Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ১ জন
আজকের পাঠক ৬৯ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৭১৬ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৯৩৬ বার
+ - R Print

সূরা কাহ্‌ফ


সূরা কাহ্‌ফ - ১৮

১১০ আয়াত, ১২ রুকু, মক্কী,
[দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

ভূমিকা : সূরা xvii এর ভূমিকাতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, কি ভাবে প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব কর্মের দ্বারা, চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারে। আত্মিক উন্নতির ধর্মীয় ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা সাধারণ বর্ণনার আওতায় আনা হয়েছে।

জীবন ক্ষণস্থায়ী ও রহস্যপূর্ণ, এই পাঠ এই বিশেষ মক্কী সূরাতে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে গুহা সঙ্গীদের কথা, যারা গুহার অভ্যন্তরে বহু বছর নিদ্রিত ছিলেন। কিন্তু তাদের ধারণা ছিলো তারা স্বল্প সময়ই সেখানে ছিলেন। তারপরে বর্ণনা করা হয়েছে হযরত মুসার রহস্যময় শিক্ষকের কথা। যিনি মুসাকে শিক্ষা দেন যে মানুষের জীবন এক রূপক কাহিনী। আরও আছে দুই শিং বিশিষ্ট জুলকারনাইনের কাহিনী। যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের অধিপতি ছিলেন, এবং অত্যাচারীদের থেকে দুর্বলকে রক্ষা করার জন্য লোহার দেয়াল তৈরী করেন। ক্ষণস্থায়ী, অনিশ্চিত , গৌরবান্বিত জীবনকে রূপক কাহিণীর মাধ্যমে এই সূরাতে প্রকাশ করা হয়েছে। জীবনের অনেক কিছুই আপতঃদৃষ্টিতে সত্য বিরোধী মনে হলেও সত্যবিরোধী নয়। জীবনের প্রকৃত অর্থ তখনই ভাস্বর হবে, যখন ধৈর্য্য ও জ্ঞানের মাধ্যমে তাদের বিচার করা হবে। পাপের আক্রমণ থেকে আত্মিক জীবনকে রক্ষা করতে হবে।

সার সংক্ষেপঃ কোরাণ হচ্ছে পথনির্দ্দেশ ও সর্তকবাণী। জীবন ক্ষণস্থায়ী ও ভাগ্যের উত্থান পতনের দ্বারা পরিবর্তনশীল। আমাদের সময়ের ধারণা ত্রুটিপূর্ণ; গুহা সঙ্গীদের গল্পের মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। গুহা সঙ্গীরা ছিলেন বিশ্বাসী, সত্যের পূজারী, ধৈর্য্যশীল এবং আরও অন্যান্য গুণে সমৃদ্ধ। কিন্তু তাদের জীবন ছিলো রহস্যে আবৃত যার গভীরতা খুব অল্প সংখ্যক লোকই নির্ণয় করতে পারে [১৮: ১-২২]

সকল জ্ঞানের উৎস এক আল্লাহ্‌। মিথ্যা অনুমান ও এর উপরে ভিত্তি করে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া থেকে বিরত থাক। কোরাণ থেকে শিক্ষা নাও যে, পার্থিব বিষয়ে অহংকারে স্ফীত ব্যক্তির সব কিছুই বৃথা [১৮:২৩-৪৪]

জীবন অনিশ্চিত ও পরিবর্তনশীল। ধার্মিকতা ও গুণাবলী হচ্ছে চরিত্রের স্থায়ী বস্তু। শেষ বিচারের দিন অবশ্যই আসবে, যেদিন আল্লাহ্‌র করুণা ও ক্রোধের প্রকাশ ঘটবে। [১৮:৪৫-৫৯]

হযরত মুসা তাঁর জ্ঞানের পিপাসায় নিজের সীমানা ভুলে গিয়েছিলো। তাঁর উপরে ধৈর্য্য ও বিশ্বাসের আদেশ দেয়া হয়। তাঁর কাছে যখন জীবনের আপতঃদৃষ্টিতে সত্যবিরোধী , কিন্তু সত্যবিরোধী নয় এ দিকগুলি তুলে ধরা হয়, তিনি তা বুঝতে পারেন। [১৮:৬০-৮২]

জুলকারনাইনের ছিলো বিশাল সাম্রাজ্য। তিনি দোষীকে শাস্তি দিতেন ও ভালোকে পুরস্কৃত করতেন। তিনি দুর্বলকে অত্যাচারী থেকে রক্ষা করতেন। তাঁর ছিলো আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস;এবং আল্লাহ্‌ তাঁকে পথ নির্দ্দেশ দিতেন। আল্লাহ্‌ এক ও অদ্বিতীয় এবং তাঁর জন্য কাজ করাই হচ্ছে পূণ্য। [১৮: ৮৩-১১০]

সূরা কাহ্‌ফ -১৮

১১০ আয়াত, ১২ রুকু, মক্কী,
[দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

১। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র ২৩২৫ যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, এবং তাতে কোন বক্রতা রাখেন নাই ২৩২৬।

২৩২৫। পূর্বের সূরার [১৭:১১১] আয়াতেও বলা হয়েছে " প্রশংসা আল্লাহ্‌রই " - তিনি একমাত্র প্রশংসার যোগ্য। এই সূরাতেও বলা হয়েছে আল্লাহ্‌- ই একমাত্র প্রশংসার যোগ্য, যিনি তাঁর বান্দাদের জন্য প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ করেছেন। মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটে ক্রমান্বয়ে - আর এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণা।

২৩২৬। পবিত্র কিতাব সম্বন্ধে অনেক লোকের বিশ্বাস যে তা হবে মানুষের বোধগম্যতার উর্দ্ধে। কারণ তা হবে রহস্যময়, অস্পষ্ট ভাষা সমৃদ্ধ, মানুষের ভাষায় তার সহজ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। ইচ্ছা মত সে ভাষাকে যে কোনও দিকে পরিচালনা করা যাবে - ফলে কখনও তার অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব, কখনও এর কোনও অর্থ থাকবে না। আরব মোশরেকদের এরূপ ধারণার কারণ ছিলো, তারা তাদের দেবদেবীর পক্ষ থেকে যে সব দৈববাণী প্রচার করতো, তা থাকতো হেঁয়ালী, ও অস্পষ্টতায় ভরা। এসব দৈববাণী সাধারণ অর্থে প্রকাশ করা যুক্তিযুক্ত ছিলো না। যারা এর প্রচার করতো, তারা পরবর্তী সময় ও ঘটনার প্রেক্ষিতে তা শ্রোতাদের নিকট ব্যাখ্যা করতো, যার সম্পূর্ণ অর্থ ভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো না। সমস্ত দৈববাণীর উদ্দেশ্যই ছিলো শঠতাপূর্ণ জুয়াচুরি। উদ্দেশ্য ছিলো সাধারণ শ্রোতাদের প্রতারণা করে তাদের আনুগত্য আদায় করা। কিন্তু কোরাণের বাণী বা প্রত্যাদেশ, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের ধরণকে বোঝানোর জন্য Qaiyim বা সহজ ও পরিষ্কার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে; যার বিপরীত অর্থবোধক শব্দ Iwaj বা বক্র যা এই আয়াতে ব্যবহার করা হয়েছে। 'সরল পথের' উল্লেখ আছে দেখুন [১৯:৩৬] আয়াত এবং টিকা ২৪৮৮।

মন্তব্য : আমাদের অনেকেই এই বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয়ে, শুধুমাত্র না বুঝে আরবী কোরাণ শরীফ পড়ে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করি। এই আয়াত তাদের চিন্তা ও চেতনার পরিবর্তন আনবে।

২। [তিনি একে করেছেন সুস্পষ্ট এবং] সরল ২৩২৭, যেনো তিনি [কাফেরদের] ভয়াবহ শাস্তি সম্বন্ধে সাবধান করতে পারেন, তাঁর পক্ষ থেকে, এবং তিনি যেনো সুসংবাদ দিতে পারেন বিশ্বাসীদের, যারা সৎ কাজ করে - তাদের জন্য আছে উত্তম পুরষ্কার ,-

২৩২৭। "Qaiyim" যার বাংলা অর্থ দাড়ায় ঋজু, যা বাঁকা নয়, রহস্যময় নয়, যার ভাষা প্রাঞ্জল বা পরিষ্কার যাতে কোনও অস্পষ্টতা নাই, যা সহজ সরল পথে পরিচালিত করে। কোরাণের ভাষা ও মর্মবাণীকে প্রকাশের জন্য উপরোক্ত বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে। কোরাণ সব অস্পষ্টতার উর্দ্ধে - এর ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। এর নির্দ্দেশাবলী সবার কাছেই সুস্পষ্ট - সকলেই এর উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
আধ্যাত্মিক জীবনের সর্বোচ্চ রহস্যের সন্ধান দেয় কোরাণ। সুতারাং কোরাণের বাণীর আবেদন সকলের নিকট সমান নয়। আধ্যাত্মিক উন্নতির তারতম্য অনুযায়ী কোরাণের বাণীর বোধগম্যতার তারতম্য ঘটে থাকে। সে অর্থে কোরাণের বাণীর গ্রহণযোগ্যতার তারতম্য ঘটে তাদের নিকট। কিন্তু এই বিশাল কিতাবের কোথাও রহস্যময়তা নাই, - মানুষের যুক্তি বা চিন্তাকে রহস্য দ্বারা আবৃত করার কোনও প্রবণতা নাই। এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে সাবধান করে দেয়া যেনো পরলোকে সে বিপদের সম্মুখীন না হয়। মানুষ যেনো পরলোকে সর্বোচ্চ শান্তির সন্ধান লাভ করে।

৩। যাতে তারা সেখানে চিরদিন স্থায়ী থাকবে ২৩২৮।

২৩২৮। অনুরূপ আশ্বাস আছে নিম্নলিখিত সূরা সমূহে। দেখুন , [৪:১২২], [৪৩:৭১] , [৬৫:১১] ,[৯৮:৮]। পুরষ্কার কোন জাগতিক বস্তু নয়। এই পুরষ্কার হচ্ছে আত্মার শান্তি ইহকালে ও পরকালে। কবি মিল্টনের ভাষ্যে , "The mind is its own place, and in itself can make a Heaven of Hell, a Hell of Heaven." [P.L, 254-55]

৪। উপরন্তু, তিনি যেনো তাদেরকেও সর্তক করতে পারেন, যারা বলে, "আল্লাহ্‌ পুত্র সন্তান গ্রহণ করেছেন। " ২৩২৯

২৩২৯। শুধুমাত্র আল্লাহকে এবং আল্লাহ্‌র বাণীকে অস্বীকারকারী নয় , এই আয়াতের মাধ্যমে যারা আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে অপমানকর ধারণা পোষণ করে তাদেরকেও সাবধান করা হয়েছে। যারা বলে আল্লাহ্‌ পুত্র ধারণ করেছেন। তারা যে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র ক্ষমতার অংশীদার কল্পনা করে তাই- ই নয় , তারা আল্লাহকে প্রাণীর যৌন-প্রবৃত্তির সমগোত্রীয় কল্পনা করে। কিন্তু আল্লাহ্‌ এক ও অদ্বিতীয় শক্তি। তাঁর সম্বন্ধে পশু প্রবৃত্তির ধারণা করা জঘন্য অপমানকর উক্তি।

৫। এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নাই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিলো না। বক্তব্য হিসেবে ওদের মুখ নিঃসৃত কথা কত ভয়ংকর ২৩৩০। তারা যা বলে তা মিথ্যা ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

২৩৩০। ' আল্লাহ্‌ সন্তান গ্রহণ করেছেন' এই মতবাদের বা ধর্মমতের কোনও বাস্তব যুক্তি বা প্রমাণ নাই। এটা শুধুমাত্র তাদের মুখ নিঃসৃত বাক্য। কোন যুক্তি বা ব্যাখ্যা বা সত্য দ্বারা তা আল্লাহ্‌র মহান ও গৌরবান্বিত ধারণার সাথে সমন্বিত করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্‌র ৯৯ টি নাম আল্লাহ্‌র শক্তির বিভিন্ন রূপকে প্রকাশের জন্য ভাষা। আল্লাহ্‌র এই বিশাল, মহান ও সুন্দর রূপের সাথে আল্লাহ্‌র জন্য যৌন প্রবৃত্তির ধারণা "ভয়ংকর"।

৬। ওরা এই বাণী বিশ্বাস না করলে তুমি সম্ভবতঃ ওদের পিছনে ঘুরে ঘুরে দুঃখে আত্ম-বিনাশী হয়ে পড়বে ২৩৩১।

২৩৩১। ইসলামের মত যুক্তিসম্মত ধর্মের প্রচার,বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের মাঝে খুব সহজেই হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীতে সত্যিকারের বিচার বুদ্ধির অভাব পরিলক্ষিত হয়। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য রসুলের (সা) নিঃস্বার্থ পরিশ্রম ও ঐকান্তিক চেষ্টা যখন দুর্বার বাঁধার সম্মুখীন হয়, স্বাভাবিক ভাবেই রসুলের সমস্ত সত্তা বিপর্যস্ত বোধ করে। ইসলাম প্রচারের মধ্যে রসুলের (সা) কোনও স্বার্থ বিদ্যমান ছিলো না, তিনি তো একান্ত ভাবে চেয়েছিলেন মানুষের আত্মার মুক্তি। হিজরতের পূর্বে মক্কার কোরেশ দলপতিদের কাছ থেকে , তাঁর নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টার বিনিময়ে তিনি পেয়েছিলেন নির্যাতন, শুধু তিনি নন , তাঁর অনুসারীরাও পেয়েছিলেন নির্যাতন ও শাস্তি। পৃথিবীকে মিথ্যা, কুসংস্কার , স্বার্থপরতা, পাপ, অবিচার এবং অত্যাচার মুক্ত করার যে বিশাল দায়িত্ব তাঁর উপরে আল্লাহ্‌ ন্যস্ত করেছিলেন, তা যে কোনও লোকের জন্য ভীতিকর কারণ ঘটাতো। কারণ এ সব মিথ্যা ও অন্যায়ের দ্বারা পৃথিবী এমনভাবে অন্ধকারচ্ছন্ন ছিলো যে একমাত্র রসুলের (সা) মত সিদ্ধান্তে অটল ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারীর পক্ষেই সম্ভব ছিলো তা দূরীকরণ করা। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাকে সান্তনা দিয়েছেন যে এই বিশাল কর্তব্যের দায়িত্বের জন্য তিনি যেনো আতঙ্কিত না হন। রসুল (সা) আত্মপ্রত্যয়ী ও দৃঢ়তার সাথে কর্তব্যে অবিচল থাকেন যার ফলে পরবর্তীতে সত্যের বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করে যদিও তা সে সময়ে দৃষ্টিগোচর ছিলো না। এ সব কোরেশ দলপতিরা মিথ্যা আত্মগর্বে এতটাই নিমগ্ন ছিলো যে, অনুধাবনে ব্যর্থ হয় যে তাদের সম্মানের মিথ্যা ক্ষেত্র ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে।

৭। পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা করা হয়েছে পৃথিবীর চাকচিক্যময় প্রদর্শনীর জন্য , যেনো আমি পরীক্ষা করতে পারি মানুষের মধ্যে আচরণে কে শ্রেষ্ঠ ২৩৩২।

২৩৩২। পার্থিব বা জাগতিক বিষয় বস্তু যেমন: অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি এগুলি অর্জনের জন্য মানুষ পৃথিবীতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়। পৃথিবীতে এ সবই তার একমাত্র কাম্য বস্তু। কিন্তু এ সবই হচ্ছে অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী বস্তু। এগুলি যেনো দ্রুত ধাবমান দৃশ্য। যদিও অস্থায়ী তবু এ সব মানুষের চোখে শোভা বর্দ্ধন করে কামনার আকাঙ্খা জাগ্রত করে। পরকালের জীবনে এ সবের কোনও মূল্যই নাই। যারা পৃথিবীতে এ সব করায়ত্ব করে তারা অস্থায়ী পৃথিবীর জীবন শেষে পরলোকের চিরস্থায়ী জীবনে এ সব দ্বারা কোনও উপকারই পাবে না। এ সব জাগতিক বস্তু তাদের পরলোকের স্থায়ী সুখের ঠিকানায় পৌঁছে দেবে যখন তারা এ সব জাগতিক বস্তুর সঠিক ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। জাগতিক নেয়ামত সামগ্রীকে সঠিক ভাবে আল্লাহ্‌র প্রদর্শিত পথে ব্যবহার করতে পারা ব্যক্তির চরিত্রের অমূল্য গুণাবলীর নিদর্শন। আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাকে বিভিন্ন নেয়ামতে ধন্য করেছেন, যেনো তাঁর বান্দারা কর্মের মাধ্যমে তাঁর দেয়া নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করে থাকে, তাঁর নেয়ামত সমূহ আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করে। যখন সে তা করতে পারে তখন সে তার নিজের প্রভু, সে প্রবৃত্তির দাস নয়। যারা প্রবৃত্তির দাস তারা আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে নিজের সুখ-সম্ভোগে , বিলাস ব্যসন চরিতার্থের জন্য ব্যয় করে থাকে। এদের অবস্থান পরলোকে হবে অত্যন্ত কষ্টদায়ক। যে এ সব জাগতিক বস্তু লাভ করে , কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রদর্শিত পথে ব্যয় করে, আবার যারা এ সব করায়ত্ব করতে পারে না , কিন্তু তার দরুণ তারা হতাশায় না ভুগে বরং নিশ্চিন্ত হয় এই ভেবে যে আল্লাহ্‌ তাকে সম্পদের, ক্ষমতার , প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রভৃতির ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দান করেছেন, এরাই হচ্ছেন তাঁরা যারা প্রকৃত খাঁটি চরিত্রের অধিকারী। মানুষের গুণাবলীর মাধ্যমেই মানুষের চরিত্রকে পরলোকে বিচার করা হবে।

উপদেশ : গুণাবলীই হচ্ছে মানুষের যোগ্যতার মাপকাঠি। আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র মানদন্ড হচ্ছে গুণাবলী বা আচরণের শ্রেষ্ঠতা। সুতারাং আমাদের যে বিশ্বাস 'পীর ' বংশ বা এরূপ আধ্যাত্মিক নেয়ামতে ধন্য বংশ, তা নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা।

৮। প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীর উপরে যা কিছু বিদ্যমান তা আমি [উদ্ভিদশূন্য করে] ধূলা ও মাটিতে পরিণত করবো ২৩৩৩।

২৩৩৩। কিয়ামতের দিনের দৃশ্যের এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীর দৃশ্যমান সকল দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটবে এবং প্রতিটি বিষয়ের সঠিক মূল্যমান দৃষ্টিগোচর হবে।

৯। তুমি কি মনে কর যে, ২৩৩৪ গুহাবাসী ২৩৩৫ এবং উৎকীর্ণ ফলক ২৩৩৬ , আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর?

