Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ১ জন
আজকের পাঠক ২৭ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩০৭২৫ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৩৬১ বার
+ - R Print

সূরা আল হিজর


সূরা আল হিজর বা প্রস্তরময় ভূভাগ- ১৫

৯৯ আয়াত, ৬ রুকু, মক্কী।
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে]


ভূমিকা : যে ছয়টি সূরা আলিফ লাম রা দিয়ে শুরু হয়েছে সূরা আল্‌ হিজর হচ্ছে তাদের শেষতম সূরা। এর অবতীর্ণ হওয়ার সময় হচ্ছে মহানবীর মক্কার অবস্থানের শেষ অথবা মধ্যবর্তী সময়ে। বিশদ বিবরণের জন্য দেখুন সূরা ১০ এর উপক্রমনিকা।

এই সূরার বিষয় বস্তুতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আল্লাহর প্রত্যাদেশ ও আল্লাহর সত্যকে রক্ষা করার উপরে। সমস্ত পাপের উৎস বা জন্ম হয় অহংকার এবং আল্লাহর ইচ্ছাকে বিকৃত করার মাধ্যমে। কিন্তু তা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে আল্লাহর দয়া ও করুণা ভিক্ষা করা। এ কথার সত্যতা প্রতিফলিত হয়েছে হযরত ইব্রাহিম, হয়রত লূতের জীবনে। 'আইকা' বাসী এবং হিজর বাসীদের জীবনে একথা সত্য হতো যদি তারা শুধুমাত্র আল্লাহর করুণার প্রত্যাশা করতো। কোরাণ, (যে মহাগ্রন্থ সাতটি অপূর্ব আয়াত দ্বারা আরম্ভ হয়েছে), হচ্ছে আল্লাহর এবাদতের জন্য অমূল্য মাধ্যম।

সার সংক্ষেপ : অবিশ্বাসীদের শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আল্লাহর বাণী হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য কারণ আল্লাহই তা রক্ষা করবেন। সব কিছুর মূল উৎস আল্লাহ। তিনি তার বান্দাদের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, এবং তিনি তাদের সকলকে একত্রিত করবেন (১৫: ১-২৫)।

ইবলিশের অহংকারই ছিলো তার পাপের উৎস। ইব্‌লিশের পাপের শাস্তি থেকে আল্লাহ তাকে সাময়িক নিবৃত্তি দেন। যারা আল্লাহর প্রত্যাদেশকে নিজের জীবনে গ্রহণ করে তাদের কোন পাপ বা ভয় স্পর্শ করবে না (১৫ : ২৬- ৫০)।

আল্লাহর করুণার বার্তা যে দেবদূতদের দ্বারা হযরত ইব্রাহিমের নিকট প্রেরণ করা হয়েছিলো, তাদেরই প্রেরণ করা হয়েছিলো লূতের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জন্য। কারণ লূতের সম্প্রদায় নিকৃষ্টতম পাপে লিপ্ত ছিলো, আইকাবাসী ও পার্বত্য উপত্যকাবাসীদের (হিজর) জন্য ছিলো তাদের পাপের প্রতিফল (১৫: ৫১-৮৪)।

পবিত্র কোরাণ এবং এর সূরাগুলি আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন শিক্ষা দেয়। আরও শিক্ষা দেয় বিনয়ের সাথে আল্লাহর এবাদত করার উপায় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সেবা করার নির্দেশ (১৫: ৮৫-৯৯)।

সূরা আল হিজর বা প্রস্তরময় ভূভাগ- ১৫

৯৯ আয়াত, ৬ রুকু, মক্কী।
[দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহর নামে]


০১। আলিফ লাম-রা। এইগুলি কোরআনের প্রত্যাদেশের আয়াত ১৯৩৩, যা সব কিছুকে বোধগম্য করে ১৯৩৪।

১৯৩৩ : দেখুন সূরা (১০ : ১) এবং টীকা ১৩৮২।

১৯৩৪ : কুর-আনের প্রত্যাদেশের প্রকাশভঙ্গী ও ভাষার বৈশিষ্ট্য, যা বিভিন্ন মূল্যবোধকে তুলে ধরেছে, তা লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে যে সব সূরাগুলি "আলিফ-লাম-রা" দিয়ে শুরু হয়েছে তাদের কথাই ধরা যায়। বর্তমান সূরাটি "আলিফ-লাম-রা" সূরার ক্রমপঞ্জির শেষ সূরা। ক্রমপঞ্জির বিভিন্ন সূরাতে "আলিফ লাম-রা" সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

সূরা ইউনুসে (১০:১) বলা হয়েছে "আলিফ লাম-রা। এগুলি হচ্ছে জ্ঞানগর্ভ কিতাবের আয়াত", এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে আল্লাহর অত্যাচার্য সৃষ্টি এবং আল্লাহর প্রত্যাদেশের সাথে তার সৃষ্টির সম্পর্ক।

সূরা হুদে (১১:১) আমরা পড়ি "আলিফ লাম-রা, ইহার আয়াতসমূহ মৌলিক এবং বিশদভাবে বিবৃত।" এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে আল্লাহর আইনের যারা বিরুদ্ধাচারণ করবে, তাদের জন্য ন্যায় বিচার ও শাস্তির বিবরণ।

সূরা ইউসুফে (১২:১) বলা হয়েছে, "আলিফ-লাম-রা, এগুলি সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত।" এই সূরার বিষয়বস্তুতে হযরত ইউসুফের কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপূর্ব ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

সূরা রাদে (১৩:১) বলা হয়েছে, "আলিফ-লাম-মীম-রা, এইগুলি কুর-আনের আয়াত।" এই সূরাতে আল্লাহর প্রত্যাদেশের ধারা ও মানুষ কিভাবে তা গ্রহণ করে তার তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু ইউসুফের কাহিনীর মত বিশদ কোন উদাহরণ দেয়া হয় নাই।

সূরা ইব্রাহীমে (১৪:১) বলা হয়েছে, "আলিফ-লাম-মীম-রা; এই কিতাব, ইহা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনতে পার।" এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে, মানুষের কল্যাণের জন্য হযরত ইব্রাহীমের প্রার্থনা। মিথ্যা এবাদতের অন্ধকার থেকে মানুষকে একত্ববাদের সত্যের আলোতে উত্তরণের জন্য আল্লাহর করুণা ভিক্ষা।

সূরা হিজরে (১৫:১) আমরা পড়ি "আলিফ-লাম-রা; এইগুলি মহাগ্রন্থ কুর-আনের সুস্পষ্ট আয়াত" এই সূরাতে পাপের ব্যাখা দান করা হয়েছে এবং কিভাবে আল্লাহর সত্য তা থেকে রক্ষা পায় সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে।


চতুর্দশ পারা

০২। অবিশ্বাসীরা কখনও কখনও আকাঙ্ক্ষা করে যে, তারা (আল্লাহর ইচ্ছার) কাছে নতি স্বীকার করে ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হবে ১৯৩৫।

১৯৩৫ : যারা কাফের, নিজেকে মিথ্যার আড়ালে লুকিয়ে রাখে বা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, কোন না কোন সময় তাদের জন্য দুঃখ ও বিপর্যয় অবধারিত। সেই বিপর্যয়ের দিনগুলিতে তারা আন্তরিকভাবে বারে বারে আল্লাহর হেদায়েত কামনা করে, সত্যের আলোর অনুসরণ করে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্ম-সমর্পন করতে চায়। প্রত্যেক কাফেরের মানসিক অবস্থা কোন না কোন সময়ে এ রকম হবে। হতে পারে তা খুব শীঘ্র, নিকট ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতেই অথবা দূর ভবিষ্যতে মৃত্যুর পরে শেষ বিচারের দিনে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, অবিশ্বাসীরা জীবনে বা মরণে কোন এক সময়ে আল্লাহ এবং আল্লাহ সত্যকে বিশ্বাসের জন্য উদগ্রীব হবে। প্রত্যেক মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সময় থাকতে নিজের প্রয়োজনেই এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া।

০৩। এদের ছেড়ে দাও পৃথিবীর জীবনের আরাম-আয়েশ উপভোগ করার জন্য এবং নিজেদের আত্মতৃপ্তির জন্য। (মিথ্যা) আশা তাদের আনন্দ দিক ১৯৩৬। শীঘ্রই তারা জানতে পারবে। ১৯৩৭

১৯৩৬ : আক্ষরিক "মিথ্যা আশা তাদের আনন্দ দিক" অর্থের বিশদ ব্যাখা করা হয়েছে আয়াত (৫:৬৬) ও টীকা ৭৭৬-তে।

১৯৩৭ : যারা আল্লাহর হুকুমে, সত্যের আলোতে বিশ্বাসী নয়, তারা পৃথিবীর জীবনকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। ভোগ-বিলাস তাদের জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সাধনা। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা তাদের কাছে মূল্যহীন। তাদের কথাই এই আয়াতে বলা হয়েছে। তারা পাপী এবং নির্বোধ। সত্যকে অবলোকন করার ক্ষমতা নাই দেখেই তারা দম্ভে অহংকারে স্ফীত হয়ে যায় এবং নিজেকে সর্বজ্ঞ মনে করে। যদি তাদের সত্যিকারের জ্ঞান থাকতো তবে তারা বুঝতে পারতো যে তারা নির্বোধ ছাড়া আর কিছু নয়।

কারণ তারা পানাহার ও ভোগ-বিলাসে ব্যস্ত থেকে মৃত্যুকে ভুলে যায়, পরকালের পুরস্কার ও শাস্তিতে বিশ্বাস করে না। তাদের সমস্ত সত্তা জুড়ে থাকে বিষয়-বৈভবের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা। অপরপক্ষে, যারা আল্লাহর হেদায়েতের আলোতে আলোকিত মুমিন বান্দা, তাঁরা পাপীদের ক্ষণস্থায়ী পার্থিব প্রাচুর্য দেখে আশ্চর্য হন না। কারণ তাঁদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আল্লাহর প্রসন্নতা লাভ। তাঁরা পাপীদের পরিণতির ভার আল্লাহর দয়া ও ন্যায় বিচারের উপরে ছেড়ে দেন।

০৪। যে সব জনপদ আমি ধ্বংস করেছি তাদের জন্য পূর্বাহ্নেই লিপিবদ্ধ ছিলো নির্দিষ্ট সময়কাল। ১৯৩৮।

১৯৩৮ : "Kitabun ma'lum" আক্ষরিক অর্থ "লিখিত সত্য" এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটিকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখা করা যায়।

(১) আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথিবীতে এক "নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়" ও কাজের পরিমাণ নির্দেশ করে দিয়েছেন। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণে মেধা, ক্ষমতা ও বিভিন্ন মানসিক দক্ষতা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করে থাকেন। ব্যক্তি তার মেধা, মননশীলতা, দক্ষতা প্রয়োগ করবে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলনের জন্য। এক কথায়, তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে তার ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সমন্বিত করতে। আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণ আত্ম-সমর্পণের মাধ্যমেই মানব সন্তান আল্লাহর বিশ্বজনীন ইচ্ছার কাছে নিজেকে বিলীণ করতে পারে। নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার বাহকরূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, আল্লাহ মানব সন্তানকে অনেক সময় দেন। যখন সেই সময় শেষ হয়ে যাবে, তার পরে আর অনুতাপ করার জন্য একটুও সময় দেয়া হবে না।

(২) পাপী বা পূণ্যাত্মা কেহই ইচ্ছা করলেই শেষ বিচারের দিনকে অগ্রগামী করতে পারবে না। আল্লাহর পরিকল্পনা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পরিচালিত হবে এবং সে "সময় নির্দিষ্ট"। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী।

(৩) কোনও জাতি বা ব্যক্তির ধ্বংস তার নিজেরই কর্মফল। আল্লাহ কাউকে ধ্বংস করেন না। জাতি বা ব্যক্তি যখন পাপে, অনাচারে লিপ্ত হয়- তার ফল স্বরূপ "নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তে" নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে। এই হচ্ছে আল্লাহর হুকুম বা আইন। প্রতিটি কাজেরই প্রতিফল আছে। ভালো কাজের ভালো প্রতিফল, মন্দ কাজের প্রতিফল ধ্বংস। সব কিছুর জন্য "নির্দিষ্ট সময়কাল" নির্ধারিত আছে। আল্লাহর এই শ্বাশত আইন প্রত্যাদেশের মাধ্যমে পূর্বেই সকলকে সতর্ক করে দেয়া হয়ে থাকে।

০৫। কোন জাতি তার নির্দিষ্ট কালকে ত্বরান্বিত করতে পারে না বা বিলম্বিত করতে পারে না। ১৯৩৯।

১৯৩৯ : দেখুন আয়াত (৭:৩৪) এবং এর টীকা।

০৬। তারা বলেন, "ওহে তুমি ! যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তুমি তো উন্মাদ (অথবা ভূতে পাওয়া)। ১৯৪০।

