সূরা তা - হা
সূরা তা - হা বা সাংকেতিক অক্ষর - ২০
১৩৫ আয়াত, ৮ রুকু, মক্কী[ দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
এই সূরার অবতীর্ণের সময়কাল , ধর্মীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সেই সূরা যা শ্রবণে হযরত ওমর, হত্যাকারী থেকে মোমেন বান্দাতে পরিণত হন, এই ঘটনা ঘটে হিজরতের সাত বৎসর পূর্বে।
ইব্নে হিসান সম্পূর্ণ ঘটনাটির খুঁটিনাটি বর্ণনা করেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ওমর ছিলেন ইসলামের অন্যতম প্রধান নির্যাতনকারী শত্রু। তিনিও অন্যান্য কোরেশদের মত সর্বদা ষড়যন্ত্র করতেন যে কিভাবে রসুলের (সা) জীবন বিনাশ করা যায়। এরকম সময়ে তাঁকে সংবাদ দান করা হয় যে, তার বোন ফাতেমা ও ভগ্নীপতি সা'দ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যেহেতু সে সময়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের উপরে অত্যাচার করা হতো সেহেতু তারা সযত্নে তাদের বিশ্বাসকে গোপন রেখেছিলেন। খবর শুনে ওমর রাগে অন্ধ হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁদের বাড়ীতে গমন করেন, সে সময়ে তাঁরা তাঁদের কাছে লিখিত এই সূরার অনুলিপি পাঠ করছিলেন। ওমর তাঁর বোন ও ভগ্নীপতিকে আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সেসময়ে প্রচন্ড ধৈর্য্যের পরিচয় দেন, কিন্তু দৃঢ়তার সাথে তাদের ঈমানের সত্যতা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। ওমর তাদের বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা ও ধৈর্য দেখে এতটাই বিমুগ্ধ হয়ে যান যে, তিনি তাঁদের কোরাণের অংশটি যা তারা পড়ছিলেন তা দেখাতে বলেন। তাঁকে তা দেয়া হয় এবং তিনি তা পাঠ করেন। এই সূরা পাঠে তার হৃদয় এতটাই অভিভূত হয়ে যায় যে, তিনি তৎক্ষণাত ইসলাম গ্রহণ করেন, শুধু তাই - ই নয়, তিনি হলেন ইসলামের এক শক্ত মজবুত স্তম্ভের মত একজন দৃঢ় সমর্থক।
হযরত সা'দের কাছে সূরার কয়েকটি পাতা ছিলো মাত্র ; সম্ভবতঃ তা ছিলো প্রথম দিকের। এই সূরার প্রারম্ভে " তা - হা" এই দুটি বর্ণমালা মুদ্রিত করা হয়েছে। এই বর্ণমালা দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে ? প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে এরূপ বর্ণমালা সন্নিবেশ দ্বারা ভাবগত অব্যয়কে বোঝানো হয়েছে যার অর্থ , " হে মানবকূল!" এই সূরাকে পূর্বের সূরার ধারাবাহিকতা বলা যায়। এখানে হযরত মুসার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র নিকট থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পরে যে সঙ্কট তিনি অতিক্রম করেন, তাঁর মায়ের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কিভাবে তিনি ফেরাউনের নিকটে নীত হন, কিভাবে তিনি সেখানে মিশর বাসীদের সর্বোচ্চ জ্ঞান বিজ্ঞান শেখার সুযোগ লাভ করেন যা পরবর্তীতে তিনি আল্লাহ্র সেবায় নিয়োজিত করেন। তাঁর পালিত পিতা [ ২৮ : ৯ ] ফেরাউনের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে এই সূরার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মুসার কাহিনীর মধ্যে বর্ণনা আছে কিভাবে বিপথগামী এক ব্যক্তি ইসরাঈলীদের মূর্তি পূঁজাতে অনুপ্রাণীত করে, এ ভাবেই চিরশত্রু শয়তান মানুষের পতন ঘটায়। আল্লাহ্র স্তুতি ও আল্লাহ্র নিকট একান্ত প্রার্থনা আধ্যাত্মিক অন্ধত্বের অবসান ঘটায়, আর এ ভাবেই আত্মাকে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ গ্রহণের যোগ্য করে তোলে।
সারসংক্ষেপ : আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ [ কোরাণ ] কোন দুঃখ দুর্দ্দশার কারণ নয় বরং তা হচ্ছে পরম করুণাময়ের করুণার উপহার। [ ২০ : ১ - ৮ ]।
আল্লাহ্ কিভাবে হযরত মুসাকে নির্বাচিত করেন এবং তাঁর ভাই হারূণ সহ হযরত মুসাকে ফেরাউনের নিকট পাঠান। [ ২০ : ৯ - ৩৬ ]।
হযরত মুসার মাতাকে আল্লাহ্ নির্দ্দেশ দান করেন শিশু মুসাকে নদীতে নিক্ষেপ করার জন্য। শিশু মুসা আল্লাহ্র তত্বাবধানে ফেরাউনের প্রাসাদে লালিত পালিত হতে থাকেন , যেনো ভবিষ্যতে মুসা ফেরাউনকে আল্লাহ্র পথে আহ্বান করতে পারেন। [ ২০ : ৩৭ - ৭৬ ]
আল্লাহ্ মুসাকে শিক্ষা দেন তাঁর লোকজনদের পরিচালনা করার জন্য এবং তাদের বিদ্রোহী মনোভাবকে দমন করার জন্য। বর্ণনা আছে কি ভাবে সামীরি ইসরাঈলীদের উত্তেজিত করে। [ ২০ : ৭৭ - ১০৪ ]
শেষ বিচারের দিনে ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বই হবে একমাত্র বিচারের বিষয় এবং সকলেই প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করবে। মানব সন্তান সর্বদা আদমের শত্রু শয়তানের থেকে নিজেকে রক্ষা করবে। তাঁরা অহংকার পরিত্যাগ করবে এবং আল্লাহ্র প্রশংসা ও প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করবে। সেদিনের ডাকের জন্য প্রত্যেকে অপেক্ষা করবে [ ২০: ১০৫ - ১৩৫]
সূরা তা - হা বা সাংকেতিক অক্ষর - ২০
১৩৫ আয়াত, ৮ রুকু, মক্কী[ দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
২৫৩৪। ব্যাখ্যার জন্য দেখুন এই সূরার ভূমিকা।
০৩। বরং যারা [ আল্লাহ্কে ] ভয় করে কেবল তাদের উপদেশের জন্য [ করেছি ]।
২৫৩৫। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ দুভাবে মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। ১) মানুষের স্বার্থপরতা সর্বগ্রাসী। আল্লাহ্র নির্দ্দেশনা এই স্বার্থপরতাকে ও সংঙ্কীর্ণতাকে বাধা দান করে। ২) এই প্রত্যাদেশ পাপীদের বিরক্তি উৎপাদন করে যার ফলে তারা ব্যঙ্গ বিদ্রূপের আশ্রয় গ্রহণ করে এবং অত্যাচার করে। এগুলি ঘটে কারণ মানুষের দূরদৃষ্টির অভাব। আল্লাহ্ কোরাণ অবতীর্ণ করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য , ক্লেশ দেওয়ার জন্য নয়। আয়াতটিতে রসুলুল্লাহকে (সা ) সান্তনা দেয়া হয়েছে , কারণ কাফেররা কোরাণকে অস্বীকার করলে তিনি খুবই কষ্ট পেতেন। উপদেশ প্রদান তাঁর কর্তব্য, তা গ্রহণ করার জন্য তিনি দায়ী নন। এই আয়াতের বক্তব্য সর্ব যুগের ও সর্ব কালের জন্য প্রযোজ্য।
০৫। পরম করুণাময় [আল্লাহ্ কর্তৃত্বের ] আসনে দৃঢ়ভাবে সমাসীন ২৫৩৬।
২৫৩৬। অনুরূপ আয়াত [ ১০:৩] এবং ব্যাখ্যার জন্য দেখুন টিকা ১৩৮৬। যেখানে , সিংহাসনে কথাটির ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। আমাদের সীমিত বিচার বুদ্ধিতে যদি কোনও কিছুকে অন্যায় অবিচার মনে হয় , তবে আল্লাহ্কে স্মরণ করতে হবে। আল্লাহ্ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে পরিব্যপ্ত করে দয়া ও করুণার সিংহাসনে সমাসীন আছেন। তিনিই সব কিছুর নির্দ্দেশ দান করেন এবং আমাদের এই বিশ্বাস মনে রাখতে হবে যে আমাদের সকল বিপদ আপদ বাঁধা তাঁর করুণায় কল্যাণে রূপান্তরিত হবে। আল্লাহ্র কর্তৃত্ব পৃথিবীর কর্তৃত্বের মত নয়। পৃথিবীর কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করা যায়, অস্বীকার করা চলে , প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আহ্বান করা যায় বা তা চিরজীবন স্থায়ী হবে না। কিন্তু আল্লাহ্র কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী , অবিনশ্বর, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্ব-ভূবনে ,দ্যুলোকে-ভূলোকে প্রকৃতির যে, আইন তা আল্লাহ্র কর্তৃত্বের প্রকাশ মাত্র। এই আইন অমোঘ, অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী ।
২৫৩৭। আল্লাহ্র কর্তৃত্বের ধারণাকে স্বচ্ছ করার জন্য এই আয়াতটির বিবরণ অত্যন্ত স্পষ্ট ও গভীরতা পূর্ণ। আকাশমন্ডলী অর্থাৎ নভোঃমন্ডল যা গ্রহ নক্ষত্র ও গ্যালাক্সী ধারণ করে, পৃথিবী এবং নভোঃমন্ডলের মধ্যবর্তী স্থান, পৃথিবীতে এবং ভূগর্ভে সর্বত্র আল্লাহ্র কর্তৃত্ব বর্তমান।
২৫৩৮। এই আয়াতটির তিন রকম ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ১) প্রকাশ্যে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা বা সশব্দে , সজোরে বলার মাধ্যমে কোনও তথ্য বা সংবাদ আল্লাহ্র কাছে পৌঁছায় না। কারণ তিনি মনের গুপ্ত, ব্যক্ত ও অব্যক্ত সকল চিন্তা ভাবনার খবর রাখেন। বাইরে সজোরে যাই প্রকাশ করা হোক না কেন অন্তরের গোপন ইচ্ছা, ভাবনা-চিন্তা সবই সেই সর্বশক্তিমানের নিকট দিবালোকের ন্যায় স্বচ্ছ। সুতারাং আল্লাহ্কে কিছু জানানোর জন্য সশব্দ হওয়ার প্রয়োজন নাই। ২) মনে এক ও মুখে অন্য কথা এরূপ মিথ্যা ভান ও অবিশ্বস্ততা কোনও মঙ্গল বয়ে আনবে না। কারণ আল্লাহ্ এসব বাহ্যিক কথাবার্তার প্রকৃত উদ্দেশ্য অবগত আছেন। আল্লাহ্র কাছে যা মূল্যবান তা হচ্ছে আত্মার স্বচ্ছতা, পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা। সুতারাং অবিশ্বস্ত কথা , প্রতিজ্ঞা , প্রার্থনা কোনও কিছুই আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ৩) সজোরে কোরাণ আবৃত্তি করা বা উচ্চস্বরে প্রার্থনা করা আল্লাহ্র কাছে খুর জরুরী নয়। কারণ এবাদতের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহ্ বাইরের শব্দচয়ন বা উচ্চস্বরের দ্বারা বিচার করবেন না। তাঁর বিচারের মানদণ্ড হবে পাঠকের বা প্রার্থনায় নিবেদিতের আত্মিক অবস্থা। অন্তরের একাগ্রতা, ও স্রষ্টার কাছে বিনয়ে একান্ত নিবেদনই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা। কে আকুলভাবে স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করে , আর কে করে না তা আল্লাহ্ খোলা বই এর মত, প্রখর দিবালোকের মত পাঠ করতে পারেন।
২৫৩৯। দেখুন আয়াত [ ১৭ : ১১০ ] ও টিকা ২৩২২। জীবনের সকল সৌর্ন্দয্য , পৃথিবীর সকল সুন্দর জিনিষ আল্লাহ্র শিল্পী সত্ত্বার প্রকাশ মাত্র। মানুষের সৃষ্ট শিল্প, সঙ্গীত, ভাষা, সাহিত্য সবই মানুষের দ্বারা আল্লাহ্ সৃষ্টি করান। আবার বিশ্ব প্রকৃতিতে অহরহ যে সৌন্দর্যের লীলাখেলা চলে, বিশ্ব-ভূমন্ডল যে সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি, তা আল্লাহ্রই শিল্পী সত্ত্বার প্রকাশ মাত্র। এই প্রকাশের বিভিন্নতাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য তারই অবদান। তাঁর এই গুণাবলীই তাঁর বিভিন্ন নামের প্রতি আরোপ করা হয়। এই আরোপিত নাম তাঁরই মাহাত্ম্য ও সম্মানকে ঘোষণা করে।
২৫৪০। হযরত মুসার কাহিনী কোরাণে বিভিন্ন সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনায় সময়ে বিভিন্ন ঘটনার উপরে আলোকপাত করা হয় যা কোরাণের বক্তব্যের নির্দ্দিষ্ট উপদেশের বর্ণনার উপরে গুরুত্ব আরোপ করে। বক্তব্যকে প্রাঞ্জল করে অনুধাবনের স্বচ্ছতা বাড়ায়। যেমন : আয়াত [ ২: ৪৯ - ৬১] তে মানুষের ধর্মীয় ইতিহাসের আলোচনার প্রেক্ষিতে মুসার কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। আয়াত [ ৭ : ১০৩ - ১৬২ ] তে ইসরাঈলী উম্মতের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে মুসার কাহিনীর মাধ্যমে। মুসার পরেও সে বর্ণনা অব্যাহত আছে। আয়াত [ ১৭ : ১০১ - ১০৩ ] তে ফেরাউনের কাহিনীর মাধ্যমে বলা হয়েছে কি ভাবে উদ্ধত অহংকারে আত্মার অধঃপতন ঘটে। এই সূরাতে আয়াত [ ২০ : ৯ - ২৪ ] তে আল্লাহ্ কর্তৃক দায়িত্ব প্রাপ্তির পথে হযরত মুসার আত্মিক উন্নতির ধাপকে চিত্রিত করা হয়েছে। আয়াত [ ২০ : ২৫ - ৩৬ ] তে মুসার সাথে তাঁর ভাই হারুনের আধ্যাত্মিক সম্বন্ধের সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আয়াত [ ২০ : ৩৭ - ৪০ ] তে মুসার সাথে তাঁর মা ও বোনের আধ্যাত্মিক সম্পর্ককে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর প্রতি প্রতিপালকের স্বর্গীয় ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করা হয়েছে। আয়াত [ ২০ : ৪১ - ৭৬ ] তে ফেরাউনের সাথে মুসার আধ্যাত্মিক সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে। এবং [ ২০ : ৭৭ - ৯৮ ] তে ইসরাঈলীদের সাথে মুসার আধ্যাত্মিক সংগ্রামকে বর্ণনা করা হয়েছে।
২৫৪২। এখান থেকে হযরত মুসার আধ্যাত্মিক জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত কর্তব্য কর্ম। হযরত মুসার জীবনী কোরাণের বিভিন্ন সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে, বিভিন্ন আধ্যাত্মিক পাঠ শিক্ষাদানের জন্য। তাঁর শৈশব, লালন-পালন, পার্থিব জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে অন্যান্য সূরাতে আলোচ্য বিষয়কে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করানোর উদ্দেশ্য। হযরত মুসা যখন যৌবন প্রাপ্ত হলেন, তিনি ফেরাউনের রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে, সিনাই উপত্যকার মাদয়ানবাসীদের নিকট গমন করেন। তিনি সেখানে বিয়ে করেন এবং এক দিন তাঁর পরিবারবর্গসহ স্থানান্তরে যাচ্ছিলেন। এ সময়েই আল্লাহ তাঁকে দায়িত্ব দেবার জন্য ডাক দেন। তিনি আগুনের উষ্ণতার আরাম ও পথের নির্দ্দেশের জন্য আগুনের সন্ধানে গিয়েছিলেন যা তাঁর ধ্যান ধারণায় ছিলো সম্পূর্ণ জাগতিক। কিন্তু সেখানে তিনি আরও উচ্চতর ও পবিত্রতম আরাম ও পথের নির্দ্দেশ পান। সম্পূর্ণ আয়াতটিতে এক বিস্ময়কর, আত্যাশ্চার্য ঘটনার বিবরণ আছে যার অর্থ অত্যন্ত গভীর। স্বল্প কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে এই গূঢ় তত্বপূর্ণ ঘটনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১২। " আমিই তোমার প্রভু! সুতারাং [ আমার উপস্থিতিতে ] তোমার যুতা খুলে ফেল ২৫৪৩। তুমি [ এখন ] পবিত্র 'তুওয়া ' উপত্যকায় রয়েছ। ২৫৪৪