২৩৩৪। ইহুদীদের পরামর্শে কোরায়েশরা 'গুহাবাসীদের সম্বন্ধে যে প্রশ্ন করেছিলো, এই আয়াতগুলি তারই জবাব। ঘটনাটি অপূর্ব রূপক বর্ণনা সমৃদ্ধ। এই অপূর্ব কাহিনীতে যে নীতিগর্ভমূলক উপদেশ দান করে তা নিম্মরূপঃ(১) সময়ের আপেক্ষিকতা, (২) পৃথিবীতে অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের; নির্যাতনকারী ও নির্যাতিতের অবস্থান স্থির নয়, তা পরিবর্তনশীল। (৩) পুনরুত্থানের দিনে প্রতিটি কর্মের প্রকৃত মূল্যমান নিরূপন করা হবে। (৪) বিশ্বাস ও প্রার্থনার শক্তিই মানুষকে সত্য পথে পরিচালিত করে। আমাদের প্রতিদিনের চেনা পৃথিবীতে উপরের উপদেশগুলির প্রতিফলন প্রতিদিনই লক্ষ্য করা যায়। যদিও তা আশ্চর্য মনে হবে।

২৩৩৫। অবিশ্বাসী কোরেশরা হযরত (সা) কে অপ্রস্তুত ও তাঁর সুনাম হানির জন্য বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করতো। তারা খৃষ্টান ও ইহুদীদের থেকে যে সব বিষয়ে অবগত হত তা থেকে হযরত (সা) কে প্রশ্ন করতো তাকে অপমান করার জন্য। কারণ তাদের ধারণা ছিলো যে হযরত (সা) এ সব বিষয়ের সঠিক জবাব দিতে সক্ষম হবেন না। এ রকমই একটি প্রশ্ন ছিলো খৃষ্টানদেন সাত জন ঘুমন্ত সাধুদের সম্বন্ধে প্রচলিত গল্পের উপরে। হযরত মূল গল্পই শোনালেন তাই-ই নয় , এর যে পরিবর্তন তারা করেছে তার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং কোরাণ শরীফে তাদের মূল উপদেশ থেকে বিচ্যুত হয়ে খুঁটিনাটির উপরে গুরুত্ব আরোপ করাকে তিরষ্কার করা হয় [দেখুন আয়াত ১৮:২২]। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তিনি সম্পূর্ণ গল্পটি আল্লাহ্‌র তরফ থেকে নীতিগর্ভমূলক গল্প বা রূপক হিসেবে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রাপ্ত হন, সে কারণে এর উপদেশের মাধুর্য্য তুলনাহীন। টিকা ২৩৩৭ এ গল্পটির সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে।

২৩৩৬। 'Raqim' - ফলক , যাতে গুহাবাসীর নাম ও বিবরণ খোদিত ছিলো [ জালালাইন] এবং অধিকাংশ তফসীরকার এ বিষয়ে একমত। যারা দ্বিমত পোষন করেন তারা বলেন এটা ছিলো তাদের কুকুরের নাম। দেখুন সূরা [১৮:১৮] আয়াত ও নীচের টিকা ২৩৫০।

১০। স্মরণ কর! যখন যুবকেরা গুহাতে আশ্রয় গ্রহণ করলো ২৩৩৭ তারা বলেছিলো , "হে আমাদের প্রভু! তোমার পক্ষ থেকে আমাদের উপরে অনুগ্রহ বর্ষণ কর এবং আমাদের কাজ কর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করো ২৩৩৮।

২৩৩৭। কোরাণের প্রতিটি কাহিনী নীতিগর্ভমূলক উপদেশের সাথে সংযুক্ত, যেখানে বাইবেলে সেই একই কাহিনী শুধুমাত্র গল্প হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। খ্রীষ্টানদের কাহিনীর বর্ণনা আছে গীবনের "Decline and fall of the Roman Empire." বইটির ৩৩নং অধ্যায়ের শেষে। কাহিনীটি এরূপঃ রোমানদের রাজত্বকালে খৃষ্টানদের হত্যা করা হতো, সে সময়ে ইফিসাসের [Ephesus] সাত জন খৃষ্টান যুবক রোমানদের অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার জন্য শহর ত্যাগ করে নিকটবর্তী পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করে। সেখানে তারা কয়েক শতাব্দী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। যখন বহু বছর পরে জেগে উঠে তারা বুঝতেই পারে নাই যে, ইতিমধ্যে কয়েক শতাব্দী অতিক্রম করে গেছে, তাদের ধারণা ছিলো যে, তারা মাত্র কিছুক্ষণ নিদ্রাতে মগ্ন ছিলো। সময় সম্বন্ধে তাদের কোনও ধারণাই ছিলো না কিন্তু তাদের একজন যখন খাবার কিনতে শহরে গেলো তখন সে আশ্চর্য হয়ে গেলো যে, ইতিমধ্যে পৃথিবীর বহু পরিবর্তন ঘটেছে। খৃষ্টান ধর্মকে দমন না করে বরং খৃষ্টানীটিকেই যুগের ধর্ম বলে সমাজে আদৃত ও স্বীকৃত। খৃষ্টান ধর্ম প্রজাতন্ত্রের প্রধান ধর্ম বলে স্বীকৃত। যুবকের পোষাক ভাষা, মুদ্রা সবই মনে হচ্ছিল অন্য গ্রহের। ফলে তা জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেশের প্রধান ব্যক্তিরা গুহা পরিদর্শন করেন এবং যুবকদের প্রশ্ন করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করেন। এই হচ্ছে মূল গল্প।

যখন লোকের মুখে মুখে গল্পটি রোমান রাজত্বে প্রচার লাভ করে , ধারণা করা হয় গুহামুখে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। এ ব্যাপারে দেখুন আয়াত [১৮:৯] এবং টিকা ২৩৩৬। সম্ভবতঃ স্মৃতিফলকটি বহু বছর সেখানে ছিলো, কারণ ইফেসাস [Ephesus] বহু বছর ধরে এশিয়া মাইনরের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত রোমানদের এক সর্ব বৃহৎ শহর রূপে বিরাজ করেছিলো। এর সঠিক অবস্থান ছিলো তুরস্কের শ্মার্না [Smyrna] এর পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে। পরবর্তীতে খলিফা ওয়াতিক [Wathiq, 842 -840 AD] শহরটির অবস্থান ও পরিচয় খুঁজে বের করার জন্য অভিযাত্রী দল প্রেরণ করেন। তিনি মধ্য এশিয়ার জুল কারনাইনের লোহার প্রাচীরের অবস্থান নির্ণয়ের জন্যও অভিযাত্রীদল প্রেরণ করেন।

লোক মুখে মুখে প্রচারিত কাহিনী সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে থাকে। ৬ষ্ঠ খৃষ্টাব্দে একজন সিরিয়ান লেখক কাহিনীকে লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর মতে যুবকের সংখ্যা ছিলো সাত; তারা সম্রাট ডেসিয়াসের [Decius , 249 – 251AD] রাজত্ব কালে নিদ্রাযান, যিনি খৃষ্টানদের উপরে নির্যাতনের জন্য পরিচিত ছিলেন। যুবকেরা জেগে ওঠে থিয়োডিয়াসে -২ [Theodosius II 408 – 450 AD] এর রাজত্বকালে। মুসলমান সাহিত্যে Decius কে Daqyanus বলা হয় ; যার নামকে অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এসব ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক তথ্য কোরাণের কোনও আয়াত বোঝার জন্য জরুরী নয় , কারণ ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক তথ্যের মধ্যে মতবিরোধ ঘটে থাকতে পারে। কোরাণের আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের হেদায়েত লাভ।

২৩৩৮। যুবকেরা নিরাপত্তার জন্য গুহাতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো সত্য, কিন্তু তাদের সর্ব নির্ভরতা ছিলো আল্লাহ্‌র উপরে। তাঁরা তাদের পরিচালনায় ভার সেই সর্ব শক্তিমানের উপরে ন্যস্ত করে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কর্তৃত্বের নিকট আত্মসমর্পনের ভাষা ও মানসিকতা যুগে যুগে মোমেন বান্দাদের পথ প্রদর্শন করবে। যুবকেরা আল্লাহ্‌র অভিভাবকত্বের নিকট আত্মসমর্পন করে নিদ্রা যান। তারা বাইরের পৃথিবীর কোনও সংবাদই জানতে পারেন নাই।

১১। অতঃপর আমি গুহার ভিতরে তাদের কানের উপর কয়েক বৎসরের জন্য [পর্দ্দা] টেনে দিয়েছিলাম ২৩৩৯।

২৩৩৯। যদিও অর্থের দিক থেকে সমার্থক, তবুও অনুবাদের পার্থক্যের জন্য নীচে কয়েকটি অনুবাদকে তুলে ধরা হলো। "কয়েক বৎসর ঘুমন্ত অবস্থায় রাখিলাম" ইসলামিক ফাউন্ডেশন। "Drew [a veil] over their ears" মাওলানা ইউসুফ আলী "কানের উপরে নিদ্রার পর্দ্দা ফেলে দেই " মুহম্মদ শফী, কানের উপরে নিদ্রার পর্দ্দা - অর্থাৎ তারা আর কিছু শুনতে পারবে না। গুহা অভ্যন্তরে থাকার দরুণ তারা বাইরের পৃথিবীর কিছু দেখতেও পারছিলো না এখন তারা কিছু শুনতেও পারছে না। সুতারাং তারা বর্হিঃবিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের মৃতবৎ মনে হয়। তাদের জ্ঞান ও ধারণা ঘুমে ঢলে পড়ার পূর্বে যেখানে ছিলো , সেখানেই স্তব্ধ হয়ে পড়ে। ঘটনাটিকে এ ভাবে তুলনা করা যায়। কোনও দুর্ঘটনার সময়ে হাত ঘড়ি বিকল হয়ে যেমন ঠিক সেই সময়ে থেমে যায় , যুবকদের জ্ঞান ও পৃথিবী সম্বন্ধে ধারণাও ঠিক সেই রূপ থেমে যায়। বিকল ঘড়ি থেকে যেমন দুর্ঘটনার সঠিক সময় নিরূপন করা সম্ভব, ঠিক সেরূপ যুবকদের সেই সময়ের জ্ঞান ও ধারণা থেকে তাদের সময়কালও নির্ধারণ করা যায়।

১২। অতঃপর আমি তাদের জাগিয়ে দিলাম ২৩৪০, পরীক্ষা করার জন্য যে, দুদলের মধ্যে কোনটি উহাদের অবস্থিতি কাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে ২৩৪১।

২৩৪০। "জাগিয়ে দিলাম " ঘুম থেকে অথবা যে অবস্থায় তাঁরা ছিলেন [১৮: ১৮]। অর্থাৎ তারা যে অবস্থায় ছিলেন তারা বাইরের পৃথিবীর কোনও সংবাদ ধারণ করতে অক্ষম ছিলেন, তাদের সে অবস্থা থেকে জাগরিত করা হলো। তাঁরা এখন বর্হির্বিশ্বের সংবাদ গ্রহণে সক্ষম।

উপদেশঃ আল্লাহ্‌ যে কোনও মূহুর্তে মানুষের চিন্তা চেতনাকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন, আবার তাঁর বাণী ও জ্ঞানের উপযুক্ত করতে পারেন।

২৩৪১। যখন যুবকেরা চেতনা ফিরে পেলো; তারা তাদের ঘুমন্ত অবস্থা ও সময় সম্বন্ধে হিসাব হারিয়ে ফেলেছিলো। যদিও তাঁরা সকলে একই সাথে গুহাতে প্রবেশ করে, এবং একই স্থানে একই সময়ে নিদ্রিত হয়ে পড়ে, কিন্তু যখন তারা জাগ্রত হলো, সময়ের ধারণা সম্বন্ধে তাঁরা একমত হতে পারে নাই। বিভিন্ন জন বিভিন্ন বক্তব্য পেশ করে। আল্লাহ্‌ এ ভাবেই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে সময়ের ধারণা সব সময়েই আপেক্ষিক। মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ। এই কাহিনী আমাদের আরও উপদেশ দেয় যে, একই ঘটনা সকল ব্যক্তির নিকট সমান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। সুতারাং নিজস্ব জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্বারা তাঁর বিচার না করে আল্লাহর উপরে নির্ভরশীল হওয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে, "তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন" [১৮:১৯]।

রুকু -২

১৩। আমি তোমার নিকট ওদের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। ওরা ছিলো কয়েকজন যুবক, যারা তাদের প্রভুর প্রতি ঈমান এনেছিলো, এবং আমি তাদের সৎ পথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম ২৩৪২।

২৩৪২। যুবকদের ঈমান বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা আত্মিক দিক থেকে অত্যন্ত পরিপূর্ণতা লাভ করেছিলো। এই আয়াতে বলা হয়েছে, "সৎ পথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম"। এই লাইনটির অর্থ ঈমানের দৃঢ়তা হচ্ছে ধীরে ধীরে পুঞ্জিভুত শক্তি। একদিনে তা লাভ করা যায় না। ধাপে ধাপে তার ক্রমন্বতির পথে অগ্রসর ঘটে। উর্দ্ধে আরোহণের সিড়ির মত একধাপ পরের ধাপের প্রতি অগ্রসর করে। এবং আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া তাঁকে সাহায্য করে। "সৎ পথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম" অর্থাৎ তাদের অন্তরে শঙ্কা, ভয় ,দ্বিধা, দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়।

উপদেশঃ আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা চিত্তকে ভয় শূন্য করে।

১৪। আমি তাদের হৃদয়ে শক্তি দান করেছিলাম ২৩৪৩। দেখো! তারা উঠে দাড়িয়ে ছিলো এবং বলেছিলোঃ "আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর প্রভুই তো আমাদের প্রভু। আল্লাহ্‌র পরিবর্তে আমরা কখনই অন্য কাউকে উপাস্য করবো না। যদি আমরা তা করি, তবে অবশ্যই তা হবে অতিশয় গর্হিত কাজ।" ২৩৪৪

২৩৪৩। সুতারাং তাঁরা বহু ইলাহ্‌ এবাদতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ উত্থাপনের সাহস করে। তাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে প্রকাশ্যে মতামত ব্যক্ত করতে তারা ভীত হয় নাই। কারণ তারা তাদের মনে, আত্মার মাঝে আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণা স্পষ্টরূপে অনুধাবন করতে পেরেছিলো। আল্লাহ্‌ তাদের সেই শক্তি দান করেছিলেন। এ ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র এখ্‌তিয়ারে।

২৩৪৪। এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা গুহাতে আশ্রয় গ্রহণের পূর্বে প্রকাশ্যে বহু ইলাহ্‌ এর বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেন। [ ১৮:১৬ ]। কাহিনীর শুরু হচ্ছে [ ১৮:১৩ ] আয়াত থেকে। কিন্তু আয়াত [ ১৮:৯-১২ ] কে পরিগণিত করা যায় ভূমিকা হিসেবে। যেহেতু কাহিনীটিকে নীতিগর্ভমূলক উপদেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং আধ্যাত্মিক উপদেশই এর মূল বিষয়বস্তু, সেহেতু ভূমিকাতে কাহিনীর সামান্য আভাষ দেয়া হয়েছে মাত্র।

১৫। আমাদেরই এই স্বজাতিরা, আল্লাহ্‌র পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে ২৩৪৫। তারা যা করে সে সম্বন্ধে কেন তারা [বিশ্বাসযোগ্য ] স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না? যে আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তার অপেক্ষা বড় পাপ আর কে করে?

২৩৪৫। খৃষ্ট ধর্মের প্রথম তিন শতাব্দী অর্থাৎ তিন খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মশূন্য অবস্থা বিরাজ করে। রোমান সম্রাটের ধর্ম বিশ্বাস সে যুগে ব্যপক প্রচার লাভ করে যা সে সময়ে প্রগতির লক্ষণ হিসেবে পরিগণিত হতো। প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময় ছিলো এফেসাসে [Ephesus] প্রতিষ্ঠিত রোম সম্রাট ডায়ান এর [Artemis] বিশাল মূর্তি। নগরটি সে সময়ে এশিয়ায় রোমান সম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো এবং বড় সমুদ্র বন্দর ছিলো। এ থেকেই ধারণা করা যায় যে সে সময়ে রোমানদের ধর্ম বিশ্বাস কতটা বিস্তার লাভ করে। সেন্ট পল সেখানে তিন বছর র্খষ্ট ধর্ম প্রচার করেন , এবং শেষ পর্যন্ত সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও অত্যাচারের মুখে তিনি দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। [Acts, xix. 1-41].

১৬। " যখন তোমরা তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত যাদের উপাসনা করতো তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রভু তোমাদের উপর তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের কাজকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সহজ করে দেবেন ২৩৪৬।"

২৩৪৬। এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্‌ সর্ব সাধারণকে এই আশ্বাস দিয়েছেন যে, " আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুকে ভয় পাবে না, তোমাদের সর্ব নির্ভরতা হবে শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র উপরে। বর্তমানে তোমরা অত্যাচারিত হতে পার, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আল্লাহ্‌ তোমাদের সকল বিপদের সমাধান করে দেবেন , যদি তুমি আল্লাহ্‌র উপরেই একমাত্র নির্ভর কর।" আয়াত [ ১৮:১৫ ] পর্যন্ত ছিলো যুবকদের মনোভাব সাধারণ লোকদের সম্বন্ধে। আয়াত [ ১৮:১৬ ] হচ্ছে তাদের নিজেদের মধ্যে ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্বন্ধে আলোচনা। এর পর আয়াতে [ ১৮ :১৭ ] বলা হয়েছে যে তারা গুহাতে প্রবেশ করে এবং সেখানে প্রশান্ত চিত্তে, আল্লাহ্‌র উপরে একান্ত নির্ভরতায় শয়ন করেছিলো।

১৭। তুমি সূর্যকে দেখতে পেতে, যখন তা উদয় হয়, তখন তা গুহা থেকে তাদের ডান দিকে হেলে পড়ে ২৩৪৭। এবং যখন তা অস্ত যায়, তখন তা তাদের বাম দিক অতিক্রম করে যায়। তারা গুহা মধ্যস্থিত এক প্রশস্ত চত্বরে অবস্থান করছে। এ সমস্ত হচ্ছে আল্লাহ্‌র নিদর্শন। আল্লাহ্‌ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন,সে সঠিক পথে পরিচালিত এবং আল্লাহ্‌ যাকে ভ্রান্ত পথে ত্যাগ করেন, তুমি কখনও তার জন্য কোন রক্ষাকারী পাবে না, সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য ২৩৪৮।

২৩৪৭। ইফেসাস [Ephesus] শহরের অবস্থান ৩৮° উত্তর অক্ষাংশে গ্রীষ্মকালে সূর্য যখন উত্তর গোলার্ধের অক্ষাংশ অতিক্রম করে তারও বহু উত্তরে এর অবস্থান। সুতারাং গুহার মুখ উত্তরে থাকলে কোনও অবস্থাতেই সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সূর্যের আলো সারা বৎসর গুহার দক্ষিণ দিকে পড়বে। কারণ গুহার প্রবেশ মুখ ছিলো উত্তর দিকে। যদি যুবকেরা গুহার প্রবেশ মুখের দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে মুখ করে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে মাথা দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে, তবে সূর্য তাদের ডান দিকে উঠবে দক্ষিণ দিকে হেলে এবং সূর্য অস্ত যাবে তাদের বাম পার্শ্ব দিয়ে। ফলে গুহাভ্যন্তরে থাকবে ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক।

২৩৪৮। যুবকদের আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা থাকার দরুণ, আল্লাহ্‌ তাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় দান করেন। তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর হয় [ ১৮ : ১৬ ]

রুকু - ৩

১৮। তোমার মনে হতো তারা জাগ্রত, কিন্তু তারা তখন ছিলো ঘুমন্ত ২৩৪৯। আমি তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করাইতাম, ডানদিকে ও বামদিকে। তাদের কুকুরটি ২৩৫০ সম্মুখের পা দুটি গুহাদ্বারে প্রসারিত করে ছিলো। যদি তুমি তাদের কাছে আসতে, তাহলে অবশ্যই তুমি ভয় পেয়ে তাদের থেকে পিছন ফিরে পালাতে, এবং তাদের ভয়ে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়তে ২৩৫১।

২৩৪৯। সম্ভবতঃ সে সময়ে তাদের চোখ খোলা ছিলো, যদিও তারা ঘুমে অচেতন ছিলো, তাদের সমস্ত অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, তাদের চোখে কোনও দৃষ্টি ছিলো না , তবুও তাদের চক্ষুদ্বয় খোলা ছিলো। তারা মাঝে মাঝে পার্শ্ব পরিবর্তন করতো , যে ভাবে একজন ঘুমন্ত মানুষ করে।

২৩৫০। পুরুষানুক্রমিক হস্তান্তরিত কাহিনীতে বিশ্বাস করা হয় যে, কুকুরুটির নাম ছিলো 'কিতমীর' এ ব্যাপারে দেখুন উপরের টিকা ২৩৩৬

২৩৫১। ঘুমন্ত যুবকদের চিত্র যে ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে , তাতে বোঝা যায় যে, মোশরেকদের অত্যাচার থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য আল্লাহ্‌ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

১৯। এই [ছিলো তাদের অবস্থা] ; আমি তাদের [ঘুম থেকে] জাগ্রত করলাম যেনো তারা পরস্পরকে প্রশ্ন করতে পারে ২৩৫২। তাদের একজন বললো, "তোমরা কতদিন [এখানে] অবস্থান করেছ?" তারা বলেছিলো, " [সম্ভবতঃ] আমরা এখানে অবস্থান করেছি একদিন অথবা দিনের একাংশ।" [শেষ পর্যন্ত] তারা [সকলে] বলেছিলো, " আল্লাহ্‌ ই [একমাত্র ] ভালোভাবে জানেন তোমরা কতদিন এখানে অবস্থান করেছ। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর ২৩৫৩। সে খুঁজে দেখুক কোন খাদ্য উত্তম ২৩৫৪, এবং তার কিছু তোমাদের জন্য আনায়ন করুক, যেন তার দ্বারা তোমরা তোমাদের ক্ষুধা পরিতৃপ্ত করতে পার। সে যেনো সাবধান ও সৌজন্যতার সাথে আচরণ করে এবং সে যেনো তোমাদের সম্বন্ধে কাউকে কিছু না জানায়।

২৩৫২। এই আয়াতটি হচ্ছে মূল কাহিনীর মর্মবাণী বা উপদেশ। যুবকেরা যখন ঘুম থেকে জেগে ঊঠলো, তখন তারা পরস্পরের মধ্যে নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করলো। মানুষের অনুভূতি বা উপলব্দি ক্ষমতা কত অসম্পূর্ণ , তাঁদের অনুভূতির প্রকাশই ছিলো তার অকাট্য প্রমাণ। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলো তাদের চিন্তা, ভাবনা ও অনুসন্ধানের ব্যাপারে সৎ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, তবুও তারা প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়, এবং প্রত্যেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। অবশ্য তারা এই অর্থহীন বির্তকে সময় নষ্ট না করে অত্যাবশকীয় কার্যে মন দেয়। তাদের এই বির্তকের সঠিক সিদ্ধান্ত জানতেন একমাত্র আল্লাহ্‌। এই কাহিনীর মাধ্যমে এই চিরন্তন সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান যুগে আমরা বিজ্ঞানের জ্ঞানকে অভ্রান্ত সত্য বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ কথাও প্রমাণিত হচ্ছে যে আজ যা বিজ্ঞানের অভ্রান্ত সত্য , পরবর্তী যুগে তা ভ্রান্ত বলে পরিতাজ্য। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই এর কারণ। যে কোনও অদ্ভুদ, অসংলগ্ন ও ব্যাখ্যার অতীত ঘটনা বিভিন্ন বোধশক্তি সম্পন্ন মানুষের মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সে তার জ্ঞান ও বুদ্ধির মাধ্যমেই তাঁর বিচার করে ও সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কিন্তু প্রকৃত সত্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্‌র নিকট। যেমন : তাদের মধ্যে কারও ধারণা ছিলো যে সে একদিন, আবার কারও একদিনের কিছু অংশ , আবার কারও কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েছে এরূপ ছিলো। সময় সম্বন্ধে এরূপ আপেক্ষিক বা প্রতারণা পূর্ণ ধারণা প্রকৃত সময়ের ধারণা সম্বন্ধে খুব সামান্য জ্ঞানই দান করে। সেরূপ মৃত্যুর পরের সময়ের ধারণা আমাদের নাই। সময় হবে অনন্ত অসীম। কারণ সেখানে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের কোনও ব্যাপার থাকবে না। পুনরুত্থান আমাদের জীবনের প্রকৃত সত্যকে প্রত্যক্ষ করাবে। সময় সম্বন্ধে এই রহস্য বহু চিন্তাশীল মানুষকে আশ্চর্য্য করে দেয়। ইংরেজ কবি Thomas Wolf তার "Of Time and the River" কবিতায় লিখেছেন, "Dark time that hunts us with the briefness of our days."

