+
-
R
[দয়াময় , পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : পরবর্তী চারটি সূরা [ ২৬ - ২৯ ] এক নূতন ক্রমপঞ্জির অবতারণা করেছে। এখানে তুলনা করা হয়েছে আল্লাহ্র নবীদের সাথে। আল্লাহ্র বাণী প্রচারের ফলে সমসাময়িক সম্প্রদায়ের মাঝে তার প্রতিক্রিয়া। উদাহরণ দেয়া হয়েছে প্রাচীন যুগের নবী রসুলদের। এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে সূরা ১৭ এর ভূমিকাতে।
এই বিশেষ সূরাটিতে হযরত মুসার কাহিনীর মাধ্যমে মুসার সাথে ফেরাউনের বিরোধ এবং ফেরাউনের পরাজয়কে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যান্য যে সব নবীদের উল্লেখ আছে, তারা হলেন ইব্রাহীম, নূহ্, হুদ, সালেহ্ , লূত এবং শুয়েব। এখানে এই শিক্ষাদান করা হয়েছে যে, কোরাণ হচ্ছে পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশেরই ধারাবাহিকতা এবং তা হচ্ছে শাশ্বত সত্য। অবশ্যই তা কোন কবির মিথ্যা গীতিকাব্য নয়।
ক্রমপঞ্জি অনুযায়ী এই সূরা রসুলের [ সা ] মক্কাতে অবস্থানের মধ্যবর্তী সময়ে অবতীর্ণ হয়। যখন নবুয়তের আলো মক্কার কোরেশদের শতাব্দীর অজ্ঞতার অন্ধকার কে আঘাত হেনেছিলো , তখন তা তারা প্রতিহত করে অহংকার , উদ্ধত অবাধ্যতা দ্বারা।
সারসংক্ষেপ : সত্য বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাসের সংঘর্ষ ভিত্তিহীন। ঠিক সেরূপ বৃথা ছিলো মুসার সাথে ফেরাউনের বিরোধিতা। ফেরাউনের সভার যাদুকরেরা মুসার প্রভাবের প্রকৃত সত্যকে প্রতিভাত করে এবং সত্যের নিকট আত্মাসমর্পন করে, অপরপক্ষে অবিশ্বাসী ফেরাউন ও তাঁর সভাসদ্রা পানিতে ডুবে মারা যায় [২৬ : ১ - ৬৯ ]।
সত্যকে প্রতিহত করার মাধ্যমে ইব্রাহীমের সম্প্রদায় কোনও কিছুই লাভ করতে পারে নাই। নূহ্ এর সম্প্রদায় তাদের অবিশ্বাসের দরুণ ধ্বংস হয়ে যায় [ ২৬ : ৭০ - ১২২ ]।
হুদ তাঁর সম্প্রদায়কে জাগতিক বিষয়ের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে সাবধান করেন। সালেহ্ নবী পবিত্র নিদর্শনকে অপবিত্র করার বিরুদ্ধে সাবধান করেন। উভয় ক্ষেত্রেই পাপীরা শাস্তি পায় [ ২৬ : ১২৩ - ১৫৯]
লূত তাঁর সম্প্রদায়কে জঘন্য পাপের বিরুদ্ধে সাবধান করেন, শোয়েব অসৎ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে এবং অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতার বিরুদ্ধে সাবধান করেন। তাদের শিক্ষা গ্রহণ না করে প্রতিহত করে ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যায় [২৬:১৬০- ১৯১ ]।
ঠিক সেভাবেই নবুয়তের আলো যখন মক্কাতে অবতীর্ণ ঘটে, পাপের পূজারীরা তাকে বাঁধা দান করে। কিন্তু সত্য তো কোনও অলীক বা কল্পনা প্রসুত কবিতা নয়, অবশ্যই তা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই [ ২৬ : ১৯২ - ২২৭ ]।
[দয়াময় , পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৩১৩৭। এই তিনটি বর্ণমালা সাংকেতিক সমষ্টি মাত্র যার প্রকৃত অর্থ একমাত্র রাব্বুল আলামীন জানেন।
৩১৩৮। দেখুন আয়াত [ ৫ : ১৫ ]।
৩১৩৯। 'তারা' শব্দটি দ্বারা মক্কার মোশরেকদের বোঝানো হয়েছে। হিজরতের পূর্বে মক্কাতে অবস্থান কালে মক্কার মোশরেকদের সত্যকে প্রতিহত করার প্রবণতা আল্লাহ্র রসুলকে [সা ] হতাশ করে। এই হতাশাকেই এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। কারণ কোনও মহৎ কাজে সফলতা না অর্জিত হলে সাধারণ মানুষের মনে হতাশার সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষের এই প্রবণতা থেকে আল্লাহ্র রসুলও মুক্ত ছিলেন না। রসুলের [ সা ] জীবনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আল্লাহ্ হেদায়েত করেছেন যে , মহৎ কাজে হতাশার স্থান নাই। সাফল্যের দাবীদার একমাত্র সেই মহাপরাক্রমশালী , বিশ্ববিধাতা।
৩১৪০। আল্লাহ্র ইচ্ছাই আল্লাহ্র পরিকল্পনা - এই বিশ্বভূবন ও বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের পরিচালনার। আল্লাহ্ যদি তার পরিকল্পনায় মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দানের ইচ্ছা প্রকাশ না করতেন , তবে বিশ্ব ভূবনে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকতো না। অন্যান্য প্রাণীদের ন্যায় সে শুধু নিজ প্রবণতা [Instinct] যা বিশ্ব বিধাতা তার মাঝে আরোপ করেছেন তা দ্বারাই পরিচালিত হতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা না করে মানুষকে "সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দান করেছেন, আবার সেই "ইচ্ছাশক্তিকে " সঠিক পথে পরিচালনার জন্য যুগে যুগে নবীদের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন, যাতে মানুষ আত্মিক উন্নতির সন্ধান লাভ করে। সুতারাং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্রই ইচ্ছা বা পরিকল্পনার অংশ।
৩১৪১। এই আয়াত গুলির মাধ্যমে রসুলের [ সা ] সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে , কিন্তু এর আবেদন সর্বকাল ও যুগের জন্য প্রযোজ্য। মক্কার অবিশ্বাসী মোশরেকরা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে ঠাট্টা -বিদ্রূপের বিষয়বস্তুতে পরিণত করে। এখানে আল্লাহ্ তাদের সাবধান করে দিয়েছেন যে তাদের কর্মফল তারা পাবে, সত্যের ক্ষমতা অনুধাবনের মাধ্যমে তারা প্রকৃত অবস্থাকে বুঝতে সক্ষম হবে যা তারা প্রতিহত করতে চেয়েছিলো। কোথায় ছিলো তখন মোশরেকরা যখন বদরের যুদ্ধে তাদের পরাজয় ঘটে যখন রক্তপাতহীন ভাবে মক্কা বিজিত হয়? এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ সর্ব যুগের মোমেন বান্দাদের এই আশ্বাস দিয়েছেন যে, প্রতিকূলতা সত্বেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জেহাদ জয় লাভ করবেই। " [খুব ] শীঘ্রই তার সত্যতা সম্বন্ধে জানতে পারবে।"
৩১৪২। এই আয়াতে আল্লাহ্ মোশরেকদের পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্ট পদার্থের দিকে দৃষ্টিপাত করার জন্য আহ্বান করেছেন। আল্লাহ্র সৃষ্টির স্বাক্ষর এই নৈসর্গে ভরা পৃথিবী। কিন্তু এই পৃথিবীর দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে আমরা দেখতে পাই যে, এখানে অন্যায়কারী ও পাপীর কোনও স্থান নাই। ক্ষণস্থায়ী অবকাশকে তারা যেনো তাদের জন্য স্থায়ী না ভাবে। পৃথিবীর ঘটনা পুঞ্জ থেকে তাদের এই নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু তারা তা লাভ করতে অক্ষম কারণ তারা আত্মিক দিক থেকে অন্ধ , চক্ষু থাকতেও তারা সত্যকে দেখতে পাবে না , তাদের আত্মা অন্ধকারে আবৃত, কারণ তাদের মাঝে ঈমান বা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের আলো নাই সুতারাং তাদের অর্ন্তদৃষ্টির [Spiritual insight] অভাব ঘটবে।
৩১৪৩। মহাপরাক্রমশালী - অর্থাৎ তিনি তাঁর সকল ইচ্ছা বা পরিকল্পনা একা কার্যে পরিণত করতে সক্ষম। দেখুন আয়াত [ ২২ : ৪০ ] ও টিকা ২৮১৮।
রুকু - ২
৩১৪৪। মুসার কাহিনীর কিছু অংশ এই সূরাতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কাহিনীতে দেখানো হয়েছে যে, দায়িত্ব প্রাপ্তির পরে মুসা কিভাবে আত্মাবিশ্বাসের অভাববোধ করেছিলেন; কিভাবে আল্লাহ্ তাকে আশ্বস্ত করেন, কিভাবে তিনি আল্লাহ্র নিদর্শনসহ ফেরাউনের নিকট গমন করেন; কিভাবে ফেরাউন ও তার সভাসদরা তা প্রত্যাখান করে; কিভাবে আল্লাহ্র নিন্দা তাদের উপরে ভয়ের কারণরূপে নিপতিত হয়। এ সবের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সত্য শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই। অন্য কথায় দুষ্ট ও পাপীদের সত্যের আলো প্রত্যক্ষে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাকেই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এর সাথে অনুভব করতে হবে ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ্র দূতদের মানসিক অবস্থা।
৩১৪৫। মুসা জন্মগতভাবে তোতলা ছিলেন। স্বাভাবিক ও স্বতঃষ্ফুর্ত ভাবে তিনি কথা বলতে পারতেন না। উপরন্তু তাঁর দায়িত্বটি ছিলো অত্যন্ত বিপদ সংকুল। [দেখুন পরবর্তী টিকা ]। আল্লাহ্র পরিকল্পনা বিচিত্র উপায়ে বাস্তবায়িত হয়। হারুনকে তাঁর সাহাযার্থে নিয়োগ করা হয় এবং মুসার দোষত্রুটি ও অক্ষমতাকে আল্লাহ্ শক্তিতে রূপান্তরিত করে দেন। সুতারাং আল্লাহ্র করুণায় হযরত মুসা ইসরাঈলীদের মধ্যে শক্তিশালী নেতারূপে আর্বিভূত হন।
৩১৪৬। হযরত মুসার প্রতিপালন ও শৈশব সর্ম্পকে উল্লেখ করা হয়েছে আয়াত [ ২০ : ৩৯ - ৪০ ] এবং টিকা ২৫৬৩ এ। তিনি ফেরাউনের প্রাসাদে প্রতিপালিত হতে থাকেন এবং মিশরবাসীদের সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের অধিকারী হন। তিনি যখন পূর্ণ যুবক তখন একদিন দেখলেন যে অন্যায়ভাবে একজন মিশরবাসী একজন ইসরাঈলীকে আঘাত করছে, তিনি মিশরবাসীটিকে আঘাত হানেন ফলে মিশরীয়টি মৃত্যুবরণ করে [ ২৮ : ১৫ ] এই অপরাধের শাস্তির ভয়ে তিনি মিশর ত্যাগ করেন ও সিনাই উপত্যকায় অবস্থিত মাদিয়ানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানেই তিনি আল্লাহ্ কর্তৃক ঐশ্বরিক দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। অপরপক্ষে মিশরে তাঁর বিরুদ্ধে মানুষ হত্যার অভিযোগ ছিলো। এ ছাড়াও হযরত মুসা ছিলেন বদরাগী স্বভাবের। কিন্তু আল্লাহ্র করুণা তার এই রাগী স্বভাবকে দূর করে দেয় এবং তাঁকে আল্লাহ্ জ্ঞানী সম্প্রদায়ের অর্ন্তভুক্ত করেন। তাঁর জিহ্বার জড়তা দূর হয়ে যায় এবং তিনি দৃঢ়ভাবে ফেরাউনের সম্মুখে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তিনি সাহস ও দৃঢ়তার সাথে আল্লাহ্র নিদর্শন দ্বারা মিশরবাসী যাদুকরদের মোকাবেলা করেন। শেষ পর্যন্ত এসব যাদুকরেরা আল্লাহ্র নিদর্শন দর্শনে ভীত হয়ে পড়ে।
৩১৪৭। এখানে ফেরাউন তার কূটবুদ্ধির প্রয়োগ করেছে। যখন মুসা ফেরাউনকে আল্লাহকে "জগহসমূহের প্রতিপালকরূপে " উপস্থাপন করেছিলেন , তখন ফেরাউন মুসাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, " তোমাকে কে প্রতিপালিত করেছিলো ? আমরা কি তোমাকে শৈশবে আমাদিগের মধ্যে লালন পালন করি নাই? " এই বাক্যটি দ্বারা ফেরাউন মুসাকে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছে যে, জগত সমূহের প্রতিপালক নয় ফেরাউনই মুসার প্রতিপালক। প্রকৃত পক্ষে ফেরাউন নিজেকে কৌশলে আল্লাহ্ বলে দাবী করেছিলো এই বক্তব্যের মাধ্যমে।
৩১৪৮। এই সাথে ফেরাউন এ কথাও মুসাকে স্মরণ করিয়ে দিলো যে, তুমি একজন মিশরীয় এর হন্তাকারী এবং এই বলে বিদ্রূপ করলো যে, " তুমি শুধু হত্যাকারী নও ; তুমি অকৃতজ্ঞও বটে। যারা তোমাকে প্রতিপালিত করলো, তাদেরই একজনকে তুমি হত্যা করেছ।"
৩১৪৯। মুসার উত্তর কি ছিলো ? দেখা যায় হযরত মুসা তাঁর কৃতকর্মের জন্য পূর্বে যেরূপ ভীত ছিলেন , এখন আর তাঁর সে ভয় নাই। তিনি প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরলেন , তাঁর অপরাধকে লঘু করার কোনও প্রচেষ্টাই সেখানে ছিলো না। " হ্যাঁ , আমি তা করেছি, কারণ তখন আমি ভ্রান্তির মাঝে ছিলাম।" তাঁর এই উক্তির অর্থ তিন রকম ভাবে করা যায় : ১) আমি রাগের বশে তাড়াহুড়া করে তা করেছি , যা অবশ্যই অন্যায়। ২) আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্যায় করেছি , কিন্তু আমি অনুতপ্ত এবং আল্লাহ্র নিকট ক্ষমাপ্রার্থী [ ২৮ : ১৫ - ১৬ ]। ৩) এ কাজ আমি সেই সময়ে করেছি যখন আমি তোমাদের প্রভাব বলয়ে বাস করতাম। সেই থেকে আমি অনুতাপের মাধ্যমে এক পরিবর্তিত মানুষ। আল্লাহ্ আমাকে ক্ষমা করে ডেকে নিয়েছেন।
৩১৫০। ফেরাউনের উত্তরে মুসা তার গতিবিধির বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন যদিও ফেরাউন তা জিজ্ঞাসা করে নাই। তিনি কিছুই গোপন করেন নাই। সে সময়ে তিনি ছিলেন ভীত সন্ত্রস্ত। ফলে তিনি মিশর থেকে পলায়ন করেন। কিন্তু এখন তিনি আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করে আল্লাহ্র রাসুল নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি এখন বিশ্বপালক মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র সেবক দাস। সুতারাং সাধারণ মানুষ থেকে তার কোনও ভয় নাই। তিনি আল্লাহ্র রাসুল।
উপদেশ : মানুষ যখন বিপদ বিপর্যয়ে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার মাধ্যমে ,বিপদকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তখন তার ভয়ের আর কোনও কারণ থাকে না। কারণ সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ স্বয়ং তার ভার গ্রহণ করেন।
৩১৫১। মিশরবাসীদের নিকট থেকে মুসা শৈশব থেকে যে সব অনুগ্রহ লাভ করেছিলো সে সব স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফেরাউন মুসাকে "অকৃতজ্ঞ বলে র্ভৎসনা করেছিলো। এরই উত্তরে মুসা বললেন যে, " কোন অনুগ্রহ ? যখন তুমি আমার ভ্রাতা ইহুদীদের দাস করে রেখেছিলে ? " এই বাক্যটি থেকে বোঝা যায় যে এখন মুসা যে উত্তর দিচ্ছেন তা তার ব্যক্তিগত কৈফিয়ত নয়। তিনি আল্লাহ্র রাসুল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তার প্রতি যে অনুগ্রহ করা হয়েছিলো তাঁর স্বজাতির উপরে অত্যাচারের ফলে তাঁর আর কোনও মূল্য নাই।
উপদেশ : ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান অপেক্ষা ইসলাম সমষ্টিগত অস্তিত্বে বিশ্বাসী।
৩১৫২। হযরত মুসা ব্যক্তিগত আক্রমণকে প্রতিহত করার পরে এবারে ফেরাউনের যুক্তি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকলো। এবারে সে আল্লাহ্র কর্তৃত্ব ও করুণা সম্পর্কে যুক্তির অবতারণা করলো। মুসা পূর্বে আল্লাহকে "জগতসমূহের প্রতিপালক" রূপে উপস্থাপন করেছিলেন [ ২৬ : ১৬ ]। এই বক্তব্যকে ফেরাউন বিকৃত করে উত্থাপন করেছে এখানে। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বক্ষমতার অধিকারী এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ফেরাউনের পক্ষে ছিলো অসম্ভব। আর এখানেই ছিলো মূল সমস্যা।
৩১৫৩। হযরত মুসার আল্লাহ্র একত্বের উল্লেখে ফেরাউনের ক্রোধকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলো। কারণ মুসার বক্তব্য ছিলো ফেরাউনের দেবত্বের উপরে খড়গাঘাতের তুল্য। উপরন্তু মুসা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে, "যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও " অর্থাৎ বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনও মানুষই বিশ্ব প্রতিপালকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ। মুসার বক্তব্যে ফেরাউন ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধে তার সভাসদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। মুসার বক্তব্য ছিলো আরও স্বচ্ছ ও তীক্ষ্ণ। সারাংশ ছিলো যে, " আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী যা কিছু সবেরই প্রভু আল্লাহ্। সুতারাং সে হিসেবে আল্লাহ্ ফেরাউনের প্রভু , ফেরাউনের সকল পূর্বপুরুষের প্রভু। এক আল্লাহ্ ব্যতীত আর সকলের এই দাবী মিথ্যা ও ভূয়া।"
৩১৫৪। হযরত মুসা যখন ঘোষণা করলেন যে, আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের এবং মিশরবাসী ও তাদের ফেরাউনেরও প্রভু। মুসার এ হেন বক্তব্যে ফেরাউন বিচলিত বোধ করলো। সে বিদ্রূপের ভঙ্গীতে তার সভাষদদের আহ্বান করে বললো যে, "তোমাদিগের রাসুলটি তো নিশ্চয়ই পাগল।" কিন্তু ফেরাউনের এই ব্যঙ্গক্তি মুসাকে অপ্রস্তুত বা লজ্জিত করতে পারে নাই। তিনি সদর্পে সত্যকে ঘোষণা করলেন, " তুমিই পাগল ! আমার ঈশ্বর বিশ্বের বিধাতা। পূর্ব পশ্চিম সকল স্থানেই তিনি বিরাজ করেন। তুমি যেখানে রাজত্ব কর সেখানেও তার অধিষ্ঠান। "
৩১৫৫। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কোনও কিছুই যখন মুসাকে তাঁর সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারলো না তখন সে তার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলো। সে মুসাকে কারারুদ্ধ করার ভয় দেখালো। মুসা কিন্তু শান্ত থেকে যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকলেন। তিনি বললেন যে " স্পষ্ট নিদর্শন প্রদর্শন করলেও কি তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করবে না সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র প্রতি ? তাহলেও কি তোমাদের বিশ্বাস হবে না যে আমি পাগল নই , আল্লাহ্র প্রেরিত বিশেষ দূত ?"
৩১৫৬। হযরত মুসার সময়ে মিশরবাসীরা যাদুবিদ্যায় ভীষণভাবে আসক্ত ছিলো। প্রকৃত পক্ষে যাদু ছিলো মানুষের জন্য দৃষ্টিবিভ্রম ও প্রতারণা। এখানে মুসার আবেদন ছিলো যদি যাদু না হয়ে তা সত্যিকারের অলৌকিক ঘটনা হয়ে থাকে , তবে কি তারা এক আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করবে ? সম্ভবতঃ তারা তাদের যাদুবিদ্যার অন্তঃসার শূন্যতা উপলব্ধি করবে এই ছিলো মুসার বিশ্বাস। অবশ্য বাস্তব ঘটনাও তাই-ই ঘটেছিলো। মিশরের প্রধান প্রধান যাদুকরেরা মুসার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শনে অভিভূত হয়ে পড়েন। কিন্তু ফেরাউন ও তার সভাষদেরা উদ্ধত অহংকারে মুসা ও মুসার প্রচারিত ধর্মকে অস্বীকার করে।
৩১৫৭। দেখুন [ ৭ : ১০৭ - ১০৮ ] সম্পূর্ণ আয়াত ও এর টিকা।
৩১৭৭। হযরত ইব্রাহীমের বক্তব্য ছিলো : যে বস্তু তোমরা পূঁজা কর তা মানব সম্প্রদায়ের শত্রু। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে ঐ বস্তুগুলি আমার শত্রু। ওগুলি আমার কোনও উপকার করার ক্ষমতা রাখে না , কিন্তু আমাকে বিপথে চালিত করার ক্ষমতা রাখে। তুলনা কর সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র ক্ষমতার সাথে তাদের অক্ষমতা। আল্লাহ্ আমাকে এবং সারা বিশ্বজাহানকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমার প্রতিপালক এবং জীবন পথের প্রদর্শক। তিনি আমার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। আমার মৃত্যুর পরে তিনি আমাকে পুনরুত্থান করে নূতন জীবন দান করবেন। তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন এবং আমার আত্মাকে মুক্তি দেবেন। এর পরেও কি তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করবে না ? মূর্তিপূঁজা ও আল্লাহ্র এবাদত কি অন্ধকার আলোর সমতুল্য নয় ?
৩১৭৮। সত্য ও মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করার পরে হযরত ইব্রাহীম তাঁর অন্তরের ইচ্ছাকে ব্যক্ত করেন প্রার্থনার মাধ্যমে। ১) তিনি তাঁর আত্মাকে উদ্ভাসিত করতে চান স্বর্গীয় জ্ঞানে [ ৮৩ ]। ২) তাঁর জীবন ও আত্মাকে সৎ কার্যে পূর্ণ করতে চান, যেনো তিনি পূণ্যাত্মাদের অর্ন্তভুক্ত হতে পারেন [ ৮৩ ]। ৩) তিনি শুধুমাত্র নিজের জন্য বা তাঁর সমসাময়িক সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করেই পরিতৃপ্ত নন। তিনি ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝেও তার সুকৃতি বিস্তার করতে চান [৮৪]। ৪) তাঁর জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে বেহেশতের সুখ ও শান্তি এবং মোমেন বান্দারূপে আল্লাহ্ দরবারে স্বীকৃতি [৮৫]। ৫) তিনি তাঁর পথভ্রষ্ট পিতা ও অন্যান্য পরলোকগত আত্নীয়দের সাথে তাঁর আধ্যাত্মিক সুখ ও শান্তি ভোগ করতে চান। সে জন্য তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। যেনো শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করেন [ ৮৬ ]।
৩১৭৯। দেখুন আয়াত [ ১৯ : ৫০ ]। সূরা মরিয়মে [ ১৯ ] এর হযরত ইব্রাহীম সম্বন্ধে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা তুলনা করুন বর্তমান সূরার আয়াতসমূহের সাথে।
৩১৮০। এই আয়াতের মাধ্যমে হাশরের দিনের প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন ব্যক্তির ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা কোন কিছুই ব্যক্তির উপকারে আসবে না। যা উপকারে আসবে তা হচ্ছে ব্যক্তির পবিত্র হৃদয়। যে হৃদয় শুধুমাত্র আল্লাহ্র প্রেমে সিক্ত পাপের কালিমা মুক্ত। এই পার্থিব জগতের সেই কাজই আল্লাহ্র কাছে শেষ বিচারের দিনে গ্রহণযোগ্য হবে যা শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিলো। সৎ কাজের উদ্দেশ্য যদি খোদা প্রেম না হয় তবে তা হবে মূল্যহীন। পূণ্যাত্মাদের সম্মুখে বেহেশত এবং পাপীদের সম্মুখে দোযখ উম্মুক্ত হবে সেদিন। পাপ তার প্রকৃত স্বরূপে আর্বিভূত হবে। নিঃসঙ্গ , অসহায় হতাশ ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে পাপীরা। শেষ বিচারের দিনে পাপীদের জন্য মুক্তির সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
৩১৮১। যারা পৃথিবীতে পাপকে পরিহার করে পবিত্র জীবন যাপন করেছেন , শেষ বিচারের দিনে তাদের সম্মুখে বেহেশত ভাস্বর হবে, বেহেশতের শান্তি তারা অনুভব করবে আত্মার মাঝে। অপরপক্ষে , পাপীরা তাদের সম্মুখে দোযখের আগুন প্রত্যক্ষ করবে। এই পৃথিবীতেই দেখা যায় যে, পূণ্যাত্মা ও পাপীদের মানসিক অবস্থা উপরের বর্ণনার ন্যায়। এই পৃথিবীতেই পূণ্যাত্মারা তাদের আল্লাহ্র নূরে আলোকিত আত্মার মাঝে বেহেশতি শান্তির পরশ অনুভব করেন। অপরপক্ষে পাপীদের আল্লাহ্র নূর বঞ্চিত অন্ধকারচ্ছন্ন আত্মায় বিরাজ করে অস্থিরতা ,যন্ত্রণা , হতাশা , যা দোযখের আগুনের সমতুল্য।
৩১৮২। পাপী এবং যারা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে, তাদের এবং তাদের উপাস্য , এবং সকল পাপের উৎস শয়তান ও তার পরিষদবর্গকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে।
৩১৮৩। যারা পাপী ও আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলো। তাদের সকলের সম্মুখে তাদের ভুল বা বিভ্রান্তি সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে। তাদের আক্ষেপকেই এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তারা আক্ষেপ করে বলবে যে, " আমরা তো পৃথিবীতে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিলাম। আমাদের এই বিভ্রান্তি পূর্বেই উপলব্ধি করা উচিত ছিলো, কারণ আল্লাহ্র একত্বের নিদর্শন পৃথিবীব্যপী ছড়ানো ছিলো, তার করুণাধারা, অমিয় ধারা বিশ্বচরাচরকে পরিব্যপ্ত করে রেখেছিলো , কিন্তু আমরা তা অনুধাবনে ব্যর্থ হই। হাশরের ময়দানে তাদের এই উপলব্ধি ঘটবে কারণ তাদের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হবে।
৩১৮৪। হাশরের ময়দানে প্রত্যেকে তাঁদের কর্মফলকে প্রত্যক্ষ করবে। তাদের কাজে যারা পথপ্রদর্শক ছিলো, যারা তাদের পাপের পথে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করে প্রভাবিত করেছিলো, তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হবে। সেদিন পাপী এবং পাপকার্যে প্ররোচনাকারী উভয়েই বিচারের সম্মুখীন হবে এবং উভয়কেই শাস্তি দান করা হবে। পাপীদের মনে আক্ষেপের আগুন প্রজ্জ্বলিত হবে এই ভেবে যে, কেন পূর্বেই তারা এসব প্ররোচনাকারীদের স্বরূপ বুঝতে পারে নাই ? যদি পারতো তবে কি তারা এসব দুষ্কৃতিকারীদের অনুসরণ করতো যারা নিজেরাই শাস্তির যোগ্য ? পাপ কাজ এ ভাবেই বিভ্রান্তির দ্বারা প্রকৃত দুষ্কৃতিকারীদের সনাক্ত করতে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। পাপীরা সঠিক পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথ গ্রহণ করে এবং দৃষ্কৃতিকারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। যদিও তদের পুণঃ পুণঃ সর্তক করা হয়েছিলো। এটা ছিলো তাদের জন্য নির্বুদ্ধিতা।
৩১৮৫। পাপীরা সেদিন হাহাকার করবে আর একবার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের এই হাহাকার প্রকৃত পক্ষে আন্তরিক নয়। যদি তাদের সত্যিকারের ভাবে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হতো , তবে তারা অনুতাপের মাধ্যমে সঠিক পথে চলার পরিবর্তে , আবার ভ্রান্ত পথে, পাপ কাজে নিমজ্জিত হতো [ ৬ : ২৭ - ২৮ ]। কারণ পাপী ব্যক্তিরা হচ্ছে মিথ্যাবাদী - আর মিথ্যাবাদী মাত্রই হবে মোনাফেক। মোনাফেক এবং মিথ্যাবাদীরা যা বলে এবং প্রতিজ্ঞা করে তার প্রতি তারা কখনও বিশ্বস্ত নয়। এই অভ্যেস তাদের চরিত্রের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সুতারাং তাদের পক্ষে প্রকৃত বিশ্বস্ততা অর্জন করা সম্ভব নয়। যদি তাদের আর একবার সুযোগ দেয়া হয় , তবে তারা আবারও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবে, কারণ পূর্বেই পৃথিবীতে তাদের পাপের পথ ত্যাগ করে সৎপথে ফিরে আসার জন্য বহু বার সুযোগ আল্লাহ্ দান করেছেন। কিন্তু তারা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে তা অসৎ কাজে ও পাপের পথে ব্যয় করে।
৩১৯৭। এ সব জাগতিক বিষয় বুদ্ধি সম্পন্ন লোক যারা শুধু আড়ম্বর প্রদর্শন ভালোবাসে তাদের বৈশিষ্ট্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা হবে দুর্বলের প্রতি কোনওরূপ দয়ামায়া প্রদর্শনে অপারগ। এরা হয় দুর্বলের প্রতি অত্যাচারী মনোভাব সম্পন্ন।
৩১৯৮। দেখুন টিকা ৩১৮৮।
৩১৯৯। " মুক্ত হস্তে দান করেছেন " বাক্যটির অর্থ, পার্থিব ও অপার্থিব যা কিছু আমাদের জীবনকে সুন্দর করে , সমৃদ্ধ করে, সব কিছুই আল্লাহ্র দান - তাঁর বান্দাদের জন্য। জাগতিক বিষয় বস্তু ও ধন-সম্পদ হচ্ছে পার্থিব দান। আবার জ্ঞান এবং জ্ঞানকে জীবনের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করার ক্ষমতা , যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়, জীবন সুন্দর হয়, সমৃদ্ধ হয়, মার্জিত হয় সে সবই আল্লাহ্র 'দান' তাঁর বান্দাদের জন্য। " আন-আম" অর্থাৎ গৃহপালিত পশু ! পশুর সংখ্যা প্রাচীন কালে পরিগণিত হতো অর্থ-সম্পদের প্রতীক হিসেবে। আবার পুত্র সন্তানকে পরিগণিত করা হতো জনশক্তির প্রতীক হিসেবে। অর্থাৎ 'জনবল' হচ্ছে ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক। 'উদ্যান ও প্রস্রবণ ' হচ্ছে আনন্দ ও পরিতৃপ্ত হওয়ার বিষয় বস্তুর প্রতীক। এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে প্রতীক অর্থে , জীবনের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাকে বোঝানোর জন্য। দেখুন নিচের আয়াত সমূহ।
৩২০০। তোমরা আল্লাহ্র দানসমূহের অপব্যবহার করেছ। সুতারাং তোমাদের অনুচিত বিনিয়োগের শাস্তি তোমরা লাভ করবে। এই আশঙ্কাই এই আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে।
৩২০১। আ'দ সম্প্রদায়ের উদ্ধত অহংকারকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের নবী হুদ কে উদ্দেশ্য করে তারা এই উক্তি করেছিলো।
৩২০২। হুদ নবীর পূর্বেও কিছু ব্যক্তি নবী হওয়ার দাবী করেছিলো। এটা কোনও নূতন উক্তি ছিলো না। তাই কাফেররা বলেছিলো যে ,এ কোন নূতন কথা নয়। ধর্মের শত্রুরা সব সময়েই এ সব কথা বলে থাকে। তারা বলে যে, " তুমি শুধু তো ধর্মের নামে প্রাচীন কালের কুসংস্কারের প্রচলন করতে প্রয়াস পাচ্ছ। কারণ তুমি ধর্মের মাদকতার দ্বারা সকলকে বশীভূত করতে চাও। পরকাল ও পরকালের হিসাব বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নাই। শস্তি প্রাপ্ত বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নাই।"
রুকু - ৮
৩২০৩। সামুদ সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন টিকা ১০৪৩ এবং আয়াত [ ৭ : ৭৩ ]। সামুদ জাতি প্রস্তর ভাস্কর্যের অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছিলো। এ ব্যতীত কৃষিকার্যে সাফল্য তাদের প্রভূত ধন-সম্পদের অধিকারী করে। তাদের সম্পদ ও ব্যবহারিক জ্ঞান তাদের উদ্ধত অহংকারী করে তোলে। তারা নিজেদের বিশেষ মর্যদাপূর্ণ বলে ভাবতে শেখে এবং গরীবদের নির্যাতন করতে তাদের বিবেক নিপীড়িত হতো না। এই আয়াত ও পরর্বতী আয়াত গুলির মাধ্যমে যে উপদেশের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ : " গরীবকে শোষণ ও নির্যাতন করে এবং আল্লাহ্র নিদর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে কতদিন তোমরা তোমাদের সম্পদ ও প্রতিপত্তি ধরে রাখতে পারবে ? " সামুদ জাতির সম্বন্ধে পাথরে উৎকীর্ণ লিপি আছে আল্ হিজর শহরের প্রস্তর খোদিত ভবনসমূহের গাত্রে। এ সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে এই সূরার শেষে পরিশিষ্টে।
৩২০৪। ফলভারে খেজুর বৃক্ষে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর ধরে থাকে। খেজুর গুচ্ছ লম্বা ডাটার অগ্রে ঝুলে থাকে। শষ্য ক্ষেত্র এবং খেজুর বাগানের জন্য সামুদ জাতি অতিশয় গর্বিত ছিলো। কৃষিক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা , ইমারত তৈরীতে তাদের ভাস্কর্যের নৈপূণ্য তাদের অহংকারে স্ফীত করে তোলে। তাদের এই ভাষ্কর্যের বৈশিষ্ট্যের সাথে পরবর্তীতে রোমানদের ভাষ্কর্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
উপদেশ : পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতা মানুষকে উদ্ধত অহংকারী করে তোলে , কারণ তারা স্রষ্টার দানকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়।
৩২০৫। এ সব উদ্ধত অহংকারীদের জন্য উপদেশ ছিলো যে, " তোমাদের দক্ষতা ও নৈপুন্য হতে পারে শ্রেষ্ঠ , কিন্তু এই দক্ষতা ও নৈপুন্যের সাথে সাথে তোমাদের চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করা কর্তব্য। যারা সীমালঙ্ঘনকারী তাদের অনুসরণ করো না। যারা ক্ষমতার ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারী, সম্পদ অর্জনে নীতিজ্ঞানহীন , জীবনযাত্রায় অমিতব্যয়ী , বিলাস -ব্যসন ও আত্ম -তুষ্টিতে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ চাওয়া পাওয়া মনে করে তারাই সীমালংঘনকারী। কারণ তাদের এই জীবন বোধ, বিকৃত মূল্যবোধ, সমাজ জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অন্যায় অবিচারের জন্ম দেয়। কিন্তু এদের জন্যও অনুতাপের দুয়ার খোলা আছে। এর পরেও কি এরা অনুতপ্ত হবে না ?
৩২০৬। সামুদ জাতিরা তাদের নবীকে মনে করেছিলো পাগল, এবং সে জন্যেই তারা উপরের উক্তি করে।
উপদেশ : স্বেচ্ছাচারীতা আত্মার মাঝে অন্ধত্বের জন্ম দেয়। ফলে সত্য ও ন্যায়কে অনুধাবন ক্ষমতা আত্মার মাঝে অনুপস্থিত হয়ে যায়, যেরূপ হয়েছিলো সামুদ জাতির। তারা তাদের নবীর চরিত্রের মহত্তর ও পবিত্র রূপকে অনুধাবনে অক্ষম হয়েছিলো।
৩২০৭। উষ্ট্রী সম্পর্কে দেখুন টিকা ১০৪৪ ও আয়াত [ ৭ : ৭৩ ]। এই উষ্ট্রীটি ছিলো সামুদ জাতির জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। তারা কি উষ্ট্রীটির চারণ ও তৃষ্ণার পানি সম্বন্ধে যত্নবান হবে?
৩২০৮। "অতঃপর তারা অনুতাপে পূর্ণ হলো।" কিন্তু অনুতাপের জন্য এই সময় খুব বেশী দেরী হয়ে গিয়েছিলো। সামুদ জাতিরা নিজেরাই সালেহ্ নবীকে আল্লাহ্র নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য বলেছিলো। ফলে আল্লাহ্ তাদের পরীক্ষা করার জন্য একটি উষ্ট্রী প্রেরণ করেন। উষ্ট্রীটি ছিলো গরীবদের প্রতীক ও প্রতিনিধি স্বরূপ। উষ্ট্রীটিকে চারণভূমিতে চারণের অধিকার ও জলাশয়েরর অধিকারের মাধ্যমে গরীবের অধিকারকে স্বীকৃত দান করা ছিলো স্রষ্টার উদ্দেশ্য। তারা কি এই উষ্ট্রী প্রতীকের মাধ্যমে ধনী ও গরীবের সমতার আইন মেনে চলবে ? যে আইন বিশ্ব স্রষ্টার গড়া। কিন্তু সামুদ জাতি তা অস্বীকার করলো এবং উষ্ট্রীকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্বস্রষ্টার নিদর্শনকে অস্বীকার ও অপবিত্র করলো। ফলে তাদের পাপ তাদের ধ্বংসের পাদ্প্রান্তে নিয়ে গেলো।
উপদেশ : এ ভাবেই প্রত্যেকেই তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে।
রুকু - ৯
৩২০৯। যুগে যুগে সত্য প্রচারকারীরা বিপথগামীদের দ্বারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। লূতের কাহিনীও সেই একই ঘটনার সাক্ষ্য দেয়। লূতের বিশদ কাহিনীর জন্য দেখুন [ ৭ : ৮০ -৮৪ ] আয়াত এবং টিকা ১০৪৯। এই সূরাতে যে প্রসঙ্গের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা হচ্ছে : লূতের সম্প্রদায়ের লোকেরা বাইরে বিকৃত যৌন জীবন যাপন করতো যা ছিলো প্রকৃতির সাধারণ রীতিনীতির বাইরে। প্রকৃতির যে আইন তা হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট তাঁর সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য কৃত আইন। এই আইন বা নিয়ম ভাঙ্গার অধিকার বা ক্ষমতা কারও নাই। যদি কেউ প্রকৃতির আইনকে লঙ্ঘন করে তবে তার ধ্বংস অনিবার্য। নারী ও পুরুষের মিলিত জীবনই হচ্ছে সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য এক বিশেষ প্রাকৃতিক আইন বা কৌশল। লূতের সম্প্রদায় সমকামিতার দ্বারা আল্লাহ্র এই আইনকে লঙ্ঘন করে। তারা লূতের সাবধান বাণীর প্রতি কর্ণপাত করে না। ফলে তাদের পাথর বৃষ্টিদ্বারা পৃথিবী থেকে ধবংস করে দেয়া হয়।
৩২১০। লূতের সম্প্রদায় লূতের সাবধান বাণীতে ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাপীরা এ ভাবেই পাপের মনোমুগ্ধকর রূপে এতটাই আত্মহারা হয়ে পড়ে যে, তাদের পাপের পরিণতি সম্বন্ধে সাবধান করলে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পরিণতিতে লূতের সম্প্রদায় ধবংস হয়ে যায় এবং সাবধানকারীরূপে হযরত লূত রক্ষা পেয়ে যান।
উপদেশ : পৃথিবীতে যারা পাপে, বিশেষভাবে যৌন বিকৃতিতে আনন্দ লাভ করে, তারা খুব কমই আল্লাহ্র রাস্তায় ফিরে আসে। এ কথা সে যুগেও প্রযোজ্য ছিলো , অদ্যাবধি তা প্রযোজ্য আছে।
৩২১১। হযরত লূত তাঁর সম্প্রদায়ের বিকৃত যৌনাচারের পাপকে ঘৃণা করতেন, কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত কর্তব্য বোধই তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়কে সাবধান করার কাজে নিয়োজিত করে। সমগ্র পরিবেশ তার জন্য ছিলো অসহনীয়। যে মুহুর্তে আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দান করেন , তিনি সাথে সাথে তাঁর সম্প্রদায়ের সংশ্রব ত্যাগ করেন। তিনি আল্লাহ্র নিকট তাঁর পরিবারের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্রার্থনা করেন।
উপদেশ : প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিজ কর্মফল ভোগ করবে। পূণ্যাত্মা ব্যক্তির সংস্পর্শে থেকেও কেউ নিজ কর্মফল থেকে অব্যহতি পেতে পারে না। যেমন লূতের পত্নীর বেলায় ঘটেছিলো - তার কর্মফল তাকে তার পাপ মোচনে সাহায্য করে নাই বা তার কর্মফলের শাস্তি থেকে অব্যহতি দান করতে পারে নাই। এই - ই হচ্ছে বিশ্ববিধাতার অমোঘ নিয়ম।
৩২১৩। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৮৪ ] এবং টিকা ১০৫২।
রুকু - ১০
৩২১৪। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ৭৮ ] এবং টিকা ২০০০।
৩২১৫। সুয়েব নবীর জন্য দেখুন আয়াত [ ৭ : ৮৫ ] এবং টিকা ১০৫৪।
৩২১৬। সুয়েব নবীর সম্প্রদায়েরা ছিলো ব্যবসায়িক সম্প্রদায়। কিন্তু তারা তাদের ব্যবসায়ে সৎ ছিলো না। তারা অন্যায় ভাবে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারণা করতো, মাপে কম দিত। প্রতারণা , অন্যায় ও অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে অশান্তি সৃষ্টি করা তাদের ছিলো নৈমিত্তিক ব্যাপার। " মাপে কম দেয়া " বাক্যটি প্রতীকধর্মী। মাপে কম দেয়ার অর্থ - যার যা প্রাপ্য বা অধিকার তাকে ততটুকু না দেয়া, এই প্রাপ্য বস্তু হতে পারে বাণিজ্যিক জিনিষপত্র , অথবা নাগরিক অধিকার। সরকারী অফিসে যখন ধর্না দিয়ে নিজস্ব প্রাপ্য বা অধিকার পাওয়ার জন্য হা পিত্তেশ করতে হয়। অথবা নাগরিক জীবনে বিভিন্ন ক্রিয়াক্রর্মে প্রতিটি পদক্ষেপে সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা যখন বিভিন্নভাবে হয়রানির শীকার হতে হয় - তখনও ব্যক্তি তার প্রাপ্য অধিকার লাভে বঞ্চিত হয়। এক্ষেত্রেও 'মাপে কম দেয়া ' বাক্যটি প্রযোজ্য। অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে কারও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নাম 'মাপে কম দেয়া '। যখনই সমাজে কারও অধিকার না দেয়া হয়, তখনই সমাজ জীবনে অন্যায় ও অবিচার বিরাজ করে। পরবর্তী আয়াতে [ ২৬ : ১৮২ - ১৮৩ ] দেখুন 'মাপে কম দেয়ার ' বিশেষ ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। "সঠিক দাড়িপাল্লা " বাক্যটি শুধুমাত্র ওজনের বাটখাড়া নয়। ওজনের ব্যাপারে যেরূপ বাটখাড়ার ও পাথরের ওজন সঠিক হওয়া প্রয়োজন, ঠিক সেরূপ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ডের "সঠিক দাড়িপাল্লার" প্রয়োজন। "প্রাপ্ত বস্তু কম দিবে না" - এই বাক্যটি দ্বারা শুধুমাত্র জিনিষ পত্রই বোঝানো হয় নাই। এই বাক্যটি প্রতীকধর্মী। একটি সমাজে ও নাগরিক জীবনে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপরে নির্ভরশীল। একটি সমাজে প্রতিটি লোকের থাকে নির্দ্দিষ্ট নাগরিক অধিকার। এই অধিকারকেই 'বস্তু' প্রতীক শব্দটির দ্বারা এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সমাজ জীবনে যখন নাগরিক অধিকার হরণ করা হয় এবং সমাজের নীতিনির্ধারক ও প্রয়োগকারীদের দ্বারা নাগরিক অধিকার যখন স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হয় তখন সমাজ জীবনে " বিপর্যয় ঘটে যায়"। অন্যায় , অবিচার, অসত্য সমাজের মূল কাঠামোকে বিধ্বস্ত করে ফেলে , ঠিক যেভাবে ঘুণ কাঠকে ধ্বংস করে ফেলে। [ যেমন বাংলাদেশে বর্তমানে ঘটেছে ] এসব অন্যায়কারীদের আল্লাহ্কে ভয় করতে বলা হয়েছে এবং আল্লাহ্র বিধান যা ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত তা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তিনিই স্রষ্টা যিনি মানুষের পূর্ববর্তীদেরও সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বিধান হচ্ছে - প্রতারণা ও অন্যায়ের মাধ্যমে কেউ সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। সমৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে সঠিক আদান প্রদান ও সমাজ জীবনে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।
৩২১৭। আয়কাবাসীরা সুয়েব নবীকে অস্বীকার করলো। পাপ তাদের এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো যে, তারা প্রকৃত সত্যকে অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলো। তাদের ধারণা ছিলো তারাই হচ্ছে আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। সুয়েব যা প্রচার করছেন তা ভ্রান্ত। শুধু ভ্রান্ত নয়। সুয়েবের প্রচারিত আদর্শ হচেছ পাগলের প্রলাপ।
উপদেশ : এ ভাবেই সমাজ জীবন যখন অন্যায় ও অসত্যের অন্ধকারে ডুবে যায়, অন্যায়কারীর সত্তা থেকে প্রকৃত ন্যায়বোধ অন্তর্হিত হয়ে পড়ে। অন্যায়ের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে সে প্রকৃত ন্যায়কে বোকামী ও পাগলের প্রলাপ বলে মনে করে।
৩২১৮। যারা আল্লাহ্র বিধান থেকে পদস্খলিত হবে তারা কোনও দিনও তাদের আত্মার মাঝে আল্লাহ্ সান্নিধ্য অনুভব করার ক্ষমতা লাভ করবে না। কারণ তাদের আত্মিক জগত হবে অন্ধকারে নিমজ্জিত - সেখানে আল্লাহ্র নূরের প্রবেশ অধিকার থাকবে না। এ সব ব্যক্তিরাই তখন প্রকৃত ধর্মের অনুসরণ না করে অলৌকিক ঘটনার অনুসন্ধান করে। কারণ স্রষ্টার হাতের পরশ যে তাদের প্রতিদিনের পৃথিবীতে পরিব্যপ্ত তারা তা অনুধাবনে অক্ষম। " আকাশের একখন্ড আমাদের উপরে ফেলে দাও " অর্থাৎ তারা অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের অনুসন্ধান করেছিলো। তাদের বক্তব্য ছিলো সুয়েব নবীর যদি সত্যি আল্লাহ্র সাথে সংযোগ থাকে তবে তিনি অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করতে পারবেন।
মন্তব্যঃ যারা পীর নামধারী ভন্ডদের শরণাপন্ন হয় তাদের মানসিকতা এই শ্রেণীভুক্ত।
৩২১৯। সুয়েব নবীকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করার জন্য যারা একখন্ড আকাশ ফেলে দিয়ে নবীত্বের প্রমাণের জন্য নবীকে প্রতিদ্বন্দীতায় আহ্বান করেছিলো তারা তা করেছিলো নিজেদের মিথ্যা বাহাদুরী প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। তাদের এই অপমানজনক উক্তির প্রতুত্তরে সুয়েব নবী কোনওরূপ উষ্মা প্রকাশ করেন নাই। তাঁর উত্তর ছিলো, " তোমাদের কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে আল্লাহ্ সম্যক অবগত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। এর বেশী আমি আর কি বলতে পারি ? " শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দান করেন।
৩২২০। "অন্ধকারচ্ছন্ন দিবসের শাস্তি " - বর্ণনাটি সম্ভবতঃ ছিলো অগ্নুৎপাতের বর্ণনা। সমস্ত আকাশ ছাই ও অঙ্গার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে সূর্যকে ঢেকে দেয়। ফলে সূর্যের আলোবিহীন দিনকে মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার দিন বলে ভ্রম হতে থাকে। যদি আয়কাবাসী ও মাদইয়ান সম্প্রদায় একই হয়ে থাকে তবে ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের সাথে প্রচন্ড ভূমিকম্পও সংঘটিত হয়। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৯১ ] এবং টিকা ১০৬৩।
৩২২১। "ভীষন দিবসের শাস্তি " - এই লাইনটির মাধ্যমে দিনটির ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ফুটন্ত লাভার স্রোত মাটিকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে , সূর্য আড়াল হয়ে গেছে ছাই ও অংগারে , প্রচন্ড নিনাদে মাটি থর থর করে কাঁপছে সে এক মহা দুর্যোগের দিন। যারা সেখানের অধিবাসী ছিলো, তারা মৃত্যুর পূর্বে প্রকৃতির এই রুদ্ররোষে ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে যায়।
৩২২২। দেখুন আয়াত [ ২৬ : ১২১ - ১২২] এবং টিকা ৩১৯৩।
রুকু - ১১
৩২২৩। যুগে যুগে আল্লাহ্র নবীদের প্রতিরোধ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমাদের মহানবী হযরত মুহম্মদ [ সা ] ও এরূপ নির্যাতন ও প্রতিরোধ থেকে রেহাই পান নাই। এই আয়াতে এরই প্রেক্ষাপটে কোরাণের বৈশিষ্ট্য সমূহকে তুলে ধরা হয়েছে : ১) কোরাণ সত্যসহ অবতীর্ণ এবং ২) মক্কার মোশরেকদের কোরাণের শিক্ষাকে প্রত্যাখান করার ইতিহাস পূর্ববর্তী নবী রসুলদের শিক্ষাকে প্রত্যাখান ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যুগে যুগে নবী রসুলদের শিক্ষাকে প্রত্যাখনের কারণ সব যুগেই এক আর তা হচ্ছে প্রতিরোধকারীদের কায়েমী স্বার্থোন্বেষীদের স্বার্থে আঘাত হানে। সুতারাং তারা সত্যকে প্রতিরোধ করে। কিন্তু সত্য সব সময়েই অপ্রতিরোধ্য।
৩২২৪। "Ruh-ul-amin" এই উপাধিটি জিব্রাইল ফেরেশতা সম্বন্ধে প্রযোজ্য তবে এই শব্দটির সঠিক এবং উপযুক্ত অনুবাদ একটি মাত্র শব্দে করা অসম্ভব। আয়াত [ ২৬ : ১০৭ ] এবং টিকা ৩১৮৭ এ 'Amin' শব্দটির বিভিন্ন রূপকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 'Amin' শব্দটি নবী করিম হযরত মুহম্মদের [ সা] উপাধির সাথে সংযুক্ত ছিলো। জিব্রাইল ফেরেশতাকে ধরা হয় আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ বহনকারী দূত হিসেবে। প্রকৃত বিশ্বাস ও সত্যের প্রতিভূ এখানে জিব্রাইলের স্বরূপ অপরপক্ষে বিভ্রান্তি ও প্রতারণা হচ্ছে মিথ্যার প্রতিভূ এবং স্বরূপ। মওলানা ইউসুফ আলী মনে করেন " ঈমান ও সত্যের প্রতিভূ " হওয়া উচিত "Ruh-ul-amin" শব্দটির অনুবাদ যা হবে জিব্রাইলের উপাধি।
৩২২৫। 'Qalb' [ হৃদয় ] সাধারণত হৃদয় শব্দটি দ্বারা ভালোবাসার উৎপত্তিস্থলকে বোঝানো হয়ে থাকে। এখানে হৃদয় শব্দটি দ্বারা স্মরণশক্তি ও অনুধাবন ক্ষমতার উৎপত্তিস্থলকেও বোঝানো হয়েছে। প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া হচ্ছে : আল্লাহ্র বাণী প্রথমে নবীর হৃদয়, মন, স্মরণশক্তি ও অনুধাবন ক্ষমতাতে স্বর্গীয় প্রভাবে অনুপ্রাণীত করে। তারপরে সেই বাণী মানুষের ভাষাতে পৃথিবীর বুকে প্রচারিত হয়। এ ক্ষেত্রে আরবীকে মানুষের ভাষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ নবী হযরত মুহম্মদ [সা ] যাদের মাঝে জন্মগ্রহণ করেন তারা ছিলেন আরবী ভাষা-ভাষী এবং তারা যাতে আল্লাহ্র বাণীকে বুঝতে পারে ও অনুধাবন করতে পারে এবং পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে সে বাণী প্রচার লাভ করে, সে কারণেই আল্লাহ্র বাণীর প্রথমে আরবীতে প্রকাশ ঘটে। ভাষা হিসেবে আরবীতে কোনও বিশেষ মাহাত্ম্য এখানে নাই। পরের আয়াতে আজামী শব্দটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে আরবী ভাষায় যারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না।
৩২২৬। 'Zubur' শব্দটি যা এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তা 'Zabur' শব্দটির বহুবচন। কোরাণে 'Zubur' শব্দটির উল্লেখ আছে দাউদ নবীর কাছে আল্লাহ্র প্রেরিত ধর্মগ্রন্থ হিসেবে। এখানে শব্দটির ব্যবহার হয়েছে পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশসমূহের জন্য।
৩২২৭। আব্দুল্লাহ্ -ইবন্ - সালাম এবং মুখাইরিকের মত খৃষ্টান পন্ডিত ও সাধুগণ রসুলকে [ সা ] সনাক্ত করতে পেরেছিলেন আল্লাহ্র প্রেরিত দূত হিসেবে। যার ফলে শেষোক্ত ব্যক্তি ইসলামের খেদমতের জন্য তাঁর প্রভূত ধন-সম্পদ দান করে যান।
৩২২৮। পূর্বেই ভবিষ্যত বাণী করা হয়েছিলো যে, আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ গ্রহণের অধিকার আরবেরাও একদিন লাভ করবে পর্যায়ক্রমে। সেক্ষেত্রে এ কথা স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয়া যায় যে, তা আরবী ভাষাতে এবং একজন আরবের মুখ থেকে প্রচারিত হবে। তা না হলে প্রচারিত আল্লাহ্র বাণী যদি একজন অ-আরবীর মুখ থেকে প্রচারিত হতো, তবে তার আবেদন আরবদের কাছে যথাযথ হতো না। ফলে আরব বাসীরা ঈমান আনতো না এবং পরবর্তীতে আরবী ভাষা ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো না।
উপদেশ : এই আয়াত থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, কোরাণ পাঠের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপনের মাধ্যমে ঈমানের ভিত্তিকে মজবুত করা।
৩২২৯। 'এই ভাবে ' শব্দটি দ্বারা যে ভাব প্রকাশ করা হয়েছে তা হচ্ছে : " আরবী ভাষার মাধ্যমে এবং আরব সম্প্রদায়ের দ্বারা।" কোরাণ অবতীর্ণ হয় আরবে আরবী ভাষী লোকদের মাঝে। তাদের বোধগম্যতার জন্যই তা আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ হয় , যেনো কোরাণের মর্মবাণী তাদের হৃদয়ে খুব সহজেই অনুপ্রবেশ ঘটে এবং হৃদয়কে গভীরভাবে অভিভূত করে। কোরাণকে আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ করার মূল উদ্দেশ্য এখানেই নিহিত।
মাতৃভাষাতে কোরাণের বাণীর মূল সৌন্দর্য্য , নৈতিক উপদেশ, ধ্বনির মাধুর্য্য ইত্যাদি উপলব্ধি আরবদের হৃদয়ে , যত সহজে ঐ বাণীর মর্মবাণী হৃদয়ে প্রবেশ লাভ করে; আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের এত বড় উপায় মাতৃভাষাতে ব্যতীত সম্ভব নয়। আরবী ব্যতীত অন্য ভাষাতে কোরাণ যদি আরবে অবতীর্ণ হতো, তবে না বুঝে কোরাণ পাঠের ফলে হৃদয়ে আল্লাহ্র বাণীর যে আবেদন তা নিষ্ফল হতো। মাতৃভাষার মাধ্যমে আবেদন বা উপদেশ হৃদয়ের অভ্যন্তরে স্থিতিলাভ করে। এর পরেও কোনও কঠিন হৃদয়ে যদি এই বাণীর আবেদন না পৌঁছে তবে সে কঠিন হৃদয়ের জন্য শাস্তি অবধারিত , কত দুঃখজনক সে পরিণতি। পরবর্তী আয়াত দেখুন।
৩২৩০। পাপীরা আল্লাহ্র হেদায়েতের প্রতি অবহেলার দরুণ অনুতাপ থেকে বিরত থাকে, প্রকৃত শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পূর্বে তারা বুঝতে অক্ষম তাদের পাপের পরিমাণ। আবার অনেক পাপী আছে যারা আল্লাহ্কে প্রতিদ্বন্দীতায় আহ্বান পূর্বক ঘোষণা করে যে শেষ বিচারের দিন নাই , সুতারাং যদি থাকে তবে তা যত শীঘ্র সম্ভব উপস্থিত করা হোক। তারা এতবড় কথা বলার সাহস রাখে কারণ তারা আল্লাহ্র এবং আল্লাহ্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়। তাদের প্রতীদ্বন্দীতার উত্তর হচ্ছে " ইহা শীঘ্রই আসবে , তখন তাদের মনে হবে যে ইহা অতি শীঘ্র ঘটেছে।"
৩২৩১। পাপীদের অনুতাপ করার জন্য আল্লাহ্ প্রচুর সময় ও সুযোগ দিয়ে থাকেন। কারণ আল্লাহ্ পরম করুণাময় ও অসীম দয়াময়। পাপীদের আল্লাহ্ পাপের সাথে সাথে শাস্তি দান করেন না। আল্লাহ্ প্রদত্ত এই অবকাশকে পাপীরা সদ্ব্যবহার করতে অক্ষম - কারণ তারা জাগতিক বিষয় বস্তুতে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকে। জাগতিক ক্ষমতা , লোভ-মোহ, আত্মগরিমা-অহংকার তাদের পার্থিব জগতের বাইরে অতীন্দ্রীয় জগতের অনুধাবনের বাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে তারা বারে বারে আল্লাহ্র আদেশকে অমান্য করে আল্লাহ্র সাবধান বাণীকে উপেক্ষা করে। তবুও আল্লাহ্ পরম করুণাময় -তাদের বারে বারে নবী রসুলদের দ্বারা সাবধান করেন চূড়ান্ত শাস্তি দানের পূর্বে। এই চূড়ান্ত শাস্তি তাদের-ই কর্মফল। এই হচ্ছে ন্যায় ও সত্য। মানুষকে চূড়ান্ত শাস্তিদানের পূর্বে বারে বারে সাবধান করা হয় কারণ দয়াময় আল্লাহ্ জানেন যে মানুষ দুর্বল চরিত্র। আল্লাহ্ ন্যায়বিচারক। সুতারাং মানুষের এই চারিত্রিক দুর্বলতাও মহাপ্রভু দয়াময় তার বিচারের অধীনে ন্যস্ত করেন।
৩২৩২। মানুষের সাধারণ ধর্ম হচ্ছে : তারা যে কোন অলৌকিক কার্যকলাপকে যাদু বা শয়তানের কাজ বলে পরিগণিত করতে চায়। হযরত মুসা থেকে কোনও নবী রসুলই এই অপবাদ থেকে রেহাই পান নাই। তাই রসুলের [ সা ] নিকট যখন কোরাণ অবতীর্ণ হলো - কোরানের বাণীর মাধুর্য, সৌন্দর্য্য ,গুঢ় মর্মার্থ , নৈতিক উপদেশাবলী , অবিশ্বাসীদের বিভ্রান্ত করে দিলো। সুতারাং রসুলের [সা ] শত্রুরা কোরাণকে অশুভ শক্তির বাহন মনে করতে থাকে। মানবাত্মার মহৎ ও চূড়ান্ত বিকাশের এত বড় দলিল কখনও শয়তানের উদ্দেশ্য হতে পারে না। শয়তান ও তাঁর সাগরেদদের কখনও ক্ষমতা হবে না এরূপ একটি গ্রন্থ রচনার - যা মানুষের আত্মিক বিকাশকে করে সমৃদ্ধশালী, পৃথিবীর জীবনযাত্রাকে করে সফলকাম। ভালো ও মন্দ কখনও এক হতে পারে না , যেমন আলো ও অন্ধকার এক হতে পারে না। ভালো ও মন্দের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। মন্দ কখনও ভালোকে সহ্য করতে পারবে না , এমনকি সদুপদেশ বা দয়া বা ক্ষমা ইত্যাদিও তার নিকট হাস্যকর ও অসত্য রূপে বিবেচিত হবে।
৩২৩৩। "পক্ষপুটকে নামিয়ে দাও " - অর্থাৎ দয়ালু, ভদ্র এবং সহানুভূতিশীল হও, ঠিক সেরূপ ভাবে , যেরূপভাবে উড়ন্ত পাখী নীড়ে ফেরার প্রাক্কালে তার শাবককূলকে পাখা দ্বারা ঢেকে দেয়। দেখুন আয়াত [১৭ : ২৪ ] ও টিকা ২২০৫ এবং [১৫: ৮৮ ]ও টিকা ২০১১।
৩২৩৪। "তারা অবিশ্বাস করে " বাক্যটি দ্বারা এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে, অবিশ্বাসী কাফেররা এমন কিছু করেছিলো রসুলের [ সা ] প্রতি যা অবাধ্যতার সামিল। ঘটনাটি ছিলো : রসুল [ সা ] তাদের ন্যায়ের পথে সত্যের পতে চলতে আদেশ দিতেন এবং অন্যায় ও পাপকে পরিহার করতে বলতেন , যা তাদের জন্য ছিলো অরুচীকর। রসুলের [ সা ] প্রচার ও প্রচেষ্টা সত্বেও যদি কেউ অন্যায় ও পাপকে পরিহার না করে। তবে সে দায়িত্ব রসুলের [সা] নয়। কারণ ভালো ও দায়িত্ববান মেষপালকেরা যেমন তার মেষের পালকে সঠিক রাস্তায় রাখতে চেষ্টা করে ও তার মেষ সমূহের রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান হয় রসুলও [ সা ] ঠিক সেরূপে তাঁর অনুসারীদের প্রতি সমভাবে যত্নশীল ও দায়িত্ব বান। এরপরেও কেউ তাঁকে অস্বীকার করলে বা অবাধ্যতা করলে সে দায়িত্ব তাঁর নয়। তিনি এর পরে কি করতে পারেন ? তিনি তাঁর প্রতি আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করবেন , মানুষকে হেদায়েত করবেন। কিন্তু কেউ যদি অস্বীকার করে, অবাধ্যতা করে তাদের মহান শিক্ষককে , নেতাকে , পথ প্রদর্শককে ,তবে সে জন্য রসুল কে [ সা ] দায়ী করা হবে না। তাঁর বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা শুধুমাত্র এক আল্লাহ্র উপরে। আল্লাহ্ সকলের কৃত কর্মের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং তিনি প্রত্যেকের কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন করেন।
উপদেশ : প্রত্যেকেই নিজ নিজ কৃত কর্মের জন্য দায়ী। কারও পাপের ভার অন্য কেউ গ্রহণ করবে না।
৩২৩৫। মূসলমানদের এবাদতের ধারাকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষের অন্তরের প্রতিটি চিন্তাধারা আল্লাহ্র নিকট প্রকাশ্য। এবাদতের প্রতি আগ্রহ, আন্তরিকতা এবং ভক্তির ব্যাপারে রসুল [ সা ] ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, আবার তাঁর অনুসারীদের জন্যও তিনি ছিলেন সমভাবে দায়িত্ববান। রসুলের [ সা ] চরিত্রের এই উজ্জ্বল দিকটি এই আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি বাঁকে, সম্পদে প্রতিপত্তিতে, দুঃখে -বিপর্যয়ে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতায়, এবাদতের আন্তরিকতায়, মুসলমানদের জীবনের দিশারী হচ্ছেন আল্লাহ্র রসুল আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তফা [ সা ]। নির্বোধ ও অবিশ্বাসীরা তাঁর চরিত্রের যে খুঁতই ধরুক না কেন, রসুলের চরিত্রের পবিত্রতা , সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্বন্ধে সর্বশক্তিমান সবিশেষ অবগত।
উপদেশ : মুসলমানদের চলার পথের সকল হিসাব সর্বশক্তিমানের কাছে রক্ষিত থাকে। মুসলমান সর্বঅবস্থায় আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল হবে। রসুলের [ সা ] জীবনের মাধ্যমে এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে।
৩২৩৬। এই আয়াতটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে রসুলের [ সা ] জীবনের প্রেক্ষিতে , যার একটি সাধারণ অর্থও বিদ্যমান যা সকল যুগের জন্য প্রযোজ্য। ইসলাম প্রচারের সময়ে অবিশ্বাসীরা বিদ্বেষবশে রসুলের চরিত্রে কালিমা লেপনের প্রয়াস পেতো। তারা বলতো রসুল [সা] যাদুগ্রস্থ ও অশুভ শক্তিদ্বারা প্রভাবিত [ দেখুন ২৬ : ২১০ আয়াত ]। এ কথার উত্তর অবশ্য পূর্বেই দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এসব অপপ্রচারের উৎসের প্রতি। বলা হয়েছে এসব মিথ্যা অপপ্রচারের মূল উৎস হচ্ছে শয়তানের প্ররোচনা। এসব মিথ্যা অপপ্রচারের পিছনে থাকে শয়তানী , অর্ধসত্য, এবং বিকৃত অপপ্রচার যেনো সাধারণ লোক আল্লাহ্র প্রকৃত রূপকে অনুধাবন করতে না পারে। অর্থাৎ প্রতিটি মিথ্যা অপপ্রচারের মূল হচ্ছে শয়তানের কাজ। এ কথাকেই নবীর জীবনের উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের জন্য সর্বকাল ও সর্বযুগের জন্য চিরস্থায়ী হেদায়েত করা হয়েছে। মিথ্যা হচ্ছে সকল পাপের উৎস। তাই মিথ্যাকে এই আয়াতে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ মিথ্যার সাথে জড়িত থাকে দুর্নীতি ; যা শয়তানের প্রকৃতি। অপরপক্ষে , সত্যের সাথে জড়িত হচ্ছে সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইত্যাদি।
উপদেশ : জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিথ্যাকে পরিহার করতে হবে।
৩২৩৭। এই আয়াতটি নীচের [ ২৬ : ২২৭ ] আয়াতটির সাথে এক সাথে পাঠ করলে যে বক্তব্য দাঁড়ায় তা হচ্ছে কবিদের অনুসরণ করো না , তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে। কবিতা এখানে প্রতীক স্বরূপ যা অন্যান্য শিল্পবিদ্যা ও কারুশিল্প যেমন সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। নিজেদের বৈশিষ্ট্যে এ সব শিল্প কলা নিজেরা ভাস্বর। যদি মানুষ ইচ্ছা করে তবে, এ সব শিল্প কলাকে আল্লাহ্র রাস্তায় মানুষের কল্যাণে , জীবনের মানোন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বভাববতঃ কারণে মানুষ অনেক সময়েই অনর্থক ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে শিল্প কলাকে ব্যবহার করে থাকে। উল্লেখিত আয়াতের প্রথমাংশ থেকে কাব্যচর্চ্চার কঠোর নিন্দা ও তা আল্লাহ্ কাছে অপছন্দনীয় হওয়া বোঝা যায়। কিন্তু শেষাংশে যে ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হয়েছে , তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কাব্যচর্চ্চা ও শিল্পকলার চর্চ্চা সর্বাবস্থায় মন্দ নয়। বরং যে কবিতায় বা গানে বা শিল্পকলায় আল্লাহ্ তায়ালার অবাধ্যতা করা হয় কিংবা আল্লাহ্র স্মরণ থেকে বিরত রাখা হয় অথবা অন্যায় ভাবে কোনও ব্যক্তির নিন্দা ও অবমাননা করা হয় বা যা অশ্লীল ও অশ্লীলতার প্রেরণাদাতা সেই কবিতা বা গান বা শিল্পকলা নিন্দনীয় ও আল্লাহ্র কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে যেসব কবিতা, গান, শিল্প কলা গোনাহ্ ও অপছন্দনীয় বিষয়াদি থেকে পবিত্র , সেগুলিকে আল্লাহ্ তায়ালা আয়াতের মাধ্যমে ব্যতিক্রম ভুক্ত করে দিয়েছেন। মানুষের আত্মার মাঝে যে শিল্প সত্তা তা সেই মহাপরাক্রমশালী মহাপ্রভুর দান। সঙ্গীত , শিল্প, কাব্য সেই মহাসত্তার শিল্প নিদর্শনের প্রকাশ মাত্র। যখন এই প্রকাশের ভাষাকে বিকৃত করা হয় তখন তা হয়ে পড়ে শয়তানের প্রতিভূ। যেমন গান - আল্লাহ্ প্রেমে নিমগ্ন গান শ্রোতার চক্ষুকে অশ্রুতে ভরিয়ে দেয়, আত্মাকে আল্লাহ্ প্রেমে করে উদ্বেলিত। অপরপক্ষে যৌন আবেদন মূলক গান পাপের দিকে করে আকৃষ্ট। এ ভাবেই শিল্প , সঙ্গীত ও কাব্যের প্রয়োগের মাধ্যমে কখনও তা হয় আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের বাহন , আবার কখনও তা হয় শয়তানের প্রতিভূ। যখন এসব শিল্প কলা জীবনের মহত্তর ও বৃহত্তর উদ্দেশ্যকে ভুলে ক্ষণস্থায়ী সুখের পিছনে ছুটে বেড়ায় তখন তা শয়তানের প্রচারমন্ত্রে পরিণত হয়। যে জ্ঞান ও শাস্ত্র আল্লাহ্ ও পরকালকে ভুলিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তি সুখ কেন্দ্রিক মানুষে পরিণত করে তা আল্লাহ্র চোখে নিন্দনীয়। জ্ঞান ও শাস্ত্রের প্রয়োগ হবে মানব জীবনকে বৃহত্তর ও মহত্তর উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালনার জন্য। যদি তা না হয়ে উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় [ প্রত্যেক উপত্যকায় ] ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ক্ষুদ্র , ক্ষুদ্র সুখের পিছনে ঘুরে বেড়ায় তবে সে জ্ঞান বা শিল্প চর্চ্চা বৃথা। শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ঐশ্বরিক আলোর সন্ধান , এবং তার প্রতি আত্মনিবেদন। এর থেকে উৎসারিত সে উদ্দেশ্য থেকে শিল্প সত্তা হয়ে পড়ে যখন বিচ্যুত, ফলে সেই শিল্প সৃষ্টির মান হয়ে পড়ে ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডিতে আবদ্ধ। বৃহত্তর মুক্তির স্বাদ সে শিল্প সত্তা কখনও অনুধাবন করতে সক্ষম হবে না।
৩২৩৮। কাব্য এবং চারু কারুকলা কখনও নিন্দনীয় বিষয় বস্তু নয়। এ কথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, মানুষের জীবনের যে কোন প্রতিভা ; জ্ঞান , শিল্পকলা, কাব্য প্রতিভা, সঙ্গীত প্রতিভা নেতৃত্বের ক্ষমতা সব কিছুই সেই মহাপরাক্রমশালী মহাপ্রভুর দান। সুতারাং এসব প্রতিভা কখনও নিন্দনীয় হতে পারে না। নিন্দনীয় হচ্ছে যখন এসব প্রতিভাশালী মন খোদাদ্রোহীতা দ্বারা উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে ওঠে এবং তাদের প্রতিভাকে আল্লাহ্র বিমুখতার প্রতি নিয়োগ করে। ফলে তাদের প্রতিভা জীবনের সুক্ষ শিল্প কলাকে প্রকাশের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তা হয়ে ওঠে আত্ম গৌরব ও আত্ম প্রশংসার মাধ্যম মাত্র। যে শিল্প-কলা স্রষ্টার মাহাত্ম্যকে প্রকাশে অক্ষম হয়, তা কখনও কালজয়ী বা যুগকাল অতিক্রান্ত শিল্প, সঙ্গীত, বা কাব্য প্রতিভা হতে পারে না। কারণ সকল শিল্প ও কলার কেন্দ্র বিন্দু সেই বিশ্বস্রষ্টা। সে কারণেই প্রকৃত শিল্পী কখনও আক্রান্ত না হলে [ যেমন জিহাদ ] আক্রমণ করে না, অবশ্য তারা সব সময়েই মন্দের প্রতিরোধে হয় সুদৃঢ়। সে ভাবে বলা চলে একজন প্রকৃত শিল্পী হচ্ছেন একজন প্রকৃত ও শ্রেষ্ঠ মানব। মানুষের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী গুণে ,গরিমায়, এই পৃথিবীতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু নিষ্কলঙ্ক বিশুদ্ধ চরিত্রের শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে পৃথিবীতে নিজেকে গড়ে তোলা এক অসম্ভব কাজ। কিন্তু এ ধূলার ধরণীতে প্রতিটি মানুষের লক্ষ্য হবে একটাই - আর তা হচ্ছে চরিত্রগত গুণে আল্লাহ্র চোখে নিজেকে বিশুদ্ধ ও নিষ্কলঙ্ক প্রমাণ করা। বিশেষতঃ যাদের আল্লাহ্ শিল্প ও কাব্য প্রতিভা দ্বারা ধন্য করেছেন। এ কথা সত্য যে, বৈশিষ্ট্য বা কলাকৌশলের জন্য কেউ কালোত্তীর্ন শিল্প সৃষ্টি করতে পারে না। কালোত্তীর্ণ শিল্প তখনই সৃষ্টি হয় যখন তা বিশ্ব ভূবনের মূল আত্মার যে বিকাশ বা প্রকাশ তা সঠিকভাবে উত্থাপন করতে পারে। এই বিশাল বিশ্বভূবনের মাঝে স্রষ্টা তাঁর জ্ঞান , শিল্প সত্তাকে বিকশিত করেছেন। এই সত্তাকে অনুধাবনের মাধ্যমে যে তা প্রকাশ করতে পারে সেই হতে পার কালোত্তীর্ণ ও ক্ষণজন্মা শিল্পী। অন্যথায় তা হবে সঙ্কীর্ণতায় পর্যবসিত। দুটোর তুলনা হচ্ছে অসীম সমুদ্রের বিশাল বারিধারা যা মনকে বিশালতায় ভরিয়ে তোলে। অপরটি হচ্ছে ছোট ডোবা যার আবদ্ধ পানি শুধু দুগর্ন্ধ ছড়ায়। বিশালতার যে পূঁজারী সেই তো পার্থিব পঙ্কিলতাময় পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবীর উর্দ্ধে উঠতে সক্ষম। এখানেই শিল্পীর বৈশিষ্ট্য এবং এখানেই শিল্প সত্তার সার্থকতা। রসুলের [ সা ] সময়ে যে সব স্বনামধন্য কবি ছিলেন তাদের মধ্যে কবি হাসান ও কবি লাবিদের কবিতা সর্বোচ্চ সাতটি কবিতার মধ্যে র্নিবাচিত কবিতা হতো যা কাবা ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো হতো সেই ইসলাম পূর্ব অন্ধকার যুগে।
৩২৩৯। বিপক্ষের সমালোচনার উত্তর কবিতার মাধ্যমে প্রদান করে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
সূরা শু'য়ারা
সূরা শু'য়ারা বা কবি - ২৬
২২৭ আয়াত, ১১ রুকু, মক্কী[দয়াময় , পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : পরবর্তী চারটি সূরা [ ২৬ - ২৯ ] এক নূতন ক্রমপঞ্জির অবতারণা করেছে। এখানে তুলনা করা হয়েছে আল্লাহ্র নবীদের সাথে। আল্লাহ্র বাণী প্রচারের ফলে সমসাময়িক সম্প্রদায়ের মাঝে তার প্রতিক্রিয়া। উদাহরণ দেয়া হয়েছে প্রাচীন যুগের নবী রসুলদের। এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে সূরা ১৭ এর ভূমিকাতে।
এই বিশেষ সূরাটিতে হযরত মুসার কাহিনীর মাধ্যমে মুসার সাথে ফেরাউনের বিরোধ এবং ফেরাউনের পরাজয়কে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যান্য যে সব নবীদের উল্লেখ আছে, তারা হলেন ইব্রাহীম, নূহ্, হুদ, সালেহ্ , লূত এবং শুয়েব। এখানে এই শিক্ষাদান করা হয়েছে যে, কোরাণ হচ্ছে পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশেরই ধারাবাহিকতা এবং তা হচ্ছে শাশ্বত সত্য। অবশ্যই তা কোন কবির মিথ্যা গীতিকাব্য নয়।
ক্রমপঞ্জি অনুযায়ী এই সূরা রসুলের [ সা ] মক্কাতে অবস্থানের মধ্যবর্তী সময়ে অবতীর্ণ হয়। যখন নবুয়তের আলো মক্কার কোরেশদের শতাব্দীর অজ্ঞতার অন্ধকার কে আঘাত হেনেছিলো , তখন তা তারা প্রতিহত করে অহংকার , উদ্ধত অবাধ্যতা দ্বারা।
সারসংক্ষেপ : সত্য বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাসের সংঘর্ষ ভিত্তিহীন। ঠিক সেরূপ বৃথা ছিলো মুসার সাথে ফেরাউনের বিরোধিতা। ফেরাউনের সভার যাদুকরেরা মুসার প্রভাবের প্রকৃত সত্যকে প্রতিভাত করে এবং সত্যের নিকট আত্মাসমর্পন করে, অপরপক্ষে অবিশ্বাসী ফেরাউন ও তাঁর সভাসদ্রা পানিতে ডুবে মারা যায় [২৬ : ১ - ৬৯ ]।
সত্যকে প্রতিহত করার মাধ্যমে ইব্রাহীমের সম্প্রদায় কোনও কিছুই লাভ করতে পারে নাই। নূহ্ এর সম্প্রদায় তাদের অবিশ্বাসের দরুণ ধ্বংস হয়ে যায় [ ২৬ : ৭০ - ১২২ ]।
হুদ তাঁর সম্প্রদায়কে জাগতিক বিষয়ের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে সাবধান করেন। সালেহ্ নবী পবিত্র নিদর্শনকে অপবিত্র করার বিরুদ্ধে সাবধান করেন। উভয় ক্ষেত্রেই পাপীরা শাস্তি পায় [ ২৬ : ১২৩ - ১৫৯]
লূত তাঁর সম্প্রদায়কে জঘন্য পাপের বিরুদ্ধে সাবধান করেন, শোয়েব অসৎ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে এবং অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতার বিরুদ্ধে সাবধান করেন। তাদের শিক্ষা গ্রহণ না করে প্রতিহত করে ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যায় [২৬:১৬০- ১৯১ ]।
ঠিক সেভাবেই নবুয়তের আলো যখন মক্কাতে অবতীর্ণ ঘটে, পাপের পূজারীরা তাকে বাঁধা দান করে। কিন্তু সত্য তো কোনও অলীক বা কল্পনা প্রসুত কবিতা নয়, অবশ্যই তা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই [ ২৬ : ১৯২ - ২২৭ ]।
সূরা শু'য়ারা বা কবি - ২৬
২২৭ আয়াত, ১১ রুকু, মক্কী[দয়াময় , পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
০১। তা - সীন - মীম ৩১৩৭।
৩১৩৭। এই তিনটি বর্ণমালা সাংকেতিক সমষ্টি মাত্র যার প্রকৃত অর্থ একমাত্র রাব্বুল আলামীন জানেন।
০২। এগুলি সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাবের আয়াত [ নিদর্শন ] ৩১৩৮।
৩১৩৮। দেখুন আয়াত [ ৫ : ১৫ ]।
০৩। যেহেতু তারা ঈমান আনছে না সেহেতু তুমি মনোঃকষ্টে দুঃখিত হয়ে পড়ো না ৩১৩৯।
৩১৩৯। 'তারা' শব্দটি দ্বারা মক্কার মোশরেকদের বোঝানো হয়েছে। হিজরতের পূর্বে মক্কাতে অবস্থান কালে মক্কার মোশরেকদের সত্যকে প্রতিহত করার প্রবণতা আল্লাহ্র রসুলকে [সা ] হতাশ করে। এই হতাশাকেই এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। কারণ কোনও মহৎ কাজে সফলতা না অর্জিত হলে সাধারণ মানুষের মনে হতাশার সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষের এই প্রবণতা থেকে আল্লাহ্র রসুলও মুক্ত ছিলেন না। রসুলের [ সা ] জীবনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আল্লাহ্ হেদায়েত করেছেন যে , মহৎ কাজে হতাশার স্থান নাই। সাফল্যের দাবীদার একমাত্র সেই মহাপরাক্রমশালী , বিশ্ববিধাতা।
০৪। [এই ] যদি আমার ইচ্ছা হতো, তবে আমি আকাশ থেকে তাদের জন্য এমন নিদর্শন পাঠাতাম যে বিনয়ে তাদের ঘাড় অবনত হয়ে পড়তো ৩১৪০।
৩১৪০। আল্লাহ্র ইচ্ছাই আল্লাহ্র পরিকল্পনা - এই বিশ্বভূবন ও বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের পরিচালনার। আল্লাহ্ যদি তার পরিকল্পনায় মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দানের ইচ্ছা প্রকাশ না করতেন , তবে বিশ্ব ভূবনে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকতো না। অন্যান্য প্রাণীদের ন্যায় সে শুধু নিজ প্রবণতা [Instinct] যা বিশ্ব বিধাতা তার মাঝে আরোপ করেছেন তা দ্বারাই পরিচালিত হতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা না করে মানুষকে "সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দান করেছেন, আবার সেই "ইচ্ছাশক্তিকে " সঠিক পথে পরিচালনার জন্য যুগে যুগে নবীদের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন, যাতে মানুষ আত্মিক উন্নতির সন্ধান লাভ করে। সুতারাং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্রই ইচ্ছা বা পরিকল্পনার অংশ।
০৫। যখনই তাদের নিকট দয়াময় [আল্লাহ্র ] নিকট থেকে কোন নূতন উপদেশ আসে, তখনই ওরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
০৬। তারা অবশ্যই [ উপদেশকে ] প্রত্যাখান করেছে। তারা যা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে, [ খুব ] শীঘ্রই তার সত্যতা সম্বন্ধে জানতে পারবে ৩১৪১।
০৬। তারা অবশ্যই [ উপদেশকে ] প্রত্যাখান করেছে। তারা যা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে, [ খুব ] শীঘ্রই তার সত্যতা সম্বন্ধে জানতে পারবে ৩১৪১।
৩১৪১। এই আয়াত গুলির মাধ্যমে রসুলের [ সা ] সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে , কিন্তু এর আবেদন সর্বকাল ও যুগের জন্য প্রযোজ্য। মক্কার অবিশ্বাসী মোশরেকরা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে ঠাট্টা -বিদ্রূপের বিষয়বস্তুতে পরিণত করে। এখানে আল্লাহ্ তাদের সাবধান করে দিয়েছেন যে তাদের কর্মফল তারা পাবে, সত্যের ক্ষমতা অনুধাবনের মাধ্যমে তারা প্রকৃত অবস্থাকে বুঝতে সক্ষম হবে যা তারা প্রতিহত করতে চেয়েছিলো। কোথায় ছিলো তখন মোশরেকরা যখন বদরের যুদ্ধে তাদের পরাজয় ঘটে যখন রক্তপাতহীন ভাবে মক্কা বিজিত হয়? এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ সর্ব যুগের মোমেন বান্দাদের এই আশ্বাস দিয়েছেন যে, প্রতিকূলতা সত্বেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জেহাদ জয় লাভ করবেই। " [খুব ] শীঘ্রই তার সত্যতা সম্বন্ধে জানতে পারবে।"
০৭। তারা কি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখে না ? সেখানে আমি পরম সুন্দর নানা রকম কত কি সৃষ্টি করেছি ৩১৪২।
৩১৪২। এই আয়াতে আল্লাহ্ মোশরেকদের পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্ট পদার্থের দিকে দৃষ্টিপাত করার জন্য আহ্বান করেছেন। আল্লাহ্র সৃষ্টির স্বাক্ষর এই নৈসর্গে ভরা পৃথিবী। কিন্তু এই পৃথিবীর দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে আমরা দেখতে পাই যে, এখানে অন্যায়কারী ও পাপীর কোনও স্থান নাই। ক্ষণস্থায়ী অবকাশকে তারা যেনো তাদের জন্য স্থায়ী না ভাবে। পৃথিবীর ঘটনা পুঞ্জ থেকে তাদের এই নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু তারা তা লাভ করতে অক্ষম কারণ তারা আত্মিক দিক থেকে অন্ধ , চক্ষু থাকতেও তারা সত্যকে দেখতে পাবে না , তাদের আত্মা অন্ধকারে আবৃত, কারণ তাদের মাঝে ঈমান বা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের আলো নাই সুতারাং তাদের অর্ন্তদৃষ্টির [Spiritual insight] অভাব ঘটবে।
০৮। অবশ্যই এটা একটা নিদর্শন। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা বিশ্বাস করে না।
০৯। আর নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু মহা শক্তিশালী , পরম করুণাময় ৩১৪৩।
০৯। আর নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু মহা শক্তিশালী , পরম করুণাময় ৩১৪৩।
৩১৪৩। মহাপরাক্রমশালী - অর্থাৎ তিনি তাঁর সকল ইচ্ছা বা পরিকল্পনা একা কার্যে পরিণত করতে সক্ষম। দেখুন আয়াত [ ২২ : ৪০ ] ও টিকা ২৮১৮।
রুকু - ২
১০। দেখো, তোমার প্রভু মুসাকে ডেকে বলেছিলো , " তুমি অন্যায়কারী সম্প্রদায়ের নিকট যাও - ৩১৪৪
১১। "ফেরাউনের সম্প্রদায়ের নিকট; তারা কি আল্লাহ্কে ভয় করবে না ? "
১১। "ফেরাউনের সম্প্রদায়ের নিকট; তারা কি আল্লাহ্কে ভয় করবে না ? "
৩১৪৪। মুসার কাহিনীর কিছু অংশ এই সূরাতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কাহিনীতে দেখানো হয়েছে যে, দায়িত্ব প্রাপ্তির পরে মুসা কিভাবে আত্মাবিশ্বাসের অভাববোধ করেছিলেন; কিভাবে আল্লাহ্ তাকে আশ্বস্ত করেন, কিভাবে তিনি আল্লাহ্র নিদর্শনসহ ফেরাউনের নিকট গমন করেন; কিভাবে ফেরাউন ও তার সভাসদরা তা প্রত্যাখান করে; কিভাবে আল্লাহ্র নিন্দা তাদের উপরে ভয়ের কারণরূপে নিপতিত হয়। এ সবের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সত্য শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই। অন্য কথায় দুষ্ট ও পাপীদের সত্যের আলো প্রত্যক্ষে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাকেই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এর সাথে অনুভব করতে হবে ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ্র দূতদের মানসিক অবস্থা।
১২। সে বলেছিলো , " হে আমার প্রভু ! আমার ভয় হচ্ছে যে তারা আমাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। "
১৩। " [ ভয়ে ] আমার বক্ষ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ৩১৪৫। এবং [ তোতলামীর জন্য ] আমার ভাষা খুব সাবলীল নয়। সুতারাং হারুনকেও আমার সাথে পাঠাও।
১৩। " [ ভয়ে ] আমার বক্ষ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ৩১৪৫। এবং [ তোতলামীর জন্য ] আমার ভাষা খুব সাবলীল নয়। সুতারাং হারুনকেও আমার সাথে পাঠাও।
৩১৪৫। মুসা জন্মগতভাবে তোতলা ছিলেন। স্বাভাবিক ও স্বতঃষ্ফুর্ত ভাবে তিনি কথা বলতে পারতেন না। উপরন্তু তাঁর দায়িত্বটি ছিলো অত্যন্ত বিপদ সংকুল। [দেখুন পরবর্তী টিকা ]। আল্লাহ্র পরিকল্পনা বিচিত্র উপায়ে বাস্তবায়িত হয়। হারুনকে তাঁর সাহাযার্থে নিয়োগ করা হয় এবং মুসার দোষত্রুটি ও অক্ষমতাকে আল্লাহ্ শক্তিতে রূপান্তরিত করে দেন। সুতারাং আল্লাহ্র করুণায় হযরত মুসা ইসরাঈলীদের মধ্যে শক্তিশালী নেতারূপে আর্বিভূত হন।
১৪। " [ উপরন্তু ] আমার বিরুদ্ধে তাদের নিকট [ মানুষ হত্যার ] অপরাধের এক অভিযোগ আছে। এবং আমি ভয় পাচ্ছি যে, তারা আমাকে হত্যা করতে পারে।" ৩১৪৬
৩১৪৬। হযরত মুসার প্রতিপালন ও শৈশব সর্ম্পকে উল্লেখ করা হয়েছে আয়াত [ ২০ : ৩৯ - ৪০ ] এবং টিকা ২৫৬৩ এ। তিনি ফেরাউনের প্রাসাদে প্রতিপালিত হতে থাকেন এবং মিশরবাসীদের সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের অধিকারী হন। তিনি যখন পূর্ণ যুবক তখন একদিন দেখলেন যে অন্যায়ভাবে একজন মিশরবাসী একজন ইসরাঈলীকে আঘাত করছে, তিনি মিশরবাসীটিকে আঘাত হানেন ফলে মিশরীয়টি মৃত্যুবরণ করে [ ২৮ : ১৫ ] এই অপরাধের শাস্তির ভয়ে তিনি মিশর ত্যাগ করেন ও সিনাই উপত্যকায় অবস্থিত মাদিয়ানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানেই তিনি আল্লাহ্ কর্তৃক ঐশ্বরিক দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। অপরপক্ষে মিশরে তাঁর বিরুদ্ধে মানুষ হত্যার অভিযোগ ছিলো। এ ছাড়াও হযরত মুসা ছিলেন বদরাগী স্বভাবের। কিন্তু আল্লাহ্র করুণা তার এই রাগী স্বভাবকে দূর করে দেয় এবং তাঁকে আল্লাহ্ জ্ঞানী সম্প্রদায়ের অর্ন্তভুক্ত করেন। তাঁর জিহ্বার জড়তা দূর হয়ে যায় এবং তিনি দৃঢ়ভাবে ফেরাউনের সম্মুখে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তিনি সাহস ও দৃঢ়তার সাথে আল্লাহ্র নিদর্শন দ্বারা মিশরবাসী যাদুকরদের মোকাবেলা করেন। শেষ পর্যন্ত এসব যাদুকরেরা আল্লাহ্র নিদর্শন দর্শনে ভীত হয়ে পড়ে।
১৫। আল্লাহ্ বলেছিলেন, " না কখনই না ! আমার নিদর্শন সহকারে তোমরা দুজনেই অগ্রসর হও। আমি তোমাদের সাথে থাকবো এবং তোমাদের [ ডাক ] শুনবো।
১৬। "সুতারাং তোমরা উভয়েই ফেরাউনের কাছে যাও, এবং বল আমরা পৃথিবীর প্রভু এবং প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছি ;
১৭। " আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলীদের যেতে দাও।"
১৮। [ ফেরাউন ] বলেছিলো ; " আমরা কি তোমাকে শিশুকালে আমাদের মধ্যে প্রতিপালন করি নাই এবং তুমি কি আমাদের মধ্যে তোমার জীবনের বহু বৎসর অবস্থান কর নাই ? " ৩১৪৭
১৬। "সুতারাং তোমরা উভয়েই ফেরাউনের কাছে যাও, এবং বল আমরা পৃথিবীর প্রভু এবং প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছি ;
১৭। " আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলীদের যেতে দাও।"
১৮। [ ফেরাউন ] বলেছিলো ; " আমরা কি তোমাকে শিশুকালে আমাদের মধ্যে প্রতিপালন করি নাই এবং তুমি কি আমাদের মধ্যে তোমার জীবনের বহু বৎসর অবস্থান কর নাই ? " ৩১৪৭
৩১৪৭। এখানে ফেরাউন তার কূটবুদ্ধির প্রয়োগ করেছে। যখন মুসা ফেরাউনকে আল্লাহকে "জগহসমূহের প্রতিপালকরূপে " উপস্থাপন করেছিলেন , তখন ফেরাউন মুসাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, " তোমাকে কে প্রতিপালিত করেছিলো ? আমরা কি তোমাকে শৈশবে আমাদিগের মধ্যে লালন পালন করি নাই? " এই বাক্যটি দ্বারা ফেরাউন মুসাকে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছে যে, জগত সমূহের প্রতিপালক নয় ফেরাউনই মুসার প্রতিপালক। প্রকৃত পক্ষে ফেরাউন নিজেকে কৌশলে আল্লাহ্ বলে দাবী করেছিলো এই বক্তব্যের মাধ্যমে।
১৯। " [ তুমি জান ] তুমি তোমার কর্ম যা করার তা করেছ। তুমি অকৃতজ্ঞ [ দুরাত্মা ] " ৩১৪৮।
৩১৪৮। এই সাথে ফেরাউন এ কথাও মুসাকে স্মরণ করিয়ে দিলো যে, তুমি একজন মিশরীয় এর হন্তাকারী এবং এই বলে বিদ্রূপ করলো যে, " তুমি শুধু হত্যাকারী নও ; তুমি অকৃতজ্ঞও বটে। যারা তোমাকে প্রতিপালিত করলো, তাদেরই একজনকে তুমি হত্যা করেছ।"
২০। মুসা বলেছিলো , " আমি তা করেছিলাম তখন , যখন আমি ছিলাম পথভ্রষ্ট ৩১৪৯।
৩১৪৯। মুসার উত্তর কি ছিলো ? দেখা যায় হযরত মুসা তাঁর কৃতকর্মের জন্য পূর্বে যেরূপ ভীত ছিলেন , এখন আর তাঁর সে ভয় নাই। তিনি প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরলেন , তাঁর অপরাধকে লঘু করার কোনও প্রচেষ্টাই সেখানে ছিলো না। " হ্যাঁ , আমি তা করেছি, কারণ তখন আমি ভ্রান্তির মাঝে ছিলাম।" তাঁর এই উক্তির অর্থ তিন রকম ভাবে করা যায় : ১) আমি রাগের বশে তাড়াহুড়া করে তা করেছি , যা অবশ্যই অন্যায়। ২) আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্যায় করেছি , কিন্তু আমি অনুতপ্ত এবং আল্লাহ্র নিকট ক্ষমাপ্রার্থী [ ২৮ : ১৫ - ১৬ ]। ৩) এ কাজ আমি সেই সময়ে করেছি যখন আমি তোমাদের প্রভাব বলয়ে বাস করতাম। সেই থেকে আমি অনুতাপের মাধ্যমে এক পরিবর্তিত মানুষ। আল্লাহ্ আমাকে ক্ষমা করে ডেকে নিয়েছেন।
২১। " সুতারাং আমি তোমাদের ভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম ; ৩১৫০ কিন্তু এখন আমার প্রভু আমাকে বিচারের জ্ঞান দান করেছেন ও আমাকে অন্যতম রাসুলরূপে নিয়োগ দান করেছেন। "
৩১৫০। ফেরাউনের উত্তরে মুসা তার গতিবিধির বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন যদিও ফেরাউন তা জিজ্ঞাসা করে নাই। তিনি কিছুই গোপন করেন নাই। সে সময়ে তিনি ছিলেন ভীত সন্ত্রস্ত। ফলে তিনি মিশর থেকে পলায়ন করেন। কিন্তু এখন তিনি আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করে আল্লাহ্র রাসুল নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি এখন বিশ্বপালক মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র সেবক দাস। সুতারাং সাধারণ মানুষ থেকে তার কোনও ভয় নাই। তিনি আল্লাহ্র রাসুল।
উপদেশ : মানুষ যখন বিপদ বিপর্যয়ে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার মাধ্যমে ,বিপদকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তখন তার ভয়ের আর কোনও কারণ থাকে না। কারণ সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ স্বয়ং তার ভার গ্রহণ করেন।
২২। " যে অনুগ্রহের জন্য তুমি আমাকে র্ভৎসনা করছো, তা হচ্ছে এই যে তুমি বনী ইসরাঈলীদের ক্রীতদাসে পরিণত করেছ।" ৩১৫১
৩১৫১। মিশরবাসীদের নিকট থেকে মুসা শৈশব থেকে যে সব অনুগ্রহ লাভ করেছিলো সে সব স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফেরাউন মুসাকে "অকৃতজ্ঞ বলে র্ভৎসনা করেছিলো। এরই উত্তরে মুসা বললেন যে, " কোন অনুগ্রহ ? যখন তুমি আমার ভ্রাতা ইহুদীদের দাস করে রেখেছিলে ? " এই বাক্যটি থেকে বোঝা যায় যে এখন মুসা যে উত্তর দিচ্ছেন তা তার ব্যক্তিগত কৈফিয়ত নয়। তিনি আল্লাহ্র রাসুল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তার প্রতি যে অনুগ্রহ করা হয়েছিলো তাঁর স্বজাতির উপরে অত্যাচারের ফলে তাঁর আর কোনও মূল্য নাই।
উপদেশ : ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান অপেক্ষা ইসলাম সমষ্টিগত অস্তিত্বে বিশ্বাসী।
২৩। ফেরাউন বলেছিলো, " জগত সমূহের প্রভু ও প্রতিপালক কি ? " ৩১৫২
৩১৫২। হযরত মুসা ব্যক্তিগত আক্রমণকে প্রতিহত করার পরে এবারে ফেরাউনের যুক্তি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকলো। এবারে সে আল্লাহ্র কর্তৃত্ব ও করুণা সম্পর্কে যুক্তির অবতারণা করলো। মুসা পূর্বে আল্লাহকে "জগতসমূহের প্রতিপালক" রূপে উপস্থাপন করেছিলেন [ ২৬ : ১৬ ]। এই বক্তব্যকে ফেরাউন বিকৃত করে উত্থাপন করেছে এখানে। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বক্ষমতার অধিকারী এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ফেরাউনের পক্ষে ছিলো অসম্ভব। আর এখানেই ছিলো মূল সমস্যা।
২৪। মুসা বলেছিলো , " তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদের মধ্যবর্তী সকল কিছুর প্রভু এবং প্রতিপালক- যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।"
২৫। [ ফেরাউন তার চারিপাশের পরিষদবর্গকে বলেছিলো , " তোমরা শুনছো তো [ সে কি বলছে ] ?" ৩১৫৩
২৫। [ ফেরাউন তার চারিপাশের পরিষদবর্গকে বলেছিলো , " তোমরা শুনছো তো [ সে কি বলছে ] ?" ৩১৫৩
৩১৫৩। হযরত মুসার আল্লাহ্র একত্বের উল্লেখে ফেরাউনের ক্রোধকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলো। কারণ মুসার বক্তব্য ছিলো ফেরাউনের দেবত্বের উপরে খড়গাঘাতের তুল্য। উপরন্তু মুসা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে, "যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও " অর্থাৎ বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনও মানুষই বিশ্ব প্রতিপালকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ। মুসার বক্তব্যে ফেরাউন ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধে তার সভাসদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। মুসার বক্তব্য ছিলো আরও স্বচ্ছ ও তীক্ষ্ণ। সারাংশ ছিলো যে, " আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী যা কিছু সবেরই প্রভু আল্লাহ্। সুতারাং সে হিসেবে আল্লাহ্ ফেরাউনের প্রভু , ফেরাউনের সকল পূর্বপুরুষের প্রভু। এক আল্লাহ্ ব্যতীত আর সকলের এই দাবী মিথ্যা ও ভূয়া।"
২৬। মুসা বলেছিলো, " প্রথম থেকেই তিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রভু।"
২৭। ফেরাউন বলেছিলো, " সত্যই; তোমাদের রাসুল, যাকে তোমাদের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে সে বাস্তবিকই পাগল।" ৩১৫৪
২৭। ফেরাউন বলেছিলো, " সত্যই; তোমাদের রাসুল, যাকে তোমাদের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে সে বাস্তবিকই পাগল।" ৩১৫৪
৩১৫৪। হযরত মুসা যখন ঘোষণা করলেন যে, আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের এবং মিশরবাসী ও তাদের ফেরাউনেরও প্রভু। মুসার এ হেন বক্তব্যে ফেরাউন বিচলিত বোধ করলো। সে বিদ্রূপের ভঙ্গীতে তার সভাষদদের আহ্বান করে বললো যে, "তোমাদিগের রাসুলটি তো নিশ্চয়ই পাগল।" কিন্তু ফেরাউনের এই ব্যঙ্গক্তি মুসাকে অপ্রস্তুত বা লজ্জিত করতে পারে নাই। তিনি সদর্পে সত্যকে ঘোষণা করলেন, " তুমিই পাগল ! আমার ঈশ্বর বিশ্বের বিধাতা। পূর্ব পশ্চিম সকল স্থানেই তিনি বিরাজ করেন। তুমি যেখানে রাজত্ব কর সেখানেও তার অধিষ্ঠান। "
২৮। মুসা বলেছিলো, " তিনি পূর্ব ও পশ্চিম ও যা কিছু উভয়ের মধ্যে রয়েছে সকলেরই প্রভু,- যদি তোমাদের বোঝার ক্ষমতা থাকতো।"
২৯। [ ফেরাউন ] বলেছিলো, " যদি তুমি আমাকে ব্যতীত অন্য কিছুকে উপাস্যরূপে উপস্থিত কর; তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে কারারুদ্ধ করবো।" ৩১৫৫
২৯। [ ফেরাউন ] বলেছিলো, " যদি তুমি আমাকে ব্যতীত অন্য কিছুকে উপাস্যরূপে উপস্থিত কর; তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে কারারুদ্ধ করবো।" ৩১৫৫
৩১৫৫। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কোনও কিছুই যখন মুসাকে তাঁর সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারলো না তখন সে তার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলো। সে মুসাকে কারারুদ্ধ করার ভয় দেখালো। মুসা কিন্তু শান্ত থেকে যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকলেন। তিনি বললেন যে " স্পষ্ট নিদর্শন প্রদর্শন করলেও কি তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করবে না সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র প্রতি ? তাহলেও কি তোমাদের বিশ্বাস হবে না যে আমি পাগল নই , আল্লাহ্র প্রেরিত বিশেষ দূত ?"
৩০। [মুসা ] বলেছিলো , " আমি যদি তোমাকে কোন সুস্পষ্ট [ এবং ] বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন প্রদর্শন করি তবুও ? " ৩১৫৬
৩১৫৬। হযরত মুসার সময়ে মিশরবাসীরা যাদুবিদ্যায় ভীষণভাবে আসক্ত ছিলো। প্রকৃত পক্ষে যাদু ছিলো মানুষের জন্য দৃষ্টিবিভ্রম ও প্রতারণা। এখানে মুসার আবেদন ছিলো যদি যাদু না হয়ে তা সত্যিকারের অলৌকিক ঘটনা হয়ে থাকে , তবে কি তারা এক আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করবে ? সম্ভবতঃ তারা তাদের যাদুবিদ্যার অন্তঃসার শূন্যতা উপলব্ধি করবে এই ছিলো মুসার বিশ্বাস। অবশ্য বাস্তব ঘটনাও তাই-ই ঘটেছিলো। মিশরের প্রধান প্রধান যাদুকরেরা মুসার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শনে অভিভূত হয়ে পড়েন। কিন্তু ফেরাউন ও তার সভাষদেরা উদ্ধত অহংকারে মুসা ও মুসার প্রচারিত ধর্মকে অস্বীকার করে।
৩১। [ ফেরাউন ] বলেছিলো, " যদি তুমি সত্যবাদী হও তবে তা প্রদর্শন কর।"
৩২। সুতারাং [ মুসা ] তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলো , এবং তৎক্ষণাৎ তা এক বিরাট অজগর সাপ হয়ে গেল।
৩৩। এবং সে তাঁর হাত বের করলো এবং তৎক্ষণাৎ উহা দর্শকদের দৃষ্টিতে সাদা চক্চক্ করতে লাগলো ৩১৫৭।
৩২। সুতারাং [ মুসা ] তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলো , এবং তৎক্ষণাৎ তা এক বিরাট অজগর সাপ হয়ে গেল।
৩৩। এবং সে তাঁর হাত বের করলো এবং তৎক্ষণাৎ উহা দর্শকদের দৃষ্টিতে সাদা চক্চক্ করতে লাগলো ৩১৫৭।
৩১৫৭। দেখুন [ ৭ : ১০৭ - ১০৮ ] সম্পূর্ণ আয়াত ও এর টিকা।
রুকু - ৩
৩১৫৮। আয়াত [ ৭ : ১০৯ ] এ বক্তব্য ছিলো পরিষদবর্গের। এই আয়াতে [ ২৬ : ৩৪ ] একই বক্তব্য পেশ করেছে ফেরাউন তার পরিষদবর্গের প্রতি।
৩১৫৯। " নির্ধারিত দিনে" দিনটি ছিলো একটি উৎসবের জন্য পূর্ব নির্ধারিত দিন। দেখুন এ ব্যাপারে আয়াত [২০: ৫৯ ]। হযরত মুসার উদ্দেশ্য ছিলো যে বেশী সংখ্যক জনসাধারণকে আকৃষ্ট করা যেনো তাদের সকলের মনে আল্লাহ্র অলৌকিক ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে। মিশরে সে সময়ে যাদুবিদ্যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। সুতারাং এ সব প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ যাদুকরদের নিকট নূতন ও সদ্যশিক্ষা প্রাপ্ত মুসার যাদু অবশ্যই পরাজয় বরণ করবে - এই ছিলো ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের গোপন আকাঙ্খা। ফেরাউনের ধারণা ছিলো তার বিজিত যাদুকরদের প্রভাব প্রজাদের উপরে বিশেষ প্রভাব বিস্তারের ফলে ফেরাউনের দেবত্ববাদ আরও শক্তিশালী হবে। সে কারণে ফেরাউনও বিশেষ পার্বণের দিনটিকে মুসা ও যাদুকরদের দ্বন্দযুদ্ধের দিন হিসেবে নির্ধারিত করে।
৩১৬০। দেখুন উপরের টিকাটি। দলে দলে লোক সমবেত হতে থাকলো রাষ্ট্রধর্মের বিজয় দেখার জন্য। ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গ মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো যে , তাদের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত যাদুবিদ্যা দ্বারা যাদুকরেরা মুসাকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে এবং সাধারণ মানুষ আরও অধিকভাবে ফেরাউনের দেবত্বের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে উঠবে। প্রজাদের শর্তহীন বশ্যতা আদায় করার এ এক অভিনব পন্থা এবং পুরোহিতদের অযৌক্তিক দাবী, বাধাহীনভাবে ও অনুগতভাবে আদায়ের জন্য ধর্মের নামে এ এক কূটকৌশল। সে সময়ে রাষ্ট্র-ধর্ম হিসেবে যাদুবিদ্যা এবং ফেরাউনকে ঈশ্বর হিসেবে পূঁজা প্রথা প্রচলন ছিলো।
৩১৬১। যারা মানুষকে প্রতারণা করে তারা কখনও প্রতারণার দ্বারা নিঃশর্ত আনুগত্য লাভ করতে পারে না। নিঃশর্ত আনুগত্য লাভ করা যায় শুধুমাত্র শর্তহীন ভালোবাসার মাধ্যমে। ফেরাউনের মত প্রতারক কখনও প্রজাদের নিকট থেকে সে শর্তহীন আনুগত্য আশা করতে পারে না। এখানে যাদুকরেরা ছিলো সম্ভবতঃ পুরোহিত সম্প্রদায়, যারা অর্থের লোভে ফেরাউনের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারে সহায়তা দান করতো। এই বিশাল সমাবেশে বিজিত হয়ে তারা তাদের মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধির আশা পোষণ করেছিলো।
৩১৬২। হযরত মুসার আহ্বান আপাতঃশ্রুতিমধুর হলেও আহ্বানটি ছিলো বিদ্রূপাত্মক । মুসা যেনো বলতে চেয়েছেন ; " আমি তোমাদের প্রতারণার কলাকৌশল সম্বন্ধে সম্যক ওয়াকেবহাল। তোমরা ভান করছো যেনো তোমরা দড়ি ও লাঠি ছুড়বে ও জনসাধারণ দেখবে যে তা সাপে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এখন দেখা যাবে তোমাদের কেরামতি।"
৩১৬৩। ফেরাউন নিজেকে ঈশ্বর দাবী করতো। সেই কারণে তারা ফেরাউনের ক্ষমতার কাছে আবেদন করেছিলো।
৩১৬৪। যাদুকরদের রজ্জু ও লাঠি সাপ বলে ভ্রম হতে থাকলো। কিন্তু হযরত মুসার লাঠি পরিণত হলো বিরাট অজগর সাপে যা যাদুকরদের সকল ক্ষুদ্র সাপগুলিকে গিলে ফেললো। এই উদাহরণের সাহায্যে এই কথাই বুঝতে চাওয়া হয়েছে যে, সত্যের আলো মিথ্যা ও প্রতারণার কৌশল থেকে বহুগুণ শক্তিশালী। মিথ্যা শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হবেই এবং সত্যের আলোতে মিথ্যার অন্ধকার বিদূরিত হবেই।
৩১৬৫। হযরত মুসার অলৌকিক ক্ষমতা দেখার সাথে সাথেই যাদুকরেরা বুঝতে পেরেছিলো যে, তারা কোন প্রতারণামূলক কৌশল দর্শন করছে না, তারা যা দেখছে তা স্বর্গীয় ক্ষমতারই স্বাক্ষর। আল্লাহ্র সর্বময় ক্ষমতা তাদের বিহ্বল করে ফেললো, তাঁরা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনায়ন করলো। যেহেতু তাদের মিশরে সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান সম্মানীয় ব্যক্তিরূপে পরিগণিত করা হতো, তাদের পরিণাম দর্শনে জনসাধারণেরও কিছু অংশ মুসার ক্ষমতায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সুতারাং এসব দর্শনে ফেরাউন যৎপরনাস্তি ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে এখান থেকেই ফেরাউনের পরাজয় শুরু হয়।
৩১৬৬। হযরত মুসার কাহিনীর এই অংশের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের যে সব নৈতিক শিক্ষা দিতে চেয়েছেন , এই আয়াতটিতে তার সারমর্ম সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়েছে। সমগ্র কাহিনীতে আল্লাহ্র হেদায়েত ছিলো নিম্নরূপ :
১) আল্লাহ্ নূরের স্পর্শে হযরত মুসার সমস্ত ভয় দূর হয়ে যায়। তিনি একজন নির্ভিক নেতারূপে রূপান্তরিত হন এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন।
উপদেশ : এভাবেই সকল মোমেন বান্দার হৃদয় যখন আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়, তখন পার্থিব ভয় আর তাকে ভীত করে না।
২) ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতারণাপূর্ণ কৌশল মুসাকে পরাজিত করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা সত্বেও শেষ পর্যন্ত তাদের সত্যের কাছে পরাজয় ঘটে।
উপদেশ : এভাবেই পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় ঘটবেই।
৩) পরশ পাথরের স্পর্শে লোহা যেরূপ সোনাতে রূপান্তরিত হওয়ার কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে, ঠিক সেরূপ আল্লাহ্র নূর বা সত্যের আলোর স্পর্শে যাদুকরেরা সম্পূর্ণ নূতন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। তাদের মনের অন্ধকার দূর হয়ে যায়। তারা সত্যের আলোকে অন্তরে ধরে রাখার জন্য সকল অত্যাচার এমনকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও দ্বিধাগ্রস্থ হয় না। সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত আত্মায় তাদের একমাত্র লক্ষ্য বস্তু হয় বিশ্বাসীদের পুরোধায় নিজেকে স্থাপন করার ইচ্ছা
উপদেশ : সত্যের আলো ও মিথ্যার অন্ধকার সব কিছুরই আবাসস্থল আত্মা। যে ব্যক্তি সত্যকে অনুধাবন করতে পারে , সে হয়ে পড়ে পরিবর্তিত মানুষ। যাদুকরদের উদাহরণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে এই উপদেশ দেয়া হয়েছে।
৩৪। ফেরাউন তার পরিষদবর্গকে বলেছিলো , " এ তো এক সুদক্ষ যাদুকর ৩১৫৮;
৩১৫৮। আয়াত [ ৭ : ১০৯ ] এ বক্তব্য ছিলো পরিষদবর্গের। এই আয়াতে [ ২৬ : ৩৪ ] একই বক্তব্য পেশ করেছে ফেরাউন তার পরিষদবর্গের প্রতি।
৩৫। "তার পরিকল্পনা হচ্ছে সে তার যাদু দ্বারা তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায়। এখন তোমাদের মতামত কি ? "
৩৬। তারা বলেছিলো , "তাঁকে এবং তাঁর ভাইকে অপেক্ষা করে থাকতে দাও [ কিছু সময়ের জন্য ], এবং নগরে নগরে সংগ্রহ করার জন্য দূত প্রেরণ কর।
৩৭। " তোমার নিকট [ আমাদের ] সুদক্ষ যাদুকরদের সমবেত কর।"
৩৮। সুতারাং এক নির্ধারিত দিনের নির্দ্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য যাদুকরদের একত্র করা হলো ৩১৫৯।
৩৬। তারা বলেছিলো , "তাঁকে এবং তাঁর ভাইকে অপেক্ষা করে থাকতে দাও [ কিছু সময়ের জন্য ], এবং নগরে নগরে সংগ্রহ করার জন্য দূত প্রেরণ কর।
৩৭। " তোমার নিকট [ আমাদের ] সুদক্ষ যাদুকরদের সমবেত কর।"
৩৮। সুতারাং এক নির্ধারিত দিনের নির্দ্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য যাদুকরদের একত্র করা হলো ৩১৫৯।
৩১৫৯। " নির্ধারিত দিনে" দিনটি ছিলো একটি উৎসবের জন্য পূর্ব নির্ধারিত দিন। দেখুন এ ব্যাপারে আয়াত [২০: ৫৯ ]। হযরত মুসার উদ্দেশ্য ছিলো যে বেশী সংখ্যক জনসাধারণকে আকৃষ্ট করা যেনো তাদের সকলের মনে আল্লাহ্র অলৌকিক ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে। মিশরে সে সময়ে যাদুবিদ্যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। সুতারাং এ সব প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ যাদুকরদের নিকট নূতন ও সদ্যশিক্ষা প্রাপ্ত মুসার যাদু অবশ্যই পরাজয় বরণ করবে - এই ছিলো ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের গোপন আকাঙ্খা। ফেরাউনের ধারণা ছিলো তার বিজিত যাদুকরদের প্রভাব প্রজাদের উপরে বিশেষ প্রভাব বিস্তারের ফলে ফেরাউনের দেবত্ববাদ আরও শক্তিশালী হবে। সে কারণে ফেরাউনও বিশেষ পার্বণের দিনটিকে মুসা ও যাদুকরদের দ্বন্দযুদ্ধের দিন হিসেবে নির্ধারিত করে।
৩৯। এবং জনসাধারণকে বলা হলো, " এখন কি তোমরা সমবেত হয়েছ ? -
৪০। " যেনো আমরা যাদুকরদের অনুসরণ করতে পারি , যদি তারা বিজয়ী হয় ? " ৩১৬০
৪০। " যেনো আমরা যাদুকরদের অনুসরণ করতে পারি , যদি তারা বিজয়ী হয় ? " ৩১৬০
৩১৬০। দেখুন উপরের টিকাটি। দলে দলে লোক সমবেত হতে থাকলো রাষ্ট্রধর্মের বিজয় দেখার জন্য। ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গ মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো যে , তাদের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত যাদুবিদ্যা দ্বারা যাদুকরেরা মুসাকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে এবং সাধারণ মানুষ আরও অধিকভাবে ফেরাউনের দেবত্বের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে উঠবে। প্রজাদের শর্তহীন বশ্যতা আদায় করার এ এক অভিনব পন্থা এবং পুরোহিতদের অযৌক্তিক দাবী, বাধাহীনভাবে ও অনুগতভাবে আদায়ের জন্য ধর্মের নামে এ এক কূটকৌশল। সে সময়ে রাষ্ট্র-ধর্ম হিসেবে যাদুবিদ্যা এবং ফেরাউনকে ঈশ্বর হিসেবে পূঁজা প্রথা প্রচলন ছিলো।
৪১। সুতারাং যখন যাদুকরেরা উপস্থিত হলো , তারা ফেরাউনকে বলেছিলো, " যদি আমরা বিজয়ী হই , আমাদের জন্য কি [ উপযুক্ত ] পুরষ্কার থাকবে ? " ৩১৬১।
৩১৬১। যারা মানুষকে প্রতারণা করে তারা কখনও প্রতারণার দ্বারা নিঃশর্ত আনুগত্য লাভ করতে পারে না। নিঃশর্ত আনুগত্য লাভ করা যায় শুধুমাত্র শর্তহীন ভালোবাসার মাধ্যমে। ফেরাউনের মত প্রতারক কখনও প্রজাদের নিকট থেকে সে শর্তহীন আনুগত্য আশা করতে পারে না। এখানে যাদুকরেরা ছিলো সম্ভবতঃ পুরোহিত সম্প্রদায়, যারা অর্থের লোভে ফেরাউনের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারে সহায়তা দান করতো। এই বিশাল সমাবেশে বিজিত হয়ে তারা তাদের মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধির আশা পোষণ করেছিলো।
৪২। সে বলেছিলো , " হ্যাঁ অবশ্যই , [ অধিকন্তু ] সেক্ষেত্রে তোমাদের [ পদমর্যদা উন্নীত করা হবে ] আমার ঘনিষ্ঠদের শামিল করে। "
৪৩। মুসা বলেছিলো , " তোমাদের যা নিক্ষেপ করার তা নিক্ষেপ কর।" ৩১৬২
৪৩। মুসা বলেছিলো , " তোমাদের যা নিক্ষেপ করার তা নিক্ষেপ কর।" ৩১৬২
৩১৬২। হযরত মুসার আহ্বান আপাতঃশ্রুতিমধুর হলেও আহ্বানটি ছিলো বিদ্রূপাত্মক । মুসা যেনো বলতে চেয়েছেন ; " আমি তোমাদের প্রতারণার কলাকৌশল সম্বন্ধে সম্যক ওয়াকেবহাল। তোমরা ভান করছো যেনো তোমরা দড়ি ও লাঠি ছুড়বে ও জনসাধারণ দেখবে যে তা সাপে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এখন দেখা যাবে তোমাদের কেরামতি।"
৪৪। সুতারাং তারা তাদের দড়ি এবং লাঠি নিক্ষেপ করলো এবং বললো , " পরাক্রমশালী ফেরাউনের শপথ, আমরাই বিজয়ী হব।" ৩১৬৩
৩১৬৩। ফেরাউন নিজেকে ঈশ্বর দাবী করতো। সেই কারণে তারা ফেরাউনের ক্ষমতার কাছে আবেদন করেছিলো।
৪৫। অতঃপর মুসা তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলো, তৎক্ষণাৎ উহা উহাদের অলীক সৃষ্টিগুলি গ্রাস করতে লাগলো। ৩১৬৪
৩১৬৪। যাদুকরদের রজ্জু ও লাঠি সাপ বলে ভ্রম হতে থাকলো। কিন্তু হযরত মুসার লাঠি পরিণত হলো বিরাট অজগর সাপে যা যাদুকরদের সকল ক্ষুদ্র সাপগুলিকে গিলে ফেললো। এই উদাহরণের সাহায্যে এই কথাই বুঝতে চাওয়া হয়েছে যে, সত্যের আলো মিথ্যা ও প্রতারণার কৌশল থেকে বহুগুণ শক্তিশালী। মিথ্যা শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হবেই এবং সত্যের আলোতে মিথ্যার অন্ধকার বিদূরিত হবেই।
৪৬। তখন যাদুকরেরা ভক্তিভরে সেজদায় অবনত হলো,
৪৭। এই বলে যে, " আমরা পৃথিবীর প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।
৪৮। " যিনি মুসা ও হারুনের প্রভু।"
৪৯। [ ফেরাউন ] বলেছিলো , " কি আমি তোমাদের অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা [ উহাতে ] বিশ্বাস করলে ? নিশ্চয়ই সে তোমাদের নেতা , যে তোমাদের যাদু শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু শীঘ্রই তোমরা [ ইহার পরিণাম ] জানতে পারবে ৩১৬৫।
৪৭। এই বলে যে, " আমরা পৃথিবীর প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।
৪৮। " যিনি মুসা ও হারুনের প্রভু।"
৪৯। [ ফেরাউন ] বলেছিলো , " কি আমি তোমাদের অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা [ উহাতে ] বিশ্বাস করলে ? নিশ্চয়ই সে তোমাদের নেতা , যে তোমাদের যাদু শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু শীঘ্রই তোমরা [ ইহার পরিণাম ] জানতে পারবে ৩১৬৫।
৩১৬৫। হযরত মুসার অলৌকিক ক্ষমতা দেখার সাথে সাথেই যাদুকরেরা বুঝতে পেরেছিলো যে, তারা কোন প্রতারণামূলক কৌশল দর্শন করছে না, তারা যা দেখছে তা স্বর্গীয় ক্ষমতারই স্বাক্ষর। আল্লাহ্র সর্বময় ক্ষমতা তাদের বিহ্বল করে ফেললো, তাঁরা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনায়ন করলো। যেহেতু তাদের মিশরে সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান সম্মানীয় ব্যক্তিরূপে পরিগণিত করা হতো, তাদের পরিণাম দর্শনে জনসাধারণেরও কিছু অংশ মুসার ক্ষমতায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সুতারাং এসব দর্শনে ফেরাউন যৎপরনাস্তি ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে এখান থেকেই ফেরাউনের পরাজয় শুরু হয়।
৫০। " নিশ্চিত থাক আমি বিপরীত দিক থেকে তোমাদের হাত এবং পা কেটে ফেলবো , এবং আমি তোমাদের সকলকে শূলে মৃত্যুবরণ করাবো। "
৫১। তারা বলেছিলো, " কোন ক্ষতি নাই ! আমরা তো আমাদের প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তন করব।
৫২। " আমাদের একমাত্র আকাঙ্খা যে, আমাদের প্রভু আমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন, যেনো আমরা মুমিনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হতে পারি।" ৩১৬৬
৫১। তারা বলেছিলো, " কোন ক্ষতি নাই ! আমরা তো আমাদের প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তন করব।
৫২। " আমাদের একমাত্র আকাঙ্খা যে, আমাদের প্রভু আমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন, যেনো আমরা মুমিনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হতে পারি।" ৩১৬৬
৩১৬৬। হযরত মুসার কাহিনীর এই অংশের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের যে সব নৈতিক শিক্ষা দিতে চেয়েছেন , এই আয়াতটিতে তার সারমর্ম সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়েছে। সমগ্র কাহিনীতে আল্লাহ্র হেদায়েত ছিলো নিম্নরূপ :
১) আল্লাহ্ নূরের স্পর্শে হযরত মুসার সমস্ত ভয় দূর হয়ে যায়। তিনি একজন নির্ভিক নেতারূপে রূপান্তরিত হন এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন।
উপদেশ : এভাবেই সকল মোমেন বান্দার হৃদয় যখন আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়, তখন পার্থিব ভয় আর তাকে ভীত করে না।
২) ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতারণাপূর্ণ কৌশল মুসাকে পরাজিত করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা সত্বেও শেষ পর্যন্ত তাদের সত্যের কাছে পরাজয় ঘটে।
উপদেশ : এভাবেই পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় ঘটবেই।
৩) পরশ পাথরের স্পর্শে লোহা যেরূপ সোনাতে রূপান্তরিত হওয়ার কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে, ঠিক সেরূপ আল্লাহ্র নূর বা সত্যের আলোর স্পর্শে যাদুকরেরা সম্পূর্ণ নূতন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। তাদের মনের অন্ধকার দূর হয়ে যায়। তারা সত্যের আলোকে অন্তরে ধরে রাখার জন্য সকল অত্যাচার এমনকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও দ্বিধাগ্রস্থ হয় না। সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত আত্মায় তাদের একমাত্র লক্ষ্য বস্তু হয় বিশ্বাসীদের পুরোধায় নিজেকে স্থাপন করার ইচ্ছা
উপদেশ : সত্যের আলো ও মিথ্যার অন্ধকার সব কিছুরই আবাসস্থল আত্মা। যে ব্যক্তি সত্যকে অনুধাবন করতে পারে , সে হয়ে পড়ে পরিবর্তিত মানুষ। যাদুকরদের উদাহরণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে এই উপদেশ দেয়া হয়েছে।
রুকু - ৪
৩১৬৭। হযরত মুসার মিশর অবস্থানকালে অন্যান্য যে সব অলৌকিক ক্রীয়া কর্ম প্রদর্শন করেন যেমন প্লেগ [ মুসার নয়টি মোজেজা দেখুন আয়াত [ ৭ : ১৩৩ ] ও [ ১৭ : ১০১ ] ] ইত্যাদি বর্তমান যুক্তির ক্ষেত্রে তা অপ্রাসঙ্গিক হওয়াতে তা এখানে উল্লেখ করা হয় নাই। এবারে ইহুদীরেদ মিশর ত্যাগের কাহিনী ও ফেরাউনের পশ্চাদ্ধাবনের কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে। এই কাহিনীর মাধ্যমে তিনটি বিষয়ের তুলনার প্রতি বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। ১) আল্লাহ্র পরিকল্পনা বা সত্য প্রচারের বিরুদ্ধে ফেরাউনের অন্ধ আক্রোশ যা সর্ব যুগে সত্য প্রচার ও প্রসারের বিরুদ্ধে অন্যায় ও মিথ্যার দ্বারা ঘটে থাকে। ২) হযরত মুসার বিশ্বাসের বিপরীতে তার সম্প্রদায়ের লোকদের ভীত মনোভাব। ৩) শেষ পর্যন্ত ইহুদীদের মিশরবাসীর অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এবং অসত্য ও মিথ্যার শক্তির শেষ পরিণাম ধবংস।
৩১৬৮। অন্যান্য বহু তফসীরকারদের মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে [ মওলানা ইউসুফ আলী ] এই আয়াতগুলির [২৬ : ৫৮ - ৬০ ] অর্থ আল্লাহ্র ইচ্ছার প্রকাশ এই ভাবে অনুবাদ করেছেন।
৩১৬৯। উদ্যানরাজি, প্রস্রবণ , ধন-ভান্ডার, সুরম্যসৌধমালা ইত্যাদির অধিকারী বনী ইসরাঈলীরা হয়েছিলো, বহু বছর মরূপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর পরে প্যালেস্টাইনে এসে। কিন্তু তারা আবার যখন আল্লাহ্র বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন তারা আবার এসব হারিয়ে ফেলে এবং অন্য সম্প্রদায় [ মুসলমান ] তা অধিকার করে নেয়। কারণ তারা ছিলো প্রকৃত বিশ্বাসী।
উপদেশ : যারা আল্লাহ্র বিধানে বিশ্বাসী ও সেই অনুপাতে জীবন যাপন প্রণালী পরিচালনা করবে আল্লাহ্ তাদের সম্মুখে পৃথিবীর ধনভান্ডার উম্মুক্ত করে দেবেন।
৩১৭০। আয়াত [ ৫৮ - ৬০ ] গুলির মাধ্যমে আল্লাহ্র সার্বজনীন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটানো হয়েছে যা সাম্প্রতিক বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কহীন। এই আয়াত [৬০ ] থেকে আবার পূর্বের কাহিনীর ধারাবাহিকতার বর্ণনা করা হয়েছে।
৩১৭১। "পথ দেখাবেন" - অর্থাৎ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলে দেবেন। এই আয়াত দ্বারা দেখানো হয়েছে মুসার সম্প্রদায়ের আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলহীনতার বিপরীতে হযরত মুসার অটল অনড় বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা আল্লাহ্র উপরে।
উপদেশ : সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র উপরে অটল নির্ভরশীলতা মোমেন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিপদ বিপর্যয়ের মাঝেই আল্লাহ্ বান্দার ঈমানের পরীক্ষা করে থাকেন।
৩১৭২। অপর দল অর্থাৎ ফেরাউনের দল। এখানে দুধরনের মোজেজা লক্ষ্য করা যায়। ১) মুসা ও তাঁর সম্প্রদায় নিরাপদে সমুদ্র অতিক্রম করেন; এবং ২) ফেরাউন ও তার অনুসদবর্গ সমুদ্রে ডুবে মারা যায়।
৩১৭৩। মুসার ঘটনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে যে উপদেশ ও জ্ঞান দান করা হয়েছে তারই ইঙ্গিত করা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। যে সব লোক নিজের অন্ধ আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে ওঠে , তারা আল্লাহ্র নিদর্শন বুঝতে ও অনুধাবনে অক্ষম হবে। অহংকারের কালো পর্দ্দা তাদের আত্মার স্বচ্ছতাকে ঢেকে দেয়। ফলে তারা চর্মচক্ষু থেকেও প্রকৃত সত্যকে দেখতে পায় না বা অনুধাবন করতে পারে না। এই -ই তাদের উদ্ধত অহংকারের শাস্তি। পরিণামে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় যা ফেরাউনের কাহিনীর মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে। অপর পক্ষে যারা সত্যের জন্য ন্যায়ের জন্য নির্যাতন ভোগ করে এবং নির্যাতন সত্বেও যারা আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা হারায় না , যারা জীবনের সর্বাবস্থায়, সুখে-দুঃখে , সম্পদে, ঐশ্বর্যে , ক্ষমতায় সব সময়ে বিনয়ী এবং কৃতজ্ঞ তারাই তো মোমেন বান্দা। মোমেন বান্দার হৃদয় আল্লাহ্র হেদায়েতের নূরে আলোকিত হয়ে ওঠে এবং পরিণামে আত্মা মোক্ষলাভ করে বা পৃথিবীর দুঃখ-ব্যথা , আশা-আকাঙ্খা , অবিচলতা ও পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয় এবং জাগতিক বন্ধন থেকে আত্মা মুক্তি পায়।
৩১৭৪। ফেরাউনের কাহিনীর মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, নির্যাতনকারী ও অন্যায়কারীর ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তাদের ষড়যন্ত্র বা প্রতিরোধ বা নির্যাতন কোনও কিছুই আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে ধ্বংস করতে পারবে না। বরং ভালোকে, সত্যকে আল্লাহ্র ইচ্ছাকে বাধাদানের ফলে মন্দ তার নিজের ধ্বংস ডেকে আনে।
রুকু - ৫
৩১৭৫। পরবর্তী আয়াতগুলির মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীমের জীবনীর যে যে অংশ যুক্তি ও উপদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক শুধুমাত্র তাই-ই তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর জীবনের যে সব ঘটনা বর্তমান সূরার যুক্তির জন্য প্রাসঙ্গিক নয় তা উত্থাপন করা হয় নাই। এখানে যার উল্লেখ হয়েছে তা নিম্নরূপ :
১) কথোপকথনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে উত্থাপন করা হয়েছে মূর্তিপূঁজার অসারতা সম্বন্ধে।
২) প্রার্থনার মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মোমেন বান্দার জীবনের উদ্দেশ্য শুধু তার নিজস্ব একক জীবনই নয়, তাঁর কাম্য হওয়া উচিত তাঁর পূর্ব পুরুষদের জন্য ক্ষমা , পরবর্তী প্রজন্মের সমৃদ্ধি ও মুক্তি।
৩) অর্ন্তদৃষ্টির সাহায্যে পরলোকের জীবনকে অনুভব ক্ষমতা।
(১) এর বক্তব্যে প্রকাশ ঘটেছে [ ৭০ - ৮২ ] আয়াতে ; (২) এর বক্তব্যের প্রকাশ ঘটেছে [ ৮৩ - ৮৭ ] আয়াতে এবং (৩) এর বক্তব্যের প্রকাশ ঘটেছে [ ৮৮ - ১০২ ] আয়াতে।
৩১৭৬। মূর্তিপূজকরা এই আয়াতের বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়কে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম তৎক্ষণাত বিষয়বস্তুর মূল চেতনাতে আঘাত হানেন এই প্রশ্ন দ্বারা , " কার প্রতি তোমরা তোমাদের নিষ্ঠাকে প্রয়োগ করছো ? এই সব বস্তু কি এই নিষ্ঠারযোগ্য? "
৫৩। ওহীর মাধ্যমে আমি মুসাকে বলেছিলাম , " আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিকালে বের হও; অবশ্যই তোমার পশ্চাদ্ধাবন করা হবে ৩১৬৭।
৩১৬৭। হযরত মুসার মিশর অবস্থানকালে অন্যান্য যে সব অলৌকিক ক্রীয়া কর্ম প্রদর্শন করেন যেমন প্লেগ [ মুসার নয়টি মোজেজা দেখুন আয়াত [ ৭ : ১৩৩ ] ও [ ১৭ : ১০১ ] ] ইত্যাদি বর্তমান যুক্তির ক্ষেত্রে তা অপ্রাসঙ্গিক হওয়াতে তা এখানে উল্লেখ করা হয় নাই। এবারে ইহুদীরেদ মিশর ত্যাগের কাহিনী ও ফেরাউনের পশ্চাদ্ধাবনের কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে। এই কাহিনীর মাধ্যমে তিনটি বিষয়ের তুলনার প্রতি বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। ১) আল্লাহ্র পরিকল্পনা বা সত্য প্রচারের বিরুদ্ধে ফেরাউনের অন্ধ আক্রোশ যা সর্ব যুগে সত্য প্রচার ও প্রসারের বিরুদ্ধে অন্যায় ও মিথ্যার দ্বারা ঘটে থাকে। ২) হযরত মুসার বিশ্বাসের বিপরীতে তার সম্প্রদায়ের লোকদের ভীত মনোভাব। ৩) শেষ পর্যন্ত ইহুদীদের মিশরবাসীর অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এবং অসত্য ও মিথ্যার শক্তির শেষ পরিণাম ধবংস।
৫৪। অতঃপর ফেরাউন সকল শহরে ঘোষক প্রেরণ করেছিলো;
৫৫। [ এই বলে ] : " এই [ ইসরাঈলীরা ] একটি ছোট দল মাত্র।
৫৬। " অথচ তারা আমাদের ক্রোধে উম্মত্ত করেছে ;
৫৭। " এবং আমরা সকলে পূর্ব থেকেই সর্তক ছিলাম।"
৫৮। সুতারাং আমি তাদের বের করে দিয়েছিলাম বাগান ও ঝরণা সমূহ থেকে , ৩১৬৮
৫৫। [ এই বলে ] : " এই [ ইসরাঈলীরা ] একটি ছোট দল মাত্র।
৫৬। " অথচ তারা আমাদের ক্রোধে উম্মত্ত করেছে ;
৫৭। " এবং আমরা সকলে পূর্ব থেকেই সর্তক ছিলাম।"
৫৮। সুতারাং আমি তাদের বের করে দিয়েছিলাম বাগান ও ঝরণা সমূহ থেকে , ৩১৬৮
৩১৬৮। অন্যান্য বহু তফসীরকারদের মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে [ মওলানা ইউসুফ আলী ] এই আয়াতগুলির [২৬ : ৫৮ - ৬০ ] অর্থ আল্লাহ্র ইচ্ছার প্রকাশ এই ভাবে অনুবাদ করেছেন।
৫৯। এবং ধন ভান্ডার ও প্রত্যেক সম্মানজনক অবস্থান থেকে।
৬০। এরূপই ঘটেছিলো, এবং আমি বনী ইসরাঈলীদের এই সমুদয়ের অধিকারী করেছিলাম ৩১৬৯।
৬০। এরূপই ঘটেছিলো, এবং আমি বনী ইসরাঈলীদের এই সমুদয়ের অধিকারী করেছিলাম ৩১৬৯।
৩১৬৯। উদ্যানরাজি, প্রস্রবণ , ধন-ভান্ডার, সুরম্যসৌধমালা ইত্যাদির অধিকারী বনী ইসরাঈলীরা হয়েছিলো, বহু বছর মরূপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর পরে প্যালেস্টাইনে এসে। কিন্তু তারা আবার যখন আল্লাহ্র বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন তারা আবার এসব হারিয়ে ফেলে এবং অন্য সম্প্রদায় [ মুসলমান ] তা অধিকার করে নেয়। কারণ তারা ছিলো প্রকৃত বিশ্বাসী।
উপদেশ : যারা আল্লাহ্র বিধানে বিশ্বাসী ও সেই অনুপাতে জীবন যাপন প্রণালী পরিচালনা করবে আল্লাহ্ তাদের সম্মুখে পৃথিবীর ধনভান্ডার উম্মুক্ত করে দেবেন।
৬১। সুতারাং সূর্যদয়কালে তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছিলো ৩১৭০।
৩১৭০। আয়াত [ ৫৮ - ৬০ ] গুলির মাধ্যমে আল্লাহ্র সার্বজনীন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটানো হয়েছে যা সাম্প্রতিক বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কহীন। এই আয়াত [৬০ ] থেকে আবার পূর্বের কাহিনীর ধারাবাহিকতার বর্ণনা করা হয়েছে।
৬২। যখন দুদল পরস্পরকে দেখলো , তখন মুসার সঙ্গীরা বললো, " নিশ্চয়ই আমরা ধরা পড়ে গেলাম। "
৬৩। [ মুসা ] বলেছিলো, " কখনও নয়! আমার প্রভু আমার সাথে আছেন ! শীঘ্রই তিনি আমাকে [ উদ্ধারের ] পথ দেখাবেন।" ৩১৭১
৬৩। [ মুসা ] বলেছিলো, " কখনও নয়! আমার প্রভু আমার সাথে আছেন ! শীঘ্রই তিনি আমাকে [ উদ্ধারের ] পথ দেখাবেন।" ৩১৭১
৩১৭১। "পথ দেখাবেন" - অর্থাৎ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলে দেবেন। এই আয়াত দ্বারা দেখানো হয়েছে মুসার সম্প্রদায়ের আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলহীনতার বিপরীতে হযরত মুসার অটল অনড় বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা আল্লাহ্র উপরে।
উপদেশ : সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র উপরে অটল নির্ভরশীলতা মোমেন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিপদ বিপর্যয়ের মাঝেই আল্লাহ্ বান্দার ঈমানের পরীক্ষা করে থাকেন।
৬৪। অতঃপর ওহীর মাধ্যমে আমি মুসাকে বললাম , " তোমার লাঠি দ্বারা সাগরকে আঘাত কর।" ফলে তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বত সদৃশ হয়ে গেল।
৬৫। এবং আমি অন্য দলকেও সেখানে পৌঁছিয়ে দিলাম ৩১৭২।
৬৫। এবং আমি অন্য দলকেও সেখানে পৌঁছিয়ে দিলাম ৩১৭২।
৩১৭২। অপর দল অর্থাৎ ফেরাউনের দল। এখানে দুধরনের মোজেজা লক্ষ্য করা যায়। ১) মুসা ও তাঁর সম্প্রদায় নিরাপদে সমুদ্র অতিক্রম করেন; এবং ২) ফেরাউন ও তার অনুসদবর্গ সমুদ্রে ডুবে মারা যায়।
৬৬। আমি মুসা এবং তাঁর সঙ্গী অন্য সকলকেও উদ্ধার করলাম।
৬৭। কিন্তু আমি অপর দলকে নিমজ্জিত করলাম।
৬৮। অবশ্যই এর মাঝে নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বিশ্বাস করে না ৩১৭৩।
৬৭। কিন্তু আমি অপর দলকে নিমজ্জিত করলাম।
৬৮। অবশ্যই এর মাঝে নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বিশ্বাস করে না ৩১৭৩।
৩১৭৩। মুসার ঘটনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে যে উপদেশ ও জ্ঞান দান করা হয়েছে তারই ইঙ্গিত করা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। যে সব লোক নিজের অন্ধ আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে ওঠে , তারা আল্লাহ্র নিদর্শন বুঝতে ও অনুধাবনে অক্ষম হবে। অহংকারের কালো পর্দ্দা তাদের আত্মার স্বচ্ছতাকে ঢেকে দেয়। ফলে তারা চর্মচক্ষু থেকেও প্রকৃত সত্যকে দেখতে পায় না বা অনুধাবন করতে পারে না। এই -ই তাদের উদ্ধত অহংকারের শাস্তি। পরিণামে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় যা ফেরাউনের কাহিনীর মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে। অপর পক্ষে যারা সত্যের জন্য ন্যায়ের জন্য নির্যাতন ভোগ করে এবং নির্যাতন সত্বেও যারা আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা হারায় না , যারা জীবনের সর্বাবস্থায়, সুখে-দুঃখে , সম্পদে, ঐশ্বর্যে , ক্ষমতায় সব সময়ে বিনয়ী এবং কৃতজ্ঞ তারাই তো মোমেন বান্দা। মোমেন বান্দার হৃদয় আল্লাহ্র হেদায়েতের নূরে আলোকিত হয়ে ওঠে এবং পরিণামে আত্মা মোক্ষলাভ করে বা পৃথিবীর দুঃখ-ব্যথা , আশা-আকাঙ্খা , অবিচলতা ও পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয় এবং জাগতিক বন্ধন থেকে আত্মা মুক্তি পায়।
৬৯। তোমার প্রভু নিশ্চয়ই শক্তিতে পরাক্রমশালী , পরম করুণাময় ৩১৭৪।
৩১৭৪। ফেরাউনের কাহিনীর মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, নির্যাতনকারী ও অন্যায়কারীর ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তাদের ষড়যন্ত্র বা প্রতিরোধ বা নির্যাতন কোনও কিছুই আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে ধ্বংস করতে পারবে না। বরং ভালোকে, সত্যকে আল্লাহ্র ইচ্ছাকে বাধাদানের ফলে মন্দ তার নিজের ধ্বংস ডেকে আনে।
রুকু - ৫
৭০। এবং তাদের নিকট ইব্রাহিমের কাহিনীর [ কিছু অংশ ] বর্ণনা কর ৩১৭৫।
৩১৭৫। পরবর্তী আয়াতগুলির মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীমের জীবনীর যে যে অংশ যুক্তি ও উপদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক শুধুমাত্র তাই-ই তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর জীবনের যে সব ঘটনা বর্তমান সূরার যুক্তির জন্য প্রাসঙ্গিক নয় তা উত্থাপন করা হয় নাই। এখানে যার উল্লেখ হয়েছে তা নিম্নরূপ :
১) কথোপকথনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে উত্থাপন করা হয়েছে মূর্তিপূঁজার অসারতা সম্বন্ধে।
২) প্রার্থনার মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মোমেন বান্দার জীবনের উদ্দেশ্য শুধু তার নিজস্ব একক জীবনই নয়, তাঁর কাম্য হওয়া উচিত তাঁর পূর্ব পুরুষদের জন্য ক্ষমা , পরবর্তী প্রজন্মের সমৃদ্ধি ও মুক্তি।
৩) অর্ন্তদৃষ্টির সাহায্যে পরলোকের জীবনকে অনুভব ক্ষমতা।
(১) এর বক্তব্যে প্রকাশ ঘটেছে [ ৭০ - ৮২ ] আয়াতে ; (২) এর বক্তব্যের প্রকাশ ঘটেছে [ ৮৩ - ৮৭ ] আয়াতে এবং (৩) এর বক্তব্যের প্রকাশ ঘটেছে [ ৮৮ - ১০২ ] আয়াতে।
৭১। স্মরণ কর! সে তাঁর পিতা এবং তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলো, " তোমরা কার এবাদত করছো ? "
৭২। তারা বলেছিলো, " আমরা [ দেবতার ] মূর্তিসকল পূঁজা করছি, এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে তাদের পূঁজায় নিয়োজিত থাকবো।" ৩১৭৬
৭২। তারা বলেছিলো, " আমরা [ দেবতার ] মূর্তিসকল পূঁজা করছি, এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে তাদের পূঁজায় নিয়োজিত থাকবো।" ৩১৭৬
৩১৭৬। মূর্তিপূজকরা এই আয়াতের বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়কে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম তৎক্ষণাত বিষয়বস্তুর মূল চেতনাতে আঘাত হানেন এই প্রশ্ন দ্বারা , " কার প্রতি তোমরা তোমাদের নিষ্ঠাকে প্রয়োগ করছো ? এই সব বস্তু কি এই নিষ্ঠারযোগ্য? "
৭৩। সে বলেছিলো, " তোমরা যখন [তাদের ] ডাক, তারা কি শোনে ,অথবা উহারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে ? "
৭৪। তারা বলেছিলো, " না , কিন্তু আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের [আমরা যা করি ] সেরূপ করতে দেখেছি। "
৭৫। সে বলেছিলো, " তোমরা কি ভেবে দেখেছ , কিসের পূঁজা করছো ?
৭৬। " তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা ?
৭৭। " জগত সমূহের প্রভু এবং প্রতিপালক ব্যতীত ; নিশ্চয়ই তারা আমার শত্রু। ৩১৭৭
৭৪। তারা বলেছিলো, " না , কিন্তু আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের [আমরা যা করি ] সেরূপ করতে দেখেছি। "
৭৫। সে বলেছিলো, " তোমরা কি ভেবে দেখেছ , কিসের পূঁজা করছো ?
৭৬। " তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা ?
৭৭। " জগত সমূহের প্রভু এবং প্রতিপালক ব্যতীত ; নিশ্চয়ই তারা আমার শত্রু। ৩১৭৭
৩১৭৭। হযরত ইব্রাহীমের বক্তব্য ছিলো : যে বস্তু তোমরা পূঁজা কর তা মানব সম্প্রদায়ের শত্রু। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে ঐ বস্তুগুলি আমার শত্রু। ওগুলি আমার কোনও উপকার করার ক্ষমতা রাখে না , কিন্তু আমাকে বিপথে চালিত করার ক্ষমতা রাখে। তুলনা কর সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র ক্ষমতার সাথে তাদের অক্ষমতা। আল্লাহ্ আমাকে এবং সারা বিশ্বজাহানকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমার প্রতিপালক এবং জীবন পথের প্রদর্শক। তিনি আমার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। আমার মৃত্যুর পরে তিনি আমাকে পুনরুত্থান করে নূতন জীবন দান করবেন। তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন এবং আমার আত্মাকে মুক্তি দেবেন। এর পরেও কি তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করবে না ? মূর্তিপূঁজা ও আল্লাহ্র এবাদত কি অন্ধকার আলোর সমতুল্য নয় ?
৭৮। " যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাকে সুপথে পরিচালনা করেন।
৭৯। " যিনি আমাকে খাদ্য ও পানীয় দান করেন।
৮০। " এবং যখন আমি অসুস্থ থাকি , তিনিই আমাকে আরোগ্য করেন।
৮১। " যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন এবং তারপরে [ পুণরায় ] জীবিত করবেন।
৮২। " এবং আমি আশা করি তিনি শেষ বিচারের দিনে আমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
৮৩। " হে আমার প্রভু ! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর, এবং আমাকে পূণ্যাত্মাদের সাথে মিলিত করে দাও। " ৩১৭৮
৭৯। " যিনি আমাকে খাদ্য ও পানীয় দান করেন।
৮০। " এবং যখন আমি অসুস্থ থাকি , তিনিই আমাকে আরোগ্য করেন।
৮১। " যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন এবং তারপরে [ পুণরায় ] জীবিত করবেন।
৮২। " এবং আমি আশা করি তিনি শেষ বিচারের দিনে আমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
৮৩। " হে আমার প্রভু ! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর, এবং আমাকে পূণ্যাত্মাদের সাথে মিলিত করে দাও। " ৩১৭৮
৩১৭৮। সত্য ও মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করার পরে হযরত ইব্রাহীম তাঁর অন্তরের ইচ্ছাকে ব্যক্ত করেন প্রার্থনার মাধ্যমে। ১) তিনি তাঁর আত্মাকে উদ্ভাসিত করতে চান স্বর্গীয় জ্ঞানে [ ৮৩ ]। ২) তাঁর জীবন ও আত্মাকে সৎ কার্যে পূর্ণ করতে চান, যেনো তিনি পূণ্যাত্মাদের অর্ন্তভুক্ত হতে পারেন [ ৮৩ ]। ৩) তিনি শুধুমাত্র নিজের জন্য বা তাঁর সমসাময়িক সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করেই পরিতৃপ্ত নন। তিনি ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝেও তার সুকৃতি বিস্তার করতে চান [৮৪]। ৪) তাঁর জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে বেহেশতের সুখ ও শান্তি এবং মোমেন বান্দারূপে আল্লাহ্ দরবারে স্বীকৃতি [৮৫]। ৫) তিনি তাঁর পথভ্রষ্ট পিতা ও অন্যান্য পরলোকগত আত্নীয়দের সাথে তাঁর আধ্যাত্মিক সুখ ও শান্তি ভোগ করতে চান। সে জন্য তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। যেনো শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করেন [ ৮৬ ]।
৮৪। " পরবর্তী [ প্রজন্মের ] মাঝে যারা সত্যবাদী তাদের মধ্যে আমাকে সম্মানীয় করো। " ৩১৭৯
৩১৭৯। দেখুন আয়াত [ ১৯ : ৫০ ]। সূরা মরিয়মে [ ১৯ ] এর হযরত ইব্রাহীম সম্বন্ধে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা তুলনা করুন বর্তমান সূরার আয়াতসমূহের সাথে।
৮৫। " আমাকে পরম সুখের বেহেশতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো।"
৮৬। " আমার পিতাকে ক্ষমা করো, নিশ্চয়ই সে পথভ্রষ্টদের একজন ছিলো। "
৮৭। " যেদিন সকলকে পুণরুত্থিত করা হবে , সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না ; -
৮৮। " যেদিন ধন-সম্পদ বা সন্তান-সন্ততি কোন কাজেই আসবে না ; ৩১৮০
৮৬। " আমার পিতাকে ক্ষমা করো, নিশ্চয়ই সে পথভ্রষ্টদের একজন ছিলো। "
৮৭। " যেদিন সকলকে পুণরুত্থিত করা হবে , সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না ; -
৮৮। " যেদিন ধন-সম্পদ বা সন্তান-সন্ততি কোন কাজেই আসবে না ; ৩১৮০
৩১৮০। এই আয়াতের মাধ্যমে হাশরের দিনের প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন ব্যক্তির ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা কোন কিছুই ব্যক্তির উপকারে আসবে না। যা উপকারে আসবে তা হচ্ছে ব্যক্তির পবিত্র হৃদয়। যে হৃদয় শুধুমাত্র আল্লাহ্র প্রেমে সিক্ত পাপের কালিমা মুক্ত। এই পার্থিব জগতের সেই কাজই আল্লাহ্র কাছে শেষ বিচারের দিনে গ্রহণযোগ্য হবে যা শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিলো। সৎ কাজের উদ্দেশ্য যদি খোদা প্রেম না হয় তবে তা হবে মূল্যহীন। পূণ্যাত্মাদের সম্মুখে বেহেশত এবং পাপীদের সম্মুখে দোযখ উম্মুক্ত হবে সেদিন। পাপ তার প্রকৃত স্বরূপে আর্বিভূত হবে। নিঃসঙ্গ , অসহায় হতাশ ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে পাপীরা। শেষ বিচারের দিনে পাপীদের জন্য মুক্তির সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
৮৯। " শুধুমাত্র সে-ই হবে [ সফলকাম ] যে আল্লাহ্র নিকট নির্দোষ [ পবিত্র ] আত্মা নিয়ে উপস্থিত হবে।"
৯০। পূণ্যাত্মাদের জন্য বেহেশতকে নিকটবর্তী করা হবে , ৩১৮১
৯০। পূণ্যাত্মাদের জন্য বেহেশতকে নিকটবর্তী করা হবে , ৩১৮১
৩১৮১। যারা পৃথিবীতে পাপকে পরিহার করে পবিত্র জীবন যাপন করেছেন , শেষ বিচারের দিনে তাদের সম্মুখে বেহেশত ভাস্বর হবে, বেহেশতের শান্তি তারা অনুভব করবে আত্মার মাঝে। অপরপক্ষে , পাপীরা তাদের সম্মুখে দোযখের আগুন প্রত্যক্ষ করবে। এই পৃথিবীতেই দেখা যায় যে, পূণ্যাত্মা ও পাপীদের মানসিক অবস্থা উপরের বর্ণনার ন্যায়। এই পৃথিবীতেই পূণ্যাত্মারা তাদের আল্লাহ্র নূরে আলোকিত আত্মার মাঝে বেহেশতি শান্তির পরশ অনুভব করেন। অপরপক্ষে পাপীদের আল্লাহ্র নূর বঞ্চিত অন্ধকারচ্ছন্ন আত্মায় বিরাজ করে অস্থিরতা ,যন্ত্রণা , হতাশা , যা দোযখের আগুনের সমতুল্য।
৯১। এবং যারা পাপের পথে গমন করে, [ দোযখের ] আগুন তাদের দৃষ্টিতে পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করা হবে।
৯২। এবং তাদের বলা হবে , " তারা এখন কোথায় ; তোমরা যাদের পূঁজা করতে, -
৯৩। " আল্লাহ্র পরিবর্তে ? তারা কি তোমাদের সাহায্য করতে পারে অথবা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম ? "
৯৪। অতঃপর তাদের এবং যারা পাপের পথে পরিভ্রমণ করে [সকলকে ] জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করা হবে অধোমুখী করে ৩১৮২;-
৯২। এবং তাদের বলা হবে , " তারা এখন কোথায় ; তোমরা যাদের পূঁজা করতে, -
৯৩। " আল্লাহ্র পরিবর্তে ? তারা কি তোমাদের সাহায্য করতে পারে অথবা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম ? "
৯৪। অতঃপর তাদের এবং যারা পাপের পথে পরিভ্রমণ করে [সকলকে ] জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করা হবে অধোমুখী করে ৩১৮২;-
৩১৮২। পাপী এবং যারা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে, তাদের এবং তাদের উপাস্য , এবং সকল পাপের উৎস শয়তান ও তার পরিষদবর্গকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে।
৯৫। এবং ইবলীসের বাহিনীর সকলকেও।
৯৬। সেখানে তারা পরস্পর কলহে লিপ্ত হয়ে বলবে,
৯৭। " আল্লার্হ শপথ, আমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিলাম , ৩১৮৩
৯৬। সেখানে তারা পরস্পর কলহে লিপ্ত হয়ে বলবে,
৯৭। " আল্লার্হ শপথ, আমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিলাম , ৩১৮৩
৩১৮৩। যারা পাপী ও আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলো। তাদের সকলের সম্মুখে তাদের ভুল বা বিভ্রান্তি সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে। তাদের আক্ষেপকেই এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তারা আক্ষেপ করে বলবে যে, " আমরা তো পৃথিবীতে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিলাম। আমাদের এই বিভ্রান্তি পূর্বেই উপলব্ধি করা উচিত ছিলো, কারণ আল্লাহ্র একত্বের নিদর্শন পৃথিবীব্যপী ছড়ানো ছিলো, তার করুণাধারা, অমিয় ধারা বিশ্বচরাচরকে পরিব্যপ্ত করে রেখেছিলো , কিন্তু আমরা তা অনুধাবনে ব্যর্থ হই। হাশরের ময়দানে তাদের এই উপলব্ধি ঘটবে কারণ তাদের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হবে।
৯৮। " যখন তোমাদের জগৎ সমূহের প্রভুর সঙ্গে সমান বলে গ্রহণ করেছিলাম ;
৯৯। " এবং আমাদের প্রলুব্ধকারী ছিলো তারাই যারা পাপে ছিলো [ আকণ্ঠ ] নিমজ্জিত ৩১৮৪।
৯৯। " এবং আমাদের প্রলুব্ধকারী ছিলো তারাই যারা পাপে ছিলো [ আকণ্ঠ ] নিমজ্জিত ৩১৮৪।
৩১৮৪। হাশরের ময়দানে প্রত্যেকে তাঁদের কর্মফলকে প্রত্যক্ষ করবে। তাদের কাজে যারা পথপ্রদর্শক ছিলো, যারা তাদের পাপের পথে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করে প্রভাবিত করেছিলো, তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হবে। সেদিন পাপী এবং পাপকার্যে প্ররোচনাকারী উভয়েই বিচারের সম্মুখীন হবে এবং উভয়কেই শাস্তি দান করা হবে। পাপীদের মনে আক্ষেপের আগুন প্রজ্জ্বলিত হবে এই ভেবে যে, কেন পূর্বেই তারা এসব প্ররোচনাকারীদের স্বরূপ বুঝতে পারে নাই ? যদি পারতো তবে কি তারা এসব দুষ্কৃতিকারীদের অনুসরণ করতো যারা নিজেরাই শাস্তির যোগ্য ? পাপ কাজ এ ভাবেই বিভ্রান্তির দ্বারা প্রকৃত দুষ্কৃতিকারীদের সনাক্ত করতে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। পাপীরা সঠিক পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথ গ্রহণ করে এবং দৃষ্কৃতিকারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। যদিও তদের পুণঃ পুণঃ সর্তক করা হয়েছিলো। এটা ছিলো তাদের জন্য নির্বুদ্ধিতা।
১০০। " এখন আমাদের না আছে কোন সুপারিশকারী ;
১০১। " না আছে কোন দরদী বন্ধু।
১০২। " এখন যদি আমাদের [ দুনিয়ায় ] ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হতো তবে আমরা অবশ্যই বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।" ৩১৮৫
১০১। " না আছে কোন দরদী বন্ধু।
১০২। " এখন যদি আমাদের [ দুনিয়ায় ] ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হতো তবে আমরা অবশ্যই বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।" ৩১৮৫
৩১৮৫। পাপীরা সেদিন হাহাকার করবে আর একবার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের এই হাহাকার প্রকৃত পক্ষে আন্তরিক নয়। যদি তাদের সত্যিকারের ভাবে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হতো , তবে তারা অনুতাপের মাধ্যমে সঠিক পথে চলার পরিবর্তে , আবার ভ্রান্ত পথে, পাপ কাজে নিমজ্জিত হতো [ ৬ : ২৭ - ২৮ ]। কারণ পাপী ব্যক্তিরা হচ্ছে মিথ্যাবাদী - আর মিথ্যাবাদী মাত্রই হবে মোনাফেক। মোনাফেক এবং মিথ্যাবাদীরা যা বলে এবং প্রতিজ্ঞা করে তার প্রতি তারা কখনও বিশ্বস্ত নয়। এই অভ্যেস তাদের চরিত্রের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সুতারাং তাদের পক্ষে প্রকৃত বিশ্বস্ততা অর্জন করা সম্ভব নয়। যদি তাদের আর একবার সুযোগ দেয়া হয় , তবে তারা আবারও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবে, কারণ পূর্বেই পৃথিবীতে তাদের পাপের পথ ত্যাগ করে সৎপথে ফিরে আসার জন্য বহু বার সুযোগ আল্লাহ্ দান করেছেন। কিন্তু তারা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে তা অসৎ কাজে ও পাপের পথে ব্যয় করে।
১০৩। অবশ্যই ইহাতে [ ইব্রাহীমের কাহিনীতে ] এক নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ লোকই বিশ্বাস করে না।
১০৪। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী ,পরম করুণাময়।
১০৪। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী ,পরম করুণাময়।
রুকু - ৬
৩১৮৬। নূহ্ এর সম্প্রদায় আল্লাহ্র বিধানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত ছিলো। তারা পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের নিকট প্রেরিত আল্লাহ্র হুকুম সমূহ মিথ্যা জ্ঞানে অস্বীকার করে পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত থাকতো। আল্লাহ্ নূহ্ কে প্রেরণ করেন তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য। নূহ্ ছিলেন তাদেরই সম্প্রদায়ের একজন [ তাদের ভাই ]। সুতারাং নূহ্ এর পূত পবিত্র জীবন, তাঁর স্বচ্ছ চারিত্রিক গুণাবলী তার সম্প্রদায়ের লোকেরা অবগত ছিলো [ যেমন ছিলো কোরেশরা হযরত মুহম্মদ [সা] এর চরিত্র সম্বন্ধে ]। আল্লাহ্র অন্যান্য পয়গম্বরদের ন্যায় নূহ্ এর অন্তঃকরণ ও চরিত্র ছিলো পূত পবিত্র, তাঁর বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিলো প্রশ্নাতীত। এ রকম এক ব্যক্তি যখন আল্লাহ্র আনুগত্যের দিকে আহ্বান করে তখনও কি তারা তা গ্রহণ করবে না ? তবুও কি তারা ভ্রান্ত পথ ত্যাগ করে সুপথে আসবে না ?
৩১৮৭। 'Amin' কাহারও উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা। শব্দটির দ্বারা বিভিন্ন ভাবকে প্রকাশ করা হয় যেগুলির হচ্ছে নিম্নরূপ :
১) বিশ্বাসভাজন ; ২) পয়গম্বরগণ যেরূপ আল্লাহ্র বাণী প্রচারের জন্য দায়বদ্ধ সেরূপ, ন্যস্ত দ্রব্য প্রর্ত্যাবর্তনের জন্য দায়বদ্ধ। ৩) পয়গম্বরগণ যেরূপ আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথের সঠিক ও নির্ভুল অনুসরণ দ্বারা আল্লাহ্র বাণী প্রচার করে থাকেন ,নিজস্ব কোনও প্রভাব থাকে না ঠিক সেরূপভাবে নিজ দায়িত্বভার অনুসরণ করা। ৪) নিজস্ব কোনও স্বার্থের অনুসন্ধান না করা।
৩১৮৮। লক্ষ্য করুণ কিভাবে পুণরাবৃত্তি দ্বারা যুক্তির সমাপ্তি করা হয়েছে। দেখুন যুক্তির পক্ষে টিকা ৩১৮৬।
৩১৮৯। হযরত নূহ্ এর সম্প্রদায়ের নেতারা যে ভাবে নূহ্ এর প্রচারিত সত্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্বাচারণ করেছিলো , বহু বছর পরে আরবের নবী হযরত মুহম্মদের [ সা ] বিরুদ্ধেও কোরেশ নেতারা একই ভাবে বিরুদ্ধাচারণ করে। "আমরা জানি আপনার জীবন নির্মল এবং চরিত্র নিষ্কলঙ্ক এবং বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। কিন্তু আপনার অনুসারীরা তো হচ্ছে গরীব ও নিম্ন লোকেরা। আপনি কি আশা করেন আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন দ্বারা আমরা নিজেদের ঐসব লোকের সমগোত্রীয় করে ফেলি ? " নূহ্ এর উত্তর ছিলো, " তাদের বিরুদ্ধে বলার মত কোনও কথা আমার জানা নাই। যদি তারা কোনও পাপ করে থাকে তবে তার জবাবদিহিতা একমাত্র আল্লাহ্র কাছে। কিভাবে আমি তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি যেখানে আল্লাহ্ আমাকে জনসাধারণকে সর্তককারীরূপে প্রেরণ করেছেন ? "
৩১৯০। দেখুন আয়াত [ ১১ : ২৯ ]। ধনী-গরীব, গুণী নির্গুণ সকলেই আল্লাহ্র বান্দা। যারা আল্লাহ্র বাণী শুনতে চায় পয়গম্বরদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের নিকট সেই অমিয় বাণীর ধারা পৌঁছে দেয়া। আল্লাহ্র বাণী শোনার অধিকার প্রতিটি মোমেন বান্দার। পার্থিব ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, উচ্চ-নীচ বংশ, সমাজের হরিজন বা নীচু শ্রেণী, রাজপুরুষ বা উচু শ্রেণী এই বাণীর অধিকার সকলের সমান। সেই কারণে আল্লাহ্র পয়গম্বররা ধনী-গরীব, উচ্চ - নীচ সকলকে সমানভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় আহ্বান করেন।
৩১৯১। আরও দুইটা ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নবীদের তাঁর সম্প্রদায়ের লোকের পাথর নিক্ষেপে হত্যার ভয় দেখায় : একটি ছিলো হযরত ইব্রাহীমের ক্ষেত্রে [ ১৯ : ৪৬ ] অপরটি হচ্ছে সুয়েব নবীর ক্ষেত্রে [ ১১ : ৯১ ]। উভয় ক্ষেত্রেই পাথর নিক্ষেপে হত্যার ভয় তাদের কর্তব্য কর্ম থেকে নিবৃতি করতে পারে নাই। বরং আল্লাহ্র শাস্তি তাদের ভীত করে তোলে। একই ঘটনা ঘটেছিলো হযরত নূহ্ ও আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ [ সা ] এর জীবনে।
৩১৯২। হযরত নূহ্ এর কাহিনী বলা হয়েছে আয়াতে [১১ : ৩৬ - ৪৮ ]। এই সূরাতে কাহিনীর বিশেষ অংশের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। নূহের ধৈর্য্য, জীবনের আশঙ্কার ভীতির বিরুদ্ধে তার দৃঢ়তা এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র সত্য-ই সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয় লাভ করে এবং স্থায়ীত্ব অর্জন করে; এই বৈশিষ্ট্য গুলির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এই সূরাতে।
৩১৯৩। এই লাইনটি গানের ধূয়ার প্রধান সুরের মত পরবর্তীতে বহুবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এক একটি কাহিনীর শেষে। এই লাইনটির মাধ্যমে বিষয়বস্তুর মর্মার্থকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যুগে যুগে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে বিভিন্ন নবী রসুলদের দ্বারা কিভাবে আল্লাহ্র বাণী প্রচারিত হয়েছে এবং সত্য বিজয় লাভ করেছে তারই প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা শেষে উক্ত লাইনটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। দেখুন আয়াত [২৬ : ৮ - ৯ , ৬৮ - ৬৯, ১০৩ - ১০৪ , ১২১-১২২, ১৩৯-১৪০, ১৫৮- ১৫৯, ১৭৪ - ১৭৫, ১৯০-১৯১]।
রুকু - ৭
৩১৯৪। আ'দ সম্প্রদায়ের বিশদ বর্ণনার জন্য দেখুন আয়াত [ ৭ : ৬৫ ] এবং টিকা ১০৪০। এই সূরাতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তাদের যে বৈশিষ্ট্যের উপরে তা হচ্ছে , আ'দ সম্প্রদায় পার্থিব বিষয়বস্তু ও পশু শক্তি ব্যতীত আর কিছুই বিশ্বাস করতো না। তারা মনে করতো যে তাদের সম্পদ ও দুর্ভেদ্য দুর্গ তাদের অনন্ত নিরাপত্তা দান করবে। কিন্তু তারা যখন আল্লাহ্র বাণীকে প্রত্যাখান করলো, তাদের এই জাগতিক সম্পদ ও নিরাপত্তা তাদের রক্ষা করতে পারলো না।
৩১৯৫। দেখুন উপরের আয়াত। আয়াত [ ২৬ : ১০৭ ] এর টিকা ৩১৮৭।
৩১৯৬। যে সভ্যতা শুধুমাত্র বস্তুগত আরাম আয়েশ এবং জাগতিক অর্থ -সম্পদের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয় সেই সভ্যতার বিশেষত্ব এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের এই সব অধিবাসীদের বিশেষত্ব হচ্ছে , তারা তাদের অর্থ -সম্পদ সম্বন্ধে আড়ম্বর ও প্রদর্শন করতে ভালোবাসবে। এই প্রদর্শনী মনোভাব থেকে তারা প্রকাশ্য স্থানে স্মৃতি স্তম্ভ তৈরী করে থাকে তাদের কীর্তিকে অক্ষয় করে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু হায় কালের অতল গহ্বরে তাদের সেই কীর্তি একদিন ধ্বংস হয়ে যায়।
১০৫। নূহ্ এর সম্প্রদায়ের লোকেরা রাসুলকে প্রত্যাখান করেছিলো।
১০৬। স্মরণ কর ! তাদের ভাই নূহ্ তাদের বলেছিলো , " তোমরা কি [আল্লাহ্কে ] ভয় করবে না ? ৩১৮৬
১০৬। স্মরণ কর ! তাদের ভাই নূহ্ তাদের বলেছিলো , " তোমরা কি [আল্লাহ্কে ] ভয় করবে না ? ৩১৮৬
৩১৮৬। নূহ্ এর সম্প্রদায় আল্লাহ্র বিধানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত ছিলো। তারা পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের নিকট প্রেরিত আল্লাহ্র হুকুম সমূহ মিথ্যা জ্ঞানে অস্বীকার করে পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত থাকতো। আল্লাহ্ নূহ্ কে প্রেরণ করেন তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য। নূহ্ ছিলেন তাদেরই সম্প্রদায়ের একজন [ তাদের ভাই ]। সুতারাং নূহ্ এর পূত পবিত্র জীবন, তাঁর স্বচ্ছ চারিত্রিক গুণাবলী তার সম্প্রদায়ের লোকেরা অবগত ছিলো [ যেমন ছিলো কোরেশরা হযরত মুহম্মদ [সা] এর চরিত্র সম্বন্ধে ]। আল্লাহ্র অন্যান্য পয়গম্বরদের ন্যায় নূহ্ এর অন্তঃকরণ ও চরিত্র ছিলো পূত পবিত্র, তাঁর বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিলো প্রশ্নাতীত। এ রকম এক ব্যক্তি যখন আল্লাহ্র আনুগত্যের দিকে আহ্বান করে তখনও কি তারা তা গ্রহণ করবে না ? তবুও কি তারা ভ্রান্ত পথ ত্যাগ করে সুপথে আসবে না ?
১০৭। " আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বাসযোগ্য রাসুল ৩১৮৭।
১০৮। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর। "
১০৮। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর। "
৩১৮৭। 'Amin' কাহারও উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা। শব্দটির দ্বারা বিভিন্ন ভাবকে প্রকাশ করা হয় যেগুলির হচ্ছে নিম্নরূপ :
১) বিশ্বাসভাজন ; ২) পয়গম্বরগণ যেরূপ আল্লাহ্র বাণী প্রচারের জন্য দায়বদ্ধ সেরূপ, ন্যস্ত দ্রব্য প্রর্ত্যাবর্তনের জন্য দায়বদ্ধ। ৩) পয়গম্বরগণ যেরূপ আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথের সঠিক ও নির্ভুল অনুসরণ দ্বারা আল্লাহ্র বাণী প্রচার করে থাকেন ,নিজস্ব কোনও প্রভাব থাকে না ঠিক সেরূপভাবে নিজ দায়িত্বভার অনুসরণ করা। ৪) নিজস্ব কোনও স্বার্থের অনুসন্ধান না করা।
১০৯। " এর জন্য আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না ; আমার পুরষ্কার রয়েছে শুধুমাত্র জগৎসমূহের প্রভুর নিকট।
১১০। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর। " ৩১৮৮
১১০। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর। " ৩১৮৮
৩১৮৮। লক্ষ্য করুণ কিভাবে পুণরাবৃত্তি দ্বারা যুক্তির সমাপ্তি করা হয়েছে। দেখুন যুক্তির পক্ষে টিকা ৩১৮৬।
১১১। তারা বলেছিলো ; " ইতর জনেরা তোমার অনুসরণ করছে জেনেও কি আমরা তোমার [ কথায় ] ঈমান আনতে পারি ? " ৩১৮৯
৩১৮৯। হযরত নূহ্ এর সম্প্রদায়ের নেতারা যে ভাবে নূহ্ এর প্রচারিত সত্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্বাচারণ করেছিলো , বহু বছর পরে আরবের নবী হযরত মুহম্মদের [ সা ] বিরুদ্ধেও কোরেশ নেতারা একই ভাবে বিরুদ্ধাচারণ করে। "আমরা জানি আপনার জীবন নির্মল এবং চরিত্র নিষ্কলঙ্ক এবং বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। কিন্তু আপনার অনুসারীরা তো হচ্ছে গরীব ও নিম্ন লোকেরা। আপনি কি আশা করেন আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন দ্বারা আমরা নিজেদের ঐসব লোকের সমগোত্রীয় করে ফেলি ? " নূহ্ এর উত্তর ছিলো, " তাদের বিরুদ্ধে বলার মত কোনও কথা আমার জানা নাই। যদি তারা কোনও পাপ করে থাকে তবে তার জবাবদিহিতা একমাত্র আল্লাহ্র কাছে। কিভাবে আমি তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি যেখানে আল্লাহ্ আমাকে জনসাধারণকে সর্তককারীরূপে প্রেরণ করেছেন ? "
১১২। সে বলেছিলো, " তারা কি করতো তার আমি কি জানি ?
১১৩। " তাদের হিসাব রয়েছে শুধুমাত্র আমার প্রভুর কাছে, যদি তোমরা তা বুঝতে পারতে।
১১৪। " যারা ঈমান এনেছে আমি তো তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি না ৩১৯০।
১১৫। " আমি তো প্রেরিত হয়েছি শুধুমাত্র প্রকাশ্য সর্তককারী হিসেবে।"
১১৩। " তাদের হিসাব রয়েছে শুধুমাত্র আমার প্রভুর কাছে, যদি তোমরা তা বুঝতে পারতে।
১১৪। " যারা ঈমান এনেছে আমি তো তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি না ৩১৯০।
১১৫। " আমি তো প্রেরিত হয়েছি শুধুমাত্র প্রকাশ্য সর্তককারী হিসেবে।"
৩১৯০। দেখুন আয়াত [ ১১ : ২৯ ]। ধনী-গরীব, গুণী নির্গুণ সকলেই আল্লাহ্র বান্দা। যারা আল্লাহ্র বাণী শুনতে চায় পয়গম্বরদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের নিকট সেই অমিয় বাণীর ধারা পৌঁছে দেয়া। আল্লাহ্র বাণী শোনার অধিকার প্রতিটি মোমেন বান্দার। পার্থিব ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, উচ্চ-নীচ বংশ, সমাজের হরিজন বা নীচু শ্রেণী, রাজপুরুষ বা উচু শ্রেণী এই বাণীর অধিকার সকলের সমান। সেই কারণে আল্লাহ্র পয়গম্বররা ধনী-গরীব, উচ্চ - নীচ সকলকে সমানভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় আহ্বান করেন।
১১৬। তারা বলেছিলো, " হে নূহ্! তুমি যদি ক্ষান্ত না হও ! তোমাকে পাথরের আঘাতে [ হত্যা ] করা হবে ৩১৯১।"
৩১৯১। আরও দুইটা ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নবীদের তাঁর সম্প্রদায়ের লোকের পাথর নিক্ষেপে হত্যার ভয় দেখায় : একটি ছিলো হযরত ইব্রাহীমের ক্ষেত্রে [ ১৯ : ৪৬ ] অপরটি হচ্ছে সুয়েব নবীর ক্ষেত্রে [ ১১ : ৯১ ]। উভয় ক্ষেত্রেই পাথর নিক্ষেপে হত্যার ভয় তাদের কর্তব্য কর্ম থেকে নিবৃতি করতে পারে নাই। বরং আল্লাহ্র শাস্তি তাদের ভীত করে তোলে। একই ঘটনা ঘটেছিলো হযরত নূহ্ ও আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ [ সা ] এর জীবনে।
১১৭। সে বলেছিলো, " হে আমার প্রভু! আমার সম্প্রদায় প্রকৃতই আমাকে প্রত্যাখান করেছে,
১১৮। " অতএব , তুমি আমার ও ওদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিচার করে দাও , এবং আমাকে ও আমার সাথে বিশ্বাসীগণ যারা আছে তাদের উদ্ধার কর।"
১১৯। সুতারাং আমি তাকে এবং তার সাথে যারা ছিলো সকলকে , [ প্রাণীতে ] পরিপূর্ণ নৌযানে উদ্ধার করলাম , ৩১৯২।
১১৮। " অতএব , তুমি আমার ও ওদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিচার করে দাও , এবং আমাকে ও আমার সাথে বিশ্বাসীগণ যারা আছে তাদের উদ্ধার কর।"
১১৯। সুতারাং আমি তাকে এবং তার সাথে যারা ছিলো সকলকে , [ প্রাণীতে ] পরিপূর্ণ নৌযানে উদ্ধার করলাম , ৩১৯২।
৩১৯২। হযরত নূহ্ এর কাহিনী বলা হয়েছে আয়াতে [১১ : ৩৬ - ৪৮ ]। এই সূরাতে কাহিনীর বিশেষ অংশের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। নূহের ধৈর্য্য, জীবনের আশঙ্কার ভীতির বিরুদ্ধে তার দৃঢ়তা এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র সত্য-ই সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয় লাভ করে এবং স্থায়ীত্ব অর্জন করে; এই বৈশিষ্ট্য গুলির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এই সূরাতে।
১২০। এরপরে যারা পিছনে পড়ে রইল, তাদের আমি ডুবিয়ে দিলাম।
১২১। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই [ এতে ] বিশ্বাস করে না ৩১৯৩।
১২২। এবং অবশ্যই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী , পরম করুণাময়।
১২১। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই [ এতে ] বিশ্বাস করে না ৩১৯৩।
১২২। এবং অবশ্যই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী , পরম করুণাময়।
৩১৯৩। এই লাইনটি গানের ধূয়ার প্রধান সুরের মত পরবর্তীতে বহুবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এক একটি কাহিনীর শেষে। এই লাইনটির মাধ্যমে বিষয়বস্তুর মর্মার্থকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যুগে যুগে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে বিভিন্ন নবী রসুলদের দ্বারা কিভাবে আল্লাহ্র বাণী প্রচারিত হয়েছে এবং সত্য বিজয় লাভ করেছে তারই প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা শেষে উক্ত লাইনটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। দেখুন আয়াত [২৬ : ৮ - ৯ , ৬৮ - ৬৯, ১০৩ - ১০৪ , ১২১-১২২, ১৩৯-১৪০, ১৫৮- ১৫৯, ১৭৪ - ১৭৫, ১৯০-১৯১]।
রুকু - ৭
১২৩। আ'দ [সম্প্রদায় ] রাসুলকে প্রত্যাখান করেছিলো ৩১৯৪।
৩১৯৪। আ'দ সম্প্রদায়ের বিশদ বর্ণনার জন্য দেখুন আয়াত [ ৭ : ৬৫ ] এবং টিকা ১০৪০। এই সূরাতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তাদের যে বৈশিষ্ট্যের উপরে তা হচ্ছে , আ'দ সম্প্রদায় পার্থিব বিষয়বস্তু ও পশু শক্তি ব্যতীত আর কিছুই বিশ্বাস করতো না। তারা মনে করতো যে তাদের সম্পদ ও দুর্ভেদ্য দুর্গ তাদের অনন্ত নিরাপত্তা দান করবে। কিন্তু তারা যখন আল্লাহ্র বাণীকে প্রত্যাখান করলো, তাদের এই জাগতিক সম্পদ ও নিরাপত্তা তাদের রক্ষা করতে পারলো না।
১২৪। স্মরণ কর তাদের ভ্রাতা হুদ তাদের বলেছিলো , " তোমরা কি [ আল্লাহ্কে ] স্মরণ করবে না ?
১২৫। " আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বাসযোগ্য রাসুল। ৩১৯৫
১২৫। " আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বাসযোগ্য রাসুল। ৩১৯৫
৩১৯৫। দেখুন উপরের আয়াত। আয়াত [ ২৬ : ১০৭ ] এর টিকা ৩১৮৭।
১২৬। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর।
১২৭। "এর জন্য আমি তো কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরষ্কার তো শুধু জগহসমূহের প্রভুর নিকট রয়েছে।
১২৮। " তোমরা কি চিত্ত বিনোদনের জন্য প্রতিটি উচ্চ স্থানে বিশেষ চিহ্ন নির্মাণ করছো ? ৩১৯৬
১২৭। "এর জন্য আমি তো কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরষ্কার তো শুধু জগহসমূহের প্রভুর নিকট রয়েছে।
১২৮। " তোমরা কি চিত্ত বিনোদনের জন্য প্রতিটি উচ্চ স্থানে বিশেষ চিহ্ন নির্মাণ করছো ? ৩১৯৬
৩১৯৬। যে সভ্যতা শুধুমাত্র বস্তুগত আরাম আয়েশ এবং জাগতিক অর্থ -সম্পদের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয় সেই সভ্যতার বিশেষত্ব এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের এই সব অধিবাসীদের বিশেষত্ব হচ্ছে , তারা তাদের অর্থ -সম্পদ সম্বন্ধে আড়ম্বর ও প্রদর্শন করতে ভালোবাসবে। এই প্রদর্শনী মনোভাব থেকে তারা প্রকাশ্য স্থানে স্মৃতি স্তম্ভ তৈরী করে থাকে তাদের কীর্তিকে অক্ষয় করে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু হায় কালের অতল গহ্বরে তাদের সেই কীর্তি একদিন ধ্বংস হয়ে যায়।
১২৯। " আর তোমরা কি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করছো এই আশায় যে তোমরা সেখানে [ চিরদিন ] থাকবে ?
১৩০। " যখন তোমরা আঘাত হান , তখন কি তোমরা স্বেচ্ছাচারী লোকের মত হয়ে যাও ? " ৩১৯৭
১৩০। " যখন তোমরা আঘাত হান , তখন কি তোমরা স্বেচ্ছাচারী লোকের মত হয়ে যাও ? " ৩১৯৭
৩১৯৭। এ সব জাগতিক বিষয় বুদ্ধি সম্পন্ন লোক যারা শুধু আড়ম্বর প্রদর্শন ভালোবাসে তাদের বৈশিষ্ট্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা হবে দুর্বলের প্রতি কোনওরূপ দয়ামায়া প্রদর্শনে অপারগ। এরা হয় দুর্বলের প্রতি অত্যাচারী মনোভাব সম্পন্ন।
১৩১। " এখন আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর ৩১৯৮।
১৩২। " হ্যাঁ, তাকেই ভয় কর যিনি তোমাদের মুক্ত হস্তে দান করেছেন তোমরা যা কিছু জান। ৩১৯৯
১৩২। " হ্যাঁ, তাকেই ভয় কর যিনি তোমাদের মুক্ত হস্তে দান করেছেন তোমরা যা কিছু জান। ৩১৯৯
৩১৯৮। দেখুন টিকা ৩১৮৮।
৩১৯৯। " মুক্ত হস্তে দান করেছেন " বাক্যটির অর্থ, পার্থিব ও অপার্থিব যা কিছু আমাদের জীবনকে সুন্দর করে , সমৃদ্ধ করে, সব কিছুই আল্লাহ্র দান - তাঁর বান্দাদের জন্য। জাগতিক বিষয় বস্তু ও ধন-সম্পদ হচ্ছে পার্থিব দান। আবার জ্ঞান এবং জ্ঞানকে জীবনের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করার ক্ষমতা , যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়, জীবন সুন্দর হয়, সমৃদ্ধ হয়, মার্জিত হয় সে সবই আল্লাহ্র 'দান' তাঁর বান্দাদের জন্য। " আন-আম" অর্থাৎ গৃহপালিত পশু ! পশুর সংখ্যা প্রাচীন কালে পরিগণিত হতো অর্থ-সম্পদের প্রতীক হিসেবে। আবার পুত্র সন্তানকে পরিগণিত করা হতো জনশক্তির প্রতীক হিসেবে। অর্থাৎ 'জনবল' হচ্ছে ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক। 'উদ্যান ও প্রস্রবণ ' হচ্ছে আনন্দ ও পরিতৃপ্ত হওয়ার বিষয় বস্তুর প্রতীক। এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে প্রতীক অর্থে , জীবনের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাকে বোঝানোর জন্য। দেখুন নিচের আয়াত সমূহ।
১৩৩। " মুক্ত হস্তে তিনি তোমাদের দান করেছেন , গৃহপালিত পশু, সন্তান - সন্ততি , -
১৩৪। " এবং উদ্যান ও প্রস্রবণ।
১৩৫। "সত্যই আমি তোমাদের জন্য মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করি।" ৩২০০
১৩৪। " এবং উদ্যান ও প্রস্রবণ।
১৩৫। "সত্যই আমি তোমাদের জন্য মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করি।" ৩২০০
৩২০০। তোমরা আল্লাহ্র দানসমূহের অপব্যবহার করেছ। সুতারাং তোমাদের অনুচিত বিনিয়োগের শাস্তি তোমরা লাভ করবে। এই আশঙ্কাই এই আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে।
১৩৬। তারা বলেছিলো, " তুমি আমাদের উপদেশ দাও অথবা নাই দাও, উভয়েই আমাদের জন্য সমান ! ৩২০১
৩২০১। আ'দ সম্প্রদায়ের উদ্ধত অহংকারকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের নবী হুদ কে উদ্দেশ্য করে তারা এই উক্তি করেছিলো।
১৩৭। " এটা তো চির প্রচলিত পুরাতন স্বভাব ; ৩২০২
৩২০২। হুদ নবীর পূর্বেও কিছু ব্যক্তি নবী হওয়ার দাবী করেছিলো। এটা কোনও নূতন উক্তি ছিলো না। তাই কাফেররা বলেছিলো যে ,এ কোন নূতন কথা নয়। ধর্মের শত্রুরা সব সময়েই এ সব কথা বলে থাকে। তারা বলে যে, " তুমি শুধু তো ধর্মের নামে প্রাচীন কালের কুসংস্কারের প্রচলন করতে প্রয়াস পাচ্ছ। কারণ তুমি ধর্মের মাদকতার দ্বারা সকলকে বশীভূত করতে চাও। পরকাল ও পরকালের হিসাব বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নাই। শস্তি প্রাপ্ত বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নাই।"
১৩৮। " এবং আমরা শাস্তি প্রাপ্তদের শামিল নই!"
১৩৯। সুতারাং তারা তাকে প্রত্যাখান করেছিলো এবং আমি তাদের ধ্বংস করেছিলাম ; অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন;কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করে না।
১৪০। অবশ্যই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী এবং পরম করুণাময়।
১৩৯। সুতারাং তারা তাকে প্রত্যাখান করেছিলো এবং আমি তাদের ধ্বংস করেছিলাম ; অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন;কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করে না।
১৪০। অবশ্যই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী এবং পরম করুণাময়।
রুকু - ৮
১৪১। সামুদ [ সম্প্রদায় ] রাসুলকে প্রত্যাখান করেছিলো ৩২০৩।
৩২০৩। সামুদ সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন টিকা ১০৪৩ এবং আয়াত [ ৭ : ৭৩ ]। সামুদ জাতি প্রস্তর ভাস্কর্যের অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছিলো। এ ব্যতীত কৃষিকার্যে সাফল্য তাদের প্রভূত ধন-সম্পদের অধিকারী করে। তাদের সম্পদ ও ব্যবহারিক জ্ঞান তাদের উদ্ধত অহংকারী করে তোলে। তারা নিজেদের বিশেষ মর্যদাপূর্ণ বলে ভাবতে শেখে এবং গরীবদের নির্যাতন করতে তাদের বিবেক নিপীড়িত হতো না। এই আয়াত ও পরর্বতী আয়াত গুলির মাধ্যমে যে উপদেশের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ : " গরীবকে শোষণ ও নির্যাতন করে এবং আল্লাহ্র নিদর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে কতদিন তোমরা তোমাদের সম্পদ ও প্রতিপত্তি ধরে রাখতে পারবে ? " সামুদ জাতির সম্বন্ধে পাথরে উৎকীর্ণ লিপি আছে আল্ হিজর শহরের প্রস্তর খোদিত ভবনসমূহের গাত্রে। এ সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে এই সূরার শেষে পরিশিষ্টে।
১৪২। স্মরণ কর, তাদের ভ্রাতা সালেহ তাদের বলেছিলো, " তোমরা কি [আল্লাহ্কে ] ভয় করবে না ?
১৪৩। " আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বাসযোগ্য রাসুল।
১৪৪। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর।
১৪৫। "এর জন্য আমি তো তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরষ্কার রয়েছে জগতসমূহের প্রভুর নিকট।
১৪৬। " তোমাদের কি নিরাপদ অবস্থায় [ উপভোগের জন্য ] ছেড়ে রাখা হবে , যা এখানে আছে তাতে,
১৪৭। " উদ্যানসমূহে এবং প্রস্রবণ সমূহে;
১৪৮। " এবং শষ্য ক্ষেত্র এবং [ফলভারে নত ] সুকোমল গুচ্ছ বিশিষ্ট খেজুর বাগানে ? " ৩২০৪
১৪৩। " আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বাসযোগ্য রাসুল।
১৪৪। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর।
১৪৫। "এর জন্য আমি তো তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরষ্কার রয়েছে জগতসমূহের প্রভুর নিকট।
১৪৬। " তোমাদের কি নিরাপদ অবস্থায় [ উপভোগের জন্য ] ছেড়ে রাখা হবে , যা এখানে আছে তাতে,
১৪৭। " উদ্যানসমূহে এবং প্রস্রবণ সমূহে;
১৪৮। " এবং শষ্য ক্ষেত্র এবং [ফলভারে নত ] সুকোমল গুচ্ছ বিশিষ্ট খেজুর বাগানে ? " ৩২০৪
৩২০৪। ফলভারে খেজুর বৃক্ষে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর ধরে থাকে। খেজুর গুচ্ছ লম্বা ডাটার অগ্রে ঝুলে থাকে। শষ্য ক্ষেত্র এবং খেজুর বাগানের জন্য সামুদ জাতি অতিশয় গর্বিত ছিলো। কৃষিক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা , ইমারত তৈরীতে তাদের ভাস্কর্যের নৈপূণ্য তাদের অহংকারে স্ফীত করে তোলে। তাদের এই ভাষ্কর্যের বৈশিষ্ট্যের সাথে পরবর্তীতে রোমানদের ভাষ্কর্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
উপদেশ : পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতা মানুষকে উদ্ধত অহংকারী করে তোলে , কারণ তারা স্রষ্টার দানকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়।
১৪৯। " এবং তোমরা তো নৈপুণ্যের সাথে [ কঠিন ] পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করেছ।
১৫০। "তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর ;
১৫১। " এবং যারা অমিতব্যয়ী তাদের আদেশ অনুসরণ করো না, ৩২০৫
১৫০। "তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর ;
১৫১। " এবং যারা অমিতব্যয়ী তাদের আদেশ অনুসরণ করো না, ৩২০৫
৩২০৫। এ সব উদ্ধত অহংকারীদের জন্য উপদেশ ছিলো যে, " তোমাদের দক্ষতা ও নৈপুন্য হতে পারে শ্রেষ্ঠ , কিন্তু এই দক্ষতা ও নৈপুন্যের সাথে সাথে তোমাদের চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করা কর্তব্য। যারা সীমালঙ্ঘনকারী তাদের অনুসরণ করো না। যারা ক্ষমতার ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারী, সম্পদ অর্জনে নীতিজ্ঞানহীন , জীবনযাত্রায় অমিতব্যয়ী , বিলাস -ব্যসন ও আত্ম -তুষ্টিতে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ চাওয়া পাওয়া মনে করে তারাই সীমালংঘনকারী। কারণ তাদের এই জীবন বোধ, বিকৃত মূল্যবোধ, সমাজ জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অন্যায় অবিচারের জন্ম দেয়। কিন্তু এদের জন্যও অনুতাপের দুয়ার খোলা আছে। এর পরেও কি এরা অনুতপ্ত হবে না ?
১৫২। " তারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং [ তাদের পথ ] সংশোধন করে না।"
১৫৩। তারা বলেছিলো, " তুমি তো যাদুগ্রস্থদের অন্যতম ! ৩২০৬
১৫৩। তারা বলেছিলো, " তুমি তো যাদুগ্রস্থদের অন্যতম ! ৩২০৬
৩২০৬। সামুদ জাতিরা তাদের নবীকে মনে করেছিলো পাগল, এবং সে জন্যেই তারা উপরের উক্তি করে।
উপদেশ : স্বেচ্ছাচারীতা আত্মার মাঝে অন্ধত্বের জন্ম দেয়। ফলে সত্য ও ন্যায়কে অনুধাবন ক্ষমতা আত্মার মাঝে অনুপস্থিত হয়ে যায়, যেরূপ হয়েছিলো সামুদ জাতির। তারা তাদের নবীর চরিত্রের মহত্তর ও পবিত্র রূপকে অনুধাবনে অক্ষম হয়েছিলো।
১৫৪। " তুমি তো আমাদের মত একজন মরণশীল [মানুষ ] ব্যতীত অন্য কিছু নও। কাজেই যদি তুমি সত্যবাদী হও তবে, একটি নিদর্শন উপস্থিত কর।"
১৫৫। সে বলেছিলো, " এই একটি উষ্ট্রী। তার পানি পানের নির্ধারিত দিনে অধিকার আছে, এবং তোমাদের [পশুদের] পানি পান করানোর [ পৃথক] নির্ধারিত দিনে অধিকার আছে ৩২০৭।
১৫৫। সে বলেছিলো, " এই একটি উষ্ট্রী। তার পানি পানের নির্ধারিত দিনে অধিকার আছে, এবং তোমাদের [পশুদের] পানি পান করানোর [ পৃথক] নির্ধারিত দিনে অধিকার আছে ৩২০৭।
৩২০৭। উষ্ট্রী সম্পর্কে দেখুন টিকা ১০৪৪ ও আয়াত [ ৭ : ৭৩ ]। এই উষ্ট্রীটি ছিলো সামুদ জাতির জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। তারা কি উষ্ট্রীটির চারণ ও তৃষ্ণার পানি সম্বন্ধে যত্নবান হবে?
১৫৬। "কোন ক্ষতি করার জন্য উহাকে স্পর্শ করো না। কেন না , তা হলে তোমাদের এক মহাদিনের শাস্তি পাকড়াও করবে। "
১৫৭। কিন্তু তারা তাকে বধ করলো। অতঃপর তারা অনুতাপে পূর্ণ হলো ৩২০৮।
১৫৭। কিন্তু তারা তাকে বধ করলো। অতঃপর তারা অনুতাপে পূর্ণ হলো ৩২০৮।
৩২০৮। "অতঃপর তারা অনুতাপে পূর্ণ হলো।" কিন্তু অনুতাপের জন্য এই সময় খুব বেশী দেরী হয়ে গিয়েছিলো। সামুদ জাতিরা নিজেরাই সালেহ্ নবীকে আল্লাহ্র নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য বলেছিলো। ফলে আল্লাহ্ তাদের পরীক্ষা করার জন্য একটি উষ্ট্রী প্রেরণ করেন। উষ্ট্রীটি ছিলো গরীবদের প্রতীক ও প্রতিনিধি স্বরূপ। উষ্ট্রীটিকে চারণভূমিতে চারণের অধিকার ও জলাশয়েরর অধিকারের মাধ্যমে গরীবের অধিকারকে স্বীকৃত দান করা ছিলো স্রষ্টার উদ্দেশ্য। তারা কি এই উষ্ট্রী প্রতীকের মাধ্যমে ধনী ও গরীবের সমতার আইন মেনে চলবে ? যে আইন বিশ্ব স্রষ্টার গড়া। কিন্তু সামুদ জাতি তা অস্বীকার করলো এবং উষ্ট্রীকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্বস্রষ্টার নিদর্শনকে অস্বীকার ও অপবিত্র করলো। ফলে তাদের পাপ তাদের ধ্বংসের পাদ্প্রান্তে নিয়ে গেলো।
উপদেশ : এ ভাবেই প্রত্যেকেই তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে।
১৫৮। কিন্তু শাস্তি উহাদের পাকড়াও করলো, অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করে না।
১৫৯। অবশ্যই তোমার প্রভু ক্ষমতার পরাক্রমশালী , পরম করুণাময়।
১৫৯। অবশ্যই তোমার প্রভু ক্ষমতার পরাক্রমশালী , পরম করুণাময়।
রুকু - ৯
১৬০। লূতের সম্প্রদায় রাসুলগণকে প্রত্যাখান করেছিলো ৩২০৯।
৩২০৯। যুগে যুগে সত্য প্রচারকারীরা বিপথগামীদের দ্বারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। লূতের কাহিনীও সেই একই ঘটনার সাক্ষ্য দেয়। লূতের বিশদ কাহিনীর জন্য দেখুন [ ৭ : ৮০ -৮৪ ] আয়াত এবং টিকা ১০৪৯। এই সূরাতে যে প্রসঙ্গের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা হচ্ছে : লূতের সম্প্রদায়ের লোকেরা বাইরে বিকৃত যৌন জীবন যাপন করতো যা ছিলো প্রকৃতির সাধারণ রীতিনীতির বাইরে। প্রকৃতির যে আইন তা হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট তাঁর সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য কৃত আইন। এই আইন বা নিয়ম ভাঙ্গার অধিকার বা ক্ষমতা কারও নাই। যদি কেউ প্রকৃতির আইনকে লঙ্ঘন করে তবে তার ধ্বংস অনিবার্য। নারী ও পুরুষের মিলিত জীবনই হচ্ছে সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য এক বিশেষ প্রাকৃতিক আইন বা কৌশল। লূতের সম্প্রদায় সমকামিতার দ্বারা আল্লাহ্র এই আইনকে লঙ্ঘন করে। তারা লূতের সাবধান বাণীর প্রতি কর্ণপাত করে না। ফলে তাদের পাথর বৃষ্টিদ্বারা পৃথিবী থেকে ধবংস করে দেয়া হয়।
১৬১। স্মরণ কর, তাদের ভ্রাতা লূত তাদের বলেছিলো, " তোমরা কি [আল্লাহ্কে ] ভয় করবে না ?
১৬২। " আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বাসযোগ্য রাসুল।
১৬৩। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর।
১৬৪। " এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরষ্কার রয়েছে শুধুমাত্র জগৎসমূহের প্রভুর নিকট।
১৬৫। " বিশ্বজগতের সকল প্রাণীর মধ্যে , তোমরাই কি পুরুষের সাথে উপগত হবে;
১৬৬। " এবং তোমাদের প্রভু তোমাদের সঙ্গী হওয়ার জন্য যাদের সৃষ্টি করেছেন তাদের ত্যাগ করবে ? না, তোমরা তো [সকল সীমা ] লংঘনকারী এক সম্প্রদায়।"
১৬৭। তারা বলেছিলো, " হে লূত! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে ৩২১০।"
১৬২। " আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বাসযোগ্য রাসুল।
১৬৩। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর।
১৬৪। " এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরষ্কার রয়েছে শুধুমাত্র জগৎসমূহের প্রভুর নিকট।
১৬৫। " বিশ্বজগতের সকল প্রাণীর মধ্যে , তোমরাই কি পুরুষের সাথে উপগত হবে;
১৬৬। " এবং তোমাদের প্রভু তোমাদের সঙ্গী হওয়ার জন্য যাদের সৃষ্টি করেছেন তাদের ত্যাগ করবে ? না, তোমরা তো [সকল সীমা ] লংঘনকারী এক সম্প্রদায়।"
১৬৭। তারা বলেছিলো, " হে লূত! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে ৩২১০।"
৩২১০। লূতের সম্প্রদায় লূতের সাবধান বাণীতে ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাপীরা এ ভাবেই পাপের মনোমুগ্ধকর রূপে এতটাই আত্মহারা হয়ে পড়ে যে, তাদের পাপের পরিণতি সম্বন্ধে সাবধান করলে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পরিণতিতে লূতের সম্প্রদায় ধবংস হয়ে যায় এবং সাবধানকারীরূপে হযরত লূত রক্ষা পেয়ে যান।
উপদেশ : পৃথিবীতে যারা পাপে, বিশেষভাবে যৌন বিকৃতিতে আনন্দ লাভ করে, তারা খুব কমই আল্লাহ্র রাস্তায় ফিরে আসে। এ কথা সে যুগেও প্রযোজ্য ছিলো , অদ্যাবধি তা প্রযোজ্য আছে।
১৬৮। সে বলেছিলো, " আমি তোমাদের এই কাজকে ঘৃণা করি ৩২১১।
১৬৯। " হে আমার প্রভু! আমাকে ও আমার পরিবারকে , ওরা যা করে , তা থেকে রক্ষা কর।"
১৬৯। " হে আমার প্রভু! আমাকে ও আমার পরিবারকে , ওরা যা করে , তা থেকে রক্ষা কর।"
৩২১১। হযরত লূত তাঁর সম্প্রদায়ের বিকৃত যৌনাচারের পাপকে ঘৃণা করতেন, কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত কর্তব্য বোধই তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়কে সাবধান করার কাজে নিয়োজিত করে। সমগ্র পরিবেশ তার জন্য ছিলো অসহনীয়। যে মুহুর্তে আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দান করেন , তিনি সাথে সাথে তাঁর সম্প্রদায়ের সংশ্রব ত্যাগ করেন। তিনি আল্লাহ্র নিকট তাঁর পরিবারের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্রার্থনা করেন।
১৭০। সুতারাং আমি রক্ষা করলাম, তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সকলকে
১৭১। একজন বৃদ্ধা মহিলা ব্যতীত। সে ছিলো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত ৩২১২।
৩২১২। এই বৃদ্ধা মহিলা ছিলেন হযরত লূতের স্ত্রী। সে পশ্চাতে অবস্থানকারীদের একজন ছিলো, ফলে সে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
১৭১। একজন বৃদ্ধা মহিলা ব্যতীত। সে ছিলো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত ৩২১২।
৩২১২। এই বৃদ্ধা মহিলা ছিলেন হযরত লূতের স্ত্রী। সে পশ্চাতে অবস্থানকারীদের একজন ছিলো, ফলে সে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
উপদেশ : প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিজ কর্মফল ভোগ করবে। পূণ্যাত্মা ব্যক্তির সংস্পর্শে থেকেও কেউ নিজ কর্মফল থেকে অব্যহতি পেতে পারে না। যেমন লূতের পত্নীর বেলায় ঘটেছিলো - তার কর্মফল তাকে তার পাপ মোচনে সাহায্য করে নাই বা তার কর্মফলের শাস্তি থেকে অব্যহতি দান করতে পারে নাই। এই - ই হচ্ছে বিশ্ববিধাতার অমোঘ নিয়ম।
১৭২। তৎপর অন্য সকলকে আমি সমূলে ধ্বংস করলাম।
১৭৩। আমি তাদের উপরে [ গন্ধকের ] ধারা বর্ষণ করলাম ৩২১৩, যারা সাবধান করা সত্বেও [ সাবধান হয় নাই ]; তাদের জন্য তা ছিলো অতি মন্দ।
১৭৩। আমি তাদের উপরে [ গন্ধকের ] ধারা বর্ষণ করলাম ৩২১৩, যারা সাবধান করা সত্বেও [ সাবধান হয় নাই ]; তাদের জন্য তা ছিলো অতি মন্দ।
৩২১৩। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৮৪ ] এবং টিকা ১০৫২।
১৭৪। নিশ্চয়ই এর মাঝে রয়েছে নিদর্শন ; কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বিশ্বাস করে না।
১৭৫। এবং নিশ্চয়ই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী , পরম করুণাময়।
১৭৫। এবং নিশ্চয়ই তোমার প্রভু ক্ষমতায় পরাক্রমশালী , পরম করুণাময়।
রুকু - ১০
১৭৬। গহন অরণ্যের অধিবাসীরা রাসুলগণকে প্রত্যাখান করেছিলো ৩২১৪।
৩২১৪। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ৭৮ ] এবং টিকা ২০০০।
১৭৭। দেখো ! সুয়েব ৩২১৫ , তাদের বলেছিলো , " তোমরা কি [ আল্লাহ্কে ] ভয় করবে না ?
৩২১৫। সুয়েব নবীর জন্য দেখুন আয়াত [ ৭ : ৮৫ ] এবং টিকা ১০৫৪।
১৭৮। " আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বাসযোগ্য রাসুল।
১৭৯। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর।
১৮০। " এর জন্য আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না; আমার পুরষ্কার রয়েছে শুধুমাত্র জগৎ সমূহের প্রভুর নিকটে।
১৮১। " মাপে সঠিক দেবে ৩২১৬। [ প্রতারণার দ্বারা ] অন্যের ক্ষতি করো না।
১৭৯। " সুতারাং আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে মান্য কর।
১৮০। " এর জন্য আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না; আমার পুরষ্কার রয়েছে শুধুমাত্র জগৎ সমূহের প্রভুর নিকটে।
১৮১। " মাপে সঠিক দেবে ৩২১৬। [ প্রতারণার দ্বারা ] অন্যের ক্ষতি করো না।
৩২১৬। সুয়েব নবীর সম্প্রদায়েরা ছিলো ব্যবসায়িক সম্প্রদায়। কিন্তু তারা তাদের ব্যবসায়ে সৎ ছিলো না। তারা অন্যায় ভাবে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারণা করতো, মাপে কম দিত। প্রতারণা , অন্যায় ও অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে অশান্তি সৃষ্টি করা তাদের ছিলো নৈমিত্তিক ব্যাপার। " মাপে কম দেয়া " বাক্যটি প্রতীকধর্মী। মাপে কম দেয়ার অর্থ - যার যা প্রাপ্য বা অধিকার তাকে ততটুকু না দেয়া, এই প্রাপ্য বস্তু হতে পারে বাণিজ্যিক জিনিষপত্র , অথবা নাগরিক অধিকার। সরকারী অফিসে যখন ধর্না দিয়ে নিজস্ব প্রাপ্য বা অধিকার পাওয়ার জন্য হা পিত্তেশ করতে হয়। অথবা নাগরিক জীবনে বিভিন্ন ক্রিয়াক্রর্মে প্রতিটি পদক্ষেপে সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা যখন বিভিন্নভাবে হয়রানির শীকার হতে হয় - তখনও ব্যক্তি তার প্রাপ্য অধিকার লাভে বঞ্চিত হয়। এক্ষেত্রেও 'মাপে কম দেয়া ' বাক্যটি প্রযোজ্য। অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে কারও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নাম 'মাপে কম দেয়া '। যখনই সমাজে কারও অধিকার না দেয়া হয়, তখনই সমাজ জীবনে অন্যায় ও অবিচার বিরাজ করে। পরবর্তী আয়াতে [ ২৬ : ১৮২ - ১৮৩ ] দেখুন 'মাপে কম দেয়ার ' বিশেষ ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। "সঠিক দাড়িপাল্লা " বাক্যটি শুধুমাত্র ওজনের বাটখাড়া নয়। ওজনের ব্যাপারে যেরূপ বাটখাড়ার ও পাথরের ওজন সঠিক হওয়া প্রয়োজন, ঠিক সেরূপ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ডের "সঠিক দাড়িপাল্লার" প্রয়োজন। "প্রাপ্ত বস্তু কম দিবে না" - এই বাক্যটি দ্বারা শুধুমাত্র জিনিষ পত্রই বোঝানো হয় নাই। এই বাক্যটি প্রতীকধর্মী। একটি সমাজে ও নাগরিক জীবনে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপরে নির্ভরশীল। একটি সমাজে প্রতিটি লোকের থাকে নির্দ্দিষ্ট নাগরিক অধিকার। এই অধিকারকেই 'বস্তু' প্রতীক শব্দটির দ্বারা এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সমাজ জীবনে যখন নাগরিক অধিকার হরণ করা হয় এবং সমাজের নীতিনির্ধারক ও প্রয়োগকারীদের দ্বারা নাগরিক অধিকার যখন স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হয় তখন সমাজ জীবনে " বিপর্যয় ঘটে যায়"। অন্যায় , অবিচার, অসত্য সমাজের মূল কাঠামোকে বিধ্বস্ত করে ফেলে , ঠিক যেভাবে ঘুণ কাঠকে ধ্বংস করে ফেলে। [ যেমন বাংলাদেশে বর্তমানে ঘটেছে ] এসব অন্যায়কারীদের আল্লাহ্কে ভয় করতে বলা হয়েছে এবং আল্লাহ্র বিধান যা ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত তা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তিনিই স্রষ্টা যিনি মানুষের পূর্ববর্তীদেরও সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বিধান হচ্ছে - প্রতারণা ও অন্যায়ের মাধ্যমে কেউ সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। সমৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে সঠিক আদান প্রদান ও সমাজ জীবনে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।
১৮২। " সঠিক এবং খাড়া দাড়িপাল্লাতে ওজন করবে।
১৮৩। " লোকদের তাদের প্রাপ্য দিতে অসম্মত হয়ো না; পৃথিবীতে মন্দ দ্বারা অশান্তির সৃষ্টি করো না।
১৮৪। " এবং তাঁকে ভয় কর যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্বের প্রজন্ম [ সৃষ্টি করেছেন ]। "
১৮৫। তারা বলেছিলো, " তুমি তো যাদুগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত।
১৮৬। " তুমি তো আমাদের মতই মরণশীল [মানুষ]। এবং অবশ্যই আমরা মনে করি তুমি একজন মিথ্যাবাদী ৩২১৭।
১৮৩। " লোকদের তাদের প্রাপ্য দিতে অসম্মত হয়ো না; পৃথিবীতে মন্দ দ্বারা অশান্তির সৃষ্টি করো না।
১৮৪। " এবং তাঁকে ভয় কর যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্বের প্রজন্ম [ সৃষ্টি করেছেন ]। "
১৮৫। তারা বলেছিলো, " তুমি তো যাদুগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত।
১৮৬। " তুমি তো আমাদের মতই মরণশীল [মানুষ]। এবং অবশ্যই আমরা মনে করি তুমি একজন মিথ্যাবাদী ৩২১৭।
৩২১৭। আয়কাবাসীরা সুয়েব নবীকে অস্বীকার করলো। পাপ তাদের এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো যে, তারা প্রকৃত সত্যকে অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলো। তাদের ধারণা ছিলো তারাই হচ্ছে আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। সুয়েব যা প্রচার করছেন তা ভ্রান্ত। শুধু ভ্রান্ত নয়। সুয়েবের প্রচারিত আদর্শ হচেছ পাগলের প্রলাপ।
উপদেশ : এ ভাবেই সমাজ জীবন যখন অন্যায় ও অসত্যের অন্ধকারে ডুবে যায়, অন্যায়কারীর সত্তা থেকে প্রকৃত ন্যায়বোধ অন্তর্হিত হয়ে পড়ে। অন্যায়ের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে সে প্রকৃত ন্যায়কে বোকামী ও পাগলের প্রলাপ বলে মনে করে।
১৮৭। " যদি তুমি সত্যবাদী হও , তবে আকাশের একখন্ড আমাদের উপরে ফেলে দাও।" ৩২১৮
৩২১৮। যারা আল্লাহ্র বিধান থেকে পদস্খলিত হবে তারা কোনও দিনও তাদের আত্মার মাঝে আল্লাহ্ সান্নিধ্য অনুভব করার ক্ষমতা লাভ করবে না। কারণ তাদের আত্মিক জগত হবে অন্ধকারে নিমজ্জিত - সেখানে আল্লাহ্র নূরের প্রবেশ অধিকার থাকবে না। এ সব ব্যক্তিরাই তখন প্রকৃত ধর্মের অনুসরণ না করে অলৌকিক ঘটনার অনুসন্ধান করে। কারণ স্রষ্টার হাতের পরশ যে তাদের প্রতিদিনের পৃথিবীতে পরিব্যপ্ত তারা তা অনুধাবনে অক্ষম। " আকাশের একখন্ড আমাদের উপরে ফেলে দাও " অর্থাৎ তারা অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের অনুসন্ধান করেছিলো। তাদের বক্তব্য ছিলো সুয়েব নবীর যদি সত্যি আল্লাহ্র সাথে সংযোগ থাকে তবে তিনি অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করতে পারবেন।
মন্তব্যঃ যারা পীর নামধারী ভন্ডদের শরণাপন্ন হয় তাদের মানসিকতা এই শ্রেণীভুক্ত।
১৮৮। সে বলেছিলো, " আমার প্রভু সব চেয়ে ভালো জানেন তোমরা যা কর।" ৩২১৯
৩২১৯। সুয়েব নবীকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করার জন্য যারা একখন্ড আকাশ ফেলে দিয়ে নবীত্বের প্রমাণের জন্য নবীকে প্রতিদ্বন্দীতায় আহ্বান করেছিলো তারা তা করেছিলো নিজেদের মিথ্যা বাহাদুরী প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। তাদের এই অপমানজনক উক্তির প্রতুত্তরে সুয়েব নবী কোনওরূপ উষ্মা প্রকাশ করেন নাই। তাঁর উত্তর ছিলো, " তোমাদের কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে আল্লাহ্ সম্যক অবগত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। এর বেশী আমি আর কি বলতে পারি ? " শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দান করেন।
১৮৯। কিন্তু তারা তাঁকে প্রত্যাখান করেছিলো। ফলে, তাদের অন্ধকারচ্ছন্ন দিবসের শাস্তি গ্রাস করলো ৩২২০। ইহা তো ছিলো এক ভীষণ দিবসের শাস্তি ৩২২১।
৩২২০। "অন্ধকারচ্ছন্ন দিবসের শাস্তি " - বর্ণনাটি সম্ভবতঃ ছিলো অগ্নুৎপাতের বর্ণনা। সমস্ত আকাশ ছাই ও অঙ্গার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে সূর্যকে ঢেকে দেয়। ফলে সূর্যের আলোবিহীন দিনকে মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার দিন বলে ভ্রম হতে থাকে। যদি আয়কাবাসী ও মাদইয়ান সম্প্রদায় একই হয়ে থাকে তবে ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের সাথে প্রচন্ড ভূমিকম্পও সংঘটিত হয়। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৯১ ] এবং টিকা ১০৬৩।
৩২২১। "ভীষন দিবসের শাস্তি " - এই লাইনটির মাধ্যমে দিনটির ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ফুটন্ত লাভার স্রোত মাটিকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে , সূর্য আড়াল হয়ে গেছে ছাই ও অংগারে , প্রচন্ড নিনাদে মাটি থর থর করে কাঁপছে সে এক মহা দুর্যোগের দিন। যারা সেখানের অধিবাসী ছিলো, তারা মৃত্যুর পূর্বে প্রকৃতির এই রুদ্ররোষে ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে যায়।
১৯০। নিশ্চয়ই এতে রয়েছে নিদর্শন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বিশ্বাস করে না।
১৯১। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু শক্তিতে পরাক্রমশালী , পরম করুণাময় ৩২২২।
১৯১। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু শক্তিতে পরাক্রমশালী , পরম করুণাময় ৩২২২।
৩২২২। দেখুন আয়াত [ ২৬ : ১২১ - ১২২] এবং টিকা ৩১৯৩।
রুকু - ১১
১৯২। অবশ্যই এটা [ আল্-কুরআন ] জগত সমূহের প্রভুর নিকট থেকে অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ ৩২২৩।
৩২২৩। যুগে যুগে আল্লাহ্র নবীদের প্রতিরোধ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমাদের মহানবী হযরত মুহম্মদ [ সা ] ও এরূপ নির্যাতন ও প্রতিরোধ থেকে রেহাই পান নাই। এই আয়াতে এরই প্রেক্ষাপটে কোরাণের বৈশিষ্ট্য সমূহকে তুলে ধরা হয়েছে : ১) কোরাণ সত্যসহ অবতীর্ণ এবং ২) মক্কার মোশরেকদের কোরাণের শিক্ষাকে প্রত্যাখান করার ইতিহাস পূর্ববর্তী নবী রসুলদের শিক্ষাকে প্রত্যাখান ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যুগে যুগে নবী রসুলদের শিক্ষাকে প্রত্যাখনের কারণ সব যুগেই এক আর তা হচ্ছে প্রতিরোধকারীদের কায়েমী স্বার্থোন্বেষীদের স্বার্থে আঘাত হানে। সুতারাং তারা সত্যকে প্রতিরোধ করে। কিন্তু সত্য সব সময়েই অপ্রতিরোধ্য।
১৯৩। বিশ্বস্ত আত্মা [ জিব্রাইল ] তা পৌঁছিয়ে দিয়েছে ৩২২৪, -
৩২২৪। "Ruh-ul-amin" এই উপাধিটি জিব্রাইল ফেরেশতা সম্বন্ধে প্রযোজ্য তবে এই শব্দটির সঠিক এবং উপযুক্ত অনুবাদ একটি মাত্র শব্দে করা অসম্ভব। আয়াত [ ২৬ : ১০৭ ] এবং টিকা ৩১৮৭ এ 'Amin' শব্দটির বিভিন্ন রূপকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 'Amin' শব্দটি নবী করিম হযরত মুহম্মদের [ সা] উপাধির সাথে সংযুক্ত ছিলো। জিব্রাইল ফেরেশতাকে ধরা হয় আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ বহনকারী দূত হিসেবে। প্রকৃত বিশ্বাস ও সত্যের প্রতিভূ এখানে জিব্রাইলের স্বরূপ অপরপক্ষে বিভ্রান্তি ও প্রতারণা হচ্ছে মিথ্যার প্রতিভূ এবং স্বরূপ। মওলানা ইউসুফ আলী মনে করেন " ঈমান ও সত্যের প্রতিভূ " হওয়া উচিত "Ruh-ul-amin" শব্দটির অনুবাদ যা হবে জিব্রাইলের উপাধি।
১৯৪। তোমার হৃদয়ে , যাতে তুমি সর্তককারী হতে পার ৩২২৫।
১৯৫। ইহাকে প্রকাশ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।
১৯৫। ইহাকে প্রকাশ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।
৩২২৫। 'Qalb' [ হৃদয় ] সাধারণত হৃদয় শব্দটি দ্বারা ভালোবাসার উৎপত্তিস্থলকে বোঝানো হয়ে থাকে। এখানে হৃদয় শব্দটি দ্বারা স্মরণশক্তি ও অনুধাবন ক্ষমতার উৎপত্তিস্থলকেও বোঝানো হয়েছে। প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া হচ্ছে : আল্লাহ্র বাণী প্রথমে নবীর হৃদয়, মন, স্মরণশক্তি ও অনুধাবন ক্ষমতাতে স্বর্গীয় প্রভাবে অনুপ্রাণীত করে। তারপরে সেই বাণী মানুষের ভাষাতে পৃথিবীর বুকে প্রচারিত হয়। এ ক্ষেত্রে আরবীকে মানুষের ভাষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ নবী হযরত মুহম্মদ [সা ] যাদের মাঝে জন্মগ্রহণ করেন তারা ছিলেন আরবী ভাষা-ভাষী এবং তারা যাতে আল্লাহ্র বাণীকে বুঝতে পারে ও অনুধাবন করতে পারে এবং পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে সে বাণী প্রচার লাভ করে, সে কারণেই আল্লাহ্র বাণীর প্রথমে আরবীতে প্রকাশ ঘটে। ভাষা হিসেবে আরবীতে কোনও বিশেষ মাহাত্ম্য এখানে নাই। পরের আয়াতে আজামী শব্দটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে আরবী ভাষায় যারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না।
১৯৬। নিশ্চয়ই পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের অতীন্দ্রিয় কিতাবসমূহে এর উল্লেখ আছে ৩২২৬।
৩২২৬। 'Zubur' শব্দটি যা এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তা 'Zabur' শব্দটির বহুবচন। কোরাণে 'Zubur' শব্দটির উল্লেখ আছে দাউদ নবীর কাছে আল্লাহ্র প্রেরিত ধর্মগ্রন্থ হিসেবে। এখানে শব্দটির ব্যবহার হয়েছে পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশসমূহের জন্য।
১৯৭। এটা কি তাদের জন্য নিদর্শন নয় যে, বনী ইসরাঈলের পন্ডিতগণ ইহাকে [ সত্য বলে ] জানে ? ৩২২৭
৩২২৭। আব্দুল্লাহ্ -ইবন্ - সালাম এবং মুখাইরিকের মত খৃষ্টান পন্ডিত ও সাধুগণ রসুলকে [ সা ] সনাক্ত করতে পেরেছিলেন আল্লাহ্র প্রেরিত দূত হিসেবে। যার ফলে শেষোক্ত ব্যক্তি ইসলামের খেদমতের জন্য তাঁর প্রভূত ধন-সম্পদ দান করে যান।
১৯৮। আমি যদি ইহা কোন অ-আরবী ভাষীর প্রতি অবতীর্ণ করতাম,
১৯৯। এবং সে তা তাদের নিকট আবৃত্তি করতো, তবুও তারা তা বিশ্বাস করতো না ৩২২৮।
১৯৯। এবং সে তা তাদের নিকট আবৃত্তি করতো, তবুও তারা তা বিশ্বাস করতো না ৩২২৮।
৩২২৮। পূর্বেই ভবিষ্যত বাণী করা হয়েছিলো যে, আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ গ্রহণের অধিকার আরবেরাও একদিন লাভ করবে পর্যায়ক্রমে। সেক্ষেত্রে এ কথা স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয়া যায় যে, তা আরবী ভাষাতে এবং একজন আরবের মুখ থেকে প্রচারিত হবে। তা না হলে প্রচারিত আল্লাহ্র বাণী যদি একজন অ-আরবীর মুখ থেকে প্রচারিত হতো, তবে তার আবেদন আরবদের কাছে যথাযথ হতো না। ফলে আরব বাসীরা ঈমান আনতো না এবং পরবর্তীতে আরবী ভাষা ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো না।
উপদেশ : এই আয়াত থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, কোরাণ পাঠের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপনের মাধ্যমে ঈমানের ভিত্তিকে মজবুত করা।
২০০। এ ভাবেই আমি পাপীদের অন্তরে অবিশ্বাস প্রবেশ করাই ৩২২৯।
৩২২৯। 'এই ভাবে ' শব্দটি দ্বারা যে ভাব প্রকাশ করা হয়েছে তা হচ্ছে : " আরবী ভাষার মাধ্যমে এবং আরব সম্প্রদায়ের দ্বারা।" কোরাণ অবতীর্ণ হয় আরবে আরবী ভাষী লোকদের মাঝে। তাদের বোধগম্যতার জন্যই তা আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ হয় , যেনো কোরাণের মর্মবাণী তাদের হৃদয়ে খুব সহজেই অনুপ্রবেশ ঘটে এবং হৃদয়কে গভীরভাবে অভিভূত করে। কোরাণকে আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ করার মূল উদ্দেশ্য এখানেই নিহিত।
মাতৃভাষাতে কোরাণের বাণীর মূল সৌন্দর্য্য , নৈতিক উপদেশ, ধ্বনির মাধুর্য্য ইত্যাদি উপলব্ধি আরবদের হৃদয়ে , যত সহজে ঐ বাণীর মর্মবাণী হৃদয়ে প্রবেশ লাভ করে; আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের এত বড় উপায় মাতৃভাষাতে ব্যতীত সম্ভব নয়। আরবী ব্যতীত অন্য ভাষাতে কোরাণ যদি আরবে অবতীর্ণ হতো, তবে না বুঝে কোরাণ পাঠের ফলে হৃদয়ে আল্লাহ্র বাণীর যে আবেদন তা নিষ্ফল হতো। মাতৃভাষার মাধ্যমে আবেদন বা উপদেশ হৃদয়ের অভ্যন্তরে স্থিতিলাভ করে। এর পরেও কোনও কঠিন হৃদয়ে যদি এই বাণীর আবেদন না পৌঁছে তবে সে কঠিন হৃদয়ের জন্য শাস্তি অবধারিত , কত দুঃখজনক সে পরিণতি। পরবর্তী আয়াত দেখুন।
২০১। তারা [ কিছুতেই ] উহা বিশ্বাস করবে না, যতক্ষণ না তারা ভয়াবহ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।
২০২। কিন্তু [ শাস্তি ] হঠাৎ করেই তাদের নিকট এসে পড়বে, তারা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই ;
২০৩। তখন তারা বলবে, " আমরা কি অবকাশ পেতে পারি না ? "
২০৪। তারপরেও কি তারা আমার শাস্তিকে ত্বরান্বিত করতে চাইবে ? ৩২৩০
২০২। কিন্তু [ শাস্তি ] হঠাৎ করেই তাদের নিকট এসে পড়বে, তারা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই ;
২০৩। তখন তারা বলবে, " আমরা কি অবকাশ পেতে পারি না ? "
২০৪। তারপরেও কি তারা আমার শাস্তিকে ত্বরান্বিত করতে চাইবে ? ৩২৩০
৩২৩০। পাপীরা আল্লাহ্র হেদায়েতের প্রতি অবহেলার দরুণ অনুতাপ থেকে বিরত থাকে, প্রকৃত শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পূর্বে তারা বুঝতে অক্ষম তাদের পাপের পরিমাণ। আবার অনেক পাপী আছে যারা আল্লাহ্কে প্রতিদ্বন্দীতায় আহ্বান পূর্বক ঘোষণা করে যে শেষ বিচারের দিন নাই , সুতারাং যদি থাকে তবে তা যত শীঘ্র সম্ভব উপস্থিত করা হোক। তারা এতবড় কথা বলার সাহস রাখে কারণ তারা আল্লাহ্র এবং আল্লাহ্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়। তাদের প্রতীদ্বন্দীতার উত্তর হচ্ছে " ইহা শীঘ্রই আসবে , তখন তাদের মনে হবে যে ইহা অতি শীঘ্র ঘটেছে।"
২০৫। তুমি কি ভেবে দেখেছ ? যদি আমি তাদের কয়েক বৎসর [ এই পৃথিবীতে ] সুখ ভোগ করতে দেই ,
২০৬। তথাপি; তাদের উপর অবশেষে সেই শাস্তি এসে পড়বে, যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেয়া হয়েছে।
২০৭। [ এই পৃথিবী জীবনের ] উপভোগ তাদের কোন উপকারে আসবে না।
২০৮। আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করি নাই , সর্তককারী [প্রেরণ ] ব্যতীত
২০৯। [যারা ছিলো ] উপদেশ স্বরূপ। আমি তো অন্যায়কারী নই ৩২৩১।
২০৬। তথাপি; তাদের উপর অবশেষে সেই শাস্তি এসে পড়বে, যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেয়া হয়েছে।
২০৭। [ এই পৃথিবী জীবনের ] উপভোগ তাদের কোন উপকারে আসবে না।
২০৮। আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করি নাই , সর্তককারী [প্রেরণ ] ব্যতীত
২০৯। [যারা ছিলো ] উপদেশ স্বরূপ। আমি তো অন্যায়কারী নই ৩২৩১।
৩২৩১। পাপীদের অনুতাপ করার জন্য আল্লাহ্ প্রচুর সময় ও সুযোগ দিয়ে থাকেন। কারণ আল্লাহ্ পরম করুণাময় ও অসীম দয়াময়। পাপীদের আল্লাহ্ পাপের সাথে সাথে শাস্তি দান করেন না। আল্লাহ্ প্রদত্ত এই অবকাশকে পাপীরা সদ্ব্যবহার করতে অক্ষম - কারণ তারা জাগতিক বিষয় বস্তুতে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকে। জাগতিক ক্ষমতা , লোভ-মোহ, আত্মগরিমা-অহংকার তাদের পার্থিব জগতের বাইরে অতীন্দ্রীয় জগতের অনুধাবনের বাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে তারা বারে বারে আল্লাহ্র আদেশকে অমান্য করে আল্লাহ্র সাবধান বাণীকে উপেক্ষা করে। তবুও আল্লাহ্ পরম করুণাময় -তাদের বারে বারে নবী রসুলদের দ্বারা সাবধান করেন চূড়ান্ত শাস্তি দানের পূর্বে। এই চূড়ান্ত শাস্তি তাদের-ই কর্মফল। এই হচ্ছে ন্যায় ও সত্য। মানুষকে চূড়ান্ত শাস্তিদানের পূর্বে বারে বারে সাবধান করা হয় কারণ দয়াময় আল্লাহ্ জানেন যে মানুষ দুর্বল চরিত্র। আল্লাহ্ ন্যায়বিচারক। সুতারাং মানুষের এই চারিত্রিক দুর্বলতাও মহাপ্রভু দয়াময় তার বিচারের অধীনে ন্যস্ত করেন।
২১০। এই [প্রত্যাদেশ ] কোন শয়তান অবতীর্ণ করতে পারে না ৩২৩২।
৩২৩২। মানুষের সাধারণ ধর্ম হচ্ছে : তারা যে কোন অলৌকিক কার্যকলাপকে যাদু বা শয়তানের কাজ বলে পরিগণিত করতে চায়। হযরত মুসা থেকে কোনও নবী রসুলই এই অপবাদ থেকে রেহাই পান নাই। তাই রসুলের [ সা ] নিকট যখন কোরাণ অবতীর্ণ হলো - কোরানের বাণীর মাধুর্য, সৌন্দর্য্য ,গুঢ় মর্মার্থ , নৈতিক উপদেশাবলী , অবিশ্বাসীদের বিভ্রান্ত করে দিলো। সুতারাং রসুলের [সা ] শত্রুরা কোরাণকে অশুভ শক্তির বাহন মনে করতে থাকে। মানবাত্মার মহৎ ও চূড়ান্ত বিকাশের এত বড় দলিল কখনও শয়তানের উদ্দেশ্য হতে পারে না। শয়তান ও তাঁর সাগরেদদের কখনও ক্ষমতা হবে না এরূপ একটি গ্রন্থ রচনার - যা মানুষের আত্মিক বিকাশকে করে সমৃদ্ধশালী, পৃথিবীর জীবনযাত্রাকে করে সফলকাম। ভালো ও মন্দ কখনও এক হতে পারে না , যেমন আলো ও অন্ধকার এক হতে পারে না। ভালো ও মন্দের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। মন্দ কখনও ভালোকে সহ্য করতে পারবে না , এমনকি সদুপদেশ বা দয়া বা ক্ষমা ইত্যাদিও তার নিকট হাস্যকর ও অসত্য রূপে বিবেচিত হবে।
২১১। এটা তাদের উপযোগীও হবে না অথবা তারা তা [ তৈরী করতেও ] সক্ষম নয়।
২১২। উহাদের তো শোনার সুযোগ থেকেও দূরে রাখা হয়েছে।
২১৩। সুতারাং আল্লাহ্র সাথে অন্য কাউকে ডেকো না , তাহলে তুমি যারা শাস্তি প্রাপ্ত তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
২১৪। এবং নিকট -আত্মীয় বর্গকে সর্তক করে দাও।
২১৫। এবং তোমার পক্ষপুটকে নামিয়ে দাও বিশ্বাসীদের জন্য , যারা তোমার অনুসরণ করে ৩২৩৩।
২১২। উহাদের তো শোনার সুযোগ থেকেও দূরে রাখা হয়েছে।
২১৩। সুতারাং আল্লাহ্র সাথে অন্য কাউকে ডেকো না , তাহলে তুমি যারা শাস্তি প্রাপ্ত তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
২১৪। এবং নিকট -আত্মীয় বর্গকে সর্তক করে দাও।
২১৫। এবং তোমার পক্ষপুটকে নামিয়ে দাও বিশ্বাসীদের জন্য , যারা তোমার অনুসরণ করে ৩২৩৩।
৩২৩৩। "পক্ষপুটকে নামিয়ে দাও " - অর্থাৎ দয়ালু, ভদ্র এবং সহানুভূতিশীল হও, ঠিক সেরূপ ভাবে , যেরূপভাবে উড়ন্ত পাখী নীড়ে ফেরার প্রাক্কালে তার শাবককূলকে পাখা দ্বারা ঢেকে দেয়। দেখুন আয়াত [১৭ : ২৪ ] ও টিকা ২২০৫ এবং [১৫: ৮৮ ]ও টিকা ২০১১।
২১৬। তারপরেও যদি তারা অবিশ্বাস করে, তাহলে বলো, " তোমরা যা কর আমি তা থেকে দায়মুক্ত।" ৩২৩৪
৩২৩৪। "তারা অবিশ্বাস করে " বাক্যটি দ্বারা এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে, অবিশ্বাসী কাফেররা এমন কিছু করেছিলো রসুলের [ সা ] প্রতি যা অবাধ্যতার সামিল। ঘটনাটি ছিলো : রসুল [ সা ] তাদের ন্যায়ের পথে সত্যের পতে চলতে আদেশ দিতেন এবং অন্যায় ও পাপকে পরিহার করতে বলতেন , যা তাদের জন্য ছিলো অরুচীকর। রসুলের [ সা ] প্রচার ও প্রচেষ্টা সত্বেও যদি কেউ অন্যায় ও পাপকে পরিহার না করে। তবে সে দায়িত্ব রসুলের [সা] নয়। কারণ ভালো ও দায়িত্ববান মেষপালকেরা যেমন তার মেষের পালকে সঠিক রাস্তায় রাখতে চেষ্টা করে ও তার মেষ সমূহের রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান হয় রসুলও [ সা ] ঠিক সেরূপে তাঁর অনুসারীদের প্রতি সমভাবে যত্নশীল ও দায়িত্ব বান। এরপরেও কেউ তাঁকে অস্বীকার করলে বা অবাধ্যতা করলে সে দায়িত্ব তাঁর নয়। তিনি এর পরে কি করতে পারেন ? তিনি তাঁর প্রতি আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করবেন , মানুষকে হেদায়েত করবেন। কিন্তু কেউ যদি অস্বীকার করে, অবাধ্যতা করে তাদের মহান শিক্ষককে , নেতাকে , পথ প্রদর্শককে ,তবে সে জন্য রসুল কে [ সা ] দায়ী করা হবে না। তাঁর বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা শুধুমাত্র এক আল্লাহ্র উপরে। আল্লাহ্ সকলের কৃত কর্মের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং তিনি প্রত্যেকের কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন করেন।
উপদেশ : প্রত্যেকেই নিজ নিজ কৃত কর্মের জন্য দায়ী। কারও পাপের ভার অন্য কেউ গ্রহণ করবে না।
২১৭। এবং সর্বশক্তিমান ও পরম দয়ালু আল্লাহ্র প্রতি তোমার আস্থা স্থাপন কর -
২১৮। যিনি তোমাকে [ প্রার্থনায় ] দন্ডায়মান দেখেন,
২১৯। এবং সিজদাকারীদের সাথে তোমার ওঠাবসা দেখেন ৩২৩৫।
২১৮। যিনি তোমাকে [ প্রার্থনায় ] দন্ডায়মান দেখেন,
২১৯। এবং সিজদাকারীদের সাথে তোমার ওঠাবসা দেখেন ৩২৩৫।
৩২৩৫। মূসলমানদের এবাদতের ধারাকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষের অন্তরের প্রতিটি চিন্তাধারা আল্লাহ্র নিকট প্রকাশ্য। এবাদতের প্রতি আগ্রহ, আন্তরিকতা এবং ভক্তির ব্যাপারে রসুল [ সা ] ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, আবার তাঁর অনুসারীদের জন্যও তিনি ছিলেন সমভাবে দায়িত্ববান। রসুলের [ সা ] চরিত্রের এই উজ্জ্বল দিকটি এই আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি বাঁকে, সম্পদে প্রতিপত্তিতে, দুঃখে -বিপর্যয়ে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতায়, এবাদতের আন্তরিকতায়, মুসলমানদের জীবনের দিশারী হচ্ছেন আল্লাহ্র রসুল আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তফা [ সা ]। নির্বোধ ও অবিশ্বাসীরা তাঁর চরিত্রের যে খুঁতই ধরুক না কেন, রসুলের চরিত্রের পবিত্রতা , সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্বন্ধে সর্বশক্তিমান সবিশেষ অবগত।
উপদেশ : মুসলমানদের চলার পথের সকল হিসাব সর্বশক্তিমানের কাছে রক্ষিত থাকে। মুসলমান সর্বঅবস্থায় আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল হবে। রসুলের [ সা ] জীবনের মাধ্যমে এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে।
২২০। তিনিই তো সব কিছু শোনেন এবং জানেন।
২২১। [ হে মানব সম্প্রদায় ! ] আমি কি তোমাদের জানাবো কার নিকট শয়তানেরা অবতীর্ণ হয় ? ৩২৩৬
২২১। [ হে মানব সম্প্রদায় ! ] আমি কি তোমাদের জানাবো কার নিকট শয়তানেরা অবতীর্ণ হয় ? ৩২৩৬
৩২৩৬। এই আয়াতটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে রসুলের [ সা ] জীবনের প্রেক্ষিতে , যার একটি সাধারণ অর্থও বিদ্যমান যা সকল যুগের জন্য প্রযোজ্য। ইসলাম প্রচারের সময়ে অবিশ্বাসীরা বিদ্বেষবশে রসুলের চরিত্রে কালিমা লেপনের প্রয়াস পেতো। তারা বলতো রসুল [সা] যাদুগ্রস্থ ও অশুভ শক্তিদ্বারা প্রভাবিত [ দেখুন ২৬ : ২১০ আয়াত ]। এ কথার উত্তর অবশ্য পূর্বেই দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এসব অপপ্রচারের উৎসের প্রতি। বলা হয়েছে এসব মিথ্যা অপপ্রচারের মূল উৎস হচ্ছে শয়তানের প্ররোচনা। এসব মিথ্যা অপপ্রচারের পিছনে থাকে শয়তানী , অর্ধসত্য, এবং বিকৃত অপপ্রচার যেনো সাধারণ লোক আল্লাহ্র প্রকৃত রূপকে অনুধাবন করতে না পারে। অর্থাৎ প্রতিটি মিথ্যা অপপ্রচারের মূল হচ্ছে শয়তানের কাজ। এ কথাকেই নবীর জীবনের উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের জন্য সর্বকাল ও সর্বযুগের জন্য চিরস্থায়ী হেদায়েত করা হয়েছে। মিথ্যা হচ্ছে সকল পাপের উৎস। তাই মিথ্যাকে এই আয়াতে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ মিথ্যার সাথে জড়িত থাকে দুর্নীতি ; যা শয়তানের প্রকৃতি। অপরপক্ষে , সত্যের সাথে জড়িত হচ্ছে সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইত্যাদি।
উপদেশ : জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিথ্যাকে পরিহার করতে হবে।
২২২। ওরা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেকটি মিথ্যাবাদী ও দুষ্ট লোকের উপরে,
২২৩। [ তাদের কানে ] মিথ্যা অহংকার ঢেলে দেয়, এবং তাদের অধিকাংশ মিথ্যাবাদী ;-
২২৪। এবং পথভ্রষ্ট লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে - ৩২৩৭।
২২৩। [ তাদের কানে ] মিথ্যা অহংকার ঢেলে দেয়, এবং তাদের অধিকাংশ মিথ্যাবাদী ;-
২২৪। এবং পথভ্রষ্ট লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে - ৩২৩৭।
৩২৩৭। এই আয়াতটি নীচের [ ২৬ : ২২৭ ] আয়াতটির সাথে এক সাথে পাঠ করলে যে বক্তব্য দাঁড়ায় তা হচ্ছে কবিদের অনুসরণ করো না , তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে। কবিতা এখানে প্রতীক স্বরূপ যা অন্যান্য শিল্পবিদ্যা ও কারুশিল্প যেমন সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। নিজেদের বৈশিষ্ট্যে এ সব শিল্প কলা নিজেরা ভাস্বর। যদি মানুষ ইচ্ছা করে তবে, এ সব শিল্প কলাকে আল্লাহ্র রাস্তায় মানুষের কল্যাণে , জীবনের মানোন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বভাববতঃ কারণে মানুষ অনেক সময়েই অনর্থক ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে শিল্প কলাকে ব্যবহার করে থাকে। উল্লেখিত আয়াতের প্রথমাংশ থেকে কাব্যচর্চ্চার কঠোর নিন্দা ও তা আল্লাহ্ কাছে অপছন্দনীয় হওয়া বোঝা যায়। কিন্তু শেষাংশে যে ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হয়েছে , তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কাব্যচর্চ্চা ও শিল্পকলার চর্চ্চা সর্বাবস্থায় মন্দ নয়। বরং যে কবিতায় বা গানে বা শিল্পকলায় আল্লাহ্ তায়ালার অবাধ্যতা করা হয় কিংবা আল্লাহ্র স্মরণ থেকে বিরত রাখা হয় অথবা অন্যায় ভাবে কোনও ব্যক্তির নিন্দা ও অবমাননা করা হয় বা যা অশ্লীল ও অশ্লীলতার প্রেরণাদাতা সেই কবিতা বা গান বা শিল্পকলা নিন্দনীয় ও আল্লাহ্র কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে যেসব কবিতা, গান, শিল্প কলা গোনাহ্ ও অপছন্দনীয় বিষয়াদি থেকে পবিত্র , সেগুলিকে আল্লাহ্ তায়ালা আয়াতের মাধ্যমে ব্যতিক্রম ভুক্ত করে দিয়েছেন। মানুষের আত্মার মাঝে যে শিল্প সত্তা তা সেই মহাপরাক্রমশালী মহাপ্রভুর দান। সঙ্গীত , শিল্প, কাব্য সেই মহাসত্তার শিল্প নিদর্শনের প্রকাশ মাত্র। যখন এই প্রকাশের ভাষাকে বিকৃত করা হয় তখন তা হয়ে পড়ে শয়তানের প্রতিভূ। যেমন গান - আল্লাহ্ প্রেমে নিমগ্ন গান শ্রোতার চক্ষুকে অশ্রুতে ভরিয়ে দেয়, আত্মাকে আল্লাহ্ প্রেমে করে উদ্বেলিত। অপরপক্ষে যৌন আবেদন মূলক গান পাপের দিকে করে আকৃষ্ট। এ ভাবেই শিল্প , সঙ্গীত ও কাব্যের প্রয়োগের মাধ্যমে কখনও তা হয় আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের বাহন , আবার কখনও তা হয় শয়তানের প্রতিভূ। যখন এসব শিল্প কলা জীবনের মহত্তর ও বৃহত্তর উদ্দেশ্যকে ভুলে ক্ষণস্থায়ী সুখের পিছনে ছুটে বেড়ায় তখন তা শয়তানের প্রচারমন্ত্রে পরিণত হয়। যে জ্ঞান ও শাস্ত্র আল্লাহ্ ও পরকালকে ভুলিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তি সুখ কেন্দ্রিক মানুষে পরিণত করে তা আল্লাহ্র চোখে নিন্দনীয়। জ্ঞান ও শাস্ত্রের প্রয়োগ হবে মানব জীবনকে বৃহত্তর ও মহত্তর উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালনার জন্য। যদি তা না হয়ে উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় [ প্রত্যেক উপত্যকায় ] ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ক্ষুদ্র , ক্ষুদ্র সুখের পিছনে ঘুরে বেড়ায় তবে সে জ্ঞান বা শিল্প চর্চ্চা বৃথা। শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ঐশ্বরিক আলোর সন্ধান , এবং তার প্রতি আত্মনিবেদন। এর থেকে উৎসারিত সে উদ্দেশ্য থেকে শিল্প সত্তা হয়ে পড়ে যখন বিচ্যুত, ফলে সেই শিল্প সৃষ্টির মান হয়ে পড়ে ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডিতে আবদ্ধ। বৃহত্তর মুক্তির স্বাদ সে শিল্প সত্তা কখনও অনুধাবন করতে সক্ষম হবে না।
২২৫। তুমি কি দেখ না ওরা [ কবিরা ] বিভ্রান্ত হয়ে প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় ?
২২৬। এবং ওরা যা সম্পাদন করে না তাই -ই বলে ?
২২৭। তারা ব্যতীত যারা বিশ্বাস করে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহ্র স্মরণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে ৩২৩৮। যারা অন্যায় ভাবে আক্রান্ত হলেই কেবলমাত্র আত্মরক্ষা করে ৩২৩৯। শীঘ্রই [ অন্যায় ] আক্রমণকারী জানতে পারবে তাদের কর্ম তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে কোথায় ফিরিয়ে নেবে।
২২৬। এবং ওরা যা সম্পাদন করে না তাই -ই বলে ?
২২৭। তারা ব্যতীত যারা বিশ্বাস করে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহ্র স্মরণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে ৩২৩৮। যারা অন্যায় ভাবে আক্রান্ত হলেই কেবলমাত্র আত্মরক্ষা করে ৩২৩৯। শীঘ্রই [ অন্যায় ] আক্রমণকারী জানতে পারবে তাদের কর্ম তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে কোথায় ফিরিয়ে নেবে।
৩২৩৮। কাব্য এবং চারু কারুকলা কখনও নিন্দনীয় বিষয় বস্তু নয়। এ কথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, মানুষের জীবনের যে কোন প্রতিভা ; জ্ঞান , শিল্পকলা, কাব্য প্রতিভা, সঙ্গীত প্রতিভা নেতৃত্বের ক্ষমতা সব কিছুই সেই মহাপরাক্রমশালী মহাপ্রভুর দান। সুতারাং এসব প্রতিভা কখনও নিন্দনীয় হতে পারে না। নিন্দনীয় হচ্ছে যখন এসব প্রতিভাশালী মন খোদাদ্রোহীতা দ্বারা উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে ওঠে এবং তাদের প্রতিভাকে আল্লাহ্র বিমুখতার প্রতি নিয়োগ করে। ফলে তাদের প্রতিভা জীবনের সুক্ষ শিল্প কলাকে প্রকাশের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তা হয়ে ওঠে আত্ম গৌরব ও আত্ম প্রশংসার মাধ্যম মাত্র। যে শিল্প-কলা স্রষ্টার মাহাত্ম্যকে প্রকাশে অক্ষম হয়, তা কখনও কালজয়ী বা যুগকাল অতিক্রান্ত শিল্প, সঙ্গীত, বা কাব্য প্রতিভা হতে পারে না। কারণ সকল শিল্প ও কলার কেন্দ্র বিন্দু সেই বিশ্বস্রষ্টা। সে কারণেই প্রকৃত শিল্পী কখনও আক্রান্ত না হলে [ যেমন জিহাদ ] আক্রমণ করে না, অবশ্য তারা সব সময়েই মন্দের প্রতিরোধে হয় সুদৃঢ়। সে ভাবে বলা চলে একজন প্রকৃত শিল্পী হচ্ছেন একজন প্রকৃত ও শ্রেষ্ঠ মানব। মানুষের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী গুণে ,গরিমায়, এই পৃথিবীতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু নিষ্কলঙ্ক বিশুদ্ধ চরিত্রের শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে পৃথিবীতে নিজেকে গড়ে তোলা এক অসম্ভব কাজ। কিন্তু এ ধূলার ধরণীতে প্রতিটি মানুষের লক্ষ্য হবে একটাই - আর তা হচ্ছে চরিত্রগত গুণে আল্লাহ্র চোখে নিজেকে বিশুদ্ধ ও নিষ্কলঙ্ক প্রমাণ করা। বিশেষতঃ যাদের আল্লাহ্ শিল্প ও কাব্য প্রতিভা দ্বারা ধন্য করেছেন। এ কথা সত্য যে, বৈশিষ্ট্য বা কলাকৌশলের জন্য কেউ কালোত্তীর্ন শিল্প সৃষ্টি করতে পারে না। কালোত্তীর্ণ শিল্প তখনই সৃষ্টি হয় যখন তা বিশ্ব ভূবনের মূল আত্মার যে বিকাশ বা প্রকাশ তা সঠিকভাবে উত্থাপন করতে পারে। এই বিশাল বিশ্বভূবনের মাঝে স্রষ্টা তাঁর জ্ঞান , শিল্প সত্তাকে বিকশিত করেছেন। এই সত্তাকে অনুধাবনের মাধ্যমে যে তা প্রকাশ করতে পারে সেই হতে পার কালোত্তীর্ণ ও ক্ষণজন্মা শিল্পী। অন্যথায় তা হবে সঙ্কীর্ণতায় পর্যবসিত। দুটোর তুলনা হচ্ছে অসীম সমুদ্রের বিশাল বারিধারা যা মনকে বিশালতায় ভরিয়ে তোলে। অপরটি হচ্ছে ছোট ডোবা যার আবদ্ধ পানি শুধু দুগর্ন্ধ ছড়ায়। বিশালতার যে পূঁজারী সেই তো পার্থিব পঙ্কিলতাময় পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবীর উর্দ্ধে উঠতে সক্ষম। এখানেই শিল্পীর বৈশিষ্ট্য এবং এখানেই শিল্প সত্তার সার্থকতা। রসুলের [ সা ] সময়ে যে সব স্বনামধন্য কবি ছিলেন তাদের মধ্যে কবি হাসান ও কবি লাবিদের কবিতা সর্বোচ্চ সাতটি কবিতার মধ্যে র্নিবাচিত কবিতা হতো যা কাবা ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো হতো সেই ইসলাম পূর্ব অন্ধকার যুগে।
৩২৩৯। বিপক্ষের সমালোচনার উত্তর কবিতার মাধ্যমে প্রদান করে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।