২৫৪৩। " যুতা খুলে ফেল " জুতা খুলে ফেলা হচ্ছে সম্মান প্রদর্শনের এক পন্থা। আমরা সম্পূর্ণ বিষয়টিকে এভাবে বিচার করতে পারি। এখন মুসা আল্লাহর কর্তৃক দায়িত্ব পাওয়ার উপযুক্ত, সুতারাং জাগতিক সকল বিষয় থেকে তিনি হবেন মুক্ত। এখানে পাদুকা জাগতিক বিষয়বস্তুর প্রতীক স্বরূপ।
২৫৪৪। " তুওয়া " উপত্যকার অবস্থান সিনাই পর্বতের পাদদেশে। এখানেই তিনি পরবর্তীতে তাওরাত গ্রন্থ লাভ করেন।
১৪। "আমিই আল্লাহ্ ; আমা ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। সুতারাং তুমি [ শুধুমাত্র ] আমারই এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নিয়মিত সালাত কায়েম কর।
১৫। "অবশ্যই কিয়ামত সমাগত ২৫৪৫ - আমার পরিকল্পনা হচ্ছে তা গোপন রাখা ২৫৪৬ ; যেনো প্রতিটি আত্মা তার চেষ্টা অনুযায়ী পুরষ্কার লাভ করতে পারে।"
২৫৪৫। আমাদের কর্তব্য কর্ম সম্বন্ধে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য এক আল্লাহর এবাদত করা, এবাদত অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা এবং সালাত কায়েম করা অর্থাৎ নামাজ বা প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য কামনা করা যা পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে বলা হয়েছে কেয়ামত বা পরকালে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। কেয়ামত হলো সেদিন , যেদিন ইহকালের সকল কর্মের হিসাব নিকাশ হবে এবং প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের পরিতোষিক প্রদান করা হবে।
২৫৪৬। "Ukfi" এই শব্দটির অর্থ " গোপন রাখা " অথবা "স্পষ্ট প্রতীয়মান " হওয়া। কোন কোন তফসীরকার প্রথমটি,কোন কোন তফসীরকার দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করেছেন। যদি প্রথম অর্থটি গ্রহণ করা হয় তবে বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায় কেয়ামতের সংবাদ গোপন রাখা মানুষের কাছ থেকে। যদি দ্বিতীয়টির অর্থ গ্রহণ করা হয় তবে এর অর্থ দাঁড়ায় কেয়ামতের সংবাদ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা মানুষের কাছে যেনো তারা সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে। মওলানা ইউসুফ আলী সাহেবের মতে দুটি অর্থই প্রযোজ্য হতে পারে।
২৫৪৭। "যারা তাতে বিশ্বাস করে না " এ স্থলে " তাতে" দ্বারা "কেয়ামতে বিশ্বাস " ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ না করাকে বোঝানো হয়েছে। এই সাবধান বাণী আল্লাহ মুসাকে লক্ষ্য করে বলেন। মুসার সামনে যে কর্তব্য কর্ম তার প্রধান অংশে বিরাজ করবে ভয়ংকর বাঁধা উদ্ধত অহংকারীদের দ্বারা। ফেরাউন ও ইজিপ্টবাসীরা অন্ধ অহংকারে হযরত মুসার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করে। পরবর্তীতে মুসাকে তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। সুতারাং হযরত মুসা যখন আল্লাহর কাছে থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন, তখন আল্লাহ তাঁকে এ সব উদ্ধত , অহংকারী , একগুয়ে লোকদের সম্বন্ধে সাবধান করে দেন। যদিও সর্তকবাণীটি ছিলো হযরত মুসার প্রতি কিন্তু তা ছিলো সার্বজনীন, সর্বকালের , সর্বসাধারণের জন্য। সাধারণ মানুষ জাগতিক বিষয়ে নিমগ্ন থাকতে ভালোবাসে , আর এভাবেই সে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়। আল্লাহর হেদায়েতের পরিবর্তে সে যদি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তবে তার ধ্বংস অনিবার্য। হেদায়েতের আলো থেকে বিচ্যুত হওয়ার উপাদান তাঁর চতুর্দ্দিকে ছড়ানো। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিপদজনক যা তারই উল্লেখ এই আয়াতে করা হয়েছে। সবচেয়ে বিপদজনক হচ্ছে আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ। এরা সব সময়ে নিজ স্বার্থ ও নিজ প্রবৃত্তি ব্যতীত অন্য কিছুকে মূল্য দেয় না। এদের মধ্যে ন্যায় ও অন্যায়ের কোন সীমারেখা নাই।
১৮। সে বলেছিলো, " এটা আমার লাঠি ২৫৪৮। এর উপরে আমি ভর দিই ; এর দ্বারা আঘাত করে আমি আমার মেষপালের জন্য বৃক্ষপত্র ফেলে থাকি; এটা অন্যান্য ব্যবহারেও লাগে।"
২৫৪৮। এখানে থেকে শুরু হয়েছে মুসার লাঠির বিবরণ। মুসাকে যখন লাঠির সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলো , তিনি সে সম্বন্ধে সাধারণ দৈনন্দিক ব্যবহারের বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেন নাই।
২০। সে উহা নিক্ষেপ করলো এবং দেখো! সেটা সাপ হয়ে নড়াচড়া করতে থাকলো ২৫৪৯।
২৫৪৯। অনুরূপ আয়াত [ ৭ : ১০৭ ] , যেখানে "Thuban" শব্দটি সাপের সর্বনাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার বর্ণনা হচ্ছে " সকলের জন্য দর্শনীয় "। অর্থাৎ সাপটি সকলের জন্য দর্শনীয় ছিলো। সেখানে ফেরাউনের রাজসভাতে ছিলো বহুলোক এবং যাদুকরেরা। সেখানে লাঠিকে সাপে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্য ছিলো সর্বসাধারণকে যাদুকরদের প্রতারণা প্রত্যক্ষ করানো। সকলেই প্রত্যক্ষ করলো যে, মুসার লাঠিটি প্রকৃত সাপ হিসেবে চলতে শুরু করলো। এই আয়াতে লাঠিটি সাপে পরিণত হলো, মুসার মনে আল্লাহর ক্ষমতার স্বাক্ষর মুদ্রিত করার জন্য। সে কারণে এখানে "Haiy" শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে , যার অর্থ " জীবন্ত সাপ" ; এবং তার " সচলতা " যা বাংলা অনুবদ করা হয়েছে " উহা সাপ হয়ে নড়াচড়া করতে লাগলো " বাক্যটি দ্বারা। এখানে লাঠির সাপে রূপান্তর এবং নড়াচড়া সবই করা হয়েছিলো শুধুমাত্র মুসার মনো জগত ও চিন্তাজগতে আল্লাহর ক্ষমতা সম্বন্ধে দৃঢ় ধারণার সৃষ্টি জন্য। কারণ সেখানে মুসা ব্যতীত আর কেহ ছিলো না।
২২। " এখন তোমার হাতকে তোমার বগলে রাখ ২৫৫০। আর একটি নিদর্শন স্বরূপ এটা বের হয়ে আসবে সাদা [উজ্জ্বল ] , নির্মল ভাবে ;
২৫৫০। দ্বিতীয় অলৌকিক ঘটনাটি ছিলো আরও আশ্চর্যজনক তা ছিলো মুসার " নির্মল উজ্জল " হাত। সাধারণত চামড়া যখন রোগাক্রান্ত হয়, তখন সাদা রং ধারণ করে। কিন্তু তা থেকে দ্যুতি বিকিরণ করে না। এক্ষেত্রে রোগের প্রশ্নই আসতে পারে না। কারণ তা ছিলো আল্লাহর কুদরত বা অত্যাশ্চর্য নিদর্শন। সেই কারণে মুসার হাত থেকে স্বর্গীয় জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতো। এ ধরণের অত্যাশ্চর্য ঘটনা প্রদর্শন পৃথিবীর কোনও যাদুকরের পক্ষেই সম্ভব ছিলো না।
২৪। "ফেরাউনের কাছে যাও ২৫৫১ , অবশ্যই সে সকল সীমা লংঘন করেছে। "
২৫৫১। এ ভাবেই আল্লাহ মুসাকে ভবিষ্যত দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত করেন এবং নির্দ্দিষ্টভাবে ফেরাউনের নিকট প্রেরণ করেন ও ফেরাউনের পথভ্রষ্টতা নির্দ্দেশ করে দেন এই বলে যে, অহংকার ও গর্বে ফেরাউন " সীমা লংঘন " করেছে। ফেরাউনের সীমালংঘন এতটাই সীমা অতিক্রম করে যে, সে নিজেকে আল্লাহ বলে ঘোষণা করে। দেখুন আয়াত [ ৭৯ : ২৪ ]
২৫৫২। " বক্ষ প্রশস্ত করে দাও " এখানে বক্ষ শব্দটি প্রতীকধর্মী। জ্ঞান ও সর্বোচ্চ আবেগ অনুভূতি ও ভালোবাসার প্রকাশকে ব্যক্ত করা হয়েছে, " বক্ষ" শব্দটি দ্বারা। দেখুন অনুরূপ প্রকাশ আয়াতে [ ৯৪ : ১ ]। মানুষের চরিত্রের সর্বোচ্চ রত্ন হচ্ছে জ্ঞান ও ভালোবাসার ক্ষমতা যা মানুষকে স্রষ্টার নিকটবর্তী করে। হযরত মুসা এই সর্বোচ্চ চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন যা সেই নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য ছিলো অতি প্রয়োজনীয়। এ ব্যতীত তিনি আরও তিনটি জিনিষের জন্য প্রার্থনা করেনঃ ১) তাঁর কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের জন্য আল্লাহর সাহায্য; যে কর্তব্য কর্ম প্রথমে তাঁর কাছে দুরূহ মনে হয়েছিলো। ২) তাঁর জিহ্বার জড়তা দূর করে বাক্পটুতা যাঞা করেছিলেন। ৩) তাঁর সহকর্মী রূপে তাঁর ভাই হারুনকে প্রার্থনা করেছিলেন। কারণ তিনি তাঁর ভাই হারুণকে ভালোবাসতেন ও বিশ্বাস করতেন। ভাইকে ব্যতীত তিনি মিশরবাসীদের মাঝে সম্পূর্ণ একা হয়ে যেতেন।
২৭। " আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও ; ২৫৫৩।
২৫৫৩। এই আয়াতটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে " আমার জিহ্বার উপর থেকে বন্ধন দূর করে দাও।"
২৯। " আমার পরিবার থেকে আমাকে একজন সাহায্যকারী দাও , -
৩০। " আমার ভ্রাতা হারুনকে।
৩১। " তার মাধ্যমে আমার শক্তি বৃদ্ধি কর ২৫৫৪।
২৫৫৪। এই আররী আয়াতটির আক্ষরিক অর্থ " আমার পিঠকে তাঁর দ্বারা শক্তিশালী কর।" ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায় মানুষের পিঠে বা শিঁর দাড়াতে মানুষের শক্তি। সেই কারণে বাংলা বাগ্ধারাতে প্রচলিত আছে " শিরঁদাড়া শক্ত করে দাড়াও" অর্থাৎ সোজা ভাবে দাড়াতে যেনো তুমি তোমার কর্তব্যের ভার সাহসের সাথে মোকাবিলা করতে পার। অর্থাৎ পিঠ বা শিঁরদাড়া হচ্ছে সাহসের প্রতীক।
৩৩। "যাতে আমরা প্রচুর ভাবে তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারি ২৫৫৫।
২৫৫৫। আমরা সাধারণ মানুষ সর্বদা জাগতিক বিষয়ের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে থাকি। হযরত মুসা নবী রাসুলের মতই জাগতিক কিছুই প্রার্থনা করেন নাই, তাঁর প্রার্থনা ছিলো আধ্যাত্মিক। তাঁর নিয়ত বা উদ্দেশ্যকে তিনি সার্বজনীন না করে নির্দ্দিষ্ট করেছিলেন এই বাক্য দ্বারা যে, তিনি যেনো প্রচুরভাবে আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারেন। প্রচুর ভাবে অর্থাৎ ধারাবাহিক ও ক্রমাগত ভাবে কখনও না থেমে আল্লাহকে স্মরণ করতে পারেন অধিক মাত্রায়।
এই আয়াত ও পরের আয়াতের উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য হযরত মুসা আয়াত ২৫ থেকে ৩২ পর্যন্ত আল্লাহর নেয়ামত ও সাহায্য প্রার্থনা করেন।
৩৫। " তুমি তো আমাদের [ কার্যক্রমের ] সম্যক দ্রষ্টা " ২৫৫৬।
২৫৫৬। হযরত মুসা আল্লাহকে প্রশংসা ও স্মরণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে যে নেয়ামতে ধন্য করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
৩৭। " আমি তো [ পূর্বেও ] তোমার প্রতি আরও একবার অনুগ্রহ করেছিলাম।
৩৮। " স্মরণ কর! ওহীর মাধ্যমে তোমার মাতাকে বাণী প্রেরণ করেছিলাম ২৫৫৭।
২৫৫৭। এই আয়াতের মাধ্যমে মুসার লালন - পালনের প্রধান প্রধান লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলির উপরে ইঙ্গিত দান করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ যখন মিশরের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন সে সময়ে বণী ইসরাঈলীদের মিশরে আগমন ঘটে। হযরত ইউসুফের বহু বছর পরে এক ফেরাউন মিশরের সিংহাসনে আরোহণ করেন যিনি ইসরাঈলীদের ঘৃণা করতেন। তিনি ইসরাঈলীদের সদ্যজাত ছেলে শিশুদের মেরে ফেলার আদেশ দান করেন। এসময়েই হযরত মুসার জন্ম হয়। মুসার মা মুসাকে জন্মের পর থেকে গোপন করে রাখেন। কিন্তু যখন তা আর সম্ভব হলো না , তাঁর মনে উদয় হলো যে, শিশুকে একটি সিন্দুকে করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার কথা। তাঁর মনের এই কল্পনা কোন খাম-খেয়াল ছিলো না। এ ছিলো মহান আল্লাহর ইঙ্গিত। কারণ আল্লাহর পরিকল্পনা ছিলো যে, হযরত মুসাকে তিনি মিশরের সর্বোচ্চ জ্ঞানে শিক্ষিত করবেন যেনো এই জ্ঞান তাকে এর অসম্পূর্ণতাকে প্রকাশ করতে ও আল্লাহর মহিমাকে ঘোষণা করতে সাহায্য করে। সিন্দুকটি নীল নদীতে ভেসে যাচ্ছিল। সিন্দুকটি যেয়ে নীলনদীর তীরে বাগানের পার্শ্বে আটকে যায়। সিন্দুকটি ফেরাউনের লোকজন তুলে নিয়ে ফেরাউনের প্রাসাদে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ফেরাউনের স্ত্রী তাঁকে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। এ সম্বন্ধে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে আয়াত [ ২৮ : ৪ - ১৩ ]।
২৫৫৮। " আমার শত্রু " অর্থাৎ ফেরাউনকে আল্লাহর শত্রুরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ ফেরাউন গর্বে ও অহংকারে নিজেকে আল্লাহ বলে ঘোষণা করে। "তার" শব্দটির দ্বারা হযরত মুসাকে বোঝানো হয়েছে। ফেরাউনকে মুসারও শত্রু রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ সে ইসরাঈলীদের ঘৃণা করতো এবং তাদের ছেলে শিশুদের মৃত্যুদন্ডাদেশ দান করে। এ ব্যতীত কারণ হচ্ছে মুসা আল্লাহর প্রত্যাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
২৫৫৯। আল্লাহ শিশু মুসাকে এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেন যে তাঁকে দেখলে কেউ না ভালোবেসে পারতো না। যারা ইসরাঈলীদের শিশুদের হত্যার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো, তাদেরও ভালোবাসা তিনি আকর্ষণ করেন।
২৫৬০। দেখুন উপরের টিকা ২৫৫৮। শিশু মুসাকে আল্লাহ এত সুন্দর করেছিলেন যে ফেরাউনের স্ত্রী তাঁকে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। এর ফলে মুসা পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধার মাঝে প্রতিপালিত হওয়ার সুযোগ পান। যেহেতু, আল্লাহ স্বয়ং তাঁর প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সে জন্য তাকে মাতৃস্নেহ বা মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হতে হয় নাই। পরবর্তী আয়াতে দেখুন কিভাবে তিনি ফেরাউনের প্রাসাদে ফেরাউনের দত্তক পুত্র রূপে থাকা সত্ত্বেও নিজ মাতৃক্রোড়ে আশ্রয় পান ও নিজ মাতৃদুগ্ধ পানের সুযোগ লাভ করেন। ফলে নিজ পরিবারের সংস্পর্শে থাকার সুযোগ লাভ করেন।
