সূরা আল-ইমরান
সূরা আল-ইমরান বা ইমরানের পরিবার - ৩
আয়াত ২০০, রুকু ২০, মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে]
ভূমিকাঃ এই সূরাটি বাকারার সমগোত্রীয়। কিন্তু এখানে বিষয়বস্তুকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সুরাতে বদরের যুদ্ধ, রমজান মাস এবং ২য় হিজরী ও ওহুদের যুদ্ধ সওয়ালের মাস ৩য় হিজরী যুদ্ধের যে উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে ঐসব অনুচ্ছেদের নাজিল হওয়ার সময় সম্পর্কে জ্ঞান দান করে।
সূরা বাকারার মত এই সূরাতে সাধারণভাবে মানব জাতির ধর্মীয় ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে, তবে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে কিতাবী জাতিসমূহের উপর। এই আলোচনার ধারাবাহিকতায় বর্ণনা করা হয়েছে নূতন মুসলিম উম্মতের আবির্ভাব, তাদের ধর্মানুষ্ঠান, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদি। সেই সাথে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সত্যর জন্য, ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করার উপরে; এবং উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে বিশ্বাসীদের, তারা যেন সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর কাছে পথ নির্দেশের জন্য প্রার্থনা করে এবং আল্লাহর মঙ্গল ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
এই সূরাতে নতুন যে বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে তা হচ্ছে; (১) খৃষ্টানদের নূতন ধর্ম গ্রহণের প্রতি আহবান করা হয়েছে। পূর্ববর্তী সূরাতে ইহুদীদের বিশেষভাবে সম্বোধন করা হয়েছিল, এ সুরাতে খৃষ্টানদের সেরূপ নূতন ধর্মের দিকে বিশেষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। (২) মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য বদর এবং ওহুদের যুদ্ধ এক বিশেষ শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত; এবং (৩) জাতি হিসেবে মুসলমানদের তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে নির্দেশ দান করা হয়েছে এবং এই দায়িত্ব ও কর্তব্য তাদের সম্প্রদায়ের জন্য যেমন প্রযোজ্য, ঠিক সমভাবে প্রযোজ্য বহির্বিশ্বের আদান-প্রদান এবং অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
সার-সংক্ষেপ : আল্লাহ তাঁর প্রত্যাদেশের মাধ্যমে, পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশ সমূহের সত্যায়ন (Confirmation) করেছেন। আমরা এই পত্যাদেশ ভক্তি সহকারে গ্রহণ করবো। এই গ্রহণ করার অর্থ, এর বক্তব্য অনুধাবন করতে চেষ্টা করবো, এবং যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের ভাবধারা বা আদর্শ প্রত্যাখ্যান করবো। [৩:১-২০]
পূর্ববর্তী কিতাবধারীরা সম্পূর্ণ কিতাব প্রাপ্ত হয় নাই, তাঁরা অসম্পূর্ণ কিতাবপ্রাপ্ত জাতি। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর এই সম্পূর্ণ প্রত্যাদেশকে প্রত্যাখান করে তবে বিশ্বাসীরা তাদের সঙ্গ পরিহার করবে। তাদের সময় শেষ। [৩:২১-৩০]
ইমরান [মেরীর পিতা] পরিবারের কাহিনী থেকে আমরা অবগত হই হযরত মুসার প্রতি প্রেরিত বিধি-বিধান, হযরত ঈসার জন্মের অলৌকিক রহস্য এবং তাঁর কার্যকাল [৩:৩১-৬৩]।
পৃথিবীতে আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রেরিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। সারা পৃথিবীর মানব জাতিকে এর ছায়াতলে আহবান করা হয়েছে। এই ধারাবাহিক প্রত্যাদেশ ইসলামে এসে সমাপ্তি লাভ করে। মুসলমানদের উপরে নির্দেশ হচ্ছে, ঐক্য এবং শৃঙ্খলার সাথে বসবাস করা, তা হলেই মুসলমানদের জন্য রয়েছে শত্রু পথের ক্ষতি থেকে নিরাপত্তার অঙ্গীকার। তাদেরকে পরস্পরের জন্য বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে বলা হয়েছে [৩:৬৪-১২০]।
বদরের যুদ্ধে আল্লাহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কিভাবে তিনি সৎ গুণ সম্পন্ন (Virtuous) ব্যক্তিদের পক্ষ অবলম্বন করেন। ধৈর্য্য, অধ্যবসায় এবং শৃঙ্খলা সাফল্যের চাবিকাঠি। অপর পক্ষে ওহুদের যুদ্ধের শিক্ষা হচ্ছে হতাশ না হওয়া, নৈতিক গুণের চর্চা করা এবং মৃত্যু ও কষ্টকে অবজ্ঞা করা। [৩ : ১২১-১৪৮]
ওহুদের যুদ্ধের বিপর্যয়ের কারণ হলো কিছু লোকের উচ্ছৃঙ্খলতা, আবার কিছু লোকের স্বার্থপরতা ও সিদ্ধান্তের অভাব; আবার মুনাফিকদের কাপুরুষতা। কিন্তু কোন শত্রুই আল্লাহর পরিকল্পনাকে রুদ্ধ করতে পারে না। [৩ : ১৪৯-১৮০]
শত্রুদের উপহাসকে অবজ্ঞা কর। আল্লাহর এবাদত করতে হবে ঐকান্তিক আন্তরিকতা নিয়ে। তাঁর অনুগত বান্দাদের সাফল্য এবং সমৃদ্ধি দান করার তিনিই একমাত্র নিয়ামক শক্তি। [৩:১৮১-২০০]
সূরা আল-ইমরান বা ইমরানের পরিবার - ৩
আয়াত ২০০, রুকু ২০, মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে]
০২। আল্লাহ্, তিনি ব্যতীত, অন্য কোন উপাস্য নাই, তিনি চিরঞ্জীব, স্বনির্ভরশীল, অনাদি ও অনন্ত।
০৩। তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি [ধাপে ধাপে] কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যা উহার পূর্বের কিতাবকে সমর্থন করে। মানব জাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য ইতিপূর্বে তিনি অবতীর্ণ করেছিলেন [মুসার] তাওরাত বা সারিয়া ৩৪৪ আইন, ও [ঈসার] ইঞ্জিল বা উপদেশ। এবং তিনি অবতীর্ণ করেছেন ফুরকান [যা ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্যকারী] ৩৪৫।
৩৪৪। [এই সুরার ৩ নং ও ৪ নং আয়াত অনুবাদের সময় অনুবাদকগণের মধ্যে কেউ ৩নং আয়াতের শেষ অংশ পরবর্তী আয়াতের সাথে মিলিয়ে ৪নং আয়াত হিসাবে অনুবাদ করেছেন। এর বিপরীত কাজ করেছেন কেউ কেউ। মাওলানা ইউসুফ আলী সাহেব দ্বিতীয় সারির দলে।
৩৪৫। 'ফুরকান' - ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য মানদণ্ড। দেখুন [২ : ৫৩] এবং টিকা ৬৮।
০৫। নিশ্চয়ই আসমান যমীনের কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকে না।
০৬। তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় ৩৪৬।
৩৪৬। মাতৃগর্ভে প্রথম সৃষ্টির উন্মেষের সময় আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও সাধ্য নাই তার রহস্য জানার। এখানে সৃষ্টি রহস্যের উল্লেখের মাধ্যমে হযরত ঈসার জন্মের গূঢ় রহস্যের প্রতি আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে [৩ : ৪১]।
০৯। "হে আমাদের প্রভু! এতে কোন সন্দেহ নাই যে, একদিন তুমি মানব জাতিকে একত্রে সমবেত করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন না।" ৩৪৯
৩৪৯। যারা জ্ঞানী এবং বিশ্বাসে অটল এ প্রার্থনা তাদেরই। যারা জ্ঞানে গভীর, শুধুমাত্র তারাই অনুধাবন করতে সক্ষম যে সেই অসীম জ্ঞানের আঁধার, সর্বজ্ঞ স্রষ্টার জ্ঞানের তুলনায় তাদের জ্ঞান কত ক্ষুদ্র, কত অকিঞ্চিতকর। যতই তাদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়, ততই তাদের এই অনুভূতি তীব্রতর হয়। 'সত্য' অনুভূতির ক্ষমতা বিদ্যুৎ চমকের মত তাদের অন্তরে ধরা দেয়, তাদের মনের দিগন্তকে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করে তোলে, তাই তারা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে সত্যকে অন্তরে ধারণ করার, অনুভব করার, হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। তাদের অন্তর সর্বদা এ 'সত্য'কে স্মরণ করে যে পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং আমাদের শেষ এবং চিরস্থায়ী গন্তব্যস্থল হচ্ছে মহান আল্লাহ্র কাছে প্রত্যাবর্তন।
রুকু - ২
১১। [তাদের দুঃখ দুর্দশা] ফের-আওনী সম্প্রদায় ও তাদের পূর্ববর্তীদের থেকে উন্নত হবে না ৩৫০। তারা আমার আয়াত সমূহ অস্বীকার করেছিলো, ফলে আল্লাহ্ তাদের পাপের জন্য তাদের শাস্তি দান করেছিলেন। আল্লাহ্ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর।
৩৫০। সৃষ্টির আদি থেকেই পৃথিবীতে পাপ বর্তমান। দম্ভ, অহংকার, অন্যায়-অত্যাচার, মানুষকে 'সত্য' বিশ্বাস থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ফেরাউনদের জীবন। হযরত মুসার সময়ে আমরা দেখি ফেরাউনের দম্ভ, অহংকার, অন্যায় ও অত্যাচার সীমা অতিক্রম করে। ফেরাউন নির্ভর করতো তার বাহুবল, ক্ষমতা, সৈন্য-সামন্ত, ধন-সম্পদের উপরে। তার ক্ষমতার উৎস ছিল পার্থিব বিষয়বস্তু। সে কারণে সে আল্লাহর নবী হযরত মুসাকে ক্ষমতার দম্ভে ঠাট্টা তামাসা করতে সাহস করে এবং তার অনুগতদের অন্যায় ও অত্যাচার জর্জরিত করে। কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। তিনি ইহুদীদের রক্ষা করেন এবং ফেরাউন ও তাঁর সঙ্গীদের শাস্তি দান করেন।
[উপদেশঃ পার্থিব বিষয়বস্তু মানুষকে দাম্ভিক ও অহংকারী করে তোলে। ফলে তার অন্তরে সত্যের আলো প্রবেশে বাঁধা পায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আত্মা মহৎ কিছু করার ক্ষমতা রাখে না, ফলে সে হয় অন্যায়কারী ও অত্যাচারী। - অনুবাদক।]
৩৫১। এই আয়াতটি হযরত মুসার উপদেশ মিশরবাসীদের প্রতি যা আল্লাহ্র তরফ থেকে নাজেল হওয়া। এই উপদেশ সর্বকালের, সর্বযুগের। সুতরাং হযরত মুহম্মদের (সাঃ) সময়ে এই উপদেশ ছিল সমসাময়িক আরব, ইহুদী, খৃষ্টান ও যারা 'সত্য'কে অস্বীকার করে তাদের প্রতি। বলা হচ্ছে যে, তাদের প্রতিরোধ আল্লাহর শক্তির কাছে খুবই নগন্য এবং তুচ্ছ। পরবর্তী আয়াতে বদরের যুদ্ধের উপমার সাহায্যে এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে বিশ্বাসীদের জন্য জয় সুনিশ্চিত। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করেন। এর পরবর্তী ইতিহাসও এই 'সত্য'র সাক্ষ্য দেয়। ইসলামের ইতিহাসে এর প্রমাণ মিলে। বাইজেন্টাইন সম্রাট ও পারস্য সম্রাটের পতনের মূল কারণ ছিল তাদের দম্ভ ও অহংকার এবং আল্লাহ্র আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা।
[উপদেশঃ হচ্ছে অন্যায়-অত্যাচারী, দাম্ভিক, অহংকারী শেষ পর্যন্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। - অনুবাদক]
৩৫২। এই আয়াতটি দ্বারা বদরের যুদ্ধের ইঙ্গিত করা হয়েছে। বদরের যুদ্ধ হিজরী ২য় বর্ষে সংগঠিত হয়। মক্কার ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় মদিনায় হিযরত করেন এবং সেখানে মদিনার আল্লাহ্ভক্ত লোকদের দ্বারা তাঁরা সাদরে গৃহীত হন। কিন্তু তাঁরা সর্বদা মক্কার কাফের এবং মদিনার ইহুদীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ভীত থাকতেন। মক্কাবাসী কাফেরদের উদ্দেশ্য ছিল তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে মদিনায় অবস্থানকারী ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা। সেই সময়ে কুরাইশদের অন্যতম নেতা আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে বাণিজ্য শেষে প্রভূত ধন-ঐশ্বর্য্য সহযোগে মক্কা প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তাঁর ভয় ছিল হয়তো বা মুসলমানেরা তাদের আক্রমণ করবে। কারণ সিরিয়া থেকে মক্কায় ফেরার পথেই মদিনার অবস্থান। সে কারণে তিনি মক্কাবাসীদের তাঁকে সাহায্য করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী প্রেরণের জন্য অনুরোধ করেন। মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্য ছিল নূতন ও ছোট্ট মুসলিম সম্প্রদায়কে চিরতরে শেষ করে দেওয়া। হিজরী ২য় বর্ষে মদিনা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে নূতন মুসলিম সম্প্রদায় ও মক্কাবাসীদের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম, মাত্র ৩১৩ জন এবং এই স্বল্প সংখ্যক সেনাদলও উপযুক্ত অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত ছিল না। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রের সম্ভারই বড় কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে নৈতিক বল। যে যুদ্ধ ন্যায়ের জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, বিশ্বাসের জন্য সংঘটিত হয় সেখানে আল্লাহর আশীর্বাদ, রহমত এবং সাহায্য অবশ্যম্ভাবী। বদরের যুদ্ধেও ঠিক তেমনটি ঘটে। স্বল্প সংখ্যক মুসলিম সেনা, অপ্রতুল অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়েও সমসাময়িক আরবের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা দ্বারা পরিচালিত সুসজ্জিত সেনা বাহিনীকে পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছিল।
[উপদেশঃ ন্যায় ও সত্যর জন্য যুদ্ধ সেনাবাহিনীর নৈতিক বল বৃদ্ধি করে, কারণ আল্লাহ্র রহমত তাদের উপর বর্ষিত হয়। যুদ্ধ ক্ষেত্রে অস্ত্রের সমারহ এবং সৈন্য সংখ্যা যুদ্ধ জয়ের একমাত্র মাপকাঠি নয়। নৈতিক মনোবলই হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের আসল চাবিকাঠি। এর প্রভূত উদাহরণ বর্তমান বিশ্বে রয়েছে। - অনুবাদক।]
৩৫৩। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ব্যতীত, উপযুক্ত অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত না হয়েও, মুসলমানদের ছোট্ট দলের জয়লাভ ছিলো এক অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, শত্রুদল ছিলো উপযুক্ত অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু বদরের যুদ্ধে মুসলমানদেরা ঈমানের দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও উৎসাহ উদ্দীপনা আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভে সমর্থ হয়েছিলো। এই যুদ্ধে কোরেশদের যারা যুদ্ধবন্দী হয়েছিলো তারা সাক্ষ্য দেয় যে, তারা মুসলিম সৈন্য সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যা থেকে বহুগুণ বেশি দেখতে পায়। এই অলৌকিক ঘটনা ছিল আল্লাহ্র অনুগ্রহ।
৩৫৪। পৃথিবীতে মানুষের যে যে বস্তু কাম্য এখানে সেগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্দরী রমনীর সান্নিধ্য উপভোগের জন্য কাম্য, উপযুক্ত সন্তান পিতা-মাতার শুধুমাত্র গর্ব এবং অহংকারের বস্তুই নয়, সে পিতা-মাতার সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতীক, সম্মানের প্রতীক, শক্তির প্রতীক। ধন-সম্পদ বিলাসী জীবনের নিরাপত্তা দান করে। প্রাচীন পৃথিবীর বিষয়-আশয় এবং ধন-সম্পদের মাপকাঠি ছিল পশু-সম্পদ। একমাত্র ধনী ব্যক্তিরাই উন্নত পশু পালনে সক্ষম ছিলেন। অভিজাত ব্যক্তিরা উন্নতমানের ঘোড়া প্রতিপালন করতেন এবং এর পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। এছাড়াও সেই প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পশু-খামার এক অর্থকরী ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। ভালো কৃষিযোগ্য জমি, সম্পদের ও নিরাপত্তার প্রতীক। পৃথিবীতে মানুষের কাম্যবস্তুর যে তালিকা এখানে দেওয়া হয়েছে তা সেই প্রাচীন যুগের জন্যও যেমন প্রযোজ্য ছিল, আজও তা সমভাবেই প্রযোজ্য। তবে এর রূপ গেছে বদলে। আজকের সভ্যতা যান্ত্রিক সভ্যতা। তাই উন্নতমানের ঘোড়ার পরিবর্তে সে স্থান দখল করেছে মোটর গাড়ী, এরোপ্লেন ইত্যাদি।
৩৫৫। দেখুন সূরা ২, আয়াত ২৫ এবং টীকা ৪৫। ইংরেজী অনুবাদের সময় 'সঙ্গীনি' কথাটি ব্যবহার না করে 'spouse' কথাটি ব্যবহার করেছেন। 'সঙ্গীনি' কথাটি শুধুমাত্র প্রযোজ্য নারী সঙ্গীর প্রতি। অর্থাৎ বেহেস্তে শুধুমাত্র পুরুষেরাই সঙ্গীনি পাবেন। মহিলা বেহেস্তবাসীদের এটা নিঃসঙ্গতারই বার্তা বহন করে। কিন্তু 'spouse' কথাটির দ্বারা বোঝানো হয় সঙ্গী বা সঙ্গীনি। কাজেই এর অর্থ সঙ্গিনী না হয়ে 'সাথী' হওয়া উচিত। এতে পুরুষ ও নারী উভয় ধরণের সঙ্গীকেই বোঝায়।
১৭। তারা প্রদর্শন করে ধৈর্য্য, দৃঢ়তা এবং আত্মসংযম ৩৫৬, [কথায় ও কাজে] সত্যবাদী, যারা এবাদতে একান্ত অনুগত, যারা [আল্লাহ্র রাস্তায়] ব্যয় করে, এবং যারা রাত্রির শেষ প্রহরে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে ৩৫৭।
৩৫৬। 'সবর' - এ কথাটির অর্থ অনেক ব্যাপক। দেখুন সূরা ২, আয়াত ৪৫ এবং সূরা ২, আয়াত ১৫৩ এবং আনুসঙ্গিক টিকা। সেখানে মাওলানা ইউসুফ আলী তিনটি গুণের উল্লেখ করেছেন সবর সম্পর্কে। সবর অর্থাৎ ধৈর্য্যশীল, দৃঢ় ও আত্মসংযমী।
আবার [ইউসুফ আলী সাহেব কর্তৃক] অনুবাদ হয়েছে, সত্যবাদী [অর্থাৎ কথা ও কাজে], অনুগত [অর্থাৎ ঐকান্তিকভাবে নিবেদিত], ব্যয়কারী [অর্থাৎ আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয়কারী]। তাহলে আয়াতটির অর্থ এই যে যারা তাকওয়া অবলম্বনকারী তাদের নিদর্শন হচ্ছে তারা হবে (১) ধৈর্য্যশীল, কর্তব্যে দৃঢ় এবং আত্মসংযমী। (২) তারা হবে সত্যবাদী, কথায় ও কাজে, (৩) অনুগত বা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে ঐকান্তিকভাবে নিবেদিত, (৪) ব্যয়কারী অর্থাৎ আলাহ্র রাস্তায় ব্যয়কারী, এবং (৫) প্রত্যুষে দিনের প্রারম্ভে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারী। এগুলিই হচ্ছে মু'মিন বান্দার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
৩৫৭। প্রকৃত আল্লাহ্র বান্দার গুণাবলী সূরা ৩ এর ১৬ ও ১৭নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা হবে বিশ্বাসী, বিনয়ী এবং আল্লাহ্র ক্ষমার প্রত্যাশী [৩ : ১৬], তাদের অন্যান্য গুণাবলীর মধ্যে [৩ : ১৭] থাকবে : (১) ধৈর্য্য, দৃঢ়তা ও আত্মসংযম। এগুলি সবই 'সবর' কথাটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ মু'মিন বান্দার চরিত্রে সবর গুণটির প্রকাশ ঘটে। সবর একটি চারিত্রিক গুণাবলী। শুধুমাত্র মুখের কথা বা বাধ্য হয়ে ধৈর্য্যধারণ করার নাম সবর নয়। যেখানেই গুণাবলী কথাটির উল্লেখ থাকে সেখানেই তা ব্যক্তিত্বের অংশরূপে পরিগণিত হয়। যে কোনও গুণাবলী-ই ব্যক্তির চিন্তার, ভাবনার, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায় বোধের বহিঃপ্রকাশ। একটি ছোট উদাহরণ দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করা যাক্। সততা একটি গুণ। এই গুণটির উৎপত্তি চিন্তার সততা থেকে। চিন্তার সততা ব্যক্তিকে সৎ থাকতে উদ্বুদ্ধ করে, পরিণামে তার কর্মেও তার প্রতিফলন ঘটে। অর্থাৎ প্রতিটি কর্মের পিছনে অদৃশ্য থেকে কর্মকে যা পরিচালনা করে তা ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা। সৎ চিন্তা সৎ কর্মের জন্ম দেয়। অসৎ চিন্তা অসৎ কর্মের জন্ম দেয়। সুতরাং যে কোনও গুণাবলীই হচ্ছে মনের যে কোনও চিন্তা ধারণার ফসল। এ এক বিশেষ মানসিক অবস্থা (state of mind); সেইরূপ যে কোনও চারিত্রিক দোষ ত্রুটিও মানসিক চিন্তাধারার ফসল। সেইভাবে সবর গুণটিও এক মানসিক অবস্থা যা বান্দাকে ধৈর্য্যশীল, দৃঢ় ও আত্মসংযমী হতে সাহায্য করে। (২) খোদাভক্ত বান্দার দ্বিতীয় গুণাবলীর বিশেষত্ব হচ্ছে, তারা তাদের প্রতিটি কাজে সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও আন্তরিক। তারা তাদের কথা ও প্রতিজ্ঞা কখনও বরখেলাপ করে না। তাদের কথা ও কাজের মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। সমাজ জীবনে তাদের চরিত্র নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল। (৩) খোদাভীরু লোকের এবাদত হবে আন্তরিক। তাদের প্রার্থনা হবে অন্তরের অন্তঃস্থলের আকুল আকুতি। তাদের পূত পবিত্র চরিত্রের মতই তাদের প্রার্থনা
