Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ১ জন
আজকের পাঠক ১৯৯ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১২৩৪ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৬৪৯ বার
+ - R Print

সূরা আম্বিয়া


সূরা আম্বিয়া বা পয়গম্বর - ২১

১১২ আয়াত , ৭ রুকু , মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : পূর্বের সূরাতে হযরত মুসা এবং হারুনের কাহিনী পৃথক পৃথক ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা তুলনা করা হয়েছে ফেরাউন এবং সামিরীর মত দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের ক্রমবর্ধমান পাপ কার্যের প্রবণতার সাথে এবং শেষ করা হয়েছে পাপের বিরুদ্ধে সাবধান করে এবং আল্লাহ্‌র এবাদত এবং সালাতের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধতার উপরে গুরুত্ব আরোপ করে। এই সূরা আরম্ভ হয়েছে আত্মিক পরিশুদ্ধতার পথে পাপের বাধাদানের প্রচেষ্টা এবং মোমেন বান্দাদের পাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার আল্লাহ্‌র অঙ্গীকারের মাধ্যমে। বিভিন্ন নবী ও রসুলদের উদাহরণের মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম পৌত্তলিকতা থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন, আল্লাহ্‌র বিধান ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে লূত সংগ্রাম করেন, আত্ম বিশ্বাস হীনতা ও ধৈর্য্যহীনতার বিরুদ্ধে আইউব নবীর সংগ্রাম, ইসমাঈল, ইদরিস, জুরকিফ ধীর স্থির ও বিশ্বাসের ঐকান্তিকতার প্রতীক , ইউনুস নবী ক্রোধকে জয় করেন, জাকারিয়া নিঃসঙ্গতাকে জয় করেন, মেরী পৃথিবীর কামনাকে জয় করেন। এদের উদাহরণের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধতার পথের বিশেষ দিক্‌গুলিকে তুলে ধরা হয়েছে। এ সব উদাহরণের মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে পয়গম্বরকূলও পাপের আক্রমণে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন না। তারা সংগ্রামের মাধ্যমে পাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, এবং আত্মিক পরিশুদ্ধতার পথের প্রতিটি ইঞ্চি তাদের কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে জয় করে নিতে হয়।

এই সূরার সময় কাল সম্বন্ধে কেহ সঠিক নয়। সম্ভবতঃ নবুয়ত প্রাপ্তির পরে মক্কায় অবস্থান কালের মাঝামাঝি সময়ে এই সূরা অবতীর্ণ হয়।

সারসংক্ষেপ : মানুষের স্বভাব ধর্ম হচ্ছে জীবনের যা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অবহেলা করা এবং তা ঘৃণা ও উপহাসের বস্তুতে পরিণত করা। কিন্তু সব কিছুরই একদিন বিচার হবে এবং শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় অবধারিত। [২১ : ১ - ২৯ ]

বিশ্ব প্রকৃতিতে আল্লাহ্‌র একত্বের স্বাক্ষর এবং আল্লাহ্‌র অঙ্গীকার : তাঁর নিরাপত্তা , অনুগ্রহ, দয়া এবং ন্যায় বিচারের অঙ্গীকার। [ ২১ : ৩০ - ৫০ ]

হযরত ইব্রাহীমের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে বিজয় এবং আল্লাহ্‌র অন্যান্য নবী রসুলেরা বিভিন্ন পাপের উপরে বিজয় লাভ করেন। [ ২১ : ৫১ - ৯৩ ]

সময় থাকতে সৎ কাজ কর। জবাবদিহিতা অবশ্যই সকলকে করতে হবে এবং শুধুমাত্র ন্যায়বানেরাই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে। [ ২১ : ৯৪ - ১১২ ]

সতের পারা

সূরা আম্বিয়া বা পয়গম্বর - ২১

১১২ আয়াত , ৭ রুকু , মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


০১। মানুষের হিসাব নিকাশের সময় ক্রমাগত নিকটবর্তী হচ্ছে , তবুও তারা উদাসীন এবং তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় ২৬৬২।

২৬৬২। হিসাব নিকাশের সময় অর্থাৎ কেয়ামতের দিন। যে ব্যক্তি মরে যায়, তার কেয়ামতের তখনই শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ হিসাব নিকাশ শুরু হয়। মানুষ যত দীর্ঘায়ুই হোক না কেন তার মৃত্যু দূরে নয়। সেই হিসেবে হিসাব নিকাশের সময় আসন্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই অমোঘ সত্যকে জানার পরেও তারা উদাসীন এবং যে বাণী বা উপদেশ তাদের পরলোকের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।

০২। যখনই তাদের প্রভুর নিকট থেকে তাঁর বাণী নবায়ন হয়ে আসে , তারা তা কৌতুকচ্ছলে শোনে ২৬৬৩।

২৬৬৩। আল্লাহ্‌ তাঁর বিধানকে যুগোপযোগী করার জন্য যুগে যুগে নবী ও রসুলদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু যখনই কোন নূতন নিদর্শন প্রেরিত হয়, তখন তারা একে কৌতুক ও হাস্য উপহাসচ্ছলে গ্রহণ করে পরবর্তীতে যা শত্রুতাতে পরিণত হয়।

০৩। তাদের অন্তর [ তা নিয়ে ] তুচ্ছ বিষয়ের মত খেলা করে। পাপীরা তাদের গোপন পরামর্শ লুকিয়ে রেখে [বলে] " সে কি তোমাদের মত একজন মানুষ নয়? তোমরা কি দেখে শুনে যাদুর কবলে পড়বে ?" ২৬৬৪, ২৬৬৫।

২৬৬৪। সীমা লংঘনকারীরা পরলোক সম্বন্ধে উদাসীন , এই আয়াত তাদের মানসিক অবস্থার অতিরিক্ত বর্ণনা। আল্লাহ্‌র বাণীর মিষ্টতা, প্রাঞ্জলতা ও ক্রিয়াশক্তি দিবালোকের মত ভাস্বর। কিন্তু সীমালংঘনকারীরা আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে গ্রহণ করার পরিবর্তে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা এর বিরুদ্দে গোপনে শলা পরামর্শ করে যেনো , লোকসমক্ষে তাদের ষড়যন্ত্রকারীরূপে চিহ্নিত করা না হয়। তাদের এই ইচ্ছাকৃত অবাধ্যতার কারণ হচ্ছে তাদের অন্তরে হিংসা রীপুর আধিক্য। হিংসা তাদের বাধা দান করে সত্যকে গ্রহণ করতে। হিংসা এই জন্য যে তাদের মতই একজন সাধারণ মানুষ সত্যকে প্রচারের জন্য আল্লাহ্‌ কর্তৃক মনোনীত হয়েছেন পথপ্রদর্শক ও রসুলরূপে।

উপদেশ : হিংসা সর্বদা প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে বাধা দান করে।

২৬৬৫। যখন আল্লাহ্‌র বাণীর মিষ্টতা , প্রাঞ্জলতা ও মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের উপরে এর ক্রিয়াশক্তি, এর নৈতিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি এবং রসুলের [ সা ] এই বাণী প্রচারে বাগ্মীতা ও আন্তরিকতা সকলকে মুগ্ধ করে তোলে , তখন এ সব সীমালংঘনকারীরা বলে, " দেখে শুনে যাদুর কবলে পড়বে ? " তারা রসুলকে [ সা ] যাদুকররূপে অভিযুক্ত করে, যার কোন সত্যের ভিত্তি ছিলো না সম্ভবতঃ তা ছিলো প্রবঞ্চনা।

০৪। বল, ২৬৬৬ " আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর [ প্রতিটি ] কথা আমার প্রভু অবগত আছেন ২৬৬৭। তিনিই সব কিছু শোনেন এবং জানেন।"

২৬৬৬। লক্ষ্য করুন, সাধারণত : আরবী ভাষাতে "Qala" শব্দটি [ According to Qiraat of Hafs ] বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উচ্চারণে পাঠ করা হয়। শব্দটি এই [ ২১ : ৪ ] আয়াতে ও [ ২১ : ১১২ ] আয়াতে এবং [২৩:১১২] আয়াতে বিদ্যমান। কিন্তু এই আয়াতগুলিতে "Qala" এর উচ্চারণ অন্য আয়াতের উচ্চারণ থেকে আলাদা [ যেমন ২০ : ১২৫ - ১২৬ ]। বসরা কিরাতে [ Basra Qiraat ] এর উচ্চারণ হয়েছে "Qul ", যার অর্থ "তুমি বল" আদেশবাচক শব্দ। " আর যদি অনুবাদ হয় "সে বলিল" তবে সে অর্থ রসুলকে [ সা ] বোঝানো হয়েছে। কিন্তু বেশীর ভাগ তফসীরকারের মতে শব্দটির অনুবাদ আদেশবাচক হওয়া উচিত এবং ইউসুফ আলী সাহেবেও এ ব্যাপারে একমত। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, যে ভাবেই অনুবাদ করা হোক না কেন অর্থের খুব একটা হেরফের হয় না, মূল বক্তব্য একই থেকে যায়। দেখুন আয়াত [ ২৩ : ১১২ ] এবং টিকা ২৯৪৮।

২৬৬৭। আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ। তিনি সব কিছুই জানেন। সরবে, নীরবে, গোপনে যা কিছুই বলা হোক না কেন সবই আল্লাহ্‌র নিকট জ্ঞাত। পাপিষ্ঠরা এবং অজ্ঞ ব্যক্তিরা যেনো ধারণা না করে যে, তাদের গোপন পরিকল্পনা আল্লাহ্‌র নিকট গোপন রাখা সম্ভব।

০৫। তারা বলে, " না, [ এ সমস্তই ] অলীক কল্পনা। সে মিথ্যা রচনা করেছে। না হয় সে একজন কবি ২৬৬৮। পূর্ববর্তী [ রাসুলগণ ] যেরূপ নিদর্শনসহ প্রেরিত হয়েছিলো , সে সেরূপ নিদর্শন আমাদের নিকট আনায়ন করুক।"

২৬৬৮। আল্লাহ্‌র প্রেরিত রাসুলের [ সা ] প্রতি কাফেরদের বিভিন্ন অভিযোগ গুলি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। কেউ বললো এসব " অলীক কল্পনা " বৈ কিছু নয়, কারণ " আমরা তা বুঝতে পারি না"। অন্য জন বলে, হায় ! সে তো মিথ্যা রচনা করেছে "। কিন্তু যদি এই কল্পনা জীবনকে সমৃদ্ধ করে, তবে তারা বলে, " সে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে।" আবার অনেকে বলে " সে একজন কবি, কারণ কবিরাই উদ্ভাবন করতে পারে।" আবার অনেকে বাধাদান করে বলে, " আমরা অলৌকিক মোজেজা দেখতে চাই। যেরূপ মোজেজার অধিকারী পূর্ববর্তী রসুলেরা ছিলেন ইত্যাদি।

০৬। তাদের পূর্বে যে সব জনপদ আমি ধ্বংস করেছি তার অধিবাসীরা ঈমান আনে নাই। এরা কি ঈমান আনবে ? ২৬৬৯

২৬৬৯। অলৌকিক মোজেজা কখনও ঈমান বা বিশ্বাসের ভিত্তি হতে পারে না। পূর্ববর্তী নবী রসুলদের অলৌকিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কাফেররা ঈমান আনে নাই। সুতারাং মোজেজা দর্শনে ঈমান আনার কথা বলা; বাহানা বই আর কিছু নয়। অলৌকিক ক্ষমতা দর্শন ঈমানের ভিত্তি হতে পারে না। ঈমান হচ্ছে অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ্‌র প্রতি এবং একান্ত নির্ভরশীলতা সেই স্রষ্টার প্রতি যিনি এক এবং অদ্বিতীয়। এটা এক ধরণের মানসিক অবস্থা [ State of mind ] এর সাথে মোজেজার কোনও সম্পর্ক নাই।

০৭। তোমার পূর্বে যে সব পয়গম্বর আমি প্রেরণ করেছিলাম তারাও ছিলো মানুষ , যাদের জন্য আমি ওহী মঞ্জুর করেছিলাম। যদি তোমরা তা না বুঝে থাক, তবে তাদের জিজ্ঞাসা কর যারা [আল্লাহ্‌র ] বাণীকে ধারণ করে থাকে ২৬৭০।

২৬৭০। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ১৬ : ৪৩ ] এবং টিকা ২০৬৯। অবিশ্বাসী বা ঈমানহীনদের কথা " সেতো আমাদের মতই সাধারণ মানুষ" এই ব্যঙ্গ বিদ্রূপের উত্তরে এই আয়াতে দেয়া হয়েছে। এ কথা সত্য যে, আল্লাহ্‌র রসুলদের প্রেরণ করেছেন মানুষের মধ্যে থেকেই , যেনো সাধারণ মানুষ তাদের বুঝতে পারে এবং তাঁরাও সাধারণ মানুষের মন মানসিকতা বুঝতে পারে।

০৮। আমি তাদের এমন কোন শরীর দিই নাই যা আহার গ্রহণ করবে না, অথবা তারা মৃত্যু থেকেও অব্যহতি পাবে না ২৬৭১।

২৬৭১। সাধারণ মানুষের শারীরিক যে চাহিদা ,নবী রসুলদের ছিলো সেই একই চাহিদা। কারণ তারাও ছিলেন শারীরিক দিক থেকে সাধারণ মানুষ। তারা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতেন এবং তারাও ছিলেন মৃত্যুর আয়ত্তাধীন।

০৯। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতি আমার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলাম এবং আমি তাদের ও তাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তাদের রক্ষা করেছিলাম। কিন্তু যারা সীমালংঘন করেছিলো তাদের ধবংস করেছিলাম ২৬৭২।

 

২৬৭২। আল্লাহ্‌র প্রেরিত নবী রসুলদের যদিও সাধারণ মানুষ থেকে শারীরিক দিক থেকে কোনও পার্থক্য ছিলো না কিন্তু আত্মিক দিক থেকে তারা আল্লাহ্‌র রহমতে ধন্য ছিলেন। তাঁদের প্রতি আল্লাহ্‌র অর্পিত দায়িত্ব ছিলো অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এই দায়িত্ব সম্পন্ন করা এক অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আল্লাহ্‌র রহমতে এরা শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করেন, এবং বিরুদ্ধচারীরা পরাজিত হয়। বিভিন্ন সূরাতে উদাহরণের মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষতঃ আয়াত [ ২১ : ৫১ - ৯৩ ] গুলিতে এই সত্যকে প্রকাশ করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্‌র রাসুল আল্লাহ্‌ তাদের রক্ষা করেন, ধ্বংস থেকে , যেখানে অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্‌র ক্রোধে নিপতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এই উপদেশ সকল মানুষ , সকল জাতির জন্য, সর্বকালে, সর্বযুগে প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি বা জাতি আল্লাহ্‌র বিধান মেনে চলে , অর্থাৎ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ও পরিকল্পনার নিকট আত্মসমর্পন করে তাদের সাফল্য অনিবার্য অপর পক্ষে যারা আল্লাহ্‌র বিধান মানে না, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করে, আল্লাহ্‌ যা নিষেধ করেছেন সেই সব পাপের পথে পা বাড়ায় তাদের শেষ পরিণতি অনিবার্য ধবংস। পৃথিবীর ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয়। পূণ্যাত্মাদের সাফল্য ও পাপীদের ধ্বংস এই -ই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান বা ইচ্ছা। " যাদের ইচ্ছা" বাক্যটি দ্বারা আল্লাহ্‌র এই বিশ্বজনীন ইচ্ছাকেই প্রকাশ করা হয়েছে যা সর্বকাল ও সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য।

 

১০। [হে মানুষ! ] আমি তো তোমাদের জন্য এক কিতাব অবতীর্ণ করেছি যার মধ্য তোমাদের জন্য আছে উপদেশ। তবুও কি তোমরা বুঝবে না ?

রুকু - ২

১১। কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি তাদের পাপের জন্য, এবং তাদের স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছি অন্য জাতিকে।

১২। তথাপি; যখন তারা অনুভব করেছিলো যে আমার শাস্তি [ আগত ] , দেখো, তারা সেখান থেকে পলায়নের [ চেষ্টা করে ] ২৬৭৩।

২৬৭৩। পাপীদের যখন বলা হয়েছিলো অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র রাস্তায় ফিরে আসতে, তারা তা প্রত্যাখান করে। শুধু প্রত্যাখানই করে না, তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু যখন তারা দেখে যে আল্লাহ্‌র শাস্তি নেমে আসছে, তখন তারা সভয়ে পলায়ন করতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে পলায়ন করা সুদূর পরাহত। কারণ অনুতাপ করার জন্য তখন তা অনেক দেরী হয়ে গেছে। আল্লাহ্‌র ক্রোধ থেকে তারা এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোথায় লুকাতে পারে ? পরের আয়াতে [ ২১ : ১৩ ] বিদ্রূপের সাথে তাদের সম্বোধন করা হয়েছে যে, " যে গৃহকে তোমরা নিরাপদ ও স্থায়ী বলে চিন্তা করতে সেই গৃহের ভোগ সম্ভোগের দিকে ফিরে যাও।"

১৩। পলাইও না , বরং ফিরে এসো তোমাদের ভোগ সামগ্রীর দিকে এবং তোমাদের আবাসগৃহে, যেনো হিসাব গ্রহণের জন্য তোমাদের ডাকা যেতে পারে ২৬৭৪।

২৬৭৪। পূর্বের টিকা দেখুন। এখানে বলা হয়েছে , " তোমরা ধারণা করেছিলে যে, তোমাদের আবাসস্থল অত্যন্ত আরামদায়ক ও নিরাপদ। এখন কেন সেখানে ফিরে যাচ্ছ না ? যেখানেই থাক জবাবদিহি তোমাদের অবশ্যই করতে হবে। শাস্তি তোমাদের ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়াবে - তোমাদের কৃত কর্মের দরুণ।" যখন আর অনুতাপ করার জন্য কোন সময় থাকবে না ; পাপীরা তখন হৃদয়ঙ্গম করবে তাদের অপরাধ। প্রকৃত সত্যকে তারা বুঝতে পারবে। কিন্তু তাদের এই অনুধাবন তাদের অনুতাপের জন্য অনেক দেরী হয়ে যাবে। তখন কোন কিছুই তাদের আল্লাহ্‌র ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

১৪। তারা বলেছিলো, " হায় ! দুর্ভাগ্য আমাদের, সত্যিই আমরা ছিলাম পাপী।"

১৫। তাদের সে কান্না থামবে না, যতক্ষণ না আমি তাদের শষ্য কাটার পরের মাঠ সদৃশ্য এবং স্তব্ধ নির্বাপিত ছাই এর ন্যায় পরিণত করি ২৬৭৫।

