Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ৩ জন
আজকের পাঠক ১০৭ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৬৫৪৫০ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬২৩০৯৬ বার
+ - R Print

সূরা আনকাবুত


সূরা আনকাবুত বা মাকড়সা - ২৯

৬৯ আয়াত, ৭ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

ভূমিকা : সূরা নং ১৭ থেকে সূরার যে শ্রেণী বিভাগ শুরু হয়েছে এই সূরাটি শ্রেণীর সর্বশেষ সূরা। এই শ্রেণী বিভাগে আলোচনা করা হয়েছে প্রতিটি মানুষের আত্মিক ক্রমোন্নতিকে স্বতন্ত্রভাবে , বিশেষ ভাবে উদাহরণ স্থাপন করা হয়েছে মহান নবী রসুলদের, যাদের আল্লাহ্‌ এই বিরাট কাজের জন্য প্রস্তুত করে নেন। তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব এবং প্রত্যাদেশ ছিলো যুগোপযোগী [ দেখুন সূরা ১৭ এর ভূমিকা ]। সূরা ২৬ থেকে যে উপশ্রেণী শুরু হয়েছে এই সূরাটি সেই উপশ্রেণীরও শেষ সূরা , যেখানে ধর্মীয় ইতিহাসে আধ্যাত্মিক আলোর প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে [ দেখুন সূরা ২৬ এর ভূমিকা ]।

পূর্বের সূরাটি শেষ করা 'Ma'ad' মতবাদ বা মানুষের চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন আল্লাহ্‌র নিকট এই মতবাদের উল্লেখের মাধ্যমে। এই মতবাদের আরও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এই সূরাতে এবং পরবর্তী তিনটি সূরাতে। এই সূরাটি বর্তমান শ্রেণীভূক্ত সূরাগুলি ও পরবর্তী তিনটি সূরার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে।

আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ ও অনুগ্রহ লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে চরিত্রের গুণাবলী অর্জন করা এই বিশেষ বিষয়বস্তুর উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। গুরুত্ব্‌ আরোপ করার জন্য পুণরায় নবীদের মধ্যে হযরত নূহ্‌, ইব্রাহীম এবং লূত এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে মিদিয়ান, আ'দ, সামুদ এবং ফেরাউনের কাহিনী যারা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে প্রত্যাখান করেছিলো। পার্থিব জীবনকে পরলোকের জীবনের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

মূল সূরাটি অবর্তীর্ণ হয় হিজরতের পূর্বে মক্কাতে অবস্থানের মধ্যবর্তী সময়ে। সময়ের এই ক্রমপঞ্জি এ কারণেই উল্লেখযোগ্য যে হিজরতের বহু পূর্বেই ভবিষ্যত সংগ্রামী মুসলিম ভাতৃত্বের সম্বন্ধে বলা হয়।

সার-সংক্ষেপ : ঈমানের বা বিশ্বাসের পরীক্ষা নেয়া হয় পৃথিবীর জীবনে দুঃখ, কষ্টের সংগ্রামে, চরিত্রের গুণাবলীর মাধ্যমে। যদিও নূহ্‌ ৯৫০ বৎসর বেঁচে ছিলেন , কিন্তু তার সম্প্রদায় সত্যকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। হযরত ইব্রাহীমের সম্প্রদায় তাঁকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে [ ২৯ : ১-২৭ ]।

লূতের সম্প্রদায় শুধু যে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে প্রত্যাখান করেছিলো তাই-ই নয়, তারা লূতকে দ্বন্দে আহ্বান করেছিলো। আ'দ ও সামুদ জাতি ছিলো বুদ্ধিমান, কিন্তু তারা তাদের বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার করে। কারূণ, ফেরাউন ,এবং হামান ধ্বংস হয়ে যায় তাদের দাম্ভিকতা ও উদ্ধতপনার জন্য। শেষ পর্যন্ত তারা বুঝতে পারে যে, তাদের পার্থিব জীবনের ক্ষমতা খুবই ভঙ্গুর , ঠিক যেনো মাকড়সার জাল [ ২৯: ২৮ -৪৪ ]।

কোরাণ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। কোরাণ আমাদের শিক্ষা দেয় পাপ ও পূণ্যের মধ্যে পার্থক্য এবং পরলোকের উৎকর্ষ লাভের জন্য গুরুত্ব আরোপ করে [ ২৯ : ৪৫ - ৬৯ ]


সূরা আনকাবুত বা মাকড়সা - ২৯

৬৯ আয়াত, ৭ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

০১। আলিফ-লাম-মীম ৩৪২২।

৩৪২২। বাইরের সংগ্রামী পৃথিবীতে মানুষের কর্মপদ্ধতির সাথে অন্তরের চিন্তা ভাবনার যে বৈষম্য তাকেই উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে এই সূরাতে এবং আল্লাহ্‌র সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য পূণ্যাত্মাদের অতীতের সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে বলা হয়েছে। এবং উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে যে, পাপের পরিবেশের প্রতিরোধের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম করতে এবং চিন্তা করতে বলা হয়েছে Ma'ad সম্বন্ধে। অর্থাৎ মানুষের জীবনের শেষ পরিণতি বা ভবিষ্যত পরিণতি বা পরকাল সম্বন্ধে।

০২। মানুষ কি মনে করে যে, " আমরা ঈমান এনেছি " - এ কথা বললেই তাদের অব্যহতি দেয়া হবে ৩৪২৩। এবং তাদের কোন পরীক্ষা নেয়া হবে না ?

৩৪২৩। 'Lip profession' বা শুধু কথার কথা। যে কথার সাথে চিন্তা বা কার্য পদ্ধতির কোনও মিল নাই। যদি কেউ নিজেকে মৌখিক ভাবে ঈমানদার দাবী করে, তবে তাঁর ঈমানের মানদণ্ড আল্লাহ্‌র নিকট পরীক্ষিত হতে হবে। পৃথিবীর সকল কিছুই সেই সর্বশক্তিমানের নিয়ন্ত্রণে। আল্লাহ্‌র আইন ভঙ্গ করার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে কারও নাই। শুধু মানুষকে আল্লাহ্‌ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দান করেছেন। ইচ্ছা করলে সে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করতে পারে অথবা মন্দকে গ্রহণ ও ভালোকে বর্জন করতে পারে। এই স্বাধীন ইচ্ছা শক্তিকে সে কিভাবে ব্যবহার করেছে পৃথিবীতে , সৎপথে না বিপথে , তারই হিসাব হবে পরলোকে। মানুষের বিশ্বাস বা ঈমানকেও সর্বশক্তিমান যাচাই করে নেবেন , বিপদ বিপর্যয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে। ব্যক্তিগত জীবনে সকল পরিবেশে , সকল অবস্থায় , দুঃখে , সুখে যে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভর করতে পারে , সেই তো সফলকাম ভাবে উত্তীর্ণ হয়। দুঃখের অমানিশা ,বিপদ , বিপর্যয়ের কালো মেঘ যখন আমাদের সর্ব অস্তিত্বকে ঘিরে ধরে, তখনও যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে নিঃশর্ত ভাবে আত্মসমর্পন করে, আল্লাহ্‌র মঙ্গল ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে বিপদ উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করে, আল্লাহকে সবার উপরে স্থান দেয়, সেই তো পারে অবিচলিতভাবে , ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়ের সাথে, বিপদের ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিতে, বিপদকে মোকাবিলা করতে।

বিপর্যয়ের, বিপদের সাগর পাড়ি দিতে আমাদের দুঃখ, ব্যথা ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন হয় ঠিকই, কিন্তু এ সবের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের আত্মিক ভাবে পরিশুদ্ধ করেন, চরিত্রের গুণাবলীকে উন্নত করেন। বিপদকে অবিচলভাবে মোকাবিলার মাধ্যমে চরিত্রে ধৈর্য্য, সাহস, অধ্যবসায়ের জন্ম নেয়। দুঃখের আগুনে পুড়ে চরিত্র খাঁটি সোনাতে রূপান্তরিত হয় - যেভাবে স্বর্ণকার আগুনে পুড়িয়ে সোনাকে খাঁটি করে।শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে ধর্ম পালনের মাধ্যমে মোমেন বান্দা হওয়া যায় না। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন বিভিন্ন্‌ ঘটনার প্রেক্ষাপটে বান্দার স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতাকে পরীক্ষা করা হবে, কে স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পন করে। আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা নির্ভর করে মানুষের " সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " প্রয়োগের উপরে। দেখুন টিকা ৪৮১ ও আয়াত [ ৩ : ১৭৯ ]।

০৩। আমি তো এদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছিলাম এবং অবশ্যই জেনে নেবো কারা সত্যবাদী কারা মিথ্যাবাদী ৩৪২৪।

৩৪২৪। দেখুন টিকা ৪৬৭ ও আয়াত [ ৩ : ১৫৪ ]। আল্লাহ্‌র পরীক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের চরিত্রের দোষত্রুটি দূর করে আত্মিক পরিশুদ্ধ করা।

০৪। যারা পাপ কাজ করে তারা কি মনে করে যে, তারা আমার আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে ? তাদের বিচার বিবেচনা কত মন্দ ৩৪২৫।

৩৪২৫। যারা সত্যের বিরোধিতা করে, মন্দ কর্ম করে, তারা কি মনে করে তারা আল্লাহ্‌র সত্যকে ধ্বংস করতে পারবে ? এরা নিতান্তই নির্বোধ। অনেক সময়ে তাদের অত্যাচার নির্যাতন বিপরীতভাবে কাজ করে। তাদের কর্মের ফলে মানুষের হৃদয়ের সত্যের প্রতি, ন্যায়ের প্রতি তীব্র আকাঙ্খা জন্মে , এবং অত্যাচারীর প্রতি ঘৃণা জন্মে।

০৫। যাদের আকাঙ্খা [ পরলোকে ] আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাত লাভ করা ৩৪২৬, [ তাদের সেজন্য চেষ্টা করতে দাও ]। কেননা আল্লাহ্‌র [নির্ধারিত ] কাল আসবেই। তিনি সব কিছু শোনেন এবং জানেন ৩৪২৭।

৩৪২৬। মোমেন বান্দার নিকট আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য সর্বোচ্চ স্থান লাভ করে। তাদের আকাঙ্খা হচ্ছে আল্লাহ্‌কে পাওয়া, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে পরকালে আল্লাহ্‌র দর্শন লাভ। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য এই পৃথিবীতে তারা প্রাণপনে চেষ্টা করেন, আল্লাহ্‌র কাজে জীবন উৎসর্গ করেন। পৃথিবীর জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত "শিক্ষানবীশকাল " পরকালের জন্য। এই " শিক্ষানবীশকাল " খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
৩৪২৭। 'Ajal' শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে :

১) মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত সময়। যে সময়ে পৃথিবীর মেয়াদ বা পরকালের জন্য শিক্ষানবীশকালের মধ্যে সমাপ্তি হয়।

২) জীবনের জন্য যে মেয়াদকে ধার্য করা হয়েছে। এই সময়ে আমরা যেনো পরকালের জন্য প্রস্তুত হতে পারি। কারণ খুব শীঘ্র এই সময় শেষ হয়ে যাবে। উভয় ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত অর্থ একই থাকে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে পরলোকের জীবনের সাফল্যের জন্য আমাদের প্রতি মূহুর্তে প্রাণপণে চেষ্টা করে যেতে হবে, ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করা চলবে না।

আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আমাদের সকল প্রার্থনা তিনি শোনেন। আমাদের না বলা কথা অথবা কর্মের নিয়ত বা উদ্দেশ্য , ভালোই হোক বা মন্দই হোক আল্লাহ্‌র কাছে কিছুই গোপন থাকে না। ব্যক্ত বা অব্যক্ত মনের সকল প্রকাশ ও চিন্তা আমাদের আধ্যাত্মিক পরিবর্তনে সাহায্য করে।

০৬। এবং যে [আল্লাহ্‌র কাজে সর্বশক্তি দিয়ে ] সংগ্রাম করে সে তা নিজের আত্মার [ কল্যাণের ] জন্য করে ৩৪২৮। অবশ্যই আল্লাহ্‌ সকল সৃষ্ট বস্তু থেকে অভাবমুক্ত।

৩৪২৮। সৎ কাজের সকল চেষ্টা আমাদের নিজেদের আত্মিক উপকারের জন্য। যখন আমরা আল্লাহ্‌র সেবার জন্য সৎ কাজ করি বা জনসেবামূলক কাজ করি , তাতে আল্লাহ্‌র কোন উপকার নাই। কারণ আল্লাহ্‌ অভাবমুক্ত। তাঁর সৃষ্ট পদার্থের তিনি মুখাপেক্ষী নন। উপকার যা তা হচ্ছে আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি। আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের আত্মিক কল্যাণের জন্য কাজ করি। যদি আমরা মন্দ কাজে নিজেদের নিয়োজিত করি, তবে তার দ্বারা আমরা আল্লাহ্‌র কোনও ক্ষতি সাধন করতে পারবো না। আমরা তার দ্বারা শুধু নিজেরই ক্ষতি সাধন করবো।

০৭। যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে , আমি অবশ্যই তাদের থেকে তাদের মন্দ [ দোষগুলি ] দূর করে দেবো ৩৪২৯। আমি অবশ্যই তাদের কাজের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট পুরষ্কার প্রদান করবো।

৩৪২৯। যারা তাদের বিশ্বাস বা ঈমানকেএবং জীবনকে পবিত্র করার মানসে চেষ্টা করে , আল্লাহ্‌ তাদের অতীতের মন্দ কাজের পরিণতি ক্ষমা করে দেবেন। আমাদের ভবিষ্যতকে সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিত করে দেবেন যা আমাদের সীমিত কর্মফলের থেকে বহুগুণ বেশী। আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা লাভ করা আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণা। এতে আমাদের নিজেদের কোনও কৃতিত্ব নাই।

০৮। আমি মানুষকে নির্দ্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে। কিন্তু যদি তারা [ তাদের প্রত্যেকে ] তোমাকে আমার সাথে [ এবাদতে ] শরীক করার জন্য জিদ্‌ [ এবং বল ] প্রয়োগ করে , যার সম্বন্ধে তোমার কোন জ্ঞান নাই , তবে তাদের সে কথা মান্য করো না ৩৪৩০। তোমাদের [সকলকে] আমার নিকট ফিরে আসতে হবে, এবং আমি তোমাদের জানিয়ে দেবো তোমরা যা করেছিলে তার [ সত্যতা ] ৩৪৩১।