উপদেশ : মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার প্রতি এই আয়াতে ইঙ্গিত করে এবং প্রকৃত সত্য একমাত্র আল্লাহ্‌র নিকট এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতাই হচ্ছে জীবনের চরম সত্য।

২৩৫৩। বৃথা তর্কে সময় নষ্ট না করে যুবকেরা তাদের করণীয় কাজে মনঃসংযোগ করে, লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, যদিও তারা বর্তমানে জাগ্রত অবস্থায় অবস্থান করছে, কিন্তু তাঁদের বর্তমান চিন্তা ভাবনা অতীতের অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভরশীল ছিলো।তারা যে সময়ে গুহাতে প্রবেশ করে সে সময়ের রোমান সম্রাট খৃস্টধর্মের অনুসারীদের উপরে অমানুষিক অত্যাচার চালাচ্ছিল। সুতারাং তাদের ধারণারও বাইরে ছিলো যে ইতিমধ্যে বহু যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সেই সম্রাটের মুদ্রা অবলুপ্ত হয়ে গেছে বা সমাজের প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে।

উপদেশ : এভাবেই মানুষ তার অভিজ্ঞতার কারাগারে বন্দী থাকে। আর মানুষের কর্মপ্রণালীও অভিজ্ঞতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা অনেক সময়েই প্রকৃত সত্যের বিপরীত হয়।

২৩৫৪। "উত্তম খাদ্য " নিয়ে আসার জন্য এখানে বলা হয়েছে। উত্তম অর্থাৎ হালাল ও পুষ্টিকর খাদ্য। যেহেতু তারা একত্ববাদের অনুসারী ছিলো, সে কারণে তারা মূর্তিপূঁজাতে উৎসর্গীত খাদ্য গ্রহণে অসম্মত ছিলো। তখনও তাদের ধারণা ছিলো যে, পৃথিবী তাদের গুহা প্রবেশের সময়ে স্তব্ধ হয়ে আছে।

উপদেশ : এ ভাবেই মানুষ নিজস্ব অভিজ্ঞতার দ্বারা বন্দী হয়ে যায়।

২০। "কারণ ওরা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে, তবে তারা তোমাদের প্রস্তরাঘাত করবে অথবা তোমাদের ওদের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য করবে ২৩৫৫। এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনও সফলতা লাভ করবে না। " ২৩৫৬

২৩৫৫। তাঁদের ধারণা ছিলো, তাদের গুহাতে প্রবেশ কাল থেকে খুব বেশী সময় অতিক্রান্ত হয় নাই। সুতারাং সামাজিক অবস্থানের খুব বেশী পরিবর্তন ঘটে নাই, সে সময়ে যারা একত্ববাদের অনুসরণ করতো ফলে তারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের জন্য পৌত্তলিকদের দ্বারা নিপীড়ন ও অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হতো এবং তাদের ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ না করলে জীবন পর্যন্ত হারাতে হতো।

২৩৫৬। "সফলতা লাভ করবে না " অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাসে বা ঈমানে সাফল্য লাভ করতে পারবে না , মানুষের ভয়ে, সত্যকে জানার পরে, সত্যকে ত্যাগ করা হচ্ছে সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য কাপুরুষতার কাজ। এ সব কাপুরুষের জন্য আত্মিক মুক্তির দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় এবং তাই -ই তাদের প্রাপ্য। কিন্তু আল্লাহ্‌র রহমতের দরজা এসব কাপুরুষদের জন্যও খোলা থাকে; যদি তারা অনুতপ্ত হয়ে সত্য ধর্মে ফিরে আসে।

২১। এ ভাবেই ২৩৫৭ তাদের ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করলাম, যেনো তারা জানতে পারে আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সত্য, এবং শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। দেখো! তারা তাদের [প্রতি] কর্তব্য সম্বন্ধে নিজেদের মধ্যে বির্তক করছিলো ২৩৫৮। [কেহ কেহ] বলেছিলো," ওদের উপর সৌধ নির্মাণ কর। " তাদের প্রভুই তাদের সম্বন্ধে ভালো জানেন। তাদের প্রতি কর্তব্য বিষয়ে যাদের [মত] প্রবল হলো, তারা বলেছিলো , "আমরা অবশ্যই ওদের ওপর পূঁজার স্থান [মন্দির] নির্মাণ করবো।"

২৩৫৭। "এই ভাবে " অর্থাৎ এ রকম কার্যপ্রণালী দ্বারা। কার্যপ্রণালীটি ছিলো : যুবকদের একজনকে খাদ্য কেনার জন্য শহরে প্রেরণ করা। তাদের প্রাচীন মুদ্রা ও অদ্ভুদ পোষাক , ভাষা, বাহ্য অবস্থা - এ সকল বাজারের লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।যখন তারা যুবকদের কাহিনী জানতে পারলো, তারা আল্লাহ্‌র অসীম ক্ষমতাকে অনুধাবনে সক্ষম হলো, যদি আল্লাহ্‌ তাঁর দাসকে অলৌকিক উপায়ে রক্ষা করতে পারেন এবং দীর্ঘদিন নিদ্রাবস্তায় থাকার পরে আবার জাগরিত করতে পারেন, তবে অবশ্য মুত্যুর পরে পুনরুত্থানের ক্ষমতাও তিনি রাখেন। "আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সত্য "। তাঁর রহমত ও করুণার দৃষ্টান্ত এভাবেই তিনি তুলে ধরেছেন - তাদের জন্য, যারা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌রই প্রদর্শিত পথে চলে তাঁর উপরেই নির্ভর করে। অপর পক্ষে গুহা যুবকদের জন্য এ সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, আল্লাহ্‌ যে কোনও অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম। মানুষের কিছু বোঝার পূর্বেই পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। সুতারাং আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা কখনও বৃথা যেতে পারে না। এ কথা আমাদের চরম হতাশা, ব্যর্থতার মাঝেও স্মরণ রাখতে হবে। এ সত্য পৃথিবী যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করেছে, বড় বড় বিপ্লব ঘটে গেছে সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে, অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত, মানুষ কোনও কিছু বোঝার বা অনুধাবনের পূর্বে। গুহার যুবকেরা যেমন বুঝতেই পারে নাই তাদের চেনা পৃথিবীর পরিবর্তন।

২৩৫৮। মানুষ সব সময়ই বিকৃত চিন্তা ভালোবাসে। যখনই সত্যের কণামাত্র তাঁর সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে সে বিতর্কে লিপ্ত হয়। মানুষের এই অদ্ভুদ মনস্তত্ব এখানে গুহা যুবকদের ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। যুবকেরা সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে, কোনও বিতর্কে না যেয়ে, জীবনের প্রাত্যহিক কাজের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে , কারণ তারা ছিলো জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। অপর পক্ষে সেই শহরের অধিবাসীরা ঘটনাটির শিক্ষণীয় দিকটি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিলো, তারা মূল্যহীন জাগতিক বিষয়বস্তু নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিবেচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। আল্লাহ্‌র ক্ষমতা, প্রজ্ঞা, করুণা অনুধাবনের পরিবর্তে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্মৃতি ফলকের নক্‌সা, নির্মাণ সামগ্রী ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণে। সেখানে কি কোনও উপাসনা গৃহ নির্মাণ করা হবে, না শুধুমাত্র স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে ইত্যাদি অর্থহীন জাগতিক বিষয়বস্তু তাদের সমগ্র চেতনা, চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তারা শেষ পর্যন্ত সেখানে উপাসনালয় নির্মাণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা প্রকৃত ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয় যতদিন না আল্লাহ্‌ কোরাণের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আমাদের তা জ্ঞাত করান।

২২। [কেউ কেউ] বললো, " তারা ছিলো তিনজন, চতুর্থটি হলো কুকুর; " [অন্যরা] বলে, " তারা ছিলো পাঁচজন, তাদের ষষ্ঠটি ছিলো কুকুর" - সন্দেহ বশে [তারা ] অজানা বিষয়ের উপরে অনুমান করেছিলো ২৩৫৯। [যদিও অন্যরা] বলেছিলো , " তারা ছিলো সাতজন, অষ্টমটি ছিলো কুকুর"। তুমি বল," আমার প্রভু উহাদের সংখ্যাটি সব চেয়ে ভালো জানেন। খুব স্বল্প সংখ্যক লোকই তাদের [প্রকৃত ঘটনা ] জানে ২৩৬০। সুতারাং সুস্পষ্ট হয়েছে এমন বিষয় ব্যতিরেকে তোমরা তাদের সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না ২৩৬১। এবং যারা ঘুমিয়েছিলো , তাদের কারও [কার্যকলাপ] সম্বন্ধেও আলোচনা করো না ২৩৬২।

২৩৫৯। পরবর্তী যুগে ঘুমন্তদের সংখ্যা সম্বন্ধে প্রবল বিতর্কের সূচনা হয়। তাঁরা কি তিন জন না পাঁচ জন না সাত জন ছিলেন? সাধারণ লোকেরা অনুমানের উপরে নির্ভর করে সংখ্যার ধারণা করতো, এ ব্যাপারে তাদের সত্যিকারের কোন জ্ঞান ছিলো না। বর্তমানে গীবন যে সংখ্যাকে সাব্যস্ত করেছেন, তাকেই সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে এ ব্যাপারে তর্ক করা বৃথা কারণ সংখ্যাটি বড় কথা নয়, বড় কথা ও শেষ কথা হচ্ছে আধ্যাত্মিক উপদেশ যা এই ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের দিতে চেয়েছেন।

২৩৬০। সংখ্যাটির সঠিকতা বড় কথা নয়। ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবন করাই হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক লোকই ঘটনার মূল তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে। তাদের প্রায় সকলেই ঘটনার অর্থহীন ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা ও চিন্তা ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায়, যদিও সে সম্বন্ধে তাদের কোনও জ্ঞানই নাই। এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদের এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে যে, শুধু সে যুগেই নয়, সর্ব যুগে সর্বসময়েই সাধারণ মানুষ অর্থহীন, গুরুত্বহীন বিষয়ের প্রতি অধিক মনোযোগ, পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করে বিষয়ের মূল বা মর্মার্থ উপলব্ধির চেষ্টা অপেক্ষা।

২৩৬১। আল্লাহ্‌ কঠোর ভাষায় অর্থহীন বিতর্কে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন।কিন্তু যুগে যুগে দেখা যায় মানুষ ধর্মের নামে এ সব অর্থহীন ও গুরুত্বহীন বিষয়ে বিতর্ক করতে ভালোবাসে, তারাই যারা প্রকৃত ঘটনাকে অনুধাবন না করে আনুষ্ঠানিকতার উপরে অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু যদি ঘটনাটির সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকে, অর্থাৎ "সাধারণ আলোচনায় " বোঝা যায় যে ঘটনার সত্যতা সঠিক তবে দ্ব্যর্থহীন ভাষাতে তা ঘোষণা করা উচিত - আল্লাহ্‌র সত্যকে তুলে ধরা উচিত।

উপদেশ : কোন ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দিলে জরুরী বিষয়গুলি বর্ণনা করা উচিত। এর পরেও যদি কেউ অনাবশ্যক আলোচনায় জড়িত হয়ে পড়ে , তবে তার সাথে সাধারণ আলোচনা করে বিতর্ক শেষ করে দেয়া বাঞ্জনীয়। নিজের দাবী প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাওয়া এবং প্রতিপক্ষের দাবী খন্ডনে অধিক জোর দেয়া অনুচিত। কারণ এতে তিক্ততার সম্ভাবনা ঘটে।

২৩৬২। যারা মিথ্যা রটনা করতে ভালোবাসে, তারা ঘটনার তাৎপর্য খুব কমই অনুধাবনে সক্ষম। বিশেষতঃ উদাহরণ ও উপমার মাধ্যমে যে শিক্ষা দেয়া হয়, তার প্রকৃত মর্মার্থ তারা বুঝতে অক্ষম। কোরাণ এ ব্যাপারে পরিষ্কার ভাষাতে তাদের অবস্থান বর্ণনা করেছে। যুবকদের সংখ্যা ও গুহাতে অবস্থানের দিনের সঠিক সংখ্যার গুরুত্ব অধিক না তাদের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর ক্ষমতার যে প্রকাশ করেছেন তা অনুধাবন করা ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের কাছে অধিক কাম্য কোনটি?

রুকু - ৪

২৩। "আমি আগামী কাল এই সব [কাজ] করবই" - এরূপ কোন উক্তি করো না।

২৪। এ কথা না বলে যে, " আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করলে।" ২৩৬৩ যদি ভুলে যাও তোমার প্রভুকে অন্তরে স্মরণ করে বলবে, " আমি আশা করি আমার প্রভু আমাকে এর থেকেও সঠিক পথে পরিচালিত করবেন। ২৩৬৪।

২৩৬৩। আয়াত ২৩ ও ২৪ সমন্বয়ে অর্থ প্রকাশ হয়। আমরা কখনও আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা ব্যতীত শুধুমাত্র নিজস্ব শক্তির উপর নির্ভর করবো না। কখনও যদি আমরা তা ভুলে যাই, স্মরণ হওয়া মাত্র আমরা আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা ব্যক্ত করবো, যেভাবে গুহার যুবকেরা করতো। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি কর্মের জন্য আমরা আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল হব।

২৩৬৪। "এর চেয়েও সঠিক পথ " এই লাইনটির অর্থ আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য বা সত্যের নিকটবর্তী হওয়া। বৃত্ত যেরূপ মূল একটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে রচিত হয় - কেন্দ্র কে আবর্তিত করেই বৃত্তের রচনা ও কেন্দ্র থেকে পরিধির দূরত্ব বৃত্তের আয়তন নির্ণয় হয়। সেরূপ মানব জীবনের জীবন বৃত্ত আবর্তিত হয় আল্লাহকে কেন্দ্র করেই। আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের সাধনাই তার পার্থিব জীবনের সাধনা। আল্লাহ্‌কে কেন্দ্র করেই মানুষের আত্মার পরিক্রমা এই পৃথিবীর সুদীর্ঘ জীবন পথে। মানব আত্মা যত আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশিত পথে চলে , তত তার অবস্থান আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যের বা সত্যের নিকটবর্তী হয়। তার জীবন বৃত্তের আয়তন ছোট হয়ে আসে।

২৫। সুতারাং তারা গুহাতে অবস্থান করেছিলো, তিনশত বৎসর এবং আরও নয় বৎসর। ২৩৬৫

২৩৬৫। এই আয়াতটি পরবর্তী আয়াতের সাথে পড়তে হবে তবেই এর সম্পূর্ণ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা যাবে। লোকমুখে গুহাবাসীদের অবস্থান বিভিন্ন ভাবে প্রচার লাভ করে। জনশ্রুতিতে তাদের গুহাভ্যন্তরে অবস্থান কাল সম্বন্ধেও বিভিন্ন মতবাদ প্রচারিত হয়। যখন বহু বছর পরে কাহিনী লেখা হয় , খৃষ্টীয়ান লেখক Simeon Metaphrastes গুহার অবস্থান কালকে ৩৭২ বৎসর বলে উল্লেখ করেন। কোরাণে প্রথমে তিনশত বৎসর বর্ণনা করেছে পরে এই তিনশতের উপর আরও নয় [৯] বেশী। প্রথমেই তিনশত নয় (৩০৯) বলা হয় নাই। সৌর বৎসর অনুযায়ী তিনশত বছরই হয় এবং চান্দ্র বর্ষের হিসেবে প্রতি একশত বৎসরে তিন বৎসর বেড়ে যায়। তাই তিনশত সৌর বৎসরে চান্দ্র বৎসর নয় বছর বেড়ে তিন শত নয় বছর হয়। এই দুই প্রকার বর্ষপঞ্জীর পার্থক্য বোঝাবার জন্য উপরোক্ত ভঙ্গীতে বর্ণনা করা হয়েছে।

এখানে ঐতিহাসিক গীবনের মতামতকে তুলে ধরা হলো। গীবনের মতে সময় কাল ছিলো সম্রাট Decius [249 – 259 AD] থেকে সম্রাট Theodosius [408 – 450AD] এর রাজত্বকালের মধ্যবর্তী সময়। সে হিসেবে ২৫০ থেকে ৪৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের পরিধি হয় ২০০ বৎসর। কিন্তু কোরাণের কাহিনীতে কোনও সম্রাটের নামের উল্লেখ করা হয় নাই। সুতারাং ঐতিহাসিকের মতামতকে অভ্রান্ত মনে করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে কাহিনীতে কোনও সম্রাটের নাম উল্লেখ করা হয় নাই। যে সম্রাট খৃষ্টানদের হত্যা ও অত্যাচার করতেন তার সাথে কাহিনীর প্রারম্ভের সময়কাল সমকালীন। এবং যে সম্রাটের সময়ে গুহাবাসীরা জেগে ওঠেন তা কাহিনীতে নির্দ্দিষ্ট ছিলো না; তা ছিলো অনুমান ভিত্তিক। কারণ কাহিনীকে লিপিবদ্ধ করা হয় দুই পুরুষ পরে, খৃস্টানদের উপর সর্বাপেক্ষা অত্যাচারী সম্রাট হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন সম্রাট নীরো [ ৫৪ - ৬৮ খৃষ্টাব্দ ]। যদি আমরা তার রাজত্বকালের শেষ সময় কালকে গুহাবাসীর গুহায় প্রবেশ কাল হিসেবে গণনা করি, এবং তাঁদের জেগে ওঠার সময়কাল ধরি ৪৪০ খৃষ্টাব্দ, তাহলে Simeon Metaphrastes এম মত অনুযায়ী ৩৭২ বৎসর হয়। তবে এ কথা সর্বাগ্রে স্মরণ রাখতে হবে যে, এসব লেখকদের সকলেরই লেখা অনুমান ভিত্তিক। এরা কেহই আমাদের থেকে খুব বেশী কিছু জানতেন না। আমাদের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে কোরাণের উপদেশ অবলম্বন করা। বৃথা যুক্তি তর্কের অবতারণা না করে কোরাণের ভাষা অনুযায়ী আমরা বলবো, " তারা কত কাল ছিলো তা আল্লাহ্‌-ই ভালো জানেন। "
[১৮ : ২৬ ]

২৬। বলঃ " আল্লাহ্‌ই প্রকৃত জানেন তারা কতকাল ছিলো। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের [জ্ঞান] তাহারই। কত সুস্পষ্ট ভাবে তিনি দেখেন এবং কত সুন্দর ভাবে তিনি [সব কিছু] শোনেন! আল্লাহ্‌ ব্যতীত উহাদের কোন রক্ষা কর্তা নাই২৩৬৬। যে কেউই হোক না কেন, তিনি তার কর্তৃত্ব কারও সাথে শরীক করেন না ২৩৬৭।

২৩৬৬। "উহাদের" - এরা কারা ? সম্ভবতঃ উহাদের দ্বারা গুহাবাসীদের বোঝানো হয়েছে। তারা নিজেদের নিরাপত্তার সকল ভার সর্বশক্তিমানের উপরে ন্যস্ত করে নিশ্চিত হন, তারা এ ব্যাপারে আল্লাহ্‌র সাথে আর কোনও অংশীদার কল্পনাও করে নাই, অথবা "উহাদের " শব্দটি দ্বারা সাধারণ ভাবে "মোশরেকদের " বুঝানো হয়েছে, যারা বিপদে আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য আরও অংশীদারকে কল্পনা করে।

২৩৬৭। " নিজ কর্তৃত্ব " - অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সর্বময় ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্ব পৃথিবীতে অথবা শেষ বিচারের দিনে।

২৭। তোমার প্রভু তোমাকে যে কিতাব প্রত্যাদিষ্ট করেছেন, তা থেকে আবৃত্তি কর [এবং শিক্ষা দাও ]। কেহ -ই তাঁর বাক্য পরিবর্তন করতে পারবে না। ২৩৬৮ তিনি ব্যতীত তুমি কোন আশ্রয় পাবে না।

২৩৬৮। " তাঁর বাক্য " - অর্থাৎ তাঁর আদেশ, হুকুম।

২৮। [১৮:২৮] তুমি নিজেকে ধৈর্য সহকারে রাখবে ওদের সংসর্গে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় আহ্বান করে ওদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ২৩৬৯। এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে ওদের থেকে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না। তুমি তার আনুগত্য করো না - যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল - খুশীর অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে। ২৩৭০

২৩৬৯। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৬: ৫২ ] ও টিকা ৮৭০। তাদেরই হৃদয় সত্যিকারভাবে আল্লাহ্‌র অনুগত যারা সকাল, সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে আহ্বান করে। এখানে " সকাল - সন্ধ্যা" বাক্যটির দ্বারা সকল সময় বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যারা জাগতিক ও পার্থিব কোনও কিছুই আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের থেকে অধিক মনে করে না। জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা গরীব হতে পারে, কিন্তু তাদের আত্মিক উন্নতি তাদের আত্মার মাঝে অপার শান্তির পরশ নিয়ে আসবে যা পার্থিব জাঁকজমক ও শোভা থেকে অনেক বেশী অনুভুত হবে।