আন্তরিকভাবে আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত। (৪) খোদাভীরু লোকের আল্লাহ্র প্রতি নিবেদন প্রকাশ পায় তাদের কাজের মাধ্যমে। এসব লোক আল্লাহ্কে ভালবেসে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাঁর সৃষ্টির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য তারা "ব্যয় করে"। এই ব্যয় যে শুধুমাত্র অর্থ সম্পদ তা-ই নয়। আল্লাহ্ যাকে যে নেয়ামত দান করেছেন সেই নেয়ামত তার সৃষ্টির সেবার জন্য ব্যয় করে। (৫) তারা হয় অত্যন্ত নিয়মানুগ। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তাই দেখা যায় এসব লোকেরা নামাজের ব্যাপারেও অত্যন্ত নিয়মানুগ। প্রতিদিন উষালগ্নে আল্লাহ্র কাছে আত্ম নিবেদনের মাধ্যমে তাদের দিনের শুরু করেন।
৩৫৮। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ যে শুধুমাত্র দেবদূতদের মাধ্যমেই প্রেরিত হয় তা নয়, আল্লাহর বাণী আকাশে, বাতাসে, তরুলতাতে, সমুদ্রে, নদীতে, সৃষ্ট জীবে, বিশ্ব-চরাচরের সর্বত্র ছড়ানো আছে। যার অনুধাবন করার মন আছে, বোঝার ক্ষমতা আছে তার কাছে আল্লাহ্র নিদর্শন দিবালোকের মত স্পষ্ট। সমস্ত সৃষ্টিতে, বিশ্ব-চরাচরে, ভূলোক-দ্যুলোকে সেই এক স্রষ্টার হাতের স্পর্শ বিদ্যমান। এ সমস্তই ইঙ্গিত করে স্রষ্টার একত্বের দিকে, তাঁর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিকে।
৩৫৯। 'বাগইয়ান' শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে বিদ্বেষবশতঃ। এর দ্বারা আরও বুঝায় হিংসা-দ্বেষ, নিজ স্বার্থে অন্ধ হয়ে এক গুয়েমী করা, বিদ্রোহী হওয়া ইত্যাদি।
৩৬০। 'ওয়াজ্হা' - সমস্ত সত্ত্বা। দেখুন টীকা ১১৪ এবং ২নং সূরার আয়াত ১১২।
৩৬১। কিতাবধারী জাতিদের জানা উচিত যে পৃথিবীতে আল্লাহ্র ধর্ম একটাই। আর তা হচ্ছে "ইসলাম" বা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। আর এই ধর্মই ইব্রাহীমের ধর্ম। যুগে যুগে বিভিন্ন নবী ও রাসূলগণ ইব্রাহীম (আঃ) এর এই ধর্ম-ই প্রচার করে গেছেন। শুধু যুগের দাবী অনুযায়ী তার হয়েছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) হযরত ইব্রাহিমের ধর্মকেই সত্যায়িত করেন। সুতরাং কিতাবধারী জাতিদের অবশ্যই জানা উচিত যে হযরত মুসার ধর্ম, হযরত ঈসার ধর্ম, হযরত মুহম্মদের ধর্মের মধ্যে কোনও বিভেদ নাই। এগুলি সবই হযরত ইব্রাহিমের ধর্ম 'ইসলাম'। এই আয়াতে অজ্ঞ আরব প্যাগানদের সম্বোধন করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে যে, তাদেরই স্বগোত্রের একজন আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত। তাদেরকে আহব্ন করা হয়েছে সেই 'সত্য'কে গ্রহণ করার জন্য। অর্থাৎ আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ বা 'ইসলাম' গ্রহণের জন্য এই আয়াতে আহবান করা হচ্ছে। এ সময়ে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু কিছু সংখ্যক ছিল যারা সত্য ধর্মকে বাঁধা দান করে। এরা 'বিশ্বাসী'দের উপরে অত্যাচার, নির্যাতনের ঝড় বইয়ে দেয়। এখানে আল্লাহ্ বলেছেন তিনি সর্বজ্ঞ - অত্যাচারীদের দায়িত্ব তাঁর।
৩৬২। এই সূরায় ১ ও ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বৃহৎ ঘটনার পটভূমির বর্ণনা করা হয়েছে। এই পটভূমি সাহিত্যিক রসে ও বর্ণনায় সমৃদ্ধ। সূরা ৩-এর আয়াত ৬ আমাদের আভাস দেয় জন্মের রহস্যের উপরে। এখান থেকেই আমরা বুঝতে পারি এটা বৃহৎ এবং রহস্যময় কোনও "জন্ম ইতিহাসের" উপক্রমণিকার সূত্রপাত। পরবর্তীতে 'যীশুর' জন্ম ইতিহাসের বর্ণনার ইঙ্গিত তা বহন করে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে ইসলাম কোনও নূতন ধর্ম নয়। এ ধর্ম হযরত ইব্রাহীমের ধর্মেরই নূতন রূপ। এর পরেই বলা হয়েছে যে কিতাবধারী জাতিরা তাদের ধর্মকে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট করে ফেলেছে। এই বর্ণনার পরেই 'ইমরান' পরিবারের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যীশুখৃষ্টের জন্মকাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে এবং ইহুদীদের দ্বারা যীশুর প্রত্যাখানের ইতিহাস এবং সেই একইভাবে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর প্রত্যাখানের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।
রুকু - ৩
৩৬৩। 'হক'-এখানে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে ন্যায়পরায়ণতা। হক্ বা ন্যায়-পরায়ণতার অর্থ অনেক ব্যাপক। হক্ আরবী শব্দটির দ্বারা যা বোঝানো হয় তা হচ্ছে- (১) অধিকার অর্থাৎ আইন অনুযায়ী ন্যায্য পাওনা (২) সঠিক পথ, অর্থাৎ মানুষ হিসাবে আমাদের চরিত্রে যে সব গুণাবলী (right conduct) থাকা প্রয়োজন। (৩) সত্য (Truth)। (৪) ন্যায় বিচার (Justice)। এই চারটির সবকয়টিই এখানে 'হক্' কথাটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যারা মুসলমান তাদের চরিত্রে উপরোক্ত গুণাবলী থাকবে। এখানে মুসলমান শুধুমাত্র নামেই নয়, বিশ্বাসে ও কর্মে মুসলমান।
৩৬৪। যুগে যুগে বহু নবী রাসূলদের হত্যা করা হয়েছে। পূণ্য রক্তের এই হত্যা প্রবাহ শুরু হয়েছে আবেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
৩৬৫। এই আয়াতটি সূরা ২ এর ২১৭নং আয়াতের শেষাংশের অনুরূপ।
৩৬৬। এখানে 'কিতাব' কথাটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে যুগে যুগে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে। হযরত মুসা, হযরত ঈসা প্রত্যেকেই আল্লাহ্ কর্তৃক প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত। এই প্রত্যাদেশকেই কিতাবপ্রাপ্ত বলা হয়েছে। তবে তাদের এই প্রত্যাদেশ ছিল অসম্পূর্ণ। এই অসম্পূর্ণ প্রত্যাদেশকেই বলা হয়েছে "কিতাবের অংশ"। কুরআনকে আল্লাহ্ বলেছেন "সম্পূর্ণ প্রত্যাদেশ"।
৩৬৭। এখানে বিজ্ঞজনের মতামত হচ্ছে, যে কোনও একটি বিশেষ ঘটনার দিকে এই আয়াতটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোনও একটি বিবাদ-বিসংবাদকে কেন্দ্র করে ইহুদীরা হযরত মুহম্মদকে (সঃ) সালিস মানে। নবী (সাঃ) তখন তাদের নিজেদের কাছে রক্ষিত তাদের ধর্মগ্রন্থের সাহায্য নিতে বলেন। কারণ তাদের ধর্মগ্রন্থও আল্লাহর কাছে থেকে প্রাপ্ত ঐশীগ্রন্থ। সেখানেও সত্য নিহিত। যদিও সেখানে সত্যের সাথে বহু মিথ্যাকে মিশ্রিত করা হয়েছে। ইহুদীরা কৌশলে সত্যকে গোপন করে হযরতের এই উপদেশকে এড়িয়ে যায়।
সাধারণ উপদেশ হচ্ছেঃ কিতাবপ্রাপ্ত জাতিদেরই উচিত ছিল সর্বপ্রথম হযরত মুহম্মদকে (সাঃ) সনাক্ত করা। কারণ তাদের ধর্ম গ্রন্থে হযরত মুহম্মদের (সাঃ) উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য তাদের মধ্যে কিছু লোক ছিল যারা হযরত (সাঃ) কে সনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছিল এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু অধিকাংশ লোক সত্যকে প্রত্যাখান করে। কারণ তারা তাদের মনগড়া ভাবধারাতে আপ্লুত হয়ে সত্যের আলো অনুভবে ব্যর্থ হয়। পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ সর্বদা নিজের সংস্কার, সংস্কৃতি, মনগড়া ভাবধারা লালন করতে এবং তার প্রভাবে নিজেকে আপ্লুত করতে ভালবাসে। সত্যকে তারা সযতনে পরিহার করে।
৩৬৮। দেখুন [২ : ৮০] আয়াত।
২৬। বল, "হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ্ ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর, এবং যার নিকট থেকে ইচ্ছে কর ক্ষমতা কেড়ে নাও। যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত কর, এবং যাকে ইচ্ছা তুমি অসম্মানিত কর। সকল কল্যাণ তোমার হাতেই ৩৬৯। নিশ্চয়ই তুমি সবার উপরে সর্বশক্তিমান।
৩৬৯। এই আয়াতটি সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং ভাবের গভীরতায় সমৃদ্ধ। এই লাইনটি "কল্যাণ তোমারই হাতে" যা ইংরেজীতে যা অনুবাদ করা হয়েছে, "In thy hand is all good" - অর্থাৎ "তোমার হাত জীবনের সব সৌন্দর্যকে ধারণ করে।" কল্যাণ বা Good, তা আমরা কিভাবে বোঝাবো ? কিভাবে বুঝাবো ? 'ভালো' বা 'কল্যাণ' কথাটি বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট বিভিন্ন অর্থ বহন করে। এই অর্থ নির্ভর করে ব্যক্তির অনুধাবন ক্ষমতা ও জ্ঞানের উপর। অবুঝ শিশু প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ হাতের মুঠোতে ধরতে চায়। কারণ তার কাছে প্রদীপের আলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সেটাকে করায়ত্ব করাকেই সে সর্বোচ্চ কল্যাণ মনে করে। সেইরূপ আমরা সাধারণ মানুষ - যারা লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ বা বিভিন্ন রিপুর দাস তারা বুঝতে অক্ষম সত্যিকারের কল্যাণ কিসে নিহিত। সত্যিকারের কল্যাণ নিহিত আল্লাহ্র নিকট। তাঁর ইচ্ছাই বান্দার জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ। সুতরাং তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ-ই হচ্ছে সর্বোচ্চ কল্যাণ। ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই। এখানেই ইসলামের আলো যা ভাস্কর। যখন বান্দা তার সব ইচ্ছাকে মহান আল্লাহ্র ইচ্ছাধীন করে, তখন সে করুণাময়ের মঙ্গল ইচ্ছা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। এই অনুধাবন ক্ষমতা তাকে হৃদয়ঙ্গম করতে দেয় যে সকল কল্যাণের উৎস সর্বশক্তিমান। সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ সম্পর্কে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু ইসলামে এ ধরণের মতভেদের অবকাশ নাই। ইসলাম অর্থ "আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ।" জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালো-মন্দ, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই সেই করুণাময়ের মহান ইচ্ছার প্রতিফলন। তিনি যাকে যা খুশি দান করেন- তাঁর দান বান্দার কল্যাণের জন্য এই বিশ্বাস মনে রাখা। সুখের দিনে, আনন্দের দিনে, প্রাচুর্য্যরে দিনে, সাফল্যের দিনে যেমন আনন্দে উচ্ছ্বাসিত না হয়ে খুঁজে দেখতে হবে কেন স্রষ্টা তাকে বিশেষভাবে আনন্দ, সাফল্য, প্রাচুর্য্য দিলেন। "স্রষ্টার ইচ্ছার" অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে - তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর ইচ্ছার পরিপূর্ণতা দান করতে হবে। আবার দুঃখের অমানিশাতে, পরাজয়ের গ্লানিতে, অভাবের কষাঘাতে, স্থিরচিত্তে অনুধাবন করতে হবে দুঃখের অমানিশা, পরাজয়ের গ্লানি, অভাবের কষাঘাতের মাধ্যমে স্রষ্টা আমাদের আত্মাকে পাপমুক্ত করার প্রয়াস পান। মুসলমান সব সময়েই স্রষ্টার মহান ইচ্ছা বা যা আমাদের সর্বোচ্চ কল্যাণ তা অনুধাবনের জন্য সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করে যাবে। এই চলমান জীবনের যা কিছু সবই তাঁর দান, তাঁর দেওয়া কল্যাণ। একবার এই বোধ জন্মালে সে নিরাপদ। কোনও বিপর্যয়ই আর তাকে নিরাশ করতে পারবে না। কারণ সে আল্লাহ্র ইচ্ছার সুরক্ষিত দূর্গের নিরাপত্তা ভোগ করে।
৩৭০। এই আয়াতটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত। এর অর্থ বহুধা। একথা ঠিক যে চব্বিশ ঘণ্টায় 'রাত্রি', দিনের আগমনে অন্তর্হিত হয়; আবার নির্দিষ্ট সময়ান্তে রাত্রির আগমনে 'দিন' আত্মসমর্পণ করে। এই যে দিন ও রাত্রির পর্যায়ক্রম আগমন, সারাটা বছর ধরে এর সময়ের কোনও নির্দিষ্ট সীমারেখা নাই। বছরের কোনও সময়ে দিনের দৈর্ঘ্য বেশী আবার কখনও রাতের দৈর্ঘ্য বেশী। এই যে দিন ও রাত্রির পর্যায়ক্রমে একে রূপক অর্থে, প্রতীক হিসাবে চিন্তা করলে আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ কিছুটা অনুধাবন করা যায়। দিন হচ্ছে আলোর প্রতিনিধি এবং রাত্রি হচ্ছে অন্ধকারের প্রতিনিধি। সুতরাং 'আলো' ও 'অন্ধকারকে' যে প্রতীক হিসাবে উপস্থাপন করা যায় তা হচ্ছে : (১) জ্ঞান ও অজ্ঞানতা। জ্ঞান হচ্ছে আলোর প্রতীক, অজ্ঞানতা অন্ধকারের। (২) সুখ ও দুঃখ। সুখের সময় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, সুতরাং তাকে আলোর প্রতীক হিসেবে ধরা যায়। দুঃখের অমানিশি অন্ধকারের প্রতীক। এরাও প্রত্যেকের জীবনে দিন ও রাত্রির মত পর্যায়ক্রমে আসে। এদের স্থায়িত্বেরও কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নাই। কখনও দীর্ঘ কখনও হ্রস্বঃ। (৩) বিবেক (Spiritual insight) ও এর উল্টো বিবেকহীন (Spiritual blindness) বিবেক বা Spiritual insight বা wisdom করে ব্যক্তির আত্মাকে করে আলোকিত। বিবেকবান ব্যক্তি হচ্ছে ন্যায় ও সত্যের প্রতীক। এঁরা হচ্ছেন মানব-সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথিক। সূর্যের প্রথম আলোর মত বিবেকবান ব্যক্তির চরিত্র নির্মল, উজ্জ্বল ও ভাস্বর। আর বিবেকহীন ব্যক্তি পশুর সমান। তার আত্মা রাত্রির অন্ধকারের ন্যায় কালো।
[উপদেশঃ জীবনের কিছুই স্থায়ী নয়। সবই অস্থায়ী এবং পর্যায়ক্রমে আবর্তিত। - অনুবাদক]
৩৭১। "তুমিই মৃত হইতে জীবিতের আবির্ভাব ঘটাও।" আমাদের চারিপাশে অহরহই এর উদাহরণ দেখা যায়। শুষ্ক মৃত মাটি বৃষ্টির পানিতে সঞ্জীবিত হয়ে জীবনের ধারায় সবুজ হয়ে যায়, আবার সবুজ ধরণী খরার কবলে মৃত, রুক্ষ মরুভূমিতে পরিণত হয়। জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি প্রবাহমান। যেখানেই মৃত্যু সেখানেই জীবনের আগমন, আবার যেখানেই জীবনের সৃষ্টি সেখানে নির্দিষ্ট সময়ান্তে তার শেষ বা মৃত্যুর সময় নির্ধারিত। প্রকৃতিতে এই জীবন ও মৃত্যুর খেলা চারিদিকে ছড়ানো। আমাদের জীবনেও জীবন ও মৃত্যু একই সুতোয় গাঁথা। আমাদের জীবনে মৃত্যু শুধু যে দৈহিকভাবে ঘটে তা-ই নয়, এই মৃত্যু হতে পারে আত্মার বিকাশের, আবেগ-অনুভূতির, বিচার-বিবেচনার, বিবেক-বুদ্ধির। অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত ব্যক্তির দৈহিক মৃত্যু না ঘটলেও আত্মার বিকাশের মৃত্যু ঘটতে পারে। এখানে মৃত্যু রূপক অর্থে ব্যবহৃত। আবার এই রূপক শুধু যে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় তা নয়, সমষ্টিগত বা জাতিগত ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কত সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতির পতন আবার নাম না জানা জাতির পৃথিবীর ইতিহাসে পরাক্রমশীল জাতি হিসাবে উত্থান। পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়। দিন ও রাত্রির মত, জীবন ও মৃত্যুর মত তা পর্যায়ক্রমে পরিবর্তনশীল।
সূরা ৩-এর আয়াত ২৬-২৭ থেকে আল্লাহ্ তা-আলার একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রাঞ্জল ও মনোরম ভাষায় ধারাবাহিকতার সাথে বর্ণিত হয়েছে। প্রথমেই তাঁর শক্তি ও রাজত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর নভোমণ্ডল ও তাঁর শক্তিসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষে আত্মা ও আধ্যাত্মিকতার বর্ণনা এসেছে। প্রকৃতপক্ষে এটাই সমগ্র বিশ্বশক্তির সর্বোচ্চ শক্তি।
৩৭২। দিন ও রাত্রির পর্যায়ক্রমে, জীবন ও মৃত্যুর স্থায়িত্বের, জীবনের উত্থান ও পতনে, মহান আল্লাহ্র সীমাহীন রহমতের দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন- বৃষ্টি আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ- তার অভাবে মাটি মরে যায় বা জীবন-শূন্য হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়, আবার মরুভূমি বৃষ্টির পানিতে সজীব হয়ে শস্য-শ্যামল ভূমির ন্যায় ধারণ করে। আল্লাহ্র নেয়ামত সীমাহীন।
২৭৩। বিশ্বাস যদি হয় আমাদের জীবনের মৌলিক একটি বিষয়, তবে আমাদের মেলামেশা ও সখ্যতা গড়ে উঠবে সেই সব ব্যক্তিবর্গের সাথে যারা আমাদের বিশ্বাসের সাথে একাত্মতা পোষণ করে। "অসৎ সংসর্গ সুআচরণকে নষ্ট করে দেয়"। এবং সর্বোপরি অসৎ সংসর্গ ঈমানকেও করতে পারে ক্ষতিগ্রস্থ। আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে আমাদের বলা হয়েছে সব সময় ঈমানদারদের সহযোগিতা নেয়ার জন্য, কখনোই অবিশ্বাসী নাস্তিকদের নয়। শুধুমাত্র এভাবেই আমাদের সমাজ সুদৃঢ় ভিত্তি ও একতার উপরে সংগঠিত থাকতে পারে। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে যেখানে কোন বিকল্প থাকে না অথবা যেখানে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের ভিন্নমতাবলম্বীদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়া একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তবে তাতে আমাদের কোন দোষ নাই। সর্ব অবস্থায়েই যেনো আমরা কোনক্রমেই আমাদের মুসলিম ভ্রাতৃত্বের উপর কোন রকম আঘাত আসতে না দেই, বরং যথাসম্ভব আমাদের চেষ্টা থাকবে তাকে আরও মজবুত করার।
