ্যস্থ হয়ে যায়, সেটাই আর অভ্যাসে পরিণত হয়। তার মানসিক অবস্থাকে বর্ণনার জন্য উপরের শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। স্রষ্টাকে অবিশ্বাসের ফলে এদের আত্মার মাঝে সত্যের আলো প্রবেশ লাভ করতে পারে না। ফলে অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন আত্মা মিথ্যা বা পাপ দ্বারা আবৃত হয়ে যায়। এরা সত্যকে ত্যাগ করার ফলে এদের মাঝে মিথ্যা, আনুষ্ঠানিকতা, কুসংস্কারের প্রতি প্রবল আনুগত্য জন্মে। এই অনুগত অবস্থাকেই এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে দুই ধাপে। প্রথমতঃ এরা পাপ, মিথ্যা, কুসংস্কার ও আনুষ্ঠানিকতার দাসত্ব করে। কারণ লৌহ জোয়াল যেরূপ গলদেশ বেষ্টন করে ক্রীতদাসের স্বাধীনতার খর্ব করে, ঠিক সেইরূপ এসব অবিশ্বাসী আত্মা পাপ, মিথ্যা, কুসংস্কার ও আনুষ্ঠানিকতার দাসত্ব করে নিজস্ব বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেয়। ফলে তারা দ্বিতীয় অবস্থা প্রাপ্ত হয়। যার বর্ণনা হচ্ছে " উহারাই হবে আগুনের অধিবাসী ও সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আরও দেখুন আয়াত [৩২:১০]।

৬। তারা তোমাকে ভালোর পরিবর্তে মন্দকে ত্বরান্বিত করতে বলে ১৮১০ যদিও তাদের পূর্বে [বহু] দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি গত হয়েছে। মানুষের পাপ সত্বেও তোমার প্রভু মানুষের জন্য ক্ষমাশীল এবং তোমার প্রভু শাস্তি দানেও কঠোর।

১৮১০: যারা অবিশ্বাসী তারা বিদ্রুপ করে বলে যদি সত্যেই পরকালে ইহকালের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি নির্ধারিত থাকে তবে তা ইহকালেই দেয়া হচ্ছে না কেন, এর উত্তর নিম্নরূপ (১) তারা কেন আল্লাহর করুণার পরিবর্তে শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করতে চায়। কোনটি মঙ্গলজনক, শাস্তি না করুণা (২) তোমরা কি কখনও পাপের শাস্তি প্রত্যক্ষ কর নাই? পৃথিবীর ইতিহাসই এই স্বাক্ষ্য দেয় যে, ব্যক্তি বা জাতি কেহই পাপ করে রেহাই পায় নাই। আল্লাহর আমোঘ শাস্তি তাদের উপরে নেমে আসবেই (৩) এ কথা ভাবার অবকাশ নাই যে, আল্লাহ শুধুমাত্র ন্যায় বিচারক ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে শাস্তিদাতা। তিনিই তো পরম করুণার আধাঁর, দয়াময় এবং ক্ষমতাশীল প্রভু। তাঁর শাস্তি অপেক্ষা তাঁর ক্ষমার হাত অধিক বিস্তৃত।

৭। এবং অবিশ্বাসীরা বলেন "তাঁর প্রভুর নিকট থেকে কেন তাঁর নিকট নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না? ১৮১১। কিন্তু তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আছে পথ প্রদর্শক।" ১৮১২।

১৮১১: বিশ্বপ্রকৃতিতে আল্লাহ্‌র নিদর্শন সর্বত্র বিদ্যমান। এসব নিদর্শনের কিছু কিছু উল্লেখ ইতিপুর্বে করা হয়েছে। এই বিশাল ভুবনের অগণিত নিদর্শন দেখার পরও কেউ যখন তা অনুভবে অক্ষম হয়, তখনই সে একগুয়ে ভাবে বলে "প্রতিপালকের নিকট হইতে তাহার নিকট কোন নিদর্শন অবতীর্ন হয় না কেন"? আল মুস্তফা (সাঃ) তার নিজস্ব চারিত্রিক গুণাবলী ও নিদর্শন দ্বারা অন্যান্য নবী রসুলদের মতই ভাস্বর। সুতরাং তিনি কেন এসব হটকারীদের অলস কৌতুহলের কৌতুহল নিবৃত্ত করবেন। তিনি কারও দাবী ও খায়েশ পুরণ করতে বাধ্য নন।

১৮১২: এই আয়াতের শেষ লাইনটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, পয়গম্বরদের কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষদের পাপ থেকে সাবধান করা। আল্লাহ প্রত্যেক জাতিকে পয়গম্বরদের মাধ্যমে পথ প্রদর্শন করে থাকেন। আর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ্‌ (সাঃ) নিজেই আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নিদর্শন স্বরূপ। আল মুস্তাফার (সাঃ) দায়িত্ব হচ্ছে সকলকে পাপ থেকে সাবধান করা। সত্য পথে চলার জন্য ধর্মোপদেশ দেয়া এবং কোরআনকে উপস্থাপন করা। তিনি যে পথ প্রদর্শন করে গেছেন তা হচ্ছে শ্বাশত সত্য। নিখিল বিশ্বের একমাত্র প্রদর্শিত পথ যা আল্লাহর মনোনীত।

রুকু - ২

৮। প্রত্যেক নারী যা [গর্ভে] ধারণ করে এবং গর্ভে যা কিছু কমে বা বাড়ে, আল্লাহ্‌ তা জানেন ১৮১৩। তাঁর বিধানে প্রতিটি বস্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে।

১৮১৩: এই আয়াতে জরায়ুর উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকে প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য, জরায়ুকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ সন্তান সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় কেউই জনে না সন্তান ছেলে না মেয়ে। আজকাল অবশ্য সন্তান ধারনের শেষ পর্যায়ে পরীক্ষার মাধ্যমে তা বলা সম্ভব। কিন্তু তবু সন্তানের গাত্রবর্ণ, আকৃতি, গঠন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ পুর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সমন্ধে কেউই কিছু বলতে পারে না। এ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্‌রই । মাতৃজঠরের উদাহরণের মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, এই দৃশ্যমান বা অদৃশ্য জগতের সকল জ্ঞান আল্লাহ্‌র আয়ত্বাধীন। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ্‌র আয়ত্বাধীন। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক আল্লাহ্‌ । বিশ্ব প্রকৃতি আমাদের এই জ্ঞান দেয় যে, সব কিছুই এখানে পরিমিত ভাবে নিয়ন্ত্রিত। সমস্ত বিশ্ব চরাচর সর্বদা ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। কারণ আল্লাহর বিধানে "প্রত্যেক বস্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে"

৯। যা কিছু অদৃশ্য ও দৃশ্যমান তিনি তা জানেন। তিনি মহান সর্বোচ্চ মর্যাদাবান ১৮১৪।

১৮১৪: মুল আরবীতে এই আয়াতটি যে ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে তার সৌন্দর্য্য প্রকাশভঙ্গি ছন্দের মাধুর্য্য তুলনা করা যায় এমন কোন কবিতার সৃষ্টি এখন পর্যন্ত হয় নাই।

১০। তোমাদের মধ্যে যে কথা গোপন রাখে, অথবা উহা প্রকাশ করে দেয়, রাত্রিতে যে লুকিয়ে থাকে অথবা দিবসে প্রকাশ্যে বিচরণ করে [আল্লাহর নিকট] উভয়েই সমানভাবে [দৃশ্যমান] ১৮১৫।

১৮১৫: মানুষের অপ্রকাশ্য চিন্তা ভাবনা সবই আল্লাহ্‌ জ্ঞাত। আজকের ইন্টারনেটের যুগে এ ব্যাপারটি ধারণা করা সম্ভব। যাদের মানুষের মস্তিষ্ক সমন্ধে সামান্য পরিমাণ জ্ঞানও আছে তারা জানেন মানুষের মস্তিষ্ক বিদ্যুৎ তরঙ্গে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং চিন্তার মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ তরঙ্গ পরিবর্তিত হয়। নিখিল বিশ্বের স্রষ্টার কোথায় কোন যন্ত্রে আমাদের মস্তিষ্কের সেই চিন্তা-চেতনার বিদ্যুৎ তরঙ্গ সাথে সাথে রক্ষিত হয় তা আমাদের সীমিত জ্ঞানের সাহায্যে ধারনা করা সম্ভব নয়। এ আয়াত থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের দৃশ্য, অদৃশ্য সকল মানসিক অবস্থাই আল্লাহর কাছে পৌছে যায় তৎক্ষনাত।

১১। প্রত্যেক [লোকের জন্য] তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পরে এক [ফেরেশতা] থাকে। ১৮১৬। তারা আল্লাহর আদেশে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজে তা পরিবর্তন করে ১৮১৭। কিন্তু যখন কোন সম্প্রদায়কে আল্লাহ্‌ শাস্তির দেয়ার ইচ্ছা করেন, তবে কেউ তা রদ করতে পারে না এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন রক্ষাকর্তা নাই।

১৮১৬: দেখুন উপরের আয়াতটি সেখানে বলা হয়েছে যে, আমাদের প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য সকল চিন্তা ভাবনা আল্লাহর কাছে প্রকাশ্য দিবালোকের মত স্পষ্ট। আমরা যেখানে যে অবস্থায় থাকি না কেন, রাতের আঁধারে বা দিনের আলোতে কোন কিছুর দ্বারাই আমরা একমুহুর্তের জন্য আল্লাহ্‌র সার্বক্ষণিক দৃষ্টির বাইরে যেতে পারবো না । আল্লাহ্‌র মঙ্গলময় ইচ্ছা সর্বদা আমাদের ঘিরে থাকে। এ কথাকেই প্রকাশ করা হয়েছে যে তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে। উহারা আল্লাহর আদেশে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। যদি কেউ মনে করে যে গোপনে সে পাপ করে আল্লাহর চক্ষুকেও ফাঁকি দিতে পারবে তবে সে নিতান্ত মুর্খ। কারণ আমাদের সকল চিন্তা ভাবনা তাৎক্ষনিক ভাবে আল্লাহর দরবারে রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে যাচ্ছে।