১৯৪০ : অবিশ্বাসী কাফেররা হযরত মুহম্মদকে (সাঃ) পাগল মনে করতো। কারণ এসব লোকেরা পৃথিবীর জীবন নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকতো। অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ, হীনতা প্রভৃতি তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে থাকে, ফলে তারা জীবনের বৃহত্তর দিক, মহত্বর সত্যের সন্ধান পায় না। হযরত (সাঃ) জীবনের যে উদ্দেশ্য, জীবনের মহত্বর উত্তরণের কথা প্রচার করতেন তা অনুধাবনের ক্ষমতা তাদের ছিলো না। মোমেন বান্দাদের কার্যপ্রণালী, কথা-বার্তা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনের উদ্দেশ্য সবই কাফেরদের কাছে মনে হতো বুদ্ধিহীন কাজকর্ম, পাগলের প্রলাপ। যার অর্থ তারা খুঁজে পেতো না। কারণ তারা ছিলো সাংসারিক বিষয়-বুদ্ধি সম্পন্ন নীতি বর্জিত লোক। তাই ন্যায় ও সত্যের আবেদন তাদের কাছে ছিলো পাগলের প্রলাপতূল্য।

০৭। "তোমার নিকট "সত্য" এসে থাকলে, কেন তুমি ফেরেশতাদের আমাদের নিকট উপস্থিত করছো না ?" ১৯৪১।

১৯৪১ : দেখুন (৬ : ৮-৯) এবং টীকা ৮৪০-৮৪১। এই আয়াতটি অবিশ্বাসীদের বিদ্রূপ বাণী। এসব অবিশ্বাসীরা পার্থিব বিষয়বস্তু ব্যতীত আর কিছুই বিশ্বাস করে না। তারা আল্লাহ বা ফেরেশতা বা প্রত্যাদেশ কোনও কিছুতেই বিশ্বাসী নয়। তাই তারা কোনও নৈতিক মূল্যবোধেও বিশ্বাস স্থাপন করে না। এই পৃথিবীর জীবনের বাইরে পরকালের জীবন সম্বন্ধে তারা ঘোরতর অবিশ্বাসী। সুতরাং তাদের আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নাই।

০৮। আমি যথার্থ কারণ ব্যতীত ফেরেশতাদের প্রেরণ করি না। ১৯৪২ ফেরেশতারা যদি (পাপীদের নিকট) আসতো; শোন, তাহলে তারা কোন অবকাশ পেতো না। ১৯৪৩।

১৯৪২ : অবিশ্বাসীদের কৌতুহল বা হুকুম মেটানোর জন্য আল্লাহ পৃথিবীতে ফেরেশতাদের প্রেরণ করতে পারেন না। শুধুমাত্র যারা নবী ও রসুল তাদের নিকট আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রেরণের জন্য এবং আল্লাহর হুকুম জারির জন্যই ফেরেশতাদের পাঠানো হয়।

১৯৪৩ : অবিশ্বাসীদের নিকট ফেরেশতা তখনই আল্লাহ পাঠাবেন যখন তাদের শেষ সময়ের হুকুম জারি হবে। যেমন হয়েছিলো লূতের সম্প্রদায়ের জন্য। ফেরেশতাদের আগমণের পরে পাপীদের আর কোন অবসর দেয়া হবে না, অবিশ্বাসীদের আর কোনও আশা থাকবে না।

০৯। সন্দেহাতীতভাবে আমি কুরআন প্রেরণ করেছি; এবং অবশ্যই আমি তা (বিকৃতি করা থেকে) রক্ষা করবো। ১৯৪৪।

১৯৪৪ : এই আয়াতে আল্লাহ্‌ সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, কুর-আনের বাণীকে নির্ভুলভাবে সংরক্ষেণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর। কুর-আনের বাণী চৌদ্দশত বৎসর থেকে রয়েছে অবিকৃত যা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের বেলায় ঘটে নাই। কু-আনের বেলায় সকল উদ্ভাবন, দুর্নীতি এবং সম্প্রসারণ সবকিছু আল্লাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ কুর-আনকে সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বা বিকৃত হতে দেবেন না বা রাহু গ্রস্থ হতে দেবেন না। সমস্ত পৃথিবী এর বিরোধীতা করলেও সত্য তার নিজস্ব জ্যোতিতে অম্লান ভাস্বর থাকবে।

১০। তোমার পূর্বে আমি প্রাচীনকালের অনেক ধার্মিক সম্প্রদায়ের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছিলাম। ১৯৪৫

১১। কিন্তু এমন কোন রাসুল তাদের নিকট আসে নাই যাকে তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করে নাই।

১৯৪৫ : Shiya'un বহুবচনে Shi'atun অর্থাৎ সম্প্রদায়, ধর্মীয় বিভক্তি। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি সত্যকে অনুধাবন করতে পারে না। তারা সত্যের অংশ বিশেষ অনুধাবন করতে পারে। আর তাকেই তারা সম্পূর্ণ সত্যরূপে প্রতিভাত করে। ফলে যুগে যুগে ধর্মের ব্যাপারে বহু বিভাজন ঘটে বহু সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। যুগে যুগে আল্লাহর প্রেরিত রসুল এই বিভেধ ও বিভাজন দূর করে আল্লাহর একত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হযরত মুহম্মদ মুস্তফাকেও (সাঃ) আল্লাহ্‌ প্রেরণ করেছেন ইহুদী, খৃষ্টান, মোশরেকদের মাঝে একত্ববাদের বাণী প্রচারের মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে তাদের বিরোধ ও বিভক্তির নিরসন করতে। যথারীতি পূর্বোক্ত রাসুলদের মত তাঁকে ও তাঁর প্রচারকে হাস্যস্পদ করা হতো। কিন্তু তা সত্যের প্রচারককে, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত করতে পারে নাই।

১২। এভাবেই আমি পাপীদের অন্তরে উহা সঞ্চার করি। ১৯৪৬

১৯৪৬ : অবিশ্বাস, সন্দেহ প্রবণতা, অশুভ শক্তি, ভালোর এবং সত্যের বিরুদ্ধাচারণ করার প্রবণতা সর্বদা এই পৃথিবীতে থাকবেই। কিন্তু যারা বিশ্বাসী শত বাধা বিপত্তির মাঝেও তারা তাদের ঈমানে অটুট থাকবে, ধৈর্য্য হারাবে না। কারণ এ সত্য অনুধাবন করতে হবে যে, মানব সন্তানকে সৃষ্টির সাথে সাথেই শয়তানের সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে শয়তানকে দেয়া হয়েছে অশেষ ক্ষমতা- মানব সন্তানকে বিপথে চালিত করার জন্য। পৃথিবীতে শয়তানের চক্রান্তকে নস্যাৎ করে জয়ী হওয়ার সাধনাই হচ্ছে আদম সন্তানকে পৃথিবীতে পাঠানোর আল্লাহর উদ্দেশ্য। এই হচ্ছে আল্লাহর বিশ্বজনীন পরিকল্পনা। আল্লাহ মঙ্গলময়, মহাজ্ঞানী, যার জ্ঞান ও কল্যাণময় ইচ্ছার পরিমাপ করা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। শয়তানের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ আদম সন্তানকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করতে হয়। তবে বিশ্বাসীদের জন্য সান্তনা এই যে, যারা শয়তানের করতলগত তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে এবং এর টীকাতে।

১৩। যেনো তারা (কোর আনে) বিশ্বাস স্থাপন করবে না; তাদের পূর্ববর্তীরা যারা গত হয়েছে তাদের মত। ১৯৪৭

১৯৪৭ : যুগে যুগে, যারা অবিশ্বাসী ও শয়তানের অনুসারী তারা কখনও আল্লাহর প্রত্যাদেশকে বিশ্বাস করবে না। কারণ পাপ ও অবিশ্বাস তাদের হৃদয়কে কঠিন করে দেবে, সে হৃদয়ে সত্যের আলোর অনুপ্রবেশ ঘটবে না। এই হচ্ছে তাদের নিয়তি। যারা হযরত মুহম্মদের (সাঃ) বিরোধীতা করেছিলো, এ কথা তাদের বেলা যেমন সত্য ঠিক সেরূপ সত্য ছিলো হযরতের (সাঃ) পূর্বের রাসুলদের বেলায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে যুগে যুগে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা ও বিভক্তি ঘটেছে।

১৪। যদি ওদের জন্য আকাশের দুয়ারও খুলে দিই ১৯৪৮ এবং ওরা (সারাদিন) তাতে আরোহণ করতে থাকে।

১৫। তবুও তারা কেবলমাত্র বলবে, "আমাদের দৃষ্টিকে সম্মোহিত করা হয়েছে; না বরং আমাদের যাদুগ্রস্থ করা হয়েছে।

১৯৪৮ : এই আয়াতটির অনুরূপ আয়াত হচ্ছে (৬:৩৫)। এই আয়াতটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। "আকাশের দূয়ার খুলিয়া"- এই বাক্যটিতে আকাশ কথাটি রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে আকাশ অর্থাৎ আল্লাহর করুণার জগত। আল্লাহ আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির জন্য করুণার সকল দরজা সকলের জন্য খুলে রেখেছেন। যে ইচ্ছা প্রকাশ করে সেই সেখানে প্রবেশ করতে পারবে। এই প্রবেশ দৈহিক নয়, আধ্যাত্মিক। এর জন্য প্রয়োজন আত্মিক উন্নতি- আত্মাকে সকল কালিমা ও পাপ থেকে মুক্ত করা। যখন আমরা আমাদের আত্মাকে পৃথিবীর লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ, কাম ক্রোধ থেকে নিবৃত্ত করতে পারবো, তখন আমরা আল্লাহর করুণা, দয়া, কল্যাণ স্পর্শ আমাদের অন্তরে অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন করবো। যাদের আত্মা পাপের বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত, তারা আত্মার এই স্বাভাবিক ক্ষমতাকে হারিয়ে ফেলে। কলুষিত আত্মা স্বাভাবিক ভাবেই আল্লাহর করুণা বা কল্যাণ স্পর্শকে অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে যা সত্য তা তাদের দৃষ্টিভ্রম ঘটায়। তারা তাকে যাদুবিদ্যা বলে মনে করে। "অপরাধীদিগের অন্তরে" থাকবে বিশ্বাসের অভাব। তারা আল্লাহর প্রত্যাদেশ কোরাণকেও সহজভাবে তাদের অন্তরে গ্রহণ করতে পারবে না। আল্লাহর বাণীকে, আল্লাহর করুণাকে, অন্তরে ধারণ করার জন্য, তাঁর মঙ্গল স্পর্শ হৃদয়ে অনুভব করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। পাপ ও অপরাধ আত্মার স্বচ্ছতা ও ভালোকে গ্রহণ করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। আল্লাহর হেদায়েত, সত্য ও বেহেশতি শান্তির স্বাদ অনুভব করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধির। অন্যথায় সত্যকে তাদের মনে হবে বিভ্রান্তি বা যাদু বিদ্যা।

রুকু- ২

১৬। আমি-ই আকাশ মণ্ডলীতে গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করেছি এবং (সকল) দর্শকদের জন্য তা সুশোভিত করেছি। ১৯৪৯-১৯৫০

১৯৪৯ : এই আয়াতে আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য ও পবিত্রতাকে তুলে ধরা হয়েছে। পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের বিপরীত হচ্ছে পাপ। পাপ কাজ আত্মার স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য নষ্ট করে আত্মাকে মসিলিপ্ত করে দেয়। আর আত্মার এ অবস্থা অস্বাভাবিক অবস্থা। পরের আয়াতে আল্লাহ বলেছেন পাপ থেকে বা শয়তান থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ পাহারা নিযুক্ত করেন।

১৯৫০ : নক্ষত্র খচিত রাতের আকাশ আমাদের মুগ্ধ করে। সীমাহীন আকাশের কোটি কোটি যোজন দূরে এসব গ্রহ-নক্ষত্র আমাদের সামনে সীমাহীন জ্ঞানের দূয়ার খুলে রেখেছে। যারা জোতির্বিজ্ঞানী তারা জানেন কোটি কোটি যোজন দূরে এসব নক্ষত্র কি নির্ভুল ভাবে নিজ নিজ কক্ষপথ পরিক্রম করে চলেছে। খুব কাছের সূর্য ও চন্দ্র, তাদের কক্ষপথে পরিক্রমায় আমাদের পৃথিবীর জীবনকে করেছে ঋতু বৈচিত্রে এবং জোয়ার ভাটাতে সমৃদ্ধ। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র পুঞ্জ শুধু যে আমাদের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ করে তাই নয়, যে চিন্তাশীল তাকে আহ্বান করে এসবের মাধ্যমে স্রষ্টাকে অনুভব করার জন্য। মহাশূন্যে নক্ষত্র পুঞ্জে, বিশ্বব্রহ্মন্ডে যে শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য বিরাজমান তা আমাদের আল্লাহর একত্বের দিকেই নির্দেশ দেয়। একমাত্র তিনিই সকল এবাদতের যোগ্য।