বিশ্বাস হচ্ছে অন্তরের ধন। এখানে 'বিশ্বাসী' কথাটির দ্বারা মু'মিন বান্দাকে বুঝানো হয়েছে। মু'মিন বান্দা কারা ? শুধুমাত্র মৌখিক আনুগত্যের মাধ্যমে মু'মিন বান্দা হওয়া যায় না। মুমিন সেই বান্দা যে আল্লাহর অস্তিত্ব শুধুমাত্র মুখেই স্বীকার করে না সে অন্তরে আল্লাহর সান্নিধ্য উপলব্ধির জন্য সর্বদা ব্যাকুল। ফলে সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম মেনে চলে। সে শুধু মুখেই বলে না 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু'। তার প্রতিটি কর্মেই আল্লাহর প্রতি এই আনুগত্য প্রকাশ পায়। সে সর্বদা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে (মু'মিন বান্দার গুণাবলীর জন্য দেখুন টিকা ৩৫৭)। আল্লাহর হুকুম কি ? আল্লাহর হুকুম হচ্ছে, সত্য কথা বলা, অন্যায়-অসত্য থেকে দূরে থাকা, মন্দকে পরিহার করা, ভালোর জন্য, ন্যায়ের জন্য জেহাদ করা, ব্যাভিচার না করা, আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করা ইত্যাদি। মু'মিন বান্দা আল্লাহর দাস। দাস কখনও তার প্রভুর হুকুম অস্বীকার করতে পারবে না। যদি কেউ করে তবে সে বিদ্রোহী। আল্লাহর হুকুমই হচ্ছে আল্লাহর আইন। যে এই আইন মেনে চলে সেই 'বিশ্বাসী' বা মু'মিন। আর যে আল্লাহর আইন না মানে [অর্থাৎ মিথ্যা, জাল, জুয়াচুরী, ব্যাভিচার, অন্যকে শোষণ ইত্যাদির সাহায্যে জীবন ধারণ করে] তারা মুখে আল্লাহর নাম করলেও তারা 'বিশ্বাসী' বা মু'মিন নয়। তারা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারী। এরা নামে মুসলমান, কিন্তু অন্তরে এরা অবিশ্বাসী বা 'কাফের'। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এদের সংখ্যা এত বেশী যে সত্যিকারের মু'মিন বান্দা খুঁজে বের করাই দুষ্কর। কারণ বাংলাদেশে ধর্মকে জীবন থেকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। তাই দেখি অফিসে ঘুষ খেয়ে মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ে। ঘুষের টাকায় রোজার ইফতারী করে। জীবন যাপন ও ধর্ম এক না হলে মু'মিন হওয়া যায় না। বিশ্বাসী বা মু'মিন তারাই যারা আল্লাহর আইন মেনে চলে আর 'অবিশ্বাসী' বা 'কাফের' তারাই যারা আল্লাহর আইন মানে না। বিশ্বাসীদেরকে অবিশ্বাসীদের থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। কারণ কথায় আছে 'সৎ" সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ'। অসৎ ব্যক্তির কর্ম, চিন্তাধারা সবই অসৎ। এই অসৎ প্রভাব, সৎ চিন্তাধারাকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। এই আয়াতে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবন যাত্রায় মু'মিন বা সৎ বান্দাকে মোমেন বান্দার সাহায্য এবং বন্ধুত্ব কামনা করতে বলা হয়েছে। কারণ, মুসলিম সমাজ তখনই শুধুমাত্র সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে স্থাপিত হতে পারবে। এর উদাহরণ আমরা ইসলামের ইতিহাসে পাই। চারিত্রিক এই দুর্লভ গুণাবলীর দ্বারাই একদিন মুসলমানেরা শৌর্য্য-বীর্য, জ্ঞানে-গুণে পৃথিবীর পথ প্রদর্শক হতে পেরেছিলেন এবং পৃথিবীকে নেতৃত্ব দান করেছিলেন। আজকে বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের অধঃপতনের কারণ, তারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করে, শুধুমাত্র ধর্মের খোলস নিয়ে মাতামাতি করে। এ যেন শাঁসবিহীন ঝিনুকের মত। ভিতরে মুক্তা বা অন্য কিছু নাই, বাইরে শুধু শক্ত ও উজ্জ্বল খোলস। যে-ই আল্লাহর হুকুম মানে তার জন্য থাকে আল্লাহর নেয়ামত। তাইতো দেখি পাশ্চাত্য জগত আল্লাহর আইন মানে। ফলে তাদের সমাজে আয়, উন্নতি, শান্তি-শৃঙ্খলা অব্যাহত। "চরিত্রের উৎকর্ষতা অনুযায়ী খোদা তা-আলা মানুষের উন্নতি দান করে থাকেন।" - আল হাদীস। ইসলাম চারিত্রিক গুণাবলীর উপরে অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। এই গুণাবলী যাতে অসৎ সংসর্গে নষ্ট না হয় সেই কারণে অবিশ্বাসীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়তে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে জগতের বুকে মানুষের অস্তিত্ব সাধারণ জন্তু জানোয়ার অথবা বৃক্ষ ও লতা-পাতার মত নয় যে জন্ম লাভ করবে, বড় হবে, এরপর মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বরং ইসলাম মনে করে যে, মানুষের জীবন একটি উদ্দেশ্যমূলক জীবন। মানুষের খাওয়া-পরা, উঠা-বসা, নিদ্রা-জাগরণ, এমনকি জন্ম-মৃত্যু সবই একটি উদ্দেশ্যের চারিপাশে ঘুরছে। এ সব কাজ কর্ম যতক্ষণ সে উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে, ততক্ষণই তা নির্ভূল ও শুদ্ধ। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্যের বিপরীত হয়ে গেলেই তা অশুদ্ধ। মানজ জীবনের একটাই উদ্দেশ্য তা হচ্ছে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা। এর জন্য চাই পুত পবিত্র আত্মা। আর পুত-পবিত্র আত্মা লাভ করা যায় পুত-পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে। আল্লাহর আইন মানাই হচ্ছে সেই পুত পবিত্র জীবনের চাবিকাঠি। অসৎ সংসর্গে যাতে আত্মার পবিত্রতা নষ্ট না হয় সে জন্যই এই হুকুম।
চলমান পৃথিবীতে আমরা যদি শুধু খুঁজে খুঁজে মু'মিন বান্দাদের সাথেই সম্পর্ক রাখি এবং আর সবাইকে আমাদের চলমান পৃথিবী থেকে খারিজ করে দেই তবে এই পৃথিবীতে আমাদের কর্মকাণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাবে। কারণ আজকের পৃথিবী অত্যন্ত ছোট। ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য পৃথিবীর মানুষকে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটতে হচ্ছে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ আজ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে- তাই এই আয়াতের শেষাংশে - কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনে সবার সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করবে। তবে নিজেকে মন্দ থেকে রক্ষা করবে। এখানে 'সতর্কতা অবলম্বন করে' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যেটা মওলানা ইউসুফ আলী 'guard yourself' কথাটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ যারা তোমার মতাদর্শী বিশ্বাসী নয় তাদের সাথেও কাজ-কর্ম করা জায়েজ তবে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া চলবে না।
৩০। যেদিন প্রত্যেকে [পৃথিবীতে] সে যে ভালো কাজ করছে এবং যে মন্দ কাজ করেছে তার সম্মুখীন হবে সেদিন সে তার এবং মন্দের [কাজের] মধ্যে দূর ব্যবধান কামনা করবে। কিন্তু আল্লাহ্ তোমাদের তাঁর {শাস্তি] সম্বন্ধে সাবধান করছেন। এবং যে আল্লাহর সেবা করে আল্লাহ্ তাঁর দাসদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।
রুকু - ৪
৩২। বল; "আল্লাহ্ ও রাসূলকে মান্য কর।" কিন্তু তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় [তবে জেনে রাখ] আল্লাহ্ ঈমান প্রত্যাখ্যানকারীকে ভালোবাসেন না।
৩৩। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আদমকে, নূহকে ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সকল মানুষের উপরে [শ্রেষ্ঠত্বে] মনোনীত করেছিলেন।
৩৪। এরা একে অপরের বংশধর। এবং আল্লাহ্ সব শোনেন এবং সব জানেন ৩৭৪।
৩৭৪। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে, তারা সবাই একই পরিবার থেকে আগত। ইহুদী, খ্রিস্টান ও আমাদের নবীসহ পৃথিবীর সকল নবী-রাসূলগণ কার্যত একই পরিবার থেকে আগত। এই বক্তব্যটি অনেক ব্যাপক। পৃথিবীতে বিশ্বাসীরা এক পরিবারভুক্ত। এখানে 'বিশ্বাসী' বলতে তাদেরই বুঝানো হচ্ছে যারা আল্লাহকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর আইন মেনে চলে। আল্লাহকে ভালোবাসা এবং তাঁর আইন মেনে চলা এবং আল্লাহর নবীকে ভালোবাসা এবং তাদের প্রতি প্রেরিত প্রত্যাদেশ মেনে চলা - একই কথা। এই দুয়ের প্রতি লোকের আনুগত্য, ভালোবাসা এবং শৃঙ্খলাবোধই ঈমানদারীতার লক্ষণ।
৩৭৫। এখান থেকে হযরত ঈসার কাহিনীর শুরু। কাহিনীর ভূমিকা হিসেবে মেরীর জন্মের ইতিহাস বর্ণনা হয়েছে। সমান্তরালভাবে আর যাদের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তারা হচ্ছেন, ব্যাপটিষ্ট জন, জাকারিয়ার ছেলে ইয়াহিয়া। ইয়াহিয়ার মা এলিজাবেথ ছিলেন যিশু খৃষ্টের মা মেরীর রক্ত সম্পর্কের জ্ঞাতি বোন। সেই হিসেবে জন এবং যিশু ছিলেন রক্ত সম্পর্কের জ্ঞাতি ভাই। এরা যে শুধুমাত্র রক্তের সম্পর্কেই ভাই ছিলেন তা-ই নয়, তাঁরা জন্ম ও জীবনাচারের নিরিখে আধ্যাত্মিক জগতেও ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। এলিজাবেথ ছিলেন হারুণের কন্যা [Luke i, ৩৬] হারুণ ছিলেন হযরত মুসার ভাই হারুণের গোত্রভুক্ত। মেরির মাতাকে হান্নাহ্ নামে ডাকা হতো এবং তাঁর পিতার নাম ছিল ইমরান। সুতরাং, হান্নাহ্ হচ্ছেন ইমরানের পুরোহিত পরিবারের অধস্তন বংশধর এবং ইমরানের স্ত্রী- এই উভয়ই। "ইমরানের নারী" এইভাবে এই দু'টি অর্থই প্রকাশ করে।
৩৭৬। 'মুহাররার' - এই আরবী শব্দটির অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত বন্ধনমুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য নিবেদিত। মেরীর মা আশা করেছিলেন যে তার গর্ভে পুত্র সন্তান জন্মাবে যে হবে আল্লাহর জন্য একান্ত নিবেদিত। কিন্তু তার পুত্র সন্তান না হয়ে হলো মেয়ে সন্তান। এই মেয়ে সন্তানই হচ্ছে আল্লাহর কর্তৃত নির্বাচিত রমনী, ভবিষ্যত নবী হযরত ঈসার মাতা। [৩ : ৪২]
৩৭৭। হযরত মরিয়মের মা পুত্র সন্তান আশা করেছিলেন। তিনি কি কন্যা সন্তান জন্মদান করে হতাশ হয়েছিলেন ? অবশ্যই না। কারণ, তিনি ছিলেন পূণ্যাত্মা নারী। তিনি জানতেন যে আল্লাহর সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সাধ্যাতীত। আল্লাহ্ যা করেন সবই মানুষের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য। হযরত মরিয়ম একজন সাধারণ কন্যাসন্তান ছিলেন না। আধ্যাত্মিক জগতে আল্লাহ্ তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছিলেন।
[উপদেশঃ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। শুধুমাত্র নারীকে বিশেষভাবে সম্মানিত করবেন বলেই হযরত ঈসার অলৌকিক জন্ম রহস্য। কারণ পৃথিবীতে সন্তানের পরিচয় পিতৃ পরিচয়ে। নারীকে বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করার জন্য আল্লাহ্ হযরত ঈসার জন্মের রহস্য পিতৃহীন করেছেন। হযরত ঈসার পরিচয় শুধুমাত্র মাতৃ পরিচয়ে ধন্য। কন্যা সন্তান পুত্র সন্তানের থেকে কোনও অংশে কম নয়, হযরত মরিয়মের জন্মের মাধ্যমে আল্লাহ্ এই সত্য তুলে ধরেছেন। ধর্মের চোখে পুরুষ নারী সমান। - অনুবাদক।]
৩৭৮। হযরত মুসার নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে সন্তানকে বায়তুল মুকাদ্দাসের খেদমতের কাজে নিয়োজিত করা চলবে না। কিন্তু হযরত মরিয়মের মায়ের আল্লাহর প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস, তাই তিনি তাঁর কন্যাসন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন।
৩৭৯। হযরত মরিয়ম আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে লালিত-পালিত। তাঁর শারীরিক ও মানসিক পুষ্টিসাধনের জন্য যা-ই প্রয়োজন হতো, তা-ই আল্লাহর তরফ থেকে পৌঁছে দেয়া হত। ফলে মরিয়মের শারীরিক বৃদ্ধি এবং আত্মিক বিকাশ অপূর্ব সুন্দর রূপ লাভ করলো। এই আয়াতে পবিত্রতা ও সুন্দর কথাটি দ্বারা আল্লাহ্ কর্তৃক হযরত মেরীর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে। খ্রিস্টানদের মতে মেরী (হযরত মরিয়ম) বার বৎসর বয়স পর্যন্ত মসজিদেই থাকতেন এবং তাঁকে ফেরেশতারা আহার্য সরবরাহ করতো।
৩৮০। যীশুর (হযরত ঈসা আঃ) মাতা মেরীর (হযরত মরিয়ম) জন্ম, যীশুর অগ্রজ ব্রাপটিষ্ট জন এর জন্ম এবং যীশুর জন্ম - যিনি ইসরায়েলের নবী, এসব বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে যীশুর জন্মের সমসাময়িক অবস্থা এবং তাঁর বংশানুক্রম বর্ণনা করাই আসল উদ্দেশ্য। হযরত ঈসা (আঃ) যাকে ইহুদীদের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল, কিন্তু ইহুদীরা তাকে অস্বীকার করে এবং [তাদের বিশ্বাসমতো] হত্যা করে - এই আয়াতগুলিতে ইহুদীদের পুরোহিত বংশের ধারাবাহিকতা বর্ণনা করে হযরত ঈসার (আঃ) স্থানকে নির্ধারণ করা হয়েছে। যাকারিয়া আল্লাহর নিকট একটি অসাধারণ পুত্র সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেন। যাকারিয়া দম্পতি সন্তান গ্রহণের বয়স সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। কিন্তু মেরীর পবিত্র সৌন্দর্য্যমন্ডিত শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি দর্শনে জাকারিয়া উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং আল্লাহর কাছে একটি পুত্র সন্তান কামনা করেন যে হবে 'সৎ বংশধর'। আল্লাহ্ তাঁর এই প্রার্থনা কবুল করেন এবং যাকারিয়া অবাক হয়ে তাঁর বংশে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম প্রত্যক্ষ করলেন।
[উপদেশঃ আল্লাহ্ আমাদের 'সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি' দিয়েছেন। পৃথিবীর আর কোনও জীবিত প্রাণী এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। এই ইচ্ছাশক্তির প্রভাব আমরা প্রয়োগ করতে পারি, আমাদের চিন্তায়, কর্মে এবং প্রার্থনায়। আমরা অসম্ভব কিছুও প্রার্থনা করতে পারি। অনুমোদন করার মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। তবে আল্লাহ্ বান্দার প্রার্থনা কবুল করেন। বৃদ্ধ বয়সে যাকারিয়ার সন্তান লাভ সেই বার্তাই বহন করে। ইয়াহিয়ার জন্মও আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার স্বাক্ষর। - অনুবাদক।]
৪০। সে বললো, "হে আমার প্রভু! আমার কিভাবে পুত্র হবে যখন আমি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা ?" উত্তর হলো, "এভাবেই আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন তা করেন।"
৪১। সে বললো, "হে আমার প্রভু! আমাকে একটি নিদর্শন দাও।" উত্তর হলো, "তোমার নিদর্শন এই যে, তিন দিন তুমি ইংগিত ব্যতীত কথা বলতে পারবে না। তখন তোমার প্রভুর প্রশংসা কীর্তন করো বারে বারে এবং সন্ধ্যায় ও সকালে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে।"
রুকু - ৫
৩৮২। হযরত ঈসার মা হযরত মেরী এক অনন্য নারী। তিনি প্রতিপালিত হন আল্লাহর তত্ত্বাবধানে এবং তিনি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন অলৌকিকভাবে। প্রচলিত নিয়মে সন্তান জন্ম লাভের দৈহিক ভূমিকাকে উপেক্ষা করে। হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্ম ছিল সব নিয়ম বহির্ভুত। কোনও দৈহিক মিলন ব্যতীত শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সৃষ্টি। এই ঘটনা থেকে কেউ যেন মনে না করে যে হযরত ঈসা (আঃ) সাধারণ মানুষ ছিলেন না। খৃষ্টানেরা যেমন হযরত ঈসাকে আল্লাহর ছেলে হিসেবে এবং আল্লাহ্ হিসেবে পূঁজা করে। আবার রোমান ক্যাথলিকেরা মরিয়মকে "আল্লাহর মা" হিসেবে পূঁজা করে। এভাবে খৃষ্টান ধর্ম এক আল্লাহর ইবাদতের পরিবর্তে বিভিন্ন শরীক পূঁজাতে ভরে যায়, ফলে ইব্রাহিমের ধর্ম, যার নাম হচ্ছে 'ইসলাম' তার মূল ভাবধারা থেকে বহুদূরে সরে যায়। এমন ধারণা সম্ভবত ৪৩১ খৃস্টাব্দে ইফিসীয় ধর্মসভা কর্তৃক প্রচলন করা হয়, মুহম্মদ (সাঃ) জন্মের সময় থেকে এক শতাব্দী পূর্বে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খৃষ্টীয় গীর্জার এইসব পাপাচার ও পাপশিক্ষা দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেননা, তাঁকে বলা হয়েছে জগতসমূহের জন্য রহমতস্বরূপ (রাহমাতুল্লিল আলামীন)।
৪৪। এ হচ্ছে অদৃশ্য বিষয়ের কিছু সংবাদ ৩৮৩ [ হে নবী ] যা তোমার নিকট ওহীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। মারইয়ামের তত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে তার জন্য যখন তারা তীর ৩৮৪ নিক্ষেপ করছিলো, তুমি তাদের মধ্যে ছিলে না। তারা যখন বাদানুবাদে লিপ্ত ছিলো তখনও তুমি তাদের মধ্যে ছিলে না ৩৮৫।
৩৮৩। 'অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ' - এ কথাটির অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সৃষ্টিতে এত কিছু আছে যা আমরা সাধারণ মানুষ আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুধাবন করতে পারি না। আজকে বিজ্ঞানও সেই কথা বলে। আমরা সাধারণ মানুষ ত্রিমাত্রিক ধারণার বাইরে আর কিছু উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু বিজ্ঞান বলে চতুর্মাত্রিক, পঞ্চমাত্রিক, এমনকি দশমাত্রিক পর্যন্ত সৃষ্টি থাকা সম্ভব। সুতরাং ত্রিমাত্রার পরের সব সৃষ্টিই আমাদের নিকট অদৃশ্য। উদাহরণ স্বরূপ আলো ও শব্দ তরঙ্গের কথা উল্লেখ করা যায়। X-ray এক ধরণের আলোর তরঙ্গ। কিন্তু আমাদের চর্মচক্ষুতে তা ধরা পড়ে না। মেশিনের চক্ষুতে তা ধরা পড়ে। আবার এমন শব্দ তরঙ্গ আছে যা আমাদের কানে ধরা পড়ে না, কিন্তু মেশিনে ধরা পড়ে। সুতরাং এই বিশাল বিশ্বজগতের জ্ঞান আমাদের জন্য অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। আমাদের জ্ঞানের বাইরে যে জগৎ তা হচ্ছে 'অদৃশ্য' জগৎ।
৩৮৪। 'Aqlam' - এই আরবী শব্দটির অর্থ লেখনী, অন্য অর্থ তীর। প্রাচীন আরবের নিয়ম অনুযায়ী তীরের সাহায্যে ভাগ্য নির্ধারণ করা হত। দেখুন সূরা ২ আয়াত ২১৯ এবং টিকা ২৪১। ইসলামে জুয়া বা লটারী নিষিদ্ধ।
৩৮৫। খৃষ্টানদের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ আছে, পুরোহিতরা নিজেদের মধ্যে মেরীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রতিযোগীতা শুরু করে। কারণ মেরীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ ছিল এক বিরাট সম্মানের ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত লটারীর মাধ্যমে যাকারিয়ার উপরে মেরীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৩৮৬। খ্রিস্ট : গ্রীক শব্দ Christos থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে দেহে তেল এবং তৈলাক্ত বস্তু লেপন করা। প্রাচীন সভ্যতায় এরূপ প্রচলন ছিল যে কোন রাজা বা পুরোহিত তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্বে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর দেহে তেল ও তৈলাক্ত দ্রব্যাদি মেখে তাঁকে তাঁর দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করা হতো। হিব্রু এবং আরবীতে এ শব্দটির অর্থ 'মসীহ্' শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
হিব্রু এবং আরবীতে (?) 'মসীহ্' কথাটির অর্থ ঈশ্বরের প্রতিনিধি। খৃষ্টানেরা হযরত ঈসার নামকে যিশুখৃষ্ট বলে। গ্রীক শব্দ Christos এর অর্থ ও ঈশ্বরের প্রতিনিধি।
৩৮৭। "মুক্কাররাব্বি" - এই আরবী শব্দটির অর্থ আল্লাহর নিকটতম ব্যক্তি।
৩৮৮। হযরত ঈসা (আঃ) এর ধর্ম প্রচারকাল ছিল মাত্র তিন বৎসর। তিনি ৩০ বৎসর বয়স থেকে ৩৩ বৎসর বয়স পর্যন্ত ধর্ম প্রচার করেন, যখন তাঁর শত্রুরা মনে করে যে তারা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে। কিন্তু লুকের গসপেলে (Luke 2, 46) বর্ণিত আছে যে তিনি বার বৎসর বা তারও আগে থেকে উপাসনালয়ে যেয়ে ধর্ম সম্বন্ধে ধর্মগুরুদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতেন। শিশু হিসেবে তাঁর মধ্যে দেখা গেছে দৃঢ় আত্মিক বল এবং অসাধারণ জ্ঞান [Luke 2, 40] । খৃষ্টানদের কোনও কোনও ধর্মগ্রন্থ মতে তিনি অপরিণত বয়স থেকেই ধর্ম প্রচার শুরু করেন।
৩৮৯। ফেরেশতাগণ মরিয়মের সাথে কথা বলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে সুসংবাদ দান করেন। প্রত্যুত্তরে মরিয়ম আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন নিবেদন করেন। তখন একজন ফেরেশতা তাঁর উত্তরে আল্লাহ্ প্রেরিত সুসংবাদ তাঁকে দান করেন [এবং তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে, বিনা পুরুষ স্পর্শেও আল্লাহ্ সন্তান দিতে পারেন, সেটি চর্মচক্ষে যতই অসম্ভব বলে মনে হোক না কেন, তিনি শুধু বলেন 'হও', আর তা হয়ে যায়। - অনুবাদক।]
৪৯। এবং তাঁকে বনি ইসরাঈলদের জন্য রাসূল করবেন, সে বলবে, "আমি তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে তোমাদের জন্য নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি কাদা থেকে পাখীর আকৃতি তৈরী করবো তারপর আমি উহাতে ফুৎকার দিব। ফলে আল্লাহর হুকুমে তা [জীবন্ত] পাখী হয়ে যাবে ৩৯০ এবং আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধি গ্রস্থকে নিরাময় করবো এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করবো। তোমরা তোমাদের ঘরে যা আহার কর এবং মজুদ কর তা তোমাদের বলে দেবো ৩৯১। যদি তোমরা বিশ্বাসী হও তবে এর মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।"
৩৯০। কাদার পাখীকে জীবন দান করা, জন্মান্ধকে দৃষ্টিদান এবং মৃতকে জীবিত করা এই মোজেজাগুলি হযরত ঈসার ছিল। এগুলির বিভিন্ন বর্ণনা খৃষ্টানদের ধর্ম গ্রন্থেও আছে। তবে এখানে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে, তা-ই প্রকৃত ঘটনা, কেননা এটি সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে বিবৃত।
