Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ০ জন
আজকের পাঠক ৪২ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৫৭৬ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৮৬৯ বার
+ - R Print

সূরা বণী ইসরাঈল


পঞ্চদশ পারা

সূরা বণী ইসরাঈল - ১৭

১১১ আয়াত, ১২ রুকু, মক্কী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে]

ভূমিকা : পূর্ববর্তী সূরার ভূমিকাতে বলা হয়েছে যে, প্রতিটি সূরার শিক্ষা ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে আত্মাকে উন্নতির দিকে পরিচালিত করে। কোরাণ শরীফের প্রথম সাতটি সূরাতে মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার প্রাচীন ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে ধাপে ধাপে। ক্রমান্বয়ে তা কোরাণের শিক্ষা ও হযরত মুহম্মদের (সা) বা আল্লাহ্‌র প্রেরিত দূতের পরিচালনায় পরিচালিত মুসলিম উম্মা বা সম্প্রদায়ের গঠন পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। পরবর্তী শ্রেণীর সূরা হচ্ছে viii-xvi পর্যন্ত। সূরা viii-xvi পর্যন্ত সূরাগুলিতে আলোচনা করা হয়েছে নূতন সম্প্রদায়ের জন্য মনোনীত সামাজিক নিয়ম-কানুন, যাতে প্রতিটি মানুষ তাদের সামাজিক অবস্থান, সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে। অর্থাৎ সম্প্রদায় বা জাতি হিসেবে পৃথিবীতে চলার ও উন্নতি করার পথ নির্দেশ আছে এই সূরা গুলিতে। [দেখুন সূরা viii, x এবং xvi এর ভূমিকা ]।

ধর্মীয় ইতিহাসে নূতন সম্প্রদায়ের গঠন ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্য করণীয় নির্দেশনার পরে এবারে শুরু হচ্ছে নূতন সূরার ক্রমপঞ্জিতে সূরা xvii-xxi পর্যন্ত। সম্পূর্ণ ক্রমপঞ্জিকে আবার তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। বিভক্তিগুলি নিম্নরূপ xvii-xxi পর্যন্ত; xxii-xxv পর্যন্ত এবং xxvi-xxix পর্যন্ত। ক্রমপঞ্জির প্রথম সূরা [xvii] শুরু হয়েছে "ইস্‌রা" শব্দটি দ্বারা। [আয়াতে উল্লেখিত মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্‌সা পর্যন্ত সফরকে "ইস্‌রা " বলা হয় এবং সেখান থেকে আসমান পর্যন্ত যে সফর হয়েছে তার নাম মে'রাজ।]
এই ক্রমপঞ্জির সূরা গুলিতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, কিভাবে প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব কর্মের দ্বারা, চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারে। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাচীন নবী রসুলদের কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ব্যক্তির নিজস্ব ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশের উপরে। সূরা xxii-xxv গুলিতে উল্লেখ করা হয়েছে ব্যক্তিগত এবাদতের যেমন: হজ্ব, সালাত ও প্রার্থনা , কৌমার্য, গোপনীয়তা প্রভৃতি ব্যক্তিগত এবাদত যা মানুষের আত্মিক উন্নতির সোপান স্বরূপ। সূরা xxvi-xxix গুলিতে পুণরায় প্রাচীন পয়গম্বরদের উল্লেখ আছে। এবারের প্রেক্ষাপট পূর্বের প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা, এবারের প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সামাজিক প্রেক্ষাপটে আত্মিক উন্নতির জন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও এবং মহান ব্যক্তিত্বের প্রেক্ষাপটে সামাজিক উন্নতির উপরে।

উপরের ভূমিকার প্রেক্ষাপটে আমরা সূরা xvii কে বিবেচনা করবো। এই সূরা শুরু হয়েছে মেরাজের উল্লেখের মাধ্যমে। এই রজনীতে রসুলকে (সা) মসজিদুল হারাম (মক্কা) থেকে মসজিদুল আক্‌সা (জেরুজালেম ) পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে তাঁকে আল্লাহ্‌র কিছু নিদর্শন দেখানো হয়। অধিকাংশ তফসীরকারের মতে তিনি সশরীরে আল্লাহ্‌র আরস পর্যন্ত আরোহণ করেন। হাদীস সংগ্রহে মেরাজ সম্বন্ধে বিশদভাবে বিবৃত করা হয়েছে যা পাঠে মেরাজের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। পবিত্র নবীকে (সা) প্রথমে, আল্লাহ্‌র প্রেরিত প্রত্যাদেশ সমূহের আদিভূমি জেরুজালেম নেয়া হয়, তার পরে তাঁকে সপ্ত আসমান ভ্রমণ শেষে আল্লাহ্‌র সিংহাসনে নীত করা হয়।

মেরাজের অভূতপূর্ব কাহিনী হচ্ছে ধর্মীয় জগতে মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার পরিক্রমার প্রতীক স্বরূপ। মেরাজের পটভূমিতে বর্ণনা করা হয়েছে পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান সমূহ। আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রথম ধাপই হচ্ছে নৈতিক চরিত্রের উন্নতি। সততা ও সুষ্ঠরূপে নিজ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নৈতিক চরিত্রের পাঠ। সন্তান ও পিতামাতার পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য , সঙ্গী-সাথীদের প্রতি দয়া ও সহানুভুতি প্রদর্শন , বিপদে সাহস ও দৃঢ় মনোবল থাকা, ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব স্বীকার করা , নামাজ বা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করা এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌র উপস্থিতি নিজ সত্ত্বার ভিতরে অনুভব করা ইত্যাদি হচ্ছে নৈতিক চরিত্রের উন্নতির প্রথম পাঠ।

সাধারণ ভাবে বলা হয় ,রজব মাসের ২৭ তারিখ রাত্রি ছিলো মেরাজের রাত্রি , যদিও ভিন্ন মত হচ্ছে রাবি মাসের ১৭ তারিখ রাত্রি। সনটি ছিলো হিজরতের পূর্বের বছর। এখান থেকেই সুরার প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময়কাল নির্ণয় করা যায়। যদিও এই সূরার কিছু কিছু অংশ এই সময় কালের পূর্বে অবতীর্ণ হয়।

সারসংক্ষেপ : নবীকে (সা) মেরাজের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা দান করা হয়, যেনো মানুষ -আল্লাহ্‌র নিদর্শন উপলব্ধি করতে পারে, এবং স্বচ্ছ ধারণা জন্মে। মানুষ মন্দ দ্বারা বিপথে চালিত হয়। মানুষের সব কাজ ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব দ্বারা পরিচালিত হবে [ ১৭: ১-২২]

আল্লাহ্‌র সেবা নিহিত আছে সামাজিক সম্পর্কের মাঝে যথাঃ পিতামাতার প্রতি দয়া ও ভালোবাসা, জ্ঞাতিদের প্রতি এবং অভাবী অনাত্মীয়ের প্রতি দয়া ও সহানুভুতি প্রদর্শন, সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালন, যৌন জীবন কে পবিত্র রাখা, মানুষের জীবনকে ন্যায় ও সম্মানের ভিত্তিতে বিচার করা, এতিমদের রক্ষা করা, যে কোন লেন-দেনে ন্যায়কে সম্মুন্নত রাখা, অহংকার ও উদ্ধত স্বভাবকে পরিহার করা। [১৭:২৩-৪০]

আল্লাহ্‌র মহিমা অতুলনীয়। যারা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে জীবনে গ্রহণ করেছে , তারা অবিশ্বাসীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যারা বিশ্বাসী তারা মতদ্বৈত পরিহার করবে এবং মানুষকে সদুপদেশ দেবে। আল্লাহ্‌ সকল কিছুকে পরিবৃত করে আছেন। [১৭: ৪১ - ৫০]

অহংকার প্রদর্শনের ফলে ইবলিসের পতন ঘটে। কিন্তু আদম সন্তানকে আল্লাহ্‌ সৃষ্টির সেরা জীবরূপে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে আল্লাহ্‌ তার কৃত কাজের দ্বারা বিচার করবেন। নির্দ্দিষ্ট সময়ে এবং রাত্রিতে প্রার্থনা করা বা নামাজ পড়া মঙ্গলজনক। কোরাণকে অবতীর্ণ করা হয়েছে আত্মিক মুক্তি ও করুণার স্বাক্ষর হিসেবে। [১৭:৫১ - ৮৪ ]

[কোরাণের ] প্রত্যাদেশ আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণা। কোন দোষত্রুটির অনুসন্ধান না করে মানুষ এর বার্তা সর্বান্তকরণে গ্রহণ করবে। আল্লাহ্‌র নিকট বিনয়ী হও প্রার্থনা (নামাজ) ও প্রশংসার মাধ্যমে। [ ১৭: ৮৫- ১১১]

সূরা বণী ইসরাঈল- ১৭

১১১ আয়াত, ১২ রুকু, মক্কী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে]

০১। মহিমান্বিত [আল্লাহ্‌ ], যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন, ২১৬৬ পবিত্র মস্‌জিদ [আল্‌ মসজিদুল হারাম] ২১৬৭ থেকে দূরবর্তী মসজিদ [ আল্‌ মসজিদুল আক্‌সা] পর্যন্ত ২১৬৮। যার সীমানাকে আমি করেছিলাম আমার আর্শীবাদ ধন্য, যেনো আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই একমাত্র যিনি [সব] শোনেন এবং দেখেন, ২১৬৯।

২১৬৬। "ইস্‌রা" সম্বন্ধে ভূমিকাতে বলা হয়েছে।

২১৬৭। "Masjid" যেখানে আল্লাহ্‌র এবাদত করা হয়। ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে "Sacred Mosque" যার বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে পবিত্র মসজিদ। এই আয়াতে মসজিদুল হারাম মক্কার কাবা শরীফকে নির্দেশ করেছে। এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হয় তখনও কাবা শরীফে পৌত্তলিক মূর্তির অপসারণ ঘটে নাই। এই আয়াত শুভ সংবাদের প্রতীক স্বরূপ যে ভবিষ্যতে কাবা হবে শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র এবাদতের স্থান।

২১৬৮। "মসজিদুল আক্‌সা" জেরুজালেমে অবস্থিত যা বায়তুল মাক্‌দিস [আল্‌ - কুদ্‌স] নামেও পরিচিত। মসজিদুল আক্‌সার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই মসজিদ ইহুদী ও খৃষ্টান সকলের নিকট সমভাবে পবিত্র। রসুলের (সা) সময়ে এই মসজিদ খৃষ্টানদের অধিকারে ছিলো, কারণ সে সময়ে তা বাইজেন্টাইন [রোমান] সম্রাজ্যের অন্ত‌‌ভূর্ক্ত ছিলো। আর রোমানরা জেরুজালেমের খৃষ্টানদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। আল্‌-আক্‌সা মসজিদের ইতিহাস নিম্নরূপ খৃষ্টপূর্ব ১০০৪ শতাব্দীতে হযরত সোলায়মান সর্ব প্রথম এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এর অবস্থান সম্পর্কে বলা হয় তা ছিলো জেরুজালেমের মরিয়া পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। খৃষ্টপূর্ব ৫৮৬ শতাব্দীতে বেবিলনের রাজা নেবুচান্দনেজার জেরুজালেম আক্রমণ করে, এবং মসজিদটিকে ধ্বংস করে দেয়। খৃষ্টপূর্ব ৫১৫ শতাব্দীতে ইজরা ও নেহেমিয়া মসজিদটির পুনঃনির্মাণ করেন। খৃষ্টপূর্ব ১৬৭ শতাব্দীতে আলেকজান্ডারের একজন উত্তরাধীকারী এন্টীওকাস এপিফেন [Antiochus Epiphaneo] একে মূর্তিপূজার স্থানে পরিণত করে। হেরোড [Herod] [খৃষ্ট পূর্ব ১৭ শতাব্দী - ২৯ খৃষ্টাব্দ] পরবর্তীতে তার সংস্কার করেন। ৭০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট টিটাস মসজিদটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। এর পর থেকে মসজিদটি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো , হযরত ওমরের (রা) আমল পর্যন্ত। তিনি এটি পুনঃ নির্মাণ করেন। এ সব উত্থান পতন আল্লাহ্‌র বিশেষ নিদর্শনকেই বহন করে। কারণ যুগে যুগে যখনই পবিত্র স্থানের দোহাই দিয়ে মানুষ পাপাচারে লিপ্ত হয় তখনই ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠে। এই -ই আল্লাহ্‌র হুকুম। কোনও পবিত্র স্থানই তা রদ্‌ করতে পারে না।

২১৬৯। আল্লাহ্‌র জ্ঞান সকল সৃষ্টিকে বেষ্টন করে আছে। সময় বা কাল আল্লাহ্‌র জন্য কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি সকল কিছু দেখেন। সকল কিছু শোনেন, - সময়, কাল, যুগ, সকল কিছুর তিনি উর্দ্ধে। মেরা'জ হচ্ছে আল্লাহ্‌র জ্ঞানেরই প্রতিচ্ছবি।

০২। আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম ২১৭০ ও উহাকে বণী ইসরাঈলীদের জন্য পথ নির্দ্দেশক করেছিলাম; [আদেশ দিয়েছিলাম] - " তোমরা আমাকে ব্যতীত অপর কাউকে [তোমাদের ] কর্ম-বিধায়ক হিসেবে গ্রহণ করো না।" ২১৭১

২১৭০। 'কিতাব' - অর্থাৎ আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্‌ মুসাকে যে কিতাব দিয়েছেন তাতে পরিষ্কার ভাবে আল্লাহ্‌র একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে বলা হয়েছে। "Thou shall have no other gods before me; thou shall not make into thee any graven image " thou shall not bow down thyself to them nor serve them; for I the Lord thy God am a jealous God.." [ Exod. xx 3- 5 ] এই লাইনগুলি বাইবেল থেকে উদ্ধৃত। "তোমরা আমাকে ব্যতীত অপর কাহাকেও কর্ম বিধায়করূপে গ্রহণ করো না " -এই নির্দ্দেশ প্রচারের মূল বক্তব্য হচ্ছে এক আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং জীবনের প্রতিটি পদে, প্রতিটি কর্মে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। 'কর্মবিধায়ক' অর্থাৎ কর্মের বিধান - যা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে আল্লাহ্‌র মনোনীত পন্থায় হতে হবে। আর এই শিক্ষাই হচ্ছে ইসলামের মূল শিক্ষা। মে'রাজের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের দেখিয়েছেন যে প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কিতাবধারী জাতিদের কাছে প্রেরিত "পথ নির্দ্দেশ" রয়েছে অপরিবর্তনীয়। কিন্তু যুগে যুগে যারা ধর্মের রক্ষকরূপে নিজেদের প্রচার করেছে তারাই ধর্মের মূল শিক্ষাকে পরিবর্তন করেছে।

উপদেশঃ মুসলমানদের মধ্যে ভেদাভেদের কারণও এই আয়াতের বক্তব্যের মধ্যে নিহিত।

০৩। হে তাদের বংশধরেরা ! যাদের আমি নূহ্‌ এর সাথে [নৌকাতে] বহন করেছিলাম ২১৭২। সে তো ছিলো পরম কৃতজ্ঞ বান্দা।

২১৭২। নূহ্‌ এর সময়ের মহাপ্লাবনের ফলে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যায়। শুধুমাত্র তারাই রক্ষা পায় যারা নূহ্‌ এর নৌকায় আশ্রয় পেয়েছিলো। যারা সেই প্রলয়ঙ্কর বন্যার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেলো , তাদের বংশধরদের উচিত ছিলো সর্বান্তকরণে আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কিন্তু তা না করে সময়ের আবর্তনে তাদের বংশধরেরা মূর্তিপূজা , পাপ ও অন্যান্য ঘৃণ্য কাজে পুনরায় লিপ্ত হয়ে যায়। তাদেরকেই এই আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে নূহ এর সাথে একই নৌকাতে আরোহণকারীদের বংশধরদের অযোগ্যতাকে। বিশেষভাবে বলা হয়েছে ইসরাঈলীদের সম্পর্কে।

০৪। আমি কিতাবে বণী ইসরাঈলীদের [সুস্পষ্ট] সাবধান বাণী দিয়েছিলাম ২১৭৩, যে, পৃথিবীতে তারা দুইবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং অতিরিক্ত অহংকারে স্ফীত হবে [এবং দুবার তাদের শাস্তি দেয়া হবে]। ২১৭৪

২১৭৩। " কিতাবের প্রত্যাদেশ" অর্থাৎ হযরত মুসাকে আল্লাহ্‌ যে কিতাব দিয়েছিলেন , তারই নির্দ্দেশের কথা এখানে বলা হয়েছে।

২১৭৪। ইহুদীদের সম্বন্ধে যে দুইবার বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে তা কি ছিলো ? দুইবার মানে এই হতে পারে যে বারে বারে বা একের অধিক বারে। অথবা 'দুইবার' দুইটি বিশেষ ঘটনাকে নির্দ্দেশ করছে। (১) হযরত সোলায়মান নির্মিত মসজিদ খৃষ্টপূর্ব ৫৮৬ বেবীলনের সম্রাট নেবুচাঁদনেজার [Nebnchadnezzar] ধবংস করে দেন এবং ইহুদীদের বন্দী করে নিজ রাজ্যে নিয়ে যান। (২) দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে খৃষ্টপূর্ব ৭০ অব্দে সম্রাট তিতাস [ Titas] মসজিদটি পূণরায় ধ্বংস করে, ইহুদীদের নির্বিচারে হত্যা করে ও তাদের ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত করে। প্রথমবারের ধ্বংসের পরে তওবা করলে তাদের পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। দ্বিতীয়বার ধ্বংসের পরে মসজিদটি আর ইহুদীদের দ্বারা নির্মিত হয় নাই। দেখুন উপরের টিকা নং ২১৬৮। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইহুদীদের পাপের দরুণ তারা আল্লাহ্‌র তরফ থেকে শাস্তি পেয়েছিলো , তাদের পাপ ছিলো , উদ্ধত অহংকারে সৎ পথকে পরিত্যাগ করা।

উপদেশঃ প্রতিটি জাতির পতনের একমাত্র কারণ অহংকারে স্ফীত হয়ে সৎ পথ ত্যাগ করা।

০৫। যখন দুটোর মধ্য প্রথম সাবধান বাণীর সময়কাল উপস্থিত হলো, আমি তোমাদের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধবাজ বান্দাদের প্রেরণ করলাম ২১৭৫। তারা তোমাদের প্রতিটি গৃহকোণে প্রবেশ করে এবং এভাবেই সাবধান বাণী [সম্পূর্ণরূপে] কার্যকর হয়েছিলো।

২১৭৫। অল্প কয়েকটি কথায় নেঁবুচাদনেজারের অধীনে বেবীলনীয়ানদের দ্বারা ইহুদীদের উপরে আক্রমণের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। যদিও বেবীলনীয়ানরা এক আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিলো না , তবুও এই আয়াতে আল্লাহ্‌ তাদের " আমার বান্দারূপে " বর্ণনা করেছেন। পৃথিবীতে মানুষের পাপের শাস্তি আল্লাহ্‌ দিয়ে থাকেন অন্য মানুষের মাধ্যমে। অবশ্য কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমেও তা ঘটে থাকে, এক্ষেত্রে বেবীলনের অধিপতি নেঁবুচাঁদনেজার ছিলেন সেইরূপ আল্লাহ্‌র এক শক্তিশালী অস্ত্র, বিদ্রোহী ও পাপী ইহুদীদের শায়েস্তা করার জন্য। কারণ নেঁবুচাঁদনেজারের বীরত্ব,বা দক্ষতা বা রণকৌশলের প্রতিভা ইত্যাদি তাঁর চরিত্রের বিভিন্ন গুণাবলী সবই জন্মলগ্নে তিনি লাভ করেন আল্লাহ্‌র নিকট থেকে, কারণ জন্মের উপরে মানুষের কোনও হাত নাই। আল্লাহ্‌ প্রদত্ত গুণাবলীর প্রকাশ মানুষ ঘটায় নিজ পরিশ্রম ও অনুশীলন দ্বারা। নেবুঁচাঁদনেজারও তাঁর যোদ্ধা হিসেবে, নৃপতি হিসেবে যে সব গুণাবলী তা লাভ করেন তাঁর জন্মলগ্নে, মাতৃগর্ভে, আল্লাহ্‌র নিকট থেকে। নেঁবুচাঁদনেজার এখানে আল্লাহ্‌র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন, যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ ইহুদীদের শাস্তি দান করে, বেবীলনীয়েরা ইহুদীদের জনপদে প্রবেশ করে, তাঁদের মসজিদ ধ্বংস করে, তাদের ঘর-বাড়ী বিধ্বস্ত করে এবং ইহুদীদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে বন্দী করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। এ সম্পর্কে বিবরণ আছে বাইবেলে [Isaiah iii 16-26]

০৬। অতঃপর আমি তোমাদের পুণরায় তাদের উপরে প্রতিষ্ঠা করলাম ২১৭৬। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করলাম এবং জন শক্তিতে সংখ্যা গরিষ্ঠ করলাম।

২১৭৬। ইহুদীরা বেবীলনীয়দের বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পায় খৃষ্টপূর্ব ৫২০ শতাব্দীতে তাঁরা তাদের পাপের জন্য তওবা করে এবং নূতন করে জীবন শুরু করে। তারা পুনরায় তাদের মসজিদ নির্মাণ করেন এবং ইজরার [Ezra] অধীনে তাঁরা নূতনভাবে সংগঠিত হয় এবং নূতন ইহুদীতত্ব [Judaism] প্রচলিত করে। সে সময়ে তারা আবার সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে। ইতিমধ্যে তাদের পূর্ববর্তী অত্যাচারী,পীড়নকারী বেবীলনীয়রা পারস্য সম্রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে পারস্য সাম্রাজ্য আলেকজান্ডার জয় করেন। এর ফলে সমস্ত পশ্চিম এশিয়া গ্রীক সভ্যতার আওতায় চলে আসে। ফলে ইহুদীদের নূতন স্কুল গ্রীক সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়, এবং আলেকজান্দ্রিয়া তাদের শক্ত ঘাঁটি রূপে পরিগণিত হয়। প্যালেস্টাইনে তারা তাদের অবস্থান রাখতে সক্ষম হয়, এবং আসমনিয়ান রাজত্বকালে [Asmonaean Dynasty] [খৃষ্টপূর্ব ১৬৭ - ৬৩ পর্যন্ত] তাদের পুণঃজাগরণ ঘটে। এর পরে খৃষ্টপূর্ব ৬৩-৪ পর্যন্ত ইডুমিয়ানস [Idumaeans Dynasty] রাজত্বকালে ইহুদীরা আংশিক স্বাধীনতা ভোগ করে। কারণ খৃষ্টপূর্ব ৬৫ শতাব্দীতে সিরিয়া [প্যালেস্টাইন সহ] রোমানদের অধীনে চলে যায়। এবং একজন ইহুদী রাজা তাদের অধীনে রাজদন্ড গ্রহণ করেন। কিন্তু ইহুদীরা পুনরায় তাদের উদ্ধত অহংকার প্রদর্শন করে থাকে। কারণ ইতিমধ্যে আল্লাহ্‌র নবী হযরত ঈসার আগমন ঘটে, এবং ইহুদীরা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের প্রতি বাধার সৃষ্টি করে। ফলে তাদের পাপের পাত্র পূর্ণ হয়, এবং ৭০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট তিতাস শহর ও মসজিদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।

০৭। যদি তোমরা ভালো কাজ কর তবে ভালো কাজ নিজেদের [মঙ্গলের] জন্য করে থাক, যদি তোমরা মন্দ কাজ কর, [তোমরা তা কর] তোমাদের নিজের বিরুদ্ধে ২১৭৭। সুতারাং যখন দ্বিতীয় সাবধান বাণীর [সময়] এসেছিলো, [আমি তোমাদের শত্রুদের অনুমতি দিয়েছিলাম] তোমাদের মুখমন্ডল বিকৃত করার জন্য ২১৭৮, তোমাদের এবাদত গৃহে প্রবেশের জন্য , ২১৭৯ যেরূপ তারা পূর্বে করেছিলো। এবং যা কিছু তাদের অধিকারে এসেছিলো সব সম্পূর্ণ ভাবে ধবংস করার জন্য। ২১৮০

২১৭৭। আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করার জন্য যে সৎকাজ করে, সে নিজের আত্মার উপকারে জন্যই করে। কারণ যে আল্লাহ্‌র আইন মানে সে তার নিজেরই জন্য তা করে। এ কথা যেনো কেউ না ভাবে যে সে সৎকাজ দ্বারা অন্যের উপকার করছে। সৎকাজের যা প্রতিদান সে তো তা লাভ করবে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে -সুতারাং তা হচ্ছে ব্যক্তির বিরাট লাভ। অপর পক্ষে মন্দ কাজের পরিণাম ব্যক্তির নিজস্ব দায়-দায়িত্ব। সে তার কৃত কর্মের ফল উপভোগ করবে।

২১৭৮। ইহুদীদের দ্বিতীয় শাস্তি নেমে আসে হযরত ঈসার প্রতি প্রেরিত আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে মেনে নিতে অস্বীকার করার ফলে। "মুখমন্ডল বিকৃত করিবার জন্য "। এই লাইনটির অর্থ তাদের সাফল্য ও ক্ষমতাকে খর্ব করিবার জন্য। 'মুখমন্ডল' শব্দটি দ্বারা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করা হয়। বাংলা বাগ্‌ধারাতে "মুখ" কথাটি ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
২১৭৯। ৭০ খৃষ্টাব্দে তিতাস জেরুজালেম ধ্বংস করেন। তিতাস ছিলেন রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ানের [ Vespasian] পুত্র। তিনি যখন জেরুজালেম ধ্বংস করেন তখন তার উপাধি ছিলো " সিজার" বা "সিংহাসনের উত্তরাধিকারী" তিনি রোমান সম্রাজ্য ৭৯ খৃষ্টাব্দ থেকে ৮১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন।

উপদেশঃ বণী ইসরাঈলদের এসব ঘটনা কোরাণে বর্ণনা করা এবং মুসলমানদের শোনানোর উদ্দেশ্য এই যে, মুসলমানদের জন্যও আল্লাহ্‌র হুকুম আলাদা নয়। তাদেরও ধর্মীয় ও পার্থিব সম্পদ, শান-শওকত, অর্থ-সম্পদ আল্লাহ্‌র আনুগত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন তারা আল্লাহ্‌ ও রসুলের আনুগত্য থেকে বিমুখ হয়ে যাবে, তখন তাদের শত্রু ও কাফেরদের তাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া হবে। মুসলমানেরা যখন পথভ্রষ্টতা ও গোনাহে লিপ্ত হবে, তখন শাস্তি হিসেবে তাদের উপসনালয় ও মসজিদ সমূহের অবমাননা করা হবে।

২১৮০। "Romans Under the Empire" গ্রন্থের লেখক ঐতিহাসিক Merivale তাঁর গ্রন্থে রোমানদের, ইহুদীদের আক্রমণ এবং নিধনের নিঁখুত বর্ণনা দিয়েছেন এই গ্রন্থে [দেখুন ১৮৯০ সংস্করণের vii. 221-25] সে সময়ে জেরুজালেমের লোকসংখ্যা ছিলো ২০০,০০০। আবার ল্যাটিন ঐতিহাসিক Tacitus এর মত অনুযায়ী এ সংখ্যা ছিলো আরও বেশী প্রায় ৬০০,০০০। ইহুদীদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয় যে, তাদের দলে দলে নির্বিচারে হত্যা করা হয়, উপরন্তু সে সময়ে দেশে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছিলো। যারা হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায় তারা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে প্রাণ হারায়। Merivale এর মতে "They [Jew] were judicially abandoned to their own passions and the punishment which naturally awaited them" [vii. Page- 221]