১৭। (অধিকন্তু) প্রত্যেক অভিশপ্ত শয়তান থেকে আমি উহাকে রক্ষা করে থাকি। ১৯৫১, ১৯৫২

১৯৫১ : "Rajim" শব্দটির অর্থ পাথর দ্বারা বিতারিত; ছুড়িয়া ফেলিয়া দেওয়া, অভিশপ্ত। দেখুন (৩:৩৬) আয়াত যেখানে শয়তানের উল্লেখ আছে "বিতারিতরূপে"।

১৯৫২ : আকাশ ও নভোমণ্ডলে, পৃথিবীর পরিমণ্ডল ও সৃষ্টির মাঝে এক সুষম ও সমন্বিত শৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যায়। জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি ধ্বংস, উত্থান-পতন, সবকিছুই সঙ্গীতের সুরের মত একতানে বাঁধা। বিশ্ব প্রকৃতির সবই সেই সঙ্গীতের সর্বোচ্চ ঐকতান। এখানে জন্ম ও মৃত্যু পাশাপাশি অবস্থান করে, কিন্তু সমতা রক্ষা করে। এক জাতির উত্থান ঘটে অন্য জাতির পতন ঘটে। বিশ্ব প্রকৃতি অনন্তকাল ব্যাপী সৃষ্টিধারার এই সমতা রক্ষা করে চলেছে অবিশ্রান্তভাবে। একেই আমরা বলি প্রকৃতি। প্রকৃতির লীলা-কুঞ্জ, সমন্বিত শৃঙ্খলার ঐকতানে বাঁধা। যদি কোনও শক্তি প্রকৃতির এই সমন্বিত শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রকৃতির ঐকতানে বাঁধা সৃষ্টি করতে চায়, এই আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহ প্রকৃতির আইনের এই ধারাকে রক্ষা করেন। যদি কোন বিদ্রোহী প্রকৃতির এই ঐকতানে নিজেকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে চায়, তবে সে স্বাগত। কিন্তু চুরি করে বিশ্ব প্রকৃতির গতিধারার বিপর্যয় ঘটানো সম্ভব নয়। কারণ মন্দ ও ভালো কখনও সহ অবস্থানে যেতে পারে না। অর্থাৎ বিশ্ব প্রকৃতির সমন্বিত শৃঙ্খলা সঙ্গীতের ঐকতানের মত যা সব প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করা হবে।

১৮। কিন্তু কেউ যদি চুরি করে সংবাদ শুনতে চায় ১৯৫৩, তাহলে প্রদীপ্ত শিখা উহার পশ্চাদধাবন করে। ১৯৫৪

১৯৫৩ : দেখুন অনুরূপ আয়াত (৩৭:৬-১০), (৭২:৮-৯), ৬৭: ৫)। এই আয়াতগুলি গভীর অর্থবোধক। আক্ষরিক অর্থে, বোঝা যায় যে, শয়তানেরা আকাশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। তারা চুরি করে বেহেশতে ফেরেশতাদের কথাবার্তা শুনতে চাইলেও তারা তা পারে না কারণ জলন্ত উল্কাপিণ্ড দ্বারা তাদের বিতারিত করা হয়। কিন্তু আয়াতটির মর্মার্থ অনেক গভীর। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর মর্মার্থ হচ্ছে, পৃথিবীর জীবনে সর্বদা দুটি ধারা বর্তমান। একটা হচ্ছে ন্যায়, সত্য, সুন্দর, শান্তি ও শৃঙ্খলার এক অপূর্ব ঐকতান বা সূরের অপূর্ব মূর্ছনা। অন্যটি হচ্ছে মন্দ বা পাপের কালো স্রোত। মন্দ বা পাপী আল্লাহর অপার দয়া ও করুণাকে গ্রহণ করতে স্বীকৃত হবে না। আল্লাহর করুণা পাওয়ার যে মাধ্যম, সত্য ও সুন্দরকে গ্রহণ করা, তারা তা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করে। প্রকারান্তে সে আল্লাহর অনুগ্রহকেই অস্বীকার করে। কিন্তু তার পাপী মন তাকে দূর্নীতির মাধ্যমে চুরি করে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে সে যাদু টোনা, দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রকৃতিতে ন্যায়, সত্য, সুন্দরের যে ঐকতান, যে সূরের মুর্ছনা তা জানার জন্য সে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। সে জানে না এভাবে তা পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহর পৃথিবী ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের জন্য । সেখানে অন্ধকারের শক্তির স্থান নাই। অন্ধকারের শক্তি অর্থাৎ শয়তানের শক্তি যা হচ্ছে পাপের পিচ্ছিল পথ, যাদু, টোনা ইত্যাদি। আলো সর্বদা অন্ধকারকে ধ্বংস করে দেয়। এখানের উপমাটি লক্ষ্য করার মত। যারা অন্ধকার পথে সত্য ও সুন্দরের মুর্চ্ছনাকে অনুভব করতে চায়, তাদের শাস্তি হচ্ছে আলো বা অগ্নিবান। স্বর্গীয় শৃঙ্খলা ও স্বর্গীয় আলো সবই, মন্দ বা পাপ বা অন্ধকার পথের বিপরীতে কাজ করে।

১৯৫৪ : "প্রদীপ্ত শিখা"- আয়াত (৩৭ : ১০) উল্লেখ আছে এ সম্বন্ধে। এর সাহায্যে উল্কাপিণ্ড বুঝানো হয়।

১৯। এবং পৃথিবীকে আমি (কার্পেটের ন্যায়) বিস্তৃত করেছি, ১৯৫৫। তাতে অনড় পর্বত মালা স্থাপন করেছি এবং সেখানে প্রত্যেক বস্তু উৎপন্ন করেছি সুপরিমিত ভাবে। ১৯৫৬

১৯৫৫ : এই আয়াতটি কবিতার উপমায় ভরপুর। কবিতার ভাষায় বলা হয়েছে, "পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করেছি কার্পেটের মত, যার উপরে পর্বতমালা স্থাপন করেছি।" আল্লাহর সৃষ্টিতে যে মহত্ব, সৌন্দর্য, শৃঙ্খলা ও পরিমিততা, সমতা লক্ষ্য করা যায় তা এক কথায় অপূর্ব। আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিদিনের সৌন্দর্য্যে, প্রতিদিনের প্রেক্ষাপটে এ কথারই সত্যতা মেলে। পৃথিবীতে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানুষের জন্য তাঁর অপার করুণা ও ভালোবাসার মাধ্যমে তিনি মানুষকে কাছে টেনেছেন। অপূর্ব সুন্দর তার সৃষ্টিকে প্রকাশ করার জন্য এই আয়াতটিতে কবিতার ভাষায় বলা হয়েছে পৃথিবীর ভূতল যেন কার্পেটের মত বিস্তৃত। কার্পেটে যেমন শিল্পীর আঁকা নানা নকশা বিদ্যমান থাকে। সেরূপ দিগন্ত বিস্তৃত ভূতল থাকে গাছ-পালা, ফুল-ফল, নদী-সমুদ্রে সুশোভিত। কার্পেটকে সস্থানে রাখার জন্য আমরা পেরেক ব্যবহার করি, ঠিক সেরূপ ভূপৃষ্টকে সস্থানে রাখার জন্য আল্লাহ পাহাড়ের সৃষ্টি করেছেন।

মন্তব্য : বর্তমান যুগে বিজ্ঞান আবিস্কার করেছে যে, ভূনিম্নের চলমান শিলাস্তর স্বস্থানে থাকে পর্বতের কারণে। চৌদ্দশ বছর পূর্বে কোরাণ এ সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করে।

১৯৫৬ : একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, প্রকৃতির সব কিছুই নির্দিষ্ট ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। "আমি পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তু উৎপন্ন করেছি সুপরিমিতভাবে।" অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিতে, পৃথিবীর মাঝে, বিশ্ব-প্রকৃতিতে কোথাও বাহুল্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকল সৃষ্টি পরিবেশের ভারসাম্য বা Ecological balance রক্ষা করে চলে। উদাহরণস্বরূপ : মাটি থেকে বৃক্ষ তার পুষ্টি আহরণ করে, সেই পুষ্টির উপর প্রাণী জগত নির্ভরশীল, আবার প্রাণীর দেহের বর্জ্য পদার্থ ও পচনশীল প্রাণী ও উদ্ভিদ দেহাবশেষ মাটিতে মিশে মাটিকে উর্বর করে এবং উদ্ভিদ জগতের পুষ্টি সাধন করে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের উপরে নির্ভরশীল, কিন্তু কোথাও বাড়াবাড়ি বা মাত্রাধিক্য নাই। এক শ্রেণীর বর্জ্য অন্য শ্রেণীর জন্য পুষ্টি এভাবেই সকল সৃষ্টি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। এ কথাকেই বলা হয়েছে "সুপরিমিত ভাবে"। সমস্ত প্রক্রিয়া হয় ধাপে ধাপে, শৃঙ্খলিতভাবে এবং পরস্পরের নির্ভরশীলতার মাধ্যমে। সৃষ্টির পরস্পর নির্ভরশীলতার শৃঙ্খলিত ধাপকেই বর্তমান বিজ্ঞান নাম দিয়েছে বাস্তু সংস্থান বা Ecological balance যা আল্লাহর আইন বা Law।

মন্তব্য : আল্লাহর আইন আছে আধ্যাত্মিক জগতের জন্য এবং প্রাকৃতিক জগতের জন্য। আধ্যাত্মিক জগতের আইন ভঙ্গকারীরা আত্মার ধ্বংস ডেকে আনে। প্রাকৃতিক জগতের আইন ভঙ্গকারীরা বা পরিবেশের ভারসাম্য ভঙ্গকারীরা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন- বর্তমান যুগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে ছিদ্র হয়ে বা 'গ্রীন হাউজ এফেক্টে' পৃথিবীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে।

২০। এবং তা থেকে আমি তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি- এবং তাদের জন্যও, যাদের জীবিকার জন্য তোমরা দায়ী নও। ১৯৫৭

১৯৫৭ : পূর্বের টীকাতে Ecological balance লক্ষ্য করুন। এই পৃথিবীতে যা কিছু জীবিত প্রাণ আছে সকলের সকল পুষ্টি সরবরাহ করে থাকেন আল্লাহ। মানব সন্তানের শারীরিক, মানসিক, আত্মিক পুষ্টির জন্য সকল ব্যবস্থা করে থাকেন সেই বিশ্বপালক। শুধু মানুষ নয় বিশ্ব-চরাচরে যত প্রাণী আছে সকলের জীবিকা নির্বাহ করেন আল্লাহ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব থেকে বিশাল প্রাণী সকলের সম্বন্ধে হয়তো আমরা ওয়াকিবহাল নই, কিন্তু মানুষের দৃষ্টির অগোচরে থেকেও এদের তত্ত্বাবধান করেন আল্লাহ। প্রকৃতি এদের আহার যুগিয়ে থাকে, রক্ষা করে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই মানুষের শত্রু বা হিংস্র বন্য জন্তু বা ক্ষতিকর। কিন্তু তারা সকলেই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহই তাদের তত্ত্বাবধায়ক। যারা জ্ঞানী তারা অবশ্যই অনুধাবন করতে পারেন যে প্রকৃতির মাঝে কোথাও বাড়াবাড়ি বা মাত্রাধিক্য নাই- সেখানে আছে নিয়ম, শৃঙ্খলা, সুসম বন্টন, যা আল্লাহর সার্বজনীন পরিকল্পনার অংশ।

২১। এবং আমার নিকট আছে প্রতিটি বস্তুর (উৎস এবং) সঞ্চিত ভাণ্ডার ১৯৫৮। কিন্তু আমি তা উপযুক্ত ভাবে নিরুপিত পরিমানেই সরবরাহ করে থাকি। ১৯৫৯

১৯৫৮ : Khazain অর্থ ধন-সম্পদ; ভাণ্ডার, যেখানে মূল্যবান বস্তু জমা করা হয়। প্রয়োজনে যেখান থেকে সময়ে সময়ে রসদ সরবরাহ করা হয়।

১৯৫৯ : পৃথিবীর সকল সুন্দর জিনিষ, ক্ষমতা (force), শক্তি (energy) সব কিছুর উৎস এক আল্লাহ। তিনি আমাদের জ্ঞাত পৃথিবীর স্রষ্টা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা। আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরের যে জগত, তা আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে যে পৃথিবী, তার তুলনায় অনেক বড়, অনেক সীমাহীন। পৃথিবীতে আমরা আল্লাহর সৃষ্টি ক্ষমতার খুব সামান্য অংশই দেখতে পাই। সেটুকু পর্যালোচনা করলেই আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। পৃথিবীতে আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আল্লাহ আমাদের জীবিকা সরবরাহ করে থাকেন। যখন কম তখন কম এবং যখন বেশী প্রয়োজন তখন বেশী পাই। মহাজ্ঞানী আল্লাহ আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তা দিয়ে থাকেন। আল্লাহর আইন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী তা ঘটে। আল্লাহর নেয়ামত অশেষ, অক্ষয়। একই ভাবে প্রকৃতি হচ্ছে শক্তির (energy) অফুরন্ত উৎস, যার নিয়ন্ত্রক বা উৎস আল্লাহ। আধ্যাত্মিক জগতের যে শক্তি তারও মূল উৎস আল্লাহ। শক্তির এই বিভিন্ন রূপ আল্লাহরই ক্ষমতার সামান্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