৩৯১। "তোমরা তোমাদের গৃহে যা আহার কর ও মওজুদ কর তা তোমাদেরকে বলে দেব।" উপরিউক্তি বাক্যটি হযরত ঈসা (আঃ) এর। এটি একটি রূপক বাক্য। পয়গম্বরসুলভ জ্ঞান দ্বারা তাঁর দৃষ্টি সীমার বাইরের ঘটনার সংবাদও তাঁর কাছে পৌঁছে যেতো।
৫১। "নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার প্রভু এবং তোমাদের প্রভু। সুতরাং তাঁর ইবাদাত কর। এটাই হচ্ছে সরল পথ।"
৫২। যখন ঈসা তাদের মাঝে অবিশ্বাস দেখতে পেলো, তখন সে বললো, "কারা আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী হবে ?" শিষ্যগণ বললো, "আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তুমি সাক্ষী থাক যে আমরা মুসলিম [আত্মসমর্পণকারী] ৩৯২।"
৩৯২। এই সূরাতে হযরত ঈসার (আঃ) কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'সাহায্যকারী' বা আনসার শব্দটি। আনসারের বা সাহায্যকারীর প্রভাব শুধু যে আমাদের নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর জীবনেই ছিল তা-ই নয়, হযরত ঈসা (আঃ) এর জীবনেও 'আনসার' বা সাহায্যকারীর প্রভাব বর্তমান ছিল। একইভাবে সূরা ৩ এর ৫৪নং আয়াতে চক্রান্তকারীদের কথা বলা হয়েছে যা হযরত ঈসা (আঃ) ও আমাদের নবী (সাঃ) এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মূল কথা হচ্ছে হযরত মুসার ধর্ম, হযরত ইসার ধর্ম, হযরত মুহম্মদের ধর্ম, সবই এক আল্লাহর ধর্ম, আর তা হচ্ছে হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম ইসলাম বা আল্লাহর ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। যারাই আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণকারী, তারাই মুসলিম।
৫৪। এবং [অবিশ্বাসীরা] ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেছিলো, আল্লাহ্ও কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। আল্লাহ্ কৌশলীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ৩৯৩।
৩৯৩। আরবী 'মাকারা' শব্দটি ভালো অর্থেও ব্যবহৃত হয় আবার মন্দ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কোনও কিছু সম্বন্ধে অত্যন্ত গোপনে কোনও পরিকল্পনা করাকেই এই আরবী শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়। আল্লাহ্র শত্রুরা সব সময়েই গোপনে বা প্রকাশ্যে চক্রান্ত করে, কিন্তু আল্লাহ্ সব জানেন, সব শোনেন। তাই বিদ্রোহীদের চক্রান্তকে ধুলিস্মাৎ করার জন্য সর্বমঙ্গলময় আল্লাহ্রও নিজস্ব পরিকল্পনা আছে যা দ্বারা চক্রান্তকারীর চক্রান্ত ধুলিস্মাৎ হয়ে যায়।
রুকু - ৬
৩৯৪। এই আয়াতটি সূরা নিসার ১৫৭ নং আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়া উচিত হবে। আয়াত ১৫৭-তে বলা হয়েছে, "অথচ তারা তাঁকে হত্যা করে নাই, ক্রুশবিদ্ধও করে নাই, কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল।" কিন্তু নবী হত্যার পাপ তাদের উপরে বর্তাবে। কারণ আল্লাহ্ মানুষকে বিচার করবেন তার নিয়ত দ্বারা, কর্ম দ্বারা নয়। বস্তুত হযরত ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ্ আসমানে তুলে নিয়েছিলেন। হযরত ঈসাকে তারা হত্যা করতে পারুক বা না পারুক, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তাদের নিয়ত ছিল নবীকে হত্যার। তারা হযরত ঈসার পরিবর্তে তার মত দেখতে অন্য লোককে হত্যা করে এবং মনে করে তারা হযরত ঈসাকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত তাদের অন্তরে নবী হত্যার নিয়ত ছিল। এই নিয়তের জন্যই তারা নবী হত্যার পাপে অভিযুক্ত।
৩৯৫। হযরত ঈসা (আঃ) কে আল্লাহর পুত্র বা আল্লাহর অবতাররূপে কল্পনা করে খৃষ্টানেরা মহাপাপ করেছে। এরাই হচ্ছে খৃষ্টান যারা যীশুকে আল্লাহরূপে পুঁজা করে। এটাই তাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি। অবশ্য খৃষ্টানদের মধ্যে খুব ক্ষুদ্র এক সম্প্রদায় আছে যারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী। দুঃখের বিষয় এদের অধিকাংশকে অত্যাচার এবং হত্যার মাধ্যমে নিঃশেষ করা হয়েছে। হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে এরূপ শেরেকী চিন্তা থেকে আল্লাহ্ হযরত ঈসাকে মুক্ত করে দিয়েছেন।
৩৯৬। 'অনুসারিগণ', ইংরেজীতে অনুবাদ হয়েছে "Those who follow thee" অর্থাৎ যারা হযরত ইব্রাহিমের ধর্মের অনুসারী। তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যারা আল্লাহ্র সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে বা অন্য কথায় আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে না। অর্থাৎ কাফির।
৩৯৭। মৃত্যুর পর আমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন হবে মহান আল্লাহর দরবারে। সেখানে আমাদের সম্মুখে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হবে। বিভিন্ন ধর্মমত ও পথের শেষ হবে এখানে। আল্লাহ্ আমাদের বিচার করবেন আমাদের অন্তরের প্রকৃত বিশ্বাস দ্বারা। বাইরে আমরা যা বলি বা করি না কেন, আল্লাহ্র কাছে তা বিচারের বস্তু নয়। আমাদের আত্মার প্রকৃত বিশ্বাস, আনুগত্য ও পবিত্রতাই হবে সেদিনের মীমাংসার বিষয়। বাহিরের প্রদর্শনী, [পোশাকে বা ধর্মীয় জ্ঞানে] সেদিন কোনই কাজে আসবে না। আমরা সত্যিকারের কি সেটাই হবে বিচার্য বিষয়, মীমাংসার বিষয়।
৫৭। আর যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে আল্লাহ্ তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করবেন। আল্লাহ্ পাপীদের পছন্দ করেন না।
৫৮। [হে মুহম্মদ, কোর-আনের] আয়াত সমূহ এবং জ্ঞানের বাণী আমি তোমার নিকট পুনরাবৃত্তি করছি।
৫৯। আল্লাহ্র নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্তের ন্যায় ৩৯৮। তিনি তাঁকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন তারপর তাকে বলেছিলেন, "হও" - ফলে সে হয়ে গেলো।
৩৯৮। রাসূল হিসেবে হযরত ঈসার অবস্থান অত্যন্ত সম্মানজনক। আল্লাহ্ হযরত ঈসা সম্পর্কে, তাঁর নবুওয়্যাত সম্পর্কে আশ্বস্ত করার পরেই তাঁর সম্পর্কে ভ্রান্ত মতবাদ পরিত্যাগ করতে বলেছেন। ঈসার অলৌকিক জন্ম রহস্যের জন্য খৃষ্টানেরা তাঁকে আল্লাহর পুত্র বা আল্লাহ্র অবতাররূপে পূজা করে। ঈসা (আঃ) আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই সত্য প্রকাশ করলে খৃষ্টানগণ দাবী করে ঈসা (আঃ) আল্লাহ্র পুত্র, বান্দা নহেন। যদি তা না হয় তবে বলে দাও তাঁর পিতা কে ? তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। আদমের সৃষ্টিতে তার জনক বা জননী কেহই ছিল না। তিনি ছিলেন আল্লাহ্র ইচ্ছার প্রতীক। সুতরাং ঈসা (আঃ) কেন জনক ব্যতীত শুধুমাত্র জননী দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছায় সৃষ্টি হতে পারবে না।
৩৯৯। হযরত ঈসার (আঃ) জন্ম রহস্যের প্রেক্ষিতে এখানে বলা হচ্ছে যে, প্রকৃত সত্যজ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্র নিকট থেকে পাওয়া যায়। ধর্ম যাজকেরা বা সমগ্র খৃষ্টান জাতি যা-ই বলুক না কেন তাতে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহ্র কাছে। সুতরাং আমাদের নবী মুস্তফা (সাঃ) প্রত্যাদেশের মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহ্র কাছ থেকে যে জ্ঞান লাভ করেছেন তাতে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না।
৪০০। নাজরানা অঞ্চলের (ইয়েমেনের কাছে সানার ১৫০ মাইল উত্তরে অবস্থিত] খৃষ্টানগণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা স্বীকার না করলে আল্লাহ্র নির্দেশে হযরত (সাঃ) তাদের সুবাহানা [দু'পক্ষই তাদের স্ত্রী, পুরুষ, শিশু সকলকেই ডেকে পরস্পরের জন্য বদদোয়া করা] করার জন্য আহবান করেন এবং ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু খৃষ্টান পাদ্রীগণ ভীত হয়ে তা থেকে বিরত থাকেন ও জিজিয়া কর দিতে স্বীকার করে সন্ধি করেন।
৬৩। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ফাসাদকারীদের সম্বন্ধে সম্যক অবগত।
৪০১। আয়াত ২ : ৮৭-তে আমরা যে প্রশ্নগুলি রেখে এসেছিলাম সেগুলির উত্তর দেবার সময় এখানে হয়েছে। ঈসা (আঃ) একজন সাধারণ মানুষ ব্যতীত আর কিছু ছিলেন না। তাঁকে আল্লা বলা বা আল্লাহ্র ছেলে বা আল্লাহ্র পুত্র বলা ঠিক নয়। সাধারণ মানুষের মত জন্মসূত্রে তাঁর কোনও পিতা নাই। এটাই আল্লাহ্র এক অসাধারণ অলৌকিক ক্ষমতা। খৃষ্টানেরা এই অলৌকিক জন্ম রহস্যের জন্য তাঁকে আল্লাহ্র স্থলাভিষিক্ত করেছে। কিন্তু আল্লাহ্র চোখে তিনি সাধারণ মানুষ ছিলেন। তবে আল্লাহ্ তাঁকে "স্পষ্ট প্রমাণ" ও "পবিত্র আত্মা" দ্বারা শক্তিশালী [২ : ৮৭: করেছেন। তাঁর অনেক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। সে ক্ষমতা তিনি প্রাপ্ত হয়েছিলেন আল্লাহ্র তরফ থেকে। এই ক্ষমতার জন্য বা তাঁর অলৌকিক জন্ম রহস্যের জন্য যারা তাকে আল্লাহ্র পুত্র বলে বা আল্লাহ্ জ্ঞানে পূজা করে তারা মুর্খ ও বিদ্রোহী বৈ আর কিছু নয়। এসবই তাদের নিজেদের মনগড়া আবিষ্কার। আল্লাহ্ আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন হযরত আদম যেরূপ পিতামাতা ব্যতীত ধুলি থেকে আল্লাহ্র ইচ্ছায় সৃষ্টি, হযরত ঈসা (আঃ) সেরূপ পিতা ব্যতীত শুধুমাত্র মাতা দ্বারা সৃষ্টি। এদের জন্ম সাধারণ মানুষের মত না হলেও এরা ছিলেন সাধারণ মানুষ। এই আয়াতে [৩ : ৬২] আল্লাহ্ সেই কথাই বলেছেন যে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নাই।
রুকু - ৭
৪০২। এই আয়াতে [৩ : ৬৪] আল্লাহ্ কিতাবধারীদের অর্থাৎ ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমানদের তিনটি নির্দেশ দিচ্ছেন; (১) আল্লাহ্ ব্যতীত আর কেহই উপাস্য নাই। (২) আমরা তাঁর সাথে আর কাউকে অংশীদার করব না। (৩) মানুষের মধ্যে থেকে কাউকে আল্লাহর অবতার কল্পনা করবে না। যারা কিতাবধারী জাতি তারা অবশ্যই উপরের তিনটি নির্দেশই মানবে। কারণ এই কথাগুলি কিতাবীদের ধর্মের মূল কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি কিতাবী জাতিরা তাদের স্বধর্ম চ্যুত হয়েছে। হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম হচ্ছে ইসলাম ধর্ম - যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ। ইসলাম বলে এই আত্মসমর্পণের জন্য বান্দার কোনও মাধ্যমের প্রয়োজন নাই। বান্দার সাথে তার প্রভু সর্বশক্তিমানের যোগাযোগ হবে সরাসরি। বান্দা তার কৃত কর্মের জন্য সরাসরি জবাবদিহি করবে তার প্রভুর কাছে। ব্যক্তিগত দায়িত্বই হচ্ছে ইসলামের মূল নির্দেশ। কিন্তু কিতাবী জাতিরা এ শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে। যেমন ইহুদীদের মধ্যে পৌরোহিত্য এমন পর্যায়ে গেছে যে তারা ধারণা করে পুরোহিতেরা আল্লাহ্র নেয়ামতপ্রাপ্ত এক বিশেষ শ্রেণী। এবং সেই কারণে তারা বিশ্বাস করে পৌরহিত্য বংশপরস্পরায় চলবে এবং তাদের অনুমতি এবং সুপারিশ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ বান্দা এবং স্রষ্টার সরাসরি যোগাযোগকে তারা বিশ্বাস করে না, যা ইসলামের মূল কথা। ঠিক একইভাবে কিতাবী জাতি খৃষ্টানদের মধ্যেও যাজক সম্প্রদায় আল্লাহ্ ও তাঁর বান্দার মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করে। অবশ্য এ ব্যতীত খৃষ্টনেরা ঈসা (আঃ) কে আল্লাহর অবতাররূপে পূঁজা করে। সুতরাং ইহুদীদের 'কোহেন', খৃষ্টানদের 'পোপ' বা পাদ্রী, হিন্দুদের ব্রাহ্মণ - এরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও স্রষ্টার মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু কিতাবী জাতিদের ধর্ম হচ্ছে হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম। এই ধর্মের মূল কথা বান্দা ও স্রষ্টার মধ্যে কোনও মাধ্যম নাই। বান্দা তার ইচ্ছাকে স্রষ্টার কাছে আত্মবিলিন করবে। সেইভাবে পীর পুঁজা, মাজার পূঁজাও ইসলামে নিষিদ্ধ। পীর বা সাধু যারা পূণ্যাত্মা এবং মু'মিন বান্দা হতে পারেন কিন্তু কেহই আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। রব [১ : ২] কথাটি অর্থই হচ্ছে বিশ্বজগতের প্রতিপালক। এই প্রতিপালনে তিনি একাই সক্ষম। কোন প্রতিনিধি প্রয়োজন নাই। হযরত ইব্রাহিম ছিলেন একজন পয়গম্বর - পূত এবং পবিত্র। তাঁকে ইহুদী বা খৃষ্টান বলা যাবে না। কারণ তিনি হযরত মুসা বা ঈসার বহু পূর্বেই গত হয়েছেন। তিনি ছিলেন খাঁটি মুসলমান অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী যার অপর নাম মুসলিম।
৬৬। আঃ ! তোমরা তো সেই সব লোক, যারা কোন বিষয়ের সামান্য জ্ঞান নিয়েও বির্তকে লিপ্ত হও ৪০৩। তবে যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নাই সে বিষয়ে কেন তর্ক করছো ? একমাত্র আল্লাহ্ জানেন, তোমরা জান না।
৬৭। ইব্রাহীম ইহুদীও ছিলো না, খৃষ্টানও ছিলো না। কিন্তু সে ছিলো প্রকৃত ঈমানদার এবং আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণকারী [যা হবে ইসলাম]। সে আল্লাহ্র সাথে কোন শরীক করে নাই ৪০৪।
৪০৩। খৃষ্টান ও ইহুদীদের কোন কোনও সম্প্রদায় তাদের ধর্ম সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে কূটতর্কে জড়িত হয়, যদিও সে সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান আছে। কিন্তু তারা যখন হযরত ইব্রাহীমের সম্বন্ধে কথা বলে তা সম্পূর্ণ তাদের মন গড়া, কারণ তিনি ইহুদী বা খৃষ্টানদের অদ্ভূত নিয়ম বা পদ্ধতির বহু পূর্বেই গত হয়েছেন।
৪০৪। এই আয়াতটি [২ : ১৩৫] আয়াতের অনুরূপ।
৬৯। কিতাবীদের একদলের মনঃষ্কামনা, যেনো তোমাদের বিপথগামী করতে পারে। কিন্তু তারা [তোমাদের নয় বরং] নিজেদেরই [নিজেরা] বিপথগামী করে কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।
৭০। হে কিতাবীগণ ! কেন তোমরা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার কর; যখন তোমরাই তার সাক্ষ্য বহন কর।
৭১। হে কিতাবীগণ ! কেন তোমরা সত্যকে মিথ্যার আবরণে ঢেকে দাও এবং জেনে শুনে সত্যকে গোপন কর ? ৪০৫
৪০৫। সত্যকে সর্বসমক্ষে গোপন করার অনেক উপায় আছে। তার মধ্যে একটা উপায় হচ্ছে, সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করা। কৌশল অবলম্বন করে বা সত্যকে মিথ্যার আবরণে ঢেকে দিয়ে এই কাজটি করা হয়। অনেক সময় অর্ধসত্য মিথ্যার থেকেও ভয়াবহ। কারণ সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে প্রতারিত হয়। আর একটি কৌশল হচ্ছে সম্পূর্ণ মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া। কিতাবী জাতিদের মধ্যে যারা আমাদের রাসূল সম্বন্ধে ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল তারাই মিথ্যা, অর্ধসত্য, হীন কুটকৌশল ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করতো। আমাদের নবী (সাঃ) এর চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে যেনো সাধারণ মানুষ নবীর (সাঃ) চরিত্র-মাধুর্য্যে আকৃষ্ট না হয়। ইহুদীরা লোকদের ইসলাম হতে বিরত রাখার জন্য এই সব চক্রান্ত করেছিল। তার মধ্যে একটা ছিল তারা সকালে ইসলাম গ্রহণ করতো এবং বিকালে তা প্রত্যাখ্যান করতো এই বলে যে, "আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা বুঝতে পেরেছি যে, ইনি সেই নবী নন যাঁর আগমন সম্বন্ধে আমাদের কিতাবে উল্লেখ আছে।" যখন কেহ ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে গোপন করার জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন তারা নিজেদেরই ক্ষতি করে, তাদের আত্মা অধঃপতনের নিম্নস্তরে পতিত হয়। তারা বোঝে না এ ক্ষতি তাদেরই, আর কারও নয়।
[উপদেশঃ স্বার্থন্বেষী এবং হিংসুকেরা সর্বদা চেষ্টা করে সত্যকে গোপন করে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে। - অনুবাদক।]
৪০৬। এখানে পূর্বোক্ত আয়াতের ধারাবাহিকতার বর্ণনা করা হয়েছে। দুষ্ট ইহুদীরা দুষ্কর্মের সহযোগীদের উপদেশ দিত দিনের প্রারম্ভে ইসলাম গ্রহণ করার এবং দিন শেষে তা পরিত্যাগ করার। তাদের ধারণা এতে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে সক্ষম হবে। এবং সাধারণ লোকদের ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পারবে।
৪০৮। কিতাবী জাতিরা দুই কারণে মুসলমানদের উপরে বিরক্ত হয়েছিল। (১) প্রথমতঃ হযরত মুহম্মদ (সাঃ) ইহুদীদের গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন না। এতদিন হযরত ইব্রাহীমের পরে হযরত মুসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) সকলেই ছিলেন ইহুদী গোত্রভুক্ত। আল্লাহ্ শেষ নবী তাদের গোত্রের বাইরে প্রেরণ করবেন এটা ছিল তাদের ঈর্ষার কারণ। (২) দ্বিতীয়তঃ মুসলমানেরা শেষ নবীর উম্মত হওয়ার ফলে শেষ বিচারের দিনে হাশরের ময়দানে ইহুদীদের বিরুদ্ধে ধর্মাদ্রোহীতার অভিযোগ আনতে পারে।
৭৫। কিতাবীদের মধ্য এমন লোকও আছে যার নিকট বিপুল সম্পদ আমানত রাখলেও ফেরত দেবে ৪০৯। আবার এমন লোকও আছে যার নিকট একটি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেও তাকে ক্রামগত তাড়া না দিলে সে ফেরত দিবে না ৪১০। কারণ তারা বলে, "এই সব অজ্ঞদের [আরবদের] প্রতি আমাদের কোন বাধ্যবাধকতা নাই ৪১১।" তারা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে এবং তারা তা জানে।
৪০৯। "কিনতার" - এটি ১২০০ আউন্স স্বর্ণের সমান। ইহা আরবদের প্রচলিত ওজন বিশেষ, ইহা দ্বারা প্রচুর সম্পদ বুঝায়।
৪১০। 'দিনার' বা রৌপ্যমুদ্রা বিশেষ। রাসূল (সাঃ) এর সময় সম্ভবত এটি সিরিয়া ও আরবে প্রচলিত ছিল।
৪১১। ইহুহীদের বিশ্বাসমতে আরবেরা মূর্খ, ধর্মহীন। কাজেই আরবদের অর্থ আত্মসাৎ করা ইহুহীদের জন্য বৈধ। এই মানসিকতা যে শুধু সে সময়েই ছিল তা নয়। এই মানসিকতা আজও দেখা যায়। পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে গর্বিত ও অন্ধ। নিজেদের দুষ্কর্মকে তারা ধর্মের নামে কৌশলে অনুপ্রাণিত করে। এসব জাতিকে দেখা যায় তারা স্বজাতির মধ্যে অত্যন্ত সৎ এবং নীতিবান, কিন্তু স্বজাতির বাইরে তারা অন্য জাতিকে ঠকাতে বা তাদের অন্যায়ভাবে শোষণ করতে দ্বিধাবোধ করে না; বা তাদের বিবেকে বাধে না। আজকের পৃথিবীতে, পাশ্চাত্য সমাজ যারা আজকে সভ্যতার ধারক, বাহক ও রক্ষক বলে দাবী করে, অনুন্নত দেশ সম্পর্কে বিশেষভাবে মুসলিমদের সম্পর্কে তাদের ঠিক ঐ ইহুদীদের মন-মানসিকতাই কাজ করে। ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, বসনিয়ার মুসলিম নির্যাতন এর একটি বড় প্রমাণ।
৭৭। যারা আল্লাহ্র সাথে কৃত চুক্তি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মুল্যে বিক্রয় করে, ৪১২, পরকালে তাদের [বেহেশতে] কোন অংশ নাই। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ তাদের সাথে কথা বলবেন না, অথবা তাদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না, এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবেন না। তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে ৪১৩।