উপদেশ : এভাবেই মানুষের মাধ্যমেই আল্লাহ্র পরিকল্পনা কার্যকর হয়ে থাকে।
২৫৬২। মনে হয় শিশু মুসাকে নদীতে ভাসানোর পরে , মায়ের চক্ষু দিয়ে অবিরল ধারাতে অশ্রু ঝড়ে পড়ছিলো। ফলে তাঁর অশ্রুসিক্ত চক্ষুতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিলো। মুসাকে ফিরে পাওয়ায় সন্তান হারানোর ব্যথা তিনি ভুলেছিলেন এবং তার অশ্রুর নিবারণ ঘটেছিলো। " চক্ষু জুড়ানো " বাক্যটি একটি বাগ্ধারা যার অর্থ অন্তরে শান্তি লাভ করা। মুসাকে ফিরে পেয়ে মুসার মা অন্তরে শান্তি লাভ করেছিলেন।
২৫৬৩। সময় পার হয়ে যায়। মুসা ধীরে ধীরে ফেরাউনের প্রাসাদে বড় হতে থাকেন। সেখানে থেকে তিনি মিশরের যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করেন। তিনি যদিও ফেরাউনের প্রাসাদে লালিত পালিত হন, কিন্তু প্রতিপালিত হন বাহ্যিকভাবে ইসরাঈল ধাত্রী দ্বারা। তিনি তারই বুকের দুধ খেয়ে বড় হন। সুতারাং ফেরাউনের প্রাসাদে পালিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ইসরাঈলীদের জন্য সমবেদনা ছিলো। একদিন তিনি ইসরাঈলীদের কলোণীতে গমন করেন। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, একজন মিশরবাসী ইসরাঈল শ্রমিককে প্রহার করছে। মুসা ইসরাঈলীটির জন্য ভাতৃমমত্ব বোধ করেন এবং মিশরীয়টিকে পাল্টা আঘাত হানেন। তিনি অবশ্য মিশরীয়টিকে হত্যা করতে চান নাই। কিন্তু তাঁর আঘাতের ফলে মিশরীয়টি মারা যায়। যখন তা জানাজানি হয়ে যায় , এর পরে ফেরাউনের প্রাসাদে তাঁর উপস্থিতি বিপদজনক হয়ে পড়ে। তিনি মিশর থেকে পলায়ন করেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহে রক্ষা পান। তিনি মিশর থেকে সিনাই উপত্যকাতে গমন করেন, মাদ্য়াইন জাতিদের বাসভূমিতে। সেখান তিনি মাদ্য়াইন সর্দ্দারের কন্যাকে বিয়ে করেন এবং অনেক বছর সেখানে বসবাস করেন। এভাবেই বহু পরীক্ষা ও প্রলোভনের মধ্যে দিয়ে মুসাকে আল্লাহ্ পরিচালিত করেন এবং মুসা তাঁর চরিত্রের বিশুদ্ধতা ও ন্যায়পরণতা শেষ পর্যন্ত বজায় রাখেন। এ ভাবেই আল্লাহ তাঁর কাজের জন্য মুসাকে প্রস্তুত করে নেন।
উপদেশ : আগুনে পুড়ে যেরূপ সোনা খাঁটি হয়, দুঃখ ও বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আত্মা বিশুদ্ধ হয়। আত্মিক গুণাবলীর প্রকাশ ঘটে।
৪২। " তুমি ও তোমার ভ্রাতা আমরা নিদর্শনসহ যাও ২৫৬৫ এবং তোমরা উভয়েই আমার স্মরণে শৈথিল্য প্রদর্শন করো না।
২৫৬৫। আমরা অনুমান করতে পারি যে, হযরত মুসা একাই মাদ্য়াইনাদের দেশে গিয়েছিলেন। সুতারাং তুওয়া উপত্যকাতে তিনি তাঁর পরিবারবর্গের সাথে ছিলেন , সেখানে তার ভাই হারুন ছিলো না। এ ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে ২৫৪২ টিকাতে। যখন মুসাকে আল্লাহ্ তাঁর বাণী প্রচারের জন্য মনোনীত করে সম্মানীত করেন এবং আল্লাহ্র তাঁর অনুরোধে তাঁর ভাই হারুনকে তুওয়া উপত্যকাতে নিয়ে আসার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সম্ভবতঃ তাঁদের দেখা হয়েছিলো তুওয়া উপত্যকাতে। অর্থাৎ মিশরে প্রবেশের পূর্বে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়। এরপরে তারা প্রার্থনা করেন এবং মিশর অভিমুখে যাত্রা করেন।
হারুন সম্ভবতঃ মুসার বড় বা ছোট ভাই ছিলেন, কারণ এ সম্বন্ধে ধর্মগ্রন্থে কোনও উল্লেখ নাই। তবে মনে হয়, হারুনের জন্ম তখনই হয়, যখন ইসরাঈলীদের নবজাত শিশুর উপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। মুসার সাথে হারুনের কোনও যোগাযোগ ছিলো না। তবুও মুসার তাঁর পরিবারের জন্য প্রচন্ড ভালোবাসা ছিলো এবং হারুনকে তিনি তাঁর কাজের সঙ্গী হিসেবে আল্লাহ্র কাছে যাঞ্চা করে নেন যে কাজ ছিলো তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
২৫৬৬। মুসার কর্তব্য কর্মের প্রথম ধাপ ছিলো ফেরাউন ও মিশরবাসীদের নিকট গমন করা এবং তার পরে ইসরাঈলীদের মিশর থেকে বের করে নিয়ে আসা।
২৫৬৭। এই আয়াতটি [ ২০ : ২৪ ] আয়াতের অনুরূপ। মুসার রসুল হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পূর্বে তাঁর জীবনকে সংক্ষেপে বর্ণনা করে তাঁর আসল কাজের সূচনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুসার পূর্ব জীবনের বর্ণনা এখানেই শেষ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে ফেরাউনের আচরণের কথা। উদ্ধত অহংকারে ফেরাউন ভুলে গিয়েছিলো , আল্লাহ্র নিকট সে কত ক্ষুদ্র , কত নগণ্য।
উপদেশ : অহংকার একটি খারাপ রীপু যা মানুষের সকল গুণাবলী নষ্ট করে দেয় । ফলে সে অন্যের গুণাবলী প্রত্যক্ষ করতে অক্ষম হয়। যেরূপ চোখের সামনে ধরা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দূরের হিমালয়কে ঢেকে দেয়।
২৫৬৮। গর্ব ও অহংকারে ফেরাউন আল্লাহ্র অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছিলো। বিশ্ব স্রষ্টার কাছে মানুষের অস্তিত্ব কত ক্ষুদ্র কত নগণ্য , সে কথা মুসাকে স্মরণ করিয়ে দিতে বলা হয়। সম্ভবতঃ সে অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। নিদেন পক্ষে , ফেরাউন আল্লাহ্র ভয়ে " সীমা লংঘন " থেকে বিরত থাকবে। সংসারে কিছু লোক থাকে যারা " উপদেশ " গ্রহণ করে এবং পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকে শুধু মাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এরা অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের। এদের দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়। আবার আর একদল আছে যারা কৃত কর্মের ভয়াবহ পরিণামের জন্য ভীত হয়ে , পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকে। এরা আত্মিক উন্নতিতে পূর্বোক্ত শ্রেণী থেকে অনুন্নত। তবে তারা পূর্বোক্ত শ্রেণীতে আরোহণের যোগ্যতা রাখেন।
এই আয়াতের অন্যতম প্রধান উপদেশ হচ্ছে কোনও বড় ও মহৎ কাজের আবেদন আল্লাহ্র কাছে হতে হবে বিনয়ের মাধ্যমে।
২৫৬৯। মুসা এবং হারুন বর্তমানে মিশরে [ দেখুন টিকা ২৫৬৫ ]। সুতারাং ফেরাউনের ক্ষমতার অধীনে। ফেরাউনের মন-মানসিকতার সাথে মুসা ও হারুন পূর্ব পরিচিত ছিলেন। সুতারাং তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেনা যে, তাদের অভিযান কতটা বিপদজনক। তারা ফেরাউনের নিকট থেকে শাস্তির আশংকা করেছিলেন। যে ভয়াবহ বিপদজনক গুরুদায়িত্ব তাদের দেয়া হয়েছে তা কার্যে পরিণত করতে সাহসের প্রয়োজন তাদের জন্য।
৪৭। সুতারাং তোমরা উভয়েই তার নিকট যাও এবং বল, "আমরা তোমার প্রভুর প্রেরিত রাসুল। সুতারাং বণী ইসরাঈলীদের আমাদের সাথে যেতে দাও এবং তাদের কষ্ট দিও না ২৫৭০। অবশ্যই আমরা তোমার প্রভুর নিকট থেকে নিদর্শনসহ এসেছি। যারা সৎ পথ অনুসরণ করে তাদের প্রতি শান্তি ২৫৭১।
৪৮। " আমাদের প্রতি ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, শাস্তি তাদের জন্য যারা প্রত্যাখান করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। "
২৫৭০। বণী ইসরাঈলীদের মিশরে ফেরাউনের লোকদের দ্বারা নগ্নভাবে নির্যাতিত ও অত্যাচারিত হতে হতো। তাদের দ্বারা কঠোর পরিশ্রম করানো হতো, তাদের নেতাকে অন্যায়ভাবে মারধর করা হতো। এ সব নির্যাতন ও অত্যাচারের অন্যতম উপায় ছিলো ইসরাঈলীদের দ্বারা খড় ব্যতীত ইট তৈরীর পদ্ধতি। তারা ছিলো দাসত্বের নিগড়ে বাঁধা। দেখুন [Exod . V. 6 – 19, VI . 5 ] .
২৫৭১। সবচেয়ে কঠিন ও মন্দ যে পাপী , যারা সর্বদা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে থাকে আল্লাহ্র করুণার ধারা তাদের সবার জন্যও অবারিত। কিন্তু তাদের পাপের কৃত মন্দ পরিণাম থেকে তারা অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য অব্যহতি পেতে পারে না। পরবর্তী আয়াতে এ সম্বন্ধে বক্তব্য আছে। পাপী অবশ্যই শাস্তি পাবো তা সে যতবড় ক্ষমতাধর হোক বা যত ক্ষুদ্রই হোক। অপরপক্ষে যারা সৎপথ অবলম্বন করে তাদের জন্য আছে শান্তি।
২৫৭২। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে , কিরূপ চতুরতার সাথে ফেরাউন মুসার বক্তব্যকে গুরুত্বহীন করার প্রয়াস পায়। আয়াতে [ ২০ : ৪৭ ] মুসা ফেরাউনকে সম্বোধন করেছিলেন " তোমার প্রভু " রূপে। মুসা ও হারুনের যে প্রভু, সেই একই মহাপ্রভু যে ফেরাউনের প্রভু এই বক্তব্যকে ফেরাউন চতুরতার সাথে ছুড়ে ফেলে দেয়। উদ্ধত অহংকারের সাথে তার বক্তব্য ছিলো, " কে তোমাদিগের প্রভু, ? কে তোমাদিগকে প্রেরণ করেছেন ?" ক্ষমতা ও দম্ভ সাধারণ মানুষকে ঠিক এ ভাবেই আল্লাহ্কে অস্বীকার করতে শেখায় , প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনের ক্ষমতা রহিত করে।
২৫৭৩। হযরত মুসা ফেরাউনের সাথে " আমার প্রভু " এবং " তোমার প্রভু" অথবা " ইসরাঈলীদের প্রভু" এবং " মিশরবাসীর প্রভু " এই বির্তকে লিপ্ত হন নাই। তাঁর প্রতি উত্তর ছিলো সহজ সরল , মর্যাদাপূর্ণ ও দ্যুতিময়। তিনি সগর্বে ঘোষণা করেন যে তিনি ও তাঁর ভাই তাঁদের প্রভুর সেবার জন্য নিবেদিত। তাঁদের প্রভু হচ্ছেন বিশ্ব ভূবনের একমাত্র প্রভু ও প্রতিপালক। যিনি পৃথিবীর সকল বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার নির্দ্দিষ্ট যোগ্য আকৃতি স্বভাব বা ধর্ম দান করে থাকেন। মানুষের স্বভাবে তিনি " সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দান করেছেন। এ ভাবেই মুসা নির্দ্দেশ করেন যে ফেরাউনও সেই বিশ্ববিধাতার ক্ষমতার অধীনে। মানুষের "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির " সঠিক ব্যবহারের জন্য আল্লাহ্ যুগে যুগে নবী ও রসুলদের প্রেরণ করেছেন। তাঁরা মানুষদের হেদায়েতের পথে আহ্বান করেছেন। মুসা ও হারুনকেও এরূপ পথ নির্দ্দেশের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। ফেরাউন কি সঠিক পথের নির্দ্দেশ অনুধাবন করবে না ও সঠিক পথে ফিরে আসবে না? "
২৫৭৪। মুসার আবেদন উদ্ধত অহংকারী ফেরাউনকে স্পর্শ করলো না। কারণ ফেরাউনের দৃষ্টিতে মুসা ছিলেন ঘৃণিত ,অবাঞ্ছিত এবং উন্নত মিশরীয় সভ্যতা বঞ্চিত এক দলত্যাগী। ফেরাউন কৌশলে সর্বসাধারণকে মুসার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে প্রয়াস পায়। তার বক্তব্য ছিলো যদি মুসার বক্তব্য অনুযায়ী স্রষ্টা শুধু একজনই হয় এবং তাঁর কাছে সকলকে জবাবদিহি করতে হয় , তবে তা হচ্ছে এক নূতন ধর্ম। তাহলে মিশরবাসীদের পূর্বপুরুষের কোন ধর্ম ছিলো ? তারা কি মিশরের দেব-দেবীদের পূঁজা করে ভুল করেছিলো ? মুসার কথা অনুযায়ী তারা যদি ভুল করে থাকেন , তবে তারা কি এখন দুঃখ - দুর্দ্দশাতে নিপতিত ? এভাবেই সর্ব সাধারণের সামনে পূর্ব পুরুষদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে মুসার বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টির প্রয়াস করা হয়। এ ভাবেই ফেরাউন কৌশলে সর্বসাধারণের জন্য ফাঁদ পাতে যেনো মুসার জন্য তাদের কোনও সহানুভূতি না থাকে।
২৫৭৫। মুসা কিন্তু ফেরাউনের এই ফাঁদে পা দেন নাই। তিনি কোনওরূপ হঠকারিতার আশ্রয় না নিয়ে নম্র ভাষাতে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন, কারণ আল্লাহ্ তাঁকে নম্র ভাষাতে ফেরাউনের সাথে কথা বলার আদেশ দান করেছেন [ ২০ : ৪৪ ]। মুসা নম্র ভাষাতে কথা বলেন কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তিনি সত্যকে দ্বিখন্ডিত করেন নাই। তিনি বলেন যে, "আল্লাহ্র জ্ঞান স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং তা লিপিবদ্ধ আছে লওহে মাহ্ফুজে। মানুষ ভুল করে, ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্ কখনও ভুল করেন না বা ভুলে যান না। আল্লাহ্ শুধু সর্বজ্ঞ -ই নন, তিনি সর্ব কল্যাণের অধিকারী। আল্লাহ্র কল্যাণময় স্পর্শের বিবরণ আছে পরের আয়াতে। চারিদিকে তাকাও সমস্ত পৃথিবী কার্পেটের ন্যায় আরামদায়ক রূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ এখানে নিরাপদে বিচরণ করে। তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি রূপ পানি প্রেরণ করেন, যা নীল নদীরূপে প্রবাহিত হয় মিশরের ভূমিকে উর্বর করে এবং মানুষের আহারের বন্দোবস্ত করেন। "
২৫৭৬। "Sabil " অর্থ শুধুমাত্র স্থলপথ নয়, এর অর্থ জলপথ, ও খাল এবং বর্তমান কালে তা আকাশ পথ ও যোগাযোগের সকল মাধ্যম।
২৫৭৭। "আমি উহা দ্বারা বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি।" এই বাক্যটি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মুসার বক্তব্যের পরে আল্লাহ্র বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়েছে কারণ এই আয়াতটিকে আয়াত [ ২০ : ৫৪ - ৫৬ ] এর সাথে সংযুক্ত করলে আল্লাহ্র বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হয়। এই আয়াতগুলিতে বিশ্ব প্রকৃতিতে আল্লাহ্র মহিমাকে তুলে ধরা হয়েছে।
২৫৭৮। "Azway " এখানে এই শব্দটিকে বিভিন্ন " প্রকার " বাক্য দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে। আবার ইংরেজীতে এর অনুবাদ করা হয়েছে "Diverse Pair" . সেখানে আয়াত [ ১৩ : ৩ এবং টিকা ১৮০৪ ] এর অনুসরণ করা হয়েছে।
২৫৭৯। এই আয়াতটির সাথে শেষ অধ্যায়ের ধারাবাহিকতার সামঞ্জস্য আছে। ইউসুফ আলী সাহেবের মতে আয়াতটি শেষ অধ্যায়েই সন্নিবেশিত হওয়া প্রয়োজন।