১৮১৭: অসীম দয়ার সাগর পরম করুণাময় আল্লাহ শাস্তি দিতে চান না। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি স্বরূপ। মানুষের আত্মা সেই পরম আত্মারই অংশ। একমাত্র মানুষকেই তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলীতে আর এ সব গুণাবলীর প্রকাশ তখনই ঘটে যখন আত্মার পবিত্রতা সৃষ্টির আদিতে যেরূপ ছিলো তা রক্ষিত হয়। মানুষকে তিনি দান করেছেন বুদ্ধি ও জ্ঞান। সর্বপরি আল্লাহর অসীম করুণা আদম সন্তানকে সর্বদা ঘিরে থাকে। এই করুণা সিন্ধুতে অবগাহন করে আদম সন্তান তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে অমূল্য গুণরাজিতে তাঁর আত্মাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। কিন্তু তা না করে তারা যদি আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারণ করে। তারা যদি পাপের পথে পা বাড়ায় তবে তারা আল্লাহর নেয়ামত ও করুণার অবমাননা করে। কিন্তু তার পরেও তাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমার দ্বার উম্মুক্ত। তখনই সে ক্ষমার উপযুক্ত হয় যখন সে তার নিজ আচরণের ভুল বুঝতে পারে ও নিজেকে সংশোধন করে।

মানুষ যখন পাপ দ্বারা তার আত্মাকে কলুষিত করে ফলে সে তার আত্মার পূত পবিত্র অবস্থা হারায়, যা সে সৃষ্টির আদিতে আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত হয়েছিল। তার ফলে সে তাঁর অন্র্তদৃষ্টি বা বিবেক থেকে বঞ্চিত হয়। চক্ষু থেকেও সে হবে অন্ধ ব্যক্তির ন্যায়, জ্ঞান থেকেও সে হবে মুর্খ ব্যক্তির ন্যায়। কলুষতা ও পাপ, আত্মার পুত পবিত্র সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে দেয়। যখন কোন ব্যক্তি বা জাতি এরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হয় তখনই সেই জাতির উপরে আল্লাহর ক্রোধের প্রকাশ ঘটে। শুধুমাত্র,সে ক্ষেত্রেই সেই জাতির অধঃপতন ঘটে। ফলে সেই সম্প্রদায় বা জাতির জীবন দুর্ভাগ্যের কালো মেঘে আচ্ছাদিত হয়। যে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি আল্লাহ তাদের দান করেছিলেন তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। আল্লাহর রহমত বা সৌভাগ্য বঞ্চিত হওয়াই হচ্ছে আল্লাহর শাস্তি বা আযাবে পতিত হওয়া। যাদের উপরে আল্লাহর শাস্তি পতিত হয়েছে তাদের রক্ষা করতে পারে এরূপ ক্ষমতা সারা পৃথিবীতে কারও নাই।

সমগ্র আয়াতটি থেকে আমরা এই উপদেশ পাই যে, আমাদের কর্মফলের দরুণই আমরা দুভার্গ্যে পতিত হই। আমাদের পাপই আমাদের সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি থেকে, দুর্ভাগ্য ও দুঃখে পতিত করে। কারণ মানুষের কর্মফল দ্বারাই আল্লাহর হুকুম নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার আল্লাহর বিধান মানার নিরলস চেষ্টার মাধ্যমে আমরা আবার আল্লাহর ক্ষমা দয়া লাভ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পাব ও সুখ সমৃদ্ধি লাভ করবো। কারণ আল্লাহ তো বলেছেন "আল্লাহ্‌ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না উহারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।"

১২। তিনিই তোমাদের বিদ্যুতের চমকে দেখান ভয় এবং ভরসা স্থল উভয় হিসেবে ১৮১৮। তিনি মেঘকে উর্দ্ধে উত্তোলন করেন [উর্বর] বৃষ্টিরূপে।

১৮১৮: অবিশ্বাসীরা সর্বদা বিদ্রূপ করে আল্লাহর শাস্তিকে আহবান করতো । এই আয়াতে সেই আহবানেরই উত্তর দান করা হয়েছে। এই উত্তর দানের মাধ্যমে আয়াতটিতে যে মহিমান্বিত ভাব ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা তুলনাহীন। এখানে আল্লাহ বলছেন, ভালো ও সুন্দরকে না চেয়ে কেন তোমরা মন্দকে চাইবে ? অর্থাৎ আল্লাহর রহমত না চেয়ে কেন তোমরা তাঁর শাস্তির কামনা কর? এখানে উপমা ব্যবহার করা হয়েছে বজ্র ও বিদ্যুতের। চক্ষু ধাধাঁনো বিদ্যুৎ ও বজ্রের উচ্চ শব্দকেই কেন স্মরণ করবে, স্মরণ করো বজ্র ও বিদ্যুৎ বৃষ্টির আগমনের বার্তা বহন করে, যে বৃষ্টির পানি মাটিকে সমৃদ্ধ করে ফুল ও ফসলে ধরিত্রিকে ভরিয়ে দেয়।

১৩। বজ্র বারে বারে তাঁর মহিমা কীর্তন করে ১৮১৯; শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়ে ফেরেশতারাও [মহিমা ঘোষণা] করে ১৮২০। তিনি উচ্চ নিনাদে বজ্রপাত ঘটান এবং যাকে ইচছা উহা দ্বারা আঘাত করেন। কে আল্লাহ্‌র [সর্বোচ্চ] শক্তি এবং ক্ষমতা সমন্ধে বিতর্ক করতে [সাহস] করে ?

১৮১৯: বজ্র, যার উচ্চ শব্দ ও আলো ভয়ের সৃষ্টি করে তা হচেছ সর্র্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র নিয়ন্ত্রণে এক শক্তি বা [Force], বজ্র ও বিদ্যুৎ আল্লাহ্‌র আজ্ঞাবহ, তাঁর হুকুমের দাস। বিশ্ব ভুবনের সমস্ত সৃষ্টি যেভাবে আল্লাহর প্রশংসা করে, বজ্র বিদ্যুৎও, সেরূপ শুধুমাত্র আল্লাহরই প্রশংসা করে। আয়াতের এই বিশেষ ভাবার্থেই সম্পূর্ণ সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে সূরা রাদ বা বজ্র। আপতঃ দৃষ্টিতে যা মনে হবে ভয়ঙ্কর ও শক্তিধর তা শুধুমাত্র আল্লাহর আজ্ঞাবহ ভৃত্য বই আর কিছু নয়। সাধারণ মানুষকে আল্লাহ এই আয়াতের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা ও শক্তিকে অনুধাবন করতে উপদেশ দিচ্ছেন যে, আল্লাহর ক্ষমতা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে ঠিক ঐ বজ্র বিদ্যুতের শক্তির মত যা বৃষ্টির পানির মাধ্যমে মাটিকে সমৃদ্ধ করে।

১৮২০: ফেরেশতা যাদের আমরা ক্ষমতা ও মহিমাতে আল্লাহর নিকটবর্তী বলে মনে করি, তারাও বিস্ময়ে সশ্রদ্ধভাবে আল্লাহর প্রশংসা করে। অর্থাৎ মানুষের চিন্তায় বা কল্পনায় যা প্রচন্ড ক্ষমতাশালী বা শক্তিধররূপে কল্পনা করা হয়, তারাও আল্লাহর আজ্ঞাবহ দাস বই আর কিছু নয়। আল্লাহ মহিমান্বিত সর্বশক্তিমান গৌরবাম্বিত এ ধারণা করার জন্যই এই উপমার ব্যবহার করা হয়েছে।

১৪। সত্যের জন্য প্রার্থনা [একমাত্র] তাঁরই জন্য ১৮২২। যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে আহবান করে, তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে তাদের ন্যায় যারা মুখে পানি পৌছানোর জন্য হস্ত প্রসারিত করলো কিন্তু পানি তাদের নিকট পৌছালো না। যাদের বিশ্বাস নাই তাদের প্রার্থনা হচ্ছে [অসার মানসিক] বিভ্রান্তি মাত্র । ১৮২৩।

১৮২২: 'Haqq' অর্থ সত্য, সঠিক, প্রাপ্য, যথাযথ, উপযুক্ত ইত্যাদি। উপরের সবগুলিই অর্থই এখানে প্রযোজ্য। সত্যের আহবান তাহারই জন্য অর্থাৎ সঠিক বা যথাযথ বা সত্য এবাদত একমাত্র আল্লাহ্‌রই প্রাপ্য। যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত করে, হতে পারে তা মুর্তি বা গ্রহ নক্ষত্র, বা প্রকৃতির ক্ষমতা, ভুত প্রেত বা নেতা বা আত্মপূঁজা বা মানুষের ক্ষমতা বা অর্থ সম্পদ বা, বিজ্ঞানের ক্ষমতা, বা পাথর বা শিল্প কলা বা প্রতিভা বা মেধা মননশীলতা ইত্যাদি। তবে সে এবাদত মুর্খতা বই আর কিছু নয়, কারণ সে এবাদতে তার কোনও আত্মিক উন্নতি ঘটবে না।

১৮২৩: আহবানের ইংরেজীতে অনুবাদে বলা হয়েছে Prayer অথবা Worship । "যাদের বিশ্বাস নাই তাদের প্রার্থনা হচ্ছে মানসিক বিভ্রান্তি মাত্র" ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে "For the prayer of those / without faith is nothing / but vain prayer" সর্বশক্তিমানের উপরে আন্তরিক বিশ্বাস ব্যতীত এবাদত মূল্যহীন। এযেনো প্রাণহীন দেহ। যারা বিশ্বাসের একগ্রতা ব্যতীত নামাজ পড়ে বা আল্লাহর এবাদত করে তারা তা করে তাদের আত্মার নীতিভ্রংশতা থেকে। তার কিছুটা সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা, কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করা ব্যতীত আর কিছু নয়। বিশ্বাস ব্যতীত যে এবাদত তা আত্মতুষ্টি ব্যতীত আর কিছু নয়। স্রষ্টার কাছে সে এবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে এবাদত আত্মার অন্তঃস্থল থেকে উৎসরিত ও আল্লাহর প্রতি একান্ত বিশ্বাস থেকে বিচ্ছুরিত নয়। এবাদতের অর্থ অনেক গভীর ও পরিপূর্ণ। যদি কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে পুজনীয়রূপে নিজের আত্মার মধ্যে অনুভব করে যাদের উল্লেখ পূর্বের টিকাতে করা হয়েছে তবে সে তার বিকৃত মানসিকতার অলীক মুর্তিকেই পুজা করে। এই এবাদত আল্লাহর জন্য একান্তভাবে নিবেদিত নয়। সুতরাং তা অর্থহীন মূল্যহীন। এবাদত এবং প্রর্থনা নিবেদিত হবে শুধুমাত্র এক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে - যিনি একমাত্র সত্য ও ধ্রুব। দেখুন টিকা ১৮২৫ ও ১৮২৭। সুন্দর উপমার মাধ্যমে এই সত্যকে প্রকাশ করা হয়েছে।