৪১২। "আল্লাহ্র সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি ও নিজেদের শপথকে" - এই লাইনটির অর্থ অনেক ব্যাপক। আমাদের চারিপাশে যে জগৎ তার পরিবেশ, মানুষ, পশু, পাখী, প্রাণী, আকাশ, বাতাস, পানি এক কথায় সমস্ত জগতের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন। আল্লাহ্ মানুষকে বিশ্ব জগতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং অন্য সবাইকে তাঁর আজ্ঞাবহ করে দিয়েছেন। মানুষকে আল্লাহ্ "আশরাফুল মাখলুকাত" বা সৃষ্টির সেরা জীব করেছেন। আল্লাহ্র কাছে মানুষ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সৃষ্টির সেবা করার জন্য, তাঁর সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। তাঁর সৃষ্টির সেবার জন্য সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মানুষকে আল্লাহ্ সম্মানিত করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। ফেরেশতাদের উপরে মানুষকে আল্লাহ্ স্থান দিয়েছেন। সেই মানুষ কিভাবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে যায় ? কিভাবে তারা আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার ভুলে পার্থিব সম্পদকে বেশী গুরুত্ব দেয় ? মানুষ হিসেবে মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, সৎ কাজ করা, সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করা - তা না করে মানুষ আত্মসুখের জন্য প্রাণপাত করে। পার্থিব ধন-সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। তাহলে কি মানুষ নিজের কাছে নিজে মিথ্যাবাদী নয় ? সে জন্য এই আয়াতে সতর্কবাণী করা হয়েছে, আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যার বেসাতী করে পার্থিব সম্পদ অর্জন করে আমরা খুব কমই লাভবান হব। আল্লাহ্র সাথে মিথ্যার বেসাতী অর্থাৎ নিজের সাথে মিথ্যাচার করা, তার অর্থ হচ্ছে নিজের আত্মাকে বিক্রী করা, নিজের ধ্বংস ডেকে আনা।
[বর্তমান সভ্যতা হচ্ছে পার্থিব সম্পদ লাভের প্রতিযোগিতা। সেখানে মানুষ স্রষ্টার কাছে তার প্রতিশ্রুতি রাখে না। সে সৃষ্টির সেবা করা থেকে, আত্মসুখ ও পার্থিব সম্পদকে অধিক গুরুত্ব দেয়। এই পার্থিব সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতার ফলে আকাশে ওজোন স্তরে ছিদ্র হয়ে মানুষের জীবন হচ্ছে সংশয়। বায়ু দূষিত হয়ে "গ্রীণ হাউজ এফেক্টের" জন্য পৃথিবী আজ সংকটাপন্ন। শিল্পের বর্জ্য পদার্থের জন্য পানি দূষিত। তাইতো আজকে টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে, "আমাদের একটাই গ্রহ, একে রক্ষা করুন।" এ হচ্ছে আল্লাহ্র সাথে ওয়াদা ভঙ্গের অভিশাপ। - অনুবাদক।]
৪১৩। এই প্রলোভনয়ময় পৃথিবীতে সাধারণ মানুষ অহরহই প্রলোভনের শিকার হয় এবং পাপে নিমজ্জিত হয়। আল্লাহ্ অসীম করুণার আঁধার - আমাদের এই পাপকেও তিনি ক্ষমা ও দয়ার দৃষ্টিতে দেখবেন। পরকালে তিনি আমাদের এই পাপ থেকে মুক্তি দেবেন, তাঁর দয়ার ও রহমতের ধারায় অভিষিক্ত করবেন। কিন্তু যারা আল্লাহ্র বিধান বা আইন না মেনে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তারা তাদের আত্মার ধ্বংস ডেকে আনে। ফলে তাদের আত্মায় ইহকালেই সত্যের আলো, বা আল্লাহ্র নূর প্রবেশে পথ পায় না। পরকালে তারা কিভাবে আল্লাহ্র করুণা প্রত্যাশা করতে পারে ? "আল্লাহ্ তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না।"
৭৯। এটা কখনও [সম্ভব নয়] যে, কোন ব্যক্তিকে কিতাব, হিকমত [জ্ঞান ও প্রজ্ঞা], এবং নবুওয়াত দান করবার পর সে মানুষকে বলবে, " আল্লাহ্র পরিবর্তে তোমরা আমার উপাসনা কর।" ৪১৪ অপর পক্ষে সে বলবে, "তোমরা রাব্বানী [ধর্মীয় পন্ডিত যে ধর্মীয় বিধান অনুশীলন করে এবং তা প্রচার করে] হয়ে যাও। কারণ তোমরা কিতাব শিক্ষা দান কর, এবং তোমরা তা অধ্যয়ন কর।"
৮০। সে কখনও তোমাদের ফেরেশতাগণ ও নবীগণকে প্রভু এবং রক্ষাকর্তা হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দিতে পারে না। তোমরা আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পণ [মুসলিম] করার পর সে কি তোমাদের কুফরীর নির্দেশ দিবে ? ৪১৫
৪১৪। নাজরানের প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে কোন কোন ইহুদী ও খৃষ্টান বলেছিল, "হে মুহাম্মদ, আপনি কি চান যে, আমরা আপনার তেমনি উপাসনা করি, যেমনি খৃষ্টানেরা যীশু খৃষ্টের উপাসনা করে?" হযরত (সাঃ) বলেছিলেন, "এটা কি করে সম্ভব যে আমরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের ইবাদত করি অথবা অপরকে এর প্রতি আহবান জানাই ? আল্লাহ্ আমাকে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন নি।" এ কথোপকথনের পরেই আলোচ্য আয়াতটি নাজিল হয়। এ কথা চিন্তা করা অবিমৃষ্যকারিতা যে আল্লাহ্র প্রেরিত দূত আল্লাহ্র বিরুদ্ধে প্রচার করবেন। যীশু খৃষ্টের আগমন তো ছিল এক আল্লাহ্র উপাসনার দিকে আহবান। সময়ের ব্যবধানে তাঁর সেই বাণীকে বিকৃত করে, তাকেই আল্লাহ্র আসনে বসানো হয়।
৪১৫। যীশুখৃষ্ট একজন আল্লাহ্র দূত বা নবী এবং ফেরেশতা হচ্ছে "পবিত্র আত্মা" যার মাধ্যমে আল্লাহ্র বাণী নবীর কাছে পৌঁছাতো। এখানে "মুসলিম" কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। (মাওলানা ইউসুফ আলী কর্তৃক) ইংরেজীতে ব্যবহার করা হয়েছে "Bowed your will (to Allah in Islam)" অর্থাৎ যে তার ইচ্ছাকে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে সেই ইসলামে বিশ্বাসী বা মুসলিম। সুতরাং আল্লাহ্র দূত বা নবী কখনও আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও ইবাদতের জন্য নির্দেশ দিবে না।
রুকু - ৯
৮২। এর পর যারা মুখ ফিরিয়ে নেবে তারাই হবে বিকৃত [মানসিকতা সম্পন্ন] সত্য লংঘনকারী।
৪১৬। আল্লাহ্ তাআ'লা সব পয়গম্বরের কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার নেন যে, আপনাদের মধ্যে থেকে কোন পয়গম্বরের পর যখন অন্য পয়গম্বর আগমন করেন - যিনি অবশ্যই পূর্ববর্তী পয়গম্বর ও খোদায়ী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী হবেন, তখন পূর্ববর্তী নবীর উম্মতদের জন্য জরুরী হবে নতুন নবীর সত্যতা ও নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আগমন সম্পর্কে বলা হয়েছে [Dent xviii ১৮], নিউ টেস্টামেন্টেও রাসূল (সাঃ) এর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে [Gospel of St. John xiv ১৬, xv ২৬ and xv ১৭]।
৮৪। বল, "আমরা আল্লাহ্তে ঈমান এনেছি এবং আমাদের নিকট যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যা অবতীর্ণ করা হয়েছিলো ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ঈসহাক, ইয়াকুব এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি এবং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মুসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীগণকে যা [কিতাব] দেয়া হয়েছিলো তাতে ঈমান এনেছি। আমরা তাদের মধ্যে কোন প্রভেদ করি না। এবং আমরা আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণকারী [ইসলামে]।
৪১৭। এক স্রষ্টা আল্লাহ্র অস্তিত্ব সমস্ত বিশ্ব ব্রাহ্মাণ্ডব্যাপী এত স্পষ্ট সত্য যে একে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। যারা ভালো, যারা সত্যবাদী, যারা প্রকৃতিস্থ, যারা স্বাভাবিক তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বকে আনন্দের সাথে অনুভব করে। এ সত্য তাদের চোখে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর মূল চালিকা শক্তি এক আল্লাহ্, সকলেই আল্লাহ্র আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। নভোমণ্ডলে সূর্য্য, চন্দ্র, তারকাপুঞ্জ আল্লাহ্র আইন মেনে চলে। পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি - গাছপালা, তরুলতা, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ, আকাশ-বাতাস, সবকিছুই স্রষ্টার অমোঘ নিয়ম মেনে চলে। তারা সবাই স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পিত। মানুষকেই একমাত্র "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে" আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে বলা হয়েছে। তাহলেই সে হবে মুসলমান। কিন্তু যাদের অন্তরে ব্যাধি [২ : ১০] তারা ন্যায় ও সত্য অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ মৃত্যুর পরে তাদের এই অনুধাবন ক্ষমতা দান করবেন [২ : ১৬৭]। সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতি এক আল্লাহ্র ইবাদত করছে, তাঁর হুকুম বা আইন মেনে চলছে। এই হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম, আমাদেরও প্রকৃতির এই স্বাভাবিক নিয়মকে মেনে চলা উচিত, অর্থাৎ আমাদের "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে" আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করাই আমাদেরও স্বাভাবিক নিয়ম। কারণ তাঁর কাছেই সবকিছু প্রত্যাবর্তন করবে।
৮৬। যে সম্প্রদায় ঈমান আনার পরে, রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্যদানের পরে, এবং তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরে যারা তা প্রত্যাখ্যান করে, আল্লাহ্ কিরূপে তাদের সৎপথে পরিচালিত করবেন ? যারা অন্যায়কারী আল্লাহ্ তাদের পথ প্রদর্শন করেন না।
৪১৮। আয়াত ৩ : ৮৪-৮৫-তে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থান পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলাম নূতন কোন ধর্মমত নয়। নয় কোন গোত্রের বা সম্প্রদায়ের ধর্ম। ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্ত ধর্মই এক। কেননা সত্য সবসময় অভিন্ন, ও এক। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণ একই দ্বীন প্রচার করেছেন - আর তা হচ্ছে সচেতনভাবে মনেপ্রাণে উৎসাহের সাথে আল্লাহ্র ইচ্ছা ও কর্ম-পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করা - যার অপর নাম ইসলাম। কিন্তু কেউ যদি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনও বিশ্বাসকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পরকালে তারা হবে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত।
৮৮। তারা এতে [দোযখে] স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না, কিংবা তাদের [কিছুক্ষণের জন্যও] বিরাম দেয়া হবে না। ১৪৮-ক
৪১৮-ক। দেখুন সূরা ২, আয়াত ১৬১-১৬২।
৯০। কিন্তু যারা ঈমান আনার পরে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যাদের সত্যকে [ঈমানকে] প্রত্যাখ্যান করার প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের তওবা কখনও কবুল হবে না। এরাই তারা যারা [উদ্দেশ্যমূলকভাবে] পথভ্রষ্ট।
৯১। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং কাফিররূপে যাদের মৃত্যু ঘটে, পৃথিবীপূর্ণ স্বর্ণের বিনিময়েও তাদের মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না। এরাই তারা যাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি [সংরক্ষিত] আছে এবং তারা কোন সাহায্যকারীও পাবে না।
রুকু - ১০
৪১৯। কাউকে কোনও কিছু দেয়াই কি দান করা ? এটি নির্ভর করে কত মূল্যবান সম্পদ বা বস্তু আমরা দান করছি তার ওপর। যা কিছু আমাদের প্রিয় বস্তু, তা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করার নামই হচ্ছে দান করা। যদি আমরা আমাদের জীবন [যা আমাদের কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়বস্তু] আল্লাহ্র জন্য দান করতে পারি, অর্থাৎ ন্যায় ও সত্য, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদে দান করতে পারি, তা-ই হবে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা উঁচুস্তরের দান। যদি আমরা আমাদের পরিশ্রম, মেধা, দক্ষতা, অর্থাৎ আমাদের চরিত্রের গুণাবলী, যা আল্লাহ্র নেয়ামতরূপে পরিগণিত, তা আল্লাহ্র রাস্তায় দান করি, তবে তা হবে দ্বিতীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ দান। যদি আমরা আমাদের অর্থ-সম্পদ, বিষয়-আশয় আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করি তাও হবে দান। তবে এই দান হবে আরো এক ধাপ নীচের স্তরের দান। কিন্তু বহুলোক আছে যারা টাকা-পয়সা, বিষয়-সম্পত্তিকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে। আরও কতকগুলি বস্তু আছে যা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করলে দানরূপে পরিগণিত হবে। তা হচ্ছে মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, উচ্চপদে অধিষ্ঠান, সুনাম, অন্যের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করার ক্ষমতা ইত্যাদি। সাধারণভাবে এই জিনিসগুলি ব্যক্তির জীবনে খুবই ক্ষণস্থায়ী। যেমন - প্রভাব-প্রতিপত্তি, উচ্চমর্যাদা, ক্ষমতা ইত্যাদি ব্যক্তির জীবনে খুবই ক্ষণস্থায়ী। যে কোন মূহুর্তে তা হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এইগুলি ব্যবহার করেও সাধারণভাবে মানুষের কল্যাণ করা সম্ভব। অর্থাৎ যা কিছু নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করা হয় তা-ই হচ্ছে দান। স্বার্থপরতা ত্যাগ করে নিঃস্বার্থভাবে আত্মত্যাগই, তা যত ক্ষুদ্র হোক না কেন, তা-ই স্রষ্টার কাম্য। যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন সবই আল্লাহ্ জ্ঞাত আছেন।
৪২০। আরবেরা উটের গোশ্ত খায়। ইসলামে উটের গোশ্ত হালাল। কিন্তু ইহুদী ধর্মগ্রন্থে এটি নিষিদ্ধ [Leviticus xi 4] ইহুদীদের আইন অত্যন্ত কঠোর ছিল, যেহেতু ইহুদীরা ছিল কঠিন হৃদয়ের লোক, উদ্ধত, অহংকারী এবং অন্যায়কারী ৬ : ১৪৬]। এই আইন প্রবর্তনের পূর্বে ইহুদীরা নিজেদের পছন্দমতো খাবার গ্রহণ করতে পারতো।
৯৫। বল, "আল্লাহ্ সত্য বলেছেন। তোমরা একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের ধর্মের আদর্শ অনুসরণ কর। সে মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলো না" ৪২১।
৪২১। হযরত মুসার বিধি বিধানের বিপরীতে ইসলামের বিধি-বিধান অনেক নমনীয়, অনেক জীবনধর্মী এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদি আমরা হযরত মুসার পূর্বের দিনগুলোতে ফিরে যাই, তাহলে দেখবো হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর যে ধর্ম তা ছিল মানব স্বভাবধর্ম। ইসলাম হচ্ছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর ধর্ম। ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরবদেরকে ইহুদীরা ঘৃণার সাথে "প্যাগান" বা বিধর্মী বলে সম্বোধন করতো। যদি আরব মুসলমানেরা প্যাগান হয়, তবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কেও সে নামে সম্বোধন করতে হবে। কিন্তু তিনি তো (তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও) 'প্যাগান' ছিলেন না।
৪২২। 'বাক্কা' সম্ভবত মক্কার পুরনো নাম। ক্কাবা গৃহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কর্তৃকই সম্পাদিত হয়।
৪২৩। "আলামীন" শব্দটির অর্থ সকল পৃথিবী [১ : ২], সকল ধরণের প্রাণী, সকল জাতি [৩ : ৪২], সকল সৃষ্টি [৩ : ৯৭]।
৪২৪। "মাকামে ইব্রাহীম"; দেখুন সূরা ২, আয়াত ২৫ এবং টীকা ১২৫।
৪২৫। পূর্ববর্তী টীকার সূত্র দেখুন।
৯৯। বল, "হে কিতাবীগণ ! যারা ঈমান এনেছে কেন তাদের আল্লাহ্র পথে বাঁধা দিতেছ উহাতে বিকৃতি অন্বেষণ করে ? অথচ তোমরা [আল্লাহ্র সাথে চুক্তির] সাক্ষী। তোমরা যা কর, আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে অমনোযোগী নন। ৪২৬।"
৪২৬। দেখুন সূরা ৩, আয়াত ৮১।
১০১। কিরূপে তোমরা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করবে, যখন আল্লাহ্র আয়াত সমূহ তোমাদের নিকট পাঠ করা হয় এবং তোমাদের মধ্যে রাসূল রয়েছে ? যে আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকবে, অবশ্যই তাকে সরল পথে পরিচালনা করা হবে।
রুকু - ১১
৪২৭। "সেভাবে ভয় কর"। ভয় অনেক প্রকার, যেমন - (১) কাপুরুষের হীনতাপূর্ণ ভয়; (২) শিশুর বা অনভিজ্ঞ লোকের অজানা বিপদের ভয়; (৩) নিজের বা আপনজনের নিরাপত্তাজনিত কারণে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন লোকের ভয়; (৪) প্রিয়জনের মনে কষ্ট দেবে এমন কোন কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার ভয়। এই চার ধরণের ভয়কে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ১নং ভয় সত্যিকারের মানুষের কাছে মূল্যহীন ভয়। কারণ, যারা কাপুরুষ, অপদার্থ, আত্মসম্মানবোধহীন ব্যক্তি, শুধু তারাই এ ধরণের ভয় দ্বারা আক্রান্ত হয়। ২ নং ভয় হচ্ছে তাদের জন্যই প্রযোজ্য যারা অপরিণত - বয়সের দিক থেকে মনের দিক থেকে, সামাজিকতার দিক থেকে, ধর্মীয় জ্ঞানের দিক থেকে, সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের ক্ষমতা না থাকার দিক থেকে। ৩ নং ভয় হচ্ছে স্বাভাবিক বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষদের ক্ষেত্রে যা দেখা যায়। এটি হচ্ছে সতর্কতামূলক ভয় সম্ভাব্য অনিষ্টের হাত থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না এমন অনিষ্টকে তাঁরা জয় করতে পারছেন। আর ৪ নং ভয় হচ্ছে সত্যানুসন্ধানীদের সকল কাজকর্মের বীজতলা। যাঁরা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে অটল তাঁরা চতুর্থ ধরণের ভয়কে মেনে চলেন। বীজতলা উপমাটি ব্যবহার করা হলো এই জন্য যে মুত্তাকী বা মু'মিন হওয়ার জন্য শুধুমাত্র নামাজ, রোজা বা কুরআন তিলাওয়াত বা হজ্জ্ব, যাকাতই যথেষ্ট নয়। মু'মিন হতে হলে কতকগুলি চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করা প্রয়োজন। আর এই গুণাবলী অর্জন করতে হবে আল্লাহকে খুশী করার জন্য। পাপ, কামনা-বাসনা ত্যাগ করতে হবে। কারণ আল্লাহ্ পাপ কাজে অসন্তুষ্ট। রিপুকে সংযত করতে হবে। কারণ, আল্লাহ্র তা অপছন্দ। আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করতে মু'মিন বান্দার কষ্ট হয়, কারণ সে আল্লাহকে ভালোবাসে। তাই যে কোন খারাপ বা পাপকাজে তার ভয় হয়। হয়তো সে বিশ্বস্রষ্টাকে অসন্তুষ্ট করে ফেলবে। ভয় হয় হয়তো আল্লাহ্র ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে। এভাবে মু'মিনের সকল কাজকর্ম আল্লাহ্র সন্তুষ্টির ইচ্ছা ও অসন্তুষ্টির ভয় থেকে উৎসারিত হবে। আল্লাহ্র অসন্তুষ্টির এই ভয়ই তাকে মুত্তাকীতে পরিণত করে। তাই এই ভয়কে সত্যানুসারীর জন্য সমস্ত কাজকর্মের 'বীজতলা' বলা হয়েছে। তৃতীয় ও দ্বিতীয় ধরণের ভয় হয়তো মানুষের জীবনে প্রয়োজন হয়, কিন্তু তা আল্লাহ্ভীতি নয়। আর প্রথম ধরণের ভয় হচ্ছে এমন ভয় যার ব্যাপারে সবারই লজ্জিত হওয়া উচিত।
৪২৮। আমাদের সমস্ত সত্তা ও কর্মধারা আল্লাহ্তে সমর্পিত হতে হবে। এটি কোন বাহ্যিক লেবাছ (প্রলেপ) বা প্রদর্শনের বিষয় হবে না। সমস্ত কাজকর্মের মূলে থাকবে আল্লাহ্র ইচ্ছা ও অনিচ্ছার প্রতি আত্মসমর্পণের দৃঢ়তা।