০৮। ইহা এ জন্য যে, সম্ভবতঃ তোমাদের প্রভু তোমাদের দয়া করবেন ২১৮১। কিন্তু তোমরা যদি [ তোমাদের পাপের ] পুনরাবৃত্তি কর, তবে আমিও [আমার শাস্তি দানের ] পুনরাবৃত্তি করবো। এবং যারা [ঈমানকে] প্রত্যাখ্যান করবে তাদের জন্য প্রস্তুত করেছি জাহান্নামের কারাগার। ২১৮২

২১৮১। এই আয়াতে রসুলের (সা) সময়কার ইহুদীদের সম্বোধন করা হয়েছে। তাদের পূর্ববর্তী পাপ যাই -ই থাকুক না কেন তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে না, যদি তারা সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদের (সা) নিকট প্রেরিত আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে অবাধ্য ও একগুয়ে ভাবে মেনে নিতে অস্বীকার না করে, যদি তারা তাদের পাপে লিপ্ত থাকে, আল্লাহ্‌র শাস্তি পুণরায় তাদের উপরে নেমে আসবে।

মন্তব্যঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানদের দ্বারা ইহুদী নিধন হয়তো বা আল্লাহ্‌রই দেয়া শাস্তি ইহুদীদের উপরে। অন্যথায় পৃথিবীতে এত হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে পারে না।

২১৮২। যাদের আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস নাই তাদের ইহজগতে অপমান লাঞ্ছনা প্রাপ্য হবে এবং পরকালে তাদের জন্য রয়েছে অশেষ শাস্তি - যে অবস্থা চলতে থাকবে অনাদি অনন্ত কাল ব্যপী। যার থেকে আর কখনও মুক্তি নাই। ইহুদীদের উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ বিশ্ববাসীকে সাবধান করেছেন - সর্বকাল সর্ব যুগের জন্য।

০৯। অবশ্যই এই কুর-আন পথনির্দেশ করে সেই দিকে, যে পথ সবচেয়ে সঠিক [ও সুদৃঢ়] ২১৮৩। এবং যে সব পূণ্যাত্মা সৎ কাজ করে তাদের সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরষ্কার।

২১৮৩। ইহুদীদের অসৎ কর্ম ও মানসিক অবস্থার বর্ণনা পূর্ববর্তী আয়াত সমূহে করা হয়েছে। এই আয়াতে তাদের পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলে দেয়া হয়েছে। কোরাণের পথ নির্দেশ পৃথিবীর সকল দেশের সকল সম্প্রদায়ের জন্য। যাদের এক আল্লাহ্‌র প্রতি অটল বিশ্বাস আছে এবং যারা সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায় তাদের চরিত্রে আল্লাহ্‌র হুকুম বা বিধান মানার মাধ্যমে, তারা তাদের সৎকর্মের সুপরিণতি ভোগ করবে। আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির মাধ্যমে তাদের আল্লাহ্‌ পুরষ্কৃত করবেন। আল্লাহ্‌র হেদায়েতই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র হেদায়েতকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তারা আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। পূর্বের পাপ, বা পূর্বপুরুষের গৌরবান্বিত ইতিহাস, কিছুই ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। সুতারাং কোরাণের বাণী বা হেদায়েত সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদের জন্য যেমন সুসংবাদ বহন করে আনে, সেইরূপ পাপী বা যারা মন্দ কার্যে লিপ্ত তাদের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ বহন করে আনে।

মন্তব্যঃ অনেকেই জাগতিক বিষয়বস্তুর মাপকাঠিতে - ইহকালের সম্পদ, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতাকে পৃথিবীর সুখ স্বাচ্ছন্দের মাপকাঠি ও আল্লাহ্‌র পুরষ্কার হিসেবে গণ্য করে। সেই মাপকাঠিতে পাপীরা , যারা সততা বা সৎকার্যের বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না তারা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে। কিন্তু গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, পৃথিবীতে আমাদের সর্বোচ্চ কাম্য বিষয়বস্তু হচ্ছে সুখ ও শান্তি। পাপীদের আত্মায় কখনও অনাবিল শান্তি ও স্থিরতা বিরাজ করবে না। অস্থিরতা, ভয় , উদ্বেগ, আশঙ্কা হবে তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। অপর পক্ষে মোমেন বান্দা, যারা সর্বদা মানুষের মঙ্গলের জন্য, সৃষ্টির সেবার জন্য সৎকাজ করে, আল্লাহ্‌র হেদায়েত মেনে চলে তাঁদের জন্য আছে মহা পুরষ্কার আল্লাহ্‌র তরফ থেকে ইহকালে ও পরকালে। সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তির অন্তরে যে মহাশান্তি বিরাজ করে তা বেহেশতি শান্তিরই নমুনা।

১০। এবং যারা পরলোকের [জীবনে] বিশ্বাস করে না, [এর দ্বারা ঘোষনা করা হয় যে], তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি ভয়াবহ শাস্তি।

রুকু -২

১১। মানুষের যেভাবে কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করা উচিত, [মানুষ] সে ভাবে মন্দের জন্য করে ২১৮৪। মানুষ তো [কর্মে] অতিমাত্রায় ত্বরা প্রিয়।

২১৮৪। স্বভাবগত ভাবে মানুষের দূরদর্শিতা কম। ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বর্তমানের রঙ্গীন ছবিই তার অধিক কাম্য। যার ফলে যা তার জন্য কল্যাণকর নয় তার প্রতিই সে অধিক আসক্ত হয়ে পড়ে। যারা জ্ঞানী ও আল্লাহ্‌র নির্দেশিত পথে চলেন তাঁরা ধৈর্য্যের সাথে আল্লাহ্‌ তাঁর জন্য যে পরিণতি নির্ধারণ করেছেন , আল্লাহ্‌র সেই কল্যাণকর স্বর্গীয় ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং নিজস্ব কামনাকে দূরে সরিয়ে দেয়। জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেরূপ ব্যগ্রভাবে আল্লাহ্‌র রহমত কামনা করে, অজ্ঞ ব্যক্তিরা ঠিক সেরূপভাবে নিজস্ব আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে অকল্যাণ কামনা করে। কারণ দূরদর্শিতার অভাবে তারা বান্দার জন্য কল্যাণকর আল্লাহ্‌র প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের উপরে নির্ভর করতে পারে না। ফলে বৃহত্তর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়ে অকল্যাণের দিকে ধাবিত হয়। কারণ তারা হবে অধৈর্য এবং ত্বরাপ্রিয় যার ফলে সে শুধু বাহ্যিক লাভ-লোকসানের দিকে দৃষ্টি রাখে অথচ অপরিণামদর্শিতায় ভুল করে।

১২। আমি রাত্রি ও দিবসকে [আমার ] দুটি নিদর্শন করেছি ২১৮৫। রাত্রির নিদর্শনকে অন্ধকার করেছি এবং দিবসের নিদর্শনকে তোমাদের নিকট আলোকিত করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের প্রভুর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার ২১৮৬। এবং যেনো তোমরা [দিনের ] সংখ্যা জান এবং বর্ষ হিসাব করতে পার। সকল কিছু আমি বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।

২১৮৫। এই আয়াতটি অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ। অনুরূপ আয়াত দেখুন [৩:২৭] এবং টিকা ৩৭০। বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে, "রাত্রির নিদর্শনকে অন্ধকার করেছি"।

আলোচ্য আয়াতে রাতের অন্ধকার ও দিনের আলোকে আল্লাহ্‌র নিদর্শনরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। রাত্রিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করার তাৎপর্য এখানে বর্ণনা করা হয় নাই, কিন্তু অন্যান্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাত্রির অন্ধকার নিদ্রা ও আরামের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। রাত্রির অন্ধকার ও দিনের উজ্জ্বলের প্রতীকের জন্য দেখুন টিকা ৩৭০।

২১৮৬। সূর্যের আলো আমাদের এই পৃথিবীকে চক্ষুদ্বারা দেখতে সাহায্য করে। শুধু তাই-ই নয় এর দ্বারা আমরা দুভাবে উপকৃত হই। (১) দিনের আলোতে আমরা জীবিকার অন্বেষণে বের হতে পারি। পৃথিবীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্বেষণের জন্য কাজ করতে পারে, যার ফলে সে প্রাকৃতিক শক্তির উপরে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। (২) দিন রাত্রির হিসেবের মাধ্যমে আমরা সময়েরর হিসেব অর্থাৎ বছর ইত্যাদির সম্বন্ধে ধারণা করতে পারি।

১৩। প্রত্যেক মানুষের কর্মের [ফল] আমি তার কণ্ঠলগ্ন করেছি ২১৮৭। শেষ বিচারের দিনে আমি তার জন্য বের করবো এক গুটানো [নির্ঘন্ট] যা সে উন্মুক্ত অবস্থায় দেখবে ২১৮৮।

২১৮৭। ইসলামে কুসংস্কারের স্থান নাই। কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষ বিশ্বাস করে অন্ধ ভাগ্যের উপরে বা দৈব প্রকৃতি বা অশুভ ও শুভ শক্তির উপরে। ইসলাম এরূপ কোনও শক্তি বা দৈবে বিশ্বাসী নয়। মুসলমানকে বিশ্বাস করতে হবে যে তার অদৃষ্টের সৃষ্টিকর্তা সে নিজে। তার কার্যকরণ সম্পর্কই তার ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রিত করবে। ভালো কাজের সুফলও সে ভোগ করবে , মন্দ কাজের অপরিণামদর্শিতাও তাকেই ভোগ করতে হবে। ভালো কাজের পথ নির্দেশ আসে মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে। যে তা প্রত্যাখ্যান করে, সে নিজের শাস্তি নিজেই ডেকে আনে। পাপের ফলে তার আত্মা ধীরে ধীরে পাপের দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। যত সে পাপের পথে যায়, আল্লাহ্‌র হুকুমের বিরুদ্ধে চলে , তত তার আত্মার স্বাধীনতা ব্যহত হয়। তার আত্মার চারিপাশে পাপের বেড়াজাল শক্ত জোয়ালের মত চেপে বসে। পাপের কুৎসিত পরিণতি তাকে কুসংস্কারচ্ছন্ন করে তোলে। বিবেক বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত না হয়ে অশুভ শক্তি, দৈব শক্তি ও অন্ধ ভাগ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভালো ও মন্দকে গ্রহণের জন্য আল্লাহ্‌ তাকে সে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দিয়েছেন তাকে সে সীমিত করে ফেলে। বিবেক ও বিচার বুদ্ধির সাহায্যে ভালো কে গ্রহণ করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে। কোনও ভাগ্য ও দৈব শক্তি নয়। মানুষের কর্মফলই তার ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই আয়াতে এবং আয়াত [৩৬:৮] [৪০:৭১] ও টিকা সমূহে অনুরূপ বর্ণনা আছে। এই কর্মফলকেই শেষ বিচারের দিনের আমলনামা বলা হয়েছে যা তাদের সাথেই থাকবে। গলায় মালার মত বা জোয়ালের মত তা ব্যক্তির সাথে সংযুক্ত থাকবে।

২১৮৮। ইসলাম অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী নয়। আমাদের কাজই হবে আমাদের ভাগ্য ও জবাবদিহিতার বিষয় শেষ বিচারের দিনে। একেই কিতাব বা আমলনামা বা পাকানো কাগজ বলা হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে প্রত্যেকের কর্মের হিসাব, এই আমলনামা প্রত্যেকের সামনে উম্মুক্ত করা হবে। আমরা আমলনামা সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকতে পারি বা রহস্যময় শক্তির বা দৈব শক্তির সাহায্য কামনা করে আমাদের শক্তি ক্ষয় করতে পারি কিন্তু তাতে আমাদের আমলনামার কোনও পরিবর্তন হবে না। মানুষ যে কোন জায়গায় যে কোন অবস্থায় থাকুক, তার কাজের হিসাব তার সাথে থাকে এবং তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হতে থাকে। মৃত্যুর পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।

১৪। [তাকে বলা হবে] তোমার [নিজের ] নথি পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে হিসাব নিকাশের জন্য যথেষ্ট। ২১৮৯

২১৮৯। পৃথিবীতে আমাদের কর্মের ফল আমাদের ভোগ করতে হয়, শেষ বিচারের দিনেও আমাদের পৃথিবীতে কৃত কর্মই হবে আমাদের মূল অভিযোগকারী। আমাদের উচিত আমাদের কল্যাণের জন্য বৃথা কুসংস্কার বা অশুভ শক্তির অন্বেষণ না করে, যা ভালো, যা সৎ তার সন্ধান করা ও সেই অনুযায়ী কর্ম করা।

১৫। যে সৎপথ অবলম্বন করে, সে তা করে তার নিজের কল্যাণের জন্য। যে বিপথে যায় সে তা করে নিজের ক্ষতির জন্য ২১৯০। কেহ কারও ভার বহন করবে না ২১৯১। [সাবধান করার জন্য ] রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি দেই না।

২১৯০। যারা পৃথিবীতে পাপ করে তারা পথভ্রষ্ট। তাদের পথভ্রষ্টতার কারণে তারা তাদের নিজেদের আত্মারই ক্ষতি সাধন করে। ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের কথা পুণরায় ঘোষণা করা হয়েছে এই আয়াতে। কারও পাপের ভার অন্য কেহ বহন করবে না। সৎ পথ যে অবলম্বন করে সে তা করে নিজের আত্মার মঙ্গলের জন্য, যে পাপ করে ও অসৎ পথ অবলম্বন করে সে নিজের ধবংস ডেকে আনে।

২১৯১। এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, প্রত্যেকের কাজের দায়-দায়িত্ব তার নিজের। কেহ কারও ভার বহন করবে না। অন্যান্য ধর্মে যেরূপ যাজক সম্প্রদায় থাকে, যারা সর্বশক্তিমানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে এবং মানুষ ও স্রষ্টার মধ্যে মধ্যবর্তী ব্যক্তি হিসেবে কাজ করে। দেখা যায় এ সব পাদ্রী, পুরোহিত ও যাজকেরা পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিয়ে থাকে। কিন্তু নির্দোষকে শাস্তির মাধ্যমে পাপের মুক্তি ঘটতে পারে না , আত্মার উন্নতি সম্ভব নয়। কারণ একজনের পাপের ভার অন্য কেহ বহন করবে না। তাই যাজকদের মাধ্যমে আত্মার মুক্তি ঘটা সম্ভব নয়। যদি ক্ষমতাবানের পাপের ভার নির্দোষকে বহন করতে হয়, তবে তা হবে অন্যায়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কর্মের ফল ভোগ করবে [৬:১৬৪]। আল্লাহ্‌ তাঁর প্রেরিত নবী রসুলের মাধ্যমে উপযুক্ত ঘোষণা দ্বারা সাবধান না করে কখনও কাউকে শাস্তি দান করেন না।

১৬। আমি যখন কোন সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে চাই, [প্রথমে] আমি যাদের বিত্তশালী করেছি, তাদের ভালো কাজের আদেশ দান করি [পালন করার জন্য] ২১৯২। কিন্তু তারা তা লংঘন করে থাকে। সুতারাং [এরপরে] তাদের বিরুদ্ধে আমার দণ্ডাজ্ঞা ন্যায় সংগত হয়ে যায় ২১৯৩। এবং অতঃপর আমি [তা] সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিই।

২১৯২। আল্লাহ্‌র করুণা ও ক্ষমা পাপীদের অনুতাপ করার জন্য পুণঃপুণঃ সুযোগ দিয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্বেও পাপীরা যখন এ সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে তা প্রত্যাখ্যান করে, তখনই আল্লাহ্‌র শাস্তি বজ্র্রের মতো নেমে আসে। কিন্তু তখনও আল্লাহ্‌র করুণা পাপীদের জন্য কাজ করে থাকে। সমাজে আল্লাহ্‌ যাদের বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেছেন, যেমনঃ অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি বা মেধা-মনন শক্তি, প্রতিভা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি, তাদের উপরে সৎকর্ম করার আদেশ মান্য করার হুকুম থাকে। অর্থাৎ সমাজের সাধারণ ব্যক্তিদের আত্মিক উন্নতির জন্য তাদের পাপের পথ থেকে বিরত রাখার জন্য ,এ সব নেয়ামত প্রাপ্ত বা প্রতিভাধর ব্যক্তিরা কাজ করে যাবেন। অর্থাৎ সমাজের যারা শীর্ষ বিন্দুতে অবস্থান করেন,যারা সমাজ বা জাতিকে পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাদের উপরে থাকে জাতি বা সমাজের সাধারণ ব্যক্তিদের সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব। যদি তারা আল্লাহ্‌র আদেশ মানতে অবাধ্যতা প্রকাশ করে, তবে তাদের আর কোনও আশা নাই, তাহাদের "প্রতি দণ্ডাজ্ঞা ন্যায়-সঙ্গত হয়ে যায়"। আল্লাহ্‌র শাস্তি তাদের উপরে বজ্রের মত নেমে আসবে। এর থেকে তখন কেউই রেহাই পায় না।

উপদেশঃ সমাজে যারা শাসক-শ্রেণীর এবং বিত্তশালী ও যারা আল্লাহ্‌র নেয়ামতে ধন্য, তাদের কর্মের দ্বারা সাধারণ জনসাধারণ প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তাই তাদের চরিত্র ও কর্ম সংশোধনের জন্য এখানে নির্দেশ দান করা হয়েছে। তারা তাদের কর্তব্য ভুলে গেলে সমগ্র জাতি ভ্রান্ত পথে চালিত হবে।

২১৯৩। 'Qaul' এই আরবী শব্দটির অর্থ হুকুম, আইন, নির্দ্দিষ্ট আইনের অধীনে কোন অভিযোগ আনায়ন করা ইত্যাদি।

১৭। নূহ্‌ এর পরে আমি কত মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছি ২১৯৪ তার বান্দাদের পাপাচরণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য তোমার প্রভুই যথেষ্ট। ২১৯৫

২১৯৪। ধর্মীয় ইতিহাসে নূহ্‌ নবীর বন্যা ছিলো নূতনভাবে জীবনকে শুরু করার অঙ্গীকার। সমস্ত পাপীদের ধবংস করে পূণ্যাত্মাদের দ্বারা পৃথিবী গড়ার প্রয়াস। কিন্তু ইতিহাস বলে এর পরেও বহু জাতি পাপের পঙ্কিল আবর্তে তলিয়ে যায়। বহু সম্রাজ্য, নগর, বন্দর, জাতি নিজেদের কৃত পাপের পরিণামে ধবংস হয়ে যায়।

২১৯৫। আল্লাহ্‌ পাপীদের পাপের শাস্তি তৎক্ষণাৎ দেন না। তিনি তাদের সময় ও সুযোগ দান করেন যেনো তারা অনুতাপের মাধ্যমে পাপের পথ ত্যাগ করে ও আল্লাহ্‌র পথে ফিরে আসে। পাপীরা যেনো এ কথা মনে না করে যে, তারা সংগোপনে আল্লাহ্‌র দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কারণ তাদের বিলাস বহুল জীবন, পার্থিব সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তি তাদের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটায় , চেতনাকে ও চিন্তাকে বিপথে চালিত করার ফলে, তারা তাদের অব্যাহতির সময়কালকে আল্লাহ্‌র দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারা বলে বিভ্রান্ত হয়। তিনি কিন্তু সকল কিছুই জানেন। প্রকাশ্য ও গোপন কোনও কিছুই তার কাছে লুক্কায়িত থাকে না। এমন কি তিনি অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকানো মানুষের গোপন চিন্তা-ভাবনার খবরও রাখেন। মানুষ মনে মনে যা ভাবে , তৎক্ষণাৎ তা আল্লাহ্‌র দরবারে নীত হয়। আজকের ই-মেইলের যুগে এ কথা খুবই স্বাভাবিক বলে প্রমাণিত। তাই পাপীর পাপের স্বপক্ষে আল্লাহ্‌র কোনও সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন নাই। আল্লাহ্‌র জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ স্বয়ংসম্পূর্ণ।

১৮। কেউ যদি [পৃথিবীর জীবনের ] ক্ষণস্থায়ী জিনিষ কামনা করে আমি যাকে যা ইচ্ছা এখানেই তৎক্ষণাত তা মঞ্জুর করি ২১৯৬। শেষ পরিণতিতে তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে যায়। সেখানে তারা অসম্মানিত ও প্রত্যাখ্যাত অবস্থায় দগ্ধ হবে। ২১৯৭

২১৯৬। বিশ্ব-সংসারে একটি খুব সাধারণ প্রশ্ন সব সময়ে উত্থাপিত হয়, আর তা হচ্ছেঃ যারা পাপী তারা কেন পার্থিব ধন-ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা -প্রতিপত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে? এই আয়াতে সে কথারই জবাব দেয়া হয়েছে। এর জবাব তিন ভাবে দেয়া হয়েছে। (১) পৃথিবীর এই ঐশ্বর্য বিভব সবই ক্ষণস্থায়ী, কখনও তা ব্যক্তির একজীবনে বা দুই এক পুরুষে হারিয়ে যায়। কিন্তু পরকালের যা প্রাপ্তি তা চিরস্থায়ী। সুতারাং চিরস্থায়ী জিনিষের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী জিনিষ কি কখনও অধিক কাম্য হতে পারে? (২) পাপীদের ইচ্ছা পূরণের জন্যই যে শুধুমাত্র তাদের পার্থিব সুখ-সম্ভোগ দান করা হয়, তা নয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ্‌র বৃহত্তর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় "এখানেই তৎক্ষণাৎ দিয়ে থাকি" বাক্যটি এই ভাবকে প্রকাশ করে। (৩) পরকালের পরিবর্তে শুধুমাত্র ইহকালের সুখ-সমৃদ্ধি যারা কামনা করে তাদের জন্য ইহকালের সুখ-সমৃদ্ধি থাকলেও পরকালে আছে তাদের জন্য অশেষ যন্ত্রণা। কারণ তারা আল্লাহ্‌র করুণা থেকে বঞ্চিত হবে। দোযখ হবে তাদের চিরস্থায়ী আবাসস্থল।

পাপীরা জাগতিক সম্পদ লাভের আশায় ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য সকল বিবেক বোধকে বিসর্জন দেয়। এরূপ ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌ ইহকালে তাদের মনোবাঞ্ছাকে পূরণ করেন। পরকালে তাদের জন্য ভয়াবহ আজাব অপেক্ষা করে।

২১৯৭। যে ঐশ্বর্য, বৈভব, সম্পদ, ক্ষমতার গর্বে পাপীরা পৃথিবীতে দম্ভ ভরে বিচরণ করতো। নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ধারণা করতো জাহান্নামে প্রবেশের সময়ে তারা অত্যন্ত বিণীতভাবে তথায় প্রবেশ করবে। তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে ও আল্লাহ্‌র দর্শন লাভে বঞ্চিত হবে। এর যে পরিণাম ও যে যন্ত্রণা তা পৃথিবীতে বসে কল্পনাও করা যায় না।

১৯। যারা পরকালের [সুখ] কামনা করে ২১৯৮ এবং তার জন্য ঈমানের সাথে যথাযথ চেষ্টা করে ২১৯৯; এরাই তারা যাদের চেষ্টা [আল্লাহ্‌র নিকট ]গ্রহণযোগ্য হবে।

২১৯৮। এই আয়াতটি পূর্বের আয়াতের বিপরীত ভাবকে প্রকাশ করে। যাদের একমাত্র কাম্য হয় পার্থিব ঐশ্বর্য, সম্পদ, ও ক্ষমতা। অর্থাৎ শুধুমাত্র জাগতিক বিষয় বস্তু, এবং এ সব অর্জন করার জন্য যারা পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের, বিবেকের অনুশাসনের বা আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশের পরোয়া করে না, তাদের আল্লাহ্‌ তা দান করে থাকেন। সুতারাং পাপীরা জাগতিক ঐশ্বর্য হস্তগত করে এবং তারা তা বিপথে ব্যয় করে। কিন্তু যারা পরকালে বিশ্বাসী, তারাও আল্লাহ্‌র নেয়ামত লাভ করে যার উল্লেখ আছে পরের আয়াতে। তবে তারা সেই নেয়ামত লাভ করে ও সদ্ব্যবহার করে আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশিত রাস্তায়। এদেরই ইচ্ছা, চেষ্টা ও নিয়ত আল্লাহ্‌র দরবারে গৃহীত হয়ে থাকে।

২১৯৯। শুধুমাত্র মৌখিক স্বীকৃতি ও ইচ্ছাই আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও স্বীকৃতি লাভের জন্য "যথাযথ চেষ্টার " প্রয়োজন। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য ঐকান্তিক কর্ম প্রচেষ্টা ও দৃঢ় ঈমানকেই এখানে যথাযথ চেষ্টা বাক্যটি দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে। শুধুমাত্র এই শর্তেই বান্দার প্রচেষ্টাকে আল্লাহ্‌ স্বীকৃতি দান করে থাকেন। অন্যথায় শুধুমাত্র নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভালোকে যথেষ্ট ভালো বলা যাবে না।

২০। তোমার প্রভুর অনুগ্রহ এদের জন্য এবং তাদের জন্য। সকলের জন্য তা সমভাবে বর্ষিত হয়। তোমার প্রভুর অনুগ্রহ [কারও জন্য ] সীমাবদ্ধ নয়। ২২০০

২২০০। আল্লাহ্‌র করুণাধারা পাপী, পূণ্যবান, সকলের জন্য সমভাবে বহমান। "এদের জন্য" দ্বারা যারা পরলোককে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে তাঁদের বোঝানো হয়েছে, এবং "তাদের জন্য " দ্বারা যারা শুধুমাত্র পার্থিব সুখ সম্ভোগ কামনা করে তাদের বুঝানো হয়েছে। যার প্রাপ্য ও যার প্রাপ্য নয় সকলকেই আল্লাহ্‌ সমভাবে তার করুণা দান করেন। তবে এর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে যার কথা নীচের আয়াতগুলিতে বলা হয়েছে।

২১। লক্ষ্য কর, আমি একদলকে অন্য দল অপেক্ষা বেশী [অনুগ্রহ] দান করেছি। পরলোকে তো [আধ্যাত্মিক ক্রমান্বতির ] মর্যাদা , ধাপে এবং গুণে আরও শ্রেষ্ঠতর ২২০১।

২২০১। আমাদের চারিপাশের পৃথিবীতে বিভিন্ন লোককে আল্লাহ্‌ বিভিন্ন নেয়ামতে ধন্য করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে কেউ হয় অর্থ-সম্পদে ধন্য, কেউ হয় সাহিত্যিক, কেউ বিজ্ঞানী, কারও বা অধিকারে থাকে ক্ষমতার রাজদন্ড ইত্যাদি। আল্লাহ্‌র এই সব বিশেষ নেয়ামত ব্যক্তি লাভ করে জন্মসূত্রে। যারা এসব বিশেষ নেয়ামতে ধন্য , তাদেরকে পৃথিবী মহামানবরূপে পরিগণিত করে। আল্লাহ্‌র সকল নেয়ামত একই শ্রেণীভুক্ত নয়। যে নেয়ামত পার্থিব উন্নতি ঘটায় তার অপেক্ষা যে নেয়ামত আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি আনে তা অনেক বেশী মূল্যবান। দুটোর মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না। সুতারাং পাপী লোকের অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতাকে পূণ্যাত্মা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ, কিন্তু পৃথিবীর মানদন্ডে তিনি অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতাশালী নন, অনুরূপ ব্যক্তির তুলনা করা মূর্খতা বৈ আর কিছু নয়। সঠিক ভাবে বিচার করলে এই দুটোর মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না।