১৫। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, ১৮২৪, তারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় [অধীনতা স্বীকার করে] আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় ১৮২৫, ১৮২৬ তাদের ছায়াগুলিও তা করে সকালে এবং সন্ধ্যায় ১৮২৭।

১৮২৪: "আকাশ ও পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে" অর্থাৎ ফেরেশতা, আত্মা, মানুষ, প্রাণহীন বস্তু এমন কি এদের ছায়া, অর্থাৎ ক্ষুদ্র অস্তিত্ব পর্যন্ত সর্বদা আল্লাহ্‌র এবাদতে মগ্ন। অর্থাৎ এই বিশ্ব ও ভুমন্ডল ও আকাশ সব কিছু আল্লাহ্‌র আজ্ঞাবহ।

১৮২৫: "সিজদাবনত হয়।" অর্থাৎ তারা সকলে আল্লাহর আইন বা বিধানকে সশ্রদ্ধ চিত্তে গ্রহণ করে ও মেনে চলে। এক্ষেত্রে তাদের নিজেদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা মূল্যহীন।

১৮২৬: বিশ্ব চরাচর আল্লাহর এবাদতে মগ্ন। তবুও এর মাঝে যারা মন্দ, যারা শয়তানের সহায় তারা আল্লাহর বিধান মানা অপেক্ষা তার বিরোধিতারই পক্ষপাত বেশী। তারা সর্বদা আল্লাহর মঙ্গলময়, কল্যাণময় বিধানকে এড়িয়ে চলারই পক্ষপাতি, কিন্তু তাদেরকেও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে হয় যদিও তা অনিচ্ছার সাথে।

১৮২৭: "ছায়াগুলি" অর্থাৎ যে বস্তুর প্রকৃত অস্তিত্ব নাই। যা অন্য বস্তুর প্রতিফলন মাত্র। "ছায়া" সব সময়ই তার অস্তিত্বের জন্য প্রকৃত বস্তুর উপরে নির্ভরশীল। প্রকৃতিতে এই অস্তিত্ব বিহীন ছায়াকেও আল্লাহর আইন মেনে চলতে হয়। বিশদ ব্যাখ্যা করে বললে বলতে হয় ছায়া আলোর ধর্মের উপরে নির্ভরশীল। আলোকধারা বাধাপ্রাপ্ত হলেই বা প্রতিফলন ঘটলেই তার সৃষ্টি সম্ভব অন্যথায় নয়। আবার সূর্য যখন দিকচক্রবালে থাকে, ছায়াগুলি হয় দীর্ঘ আবার সুর্য যখন মধ্যাহ্নে মাথার উপরে থাকে, ছায়া ছোট হতে হতে হতে অদৃশ্য হয়ে যায়। ছায়া দীর্ঘ বা খর্বকায় যাই-ই হোক না কেন তা সর্বদা আলোর ধর্ম যা বিশ্বস্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট যে আইন তা মেনে চলে। অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে দৃশ্য, অদৃশ্য, মুর্ত বা বিমুর্ত সব কিছুই আল্লাহর আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সকলেই আল্লাহর আজ্ঞাবহ দাস মাত্র।

১৬। বল : আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কে প্রভু এবং প্রতিপালক ২১২৮? বল "আল্লাহ"! বল : "তবে কি তোমরা [এবাদতের জন্য] তাঁকে ব্যতীত অন্য কাউকে রক্ষাকারীরূপে গ্রহণ করবে, যারা নিজের লাভ বা ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয় ১৮২৯?"  বলঃ "অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমকক্ষ অথবা গভীর অন্ধকার ও আলো সমান"? তবে কি তারা আল্লাহ্‌র এমন শরীক স্থির করেছে যারা আল্লাহর সৃষ্টির মত [এমন কিছু] সৃষ্টি করেছে যে সৃষ্টি তাদের নিকট সদৃশ্য মনে হয়? বল : "আল্লাহ সকল কিছুর স্রষ্টা। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, সর্বোচ্চ এবং অপ্রতিরোধ্য।" ১৮৩০।

১৮২৮: Rabb শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। [১:২] আয়াতে ও টিকা ২০।

১৮২৯: দেখুন আয়াত [৫:৭৯]।

১৮৩০: এই আয়াতটিকে ছয়টি অংশে বিভক্ত করা যায়। প্রশ্ন এবং উত্তর মিলে দুইটি অংশে একটি ভাবের প্রকাশ করে। একমাত্র পঞ্চম অংশ ব্যতীত প্রতিটি অংশ "বল" কথাটি দ্বারা শুরু হয়েছে। পঞ্চম অংশ শুরু হয়েছে, তবে কি তাদের নিকট সদৃশ্য মনে হয়? এখানে বল শব্দটি ব্যবহার করা হয় নাই। কারণ এই উক্তিটি পরোক্ষ।

(১) কে আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর প্রভু ও প্রতিপালক? উত্তরঃ এক আল্লাহ (২) তবুও কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও এবাদত করবে? উত্তরঃ কেহই আল্লাহর সমকক্ষ নয়। (৩) অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান ?(৪) অন্ধকার কখনও আলোর সমান হতে পারে না। (৫) তোমাদের উপস্যরা কি এমন কিছু সৃষ্টি করে যা দ্বারা তোমরা বিভ্রান্ত হতে পারবে? অবশ্যই না। (৬) তিনি-ই সকল কিছুর স্রষ্টা। তিনিই সর্বশক্তিমান।

১৭। তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। এবং নদী নালাগুলি পরিমাণমত প্লাবিত হয় ১৮৩১। কিন্তু জলস্রোতে উপরিভাগে স্তুপাকার [আবর্জনার] ফেনা সৃষ্টি করে। সেরূপ, যখন অলংকার অথবা তৈজসপত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে [খনিজ পদার্থকে] আগুনে উত্তপ্ত করা হয়; গাদ উপরিভাগে আসে ১৮৩২। এভাবেই আল্লাহ্‌ উপমার মাধ্যমে সত্য এবং মিথ্যাকে প্রকাশ করেছেন। যা গাদ [আবর্জনা] তা ফেলে দেয়া হয়। মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তা পৃথিবীতে থেকে যায়। এ ভাবেই আল্লাহ উপমা দিয়ে থাকেন।

১৮৩১: এই আয়াতটি নীতিগর্ভপূর্ণ রূপক দ্বারা পরিপুর্ণ। এই আয়াতে কয়েকটি বিশেষ উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে আল্লাহর মহিমাকে প্রকাশ করার জন্য (১) আল্লাহর ক্ষমতাবলে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত ঘটে যা ধনী গরীব সকলের জন্যই সমান। বৃষ্টির পানির এই প্রবাহ আল্লাহর হুকুমে বিভিন্নভাবে প্রবাহিত হয়। পুকুর ডোবা বিলে এসব পানি জমে থাকে, আবার কোথাও বৃষ্টির পানি, স্রোতের মত প্রবাহিত হয়। এই স্রোতের কত বিভিন্নতা, কোথাও বিশাল নদীর প্রচন্ড স্রোত থেকে শুরু করে, পাহাড়ী ছোট নদী যার স্বচ্ছতা কাঁচের মত, তলদেশের নুড়ি যেখানে দৃষ্টিগোচর হয়, সবই বৃষ্টির পানি দ্বারা পরিপুষ্ট। এসব নদ নদীর পানি বিধৌত হয়ে পৃথিবী শস্য উৎপাদন করে। এসব জলাশয়ের কোনটার পানি সুমিষ্ট সুস্বাদু আবার কোনটা পানের অযোগ্য বিস্বাদ। কোনটাতে ভয়ঙ্কর কুমিরের বা অন্যান্য জলজ ভয়ঙ্কর জন্তুর বাস। অর্থাৎ একই বৃষ্টির পানি দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েও প্রাকৃতিক জলাধারের বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কোনটা স্বচ্ছ সলিল ছোট পাহাড়ী নদী, কোনটা বৃহৎ সরোবর, কোনটা প্রচন্ড ঘুর্ণিস্রোতে প্রবাহিত বিশাল নদী, আবার কোনটা দিগন্ত বিস্তৃত মহা সমুদ্র। এই নীতিগর্ভমুলক রূপকটি ব্যবহার করা হয়েছে, আল্লাহর করুণা, জ্ঞান, ও প্রজ্ঞা যা তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিকে দান করেন তা বোঝানোর জন্য। আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি সকলের জন্য সমানভাবে বর্ষিত হয় তা বিভিন্ন ব্যক্তির মাঝে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায়। কারণ বিভিন্ন ব্যক্তির ধারণ ক্ষমতা বিভিন্ন এবং সেই ক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যেকে আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি ধারণ করতে পারে। আল্লাহর করুণা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, হেদায়েত সকলের জন্য সমানভাবে প্রবাহিত। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতা অনুযায়ী আমরা তা ধারণ করি। (২)পার্থিব জীবনে পানির আরেক নাম জীবন। আবার পানি হচ্ছে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার প্রতীক। কিন্ত যখন প্রবল বৃষ্টিপাতের পর স্রোতের ন্যায় প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হয়, সে পানি ভুপৃষ্টের সকল আবর্জনা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে বৃষ্টির পানির স্রোতে বর্ষার পানিতে ফুলে ফেঁপে উঠা নদীতে দেখা যায় আবর্জনার স্তুপ ভেসে যাচ্ছে। এই আবর্জনার পরিমাণ নির্ভর করে স্থানীয় জায়গার উপরে। খরস্রোতা বন্যার পানি যেরূপ ভুপৃষ্ঠের আবর্জনাকে বিদুরিত করে ভুপৃষ্ঠকে পরিস্কার করে দেয়। ঠিক সেভাবেই আল্লাহর রহমতের বন্যা আমাদের অধ্যাত্মিক জগতের সকল আবর্জনা বিদুরিত করে আমাদের আত্মাকে পবিত্র ও বিশুদ্ধ করে তোলে। (৩) আবর্জনার ফেনা সাধারণত পানির উপরে ভেসে থাকে। প্রথমতঃ মনে হয় বিশাল এবং অপ্রতিরোধ্য কিন্তু খরস্রোতা পানির বেগে তার স্থায়িত্ব খুব বেশীক্ষণ হয় না। শেষ পর্যন্ত তা ভেসে যায় ও বিদুরিত হয় এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পানি অস্তিত্ব লাভ করে। ঠিক সেরূপ আদম সন্তানের পার্থিব জ্ঞান কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। যতক্ষণ না তা আল্লাহর করুণা দ্বারা বিধৌত হচ্ছে। যে জ্ঞান বিভিন্ন মতবাদ, বিভিন্ন বিশ্বাস দ্বারা কলুষিত আচ্ছন্ন, পার্থিব জীবনে তার চাকচিক্য ও দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী তবে তা ক্ষণস্থায়ী বন্যার পানির প্রথম ধারার উপরে ভাসমান আবর্জনার স্তুপের ন্যায়। এসব বুদবুদের ন্যায় ক্ষণস্থায়ী চাকচিক্যময় জ্ঞান সময়ের আবর্তনে শেষ হয়ে যায়। স্থায়ীত্ব লাভ করে শুধু মাত্র আল্লাহর ঐশী বাণী বা চিন্তরন সত্য। উভয় দৃষ্টান্তের সারমর্ম এই যে, ময়লা ও আবর্জনা যেমন কিছুক্ষণের জন্য আসল বস্তুর উপরে দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু পরিণামে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয় এবং আসল বস্তু অবশিষ্ট থাকে। তেমনি মিথ্যাকে কিছুদিন সত্যের উপরে প্রাধাণ্য বিস্তার করতে দেখা যায়। কিন্তু অবশেষে মিথ্যা বিলুপ্ত ও পর্যুদস্ত হয় এবং সত্য অবশিষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত থাকে।