২৫৮০। এই আয়াতটি হযরত মুসা ও ফেরাউনের মধ্যে যে সংঘর্ষ ঘটে তারই ভূমিকা স্বরূপ। আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহ মিশরীয়দের প্রতারণামূলক ম্যাজিককেই শুধুমাত্র মিথ্যা প্রমাণ করে নাই ,পরবর্তীতে প্লেগ [ এখানে উল্লেখ করা হয় নাই ] ও লোহিত সাগর অতিক্রম , এর থেকেও অধিক অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন।
২৫৮১। মিশরবাসীরা হযরত মুসাকে অভিযুক্ত করেন যে তিনি মিশরবাসীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্র করছেন , তাঁর যাদু বিদ্যার প্রদর্শন দ্বারা। কিন্তু তাঁদের এই অভিযোগ ছিলো স্পষ্টতঃ মিথ্যা। মুসার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো ইসরাঈলীদের মিশরে মুক্ত করা। যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তাঁকে প্রেরণ করেন। মিশরবাসীরা ক্ষমতার দম্ভে আল্লাহ্র অলৌকিক ক্ষমতাকে অনুধাবন করতে অক্ষম হয়েছিলো। তারা তাদের যাদু বিদ্যার ক্ষমতার সাথে মুসার অলৌকিক ক্ষমতা যা আল্লাহ্ তাঁকে দান করেন তা তুলনা করে। তারা আল্লাহ্র নবীর অলৌকিক ক্ষমতাকে যাদুবিদ্যা বলে অভিযুক্ত করে। তারা বুঝতে ও উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়েছিলো যে, মুসার অলৌকিক শক্তি ও ক্ষমতার উৎস সম্পূর্ণ আলাদা।
২৫৮২। "Suwan" আক্ষরিক অর্থ সমান, মসৃণ। এর দ্বারা এই আয়াতে নিম্নোক্ত ভাবসমূহ প্রকাশ করা যায় :
১) দুদিক থেকেই সমদূরবর্তী বা মধ্যবর্তী স্থান।
২) দু পক্ষের জন্য সম উপযোগী;
৩) সমান মসৃণ ভূমি যেখানে থেকে সকলেই দেখতে পাবে।
২৫৮৩। মিশরবাসীদের বিশেষ উৎসবের দিনকে হযরত মুসা নির্ধারিত করেন। এদিনে মন্দির ও রাস্তা ঘাট বিশেষ ভাবে সজ্জিত করা হয়। জনসাধারণ পূঁজা উপলক্ষে কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে। এ দিনে মিশরের আপামর জনসাধারণ মন্দিরে সমবেত হয়। হযরত মুসা তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বা আল্লাহ্র মোজেজা প্রদর্শনের জন্য এ দিনকেই নির্ধারিত করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো তিনি যেনো বিরাট জনগোষ্ঠির সামনে আল্লাহ্র সত্যকে প্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেন। তাঁর এই উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল হয়। কারণ মিশরের কিছু প্রভাবশালী যাদুকর মুসার অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন [ ২০ : ৭০, ৭২ - ৭৬ ]।
২৫৮৪। ঘটনার বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুসা কর্তৃক জন সাধারণের উৎসবের দিনটিকে ধার্য করার ফলে ফেরাউন কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ সাধারণ ভাবেই সেদিন বিপুল লোকের সমাগম ঘটবে। আর এই বিপুল জন সমাবেশের মাঝে কিছু লোক অবশ্যই থাকবে যারা ফেরাউনের যাদুকরদের কৌশলের সমালোচক হবে। এই ব্যাপারটি ফেরাউনের অত্যন্ত অপছন্দ ছিলো। পরবর্তী আয়াতে মুসার বক্তব্য থেকেও এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, ফেরাউন ও তার লোকেরা গভীর ষড়যন্ত্র করেছিলো যা ছিলো অন্যায় ও কুচক্রান্তে ভরা।
২৫৮৫। মুসার ফেরাউনের লোকদের কুচক্র, প্রতারণা ও কৌশল সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিলো। এই সব যাদুকরেরা তাদের প্রতারণাপূর্ণ কৌশলকে তাদের উপাস্যের মোজেজারূপে প্রকাশ করার প্রয়াস পায়। সাধারণ লোকদের প্রতারিত করতে চেয়েছিলো এই ভাবে যে তাদের উপাস্য দেবতারা আল্লাহ্ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। মুসা তাদের এই বলে সর্তক করে দেন যে, তাদের কুচক্রী কৌশল জন সাধারণের নিকট প্রকাশিত করা হবে, এবং তারা সমূলে ধ্বংস হবে।
২৫৮৬। যাদুকরেরা বুঝতে পেরেছিলো যে, তারা কোন সাধারণ ব্যক্তির সাথে বোঝাপড়া করছে না। কারণ মুসা ছিলেন তাদের পূর্ব পরিচিত। সুতারাং তারা আশঙ্কা করেছিলো যে, মুসার ক্ষমতা তাদের থেকে বেশী হতে পারে। মন্দ সব সময়েই মন্দভাবে চিন্তা করতে ভালোবাসে। তারা মুসার ক্ষমতার উৎস যে স্বর্গীয় তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। সে কারণে তারা মুসা ও হারুনকে তাদের নিজেদের সমমান সম্পন্ন বলে ধারণা করেছিলো। সুতারাং তারা একতাবদ্ধ ভাবে মুসা ও হারুনকে পরাজিত করার পরিকল্পনা করে। এখানে আয়াত [ ২০:৬৩ - ৬৪ ] হচ্ছে যাদুকরদের গোপন আলোচনা এবং আয়াত [ ২০ : ৬৫ ] হচ্ছে গোপন আলোচনার পরে যাদুকরদের প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দীতার আহ্বান মুসার প্রতি।
২৫৮৭। " লালিত জীবন ব্যবস্থা " দ্বারা এই আয়াতে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, তাদের পূর্বপুরুষদের যাদুবিদ্যা সমৃদ্ধ বিলাসী জীবন ব্যবস্থা "Amthal" এর স্ত্রী লিঙ্গে "Muthla "। "Amthal" এর সকল অর্থ এখানে প্রযোজ্য যার অর্থ সম্মানীয় , বিশিষ্ট, ইত্যাদি। "Tariqat" - জীবন ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান, চরিত্র।
২৫৮৮। এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ফেরাউন সে সময়ে সম্ভবতঃ তাঁর গোপন মন্ত্রণা কক্ষে পরামর্শে ব্যস্ত ছিলো। ফেরাউন বললো যে, যাদুকরেরা যদি মুসাকে পরাজিত করতে পারে তবে, তাদের জন্য আছে অঢেল পুরষ্কারের ব্যবস্থা। [ দেখুন আয়াত ৭ : ১১৪ ]। যাদুকরদের জন্য দিনটি ছিলো অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। যদি তারা জয়লাভ করে, তবে তাদের জন্য তা হবে চিরস্থায়ী বিজয়। পরিণামে মুসা ও তাঁর লোকজন ধ্বংস হয়ে যাবে।
৬৬। সে বলেছিলো, " বরং তোমরাই প্রথমে নিক্ষেপ কর।" তাদের জাদুর প্রভাবে ,তাদের দড়ি ও লাঠি মুসার নিকট মনে হলো জীবন্ত হয়ে নড়াচড়া করছে ২৫৮৯।
২৫৮৯। যাদুকরদের যাদুর কৌশলগুলি এতই চমকপ্রদ ছিলো যে, সকল দর্শকেরা এবং মুসার চোখে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটালো। তাদের দড়ি এবং লাঠিকে সাধারণ মানুষের চোখে সাপ বলে ভ্রম হচ্ছিল। এমন কি মুসার চোখেও তা জীবন্ত সাপ বলে ভ্রম হচ্ছিল। কিন্তু যাদুকরদের সবই ছিলো শুধুমাত্র প্রতারণার কৌশল মাত্র।
২৫৯০। ঐক্যবদ্ধ ও সুপরিকল্পিত মিথ্যার আক্রমণ অনেক সময়েই প্রকৃত সত্যকে প্রকাশে বাঁধা দান করে। সে সময়ে মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিভাত হয়, এবং মিথ্যা সর্বক্ষেত্রে প্রশংসিত হয়। এ সব ক্ষেত্রে সত্যে বিশ্বাসীদের বিভ্রান্তিতে নিপতিত করে। এ হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। মুসার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। মিথ্যার আক্রমণে তিনি অন্তরে কিছু ভীতির অনুভব করেন, কিন্তু আল্লাহ্র করুণা ও দয়া তাঁকে আত্মপ্রত্যয়ী হতে সাহায্য করে। শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্য মিথ্যা কৌশলকে ধ্বংস করে।
৬৯। তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ কর। ইহা তারা যে প্রতারণা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। ওরা যে প্রতারণা করেছে তা তো কেবল জাদুকরের কৌশল মাত্র। জাদুকরেরা যেখানেই থাকুক না কেন [ তাতে কিছু আসে যায় না ] ; তারা সমৃদ্ধি লাভ করবে না ২৫৯১।
২৫৯১। এই আয়াতটি সমগ্র ঘটনাটির উপদেশ স্বরূপ। উপদেশ হচ্ছে : ১) মিথ্যা এবং প্রতারণা চিরস্থায়ী হতে পারে না। কিছুদিন মিথ্যা বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে সত্য, কিন্তু সত্যের উপস্থিতিতে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। অথবা ২) প্রতারণা ও কৌশলের শেষ পরিণতি অবশ্যই মন্দ। তা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।।
২৫৯২। এই আয়াতটি [ ৭ : ১২০ - ১২৬ ] আয়াতের এবং এর টিকার সমরূপ।
২৫৯৩। ফেরাউন যাদুকরদের মুসার অনুসারীরূপে অভিযুক্ত করলো। তার ধারণা হলো মুসা যাদুকরদের বশীভূত করেছে এবং তাদের পরিচালিত করছে। সে প্রকৃত সত্যকে প্রত্যক্ষ করতে ছিলো অপারগ। এ ভাবেই মানুষের উদ্ধত্য দম্ভ অহংকার মানুষকে সত্য প্রত্যক্ষ করতে বাঁধার সৃষ্টি করে। যারা অহংকারী তাদের গর্ব ,অহংকার তাদের উদ্ধত ও দাম্ভিক করে তোলে। ফলে তারা প্রকৃত সত্যকে , আল্লাহ্র নিদর্শনকে উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ ঔদ্ধত্য তাদের উপলব্ধির ক্ষমতাকে সঙ্কীর্ণ করে তোলে। এ ভাবেই তাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে সত্যের মহিমান্বিত রূপ ধরা পড়ে না। সত্যিকার অর্থে তারা অন্ধ ব্যক্তির ন্যায়। কারণ চতুরতা ও অহংকার তাদের সত্য পথ থেকে বহুদূরে নিক্ষিপ্ত করে।
উপদেশ : গর্ব ও অহংকার মানুষকে দাম্ভিক উদ্ধত করে তোলে, পরিণামে মানুষ সত্যকে প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা হারায়। ফলে সে হয় বিভ্রান্ত।
২৫৯৪। স্পষ্ট নিদর্শন ; অলৌকিক ঘটনা, আল্লাহ্র প্রেরিত দূতের ব্যক্তিত্ব, ঘটনার ধারাবাহিকতা যেভাবে তা সংঘটিত হয়েছে , তাদের বিবেকের দৃঢ় বিশ্বাস - এ সকলই হচ্ছে স্পষ্ট নিদর্শন। আল্লাহ্র নিদর্শনের আরও প্রমাণ আছে সূরার অন্যান্য জায়গায় যেমনঃ [ ২০ : ৫৩ - ৫৪ ]।
২৫৯৫। এ ভাবেই মুসার উপরে প্রদত্ত মিশরবাসীদের প্রতি দায়িত্বের প্রথম অংশ সম্পন্ন হয়। দেখুন আয়াত [ ৭ : ১২৬ ] ও টিকা ১০৮৩।
উপদেশ : বিচিত্র পদ্ধতিতে আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় এবং তা হবেই।
২৫৯৭। আয়াত [ ২০ : ৭৪ - ৭৬ ] পর্যন্ত সেই সব মিশরবাসীদের জন্য প্রযোজ্য যারা মিথ্যাকে ত্যাগ করে সত্যকে গ্রহণ করেছিলো এবং নিজেকে পাপ থেকে রক্ষা করে পবিত্র হয়েছিলো তাদের জন্য মন্তব্য হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। আবার অনেক অনুবাদকের মতে এই আয়াত কয়টি যাদুকরদের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা।
৭৬। অনন্ত জান্নাত , যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। হ্যাঁ , সেখানে তারা বাস করবে। যারা নিজেদের পবিত্র রাখে [পাপ থেকে] ,তাদের পুরষ্কার হবে এরূপই ২৫৯৮।
২৫৯৮। মিশরের যাদুকরেরা যেরূপ সত্যকে গ্রহণ করে এবং আল্লাহ্র একত্বকে স্বীকার করে নিজেকে বেহেশতের যোগ্যরূপে গড়ে তোলে, সেরূপ সকল মোমেন বান্দাদের কথা বলা হয়েছে।
২৫৯৯। মুসার মিশরে আগমনের পরে সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। অবশেষে একদিন মুসার প্রতি আল্লাহ্র আদেশ প্রেরিত হয় রাত্রিযোগে সকল ইসরাঈলীদের নিয়ে মিশর ত্যাগ করার। তাদের লোহিত সাগর অতিক্রম করে সিনাই উপত্যকাতে যেতে বলা হয়। তাদের এই বলে আস্বস্ত করা হয় যে, তারা যেনো সাগর বা অচেনা মরুভূমির দেশ সিনাই দেখে ভয় না পায়। তারা সমুদ্রের মধ্যে তৈরী শুকনা পথ অতিক্রম করে চলে যায়, কিন্তু পশ্চাৎ ধাবনকারী ফেরাউন তার দলবলসহ সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এ ভাবেই ফেরাউন ও তার সকল লোকজন ধ্বংস হয়ে যায়। এই আয়াত পর্যন্ত মুসার কর্তব্য কর্মের সম্পাদনের জন্য কোনও বিশেষ কঠোর পরিশ্রমের উল্লেখ করা হয় নাই। কিন্তু ইসরাঈলীদের মিশরের দাসত্ব থেকে মুক্তি দান করার পরে কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের জন্য মুসাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তাঁর নিজ লোকজনের মধ্যে।
৭৯। ফেরাউন তার সম্প্রদায়কে সঠিক পথের পরিবর্তে ভুল পথে পরিচালিত করেছিলো ২৬০০।
২৬০০। নেতা ও দেশের নৃপতির দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সাধারণ জনসাধারণকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। কিন্তু যে সব নেতা ও নৃপতি পাপী ও মন্দ , তারা জন সাধারণকে সঠিক পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। ফলে বিশাল জনগোষ্ঠির ধ্বংসের কারণ হয়।
২৬০১। দেখুন আয়াত [ ১৯ : ৫২ ] এবং টিকা ২৫০৪। সিনাই পর্বতের যে পার্শ্ব সৌদী আরবের দিকে অবস্থিত তা জাবাল মুসা নামে পরিচিত। এখানেই মুসা মিশর গমনের পূর্বে আল্লাহ্ কর্তৃক দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং মিশর থেকে ইসরাঈলীদের বহিষ্কার করে নিয়ে আসার পরে তাওরাত গ্রন্থ লাভ করেন।
২৬০২। দেখুন আয়াত [ ২ : ৫৭ ] ও টিকা ৭১ এবং [ ৭ : ১৬০ ]। "ভাল বস্তু আহার কর" - এই লাইনটি আক্ষরিক অর্থে অনুধাবন করার কোনও কারণ নাই। কারণ পরবর্তী লাইনগুলি থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, বাক্যটির অর্থ আক্ষরিক অপেক্ষা অধিক গভীর , আলংকারিক ও প্রতীক ধর্মী। আল্লাহ্ ইসরাঈলীদের সম্বোধন করে পূর্বের আয়াত বলেছেন, "তোমরা আল্লাহ্র কৃপায় রক্ষা পেয়েছ। তিনি তোমাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক হেদায়েত দান করেছেন। এর যে সুফল তা ভোগ কর, কিন্তু গর্বে ও অহংকারে সীমালংঘন করো না, সীমালংঘনকারীরা আল্লাহ্র ক্রোধের পাত্র। ভাল ভাল বস্তু আহার কর বাক্যটি এখানে রূপক অর্থে ব্যবহৃত।
২৬০৩। এই আয়াতটি থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুসাকে সর্বদা বিদ্রোহী ইসরাঈলীদের সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। কারণ আল্লাহ্ তাদের সম্বন্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। পরবর্তী আয়াতে ইসরাঈলীদের স্বর্ণের বাছুর দ্বারা এ কথার সত্যতাই প্রমাণিত হয়।
৮৩। [ যখন মুসা পর্বতে আরোহণ করেছিলেন ২৬০৪ আল্লাহ্ বলেছিলেন! ] " হে মুসা ! তোমার সম্প্রদায়কে পশ্চাতে ফেলে তোমাকে ত্বরা করতে বাধ্য করলো কি সে ?"