২৬৭৫। পাপীদের আর্তনাদকে দুইটি উপমার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পাপীরা যখন আল্লাহ্‌র শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করবে, তখন তারা সভয়ে সেখান থেকে পলায়ন করতে চাইবে। কিন্তু সেদিন কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। শুধু পাপীদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু তাদের সেই আর্তনাদকে ধীরে ধীরে স্তব্ধ করে দেয়া হবে, ঠিক সেই ভাবে, যে ভাবে পাকা শষ্যে ভরা মাঠ থেকে শষ্যকে কেটে অদৃশ্য করা হয় অথবা নির্বাপিত আগুন যে ভাবে ধীরে ধীরে নিভে যায়। তাদের আর্তনাদ স্তব্ধ হলেও তারা মৃত হবে না, কিন্তু তাদের ইচ্ছা হবে তারা যেনো নির্মূল হয়ে যায় বা ধ্বংস হয়ে যায় বা মরে যায়; দেখুন আয়াত [ ৭৮ : ৪০ ]।

১৬। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এর মধ্যবর্তী যা কিছু , আমি তা [ অলস ] ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করি নাই ২৬৭৬।

২৬৭৬। হিন্দু ধর্মে বলা হয় পৃথিবীর সৃষ্টি " ভগবানের লীলাখেলা " - অর্থাৎ ভগবানের খেয়ালখূশী। কিন্তু ইসলামের বক্তব্য এ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহ্‌র আইনকে মানার জন্য, আল্লাহ্‌র আইন ও বিধানকে প্রতিষ্ঠার জন্য। সত্য , পূণ্য, করুণা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি বিভিন্ন গুণাবলী আল্লাহ্‌র নামেরই গুণবাচক শব্দ। পৃথিবীতে যা কিছু সত্য ও সুন্দর তাই আল্লাহ্‌র বিশেষণ। আর এ সব প্রতিষ্ঠার জন্যই পৃথিবীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি তার সৃষ্টির সাথে তামাশা কৌতুক করেন না।

১৭। যদি [ শুধুমাত্র ] ক্রীড়াকৌতুকই আমার মনঃষ্কামনা হতো ,তবে আমার নিকটবর্তী যে সব জিনিষ আছে তা দিয়েই তা করতাম ২৬৭৭।

২৬৭৭। যদি আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে খেলাধূলার ধারণা দেয়া হয়, তবে তার জন্য মানুষের মত নশ্বর দেহধারীর প্রয়োজন ছিলো না। মাটির তৈরী মানুষ অপেক্ষা আলোর তৈরী তাঁর নিকটবর্তীদের নিয়েই তিনি খেলাধূলা করতেন। সুতারাং মানুষ সৃষ্টি খেলাধূলার জন্য এ এক অবান্তর ধারণা।

১৮। আমি সত্য দ্বারা মিথ্যাকে আঘাত করি, ফলে উহা মিথ্যাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় এবং দেখো, মিথ্যা ধ্বংস হয়ে যায়। হায়! দুর্ভোগ তোমাদের। তোমরা [ আমার ] সম্বন্ধে যে মিথ্যা আরোপ করছো তার জন্য ২৬৭৮।

২৬৭৮। পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা আরোপ করা হয় যেমন ১) আল্লাহ্‌র সাথে অংশীদার কল্পনা করা হয় [ ২১ : ২২ ] অথবা ২) আল্লাহ্‌র ছেলে আছে [ ২১ : ২৬ ] অথবা ৩) আল্লাহ্‌র কন্যা সন্তান আছে [ ১৬: ৫৭ ]। এ সমস্ত আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা আরোপ করা যা অসম্মানজনক। এই আয়াতে বলা হয়েছে এসব মিথ্যার অন্ধকার সত্যের আলোর অবির্ভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় বা বিদূরিত হয়।

উপদেশ : যদি আয়াতটির অর্থ ব্যপক অর্থে ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, পৃথিবীতে মিথ্যার স্থায়ীত্ব স্বল্পকালীন। সত্যের দ্বারা মিথ্যা সর্বদা পরাজিত ও বিদূরীত হয়। এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র অমোঘ আইন। " আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর ফলে উহা মিথ্যাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। "

১৯। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল [ প্রাণী ] আল্লাহ্‌র অধীনে। যারা তাঁর সান্নিধ্যে রয়েছে তারাও তাঁর এবাদত করতে অহংকার বোধ করে না, [ এমনকি ] ক্লান্তিও বোধ করে না ,২৬৭৯

২০। তারা দিবা -রাত্র তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে। তারা অবসন্ন হয় না বা বন্ধ করে না।

২৭৭৯। ফেরেশতাকূল যারা আলোর সৃষ্টি, তারা আল্লাহ্‌র সিংহাসনকে ঘিরে সর্বদা আল্লাহ্‌র গুণগানে নিমগ্ন। " তারাও তার এবাদত করতে অহংকার বোধ করে না " আল্লাহ্‌ অবস্থান সুউচ্চ সব কিছুর উর্দ্ধে।

২১। ওরা মাটি থেকে তৈরী যে সব দেবতা [ এবাদতের জন্য ] গ্রহণ করেছে, তারা কি [ মৃতকে ] জীবিত করতে সক্ষম? ২৬৮০ , ২৬৮১

২৬৮০। বিশ্ব ভূবনের মালিক শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌। কিন্তু মানুষ আল্লাহ্‌ ব্যতীত বহু ইলাহ্ এর এবাদত করতে ভালোবাসে। আর এসব বহু ইলাহ্‌ তার নিজেরই মনের কল্পনা প্রসূত। আয়াত [ ২১ : ২৩ ] পর্যন্ত এই সব বহু ইলাহ্‌ এদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এ সব ইলাহ্‌ কখনও হয় মাটির তৈরী দেব মূর্তি, কখনও ভক্তির পাত্রপাত্রী, কখনও স্থানীয় লোকদের পূজনীয় , কখনও জাতীয় বীর, বিশেষ প্রাণী বা বিশাল মহীরূহ অথবা প্রাকৃতিক শক্তি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতি যুগে যুগে এরূপ মনগড়া ইলাহ্‌ এর পূঁজা করেছে বা করে। কিন্তু আল্লাহ্‌ বলছেন যে, এসব দেব-দেবী বা পূজনীয় ঈশ্বর ক্ষমতাহীন। এদের প্রতি যে ক্ষমতা আরোপ করা হয়, তা তাদের ভক্তদের সৃষ্টি মাত্র।

২৬৮১। " মৃতকে জীবিত করিতে সক্ষম ? " উত্তর অবশ্যই হবে " না " আল্লাহ্‌ ব্যতীত এ ক্ষমতা আর কারও নাই। যীশু খৃষ্টকে আল্লাহ্‌ এই অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। দেখুন যীশু খৃষ্টের অলৌকিক ক্ষমতা বা মোজেজা [ ৩ : ৪৯ এবং ৫ : ১১৩ ] আয়াত। কিন্তু যীশু খৃষ্টের এই অলৌকিক ক্ষমতা তার নিজস্ব কোন ক্ষমতা নয়, এ ক্ষমতা তাকে আল্লাহ্‌ দান করেছিলেন। এটা ছিলো আল্লাহ্‌র অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ যীশুর মাধ্যমে। পৃথিবীর সব ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌।

২২। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ্‌ ব্যতীত যদি অন্য উপাস্য থাকতো , তবে সেখানে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করতো ২৬৮২। আরশের অধিপতি আল্লাহ্‌ মহান পবিত্র। তারা যা আরোপ করে তিনি তার [ বহু উর্দ্ধে ]।

২৬৮২। পৌত্তলিক হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেব দেবী। প্রাচীন বহু ধর্মে দেখা যায় দেব-দেবীর আধিক্য; যেমন গ্রীকদের বহু দেব-দেবী বিদ্যমান ছিলো। এ সব দেব দেবীদের কাহিনী হচ্ছে পরস্পরের প্রতি শত্রুতা , যুদ্ধ ইত্যাদি। হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনী ও গ্রীকদের কাহিনী হচ্ছে পরস্পরের এই শত্রুতা, বিদ্বেষ ও যুদ্ধের কাহিনী। যদি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ্‌ ব্যতীত বহু ইলাহ্‌ থাকতো, তবে তাদের ঝগড়া-ঝাটি এবং যুদ্ধের পরিণতিতে সকল বিশ্ব ব্রহ্মান্ড ধ্বংস হয়ে যেতো বা পৃথিবী এক কুরুক্ষেত্রে পরিণত হতো।

২৩। তাঁর কাজের জন্য তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না , বরং [ তাদেরকে ] প্রশ্ন করা হবে ২৬৮৩।

২৬৮৩। আল্লাহ্‌ স্বয়ং সম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর। বিশ্ব সংসারের সকল জীবনকে তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ্‌ কারও কাছে জবাবদিহি করবেন না। সকলেই তাঁর উপরে নির্ভরশীল , তিনি কারও উপরে নির্ভরশীল নন।

২৪। অথবা ওরা কি আল্লাহ্‌ ব্যতীত [ অন্য ] উপাস্য গ্রহণ করেছে ? ২৬৮৪। বল, " তোমাদের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস্থিত কর। ইহা আমার সাথে যারা আছে তাদের জন্য উপদেশ এবং আমার পূর্বে যারা ছিলো তাদের জন্য উপদেশ " ২৬৮৫। কিন্তু ওদের অধিকাংশই প্রকৃত সত্য জানে না , ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।

২৫। আমি তোমার পূর্বে এমন কোন রাসুল প্রেরণ করি নাই, তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে , আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। সুতারাং আমার এবাদত কর এবং আনুগত্য কর।

২৬৮৪। উপরের টিকা ২৬৮২ তে দুধরণের ইলাহ্‌ বা মিথ্যা উপাস্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এই দুধরণের মিথ্যা উপাস্য থাকতো তবে তার পরিণতির উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতে বহু উপাস্যের ফলে তৃতীয় আর এক পরিণতি বা ক্ষতির উল্লেখ করা হয়েছে। আরব মোশরেকরা বহু উপাস্যের উদ্ভাবনে ছিলো উর্বর মস্তিষ্ক। কিন্তু তা ছিলো প্রকৃত সত্য থেকে বহুদূর। নীচের [২৬ ] আয়াতে চতুর্থ আর এক ধরণের উপাস্যের ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। যারা ধারণা করে আল্লাহ্‌র পুত্র সন্তান পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহ্‌র পরিবর্তে তাই হচ্ছে উপাস্য।

২৬৮৫। এই আয়াতটি [ ২৪ ] পরবর্তী [২৫ ] আয়াতের সাথে সমন্বিত করে পড়তে হবে। পূর্ববর্তী আয়াতগুলিতে এ কথাই বলা হয়েছে যে, বহু উপাস্যের ধারণা পরস্পর বিরোধী ধারণা যা সৃষ্টিকে রক্ষা করার পরিবর্তে ধ্বংস করে দেবে। সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ্‌র একত্বের দিকে নির্দ্দেশ করে। এই একত্ববাদের ধারণা শুধু যে ইসলামে বিদ্যমান তা নয়। শুধু যে হযরত মুহম্মদ [সা] এই বাণী প্রচার করেছেন তা নয়; এই আয়াতে রসুলুল্লাহ্‌ [সা] বলছেন যে তার পূর্ববর্তী নবী ও রসুলেরাও এই একই একত্ববাদের প্রচার করে গেছেন। প্রচারক হিসেবে হযরত মুহম্মদ [ সা ] শেষ নবী। সৃষ্টির আদিতে হযরত আদম থেকে শেষ নবী হযরত মুহম্মদ [সা] পর্যন্ত আল্লাহ্‌র একত্বের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সকল নবী ও রসুলদের প্রত্যাদেশের মর্মবাণীই ছিলো আল্লাহ্‌র একত্বের ঘোষণা। পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক , নৈতিক, জাগতিক সকল বিষয়বস্তুর মূল সূত্র হচ্ছে আল্লাহ্‌র একত্বে বিশ্বাস থেকে উদ্ভুদ।

২৬। এবং তারা বলেছিলো, " পরম করুণাময় [আল্লাহ্‌ ] সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র, মহান ! তাঁরা তো কেবল সম্মানিত বান্দা ২৬৮৬।

২৬৮৬। " পরম করুণাময় [আল্লাহ্‌] সন্তান গ্রহণ করেছেন " - এই বাক্যটি দ্বারা খৃষ্টানদের "ট্রিনিটির" ধারণা ও আবর মোশরেকদের ধারণা যে দেবদূতেরা আল্লাহ্‌র কন্যা প্রকাশ করা হয়েছে, এই উভয় ধারণাকে সন্তান কথাটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। এ সকল ধারণা হচ্ছে কুসংস্কার যা আল্লাহ্‌র মাহাত্ম্যকে খর্ব করে। নবী ও রসুল এবং ফেরেশতারা আল্লাহ্‌র অনুগত ভৃত্য বই আর কিছু নয়। নবী ও রসুলেরা আল্লাহ্‌র সম্মানিত বান্দা , সুতারাং তারা আমাদের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের পাত্র। কিন্তু তাই বলে আল্লাহ্‌র পুত্র হিসেবে উপাস্য নয়।

২৭। তিনি কথা বলার পূর্বে তারা কথা বলে না ২৬৮৭। তারা [ সকল ব্যাপারে ] তার আদেশ অনুসারে কাজ করে।

২৬৮৭। আল্লাহ্‌র প্রেরিত নবী ও রসুলেরা আল্লাহ্‌র হুকুম ব্যতীত কোন বার্তা বা বাণী প্রচার করেন না। তাদের জীবনের সকল ক্রিয়াকর্ম আল্লাহ্‌র হুকুম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেন্ট জনের গসপেলে যীশু ঠিক এই কথা বলেছেন, [xii 49 – 50 ]

২৮। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তাঁরা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্য যাদের প্রতি আল্লাহ্‌ সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়ে সশ্রদ্ধ ভীত ২৬৮৮, ২৬৮৯।

২৬৮৮। দেখুন আয়াত [ ২০: ১০৯ ] যারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। যারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা অর্থাৎ তাঁর আইন বা বিধানকে পৃথিবীতে মেনে চলে, তারাই আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ করে।

২৬৮৯। "তাঁরা " বিশেষণটি তাঁদের সম্বন্ধেই ব্যবহার করা হয়েছে যারা সুপারিশ করে থাকেন। এরা সকলেই আল্লাহ্‌র একান্ত অনুগত ভৃত্য। আবার " তাঁরা" বিশেষণটি তাদের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে যারা সুপারিশের জন্য আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করেন। তারা সুপারিশকে তাদের অধিকার বা প্রাপ্য বলে জানেন না। সুতারাং তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় অপেক্ষা করেন।

২৯। যদি তাদের মধ্যে কেউ বলে, " তিনি ব্যতীত আমি উপাস্য" তাকে আমি পুরষ্কার দিব্‌ জাহান্নাম। এ ভাবেই আমি যারা পাপ করে তাদের পুরষ্কৃত করে থাকি।

রুকু - ৩

৩০। অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পৃথক হওয়ার পূর্বে সংযুক্ত ছিলো [ একক বস্তু হিসেবে ] ২৬৯০ ? আমি পানি থেকে সকল জীবিত প্রাণী সৃষ্টি করেছি ২৬৯১। এর পরেও কি তারা বিশ্বাস করবে না ?

২৬৯০। এই আয়াতে বির্বতনের মাধ্যমে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতের সাথে এই আয়াতে আল্লাহ্‌ পৃথিবী ও বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি সম্বন্ধে যে ইঙ্গিত করেছেন তা অভিন্ন। চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে যখন বর্তমান বিজ্ঞান সম্বন্ধে মানুষের কোনও ধারণাই ছিলো না, তখন এই বৈজ্ঞানিক ধারণাই প্রমাণ করে এই মহাগ্রন্থ সেই বিশ্ব স্রষ্টার নিকট থেকে আগত। আধুনিক মতে সৃষ্টির আদিতে সূর্য , নক্ষত্র, আকাশ , পৃথিবী এদের কোন পৃথক সত্তা ছিলো না। মহাবিশ্ব ছিলো নিহারীকা নামক অসংখ্য গ্যাসীয় কণার সমষ্টি , যা পরবর্তীতে বহু অংশে বিভক্ত হয়ে , নক্ষত্রপুঞ্জ , সূর্য ও পৃথিবীর জন্ম দেয়।

২৬৯১। " আমি পানি থেকে সকল জীবিত প্রাণী সৃষ্টি করেছি " পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি দ্বারা আবৃত। পৃথিবীর প্রায় ৭২% পানি দ্বারা আবৃত। যদি পৃথিবীর স্থলভাগকে সমানভাবে সমুদ্রের তলদেশ থেকে স্থলভাগে সমান ভাবে বিস্তৃত করা হতো - কোথাও কোন উঁচু নীচু থাকতো না, তবে হিসাব করে দেখা গেছে যে, পৃথিবীতে কোনও স্থলাভাগ বিদ্যমান থাকতো না। সে সময়ে স্থলাভাগের যে গড় উচ্চতা হতো তা গড়ে ৭,০০০ - ১০,০০০ ফুট সমুদ্রের পানির নীচে থাকতো। এই উপাত্তকে তুলে ধরা হলো এজন্য যে সমস্ত পৃথিবীতে যে পানির আধিক্য বেশী তা বোঝানোর জন্য। বর্তমানে জীব বিজ্ঞান বলে যে জীবনের আবির্ভাব ঘটে পানি থেকে যা চৌদ্দশ বছর পূর্বে কোরাণের ভাষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জীব বিজ্ঞানের মতে সাগরের অভ্যন্তরে অর্থাৎ পানিতেই জীবনের মূল উপাদান প্রোটপ্লাজম থেকে জীবের প্রথম সৃষ্টি হয়। আরও দেখা যায় যে , স্থলাভাগে মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহে এমন কিছু অংগ বিদ্যমান যা জলভাগের প্রাণী মাছেও বিদ্যমান। এ উপাত্ত এ সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে যে, জীবনের প্রথম সৃষ্টি পানিতে। এখানে লক্ষণীয় যে প্রোটোপ্লাজমের ৮০ -৮৫ ই হচ্ছে পানি দ্বারা গঠিত।

৩১। আমি পৃথিবীতে স্থাপন করেছি সুদৃঢ় পর্বতমালা, যেনো তাদের নিয়ে পৃথিবী দুলতে না পারে ২৬৯২। এবং আমি সেখানে [ দুই পর্বতের মধ্যে ] প্রশস্ত বাণিজ্য পথের সৃষ্টি করেছি তাদের চলাচলের জন্য, যেনো তারা পথ নির্দ্দেশ লাভ করে ২৬৯৩।

২৬৯২। অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন [ ১৬ : ১৫ ] আয়াত এবং টিকা ২০৩৮ এবং আয়াত [৭৮ : ৭ ]।