৩৪৩০। আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনা এবং এক আল্লাহ্‌র উপাসনার ব্যাপারে পিতামাতার কোনও কর্তৃত্ব নাই। তারা এক আল্লাহ্‌ এবাদতে অবশ্যই বাধা সৃষ্টি করবে না। যদি করে তবে তা সন্তানেরা মানতে বাধ্য নয়।

৩৪৩১। শেষ বিচারের দিনে যখন সকলে বিচারের জন্য আল্লাহ্‌র সমীপে নীত হবে, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন সম্পর্ক যেমন পিতামাতা ও সন্তান ,স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি কিছুই থাকবে না। প্রতিটি মানব সন্তান শুধুমাত্র তার কর্মের ফলাফলসহ অপেক্ষা করবে। প্রত্যেককেই প্রত্যেকের কাজের জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পৃথিবীতে একদল লোকের আইনের মাধ্যমে অন্যদলের উপরে প্রভুত্ব থাকতে পারে। যেমন পিতামাতার আছে তাদের সন্তানের উপরে। কিন্তু যদি বিশ্বাস বা ঈমানের ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতদ্বৈত ঘটে, তবে সেক্ষেত্রে সন্তান পিতামাতার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে পারে। পৃথিবীর মতদ্বৈততার কারণ শেষ বিচারের দিনে মিটে যাবে কারণ তখন চোখের সামনে প্রকৃত সত্যের রূপ ভাস্বর হবে।

০৯। এবং যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের আমি পূণ্যাত্মাদের অর্ন্তভূক্ত করবো ৩৪৩২।

৩৪৩২। পূর্বের আয়াত নং ৭ এবং এই আয়াতের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে একই ভাবে তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। পূর্বের [ ৭ ] আয়াতে বলা হয়েছে যে ঈমান ও সৎকর্ম আল্লাহ্‌র ক্ষমা ও করুণালাভের পূর্বশর্ত। এখানে বলা হয়েছে ঈমান ও সৎকর্ম পাপীদের পাপমুক্ত হয়ে পূণ্যাত্মাদের অন্তর্ভূক্তির পূর্বশর্ত।

১০। মানুষের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা বলে, " আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি।" কিন্তু যখন তারা আল্লাহ্‌র পথে কষ্ট পায়, তারা মানুষের নিপীড়নকে আল্লাহ্‌র ক্রোধ রূপে গণ্য করে। যদি তোমার প্রভুর নিকট থেকে কোন সাহায্য আসে তারা নিশ্চয়ই বলবে, ৩৪৩৩" আমরা তো সর্বদা তোমাদের সাথেই ছিলাম"? সকল সৃষ্টির অন্তঃকরণে যা আছে আল্লাহ্‌ কি তা সম্যক অবগত নন ?

৩৪৩৩। দেখুন [৯ : ৫৬ ] আয়াত এবং এরূপ অন্যান্য আয়াত যেখানে মোনাফেকদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হয়েছে। যে লোক বিপদ বা বিপর্যয়ে পড়লেই ঈমান বা বিশ্বাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যে বিশ্বাসীদের সাথে বন্ধুত্ব করে শুধুমাত্র লাভের আশায় , এসব মোনাফেক দুভাবে নিন্দনীয়। প্রথমতঃ ঈমান ও সত্যকে প্রত্যাখান করার জন্য। দ্বিতীয়তঃ সে যাদের ঘৃণা করে তাদের একজন রূপে ভান করার জন্য। কিন্তু তারা কি জানে না আল্লাহ্‌র সকলের অন্তরের খবর অবগত।

১১। এবং অবশ্যই আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই জানেন কারা ঈমান আনে, এবং নিশ্চয়ই জানেন কারা মোনাফেক ৩৪৩৪।

৩৪৩৪। দেখুন উপরের আয়াত [২৯ : ৩ ]। সেখানে "অবশ্যই জেনে নেবো, কারা সত্যবাদী , কারা মিথ্যাবাদী।" কথাটি ছিলো সার্বজনীন অর্থে , এখানে ব্যবহার করা হয়েছে মোনাফেকদের প্রেক্ষাপটে। মোনাফেকেরা বিশ্বাসীদের ঘৃণা করে কিন্তু যখনই কিছু প্রাপ্তির আশা থাকে তখনই তারা বিশ্বাসীদের বন্ধুত্ব কামনা করে , পরের দুটো আয়াতে উপসংহার টানা হয়েছে।

১২। এবং কাফেররা বিশ্বাসীগণকে বলে, " আমাদের পথ অনুসরণ কর, আমরা তোমাদের পাপের [পরিণাম] বহন করবো ৩৪৩৫। " কিন্তু তারা তো তাদের পাপের [ ভার ] বহন করবে না। প্রকৃতপক্ষে তারা হচ্ছে মিথ্যাবাদী।

৩৪৩৫। এই আয়াতে মোনাফেক ব্যতীত অন্য আর এক দল লোকের কথা বলা হয়েছে ; যারা প্রকাশ্যে বিশ্বাসীদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে থাকে। তারা বলে, " আমাদের মত জীবন যাপন কর, আমরা তোমাদের পাপের ভার গ্রহণ করবো।" যেনো তারা সে ক্ষমতা রাখে। প্রতিটি আত্মাকে তার নিজস্ব কর্মফল ভোগ করতে হবে। প্রত্যেকের নিজের কর্মের দায়িত্ব নিজের। কেউ কারও দায়িত্ব বহন করবে না। এই হচ্ছে ইসলামের নীতি। এমন কি যাজক সম্প্রদায় বা আমাদের মৌলবী সম্প্রদায়ও এর বাইরে নয়। যদি একজন অন্যের পাপের বোঝা বহন করতে পারতো তবে তা হতো অন্যায় ও অবিচার। কিন্তু মহান আল্লাহ্‌ ন্যায় ও সত্যের প্রতীক।

১৩। তারা তাদের নিজেদের [ পাপের ] বোঝা বহন করবে, এবং নিজেদের সাথে [ অন্যদের ] বোঝাও ৩৪৩৬। এবং শেষ বিচারের দিনে , তাদের [ উদ্ভাবিত ] মিথ্যার হিসাব গ্রহণের জন্য ডাকা হবে।

৩৪৩৬। এ সব লোকেরা নিজেদের পাপের বোঝা বহন করবে এবং সেই সাথে যাদের পথভ্রান্ত করে প্রতারিত করেছে তাদের পাপের বোঝাও তাদের বহন করতে হবে - প্রতারিত করার দরুণ।

রুকু - ২

১৪। [একদা ] আমি নূহ্‌ কে তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের নিকট অবস্থান করেছিলো পঞ্চাশ কম হাজার বছর। অতঃপর প্লাবন তাদের নিমজ্জিত করেছিলো ,যখন তারা পাপের [মাঝে সর্বদা লিপ্ত ছিলো ] ৩৪৩৭।

৩৪৩৭। এই সূরাতে নূহ্‌ এর বন্যার কাহিনী বর্ণনা করা হয় নাই। সে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে অন্য সূরাতে [১১: ২৫ - ৪৮ অথবা ২৬ : ১০৫- ২২]। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নূহ্‌ এর সময়কাল ছিলো অত্যন্ত দীর্ঘ তা ছিলো ৯৫০ বৎসর। [ Genix 28 -29 ] -এ উল্লেখ আছে যে নূহ্‌ জীবিত ছিলেন ৯৫০ বৎসর , তার মধ্যে ৩৫০ বৎসর ছিলো মহাপ্লাবনের পরে। দীর্ঘ সময়ের উল্লেখের কারণ হচ্ছে ,এই সূদীর্ঘ কালেও মন্দরা তাঁর হেদায়েত গ্রহণ করে নাই, তার ফলে তাদের আল্লাহ্‌ ধ্বংস করে দেন। নূহ্‌ এবং তাঁর নৌকা ও মহাপ্লাবনের কাহিনী মানুষের জন্য এক অমোঘ সর্তকবাণীর প্রতীক। এই কাহিনীর মাধ্যমে মানুষ জাতিকে সাবধান করা হয়েছে যে দুষ্কৃতিকারীকে আল্লাহ্‌ ধ্বংস করবেন এবং পূণ্যাত্মাদের আল্লাহ্‌ রক্ষা করবেন। বিশ্ব জগতের জন্য এ হচ্ছে যুগ কাল অতিক্রান্ত এক নিদর্শন।

১৫। কিন্তু আমি তাঁকে এবং নৌকায় যারা ছিলো , তাদের উদ্ধার করেছিলাম। এবং আমি বিশ্ববাসীর জন্য ইহাকে [নৌকাকে ] একটি নিদর্শন করেছিলাম।

১৬। এবং [ আমি রক্ষা করেছিলাম ] ইব্রাহীমকে। স্মরণ কর সে তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলো , " আল্লাহ্‌র এবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর। যদি তোমরা বুঝতে পার , তবে তাই-ই হবে সর্বোৎকৃষ্ট ৩৪৩৮।

৩৪৩৮। হযরত ইব্রাহীমের কাহিনী বিভিন্ন সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান অংশের বর্ণনার সাথে প্রাসঙ্গিক যে সব সূরার অংশ সেগুলি হচ্ছে [ ২১ : ৫১- ৭২ ] ; যেখানে তাঁর আগুনে নিক্ষেপের এবং আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার ঘটনার বর্ণনা আছে। এবং সূরা [ ১৯ : ৪১ - ৪৯ ] আয়াত যেখানে বলা হয়েছে যে, তিনি পিতৃগৃহ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে মাতৃভূমি ত্যাগ করেন। এই সূরাতে পূর্ববর্তী সূরার কাহিনীর পুণরাবৃত্তি করা হয় নাই, কিন্তু উল্লেখ করা হয়েছে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপরে গুরুত্ব আরোপ করার জন্য :

১) ইব্রাহীমের সম্প্রদায় হেদায়েতের পরিবর্তে ইব্রাহীমকে পুড়িয়ে মারার জন্য ভীতি প্রদর্শন করে [ ২৯ : ১৬-১৮; ২৪ ]। ]

২) মন্দরা পরস্পর পরস্পরের সহগামী , কিন্তু পরলোকে তাদের নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতে হবে [ ২৯ : ২৫ ]।

৩) ভালো সর্বদা ভালোর সহচার্য কামনা করে এবং আল্লাহ্‌র আশীর্বাদে ধন্য হয় [২৯ : ২৬ - ২৭ ]। লক্ষ্য করুন [ ২৯ : ১৯ - ২৩ ] আয়াতগুলি হযরত ইব্রাহীমের কাহিনী বর্ণনার মাঝে মন্তব্য স্বরূপ , যদি কোনও কোনও তফসীরকার মনে করে যে, এগুলি হযরত ইব্রাহীমের নিজস্ব বক্তব্য।

১৭। " তোমরা আল্লাহ্‌কে ছেড়ে মূর্তি পূঁজা করছো এবং তোমরা মিথ্যার উদ্ভাবন করছো। তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের পূঁজা করছো , তোমাদের জীবনোপকরণ দেয়ার ব্যাপারে তাদের কোনও ক্ষমতা নাই। সুতারাং তোমরা আল্লাহ্‌র নিকট জীবনোপকরণ অনুসন্ধান কর ৩৪৩৯। তাঁর এবাদত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। তাঁর কাছেই হবে তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন।

৩৪৩৯। " জীবনোপকরণ' শব্দটির আক্ষরিক ও প্রতীকধর্মী অর্থ বিদ্যমান। আল্লাহ্‌র নিকট জীবনোপকরণ চাইতে বলা হয়েছে। এই জীবনোপকরণ হবে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সকল সমৃদ্ধির উৎস। জাগতিক জীবনোপকরণ জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন, আবার আধ্যাত্মিক জীবনোপকরণ পরলোকের সুখ ও শান্তির জন্য প্রয়োজন। ইব্রাহীমের আবেদন নিম্নরূপ : সকল আশা আকাঙ্খা একমাত্র আল্লাহকেই নিবেদন কর, তিনি তোমাকে তোমার সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তা দান করবেন। সুতারাং তোমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনই হবে বান্দার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা।

১৮। " এবং যদি তোমরা [ সত্যধর্মকে ] প্রত্যাখান কর , যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম করেছিলো ; [ তাহলে] রাসুলের কর্তব্য তো শুধু প্রকাশ্যে [ সুস্পষ্টরূপে আল্লাহ্‌র বাণী ] প্রচার করা।"

১৯। তারা কি দেখে না কি ভাবে আল্লাহ্‌ সৃষ্টিকে প্রথমে আরম্ভ করেন ; তারপরে তার পুণরাবৃত্তি করেন। আল্লাহ্‌র পক্ষে সত্যিই তা খুব সহজ ৩৪৪০।

৩৪৪০। অন্তহীন মহাবিশ্বের সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনাদি যুগ থেকে অণু পরামাণুর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া কখনও থেমে নাই। সেই অনন্ত অনাদি কাল থেকে আজও তা সমভাবে চলছে। প্রতি মূহুর্তে প্রতি পলে নূতন জিনিষ সৃষ্টি হচ্ছে। সৃষ্টি প্রক্রিয়া পুণঃ পুণঃ আবর্তিত হয় আল্লাহ্‌র অমোঘ আইন অনুযায়ী যাকে আমরা প্রাকৃতিক আইন নামে অভিহিত করে থাকি। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমাপ্তি লাভ করবে 'Ma'ad' এ এসে, যখন নূতন পৃথিবী নূতন আঙ্গিকে নূতন আইনের আওতায় সৃষ্টি হবে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব জিনিষেরই শুরু থাকে আবার শেষও আছে - শুধু সেই সর্বশক্তিমান বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্‌ অনাদি ও অনন্ত , চিরঞ্জীব। তাঁর কোনও প্রথম বা শেষ নাই , তিনি অনন্ত কাল ব্যপী বিরাজমান।

২০। বল, " পৃথিবী ভ্রমণ কর এবং অনুধাবন কর কি ভাবে আল্লাহ্‌ সৃষ্টিকে প্রথমে আরম্ভ করেছেন। সে ভাবেই আল্লাহ্‌ পরবর্তী [ দ্বিতীয় ] সৃষ্টিও করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাবান ৩৪৪১।