২৬০৪। দেখুন আয়াত [ ২ : ৫১ ] এবং টিকা ৬৬। হযরত মুসার তাওরাত আনতে তূর পাহাড়ে যাওয়ার সময়ে তাঁর পশ্চাতে ইসরাঈলী সম্প্রদায়কে হারুনের তত্বাবধানে রেখে আসেন। [ Exod xxiv. 14 ]। এ কথারই উল্লেখ এখানে করা হয়েছে। মুসা যখন আল্লাহ্ কর্তৃক সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হচ্ছিলেন, তূর পাহাড়ে , তখন তার অনুসারীরা নীচে নাটকের অন্য দৃশ্যের অভিনয় করছে। আল্লাহ্ তাদের ঈমানের পরীক্ষা করেছিলেন কিন্তু তারা সে পরীক্ষাতে কৃতকার্য হতে পারে নাই, নীচের আয়াতে দেখুন তারা স্বর্ণের বাছুর তৈরী করে পূঁজা আরম্ভ করে। আরও দেখুন আয়াত [ ৭ : ১৪৮ - ১৫০ ] এবং এর টিকা।
৮৫। [আল্লাহ্ ] বলেছিলেন, " তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি। সামিরী তো ওদের পথভ্রষ্ট করেছে।" ২৬০৫
২৬০৫। এই সামিরী কে ছিলো ? যদি এই নামটি ব্যক্তিগত হয় , তবে তা মূল শব্দের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। "সামিরীর" মূল শব্দটি কি ছিলো ? মিশরের ইতিহাস বলে যে, সেমের [ Shemer ] নামে এক আগন্তুক ছিলো, [ Sir E. A Wallis Budges Egyptian Hieroglyghtic Dictionary 1920, P. 815b ]। ইসরাঈলীরা যখন মিশর ত্যাগ করে সে তখন তাদের সাথে ছিলো সম্ভবতঃ সে একজন ইহুদীই ছিলো যার ডাক নাম ছিলো সামিরী। পরবর্তীতে তাওরাতে [ Shemer ] নামটির উল্লেখ খুব অপরিচিত ছিলো না। তাওরাতে [ I King xvi . 21 ] উল্লেখ আছে যে ইসরাঈলীদের রাজা Omri যিনি ৯০৩ - ৮৯৬ খৃষ্টপূর্বে রাজত্ব করেন। তিনি পাহাড়ের চূড়াতে Samaria নামে এক শহরের স্থাপন করেন, যে স্থানটি তিনি Shemer নামে এক ব্যক্তির নিকট থেকে ক্রয় করেন। দেখুন [ Renan এর রচিত History of Isrel , ii 210 ]।
২৬০৬। এই আয়াতে দুইটি প্রতিশ্রুতি উল্লেখ আছে। একটি প্রতিশ্রুতি হচ্ছে , আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি। অন্যটি ইসরাঈলীদের প্রতিশ্রুতি। আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতির উল্লেখ আছে আয়াতে [ ২০ : ৮০ ] এবং ইসরাঈলীদের প্রতিশ্রুতির উল্লেখ আছে [ ২ : ৬৩ ] আয়াতে এবং ব্যাখ্যা আছে টিকা নং ৭৮। আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি ছিলো ইসরাঈলীদের রক্ষা করা এবং প্রতিশ্রুত দেশে পৌঁছানো এবং ইসরাঈলীদের প্রতিশ্রুতি ছিলো আল্লাহ্র আইন বা প্রত্যাদেশকে মেনে চলার।
২৬০৭। দেখুন [ Exod . xii 35 – 36 ] বণী ইসরাঈলীরা ঈদের বাহানায় মিশরবাসীদের কাছ থেকে অলংকার ধার করেছিলো এবং সেগুলো তাদের সাথে ছিলো। তাওরাতের বর্ণনা অনুযায়ী "Jewels of silver and jewels of gold and raiment and they spoiled the Egyptian" অলংকারগুলো তাদের ফেরত দেয়া কর্তব্য ছিলো। কিন্তু তা না দিয়ে তারা অন্যভাবে তা চিত্রিত করার প্রয়াস পায়। সত্য পথ পরিত্যাগকারী ও কুটিল ইহুদীদের বক্তব্য এখানে অনুধাবনযোগ্য ১) সামিরী তাদের সোনার গোবৎস তৈরীর জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলো সত্য, কিন্তু, তাই বলে তাদের নিজস্ব দায় দায়িত্ব তা থেকে কমে যায় না। প্রত্যেকের কৃত পাপের বোঝা স্ব স্ব ব্যক্তিকে বহন করতে হবে। কৃত পাপকে পরিহার করার ক্ষমতা তার ছিলো না , এ কথা অজুহাত ব্যতীত আর কিছু নয়। সে যতই ভান করুক যে পাপকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার ছিলো না, কিন্তু তা সত্য নয়। ২) যদি সমস্ত স্বর্ণালঙ্কার একজন বা দুজন বহন করে তবে তা ভারী হবে সত্য, কিন্তু তা যদি সমগ্র ইসরাঈলীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়, তবে তার ওজন হবে খুবই নগণ্য। সুতারাং অলংকারের ভারের কথা বলা অজুহাত বই আর কিছু নয়। ৩) সোনা মূল্যবান বস্তু। যদি সত্যিই তারা এই মূল্যবান বস্তুর ভার বহনে অপারগ হয়, তবে তার জন্য সোনাকে আগুনে ফেলার প্রয়োজন হয় না , কারণ আগুন সোনাকে ধ্বংস করে না। শুধুমাত্র গলিয়ে ফেলতে পারে। সুতারাং সোনার বোঝাকে হালকা করার কথা ছিলো শুধুমাত্র একটা অজুহাত।
উপদেশ : দুষ্ট লোকেরা সর্বদা অজুহাত প্রদর্শনে অত্যন্ত দক্ষ।
২৬০৮। সামিরীর সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে টিকা ২৬০৫ এ। যদি মূল শব্দটিকে মিশরীয় না ধরে হিব্রু ধরা হয় তবে "Shemer " শব্দটির অর্থ হবে পাহারাদার, রাত্রিকালীন প্রহরী, রক্ষী। সম্ভবতঃ সেই ব্যক্তি ছিলো প্রহরী বা তার নাম হতে পারে সামিরী।
২৬০৯। দেখুন আয়াত [ ৭ : ১৪৮ ] ও টিকা ১১১৩।
২৬১০। দেখুন আয়াত [ ৭ : ১৪৮ ] ও টিকা ১১১৪।
২৬১১। " কিন্তু মুসা তা ভুলে গেছে।" - অর্থাৎ মুসা ইসরাঈলীদের কথা এবং তাঁর উপাস্য গোবৎসের কথা ভুলে গেছে। কারণ মুসা বহুদিন হলো ইসরাঈলীদের ত্যাগ করে তূর পর্বতে গেছেন। সেখানে মুসা মিথ্যাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন উপাস্যের সন্ধানে। তার সত্যিকারের উপাস্য আছে এখানে সোনার তৈরী গোবৎস। এরূপই একটি ভাষণ দিয়েছিলো সামিরী ও তার অনুসারীরা। কিন্তু তাদের এই প্ররোচনাকে কেউ-ই বাধা দেয় নাই। ইসরাঈলীরা সামগ্রিকভাবে সামিরীর এই বক্তব্যকে গ্রহণ করে। সুতারাং সে হিসেবে বলা চলে যে বক্তব্যটি সমগ্র ইসরাঈলীদের ছিলো।
২৬১২। সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে এই আয়াতে মন্তব্য করা হয়েছে। ইসরাঈলীরা সর্বশক্তিমান অল্লাহ্র বিভিন্ন ক্ষমতার সাক্ষী, তবুও তারা সেই সর্বশক্তিমানের এবাদত ত্যাগ করে মূর্তি পূঁজাতে অধিক আগ্রহী। আল্লাহ্ তাদের নির্দ্দিষ্ট আদেশ দান করেছেন। ইহুদীরা সেই আদেশকে অমান্য করে গোবৎসের হাম্বা রবের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়। এ কথা তাদের চিন্তায় আসে নাই যে গোবৎসের হাম্বা রব হয়তো পূঁজারীর প্রতারণা - যা অহরহই ঘটে থাকে। গো বৎসের এই মূর্তি ভালো বা মন্দ করার কোনও ক্ষমতাই রাখে না। আল্লাহ্ হচ্ছেন সমস্ত বিশ্বভূবনের পালনকর্তা , রক্ষাকর্তা। যার দয়া ও করুণা অপরসীম, যার ক্রোধ ভয়াবহ।
২৬১৩। দীর্ঘদিন মিশরে থাকার ফলে ইসরাঈলীরা মিশরের ভাবধারাতে প্রভাবিত ছিলো। আল্লাহ্র প্রচন্ড ক্ষমতা দর্শনের পরেও তারা সে প্রভাব মুক্ত হতে পারে নাই। তাদের আল্লাহ্ সামিরীর দ্বারা মিশরের মূর্তি পূঁজার দিকে প্রলোভিত করেন। তারা যেনো সামিরীর প্রভাব মুক্ত হয়ে শুধু মাত্র এক আল্লাহ্র উপাসনা করে। এ ছিলো আল্লাহ্র তরফ থেকে এক পরীক্ষা।
২৬১৪। বাইবেলে হারুনকে প্রধান অপরাধী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যাকে আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত মুসার সাহায্যকারী রূপে কোরাণে বর্ণিত। হারুনের দায়িত্বের বিপরীত ভাবধারাকে প্রকাশ করে [ দেখুন ৭ : ১৫০ ও টিকা ১১১৬ ]। অপর পক্ষে কোরাণের বক্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ হারুনকে হযরত মুসার সাহায্যকারী রূপে আল্লাহ্ মনোনীত করেছেন।। তাঁর পক্ষে সামিরীর তৈরী গোবৎসের পূঁজাতে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। মিশরবাসীর ষাড় দেবতা Osiris এর অনুকরণে সামিরী সোনার গোবৎসকে তৈরী করে যেনো ইসরাঈলীরা মিশরবাসীদের প্রভাবমুক্ত হতে না পারে।
২৬১৫। আয়াত [ ২০ : ৯০ ] ছিলো হারুনের আবেদন ইসরাঈলীদের প্রতি এবং [ ২০ : ৯১ ] আয়াত ছিলো ইসরাঈলীদের বিরোধিতাপূর্ণ প্রতিউত্তর। অবশ্য এ দুটো আয়াতের বক্তব্য ছিলো মুসার তূর পর্বত থেকে তাওরাত সহযোগে ফিরে আসার পূর্বে।
২৬১৬। বিদ্রোহী ইসরাঈলীদের বিশ্বাসের ভিত্তি এত ভঙ্গুর ছিলো যে, তাদের ধারণা হয়েছিলো যে, হযরত মুসা আর ফিরে আসবে না।
৯৩। "আমার অনুসরণ করা থেকে ? তবে কি তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে ? "২৬১৭
২৬১৭। হযরত মুসা ফিরে এসে ইসরাঈলীদের অবস্থা দর্শনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর অন্তর দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। তিনি তাঁর ভাই হারুনকে র্ভৎসনা এবং দুর্ব্যবহার করেছিলেন , যার বর্ণনা পাওয়া যায় পরবর্তী আয়াতে। তূর পর্বতের গমনের পূর্বে হারুনকে দেয়া নির্দেশ সমূহ আছে আয়াত [ ৭ : ১৪২ ] ;
২৬১৮। দেখুন [ ৭ : ১৫০ ]।
২৬১৯। এই আয়াতের হারুনের বক্তব্য ও সূরা [ ৭ : ১৫০ ] এর হারুনের বক্তব্য একই। দুটো বক্তব্যের মধ্যে অসংলগ্ন কিছু নাই। তবে এই দুই ক্ষেত্রেই বক্তব্যের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রসঙ্গের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সূরা - ৭ ইসরাঈলী উম্মতের উপরে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে হারুনের বক্তব্য ছিলো " সাধারণ লোকেরা ...............................।
এই উক্তি দ্বারা হারুন তাঁর ভাই মুসার ঐকান্তিক ইচ্ছার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন মাত্র। মুসার ইচ্ছার নিহিতার্থ ছিলো উম্মতের " বিশ্বাসের" একতা। এই আয়াতের মূল বক্তব্যে সেই " ইচ্ছারই " প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। মূল বক্তব্যে ইসরাঈলী উম্মতের একতার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সামিরীকে অপরাধ সংঘটক রূপে চিত্রিত করা হয়েছে, যে ইসরাঈলী সম্প্রদায়ের মাঝে বিভেদের বীজ বপন করেছিলো।
২৬২০। এবারে মুসা হারুনকে ত্যাগ করে সামিরীর দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলেন। মুসার প্রশ্নের উত্তরে সামিরী বক্তব্যের উত্থাপন করেছিলো যার মাধ্যমে তার চরিত্রের বিশেষ দিক উন্মোচিত হয়। সম্পূর্ণ ঘটনার যে চিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে তা প্রতীকধর্মী। যাদের ঈমানের ভিত্তি মজবুত নয় তারা অনুকূল পরিবেশে সত্যে বিশ্বাসী এবং আল্লাহ্র অনুগত থাকে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে বা সুযোগ পেলেই তারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচারণ করতে দ্বিধা বোধ করে না । এ সব লোক ফেরাউনের মত অহংকারী উদ্ধত ব্যক্তির থেকে কোন অংশে কম নয়। এরা ফেরাউনের মতই নেতা হিসেবে জাতিকে দুর্ভোগ ও দুর্যোগের পথে পরিচালিত করে।
২৬২১। হযরত মুসার প্রশ্নের জবাবে সামিরী যে উত্তর দান করে তা ছিলো, মিথ্যা ওজর দ্বারা সত্যকে এড়ানোর এক ধৃষ্টতাপূর্ণ নির্লজ্জ্ব অপচেষ্টা মাত্র। সে এমন এক ভানের আশ্রয় গ্রহণ করলো যাতে মনে হতে পারে সে সাধারণ অশিক্ষিত জনসাধারণের থেকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী। সে যা প্রত্যক্ষ করতে পারে, সাধারণ অশিক্ষিত জনসাধারণ তা পারে নাই। সে দাবী করে যে সে এক অলৌকিক দৃশ্য অবলোকন করেছে। সে দেবদূতের অবতরণ প্রত্যক্ষ করেছে, যা সাধারণ লোক করে নাই। " রাসুল " [ রসুলের বহুবচন শব্দটি এখানে দেবদূতের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে যা এক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে [ ১১: ৬৯, ৭৭ ] এবং [ ৩৫ : ১ ] আয়াতে। এখানে " রাসুল " শব্দটি দ্বারা জিবরাঈলকে বোঝানো হয়েছে। যদি এখানে রাসুল শব্দটি দ্বারা আল্লাহ্র দূত হিসেবে হযরত মুসাকে উল্লেখ করা হয়, তবে এর অর্থ দাঁড়াবে সামিরী হযরত মুসার পদচিহ্নে অলৌকিক রহস্যের সন্ধান পান। সে কারণেই সে তাঁর পদচিহ্নের ধূলি ব্যবহার করে। হতে পারে তা ধূর্ত সামিরীর এক কূট কৌশল মাত্র। সম্ভবতঃ সে মনে করেছিলো যে, তোষামোদ দ্বারা সে মুসার মন আর্দ্র করতে পারবে ও ক্ষমা লাভ করবে। মুসার পবিত্র পদচিহ্নের ধূলিও পবিত্র , তাই সোনার গোবৎস নিম্নস্বরে হাম্বা রব করে। সে এ ভাবেই বক্তব্যের উপস্থাপন করেছে যেনো দূতদের বা মুসার পদচিহ্নের ধূলার অলৌকিক ক্ষমতাই আসল বস্তু। মূল অভিযোগ যে আল্লাহ্ ব্যতীত সোনার গোবৎসের পূঁজা , তা সে কৌশলে এড়িয়ে যায়। মূল অভিযোগের সে কোনও উত্তরই দেয় নাই। তবে শেষ পর্যন্ত সে ধৃষ্টতার সাথে উত্তর দান করে যে, " এ ভাবেই আমার আত্মা আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলো।"
২৬২২। হযরত মুসা সামিরীর জন্য পার্থিব জীবনে এই শাস্তি ধার্য করেন যে, সবাই তাকে বর্জন করবে এবং কেউ তার কাছে ঘেষবে না। তিনি তাকেও নির্দ্দেশ দেন যে, কারও গায়ে হাত লাগাবে না। সম্ভবতঃ এই শাস্তিটি একটি আইনের আকারে ছিলো।
২৬২৩। "উপরন্তু [ভবিষ্যতের শাস্তির] জন্য অঙ্গীকার রইল যার ব্যত্যয় হবে না।" অর্থাৎ নির্দ্দিষ্ট সময় অন্তে আল্লাহ্র শাস্তির ব্যতিক্রম ঘটবে না।
২৬২৪। এ ভাবেই সোনার গোবৎসকে ধবংস করা হয়। এখানেই সামিরীর কাহিনীর শেষ হয় এবং এই কাহিনীর উপদেশ পূর্ব টিকা ২৬২০ তে উল্লেখ করা হয়েছে।
৯৯। এভাবেই পূর্বে যা ঘটেছে তার কাহিনী তোমার নিকট বর্ণনা করি। আমার নিকট থেকে তোমাকে প্রেরণ করেছি উপদেশ ২৬২৫।
২৬২৫। এ ভাবেই পূর্ববর্তী আদেশসমূহ রহিত করা হয়েছে, উপদেশ [ কোরাণ ] দ্বারা। কারণ কোরাণ সরাসরি আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রাপ্ত, এখানে অন্য কারও কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয় নাই।
১০১। তারা এই [ অবস্থায় ] স্থায়ী হবে। সেদিন এই বোঝা হবে কষ্টকর , ২৬২৬