৪২৯। এই উপমাটি এরূপ যেন গভীর সমুদ্রে নিমজ্জমান কোন ব্যক্তির প্রতি তাকে উদ্ধারের জন্য কোন সদাশয় ব্যক্তি রজ্জু নিক্ষেপ করলেন যেন নিমজ্জমান ব্যক্তি তা আঁকড়ে ধরে এবং নিমজ্জমান ব্যক্তিকে টেনে তীরে তোলা যায়। অথবা মুসলমানদের অবস্থা ঐ ব্যক্তিদের অনুরূপ, যারা কোন উচ্চ পর্বতে আরোহণের সময় শক্ত রজ্জু ধারণ করে নিশ্চিত পতনের সম্ভাবনা থেকে নিরাপদ থাকে। এখানে "আল্লাহ্র রজ্জু" অর্থাৎ কুরআন ও ইসলাম। কুরআনে বর্ণিত ইসলামের বিধানকেই আল্লাহ্ নিমজ্জমান ব্যক্তির জন্য রজ্জু হিসাবে উপমা দান করেছেন। ইসলামের বিধান একজন ব্যক্তিকে করে সৎ, চরিত্রবান, উদার, সহিষ্ণু, পরোপকারী, রাষ্ট্রের ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতি অনুগত। সর্বোপরি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য এসব লোক ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে, জিহাদে জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা হয় না। তাদের চরিত্র মাধুর্য সমাজকে করে সুসংহত, সুন্দর ও উজ্জ্বল। আল্লাহ্ এই রজ্জুকে এক সাথে ধরতে বলেছেন এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ সত্যিকারের মুসলমান যারা তাদের আল্লাহ্র বিধানে বিশ্বাসী হতে হবে, এবং তাদের একতাবদ্ধ থাকতে নির্দেশ দান করা হয়েছে। কারণ একতাবদ্ধভাবে আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস রেখে সমস্ত বিপদ আপদের মুকালিবাই সম্মিলিত মুসলিম সমাজের নিরাপত্তা জোরদার করবে।
[এই আয়াতে মু'মিন হওয়ার তিনটি পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে। (১) কুরআনের বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করা; (২) পরস্পর একতাবদ্ধ থাকা এবং কখনো বিচ্ছিন্ন না হওয়া এবং (৩) আল্লাহ্ প্রদত্ত সকল নেয়ামতের জন্য আল্লাহ্র নিকট শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। - অনুবাদক।]
৪৩০। আল্লাহ্র নবীর আগমনের পূর্বে মদিনার লোকেরা গৃহযুদ্ধে এবং পরস্পর হানাহানির মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতো। আল্লাহ্র নবী (সাঃ) এর পদধূলিতে মদিনা হলো ধন্য। গৃহযুদ্ধ, হানাহানি বন্ধ করে সকলেই একতাবদ্ধ হলো। ঈমানের দৃঢ়তায়, চারিত্রিক গুণাবলীতে উজ্জ্বল, নক্ষত্রের মতো ভাস্মর এবং ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ এক জাতিতে পরিণত হলো। আমাদের নবীর জীবনের এই উদাহরণ সর্বকালের সর্বজাতির জন্য প্রযোজ্য। হাদীসে আছে - রাসূল (সাঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের জন্য তিনটি বিষয় পছন্দ করেছেন। পছন্দনীয় জিনিসগুলি এই, (১) তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার করবে না; (২) আল্লাহ্র কিতাব কুরআনকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করবে এবং অনৈক্য থেকে বেঁচে থাকবে; (৩) শাসনকর্তাদের প্রতি শুভেচ্ছার মনোভাব পোষণ করবে। পারস্পরিক ঐক্যের দিক ব্যাখ্যা করে আয়াতে ঐ অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যাতে ইসলামপূর্বকালে আরবেরা লিপ্ত ছিল। গোত্রসমূহের পারস্পরিক শত্রুতা, কথায় কথায় অহরহ খুনখারাবি ইত্যাদি কারণে গোটা আরবজাতি নিশ্চিত হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। একমাত্র ইসলামরূপ আল্লাহ্র বিশেষ রহমতই তাদেরকে এহেন অশান্তির আগুন থেকে উদ্ধার করেছে।
[উপদেশঃ বাংলাদেশীরা আজ আল্লাহ্র রজ্জুকে হাত থেকে খুলে ফেলে দিয়েছে। তাই তাদের মধ্যে মুনাফেকী, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অন্যায়-অত্যাচার এত প্রবল। হানাহানি, খুনোখুনি আমাদের আজ ধ্বংসের প্রান্তসীমায় দাঁড় করিয়েছে। একদল হানাহানি করে ধর্মের নামে, অন্যদল করে সংস্কৃতির নামে, আর এক দল করে জাতীয়তাবাদের নামে। একমাত্র কুরআনের বিধান অনুযায়ী জীবনবোধই আমাদের এই ধ্বংস থেকে বাঁচাতে পারে। মুসলিম বিশ্বে মিথ্যা, ঘুষ, অন্যায়-অত্যাচারে আজ প্রতিদিনের জীবন বিভক্ত। যে সমাজে ন্যায় ও সত্য অনুপস্থিত, সে সমাজ কখনও আল্লাহ্র রহমত পেতে পারে না। আল্লাহ্র বিধান থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে আজ মুসলমানদের উপর অমুসলমানরা আধিপত্য কায়েম করেছে। কারণ, আল্লাহ্র শিক্ষা হচ্ছে, যদি মুসলমানরা আল্লাহ্র পথ থেকে দূরে সরে যায়, তখন আল্লাহ্রই ইচ্ছায় আল্লাহ্র গজবস্বরূপ মুসলমানদের উপর অমুসলমানদের আধিপত্য কায়েম হয়। এটি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অমুসলমানদের প্রতি নেয়ামত নয়, বরং মুসলমানদের আল্লাহ্ বিমুখতার জন্য আল্লাহ্ নির্ধারিত শাস্তিস্বরূপ আপতিত। - অনুবাদক।]
৪৩১। "সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ"। পূর্বোক্ত আয়াতে [৩ : ১০৩] ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু - " আল্লাহ্র রজ্জুকে" শক্তহাতে ধারণ করার প্রতি আহবান করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে যে, ঐক্যবদ্ধভাবে সমগ্র জাতি এ রজ্জুকে ধারণ করবে। অর্থাৎ আল্লাহ্র বিধান মেনে চলবে। এর ফলে সমগ্র জাতি এক সত্তায় পরিণত হবে। "সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ" দ্বারা এই ঐক্যবদ্ধতাকে শক্তিশালী করা হয়েছে। কারণ, কোন জাতি তখনই উন্নতি লাভ করে যখন তা একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যে কাজ জনকল্যাণমুখী - তা-ই সৎ কাজ। এ আদেশ পরবর্তী আরো দু'টি আয়াতে আছে [৩ : ১১০, ১১৪]। সুতরাং, ইসলামে সৎ কাজের গুরুত্ব সর্বাধিক। এই আয়াতে [৩ : ১০৪] আল্লাহ্ বলেছেন, তারা সফলকাম হবে। অর্থাৎ ইহকাল ও পরকালের সুখ ও শান্তির অধিকারী তারা হবে। Muflih, Aflaha, Falah- এই আরবী শব্দগুলির ভাবার্থ হচ্ছে - এই পৃথিবীতে এবং পরকালের জন্য সুখ ও শান্তির আকাঙ্ক্ষা। এই পৃথিবীর জীবনে সুখ ও শান্তির প্রতীক হচ্ছে সাফল্য, সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা, দুঃশ্চিন্তামুক্ত জীবন, নিরাপত্তা, ভালোবাসা, সর্বোপরি মানসিক প্রশান্তি। যদি আমরা সৎ কাজ করি এবং অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করি, তবে আল্লাহ্র তরফ থেকে তার পুরষ্কার হচ্ছে অপার্থিব আত্মিক শান্তি ও আল্লাহ্র অপার রহমত ও করুণাধারা। পরের আয়াতে আছে "Azab"। যা শান্তির বিপরীত। পরের আয়াতে [৩ : ১০৫] নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, বিচ্ছিন্নতা ও মতবিরোধের কারণে পূর্ববর্তী জাতিসমূহ ধ্বংস হয়ে গেছে। এই মতবিরোধ মূলতঃ দ্বীনের ব্যাপারেই করা হয়। দ্বীনের ব্যাপারে মতবিরোধের মূল কারণ স্বার্থপরতা এবং আল্লাহ্র বিধানকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এর ফলে সমাজে জন্ম নেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীর। জাতি হয়ে পড়ে বহুধা বিভক্ত। আজ যে কারণে মুসলিম জাতি বহুধা বিভক্ত তা হচ্ছে, আল্লাহ্র বিধানের মূলনীতি থেকে আজকের মুসলিম সমাজ বহু দূরে সরে গেছে। বিচ্ছিন্ন সমাজ আল্লাহ্র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে, একতাবদ্ধভাবে ধরতে অক্ষম, ফলে তাদের মধ্যে জন্ম নেয়, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অসৎ পন্থা, ধর্মের নামে ভণ্ডামী ইত্যাদি। এর ফলে জাতির ভাগ্যে নেমে আসে দুঃখ-দুর্দশা, ব্যর্থতা, পরাধীনতার গ্লানি, দারিদ্রতার অভিশাপ ইত্যাদি। পৃথিবীতে এগুলি হচ্ছে আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রাপ্ত মহাশাস্তি। পরকালের শাস্তিও তাদের প্রাপ্য। প্রকৃত মুসলিম সমাজ হবে আল্লাহ্র বিধানে বিশ্বাসী, তারা হবে একতাবদ্ধ, দৃঢ়, স্বাধীনচেতা, সমৃদ্ধিশালি এক জাতি। যাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকবে না, থাকবে না কোন মানসিক বা বিবেকের অন্তর্দাহ। কারণ, তারা জানে তারা আল্লাহ্র বিধান মেনে চলে, সৎ কাজ করে, সৎ কাজকে সনাক্ত করে, সৎ কাজকে স্বীকৃতি দেয় এবং সৎ কাজে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করে। প্রকৃত মুসলিম সমাজ হবে ভয়শূন্য। কারণ, আল্লাহ্র তাদের রক্ষাকর্তা। তারা হবে অন্যায় বা অসৎ কাজের বিরোধী।
১০৬। সেদিন কতক মুখ [আনন্দে উজ্জ্বল] শুভ্র হবে, এবং কতক মুখ [বিষাদে] কালো হবে ৪৩২। যাদের মুখ কালো হবে [তাদের বলা হবে], "ঈমান আনার পর তোমরা কি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলে ? সুতরাং ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করার শাস্তি ভোগ কর।"
৪৩২। 'Wajh' - এই আরবী শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে "মুখ" কথাটির দ্বারা। এর অর্থ এক কথায় প্রকাশ করা যায় না। এর অর্থ হবে সত্ত্বা বা ব্যক্তিত্ব বা আত্মার অনুভব। উজ্জ্বল কথাটি আলোর ধারণাকে বহন করে। "কতক মুখ উজ্জ্বল হবে" অর্থাৎ আলোর ন্যায় উজ্জ্বল রূপ ধারণ করবে। এর অর্থ তাদের আত্মিক শান্তি তাদের সর্ব অবয়ব ব্যপ্ত করে দেবে। উজ্জ্বলতা দ্বারা ঈমানের নূরে উদ্ভাসিত বুঝায়। এই শান্তির উৎস আল্লাহ্র রহমত। কালো রঙ অন্ধকারের রঙ। এখানে অন্ধকার অর্থাৎ আত্মার অন্ধকার। যে আত্মায় আল্লাহ্র নূর প্রবেশের পথ পায় নাই। কারণ এসব আত্মা ছিল আল্লাহ্র বিধানের প্রতি বিদ্রোহী। এরা পাপের অন্ধকারে নিমজ্জিত। ফলে এরা আল্লাহ্র রহমত থেকে বঞ্চিত। ঈমানের নূর থেকে এদের আত্মা বঞ্চিত।
১০৮। এগুলি আল্লাহ্র আয়াত : তোমার নিকট যথাযথভাবে আবৃত্তি করছি। আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট জগতের প্রতি জুলুম করতে চান না।
১০৯। আসমানে যা কিছু আছে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সব আল্লাহ্রই। সকল প্রশ্নের [শেষ মীমাংসা] আল্লাহ্র নিকট প্রত্যাণীত হবে ৪৩৩।
৪৩৩। দেখুন সূরা ২, আয়াত ২১০।
রুকু - ১২
৪৩৪। এই আয়াতটি [৩ : ১১০] থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম ধর্মে কোনরূপ সাম্প্রদায়িকতা, জাতি বিদ্বেষ বা কোন মতবাদের প্রতি অন্ধ আসক্তি নাই। একথা কোরান শরীফের বহু জায়গায় বার বার বলা হয়েছে যে, ইসলাম অর্থ আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। এই সমর্পণকে ইসলাম দু'ভাবে ব্যাখ্যা দান করেছে। (১) আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সৎ কাজ করা। সৎ কাজের অর্থ যে কাজ ইসলাম অনুমোদিত, তা-ই সৎ কাজ। সেভাবে ন্যায়ের জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ্ নির্ধারিত পথে কাজ করাও সৎ কাজ। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৎ কাজ। কারণ আল্লাহ্ "জালিম সম্প্রদায়কে সৎ পথে পরিচালিত করেন না" [৩ : ৮৬]। এখানে "জালিম" অর্থ যারা অন্যায় করে। (২) আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য মন্দ থেকে বিরত থাকা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপ কাজ হচ্ছে অন্যায়ের সাথে সন্ধি করা, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। আবহমান কাল থেকে পৃথিবীতে ন্যায় ও অন্যায়ের যুদ্ধ চলে আসছে। যে কোনও জনকল্যাণমুখী কাজই হচ্ছে সৎ কাজ, তবে ন্যায় ও সত্য, তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সৎ কাজ। কারণ আল্লাহ্ একে জিহাদরূপে ঘোষণা করেছেন। ন্যায়কে অন্যায় থেকে পার্থক্য করতে জানতে হবে, ন্যায়কে সনাক্ত করতে হবে - তবেই ভালো ও মন্দের পার্থক্য নিরূপণ করা সম্ভব হবে। ইসলামে কোনও রূপ সাম্প্রদায়িকতার স্থান নাই। আল্লাহ্ বলছেন কিতাবধারী জাতিরা যদি শরীক না করে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হতো তবে তারা ইসলামের অংশীদাররূপে পরিগণিত হত। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ কিতাবধারীরা প্রধান বিশ্বাস থেকে দূরে সরে গিয়ে আল্লাহ্র শরীকে বিশ্বাসী। মূল বক্তব্য হচ্ছে ইসলামের মূল কথা আল্লাহতে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ, বিশ্বাস ও আল্লাহ্ নির্ধারিত কাজে সর্বদা নিজেকে ব্যপৃত রাখা।
১১২। আল্লাহ্র [নিরাপত্তার] অঙ্গীকার ও মানুষের প্রতিশ্রুতির বাইরে যেখানেই তারা গিয়েছে সেখানেই লাঞ্ছনা তাদের ঘিরে ধরেছে [তাবুর ন্যায়] ৪৩৫। তারা আল্লাহ্র ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়েছে এবং চরম হীনতার [তাবুতে] নিজেদের আবৃত করেছে। এর কারণ তারা আল্লাহ্র আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করতো এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করতো ৪৩৬। ইহা এ জন্য যে, তারা ছিলো [আল্লাহ্র] অবাধ্য ও [পাপে] সীমালংঘনকারী।
৪৩৫। অনেকে মনে করেন এই আয়াতটি ইহুহীদের সম্পর্কে নাজেল হয়েছে। ইহুদীদের লাঞ্ছনা ও অপমান লেগেই থাকবে। তবে তারা দুই উপায়ে লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পেতে পারে। (১) আল্লাহ্র অঙ্গীকার; বৃদ্ধ, নারী, শিশু, মঠে বসবাসকারী সাধু-সন্ন্যাসী - এদের উপরে হাত তোলা নিষেধ, এই আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি। (২) আর সন্ধি ও চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রদান - এটি আল্লাহ্ নির্দেশিত মুসলিম জনগণের প্রতিশ্রুতি। বর্তমান ইহুদী রাষ্ট্রের অবস্থা জ্ঞানী মাত্রেরই অজানা নয়। ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে খৃষ্টান পাশ্চাত্যের একটি সামরিক ছাউনি। বৃহৎ শক্তিবর্গ এর উপর থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিলে এটি একদিনও স্বীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে না। কুরআনের বাণী সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বসাধারণের জন্য। অর্থাৎ ইহুদী ব্যতীতও এর বাণী সবার জন্যই প্রযোজ্য। যারাই আল্লাহ্র অঙ্গীকার লঙ্ঘন করেছে, তারা আল্লাহ্র ক্রোধের পাত্রে পরিণত হবে। তারা হবে "হীনতাগ্রস্থ" অর্থাৎ তাদের অপমান, লাঞ্ছনা, চরম দারিদ্রতা লেগেই থাকবে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, "সাবধান ! যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি অত্যাচার করে কিংবা তার প্রাপ্য হ্রাস করে, কিংবা তার উপর সামর্থের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়, অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছ থেকে কোন জিনিস গ্রহণ করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি ঐ অমুসলিমের পক্ষে অত্যাচারী মুসলিমের বিপক্ষে উকিল হব।"
৪৩৬। এই আয়াতটি ৩ : ২১ এর সমতুল্য। 'অন্যায়রূপে' কথাটি অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ন্যায়কে প্রতিহত করা আল্লাহ্র চোখে অত্যন্ত গহির্ত কাজ। ন্যায় যেখানে লঙ্ঘিত সেখানে অত্যাচারিতের কান্নায় আল্লাহ্র আসন টলে যায়। দেখুন টীকা ৩৬৩।
৪৩৭। ইসলাম কুরআন ও সুন্নার আলোকে সত্যিকারের পরহেজগারীকে মূল্য দান করে। আল্লাহ্র একত্বের প্রতি আন্তরিক অটল "বিশ্বাস" এবং ন্যায় ও সত্যের জন্য যারা অবিচল, ইসলাম তাদের শ্রদ্ধা করে। তফসীরকারদের মতে আয়াতের শেষ অংশে আহলে কিতাবীগণের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাঁদের কেউ কেউ মু'মিন। কারণ এরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। তবে শর্ত হচ্ছে এই, আহলে কিতাবীগণ "ন্যায়ের জন্য অবিচল" থাকবে।
১১৫। তারা যা কিছু উত্তম কাজ করে তার কিছুই হারিয়ে যাবে না। যারা মুত্তাকী [পূণ্য কাজ করে] আল্লাহ্ তাদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।
১১৬। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের ধনৈশ্বর্য ও [অগণিত] সন্তান-সন্তুতি আল্লাহ্র বিরুদ্ধে কখনও কোন কাজে আসবে না। তারা হবে আগুনের অধিবাসী সেখানেই তারা চিরস্থায়ী হবে ৪৩৮।
৪৩৮। এই আয়াতটি পূর্বের আয়াত [৩ : ১০] এর অনুরূপ।
৪৩৯। "ব্যয় করে" কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যয়কে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় বলা যাবে না। সৃষ্টির কল্যাণের জন্য যা ব্যয় করা হয় তা-ই আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করা। আর এই ব্যয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করা। যদি এই ইচ্ছা না থাকে তবে সে ব্যয় বা 'দান' যে নামেই অভিহিত করি না কেন, তা কোনও দান নয়। কারণ, 'দানের' মূল বা হৃদয় হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তাঁর সন্তুষ্টিই হচ্ছে 'দানের' একমাত্র উদ্দেশ্য। যদি এই নিয়তে দান না হয় তবে তা আল্লাহ্র কাছে দানরূপে গৃহীত হবে না। কারণ অবশ্যই এই দানের পিছনে দাতার কোনও উদ্দেশ্য থাকে। হতে পারে তা লোক দেখানো বা বড়াই করার জন্য, হতে পারে গ্রহীতাকে তার নিজের আয়ত্বাধীন করার জন্য, হতে পারে তা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য [যেমনটি নির্বাচনের পূর্বে প্রার্থীরা দানের নামে ভোটদাতাদের কুক্ষিগত করে।] এই পার্থিব জীবনের কোনও কিছু পাওয়ার আশায় যদি দান করা হয়, তবে তা দান নয়, দানের ছদ্মবেশে স্বার্থপরতা ও ভণ্ডামী। এই ব্যয়ের পরিবর্তে দাতা যা পেতে পারে তাকে উপমার সাহায্যে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই আয়াতে। কৃষক তার জমিতে ফসল বপন করে ফসল ঘরে তোলার আশায়। ফসল পরিপক্কতা লাভের পূর্বেই তুষার ঝরে সমস্ত জমির গাছ তুষারে আচ্ছাদিত হয়ে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষক তার কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারে না। যে দান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য না হয়ে শুধুমাত্র পার্থিব লাভের জন্য করা হয়, তা যেনো ঐ কৃষকের জমির ফসলের সমতুল্য। আকাঙ্ক্ষিত ফল লাভ ঘটে না। পার্থিব লাভের আশায় ব্যয় করে সত্যিকার দানের সওয়াব বা প্রতিদান আল্লাহ্র কাছে চাওয়া মূর্খতার সামিল। প্রতিদান হবে ঐ তুষার ঝড়ের সমতুল্য। অর্থাৎ বিপদ-আপদ, প্রতিকূল অবস্থা, যা তার সারা জীবনের কৃতকর্মকে ধুলিস্মাৎ করে দেবে। এক্ষেত্রে তারা তাদের ভাগ্যকে দোষ দেবে। হতাশা তাদের ঘিরে ধরবে, সবকিছুর জন্য আল্লাহকে দোষারোপ করবে। কিন্তু পৃথিবীতে অন্ধ ভাগ্য বলে কিছু নাই। মানুষ সব সময়ে কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে, এই আল্লাহ্র বিধান। পরম করুণাময় আল্লাহ্ কখনও কারও প্রতি অন্যায় করেন না বা ক্ষতি করেন না। তাঁর করুণার হাত সর্বদা সম্প্রসারিত। যা কিছু ক্ষতি বা অন্যায় তা আল্লাহ্র তরফ থেকে নয়, তা তার কৃতকর্মের প্রতিদান। সে তার নিজের আত্মাকে নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তার পাপ কাজ দ্বারা। ফলে সে হয় ক্ষতিগ্রস্থ। এখানে উপদেশ হচ্ছে : যে কোনও সৎ কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্য যদি মহৎ না হয়, তবে তা কোনও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এটা যেমন ব্যক্তির জীবনের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি সামাজিক জীবনের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। কোনও ভালো কাজ যদি অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য করা হয় তবে তার পরিণতিতে সেই ব্যক্তির বা জাতির ভাগ্যে নেমে আসে "তুষার ঝড়।" "তুষার ঝড়" এখানে প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি বা জাতি নিপতিত হয় লাঞ্ছনা, গঞ্ছনা, দারিদ্রতার মধ্যে। "তুষার ঝড়" ঐ লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, দারিদ্রতার প্রতীক। দুষ্টলোকের মহৎ কাজ মহৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত পার্থিব লাভের আশায় হয়। সুতরাং তার শেষ পরিণতি হয় ব্যর্থতা।