২২। আল্লাহ্‌র সাথে এবাদতে অন্য কাউকে শরীক করো না ২২০২। [হে মানব সম্প্রদায়] করলে নিন্দিত এবং লাঞ্ছিত হয়ে পড়বে। ২২০৩

২২০২। যাদের জ্ঞান ও দূরদৃষ্টির অভাব তারাই আল্লাহ্‌র পক্ষপাত শূন্যতা নিয়ে তর্কে মেতে ওঠে। তাদের দূরদৃষ্টির অভাব ঘটে, কারণ তাদের বিশ্বাসের অভাবের দরুণই তাদের আল্লাহ্‌র করুণাকে বোঝার বা অনুভব করার ক্ষমতা থাকে না। আর ক্ষমতা থাকে না দেখেই তারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুকে তাদের এবাদতের বস্তু হিসেবে গণ্য করে। আল্লাহকে ভুলে যেয়ে, কেউ অর্থ-সম্পদের পূঁজা, কেউ ব্যক্তি পূঁজা, কেউ বীর পূঁজা, কেউ বিজ্ঞানের পূঁজা ইত্যাদি নিয়ে মেতে ওঠে। কিন্তু আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কেহ এবাদতের যোগ্য নয়।

২২০৩। যারা অজ্ঞান ও মূর্খ তারাই আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুকে এবাদতের মাধ্যম হিসেবে স্থির করে। এর ফলে তার চরিত্রে হীনমন্যতার জন্ম নেবে এবং সে অন্যের চোখে আত্মসম্মানহীন ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হবে। অপর পক্ষে আধ্যাত্মিক জগতে সে হবে দেউলিয়া। তার প্রতিভা বা সৎকাজের কোনও মূল্যই থাকবে না আল্লাহ্‌র কাছে। কারণ তার প্রতিভার বিকাশ বা সৎকাজ আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় নাই।

রুকু - ৩

২৩। তোমার প্রভু আদেশ দিয়েছেন যে তাঁকে ব্যতীত তোমরা অন্য কারও এবাদত করবে না ২২০৪, পিতামাতার প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। তাদের একজন বা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্দ্ধক্যে উপণীত হলে, তাদেরকে [সামান্য ] অপমানকর শব্দও উচ্চারণ করবে না, তাদের প্রতিরোধ করো না। তাদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলবে।

২২০৪। এখান থেকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দায়িত্বগুলি পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কেহ এবাদতের যোগ্য নয়। আর এ কারণেই শুধুমাত্র আল্লাহকেই এবাদত করতে হবে। এখানেই বাইবেলের বর্ণনা সাথে আমাদের পার্থক্য। নীচে বাইবেলের বর্ণনা তুলে ধরা হলো, স্রষ্টার এবাদত করতে হবে কারণ, "The Lord thy God is a jealous God, visiting the iniquity of the fathers upon the children unto the third and fourth generation of them that hate Me" [Exod xx 5]

২৪। এবং মমতাবশে তাদের প্রতি বিনয়ের পক্ষপুট নামিয়ে দেবে ২২০৫, এবং বলবে, " হে আমার প্রভু! শৈশবে তারা যে ভাবে আমাকে প্রতিপালন করেছে, সে ভাবে তাদের দয়া কর"। ২২০৬

২২০৫। এখানে উপমা ব্যবহার করা হয়েছে পক্ষীমাতার পাখার সাথে। আকাশে ডানা মেলে দেয়া উড়ন্ত পাখী যখন তার নীড়ে শাবকদের কাছে ফিরে আসে- সে তার মেলে দেয়া ডানাকে বন্ধ করে দেয়, পক্ষী শাবকের নিকটে এসে -স্নেহে ও ভালোবাসাতে আপ্লুত হয়ে। স্নেহ ভালোবাসার অনুরূপ প্রকাশ করা হয়েছে আয়াতে [১৫:৮৮] এবং এর টিকাতে। এই আয়াতের মাধ্যমে দু'ধরণের তৎপরতার বর্ণনা করা হয়েছে। (১) যখন পিতামাতা শক্ত সামর্থ থাকেন এবং সন্তানেরা দুর্বল এবং অসহায় থাকে, পিতামাতার স্নেহ-ভালোবাসা সন্তানকে আপ্লুত করে রাখে। আবার যখন সন্তান বড় হয়ে যায়, পিতামাতা বৃদ্ধ অবস্থায় অসহায় ও দুর্বল হয়ে পড়েন তখন কি তাদের প্রতি বিরক্তি বা অবজ্ঞা বা ক্রোধ ও ঘৃণা প্রকাশ করা উচিত? (২) অধিকন্তু পিতা-মাতার বার্দ্ধক্য উপস্থিত হলে তাদের নিকট সম্মানের সাথে, কোমলতার সাথে, বিনয়ের সাথে ব্যবহার করা প্রয়োজন , ঠিক যে ভাবে তারা সন্তানকে সকল বিপদ ও ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করেন। পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসার ন্যায় আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া কি তার সৃষ্টিকে পক্ষী মাতার ন্যায় তার পক্ষপুটের দ্বারা সকল অকল্যাণ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পায় না? এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ্‌ পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মাধ্যমে বৃহত্তর, মহত্তর আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ইঙ্গিত করেছেন।

২২০৬। লক্ষ্য করুণ আল্লাহ্‌ আদেশ করেছেন পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করতে। তাদের সাথে নম্রতার সাথে, দয়া ও ভালোবাসার সাথে ব্যবহার করতে, এবং তারই মাধ্যমে জীবনের সার্বজনীন ও বৃহত্তর লক্ষ্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রথমতঃ পিতা-মাতাকে শুধুমাত্র সম্মান নয় , তাদের সাথে দয়া, সহানুভূতি, ভালোবাসার সাথে, বিনয়ের সাথে নম্রভাবে ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ এই আদেশের পরেই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে পিতা-মাতার কল্যাণের জন্য। অর্থাৎ পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহারকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হয়েছে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে। যে স্রষ্টা এক ও অদ্বিতীয়। পিতা-মাতার প্রতি ব্যবহার ও স্রষ্টার কাছে প্রার্থনাকে সমভাবে উত্থাপন করা হয়েছে, কারণ পৃথিবীতে একমাত্র পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসাই হচ্ছে নিঃস্বার্থ স্বর্গীয় ভালোবাসা। পৃথিবীর কোনও কিছুই এর সমকক্ষ নয়। আমরা তাঁদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা লাভ করি পৃথিবীর কোনও কিছুই তার তুলনাযোগ্য নয়। বিশ্ব জগতের প্রতি আল্লাহ্‌র ভালোবাসার রূপ সামান্য প্রতিফলিত হয়েছে একমাত্র পিতা-মাতার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মাধ্যমে। তৃতীয়তঃ [পরের আয়াত]। আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতিকে পরীক্ষা করা হয়েছে। পিতা-মাতার বার্দ্ধক্যে আমরা যদি তাদের প্রতি নির্দ্দয় ব্যবহার করি, তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিদান না দেই, তবে আমরা কিভাবে সেই বিশ্ব প্রতিপালকের দয়া ও ক্ষমার যোগ্য হব?

২৫। তোমার প্রভু সবচেয়ে ভালো জানেন তোমাদের হৃদয়ে যা আছে। যদি তোমরা সৎকাজ কর, অবশ্যই তিনি ক্ষমাশীল তাদের প্রতি যারা [প্রকৃত অনুতাপের মাধ্যমে] বারে বারে আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে আসে। ২২০৭

২২০৭। আল্লাহ্‌ মানুষের অন্তরের গোপন চিন্তাভাবনা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আমাদের কর্ম নয়, কর্মের উদ্দেশ্য দ্বারাই আমাদের বিচার করা হবে। কারণ আল্লাহ্‌ "তোমাদের অন্তরে যা আছে তা ভালো জানেন"।

২৬। আত্মীয় স্বজনদের তাদের প্রাপ্য দেবে, অভাবগ্রস্থ ও পথচারীদেরও ২২০৮। কিন্তু [তোমাদের সম্পদ] খরচের ব্যাপারে অপব্যয়ী হয়ো না। ২২০৯

২২০৮। হযরত মুসার মাধ্যমে যে দশটি আদেশ দান করা হয়েছে,তা ছিলো প্রাচীন ইহুদী জাতির জন্য, যারা ছিলো কঠিন হৃদয়ের লোক। সুতারাং তাদের কাছে "অভাবগ্রস্থ ও পর্যটক" যা সম্পূর্ণ অপরিচিত, তাদের প্রতি দয়া দেখানোর মত মানসিক সমৃদ্ধি তাদের ছিল না। সুতারাং দশটি আদেশের মাঝে সম্পূর্ণ অপরিচিতের জন্য দয়া প্রদর্শনের কোন কথা ছিলো না। অপব্যয় সম্বন্ধেও কোন সর্তকবাণী ছিলো না। এমন কি পিতা -মাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আদেশটিও ছিলো আনুষ্ঠানিক সাবাত দিবসের আদেশের পরে। মুহম্মদ (সাঃ) সর্বশেষ নবী। সময়ের ব্যবধান ও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মানসিক সমৃদ্ধি লাভ ঘটেছে। তাই শেষ নবীর মাধ্যমে আল্লাহকে এবাদতের হুকুমকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য 'দয়া' কে সংযুক্ত করা হয়েছে। এই দয়ার ক্ষেত্র পিতা-মাতার মত নিকটজন থেকে শুরু করে, অভাবগ্রস্থ ও সম্পূর্ণ অচেনা ও অজানা পর্যটক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই দয়া প্রদর্শন শুধু মাত্র ব্যক্তির ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল নয়, বা এটা কোন মৌখিক অঙ্গীকার নয়। এটা হচ্ছে আল্লাহ্‌র আদেশ বা তাদের "প্রাপ্য" যা আমাদের পূর্ণ করতে হবে।

২২০৯। দান হবে সর্বদা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী। সাধ্যের বাইরে যে কোনও ব্যয় বা দানকেই এখানে অপব্যয়রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুনামের জন্য বা প্রদর্শনের জন্য দানকে আল্লাহ্‌ গ্রহণ করেন না। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য সাধ্য অনুযায়ী দানই আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য। বিয়ে, চল্লিশা, জন্মদিন, বার্ষিকীতে অপব্যয়ের যে বহুল প্রচলন দারিদ্রতা আক্রান্ত বাংলাদেশে হয়েছে, তা আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্যের-ই নামান্তর। যদিও একে অপব্যয়কারীরা "সামাজিক অঙ্গীকাররূপে" পরিগণিত করেন। আল্লাহ্‌র এই আদেশের প্রতি সমগ্র মুসলিম সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত বিশেষতঃ যারা মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করেন।

২৭। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই। এবং শয়তান তার প্রভুর নিকট অতিশয় অকৃতজ্ঞ। ২২১০

২২১০। অপব্যয় করা বোকামীর সামিল। অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাইরূপে সম্বোধন করা হয়েছে, অর্থাৎ একই গোত্রভুক্ত করা হয়েছে। আর শয়তান তো আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের প্রতি সর্বাপেক্ষা অকৃতজ্ঞ। সুতারাং যারা আল্লাহ্‌র নেয়ামতের অপব্যবহার করে তারাও প্রকারান্তে আল্লাহ্‌র প্রতি অকৃতজ্ঞ।

২৮। এবং যদি তাদের নিকট থেকে তোমার মুখ ফিরাতেই হয়, [যেহেতু] তুমি তোমার প্রভুর অনুগ্রহ আশা কর , [সেহেতু ] তখনও ওদের সাথে দয়ার্দ্র ভাবে কথা বলো। ২২১১

২২১১। 'দান' করা থেকে বিরত থাকা নিম্নোক্ত দুটি সময়ে জায়েজ। (১) যদি দান করার মত কোনও সামর্থ্য না থাকে। এবং (২) গ্রহীতার চিন্তা -চেতনার সাথে দাতার চিন্তা-চেতনার সমন্বয় না থাকে যেমন সুস্থ শরীরের ভিক্ষুককে দান করা, এরূপ ক্ষেত্রে দান করতে না পারলেও ক্ষতি নাই, কিন্তু তাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে ভালো ব্যবহারের সাথে। 'ভদ্র' ব্যবহার নয় কথাটি ভালো ব্যবহার। কারণ বাক্যটি হচ্ছে "দয়ার্দ্রভাবে কথা বলো"। অর্থাৎ দয়া ও সহানুভূতির সাথে তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। দেখুন আয়াত [২:৮৩] ও টিকা ৮৭। যেখানে মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, "মানুষের সাথে সদালাপ করবে" বা "Speak fair to the people" বাক্যটি দ্বারা। সম্পদ, সংস্কৃতিতে ও শিক্ষাতে বিরাট ব্যবধান থাকা সত্বেও মানুষ তার থেকে করুণা প্রার্থীকে তখনই দয়া ও সহানুভূতির সাথে ব্যবহার করতে পারে, যখন ধর্মীয় নির্দ্দেশ বা আল্লাহ্‌র হুকুমকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়। তার প্রজ্ঞা, জ্ঞান তাকে মানুষের সাথে আদান প্রদানের সময়ে বিনয়ী হতে সাহায্য করে।

২৯। তুমি তোমার হস্ত [কৃপনদের মত] ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখো না। অথবা উহা সম্পূর্ণ প্রসারিত করো না, যার ফলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে। ২২১২

২২১২। "হস্ত বেঁধে রাখা" আরবী বাগ্‌ধারাটি [৫:৬৪] আয়াতেও ব্যবহার করা হয়েছে।দাতার হাত এত প্রসারিত হবে না যাতে দাতা গরীব হয়ে যায় বা এত কৃপণ হবে না যাতে সাহায্যপ্রার্থীর হাত সাহায্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। দান করতে হবে মিতাচারের সাথে যা, অপরের সাহায্যে প্রতিবন্ধকতাও না হয় এবং নিজের বিপদও ডেকে না আনে।

৩০। তোমার প্রভু যার জন্য ইচ্ছা অপরিমিত রিজিকের ব্যবস্থা করেন, এবং তিনি তা ন্যায়নীতিতে বন্টন করেন। ২২১৩ তিনি তাঁর সকল বান্দাকে জানেন এবং বিবেচনা করেন।

২২১৩। যদি দানের দ্বারা কেউ নিঃস্ব ও হতদরিদ্রতে পরিণত হয়, তবে তাকে অপব্যয়ীরূপে অভিহিত করা যায়। এ রূপ ক্ষেত্রে অপব্যয়ী ব্যক্তি দানে হয়তো মনে করতে পারে তার দানে অনেকের উপকার হয়েছে। এ কথা হয়তো সত্য, কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাদের এই আয়াতের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ্‌ সকলের রক্ষাকর্তা। তিনি সকলের অভাব অভিযোগ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞাত আছেন এবং তিনি সকলের প্রতি যত্নশীল, তিনি কাউকে কাউকে প্রয়োজনের অধিক দেন সত্য কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁর রহমতম সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে বন্টিত হয়। সেখানে আমাদের পক্ষে অধিক দান করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ঔদ্ধত্য প্রকাশ করা বৈকি।

রুকু - ৪

৩১। দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। ২২১৪ আমি তাদের জন্য এবং তোমাদের জন্যও রিজিকের ব্যবস্থা করি। তাদের হত্যা করা অবশ্যই মহাপাপ।

২২১৪। রসুলুল্লাহ্‌র (সা) পূর্বে আরবরা কন্যা সন্তানকে হত্যা করতো। যেহেতু তদানীন্তন আরবের সমাজে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকতো, সে কারণে পুত্র সন্তান ছিলো শক্তির প্রতীক এবং কন্যা সন্তান ছিলো দুর্বলতা ও লজ্জ্বার প্রতীক। বর্তমান যুগেও কন্যা সন্তান হত্যার প্রচলন আছে ভারত, চীন, প্রভৃতি দেশে, যে কারণে এ সব স্থানের সমাজবিদেরা ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

৩২। আর ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। যেহেতু এটা একটি অশ্লীল [কাজ] এবং পাপ [আচরণ] ; যা [অন্য পাপের] রাস্তা খুলে দেয়। ২২১৫

২২১৫। ব্যভিচার শুধু যে, অশ্লীল ও লজ্জাষ্কর ব্যাপার তাই-ই নয় এ একটি নিকৃষ্ট আচরণ।কারণ এই পাপ নিজের প্রতি ও অন্যের প্রতি সম্মান বোধকে খর্ব করে। ব্যভিচার নরকের পথ উম্মুক্ত করে। কারণ ব্যভিচারী ব্যক্তি পরিবারের সঙ্গী বা সঙ্গীনীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, যার ফলে পরিবারের ভিত্তি হয়ে পড়ে দুর্বল, পরিবারের বন্ধন হয়ে পড়ে দুর্বল, বাইরের নিষ্ঠুর পৃথিবীতে পরিবার হচ্ছে মরুভূমির মাঝে মরুদ্যানের মত। এখানেই স্নেহ-ভালোবাসা মানুষের জীবনকে ভরিয়ে দেয়। যদি সেই ভালোবাসার ফল্গুধারা শুকিয়ে যায় তবে সে পরিবারে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্থ হয় পরিবারের শিশুরা। যৌন কেলেংকারী, খুন, হত্যা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদির জন্ম দেয়। এর ফলে ব্যক্তির সুনাম হানি ঘটে, পরিবার ভেঙ্গে যায়। আর ভগ্ন পরিবার সমাজের জন্য ক্ষতিকর। সুতারাং যে কোন যৌন ঘটিত পাপ থেকে দূরে থাকতে হবে, কোনও রকম প্রলোভনকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়।

৩৩। যথার্থ কারণ ব্যতীত, আল্লাহ্‌ যাদের জীবনকে পবিত্র [ঘোষণা] করেছেন তাদের হত্যা করো না। যদি কেউ ভুলক্রমে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধীকারিকে [কিসাস্‌ দাবী করার বা ক্ষমা করার ] অধিকার দান করেছি। ২২১৬। হত্যার ব্যাপারে সে যেনো সীমা অতিক্রম না করে। কারণ সে তো [আইনের দ্বারা ] সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছে।

২২১৬। আইনগত প্রতিকার গ্রহণের অধিকার - বা 'কিসাস' গ্রহণ। "কিসাস" এর জন্য দেখুন [২:১৮] এবং এর টিকা। 'কিসাস' গ্রহণের সীমানা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তা হচ্ছে মৃতের উত্তরাধীকারীদের অধিকার থাকবে জীবনের পরিবর্তে জীবন গ্রহণের। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই নির্দ্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে পারবে না। কারণ সে তো আইনের সাহায্য প্রাপ্ত। কোন কোন তফসীরকারের মতে , " সে তো সাহায্য প্রাপ্ত" বাক্যটিতে 'সে' সর্বনামটি ব্যবহার করা হয়েছে হত্যাকারীর উত্তরাধীকারীদের সম্বন্ধে। তাদের যুক্তি হচ্ছে : হত্যাকারীর উত্তরাধীকারীরা আইনের সাহায্যপ্রাপ্ত। কারণ প্রতিশোধ গ্রহণকারী যদি বাড়াবাড়ি করে তবে আইনের চোখে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যে পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির উত্তরাধীকারী ইনসাফের সাথে নিহতের প্রতিশোধ নিতে চাইবে সে পর্যন্ত শরীয়ত আইন তার পক্ষে থাকবে। আল্লাহ্‌ তার সাহায্যকারী হবেন। কিন্তু সে যদি প্রতিশোধ স্পৃহায় উম্মত্ত হয়ে "কিসাসের " সীমা লঙ্ঘন করে তবে সে অত্যাচারী আইন তার বিপক্ষে।

৩৪। এতিম পূর্ণ বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সম্পত্তির উন্নতি করার লক্ষ্য ব্যতীত এর নিকটবর্তী হয়ো না। ২২১৭, ২২১৮। এবং প্রত্যেক প্রতিশ্রুতি পালন করো ২২১৯। কারণ, [হিসাব গ্রহণের দিনে] প্রতিটি প্রতিশ্রুতি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা হবে। ২২২০

২২১৭। দেখুন অনুরূপ আয়াত [৬:১৫১] এবং এতিমের সম্বন্ধে আরও আছে আয়াত [২:২২০] যারা এতিমের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে এই আয়াতে। "উন্নতি করা ছাড়া তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না"। ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে, "Come not night / to the orphan’s property / Except to improve it" অর্থাৎ যদি কেউ এতিমের সম্পত্তি স্পর্শও করে তবে সে তা করবে সম্পত্তির উন্নতি বিধানের জন্য, অথবা এতিমের যা ছিলো তার থেকে আরও ভালো কিছু দেবার জন্য। এই আয়াতে কঠোর ভাবে এতিমের অভিভাবকদের সাবধান করা হয়েছে যে,তারা যেনো কোনওরূপ ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ না করে , এতিমদের স্বার্থের পরিপন্থি কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ না হয়। তারা শুধু এতিমদের স্বার্থ দেখবেন। এ কর্মধারা ততদিন অব্যাহত থাকবে যতদিন শিশু যৌবনে পদার্পণ করে।

২২১৮। "Ashuddun" যার অর্থ হচ্ছে বয়োপ্রাপ্ত হওয়া অর্থাৎ বয়সে জ্ঞান ও বুদ্ধিতে পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়া। এর সর্বনিম্ন সীমা ১৮ ও সর্বোচ্চ সীমা ৩০ বৎসর। আইনের চোখে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে আমাদের দেশে ধরা হয় ১৮ বৎসর বয়েস। আমেরিকা ও ইউরোপের বহুদেশে একে ধরা হয় ২১ বৎসর। বিশেষ কিছু কারণে ইসলামিক আইনে এই বয়েসকে ধরা হয়েছে ১৮ বৎসরের নীচে। তবে এতিমের সম্পত্তির ব্যাপারে এই বয়সের মানকে আরও কঠোর করা প্রয়োজন।

২২১৯। নির্দ্দিষ্ট 'al' শব্দটি দ্বারা সমষ্টিগত ভাবকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ 'সমস্ত' অঙ্গীকার ভাবকেই বোঝানো হয়েছে। অঙ্গীকার দুধরণের (১) আল্লাহ্‌র সাথে অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকারের বিষয়বস্তু হচ্ছে, তাঁর নির্দ্দেশাবলী মানতে হবে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সৎ কাজ করতে হবে। মোট কথা আল্লাহ্‌র বিধানবলীর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। (২) দ্বিতীয় প্রকার অঙ্গীকার যা এক মানুষ অন্য মানুষের সাথে করে। এর মধ্যে ব্যক্তি বা গোষ্টি বা রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক লেন-দেন সমস্তই অন্তর্ভূক্ত।

২২২০। এতিমের সম্পত্তির ব্যাপারে অভিভাবকের চুক্তি বা অঙ্গীকার বা দায়িত্ব গ্রহণ, প্রভৃতি সকল অর্থে প্রযোজ্য। যদিও আয়াতটি শুরু হয় শুধুমাত্র এতিমদের সম্পর্কে কিন্তু শেষ করা হয়েছে সাধারণভাবে ব্যাপক অর্থে। কারণ অনুরূপ আয়াত [৬:১৫২] এতিমদের সম্পত্তির ব্যাপারে বর্ণনা আছে; যেখানে বিভিন্ন সামাজিক বিধানের নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে; কিন্তু এরূপ কোন ব্যাপক অর্থ বোধক নির্দ্দেশ নাই। এই আয়াতে অঙ্গীকার পালনের এই সাধারণ নির্দ্দেশ উপযুক্ত স্থানেই সন্নিবেশিত হয়েছে, কারণ এই নির্দ্দেশের আওতায় এতিমের অভিভাবকদের ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব অন্তর্ভূক্ত।

৩৫। মেপে দিবার সময়ে পূর্ণ মাপে দিবে, এবং সঠিক দাড়িপাল্লায় ওজন করবে। শেষ পরিণামে ইহাই সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে লাভজনক ২২২১।

২২২১। মাপ ও ওজন সঠিক দেয়ার নির্দ্দেশ এখানে দেয়া হয়েছে। মাপ ও ওজন সম্পর্কে দুটি বিষয় বলা হয়েছে। (১) এ হচ্ছে একটি সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। অর্থাৎ এরূপ করা শুধু যে শরীয়ত অনুযায়ী যুক্তিযুক্ত তাই-ই নয়, এর ফলে ব্যক্তির বিবেক স্বাভাবিক বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয় না যার পরিণতিতে সে ধার্মিকতার পথে অগ্রসর হতে পারে। (২) পরিণতি লাভজনক। এতে পরকালের শুভ পরিণতি ব্যতীতও দুনিয়ার পরিণতির দিকে ইঙ্গিত দান করা হয়েছে। কোন ব্যবসা ততক্ষণ পর্যন্ত উন্নতি করতে পারে না ,যে পর্যন্ত জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে না পারে। বিশ্বাস ও আস্থা উপরোক্ত বাণিজ্যিক সততা ব্যতীত অর্জিত হতে পারে না। এখানে পূর্ণমাপে শব্দটি প্রতীকধর্মী। এর মাঝে বস্তুর দ্রব্যগুণ অর্থাৎ যে বস্তুর মান যা ক্রেতাকে দেয়া হবে বলে বলা থাকে সেই মান ও পরিমাণ বোঝানো হয়েছে। আবার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যার যা প্রাপ্য তাকে তা সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়াও হচ্ছে সঠিক মাপে দেখা। যেমন ডাক্তারের কাছে গুণগত মানের সেবা, শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা, প্রশাসনের ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি ইত্যাদি হচ্ছে পূর্ণ মাপের প্রতীক।

৩৬। তোমার যে বিষয়ে জ্ঞান নাই উহার অনুসরণ করো না ২২২২। যা কিছু শুনবে, অথবা যা কিছু দেখবে, অথবা হৃদয়ে যা কিছু [অনুভব করবে] , সব কিছুর অনুসন্ধান করা হবে [ হিসাব গ্রহণের দিনে]।

২২২২। অহেতুক কৌতুহল ভালো নয়। অনেক সময়ে তা ব্যক্তিকে মন্দ পথে উপণীত করে। কারণ আমরা জানি না যে কৌতুহলের শেষ প্রান্ত আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। আমরা সর্বদা নিজেদের এরূপ বিপদ থেকে রক্ষা করে চলবো। আমরা সেই কথাই শুনবো যা সুপথে চালিত করে, সেই জিনিষই দেখবো যা ভালো, উপদেশ পূর্ণ এবং আমাদের অনুভূতি ও মনকে তৃপ্ত করে এবং আত্মার সমৃদ্ধিতে সহায় হয়। স্রষ্টা আমাদের জ্ঞান লাভের জন্য বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দান করেছেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান লাভ করি ও হৃদয়ের অনুভূতির মাধ্যমে এই জ্ঞানকে আমরা আত্মস্ত করি। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কর্ণ ও চক্ষু, জ্ঞান আহরণের জন্য সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় মাধ্যম। সুতারাং স্বতন্ত্রভাবে এ দুটির উল্লেখ এখানে করা হয়েছে। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়কে কিভাবে ব্যবহার করেছি পৃথিবীতে তার হিসাব আমাদের দিতে হবে পরলোকে। এখানে জাপানের এক মন্দিরের গাত্রে খোদিত বিখ্যাত ভাস্কর্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। মন্দিরের গাত্রে তিনটি বানরের মূর্তি খোদিত করা আছে তাদের একজন কানে একজন চোখে, অন্যজন মুখে হাত দিয়ে আছে। বক্তব্য হচ্ছেঃ আমরা খারাপ, অশ্লীল ও মন্দ কিছু দেখবো না, শুনবো না বা বলবো না। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে অহেতুক কৌতুহলকে নিন্দা করা হয়েছে। মানুষ অহেতুক কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই নিষিদ্ধ জিনিষের স্বাদ গ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। সে নিষিদ্ধ জিনিষ দেখে, অশ্লীল কথা শোনে ও মন্দ কথা বলে। এমন কি নিরর্থক কথা ও কাজও পরিহার কর উচিত , যদিও তা "মন্দকে" প্ররোচিত করে না।