২৬২৬। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৩১ ] যেখানে এই " বোঝার " উল্লেখ আছে। মানুষ পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনে এতটাই নিমগ্ন হয়ে যায় যে, পৃথিবীর লোভ-লালসা ভরা ক্ষণস্থায়ী জীবনটাকেই সে শ্বাশত সত্য বলে বিশ্বাস করে। মিথ্যা ও পাপের চাকচিক্য তাকে বিমোহিত করে ফেলে। ফলে পরকালের অনন্ত শ্বাশত জীবনকে সে ইহাকালে অনুভব করতে পারে না। তার সমস্ত সত্তা শুধুমাত্র এই পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। শেষ বিচারের দিনে এ সব লোকদের চেতনাতে , অনুভবে পরকালের জীবন ভাস্বর হবে। নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি হবে তারা। পৃথিবীর জীবন ছিলো তাদের জন্য মধুর। অপরকে ঠকানো, শুধুমাত্র জাগতিক সুখের অন্বেষণ করা , বিদ্বেষ - ঘৃণা , হিংসা ইত্যাদিই ছিলো সেই জীবনের একমাত্র বিষয়বস্তু। এ সব লোকেরা পার্থিব জীবনে কোনও দিনই আল্লাহ্কে খুশী করার জন্য সৎ কাজের অন্বেষণ করে নাই, আজ বিচারের ময়দানে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হবে - তারা জেগে দেখবে তাদের অসৎ কর্মকান্ড তাদের উপরে বোঝার ন্যায় চেপে বসে আছে। সেই " বোঝা " থেকে কিছুতেই তারা নিজেদের মুক্ত করতে পারছে ন।
২৬২৭। "Zurq" শব্দের অর্থ নীলচক্ষু বিশিষ্ট। অর্থাৎ চক্ষুর স্বাভাবিক যে রং তা না হওয়া। এটা একটি আরবী বাগধারা , যার অর্থ ভয়ে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়া।
২৬২৮। পরকালে শেষ বিচারের দিনে এ সব পাপীদের চৈতন্যদয় ঘটবে যে , পৃথিবীর জীবন শেষ ,এবং তারা পরকালের অনন্ত জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। অনন্ত জীবনের ধারণা তাদের আতংকগ্রস্থ করে তুলবে। অনন্ত জীবনের তুলনায় পৃথিবীর জীবনকে তাদের কাছে মনে হবে অকিঞ্চিৎকর, যেনো কয়েকটি দিনের সমষ্টি মাত্র। " দশ দিন " বাক্যটি একটি বাগ্ধারা বিশেষ , যার দ্বারা খুব সামান্য কয়েকটি দিনকে বোঝানো হয়েছে।
২৬২৯। "সর্বাপেক্ষা উন্নত চরিত্রের " ভিন্নমতে ইহার অর্থ ইহাদের মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তায় অপেক্ষাকৃত উন্নত। এরাই প্রকৃত অবস্থা খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারবে।
২৬৩০। পূর্বের আয়াতে সময়ের প্রতারণামূলক ধারণা সম্পর্কে এবং সময় যে আপেক্ষিক সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে। অর্থাৎ সময় সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা, তা হচ্ছে দিন ও রাত্রির ধারণা থেকে সৃষ্টি। কিন্তু যদি সুদীর্ঘ দিন ও সুদীর্ঘ রাত্রি হতো, বা শুধু দিন বা শুধু রাত্রি চলতো তবে সময়ের হিসেবের ধারণা অন্যরকম হতে বাধ্য। সে কারণে মহাশূন্যে গমনকারী নভোচারীরা সময়ের হিসেব পৃথিবীর সাথে তুলনা করে হিসেব করেন, কারণ সেখানে সুনির্দ্দিষ্ট দিন বা রাত্রি নাই। এই সত্যকেই পূর্বের আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতে চতুর্দ্দিকের বিস্তৃতি বা প্রসার দৃঢ়তা, আকার, আয়তন এর উপরে আলোকপাত করা হয়েছে। উপমা হিসেবে পর্বতের কথা বলা হয়েছে। রসুলকে [ সা ] প্রশ্ন করা হয়েছিলো, " পর্বতসমূহের কি হবে ? " পর্বত অনন্তকাল থেকে পৃথিবীতে দাড়িয়ে আছে। পর্বত অনন্তকালের সাক্ষ্য। এই পৃথিবীর সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী। সে ভাবে বিবেচনা করলে পর্বতকে মনে করা যায় অনন্ত কালের সাক্ষী। অবিশ্বাসীরা নূতন পৃথিবী সৃষ্টি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে [ দেখুন আয়াত ১৩ : ৫ ]। কিন্তু হাশরের দিনে যখন পৃথিবীকে নূতনভাবে সৃষ্টি করা হবে, তখন স্থায়ী , দৃঢ়, উন্নত পর্বতের চিহ্ন মাত্র থাকবে না। তা হবে এক নূতন পৃথিবী। আমরা শেষ বিচারের সভার দৃশ্যটি কল্পনা করতে পারি এ ভাবে। বিরাট , বিশাল, আদিগন্ত বিস্তৃত সমভূমি যার কোথাও উচুঁ বা নীচু নাই। দিগন্ত বিস্তৃত এই সমভূমিতে কোথাও লুকানোর কোনও স্থান থাকবে না। যত দূরে চোখ যায়, দৃষ্টি চলে যাবে বাধা বন্ধন হীন ভাবে। হাশরের মাঠে কারও কোনও রহস্য লুকানো থাকবে না।
২৬৩১। "Nasafa" শব্দটির ভাবার্থ হচ্ছে ১) শিকড়সহ উপরানো। ২) ধূলিতে চুর্ণবিচূর্ণ করা এবং ৩) তুষের ন্যায় উড়ানো।
১০৭। কোন বক্রতা বা উচ্চতা দেখতে পাবে না।
১০৮। সেদিন তারা আহ্বানকারীকে [ সোজা ] অনুসরণ করবে ২৬৩২। কোন বক্রতাই তার মাঝে থাকবে না। পরম করুণাময় [আল্লাহ্র ] সম্মুখে সকল শব্দ বিনম্র হয়ে যাবে ২৬৩৩। সুতারাং মৃদু পদধ্বনি ব্যতীত তুমি কিছুই শুনবে না।
২৬৩২। " আহ্বানকারী" অর্থাৎ ফেরেশতারা আহ্বান করবে এবং সকল আত্মাকে তাদের অনুসরণ করতে হবে।
২৬৩৩। এই আয়াতগুলির মাধ্যমে হাশরের ময়দানের এক অনবদ্য দৃশ্যকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমে শিঙ্গা ফুৎকারের এক বিরাট বিস্ফোরণের শব্দ , তারপর মৃদু ডাক শোনা যাবে " জাগো"। নিঃশব্দতা সমগ্র বিশ্বচরাচরকে গ্রাস করবে। শুধুমাত্র অনুসরণকারীদের মৃদু পদশব্দ ব্যতীত আর কিছুই শ্রুতিগোচর হবে না।
২৬৩৪। অনুরূপ লাইন আছে, " আয়াতাল কুরশী " আয়াতে [ ২ : ২৫৫ ] যাদের আল্লাহ্ অনুমতি দেবেন তারা ব্যতীত আর কারও মধ্যস্ততা সেদিন কারও উপকারে আসবে না। সেই দিন তারাই আল্লাহ্র অনুগ্রহের যোগ্য হবে যারা আন্তরিক ভাবে অনুতপ্ত ছিলো অথবা আল্লাহ্ যাদের অনুমতি দেবেন তারা ব্যতীত আর কারও মধ্যস্ততা গ্রহণ করা হবে না।
২৬৩৫। একই রকম ধারা বর্ণনা আছে আয়াতাল কুরশী আয়াতে। দেখুন [ ২ : ২২৫ ] এবং টিকা ২৯৭। পার্থক্য হচ্ছে এই আয়াতে শেষ বিচারের দিনকে উপলক্ষ্য করে উপরের লাইনটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং আয়াতাল কুরশী আয়াতের বক্তব্য সার্বজনীন - সময়, যুগ ও কাল অতিক্রান্ত। বর্তমান পৃথিবীর জন্য প্রযোজ্য ও পরকালে বিচারের দিনের জন্যও প্রযোজ্য।
২৬৩৬। " অন্যায়ের বোঝা" বা " পাপের বোঝা " বা অন্যায় কাজের ফলাফল। শেষ বিচারে দিনে জুলুমকারী বা অন্যায়কারী তার পাপের বোঝা তার পিঠে বহন করবে। দেখুন [ ২০ : ১০০ - ১০১ ] এবং [ ৬ : ৩১ ] যেখানে এই বোঝার উল্লেখ আছে। সেদিন পাপী ও পূণ্যবান সকলেই বিনয়ের সাথে ভয়ের সাথে আল্লাহ্র দরবারে " অধোবদন" ভাবে উপস্থিত হবে। পৃথিবীর জীবন - পঙ্কিলময় জীবন। পূন্যাত্মারাও সম্পূর্ণ নিষ্পাপ এ দাবী করতে পারেন না। কারণ পৃথিবীতে পাপের ফাঁদ ঘাটে ঘাটে পাতা। শেষ বিচারের দিনে একমাত্র আল্লাহ্র করুণাই তাঁদের ভরসা।তাঁর দয়াই শেষ এবং একমাত্র ভরসাস্থল। মৃত্যুর দুয়ার অতিক্রমের ফলে সেদিন সকলের চোখের সামনে বাস্তব সত্য প্রতিভাত হবে, জাগতিক সব মিথ্যা মূল্যবোধ ও ধ্যান ধারণার অবসান ঘটবে, প্রকৃত সত্যর অনুধাবন ঘটবে। সেদিন যারা পাপের বোঝা বহন করে আল্লাহ্র দরবারে হাজির হবে, তারা প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনের ফলে, হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
২৬৩৭। তুলনা করুন পূর্বের টিকার সাথে, যেখানে অন্যায়কারী বা জুলুমবাজের কথা বলা হয়েছে। এই আয়াতে পূণ্যাত্মাদের কথা বলা হয়েছে, যারা তাদের "বিশ্বাসের" বা ঈমানের মজবুত ভিত্তির উপরে পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরলোকে আল্লাহ্র দরবারে এসব লোকেরা নিজেদের বিশ্বাস বা ঈমানকে ন্যায়সঙ্গতরূপে প্রত্যক্ষ করবে। এই আয়াতে আল্লাহ্ এসব বিশ্বাসী লোকদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, তাদের কোন ভয় নাই , কোনও ক্ষতিও তাদের ঘটবে না। তাদের কর্মের পূর্ণ পুরষ্কার তাদের দেয়া হবে। তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না। শুধু তাই নয় আয়াত [ ৩ : ২৭ ] এবং যা প্রাপ্য পুরষ্কার হিসেবে তার থেকেও বেশী তাদের দান করা হবে।
২৬৩৮। কোরাণ আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, আরবভাষী অজ্ঞ লোকেরাও যেনো এই ঐশী গ্রন্থের মূল বক্তব্যকে অনুধাবন করতে পারে, এবং বাণীকে অনুধাবনের মাধ্যমে ও প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তার প্রতিফলনের দ্বারা সে সর্তক হতে পারে, উপকৃত হতে পারে। কোরাণকে আল্লাহ্ রসুলের [সা] অন্তরে ওহী বা অনুপ্রেরণার [ Inspiration] মাধ্যমে প্রেরণ করেন যা রসুলের [ সা ] মাতৃভাষা আরবীতে প্রকাশ পায়। এ যেনো এক প্রদীপ্ত প্রদীপ অগ্নি শিখা, যার আলো মূল আঁধার থেকে চর্তুদ্দিকে বিচ্ছুরিত হয়। আরব থেকে ইসলামের প্রচার শুরু হয় যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীকে আলোকিত করতে সক্ষম হবে। ইসলামের প্রচারের প্রথম কয়েক শতাব্দীতে এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে। যদি আমরা কোরাণের দীপ্তিকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পারি, তবে এ বিশ্বসভায় এ কথার সত্যতা আবার প্রমাণ হতে বাধ্য। পাপীদের জন্য এতে আছে সর্তকবাণী যেনো তারা অনুতাপের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করে। পূণ্যাত্মাদের জন্য কোরাণ হচ্ছে বিশ্বাসের অঙ্গীকার যা আল্লাহ্র স্মরণ দ্বারা শক্তি লাভ করে ও শান্তি পায়।
উপদেশ : কোরাণকে বুঝে পড়তে হবে , সেই জন্য আরবীর সাথে সাথে কোরাণের অনুবাদ ও তফসীর পাঠের প্রয়োজন।
২৬৩৯। পার্থিব সকল ঘটনা ও মানুষের সকল ইচ্ছা বা আশা-আকাঙ্খার উর্দ্ধে আল্লাহর অবস্থান। পার্থিব সকল কিছুকেই পরিবেষ্টন করে থাকে সর্বশক্তিমানের ইচ্ছা। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই তাঁর ইচ্ছার প্রকাশ মাত্র। সারা বিশ্ব ভূবন একই উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত, তিনি আদি ও অন্ত। আল্লাহ্ -ই হচ্ছেন একমাত্র সত্য , ধ্রুব সত্য, সম্পূর্ণ সত্য। বিশ্ব ভূবনে তাঁর আইন বা শাসন হচ্ছে সত্যের প্রকাশ মাত্র। তাঁর আইনের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে যা পৃথিবীর জন্য ধ্রুব সত্য। পৃথিবীতে এই সত্যের প্রকাশ ঘটে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। কোরাণকেও সেই ভাবে আল্লাহ্ রসুলের [সা] অন্তরে ধীরে ধীরে ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। ধীরে ধীরে , ধাপে ধাপে এই জন্য যে, প্রতিটি ধাপ পরিপূর্ণতা লাভের পরে পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হওয়ার জন্য। এই আয়াতে " হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর, " এই বাক্যটি দ্বারা এ বার্তার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোরানের সম্পূর্ণ জ্ঞানকে একবারে কেউ অনুধাবনে সক্ষম নয়। এর জ্ঞান ধীরে ধীরে প্রতিদিনের চেষ্টায় ধাপে ধাপে ব্যক্তির অন্তরে বিকাশ লাভ করে পরিষ্ফুট হয়। কোরাণের জ্ঞান হচ্ছে সত্যের আলো, বিবেকের বিকাশ - হতে পারে তা ব্যক্তির জীবনে বা জাতির জীবনে। বিবেকের বিকাশই হচ্ছে সত্যের জ্ঞানকে আত্মার মাঝে ধারণের নিদর্শন। বিবেকবান ব্যক্তি অবশ্যই সত্য জ্ঞানকে নিজের অন্তরে ধারণ করার ক্ষমতা লাভ করেছেন। এ ক্ষমতা ধীরে ধীরে অর্জিত হয়। একটি জাতিও সত্য জ্ঞানের দ্বারা বিবেকবান জাতিরূপে পৃথিবীতে স্বীকৃতি লাভ করে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের বলছেন যে, রসুলের [ সা ] মাঝে সত্যকে যেরূপ ধীরে ধীরে প্রকাশ করা হয়েছে, সকল মানুষই সেরূপ কোরানের জ্ঞানকে ধীরে ধীরে ধৈর্য্য , প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজের আত্মার মাঝে ধারণ করতে সক্ষম হবে। এ ব্যাপারে অধৈর্য্য হওয়ার কোনও কারণ নাই। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমাদের একাগ্র চিত্তে আন্তরিক ভাবে মহান আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা করতে হবে আমাদের জ্ঞানকে বৃদ্ধি সাধন করার জন্য। যে জ্ঞানের সমুদ্রের কোন শেষ নাই সীমা নাই। যা অসীম।
২৬৪০। আমাদের পূর্বেও আধ্যাত্মিক জগতে পতনের ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে ফেরাউন ও সামিরীর উল্লেখ করা হয়েছে। ফেরাউনের আধ্যাত্মিক পতন ঘটেছিলো দাম্ভিকতা ও উদ্ধতপনার জন্য। সামিরীর পতন ঘটে তার দুষ্ট প্রকৃতির জন্য যে প্রকৃতি সকলের ক্ষতির চেষ্টা চালাতো। এই আয়াতে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে অশুভ শক্তির প্রতীক শয়তানের দিকে, যার দ্বারা হযরত আদম প্রলোভিত এবং প্রতারিত হন। এই আয়াতে হযরত আদমের উদাহরণের মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। হযরত আদমকে শয়তান সম্বন্ধে সাবধান করা সত্বেও তিনি শয়তানের প্রলোভনের ফাঁদে পা রাখেন। ঠিক সেই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় সমগ্র মানব জাতির মধ্যে। মানুষ জানে " লোভে পাপ , পাপে মৃত্যু " - শয়তান মানুষকে লোভের ফাঁদে ফেলে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। শয়তানের এই অশুভ শক্তি সম্বন্ধে মানবকূলকে সাবধান করা সত্ত্বেও মানুষ খুব কমই শয়তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। প্রথম সুযোগেই তারা শয়তানের শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করে - ঠিক যেভাবে আমাদের আদি পিতা হযরত আদম করেছিলেন। সাধারণ মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা " সংকল্পে দৃঢ় নয়।"