১১৯। আঃ ! তোমরাই তাদের ভালোবাস, কিন্তু তারা তোমাদের ভালোবাসে না, অথচ তোমরা সমস্ত কিতাবের উপর ঈমান আন ৪৪০। যখন তারা তোমাদের নিকট আসে, তখন তারা বলে, "আমরা বিশ্বাস করি" ৪৪১। কিন্তু যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তখন তারা তোমাদের প্রতি আক্রোশে নিজেদের আঙ্গুলের অগ্রভাগ দাঁতে কাটতে থাকে। বল, "তোমাদের আক্রোশে তোমরা ধ্বংস হও। হৃদয়ের সকল [চিন্তার] গোপনীয়তা সম্বন্ধে আল্লাহ্ সম্যক অবগত।"
৪৪০। কুরআন শরীফ আল্লাহ্র প্রদত্ত প্রত্যাদেশ। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ কিতাবধারী জাতিরাও প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু ঐসব প্রত্যাদেশ ছিল আংশিক। ইসলাম হচ্ছে হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম। যুগে যুগে নবী রাসূলগণকে প্রেরণ করা হয়েছে ধর্মকে যুগোপযোগী করার জন্য। সেজন্য তাদের ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় নাই। আমাদের নবী করিমের (সাঃ) প্রাপ্ত প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আল্লাহ্ তার প্রত্যাদেশ পূর্ণতা দান করেছেন। দেখুন আয়াত ৩ : ২৩ ও টীকা ৩৬৬।
৪৪১। দেখুন আয়াত ২ : ১৪।
রুকু - ১৩
৪৪২। এই আয়াতটিতে ওহুদের যুদ্ধের প্রস্তুতিকালের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ওহুদের যুদ্ধ ছিল নূতন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক মহাপরীক্ষা। বদরের যুদ্ধে স্বল্প সংখ্যক মুসলমান তাদের তিনগুণ বেশী কুরাইশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। মুসলমানদের শুধু যে সংখ্যার স্বল্পতা ছিল তা-ই নয়, তারা অস্ত্রে-শস্ত্রেও সুসজ্জিত ছিল না। অপরপক্ষে কুরাইশরা ছিল সুসজ্জিত, অভিজ্ঞ এবং দক্ষ যোদ্ধা। কিন্তু তদুপরিও নব্য মুসলিমদের নেতা আমাদের নবী (সাঃ) এর সাহস, জ্ঞান, আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার কারণে সে যুদ্ধে কুরাইশদের মর্মান্তিক পরাজয় ঘটে। এই পরাজয়ের পর থেকেই মক্কাবাসীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল যে, নব্য মুসলিম সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে এর প্রতিশোধ নেবে। তারা (৩০০০) তিন হাজার সৈন্যবাহিনী সহযোগে মদিনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের অধিনায়কের পদ গ্রহণ করেন আবু সুফিয়ান। মক্কাবাসীরা তাদের জয় সম্বন্ধে এত সুনিশ্চিত ছিল যে তাদের মহিলারাও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুসলমানেরা সংখ্যায় অল্প, তাদের সংখ্যা ৭০০-১০০০ মতন। শুধু যে তারা সংখ্যায় অল্প তা-ই নয়, তারা মক্কাবাসীদের তুলনায় সুসজ্জিতও ছিলেন না। কিন্তু আল্লাহ্র দূত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর স্বাভাবিক সাহস, দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের দ্বারা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি কুরাইশদের প্রতিরোধ করার জন্য মদীনা থেকে তিন মাইল উত্তরে ওহুদ পর্বতের পাদদেশে মুসলমানদের ঘাঁটি স্থাপন করেন। মদিনাতে প্রবেশের মুখে এই পর্বত প্রাধান্য বিস্তার করে। ৭ই সওয়াল, ৩য় হিজরী (জানুয়ারি ৬২৫ খৃষ্টাব্দ) তিনি যুদ্ধের জন্য তাঁর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। এই আয়াতে তারই উল্লেখ রয়েছে। সেটা ছিল শীতকাল। মদিনার হাড় কাঁপানো শীত সে বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশী ছিল। এর মধ্যেই মুসলমানেরা প্রত্যুষে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হযরত (সাঃ) পাহাড়ের গিরিপথে ৫০ জন তীরন্দাজকে মোতায়েন করেন এবং কঠোর নির্দেশ দান করেন তারা যেনো কোনও অবস্থাতেই স্বস্থান ত্যাগ না করে এবং পিছন দিক থেকে আগত শত্রু সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করে। শত্রুদের মূল আক্রমণ ছিল মুসলমানদের ব্যূহ ভেদ করে মদিনায় প্রবেশ করা। প্রথম দিকে যুদ্ধের গতি ছিল মুসলমানদের পক্ষে। শত্রুরা পলায়ন শুরু করলে মুসলমানেরা শত্রুদের পশ্চাৎধাবন করে। যে ৫০ জন তীরন্দাজকে গিরিখাতে নিয়োজিত করা হয়েছিল তারা লুটের মালের লোভে স্বস্থান ত্যাগ করে শত্রুসেনাদের পশ্চাৎধাবনকারী মুসলমানদের সাথে যোগ দেয়। এ ছাড়াও আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাঈ নামক একজন মুনাফিক ৩০০ সৈন্যসহ মুসলমানদের পক্ষ ত্যাগ করে। এই সুযোগ মক্কাবাসীরা গ্রহণ করে। তারা উন্মুক্ত গিরিপথ ব্যবহার করে মুসলমান সেনাদলের পিছনে প্রবেশের সুযোগ পায় এবং তারা সে সুযোগ গ্রহণ করে। এবারে কুরাইশদের একদল মুসলমানদের পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে। এতে মুসলমানেরা সামনে এবং পিছন দু'দিক থেকেই মক্কাবাসীদের দ্বারা পরিবৃত্ত হয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ্র সৈনিকদের মধ্যে কোনও বিশৃঙ্খলা দেখা যায় নাই। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করতে থাকেন। মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। মুসলমানদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মাথায় এবং মুখে আঘাত পান, তাঁর সম্মুখের একটি দাঁতও ভেঙ্গে যায়। কিছু সংখ্যক মুসলমানের লোভের ফলে নিশ্চিত জয়ের প্রাক্কালে ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের যে বিপর্যয় শুরু হয়েছিল, সেই সময়ে আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীলতা এবং ঠাণ্ডা মাথায় লক্ষ্যের প্রতি এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা মুসলিম সেনাদের সেই ঘোর বিপদের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত করে। ফলে পরের দিন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বহু মুসলমান অনুপ্রাণিত হয়ে আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মুসলমানদের চরিত্রের দৃঢ়তা মক্কাবাসীদের ভীত করে তোলে। আবু সুফীয়ান এবং তার অধীনস্থ মক্কার সৈন্যবাহিনীর ধারণা হলো আর লোক ক্ষয় না করে মক্কায় ফিরে যাওয়াই হবে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। ফলে আল্লাহ্র রহমতে মদিনা রক্ষা পেলো। কিন্তু এ যুদ্ধ মুসলমানদের বহু চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দিল। (১) লোভ মানুষকে ধ্বংস করে। লোভের পরিণতি কখনোই ভাল হয় না। (২) যুদ্ধক্ষেত্রে নেতার কথা অমান্য করার ফল অত্যন্ত ভয়াবহ। যুদ্ধক্ষেত্রে শৃঙ্খলা এবং আনুগত্য প্রয়োজনীয়; যে নিয়ম আজকের পৃথিবীর উন্নত সুসভ্য সামরিক বাহিনী মেনে চলে। (৩) চরিত্রে দৃঢ়তা, সকল্পের দৃঢ়তা, ধীর-স্থিরভাবে কর্তব্যকর্মে অগ্রসর হওয়া। বিপদে হতবুদ্ধি না হয়ে সর্বোপরি আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীলতা বিপদকে অতিক্রম করতে সক্ষম করে তোলে। (৪) "বিপদেই বন্ধুর পরীক্ষা" - সেই ঘোর বিপদেই চেনা গিয়েছিল, আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ও তার ৩০০ মুনাফিক সহচরকে। যারা সুসময়ে নিজেদের মুসলমানদের বন্ধু বলে পরিচয় দিত এবং দুঃসময়ে তাদের ত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করে নাই।
[উপদেশঃ ওহুদের যুদ্ধ গত হয়েছে বহু দিন আগে। কিন্তু আমাদের চারিপাশে প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধে আমরা এরকম বহু অবস্থার সম্মুখীন হই অহরহ। লোভ আমাদের বিপদে ফেলে, দুঃসময়ে বন্ধুরূপী মুনাফিকেরা আমাদের ত্যাগ করে। জীবনের যে কোনও বিপদে যদি আল্লাহ্র উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করে ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সাথে ধীর-স্থিরভাবে বিপদকে মোকাবিলা করা যায় তবে বিপদের ঘোর অমানিশা পার হয়ে সাফল্যের সোনালী সূর্য্য দেখা দেবেই। - অনুবাদক।]
৪৪৩। ওহুদের যুদ্ধের প্রাক্কালে মুসলমানদের মধ্যে দুটো গোত্র কাপুরুষের মত মতামত প্রকাশ করেছিল। সম্ভবতঃ এরা ছিল বানু সালমা খাযরাজ গোত্র এবং বানু হারিসা গোত্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্র নবীর উদাহরণে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে।
[এখানে উপদেশ হচ্ছেঃ সাধারণ মানুষ দুর্বল। কিন্তু তার সম্মুখে যদি মহৎ উদাহরণ থাকে তবে সে তার সেই দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে মহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারে। সে কারণেই ইসলামে নেতা নির্বাচনের ব্যাপারে চারিত্রিক গুণাবলীর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হযরত (সাঃ) এর মৃত্যুর পরে তাঁর বংশধর কেউ নেতা নির্বাচিত হন নাই। উপযুক্ততার ভিত্তিতেই নেতা নির্বাচন করা হয়। চার খলিফার নির্বাচন ছিল এরকমই নির্বাচন। অর্থাৎ নেতার চরিত্র হবে অনুকরণীয়। কোনও অন্যায় বা কোনও খারাপ দোষ তার চরিত্রে থাকবে না। তবেই তিনি মুসলিম সমাজের প্রধান শাসনকর্তা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। আমরা ভোটের মাধ্যমে কাদের নির্বাচন করি তা বিচার্য্য। - অনুবাদক।]
৪৪৪। "কৃতজ্ঞতা" - এই গুণটির কথা কুরআন শরীফে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা শুধুমাত্র কথার কথা নয়। কৃতজ্ঞতাবোধ ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের অংশ। এই আয়াতে আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। কিভাবে ? একি শুধু কথা দ্বারা ? না, আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। বদরের যুদ্ধে স্বল্পসংখ্যক মুসলিম সৈন্য বিরাট কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়। কারণ, আল্লাহ্ তাদেরকে ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেছিলেন। এই বিজয় গৌরবের জন্য মুসলমানদের আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। যদি তারা সত্যিকার অর্থে কৃতজ্ঞ হতো তবে তারা কখনও লোভের বশবর্তী হয়ে রাসূলের আদেশ অমান্য করে, গণিমতের মাল লুটের জন্য গিরিপথ ত্যাগ করতো না। পূর্বোক্ত আয়াতে [৩ : ১২২] যে দুটি গোত্রের কাপুরুষতার কথা বলা হয়েছে তাদের চিন্তাধারাতে কাপুরুষতা স্থান পেতো না, যদি তারা কৃতজ্ঞ হতো যে, আল্লাহ্ বদর যুদ্ধে এত বড় বিজয় দান করেছেন তার জন্য গণিমতের মাল বা জীবন ত্যাগ করা তুচ্ছ ব্যাপার। সত্যিকারের কৃতজ্ঞ ব্যক্তির আচরণ এ-ই হওয়া উচিত। আল্লাহ্র রহমতের জন্য যদি কৃতজ্ঞ হতে পারি তবে আমাদের অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসবে। অকৃতজ্ঞ অন্তর আল্লাহ্র রহমত সনাক্ত করতে অক্ষম, ফলে যা তার আছে তার জন্য সে কখনও কৃতজ্ঞ হয় না, যা তার নাই, যা তার প্রাপ্য নয়, তার জন্য সে সর্বদা হাকাকার করে। ফলে তার হৃদয়ের প্রশান্তি অন্তর্হিত হয়। জুতো কিনতে না পারার যে অন্তর্দাহ তা বিকলাঙ্গ পা-হীন লোক দেখে সাথে সাথে নিজের দুটি পা থাকার জন্য কৃতজ্ঞতায় অন্তর ভরে উঠে। মনে প্রশান্তি নামে। কৃতজ্ঞ ব্যক্তির সবচেয়ে বড় পাওয়া তার অন্তরের প্রশান্তি। কবির ভাষায় "দেখি সেথা একজন পদ নাহি তার; অমনি যুতার খেদ ঘুচিল আমার।"
৪৪৫। আয়াত ১২৪ পড়ার সময়ে নিচের ৫টি আয়াতকে এক সাথে পড়তে হবে তবেই এর পূর্ণাঙ্গ অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
১২৬। আল্লাহ্ ইহা তোমাদের জন্য আশা ও তোমাদের হৃদয়কে নিশ্চিত করার জন্য করেছেন। এবং [সব সময়ে] সাহায্য তো শুধু পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্র নিকট থেকে আসে - ৪৪৭
৪৪৭। যাই ঘটুক না কেন, এই বিশ্বাস মনে রাখা যে আল্লাহ্ সমস্ত সাহায্য ও ভরসার মালিক। এই সাহায্য বাহ্যিক উপায় উপকরণ হতে পারে বা অলৌকিকও হতে পারে। আল্লাহ্র উপর পূর্ণ ভরসার নামই হচ্ছে 'তাওয়াক্কুল।' এর অর্থ যেনো একথা কেউ না বোঝে যে বাহ্যিক উপায় উপকরণ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে বসে থাকার নাম "তাওয়াক্কুল।" বরং আল্লাহ্র উপর পূর্ণ ভরসা হলো - সামর্থ্য অনুযায়ী যাবতীয় বাহ্যিক উপায় অবলম্বনের পর ফলাফলের ব্যাপারটি আল্লাহ্র কাছে সমর্পণ করা এবং বাহ্যিক উপায়াদির জন্য গর্ব প্রকাশ না করে আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং সাফল্যের জন্য আল্লাহ্র উপরে ভরসা করা। মানুষ যেনো উদ্ধত অহংকারী না হয় তার বিত্ত, অর্থ-বৈভব বা শক্তির আতিশয্যে। একথা যেনো কেউ না ভাবে তার শক্তি সামর্থের দ্বারা আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে পারবে। এ কথা ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য, জাতির জন্যও প্রযোজ্য। যেমন : প্রাচীন কালের আদ জাতি, বর্তমান কালে জার্মান জাতি এক সময়ে মনে করেছিল, তারা তাদের শক্তির দম্ভে পৃথিবী পদানত করবে। যদি আল্লাহ্র তা-ই ইচ্ছ হতো, তবে তা হতো। পৃথিবীর জীবনযাত্রায় বাহ্যিক উপকরণের প্রয়োজন আছে - তবে তা-ই শেষ কথা নয়। আল্লাহ্র নিকট সাফল্য চাওয়া ও তার উপরে নির্ভরশীলতাই হচ্ছে শেষ কথা। আগেই বলা হয়েছে এর মানে এই নয় যে আল্লাহ্র সাহায্যের আশায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। আল্লাহ্ তাকেই সাহায্য করেন যে তার দেওয়া নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করে। পৃথিবীতে চলার পথে যে ধৈর্য্য, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, সাহস প্রদর্শন করে এবং স্বীয় কর্তব্য-কর্মের দিকে অবিচলভাবে এগিয়ে যায় এবং এই এগিয়ে যাওয়ার পথে সে আল্লাহ্র প্রদত্ত সব নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করে এবং ফলাফলের জন্য শুধুমাত্র আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে, আল্লাহ্র রহমত তাদের জন্য। বদর এবং ওহুদের যুদ্ধে নবী করিমের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষাই লাভ করি। এখানে একটি কথা স্মরণযোগ্য, আল্লাহ্ "পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়"। অর্থাৎ মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ-সিদ্ধির আশায় আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার অনেক উর্ধ্বে আল্লাহ্র অবস্থান। আল্লাহ্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শক্তি আমাদের ধারণার বাইরে।
[উপদেশঃ বাংলাদেশীরা যে অন্ধ ভাগ্যে বিশ্বাসী এ আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ কর্তৃক তা মনোনীত নয়। মুসলমান হবে কর্মযজ্ঞে বিশ্বাসী এবং ফলাফল আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল। মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে এই পার্থক্য হবে যে মুসলমানরা সব উপকরণ সুবিধা ও সামর্থ্য থাকা সত্বেও এক আল্লাহ্র উপর নির্ভরশীল হবে। পক্ষান্তরে অমুসলিমরা তাদের বৈষয়িক শক্তির উপরেই ভরসা করে। - অনুবাদক।]
৪৪৮। "কাফেরদের এক অংশ" - এ কথাটির অর্থ এই যে, সকলে নয় কিছু অংশ। এখানে এর অর্থ হচ্ছে মক্কার কাফেরদের প্রধান এবং তার অধীনস্থ যোদ্ধারা যারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাবে মদিনা আক্রমণ করেছিল নিশ্চিত জয়ের আশায়, তাদের সে আশা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল - যেনো আল্লাহ্ তাদের এক অংশ নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। ওহুদের যুদ্ধে মক্কাবাসীরা যে প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয়, এমনকি তারা মুসলমান শহীদদের উপরে যে বর্বরোচিত আচরণ করে তা যুগ যুগ ধরে কলঙ্কিত অধ্যায়রূপে তাদের জন্য বিশ্ববাসীর ঘৃণাই কুড়াবে। এটাও আল্লাহ্র তরফ থেকে তাদের প্রাপ্য শাস্তি। তাদের এই নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক ব্যবহারই হয়তো মক্কাবাসীদের মধ্যে যারা বিবেকবান তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে দেয়, মুসলমানদের মহত্ব তাদের মুগ্ধ করে। এই ঘটনার পরেই খালেদ-বিন-ওয়ালিদ শুধু যে ইসলাম গ্রহণ করেন তা-ই নয়, তিনি ইসলামের ঝাণ্ডা উত্তোলনকারীদের মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছিলেন। এই সেই খালিদ-বিন-ওয়ালিদ যিনি ওহুদের যুদ্ধের সময়ে গিরিপথে মুসলিম সৈন্যদের অনুপস্থিতিতে তার সুযোগ গ্রহণ করে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে মুসলমানদের বিপর্যস্ত করেন। তিনি অত্যন্ত কুশলী বীর যোদ্ধা ছিলেন। পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ে তিনি মুসলিমদের পুরোধায় ছিলেন এবং সিরিয়া ও ইরাক জয় করে তিনি যোদ্ধা হিসেবে বিশ্ব বিখ্যাত হন। এ হিসেবেও আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় কাফেরদের এক অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে মুসলিমে রুপান্তরিত হয়।
১২৯। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
৪৪৯। বদর এবং ওহুদের যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য এক পথ নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পথ নির্দেশক এই জন্য যে এর শিক্ষা সে যুগে যেমন প্রযোজ্য ছিল, অদ্যাবধিও তা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে সমভাবে না বলে বলা যায় এর দিক-নির্দেশনা এ যুগে আরও বেশি করে মুসলিম সমাজের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ্র সাহায্য বা করুণা তখনই পাওয়া যায় যখন আমাদের মধ্যে বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা, চেষ্টা, আন্তরিকতা, শৃঙ্খলা, একতা, ন্যায়পরায়ণতা প্রভৃতি গুণের জন্মলাভ করে। যে ব্যক্তি বা জাতির মধ্যে উপরের গুণাবলীর জন্ম নেবে অবশ্যই সে ব্যক্তি বা জাতি হবে সফলকাম - ইহকালে এবং পরকালেও। ভেবে দেখার বিষয় মুসলিম জাতি হিসেবে আমরা এসব গুণ বর্তমানে কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি। যারা ঐসব গুণ অর্জন করতে পারে না তারা সফলকাম হয় না সত্য, কিন্তু আল্লাহ্র করুণার ধারা তাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায় না। তাঁর করুণা-ধারায় বিশ্বজগৎ আপ্লুত। আল্লাহ্র করুণা বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, ইসলামের শত্রু-মিত্র, সকলের জন্য সমভাবে প্রবাহিত। অবিশ্বাসী, অবিশ্বস্ত, মিথ্যাবাদী, অন্যায়কারী আল্লাহ্র করুণা বা রহমত ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না।ফলে তারা সফলকাম হতে পারে না। আল্লাহ্র পরিকল্পনা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নাই। ওহুদের যুদ্ধের পরে খালিদ-বিন-ওয়ালিদের মতো বীর যোদ্ধা, যিনি ইসলামের গৌরব, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ওহুদের যুদ্ধে বিপর্যয় এবং মক্কাবাসীদের নিষ্ঠুরতা খালেদ-বিন-ওয়ালিদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে দেয়। পাপীকে অনুতাপের সুযোগ দান আল্লাহ্র এক বিশেষ দয়া। আমরা যাদের অবিশ্বাসী মনে করি, পাপী মনে করি, হয়তো তাদের মধ্যেও নিশ্চয়ই অনেক ভালো গুণ আছে যার জন্য আল্লাহ্ তাদের বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে হেদায়েত করতে চান। আমাদেরও আল্লাহ্ সেই সুযোগ করে দিচ্ছেন তাদের উদাহরণের মাধ্যমে, যেনো আমরা আমাদের নিজেদের মূল্যায়ন করতে পারি। অন্ধ অহংকারে নয়, গর্বের সাথে নয়, বিনয়ের সাথে আমাদের চরিত্রে কোন কোন গুণের অভাব তা বিশ্লেষণ করি এবং আত্ম-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আত্ম উন্নতির চেষ্টা করি তবেই আমরাও হব সফলকাম।