৩৪৪১। " পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর " - বাক্যটির আক্ষরিক ও প্রতীক অর্থ বিদ্যমান। এই বিশাল বিশ্বভূবন আল্লাহ্‌র সৃষ্টির সৌন্দর্য্যে ভরপুর। পূর্ব , পশ্চিম,উত্তর , দক্ষিণ পৃথিবীর সর্বত্র সৃষ্টির বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকার গ্রান্ড ক্যানিয়ন , জাপানের ফুজিয়ামা পর্বত, ভারতের হিমালয় পর্বত শ্রেণী, এশিয়ার এলবুজ পর্বতশ্রেণী, মিশরের নীল নদী ও তার জলপ্রপাতসমূহ , নরওয়ের পর্বত বেষ্টিত উপসাগর ও সমুদ্র খাঁড়ি , আইসল্যান্ডের উষ্ণ প্রস্রবন, মধ্যরাতের সূর্যের দেশ, ইত্যাদি অসংখ্য দৃশ্যমান অত্যাশ্চার্য জিনিষ আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র এই পৃথিবীতেই। দৃশ্যমান নয় এরূপ আরও বহু অত্যাশ্চার্য জিনিষ এই পৃথিবীতে আছে যেমন , ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু, পরমাণুর গঠন। অদৃশ্য ক্ষুদ্র এই পরমাণু বিশাল শক্তির আঁধার [Atomic energy], বুদ্ধিহীন প্রাণীকূলের ভিতরে যে সব স্বাভাবিক প্রবণতা [Instinct] দেখা যায় যেমন তারা সন্তান পালন করে, প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়, এ সবই আল্লাহ্‌র কুদরত। চিন্তা করলে দেখা যায় সারাটা পৃথিবী আল্লাহ্‌র সৃষ্টির অত্যাশ্চার্য কলাকৌশলে সমৃদ্ধ। এর কোন সীমা পরিসীমা নাই। প্রতিটি মূহুর্তে , প্রতি পলে , এই সৃষ্টিকর্ম চল্‌ছে অনাদি অনন্ত কাল থেকে। এর কোনটা মানুষের দৃষ্টি সীমার মধ্যে কোনটা দৃষ্টিসীমার বাইরে ঘটে। সে ভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে মানুষের মন কি আল্লাহ্‌র এক অত্যাশ্চার্য সৃষ্টি নয় ? কি বিশাল এই মনের ধারণ ক্ষমতা - সে জানা থেকে অজানাকে অনুধাবন করতে সক্ষম, যা শুধু মানুষের পক্ষেই সম্ভব। দৃশ্য থেকে অদৃশ্যে উপলব্ধিতে সক্ষম।

২১। " তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর নিকটেই তোমরা ফিরে যাবে ৩৪৪২।

৩৪৪২। প্রতিটি মানুষের শেষ গন্তব্যস্থল হচ্ছে মৃত্যুর পরে আল্লাহ্‌র নিকট প্রত্যাবর্তন। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে মানুষের প্রতিটি প্রয়োজন তৃপ্ত হয়। মানুষ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের উপরে নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী। লক্ষ্য করুন পরের আয়াতে [ ২২ ] বলা হয়েছে মানুষ ইচ্ছা করলেই আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করতে পারে না। কারণ মানুষকে অত্যন্ত দুর্বল ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে; একমাত্র আল্লাহ্‌ই তার রক্ষাকর্তা। মানুষ আল্লাহ্‌র আনুগত্য করুক বা না করুক তাঁকে আল্লাহ্‌র নিকট ফিরে যেতেই হবে। আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা নস্যাৎ করার ক্ষমতা মানুষের নাই। আল্লাহ্‌র বিচক্ষণ পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি কাউকে অঢেল অনুগ্রহ দান করেন, কাউকে দেন না। মেধা, মননশক্তি, সৃজনক্ষমতা, প্রতিভা ইত্যাদি হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহ ও নেয়ামত। এ সব অনুগ্রহ সকলে সমানভাবে লাভ করে না। আল্লাহ্‌ পৃথিবীকে এক নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন প্রতিভাধর ব্যক্তির জন্ম দেন তার পরিকল্পনা অনুযায়ী যারা পৃথিবীর মানব সভ্যতাকে এক নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন।

২২। " না পৃথিবীতে , না আসমানে ,তোমরা আল্লাহ্‌র [ পরিকল্পনা ] ব্যর্থ করতে পারবে না। আল্লাহ্‌ ব্যতীত তোমাদের কোন রক্ষাকর্তা বা সাহায্যকারী নাই। "

রুকু - ৩

২৩। যারা আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে এবং [পরলোকে ] তাঁর সাথে সাক্ষাৎকে প্রত্যাখান করে; এরাই তারা যারা আমার অনুগ্রহ সম্বন্ধে নিরাশ হয়। এরাই তারা যারা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি [ ভোগ ] করবে ৩৪৪৩।

৩৪৪৩। ' তারা ' অর্থাৎ যারা আল্লাহ্‌র নিদর্শন ও পরকালে তাঁর সাক্ষাৎ অস্বীকার করে তারা। পরলোকে তাদের জন্য আছে শাস্তি ,হতাশা তাদের ঘিরে ধরবে এবং তারা যন্ত্রণাতে পতিত হবে। আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া সকলের জন্য অবারিত। যারা আল্লাহ্‌র উপরে ঈমান আনে ,তাদের আত্মা আল্লাহ্‌র নূরে উদ্ভাসিত হয়, ফলে তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়। অপরপক্ষে , যারা আল্লাহ্‌কে অস্বীকার করে তাদের আত্মায় আল্লাহ্‌র নূর পৌঁছাতে পারে না। ফলে অন্ধকারচ্ছন্ন আত্মা আত্মিক যন্ত্রণায় ভোগে।

২৪। [ ইব্রাহীমের ] সম্প্রদায়ের শুধু এই উত্তর ছিলো, " তাকে হত্যা কর অথবা আগুনে পোড়াও।" কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁকে আগুন থেকে রক্ষা করেন ৩৪৪৪। যারা বিশ্বাসী এর মাঝে তাদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।

৩৪৪৪। দেখুন [ ২১ : ৬৬- ৭০ ] আয়াত। হযরত ইব্রাহীমকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হলো , কিন্তু আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে অগ্নি তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারলো না। এই উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের উপদেশ দিয়েছেন যে, দুষ্টদের ষড়যন্ত্রের দ্বারা পূণ্যাত্মাদের কোনও ক্ষতি হবে না কারণ তাদের রক্ষা করবেন স্বয়ং আল্লাহ্‌। কিন্তু প্রয়োজনে তাদের পাপের আবাসস্থলকে ত্যাগ করতে হবে, যদি প্রয়োজন হয় নিজ জন্মভূমিও যেমন করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম।

২৫। এবং সে বলেছিলো, " এই পার্থিব জীবনে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মানের খাতিরে তোমরা, তোমাদের জন্য আল্লাহ্‌র পরিবর্তে মূর্তিকে গ্রহণ করেছ [এবাদতের জন্য ] ৩৪৪৫। কিন্তু শেষ বিচারের দিনে তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং পরস্পর পরস্পরকে অভিসম্পাত করবে। এবং তোমাদের আবাস হবে আগুন এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।

৩৪৪৫। যারা মন্দলোক , পাপ কাজে তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু , পরস্পর পরস্পরের কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। তারা বন্ধুরূপে পরস্পরের সাথে কৌতুকরস করে এবং বিভিন্ন কাজে পরস্পরকে সমর্থন করে। তারা পরস্পর পরস্পরের মন্দ কাজগুলিকে বাগাড়ম্বর পূর্ণ নামে অভিহিত করে থাকে এবং বলে থাকে এগুলি তাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ। বাস্তব সত্য হচ্ছে, এরূপ সমর্থন ও পৃষ্টপোষকতা ও কলাকৌশল দ্বারা দুষ্টরা পৃথিবীতে অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্জন করতে সমর্থ হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে , তারা লাভবান হয় না। তারা নিজেদের প্রতারিত করে এবং পরস্পরকেও প্রতারিত করে। পৃথিবীতে তারা ছিলো বন্ধুরূপে, মৃত্যুর পরে পরলোকে তাদের কি অবস্থা হবে ? পরলোকে তারা পরস্পরের বন্ধুত্ব অস্বীকার করবে, কারণ প্রত্যেককে তখন ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হবে। সেখানে তারা পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করবে বিপথে চালনা করার জন্য। তারা পরস্পর পরস্পরকে অভিসম্পাত দেবে। কিন্তু তখন আর কোনও প্রতিকার থাকবে না। তাদের জন্য নির্ধারিত হবে দোযখের আগুন।

২৬। কিন্তু লূতের আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস ছিলো ৩৪৪৬। সে বলেছিলো , " আমার প্রভুর জন্য আমি আমার দেশ ত্যাগ করবো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমতায় মহাশক্তিধর এবং প্রজ্ঞাময়। "

৩৪৪৬। হযরত লূত ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের ভাইয়ের পুত্র। তিনি ইব্রাহীমের অনুগত ছিলেন। তিনি ইব্রাহীমের শিক্ষাকে গ্রহণ করেন, আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনেন এবং স্বেচ্ছায় ইব্রাহীমের সাথে নির্বাসনে গমন করেন। হযরত ইব্রাহীম তাঁর পিতৃগৃহ ত্যাগ করে মাতৃভূমি চালদিয়া থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত হয়ে সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনে গমন করেন। সেখানে আল্লাহ্‌ তাঁকে শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করেন। তাঁর পরিবার পরিজন বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সেখানে আল্লাহ্‌র একত্বের ধ্বজা উত্তোলন করেন।

২৭। এবং আমি [ ইব্রাহীমকে ] দিয়েছিলাম ঈসাহাক, ইয়াকুবকে এবং তার বংশধরদের জন্য স্থির করেছিলাম নবুয়ত ৩৪৪৭ ও প্রত্যাদেশ এবং আমি তাকে এই জীবনেই পুরষ্কার দান করেছিলাম। এবং পরকালে সে পূণ্যাত্মাদের দলভূক্ত হবে ৩৪৪৮।

৩৪৪৭। হযরত ইব্রাহীমের ছিলো দুই পুত্র সন্তান জ্যেষ্ঠ ইসমাঈল এবং কনিষ্ঠ ঈসাহাক। ঈসাহাকের বংশে জন্ম গ্রহণ করেন ইয়াকুব এবং তাঁর মাধ্যমে হযরত মুসা ও ঈসা। আবার ইসমাঈলের বংশে জন্মগ্রহণ করেন শেষ নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তফা [ সা ]। ইয়াকুবের নামকরণ করা হয় ইসরাঈল [Gen 32 : 28 ; 35 : 10] এবং সে কারণে তাঁর বংশধরদের উপাধি হচ্ছে ' বনী ইসরাঈল ' বা ইসরাঈলের সন্তান [Children of Israel]। এ ভাবেই আল্লাহ্‌ নবুয়তের দুই প্রধান ধারা ইব্রাহীমের দুই পুত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত করেন।

৩৪৪৮। দেখুন [ ২৯ : ৯ ] এবং [ ৪ : ৬৯ ] এবং টিকা ৫৮৬।

২৮। এবং [ স্মরণ কর ] লূতের কথা। দেখো সে তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলো, " তোমরা তো এমন অশ্লীল কাজ করছো , যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেহ করে নাই ৩৪৪৯।

৩৪৪৯। দেখুন [ ৭ : ৮০ ]। লূতের সম্প্রদায়ের ঘৃণ্য পাপ যা পৃথিবীতে কেউ কখনও করে নাই তার প্রতি লূতের বক্তব্য ছিলো সুবিবেচনাপূর্ণ উপদেশ।

২৯। " তোমরা কি পুরুষের সাথে সমকামিতার অভ্যাস করবে এবং বাণিজ্য পথে ডাকাতি করবে ৩৪৫০ ? [এমন কি ] তোমরা তোমাদের সভাঘরেও [ প্রকাশ্যে ] পাপাচার করবে ? " কিন্তু তার সম্প্রদায়ের শুধু এই উত্তর ছিলো, তারা বললো , " যদি তুমি সত্য বলে থাক তবে আমাদের উপরে আল্লাহ্‌র ক্রোধকে আনায়ন কর। " ৩৪৫১

৩৪৫০। লূতের সম্প্রদায়ের পাপ ছিলো সমকামিতা। [ ৭ : ৮১ ] আয়াত দেখুন। এ ব্যাপারে তারা গোপনীয়তার প্রয়োজন বোধ করতো না। তারা এই ঘৃণ্য কাজ বাণিজ্য পথে হামলা করে সেখানে করতো। প্রকাশ্য রাজপথে করতো, এমনকি তাদের মজলিসেও তারা প্রকাশ্যে এ কাজ করতো। কোন কোন তফসীরকারের মতে রাহাজানি বা ইংরেজীতে যার অনুবাদ হয়েছে "Cut off highway?" - এর অর্থ বাণিজ্য পথে ডাকাতি। সেটাও সম্ভব এবং মজলিসে তাদের অপরাধ ছিলো অন্যায় অবিচার ও ঝগড়াঝাটি। হতে পারে তিন ধরনের পাপেই তারা অভ্যস্ত ছিলো। কিন্তু এই আয়াতটির প্রেক্ষাপট হচ্ছে লূতের সম্প্রদায়ের সমকামিতার জঘন্য অপরাধ। এখানে যে প্রসঙ্গের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা হচ্ছে তারা তাদের পাপের জন্য বিন্দু মাত্র লজ্জিত ছিলো না। এটা যে জঘন্য পাপ সে বোধই তাদের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো আর এ কারণেই তা প্রকাশ্যে করতেও দ্বিধা বোধ করতো না। এর থেকে নৈতিক অধঃপতন আর কিছু হতে পারে না।

৩৪৫১। সূরা [ ৭ : ৮২ ] আয়াতে লূতের সম্প্রদায়ের ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি আছে। এই আয়াতে আরও একটি ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি উক্তিই পরস্পরের সম্পূরক। এখানের উক্তিতে যার উপরে তারা গুরুত্ব আরোপ করে তা হচ্ছে , তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় সুতারাং আল্লাহ্‌র শাস্তির কথা তাদের নিকট হাস্যকর। সে কারণে তারা আল্লাহ্‌র শাস্তিকে আহ্বানের জন্য সাহসী হয়েছিলো।

৩০। সে বলেছিলো, " হে আমার প্রভু ! অশান্তি সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য কর। "

রুকু - ৪

৩১। যখন আমার বার্তাবাহক দূত ইব্রাহীমের নিকট সুসংবাদ সহ আগমন করলো ৩৪৫২; তারা বলেছিলো , "আমরা অবশ্যই এই জনপদের অধিবাসীদের ধ্বংস করতে যাচ্ছি ৩৪৫৩। সত্যিই তারা অপরাধে [ আসক্ত]।"

৩৪৫২। দেখুন [ ১১ : ৬৯ - ৭৬ ] আয়াত। ফেরেশতারা লূতের সম্প্রদায়ের ধ্বংসের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। কারণ লূতের সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের জঘন্য পাপের দ্বারা পৃথিবীর পরিবেশকে কলুষিত করে তুলেছিলো। পথে ফেরেশতারা ইব্রাহীমকে বৃদ্ধ বয়েসে পুত্র সন্তান লাভের সুসংবাদ দান করেন। ইব্রাহীম জানতেন যে সেখানে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র লূত অবস্থান করছেন, সুতারাং তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন বোধ করেন। ফেরেশতারা তাঁকে লূতের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দেন।

