সূরা ফুরকান
সূরা ফুরকান বা মানদণ্ড - ২৫
৭৭ আয়াত, ৬ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : জ্ঞানী ও মূর্খ , পূণ্যাত্মা ও পাপী , আত্মিক সমৃদ্ধি ও আত্মিক অধঃপতনের মধ্যে বৈষম্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তুলনা করার জন্য আলো ও অন্ধকারের উপমাকে এই সূরাতে ব্যবহার করা হয়েছে। মোমেন বান্দার পরিচয় তার কর্মের মাধ্যমে। এই কর্মের সঞ্চার মাধ্যমে এই সূরাকে শেষ করা হয়েছে।
এই সূরাটি প্রধানতঃ একটি মক্কী সূরা। কিন্তু এর অবতরণ কাল সম্বন্ধে কোনও নির্দ্দিষ্ট সময় বা তারিখ জানা যায় না।
সারসংক্ষেপ : মানুষের প্রতি আল্লাহ্র সর্বোচ্চ দান বা নেয়ামত হচ্ছে তিনি মানুষকে ন্যায়, অন্যায় , পাপ ও পূন্যের মানদন্ড দান করেছেন। আল্লাহ্ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আমাদের পরকালের অনন্ত জীবনের তাৎপর্য সম্বন্ধে শিক্ষা দান করেন [ ২৫ : ১ - ২০ ]।
যারা পৃথিবীতে এই মানদন্ড মেনে চলে না , শেষ বিচারের দিনে তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ হবে। আল্লাহ্ সর্বদা, মানুষকে সাবধান করে দিয়েছেন। [ ২৫ : ২১ - ৪৪ ]।
সূর্যকিরণ ও ছায়া , রাত্রি ও দিন , মৃত্যু ও জীবন এবং আল্লাহ্র সৃষ্টির শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের অনুধাবনের মাঝে, মানুষের জন্য নিহিত আছে আল্লাহ্র মহত্বকে অনুধাবনের ও শিক্ষার ব্যবস্থা। মোমেন বান্দার গুণাবলীই তাকে আল্লাহ্র তত্ববধানের উপযুক্ত করে। [ ২৫ : ৪৫ - ৭৭ ]।
সূরা ফুরকান বা মানদণ্ড - ২৫
৭৭ আয়াত, ৬ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৩০৫৩। ''ফুরকান" অর্থাৎ যার মাধ্যমে আমরা পাপ পূণ্যের পার্থক্য করতে পারি। এই আয়াতে ফুরকান দ্বারা কোরাণকে বোঝানো হয়েছে যা পূর্বেই আলোর প্রতীক দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রতীককে এখানে আরও দীর্ঘায়িত করা হয়েছে এবং বৈষম্যগুলিকে তুলনা করা হয়েছে। এই তুলনার মাধ্যমেই আমরা পাপ ও পূণ্যের মধ্যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। ফুরকান আমাদের সেই আলোর পথে পরিচালিত করে।
৩০৫৪। 'Yakuna' সর্বনামটি দ্বারা ফুরকান কে বোঝানো হয়েছে অথবা Abd বা রসুলকে বোঝানো হয়েছে। উভয়ক্ষেত্রে অর্থের কোনও তারতম্য ঘটে না। কোরাণ হচ্ছে পাপ ও পূণ্যের মধ্যে পার্থক্যের প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ড।
৩০৫৫। মহান আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। তিনি সকল অভাবমুক্ত , তিনি কারও সাহায্যপ্রার্থী নন। তাঁর দয়া ও করুণার প্রকাশ সমস্ত সৃষ্টির মাঝে বিদ্যমান।
৩০৫৬। পাপ ও পূণ্যের মানদন্ডের প্রথম এবং প্রধান পাপকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র একত্বের পরিবর্তে অন্য কিছুকে তাঁর সমকক্ষ কল্পনা করাই হচ্ছে পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা জঘন্য পাপ।
৩০৫৭। 'Ifk'এবং আয়াতের শেষে 'zur' শব্দ দুটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে 'মিথ্যা' শব্দ। 'Ifk' শব্দটি তখনই প্রযোজ্য হয় যখন কোনও ঘটনার অস্তিত্বই থাকে না। এখানে রসুলের [ সা ] শত্রুরা তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে যে, আল্লাহ্র নবীর দাবী হচ্ছে বানোয়াট যা তাঁর অনুগত লোকেরা [ ভিন্ন সম্প্রদায় ] তা প্রচারে সাহায্য করে থাকে মাত্র। তাদের রটনার মূল ভাবার্থ ছিলো এই যে; ১) আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সমূহ হচ্ছে মিথ্যা রচনা এবং প্রতারণা। ২) প্রত্যাদেশে যা বলা হয়েছে যেমন শেষ বিচারের দিন, পুনরুত্থান, পরলোক, পূণ্যাত্মার শান্তিলাভ এবং পাপীর শাস্তি ও যন্ত্রণা এসবই হচ্ছে অলীক কল্পনা যার কোনও প্রকৃত ভিত্তি নাই। এ তো স্পষ্ট বিভ্রান্তি। এর উত্তরে বলা হয়েছে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সত্য এবং রসুলের প্রতি আরোপিত অভিযোগ সবৈব মিথ্যা ['Zur'] তাদের এই মিথ্যাতে উপণীত হওয়ার কারণ তাদের চরিত্রের অন্যায় প্রবণতা মধ্যে নিহিত। অবিশ্বাসীদের আত্মিক ও মানসিক অবস্থা তাদের অন্যায় প্রবণতা বা 'জুলুম' থেকে জন্মলাভ করে। এই মানসিক অবস্থায় তারা প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে অক্ষম হয় এবং বিভ্রান্ত মানসিক অবস্থায় মিথ্যায় ['Zur'] উপণীত হয়।
৩০৫৮। অবিশ্বাসীরা উদ্ধত অহংকারে বলে আমরা এ সব কথা পূর্বেও শুনেছি। এগুলি সবই প্রাচীন যুগের উপকথা। এগুলি আনন্দ লাভের জন্য শোনা যায় কিন্তু ঈমান লাভের জন্য এগুলোর কোন গুরুত্ব নাই। সুতারাং কে এগুলি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে ? যখন কোরাণের আয়াতের সৌন্দর্য্য ও আধ্যাত্মিক জগতের বিকাশের উপরে এর অপরিসীম প্রভাবের প্রতি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ কর হয়, এবং বলা হয় যে এরূপ একটি অপূর্ব গ্রন্থের আবির্ভাব ঘটেছে একজন 'উম্মী' বা নিরক্ষর নবীর মাধ্যমে , এটা কি স্রষ্টার এক অলৌকিক ঘটনার নিদর্শন নয় ? তখন তারা বলে যে "সে [ হযরত মুহম্মদ [সা ] ] লিখিয়ে নিয়েছে।" অর্থাৎ অন্য লোকে তা রসুলকে [ সা ] লিখে দিয়েছে। যদিও বহু চেষ্টা সত্বেও তারা অনুরূপ একটি আয়াত লিখতে অক্ষম।
৩০৫৯। কোনও মানুষই অনুরূপ আয়াত লিখতে অক্ষম কারণ কোরাণ অবতরণ হয়েছে মহাশক্তিশালী পরাক্রমশালী আল্লাহ্র নিকট থেকে। কোরাণ মানুষকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষা দান করে যে জ্ঞানের দীপ্তি সাধারণ মানুষের চোখে ভাস্বর নয়। এই জ্ঞান সাধারণ মানুষের হৃদয়ে আসে শুধুমাত্র আল্লাহ্র হেদায়েতের মাধ্যমে। এই জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত, যিনি তাঁর সৃষ্টির সকল রহস্য অবগত। মানুষ পাপ ও দোষত্রুটি সত্বেও তিনি বারে বারে ক্ষমা করেন এবং তাঁর নেয়ামতে ধন্য করেন। প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তাদের সুপথের সন্ধান দান করেন।
৩০৬০। অবিশ্বাসী হৃদয় প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে সব সময়েই ব্যর্থ হবে। এই ব্যর্থতা সর্বকালের সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। হযরত মুহাম্মদ [ সা ] এর বেলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। কাফেররা রসুলের [সা ] মাঝে নবী সুলভ কোন গুণের সন্ধান পায় নাই। সাধারণ মানুষ সর্বদা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের সাথে নবী রসুল এবং আল্লাহ্র বান্দাদের সম্পৃক্ত করতে ভালোবাসে। হযরত মুহম্মদ [ সা ] কোন অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদার ছিলেন না সত্য , তবে যিনি বাল্য বয়সে অন্ধকারচ্ছন্ন আরব সমাজে ' আল-আমীন' উপাধিতে ভূষিত তিনিই তো মনুষ্যদেহধারী মহামানব এই সাধারণ সত্যকে কাফেররা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। তারা আল্লাহ্র রসুলকে [ সা ] দৈনন্দিন জীবন যাপন করাকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে। তারা ঠাট্টা করে বলে " তিনি যদি আল্লাহ্র নবী হবেন তবে কেন তার সাথে ফেরেশতারা নাই।" এর উত্তর হচ্ছে মানুষের মানসিক অবস্থা অনুধাবনের ক্ষমতা ফেরেশতাদের নাই। কারণ মানুষ হচ্ছে রীপুর দাস। কাম-ক্রোধ,লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ প্রভৃতি রীপু সমূহের আক্রমনে মানুষ সর্বদা পর্যুদস্ত থাকে। ফেরেশতারা এ সব থেকে মুক্ত। সুতারাং তাদের পক্ষে মানুষের মানসিক অবস্থা বা এ সব থেকে মুক্তির পথ অনুধাবন করা বা উপদেশ দেয়া অসম্ভব। ফেরেশতাদের কার্যালয় আলাদা, যিনি বিশ্ব মানবের শিক্ষক হবেন তাকে অবশ্যই মানুষের দুঃখ-ব্যাথা , হাসি-কান্না , ভালোবাসা-ঘৃণা,লোভ-লালসা , ইত্যাদি সকল মানসিক অভিব্যক্তি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হবে। তবেই না তিনি মানুষের সকল দোষত্রুটি দূর করার উদ্দেশ্যে নিজেকে এসব থেকে মুক্ত করে এ সবের উর্দ্ধে থেকে নির্দ্দিষ্ট মহৎ কর্তব্য সম্পাদনে সক্ষম হবেন। যিনি সাধারণ মানুষ হয়েও মানুষের উর্দ্ধলোকে ফেরেশতাদের সমতূল্য চরিত্রের অধিকারী হতে পারেন তিনিই তো আল্লাহ্র প্রেরিত দেবদূত চরিত্রের অধিকারী। সত্যের এই প্রকৃত রহস্য অবিশ্বাসী হৃদয়ে ধরা পড়ে না। দেখুন [ ২১ : ৭ -৮ ]।
৩০৬১। " .................. উপভোগের জন্য "। পূর্বোক্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াত। এখানে "বাগান" শব্দটি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ জীবনকে উপভোগ করতে যে সব আরাম আয়েশের প্রয়োজন 'বাগান' দ্বারা তাই বোঝানো হয়েছে। বাগানের ফলকে আহার করে তৃপ্তি লাভ করা যায়, ফোয়ারা ও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী মনের সৌন্দর্য বোধকে পরিতৃপ্ত করে, এর মাঝে বিশ্রাম দেহ মন জুড়িয়ে যায় ও সতেজ হয়। অর্থাৎ সুন্দর বাগান শারীরিক ও মানসিক সকল প্রয়োজনই মিটিয়ে থাকে।
৩০৬২। দেখুন আয়াত [১৭ : ৪৭ ]। এই বাক্যগুলি পাপিষ্ঠ সীমালংঘনকারী যারা কাফেরদের থেকেও ঘৃণ্য। এরা রসুলকে [সা] উম্মাদ রূপে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলো।
উপদেশ : কালের পটভূমিতে আঁকা রসুলের [সা ] উজ্জ্বল চরিত্র যুগে যুগে সত্যের দিশারীদের এভাবেই সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায় যে, সীমালংঘনকারীরা সর্বদা সত্যকে প্রতিহত করবেই , এবং তাদের এই প্রতিরোধ অনেক সময়েই জঘন্যতম রূপে প্রকাশ পায়।
৩০৬৩। " কখনও কোন পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হবে না।" - এ এক ভীষণ সাবধান বাণী , আল্লাহ্র তরফ থেকে। আয়াতটি অবতীর্ণ হয় রসুলের [ সা ] জীবনীর পরিপ্রেক্ষিতে। রসুলুল্লাহ্র [সা ] নামে মিথ্যা অভিযোগ, সত্যের অপ্রতিহত যাত্রাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে নাই। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবেই। পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকে। কিন্তু যে সব ব্যক্তি সত্যকে ত্যাগ করে থাকে, তা তাদের বিকৃত চিন্তাধারার ফসল। সত্যকে ত্যাগ করার ফলে, তাদের চরিত্র থেকে ন্যায়,সত্য ও বিশ্বস্ততাই যে শুধু হারিয়ে যায় তাই নয় , তাদের বিকৃত মানসিকতার জন্য তাদের জন্য স্বর্গীয় শাস্তিও অবধারিত হয়ে যায়। তাদের জন্য সত্য পথের নিশানা বা ঠিকানা অবরুদ্ধ হয়ে যায়, আল্লাহ্র এই সাবধান বাণী সে যুগের জন্যও যেমন প্রযোজ্য ছিলো আজও সমভাবে প্রযোজ্য আছে। যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ন্যায় ও সত্যের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে, তাদের সত্যকে বোঝার ক্ষমতা , ন্যায়কে সনাক্ত করার ক্ষমতা অন্তর্হিত হবে। এই -ই হচ্ছে আল্লাহ্র তরফ থেকে শাস্তি।
৩০৬৪। "মঙ্গলময় তিনি " - এই বাক্যটি সূরার প্রথমে [ ২৫ : ১ ] আয়াতেও বলা হয়েছে। সেখানে থেকে শুরু হয়েছে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ , তাঁর প্রেরিত রসুলের কাহিনী। এরপরে এখান থেকে আবার শুরু হচ্ছে নূতন যুক্তি যা পূর্বের সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব বহন করে। এর পরে আছে সত্য প্রত্যাখানকারীদের ভাগ্যের আলোচনা।
৩০৬৫। বেহেশতের বর্ণনা প্রতীক ধর্মী। বাস্তব যখন কল্পনাকে অতিক্রম করে যায় তখন তা প্রকাশের ভাষা হয়ে থাকে প্রতীক। বেহেশতের সুখ ও শান্তি এই পৃথিবীতে বসে কল্পনাও করা যায় না। এখানে 'বাগানসমূহ' শব্দটি বেহেশতের শান্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কাফেররা ঠাট্টা করতো যে আল্লাহ্র নবীর [সা ] জন্য পার্থিব আরাম আয়েশের বন্দোবস্ত আল্লাহ্ কেন করেন না ? আল্লাহ্ এই আয়াতে বলছেন যে যদি পার্থিব আরাম আয়েশ আল্লাহ্র পরিকল্পনার অর্ন্তভুক্ত থাকতো তবে, আল্লাহ্ তার রসুলদের পৃথিবীতেই সুখ-শান্তি , ক্ষমতা , অর্থ-বিত্ত অর্থাৎ পার্থিব সকল জিনিষই দান করতেন। [ যেমন করেছিলেন দাউদ নবী , সুলায়মান নবীকে ] পৃথিবীতে যারা আল্লাহ্র বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করতে আসেন পরিবর্তে তাদের প্রতি নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার, নির্যাতন ,ঠাট্টা , বিদ্রূপ , স্বদেশ থেকে বিতারণ ইত্যাদি। সত্যকে বা আল্লাহ্র বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহ্র রসুলদের যুগে যুগে এ সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। যদি তাদের জাগতিক আরাম আয়েশ ও ক্ষমতা প্রতিপত্তি থাকতো, তবে শত অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে , কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে তারা পৃথিবীর সামনে যে জ্বলন্ত উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন , তা থেকে পৃথিবী বঞ্চিত হতো। তাদের পৃথিবীতে প্রেরণ করাই হয়েছে সংগ্রামী মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ।
৩০৬৬। কেয়ামত বা শেষ বিচারের দিনকে অস্বীকার করার অর্থ এ কথাকে অবিশ্বাস করা যে, শেষ পর্যন্ত ন্যায় ও সত্য জয়লাভ করবেই। পৃথিবীতে যদিও বা দুষ্কৃতিকারী রেহাই পেয়ে যায়। কিন্তু পরকালে তাদের জন্য থাকবে কঠোর শাস্তি। শেষ পর্যন্ত ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা হবেই। শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবেই এই বিশ্বাস যার অন্তরে নাই , সে অসত্য ও অন্যায়ের কাছে, পাপের কাছে খুব সহজেই আত্মসমর্পন করে। এদের মানসিক চিন্তা ভাবনা অসুস্থ। এদের শাস্তি সম্বন্ধে পরবর্তী আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
৩০৬৭। 'Zafir' অর্থ গভীর নিঃশ্বাস , বা দীর্ঘশ্বাস : দেখুন [ ১১ : ১০৬ ] আয়াতের টিকা ১৬০৭। এখানে শব্দটি আগুনের লেলিহান শিখার প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছে। সুতারাং শব্দটি দ্বারা আগুনের প্রচন্ড শব্দকে বোঝানো হয়েছে। যা মনে হয় দাহ্য শক্তির প্রচন্ড ক্ষুধায় আগুন প্রচন্ড গর্জন ও চীৎকার করছে। পাপীরা তাদের পৃথিবীর বিশ্বাস ও ধারণাকে পরলোকে বহন করে নেবে। তারা পূর্বের বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরে থাকবে যতক্ষণ না তারা আগুনের প্রচন্ড গর্জন ও লেলিহান শিখা দেখতে পাবে। প্রকৃত শাস্তির পরিমাণ বুঝতে পেরে এবারে তাদের আত্মা ভয়ে কাঁপতে থাকবে। তাদের শৃঙ্খলিত করে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।
৩০৬৮। যন্ত্রনাতে অস্থির হয়ে পাপীদের মনে হবে মৃত্যুও এর থেকে শ্রেষ্ঠ। মৃত্যু অর্থ এখানে সম্পূর্ণ ধ্বংস। কারণ তখনকার অবস্থা হচ্ছে মৃত্যুর পরের অবস্থা। তারা তাদের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ ধ্বংস কামনা করবে। কিন্তু তা কখনও মঞ্জুর করা হবে না। একেবারে ধবংস তাদের কখনও করা হবে না কারণ তবে তো তাদের যন্ত্রনা অনন্তকাল স্থায়ী হবার নয়। তারা বারে বারে তাদের ধ্বংস কামনা করবে যেনো তারা সেই প্রচন্ড যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
১৫। বল, " এটাই কি উত্তম , না স্থায়ী বেহেশ্ত , যার প্রতিশ্রুতি পূণ্যাত্মাদের দেয়া হয়েছে তা ? ৩০৬৯ তাদের জন্য এটা হচ্ছে পুরষ্কার এবং [ সকল চাওয়া পাওয়ার ] শেষ গন্তব্য স্থল ৩০৭০।
৩০৬৯। এখানে বক্তব্যের ধারাকে পরিবর্তন করা হয়েছে। পরকালের দোযখের আগুন ও বেহেশতের শান্তির বর্ণনার পরে মর্তের মানুষদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে , " পাপের ও পূণ্যের ফলাফল এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, এখন বল তোমরা কোনটা পছন্দ করবে ? "
৩০৭০। এই আয়াতটি গভীর তত্বজ্ঞান পূর্ণ। পাপ ও পূণ্যের বিচার এবং শাস্তি ও পুরষ্কার। শুধু সাদামাটা এই বক্তব্যের দ্বারা আয়াতটির পূর্ণ অর্থ বোধগম্য নয়। পুরষ্কার শব্দটি দ্বারা সঠিক ভাবকে প্রকাশ করা যায় না কারণ ১) পূণ্যাত্মারা বেহেশতে যে শান্তি লাভ করবেন তা তাদের কৃত কর্মের পুরষ্কারের বহুগুণ হবে এবং ২) পূণ্যাত্মা নিজেই নিজের পুরষ্কার। পূণ্যাত্মাদের প্রকাশ এ ভাবে করা যায় যে, তাদের সকল ইচ্ছা এমন কি সর্বোচ্চ ইচ্ছাকেও সম্মান করা হবে। পার্থিব জীবনে তাদের একান্ত এবং সর্বোচ্চ কাম্য ছিলো আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করা, পরলোকে স্রষ্টা তাদের সেই ইচ্ছা পূরণ করবেন। আল্লাহ্র সান্নিধ্যে পূণ্যাত্মারা হবে ধন্য। মানব জীবনের সর্বোচ্চ পাওয়ায় তারা হবেন পরিতৃপ্ত তাদের আত্মার মোক্ষলাভ ঘটবে।
৩০৭১। পূণ্যাত্মাদের জন্য পরলোকে যে বেহেশতের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বান্দা যা চাইবে আল্লাহ্ তাঁকে তাই-ই দেবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর এই পাওয়া ক্ষণস্থায়ী হবে না। তা হবে স্থায়ী। "আর এটা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে অবশ্য পালনীয় প্রতিশ্রুতি।"
৩০৭২। আদালতের প্রশ্নোত্তর পর্বের ন্যায় এখানেও আল্লাহ্র বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে শেরেককারীদের।
৩০৭৩। আল্লাহ্র সাথে অংশীদার করে মোশরেকরা যাদের উপাস্য রূপে এবাদত করতো সেই উপাস্যদের শেষ বিচারের দিনে জিজ্ঞাসা করা হবে যার উল্লেখ করা হয়েছে পূর্বের আয়াতে। এই আয়াতে মিথ্যা উপাস্যরা যে উত্তর দান করবে তার বর্ণনা আছে। আল্লাহ্র সৃষ্ট পদার্থ , যাদের উপাস্যরূপে পূঁজা করা হতো তারা প্রমাণ করবে যে, তারা এই পূঁজা দাবী করে নাই। অপরপক্ষে তারাই বরং আল্লাহ্র এবাদত করেছে আল্লাহ্ মনোনীত পন্থায়। কারণ আল্লাহ্-ই একমাত্র রক্ষাকর্তা ও অভিভাবক। দেখুন আয়াত [ ৪৬ : ৫-৬ ] সেই দিন মিথ্যা উপাস্যেরা শুধু যে অভিভাবকত্ব অস্বীকার করবে তাই নয়, তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে মোশরেকদের অকৃতজ্ঞতাকে। আল্লাহ্ তাদের প্রাচুর্য দেওয়া সত্বেও তারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। এরা সত্যিই "মূল্যহীন " এবং ধ্বংসের যোগ্য। "Bur" শব্দটির দ্বারা এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে।
৩০৭৪। "তারা" অর্থাৎ উপাস্যগুলি। সমস্ত দৃশ্যপটটি হবে আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের আদালতে সওয়াল জবাবের মত। যদি মোশরেকরা বলতো যে তারা মিথ্যা উপাস্যদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে মিথ্যা উপাস্যরা তাদের বিরুদ্ধে আণীত অভিযোগকে এ ভাবেই খন্ডন করবে যে ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ভাবেই মোশরেকদের আবেদন নিবেদন, অজুহাতকে মিথ্যা প্রমাণিত করে ধূলিস্যাৎ করা হবে। মোশরেকরা তাদের উপাস্যের নিকট থেকে কোনও সাহায্যই পাবে না এবং তাদের শাস্তি থেকেও অব্যহতি লাভ করবে না। মিথ্যা উপাস্যের উপসনাকে এখানে পাপের প্রতীক হিসেবে বলা যায়। শুধু মাত্র মূর্তি পূঁজা মানেই মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা নয়। আল্লাহ্র হুকুমকে অমান্য করে আত্মা যখন পাপে আকণ্ঠ নিমগ্ন হয় তখন পাপীর সর্ব সত্ত্বা ঘিরে রাখে পাপের করাল গ্রাস , শয়নে , স্বপনে, জাগরণে সে সেই পাপ চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে। সেখানে আল্লাহ্র স্মরণ স্থান পায় না। এও এক ধরণের মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা বৈকি। মিথ্যা উপাসনা হচ্ছে পাপ; যার উৎপত্তি আল্লাহ্র হুকুম বা বিধানকে অস্বীকারে মাধ্যমে শুরু হয়। তখন এসব পাপীরা আল্লাহ্র মহত্ব ও গুণাবলীর প্রতি মিথ্যা বিশেষণ প্রয়োগে ইতঃস্ততত করে না। তারা আল্লাহ্র করুণা , দয়া ও ক্ষমাকে অস্বীকার করে। পাপিষ্ঠ লোকেরা এ ভাবেই পাপকে ত্যাগ করতে অস্বীকার করে, আল্লাহ্র হুকুম মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। তারা আল্লাহ্র সেবা বা আল্লাহ্র জন্য কাজ ব্যতীত অন্য কাজে নিয়োজিত হতে ভালোবাসে।
৩০৭৫। দেখুন উপরের আয়াত [ ২৫ : ৭ ]।
৩০৭৬। এই বিশাল বিশ্ব ভূবনের সকল কিছুই সৃষ্টি করা হয়েছে এক মহা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। কোনও কিছুই বৃথা সৃষ্টি করা হয় নাই। সমাজে ধনী, গরীব, প্রতিভাবান, সাধারণ, বুদ্ধিমান-বোকা, স্বাস্থ্যবান-রুগ্ন, উচ্চ ও নীচ শ্রেণী , ইত্যাদি বিভিন্ন বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। এই বৈষম্য অনেককে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা এর কারণ খুঁজে পায় না। এই বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়, মানুষে-মানুষে, শ্রেণীতে, জাতিতে ও পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশেও। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ এই বৈষম্যের ব্যাখা দান করেছেন। পৃথিবীতে মানব সন্তানের আগমন উদ্দেশ্যমূলক। পৃথিবীর জীবনযাপন প্রণালীর মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি লাভ করাই হচ্ছে এই পৃথিবীতে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য। পরকালের বাণিজ্যে [ ২১ : ১৬ ] যে লাভ করতে পারবে সেই তো বিজয়ী। ধনীকে দেখে দরিদ্র হিংসা করবে না, কারণ ধনীর উপরে আছে সম্পদের দায়িত্ব। সম্পদ শুধু নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য খরচ করা পরকালের বাণিজ্যে লোকসান দেয়া। তাকে আল্লাহ্ যে সম্পদ দান করেছেন তা আল্লাহ্র রাস্তায় সুষ্ঠু ব্যবহারের নিমিত্তে। এখানেই তাঁর দায় দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে তাঁর জন্য পরলোকে আছে কঠোর শাস্তি। আবার গরীবের জন্য সম্পদের দায়িত্ব না থাকলেও আছে অন্যান্য দায়িত্ব। দুঃখে বিপর্যয়ে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে সবর ধারণ করা, তার কর্তব্য। অন্যকে হিংসা করার প্রয়োজন নাই। কারণ আল্লাহ্র আদেশ পালনের মাধ্যমে যে ইহজীবনকে অতিবাহিত করতে পারে সেই তো প্রকৃত মোমেন বান্দা। এ ভাবেই মেধা, মননশক্তি , সম্পদ , ক্ষমতা, প্রতিভা যে নেয়ামতেই বান্দা ধন্য হোক না কেন তা জনহিতকর কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে প্রতিটি বান্দার অবশ্য কর্তব্য। আবার কোনও কিছু না পেলে হিংসায় বিপর্যয় ঘটানোও উচিত নয়। মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে আমরা একে অপরের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। এ কারণেই রসুলুল্লাহ্র [ সা ] শিক্ষা এই যে, যখন তোমার দৃষ্টি এমন ব্যক্তির উপরে পতিত হয় যে, ধন-সম্পদ কিংবা স্বাস্থ্য , শক্তি অথবা প্রতিপত্তিতে তোমা অপেক্ষা বেশী তখন তুমি কাল বিলম্ব না করে এমন লোকদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর , যারা এ সব বিষয়ে নিম্নস্তরের - যাতে হিংসার গুণাহ্ থেকে বেঁচে যাও। এই হাদীসকেই কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত এ ভাবে প্রকাশ করেছেন,
" একদা ছিলো না যুতা চরণ যুগলে
দহিল হৃদয় মন সেই ক্ষোভানলে -
......................................
......................................
দেখি সেথা একজন পদ নাই তার
অমনি যুতার ক্ষোভ ঘুচিল আমার। "
প্রকৃত সত্য হচ্ছে মানুষের সমাজ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর লোকবলের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ্র দুনিয়ায় গরীব বা নিম্ন বলে কিছু নাই। সমাজ গড়ার জন্য সকলের প্রয়োজন আছে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কর্মক্ষেত্রকে স্ব-স্ব আধ্যাত্মিক উন্নতির ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করবে।
রুকু - ৩
৩০৭৭। কাফেরদের প্রকৃতিকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বা পরলোকে বিশ্বাসী নয়। তারা ধর্মকে ঠাট্টার বিষয়বস্তু মনে করে থাকে , ফলে তারা অদ্ভুদ সব কথাবার্তা বলে থাকে যা হটকারীতা বই আর কিছু নয়। তাদের এই হঠকারী কথাবার্তার উৎপত্তিত হচ্ছে তাদের ঔদ্ধত্য ও অহংকার এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা। তাদের ঔদ্ধত্য এতটাই সীমালংঘন করে যে তারা বলতে সাহস পায় যে, " আমরা আমাদের প্রতিপালককে প্রত্যক্ষ করি না কেন ? "
৩০৭৮। দেখুন আয়াত [ ২ : ৫৫ ] ; যেখানে ইসরাঈলীরা অন্ধ অহংকারে হযরত মুসার নিকট আল্লাহ্র সাক্ষাতকার দাবী করেছিলো। পরিণতিতে তাদের উপরে বজ্রপাত ঘটে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে। তবে আল্লাহ্র করুণায় তারা আবার জীবন ফিরে পায়।
৩০৭৯। যে ফেরেশতাদের দেখার জন্য কাফেররা দুনিয়াতে বায়না ধরতো মৃত্যুর পরে সেই ফেরেশতাদের দর্শন তাদের জন্য খুব একটা সুখের অনুভূতি বহন করবে না। অবিশ্বাসীদের জন্য পরকালের জীবনে ইহকালের জীবনের ন্যায় কোনও সুখ ও শান্তির আশ্বাস থাকবে না। পৃথিবীর জীবনের অতীত কুকর্ম তাদের পরলোকের জীবনের শান্তির পথে দুলর্ঘ্য বাঁধার প্রাচীর সৃষ্টি করবে।
৩০৮০। কাফেরদের কাজ আল্লাহ্র দরবারে মূল্যহীন। তাদের সকল কাজ হবে যেনো বাতাসে নিক্ষিপ্ত ধূলিকণার মত নিষ্ফল ও মূল্যহীন।
৩০৮১। পাপীদের পাপ কার্য পরকালে পাপীদের বেহেশ্ত লাভের পথে দুর্লঘ্য প্রাচীরের সৃষ্টি করবে। অপরপক্ষে , পূণ্যাত্মাদের জন্য এরূপ কোন বাঁধার প্রাচীর থাকবে না। তাঁদের জন্য থাকবে উৎকৃষ্ট বাসস্থান এবং মনোরম বিশ্রাম আলয়।
৩০৮২। কেয়ামতের দিনকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এই হচ্ছে সেই দিন যেদিন আমাদের চেনা জানা পৃথিবী আমাদের চোখের সামনে থেকে মুছে যাবে - নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে [ ২১: ১০৪ ]। নূতন পৃথিবীর বর্ণনায় মানুষের পৃথিবীর অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বর্ণনা করা হয়েছে। দূরের আকাশ দীর্ণ-বিদির্ণ হয়ে যাবে। জ্যোর্তিময় ফেরেশতাদের নামিয়ে দেয়া হবে মেঘের চাদরে। সকল আধ্যাত্মিক আলো দৃষ্টিগোচর হবে। আল্লাহ্র কর্তৃত্ব সকল বিশ্বচরাচর ব্যপী বিরাজ করবে।
৩০৮৩। দেখুন উপরে আয়াত।
৩০৮৪। এই আয়াতটি মক্কার অন্যতম মোশরেক সর্দ্দার ওকবা ইবনে আবী মুয়ীতের ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এর বিধান ব্যাপক এবং সার্বজনীন। একজন লোক যদি সত্য ধর্ম গ্রহণের পরে জাগতিক বন্ধুর চক্রান্তে সত্য পথ ত্যাগ করে তবে তা অধিক নিন্দনীয়। ওকবা ইসলাম গ্রহণ করেন কিন্তু পরবর্তীতে তার বন্ধুর পরামর্শে সে স্বধর্ম ত্যাগ করে এবং আল্লাহ্ বিদ্রোহীতে পরিণত হয় । ফলে তার শেষ পরিণতি হয় অত্যন্ত ভয়াবহ।
২৯। " আমার নিকট [আল্লাহ্র ] উপদেশ পৌঁছানোর পরে সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছে। হায় ! শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক ৩০৮৫। "
৩০৮৫। শয়তানের প্রতারণার ফাঁদ মনোমুগ্ধকর। আর এই মনোমুগ্ধকর ফাঁদে মানুষ খুব সহজেই ধরা পড়ে। এ ফাঁদ হচ্ছে প্রতারণা ও বিশ্বাস ঘাতকতায় ভরা। অনেকেই লোভের বশবর্তী হয়ে ক্ষণস্থায়ী লাভকে বিশাল পাওয়া মনে করে। কিন্তু শেষ পরিণতিতে হতভাগ্যের জন্য থাকে হতাশা ও বিপর্যয়। শয়তানের প্রতারণা কখনও স্থায়ী ফল আনতে সক্ষম নয়। শয়তানের প্রতারণার অর্থ আমাদের জীবনে আমরা অনেক সময়েই পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের পরিবর্তে প্রতারণার মাধ্যম সহজেই কর্ম সম্পাদন করে সাফল্য অর্জন করতে চাই। কিন্তু প্রতারণার মাধ্যমে যে সাফল্য তা কখনও স্থায়ী হতে পারে না। তার শেষ পরিণতি এই পৃথিবীতেই ভয়াবহ, পরকালের শাস্তি তো রইলই। যেমন উদাহরণ : কোন ছাত্র যদি তার পরীক্ষার ফলাফলকে ভালো করার জন্য পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের পরিবর্তে নকল ও পরীক্ষকদের প্রভাবিত করার মত প্রতারণার সাহায্য গ্রহণ করে, তবে সে হয়তো অস্থায়ীভাবে সাফল্য লাভ করতে পারে , কিন্তু শেষ পরিণতিতে তার ব্যর্থতা অপরিহার্য।
মন্তব্য : নির্দ্দিষ্ট ঘটনার মাধ্যমে যুগকাল অতিক্রান্ত এই উপদেশ সকল মানুষকে দেয়া হয়েছে।
৩০৮৬। " আমার সম্প্রদায় " অর্থাৎ অবিশ্বাসী কোরেশ সম্প্রদায়। কোরেশদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসী তারা কোরাণকে অশ্রদ্ধার সাথে ব্যবহার করতো, যেনো তা পরিতাজ্য। তবে কোরেশ সম্প্রদায়ের মধ্যে এদের সংখ্যা খুব বেশী না হলেও এরা ছিলেন সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তি যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছিলো ইসলামের বিধানাবলীর দ্বারা। তবে সময়ের ব্যবধানে ইসলামের এই সব শত্রুরা ধরাধাম ত্যাগ করে এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম সমগ্র আরবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। কোরাণ হচ্ছে মানব সমাজের নিকট সেই গ্রন্থ যার মধ্যে নিহিত আছে মানুষের জীবন বিধানের নির্দেশনার অমূল্য রত্নরাজি - যার ভাষার প্রকাশ গভীর এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ।
৩০৮৭। রসুলের [সা ] জীবনের মাধ্যমে সর্বকালের মানব সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহ্ এই উপদেশ দিয়েছেন যে, পাপীরা সর্বদা সত্য ও পূণ্যের বিরোধিতা করবেই। কিন্তু তাদের এই বিরোধিতা যেনো পূণ্যাত্মাদের মনে কোনও সংশয় উৎপন্ন না করে যেহেতু, পূণ্যাত্মাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা পাপীদের নাই। কারণ পূণ্যাত্মাদের রক্ষাকর্তা স্বয়ং আল্লাহ্। যারা আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করে, আল্লাহ্ তাদের পথ প্রদর্শন করেন এবং সাহায্য করেন। আল্লাহ্র সাহায্য হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্য।
উপদেশ : মোমেন ব্যক্তিদের অন্তরে অন্তর্দৃষ্টির জন্মলাভ করে যা তাদের মধ্যে বিচক্ষণতা ও যে কোনও কাজে সঠিক সিদ্ধান্ত লাভের ক্ষমতা দান করে। সঠিক সিদ্ধান্ত ও আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা, মোমেন ব্যক্তির জন্য সফলতা ও শান্তির দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। এই আয়াতের এই-ই হচ্ছে উপদেশ।
৩০৮৮। কোরাণকে ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ করার পক্ষে তিনটি যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। ১) "তোমার হৃদয়কে উহা দ্বারা শক্তিশালী করতে পারি। " আরব বাসীদের মত শক্ত হৃদয়ের মানব সম্প্রদায়ের হৃদয়ে আল্লাহ্র বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করা ছিলো এক অমানুষিক দুঃসাধ্য কর্মপ্রচেষ্টা - যা নবীকে আল্লাহ্ দায়িত্ব দান করেছিলেন। ইসলাম আরববাসীর মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করবে। এই হচ্ছে রাব্বুল -আলামীনের ইচ্ছা। এই দুঃসাধ্য কাজকে সাফল্যে পরিণত করতে যে ধৈর্য্য, একাগ্রতা, অধ্যবসায়, এবং দৃঢ়তার প্রয়োজন নবীর চরিত্রে সে সব ধীরে ধীরে সৃষ্টির জন্য আল্লাহ্ তাঁর বাণীকে বিভিন্ন সমস্যার পটভূমিতে ধীরে ধীরে অবতীর্ণ করেছেন - যেনো নবীর [ সা ] চরিত্র উপরোক্ত গুণাবলী ধারণ করে সমস্যাকে দৃঢ় ও কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে পারেন। ২) "ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে " - সুদীর্ঘ তেইশ বছর ব্যপী ,সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতির সোপান অতিক্রমের ধারাবাহিকতায় কোরাণ নাজেল হয়েছে ক্রমে ক্রমে ধাপে ধাপে। কোরাণ যদিও অবতীর্ণ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে , কিন্তু সম্পূর্ণ কোরাণ অবতীর্ণ হওয়ার পরে তাকে ধাপে ধাপে বিন্যস্ত করা হয়েছে আধ্যাত্মিক নির্দ্দেশনার সোপান রূপে। ৩) পরবর্তী আয়াতে আছে যে, কোরাণ ধীরে ধীরে অবতীর্ণ করা হয়েছে প্রতিটি সমস্যার ব্যাখ্যাদান করার জন্য এবং ধীরে ধীরে অবতীর্ণের ফলে মানব হৃদয়ে কোরাণের উপদেশাবলী অনুশীলনের মাধ্যমে ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এজন্য।
উপদেশ : বিশ্ব মানবের জন্য কোর-আনকে আত্মার মাঝে ধারণ করার উপায় এ ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। সে কারণেই কোরাণকে প্রতিদিন পাঠ করতে হবে।
৩০৮৯। কোরাণ হচ্ছে স্বর্গীয় জ্ঞানের মানুষের ভাষায় প্রকাশ মাত্র। স্বর্গীয় জ্ঞানের কোন সীমানা নেই - তা হচ্ছে আদিগন্ত, অসীম সমুদ্রের ন্যায়। যদি কেউ আন্তরিক ভাবে আল্লাহ্র জ্ঞানের সন্ধান লাভ করতে চায় তবে প্রথমে সত্যের সামান্য ঝলক মাত্র তার মনের পর্দ্দাকে উদ্ভাসিত করে। তবে আন্তরিক প্রচেষ্টা, তাদের মনোদিগন্তে ধীরে ধীরে সত্যের আলোর বা জ্যোতির প্রসারতা ঘটায়। আর এই প্রসরণ ঘটে ধাপে ধাপে। অন্তরের সত্যের বিকাশ এ ভাবেই বিশেষতঃ ঘটে থাকে। দৈনন্দিন সমস্যার উপরে আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথের সমাধান অনুসন্ধানের মাধ্যমে শুরু হয় তার আত্মান্বেষণের যাত্রা এবং সত্যকে অনুধাবনের ক্ষমতার। আর এই অনুধাবন ক্ষমতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। যদি তারা সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং সঠিক সমাধানের জন্য স্বর্গীয় সমাধানের সাহায্য প্রার্থনা করে , তবে তাদের জন্য সত্যের দুয়ার উম্মুক্ত হয়ে যায়। নবাগত মুসলিম উম্মার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও পথের নির্দ্দেশনা আল্লাহ্ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে অবতীর্ণ করেছেন , এ ভাবেই যখন কোনও সমস্যা সম্পর্কে নির্দ্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয় তা শুধু সে যুগের বা নির্দ্দিষ্ট সেই ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা হয়ে যায় সার্বজনীন ও যুগ কাল অতিক্রান্ত। কারণ কোরাণের শিক্ষার আলো, মানুষের অনুভবের চেতনাকে সমৃদ্ধ করে তার চরিত্রকে সমুন্নত ও সঠিক পথে পরিচালিত করে। এ ভাবেই আল্লাহ্ কোরাণের মাধ্যমে মানুষের জন্য যে সমাধান বা পথ নির্দ্দেশ দান করেছেন তা নির্দ্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হলেও তার আবেদন সার্বজনীন।
৩০৯০। "মুখে ভর " অর্থাৎ অত্যন্ত অসম্মানজনক অবস্থা।
৩০৯১। এই আয়াতটি [ ২৫ : ২৪ ] আয়াতের সাথে বিপরীতে তুলনা করা যায়। পূর্বের আয়াত ও এই আয়াতে পূণ্যাত্মা ও পাপীর মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। পূর্বের আয়াতে [ ২৫ : ২৪ ] বলা হয়েছে , "জান্নাতবাসীদের বাসস্থান ................... মনোরম, এবং এই আয়াতে বলা হয়েছ , " জাহান্নামবাসীরা হবে দুর্দ্দশাগ্রস্থ এবং সবচেয়ে পথভ্রান্ত।" এভাবেই আয়াতটিকে শেষ করা হয়েছে।
৩০৯২। দেখুন আয়াত [ ২০ : ২৯ ] , যেখানে হযরত মুসার আবেদনকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই আয়াতকে [ ২৫ : ৩৫ ] বলা চলে পূর্বের আয়াতের ধারাবাহিকতা যেখানে আল্লাহ্ মুসার আবেদনকে মঞ্জুর করেছেন। এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে যে, কিভাবে প্রাচীন যুগের লোকেরা আল্লাহ্র প্রেরিত দূতদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছিলো , কিন্তু আল্লাহ্র প্রেরিত দূতেরা আল্লাহ্র প্রেরিত ন্যায় -অন্যায় , সত্য- অসত্যের মানদন্ডের উপরে ছিলেন অবিচলিত।
৩৭। এবং নূহ্ এর সম্প্রদায় , যখন তারা রসুলকে প্রত্যাখান করলো - মানুষের নিকট দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য আমি তাদের [ পানিতে ] নিমজ্জিত করেছিলাম ৩০৯৩। এবং আমি [ সকল ] পাপীদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি; -
৩০৯৩। নূহ্ নবী আ'দ জাতি এবং সামুদ জাতির [ এবং আর অন্যান্য ] বর্ণনা আছে পরবর্তী সূরার [ ২৬ : ১০৫ - ১৫৯ ] আয়াতে। এ সব সম্প্রদায় আল্লাহ্র প্রেরিত দূতদের শিক্ষাকে গ্রহণ করার পরিবর্তে তাঁদের অসম্মান করে। এই আয়াতে পরবর্তী আয়াতের ঘটনার সামান্যমাত্র উল্লেখ করা হয়েছে কি ভাবে সত্যের শিক্ষাকে যুগে যুগে অবমাননা করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে সত্য কখনও স্তব্ধ হয়ে যায় নাই। বরং সত্য প্রত্যাখানকারীরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় যুগে যুগে।।
৩০৯৪। "রাস্সের অধিবাসী " বলতে সঠিক ভাবে কাদের বোঝানো হয়েছে , তফসীরকারগণ এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নন। "Rass" মূল শব্দটির অর্থ কূপ বা পানির অগভীর উৎস। এর অন্য আর একটি অর্থ মৃতের কবর দেয়ার সাথে সংযুক্ত। কিন্তু সম্ভবতঃ 'রাসসের' অধিবাসীরা সুয়েব নবীর সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলো, কারণ এখানে আদ, সামুদ জাতির সাথে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে। আরবের উত্তর পশ্চিমে ছিলো 'মাদিয়ান' সম্প্রদায়ের আবাসস্থল - যেখানে বহু পূরানো কূপের সন্ধান পাওয়া যায়। নাজদ [Najd] মধ্যবর্তী স্থানে কাশিম [Qasim] জেলাতে মরুদ্যান বেষ্টিত শহর আল-রাস [Al- Rass] আছে যার সঠিক অবস্থান হচ্ছে নিম্নরূপ : আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রবিন্দুতে, মক্কা ও বসরার মধ্যবর্তী স্থানে " উনাইজা " [Unaiza] শহরের পয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণ -পশ্চিমে, এই ছোট্ট শহর আল রাসের অবস্থান। দেখুন Doughty's Arabia Deserta বই। পাতলা কাগজে বাঁধানো একখন্ডে লন্ডন থেকে ১৯২৬ সনে প্রকাশিত edition, London 1926, এর II 435 পৃঃ এবং ম্যাপে যার অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে , অক্ষাংশ ২৬° উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৪৩° পূর্ব। ]
৪০। এবং যে জনপদের উপরে বর্ষিত হয়েছিলো অকল্যাণের বৃষ্টি, (অবিশ্বাসীরা) তো সেই জনপদ দিয়েই যাতায়াত করে ৩০৯৫। তারা কি তা প্রত্যক্ষ করে না? কিন্তু তবুও তারা পুনরুত্থানের ভয় করে না।
৩০৯৫। 'সেই জনপদ' দ্বারা লূতের সম্প্রদায়ের বাসস্থানকে বোঝানো হয়েছে। মরু সাগরের [Dead Sea] তীরে অবস্থিত 'সদম' ও ' গোমরাহ্ ' শহরের ধ্বংসের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে , যা প্রস্তর খন্ড বর্ষণ দ্বারা ধ্বংস করা হয়। স্থানটির অবস্থান সম্পর্কে বলা হয় , তা আরব ও সিরিয়ার বানিজ্য পথের ধারে মরু সাগরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ছিলো। দেখুন [ ১৫ : ৭৪, ৭৬ ] আয়াত এবং টিকা ১৯৯৮।
৪২। " সে তো আমাদের আমাদিগের উপাস্য থেকে পথভ্রষ্ট করে ফেলার উপক্রম করেছিলো, যদি না আমরা তাদের প্রতি অবিচলিত থাকতাম।"- শীঘ্রই তারা জানতে পারবে, যখন তারা শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করবে- যে কোন্ ব্যক্তি পথ থেকে অধিক ভ্রষ্ট। ৩০৯৬
৩০৯৬। "Sabil" শব্দটির অর্থ পথ। এখানে পথভ্রষ্ট শব্দটির দ্বারা চরিত্রের নৈতিক মূল্যবোধ বিচ্যুতিকে বোঝানো হয়েছে। জীবন যাপনে নৈতিকতা বর্জিত ব্যক্তি।
৪৪। তুমি কি মনে কর তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বুঝতে পারে ? তারা তো গৃহপালিত পশুর মতই ; বরং পথভ্রষ্টতায় নিকৃষ্টতম।
৩০৯৭। যে লোক প্রবৃত্তির অধীনে , যে শুধুমাত্র নিজ প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তিতে নিয়োজিত তার পক্ষে আল্লাহ্র হেদায়েত গ্রহণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রবৃত্তির বশীভূত ব্যক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করা বা হেদায়েত করা সম্ভব নয়। সে কথাকেই এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের বলেছেন। মানুষের দেহে একই সাথে প্রবৃত্তিরূপ শয়তান বিদ্যমান আবার মহৎ গুণাবলী যা আল্লাহ্র নামের সাথে সম্পৃক্ত তাও বিদ্যমান। মানুষের বিভিন্ন রীপু সমূহ যথা , কাম, ক্রোধ, লোভ, অহংকার, আত্মগরিমা, হিংসা -দ্বেষ , প্রভৃতি রীপু এবং এ সব রীপু থেকে উৎপন্ন খারাপ ও কদর্য অভ্যাস সমূহ যেমন মিথ্যাচারীতা, প্রতারাণার প্রবণতা, অন্যের জিনিষ অন্যায় ভাবে গ্রাসের প্রবণতা, অহেতুক বিলাসীতার আকাঙ্খা ইত্যাদি একজনকে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত করে। সুতারাং যারা প্রবৃত্তির দাস , তাদের কথা আল্লাহ্ পরবর্তী আয়াতে বলেছেন যে তারা পশুর সমকক্ষ বা তারও অধম। কারণ কোনও হেদায়েতই এদের সঠিক পথে আনতে পারবে না। এমনকি নবী করিমের [ সা ] আবেদনও এদের কাছে তুচ্ছ মনে হবে। কারণ পাপাচারীরা প্রবৃত্তির তারণায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। কোন যুক্তিই তাদের অন্ধ কামনা-বাসনার উপরে স্থান লাভ করে না। তারা তাদের অন্ধ কামনা-বাসনার আকাঙ্খা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তাদের জন্য সঠিক পথের অন্বেষণ করা বাতুলতা মাত্র। তার হেদায়েতের দায়িত্ব গ্রহণ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়, কারণ সে কোনও নৈতিক আইন বা উপদেশ মানতে ইচ্ছুক নয়। নৈতিকতা অর্জন ব্যতীত কিভাবে হেদায়েতের পথ পাওয়া সম্ভব ? সে তো পশুরও অধম। পশু হয়তো সদুপদেশ বুঝতে পারে না , একথা সত্য , কিন্তু আল্লাহ্ পশুর চরিত্রে যে সহজাত স্বাভাবিক প্রেরণা প্রেথিত করে দিয়েছেন তার সৃষ্টিলগ্নে , তা পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। এই প্রেরণা বা প্রবণতাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কোনও প্রাণীর নাই। "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " লাভের ফলে মানুষ বারে বারে আল্লাহ্র আইনকে লঙ্ঘন করে ফলে সে প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে পড়ে এবং আল্লাহ্র হেদায়েত গ্রহণে হয় অপারগ।
রুকু-৫
৩০৯৮। লক্ষ্য করুণ আয়াত [ ২৪ : ৩৫ ] এ আল্লাহ্কে বলা হয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর আলো স্বরূপ। এই আর একটি আয়াত যেখানে আল্লাহ্র মহিমান্বিত রূপকে অনুধাবন করতে বলা হয়েছে তাঁর সৃষ্ট আলো ও ছায়ার ধারণা সম্বন্ধে চিন্তার মাধ্যমে।
৩০৯৯। নগর কেন্দ্রীক জীবনে আমরা , আলো ও ছায়ার যে অপূর্ব লীলা খেলা বিশ্ব ভূবন জুড়ে প্রতি নিয়ত প্রতি পলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে , তার খোঁজ আমরা রাখি না। আমরা সূর্যাস্তের রং এর খেলা দেখে মুগ্ধ হই। গোধূলীর আবীরে মাখা পশ্চিম আকাশের সৌন্দর্য আমাদের পৃথিবীর মালিন্যের উর্দ্ধে নিয়ে যায়। কিন্তু শহর ভিত্তিক অধিকাংশ লোকই প্রত্যুষের সূর্যদয়ের লগ্নে আলো ছায়ার স্বর্গীয় দৃশ্য জীবনে কখনও অবলোকনের সুযোগ পায় নাই। সূর্য দিক্চক্রবালের অতিক্রমের পূর্বে শুরু হয় আলো আঁধারির খেলা। সূর্যের সমস্ত দিনের যাত্রা পথে প্রত্যুষ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা পবিত্র সময়। কারণ এ সময়ে দিনের কর্ম কোলাহল থাকে না। কর্মচঞ্চলতামুক্ত প্রকৃতি থাকে কলুষতা মুক্ত। সারারাত্রি বিশ্রামের পরে বিশ্ব প্রকৃতি থাকে নূতন সূর্যদয়ের জন্য উন্মুখ - পূত পবিত্র ভাব সমস্ত প্রকৃতিকে পরিব্যপ্ত করে থাকে। এর মাঝে দিক্চক্রবালে চলে আলো আঁধারির খেলা। প্রত্যুষের ও গোধূলির যে আলো তা সূর্যের সরাসরি আলো নয়, তা প্রকৃত সূর্যের আলোর প্রতিফলন মাত্র। গোধূলি বিলিন হয় রাত্রির অন্ধকারে, প্রত্যুষের অর্ন্তধান ঘটে দিনের আগমনে। দিনের সূর্য , প্রকৃত ছায়ার সাথে সম্পৃক্ত।
৩১০০। সকালের সূর্যের যে ছায়া তা স্পষ্ট ও দীর্ঘায়িত। এই ছায়ার আকৃতি ও দিক্ সূর্যের গতিপথের সাথে সম্পৃক্ত। এই ছায়ার অস্তিত্ব প্রতি মূহুর্তে সূর্যের সাথে পরিবর্তনশীল।
৩১০১। 'একে' অর্থাৎ ছায়াকে। সূর্য যত উপরে উঠতে থাকে, ছায়ার দৈর্ঘ তত ছোট হতে থাকে। সূর্য যখন দুপুরে ঠিক মাথার উপরে থাকে তখন ছায়া অত্যন্ত খর্বাকৃতি হয়, প্রায় থাকে না বললেই চলে। ছায়া তখন কোথায় যায়। ছায়া বস্তুর দ্বারা সূর্যরশ্মী বাধা প্রাপ্ত হওয়ার ফলে সৃষ্টি হয় , আবার এই ছায়া বস্তু দ্বারাই খর্বাকৃতি হয় এও এক প্রকৃতির নিয়ম।
৩১০২। পরিবর্তনশীল ছায়ার মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, পৃথিবীর সকল কিছুই , জীবনের সকল কিছুই সর্বদা পরিবর্তনশীল। যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করতেন, তবে প্রকৃতির আইনকে অন্যভাবে সৃষ্টি করতে পারতেন, যাতে সকল বস্তু স্থায়ী রূপ লাভ করতো।
৩১০৩। আলো ও অন্ধকারের তুলনা এই আয়াতেও করা হয়েছে। আলো হচ্ছে দিনের প্রতীক;অন্ধকার রাত্রির প্রতীক। রাত্রির অন্ধকারকে পোষাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে, পোষাক যেরূপ শরীরকে আবৃত করে , লজ্জা নিবারণ করে এবং শীত ও গ্রীষ্মের প্রকোপ থেকে শরীরকে রক্ষা করে আরাম প্রদান করে , রাত্রিও সেরূপ বিশ্রামের সুষুপ্তি দ্বারা দিবসের কর্মের ক্লান্তি থেকে শরীরকে রক্ষা করে। রাত্রির অন্ধকার আমাদের বিরত রাখে দিবসের ব্যস্ত কর্মময় জীবন, থেকে ঠিক পোষাকের মত। অপর পক্ষে , দিনের আলো হচ্ছে উদ্যম, কর্ম ও জীবন সংগ্রামের প্রতীক। আবার রাত্রির ঘুমের উপমা হচ্ছে মৃত্যুসম। প্রকৃত মৃত্যুর পূর্বে অস্থায়ী মৃত্যু। কারণ ঘুমের মাঝে আমাদের চেতনা লোপ পায়। দিনের আলোতে আমরা জেগে উঠি, আমাদের জীবনে আবার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। সে ভাবে দিন হচ্ছে জীবনের এবং জীবনের সংগ্রামের প্রতীক।
৩১০৪। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৫৭ ]। মেঘভারাক্রান্ত বায়ু আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ। আল্লাহ্র রহমত ও করুণাকে মেঘভারাক্রান্ত বায়ুর উপমার সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতের মাধ্যমে আলোর প্রতীককে নূতন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দিনের আলোর সাথে সূর্যের তাপের সম্পর্ক বিদ্যমান। সূর্যের তাপ বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি করে পৃথিবীতে এবং সমুদ্র থেকে জলীয় বাস্প উত্থিত করে মেঘে পরিণত করে। এই মেঘ বায়ুপ্রবাহের দ্বারা তাড়িত হয়ে স্থলভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায়। জীবনের বিকাশের জন্য 'তাপের' প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা সকলেই জানি। আবার গ্রীষ্মের দাব্দাহে প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে, মেঘভারাক্রান্ত বায়ু তখন বৃষ্টির সুসংবাদ বহন করে আনে।
৩১০৫। "বিশুদ্ধ পানি" - বৃষ্টির পানি হচ্ছে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ পানি। আল্লাহ্র বিশাল রসায়নাগারে প্রাকৃতিক উপায়ে পানি পাতিত [Distilled] হয়ে মেঘরূপে জমা হচ্ছে। বৃষ্টির পানি হচ্ছে বিশুদ্ধ পাতিত পানি [Distilled]।
৩১০৬। এই আয়াতের মাধ্যমে প্রকৃতির 'পানি চক্রের' উপস্থাপন করা হয়েছে। পানি চক্র হচ্ছে : সমুদ্রের পানির বাষ্প হয়ে মেঘে বা শিলা বা তুষারে পরিণত হওয়া আবার মেঘ বা তুষার স্থলভাগে ঝরে পড়া এবং নদীবাহিত হয়ে এই পানির পুণরায় সাগর বক্ষে প্রত্যাবর্তন। সমুদ্রের লবনাক্ততা নদীবাহিত পানির বর্জ্য দ্রব্য সমূহ পরিশোধিত করে যাচ্ছে অবিরত ধারাতে। এ ভাবেই পৃথিবী পৃষ্ঠ প্রতিমূহুর্তের বর্জ্য পদার্থ মুক্ত হয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। আবার বৃষ্টি , তুষার, হিমাবহ, নদী , হ্রদ ইত্যাদি পানির বিভিন্ন অবস্থান পৃথিবী পৃষ্ঠে বিরাজমান। ভূপৃষ্ঠের পানির এই বিভিন্ন অবস্থানের জন্য পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভূগোলের জন্ম দেয়। বৃষ্টির অভাবে শষ্য শ্যামল ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়, আবার উষর মরুভূমি বৃষ্টির স্পর্শে শষ্যশ্যামল ভূমিতে পরিণত হয়। সমস্ত সুপেয় পানির উৎস যথাঃ নদী, খাল-বিল, হ্রদ, জলাধার , ঝরণা , কূপ, অথবা যে কোনও প্রকার সূপেয় পানির উৎস হচ্ছে বৃষ্টি। পানির সাথে জীবনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পানির অপর নাম জীবন। কারণ জীবনের যে মূল কণিকা প্রোটোপ্লাজমের অধিকাংশ পানি দ্বারা গঠিত। দেখুন নীচের আয়াত [ ২৫ : ৫৪ ]।
৩১০৭। আল্লাহ্র করুণা আল্লাহ্র প্রজ্ঞারই স্বাক্ষর। পৃথিবীর বুকে পানির সুসম বন্টন সেই প্রজ্ঞারই স্বাক্ষর বহন করে। প্রকৃতিতে জীবনের জন্য যেখানে যতুটুকু বৃষ্টির প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই বন্টিত হয়েছে। আয়াত [২৫:৪৮-৫০] এর বর্ণনা ভিন্ন আঙ্গিকে তুলনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে পানিই জীবন। পানি ব্যতীত জীবন ধারণ কল্পনাও করা যায় না। এই হচ্ছে সাধারণ সত্য। এই সত্যের মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে জীবনের মহত্তর ও বৃহত্তর সত্যের প্রতি। পানিকে আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতীক হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। পানির উপমার মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে পানির অভাবে যেমন জীব মৃত্যুবরণ করে ঠিক সেরূপ আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের করুণা ও নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ ও অনুশীলন ব্যতীত আত্মার মৃত্যু [Spiritual death] ঘটে। এখানে বৃষ্টিকে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের সাথে প্রতীক হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। আমাদের আত্মিক জীবন সমৃদ্ধকারী আল্লাহ্র করুণা বিভিন্নভাবে আমাদের মাঝে আত্মপ্রকাশ করে। কখনও তা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, কখনও তা আমরা বিপদ বিপর্যয়ের মাধ্যমে আত্মার মাঝে অনুভব করি। আত্মার প্রচন্ড অস্থিরতা ও বিপর্যয় , দুঃখ-ব্যথা অনেক সময়েই আমাদের মনোজগতের পরিবর্তন ঘটায়, যে পরিবর্তন আত্মার মাঝে প্রকৃত অনুভব ক্ষমতা এবং অনুধাবন ক্ষমতার জন্ম দেয়। আল্লাহ্র করুণাকে অনুভব করতে পারা এবং তাঁর মঙ্গলময় ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক জগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। মেঘ যেরূপ বৃষ্টির বার্তা বহন করে , জাগতিক বিপদ বিপর্যয়ও সেরূপ আল্লাহ্র রহমত ও করুণার সুখবর দান করে। বৃষ্টি যেরূপ পৃথিবীর উপরিভাগের বর্জ্য দূর করে। আল্লাহ্র করুণা ধারা আত্মাকে কর পরিশুদ্ধ , পাপমুক্ত। বৃষ্টি যেরূপ মরুভূমিকে শষ্য শ্যামল ভূমিতে পরিণত করে, আল্লাহ্র করুণাও সেরূপ ঘুমন্ত বা মৃত আত্মাকে জাগরিত করে। বৃষ্টির পানি যেরূপ ভূপৃষ্ঠের সুপেয় পানির উৎসকে স্থির রাখে , আল্লাহ্র করুণার ধারাও সেরূপ আধ্যাত্মিক জগতের সকল প্রয়োজনের সঠিক ধারাটি বজায় রাখে। বৃষ্টি যেরূপ সকল পৃথিবীব্যপী ঘটে থাকে, আল্লাহ্র করুণা ধারাও সেরূপ সকল বিশ্বব্যপী পরিব্যপ্ত। তা স্থান ও কালের উর্দ্ধে। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্র বিশ্বব্যপী করুণার সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
৩১০৮। আল্লাহ্র সীমাহীন করুণার প্রেক্ষাপটে মানুষের অকৃতজ্ঞতাকে তুলনা করা হয়েছে।
৩১০৯। আল্লাহ্র বাণী বা প্রত্যাদেশ বিশ্ব জগতের সকল মানুষের জন্য। তা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য সমভাবে বিতরণ করা হয়েছে। যেখানে আল্লাহ্ প্রয়োজন মনে করেছেন , তিনি সেখানে নবী ও রসুলদের প্রেরণ করে থাকেন। ইচ্ছা করলে তিনি প্রতি শহরে প্রতি গ্রামে তার নবীদের প্রেরণ করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা করেন নাই কারণ তাঁর পরিকল্পনা সে ভাবে নাই। আল্লাহ্ প্রতিটি মানুষের অন্তরে তার বিবেক রূপ আলো প্রেরণ করেছেন। জাগ্রত বিবেকই হচ্ছে আল্লাহ্র নূর [Spiritual insight]। যে বিবেককে জাগ্রত রাখে সে আল্লাহ্র নূরকে আত্মার মাঝে ধারণ করে। তাঁর আত্মা কখনও পাপের পঙ্কিলতায় পথ হারায় না। আল্লাহ্র স্বাক্ষর বিদ্যমান সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতিতে , তাঁর প্রত্যাদেশে। বিবেকের নূরে সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মাঝে আল্লাহ্র স্বাক্ষরকে অনুভবের ক্ষমতা সে লাভ করে।
৩১১০। আল্লাহ্র নিদর্শন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডব্যপী পরিব্যপ্ত। আল্লাহ্ তাঁর নবীকে কাফেরদের সমালোচনাতেও ভ্রক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্র রাস্তায় জেহাদ করতে বলা হয়েছে আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী যে বিধান প্রত্যাদেশের মাধ্যমে অবতীর্ণ।
৩১১১। 'Maraja' আক্ষরিক অর্থ চারণভূমিতে বাঁধা পশুকে মুক্ত করা বা বন্ধনকে আলগা করা। Bahrain অর্থ দুটি সমুদ্র বা দুটি প্রবাহমান পানির ধারা। 'Bahr' শব্দটি লোনা এবং মিঠা পানি উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভূপৃষ্ঠের সকল পানিকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় : ১) বিশাল সমুদ্রের পানি যা লবণাক্ত এবং ২) মিঠা পানি যার উৎস বৃষ্টির পানি যথা : নদী, হ্রদ, খাল-বিল, কূপ , ভূগর্ভস্থ পানি, ঝরণা ইত্যাদি। এই আয়াতে বিজ্ঞানের দুটি সুত্রকে উত্থাপন করা হয়েছে। মিঠা পানি ও লোনা পানি এই দ্বিবিধ পানি ভূপৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ অধিকার করে আছে - দুটোই দুই সমুদ্রের মত বিশাল। এই দুই পানির ধারা মিলিতভাবে প্রবাহিত হলেও কখনও লোনা পানি ও মিঠা পানি মিশে যায় না। "প্রবাহমান দুই জলরাশিকে মুক্ত করে রেখেছেন" - এবং " উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায় " - এই বাক্যদুটি বিজ্ঞানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ তত্বকে ব্যাখ্যা করছে, যা চৌদ্দশ বছর পূর্বে মানুষের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব ছিলো না। প্রথমতঃ ভূপৃষ্ঠ " পানিচক্র " দ্বারা মিঠা পানির অবিরত ধারাটি সর্বদা বজায় রাখতে পারে। আমরা জানি সুমিষ্ট পানির সকল উৎস হচ্ছে বৃষ্টির পানি। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর -হ্রদ, কূপ, ঝরণা , তুষার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর , সকল কিছুর উৎস হচ্ছে বৃষ্টির পানি। আবার মেঘের উৎস হচ্ছে সমুদ্রের লোনা পানি। সূর্যের তাপে সমুদ্রের পানি মেঘরূপে সুমিষ্ট পানিতে পরিণত হয় এবং বৃষ্টিরূপে ভূপৃষ্ঠে ঝরে পড়ে। আবার বৃষ্টির এই পানি ভূপৃষ্ঠের সকল আবর্জনা ধৌত করে নদীতে নিক্ষিপ্ত করে এবং নদী দ্বারা বাহিত হয়ে মিঠা পানির এই স্রোত সমুদ্রে পতিত হয় এবং মিশে যায়। বিজ্ঞানের ভাষাতে একে বলা হয় পানিচক্র যার রেখচিত্র নিম্নরূপ :
সমুদ্রের লোনা পানি-> মেঘ-> বৃষ্টি-> ভূপৃষ্টের নদী-নালা দ্বারা প্রবাহিত-> সমুদ্রের লোনা পানি।
মেঘ যদিও সমুদ্রের লোনা পানি থেকে সৃষ্টি , কিন্তু তা হচ্ছে মিষ্টি পানির উৎস এবং কোনও অবস্থাতেই মেঘের পানিতে সমুদ্রের লোনা পানি মিশে যাবে না। সেখানে থাকবে অনতিক্রম্য ব্যবধান। আবার ভূপৃষ্ঠের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখতে পাই মিঠা পানির বিশাল আঁধার রয়েছে ভূগর্ভে। যদিও স্থল ভাগ সমুদ্রের লোনা পানি দ্বারা বেষ্টিত তবুও এই ভূগর্ভস্থ পানি কখনও সমুদ্রের লোনা পানি দ্বারা মিশে যায় না। এমন কি সমুদ্রের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ যেমন আমাদের মহেশখালী ইত্যাদি , যেগুলি সমুদ্রের লোনা পানি দ্বারা বেষ্টিত, তা সত্বেও এসব দ্বীপের অভ্যন্তরে স্রষ্টা প্রাণীর বসবাসের জন্য ও তরুলতার বৃদ্ধির জন্য ভূগর্ভস্থ মিষ্টি পানির ধারাটি অক্ষুন্ন রাখেন। তা কি করে সম্ভব হয় ? কেন সমুদ্র উপকূলের দেশ সমূহের এবং দ্বীপ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সমুদ্রের লোনা পানি মিশে তিক্ত হয় না ? কি সে অনতিক্রম্য ব্যবধান যা স্রষ্টা এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন ? বিজ্ঞানের এই তত্বটি হচ্ছে Osmosis প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় গাছেরা শিকড় দ্বারা মাটি থেকে সুমিষ্ট পানি নিজ দেহভ্যন্তরে টেনে নেয় এবং শিকড় থেকে গাছের শীর্ষে পর্যন্ত পানির সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখে। সমুদ্র উপকূলের মাটি ও দ্বীপের মাটি এই প্রক্রিয়াতে Semi permeable বা অর্ধভেদ্য পর্দ্দারূপে কাজ করে যা মিঠা পানিকে সমুদ্রে প্রবেশে বাঁধা দেবে না কিন্তু সমুদ্রের লোনা পানিকে মিঠা পানিতে ঢুকতে "অনতিক্রম্য বাঁধার" সৃষ্টি করবে। এই প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানের ভাষাতে বলে Osmosis প্রক্রিয়া। এ ভাবেই স্রষ্টা জীবনের প্রয়োজনে লোনা ও মিঠে পানিকে মিশ্রিত হওয়া থেকে বিরত রাখেন। আল্লাহ্ যদি Osmosis প্রক্রিয়ার সৃষ্টি না করতেন তবে বাংলাদেশের মত বদ্বীপ এলাকা ও সাগর বক্ষে দ্বীপ এলাকা জীবনশূন্য হয়ে যেতো। কারণ এ ঘটনার এই অটুট ব্যবস্থাপনা আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার অভাবনীয় দৃষ্টান্ত এবং তাঁর অপার রহস্যের অকাট্য প্রমাণ।
৩১১২। "অনতিক্রম্য ব্যবধানের " ব্যাপারটি উপরের আয়াতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্রষ্টা এ ভাবেই লোনা পানি ও মিঠা পানিকে সংযুক্ত রাখলেও আলাদা রেখে দেন। এ তো স্রষ্টারই জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই স্বাক্ষর।
৩১১৩। সমস্ত জীবিত জীবকোষের মূল পদার্থ হচ্ছে প্রোটপ্লাজম। যার মূল পদার্থ পানি। দেখুন আয়াত [ ২৪ : ৪৫] এবং [ ২১ : ৩০ ] এবং টিকা সমূহ।
৩১১৪। পানি খুব সহজেই তরল থেকে বাষ্পে পরিণত হয়। সে ভাবে বিচার করলে পানি একটি অস্থায়ী ও সুলভ তরল পদার্থ। তবুও এই সুলভ তরল পদার্থ থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জীবনের প্রকাশ ঘটেছে। মানুষ যার নাম। মানুষ সর্বোচ্চ শুধুমাত্র তার বৈশিষ্ট্য ও কর্মক্ষমতার গুণে হয়; পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে তার বংশগতির ধারাকে রক্ষা ও স্মরণ করে ; পূর্ব পুরুষদের স্মরণ করে এবং তাদের সাথে আত্মিক সম্পৃক্ততা অনুভব করে। সম্পর্ককে মানুষ এভাবেই আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে, রক্তের সম্পর্ক স্থাপন করে, যে সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিমূর্ত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর আর কোনও প্রাণী এরূপ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম নয়। আবার বিবাহের মাধ্যমে রক্তের সম্পর্কশূন্য দুজনের মাঝে গভীর প্রেম প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রাণী জগতেও যৌন জীবন আছে কিন্তু তা কোনও স্থায়ী সম্পর্কের সৃষ্টি করতে পারে না। এসব সামাজিক ও প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন করা যায়।
৩১১৫। এই আয়াতের মাধ্যমে উপাস্য হিসেবে জড় ও আল্লাহ্র ক্ষমতার মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। এসব জড় উপাস্যের কোনও ক্ষমতাই নাই, অপরপক্ষে আল্লাহ্ মহাক্ষমতাধর , মহাশক্তিশালী। তুলনা করা হয়েছে বিশ্বাসী ও কাফেরদের। কাফেরদের জন্য আছে সর্তকবাণী।
৫৭। বল; " এর জন্য আমি তো কোন পুরষ্কার চাই না এ ব্যতীত যে, প্রত্যেকে যেনো তার প্রভুর দিকের [ সরল ] পথ গ্রহণ করে।"
৫৮। তুমি তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন কর যিনি চিরঞ্জীব , যিনি মরবেন না , এবং তাঁর প্রশংসা কীর্তন কর; বস্তুতঃ স্বীয় বান্দাদের পাপ সম্বন্ধে সংবাদ রাখার জন্য তিনিই যথেষ্ট ৩১১৬।
৩১১৬। আল্লাহ্ আমাদের স্রষ্টা। তিনি আমাদের পাপ ও দোষত্রুটি সম্বন্ধে আমাদের অপেক্ষাও বেশী ওয়াকিবহাল। তাঁর নিকট কিছু গোপন করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। সুতারাং আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় শুধু তাঁরই উপরে আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করা ও নির্ভর করা। তিনি সকলের মঙ্গলময় প্রভু।
৩১১৭। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৫৪ ] এবং টিকা ১০৩১।
৩১১৮। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৩ ] এবং টিকা ১৩৮৬।
৩১১৯। এখানে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, কার প্রতি আমরা আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করবো ? যারা শুধুমাত্র জাগতিক বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন , তারা সর্বদা জাগতিক শক্তি সামর্থের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ তারা তাদের হৃদয়ে স্বর্গীয় জ্ঞানের সন্ধান লাভ করেন - যার ফলে তারা জাগতিক কোনও কিছুর উপরেই বিশ্বাস স্থাপন করেন না। তাদের একমাত্র নির্ভরতা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ যিনি সর্বশক্তির উৎস। যদি কেউ তা অনুধাবনে অক্ষম হয় তাদেরকেই এই আয়াতে জিজ্ঞাসা করতে বলা হয়েছে সেই সব পূণ্যাত্মাদের যারা স্বর্গীয় জ্ঞানের অধিকারী ; যাদের আত্মা স্বর্গীয় আলোতে আলোকিত।
৩১২০। যাদের হৃদয়ে স্বর্গীয় আলো বা নূর প্রবেশ করে নাই, তারা আল্লাহ্র উপরে সর্ব নির্ভরশীলতা বা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করার প্রকৃত ভাবার্থ বুঝতে অক্ষম। কারণ তাদের সকল চিন্তা ভাবনা জাগতিক ও স্বার্থ বুদ্ধি সম্পন্ন। সুতারাং যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ ব্যহত হয় সেখানে তারা কোনও রূপ নৈতিকতা বা নীতিজ্ঞানের পরোয়া করে না। এ সব বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা জাগতিক বিষয়ের উর্দ্ধে আর কোন কিছুই তারা বুঝতে বা অনুধাবনে অক্ষম। নীতি বা নৈতিকতার জন্য পার্থিব ক্ষতি তাদের নিকট বোকামীর সামিল। এর কারণ তাদের মাঝে প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসের অভাব। যদিও সে সমাজে ধার্মিক বলে বিবেচিত হয় এবং ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা সে নির্ভুলভাবে পালন করে থাকে, তবুও সে প্রকৃত ধার্মিক নয়। তার বিশ্বাস শুধুমাত্র মৌখিক , কারণ জীবনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে সে আল্লাহ্র রহমত অনুধাবনে হয় ব্যর্থ। এ সব মৌখিক ভাবে ধর্ম পালনকারীদের সম্পর্কেই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ্র গুণবাচক নাম রাহমান [ পরম করুণাময় ] কথাটির প্রকৃত অর্থ কখনই অনুধাবন করতে পারবে না। সম্ভবতঃ তাদের পাপ কার্য তাদের অনুধাবন ক্ষমতাকে অন্ধকারের পর্দ্দায় ঢেকে ফেলে। যার ফলে তারা তাদের অন্তরে আল্লাহ্র নূরকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। চর্ম চক্ষু থাকতেও তারা অর্ন্তদৃষ্টি বিহীন ফলে তাদের চারিদিকে ছড়ানো আল্লাহ্র রহমতকে তারা প্রত্যক্ষ করতে পারে না। হৃদয় থাকতেও হৃদয় আল্লাহ্র নূরে উদ্ভাসিত না হয়ে অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে পড়ে [ ২৪ : ৪০ ]।
এভাবেই ধার্মিকতার নামধারীদের সাথে আল্লাহ্র প্রকৃত বান্দার তুলনা করা হয়েছে। মোমেন ব্যক্তিদের সম্বন্ধে নীচের আয়াতে [ ২৫ : ৬৩ - ৭৫ ] বলা হয়েছে।
রুকু - ৬
৩১২১। 'প্রদীপ' অর্থাৎ যা নিজে আলো বিতরণ করে এখানে সূর্যকে বোঝানো হয়েছে। আবার চন্দ্রের পূর্বে জ্যোতির্ময় বিশেষণটি প্রয়োগ করা হয়েছে যার অর্থ হবে উজ্জ্বল আলো বিশিষ্ট কিন্তু নিজস্ব আলো বিকিরণের ক্ষমতা নাই , অন্যের ধার করা আলো যে প্রতিফলিত করে। রাশিচক্র হচ্ছে তারাকামন্ডলীর গতিপথ।
৩১২২। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র জ্ঞান , প্রজ্ঞা, শিল্পী সত্তা, করুণাময় রূপ প্রকাশ পেয়েছে তার সৃষ্টির মাঝে। মহান আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির মাঝেই নিজের গুণাবলীর আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। আল্লাহ্র হাতের নিদর্শন তার সব সৃষ্টির মাঝে বিদ্যমান। তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন তাঁর সৃষ্ট কর্মের মাধ্যমে। যে তা বুঝতে পারে সেই তো সেই বিশ্বস্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে। এই আত্মসমর্পনের পন্থা হিসেবে দুইটি উপায়ের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে : ১) 'রাত্রি ও দিবস' দ্বারা বুঝতে চাওয়া হয়েছে তার সৃষ্টিতত্বকে। নিরাকার স্রষ্টাকে হৃদয়ে অনুভবের অন্যতম উপায় হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিতত্বের জ্ঞান লাভ করা। তিনি যে কতবড় জ্ঞানী, বিচক্ষণ, শিল্পী, এই বোধ আমাদের সমস্ত সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, যখন আমরা তার সৃষ্টিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে চেষ্টা করি। শুধু তখনই আমাদের তাঁর প্রতি প্রশংসা বাণী উত্থিত হবে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ফলে স্রষ্টার প্রশংসার মাধ্যমে স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পন করার ইচ্ছা হবে। ২) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মাধ্যমেও স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পন করা যায়। কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা মৌখিক নয়, তার প্রকাশ ঘটাতে হবে কৃত কর্মের মাধ্যমে। কৃতকর্ম অর্থাৎ আল্লাহ্র ইচ্ছা অনুযায়ী পার্থিব জীবনের কার্যাবলী পরিচালনা করতে হবে, তাঁর সৃষ্টির সেবার জন্য আত্মোৎসর্গ করতে হবে যেনো আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হন। স্রষ্টার প্রতি প্রশংসা করার ইচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এই দুই মনোভাব যখন আত্মার মাঝে সৃষ্টি হয় , তখন ব্যক্তির চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে। যার বর্ণনা আছে পরবর্তী আয়াতসমূহে।
মন্তব্য : এ কারণেই ইসলাম নারী পুরুষ সকলের জন্য জ্ঞান শিক্ষাকে ফরজ করেছে। কারণ জ্ঞান ব্যতীত বিশ্ব কর্মার কর্ম অনুধাবন সম্ভব নয়। অজ্ঞ লোক হয় কুসংস্কারচ্ছন্ন যা আল্লাহ্র প্রকৃতরূপ অনুধাবনে বাঁধার সৃষ্টি করে।
৩১২৩। 'অজ্ঞ' - এই আয়াতে অজ্ঞ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তাদের সম্বন্ধে যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বঞ্চিত। "সম্বোধন " শব্দটি এখানে আক্রমণাত্মক ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। মোমেন বান্দারা বিনয়কে দুভাবে প্রকাশ করে থাকেন : ১) মোমেন বান্দা , যারা সত্যিকার ভাবে জ্ঞানের অনুসন্ধানে ব্যপৃত তারা তাদের সেই জ্ঞান দান করেন সকলকে, অবশ্য যোগ্যতা অনুযায়ী , যতটুকু তারা ধারণ করতে পারবে। এ ব্যাপারে তাঁদের কোনও অহমিকা নেই। ২) আর যারা অজ্ঞ, যারা শুধু কূটতর্কে ব্যপৃত থাকে, তাদের প্রতিও কোনও কর্কশ বাক্য প্রয়োগ নয়। তাদের জন্যও থাকবে শান্তির সম্ভাষণ। বাক্যগুলি এরূপ হতে পারে যথা : সম্ভবতঃ এই তোমাদের জন্য ভালো, ভবিষ্যতে তোমাদের অনুতাপ তোমাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে।" অথবা " তোমাদের এই সব বাহাস ও কূটর্তক থেকে আল্লাহ্ আমাকে শান্তি দিন" , অথবা " শান্তি এবং বিদায় " ইত্যাদি।
৩১২৪। এই আয়াতটিতে মোমেন বান্দার মানসিক অবস্থাকে তুলে ধরা হয়েছে বিনয়ে অবনত প্রার্থনাই বান্দাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্যের উপযোগী করে।
৩১২৫। এই আয়াতের প্রার্থনার মাধ্যমে পূণ্যাত্মাদের বিনয়কে তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রার্থনার ভাষা তাদেরই যারা পরকালের শান্তির জন্য ইহকালের সৎ কাজের উপরে নির্ভরশীল নয়। তারা সৎ কাজ করেন শুধুমাত্র আল্লাহ্র হুকুমকে বাধ্যভাবে মানার জন্য, আল্লাহ্কে খুশী করার জন্য। কিন্তু পরলোকে দোযখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য তারা শুধুমাত্র আল্লাহ্র করুণার প্রত্যাশী। আল্লাহ্র করুণার প্রত্যাশী মনোভাব তাদের করে তোলে বিনয়ী।
৩১২৬। পাপের ফলে যে দুঃখ ও দুর্দ্দশার উদ্ভব ঘটে তা তাদের গৃহ ও পরিবেশের শান্তি নষ্ট করে দেয়। 'বাসের জন্য ' ও ' বিশ্রামের জন্য ' দ্বারা এই গৃহ ও পরিবেশকে বোঝানো হয়েছে।
৩১২৭। এই আয়াতে পুণ্যাত্মাদের কর্মপ্রণালী বর্ণনা করা হয়েছে। যারা অর্থাৎ পূণ্যাত্মারা অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের সময়ে জ্ঞানী লোকদের পন্থা অবলম্বন করে। খরচের ব্যাপারেও তারা মিতব্যয়ী। এমন খরচ সে করে না যা তাকে দরিদ্রে পরিণত করবে বা এমন মিত্যবয়ী নয় যা তাকে কৃপণের পর্যায়ে নিয়ে যাবে। অর্থ সম্পদ ব্যয়ের মানদণ্ড এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষতঃ লোকে অপব্যয়ী হয় অন্যকে দেখানোর মনোভাব থেকে, অথবা অন্যকে প্রভাবিত করার জন্য। উপরের যে কোন মনোভাবে এরূপ ব্যয় হবে অপব্যয়ের সামিল। আবার ব্যয়ে এমন কার্পন্য হবে না যাতে অপরে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ব্যয়ের ব্যাপারে ন্যায়ের মানদন্ড বজায় রাখতে হবে, প্রত্যেকে যেনো তার নিজস্ব অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। এমন কি নিজের যা প্রাপ্য তাও ভোগ করার প্রয়োজন আছে।
৩১২৮। তিনটি জিনিষকে ইসলামে নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে; ১) আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাসনা করা; ২) হত্যা করা। বিনা প্রয়োজনে হত্যা জঘন্য পাপ যা তার পরিবেশকে কলুষিত করে। ৩) ব্যভিচার। যে পাপ নিজ আত্মাকে কলুষিত করে, আত্মসম্মানবোধকে বিনষ্ট করে। এই তিন ধরণের পাপ কাজের মধ্যে প্রথমটি আল্লাহ্র বিরুদ্ধে , দ্বিতীয়টি আল্লাহ্র সৃষ্ট জীবের বিরুদ্ধে , এবং তৃতীয়টি নিজের আত্মার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। হত্যাকে অনুমতি দান করা হয়েছে সুনির্দ্দিষ্ট কারণে এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে , যেমনঃ মানুষ খুনের শাস্তি আইনের চোখে ফাঁসি। আবার আত্মরক্ষার্থে, আহার্যের জন্য পশু হত্যা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ যা সমাজ জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষা ও ন্যায় বিচারের সহায়ক।
৩১২৯। উপরে যে তিনটি পাপের বর্ণনা করা হলো , এগুলির শাস্তি অন্য পাপের শাস্তির দ্বিগুণ হবে।
৩১৩০। উপরে যে তিনটি পাপের বর্ণনা করা হয়েছে , সেই সব পাপীদের জন্য এই আয়াতে আছে আশ্বাস। যদিও এই পাপগুলি জঘন্য এবং এর শাস্তি সাধারণ পাপের দ্বিগুণ , তবুও পাপী যদি তার পাপ কর্মের জন্য সত্যিকার ভাবে অনুতপ্ত হয় এবং নিজের চরিত্রকে সংশোধন করে তবে আল্লাহ্র করুণাধারা তার জন্যও অবারিত। পাপীর কলুষিত আত্মা পাপ মুক্ত হয়ে পূণ্যের আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠবে।
৭২। এবং যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না [ বা মিথ্যা বলে না ] ৩১৩১; এবং অসার ক্রিয়াকলাপের সম্মুখীন হলে স্বীয় মর্যদার সাথে তা পরিহার করে চলে। ৩১৩২
৩১৩১। মিথ্যা সাক্ষ্যের দুটি তাৎপর্য বিদ্যমান। ১) মিথ্যাভাষণ ২) প্রতারণা জোচ্চুরী ইত্যাদি কাজ যা মিথ্যার সাথে জড়িত।
৩১৩২। মিথ্যার সাথে জড়িত যে সব ক্রিয়া কর্ম সেগুলিকে বলা হয়েছে অসার ক্রিয়া কর্ম। এই আয়াতের মাধ্যমে মিথ্যা ভাষণকেই শুধু নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় নাই, নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে সত্যের সাথে মিথ্যাকে জড়িত করা কথা; বাজে বা নিরর্থক গল্প গুজব; কুৎসিত ঠাট্টা তামাশা, প্রদর্শনীর মনোভাব থেকে বড়াই করা ইত্যাদি সকল কিছুই নিন্দনীয়। যদি কোন ভালো মানুষ নিজেকে এই কুৎসিত পরিবেশে আবিষ্কার করে , তবে সে অবশ্যই সেই পরিবেশ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করবে। তবে তাঁর এই প্রত্যাহার হবে সম্মানজনক ভাবে, বৃথা হৈচৈ এর মাধ্যমে নয়।
৩১৩৩। 'Kharra' অর্থ পিছনে পড়া বা নাক ডাকা, অচেতন হওয়া, অমনোযোগী হওয়া ,বিরক্ত হওয়া বা কোন কিছু শুনতে বা দেখতে অস্বীকার করা।
৭৫। এরাই তারা যাদের পুরষ্কৃত করা হবে বেহেশতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দ্বারা কারণ তাদের ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তা। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা করা হবে অভিবাদন ও শান্তির বাণী দ্বারা ; -
৩১৩৪। মুত্তাকীদের প্রার্থনা হবে আল্লাহ্র বিধান বা আইনের সহায়তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রার্থনা করা। এই প্রার্থনা হবে স্ত্রী-পুত্রদের মুত্তাকী অর্জনের জন্য, যেনো তাদের মাধ্যমে আল্লাহ্র বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। স্ত্রী-পুত্র পরিজন যেনো শুধুমাত্র সামাজিক সম্মান ও অন্যের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের বিষয়বস্তু না হয়। তা হলে তারা জীবনের স্থায়ী সুখের কারণ হবে না। যদি তারা অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করে তবেই তারা হবে মুত্তাকীদের জন্য 'নয়নপ্রীতির ' কারণ। হয়তো তাদের কৃতকর্মের দরুণ আমরা আল্লাহ্র করুণা ও রহমতের সন্ধান লাভে সক্ষম হব। হয়তো তাদের যোগ্যতার গুণে মানুষ ধর্ম ও আমলে তাদের অনুসরণ করবে। আমাদের জ্ঞান ও আমল দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে। ফলে আমরা এর সওয়াব পাব। পরিবার ও সন্তান সন্ততিদের জন্য মুত্তাকীদের প্রার্থনার কল্যাণকর দিকটি এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে।
৩১৩৫। আল্লাহ্র প্রকৃত বান্দাদের গুণাবলীকে এভাবে সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়েছে "রহমানের" বান্দা তারাই যারা : ১) বিনয়ী ভাবে পৃথিবীতে চলাফেরা করে এবং আধ্যাত্মিক অজ্ঞ ব্যক্তিদের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করে [ ২৫ : ৬৩ ]। ২) তারা সর্বদা আল্লাহ্র প্রশংসায় নিয়োজিত থাকে [ ২৫ : ৬৪ ]। ৩) তারা সর্বদা শেষ বিচারের দিনকে স্মরণ করে [ ২৫ : ৬৫ ]। ৪) তারা জীবনের সর্ব ব্যাপারে হবে মিতাচারী [২৫ : ৬৭ ]। ৫) তারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বা তাঁর সৃষ্ট জীবের বিরুদ্ধে বা নিজের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে না [ ২৫ : ৬৮ ]। ৬) তাঁরা শুধু যে মিথ্যাকে পরিহার করে চলেন তাই-ই নয়, তাঁরা অসার ক্রিয়া কলাপকে এড়িয়ে চলেন [ ২৫ : ৭২ ]। ৭) তাঁরা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী [ ২৫ : ৭৩ ]। ৮) তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হবে তাদের পরিবার ও সন্তান সন্ততিদের পূণাত্মারূপে গড়ে তোলা। সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চেতনার সমৃদ্ধি লাভের সুন্দর নিয়মাবলী হচ্ছে উপরের আয়াত সমূহ [২৫:৭৪]। ৯) সেই সাথে তারা হবে ধৈর্য্যশীল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ [ ২৫ : ৭৫ ]।
৭৭। [ প্রত্যাখানকারীদের ] বল, " তোমরা আমার প্রভুকে না ডাকলে তার কিছুই আসে যায় না ৩১৩৬। যেহেতু তোমরা [ তাঁকে ] প্রত্যাখান করেছ, ফলে অচিরেই নেমে আসবে অপরিহার্য [ শাস্তি ]।"
৩১৩৬। কোনও অবিমৃষ্যকারী যেনো মনে না করে যে মানুষের এবাদতের দ্বারা আল্লাহ্ উপকৃত হন। আমরা তাঁর উপাসনা করি আমাদের নিজের আত্মিক সমৃদ্ধির জন্য। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত। মানুষের নিকট তাঁর কিছুই চাওয়া পাওয়ার নাই। বরং তাঁর করুণা ব্যতীত তাঁর সৃষ্টি অস্তিত্ব রাখতে অক্ষম। যারা একগুঁয়ে ও অবাধ্য ভাবে বিশ্ব স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করে। মহাক্ষতি তাদের দ্বারপ্রান্তে। শাস্তি তাদের অপরিহার্য।