সূরা নাম্ল
সূরা নাম্ল বা পিপড়া - ২৭
৯৩ আয়াত, ৭ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : এই সূরাটি পূর্ববর্তী সূরা ও পরবর্তী দুইটি সূরার সমপ্রকৃতির । এই সূরাটির সময়ের ক্রমপঞ্জি মধ্য মক্কান।
হযরত মুসার কাহিনীর পবিত্র আগুন, সাদা উজ্জ্বল হাত , লাঠি, সুলাইমানের কাহিনীর পাখীর ভাষা , মানুষ ও জ্বীনের ভীড়ে ক্ষুদ্র পিপীলিকার আত্মরক্ষার প্রয়াস ,হুপী পাখী ও সেবার রাণী ; সালেহ্র কাহিনীর নয়জন দুষ্ট লোকের পরাজয়; লূতের কাহিনীর প্রকাশ্য পাপ; আমাদের সত্য ও মিথ্যা উপাস্যের পার্থক্য শিক্ষা দেয়া ও আল্লাহ্র করুণা ও প্রত্যাদেশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই সূরা।
সার সংক্ষেপ : হযরত মুসার দৃষ্ট পবিত্র আগুন আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের মতই এক অলৌকিক ঘটনা। পবিত্র আলো ছিলো আল্লাহ্র মহিমার প্রকাশের ক্ষুদ্র ঝলক মাত্র। [ ২৭ : ১ - ১৪ ]।
সুলাইমান পাখীর ভাষা বুঝতে পারতেন। তাঁর অধীনে বিশাল জ্বিনের ও মানুষের বাহিনী ছিলো। ক্ষুদ্র ও জ্ঞানী পিপীলিকা সুলাইমানের বাহিনীর অজ্ঞানতাপ্রসূত ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার উপায় অবলম্বন করে। হুপী পাখী তার তালিকাভূক্তির হাজিরা থেকে অনুপস্থিত থাকা সত্বেও সুলাইমানের জন্য কাজ করেছে। সেবার রাণীর বিরাট রাজত্ব ছিলো; কিন্তু তবুও সে জ্ঞানী সুলাইমানের নিকট আত্মসমর্পন করে। [ ২৭ : ১৫ - ৪৪ ]
সালেহ্ নবীর কাহিনীতে নির্বোধেরাই মঙ্গল চিহ্নকে মন্দ ভাগ্যরূপে চিহ্নিত করে। লূতের কাহিনীতে বিকৃত পাপকে প্রকাশ্য করে। কিন্তু পাপীদের সকল পরিকল্পনা ও ক্রোধ আল্লাহ্ ধ্বংস করে দেন। [ ২৭ : ৪৫ - ৫৮ ]
আল্লাহ্র মহিমা ও কল্যাণ সৃষ্টির সকল কিছুর উর্দ্ধে। শেষ পর্যন্ত সত্যের ও প্রকৃত মূল্যবোধের নিকট অবিশ্বাস নতি স্বীকার করবে। সুতারাং আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অনুসরণ কর, আল্লাহ্র সেবা কর এবং তাঁর প্রতি সর্ব বিশ্বাস স্থাপন কর। [ ২৭ : ৫৯ - ৯৩ ]
সূরা নাম্ল বা পিপড়া - ২৭
৯৩ আয়াত, ৭ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৩২৪০। এগুলির অর্থ একমাত্র প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্-ই জানেন।
০৩। যারা নিয়মিত নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, এবং পরকালের প্রতি স্থির বিশ্বাস রাখে।
৩২৪১। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে তিনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে :
১) প্রত্যাদেশ আমাদের জ্ঞাত করে আল্লাহ্র অপার মহিমা ও করুণা, আল্লাহ্র গুণাবলী , স্রষ্টার সাথে আমাদের এবং বিশ্বচরাচরের সম্পর্ক।
২) প্রত্যাদেশের অর্থাৎ কোরাণের আয়াতের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে চলার পথের নির্দ্দেশ খুঁজে পাই। আমাদের জীবন পথের সঠিক নির্দ্দেশনার মানদণ্ড এই কোরাণ। সঠিক পথ নির্দ্দেশ ও পাপকে সনাক্ত করণের উপায় হচ্ছে আল্লাহ্র আয়াত বা প্রত্যাদেশ।
৩) যারা আল্লাহ্র পথ নির্দ্দেশকে জীবনে গ্রহণ করে এবং আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্য আছে আল্লাহ্র ক্ষমা , আত্মিক পরিশুদ্ধতা ও আত্মার মুক্তির সুসংবাদ।
৩২৪২। যারা আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধানকে প্রত্যাখান করে এবং পাপের পথে নিজেকে পরিচালিত করে , তাদের নিজেদের কর্মকে তাদের নিজের চোখে অতিশয় মনোহর বলে মনে হবে এবং তারা আত্মগর্বে বিমোহিত থাকবে। এই হচ্ছে বিধির বিধান। যদিও তাদের কৃতকর্ম অন্য কেউ পছন্দ করবে না, কিন্তু পাপীদের চোখে নিজস্ব পাপকে স্বীয় সাফল্যের মানদন্ডরূপে বিবেচিত হবে। কারণ আল্লাহ্ তা তাদের চোখে শোভন করেন। কারণ যেহেতু তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত পথকে প্রত্যাখান করেছে, সেহেতু আল্লাহ্ তাদের গৃহীত পাপের পথকে তাদের দৃষ্টিতে শোভন করে দেন। অন্যায় ও পাপকে তখন আর তাদের ধারণায় অন্যায় ও পাপ বলে বোধ হয় না। ন্যায় ও সত্য তাদের চোখে মনে হবে হাস্যস্কর ব্যাপার মাত্র। আল্লাহ্ তাদের অনুতাপ করার জন্য আরও সুযোগ দান করেন। কিন্তু এসব পাপীরা আর সুপথে ফিরে আসে না , তারা তাদের নিজস্ব কল্পনা ও খেয়ালেরই অনুসরণ করে থাকে। ফলে তারা আধ্যাত্মিক দিক থেকে বিভ্রান্তকর অবস্থায় পৌঁছে যায়। এই বিশ্বচরাচরের সকল কিছুই এক স্রষ্টার আদেশ মান্য করে চলেছে। মানুষকেও সেই একই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই নশ্বর দেহের মাঝে যে অমর আত্মার বাস তার ধর্মই হচ্ছে এক আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, আয়াতে (৫১:৫৬) বলা হয়েছে " আমি জ্বিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এজন্য যে, তারা শুধু আমারই এবাদত করবে।" যখন সে আল্লাহ্ প্রদত্ত পথ নির্দ্দেশকে উপেক্ষা করে পাপের পথে ধাবিত হয় , তখন সে তার আদি ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়। ফলে আত্মা হয় পথ ভ্রান্ত , বিভ্রান্ত ও স্ব ধর্মচ্যুত। কারণ আত্মার জন্য তখন অনুসরণযোগ্য কোনও নির্দ্দিষ্ট মানদণ্ড তখন থাকে না। আত্মার প্রকৃত গুণাবলী নষ্ট হয়ে যায় , সেই আত্মা বিশ্বস্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা হারায়। উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করবো : স্বচ্ছ সলিল সে কোনও বস্তুর ময়লাধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে দেয়। কিন্তু সেই পানিই যদি ড্রেনের ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি হয়, তবে তা পরিষ্কার করার যোগ্যতা হারায় - যদিও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সে পানিরও মূল উপাদান ঐ স্বচ্ছ পানির ন্যায়।
সেই রূপ পাপে আসক্ত আত্মা - ঐ ড্রেনের পানির সমতুল্য , যার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায় , ফলে সে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা হারায়।
৩২৪৩। সব কাজেরই মূল্যায়ন ঘটে শেষ যোগফলের মাধ্যমে। এ সব পাপী আত্মার শেষ পরিণতি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। পরলোকে যখন হিসাবের জন্য এ সব আত্মাকে উপস্থিত করা হবে, তখন দেখা যাবে তারা বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন। পার্থিব জগতের পাপ কাজ তাদের যে আত্মপ্রসাদ ও পরিতৃপ্তি দান করতো তার শেষ পরিণতি হবে সর্বাধিক ক্ষতি।
০৭। স্মরণ কর! মুসা তাঁর পরিবারকে বলেছিলো,৩২৪৪: " আমি আগুনের [ অস্তিত্ব ] উপলব্ধি করছি। শীঘ্রই আমি ঐ স্থান থেকে তোমাদের জন্য কোন সংবাদ অথবা, তোমাদের জন্য জ্বলন্ত অঙ্গার আনবো যা হবে তোমাদের উষ্ণ করার জন্য জ্বালানী।
৩২৪৪। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২০: ৯ - ২৪ ]। উল্লেখিত আয়াতগুলি এবং এই আয়াতে যে আগুনের উল্লেখ আছে তা হচ্ছে হযরত মুসার হৃদয়ে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ পাওয়ার ঊষালগ্নের বিবরণ। পূর্বের বর্ণনায় যার উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা আনুসঙ্গিক টিকাতে দ্রষ্টব্য। এই আয়াতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ঐশ্বরিক আগুনের প্রকৃতির উপরে এবং বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে হযরত মুসা ঐশ্বরিক আলোতে অবগাহন করে পরিবর্তিত মানুষে রূপান্তরিত হন। বর্ণনা অনুযায়ী হযরত মুসা পরিবার পরিজন সহ সিনাই উপত্যকাতে পরিভ্রমণ করছিলেন। তিনি আলো উষ্ণতার জন্য সাধারণ আগুনের অন্বেষণে ছিলেন - কিন্তু আল্লাহ্ তাঁকে সর্বোচ্চ আলো ও আল্লাহ্ প্রেমের উষ্ণতা দান করেন যা ছিলো আল্লাহ্র নৈকট্য এবং আল্লাহ্র অলৌকিক নিদর্শন। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ কোনও অলৌকিক বা আকস্মিক ঘটনা নয়। ব্যক্তির আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতাই হচ্ছে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের একমাত্র উপায়। মানুষের আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা হচ্ছে মানুষের অন্তরের ইতিহাস। পৃথিবীর মানদন্ডে ক্ষমতা অবস্থান যা ব্যক্তিকে সাধারণ মানুষের চোখে সম্মানীয় ও স্মরণীয় হতে সাহায্য করে, তার সাথে আত্মিক পরিশুদ্ধতার কোনও যোগসূত্র নাই। আত্মিক শুদ্ধতা হচ্ছে একমাত্র মানদন্ড যা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের একান্ত নিজস্ব ইতিহাস। হযরত মুসা আধ্যাত্মিক আলো লাভের পূর্বেই সেই পরিশুদ্ধতা লাভ করেন।
৩২৪৫। তফসীরকারগণ মনে করেন যে, এটা কোনও জাগতিক আগুন নয় , এটা ছিলো স্বর্গীয় আলোর বিচ্ছুরণ , আল্লাহ্র নূরের প্রকাশ।
১০। " এখন তুমি তোমার লাঠিটি নিক্ষেপ কর ৩২৪৬।" কিন্তু যখন সে উহাকে সাপের মত [ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ] নড়াচড়া করতে দেখলো , সে পিছন ফিরে পশ্চাদপসরণ করলো এবং আর সামনে গেলো না। [ বলা হলো ], " হে মুসা! ভয় পেয়ো না : কেননা যাদের রাসুল বলা হয়, তাদের আমার সান্নিধ্যে কোন ভয় নাই , ৩২৪৭ -