৩৪৫৩। জনপদবাসী বলতে এখানে 'সদ্‌ম' ও 'গোমরাহ্‌ ' নামক দুটি শহরকে বোঝানো হয়েছে। এই শহর দুটির লোক তাদের ঘৃণ্য কার্যকলাপের দ্বারা সীমা অতিক্রম করেছিলো। সুতারাং তারা আল্লাহ্‌র করুণা লাভে অসমর্থ হয়েছিলো।

৩২। সে বলেছিলো , " কিন্তু সেখানে লূত রয়েছে।" তারা বলেছিলো , " সেখানে কে রয়েছে আমরা তা ভালোভাবে জানি। আমরা অবশ্যই তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের রক্ষা করবো- কিন্তু তার স্ত্রীকে নয়। সে তো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অর্ন্তভূক্ত।" ৩৪৫৪

৩৪৫৪। লূতের স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি অনুগত ছিলো না। প্রথাগতভাবে বলা হয়ে থাকে যে, লূতের স্ত্রী মন্দ লোকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো। সুতারাং সে তাদের ত্যাগ করে যেতে অনিচ্ছুক ছিলো। লূতের ধর্মের প্রতি তাঁর স্ত্রীর কোনও বিশ্বাস ছিলো না বা অতিথি হিসেবে আগত ফেরেশতাদের উপরেও তার কোনও বিশ্বাস ছিলো না।

৩৩। আর যখন আমার প্রেরিত দূতগণ লূতের নিকট উপস্থিত হলো, তাদের কারণে সে দুঃখিত হয়ে পড়লো , এবং [ তাদের রক্ষার ব্যাপারে ] নিজেকে অসহায় মনে করলো ৩৪৫৫। কিন্তু তারা বলেছিলো," তুমি ভয় পেয়ো না , দুঃখও করো না। আমরা [ এখানে ] এসেছি তোমাকে ও তোমার অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য [অবশ্য ] তোমার স্ত্রী ব্যতীত। সে তো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভূক্ত।

৩৪৫৫। লূতের কাহিনীর এই অংশে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে [ ১১ : ৭৭- ৮৩] আয়াতে।

৩৪। " আমরা এই জনপদের অধিবাসীদের উপরে আকাশ থেকে শাস্তি আনায়ন করতে যাচ্ছি ৩৪৫৬। কারণ তারা পাপাচারে নিমগ্ন। "

৩৪৫৬। লূতের সম্প্রদায়ের শাস্তি ছিলো : তাদের উপরে আশমান থেকে পাথর বৃষ্টি হয়েছিলো যা সম্পূর্ণ শহরকে ঢেকে দেয়। সম্ভবতঃ তা ছিলো ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির আগ্নেয়পাত।

৩৫। যারা অনুধাবন করতে চায়, তাদের জন্য সেখানে আমি স্পষ্ট নিদর্শন রেখেছি ৩৪৫৭।

৩৪৫৭। মরু সাগরের [Dead Sea] পূর্ব পাশের সম্পূর্ণটা জুড়ে ছিলো 'সদম' ও গোমরাহ্‌ ' শহরের অবস্থান। এই স্থানটি এখনও গন্ধকের লবণ দ্বারা আবৃত সুতারাং সেখানে কোন বৃক্ষ বা তরুলতা নাই, প্রাণীর জন্য স্থানটি বিপদজনক। মরু সাগরকে আরবীতে বলা হয় 'Bahr Lut' [ লূতের সাগর ] ।এই প্রান্তরটি বৃক্ষ তরুলতা বিহীন ,জনপ্রাণী শূন্য ঊষর প্রান্তর। পাপের চরম পরিণতির স্বাক্ষর হিসেবে স্থানটি এখনও বিরাজমান।

৩৬। মাদইয়ান সম্প্রদায়ের জন্য [ আমি ] তাদের ভ্রাতা শোয়েবকে প্রেরণ করেছিলাম। সে তখন বলেছিলো , " হে আমার সম্প্রদায় ! আল্লাহ্‌র এবাদত কর এবং শেষ বিচারের দিনকে ভয় কর। পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাপাচার করো না। "

৩৭। কিন্তু তারা তাকে প্রত্যাখান করেছিলো। অতঃপর এক শক্তিশালী বিস্ফোরণ তাদের গ্রাস করলো ৩৪৫৮। এবং তারা প্রভাতে নিজ নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় পড়ে থাকলো।

৩৪৫৮। সুয়েব নবী ও মাদ্‌য়ানবাসীর কাহিনীর উল্লেখমাত্র এখানে করা হয়েছে। মূল কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে [ ১১ : ৮৪ - ৯৫ ] আয়াতে। তাদের পাপ ছিলো মিথ্যা প্রতারণা ও বাণিজ্যে নৈতিকতার অভাব। তাদের শাস্তি ছিলো শক্তিশালী ঝঞ্ঝা ,সম্ভবতঃ আগ্নেয়গিরির আগ্নেয়পাত। এই সূরাতে তাদের উল্লেখের কারণ তারা কাজের দ্বারা পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটাতো এবং সে সম্বন্ধে তাদের কোনও পাপবোধ ছিলো না , কারণ তারা 'Ma'ad' বা শেষ দিবসের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো না ; 'Ma'ad' বা 'শেষ দিবস' বা আল্লাহ্‌র কাছে প্রত্যাবর্তন যা এই সূরার মর্মার্থ।

এই একই প্রসঙ্গের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে আদ্‌ ও সামুদ জাতির উল্লেখের মাধ্যমে আরও উল্লেখ করা হয়েছে কারূণ, ফেরাউন এবং হামানের কথা , যদিও এদের প্রত্যেকের পাপ ছিলো ভিন্ন প্রকৃতির কিন্তু এক বিষয়ে তারা ছিলো অভিন্ন , আর তা ছিলো তারা কেউই "শেষ দিবসের " বিশ্বাসী ছিলো না।

৩৮। [ আরও স্মরণ কর ] আ'দ ও সামুদ [জাতির ] কথা ৩৪৫৯। [ তাদের ভাগ্য ] সুস্পষ্ট রূপে তোমার নিকট প্রতিভাত হবে তাদের প্রাসাদসমূহের [ ধবংসাবশেষ ] থেকে। শয়তান তাদের কাজকে তাদের নিকট মনোমুগ্ধকর করেছিলো ৩৪৬০, এবং তাদের সৎপথ থেকে ফিরিয়ে রেখেছিলো , যদিও তারা ছিলো বুদ্ধি ও দক্ষতায় বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্ত।

৩৪৫৯। আদ্‌ জাতির জন্য দেখুন [ ৭ : ৬৫ - ৭২ ] আয়াত এবং টিকা ১০৪০ এবং সামুদ জাতির জন্য দেখুন [৭ : ৭৩ - ৭৯ ] আয়াত ও টিকা ১০৪৩।

১) তাদের সভ্যতার ধবংসাবশেষ এ কথাই প্রমাণ করে যে, তারা উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিলো এবং তারা ছিলো জাতি হিসেবে বুদ্ধিমান ও সুদক্ষ কারিগর।

২) তারা তাদের পার্থিব সভ্যতাকে সর্বোচ্চ মনে করতো এবং সে জন্য তারা খুব গর্বিত ছিলো।

৩) তাদের ধ্বংস এ কথাই প্রমাণ করে যে, উন্নত প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সভ্যতাই পৃথিবীতে টিকে থাকার একমাত্র মানদন্ড নয়। যারাই আল্লাহ্‌র দেয়া নৈতিক নীতিমালাকে লঙ্ঘন করে বা করেছিলো তাদের ধবংস ছিলো অনিবার্য।

৩৪৬০। আদ্‌ জাতি ছিলো উদ্ধত, অহংকারী ও আত্মতৃপ্ত। তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো পার্থিব জীবনের সুখ সম্ভোগ , জীবনের বৃহত্তর ও মহত্তর উদ্দেশ্যকে তারা অস্বীকার করতো। পার্থিব জীবন শেষে পরলোকের জীবনের প্রতি তারা ছিলো উদাসীন। সুতারাং তারা আল্লাহ্‌ নির্দ্দেশিত জীবন বিধানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতো। তারা নির্বোধ ছিলো না তারা ছিলো বুদ্ধিমান জাতি। সে হিসেবেও তাদের উপলব্ধি করা উচিত ছিলো যে মনুষ্য জাতি অন্যান্য প্রাণী জগতের ন্যায় নয়। মনুষ্য জাতির সৃষ্টি আল্লাহ্‌র বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ - যারা মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না। বুদ্ধিমত্তা থাকা সত্বেও তারা এই সহজ সত্যকে অনুধাবন করতে পারে নাই , কারণ উদ্ধত , অহংকার ও আত্মতৃপ্তি তাদের সাধারণ চিন্তাধারাকে বিপথে চালিত করে। তাদের পাপ কাজকে তাদের চোখে শোভন মনে হতে থাকে। ফলে বিচক্ষণ হওয়া সত্বেও তারা সৎপথ অবলম্বন করে না, এ সত্য আদ্‌ জাতির জন্য যেমন ছিলো সত্য, বর্তমানেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। যারা উদ্ধত ও অহংকারী তারা সঠিকভাবে প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে পারবে না। নিজের অন্যায় কাজকে তাদের চোখে শোভন মনে হবে। কারণ ঔদ্ধত্য ও অহংকার একটি অত্যন্ত খারাপ রীপু।

৩৯। [ আরও স্মরণ কর ] কারূণ , ফেরাউন ও হামানকে ৩৪৬১। মুসা তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণসহ উপস্থিত হলো , তথাপি পৃথিবীতে তারা ঔদ্ধত্য করে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু তারা [ আমাকে ] অতিক্রম করতে পারলো না।

৩৪৬১। কারূণের বিবরণের জন্য দেখুন সূরা [ ২৮ : ৭৬- ৮২ ]। ফেরাউনের কথা কোরাণ শরীফের বহুস্থানে উল্লেখ আছে ; কিন্তু হামানের সাথে উল্লেখ আছে [ ২৮ : ৬ ] আয়াতে এবং এই আয়াতে। তাদের উদ্ধত অহংকারের সাথে খোদাদ্রোহীতার উল্লেখ আছে [২৮ : ৩৮ ] আয়াতে।

৪০। তাদের প্রত্যেককেই আমি তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম। তাদের কারও বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছি [ পাথর বর্ষণ সহ ] প্রচন্ড ঝটিকা ৩৪৬২ , কাউকে আঘাত করেছিলো [ প্রচন্ড ] বিস্ফোরণ ৩৪৬৩ ; কাউকে প্রোথিত করেছিলাম ভূগর্ভে ৩৪৬৪, এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত ৩৪৬৫। আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষতি [বা অত্যাচার ] করেন নাই ; তারা নিজেরাই নিজের আত্মার প্রতি ক্ষতি ও অত্যাচার করেছিলো।

৩৪৬২। 'Hasib' প্রস্তরসহ প্রচন্ড ঝটিকা ; দেখুন আয়াত [ ১৭ : ৬৮ ] এই শাস্তি দান করা হয়েছিলো লূতের সম্প্রদায়কে [ দেখুন ৫৪ : ৩৪ ] কোন কোন তফসীরকারে মতে এই আয়াতে উল্লেখিত এই শাস্তি দেয়া হয়েছিলো আদ্‌ জাতিকে। কিন্তু তাদের শাস্তির বিবরণ আছে [ ৪১ : ১৬; ৫৪ : ১৯ এবং ৬৯ : ৬ ] আয়াত সমূহে যা থেকে ধারণা করা যায় যে , আদ্‌ জাতির উপরে যে ভয়াবহ শাস্তি নেমে এসেছিলো সেখানে প্রস্তর বৃষ্টি ছিলো না। তা ছিলো প্রচন্ড বালির ঝঞ্ঝা। যার ফলে অন্য স্থানের বালি এসে তাদের দেশকে বালির নীচে ডুবিয়ে দেয়।

৩৪৬৩। Saihat মহানাদ বা বিস্ফোরণের প্রচন্ড ধাক্কা। দেখুন বিবরণের জন্য আয়াত [ ১১ : ৬৭ ] এবং টিকা ১৫৬১; আয়াত [ ৭ : ৭৮ ] এবং টিকা ১০৪৭; আয়াত [ ১৫ : ৭৩ ] এবং টিকা ১৯৯৬। এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে নিম্ন লিখিত জাতিসমূহের পরিণতি বর্ণনা করার জন্য।

১) সামুদ জাতি [ ১১ : ৬৭ ] ; মাদিয়ান জাতি [ ১১ : ৯৪ ]; লূতের সম্প্রদায় [ ১৫ : ৭৩ ] ; এবং হিজ্‌র বা পার্বত্য এলাকার অধিবাসী [ ১৫ : ৮৩ ] যা সামুদ জাতির রাজ্যের অর্ন্তগত ছিলো।

৩৪৬৪। এই শাস্তি ঘটেছিলো কারূণের বেলাতে। দেখুন [ ২৮ : ৮১ ] এবং [ ১৬ : ৪৫ ] আয়াত ও টিকা ২০৭১।

৩৪৬৫। এই শাস্তিটি ছিলো ফেরাউন , তার অনুসারীরা ও হামানের জন্য [ ২৮ : ৪০ ] এবং নূহ্‌ এর সময়ের দুষ্ট লোকদের ভাগ্যে [ ২৬ : ১২০ ]।

৪১। আল্লাহ্‌ ব্যতীত যারা অন্যকে রক্ষাকর্তারূপে গ্রহণ করেছে, তাদের উপমা হচ্ছে মাকড়সা , যে [ নিজের জন্য ] ঘর তৈরী করে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে সকল ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই সর্বাপেক্ষা দুর্বল ৩৪৬৬, ৩৪৬৭। [অবশ্য ] যদি তারা তা বুঝতে পারতো।