১৮৩২: বৃষ্টির পানির প্রথম স্রোত ধারার উপরে ভাসমান যে আবর্জনার স্তুপের রূপক বর্ণনা এখানে দেয়া হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান রূপকের অবতারণা করা হয়েছে। (৪) চতুর্থ এই রূপকটিতে ধাতুর নিষ্কাশনের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে । ধাতুর আকরিক সমূহে মূল ধাতু ব্যতীত অন্যান্য পদার্থ মিশ্রিত থাকে। এ সব পদার্থ থেকে ধাতুকে নিখাঁদ অবস্থায় নিষ্কাশন করার জন্য ধাতুর আকরিককে উত্তপ্ত করে গলানো হয় যেনো বর্জ পদার্থসমূহ উপরে ভাসমান হয় এবং বিদুরিত করা যায় । বর্জ পদার্থসমূহ বিদুরিত করার ফলে ধাতু বিশুদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং তখনই তার দ্বারা গহনা, তৈজসপত্র, বা অস্ত্র-শস্ত্র বানানো সম্ভব । (৫) আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, এসব উপমা ও রূপকের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ সাধারণ মানুষকে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, পার্থিব জীবনটা হচ্ছে আল্লাহ্‌র পরীক্ষা ক্ষেত্র স্বরূপ। দুঃখ, ব্যাথা; বিপদ, বিপর্যয়, ক্ষণস্থায়ী। দুঃখের আগুনে পুড়েই আত্মা খাঁটি সোনাতে রূপান্তরিত হয়, অর্থাৎ , আত্মা পরিপূর্ণতা লাভ করে। আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা থেকে আত্মার মাঝে ধৈর্য, একাগ্রতা, বিনয়ের সৃষ্টি হয় । চরিত্রের মাঝে জন্মলাভ করে দৃঢ়তা ও অধ্যাবসায়।

আবার ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যের মাঝেও আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন। যারা ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যের মাঝেও আল্লাহ্‌ নির্দ্দেশিত পথ ত্যাগ করে না, নিজেকে ভোগ-বিলাস ও লোভ-লালসার উর্দ্ধে স্থাপন করতে পারে সেই তো আল্লাহ্‌র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ । তারই চরিত্রে জন্ম নেয় আল্লাহ্‌র প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ক্ষমতা । আগুন যেরূপ ধাতুকে পুড়িয়ে আকরিকের অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল খাঁদ বা আবর্জনাকে পুড়িয়ে ফেলে ধাতুকে বিশুদ্ধ করে তোলে, সেরূপ আল্লাহ্‌র পরীক্ষা আমাদের সকল চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি দূর করে দেয়। অহংকার, লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ প্রভৃতি রীপুসমূহ. - যা ঐ গলিত ধাতুর উপরে অবস্থিত ফেনার ন্যায় ধাতুর অবস্থানকে ঢেকে রাখে, আমাদের আসল সত্যকে অনুধাবনে বাঁধা দান করে। জীবনের চলার পথের বাঁকে বাঁকে আমরা অনেক আবর্জনারূপ পাপের সঞ্চয় করি, একমাত্র আল্লাহ্‌ প্রেমের আগুনই পারে তা পুড়িয়ে আমাদের চরিত্রকে বিশুদ্ধ করতে।

১৮। [সকল] মঙ্গল তাদের জন্য যারা তাদের প্রভুর আহবানে সাড়া দেয়। এবং যারা তাঁর ডাকে সাড়া দেয় না, তাদের যদি আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সমস্তই এবং তার সাথে [সমপরিমাণ] আরো থাকতো,[বৃথাই] তারা তা মুক্তিপণ হিসেবে দিতে চাইত ১৮৩৩। ওদের হিসাব হবে কঠোর। জাহান্নাম হবে তাদের আবাস- তা কত নিকৃষ্ট আবাস স্থল।

১৮৩৩: দেখুন [৩:৯১] এবং [১০:৫৪] আয়াত।

রুকু-৩

১৯। তাহলে তোমার প্রভুর নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যে ব্যক্তি সত্য বলে জানে, সে কি, যে ব্যক্তি অন্ধ তার সমকক্ষ ? ১৮৩৪। তারাই উপদেশ গ্রহণ করে যারা বোধশক্তি সম্পন্ন।

১৮৩৪: এই আয়াতে আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস ও সৎকাজের বিপরীতে তুলনা করা হয়েছে অবিশ্বাসী বা নাস্তিক ও দুষ্কর্মপরায়ণের সাথে। তারাই মুত্তাকী বা খোদাভীরু বান্দা যারা (১) আল্লাহর প্রেরিত সতর্কবাণী গ্রহণ করে [১৩:১৯] (২) আল্লাহ আদেশ বা বিধান মেনে চলে [১৩:২০] (৩) আল্লাহ প্রেরিত শ্বাশত ধর্মকে অনুসরণ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ককে রাখতে আদেশ দিয়েছেন তা রাখে [১৩:২১] (৪) বিপদে-বিপর্যয়ে দুঃখ-ব্যাথাতে আল্লাহর উপরে নির্ভর করে ধৈর্য্য ধারণ করে [১৩:২২] (৫) নিয়মিত প্রার্থনা করে [১৩:২২] (৬) গোপনে বা প্রকাশ্যে মুক্ত হস্তে দান করে [১৩:২২] (৭) প্রতিহিংসা পরায়ণ নয়, উপরন্তু মন্দ ব্যবহারকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করতে চায়, আর এভাবেই তারা মন্দের চিরস্থায়ী রূপকে ভেঙ্গে দেবার প্রয়াসী হয়। [১৩:২২]

২০। যারা আল্লাহ প্রদত্ত অঙ্গীকার পুরণ করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না।

২১। যারা আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আদেশ দিয়েছেন তা অক্ষুন্ন রাখে ১৮৩৫। তাদের প্রভুকে শ্রদ্ধার সাথে ভয় করে এবং [তাঁর] কঠোর হিসাবকে ভয় করে।

১৮৩৫: ''আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আদেশ দিয়েছেন যারা তা অক্ষুন্ন রাখে"। অর্থাৎ ঈমানের সাথে আমলের সম্পর্ক অটুট রাখে অর্থাৎ তারা ঈমানের সাথে সৎকর্মকে, অথবা রসুলের (সা) প্রতি বিশ্বাসের সাথে পূববর্তী পয়গম্বরদের এবং তাদের গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাসকে যুক্ত করে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে কার্যে পরিণত করে নিম্নলিখিতভাবে : মানুষকে ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি ভালবাসা নিবেদন করে, আল্লাহ প্রেরিত সকল নবী ও রসুলকে সমভাবে শ্রদ্ধা করে অর্থাৎ তাদের প্রচারিত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে, অবশ্য তাদের ধর্মে, ধর্মের নামে যে অপব্যাখ্যা চালু আছে তা নয়।

২২। যারা ধৈর্যের সাথে অধ্যাবসায়ী, [যারা] তাদের প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের জন্য চেষ্টা করে নিয়মিত সালাত কায়েম করে; [উপহার হিসেবে] আমি তাদের যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে গোপনে এবং প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা মন্দকে ভালো দ্বারা দুরীভুত করে, তাদের জন্য শেষ প্রাপ্তি হবে [শান্তিময় অনন্ত] বাসস্থান, ১৮৩৬।

১৮৩৬: যাদের চরিত্রে উপরে বর্ণিত গুণাবলীর প্রকাশ ঘটে, তাদের জন্য আছে শান্তিময় অনন্ত জীবন। বেহেশত তাদের শেষ আবাসস্থল যার বর্ণনা আছে নিম্নের আয়াতগুলিতে।

২৩। চিরস্থায়ী শান্তির বাগানে তারা প্রবেশ করবে এবং [তেমনি] তাদের পিতারা, পতি-পত্মীরা ও সন্তান সন্ততিদের মধ্যে যারা পূণ্যাত্মা তারাও প্রবেশ করবে ১৮৩৭ এবং ফেরেশতারা তাদের নিকট প্রতিটি দ্বার দিয়ে [অভিবাদন সহকারে] প্রবেশ করবে।