৩৭। পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভাবে বিচরণ করো না ২২২৩। কারণ তুমি তো কখনও [পদভারে] ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না , এবং উচ্চতায় কখনও পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।

২২২৩। ঔদ্ধত্য, অহংকার , দম্ভ ও একগুয়েমী আল্লাহ্‌র চোখে অত্যন্ত অশোভনীয়। অহংকারের অর্থ হচ্ছে, নিজেকে অন্যের চাইতে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে নিজের চাইতে হেয় ও ঘৃণ্য মনে করা। অহংকার ও গর্ব হচ্ছে পাপের পথের প্রথম ধাপ। ইব্‌লীসের পতনের কারণই ছিলো অহংকার। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায় নিজের কোন বিশেষ ক্ষমতা বা দক্ষতার জন্য অহংকার বা গর্ব প্রকাশ করা অন্যায়। কারণ ব্যক্তির চরিত্রের যা কিছু নেয়ামত বা প্রতিভা বা ক্ষমতা ও সম্পদ সবই আল্লাহ্‌র তরফ থেকে দান। ব্যক্তির নিজস্ব কিছু কৃতিত্ব তাতে নাই।

৩৮। এগুলির মধ্য যেগুলি মন্দ, তোমার প্রভুর দৃষ্টিতে সেগুলি ঘৃণ্য।

৩৯। তোমার প্রভু তোমাকে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে [নৈতিক শিক্ষার] যে জ্ঞান দান করেছেন এগুলি তার অন্তর্গত। এবাদতের জন্য আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কিছুকে গ্রহণ করো না ২২২৪। করলে তুমি নিন্দিত ও বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে ২২২৫।

২২২৪। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, " সমগ্র তওরতের বিধানবলী সূরা বণী ইসরাঈলের [১৭:১৩-৩৯] এই ১৭টি আয়াতে সন্নিবেশিত করে দেয়া হয়েছে [মাযহাবী]। কোরাণের বর্ণনার সাথে তওরাতের বর্ণনার পার্থক্য হচ্ছে তওরাতের বর্ণনা অপেক্ষা কোরাণের বাণীতে নৈতিক নীতিমালার উপরে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে যা আমাদের আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের উপযোগী করে তোলে, শুরু হয়েছে[১৭:২৩] এক আল্লাহ্‌র এবাদত করার নির্দ্দেশের মাধ্যমে এবং শেষ করা হয়েছে [১৭:৩৯] অনুরূপ নির্দ্দেশের মাধ্যমে। এর মধ্যে জীবনের ১৫ টি নৈতিক নীতিমালার উল্লেখ আছে তা নিম্নরূপঃ
(১) এক আল্লাহ্‌র উপসনা [১৭:২৩]
(২) পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার [১৭:২৩]
(৩) সকল আত্মীয়ের হক দিতে হবে [১৭: ২৬]
(৪) অপব্যয়ে নিষেধাজ্ঞা [১৭:২৭]
(৫) সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করা [১৭:২৮]
(৬) ব্যয়ের ব্যাপারে মধ্য পথ অবলম্বন করা [১৭: ২৯]
(৭) সন্তান হত্যা পাপ [১৭:৩১]
(৮) ব্যভিচার পাপ [১৭:৩২]
(৯) ন্যায়ের ভিত্তি ব্যতীত নর হত্যা পাপ ও এর বিধান [১৭:৩৩]
(১০) এতীমের সম্পদ গ্রাস করা হারাম। প্রতিশ্রুতি পালন করবে [১৭:৩৪]
(১১) মাপে ও ওজনে কারচুপি না করা [১৭:৩৫]
(১২) অযথা কৌতুহল প্রকাশ না করা [১৭:৩৬]
(১৩) দম্ভ ও অহংকার প্রকাশ না করা [১৭:৩৭]
(১৪) সকল পাপই আল্লাহ্‌র চোখে ঘৃণ্য [১৭:৩৮]
(১৫) পুণরায় এক আল্লাহ্‌র উপাসনার আদেশ [১৭:৩৯]

এভাবেই মানুষ ও সমাজের প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্বের মধ্যে দিয়ে এক আল্লাহ্‌র এবাদতের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র ভালোবাসা বিশ্ব সংসারের সকল কিছুকে পরিব্যপ্ত করে আছে। তাই মানুষকে ভালোবাসা ও তাদের সাহায্যের মধ্যে দিয়েই আল্লাহ্‌র ভালোবাসার নিকট পৌঁছানো যায়। এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠ এবাদত।

২২২৫। "নিন্দিত" শব্দটি আয়াত [ ১৭:২৯] ব্যবহার করা হয়েছে অবশ্য সেখানে অপরাধ ছিলো অন্যের অধিকারকে নিজের কুক্ষিগত করে রাখা কৃপণের ন্যায়। আবার এই আয়াতে [১৭:৩৯] "বিতাড়িত" ও আয়াতে [১৭:১৮] আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ হইতে দূরীকৃত একই ভাব বহন করে। "মাদহুর " এই আরবী শব্দটির অর্থ দূরীকৃত বা "আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত।" বান্দার জন্য নিন্দিত থেকে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়া অনেক বড় ক্ষতি।

৪০। [হে মোশরেকরা!] তবে কি তোমাদের প্রভু তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান নির্বাচিত করেছেন এবং নিজের জন্য ফেরেশ্‌তাদের কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন? তোমরা তো ভয়ানক কথা উচ্চারণ করে থাক। ২২২৬

২২২৬। অনুরূপ আয়াত দেখুন [১৬:৫৭-৫৯]। ইসলামে এক আল্লাহ্‌র এবাদতের উপরে পুণঃপুণঃ গুরুত্ব আরোপ করে। এক আল্লাহ্‌র উপাসনার অর্থ মিথ্যা উপাস্য পরিত্যাগ করা ও আল্লাহ্‌র আসনকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা। সেখানে আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে অসম্মানজনক কিছু উদ্ভাবন করা অন্যায় নয় কি? আরবদের সমাজে,যেখানে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়াকে ঘৃণা ও অপমানজনক মনে করা হতো। যেখানে ইসলামের আবির্ভাবে কন্যা সন্তানের জীবনকে আল্লাহ তার আইন দ্বারা সুরক্ষিত করেছেন সেখানে আল্লাহ্‌র জন্য কন্যা সন্তানকে দেয়া কি ভয়ানক কথা নয়?

রুকু - ৫

৪১। এই কুর-আনে আমি [ বিষয়গুলি] বহুভাবে ব্যাখ্যা করেছি, যেনো তারা সর্তকবাণী গ্রহণ করে ২২২৭। কিন্তু এতে তাদের [সত্য] বিমুখতাই বৃদ্ধি করে।

২২২৭। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের উন্নতি ও সমৃদ্ধি ও ফলপ্রসূ জীবন ব্যবস্থার জন্য কোরাণে নানাভাবে নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। কখনও নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে গল্পের মাধ্যমে, কখনও উপমা, কখনও বাক্যালঙ্কার, কখনও স্পষ্ট নির্দ্দেশের মাধ্যমে। যারা পাপে আসক্ত থাকবে তাদের কাছে কোরাণের নির্দ্দেশাবলীর কোনও আবেদনই থাকবে না। তারা এর দ্বারা কোনও উপকারই পাবে না। বরং তারা সত্য থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যেতে থাকবে।

৪২। বলঃ তাদের কথা অনুযায়ী আল্লাহ্‌র সাথে যদি [সেরূপ আরও] উপাস্য থাকতো - দেখো! তবে তারা অবশ্যই আরশ অধিপতির কাছে পৌঁছানোর একটা পথ বের করে নিত ২২২৮।

২২২৮। এক মাত্র এক আল্লাহ্‌ই সত্য। তিনি-ই এক ও অদ্বিতীয়। যদি আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কোন অতিরিক্ত উপাস্য থাকতো , তবে সৃষ্ট জগতের শৃঙ্খলা বজায় থাকতো না। যদি সৃষ্ট জগতের স্রষ্টা, মালিক ও পরিচালক এক আল্লাহ্‌ না হন বরং তাঁর সাথে যদি শরীক থাকতো, তবে অবশ্য তাদের মধ্যে মতানৈক্য হবে। মতানৈক্য হলে সমস্ত বিশ্ব ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় বিশ্ব ব্যবস্থায় একই বিষয় সর্বত্র প্রচলিত; যেমনঃ পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা ইত্যাদি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যে ধর্ম তা আমাদের গ্রহের জন্য যেমন প্রযোজ্য, ঠিক সমভাবে প্রযোজ্য পৃথিবীর বাইরের গ্রহ নক্ষত্রের বেলাতেও। এ সব স্রষ্টার একত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে। আয়াত [১৭:৪৪] এ কথাকেই প্রকাশ করা হয়েছে।

৪৩। তিনি মহিমান্বিত ! তারা যা বলে তিনি তার উর্দ্ধে। তিনি [ধারণার অতীত] মর্যাদাপূর্ণ।

৪৪। সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এর মধ্যবর্তী সকল কিছু , তাঁর মহিমা ঘোষণা করে। এমন কিছু নাই যা তার প্রশংসা ঘোষণা করে না। কিন্তু তারা কিভাবে আল্লাহ্‌র মহিমা ঘোষণা করে তোমরা তা বুঝতে পার না ২২২৯। অবশ্যই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।

২২২৯। জড় বা জীব সকলেই আল্লাহ্‌র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। জীবিত প্রাণ সচেতনভাবে আল্লাহ্‌র মহিমা ঘোষণা করে এবং চেতনাহীন বা প্রাণহীন বস্তু তাদের অস্তিতের সাক্ষরতার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র মহিমা ঘোষণা করে। কারণ তারা কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা বৃহৎ শক্তির মুখাপেক্ষী। অবস্থার এই সাক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহ্‌র মহিমা ঘোষণা। বিষয়টির ব্যাখ্যা এরূপঃ সৃষ্টি জগতের জড় বা জীব সকলকেই আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জন্য আল্লাহ্‌ আইন প্রণয়ন করেছেন, উদাহরণ যেমনঃ আলো সরল রেখাতে চলে, পানির গতি নিম্নাভিমুখী ইত্যাদি, জীব জগতের উদারহরণঃ দেহ রক্ষার জন্য জীব খাদ্য গ্রহণ করে, জীব বংশ বৃদ্ধি করে অর্থাৎ তার জৈবিক প্রক্রিয়া সমূহে কোনওরূপ হস্তক্ষেপ চলে না। সময়ের আর্বতনে জীব জন্ম গ্রহণ করে, বৃদ্ধি পায় , বংশ বৃদ্ধি করে আবার মরে যায়। এই জীবন চক্রকে ইচ্ছা করলেও কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। এভাবেই আল্লাহ্‌ জীব ও জড় পদার্থের জন্য ও বিশ্ব্‌ প্রকৃতির জন্য তার অমোঘ নিয়ম কানুনের প্রবর্তন করেছেন , যা জীব ও জড় পদার্থ এবং বিশ্ব প্রকৃতি নিষ্ঠার সাথে পালন করে থাকে। কারণ আল্লাহ্‌র হুকুম বা আইন অমান্য করার ক্ষমতা তাদের দেয়া হয় নাই। "সপ্ত আকাশ , পৃথিবী এবং উহাদিগের অন্তবর্তী সমস্ত কিছুই তাঁহারই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।" বাক্যটির অন্তর্নিহিত ভাব হচ্ছে উপরের বক্তব্য। বিশ্ব প্রকৃতিতে যে নিয়ম চালু আছে, তাই -ই আল্লাহ্‌র আইন বা আল্লাহ্‌র হুকুম। বিশ্ব প্রকৃতি আল্লাহ্‌র হুকুম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। এই মেনে চলাকেই বলা হয়েছে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করা। বিশ্ব-প্রকৃতি প্রাকৃতিক আইন লঙ্ঘন করে না। কারণ সে ক্ষমতা তাঁকে দেয়া হয় নাই। একমাত্র মানুষকেই এই ক্ষমতা দান করা হয়েছে ও মানুষের দেহ নয়, আত্মাকে করা হয়েছে স্বাধীন। শৈশব থেকে বার্দ্ধক্য পর্যন্ত নশ্বর দেহ তার উপরে ন্যস্ত আল্লাহ্‌র হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। চেষ্টা করলেও আমরা যৌবনকে ধরে রাখতে পারি না , বার্দ্ধক্য জড়া তাকে আক্রমণ করবেই। একমাত্র আত্মাকে দেয়া হয়েছে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" আর মানুষকে বলা হয়েছে এই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করতে আল্লাহ্‌র আনুগত্যের জন্য। কারণ আত্মাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে আল্লাহ্‌র আনুগত্যের জন্য। এই-ই আত্মার প্রকৃত ধর্ম। আল্লাহকে অস্বীকারের মাধ্যমে আত্মা তার স্বধর্মচ্যুত হয়। এ সব মানবাত্মা অনুধাবন করতে অক্ষম যে বিশ্ব প্রকৃতি এক ও অদ্বিতীয় শক্তির দ্বারা পরিচালিত এবং প্রকৃতির প্রতি জিনিষই আনন্দ ও গর্বের সাথে সেই স্রষ্টার মহিমা ঘোষণা করছে। মানবের এই অধঃপতন সত্বেও আল্লাহ্‌ সহনশীল ও ক্ষমাপরায়ণ।

৪৫। যখন তুমি কুর-আন আবৃত্তি কর -তখন যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তাদের ও তোমার মাঝে এক অদৃশ্য আবরণ টেনে দিই ২২৩০।

২২৩০। মওলানা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন , "Veil invisible" বাংলা অনুবাদ হয়েছে " অদৃশ্য আবরণ"। কোন কোন তফসীরকারের মতে, এস্থলে "Mastur" শব্দটি "Satir" শব্দটির সমার্থক। "Satir" অর্থ এমন পর্দ্দা যা অদৃশ্য , মোটা বা কালো পর্দ্দা। মওলানা ইউসুফ আলীর মতে "Mastur" পরিবর্তে "লুক্কায়িত বা অদৃশ্য " শব্দটি অধিক সামঞ্জস্য পূর্ণ। বিশ্ব -ব্রহ্মান্ডের সব কিছুকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহ্‌র আইনকে মানার জন্য। মানুষকেও সেই একই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে ‌মানুষকে "সীমিত স্বাধীত ইচ্ছা শক্তি " দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে সে স্ব ইচ্ছায় আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্ম সমর্পণ করবে। আত্মা হচ্ছে পরমাত্মার অংশ। তাই আত্মার ধর্মই হচ্ছে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করা। এর মাধ্যমেই সে তার সার্থকতা ও আনন্দ এবং শান্তি খুঁজে পায়। তারাই হতভাগ্য যারা আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে না। এদের কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্‌ এদের মোমেন বান্দাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেন এবং আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ ধারণ করার ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করেন। দেখা যায় এ সব বিপথগামীরা আল্লাহ্‌র বাণীর তাৎপর্য ও মাধুর্য্য গ্রহণে অক্ষম। যে বাণীর মাধুর্য্য মোমেন বান্দার অন্তরে শান্তির প্রলেপ দেয়, সেই বাণী অবিশ্বাসীদের অন্তরে বিদ্বেষ ও ঘৃণার সৃষ্টি করে। কারণ "অদৃশ্য পর্দ্দা" তাদের আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশে বাঁধার সৃষ্টি করে। কারণ (১) তারা মোমেন বান্দাদের সহচার্যের যোগ্য নয়। এবং (২) মোমেন বান্দাদের পবিত্র আত্মা এবং আল্লাহ্‌র বাণীকে অবিশ্বাসীদের ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প থেকে রক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা কখনও মোমেন ও বিশ্বাসীদের এবং কোরাণের বাণীকে বিশ্বাস করতে পারবে না। তাদের মধ্যে সর্বদা যোজন দূরত্ব বজায় থাকবে। যদিও এই পর্দ্দা অদৃশ্য কিন্তু এ দৃশ্যমান পর্দ্দার তুল্য।

৪৬। এবং আমি তাদের হৃদয় [ ও মনের ] উপরে ঢাকনা দিয়ে দিই, যেনো তারা কুর-আন উপলব্ধি করতে না পারে এবং কানে দিয়ে দিই বধিরতা ২২৩১। যখন তুমি কুর-আনে শুধুমাত্র তোমার প্রভুকে স্মরণ কর, তারা তখন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে [সত্য ] থেকে সরে পড়ে।

২২৩১। সত্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রত্যাখ্যানের ফলে অবিশ্বাসীদের হৃদয় সত্যকে গ্রহণের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। পার্থিব ভোগ বিলাসের জীবনকে বা নিজেদের মন গড়া তত্ব বা তথ্যকে যারা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের উপরে স্থান দেয় তাদের আত্মা সত্যের আলো থেকে বঞ্চিত হয়। সত্যের আলো হচ্ছে আল্লাহ্‌র নূর। যার অন্তর সত্যের আলোতে উদ্ভাসিত তার আত্মার মাঝে বিরাজ করবে জাগ্রত বিবেক [Spiritual insight]। সত্য-মিথ্যা , ভালো-মন্দ, ও ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা তাদের সম্মুখে হবে ভাস্বর। অপর পক্ষে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের আত্মা হবে আল্লাহ্‌র নূর বা সত্যের আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। তাদের বিবেক বুদ্ধি হবে কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারময়। সূর্যের আলো যেমন শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে পৃথিবীতে পৌঁছায় না। ঠিক সেরূপ অবিশ্বাসীদের সত্যকে, ন্যায়কে , ভালোকে বোঝার ক্ষমতা অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে যাবে। সুতারাং তারা কান থাকতেও সত্যের বাণীকে শুনতে পারবে না, তাদের উপলব্ধি ক্ষমতা হবে তিরোহিত। এক কথায় বলা যায় তাদের সঞ্চিত পাপের শাস্তিস্বরূপে তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে। প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাই হচেছ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ।

৪৭। যখন তারা কান পেতে তোমার কথা শোনে, কেন তারা তা শোনে আমি সবচেয়ে ভালো জানি, ২২৩২ এবং যখন তারা গোপন পরামর্শে মিলিত হয়, দেখো, দুষ্টরা বলে, " তোমরা তো এক যাদুগ্রস্থ ব্যক্তির অনুসরণ করছো।"

২২৩২। অবিশ্বাসীদের মানসিক অবস্থার বর্ণনা পূর্বোক্ত আয়াতে করা হয়েছে। যেহেতু তাদের আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ উপলব্ধির বা ধারণ করার ক্ষমতা থাকবে না, সেহেতু তারা যখন আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে শুনবে তা হবে ভান করা মাত্র। তারা প্রত্যাদেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তা শুনবে না , তারা তা শুনবে প্রত্যাদেশকে বিদ্রূপ করার জন্য। শোনাটা তাদের ভান মাত্র , কারণ যখন তারা সমবেত হয়, তখন তাদের প্রকৃত স্বরূপ উদ্বঘাটিত হয়। দেখুন [২:১৪] আয়াত এবং [৩:১১৯] আয়াত। তবে তারা এ কথা স্বীকার না করে পারে না যে যারা কোরাণের বাণী শোনে তারা এর মাধ্যমে শান্তি পায়, সান্তনা লাভ করে এবং বহু লোকের চরিত্র ও মানসিকতার পরিবর্তন হয়। সুতারাং তারা বলে যে "তারা যাদুগ্রস্থ ব্যক্তি দ্বারা আচ্ছন্ন। "তারা নিজেদের তাদের অপেক্ষ শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং বিশ্বাসীদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে এই বলে যে, "তোমরা তো এক যাদুগ্রস্থ ব্যক্তির অনুসরণ করছো।"

৪৮। দেখ, তোমার সম্বন্ধে তারা কি উপমা দেয়। উহারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা কখনও পথ খুঁজে পাবে না ২২৩৩।

২২৩৩। লক্ষ্য করুণ 'Sabilan' শব্দটির অর্থ 'কোন পথ' "পথটি" নয়। অবিশ্বাসীরা বিপথগামী, তারা সঠিক রাস্তাকে ত্যাগ করেছে, সুতারাং তারা সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য আর কোন পথ খুঁজে পাবে না।

৪৯। তারা বলে, " কি? অস্থিতে ও ধূলাতে পরিণত হলেও কি আমরা নূতন সৃষ্টিরূপে উত্থিত হব?" ২২৩৪

২২৩৪। অবিশ্বাসীরা অনুধাবনে ব্যর্থ যে কিভাবে মৃত্যুর পরে আবার তাদের পুণরুত্থান করা হবে। তিনি প্রথমে তাদের সৃষ্টি করেছেন কোনও কিছু ব্যতীত। যদি তিনি তা পারেন তবে তাদের অতীত অস্তিত্ব, স্মৃতি কথা থেকে তাদের আবার সৃষ্টি করা আল্লাহ্‌র জন্য কি এতই কঠিন? অবশ্যই তাদের পুণরুত্থান করা হবে , হিসাব-নিকাশ দাখিলের জন্য। পৃথিবীতে আল্লাহ্‌ যাকে যে সম্পদ দিয়েছেন, যেমন মেধা, মননশক্তি, প্রতিভা, দক্ষতা, ক্ষমতা , প্রভাব- প্রতিপত্তি, সব কিছুর সুষ্ঠু ব্যবহারের হিসাব প্রতিপালকের নিকট পুণরুত্থানের দিনে দাখিল করতে হবে। তাদের দেহাবশেষ অবশ্যই তাদের অস্তিত্বের, তাদের ব্যক্তিত্বের শেষ চিহ্ন ধারণ করে। কিন্তু যদি মৃত্যুর পরে তারা পাথর বা লোহাতেও পরিণত হত, যা বিশ্বাস করাও অবিশ্বাস্য, তবুও তা থেকে পুনরুত্থান ঘটানো আল্লাহ্‌র পক্ষে অসম্ভব নয়। আল্লাহ্‌ তার প্রত্যাদেশের মাধ্যমে পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি কর্মের হিসাব দাখিল করতে হবে।

৫০। বল, " তোমরা পাথর বা লৌহ হলেও, -

৫১। " অথবা এমন কিছু বস্তু যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন হবে [ উত্থিত করার জন্য ] , [তবুও তোমাদের উত্থিত করা হবে]।  তখন তারা বলবে, কে আমাদের পুনরাত্থিত করবে? বল্‌, তিনিই যিনি তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন।" তখন তারা তোমার দিকে মাথা নেড়ে বলবে ২২৩৫ , "উহা কবে?" বল, " সম্ভবতঃ শীঘ্রই হবে-

২২৩৫। সন্দেহ প্রবণরা যখন যুক্তিতে কোনঠাসা হয়ে পড়ে, তখন তারা একথা আর বলতে পারে না যে, পুনরুত্থান অসম্ভব। তাদের অস্তিত্ব, তাদের স্মৃতি, তাদের ব্যক্তিত্ব, তাদের দেহাবশেষ কখনও কালের অতল গর্ভে হারিয়ে যায় না। মহান আল্লাহ্‌র দরবারে তা রক্ষিত থাকে। সুতারাং সেখান থেকে তাদের পুণরায় সৃষ্টি সম্ভব। যদিও তারা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারে না, অবিশ্বাস, সন্দেহ তাদের ক্ষতবিক্ষত করে কিন্তু তারা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকে। তারা দ্বিধাগ্রস্থভাবে বলে, "উহা কবে" সংঘটিত হবে? অবশ্যই সে ঘটনা সংঘটিত হবে, তবে তার হিসাব আমাদের পৃথিবীর সময়ের হিসেবে করা সম্ভব নয়। আমরা সময়কে হিসাব করি আপেক্ষিক ভাবে। পুণরুত্থানের দিনে সময়কে ধারণ করা হবে অন্যমাত্রাতে , পৃথিবীর হিসেবে তা করা সম্ভব হবে না। তখন মনে হবে, অল্পকালই পৃথিবীতে অবস্থান করা হয়েছে। নূতন পৃথিবী হবে অন্যমাত্রার পৃথিবী।

৫২। "যেদিন তিনি তোমাদের আহ্বান করবেন, এবং তোমরা আল্লাহ্‌র প্রশংসা [বাণীর ] মাধ্যমে [তাঁর ডাকে] সাড়া দেবে ২২৩৬। এবং তোমরা মনে করবে তোমরা অল্প সময়ই [পৃথিবীতে] অবস্থান করেছিলে।" ২২৩৭

২২৩৬। পূর্বের আয়াতের শেষাংশে সন্দেহ বাতিকদের প্রশ্নের উত্তর দান করা হয়েছে যার আরম্ভ হয়েছে 'বল' শব্দটির দ্বারা। এই আয়াতটি [১৭:৫২] ওল্টানো কমার মধ্যে ধারণ করা হয়েছে। এ থেকে এই প্রতীয়মান হয় যে, এই আয়াতটিও অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের উত্তরের শেষাংশ যা শুরু হয়েছে পূর্বের আয়াতে। তবে আয়াতটির অর্থ সার্বজনীন। এর বক্তব্যে মোমেন বান্দাদের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য! " তোমরা আল্লাহর প্রশংসা [বাণীর ] মাধ্যমে [তাঁর ডাকে] সাড়া দিবে।" এতো মোমেন বান্দাদেরই কাজ।

২২৩৭। যারা পৃথিবীর জীবনের শেষে আর কোনও জীবন কল্পনা করে না, তাদের চেতনায় জীবনের প্রকৃত সত্যরূপ কখনও ধরা পড়ে না। আধ্যাত্মিক জগতের ধারণা তাদের চিন্তা জগতে স্থান পায় না। ফলে আধ্যাত্মিক জগত সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ইত্যাদি সম্বন্ধে তারা অন্ধ থাকে। কিন্তু পুণরুত্থানের দিনে অন্য মাত্রার [Another plane] যে পৃথিবী সৃষ্টি হবে সেখানে তাদের অজ্ঞতার আড়াল ঘুচে যাবে, তাদের অন্ধত্ব মোচন হবে। তারা প্রকৃত সত্যকে দেখতে পাবে। তাদের জ্ঞাননেত্র উম্মোচিত হবে। আল্লাহ্‌র একত্ব ও অস্থিত্ব সম্বন্ধে তাদের আর কোনও বিভ্রান্তি থাকবে না। তারা সকলেই সত্যকে স্বীকার করবে এবং মহান আল্লাহ্‌র প্রশংসা করবে। নূতন পৃথিবী হবে অন্য মাত্রার [Another plane] পৃথিবী যেখানে সময়ের ধারণাও হবে ভিন্ন মাত্রার। নূতন মাত্রার সময়ের হিসেবে পৃথিবীর জীবনের সময়ের হিসাবকে মনে হবে খুবই স্বল্প দীর্ঘ। সুতারাং তারা পৃথিবীর জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে। এবারে তারা সঠিক মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। দেখুন অন্যমাত্রার পৃথিবীর জন্য আয়াত [ ১৪:৪৮] ও [ ৫৬:৬১]।

রুকু - ৬

৫৩। আমার বান্দাদের বল, যা সবচেয়ে ভালো, তারা [শুধু] তাই-ই বলবে। নিশ্চয়ই শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির বীজ বপন করে। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। ২২৩৮