৩৪৬৬। মাকড়সার বাসা আল্লাহ্‌র সৃষ্টির এক অপূর্ব নিদর্শন। মাকড়সা তার গ্ল্যান্ড থেকে সরু সিল্কের ন্যায় সূতো বের করে বাসা বানায়। পৃথিবীতে বহু ধরণের মাকড়সা আছে, তবে সাধারণতঃ দুই ধরণের বাসা উল্লেখযোগ্য। এক ধরণের হচ্ছে ফাঁপা নলের ন্যায় বাসা বা জালের ন্যায়। এটা তাদের প্রাসাদ বা সুরক্ষিত দুর্গ। এগুলির সাথে থাকে একটি বা দুটি শিকার ধরার ফাঁদ। তবে সাধারণতঃ আমরা যে সব মাকড়সার জাল দেখি সেগুলির একটি মধ্যবিন্দু থাকে। সেই মধ্যবিন্দু কে কেন্দ্র করে চতুর্দ্দিকে কতকগুলি টানা থাকে এবং এই সব টানার সাথে মাকড়সারা তাদের জাল বোনে। এটা তাদের বাসা বা শিকারের জন্য ফাঁদ। মাকড়সার জাল বা বাসা শুধু যে শিল্পনৈপুন্যের উদাহরণ তাই নয় তা হচ্ছে মাকড়সার সম্পদ ও শক্তির নির্দ্দেশক। যদি কোন পতঙ্গ তার জালে আটকে যায়। তাহলে টানা গুলির মাধ্যমে পতঙ্গের নড়াচড়ার তরঙ্গ সর্বদিকে বিস্তারিত হয় এবং তা মাকড়সার নিকট পৌঁছায়। তখন মাকড়সা শিকারকে হত্যা করার জন্য অগ্রসর হয়। কিন্তু যদি শিকার আকারে বড় হয়, তবে মাকড়সা তার শরীরের গ্ল্যান্ড থেকে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ শিকারের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। ফলে শিকার মৃত্যু বরণ করে। সাধারণতঃ মাকড়সা তার জালের কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থান করে, অথবা পাতার আড়ালে বা ফাটলের আড়ালে লুকিয়ে থাকে , কিন্তু তার হাতে উর্ণনাভের একটি সূতো সব সময়েই থাকে যেনো শিকার জালে পড়ার সাথে সাথে সে সংবাদ পায়। এ যেনো ঠিক টেলিফোনে সংবাদ প্রাপ্তির মত। বিশেষতঃ স্ত্রী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সার থেকে বড় হয়। আরবীতে মাকড়সার স্ত্রী বর্গ নাম [Generic gender] হচ্ছে আনকাবুত।

৩৪৬৭। এই আয়াতে ঊর্ণনাভকে ব্যবহার করা হয়েছে রূপক হিসেবে। মাকড়সার অনুপাতে তাঁর জাল অত্যন্ত মজবুত ও কৌশলপূর্ণ সন্দেহ নাই। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে মাকড়সার জাল অত্যন্ত শক্তিহীন , বিশেষতঃ যখন তা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ঠিক সেরূপ শক্তিহীন, ও দুর্বল মানুষের পার্থিব সহায় সম্পদ, শক্তি তা যতই সুন্দর , মজবুত ও কৌশলপূর্ণ হোক না কেন ; আল্লাহ্‌র অসীম ক্ষমতার নিকট মানুষের সকল শক্তি, সম্পদ, কলাকৌশল অতি তুচ্ছ। মাকড়সার সুক্ষ কৌশলপূর্ণ স্থাপত্য মানুষের হাতের এক ধাক্কা সহ্য করতে পারে না। ঠিক সেরূপ সেই অসীম শক্তির নিকট মানুষের দম্ভ, অহংকার,সব কিছু মূহুর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ তা বুঝতে চায় না।

৪২। আল্লাহ্‌ ব্যতীত তারা যা কিছুকে ডাকে, অবশ্যই আল্লাহ্‌ তা জানেন। এবং তিনি [ ক্ষমতায় ] পরাক্রমশালী , প্রজ্ঞাময় ৩৪৬৮।

৩৪৬৮। মানুষের আধ্যাত্মিক জগত যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে , তখন তারা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে ঊর্ণনাভের মত অবাস্তব ও শক্তিহীন জিনিষে তার নির্ভরতা স্থাপন করে। উর্ণনাভ খুব সামান্য বাতাসে বা প্রাণীর পদচারণায় ধ্বংস হয়ে যায়। মাকড়সার কাছে তার জাল যতই শক্তিশালী ও নিরাপদ মনে হোক না কেন বাস্তবে তা অত্যন্ত হাল্‌কা ও শক্তিহীন। ঠিক সেরূপ হচ্ছে এ সব লোকের নির্ভরতার পাত্র। যদি তারা নিজেদের মঙ্গল বুঝতে না পারে, তবে তাদের উচিত ছিলো সেই মঙ্গলময় আল্লাহ্‌র সাহায্যের অন্বেষণ করা। তিনি সব জানেন -মানুষের দুর্বলতা, আশা-আকাঙ্খা,কার্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য, মিথ্যা উপাস্য ,যাদের তারা উচ্চ আসনে স্থাপন করে, সত্য ও ন্যায়কে অবহেলা করে সংসারে যারা বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং তাদের যারা পাপের ফাঁদে নিজেকে আবদ্ধ করেছে। আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ ,জ্ঞানী এবং তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সক্ষম। সকলকেই তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।

৪৩। এভাবেই আমি মানব সম্প্রদায়ের জন্য উপমা , উপস্থাপন করে থাকি। কিন্তু শুধু তারাই তা বুঝতে পারে যারা জ্ঞানী ৩৪৬৯।

৩৪৬৯। কোরাণ শরীফে যেসব রূপক ব্যবহার করা হয়েছে তা অত্যন্ত সাধারণ , কিন্তু তার অন্তর্নিহিত উপদেশ অত্যন্ত গভীর ও অর্থবহ এবং মানব জীবনের সাথে এর সামঞ্জস্য খুঁজে পাবে শুধু তারাই যারা দিব্যজ্ঞানে সমৃদ্ধ কারণ তাঁরা এ ক্ষমতা লাভ করবেন আল্লাহ্‌র করুণায় বিধৌত হওয়ার ফলে।

৪৪। আকাশ পৃথিবীকে আল্লাহ্‌ সুষমরূপে সৃষ্টি করেছেন। যারা বিশ্বাসী এ সবের মধ্যে তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে ৩৪৭০।

৩৪৭০। দেখুন [ ৬ : ৭৩ ] আয়াত ও টিকা ৮৯৬। 'সুষমরূপে' এই শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। আল্লাহ্‌র সৃষ্টি কৌশল শুধু যে শিল্প সৌন্দর্যে ভরপুর তাই-ই নয়; তা অত্যন্ত সুসামঞ্জস্যপূর্ণ , সুশৃঙ্খল, কৌশলপূর্ণ এবং নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে যেনো তাঁর সৃষ্টির জন্য হয় সর্বোচ্চ মঙ্গল, জীবনোপকরণ এবং নিরাপত্তা। আকাশ , পৃথিবী এই বিশাল বিশ্বভূবন, আল্লাহ্‌র অসীম জ্ঞানের সাক্ষর বহন করে। অপূর্ব বিচক্ষণতায় সৃষ্ট সৃষ্টিকে তিনি লালন-পালন করে চলেছেন , সকল প্রয়োজন মিটিয়ে চলেছেন। মানুষের সনির্বন্ধ আবেদন তিনি কখনও প্রত্যাখান করেন না। যারা প্রার্থনা করে, আল্লাহ্‌র আনুগত্যের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে ,ঈমানকে দৃঢ় করার জন্য আল্লাহ্‌র অনুসন্ধান করে , তাদের জন্য আল্লাহ্‌র সৃষ্ট এই বিশাল বিশ্বভূবন এক জ্ঞানময় ইঙ্গিত বহন করে।

একবিংশতিতম পারা

রুকু - ৫

৪৫। তুমি আবৃত্তি কর কিতাব থেকে যা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে ৩৪৭১। এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌র স্মরণ [ জীবনের জন্য ] সর্বোৎকৃষ্ট কাজ। তোমরা [ যে কাজ ] কর , আল্লাহ্‌ তা জানেন।

৩৪৭১। 'Tilawat' কোরাণ শরীফ আবৃত্তি করার পরিবর্তে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ অত্যন্ত ব্যপক। এর দ্বারা যা বুঝানো হয় তা হচ্ছে :

১) উচ্চ কণ্ঠে পুণরাবৃত্তি করা বা আবৃত্তি করা এবং তা পৃথিবীর সম্মুখে প্রকাশ করা,

২) আমাদের নিজেদের আত্মিক উপকারের জন্য পড়া,

৩) এর অর্থকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য অন্তরে অনুভব ও উপলব্ধি করার জন্য অর্থ বুঝে পড়া ও উপলব্ধি করা প্রয়োজন [ ২ : ১২১ ] ,

৪) কোরাণের বক্তব্য আল্লাহ্‌র বক্তব্য; বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ

সুতারাং শুধু পড়ার এবং বোঝার মাধ্যমেই এর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কোরাণের বক্তব্যের উপরে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা, যদি কোরাণ শরীফ বুঝে পড়ে তার উপরে চিন্তা ভাবনা ও ধ্যান করি , তাহলেই শুধু আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত হতে পারে, আমাদের জীবন ধারণ ও আশা-আকাঙ্খা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার সাথে সমন্বিত হতে পারে। যখন আমরা তা করতে পারি ,তখনই আমাদের প্রার্থনা বা সালাত আমাদের জীবনের সাথে মিশে যায়, আমাদের সকল চাওয়া পাওয়া আল্লাহ্‌র ইচ্ছার সাথে সমন্বিত হয়ে তার স্বতঃস্ফুর্ত বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে। তার ফলে আমাদের আত্মা পরিশুদ্ধ হয়, কারণ আমাদের সকল কাজ, পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা, কর্মের উদ্দেশ্য বা নিয়ত ,বক্তব্য অর্থ এক কথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে , ফলে সকল অন্যায় অসত্য থেকে আত্মা রক্ষা পায় ও পরিশুদ্ধতা লাভ করে। এভাবে আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশের বা কোরাণের বক্তব্যের চিন্তায় সমগ্র সত্তাকে আপ্লুত করার ফলে বান্দার প্রার্থনা বা সালাত তাঁকে আল্লাহ্‌র উপস্থিতি তাঁর হৃদয়ের মাঝে উপলব্ধিতে সাহায্য করে ফলে তার তৃতীয় নয়ন বা অন্তর্দৃষ্টি জন্মলাভ ঘটে। হৃদয়ের মাঝে আল্লাহ্‌র উপস্থিতির অনুভবের মাধ্যমে , অন্তরে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। আর তাই -ই হচ্ছে প্রকৃত জিক্‌র [Zikr] বা আল্লাহকে স্মরণ করা। মুখে আল্লাহ কে স্মরণ করে , হৃদয় যদি অন্য কথা বলে বা চিন্তা করে, তা কখনও জিক্‌র পর্যায়ে পড়ে না। জিকর অর্থ স্মরণ করা। স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে যা আমাদের সম্মুখে নাই তার উপস্থিতি হৃদয়ের মাঝে ধারণ করা , মনঃচক্ষে দেখতে পাওয়া। সুতারাং প্রকৃত সালাত ও জিকর আমাদের আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য উপলব্ধিতে সাহায্য করে। আর এর শুরু হচ্ছে কোরাণ পাঠে, আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশের সাথে নিজস্ব চিন্তা চেতনাকে আপ্লুত করার ফলে। পরবর্তীতে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কর্মে। নিজেকে উপলব্ধি করা ও নিজের সত্তার মাঝে আল্লাহ্‌র উপস্থিতি অনুভব করার এক অনন্য পদ্ধতি হচ্ছে কোরাণ তেলাওয়াত। জীবনে এ এক পরম ও চরম পাওয়া। যদিও আল্লাহ্‌র উপস্থিতি সর্বত্র বিদ্যমান , কিন্তু আমাদের কর্মফলে আমরা হৃদয়ের মাঝে তাঁকে অনুভব করতে পারি না। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র বাণী বা কোরাণের বক্তব্য উপলব্ধির মাধ্যমে হৃদয়ের এই বন্ধ্যাত্ব দূর হয়।

৪৬। এবং কিতাব প্রাপ্তদের সাথে উত্তম পন্থা ব্যতীত তোমরা [ অযথা ] বির্তকে লিপ্ত হবে না ৩৪৭২। তবে তাদের সাথে করতে পার যারা সীমালংঘন করে ৩৪৭৩। বরং বল, " আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি। তোমাদের উপাস্য ও আমাদের উপাস্য একই ; এবং তারই নিকট আমরা আত্মসমর্পন করছি [ ইসলামে ] ৩৪৭৪। "

৩৪৭২। র্তকের খাতিরে র্তক করা অর্থহীন। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে কিতাবীদের সাথে অর্থাৎ পূর্বে যারা আল্লাহ্‌র কিতাব প্রাপ্ত হয়েছে ; তাদের সাথে মুসলমানদের বিশ্বাসের বা ঈমানের ব্যাপারে সার্বজনীন ভিত্তি আছে। যার কথা এই আয়াতের শেষে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতারাং তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে কোনও বির্তক উত্তম পন্থা ব্যতীত করা উচিত নয়। উত্তম পন্থা অর্থাৎ সুসভ্য , মার্জিত , ভদ্র , সংবেদশীল ও আন্তরিক ভাবে বোঝাতে হবে। তাদের বক্তব্যে যেনো অপরের মঙ্গলের জন্য চিন্তা, সত্যের প্রকাশকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় , নিজের জ্ঞানের জাহির করা বা আত্মপ্রচার বা নিজের কোন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তা করা উচিত নয়।

৩৪৭৩। সীমালঙ্ঘনকারী বা যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে প্রতিহত করে, এবং অন্যের দুঃখ দুর্দ্দশার কারণ হয়। এদের কথা বলা হয়েছে যে এদের কঠোর ভাবে দমন করার প্রয়োজন আছে। কারণ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এরা বিশ্বাসীদের সাথে একই সমতলে অবস্থান করে না। বিশ্বাসীরা [ কিতাবী জাতিরা ] সকলেই কতকগুলি সাধারণ সত্যে বিশ্বাসী। কিন্তু সীমালঙ্ঘনকারীর আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান নাই দেখেই তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সীমাকে লঙ্ঘন করে ও অপরের দুঃখ দুর্দ্দশার কারণ হয়। সুতারাং তাদের জন্য কোনও সার্বজনীন সত্য নাই , যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধৈর্য্য , সংযত ও সংবেদনশীল হতে হবে। এদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ,যতক্ষণ না তারা অপরের ক্ষতি থেকে বিরত হয়।