২৩৭০। যারা আল্লাহ্‌র রাস্তা ত্যাগ করে বিপথে যায়, আল্লাহ্‌র করুণা তাদের বিপথ হতে ফিরে আসতে প্রভাবিত করে। নানা বিপর্যয় ও দুঃখ কষ্টের মাধ্যমে তাদের আল্লাহ্‌র আশ্রয়ে ফিরে আসার জন্য অনুপ্রাণীত করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও যারা উদ্ধত একগুয়ে ভাবে আল্লাহ্‌র পথে বাঁধা সৃষ্টি করে, এবং তাদের বিকৃত আকাঙ্খাকে চরিতার্থ করে তাদের আল্লাহ্‌র রাস্তায় ফেরার আশা নাই। তারা এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যায় যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনও পথ খোলা থাকে না। এরূপ অবস্থায় তাদের নিকট আল্লাহ্‌র করুণা ধারা পৌঁছায় না। অন্ধ অহংকার ও গর্ব তাদের উদ্ধত ও একগুয়ে করে তোলে এবং আল্লাহ্‌র করুণা পৌঁছানোর সকল রাস্তা অহংকার ও গর্বের বেড়াজালে ঢাকা পড়ে যায়। এদের উদাহরণ ও পরামর্শ সম্বন্ধেই এই আয়াতে সাবধান করা হয়েছে। এরূপ সংসর্গ ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।

২৯। বল, " সত্য তোমার প্রভুর নিকট থেকে আগত।" সুতারাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক যার ইচ্ছা [তা] প্রত্যাখান করুক ২৩৭১। পাপীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি, যার [ধোঁয়া এবং শিখা] হবে তাবুর দেয়াল ও ছাদের ন্যায় পরিবেষ্ঠন কারী। যদি তারা যন্ত্রনার লাঘব প্রার্থনা করে, তাদের দেয়া হবে গলিত [উত্তপ্ত] ধাতুর ন্যায় পানীয়, যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে। কি ভয়াবহ সে পানীয়! হেলান দেয়ার জন্য কত নিকৃষ্ট সেই আরাম কেদারা।

২৩৭১। আল্লাহ্‌ মানুষকে সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন। ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করার পূর্ণ স্বাধীনতা তার আছে। আর ভালো ও মন্দ প্রতিটি কাজের জন্য সে ব্যক্তিগত জবাবদিহিতায় আল্লাহ্‌র নিকট দায়বদ্ধ। সত্য আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত। যুগে যুগে এই সত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও যদি আমরা তা প্রত্যাখান করি তবে আমাদের কৃত কর্মের ফল আমাদের ভোগ করতেই হবে , যার বর্ণনা আছে এই আয়াতে। দোযখের আগুন চতুর্দিক ছাদ পর্যন্ত বেষ্টন করে থাকবে - তাবুর মত। সাধারণতঃ প্রচন্ড গরমে আমরা ঠান্ডা পানীয় দ্বারা তৃষ্ণা নিবারণ করি। কিন্তু দোযখে পানীয় হিসেবে দেয়া হবে গলিত উত্তপ্ত ধাতু। গলিত ধাতুর ন্যায় বিশেষত্ব হচ্ছে তা যে শুধু প্রচন্ড উত্তপ্ত থাকে তাই -ই নয়, তা হয় ঘন, ভারী তরল পদার্থ। এই পদার্থ মুখের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে এর প্রচন্ড তাপ মুখমন্ডল দগ্ধ করে ফেলবে।

৩০। যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, আমি তো অবশ্যই কারও [বিন্দু পরিমাণ] সৎ কাজের [প্রাপ্য] পুরষ্কার নষ্ট করি না ২৩৭২।

২৩৭২। যারা বিশ্বাসী এবং সৎকর্ম করে, তাদের পুরষ্কারের কথা বারে বারে ঘোষণা করা হয়েছে। দেখুন [ ২৮ : ৮৪ ], [ ৩০ : ৩৯ ] আয়াত। তাদের ক্ষুদ্রতম সৎকাজকেও পুরষ্কৃত করা হবে - কোন কণামাত্রকেও হারিয়ে যেতে দেয়া হবে না। আল্লাহ্‌র করুণা তাদের দোষত্রুটি দূর করে দেবেন। ধীরে ধীরে কামনা - বাসনার কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে ও আধ্যাত্মিক ভাবেও সমৃদ্ধি লাভ করবে।

৩১। তাদের জন্য আছে অনন্ত সুখের উদ্যান; যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তাদের সোনার কংকন দ্বারা ভূষিত করা হবে, তারা সেথায় সবুজ রং এর রেশম, পুরু ব্রোকেডের বস্ত্র পরিধান করবে ২৩৭৩। সেখানে তারা উচ্চ সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। কত উত্তম সে পরিশোধ, এবং কত সুন্দর সে আরাম কেদারা হেলান দেয়ার জন্য ২৩৭৪।

২৩৭৩। বেহেশতের ধারণাকে আমাদের চেতনাতে সুখ,শান্তি, আরাম ও আয়েশের প্রতীকরূপে অঙ্কন করা হয়েছে। বেহেশতের শান্তি আমাদের ধারণার বাইরে। এই পার্থিব জীবনে সে ধারণাকে আমাদের চেতনাতে প্রতিভাত করার জন্য,আমাদের পৃথিবীর জীবনের সুখ, প্রাচুর্য ও আরাম আয়েসের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অনুভবের প্রয়াস করা হয়েছে। বাগান,ঝরণার স্বচ্ছ সলিল , সুন্দর নৈসর্গ; সুন্দর মূল্যবান গহনা, পোষাক এখানে সবুজ রং এর উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ সবুজ হচ্ছে সজীবতার ও যৌবনের প্রতীক। এই রং চক্ষুর জন্য শান্তিদায়ক এবং বাগানের বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বেহেশতবাসীরা নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী সিল্ক,অথবা ভারী ব্রোকেড পছন্দ করতে পারবে। তাদের আসন হবে সুউচ্চ সম্মানের। সমস্ত বর্ণনাই প্রতীকধর্মী।

২৩৭৪। এই আয়াতে বেহেশতের বর্ণনাকে শেষ করা হয়েছে, "উত্তম পরিশোধ" রূপে; যা দোযখের বর্ণনার বিপরীত। উপরের আয়াতে দোযখের বর্ণনায় বলা হয়েছে, "কত নিকৃষ্ট আশ্রয় "।

রুকু - ৫

৩২। তাদের সামনে উপস্থাপন কর দুই ব্যক্তির উপমা। তাদের একজনকে দিয়েছিলাম দুইটি আঙ্গুর বাগান এবং এই দুটিকে আমি খেজুর বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছিলাম। এই দুই এর মধ্যবর্তী স্থানকে শস্যক্ষেত্র করেছিলাম ২৩৭৫।

২৩৭৫। এখানে দুইটি লোকের উদাহরণের মাধ্যমে রূপক নীতিগর্ভমূলক উপদেশ দান করা হয়েছে। একজন তার ধনের গর্বে আত্মবিস্মৃত হয়। তার ধনবল, জনবল, সবই যে সেই পরম করুণাময়ের দান তা ভুলে যায়। বুঝতে পারে না যে এসব সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাকে দান করা হয়েছে - এ হচ্ছে তাঁর জন্য আল্লাহ্‌ তরফ থেকে বিশ্বাসের পরীক্ষা , আল্লাহ্‌র দেয়া কর্তব্য সঠিকভাবে পালনের পরীক্ষা। অপরজন কোনও ধন-সম্পদের জন্য অহংকার করে নাই। কারণ সে সঠিকভাবে জানে যে, সে শুধু এ সবের জিম্মাদার মাত্র। সে শুধু আল্লাহ্‌র করুণার প্রত্যাশী। ফলে প্রথম ব্যক্তির সমস্ত সম্পদ নষ্ট হয়ে যায় , এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি তার শেষ পরিণতিতে সুখ ও শান্তি লাভ করে।

৩৩। উভয় উদ্যানই [ফসল] উৎপাদনে কোনরূপ ত্রুটি প্রদর্শন করতো না। এবং দুটি [বাগানের ] মাঝে আমি নদীকে প্রবাহিত করেছিলাম।

৩৪। এই লোকটির [ প্রচুর] উৎপাদিত দ্রব্য ছিলো। পরস্পরের মাঝে বির্তকের সময়ে লোকটি বলেছিলো, "তোমার থেকে আমার ধন-সম্পদ বেশী, এবং সম্মান ও ক্ষমতায় [আমার অনুসারী লোক] বেশী ২৩৭৬।

২৩৭৬। দুজনে পরস্পরের মধ্যে তুলনা করতে শুরু করে। অহংকারী ব্যক্তি নিজের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি,সম্মান -প্রতিপত্তি ইত্যাদির জন্য গর্বে অহংকারে আত্মপ্রসাদে স্ফীত হয়ে পড়ে এবং তার ধারণা জন্মে যে এসব তার এবং তার বংশের অধিকারে চিরজীবনের জন্য কুক্ষিগত থাকবে। এই অহংকারে স্ফীত হয়ে সে তার সঙ্গী অপর লোককে হেয় দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে কারণ অর্থ-সম্পদে অপর ব্যক্তি তার সমকক্ষ নয়। সে অনুধাবনে ব্যর্থ হয় যে, চারিত্রিক গুণাবলীতে সে ব্যক্তি তার থেকে উন্নত। আর আল্লাহ্‌র নিকট ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলীই কাম্য , অর্থ সম্পদ বা মিথ্যা গর্ব নয়।

৩৫। এ ভাবে সে তার আত্মার প্রতি অন্যায় করা [মানসিক অবস্থায়] তার বাগানে প্রবেশ করেছিলো ২৩৭৭। সে বলেছিলো, "আমি মনে করি না যে, এটা কখনও ধ্বংস হবে।"

২৩৭৭। দুই ব্যক্তিরই বাগান ছিলো, অর্থ ছিলো, জনবল ছিলো, প্রভাব প্রতিপত্তি ছিলো। কিন্তু এদের একজন এ সব পেয়ে অহংকারী হয়ে উঠলো, এবং অপর জনের চারিত্রিক গুণাবলী ও বিনয়ে এসবের জন্য তারতম্য ঘটলো না। অর্থ সম্পদ নয় , অর্থ সম্পদ প্রাপ্তিতে প্রথম জনের যে মানসিক বৈকল্য ঘটে, তাই -ই তার ধ্বংসের কারণ। গর্ব বা অহংকার দ্বারা সে যে শুধু তার প্রতিবেশীর প্রতি অবিচার করেছিলো তাই নয় ,তার থেকে বেশী ক্ষতি করে সে তার নিজের আত্মার। ধন-সম্পদের মোহ তার মনে অহংকারের জন্ম দেয়, তার অন্তর্দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর রীপু আচ্ছাদিত আত্মাতে আল্লাহ্‌র নূর প্রবেশে বাধা পায়, তারা সত্যকে চিনতে পারে না, অনুধাবন করতে পারে না। তাদের আধ্যাত্মিক জগত ধীরে ধীরে অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাদের নিকট পরলোকের কোনও গুরুত্ব থাকে না।

৩৬। "আমি এও মনে করি না যে, শেষ বিচারের দিন [কখনও ] আসবে। যদি আমাকে আমার প্রভুর নিকট ফিরিয়ে নেয়া হয়-ই, তবে আমি তো [ সেখানে ] নিশ্চয়ই এর পরিবর্তে উৎকৃষ্ট কিছু পাব "। ২৩৭৮

৩৭। বিতর্কের এক পর্যায়ে তার সঙ্গী তাকে বললো, "যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা, ও পরে শুক্র থেকে এবং তার পরে পূর্ণাংগ করেছেন মানুষ আকৃতিতে তুমি কি তাকে অস্বীকার করছো? " ২৩৭৯।

২৩৭৮। জাগতিক বিষয়ের প্রতি যাদের আকর্ষণ অত্যন্ত বেশী তাদের মানসিক বৈকল্য এবং ধন সম্পদের জন্য লোলুপতা ও আকাঙ্খাকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যারা শুধুমাত্র পার্থিব বিষয়ের উপরে গুরুত্ব আরোপ করে তাদের নিকট "ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট " হচ্ছে আরও অর্থ-সম্পদ, আরও প্রভাব প্রতিপত্তি, আরও ক্ষমতা। তাদের ধারণায় তারা পৃথিবীদে যে অর্থসম্পদ , প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা উপভোগ করছে তাই-ই একমাত্র সুখের মাপকাঠি। তাদের সুখের সংজ্ঞা চোরাবালির উপরে দাড়ানো। তারা জানে না যে, এর কোনও মজবুত ভিত্তি নাই, চোরাবালির উপরে গড়া ইমারত যেমন ধ্বসে পড়ে, তাদেরও জাঁকজমক, অর্থসম্পদ খুবই ক্ষণস্থায়ী। পরলোকের স্থায়ী জীবনে এর কোনও প্রভাব থাকবে না।

২৩৭৯। মানুষের সৃষ্টির তিনটি ধাপকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ মাটি বা কাদা যা আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন "শূন্য " থেকে , যা হচ্ছে মানবদেহের প্রধান উপাদান। তার পরে সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় পিতামাতার ভূমিকা। এখানে শুক্রের উল্লেখ আছে অর্থাৎ শুক্রকে গ্রহণের প্রক্রিয়াও থাকবে। পরবর্তীতে শুক্রের আনুসঙ্গিক মিলন দ্বারা পূর্ণাঙ্গ মনুষ্য আকৃতি লাভ করে। এর পরে আল্লাহ্‌ তার মাঝে রূহকে ফুঁকে দেন। আয়াত [ ১৫: ২৮ - ২৯ ]

৩৮। "কিন্তু [ আমি মনে করি ] আমার পক্ষ থেকে তিনি আমার প্রভু, আল্লাহ্‌। আমি আমার প্রভুর সাথে কাউকে শরীক করি না। "

৩৯। তুমি যখন বাগানে প্রবেশ করলে, তখন কেন বললে না; " আল্লাহ্‌র ইচ্ছা [ কার্যকর হয় ] ! আল্লাহ্‌র শক্তি ব্যতীত অন্য কোন শক্তি নাই তুমি যদি আমাকে ধনে এবং সন্তানে তোমা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর মনে কর ২৩৮০

২৩৮০। সঙ্গীটির উত্তরকে পাঁচটি যুক্তিপূর্ণ ভাবে ভাগ করা যায়। (১) সে তীব্র ভাষাতে আত্মগর্ব ও আল্লাহকে অস্বীকার করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে [ ১৮ : ৩৭ ]। (২) সে তাঁর নিজস্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দ্বারা বুঝতে পারে যে আল্লাহ্‌ এক এবং অদ্বিতীয় , এবং তিনিই একমাত্র প্রতিপালক প্রভু [ ১৮ : ৩৮ ]। (৩) সে তার সঙ্গীকে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও অনুকম্পার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উপদেশ দান করে [ ১৮ : ৩৯ ] (৪) আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের জন্য সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে [ ১৮ : ৪০ ]। (৫) অকৃতজ্ঞতার জন্য সে তার সঙ্গীকে সাবধান করে দেয়। আল্লাহ্‌র ক্রোধ যে কোন সময়ে ক্রুদ্ধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে হয়তো তার সাজানো বাগান উদ্ভিদশূন্য হয়ে যাবে বা ভূগর্ভস্থ পানি অন্তর্হিত হয়ে পড়বে [ ১৮ : ৪০ - ৪১ ]।

মন্তব্য : অত্যাধিক অহংকার ও গর্ব আল্লাহ্‌ সহ্য করেন না। এই উদ্ধত অহংকারের কারণেই বেহেশত থেকে শয়তানের পতন ঘটে।

৪০। "তবে হয়তো আমার প্রভু আমাকে তোমার উদ্যান থেকে উৎকৃষ্টতর কিছু দেবেন। এবং তোমার উদ্যানে আকাশ থেকে বজ্রপাত ঘটাবেন [ প্রতিশোধ হিসেবে ] ! ফলে তা [ উদ্ভিদ শুণ্য ] মসৃণ বালিতে পরিণত হবে,

৪১। "অথবা, উদ্যানের পানি ভূগর্ভে অন্তর্হিত হবে, যেনো তুমি কখনও তার সন্ধান লাভে সক্ষম না হও।" ২৩৮১

২৩৮১। "Husbanan" অর্থ বজ্রপাত; অনেক বাংলা অনুবাদ হয়েছে আকাশ থেকে নির্ধারিত বিপর্যয়। এখানে আল্লাহ্‌র শাস্তি বজ্রের আকারে আকাশ থেকে নেমে আসবে তাই বোঝানো হয়েছে। তবে এর অর্থ অনেক ব্যপক। যে কোন বিপর্যয় আল্লাহ্‌র শাস্তিরূপে নেমে আসবে। যেমনঃ ভূমিকম্প, নদীর গতি পরিবর্তিত হওয়া বা মাটির স্তর থেকে পানি সরে যাওয়া যার ফলে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে, আগ্নেয়গিরির আগ্নেয়পাৎ ইত্যাদি।

৪২। সুতারাং তার ফল-সম্পদ [ এবং উপভোগ সামগ্রী ধ্বংসের দ্বারা ] পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লো। এবং সে তার সম্পত্তিতে যা ব্যয় করেছিলো তার জন্য আক্ষেপ করতে লাগলো, ২৩৮২, যখন তা ভিত্তিসহ খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙ্গে পড়লো। এবং সে শুধুমাত্র এ কথা বলতে পারলো, "হায় ! আমার প্রভু এবং প্রতিপালকের সাথে যদি কাহাকেও অংশীদার আরোপ না করতাম ২৩৮৩।

২৩৮২। "ফল-সম্পদ " "ব্যয় করা " এবং আক্ষেপ করা " শব্দগুলি এই আয়াতে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলির অর্থ অনুধাবনের জন্য চিন্তার সীমারেখাকে আক্ষরিক অর্থের বাইরে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। পৃথিবীতে প্রতিটি কর্মেরই নির্দ্দিষ্ট প্রতিফল আছে। একেই ফল-সম্পদ রূপে প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে বর্ণিত ব্যক্তি প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয় তার বাগানের দৌলতে। তার প্রচুর আয় ফলে সে এ ব্যাপারে পরিতৃপ্ত। তার বিলাসী জীবনযাত্রার জন্য সে সুখী। তার সকল চিন্তা ভাবনা আবর্তিত হয় , জাগতিক বৈভব ও আরাম আয়েশকে কেন্দ্র করে। সে পার্থিব সুখ সম্পদের বাইরে আর কিছু চিন্তা করতে পারে না। তার সকল সত্তা জাগতিক চিন্তায় আচ্ছাদিত থাকে। তার আশা আকাঙ্খা সবই পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এটাই তার জীবনের একমাত্র কাম্য বস্তু। গভীর আবেগে সে এই চিন্তায় নিবিষ্ট থাকে, একেই বলা হয়েছে "ব্যয় করা" অর্থাৎ তার শ্রম, মেধা, মননশীলতা,পরিশ্রম, চিন্তা, ভাবনা , আবেগ ইত্যাদি যা সে ব্যয় করেছে পার্থিব "ফল" লাভের জন্য। পার্থিব যে কোন "ফল লাভ " হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী লাভ - একমাত্র আল্লাহ্‌র চিন্তাই স্থায়ী "ফল" লাভে সক্ষম। ক্ষণস্থায়ী ফল যে কোন মূহুর্তে ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। যাকে "ভিত্তিসহ খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙ্গে পড়লো " উপমাটির সাহায্যে বোঝানো হয়েছে।

২৩৮৩। "কাহাকেও " এক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র এই শরীক ছিলো তার নিজের মন বা চিন্তার মাঝে। আত্ম অহংকার বা আত্মগর্ব তাকে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পরিবর্তে ও তাকে বিনয়ী করার পরিবর্তে তার মাঝে উদ্ধত, একগুয়েমী ও শ্রেষ্ঠত্বের ভাব আনায়ন করে। যার ফলে আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য অপেক্ষা নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে বিশাল করে দেখার প্রবণতা জন্মে। একেই এখানে আল্লাহ্‌র সাথে শরীক রূপে বলা হয়েছে।

উপদেশ : যুগে যুগে এ ভাবেই সম্পদ ও ক্ষমতা মানুষের মাঝ থেকে বিনয়কে দূরীভূত করে এবং আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে স্মরণ করতে বাধা দান করে।

৪৩। আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করার কেউ ছিলো না এবং সে নিজেও প্রতিকারে সমর্থ ছিলো না ২৩৮৪।

২৩৮৪। সম্পদশালী লোকেরা সব সময়েই লোকজন পরিবৃত অবস্থায় থাকে, যারা তার কৃপাপ্রার্থী ও চাটুকার। আর সে কারণে ক্ষমতা ও বিত্তশালীরা নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে ও গর্বিত হয়। কিন্তু যখন সে তার ক্ষমতা ও সম্পদ থেকে বিচ্যুত হবে, তখন এসব লোকজন কোন কাজেই আসবে না। সে নিজেই নিজের কোনও উপকারে আসবে না, তখন অন্য লোকে কিভাবে তাকে সাহায্য করবে?