২২। আমি উর্বরকারী বায়ুকে প্রেরণ করি ১৯৬০। তারপরে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি, এবং যার সাহায্যে তোমাদের জন্য (প্রচুর পরিমাণে) পানি সরবরাহ করে থাকি, যদিও তোমরা এই ভাণ্ডারের অভিভাবক নও। ১৯৬১, ১৯৬২

১৯৬০ : 'Lawaqih' একবচনে 'Laqih' যা 'Laqaha' শব্দ থেকে উদ্ভুদ। এর অর্থ গর্ভবর্তী করা বা স্ত্রী খেজুর গাছকে ফলবতী করা। খেজুর, পেঁপে, তাল প্রভৃতি গাছের মধ্যে দু'ধরনের গাছ থাকে। স্ত্রী গাছ ও পুরুষ গাছ। প্রজননের সময়ে পুরুষ গাছের রেণু বায়ু তাড়িত হয়ে স্ত্রী গাছের ফুলের উপরে পতিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে স্ত্রী গাছে ফল উৎপন্ন হয়। এই আয়াতে "উর্বরকারী, বায়ু" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ যে বায়ুতে বৃষ্টিপাত ঘটে ও গর্ভধারণে সাহায্য করে। বিশেষ উদ্ভিদ প্রজাতির গর্ভধারণের এই কাজটি সমাপণ করে থাকে বায়ু এবং সেই সাথে এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে বায়ু তাড়িত মেঘের কথা। সুন্দর উপমার সাহায্যে ব্যাখা করা হয়েছে বৃক্ষের ফল উৎপাদনে পুঃরেণুর যেমন ভূমিকা আছে। সম ভূমিকা পালন করে মেঘ ও বৃষ্টি। কারণ মেঘ বৃষ্টির সৃষ্টি করে যা জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায় ও বিভিন্ন ফল, শস্য, শব্জী উৎপাদনে সাহায্য করে। সমুদ্রের পানি বাষ্প হয়ে উঠে যায়, সেখানে তা ঠাণ্ডার সংস্পর্শে এসে মেঘে পরিণত হয় এবং বায়ু চালিত হয়ে স্থল ভাগে এসে বৃষ্টিরূপে ঝড়ে পড়ে। "তারপরে" শব্দটি অত্যন্ত সুন্দর ও সঠিক ভাবে এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে। কারণ এই ছোট্ট শব্দটি দ্বারা বাতাসের সাথে বৃষ্টির সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে।

১৯৬১ : "ভাণ্ডার" শব্দটির ব্যাখা পূর্ববর্তী আয়াতে করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে। আল্লাহই সকল কিছুর উৎস।

১৯৬২ : দেখুন পূর্বের আয়াত এবং টীকা ১৯৫৮। মানুষ বিভিন্ন জলাধার যথা, বিভিন্ন পাত্র, পুকুর, হ্রদ, খাল-খনন করে পানি সংরক্ষণ করতে পারে। কিন্তু পানির উৎস মুখের উপরে তাঁর কোনও কর্তৃত্ব নাই। চিন্তা করলে দেখা যাবে সকল পানির উৎস হচ্ছে মেঘ বা বৃষ্টি। বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর উৎস মুখ পানিতে সমৃদ্ধ হয়, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর পানিতে ভরে ওঠে। এমনকি ভূগর্ভস্থ স্তরের পানির বিন্যাস ঘটে বৃষ্টিপাতের ফলে। আর মেঘকে চালিত করে বায়ু। বায়ু দ্বারা চালিত হয়ে স্থল ভাগের বিভিন্ন স্থানে মেঘ বৃষ্টিপাত ঘটায়।

২৩। প্রকৃতই, আমি-ই জীবন দান করি ও মৃতু ঘটাই ১৯৬৩। (সকল কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও) আমি-ই চূড়ান্ত মালিক। ১৯৬৪

১৯৬৩ : আয়াত (১৫ : ১৬) থেকে (১৫ : ২৩) পর্যন্ত যুক্তির যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে তা লক্ষ্য করার মত। যুক্তির সমর্থনে প্রথমে সূদুর নক্ষত্র পুঞ্জ থেকে শুরু করে একেবারে কাছের জিনিষকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব উপমার সাহায্যে, সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর মাহত্ম, মহানুভবতা, কল্যাণ, সৌন্দর্য শৃঙ্খলাকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমতঃ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে সূদুরে বিচরণশীল নক্ষত্র পুঞ্জের কথা বলা হয়েছে। আকাশ, রাশিচক্র, তারা এবং উল্কাপিণ্ড যা উর্দ্ধ আকাশে মানুষের সীমানার বাইরে লক্ষ যোজন মাইল দূরে যাদের অবস্থান, তাদের ভারসাম্য, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যকে তুরে ধরা হয়েছে আল্লাহর ক্ষমতা, মহত্বকে বুঝানোর জন্য। এর পরে বলা হয়েছে পৃথিবীর কথা। একটু লক্ষ্য করলেই অনুধাবন করা যায় পৃথিবীর সমস্ত কর্মকাণ্ড, সমতা ও ভারসাম্যের উপরে অধিষ্ঠিত। এখানে জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয় বিভিন্ন শক্তি, যেখানে মানব জীবনচক্রকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তার পরে উল্লেখ করা হয়েছে শক্তির (Energy) সীমাহীন উৎস সম্বন্ধে। এই সীমাহীন শক্তির উৎস সর্বশক্তিমান আল্লাহ। যদিও এই শক্তির উৎস অশেষ, তবুও মানুষের কাছে তাকে প্রেরণ করা হয় প্রয়োজন অনুসারে। এবং সর্বশেষে বলা হয়েছে জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে যা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে, কিন্তু আল্লাহ চিরন্তন সত্য, তার কোনও বিনাশ নাই। এই আয়াতগুলির মাধ্যমে আল্লাহর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতাকে তুলে ধরা হয়েছে তার সৃষ্টির মাধ্যমে। এক কথায় এই আয়াতগুলির মাধ্যমে আল্লাহর গুণাবলীর যথার্থতা প্রতিপাদন করা হয়েছে- যার সৌন্দর্য অতুলনীয়।

১৯৬৪ : "আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী।" অনুরূপ আয়াত দেখুন (৩ : ১৮০)। আরও দেখুন আয়াতের (৬ : ১৬৫) শেষ অংশ ও টীকা ৯৮৮।

২৪। তোমাদের মধ্যে যারা সম্মুখে দ্রুতগামী এবং যারা পশ্চাদগামী, সকলকেই আমি জানি। ১৯৬৫

২৫। নিঃসন্দেহে, তোমার প্রভুই তাদের সকলকে সমবেত করবেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তিনি সম্পূর্ণ।

১৯৬৫ : আয়াত (৯: ১০০)-এ ব্যবহার করা হয়েছে 'Sabiqun' শব্দটি, সম্ববতঃ এই আয়াতের 'Mustaqdimi'n' শব্দটির পরিবর্তে। সেক্ষেত্রে দু'দলের একদল হচ্ছে যারা সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণ করে এবং সৎকর্ম পরায়ণ এবং অন্যদল যারা পরে এসেছে কিন্তু বিশ্বাসী তাদেরও পূণ্যাত্মা বা ঈমানদার রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিকল্প অর্থ দাঁড়ায় যে, "তোমাদের পূর্ববর্তী সময়ে যারা গত হয়েছে এবং যারা পরে আসবে" আল্লাহ তাদের সকলের সম্বন্ধেই জ্ঞাত এবং শেষ বিচারের দিনে তাদের সকলকে সমবেত করা হবে।

রুকু- ৩

২৬। ঠনঠনে (শুষ্ক) কাঁদা থেকে আমি মানুষের ছাঁচ তৈরী করেছি। ১৯৬৬

১৯৬৬ : "Salsal" অর্থাৎ শুকনা মাটি যা ঠনঠন শব্দ করে যেমন পোড়া মাটির পাত্র। অনুরূপ আয়াত দেখুন (৫৫ : ১৪)। আয়াত ২৬ এবং ২৯ কে একত্র করলে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হচ্ছে, মানুষের শরীর কাঁদা নিয়ে তৈরী করে তা শুকানো হয় যেনো শুকনো মাটি ঠনঠন শব্দ করে। তারপরে তাকে আরও প্রথা অনুযায়ী গঠন করা হয় এবং শেষ করা হয়। মাটি দিয়ে গঠিত দেহের এই অংশ জান্তব যা পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীরও আছে। এই নশ্বর জান্তব দেহে আল্লাহ তার রুহু সঞ্চার করান যাকে আমরা আত্মা বলি [১৫:২৯], [৩২:৯], [৩৮:৭২]। দেহ অভ্যন্তরে এই আত্মার অবস্থানের ফলেই মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ট জীব। আর এ কারণেই মানুষ ফেরেশতাদের অভিবাদনের যোগ্য হয়।

২৭। এর আগে জ্বিনদের সৃষ্টি করেছি দগ্ধকারী বাতাসের আগুন থেকে। ১৯৬৭

১৯৬৭ : দেখুন আয়াত (৬ : ১০০) এবং টীকা ৯২৯।

২৮। স্মরণ কর। তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলাম, "আমি ঠনঠনে (শুষ্ক) কাঁদা থেকে মানুষের ছাঁচ তৈরী করতে যাচ্ছি;

২৯। যখন আমি তাকে (উপযুক্ত সৌষ্ঠবে) গঠন করবো এবং আমার রুহুর (অংশ) তার মাঝে ফুৎকার (দান) করে দেবো, তখন তোমরা সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। ১৯৬৮

১৯৬৮ : যেসব আয়াতে আদম সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি হচ্ছে (২: ৩০-৩৯) এবং (৭:১১-২৫)। এই আয়াতে যদিও মানুষ সৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে, তবুও এই আয়াত ও পরবর্তী আয়াতের মাধ্যমে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

(১) "আল্লাহর রুহু সঞ্চার করা হয়েছে"- অর্থাৎ মানুষের মাঝে আল্লাহর গুণাবলী ও জ্ঞান সঞ্চার করা হয়েছে। যদি সে এই গুণাবলী ও জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করে তবে সে পৃথিবীতে সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করবে। দেখুন [৩৮:৭২] আয়াত।

(২) শয়তানের অপকর্মের বা পাপের উদ্ভব ঘটে তার অহংকার, হিংসা এবং আত্মম্ভরিতা থেকে। হিংসা, অহংকার ও এক গুয়েমীর ফলে শয়তান আদমের আত্মার মহৎ দিকটি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়, সে আদমের নশ্বর দেহ যে মাটি থেকে তৈরী সেটুকুই শুধু অনুধাবণে সমর্থ হয়। সেরূপ, পৃথিবীতেও যারা হিংসুক ও অহংকারী ও উদ্ধত তারা কখনও প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে পারবে না।

(৩) আয়াত (১৫ : ৪০, ৪২)-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা পাপে নিমগ্ন হবে তারাই শয়তানের করতলগত হবে। অপরপক্ষে, যারা আল্লাহর অনুগত হবে তাদের উপর শয়তানের কোনও ক্ষমতা থাকবে না। আল্লাহ তাদের পরিশুদ্ধ করে নেবেন। এই আয়াতগুলিতে আদমের নাম উল্লেখ করা হয় নাই। অপরপক্ষে সাধারণভাবে 'মানুষ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

৩০। সুতরাং ফেরেশতারা সকলেই একসাথে সিজদা করলো।

৩১। ইবলীস ব্যতীত (১৯৬৯, ১৯৭০)। সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত হতে অস্বীকার করলো। ১৯৭১

১৯৬৯ : দেখুন আয়াত (২:৩৪) ও টীকা ৪৯।

১৯৭০ : 'ইবলীস' মূল ভাবধারা হচ্ছে বিদ্রোহী। দেখুন আয়াত (২:৩৬) এবং টীকা ৫২।

১৯৭১ : ইবলীসের বিদ্রোহের কারণ দুইটা :

(১) মানুষ মাটির সৃষ্টি এবং সে আগুনের সৃষ্টি সুতরাং শ্রেষ্ঠ।

(২) সে যেহেতু শ্রেষ্ঠ, সেহেতু সে অন্য ফেরেশতারা যা করবে তা সে করবে না "সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত হতে অস্বীকার করলো।"

শয়তানের এই ধারণাগুলি ছিলো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত কারণ :

(১) সে অনুধাবনে ব্যর্থ ছিলো যে মানুষ শ্রেষ্ঠ তার নশ্বর দেহের কারণে নয়। সে শ্রেষ্ঠ কারণ সে যে আত্মাকে তার নশ্বর দেহের মাঝে ধারণ করে তা হচ্ছে আল্লাহর রুহুর অংশ। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।

(২) যে সব ফেরেশতা আল্লাহর হুকুম পালন করেছিলো, আদমকে সেজদা করে, তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করার ফলে ইবলীসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায় নাই বরং তার বিদ্রোহী, অহংকারী ও নীচ মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।

৩২। (আল্লাহ) বলেছিলেন, "হে ইবলীস সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার জন্য তোমার কারণ কি ?"