২৬৯৩। তারা শব্দটি দ্বারা সকল মনুষ্য সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়েছে, তবে বিশেষভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে তাদের প্রতি যারা আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া অনুধাবনে অক্ষম। পাহাড় যা দুদেশের মাঝে প্রাচীরবৎ দাড়িয়ে থাকে। আল্লাহ্‌র অসীম করুণা পাহাড়ের মাঝের গিপিপথ তাদের সুউচ্চ পর্বতমালাকে অতিক্রমে সাহায্য করে। তাদের ব্যবসা বাণিজ্যে সুবিধা হয় এবং বাণিজ্য শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তন অধিক সহজ হয়। পূর্বের টিকাতে [ ২৬৯১] দেখুন পর্বতসমূহ সুউচ্চ না থাকলে সকল স্থলভাগ সমুদ্রের নীচে তলিয়ে যেতো। সুতারাং স্থলাভাগের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পর্বতের সৃষ্টি। আবার টিকাতে [ ২০৩৮ ] দেখুন পর্বতমালা কিভাবে ভূগর্ভস্থ চলমান শিলাকে স্বস্থানে রাখতে সাহায্য করে - অন্যথায় পৃথিবীতে সর্বদা ভূমিকম্প লেগে থাকতো, ফলে সভ্যতার বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ হতো। পৃথিবীর বৃষ্টিপাত, বায়ু প্রবাহ বহু প্রকার প্রাকৃতিক ঘটনা সুউচ্চ পর্বতের সাথে জড়িত। এই আয়াতে বলা হয়েছে, " যেনো তারা পথ নির্দ্দেশ লাভ করে " বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বাক্যটির যেমন আক্ষরিক অর্থ বিদ্যমান ঠিক সেরূপ এর আছে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মর্মার্থ। আক্ষরিক অর্থে মানুষ গিরিপথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, বিদেশ ও স্বদেশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। আলঙ্কারিক বা উপমার্থে এর অর্থ হচ্ছে , আল্লাহ্‌র রাজ্যে এ সব সৃষ্টি মানুষকে চিন্তা করতে শেখাবে, আল্লাহ্‌র শক্তিকে অনুধাবনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ ক্ষমতার বিশালতা, আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণার ব্যপকতা অনুধাবন ক্ষমতা জন্মাবে। ফলে মানুষ হেদায়েতের আলোর সন্ধান লাভ করবে। সুউচ্চ পর্বতের বাধা অতিক্রম করে গিরিপথ যেরূপ ব্যক্তিকে তার নিজ দেশে প্রত্যার্পনকে সহজ করে। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্‌র ক্ষমতা , শক্তি , ও করুণা অনুধাবনের ফলে হেদায়েতের আলো লাভ করে মঞ্জিলে পৌঁছানো অনেক সহজ হয়ে যায়।

৩২। আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ হিসেবে বানিয়েছি ২৬৯৪। এ সব জিনিষ যার প্রতি [ নির্দ্দেশ করে ], নিদর্শন দেখার পরও তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

২৬৯৪। "সুরক্ষিত ছাদ " - অর্থাৎ আকাশটা যেনো গৃহের ছাদের মত যা সুরক্ষিত যেনো পড়ে না যায়। সুউচ্চ আকাশ মহিমান্বিত রহস্যময় সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করে যার খুব অল্পই মানুষ অনুধাবন করতে পারে। সব ক্ষতিকর শক্তি থেকে পৃথিবী আকাশ দ্বারা সুরক্ষিত। দেখুন [ ১৫ : ১৭ ]। আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকে অনুধাবনের মাধ্যমেই একমাত্র আল্লাহ্‌র ক্ষমতা, সৃষ্টি নৈপুণ্য,জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সৃষ্টির জন্য তাঁর করুণা দয়াকে অনুধাবন করা সম্ভব।

৩৩। তিনিই রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করেছেন। সকল [ স্বর্গীয় বস্তু ] নিজ নিজ কক্ষ পথে বিচরণ করে ২৬৯৫।

২৬৯৫। এই আয়াতটি অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণা সম্বলিত। আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে এই আয়াতটি রাত্রি দিবস কথাটি দ্বারা পৃথিবীর আহ্নিক গতি এবং পৃথিবী সূর্য ও চন্দ্রের নিজস্ব কক্ষপথ পরিক্রমের দিকে ইঙ্গিত করে যা সেসময়ে ছিলো ধারণারও বাইরে। এটিও আল্লাহ্‌র করুণারই আর এক স্বাক্ষর।

৩৪। [ পৃথিবীতে ] তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করা হয় নাই ২৬৯৬। সুতারাং তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরদিন বেঁচে থাকবে ?

২৬৯৬। যেদিনই মানব শিশু পৃথিবীতে জন্ম লাভ করে ,তার পর থেকেই শুরু হয় তার মৃত্যুর দিকে পথযাত্রা। প্রতিটি জীবন মানেই মৃত্যু। নবী রসুলেরাও এর ব্যতিক্রম নয়। কাফেররা হযরত মুহম্মদকে [সা] বিদ্রূপ করতো যে তিনি যদি সত্য নবী হন তবে মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করবে না। এরই প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত নাজেল হয়।

৩৫। প্রতিটি আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে ২৬৯৭। আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আমারই নিকট তোমরা ফিরে আসবে।

২৬৯৭। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৩ : ১৮৫ ] এবং টিকা ৪৯১। আত্মা চিরঞ্জীব, অমর। কারণ আত্মা তো সেই পরমাত্মার অংশ। আল্লাহ্‌ আদম সৃষ্টির আদিতে মৃত্তিকার তৈরী নশ্বর দেহে রুহু বা আত্মা দান করেছেন [ ১৫ : ২৯] ][৩২:৯], [৩৮:৭২]। সময়ের পরিক্রমায় এই নশ্বর দেহ বার্দ্ধক্য , জরা, রোগে আক্রান্ত হয় এবং একদিন আত্মা এই বার্দ্ধক্য ও জরা পীড়িত দেহ ত্যাগ করে মৃত্যুর সিংহদুয়ার অতিক্রম করে এবং পরলোকে যাত্রা করে। যে আত্মা সুদীর্ঘকাল দেহের খাঁচায় বন্দী থেকে দেহের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়; মৃত্যুর মাধ্যমে আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নশ্বর দেহ পড়ে থাকে মাটির পৃথিবীতে, কিন্তু দেহকে ত্যাগ করার যে অভিজ্ঞতা তাই হচ্ছে আত্মার জন্য "মৃত্যুর স্বাদ" বা অভিজ্ঞতা যা আত্মা বহন করে নেবে পরলোকে। এই পৃথিবীতে আত্মার অবস্থান ক্ষণকালীন " শিক্ষানবীশ" হিসেবে পরলোকের জন্য। পৃথিবীর যাত্রাপথে দেহের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আত্মা লাভ করে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা। আমাদের দৃঢ়তা, চরিত্রের গুণাবলী সবই পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হতে হবে পৃথিবীর এই শিক্ষানবীশ কালে। এ সব পরীক্ষা কখনও আসে বিপদ দুর্বিপাকের আকারে। কখনও আসে শোক ও দুঃখের মাধ্যমে, কখনও আসে প্রাচুর্য ও সুখের রূপ ধরে। আল্লাহ্‌ পরীক্ষা করে নেন তাঁর কোন বান্দা দুঃখের অমানিশাতে ধৈর্য্য না হারিয়ে শুধু মাত্র আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভর করে বিপদ ও দুঃখকে অতিক্রম করতে পারে। পরীক্ষা করে নেন তাঁর কোন বান্দা প্রাচুর্য ও সুখের দিনে অহংকারে ও দম্ভে স্ফীত না হয়ে , বিনয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র শোকর গোজারী করে এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় সকল অবস্থায় আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল হয় - বান্দার এই মানসিক অবস্থা [ State of mind ] , যা আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত নিবেদিত, আল্লাহ্‌র কাম্য। বান্দা যখন আল্লাহ্‌র প্রতি নিবেদিত এবং নির্ভরশীলতার এই আত্মিক অবস্থা লাভ করে , তখন ব্যক্তির চরিত্রে দুর্লভ গুণাবলীর জন্ম লাভ করে। ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা, সংযম, সাহসিকতা,একাগ্রতা, অধ্যবসায়ী প্রভৃতি বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলী তাঁর চরিত্রকে করে উজ্জ্বল ও সমুন্নত। যদি আমরা এই পৃথিবীর জীবনে আমাদের চরিত্রকে সমুন্নত রাখতে পারি, চারিত্রিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করতে পারি, তবেই আমরা আমাদের ক্ষণকালীন " শিক্ষানবীশ কাল" সাফল্যের সাথে উত্তরণ করতে সক্ষম হব। প্রত্যেককেই মৃত্যুর দুয়ার পেরিয়ে পরলোকে আল্লাহ্‌র নিকট নীত করা হবে। এবং সেখানেই তাদের পৃথিবীর শিক্ষানবীশ কালের মূল্যায়ন করা হবে।

৩৬। অবিশ্বাসীরা যখন তোমাকে দেখে, তখন ওরা তোমাকে কেবল বিদ্রূপের পাত্ররূপেই গ্রহণ করে।  [ তারা বলে ] "এই কি সেই যে তোমাদের দেব-দেবীদের সমালোচনা করে ? " এবং তারা পরম করুণাময় [আল্লাহ্‌র ] উল্লেখে নিন্দা বাক্য প্রয়োগ করে ২৬৯৮।

২৬৯৮। এই আয়াতটিতে আমাদের নবীকে সম্বোধন করা হয়েছে; কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন। যারা প্রকৃত মোমেন বান্দা, তাদের নিকট প্রকৃত এবাদত ও মিথ্যা এবাদতের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। কাফের ও সন্দেহবাতিকদের নিকট এবাদত হাসি ঠাট্টার বিষয়বস্তু। তারা ধর্মকে হাসি ঠাট্টার বিষয়বস্তু রূপে গ্রহণ করে এবং মোমেন বান্দাদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে যেরূপ আরবের কাফেররা নবীকে করতো। তারা নবীকে শুধু ঠাট্টা বিদ্রূপই করতো না , তারা আল্লাহ্‌র নামের উল্লেখে মাত্র তার নিন্দা জ্ঞাপন করতো। এর উত্তর পরবর্তী আয়াতে দেয়া হয়েছে।

৩৭। মানুষ [ সৃষ্টিগত ভাবে ] ত্বরাপ্রবণ প্রাণী ২৬৯৯। শীঘ্রই আমি আমার নিদর্শনাবলী দেখাব। সুতারাং [ তাদের সম্বন্ধে ] ত্বরা করতে বলো না।

২৬৯৯। মানুষকে আল্লাহ্‌ সৃষ্টিগত ভাবেই অধৈর্য করে সৃষ্টি করেছেন। যখন তাকে অনুতাপ করে আল্লাহ্‌র রাস্তায় ফিরে আসার জন্য অবকাশ দান করা হয় ,সে সেই সুযোগ গ্রহণ করার পরিবর্তে অধৈর্য হয়ে উঠে। সে অস্থির ভাবে বলে, "যদি সত্যি তুমি সত্য কথা বলে থাক, তবে সেই শাস্তি শীঘ্রই হাজির কর। " হায়! সে যদি জানতো শাস্তি অবধারিত। যখন তা নিপতিত হবে তখন সে আর ত্বরা করবে না। সে বরং তার অবসর কালকে প্রলম্বিত করতে চাইবে। হতভাগ্য জীব এরা।

উপদেশ : ধৈর্যহীনতা বা ত্বরা করার প্রবণতা যদিও মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা তবুও আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে ধৈর্য্য ধারণ করে ধীর স্থির ভাবে অগ্রসর হওয়া। সবর বা ধৈর্য্যধারণ চরিত্রের এক প্রধান গুণ।

৩৮। তারা বলে, " তোমরা যদি সত্য বলে থাক, তাহলে বল, এই প্রতিশ্রুতি কখন পূর্ণ হবে ? "

৩৯। যদি অবিশ্বাসীরা [সেই সময়ের কথা ] জানতো ২৭০০ , যখন তারা তাদের সম্মুখ থেকে আগুন প্রতিরোধ করতে পারবে না , পশ্চাৎ থেকেও পারবে না, কোন সাহায্য তাদের নিকট পৌঁছবে না।

২৭০০। যদি কাফেররা তাদের শেষ পরিণতির কথা সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারতো তবে অবশ্যই তারা শাস্তিকে ত্বরান্বিত করার জন্য অধৈর্য্য হতো না। তাদের শাস্তির বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে : শাস্তির আগুন তাদের সর্বদিক থেকে আবৃত করে ফেলবে। তারা কোনও সাহায্যকারী পাবে না। তাহলে শেষ পরিণতির কথা চিন্তা করে এখনই অনুতাপ করার শ্রেষ্ঠ সময় নয় কি ? তাদের উপরে নিপতিত শাস্তি সহসাই আসবে যার কথা পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে।

৪০। কেবল তাই নয়, উহা তাদের উপর আসতে পারে অতর্কিত ভাবে এবং তা তাদের হতবুদ্ধি করে দেবে। উহা নিবারণ করার কোন শক্তিই তাদের থাকবে না। [ তখন ] ওদের কোন অবকাশও দেয়া হবে না।

৪১। তোমার পূর্বে [ অনেক ] রাসুলকে বিদ্রূপ করা হয়েছিলো। পরিণামে তারা যা নিয়ে ঠাট্টা - বিদ্রূপ করতো তা বিদ্রূপকারীদের পরিবেষ্টন করবে ২৭০১।

২৭০১। অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন [ ৬ : ১০ ] আয়াত এবং টিকা ৮৪৩। কাফেররা যা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো সেই ব্যঙ্গ বিদ্রূপের শাস্তি তাদের ঘিরে ধরবে।

রুকু - ৪

৪২। বল, " পরম করুনাময় [আল্লাহ্‌র ক্রোধ ] থেকে রাত্রিতে ও দিনে কে তোমাদের রক্ষা করবে " ২৭০২। তথাপি তারা তাদের প্রভুর উল্লেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

২৭০২। আল্লাহ্‌ রাহ্‌মানুর রহীম। তাঁর অপার করুণায় সারা বিশ্ব জাহান বিধৌত। তাঁর দয়া ও করুণা সত্বেও যদি কেউ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তবে সারা বিশ্ব ভূবনে কে আছে যে তাকে আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে রক্ষা করবে ? আল্লাহ্‌র শাস্তি যে কোন মূহুর্তে নেমে আসতে পারে।

৪৩। তাহলে তাদের দেব-দেবী কি তাদের আমার থেকে রক্ষা করতে পারবে ? তাদের নিজেদেরই সাহায্য করার ক্ষমতা নাই , আমার বিরুদ্ধে তারা আত্মরক্ষাও করতে পারে না।

৪৪। আমি এ সব লোককে এবং এদের পিতৃপুরুষদের এই জীবনে [ সমৃদ্ধি ] ভোগ সম্ভার দিয়েছিলাম যতক্ষণ না [সমৃদ্ধির ] সময়কাল তাদের জন্য দীর্ঘ হয়েছিলো ২৭০৪। ওরা কি দেখতে পাচ্ছে না যে আমি ওদের দেশের চারিদিক থেকে ওদের নিয়ন্ত্রণকে সঙ্কুচিত করে আনছি ? ২৭০৫। এর পরেও কি তারাই জয়ী হবে ?

২৭০৪। "Umr" অথবা "Umur" অর্থ আয়ু, প্রজন্ম, প্রর্যায়, সময়, জীবনকাল ইত্যাদি। ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে "period" বা পর্যায় বা কাল অধিক উপযোগী হবে কারণ শব্দটি দ্বারা বহু প্রজন্মকে বোঝানো হয়েছে যেমন পিতা, ছেলে, তার ছেলে ইত্যাদি।

২৭০৫। ইসলামের প্রথম উন্মেষ ঘটে মক্কা নগরীতে। কিন্তু এর প্রচারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ইসলামের বিজয় শুরু হয় মক্কার দূরবর্তী স্থান থেকে। ধীরে ধীরে তা সামাজিক, ভৌগোলিক ও দেশের সীমারেখাকে অতিক্রম করে বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে মক্কার কাফেরদের অধিকারের সীমানা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসে। এ সবই ঘটে আল্লাহ্‌র হুকুমে। সামাজিক সীমারেখা বলতে বুঝানো হয়েছে যে, মক্কার অভ্যন্তরে যারা গরীব , নির্যাতিত , নিপীড়িত ও ক্রীতদাস তারা ইসলাম গ্রহণ করে। ভৌগলিক ও দেশের সীমারেখা নির্দ্দেশ করেছে ইসলামের প্রসার শুরু হয় মদিনা থেকে যা মক্কার কেন্দ্রবিন্দু থেকে বহু দূরে। ধীরে ধীরে ইসলাম মদিনার সীমান্ত অতিক্রম করে বিস্তৃতি লাভ করে। কোরেশরাই হচ্ছে সর্বশেষে যারা ইসলাম গ্রহণ করে। সম্পূর্ণ ঘটনাটিকে এ ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, "আমি ওদের দেশকে চর্তুদ্দিক হতে সঙ্কুচিত করে আনছি।" বৃত্তকে ধীরে ধীরে ছোট করে যেভাবে কেন্দ্রের দিকে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসা যায় ঠিক সেভাবে কাফেরদের পরিধিকে ধীরে ধীরে সংকুচিত করে আনা হয়েছে। আয়াতটি যদিও ইসলামের প্রচার ও বিজয়কে তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু এর আবেদন সার্বজনীন - যুগ কাল অতিক্রান্ত। যুগে যুগে আল্লাহ্‌র বাণী সর্ব প্রথম গরীব এবং সমাজের নিম্নে অবস্থানকারীদের মধ্যে প্রসার লাভ করবে। কারণ তাদের হৃদয় ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতার প্রভাবে কলুষিত হয়ে যায় নাই। সম্পদ ও ক্ষমতা মানুষের অন্তরে উদ্ধত অহংকারের জন্ম দেয়। ফলে মিথ্যাকে মহিমান্বিত করে দেখার প্রবণতা জন্মে। কিন্তু তাদের অবস্থান স্থায়ী হয় না।

৪৫। বল, " আমি তো কেবল প্রত্যাদেশ অনুযায়ী সর্তক করে থাকি।" কিন্তু বধির তো ডাক শুনতে পারবে না যখন তাদের সর্তক করা হবে ২৭০৬।
২৭০৬। যে জেগে জেগে ঘুমায় তাকে যেমন জাগানো যায় না, সেরূপ যে শুনতে চায় না তার অন্তরে কিছু প্রবেশ করে না। তাকে কিছু শোনানো যায় না। ব্যক্তির যখন এরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হয় সেই অবস্থাকেই এখানে বধিরতার সাথে তুলনা করা হয়েছে। যখন কেউ আল্লাহ্‌র করুণাময় আহ্বানকে ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রত্যাখান করে, শ্রবণশক্তিকে বধির করে দেয়, তখন তার সেই কাজের দায়-দায়িত্ব ও পরিণতি তার নিজের। এ সব অবিমৃষ্যকারী কাপুরুষদের শেষ আচরণ পরবর্তী আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। যখন আল্লাহ্‌র শাস্তি তাদের স্পর্শ করবে।