১৮৩৭: পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী, এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের আত্মীয়তার বন্ধন অনন্ত কালের জন্য স্থায়ী বন্ধন নয়। কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা পূণ্যাত্মা যারা আল্লাহর রহমতে ধন্য, তারা পরস্পরের মধ্যে বন্ধন অনুভব করবে। কারণ ভালোর জন্য পূণ্যের জন্য, যে ভালোবাসার প্রকাশ তা আল্লাহ বান্দার মনে চিরস্থায়ী করবেন, যার উপস্থিতি বান্দা পরকালেও অনুভব করবে। ফলে আপন জন, যারা পুণ্যাত্মা তারা পরস্পর মিলিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

২৪। "তোমরা ধৈর্য্য ধারণ করেছ বলে, তোমাদের প্রতি শান্তি, কি চমৎকার এই চুড়ান্ত আবাস।"

২৫। কিন্তু যারা আল্লাহর সাথে [কৃত] অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পরে তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে ১৮৩৮ এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের উপরে আছে অভিশাপ, তাদের জন্য আছে ভয়াবহ আবাস। ১৮৩৯।

১৮৩৮: আয়াত [১৩:২১] এবং টিকা ১৮৩৫ এ যা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এই আয়াতে তাদের কথা বলা হয়েছে যারা তার বিপরীত কাজ করে।

১৮৩৯: পুর্ববর্তী আয়াত সমুহে [১৩ : ২২-২৪] যেমন অনুগত বান্দাদের প্রতিদান উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যে তাদের স্থান হবে জান্নাতে, তেমনিভাবে এ আয়াতে অবাধ্যদের অশুভ পরিণতির কথা বলা হয়েছে যা বেহেশতি শাস্তির বিপরীত। অবাধ্য তারাই যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, অর্থাৎ আল্লাহর ও রসুলের বর্ণিত বিধি বিধান পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ।

২৬। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তার জীবনোপকরণ বৃদ্ধি করেন, অথবা [কঠিনভাবে] সংকুচিত করেন ১৮৪০ [বৈষয়িক লোকেরা] পার্থিব জীবনে উল্লাসিত হয়, কিন্তু দুনিয়ার জীবন তো পরলোকের জীবনের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগমাত্র ১৮৪১।

১৮৪০: আল্লাহ্‌ যিনি বিশ্ব প্রতিপালক, বিশ্বের রিজিকদাতা। আল্লাহ যাকে খুশী অপরীসীম জীবিকা দান করেন। যাকে খুশী সীমিত জীবিকা দান করেন। এ ব্যাপারে তাঁকে কেউ জবাবদিহি করতে পারে না। তিনি সকল জবাবদিহিতার উর্দ্ধে। তিনি সর্বশ্রষ্ঠ, তিনি সর্বশক্তিমান।

১৮৪১: (দেখুন [৯:৩৮]) এখানে আয়াতটির অর্থ : পৃথিবীর বর্তমান জীবন হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী যা পরলোকের অনন্ত জীবনের জন্য শিক্ষানবীশ কাল মাত্র। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষে অনন্ত জীবনে প্রবেশ লাভ করতে হবে। যে জীবনে প্রবেশ লাভের চাবিকাঠী এই পৃথিবীর জীবনে নিহিত। পৃথিবীর জীবনকে বলা যায় পরকালের জীবনের প্রবেশের সিড়ি বা পান্থশালা বা পথ। পরকালের অনন্ত জীবনের তুলনায় এই পৃথিবীর জীবনের গুরুত্ব খুবই সীমিত।

রুকু -৪

২৭। অবিশ্বাসীরা বলে, "কেন তাঁর প্রভুর নিকট থেকে তাঁর কাছে কোন নিদর্শন পাঠানো হয় না?" ১৮৪২। বলঃ "সত্যই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন বিভ্রান্ত করেন, কিন্তু যারা অনুতপ্ত হয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসে তিনি তাদের পথ দেখান;

১৮৪২: আয়াত : [১৩:৭] এ অবিশ্বাসীরা যে প্রশ্ন করেছিলো। এই আয়াতে সেই প্রশ্নেরই পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তাদের প্রশ্নের উত্তরে যে যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল এখানে তারই সমাপ্তি টানা হয়েছে আর তা করা হয়েছে সম্পুর্ণ ভিন্ন পথে। এখানে বলা হয়েছে আল্লাহ তাদেরই হেদায়েত করবেন, যারা অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহ্‌র আনুগত্য স্বীকার করে। কিন্তু যারা আল্লাহর করুণা ও দয়াকে অস্বীকার করে। তার নির্দশন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ফিরিয়ে রাখে, তাদের আল্লাহ পরিত্যাগ করবেন। তাদের হেদায়েত করবেন না। ফলে আল্লাহর স্মরণে বা প্রশংসায় অন্তরে যে শান্তির পরশ অনুভুত হয় তা থেকে তারা বঞ্চিত হবে।

২৮। "যারা ঈমান আনে ও আল্লাহর স্মরণে যারা প্রশান্তি লাভ করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্তি খুঁজে পায়। ১৮৪৩।

১৮৪৩: এই আয়াতটি তাৎপর্যপুর্ণ। যারা আল্লাহর নিদর্শনের অর্থ কোন অলৌকিক ক্রিয়া কর্ম মনে করে। তাদের জন্য এই আয়াতটি গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বব্যাপী আল্লাহর নিদর্শন বিদ্যমান, আকাশে, বাতাসে, সমস্ত সৃষ্টিতে তার হাতের পরশ বিদ্যমান। সুতরাং তার অস্তিত্ব অনুসন্ধানের জন্য বাইরের অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের অনুসন্ধান করা মুর্খতা বৈ কিছু নয়। যে বিশ্বাসী, সে জানে তার অনুভুতিতে যে, আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা মানুষের মনে, তার অন্তরে, তার বুদ্ধিতে, তার আত্মায় ক্রীয়াশীল। মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস যত দৃঢ়তা লাভ করে তত সে অন্তরের অন্থঃস্থল থেকে অনুভব করতে পারে আল্লাহর অস্তিত্ব। যার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে সে জানে আল্লাহর নুর আত্মাকে আলোকিত উদ্ভাসিত করে তখনই যখন বান্দা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে, তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে। যারা তা না করে আল্লাহ কাউকে জবরদস্তি করেন না। কারণ এই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ হতে হবে বান্দার স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে। একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ এই স্বাধীনতা দিয়েছেন।

২৯।" যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে। পরম আনন্দ এবং শুভ পরিণাম তাদেরই ১৮৪৪।"

১৮৪৪: "Tuba" ইংরেজী করা হয়েছে Blessedness এবং বাংলা হয়েছে "আনন্দ" শব্দটির দ্বারা। অবশ্য শব্দটির প্রকৃত অনুবাদ সম্ভব নয়। এই শব্দটির দ্বারা এমন এক মানসিক অবস্থাকে (State of mind) বোঝানো হয়েছে যা অন্তরের অন্থঃস্থল থেকে উৎসারিত। সেই বিশেষ মানসিক অবস্থায় আত্মা ভরে যায় অনাবিল আনন্দে যে আনন্দকে ভাষায় প্রকাশের ক্ষমতা কোনও কথাশিল্পীর নাই। আকাশে বাতাসে সে অনুভব করে স্বর্গীয় আনন্দ অনুভুতি। এই অনুভুতি সম্পুর্ণ তার নিজস্ব। স্রষ্টাকে অন্তরে অনুভব করার মাধ্যমে এই অনুভুতি জন্মলাভ করে। কবির ভাষাতে তা হচ্ছে, " আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ।" যারা সৎ পূণ্যাত্মা ও ভালো লোক, তাদের বিপদে, দুঃখে, ব্যাথায়, ভালো, মন্দে জীবনের সর্ব অবস্থায় এই কল্যাণের অনুভুতি তাদের ঘিরে থাকে। কারণ এই মাটির পৃথিবীর কোনও মলিনতা বা দুঃখ ব্যাথা বা ভালো মন্দ কিছুই তাঁদের স্পর্শ করতে পারে না। চুম্বক যেমন সর্বাবস্থায় সর্বস্থানে সর্বদা উত্তর দক্ষিণে মুখ করে থাকে। সুর্যমুখী যেমন সারাবেলা সুর্যের দিকে চেয়ে থাকে। ঠিক সেরূপ এসব পূণ্যাত্মারা তাঁদের জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পায় এক আল্লাহর কাছে তাদের বিশ্বাসের আনুগত্যে ও সৎকাজের নিবেদনের মাধ্যমে। তাদের সর্বসত্তা সেই কল্যাণময় সত্তার দিকে চেয়ে থাকে। তারা জানে পৃথিবীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ চলার পথে, পৃথিবীর জীবন শেষে, পরকালে তাদের জন্য আছে এক অনাবিল শান্তি ও আনন্দময় জীবনের প্রতিশ্রুতি। জীবনের সকল সংগ্রাম শেষে সেই করুণাময়ের শান্তিময় আশ্রয় তাদের শেষ আবাস স্থল। আল্লাহর নিকট তাদের আশ্রয় তাদের সকল পথ চলার শেষ বিন্দু।

৩০। এভাবেই আমি তোমাকে পাঠিয়াছি এক সম্প্রদায়ের নিকট যাদের [পূর্বে বহু] সম্প্রদায় গত হয়েছে ১৮৪৫। আমি তোমার নিকট প্রত্যাদেশের মাধ্যমে যা প্রেরণ করেছি তা তুমি যেনো তাদের নিকট তিলাওয়াত করতে পার। তথাপি তারা দয়াময়কে অস্বীকার করে। বলঃ "তিনি আমার প্রভু! তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তাঁর উপরেই আমি নির্ভর করি এবং আমার প্রত্যাবর্তন তাঁরই নিকটে ১৮৪৬। "

১৮৪৫: আমাদের রসুলের (সাঃ) আগমন সকল রসুলদের শেষে। তিনিই শেষ নবী। তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ তার ঐশি বাণী ও মানুষের প্রতি তার বিধান বা ধর্মকে পূর্ণতা দান করেছেন। ইসলাম হচ্ছে বিশ্ব মানবতার ধর্ম। রসুলের (সাঃ) আগমনের পর থেকেই ইসলামের প্রসার শুরু হয় যা আজ পর্যন্ত সমভাবে বর্তমান।