৩৩। (ইবলীস) বলেছিলো, "আপনি ঠনঠনে (শুষ্ক) কাঁদা থেকে (মানুষের) যে ছাঁচ তৈরী করেছেন, আমি তাকে সেজদা করতে যাচ্ছি না।"

৩৪। আল্লাহ (বলেছিলেন), "তাহলে এখান থেকে বের হয়ে যাও; কারণ তুমি প্রত্যাখাত ও অভিশপ্ত।"

৩৫। "শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত তোমার উপরে অভিশাপ বলবৎ থাকবে।" ১৯৭২

১৯৭২ : শেষ বিচারের দিনে আমাদের চেনা-জানা বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে। যে পৃথিবী সৃষ্টি হবে তা হবে সম্পূর্ণ এক নতুন পৃথিবী। যার মাত্রা অর্থাৎ dimension বা plane হবে বর্তমান চেনা জানা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অনুরূপ আয়াত দেখুন (১৪:৪৮; ২০:১০৫-১০৭; ২১:১০৪; ৮১:১-৬; ৮২:১-৩; ৮৪:৩)। শুধু যে পৃথিবীকেই নতুন মাত্রাতে সৃষ্টি করা হবে তাই নয়; মানুষকেও নতুন আঙ্গিক দান করা হবে। দেখুন আয়াত (৫৬:৬১-৬২)।

৩৬। (ইবলীস) বলেছিলো, "হে আমার প্রভু ! তাহলে আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।" ১৯৭৩

১৯৭৩ : "অবকাশ" এই অবকাশ কিরূপ ? এর ব্যাখ্যা নিম্নরূপ। ইবলীস তার অবাধ্যতার জন্য আল্লাহর লানত প্রাপ্ত হয়। ফলে আল্লাহর করুণা ও দয়ার প্রস্রবণ তার জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। যে আল্লাহর করুণা বঞ্চিত তার জন্য আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর জীবনে অপরাধীরা যেমন সরকারের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে বঞ্চিত হয়, শয়তানও সেরূপ আধ্যাত্মিক জীবনে আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলো। পৃথিবীতে দুষ্কৃতিকারী, অপরাধীরা আইনকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে যেতে পারে, কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ফাঁকি দেয়া যায় না। সুতরাং শয়তানের অস্তিত্বের জন্য, ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, আল্লাহর কাছে কিছুকাল "অবকাশ" প্রার্থনা করে। অবকাশ চাওয়ার কারণ নীচের আয়াতে (১৫:৩৯) প্রকাশ করা হয়েছে। এই পৃথিবীর জীবনে, মানুষকে আল্লাহ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করেছেন। সে ইচ্ছা করলে ভালো-কে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করতে পারে, বা মন্দকে গ্রহণ বা ভালোকে বর্জন করতে পারে। পৃথিবীর জীবনে চলার পথের বাঁকে বাঁকে শয়তানের প্রলোভনের ফাঁদ পাতা থাকে। প্রলোভন, লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ, ইর্ষা-বিদ্বেষ প্রভৃতি শয়তানের ফাঁদ, যা মানুষকে প্রলুব্ধ করে। এই ফাঁদে মানুষকে স্ব-ইচ্ছায় ধরা দিতে হয়। কিন্তু যে স্ব-ইচ্ছায় লোভ-লালসার পথকে পরিহার করে, যে আন্তরিক ভাবে শুধু মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাঁর উপরে শয়তানের সৃষ্ট প্রলোভন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। এই-ই আল্লাহর হুকুম। শয়তানের এই ক্ষমতা শুধুমাত্র এই পৃথিবীতে মানুষের "শিক্ষানবীশ কাল" পর্যন্ত পরিব্যপ্ত।

৩৭। আল্লাহ বলেছিলেন, "তোমার অবকাশ মঞ্জুর করা হলো।

৩৮। "অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।"

৩৯। (ইবলীস) বলেছিলো, "হে আমার প্রভু। যেহেতু আপনি (মানুষের জন্য) আমাকে বিপথগামীদের অন্তর্ভূক্ত করলেন ১৯৭৪, সেজন্য আমিও পৃথিবীতে মানুষের জন্য (পাপকে) শোভন করে তুলবো এবং আমি ওদের সকলকেই বিপথগামী করবো। ১৯৭৫

১৯৭৪ : "Agwaitani" অর্থ বিপথগামী করা, বা পাপে নিক্ষিপ্ত করা। শয়তানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দেখুন আয়াত (৭:১৬) ও টীকা ১০০১। শয়তান কখনও সহজ-সরল হতে পারে না। এমনকি আল্লাহর সম্মুখেও সে সহজ সত্যকে প্রকাশে অপারগ। শয়তান তার একগুয়েমী, বিদ্রোহী ও অবাধ্যতার জন্য আল্লাহর লানত প্রাপ্ত হয়, কিন্তু নিজ দোষ স্বীকারের পরিবর্তে সে আল্লাহর উপরে সব দোষ আরোপ করে। আল্লাহর ন্যায় বিচার ও শয়তানের প্রলোভন ও মিথ্যার ফাঁদের মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না, কিন্তু শয়তান এমন ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, যেনো তার ও আল্লাহর অবস্থান এক সমতলে। লক্ষ্যণীয় যে, আয়াত ৩৯ এ শয়তান আল্লাহর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ পেশ করেছে, তা সে করেছে "অবকাশ" পাওয়ার পরে। অর্থাৎ সে আল্লাহ প্রদত্ত "অবকাশের" সুযোগ গ্রহণ করেছে।

উপদেশ : পৃথিবীতে যারা শয়তানের ফাঁদে আত্মসমর্পণ করে, তারাও শয়তানের মত মিথ্যাবাদী, অবাধ্য ও একগুয়ে হয়ে থাকে।

১৯৭৫ : শয়তানের আক্রোশকে এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। নিজ অবাধ্যতা ও একগুয়েমীর জন্য শয়তান আল্লাহর লানত প্রাপ্ত হয়, কিন্তু কৌশলে সে সব দোষ আল্লাহর উপরে স্থাপন করার প্রয়াস পায়। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে শয়তানের ক্ষমতা অত্যন্ত নগণ্য, সুতরাং আক্রোশের বশে সে মানুষের উপরে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়।

মন্তব্য : পৃথিবীতেও যারা মন্দ তারা নিজ দোষ স্বীকারের পরিবর্তে অন্যের প্রতি হয় প্রতিশোধ পরায়ণ। তাদের আক্রোশ হয় অত্যন্ত তীব্র।

৪০। তবে তারা ব্যতীত, যারা (আপনার প্রতি) অনুগত ও পবিত্র (আত্মা) বান্দা।"

৪১। (আল্লাহ) বলেছিলেন, "(আমার অনুগত বান্দাদের জন্য) আমার নিকট পৌঁছানোর ইহাই প্রকৃত সহজ সরল পথ। ১৯৭৬

১৯৭৬ : যারা আন্তরিক ভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য কামনা করে, আল্লাহর প্রকৃত উপাসনা করতে চায়, সর্ব প্রথম তাদের সমস্ত পাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। পাপের প্রভাব যেনো তাদের আত্মাকে কালিমালিপ্ত না করে। যদি কেউ "স্ব-ইচ্ছায়" পাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে, তবে তাঁর সর্বসত্ত্বায় এক অপূর্ব পরিবর্তন ঘটে যাবে। এর পরে কোন পাপ, কোনও অনিষ্ট তাঁকে স্পর্শ করার সাহস পাবে না। শয়তানের কৌশল তার কাছে হবে পরাস্ত; সে বুঝতে পারবে যে, এসব বান্দার কাছে তার ক্ষমতা নগণ্য। সুতরাং সে তাঁকে প্রলোভিত করতে সাহস পাবে না। এসব আত্মা হচ্ছে পূত এবং পবিত্র। এরা ব্যতীতও যারা সত্যকার ভাবে আল্লাহর এবাদত করে এবং আল্লাহর ক্ষমা ও করুণার প্রত্যাশী আল্লাহর করুণা তাদেরও রক্ষা করে থাকে। মানুষের ভুল ত্রুটি সংশোধনের পরে ক্ষমা করার জন্য আল্লাহ-ই তো দু'হাত বাড়িয়ে থাকেন। তিনিই তো পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল। কিন্তু কেউ যদি স্ব-ইচ্ছায় প্রলোভন বা লোভের বশবর্তী হয়ে মন্দ পথ অবলম্বন করে, তার কর্মের প্রতিফল তাকেই ভোগ করতে হবে। দোষ তো শুধু শয়তানের নয়, যে নিজেকে স্ব-ইচ্ছায় শয়তানের কৌশলের কাছে আত্মসমর্পণ করে তার পরিণাম তাকেও ভোগ করতে হবে বৈকি। দেখুন আয়াত (১৪:২২; ১৫:৪২)।

৪২। "যারা পাপ করে এবং তোমার অনুসরণ করে, তারা ব্যতীত আমার (নেককার) বান্দাদের উপর তোমার কোন কর্তৃত্ব থাকবে না।"

৪৩। এবং নিশ্চয়ই জাহান্নাম হবে তাদের সকলেরই প্রতিশ্রুত স্থান।

৪৪। যার সাতটি দরজা থাকবে, ১৯৭৭। প্রত্যেক দরজার জন্য (পৃথক পৃথক) শ্রেণীর (পাপী) আছে।

১৯৭৭ : এই আয়াতের সাত সংখ্যাটি অন্তত্য রহস্যপূর্ণ সংখ্যা। পাপের পথ বহু ধরনের। এ সমস্তকে যদি সাতটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, তবে প্রত্যেক শ্রেণীর জন্য এক একটি দরজা আছে। আক্ষরিক অর্থে তাই-ই দাঁড়ায়। তবে সম্পূর্ণ অধ্যায়টিতে অতীন্দ্রিয় উপমার সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে, শুধু এই অধ্যায় নয় পুরো সূরাটির বেলায় এই কথা খাটে। এসব অতীন্দ্রিয় উপমার সঠিক এবং পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যে কোন তফসীরকারের অসাধ্য।

রুকু- ৪

৪৫। পূণ্যাত্মারা থাকবে জান্নাতে ও (স্বচ্ছ প্রবাহিত পানির) প্রস্রবণ সমূহের মধ্য।

৪৬। (তাদের প্রতি সম্ভাষণ হবে) "তোমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে এখানে প্রবেশ কর।"

৪৭। এবং (সেখানে) আমি তাদের হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা বিদ্বেষ ভাবকে দূর করে দেবো। (তারা) ভাতৃভাবে (আনন্দের সাথে) পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে (সম্মানের) সিংহাসনে সমাসীন হবে। ১৯৭৮

১৯৭৮ : অনুরূপ আয়াত দেখুন (৭:৪৩) ও টীকা ১০২১। বেহেশতবাসীদের অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে ঐশ্বর্য সম্পদ, ক্ষমতা সবকিছু থাকা সত্ত্বেও মানুষ সম্পূর্ণ সুখী হতে পারে না। কারণ ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুখের মানদণ্ড নয়। পার্থিব জিনিষ কখনও মনের সুখ সৃষ্টি করতে পারে না। মন আপনার সুখ আপনি সৃষ্টি করে নিতে পারে। এবং তা সম্ভব যখন মানুষের মন হিংসা-দ্বেষ, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, ক্ষোভ-হতাশা মুক্ত হতে পারে। তবে পৃথিবীর জীবনে এসব সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বেহেশতবাসীদের আল্লাহ তাদের অন্তরকে এসব থেকে মুক্ত করে দেবেন। ফলে তাদের অন্তরে বিরাজ করবে অপার শান্তি। সকলেই সেখানে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। সকলেই সেখানে সম্মানজনক অবস্থানে থাকবে। পৃথিবীর জীবনের মত সেখানে ছোট ও বড়র ভেদাভেদ থাকবে না। "ভাতৃভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে অবস্থান করবে।" সেখানে কোনও অবসাদ বা ক্লান্তি থাকবে না। সেটা হবে চির আনন্দের দেশ।