৪৪। এ ক্ষেত্রে আশ্রয় [ একমাত্র ] আল্লাহ্‌র নিকট থেকে আসে, যিনি সত্য। পুরষ্কার দানে, এবং সাফল্য দানে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ২৩৮৫।

২৩৮৫। ইহকাল ও পরকালে সাহায্য একমাত্র আল্লাহ্‌রই। আর সবই হচ্ছে মিথ্যা গর্ব ও অহংকার যা সময়ের পরিক্রমায় একদিন মহাকালে বিলীন হয়ে যাবে। একমাত্র সত্য আল্লাহ্‌ যা চিরস্থায়ী, একমাত্র আশা আল্লাহ্‌। সর্বোচ্চ পুরষ্কার, সম্মান ও সাফল্য আল্লাহ্‌রই দান। আর সবই ভ্রান্তি ও ক্ষণস্থায়ী।

রুকু - ৬

৪৫। তাদের নিকট পৃথিবীর জীবনের উদাহরণ উপস্থাপন কর। [ জীবনটা হচ্ছে এমন ] : যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, পৃথিবীর উদ্ভিদ জগত তা শোষণ করে নিয়ে [ সুশোভিত হয় ]। কিন্তু শীঘ্রই উহা শুষ্ক হয়ে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায় এবং বাতাস উহাকে বিক্ষিপ্তভাবে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ্‌র ক্ষমতা সকল কিছুর উপরে শক্তিমান ২৩৮৬।

২৩৮৬। সুন্দর উপমার মাধ্যমে পার্থিব জীবনকে এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। বৃষ্টির পানি দ্বারা মাটি সিক্ত হয় এবং ধরণী উদ্ভিদ দ্বারা ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে মাটির সিক্ততা অন্তর্হিত হয় এবং তরুলতা শোভিত পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যায় , গাছ-পালা শুকিয়ে যায় এবং একদিন দমকা বাতাস তাদের আবর্জনার স্তুপের মত দূরে নিয়ে ফেলে দেয়। যে বৃক্ষরাজি একদিন সম্পদের ও সৌন্দর্যের প্রতীক রূপে বিরাজ করতো, বৃষ্টির অভাবে তার কোনও মূল্যই থাকে না। অর্থাৎ বৃক্ষের সজীবতা বৃষ্টির উপরে নির্ভরশীল যা স্থায়ী নয়। আমাদের পার্থিব জীবনও ঠিক সেরূপ। এই জীবনের বৈভব , বিত্ত, ক্ষমতা, সবই আল্লাহ্‌র করুণার উপরে নির্ভরশীল। এগুলির নিজস্ব কোনও স্থায়ীত্ব বা ক্ষমতা নাই - সবই ক্ষণস্থায়ী। যা স্থায়ী, তা হচ্ছে আধ্যাত্মিক জগত, মৃত্যুর পরেও যা আমাদের অস্তিত্বের চেতনাকে বহন করে নিয়ে যাবে। আল্লাহ্‌-ই হচ্ছেন একমাত্র শক্তি যিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান, এবং অনন্তকাল বিরাজমান।

৪৬। সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এই পার্থিব জীবনের শোভা। কিন্তু যা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে তা হচ্ছে সৎকাজ। [ আর তা হচ্ছে ] তোমার প্রভুর দৃষ্টিতে পুরষ্কার প্রাপ্তির জন্য সর্বোৎকৃষ্ট , এবং আশা- আকাঙ্খার [ ভিত্তি হিসেবে ] উহা সর্বোৎকৃষ্ট ২৩৮৭।

২৩৮৭। পার্থিব জীবনের বৈভব-বিত্ত, ক্ষমতা, প্রভাব -প্রতিপত্তি , মান-সম্মান , মেধা-মননশক্তি ইত্যাদি সবই ব্যক্তির জীবনে ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী এ জন্য যে মৃত্যুর পরে এর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। এগুলি শুধু পার্থিব জীবনের শোভা বর্দ্ধন করে। কিন্তু ব্যক্তির "সৎকর্ম " স্থায়ী। আল্লাহ্‌ সৎকর্মকে স্বীকৃতি দেন। ব্যক্তি তাঁর সৎকর্মের পূণ্য পরকালেও বহন করে নিয়ে যাবে। সৎকর্মের পুরষ্কার দুই কারণে শ্রেষ্ঠ যা এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে , (১) তার পুরষ্কার প্রতিপালকের নিকট থেকে সরাসরি প্রাপ্ত। অর্থাৎ যারা সৎকর্ম করে তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে সরাসরি তাদের অন্তরে অনুভব করতে পারে, ফলে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি আরও মজবুত ও দৃঢ় হয়। (২) আত্মার মাঝে স্রষ্টার অনুগ্রহের অনুভব, পরকালেও আল্লাহ্‌র করুণা পাওয়ার যোগ্যতার অনুভুতিকে তীব্র করে। পরলোকে পুরষ্কারের আশা-আকাঙ্খার ভিত্তি হচ্ছে এই অনুভব। পূণ্যাত্মা ব্যক্তির এই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আকাঙ্খা এবং আল্লাহ্‌র নিকট থেকে "কাঙ্খিত" শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার।

মন্তব্য : কিছু সৎ কর্মের ফল মৃত্যুর পরেও পাওয়া যায়, যথাঃ সুশিক্ষা প্রদত্ত সৎ সন্তান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা জ্ঞান বিতরণ করে, হাসপাতাল যা সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে ইত্যাদি কাজ যা ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও স্থায়ী থাকে। তার ফল ব্যক্তি মৃত্যুর পরেও লাভ করতে থাকে।

উপদেশ : ইসলাম সমাজের মঙ্গলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য সৎ কাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করে। সৎ কর্ম আল্লাহ্‌র চোখে অত্যন্ত সম্মাজনক। আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্টি করার এ এক অত্যন্ত উচ্চমানের এবাদত।

৪৭। একদিন আমি পর্বতমালাকে অপসারণ করবো, এবং তুমি পৃথিবীকে সমতল ভূমি হিসেবে দেখবে ২৩৮৮। সেদিন সকলকে একত্র করবো, এবং তাদের কাকেও আমি অব্যহতি দেবো না।

২৩৮৮। কেয়ামতের দিনে বর্তমান পৃথিবীর মানচিত্রের বা নৈসর্গের যে বৈশিষ্ট্য তা থাকবে না।

৪৮। সেদিন তাদের সারিবদ্ধ ভাবে তোমার প্রভুর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে [ এবং ঘোষণা করা হবে ] : "তোমাদের প্রথমে যে ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিলো সে ভাবেই [ নিঃস্ব ও রিক্ত অবস্থায় ] তোমরা আমার নিকট উপস্থিত হয়েছ ২৩৮৯। অথচ তোমরা মনে করতে যে তোমাদের জন্য [ আমার সাথে ] প্রতিশ্রুত সাক্ষাতের ক্ষণ কখনও আসবে না।" ২৩৯০

২৩৮৯। জন্মসূত্রে সকল মানুষ সমান। প্রকৃতির আলো, হাওয়া, জল-বায়ু প্রভৃতি সকল মানুষই সমভাবে আল্লাহ্‌র নেয়ামত হিসেবে উপভোগ করে। পরবর্তীতে মানুষ কৃত্রিমভাবে উচ্চ নীচ পদমর্যাদা ও ব্যবধানের সৃষ্টি করে। কিন্তু মৃত্যুর পরে এই ব্যবধান তিরোহিত হবে এবং জন্মের প্রথম অবস্থার মত রিক্ত ভাবে [ সমভাবে ] সকলকে উপস্থিত করা হবে।

২৩৯০। কেয়ামতের দিনে সন্দেহবাতিকরা নিশ্চিত ভাবে সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। তাদের সন্দেহ দূর হবে।

৪৯। এবং তোমাদের [ কর্ম বিবরণীর ] নথি [ তোমাদের সম্মুখে ] উপস্থিত করা হবে। পাপীরা আতংকিতে হবে, কারণ সেখানে যা [ লিপিবদ্ধ আছে তা দেখে ]। তারা বলবে, " হায়! দুর্ভাগ্য আমাদের এটা কেমন গ্রন্থ! ইহা তো ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয় নাই, বরং উহার সমস্ত হিসাব রেখেছে।" তারা [পৃথিবীতে ] যা করেছে সব তাদের সম্মুখে দেখতে পাবে। এবং তোমার প্রভু কারও প্রতি অন্যায় করেন না ২৩৯১।

২৩৯১। পরকালে আমাদের জবাবদিহিতার প্রধান বিষয় হবে ব্যক্তিগত কাজের দায় দায়িত্ব। এই জবাবদিহিতা হবে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে। পৃথিবীতে আমাদের সকল কৃতকর্মের বিবরণ আল্লাহ্‌র কাছে রক্ষিত আছে। আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিন্তা ভাবনা , কাজ আমাদের মৃত্যুর বহুপূর্বে তৎক্ষণাত আল্লাহ্‌র দরবারে পৌঁছে যায়। মানুষের যাবতীয় কর্মের ইতিহাস আল্লাহ্‌র কাছে এ ভাবেই সংরক্ষিত থাকে। এই সংরক্ষিত কর্ম বিবরণীর নাম হচ্ছে "আমলনামা"। এই বিবরণ হাশরের ময়দানে প্রত্যেকের সম্মুখে উপস্থিত করা হবে। এই বিবরণ এত সূক্ষ ও সম্পূর্ণ হবে যে, অপরাধীরা তা দেখে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়বে। হাশরের ময়দানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সম্পূর্ণ জীবনকে স্মরণ করতে সক্ষম হবে। ফলে তারা তাদের কৃতকর্মের বিবরণের নির্ভুলতা এবং খুঁটিনাটি দেখে দিশাহারা হয়ে পড়বে। কারণ তারা তখন বুঝতে পারবে যে, তাদের পাপ কর্মের দরুণ তারা শাস্তি অর্জন করেছে এবং তা তাদের ভোগ করতে হবে।

রুকু - ৭

৫০। দেখো! আমি ফেরেশ্‌তাদের বলেছিলাম, " আদমকে সেজদা কর " ২৩৯২। ইবলীস ব্যতীত সকলেই তাঁকে সেজদা করলো। সে ছিলো জ্বিনদের অন্তর্ভূক্ত ২৩৯৩, এবং সে তার প্রভুর আদেশ অমান্য করলো। তারপরেও কি তোমরা তাকে এবং তার বংশধরদের আমার পরিবর্তে রক্ষাকর্তারূপে গ্রহণ করবে ২৩৯৪? ওরা তো তোমাদের শত্রু। পাপীদের এই বিনিময় হবে মন্দ ২৩৯৫।

২৩৯২। আয়াত [ ২ : ৩৪ ] এ ইবলিসের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে , যেখানে তুলে ধরা হয়েছে বেহেশতে থেকে মানুষের পতনের ইতিহাসকে হযরত আদমের মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির পতনের ইতিহাস তুলে ধরাই ছিলো এই আয়াতের প্রধান উদ্দেশ্য। এই আয়াতে [ ১৮ : ৫০ ] ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এখানে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছেঃ ইবলিস তোমাদের শত্রু, তার পতনের ইতিহাস তোমাদের বর্ণনা করা হয়েছে‌। তবুও কি তোমরা করুণাময়, দয়াময়, প্রতিপালক আল্লাহ্‌র পরিবর্তে ইবলিসকে গ্রহণ করবে? যদি কর তবে তোমাদের বিনিময় হবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট।

২৩৯৩। দেখুন [ ৬ : ১০০ ] আয়াত এবং টিকা ৯২৯।

২৩৯৪। "শয়তানের বংশধর "এই বর্ণনামূলক আখ্যাটিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার কোনও কারণ নাই। বংশধর কথাটির অর্থ এখানে শয়তানের সন্তানকে বোঝানো হয় নাই। যারা পাপে ও অন্যায়ে লিপ্ত, যারা প্রতিমূহুর্তে আল্লাহ্‌র আদেশকে অমান্য করে শয়তানের মত, তারা সবাই শয়তানের অনুসারী। এদেরকেই শয়তানের বংশধর বলা হয়েছে। বংশধর কথাটি এখানে প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত।

২৩৯৫। পৃথিবীতে দুইটি অদৃশ্য শক্তি পাশাপাশি বিরাজমান। ভালো এবং মন্দ অথবা পূণ্য এবং পাপ। আল্লাহ্‌ মানুষকে সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন। পাপ ও পূণ্যকে সনাক্তকরণ ও গ্রহণের স্বাধীনতা তাকে দান করা হয়েছে। কিন্তু সে যদি এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে, ভালোকে বর্জন করে মন্দকে বা শয়তানের পথকে গ্রহণ করে , তবে কি হবে তার বিনিময় ! কারণ আল্লাহ্‌ মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য সদা সচেষ্ট। সেই পথ ত্যাগ করে যারা আল্লাহ্‌র শত্রুর দাসত্ব গ্রহণ করে, অবশ্যই তারা জালিম।

৫১। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টিকালে আমি ওদের সাক্ষীরূপে ডাকি নাই। ওদের সৃষ্টিকালেও নয়। যারা [মানুষকে] বিভ্রান্ত করে আমার পক্ষে তাদের সাহায্যকারী রূপে গ্রহণ করি না ২৩৯৬।

২৩৯৬। "ওদের" অর্থাৎ শয়তানকে। আল্লাহ্‌ মানুষের মঙ্গলময় প্রভু, ও করুণাময় প্রতিপালক, তিনি কি কখনও শয়তানের মত মন্দকে তাঁর অংশীদার করতে পারেন?

৫২। এক দিন আল্লাহ্‌ বলবেন, " তোমরা যাকে আমার শরীক মনে করতে তাদের আহ্বান কর। " এবং তারা তাদের আহ্বান করবে, কিন্তু তারা [ উপাস্যরা ] তাদের আহ্বানে সাড়া দিবে না। তাদের উভয়ের মধ্য থাকবে একটি মরণ ফাঁদ ২৩৯৭।

২৩৯৭। "তাদের উভয়ের.... মরণ ফাঁদ" অর্থাৎ পাপীর শেষ বিচারের দিনে , তারা যাদের অনুসরণ করেছিলো তাদের দেখতে পাবে না। তাদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান থাকবে।

৫৩। পাপীরা আগুনকে দেখতে পাবে এবং অনুমান করবে যে তারা তথায় পতিত হতে যাচ্ছে। ওরা সেখান থেকে কোন পরিত্রাণ স্থল পাবে না।

রুকু - ৮

৫৪। মানুষের উপকারের জন্য, এই কুর-আনে আমি উপমার সাহায্যে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি। কিন্তু মানুষ অধিকাংশ ব্যাপারেই বির্তক প্রিয় ২৩৯৮।

২৩৯৮। আল্লাহ্‌র আয়াত সমূহের অর্থ পরিষ্কার ভাবে বুঝানোর জন্য বিভিন্ন উপমার আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। এর পরে মানুষের পক্ষে তা না বোঝা সম্ভব নয় - যদি তাদের বোঝার ইচ্ছা থাকে। তাদের উচিত সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহ্‌র আহ্বানে সাড়া দেয়া। কিন্তু তার পরিবর্তে তারা বৃথা যুক্তি তর্কের অবতারণা করে থাকে।

৫৫।এখন যখন তাদের নিকট পথ নির্দ্দেশ আসে, তখন মানুষকে ঈমান আনা এবং তাদের প্রভূর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা থেকে যা বিরত রাখে তা কেবল ইহা যে, তারা [সম্ভবতঃ ] পূর্ববর্তী মানুষদের অবস্থা তাদের কাছে এসে পৌঁছানোর কিংবা [ আমার ] শাস্তি তাদের সামনে এসে হাজির হবার অপেক্ষা করে ২৩৯৯।

২৩৯৯। মানুষের অবাধ্য ও একগুয়ে মনোভাবকে এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। যারা আল্লাহ্‌র প্রদর্শিত পথে চলে না, তারা একগুয়ে ভাবে অতীতের ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি চায়। অতীতের ঘটনা, অর্থাৎ অতীতে যারা আল্লাহ্‌কে অবিশ্বাসের দরুণ ও তাদের পাপের দরুণ শাস্তি পেয়েছিলো। তাদের এই আচরণের কারণ হয়তো বা কৌতুহল বা আল্লাহ্‌র প্রতি প্রতিদ্বন্দিতার মনোভাব, যার দরুণ তারা স্বইচ্ছায় বিপদকে ডেকে আনে। কিন্তু যখন তা আসবে তারা তখন মনে করবে যে তা খুব শীঘ্র পতিত হয়েছে‌। দেখুন আয়াত [ ১৩ : ৬ ] এবং টিকা ১৮১০।

৫৬। আমি রাসুলগণকে প্রেরণ করে থাকি কেবলমাত্র সুসংবাদদাতা ও সর্তককারীরূপে ২৪০০। কিন্তু অবিশ্বাসীরা মিথ্যা যুক্তিতে বির্তক করে থাকে - যেনো এর দ্বারা তারা সত্যকে দুর্বল করতে পারে এবং আমার নিদর্শনসমূহ ও যার সাহায্যে তাদের সর্তক করা হয়েছে তাকে বিদ্রূপের বিষয়বস্তু রূপে পরিণত করতে পারে।

২৪০০। দার্শনিক মত বিরোধিতা করে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য বা কৌতুহলীদের কৌতুহল নিবৃত্ত করার জন্য, বা অলৌকিক কর্মকান্ড প্রদর্শণ বা অদৃশ্যের সংবাদ প্রচারের জন্য আল্লাহ্‌ রাসুলগণকে পাঠান নাই। রাসুলদের প্রেরণের উদ্দেশ্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের পাঠানো হয়েছে সুসংবাদদাতা ও সর্তককারীরূপে। এখানে কোনওরূপ বক্রতা বা না বোঝার কিছু নাই [ ১৮ :১ ]। এ ব্যাপারে রাসুলদের বক্তব্য অত্যন্ত প্রাঞ্জল। তাদের আগমন ঘটেছে সত্যকে প্রচারের জন্য। তাদের প্রচারিত সত্যের বাণী সহজ, সরল, ও প্রাঞ্জল। সত্যের ধারণাতে কোনও বিমূর্ত ধারণাকে স্থান দেয়া হয় নাই। সত্যের ধারণা হচ্ছে স্বচ্ছ এবং তাকে মূর্ত বা স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, আমাদের আচরণ ও চরিত্রের উদাহরণ দ্বারা। তাদের প্রচারিত সত্যের বাণী, পাপ ও পূণ্যকে চিনতে সাহায্য করে। পূণ্য পথে চলার পথ নির্দ্দেশ দেয় ও আত্মাকে পাপের দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ নির্দ্দেশ দান করে। তাঁরা আমাদের পাপের পরিণাম সম্বন্ধে সর্তক করে দেন। বৃথা বির্তক দ্বারা কাফিরগণ তাদের প্রচারিত বাণীর যথার্থতা ও গুরুত্ব হ্রাস করতে চায় এবং তাদের হাস্যষ্কর করার প্রয়াস পায়। কাফিরদের আর একটি পদ্ধতি হচ্ছে সত্যের বাণীকে হাসি তামাসার ও বিদ্রূপের পাত্রে পরিণত করা।

উপদেশ : কাফেরদের এই চেষ্টা সর্বযুগেই ছিলো, বর্তমানেও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এই চিরন্তন সত্যের দিকে এই আয়াতের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

৫৭। তার থেকে বেশী পাপ আর কে করে যে তার প্রভুর নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেবার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এবং ভুলে যায়, নিজের কৃতকর্ম ২৪০১ ? অবশ্যই আমি ওদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেনো তারা ইহা [ কুর-আন] বুঝতে না পারে। এবং বধিরতা দিয়েছি কানের উপরে। তুমি তাদের সৎপথে আহ্বান করলেও তারা , কখনও সৎ পথের ঠিকানা গ্রহণ করবে না।

২৪০১। মানুষের আত্মার উপরে পাপ কার্যের আরোপিত প্রভাবকে এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষ যখন সৎপথ ত্যাগ করে পাপের পথ অবলম্বন করে, সে তার আত্মার উপরে অত্যাচার করে,তার আত্মা ধীরে ধীরে পাপের অন্ধকারে আবৃত হয়ে পড়ে। ফলে সে আল্লাহ্‌র সর্তক বাণী শুনতে পায় না , আল্লাহ্‌র মঙ্গল ইচ্ছাকে অনুভব করতে পারে না। তাদের পাপ কর্মের ফলে তাদের আত্মা এত গভীর ভাবে পাপের অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে যে, তাদের অন্তরে আর সত্যের আলো পৌঁছানোর কোনও পথই খোলা থাকে না। আল্লাহ্‌র নূর তাদের অন্তরে পাপের দুর্ভেদ্য পর্দ্দা ভেঙ্গে পৌঁছাতে পারে না। এই অবস্থায় তারা কান থাকতেও সত্যের আহ্বানকে সনাক্ত করতে পারবে না। এই অবস্থানকেই বলা হয়েছে যে, " আমি ওদের .............................. . কানে বধিরতা দিয়াছি।" এদের কথাই বলা হয়েছে যে, "তারা কখনও সৎ পথে আসবে না।" তাদেরকে অনুতাপ করার জন্য ও আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ কামনা করার জন্য সুযোগ দেয়া হবে। যদি তারা এ সুযোগ গ্রহণ না করে তবে তা তাদের নিজেদেরই ক্ষতি। দেখুন পরের আয়াত।

৫৮। কিন্তু তোমার প্রভু পরম ক্ষমাশীল, অনুগ্রহে পূর্ণ। যদি তিনি তাদের কৃতকর্মের হিসাবের জন্য [ তৎক্ষণাত ] ডাক দিতেন , তবে তিনি অবশ্যই ওদের শাস্তি ত্বরাণ্বিত করতে পারতেন। কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে নির্দ্দিষ্ট সময়কাল, যার পরে তারা আর কোন আশ্রয়স্থল পাবে না ২৪০২।

২৪০২। "Minduni-hi"। এই আয়াতের এই লাইনটি সম্বন্ধে তফসীরকারদের মধ্যে মতদ্বৈত আছে। " তাদের জন্য রয়েছে নির্দ্দিষ্ট সময়কাল, যার পরে তারা আর কোন আশ্রয়স্থল পাবে না। " একদল তফসীরকারের মতে , "যার" সর্বনামটি "প্রতিশ্রুত মূহুর্তের "পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। আর একদলের মতে, " যার " সর্বনামটি আয়াতের প্রথমে লেখা "তোমার প্রতিপালক " বাক্যটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অনুবাদ হবে, " উহাদিগের জন্য রহিয়াছে এক প্রতিশ্রুত মূহুর্ত , আল্লাহ্‌ ব্যতীত উহারা কখনই কোন আশ্রয়স্থল পাবে না। " মওলানা ইউসুফ আলী সাহেব শেষোক্তদের মতে। তার মতে আল্লাহ্‌ পাপীদের তাদের স্বাধীন ইচ্ছার কাছে বিভ্রান্ত ভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দান করেন , কারণ তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্‌র করুণাকে প্রত্যাখান করে। কিন্তু তবুও আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণার দুয়ার এই সব পাপীদের জন্যও অবারিত থাকে। একমাত্র আল্লাহ্‌র করুণা ও অনুগ্রহই তাদের রক্ষা করতে পারে। তিনিই একমাত্র আশ্রয় স্থল।
অন্য দলের মতে, "প্রতিশ্রুত সময়ের " পরে তারা আর কোনও আশ্রয় স্থল পাবে না।