২২৩৮। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ মানুষকে দুইটি আদেশ দান করেছেন। (১) সকল সময়েই সকলের ভালো দিকটি সম্বন্ধে কথা বলবে। এমন কি যারা তোমার শত্রু এবং আল্লাহ্‌র শত্রু তাদের সম্বন্ধেও কুৎসা এবং খারাপ কিছু বলতে নিষেধ করা হয়েছে। মানুষের দোষত্রুটি অন্বেষণ করার কোনও অধিকার আমাদের নাই। আমরা পরের দোষ অন্বেষণ করার কি ক্ষমতা রাখি? আমরা তাদের বিচার করার কে? বিচারের ক্ষমতা একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র। কারণ তিনি সর্বশ্রোতা , সর্বজ্ঞাত। তিনি মনুষ্য সম্প্রদায়ের সৃষ্টিকর্তা এবং সকলের থেকে তিনিই তাদের সম্বন্ধে বেশী জানেন। মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি কখনও পূর্ণাঙ্গ নয়। এবং এরই সুযোগ গ্রহণ করে শয়তান মানুষকে কলহে লিপ্ত করে বিভক্ত করতে প্রয়াস পায়। (২) তোমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময়ে সন্দেহ গ্রস্থ হয়ে পরস্পরকে দোষারোপ না করে বিনয় ও ভদ্রভাবে কথা বলবে। কারণ মিথ্যা সন্দেহ ও অভিযোগ , বা নিষ্ঠুর কথা বহুদিনের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠতাকে নষ্ট করে দেয়। বহুদিনের বন্ধুত্বের বন্ধনকে ছিন্ন করে ফেলে। কারণ "শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির বীজ বপন করে"। যেহেতু বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তি শয়তানের, সেজন্য এই শক্তির বহুরূপ সমাজে বিদ্যমান। ঐক্য বা একতার শক্তি অপেক্ষা বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তির উপায় ও রূপ বহুধরণের হয়ে থাকে।

উপদেশ : পারস্পরিক মতানৈক্যের সময়ে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করো না।

৫৪। তোমাদের প্রভুই তোমাদের ভালোভাবে জানেন। যদি তিনি ইচ্ছা করেন, তিনি তোমাদের দয়া করেন, অথবা যদি তিনি ইচ্ছা করেন, শাস্তি [দেন]। আমি তোমাকে উহাদের কাজের ব্যবস্থাপক করে পাঠাই নাই ২২৩৯।

২২৩৯। ক্ষুদ্র মানুষ অনেক সময়েই নিজস্ব জ্ঞান ও বুদ্ধিতে নিজে বিমোহিত হয়। কিন্তু ক্ষণকালের জন্যও এ ধারণা তার কল্পনায় আনা উচিত নয় যে সে আল্লাহ্‌র কার্যকে বিচার করার ক্ষমতা রাখে। মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি পূর্ণাঙ্গ নয়। তা অত্যন্ত সীমিত। তার বিচার ক্ষমতা যুগ ও কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আল্লাহ্‌র জ্ঞান যুগ, কাল ও সময়ের উর্দ্ধে। সৃষ্টির সকল কিছু তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান ও বিচার শক্তিতে অনেক সময়ে মনে হয় পাপী ও অন্যায়কারীর উপরে আল্লাহ্‌র বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়েছে, আবার যাদের আমরা পূণ্যাত্মা ও ভালো লোক বলে বিচার করি তাদের উপরে আল্লাহ্‌র শাস্তি নেমে এসেছে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের নবীকে সাবধান করেছেন যে, পাপীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁকে প্রেরণ করা হয় নাই। তাঁকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে শিক্ষকরূপে, আল্লাহ্‌র বাণী প্রচারের জন্য। সেখানে আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে অন্য লোকের সম্বন্ধে বিচার করা, সিদ্ধান্ত দেয়া ও মন্তব্য করা কি অত্যন্ত অবিমৃষ্যকারীতা ও হটকারীতা নয় ? Mashiyat, - "আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা এবং ইচ্ছা" - মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির সীমানার বহু উর্দ্ধে।

৫৫। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তোমার প্রভু তার সকল কিছু ভালোভাবে জানেন ২২৪০। আমি তো নবীগণের কতককে কতকের উপরে মর্যাদা দিয়েছি। এবং দাউদকে প্রার্থনা সংগীতের [প্রতিভা] দান করেছিলাম। ২২৪১

২২৪০। আমরা সাধারণ লোকের দোষত্রুটি সম্বন্ধে সমালোচনা করবো না। এমন কি নবীদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে বৃথা কূটতর্কে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্‌ই একমাত্র বিচারকর্তা শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারনের। আরবদের মাঝে প্রেরিত নবী, নিরক্ষর হওয়া সত্বেও পৃথিবীতে তিনি মানুষের জন্য রহমত স্বরূপ বলে আল্লাহ্‌ বলেছেন। আবার অপরজনকে আল্লাহ্‌ "Kalimullah" বলেছেন। আবার অন্য আর একজনের জীবন শুরু হয় অলৌকিক জন্ম রহস্যের মধ্যে দিয়ে। এগুলি শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের মাপকাঠি নয়।এগুলি শুধুমাত্র ইঙ্গিত করে আল্লাহ্‌র অপরিসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিকে। একমাত্র আল্লাহই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের নিয়ামক শক্তি।

২২৪১। বিভিন্ন নবীদিগের আল্লাহ্‌ যে বিভিন্ন মর্যাদা বা নেয়ামতে ধন্য করেছিলেন,তা ছিলো সমসাময়িক পৃথিবীর প্রয়োজন ও পরিবেশের ভিত্তিতে। কারণ আল্লাহ্‌র জ্ঞান ও বিচক্ষণতা যুগ কাল অতিক্রান্ত। এখানে দাউদ নবীর যাবুর গ্রন্থের উল্লেখ বিশেষভাবে করা হয়েছে। যাবুর হচ্ছে প্রার্থনা সঙ্গীত যার অপভ্রংশ এখনও বিদ্যমান আছে। যেখানে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রশংসা বা গুণকীর্তন করা হয়েছে। এখানে ফরজ কর্তব্যের বিবরণ নাই। আয়াত [৪:১৬৩] যেখানে দাউদ নবীর সম্বন্ধে ঠিক একই বিবরণ ব্যবহার করা হয়েছে।

৫৬। বলঃ "আল্লাহ্‌কে ব্যতীত তোমরা যাদের কল্পনা কর তাদের আহ্বান কর। তোমাদের দুঃখ কষ্ট দূর করার অথবা তা পরিবর্তন করার কোন ক্ষমতা তাদের নাই।" ২২৪২

২২৪২। পূর্বোক্ত আয়াত সমূহে নবীদের সম্বন্ধে সমালোচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই আয়াতে তীব্র ভাষাতে তাদেরই নিন্দা জ্ঞাপন কর হয়েছে, যারা এক আল্লাহ্‌র পরিবর্তে অন্য উপাস্যের উপাসনা করে। আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান। মিথ্যা উপাস্যের কোনও শক্তি বা ক্ষমতা নাই ,তারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে পারে না। এমন কি মানুষের অবস্থার সামান্যতম পরিবর্তন করে তাদের একটু আরাম দেয়ার ক্ষমতাও তাদের নাই। তবে কেন তারা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করবে?

৫৭। ওরা যাদের আহ্বান করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী যে, এমনকি তারাও [নিজেদের জন্য] তাদের প্রভুর নৈকট্য লাভের সন্ধান করে। ২২৪৩ তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের আশা করে এবং তাঁর ক্রোধকে ভয় করে। নিশ্চয়ই তোমার প্রভুর ক্রোধকে ভয় করার মত।

২২৪৩। পুথিবীতে মানুষের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে অসাধারণ কিছুকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করা, বা তার কাছে সাহায্য চাওয়া। এই প্রবণতা থেকেই উদ্ভব হয় পীর পূঁজা, ব্যক্তিপূঁজা,বীরপূঁজা, আদর্শপুরুষ পূঁজা, নিদেনপক্ষে আল্লাহ্‌র প্রেরিত পুরুষদের পূঁজা [হযরত ঈশা (আ)] ইত্যাদি। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের সাবধান করেছেন যে, (১) তারা অসাধারণ হতে পারেন, পূণ্যাত্মা হতে পারেন কিন্তু মানুষের কল্যাণ করার ক্ষমতা বা মঙ্গল করার ক্ষমতা তাদের নাই। তারা নিজেরাই সর্বদা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের প্রার্থী। তারা কি ভাবে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে মানুষের জন্য নিয়ে আসবে? (২) আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে এ কথা অনুমান করাও অসম্ভব যে এ সব অসাধারণ ও পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরাও আল্লাহ্‌র আইনের আওতাভূক্ত। তারাও ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের [যা ইসলামের প্রধান শর্ত] উর্দ্ধে নয়। সকলেই জবাবদিহিতার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে নীত হবে। এদের কেউ যদি আল্লাহ্‌র আইন ভঙ্গ করেন তবে তারাও শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন না।

উপদেশ : অনুন্নত মুসলিম সমাজে ভন্ড পীরেরা মানুষের এই স্বাভাবিক প্রবণতার সুযোগ গ্রহণ করে যা অনৈসলামিক।

৫৮। এমন কোন জনপদ নাই যা আমি শেষ বিচার দিনের পূর্বে ধ্বংস করবো না অথবা ইহাকে ভয়াবহ দণ্ড দ্বারা শাস্তি দেবো না ২২৪৪। এটা তো লেখা আছে [শাশ্বত] নথিতে।

২২৪৪। পূর্বের আয়াতের শেষ লাইনটির [ "তোমার প্রভুর ক্রোধকে ভয় করার মত" ] ধারা বিবরণ হচ্ছে এই আয়াতটি। নাস্তিক ও অপরিণামদর্শীরাই আল্লাহ্‌র শাস্তিকে প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করতে সাহস করে। তারা কি সেই শাস্তির ভয়াবহতা সম্বন্ধে কোনও রূপ ধারণা পোষণ করে? আল্লাহ্‌র করুণা ব্যতীত সে শাস্তির ভয়ে পূণ্যাত্মারাও দিশেহারা ও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। আল্লাহ্‌ শাস্তি কঠোর। যারা পরকালে বিশ্বাসী নয়, তারা ভবিষ্যতের অশুভ পরিণতির কথা অনুধাবন করে না। তারা বর্তমানকেই জীবনের সব কিছু বলে ধারণা করে। সুতারাং তারা পরকালের শাস্তি সম্পর্কে নির্বিকার থাকতে সাহস করে। তাদের এই অজ্ঞতাই তাদের আল্লাহ্‌র শাস্তি ও অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি প্রতিদ্বন্দিতার আহ্বানে সাহস করে। তারা কি জানে না যে, আল্লাহ্‌র শাস্তি অবিশ্বাসীদের জন্য কত ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনবে? এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে কেয়ামতের দিনে সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। পাপীরা শাস্তি পাবে; সুতারাং যারা জ্ঞানী ও দূরদর্শী তারা সময় থাকতেই সাবধান হবে।

৫৯। আমি নিদর্শন প্রেরণ থেকে বিরত থাকি, তার একমাত্র কারণ হচ্ছে পূর্ববর্তী প্রজন্মের লোকেরা তা মিথ্যা বলে মনে করতো ২২৪৫। আমি সামুদ জাতির [জ্ঞান] চক্ষু উম্মীলন করার জন্য উষ্ট্রী প্রেরণ করেছিলাম ২২৪৬, কিন্তু তারা উহার সাথে অন্যায় ব্যবহার করেছিলো। আমি কেবল ভীতি প্রদর্শনের জন্য [এবং পাপ থেকে সাবধান হওয়ার জন্য ] নিদর্শন প্রেরণ করি ২২৪৭।

২২৪৫। অতীতে বহু জাতি আল্লাহ্‌র নিদর্শন ও মোজেজা ও ভীতিকে ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তার পরিণতিও তারা ভোগ করেছে। একমাত্র আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়াই পারে সেই সব বিপর্যয় , অশুভলক্ষণ ও শাস্তি থেকে মানব সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে। অন্যথায় আল্লাহ্‌র ভয়াবহ শাস্তি তাদের গ্রাস করে ফেলবে।

২২৪৬। এই আয়াতে সামুদ জাতির উদাহরণকে তুলে ধরা হয়েছে। একটি সুন্দর উষ্ট্রীকে তাদের মাঝে প্রেরণ করা হয় আল্লাহ্‌র ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। তাদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য। তাদের পাপ তাদের প্রকৃত ঘটনা অনুধাবনে বাধা দান করে। তারা উষ্ট্রীকে বধ করে। যে উষ্ট্রীর রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তারা তাদের পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারতো , ফলে সেই উষ্ট্রীই তাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়ায়। তাদের পাপের পাত্র পূর্ণ হয়। আল্লাহ্‌র প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্রোহ প্রকাশ্যরূপ ধারণ করে। উষ্ট্রীর কাহিনী ও এর সম্বন্ধে আনুসঙ্গিক জ্ঞাতব্যের জন্য দেখুন আয়াত [৭:৭৩] ও টিকা ১০৪৪।

২২৪৭। যুগে যুগে আল্লাহ্‌ তাঁর নিদর্শন , মোজেজা, এবং অশুভ ঘটনার পূর্বলক্ষণ প্রকাশ করেছেন বিভিন্নভাবে যেনো পাপীদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার ঘটে এবং তারা সঠিক পথে প্রত্যাবর্তন করে। আয়াতের [২:৭৪] টিকা ৮২ তে বলা হয়েছে যে, একমাত্র খোদাভীতিই কঠিন হৃদয়কেও অনুতাপ করতে সাহায্য করবে। মানুষকে আল্লাহ্‌ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন।" সে ইচ্ছা করলে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করতে পারে। কিন্তু যখন সে স্ব-ইচ্ছায় পাপের পথকে গ্রহণ করে। আল্লাহ্‌ কিন্তু তাকে তৎক্ষণাত শাস্তি দান করেন না। তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ্‌ তাঁর নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করেন। যুগে যুগে বিভিন্ন নবী রসুলের মাধ্যমে, প্রত্যাদেশের মাধ্যমে, সতর্কবাণী প্রেরণ করেছেন পাপীদের জন্য, যেনো তারা সঠিক পথের অন্বেষণ করে। কিন্তু আল্লাহ্‌র নিদর্শন ও ভীতি প্রদর্শন তাদের সঠিক পথে আনয়ন করতে অপারগ হয় এবং নিজেদের ধবংস নিজেরাই ডেকে আনে। যেমনটি ঘটেছিলো সামুদ জাতির বেলায়।

৬০। সাবধান! আমি তোমাকে বলেছি যে, তোমার প্রভু মানব জাতিকে পরিবেষ্টন করে আছেন ২২৪৮। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য আমি তোমাকে দৃষ্টি দান করে দেখিয়েছিলাম ২২৪৯ কুর-আনে [উল্লেখিত] অভিশপ্ত গাছ ২২৫০। এর সাহায্যে আমি ভীতি প্রদর্শন [ ও সাবধান ] করে থাকি; কিন্তু ইহা কেবল তাদের ঘোর অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে।

২২৪৮। অনুরূপ বাক্য আছে আয়াতে [৭২:২৮[ যে সূরাটি ইসলামের প্রথম যুগে মক্কাতে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু লাইনটির উপদেশ বা বক্তব্য কোন সময়ের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অজ্ঞ লোকেরা মনে করে আল্লাহ্‌র অবস্থান শুধুমাত্র সপ্ত আশমানের উপরে এবং তিনি সেখানেই সিংহাসনে আসীন। আল্লাহ্‌র ক্ষমতাতে আমাদের সৃষ্টি, তাঁর দয়া ও করুণায় আমাদের অস্তিত্ব। সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্ব, তাঁরই অনুভূতির প্রকাশ। আল্লাহ্‌ এক বিরাট বিশাল শক্তি, যিনি ভূলোকে দ্যুলোকে বিশ্বচরাচরে সর্ববস্তুকে অনুক্ষণ পরিবেষ্টন করে আছেন। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কোন ব্যবধান নাই। তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি বস্তুই তার সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে। এই সম্পূর্ণ আয়াতটি তিন অংশে বিভক্ত। সর্তকবাণী , ভীতিপ্রদর্শন বা নিদর্শন সমূহ আল্লাহ্‌ প্রেরণ করবেন কি না তা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র ইচ্ছাধীন আল্লাহ্‌র বৃহত্তর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আওতাভূক্ত। এ কথা কেউ যেনো মনে না করে যে, পাপীদের সাময়িক বিরতি দান আল্লাহ্‌র পরিকল্পনার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে সম্বন্ধহীন। কারণ : (১) আল্লাহ্‌ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে আছেন। পাপীদের সাময়িক অব্যহতি দান তার ক্ষমতার খর্বতাকে বোঝায় না। (২) আল্লাহ্‌ নবীকে যে দৃশ্য দেখান [মে'রাজের দৃশ্য ] তা ছিলো সত্যের প্রতীক। বিশ্বাসের দৃঢ়তা পরীক্ষার জন্য। কারা আল্লাহ্‌র এই নিদর্শনকে বিশ্বাস করে তা প্রমাণিত করার জন্য। (৩) আল্লাহ্‌ মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করেন তাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য। এটা তাঁর করুণা ও দয়ার স্বাক্ষর। তাৎক্ষণিক শাস্তি দান না করে অব্যহতি দান করেন পাপের পথকে পরিত্যাগ করার জন্য।

২২৪৯। কোন কোন তফসীরকারের মতে দৃশ্যটি মেরাজের দৃশ্য , আবার অনেকেই এ সম্বন্ধে দ্বিমত পোষণ করেন। মেরাজ আল্লাহ্‌র ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ , আল্লাহ্‌র বিরাট মোজেজা। মেরাজ বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের ভিত্তি আরও দৃঢ় করে এবং অবিশ্বাসীদের অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়। এ কথাকেই আয়াতে বলা হয়েছে, "মানুষের পরীক্ষার জন্য " আল্লাহ্‌ এসব অলৌকিক ক্রিয়া প্রদর্শন করেন যাতে বিশ্বাসীদের ঈমান আরও দৃঢ় হয় এবং অবিশ্বাসীদের সনাক্ত করা যায়।

২২৫০। বৃক্ষটির নাম "Zaqqum" গাছ। দেখুন জাকুম গাছের সম্বন্ধে বর্ণনা আছে আয়াত [৩৭: ৬২-৬৫]; [৪৪:৪৩-৪৬] এবং [৫৬: ৫২]। এই সূরাগুলি সূরা বণী ইসরাঈলের পূর্বে অবতীর্ণ হয়। এসব বর্ণনা থেকে অনুধাবন করা যায় যে, বৃক্ষটি দোযখের সর্বনিম্ন স্তরের ফসল। পাপীদের জন্য এ বৃক্ষ তাদের যোগ্যতার বিচারের পরীক্ষা স্বরূপ।

রুকু - ৭

৬১। স্মরণ কর! আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম, ২২৫১" আদমকে সেজ্‌দা কর।" ইব্‌লীস্‌ ব্যতীত তারা সকলেই সেজ্‌দা করলো। ইব্‌লীস্‌ বলেছিলো, " আমি কি তাকে সিজ্‌দা করবো যাকে আপনি কাদা থেকে সৃষ্টি করেছেন?"

২২৫১। বিভিন্ন সূরাতে আদমের কাহিনীর বর্ণনা আছে। তবে একই ঘটনাকে বর্ণনা করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। আয়াতের [৭:১১- ১৮] বর্ণনা অনুযায়ী: লোভ- লালসার ফাঁদে প্রতিটি আত্মার অধঃপতনকে শয়তান তরান্বিত করবে। অর্থাৎ শয়তানের আক্রমণ হবে প্রতিটি আত্মার উপরে ব্যক্তিগত ভাবে। আবার আয়াতে [২:৩০ -৩৮] বর্ণনা করা হয়েছে সকল মনুষ্য সম্প্রদায়কে সমষ্টিগত ভাবে। আদম ছিলেন সকল মনুষ্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, উদ্ধতপনা এগুলি ছিলো শয়তানের চরিত্রের অংশ যার কারণে তার পতন ঘটে।

উপদেশ : যে মানুষের চরিত্রে উপরের দোষগুলির প্রাধান্য বিস্তার করবে তাদেরও পতন অবশ্যাম্ভবী।

৬২। সে বলেছিলো, " আপনি কি বিবেচনা করেছেন? এই সেই ব্যক্তি যাকে আপনি আমার উপরে সম্মান দিয়েছেন। আপনি যদি আমাকে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, তবে অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরদের [সকলকেই] অবশ্যই আমার কর্তৃত্বাধীন করে ফেলবো !" ২২৫২

২২৫২। আল্লাহ্‌ মানুষকে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, এই ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে সে "ভালো" কে গ্রহণ করে চরিত্রে, গুণে,মর্যাদায়, সে ফেরেশতাতুল্য হতে পারে। আবার, "ভালো" কে ত্যাগ করে "মন্দ" কে গ্রহণ করে পশুর স্তরে নেমে যেতে পারে। অর্থাৎ পাপের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে স্ব-ইচ্ছায়। শয়তান তাকে প্ররোচনা দিতে পারে মাত্র। শয়তানের শুধু এটুকুই ক্ষমতা। কিন্তু কেউ যদি আন্তরিক ভাবে আল্লাহ্‌র উপাসনা করে, তাঁর সাহায্য কামনা করে ও সৎকাজ করে তবে শয়তানের সাধ্য নাই তাকে বিপথে, পাপের পথে পরিচালিত করার। এই বার্তাই বহন করে এনেছে আয়াত [১৭:৬৫] এবং কোরাণ শরীফের বহু আয়াতে।

৬৩। [আল্লাহ্‌ ] বলেছিলেন, " তোমার পথে চলে যাও ২২৫৩। যদি তাদের কেউ তোমাকে অনুসরণ করে তবে তাদের [সকলের] পুরষ্কার হবে জাহান্নাম - প্রচুর পরিমাণে পুরষ্কার।

২২৫৩। শয়তানের শক্তি হচ্ছে, পাপের শক্তি। যারা আল্লাহ্‌র হুকুম মান্য করে , তাদের জন্য এ শক্তি কার্যকর নয়। এই আয়াতের সার সংক্ষেপ এই। আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশ শয়তানের প্রতি ছিল নিম্নরূপঃ "তোমার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা কর, যদি কেউ তার "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অপব্যহার করে পাপের পথে ধাবিত হয় , তারা তাদের কর্মের ফল ভোগ করবে। তোমরা প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্মের জবাবদিহিতার জন্য বাধ্য থাকবে। "

৬৪। "তাদের মধ্যে যাদের পার ধ্বংসের পথে পরিচালনা কর, ২২৫৪ তোমার মনোমুগ্ধকর আহ্বানে ২২৫৫ তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা আক্রমণ কর ২২৫৬। সম্পদ ও সন্তান-সন্তদিতে পরস্পর অংশ গ্রহণ কর ২২৫৭ এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দাও। " কিন্তু শয়তান তাদের যে প্রতিশ্রুতি দেয় উহাতো ছলনা মাত্র। ২২৫৮

২২৫৪। এখানে আল্লাহ্‌ শয়তানকে বলছেন, " তোমার সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহার তুমি করতে পার। তোমাকে এবং তোমার অনুসারী উভয়কে সাবধান করা হচ্ছে যে, তোমাদের পাপের পথের শেষ প্রান্তে তোমাদের জন্য আছে আত্মঘাতী ধবংস।

২২৫৫। শয়তানের ফাঁদ বিশ্বভুবনের সর্বত্র বিরাজমান। এই ফাঁদের ধরণও বিভিন্ন। এর মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে, ব্যক্তিগত আবেদনের সম্মোহনী প্রতিক্রিয়া। অসৎ পরামর্শ, খারাপ সঙ্গ ইত্যাদি "তোমার মনোমুগ্ধকর আহ্বান" বাক্যটির ভাবকেই বহন করে।

২২৫৬। এই আয়াতে শয়তানের শক্তিকে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। সম্মুখ সমরে বিপক্ষ শক্তিকে আক্রমণের জন্য অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়, মানুষকে বিপথে চালিত করার জন্য শয়তানের যে শক্তি তা অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সমতুল্য। উপমার সাহায্যে সেই শক্তিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। লোভ এবং অসৎ পরামর্শ যখন কৃতকার্য হতে পারবে না, তখন শক্তির প্রয়োগ হবে , সঙ্গে থাকবে বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র। যেমন থাকে সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর সাথে।

২২৫৭। শয়তানের শক্তির বিভিন্নরূপের ব্যাখ্যা এখানে দান করা হয়েছে। তাঁর ভান্ডারে বিভিন্ন অস্ত্র জমা আছে। এর মধ্যে জাগতিক বস্তু ও সন্তান সন্ততির মাধ্যমে নিজের অহংকার প্রদর্শনের ইচ্ছা অন্যতম। অর্থ-সম্পদ, ধন-দৌলত লাভের জন্য মানুষ যখন ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য ভুলে যায়, তখনই সে শয়তানের অস্ত্রের কাছে পরাজিত হয়। আবার যখন সন্তান সন্ততিকে পার্থিব ও জাগতিক অর্থ সম্পদ ও ক্ষমতার অশুভ প্রতিযোগীতাতে শরীক করা হয় তখনও সে শয়তান দ্বারা পরাজিত হয়। এ ক্ষেত্রে মানুষের লোভ ও অহংকার এই দুইটি রীপুর তৃপ্ত সাধন করাই হয় শয়তানের কুমন্ত্রণার উদ্দেশ্য। লক্ষণীয়, যে কারণে আদমের ও শয়তানের বেহেশ্‌ত থেকে পতন ঘটে; তার মধ্যে উপরের দুইটি রীপু প্রধান। অন্যায় ও অসৎ পথে ধন-সম্পদ অর্জন লোভেরই পরিণাম। আর এসব দ্বারা নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা ও অন্যকে নিকৃষ্ট ধারণা করা অহংকারেরই পরিণাম।

২২৫৮। উপরে শয়তানের শক্তির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে আয়াতের শেষ বাক্যটি উহারই অংশ বিশেষ। এখানে শয়তান বা পাপের পথের শেষ পরিণতির উল্লেখ করা হয়েছে।

৬৫। [অপর পক্ষে] " আমার বান্দাদের উপরে তোমার কোনও কর্তৃত্ব থাকবে না " ২২৫৯। তোমাদের কর্ম বিধায়ক হিসেবে আল্লাহ্‌- ই যথেষ্ট ২২৬০।

২২৫৯। এই আয়াতটির অর্থ সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে, পূর্বোক্ত দুটি আয়াতকে সংযুক্ত করে এক সাথে পড়তে হবে। মন্দের বা পাপের বা শয়তানের ভালোর উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ নাই। শয়তানের নিয়ন্ত্রণ তাদের উপরেই থাকে যারা তার পরামর্শ গ্রহণ করে ও শয়তানের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে।

২২৬০। যেহেতু অশুভ শক্তির আল্লাহ্‌র অনুগত বান্দাদের উপরে কোনওরূপ কর্তৃত্ব নাই, প্রকৃত আল্লাহ্‌ভক্ত বান্দারা, তাদের সকল বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা হবে শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র উপরে। বান্দার সকল কার্যের পরিচালনার শক্তি একমাত্র তারই, তিনি সর্বশক্তিমান। তাঁর করুণা মোমেন বান্দাকে সকল অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। প্রতিপালক ও কর্মবিধায়ক হিসেবে তিনিই যথেষ্ট।

৬৬। তিনিই তোমাদের প্রভু যিনি সমুদ্রে তোমাদের নৌযানসমূহ নিরাপদে পরিচালিত করেন, যেনো তোমরা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পার। ২২৬১ নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।