৩২৪৬। হযরত মুসা এখন এক সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষ। স্বর্গীয় আলোর স্পর্শে তিনি আত্মিক দিক থেকে এক নূতন পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছেন। যা তিনি মনে করেছিলেন সাধারণ আগুন তা ছিলো স্বর্গীয় আলোর বিচ্ছুরণ। জাগতিক জীবনের মলিনতার উর্দ্ধে ঐশ্বরিক আলোর ভূবনে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঐশ্বরিক আলোর মাধ্যমে তিনি দিব্যজ্ঞান ও ক্ষমতা লাভ করেন। তাঁর মেষ চরানোর সাধারণ লাঠি আর প্রাণহীন লাঠিমাত্র ছিলো না। তা রূপান্তরিত হয় জীবন্ত প্রাণীতে। জীবনের সকল অনুভব সে লাঠিতে বিরাজ করে। ঠিক সেই রকম স্বর্গীয় আলোর সংস্পর্শে হযরত মুসা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষে পরিণত হন। মুসার পরিবর্তন বর্ণনা করা হয়েছে পরবর্তী টিকাতে।
৩২৪৭। হযরত মুসা এখন সম্পূর্ণ নূতন এক আধ্যাত্মিক জগতে আগমন করেছেন। এই নূতন জগতের অপূর্ব সৌন্দর্য ও আলোর ঝলকানি তাঁকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে। অন্ধকার থেকে আলোতে হঠাৎ প্রবেশ কালে চক্ষুকে যেরূপ আলোর সাথে বিন্যস্ত করে নিতে হয়, সেরূপ আধ্যাত্মিক ভাবে ঐশ্বরিক আলোতে আলোকিত উদ্ভাসিত জগতের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে মুসাকে চেষ্টা করতে হয়। প্রাণহীন লাঠি সাপে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে তিনি ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। যদিও লাঠিটি ছিলো তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গী, মেষ চারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ। এখন হযরত মুসার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়েছে। মেষ পাল পরিচালনার পরিবর্তে এখন তাঁকে ইসরাঈলীদের রাসুল রূপে প্রেরণ করা হবে ; তাই তাঁর লাঠিকেও পরিবর্তিত কর্মক্ষেত্রের উপযোগী করা হয়। সুতারাং তাঁর মন থেকে সকল ভয় দূর করতে বলা হয় - কারণ তিনি আল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তি।
৩২৪৮। মিশরে অবস্থান কালে হযরত মুসা দুর্ঘটনাক্রমে একজন মিশরবাসীকে হত্যা করে ফেলেন। [ দেখুন টিকা ৩১৪৬ এবং আয়াত ২৬ : ১৪ ] যদিও হত্যাটি সংঘটিত হয় অত্যাচারীকে প্রতিরোধ এবং নির্যাতিতকে রক্ষা কল্পে; তবে তা ছিলো একটি দুর্ঘটনা বই আর কিছু নয়। তবুও সেই পাপ থেকে হযরত মুসার পরিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু। আল্লাহ্ তাঁকে শুধু ক্ষমাই করেন নাই তাঁকে আরও অলৌকিক ক্ষমতা দান করেন। এই আয়াতটি যদিও হযরত মুসার নবুয়ত পাওয়ার প্রেক্ষিতে বর্ণনা করা হয়েছে , কিন্তু এর আবেদন সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। যদি কেউ জুলুম করে, অর্থাৎ আত্মার প্রতি জুলুম করে। আত্মার প্রতি জুলুম , তখনই ঘটে যখন কেউ পাপ কাজে আসক্ত হয়ে যায়। যদি কেউ পাপ করে তখন সে নিজ আত্মার প্রতি জুলুম করে। পরবর্তীতে যদি সে অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে সৎ ও ভালো কাজে নিয়োজিত করে তবে পরম করুণাময় আল্লাহ্ তার প্রতি ক্ষমাশীল। বিশ্ব মানবের জন্য এ এক মহান বার্তা।
৩২৪৯। দেখুন আয়াত [ ২০: ২২ ] যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে , "Draw thy hand close to thy side" হাতের প্রাকৃতিক ধর্মের দিক থেকে উপরের বর্ণনা ও এই আয়াতের বর্ণনার মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নাই। কারণ হাতের যে বৈশিষ্ট্য তা উভয় আয়াতে একই রূপ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত মুসার পোষাক ছিলো ঢিলা ঢোলা - প্রাচীন যুগের লোকদের যেরূপ থাকতো। যদি তিনি তাঁর ডান হাতকে ঢিলা পোষাকের ডান দিক দিয়ে প্রবেশ করান , তবে তা বুকের বাঁ দিকে পৌঁছাবে। অনুরূপ ভাবে বাঁ হাত ডান দিকে পৌঁছাবে। সুতারাং দুইটি আয়াতেরই বর্ণনা সামঞ্জস্যপূর্ণ। যখন হযরত মুসা হাতকে বের করে আনেন তখন তা উজ্জ্বল সাদা আলো বিচ্ছুরণ করে। সাধারণভাবে শরীরের কোনও অংশ সাদা হওয়াকে শ্বেত কুষ্ঠের পরিণতি হিসেবে পরিগণিত করা হয়। কিন্তু এখানের সাদা ছিলো ঠিক তার বিপরীত। এই সাদা ছিলো পূত পবিত্রতা ও স্বর্গীয় আলোর প্রতীক।
৩২৫০। নয়টি নিদর্শনের জন্য দেখুন টিকা ১০৯১ এবং আয়াত [ ৭ : ১৩৩ ]।
৩২৫১। যদি ফেরাউনের লোকেরা প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে চাইত, তবে হযরত মুসার নিকট প্রেরিত আল্লাহ্র স্পষ্ট নিদর্শন সমূহ তাদের জ্ঞান চক্ষুকে উন্মীলনে সাহায্য করতো। কিন্তু যারা জ্ঞান পাপী, বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন , তারা সত্যকে তাদের হৃদয়ে অনুধাবন করলেও তা গ্রহণ করে না। সত্যকে তাদের হৃদয়ে অনুভব করে; কিন্তু উদ্ধতভাবে তারা সত্যকে বা আল্লাহ্র নিদর্শনকে প্রত্যাখান করে। তাদের অন্তর এগুলিকে সত্য বলে অনুধাবন করলেও তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। এভাবেই তারা তাদের বিবেককে অন্যায় ও অসত্যের নীচে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে। এ ভাবেই তারা তাদের পাপের পাত্র পূর্ণ করে। এরাই হলো বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ফেরাউনের উদাহরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে সর্বযুগে বিপর্যয়কারী এ সব লোকের কথাই বলা হয়েছে।
৩২৫২। দেখুন আয়াত [ ২১ : ৭৮ - ৮২ ]। আমরা সাধারণভাবে জ্ঞানীলোক বলতে তাদেরই বুঝাই যারা জাগতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ। জাগতিক জ্ঞান অর্থাৎ যে জ্ঞান পার্থিব সম্পদ অর্জনে সহায়ক। এ সব অর্থকরী জ্ঞানের উদাহরণ যেমন : বিজ্ঞানের জ্ঞান, প্রযুক্তির জ্ঞান , শিল্প সাহিত্যের জ্ঞান , মানবিক জ্ঞান ইত্যাদি। এ সব জ্ঞান আমাদের জীবনের মান উন্নয়নে সহায়ক। এ সব জ্ঞান ব্যতীত অন্য আর এক ধরণের জ্ঞানের উল্লেখ এই আয়াতে পরম করুণাময় আল্লাহ্ করেছেন। যে জ্ঞান শুধুমাত্র সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত। যে ' জ্ঞান ' তিনি দাউদ নবী ও সুলাইমান কে দান করেন। এই 'জ্ঞান ' হচ্ছে আল্লাহ্র হেদায়েতের জ্ঞান বা 'মারেফতী' জ্ঞান। যিনি এই জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি হন বিচক্ষণ , বিবেকবান, ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তি। তাদের এই জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটে তাদের প্রতিদিনের জীবনে।
তারা বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপর এবং তারা হবেন ন্যায়বান। জীবনের মহত্তর ও বৃহত্তর দিক অনুধাবনে তারা সক্ষম, এই পার্থিব জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন যা সাধারণ মানুষের পক্ষে এক অসাধারণ ঘটনা। দাউদ নবী ও হযরত সুলাইমান দুজনেই ছিলেন ধর্মভীরু , ন্যায়বান এবং আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত বান্দা। তাই আল্লাহ্ তাদের অদৃশ্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন যে জ্ঞান জীবনকে বুঝতে ,জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে অনুধাবন করতে, জীবনকে মহত্তর ও উচ্চতর দিকে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। দাউদ ও সুলাইমানের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের অনুধাবন করতে বলেছেন যে, যারা পূত ও পবিত্র জীবন যাপন করবে, অন্যায় অসত্য থেকে দূরে থাকবে , জীবনের সকল ইচ্ছাকে সেই সর্বশক্তিমানের ইচ্ছার কাছে সমর্পন করবে আল্লাহ্ তাদের অদৃশ্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ করবেন। বড় বড় ওলি ও আওলিয়ারা এই জ্ঞানে ধন্য হন।
৩২৫৩। " প্রশংসা আল্লাহ্র ................ শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছেন " দাউদ নবী ও হযরত সুলাইমানের এই বাক্যটির মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাদের বিনয় ও আল্লাহ্ ইচ্ছার নিকট আত্ম সমর্পিত দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁরা ছিলেন ন্যায়বান, বিচক্ষণ, বিবেকবান ও জ্ঞানী। কিন্তু তাঁরা সে জন্য কোনও রূপ অহংকার প্রকাশ করেন নাই। কারণ তাঁরা জানতেন সকল জ্ঞানের উৎস সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। তাই তাঁরা তাঁদের জ্ঞান, বিবেক , অন্তর্দৃষ্টি , বিচক্ষণতা, ক্ষমতা সব কিছুর জন্য আল্লাহ্কে উৎস বলে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
উপদেশ : ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বা সাফল্য নিজস্ব বলে ধারণা করার কোনও কারণ নাই। সবই সেই করুণাময়ের দান। কৃতিত্ব বা সাফল্য নিজস্ব বলে ধারণা করলেই তখন দাম্ভিকতা ও অহংকারের উৎপত্তি হয়।
৩২৫৪। হযরত সুলাইমান শুধু যে তাঁর পিতার সিংহাসনের উত্তরাধীকারী হন তাই -ই নয়, তিনি তাঁর পিতার নবী সুলভ জ্ঞান , প্রজ্ঞা , বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন। এটা ছিলো আল্লাহ্র এক বিশেষ অনুগ্রহ। কারণ এসব জিনিষ আল্লাহ্ বংশ পরম্পরায় দান করেন না। আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ দেখেই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে সুলাইমান ছিলেন দাউদের উত্তরাধীকারী।
৩২৫৫। পাখীরা কি কথা বলে ? হয়তো তারা মানুষের মত ভাষার মাধ্যমে কথা বলে না। কিন্তু পাখী এবং অন্যান্য প্রাণীকূল যারা যুথবদ্ধভাবে বাস করে তাদের আচরণ লক্ষ্য করলেই একথা সুস্পষ্ট হয় যে, তারা তাদের মাঝে ভাবের আদান প্রদান ঘটায়। বসন্তের সোনালী প্রভাতে পাখীরা গান গায় , জোড়া বাঁধে , বাসা তৈরী করে। অপরাহ্নে পাখীরা যখন দিনশেষে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে , দল বেঁধে একই শ্রেণীর পাখী একই গাছে থাকে। কিচির মিচির করে মনের ভাব প্রকাশ করে, পরস্পরের মাঝে। যুথবদ্ধ প্রাণীকূলেও দেখা যায় তারা পরস্পরের মাঝে ভাবের আদান প্রদান করে থাকে। দেশান্তরে ভ্রমণশীল পাখীদের [ Migratory bird ] শৃঙ্খলা , পিপীলিকা মৌমাছির সুশৃঙ্খল আচরণ ও যে সব প্রাণী যুথবদ্ধ ভাবে বাস করে তাদের জীবন পদ্ধতি থেকে বোঝা যায়, এ সব প্রাণীরাও পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে; ভাবের আদান -প্রদান করে। হযরত সুলাইমানকে আল্লাহ্ সেই জ্ঞান দান করেছিলেন যার মাধ্যমে তিনি স্বল্প বুদ্ধি সম্পন্ন এ সব বিহঙ্গকূল ও প্রাণীকূলের ভাবের আদান-প্রদানকে বুঝতে পারতেন।
৩২৫৬। হযরত সুলাইমান ছিলেন মহাপরাক্রান্ত , ক্ষমতাশালী নৃপতি। তাঁর নিজস্ব রাজত্বের বাইরেও তাঁর প্রতিবেশী নৃপতিদের উপরেও তার প্রভাব ছিলো। তিনি যে শুধুমাত্র শক্তিশালী নৃপতিই ছিলেন তাই-ই নয় আল্লাহ্ তাঁকে আরও বহুবিধ নেয়ামতে ধন্য করেছিলেন। তিনি বিহঙ্গকূলের এবং প্রাণী কূলের ভাষা বুঝতে পারতেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানী , বিচক্ষণ , ন্যায়বান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর ছিলো আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি , যার ফলে তিনি আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করেন। এভাবেই আল্লাহ্ তাঁকে কাঙ্খিত " সকল কিছু " নেয়ামতে ধন্য করেন। হযরত সুলাইমান এই " সকল কিছু " নেয়ামতের জন্য আল্লাহ্কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ক্ষমতা , অর্থ , বিত্ত , জ্ঞান , প্রভাব প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ শিখরে থেকেও সুলাইমান অনুধাবন করেছিলেন আল্লাহ্র বিশেষ ' অনুগ্রহকে '। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ আল্লাহ্র নেয়ামতের সামান্য কণা মাত্র আয়ত্ব করলে অন্ধ অহংকার ও দম্ভে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ি যে, সব কিছুর মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। ভুলে যাই তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। দম্ভ ও অহংকার আমাদের সত্ত্বাকে গ্রাস করে ফেলে। দাউদ নবী ও সুলাইমানের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই উপদেশ দিয়েছেন যে, আল্লাহ্র অনুগ্রহ বিনয়ের সাথে অবনত মস্তকে কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়।
৩২৫৭। এই আয়াতটির আক্ষরিক অর্থের বাইরেও এর অপর প্রতীকধর্মী অর্থ বিদ্যমান। যেমন :
১) সুলাইমান প্রজাকূলকে তাদের বুদ্ধি , রুচি, সভ্যতার বিকাশ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন এবং তাদের শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের সাথে সুদক্ষ প্রশাসনের মাধ্যমে পরস্পরকে সমন্বিত করেন।
২) তিনি আল্লাহ্র নিকট থেকে যে সব বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন [ পরবর্তী আয়াত দ্রষ্টব্য ] তা তিনি দক্ষ প্রশাসনের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যাস্ত করেন, সমন্বিত করেন যেনো তারা কোনও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী। এ ভাবেই তিনি আল্লাহ্ প্রাপ্ত গুণাবলীর সর্বোচ্চ ব্যবহারকে নিশ্চিত করেন যেনো জীবনে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করতে পারেন।
উপদেশ : জীবনে সাফল্য লাভের প্রধান উপায় এই আয়াতে সুলাইমানের মাধ্যমে শিক্ষা দান করা হয়েছে। শৃঙ্খলা এবং সমন্বিত কার্য পদ্ধতিই একমাত্র সাফল্যের চাবিকাঠি।
৩২৫৮। এই আয়াতটি ও পরবর্তী আয়াতটি একসাথে পড়তে হবে, তাহলেই আয়াতগুলির প্রতীকধর্মী অর্থ সুস্পষ্ট হবে। পিপীলিকা খুবই ক্ষুদ্র ও নগণ্য প্রাণী। পৃথিবীর শক্তিশালী ও বিশাল প্রাণীকূল দ্বারা তার ক্ষতির সম্ভাবনা , এমন কি অজ্ঞানতা ও অসাবধানতাবশতঃ পদতলে পিষ্ঠ হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা বিদ্যমান। তবুও এত ক্ষুদ্র প্রাণী হওয়া সত্বেও তারা তাদের গৃহে সুরক্ষিত। যুগ যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু ক্ষুদ্রতা সত্বেও তারা ধরাতল থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নাই। তাদের মাঝে মহান স্রষ্টা যে জ্ঞান দান করেছেন তার সাহায্যেই তারা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে এবং পৃথিবীর প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে চলেছে। ঠিক সে ভাবেই পার্থিব জগতে যারা সমাজের চোখে নগন্য , হতভাগ্য - তাদের জন্যও আধ্যাত্মিক জগতের দ্বারা উম্মুক্ত করে রেখেছেন মহান স্রষ্টা । আল্লাহ্র চোখে তারাও নগন্য নয়।
৩২৫৯। নগন্য পিপীলিকার প্রেক্ষাপটের বিপরীতে হযরত সুলাইমানের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে যার শক্তি , ক্ষমতা, শৈর্য্য, বীর্য, সমসাময়িক ধরাতলকে প্রকম্পিত করতো। পিপীলিকার বক্তব্যের বিপরীতে সুলাইমানের প্রার্থনাটি উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রার্থনা করেন যে, তাঁর ক্ষমতা , জ্ঞান , এবং অন্য আর সকল অনুগ্রহ যা আল্লাহ্ তাঁকে দান করেছেন তার সব যেনো তিনি সৎ কাজে সকলের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করতে পারেন। যাতে তিনি আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করতে পারেন। ক্ষুদ্র পিপীলিকার বক্তব্য তাঁর চিন্তাধারা কে উদ্বেলিত করেছিলো এভাবে যে , আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাঁকে যেন শক্তিমদমত্ত করে না তোলে। এমন কি অসর্তক ভাবেও তিনি যেনো পিপীলিকার মত ক্ষুদ্র প্রাণীকে পদদলিত করে না ফেলেন। পিপীলিকাকে পদদলিত করা প্রতীক অর্থে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ তাঁর চতুপার্শ্বে যারা ক্ষুদ্র সামান্য, তিনি যেনো ভুলবশতঃ বা অসাবধানে তাঁদের কোনও ক্ষতি করে না ফেলেন।
৩২৬০। এমন অনেক কাজ আছে যা সমাজ ও সংসারে প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু আল্লাহ্র চোখে তা অপছন্দনীয়। সুলাইমান প্রার্থনা করেন যে, তিনি যেনো আল্লাহ্র পছন্দের কাজকে জীবনের শ্রেষ্ঠ মানদণ্ডরূপে পরিগণিত করতে পারেন। পার্থিব প্রশংসা বা জাগতিক সাফল্যের মোহ যেনো তাকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে তিনি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক।
৩২৬১। আল্লাহ্র রাজত্বে সৎকর্ম পরায়ণতা হচ্ছে নাগরিকত্বের পরিচয় জ্ঞাপক চিহ্ন। যদিও আল্লাহ্র রাজত্বে সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের মধ্যে শ্রেণী বিভাগ আছে। [ দেখুন আয়াত ৪ : ৬৯ এবং টিকা ৫৮৬ ] , কিন্তু তাদের মূল পরিচয় হচ্ছে সৎ কাজে তারা একে অপরের অংশীদার। এভাবেই তারা এক বিশাল সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শ্রেণী বা বিশ্ব ভাতৃত্বের অংশ। সুলাইমান সেই বান্দাদের শ্রেণীভুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন।
৩২৬২। পূর্বেই বলা হয়েছে হযরত সুলাইমান আল্লাহ্ প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও অনুগ্রহ, শৃঙ্খলার সাথে বিন্যস্ত ও সমন্বিত করতেন। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তিনি তাঁর প্রশাসনের সকল সংস্থা , সেনাদল ও শক্তির উৎস সমূহ সর্বদা কঠোর তত্বাবধানে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতেন। তার বিচরণশীল সেনাদলে ছিলো বিহঙ্গকূল। বিহঙ্গরা সর্বত্র উড়ে বেড়াতো এবং রাজত্বের সকল খবরা-খবর সংগ্রহ করতো। একদিন সুলাইমান হুদ্হুদ্ কে অনুপস্থিত দেখতে পেলেন সমাবেশে। হুদহুদ পাখীর স্বাভাবিক সৌষ্ঠব হচ্ছে হালকা এবং সৌন্দর্য্য মন্ডিত। এর পালকগুলি বহুবর্ণে রঞ্জিত। মাথায় সুন্দর হলুদ পালকগুচ্ছ মুকুটের ন্যায় শোভা পায় - যার ফলে হুদ্হুদ্ কে পাখীর রাজার ন্যায় দেখায়।
২২। কিন্তু অনতিবিলম্বে হুদহুদ এসে পড়লো এবং বললো; " আমি এমন এক রাজ্য প্রদক্ষিণ করে এসেছি যা আপনি করেন নাই, এবং আমি আপনার নিকট সাবা দেশ থেকে সত্য খবর এনেছি ৩২৬৩।
৩২৬৩। বাইবেলে উল্লেখিত নগরী সেবা ও এখানে উল্লেখিত সাবা একই নগরী। পরবর্তীতে সূরা সাবাতে [ ৩৪ : ১৫ - ২০ ] এই নগরীর নাম অনুযায়ী নামকরণ করা হয়। সাবা ইয়েমেনের একটি নগরী। সা'না থেকে তিন দিনের পদব্রজের পথ [ প্রায় ৫০ মাইল ]। একজন জার্মান প্রত্নতত্ববিদ Dr. Hans Helfritz বর্তমানে দাবী করেন যে তিনি হাদরামাউতে [ Hadhramaut ] সাবার অবস্থান সনাক্ত করতে পেরেছেন। বিখ্যাত Maarib এর বাঁধ দেশটিকে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করে, ফলে তারা উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি করে। সুতারাং সেবার রাণী এরূপ একটি উন্নত সভ্যতা ও সমৃদ্ধশালী সম্রাজ্যের রাণী হওয়ার দরুণ স্বাভাবিক ভাবেই গর্বিত ছিলেন যতদিন না তিনি সুলাইমানের যশ ও গৌরব দর্শন করেছিলেন।
৩২৬৪। এই মহিলা ছিলেন সেবার রাণী বিলকিস্। আরব দেশে প্রথা অনুযায়ী সেবার রাণীকে বিলকিস ডাকা হতো। সেবার রাণী ইয়েমেন থেকে আগত, তবে তাঁর আবেসিনিয়ার সাথে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিলো। সম্ভবতঃ তিনি আবেসিনিয়াও শাসন করতেন। হাবাসা গোত্র [ Habasha ] ইয়েমেন থেকে আগত এবং হাবাসার নাম অনুসারে আবেসিনিয়ার নামকরণ করা হয়। ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূল এবং আবেসিনিয়ার উত্তর পূর্ব উপকূল মাত্র ২০ মাইল সংঙ্কীর্ণ প্রণালী [ Bab-al- Maudab ] দ্বারা বিভক্ত। খৃষ্টপূর্ব ১০ - ১১ শতাব্দীতে আরব থেকে ঘন ঘন আবেসিনিয়া আক্রমণ করা হতো যে সময় কাল সুলাইমানের রাজত্বকালের সাথে [ খৃষ্টপূর্ব ৯৯২ - ৯৫২ ] সামঞ্জস্য পূর্ণ। দক্ষিণ আরবে ইসলাম পূর্ব যে শিলালিপি পাওয়া যায় তার বর্ণমালার প্রভাব সাবাঈন [Sabaean] এবং হিমেয়ারাইট [ Himyarite ] বর্ণমালাতে লক্ষ্য করা যায়। এই ভাষা ইথিওপিয়ার মাধ্যমে আবেসিনিয়ার ভাষারূপে পরিচিত। আবেসিনিয়ার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বর্তমান"The Book of The Glory of Kings" [ Kebra Nagast ] MÖš’wU Sir E. A. Wallis Budge [Oxford 1932 ] দ্বারা ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইতে সেবার রাণী এবং তাঁর একমাত্র পুত্র Menyelek I যিনি আবেসিনিয়ার রাজবংশের পত্তন করেন, তার বর্ণনা আছে।
৩২৬৫। "সকল কিছু " বাক্যটি মওলানা ইউসুফ আলীর মতে শুধুমাত্র ঐশ্বর্য,সোনা-দানা বা খাদ্য সম্ভারের প্রাচুর্য-ই নয়। এসব ব্যতীতও সেবার রাণীর রাজত্বে বিজ্ঞান ও শিল্পেরও চর্চ্চা করা হতো।
৩২৬৬। সাবার লোকদের [ Himyar or Sabaeans ] প্রাচীন ধর্ম ছিলো নভোমন্ডলের সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজিকে পূঁজা করা। সম্ভবতঃ এই ধর্ম বিশ্বাস হযরত ইব্রাহীমের পিতার দেশ চালদিয়া [ Chaldaea ] থেকে আগত। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৭৫ - ৭৯ এবং এর টিকা ]। কারণ আবেসিনিয়া মেসোপটেমিয়া এবং পারস্য উপসাগরে ইয়েমেনবাসীদের অবাধ যাতায়াত ছিলো।
সাবাঈনদের ধর্ম [ Sabaean আরবীতে সিন্ দিয়ে লেখা হয় ] এবং সাবীয়ানদের ধর্মের [ Sabian আরবীতে সোয়াদ দিয়ে লেখা হয় ] মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলা ঠিক নয়। সাবীয়ানদের সম্পর্কে দেখুন আয়াত [ ২ : ৬২ ] এবং টিকা ৭৬।
৩২৬৭। সাবাঈনদের মিথ্যা উপাস্যের উপাসনাকে তিন ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
১) তারা তাদের নিজেদের সাফল্যে বিমোহিত কারণ শয়তান তাদের কার্যাবলী তাদের চোখে শোভন করে দেয়। তারা সর্ব সাফল্যের জন্য আল্লাহ্র অনুগ্রহকে স্মরণ করতে ভুলে যায়।
২) যে জ্যোতিষ্কমন্ডলীর পূঁজা তারা করে, সে সবের অস্তিত্ব আল্লাহ্র অনুগ্রহের উপরে নির্ভরশীল। স্রষ্টাকে পূঁজা করতে হয়, তাঁর সৃষ্টিকে নয়, এই সহজ সত্য তারা শয়তানের প্ররোচনাতে অনুধাবনে ব্যর্থ।
৩) আল্লাহ্ মানুষের মনের ব্যক্ত অব্যক্ত সকল চিন্তাধারা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তারা যার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে সম্বন্ধেও আল্লাহ্ ওয়াকিবহাল। আসলে তাদের আনুগত্য তাদের আত্ম পূঁজা। নিজেদের মনগড়া মিথ্যা উপাস্য তাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। নিজের সৃষ্টির পূঁজার মাধ্যমে তারা আত্মপূঁজাতেই আত্মনিমগ্ন থাকে। স্রষ্টাকে ভয় পায়। কারণ তিনি সব কিছু জানেন। তাদের অন্তরের গোপন পাপের খবরও তিনি জ্ঞাত।
৩২৬৮। হুদ্হুদ্ ছিলো হযরত সুলাইমানের উপযুক্ত পূণ্যাত্মা দূত। তার বক্তব্য ছিলো : প্রথমে সাবাঈনের মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার উল্লেখ করে সে একত্ববাদের ঘোষণা করে এবং আল্লাহ্কে মহা আরশের অধিপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। কারণ সে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, মানুষের সিংহাসন যত চমৎকার ও জাঁকজমকপূর্ণ হোক না কেন [ ২৭ : ২৩ ] - সবার উপরে আল্লাহ্র আরশের অবস্থান। এর মানে এই নয় যে, সে সুলাইমানের বিশ্বস্ত ছিলো না, এখানে শুধু সে একত্ববাদের ধর্মকে ব্যাখ্যাদান করে।
৩২৬৯। হুদহুদের নূতন দেশ ভ্রমণের বর্ণনা সুলাইমান সন্দেহ করেন নাই, কিন্তু তিনি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন যে, বর্ণনার মধ্যে অতিরঞ্জিত আছে কি না। হুদহুদের কল্পনা , বাস্তব ঐশ্বর্য, জাঁকজমক ও তাদের ধর্মের বর্ণনাকে অতিক্রম করে বাহুল্যেতে পর্যবসিত কি না , এই ছিলো সুলাইমানের পরীক্ষার বিষয়।
২৯। [ রাণী ] বলেছিলো, " হে পরিষদবর্গ আমাকে এক সম্মানীত পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। "
৩০। " এটা এসেছে সুলেমানের পক্ষ থেকে এবং তা এই : " দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ! ৩২৭০"
৩২৭০। সুলাইমান তাঁর পত্র পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে শুরু করে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি নূতন সম্প্রদায়কে আল্লাহ্র প্রতি সত্যের প্রতি আহ্বান করেছেন। তাঁর এই আহ্বান সমর শক্তি দ্বারা দেশ জয় করার অভিপ্রায় নয়। এই আহ্বান ছিলো সম্মানজনক আহ্বান আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোয়।
৩৩। তারা বলেছিলো, " আমরা তো শক্তিতে সমৃদ্ধ প্রচন্ড যুদ্ধে পারদর্শী। কিন্তু আপনি হুকুম দেয়ার মালিক। সুতারাং ভেবে বলুন আপনি কি হুকুম দেবেন। "
৩৪। সে বলেছিলো, " রাজা-বাদশারা যখন কোন দেশে [ বিজয়ী রূপে ] প্রবেশ করে, তখন সে দেশ লুণ্ঠন করে ৩২৭১। সেখানের মর্যদাবান ব্যক্তিদের লাঞ্ছিত করে। এরাও এরূপই করবে।
৩২৭১। এই আয়াতের মাধ্যমে রাণী বিলকিসের চরিত্রের বিশেষ দিক প্রকাশিত করা হয়েছে। রাণী শাসক হিসেবে ক্ষমতা, ঐশ্বর্য্য ,সম্মান , প্রজাদের আনুগত্য সব কিছুই পূর্ণমাত্রায় ভোগ করছিলেন। কিন্তু তিনি পরিষদদের সাথে আলোচনা ব্যতীত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। তাঁর পরিষদবর্গ ছিলো তাঁর একান্ত অনুগত এবং তাঁর আদেশ মানার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। তাঁর প্রজাবর্গ ছিলো সাহসী, অনুগত ও তৃপ্ত। যদিও তাঁরা দেশকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু রাণী বিলকিস সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ছিলেন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ। তিনি তাঁর দেশকে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত করতে চান নাই। তিনি তাঁর বিচক্ষণতার দ্বারা অনুধাবন করেছিলেন যে, সুলাইমান ঠিক অন্য আর সকল নৃপতির মত অস্ত্রের মাধ্যমে দেশ জয়ের পক্ষপাতি নন। সম্ভবতঃ বিলকিসের হৃদয় ছিলো পবিত্র, তাই আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো পূর্ব থেকেই সে হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলো , যার দরুণ সত্য ও মিথ্যাকে প্রভেদ করার ক্ষমতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাঁর হৃদয়ে তিনি লাভ করেছিলেন ; যদিও তাঁর রাজত্বে তাঁর সকল প্রজা ছিলো মোশরেক। রাণী ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসক এবং প্রজাবৎসল। প্রজাদের জন্য তাঁর ছিলো অপরিমেয় স্নেহ ভালোবাসা। সুতারাং প্রজারাও তাদের রাণীকে যৎপরনাস্তি ভালোবাসতো। যে কোন অবস্থাতেই তারা রাণীর পাশে অবস্থান নেবে। সুতারাং যুদ্ধের রাস্তায় না যেয়ে রাণী সিদ্ধান্ত নিলেন যে, উপঢৌকন প্রেরণ করা হোক। সম্ভবতঃ রাণীর হৃদয়ে আধ্যাত্মিক আলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছিলো - কারণ তাঁর সিদ্ধান্ত ছিলো মানবিক ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন। রাণী বিলকিসের চরিত্রে দূরদর্শিতা ও নারীর মমত্বের রূপ লক্ষ্য করা যায় কারণ প্রজাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব সত্বেও তিনি শান্তির পথে তাদের টেনে নিতে সক্ষম ছিলেন।
৩৬। দূতেরা যখন সুলেমানের নিকট পৌঁছুলো, সে বলেছিলো, " তোমরা কি আমাকে প্রচুর সম্পদ দিতে চাও ? কিন্তু আল্লাহ্ আমাকে যা দিয়েছেন তা , তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তা থেকে উত্তম। অথচ তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে উৎফুল্ল বোধ করছো ৩২৭২।
৩২৭২। বেচারী বিলকিস্ - তাঁর ধারণা ছিলো যে মেয়েলী কৌশল দ্বারা সুলাইমানকে তিনি শান্ত করতে পারবেন, এবং তাঁর যুদ্ধংদেহী মনোভাব সম্পন্ন প্রজাকূলকে নিবৃত করতে পারবেন। কিন্তু রাণীর এই কৌশল সুলাইমানের উপরে উল্টো ভাবে কাজ করেছিলো। তিনি একে অপমান বলে গ্রহণ করলেন। কারণ সুলাইমানের আহ্বান কোনও রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্খা ছিলো না। তা ছিলো সত্য ধর্মের প্রতি, এক আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের আহ্বান। মহত্তর, সত্যের আহ্বানের পরিবর্তে উপঢৌকন , হাস্যকর ব্যাপার বৈকি। তিনি উপঢৌকন প্রত্যাখান করেন এবং বলেন যে, " এ সব ঝকমকে তুচ্ছ বস্তু তোমাদের হৃদয়ে আনন্দ সঞ্চার করুক। আমার ওসবে প্রয়োজন নাই, কারণ আল্লাহ্ আমাকে জাগতিক প্রচুর ধনসম্পদ দান করেছেন। তা ব্যতীত এমন কিছু দিয়েছেন যা পার্থিব সম্পদের থেকে শ্রেষ্ঠ।" এখানে তিনি আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর কথা বলেছেন।
৩৮। সে [ সুলেমান ] বলেছিলো, " হে আমার পরিষদবর্গ তারা আমার নিকট [ আনুগত্যে ] আত্মসমর্পনের জন্য আসার পূর্বেই তোমাদের মধ্যে কে তাঁর সিংহাসন আমার নিকট নিয়ে আসতে পারবে ? " ৩২৭৩
৩২৭৩। সিংহাসন হচ্ছে ক্ষমতা ও মর্যদার প্রতীক। রাণীর সিংহাসন [ বা ক্ষমতা ও সম্মান ] ছিলো জাগতিক অর্থ - সম্পদের উপরে প্রতিষ্ঠিত। আধ্যাত্মিক শক্তির স্থান সেখানে ছিলো না। সুলাইমান রাণীর সিংহাসনকে [ ক্ষমতা ও সম্মান ] ঈমান ও সত্য ধর্মের উপরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
৩২৭৪। "Ifrit" বড় শক্তিশালী জ্বিন।
৩২৭৫। রাণী বিলকিসের জানার পূর্বেই তাঁর সিংহাসনকে সুলাইমানের দরবারে হাজির করা হলো। এখানে উল্লেখযোগ্য এবং দ্রষ্টব্য এই যে, সুলাইমানের এত শক্তিশালী জনগোষ্ঠি থাকা সত্বেও তিনি ক্ষমতার গর্বে , অহংকারে স্ফীত হয়ে ওঠেন নাই। তিনি আল্লাহ্র দরবারে তাঁর এই ক্ষমতার জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন।
উপদেশ : যারা প্রকৃত মোমেন বান্দা , তারা তাদের সত্ত্বার মাঝে অনুভব করেন যে, পৃথিবীর সকল ক্ষমতা ও নেয়ামতের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। তিনি যাকে যতটুকু ইচ্ছা তাঁর নেয়ামতে ধন্য করেন।
৩২৭৬। যদি সুলাইমান আল্লাহ্র নেয়ামতের জন্য অকৃতজ্ঞ হতেন, তবে তিনি তাঁর ক্ষমতা ও শক্তিকে নিজস্ব জাগতিক উন্নতির জন্য ব্যবহার করতেন। 'ইফরীত' জ্বীনের ক্ষমতাকে তিনি পার্থিব শক্তি ও সুনামের জন্য নিয়োজিত করতেন। যে আল্লাহ্র নেয়ামতের জন্য অকৃতজ্ঞ সে আল্লাহ্র নেয়ামতকে নিজস্ব ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করে। আর যে, আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ সে তার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটায় প্রাপ্ত নেয়ামতের সুষ্ঠু ব্যবহারে। আল্লাহ্র সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে তাঁর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে। ক্ষুদ্র স্বার্থ বুদ্ধির উর্দ্ধে উঠতে সে সক্ষম হয়। এখানে সুলাইমান ইফরীতের ক্ষমতার প্রয়োগ করে রাণী বিলকিসের সিংহাসনের এমন পরিবর্তন ঘটান ,যে পরিবর্তন রাণী ও তাঁর প্রজাকূলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। স্বর্গীয় হেদায়েতের আলোতে তাঁরা অবগাহন করে সর্বোচ্চ কল্যাণের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন। সুলাইমানের সম্মুখে খোলা ছিলো দুটি পথ। একটি হচ্ছে শক্তির সাহায্যে বিলকিসকে পরাভূত করে সামাজ্যের বিস্তার করা এবং পার্থিবভাবে লাভবান হওয়া। অন্য রাস্তাটি হচ্ছে রাণী বিলকিস ও তাঁর প্রজাকূলকে সত্যের রাস্তায় আল্লাহ্র হেদায়েতের রাস্তায় নিয়ে আসা। সুলাইমান দ্বিতীয় পথটি অবলম্বন করেন, কারণ তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত আল্লাহ্ভীরু এবং আল্লাহ্র নিকট কৃতজ্ঞ ব্যক্তি।
৩২৭৭। আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ফলে আল্লাহ্র কোন উপকার সাধিত হয় না। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত। আল্লাহ্কে স্মরণ করা, বা আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তিসত্ত্বার আমূল পরিবর্তন ঘটে। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তার নিজস্ব কল্যাণের জন্য করে। স্রষ্টার প্রতি এই কৃতজ্ঞাবোধ আত্মার মাঝে তৃপ্ত , শান্ত, অনুভবে ভরিয়ে দেয় , যা আত্মার উন্নতিতে সহায়ক , যা তাঁকে পরলোকের জীবনে উচ্চতর অবস্থানে নিতে সক্ষম হবে। কৃতজ্ঞ আত্মা শান্তির আবাসস্থল ইহলোকে এবং পরলোকেও। অপরপক্ষে অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির অন্তর সর্বদা হাহাকারে পরিপূর্ণ থাকে। জীবনে না পাওয়ার হিসাবে সে সর্বদা ব্যস্ত - ফলে আত্মিক শান্তি হয় তিরোহিত। যে নেয়ামতে আল্লাহ্ তাকে ধন্য করেছেন তা সনাক্ত করতে সে অক্ষম ,ফলে তার জীবন না পাওয়ার হাহাকারে ভরে যায়। মানুষের অকৃতজ্ঞতা - আল্লাহ্র মহিমা সম্মান বা নেয়ামতকে খর্ব করতে পারবে না। আল্লাহ্ এ সবের উর্দ্ধে ; তিনি সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী , তার মহিমা ও বদ্যনতা অপ্রতিদ্বন্দী। আরবী 'করিম ' শব্দটি আল্লাহ্র উপরিউক্ত গুনাবলীর জন্য আরোপিত।
৩২৭৮। সিংহাসনের প্রকৃত চেহারা গোপন করা হয়েছিলো কারণ রাণী বিলকিস তা সনাক্ত করতে পারেন কি না এই ছিলো পরীক্ষা।
৩২৭৯। রাণী বিলকিসকে পরীক্ষা করা হলো। কিন্তু তিনি তাঁর সিংহাসনকে সনাক্ত করতে সক্ষম হলেন - যদিও তা সম্পূর্ণরূপে তাঁর মূল সিংহাসনের মত ছিলো না। পরবর্তী লাইন গুলিতে দেখা যায় , রাণী আল্লাহ্র রহমত ও করুণার জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন কারণ তিনি গর্বিত হন তাঁর সৌভাগ্যের জন্য। সৌভাগ্য এই জন্য যে, আল্লাহ্ তাঁর হেদায়েতের আলোর দ্বারা তাঁকে ও তাঁর প্রজাকূলকে ধন্য করেছেন, তিনি আল্লাহ্র নবী সুলাইমানকে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন , এবং অন্তরের সাথে সত্য ধর্মকে গ্রহণ করেন। [ সিংহাসন হচ্ছে ক্ষমতা ও মর্যদার প্রতীক দেখুন টিকা ৩২৭৩ ]
৩২৮০। এই আয়াতটি দুভাবে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। এখানের বর্ণনা অনুযায়ী উপরের আয়াতের শেষাংশ ও এই আয়াতের প্রথমাংশ হযরত সুলাইমানের বক্তব্য ; যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, " আল্লাহ্র হেদায়েতের জ্ঞান আমাদের [ সুলাইমানকে ] বিলকিসের পূর্বেই দান করেছেন। এবং আমরা তা গ্রহণ করেছি [পূর্বের আয়াতের শেষাংশ ] আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য উপাস্যের উপাসনা বিলকিসকে সত্য গ্রহণে বাধার সৃষ্টি করে [এই আয়াতের প্রথমাংশ ]। "
দ্বিতীয় অনুবাদক ও তফসীরকারদের মত মওলানা ইউসুফ আলী গ্রহণ করেন , যে অনুযায়ী এর অনুবাদ হবে ," And he diverted her from the worship of others besides Allah" অর্থাৎ সুলাইমান বিলকিসকে আল্লাহ্ ব্যতীত মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা থেকে বিরত রাখেন।
৩২৮১। সম্পূর্ণ দৃশ্যটি এভাবে কল্পনা করা যায়। রাণী বিলকিসকে সসম্মানে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। রাণী তাঁর পরিবর্তিত সিংহাসনকে সনাক্ত করতে পেরেছেন। সম্ভবতঃ তা ছিলো প্রাসাদের বাইরের অংশে রক্ষিত। এর পরে তাঁকে মূল প্রাসাদে প্রবেশের অনুরোধ করা হয়। মূল প্রাসাদের মেঝে ছিলো স্বচ্ছ স্ফটিকের তৈরী - যা পানির ন্যায় উজ্জ্বল চক্চকে ছিলো। রাণী মেঝেকে পানি বলে ভ্রম করলেন এবং অতিক্রম করার মানসে পায়ের কাপড় উচুঁ করে ধরলেন যেনো ভিজে না যায়। ফলে তাঁর নগ্ন পায়ের পাতা ও গোড়ালি দৃশ্যমান হলো। একজন রাণীর জন্য দৃশ্যটি অবশ্যই খুব অসম্মানজনক , সুলাইমান তৎক্ষণাত তাঁকে সত্য অবগত করে দেন। সত্য অবগত হওয়ার পরে রাণী আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতায় সুলাইমানের সাথে আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পন করেন।
৩২৮২। একজন সহানুভূতিশীল নেতা তাঁর অনুসারীদের ভুল সংশোধন করে দেন নম্র ও অমায়িক ভাবে। হযরত সুলাইমান ঠিক সেইভাবে রাণী বিলকিসকে প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে সাহায্য করেন। সত্য অনুধাবনের পরে রাণী কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাঁর ভুলকে স্বীকার করেন। কৃতজ্ঞ রাণী আন্তরিকভাবে তাঁর শিক্ষক সুলাইমানের সাথে আল্লাহ্র এবাদতে আত্মনিয়োগ করেন। কারণ সকল জ্ঞান ও সত্যের মূল উৎস একমাত্র আল্লাহ্।
৩২৮৩। সামুদ সম্প্রদায়ের মূল কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে আয়াতে [ ২৬ : ১৪১ - ১৫৯ ] ; যেখানে বলা হয়েছে যে, সামুদ জাতি ধনী সম্প্রদায় ও দরিদ্র সম্প্রদায় রূপে দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং ধনীরা গরীবদের জীবনের সকল স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত করে রাখতো। তাদের সংশোধনের নিমিত্তে পরীক্ষা স্বরূপ আল্লাহ্ একটি উষ্ট্রী প্রেরণ করেন। দেখুন উল্লেখিত আয়াতের টিকা সমূহে। এখানে সামুদ সম্প্রদায়ের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে আল্লাহ্র নবীর বিরুদ্ধে নয় জন দুষ্ট লোক দূরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র করে। সামুদ সম্প্রদায় সালেহ্ নবীর শিক্ষাকে অশুভ মনে করতো এবং তাদের বিপর্যয়ের কারণ বলে মনে করতো। তারা যা অশুভ শক্তি হিসেবে মনে করতো তা ছিলো তাদের পাপের শাস্তি। এসব দুষ্টলোকের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয় এবং সম্পূর্ণ সম্প্রদায় যারা পাপে নিমগ্ন ছিলো তারা ধবংস হয়ে যায়।
উপদেশ : পাপী ও দুষ্ট কখনও নিজের অসৎ কর্মকে অনুধাবন করতে পারে না।
৩২৮৪। দেখুন আয়াত [ ১৩ : ৬ ]। যারা পাপে আসক্ত থাকে তারা বুঝতে পারে না যে, তারা তাদের নিজের ধবংস নিজেই ত্বরান্বিত করে। সামুদ সম্প্রদায় গরীবদের শোষণ ও নিষ্পেষণ দ্বারা তাদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করেছিলো। সালেহ্ নবীর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার আহ্বান তাঁদের নিকট অশুভ মনে হয়েছিলো। তাদের কার্যকলাপ ছিলো অশুভ। কারণ তাদের অন্যায় কার্যাবলীই ছিলো তাদের জন্য অমঙ্গলের এবং প্রাপ্য শাস্তির কারণ।
৩২৮৫। পৃথিবীতে সকল পাপই সর্বদা শাস্তি পায় না। এর অর্থ এই নয় যে,এই সকল পাপ আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা লাভ করে। আল্লাহ্ এদের সুযোগ দান করে থাকেন যেনো তারা অনুতাপের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ গ্রহণ করে। আল্লাহ্ তাদের অনুগ্রহ করে সুযোগ দান করে থাকেন। তাদের পরীক্ষা করার মানসে। তারা যাকে " অশুভ শক্তি " বলে থাকে তা হচ্ছে তাদের পাপের শাস্তি। এ শাস্তি আল্লাহ্র তরফ থেকে আগত ন্যায় বিচার।
৩২৮৬। এখানে যে নয় ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে এরা ন্যায়কে প্রতিহত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো। কিন্তু তারা ন্যায় বিচারকে ধ্বংস করতে পারে নাই ; বরং ন্যায়সঙ্গতভাবে তারাই ধ্বংস হয়ে যায়।
উপদেশ : পৃথিবীতে অন্যায় শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হবেই এবং ন্যায় জয়লাভ করবে।
৩২৮৭। তাদের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ছিলো অত্যন্ত কাপুরুষোচিত কারণ :
১) পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে অত্যন্ত গোপনে;
২) রাতের অন্ধাকারে তা সংঘটিত করা হবে;
৩) তাদের প্রতারণার শিকারকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ অবস্থায় আক্রমণ করা হবে;
৪) তারা সকলে সর্তকতা অবলম্বন করেছিলো এই বলে যে তারা যদিও সালেহ্ নবীকে হত্যা করবে, কিন্তু তারা একযোগে ঘটনাকে অস্বীকার করবে এবং বলবে যে তারা সত্যবাদী। তারা ঘটনা সম্পর্কে কিছুই অবগত নয়। কারণ সালেহ্ নবীর উত্তরাধীকারী [ যদিও কেহ জীবিত থাকে ] বা তাঁর গোত্রের লোকেরা যেনো তাদের উপরে প্রতিশোধ নিতে না পারে। এই ঘটনার উল্লেখের কারণ ঠিক একই প্রকার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো আমাদের নবী হযরত মুহম্মদের [ সা ] সময়েও। যুগে যুগে সত্যের প্রচারকরা একই ভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকেন। এ কথা সকল সময়ের জন্য প্রযোজ্য।
৩২৮৮। দেখুন আয়াত [ ৩ : ৫৪ ]। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তাদের দুরভিসন্ধিমূলক দুষ্ট চক্রান্ত আল্লাহ্র কাছে সুবিদিত ছিলো , কিন্তু আল্লাহ্র ন্যায় বিচার ও কল্যাণকর পরিকল্পনা সম্বন্ধে তারা জ্ঞাত ছিলো না। সুতারাং পাপীদের পক্ষে আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করা সম্ভব ছিলো না। পাপ এবং পাপীর শেষ পরিণতি অবশ্যই ভয়াবহ।
৫২। এখন এই তো তাদের ঘর বাড়ী - যা সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তুপ ; কারণ তারা পাপ কাজের অভ্যাস করতো। অবশ্যই এর মাঝে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
৫৩। যারা ঈমান এনেছিলো এবং সৎ কাজ করতো আমি তাদের রক্ষা করেছিলাম।
৫৪। [ আমি আরও প্রেরণ করেছিলাম ] লূতকে ৩২৮৯ [ রাসুল রূপে ]। স্মরণ কর , সে তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলো , " তোমরা [ অন্যায় ] জেনেও কি এই অশ্লীল কাজ করবে ?
৩২৮৯। লূতের কাহিনী আরও অন্যান্য সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা [ ২৬ : ১৬০ - ১৭৫ ] আয়াতে এবং সূরা [ ৭ : ৮০ - ৮৪ ] আয়াতে লূতের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরার এই আয়াতে লূতের কাহিনীর মাধ্যমে যে বিষয়ের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে , তা হচ্ছে লূতের নগরীর লোকেরা মানুষের স্বভাব ধর্মের বিপরীত কাজ করছিলো। তারা জানতো যে এ এক নিদারুণ দুষ্কার্য এবং পাপ , তবুও তারা সেই পাপে নিমগ্ন থাকতো। লূতের স্ত্রী লূতের ন্যায় পূণ্যাত্মা লোকের সংস্পর্শে থেকেও পাপীদের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ছিলো [ দেখুন নীচের আয়াত নং ৫৭ ] এবং সে ছিলো লূতের প্রচারে অবিশ্বাসী। ফলে তাঁর ভাগ্যেও নেমে এসেছিলো শাস্তির কালো মেঘ। সেও ধ্বংস প্রাপ্তদের অর্ন্তভুক্ত হয়েছিলো।
৩২৯০। "অজ্ঞ সম্প্রদায় " - এই অজ্ঞতা হচ্ছে আধ্যাত্মিক অজ্ঞতা। এই অজ্ঞতা হচ্ছে সেই অজ্ঞতা যার ফলে পাপ ও পূণ্যের মধ্যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে , ভালো ও মন্দের মধ্যে , ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে যায়। এ সব আত্মা হচ্ছে অন্ধকার আচ্ছাদিত আত্মা। ফলে তারা পাপের যে অশ্লীলতা ও লজ্জ্বা তা অনুধাবনে অক্ষম হয় তাদের নৈতিকতা বিরোধী কাজ তাদের যে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে তা অনুধাবনেও তারা অক্ষম। অক্ষমতা তাদেরই ক্ষতির কারণ। তারা জানে যে তাদের অশ্লীল কাজ অন্যায়। তাদের এই জেনে পাপ করার দরুণ তাদের আধ্যাত্মিক অজ্ঞতা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, ফলে তা হয় নিন্দনীয়। ঘটনা বিকৃত করার মানসে বা অন্যকে প্রতারণার করার মানসে যারা সত্যকে বিকৃত করে এবং মিথ্যা বা অর্ধ সত্যের আশ্রয় নেয় তারা জ্ঞান পাপী। যারা অভ্যেসবসে বা অসর্তকতার দরুণ বা অমনোযোগের ফলে মিথ্যা বলে তাদের তুলনায় এ সব জ্ঞান পাপীরা অনেক বেশী নিন্দনীয়। ঠিক সেরূপ লূতের সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের কার্যকে পাপ জেনেও তা করার ফলে তারা আল্লাহ্র রোষানলে পতিত হয়।
৩২৯১। এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, অশ্লীল কাজের দরুণ লূতের সম্প্রদায় লজ্জ্বা তো পায়ই নাই , উপরন্তু তারা লূত ও তাঁর অনুসারীরা যারা পবিত্র জীবন যাপন করতেন তাদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপে ক্ষত বিক্ষত করেছিলো। তাদের বক্তব্য থেকে মনে হয় যেনো সুপথের আহ্বানের দ্বারা লূত এক মহা অন্যায় কাজ করেছেন।
৫৮। এবং আমি তাদের উপরে গন্ধকের ধারা বর্ষণ করেছিলাম। কত মন্দই না ছিলো সেই বর্ষণ যা সেই সকল লোকের উপর বর্ষিত হয়েছিলো , যাদের সতর্ক করা হয়েছিলো [ কিন্তু শোনে নাই ]।
৩২৯২। যুগে যুগে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সাধারণ মানুষের জন্য নৈতিক জীবনের পথ নির্দ্দেশ , আত্মার জন্য আলো , যে আলোতে সে পথের নির্দ্দেশকে সনাক্ত করতে পারবে এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহকে। আল্লাহ্র এই অনুগ্রহ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নবী রসুলদের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের নিকট প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্র এই মনোনীত বান্দাদের প্রতি আল্লাহ্র রহমতের জন্য আমাদের দোয়া করা উচিত। কারণ , আল্লাহ্র বাণী প্রচারের কারণে এসব বান্দাদের দুষ্টদের দ্বারা যে নির্মম অত্যাচার , নির্যাতন, নির্বাসন প্রভৃতি ভোগ করতে হয় তা অবর্ণনীয়। এরা মানুষের মঙ্গলের জন্য আল্লাহ্র বাণীকে প্রচারের জন্য জীবনের সকল সুখ স্বাচ্ছন্দকে পরিত্যাগ করেন, সুখের পথকে পরিহার করে দুঃখ কষ্টের কণ্টকাকীর্ণ পথকে গ্রহণ করেন, এরা আমাদের নমস্য। এদের আত্মত্যাগের কারণেই পৃথিবীতে আল্লাহ্র শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহ্-ই হচ্ছেন চরম সত্য; সর্বোচ্চ কল্যাণ। আল্লাহ্ ব্যতীত আর যারই এবাদত করা হোক না কেন সবই মিথ্যা এবং পাপ। তবুও কি আমরা মিথ্যা এবং পাপকে সত্য এবং মঙ্গলের উপরে স্থান দেব?
বিংশতি পারা
৩২৯৩। এই বিশাল বিশ্ব ভূবনের সৌন্দর্য্য , চমৎকারিত্ব এবং শৃঙ্খলার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে এই আয়াতে। আবেদন করা হয়েছে , চেয়ে দেখতে কি অপূর্ব তাঁর সৃষ্টি , সমস্ত সৃষ্টির মাঝে কি অপূর্ব সমন্বয় ও শৃঙ্খলা যা এক নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। যার সামান্য পরিমাণ অনুভব করার ক্ষমতা আছে সেই অনুধাবন করতে পারবে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার মঙ্গল ইচ্ছা মানুষের জন্য।
যারা অজ্ঞ ,অমনোযোগী ও অন্যায়কারী একমাত্র তারাই এক আল্লাহ্র পরিবর্তে বহু ঈশ্বরের বা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করতে পারে।
৩২৯৪। আমাদের চারিপাশের প্রকৃতি - বৃক্ষ -তরুলতা , ফুল , ফলে শোভিত। প্রতিদিনের জীবনে আমরা এদের সৌন্দর্যে মোহিত হই। কিন্তু একটি বৃক্ষের জন্ম ইতিহাস যে স্রষ্টার অসীম ক্ষমতার প্রকাশ তা আমরা কখনও অনুধাবন করি না। ক্ষুদ্র বীজের যখন অঙ্কুরোদ্গম ঘটে, তখন বীজের অভ্যন্তরে যে বিশাল রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যার দরুণ ক্ষুদ্র বীজ শিকড়, কান্ড ও পাতাতে পরিণত হয় - সেই রূপান্তর কি মানুষের পক্ষে ঘটানো সম্ভব ? আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, আমাদের চারিপাশে অহরহ এরূপ বহুবিধ পরিবর্তন দেখে থাকি যা আমরা অনুধাবন করি না - কি বিশাল ও জটিল সে পরিবর্তন , যে পরিবর্তন ঘটানো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ যা পারে তা হচ্ছে সুশোভিত বাগান তৈরী করতে। সুন্দর ফুল ও ফলের বাগান আমাদের মোহিত করে - বাগানের মালিকের সৌন্দর্যবোধ, পরিকল্পনা ও নকশা আমাদের মুগ্ধ করে। গাছ গুলিকে সুনির্দ্দিষ্ট সারিতে রাখা হয় যেনো তাদের বেড়ে ওঠার সময়ে শিকড়ের প্রসারের জন্য স্থান সংঙ্কুলান না হয়, ডাল পাতা যেনো প্রচুর সূর্যালোক পায়। মাটি যেনো বায়ু চলাচলের উপযুক্ত থাকে ইত্যাদি , মালিকের সুনির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনার ফসল। একটি ক্ষুদ্র বাগানের জন্য যখন এত পরিকল্পনা, সৌন্দর্যবোধ , সূচিন্তিত ও পরিশীলিত রুচিবোধের প্রয়োজন হয় , তখন মানুষ কি চিন্তা করে না যে এই বিশাল বিশ্বভূবন যার অণু পরমাণুতে সৌন্দর্যবোধ ও শৃঙ্খলা , সমন্বিত হয়ে আছে, প্রকৃতির সেই বিশাল বাগান মালিক বিহীন ভাবে কি বেড়ে ওঠা সম্ভব ? সৌন্দর্যের লীলা ভূমি এই ধরাতল অবশ্যই কোন মহৎ স্রষ্টার পরিকল্পনা - যা জ্ঞানী লোকদের জ্ঞান চক্ষুকে স্রষ্টার একত্বের দিকে উন্মীলন করে।
৩২৯৫। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ১৫ ] এবং টিকা ২০৩৮ ও ২০৩৯ এবং [২৫:৫৩] ও টিকা ৩১১১
শুকনা স্থল ভূমি ও প্রবাহিত পানির স্রোতের মাঝে আল্লাহ্ সুকৌশলে পানির চক্র স্থাপন করেছেন।
পানি চক্র হচ্ছে :
সমুদ্রের লোনা পানি ->মেঘ ->বৃষ্টি ->নদী,নালা ->সমুদ্রের লোনা পানি
সব কিছুই একই পানি বারে বারে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে কিন্তু আল্লাহ্র কি অপার করুণা কখনও সমুদ্রের লবণাক্ত পানি আবর্তিত মিষ্টি পানির সাথে মিশে যাচ্ছে না। শুধু কি তাই; সমুদ্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র দ্বীপাবলীর [ যেমন মহেশখালী ] মাঝে পাওয়া যায় মিষ্টি সুপেয় জলরাশি। স্রষ্টার এ এক অদৃশ্য বাঁধা বা অন্তরায় যার ফলে লবণাক্ত পানির দরিয়া ও সুস্বাদু মিষ্টি পানিতে কখনও মিশে যায় না।
৩২৯৬। দেখুন আয়াত [ ২৫ : ৫৩ ] এবং টিকা ৩১১১ ও ৩১১২।
৩২৯৭। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, বাইরের এই বিশাল বিশ্বভূবনে যেমন তাঁর নিদর্শন ও অনুগ্রহ ছড়ানো আছে, মানুষ যদি তাঁর অন্তরের মাঝে , তাঁর বিবেকের কাছে খুঁজে দেখে তবে সে আল্লাহ্র অসীম অপার করুণা সিন্ধুর সন্ধান পাবে। মানুষ যখন বিপদ বিপর্যয়ের মাঝে, দুঃখে-কষ্টে , দুঃশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করে , আল্লাহ্র সাহায্য তখন তার অতি নিকটেই থাকে। আল্লাহ্ মনুষ্যজাতিকে পৃথিবীতে সকল সৃষ্ট জগতের উপরে শ্রেষ্টত্ব দান করেছেন মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে। মানুষকে করা হয়েছে আল্লাহ্র প্রতিনিধি স্বরূপ। এর পরেও মানুষ কি ভাবে আল্লাহ্কে ভুলে যায় এবং মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে ?
৩২৯৮। দেখুন আয়াত [ ৬ : ১৬৫ ] এবং টিকা ৯৮০।
৩২৯৯। দেখুন [ ২৫ : ৪৮ ] আয়াত এবং টিকা ৩১০৪।
৩৩০০। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৩৪ ] এবং টিকা ১৪২৮।
৩৩০১। "জীবনোপকরণ " - এখানে জীবনোপকরণ বলতে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ের সমৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তা বোঝানো হয়েছে।
৩৩০২। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই আল্লাহ্র একত্বের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমন কিছুই নাই যা আল্লাহ্র একত্বের বিরুদ্ধে যায়।
৩৩০৩। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে আল্লাহ্র অস্তিত্ব সর্বত্র বিদ্যমান। সকল কিছু আল্লাহ্র একত্বের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আল্লাহ্ আমাদের পরলোকের জ্ঞান দান করেন; যে জ্ঞান আমাদের নিকট অদৃশ্য। আত্মার অমরত্ব ও পরলোকের অস্তিত্ব ধ্রুব সত্য। কিন্তু যারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় তারা এই অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান লাভে অক্ষম।
৩৩০৪। যারা অবিশ্বাসী তারা হয় পার্থিব বিষয় বুদ্ধি সম্পন্ন। তারা এই জাগতিক বিষয়ের বাইরে চিন্তা করতে অক্ষম। কারণ মানুষের সসীম জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারা পরলোকের অদৃশ্যলোকের ধারণা করা সম্ভব নয়। আধ্যাত্মিক জীবনে বিশ্বাসের মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সত্তার মাঝে আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির জন্ম নেয়। অপরপক্ষে অবিশ্বাসীরা এই অন্তর্দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ তাদের পার্থিব বিষয়বুদ্ধি তাদের সন্দেহ এবং অনিশ্চিয়তার মধ্যে নিপতিত করে। তাদের এই সন্দেহ ও অনিশ্চিয়তার ফলে তাদের আত্মায় আধ্যাত্মিক জগতের আলো প্রবেশে বাঁধা পায়, ফলে তাদের আত্মা আল্লাহ্র নূর বঞ্চিত হয়ে অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব তাদের পরলোকের ভবিষ্যত জীবনের ধারণাকে সন্দেহ ও অবিশ্বাসে ভরিয়ে তোলে। এরা চর্ম চক্ষু থাকা সত্বেও অন্তর্দৃষ্টিহীন। অন্তর্দৃষ্টিহীন ব্যক্তি আধ্যাত্মিক দিক থেকে অন্ধ। তারা শুধু দৃশ্যমান পৃথিবীকেই দেখতে পায়।
৬৮। " এ কথা সত্য যে , আমাদের ও আমাদের পূর্বপুরুষদের [ এ ব্যাপারে ] প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো। এগুলি প্রাচীন কালের কাহিনী ব্যতীত অন্য কিছু নয়। "
৬৯। বল, " পৃথিবী পরিভ্রমণ কর এবং দেখ যারা [ পাপের দ্বারা ] অপরাধী, তাদের শেষ পরিণতি কেমন হয়েছে।" ৩৩০৫
৩৩০৬। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ১২৭ ] এবং টিকা ২১৬৪। যারা মুত্তাকী তারা সর্বদা আল্লাহ্ প্রদর্শিত ন্যায় ও সত্যের পথে জীবন যাপন করেন। পৃথিবীর অন্যায় , অসত্য অনেক সময়েই তাদের জীবনকে ঘন মেঘে আচ্ছাদিত করে ফেলে। এই আয়াতে আল্লাহ্ মোমেন বান্দাদের আশ্বাস দিচ্ছেন যে, অন্যায় ,অসত্যের প্রচন্ড বিরোধিতায় তাদের মনক্ষুণঃ হওয়ার কোনও কারণ নাই। কারণ অন্যায় ও অসত্য আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে বান্চাল্ করতে পারবে না। যদিও এই আয়াতে রসুলকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্র এই আশ্বাস সকল মুত্তাকী বা সত্যের ও ন্যায়ের পূঁজারীদের জন্য প্রযোজ্য।
৭২। বল, " তোমরা যে ঘটনার জন্য তাড়াহুড়া করছো, সম্ভবতঃ তার কিছু অংশ তোমাদের পশ্চাদ্ধাবন করছে ৩৩০৭।"
৩৩০৭। যারা অবিশ্বাসী বা দৃঢ় বিশ্বাসী নয়, বিশ্বাসে শিথিল, তারা সাধারণতঃ বলে থাকে, "এত দূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কি লাভ ? বরং বর্তমান জীবনকে ভোগ করে নাও।" এভাবে তারা নিজেকেই প্রতারণা করে থাকে। আখেরাত অবশ্যই আসবে - তা ধ্রুব সত্য। যখন রোজকেয়ামত আসন্ন হবে, তখন এসব অবিশ্বাসীদের জন্য ধ্বংসের ঘণ্টা বেজে উঠবে। তখন আর অনুতাপের সময় থাকবে না। আল্লাহ্র মঙ্গল ইচ্ছা পাপী, পূণত্মা সকলকে ঘিরে আছে। অনুতাপের মাধ্যমে, তার মঙ্গলময় ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অকৃতজ্ঞ।
৭৪। এবং তাদের অন্তর যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে তোমার প্রভু অবশ্যই তা জানেন।
৭৫। আকাশ ও পৃথিবীতে এমন কোন কিছু অদৃশ্য নাই যা [ নথিতে ] সুস্পষ্টভাবে লেখা হয় নাই ৩৩০৮।
৩৩০৮। দেখুন [ ২২ : ৭০ ] ; [ ৩৬ : ১২ ] ; [ ৫৭ : ২২ ]
৭৭। যারা ঈমান আনে , ইহা তাদের জন্য অবশ্যই পথের নিশানা এবং [আল্লাহ্র ] অনুগ্রহ।
৩৩০৯। ইহুদীদের মাঝে ধর্মের ব্যাপারে বহু দল ও উপদল বিদ্যমান। এসব দল ও উপদল পরস্পর পরস্পরের সাথে বিবাদমান। তাদের বিভিন্ন মতবাদের যুক্তি ও কূটর্তকের সমাধান করেছে আল্-কোরাণ। কোরাণের মাধ্যমে মুসার আইনের সম্পূর্ণতা আনায়ন করা হয়েছে।
কোরাণ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে আল্লাহ্র বিভিন্ন গুণাবলী সম্বন্ধে, প্রত্যাদেশের প্রকৃত রূপ এবং পরলোক সম্বন্ধে মতবাদকে।
৩৩১০। বিভিন্ন মতবাদ ও দলের মধ্যে ধর্ম সম্বন্ধে ঝগড়া ও বিবাদ ও দলাদলি আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত বা আইন বা হুকুম অনুযায়ী ফলসালা হবে : ১) কোরাণের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে , অথবা ২) সময়ের বিবর্তনে - বহু গোষ্ঠি বহু উদ্ভাদিত ধর্ম হারিয়ে যায় সময়ের বিবর্তনে , অথবা ৩) শেষ বিচারের দিনে সকলেই তাদের ভুল দেখতে পাবে।
৮০। সত্যিই তুমি মৃতকে [ কথা ] শুনাতে পারবে না ; বধিরকেও আহ্বান শুনাতে পারবে না [ বিশেষতঃ ] যখন তারা পিছন ফিরে চলে যায় ৩৩১১।
৩৩১১। রাসুলের দায়িত্ব হচ্ছে সঠিকভাবে আল্লাহ্র বাণী প্রচার করা এবং আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথকে প্রদর্শন করা। যারা পূণ্যাত্মা তারা রাসুলের প্রচারিত বাণীর মর্ম বুঝতে পারে এবং ঈমান আনায়ন করে। কিন্তু যারা অবাধ্য ও একগুয়ে ভাবে আল্লাহ্র নিদর্শনকে অস্বীকার করে, সত্যকে প্রতিরোধ করে, তাদের উপমা দেয়া হয়েছে এই আয়াতে। তাদের আত্মা মৃত , তারা বধির। সুতারাং তাদের অবিশ্বাসের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। আল্লাহ্র রাসুলের কোনও দায় দায়িত্ব নাই।
৮২। যখন তাদের [ অন্যায়কারীদের ] বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি কাল পূর্ণ হবে , ৩৩১২ ; [ তখন ] আমি তাদের জন্য এক জানোয়ার কে [ পশুকে ] মৃত্তিকা থেকে বের করবো ৩৩১৩। সে তাদের সাথে কথা বলবে, এই জন্য যে , মানুষ আমার নিদর্শনাবলীর আশ্বাস বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করে নাই।
৩৩১২। " প্রতিশ্রুতি কাল " অর্থাৎ পরলোকে শেষ বিচারের দিনে যখন ন্যায় ও অন্যায়ের প্রকৃত মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে তখন অনুতাপের জন্য পাপীদের পৃথিবীতে যে অবকাশ দেয়া হয়েছিলো সে অবকাশের সময় শেষ হয়ে যাবে। তাদের পাপের পাত্র পূর্ণ হবে, আল্লাহ্র শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে।
৩৩১৩। কেয়ামতের পূর্বে এই জীবের আবির্ভাব ঘটবে। এই জীব মানুষের সাথে কথা বলবে। এর আগমন কেয়ামতের একটি নিদর্শন। যদি Takallimuhum এর পরিবর্তে যদি Takalimuhum পড়া হয় তবে তার অর্থ দাঁড়াবে যে জীবটি তাদের আহত করবে।
৮৪। যতক্ষণ না তারা [ বিচারকের সম্মুখে ] উপস্থিত হবে, [ তখন আল্লাহ্ ] বলবেন, " তোমরা কি আমার নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখান করেছিলে, যদিও তোমরা তা জ্ঞান দ্বারা হৃদয়ঙ্গম কর নাই ৩৩১৪, বরং আরও কি করেছিলে ? "
৩৩১৪। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে যে, " তোমাদের কোনও জ্ঞান না থাকা সত্বেও তোমরা আমার নিদর্শনকে উপেক্ষা করেছ। এ কথা কি সত্য ; না কি তোমাদের কোনও আবেদন আছে ?"
৩৩১৫। পাপীরা কোনও আবেদন করতে পারবে না , কারণ অভিযোগের প্রতিটি কথাই সত্য। সুতারাং তাদের উপর শাস্তির খড়্গ নেমে আসবে।
৩৩১৬। রাত্রি ও দিন , বিশ্রাম এবং আলো এই আয়াতের এই শব্দগুলির আক্ষরিক অর্থের সাথে প্রতীকধর্মী অর্থ বিদ্যমান। দিবসের কর্ম ক্লান্তির পরে রাত্রি আসে বিশ্রামের জন্য। যে রাত্রিতে সুপ্তির কোলে বিশ্রাম নেয়, পরদিন সে নব উদ্যমে তার কর্ম শুরু করতে পারে। কিন্তু তা না করে যে, সারাটা রাত্রি পাপের অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হয়। দিবস তার জন্য কিসের বারতা আনবে? সে তো অভিশপ্ত। আবার দিন হচ্ছে কর্মচাঞ্চল্যের প্রতীক। আল্লাহ্র নেয়ামত ও অনুগ্রহ অন্বেষণের জন্য দিবসকে করা হয়েছে আলোকময়। যে তা না করে সে আল্লাহ্র নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ। প্রতীক অর্থে কার্যের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের সাধনার জন্য দিবসের সৃষ্টি। প্রতিদিনের জীবনে সৎ পথে , আল্লাহ্ নির্দ্দেশিত পথে, পৃথিবীর কর্মকান্ড যে পরিচালনা করতে পারে, সেই তো করতে পারে দিবালোকের সদ্ব্যবহার। কর্মচঞ্চল দিনের শেষে যখন রাত্রি নেমে আসে তখন সকল কর্মচাঞ্চল্যের সমাপ্তি ঘটে। ঠিক সেরূপ জীবনের শেষে আর অনুতাপের অবকাশ পাওয়া যাবে না। সত্যের সাধনার জন্য দিনের আলো শেষ হয়ে যাবে।
৩৩১৭। ' বিনীত অবস্থায় ' - অর্থাৎ সকল ঔদ্ধত্য সেদিন বিদায় নেবে। কেয়ামতের দিনে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানকে উপলব্ধি করতে পারবে। কারণ প্রত্যেকের মনের উপর থেকে অজ্ঞতার পর্দ্দা সরে যাবে, ফলে ভয়ে শঙ্কায় সকল উদ্ধত অহংকার ও একগুয়েমী দূর হয়ে তারা বিনীত হবে।
৩৩১৮। পৃথিবীর বর্তমান অবস্থানে মনে হয় পর্বত সমূহ অটল, অচল, অনন্তকালব্যপী যার স্থায়ীত্ব। কিন্তু কেয়ামতের দিনে যখন নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে, এই পর্বত সমূহের অস্তিত্ব তখন থাকবে না। মেঘের মত তারা সঞ্চারমান হবে। এই আয়াতে পর্বতের উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে মিথ্যা মূল্যবোধ ও প্রকৃত মূল্যবোধকে বোঝানোর জন্য। পৃথিবীর জীবনে যে সব মূল্যবোধ বা সংস্কৃতি বা আচার অনুষ্ঠানকে মনে হয় পর্বতের ন্যায় দৃঢ় , অটল এবং অপরিবর্তনীয় , পরলোকে যখন প্রকৃত মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে তখন পার্থিব সেই অটল অনড় মূল্যবোধ মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হবে। পর্বত যেরূপ মেঘের ন্যায় হাল্কা হয়ে উড়ে যাবে ঠিক সেরূপ মিথ্যা মূল্যবোধের পরলোকে কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। তা শুধু কল্পনায় পর্যবেসিত হবে।
৩৩১৯। "Atqana" অর্থ সুবিন্যস্ত করা , শিল্প সম্মতভাবে সাজানো যেনো সর্বোচ্চ সফলতা লাভ করা যায়। বর্তমান পৃথিবী এবং ভবিষ্যতের পরলোকের জগৎ সব কিছুই এক সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি নিবেদিত। আল্লাহ্র পরিকল্পনায় ইহকাল ও পরকালের জীবনের আছে এক সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। আল্লাহ্র পরিকল্পনায় সকল কিছু সুবিন্যস্ত ও শিল্প সম্মত।
আমাদের সকল কর্মকান্ড সম্বন্ধে আল্লাহ্ জ্ঞাত , আমাদের সকল কর্ম, কর্মের উদ্দেশ্য, সকল চিন্তা ভাবনা , আমাদের প্রয়োজন সব সেই সর্বশক্তিমান জানেন এবং সে ভাবেই সকল কিছুকে তিনি বিন্যস্ত করেন। বিশ্ব প্রকৃতির সমন্বিত শৃঙ্খলা সেই বিশ্ব স্রষ্টার শিল্প সত্তার প্রকাশ মাত্র। যে তা অনুভবে সক্ষম সে কি তাঁর প্রশংসা না করে পারে ?
৯০। এবং কেউ যদি মন্দ কাজ করে , তবে তাকে অধোমুখ করে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে ৩৩২০। [ বলা হবে ] : " তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল তোমাদের দেয়া হচ্ছে। " ৩৩২১
৩৩২০। 'অধোমুখে' অর্থাৎ মুখ নীচুদিক করে বা মুখ নীচু ও পা উপরে। শব্দটি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। পাপী বা যারা পৃথিবীতে অসৎকর্ম করবে, তাদের সর্বোচ্চ পাপ কাজকে সর্বপ্রথম দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। সম্ভবতঃ তাদের যা নিয়ে ছিলো অহংকার , গর্ব , আত্মম্ভরিতা , যে কর্মকে তারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সম্মান মনে করতো সেই কর্মের ফলকেই সর্বপ্রথম আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। অর্থাৎ তাদের ধারণায় জাগতিক সর্বোচ্চ সম্মানের কর্ম, পরলোকে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট কর্মরূপে পরিগণিত হবে। তাদের এই অসৎ কর্মগুলি পৃথিবীতে তাদের নিকট মনে হয়েছিলো আকর্ষণীয়।
৩৩২১। 'তোমরা যা করতে' - অর্থাৎ তোমাদের পৃথিবীর জীবনের কর্মদ্বারাই তোমাদের বিচার হবে। পৃথিবীর জীবন পরকালের জীবনের জন্য " শিক্ষানবীশ কাল" মাত্র। এই জীবনে যে তার চরিত্রকে [ Conduct of life] পূত পবিত্র রাখতে পারে এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সৎ কাজ করতে পারে সেই তো সফলকাম। যে যতটুকু পাপ করবে সে ততটুকুই শাস্তি পাবে - এই আল্লাহ্র বিধান।
৯২। এবং [ আরও আদিষ্ট হয়েছি ] কুর-আন আবৃত্তি করতে। যদি কেউ নির্দ্দেশ গ্রহণ করে সে তা করে নিজের আত্মার কল্যাণের জন্য। এবং কেউ যদি পথভ্রষ্ট হয় তবে বল, " আমি তো কেবলমাত্র একজন সর্তককারী।"
৯৩। এবং বল, " সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্রই নিশ্চয়ই তিনি শীঘ্রই তোমাদের তাঁর নিদর্শন দেখাবেন , যেনো তোমরা তা চিনতে পার। এবং তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে তোমার প্রভু অমনোযোগী নন ৩৩২৫।
৩৩২৫। ইসলাম প্রচারের প্রথম যুগে নবী [সা ] ও তাঁর অনুসারীদের যে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দ্দশা, মানসিক যন্ত্রণা, অমানবিক নির্যাতন , অত্যাচার ও নির্বাসন ভোগ করতে হয়েছে আল্লাহ্ সব জ্ঞাত আছেন। মহাকালের গর্ভে কিছুই হারায় না - তাদের কষ্ট ও সহিষ্ণুতার জন্য আল্লাহ্ তাদের পুরষ্কৃত করবেন। আল্লাহ্র এই আশ্বাস সর্বসাধারণের জন্য। যারাই আল্লাহ্র কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে এবং সে কারণে দুঃখ দুর্দ্দশা কষ্ট সহ্য করবে , তাদের ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার পুরষ্কার তাঁরা পাবেন।