১৮৪৬: এই আয়াতটিতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আন্তরিকতাকে তুলে ধরা হয়েছে। আন্তরিক বিশ্বাসের যে আনুগত্য তা অবিশ্বাসীদের যে কোনও পরিকল্পনাকে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। অবিশ্বাসীদের 'দয়াময়কে' অস্বীকার করার ফলে আল্লাহর পরিকল্পনা থেমে থাকবে না।

৩১। যদি এরূপ একটি কুর-আন হতো, যা পর্বতকে গতিশীল করতো, অথবা পৃথিবীকে বিদীর্ণ করতো, অথবা মৃতকে কথা বলাতো [তবে এটা হতো এই কুর-আন]। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সকল বিষয় আল্লাহর হুকুমের অধীন ১৮৪৭। বিশ্বাসীরা কি জানে না যে, যদি আল্লাহ [সে রকমই ] ইচ্ছা করতেন, তিনি সকল মানব সম্প্রদায়কে [সঠিক পথে] পরিচালিত করতে পারতেন ? কিন্তু অবিশ্বাসী যারা, তাদের [অশুভ] কর্মফলের জন্য বিপর্যয় কখনও তাদের ত্যাগ করবে না অথবা [বিপর্যয়] তাদের আশে পাশে স্থিতি লাভ করবে, যতক্ষণ না আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিশ্রুতির পালনে অকৃতকার্য হন না। ১৮৪৮।

১৮৪৭: এই আয়াতটিতে মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রের এক সুন্দর বর্ণনা আছে। যে কোনও আশ্চর্যজনক ঘটনাতে মানুষ খুব সহজেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদি কুরানের আয়াত দ্বারা পর্বতকে গতিশীল করা যেতো, অথবা পৃথিবীকে বিদীর্ণ করা যেতো, বা মৃতের সাথে কথা বলা যেতো, তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ তাকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করতো। তারা তাকে প্রাকৃতিক আইন বলে গ্রহণ করতো। কিন্তু প্রাকৃতিক আইন যে আল্লাহরই সৃষ্টি, আল্লাহরই ক্ষমতার অন্তুর্ভুক্ত সে বোধ বা অর্ন্তদৃষ্টি তাদের মধ্যে জন্ম লাভ করে না কারণ তারা অবিশ্বাসী। আল্লাহর কল্যাণকর পরিকল্পনা সকল কিছুকে ঘিরে থাকে। মানুষের জন্য যা কিছু কল্যাণকর তাই আল্লাহ মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এ ব্যাপারে সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহরই। বিশ্বব্রক্ষান্ডে কারও ক্ষমতা নাই আল্লাহকে হুকুম করার। কিন্তু বিশ্ব ভুবনের সকল কল্যাণ সেই এক আল্লাহর নিকট থেকে আগত।

১৮৪৮: দেখা যায় যারা অবিশ্বাসী, যারা আল্লাহর বিধান মানে না বা কোনও নীতি বা নৈতিকতার ধার ধারে না ফলে পার্থিব জীবনে তাদের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি ঘটে। কিন্তু জীবনের সেটাই শেষ কথা নয়। এদেরকেই সাবধান করা হয়েছে এখানে। আর এই সাবধান বাণী করা হয়েছে তিনটি পর্যায়ে। (১) তাদের মন্দ কাজের পরিণতি অবশ্যই মন্দ হবে। কারণ অসৎপথে তাদের যে পার্থিব উন্নতি তার কোনও শক্ত ও মজবুত ভিত্তি থাকে না। ফলে তা শেষ পর্যন্ত তাসের ঘরের মত ধ্বসে যায়। (২) তাদের গৃহ, তাদের বিশ্রামস্থল, তাদের কর্মস্থল, যেখানে তাদের গতিবিধি সর্বস্থান তাদের কুকর্ম দ্বারা কুলষিত হয়ে যাবে, ফলে কুকর্মের শেষ পরিণতি তাদের সর্ব অবয়বকে ঘিরে ধরবে, " বিপর্যয় তাদের আশে পাশে স্থিতি লাভ করবে।" কারণ মন্দ কাজ সর্বদা এক কলুষিত আবহাওয়ার সৃষ্টি করে। যার পরিমন্ডলে সব কিছু হয় কলুষিত, ফলে বিভিন্ন বিপর্যয় তাদের জন্য হয়ে উঠে অবশ্যাম্ভবী। (৩) যারা আল্লাহর বিধান না মেনে পৃথিবীকে কলুষিত করে তোলে তাদের শেষ পরিণতি ধ্বংস এই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি। আল্লাহ কখনও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। শেষ পর্যন্ত ন্যায়, সত্য ও ভালো পৃথিবীতে বিরাজ করবে এবং মন্দ ধ্বংস হয়ে যাবে।

অনেক তফসীরকার রসুলের (সাঃ) জীবনীকে উক্ত আয়াতের পটভূমিরূপে বর্ণনা করেছেন। মক্কা থেকে নির্বাসন, মদিনাতে অবস্থান এবং ইসলামের বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠা এসবই উপরের আয়াতের পটভূমি। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা এ কথার সত্যতার অনেক উদাহরণ দেখতে পাই। কোন জাতি অন্যায় ও অবিচারের মাধ্যমে পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে নাই। শেষ পর্যন্ত ন্যায় ও সত্য যা আল্লাহর বিধান তাই-ই টিকে থাকে। তবে সব কিছুই ঘটে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী।

রুকু - ৫

৩২। তোমার পূর্বে [অনেক] রাসুলকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা হয়েছে ১৮৪৯। কিন্ত আমি অবিশ্বাসীদের [সাময়িক] অবকাশ দিয়েছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত তাদের শাস্তি দিয়েছিলাম। কিরূপ [ভয়ঙ্কর] ছিলো আমার প্রতিশোধ ১৮৫০।

১৮৪৯: দেখুন আয়াত [৬: ১০]

১৮৫০: যারা পাপী ও অন্যায়কারী আল্লাহ তাদের সংশোধনের জন্য সময় দেন। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় অন্যায়কারী ও পাপীরা খুব দ্রুত বৈষয়িক উন্নতি করছে। তাদের কোনও শাস্তি হচ্ছে না। কিন্ত যখন তাদের পাপের ভাড়া পূর্ণ হবে তখন আল্লাহর শাস্তি তাদের উপরে পতিত হয়। শেষ পর্যন্ত পাপী ও অন্যায়কারীর ধ্বংস অনিবার্য।

৩৩। যিনি প্রতিটি আত্মার সকল কর্মের পর্যবেক্ষক [তিনি কি অন্যদের মত]? তথাপি তারা আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব করে। বলঃ "কিন্তু তাদের নাম বল ১৮৫১। তোমারা কি তাঁকে পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিবে যা তিনি জানেন না? অথবা এটা [শুধুমাত্র] কথার আড়ম্বর ?" না, যারা ঈমান আনে না, তাদের ছলনা তাদের নিকট মনোরম মনে হয় কিন্তু [তা দ্বারা] তাদের সৎ পথ থেকে নিবৃত্ত করা হয়েছে ১৮৫২। আল্লাহ যাকে বিপথে পরিত্যাগ করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নাই।

১৮৫১: দেখুন [১২:৪০] আয়াত। এই আয়াতে যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে তাদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে তারা তাদের উপাস্য বা ইলাহ এর পরিচয় দান করুক। তাদের মিথ্যা উপাস্যগুলি কতকগুলি নামের সমষ্টি বই তাদের সত্যিকারের কোনও অস্তিত্ব নাই। অপরপক্ষে আল্লাহর অস্তিত্ব সর্বত্র, তাঁর সৃষ্টিতে বিদ্যামান। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আকাশ ও ভুমন্ডলের প্রতিটি বস্তুর প্রতিটি অণু পরমাণুর খবর তিনি রাখেন। তবে কি অবিশ্বাসীরা পৃথিবীর এমন কোনও বস্তুর খরব দিতে চায় যার অস্তিত্ব সমন্ধে আল্লাহ অবগত নন। কিংবা এমনও হতে পারে এগুলি সবই অবিশ্বাসীদের ছলা কলা বা ভান বা কথার আড়ম্বর যা বিশ্বাসীদের প্রতারিত করার জন্য তারা ব্যবহার করে।

১৮৫২: যারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত করে তারা সর্বদা মনগড়া বহু কিছু কল্পনা করে এবং বহু অসাড় এবং কল্পনায় ভরা বিধানে তারা বিশ্বাস করে ধর্মের নামে। এরাই ধর্মের পথের প্রকৃত বাঁধা। সত্য এবং ন্যায়কে এরাই বাঁধা দান করে। যদি তারা একগুয়ে ভাবে এই ভ্রান্ত পথকে অনুসরণ করে, তবে তারা আল্লাহ্‌র করুণা ও রহমত লাভে ব্যর্থ হবে। আর যে আল্লাহ্‌র রহমত লাভে ব্যর্থ কে তাকে সঠিক পথের সন্ধান দান করবে? কারণ আল্লাহ্‌ প্রেমের যে জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি (Spiritual insight) একমাত্র আল্লাহই তা দান করতে পারেন। যদি কেউ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী না হয়। তবে পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী হয়েও সে সেই আধ্যাত্বিক জ্ঞান লাভে হবে ব্যর্থ। আধ্যাত্মিক জ্ঞান (Spiritual insight or wisdom) একমাত্র আল্লাহ্‌প্রেম ও আল্লাহ্‌র একত্বে বিশ্বাস থেকে উৎপত্তি ও প্রবাহিত একেই বলা হয়েছে আল্লাহ্‌ কর্তৃক পথ প্রদর্শন ।

৩৪। এই পার্থিব জীবনে তাদের জন্য আছে শাস্তি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরকালের শাস্তি কঠিনতর এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে তাদের কোন রক্ষাকারী নাই। ১৮৫৩।

১৮৫৩: পৃথিবীর জীবনে পাপ ও অন্যায় দীর্ঘ স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। পাপী ও অন্যায়কারীর শাস্তি এই পৃথিবীতেই শুরু হয়ে যায়। কিন্তু পরলোকের শাস্তির তুলনায় তা অত্যন্ত নগণ্য।