মন্তব্য : বেহেশতের সুখের বর্ণনায় মনের অবস্থার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই আয়াতে। লক্ষ করা যায় পৃথিবী থেকেই পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের মানসিক এই অবস্থান শুরু হয়। মানসিক অবস্থানের জন্য পৃথিবী হয় শান্তিময় বা অশান্তিময়।

৪৮। সেখানে তাদের অবসাদ স্পর্শ করবে না, সেখান থেকে তারা (কখনও) বহিস্কৃতও হবে না।

৪৯। আমার বান্দাদের বলে দাও (১৯৭৯) যে আমি তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

১৯৭৯ : এই আয়াতে আল্লাহর গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর দয়া, করুণা, ক্ষমার কোনও শেষ নাই। যদি আমরা আমাদের দোষ-ত্রুটি ও পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা না চাই, তাঁর করুণা ভিক্ষা না করি, তবে তাঁর ন্যায় বিচার এবং শাস্তি অবধারিত যা আমাদের ধারণারও বাইরে।

৫০। এবং আমার প্রদত্ত শাস্তি হবে- অতি ভয়াবহ শাস্তি।

৫১। তাদের বল ইব্রাহীমের অতিথিদের কথা। ১৯৮০

১৯৮০ : আল্লাহর করুণা, দয়া ও ক্ষমার বিপরীতে তাঁর শাস্তির তুলনা করা হয়েছে; যেভাবে ভালো ও মন্দের তুলনা করা হয়। এই তুলনার জন্য প্রাচীন যুগের উদাহরণকে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন- (১) ইব্রাহীমের কাহিনী, (২) ইব্রাহীমের ভ্রাতুষ্পুত্র লূতের কাহিনী; যেখানে বলা হয়েছে লূতের নগরী ধ্বংসের পূর্বে লূতকে সাবধান করা হয়েছিলো। (৩) "আয়কাবাসী" বা অরণ্যবাসী। এবং (৪) শিলাময় অঞ্চলের অধিবাসী (হিজর)- এই সূরার নামকরণ সেভাবে করা হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আল্লাহর শাস্তির উল্লেখের পূর্বে যথাযথভাবে প্রথমে আল্লাহর করুণা, দয়া ও ক্ষমার উল্লেখ করা হয়েছে।

৫২। যখন তারা তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললো, "সালাম" তখন সে বলেছিলো, "আমরা তোমাদের আগমনে ভীত হচ্ছি।" ১৯৮১

১৯৮১ : এই আয়াতটি অনুধাবন করতে হলে, আয়াত (১১:৬৯-৭৩) গুলি পাঠ করা প্রয়োজন; যেখানে বলা হয়েছে ফেরেশতারা হযরত ইব্রাহীমকে তার বৃদ্ধ বয়সে সন্তান লাভের সুখবর দান করেন। দুজন অসাধারণ আগন্তুকের আগমন এবং তারা যখন হযরত ইব্রাহীমের আতিথেয়তা গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তখন হযরত ইব্রাহীম আগন্তুকদের সম্বন্ধে সান্দিহান হয়ে পড়েন। তারই প্রেক্ষিতে তিনি উপরের মন্তব্য করেন।

৫৩। তারা বলেছিলো, "ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে এক প্রজ্ঞা সম্পন্ন পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। ১৯৮২

১৯৮২ : বৃদ্ধ বয়সে পুত্র সন্তান লাভ করা, হযরত ইব্রাহীমের জন্য অবশ্যই অত্যন্ত সুসংবাদ। উপরন্তু যাকে আল্লাহ জ্ঞানীরূপে প্রেরণ করবেন তাঁর আগমনের বার্তা। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে বিবেচনা করলে সংবাদটি শুধু মাত্র যে হযরত ইব্রাহীমের নিকটই সুসংবাদ ছিলো তা নয়, তা ছিলো পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা। আর সে কারণেই শুভ সংবাদদাতা ছিলেন স্বর্গীয় ফেরেশতারা, আর সে বার্তা ছিলো : অনাগত সন্তান হবে স্বর্গীয় জ্ঞানে ধন্য। পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাস বলে হযরত ইব্রাহীমের বংশধরদের মাধ্যমে আল্লাহ পৃথিবীর প্রধান তিন ধর্মের প্রচারকদের প্রেরণ করেন। ইব্রাহীম হচ্ছেন সকল ধর্ম প্রচারকের প্রধান শিকড়।

৫৪। সে বলেছিলো, "তোমরা কি আমাকে (পুত্রের) সুসংবাদ দিতেছ যখন বার্দ্ধক্য আমাকে গ্রাস করেছে ? তোমারা কি বিষয়ে শুভ সংবাদ দিতেছ ?"

৫৫। তারা বললো, "আমরা সত্য সংবাদ দিতেছি; সুতরাং তুমি হতাশ হয়ো না।"

৫৬। সে বলেছিলো, "যারা পথভ্রষ্ট, তারা ব্যতীত আর কে তার প্রভুর অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয় ?" ১৯৮৩

১৯৮৩ : দেখুন আয়াত (১১:৬৯)।

৫৭। ইব্রাহীম বলেছিলো, (১৯৮৪) : "হে (আল্লাহর) ফেরেশতারা ! আর কি কাজে তোমাদের (আগমন) ?"

১৯৮৪ : যখন হযরত ইব্রাহীম ও তাঁর অতিথিদের মধ্যে আন্তরিকতা প্রতিষ্ঠিত হলো এবং যখন সম্ভবতঃ অতিথিরা চলে যেতে উদ্যত হলো, ইব্রাহীম তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, "হে প্রেরিতগণ ! তোমাদিগের আর বিশেষ কি কাজ আছে ?" অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীম ফেরেশতাদের সাহায্য করার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করেন। কিন্তু ফেরেশতাদের অর্পিত দায়িত্ব ছিলো ভিন্নরূপ। তাঁরা এসেছিলেন লূতের সম্প্রদায়ের জঘন্য পাপের শাস্তি দানের জন্য। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে যখনই আল্লাহর শাস্তির উল্লেখ আছে, তার পূর্বে আল্লাহর রহমত ও দয়ার উল্লেখ থাকে। কারণ আল্লাহ শাস্তিদাতা অপেক্ষা অধিক রহমত দানকারী। এই আয়াতগুলি আল্লাহর এই গুণাবলীর স্বাক্ষর। সদম ও গোমরাহ শহরের বাসিন্দাদের ধ্বংসের পূর্বে, হযরত ইব্রাহীমের মাধ্যমে আল্লাহ বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন তাঁর প্রেরিত অনাগত রাসুলদের শুভ সংবাদ, যা বিশ্বের জন্য এক অমিয় শান্তি ও পূণ্যের ধারা বয়ে আনবে। কুরআনের আয়াত আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ দয়া, করুণা ও ক্ষমা অসীম কিন্তু তাঁর শাস্তি ও ক্রোধ অত্যন্ত সীমিত।

৫৮। তারা বলেছিলো, (গভীর) পাপে নিমজ্জিত এক সম্প্রদায়ের জন্য আমরা প্রেরিত হয়েছি। ১৯৮৫

১৯৮৫ : যে লূতের সম্প্রদায়ের শাস্তির জন্য ফেরেশতাদের প্রেরণ করা হয়, তাদের শহরের অবস্থান ছিলো Dead Sea বা মরু সাগরের পার্শ্বের সমতলভূমি। এই ভূমিকে এখনও লোকে বলে, "বাহার লূত।" লূতের সম্প্রদায় এক জঘন্য পাপে লিপ্ত ছিলো। এ সম্পর্কে জানার জন্য পড়ুন আয়াত (১১: ৭৭-৮৩) এবং (৭: ৮০-৮৪)।

৫৯। "তবে লূতের পরিবার বর্গের বিরুদ্ধে নয়; আমরা অবশ্যই তাদের সকলকে রক্ষা করবো। ১৯৮৬

১৯৮৬ : এই আয়াতেরও লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে লূতের পরিবারের জন্য আল্লাহর রহমত পরে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহর ক্রোধ লূতের স্ত্রীর উপরে। অর্থাৎ বিশ্বচরাচরে আল্লাহর রহমত সর্বত্র ব্যপ্ত, আল্লাহর ক্রোধ অত্যন্ত সীমিত।

৬০। "তবে তার স্ত্রী ব্যতীত; আমরা স্থির করেছি যে, সে অবশ্যই হবে পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভূক্ত। ১৯৮৭

১৯৮৭ : দেখুন (১১ : ৮১) এবং টীকা ১৫৭৭।

রুকু- ৫

৬১। অবশেষে ফেরেশতারা লূতের পরিবারের নিকট এলো।

৬২। লূত বলেছিলো, "তোমাদের অপরিচিত বোধ হচ্ছে।"

৬৩। তারা বলেছিলো, "হ্যাঁ ! তারা যে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতো আমরা তা সম্পাদন করতে এসেছি। ১৯৮৯

১৯৮৯ : হযরত ইব্রাহীমের মত লূতও ফেরেশতাদের আগমণে হতভম্ব হয়ে যান। তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের জঘন্য পাপ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, সেই কারণে তিনি সুদর্শন যুবকদ্বয়কে আপ্যায়ন করতে ভয় পাচ্ছিলেন। ফেরেশতারা সঙ্গে সঙ্গে লূতের নিকট তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব প্রকাশ করলো, তারা বললো, "লূত আপনি অনর্থক এই দুষ্ট সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহর বাণী প্রচার করছেন কারণ তারা আপনার প্রচারকে হাসি ঠাট্টার বিষয় বলে গণ্য করে এবং সন্দেহ পোষণ করে। সময় হয়েছে তাদের সন্দেহ মোচনের। সকালের পূর্বেই তাদের ধ্বংস কর্ম সম্পাদন করা হবে।"

৬৪। যা অবশ্যই ঘটবে, আমরা তার (সংবাদ) তোমার কাছে এনেছি। ১৯৯০

১৯৯০ : "Al-Haqq" সত্য সংবাদ অর্থাৎ আল্লাহর শাস্তি যা তাদের জন্য ছিলো অবধারিত। দেখুন আয়াতে (২২ : ১৮) আল্লাহর অবধারিত শাস্তির উল্লেখ আছে।

৬৫। "সুতরাং তুমি রাত্রির (কিছু অংশ) বাকী থাকতেই তোমার পরিবারবর্গসহ বের হয়ে পড়, এবং তুমি তাদের পিছনে দূর থেকে অনুসরণ করবে এবং তোমাদের মধ্য কেহ পিছনে ফিরে তাকাবে না; বরং তোমাদের যেখানে যেতে আদেশ করা হয়েছে, সেখানে চলে যাবে।

৬৬। এবং আমি তাকে আমার এই আদেশ জানিয়ে দিলাম যে, (পাপীদের) শেষ অবশিষ্টাংশ পর্যন্ত সকালের মধ্য নির্মূল করা হবে। ১৯৯১

১৯৯১ : যেহেতু লূত এবং লূতের সঙ্গী যারা পূণ্যাত্মা ছিলেন তাদের আল্লাহ ধ্বংস থেকে রক্ষা করবেন, সেহেতু লূতকে আল্লাহ পূর্বাহ্নেই ফেরেশতাদের মাধ্যমে অবহিত করেন। লূতকে আদেশ দান করা হয় তিনি যেনো পাপিষ্ঠদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন ধ্বংস যজ্ঞের পূর্বেই।

৬৭। (যুবকদের আগমণের সংবাদে) নগরের অধিবাসীরা আনন্দে (পাগল) হয়ে উপস্থিত হলো। ১৯৯২

১৯৯২ : নগরবাসীরা জঘন্য পাপে অভ্যস্ত ছিলো। তারা দুজন সুদর্শন যুবকের (ফেরেশতা) আগমণের সংবাদে উল্লাসিত হয়ে উঠলো। তাদের বিকৃত কামনার অগ্নি প্রজ্জলিত হলো। পতঙ্গ যেরূপ অন্ধের মত প্রজ্জলিত অগ্নি শিখাতে আত্মাহুতি দিয়ে নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে, ঠিক সেইরূপ লূতের সম্প্রদায় ধ্বংসের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও, নিজেকে প্রতিরোধ করতে পারে নাই। অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহর করুণা লাভের শেষ সূত্র-ও তারা ছিড়ে ফেলে তাদের কাজের পরিণতি দ্বারা। নিয়তির অন্ধ আকর্ষণে তারা ছুটে যায়, নিজের ধ্বংস নিজেই ঢেকে আনে।

উপদেশ :
যারা আকণ্ঠ পাপে নিমজ্জিত : তারা কখনও আল্লাহর করুণার রাস্তা দেখতে পারবে না কারণ তাদের মধ্যে কখনও অনুতাপের জন্ম নেবে না। পাপ ও তাদের কুকর্ম তাদের চোখে মনোহর রূপে দেখা যাবে।

৬৮। লূত বলেছিলো, "এরা আমার অতিথি। আমাকে হেয় করো না।"

৬৯। "আল্লাহকে ভয় কর এবং আমাকে লজ্জায় ফেলো না।"

৭০। তারা বলেছিলো, "আমরা কি তোমাকে (বিদেশী) লোকদের আশ্রয় দিতে নিষেধ করি নাই ?" ১৯৯৩

১৯৯৩ : এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যেহেতু নগরীর মধ্যে লূতই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি ছিলেন ধর্মভীরু, পূণ্যাত্মা, ফলে তিনি তার সম্প্রদায়ের জঘন্য পাপের বিরুদ্ধে প্রায়ই তীব্র আপত্তি উত্থাপন করতেন। কিন্তু নগরবাসীরা তার কথায় কর্ণপাত তো করতই না উপরন্তু তাকে বারে বারে কারও বিরুদ্ধে না বলার জন্য সাবধান করা হয়। এই আয়াতে তারা লূতকে বিদ্রূপ করে বলছে যে তাকে সকল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের রক্ষাকর্তা হতে নিষেধ করা হয়েছে। কোনও কোনও তফসীরকারের মতে এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, "আমরা কি তোমাকে কোন আগন্তুককে আপ্যায়ন করতে নিষেধ করি নাই ?"