৪৬। যদি তোমার প্রভুর ক্রোধের সামান্য নিঃশ্বাসও তাদের স্পর্শ করে, তারা তখন বলে উঠবে, " দুর্ভাগ্য আমাদের! প্রকৃতই আমরা পাপী।"

৪৭। শেষ বিচারের দিনে আমি ন্যায়ের মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করবো, যেনো কোন আত্মার প্রতি সামান্য পরিমাণ অন্যায়ও করা না হয়। [ কর্ম ] যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, তবুও আমি তা [ হিসাবের জন্য ] উপস্থিত করবো ২৭০৭। এবং হিসাব গ্রহণে আমিই যথেষ্ট ২৭০৮।

২৭০৭। শুধু আমদের জীবনই নয়, সারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর হিসাব আল্লাহ্‌র নখদর্পনে। অতিক্ষুদ্র জিনিষও তাঁর অজ্ঞাত নয়। মহাকালের গর্ভে কিছুই হারিয়ে যায় না।

২৭০৮। " হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।" এই বাক্যটির মাধ্যমে আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকে প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র হিসাব নির্ভুল , এই হিসাব গ্রহণের জন্য তাঁর কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয় না। এই হিসাব গ্রহণ সম্পূর্ণ নিখুঁত ও নির্ভুল। পৃথিবীর মানুষের হিসাব নিকাশের জন্য বহু ব্যক্তি ,কাগজপত্র, সাহায্য-সহযোগিতার সাহায্য গ্রহণ প্রয়োজন। কারণ তার জ্ঞান সীমাবদ্ধ। যা সে বুঝতে পারে না, তার জন্য অন্যের সাহায্য সহযোগীতার প্রয়োজন হয়। আল্লাহ্‌ অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর অগোচরে বিশ্বচরাচরের কোনও ঘটনাই ঘটা সম্ভব নয়। এমন কি মানুষের অন্তরের লুক্কায়িত চিন্তা ভাবনাও আল্লাহ্‌র নিকট দিবালোকের ন্যায় ভাস্বর। তাঁর বিচার হচ্ছে সর্বোচ্চ ন্যায় এবং নির্ভুল এবং সম্পূর্ণ। কারণ দৃশ্য -অদৃশ্য , স্পষ্ট -অস্পষ্ট, ভিতর - বাহির , মানুষের চরিত্রের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুভূতি কর্মের উদ্দেশ্য বা নিয়ত সবই আল্লাহ্‌র নিকট দিবালোকের ন্যায় ভাস্বর। আল্লাহ্‌র অগোচর কিছুই নাই। তিনি সব কিছুরই হিসাব গ্রহণে তৎপর। এই আয়াতটিকে [ ২১ : ৪৭ ] আয়াতের [ ১৮: ১০৪ - ১০৫ ] সাথে তুলনীয়। আয়াত [ ১৮ : ১০৪ - ১০৫ ] এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষের সকল কর্মই আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় না। মোনাফেকদের সকল সৎকর্মই হয় লোক দেখানো, এবং আত্মগর্ব ও আত্ম প্রশংসার উদ্দেশ্যে। এসব কাজ আল্লাহ্‌র চোখে অর্থহীন, মূল্যহীন। এই আয়াতে [ ৪৭ ] বলা হয়েছে " আল্লাহ্‌ হিসাব গ্রহণে যথেষ্ট।" দুইটি আয়াতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিদ্যমান , আল্লাহ্‌র বিচার ন্যায়বিচার কারণ সেখানে দৃশ্য - অদৃশ্য সকল কিছুরই মূল্যায়ন ঘটে।

৪৮। অতীতে মুসা ও হারুণকে [ ন্যায় অন্যায় পার্থক্যকারী ] মানদণ্ড প্রদান করেছিলাম ২৭০৯ এবং [ জীবন পথের ] আলো ও উপদেশ [দিয়েছিলাম ] , তাদের জন্য যারা সৎ পথে চলে -

২৭০৯। দেখুন আয়াত [ ২ : ৫৩ ] এবং টিকা ৬৮ যেখানে " ফুরকান " শব্দটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই আয়াতে তিনটি জিনিষের উল্লেখ আছে যা হযরত মুসা ও হারুনকে আল্লাহ্‌ দান করেনঃ ১) "ফুরকান " - আল্লাহ্‌র নিদর্শন যা ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্যকারী, সত্য - মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী. ভালো - মন্দের মধ্যে পার্থক্যকারী , ন্যায় - বিচারের মানদণ্ডস্বরূপ। ২) জ্যোতি - মানবাত্মারর জন্য আলো , অর্থাৎ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে অন্ধকার থেকে আত্মাকে হেদায়েতের আলোতে নিয়ে আসা। ৩) উপদেশ অর্থাৎ তাওরাত গ্রন্থ যা আল্লাহ্‌ হযরত মুসাকে দান করেন, যা হারুন ও তার সহযোগীরা অনুসরণ করেন সাধারণ মানুষদের হেদায়েতের জন্য।

৪৯। যারা তাদের [ অন্তরের ] নিভৃত চিন্তাতেও আল্লাহকে ভয় পায় এবং শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে থাকে ভীত সন্ত্রস্ত ২৭১০।

২৭১০। লক্ষ্য করুন তিন ধরণের ভয়ের উল্লেখ আছে আয়াতে [ ২১ : ৪৮ - ৪৯ ] 'মুত্তাকী' অর্থাৎ যারা 'তাকওয়া' অবলম্বন করে। 'তাকওয়া' অর্থ আল্লাহ্‌ ভীতি তবে এই ভয় শাস্তির ভয় নয়। এই ভয় প্রিয়জনের মনে ব্যাথা দেওয়ার ভয়। এই ভয়ের উৎপত্তি আল্লাহ্‌র প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে জন্ম। আল্লাহ্‌র নামে তাদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায় আনন্দে , কৃতজ্ঞতায় ,ভালোবাসায়, এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : এরা হলেন পূত পবিত্র চরিত্রের অধিকারী , ন্যায়ের পথে যারা ধ্বজাধারী। এরা হলেন সর্বোচ্চ। ২) "Khashyat" - যারা না দেখেও তার প্রতিপালককে ভয় পায়। এ সব লোক তাদের অন্তরে এই ধ্যান ধারণা রাখে যে তারা আল্লাহ্‌র সম্মুখে সর্বদা উপস্থিত। সুতারাং মহামান্য আল্লাহ্‌র ভয়ে তারা প্রকাশ্যে বা গোপনে যে কোনও সময়ে আল্লাহ্‌ কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজ করতে ভয় পায়। তারা প্রাণপণে চেষ্টা করে আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্দ্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী জীবনকে পরিচালিত করতে। এরাও পূণ্যাত্মা , তবে প্রথম শ্রেণীর অর্থাৎ 'তাকওয়া' অবলম্বনকারীদের নিম্নে এদের অবস্থান। 'তাকওয়ার' জন্ম আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা থেকে অপর পক্ষে "Khashyat" এর জন্ম আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় থেকে। আর এক ধরণের লোক আছেন যারা পরকালের শাস্তির ভয়ে [ Ishfaq ] পাপ থেকে বিরত থাকেন। এর ফলেও তারা মুত্তাকী অর্জন করেন, এরাও পূণ্যাত্মা বলে পরিগণিত তবে, তিন শ্রেণীর মধ্যে এদের অবস্থান সর্বনিম্নে। সম্ভবতঃ উপরের আয়াতে মানদণ্ড বা ফুরকান , জ্যোতি, ও উপদেশের কথা বলা হয়েছে এই তিন শ্রেণীর লোক তারই অনুরূপ।

৫০। এবং আমি এই কল্যাণময় উপদেশ প্রেরণ করেছি। তবুও কি তোমরা একে প্রত্যাখান করবে ? ২৭১১

২৭১১। হযরত মুহম্মদের [ সা ] কথা এখানে বলা হয়েছে। যিনি হযরত মুসা এবং তাঁর কিতাব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তবুও কি তোমরা অস্বীকার কর ?

রুকু - ৫

৫১। পূর্বে আমি ইব্রাহিমকে ন্যায় - অন্যায়ের জ্ঞান দান করেছিলাম ২৭১২ এবং আমি তাঁর সম্বন্ধে সম্যক অবগত ছিলাম ২৭১৩।

২৭১২। "Rushd" সঠিক চারিত্রিক গুণাবলী, যা তাঁকে 'হানিফ' নামের উপযুক্ত করেছিলো। দেখুন আয়াত [ ২: ১৩৫ ] এবং অন্যান্য আয়াত।

২৭১৩। হযরত ইব্রাহীমের উপাধি ছিলো " খলিল উল্লাহ্‌ " [ ৪ : ১২৫ ] বা আল্লাহ্‌র বন্ধু।

৫২। স্মরণ কর ! সে তার পিতাকে এবং তার সম্প্রদায়কে বলেছিলো, " এগুলি কিসের মূর্তি যার প্রতি তোমরা [ এতটা ] একাগ্র ভাবে নিবেদিত ? " ২৭১৪

২৭১৪। হযরত ইব্রাহীমের উল্লেখ বহু সূরাতে আছে। সূরা [ ১৯ : ৪২ - ৪৯ ] আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের সাথে তাঁর পিতার দ্বন্দের উল্লেখ আছে। যে আয়াতগুলির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র প্রতি কর্তব্য কর্মে একজন খোদভীরু লোক কিভাবে তাঁর পিতার ন্যায় নিকটজন কাফেরের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। এই আয়াতে [ ২১ : ৫২ ] হযরত ইব্রাহীমের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, কিভাবে একজন খোদাভীরু লোক খারাপ সম্প্রদায়ের সাথে ব্যবহার করবে এবং কাফের সম্প্রদায়কে পরাজিত করবে। ইব্রাহীমের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে কি ভাবে খোদভীরু বান্দা পাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। শত অত্যাচার , এমন কি আগুনে নিক্ষেপের মত অত্যাচারেও খোদাভীরু বান্দারা আত্মপ্রত্যয়ী ও দৃঢ় থাকেন। ফলে আল্লাহ্‌র করুণা তাদের উপরে বর্ষিত হয়। তাদের উপরে নির্যাতনের আগুন তাদের জন্য শান্তিরূপে নেমে আসে।
৫৩। তারা বলেছিলো , " আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের এদের পূঁজা করতে দেখেছি।"

৫৪। সে বলেছিলো , " তোমরা এবং তোমাদের পিতৃপুরুষেরা অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছ।"

৫৫। তারা বলেছিলো, "তুমি কি আমাদের নিকট সত্য এনেছ, না তুমি তাদের একজন যারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করে ? " ২৭১৫

২৭১৫। হযরত ইব্রাহীম জীবনকে বিবেচনা করতেন অত্যন্ত গুরুতররূপে, যেখানে তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট জীবনের অর্থ ছিলো গুরুত্বহীন। তারা ধর্মের নামে শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের আনুষ্ঠানিকতাকেই সত্য বলে মনে করতো। যেহেতু হযরত ইব্রাহীম ছিলেন সত্যের পূজারী , সে কারণে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের দ্বারা লাঞ্ছিত হন। কিন্তু কোনও লাঞ্ছনাই তাঁকে ভীত করতে পারে নাই। তিনি ছিলেন সত্য পথের নির্ভিক সৈন্য ফলে আল্লাহ্‌ তাঁর জন্য বিজয় নির্ধারণ করেন।

৫৬। সে বলেছিলো, " না, তোমাদের প্রভু তো আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রভু, যিনি উহাদের [ শূন্য থেকে ] সৃষ্টি করেছেন। এবং আমি এই [ সত্যের ] একজন সাক্ষী।

৫৭। "আল্লাহ্‌র শপথ, তোমরা পিছন ফিরে চলে গেলে তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে আমার পরিকল্পনা আছে ২৭১৭। "

২৭১৭। হযরত ইব্রাহীম তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট মূর্তিপূঁজার অসারতা ও মূর্তিদের ক্ষমতাহীনতা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা গোপনে বা শঠতাপূর্ণ উপায়ে করতে চান নাই। সে কারণে তিনি বলেছিলেন যে, "তোমরা চলে গেলে তোমাদের মূর্তিগুলির সম্বন্ধে আমার পরিকল্পনা আছে " এই বাক্য দ্বারা এই মনোভাবেরই প্রকাশ পায় যে মূর্তিগুলি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের রক্ষণাবেক্ষনের দ্বারা নির্ভরশীল। তাদের অবর্তমানে হযরত ইব্রাহীম তাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সম্ভবতঃ ইব্রাহীমের এই উক্তি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা হাল্‌কাভাবে গ্রহণ করে এবং তারা দেখতে চেয়েছিলো যে, দেখা যাক ইব্রাহীম কি করেন। তাদের ধারণারও বাইরে ছিলো যে তাদের বংশ পরম্পরায় পূজিত মূর্তির গায়ে হাত দিতে কেউ সাহস করবে। সুতারাং তারা ইব্রাহীমকে সেখানে রেখে যায়।

৫৮। সুতারাং সবচেয়ে বড় মূর্তিটি বাদে অন্য মূর্তিগুলি সে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেললো , যেনো, [ জিজ্ঞাসা করার জন্য ] তারা উহার নিকট ফিরে আসতে পারে ২৭১৮।

২৭১৮। নিষ্প্রাণ ও ক্ষমতাহীন পাথর পূজা যে লজ্জাষ্কর এ কথা প্রমাণ করার জন্য হযরত ইব্রাহীম এক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের অনুপস্থিতিতে বড় মূর্তিটি ব্যতীত অন্য মূর্তিগুলি ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করলেন। দৃশ্যটি এমন যেনো প্রতীমারা নিজেরা মারামারি করেছে এবং বড় মূর্তিটি ছোট গুলিকে ধ্বংস করেছে। যদি সত্যি প্রতিমাদের ক্ষমতা থাকে তবে বড় মূর্তিটিকে তারা জিজ্ঞাসা করুক ঘটনাটি কি ঘটেছিলো। এই কার্য দ্বারা হযরত ইব্রাহীমের উদ্দেশ্য ছিলো তাদের দেখানো যে, তাদের উপাস্য মূর্তিগুলি পূঁজার যোগ্য নয়, এ জ্ঞান তাদের মাঝে ফিরে আসবে। এরপর তারা ইব্রাহীমের ধর্মের দিকে প্রত্যার্পন করবে।

৫৯। তারা বলেছিলো , " আমাদের উপাস্যগুলির কে এ দশা করেছে ? অবশ্যই সে একজন নাস্তিক মানুষ।"

৬০। তারা বলেছিলো , " একজন যুবককে উহাদের সম্বন্ধে বলতে শুনেছি। তার নাম ইব্রাহিম ২৭১৯। "

২৭১৯। বিভিন্ন দলের লোক বিভিন্ন বক্তব্য প্রদান করতে লাগলো। যারা ইব্রাহীমের বক্তব্য [ ৫৭ ] শুনে নাই তারা বলতে লাগলো, " কে এই কাজ করেছে ? " জনতার মধ্যে থেকে ইব্রাহীমের নাম উচ্চারিত হয় ফলে এক মন্ত্রণা সভা গঠন করা হয় এবং ইব্রাহীমকে জবাবদিহির জন্য উপস্থিত করা হয়।

৬১। তারা বলেছিলো, " তাহলে , তাকে লোক সম্মুখে উপস্থিত কর, যাতে তারা সাক্ষী থাকতে পারে।"

৬২। তারা বলেছিলো , " হে ইব্রাহিম! তুমিই কি আমাদের দেবতাগুলির এই অবস্থা করেছ ? " ২৭২০

২৭২০। মন্ত্রণা সভার সামনে ইব্রাহীমকে উপস্থিত করা হয় এবং তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসা করা হয়। মূর্তি ভাঙ্গার ব্যাপারে কোনও গোপনীয়তা ছিলো না কারণ হযরত ইব্রাহীম প্রকাশ্যে প্রতীমা গুলির সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন। সুতারাং যারা তা শুনেছিলো তারা জনতার মাঝে ছিলো এবং তারাই সাক্ষ্য দিয়েছিলো। এবারে হযরত ইব্রাহীম তাদের ব্যঙ্গ করে বললেন যে, " তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা কর কেন ? তোমাদের পাথরের প্রতীমাগুলিকে জিজ্ঞাসা কর না কেন ? এ কথা কি মনে হচ্ছে না যে ,এই বড় প্রতিমাটিই ঝগড়া করে ছোটগুলিকে ভেঙ্গে ফেলেছে ? যদি তারা তাদের উপাস্য প্রতীমাকে জিজ্ঞাসা না করে ,তাহলে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, প্রতীমাগুলির কথা বলার মত বুদ্ধিমত্তা বা ক্ষমতা নাই।" অবশ্য এই যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে আয়াতে [ ২১ : ৬৪ - ৬৭ ]। লক্ষণীয় হচ্ছে যে, কাফেররা যখন তাঁর আল্লাহ্‌র প্রতি একাগ্রতা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেছিলো , তাঁর প্রতিউত্তরে তিনি দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন - যা তাঁর সত্যকে প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করে।

৬৩। সে বলেছিলো, " বরং এদের প্রধান যে সে - ই এ কাজ করেছে। ওদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তারা বুদ্ধিমানের মত উত্তর দিতে পারে।"

৬৪। সুতারাং তারা পরস্পরের দিকে ফিরে বললো, " সত্যিই তো তোমরাই তো ভুল করেছ " ২৭২১

২৭২১। ইব্রাহীমের নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তাদের অন্তরে বিদ্ধ হতে থাকলো। এই বিদ্রূপের উত্তর তো তাদের জানা নাই। তাদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা হলো যে, ইব্রাহীমের যুক্তির সারবত্তা আছে, সুতারাং তারা বললো যে, ইব্রাহীমের সাথে যুক্তি তর্ক করা বৃথা। দোষ তোমাদেরই , তোমরা মূর্তিগুলিকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখেছ। সুতারাং তোমরাই তো সীমালংঘণকারী। লজ্জায় তাদের মস্তক অবনত হয়ে গেলো [২১ : ৬৫ ] এবং তারা ইব্রাহীমের ব্যঙ্গকে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করে তার প্রতিউত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। তারা বললো যে, " তুমি তো জান প্রতীমারা কথা বলতে অক্ষম।" আর ঠিক এই উত্তরটাই হযরত ইব্রাহীম আশা করেছিলেন প্রতিমা পূজারীদের নিকট থেকে এর পরেই তিনি তার মূল আঘাতটি হানেন প্রতিমা পূজারীদের উপরে, দেখুন টিকা ২৭২৩ ও আয়াত [ ২১ : ৬৬ - ৬৭ ]।

৬৫। ফলে লজ্জ্বায় তারা অপ্রতিভ হয়ে [ বললো ] , " তুমি তো ভালো করেই জানো এই [ মূর্তিগুলো ] কথা বলে না।" ২৭২২

২৭২২। তারা লজ্জায় মাথা নত করেছিলো আক্ষরিক ভাবে অর্থ তাই দাড়ায়। তবে সে লজ্জা মূর্তি পূজার জন্য নয়। তারা যে ইব্রাহীমের কাছে যুক্তি তর্কে পরাভূত হয়েছে এই লজ্জায়। বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে এই আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন।

৬৬। [ ইব্রাহিম ] বলেছিলো , " তবে কি তোমরা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এমন কিছুর এবাদত কর যা তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি [ কিছুই ] করতে পারে না?