৫৯। এরাই সেই জনপদ যাদের আমি ধবংস করেছি যখন তারা পাপে নিমগ্ন হয়। কিণ্তু আমি উহাদের ধ্বংসের জন্য এক নির্দ্দিষ্ট সময় স্থির করেছিলাম ২৪০৩।

২৪০৩। প্রাচীন পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণও এই আইনের অর্ন্তগত ছিলো। আল্লাহ্‌ তাদের প্রচুর অব্যহতি দান করেছিলেন যেনো তারা অনুতপ্ত হয়ে পাপের পথ ত্যাগ করে এবং আল্লাহ্‌র ক্ষমা ও করুণা লাভের সুযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু যখন তারা সে সুযোগ গ্রহণ না করে সীমালংঘন করে, তখন তাদের ধ্বংসের জন্য আল্লাহ্‌ নির্দ্দিষ্ট ক্ষণ স্থির করেন।

রুকু - ৯

৬০। স্মরণ কর, মুসা তাঁর খাদেমকে বলেছিলো ২৪০৪ , "দুই সাগরের সংগম স্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি থামবো না ২৪০৫ অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবো ২৪০৬।

২৪০৪। এ অধ্যায় থেকে নূতন কাহিনীর অবতারণা কর হয়েছে। হযরত মুসার কাহিনীর মাধ্যমে চারটি বিষয়ের শিক্ষা দান করা হয়েছে। (১) হযরত মুসা মিশরবাসীদের সকল জ্ঞানের অধিকারী হন। সে সময়ে মিশর ছিলো সভ্যতার পাদপীঠ। সর্বোৎকৃষ্ট সভ্যতার সকল জ্ঞানও আল্লাহ্‌র সব জ্ঞানকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। বর্তমানে আমরা বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, প্রভৃতি জ্ঞানের জন্য গর্ব বোধ করে থাকি। যদি এ সমস্তের সমস্ত জ্ঞানও শুধুমাত্র একক ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ লাভ করতো, তবুও তাঁর জ্ঞান ভান্ডার অসম্পূর্ণ রয়ে যেতো। কারণ স্বর্গীয় জ্ঞানের ভান্ডার অফুরন্ত। যদিও হযরত মুসা আল্লাহ্‌র তরফ থেকে নবুয়ত প্রাপ্ত হন, তবুও তাঁর জ্ঞান ছিলো অসম্পূর্ণ। (২) নিরলস প্রচেষ্টার দ্বারা সময়ের সাথে সাথে নূতন জ্ঞানকে গ্রহণ করে নিজের জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করতে হয়। হযরত মুসা সেই প্রচেষ্টাই করেন। (৩) মুসা রহস্যময় সাধুপুরুষের সন্ধান লাভ করেন [ ১৮ : ৬০ এবং টিকা নং ২৪১১ ] যার নাম Khidhr [literally, Green] । তিনি জীবনের অদৃশ্য জ্ঞানের বা গায়েবী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। (৪) জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে যা প্রচলিত মতবিরোধী হলেও সত্য [Paradoxes]। জীবনের সব হিসাব বর্তমান ক্ষণে সব সময়ে করা সম্ভব নয়। জীবনের শেষে শেষ যোগফল অর্জন হচ্ছে সর্বোচ্চ হিসাব। তাৎক্ষণিক ক্ষতির শেষ পরিণাম লাভজনক হতে পারে। বর্তমানের নিষ্ঠুরতা হয়তো বা ভবিষ্যতের জন্য সুফল বয়ে আনবে। মন্দের প্রতিদানে মঙ্গল করা হয়তো বা সর্বোচ্চ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা [ ১৮ : ৭৯ - ৮২ ] এবং তা হয়তো মহানুভবতা নয়। স্বর্গীয় জ্ঞান এভাবেই মানুষের সকল জ্ঞানকে অতিক্রম করে যায়।

২৪০৫। এই কাহিনীটি রূপক। নীতিগর্ভমূলক উপদেশ দান করাই এর উদ্দেশ্য। সুতারাং এর ভৌগলিক অবস্থানের অনুসন্ধান খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। লোহিত সাগরের দুই বাহু যেখানে এসে মিলিত হয়েছে অর্থাৎ যেখানে আকাবা উপসাগর [Gulf of Aqaba] এবং সুয়েজ উপসাগর [Gulf of Suez] এসে মিলিত হয়েছে। এই দুই উপসাগর সিনাই উপত্যকাকে পরিবেষ্টন করে আছে। এই সেই সিনাই উপত্যকা যেখানে হযরত মুসা এবং ইসরাঈলীরা বহু বছর উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ান।

২৪০৬। "Huqub" অর্থ অসীম দীর্ঘ সময়। কখনও কখনও শব্দটি দ্বারা ৮০ বৎসর সময় কে বুঝায়।

৬১। কিন্তু তারা যখন [ দুই সমুদ্রের ] সংগম স্থলে পৌঁছালো ২৪০৭ ; তারা তাদের মাছের কথা ভুলে গেলো , ২৪০৮। সুড়ঙ্গের ন্যায় উহা [ মাছটি ] সমুদ্রের মাঝে পথ করে নিল।

২৪০৭। দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে - অর্থাৎ যেখানে দুইসমুদ্র মিলিত হয়েছে।

২৪০৮। হযরত মুসা জ্ঞানী সাধুপুরুষের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, যিনি তাকে সেই স্বর্গীয় জ্ঞান শিক্ষা দিতে পারবেন যা তিনি জানেন না। তাঁর কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি একটি মাছের সাহায্য নেন। পৌঁছানোর পরে মাছটি অদৃশ্য হয়ে যাবে।

৬২। তারা যখন [ আরও কিছু দূর ] অতিক্রম করলো, মুসা তাঁর খাদেমকে বলেছিলো, " আমাদের প্রাতঃরাশ আন। আমাদের ভ্রমণের এই [ পর্যায়ে ] আমরা খুব ক্লান্তি বোধ করছি ২৪০৯। "

২৪০৯। যখন তারা দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে পৌঁছালেন, মুসা মাছের কথা ভুলে গেলেন। ক্ষুৎ পিপাসায় তিনি ক্লান্তি বোধ করেন। তার সংগীও তাঁকে বলতে ভুলে গেলো যে, সে মাছটিকে " আশ্চর্যজনক ভাবে " পথ করে সমুদ্রে নেমে যেতে দেখেছে। মাছটি অদৃশ্য হওয়ার স্থানের পর থেকে মুসার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত ভারী বোধ হতে থাকে, এবং ক্লান্তি তাঁকে আচ্ছন্ন করে। কারণ তিনি তার গন্তব্যস্থলের শেষ সীমা অতিক্রম করেছেন এ তারই ইঙ্গিত।

৬৩। সে উত্তর করেছিলো, " [ কি ঘটেছে ] আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যখন আমরা শিলাখন্ডে বিশ্রাম করছিলাম ? আমি মাছের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। শয়তানই উহার কথা [ আপনাকে ] বলতে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। মাছটি চমৎকারভাবে সমুদ্রের মাঝে নিজের পথ করে নেমে গেলো ২৪১০। "

২৪১০। সঙ্গীটি মাছটিকে সমুদ্রের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু তবুও সে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্য স্মরণ করতে পারে নাই এবং তার প্রভুকে সে কথা বলতে ভুলে যায়। এই ভুলে যাওয়া সাধারণ ভুলে যাওয়া নয়। এক ধরনের 'জড়ত্ব ' যা তাকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের গুরুত্ব বুঝতে অক্ষম করে, এবং লক্ষ্য করলেও তা প্রকাশ করার কথা মনে থাকে না। এ ধরনের জড়তাকে তুলনা করা চলে সক্রিয় বিদ্বেষের সাথে যা বিশেষতঃ শয়তানের কুমন্ত্রণা।

৬৪। মুসা বলেছিলো, " আমরা তো সেই স্থানটিরই অনুসন্ধান করছিলাম। " সুতারাং তারা [ যে পথে এসেছিলো ] নিজেদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললো।

৬৫। সেখানে তারা আমার এক বান্দার সাক্ষাত পেলো ২৪১১ যার উপরে আমার অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছিলো এবং যাকে আমার নিকট থেকে এক বিশেষ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলাম ২৪১২।

২৪১১। " আমার এক বান্দার" - কোরাণ শরীফে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয় নাই। কিন্তু প্রথা অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় যে, তাঁর নাম ছিলো খিদির। তাঁর সম্বন্ধে অনেক লোক গাঁথা প্রচলিত আছে, কিন্তু সে সবের উল্লেখের এখানে প্রয়োজন নাই। "খিদির "অর্থ সবুজ - যার জ্ঞান সবুজ ও সতেজ। যে জ্ঞান জীবনকে কেন্দ্র করে, যা আল্লাহ্‌ তাঁকে সরাসরি দান করে থাকেন। তিনি ছিলেন রহস্যময় ব্যক্তি। হযরত মুসা তাঁকে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের অনেক ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যা করতে অক্ষম বা ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারে না। ফলে অনেক সময়েই তারা ঘটনাটির প্রকৃত সত্য অনুধাবন না করে ভুল অর্থ করে। খিদির ও মুসার ঘটনার মধ্যে দিয়ে আল্লাহ্‌ এই সত্যকে তুলে ধরেছেন যে, মানুষের জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্‌র নিকট।

২৪১২। খিদির আল্লাহ্‌র নিকট থেকে বিশেষ দুটি অনুগ্রহ পেয়েছিলেন। (১) আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া উপলব্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভ এবং (২) আল্লাহ্‌র নিকট থেকে প্রকৃত জ্ঞান লাভের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র উপস্থিতি অনুভবের ক্ষমতা। প্রথম অনুগ্রহের ফলে তিনি প্রতিদিনের জীবনের গ্লানি থেকে মুক্ত ছিলেন এবং দ্বিতীয়টির ফলে তিনি প্রতিটি ঘটনার প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে এবং ব্যাখ্যা করতে পারতেন যা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ্যে নয়।

৬৬। মুসা তাঁকে বলেছিলো, " আমি কি আপনার পদ চিহ্ন অনুসরণ করতে পারি, যেনো সত্য সম্বন্ধে যে [ উচ্চতর ] জ্ঞান আপনাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে তার কিছু আপনি আমাকে শিক্ষা দিতে পারেন? "২৪১৩

২৪১৩। হযরত মুসা খিদিরকে যে অনুরোধ করেছিলেন তার প্রকৃত তাৎপর্য তিনি অনুধাবন করতে পারেন নাই। খিদিরকে আল্লাহ্‌ যে জ্ঞান দান করেছেন তিনি তা শিখতে চেয়েছিলেন।

৬৭। [ অন্য জন ] বলেছিলো, " আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারবেন না।" ২৪১৪

২৪১৪। মুসার অনুরোধে খিদির হাস্য করলেন। কারণ তিনি জানতেন যে তার আচার, ব্যবহার, রীতিনীতি মুসা বুঝতে পারবেন না। যার ফলে মুসা তাঁর ধৈর্য রাখতে পারবে না। কারণ জীবনের সর্বোচ্চ জ্ঞান অনেক সময়েই আপাতঃদৃষ্টিতে সত্য বিরোধী বলে ভ্রম হয়। সুতারাং তিনি মুসাকে নিষেধ করেন। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরা যখন দুঃখে , কষ্টে , বিপদ- বিপর্যয়ের সম্মুখীন হই আমরা তার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনে অক্ষম হয়ে অনেক সময়েই হতাশ হয়ে পড়ি, ধৈর্য্য ধারণ করতে পারি না।

৬৮। "যে বিষয়ে আপনার বুঝার ক্ষমতা আয়ত্বাধীন নয়, সে বিষয়ে আপনি কি ভাবে ধৈর্য ধারণ করবেন? " ২৪১৫

২৪১৫। খিদির অবশ্য মুসাকে দোষারোপ করেন নাই। কারণ সীমাবদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত ঘটনা উপলব্ধি করা বা তার তাৎপর্য বিচার করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের যদি ঐকান্তিক বিশ্বাস থাকে, তবে আমরা অনেক ভুল ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে পারি।

৬৯। মুসা বলেছিলো, " আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় আপনি আমাকে [ প্রকৃত ] ধৈর্যশীল পাবেন। এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করবো না ২৪১৬।

২৪১৬। হযরত মুসার আল্লাহ্‌র প্রতি ছিলো দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের যেরূপ আনুগত্য থাকে সেই মনোভাব প্রদর্শন করেন।তিনি আল্লাহ্‌র সাহায্যে সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করেন। শিক্ষক কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করেন তার আনুগত্য সম্বন্ধে। তবুও তিনি মুসাকে তাঁর অনুসরণ করতে অনুমতি দান করেন। কিন্তু শর্ত ছিলো যে মুসা কোনও প্রশ্ন করতে পারবেন না যতক্ষণ না শিক্ষক তাকে নিজে থেকে কিছু ব্যাখ্যা করেন।

৭০। অন্যজন বলেছিলো, " ঠিক আছে , আপনি আমাকে অনুসরণ করুণ এবং আমাকে কোন প্রশ্ন করবেন না যতক্ষণ না আমি নিজে থেকে সে সম্বন্ধে কিছু বলি। "

রুকু - ১০

৭১। অতঃপর উভয়েই চলতে লাগলো; যতক্ষণ না তারা নৌকাতে আরোহণ করলো। সে উহা ছিদ্র করলো ২৪১৭। মুসা বলেছিলো, " আপনি কি ইহার আরোহীদের নিমজ্জিত করার জন্য উহা ছিদ্র করেছেন? আপনি তো সত্যিই এক অদ্ভুদ কাজ করেছেন।"

২৪১৭। নৌকা ছিদ্র করার ব্যাখ্যা আছে [ ১৮ : ৭৯ ] আয়াতে।

৭২। সে উত্তর দিয়েছিলেন, " আমি কি বলি নাই যে আপনি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না ? "

৭৩। মুসা বলেছিলো, " আমার ভুলের জন্য আমাকে তিরষ্কার করবেন না। আমার ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে আমাকে দুঃখিত করবেন না। "

৭৪। অতঃপর তারা অগ্রসর হতে থাকলো , যতক্ষণ না তারা একজন কিশোরের সাক্ষাত লাভ করলো। সে তাকে হত্যা করলো ২৪১৮। মুসা বলেছিলো , "হত্যার অপরাধ ছাড়াই আপনি কি এক নিষ্পাপ জীবন হত্যা করলেন? প্রকৃতই আপনি এক জঘন্য কাজ করেছেন। "

২৪১৮। বালককে হত্যা করার ব্যাখ্যা আছে আয়াত [ ১৮ : ৮০ - ১৮ ]।

পারা - ১৬

৭৫। সে উত্তর দিয়েছিলো, " আমি কি আপনাকে বলি নাই যে, আপনি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পারবেন না?"

৭৬। [ মুসা ] বলেছিলো, " এর পরে যদি আমি আপনাকে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি, তবে আপনি আমাকে সঙ্গে রাখবেন না। এ ক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে [ চূড়ান্ত ] ওজর আপত্তি লাভ করেছেন। "

৭৭। এর পরে তারা অগ্রসর হতে থাকলো, [ চলতে চলতে ] যখন তারা এক জনপদে উপণীত হলো, তারা তার অধিবাসীদের নিকট খাদ্য প্রার্থনা করলো ২৪১৯। কিন্তু তারা আতিথেয়তা জ্ঞাপন করতে অস্বীকার করলো। সেখানে তারা এক পতনোম্মুখ প্রাচীর দেখতে পেলো এবং সে সেটাকে [ মেরামত দ্বারা ] সোজা করে দিলো। [ মুসা ] বলেছিলো, "যদি আপনি ইচ্ছা করতেন, তবে এই [ কাজের]জন্য পারিশ্রমিক দাবি করতে পারতেন।" ২৪২০

২৪১৯। জনপদের অধিবাসীরা ছিলো অভদ্র ও রুঢ়। প্রাচ্যদেশীয় অধিবাসীদের আজন্ম সংস্কৃতি হচ্ছে অতিথি আপ্যায়ন। কিন্তু জনপদের অধিবাসীরা প্রাচ্যের সেই চিরাচরিত নিয়ম ভঙ্গ করে। এভাবেই তারা মানব সভ্যতার নূন্যতম ভদ্রতাকে অস্বীকার করে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে ক্লান্ত শ্রান্ত বিদেশী পথিককে আতিথেয়তার জন্য আহ্বান করা তাঁর অসুবিধা দূর করার চেষ্টা করা সাধারণ ভদ্রতা। এই সাধারণ ভদ্রতাটুকু মানুষ মানুষের নিকট আশা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মুসা উপযাজক হয়ে তাদের নিকট আতিথেয়তা যাঞ্চা করেন। কিন্তু তারা তা সরাসরি প্রত্যাখান করে।

২৪২০। আত্ম সম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি কখনও তাঁর সাহায্য গ্রহণ করবে না যাকে তারা সাহায্য করতে অস্বীকার করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা খিদিরকে আপ্যায়ন করতে অস্বীকার করলেও তার সাহায্য গ্রহণে দ্বিধা বোধ করে না। খিদির তাদের জন্য জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। শহরের বাইরে যে প্রাচীর ছিলো যা শহরকে রক্ষা করতো তা সময়ের প্রাচীনতার জন্য পতোন্মুখ হয়ে পড়েছিলো। খিদির এ প্রাচীরটি সংস্কার সাধন করেন - কিন্তু তাঁর জন্য তিনি কোনও প্রকার মজুরী বা ক্ষতিপূরণ দাবী করেন নাই। সম্ভবতঃ তিনি এই কাজের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করেন যার মজুরী তিনি নিজে দান করেন। বাহ্যিকভাবে একথাই মনে হয় যে, যারা তাঁর প্রতি নিকৃষ্ট ব্যবহার করেছিলো তিনি তাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন। সুতারাং স্বভাবতই হযরত মুসা আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, " আপনি তো ইচ্ছা করিলে ইহার জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন।"

৭৮। সে উত্তর দিয়েছিলো, " আপনার ও আমার মধ্য সম্পর্কচ্ছেদ হলো। যে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেন নাই এখন আমি তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবো। ২৪২১

২৪২১। এই আয়াতগুলির মাধ্যমে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে মূল কাহিনী ও এর তাৎপর্য কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মূলভাব ও উপদেশকে মনের মধ্যে, আত্মার মাঝে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে জীবনের ঘটনাগুলিকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাহিনীর তাৎপর্য অনুধাবনের।

৭৯। "নৌকাটির ব্যাপার - ওটা ছিলো কতগুলি হত দরিদ্র লোকের। তারা পানিতে নৌকা চালনা করে থাকে [ জীবিকার জন্য ]। কিন্তু আমি তা ব্যবহারের অযোগ্য করতে ইচ্ছা করলাম। কারণ তাদের পশ্চাতে আছে এক বাদশা, যে জোর পূর্বক সকল নৌকা দখল করবে। ২৪২২

২৪২২। খিজির ও হযরত মুসা যে নৌকাতে আরোহণ করেন তা ছিলো ভাড়াতে খাটানো এক নৌকা। এর মালিক ছিলো কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তি যারা জীবিকা নির্বাহের জন্য নৌকা ব্যবহার করতো। সম্ভবতঃ সে সময়ের সামাজিক কাঠামোতে দরিদ্রদের জন্য সম্মানজনক ভাবে বাঁচার কোনও পথ সমাজ ,করে দিত না। যদিও এদের জন্য সমবেদনা ও সহমর্মিতার প্রয়োজন, কিন্তু প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় তা ছিলো অনুপস্থিত। যদিও এরা গরীব কিন্তু এরা ছিলেন আত্মমর্যদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি। সুতারাং তারা ভিক্ষা অপেক্ষা সৎ কাজের দ্বারা সাধারণ ও দরিদ্র জীবনকে অধিক পছন্দ করতো। খিদির জানতেন যে, সে দেশের অত্যাচারী রাজা যুদ্ধের জন্য কিছু নৌকাকে চিহ্নিত করবেন। সম্ভবতঃ দরিদ্র লোকদের নৌকাটি নূতন বিধায় তাদের নৌকাটিও রাজার লোকদের দ্বারা চিহ্নিত হবে। এসব আত্ম মর্যদা সম্পন্ন দরিদ্র ব্যক্তিরা যদি তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হারায়, তবে তারা ভিক্ষা বৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হবে। নৌকাটিকে যদি অকেজো করা যায়, শুধুমাত্র তখনই তা রাজার লোভ থেকে অব্যহতি পেতে পারে। বিপদ অতিক্রম করার পরে নৌকার মালিকরা তা মেরামত করে নিতে পারবে। সম্ভবতঃ খিদির ভাড়া ও ক্ষতির জন্য তাদের মূল্য দিয়েছেন। বাহ্যিকভাবে , তাৎক্ষনিকভাবে খিদিরের কার্যক্রমকে নিষ্ঠুরতা মনে হলেও সময়ের ব্যবধানে তাঁর সেই কাজ ছিলো সর্বোৎকৃষ্ট দান। প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন ঘটে তার পরিণাম দিয়ে , শেষ যোগফল দিয়ে। সেভাবেই খিদিরের কাজের মূল্যায়ন হবে সমাজ, সংসার ও আল্লাহ্‌র কাছে।