২২৬১। এই আয়াতে সুন্দর উপমার সাহায্যে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের বর্ণনা করা হয়েছে। অসীম সমুদ্র হচ্ছে বিশাল, নিঃসীম। মানুষ সমুদ্রের তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র। কিন্তু এই ক্ষুদ্র মানুষ এই বিশাল জলরাশিকে অতিক্রম করে দেশে বিদেশে বাণিজ্য করে, পরিভ্রমণ করে। এই বিশাল সিন্ধুকে অতিক্রম করার যে দক্ষতা সেতো আল্লাহ্‌রই দান। দেশ দেশান্তরে যাত্রার ফলে মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করে ফলে সে জাগতিক অর্থ-সম্পদের মালিক হয়, আবার পৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষ আর এক প্রান্তে যাত্রার ফলে সামাজিক সংমিশ্রণ ঘটে। ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। মানুষ মানুষকে জানার সুযোগ পায়। আবার জ্ঞানর্জনের ফলে মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের সুযোগ ঘটে। আল্লাহ্‌র বাণীর প্রচার ও প্রসার ঘটার সুযোগ লাভ করে। আয়াত [২:১৬৪] তে অনুরূপ ভাবে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে বর্ণনা করা হয়েছে।

৬৭। যখন সমুদ্রে বিপর্যয় তোমাদের পাকড়াও করে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত তোমরা যাদের ডাকতে , তারা তোমাদের হতাশার মাঝে ত্যাগ করে চলে যায়। কিন্তু যখন তিনি তোমাদের নিরাপদে স্থলে ফিরিয়ে আনেন, তোমরা [তাঁর থেকে ] মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ তো অতিশয় অকৃতজ্ঞ। ২২৬২

২২৬২। আল্লাহ্‌র সদয় অনুগ্রহ এবং দয়াকে মানুষের অকৃতজ্ঞতার বিপরীতে তুলনা করা হয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে বিপদে কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে, কিন্তু যখনই বিপদ থেকে উদ্ধার পায় তখন সে আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের পরিবর্তে আল্লাহ্‌কে ভুলে যায় এবং সকল কৃতিত্ব নিজে ভোগ করতে চায় বা মিথ্যা উপাস্যের প্রতি আরোপ করে। মিথ্যা উপাস্য যথা দৈব শক্তি প্রাপ্ত ব্যক্তি, বা তাবিজ,মাদুলী বা পীর , ফকির বা মানুষের দক্ষতা ইত্যাদি দেখুন [১০:২২-২৩]।

৬৮। এরপরেও কি তোমরা নিরাপদ বোধ কর যে তোমরা যখন স্থলে থাক, তিনি তোমাদের সহ কোন ভূভাগ ধ্বসিয়ে দেবেন না , ২২৬৩ অথবা তিনি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় [পাথর সহ] প্রেরণ করবেন না ? তখন তোমরা তোমাদের কোন কর্ম বিধায়ক পাবে না।

২২৬৩। মানুষ গৃহ নির্মাণ করে সুউচ্চ দুর্গ নির্মাণ করে তাঁর মধ্যে বাস করে ধারণা করে সে সর্বাপেক্ষা নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করছে। কিন্তু আল্লাহ্‌র দয়া ও অনুগ্রহ ব্যতীত কেহই নিরাপদ নয়। সে স্থলে, জলে, আকাশে, সমুদ্রে যেখানেই যে অবস্থায় থাকুক না কেন আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ব্যতীত সে নিরাপদ নয়। এখানে স্থল ভাগের দুইটি দুর্যোগের উল্লেখ করা হয়েছে , যা জনপদকে ধবংস করে দিতে পারে মূহুর্তের মধ্যে। একটি ভূমিকম্প অন্যটি টর্নেডো বা ঘূর্ণি ঝড়। ভূমিকম্পের ধবংসলীলা আমাদের অজানা নয়। মূহুর্তের মধ্যে শত শত লোকের জীবন নাশের কারণ ঘটে একেই বলা হয়েছে "ভূগর্ভস্থ করা" আবার আগ্নেয়গিরির ধ্বংসলীলা সম্বন্ধেও আমাদের ধারণা আছে। সে সম্বন্ধে আমরা সম্যক অবহিত। উভয় ক্ষেত্রে ধবংসলীলা এতই আকস্মিক ভাবে ঘটে যে মানুষ তার জীবন রক্ষার জন্য সামান্যতম সুযোগই পায় না। নিঃশেষে জনবসতি মুছে যায় মূহুর্তের মধ্যে।

৬৯। অথবা তোমরা কি নিরাপদ বোধ করছো যে তিনি তোমাদের দ্বিতীয়বার সমুদ্রে প্রেরণ করবেন না এবং তোমাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঝটিকা প্রেরণ করবেন না , তোমাদের নিমজ্জিত করার জন্য? কারণ তোমাদের অকৃতজ্ঞতার জন্য ২২৬৪। তখন তোমরা আমার বিরুদ্ধে কোন সাহায্যকারী পাবে না।

২২৬৪। এই আয়াতে আল্লাহ্‌র গজবের আর দুটি বর্ণনা করা হয়েছে। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস ও প্রচন্ড টনের্ডো বা ঝটিকা। নিকট অতীতে সুনামীর ধ্বংস করার ক্ষমতাও মানুষের নিকট সুপরিজ্ঞাত। মানুষ আল্লাহ্‌র ক্রোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্থল থেকে সমুদ্রে অথবা সমুদ্র থেকে ডাঙ্গাতে যেখানেই যাক না কেন, কোথাও সে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ব্যতীত নিরাপদ নয়। সে বারে বারে সমুদ্রে যাত্রা করতে পারে , তবে সে কি বলতে পারে তার শেষ পরিণতি কি? সে কি সমুদ্রে ডুবে যেতে পারে না? একমাত্র আল্লাহ্‌র অনুগ্রহই মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দান করতে পারে।

৭০। আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি। তাদের স্থলভাগে ও সমুদ্রে চলাচলের জন্য বাহন দান করেছি। তাদের ভালো ও পবিত্র জীবনোপকরণ দান করেছি; এবং আমার সৃষ্টির অধিকাংশের উপরে তাদের বিশেষ মর্যাদা দান করেছি ২২৬৫।

২২৬৫। আদম সন্তানকে আল্লাহ্‌ পৃথিবীতে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব রূপে প্রেরণ করেছেন। তাকে অন্যান্য সব সৃষ্ট পদার্থ থেকে বেশী মর্যাদা দান করা হয়েছে। এই আয়াতে এই সব মর্যাদার কয়েকটির উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ তাদের কর্তব্য ও দায়িত্বকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য। তাকে দান করা হয়েছে বিশেষ কর্মদক্ষতা যার সাহায্যে সে জলে, স্থলে বর্তমানে আকাশেও পরিভ্রমণ করতে পারে। বেঁচে থাকার জন্য এবং শরীর ধারণের জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের উত্তম রিযকের সুবন্দোবস্ত করেছেন। একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ্‌ বিবেক ও বিচার বুদ্ধি [Spiritual faculties] দান করেছেন, যা আল্লাহ্‌র সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এই দানের মর্যাদা অবশ্যই আদম সন্তানকে বুঝতে হবে। সুতারাং পরকালের অনন্ত জীবনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা কি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য নয়?

রুকু - ৮

৭১। একদিন আমি সকল মানব সম্প্রদায়কে এক সাথে আহ্বান করবো তাদের [নিজ নিজ] ইমাম সহ ২২৬৬। যাদের ডান হাতে তাদের আমলনামা দেয়া হবে, তারা তা [আনন্দের ] সাথে পাঠ করবে। এবং তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণ অন্যায়ও করা হবে না ২২৬৭।

২২৬৬। "Imam" শব্দটির বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে সূরার [২:১২৪] আয়াতে এবং টিকা ১২৪। এই আয়াতে এর অর্থ কি হবে। এ ব্যাপারে তফসীরকারেরা একমত নন। একদল মনে করেন শেষ বিচারের দিনে যখন পুণরুত্থান ঘটবে, আদম সন্তানের প্রতিটি দলের তাদের স্ব স্ব নেতা সহ আবির্ভাব ঘটবে। নেতা তাদের পাপ ও পূণ্যের সাক্ষী হবেন [দেখুন ১৬: ৮৪] আয়াত। অন্যদলের অভিমত হচ্ছে ইমাম শব্দটি প্রত্যাদেশ ও কিতাবের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। তৃতীয় দলের অভিমত হচ্ছে 'ইমাম' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীতে প্রত্যেকের কৃত কর্মের বিবরণীর পরিবর্তে। প্রত্যেকের কৃত কর্ম সে দিন সাক্ষী হিসেবে কাজ করবে। পরবর্তী আয়াতে যেরূপ বলা হয়েছে। [মওলানা ইউসুফ আলী প্রথম দলের অনুগামী]

২২৬৭। 'fatil' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে পরিমানের সামান্য বোঝানোর জন্য। এত সামান্য যে, খেজুরের বীচির সাথে সে সামান্য পরিমাণ শ্বাস লেগে থাকে তার থেকেও কম।

৭২। কিন্তু যারা এই পৃথিবীতে অন্ধ থাকবে , সে পরলোকেও অন্ধ থাকবে এবং সবচেয়ে বেশী পথভ্রষ্ট হবে। ২২৬৮

২২৬৮। এখানে 'অন্ধ' শব্দটি প্রতীকধর্মী। মানুষ যে শুধু চক্ষুবিহীন হলেই অন্ধ হয়, তা নয়, মানুষ যখন বিবেক [spiritual insight] ও বিচার বুদ্ধি [judgement] হারিয়ে ফেলে তখন সে আধ্যাত্মিক দিক থেকে অন্ধ হয়ে যায়। সে তখন ন্যায় -অন্যায়, ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। সত্যের আলো, ন্যায়ের আলো , ভালোর আলো তার অন্তরকে আলোকিত করে না। চক্ষু থাকতেও এরা অন্ধ। এদের কথাই এই আয়াতে বলা হয়েছে অন্ধ, বোবা ও বধির। এরাই হলো অন্ধকারের সন্তান। এরা পৃথিবীতেও বিবেক বর্জিত বা অন্ধ, পরকালেও তাদের অন্ধ ভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে। আল্লাহ্‌র নূর তাদের হৃদয়কে ইহকালে আলোকিত করে নাই ফলে পরকালেও করবে না। " বেশী পথভ্রষ্ট" বাক্যটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, এরা যত বেশী দিন পৃথিবীতে থাকে,তত বেশী পথভ্রষ্ট হয়। অন্ধত্ব অর্থাৎ আলোকে দেখতে না পাওয়াকে পথভ্রষ্ট বা সঠিক পথ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়ার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে।

৭৩। আমি তোমার প্রতি যে প্রত্যাদেশ দিয়েছি, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা থেকে তোমাকে পদস্খলনে প্রলোভিত করা , যাতে করে তুমি [ওহীর বদলে] সম্পূর্ণ অন্য কিছু উদ্ভাবন কর ২২৬৯। দেখো! [সে ক্ষেত্রে] তারা অবশ্যই তোমাকে [তাদের ] বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে।

২২৬৯। যুগে যুগে আল্লাহ্‌র সৈনিকদের পদস্খলনের চেষ্টা করা হয়েছে। এ থেকে আমাদের নবীও রেহাই পান নাই। পার্থিব ও জাগতিক বস্তুর বিনিময়ে আল্লাহর সৈনিকদের তাদের সংগ্রামের আপোস-মিমাংসা করার প্রলোভন দান করা হয়। "সামান্য আপোস" এর বিনিময়ে "ক্ষমতার" কেন্দ্রে প্রবেশে সহায়তা দান করা। সামান্য আপোস এখানে মক্কার কাবা ঘরে প্রতিষ্ঠিত পৌত্তলিকদের সম্মান প্রদর্শনের বিনিময়ে মক্কার শাসক গোষ্ঠির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ লাভ করা। মুসাইলামার মত মোনাফেক ও অসৎ লোকেরা এরূপ প্রস্তাবের বাস্তবায়নে সর্বাপেক্ষা উল্লসিত হতো, এবং বন্ধু ও সাহায্যকারী রূপে নবীর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতো। একেই বলা হয়েছে " পদস্খলনে প্রলোভিত করা।" কিন্তু আল্লাহ্‌র সৈনিক ও নবীরা তাদের কর্তব্যে অটল থাকেন। আপতঃমধুর প্রতারণাকে প্রত্যাখ্যান করার মত ক্ষমতা আল্লাহ্‌ তাদের দান করেন।

উপদেশঃ এই আয়াতের উপদেশ সার্বজনীন। যুগে যুগে মহৎ কাজকে পন্ডশ্রম করার জন্য বিরুদ্ধ শক্তি যখন নীপিড়ন ও অত্যাচারের মাধ্যমে সাফল্য লাভ না করে, তখন তারা জাগতিক ও পার্থিব প্রলোভনের দ্বারা আল্লাহ্‌র সৈনিকদের পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে। এর প্রচুর উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে বর্তমান।

৭৪। আমি যদি তোমাকে শক্তি না দিতাম , তুমি প্রায় তাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে ২২৭০।

২২৭০। এই আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, তাৎক্ষণিক লাভের দিকে ঝুকে পড়া মানুষের একটি সাধারণ দুর্বলতা। এ থেকে আমাদের নবীও রেহাই পান নাই। সামান্য আপোষের মাধ্যমে যদি আল্লাহ্‌র বাণীর প্রচার দ্রুত করা যায়। এই চিন্তা তাঁকে ব্যপ্ত করেছিলো। তাঁর চিন্তা ও চেতনাকে ব্যপ্ত করে ছিলো, স্বর্গীয় দায়িত্ব, যা তাঁকে বিশেষভাবে দান করা হয়েছিলো, প্রচার ও প্রকাশের জন্য। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে এই কাজ সহজতর হবে এই চিন্তা তাকে প্রলোভিত করে কিন্তু আল্লাহ্‌ তার নবীকে শেষ পর্যন্ত অবিচলিত রাখেন। তিনিই তাঁকে সকল বাঁধা বিপত্তির মুখে দৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। অন্যায় ও অসত্যের সাথে আপোষ-মিমাংসার প্রলোভনকে জয় করতে সাহায্য করেন।

উপদেশঃ কোনও মহৎ কাজে সামান্য পরিমাণ হলেও অন্যায়ের সাথে আপোষ মিমাংসাকে আল্লাহ্‌ নিষেধ করেছেন। অন্যায় ও অসত্যের ধর্মই হচ্ছে ক্ষুদ্র থেকে তা বৃহৎ ব্যপ্তি ঘটায়। অর্থাৎ সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়া।

৭৫। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে দ্বিগুণ ও পরজীবনে দ্বিগুণ [শাস্তি] আস্বাদন করাইতাম ২২৭১। এবং তখন আমার বিরুদ্ধে তোমার জন্য কোন সাহায্যকারীও পেতে না ২২৭২।

২২৭১। যদি বিপথগামীদের প্রলোভনের কাছে নবী আত্মসমর্পন করতেন তবে তাঁকেও পরকালে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হতো। যেহেতু তাঁর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সাধারণ মানুষের অপেক্ষা বেশী, সুতারাং তাঁর কর্তব্যের প্রতি অবহেলার শাস্তিও সাধারণ লোকের অপেক্ষা বেশী। "এই জীবনে দ্বিগুণ ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তি" হত সত্যকে ত্যাগ করার জন্য।

উপদেশ : প্রতিটি লোককেই নির্দ্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য সে আল্লাহ্‌র নিকট অঙ্গীকার বদ্ধ। জীবনের কোনও অবস্থাতেই তা পরিত্যাগ করা চলবে না। এই আয়াতগুলিতে এই উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, স্ব-স্ব কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করতে হবে সত্য ও ন্যায়ের পথে যা আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্দ্দেশিত পথ। বক্র পথে বা অন্যায় পথে বা অসত্য পথে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছানোর হুকুম নাই। জীবনের কোন অবস্থাতে কোনও প্রতিকূলতাতে অন্যায় ও অসত্যের সাথে সন্ধি স্থাপন করা আল্লাহ্‌ অনুমোদন করেন না।

২২৭২। আয়াতগুলিতে একটি নির্দ্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে সার্বজনীন উপদেশ প্রদান করা হয়েছে যা যুগ কাল অতিক্রান্ত। সত্যের সাথে মিথ্যার, ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের , ভালোর সাথে মন্দের কখনও আপোষ-মিমাংসা বা সন্ধি হতে পারে না। এরূপ সন্ধি বা আপোষের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন তা কোন সুফল বয়ে আনবে না। তাৎক্ষণিক ভাবে মনে হতে পারে আপোষের মাধ্যমে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক হলে ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে , আল্লাহ্‌র পথে সংগ্রাম সহজতর হবে। কিন্তু তা হবে প্রতারণাপূর্ণ উপায়। আল্লাহ্‌র রাস্তায় যুদ্ধে কোন প্রতারণা বা আল্লাহ্‌র সাহায্য অপেক্ষা অন্য কারও উপরে নির্ভর করা হচ্ছে আল্লাহ্‌র মহিমাকে খর্ব করা।

উপদেশঃ জীবনের সর্বঅবস্থায় আল্লাহ্‌ই হচ্ছেন একমাত্র অবলম্বন ও ভরসাস্থল।

৭৬। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাকে দেশ থেকে উৎখাত করা যেনো তোমাকে সেখান থেকে বের করে দেবার ভয় দেখাতে পারে। সে ক্ষেত্রে,তোমার পরে [সেখানে] তারা অল্পকাল টিকে থাকতো। ২২৭৩

২২৭৩। একবার মক্কার কাফেররা তাদের মধ্যে থেকে রসুলুল্লাহ্‌ (সা) কে বহিস্কার করার চেষ্টা করে যেনো শেষ পর্যন্ত তাকে দেশ থেকে উৎখাত করা যায়। কিন্তু ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে তা শুধুমাত্র জানেন আল্লাহ্‌। তাঁর পরিকল্পনাই একমাত্র সফল হবে। রসুলুল্লাহ্‌ (সা) স্বল্পকালের জন্য মদীনাতে হিজরত করেন সত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাফেররা পরাজিত হয় ও মক্কা মুসলমানদের করতলগত হয়।

উপদেশঃ যদি অন্যায়কারীরা মোমেন বা পূণ্যাত্মাদের উপরে অত্যাচার করে, তবে নিজেরাই নিজেদের কবর খনন করে।

৭৭। তোমার পূর্বে যে সব নবীদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের ক্ষেত্রেও এরূপ নিয়ম ছিলো। তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না। ২২৭৪

২২৭৪। যুগে যুগে আল্লাহ্‌র নবী রসুল এবং আল্লাহ্‌র সৈনিকেরা এ ভাবেই অন্যায় ও অসত্যের দ্বারা বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু অন্যায় ও অসত্য শেষ পর্যন্ত ধবংস হবেই, ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই। কারণ আল্লাহ্‌ স্বয়ং তাদের রক্ষা করেন। হয়তো বা সাময়িক ভাবে অন্যায় ও অসত্যের প্রভাব কিছু দিনের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে।

৭৮। নিয়মিত সালাত আদায় করবে ২২৭৫ - সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত; এবং [আদায় করবে] প্রত্যুষের সালাত ও [কুর-আন] পাঠ। নিশ্চয়ই প্রত্যুষে [কুর-আন ] পাঠ তাদের [ফেরেশতাদের ] সাক্ষ্য গ্রহণ করে ২২৭৬।

২২৭৫। তফসীরকারদের মতে এই আয়াতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ দান করা হয়েছে। সূর্য মধ্যাহ্ন আকাশ থেকে ঢলে পড়ার পর থেকে রাত্রির অন্ধকার সম্পূর্ণরূপে ধরণীকে ঢেকে দেয়া পর্যন্ত চারবার এবং প্রত্যুষে ফজরের নামাজ। "কুর-‌আ-নাল ফজর" বাক্যটির এখানে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে " ফজরের সালাত"। এখানে কুরাণের অর্থ 'সালাত' করা হয়েছে। অন্যান্য বাংলা অনুবাদে বলা হয়েছে, " ফজরের কোরাণপাঠ"। ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে "Recital of Quran in the morning prayer." ফজরের কোরাণ পাঠ কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এর গুরুত্ব প্রকাশের জন্য। সূর্য মধ্যাহ্ন গগণ থেকে ঢলে পড়ার পরে যে সব নামাজের সময় হয়, সেগুলি হলো, জোহর, সূর্য মধ্য আকাশ অতিক্রমের সাথে সাথে শুরু হয়, যতক্ষণ না বিকাল শুরু হয়। শেষ বিকেলে আসরের নামাজের সময় হয়। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং আকাশ থেকে সূর্যের শেষ লালিমা বিকিরণ শেষ হয়ে গেলে রাত্রির অন্ধকার ঘণীভূত হওয়ার পরে এশার ওয়াক্ত শুরু হয়। নির্দ্দিষ্ট কোনও শব্দের অর্থ সম্বন্ধে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু তাতে আয়াতগুলি সামগ্রিক অর্থের কোনও তারতম্য ঘটে না।

২২৭৬। ফজরের নামাজকে এককভাবে নির্দ্দিষ্ট করা হয়েছে বিশেষভাবে। রাত্রির অবসানে প্রত্যুষে প্রকৃতি থাকে দিনের কোলাহল মুক্ত শান্ত ও পবিত্র। সারা রাত্রি বিশ্রামের পরে প্রকৃতির এই বিশেষ ক্ষণটির মাধুর্য্য মানুষের আত্মার উপরে প্রভাব বিস্তার করে। শান্ত প্রকৃতির মাঝে প্রার্থনার মাধ্যমে স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পন হয় সহজ ও সুন্দর।

৭৯। এবং [ভোর ] রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে ২২৭৭ এটা হবে তোমার [আধ্যাত্মিক লাভের] জন্য অতিরিক্ত প্রার্থনা। শীর্ঘ্রই তোমার প্রভু তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত ও মহিমান্বিত স্থানে। ২২৭৮

২২৭৭। এই আয়াতটিতে রসুলুল্লাহকে (সা) সম্বোধন করে বিশেষভাবে নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে , তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য। অর্থাৎ পাঁচওয়াক্তের পরেও তা শুধুমাত্র রসুলুল্লাহ্‌র (সা) জন্য "অতিরিক্ত কর্তব্য" বলে ধার্য করা হয়েছে। তাহাজ্জুদের সময় মধ্যরাত্রির পরে শুরু হয় এবং প্রত্যুষের কিছুপূর্বে শেষ হয়।

২২৭৮। "Maqam Mahmud" অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থান। পরলোকে রসুলুল্লাহ্‌ কে (সা) সর্বোচ্চ প্রশংসার স্থানে অধিষ্ঠিত করার আশ্বাস দিয়েছেন। এই সূরাটি মক্কাতে অবতীর্ণ হয়, সুতারাং তাৎক্ষণিক ভাবে আশা করা যায় যে শীঘ্রই মক্কাবাসীর অত্যাচারের অবসান ঘটবে এবং মদিনার গৌরবজ্জল অধ্যায় শুরু হবে।

৮০। বলঃ " হে আমার প্রভু আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সাথে এবং নিষ্ক্রান্ত করাও কল্যাণের সাথে ২২৭৯ এবং তোমার নিকট থেকে [আমাকে] দান কর সাহায্যকারী শক্তি। ২২৮০

২২৭৯। "প্রবেশ ও নিষ্ক্রান্ত" এই শব্দটি ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই আয়াতে শব্দ দুটিকে চারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। (১) মৃত্যুর রাজ্যে প্রবেশ করা ও মৃত্যুর রাজ্য থেকে পুনরুত্থানের মাধ্যমে নিষ্ক্রান্ত হওয়া। যারা পূণ্যাত্মা ও মোমেন বান্দা তারা তাদের আত্মাকে পবিত্র করেন নামাজের মাধ্যমে [পূর্ববর্তী আয়াতে দ্রষ্টব্য] এবং কোরাণের শিক্ষার মাধ্যমে [পরবর্তী আয়াতে দ্রষ্টব্য]। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সত্যকে হৃদয়ঙ্গমের মাধ্যমে তারা অপার আনন্দ লাভ করেন। অপর পক্ষে যারা আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকে তাদের জীবনবোধ হয় সম্পূর্ণ আলাদা। সত্যের শিক্ষা তাদের মনে তিক্ততার বৃদ্ধি করে। তাদের জন্য অপেক্ষা করে অসম্মান। (২) এর অর্থ হতে পারে নবীর মদিনায় প্রবেশ লাভ করা , যদিও তা তখনও ছিলো ভবিষ্যতের গর্ভে। এবং নিষ্ক্রমন ঘটবে অত্যাচার থেকে, মিথ্যায় কলুষিত পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে। মক্কার পৌত্তলিক পরিবেশ থেকে নিষ্ক্রমণ ঘটবে। (৩) মদিনাতে হিজরতের ইঙ্গিতে উপরোক্ত প্রার্থনা হতে পারে। মদিনাতে প্রবেশ লাভ হয় যেনো সত্য নিয়তে প্রশান্ত চিত্তে, সম্মানের সাথে, অত্যাচারী মক্কবাসীদের উপরে ক্রোধের বশবর্তী না হয়ে অথবা মদিনাতে ক্ষমতা লাভের উচ্চাশার বশবর্তী না হয়ে। লোভ-লালসা ও রাগ-দ্বেষ থেকে নিষ্ক্রমণ চাওয়া হয়েছে। (৪) চতুর্থত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ ঘটে থাকে তা যেনো কল্যাণের সাথে ঘটে এই প্রার্থনা স্রষ্টার কাছে নিবেদনের মাধ্যমে।

২২৮০। সকল নামাজ বা প্রার্থনার উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করা। আল্লাহ্‌ ব্যতীত ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি দানের ক্ষমতা কারও নাই। আমরা যত পরিকল্পনাই করি না কেন আমাদের সাফল্য আল্লাহ্‌র সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল।

৮১। এবং বল, " সত্য এসেছে এবং মিথ্যা ধ্বংস হয়েছে। [স্বাভাবিক ভাবেই ] মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই।" ২২৮১

২২৮১। সত্য চিরস্থায়ী অপর পক্ষে মিথ্যার অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী। মিথ্যার শেষ পরিণতি ধ্বংস।

৮২। [ধাপে ধাপে] আমি এই কুর-আন অবতীর্ণ করেছি যা বিশ্বাসীদের জন্য [আত্মার] আরোগ্য ও রহমত। কিন্তু অন্যায়কারীদের জন্য উহা ক্ষতির উপরে ক্ষতি বৃদ্ধি করে। ২২৮২

২২৮২। দুঃখের অমানিশাতে যখন আমাদের হৃদয় নিরাশার অন্ধকারে ডুবে যায়, দুঃখ তাপে আমরা যখন দিশেহারা হয়ে পড়ি , ভবিষ্যত আমাদের কাছে অন্ধকারে ঢাকা থাকে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ সেই দুঃখ ভারাক্রান্ত আত্মার জন্য আরোগ্য ও রহমত। কারণ তা আমাদের পাপের জন্য ক্ষমার বার্তা বহন করে; আল্লাহ্‌র ক্ষমা আত্মাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়। যাদের হৃদয়ে বিশ্বাসের দৃঢ়তা আছে, তারা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের এই সুযোগ লাভ করে থাকে। যারা আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অর্থাৎ আল্লাহ্‌র আইনকে ভঙ্গ করে তারা হয় ক্ষতিগ্রস্থ। যত তারা সত্যকে প্রতিহত করবে, তত তারা পাপের পঙ্কে ডুবে যেতে থাকবে এবং আল্লাহ্‌র ক্রোধের পাত্রে পরিণত হবে যা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার থেকেও ভয়ংকর। একমাত্র মোমেন বান্দারাই আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ থেকে জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। পৃথিবীতে মানুষের কামনা বাসনা মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে। ফলে পাপের কালিমা আত্মাকে করে ক্ষতবিক্ষত ও ব্যাধিগ্রস্থ। একমাত্র আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশই পারে সঠিক পথের সন্ধান দ্বারা আত্মাকে ব্যাধিমুক্ত করতে। কুর-আন আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ, আল্লাহ্‌র রহমত স্বরূপ।

৮৩। তবুও যখন আমি মানুষের উপরে আমার অনুগ্রহ বর্ষণ করি, সে [আমার দিকে আসার পরিবর্তে] মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং দূরে সরে যায়। এবং যখন মন্দ তাকে ঘিরে ধরে, সে হতাশ হয়ে পড়ে ২২৮৩।

২২৮৩। মানুষ যখন আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করে, তার স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, গর্বে, অহংকারে স্ফীত হওয়া। সুখের দিনে সে আল্লাহকে ভুলে যায়। আবার দুঃখ-কষ্ট ও দুর্যোগ যখন আমাদের ঘিরে ধরে তখন সাধারণ মানুষ হতাশায় ডুবে যায়। বিপদে আল্লাহকে ডাকার পরিবর্তে সে হতাশগ্রস্ত হয়। কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ আমাদের এই দুই চরম অবস্থা থেকে রক্ষা করে। আমাদের বলা হয়েছে সুখের দিনে, আনন্দের দিনে গর্বে , অহংকারে স্ফীত না হয়ে সে একান্তভাবে আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ্‌র নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, যার দানে তার এই সুখ ও সমৃদ্ধি। আবার দুঃখ বিপর্যয়ের দিনে সে একাগ্রভাবে আল্লাহ্‌রই আশ্রয় প্রার্থনা কামনা করে, কারণ তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়দাতা আর কে আছে?

