Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ০ জন
আজকের পাঠক ৭১ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৬০৫ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৮৮১ বার
+ - R Print

সূরা নূর


সূরা নূর বা আলো - ২৪

৬৪ আয়াত, ৯ রুকু , মাদানী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করার পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রধান উপকরণ হচ্ছে স্ত্রী -পুরুষের যৌন জীবন, বিশেষভাবে যখন এই যৌন জীবনকে অপব্যবহার করা হয়। যৌন জীবনকে অপব্যবহার করার ফলে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ বিনষ্ট হয়। মানুষ বিভিন্নভাবে যৌন জীবনকে কলুষিত করে থাকে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের মাধ্যমে, অথবা মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করে, অথবা পরিশুদ্ধ গার্হস্থ্য জীবনের চুক্তি ভঙ্গের দ্বারা। জীবন পথের বাঁকে বাঁকে থাকে যৌন জীবনকে কলুষিত করার ফাঁদ। যে এই সব ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, তাঁর আত্মাই পারে আল্লাহ্‌র 'আলোকে' আত্মার মাঝে ধারণ করতে; আত্মাকে পূত পবিত্ররূপে পরিশুদ্ধ করতে, - সৃষ্টির আদিতে তাকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এই সূরার মূল বিষয়বস্তুকে এ ভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।

মহিলাদের প্রতি মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করাকে দণ্ডনীয় অপরাধ করা হয়েছে [ ২৪ : ১১ - ২০ ]। এই আয়াতটি হযরত আয়েশার জীবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হয় , ৫ - ৬ হিজরীতে। সূরাটির অবতরণের সময়পুঞ্জি অনুসারে সূরাটি হবে মদিনার সূরা।

সারসংক্ষেপ : যৌন কলুষতাকে কঠোর শাস্তির মাধ্যমে দমন করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রকৃত সাক্ষী প্রমাণের প্রয়োজন হবে। মহিলাদের সম্বন্ধে মিথ্যা কলঙ্ক রটনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মেয়েদের সম্বন্ধে লঘু কথা বলা বা তাদের অশালীনভাবে বিরক্ত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ [ ২৪ : ১ - ২৬ ]।

গোপনীয়তাকে সম্মান করতে হবে। পোষাক ও ব্যবহারে শালীনতা রক্ষা করে চলতে হবে [ ২৪ : ২৭ - ৩৪ ]।

আলো এবং অন্ধকার; শৃঙ্খলা ও উচ্ছৃঙ্খলতার উপমাসমূহ দ্বারা মানুষকে ধর্মীয় কর্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়েছে [ ২৪ : ৩৫ - ৫৭ ]।

পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের আচার ব্যবহার চারিত্রিক গুণাবলী বিকাশের মাধ্যম বিশেষ। আর চারিত্রিক গুণাবলী-ই মানব সন্তানকে আল্লাহ্‌র প্রতি কর্তব্য কর্মে উদ্বুদ্ধ করে আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ প্রদর্শন করে [ ২৪ : ৫৮ - ৬৪ ]।

সূরা নূর বা আলো - ২৪

৬৪ আয়াত, ৯ রুকু , মাদানী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


০১। এটা একটি সূরা যা আমি অবতীর্ণ করেছি এবং যার [ বিধানকে ] অবশ্য পালনীয় করেছি ২৯৫৩। এর মধ্যে আমি স্পষ্ট আয়াতসমূহ প্রেরণ করেছি, যেনো তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।

২৯৫৩। ইসলাম যৌন জীবনের পবিত্রতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে থাকে। এ কথা কেউ যেনো মনে না করে যে, যৌন জীবনের ছোট-খাট অসংযত আচরণের ক্ষতিকর কোন প্রভাব নাই আধ্যাত্মিক জীবনের উপরে। এই আয়াতটি মূলতঃ যৌন জীবনের পবিত্রতার উপরে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে আধ্যাত্মিক জীবনের বিকাশের সাথে সংম্পৃক্ত করা হয়েছে।

০২। মহিলা ও পুরুষ , যারা ব্যভিচারের পাপে অভিযুক্ত ২৯৫৪, প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করবে ২৯৫৫। যদি তুমি আল্লাহ্‌র বিধানে বিশ্বাস কর এবং শেষ বিচার দিবসে বিশ্বাস কর, তবে আল্লাহ্‌র আদেশ কার্যকর করতে তাদের প্রতি যেনো তোমাদের দয়া না হয়। মুমিনদের একটি দল যেনো তাদের শাস্তির সাক্ষী থাকে ২৯৫৬।

২৯৫৪। 'Zina' শব্দটির অর্থ পুরুষ ও নারীর মধ্যে অবৈধ যৌন সঙ্গম। যখন বিবাহিত পুরুষ বা মহিলা বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে বা অবিবাহিত পুরুষ ও মহিলা অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে, এদের সকলকেই জ্বেনা শব্দটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ইসলামে বিবাহ ও তালাকের আইনকে অত্যন্ত সহজ করা হয়। যেনো মানব সম্প্রদায় বিবাহ বহির্ভূত অসংযত যৌন সম্পর্ক স্থাপনে প্রলোভিত না হয়। আর সে কারণেই জ্বেনার শাস্তিকে অত্যন্ত কঠোর করা হয়েছে। যেনো জীবনের কোনও অবস্থায়ই পুরুষ বা মহিলা কেহ বিবাহ বহির্ভূত যৌন সর্ম্পক স্থাপনে আগ্রহী না হয়। পবিত্র বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের আত্মসম্মান বোধকে জাগ্রত করে; সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, সামাজিক স্বীকৃতি দান করে, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি পরিবারকে সুসংহত ও সুগঠিত করে। ফলে জাতীয় জীবনে ভবিষ্যত বংশধরেরা সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বীকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করে যা একটি সুখী সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত। [ যদিও 'জ্বিনা' শব্দটি বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য , তবুও মুসলিম দর্শনে শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিদের অভিমত হচ্ছে : এই আয়াতে যে শাস্তির উল্লেখ আছে একশত কশাঘাত তা অবিবাহিত মহিলা ও পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য। রসুলের [সাঃ] সুন্না অনুযায়ী বিবাহিত পুরুষ ও মহিলাদের জন্য জ্বেনার শাস্তি হবে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু।]

২৯৫৫। দেখুন আয়াত [ ৪ : ১৫ ] এবং টিকা ৫২৩।

২৯৫৬। 'জ্বেনার' শাস্তি হবে সর্বসমক্ষে, যেনো তা দর্শনে অন্যেরা শিক্ষা লাভ করে।

০৩। ব্যভিচারে অভিযুক্ত পুরুষকে একই পাপে অভিযুক্ত নারী অথবা মোশরেক নারী ব্যতীত অন্য নারীকে বিবাহ করতে দেয়া হবে না, অথবা ব্যভিচারিণী তাকে ব্যভিচারি অথবা মুশরিক পুরুষ ব্যতীত অন্য কেহ বিবাহ করবে না। বিশ্বাসীদের জন্য ইহা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ২৯৫৭।

২৯৫৭। পুরুষ ও মহিলা সকলের জন্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলাম যৌন পবিত্রতা পালনে অত্যন্ত কঠোর। বিয়ের পূর্বে বা বিবাহকালীন অবস্থায় বা বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সর্ব সময়ে ইসলামের বিধানে যৌন পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। ব্যভিচারী পুরুষ ও মহিলাদের পবিত্র বিবাহ বন্ধনের বাইরে রাখা হয়েছে, কারণ তাদের বিবাহ বন্ধনের অযোগ্য করা হয়েছে মোমেন বান্দাদের জন্য।

০৪। এবং যারা সতী রমনীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না [ তাদের অভিযোগকে সমর্থন করার জন্য ] , তাদের আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং এরপর থেকে কখনও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না ২৯৫৮। কারণ এরূপ ব্যক্তিরা দুষ্ট এবং সীমালংঘনকারী ; -

২৯৫৮। সতী স্বাধ্বী রমনীর প্রতি কলঙ্ক আরোপকারীদের প্রতি এই আয়াতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ ব্যতীরেকে এরূপ কাজ অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং গর্হিত। মহিলাদের নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে কোনও বাক্যউচ্চারণের পূর্বে চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে। সাধারণ যে কোনও ঘটনায় বা ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এমন কি খুনের ব্যাপারে প্রমাণের জন্য দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্যদানকে যথেষ্ট ধরা হয়। ইসলাম পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের অসহায়ত্ব বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে আরবের সেই অন্ধকারময় যুগে, সমকালীন বিশ্বে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি ইসলামই প্রথম মেয়েদের দান করে। অসহায় স্বাধ্বী মহিলাদের মিথ্যা কলঙ্ক থেকে রক্ষা করার এ এক যুগান্তকারী দলিল। মিথ্যা সাক্ষী চারজন সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সে কারণেই চার জন সাক্ষীর উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কেউ কোন মহিলার চরিত্রের অপবাদকে চারজন সাক্ষী দ্বারা সমর্থন করতে না পারে, তবে তাকে আশিটি বেত্রাঘাত করা হবে , এবং তাকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। এই নাগরিক অধিকারটি হচ্ছে : তার কোনও সাক্ষ্যকে গ্রহণ করা হবে না। অর্থাৎ সে রাষ্ট্রের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে যা অত্যন্ত অসম্মানজনক। তবে সে যদি তওবার মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করে তবে তাকে তার নাগরিক অধিকার প্রত্যাবর্তন করা হবে।

মন্তব্য : পুরুষদের কুৎসা থেকে মহিলাদের রক্ষা করার এ এক অপূর্ব ঐশ্বরিক সনদ। সারা পৃথিবীর এবং বাংলাদেশের মুসলিম মহিলারা বাইরের পৃথিবীর কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করছে ফলে অনেক সতী সাধ্বী মহিলারাও পুরুষদের কুৎসা ও অপবাদের শিকার হন। তাদের জন্য এই আয়াত এক জ্বলন্ত দলিল।

০৫। যতক্ষণ না তারা এ ব্যাপারে অনুতপ্ত হয় এবং [ তাদের চরিত্রের ] সংশোধন করে ২৯৫৯। আল্লাহ্‌ তো বারে বারে ক্ষমাশীল , পরম করুণাময়।

২৯৫৯। উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ ব্যতীত মহিলাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা ইসলামে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এই শাস্তি হচ্ছে আশিটি বেত্রাঘাত ও নাগরিক অধিকার হরণ। এই নাগরিক অধিকার ফেরত পেতে পারে, যদি পরবর্তীতে সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং তার চরিত্রকে সংশোধনের মাধ্যমে সে প্রমাণ করতে পারে যে , সে যা করেছে তার জন্য সে দুঃখিত এবং অনুতপ্ত। এবং ভবিষ্যতে এরূপ কাজ তার দ্বারা সংঘটিত হবে না। যদিও বর্তমান বিশ্বে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে মুসলিম এই আইনের ধারা প্রযোজ্য হয় না , তবুও মুসলমান হিসেবে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে ও উপলব্ধি করতে হবে যে, এই ঐশ্বরিক আইনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মহিলাদের সম্মান করা। আরবের ও সমসাময়িক বিশ্বের অন্ধকারময় যুগে নারীদের সম্মানকে নিরাপদ করার এ এক অপূর্ব ঐশ্বরিক সনদ।

০৬। এবং যারা তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে, কিন্তু নিজেরা ব্যতীত এ ব্যাপারে তাদের কোন সাক্ষী নাই ২৯৬০, তাদের নিভৃত সাক্ষ্য [ গ্রহণ করা হবে ] , যদি তারা চার বার আল্লাহ্‌র নামে [ শপথ গ্রহণ করে ] বলে যে তারা অবশ্যই সত্য বলছে।

০৭। এবং পঞ্চম বারের [ শপথ ] হবে যে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার উপরে আল্লাহ্‌র লা'নত নেমে আসবে।

২৯৬০। এই আয়াতে [ ২৪ : ৬ ] বৈবাহিক জীবনে ব্যভিচারের পরিণাম সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিবাহিত ব্যক্তির দাম্পত্য জীবন, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে আলাদা। যদি স্বামী বা স্ত্রী যে কেহ ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তবে এক পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ বিবাহ বন্ধন এমন এক নিভৃত এবং দৃঢ় বন্ধন যে শত মত পার্থক্য থাকা সত্বেও মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী অন্য পক্ষকে কলঙ্কিত করার ক্ষমতা রাখে, কারণ মানুষ তা বিশ্বাস করে। মনে করুণ স্বামী স্ত্রীকে ব্যভিচারের সময় পর পুরুষের সাথে হাতে নাতে ধরে ফেললেন। স্বামী যতক্ষণে চারজন সাক্ষীকে ডেকে আনতে যাবেন, ততক্ষণ কি অপরাধীরা সেখানে অবস্থান করবেন? সেক্ষেত্রে বাইরের চারজন সাক্ষী অসম্ভব ব্যাপার। এরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তীতে তাদের পূর্বের দাম্পত্য জীবন যাপন অসম্ভব ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে দু পক্ষেরই সামাজিক সম্মানের প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়ে। সমাজের চক্ষে অপরাধী ও নির্যাতিত উভয়েরই সমভাবে সম্মান হানি ঘটে থাকে। যেহেতু এ ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার , সে জন্য এ ক্ষেত্রে শাস্তিটি একটু ভিন্ন মাত্রার হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যাপারটির ফয়সালার দায়িত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মর্যদার উপরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। স্বামী চারবার শপথ করবে যে , তার অভিযোগ সত্য এবং পঞ্চম বার সে আল্লাহ্‌র শাস্তিকে আহ্বান করে। শপথ করবে এই বলে যে তার স্ত্রীর প্রতি আরোপিত অভিযোগ মিথ্যা হলে আল্লাহ্‌র শাস্তি তার উপরে পতিত হবে। ঠিক সমভাবে স্ত্রীকেও ব্যভিচারের অভিযোগের সত্যতার বিপক্ষে চার বার শপথ করতে হবে এবং পঞ্চম বারে আল্লাহ্‌র শাস্তিকে আহ্বান করবে। যদি সে তা না করে বা করতে অস্বীকার করে , তবে সে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে এবং ব্যভিচারিণীর যা শাস্তি তা তার প্রাপ্য হবে। উভয় ক্ষেত্রে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। কারণ এরূপ একটি জঘন্য অভিযোগের পরে তাদের পক্ষে আর স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস করা সম্ভব নয়।

মন্তব্য : আয়াতগুলিতে দেখা যায় ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের জন্য শাস্তির বিধান সমান। এই আয়াতগুলি নারী ও পুরুষের সমতার জ্বলন্ত সনদ। তবে দুঃখের বিষয় অনেকে মনে করেন আয়াতগুলি বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য প্রযোজ্য - কারণ তাদের বিশ্বাস মেয়েদের সতীত্ব রক্ষার মাধ্যমেই সামাজিক শৃঙ্খলা বিরাজ করবে। এ সব বক্তারা ভুলে যান যে, ব্যভিচার কখনও এককভাবে সংঘটিত হয় না। নারী পুরুষের যৌথ ক্রিয়াতেই যৌন ক্রিয়া সংঘটিত হয়। সুতারাং ব্যভিচারের জন্য নারী যতটুকু দায়ী থাকবে, পুরুষও ততটুকু দায়ী থাকবে। সুতারাং শাস্তিও সমভাবে প্রযোজ্য হবে, এটাই ন্যায় বিচার এবং আল্লাহ্‌র প্রেরিত সত্য। সমাজের নারীদের প্রতি একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সমাজে মুসলমান পুরুষেরা হয়ে ওঠে স্বেচ্ছাচারী ফলে মেয়েরা স্ব অধিকার লাভে ব্যর্থ হয় এবং ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে নির্বাসিত হয়ে ঘরের কোণাতে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। তারপরেও তাদের মুক্তি নাই। আজকে বাংলাদেশের সমাজে অহরহ নারী হচ্ছে ধর্ষিতা, এসিডে নির্যাতিত ও মিথ্যা কলঙ্কে ভূষিত এবং ফতোয়ার দ্বারা অত্যাচারিত। কোরাণ পুরুষকে সংযমের আদেশ দান করেছে তা তারা অনুধাবনে অক্ষম [ ২৪ : ৩০ ]। ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা হচ্ছে ব্যহত। কারণ ঘরের কোণাতেও মেয়েরা আজকে নিরাপদ নয়।

০৮। কিন্তু স্ত্রীর শাস্তি রহিত হবে যদি সে চারবার আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে সাক্ষ্য দেয় যে, তার স্বামীই মিথ্যাবাদী।

০৯। এবং পঞ্চম বারে বলে যে, তার স্বামী সত্যবাদী হলে তার নিজের উপরে নেমে আসবে আল্লাহ্‌র গজব।

১০। যদি তোমাদের উপরে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো এবং যদি আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন না হতেন [ তবে তোমরা ধ্বংস প্রাপ্ত হতে ] ২৯৬১।

২৯৬১। দেখুন আয়াত [ ২৪ : ১১ - ১৪ ] এবং টিকা ২৯৬২। এই আয়াতগুলি একটি নির্দ্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ করা হয়।

রুকু - ২

১১। যারা এই মিথ্যাকে রচনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল ২৯৬২। একে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে না করে বরং ইহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর মনে কর ২৯৬৩। ওদের প্রত্যেকের জন্য আছে ওদের কৃত পাপ কর্মের ফল এবং ওদের মধ্যে যে এই ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে , তার জন্য আছে মহাশাস্তি ২৯৬৪।

২৯৬২। ৫ - ৬ ই হিজরীতে রসুল [ সা ] যখন বানু-মুসতালিকের অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখনই ঘটনাটি সংঘটিত হয়। ঘটনাটি এরূপ; এই ঘটনার পূর্বেই পর্দ্দার আয়াতগুলি অবতীর্ণ হয়েছিলো। এই যুদ্ধে হযরত আয়েশা রসুলুল্লাহ্‌ [ সা ] সাথে গমন করেন। হযরত আয়েশার জন্য উটের পিঠে পর্দ্দা বিশিষ্ট আসনের ব্যবস্থা করা হয়। হযরত আয়েশা প্রথমে পর্দ্দা বিশিষ্ট আসনে সওয়ার হয়ে যেতেন, এরপরে লোকেরা আসনটিকে উটের পিঠে বসিয়ে দিত। এটাই ছিলো নিত্যদিনের অভ্যাস। যুদ্ধ সমাপ্তির পরে মদিনায় ফেরার পথে একদিন একটি ঘটনা ঘটলো। যখন যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে তাবু গুটানো হচ্ছিলো, সে সময়ে হযরত আয়েশা তাঁর তাঁবুতে ছিলেন না। তিনি তাঁর হারানো মূল্যবান গলার হার তল্লাসীতে তাঁবু থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন। যেহেতু তাঁর আসনটি ঘেরা ছিলো , এবং তিনি তাঁবুতে ছিলেন না , সুতরাং বাহকেরা মনে করেছিলো যে তিনি তাঁর পর্দ্দা ঘেরা আসনে অপেক্ষা করছেন। সেভাবেই যাত্রা শুরু হয়ে যায় এবং সেনাবাহিনী পরবর্তী স্থানে না থামা পর্যন্ত তা লক্ষ্য করা হয় না। ইতিমধ্যে হযরত আয়েশা ফিরে এসে দেখেন যে কাফেলা চলে গেছে। তিনি কিণ্তু অস্থির না হয়ে ধীরে স্থির ভাবে সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকেন। কারণ তাঁর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করলেই তাঁর উদ্ধারের জন্য লোক প্রেরণ করা হবে এ বিশ্বাস তাঁর ছিলো। সময়টি ছিলো রাত্রি সুতারাং তিনি ঘুমে ঢলে পড়েন। অপর দিকে সাফওয়ান নামে একজন মুহাজিরকে রসুলুল্লাহ্‌ [ সা ] নিয়োজিত করেছিলেন এ জন্য যে, সে কাফেলার পিছনে আসবে, যদি ভুলক্রমে কাফেলা কোন জিনিষ পিছনে ফেলে আসে তা কুড়িয়ে আনার জন্য। পর দিন সকালে সাফওয়ান হযরত আয়েশাকে দেখতে পান এবং তিনি তাঁকে উটের পিঠে সওয়ারী করে উটের দড়ি হাতে ধরে পদব্রজে যাত্রা করেন। এই ঘটনা মোনফেক ও শত্রুদের মাঝে কুৎসা ও অপবাদ রটনার সুযোগ করে দেয়। অপবাদ রটনাকারীদের দলপতি ছিলো আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে উবাই নামে মদিনার এক মোনাফেক - যার উল্লেখ এই আয়াতের শেষে করা হয়েছে। এই উবাই বহু ধরনের পাপের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলো এবং শেষ পর্যন্ত অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন না করেই সে পাপী অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করে। অপরপক্ষে যারা তাঁর সাথে যোগদান করেছিলো তারা নির্দ্দিষ্ট শাস্তি গ্রহণ করে ও তওবার মাধ্যমে আত্ম সংশোধন করে। এই হচ্ছে পরবর্তী আয়াতসমূহ প্রত্যার্পনের আনুসঙ্গিক ঘটনা।

২৯৬৩। মিথ্যা কুৎসা গোপনে রটনা অপেক্ষা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করা উত্তম। কারণ তখন তা মিথ্যা প্রমাণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় না। ফলে, পাপীরা অনুতপ্ত হয়ে পাপ মোচনের সুযোগ লাভ করে।

২৯৬৪। অপবাদ রটনাকারীর প্রধান ভূমিকা গ্রহণকারী সম্পর্কে বলা হয়েছে টিকা ২৯৬২ তে।

১২। বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীগণ ২৯৬৫ , যখন তোমরা এ কথা শুনলে - তখন কেন তোমরা তাদের সম্বন্ধে ভালো ধারণা করলে না এবং বললে না, " ইহা তো সুস্পষ্ট অপবাদ"।

২৯৬৫। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই কলঙ্ক রটনাতে অংশ গ্রহণ করে। এই রটনাকারীদের চিন্তা করা উচিত ছিলো যে তারা " বিশ্বাসীদের মাতা" নবী করিমের স্ত্রী [ রা ] এবং এক জন প্রকৃত বিশ্বাসী মুসলিম রমনীর চরিত্র সম্বন্ধে কুৎসা রটনা করছে। তাদের কর্তব্য ছিলো এসব মিথ্যাকে প্রতিহত করে বলা , " ইহা তো সুস্পষ্ট অপবাদ।"

১৩। কেন তারা প্রমাণ স্বরূপ চারজন সাক্ষী উপস্থিত করলো না ? ২৯৬৬। যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করে নাই সে কারণে , তারা আল্লাহ্‌র নিকট মিথ্যাবাদী।

২৯৬৬। যদি কেহ সন্দেহ পোষণই করে থাকে, তবে তারা তা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে গ্রহণ করে নাই কেন ? অপবাদ রটনা না করে তাদের উচিত ছিলো এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো এবং প্রকৃত সত্যকে উদ্‌ঘাটন করা এবং চারজন সাক্ষীকে সংগ্রহ করা। যেহেতু তারা কুৎসা রটনা ব্যতীত সত্যকে প্রমাণ করার জন্য কোন উদ্যোগই গ্রহণ করে নাই , সুতারাং তারা মিথ্যাবাদী ও অপবাদ রটনাকারী রূপে চিহ্নিত এবং তার দরুণ যে শাস্তি, তা তাদের প্রাপ্য।

মন্তব্য : উপরের আয়াতগুলির মাধ্যমে মহিলাদের রক্ষা করার কি অপূর্ব বিধান আল্লাহ্‌ প্রেরণ করেছেন। হযরত আয়েশা [রা] পর্দ্দা প্রথা চালু হওয়ার পরেও মহিলা হওয়া সত্বেও যুদ্ধের মত কঠিন কর্মে অংশ গ্রহণ করেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে , পর্দ্দা প্রথা সত্বেও, মহিলাদের বাইরের পৃথিবীর কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে কোনও আয়াত অবতীর্ণ হয় নাই। বরং এসব মিথ্যা কুৎসা রটনাকারীদের কঠোর শাস্তির বর্ণনা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ মেয়েদের কর্ম জগত শুধুমাত্র ঘরে-ই আল্লাহ্‌ সীমাবদ্ধ রাখেন নাই। বাইরেও তাদের কর্ম জগতের অবশ্যই বিস্তৃতি ঘটবে এবং সেখানে যারা এসব মহিলাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করবে পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন তাদের আশিটি বেত্রাঘাত ও নাগরিক অধিকার হরণ করা হবে। সুতারাং বাহিরের কর্মজগত মহিলাদের কাজের উপযোগী করার নির্দ্দেশই দেয়া হয়েছে পুরুষদের। বিবি আয়েশার [রা ] জীবনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ বিশ্বের নারী জাতির ভবিষ্যতকে নিরাপদ করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুসলিম সমাজ কোরানের এই শিক্ষা থেকে বহু দূরে।

১৪। দুনিয়া ও আখিরাতে যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র দয়া ও অনুগ্রহ না থাকতো, তবে তোমাদের এই [কুৎসা ] রটনার জন্য মহাশাস্তি তোমাদের ঘিরে ধরতো ২৯৬৭।

২৯৬৭। দেখুন আয়াত [ ২৪ : ১০ ]। হযরত আয়েশার [ রা ] মাধ্যমে যে ঘটনার সুত্রপাত ঘটে, আল্লাহ্‌র করুণা না থাকলে কুৎসা রটনার দরুণ দুনিয়ার ও আখেরাতের কল্যাণ তাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যেতো এবং কঠিন শাস্তি তাদের স্পর্শ করতো ইহকালে এবং পরকালেও। ইহকালে, কারণ নবীজীর [সা ] বিচক্ষণতা ও জ্ঞান দ্বারা ঘটনাটির সুত্রপাতেই যদি বিনষ্ট হয়ে না যেতো, তবে নব্য গঠিত মুসলিম উম্মার মধ্যে যারা ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠ ও নিকটজন এবং মুসলিম জগতের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব , তাদের মাঝে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো এবং মুসলিম উম্মার একতাতে ফাটল ধরতো। ইহকালের এই বিপর্যয় থেকে আল্লাহ্‌ নও মুসলিমদের রক্ষা করেন। যারা এই মিথ্যার রটনা করেছিলো এবং অংশ গ্রহণ করেছিলো তাদের পরকাল বা আধ্যাত্মিক জগত ধ্বংস হয়ে যেতো, যদি না তারা ঠিক সময়েই তওবা করে ক্ষমার সুযোগ লাভ করতো। তাদের মনে কোনও সন্দেহ বা বিভেদ বা অবিশ্বাস, বা বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছিলো না, - সম্পূর্ণ ব্যাপারটির ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পরে। এ ভাবেই মুসলিম উম্মার ইহকাল ও পরকাল রক্ষা পায় আল্লাহ্‌র করুণায়।

১৫। স্মরণ কর, তোমরা তা গ্রহণ করেছিলে নিজেদের জিহ্বায় এবং মুখে মুখে বলেছিলে ঐ মিথ্যা কথা যার সম্বন্ধে তোমাদের কোন জ্ঞানই ছিলো না এবং তোমরা একে সামান্য ব্যাপার মনে করেছিলে, অথচ, আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে ইহা ছিলো অত্যন্ত গুরুতর বিষয় ২৯৬৮।

২৯৬৮। এই আয়াতটির মাধ্যমে তিনটি বিষয়ের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষাদান করা হয়েছে। ১) যখন মুখে মুখে ইহা ছড়াইতেছিলো " অর্থাৎ মন্দ ও কুৎসিত কথা বা অপবাদকে তোমরা সংযত না করে মুখে মুখে সংক্রামিত করছিলে - ফলে তোমাদের জিহ্বাকে কলুষিত করছিলে। কেউ যদি মন্দ কথা বলে ও অপবাদ রটনা করে, সে কারণে তোমরাও অংশীদার হবে বা তোমাদের জিহ্বাকে কলুষিত করবে তার কোন যৌক্তিকতা নাই। ২) "এমন মিথ্যা কথা যার সম্বন্ধে কোন জ্ঞান তোমাদের ছিলো না " অর্থাৎ তোমরা সেই কুৎসিত কথাকে পল্লবিত করে প্রকাশ কর যার সত্যতা সম্পর্কে সামান্য জ্ঞানও তোমাদের ছিলো না। যদি বাস্তব বিষয় সম্বন্ধে তোমাদের প্রকৃত ধারণা না থাকে তবে সন্দেহকে কখনও কথায় প্রকাশ করো না। ৩) তোমরা ইহাকে সামান্য ব্যাপার মনে করেছিলে " অর্থাৎ বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু মনে করেছিলে। সাধারণতঃ পরনিন্দা বা কুৎসা বা কলঙ্ক রটনার ক্ষেত্রে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা না করে এক বিকৃত আনন্দে রটনাকারী রটনা করে চলে। বিষয়টি যে এক জনের মান সম্মানের সাথে জড়িত সে কথা তখন রটনাকারী ভুলে যায়। তাদের কাছে ব্যাপারটি মনে হয় খুবই গুরুত্বহীন। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে, " আল্লাহ্‌র নিকট ইহা গুরুতর বিষয় " - বিশেষভাবে যখন তা হয় কোন পূণ্যাত্মা মহিলার ক্ষেত্রে।

মন্তব্য : বাংলাদেশে মহিলাদের কোনও সম্মানজনক অবস্থান নাই। সুতারাং এই সমাজে কর্মজীবী মহিলাদের অহরহ কুৎসার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময়েই দেখা যায় যার কোনও প্রকৃত ভিত্তি নাই। এই আয়াত সেই সব রটনাকারীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।

১৬। যখন তোমরা ইহা শুনলে, তখন কেন বললে না যে, " এ কথা বলা আমাদের পক্ষে উচিত নয়। আল্লাহ্‌ মহিমাময় , এটা একটা জঘন্য অপবাদ ? " ২৯৬৯

২৯৬৯। এই আয়াতগুলি হযরত আয়েশার [ রা ] ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ, কিন্তু এর শিক্ষা সকল যুগের নির্যাতিত নারীদের জন্য প্রযোজ্য। কোনও মোমেন বান্দা যখন কোনও নারীর কুৎসা শ্রবণ করবে তার দায়িত্ব এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিক পথ হচ্ছে এই অপবাদ রটনাকে বন্ধ করা। এটা দুভাবে করা চলে - তাদের প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশের মাধ্যমে বা তাদের প্রচারে সাহায্য না করে।

উপদেশ : প্রকৃত মুসলিম নারীর সম্মান রক্ষার জন্য সর্বদা সচেষ্ট হতে হবে মোমেন বান্দাদের।

১৭। আল্লাহ্‌ তোমাদের সর্তক করছেন যে, যদি তোমরা [ প্রকৃত ] মুমিন হও তবে এরূপ [ ব্যবহারের ] পুনরাবৃত্তি করবে না।

১৮। এবং আল্লাহ্‌ তোমাদের নিকট আয়াতসমূহ সহজ ভাবে প্রকাশ করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ।

১৯। যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার [ দেখতে ] ভালোবাসে , তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে আছে মর্মন্তুদ শাস্তি। বস্তুতঃ আল্লাহ্‌ জানেন তোমরা জান না ২৯৭০।

২৯৭০। সংসারে ভালো অপেক্ষা মন্দের প্রভাব অত্যন্ত দ্রুতভাবে বিস্তৃতি লাভ করে থাকে। এক পাত্র দুধ যেরকম এক ফোঁটা গোময়ের প্রভাবে সম্পূর্ণ দুধ নষ্ট হয়ে যায়। ভালো ও মোমেন বান্দারা সেরূপ স্বল্প সংখ্যক দুষ্ট ও মন্দ দ্বারা প্রতারিত হয়। উপরে হযরত আয়েশার [ রা] কাহিনীর মাধ্যমে এই সত্যকেই আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। হযরত আয়েশার কলঙ্ক রটনায় উবাই এর সাথে অন্যান্য মুসলিমরাও জড়িত হয়ে পড়েন। সমাজ জীবনেও দেখি, আমরা আমাদের অজান্তে অশ্লীলতা প্রসারে সাহায্য করে থাকি, মন্দ ও দুষ্টের মন্দ কাজের সহযোগী হিসেবে। এ ব্যাপারে আমরা সচেতন না থাকতে পারি, কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ সবই জানেন। সুতারাং মানুষ সর্বদা সচেতনভাবে তার বাক্য প্রয়োগ করবে, কথাকে সংযত রাখবে, দুষ্টের পাতা ফাঁদে পা দেবে না। এ ব্যাপারে বান্দা আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করবে একমাত্র আল্লাহ্‌ই পারেন এ ব্যাপারে সাহায্য করতে।

২০। তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে এবং যদি আল্লাহ্‌ দয়া ও করুণার আঁধার না হতেন [ তবে তোমাদের কেহই অব্যহতি পেতো না ] ২৯৭১।

২৯৭১। " তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে ................ " এই বাক্যটি চার বার পুণরাবৃত্তি করা হয়েছে। প্রতি বারে বাক্যটি বলা হয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ১) [ ২৪ : ১০ ] আয়াতে বাক্যটিকে সংযুক্ত করা হয়েছে ; স্বামী যখন তাঁর স্ত্রীকে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। সেক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়কে সাবধান করা হয়েছে অসত্য ও সন্দেহের বিরুদ্ধে এবং উপরের বাক্যটি দ্বারা আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। ২) [ ২৪ : ১৪ ] আয়াতে বিশ্বাসীদের সর্তক করা হয়েছে মিথ্যা গুজব সম্বন্ধে। কারণ মিথ্যা প্রসার বিশ্বাসীদের মধ্যে একতাকে বিনষ্ট করবে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ্‌র করুণাই সকলকে একতা বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে পারে। ৩) এই আয়াতে [ ২৪ : ২০ ] সাবধান করা হয়েছে মন্দ ও দুষ্টের পাতা ফাঁদ সম্পর্কে , যেখানে সহজ সরল লোকেরা খুব সহজেই ধরা পড়ে। একমাত্র আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণাই পারে দুষ্টের এই ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে। ৪) [ ২৪ : ২১ ] আয়াতে সার্বজনীন সর্তকবাণী প্রদান করা হয়েছে। সর্তক করা হয়েছে কথা ও কাজে পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য। এই কথা ও কাজ নিজের পবিত্রতা যেমন রক্ষা করবে অন্যের পবিত্রতা রক্ষার জন্যও সচেতন হবে। একমাত্র আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়াই পারে বান্দাকে নিষ্কলঙ্ক রাখতে। কারণ তিনি বান্দার প্রার্থনা শোনেন। একমাত্র তিনিই জানেন চলার পথে শয়তানের যে সব ফাঁদ পাতা থাকে।

রুকু - ৩

২১। হে মুমিনগণ ! শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যদি কেহ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সে তো [ শুধু ] অশ্লীলতা ও পাপ কার্যের নির্দ্দেশ দেয়। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেহই কখনও পবিত্র হতে পারতে না ২৯৭২। কিন্তু আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করেন। আল্লাহ্‌ -ই [ সব ] শোনেন ও জানেন ২৯৭৩।

২৯৭২। দেখুন টিকা ২৯৭১।

২৯৭৩। এখানে যে পবিত্রতার উল্লেখ আছে তা শুধুমাত্র দৈহিক পবিত্রতা নয়। চিন্তায়, কথায় ও কাজে যে পবিত্রতা তাই হচ্ছে আত্মিক পবিত্রতা। এই আয়াতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এই আত্মিক পবিত্রতার কথা। আত্মার বিকাশ প্রতি মূহুর্তে শয়তানের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে প্রতিহত হয় এবং সৃষ্টির আদিতে প্রাপ্ত আত্মা তার পবিত্রতা হারায়। একমাত্র শুদ্ধ চিন্তা , সংযত বাক্য ও সৎ কাজই পারে তাকে এই ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে। আর ব্যক্তির এই বিশুদ্ধ চিন্তা , কথা ও কাজের উৎস হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত। অপরের মঙ্গলের ইচ্ছা থেকেই শুদ্ধ নিয়তের উৎপত্তি। আত্মার এই পবিত্রতা অর্জন সম্ভব একমাত্র আল্লাহ্‌র সাহায্যের মাধ্যমে। সুতারাং চাইতে হবে একমাত্র সেই মহাপরাক্রমশালী , মহান দয়াময় আল্লাহ্‌র কাছে। তিনি সকলের প্রার্থনাই শোনেন। তিনি-ই সর্বজ্ঞ। তিনি ব্যক্তির হৃদয়ের লোভ-লালসার কথা সম্যক অবগত। মানুষের চরিত্রের দুর্বলতার খবর তিনি পরিজ্ঞাত। তাঁর পরিকল্পনা হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক জগতকে রক্ষা করা। তাঁর কল্যাণময় ইচ্ছা হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ ও সুখ-শান্তিতে ভরিয়ে তোলা। সুতারাং আমাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে বিশ্ববিধাতার নিরাপদ হস্তে নিজেকে আত্মসমর্পন করা।

২২। তোমাদের মধ্য যারা [আল্লাহ্‌র ] অনুগ্রহ ভাজন ও প্রাচুর্যের অধিকারী ২৯৭৪, তারা যেনো শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয় -স্বজন , অভাবগ্রস্থ এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় যারা হিজরত করেছে, তাদের [ কিছুই ] দান করবে না। তাদের ক্ষমা কর এবং [দোষত্রুটি ] উপেক্ষা কর। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করুন? নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।

২৯৭৪। এই আয়াতের প্রত্যাদেশ কাল হযরত আবু বকরের ঘটনার সাথে জড়িত। হযরত আবু বকর [ রা ] হযরত আয়েশার [ রা ] পিতা ছিলেন। আধ্যাত্মিক দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মোমেন বান্দা ও আল্লাহ্‌র বিশেষ করুণায় ধন্য , জাগতিক দিক থেকেও তিনি ছিলেন প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক। আর এ সব অর্থ-বিত্ত তিনি সব সময়েই গরীব দুঃখীদের দুঃখ মোচনের কাজে ব্যবহার করতেন। হযরত আবু বকরের জ্ঞাতিভ্রাতা নাম 'মিশতা' যিনি ছিলেন অত্যন্ত গরীব। আবু বকর তাকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন, এই মিশ্‌তা হযরত আয়েশার [ রা ] কলঙ্ক রটনায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ আবু বকর অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেন। এরই প্রেক্ষিতে এই আয়াতটি অবতীর্ণ করা হয়। এই আয়াতের মাধ্যমে প্রকৃত মোমেন বান্দা যারা আধ্যাত্মিক জগতে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত তাদের মানদণ্ড বর্ণনা করা হয়েছে। অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করা ও তাদের অপরাধ ভুলে পুণরায় ভাতৃবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে প্রকৃত মোমেন বান্দার বৈশিষ্ট্য। হযরত আবু বকর এই আয়াত নাজেল হওয়ার পরে মিশতাকে ক্ষমা করেন ও তাঁর অর্থ সাহায্য পূনর্বহাল করেন। এর ফলে মুসলিম উম্মার মাঝে পুণরায় শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে, এই আয়াতটি যদিও একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয় , কিন্তু এর শিক্ষা সার্বজনীন , যুগকাল অতিক্রান্ত। একজন মহানুভব দাতা ও পৃষ্ঠপোষক কখনও তার ব্যক্তিগত রাগ ও বিদ্বেষের কারণে তার দান বা পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে পারে না, যদি অপরাধী অনুতপ্ত হয় এবং আত্ম সংশোধন করে। যদি সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ মহা অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন তবে অপরাধীর অনুতাপকে ফিরিয়ে দেবার আমাদের কি অধিকার আছে ?

২৩। যারা সতী, সরলমনা ও বিশ্বাসী নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে ২৯৭৫, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত। তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি , -
২৯৭৫। পূণ্যাত্মা ও ভালো মহিলারা অনেক সময়েই লোকদের অপরিণামদর্শীতার শিকার হয়। তাদের নিষ্পাপতা সত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অপবাদ সহ্য করতে হয়, এর ফলে তাদের নিকট জনদের অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। ঠিক এরূপ অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছিলো হযরত আয়েশার [রা ] ক্ষেত্রে। নিষ্পাপ আয়েশা কলঙ্ক রটনাকারীদের রটনায় প্রচন্ড মনোঃকষ্টে ভুগেছিলেন। তাঁর কলঙ্কগাথা যখন আলোচনার বিষয়বস্তু সেই একটা মাস তিনি অবর্ণনীয় মানসিক যাতনায় ক্ষতবিক্ষত হন। তাঁর স্বামী রসুলুল্লাহ্‌ [ সা ] এবং পিতা আবু বকর [ রা ] এক অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হন। তাদের সামাজিক অবস্থান , দায়িত্ব ও কর্তব্যে তাদের অবস্থাকে আরও সঙ্কাটাপন্ন করে তোলে। যেসব নীতিবিহীন লোক এই অপবাদের সুত্রপাত ঘটায় এবং যেসব নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী লোক না বুঝে এই অপবাদ রটনাতে অংশ গ্রহণ করে তারা উভয়েই ভয়াবহ আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কারণ তারা তাদের পাপের দরুণ আল্লাহ্‌র করুণা ও রহমত বঞ্চিত হবে। আল্লাহ্‌র রহমত বঞ্চিত হওয়ার অর্থ বিশেষ অভিশাপগ্রস্থ অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া।

মন্তব্য : মহিলাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপের বিরুদ্ধে এ এক সার্বজনীন ঐশ্বরিক দলিল। মহিলা অধিকার সংরক্ষণের এত গুরুত্বপূর্ণ দলিল আর কোনও ধর্মে আছে কিনা আমার জানা নাই। এর পরেও বিশ্বব্যপী মুসলিম মহিলাদের নির্যাতন সীমাহীনব্যপী বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্মোন্মাদ মৌলবাদীদের দ্বারা।

২৪। সেদিন , যেদিন তাদের জিহ্বা , তাদের হাত, এবং তাদের পদদ্বয়, তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে ২৯৭৬।

২৯৭৬। আমাদের বিভিন্ন অংগ প্রত্যঙ্গ দ্বারা আমাদের মানসিক বিভিন্ন দক্ষতাকে বোঝানো হয়েছে। রসনাকে দেয়া হয়েছে মনের ভাবকে প্রকাশের জন্য আর বলা হয়েছে তা যেনো অসৎ কথায় ব্যবহার না করে আল্লাহ্‌র কাজে ব্যবহার করা হয়। সেই ভাবে হাত যে কর্ম সম্পাদন করবে তা যেনো আল্লাহ্‌র প্রতি নিবেদিত হয়। চরণ যেনো পাপ স্থানে গমন না করে আল্লাহ্‌র জেহাদে শরীক হয় ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে প্রকাশের জন্য শরীরের বিভিন্ন অংগ প্রত্যঙ্গকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যদি আমরা আমাদের মন , মেধা, সৃজনক্ষমতা , পরিশ্রম ইত্যাদিকে আল্লাহ্‌র প্রদর্শিত পথে পরিচালনা না করি , তবে শেষ বিচারের দিনে আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী স্বরূপ কাজ করবে।

২৫। সেদিন আল্লাহ্‌ তাদের প্রাপ্য , [ সকল ] পাওনা পরিশোধ করবেন, এবং তারা অনুধাবন করবে যে, আল্লাহ্‌-ই সত্য, যা সব কিছুকে সুস্পষ্ট করে ২৯৭৭।

২৯৭৭। শেষ বিচারের দিনে আমাদের অপ্রকাশ্য গোপন পাপ বা চিন্তাধারা কিছুই গোপন থাকবে না। আল্লাহ্‌র সিংহাসনের সম্মুখে সকলেই দিবালোকের মত ভাস্বর হবে। কারণ সেদিন আল্লাহ্‌ই একমাত্র সত্য আল্লাহই একমাত্র বাস্তবতা, আল্লাহ্‌র নূরই একমাত্র আলো [ ২৪ : ৩৫ ] আর সব আলো তাঁর আলোর প্রতিফলন মাত্র।

২৬। দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য; দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্য। এবং সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য। লোকে যা বলে ইহা তা দ্বারা প্রভাবিত নয় ২৯৭৮। তাদের জন্য আছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা ২৯৭৯।

২৯৭৮। সচ্চরিত্র পবিত্র বান্দারা পরস্পরের জীবনসঙ্গী হতে পারে, অপর পক্ষে দুশ্চরিত্র ও অপবিত্র যারা তারা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গ পছন্দ করবে জীবনসঙ্গী হিসেবে। যদি দুশ্চরিত্র ও অপবিত্ররা , চরিত্রবান ও পবিত্রদের বিরুদ্ধে কলঙ্ক ও অপবাদ রটনা করে তবে তা হচ্ছে তাদের অপবিত্র ও পাপ চিন্তার ফসল। এর দ্বারা পবিত্র ও সচ্চরিত্র বান্দারা কোনও ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। আল্লাহ্‌ তাদের জন্য মঞ্জুর করেছেন ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। তবে তাদের উচিত এসব কথাবার্তা থেকে দূরে থাকা।

২৯৭৯। যারা একান্ত বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সাথে পবিত্রতা রক্ষা করেও দুষ্টলোকের অপবাদের ও চক্রান্তের শীকার হয় তাদের জন্য আছে আল্লাহ্‌র ক্ষমা ও আধ্যাত্মিক ও জাগতিক সম্মানজনক জীবিকা। এর অর্থ এই যে যতই শয়তান তাদের সম্মান হানির চ্ষ্টো করবে ততই আল্লাহ্‌ তাদের সমর্থন করবেন এবং তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনকে সমৃদ্ধশালী করবেন।

রুকু - ৪

২৭। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আপন গৃহ ব্যতীত অন্য কোন গৃহে প্ররেশ করো না যতক্ষণ না সেই গৃহের মালিকের নিকট অনুমতি নাও এবং সালাম কর। [ নৈতিকতা ও শালীনতার দিক থেকে ] এটাই তোমাদের জন্য উত্তম , যেনো তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর ২৯৮০।

২৯৮০। কতগুলি সাধারণ প্রথা আছে যা মানা না মানার উপরে জীবন ধারণের সৌন্দর্য , সংস্কৃতি বিকাশের ধারা নির্ভরশীল। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হচ্ছে সংস্কৃতিবান জীবন, পবিত্র ও সুন্দর জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। ইংরেজীতে একটা কথা আছে যে ইংরেজদের বাড়ী হচ্ছে দূর্গের ন্যায় - অর্থাৎ তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা দুর্গের ন্যায় দুর্ভেদ্য। এই বাক্যটি দ্বারা কিছুটা সামাজিক শ্রেণী বিভাগ ও উচ্চ বংশ ও হীনমন্যতার ধারণা দেয়। অপর পক্ষে মুসলামদের জন্য ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে অনুমতি সাপেক্ষে এবং সালাম বিনিময়ে গৃহে প্রবেশের মাধ্যমে। এর থেকে এই প্রমাণ হয় যে মুসলমান ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অনুমোদন করে তবে তা যেনো শ্রেণী বিভাগের জন্ম না দেয়, মুসলিম ভাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের চ্ছেদন না ঘটায়। আবার এতটা বাড়াবাড়ি না করে যাতে ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ব্যহত হয়।

২৮। যদি তোমরা গৃহে কাউকে না পাও , তাহলে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না তোমাদের অনুমতি দেয়া হয়। যদি তোমাদের ফিরে যেতে বলা হয় ,তবে ফিরে যাবে। ইহা তোমাদের বৃহত্তর পবিত্রতার জন্য; এবং তোমরা যা কর আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত ২৯৮১।

২৯৮১। গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রে গৃহের মালিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার রক্ষার উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রথমতঃ বলা হয়েছে মালিকের অনুমতি ব্যতীক গৃহে প্রবেশ করবে না। দ্বিতীয়তঃ বলা হয়েছে যদি উত্তর না পাওয়া যায় , তাহলে হয়তো বা গৃহের মালিক বাহিরে বের হওয়ার বা অতিথি অভ্যর্থনা করার উপযুক্ত পরিচ্ছদ বা অবস্থায় নাই। তৃতীয়তঃ হয়তো বা বাড়ীতে কেহ নাই সেই কারণে কেহ উত্তর দান করতে পারে নাই। উপরের যে কোনও পরিস্থিতিতে মালিকের অনুমতি ব্যতীত গৃহে প্রবেশকে অনুমোদন করা হয় নাই। তোমরা অপেক্ষা করবে, দরজায় দুবার বা তিনবার করাঘাত করবে। এর পরেও যদি অনুমতি না মেলে তবে ফিরে যাবে। চতুর্থ অবস্থা হচ্ছে যদি বাড়ীর মালিক অতিথি অভ্যর্থনা করার মত অবস্থায় নাই সেই কারণে সেদিন ফিরে যেতে বললো বা মালিক তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক নয় বিধায় চলে যেতে বললো , ঘটনা যাই-ই হোক না কেন আগন্তুকদের ফিরে যেতে হবে। যদি তোমরা বাড়ীর মালিকের ঘনিষ্ট বন্ধুও হও তবুও বিনা অনুমতিতে গৃহে প্রবেশ নিষিদ্ধ। গৃহের মালিকের ইচ্ছার সম্মান করতে তোমরা বাধ্য থাকবে। এভাবেই তোমরা তোমাদের জীবনের ও আচরণের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারবে এবং তোমাদের চরিত্রের ও নিয়তের পরীক্ষা আল্লাহ্‌ করে থাকেন।

২৯। কিন্তু যদি তোমরা এমন কোন ঘরে প্রবেশ কর যেখানে কেহ বাস করে না , অথচ উহাতে তোমাদের কোন কাজ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে তোমাদের দোষ হবে না ২৯৮২। তোমরা যা কিছু প্রকাশ কর অথবা গোপন কর , আল্লাহ্‌ তা জানেন।

২৯৮২। বাসগৃহে প্রবেশের আইনকে অত্যন্ত কঠোরভাবে পালনের নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। কারণ সুন্দর সংস্কৃতিসম্পন্ন ও শৃঙ্খলা পূর্ণ পারিবারিক জীবনের চাবিকাঠি হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। তবে পারিবারিক বাসগৃহে প্রবেশের যে নিয়ম সে নিয়ম বাস গৃহ ব্যতীত অন্যান্য গৃহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যেমন সরাই খানা বা হোটেল বা দোকান বা গুদামঘর যেখানে ব্যক্তির মালামাল রক্ষিত আছে। এ সব ক্ষেত্রে অনুমতির ব্যাপারে হুকুম না থাকলেও , বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী মালিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়া বা মালিকের অনুমতি দেওয়া উভয় ব্যাপারই ভদ্রতার আওতায় পড়ে। অর্থাৎ প্রয়োজনে প্রবেশ করা যায়।

৩০। [ হে মুহম্মদ (সা) ] বিশ্বাসী পুরুষদের বল, তারা যেনো আপন দৃষ্টি সংযত ও নত রেখে চলে এবং আপন লজ্জা স্থানকে সংযত রাখে ২৯৮৩। এটা তাদের জন্য বৃহত্তর পবিত্রতা এবং তারা যা করে আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।

২৯৮৩। পুরুষ ও মহিলা ঊভয়ের জন্য চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করার হুকুম সমভাবে প্রযোজ্য। এই আয়াতটি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য যেখানে দৃষ্টিকেও সংযত করতে বলা হয়েছে। পুরুষদের দৃষ্টির সংযম রক্ষা যে শুধুমাত্র নারীদের রক্ষা করার জন্য তা নয়, এটা পুরুষদের আধ্যাত্মিক মঙ্গলের জন্য কল্যাণকর।

মন্তব্য : অনেকের ধারণা পুরুষ মানুষের যথেচ্ছা দৃষ্টি দেয়ার অধিকার আছে। এই বোধ থেকে তাদের মানসিক অবস্থা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। ফলে সঠিক কাপড় চোপর পড়েও মহিলারা ও কিশোরীরা এদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায় না। স্কুল , কলেজের অল্পবয়েসী মেয়েরা অহরহ টিট্‌কারী ও নানা অশ্লীর বাক্যবাণে আবদ্ধ হয়। এমনকি গার্মেন্টস শ্রমিকেরা নিত্যদিন নানা যন্ত্রনায় শিকার হয়। যারা আল্লাহ্‌র হুকুমকে অমান্য করে তাদের কঠোর শাস্তির প্রয়োজন। এরাই সমাজকে কলুষিত করে।

৩১। আর বিশ্বাসী নারীদের বল, তারা যেনো তাদের আপন দৃষ্টি সংযত রাখে , আপন লজ্জ্বা স্থানকে রক্ষা করে চলে ২৯৮৪। তারা তাদের সৌন্দর্য ও অলংকারের প্রদর্শনী করবে না ২৯৮৫; ততটুকু ব্যতীত যতটুকু সাধারণতঃ এমনি প্রকাশ পায়। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেনো চাঁদর দ্বারা আবৃত করে; তারা যেনো তাদের স্বামী , পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র , ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, অথবা তাদের [ সমাজের ] নারীগণ বা তাদের অধীনস্থ গোলাম [ দাসগণ ] অথবা কামপ্রবৃত্তিহীন ভৃত্য অথবা সেই সকল শিশু যারা নারীদের গোপনীয় বিষয় সম্বন্ধে জানে না , এরা ব্যতীত আর কাহারও নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেনো তাদের গোপন অলংকার প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে ২৯৮৬। এবং হে বিশ্বাসীগণ ! তোমরা সকলে মিলে একত্রে আল্লাহ্‌র দিকে প্রত্যাবর্তন কর, তাহলেই তোমরা পরম শান্তি লাভ করবে ২৯৮৭।

২৯৮৪। পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই জন্য যৌন সংযম সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু লিঙ্গ ভেদের জন্য প্রকৃতিগত ভাবে পুরুষ ও মহিলার মধ্য যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় তার দরুণ সমাজে পুরুষ ও মহিলার মধ্য মেজাজ , মর্জি, যৌন আকাঙ্খার মধ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সে কারণেই পুরুষ অপেক্ষা মেয়েদের অধিক গোপনীয়তা প্রয়োজন বিশেষভাবে পোষাক পরিচ্ছদ এবং শরীর ঢাকার ব্যাপারে।

২৯৮৫। লিঙ্গভেদে প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী পুরুষের মানসিক ও দৈহিক প্রকৃতি এবং সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী পুরুষেরা যৌন জীবনে অধিক আগ্রহী দেখা যায়। এটা কিছুটা প্রকৃতির নিয়ম। সে কারণে সামাজিক পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব ও কর্তব্য পুরুষদের অপেক্ষা মহিলাদের বেশী। সুতারাং পুরুষের বেলায় তাদের কর্তব্য দ্বিবিধ প্রথমতঃ দৃষ্টিকে সংযত রাখতে হবে ও দ্বিতীয়তঃ নিষিদ্ধ যৌন সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। মহিলাদের বেলাতে এই দায়িত্বকে আরও অধিক করা হয়েছে। তাদের বলা তারা যেনো তাদের সৌন্দর্য্য, আভরণ নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত আর কাউকে প্রদর্শন না করে। এখানে "Zinat" শব্দটির অর্থ স্বাভাবিক সৌন্দর্য এবং অলংকার। এই দুই অর্থই এখানে প্রযোজ্য তবে প্রথম অর্থটি অধিক প্রযোজ্য। যাদের সম্মুখে বের হওয়ার কোনও বাধা নিষেধ থাকবে না তারা হলেনঃ ১) স্বামী ২) স্বামীর নিকট আত্মীয়দের সম্মুখে কিছুটা শিথিলতা অনুমোদন যোগ্য , ৩) মহিলাদের সম্মুখে; ৪) পুরুষ ও মেয়ে ক্রীতদাস ও দাসী; যারা ঘরের মধ্যে কাজ করে। ৫) যৌন আকাঙ্খাহীন পুরুষ যাদের গৃহভ্যন্তরে যাওয়ার অনুমতি আছে এবং ৬) ছোট শিশু যাদের তখনও যৌন আকাঙ্খা হয় নাই। আরও দেখুন [৩৩ : ৫৯ ] আয়াতে দেখুন পর্দ্দা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে। অবশ্য ৪) নম্বরের নিষেধাজ্ঞা এখন বাতিল বলে গণ্য , কারণ পৃথিবীতে এখন ক্রীতদাস প্রথা নাই।

২৯৮৬। এই লাইনটিতে নারীকে সাবধান করা হয়েছে তারা যেনো পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ছলনার আশ্রয় না করে।

২৯৮৭। যদিও আয়াতগুলিতে গার্হস্থ জীবনকে সুস্থ ও সুরুচীশীল করার উপায় হিসেবে খুঁটিনাটি বর্ণনা করা হয়েছে , কিন্তু আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবনের পরিশীলন করা। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন হচ্ছে পরকালের শিক্ষানবীশ কাল। পরকালের জীবনের সাফল্য ও সুখ শান্তির জন্য, ইহকালের ক্ষুদ্র জীবনের চেষ্টা অপরিহার্য। এই জীবনের ব্যক্তিগত চেষ্টা, পারিবারিক জীবন, সামাজিক কর্মকান্ড সবই সেই পরলোকের জীবনের সফলতার জন্য অনুশীলন মাত্র। আল্লাহ্‌ তাই বলেছেন, "তাহলেই তোমরা পরম শান্তি লাভ করবে।"

৩২। তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত ২৯৮৮, অথবা তোমাদের ক্রীতদাসদের মধ্য, পুরুষ বা নারী, যারা পূণ্যাত্মা তাদের বিবাহ দাও [ কর ]। যদি তারা দরিদ্র হয় আল্লাহ্‌ নিজ কৃপায় তাদের অভাবমুক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সব কিছু বেষ্টন করে আছেন ২৯৮৯, এবং তিনি সব কিছু জানেন।

২৯৮৮। "Ayama" হচ্ছে "Aiyim"এর বহু বচন। অর্থ যে পুরুষের স্ত্রী নাই অথবা যে নারীর স্বামী নাই। উহারা অবিবাহিত বিপত্নীক অথবা বিধবা যাই হোক না কেন, যৌন জীবনকে পবিত্র রাখতে বিবাহ বন্ধন অত্যাবশ্যক।

২৯৮৯। দেখুন আয়াত [ ৫ : ৫৪ ]। আল্লাহ্‌র করুণা সকলের জন্য সমভাবে বিদ্যমান। তাঁর দয়া ও রহমত কোন বিশেষ শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত থাকে না।

৩৩। যারা বিবাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বন্দোবস্ত করতে পারে না, তারা যেনো নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করে সংযত ভাবে চলে, যতদিন না আল্লাহ্‌ আপন কৃপায় তাদের সচ্ছল করেন ২৯৯০। এবং তোমাদের অধীনস্ত ক্রীত দাস-দাসীগণ যারা [ অর্থের পরিবর্তে ] স্বাধীনতার চুক্তি লিখিয়ে নিতে চায়, তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হও ২৯৯১, যদি তোমরা তাদের মধ্য মঙ্গলজনক কিছু বুঝতে পার। হ্যাঁ, [ সেক্ষেত্রে ] আল্লাহ্‌ তোমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তাদের কিছু দান করবে। আর তোমাদের দাসীগণ যখন সতীত্ব রক্ষা করতে চায়, তখন পার্থিব লাভের আশায় তাদের ব্যভিচারিণী হতে বাধ্য কর না ২৯৯২ , ২৯৯৩। কিন্তু যদি কেউ তাদের [ব্যভিচারে ] বাধ্য করে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তাদের বাধ্যতার পরে তাদের প্রতি ক্ষমাকারী , পরম করুণাময় ২৯৯৪।

২৯৯০। মুসলিম যুবকদের বিবাহের সময়ে মেয়েকে দেনমোহর দিতে হয়। আর এই দেনমোহর নগদ পরিশোধ যোগ্য। সেই কারণে দরিদ্র যুবকদের অনেক সময়েই দেনমোহরের অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। যদি কেহ গরীব হয়, বিবাহের সামর্থ্য না থাকে তবুও তাকে কৌমার্য রক্ষা করতে হবে। বিবাহ বর্হিভূত যৌন আকাঙ্খা তৃপ্ত করার কোনও সুযোগ ইসলামে নাই। যৌন আকাঙ্খা একমাত্র বিবাহের মাধ্যমে, সুস্থ ও পবিত্র দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে, পরিপূর্ণ করার বিধান ইসলাম অনুমোদন করে।

২৯৯১। ক্রীতদাস প্রথা বর্তমানে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ক্রীতদাস প্রথা সারা পৃথিবীতে প্রচলিত ছিলো। কিন্তু ইসলামে সে যুগেও ক্রীতদাসদের মুক্তির উপায় সহজ করে আয়াত নাজেল হয়। ক্রীতদাস বা দাসীদের মধ্যে কেহ যদি শর্তসাপেক্ষে মুক্তি প্রার্থনা করে এবং লিখিত অঙ্গীকার করে মুক্তির বিনিময়ে নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের , তবে আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে ঐ ক্রীতদাস ও দাসীকে ঐ অর্থ সৎ উপায়ে উপার্জনের অধিকার দান করা। ক্রীতদাস ও দাসীর ঐ আবেদন যদি যুক্তি-যুক্ত হয় এবং ক্রীতদাস বা দাসী যদি উক্ত কর্ম সম্পাদনের যোগ্য হয়, তবে তাদের আবেদন যেনো অস্বীকার করা না হয়। দাস মুক্তির সনদ শুধু এখানেই শেষ নয়; এমন কি মনিবকে অর্থ দ্বারা সাহায্য করতেও বলা হয়েছে দাস বা দাসীকে। সেই অন্ধকারময় যুগে ইসলামই প্রথম দাস মুক্তির সনদ নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়।

২৯৯২। যে যুগে ক্রীতদাস প্রথা সারা পৃথিবীতে চালু ছিলো, তখনও দাসীদের অধিকার রক্ষার সনদ নাজেল হয়। মনিবকে নিষেধ করা হয়েছে দাসী দ্বারা বেশ্যাবৃত্তি না চালানো। যদিও বর্তমান পৃথিবীতে দাস প্রথা অবলুপ্ত হয়েছে , কিন্তু সভ্য সমাজে বেশ্যাবৃত্তির নামে 'দাসপ্রথা' এখনও চালু আছে। মেয়েদের এই প্রথাতে নিয়োজিত করা ও বাধ্য করা আল্লাহ্‌ পূর্ণ নিষেধ করেছেন।

২৯৯৩। "সতীত্ব রক্ষা করিতে চাহিলে ....... " - অর্থাৎ যদি সে নিজস্ব সতীত্ব রক্ষা করতে চায়, তাহলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা চলবে না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন চাপে অনেক সময়ে অনেক মেয়েকে এ পথে নিয়ে আসা হয়। যার দরুণ বহু মুসলিম দেশেও পতিতালয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ইসলাম এ ব্যবস্থাকে অনুমোদন করে না। এ সব পতিতাদের সুস্থ সবল জীবনে ফিরিয়ে আনা মুসলমান মানেই কর্তব্য। কারণ এ ব্যবস্থা আল্লাহ্‌র চোখে অপছন্দীয়

২৯৯৪। হতভাগ্য নারীরা যারা ভাগ্যচক্রে স্বইচ্ছার বিরুদ্ধে এই পথ অবলম্বনে বাধ্য হয়েছে , যারা পুরুষের এই যৌন বিকৃতির শীকার , যারা এই ঘৃণ্য ও পাপিষ্ঠ বাণিজ্যের পণ্য, আল্লাহ্‌ তো পরম দয়াময় ও ক্ষমাশীল। সমাজের চোখে প্রমাণিত এ সব পাপিষ্ঠদের জন্য আছে আল্লাহ্‌র ক্ষমা ও দয়া। তাঁর নেয়ামত সকলের জন্য অবারিত।

৩৪। আমি ইতিমধ্যে সব কিছু সুস্পষ্ট করে তোমার নিকট আয়াতসমূহ প্রেরণ করেছি যা হচ্ছে তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে তাদের কাহিনী থেকে দৃষ্টান্ত এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের প্রতি উপদেশ ২৯৯৫।

২৯৯৫। এই আয়াতটি পরবর্তী আয়াতের ভূমিকা স্বরূপ যেখানে স্বর্গীয় আলোর উল্লেখ আছে যার অর্থ হচ্ছে মহিমান্বিত আল্লাহ্‌র রূপ।

রুকু - ৫

৩৫। আল্লাহ্‌ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি ২৯৯৬, ২৯৯৭। তাঁর জ্যোতির উপমা হলো এই যে, যেমন একটি দীপাধার [কুলুঙ্গী] যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ। বাতিটি কাঁচে ঘেরা, ২৯৯৮ কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ ২৯৯৯ ইহা প্রজ্জ্বলিত করা হয় পূত পবিত্র জলপাই বৃক্ষের তেল দ্বারা যা না পূর্বদেশীয় না পশ্চিম দেশীয় ৩০০০, ৩০০১। তাহার তেল এমনি উজ্জ্বল যে আগুন স্পর্শ করার পূর্বেই যেনো জ্বলে ওঠে ৩০০২। জ্যোতির উপরে জ্যোতি। আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা পথ নির্দ্দেশ করেন তাঁর জ্যোতির দিকে ৩০০৩। আল্লাহ্‌ মানুষের জন্য উপমাসমূহ স্থাপন করেন।এবং আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ে অবগত আছেন।

২৯৯৬। সংস্কৃতিবান ও সুরুচীসম্পন্ন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের নিদ্দের্শনা দানের পরে এই চমৎকার গৌরবময় আলোর উপমা বর্ণনা করা হয়েছে। এই আলোর উৎস হচ্ছে আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয় সত্যকে অনুভবের ক্ষমতা যা স্তরে স্তরে গঠিত। এই আয়াতটি আধ্যাত্মিক রহস্যে সমৃদ্ধ , যার প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে পুস্তকের পরে পুস্তক রচনা করা হয়েছে। এখানে [ মওলানা ইউসুফ আলী ] খুব সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন।

২৯৯৭। অন্ধকার ও আলো। অন্ধকারকে অপবিত্র , কুৎসিত, পাপের উৎসরূপে কল্পনা করা হয়। অপরপক্ষে আলো হচ্ছে সত্য, সুন্দর, পবিত্রতা, ন্যায় ও পূণ্যের প্রতীক। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক যে আলো, তার উৎস আল্লাহ্‌। আল্লাহ্‌র আলোর প্রতিফলনই হচ্ছে স্বাভাবিক আলো। আল্লাহ্‌ নিরাকার , অসীম শক্তির উৎস। তাঁর সম্বন্ধে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে অনুভব করা সম্ভব নয়। তাঁর অস্তিত্ব শুধুমাত্র অনুভব করা সম্ভব আত্মার অস্তিত্বের মাঝে, যেখানে আত্মাও নিরাকার। যদি আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধারণা করতে হয়, তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর মধ্যে আলো হচ্ছে সর্বাপেক্ষা পবিত্র ও সুন্দর বস্তু , যেখানে সামান্য হলেও তুলনা করা যায়। তবে স্বাভাবিক আলো, যার সাথে আমরা প্রতিদিনের জীবনে অভ্যস্ত , আল্লাহ্‌র নূরের সাথে তার তুলনায় কিছু অসুবিধা আছে। স্বাভাবিক আলোর অসুবিধাগুলি নিম্নরূপ : ১)জাগতিক আলোর নিজস্ব অস্তিত্ব নাই। সর্বদা তা কোনও উৎস থেকে উৎসারিত হবে। অর্থাৎ জাগতিক আলো উৎসের উপরে নির্ভরশীল। ২) জাগতিক আলো স্থির নয়, তা সর্বদা অতিবাহিত হচ্ছে। সকালে সূর্যের নরম সোনার আলো, দুপুরে তীব্র হয়ে অপরাহ্নে অস্তগামী সূর্যের সাথে শেষ হয়ে যায়। যদি আমরা বিজ্ঞানের ভাষায় আলোকে গতির বা শক্তির রূপ হিসেবে কল্পনা করি, তা হলে দেখা যায় আলো স্থির নয়। আলোর সাথে গতির নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ৩) জাগতিক আলো স্থান ও কালের সাথে সম্পর্কিত। এর গতি ১,৮৬,০০০ মাইল প্রতি সেকেন্ডে। সূদূর আকাশে এমন তারাও বিরাজমান যার আলো উপরের গতিতে বিচ্ছুরিত হয়েও আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছুতে হাজার বছর লেগে যায়। উপরে জাগতিক আলোর যে সব দোষত্রুটি বর্ণনা করা হলো , আল্লাহ্‌র নূর তার সকল কিছুর উর্দ্ধে। জাগতিক আলো আল্লাহ্‌র সত্তার জন্য প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ্‌ নভোমন্ডল ও এর মাঝে যা কিছু সব সৃষ্ট বস্তুর নূর দাতা।

২৯৯৮। আল্লাহ্‌র নূরের প্রকাশকে তিনটি উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে, এগুলি হচ্ছে দীপাধার, প্রদীপ এবং কাঁচ। ১) "Miskkat" বা দীপাধার। প্রাচ্যদেশে দেয়ালে সামান্য খাঁজকেটে প্রদীপ স্থাপনের বন্দোবস্ত করা হয়। এই খাঁজটি বা দীপাধারটি মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে স্থাপন করা হয়ে থাকে, যেখানে প্রদীপটিকে রাখা হয়। এই বন্দোবস্ত ইলেকট্রিসিটি আবিষ্কারের পূর্বে ছিলো। উচ্চে স্থাপন করার ফলে প্রদীপের আলো সমস্ত ঘরকে আলোকিত করতে সক্ষম হতো। দীপাধারের পিছনের ও পাশের দেয়াল যদি সাদা রং করা থাকে , তবে আলোকে আরও সহজ ও সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়। দীপাধারের সম্মুখভাগ খোলা যা হচ্ছে কোনও দেয়াল শূন্য। জাগতিক দীপাধারকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আধ্যাত্মিক আলোর দীপাধারকে বোঝানোর জন্য। আত্মাকে আলোকিত করার জন্য যে আলো সে আলোর উৎস জাগতিক বস্তুর বহু উর্দ্ধে অবস্থিত। দীপাধার যেরূপ উচ্চে স্থাপন না করলে সমগ্র ঘরকে আলোকিত করতে সক্ষম হয় না, ঠিক সেরূপ জাগতিক বিষয় থেকে নিজেকে উর্দ্ধে স্থাপন না করলে আল্লাহ্‌র নূরে হৃদয় আলোকিত হয় না। মোমেন বান্দার হৃদয় হচ্ছে এরূপ দীপাধার। পার্থিব ও জাগতিক বিষয়বস্তু থেকে নিজেকে উর্দ্ধে স্থাপন করতে পারলেই , মোমেন বান্দার অন্তর আল্লাহ্‌র নূরকে অন্তরের দীপাধারে ধারণ করার ক্ষমতা লাভ করে। আল্লাহ্‌র নূর হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ ও অন্যান্য নিদর্শন। মোমেন বান্দার অন্তরে আল্লাহ্‌র নূরের হেদায়েত আসে বিচিত্র উপায়ে। এই নূর সকলের জন্যই অবারিত কিন্তু যারা বিশ্বাস করে না এবং গ্রহণে অসম্মত তাদের জন্য এই নূর প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। দীপাধারটি মোমেন বান্দার হৃদয়ের প্রতীক স্বরূপ। দীপাধার যেরূপ প্রদীপকে ধারণ করে, মোমেন বান্দার হৃদয় সেরূপ আল্লাহ্‌র নূরকে ধারণে সক্ষম। ২)প্রদীপ যেরূপ আলোর উৎসের মূল কেন্দ্র বিন্দু, আল্লাহ্‌র নূর সেরূপ আধ্যাত্মিক বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। প্রদীপ ব্যতীত যেরূপ দীপাধার অর্থহীন। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্‌র নূর ব্যতীত আধ্যাত্মিক সত্য অস্তিত্ববিহীন। দীপাধার যেরূপ শুধুমাত্র প্রদীপ স্থাপনের জন্য নির্মিত ; ঠিক সেরূপ নূরে হেদায়েত মোমেন বান্দার অন্তরের সাথে সম্পর্কিত। ৩) কাঁচ একটি স্বচ্ছ পদার্থ যার মধ্য দিয়ে আলো খুব স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। দীপাধার যদি কাঁচের আবরণে ঢাকা থাকে, তবে মূল প্রদীপ পোকামাকড় ও বাতাসের ঝাপটা থেকে রক্ষা পায়। অপর পক্ষে কাঁচ স্বচ্ছ হওয়ার দরুণ আলোর বিকিরণে কোনও বাঁধার সৃষ্টি করে না। যদিও কাঁচ তৈরী হয় জাগতিক অস্বচ্ছ পদার্থ যথা বালি, সোডা, পটাশ ইত্যাদি থেকে , কিণ্তু কাঁচ নিজে আলোর প্রতিসরণের জন্য স্বচ্ছ - অর্থাৎ কোনও বাঁধার সৃষ্টি করে না। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্‌র নূর বা হেদায়েত বা নূরে-হেদায়েত যে নামেই আখ্যায়িত করি না কেন সেই সত্য যা মানুষের বা জাগতিক ভাষায় প্রকাশ করা হয় সাধারণ মানুষের বুদ্ধির সীমার মাঝে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য। দীপাধারের কাঁচের পর্দ্দা ভেদ করে দীপাধারের আলো যেরূপ বিচ্ছুরিত হয় ; ঠিক সেরূপ মানুষের জাগতিক ভাষাকে অতিক্রম করে আল্লাহ্‌র নূরে মোমেন বান্দার হৃদয়ে স্থান লাভ করে।

২৯৯৯। কাঁচ নিজে নিজে আলোকে প্রতিফলন বা প্রতিসরণ করতে পারে না। যখন আলোর উৎসকে কাছে আনা হয়, শুধু তখনই কাঁচ উজ্জ্বলভাবে আলো বিকিরণ করে, যেনো উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। ঠিক সেরূপ মোমেন বান্দা যারা আল্লাহ্‌র বাণীকে প্রচার করে, তাদের চরিত্রের মাধুর্য্য ও গুণাবলী উজ্জ্বল আলোর ন্যায় ভাস্বর হয়। আর এই আলোর উৎস আল্লাহ্‌র সত্যের প্রকাশ মাত্র এই সব মোমেন বান্দার চরিত্রে। মোমেন বান্দারা মাধ্যম হিসাবে কাজ করেন , যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সত্যের দীপ্তি ধরা পড়ে। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সত্যের আলো বিকিরীত হয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করে। এখানেও মোমেন বান্দার আত্মার কোনও নিজস্ব নূর বা আলো নাই। তারা শুধু আল্লাহ্‌র নূরকে ধারণে সক্ষম যার দ্যুতি তাদের মাধ্যমে সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয়।

৩০০০। 'জয়তুন' গাছ হচ্ছে জলপাই পাছের সমগোত্রীয়। এই গাছ খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। এর পাতা অনুজ্জল সবুজ রং এর ছোট ছোট আকর্ষণহীন। কিন্তু এর তেল প্রাচীন যুগ থেকেই পবিত্র বলে বিবেচিত। কোরাণ শরীফেও এর তেলকে বিশেষ মর্যদা দান করা হয়েছে। উপরন্তু জলপাই এর তেল একটি সুষম খাদ্য। ফলের বিশেষ সুগন্ধ আছে। আরও দেখুন [ ২৩ : ২০ ] আয়াতে টিকা ২৮৮০।

৩০০১। "যাহা প্রাচ্যের নয়, প্রাশ্চাতেরও নয়" - অর্থাৎ এই জলপাই এর গাছের অবস্থান কোনও নির্দ্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। আল্লাহ্‌র সত্য যেরূপ বিশ্ব ভূবনের সকল স্থানেই বিদ্যমান। ঠিক সেরূপ এই জলপাই গাছ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সকল স্থানেই বিদ্যমান। প্রাচ্যের জলপাই গাছ প্রাচ্যের সূর্যালোক পায় , পাশ্চাত্যের জলপাই গাছ পাশ্চাত্যের সূর্যরশ্মি লাভ করে। ঠিক সেই রকম আল্লাহ্‌র বাণীর মাহাত্ব্য দেশ ও কালের সীমানার উর্দ্ধে।

৩০০২। " তাহার তেল এমনি উজ্জ্বল যে আগুন স্পর্শ করার পূর্বেই যেনো জ্বলে ওঠে। " এই লাইনটি জলপাই এর তেলের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র শাশ্বত সত্যের রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। খাঁটি জলপাইয়ের তেলের বর্ণ সুন্দর , ঘনত্ব স্বচ্ছ ,এবং আলো দান করার ক্ষমতা অপূর্ব। যুগে যুগে আলোর জ্বালানী হিসেবে মানুষ বিভিন্ন জিনিষ ব্যবহার করেছে যেমন ভেজষতেল, প্রাণীর চর্বি ও খনিজ তেল যথা কেরোসিন ইত্যাদি। তবে সর্বোচ্চ স্থানে আছে বর্তমানে ইলেকট্রিসিটি। কিন্তু আলোর দ্যুতিতে ইলেকট্রিসিটি সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করলেও, ভেজষ তেল জ্বালানী হিসেবে যে আলো দান করে তা শান্ত, সমাহিত, কমনীয় এবং চোখের জন্য শান্তিদায়ক ও নিরাপদ। আবার ভেজষ তেলের মধ্যে অলিভ তেলের স্থান সর্বোচ্চ , ফলে যে কোন পবিত্র অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার প্রাচীন যুগ থেকেই। এর বিশুদ্ধতা প্রায় আলোর বিশুদ্ধতার ন্যায়। আগুনে জ্বলার পূর্বে একে আলো বলে ভ্রম হয়। আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা আল্লাহ্‌র সত্যকে উপস্থাপন করার জন্য এই উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ আগুনে জ্বলে জলপাই এর তেল যেমন সুন্দর , কমনীয় , শান্ত ও পবিত্র আলো বিতরণ করে; ঠিক সেরূপ আল্লাহ্‌র সত্য মানুষের হৃদয়কে , আত্মাকে অতীন্দ্রয় অনুভূতিতে আলোকিত করে, উজ্জীবীত করে, প্রকৃত সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করার পূর্বে। এই আলোকিত আত্মাতেই আল্লাহ্‌র নূর প্রোথিত হয়। যেমন আগুন স্পর্শ না করলেও মনে হয় জলপাইএর তেল উজ্জল আলো দিতেছে।

৩০০৩। মহিমান্বিত উজ্জ্বল আলো , যার ধারণা করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব বা যার বর্ণনা করা কোনও লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়; যার পরিমাপ করা কোনও হিসাবরক্ষকের ক্ষমতার বাইরে। আল্লাহ্‌র নূরের ধারণ ক্ষমতার শ্রেণীভেদ আছে, যা ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে অত্যুজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতার দিকে অগ্রসরমান। আত্মিক উন্নতির এই ধাপ সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। আলোর সর্বোচ্চ চূড়ার আদর্শ হচ্ছে আল্লাহ্‌র নূর যা প্রকৃত আলো ও সত্য। আর সব হচ্ছে এই আলোর প্রতিফলন মাত্র যা মানুষের আত্মার মাঝে বিভিন্ন ধাপে প্রকাশ পায় মাত্র।

৩৬। [ এরূপ আলো জ্বলে ] ৩০০৪, সেই সকল ঘরের মধ্যে যা আল্লাহ্‌র হুকুমে উচ্চ সম্মান পেয়েছে ৩০০৫, এবং যাতে আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ হয়ে থাকে - সকালে ও সন্ধ্যায়, [ পুণঃ পুণ : ] তাঁর মহিমা ঘোষণা করতে থাকে ৩০০৬;-

৩০০৪। সেই সকল গৃহ অর্থাৎ মসজিদ ও উপসনালয়।

৩০০৫। যেখানে আল্লাহ্‌র এবাদত করা হয় - অনেকে একে মনে করেন সকল মসজিদ ও স্থান যেখানে আল্লাহ্‌র এবাদত করা হয়, তবে অনেক ব্যাখ্যাকারীর মতে এই আয়াত দ্বারা শুধুমাত্র কাবা শরীফকে অথবা মদীনার মসজিদ অথবা জেরুজালেমের মসজিদকে বোঝানো হয়েছে। এই মসজিদসমূহকে বিশেষ সম্মানের সাথে বিবেচনা করা হয়।

৩০০৬। "Asil" আরবী শব্দটি বহুবচনে ব্যবহৃত। "সকাল-সন্ধ্যায়" বাক্যটি বাগ্‌ধারা বিশেষ যার দ্বারা বহুবচনের প্রকাশ ঘটেছে অর্থাৎ পুণঃ পুণঃ আল্লাহ্‌র নাম যেখানে স্মরণ করা হয়।

৩৭। সেই সব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা ক্রয়-বিক্রয়, আল্লাহ্‌র স্মরণ থেকে এবং নিয়মিত সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান থেকে বিরত রাখে না ৩০০৭। তাদের [ একমাত্র ] ভয় সেই দিনকে যখন অন্তর ও দৃষ্টি পরিবর্তিত হয়ে পড়বে [ সম্পূর্ণ এক নূতন পৃথিবীতে ] , - ৩০০৮

৩০০৭। " আল্লাহ্‌র স্মরণ " শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ হচ্ছে আল্লাহ্‌ প্রেম, যা আরও গভীর ও আরও সম্পৃক্ত। আল্লাহকে স্মরণ অর্থ নিঃশব্দে তাঁর ধ্যান করা, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির নিয়তে জনহিতকর কাজ করা, তাঁর সৃষ্টির সেবায় নিবেদিত হওয়া ইত্যাদি। প্রাত্যহিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও যাকাত একটি সুশৃঙ্খল সংঘবদ্ধ সামাজিক জীবনের চাবিকাঠি, যার মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর বুকে নিজেকে মুসলমানরূপে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারি। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ দুনিয়ার বুকে আমাদের মুসলিম উম্মা রূপে পরিচিত করে এবং আল্লাহ্‌র এবাদতের চাবিকাঠিরূপে পরিচিত করে। কিন্তু আল্লাহ্‌র স্মরণ বা জিকির হচ্ছে আল্লাহ্‌র এবাদতের আরও বৃহত্তর রূপ। সুতারাং সালাত ও যাকাত থেকে আলাদাভাবে তা উত্থাপন করা হয়েছে।

৩০০৮। মুমিনরা আল্লাহ্‌র জিকির , আনুগত্য ও এবাদতে মশগুল থাকা সত্বেও শেষ বিচারের দিনের সম্বন্ধে নিশ্চিত ও ভয়শূন্য হয়ে যায় না। তবে এক্ষেত্রে তারা যেহেতু মোমেন, সুতারাং তাদের 'তাকওয়া' বা ভয় হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থেকে উদ্ভুত। তারা আল্লাহ্‌র নিকট থেকে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারের আশা পোষণ করে পরকালের পৃথিবীতে, যে পৃথিবী হবে এক নূতন পৃথিবী। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২১ : ১০৪ ]।

৩৮। যেনো আল্লাহ্‌ তাদের সবচেয়ে উত্তম কাজ অনুযায়ী পুরষ্কার দিতে পারেন ৩০০৯ এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের প্রাপ্যের অধিক দান করবেন। বস্তুতঃ আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।

৩০০৯। পরিশেষে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তাদের কর্মের উৎকৃষ্ট প্রতিদান দেবেন। শুধু কর্মের প্রতিদানই শেষ কথা নয়, বরং আল্লাহ্‌ নিজ কৃপায় তাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ্‌র করুণার ভান্ডার অসীম। তিনি যাকে খুশী অপরিসীম জীবিকা দান করেন। আল্লাহ্‌র নেয়ামত সীমাহীন , পুরষ্কার দানে তিনি মুক্ত হস্ত।

৩৯। কিন্তু অবিশ্বাসীদের কর্ম হচ্ছে বালুকাময় মরুভূমির মধ্যে মরিচিকা সদৃশ্য ৩০১০। পিপাসায় কাতর ব্যক্তি যাকে পানি বলে ভুল করে, যতক্ষণ না সে উহার নিকট আসে এবং কিছুই খুঁজে পায় না ৩০১১। কিন্তু সে তার সাথে আল্লাহকে খুঁজে পায় ৩০১২ , এবং আল্লাহ্‌ তার প্রাপ্য পুরোপুরি দিয়ে দেবেন। বস্তুতঃ আল্লাহ্‌ হিসাব গ্রহণে তৎপর।

৩০১০। আল্লাহ্‌র নূর এবং যারা অন্তরে আল্লাহ্‌র নূরকে ধারণ করে পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে তাদের কথা বলা হয়েছে। এই আয়াতে রূপকের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে তাদের কথা, যারা আল্লাহ্‌র নূরকে অস্বীকার করে, ফলে তাদের অন্তর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। আল্লাহ্‌র নূর হচ্ছে প্রকৃত সত্য যা সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীত বাস্তবতা ; এবং যে সব আত্মা এই নূরকে আত্মার মাঝে ধারণ করে তারা সেই সত্যের আলোকে প্রতিফলিত করে, যার উল্লেখ পূর্ববর্তী আয়াতে করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্‌র নূরকে ধারণ করে থাকে, সেই সব মোমেন বান্দার জীবন ইহকাল ও পরকালে সুনিশ্চিত সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে - তাদের জীবন ধন্য। আল্লাহ্‌র পুরষ্কার প্রাপ্তিতে তাদের জীবনের সকল শঙ্কা, ভয় কেটে যাবে। অপর পক্ষে অন্ধকার কখনও বাস্তবতা হতে পারে না তা হচ্ছে আলোর বিপরীত। যারা আল্লাহ্‌র সত্যকে অস্বীকার করে , তাদের আত্মার যে অবস্থা তাই বর্ণনা করা হয়েছে এই আয়াতে। এই বর্ণনার জন্য দুটো উপমার ব্যবহার করা হয়েছে। একটি হচ্ছে মরীচিকা ও অন্যটি পরের আয়াতে বলা হয়েছে গভীর সমুদ্র তলের অন্ধকার।

৩০১১। মরীচিকা দেখা যায় মরুভূমির মাঝে। এ এক আশ্চর্য্য দৃশ্য। মুরুভূমির মাঝে যাত্রীরা যদি কখনও পথ হারিয়ে ফেলে, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে দিগবিদিগ্‌ জ্ঞান শূন্য হয়ে একবিন্দু পানির জন্য ছুটাছুটি করছে - মাথার উপরে গনগনে মধ্যাহ্ন সূর্যের তাপ সে সময়ে তাদের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে। তারা দেখতে পায় দূরে মরূদ্যান। ছায়া-সুশীতল , খেজুর বৃক্ষ শোভিত শীতল পানির নহর। তারা উন্মাদের ন্যায় সেদিকে ধাবিত হয় কিন্তু হায়! পৌঁছে দেখতে পায় সবই মিথ্যা। আবার অন্যপ্রান্তে ভেসে ওঠে মরীচিকার দৃশ্য। ছুটাছুটি করতে করতে হতভাগ্য যাত্রী শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে।

৩০১২। যারা আল্লাহ্‌ কে অস্বীকার করে , তাদের অবস্থাকে বোঝানোর জন্য মরীচিকার উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। যারা মরীচিকা দেখে বিভ্রান্ত হয়, তাদের শেষ পরিণতি মৃত্যু। ঠিক সেই ভাবে যারা আল্লাহ্‌র সত্যকে অস্বীকার করে তাদের আত্মা থাকে বিভ্রান্ত , অশান্ত ও সত্য বিমুখ। শান্তির আশায় তারা দিগবিদিগ জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটাছুটি করে। অর্থাৎ বিভিন্ন উপায়ে তারা আত্মার মাঝে প্রশান্তি লাভের চেষ্টা করে। অবশ্য তাদের এই চেষ্টা হয় মূলতঃ জাগতিক বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক। ফলে প্রকৃত সত্য তাদের থেকে বহুদূরে থেকে যায়। কিন্তু তারা বুঝতে অক্ষম আল্লাহ্‌র সত্য তাদের সাথেই বিরাজমান। মৃত্যুর মাধ্যমে দেহের বন্ধন মুক্ত হওয়ার পর আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব সে আত্মার মাঝে অনুভবে সক্ষম হবে। " সে তার সাথে আল্লাহ্‌কে খুঁজে পায়।"

৪০। অথবা [ অবিশ্বাসীদের অবস্থা হচ্ছে ] গভীর সমুদ্র তলের জমাট অন্ধকার সদৃশ্য যাকে আচ্ছন্ন করে ঢেউয়ের উপরে ঢেউ, যার উর্দ্ধে মেঘপুঞ্জ ৩০১৩। স্তরের উপরে স্তর জমাট অন্ধকার পুঞ্জ ৩০১৪। যদি কেহ নিজের হাতকে প্রসারিত করে সে তা আদৌ দেখতে পাবে না। যাকে আল্লাহ্‌ জ্যোতি দান করেন না , তার জন্য কোন আলো নাই ৩০১৫।

৩০১৩। অন্ধকারের কি ভয়ানক চিত্র এই আয়াতে আঁকা হয়েছে। এই অন্ধকার হচ্ছে আত্মার অন্ধকার। যে হৃদয় স্রষ্টাকে হৃদয়ের মাঝে অনুভব করতে পারে তাঁর আত্মা মুক্তি পায় অন্ধকার থেকে, আলোর জগতে তাঁর বিচরণ। আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের অনুভূতি তার আত্মাকে সত্যের আলোতে ভরিয়ে দেয়। ফলে এই পৃথিবীর জীবন তাঁর জন্য হয় শান্তিময় এবং পরলোকের জীবনের সে পায় নিরাপত্তার আশ্বাস। অপর পক্ষে আল্লাহকে অস্বীকারকারী ও আল্লাহ্‌র সত্যকে [ বিধান ] বিসর্জনকারীরা কখনও তাদের আত্মার মাঝে আল্লাহ্‌র অস্তিত্বকে অনুভবে সক্ষম হবে না। সুতারাং প্রকৃত সত্যের বা আল্লাহ্‌ নূরের আলো থেকে তারা হবে বঞ্চিত। এ সব আত্মা বিভ্রান্তির ধূম্রজালের অতল গহ্বরে নিপতিত হয়। এই অন্ধকারকে গভীর সাগরের তলদেশে , গভীর অন্ধকার তার উপরে ঢেউএর উপরে ঢেউ। সেই সাথে গভীর কালো মেঘপুঞ্জ সূর্যের আলো ঢেকে দিয়েছে। আত্মার সেই অন্ধকারকে ভাষায় প্রকাশের জন্য উপরের উপমাগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে।

দ্রষ্টব্য : গভীর সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার আমরা কল্পনা করতে পারি না। কারণ মানুষের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয় - পানির প্রচন্ড চাপের কারণে। কিন্তু অগভীর সমুদ্রের তলদেশেও আলোর প্রবেশ লাভ খুব একটা ঘটে না। কারণ এসব গভীরতায় যে সব মাছ পাওয়া যায়, দেখা যায় তাদের দৃষ্টি শক্তি নাই। কারণ সেই অন্ধকারে দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজন হয় না।

৩০১৪। "স্তরের উপর স্তর অন্ধকার পুঞ্জ " - এই লাইনটি তুলনা যোগ্য [ ২৪ : ৩৫ ] আয়াতের পংক্তিটি যেখানে বলা হয়েছে " জ্যোতির উপর জ্যোতি "। পাপীদের আত্মিক অবস্থা ও পূণ্যাত্মাদের আত্মিক অবস্থা উপরের পংক্তিদ্বয়ের দ্বারা রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।

৩০১৫। একমাত্র আল্লাহ্‌-ই হচ্ছেন জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সকল আলোর উৎস। মোমেন বান্দাদের হৃদয় বা আত্মা আল্লাহ্‌র নূরে আলোকিত হয়। তাদের আত্মায় আল্লাহ্‌র সত্য ভাস্বর হয়। এ সব আলোকিত আত্মিক গুণসম্পন্ন লোকের কর্ম দ্বারা পৃথিবীর অংগন আলোকিত হয়। তাদের কাজের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র আলোর প্রতিফলন ঘটে - যার উল্লেখ পূর্বের আয়াতে করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্‌র সত্যকে অস্বীকার করে, তার বিধানের বিরোধিতা করে তারা আল্লাহ্‌র নূর থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তাদের আত্মায় আলোকিত হওয়ার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এ সব আত্মাকেই বলা হয়েছে অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত আত্মা। আল্লাহ্‌র নূর বঞ্চিত আত্মা হবে সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই অন্ধকার হবে সম্পূর্ণ জ্যোতিহীন। অর্থাৎ আপেক্ষিক বা হাল্‌কা অন্ধকার হবে না।

রুকু - ৬

৪১। তুমি কি দেখ না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে ৩০১৬ যারা আছে তারা এবং [ বাতাসে ] ডানা মেলে দেয়া পাখীরা আল্লাহ্‌র গুণকীর্তণ করে ৩০১৭। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ প্রার্থনা এবং [আল্লাহকে ] প্রশংসা করার [পদ্ধতি ] জানে। এবং তারা যা করে আল্লাহ্‌ তা জানেন।
৩০১৬। দেখুন আয়াত [ ২১ : ১৯ - ২০ ]।

৩০১৭। বেহেশতের সকল অধিবাসী যেমন ফেরেশতারা, নভোমন্ডলের সকল বস্তু যেমন সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি , পৃথিবীর ভূভাগের সকল প্রাণী যেমন মানুষ, প্রাণী, কীট পতঙ্গ, মাছ ও জলচর প্রাণী এবং বাতাসের সকল প্রাণী যেমন পাখী ও সমগোত্রীয় প্রাণী সকলেই একমাত্র মানুষ ব্যতীত , দিবারাত্র আল্লাহ্‌র এবাদতে ব্যস্ত। " আল্লাহ্‌র গুণ কীর্তন করে" কথাটি প্রতীকধর্মী। আল্লাহ্‌ প্রতিটি বস্তুকে এক একটি বিশেষ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি বস্তু সর্বক্ষণ সেই কাজেই ব্যস্ত আছে এক চুলও বিরোধিতা না করে ? একমাত্র মানুষ ব্যতীত। এ ভাবেই তারা আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে ও তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র , জীব , জন্তু, কীট, পতঙ্গ প্রত্যেকেই ন্যস্ত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে। আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রত্যেকেরই নিজস্ব পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিই হচ্ছে তার এবাদত। যেমন, ক্ষুদ্র পাখীরা বাসা বাঁধে , সন্তান জন্মদান করে, নিজ আহার্য্য সন্তানকে খাইয়ে বড় করে। পক্ষীশাবক বড় হলে, বাচ্চার কথা ভুলে যায়। কারণ তার প্রতি আল্লাহ্‌র কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ্‌র সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। বিভিন্ন প্রাণীর জীবন গতি , গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ সব কিছুই নির্দ্দেশ করে স্রষ্টার শিল্প নৈপুন্য ও এসব প্রাণী ও পদার্থের জীবন গতি ও ধর্মই হচ্ছে তাদের প্রতি আল্লাহ্‌র আদেশ এবং তা মান্য করাই হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা এবং এবাদতের ভাষা। " প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ প্রার্থনা ও আল্লাহ কে প্রশংসা করার পদ্ধতি জানে।"

৪২। হ্যাঁ, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহ্‌র অধীনে। এবং [সকলেরই ] শেষ গন্তব্যস্থল হচ্ছে আল্লাহ্‌; ৩০১৮।

৩০১৮। নভোমন্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সকল কিছুর মালিক এক আল্লাহ্‌ তিনিই সকল কিছুর উপর ক্ষমতাশীল এবং তাঁর কাছেই সকল কিছু প্রত্যার্পন করবে।

৪৩। তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ্‌ মেঘ মালাকে মৃদুমন্দ ভাবে চালিত করেন, তারপর তাদের একসাথে সংযুক্ত করেন, তারপরে তাদের স্তুপাকার করেন ? তারপর তুমি দেখবে তার মধ্য থেকে বৃষ্টিধারা নির্গত হতে ৩০১৯। এবং তিনি আকাশ থেকে পর্বত প্রমাণ [মেঘকে ] প্রেরণ করেন যার মধ্যে থাকে শিলা। এর দ্বারা তিনি যাকে খুশী আঘাত করেন এবং যাকে ইচ্ছা তার উপর থেকে ইহা অন্য দিকে ফিরিয়ে নেন। মেঘের বিদ্যুৎ ঝলক দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়।

৩০১৯। প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে তাদের শিল্পীমন এই আয়াতের মেঘের বর্ণনায় মুগ্ধ হতে বাধ্য। প্রথমে নীল আকাশে ছেড়া হাল্‌কা মেঘের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। এই হাল্‌কা মেঘপুঞ্জ একত্রিত হয়ে মেঘ স্তুপে পরিণত হয় যা পরবর্তীতে বৃষ্টিরূপে ধরণীতে আপতিত হয়। আবার এই ঘন কালো পুঞ্জীভূত মেঘের থেকে শিলা নির্গত হয় শিলা বৃষ্টিরূপে। বৃষ্টি ও শিলা বৃষ্টির উৎপত্তি একই মেঘ, তবুও তাদের মধ্যে কতই না পার্থক্য বিরাজমান। শিলাবৃষ্টি উৎপন্নকারী মেঘকে "পর্বত" হিসাবে এখানে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বর্ণনার দিক থেকে তা যথার্থ কারণ এই মেঘ পর্বতের ন্যায় শিলাকে ধারণ করে। "এর দ্বারা তিনি যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন। " এই লাইনটিকে এ ভাবে ব্যাখা করা যায়। এই শিলাবৃষ্টি সব সময়েই কোন নির্দ্দিষ্ট অবস্থানে ঘটে থাকে, এবং অন্যান্য স্থান শিলাবৃষ্টি মুক্ত থাকে। মেঘের বিদ্যুৎ চমক ও বজ্রের ধ্বনি কানে তালা লাগে। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য ও এর কার্যকলাপ হচ্ছে বিশ্ব স্রষ্টার নিজস্ব লিপিতে লেখা বই - যে এই বই পাঠ করতে পারে সেই ধন্য, সেই তো এই আয়াতে মেঘের বর্ণনার মাঝে সৌন্দর্য্য খুঁজে পেতে সমর্থ, বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে আল্লাহ্‌র মঙ্গলময় হাতের স্পর্শ অনুভবে সক্ষম

৪৪। আল্লাহ্‌-ই রাত্রি ও দিনের পরিবর্তন করে থাকেন ৩০২০। যাদের অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে অবশ্যই এর মধ্যে তাদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয়।

৩০২০। আল্লাহ্‌র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ক্ষমতা শিল্প সত্তা ও মঙ্গলময় ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে তার সৃষ্টির মাঝে। বিশ্ব প্রকৃতির দৃশ্যমান বিষয়ে যথাঃ দিন ও রাত্রির পরিবর্তনে , ঋতুভেদে, সঞ্চারণশলী মেঘের আনাগোনায়, বৃষ্টি, বজ্রপাতে সর্বত্রই সেই বিশ্বস্রষ্টার হাতের স্পর্শ বিদ্যমান। এই বিশাল পৃথিবী , নভোমন্ডল, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও বৈচিত্র সবই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার হাতে লেখা 'বিশ্ব প্রকৃতি' নামে বইটি। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় স্রষ্টার মঙ্গলময় হাতের স্পর্শ বিদ্যমান। যে জ্ঞানী , যার এই পাঠ উদ্ধারের ক্ষমতা আছে সেই পারে একমাত্র এর পাঠোদ্ধার করতে। প্রকৃতির পাঠের মাধ্যমে আল্লাহ্‌কে অনুভব করতে হলে আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি [ Spiritual vision ] থাকতে হবে। যদি এই আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি থাকে শুধু তখনই প্রকৃতির জ্ঞানের দ্বারা আধ্যাত্মিক জগতকে সমৃদ্ধশালী করা যায়। অন্যথায় তারা নাস্তিক বিজ্ঞানী বা শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হয় যাদের আত্মা আলোর পরিবর্তে অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়।

৪৫। আল্লাহ্‌ সকল জীবকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে ৩০২১ তাদের মধ্যে কতক পেটে ভর দিয়ে চলে, কতক দুই পায়ে হাঁটে, এবং কতক চার পায়ে হাঁটে ৩০২২। আল্লাহ্‌ যা ইচ্ছা করেন তা সৃষ্টি করেন। অবশ্যই সকল বিষয়ের উপরে আল্লাহ্‌র ক্ষমতা বিদ্যমান ৩০২৩।

৩০২১। দেখুন আয়াত [ ২১ : ৩০ ] এবং টিকা ২৬৯১। প্রোটপ্লাজম হচ্ছে জীবকোষের মূল ভিত্তি। আর এই প্রোটপ্লাজমের অস্তিত্ব পানির উপরে নির্ভরশীল।

৩০২২। "কতক পেটে ভর দিয়ে চলে " - অর্থাৎ এরা পোকা শ্রেণীর জীব। এই শ্রেণীর প্রাণীরা প্রাণীজগতের নিম্নশ্রেণীতে অবস্থান করে যেমন : সাপ, কেঁচো, বিছা, কেন্নো প্রভৃতি , মাকড়সা, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি। এদের মধ্যে যাদের পা আছে তারা ক্ষুদ্র আকৃতি বিশিষ্ট হয় : যেমন : বিছা, কেন্নো ইত্যাদি। এদের বেলাতে পা থাকলেও হাটা কথাটি প্রযোজ্য হয় না। সামুদ্রিক প্রাণীদের সম্পর্কের 'হাটা' শব্দটি প্রযোজ্য নয়। তাদের বলা হয় "সাঁতার কাটে "। দুই পায়ের প্রাণী সম্বন্ধে "হাটা" শব্দটি প্রযোজ্য যথাঃ মানুষ,পাখী আবার চারিপায়ের চতুষ্পদ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সম্বন্ধে হাটা শব্দটি সমভবে প্রযোজ্য।

৩০২৩। আল্লাহর পরিকল্পনা ও ইচ্ছা তার সৃষ্টি বৈচিত্রের মাঝে বিদ্যমান। তিনি যাহা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। প্রাণী জগতের বিভিন্ন প্রাণীর বিভিন্ন জীবন গতি থেকে জীববিদ্যার উদ্ভব। এই সব সৃষ্টি কৌশল আল্লাহর প্রজ্ঞার স্বাক্ষর।

৪৬। আমি অবশ্যই সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ প্রেরণ করেছি। এবং আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

৪৭। তারা ৩০২৪ বলে, " আমরা আল্লাহ্‌ ও রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করলাম।" কিন্তু এর পরও ওদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরা [ প্রকৃতপক্ষে ] বিশ্বাসী নয়।

৩০২৪। এই আয়াতে মোনাফেকদের বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে। মোনাফেকরা জাগতিক স্বার্থের বাইরে আর কিছু দেখতে অক্ষম। তাই তাদের আল্লাহর প্রত্যাদেশ থেকে উপকৃত হওয়ার আশা থাকে না।

৪৮। যখন তাদের আল্লাহ্‌ ও রাসুলের দিকে আহ্বান করা হয় এই জন্য যে, রাসুল তাদের বিবাদের বিচার করে মীমাংসা করে দেবেন , তখন দেখ অকস্মাৎ একদল [ আসতে ] অস্বীকার করে।

৪৯। কিন্তু যদি ন্যায় [ বিচার ] তাদের পক্ষে থাকে ৩০২৫, তবে তারা আনুগত্য সহকারে রাসুলের নিকট ছুটে আসে।

৩০২৫। আলোচ্য আয়াতে বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজেল হয়েছে। বিশর নামে জনৈক মুসলিম ও ইহুদীর মধ্যে জমি সংক্রান্ত কলহ বিবাদ ছিল। বিশর প্রকৃত মুসলিম ছিলো না,ছিলো মোনাফেক। ইহুদী তাকে বিবাদের মীমাংসা করার জন্য রসুলুল্লাহ্‌ [ সা ] নিকট যাওয়ার প্রস্তাব করলো। কিন্তু মোনাফেক বিশর ছিলো অন্যায়ের উপর। সে জানতো যে, রসুলুল্লাহ্‌ [সা ] ন্যায় বিচার করবেন এবং সে হেরে যাবে। সুতারাং সে অস্বীকার করলো। মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তখনই তারা ন্যায় বিচার চাইবে , যখন তা মুনাফিকের স্বার্থ অনুযায়ী তার পক্ষে হবে।

উপদেশঃ এরূপ স্বার্থপরতা ও অন্যায় আচরণ যে শুধুমাত্র মদিনার মুসলমানরে মধ্যেই ছিলো তাই-ই নয়। মোনাফেকদের এই বৈশিষ্ট সর্বকালের সর্বযুগের যা এখনও বিদ্যমান।

৫০। তাদের অন্তরে কি ব্যাধি আছে ? অথবা তারা কি সন্দেহ পোষণ করে ? অথবা তারা কি ভয় পায় যে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুল তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করবেন ? বরং ওরাই নিজেদের প্রতি পাপ করে থাকে ৩০২৬।

৩০২৬। প্রকৃত সত্য হচ্ছে মোনফেকদের অন্তরে ব্যাধি, কিন্তু তাদের বিবেক তাদের আঘাত করে থাকে। তারা তাদের অন্তরে ভালো করেই জানে, যে অন্যায় তারা সংঘটিত করে। সেই কারণে যিনি কোন তদ্বিরের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে ন্যায় বিচার করবেন, তার কাছে মোনাফেকরা কখনও বিচার প্রার্থী হবে না।

রুকু - ৭

৫১। যখন বিশ্বাসীদের আল্লাহ্‌ ও রাসুলের দিকে ডাকা হয়, যেনো রাসুল তাদের মধ্যে বিচার করে মীমাংসা করে দিতে পারেন; তখন তারা শুধু এই উত্তর দেয় যে, " আমরা শুনলাম এবং আমরা মেনে নিলাম।" ৩০২৭ এরাই তারা যারা সুখ শান্তি অর্জন করবে ৩০২৮।

৩০২৭। দেখুন [ ২: ২৮৫ ] আয়াত। এখানে মোমেন বান্দাদের মানসিকতাকে, মোনাফেক ও অবিশ্বাসীদের মানসিকতার বিপরীতে তুলে ধরা হয়েছে। মোনাফেকদের মানসিকতা সব সময়েই হয় লোক দেখানো। তারা উচ্চস্বরে বলে " আমরা শুনলাম " - কিন্তু তাদের হৃদয় অবিশ্বাসে পূর্ণ থাকে। [ ২ : ৯ ৩ ]।

৩০২৮। ইহকাল এবং পরকালের প্রকৃত সুখ ও শান্তি, প্রতারণা ও কপটতার মাধ্যমে অর্জন করা যায় না। তারাই ইহকাল ও পরকালের সুখ শান্তি অর্জনে সফলকাম যারা সদুপদেশ শোনে এবং নিজের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটায়।

৫২। যারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয় করে এবং ন্যায় কাজ করে [ শেষ পর্যন্ত ] এরাই জয় লাভ করবে।

৫৩। তারা আল্লাহ্‌র নামে কঠিন শপথ করে বলে যে, তুমি ওদের আদেশ দিলে ওরা অবশ্যই [ তাদের বাড়ী-ঘর ছেড়ে ] বের হবে ৩০২৯। বল, " শপথ করো না, আনুগত্য হচ্ছে [ অধিক ] ন্যায় সংগত। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।"


৩০২৯। " তারা অবশ্যই বের হবে" এখানে এই লাইনটি দ্বারা " তারা জিহাদের জন্য বের হবে" বুঝাচ্ছে। এই আয়াতে মোনাফেকদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারা মুখে জিহাদে বের হবার কথা বলে, কিন্তু কাজে পরিণত করে না। মদিনার মোনাফেকরা প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য তাদের বাড়ী-ঘর সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিণ্তু তাদের এ শপথ ছিলো সবই বাহ্যিক। কারণ মোনাফেকদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তারা মুখে এক কথা বলে, তাদের অন্তর অন্য কথা গোপন রাখে। মোনফেকদের এই বৈশিষ্ট্য সর্বকালে , সর্বযুগে বিরাজমান। এই আয়াতে মোনাফেকদের বীরোচিত কাজে জীবন উৎসর্গের শপথ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে বীরত্বের প্রয়োজন নাই, প্রতিদিনের সাধারণ যে কর্তব্য ও দায়িত্ব তাই তারা নিষ্ঠার সাথে পালন করুক। বাগাড়ম্বর জীবনের ক্ষেত্রে মূল্যহীন। জীবনকে বিচার করা হবে কাজের দ্বারা - বড় বড় কথার দ্বারা নয়। আল্লাহ বান্দাকে বিচার করবেন কাজ ও কাজের নিয়ত দ্বারা। বাইরের ফাঁকা বুলির দ্বারা নয়।

৫৪। বল, " আল্লাহকে মান্য কর এবং রাসুলকে মান্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ঘুরিয়ে নাও, তবে [ রাসুল ] শুধুমাত্র তাঁর উপরে অর্পিত দায়িত্বের জন্য দায়ী থাকবে , এবং তোমাদের উপরে অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরাই দায়ী। যদি তোমরা তাঁর আনুগত্য কর তাহলে সঠিক [ পথের ] নির্দ্দেশ লাভ করবে। রাসুলের দায়িত্ব তো শুধু [আল্লাহ্‌র বাণী ] সুস্পষ্ট ভাবে প্রচার করা ৩০৩০।

৩০৩০। রসুল [ সা ] আল্লাহর আদেশকে সঠিকভাবে পৌঁছে দেন, আল্লাহর আদেশ মানা না মানা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দায় দায়িত্ব। এ ব্যাপারে কোনও বাধ্যবাধকতা নাই। রসুলের [ সা ] দায়িত্ব লোকদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়া ও আল্লাহর প্রত্যাদেশকে মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। চরিত্র সংশোধনের মূল দায়িত্ব প্রত্যেকের নিজস্ব দায়িত্ব। ইসলামে ব্যক্তিগত দায়িত্ব হচ্ছে মূল কথা ,কেউ কারও পাপের অংশীদার হবে না, বা কারও পূণ্য কেউ নিতে পারবে না। পৌরহিত্য ও ধর্মযাজকের প্রথা ইসলামে অবলুপ্ত।

৫৫। তোমাদের মধ্য সেই সকল লোকের সাথে আল্লাহ্‌ প্রতিশ্রুতি দিতেছেন, যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে, ৩০৩১ যে, নিশ্চয়ই তিনি তাদের দুনিয়াতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি তাদের পূর্ববর্তীদের দান করেছিলেন, এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের ধর্ম - যে ধর্ম তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন। এবং যে ভয় ভীতির মধ্যে [ তারা বাস করতো ] সে অবস্থার পরিবর্তন করে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন ৩০৩২। "তারা শুধু আমারই এবাদত করবে এবং আমার সাথে কখনও কিছু শরীক করবে না।" এর পরেও যদি কেহ ঈমানকে প্রত্যাখান করে, তবে তারাই হবে বিদ্রোহী ও দুষ্ট।

৩০৩১। এই আয়াতের মাধ্যমে , যারা এক আল্লাহ্‌তে বিশ্বাসী ও আল্লাহর বিধানকে মেনে চলে তাদের তিনটি ব্যাপারে আল্লাহ আশ্বাস দিয়েছেন। ১) তাদের পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করবেন। এই কর্তৃত্ব কোন ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে নয়, বা প্রিয়-তোষণের জন্য নয়। এই কর্তৃত্ব দান করা হবে পৃথিবীতে আল্লাহর বিধানকে [ ন্যায় ও সত্য ] প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। অর্থাৎ যে জাতি বিশ্বাসী ও ন্যায়বান তাদের আল্লাহ দুনিয়াতে কর্তৃত্ব দান করবেন, যেমন পূর্ববর্তীদের করেছেন। [ মুসলিম জাতিদের এরই প্রেক্ষিতে নিজেদের আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন কেন তাদের দুনিয়া জোড়া জিল্লাতি। ] ২) আল্লাহর মনোনীত ধর্ম অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যায়, অসত্য , নির্যাতন সর্ব পাপকে অবদমিত করা হবে। কারণ বিশ্বাস ও ন্যায়, সত্যের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। ইসলামী জীবন যাত্রা প্রণালীর এই হচ্ছে মূল কথা। ৩) পূণ্যাত্মারা জীবনের সকল অবস্থাতেই শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে থাকবে কারণ তাদের জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন স্বয়ং আল্লাহ। ধর্মের কারণে বা জেহাদের কারণে তারা যে কোনও নির্যাতনই ভোগ করুক না কেন তা তাদের মানসিক শান্তি ও নিরাপত্তা নষ্ট করবে না। তাদের অন্তরে কোনও শত্রুভীতি থাকবে না। ইসলামের প্রথম যুগে ইসলামের বিজয় এই সত্যতারই সাক্ষর বহন করে। আল্লাহর আয়াতের বৈশিষ্ট্য তা সর্ব কালের সর্বযুগের জন্য। এই বাণীর আশ্বাস সে যুগের জন্যও যেমন প্রযোজ্য ছিলো আজও তা সমভাবে প্রযোজ্য। আজকের পৃথিবীতে যে জাতির সমাজ ব্যবস্থা ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে সেখানেই আল্লাহর আশ্বাস কার্যকর হয়। যে সমাজে অন্যায় অত্যাচার বিরাজ করলে সে সমাজ আল্লাহর অভিশাপগ্রস্থ হয়। [ দুনিয়া জোড়া মুসলমানদের বিপর্যয় এরই প্রেক্ষিতে আত্ম বিশ্লেষণ করতে হবে। ]

৩০৩২। এই আয়াতটি নাজেল হয় হিজরী ৪ - ৫ সনে পরিখার যুদ্ধ বা খন্দকের যুদ্ধের সময়ে। সে সময়ে মদিনার মুসলিমরা তাদের সংখ্যার দশগুণ বেশী শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে অবরোধে কালাতিপাত করছিলেন। সে সময়ে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা ছিলো উদ্বেগ ও বিপদের আশঙ্কাতে পরিপূর্ণ [ ৩৩ : ৯ - ২০ ]। এই আয়াত তাদের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর আশ্বাস কার্যকর হয় এবং মুসলমানেরা তাদের নিরাপত্তা এবং কর্তৃত্ব প্রভুত পরিমাণে লাভ করে।

উপদেশ : আল্লাহ্‌র আশ্বাস সর্বকাল ও সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য।


৫৬। সুতারাং নিয়মিত নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত দাও ; এবং রাসুলকে অনুসরণ কর যেনো তোমরা অনুগ্রহ পেতে পার।

৫৭। তুমি কখনও মনে করো না যে, অবিশ্বাসীরা [আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ] ব্যর্থ করবে। তাদের বাসস্থান হবে আগুন, এবং এটা অবশ্যই এক মন্দ আশ্রয়স্থল।

রুকু - ৮

৫৮। হে মুমিনগণ ! ৩০৩৩ তোমাদের মালিকানধীন দাস দাসীগণ ৩০৩৪ এবং তোমাদের মধ্য যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় নাই ৩০৩৫ , তারা যেনো তোমাদের [ সম্মুখে উপস্থিত হতে ] তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে। ফজরের সালাতের পূর্বে, দুপুরের সময়ে যখন তোমরা গরমের জন্য কাপড় খুলে রাখ এবং এশার নামাজের পরে [ রাত্রে ] । এই তিন সময় তোমাদের কাপড় খুলে রাখার সময় ৩০৩৬। এই তিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে বিনা অনুমতিতে যাতায়াত করলে তোমাদের জন্য ও তাদের জন্য কোন দোষ নাই। এ ভাবেই আল্লাহ্‌ তাঁর নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্ট ভাবে তোমাদের নিকট বিবৃত করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ।

৩০৩৩। এখান থেকে শুরু হয়েছে পারিবারিক জীবনের শালীনতার উপদেশ যা প্রয়োজন হয় একটি সুরুচিশীল সংস্কৃতবান সমাজ গঠনের জন্য। সামাজিকতা ও পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতের রীতিনীতি ইতিপূর্বে এই সূরার ২৭, ২৮, ২৯ আয়াতে "অনুমতি চাওয়ার বিধানাবলী" শিরোনামে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, পুরুষ বা মহিলা যেই হোক অন্যের গৃহে প্রবেশের পূর্বে আগন্তুককে অনুমতি নিতে হবে। এই বিধান ছিলো বাইরে থেকে আগমনকারী অপরিচিতদের জন্য। এখনকার বিধান হচ্ছে গৃহের অধিবাসীদের জন্য। বিশেষতঃ দাস-দাসী ও ছোট শিশুদের গৃহের অভ্যন্তরে অবাধ যাতায়াত থাকে। এদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে তারা তিনটি সময়ে অনুমতি সাপেক্ষে ঘরে প্রবেশ করবে। প্রথমতঃ ফজরের নামাজের পূর্বে , কারণ অতি প্রত্যুষে মানুষ বিছানায় পরিপূর্ণভাবে পোষাকে সজ্জিত থাকে না, আবার অতি প্রত্যুষে মানুষের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটে। দ্বিতীয়তঃ মধ্যাহ্নের বিশ্রামের সময়ে , একই যুক্তি সেখানেও প্রযোজ্য এবং তৃতীয়তঃ এশার নামাজের পরে যখন মানুষ পোষাক খুলে রাতের বিশ্রামের জন্য তৈরী হয়। পূর্ণবয়স্কদের জন্য এই বিধান আরও কঠোর করা হয়েছে।

৩০৩৪। এখানে দাস-দাসী অর্থ ক্রীতদাস ও দাসীদের বোঝানো হয়েছে, যা সে যুগে বিদ্যমান ছিলো।

৩০৩৫। বয়ঃপ্রাপ্ত হয় নাই অর্থাৎ যৌবন প্রাপ্ত হয় নাই। তাদের জন্য অনুমতির প্রয়োজন , কারণ বিশেষতঃ উক্ত সময়গুলিতে মানুষ বিশ্রাম গ্রহণ করে এবং এ সময়ে স্বামী-স্ত্রী অসংযত হতে পারে বা বিশ্রামের সময়ে এমন অবস্থায় থাকতে পারে যা ছোট শিশুদের দেখা অনভিপ্রেত।

৩০৩৬। নারী ও পুরুষের শালীন জীবন যাপনের এটা একটা প্রকৃষ্ট পন্থা ও বিশেষ পদ্ধতি। শালীন ও সভ্য সমাজে পোষাক পরিচ্ছদ, আচার - আচরণ ও কর্থা-বার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। সেই কারণে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মুসলমান নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেই আচার - আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তায় হবে পরিশীলিত , মার্জিত ও সুরুচিসম্পন্ন হবে। শালীনতা ও ভদ্রতা ইসলামের অন্যমত প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুরুচি সম্পন্ন জীবনবোধ ও ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নারী-পুরুষ গঠন করতে পারে এক সুশীল সমাজ , যে সমাজে আধ্যাত্মিক বিকাশের পথ হয় সহজ। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা পারিবারিক রুচিশীলতা ,আত্মসম্মানবোধ, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এগুলির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি এই আয়াতগুলিতে বর্ণনা করা হয়েছে, তবে দেশ , কাল , জাতি , বর্ণ , পরিবেশের প্রেক্ষিতে কিছু পরিবর্তন পরিমার্জন ঘটতে পারে। তবে মূল বিষয় হলো খুব সাধারণ কতগুলি ভদ্রতা যা নিজস্ব সম্মানবোধ অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের উপরে প্রতিষ্ঠিত।

৫৯। আর তোমাদের শিশুরা যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হয় ৩০৩৭ তারাও যেনো, অনুমতি প্রার্থনা করে, যেমন ভাবে তাদের বয়োজ্যেষ্ঠগণ করে থাকে ৩০৩৮। এ ভাবেই আল্লাহ্‌ তার নির্দ্দেশ সমূহ সুস্পষ্টভাবে তোমাদের জন্য বিবৃত করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ ৩০৩৯।

৩০৩৭। " তোমাদের শিশুরা " এ বাক্যটির অর্থ শুধু মাত্র নিজস্ব সন্তান সন্ততি নয়। এ বাক্যটির অর্থ নিজ বাড়ীর বা জ্ঞাতিগোষ্ঠির বা পাড়া প্রতিবেশীর সন্তান সন্ততি।

৩০৩৮। "এখানে বয়ঃজ্যেষ্ঠ " বাক্যটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে তাদের যারা পূর্বে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে , যাদের কথা পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। মূল বক্তব্য হচ্ছে নূতন প্রজন্ম যখন বড় হয়ে উঠবে ,তারা বয়জ্যেষ্ঠদের রীতিনীতি অনুসরণ করবে। শিশুদের শিশুর মত ব্যবহার করতে হবে এবং শিশুরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তারা তাদের বয়স অনুযায়ী ব্যবহার করবে।

৩০৩৯। " এই ভাবে আল্লাহ্‌ .............. আল্লাহ্‌ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ।" ঠিক এই লাইনটি পূর্বের আয়াতেও বিদ্যমান। পার্থক্য শুধু পূর্বের আয়াতের " তোমাদের নিকট " শব্দটি এখানে পরিবর্তন করে " তোমাদের জন্য " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই আয়াতের শব্দটির জন্য এর অর্থ অধিক ব্যক্তিগত ভাবের প্রকাশ ঘটেছে।

৬০। বয়ষ্ক নারী ৩০৪০ , যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের কোন অপরাধ নাই , যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের [ বর্হিবাস ] পোষাক খুলে রাখে। তবে লজ্জ্বাশীল হওয়াই তাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ্‌-ই সব দেখেন সব জানেন ৩০৪১।

৩০৪০। বয়স্ক মহিলা যাদের রূপ যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে, বিবাহের বয়েস অতিক্রান্ত হয়েছে , অর্থাৎ পুরুষের কুদৃষ্টির প্রভাব মুক্ত ,তাদের জন্য পর্দ্দার প্রয়োজনীয়তা নাই। তারা বাইরে যাওয়ার সময়ে তাদের বর্হিবাস খুলে রাখতে পারে। বোরখা বা চাদরের ব্যাপারটি তরুণী ও যুবতীদের জন্য করা হয়েছে এই জন্য যে ,এতে তারা পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। ইসলামে পর্দ্দা প্রথার বিরুদ্ধে বহু প্রচার আছে। কিন্তু পক্ষপাতশূন্য ভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে বর্হিবিশ্বের কাজে অংশ গ্রহণে তরুণীদের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে তাদের রূপ ও যৌবন। পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে রূপ ও যৌবনকে ঢেকে রাখলে এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। পর্দ্দা প্রথার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে মেয়েদের নিরাপত্তা।

৩০৪১। "আল্লাহ্‌ সব দেখেন , সব জানেন " এই লাইনটি গানের ধূয়ার মত বারে বারে পুণরাবৃত্তি করা হয়েছে। আয়াত ৫৮ ও ৫৯ এর বিষয় বস্তু প্রায় একই রকম। সুতারাং তাদের শেষ লাইনটি একই ধূয়া দ্বারা শেষ করা হয়েছে। এই আয়াতটি [ ৬০ ] যদিও পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত তবুও সম্পূর্ণ এক নয়। সুতারাং শেষ লাইনটিতে সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

৬১। অন্ধের জন্য দোষ নাই, খোড়ার জন্য দোষ নাই, রুগীর জন্য দোষ নাই, ৩০৪২ তোমাদের নিজেদের জন্য দোষ নাই , আহার গ্রহণ করা তোমাদের গৃহে, অথবা তোমাদের বাবা-মা, ভাই-বোনদের ঘরে বা চাচা-ফুপুদের , মামাদের কিংবা খালাদের ঘরে অথবা সেই সব ঘরে যে সব ঘরের চাবি তোমাদের দখলে আছে অথবা তোমাদের বিশ্বস্ত বন্ধুর ঘরে। ইহাতেও কোন দোষ নাই যে, তোমরা একত্রে খাও কিংবা পৃথকভাবে একা আহার কর। কিণ্তু যখন তোমরা কোন গৃহে প্রবেশ করবে পরস্পরকে অভিবাদন করবে - সম্ভাষণ হবে আল্লাহ্‌র নিকট থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র ৩০৪৩। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর নির্দ্দেশ বিশদভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা বুঝতে পার ৩০৪৪।


৩০৪২। ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে আরব সমাজে বহুধরণের কুসংস্কারের প্রচলন ছিলো। তার মাঝে একটি ছিলো এই যে , তারা মনে করতো যারা শারীরিক ভাবে ত্রুটিযুক্ত অথবা রুগ্ন তারা দেবতার অভিশাপ গ্রস্থ। সুতারাং তাদের সংস্রব থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। এ কারণেই তাদের সাথে তারা একত্রে আহার করতো না। আবার "তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করিও না " [ ২ : ১৮৮ ]। এই আয়াতটি প্রাপ্তির পর সাহাবীগণ অন্যের এমনকি নিকট আত্নীয়ের গৃহেও খাদ্য গ্রহণ করা হতে বিরত থাকতে শুরু করেন। এ সবের প্রেক্ষিতেই এই আয়াতটি নাজেল করা হয়। ১) অন্ধ, খঞ্জ, বা রুগ্ন ব্যক্তিদের সম্বন্ধে আমাদের এ ধারণা করা অন্যায় যে তারা স্বর্গীয় অভিশাপ গ্রস্থ এবং সে কারণেই তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা। বরং তাদের প্রতি আমাদের সর্বাত্মক সহানুভূতি থাকা প্রয়োজন। ২) নিকট আত্নীয় স্বজনের গৃহে খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে এত অধিক সর্তকতা অবলম্বন না করলেও দোষ নাই। অনেকের ধারণা হয়েছিলো এক সাথে আহারে বসলে যৌথ খাদ্যদ্রব্য সকলের জন্য সমভাবে বন্টিত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। যৌথ খাদ্য দ্রব্য সকলের মাঝে সমভাবে বন্টিত হওয়া উচিত। এই আয়াতে এ ধরণের সুক্ষদর্শিতা ও লৌকিকতা থেকে তাদেরকে মুক্ত করা হয়। ৩) সায়ীদ ইবনে মুসাইয়ের বলেন, মুসলমানগণ জেহাদে যাওয়ার সময়ে নিজ নিজ গৃহের চাবি বিকলাঙ্গদের হাতে সোর্পদ করে যেতেন, এবং বলে যেতেন যে গৃহে যা কিছু আছে তা তোমরা পানাহার করতে পার। কিণ্তু তারা সাবধানতাবশতঃ তাদের গৃহ থেকে কিছুই খেত না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতের বক্তব্য। ৪) "তোমাদিগের বন্ধুদিগের গৃহে" এই বাক্যটি দ্বারা চেনা জানা বন্ধুস্থানীয় সকলকেই অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। শুধুমাত্র অকৃত্রিম ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুই নয়। ৫) কেউ যেনো নিজস্ব ধারণার বশবর্তী হয়ে সর্বদা পৃথকভাবে আহার গ্রহণ না করে অথবা সর্বদা একত্রে আহার গ্রহণ না করে। মানুষের প্রয়োজন ও পরিবেশ অনুযায়ী মানুষ তার নিজস্ব জীবনকে পরিচালিত করতে পারবে। এই আয়াতের বক্তব্যে এ কথাই অনুধাবন যোগ্য যে, কোনও অন্ধ আনুষ্ঠানিকতাকে আল্লাহ্‌ অনুমোদন করেন না। যা জীবনকে সুন্দর , সুস্থ ও মার্জিত করে, যা জীবনকে বিকশিত করে, যে জীবন ব্যবস্থা প্রতিটি মানুষের জীবনকে , সে অন্ধই হোক বা পঙ্গুই হোক, সম্মানের সাথে বাঁচার অঙ্গীকার করে তাই -ই ইসলাম অনুমোদন করে।

৩০৪৩। "Salam" শব্দটি আয়াত [ ১৯ : ৬২ ] এ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ টিকা ২৫১২তে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে সামাজিক জীবনে পরস্পরের প্রতি আতিথেয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে। এবারে নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে এই সর্ম্পকে প্রাণবন্ত ও উৎসাহিত করার যে চেতনা ও তার উপায় সম্বন্ধে। বন্ধু ও আত্নীয় পরিজনদের আতিথেয়তার যে আনন্দ তা শুধুমাত্র আত্মতৃপ্তি বা জাগতিক বিষয়ের মাঝে আবদ্ধ না রেখে তা বৃহত্তর পরিসরে পরিব্যপ্ত করা হয়। আল্লাহ্‌র চোখে তা পবিত্র হোক কল্যাণময় হোক এই কামনা করে গৃহে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে।

৩০৪৪। দেখুন টিকা ৩০৩৯ এবং ৩০৪১। গানের ধূয়াতে যেরূপ একটি বিশেষ পংক্তি বারে বারে গাওয়া হয়, এখানেও ঠিক সেরূপ কোরাণের আয়াতের সমাপ্তি করা হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে।

 

রুকু - ৯

 

৬২। তারাই কেবলমাত্র বিশ্বাসী যারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলে বিশ্বাস স্থাপন করে। যখন কোন সমষ্টিগত কাজের প্রয়োজনে তারা রাসুলের সাথে থাকে ৩০৪৫, অনুমতি না নিয়ে তারা কখনও স্থান ত্যাগ করবে না। যারা তোমার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে এরাই তারা যারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলে বিশ্বাস করে। সুতারাং যখন তারা নিজেদের কোন কাজের জন্য ছুটি চায় , তখন তাদের যাকে ইচ্ছা কর তুমি অনুমতি দান করো ৩০৪৬, এবং তাদের জন্য আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো ৩০৪৭। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল , পরম করুণাময়।

৩০৪৫। "সমষ্টিগত ব্যাপার" বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয় জনসমষ্টি যথা : সভা, সমিতি বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেখানে সমাজের সকল শ্রেণীর লোকেরা একত্রিত হয়। জুম্মা ও ঈদের জামাত এরূপ ধর্মীয় সমষ্টিগত সামাজিক জমায়েত। ইউসুফ আলী সাহেবের মতে এই বাক্যটি দ্বারা সমষ্টিগত ধর্মীয় সম্মেলন ব্যতীত এর দিগন্তকে প্রসারিত করা হয়েছে সেরূপ সভা বা সমিতি যেখানে সম্প্রদায়ের সকল সদস্য সদস্যাদের মতামতকে নেয়া হয় এবং অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয় যেমন জেহাদ বা শান্তির জন্য কোন সংঘের কাজ ইত্যাদি।

৩০৪৬। যে কোনও সভা বা সমিতি সম্মেলন ত্যাগ করার পূর্বে সভাপতির অনুমতির প্রয়োজন হবে। সেখানে সভাপতির ক্ষমতা প্রয়োগের অনুমতি দান করা হয়েছে নিরপেক্ষভাবে। "যাকে ইচ্ছা " বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে সেই ইচ্ছা যার পিছনে নির্দ্দিষ্ট ন্যায় নীতি কাজ করবে - স্বেচ্ছাচারিতা নয়।

৩০৪৭। কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা থেকে কেউ যদি স্থানত্যাগ করে বা করতে বাধ্য হয়, তবে সে যেনো আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয়। যদিও তাকে স্থান ত্যাগের অনুমতি দান করা হয়ে থাকে, তবুও জরুরী কর্তব্য কর্ম সর্বদা আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে নিবেদিত হবে। সামাজিক, ধর্মীয় সকল কর্তব্যই আমাদের আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত থাকতে হবে। সুতারাং সেই কর্তব্য যখন সঠিক ভাবে সম্পাদিত করা যায় না, তখন পরম ক্ষমাশীল আল্লাহ্‌র দরবারে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে। এই লাইনটির বক্তব্য জীবনের সর্ব সময়ের জন্য প্রযোজ্য।

৬৩। রাসুলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি আহ্বানের মত গণ্য করো না ৩০৪৮। তোমাদের মধ্যে যারা অজুহাতের আড়ালে সরে পড়ে আল্লাহ্‌ তো তাদের জানেন। সুতারাং যারা রাসুলের আদেশের বিরুদ্ধে চলে, তারা সাবধান হোক যে, কোন বিপদ-বিপর্যয় তাদের উপরে আপতিত হবে ৩০৪৯, অথবা তাদের উপরে কোন দুঃখজনক শাস্তি পৌঁছুবে।

৩০৪৮। এই আয়াতের তফসীর সম্বন্ধে মতভেদ আছে। তিন প্রকারে এই আয়াতের তফসীর করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে আয়াতের বর্ণনা , অর্থাৎ রসুলুল্লাহ্‌ [ সা ] যখন আহ্বান করেন তখন একে সাধারণ মানুষের আহ্বানের মত মনে করো না যে, সাড়া দেয়া না দেয়া ইচ্ছাধীন। বরং সাড়া দেয়া ফরজ হয়ে যায় এবং অনুমতি ব্যতীত চলে যাওয়া হারাম। দ্বিতীয় মতবাদ হচ্ছে : মনে করো না যে আল্লাহ্‌র নবীর [ সা ] প্রার্থনা বা আল্লাহ্‌র দরবারে আবেদন এবং সাধারণ লোকদের আবেদন এক কাতারে ফেলা যাবে। নবীর [ সা ] প্রার্থনা স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ্‌র দরবারে অধিক গ্রহণযোগ্য। তৃতীয় মত হচ্ছে : নবীকে [ সা ] তোমরা সাধারণ লোককে যেভাবে ডাক সে ভাবে ডেকো না। তাকে সর্বদা যথাযথ সম্মানের সাথে সম্বোধন করবে।

৩০৪৯। 'বিপর্যয় ' শব্দটি দ্বারা জাগতিক বিপদ ও দুঃখ দুর্দ্দশার কথা বলা হয়েছে এবং 'দুঃখজনক শাস্তি' বাক্যটি দ্বারা পরলোকের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

৬৪। নিশ্চিত হও যে , আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহ্‌রই। তিনি নিশ্চয়ই জানেন তোমরা যে অবস্থায় যাতে ব্যাপৃত থাক ৩০৫০। একদিন তাদেরকে তাঁর নিকট ফিরিয়ে আনা হবে , এবং তিনি তাদের জানিয়ে দেবেন তারা যা কিছু করতো তার সত্যকে ৩০৫১। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল কিছুই জানেন।

৩০৫০। "তোমরা যাতে ব্যাপৃত "। প্রতিটি কর্মের সাথে জড়িত থাকে ব্যক্তির মানসিক ইচ্ছা বা নিয়ত , ক্ষমতা , শক্তি , পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদি। আল্লাহ্‌ সব কিছু সম্বন্ধেই সম্যক অবগত।

৩০৫১। সমস্ত কাজের নিয়ত হবে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে নিবেদিত - কারণ তিনিই বান্দার সকল ক্ষমতা,শক্তি , অবস্থা ও রিযিকের মালিক। যদি কাজের উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত না হয়, তবে সে কাজ আল্লাহ্‌র চোখে অর্থহীন। যেমন অনেকেই সৎ কাজ করে থাকে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য, বা সম্মান , প্রতিপত্তি লাভের জন্য, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হওয়ার জন্য। এ সব কাজের পিছনে কাজ করে ব্যক্তির আত্ম অহংকার ও স্বার্থপরতা। সমাজের চোখে বা মানুষের চোখে হয়তো বা সে খুব গণ্যমান্য বা সম্মানীয় ব্যক্তিরূপে বিবেচিত হয়, কিন্তু আল্লাহ্‌র কাছে এসব কাজের কোনও মূল্য নাই। আবার অনেকে নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে সহজ সরল জিনিষের ভুল ব্যাখ্যা দান করে সাধারণ মানুষকে বিপথে চালিত করে। আবার অনেকে অন্যকে প্রতারণার মাধ্যমে নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধার করে ও নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। তাদের এসব ক্রিয়াকর্ম সাধারণ মানুষের অজ্ঞাত থাকলেও আল্লাহ্‌ তার হিসাব ঠিকই রাখেন এবং পরলোকে শেষ বিচারের দিনে এসব ব্যক্তিরা তাদের কৃতকর্মকে সঠিক ভাবে প্রত্যক্ষ করবে। আল্লাহ্‌ সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।