১১৭। অতঃপর আমি বললাম, " হে আদম ! অবশ্যই সে তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু। সুতারাং তোমাদের জান্নাত থেকে বের করে দিতে তাকে [ প্রশয় ] দিও না। তাহলে তোমরা দুঃখ কষ্টের মাঝে নিপতিত হবে ২৬৪১।
২৬৪১। উপরের টিকাতে দ্রষ্টব্য। হযরত আদমের কাহিনীর মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতার প্রতি। সাধারণ মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে খুব সহজেই শয়তানের খপ্পরে নিজেকে সমর্পন করে। যদিও তাঁকে পূর্বে সাবধান করা হয়ে থাকে কিন্তু লোভ-লালসার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তাকে সঠিক পথে চলতে বাঁধার সৃষ্টি করে। সে শয়তানের নিকট আত্মসমর্পন করে।
১১৯। " সেখানে তৃষ্ণার্ত হবে না বা রৌদ্র ক্লিষ্টও হবে না। "
উপদেশ : লোভ মানুষকে ধ্বংস করে।
২৬৪৩। হযরত আদমের কাছে শয়তানের প্রতারণামূলক প্রস্তাব ছিলো সুক্ষ কৌশলে ভরা। সচারচর যেমনটি হয়ে থাকে। যদিও শয়তানের কুমন্ত্রণা ছিলো মিথ্যার বেসাতি কিন্তু আপাতঃদৃষ্টিতে তা ছিলো ন্যায়সঙ্গত ও লোভনীয়। মিথ্যা এই কারণে যে ১) শয়তানের কুমন্ত্রণায় হযরত আদম বিভ্রান্ত হন যে বেহেশতের বাগানের সুখ শান্তি চিরস্থায়ী নয় তা ক্ষণস্থায়ী, পৃথিবীর জীবনের ন্যায়। সুতারাং হযরত আদম অনন্ত সুখের ঠিকানার লোভে শয়তানের ফাঁদে পা দেন। ২) তাদের অক্ষয় রাজ্যপাটের প্রলোভন দেখানো হলো , রাজ্যপাট অর্থাৎ অসীম ক্ষমতা। শয়তান আদমকে দুটো জিনিষের লোভ দেখিয়েছিলো প্রথমতঃ অনন্ত অসীম সুখের জীবন ও দ্বিতীয়তঃ অসীম ক্ষমতা। সৃষ্টির সেই আদি থেকে অদ্যাবধি মানুষ জাগতিক সুখ ও ক্ষমতার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এ দুটো তার জীবনে স্থায়ী সুখের পরিবর্তে দুঃখের পরিমাণ বাড়ায়। বিপথে চালনার জন্য এটা শয়তানের এক ধরনের টোপ বৈকি, কারণ ১) আদমকে আল্লাহ্ অনন্ত সুখের জীবনের কথা কিছুই বলেন নাই। কারণ তারা অনন্ত জীবন সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না, তবুও তারা লোভের ফাঁদে পা দেন। ২) খ্যাতির আকাঙ্খা ও অন্যের প্রতি আধিপত্যের মনোভাব থেকে ক্ষমতার মোহ জন্মায়। এই মোহের মনোমুগ্ধকর আকর্ষণ ব্যক্তিকে ক্ষমতার জন্য বিপথে চালিত করতে প্রয়াস পায়।
উপদেশ : সৃষ্টির সেই আদি থেকে অদ্যাবধি মানুষ শয়তানের সৃষ্ট এই দ্বিবিধ ফাঁদে ধরা পড়ে নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনে।
২৬৪৪। " তারা উভয়েই বৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করলো " - অর্থাৎ গাছের ফল ভক্ষণ করলেন। এই ফল ভক্ষণের পূর্বে তাদের পাপ কাজ সম্বন্ধে কোনরূপ ধারণাই ছিলো না। তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ। এখন আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার অপরাধ তাদের আত্মাকে গ্রাস করে ফেললো। তাঁদের আত্মা কলঙ্কিত হয়ে গেলো। " নগ্নতা প্রকাশ পেল " অর্থাৎ তাঁদের পোষাক ছিন্নভিন্ন হয় গেলো এবং নগ্নতা প্রকাশ পেলো। আক্ষরিক অর্থে তাদের আদিম রীপু যৌনতার প্রকাশ ঘটে যা এতদিন তাদের নিকট অজ্ঞাত ছিলো।
"নগ্নতা প্রকাশ পেল " বাক্যটি যদি আলঙ্কারিক বা উপমার্থে ব্যবহার করি তবে এর অর্থ দাঁড়াবে আল্লাহ্র হুকুম অস্বীকার করার ফলে তাদের পূণ্যের আবরণ বা পোষাক ছিড়ে যায় বা বেহেশতের পোষাক ছিনিয়ে নেয়া হয়। আত্মা অপবিত্র হয়ে পড়ে এবং অপবিত্র আত্মার বিভৎস রূপ বা পাপের বিভিন্ন রূপ তাদের সামনে উলঙ্গভাবে প্রকাশ লাভ করে। তারা বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজেদের আবৃত করতে লাগল। আক্ষরিক অর্থে এখানে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাকেই বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ সর্বদা নিজের পাপের কাজকে সর্ব সমক্ষে প্রকাশ না করে গোপন রাখতে ব্যস্ত থাকে। হযরত আদমও সেই চেষ্টাই করেছিলেন।
২৬৪৫। হযরত আদম আমাদের আদি পিতা। আল্লাহ্ তাকে " সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দান করেছিলেন ভালোকে গ্রহণ করা ও মন্দকে বর্জন করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর ছিলো। কিন্তু তিনি তার এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করেন। এই অপব্যবহারের ফলে তিনি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতেন, যদি না আল্লাহ্র রহমত তাকে উদ্ধার করতো। আল্লাহ্ তাঁর অনুতাপ গ্রহণ করেন এবং আল্লাহ্ তাঁকে বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেন। তাঁকে মনোনীত করেন। দেখুন পরের আয়াতে।
১২৩। তিনি বলেছিলেন, " তোমরা উভয়েই একই সঙ্গে জান্নাত থেকে নেমে যাও; তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু ২৬৪৬। যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট পথ নির্দ্দেশ আসে, যে আমার পথ নির্দ্দেশ অনুসরণ করবে নিশ্চয়ই সে পথ হারাবে না , বা দুঃখ কষ্ট পাবে না ২৬৪৭।
২৬৪৬। "Ihbita" উভয়ে নামিয়া যাও। এখানে উভয়ে অর্থাৎ আদম ও হাওয়া যারা আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। অনেকের মতে উভয় অর্থ আদম ও শয়তান। [ ২ : ৩৮ ] আয়াতে "Ihbitu" হচ্ছে বহুবচন যা ব্যবহার করা হয়েছে শয়তান ও মানুষ সকলের জন্য। এখানে মানুষ অর্থ সকল মনুষ্য সম্প্রদায়। কিন্তু শয়তান তো পূর্বেই বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়েছে। সুতারাং বেহেশতে শুধুমাত্র দুজনেরই থাকার অধিকার ছিলো। হযরত আদম ও বিবি হাওয়া। তাহলে এখানে আদম ও বিবি হাওয়াকে সম্বোধন করা হয়েছে। ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে : He said, "get ye down,/ Both of you all together,/ From the garden, with enmity/ One to another" একই সঙ্গে "সকলে" শব্দটি দ্বারা শয়তানকে অন্তর্গত করা হয়েছে। এবং " পরস্পরের শত্রু " বাক্যটি দ্বারা মানুষ ও শয়তানের মাঝে অনন্তকাল স্থায়ী শত্রুতাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের সুপ্রবৃত্তির ও কুপ্রবৃত্তির সংগ্রামকে বোঝানো হয়েছে।
২৬৪৭। যে আল্লাহ্র নির্দ্দেশ অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না বা পাপে আসক্ত হবে না, এবং পরিণামে হতাশা ও দুঃখ কষ্ট থেকে রক্ষা পাবে। আয়াতে [ ২ : ৩৮ ] সম্বোধন করা হয়েছে বহুবচনে, " যাহারা আমার সৎ পথের নির্দ্দেশ অনুসরণ করবে"। এই আয়াতে একবচনে, " যে আমার পথ অনুসরণ করিবে।" একবচনে সম্বোধন করা হলেও এর বক্তব্য সকলের জন্যই প্রযোজ্য।
২৬৪৮। পূর্বের আয়াত [ ২ : ৩৯ ] এ সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে , আল্লাহ্র নির্দ্দেশসমূহ অমান্য করার ফল। এই আয়াতে ব্যক্তিগত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে আল্লাহ্র নির্দ্দেশ অমান্য করার ফলাফল। " জীবন যাপন সংকুচিত " হওয়া এবং " উত্থিত করিব অন্ধ অবস্থায় " বাক্যগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। " জীবিকার সঙ্কীর্ণতার" অর্থ যে, তাদের কাছ থেকে অল্পে তুষ্টির গুণটি ছিনিয়ে নেয়া হবে। অল্পে তুষ্টি লাভ করার ক্ষমতা আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামত বান্দার জন্য। যার এই গুণ নাই সে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করার পরেও থাকবে অতৃপ্ত। কারণ তার মাঝে সাংসারিক লোভ লালসার বৃদ্ধি পাবে আগুনের ন্যায়। তাদের আত্মার মাঝে লোভ লালসার আগুন বৃদ্ধি করা হবে। এর ফলে তাদের যত অর্থ সম্পদই সঞ্চিত হোক না কেন; আন্তরিক শান্তি তাদের ভাগ্যে জুটবে না। সদাসর্বদা সম্পদ বৃদ্ধি করার চিন্তা, রক্ষা করার চিন্তা এবং ক্ষতির আশঙ্কা তাদের অস্থির করে রাখবে। ফলে জাগতিক সুখের সামগ্রী প্রচুর থাকা সত্ত্বেও শান্তি তাদের ভাগ্যে জোটে না। কারণ তাদের উপরে আল্লাহ্র রহমত অনুপস্থিত। সত্যিকারের অভাব না থাকা সত্বেও তাদের আত্মার মাঝে তীব্র অভাব বোধ বিরাজ করবে। এই বাক্যটির আর একটি অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি বা জাতি যখন আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথকে পরিহার করে তখন সেই ব্যক্তি বা জাতির উপর থেকে আল্লাহ্র রহমত তুলে নেয়া হয়- ফলে বিশ্ব সভায় তার ভাগ্যে জোটে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা। এর বিশদ ব্যাখ্যা হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনে বা জাতীয় জীবনে যখন কেউ আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথ অর্থাৎ সৎ পথকে ত্যাগ করে অসৎ পথ অবলম্বন করে,তার শেষ পরিণতি কখনও ভালো হবে না। অসৎ পথে অর্জিত সম্পদ ব্যক্তির জীবনে স্থায়ী সাফল্য বয়ে আনতে পারে না। ঠিক সেই একই ভাবে যাদের জাতীয় জীবনে মিথ্যা, প্রতারণা, অন্যায় বিরাজ করে [ যেমন বাংলাদেশে ] সে জাতি কখনও বিশ্ব সভায় স্থান পেতে পারে না। তাদের জীবিকাকে আল্লাহ্ সংকুচিত করে দেবেন। আল্লাহ্র দেয়া প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও জাতীয় জীবনে তারা সে সম্পদকে ধরে রাখতে সক্ষম হবে না। প্রাচুর্যের পরিবর্তে জাতীয় জীবনে তাদের জীবনোপকরণ হবে সংকুচিত। একমাত্র ন্যায় ও সত্যের পথেই প্রাচুর্য অর্জন করা ও প্রাচুর্য ধরে রাখা সম্ভব।
২৬৪৮ -ক। "উত্থিত করিব অন্ধ অবস্থায়" - এই বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যারা শুধুমাত্র জাগতিক বিষয়বস্তুর প্রতি তাদের সর্ব সত্তাকে নিয়োজিত করে; পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে যারা আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত ন্যায় ও সত্য পথকে পরিত্যাগ করে, তাদের মানসিক অবস্থাকে এখানে উপরের বাক্যটির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ন্যায় - অন্যায় , ভালো-মন্দ, সত্য - মিথ্যার মধ্যে যারা ভেদাভেদ না করে শুধুমাত্র জাগতিক বিষয়ের প্রতি তাদের সর্ব আকর্ষণ , চিন্তা ও ধ্যান ধারণাকে নিয়োজিত করে,তারা জীবনের প্রকৃত রূপকে অনুধাবনে অক্ষম। অন্ধ ব্যক্তি যেমন স্পর্শাতীত কোনও জিনিষই অনুধাবনে সক্ষম নয় এসব ব্যক্তিরা সেরূপ জীবনের প্রকৃত স্বরূপকে অনুধাবনে হবে অক্ষম। এরা ন্যায়কে অন্যায় থেকে, ভালোকে মন্দ থেকে , সত্যকে মিথ্যা থেকে , পূণ্যকে পাপ থেকে পার্থক্য করতে পারবে না। মনুষ্য জন্মের সার্থকতাই হচ্ছে তার বিবেক- যা প্রাণীকুলের মধ্যে অনুপস্থিত। এসব জাগতিক বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন লোক তাদের কর্মের ফলে, নিজস্ব বিবেকের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে ফেলে। বিবেকহীন লোক ঐ সব অন্ধ ব্যক্তির ন্যায় যারা তাদের চারিপার্শ্বের পৃথিবীর প্রকৃত দৃশ্যকে অনুধাবন করতে পারে না। এরা অন্ধ স্বরূপ। বিবেক বিহীন লোক প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে ব্যর্থ। পৃথিবীতেও তাদের এই অবস্থা থাকবে, মৃত্যুর পরেও তাদের সেই অবস্থায় পুণরুত্থিত করা হবে। কারণ মৃত্যু তো আত্মাকে ধ্বংস করে না। আত্মা শুধুমাত্র তার বাহন এই নশ্বর দেহকে ত্যাগ করে অনন্ত লোকে যাত্রা করে। মৃত্যু হচ্ছে জীবনের ধারাবাহিকতার আর এক রূপ। আত্মা তার জাগতিক সকল অভিজ্ঞতাই পরলোকে বহন করে নিয়ে যায়। বিবেক হচ্ছে অন্তর্দৃষ্টি বা আত্মার চোখ, যে ব্যক্তি এই পৃথিবীতে বিবেকহীন বা আত্মার চক্ষুহীন, সে সেই ভাবেই তার পরলোকের যাত্রা শুরু করবে।
২৬৪৯। এই পৃথিবীতে আল্লাহ্ আদম সন্তানকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় শোভিত করে প্রেরণ করেন। এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে পার্থিব জ্ঞান লাভ করে। আর এই পার্থিব জ্ঞান আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে পরিশুদ্ধ হয়ে ব্যক্তির জীবনে বিবেকের জন্ম দেয়। সে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে থেকে ন্যায় - অন্যায় , সত্য - মিথ্যা , ভালো - মন্দ ও পূণ্য - পাপের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে। এই হচ্ছে বিবেক বা অন্তর্দৃষ্টি বা আত্মার চক্ষু। পৃথিবীতে বিবেকহীন ব্যক্তিরও শারিরীক চক্ষু বিদ্যমান। সে ভুলে যায় এই চক্ষু তাকে দান করা হয়েছে তাকে পরীক্ষার জন্য। কিভাবে সে এই পৃথিবীতে তার চক্ষুকে ব্যবহার করে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে তা পরীক্ষার জন্য। যদি সে এই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়, তবে মৃত্যুর সাথে সাথে সে যখন জাগতিক দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে, পরকালের জন্য সে হবে অন্ধ সদৃশ্য, কারণ পৃথিবীতে সে ছিলো অন্তর্দৃষ্টি হীন।