৮৪। বল, " প্রত্যেকই নিজ প্রবৃত্তি অনুযায়ী কাজ করে থাকে। কিন্তু তোমার প্রভু ভালো করে জানেন, চলার পথে কে সর্বাপেক্ষা নির্ভুল। " ২২৮৪

২২৮৪। এই আয়াত দ্বারা গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে নিষেধ করা হয়েছে। পাপীরা তাদের নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী চলবে। তাতে আমাদের নিরাশ বা হতাশ হওয়ার কিছু নাই। কারণ এই তাদের ধর্ম। আমরা আল্লাহ্‌র নিকট পথের নির্দ্দেশ যাঞ্চা করবো এবং দৃঢ় ভাবে সে পথে চলবো।

রুকু - ১০

৮৫। তারা তোমাকে [ওহী দানকারী] রূহু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে ২২৮৫। বল, " রূহু আমার প্রভুর আদেশে [আসে]। [হে মানব] এ সম্পর্কে খুব সামান্য জ্ঞানই তোমাদের দেয়া হয়েছে।

২২৮৫। রূহ বলে কি বোঝানো হয়েছে? এ বিষয় এখানে প্রথমে প্রাণীধানযোগ্য যে, প্রশ্নকারী কোন অর্থের দিক দিয়ে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলো?কোন কোন তফসীরকার বর্ণনার পূর্বাপর ধারার প্রতি লক্ষ্য করে প্রশ্নটি ওহী কোরাণ অথবা ওহীবাহক ফেরেশতা জিবরাঈলকে সাব্যস্ত করেছেন। ওহী বা প্রত্যাদেশ কি? এর ধরণ কি? কে তা আনে? কিভাবে আসে? ইত্যাদি বহুবিধ প্রশ্ন প্রত্যাদেশ বা ওহী এবং এর বাহক সম্বন্ধে করা হতো। কোরাণ অথবা ওহীকে রূহ বলা কোরাণের একটি বিশেষ পরিভাষা ছিলো। এ সব প্রশ্নের জবাব এখানে দেয়া হয়েছে। প্রত্যাদেশকে আমাদের দৈনন্দিক জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রত্যাদেশ পাওয়া আত্মার জন্য সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা যা মানুষের ভাষাতে প্রকাশ অসম্ভব। এই অভিজ্ঞতা জাগতিক নয়, এই অভিজ্ঞতা আধ্যাত্মিক। রূহ [জিব্রাঈল] নিজ ইচ্ছা দ্বারা আসতে পারে না। জিব্রাঈল (আ) শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করেন এবং আল্লাহ্‌ যে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেন শুধু তাই-ই প্রকাশ করেন। মানুষের জ্ঞান যত বেশীই হোক না কেন, বস্তুনিচয়ের সর্বব্যপী স্বরূপের দিক দিয়ে তা অল্পই। বিশেষতঃ আধ্যাত্মিক জ্ঞানের খুব অল্পই মরণশীল মানুষ অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানুষ ততটুকুই আয়ত্ব করতে পারে, যতটুকু তাঁকে আল্লাহ্‌ বোঝার ক্ষমতা দান করেন। তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা স্রষ্টা আমাদের দান করেন নাই। 'রূহ' সম্পর্কে প্রশ্নটি ছিলো সেরূপ প্রশ্ন যার উত্তর বোঝার বা অনুধাবন করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাই। স্রষ্টার অসীম জ্ঞানের রহস্য, যা আমাদের ধারণ ক্ষমতার বাইরে, তার সম্বন্ধে প্রশ্ন মূর্খতা বই আর কিছু নয়। কারণ আমাদের যা জ্ঞান তা আমাদের ক্ষমতায় অর্জিত হয় না তা ধারণ করার ক্ষমতাও আল্লাহ্‌র দান। বিশেষতঃ আধ্যাত্মিক জ্ঞান কখনও জাগতিক জ্ঞানের দ্বারা অর্জিত হয় না। আল্লাহ্‌র বিশেষ রহমতে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সন্ধান লাভ করা যায়।

মন্তব্য : জাগতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ ব্যক্তিরা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ নাও হতে পারে।

৮৬। যে প্রত্যাদেশ তোমাকে দেয়া হয়েছে , আমি যদি ইচ্ছা করতাম তা প্রত্যাহার করে নিতে পারতাম ২২৮৬ তা হলে এ বিষয়ে তুমি আমার বিরুদ্ধে কোন কর্ম বিধায়ক পেতে না ; -

২২৮৬। এই আয়াতে নবীকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন। আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য যে আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞান তা আল্লাহ্‌র দান করেন। এ কথা ভাবার অবকাশ নাই যে, তা অর্জিত হয়েছে আমাদের কৃতিত্বে। আধ্যাত্মিক জ্ঞান কেউ ইচ্ছা করলেই অর্জন করতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ্‌ই তার বান্দাকে তা দান করে থাকেন। এ তো আল্লাহ্‌রই করুণা ও দয়ার স্বাক্ষর। যদি তিনি ইচ্ছা করেন তবে তা প্রত্যাহার করতে পারেন। এ ব্যাপারে আল্লাহকে প্রশ্ন করার অধিকার কারও নাই।

৮৭। তোমার প্রভুর অনুগ্রহ ব্যতীত ২২৮৭। তোমার প্রতি তোমার প্রভুর অনুগ্রহ [সত্যিই ] অসীম।

২২৮৭। আমাদের আত্মিক উন্নতি, সমৃদ্ধি ও জ্ঞান আল্লাহ্‌রই দয়া ও করুণার স্বাক্ষর। আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করলেই তা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়ার উপরে নির্ভরশীল। রসুলুল্লাহ্‌কে (সা) বলা হয় আল্লাহ্‌র "করুণা ও দয়া"। কারণ আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়ার বিমূর্ত রূপকে মূর্তরূপে আল্লাহ্‌ প্রকাশ করেছেন রসুলের (সা) মাধ্যমে। সে কারণেই রসুলের (সা) আর এক উপাধি "আল্লাহ্‌র রহমত" আল্লাহ্‌র করুণার আর এক মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে কুর-আনে। সেই কারণে প্রতিটি সূরার প্রারম্ভ হচ্ছে পরম করুণাময়ের নামে।

৮৮। বল, " যদি এই কুর-আনের অনুরূপ কুর-আন উপস্থাপন করার জন্য সকল মানুষ ও জ্বিনকে সমবেত করা ২২৮৮ হতো, এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য সহযোগীতা করতো, তবুও তারা অনুরূপ [কুর-আন] উপস্থাপন করতে পারতো না ২২৮৯।

২২৮৮। 'জ্বিন' শব্দটির প্রকৃত অর্থের জন্য দেখুন সূরা [৬:১০০] আয়াত ও টিকা ৯২৯।

২২৮৯। ঐশীগ্রন্থ হিসেবে কোরাণের প্রমাণ হচ্ছে এর প্রকৃতি, এর সৌন্দর্য এবং যে পরিপ্রেক্ষিতে তা নাজেল হয় তার পটভূমিতে এর সার্বজনীন আবেদন যা যুগ ও কাল অতিক্রান্ত। যার বাণীর মাধুর্য আত্মাকে জাগতিক কালিমা থেকে উর্দ্ধ জগতে আরোহনের পথ করে দেয়। আত্মা হয় সমৃদ্ধ ও মুক্ত। পৃথিবীর সমস্ত শক্তিকে অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনার জন্য প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু তা কখনও সম্ভব হয় নাই। এই-ই একমাত্র ধর্ম গ্রন্থ যা অদ্যাবধি অবিকৃত অবস্থায় আছে। অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন সূরা [২:২৩] আয়াত, সূরা [১০:৩৮] আয়াত এবং সূরা [১১:১৩] আয়াত।

৮৯। এই কুর-আনে আমি মানুষের জন্য বিভিন্ন উপমা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি ২২৯০। তবুও অধিকাংশ মানুষ অকৃতজ্ঞ হওয়া ব্যতিরেকে তা [গ্রহণ করতে ] অস্বীকার করে থাকে। ২২৯১

২২৯০। কোরাণে আল্লাহ্‌র হুকুমকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন উদাহরণ, উপমা, রূপক, উপদেশ মূলক গল্প ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে শুধুমাত্র গল্প বা বিমূর্ত ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় নাই। বোঝানোর জন্য খুঁটিনাটি বর্ণনা এতে আছে।

২২৯১। "অকৃতজ্ঞতা করা ব্যতীত "। বাক্যটি অন্তত্য গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষ কুর-আনকে ঐশিগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করে ঠিকই কিন্তু তা যে ভাবে গ্রহণ করা উচিত তা তারা করে না। তারা শুধুমাত্র মৌখিক শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করে দেয়। কুর-আনকে আরবী ভাষাতে নাজেল করা হয়েছে ,যেনো আরবী ভাষী লোকেরা [যেখানে কুর-আন অবতীর্ণ হয়] কুর-আনের বক্তব্য পড়ে বুঝতে পারে ও হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। অনুরূপ আয়াত দেখুন [২:১২১] এবং [১২:২]; [১৯:৯৭] ; [৪২:৭]; [৪৩:৩]। সুতারাং কুর-আনকে পড়ে বুঝে আত্মার মাঝে ধারণ করার উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অন্যথায় তা হবে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার বা কুফরী করার সামিল।

৯০। তারা বলে, "আমরা কখনই তোমাকে বিশ্বাস করবো না, যতক্ষণ না তুমি ভূমি থেকে আমাদের জন্য এক প্রস্রবণ উৎসারিত কর, ২২৯২

২২৯২। দেখুন অনুরূপ আয়াত [২: ৬০]

৯১। [যতক্ষণ না ] তোমার খেজুর ও আঙ্গুঁরের বাগান হবে, যার মধ্যে দিয়ে প্রচুর পানি বহন করে স্রোতস্বীনি নদী বয়ে যাবে ২২৯৩

২২৯৩। বিশ্বাসের ভিত্তি যেখানে থাকে দুর্বল, সেখানে লোকে ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তে অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের অনুসন্ধান করে। আলোচ্য আয়াত সমূহে যে সব অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের ফরমায়েশ করা হয়েছে বিশ্বাসের পূর্বশর্ত হিসাবে, সেগুলি তালগোল পাকানো, যুক্তিহীন আবদার ব্যতীত আর কিছু নয়। মরুভূমির মাঝে তৃষ্ণার্ত ইহুদীদের কাছে হযরত মুসা কর্তৃক প্রস্রবণ সৃষ্টি, জম্‌জম্‌ কূপের সৃষ্টি, এগুলি অলৌকিক ক্রিয়া কর্ম ছিল সত্য, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের পূর্বশর্ত নয়। অবিশ্বাসীদের আবদারগুলি ছিলো প্রায় ঠাট্টা তামাসার সমশ্রেণী। এ ধরণের প্রশ্নের জবাবে মানুষ স্বভাবতঃই রাগের বশবর্তী হয়ে জবাব দেয়। কিন্তু আল্লাহ্‌ তায়ালা স্বীয় পয়গম্বরকে যে জওয়াব শিক্ষা দিয়েছেন, তা প্রণিধানযোগ্য, সংস্কারকদের জন্য চিরস্মরণীয় এবং কর্মের আদর্শ করার বিষয়। এই জবাব শুরু হয়েছে ৯৩ আয়াতের শেষ থেকে এবং সম্প্রসারিত হয়েছে ১১ ও ১২ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত জবাবগুলিতে কোনও রূপ বিদ্রূপাত্মক শব্দ বা হটকারীতাপূর্ণ বাক্য উচ্চারণ করা হয় নাই বা তাদের নিবুর্দ্ধিতা প্রকাশ করা হয় নাই। জবাবগুলি ছিলো যুক্তিপূর্ণ ও ধীরস্থির। তাদের ফরমায়েশ ছিলো , জলসিঞ্চিত তরুলতা ও বৃক্ষশোভিত সতেজ সবুজ উদ্যান। সুন্দর উদ্যানকে কোরাণ শরীফে বেহেশতের সুখ ও শান্তির প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। স্বর্ণ নির্মিত গৃহ, যা পার্থিব ও জাগতিক সম্পদের প্রতীক। তাদের আরও দাবী ছিলো আকাশকে খন্ড বিখন্ড করা, আল্লাহ্‌ ও ফেরেশতাদের সম্মুখে আনায়ন করা, আকাশে আরোহণ করা, সরাসরি তাদের হাতে কিতাব দান করা, ইত্যাদি। অবিশ্বাসীরা আল্লাহকে হুকুম করতে পারে না তাদের কৌতুহল মেটানোর জন্য। তাদের বক্তব্য এ কথাই প্রমাণ করে যে, তাদের ধারণাগুলি ছিলো অশ্রদ্ধাতে পরিপূর্ণ।

৯২। " অথবা তুমি যেরূপ বল, [সেরূপে] আকাশ খন্ড বিখন্ড হয়ে আমাদের উপরে পড়বে ২২৯৪। অথবা তুমি আল্লাহ্‌ এবং ফেরেশ্‌তাদের [আমাদের ] সম্মুখে মুখোমুখি দাঁড় করাবে , ২২৯৫

২২৯৪। আকাশকে খন্ড বিখন্ড করার বর্ণনা আছে [৮২:১] আয়াতে ও [২৫:২৫] আয়াতে। এই আয়াতগুলির বর্ণনাতে যে ভয় ও শ্রদ্ধার উদ্রেক করে অবিশ্বাসীরা এই বর্ণনাকেই বিদ্রূপ ও ব্যঙ্গক্তি করেছে। আমরা জানি উপরোক্ত বর্ণনা ছিলো কেয়ামতের বর্ণনার অংশ বিশেষ যাকে অবিশ্বাসীরা হাসি ঠাট্টার বিষয়ে পরিণত করে।

২২৯৫। ইহুদীরা পূর্বেও এরূপ অযৌক্তিক দাবীর উত্থাপন করেছিলো। এ ব্যাপারে দেখুন সূরা [২:৫৫] আয়াত ও [৪:১৫৩] আয়াতের বর্ণনা। সুরা [৬:৮-৯] আয়াতে আছে ফেরেশতাদের পৃথিবীতে পাঠানো সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের প্রত্যয়ন উৎপাদনের জন্য। এসব আয়াত এ কথাই প্রমাণ করে যে, যুগে যুগে অবিশ্বাসীদের সন্দেহের প্রকাশ একই রূপ।

৯৩। " অথবা তোমার একটি স্বর্ণ নির্মিত গৃহ থাকবে, অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে ২২৯৬। কিন্তু তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনও ঈমান আনবো না যতক্ষণ না তুমি আমাদের [নিকট ] এক কিতাব অবতীর্ণ কর যা আমরা পাঠ করবো " ২২৯৭। বল: " আমার প্রভু মহিমান্বিত! আমি তো হচ্ছি কেবল একজন মানুষ,একজন রাসুল মাত্র ২২৯৮। "

২২৯৬। অনুরূপ আয়াত দেখুন [৬:৩৫]

২২৯৭। পার্থিব জগতের বাইরে যারা কিছু কল্পনাও করতে পারে না তাদের পক্ষে এরূপ নিবুর্দ্ধিতার পরিচয় দেয়া সম্ভব যে তাদের হাতে কিতাব বা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করা হবে। স্বর্গ থেকে পাচমেন্ট কাগজে লিখিত আকারে কিতাব তাদের হাতে দিলেই তাদের বিশ্বাস উৎপন্ন হবে। হায়রে বস্তুবাদী মানব, বস্তুর বাইরে অপার্থিব কিছু তাদের ধারণারও বাইরে। দেখুন অনুরূপ আয়াত [৬:৭]

২২৯৮। সাধারণ মানুষের যে সব জৈবিক প্রয়োজন থাকে আল্লাহ্‌র রসুলেরও তা ছিলো। তিনিও মানবীয় অভাব ও প্রয়োজনে অভ্যস্ত ছিলেন। কাজেই অবিশ্বাসীদের ধারণা ছিলো তাঁর সাধারণ মানুষের উপরে কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নাই। বস্তুবাদী লোক বস্তুর বাইরে আধ্যাত্মিক জগতকে চিন্তা করতে অক্ষম। এ কথা তাদের পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব ছিলো যে, আল্লাহ্‌র নবীর শ্রেষ্ঠত্ব তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। তিনি সাধারণ মানুষ, তবে আল্লাহ্‌র তরফ থেকে নবুয়ত প্রাপ্তির ফলে তিনি সাধারণ থেকে অসাধারণত্বে উপণীত হন। তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের কর্মক্ষেত্র ছিল সুবিস্তৃত বিশাল। অবিশ্বাসীদের কুটিল খেয়াল বা কল্পনাকে চরিতার্থ করার কোনও প্রয়োজনই তাঁর নাই। আধ্যাত্মিক জগতের সামান্যতম জ্ঞানও যদি তাদের থাকতো, তবে তারা অনুধাবন করতো যে সমগ্র কুর-আন শরীফ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মোজেজা বা অলৌকিক কর্ম। কুর-আন হচ্ছে আল্লাহ্‌র স্থায়ী মোজেজা যা যুগ কাল অতিক্রান্ত। নিরক্ষর নবীর দ্বারা এরূপ গ্রন্থ প্রকাশ করা এবং যুগ যুগ ধরে তা অবিকৃত থাকা আল্লাহ্‌র অলৌকিক ক্রিয়া কর্ম নয় কি? তবে তারা তা অনুধাবন করে না কেন? এর সত্যিকারের কারণ হচ্ছে ইবলীসের মত তাদের বিদ্বেষ, হিংসা যা পরবর্তী আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।

উপদেশঃ বিদ্বেষ পরায়ণ ও হিংসুকেরা কখনও প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বকে অনুধাবন করতে পারবে না।

রুকু - ১১

৯৪। যখন ওদের নিকট পথ নির্দেশ আসে, তখন তাদের ঈমান আনা থেকে যা বিরত রাখে তা হচ্ছে, তারা বলেঃ "আল্লাহ্‌ কি [আমাদের মত] একজন লোককে [তাঁর ] রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন? " ২২৯৯

২২৯৯। এই আয়াতগুলিতে যদিও আল্লাহ্‌ রসুলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তবুও এর আবেদন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বসাধারণের জন্য। হিংসুক ও বিদ্বেষ পরায়ণ লোকের বৈশিষ্ট্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যারা হিংসুক ও বিদ্বেষপরায়ণ , তারা সগোত্রের বা ভাতৃস্থানীয় কারও উন্নতিতে বা সম্মান লাভে আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে ঈর্ষাণ্বিত হয়ে ওঠে এবং খোঁড়া যুক্তির অবতারণা করে, যেমন অবিশ্বাসীরা রসুলের নবুয়ত সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছিলো। কারণ হিংসা ও ঈর্ষা তাদের হৃদয়ে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়; যেমন ইবলিসের হৃদয়ে আদমের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে হিংসায় প্রজ্জ্বলিত হয়েছিলো। দেখুন সূরা [১৭:৬১] এবং এর টিকা ২২৫১। এ সব লোক নিজ ভ্রাতারও সম্মান, প্রতিপত্তি, গৌরব সহ্য করতে পারে না। আল্লাহ্‌র নেয়ামত হিংসুক ব্যতীত আর কেহ পাবে এই চিন্তা তাকে অসহণীয় করে তোলে। ফলে তারা নিজ ভ্রাতারও বিরোধিতা করতে দ্বিধা বোধ করে না। এই বিরোধিতা করার জন্য তারা বিভিন্ন মিথ্যা যুক্তি তর্কের অবতারণা করে।

৯৫। বলঃ " যদি পৃথিবীতে শান্ত ও নিশ্চিন্ত ভাবে বিচরণ ফেরেশ্‌তাদের জন্য নির্দ্দিষ্ট করা হতো ২৩০০; তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান থেকে কোন ফেরেশতাকেই নবী করে পাঠাতাম। "

২৩০০। এই আয়াতের যুক্তি হচ্ছে ফেরেশতারা যদি পৃথিবীতে বাস করতে পারতো, তবে পৃথিবীতে ধর্ম প্রচারক হিসেবে ফেরেশতাদেরই প্রেরণ করা হতো। তাহলে ফেরেশতা ও মানুষ সহঅবস্থানের ফলে পরস্পরকে বুঝতে পারতো এবং আল্লাহ্‌র বাণীকে খুব সহজেই তারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিত। কিন্তু পৃথিবীকে ফেরেশতাদের বাসের উপযোগী করা হয় নাই, পৃথিবীকে শুধুমাত্র মানুষেরই বাসের উপযোগী করা হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ বিভিন্ন গোত্র, জাতি এবং শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক শ্রেণীর জন্য আল্লাহ্‌ রসুল প্রেরণ করেছেন তাদের স্বগোত্রের মধ্য থেকে। যেমনঃ নবী হুদকে প্রেরণ করা হয় তাঁর স্বগোত্র আদ্‌দের জন্য [১১:৫০], নবী সালেহ্‌ কে প্রেরণ করা হয় তাঁর স্বগোত্র সামুদ জাতির জন্য [১১:৬১] ইত্যাদি। এমন কি লূতের সম্প্রদায়ের কাছে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতাদের প্রেরণ করা হয় [১১:৭৭-৮০]। কিন্তু পাপ যাদের ঘিরে রাখে তারা মানুষ কি ফেরেশতা কারও উপদেশই শুনতে রাজী থাকে না। সেক্ষেত্রে ফেরেশতাকেও যদি আল্লাহ্‌র বাণী প্রচারের জন্য পাঠানো হতো, তবে তারা কৃতকার্য হতো না।

৯৬। বলঃ " তোমাদের ও আমার মাঝে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্‌ -ই যথেষ্ট ২৩০১। তিনি তাঁর বান্দাদের সম্বন্ধে ভালোভাবে জানেন এবং [সব কিছু] দেখেন। "

২৩০১। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ রসুলকে সম্বোধন করেছেন অবিশ্বাসীদের বলতে যে, "যদি তোমরা সত্যিই প্রমাণ চাও, তবে তার জন্য অলৌকিক ক্রিয়া কর্মকে আহ্বান করার প্রয়োজন কি? সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্‌ ই যথেষ্ট। আধ্যাত্মিক জগতকে অনুভব করার জন্য অলৌকিক কর্মকান্ডের প্রয়োজন নাই। আধ্যাত্মিক জগত, বিবেক [Spiritual insight] ও অন্তর্দৃষ্টি তখনই আত্মার ভিতরে অনুভব করা সম্ভব হবে, যদি অনুতাপের মাধ্যমে পাপকে ক্ষয় করা হয় এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা যায়। পরিশুদ্ধ আত্মাতে কেউ যদি একান্ত ও বিশ্বস্তভাবে আল্লাহ্‌র কাছে পথের নির্দ্দেশ কামনা করে, আল্লাহ্‌ তাকে পথের নির্দ্দেশ দান করেন। কারণ তিনি বান্দাদিগকে সবিশেষ জানেন ও দেখেন।

৯৭। আল্লাহ্‌ যাকে পথ নির্দ্দেশ দান করেন সেই তো সত্য পথ প্রাপ্ত। কিন্তু তিনি যাদের বিপথে ছেড়ে দেন, তুমি তাদের জন্য আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কাউকে রক্ষাকারী পাবে না ২৩০২। শেষ বিচারের দিনে আমি তাদের সমবেত করবো, নতমুখে , অন্ধ , বোবা এবং বধির [অবস্থায়]। তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। যখনই তা স্থিমিত হয়ে আসবে আমি তখনই আগুনের প্রচন্ডতা বৃদ্ধি করে দেবো ২৩০৩।

২৩০২। অবিশ্বস্ততা বা সুক্ষ কৌশলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করা যায় না। এ সব প্রতারণাপূর্ণ কৌশল আল্লাহ্‌র নিকট সুস্পষ্ট। সুতারাং এ সবের মাধ্যমে তারা কখনই সঠিক পথের সন্ধান লাভ করবে না। যদি একান্ত বিশ্বস্ত ভাবে আল্লাহ্‌র করুণা লাভের জন্য, সঠিক পথের জন্য প্রার্থনা না করা হয়, তবে অবশ্যই সে পথ ভ্রান্ত হবে। যে পথ ভ্রান্ত আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কাকে ওদের অভিভাবক পাবে?