৭১। লূত বলেছিলো, "একান্তই যদি তোমরা কিছু করতে চাও, তবে আমার (বিবাহযোগ্য) কন্যাগণ রয়েছে।" ১৯৯৪

১৯৯৪ : দেখুন অনুরূপ আয়াত (১১:৭৮) এবং টীকা ১৫৭৫। এই আয়াতে লূতের ন্যায় শ্রদ্ধেয় ও পূণ্যাত্মা ব্যক্তি যখন "আমার কন্যাগণ" কথাটি উল্লেখ করেছেন, তখন তিনি নগরের যুবতী তরুণীদের কথাই উল্লেখ করেছেন, কারণ সেটাই এক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। লূতের অতিথিদের করতলগত করতে যে অধিক সংখ্যক লোক লূতের বাড়ী অবরোধ করেছিলো তাদের জন্য অধিক সংখ্যক তরুণীর আবশ্যক ছিলো, সেক্ষেত্রে নগরীর তরুণীদের উল্লেখ করা খুবই স্বাভাবিক।

৭২। (হে নবী), তোমার জীবনের শপথ, বন্য মত্ততায় তারা বিক্ষিপ্ত চিত্তে ঘুরে বেড়ায়। ১৯৯৫

১৯৯৫ : অশালীন কামনার উত্তেজনায় পাগল পাপাচারী নগরবাসী লূতের সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করে নাই, ভ্রূক্ষেপ করে নাই তাদের পরিণতির দিকে। বরং তাঁকে উপহাস করেছে। ফলে আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ পাওয়ার শেষ সূত্রটিও তারা ছিন্ন করে ফেলে এবং নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনে। এতো কাণ্ডজ্ঞানহীনতার স্পষ্ট প্রমাণ।

মন্তব্য : অবৈধ কামনার উত্তেজনা মানুষকে কাণ্ডজ্ঞানহীন পশুতে পরিণত করে। ফলে সে বিভ্রান্ত হয়, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

৭৩। সকালের পূর্বে বিস্ফোরণ তাদের গ্রাস করলো। ১৯৯৬

১৯৯৬ : As-Saihat অর্থাৎ প্রচণ্ড ঝঞ্জা, এই আয়াতে অনুবাদ করা হয়েছে "বিস্ফোরণ" সূরা (১১ : ৬৭-৯৪) অনুরূপ শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে যার সাথে ভূমিকম্পের মত প্রলয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াত এবং পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে প্রচণ্ড ঝঞ্জা, যা মহাপ্রলয়ের মত ছিলো, তার সাথে সংযুক্ত হয়েছিলো প্রস্তর খণ্ডের বৃষ্টির মত বর্ষণ। এসব বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আগ্নেয়গিরির আগ্নেয় পাত-এর সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ যে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ঠিক সেরূপ ঘটনাই ঘটেছিলো।

৭৪। এবং আমি নগরীকে উল্টিয়ে দিলাম এবং তাদের উপরে ইটের ন্যায় শক্ত গন্ধকের বর্ষণ করলাম। ১৯৯৭

১৯৯৭ : লূতের জনপদ ধ্বংসের অনুরূপ বর্ণনা আছে সূরা (১১ : ৮২) আয়াতে এবং এর টীকাতে।

৭৫। স্মরণ কর ! যারা নিদর্শন বুঝতে পারে, এর মাঝে তাদের জন্য আছে চিহ্ন।

৭৬। (নগরগুলি) এখনও বাণিজ্য পথের পার্শ্বে বিদ্যমান। ১৯৯৮

১৯৯৮ : লূতের জনপদ "সদম" ও "গোমরাহ" নগরী আল্লাহর ক্রোধে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। যে কোনও প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই জনপদকে আল্লাহ এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন যে, তাদের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্ভুলভাবে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা শক্ত, কিন্তু আরব ও সিরিয়ার প্রধান বাণিজ্য পথের পার্শ্বে, মরু সাগরের (Dead Sea) উপকূলে বিস্তীর্ণ এলাকা লক্ষ্য করা যায়, যা শুধুমাত্র প্রস্তর ও কঙ্কর দ্বারা পরিপূর্ণ। কোরাণের বর্ণনা অনুযায়ী এখানেই ছিলো লূতের সম্প্রদায়ের জনপদ। কত হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এখনও মরু সাগরের উপকূলবর্তী এই স্থান জনশূন্য। ঊষর, প্রস্তরময় ভূখণ্ড যা দর্শনে মনে ভয়ের এবং অন্ধকারময় বিভিষিকার জন্ম দেয়। জনপদ এখনও কোনও প্রাণের স্পর্শ বর্জিত। এভাবেই লূতের সম্প্রদায়ের পাপের পরিণতির স্বাক্ষর আজও প্রকৃতি বহন করে চলেছে। "মরু সাগর" নামকরণের কারণ এর পানিতে কোন মাছ, ব্যাঙ, উদ্ভিদ ইত্যাদি কোন প্রাণেরই অস্তিত্ব নাই। কোনও প্রাণই এখানে জীবিত থাকতে পারে না।

৭৭। স্মরণ কর। যারা বিশ্বাসী এর মাঝে তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। ১৯৯৯

১৯৯৯ : আয়াত ৭৫-এ বলা হয়েছে তাদের কথা যারা আল্লাহর নিদর্শনকে অনুধাবন করতে সক্ষম। যারা আরব ও সিরিয়ার প্রধান বাণিজ্য পথে যাতায়াত করে এই আয়াত (৭৬-৭৭)-এ তাদের সম্বোধন করা হয়েছে। দিগন্ত বিস্তৃত প্রাণের অস্তিত্ব বিহীন ঊষর প্রান্তর তাদের আল্লাহর ক্ষমতা ও পাপের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

৭৮। এবং অরণ্যের অধিবাসীরাও (২০০০) ছিলো পাপী।

২০০০ : "As-hab ul Aikati" শাব্দিক অর্থ গহন অরণ্যের অধিবাসী, কারা ছিলো এই আইকাবাসী ? সম্ভবত আইকা হচ্ছে কোন জনপদ বা স্থানের নাম। আইকাবাসীদের কথা কোরাণ শরীফে চার বার উল্লেখ করা হয়েছে। যথাঃ এই সূরাতে, এবং (২৬: ১৭৬-১৯১), (৩৮:১৩), এবং ৫০:১৪) আয়াতে। যে সূরাতে আয়কাবাসীদের সম্বন্ধে বিশদ বলা হয়েছে, তা হচ্ছে (২৬ : ১৭৬-১৯১) আয়াতে। সেখানে বলা হয়েছে যে তাদের নবী ছিলেন শূয়েব। শূয়েব ছিলেন মাদিয়ান সম্প্রদায়ের নবী (৭:৮৫-৯৩) আয়াতে দ্রষ্টব্য এবং সেখানে টীকাতে এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। যেহেতু শূয়েব নবী, আয়কাবাসী ও মাদিয়ান সম্প্রদায় উভয়ের নবী ছিলেন। সুতরাং এ কথা যুক্তিগ্রাহ্য যে, আয়কাবাসী ও মাদিয়ান সম্প্রদায় ছিলো একই সম্প্রদায়, অথবা আয়কাবাসী ছিলো মাদিয়ানদের পার্শ্ববর্তী এলাকার লোক।

৭৯। সুতরাং আমি তাদের উপরে প্রতিশোধ নিয়েছি। তারা উভয়ই প্রকাশ্য বাণিজ্য পথের পার্শ্বে দৃশ্যমান হিসেবে বিদ্যমান। ২০০১

২০০১ : "উভয়ই" অর্থাৎ লূতের বা প্রস্তরময় ঊষর ভূমি এবং আয়কাবাসী। লূত ও শূয়েবের উভয় সম্প্রদায়ের জনপদের ধ্বংসস্তূপের কথা এখানে বলা হয়েছে।

রুকু-৬

৮০। পার্বত্য অঞ্চলে (হিজর) অধিবাসীগণও রাসুলকে প্রত্যাখান করেছিলো। ২০০২

২০০২ : 'হিজর' একটি পার্বত্য উপত্যকার নাম, যেখানে সামুদ সম্প্রদায় বাস করতো। মদিনা থেকে ১৫০ মাইল উত্তরে আরবের পার্বত্য অঞ্চলে হিজর পর্বতের অবস্থান। স্থানটি আরব ও সিরিয়ার বাণিজ্য পথের পার্শ্বে অবস্থিত। সামুদ সম্প্রদায় সম্বন্ধে দেখুন আয়াত (৭:৭৩) এবং টীকা ১০৪৩।

৮১। আমি তাদের আমার নিদর্শন প্রেরণ করেছিলাম, কিন্তু তারা একগুয়েমী ভাবে তা থেকে ফিরে গিয়েছিলো।

৮২। তারা পর্বত কেটে অট্টালিকা বানিয়ে (নিজেদের) নিরাপদ ভাবতো। ২০০৩

২০০৩ : হিজর পর্বতের গাত্র কেটে সামুদ সম্প্রদায় যেসব সুরম্য প্রাসাদ তৈরী করেছিলো, সে সবের ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। হিজর পর্বত থেকে ৩৮০ মাইল দূরে পেট্রা নগর বর্তমান, যেখানে সামুদদের অবস্থান ছিলো। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত দেখুন (৭:৭৩) আয়াত এবং টীকা ১০৪৩। পেট্রা শব্দটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ পর্বত।

৮৩। কিন্তু প্রভাতকালে (শক্তিশালী) বিস্ফোরণ তাদের আঘাত করলো। ২০০৪

২০০৪ : প্রচণ্ড শব্দ, ঝঞ্জা, বায়ুপ্রবাহ, সেই সাথে ভূমিকম্প তাদের আঘাত করেছে। দেখুন (৭:৭৮) এবং টীকা ১০৪৭ যেখানে সামুদ জাতির ধ্বংসের বিবরণের মধ্যে ভূমিকম্পের উল্লেখ আছে।

৮৪। (পরিশ্রম ও কলাকৌশলের মাধ্যমে) তারা যা অর্জন করেছিলো, তা তাদের কোন কাজে আসে নাই।

৮৫। আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এর মধ্যবর্তী সকল কিছুই আমি অযথা সৃষ্টি করি নাই, ২০০৫। কেয়ামত অবশ্যম্ভাবী, সুতরাং তুমি (মানুষের ভুল-ভ্রান্তি) উপক্ষো কর ও সৌজন্যের সাথে ওদের ক্ষমা কর। ২০০৬

২০০৫ : এই বিশ্ব ভূবন, আকাশ ও পৃথিবী আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মহৎ উদ্দেশ্যে, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য। দেখুন (১০:৫) আয়াত। আবার আয়াত (২১:১৬) তে বলা হয়েছে, "আল্লাহ ইহা খেয়াল খুশী বা খেলা ধুলার জন্য সৃষ্টি করেন নাই।" আল্লাহ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে।

২০০৬ : সেদিন অবশ্যম্ভাবী, যেদিন প্রত্যেকের জীবনের প্রকৃত চিত্র উদঘাটিত করা হবে। সেদিনের কথা স্মরণ করে আমাদের ধৈর্য্যহীন হওয়া উচিত নয় বরং সহনশীল ও অপরের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা কর্তব্য।