৬৭। " ধিক্‌ তোমাদের এবং আল্লাহ্‌র পরিবর্তে যাদের এবাদত কর তাদের, তোমাদের কি কোন বিচারশক্তি নাই ? " ২৭২৩

২৭২৩। যখন প্রতিমা পূজারীরা স্বীকার করলো যে প্রতিমারা কথা বলতে অক্ষম , তখনই মিথ্যা আরধ্যের উপাসকদের সত্যের আলোতে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি তার শেষ চেষ্টা করেন। "ধিক্‌ তোমাদের এবং আল্লাহ্‌র পরিবর্তে যাদের এবাদত কর তাদের " এই বক্তব্যের পরে অপরপক্ষের কোন সদুত্তরই থাকতে পারে না সন্ত্রাস ব্যতীত। যুক্তি তর্কে হেরে যেয়ে তারা গায়ের জোরে জয়লাভের পন্থা হিসেবে গ্রহণ করে। ইব্রাহীমের সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রতি উত্তর ছিলো , " তাকে পোড়াও।" কিন্তু তাদের সন্ত্রাসী কাজ ইব্রাহীমের কোনও ক্ষতিই করতে পারে নাই [ ২১ : ৭০ ]। ক্ষতি হয়েছিলো যারা সন্ত্রাসী করেছিলো তাদের।

উপদেশ : বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আয়াতটির গুরুত্ব অসীম। মন্দ বা খারাপ যারা তারা কখনও সত্য বা ভালোকে সহ্য করতে পারবে না। তারা সর্বদা সন্ত্রাস দ্বারা ভালোকে দমন করতে প্রয়াস পাবে। হযরত ইব্রাহীমের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন , যা যুগে যুগে প্রযোজ্য ছিলো এবং এখনও প্রযোজ্য।

৬৮। তারা বলেছিলো, " তাকে পোড়াও এবং যদি তোমরা [ প্রকৃতই কিছু ] করতে চাও, তবে তোমাদের দেবতাদের রক্ষা কর। "

৬৯। আমি বললাম, " হে আগুন ২৭২৪। তুমি ইব্রাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপত্তার [ কারণ ] হয়ে যাও" ২৭২৫।

২৭২৪। আগুনের ধর্মই হচ্ছে উত্তপ্ত হয়ে কোনও জিনিষকে পুড়িয়ে ফেলা। আল্লাহ্‌র হুকুমে সেই আগুন তার ধর্ম হারিয়ে শীতল হয়ে যায়।

২৭২৫। হযরত ইব্রাহীমকে কোথায় আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো এবং কোথায় তাঁর জীবন প্রথম শুরু হয় সে সম্বন্ধে ধারণা করার প্রয়াস হোক। পারস্য উপসাগর থেকে একশত মাইল দূরে ইউফ্রেটিস নদীর নিম্ন অববাহিকায় চালদিসের [ Chaldees ] উর নামক স্থানে হযরত ইব্রাহীম জন্ম গ্রহণ করেন। এই স্থানটি হচ্ছে প্রাচীন মানব সভ্যতার ক্রোড়ভূমি বা আদি ভূমি। সেই প্রাচীন যুগেই তারা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শীতা লাভ করে। তারা সূর্য , চন্দ্র এবং তারার পূঁজা করতো ধর্ম হিসেবে। হযরত ইব্রাহীম জীবনের শুরুতেই এই মিথ্যা উপাস্যের বিরোধিতা করেন এবং তাঁর বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়েছে সূরা [ ৬ : ৭৪ - ৮২ ] আয়াতে। ইব্রাহীমের সম্প্রদায় মন্দিরে পূঁজা করতো। সম্ভবতঃ মূর্তিগুলি স্বর্গীয় বস্তুর প্রতীক ছিলো। ইব্রাহীম যখন মূর্তিগুলি ভাঙ্গেন তখন তিনি ছিলেন একজন তরুণ মাত্র [ ২১ : ৬০ ]। এই ঘটনা ছিলো তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এই ঘটনার পরে তাঁকে বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভবতঃ এই ঘটনার পরে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হয় এবং তার পরে তাঁকে বিদ্রোহী হিসেবে আগুনে নিক্ষেপ করা হয় [ ২১ : ৬৮ - ৬৯ ]। ঐতিহ্যগত ভাবে যে রাজা ইব্রাহীমকে আগুনে নিক্ষেপ করেন তাকে নমরূদ নামে অভিহিত করা হয় , যার সম্পর্কে আছে [ ১১ : ৬৯ ] আয়াতের টিকা ১৫৬৫ তে। নমরূদের পরিচয় সম্বন্ধে জানা যায় যে, তার রাজধানী ছিলো নিনেভার [ বর্তমান ইরাকের মসুল নগরীর নিকট ] নিকটবর্তী আসেরিয়াতে [ Assyria ]। যদি তাই হয় তবে তার রাজত্ব সমগ্র মেসোপটেমিয়াতে বিস্তৃত ছিলো। কারণ হযরত ইব্রাহীমের জন্ম স্থান থেকে আসেরিয়ার দূরত্ব সমগ্র মেসোপটেমিয়ার মালভূমি। অথবা হযরত ইব্রাহীম বেবীলনের মধ্য দিয়ে উত্তরে পরিভ্রমণ করেন নমরূদের রাজধানী আসেরিয়া পর্যন্ত। হযরত ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে শত্রুরা বহু পরিকল্পনা করে [ ২১ : ৭০ ] , কিন্তু আল্লাহ্‌র করুণা সর্বদা তাকে রক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন যৌবন প্রাপ্ত হন, তিনি তাঁর পিতার সাথে সর্ম্পক ছেদ করেন। এই ঘটনার বর্ণনা আছে আয়াতে [ ১৯ : ৪১ - ৪৮ ]। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের দেশ ত্যাগ করে বিদেশে যাত্রা করেন। এই যাত্রাতে তিনি সিরিয়ার মরুভূমিকে পবিহার করে, ক্যানানের [ Canaan ] দক্ষিণে আরাম [Aram ] নামক সিরিয়ার উর্বর স্থানে গমন করেন। এখানেই আয়াতের [ ১১ : ৬৯ - ৭৬ ] বর্ণিত ঘটনার সূত্রপাত হয়। সম্ভবতঃ এই ঘটনার কয়েক বৎসর পরে তিনি ইসমাঈল সহযোগে কাবা ঘর নির্মাণ করেন [ ২ : ১২৪ -১২৯ ]। এবং এ সময়ে তাঁর প্রার্থনার বিবরণ আছে আয়াতে [ ১৪ : ৩৫ - ৪১ ]। তাঁর মিশরে ভ্রমণের কথা অবশ্য কোরাণে উল্লেখ নাই। এর উল্লেখ আছে [ Gen xii 10] তে।

৭০। অতঃপর তারা তার বিরুদ্ধে প্রতারণা করার ফন্দি করেছিলো। কিন্তু আমি তাদেরই করেছিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ ২৭২৬।

২৭২৬। যখন শত্রুরা আগুনে নিক্ষেপ করেও তাঁকে হত্যা করতে পারলো না , তখন তারা ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে গোপনে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। কিন্তু আল্লাহ্‌র করুণায় তাদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। তাদের ষড়যন্ত্রে ইব্রাহীমের কোনও ক্ষতি হয় নাই। ক্ষতি যা তা ঐ ষড়যন্ত্রকারীদের। অপর পক্ষে , ইব্রাহীম ষড়যন্ত্রকারীদের ত্যাগ করে হিজরত করেন এবং সেখানে তিনি সমৃদ্ধি লাভ করেন এবং আল্লাহ্‌ তাঁকে নবী রসুলদের আদি পুরুষরূপে সম্মানিত করেন।
৭১। আমি তাঁকে এবং [ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ] লূতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য ২৭২৭।

২৭২৭। 'আরাম ' [Aram] বা সিরিয়া , অনেকেই বৃহৎ অর্থে ক্যানন বা প্যালেসষ্টাইনকে এর অন্তর্ভূক্ত করে থাকে। সিরিয়া একটি শষ্য শ্যামল জলসিঞ্চিত উর্বর ভূমি। এর এক পার্শ্বের সীমারেখাতে ভূমধ্যসাগর, যেখানে তায়ের [ Tyre ] এবং সিডন [ Sidon ] নামক দুটি বাণিজ্যিক শহর অবস্থিত। সিরিয়ার জনসাধারণ বিভিন্ন জাতির মিশ্রণ, কারণ সেই প্রাচীন যুগ থেকে বিভিন্ন শতাব্দীতে পশ্চিম এশিয়া , মিশর , প্রভৃতি দেশের বড় বড় নৃপতির রাজত্বে, আবার অপর দিকে ইউরোপের বাণিজ্যিক স্বার্থে এ স্থান যুগে যুগে ব্যবহৃত হয়েছে। তার ফলে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ ঘটেছে।

৭২। এবং আমি তাঁকে দান করেছিলাম ইসাহাককে এবং [ পৌত্র হিসেবে ] অতিরিক্ত উপহার ইয়াকুবকে। এবং [ তাদের ] প্রত্যেককে পূণ্যাত্মা করেছিলাম ২৭২৮।

২৭২৮। "Nafilat" এই শব্দটি বহু অর্থে ব্যবহৃত হয় : ১) লুঠের মাল ২) অতিরিক্ত কাজ বা প্রার্থনা , ৩) অতিরিক্ত বা উপহার , ৪) পৌত্র। এই আয়াতের জন্য শেষের দুটি অর্থ প্রযোজ্য। বৃদ্ধ বয়েসে ইব্রাহীমকে শুধুমাত্র একটিই পুত্র সন্তানই দান করা হয় নাই, শুধুমাত্র ইস্‌হাককেই আল্লাহ্‌র দান করেন নাই, তাকে এ ব্যতীত আরও পুত্র সন্তান দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ইস্‌হাক, ও ইসমাঈল। তিনি পৌত্রও দেখে যেতে পারেন। আয়াত [ ২১ : ৮৫ ] তে বিশেষভাবে ইসমাঈলের এবং তাঁর বংশধরদের উল্লেখ আছে। কারণ ইসমাঈলের বংশেই শেষ নবী হযরত মুহম্মদের [ সা ] জন্ম।

৭৩। আমি তাদের নেতা করেছিলাম, আমার আদেশ অনুযায়ী তারা [ মানুষদের ] সৎপথ প্রদর্শন করতো। এবং আমি তাদের ওহী প্রেরণ করেছিলাম ভালো কাজ করার জন্য, নিয়মিত সালাত প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং যাকাত দেওয়ার জন্য। তারা সর্বদা [ শুধুমাত্র ] আমারই আনুগত্য করতো ২৭২৯।

২৭২৯। "তারা আমারই এবাদত করতো"। "আমারই " শব্দটি দ্বারা এই আয়াতে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পূণ্যাত্মা ব্যক্তি কখনও মন্দের সাথে বা পাপের সাথে সমঝোতা করে না। যদি এর জন্য সে উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়, তবুও সে তাঁর নীতিতে অনড় ও অটল থাকে। সে প্রকাশ্যে তাঁর ঈমানকে ঘোষণা করে। মন্দ ও অসৎ সর্বদা মোমেন ও সৎ বান্দাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাইবে, তাদের ক্ষতি সাধন করতে চাইবে, কিন্তু আল্লাহ্‌ স্বয়ং তাঁদের রক্ষা করবেন। পাপিষ্ঠরা তাদের পাপের পরিণতিতে ধ্বংস হয়ে যাবে।

৭৪। আমি লূতকেও দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। এবং আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম এমন এক জনপদ থেকে যারা লিপ্ত ছিলো অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজে। সত্যিই তারা ছিলো এক মন্দ ও বিদ্রোহী সম্প্রদায় ২৭৩০।

২৭৩০। লূতের সম্প্রদায় এক জঘন্য পাপে লিপ্ত ছিলো। আল্লাহ্‌ লূতকে প্রেরণ করেন তাদের সাবধান করার জন্য। তিনি তাদের এই পাপ কাজের বিরুদ্ধাচারণ করেন, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখান করে। তার ফলে তাদের উপরে আল্লাহ্‌র শাস্তি খড়গের মতো নেমে আসে, কিন্তু লূত ও তাঁর অনুসারীরা রক্ষা পায়। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ৬১ - ৭৪ , ১১ : ৭৭ - ৮২ এবং ৭ : ৮০ - ৮৪ ]।

৭৫। এবং আমি তাঁকে আমার অনুগ্রহভাজন করেছিলাম। কারণ সে ছিলো পূণ্যাত্মাদের একজন।

রুকু - ৬

৭৬। [ স্মরণ কর ! ] নূহকে , পূর্বে সে যখন আবেদন করেছিলো, ২৭৩০ - ক , আমি তাঁর [ প্রার্থনা ] শুনেছিলাম এবং তাঁকে এবং তাঁর পরিবারবর্গকে মহা বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করেছিলাম ২৭৩১।

২৭৩০ -ক। হযরত ইব্রাহীমের আগমনের বহু পূর্বে নূহ্‌ নবীর দুনিয়াতে আগমন।

২৭৩১। নূহ্‌ এর সম্প্রদায়ের লোকেরা আল্লাহ্‌র প্রতি অবিশ্বাস, গরীবদের নির্যাতন এবং বৃথা তর্ক কলহে নিমগ্ন ছিলো। হযরত নূহ্‌ তাদের মাঝে আল্লাহ্‌র বাণী প্রচার করেন, এবং শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও তাঁর ঈমান বা বিশ্বাসে অটল থাকেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে এক সুবিশাল নৌকা তৈরীর হুকুম দান করেন। সেই নৌকায় তিনি ও তার অনুসারীরা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পায় কিন্তু দুষ্ট লোকেরা ডুবে মারা যায়। দেখুন [ ১১ : ২৫ - ৪৮ ]।

৭৭। এবং আমি ঐ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করেছিলাম যারা আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখান করেছিলো। প্রকৃতপক্ষে উহারা ছিলো এক মন্দ সম্প্রদায়। সুতারাং আমি তাদের এক সাথে [ বন্যাতে ] নিমজ্জিত করলাম।

৭৮। এবং স্মরণ কর দাউদ ও সুলাইমানকে , যখন তারা বিচার করছিলো কোন সম্প্রদায়ের মেষ পাল সম্বন্ধে , যেগুলি রাত্রিকালে [ অপরের ] শষ্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলো। আমি তাদের বিচার কার্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম।

৭৯। সুলাইমানকে আমি বিষয়টির [সঠিক ] মীমাংসায় অনুপ্রাণীত করেছিলাম ২৭৩২। তাদের [ উভয়কে ] আমি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম। পাহাড় ও বিহঙ্গকুল দাউদের সাথে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতো, তা ছিলো আমারই ক্ষমতা ২৭৩৩। [ এ সকল ] আমিই কার্যকর করেছিলাম।

২৭৩২। এক মেষ পালকের কয়েকটি মেষ রাত্রিকালে পার্শ্বের কৃষকের [ আঙ্গুর ] ক্ষেতে প্রবেশ করে এবং তার ক্ষেতের চারা গাছগুলি খেয়ে ফেলে। সম্ভবতঃ সারা বছরের ফসলই এভাবে নষ্ট হয়ে যায়। সে সময়ে দাউদ নবী রাজা ছিলেন। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক যখন বিচার প্রার্থী রূপে দাউদ নবীর কাছে বিচার প্রার্থনা করলো , দাউদ ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মেষগুলি ক্ষতিগ্রস্থ কৃষককে প্রদান করার রায় দেন। সে সময়ে দাউদের পুত্র সোলায়মান ছিলেন এগার বছরের বালক মাত্র। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ ব্যাপারটির রায় ভিন্নভাবে দিলেন। যা হবে ন্যায় বিচার। ক্ষতিগ্রস্থের ক্ষতি ছিলো সাময়িক যা এক বছরের ফসল। যদি সে জমি হারাতো তবে তা হতো স্থায়ী ক্ষতি। সুতারাং সাময়িক ক্ষতির জন্য মেষ পালকের মেষগুলিকে স্থায়ী ভাবে হারানো ন্যায় বিচার নয়। হযরত সোলায়মান প্রস্তাব ছিলো নিম্ন রূপ : কৃষকের নিকট মেষপাল থাকবে, সে উহার দুগ্ধ পান করবে , উল ব্যবহার করবে এবং মেষ পাল যে নূতন বাচ্চা জন্ম দেবে তার অধিকার লাভ করবে। আর মেষের মালিক ক্ষেতটিতে পানি দেবে, ক্ষেতের চারা গাছের যত্ন নেবে। ক্ষেতটি পূর্বের অবস্থা লাভ করলে সে মেষগুলি ফেরত পাবে। দাউদ নবী নিজের রায় নাকচ করে পুত্রের রায় গ্রহণ করলেন। দাউদের যোগ্যতা হচ্ছে , তিনি ন্যায় ও সত্যকে তৎক্ষণাত চিনতে ও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যদিও প্রস্তাবটি এসেছিলো মাত্র এগারো বৎসরের বালকের নিকট থেকে। সোলায়মানের যোগ্যতা হচ্ছে তিনি পার্থক্য করতে পেরেছিলেন স্থায়ী আয়ের উৎস এবং অস্থায়ী আয়ের মধ্যে। যদিও তিনি ছিলেন বালকমাত্র। কিন্তু তিনি তাঁর ন্যায় প্রস্তাবকে পিতার নিকট উপস্থাপন করতে দ্বিধা বোধ করেন নাই। কিন্তু এই দ্বিবিধ ক্ষেত্রেই সমস্ত প্রশংসার দাবীদার আল্লাহ্‌। তিনিই বান্দার অন্তরে ন্যায়নীতি অনুধাবনের ক্ষমতা দান করেন। তিনি সকল বিষয়ের সাক্ষী, তাঁর উপস্থিতি সর্বত্র।