৮০। " আর কিশোরটির [ ব্যাপার ] - তার পিতা মাতা ছিলো ঈমানদার ব্যক্তি। আমার আশংকা বিদ্রোহ ও [ আল্লাহ্‌ ও মানুষের প্রতি ] অকৃতজ্ঞতার দ্বারা সে তার পিতা মাতাকে কষ্ট দেবে। ২৪২৩

২৪২৩। খিদিরের এই কাজটি পূর্বের থেকেও নিষ্ঠুর ছিলো। কিন্তু বালকটিকে হত্যা না করলে তার পরিণাম হতো আরও ভয়াবহ। পরবর্তী জীবনে সে যখন যুবক হবে, সে পাপের পথে পা বাড়াবে। কুফরী ও সমাজের আইনভঙ্গকারীদের একজন হিসেবে একদিন সে তাঁর পিতামাতাকে হত্যা করবে। অপর পক্ষে তার পিতামাত আল্লাহ্‌ ভীরু মোমেন ব্যক্তি। তারা তাকে স্নেহ ও ভালোবাসার মাধ্যমে লালন-পালন করেও শেষ বয়সে সেই স্নেহভাজন পুত্র দ্বারা নির্মম আঘাত পাবে। সুতারাং সমাজের মঙ্গলের জন্য, পিতামাতার ন্যায় মোমেন ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য এমন অনুপযুক্ত সন্তানের নিধন ছিলো অত্যাবশ্যক। সম্ভবতঃ ইতিমধ্যেই সে খুন ও ডাকাতি আইনভঙ্গের অপরাধে অপরাধী। কিন্তু সে কৌশলে ও প্রতারণার মাধ্যমে আইনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। খিজির তার বিশেষ ক্ষমতাবলে সে ঘটনা বুঝতে পেরেছিলেন। দেখুন পরবর্তী টিকা।

৮১। " সুতারাং আমি চাইলাম যে, তাদের প্রভু এর পরিবর্তে এক [ পুত্র ] সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্র [ চরিত্রের অধিকারী ] এবং ভালোবাসায় নিকটতর। ২৪২৪

২৪২৪। পুত্রটি ছিলো আইন অমান্যকারী এবং সাধারণ জনসাধারণের জান-মালের জন্য হুমকী স্বরূপ। অপর পক্ষে তার পূণ্যাত্মা পিতামাতার জন্য দুঃখের কারণ। তবুও খিদির যদি শুধুমাত্র নিজের বিচার বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে ছেলেটিকে হত্যা করতেন তবে তা অন্যায় হতো। কিন্তু খিজির ছিলেন আল্লাহ্‌র একান্ত অনুগত বান্দা। তিনি নিজে থেকে কিছু করেন নাই। আল্লাহ্‌র হুকুমেই তিনি সমাজের জন্য হুমকী ও আইন অমান্যকারীকে হত্যা করেন। অবশ্য এরূপ আইন অমান্যকারী, অপরাধী সন্তান পিতামাতার দুঃখের কারণ হয়। এই দুঃখ আরও তীব্র হয় যদি পিতামাত নিজে মোমেন বান্দা হন। খিজির তার পিতামাতাকে শুভ সংবাদ দিলেন, যে আল্লাহ্‌ তাদের মোমেন সন্তান দ্বারা পুরষ্কৃত করবেন। যার জন্য তারা গর্ব অনুভব করবেন।

৮২। " আর ঐ প্রাচীরটি - ওটা ছিলো শহরের দুই এতিম কিশোরের। এর নীচে লুকানো আছে ধন-সম্পদ যার অধিকারী তারা।তাদের পিতা ছিলো পূণ্যাত্মা ব্যক্তি ২৪২৫। সুতারাং তাদের প্রভুর ইচ্ছা তারা পরিপূর্ণরূপে বয়ঃপ্রাপ্ত হোক এবং তাদের ধন ভান্ডার উদ্ধার করুক ২৪২৬। এটা আপনার প্রভুর দয়া [ এবং অনুগ্রহ ]। আমি নিজ থেকে কিছু করি নাই ২৪২৭। আপনি যে সব বিষয়ে ধৈর্য ধারণে অক্ষম হয়েছিলেন, এই হচ্ছে তার ব্যাখ্যা [ ও তাৎপর্য ]।"

২৪২৫। প্রাচীরটির ছিলো ভগ্নদশা। ঐ প্রাচীরের নীচে গুপ্তধন ছিলো। যদি প্রাচীরটি ধ্বসে যেতো তবে শহরের অধিবাসীরা তা লুট করে নিত। কারণ তারা ছিলো স্বার্থপর ও রূঢ়। দেখুন টিকা ২৪১৯। গুপ্তধনের মালিক ছিলো একজন পূণ্যাত্মা ব্যক্তি। সে সৎভাবে তা অর্জন করে এবং মৃত্যুর সময়ে তার এতিম সন্তানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রাচীরের নীচে পুঁতে রাখে যেনো ছেলেরা বড় হয়ে তার সন্ধান পায় ও ভোগ করতে পারে। সম্ভবতঃ তারাও ছিলো তাদের পিতার মত পূণ্যাত্মা। সুতারাং ঐ অর্থ তারা সমাজের মঙ্গলের জন্য ভবিষ্যতে ব্যয় করতে পারবে। এই তিনটি ঘটনার মাধ্যমে এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে, আপাতঃদৃষ্টিতে কোন ঘটনাকে বিচার করা যায় না। আল্লাহ্‌র মঙ্গল ইচ্ছাকে অনুধাবন করা যায় সময়ের ব্যবধানে, ধৈর্য্য অবলম্বনের মাধ্যমে। আপাতঃ বিপদ বিপর্যয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাকে বৃহত্তর কল্যাণের পথে পরিচালিত করেন। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই অনুধাবন করা সম্ভব হয় না।

২৪২৬। "বয়ঃপ্রাপ্ত " এ সম্পর্কে দেখুন আয়াত [ ১৭ : ৩৪ ] ও টিকা ২২১৮।

২৪২৭। "আমি নিজে থেকে কিছু করি নাই। " যারা নিজস্ব আবেগ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে বা খেয়ালখুশী মত বা অন্যের চোখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোনও কাজ করে না। শুধুমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র হুকুম দ্বারা পরিচালিত হয়, তাদের অনেক কাজই অনেক সময়ে সর্বসাধারণের দ্বারা স্বীকৃত হয় না। তাদের কাজের মাধ্যমে যে মঙ্গলময়, করুণাময়, প্রভুর মঙ্গল ইচ্ছা যে কার্যকর হচ্ছে তা অনেক সময়েই সাধারণ লোকেরা বুঝতে পারে না। ফলে তাদের দোষারোপ করা হয়। কারণ সর্বোচ্চ জ্ঞান ও কল্যাণ সকলের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

রুকু - ১১

৮৩। ওরা তোমাকে জুল্‌-কারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে ২৪২৮। বল, " আমি তোমাদের কাছে তাঁর কাহিনীর কিছু কিছু বর্ণনা করব। "

২৪২৮। "Zul-qarnain" অর্থ "দুই শিং বিশিষ্ট" অর্থাৎ যে রাজার দুইটি শিং ছিলো বা এভাবেও বলা হয় যে, দুই যুগের প্রভু। পাশ্চাত্যে ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করার কারণে জুল-কারনাইন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। এ জুল-কারনাইন দ্বারা কাকে বুঝানো হয়েছে? তিনি কোন যুগে কোথায় বাস করতেন? কোরাণে এমন কোনও তথ্য নাই যার দ্বারা আমরা কোনও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। অবশ্য তার কোনও প্রয়োজনও নাই। কারণ কোরাণ শরীফে কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে উপমা হিসেবে , নীতিগর্ভমূলক উপদেশ দানের জন্য। তবে জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে জুল-কারনাইন হচ্ছেন মহান সম্রাট আলেক্সজান্ডার। অথবা অন্য মত অনুসারে তিনি হচ্ছে প্রাগঐতিহাসিক সম্রাট Himyarite।

'জুল-কারনাইন' ছিলেন এক অত্যন্ত ক্ষমতাধর নৃপতি। কিন্তু তাঁর এই ক্ষমতার উৎস ছিলেন আল্লাহ্‌। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁকে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও উপায় উপকরণ দান করা হয়। যেনো তিনি তাঁর আরদ্ধ কাজ শেষ করতে পারেন। তাঁর রাজত্ব পূর্বে ও পশ্চিমে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, ফলে বিভিন্ন সভ্যতার, সংস্কৃতির, বিভিন্ন জাতি তার সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। জুল-কারনাইন কোনও অত্যাচারী ও স্বার্থপর নৃপতি ছিলেন না। তিনি ছিলেন সৎ ও ন্যায় পরায়ণ সম্রাট। তিনি দুর্বলকে রক্ষা করতেন এবং অপরাধী ও আইন অমান্যকারীকে শাস্তি দান করতেন। পরবর্তীতে তাঁর তিনটি অভিযানের বর্ণনা করা হয়েছে , যার প্রতিটিতে তাঁর ক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে নৈতিক নীতিমালার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

৮৪। আমি তো তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং সকল বিষয়ের উপায় উকরণের পথ বাত্‌লে দিয়েছিলাম ২৪২৯।

২৪২৯। "জুল-কারনাইন " প্রচন্ড ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং আল্লাহ্‌ তাকে সুযোগও দান করেছিলেন "উপায় উপকরণ " দ্বারা। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ন ও সুবিচারক। আল্লাহ্‌র দানকে তিনি সঠিক পথে ব্যবহার করতেন। কারণ তিনি অনুধাবনে সক্ষম ছিলেন যে, তাঁর কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, এবং সুযোগ সুবিধা আল্লাহ্‌ তাঁকে দান করেছেন জিম্মাদার হিসেবে। আল্লাহ্‌র প্রতি তাঁর ছিলো ঐকান্তিক বিশ্বাস এবং তিনি জীবনের কোনও অবস্থাতেই আল্লাহ্‌কে বিস্মৃত হতেন না।

৮৫। [ এরূপ ] একটি পথ সে অনুসরণ করেছিলো ,

৮৬। যতক্ষণ না সে সূর্যাস্তের নিকট পৌঁছালো ২৪৩০। সে দেখলো, ঘোলা পানির জলাশয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে দেখলো। আমি বলেছিলাম , " হে জুল্‌-কারনাইন ! এদের প্রতি শাস্তি দানের অথবা সদয় ব্যবহারের কর্তৃত্ব তোমাকে দান করা হলো। " ২৪৩১

২৪৩০। তিনটি অভিযানের প্রথমটি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম অভিযানটি ছিলো "সূর্যের অস্তগমন স্থান " পর্যন্ত। অর্থাৎ পশ্চিম সীমান্তের শেষ প্রান্তে। পৃথিবীতে পশ্চিমের শেষ প্রান্ত বলে কোনও স্থান নাই। কারণ পৃথিবী গোল হওয়ার দরুণ পূর্ব ও পশ্চিমের ধারণা আপেক্ষিক যা মানব সভ্যতার সৃষ্টি। এই লাইনটির অর্থ পশ্চিমের অভিযাত্রা "ঘোলা পানির জলাশয় " পর্যন্ত যেয়ে থেমে যায়। এই লাইনটি অনেক তফসীরকারদের হতবুদ্ধি করে দেয়। তারা অনেকে এর অর্থ করেন পশ্চিমের কালো ও ঝটিকা বিক্ষুব্ধ সাগর রূপে যার ওপারে আর কোন দেশ নাই। কিন্তু বাস্তবে পশ্চিমে এরূপ কোনও সাগর নাই। এরূপ একটি হ্রদ দেখা যায় মেসাডোনিয়ার পশ্চিমে লিচনাইটে [Lychnitis now Ochrida]। এই জলাশয়টি যে ঝর্ণার পানি দ্বারা পরিপূর্ণ তা চূনাপাথর অঞ্চলে অবস্থিত। ফলে এর পানি সর্বদা ঘোলা ও পংকিল, কখনও স্বচ্ছ নয়। তাহলেই " ঘোলা পানির জলাশয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে " বাক্যটি অর্থবোধ সম্পন্ন ও যুক্তিগ্রাহ্য হয়। সূর্যকে এরূপ জলাশয়ের ওপারে অস্ত যাওয়ার সময়ে দর্শক মাত্রই অনুভব করবে যে, সূর্য ঘোলা পানির জলাশয়ে ডুবে যাচ্ছে।আলেকজান্ডার ছিলেন ম্যাসেডোনিয়ার অধিপতি। সুতারাং আলেকজান্ডারকে জূল-কারনাইনের সপক্ষে পরিচিত করার এ এক প্রধান যুক্তি।

২৪৩১। জুল-কারনাইন ছিলেন প্রচন্ড শক্তিধর এবং আল্লাহ্‌ কর্তৃক দেয় সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত। পাশ্চাত্যে আগমনের পরে সেখানে তিনি এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেলেন যারা ছিলো সন্ত্রাসী ও আবাধ্য। যারা আইন শৃঙ্খলার পরোয়া করতো না। জুল - কারনাইন ইচ্ছা করলে এদের শাস্তি দিতে পারতেন অথবা যতক্ষণ তাঁর অপ্রতিহত ক্ষমতা প্রতিহত না হয় , ততক্ষণ নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য এসব অবাধ্য লোকের অন্যায়কে প্রশয় দিতে পারতেন। অর্থাৎ তিনি কি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা করবেন, অথবা স্বার্থপরের মত নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্যাকারীকে প্রশ্রয় দিবেন। পরবর্তী আয়াতে দেখুন তিনি সঠিক ও ভালো পথটিই বেছে নিয়েছিলেন। দুর্বল ও অসহায়কে রক্ষা করার জন্য তিনি অপরাধী ও অন্যায়কারীদের দমন করেন। তবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তার বিনয় ও আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস। পৃথিবীর অধিপতি হয়েও তিনি শক্তির অহংকারে ও গর্বে ফেরাউনের মত আল্লাহ্‌কে ভুলে যান নাই। পৃথিবীর শান্তি রক্ষার জন্য তিনি ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দুষ্টকে বা অত্যাচারী ও অন্যায়কারীকে শাস্তি দেবেন সত্যি, কিন্তু আসল শাস্তি দেবার মালিক আল্লাহ্‌। তিনি পরকালে অন্যায়কারী ও অত্যাচারীকে তা দেবেন , এ কথা তিনি সর্বদা মনে রাখতেন।

৮৭। সে বলেছিলো, "যে কেহ সীমা লংঘন করবে, আমি তাকে শাস্তি দেবো। তারপরে তাকে তার প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তিত করা হবে ২৪৩২। এবং তিনি তাকে ধারণাতীত শাস্তি দান করবেন।

২৪৩২। যদিও জুল-কারনাইন, সমসাময়িক পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন, তবুও তিনি সর্বদা মনে রাখতেন যে, তাঁর ক্ষমতা মানুষের ক্ষমতা, যা সব সময়েই আল্লাহ্‌ কর্তৃক দেয়। সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হচ্ছেন আল্লাহ্‌। দুষ্কৃতিকারীকে জুল-কারনাইন যে শাস্তিই দেন না কেন তা ক্ষণস্থায়ী। পৃথিবীর শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সরকারী ভাবে তা করা প্রয়োজন। কিন্তু পরকালের শাস্তি, পৃথিবীর কোনও শাস্তির সাথে তুলনাযোগ্য নয়। এমন কি পৃথিবীর সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাণদন্ড ও পরকালের শাস্তির তুলনায় নগণ্য।

৮৮। "কিন্তু যে কেহ ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, তার জন্য আছে উৎকৃষ্ট পুরষ্কার এবং আমিও তার সাথে আমার কাজ কর্ম সম্পাদনের সময়ে একান্ত বিনম্র ব্যবহার করবো। " ২৪৩৩

২৪৩৩। এখানে লক্ষণীয় যে যুল-কারনাইন ফেরাউনের ন্যায় শক্তি মদমত্ততায় অন্ধ হয়ে যান নাই। দেখুন আয়াত [ ৭৯ : ২৪ ] , যেখানে ফেরাউন নিজেকে আল্লাহ্‌ বলে ঘোষণা করেছে। ফেরাউনের চরিত্রের সাথে তুলনা করলে যুল-কারনাইনের চরিত্রের মাহত্ম্য ও বিনয় অনুধাবন করা যায়। তিনি দুষ্কৃতিকারীদের যে শাস্তি দান করতেন তা সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই প্রদান করতেন। অপর পক্ষে তিনি ঈমান ও সৎকর্মের উপরে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। যারা সৎ নাগরিক ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবন ধারণ করেন জুল-কারনাইনের শাসন ব্যবস্থা তাদের রক্ষার জন্য কাজ করে। " আমিও তার সাথে ... ...বিনম্র ব্যবহার করবো " - অর্থাৎ বিজিতদের জন্য জুল-কারনাইন কোনও কঠিন শর্ত আরোপ করেন নাই, তিনি ধনী , গরীব নির্বিশেষে প্রত্যেককে সুযোগ দান করেছিলেন, যেনো প্রত্যেকে সৎ কাজের মাধ্যমে স্ব স্ব গুণাবলীর প্রকাশ ঘটাতে পারে। জুল-কারনাইনের প্রথম অভিযানের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ শাসক শ্রেণীকে এই আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েছেন যে ক্ষমতা ও শক্তি যেনো তাদের অন্ধ করে না দেয়। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করা এবং আল্লাহ্‌র ক্ষমতার উপরে নির্ভর করা।

৮৯। তারপরে সে [ অন্য ] পথ অনুসরণ করলো।

৯০। যতক্ষণ না সে সূর্যদয়ের স্থানে পৌঁছালো।২৪৩৪ সে দেখলো উহা এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদয় হচ্ছে যাদের জন্য সূর্যতাপ থেকে রক্ষা করার কোন অন্তরাল আমি সৃষ্টি করি নাই। ২৪৩৫

২৪৩৪। এবাবে জুল-কারনাইনের দ্বিতীয় অভিযানের বর্ণনা করা হয়েছে এই অভিযান ছিলো "সূর্যোদয় স্থান" পর্যন্ত। পূর্বে "সূর্যের অস্তগমন স্থানের" সীমা যে ভাবে করা হয়েছে সে প্রকার হবে, দেখুন আয়াত [ ১৮:৮৬ ] ও টিকা ২৪৩০।

২৪৩৫। পূর্বের এই স্থানের জনসাধারণের জীবন যাপন প্রণালী ছিলো অত্যন্ত সাদাসিধে ও সরল। সম্ভবতঃ আবহাওয়া ছিলো প্রচন্ড গরম, যার ফলে তারা বাড়ী নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতো না। তারা খোলা আকাশের নীচে থাকতো এবং খুব বেশী কাপড়ও পরিধান করতো না সূর্যের তাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য অর্থাৎ তাদের ঘর-বাড়ী কাপড়-চোপড় কিছুই ছিলো না। এবারে তিনি তাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেন? দেখুন পরবর্তী টিকা।

৯১। সে তাদের সে ভাবেই [ ত্যাগ করলো ] :তার সম্মুখে যা কিছু ছিলো আমি সম্যক অবগত আছি। ২৪৩৬

২৪৩৬। সম্ভবতঃ তারা ছিলো আদিম অধিবাসী। তিনি তাদের সভ্যতা বিবর্জিত জীবন ধারণের জন্য কোনও প্রকার হৈ চৈ বা ব্যস্ততা প্রকাশ করেন নাই। তিনি তাদের নিজস্ব জীবন ধারাতে সুখ ও শান্তির সাথে বসবাসের জন্য সুযোগ দেন। মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ চাওয়া ও পাওয়া হচ্ছে সুখ ও শান্তি। যুল-কারনাইনের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যে সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার -ই স্বাক্ষর বহন করে। অপ্রতিহত ক্ষমতা ও শক্তি মানুষকে উদ্ধত ও অহংকারী করে তোলে। সাধারণ ভাবে শক্তিমদমত্ত ব্যক্তি তার বিজয় -গৌরব ও শক্তিকে যারা মহিমান্বিত করতে না পারবে তাদের সহ্য করতে পারে না। এখানেই জুল-কারনাইনের বৈশিষ্ট্য। আদিম অধিবাসী, যাদের পৃথিবীর বিশালত্ব ও জুল-কারনাইনের ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনও ধারণাই ছিলো না -তিনি তাদের সে ধারণা দানে বিরত থাকেন। তিনি তাদের সম্বন্ধেও সহনশীলতা প্রদর্শন করেন। কারণ আল্লাহ্‌র চোখে তিনি তাঁর সীমাবদ্ধতা জানতেন। যখনই মানুষ গর্বে ও অহংকারে অন্ধ হয়ে যায়। তখনই সে আল্লাহ্‌র চোখে তার নিজস্ব অবস্থানকে ভুলে যায়। কিন্তু সে যদি বিনয়ের সাথে আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পন করতে পারে, শুধু তখনই তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে সকল মানুষের অধিকার সম্বন্ধে উপলব্ধি করা। আল্লাহ্‌র দুনিয়ায় নিজে বাঁচা ও অন্যকেও বাঁচতে দেয়ার অধিকার হচ্ছে আল্লাহ্‌র হুকুম। জুলকারনাইনের দ্বিতীয় অভিযানের কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের এই আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।

৯২। অতঃপর সে [ আর এক ] পথ ধরলো ;

৯৩। যতক্ষণ না সে দুই পর্বতের মধ্যবর্তী [ ভূভাগে ] পৌঁছালো ২৪৩৭ সেখানে এ গুলির [ পর্বতের ] নীচে সে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেলো, যারা খুব কমই কথা বুঝতে পারে ২৪৩৮।