২৩০৩। এই লাইন কয়টিতে পাপীর বর্ণনাকে প্রতীকধর্মীরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদি কেউ অবাধ্য, একগুয়ে ভাবে পাপের পথে চলতে থাকে, তাদের অবস্থা এবং শেষ পরিণতির বর্ণনা আছে এই লাইন কয়টিতে। তাদের জন্য আছে অপমানকর লাঞ্ছনা। "নতমুখে" অবস্থা হচ্ছে অপমানিত ব্যক্তির লজ্জায় অপমানে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার প্রবণতা যারা পৃথিবীতে পাপে আসক্ত থাকে, তারা এই পৃথিবীতেই তাদের পাপের শাস্তি পেতে শুরু করে। তাদের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। তারা নিজস্ব স্বার্থ ব্যতীত ন্যায়-অন্যায় , ভালো-মন্দে, সত্য-অসত্যের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে অপারগ হয়। ফলে তাদের বিবেক হয়ে পড়ে তমসাচ্ছন্ন। তমসাচ্ছন্ন আত্মায় সত্যের আলো পৌঁছায় না। এদের বর্ণনায় বলা হয়েছে অন্ধ মূক ও বধির। 'অন্ধ' কারণ , বিশ্বপ্রকৃতিতে যে, আল্লাহ্‌র নিদর্শন পরিব্যপ্ত হয়ে আছে তা তাদের অনুভবে দৃষ্টিগোচর হবে না। তারা হবে যেনো চক্ষু থাকতেও অন্ধ। 'মুক' অর্থাৎ কথা বলার ক্ষমতা রহিত বা বোবা। যাদের আত্মা তমসাচ্ছন্ন তারা আত্মার মাঝে কখনও আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য কামনা করবে না। তাদের প্রার্থনায় কখনও আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাবে না। তারা কখনও ন্যায় ও সত্যের বাণীকে প্রচারে উৎসাহ প্রকাশ করবে না। তারা কখনও আল্লাহ্‌র কাছে আত্মনিবেদনের ভাষাকে অনুভব করতে পারবে না। তারা যেনো বোবা, বধির,বা যারা কানে শোনে না। বিশ্ব প্রকৃতি শান্তি ও শৃঙ্খলার এক অনবদ্য ঐক্যতানে আবদ্ধ। পূণ্যাত্মা ব্যক্তির জীবনও এই ঐকতানের সূরে বাঁধা। শান্তি ও প্রশান্তিতে ভরা জীবন তাকে বৃহত্তর মহত্তর জীবনের সুরের সন্ধান দেয়। কিন্তু পাপিষ্ঠ আত্মায় আল্লাহ্‌র বাণীর মাধুর্য্য, ন্যায়ের ডাক, সত্যের বার্তা কিছুই তার হৃদয়ে পৌঁছায় না। ঠিক যেরূপ বধির ব্যক্তি কোনও শব্দই শুনতে পায় না। আবার আংশিক বধির যারা তারা বিভিন্ন শব্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, ফলে বিশৃঙ্খল শব্দ সম্ভার তাদের শ্রুতিতে গোচর হয়। এই উপমাগুলির সাহায্যে এ কথাই বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে মানুষের বিভিন্ন ঐশ্বরিক মানসিক দক্ষতা [Faculties of judgment] বা বিবেক লুপ্ত হয়ে যাবে পাপের দরুণ। এবং লুপ্ত বা বিবেকহীন অবস্থাতেই তাদের হাশরের ময়দানে পুনরুত্থান ঘটবে। একেই বলা হয়েছে অন্ধ, মূক ও বধির অবস্থায় সমবেত করা। দেখুন আয়াত [২: ১৮]

৯৮। ইহাই তাদের প্রতিফল; কারণ তারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিলো, এবং বলেছিলো , " যখন আমরা অস্থিতে পরিণত হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হব, [তাহলেও ] কি আমরা নূতন সৃষ্টি রূপে উত্থিত হব? " ২৩০৪

২৩০৪। আয়াত [১৭:৪৯] কে এই আয়াতে পুনরাবৃত করা হয়েছে। সমস্ত সূরাতে, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে এবং অবিশ্বাসের প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের অন্তরে আল্লাহ্‌র প্রতি অবিশ্বাস বিভিন্নরূপে বিরাজ করে। অবিশ্বাসের এই বিভিন্নরূপের বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং রূপকের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে এবং এখানে এসে শেষ করা হয়েছে। পরবর্তী অনুচ্ছেদে ফেরাউনের উদারহণকে তুলে ধরা হয়েছে অবিশ্বাসীর প্রতীকরূপে। এর পরে সূরাটিকে শেষ করা হয়েছে বিশ্বাসের প্রতি প্রেরণা দান ও আল্লাহ্‌র প্রতি মাহাত্ম্য ঘোষণার মাধ্যমে।

৯৯। ওরা কি দেখে না যে আল্লাহ্‌ , যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি উহার অনুরূপ [নূতন] সৃষ্টি করতে সক্ষম? ২৩০৫ শুধুমাত্র তিনি এক নির্দ্দিষ্ট সময়কাল স্থির করেছেন যার সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু অন্যায়কারীরা অকৃতজ্ঞতা ব্যতীত [তা গ্রহণ করতে] অস্বীকার করলো। ২৩০৬

২৩০৫। আল্লাহ্‌ , যিনি আকাশ, পৃথিবী ও বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি কর্তা, তিনি অশেষ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ইচ্ছা করলেই মৃত্যুর পরে এই নশ্বর দেহ যখন মাটিতে মিশে যাবে তার পরেও তিনি আবার প্রত্যেক আত্মাকে পূণর্জীবিত করতে সক্ষম। এই পুণরুত্থান ঘটবে প্রতিটি আত্মার, তার পূর্ব অনুভূতি, স্মৃতি, মূল্যবোধ এক কথায় আত্মার পৃথিবীর প্রতিটি অভিজ্ঞতা সহ। আমাদের আত্মার পরিক্রমা শুরু হয় পৃথিবীর যাত্রা পথে, দেহের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, শেষ হবে পরলোকে, মৃত্যুর সিংহদূয়ার পার হয়ে , এই নশ্বর দেহকে ত্যাগ করে। এই সময়কালটি স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত। আত্মা তার নশ্বর দেহ ত্যাগ করলেও পৃথিবীর অভিজ্ঞতাকে বহন করে নিয়ে যাবে পরলোকে। এই হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক ইতিহাস। আল্লাহ্‌ পৃথিবীতে আমাদের স্থায়িত্বকালের বিভিন্ন ধাপকে সুনির্দ্দিষ্ট করে দিয়েছেন যা আমরা ইচ্ছা করলেই বাড়াতে পারবো না বা কমাতে পারবো না।

২৩০৬। এই উক্তিটি পূর্বের আয়াতের [১৭:৮৯] পুণরুক্তি মাত্র। সেখানে ব্যক্ত করা হয়েছে, যারা অবিশ্বাসী, যারা কুর-আনকে অস্বীকার করে তাদের মানসিকতাকে এই উক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে যারা অস্বীকার করে তারা আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকেই অস্বীকার করে।

১০০। বলঃ " যদি তোমরা আমার প্রভুর অনুগ্রহের ভান্ডারের অধিকারী হতে, তবুও খরচ হয়ে যাবে এই ভয়ে তোমরা তা লুকিয়ে রাখতে। মানুষ তো [অতিশয়] কৃপণ " ২৩০৭।

২৩০৭। এই আয়াতে নূতন যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। এই আয়াতে মানুষের স্বার্থপরতার এক রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীতে একদল লোক আছে যারা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। তারা তা শুধুমাত্র নিজস্ব গন্ডীর মধ্যে ধরে রাখতে ব্যগ্র। এই শ্রেণীর লোকের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইহুদীরা। তারা নিজেদের জন্মসূত্র সম্বন্ধে এতটাই শ্রেষ্ঠ ধারণা পোষণ করে যে, তারা বুঝতে অক্ষম কিভাবে একজন অ-ইহুদী আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ বা নবুয়ত পেতে পারে? কারণ তাদের ধারণা নবুয়ত শুধুমাত্র ইহুদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। তারাই একমাত্র আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের রক্ষক। এই সম্মান তারা অন্যান্য জাতির সাথে সমতার ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব করতে অপারগ। সামগ্রিকভাবে এই মানসিকতা শুধু ইহুদী নয় পৃথিবীতে সর্বকালে, সর্বত্র বিদ্যমান। কোনও নির্দ্দিষ্ট জাতি বা গোত্র, সভ্যতা বা সংস্কৃতির লোকের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যে , তারাই একমাত্র আল্লাহ্‌র বাণীর ধারক, বাহক ও রক্ষক। এবং এ সম্পর্কে তারা অত্যন্ত গর্বিত। একমাত্র তাদেরই অধিকার আছে তা সংরক্ষণের ও প্রচারের। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল। আল্লাহ্‌র বাণী ও প্রত্যাদেশ যে কোন মাধ্যমেই প্রকাশ ঘটা সম্ভব। তার নেয়ামত বিশ্বজনীন। তিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তার নেয়ামত প্রকাশ করে থাকেন, যার রূপ বিশ্বজনীন। তাঁর রহমত ও দয়া, তাঁর নেয়ামতের ভান্ডার অশেষ, অসীম। তা খরচ করে শেষ করার সাধ্য কারও নাই। কারণ সে ভান্ডার অফুরন্ত। একমাত্র কৃপণ যারা , যাদের চরিত্রে উদারতার অভাব তারাই আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় করে। যেমন ইহুদীরা হচ্ছে আধ্যাত্মিক ভাবে কৃপণ। সে কারণে তারা আল্লাহর প্রত্যাদেশের প্রকাশ অন্য জাতির মধ্যে দেখতে ভয় পায়। সে কারণেই তারা তাদের গোত্রের বাইরে রসুলুল্লাহের (সা) আগমনে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ তাদের গোত্রের বাইরে নাজেল হয়েছে, তারা তাকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব হারাবার ভয়ে স্বীকার করতে পারে নাই।

উপদেশঃ এই আয়াতের উপদেশ সার্বজনীন। কৃপণ সর্বদা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব হারানোর ভয়ে শঙ্কিত ও সন্ত্রস্ত থাকে। এই কৃপণতা শুধুমাত্র অর্থ, বিত্ত নয়। ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক ব্যাপারেও এ কৃপণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব হারাবার ভয়ে তা সংরক্ষণ করতে ব্যস্ত। তারই ফলে ইসলাম ও বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। সংস্কৃতিক অঙ্গনে এত বিভেদ ও হানাহানি।

রুকু - ১২

১০১। বণী ইস্‌রাঈলীদের জিজ্ঞাসা কর, মুসাকে আমি নয়টি স্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলাম ২৩০৮। যখন সে তাদের নিকট এসেছিলো ফেরাউন তাঁকে বলেছিলো, "হে মুসা প্রকৃতই আমি মনে করি, তুমি যাদুগ্রস্থ" ২৩০৯, ২৩১০।

২৩০৮। "নয়টি স্পষ্ট নিদর্শন" এর জন্য দেখুন সূরা [৭:১৩৩] আয়াত ও টিকা ১০৯১। এখানে ফেরাউনের কাহিনীর যে অবতারণা করা হয়েছে তার পটভূমি হচ্ছেঃ মানুষের অহংকার, ক্ষমতা ও উচ্চ পদ মর্যাদা কি ভাবে আত্মার ধ্বংস ডেকে আনে তারই দৃষ্টান্ত।

২৩০৯। "তাদের নিকট" অর্থাৎ ফেরাউনের নিকট। ফেরাউন যখন তাঁর সভাসদ ও আমাত্যবর্গ সহ সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলো, তখন তাদের নিকট মুসা এসেছিলেন। দেখুন সূরা [৭:১০৩] আয়াত। সূরা [৭:১০৩-১৩] আয়াতগুলিতে বর্ণনা আছে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের।

২৩১০। সূরা [৭:১০৯] আয়াতে ফেরাউনের প্রধান মন্ত্রণাদাতারা হযরত মুসাকে যাদুকর রূপে আখ্যায়িত করে। হযরত মুসার মোজেজা দর্শনে, তাঁকে ফেরাউন "যাদুগ্রস্থ" বা যে যাদুর দ্বারা সম্মোহিত, এই বলে তাঁকে অভিযুক্ত করে এই আয়াতে [১৭:১০১]

১০২। মুসা বলেছিলো, " তুমি তো ভালো ভাবেই জান যে এই সমস্ত [স্পষ্ট নিদর্শন] আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রভুই অবতীর্ণ করেছেন প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ ২৩১১। হে ফেরাউন ! আমি প্রকৃতই মনে করি তোমার ধবংস আসন্ন।"

২৩১১। হযরত মুসা (আ) ফেরাউনের প্রসাদে সন্তান স্নেহে লালিত পালিত হন। তিনি মিশরবাসীদের সকল জ্ঞান ও বিদ্যার অধিকারী ছিলেন। সুতারাং তাকেঁ "যাদুগ্রস্থ" বলার আগে ফেরাউনের স্মরণ করা উচিত ছিলো মুসার অতীত ইতিহাস। [এই আয়াতের বক্তব্য থেকে মনে হয় যখন মুসাকে (আ)যাদুগ্রস্থ বলা হয়, মুসা সম্ভবতঃ অতীতকে স্মরণ করতে বলেছিলেন। ] মুসার (আ) অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে তিনি কখনও স্থুল বুদ্ধি সম্পন্ন বা প্রতারণাপূর্ণ যাদুকর ছিলেন না। তিনি ফেরাউনকে যা দেখাচ্ছিলেন তা যাদু অপেক্ষা উচ্চমানের। যাদু হচ্ছে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চোখে ধূলা দেয়া, যা ফেরাউনের লোকেরা করতো। কিন্তু মোজেজা হচ্ছে, ঐশী নিদর্শন, যার মধ্যে কোনও প্রতারণা নাই, যা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে আগত। আল্লাহ্‌র এই 'স্পষ্ট নিদর্শন' দর্শনে ফেরাউনের উচিত ছিলো আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকে সনাক্ত করা। কিন্তু তার পরিবর্তে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। মুসা (আ) তাঁকে সাবধান করে দেন তাঁর শেষ পরিণতি সম্পর্কে। ফেরাউনের শেষ পরিণতি ধ্বংস।

১০৩। সুতারাং ফেরাউন তাদের পৃথিবীর বুক থেকে উচ্ছেদ করতে চাইলো ২৩১২। কিন্তু আমি ফেরাউনকে ও তার সাথে যারা ছিলো, তাদের সকলকে নিমজ্জিত করলাম।

২৩১২। ফেরাউন শুধুমাত্র হযরত মুসাকে নয় মুসার সমস্ত লোকদের ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করেন। এই সূরাতে হযরত মুসার কাহিনীর বিশদ বর্ণনা নাই, বিশদ বর্ণনার জন্য পড়ুন সূরা ৭। ফেরাউনের বিভিন্ন কৌশল ও পরিকল্পনা সত্বেও ফেরাউন সফল হতে পারলো না। কারণ আল্লাহ্‌র ক্রোধ, ফেরাউন ও তাঁর অনুসারীদের ঘিরে ধরে। সূরা [৭:১২১-১২৬] আয়াতে দেখুন কিভাবে মিশরবাসীদের মধ্যে যারা তাদের পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো তাঁরা ফেরাউনের ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়।

১০৪। এবং এরপর আমি বণী ইস্‌রাঈলীদের বলেছিলাম, "[প্রতিশ্রুত] দেশে তোমরা নিরাপদে বাস কর।" ২৩১৩ কিন্তু যখন কেয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে, তখন আমি তোমাদের সকলকে মিশ্রিত করে একত্রিত করবো ২৩১৪।

২৩১৩। আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুত দেশে [Promise Land] , এই বাক্যটি দ্বারা প্যালেস্টাইনের যেখানে অতীতে ইসরাঈলীরা তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলো, সেই স্থানকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্‌ তাদের গৌরব ও সম্মানের সাথে প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করান, কিন্তু ইহুদীরা সৎপথ পরিত্যাগ করে পাপের পথ অবলম্বন করে এবং পরিণামে তাদের গৌরবজনক অবস্থানের অধিকার হারায়। তাদের সকলকে কেয়ামতের দিনে, ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের সম্মুখীন হতে হবে।

২৩১৪। "যখন কেয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে" লাইনটি মওলানা ইউসুফ আলী সাহেব অনুবাদ করেছেন "But when the second of the warning came to pass." প্রথম তফসীরকার দলের মতে দ্বিতীয় সর্তকবাণীটি বাস্তবায়িত হবে কেয়ামতের দিনে যার অঙ্গীকার আল্লাহ্‌ করেছেন। দ্বিতীয় দলের তফসীরকারের মতে, দ্বিতীয় সর্তকবাণী সম্ভবতঃ যা উল্লেখ করা হয়েছে [১৭:৭] আয়াতের মাঝামাঝিতে, যখন তারা একগুয়েভাবে হযরত ঈসাকে অস্বীকার করে। প্রথম সাবধান বাণীটির উল্লেখ আছে [১৭:৫] আয়াতে।

১০৫। আমি সত্য সহ [কুর-আন] অবতীর্ণ করেছি এবং সত্য -সহই তা অবতীর্ণ হয়েছে ২৩১৫। আমি তো [পাপীদের জন্য ] তোমাকে প্রেরণ করেছি কেবলমাত্র সুসংবাদ দাতা ও সর্তককারীরূপে ২৩১৬।

২৩১৫। সত্যের আলোয় কুর-আন ভাস্বর। এবং এই সত্য সহই কুর-আন শরীফ অবতীর্ণ হয়েছে। কোন জাগতিক শক্তিই এই সত্যকে বিকৃত করতে পারে নাই। সময়ের ব্যবধানে ও প্রচারের মাধ্যমে কুরা-আনের সত্যকে কলুষিত করা সম্ভব হয় নাই।

২৩১৬। এখানে নবীর (সা) দায়িত্ব ও কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ যদি সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তবে সে দায় দায়িত্ব নবীর নয়। তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে কুরা-আনের বক্তব্যকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচার করা, ব্যাখ্যা দান করা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তা সংরক্ষণ করা।

১০৬। আমি তো কুর-আনকে খন্ড খন্ড রূপে ভাগ করেছি যেনো তুমি তা মানুষের নিকট ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করতে পার। আমি তা ধাপে ধাপে অবতীর্ণ করেছি ২৩১৭।

২৩১৭। কুর-আন শরীফ অবতীর্ণ হয় সুদীর্ঘ তেইশ বছর ধরে - বিভিন্ন সময়ে। বিভিন্ন ঘটনার পটভূমিতে খন্ড খন্ড ভাবে। কিন্তু এর বিস্ময়কর দিক হচ্ছে, বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে এবং উপযুক্ত ভাবে সমন্বিত করা হয়েছে। এই বিশাল গ্রন্থের কোথাও অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাবে না। সকল প্রত্যাদেশের লক্ষ্যই হচ্ছে, পৃথিবীকে আত্মিক অগ্রগতির সামিল করা। কুর-আনের পূর্বে আল্লাহ্‌র যে সব প্রত্যাদেশ ছিলো, পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় ছিলো তাদের ভূমিকা। প্রাচীন যুগ থেকে যুগে যুগে আল্লাহ্‌ নবী ও রসুলদের প্রেরণ করেছেন মানুষের আধ্যাত্মিক জগতকে অগ্রগামী করার জন্য, এগিয়ে নেবার জন্য। এই হচ্ছে মানুষের ধর্মীয় ইতিহাস। নৈতিক মূল্যবোধই হচ্ছে মানুষের আত্মিক বিকাশের চাবিকাঠি। আর এই নৈতিক মূল্যবোধ যুগে যুগে বিকশিত হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের আচরণ, কর্মধারা নিয়ন্ত্রিত হয় তার মন বা চিন্তাধারা দ্বারা। আবার সে মানসিকভাবে ততটুকুই ধারণ করতে সক্ষম, যতটুকু তার আত্মিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। সে কারণে যুগে যুগে আল্লাহ্‌ তাঁর প্রত্যাদেশকে ততটুকুই প্রেরণ করেছেন, যা সে যুগের মানুষের আত্মিক বিকাশের জন্য উপযোগী। এ ভাবেই ধর্মীয় ইতিহাস মানুষের আধ্যাত্মিক অগ্রযাত্রার সীমানা নির্দ্দেশ করে থাকে। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ আমাদের জীবনে চলার পথকে আলোকিত করে। জীবনের উত্থান, পতন, দুঃখ, ব্যাথা, বিপর্যয়ে, সুখে, আনন্দে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পথের নির্দ্দেশনার মাধ্যমে আমাদের আধ্যাত্মিক জগতকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে। এ ভাবেই এই আয়াতে "খন্ড খন্ড" ও "ধাপে ধাপে" বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মীয় ইতিহাসের প্রতিটি যুগকে "খন্ড খন্ড " ভাবে চিন্তা করলে সেই সব যুগের প্রত্যাদেশকে বোঝায়। আবার কোরাণকেও খন্ড খন্ড ভাবে অবতীর্ণ করা হয়েছে "ধাপে ধাপে" যেনো এই ঐশী বাণী ধারণের জন্যে ধীরে ধীরে মানসিক প্রস্তুতি হয়।

১০৭। বলঃ " তোমরা ইহা বিশ্বাস কর বা না কর, এটা সত্য যে যাদের পূর্বে জ্ঞান দেয়া হয়েছিলো , তাদের নিকট যখন তা আবৃত্তি করা হয়, তখনই তারা বিনয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। ২৩১৮

২৩১৮। কারও বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোরাণের বাণীর মাধুর্য্যকে, সৌন্দর্যকে ম্লান করতে পারবে না। আধ্যাত্মিক জ্ঞানে যাদের আত্মা আলোকিত তারা কোরাণের বাণী শোনা মাত্র বুঝতে পারে যে এ হচ্ছে ঐশী বাণী। তাদের জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক চেতনা তাদের অন্তর্দৃষ্টি দান করে ঐশী প্রত্যাদেশকে সনাক্ত করার জন্য। তারা তা শোনা মাত্র ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে সেজ্‌দা অবনত হয়। এসব জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে পূর্বে প্রত্যাদেশ প্রাপ্তদের অনেকেই আছেন। যারা নিজেদের সর্বপ্রকার পাপ ও বিকৃত থেকে রক্ষা করেন, তারাই এর অন্তর্ভূক্ত।

১০৮।" এবং তারা বলে, আমাদের প্রভুর মহিমা! আমাদের প্রভুর প্রতিশ্রুতি সত্যই কার্যকরী হয়ে থাকে ?" ২৩১৯

২৩১৯। যারা পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশ পেয়েছেন, তারা প্রত্যাদেশ হিসেবে কুর-আনকে এবং আল্লাহ্‌র দূত বা রসুলকে (সা) সনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং তাঁরা বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ্‌র অঙ্গীকার পূর্ণ হবেই। যারা আধ্যাত্মিক দিক থেকে এর জন্য প্রস্তুত থাকে, তাদের আধ্যাত্মিক আশা -আকাঙ্খার আকুলতার এ ভাবেই পরিতৃপ্তি লাভ করে। আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুত কার্যকর হবেই।

১০৯। তারা অশ্রুসিক্ত নয়নে সিজদাবনত হয় এবং তা তাদের [আন্তরিক ] বিনয়কে বৃদ্ধি করে ২৩২০।

২৩২০। এই আয়াতে মানুষের আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পনের যে অনুভূতি সেই অনুভূতিকে প্রকাশ করা হয়েছে। মানুষ যখন বুঝতে পারে যে, তাঁর অযোগ্যতা, ও দোষত্রুটি সত্বেও সে আল্লাহ্‌র করুণা লাভে সক্ষম হয়েছে, সে মহান সত্যকে অনুভব করার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তখন বিনয়, কৃতজ্ঞতা ও আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসায় তাঁর হৃদয় আপ্লুত হয়ে যায়। তাঁর আবেগ তখন এত সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায় যে, সে "অশ্রুসিক্ত নয়নে সিজ্‌দাবনত হয়" কারণ সে আবেগের প্রকাশ একমাত্র ঘটতে পারে চোখের পানিতে আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে।

১১০। বল, " তোমরা আল্লাহ্‌ নামে বা রাহমান নামে যে নামেই ডাক না কেন [তা উত্তম] ২৩২১। সকল সুন্দর নামই তো তাঁর ২৩২২। সালাতে তোমাদের স্বর খুব উচ্চ বা অতিশয় ক্ষীণ করো না ২৩২৩। বরং দুই এর মধ্য পথ অবলম্বন করো।"

২৩২১। 'Rahman' এই আরবী শব্দটির বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে, পরম করুণাময় শব্দটির দ্বারা। এই শব্দটি দ্বারা আল্লাহ্‌র বিশেষ গুণকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্‌র এই করুণা পাপী পূণ্যাত্মা সকলের জন্য সমভাবে বহমান [দেখুন [১:১] আয়াত ও টিকা ১৯] এই সেই করুণাধারা যা পাপীকে পাপ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পায়, যা পূণ্যাত্মাকে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসরমান করে। আল্লাহ্‌ নামটি যা আল্লাহ্‌র সকল গুণাবলীর প্রতীক, একক সত্তা। আবার 'রহমান' শব্দটি আল্লাহ্‌ বহু গুণাবলীর মধ্যে নির্দ্দিষ্ট এক গুণকে চিহ্নিত করে, আমাদের সীমিত ক্ষমতার দ্বারা আল্লাহ্‌র অনুভবকে আত্মার মাঝে অনুভব করার এ এক প্রচেষ্টা। 'রহমান' আল্লাহ্‌র এই বিশেষ গুণবাচক শব্দটি আরব মুশরেকদের অত্যন্ত অপছন্দ ছিলো, দেখুন অনুরূপ ভাব প্রকাশকারী সূরা [২৫:৬০] এবং আয়াত ও সূরা [২১:৩৬] আয়াত।

২৩২২। আল্লাহ্‌র সুন্দর গুণবাচক নাম অনেক। তিরমিজী হাদীসকে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রামাণিক বলে ধরা হয়। তিরমিজী হাদিস অনুযায়ী আল্লাহ্‌র গুণবাচক নাম ৯৯ টি ধরা হয়। 'Sir Edwin Arnolds' এর বই "Pearl of the Faith" গল্পের শেষে কবিতার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নামের মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছেন। যারা আগ্রহী তারা দেখতে পারেন।

২৩২৩। উচ্চ স্বরের কথা পূর্বেও বলা হয়েছে সূরা [৭:২০৫] আয়াতে। নামাজ বা প্রার্থনার মূল কথা হচ্ছে বিনয় ও একাগ্রতার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য আত্মার মাঝে অনুভব করা; সান্নিধ্য কামনা করা। নামাজের এই মনোভাব একা একা অথবা জামাত বা সমবেত ভাবে নামাজ পড়া উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নামাজের প্রধান উদ্দেশ্য হবে একান্তভাবে আত্মার নিবেদন। এই মনোভাবের সাথে নামাজে উচ্চস্বর বেমানান। অবশ্য সমবেত নামাজে ব্যক্তিগত নামাজ থেকে স্বরের উচ্চতা বেশী হবে। আজান হবে উচ্চ স্বরে যেনো কাছে এবং দূরের সকল স্থান থেকে শ্রুতিগোচর হয়। কিন্তু নামাজে কোরাণের আয়াতের আবৃত্তি এত সশব্দে হবে না যাতে অবিশ্বাসী মোশরেকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও তাদের শত্রুতা বৃদ্ধি করে। আবার এত আস্তেও হবে না যাতে সমবেত নামাজীদের শ্রুতিগোচর না হয়।

১১১। বল, " প্রশংসা আল্লাহ্‌র-ই , তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেন নাই, এবং সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন অংশীদার নাই। অপমান থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁর কাউকে [প্রয়োজন ] নাই। সুতারাং সসম্ভ্রমে তার মাহাত্ম্য ও মহিমা ঘোষণা কর। " ২২২৪

২৩২৪। নামাজের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য ও মহিমা ঘোষণার দ্বারা আল্লাহকে আমাদের আত্মার মাঝে অনুভবের চেষ্টা করি। উপরের আয়াতে নামাজের মনোভাব ও প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহ্‌র গুণাবলীকে আত্মার মাঝে অনুভব করার উপায় বলে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্‌র গুণাবলীকে আত্মার মাঝে অনুভবের প্রধান উপায় হচ্ছে নিজের মনকে সকল কুসংস্কার মুক্ত করা যেমন: আল্লাহ্‌ সন্তান গ্রহণ করেন বা তাঁর অংশীদার বর্তমান বা তাঁর অভিভাবকের প্রয়োজন ইত্যাদি। আল্লাহ্‌র করুণা, মাহাত্ম্যকে বুঝতে হলে, সর্বাগ্রে আল্লাহ্‌র একত্বের ধারণাকে আত্মার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর মহিমা, শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব, অতুলনীয়। আমাদের সীমিত ধারণায় আল্লাহ্‌র গুণাবলীর প্রকৃত স্বরূপ ধারণা করাও সম্ভব নয়। আমরা যেটুকু পারি তা হচ্ছে " সসম্ভ্রমে তাঁহার মাহাত্ম্য ঘোষণা করতে"। বিনয়ে নম্র, ভক্তিতে আপ্লুত আত্মা-ই শুধু তাঁর মাহাত্ম্যের কণা অনুধাবনে সক্ষম।

এই সূরাটি শুরু হয়েছে আল্লাহ্‌র প্রশংসা কীর্তনের মাধ্যমে। এবং সূরাটি শেষ করা হয়েছে একই সুর বা বৈশিষ্ট্য দ্বারা। পরের সূরাটির বক্তব্যও প্রায় সমধর্মী কিন্তু তা উপস্থাপন করা হয়েছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে। পরের সূরাটির শুরু হয়েছে একই ভাবে অর্থাৎ আল্লাহ্‌র প্রশংসা কীর্তনের মাধ্যমে "প্রশংসা আল্লাহ্‌রই" এই বাক্যটির দ্বারা।