২৭৩৩। [ ১৭ : ৪৪; ৫৭ : ১; ১৬ : ৪৮ - ৫০ ] এই আয়াতগুলির মাধ্যমে বলা হয়েছে আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে , সকলেই আল্লাহ্‌র গুণগান করে। আয়াত [ ১৩ : ১৩ ] তে বলা হয়েছে যে, "বজ্র নির্ঘোষ ও ফিরিশতাগণ সভয়ে তাঁহার সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে।" সারা বিশ্বব্রহ্মান্ড আল্লাহ্‌র প্রশংসায় মগ্ন। দাউদ নবীর ধর্মসংগীতে আল্লাহ্‌র প্রশংসা ব্যপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। দাউদ নবী যখন গান গাইতেন তাঁর সাথে বিশ্ব প্রকৃতিও যোগদান করতো। আকাশ , বাতাস , পাহাড় , প্রকৃতি তাঁর সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি করতো। দেখুন আয়াত সমূহ [ ৩৪ : ১০ এবং ৩৮ : ১৮ - ১৯ ] যেখানে বলা হয়েছে দাউদ নবীর সাথে তাঁর ধর্ম সংগীতে বিশ্ব প্রকৃতিও যোগ দান করতো।

মন্তব্য : এই আয়াত থেকে এই কথাই প্রতীয়মান হয় যে, সঙ্গীতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রশংসা গীতি নিষিদ্ধ নয়। কারণ সঙ্গীতের এই বিশেষ ক্ষমতা দাউদ নবীকে আল্লাহ্‌ দান করেছিলেন। সঙ্গীত মনের এক বিশেষ ক্ষমতা [ Faculty of mind]। সংগীত মানুষের মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে বিধায় কোরাণ শরীফ মানুষ সংগীতের সুরে পাঠ করে , আজান সুললিত সুরে ধ্বনিত হয়। তবে সংগীতের খারাপ ব্যবহার অবশ্যই খারাপ।

৮০। আমিই তোমাদের উপকারেরর জন্য তাঁকে লোহার কোট [ বর্ম ] তৈরী করতে শিখিয়েছিলাম , যেনো তোমরা [যুদ্ধক্ষেত্রে ] পরস্পরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পার। সুতারাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না ? ২৭৩৪, ২৭৩৫।

২৭৩৪। দাউদ নবী সর্বপ্রথম লোহার বর্ম তৈরী করেন। প্রাচীনযুগে যখন তরবারীর সাহায্যে যুদ্ধ হতো , সে ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্য লোহার বর্মের আবিষ্কার এক অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার বইকি। [ ৩৪ : ১০ - ১১ ] আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে,এই বিশেষ দক্ষতাটি দাউদ নবীকে আল্লাহ্‌ দান করেছেন, কারণ দাউদ নবী ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও পূণ্যাত্মা ব্যক্তি [ ৩৪ : ১১ ]। তাঁর এই বিশেষ দক্ষতাটি তিনি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতিতের রক্ষার জন্য ব্যয় করবেন। অর্থাৎ তাঁর যুদ্ধ হবে ধর্মযুদ্ধ। এই আয়াতের মাধ্যমে এই উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র দান যে কোন দক্ষতাকে মহত্বর উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদন করতে হবে। বর্তমান যুগে বিশ্ব জুড়ে যে অস্ত্র প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে তার পিছনে কোন মহত্বর উদ্দেশ্য নাই, কোন কল্যাণ নাই; যা আছে তা হচ্ছে হিংসা ও সন্ত্রাস ও অন্যকে অবদমিত করার প্রয়াস মাত্র।

২৭৩৫। দাউদ নবীর গুণাবলী কোরাণ শরীফে এ পর্যন্ত যে ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে : ১) তিনি খুব সহজেই ন্যায়কে অন্যায় থেকে পার্থক্য করতে পারতেন, ২) তিনি যে প্রার্থনা সংগীত বা ধর্ম সংগীত গাইতেন তা বিশ্ব প্রকৃতিতে আলোড়ন তুলতো, তারা দাউদ নবীর সংগীতের প্রতিধ্বনি তুলতো, ৩) তিনি লোহার আত্মরক্ষামূলক বর্ম তৈরীতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি এ সব করতে সক্ষম ছিলেন কারণ আল্লাহ্‌ তাকে এই বিশেষ দক্ষতা বা ক্ষমতা দান করেছিলেন। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ এই উপদেশ দিয়েছেন যে, জ্ঞান , বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য , সংগীত, ইত্যাদি বিভিন্ন মানসিক দক্ষতা বা ক্ষমতা যার সাহায্যে মানুষ সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী হয় তা সবই আল্লাহ্‌র বিশেষ দান। মানুষ এই সাধারণ কথাটি ভুলে যেয়ে নিজস্ব কৃতিত্বের অহংকারে মত্ত হয়ে যায় তাই আল্লাহ্‌ বলেছেন, " সুতারাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হইবে না ? " এসব নেয়ামতের জন্য মানুষের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

৮১। এবং আমি প্রবল বাতাসকে সুলাইমানের আজ্ঞাধীন করেছিলাম ২৭৩৬, যেনো বাতাস তাঁর হুকুমে [ মুদু গতিতে ] বয়ে যেতে পারে সেই সব দেশে যে দেশকে আমি আর্শীবাদ ধন্য করেছি। নিশ্চয়ই আমি সকল বিষয় সম্বন্ধে অবগত ২৭৩৭।

২৭৩৬। দেখুন আয়াত [ ৩৪ : ১২ এবং ৩৮ : ৩৬ - ৩৮ ]। এই আয়াতগুলিতে বলা হয়েছে যে, সোলেমান নবীকে আল্লাহ্‌ অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। বাতাস তাঁর হুকুমে প্রবাহিত হতো। হযরত সোলায়মান এই ক্ষমতা লাভ করেন আল্লাহ্‌র বিশেষ নেয়ামত স্বরূপ। তাঁর সমস্ত ক্ষমতার উৎস ছিলেন আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। এ ভাবেই মহাক্ষমতাধর আল্লাহ্‌ মানুষকে ক্ষমতা দান করে থাকেন যেনো সে প্রকৃতিকে জয় করতে পারে। বিজ্ঞানের ক্ষমতা বলে আজকের মানুষ প্রকৃতিকে জয় করতে সক্ষম। কিন্তু বিজ্ঞানের জ্ঞান বা এই অত্যাশ্চর্য দক্ষতা আল্লাহ্‌র -ই দান এ কথা লোকে ভুলে যায়।

২৭৩৭। "সেই দেশে, যে দেশকে আমি আর্শীবাদ ধন্য করেছি "। অর্থাৎ প্যালেস্টাইনের দিকে যেখানে সোলায়মান বাদশার বাজধানী ছিলো ; যদিও তাঁর রাজত্ব সিরিয়ার উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।

৮২। এবং কিছু মন্দ [ জ্বিন ] তার জন্য ডুবুরীর কাজ এবং এছাড়াও অন্যান্য কাজও করতো ২৭৩৮। আমিই তাদের পাহারা দিয়ে রাখতাম।

২৭৩৮। পৃথিবীর বিভিন্ন শক্তিকে হযরত সোলায়মানের বশীভূত করে দেয়া হয়েছিলো ; কিন্তু সকল শক্তির বা ক্ষমতার উৎস এক আল্লাহ্‌। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের ফলে সোলায়মান জ্বিনদের বশীভূত করেন।

৮৩। এবং [ স্মরণ কর ! ] , যখন আইউব তাঁর প্রভুর নিকট কেঁদে বলেছিলো, " দুঃখ - দুর্দ্দশা আমাকে গ্রেফতার করে ফেলেছে ২৭৩৯। কিন্তু তুমি তো দয়ালুদের মধ্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ। "

২৭৩৯। আইউব নবী আরবের উত্তর পূর্ব প্রান্তের কোন এক জায়গায় থাকতেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন সম্পদশালী। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর উপরে বিপর্যয়ের ঝড় বয়ে যায়। তাঁর পশু সম্পদ বিনষ্ট হয়, ভৃত্যরা নিহত হয়, পরিবার পরিজন ধ্বসে পড়া বাড়ীর নীচে চাপা পড়ে মৃত্যু বরণ করে। এত বিপর্যয়েও আইউব নবী তাঁর ধৈর্য্য হারান নাই, তিনি আল্লাহ্‌র প্রতি ছিলেন বিশ্বাসে অটল। তার বিপদ বিপর্যয় এখানেই শেষ হয় নাই। তাঁর সমস্ত শরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুজ রক্ত পূর্ণ ক্ষততে ভরে যায়। ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত আইউব নবীর ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। তিনি পৃথিবীতে তাঁর জন্মকেই অভিশপ্ত মনে করতে থাকেন। তার বন্ধু বলে আখ্যায়িত ব্যক্তিরা তাঁকে ত্যাগ করে চলে যায় এবং বলে যে এ সব তাঁর পাপের পরিণতি। তাঁর এ সব বন্ধুরা প্রকৃত পক্ষে বন্ধু ছিলো না। ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি মানসিক ভারসাম্য হারান। কিন্ত শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতি আল্লাহ্‌র করুণা হয় এবং তিনি তাঁর মনের ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা, বিনয় বিশ্বাসের দৃঢ়তা, এবং বিচার বুদ্ধি ফিরে পান। আল্লাহ্‌ তাকে সুস্থ করে তোলেন এবং তাঁর ধন সম্পদ ,মান - মর্যাদা , পরিবার - পরিজন সব ফিরিয়ে দেন এবং তা পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ ভাবে ফিরিয়ে দেন। তাঁর বন্ধুবান্ধব আত্মীয় - স্বজনেরা আবার তাঁর নিকট ফিরে আসে। তিনি নূতন ভাবে পরিবারের সৃষ্টি করেন। এবারে তার সাত ছেলে ও তিন মেয়ে জন্ম লাভ করে। এরপর তিনি বহু বছর জীবিত ছিলেন। ওল্ড টেস্টামেন্টে হীব্রু ভাষাতে এসব কথা লেখা আছে। বাইবেলে হযরত আইউবের চরিত্রকে যেভাবে অংকন করা হয়েছে তার থেকে কোরানের এবং হাদীসের ভাষ্য ভিন্নতর। মুসলিম ধর্মগ্রন্থে তাঁকে চিত্রিত করা হয়েছে ধৈর্য্যের প্রতীক হিসেবে , সম্মানীয় নবী এবং সর্ব অবস্থায় আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল এবং বিশ্বস্ত হিসেবে। বাইবেলে তাঁকে এভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যে, তিনি বিপদ বিপর্যয়ের দ্বারা অধৈর্য্য হয়ে মনের ভারসাম্য হারান এবং নিজেকে অভিশপ্ত মনে করেন। একথা সত্যের অপলাপ ব্যতীত আর কিছু নয়। কারণ কোরাণ তাঁকে বর্ণনা করেছে বিপদ বিপর্যয়ের দ্বারা আল্লাহ্‌র পরীক্ষার মাঝে তিনি ছিলেন দৃঢ়তা ,সহিষ্ণুতার প্রতীক স্বরূপ। তিনি সবর করে যান, অবশেষে আল্লাহ্‌র রহমতে মুক্তি পান। সবরের মাধ্যমেই আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয় বান্দাদের কাছে টেনে নেন।

৮৪। সুতারাং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম ও তাঁর দুঃখ-দুর্দ্দশা দূর করে দিলাম। এবং তাঁকে তাঁর পরিবার -পরিজন প্রত্যার্পন করলাম এবং তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করলাম - আমার রহমত স্বরূপ ,এবং যারা আমার আনুগত্য করে তাদের জন্য উপদেশ স্বরূপ ২৭৪০।

২৭৪০। আইউব নবী ছিলেন বিনয়, ধৈর্য্য এবং আল্লাহ্‌র প্রতি অটল বিশ্বাসের প্রতীক স্বরূপ। এই অস্ত্রের সাহায্যেই তিনি সকল প্রতিকূলতা, বিপদ, বিপর্যয়কে দূর করেন। যারা এবাদতকারী তাদের জন্য হযরত আইউবের জীবনী উপদেশ স্বরূপ।

৮৫। এবং [স্মরণ কর ] ইসমাঈল ২৭৪১, ইদ্রিস ২৭৪২, এবং যুল - কিফল এর কথা ২৭৪৩, এরা প্রত্যেকেই ছিলো দৃঢ় চরিত্রের এবং ধৈর্য্যশীল।

২৭৪১। হযরত ইব্রাহীমের বংশের সম্মানীয় দুইটি ধারা হযরত ইসহাক ও হযরত ইসমাঈল দ্বারা সূচিত হয়। হযরত ইস্‌হাকের বংশধারা যা [ ২১ : ৭২ ] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে তা ব্যতীত এই আয়াতে হযরত ইসমাঈলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি হচ্ছেন বিশাল মুসলিম উম্মার প্রতিষ্ঠাতা। ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তার তিনিও ছিলেন অগ্রপথিক। যুগে যুগে যারা আল্লাহ্‌র প্রিয় বান্দা তাদের আল্লাহ্‌র বিপদ বিপর্যয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে কাছে টেনে নেন। যারা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে তারাই আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। হযরত ইসমাঈলের দুঃখ কষ্ট শিশু অবস্থায় শৈশবেই শুরু হয় , [ দেখুন টিকা ১৬০ এবং আয়াত ২ : ১৫৮ ] যখন তিনি নির্বাসিত হন। তিনি ধৈর্য্য , দৃঢ়তা ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন যখন তিনি দৃঢ় ও নির্ভিকভাবে আল্লাহ্‌র কাছে কোরবানীর জন্য প্রস্তত হন। তিনি যথার্থই " আল্লাহ্‌র জন্য উৎসর্গীত " বা "Sacrifice to Allah" এই উপাধির যোগ্য [দেখুন টিকা ২৫০৬ এবং আয়াত ১৯ : ৫৪ ] তাঁর ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে নিবেদিত।

২৭৪২। হযরত ইদরীসের জন্য দেখুন টিকা ২৫০৮ এবং আয়াত [ ১৯ : ৫৬ ] জীবনে তিনি উচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত ছিলেন, কিন্তু তা তাকে বিপথে চালিত করতে পারে নাই। তিনি ছিলেন সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা ছিলো ধৈর্য্য ও সংকল্পের দৃঢ়তার বৈশিষ্ট্য।

২৭৪৩। "Zul-Kifl" শব্দটির আক্ষরিক অর্থ 'মালিক' বা "দ্বিগুণ প্রতিদান" বা "অংশ" অথবা "যে দু-পরল বা দু-স্তরে কাপড় পরিধান করে।"তফসীর কার গণ মতদ্বৈত প্রকাশ করেন যে এই উপাধিটি কাকে এবং কখন দান করা হয় এবং কেন তাঁকে হযরত ইসমাঈল এবং ইদরীসদের মত নবীদের সাথে এক সাথে উল্লেখ করা হয়। মনে হয় এ ব্যাপারে "Karsten Niebuhr" এর গ্রন্থ Reisebeschreibung nach Arabien [ ii 264- 266] , যা ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে কোপেনহেগেন থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য। যেখানে তিনি Encyclopaedia of Islam under 'Dhul – Kifl' থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি ইরাকের Meshed Ali এবং Najaf এবং Hilla [ Babylon ] মধ্যবর্তী ছোট শহর Kefil পরিদর্শন করেন। তাঁর মতে EzeKielএর মন্দির এই শহরে অবস্থিত। ইহুদীরা তীর্থযাত্রার জন্য এই শহরে আগমন করে।

যদি আমরা "Zul – Kifl" কে গুণবাচক উপাধি হিসেবে গ্রহণ না করে "EzeKiel" এর আরবী সংস্করণ হিসেবে গ্রহণ করি তবে তা আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। "EzeKiel " ছিলেন ইহুদীদের একজন নবী যিনি বেবীলনের রাজা নেবুচাঁদনেজার দ্বারা দ্বিতীয় বার জেরুজালেম আক্রমণের পরে [ খৃষ্ট পূর্ব ৫৯৯ শতাব্দী ] বন্দী হন। তাঁর বাণী ইংরেজী বাইবেলে [ Old Testament ] স্থান পেয়েছে। নেবুচাঁদনেজার তাকে শৃঙ্খলিত করে কারাগারে পাঠান এবং সেখানেই তাঁকে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। তিনি তাঁর এই দুঃসহ নির্যাতন ধৈর্য্য ; দৃঢ়তা ও সহিষ্ণুতার সাথে মোকাবিলা করেন এবং শত নির্যাতনেও ইহুদীদের পাপ কার্যের তীব্র নিন্দা অব্যাহত রাখেন। জ্বালাময়ী ভাষায় তিনি তাদের বিপথগামী নেতাদের সমালোচনা ও অস্বীকার করেন।

"Zul – Kifl" এর উল্লেখ আবারও কোরাণে করা হয়েছে [ ৩৮ : ৪৮ ] আয়াতে ইসমাঈল এবং আল- আইসার সাথে।

৮৬। আমি তাদের আমার অনুগ্রহভাজন করেছিলাম। কারণ তারা ছিলো পূণ্যাত্মা।

৮৭। এবং স্মরণ কর যুন নুন ২৭৪৪, এর কথা , যখন সে ক্রোধভরে বের হয়ে গিয়েছিলো এবং মনে করেছিলো যে, তার উপরে আমার কোন ক্ষমতা নাই। অতঃপর সে অতল অন্ধকার থেকে আর্তনাদ করেছিলো , " তুমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তুমি পবিত্র মহান ! আমি তো পাপী।"

২৭৪৪। "যুন -নুন " অর্থ মাছের অধিকারী বা মাছের সাথে সর্ম্পকিত ব্যক্তি। এই উপাধিটি দেয়া হয় হযরত ইউনুসকে। কারণ তাঁকে এক বিরাট মাছ [তিমি মাছ ] গিলে ফেলেছিলো। আল্লাহ্‌ তাঁকে আসেরিয়ান সম্রাজ্যের রাজধানী নিনেভাতে নবী হিসেবে পাঠান। নিনেভার জন্য দেখুন টিকা ১৪৭৮ এবং আয়াত [ ১০ : ১৮ ] এবং হযরত ইউনুসের কাহিনীর জন্য দেখুন [ ৩৭ : ১৩৯ - ১৪৯ ] আয়াত। যখন নিনেভা নগরীর বাসিন্দারা ইউনুস নবীর প্রথম সাবধান বাণীকে উপেক্ষা করলো। তিনি অধৈর্য্য হয়ে তাদের উপরে আল্লাহ্‌র গজব কামনা করলেন। কিন্তু নিনেভার অধিবাসীরা সময় থাকতেই অনুতপ্ত হয়েছিলো , এবং আল্লাহ্‌র ক্ষমা লাভে সমর্থ হয়েছিলো। কিন্তু ইতিমধ্যে ইউনুস নবী , আল্লাহ্‌ কর্তৃক প্রদত্ত কর্মে সাময়িক ভাবে দৃশ্যতঃ অকৃতকার্য হওয়ার দরুণ নিনেভাবাসীদের উপরে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং রাগে দুঃখে তিনি নগরী ত্যাগ করেন।

কিন্তু আল্লাহ্‌র নবী হিসেবে তাঁর উচিত ছিলো সেই হতাশাভরা দুঃখের দিনগুলিতেও আল্লাহ্‌র করুণার উপরে নির্ভর করে ধৈর্য্য অবলম্বন করা এবং দৃঢ় পদক্ষেপে কর্তব্যকর্মে অগ্রসর হওয়া। সাফল্যের দাবীদার একমাত্র করুণাময় আল্লাহ্‌। কারণ আল্লাহ্‌ সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। আল্লাহ্‌-ই একমাত্র ক্ষমতাশালী নিনেভাবাসী ও তার নবীর উপরে। ইউনুস নবী নিনেভা নগরী ত্যাগ করে সমুদ্র যাত্রা করেন। কিন্তু জাহাজের নাবিকেরা তাঁকে "অপয়া" বা অশুভ কল্পনা করে তাঁকে গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। সেখানে তাঁকে এক বিরাট মাছ গিলে ফেলে। মাছের পেটের ভিতরে সেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে তিনি ব্যকুলভাবে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করেন, নিজের কৃত অপরাধ স্বীকার করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আল্লাহ্‌র হুকুম ব্যতীত তাঁর উপরে অর্পিত দায়িত্ব ত্যাগ করা এক মহা অপরাধ। " অন্ধকার থেকে আর্তনাদ করেছিলো।" " অন্ধকার " শব্দটি দ্বারা রাত্রির মত অন্ধকার যা মাছের পেটের মাঝে বিদ্যমান ছিলো তা বোঝানো হয়েছে। আক্ষরিক ভাবে , আবার আত্মার অন্ধকারকেও বোঝানো হয়েছে। কারণ ইউনুস নবী এ সময়ে হতাশার অন্ধকারে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। আর এই হতাশার অন্ধকার তাঁর আত্মাকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিলো। আল্লাহ্‌ পরম করুণাময়। তিনি তাঁকে ক্ষমা করেন। ফলে তিনি মাছের পেট থেকে অব্যহতি লাভ করেন এবং মাছ তাঁকে তীরে বমি করে ফেলে। ক্লান্ত অবসন্ন ইউনুস নবী তীরের তরুলতা দ্বারা আশ্রয় ও নিরাপত্তা লাভ করেন। অবশেষে তিনি বিপদমুক্ত হন এবং সুস্থতা লাভ করে স্বাস্থ্য ফিরে পেয়ে নিজের কর্তব্য কর্মে মনোনিবেশ করেন এবং শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করেন। এ ভাবেই তিনি অনুতাপ এবং আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা দ্বারা হতাশা ও ব্যর্থতা থেকে মুক্তি লাভ করেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে ক্ষমা করেন।

উপদেশ : আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহ্‌ কিছু না কিছু কর্তব্য কর্ম দ্বারা এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। জীবনের কোনও অবস্থাতেই সেই কর্মকে পরিত্যাগ করার অধিকার আমাদের নাই। ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা দ্বারাই শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করা যায়। কারণ পরের আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছিলেন, " আমি মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি।"

৮৮। সুতারাং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুর্দ্দশা থেকে উদ্ধার করলাম। এভাবেই আমি তাদের উদ্ধার করি যাদের ঈমান আছে।

৮৯। এবং [স্মরণ কর ] জাকারিয়ার ২৭৪৫ কথা , যখন সে তাঁর প্রভুর নিকট কেঁদে বলেছিলো, " হে আমার প্রভু! আমাকে নিঃসন্তান [ অবস্থায় ] ত্যাগ করো না, যদিও তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী ২৭৪৬। "

২৭৪৫। " আমাকে নিঃসন্তান অবস্থায় ত্যাগ করো না " এ স্থলে দেখুন আয়াত [ ১৯ : ২ - ১৫ ] এবং [ ৩ : ৩৮ - ৪১]। জাকারিয়া একজন পুরোহিত ছিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই ছিলেন একান্ত অনুগত এবং কর্তব্য কর্মে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও দৃঢ়। তাঁরা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তাঁদের কোনও বংশধর ছিলো না। এ ব্যাপারে জাকারিয়া মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত উদ্বেগ বোধ করছিলেন। উদ্বেগের কারণ এ নয় যে তিনি তাঁর বংশধর না রেখে এ ধরাধাম ত্যাগ করবেন, উদ্বেগের কারণ হচ্ছে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর অবর্তমানে তাঁর কর্মভার বহন করার লোকের বড় অভাব হবে। কারণ তিনি যদি কাউকে আল্লাহ্‌র কাজের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে না যান তবে আল্লাহ্‌র কাজের জন্য নিঃস্বার্থ ও বিশ্বস্ত লোক তাঁর মৃত্যুর পরে থাকবে না। আল্লাহ্‌ তাঁকে এক পুত্র সন্তান দান করেন। যার নাম রাখা হয়েছিলো ইয়াহিয়া [ John the Baptist ]। ইয়াহিয়া তাঁর বংশের আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত আনুগত্যের ধারাটি রক্ষা করেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে বলেছেন, " নেতা, জিতেন্দ্রীয় এবং পূণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী " [ ৩ : ৩৯]।
এভাবেই পিতা, মাতা এবং পুত্র প্রত্যেকেই ছিলো সৎকাজের যোগ্যতা সম্পন্ন , তারা সৎকাজে প্রতিযোগীতা করতো, পাপ থেকে দূরে থাকতো এবং আশা ও ভীতির সাথে আল্লাহ্‌র নিকট বিণীত থাকতো।

২৭৪৬। " তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী " আকাশ , পৃথিবী বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌। এই বিপুল বিশ্ব ভূবনের সৃষ্টি , রক্ষণাবেক্ষণ তাঁরই করুণা, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক ও মালিক। জাকারিয়া ছিলেন পূণ্যাত্মা। তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের এই সত্যকে অনুধাবন করেছিলেন খুব সহজেই যে, পৃথিবীর কিছুই স্থায়ী নয়। সুতারাং উত্তরাধিকারী বা বংশধারা যার জন্য মানুষ খুব ব্যগ্র থাকে তাও কিছু স্থায়ী নয়। তিনি উত্তরাধিকারী বা বংশধর রেখে যাওয়ার জন্য ব্যগ্র ছিলেন না। তাঁর আশঙ্কা ছিলো যে, হয়তো বা তাঁর মৃত্যুর পর আল্লাহ্‌র পথে আহ্বান করার জন্য অকৃত্রিম নিবেদিত প্রাণ আর কেউ থাকবে না। সেই কারণে তিনি এক পুত্র সন্তান কামনা করেন যাকে তিনি উপযুক্ত রূপে গড়ে তুলতে পারবেন।

৯০। সুতারাং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং ইয়াহ্‌ইয়াকে দান করেছিলাম। আমি তাঁর স্ত্রীর [ বন্ধ্যাত্ব ] আরোগ্য করেছিলাম ২৭৪৭। তারা [ তিনজন ] সৎ কাজে প্রতিযোগীতা করত। তারা আমাকে ভালোবাসা ও ভক্তি সহকারে ডাকতো , এবং নিজেদের আমার সামনে করতো বিনীত।

২৭৪৭। "Aslaha" - সংশোধন করে উন্নত করা। এখানে শব্দটি যোগ করা হয়েছে জাকারিয়ার স্ত্রীর সম্পর্কে। শব্দটির প্রয়োগ সম্পর্কে দুরকমের ব্যাখ্যা করা যায়। ১) তাঁর বন্ধ্যাত্ব দূর করে তাঁকে মাতৃত্ব ধারণের উপযোগী করা এবং ২) তাঁর আধ্যাত্মিক জগতের অন্ধকার দূর করে তাঁকে সমুন্নত করা হয়েছিলো মহামানব ইয়াহিয়ার [ John the Baptist ] মাতৃত্বের উপযোগী করার জন্য।

৯১। এবং [ স্মরণ কর ] সেই নারীকে যে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিলো। আমি তাঁর মধ্য আমার রুহুকে ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং আমি তাঁকে ও তাঁর পুত্রকে বিশ্বাসীর জন্য করেছিলাম এক নিদর্শন ২৭৪৮।

২৭৪৮। মরিয়ম [ আ ] ছিলেন হযরত ঈসা [ আ ] এর মাতা। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলছেন যে সতীত্ব ছিলো তাঁর বিশেষ গুণ। তিনি ছিলেন কুমারী মাতা। পিতা ব্যতীত সন্তানের জন্ম দান দ্বারা তিনি এবং তাঁর পুত্রকে আল্লাহ্‌ বিশ্ববাসীর জন্য করেছেন এক অলৌকিক নিদর্শন।

৯২। অবশ্যই তোমাদের এই উম্মত হচ্ছে একই উম্মত ২৭৪৯। এবং আমি তোমাদের প্রভু ও প্রতিপালক। সুতারাং আমার আনুগত্য কর [অন্য কারও নয় ]।

২৭৪৯। "Ummat " এই শব্দটি 'জাতি' শব্দটির দ্বারা অনুবাদ করা যায়। 'সম্প্রদায় ' 'শ্রেণী' বা 'বংশ ' , "জাতি" ইত্যাদি শব্দগুলিও উম্মত শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয়। আবার 'উম্মত' শব্দটির থেকে যে ভাবধারা প্রয়োগ হতে পারে তা হচ্ছে , "একই ধর্ম বিশিষ্ট " বা "জীবনধারা বিশিষ্ট "যার প্রয়োগ অন্যান্য স্থানে করা হয়েছে ; কিন্তু এ আয়াতে তা প্রযোজ্য নয়। এই আয়াতে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির প্রতি। বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারার অধিকারী। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে জাতির বা সম্প্রদায়ের জীবনে তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। কারণ এগুলি কোনটাই স্থায়ী নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনধারা আমূল পাল্টে যায়। ফলে জাতির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবই হয়ে পরে পরিবর্তনশীল। পৃথিবীতে স্থান ও কালের দূরত্বের জন্য , সময়ের ব্যবধানের জন্য , ভাষার পার্থক্যের জন্য, পরিবেশ ও প্রকৃতির বিভিন্নতার কারণে, মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ভাষাগত , সংস্কৃতিগত পার্থক্যের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র সেবায় নিয়োজিত, যাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন ও সান্নিধ্য লাভের কামনা , তারা পৃথিবীর যেখানেই বাস করুন না কেন, যে পরিবেশেই থাকুন না কেন তারা "একই জাতি" বা সম্প্রদায়। কারণ দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে যে পার্থক্য তা মানুষের রচনা। যে মুহুর্তে যে কোন ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জীবনকে নিয়োজিত করে সে বৃহত্তর উম্মত বা সম্প্রদায়ের তালিকাভূক্ত হয়ে যায়। সে নারীই হোক বা পুরুষই হোক সে বিশ্বমানবতার জন্য উৎসর্গীকৃত এক সম্মানজনক সম্প্রদায়ের সদস্যভূক্ত হয়ে যায়। যারা শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র এবাদত করে ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাঁর সেবা বা তাঁর সৃষ্টির সেবায় আত্ম নিয়োগ করে। এ ভাবেই তারা একই জাতি বা ধর্ম বিশিষ্ট। এভাবেই ইসলাম বিশ্ব মানবতার অগ্রপথিক।

৯৩। কিন্তু [ পরবর্তী প্রজন্ম ] তাদের ধর্মের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ফেলেছে , কিন্তু সকলেই আমার নিকট ফিরে আসতে হবে ২৭৫০।

২৭৫০। কালের প্রবাহে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ আল্লাহ্‌র প্রেরিত বিশ্বমানবতার এই শ্বাশত বাণীকে ভুলে যায়। ভুলে যায় যে, ধর্ম কোন আনুষ্ঠানিক ব্যাপার নয়। ধর্ম ও জীবন এক এবং অবিচ্ছেদ্য। সৃষ্টির আদি থেকে একটাই ধর্ম প্রচলিত হচ্ছে আর তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র একত্ববাদের ধর্ম। আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে " [ শুধুমাত্র ] আমার ইবাদত কর।" এভাবেই বিশ্বমানব সম্প্রদায় এক সম্প্রদায় , এক জাতিতে পরিণত হয়। সে কারণে আল্লাহ্‌র প্রেরিত সকল নবী রসুলকে ইসলামের দৃষ্টিতে সম্মানীয় বিবেচনা করা হয় এবং মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করে যে, তারা সকলেই এক মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী আল্লাহ্‌র নিকট থেকে প্রেরিত। এখানেই ইসলামে সাম্য বিরাজ করে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পূর্ববর্তী সম্প্রদায় আল্লাহ্‌র এই অমোঘ বাণীর তাৎপর্য অনুধাবন করে না, ফলে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে, শুধুমাত্র নাম সর্বস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধকে আকড়ে ধরে। এর ফলে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়। আল্লাহ্‌র বাণীর মূল মর্মার্থ জীবন থেকে হারিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় ধর্মের নামে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়। এক জাতির পরিবর্তে সৃষ্টি হয় বহু বিশ্বাসের ভিত্তিতে বহু জাতি, বহু সম্প্রদায়। এ সবই মানুষের সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল মূল্যবোধ অনুধাবন না করার ফলশ্রুতি।

উপদেশ : পূর্ববর্তী ধর্মীয় ভেদাভেদ সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে আজকের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এ কথা আজ সমভাবে প্রযোজ্য। বিশ্বব্যপী মুসলমানেরা আজ ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশ্ব সভাতে হচ্ছে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত।

রুকু - ৭

৯৪। যদি কারও ঈমান থাকে ও কোন সৎকাজ করে , তার প্রচেষ্টা কখনও প্রত্যাখান করা হবে না। আমি তা তাঁর অনুকূলে লিখে রাখবো ২৭৫১।

২৭৫১। 'সৎকাজ' অর্থাৎ 'ভালোকাজ' - মানুষের যে কোনও সৎকাজকে আল্লাহ্‌ হারিয়ে যেতে দেন না, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন। সৎকাজকে আল্লাহ্‌ অত্যন্ত সম্মান করেন এবং আল্লাহ্‌ বান্দাকে তাঁর সৎকাজের প্রতিদান করেন বহুগুণ বৃদ্ধি করে। যদি আল্লাহ্‌র প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস রেখে, শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সৎ কাজ করা হয় তবে বান্দার জীবনে তা হবে আত্মিক উন্নতির সোপান স্বরূপ। সৎ কাজ কখনও মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যায় না। আল্লাহ্‌র কাছে তার হিসাব লেখা থাকে।

৯৫। যে জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি তার লোকদের উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; তারা আর ফিরে আসবে না ২৭৫২,

২৭৫২। যখন কোন ব্যক্তি বা জাতি পাপের সর্বোচ্চ সীমায় উপণীত হয়, তখন সে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় নীত হয়। আল্লাহ্‌ শাস্তির সময়কাল সেই ব্যক্তি বা জাতির জন্য অতি আসন্ন। কোরাণ শরীফে এরূপ বহু জাতির বিবরণ আছে যারা আল্লাহ্‌র ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়ে ধবংস হয়ে যায়। যেমন সদম ও গোমরাহ্‌ শহরের বাসিন্দাদের পাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোনও আশা ছিলো না। এ সব ক্ষেত্রে কোরাণ শরীফে উল্লেখ আছে যে, যারা পূণ্যাত্মা আল্লাহ্‌র ক্রোধের প্রকাশের পূর্বেই তাদের সাবধান করে দেয়া হয় এবং তাঁদের ধ্বংসজজ্ঞ থেকে রক্ষা করা হয় যেমনটি করা হয়েছিলো হযরত নূহ্‌ ও লূতকে। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা ধ্বংস প্রাপ্ত হবে সে সব পাপীদের অনুতাপের ও সংশোধনের জন্য আর কোনও সুযোগ দেয়া হবে না। কারণ তারা তাদের সুযোগের সদ্ব্যবহার করার পরিবর্তে তা হাসি ঠাট্টার বিষয়বস্তুতে এবং অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত করেছিলো। সুতারাং তাদের আর পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হবে না। শেষ বিচারের দিনে তাদের পুনরুত্থিত করা হবে।

৯৬। যতক্ষণ না ইয়াযুজ মাজুজ [ সম্প্রদায়কে ] তাদের বন্ধন মুক্ত করা হবে ২৭৫৩। এবং তারা প্রত্যেক উচ্চস্থান থেকে পতঙ্গের পালের ন্যায় [ ঝাঁকে ঝাঁকে ] ছুটে আসবে।

২৭৫৩। ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্বন্ধে দেখুন টিকা ২৪৩৯ এবং আয়াত [ ১৮ : ৯৪ ]। এই নাম দুটি অসভ্য বর্বর জাতিদের প্রতি প্রতীক স্বরূপ ব্যবহার করা হয়। বুনো বর্বর জাতিরা পঙ্গপালের মত ঝাঁকে ঝাঁকে সমস্ত বাধা নিষেধের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে সমস্ত পৃথিবী অধিকার করে ফেলবে। ইয়াজুজ , মাজুজের নাম এখানে প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ রোজ কেয়ামতের পূর্বে সারা পৃথিবীতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে। অন্যায়কারী উচ্ছৃঙ্খল জনতার দখলে পৃথিবীর শাসন ভার চলে যাবে। এই হবে রোজ কেয়ামতের পূর্ব লক্ষণ। কোরাণের ভবিষ্যত বাণী এরূপ।

৯৭। তখন অমোঘ প্রতিশ্রুতি কাল নিকটে এসে পৌঁছবে। অতঃপর দেখো! অবিশ্বাসীদের চক্ষু আতঙ্কে স্থির হয়ে যাবে ২৭৫৪। " হায় ! দুর্ভোগ আমাদের ! সত্যই আমরা এ থেকে অমনোযোগী ছিলাম , আমরা [ বাস্তবিকই ] পাপ করেছিলাম। "

২৭৫৪। দেখুন আয়াত [ ১৪ : ৪২ ]।

৯৮। নিশ্চয়ই তোমরা [ অবিশ্বাসীরা ] এবং আল্লাহ্‌ বাদে তোমরা যে [মিথ্যা ] উপাস্যের এবাদত করতে সকলকেই জাহান্নামের ইন্ধন হতে হবে। [ অবশ্যই ] তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে।

৯৯। যদি তারা [ প্রকৃত ] উপাস্য হতো ,তবে তারা সেখানে প্রবেশ করতো না ২৭৫৫। কিন্তু প্রত্যেকেই সেখানে চিরকাল থাকবে।

২৭৫৫। সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রমাণ হচ্ছে ; সত্য শেষ পর্যন্ত বিকাশমান ও স্থায়ী , অপর পক্ষে মিথ্যা অস্থায়ী ও এর ধ্বংস অনিবার্য। সেরূপ যারা সত্যের পূজারী তাঁরা তাঁদের আত্মার মাঝে সত্যের আলোকে অনুধাবনে সক্ষম হবেন। সত্যের আলো তাদের পথের ঠিকানা বাতলে দেবে। এই সত্য হচ্ছে একত্ববাদ , সত্যের অনুধাবন হচ্ছে একত্ববাদের আলো। একত্ববাদ আত্মাকে সর্বোচ্চ সত্যকে অনুভবের ক্ষমতা দান করে যা একজন বহু ইলাহী এর এবাদতকারীর চরিত্রে জন্ম লাভ করে না। কারণ তাদের শেষ পরিণতি দোযখের আগুন। পৃথিবীতে তারা এই শাস্তির পরিণাম কল্পনাও করতে পারে নাই। সুতারাং যখন তারা শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করবে , তখন অনুতাপের মাধ্যমে ফিরে আসার উপায় থাকবে না। তখন শুধু আর্তনাদ , হাহাকার এবং দীর্ঘশ্বাস হবে তাদের স্থায়ী জীবন।

১০০। তাদের নিয়তি হবে কাঁদা; সেখানে তারা কিছুই শুনতে পাবে না।

১০১। যাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে পূর্বেই মঙ্গল নির্ধারিত হয়েছে তাদের সেখান থেকে বহু দূরে রাখা হবে ২৭৫৬।

২৭৫৬। অপর পক্ষে , যারা সৎকর্মশীল এবং একত্ববাদের সত্যে বিশ্বাসী তাদের তুলনা করা হয়েছে ঐ সব বহুশরীকবাদী দোযখবাসীদে সাথে। এ সব সৎকর্মশীল ও সত্যে বিশ্বাসীদের নিকট দোযখের কোন আর্তনাদ, হাহাকার বা দীর্ঘশ্বাস পৌঁছবে না। সত্যের আলোতে উদ্ভাসিত এ সব আত্মার সকল আশা আকাঙ্খা পরিপূর্ণভাবে এবং অনন্তকালের জন্য পূর্ণ করা হবে এবং তাদের পৌঁছে দেয়া হবে স্থায়ী সুখ শান্তির ঠিকানায়। এই ঠিকানা পৃথিবীর সুখের মত ক্ষণস্থায়ী হবে না। তা হবে অনন্তকাল ব্যপী, চিরস্থায়ী।

১০২। তারা [ পূণ্যাত্মারা ] দোযখের ক্ষীণতম শব্দও শুনবে না। তাদের আত্মা যা চায়, তারা তার মধ্যেই [ চিরকাল ] থাকবে।

১০৩। মহাভীতি তাদের কোন দুঃখ দেবে না ২৭৫৭। পক্ষান্তরে ফেরেশতারা তাদের অভ্যর্থনা করবে এই বলে, " আজকে তোমাদের দিন, যে দিন সম্বন্ধে তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো। "

২৭৫৭। শেষ বিচারের দিনে পাপীদের অন্তর জবাবদিহিতার আতঙ্কে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু যারা পূণ্যাত্মা তারা থাকবেন এসব ভয় ভীতি , উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা ও দুঃখ দুর্দ্দশা মুক্ত। এই সেই দিন যেদিন তাদের আশা আকাঙ্খার পরিপূর্ণতা লাভ করবে। সুখ ও শান্তি তাদের জীবনকে ধন্য করবে। পৃথিবীর সৎ কর্মফল পরলোকে তাদের সাফল্যের স্বর্ণ দুয়ারে পৌঁছে দেবে। সেখানে তাদের ফেরেশতারা স্বাগতম জানাবে, সাদরে অভ্যর্থনা করবে। আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে লাভের মাধ্যমে তাদের মানব জীবনের সর্বোচ্চ সফলতা লাভ করবে, অপার নিঃসীম শান্তির ক্রোড়ে হবে তাঁদের অবস্থান।

১০৪। সেদিন আকাশমন্ডলীকে আমি গুটানো কাগজের ন্যায় পেঁচিয়ে গুটিয়ে ফেলবো। যে ভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম , সেভাবেই আমি নূতন সৃষ্টি করবো ২৭৫৮। যে প্রতিশ্রুতির দায়িত্ব আমি নিয়েছি, আমি তা অবশ্যই পালন করবো।

২৭৫৮। প্রাচীন কালে দলীল দস্তাবীজ, ফরমান ইত্যাদি গুটিয়ে রাখা হতো। এই গুটানোকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সেই দিন যেদিন সারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কাজকে শেষ করে গুটিয়ে ফেলা হবে। এখানে আকাশমন্ডলী দ্বারা পৃথিবী এবং সারা বিশ্ব জাহান অর্থাৎ নভোমন্ডল, গ্যালাক্সী ইত্যাদি সকলকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্‌ যদি শূন্য থেকে পৃথিবী সৃষ্টির ক্ষমতা রাখেন [Big Bang Theory ] , তবে তাঁর পক্ষে নূতন পৃথিবী সৃষ্টিও সম্ভব। এ হবে সম্পূর্ণ নূতন পৃথিবী , হয়তো বা তা হবে নূতন মাত্রা বিশিষ্ট [ Another Plane ] , যার সম্বন্ধে বর্তমান মানুষের ধারণা করাও সম্ভব নয়। এই হচ্ছে বিশ্ববিধাতার পরিকল্পনা, এই তাঁর প্রতিজ্ঞা। নূতন মাত্রার পৃথিবীর জন্য দেখুন [ ১৪ : ৪৮ ] , [ ৫৬ : ৬১ ] আয়াত।

১০৫। নিশ্চয়ই আমি [ মুসার ] সর্তককারী তাওরাতের পরে যবুরের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি যে , " আমার পূণ্যাত্মা সৎ বান্দারাই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে।" ২৭৫৯, ২৭৬০।

২৭৫৯। "" দাউদ নবীর কাছে প্রার্থনা সংগীত পূর্ণ যে কিতাব প্রেরণ করা হয় তার নাম যবুর "। দাউদ নবীর উল্লেখের সাথে আয়াতে [ ৪ : ১৬৩ এবং ১৭ : ৫৫ ], 'যবুরের' উল্লেখ আছে। যবুরে যে সব উপদেশ আছে তা নিম্নরূপ : "Psalms xxv : 13 , " his seed shall inherit the earth" xxxvii : 11, " The meek shall inherit the earth" [ quoted by Jesus in Matt v . 3 ] ; and xxxvii : 29 , "The righteous shall inherit the land" কোরাণের উপদেশ হচ্ছে, My servants / the righteous , shall inherit the earth. যার বাংলা অনুবাদ হয়েছে, " পূণ্যাত্মা সৎ বান্দারাই পৃথিবীর অধিকারী হবে।"

২৭৬০। একই প্রতিশ্রুতি আছে Pentatench বা বাইবেলের প্রথম পাঁচটি খন্ডে Exod xxxii : 13.

১০৬। নিশ্চয়ই এই [ কোর-আন হচ্ছে ] তাদের জন্য উপদেশ যারা [ প্রকৃতই ] আল্লাহ্‌র এবাদত করে ২৭৬১।

২৭৬১। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের সর্বোচ্চ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে কোরাণ শরীফ নাজেল হওয়ার মাধ্যমে। কোরাণ পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশ সমূহকে সত্যায়ন করে, মানুষ এ সব প্রত্যাদেশের যে সব অংশ বিকৃত করে ফেলেছিলো , কোরাণ তা সংশোধন করে এবং যারা আল্লাহ্‌র প্রকৃত এবাদতকারী তাদের জন্য আছে বিশদ ব্যাখ্যা ও সত্য পথের পথ- নির্দ্দেশ। কোরাণ জাতি , ধর্ম , স্থান কাল নির্বিশেষে , সকলের জন্য , তারা পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী হোক কিংবা না হোক, সকলের জন্য সুপথ প্রদর্শক। কারণ এখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে , " এতে রয়েছে তাদের জন্য উপদেশ যারা আল্লাহ্‌র এবাদত করে।" অর্থাৎ যারা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র একত্বে বিশ্বাসী। যাদের এবাদতে কোনও অংশীদারিত্ব নাই, জাতি, ধর্ম , নির্বিশেষে তাদের জন্য কোরাণ হচ্ছে সত্য পথের দিশারী , পথ প্রদর্শক।

১০৭। এবং আমি তোমাকে সকল সৃষ্টির জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি ২৭৬২।

২৭৬২। এই আয়াতটির মাধ্যমে এই সত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হযরত মুহম্মদ [ সা ] কে আল্লাহ্‌ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে 'বিশ্ব জগত' অর্থাৎ সারা দুনিয়ার জন্য রহমত স্বরূপ। জাতিতে - জাতিতে, বা আল্লাহ্‌র নির্বাচিত শ্রেণীর দাবীদার, বা ইব্রাহীমের প্রজন্ম , বা দাউদ নবীর প্রজন্ম, হিন্দু বা ইহুদী অথবা অ-ইহুদী, আরব - অথবা অ-আরব, তুর্কী অথবা তাজিক, ইউরোপীয়ান অথবা এশিয়ান, সাদা অথবা কালো, আর্য অথবা অনার্য , মঙ্গোলিয়ান অথবা আফ্রিকান, আমেরিকান অথবা অস্ট্রেলিয়ান , একেশ্বরবাদী অথবা বহু ঈশ্বরবাদী পৃথিবীর সকলের জন্য তিনি হচ্ছেন রহমত স্বরূপ। যাদেরই আল্লাহ্‌ আধ্যাত্মিক দায়িত্ব দান করেছেন তাদের সকলের জন্য এই আয়াতের বক্তব্য প্রযোজ্য। ইসলাম হচ্ছে সার্বজনীন বিশ্ব ধর্ম।

১০৮। বল, " আমার নিকট যে ওহী এসেছে তা হচ্ছে , তোমাদের একমাত্র প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ্‌। সুতারাং তোমরা কি তাহলে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে অনুগত হবে [ ইসলামে ] ? " ২৭৬৩।

২৭৬৩। এই বিশাল মহা-বিশ্ব , আকাশ - পৃথিবীর স্রষ্টা একজনই , আর তিনি-ই শুধুমাত্র সকলের এবাদতের অধিকারী। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় , তিনি স্রষ্টা , পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা।

১০৯। কিন্তু যদি তারা [ অবাধ্যভাবে ] ফিরে যায়, তবে বল, " আমি তোমাদের সকলের নিকট সমান ভাবে উপদেশ ও সত্যকে ঘোষণা করেছি। কিন্তু আমি জানি না তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা নিকটে না দূরে ২৭৬৪।

২৭৬৪। রসুলুল্লাহ্‌ [ সা ] যে বাণী প্রচার করেছেন , কেউ যদি তার মর্মার্থ অনুধাবন করতে না পারে , তবে সে দায়িত্ব রসুলুল্লাহ্‌ -র [ সা ] নয়। মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব কারণ স্রষ্টা তাকে সীমিত আকারে হলেও "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি"দান করেছেন, সে ইচ্ছা করলে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করতে পারে। অথবা মন্দকে গ্রহণ ও ভালোকে বর্জন করতে পারে। এই স্বাধীনতা স্রষ্টা আদম - সন্তানকে দান করেছেন এবং এখানেই মানুষের প্রাণী জগতে শ্রেষ্ঠত্ব। তবে এই "স্বাধীন সীমিত ইচ্ছা শক্তির " জবাবদিহিতা তাকে করতে হবে পরকালে। রসুল [সা] পূণ্যাত্মাদের সুখবর ও পাপীদের সাবধান করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি নিরপেক্ষ , কোনও ব্যক্তি বা জাতি বা গোষ্ঠির প্রতি কোন বিশেষ অনুগ্রহ দেখান নাই এবং একবিন্দু সত্যকেও তিনি গোপন করেন নাই। সত্যকে তিনি প্রচার করেছেন মুক্ত ভাবে সততার সাথে। অবিশ্বাসীরা রসুলকে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ রসুলকে বলতে বলেছেন, " আমি জানি না, তা নিকট না দূরে " একমাত্র আল্লাহ্‌র নিকট কেয়ামত দিবসের জ্ঞান, তিনি ব্যতীত এ জ্ঞান আর কারও কাছে নাই।
১১০। " তোমাদের কথায় যা প্রকাশ কর এবং যা [ তোমাদের অন্তরে ] গোপন রাখ তিনি [সব ] জানেন ২৭৬৫।

২৭৬৫। আল্লাহ্‌র রসুল [ সা ] আল্লাহ্‌র সত্যকে সারা বিশ্ব জাহানের জন্য প্রচার করেছেন। এই সত্যকে গ্রহণের মাধ্যমেই মানুষ 'সরল পথ' বা সঠিক পথের ঠিকানা খুঁজে পায়, কে সঠিক পথে চলার জন্য আন্তরিক আর কে শুধুমাত্র নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভান করে তা সবই রাব্বুল আলামীন মহান আল্লাহ্‌র নিকট দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। মোনফেকরা নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভালো মানুষের ছদ্মবেসে নিজেকে জাহির করে এবং মুসলিম উম্মার সৎ সম্প্রদায়ের নিকট গমন করে। তাদের কাজে কোনও মহৎ উদ্দেশ্য বা আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা থাকে না। পৃথিবীর কেউ মোনাফেকদের মনের এই ভাব বা চিন্তাধারার টের না পেলেও মহাশক্তিধর আল্লাহ্‌র নিকট কিছুই গোপন থাকে না।

১১১। " আমি জানি না , [তোমাদের জন্য পার্থিব ] জীবনোপকরণ কিছুকালের জন্য অনুমোদন করা , হয়তো তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা বিশেষ।" ২৭৬৬

২৭৬৬। সৎ উদ্দেশ্য ও সৎ কর্ম যে পৃথিবীতে সর্বদা স্বীকৃতি লাভ করে তা সত্য নয়। বরং জগৎ সংসারে এর বিপরীত ব্যবস্থাই ঘটে থাকে। যারা অসৎ ও মোনাফেক তারাই জগৎ সংসারে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা পায়। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে কারও জাগতিক ও পার্থিব সমৃদ্ধিতে যেনো সৎ লোকদের মনঃকষ্ট না হয়। কারণ এই জাগতিক ও পার্থিব বিষয়বস্তু বান্দার জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। এ সবের সঠিক ব্যবহার করতে না পারলে পরলোকের জবাবদিহিতা হবে অত্যন্ত কঠিন। এ সব পার্থিব সম্পদ না থাকা মানেই দুর্ভাগ্য নয়। হয়তো প্রলোভন, পাপ ইত্যাদি থেকে ইহকালে অব্যহতি দেয়ার জন্যই স্রষ্টার এই ব্যবস্থা পূণ্যাত্মাদের জন্য। রসুলকে [ সা ] আল্লাহ্‌র এই বার্তা প্রচারের জন্য নির্দ্দেশ দান করেছেন এই আয়াতে।

১১২। বল, ২৭৬৭, " হে আমার প্রভু ! তুমি ন্যায়ের সাথে ফয়সালা করে দিও " ২৭৬৮। " আমাদের প্রভু পরম করুণাময়, তোমরা  আল্লাহর প্রতি যে বিদ্রোহ বাক্য উচ্চারণ করছো তার বিরুদ্ধে আমরা তাহারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।" ২৭৬৯।

২৭৬৭। দেখুন টিকা ২৬৬৬ এবং আয়াত [ ২১ : ৪ ]। ইউসুফ আলী সাহেবের মতে অনুবাদ হওয়া উচিত "বল" - যার দ্বারা রসুলের [ সা ] প্রতি আল্লাহ্‌র আদেশকে বোঝায়। আয়াত [ ২১ : ১০৯ - ১১২ ] গুলির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ রাসুলকে [ সা ] তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হতে আদেশ দিয়েছেন। ১) আয়াত [ ২১ : ১০৯ - ১১১ ] গুলিতে যারা আল্লাহ্‌র হেদায়েত থেকে বিমুখ তাদের সম্বোধন করা হয়েছে। ২) [২১ :১১২ ] আয়াতের প্রথমার্ধে " হে আমার প্রতিপালক ! তুমি ন্যায় বিচার করো " আল্লাহ্‌র নিকট প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। এবং ৩) [ ২১ : ১১২ ] আয়াতের শেষার্ধে " আমাদের প্রভু পরম করুণাময়, তোমরা  আল্লাহর প্রতি যে বিদ্রোহ বাক্য উচ্চারণ করছো তার বিরুদ্ধে আমরা তাহারই সাহায্য প্রার্থনা করি।" বিশ্বাসীদের জন্য পরোক্ষভাবে উপদেশ প্রদান করা হয়েছে।

২৭৬৮। " ন্যায়ের সহিত ফয়সালা করে দিও " এই বাক্যটি দ্বারা বিভিন্ন ভাবকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্‌র ফয়সালা কামনা করেছেন তাঁর প্রেরিত দূত ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে অথবা মোমেন বান্দা ও তাদের যারা উপহাস করতো নিম্ন অবস্থার জন্য তাদের মধ্যে। আর এই ফয়সালা একদিন হবেই - এ অবধারিত সত্য। এবং আল্লাহ্‌র বাণীর প্রচারক ও মোমেন বান্দারা অবশ্যই এ ব্যাপারে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপরেই নির্ভর করবে।

২৭৬৯। আল্লাহ্‌র নিন্দা এক মহাপাপ। আমরা সর্বদা আমাদের নিজেদের এই মহাপাপ থেকে বিরত রাখবো। শুধু নিবৃত রাখা নয় সদা সর্বদা নিজেদের সর্তকাবস্থায় রাখবো যেনো এ পাপ আমাদের স্পর্শ না করে। কিন্তু অন্যকে যদি আমরা এ পাপ থেকে বিরত রাখতে না পারি তখন আমাদের যে কর্তব্য তারই ইঙ্গিত এখানে দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা সেই সর্বশক্তিমানের ক্ষমতার উপরে নির্ভর করবো। কখনও জিঘাংসা বৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করবো না। "তোমরা  আল্লাহর প্রতি যে বিদ্রোহ  বাক্য .............. " অর্থাৎ তিনিই একমাত্র আশ্রয়স্থল।

মন্তব্য : আজকে বাংলাদেশে ধর্মের নামে যে হানাহানি চলছে তার সমাধান আছে এই আয়াতে।