৩৫। পূণ্যাত্মাদের যে বেহেশ্‌তের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার উপমা হচ্ছে এরূপঃ এর পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানের আনন্দ ১৮৫৪ এবং ছায়া হবে চিরস্থায়ী ১৮৫৫। এরূপ হচ্ছে পূণ্যাত্মাদের শেষ পরিণতি, [অপরপক্ষে] অবিশ্বাসীদের সমাপ্তি হবে আগুনে ১৮৫৬।

১৮৫৪: Akala এই আরবী শব্দটির অর্থ খাওয়া বা To eat । কিন্তু প্রয়োগ ক্ষেত্রে এর যে অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে তার জন্য দেখুন [৫:৬৯] আয়াত ও টিকা নং ৭৭৬। এই শব্দটির দ্বারা এখানে যে অর্থ বোঝানো হয়েছে, আক্ষরিক অর্থে উপাদেয় ফলমূল যা আহারে রসনার তৃপ্তি হয়। আধ্যাত্মিক অর্থে সকল প্রকার উপভোগের সামগ্রী তা বস্তুগত ও পার্থিব হতে পারে, আবার আধ্যাত্মিকও হতে পারে। অর্থাৎ পার্থিব, অপার্থিব সকল প্রকার উপভোগের সামগ্রী যা দেহ মন ও আত্মাকে করে তৃপ্ত ও প্রশান্ত। পার্থিব ভোগ বিলাস কখনও আত্মাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয় না। পার্থিব ভোগ বিলাস আত্মার মাঝে ক্লান্তির সৃষ্টি করে। তৃপ্তির পরিবর্তে আরও আকাঙ্খার সৃষ্টি করে। অপরপক্ষে, বেহেশতি ভোগ বিলাস আত্মার মাঝে পরম প্রশান্তি আনয়ন করবে, যার অস্তিত্ব হবে অনন্ত কাল। কোনও কালিমা বা আত্মগ্লানি বা আশঙ্কা আত্মার সেই পরিতৃপ্ত প্রশান্ত অবস্থার বিঘ্ন ঘটাতে পারবে না। বেহেশতি আনন্দের তুলনা এ পৃথিবীতে করা সম্ভব নয়।

১৮৫৫: "Zillum" এই আরবী শব্দটির অর্থ ছায়া বা আশ্রয়, নিরাপত্তা। এই আয়াতে এ অর্থগুলির সব গুলিই প্রযোজ্য। ছায়াঘেরা প্রাপ্ত, বাগানের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। দেখুন [৪:৫৭] আয়াত ও টিকা ৫৭৯।

১৮৫৬: এই আয়াতে এবং কুর-আনের বহুস্থানে দোযখের যন্ত্রণাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার জন্যও তুলনামূলক বৈষম্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বাগানের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, বেহেশতের সুখ ও শান্তির বিপরীতে। আগুনের যন্ত্রণার বিপরীতে ছায়াঘেরা বাগানের আরাম এবং দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণার বিপরীতে বেহেশতি শান্তি। বাগান ও আগুনের বিপরীত বৈষম্যগুলি তুলনার মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিও কল্পনা করা যায়। আগুনের তাপের কথা আমাদের সেই প্রাকৃতিক রূপকে স্মরণ করিয়ে দেয় যা সুর্যের দাবদাহে অনুর্বর, খরা প্রকোপে বৃক্ষলতা শুন্য ঊষর মরুভুমি সদৃশ্য। অপরপক্ষে বাগানের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শ্যামল সজীবতার কথা। অর্থাৎ আগুন হচ্ছে দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণার প্রতীক ও বাগান হচ্ছে আনন্দের প্রতীক। এখানে আগুন হচ্ছে প্রচন্ড দাবদাহ যার থেকে কোনও প্রতিকার বা প্রতিরোধ বা আশ্রয় বা নিরাপত্তা নাই। এরই বিপরতে বলা হয়েছে বেহেশতের বাগানের কথা যা ছায়া ঘেরা সুশীতল শন্তির প্রতীক স্বরূপ।

৩৬। আমি যাদের কিতাব দিয়েছি ১৮৫৭ তারা তোমার প্রতি অবতীর্ণ ওহীতে আনন্দ প্রকাশ করে। কিন্তু কোন কোন দল ১৯৫৮ উহার কতক অংশ অস্বীকার করে।বলঃ "আমাকে আল্লাহর এবাদত করতে এবং তাঁর সাথে কোন শরীক না করতে আদেশ করা হয়েছে। তাঁর দিকেই আমি [সকলকে] আহ্বান করি এবং তারই নিকট আমার প্রত্যাবর্তন।"

১৮৫৭: "কিতাব" কথাটি কুর-আন শরীফের পরিবর্তে সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ আল্লাহর প্রত্যাদেশের পরিবর্তে। "আমি যাদের কিতাব দিয়েছি" লাইনটির অর্থ (১) পূর্ববর্তীগণ যারা রসুলের (সাঃ) পূর্বে আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়েছেন। যারা আরবীতে প্রেরিত আল্লাহর নূতন প্রত্যাদেশ পাঠ করে এবং আরবীতে পড়ার ব্যাপারে তাদের কোনও সংস্কার নাই। এবং তারা বিশ্বাস করে যে পুর্ববর্তী রসুলেরা যে সব কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন নতুন আরবী কিতাব সেইসব পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়ন করে। (২) মুসলমান হচ্ছে তারাই যারা কুর-আনকে এরূপ আনন্দের সাথে এবং আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে ঐশি গ্রন্থরূপে গ্রহণ করে।

১৮৫৮। Ahzab এবং [বহুবচনে "Hizb" অর্থ দল, গোত্র বংশ বা গোষ্ঠি]। এখানে বলা হয়েছে মানুষ সাধারণত নিজের স্বার্থ এবং অহংকারে অন্ধ হয়ে আল্লাহর কিতাবের যে অংশ তার স্বার্থ এবং মিথ্যা অহংকারকে চরিততার্থ করে তা গ্রহণ করে এবং যে অংশ তার বিরুদ্ধে যায় তা পরিত্যাগ করে। আল্লাহর হুকুমকে এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে, আর তা হচ্ছে একমাত্র এক আল্লাহর এবাদত করতে হবে, তার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। আল্লাহ ব্যতীত আর কোনও কিছুর নিকট মাথা নত করা যাবে না। রসুল (সাঃ) আমাদের সেই এক আল্লাহর দিকে আহবান করেন এবং আল্লাহর নিকটই আমাদের শেষ পরিণতি।
৩৭। এরূপে আমি ইহা আরবী ভাষায় বিধান রূপে প্রকাশ করেছি ১৮৫৯। জ্ঞান প্রাপ্তির পরে তুমি যদি তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহর বিরুদ্ধে তুমি পাবে না কোন রক্ষাকারী পাবে না কোন প্রতিরোধকারী ১৮৬০।

১৮৫৯: এই আয়াতে কুর-আনকে বা আল্লাহর প্রত্যাদেশকে আরবীতে প্রেরণের কারণ ব্যাখা করা হয়েছে। আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদকে (সাঃ), আরবী ভাষায় কথা বলে এমন জাতির মধ্যে প্রেরণ করা হয়। আল্লাহর প্রত্যাদেশ রসুলুল্লাহর ভাষায় রূপন্তরিত হলে অর্থাৎ আরবীতে রূপান্তরিত করা হলে সাধারণ লোকের পক্ষে তার যথার্থ অনুধাবন করা সহজ হবে। তার ফলে তাদের প্রতিদিনের জীবন যাত্রায় আল্লাহর আদেশ ও নির্দ্দেশের প্রতিফলন ঘটানো সহজ হবে। বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে " বিধানরূপে" এবং ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে Judgement of authority অর্থাৎ ন্যায় ও সত্য পথের পথ প্রদর্শক, এবং তা আরবী ভাষাতে নাজেল হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে জ্ঞান প্রাপ্তির সুবিধার্থে আরববাসীদের বোঝার সুবিধার্থে আরবী ভাষাতে নাজেল করা হয়েছে। দেখুন [১২:২], [১৯:৯৭], [৪২:৭]: [৪৩:৩] যারা বলে যে আরবীতে না বুঝে কুর-আন পড়ার মধ্যে অধিক সওয়াব বিদ্যমান তাদের ভ্রান্ত ধারণার উত্তর হচ্ছে উপরিউক্ত আয়াতগুলি।

১৮৬০: এই আয়াতটি [১৩:৩৭] পূর্বের সুরার [২:১২০] আয়াতের সমতুল্য। পার্থক্য হচ্ছে পুর্বের সূরাতে Nasir শব্দটিতে পরিবর্তে এই সূরাতে Waq শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে সম্পুর্ণ আয়াতটির বক্তব্য অনুযায়ী ভাব প্রকাশের সম্পুর্ণতার জন্য উপযুক্ত শব্দ চয়ন করা হয়েছে।

রুকু - ৬

৩৮। আমি তোমার পূর্বেও অনেক রসুল প্রেরণ করেছিলাম। এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তান সন্তদি দিয়েছিলাম। ১৮৬১। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোন নিদর্শন উপস্থিত করা কোন রাসুলের কাজ নয় ১৮৬২। [বস্তুত] প্রতিটি যুগের জন্য রয়েছে একটি কিতাব ১৮৬৩।