৮৬। অবশ্যই তোমার প্রভুই মহা-স্রষ্টা, যিনি মহাজ্ঞানী। ২০০৭

২০০৭ : "Khallaq"- এই শব্দটির অর্থ এক কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। 'স্রষ্টার' সম্বন্ধে ধারণা করার জন্য উপরিউক্ত শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ, স্রষ্টা জ্ঞানে, দক্ষতায়, সৃষ্টিতে স্বয়ং সম্পূর্ণ, যে সম্পূর্ণতা প্রকাশের ভাষা নাই। অত্যন্ত জোড়ালো ও আবেগপূর্ণ ভাষাও স্রষ্ঠার পূর্ণ মহিমা প্রকাশে অক্ষম। আল্লাহর সৃষ্টি আল্লাহর জ্ঞানে স্বয়ং সম্পূর্ণ। তাঁর সৃষ্টিতে কোন ব্যতিক্রম নাই- সব কিছু তাঁর আয়ত্মাধীন। যদি আমাদের দৃষ্টিতে কোনও ব্যতিক্রম বা ভুল ধরা পরে তবে তা আমাদেরই দৃষ্টি বিভ্রম। কারণ আল্লাহর সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা অনুধাবনের ক্ষমতা আমাদের নাই। এই মুহূর্তে যা আমাদের মনে হবে অসম্পূর্ণ ও অন্যায় ও অসত্য- তা হবে আমাদের অসম্পূর্ণ মনের অসম্পূর্ণ চিন্তার বিকাশ যা মহাজ্ঞানী আল্লাহর সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ধারণে অক্ষম। তিনিই তো "মহাস্রষ্টা মহাজ্ঞানী"।

৮৭। এবং আমি তোমাকে দান করেছি পুনঃ পুনঃ আবৃত্তিকারী সাতটি (আয়াত) এবং মহান কুরআন। ২০০৮

২০০৮ : "সাত আয়াত যা পুনঃ পুনঃ আবৃত হয়"- এই সাত আয়াত হচ্ছে সূরা ফাতেহা। সূরা ফাতেহাকে বলা হয় সমগ্র কোরাণের সার-সংক্ষেপ। সূরা ফাতেহা অথবা কোরাণ থেকে বেশী মূল্যবান উপহার আর কি হতে পারে একজন মোমেন মুসলমানের জন্য? ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, সম্মান সবই পার্থিব। এসব আত্মাকে বিকশিত করতে সাহায্য করে না। বরং এসব পার্থিব ভোগ-বিলাস আত্মাকে সম্ভোগের রাস্তায় বিপথে পরিচালিত করে এবং ফলে আত্মার পবিত্রতা নষ্ট হয়। পরিণতিতে আত্মার বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অপরপক্ষে সূরা ফাতেহা ও সমগ্র কোরাণ মানব সন্তানকে সেই পথ প্রদর্শন করে যে পথে আছে আত্মার মুক্তি, পার্থিব জীবনের ক্লেদাক্ত পরিবেশ থেকে। সুতরাং পার্থিব ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সম্মান, ক্ষমতা সবই আত্মার মুক্তির কাছে অতি নগন্য সম্পদ। আর সেই মুক্তির বারতাই বহন করে আনে সূরা ফাতেহার সাতটি অমূল্য আয়াত।

৮৮। এক শ্রেণীকে আমি যা দান করেছি তার দিকে (সতৃষ্ণ) নয়নে তাকিয়ে থেকে তোমার চক্ষুদ্বয়কে কষ্ট দিও না (২০০৯) বা (তাদের জন্য) দুঃখ করো না ২০১০। তুমি বিশ্বাসীদের জন্য তোমার পক্ষপুট (কোমলভাবে) অবনমিত কর। ২০১১

২০০৯ : যারা জীবনকে শুধুমাত্র পার্থিব ভোগ-বিলাসের বস্তু হিসেবে কল্পনা করে, তারা সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা সম্মান প্রভৃতিকে জীবনের চরম ও পরম পাওয়া বলে পরিগণিত করে। সে কারণেই এসব লোকেরা, যারা পার্থিব সম্পদে ধন্য তাদের হিংসা করে থাকে। জীবনের চরম ও পরম পাওয়া যদি হয় সুখ ও শান্তি, তবে চিন্তা করে দেখা দরকার, যারা প্রভুত অর্থ সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি-র অধিকারী তারা কি তাদের পার্থিব চাওয়া পাওয়ার দ্বারা জীবনের সুখের ঠিকানা, শান্তির দরজার চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছে ? শান্তি ও সুখের আলয় হচ্ছে মন বা আত্মা। মন আপনার সুখ আপনি সৃষ্টি করতে সক্ষম। যদি কেউ মনে করে পার্থিব বস্তু মনের সুখ সৃষ্টি করতে সক্ষম তবে তা হবে মূর্খতার সামিল। কারণ পার্থিব বস্তু যে সুখের সন্ধান দেয় তা খুবই ক্ষণস্থায়ী, কারণ পার্থিব বস্তু থেকে যে সুখের উদ্ভব হয় তা আত্মাকে করে বিষাক্ত, তার প্রভাবে আত্মার বিকশিত হওয়ার পথ হয়ে পড়ে রুদ্ধ। অবরুদ্ধ আত্মা মুক্তির পথ খুঁজে ফেরে, ফলে আত্মার মাঝে যন্ত্রণার উদ্ভব ঘটে। ফলে পার্থিব বস্তু যখন সুখ সৃষ্টির প্রয়াস করে তখন জীবন থেকে শান্তির চাবিকাঠি হারিয়ে যায়। সকল শান্তির উৎস এক আল্লাহ। একমাত্র তারই করুণার স্পর্শে আত্মা হয় সমৃদ্ধ, পার্থিব আকাঙ্ক্ষা মুক্ত, খুঁজে পায় লোভ-লালসা মুক্ত অপার শান্তির আলয়ের ঠিকানা। সুতরাং মোমেন ব্যক্তি কখনও ভোগ-বিলাসের উপকরণের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবে না, তার পার্থিত বস্তু হবে আল্লাহর করুণা ও সান্নিধ্য লাভ।

উপদেশ : হিংসা না করা হচ্ছে মোমেন বান্দার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

২০১০ : ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর জীবনে, মরণশীল মানুষ নশ্বর পার্থিব বস্তু লাভে অহংকারে স্ফীত হয়ে ওঠে এবং আল্লাহর বাণীর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে। এসব দর্শনে আল্লাহর নবীর হৃদয় স্বাভাবিকভাবে এসব অবিমৃস্যকারীদের জন্য ভালোবাসা ও করুণায় আর্দ্র হয়ে ওঠে। কারণ এদের শেষ পরিণতির কথা ভেবে আল্লাহর নবী বিমর্ষ হয়ে যান। এই আয়াতে আল্লাহ নবীকে সম্বোধন করে বললেন যে, নবীর দুঃখিত হওয়ার কারণ নাই। বিশ্ব প্রকৃতি সৃষ্টির সময়েই আল্লাহ তাঁর আইন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চেনা-জানা ভূবনে যেরূপ প্রাকৃতিক আইন বিদ্যামান, অদৃশ্য জগতের অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জগতের জন্যও আল্লাহ সেরূপ তাঁর আইন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে চেনা-অচেনা, দৃশ্য-অদৃশ্য জগতে আল্লাহর আইন নির্ভুলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা ত্রুটিহীন। আল্লাহর আইন লঙ্ঘনের ক্ষমতা কারও নাই- তা প্রতিষ্ঠিত হবেই। সুতরাং নবী যেনো ভোগ-বিলাসীদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য দুঃখ না পায়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কর্মফল ভোগ করবেই। যদিও এই আয়াতে আল-মোস্তফা (সাঃ)-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে এই সম্পূর্ণ আয়াতটির বক্তব্য সকল মোমেন ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য।

২০১১ : "পক্ষপুট" অর্থাৎ পাখীর ডানা। এই উপমাটি আরও একবার ব্যবহার করা হয়েছে আয়াতে (১৭ : ২৪) যেখানে বৃদ্ধ পিতা-মাতার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সন্তানকে বলা হয়েছে। মা পাখী তাঁর সন্তানকে তার ডানার সাহায্যে বাইরের ঝড়-বৃষ্টি, রৌদ্র-বাতাস অর্থাৎ সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে সন্তানকে রক্ষা করে। সেইরূপ ভালোবাসায় উৎকণ্ঠিত ডানা মোমেনদের জন্য ন্যস্ত করতে রসুলকে (সাঃ) বলা হয়েছে।

৮৯। এবং বল "আমি তো কেবল দ্বর্থ্যহীনভাবে প্রকাশ্য সতর্ককারী"। ২০১২

১০১২ : "প্রকাশ্য সতর্ককারী"- অর্থাৎ আল-মুস্তফার (সাঃ) কার্যকাল বা প্রচারে কোনরূপ দ্ব্যর্থক ভাষা বা আপোষ মীমাংসার কণামাত্র ছিলো না। যা মন্দ যা পাপ তাকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ্যভাবে ত্যাগ করতে বলা হয়। "Mubin" শব্দটি ব্যবহার হয়েছে অবাধ, মুক্ত, স্পষ্টভাবে প্রভৃতি ভাবকে বুঝানোর জন্য অর্থাৎ আল-মুস্তফার (সাঃ) প্রচারের মধ্যে কোনরূপ অস্পষ্টতা নাই।

৯০। যেভাবে আমি (ক্রোধকে) প্রেরণ করেছি তাদের উপর যারা বিভক্ত করে (ধর্ম গ্রন্থকে বিভিন্ন অংশে)। ২০১৩

২০১৩ : আয়াত ৯০ এবং ৯১ সম্বন্ধে তফসীরকারদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ৯০ ও ৯১ আয়াতে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে, তারা কি একই দল না দু'দল এ সম্বন্ধে মত পার্থক্য আছে। তারা কারা ? মওলানা ইউসুফ আলী মনে করেন দু'দল আলাদা কিন্তু তাদের মন মানসিকতা একইরূপ, অভিন্ন। মওলানা ইউসুফ আলীর মতে আয়াত ৯০-তে ইহুদী ও খৃষ্টানদের উল্লেখ করা হয়েছে। যারা আল্লাহর বাণীকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী নির্বাচন করতো বা বর্জন করতো। দেখুন আয়াত (২ : ৮৫, ১০১)। আয়াত নং ৯১ এর জন্য দেখুন পরবর্তী টীকা।

৯১। (উপরন্তু) যারা কুর-আনকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে (তাদের ইচ্ছামত)। ২০১৪

২০১৪ : ইসলামের প্রথম যুগে মক্কার মোশরেফেরা কুর-আনকে হাস্যস্পদ ও অসম্মান করার জন্য কুর-আনের বাণীকে, যা সে সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিলো, বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত করতো এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আগত তীর্থ যাত্রীদের নিকট তা উপস্থাপন করতো মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করার জন্য বা বিকৃত করার জন্য।

৯২। সুতরাং শপথ তোমার প্রভুর, অবশ্যই আমি তাদের হিসাব গ্রহণের জন্য ডাকবই,-

৯৩। তাদের সকল কৃতকর্মের জন্য। ২০১৫

২০১৫ : যে বা যারা ঐশি বাণীকে বিকৃত করে হাস্যস্পদ করবে এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাদের সাবধান করে দিয়েছেন যে তাদের অবশ্যই বিচার হবে।

৯৪। সুতরাং তোমাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা তুমি প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং যারা আল্লাহর সাথে মিথ্যা উপাস্য গ্রহণ করে তাদের থেকে ফিরে যাও।

৯৫। তোমার জন্য বিদ্রূপকারীদের বিপক্ষে আমিই যথেষ্ট। ২০১৬

২০১৬ : নবীর জীবন আলোচনা করলে আমরা দেখি তাঁর প্রচারের প্রথমকালে আরবের মুশরেকেরা একতাবদ্ধভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করে। এই আয়াতে আল্লাহ নবীকে বলেছেন যে, সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে আল্লাহর নিরাপত্তা সব কিছুর উর্দ্ধে। হাজার হোক, বিদ্রূপকারীরা হচ্ছে আল্লাহরই সৃষ্ট জীব। সুতরাং শীঘ্রই তাদের মুখোশ উন্মোচিত হবে, তাদের মিথ্যার রূপ সকলের নিকট ধরা পড়বে। আল্লাহর সত্য চির ভাস্বর।

৯৬। যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য গ্রহণ করে; শীঘ্রই তারা জানতে পারবে।

৯৭। আমি অবশ্যই জানি, তাদের বক্তব্য তোমার হৃদয়কে কতটা ব্যথিত করে। ২০১৭

২০১৭ : "অন্তর ব্যথিত করে"- অর্থাৎ অন্তর নিদারুণ বেদনা ভোগ করে। মওলানা ইউসুফ আলী লাইনটির অনুবাদ করেছেন এভাবে, "We do know / How thy heart is distressed / At What they say."

৯৮। সুতরাং তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং যারা ভক্তিতে অবনত হয়, তাদের অন্তর্ভূক্ত হও।

৯৯। এবং তোমার প্রভুর সেবা কর, যতক্ষণ না সুনির্দিষ্ট সেই মুহূর্ত (মৃত্যু) উপস্থিত হয়। ২০১৮

২০১৮ : "Yaqin" এর অর্থ নিশ্চিত বিশ্বাস। এ স্থলে ইহা মৃত্যু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।