৩৪৭৪। এই আয়াতটিতে ইসলাম ধর্মের মর্মার্থের বর্ণনা দেয়া হয়েছে , সমস্ত কিতাবধারীদের ইলাহ্‌ এক আল্লাহ্‌। খৃষ্টানরা তাঁকে গড্‌ বলে ডাকে, ইহুদীরা ডাকে জহুবা বলে। কিন্তু সেতো শুধু ভাষার পার্থক্য। আল্লাহ্‌ বা গড্‌ বা জহুবা যাই বলা হোক না কেন তিনি হচ্ছেন সর্বশক্তিমান, সারা পৃথিবীর মালিক , স্রষ্টা ও প্রতিপালক এবং সকল সৃষ্ট জীবের একমাত্র উপাস্য। সকল সৃষ্ট জীব তাঁর ইচ্ছার বা আইনের কাছে আত্মসমর্পন করবে। স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের অপর নাম ইসলাম। যারা তা করে তারাই মুসলমান।

৪৭। এবং এভাবেই ৩৪৭৫ আমি তোমার নিকট কিতাব অবতীর্ণ করেছি। অতএব কিতাব প্রাপ্ত সম্প্রদায় তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে ৩৪৭৬, এবং এদেরও [ মুশরিক আরবেরা ] কেউ কেউ আছে যারা এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ৩৪৭৭। এবং অবিশ্বাসীরা ব্যতীত কেহই আমার নিদর্শন প্রত্যাখান করে না।

৩৪৭৫। উপরে ইসলামের মর্মার্থের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে এই মূলনীতির উপরে ভিত্তি করে যুগে যুগে প্রত্যাদেশ আল্লাহ্‌র নিকট থেকে আগত। আল্লাহ্‌ এক এবং অদ্বিতীয়। সুতারাং স্থান ভেদে এবং সময়ের পরিবর্তনে এক আল্লাহ্‌র বাণী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাসুলের নিকট প্রেরিত হতে পারে , কিন্তু তার মূলনীতির কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্‌ এক জনই এবং তিনি স্থান, কাল ও পাত্রের উর্দ্ধে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়,তা যুগের দাবীর সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে যুগের প্রয়োজনে যুগোপযোগী করা হয়েছে মাত্র।

৩৪৭৬। ধর্মপ্রাণ ইহুদী এবং খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা থেকে রসুলকে [ সা ] এবং তাঁর প্রচারিত ধর্মকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলো। সেই প্রেক্ষিতে কোন কোন ইহুদী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমানে রূপান্তরিত হয়। সূরা [ ২৬ : ১৯৭ ] আয়াতে এবং টিকা ৩২২৭ এ এদের বর্ণনা আছে। খৃষ্টানদের মধ্যেও ইসলামের বাণী প্রসার লাভ করতে থাকে। রাসুল [সা ] ৬ষ্ঠ বা ৭ম হিজরীতে আরবের চর্তুদ্দিকে প্রধান প্রধান দেশগুলিতে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেনঃ যেমন বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে [ কনস্‌টান্টিনেপ্‌লস ] , পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানীতে[ মাদাইন] , সাসানিয়ানের [Sasanian] রাজধানীতে, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব গ্রীক নাম টেসিফোন [Ctesi phone] নামে চেনে, [ এর অবস্থান বর্তমান বাগদাদের ত্রিশ মাইল দক্ষিণে ] , সিরিয়া , আবেসিনিয়া, এবং মিশর দেশ। পারস্য ব্যতীত অন্য সকল দেশই ছিলো খৃষ্টান ধর্মালম্বী। একই সময়ে আরবের ইয়ামামাতে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করা হয়; যেখানে খৃষ্টধর্মালম্বী বানু হানিফা গোত্র বসবাস করতো। ইয়ামামার অবস্থান হিজাজের পূর্বে। আবেসিনিয়া ব্যতীত অন্য সমস্ত দেশই শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করে। আবেসিনিয়াতে বর্তমানে বহু মুসলমান বাস করে। সাধারণ ভাবে এ কথা সত্য যে, ৭ম হিজরীতে খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশসমূহ সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। খৃষ্টানদের মাঝে অল্প কিছু যারা ইসলাম গ্রহণে বিরত থাকে তারা নূতন দেশে তাদের কার্যকলাপ বিস্তৃত করে। রোমান ক্যাথলিক চার্চ উত্তরের [Germanic] প্যাগানদের ধর্মান্তরিত করে। বাইজেনটাইন চার্চ পূর্বের [Slavonic] প্যাগানদের ধর্মান্তরিত করে। ১৬শ শতাব্দীতে প্রোটেস্টান চার্চ খৃষ্টান ধর্মকে নূতন ভাবে সংস্কার করে যার সাথে ইসলামের রীতিনীতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন , পৌরহিত্য প্রথার বিলোপ সাধন, ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব , ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা হ্রাসকরণ, জীবনের প্রাত্যহিক কর্তব্য কর্মকে সহজ রূপে রূপান্তরিত করার উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

৩৪৭৭। আরব প্যাগান বা মুশরেকরা ধীরে ধীরে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়। কেউ কেউ বলতে আরব মুশরেকদের বোঝানো হয়েছে।

৪৮। এবং [ এই কিতাবের ] পূর্বে তুমি তো কোন কিতাব পড়তে [ সক্ষম ছিলে না ]। তোমার ডান হাত দ্বারা ইহা নকল করতেও [ সক্ষম ] নও ৩৪৭৮। সেক্ষেত্রেও মিথ্যুক দাম্ভিকেরা [ এতে ] সন্দেহ পোষণ করছে।

৩৪৭৮। নবী করিম ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন। কোরাণ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে, তিনি কখনও আল্লাহ্‌র তরফ থেকে প্রত্যাদেশ পাওয়ার দাবী করেন নাই। তিনি কখনও কোনও সত্য প্রচার করেন নাই। এ অভ্যেস তাঁর কোনও দিনও ছিলো না। তিনি লেখাপড়া জানতেন না। সুতারাং নিজ হাতে কিছু লেখার প্রশ্নই আসে না। যদি তিনি লেখাপড়া জানতেন তবে হট্‌কারী ব্যক্তিরা এ কথা দাবী করতো যে তিনি কোন প্রত্যাদেশ লাভ করেন নাই ; তিনি যা প্রচার করছেন তা কোন বই থেকে সংগ্রহ করা। অথবা তিনি স্বহস্তে কোরাণের সুন্দর আয়াতগুলি রচয়িতা এবং তিনি তা স্মৃতিতে ধরে রেখে প্রচার করে থাকেন। কিন্তু উম্মী নবীর [ সা ] পক্ষে এর কোনটাই সম্ভব নয়। সুতারাং উম্মী নবীর [ সা ] কাছে কোরাণের মত গ্রন্থ অবতীর্ণ হওয়াই হচ্ছে, আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের শ্রেষ্ঠ জ্বলন্ত মোজেজা।

৪৯। কিন্তু যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে , তাদের অন্তরে উহা উজ্জ্বল নিদর্শন স্বরূপ রয়েছে ৩৪৭৯। অন্যায়কারীরা ব্যতীত আর কেহ আমার নিদর্শন প্রত্যাখান করে না ৩৪৮০।

৩৪৭৯। 'Ilm' বা জ্ঞান। এই জ্ঞানের অর্থ পাঠ্য বইয়ের জ্ঞান নয়। পাঠ্যবই এর জ্ঞান হচ্ছে অর্থকরী বিদ্যা। অপরপক্ষে এ জ্ঞান হচ্ছে দিব্যজ্ঞান যার সাহায্যে ব্যক্তি প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। অবশ্য যারা এই দিব্যজ্ঞানের অধিকারী তারা পার্থিব ও আধ্যাত্মিক সকল ব্যাপারেই অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে থাকেন। তারা অপরের সাহায্য ব্যতীতই আল্লাহ্‌র নিদর্শন ও প্রত্যাদেশ উপলব্ধি করতে সক্ষম। তারা তাদের হৃদয়,মন ও উপলব্ধির উপরে এই দায়িত্ব অর্পন করে থাকেন, বাইরের কোনও সাহায্যই তাদের প্রয়োজন হয় না। কারণ স্বয়ং আল্লাহ্‌ তাদের সেই জ্ঞান দানে ধন্য করেন। 'Sadr' অর্থাৎ বুক যার দ্বারা বোঝানো হয়েছে অন্তঃকরণ বা হৃদয় ও মন।

৩৪৮০। [২৯ : ৪৭ ] আয়াতের শেষাংশ দেখুন। সেখানে বলা হয়েছে যে, কাফেররা আল্লাহ্‌র নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করবে। এই আয়াতে আর এক ধাপ অগ্রসর হয়ে বলা হয়েছে যে, যারা জালিম বা অন্যায়কারী ও অত্যাচারী তারা আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে ইচ্ছাকৃত ভাবে অস্বীকার করবে। যে কোন সৎ মানুষকে আল্লাহ্‌র যে নিদর্শন দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করবে, জালেম ব্যক্তি তা গ্রহণে অস্বীকার করবে। আমাদের চারিপাশে এর বহু উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।

৫০। তবুও তারা বলে, " তাঁর প্রভুর নিকট থেকে কেন তাঁর নিকট নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করা হয় না ? " বল, " নিদর্শন সমূহ আল্লাহ্‌র অধীনে। আমি তো একজন প্রকাশ্য সর্তককারী মাত্র। " ৩৪৮১

৩৪৮১। পূর্বের টিকা দেখুন। পূর্বের আয়াতে [২৯ : ৪৯ ] বলা হয়েছে যে, কোরাণ নিজেই হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রেরিত অত্যাচার্য নিদর্শন। যারা নিজ আত্মাকে পাপমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে , কোরাণের বাণী তাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস উৎপন্ন করে। এটাও আল্লাহ্‌র কুদরত বা অলৌকিক নিদর্শন। এসব দর্শনেও অবিশ্বাসীদের মনে কোনও রেখাপাত করে না। তারা তাদের নির্বোধ মনের মনগড়া অলৌকিক কর্মকান্ড দর্শনে আগ্রহী। অবশ্যই আল্লাহ্‌ তাদের খেয়াল খুশী চরিতার্থ করতে সক্ষম। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাদের নির্বুদ্ধিতায় ব্যঙ্গ কৌতুক করতে চান না কারণ আল্লাহ্‌ জানেন যে তারা যে দাবী করে তা তাদের বিশ্বাস বা ঈমানের পূর্বশর্ত নয়, তা হচ্ছে তাদের কপটতা বা ভান মাত্র। আল্লাহ্‌ তার রাসুল প্রেরণ করেছেন তাঁর নিদর্শন সমূহ পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য এবং আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্যকারীদের পরিণতি সম্বন্ধে সাবধান করার জন্য। এটাই কি যথেষ্ট নয় ?

৫১। এবং তাদের জন্য এটাই কি যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব প্রেরণ করেছি, যা তাদের নিকট পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে তাদের জন্য যারা, বিশ্বাস করে ৩৪৮২।

৩৪৮২। আল্‌-কোরাণ হচ্ছে প্রাঞ্জল কিতাব ; যার বাণী সমূহ আল্লাহ্‌র রাসুল পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই কিতাব ও বিশ্ব চরাচরে আল্লাহ্‌র যে অনুগ্রহ ছড়ানো আছে, যারা মুমিন তাদের মনে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদনের জন্য তাই-ই যথেষ্ট। আকাশ , বাতাস, বিশ্বচরাচরের সকল প্রাণ তারই অনুগ্রহের ফল। এর পরেও যারা অন্য কোন অলৌকিক নিদর্শনের অন্বেষণ করে , তারা নিজ আত্মার নিকট অবিশ্বস্ত এবং তারা অহমিকা প্রদর্শনের জন্যই তা করে থাকে। আরও দেখুন [ ৬ : ১২৪ ] আয়াত এবং টিকা ৯৪৬।

রুকু - ৬

৫২। বল, " আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে তা তিনি অবগত ৩৪৮৩। যারা অহংকারে বিশ্বাসী এবং আল্লাহ্‌কে প্রত্যাখান করে এরাই তারা যারা [ শেষ পর্যন্ত ] ধ্বংস হয়ে যাবে ৩৪৮৪। "

৩৪৮৩। কোরাণ যে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে, রাসুলের [ সা ] জীবন ও তাঁর শিক্ষা। কোন প্রতারণা বা মিথ্যা আল্লাহ্‌র দুনিয়াতে শেষ পর্যন্ত স্থায়িত্ব লাভ করবে না। এই-ই আল্লাহ্‌র বিধান। কারণ আকাশ ও পৃথিবীতে যা ঘটে, মানুষের মনের অভ্যন্তরের চিন্তা -ভাবনা সবই তিনি জ্ঞাত আছেন। প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য কিছুই তাঁর অগোচরে থাকে না।

৩৪৮৪। পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র বিধান হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মিথ্যা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু যারা সত্যকে প্রতিহত করে এর দ্বারা সত্যের প্রচার বা প্রসারে কোনও ক্ষতি হয় না। ক্ষতি হয় যারা সত্যকে প্রতিহত করে , কারণ তাদের শেষ পরিণতি ধ্বংস।

৫৩। তারা তোমাকে [তাদের জন্য ] শাস্তিকে ত্বরাণ্বিত করতে বলে যদি নির্ধারিত কাল [ অবকাশ ] না থাকতো , তবে ৩৪৮৫ শাস্তি তাদের উপরে অবশ্যই আসতো। তারা কিছু উপলব্ধি করার আগেই , উহাদের উপরে আকস্মিক ভাবে অবশ্যই শাস্তি এসে পড়বে।

৩৪৮৫। দেখুন আয়াত [ ২২ : ৪৭ ] এবং টিকা ২৮২৬। অবিশ্বাসীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে আল্লাহকে প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করে যে, " যদি পার তবে আল্লাহ্‌র শাস্তিকে ত্বরান্বিত কর, আমরা দেখি।" কিন্তু এসব মূর্খদের প্রতিদ্বন্দিতায় আল্লাহ্‌ তাঁর পরিকল্পনার পরিবর্তন করতে পারেন না। পৃথিবী সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে আল্লাহ্‌র সমস্ত সৃষ্টি এক নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি ধাবিত হচ্ছে। আল্লাহ্‌র এই পরিকল্পনায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক "নির্ধারিত কাল" মঞ্জুর করা হয়েছে। অবিশ্বাসীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে আল্লাহ্‌ তাঁর পরিবর্তন করেন না। বরং এটা তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ যে, তিনি পাপীদের অবকাশ দেন, অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের। যদি তারা অনুতপ্ত হয়ে আত্ম সংশোধন না করে , তবে তাদের শেষ পরিণতি হবে ধ্বংস। তাদের উপরে আপতিত এই শাস্তি আসবে, 'হঠাৎ করে' , তারা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই। সে সময়ে আর অনুতাপ করার সময় থাকবে না।

৫৪। তারা তোমাকে শাস্তিকে ত্বরান্বিত করতে বলে ৩৪৮৬। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে জাহান্নাম তো কাফেরদের পরিবেষ্টন করবেই।

৩৪৮৬। পাপী ও মন্দদের আল্লাহ্‌র প্রতি নির্ভিক ও দুঃসাহসিক প্রতিদ্বন্দীতার উত্তর দেয়া হয়েছে পূর্বের আয়াতে। সেখানে শাস্তির ঊল্লেখের সাথে বলা হয়েছে করুণাময় আল্লাহ্‌র পাপীদের অনুতাপের সুযোগ ও সময় দানের কথা। এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে পাপীরা যদি অবকাশের সদ্ব্যবহার না করে, যদি অনুতাপের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন না করে, তবে তাদের জন্য শাস্তি অবশ্যম্ভাবী এবং সে শাস্তি তাদের চতুর্দ্দিক থেকে ঘিরে ধরবে।

৫৫। সেই দিন শাস্তি তাদের আচ্ছন্ন করবে তাদের উর্দ্ধ ও অধঃদেশ থেকে ৩৪৮৭ ; এবং [ একটি কণ্ঠস্বর ] বলবে; " তোমাদের কাজের [ প্রতিফল ] আস্বাদন কর ৩৪৮৮। "

৩৪৮৭। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৬ : ৬৫ ]।

৩৪৮৮। নিউটনের সূত্র অনুযায়ী "Every action there is an equal and opposite reaction"। এ কথা শুধু যে পদার্থ বিদ্যায় জড় পর্দাথের বেলাতে প্রযোজ্য তাই নয় , এ কথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এমনকি আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিও তা প্রযোজ্য। সুতারাং এই আয়াতে " তোমাদের কাজের প্রতিফল আস্বাদন কর " বাক্যটি কোনও তীব্র ভৎর্সনা নয়, পাপীদের কর্মফলের উল্লেখ করা হয়েছে। পাপ কাজ তাদের আত্মার স্বচ্ছতাকে ঢেকে দেয় - আত্মা পাপের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। সুতারাং আত্মার অন্ধত্ব তাদেরই কর্মফল বই আর কিছু নয়। এ ব্যাপারে তারা আর কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না। দয়াময় আল্লাহ্‌ তাদের বারে বারে সুযোগ দান করেছেন , কিন্তু তারা তা গ্রহণ করে নাই, সুতারাং আল্লাহ্‌র ন্যায় বিচার বা আইন এখন প্রযোজ্য হবেই।

৫৬। হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ ! সত্যই আমার পৃথিবী প্রশস্ত ৩৪৮৯। সুতারাং তোমরা [ কেবলমাত্র ] আমারই এবাদত কর।

৩৪৮৯। যখন কোন সমাজ পাপে আসক্ত হয় এবং পাপের পঙ্কে পুরো সমাজ ডুবে যায় , অন্যায়, অবিচারে সারাটা দেশ ভরে যায়, সে অবস্থায় একজন মোমেন বান্দার কি করা কর্তব্য সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে এখানে। এ কথা বা ওজর আল্লাহ্‌র নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না যে, মন্দ পরিবেশের কারণে বা যে যুগে সে বাস করেছে সেই যুগের প্রভাব তার পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব ছিলো না। যা মন্দ ,যা পাপ তা সব সময়ে সর্ব অবস্থাতেই পরিহার করতে হবে, এবং ভালো এবং পূণ্যের অন্বেষণ করতে হবে। কেউ যদি তা করতে চায় তবে তার জন্য আল্লাহ্‌র দুনিয়া অত্যন্ত প্রশস্ত। যদি কারও ইচ্ছা , ধৈর্য , একাগ্রতা ও অধ্যাবসায় থাকে তবে অবশ্যই যে কোনও পরিবেশে যে কোনও স্থানে ও সময়ে তার পক্ষে পাপকে ও মন্দকে পরিহার করা সম্ভব। হয়তো পাপকে পরিহার করার জন্য আমাদের স্থান পরিবর্তন [ হিজরত ] করতে হবে : নিজস্ব গ্রাম বা শহর বা দেশ। আবার এমনও ঘটতে পারে যে, প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধব, অথবা আমাদের বদভ্যাস বা সমাজে আমাদের অবস্থান অথবা সমাজে আমাদের আদান-প্রদানের অভ্যাস ইত্যাদি পরিবর্তনের [ এও একধরণের হিজরত ] মাধ্যমেও আমরা পাপের পথকে পরিহার করতে পারি। যদি প্রয়োজন হয় ধর্মের জন্য, নিজের ঈমানকে সুসংহত সঠিক পথে রাখার জন্য নিজ জন্মভূমি ত্যাগ [ হিজরত ] করার নির্দ্দেশও আছে, যে ভাবে আমাদের প্রিয় নবী [সা ] করেছিলেন। আল্লাহ্‌ আমাদের প্রত্যেককে তাঁর নেয়ামতের কিছু না কিছু দ্বারা ধন্য করেছেন, যেনো আমরা তাঁর বিধান অনুযায়ী সঠিক পথে জীবনকে পরিচালিত করতে পারি। যদি আমরা তা না পারি তবে তা আমাদেরই অক্ষমতা।

৫৭। প্রতিটি আত্মাই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে ৩৪৯০। সবশেষে তোমাদের আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে।

৩৪৯০। দেখুন [ ৩ : ১৮৫ ] আয়াত ও টিকা ৪৯১ এবং আয়াত [ ২১ : ৩৫ ] ও টিকা ২৬৯৭। আত্মা অমর, সে পরমাত্মার অংশ। এই নশ্বর দেহের খাঁচায় তা আবদ্ধ করে এই পৃথিবীতে আমাদের প্রেরণ করা হয়, এক নির্দ্দিষ্ট সময় অতিক্রম করার জন্য। সেই সময় শেষে এই দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং দেহ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই হচ্ছে মৃত্যুর সংজ্ঞা - যে কারণে বলা হয়েছে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, মৃত্যু নয়। অর্থাৎ দৈহিক মৃত্যুর স্বাদ অমর আত্মা লাভ করবে। মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মাসমূহ আল্লাহ্‌র কাছে নীত হবে। উপরের টিকাতে যে বিভিন্ন রকম হিজরতের কথা বলা হয়েছে : দৈহিক বা আধ্যাত্মিক , সে ভাবে বিচার করলে মৃত্যুও এক ধরণের হিজরত বৈকি। এই চেনা পৃথিবী ত্যাগ করে আত্মা অন্য ভূবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মৃত্যু অর্থ যদি তাই-ই হয়, তবে পূণ্যাত্মাদের ভয় কিসের ?

৫৮। কিন্তু যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে ,তাদের আমি বেহেশতে বাসস্থান দিব, ৩৪৯১, [ যা হবে ] সুউচ্চ প্রাসাদ যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত - যেখানে তারা চিরদিন থাকবে। যারা [ ভালো ] কাজ করে তাদের জন্য উত্তম পুরষ্কার -

৫৯। যারা [ বিপদে ] ধৈর্য্যের সাথে অধ্যবসায়ী হয় এবং তাদের প্রভু এবং প্রতিপালকের উপরে তাদের আস্থা স্থাপন করে।

৩৪৯১। পরলোকে সুন্দর প্রাসাদের কথা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়ছে আয়াত [ ১৬ : ৪১ ]। সেখানে বলা হয়েছে পরলোকের প্রাসাদ উত্তম হবে যা মানুষের কল্পনারও বাইরে। এখানে প্রাসাদ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাসাদ শব্দটি বেহেশতের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। বেহেশত্‌ হবে ছবির মত মনোরম স্থান। যার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং মৃদু স্বরে কুলুকুলু ধ্বনি সহযোগে প্রবাহিত ছোট নদী এক মহিমান্বিত অত্যুচ্চ দৃশ্যের অবতারণা করবে। আর সেখানে আত্মার অবস্থান হবে অনন্তকালের জন্য।

৬০। কত রকম প্রাণী [ পৃথিবীতে ] রয়েছে যারা তাদের জীবনোপকরণ [ জমা করে ] রাখে না ৩৪৯২ আল্লাহ্‌ই তাদের এবং তোমাদের [ উভয়কেই ] আহার দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি [ সব কিছু ] শোনেন এবং জানেন।

৩৪৯২। বিহঙ্গকূল যখন প্রভাতে তাদের নীড় ত্যাগ করে আকাশে ডানা মেলে ,সে জানে না তার খাদ্য কোথায় সঞ্চিত আছে। কিন্তু দিন শেষে সে যখন তার নীড়ে ফেরে , তার উদর থাকে পরিপূর্ণ এবং সে থাকে তৃপ্ত। এ কথা আল্লাহ্‌র সৃষ্ট সকল প্রাণীর জন্য প্রযোজ্য। এমন অনেক প্রাণী আছে যারা প্রকৃত পক্ষেই অসহায় এবং শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত ; তবুও তারা পৃথিবী থেকে খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। আল্লাহ্‌ তাদের রক্ষা করার জন্য প্রকৃতির বুকে নানা কৌশলের সৃষ্টি করে রেখেছেন। একটু চিন্তা করলে দেখা যায় মানব শিশু পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় জন্ম লাভ করে। পূর্ণ বয়স্ক হতে মানব শিশুর অন্তঃত পক্ষে প্রায় বিশ বৎসর প্রয়োজন হয়। এই সুদীর্ঘকাল তার প্রতিপালনের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। কি সুকৌশলে স্রষ্টা বিবাহের মাধ্যমে স্নেহশীল পিতামাতার গৃহে মানব শিশুকে প্রতিপালন করেন। এ কথাটিই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ভাবে লিখেছেন,

" পিতার বক্ষে রেখেছ মোরে,
জনম দিয়েছ জননী ক্রোড়ে,
বেধেছ সখার প্রণয়ডোরে
তুমি ধন্য ধন্য হে।
তোমার গৃহে পালিছ স্নেহে
তুমি ধন্য ধন্য হে। "

সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ বিশ্বচরাচরের সকল প্রাণীর আহার বাসস্থানের ও নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত করে থাকেন। আল্লাহ্‌ সকলের প্রার্থনা শোনেন, সকলের মনের ইচ্ছা পূরণ করেন, তিনি সকলের প্রয়োজন জানেন এবং তিনি জানেন কি কৌশলে তাদের এই প্রয়োজন মেটাতে হবে।

সুতারাং এত বিরাট বিশাল মহান যে রক্ষাকর্তা তাঁর অধীনে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পন করে আল্লাহ্‌র রাস্তায় কাজ করার জন্য নিগৃহীত হতে বা স্বদেশ জন্মভূমি ত্যাগ করে হিজরত করতে ভয় কিসের ? তিনি তো সর্বশ্রোতা , সর্বজ্ঞ।

৬১। যদি তুমি তাদের জিজ্ঞাসা কর, ৩৪৯৩ " কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং সূর্য এবং চন্দ্রকে [ তাঁর আইনের ] অধীন করেছেন ?" ৩৪৯৪ তারা অবশ্যই উত্তর দেবে , " আল্লাহ্‌ "। তাহলে কিভাবে তারা [ সত্য থেকে ] প্রতারিত হচ্ছে ?

৩৪৯৩। অনুরূপ আয়াত দেখুন [ ২৩ : ৮৪ - ৮৯ ]। এই উভয় সূরার আয়াতে 'তাদের দ্বারা সেই সব লোককে বোঝানো হয়েছে যারা অসঙ্গত ও আত্মবিরোধী। এরা সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ্‌ ক্ষমতা অনুভব করে সত্য , কিন্তু এদের আল্লাহ্‌র আইন অমান্য করার প্রবণতা ও আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে অশ্রদ্ধা করার প্রবণতা থাকে, মিথ্যার প্রতি আসক্তির ফলে। মিথ্যার মত খারাপ রীপু আর নাই।

৩৪৯৪। দেখুন আয়াত [ ১৩ : ২ ] এবং [ ২৩ : ৮৫ ] আয়াত সমূহ। নভোমন্ডল ও বিশ্বভূবন আল্লাহ্‌র আইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে। সূর্য পূর্বে ওঠে পশ্চিমে ডোবে। বছরের নির্দ্দিষ্ট সময়ে নির্দ্দিষ্ট ঋতুর পরিবর্তন ঘটে। এরূপ হাজার হাজার উদাহরণ প্রকৃতিতে আছে যা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত আইন বিশ্ব প্রকৃতি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অক্ষরে অক্ষরে নির্দ্দিষ্টভাবে মেনে আসছে। মানুষকেও আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন তার বিধানকে মেনে জীবন অতিবাহিত করার জন্য। আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনের মাধ্যমেই মানুষ পারে বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে শান্তি ও শৃঙ্খলার সাথে সমন্বিত হতে। তাহলেই সে আশা করতে পারে তার আত্মিক সমৃদ্ধি।

৬২। আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা জীবনোপকরণ বৃদ্ধি করে দেন ৩৪৯৫। [ অনুরূপ ভাবে ] যার জন্য ইচ্ছা উহা সীমিত করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন।

৩৪৯৫। দেখুন [ ১৩ : ২৬ ]। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ আল্লাহ্‌ সকলকে সমভাবে বন্টন করেন না। মানব সভ্যতাকে নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে আল্লাহ্‌ প্রতিভাধর ব্যক্তিদের পৃথিবীতে প্রেরণ করে থাকেন যারা আল্লাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহ প্রাপ্ত। এ সবই আল্লাহ্‌র বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। সুতারাং অসম বণ্টন মানেই বিশৃঙ্খলা বা অন্যায় নয়। সৃষ্টি জগতের পরিচালনার জন্য , বিশ্ব প্রকৃতিতে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যেখানে যা প্রয়োজন আল্লাহ্‌ সেভাবেই তার নেয়ামত বিশ্ব প্রকৃতিতে বণ্টন করে থাকেন।

৬৩। এবং যদি তুমি তাদের জিজ্ঞাসা কর ৩৪৯৬ আকাশ থেকে কে বৃষ্টি প্রেরণ করে মৃত পৃথিবীকে তা দ্বারা জীবন দান করেন ? তারা নিশ্চয়ই উত্তর দেবে, " আল্লাহ্‌ "। বল, "সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌রই।" কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা উপলব্ধি করে না।