২৪৩৭। দেখুন আয়াত [ ২১ : ৯৬ ]।

২৪৩৮। এর অধিবাসীরা বিজয়ী নৃপতির ভাষা বুঝতে অক্ষম ছিলো। পরবর্তী আয়াত থেকে [ ১৮ : ৯৪ - ৯৮ ] এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, জুলকারনাইনের সাথে স্থানীয় অধিবাসীরা যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলো, সম্ভবতঃ তা হয়েছিলো কারণ জুলকারনাইনের সাথে দোভাষী ছিলো।

৯৪। তারা বলেছিলো , " হে জুল-কারনাইন ! ইয়াজুজ ও মাজুজ জাতি পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছে। আমরা কি তাহলে আপনাকে রাজস্ব অর্পণ করবো যেনো আপনি আমাদের ও ওদের মধ্যে প্রাচীর উত্তোলন করতে পারেন ?২৪৩৯

২৪৩৯। এই আয়াত ও পরবর্তী আয়াতের কাহিনী অত্যন্ত প্রাঞ্জল। যা আমাদের বোঝার বিষয় তা হচ্ছে কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের যা শিক্ষা দিতে চেয়েছেন তার ব্যাখ্যা। এবারে বিজয়ী সম্রাট পূর্বে এমন এক সম্প্রদায়ের মধ্যে আগমন করলেন যারা জুলকারনাইনের ভাষা না বুঝলেও সভ্যতা বিবর্জিত আদিম উপজাতি ছিলো না। তারা ধাতুর ব্যবহার জানতো। তারা হাপর বা ফুঁক নল দ্বারা বায়ু প্রবাহ চালনা করে ধাতুকে উত্তপ্ত করে গলাতে সক্ষম ছিলো এবং তারা লোহার পিন্ড ও গলিত সীসাও তৈরী করতে পারতো। পরবর্তী আয়াতের বিভিন্ন বাংলা অনুবাদে গলিত তামার উল্লেখ আছে; ইংরেজী অনুবাদে তামার স্থলে সীসার উল্লেখ আছে [ ১৮ : ৯৬ ]। তবে সীসা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ লোহার উপরে গলিত সীসার আবরণ দ্বারা লোহার মরিচা প্রতিরোধ করা হয় যা লোহাকে গ্যালভানাইজিং করা বলা হয়। মনে হয় তারা ছিলো শান্তি প্রিয় এবং পরিশ্রমী জাতি। কিন্তু তারা প্রায়ই বহিঃশত্রু ইয়াজুজ ও মাজুজদের দ্বারা আক্রান্ত হতো। তারা বিজয়ী সম্রাট জুলকারনাইনের নিকট ইয়াজুজ ও মাজুজদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষা কামনা করেছিলো।

৯৫। সে বলেছিলো, " আমার প্রভু আমাকে যে [ ক্ষমতা ] দান করেছেন তা [ রাজস্ব ] অপেক্ষা উত্তম। ২৪৪০ সুতারাং তোমরা আমাকে শক্তি [ ও শ্রম ] দ্বারা সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে এক মজবুত প্রাচীর উত্তোলন করবো।

২৪৪০। যুলকারনাইন অত্যাচারী বা লোভী ছিলেন না। তিনি একটি পরিশ্রমী জাতিকে লুণ্ঠন করতে চান নাই। কারণ তিনি উপলব্ধি করতেন যে, আল্লাহ্‌ বিভিন্ন ব্যক্তিকে তার বিভিন্ন অনুগ্রহে ধন্য করেন। অন্যের উপরে অত্যাচারে আল্লাহ্‌র সেই নেয়ামতের অপব্যবহার করা হয়। যে আল্লাহ্‌র নেয়ামত প্রাপ্ত হয় , সেই নেয়ামতের সঠিক ব্যবহারের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তার উপরে অর্পিত হয়। জুলকারনাইন ছিলেন পূণ্যাত্মা সম্রাট। সুতারাং তিনি প্রজাপালন ও তাদের নিরাপত্তার পরিবর্তে প্রজাদের করভারে জর্জরিত করতে চান নাই। বিজিত জাতিরা যখন তাঁর কাছে ইয়াজুজ মাজুজদের আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা কামনা করলো তিনি তাদের কর্মদক্ষতা , নিজেদের সংগঠিত করার ক্ষমতাকে উদ্দীপ্ত করেন এবং কাজে লাগান। তাদের নিজস্ব চেষ্টা, পরিশ্রম ও উদ্দীপনাই তাদের নিজেদের রক্ষাকবচ। জুলকারনাইন তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীকে এই কাজে নিয়োজিত করেন নাই। কারণ তিনি জানতেন যে, কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারে না। সকলেরই নিজেকে নিজে রক্ষা করতে হয়। অন্যায় , অত্যাচারের প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজস্ব হতে হয়। কল্যাণের শক্তি, মঙ্গলের শক্তি, প্রতিরোধের শক্তি আল্লাহ্‌ তখনই কোনও জাতিকে দান করেন যখন তা তাদের নিজস্ব সত্তা থেকে উৎসরিত হয়। সে কারণে জুলকারনাইন তাদের প্রতিরোধ প্রাচীর তৈরী করার জন্য উপাদান ও শ্রম সরবরাহ করতে বললেন। তারা নিজেরাই জুলকারনাইনের আদেশ মত দুই পর্বতের মাঝে শক্ত লোহার প্রাচীর বা গেট তৈরী করলো। এখানে গেট শব্দটি ব্যবহার করা হলো কারণ "Radm" এই আরবী শব্দটির দ্বারা প্রাচীর বোঝায় না, বরং বদ্ধ দরজা বা প্রবেশ মুখ বোঝায়।

৯৬। "তোমরা আমার নিকট লৌহ পিন্ডসমূহ আনায়ন কর। " ২৪৪১ শেষ পর্যন্ত যখন সে দুই পর্বতের খাড়া ধারের মধ্যবর্তী স্থান [ লৌহ দ্বারা ] পূর্ণ করলো , সে বলেছিলো, " [ তোমাদের হাপরে ] দম দাও।" অতঃপর যখন সে তা আগুনের মত [ লাল ] করলো সে বলেছিলো, " গলিত সীসা আমার নিকট নিয়ে এসো যেনো আমি তা উহার উপর ঢেলে দিতে পারি। " ২৪৪২

২৪৪১। বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শত্রুর আক্রমণ থেকে প্রতিরোধের জন্য গিরিপথের মাঝে লোহার প্রাচীর বা গেট তৈরী করা হয়, যা গলিত সীসা দ্বারা, আবৃত করা হয়। এই আবৃত করার কারণ লোহা যেনো সময়ের ব্যবধানে ও প্রাকৃতিক কারণে মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে না যায়।

মন্তব্য : অনুবাদের সময়ে আমিও সীসা ধাতুটির উল্লেখ করলাম যা যুক্তিসম্মত - অনুবাদক।

২৪৪২। " আগুনের মত লাল করলো " এর অর্থ কি? সম্ভবতঃ তা হচ্ছে উত্তপ্ত লোহার দ্বারা লৌহ প্রাচীর তৈরীর প্রক্রিয়া।

৯৭। এ ভাবেই তাদের অতিক্রম করার ক্ষমতা রহিত করা হয়েছিলো। ২৪৪৩

২৪৪৩। লোহার প্রাচীর বা গেট এবং পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ এতটাই সুউচ্চ ছিলো যে,তা অতিক্রম করা বা ছিদ্র করা শত্রুদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

৯৮। সে বলেছিলো, " এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ ২৪৪৪। কিন্তু যখন আমার প্রভুর প্রতিশ্রুতি কাল পূর্ণ হবে, তিনি এটাকে ধূলিতে পরিণত করবেন। আমার প্রভুর প্রতিশ্রুতি সত্য।

২৪৪৪। এরূপ বিশাল দায়িত্ব ও কর্ম সম্পাদনের পরেও যুলকারনাইন নিজের জন্য কোনও কৃতিত্ব বা প্রশংসা দাবী করেন নাই। তিনি শুধু বিজয়ী শাসক হিসেবে তাঁর কর্তব্য শেষ করেছেন। সমস্ত প্রশংসা প্রতিপালক আল্লাহ্‌র। তিনি বিজিত সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এক আল্লাহ্‌র প্রতি, যার অনুগ্রহে এতবড় বিশাল কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয়েছিলো। সেই সাথে তিনি এ কথাও স্মরণ করালেন যে পৃথিবীর কোনও বস্তুই স্থায়ী নয়। নির্দ্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আল্লাহ্‌র হুকুমে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা, জ্ঞান, দক্ষতা, সভ্যতা, সংস্কৃতি সবই আল্লাহ্‌ নির্দ্দিষ্ট সময় বা কালের জন্য দান করেন। সেই সময় বা কাল পূর্ণ হলেই সব কিছু ধবংস হয়ে যাবে। আল্লাহ্‌ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আমাদের এই প্রতিশ্রুতি দান করেন। এবং আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সত্য।

জুলকারনাইনের তৃতীয় অভিযান আমাদের এই নৈতিক উপদেশ শিক্ষা দান করে যে, পাপ ও অশুভ শক্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য মানুষের পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, তবে মানুষের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আল্লাহ্‌র দেয়া নিরাপত্তা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্পূর্ণ। মানুষের নিরাপত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ চেষ্টা আল্লাহ্‌ কর্তৃক দেয় নির্দ্দিষ্ট দিনের পরে তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। বর্তমান কালের চীনের প্রাচীর এর বড় প্রমাণ।

৯৯। সেদিন আমি তাদের ছেড়ে দেবো অন্য দলের উপরে তরঙ্গের ন্যায় প্রচন্ড বেগে পতিত হওয়ার জন্য। শিংগাতে ফুৎকার দেয়া হবে এবং আমি তাদের সকলকে একখানে একত্র করবো, ২৪৪৫ -

২৪৪৫। শেষ বিচারের দিনের তলবের পূর্বের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে সৃষ্ট সকল বাধা বন্ধন অপসারিত করা হবে, মানুষ উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় ধাবিত হবে, তারপরে যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, তখন বিচারকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

১০০। এবং সেদিন অবিশ্বাসীদের দেখানোর জন্য জাহান্নামকে বিস্তৃত করে উপস্থাপন করবো ২৪৪৬।

২৪৪৬। যারা পৃথিবীতে পরকালকে বিশ্বাস করে না। যাদের ধারণা জীবনের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ , মৃত্যুর পরে আর কিছু নাই। যারা পৃথিবীতে পরকালের জীবন সম্বন্ধে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতো, শেষ বিচারের দিনে তাদের জ্ঞান চক্ষুর উম্মেলন ঘটবে। তারা তাদের কাজের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করতে পারবে।

১০১। আমাকে স্মরণ করা থেকে বিরত রাখতে [ অবিশ্বাসীদের ] চক্ষুকে পর্দ্দা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম এবং এমনকি তারা শুনতেও অক্ষম ছিলো। ২৪৪৭

২৪৪৭। পৃথিবীতে যারা অবাধ্য ও একগুয়ে ভাবে আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে অস্বীকার করে তাদের আল্লাহ্‌র বাণী শোনার ও অনুধাবন করার ক্ষমতা তিরোহিত হবে। তাদের অবিশ্বাসের ফলে পার্থিব জীবনে তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্বকে তাদের সত্তার মাঝে অনুধাবন করবে না। তাদের অর্ন্তদৃষ্টির অভাব ঘটবে। চক্ষুষ্মান ব্যক্তি হয়েও তারা হবে অন্ধের ন্যায়। প্রকৃত সত্যকে তারা কখনও দেখতে পারবে না। দেখুন [ ২ : ১৮ ] এটা হচ্চে আল্লাহর বিধান।

রুকু - ১২

১০২। অবিশ্বাসীরা কি মনে করে যে, তারা আমার বান্দাকে আমার পরিবর্তে রক্ষাকর্তা রূপে গ্রহণ করবে? নিশ্চয়ই আমি অবিশ্বাসীদের আপ্যায়নের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছি।

১০৩। বল, " আমি কি তাদের কথা বলবো কারা তাদের কাজের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ ? ২৪৪৮

২৪৪৮। আমাদের সকল কাজ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হওয়া উচিত। যদি তা না হয়ে, আমাদের কাজের উদ্দেশ্য হয় অন্য কিছু, তবে তা আল্লাহ্‌র চোখে হবে নিরর্থক। পার্থিব জীবনে বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্দেশ্য বিভিন্ন হয়। কেউ সৎ কাজ করে নিজের আত্মতৃপ্তি ও গর্ব প্রকাশ করার জন্য, কেউ করে অন্যের কাছে শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য , কেউ করে অন্যকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এসবই আত্ম অহংকারের ফলশ্রুতি, ইহকালে এগুলিই তাদের উপাস্যরূপে কাজ করে। কারণ তাদের সকল ভাবনা চিন্তা আবর্তিত হয় এগুলিকে ঘিরে। পরকালে তাদের জ্ঞান চক্ষু উম্মীলিত করা হবে। কারণ তাদের সেসব কাজের কোনও মূল্যই থাকবে না। কাজের নিয়ত দ্বারা পরকালে ব্যক্তির মূল্যায়ন হবে। যে কাজের নিয়ত আল্লাহ্‌ সন্তুষ্টির জন্য নয়, তা জাহান্নামের খোরাক। হতভাগ্য তারা, কারণ ইহকালে তারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অপর কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করে ও আল্লাহ্‌ ব্যতীত অপর কিছুকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে। আল্লাহ্‌-ই একমাত্র অভিভাবক। অন্য কিছুর অভিভাবকত্ব পরকালে কোনও কাজেই আসবে না।

১০৪। "ওরাই-তারা, এই পার্থিব জীবনে তাদের প্রচেষ্টা নষ্ট হয়, কিন্তু তারা মনে করে কাজের মাধ্যমে তারা কল্যাণ অর্জন করছে? ২৪৪৯

২৪৪৯। পৃথিবীতে অনেক লোক আছেন যারা নিজেদের আল্লাহ্‌র প্রিয় বান্দা বলে ভাবতে ভালোবাসে। তাঁরা নিজেদের কৃতিত্ব সম্বন্ধে এতটাই দৃষ্টিকটুভাবে আত্মতৃপ্ত যে, যখন তারা ভুল করে ও যে সব কাজ বিবেক বর্জিত ও অন্যায়, সে কাজও তাদের চোখে সৎকর্ম বলে প্রতিভাত হয়। উদাহরণ স্বরূপ দানের কথা উল্লেখ করা যায়। যাদের দানের উদ্দেশ্য থাকে লোক দেখানো বা নিজস্ব কোনও স্বার্থ উদ্ধার বা পার্থিব কোন লাভ, তাদের দানের জন্য যে সৎকর্ম হয় তার দরুণ কোনও পূণ্যই তারা ভোগ করবে না। সেই রকম মোনাফেকরা অনেক সময়েই আশ্চর্য হয়ে যায় যে, অন্যের জন্য তাদের শুভ প্রচেষ্টা বা সৎ কাজ শেষ পর্যন্ত প্রশংসা লাভ করে না। না করার কারণ হচ্ছে তাদের গোপন নিয়ত ছিলো নিজেকে মহিমান্বিত করা অপরের জন্য সত্যিকারের কল্যাণ কামনা নয়। সত্যিকারের কল্যাণ কামনা তখনই করা সম্ভব যখন তা হয় শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত। তারাই সৎ কাজে আত্মনিবেদিত, যারা তাদের আধ্যাত্মিক দায়-দায়িত্বকে স্বীকার করে ও শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে।

১০৫। "ওরাই তারা, যারা তাদের প্রভুর নিদর্শন সমূহ এবং [ পরলোকে ] তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি অস্বীকার করে। ফলে ওদের কর্ম নিষ্ফল হয়। সুতারাং শেষ বিচারের দিনে আমি তাদের বিষয়ে কোন ওজন [গুরুত্ব ] দিব না। ২৪৫০

২৪৫০। যে কাজের নিয়ত বিশুদ্ধ নয়, তা আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের কাজের সাফল্য দ্বারা নয়, কাজের নিয়ত দ্বারাই পরকালে আমাদের বিচার হবে। মহাকালের গর্ভে সকল কাজই হারিয়ে যায়। কিন্তু বান্দার নিয়ত বা ঐকান্তিক ইচ্ছা আল্লাহ্‌র কাছে স্থায়ীভাবে পৌঁছে যায়। যে কাজের নিয়ত বিশুদ্ধ নয়, যার উদ্দেশ্য মন্দ, তা কিভাবে তার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে? আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের বিষয় বা পরকালে আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাতের বিষয় তাদের চিন্তা বা চেতনায় স্থান পায় না। তাই তাদের সৎকাজের নিয়তও বিশুদ্ধ হয় না। তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্বেই বিশ্বাসী নয়, কিভাবে তারা বিশুদ্ধ নিয়তে সৎ কাজ করবে?

১০৬। "জাহান্নাম - এটাই তাদের পুরষ্কার। কারণ তারা ঈমানকে প্রত্যাখান করেছিলো, এবং আমার বাণী ও রাসুলগণকে বিদ্রূপের বিষয় বলে গ্রহণ করেছিলো।" ২৪৫১

২৪৫১। মিথ্যা নিয়ত, ভান, প্রতারণা দ্বারা মোনাফেকরা দ্রুত পার্থিব উন্নতি লাভ করে, কারণ তারা পরকালের জীবন সম্পর্কে কোনও গুরুত্বই প্রদান করে না। পরকালের জীবন তাদের কাছে ঠাট্টা বিদ্রূপের বিষয়। ফলে তাদের কোনও কাজেই ন্যায় অন্যায়ের সীমারেখা বিরাজ করে না। আল্লাহ্‌র নিদর্শন ও তাঁর প্রেরিত রাসুলগণ হচ্ছে আল্লাহ্‌র অপার করুণা ও অনুগ্রহ। তারা তা অস্বীকার করে, কারণ তাদের কাছে পার্থিব জীবনের গুরুত্ব অধিক।

১০৭। যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের আপ্যায়নের জন্য আছে বেহেশ্‌তের বাগান ২৪৫২।

২৪৫২। "Firdaus" জান্নাতের এক উত্তম অংশের নাম। পার্শিয়ান ভাষাতে এর অর্থ হচ্ছে বেষ্টিত উদ্যান। আধ্যাত্মিক জগতে ফেরদৌস শব্দটির দ্বারা বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানকে বোঝানো হয়। এই স্থান তাদের জন্যই নির্ধারিত থাকবে যারা নির্ধারিত দুটি অঙ্গীকার আল্লাহ্‌র সাথে পূরণ করবে। প্রথমতঃ বিশ্বাস বা ঈমান হবে খাঁটি। দ্বিতীয়তঃ সৎ কর্মশীলতা হবে। ছোট ছোট ভুলত্রুটি আল্লাহ্‌ ক্ষমা করে দেবেন। তিনিই তো দয়াময় রহমানুর রহিম।

১০৮। যেখানে [ চিরস্থায়ী রূপে ] বসবাস করবে। সেখান থেকে তারা স্থানান্তর কামনা করবে না।

১০৯। বল; " আমার প্রভুর কথা [ লেখার জন্য ] সমুদ্র যদি কালি হয়ে যেতো ২৪৫৩, তবে আমার প্রভুর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই শীঘ্রই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যেতো। এমন কি আমি যদি এর সাহাযার্থে অনুরূপ আর একটি সমুদ্রও যোগ করি [তবুও ]।

২৪৫৩। আমাদের অস্তিত্ব তথা সারা পৃথিবীর অস্তিত্ব হচ্ছে পরম করুণাময়ের করুণার স্বাক্ষর। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারই করুণায় বিধৌত। তাঁর অনুগ্রহকে মানুষের ভাষাতে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমাদের সর্বোচ্চ কল্পনা শক্তিও তা ধারণ করতে অক্ষম।

১১০। বল, " আমি তোমাদের মত একজন মানুষ; [ কিন্তু ] আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের আল্লাহ্‌ এক ও অদ্বিতীয়। সুতারাং যে তাহার প্রভুর সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎ কাজ করে, এবং প্রভুর এবাদতে কাউকে শরীক না করে। ২৪৫৪।

২৪৫৪।এই সূরাটি শেষ করা হয়েছে ইসলাম ধর্মের মূল বক্তব্যকে প্রাঞ্জল ভাষাতে প্রকাশ করে। এখানে বলা হয়েছে যে, " যে তাহার প্রতিপালকের সাক্ষাত কামনা করে, সে যেনো সৎকর্ম করে ও তাহার প্রতি পালকের ইবাদতে কাহাকেও শরীক না করে।" সত্যিকারের পুণ্যাত্মা লোকের বিশেষত্ব এখানে তুলে ধরা হয়েছে যারা পরলোকে আল্লাহ্‌র সাক্ষাতে ধন্য হবেন। সৎকাজ ও আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত আনুগত্য। এই আনুগত্যের অর্থ হচ্ছে অন্য কিছুকে আল্লাহ্‌র ক্ষমতার সাথে শরীক না করা।

এই শরীক করা হতে পারে মূর্তিপূঁজা, বা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের পূঁজা বা প্রাকৃতিক শক্তির পূঁজা বা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মকে আল্লাহ্‌র শক্তির উপরে স্থান দেয়া বা মানুষের উদ্ভাবনী শক্তিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা বা আত্মপূঁজা ইত্যাদি। শুধুমাত্র মূর্তিপূঁজা নয় , পৃথিবীর যে কোনও বস্তুকে আল্লাহ্‌র ন্যায় শক্তিশালী কল্পনা করাই হচ্ছে আল্লাহ্‌র সাথে শরীক কল্পনা করা। আর সৎ কাজ হচ্ছে সেই কাজ যে কাজ শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সৃষ্টির কল্যাণের জন্য একান্তভাবে নিবেদিত হয়। আল্লাহ্‌র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য কাজকে সৎকাজ বলে, এমন কি বান্দা যখন আল্লাহ্‌র ভয়ে নিজেকে পাপ ও অন্যায় থেকে সংযত করে তাও সৎ কাজ। যে কাজই আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত তাই - ই সৎ কাজ।