১৮৬১: রসুলুল্লাহর (সাঃ) পূর্বে আল্লাহ্‌ যত নবী রসুল প্রেরণ করেছিলেন তাদের সকলেরই স্ত্রী এবং সন্তান সন্তদি বিদ্যমান ছিলো শুধু একজন ব্যতীত। এই ব্যতিক্রম একজন ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ) যিনি বিবি মরিয়মের পুত্র। কিন্তু হযরত ঈসার জীবন কাল বা কার্যকাল তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নাই। তার নবুয়তের কার্যকাল ছিলো মাত্র তিন বৎসর প্রায়। আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট কাজের মেয়াদকাল তার জন্য ছিলো অত্যন্ত সীমিত। সুশৃঙ্খল সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধান ন্যায় ও ধর্মের ভিত্তিতে কি হওয়া প্রয়োজন সে সমন্ধে আল্লাহর নির্দেশ পৌছানো এবং কার্যে পরিণত করা, এই স্বল্প সময়ে হযরত ঈসার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। তবুও আমরা তাঁকে যোগ্য সম্মান করি কারণ তিনি আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত রসুল। কিন্তু তার প্রতি প্রেরিত প্রত্যাদেশ সমাজের সব ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে না। কারণ তিনি সে সময় পান নাই। আল-মুস্তফার প্রতি প্রেরিত প্রত্যাদেশ জীবনের, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে পরিবৃত করে এবং তা সার্বজনীন এবং বিশ্বব্যাপী, সকল সমাজ ও মানুষের জন্য তা প্রযোজ্য। আল মুস্তফার জীবনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রত্যাদেশকে কার্যে প্রতিফলিত করা হয়েছে, হযরতের জীবন কোন অলৌকিক জীবন কাহিনী নয়। তার জীবন যাত্রা ছিলো সাধারণ সংসারী মানুষের জীবন যাত্রার ন্যায়। তবুও সেই সাধারণের মধ্যেই যিনি ছিলেন অসাধারণ। তার জীবন যাপন প্রণালীর মাধ্যমেই তিনি দেখিয়েছেন যে কিভাবে লোভ লালসা ভরা পৃথিবীতে থেকেও এসবের উর্দ্ধে উঠে ন্যায় ও সত্যের পথে জীবনকে পরিচালনা করা যায়। জীবনকে সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করা যায়। এই পথ চলার জন্য কোনও অলৌকিক ক্ষমতার প্রয়োজন নাই। যে কোনও সাধারণ লোকই তার পদাঙ্ক অনুসরণ করলে সে পথের নিশানা খুঁজে পাবে। তিনি আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

১৮৬২: আল্লাহ বিভিন্ন রসুলকে বিভিন্ন মোজেজা বা অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছেন। এই মোজেজা বা অলৌকিক ক্ষমতা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী দান করা হয়েছে। কোন নবী বা রসুল তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর রসুলদের প্রেরণ করেন পৃথিবীর বৃহত্তর কল্যাণের জন্য, মহত্তর উদ্দেশ্য সাধনার জন্য। ক্ষুদ্র জাতীয়তা বা গোষ্ঠির দাবী এখানে অবান্তর। আল্লাহর প্রেরিত দূতদের বাণী ও শিক্ষা যুগ ও কাল অতিক্রান্ত। তা কোন দেশ বা জাতি বা গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তা হচ্ছে বিশ্ব মানবতার ধর্ম, যুগ কাল ও দেশের সীমা অতিক্রান্ত। আমাদের রসুলের সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেজা হচ্ছে কুর-আন শরীফ। এই কিতাবের বাণী মানুষের অন্তর্লোকে যে পরিবর্তন আনতে সক্ষম, এর সৌন্দর্য ও উজ্জ্বল্য যেভাবে মানব হৃদয়কে আকৃষ্ট করে, তা নবী করিম আল-মুস্তফার (সাঃ) সময়ে যেমন ছিলো অদ্যাবধি এর আবেদন একই আছে। বরং যুগের পরিবর্তনে বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারের ফলে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কুর-আনের ভাষা, আবেদন, সৌন্দর্য ও জ্ঞান মানুষের অর্ন্তলোকে এখনও সমভাবে উদ্ভাসিত করে।

১৮৬৩: কিতাবের অর্থ হতে পারে A law decree অথবা A decree established অবশ্য বক্তব্যের দিক থেকে বিচার করলে সব কিছুর অর্থ একই। অর্থাৎ আল্লাহর প্রত্যাদেশকে বা বিধানকে সর্বদা যুগোপযোগী করা হয়েছে।
এখানে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে "প্রতিটি যুগের জন্য রয়েছে একটি কিতাব। " অর্থাৎ মানুষের জ্ঞান ও আত্মিক উন্নতি অনুযায়ী, মানুষের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহ যুগে যুগে তার নবী ও রসুলদের প্রেরণ করেছেন আল্লাহর কিতাব বা আইন বা বিধানকে যুগোপযোগী করতে। প্রত্যেক রসুলের প্রতি প্রেরিত বিধান একটি সুনির্দিষ্ট কালের জন্য লিপিবদ্ধ।

৩৯। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা নিশ্চিহ্ন করেন, অথবা প্রতিষ্ঠিত করেন। তার নিকট রয়েছে উম্মুল কিতাব [বা সংরক্ষিত ফলক] ১৮৬৪।

১৮৬৪: "Umm-ul-Kitab" অনুবাদ করা হয়েছে ইংরেজীতে "Mother of the book " বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "কিতাবের মূল" অর্থাৎ "সংরক্ষিত ফলক" বা "লওহে মাহফুজ।" পৃথিবীর সকল প্রত্যাদেশের মূল তা উৎস বা ভিত্তি হচ্ছে "লওহে মাহফুজ" যাতে কোনরূপ পরিবর্তন পরিবর্ধন হতে পারে না। আল্লাহর বিধান বা আইনের মর্মার্থ এখানে সংরক্ষিত দেখুন [৩:৭] আয়াত ও টিকা ৩৪৭। প্রত্যেক যুগের উপযোগী বিধি ও বিধান আসতে থাকা যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত।

৪০। উহাদের যে [শাস্তির] প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যদি তার কিছু অংশ [তোমার জীবদ্দশায়] দেখাই অথবা [তার আগেই] তোমার মৃত্যু ঘটাই, তোমার কর্তব্য তো কেবল প্রচার করা। তাদের হিসাবের জন্য ডাকা তো আমার কাজ।

৪১। ওরা কি দেখে না যে, আমি তাদের [অধিকারে] থাকা ভূমি চর্তুদিক থেকে ক্রমাগত সংকুচিত করে নিচ্ছি। ১৮৬৫ ? আল্লাহর আদেশ [যেখানে], সেখানে তার আদেশ রদ করার কেউ নাই। এবং তিনি হিসাব গ্রহণে তৎপর।

১৮৬৫: মক্কায় রসুলুল্লাহ্‌ (সা) সব চেয়ে বেশী বাঁধার সম্মুখীন হন মক্কার প্রতিপত্তিশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নিকট থেকে । এরা ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে, তাই তারা ছিলো একগুঁয়ে ও উদ্ধত। অপরপক্ষে, যারা ছিলো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে তারা ছিলো বিনয়ী এবং গরীব। তারা এবং মক্কার চর্তুপাশ্বের গোষ্ঠিগুলি ধীরে ধীরে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। হিজরতের পরে এই বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে, এবং এরই শেষ পরিণতি হিসেবে ঘটে মক্কা বিজয় । মক্কা বিজয়, রক্তপাতহীন বিজয় যা ঘটেছিলো হিজরতের আট (৮) বৎসর পর, অর্থাৎ ৮ই হিজরী সনে। এ কথাকেই বলা হয়েছে, " আমি উহাদের দেশকে চতুর্দ্দিক থেকে সঙ্কুচিত করে নিচ্ছি। " অর্থাৎ কাফেরদের ভূখন্ড চতুর্দ্দিকে থেকে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে।এদের অধিবাসীরা মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে কাফেরদের অধিকৃত এলাকা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে এ বিজয় চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। মক্কা থেকে মুশরেকী অপসারিত হয়। এই আয়াতটির সার্বজনীন শিক্ষা হচ্ছে, সত্য সব সময়ে গরীব এবং বিনয়ী লোকদের অন্তরে খুব সহজেই প্রবেশাধিকার পায়। সত্য প্রথমেই ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দুতে আঘাত হানতে পারে না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় একদিন সত্যের আসন প্রতিষ্ঠিত হয় । শ্বাসত সত্য বিজয় লাভ করে। কারণ সত্যের ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য।

উপদেশঃ যে কোন মহত কাজের সফলতা আসে ধীরে ধীরে। সমাজের খুব সাধারণ স্তর থেকে শুরু হয় অগ্রযাত্রা এবং ধীরে ধীরে তা সাফল্যের শীর্ষ বিন্দুতে আরোহণ করে। রাসুলের (সা) জীবনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন, "শুভ পরিণাম" এদেরই জন্য ।

৪২। তাদের পূর্বে যারা ছিলো তারাও চক্রান্ত করেছিলো। কিন্তু সর্বদা সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা আল্লাহর ১৮৬৬। প্রতিটি আত্মার ক্রিয়াকর্ম তিনি জানেন। শ্রীঘ্রই অবিশ্বাসীরা জানতে পারবে, কারা পাবে শেষ পর্যন্ত [সুখের] নিবাস।

১৮৬৬: দেখুন [৩:৫৪] আয়াত ও টিকা ৩৯৩।

৪৩। অবিশ্বাসীরা বলে : "তুমি কোন নবী নও" ১৮৬৭। বলঃ "তোমাদের ও আমার মধ্যে স্বাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ঠ এবং যার কিতাবের জ্ঞান আছে [সেও এ ব্যাপারে সচেতন] " ১৮৬৮

১৮৬৭: ইসলামের শত্রুরা রসুল্লাহর (সাঃ) চরিত্রের মহত্ব, সৌন্দর্য, সততা, বিশ্বস্ততা প্রভৃতি গুণাবলীর প্রশংসা করতো ঠিকই, কিন্তু তারা তাঁকে আল্লাহর প্রেরিত দুত হিসেবে স্বীকার করতো না। তারা মুর্খ, তা না হলে রসুলের (সাঃ) জীবদ্দশায় তিনি ইসলামের যে বিজয় অর্জন করেছিলেন তা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। উপরন্তু কুর-আনের মত মহা গ্রন্থ এক মোজেজা, কারণ কোনও নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে কুর-আনের মত গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব নয়। কারণ জীবন ধারণের প্রতিটি পদক্ষেপের নির্দেশনা আছে কুর-আনে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ,শান্তি, যুদ্ধ, অধ্যাত্মিক এক কথায় মানব জীবনের প্রতিটি স্তরের জন্য আছে অধ্যাত্মিক নির্দেশনা যার জ্ঞান লাভ করা,কোন একজন লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য কুর-আন বা ঐশি গ্রন্থ হচ্ছে রসুলের নবুয়তের প্রত্যক্ষ ও জলন্ত প্রমাণ।

১৮৬৮: যারা আল্লাহর কিতাব বা প্রত্যাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, তারা অবশ্যই কুর-আনকে ঐশি গ্রন্থ হিসাবে সনাক্ত করতে সক্ষম হবে।