৩৪৯৬। আয়াত [ ২৯ : ৬১ ] এ একদল লোকের কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহ্‌র " ক্ষমতা " উপলব্ধি করে, কিন্তু তার পরেও মিথ্যা ধারণা ও মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে থাকে। এই আয়াতে অন্য আর একদল লোকের কথা বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ্‌র "মহত্ব ও মঙ্গলময় ইচ্ছাকে " উপলব্ধি করে। প্রকৃতিতে বৃষ্টির মত জীবন রক্ষাকারী আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে তারা সনাক্ত করতে পারে , দিনের পরিবর্তনে, ঋতু চক্রের আবর্তনে প্রকৃতি বিভিন্ন ভাবে আল্লাহ্‌র মঙ্গল ইচ্ছার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, মৃত মাটি, মৃত প্রকৃতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে পুণরায় জীবন্তরূপ ধারণ করে। সুতারাং আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে পার্থিব বস্তু যেরূপ পূণর্জীবিত হয়, ঠিক সেরূপ আধ্যাত্মিক জগতও পুণর্জীবিত হয়। এই দল লোক এত কিছু উপলব্ধি করার পরও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম হয়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টি , সূর্য ও চন্দ্র , উদ্ভিদ উৎপন্ন করার সমস্ত কাজ যে, আল্লাহ্‌র নিয়ন্ত্রণাধীন একথা স্বীকার করার পরও তারা শেরেক করে। ফলে তারা তাদের জীবনকে সত্য ও সুন্দর পথে পরিচালিত করতে পারে না। সুতারাং যখন পৃথিবীর এই ক্ষণকালের শিক্ষানবীশকাল অতিক্রান্ত হয়ে যায়, মৃত্যুর মাধ্যমে পৃথিবীর জীবন শেষ করে অনন্ত জীবনে প্রবেশ করে তখন সে সুন্দর ভবিষ্যতের আকাঙ্খা করতে পারে না। তারা বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ , আল্লাহ্‌র সর্বময় ক্ষমতাকে উপলব্ধি করার পরও দুঃখের বিষয় , চূড়ান্ত সময়ে তারা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে নাই। তাদের উচিত ছিলো এসব উপলব্ধির মাধ্যমে , সেই সর্বশক্তিমানের প্রশংসা করা এবং তার কাছে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে তাঁর অনুগ্রহ লাভে আত্মাকে সমৃদ্ধ ও আলোকিত করা। কিন্তু আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের জন্য তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে তারা তা অনুধাবন করে না। কারণ পার্থিব জীবনের বৈষয়িক চিন্তা ভাবনা , ধ্বংসশীল কামনা-বাসনা তাদেরকে পরকালের চিন্তা থেকে অন্ধ করে রাখে।

রুকু - ৭

৬৪। ক্রীড়া -কৌতুক ব্যতীত এই পার্থিব জীবনে আর কি আছে ? কিন্তু প্রকৃত জীবন হচ্ছে পারলৌকিক জীবন - যদি তারা তা বুঝতে পারতো ৩৪৯৭।

৩৪৯৭। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৩২ ]। খেলাধূলা ও আনন্দকে উপভোগ করার প্রয়োজন গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে। কারণ তাতে লোকের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পার্থিব জীবনকে ক্রীড়া কৌতুকের জীবন বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, ক্রীড়া কৌতুকের যেমন কোনও স্থিতি নাই এবং এর দ্বারা কোন বড় সমস্যার সমাধান হয় না, অল্পক্ষণ পরেই শেষ হয়ে যায়, পার্থিব জীবনের অবস্থাও তদ্রূপ। পৃথিবীর জীবন আমাদের জন্য নাটকের দুই অঙ্কের মধ্যবর্তীকালের অভিনীত ক্ষুদ্র নাটক স্বরূপ। পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেও আমাদের আত্মার অস্তিত্ব ছিলো আল্লাহ্‌র কাছে। মৃত্যুর পরও আমরা আবার তাঁরই কাছে নীত হবো। শুধু মধ্যবর্তী এই পৃথিবীর জীবনকে করে দেয়া হয়েছে শিক্ষানবীশ কাল স্বরূপ , পরকালের জন্য। পরকালের জীবন হচ্ছে অনন্ত জীবন, প্রকৃত জীবন ও স্থায়ী জীবন, আর পৃথিবীর জীবন হচ্ছে এই জীবনের জন্য প্রস্তুতি স্বরূপ। সুতারাং পার্থিব জীবনে সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ,যেগুলির গর্ব মানুষ সাধারণতঃ করে থাকে, সেগুলি যেনো আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না করে। পৃথিবীর জীবন যাপনের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধতা ও সমৃদ্ধি লাভই হচ্ছে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। কারণ পারলৌকিক জীবনে আত্মিক পবিত্রতা ও সমৃদ্ধিই একমাত্র বিচারের বিষয়বস্তু হবে। সুতারাং " পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নহে।"

৬৫। এখন, যদি তারা নৌযানে আরোহণ করে, তারা আল্লাহকে ডাকে একান্তভাবে [ শুধুমাত্র ] তার প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে ৩৪৯৮। কিন্তু যখন তিনি তাদের নিরাপদে [ শুকনো ] মাটিতে অবতরণ করান, দেখো তারা [তাদের আনুগত্যের ] অংশীদার করে ,-

৩৪৯৮। পূর্বের আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, পৃথিবীর এই জীবন ক্রীড়া কৌতুক বই আর কিছু নয়; এই জীবনের স্থায়ীত্ব খুবই স্বল্পকাল। স্থায়ী ও অনন্ত জীবন হচ্ছে পরকাল। যারা পরলোকের জীবনকে অনুভব করতে পারে না , এরূপ অদূরদর্শী নির্বোধ লোকদের বর্ণনা করা হয়েছে এই আয়াতে। পৃথিবীর জীবনে বহু বিপদ আপদের মধ্য দিয়ে স্রষ্টা আমাদের তাঁর কাছে টেনে নেন। এখানে উপমা হিসেবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে তুলে ধরা হয়েছে। যখন তারা গভীর সমুদ্রে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখন তারা সর্বান্তঃকরণে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ্‌ যখন তাদের নিরাপদে তীরে নিয়ে আসেন, তখন তারা আল্লাহ্‌র নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পরিবর্তে , নিজের বুদ্ধিমত্তা বা অন্য কিছুকে বিপদ উদ্ধারের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ও গর্ব প্রকাশ করে থাকে। এ ভাবেই তারা শিরক করে থাকে। এখানে নৌযানের নিরাপত্তাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অদূরদর্শী যারা, তারা বিপদে বিপর্যয়ে বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করে থাকে, কিন্তু বিপদ-বিপর্যয় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেই তারা প্রকৃত অবস্থা ভুলে যায়, এবং পৃথিবীর আমোদ-ফূর্তিতে নিমগ্ন হয়ে পড়ে , অস্থায়ী জীবনের বিষয়বস্তুর গর্ব তাদের স্থায়ী জীবনকে ভুলিয়ে দেয়।

৬৬। অকৃতজ্ঞ ভাবে আমার দানকে তারা অবজ্ঞা করে এবং [ পার্থিব ] ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে ৩৪৯৯। কিন্তু শীঘ্রই তারা জানতে পারবে।

৩৪৯৯। উপরের আয়াত সমূহে মানুষের অদূরদর্শীতা ও নিবুদ্ধিতা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া যারা আত্মার মাঝে অনুভবে অক্ষম হয় , তারাই এরূপ নির্বোধের ন্যায় ব্যবহার করে থাকে। এরূপ নির্বোধ লোকেরা পার্থিব আনন্দ-ফূর্তি এবং গর্ব অহংকারের মত্ত হয়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীর এই অনন্দ-ফূর্তি ও গর্ব অহংকারের জীবন একদিন শেষ হয়ে যাবে। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন মানুষকে প্রতারিত করে, এবং পরলোকের জীবনকে উপলব্ধি করতে বাধা দান করে থাকে। কিন্তু তাদের এই বিভ্রান্তি মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যাবে , কারণ তখন তারা পারলৌকিক জীবনকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

৬৭। তারা কি দেখে না যে, আমি [ হারামকে ] নিরাপদ স্থান করেছি, যেখানে তার চর্তুপাশ্বের লোকেরা নির্যাতন ভোগ করছে ৩৫০০। তারপরেও কি তারা অসার জিনিষে বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে প্রত্যাখান করবে?

৩৫০০। যারা নির্বোধ তারাই শুধুমাত্র পার্থিব চিন্তা -ভাবনায় নিজেকে ব্যপৃত রাখে, তাদের পক্ষে ইন্দ্রিয়াতীত কোনও কিছু অনুভব করা বা আত্মার মাঝে উপলব্ধি করা অসম্ভব ব্যাপার। এই সব নির্বোধ লোক , যারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পার্থিব জিনিষ ব্যতীত অন্য কিছুই অনুভব করতে পারে না, তাদের-কেই আল্লাহ্‌ সম্বোধন করেছেন। কাবা শরীফের চতুপার্শ্বস্থ নির্ধারিত সীমিত স্থানকে হারাম শরীফ বলা হয়। চারিত্রিক হতাশা, নিরাশা , আশাভঙ্গের বেদনার মাঝে 'হারাম' আল্লাহ্‌ সকলের জন্য জন্য নিরাপদ ও শান্তির স্থান করে দিয়েছেন। আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার কারণ ছিলো কোন কোনও মুশরিক এই অজুহাত পেশ করতো যে, তারা রসুলুল্লাহ্‌র [সা ] প্রচারিত ধর্মকে সত্য ধর্ম বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু প্রাণনাশের ভয়ে তা গ্রহণে অপারগ। কারণ সমগ্র আরব ইসলাম বিরোধী। এর জওয়াবে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে, হারাম শরীফকে তিনি আশ্রয়স্থল করে দিয়েছেন। মুমিন,কাফের নির্বিশেষে আরবের বাসিন্দারা সবাই হারামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে , এতে খুন-খারাপি হারাম মনে করে। বহিরাগত কেউ হারামে প্রবেশ করলে সে হত্যার কবল থেকে নিরাপদ হয়। প্রকৃত পক্ষে এই নিরাপদ স্থান থেকেই ইসলামের প্রসার ধীরে ধীরে শুরু হয় , যখন হিজরতের পূর্বে হারাম শরীফের চর্তুপাশ্বে বিধর্মী কোরেশদের অবস্থান ছিলো। ইসলামের প্রাথমিক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে বহু পূর্বে কিন্তু হারাম শরীফ অদ্যাবধি বিশ্ব মানবের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ স্থান, তার কারণ আল্লাহ্‌ একে নিরাপদ করেছেন।

৬৮। তার অপেক্ষা অধিক পাপ আর কে করে , যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করে অথবা সত্য তার নিকট পৌঁছানোর পর তা প্রত্যাখান করে ৩৫০১ ? যারা সত্যকে প্রত্যাখান করে তাদের আবাস কি জাহান্নাম নয় ?

৩৫০১। দেখুন [৬ :২১ ] আয়াত। জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, যারা আল্লাহ্‌র বিধানকে প্রত্যাখান করে, তারা হতভাগ্য। হতভাগ্য এ কারণে যে, আল্লাহ্‌র সত্যকে অস্বীকারের ফলে তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়। ফলে তাদের আত্মা অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে , তাদের মাঝে বিবেক, বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টির উদ্ভব ঘটে না। ফলে তাদের মন থেকে শান্তি অন্তর্হৃত হয়। কিন্তু যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে এবং মিথ্যা উপাস্য তৈরী করে উপাসনার জন্য, তাদের কি শাস্তি কল্পনা করা যায় যে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ থেকে স্থায়ী ভাবে বঞ্চিত হওয়া এবং দোযখের অধিবাসী হওয়া ব্যতীত ?

৬৯। যারা আমার [ কারণে ] সংগ্রাম করে ৩৫০২ - আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করবো ৩৫০৩। যারা ন্যায়বান আল্লাহ্‌ তাদের সাথে থাকেন।

৩৫০২। "যারা আমার [ কারণে ] সংগ্রাম করে " সফলতা-ই শেষ কথা নয়। মূল কথা হচ্ছে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে সংগ্রাম। যখন কেউ সর্বশক্তি দিয়ে, ধৈর্য্য , অধ্যাবসায় , দৃঢ়তা ও একাগ্রতার সাথে আল্লাহ্‌র সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম করে, সে সফলতা লাভ করুক বা না করুক তখন তার মাঝে এক অপূর্ব শক্তির উদ্ভব ঘটে। কারণ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ তখন তার উপরে বর্ষিত হতে থাকে, ফলে তার আত্মা স্বর্গীয় আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এর ফলে তার চরিত্রের সকল অপূর্ণতা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, সকল ত্রুটি বিচ্যুতি দূরীভূত হয়, নিজেকে সকল ক্ষুদ্রতা , দীনতা, হীনতার উর্দ্ধে স্থাপন করতে সক্ষম হয়। সিরাত-উল-মুস্তাকিম্‌ বা সরল পথের ঠিকানা তার নিকট হয় উদ্ভাসিত।

৩৫০৩। " আল্লাহ্‌র পথ " [Sirat-ul-Mustaqin] বা সরল পথ। অর্থাৎ পৃথিবীতে চলার যে পথ বা জীবন ধারণের যে বিধি ব্যবস্থা তা অত্যন্ত সহজ ও সরল। আমাদের নবী করিমের জীবন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু মানুষ সর্বদা সেই সহজ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে বিপথে চলে যায়। আমাদের নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে আত্মার অবস্থান, সৃষ্টির আদিতে যা থাকে পূত এবং পবিত্র। আত্মার মূল রূপ পূত পবিত্র, কিন্তু জাগতিক কলুষতা ধীরে ধীরে তা কালিমালিপ্ত করে থাকে। আল্লাহ্‌র পথে জীবন ধারণ আত্মার পবিত্রতাকে বজায় রাখে। বিভিন্ন উপায়ে আমরা আল্লাহ্‌র পথে ফিরে যেতে পারি। আর সে জন্য প্রয়োজন আল্লাহ্‌র দয়া ও অনুগ্রহ। বহু পথ তাদের সম্মুখে উন্মুক্ত থাকে আল্লাহ্‌র পথে পৌঁছানোর জন্য। কেউ যদি সবান্তঃকরণে আল্লাহ্‌র পথে যেতে চায় তবে তারা একাগ্রভাবে জেহাদের মানসিকতা নিয়ে তাদের সমস্ত মন প্রাণ এবং সম্পদ দিয়ে ন্যায়ের পথে চেষ্টা করে যাবে। তাহলেই তারা পৃথিবীর মায়া জাল, যাকে আল্লাহ্‌ উর্ণনাভের সাথে তুলনা করেছেন তা ছিন্ন করতে সক্ষম হবে। কারণ পার্থিব মায়াজাল মাকড়সার জালের মতই ভঙ্গুর ও নশ্বর। যদি কেউ আল্লাহ্‌র পথে চলার ক্ষমতা লাভ করে তবে তাঁর জীবন সার্থক। সে লাভ করবে পরম শান্তি এবং সে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।