২৬৫০। পৃথিবীতে যে বান্দা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহকে অস্বীকার করে, সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই অনুগ্রহ সমূহ বর্জন করে, ফলে পরলোকেও সে আল্লাহ্র অনুগ্রহ সমূহ অনুধাবনে অক্ষম হবে এবং আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত হবে। "এই ভাবেই তুমি তা অগ্রাহ্য করেছিলে " বাক্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের ইচ্ছা এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ আত্মার মাঝে অনুধাবন করা এ সবই পূণ্যাত্মা লোকের আত্মপ্রকাশ। পৃথিবী থেকেই পূণ্যাত্মাদের আল্লাহ্র অনুগ্রহকে অনুধাবনের ক্ষমতা জন্মে এবং তারা এ কারণে আল্লাহ্র দরবারে কৃতজ্ঞ থাকেন। এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করে মৃত্যুর সিংহদুয়ার অতিক্রম করার পরেও তাদের আত্মার এই অবস্থা বর্তমান থাকে এবং আল্লাহ্র অপার করুণাতে তা বৃদ্ধি পায়। অপর পক্ষে যারা আল্লাহকে এবং আল্লাহ্র নিদর্শন ও রহমতকে এই পৃথিবীতে সনাক্ত করতে অক্ষম ছিলো ,যারা ছিলো এ সম্বন্ধে বিস্মৃত - তাদের আত্মায় মৃত্যুর পরেও সেই বিস্মৃতি বিরাজ করবে। কারণ পৃথিবী থেকে পরলোকে আত্মার যাত্রা অবিচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক। পৃথিবীর অভিজ্ঞতাই সে পরলোকে বহন করে নেবে তার আত্মার মাঝে।
২৬৫১। এই পৃথিবীর জীবন পরকালের জীবনের শিক্ষানবীশকাল মাত্র। পৃথিবীতে আত্মার যে অভিজ্ঞতা তাই সে পরলোকে বহন করে নিয়ে যাবে। উপরের আয়াতগুলির মাধ্যমে এ কথারই সত্যতাকে বিবৃত করা হয়েছে। যে ইহকালে আল্লাহ্র নিদর্শনের প্রতি অন্ধ সে পরকালেও অন্ধরূপেই স্রষ্টার নিকট নীত হবে। আর সে অন্ধত্ব হবে "কঠিনতর এবং অধিক স্থায়ী "। "অধিক স্থায়ী "। এই বাক্যটির অর্থ ইহকালের জীবন ক্ষণস্থায়ী। নির্দ্দিষ্ট মেয়াদান্তে তার সমাপ্তি ঘটে। সুতারাং পার্থিব জীবনের চক্ষুহীনতা বা অন্ধত্বও ক্ষণস্থায়ী। সে তুলনায় পরলোকের জীবন অনন্ত ও সীমাহীন। সেই সীমাহীন জীবনের সীমাহীন অন্ধত্ব অবশ্যই কঠিনতর হবে।
২৬৫২। " যারা বুঝতে পারে, " এই বাক্যটি পূর্বেও ব্যবহার করা হয়েছে আয়াত [ ২০ : ৫৪ ] তে। হযরত মুসা ও ফেরাউনেরর মধ্যে যে যুক্তি তর্কের অবতারণা ঘটেছিলো তারই সমাপ্তি পর্বে এই বাক্যটির উল্লেখ করা হয়েছে। ফেরাউন অন্ধ বিদ্বেষে ক্রমাগত আল্লাহ্ নির্দ্দেশ সমূহ অস্বীকার করেছিলো - ফলে তাঁর আত্মা পাপের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। সে আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব বরণ করে। ফেরাউনের আত্মিক অন্ধত্বের বর্ণনা প্রসঙ্গে উক্ত উক্তি করা হয়। কিন্তু এই আয়াতে বাক্যটির প্রয়োগ হয়েছে সার্বজনীন ভাবে, যে মানুষ ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে সার্বজনীন ভাবে তাদের পরিপ্রেক্ষিতেই উপরের বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। এরা হচ্ছে তারা যারা চক্ষু থাকতেও অন্ধ - অর্থাৎ বিবেকবুদ্ধি বর্জিত ফলে অন্তর্দৃষ্টিহীন।
২৬৫৩। পূর্ব সিদ্ধান্ত বা পূর্ব ঘোষণার কথা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে আয়াত [ ১০ : ১৯ ] ও টিকা ১৪০৭ এবং আয়াত [ ১১ : ১১০ ] তে। বিশ্ব প্রকৃতিতে আল্লাহ্র বিধান বা আইন এমন সুনির্দ্দিষ্ট ভাবে প্রয়োগ করা আছে যার ফলে সমস্ত সৃষ্টি সমন্বিত ভাবে শৃঙ্খলার সাথে আল্লাহ্র মহৎ উদ্দেশ্যের সার্থকতার দিকে অগ্রসরমান হয়। বিশ্ব প্রকৃতির সকল কিছুর জন্য হিতাকাঙ্খা আল্লাহ্র সুনির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনাতে বিদ্যমান। পাপী , পূণ্যাত্মা সকলকে তিনি সমভাবে নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সময় ও সুযোগ দান করে থাকেন। তাঁর করুণার হস্ত সকলের জন্য সমভাবে প্রসারিত। এই হচ্ছে আল্লাহ্র "পূর্ব সিদ্ধান্ত।" জঘন্য পাপীদের তিনি তৎক্ষণাত শাস্তি দান করেন না। তাদেরও এক নির্দ্দিষ্ট সময়কাল সময় দান করা হয়, যেনো তারা অনুতাপ করার সুযোগ পায় এবং অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র রাস্তায় ফিরে আসে। যদি এই অবকাশ দান আল্লাহ্র পূর্ব নির্ধারিত বিধান না হতো, তবে পাপীরা তাদের পাপের শাস্তি তৎক্ষণাত লাভ করতো।
২৬৫৪। যদিও এই আয়াতটিতে রসুলের [সা] প্রতি উপদেশ দান করা হয়েছে, কিন্তু এর আবেদন সকল যুগের পূণ্যাত্মাদের জন্য প্রযোজ্য। চারিদিকে পাপীদের তান্ডবলীলা দর্শনে পূণ্যাত্মারা অধৈর্য্য হবে না। তারা ধৈর্য্য ধারণ করবে। এই ধৈর্য্য ধারণের অর্থ এই নয় যে, নিষ্ক্রিয়তা, হাত পা গুটিয়ে নিষ্কৃয়ভাবে বসে থাকা। পাপীদের অন্যায় কাজকে বা পাপকে প্রতিহত করার জন্য কোন উদ্যোগই সে গ্রহণ করবে না, একে ধৈর্য্য ধারণ করা বলে না। ইসলামের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং এই সংগ্রামে একান্ত বিশ্বস্তভাবে আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীলতায় পথ অতিক্রম করতে হবে। কোন অবস্থাতেই অধৈর্য হয়ে সংগ্রামের পথকে পরিহার করা চলবে না। আল্লাহ্র কাছে তারা প্রার্থনা করবে , যোগাযোগ স্থাপন করবে যেনো আল্লাহ্ তাদের সৎপথে থাকার ও পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার তৌফিক দান করেন। প্রার্থনার মাধ্যমে তাদের মনোবল ও বিশ্বাসের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে। ফলে তারা অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে আরও সুদৃঢ় ভাবে অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে। তাদের এই সংগ্রামে শুধু যে ইহকালেই তাদের ধৈর্য্য;মনোবল ও বিশ্বাসের ভিত্তি সুদৃঢ় হবে তাই - ই নয় , পরকালেও তারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করবে।
২৬৫৫। সূর্যদয়ের পূর্বের প্রার্থনা হচ্ছে 'ফজর'। সূর্যাস্তের পূর্বে ' আসর' , রাত্রির একাংশ হচ্ছে 'মাগরিব' এবং 'এশা'। মাগরিব হচ্ছে রাত্রির প্রথমাংশ এবং এশা শয়ন গ্রহনের পূর্বে। দিবসের প্রান্তে অর্থাৎ সূর্য মধ্যাহ্ন গগন থেকে হেলে যাওয়ার পরে অর্থাৎ 'জোহর'। এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিবরণ, এখানে দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ তফসীরকারগণ এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথাই বলেছেন। তবে কেউ কেউ এর সাথে ঐচ্ছিক বা নফল এবাদতেরও উল্লেখ করেছেন। আসলে পূণ্যাত্মা ব্যক্তির জীবন হচ্ছে আল্লাহ্র এবাদতে নিবেদিত প্রাণ। তার সর্ব সত্তাই হচ্ছে আল্লাহ্র প্রশংসা গীত। অর্থাৎ নির্দ্দিষ্ট সময়ের বাইরেও তাদের অন্তরাত্মা সর্বদা প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকে।
২৫৫৬। এই পৃথিবীতে সম্পদ ,বিত্ত , ক্ষমতা, মেধা, প্রতিভা প্রভৃতি যা পৃথিবীতে সাফল্যের মাপকাঠি রূপে পরিগণিত তা সকলের মধ্যে আল্লাহ্ সমভাবে বণ্টন করেন নাই। কারও বেশী থাকলে তাতে ঈর্ষান্বিত হতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে , এসব আল্লাহ্ বান্দাকে দান করেন পৃথিবীতে তাকে পরীক্ষার জন্য। আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামতসমূহকে সে কিভাবে ব্যয় করেছে সে হিসাব তাকে দাখিল করতে হবে পরলোকে। আর এসব নেয়ামত ক্ষণস্থায়ী। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষে এই পৃথিবীর বিত্ত,সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি সব রেখে অনন্তলোকে যাত্রা করতে হয়। সুতারাং সবই ক্ষণস্থায়ী। অপর পক্ষে পরকালের সাফল্য হচ্ছে স্থায়ী সাফল্য। পৃথিবীর সাফল্য একদিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু পরকালের সাফল্য হচ্ছে স্থায়ী সাফল্য, যা স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর অনুগত বান্দাকে দান করে থাকেন। পরলোকের সাফল্য হচ্ছে অমূল্য এবং যা অনন্তকাল ব্যপী স্থায়ী। সকলকেই আল্লাহ্ তাঁর কোন না কোন নেয়ামত সমূহ দ্বারা এই পৃথিবীতে ধন্য করে থাকেন। যে বান্দা সঠিক ভাবে সেই নেয়ামত ব্যয় করতে পারে সেই পূণ্যাত্মা - আর যে না পারে সে মহাকালের অতলগর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়।
২৬৫৭। " জীবনোপকরণ" - অর্থাৎ জীবনকে ধারণ করার জন্য যে সব উপকরণের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবন যাপনের জন্য জীবনোপকরণ সংগ্রহের জন্য আল্লাহ্র মুখাপেক্ষি। পূণ্যাত্মা , পাপী সকলের জীবনোপকরণ দান করেন আল্লাহ্। "শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য " - শুভ পরিণাম অর্থাৎ কর্মের শেষ ফলাফল। আল্লাহ্র নেয়ামত পাপী , পূণ্যাত্মা সকলের জন্য বিদ্যমান। কিন্তু যে পূণ্যাত্মা , যে নিজের জীবনকে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করে, পৃথিবীর কর্মফলের শেষ পরিণাম তার জন্য শুভ ফল বহন করে আনবে। কারণ পার্থিব জীবনোপকরণের সাথে সাথে পূণ্য কর্ম দ্বারা তার আধ্যাত্মিক জীবনও সমৃদ্ধি লাভ করবে। পরিণামে সে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভে ধন্য হবে।
২৬৫৮। অবিশ্বাসীদের শঠতাপূর্ণ ধূর্ত মানসিকতার দিকে এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কোরাণ স্বয়ং স্রষ্টার সুস্পষ্ট নিদর্শন ও প্রমাণ। যারা পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাসী , তারা তাদের ধর্ম গ্রন্থেই সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে যা তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি। আল্লাহ্র কিতাবে সব কালেই শেষ নবী হযরত মুহম্মদ [সা] এর নবুয়ত ও রেসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে তার পরেও অবিশ্বাসীরা কিভাবে কৌশল অবলম্বন করে ?
২৬৫৯। পূর্ববর্তী আয়াতে রসুলের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে যে যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে , তাতে প্রতীয়মান হয় যে, এ সব অবিশ্বাসীরা নিজ ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থের বাণীর প্রতিও বিশ্বস্ত নয়। তারা মিথ্যা দাবী করে যে, তারা পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মে বিশ্বাসী। যদি তারা তাদের ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাসই হতো, তবে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমেই শেষ নবীকে সনাক্ত করতে সক্ষম হতো। তারা সত্যবাদী নয়, তারা মিথ্যাবাদী ও অবিশ্বাসী। তারা নিজের কাছে নিজে বিশ্বস্ত নয়। তাদের মিথ্যা আচরণ ও অবিশ্বস্ততার দরুণ তাদের তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রাপ্য হয়ে যায় - যদি ন্যায় বিচার করা হয়। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের অবকাশ দান করেন কারণ তা না হলে তারা নূতন যুক্তি তর্কের অবতারণা করবে। কারণ মিথ্যাবাদী ও অবিশ্বাসীরা সব সময়েই হয় ধূর্ত, শঠ ও কৌশলপূর্ণ। অনুতাপ করার জন্য অবকাশ না দিলে তারা বলতো যে, "আল্লাহ্ যদি আমাদের জন্য একজন রসুল প্রেরণ করতেন তবে, আমরা ঈমান আনতাম।" কিন্তু সত্যিই যখন তারা একজন রসুলকে স্বশরীরে লাভ করলো তারা আরও প্রমাণের জন্য বায়না ধরলো এবং রসুলল্লাহকে [ সা] অপমান ও অবজ্ঞা করলো।
২৬৬০। যদি কিতাবধারী জাতিরা তাদের নিজেদের ধর্মগ্রন্থ সম্বন্ধে বিশ্বস্ত হতো তবে, তারা শেষ নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তফার [ সা ] আগমন সম্বন্ধে কোন সন্দেহ পোষণ করতো না কোন যুক্তি তর্কের অবতারণা করতো না। কারণ তাদের ধর্মগ্রন্থেই শেষ নবীর আগমন সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এরা কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নয় - শুধু ধর্মের লেবেলধারী। এদের সম্বন্ধে কি বা বলার থাকে ? আল্লাহ্র নবী শুধুমাত্র বলতে পারেন যে, " আমরা প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছি, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র সত্য বা বিধানই স্থায়ীত্ব লাভ করবে ও বিরাজ করবে।" দেখুন আয়াত [ ৯ : ৫২ ] যেখানে সত্যকে প্রত্যক্ষ করার জন্য অপেক্ষা করার কথা আছে।
২৬৬১। দেখুন আয়াত [ ১৯ : ৪৩ ] যেখানে সরল ও সত্য পথের উল্লেখ আছে। সরল ও সত্য পথ হচ্ছে সৎ পথ। পৃথিবীতে সৎপথই স্থায়ীত্ব লাভ করবে - এই হচ্ছে আল্লাহ্র শ্বাশত বাণী। যারা সৎ পথে জীবন ধারণ করেন শুধুমাত্র তারাই আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভে সক্ষম। আল্লাহ্ স্বয়ং তাদের পথ নির্দ্দেশ দান করেন ও হেদায়েত দান করেন। যে জীবন যাপন প্রণালীতে সত্য পথের , সরল পথের অনুসারী ,সততা ও ন্যায়নীতি যার জীবনের অঙ্গ, তার পরিশুদ্ধ ও নির্মল হৃদয়ে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো পরিষ্ফুট হয়। মিথ্যা ও চক্রান্তকারীরা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে - পৃথিবীতে একমাত্র স্থায়ী হচ্ছে 'সত্য' যা আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত।