Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ২ জন
আজকের পাঠক ৩৫ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৫৬৮ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৮৬১ বার
+ - R Print

সূরা মু'মিনূন


সূরা মু'মিনূন বা বিশ্বাসী - ২৩

১১৮ আয়াত, ৬ রুকু , মক্কী
[দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : এই সূরার মূল বক্তব্য হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলী যা মুমিন বা বিশ্বাসী হওয়ার 'বীজতলা ' বা মূলভিত্তি। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেই রূপ পরিবেশের যখন সত্যকে অস্বীকার করা হয় এবং সত্যের অনুসারীদের অত্যাচার ও অপমানে জর্জরিত করা হয়। সত্য এক, অদ্বিতীয় এবং সন্দেহাতীত এবং শেষ পর্যন্ত সত্য চিরস্থায়ী। যারা পাপের রাস্তায় থাকে তাদের শেষ মুহুর্তের অনুতাপ গ্রহণযোগ্য হবে না।

এই সূরাটি মক্কাতে অবতীর্ণ সূরাগুলির শেষ দিকে অবতীর্ণ।

সার সংক্ষেপ : বিশ্বাসের বা ঈমানের ভিত্তি যখন বিনয়, প্রার্থনা ও দানের সাথে সমন্বিত হয়; অহংকার ও প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকে এবং জীবন যখন একনিষ্ঠ সততার দ্বারা পরিচালিত হয়, তখনই আত্মিক সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করা সম্ভব হয়। সেজন্য হয়তো তাঁকে মানুষের ঠাট্টা বিদ্রূপ সহ্য করতে হয় - যেমন করতে হয়েছিলো নূহ্‌ , মুসা এবং ঈসা নবীকে [ ২৩ : ১ - ৫০]।

আল্লাহ্‌র নবী - রসুলেরা এবং মোমেন বান্দারা একই ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু যারা বিভেদ সৃষ্টিকারী তারা কিছুতেই সত্য বিশ্বাসের বহু নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা সত্বেও আল্লাহর মহত্ব ও করুণার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে না [ ২৩ : ৫১ - ৯২ ]।

মন্দকে ভালোর দ্বারা এবং আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাসের দ্বারা অবদমিত করতে হবে। পরলোকের জীবন অবশ্যাম্ভবী সত্য। যারা অবিশ্বাসী তারা পরলোকে অনুতাপ করার জন্য সুযোগ প্রার্থনা করবে। কিন্তু তখন তা হবে সূদূর পরাহত। [ ২৩ : ৯৩ - ১১৮ ]

অষ্টাদশ পারা

সূরা মু'মিনূন বা বিশ্বাসী - ২৩

১১৮ আয়াত, ৬ রুকু , মক্কী
[ দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


০১। বিশ্বাসীরা [শেষ পর্যন্ত ] জয়ী হবে, - ২৮৬৫

২৮৬৫। "Aflaha"- জয়লাভ করা , সমৃদ্ধি লাভ করা , সাফল্য লাভ করা, নির্দ্দিষ্ট অভীষ্টে পৌঁছানো , জাগতিক দুঃখ-কষ্ট ও পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা। এই আয়াতটি ১০ এবং ১১ নম্বর আয়াতের সাথে সংযুক্ত। এই পৃথিবীতেই সাফল্য বা বিজয় আসতে পারে , কিন্তু মোমেন বান্দাদের জন্য পরলোকের সাফল্য স্থায়ী ও নির্ধারিত সত্য।

০২। যারা সালাতে নিজেদের বিনয়ী রাখে , ২৭৬৬;

২৭৬৬। মোমেন বান্দাদের সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে যে সব বৈশিষ্ট্যের বা গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে তার শীর্ষে রয়েছে 'বিনয়ের " বা নম্রতার স্থান। সালাতে নম্রতার অর্থ : ১) আল্লাহ্‌র উপস্থিতি নিজের আত্মার মাঝে অনুভব করা এবং সেই মহাশক্তিধরের উপস্থিতিতে নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও অসহায়ত্ব উপলব্ধি করা। ২) আল্লাহ্‌র সাহায্য ব্যতীত নিজস্ব ক্ষমতা বা শক্তি যে মূল্যহীন এই বোধ নিজের ভিতরে অনুভব করা ; ৩) নিজস্ব চাওয়া ও পাওয়াকে আল্লাহ্‌র নিকট নিবেদন করা এবং তা আল্লাহ্‌র করুণায় পাওয়ার আকাঙ্খা করা।

০৩। যারা অসার বাক্য পরিহার করে;

০৪। যারা দান কাজে সক্রিয় ;

০৫। যারা [ অ-অনুমোদিত ] যৌন কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখে , ২৮৬৭

২৮৬৭। যৌন জীবন মানর জীবনচক্রের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু এই জীবনকে উচ্ছৃঙ্খলভাবে ব্যয় করা চলবে না। সংযত যৌন জীবন যাপন আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশ। মুসলমান সকল প্রকার যৌন অসংযতা থেকে দূরে থাকবে এবং ব্যভিচার ও উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে নিজেকে পবিত্র রাখবে। দেখা গেছে সমাজে বিভিন্ন পাপের উৎপত্তি , জন্মলাভ করে থাকে ব্যভিচার থেকে। এ ব্যাপারে ফ্রয়েডের মনঃস্থাত্বিক বিশ্লেষণ এ কথা স্বীকার করে যে, মানুষের সুপ্ত বহু ইচ্ছা যৌন ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। আমরা দৈনন্দিক জীবনে এর প্রতিফলন দেখে থাকি। খ্যাতি , প্রভাব-প্রতিপত্তি বা শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ শিখর থেকে পতন ঘটে যৌন অধঃপতন থেকে। ইসলামের নির্দ্দেশ হচ্ছে বিবাহ বহির্ভূত যৌন জীবনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা। যৌন জীবনে বিবাহের মাধ্যমেই একমাত্র প্রবেশিধাকার লাভ করা যাবে এবং সেখানে নারী ও পুরুষের নিজস্ব অধিকারের ভিত্তিতে তা নিয়ন্ত্রিত হবে।

০৬। যাদের সাথে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ অথবা অধিকারভূক্ত দাসীগণ [ বন্দী ] ব্যতীত ২৮৬৮, এক্ষেত্রে তারা নিন্দনীয় হবে না।

২৮৬৮। এ সম্বন্ধে বিশদভাবে বলা হয়েছে [ ৪ : ২৫ ] আয়াতে।

০৭। কিন্তু যারা এই সীমাকে অতিক্রম করতে ইচ্ছা করে, তারা সীমালংঘনকারী ; -

০৮। যারা বিশ্বস্তভাবে তাদের আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে ২৮৬৯;

২৮৬৯। আমানত ও প্রতিশ্রুতি দুধরণের হতে পারে : লিখিত বা প্রকাশ্য এবং অলিখিত বা অপ্রকাশ্য। লিখিত আমানাত হচ্ছে : সম্পত্তি বা দায়িত্ব যা লিখিত ভাবে অন্যকে অর্পন করা হয় - যেমন চাকুরীরত কর্মকর্তারা সরকারের অধীনে জনসাধারণের কাজের জন্য নির্দ্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। জনগণের এই দায়িত্ব তাদের আমানত ইত্যাদি। অলিখিত বা অপ্রকাশ্য আমানতের উৎস বা উৎপত্তিস্থল হচ্ছে , ক্ষমতা, অথবা সুযোগ সুবিধা, মর্যদা বা সামাজিক বন্ধন ইত্যাদি যেমন :রাজার নিকট তার রাজ্য আল্লাহ্‌র নিকট থেকে প্রাপ্ত তার প্রজা সাধারণের অপ্রকাশ্য আমানত।

আমানত ও প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার দুটি শব্দ পরস্পর পরস্পরের সম্পূরক। চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি জন্ম দেয় বা সৃষ্টি করে বাধ্যবাধকতার বা আমানতের, চুক্তি ও আমানত আমাদের সমাজ জীবনে লিখিত বা অলিখিত হতে পারে তাতে কিছু যায় আসে না। আমানতের প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি মানব জীবনকে সামাজিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাধ্যবাধকতার বন্ধনে আবদ্ধ করে। এ সম্বন্ধে বিশদ ব্যাখ্যার জন্য দেখুন টিকা ৬৮২ এবং আয়াত [ ৫:১ ]।

০৯।এবং যারা [ কঠিনভাবে ] তাদের সালাতকে রক্ষা করে; ২৮৭০

২৮৭০। আয়াত [ ২৩ : ২ ] এ নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে বিনয় ও একাগ্রতার সাথে প্রার্থনা করার জন্য। এই আয়াতে বিশেষভাবে বলা হয়েছে প্রার্থনা বা সালাতকে নিয়মিত ভাবে পালনের অভ্যাস গঠনের জন্য। কারণ নিয়মিত অভ্যাস আত্মিক শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। এবং সালাত ব্যক্তির আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের সহায়ক। এ ভাবেই সাতটি অমূল্য নির্দ্দেশনার মাধ্যমে ঈমানের রূপরেখাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই সাতটি অমূল্য রত্ন হচ্ছে : ১) বিনয় ২) অহংকার ও আত্মগরিমা ত্যাগ করা ৩) দান ৪) যৌন পবিত্রতা ৫) আমানতের বিশ্বস্ততা ও ৬) প্রতিশ্রুতির বিশ্বস্ততা এবং ৭) একান্তভাবে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খা।

১০। তারাই হবে উত্তরাধীকারী , ২৮৭১

১১। তারাই উত্তরাধীকার সুত্রে জান্নাত লাভ করবে। সেখানে তারা [ চিরদিন ] বাস করবে।

২৮৭১। দেখুন আয়াত [ ২১ : ১০৫ ] যেখানে বলা হয়েছে " আমার সৎ কর্মপরায়ন বান্দাগণ পৃথিবীর অধিকারী হবে।" এই সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের কথা যারা সাফল্য অর্জন করবে। এরা হলেন মুমিন বান্দা - ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সকল সাফল্য তাদের জন্যই। কারণ পৃথিবীতে সত্যের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই। অসত্য ও অন্যায়ের স্থায়ীত্ব ক্ষণস্থায়ী। তবে এই বিজয় দর্শন ব্যক্তিগত ভাবে কোনও ব্যক্তির জীবনে নাও ঘটতে পারে। অনেক সময়েই অন্যায় ও অসত্যের ধুম্রজাল কিছুকালের জন্যে সত্যের আলোকে ডেকে ফেলতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিথ্যা ও অন্যায়ের কালো মেঘ অপসারিত হবেই হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে কেউ এর প্রভাব প্রত্যক্ষ নাও করতে পারেন কিন্তু এ কথা সত্য যে পরবর্তী বংশধরেরা পূর্ববর্তীদের সত্যের জন্য ত্যাগ তিতিক্ষার সুফল অবশ্যই ভোগ করবে। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবেই। এই পৃথিবীতে সকলেই তাদের সত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকারে ফলাফল স্বচক্ষে দেখে যেতে নাও পারেন এ কথা সত্য , কিন্তু পরলোকে তারা তাদের কর্মফল স্বচক্ষে দেখতে সক্ষম হবেন। আল্লাহ্‌ বেহেশতের সৃষ্টি করেছেন পূণ্যাত্মা বা মোমেন বান্দাদের জন্য। মৃত্যুর পরে সকল মোমেন বান্দারা তাদের সুকর্মের ফল ভোগ করবেন।

১২। আমি মানুষকে [ কাদার ] সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি ২৮৭২;

২৮৭২। আলোচ্য আয়াত সমূহে মানব সৃষ্টির সাতটি স্তরের উল্লেখ করা হয়েছে। সর্ব প্রথম স্তর মৃত্তিকার উপাদান, দ্বিতীয় স্তর বীর্য, তৃতীয় স্তর জমাট রক্ত , চতুর্থ স্তর মাংসপিন্ড, পঞ্চম অস্থি-পিঞ্জর, ষষ্ঠ অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃতকরণ সপ্তম সৃষ্টির পূর্ণত্ব অর্থাৎ রূহ সঞ্চারকরণ। এই আয়াতগুলির মাধ্যমে মহান স্রষ্টার নিপুন শিল্পকর্মকে তুলে ধরা হয়েছে এবং মানবকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে তার শেষ পরিণতি ও ভবিষ্যত , যার উল্লেখ আছে আয়াত [ ১০ - ১১ ] তে। আয়াত [ ২ : ১১৭ ] উল্লেখ আছে আল্লাহ্‌ শূন্য থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি করেন তাঁর আদেশের মাধ্যমে। এখানে এই আয়াতগুলিতে সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা করা হয় নাই। বর্ণনা করা হয়েছে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার একটি ধাপ আর সে ধাপটি হচ্ছে মানুষ সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর। সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর মূল কণিকা প্রাণহীন অজৈব পদার্থ জীবন লাভে সক্ষম হয়। মাটির অজৈব পদার্থ তরুলতার মাধ্যমে জৈব পদার্থে রূপ লাভ করে এবং খাদ্যের মাধ্যমে তা দেহভ্যন্তরে স্থান পায়। প্রাণীদেহ তা শুক্রে রূপান্তরিত করে। এই শুক্র স্ত্রীকোষের ডিম্ব দ্বারা নিষিক্ত হয়ে মায়ের জরায়ুতে নিরাপদে স্থান লাভ করে। নিষিক্ত ডিম্বটি এখানে সৃষ্টি প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে। প্রথম স্তরে নিষিক্ত ডিম্বটি জমাট রক্ত পিন্ডে পরিণত হয় , যা জীববিজ্ঞানে "জাইগট" নামে পরিচিত পরবর্তী স্তরে "জাইগটের" বিভক্তিকরণ শুরু এবং ভ্রূণের সৃষ্টি হয় , পরবর্তীতে ভ্রূণ একটি নির্দ্দিষ্ট পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। ফলে ভ্রূণ থেকে হাড়, মাংস, এবং বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের সৃষ্টি হয়। এ পর্যন্ত মানব শিশুর সৃষ্টি ও প্রাণীকূলের সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য নাই। কিন্তু পার্থক্য আছে শেষ স্তরে। শেষ স্তরকে আল্লাহ্‌ এ ভাবে বর্ণনা করেছেন , " অবশেষে উহাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে [ ২৩ : ১৪]।" যার ফলে মানব শিশু প্রাণী শিশু থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। আর এই ভিন্নতার কারণ, মানব শিশুর মাঝে আল্লাহ্‌র রূহকে প্রবেশ করানো হয়, দেখুন আয়াত [ ১৫ : ২৯ ]। রূহ বা আত্মার এই অনুপ্রবেশ হতে পারে ধারাবাহিক। দেহের বৃদ্ধির সাথে সাথে আত্মারও পরিবর্ধন ও পরিবর্তন ঘটে। শিশু জন্মলাভ করে, বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় ও যৌবনে পদর্পন করে , আবার বার্দ্ধক্যে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের আত্মিক পরিবর্তনও সাধিত হয়। মানব জীবনে মৃত্যুই শেষ কথা নয়। মৃত্যুর মাধ্যমে সে প্রবেশ করে অন্য ভূবনে, যে ভূবনে সে এই পৃথিবীর সকল স্মৃতি ও কর্মকান্ডের হিসাব বহন করে নিয়ে যায়।

১৩। অতঃপর উহাকে শুক্র বিন্দুরূপে স্থাপন করি নিরাপদ আঁধারে ২৮৭৩।

২৮৭৩। জরায়ুতে ভ্রূণ সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় নিঃশব্দে , লোকচক্ষুর অন্তরালে। ভ্রূণকে মাতৃজঠরের নিরাপদ আশ্রয়ে স্রষ্টা স্থাপন করেন যে রকম ভাবে নৃপতি দুর্গের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে। ভ্রূণকে মাতৃজঠরে জরায়ূর অভ্যন্তরে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সংশ্লিষ্ট করে দেয়া হয়, যেনো সে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে নিরাপত্তা লাভ করে, বৃদ্ধি লাভ করে ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত।

১৪। পরে আমি শুক্র বিন্দুকে জমাট রক্তপিন্ডে পরিণত করি। অতঃপর ঐ পিন্ড থেকে [ভ্রূণের ] পিন্ড তৈরী করি। অতঃপর সেই পিন্ড থেকে অস্থি তৈরী করি এবং অস্থিকে মাংস দ্বারা ঢেকে দেই। অবশেষে তা থেকে আমি উহা অন্য সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি। সুতারাং আল্লাহ্‌ মহান , সর্বোত্তম স্রষ্টা ২৮৭৪।

২৮৭৪। " অবশেষে তা থেকে আমি উহা অন্য সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি" - এই লাইনটির মাধ্যমে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের অপূর্ব নিদর্শনকে তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণ প্রাণী থেকে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। অনুধাবন সম্পন্ন মানুষকেই স্তম্ভিত করবে স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুন্য। প্রাণহীন মৃত্তিকার ধূলি থেকে [ ২২ : ৫ ] প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। মাটির মূল উপাদান অজৈব মৌলিক পদার্থ সমূহ প্রাণের মূল জৈব পদার্থ প্রোটপ্লাজমে রূপান্তরিত হয়। প্রোটপ্লাজমই হচ্ছে প্রতিটি জীব কোষের মূল উপাদান। এখান থেকেই প্রাণের উৎপত্তি। আবার প্রাণী জগতে মানুষের সৃষ্টি এক অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি। কারণ প্রাণীকূল ও মানব একই জৈবিক নিয়মের নিয়ন্ত্রনাধীন। উভয়ে জন্ম গ্রহণ করে, খাদ্য গ্রহণ করে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, প্রজনন করে, আবার এক সময়ে মৃত্যু বরণ করে। উভয়ের শরীর বৃত্ত [Physiology ] একই নিয়মের অধীন। কিন্তু আল্লাহ্‌র বিশেষ দান [ রূহ ] দ্বারা মানবকে করেছেন সম্মানিত। মানুষকে আল্লাহ্‌ বিশেষ বিশেষ মানসিক দক্ষতা [ Faculties of mind ] দানে ধন্য করেছেন এবং তাকে পৃথিবীর খলিফারূপে প্রেরণ করেছেন। মানুষের মাঝেই আল্লাহ্‌র জ্ঞান, ক্ষমতা, সৃষ্টিকরার দক্ষতা ইত্যাদি গুণাবলী প্রকাশ পায় এবং এসবের ব্যবহারের সেই একমাত্র প্রাণী যে তাঁর চারিপাশের জগতে স্রষ্টার জ্ঞান ও করুণাকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।

১৫। এর পরে , অবশেষে তোমাদের মৃত্যু হবে ২৮৭৫।
২৮৭৫। এই আয়াতে যে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে তা দৈহিক মৃত্যু। আত্মা অমর ও চিরস্থায়ী। আত্মার সুদীর্ঘ যাত্রাপথে পার্থিব বা দৈহিক মৃত্যু হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী বিরতী। যদি এখানেই আমাদের এ জীবনের শেষ হয়ে যেতো তবে এ জীবনের কোন মহত্তর বৃহত্তর উদ্দেশ্য থাকতো না। কিন্তু আমরা আমাদের সাধারণ বুদ্ধি বৃত্তির সাহায্যেই বুঝতে পারি যে, মানুষকে আল্লাহ্‌ অন্যান্য প্রাণীকূল থেকে ভিন্নভাবে সৃষ্টি করেছেন। সে শুধু তরুলতা -গুল্ম বা অন্যান্য প্রাণীদের ন্যায় জন্ম -মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনকে শেষ করার জন্য নয়। আল্লাহ্‌ বলেছেন মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা অন্য ভূবনে প্রবেশাধিকার লাভ করবো। সেখানেই আমাদের ইহজগতের সকল কর্মের হিসাব দাখিল করতে হবে।

১৬। পুণরায় শেষ বিচারের দিনে তোমাদের পুণরুত্থিত করা হবে।

১৭। এবং আমি তোমাদের উর্দ্ধে সাতটি স্তর সৃষ্টি করেছি ২৮৭৬। এবং আমি [ আমার ] সৃষ্টি সম্পর্কে কখনও অমনোযোগী নই ২৮৭৭।

২৮৭৬। "Taraiq" অর্থ রাস্তা, পথ , কক্ষপথ, অঞ্চল ইত্যাদি। এই আয়াতে এই আয়াতটির অর্থ সপ্ত আকাশের স্তর। পরবর্তী লাইনে মানব কূলকে এই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে সহৃদয়। তাঁর করুণা ও দয়া সর্বদা তাঁর সৃষ্টিকে ঘিরে থাকে।

২৮৭৭। আল্লাহ্‌র কল্যাণ কামনা তাঁর সৃষ্টিকে সর্বদা ঘিরে থাকে। আল্লাহ্‌র করুণা ও কল্যাণের কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হয়েছে আয়াত [ ২৩ : ১৮-২২ ] পর্যন্ত এবং আত্মিক কল্যাণের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে ২ থেকে ৫ রুকু পর্যন্ত।

১৮। আমি আকাশ থেকে পরিমাণ মত বৃষ্টি প্রেরণ করি এবং আমি তা মৃত্তিকায় সংরক্ষিত করি। এবং [ খুব সহজেই ] আমি তা অপসারণ করতে সক্ষম ২৮৭৮।

২৮৭৮। "আকাশ থেকে পরিমাণ মত বৃষ্টি প্রেরণ করি" - এখানে বৃষ্টির উদাহরণের দ্বারা দয়াময় আল্লাহ্‌র করুণাধারাকে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। বিশ্ব-প্রকৃতি নির্দ্দিষ্ট নিয়মের সুত্রে বাঁধা। প্রকৃতির বিভিন্ন নিয়মাবলীকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে , প্রকৃতির নিয়মের প্রতিটি সুত্র এক সুশৃঙ্খল নিয়মের অধীন। সৃষ্ট জীবের জন্য যা কিছু কল্যাণকর শুধু ততটুকুই প্রকৃতি ধারণ করে থাকে। উদাহরণ দেয়া হয়েছে , বৃষ্টির। বৃষ্টি হচ্ছে ধরিত্রির জন্য প্রাণরক্ষাকারী। কিন্তু এর আধিক্য ধরিত্রির বুকে আবার বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। সাধারণতঃ প্রতিটি ভূখন্ডের উপরে ততটুকুই বৃষ্টিপাত ঘটে, যতটুকু সে দেশের ভূখন্ডের জন্য প্রয়োজনীয়। পরিমিত বৃষ্টি মাটিকে আর্দ্র রাখে, যাতে শষ্যের ফলন উপযুক্ত হয়। আবার বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি মাটির স্তর ভেদ করে ভূগর্ভস্ত পানির স্তর সৃষ্টি করে , যা ভূমির গুণাগুণ বৃদ্ধিতে সহায়ক। আবার মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা নদী সমূহকে বয়ে যেতে সাহায্য করে। কারণ দেখা যায় নদীর গতিপথ অনেক সময়ে এমন দেশের মধ্যে দিয়ে ধাবিত হয় যেখানে বৃষ্টিপাত অতি নগণ্য। কিন্তু মাটির এই পানি ধারণ ক্ষমতার ফলে সে সব দেশে নদীর সমস্ত পানি ভূগর্ভস্ত স্তরে শোষিত হয় না। ভারতের বহু স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অত্যন্ত কম হওয়ায় তারা এ সব নদীর পানি বাঁধের সাহায্যে ব্যবহার যোগ্য করে মরুভূমি সদৃশ্য ভূমিকে শষ্য শ্যামল ভূমিতে পরিণত করেছে। প্রকৃতিতে আকাশ থেকে প্রাপ্য পানির সুষম ও পরিমিত বন্টনের আর একটি উদাহরণ হচ্ছে তুষার পাত। প্রকৃতিতে তুষারপাতের অবদানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা মাটি ও বাতাসকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ রাখে। যদি সুউচ্চ পর্বতমালাতে তুষারের আধিক্য না থাকতো তবে সারাটা বছর নদীগুলি তাদের নাব্যতা রক্ষা করতে পারতো না। গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে কি অপূর্ব বিধান প্রকৃতির পানির সুষম বন্টনের জন্য। বৃষ্টির পানি পৃথিবীকে ধৌত করে ও তার আর্দ্রতা রক্ষা করে সমুদ্রে ফিরে যায় এবং আবার মেঘ রূপে পৃথিবীতে ফিরে আসে। একেই আজকের বিজ্ঞান বলে পানিচক্র। যদি বৃষ্টির পানি প্রাকৃতিক নিয়মে নিঃস্বারিত না হতো তবে সমস্ত পৃথিবীতে জলাবদ্ধতা , এবং বন্যার ব্যপকতা ঘটতো। যেমন নদী ভরাট হওয়ার ফলে বাংলাদেশে নদীবাহিত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হওয়ার সুযোগ পায় না ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। আবার যদি নির্দ্দিষ্ট পরিমাণের কম বৃষ্টিপাত ঘটে তবে মাটি ও আবহাওয়া শুষ্ক হওয়ার ফলে মাটি ও ফসলের ব্যপক ক্ষতি সাধিত হয়। আমাদের জীবনে পরিমিত বৃষ্টি যে কতটুকু প্রয়োজনীয় তা আমরা বন্যা বা খরা কবলে পতিত না হলে বুঝতে পারি না। কিন্তু প্রকৃতির এ ভারসাম্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষ কতটুকু কৃতজ্ঞ ? বিশ্ব প্রকৃতিকে স্রষ্টা মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে। অকৃতজ্ঞ মানুষ কি তা অনুধাবনের চেষ্টা করে ?
১৯। এর সাহায্যে তোমাদের জন্য আমি খেজুর ও আঙ্গুর বাগান উৎপন্ন করি। ইহাতে তোমাদের জন্য আছে প্রচুর ফল , এবং তোমরা তা খাও এবং [ উপভোগ কর ] ; ২৮৭৯ -

২৮৭৯। দেখুন আয়াত [ ৭ : ১৯ ] এবং টিকা ৭৭৬ ও আয়াত ৫ : ৫৬।

২০। এবং সিনাই পর্বতে উদ্‌গত করি এক বৃক্ষ, যা তেল উৎপন্ন করে এবং খাদ্য হিসেবে [ যে তেল ] সুস্বাদু ২৮৮০।

২৮৮০। এই বৃক্ষটিকে 'যায়তুন' বৃক্ষ বলা হয়েছে। যায়তুন হচ্ছে জলপাই এর আরবী নাম। আরবের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উন্নতমানের জলপাই উৎপন্ন হয় মাউন্ট সিনাইতে। ডুমুর , জলপাই, সিনাই পর্বত এবং পবিত্র মক্কা নগরীর কথা একই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে আয়াতে [ ৯৫ : ১ -৫ ] বিভিন্ন প্রকার তেলের মাঝে জলপাই এর তেল এক উচ্চ গুণাগুণ সম্পন্ন ভেজষ তেল যা যুগে যুগে ঔষধ তৈরীতে ব্যবহৃত হয়েছে। খাদ্য হিসেবেও জলপাই স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। দেখুন [ ২৪ : ৩৫ ] আয়াত যেখানে জলপাই গাছকে " পূত পবিত্র যয়তুন বৃক্ষ " বলা হয়েছে। দেখুন টিকা ৩০০০।

২১। এবং গৃহপালিত পশুদের মধ্যেও তোমাদের জন্য আছে উপদেশপূর্ণ উদাহরণ ২৮৮১। তাদের দেহের অভ্যন্তরে থেকে তোমাদের পান করার জন্য [ দুধ ] উৎপন্ন করি। [ এছাড়াও ] ইহাদের মাঝে তোমাদের জন্য [আরও ] অসংখ্য উপকারিতা আছে; এবং ইহাদের [ মাংস ] তোমরা আহার কর।

২৮৮১। " আন্‌ - আম " অর্থ গৃহপালিত পশু। গৃহপালিত পশু থেকে আমরা দুধ পাই, মাংস পাই। তাদের চামড়া দ্বারা আমরা জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিষ তৈরী করি। তাদের শিং ও হাড় দ্বারা চিরুনী , তৈজষ পত্র ও গহনা তৈরী করা হয়। উট, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর এবং গরুর গাড়ী প্রভৃতি যানবাহন ও মাল টানার জন্য প্রাচীন পৃথিবীতে ব্যবহৃত হতো। সত্যিই এ সবের মধ্যে রয়েছে " তোমাদিগের জন্য প্রচুর উপকারিতা। "

২২। এবং তোমরা উহাতে ও নৌযানে আরোহণও করে থাক।

রুকু - ২

২৩। [ উপরন্তু,] তোমাদের উপদেশের জন্য বহু নবীকূল প্রেরণ করেছি ] ২৮৮২। নূহ্‌কে প্রেরণ করেছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে ২৮৮৩। সে বলেছিলো, " হে আমার সম্প্রদায় ! আল্লাহ্‌র এবাদত কর! তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তবুও কি তোমরা [ তাঁকে ] ভয় করবে না? " ২৮৮৪

২৮৮২। এতক্ষণ জাগতিক বিষয়বস্তু যা আমাদের পার্থিব আরাম আয়েশের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তার বর্ণনা করা হয়েছে উপরের আয়াত সমূহের দ্বারা। এ সব বস্তুকে দান করা হয়েছে পরিমিত ভাবে আল্লাহ্‌র বিচক্ষণ ও সুবিবেচনাপূর্ণ তত্বাবধানে। এবারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য মহান আল্লাহ্‌ যে সব বন্দোবস্ত করেছেন। তিনি যুগে যুগে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য, মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য শিক্ষক প্রেরণ করেছেন। তারা যুগে যুগে বিপথগামীদের দ্বারা ব্যঙ্গ -বিদ্রূপের পাত্রে পরিণত হয়েছেন, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, মিথ্যাবাদীরূপে অভিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু মহান আল্লাহ্‌ তাদের রক্ষা করেছেন এবং পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত "সত্য" ই স্থায়ী হয়।

২৮৮৩। " সম্প্রদায়" শব্দটি এখানে নূহ্‌ এর সমসাময়িক পৃথিবীবাসীদের বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

২৮৮৪। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৫৯ ]। আল্লাহকে ভয় করার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্‌র ভয়ে পবিত্র জীবন যাপন করা ও পাপকে পরিহার করা।

২৪। তার সম্প্রদায়ের প্রধানেরা বলেছিলো , " সে তো তোমাদের মত মানুষের থেকে বেশী কিছু নয়; তার ইচ্ছা তোমাদের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। আল্লাহ্‌ যদি [ একজন দূত প্রেরণ করতেই ] ইচ্ছা করতেন ,তবে তিনি ফেরেশতা প্রেরণ করতে পারতেন। [ সে যা বলছে ] এরূপ কথা আমরা পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে শুনি নাই। " ২৮৮৫

২৮৮৫। প্রতিটি মানুষই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার দাস। নূহ্‌ এর সম্প্রদায়ের লোকদের অভিযোগ এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। তারা হযরত নূহ্‌ কে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করলো। তাদের ধারণা নূহ্‌ তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ ও সম্প্রদায়ের উপরে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এক আল্লাহ্‌র ধারণাকে প্রচার করছে। তাদের বক্তব্য ছিলো, " যদি আল্লাহ্‌, নবী বা প্রচারক প্রেরণের ইচ্ছাই প্রকাশ করে থাকেন তবে তাঁরা আমাদের মত মানুষ না হয়ে ফেরেশতা হতো। আমাদের পূর্বপুরুষেরা একত্ববাদে বিশ্বাস করেন নাই। সুতারাং আমরা কেন তা করবো? "

২৫। [এবং কেউ কেউ বলেছিলো ] : "তাকে পাগলামিতে পেয়েছে। সুতারাং তোমরা তার সাথে[ধৈর্য্য ধারণ পূর্বক ] কিছুকাল অপেক্ষা কর ২৮৮৬।

২৮৮৬। এই আয়াতের উক্তি যারা করেছিলো , সম্ভবতঃ তারা ছিলো অবিশ্বাসীদের মধ্যে একটি দল। তাদের ধারণা হয়েছিলো যে, তাদের পূর্ববর্তী উপাস্যকে ত্যাগ করে একত্ববাদের প্রতি আহ্বান হচ্ছে নূহ্‌ এর পাগলামীর লক্ষণ , পাগলের প্রলাপে মনোনিবেশ না করে তাকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। তাহলে হয়তো এক সময়ে পাগলামী শেষ হয়ে যেতে পারে অথবা নূহ্‌ এর শেষ পরিণতি খুব খারাপ হতে পারে।

২৬। [ নূহ্‌ ] বলেছিলো , " হে আমার প্রভু! আমাকে সাহায্য কর; কারণ তারা আমাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। "

২৭। সুতারাং তাকে আমি [ এই ওহী ] প্রেরণ করলাম : " আমার তত্বাবধানে এবং আমার নির্দ্দেশমত বড় জাহাজ তৈরী কর ২৮৮৭। অতঃপর যখন আমার আদেশ আসবে এবং পৃথিবীর প্রস্রবণসমূহ প্রবলবেগে নির্গত হবে ২৮৮৮; তখন তুমি প্রত্যেক প্রজাতির একজোড়া পুরুষ ও মেয়ে এবং তোমার পরিবারকে নৌকাতে উঠিয়ে নিও ২৮৮৯; তারা ব্যতীত যাদের বিরুদ্ধে পূর্বে সিদ্ধান্ত হয়েছে ২৮৯০। এবং পাপীদের অনুগ্রহের জন্য আমাকে সম্বোধন করো না। নিশ্চয়ই তারা [ বন্যাতে ] নিমজ্জিত হবে।

২৮৮৭। এই আয়াতটিতে নূহ্‌ এর মহাপ্লাবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অনুরূপ আয়াত এর জন্য দেখুন [১১ : ৩৬ - ৪৮ ] আয়াত এবং এদের টিকা সমূহ।

২৮৮৮। দেখুন [ ১১ : ৪০ ] আয়াতের টিকা ১৫৩৩।

২৮৮৯। দেখুন [ ১১ : ৪০ ] আয়াতের টিকা ১৫৩৪।

২৮৯০। দেখুন [ ১১ : ৪০ ] আয়াতের টিকা ১৫৩৫।

২৮। তুমি ও তোমার সাথে যারা থাকবে তারা যখন নৌযানে আরোহণ করবে তখন বলো : " সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র, যিনি আমাদের উদ্ধার করেছেন পাপী সম্প্রদায় থেকে ২৮৯১। "

২৮৯১। "Istawa" শব্দটির জন্য দেখুন [ ১০ : ৩ ] আয়াতের টিকা ১৩৮৬।
২৯। এবং বলো , " হে আমার প্রভু! ২৮৯২ , তোমার কল্যাণ আশীষের সাথে আমাদের অবতরণ করাও। [আমাদের ] অবতরণ করানোতে তুমিই সর্বাপেক্ষা সক্ষম।"

২৮৯২। দ্বিতীয় প্রার্থনার প্রত্যাদেশ নূহকে প্রেরণ করা হয় নৌযান থেকে অবতরণ কালে, যখন বন্যার পানি সরে যায়।

৩০। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে [ মানুষের অনুধাবন করার জন্য ]। [ এভাবেই ] আমি [ মানুষদের ] পরীক্ষা করে থাকি ২৮৯৩।

২৮৯৩। নূহ্‌ এর সম্প্রদায়কে বিভিন্ন ভাবে তাদের পাপ কাজের জন্য সাবধান করা হয় এবং অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের সুযোগ দান করা হয়। কিন্তু তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ধবংস প্রাপ্ত হয়। আল্লাহ্‌র সত্য ধ্বংস হওয়ার নয় তা চিরন্তন সত্য, স্থায়ী। পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে তা বিরাজ করবেই। নূহ্‌ এর মহাপ্লাবনের পরে 'আদ' সম্প্রদায়ের আগমন। তবে আল্লাহ্‌র এই বাণী কোন নির্দ্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য নয়। তা যুগ ও কাল অতিক্রান্ত। মানুষ তবুও কি তা অনুধাবন করবে না?

৩১। তাদের পরে আমি অন্য এক প্রজন্মের সৃষ্টি করেছিলাম।

৩২। এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকে আমি তাদের নিকট রসুল রূপে প্রেরণ করেছিলাম ২৮৯৪। [ সে বলেছিলো] " আল্লাহ্‌র এবাদত কর। তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তবুও কি তোমরা [ তাঁকে ] ভয় করবে না ?"

২৮৯৪। এই আয়াতে রাসুলদের নাম উল্লেখ করা হয় নাই। তবে আয়াত ৩১ থেকে অনুধাবন করা যায় যে, এই রসুলের আগমন নূহ্‌ এর মহাপ্লাবনের পরবর্তীতে। সম্ভবতঃ হুদ নবী যাকে আদ সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয় অথবা সালেহ্‌ নবী যাকে সামুদ সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয়। কারণ নূহ্‌ নবীর পরে ধারাবাহিকতায় তাদেরই আগমন ঘটেছে। দেখুন আয়াত [ ১১ : ৫০ - ৬০ এবং ৬১ - ৬৮ ]। তবে যেহেতু এখানে কোন নামের উল্লেখ নাই, আমরা মহাপ্লাবনের পরে আগত নবী রসুলদের সম্বন্ধে সার্বজনীন ভাবে এই বক্তব্য গ্রহণ করতে পারি। এ সব নবী রসুলদের শেষ পর্যায়ে হযরত মুসা ও হযরত ঈসার আগমন। এই আয়াতে রসুলদের আগমনের উল্লেখ দ্বারা পূর্ববর্তী ঘটনাকে স্মরণ করানোর উদ্দেশ্য নয়; মূল কারণ হচ্ছে মানুষকে দেখানো যে, পাপের শক্তি ও বাঁধা যত প্রচন্ড ও অপ্রতিরোধ্য -ই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই।

রুকু - ৩

৩৩। তাঁর সম্প্রদায়ের প্রধানগণ , যারা অবিশ্বাস করেছিলো, এবং পরলোকের সাক্ষাত করাকে অস্বীকার করেছিলো এবং যাদের আমি পার্থিব জীবনে [ প্রচুর ] ভোগ-সামগ্রী দিয়েছিলাম, তারা বলেছিলো, " সে তো তোমাদের মত একজন মানুষের বেশী কিছু নয়; তোমরা যা আহার কর , সে তাই আহার করে এবং তোমরা যা পান কর সেও তাই পান করে।"

৩৪। "যদি তোমরা তোমাদেরই মত একজন মানুষের আনুগত্য কর, সাবধান , এটা নিশ্চিত যে,তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে ২৮৯৫।

২৮৯৫। এই আয়াতে আ'দ বা সামুদ সম্প্রদায়ের আরও বর্ণনা দান করা হয়েছে। এই বর্ণনার মাধ্যমে সকল যুগের কাফেরদের মানসিকতাকে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের ধারণা পার্থিব জীবন ব্যতীত অন্য কোন জীবন নাই। সুতারাং জীবন মরণ এই দুনিয়াই এবং কোন পুনরুজ্জীবন নাই। এ সব অবিশ্বাসীদের বিদ্বেষ ও হিংসা এই আয়াতে এক লাইনে সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে; "তোমরা তোমাদিগেরই মত একজন মানুষের আনুগত্য কর " বাক্যটি দ্বারা। তাদের ধারণা পরকাল বলে কিছু নাই। এ সব কথা বলা হচ্ছে শুধুমাত্র আনুগত্য আদায় করার উদ্দেশ্যে। এ সব কাফেররা পরলোকের উল্লেখেও বিরক্ত বোধ করে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে তারা অপারগ। বর্তমান তাদের সব কিছু। শুধুমাত্র বর্তমানকে উপভোগের মাধ্যমেই তারা তাদের জীবনের শেষ পরিণতি দেখতে চায়।

মন্তব্য : বর্তমান পৃথিবীতে মুসলমানদের মধ্যেও এক বিরাট জনসমষ্টির উদ্ভব ঘটেছে , যারা নামেই শুধুমাত্র মুসলমান। কর্মে তারা প্রমাণ করে যে পরলোকের জীবন তাদের শুধুমাত্র হাসি খেলার বস্তু।

৩৫। " সে কি তোমাদের এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, যখন তোমাদের মৃত্যু হবে এবং তোমরা মাটি ও হাড়ে পরিণত হবে, তোমাদের পুনরায় উত্থিত করা হবে ?

৩৬। " অসম্ভব , তোমাদের যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা অসম্ভব।

৩৭। " এই পৃথিবীর জীবন ছাড়া অন্য কোন জীবন নাই। আমরা [ এখানেই ] মরি ও বাঁচি। সুতারাং আমরা কখনও পুনরায় উত্থিত হব না ২৮৯৬।

২৮৯৬। এই আয়াতে পরলোক সম্বন্ধে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাসকে চিত্রিত করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে : "মৃত্যুর পরে কোনও জীবন নাই। পৃথিবীর জীবনই একমাত্র সত্য। জন্মমৃত্যু প্রাকৃতিক নিয়ম। সে হিসেবে মৃত্যুও সত্য। এর পরে আর কোনও জীবন নাই। কারণ তাদের আত্মিক অন্ধত্ব তাদেরকে পুনরুত্থানে বিশ্বাস করা থেকে বিরত রাখে।

৩৮। " সে তো কেবলমাত্র একজন মানুষ, যে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে মিথ্যার উদ্ভবন করে থাকে। কিন্তু তাকে আমরা বিশ্বাস করতে যাচ্ছি না।" ২৮৯৭

২৮৯৭। তারা আল্লাহ্‌র প্রেরীত নবীকে ভন্ড এবং মিথ্যুকরূপে পরিগণিত করলো। কারণ তাদের অবিশ্বাসী আত্মায় আল্লাহ্‌র প্রকৃত রূপকে অনুধাবন করা, পরলোকের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা ও উপলব্ধি করা ছিলো এক অসম্ভব ব্যাপার। তারা নিজেদের বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণরূপে পরিগণিত করতো।

উপদেশ : এ ভাবেই কাফেরদের আত্মায় কখনও সত্যের অনুপ্রবেশ ও প্রকৃতরূপ ধরা পড়বে না। নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় তারা নিজেরা বিমোহিত থাকবে।

৩৯। [নবী ] বলেছিলো : " হে আমার প্রভু ! আমাকে সাহায্য কর ; কারণ তারা আমাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে ২৮৯৮। "

২৮৯৮। দেখুন নূহ্‌ এর বক্তব্য [ ২৩ : ২৬ ] আয়াতে। যুগে যুগে আল্লাহ্‌র প্রেরিত নবী ও রসুলদের সত্য প্রচারের জন্য অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হতে হয়েছে।

৪০। [আল্লাহ্‌ ] বলেছিলেন : " অচিরেই তারা নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হবে। " ২৮৯৯

২৮৯৯। যখন আল্লাহ্‌র শাস্তি তাদের উপরে নিপতিত হবে, তখন পাপীরা তাদের কৃতকর্ম উপলব্ধি করতে পারবে ও অনুতপ্ত হবে। কিন্তু সে সময়ে অনুতাপ করার জন্য খুব দেরী হয়ে যাবে। তাদের আর অনুতাপ করার জন্য অবকাশ দেয়া হবে না।

৪১। অতঃপর ন্যায়সঙ্গত ভাবে এক বিষ্ফোরণ তাদের গ্রাস করলো ২৯০০ এবং [ কালের সমুদ্রে ] আমি তাদের শুকনো পাতার ন্যায় আর্বজনাতে পরিণত করলাম ২৯০১। ফলে তারা হারিয়ে গেলো, তাদের সাথে, যারা পাপ করেছিলো।

২৯০০। দেখুন আয়াত [ ১১ : ৬৬ ] এবং টিকা ১৫৬৩ ও ১৫৬১।

২৯০১। "Guthann": শুকনা পাতার আবর্জনা ; পানির স্রোতের উপরে ভাসমান আবর্জনা।

৪২। অতঃপর তাদের পরে আমি অন্য জাতিদের সৃষ্টি করেছি।

৪৩। কোন জাতিই তার নির্ধারিত কালকে ত্বরান্বিত বা বিলম্বিত করতে পারে না।

৪৪। অতঃপর আমি একের পরে এক আমার রাসুল প্রেরণ করেছি। যখনই কোন জাতির নিকট তাদের রাসুল এসেছে , তারা তাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। সুতারাং আমি তাদের একের পরে এককে [ শাস্তির দ্বারা] অনুসরণ করাইলাম। আমি তাদের কাহিনীতে পরিণত করেছি ২৯০২। সুতারাং [ তারা ] অবিশ্বাসীদের সাথে ধ্বংস হোক।

২৯০২। অবিশ্বাসীদের শেষ পরিণতি ধ্বংস। তাদের সভ্যতা , সংস্কৃতি সব ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিঃশেষ হয়ে যায়। শুধু থেকে যায় তাদের কাহিনী মানুষের স্মৃতিতে ; পুরানো দিনের কল্প-কাহিনী হিসেবে।

৪৫। অতঃপর আমি মুসা ও তাঁর ভাই হারুনকে আমার নিদর্শন ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছিলাম , ২৯০৩-

২৯০৩। মুসা ও হারুনের প্রতি আল্লাহ্‌ দ্বিবিধ কর্তব্য সম্পাদনের জন্য প্রেরণ করেন : ১) ফেরাউন ও তার সভাসদ্‌দের প্রতি। এরা ছিলো উদ্ধত ও অহংকারী। ২) ইসরাঈলীদের প্রতি যাদের জন্য ধর্মীয় বিধান আল্লাহ্‌ সিনাই পর্বতে হযরত মুসাকে দান করেন। কিন্তু ইহুদীরা বারে বারে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই উভয় ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস উৎপন্ন করার জন্য আল্লাহ্‌ হযরত মুসাকে অলৌকিক নিদর্শন এবং সুস্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করেন। তিনি যে, আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে কার্যকর করার জন্য আগত এই বিশ্বাস অর্জন করার জন্যই তাঁকে নিদর্শন ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করা হয়।

৪৬। ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের নিকট। কিন্তু তারা উদ্ধত আচরণ করলো। তারা ছিলো এক উদ্ধত সম্প্রদায়।

৪৭। তারা বলেছিলো, " আমরা কি আমাদের মত দুজন মানুষের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবো ? অথচ তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাদের দাসত্ব করে।" ২৯০৪।


২৯০৪। মিশর সে যুগে পৃথিবীর সভ্যতার পাদপীঠরূপে বিবেচিত ছিলো। শৈর্যে, বীর্যে তারা ছিলো পৃথিবীতে অতুলনীয়। তাদের সভ্যতা, তাদের শক্তি, তাদের প্রাচুর্য, তাদের করে তোলে অহংকারী গর্বিত ও উদ্ধত। তাই তারা সত্যের ডাককে শুনতে পায় নাই, শুনেও সাড়া দিতে পারে নাই। বরং তারা উদ্ধত অহংকারে বলেছিলো, " অথচ তাদের সম্প্রদায় আমাদিগের দাসত্ব করে। " তাদের আমরা আল্লাহ্‌র নবী বলে কি ভাবে মানবো ?
 

উপদেশ : অহংকার মানুষকে প্রকৃত সত্যকে চিনতে বাঁধা দান করে।

৪৮। সুতারাং তারা তাদের মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করলো, এবং [ ফলে ] যারা ধবংস হয়েছিলো তাদের অর্ন্তভূক্ত হলো।

৪৯। আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম , যেনো তারা পথ নির্দ্দেশ লাভ করে ২৯০৫।

২৯০৫। হযরত মুসা আল্লাহ্‌র নিকট থেকে যে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সেই কর্তব্য ও দায়িত্বের দ্বিতীয় অংশের বর্ণনা আছে এই আয়াতে। এখানে " তারা " অর্থাৎ ইসরাঈলীদের বোঝানো হয়েছে, যারা শেষ পর্যন্ত ঈমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। দেখুন টিকা ২৯০৩।

৫০। এবং আমি মারইয়াম পুত্র ও তাঁর মাতাকে নিদর্শন স্বরূপ করেছিলাম ২৯০৬। আমি তাদের ঊভয়কে ঝরণা বিশিষ্ট উচ্চ স্থানে আরাম ও নিরাপদে বসবাসের জন্য আশ্রয় দান করেছিলাম ২৯০৭।

২৯০৬। "মরিয়ম তনয়" অর্থাৎ হযরত ঈসার কথা এখানে বলা হয়েছে, কুমারী মরিয়মের গর্ভে ঈসার জন্ম বিশ্বে এক অলৌকিক ঘটনা। কিন্তু আল্লাহ্‌র এই অলৌকিক কর্ম বোঝার ক্ষমতা সমসাময়িক লোকদের ছিলো না। তারা বিবি মরিয়মকে অসতীরূপে আখ্যায়িত করেছিলো। কিন্তু শিশু ঈসা তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন দ্বারা তাঁর মাতাকে এই অপমান ও গ্লানি থেকে উদ্ধার করেন [ ১৯ : ২৭ - ৩৩ ] এবং প্রমাণ করেন যে মরিয়মের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা।

২৯০৭। বিবি মরিয়ম ও শিশু ঈসার কাহিনী বর্ণনা আছে [ ১৯ : ২২-২৬ ] আয়াতে। যেখানে মরিয়ম ও শিশু ঈসা আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন সেই স্থানের বর্ণনা আছে এই আয়াতে। নিজ গোত্র থেকে বিতাড়িত হয়ে, তিনি যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন তা ছিলো খেজুর গাছ বিশিষ্ট উচ্চভূমি যার নিচ দিয়ে প্রস্রবণ বয়ে যাচ্ছিল। সেখানেই বিবি মরিয়ম সন্তান প্রসব করেন এবং কিছুকাল বিশ্রাম করেন এবং সেখান থেকেই শিশুসহ নিজ গোত্রের নিকট গমন করেন।

রুকু - ৪

৫১। হে রাসুলগণ ! [ সকল ] ভালো ও পবিত্র বস্তু উপভোগ কর , এবং সৎ কাজ কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কিছু কর [ সে সব ] সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত ২৯০৮।

২৯০৮। "উপভোগ কর" বাক্যটি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। দেখুন টিকা ৭৭৬ এবং আয়াত [ ৫ : ৬৬ ] যেখানে শব্দটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই আয়াতে সুস্পষ্ট নির্দ্দেশ আছে যে, যারা আল্লাহ্‌র রাসুল, নবী বা ওলী তাদেরও কঠোর সংযমী হওয়ার প্রয়োজন নাই। আল্লাহ্‌ প্রদত্ত সকল নেয়ামত তারা ভোগ করবে এবং সে জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে তারা কৃতজ্ঞতা জানাবে। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য। খৃষ্টান, ইহুদী ও পৃথিবীর বহু ধর্মে সংসার ত্যাগী সাধু, সন্ন্যাসীদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ইসলাম সংসার ত্যাগ করে শুধু মাত্র ধর্মকে অবলম্বন করা অনুমোদন করে না। দ্বীন ও দুনিয়া এই দুয়ে মিলেই ইসলাম ধর্ম। দুনিয়া ব্যতীত দ্বীনকে ইসলাম অনুমোদন করে না। কারণ একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, ধর্মীয় বিধান হচ্ছে জীবনের মূল নৈতিক নীতিমালা , যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুষ্ঠ ও সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। যে সমাজ আল্লাহ্‌র প্রেরিত নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত সে সমাজ উন্নতি লাভে শীর্ষে অবস্থান করবে। উদাহরণ : যেমন সততা - যদি সমাজে সততা বিরাজ করে , তবে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার লাভ ঘটবে। যদি ন্যায় বিরাজ করে তবে সমাজের প্রতিটি ক্রিয়াকর্ম সুষ্ঠভাবে সম্পাদিত হবে। যদি গরীবের প্রতি নিষ্পেষণ না করা হয়, তবে সমাজের প্রতিটি নাগরিক সমভাবে বাঁচার অধিকার লাভ করবে। এ ভাবে আল্লাহ্‌র প্রেরিত প্রতিটি নৈতিক নীতিমালা একটি সমাজকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী হতে সাহায্য করে। সুতারাং ইসলাম ও জীবন ব্যবস্থা কোনও পৃথক ব্যবস্থা নয়।
৫২। এবং নিশ্চয়ই তোমাদের এই ভাতৃত্ব একই ভাতৃত্ব ২৯০৯, এবং আমি তোমাদের প্রভু ও প্রতিপালক। সুতারাং আমাকে ভয় কর [ অন্য কাউকে নয়]।

২৯০৯। দেখুন আয়াত [ ২১ : ৯২ - ৯৩ ]। নবী ও রসুলেরা বিভিন্ন স্থানে জন্মগ্রহণ করতে পারেন কিন্তু তারা সকলেই একই ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভূক্ত। কারণ তাঁদের চিন্তা, কর্ম, এবং প্রচারিত বাণীর মর্মার্থ এক। কারণ তারা সকলে এক আল্লাহ্‌র নিকট থেকে আগত এবং তাঁদের প্রচারিত বিশ্বাস, ধর্ম ও শিক্ষা এক। তাঁরা সকলেই এক বিশ্ব স্রষ্টার এবাদত করে থাকেন - যিনি তাদের প্রতিপালন করেন ও ভালোবাসেন। তাঁরা এক আল্লাহ্‌র নিকট শুধুমাত্র আমানতের অঙ্গীকারে আবদ্ধ। জন্মসূত্রে তাঁরা বিভিন্ন হলেও আত্মিক বন্ধনে তারা এক। সুতারাং যুগে যুগে নবী রসুলেরা যে ধর্মের প্রচার করেছেন তা একই ধর্ম , আর তা হচ্ছে ইসলাম।

৫৩। কিন্তু মানুষ নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে নানা ভাগে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত ২৯১০।

২৯১০। পরবর্তী প্রজন্ম ধর্মের নামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের এই বিভক্তির ভিত্তি ধর্মের প্রতি অনুরাগ নয় বরং হীন স্বার্থপরতা থেকে উদ্ভুদ। ফলে তা হয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বিষাক্ত। কিন্তু ধর্মের নামে এই সব সম্প্রদায় নিজেদের ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ মতবাদে সন্তুষ্ট ও আত্মতৃপ্ত। তারা আল্লাহ্‌র বিশ্বজনীন ধর্মের রূপ অনুধাবনে অক্ষম ও অন্ধ। ফলে জন্ম নেয় ধর্মন্ধতা ও মৌলবাদীর। এরা ইসলামের সার্বজনীন রূপকে গ্রহণের পরিবর্তে ধর্মকে সাম্প্রদায়িক গন্ডির মধ্যে টেনে আনে, তাদের এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধর্মন্ধতা তাদের নিজেদের সৃষ্টি। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে, তাদের উন্মাদনা স্থায়ী হবে না,সত্যের আলোতে তা ধবংস হয়ে যাবে।

৫৪। অতএব কিছু কালের জন্য ওদের অজ্ঞতার বিভ্রান্তিতে থাকতে দাও।

৫৫। তারা কি মনে করে যেহেতু তাদের আমি অপরিমিত সম্পদ ও সন্তান সন্ততি দান করেছি , -

৫৬। আমি তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করবো ? না তারা কিছুই বোঝে না ২৯১১।

২৯১১। আল্লাহ্‌ বারে বারে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, পার্থিব অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমত সবই বান্দার জন্য পরীক্ষা স্বরূপ দেয়া আল্লাহ্‌র তরফ থেকে। যারা আল্লাহ্‌র এ সব নেয়ামত লাভ করেছেন তারা যেনো মনে না করেন যে, পার্থিব ভোগ্য বস্তুই সকল সুখ ও শান্তির উৎস।

৫৭। নিশ্চয় যারা তাদের প্রভুর ভয়ে সন্ত্রস্ত;

৫৮। যারা তাদের প্রভুর নিদর্শনাবলীতে ঈমান আনে;

৫৯। যারা তাদের প্রভুর সাথে শরীক করে না;

৬০। যারা তাদের প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তনের ভয়ে, ভীত কম্পিত হৃদয়ে দান করে ২৯১২।

২৯১২। যারা আল্লাহ্‌র নেয়ামতে ধন্য তাদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আয়াতগুলিতে। আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় ভক্তি ও ভালোবাসাতে তাঁদের হৃদয় পূর্ণ থাকে। তাদের দানের উদ্দেশ্য একটাই আর তা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে পরলোকের জন্য জবাবদিহিতায়। তাদের আর এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা তাদের সৎকর্মের জন্য সর্বদা ভীত চিত্তে স্রষ্টার প্রসন্নতার ও সন্তুষ্টির জন্য উদ্বিগ্ন থাকে। সর্ব কাজে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি হবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ। পরের আয়াতে এদের কথাই বলা, হয়েছে , যারা কল্যাণকর কাজে দ্রুতগামী এবং অগ্রগামী।
৬১। এরাই তারা যারা ভালো কাজে দ্রুতগামী , এবং এরাই তারা যারা তাতে অগ্রগামী।

৬২। আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত ভার অর্পন করি না ২৯১৩। আমার সামনে আছে এক তালিকাপুস্তক যা সত্যকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে ২৯১৪। তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না।

২৯১৩। অনুরূপ আয়াত দেখুন [ ২ : ২৮৬ ] এবং টিকা ৩৩৯।

২৯১৪। আমাদের সকল চিন্তা-ভাবনা কার্যের নিয়ত, কৃতকার্য , সাফল্য-ব্যর্থতা, মন-মানসিকতা, পরিবেশ সবই আল্লাহ্‌র দরবারে মূহুর্তের মধ্যে নীত হয় এবং রক্ষিত হয়। প্রতিটি আত্মার পৃথিবীর কর্মপ্রণালীর সব হিসাব আল্লাহ্‌র কাছে বিদ্যমান। কর্মের দ্বারাই জবাবদিহিতার বিচার করা হবে। সেখানে কোনও প্রকার অন্যায় করা হবে না। পাপীরা ততটুকুই শাস্তি ভোগ করবে যতটুকু পাপ তারা করেছে। কিন্তু পূণ্যাত্মারা তাদের পূণ্যকর্মের উপযুক্ত সম্মানী তো পাবেনই , উপরন্তু আল্লাহ্‌র তরফ থেকে তাদের জন্য আছে পুরষ্কার। পাপীদের জুলুম করা হবে না, কিন্তু পূণ্যাত্মারা তাদের প্রাপ্য বাদেও পুরষ্কার লাভ করবে।

৬৩। কিন্তু তাদের হৃদয় এই বিষয়ে অজ্ঞতায় বিভ্রান্ত ২৯১৫। এ ছাড়াও তাদের আরও পাপ কাজ আছে যা তারা করতেই থাকবে, ২৯১৬।

৬৪। যতক্ষণ না আমি শাস্তি দ্বারা ধৃত করবো তাদের , যারা এই পৃথিবীতে ভালো জিনিষ লাভ করেছে। দেখো! [তখন] তারা আর্তনাদ করে মিনতি করে থাকে।

২৯১৫ " তাদের হৃদয় এই বিষয়ে অজ্ঞতায় বিভ্রান্ত" - এই বাক্যটি তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা অবিশ্বাসী ও আল্লাহ্‌র সত্যকে প্রত্যাখান করে এবং পার্থিব ধনসম্পদ ও ক্ষমতা প্রতিপত্তির মোহে,দম্ভে ও অহংকারে স্ফীত হয়। এ সব লোকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা সত্যের ঘোষণার প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। পরলোকের সম্বন্ধে এরা সন্দিহান। শেষ দিবসের বিচারকে এরা বিশ্বাস করে না। কারণ "তাদের অন্তর অজ্ঞানতায় বিভ্রান্ত।"

২৯১৬। সত্যকে প্রত্যাখান ব্যতীতও আরও পাপ কাজ এসব লোকেরা করে থাকে। সত্যকে প্রতিহত করা ও সত্যের আলোকে ঘৃণা করা থেকে তারা বিরত থাকবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ্‌ তাদের "শাস্তি দ্বারা ধৃত করেন"। কিন্তু তখন আর অনুতাপ করার সময় থাকবে না।

৬৫। [ তাদের বলা হবে ] : " আজকে চীৎকার করে মিনতি করো না। তোমরা অবশ্যই আমার নিকট থেকে কোন সাহায্য পাবে না।

৬৬। " আমার আয়াত তো তোমাদের নিকট আবৃত্তি করা হতো , কিন্তু তোমরা উল্টো দিকে ফিরে যেতে, -

৬৭। " দম্ভ ভরে : [কুর-আন] সম্বন্ধে বাজে কথা বলতে , যেনো কেউ রাত্রিতে খোশ-গল্প করছে।" ২৯১৭

২৯১৭। "Samir" সেই ব্যক্তি যে অর্থহীন গল্পগুজব যেমন :- প্রেম-ভালোবাসা বা আমোদ-ফুর্তি ইত্যাদির গল্পে রাত্রি অতিবাহিত করে।

৬৮। তবে কি ওরা [আল্লাহ্‌র ] বাণী সম্বন্ধে চিন্তা করে না ? অথবা ,তাদের নিকট কি এমন কিছু [ নূতন ] এসেছে যা তাদের পূর্বপুরুষদের নিকট আসে নাই ? ২৯১৮

২৯১৮। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ এক চিরন্তন সত্যকে উত্থাপন করেছেন। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই সকলেই দেখতে পাবে যে আল্লাহ্‌র বাণীর মূল বক্তব্য সব যুগে একই আর তা নিবেদিত বিশ্ব মানবের কল্যাণের নিমিত্তে। হযরত আদম থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র প্রচারিত বাণীর কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই - কারণ আল্লাহ্‌র মনোনীত ধর্ম সর্ব যুগেই হচ্ছে "ইসলাম" সকল যুগের জন্য ইসলাম আল্লাহ্‌র মনোনীত ধর্ম। তা কখনও পুরানো হয় না বা কখনও নূতন হয় না।

৬৯। অথবা তারা কি তাদের রসুলকে সনাক্ত করতে পারে নাই বলে তাকে অস্বীকার করে ?

৭০। অথবা তারা বলে , " সে তো পাগল ? " না সে তো তাদের জন্য সত্যকে এনেছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই সত্যকে ঘৃণা করে।

৭১। যদি সত্য তাদের কামনা- বাসনার অনুগামী হতো, তবে অবশ্যই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর এবং উহাদের মধ্যবর্তী সকল কিছুই বিশৃঙ্খল ও দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়তো ২৯১৯। বরং আমি তাদের নিকট উপদেশ পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা উপদেশ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

২৯১৯। আল্লাহ্‌ মহা-জ্ঞানী ও সকল কল্যাণের অধিশ্বর। পৃথিবীতে যারা জ্ঞানী তারা সারা বিশ্ব -জাহানের সৃষ্টির মাঝে এক সমন্বিত শৃঙ্খলার ঐক্যতান দর্শনে বিমোহিত হয়ে যান। সারা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড স্রষ্টার অমোঘ , সুশৃঙ্খল নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ। একেই আমরা বলে থাকি প্রাকৃতিক আইন। এই আইনকে লংঘন করার শক্তি কারও নাই। আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা স্বয়ং সম্পূর্ণ। যদি আল্লাহ্‌র অমোঘ আইন অপ্রতিরোধ্য না হয়ে প্রতিরোধ্য হতো, এবং এসব হীন-স্বার্থপরদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সুযোগ থাকতো, তবে পৃথিবী এক ভয়াবহ স্থানে পরিণত হতো। তা হতো দূর্নীতি , দুঃশাসন ও বিশৃঙ্খলাতে পরিপূর্ণ।

৭২। অথবা তুমি কি তাদের নিকট প্রতিদান চাও ? কিন্তু তোমার প্রভুর প্রতিদানই শ্রেষ্ঠ। তিনিই শ্রেষ্ঠ জীবনোপকরণ দাতা ২৯২০।

২৯২০। আয়াত [ ২৩ : ৬৮ ] হতে যে প্রশ্ন ধারার আরম্ভ হয়েছে তা শেষ হয়েছে এই আয়াতে। অবিশ্বাসীদের অযৌক্তিক প্রশ্নগুলিকে এ ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে ; ১) মানুষের ইতিহাস যতদিনের পুরানো , আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশও ততদিনের পুরানো তবে কেন তারা তা অনুধাবন করে না [ ২৩ : ৬৮ ]। ২) তারা তাদের রসুলকে সত্যবাদী ও পূণ্যাত্মারূপে চেনে।তবে কেন তারা তার প্রচারিত সত্যকে অস্বীকার করে [ ২৩ : ৬৯ ] ৩) সত্যকে প্রচার করা কি উন্মত্ততার লক্ষণ যে তারা তাঁকে উম্মাদ বলে [ ২৩ : ৭০] ? ৪) রসুল [সা] কি সত্য প্রচারের বিনিময়ে কোনও পার্থিব পারিশ্রমিক দাবী করেন [২৩ : ৭২]। তবে কেন তারা সত্য বিমুখ। সত্যকে গ্রহণ করে না?

৭৩। কিন্তু তুমি তো তাদের সরল পথে আহ্বান কর।

৭৪। যারা পরলোকের জীবনে বিশ্বাসী নয়, অবশ্যই তারা সে [ সরল ] পথ থেকে বিচ্যুত হবে।

৭৫। আমি যদি তাদের দয়া করি এবং তাদের দুঃখ - দুর্দ্দশা দূর করে দিই , তথাপি তারা একগুয়ে ভাবে অবাধ্য হয়ে উদ্‌ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবে ২৯২১।

২৯২১। এই আয়াতে যে "দুঃখ -দুর্দ্দশার" উল্লেখ আছে তা ছিলো সমসাময়িক দুর্ভিক্ষবস্থা। মক্কার কোরেশরা এই দুর্ভিক্ষের জন্য রসুলুল্লাহ্‌র [ সা] সত্য ধর্ম প্রচারকে দায়ী করতো। তাদের ধারণা হয়েছিলো যে তাদের দেবদেবীকে পরিত্যাগ করে এক আল্লাহ্‌র উপাসনার কথা প্রচার করাতে দেবদেবীর ক্রোধের পরিণতিই হচ্ছে মক্কাতে দুর্ভিক্ষ। এই সূরাটি মক্কী সূরা। এই দুর্ভিক্ষের বর্ণনা করেছেন ইব্‌নে কাতির [ Kathir ] যা রসুলুল্লাহ্‌র [ সা ] নবুয়ত প্রাপ্তির অষ্টম বর্ষে সংঘটিত হয়। হিজরতের প্রায় চার বৎসর পূর্বের ঘটনা এটি। হিজরতের পরেও মক্কাতে দুর্ভিক্ষ হয় যা বুখারীতে উল্লেখ আছে - তার পরবর্তী ঘটনা।

৭৬। আমি তাদের শাস্তি প্রয়োগ করি , কিন্তু [ তবুও ] তারা তাদের প্রভুর নিকট বিনয়ী হয় না ; বা অনুগত হয়ে প্রার্থনা করে না ২৯২২ -
২৯২২। কোনও কোনও তফসীরকারের মতে এই আয়াতটিতে বদরের যুদ্ধকে বোঝানো হয়েছে। তাই যদি হয় তবে এই আয়াতটি মদিনাতে অবতীর্ণ। তবে এটাই বেশী অনুধাবনযোগ্য হয় , যদি এই আয়াতের শাস্তিকে পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সমন্বিত করা হয়। অথবা আল্লাহ্‌র শাস্তিকে কোনও নির্দিষ্ট ঘটনার সাথে সমন্বিত না করে তাকে সার্বজনীন করাই বেশী সমাচীন। অবাধ্য পাপীরা যখন পুনঃ পুনঃ হেদায়েত সত্বেও সত্যের বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে , সত্যকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় অনুতাপের মাধ্যমে সংশোধন থেকে বিরত থাকে - তখনই আল্লাহ্‌র শাস্তি তাদের ঘিরে ধরে। এই সার্বজনীন সত্যকে উপরের আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এ ভাবেও এর ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে।

৭৭। যতক্ষণ না আমি তাদের সম্মুখে ভয়াবহ শাস্তির দ্বার উম্মুক্ত করি। দেখো ! তারা তখন হতাশার মাঝে নিমজ্জিত হয় ২৯২৩।

২৯২৩। দেখুন [ ৬ : ৪৪ ] আয়াত। আল্লাহ্‌ মানুষকে দুঃখ-বিপদ ও বিপর্যয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে বান্দাকে তাঁর রাস্তায় ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পান। দুঃখ বিপর্যয় পূণ্যাত্মাদের সাহস, ধৈর্য্য, অধ্যাবসায়, ও মনোবল বৃদ্ধি করে , কারণ সর্ব দুঃখ বিপর্যয়ে তাঁরা আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল। আর সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ অপেক্ষা বড় রক্ষাকারী আর কে আছে ? অপরপক্ষে দুঃখ বিপর্যয় পাপীদের হতাশায় নিক্ষিপ্ত করে। পরলোকে যখন তারা তাদের বিচারের রায় পেয়ে যাবে তখন প্রচন্ড হতাশা তাদের ঘিরে ধরবে কারণ তখন আর অনুতাপের মাধ্যমে সংশোধনের কোনও সময় থাকবে না।

রুকু - ৫

৭৮। তিনিই তোমাদের জন্য শ্রবণের, দৃষ্টির, [অন্তরের] অনুভূতির এবং অনুধাবনের [ ক্ষমতার ] সৃষ্টি করেছেন ২৯২৪। [ এ জন্য ] তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক।

২৯২৪। অন্যান্য আয়াতে "অন্তঃকরণ " বা " হৃদয়" শব্দটি আরবীতে বুদ্ধি ও অনুভবের আঁধারকে বোঝানো হয়েছে, যেখান থেকে হৃদয় বৃত্তি বা অনুভব এবং বুদ্ধিমত্তার জন্ম হয়। চক্ষু , কর্ণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় যার মাধ্যমে মানুষ এই চেনা জানা পৃথিবীর জ্ঞান অর্জন করে এবং হৃদয়ের মাধ্যমে এই জ্ঞানকে পরিশ্রুত করে বিচার বিবেচনার মাধ্যমে আত্মার মাঝে বিবেক , বিচারবুদ্ধি ও মহত্বের জন্ম দান করে। আর এ সব কিছুই পরম করুণাময়েরই দান। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গাহ্য সকল জ্ঞানের উৎস আল্লাহ্‌। ব্যক্তির মেধা , মননশক্তি , বুদ্ধিমত্তা,সৃজনক্ষমতা সবই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে বান্দার জন্য দান বা নেয়ামত। এ সকলের জন্য বান্দার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আর কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা হচ্ছে আল্লাহ্‌র দেয়া নেয়ামতকে আল্লাহ্‌র রাস্তায় খরচ করা। আল্লাহ্‌র রাস্তা অর্থাৎ তার সৃষ্টির সেবার জন্য খরচ করা। কিন্তু এ সব অবিশ্বাসীরা কৃতজ্ঞতা জানানোর পরিবর্তে আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন করে এবং আল্লাহ্‌র নিন্দাতে লিপ্ত হয়।

৭৯। তিনি পৃথিবীর বুকে তোমাদের [বংশ ] বৃদ্ধি করেছেন , এবং তোমাদের তারই নিকট একত্রিত করা হবে।

৮০। তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। তাঁরই অধিকারে রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তন। তবুও কি তোমরা বুঝবে না ? ২৯২৫

২৯২৫। "দিবা ও রাত্রির পরিবর্তন " বাক্যটি দ্বারা সৃষ্টির জন্য আল্লাহ্‌র কল্যাণকর পরিকল্পনাকে বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতির প্রতিটি জিনিষ, প্রাকৃতিক নিয়ম কানুন সবই বিশ্ব স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন মানুষের শারিরীক , মানসিক ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির জন্য।

৮১। এতদ্‌সত্বেও তারা বলে , যেমন বলেছিলো পূর্ববর্তীগণ ২৯২৬।

২৯২৬। মানুসের স্বভাব ধর্মকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। নূতন যুগের আগমনে নবীনদের সর্বদা দেখা যায় যে তারা পুরাতনদের সব কিছুই ত্যাগ করতে আগ্রহী। কিন্তু রসুলের [ সা ] আগমনে তারা যখন সম্পূর্ণ প্রত্যাদেশ লাভ করলো - সেক্ষেত্রে তাদের উচিত ছিলো সেই নূতন প্রত্যাদেশ গ্রহণ করা। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করার পরিবর্তে পূর্বের অধিবাসী, যারা গত হয়েছেন তাদের, মত , পথ ও অবিশ্বাস আঁকড়ে ধরে। আসলে "দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না" এই প্রবাদ বাক্যটি যর্থাথই মনুষ্য চরিত্রকে উন্মোচন করেছে।

৮২। তারা বলে , " কি ! যখন আমাদের মৃত্যু হবে এবং আমরা মাটি এবং অস্থিতে পরিণত হব, সত্যিই কি তখন আমাদের পুনরায় উত্থিত করা হবে ?

৮৩। " আমাদের এরূপ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে এবং অতীতে আমাদের পূর্ব পুরুষদেরও। এগুলি তো প্রাচীন কালের কাহিনী ছাড়া অন্য কিছু নয়। "

৮৪। বল : " এই পৃথিবী এবং এতে যা আছে তা কার অধিকারে ? যদি তোমরা জান [ তবে বল ]। "

৮৫। তারা বলবে : " আল্লাহ্‌র। " বল : " তবুও কি তোমরা সর্তক বাণী গ্রহণ করবে না ২৯২৭। "

২৯২৭। যারা পরলোকের জীবনে অবিশ্বাসী , তাদের এই আয়াতের মাধ্যমে চারিদিকের পৃথিবীতে দৃষ্টিপাত করতে বল হয়েছে। এই পৃথিবী ও পৃথিবীর সকল কিছু এবং বিশাল বিশ্ব-ভূবন অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মে পরিচালিত। কে তাদের জন্য এই নিয়মের সৃষ্টি করলো ? এ সব জড় ও জীব পদার্থ অবশ্যই তাদের নিজস্ব ধর্মের প্রচলন নিজে নিজে করে নাই। বাইরে থেকে কোন এক শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। প্রকৃতির এসব অমোঘ শক্তির দিকে এসব অবিশ্বাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এরা এই শক্তির উৎস - আল্লাহ্‌ বলে স্বীকার করে। দৃষ্টিকে আর একটু প্রসারিত করলে বিশাল নভোমন্ডলের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। অসীম আকাশ আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ; যার শেষ কোথায় বর্তমান বিজ্ঞান তা বলতে পারে না। কাছের আকাশের অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে। কে এই সৌন্দর্যকে সৃষ্টি করেন? মহা বিশ্ব ভূবনের নিয়ন্ত্রণের পিছনে যে শক্তি কাজ করে, এসব অবিশ্বাসীদের তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং বিশাল মহা বিশ্ব ভূবনের তুলনায় নিজেদের ক্ষুদ্রতাকে অনুধাবন করতে বলা হয়েছে।

৮৬। বল : " কে সপ্ত আকাশ এবং [ গৌরবের ] সর্বোচ্চ সিংহাসনের প্রভু ২৯২৮ ? "

২৯২৮। দেখুন আয়াত [ ৯ : ১২৯ ]।

৮৭। তারা বলবে , " আল্লাহ্‌।" বল : " তবুও কি তোমরা ভীত সন্ত্রস্ত হবে না ? " ২৯২৯

২৯২৯। দেখুন টিকা ২৯২৭। মহা বিশ্ব ভূবনের এই অপরূপ সৌন্দর্য এবং মহিমময় সৃষ্টি যদি আমাদের বিস্মিত করতে পারে তবে এসবের নিয়ন্ত্রণকর্তা যিনি , তার ক্ষমতা ও সুউচ্চ অবস্থান কি আরও অধিক বিস্ময়ের উদ্ভব করে না? মানুষ কি বিশ্ব ভূবনের অধিপতির শ্রেষ্ঠত্ব, ক্ষমতা ও মহিমান্বিত রূপকে অনুধাবন করে নিজের ক্ষুদ্রতা ও অসহায়ত্ব উপলব্ধি করতে পারে না ?

৮৮। বল : " কে তিনি যার হাতে সকল কিছুর কর্তৃত্ব ; - যিনি সকলকে রক্ষা করেন, কিন্তু তার উপরে [ কোন ] রক্ষাকর্তা নাই ? [ বল ] যদি তোমরা জান ? "

৮৯। তারা বলবে, " আল্লাহ্‌র [ অধিকারে ]।" বল : " তাহলে কেমন করে তোমরা বিভ্রান্ত হচ্ছ ? " ২৯৩০

২৯৩০। আল্লাহ্‌কে - আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকে অনুধাবন করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকে অনুধাবন করতে বলা হয়েছে। মহা বিশ্ব -ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হচ্ছে স্রষ্টার সৃষ্টি কৌশলের এক অনন্য নিদর্শন। বিজ্ঞান, শিল্প, সৌন্দর্য সব তাঁর সৃষ্টির মাঝে এসে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর সৃষ্টি স্বয়ংসম্পূর্ণ - বিজ্ঞানের সুত্রের সর্বোচ্চ প্রয়োগ, সৌন্দর্যের আঁধার , মানুষের নিরাপত্তার প্রতীক , বেঁচে থাকার অবলম্বন। সমস্ত সৃষ্টির মাঝে তার কল্যাণকর হাতের স্পর্শ সর্বত্র বিদ্যমান। বিজ্ঞান বলে, সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতি একই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। এই সত্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহ্‌র একত্বের দিকে। যার অনুভব আছে, জ্ঞান আছে, সেই এই সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম। সুতারাং যারা আল্লাহ্‌র একত্বকে ত্যাগ করে এবং তাঁর মঙ্গলময় ইচ্ছাকে অনুধাবনে অক্ষম হয়ে, কুফরী করে তারা পাগল বই আর কিছু নয়। আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য উপাস্যের উপাসনা বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছু নয়।

৯০। আমি তাদের সত্য প্রেরণ করেছি; কিন্তু তারা প্রকৃতই মিথ্যার অভ্যাস করে।

৯১। আল্লাহ্‌ কোন পুত্র সন্তান গ্রহণ করেন নাই এবং তাঁর সাথে অন্য কোন উপাস্য নাই। [ যদি সেখানে বহু উপাস্য থাকতো ] , শোন, তবে প্রত্যেক উপাস্য তার স্বীয় সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেতো এবং একে অপরের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করতো ২৯৩১। ওরা আল্লাহ্‌র প্রতি যা আরোপ করে [ তিনি তা থেকে মুক্ত ]।

২৯৩১। দেখুন আয়াত [ ১৭ : ৪২ ] এবং টিকা ২২৮। বহু ঈশ্বরের কল্পনা এক মূর্খের কল্পনা। কারণ পৃথিবী ও নভোমন্ডল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই স্রষ্টার একত্বের স্বাক্ষর মেলে। যদি তা বহু ঈশ্বরের সৃষ্টি হতো, তবে প্রাকৃতিক নিয়মের সুত্রের মাঝে বহুধা বিভক্তি লক্ষ্য করা যেতো। যা শেষ পর্যন্ত সৃষ্ট পদার্থের সমন্বিত শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতো।

৯২। তিনি জানেন যা কিছু গুপ্ত এবং যা কিছু প্রকাশ্য। ওরা তাঁর প্রতি যে অংশীদারিত্ব আরোপ করে তিনি তা থেকে বহু উর্দ্ধে ২৯৩২।

২৯৩২। আল্লাহ্‌র সন্তান বা পরিবার বা অংশীদার ইত্যাদি আল্লাহ্‌ সম্পর্কে কল্পনা করা, আল্লাহ্‌র মহিমাকে খর্ব করার সামিল। এসব অসত্য থেকে আল্লাহ্‌র অবস্থান বহু উর্দ্ধে। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। পৃথিবীর কোনও কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়।

রুকু - ৬

৯৩। বল : " হে আমার প্রভু ! তুমি যে বিষয়ে তাদের সর্তক করেছ তা যদি তুমি [ আমার জীবদ্দশায় ] আমাকে দেখাতে চাও , - ২৯৩৩

৯৪। " তাহলে হে আমার প্রভু ! তুমি আমাকে পাপী সম্প্রদায়ের মধ্যে রেখো না। "

২৯৩৩। এখানে "বল" শব্দটি দ্বারা রসুলকে [ সা ] সম্বোধন করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি তাঁর রসুলের [সা ] নিকট মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ণ হয়। কিন্তু এই আয়াতটির সমসাময়িক অর্থ ব্যতীতও একটি সার্বজনীন অর্থ বিদ্যমান যা সর্বযুগে সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। পাপ কখনও বিনা শাস্তিতে রেহাই পাবে না। এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র হুকুম। সে শাস্তি যে শুধুমাত্র পরকালের জন্যই নির্ধারিত তা নয়। ইহকালে পাপীদের আল্লাহ্‌র অনুতাপের মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ দান করে থাকেন। কিন্তু এই সময় দান অফুরন্ত কালের জন্য চলতে পারে না। যখন তাদের পাপের পাত্র পূর্ণ হয় এই পৃথিবীতেই তাদের শাস্তি আরম্ভ হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে আমাদের অনুভবে যদি উপলব্ধি ঘটে যে কোন সম্প্রদায়ের উপরে আল্লাহ্‌র শাস্তি নিপতিত হয়েছে, তবে আমাদের প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে আমরা যেনো ঐ জালিম সম্প্রদায়ের অর্ন্তভূক্ত না হই [ ২৩ : ৯৪ ]। অন্য কথায় ঐ জালিম সম্প্রদায় থেকে নিজেদের দূরে থাকতে হবে।

৯৫। এবং তাদের যে বিষয়ে সাবধান করা হয়েছে , তার [ পূর্ণতা ] তোমাকে দেখাতে আমরা অবশ্যই সক্ষম।

৯৬। মন্দকে প্রতিহত কর যা সর্বোৎকৃষ্ট তা দ্বারা ২৯৩৪। তারা যা বলে সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।

২৯৩৪। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের সার্বজনীন উপদেশ দান করেছেন। যদি লোকে তোমার সম্বন্ধে মন্দ বলে, তা সম্মুখেই হোক বা পশ্চাতেই হোক অথবা তোমার ক্ষতি করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে - সব কিছুই ঘটে আল্লাহ্‌র উপস্থিতিতে। অন্যায়কারীর শাস্তি দাতা তুমি নও। তোমার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে ; তাদের প্রতি প্রতিশোধ না নেওয়া বরং তাই করা উচিত যার দ্বারা পাপীদের চৈতন্যদয় ঘটে। কারণ মন্দের পরিবর্তে মন্দ কোনও সুফল বয়ে আনে না। দেখুন [ ৪১ : ৩৪ ] আয়াত ও টিকা ৪৫০৪।

৯৭। এবং বল , " হে আমার প্রভু ! আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি ২৯৩৫।

৯৮। "আমি আশ্রয় প্রার্থনা করি হে আমার প্রভু এ থেকে , তারা যেনো আমার নিকট উপস্থিত হতে না পারে।"

২৯৩৫। যদি এমন হয় যে নিজ চেষ্টা সত্বেও কেউ পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছে না , এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাদের বলেছেন যে, সে ক্ষেত্রে শয়তানের প্ররোচনা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা যেনো আল্লাহ্‌র সাহায্য ও নিরাপত্তা কামনা করে। পাপের শক্তি মোহময়ী ও অপরিসীম। এই শক্তিকে প্রতিরোধ্য করার জন্য শুধু যে পাপের তৎপরতা বন্ধের চেষ্টা করবে তাই নয়, পাপের নিকটেও যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ যে কোনও কারণে পাপের নিকটবর্তী হলে মানুষ অনেক সময়ে পাপের মোহময়ী আকর্ষণীয় ক্ষমতায় গ্রেফতার হয়ে পড়ে। হতে পারে তা পাপের দমনের চেষ্টা বা কৌতুহল যে, পাপের স্বরূপ কি তা আবিষ্কারের চেষ্টা। যেমন : যুব সমাজের অনেকেই কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে শেষ পর্যন্ত মাদকে আসক্ত হয়ে যায় এরূপ ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। সুতারাং পাপের ত্রিসীমানাতে যাওয়া উচিত নয়। এই ব্যাপারে সর্বদা আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। এরূপ প্রার্থনা মনোবল বৃদ্ধি করে।

৯৯। [ তারা মিথ্যার মাঝে থাকবে ] যতক্ষণ না তাদের মধ্যে কারও মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখন সে বলে, " হে আমার প্রভু ! আমাকে পুণরায় [ পৃথিবীতে ] প্রেরণ কর ,।২৯৩৬

২৯৩৬। ইউসুফ আলী সাহেবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই আয়াতটি, [ ২৩ : ৯০ ] আয়াতের ধারাবাহিকতা হওয়া প্রয়োজন। যদিও আল্লাহ্‌র বাণীর মহিমা সর্বত্র প্রচারিত ও প্রকাশিত তবুও পাপীরা সত্যকে ত্যাগ করে মিথ্যাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চায় - যতক্ষণ না মৃত্যু তাদের দুয়ারে হানা দেয়।

১০০। " যাতে আমি সৎকাজ করতে পারি, যা আমি পূর্বে অবহেলা করেছি; ২৯৩৮" - " না তা হবার নয়, [কারণ ] সে যা বলছে তা কথার কথা মাত্র " ২৯৩৯ - পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে মধ্যবর্তী প্রাচীর বা বারযাখ ২৯৪০।

২৯৩৮। পাপীরা মৃত্যুকালে পাপকে পরিত্যাগ করে পূণ্যময় জীবন যাপনের জন্য আর একবার সুযোগ প্রার্থনা করবে। কিন্তু মৃত্যুকালে কোনও প্রার্থনা মঞ্জুর হবে না। অনুতাপ বা তওবা করার সময় তখন হবে বহুদূরে।
মন্তুব্য : তওবা হচ্ছে অনুতাপের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করা। কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রীর সংশোধনের সুযোগ থাকে না। সে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কাছে প্রমাণ করতে পারে না যে, সে নিজেকে সংশোধন করেছে। সুতারাং তওবার মূল অংশ থাকে অনুপস্থিত। সুতারাং তওবা কবুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। দেখুন টিকা ৫৫।

২৯৩৯। মৃত্যুকালে পাপীদের অনুতাপ প্রকাশের কোন অর্থই নাই। তা শুধুমাত্র কথার কথা , অন্তঃসারশূন্য বাক্য মাত্র। কারণ পৃথিবীতে তাদের বহুবার সুযোগ দান করা হয়েছে, বহু সময় দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা শুধু যে তা প্রত্যাখান করেছে তাই -ই নয়, তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্বেই বিশ্বাসী ছিলো না , পরলোকের জীবনে বিশ্বাসী ছিলো না ফলে পৃথিবীতে তারা কোনও দিনই আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা করে নাই।

২৯৪০। "Barzakh" প্রতিবন্ধক দুই ঘরের মধ্যবর্তী পৃথকীকরণ পর্দ্দা , বাঁধা ইত্যাদি। মৃত্যুর সাথে সাথে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ অন্তর্হিত হবে, পৃথিবীর সাথে হবে সম্পর্কশূন্য। আবার সে সময়ে পরকালও দৃষ্টিগোচর হবে না। এই অবস্থায় মানুষ পুনরুত্থান পর্যন্ত অবস্থান করবে। দেখুন [ ২৫ : ৫৩ ও ৫৫ : ২০ ] আয়াত, যেখানে অন্য আর এক ধরণের পৃথকীকরণ পর্দ্দার উল্লেখ আছে। মৃত্যু হচ্ছে অমর আত্মার এই দেহকে ত্যাগ করা। এ এক বিশেষ অবস্থা। আত্মার এ অবস্থায় পিছনে থাকবে মৃত্যুর বাঁধা বা পর্দ্দা এবং সামনে থাকবে "Barzakh" অর্থাৎ প্রতিবন্ধক যা শেষ বিচারের পূর্বে তুলে নেয়া হবে না। এই অবস্থায় আত্মা পুনরুত্থান পর্যন্ত অবস্থান করবে।

১০১। এরপরে যখন সিংগায় ফুঁ দেয়া হবে, সেদিন পরস্পরের মধ্যে কোন [ আত্মীয়তার ] সম্পর্ক থাকবে না। কেহ কারও খোঁজ -খবর নেবে না ২৯৪১।

২৯৪১। এখানে পুনরুত্থান দিবসের বর্ণনা করা হয়েছে। সেদিন প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মফলের হিসাব দাখিলের জন্য আল্লাহ্‌র সমীপে নীত হবে। পৃথিবীর পুরানো আত্মীয়তার বন্ধন সেদিন হবে অদৃশ্য। বংশ পরিচয়, আত্মীয়তার বন্ধন, প্রভাব-প্রতিপত্তি , অর্থ-সম্পদ কিছুই সেদিন ধর্তব্যের মধ্যে থাকবে না। প্রত্যেক আত্মা শুধুমাত্র নিজস্ব কর্মের জন্য দায়ী থাকবে

১০২। তখন যাদের [ সৎ কাজের ] পাল্লা ভারী হবে, তারা [ আধ্যাত্মিক ] মুক্তি লাভ করবে ২৯৪২।

২৯৪২। প্রত্যেকের সৎকাজ ও মন্দ কাজকে তুলনা করা হবে বা ওজন করা হবে। যদি সৎ কাজের পাল্লা ভারী হয় তবে আত্মা মুক্তি পাবে বা সফলকাম হবে অর্থাৎ "Falah" অর্জন করবে। "Falah" অর্থাৎ সমৃদ্ধি, শান্তি, মুক্তি , সফলকাম ইত্যাদি। যদি মন্দ কাজের পাল্লা ভারী হয় আত্মা দোযখের তীব্র যাতনা ও দুঃখ কষ্ট ভোগ করবে।

১০৩। কিন্তু যাদের পাল্লা হবে হাল্‌কা , এরাই তারা যাদের আত্মা [ মিথ্যার মাঝে ] হারিয়ে গেছে ; ২৯৪৩ তাদের আবাস হবে জাহান্নাম।

২৯৪৩। এই আয়াতে দোযখবাসীদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে। যারা পৃথিবীতে মন্দ কাজ করেছে, তারা নিজেরা নিজেদের আত্মার ক্ষতি করেছে। পুনরুত্থানের মাধ্যমে তাদের শেষ বিচারের দিনে সমবেত করা হবে। মন্দ কাজের পরিণতিতে তাদের দোযখ বাস ঘটবে। ক্ষতি বা দোযখ বাস অর্থ এই নয় যে, আত্মার বিনাশ ঘটবে বা আত্মার আর কিছু অনুভবের ক্ষমতা থাকবে না। দোযখের যন্ত্রণা আত্মা প্রতি পলে অনুভব করবে যার বর্ণনা আছে আয়াত [ ১৪ : ১৭ ]। আত্মার বিনাশ ঘটলে বা আত্মার যন্ত্রণা অনুভব ক্ষমতা না থাকলে তখন এ সব যন্ত্রণা আর যন্ত্রনা থাকতো না।

১০৪। আগুন তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে। স্থানচ্যুত ঠোঁটের ফলে দাঁত বের করা [ বীভৎস ] চেহারায় তারা তথায় থাকবে ২৯৪৪।

২৯৪৪। ভয়ে ও দুঃশ্চিন্তায় পাপীদের মুখমন্ডল বীভৎস আকার ধারণ করবে। তাদের ঠোঁট কাঁপতে থাকবে এবং স্বস্থানচ্যুত হয়ে তাদের দাঁত বেরিয়ে পড়বে। ফলে তাদের চেহারা বীভৎস আকার ধারণ করবে।

১০৫। " তোমাদের নিকট কি আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হতো না ? তোমরা তো তা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করতে ? "

১০৬। তারা বলবে, " হে আমাদের প্রভু ! আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত করেছে ২৯৪৫। এবং আমরা ছিলাম এক বিভ্রান্ত সম্প্রদায়।

২৯৪৫। পাপীরা সেদিন আকুল ভাবে সৃষ্টিকর্তার নিকট আবেদন করবে। তাদের আবেদনের ভাষা হবে এরূপ " পাপ আমাদের গ্রাস করে আমাদের উপরে জয়ী হয়েছিলো। আমরা হতভাগ্য , কারণ আমরা পাপের শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করেছিলাম।" তারা ভুলে যাবে যে তারা স্ব-ইচ্ছায় পাপের নিকট আত্মসমর্পন করেছিলো। পরবর্তী আয়াতে [ ২৩ : ১০৯- ১১০] সেই কথাই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা পৃথিবীতে পূণ্যাত্মাদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো তাদের ঈমান ও সৎ কাজের দরুন এবং নিজেরা মন্দ কাজে আত্মসমর্পন করতো স্ব-ইচ্ছায়।

১০৭। " হে আমাদের প্রভু ! এই [ আগুন ] থেকে আমাদের উদ্ধার কর। যদি আমরা কখনও [ মন্দ পথে ] ফিরে যাই , তবে আমরা অবশ্যই পাপী হব।"

১০৮। আল্লাহ্‌ বলবেন, " তোরা [অসম্মানের ] মাঝে এখানেই থাক্‌ এবং আমার সাথে কোন কথা বলিস না ২৯৪৬।

২৯৪৬। পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র নিদর্শনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং পূণ্যাত্মাদের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপের কারণে পরলোকে আল্লাহ্‌র করুণা প্রার্থনা করার অধিকার পাপীদের থাকবে না।

১০৯। " আমার একদল বান্দা প্রার্থনা করতো , 'হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান এনেছি। তুমি আমাদের ক্ষমা কর , এবং আমাদের দয়া কর। তুমিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু '

১১০। " কিন্তু তোমরা তাদের নিয়ে এত পরিহাস করতে যে , তাদের প্রতি তোমাদের [ ঠাট্টা বিদ্রূপ ] তোমাদেরকে আমার উপদেশ ভুলিয়ে দিয়েছিলো যখন তোমরা তাদের প্রতি পরিহাসে মত্ত ছিলে ২৯৪৭;

২৯৪৭। "তোমরা তো তাদের নিয়ে এত পরিহাস করতে।" অর্থাৎ পাপীরা আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে অস্বীকার করতো ও এ সব নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপে এতটাই মগ্ন থাকতো পৃথিবীতে ,যে তারা বুঝতে অক্ষম হয় যে, এ সবের মাধ্যমে সে তার নিজের আত্মার পতনকেই ত্বরান্বিত করছে। এ ভাবেই পাপী তার পাপ কার্যের দ্বারাই ধ্বংস হয়ে যায়। পাপীরা যাদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে বা অত্যাচার, নির্যাতন করে। পরিণামে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা নির্যাতিত অপেক্ষা নির্যাতনকারী অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আল্লাহ্‌র এই বিধান বা নিয়মকে এই আয়াতে দোযখবাসীর বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

উপদেশঃ আল্লাহ্‌র এই বিধান আমাদের পার্থিব জীবনেও প্রযোজ্য। কোনও সমাজ ও জীবন যখন অত্যাচার ও অন্যায়ে ভরে যায়। তখন সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাড়ায়। আর এই ধ্বংস যজ্ঞে অত্যাচারী ও অত্যাচারিত উভয়েই ধ্বংস হয়ে যাবে।

১১১। "আজকে আমি তাদের ধৈর্য এবং দৃঢ়তার জন্য পুরষ্কৃত করবো। এরাই তারা যারা স্বর্গ সুখ অর্জন করেছে "।

১১২। আল্লাহ্‌ বলবেন, " তোমরা পৃথিবীতে কত বৎসর অবস্থান করেছ ? " ২৯৪৮

২৯৪৮। কুফা কিরাত অনুযায়ী "Qala" উচ্চারণ করা হয় যার অর্থ হবে " তিনি বলিবেন"। আবার বসরা কিরাত অনুযায়ী পড়া হয় "Qual" যার অর্থ বল[আদেশ বোধক ]। ব্যাপারটির পার্থক্য ব্যাকরণগত। দেখুন টিকা ২৬৬৬ এবং আয়াত [ ২১ : ৪ ]।

১১৩। তারা বলবে, " আমরা অবস্থান করেছিলাম একদিন বা দিনের কিছু অংশ ২৯৪৯। যারা হিসাব রক্ষক, আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করুন।"

২৯৪৯। সময়ের উল্লেখের দ্বারা এখানে দুইটি বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। ১) পাপীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে ; পরলোকের জীবনের তুলনায় পৃথিবীর স্বল্প স্থায়ীত্বতার দিকে। পাপীরা যখন পরলোকের অনন্ত জীবনকে দেখতে পাবে , তখন তাদের চৈতন্যদয় ঘটবে যে, পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক জীবনকে অবহেলা করে শুধুমাত্র জাগতিক বিষয়বস্তু নিয়ে ব্যস্ত থেকে কি অপূরণীয় ভুল ও ক্ষতির সম্মুখীন তারা হয়েছে।। ২) পৃথিবীর বর্তমান দিনরাত্রির সময়ের হিসাব পরকালে থাকবে না। পরকালে সময়ের ধারণা হবে অসীম ও অনন্ত। সময়ের ধারণা হচ্ছে আপেক্ষিক যা গুহাসঙ্গীরা অনুভব করেছিলো আয়াত [ ১৮ : ১৯ ]। সুতারাং সময়ের সেই আপেক্ষিক ধারণাতে পরকালে ইহকালের এক জীবনের সময়কে মনে হবে একদিন বা একদিনের কিছু অংশ। "

১১৪। তিনি বলবেন, " তোমরা অল্পকালই অবস্থান করেছিলে, - যদি তোমরা তা জানতে !

১১৫। "তোমরা কি তবে মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদের কৌতুকচ্ছলে সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না ? " ২৯৫০

২৯৫০। মানুষ হচেছ " আশরাফুল মাখলুকাত " - স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষকে সৃষ্টি স্রষ্টা উদ্দেশ্য বিহীনভাবে করেন নাই। এই সৃষ্টির পিছনে স্রষ্টার এক নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্য বিদ্যমান। সুতারাং পার্থিব জীবন অসার বিষয়বস্তুতে নষ্ট করা উচিত নয়। মানুষের জন্য আছে পরকালের জবাবদিহিতা। এই পৃথিবীর সকল কাজকর্মের হিসাব তাকে পরকালে আল্লাহ্‌র নিকট দিতে হবে। এই পৃথিবীর জীবন স্বপ্ন বা অলীক নয়। এ জীবন সত্য, এ জীবন পরলোকের জন্য নিবেদিত। কবরেই জীবনের শেষ নয়। সুতারাং আমরা সকলে আন্তরিক ভাবে পরলোকের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবো। আল্লাহ্‌ যে উদ্দেশ্যে আমাদের সৃষ্টি করেছেন সেই উদ্দেশ্যের প্রতি আন্তরিকভাবে অগ্রসর হওয়া ও সত্যকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা মানুষের কর্তব্য। যে চেষ্টা করে আল্লাহ্‌র করুণা তাঁকে বেষ্টন করে থাকে।

১১৬। সুতারাং আল্লাহ্‌ মহিমান্বিত , তিনিই মালিক , প্রকৃত সত্য। তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই ; তিনিই সম্মানীয় আরশের প্রভু।

১১৭। যদি কেউ আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্যের উদ্ভাবন করে, এ ব্যাপারে তার কোন বিধিসংগত ক্ষমতা নাই। তার হিসাব - নিকাশ হবে শুধুমাত্র তার প্রভুর নিকট ২৯৫১। নিশ্চয়ই অবিশ্বাসীরা বিজয় লাভে সমর্থ হবে না।

২৯৫১। আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব হচ্ছে চরম সত্য। তিনি ব্যতীত অন্য কোনও উপাস্য নাই। তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং এই বিশ্ব সংসারের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। যদি কেউ নিজস্ব কল্পনার বশবর্তী হয়ে আল্লাহ্‌র পরিবর্তে অন্য উপাস্যের উপাসনা করে, তবে সে অবশ্যই প্রতারিত হবে। আমাদের শত দোষত্রুটি সত্বেও যদি আমরা তাঁর ক্ষমাপ্রার্থী হই, তবে তিনি আমাদের ক্ষমা করে দেবেন ,সেই আশ্বাস দেয়া হয়েছে পরবর্তী আয়াতে।

১১৮। সুতারাং বল, " হে আমার প্রভু ! তুমি ক্ষমা কর এবং দয়া কর। তুমিই তো শ্রেষ্ঠ দয়ালু।"

২৯৫৩। এই সূরার প্রথম আয়াতে বিশ্বাসীদের সম্বন্ধে যে আশ্বাস দেয়া হয়েছে ঠিক সেই একই ভাষাতে অবিশ্বাসীদের বিপরীত ভাবে সাবধান করা হয়েছে। যারা পূণ্যাত্মা তাদের সফলতা দান করবেন স্বয়ং স্রষ্টা। অপরপক্ষে যারা কুফরী করে তাদের পতন অবশ্যাম্ভবী।