রুকু - ১৪
৪৫০। দেখুন সূরা ২, আয়াত ২৭৫ এবং এর টীকা। পূর্বের আয়াতে [৩ : ১২৯] আল্লাহ্র ক্ষমাশীলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এমনকি তাঁর এই ক্ষমাশীলতা শত্রুর জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। যারা বিপথগামী, যারা তাদের পার্থিব ধন বৃদ্ধির আশায় অপরকে শোষণ করে, অত্যচার করে, তাদের জন্যও আল্লাহ্র করুণার অভাব হয় না। গরীবকে শোষণ করার, অত্যাচার করার অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে সুদ প্রথা। সুদ হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় দান, স্বার্থহীনতা, কল্যাণপ্রচেষ্টা এবং আল্লাহ্ ও মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার ঈমানী দাবীর ঠিক বিপরীত।
৪৫১। সত্যিকারের উন্নতি ও সফলতা লোভে নয়, বরং বিলিয়ে দেয়ার মধ্যে নিহিত - যে দেয়ার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে আল্লাহ্র নির্দেশ মানার জন্য, আল্লাহ্র সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আল্লাহ্র সৃষ্টির কল্যাণের জন্য নিজের জীবন ও সম্পদকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়া।
১৩২। এবং আল্লাহ্ এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যেনো তোমরা [আল্লাহ্র] অনুগ্রহ লাভ করতে পার।
১৩৩। তোমার প্রভুর ক্ষমা লাভের উদ্দেশ্যে দ্রুত ধাবমান হও। এবং সেই জান্নাতের জন্য [প্রতিযোগিতা কর] যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের সমান ৪৫২, যা প্রস্তুত করা হয়েছে পূণ্যাত্মাদের জন্য।
৪৫২। দোযখের তুলনা করা হয়েছে আগুনের সাথে। এই উপমা আমরা আগের আয়াতে [৩ : ১৩১] পেয়েছি। আর বেহেস্তের সুখ ও শান্তিকে তুলনা করা হয়েছে বাগানের সাথে। এখানে এবং সূরা হাদীদেও উল্লেখ করা হয়েছে যে বেহেস্তের ব্যপ্তি আসমান ও যমীনের ন্যায়। এই কথাটি প্রতীকধর্মী। এর গূঢ় অর্থ একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন।
৪৫৩। এখানে 'সৎ কর্মপরায়ণ বা 'মোমেন বান্দার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তারাই সৎ কর্মপরায়ণ বা মোমেন বান্দা, যারা পার্থিব অর্থ সম্পদ শুধু নিজের ভোগের জন্যই ব্যয় করে না, তারা তা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য পরের হিতার্থে ব্যয় করে। তারা পার্থিব অর্থ-সম্পদ, মেধা-মননশক্তি, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি অর্থাৎ এই পার্থিব পৃথিবীতে যা কিছু আল্লাহ্র নেয়ামত তা তারা কুক্ষিগত না করে স্রষ্টার সৃষ্টির সেবায় তারই সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করে। এই ব্যয় করার মনোবৃত্তি বা উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ। সুতরাং তাদের এই মনোবৃত্তি প্রাচুর্যের সময়ে যেমন বিদ্যমান থাকবে, ঠিক সমভাবে বিদ্যমান থাকবে যখন প্রাচুর্য্য থাকবে না। অন্যকে সেবার মনোবৃত্তি-ই হচ্ছে আল্লাহ্র কাছে কাম্য। এর সাথে অর্থ সম্পদের সম্পর্ক খুব কম। অর্থ সম্পদ ছাড়াও অসচ্ছল অবস্থায়ও অন্যের সেবায় নানাভাবে নিজেকে নিয়োজিত করা যায়। মানুষের বিপদে আপদে সাহায্যের হাত বাড়ানোও হচ্ছে নিজেরে উদ্দ্যম বা শক্তিকে দান করা। মোমেন ব্যক্তিরা দুঃখ কষ্ট বা অপরের দুর্ব্যবহারে বিক্ষুব্ধ হয় না। কিংবা যদি তাদের নিজেদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় তখনও তারা অবিচল থাকে - কারণ তারা সর্বদা আল্লাহ্র মঙ্গলময় ইচ্ছার কাছে সমর্পিত। বরং দুঃখের তিমির রাতে তারা আরও গভীরভাবে আল্লাহ্র ভালোবাসা, আল্লাহ্র রহমত পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়। তাদের এই চেষ্টা হয় আরও প্রবল।
এই কথাটিকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবে প্রকাশ করেছেন-
"নম্রশিরে সুখের দিনে
তোমার মুখ লইব চিনে
দুঃখের রাতে নিখিল ধরা
যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়"।
দুঃখ কষ্টের মধ্যে নিপতিত মোমেন বান্দা বা সৎকর্মশীল বান্দা তার দানের হাত আরও প্রসারিত করে, স্রষ্টার করুণা লাভের আশায়। তারা তাদের দুঃখ দুর্দশার জন্য কাউকে এমন কি নিজের ভাগ্যকেও দোষারোপ করে না। মোমেন বান্দার হৃদয় অন্যের প্রতি রাগ বা দ্বেষ পোষণ করে না, সে কখনও অন্যের দোষত্রুটি খুঁজবে না। সে সর্বদা ব্যাকুল থাকে তার নিজস্ব ত্রুটির অন্বেষণে, যে ত্রুটির কারণে তার এই দুঃখ-দুর্দশা। কারণ আল্লাহ্ তো বারে বারে বলেছেন সুখ-সমৃদ্ধি আল্লাহ্র দান। দুঃখ-দুর্দশা মানুষের নিজেরই কর্মফল। মানুষ নিজেই নিজের আত্মার ক্ষতি করে। তাই মোমেন বান্দা কোনও অবস্থায়ই অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে না বা দোষারোপ করা থেকে নিবৃত্ত থাকে। দুঃখের অমানিশাতে সে স্রষ্টার কাছে তার নিজের দোষ ত্রুটি খুঁজে পেতে চেষ্টা করে এবং স্রষ্টার কাছে সর্বান্তকরণে তার দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।
৪৫৪। অন্যায়, অশ্লীল এবং গর্হিত কাজ যা আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন তা করলে আত্মার মাঝে যন্ত্রণা বা অবনতি হয়। আত্মার ভিতরে এক প্রকার যন্ত্রণার উদ্ভব হয়। এই যন্ত্রণ আত্মাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করে। আল্লাহ্র নূরে আত্মা আলোকিত হতে বাধাগ্রস্থ হয়। একেই বলা হচ্ছে আত্মার প্রতি জুলুম বা wornged their own soul। মু'মিন বান্দারা কোনও অবস্থায়ই ভুল-ভ্রান্তির উর্ধ্বে নয়। তারাও সাধারণ মানুষ, ভুল-ভ্রান্তি তাদেরও হয়, তাদেরও অসম্পূর্ণতা রয়েছে। যদি কোনও মু'মিন বান্দা অসতর্ক অবস্থায় কোনও অশ্লীল কাজ করে ফেলে বা তার দ্বারা কোনও পাপ সংঘটিত হয় তাহলেও হতাশ হওয়ার কিছু নাই, কারণ আল্লাহ্ আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন তাঁকে স্মরণ করতে, তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে, তাঁর চাইতে বড় ক্ষমাশীল আর কে আছে ? যদি এই ক্ষমা চাওয়া আন্তরিক হয় তবে অবশ্যই আল্লাহ্ বান্দার গুনাহ্ মাফ করবেন। 'আন্তরিক' অর্থাৎ সে সেই অশ্লীল পথ, অন্যায় পথ চিরতরে ত্যাগ করবে। তবেই আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়া যাবে।
৪৫৫।যুলুম বা পাপ এক ধরণের আত্মার শাস্তি। কারণ আমরা দৈহিক সুখের জন্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা পসরা সাজিয়ে বসি। ভাবি জীবনের উপকরণ আমাদের সুখের সন্ধান দিতে পারবে। এই সুখের সন্ধান করতে গিয়ে আমরা ন্যায়-অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলি, সত্য-অসত্য পথের নিদর্শন মুছে ফেলি, ভাবি পার্থিব এবং জাগতিক বস্তু সম্ভারই আমাদের সুখের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারবে। আমরা ভুলে যাই আমাদের এই দেহের ভিতরে বাস আমাদের আত্মা। তার জন্য এত আয়োজনের প্রয়োজন নাই। তার সুখ আল্লাহ্র সান্নিধ্যে। তার যন্ত্রণা অশ্লীল কাজে, পাপে। আমাদের পাপ দ্বারাই আমরা আমাদের আত্মাকে যন্ত্রণায় নিক্ষিপ্ত করি, পরিণামে আমরা সৃষ্টিকর্তার রহমত ধারণে অক্ষম হই। ধারণ কথাটি বললাম এই জন্য যে, আল্লাহ্র রহমত পাপী পূণ্যাত্মা সকলের জন্য সমভাবে রহমান। পাপীরা তা ধারণ করতে অক্ষম তাদের আত্মার যন্ত্রণার জন্য। পরিণতিতে তাদের প্রতি নেমে আসে বিপদ বিপর্যয়। এটাকে এসব ব্যক্তিরা চিহ্নিত করতে প্রয়াস পায় অদৃষ্টকে দোষারোপ করে, বা আল্লাহ্র কোপানল, বা কোনও অশুভ শক্তির অশুভ তৎপরতা ভেবে। আত্মার পাপের এই যন্ত্রণাকেই "নিজের প্রতি যুলুম" বা "Wronged their own soul" কথাটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।
১৩৭। তোমাদের পূর্বে বহু রকম জীবন ব্যবস্থা গত হয়েছে। পৃথিবী ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা সত্যকে ত্যাগ করেছিলো তাদের শেষ পরিণতি কি ঘটেছে ৪৫৬।
৪৫৬। "Our little systems have their day.
They have their day and cease to be:
They are but broken lights of Thee,
And Thou, 0 Lord! art more than they."
- Tennyson [In Memorium]
একমাত্র আল্লাহ্র বিধানই সত্য এবং পৃথিবীতে চিরস্থায়ী। টেনিসনের উদ্বৃত কবিতার মত জীবনের আর সবকিছুই অস্থায়ী। পৃথিবীতে যারা আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী ন্যায় ও সত্যাশ্রয়ী তারা পৃথিবীতে এবং পরকালেও সৌভাগ্যের অধিকারী। যারা আল্লাহ্র পথ অর্থাৎ ন্যায় ও সত্যের পথ ত্যাগ করে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ্ কুরআন শরীফে আ'দ, সামুদ, হযরত নূহ (আঃ) এর লোক এবং হযরত লুত (আঃ) এর কাহিনীর মাধ্যমে এই সত্যই প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশ ভ্রমণ করতে বলা হয়েছে এই সত্যকে অনুধাবন করতে। কত সভ্যতা, কত জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের অনুধাবন করতে বলা হয়েছে তাদের শৌর্য, বীর্য এবং অনুধাবন করতে বলা হয়েছে তাদের পতনের কারণ। দেখা যাবে এ সব সভ্যতার উত্থানের কারণ সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা এবং পতনের কারণ একটাই আল্লাহ্র বিধান থেকে পদস্খলন।
[উপদেশঃ দেশভ্রমণ করা আল্লাহ্র হুকুম। দেশ ভ্রমণ মানুষকে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আনে, এই সংস্পর্শ তাকে তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন করতে শেখায়। যা ভালো তা গ্রহণ করার এবং যা মন্দ তা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা জন্মে। মানুষের চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত হয়। সত্য ও ন্যায়কে অনুধাবনের ক্ষমতা বাড়ে। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সে অনুধাবন করতে পারবে যে পৃথিবীতে "সত্যই" স্থায়ী আর সবই অস্থায়ী। এই বোধ আত্মাকে করে আলোকিত। আত্মাকে করে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের উপযোগী। তাই আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে দেশ ভ্রমণ করার। মুত্তাকীদের জন্য দিশারী ও উপদেশ। - অনুবাদক।]
১৩৯। সুতরাং দিশাহারা হয়ো না এবং হতাশও হয়ো না। যদি তোমরা প্রকৃত ঈমানদার হও তবে তোমরাই কর্তৃত্ব লাভ করবে।
১৪০। যদি কোন আঘাত তোমাদের স্পর্শ করে, ৪৫৭, তবে নিশ্চিত হও, অনুরূপ আঘাত তাদেরও লেগেছিলো। [ভালো-মন্দের] এরূপ দিনগুলির পর্যায়ক্রমে আবর্তন মানুষের মধ্যে আমিই ঘটাই; যেনো আল্লাহ্ মুমিনগণকে জানতে পারেন। এবং তোমাদের মধ্য থেকে কতককে শহীদরূপে গ্রহণ করতে পারেন। এবং যারা পাপ করে আল্লাহ্ তাদের পছন্দ করেন না।
৪৫৭। এই আয়াতটি ওহুদের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়। আল্লাহ্ এখানে ওহুদের বিপর্যয়ের পর মু'মিনদের বলছেন : (১) যারা সত্যের জন্য যুদ্ধ করে আহত হয়েছে তাদের আহত স্থানের ব্যথা এবং বেদনা আছে সত্য, তবে তাদের এক বিরাট সান্ত্বনার স্থান হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস। কারণ তারা জানে তারা যুদ্ধ করেছে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, তাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়। আল্লাহ্ তাদের সান্ত্বনা দেবেন, শান্তি দেবেন, পুরস্কার দেবেন। কাফেররা যা সাধারণভাবে বলা যায় অন্যায়কারীরাও একই ধরণের আঘাত পেয়ে আহত হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও বৃহত্তর বা মহত্তর উদ্দেশ্য নাই। সুতরাং এই যন্ত্রণা বা কষ্টে তাদের কোনও অংশীদার নাই ভাগ করে নেয়ার; যেটা মু'মিন বান্দাদের আছে। (২) সাফল্য ও ব্যর্থতা, জয় বা পরাজয় প্রতিটি মানুষের জীবনেই পালাক্রমে আসে। নিরবিচ্ছিন্ন সুখ বা নিরবিচ্ছিন্ন দুঃখ সংসারে নাই। এ কথা মনে রাখতে হবে সাফল্য বা ব্যর্থতা সবই আল্লাহ্র দান। ব্যর্থতা বা পরাজয় বা দুঃখের দিনগুলিতে হতাশাগ্রস্থ হওয়া বা অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। ওহুদের যুদ্ধের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্ মুসলমানদের জীবনের এক বিরাট শিক্ষা দিয়েছেন যা অমূল্য। ঠিক সেইরকম জীবনের কোন না কোনও ত্রুটির কারণেই আমাদের উপরে বিপদের কালো মেঘ, অশনি সংকেত করে। সে সময়ে আল্লাহ্র উপরে ভরসা করে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আমাদের সেই সব ত্রুটি বিচ্যুতি। আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ্র সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বুঝতে পারি না। আমাদের জ্ঞানে আমরা দেখি শুধু আংশিক। সুতরাং যে কোনও দৈব-দুর্বিপাকে হতাশ বা ধৈর্যহীন হওয়া উচিত নয়। (৩) দুঃখ কষ্ট, বিপদ-আপদ, ব্যর্থতা, লাঞ্ছনা, ব্যাথা-বেদনার মধ্য দিয়েই বিকাশ লাভ করে ব্যক্তির চরিত্রের প্রকৃত গুণাবলী। দুঃখের অমানিশাতে, বিপদের অশনি সংকেতের মাঝে যে একমাত্র আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে ধৈর্য্যরে সাথে, দৃঢ়তার সাথে, অবিচলভাবে ধীরস্থিরভাবে বিপদকে অতিক্রম করতে পারে সে-ই তো মু'মিন। আল্লাহ্ ঐসব মু'মিনদের বিপদের পরীক্ষার মাধ্যমে চিনে নিতে চান। (৪) ইসলাম ও ইসলামের স্বার্থরক্ষার জন্য সংগ্রামে যে মৃত্যুবরণ করে সে হয় শহীদ। শহীদের মৃত্যু আল্লাহ্র চোখে অত্যন্ত সম্মানের। যেমন, হযরত হামযার শাহাদাৎ সারা মুসলিম জাহান শ্রদ্ধার সাথে, গৌরবের সাথে স্মরণ করে- এর কারণ আল্লাহ্ তাঁকে এই সম্মানে ভূষিত করেছেন। (৪) আমাদের চরিত্রের যদি কোনরূপ দোষত্রুটি থাকে আল্লাহ্ বাধা-বিপত্তির মধ্যে দিয়ে সেই দোষত্রুটি পরিশুদ্ধ করে নেবেন। (৬) পাপীদের আল্লাহ্ সাময়িক সুযোগ দান করেন, যেনো পাপীরা নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনে। এই উদাহরণ আমরা ওহুদের যুদ্ধেই দেখতে পাই। মুসলমানদের উপর বর্বরোচিত আচরণ, অমানবিক ব্যবহার, সর্বোপরি শহীদদের উপর অমানুষিক অত্যাচার কুরাইশদের পাপের পাত্র পূর্ণ করে দেয়। কারণ এর ফলে কুরাইশদের মধ্যে যারা বিবেকবান তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়। তারা এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে কুরাইশদের উপর থেকে তাদের সমর্থন তুলে নেয়। এর ফলে খালেদ-বিন-ওয়ালিদের মত বীর যোদ্ধাও ইসলাম গ্রহণ করেন। দেখুন সূরা ৩, আয়াত ১২৭ ও টীকা নং ৪৪৮।
৪৫৮। পরিশোধন দু'অর্থে ব্যবহৃত : (১) ওহুদের যুদ্ধে মুনাফিকদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয় এবং মুসলমানদের তাদের থেকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। (২) আল্লাহ্র পরীক্ষা হচ্ছে দুঃখ-ব্যাথা, বিপদ-আপদ, ব্যর্থতা, লাঞ্ছনা অতিক্রমের পরীক্ষা। এ পরীক্ষা এক মহাপরীক্ষা। দুঃখের অমানিশাতে যে অবিচলভাবে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করতে পারে সে-ই তো মু'মিন। কারণ দুঃখ বা বিপদকে অতিক্রমের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই ব্যক্তির চরিত্র গুণাবলীতে ভূষিত হয়। ভীতু হয় সাহসী, দুর্বল হয় শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসহীন পরিণত হয় আত্মবিশ্বাসীতে। ফলে যারা ঈমানে দুর্বল তারা দুঃখের পথ আল্লাহ্র উপরে একান্ত ভরসা করে অতিক্রম করার ফলে তাদের ঈমানের ভিত্তি হয় মজবুত ও সুদৃঢ়। আমাদের চরিত্রকে বিকশিত করতে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা বাড়াতে, সংগ্রামী জীবনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এভাবে আল্লাহ্ আমাদের পরিশোধন করেন। এর উদাহরণ আমরা পাই, ওহুদের যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) আহত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ় ও অবিচল। তাঁর এই চারিত্রিক দৃঢ়তা অন্যান্য যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মুসলমানদের নূতন জীবন দান করে। তাদের মধ্যে ঈমানের দৃঢ়তা সঞ্চারিত হয়। রাসূল (সাঃ) এর যন্ত্রণার পরিবর্তে মুসলমানেরা ঈমানের দৃঢ়তা লাভ করে। আল্লাহ্র পরীক্ষায় মুসলমানেরা জয় লাভ করে।
৪৫৯। দেখুন সূরা ২, আয়াত ২১৪।
১৪৪। মুহম্মদ একজন রাসূল বৈ আর কিছু নয় ৪৬০। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে। যদি তার মৃত্যু ঘটে বা সে নিহত হয়, তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে [অবিশ্বাসীরূপে] ? যদি কেউ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহ্র কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বরং যারা কৃতজ্ঞতার সাথে [আনুগত্য করে]; আল্লাহ্ শীঘ্র তাদের পুরষ্কৃত করবেন।
৪৬০। এই আয়াতটি ওহুদের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়। রণক্ষেত্রের যখন বিধ্বস্ত অবস্থা তখন গুজব রটে গেলো যে আল্লাহ্র নবী নিহত হয়েছেন। তার ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তিনি সত্যিই গুরুতররূপে আহত হয়েছিলেন। কিন্তু হযরত তালহা, হযরত আবু বকর, হযরত আলী প্রমুখ তাঁকে রক্ষার জন্য তাঁর পাশে এসে দাড়ান। সর্বোপরি রাসূল (সাঃ) এর অবিস্মরণীয় সাহস ও অনমনীয় দৃঢ়তা বিশৃঙ্খল মুসলমানদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর মৃত্যুর গুজব প্রচারিত হওয়ার পরে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, অনেকেই ভয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করতে শুরু করে এরই প্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয়। এই আয়াতে হুঁশিয়ার করা হয়েছে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) একজন আল্লাহ্র দূত ব্যতীত আর কিছু নয়। একদিন না একদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন। তারপরও মুসলমানদের ইসলামের উপর অটল থাকতে হবে। ওহুদের যুদ্ধে সাময়িক পরাজয়, হুজুর (সাঃ) এর আহত হওয়া, তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হওয়া, তার দরুন মুসলমানদের হতোদ্যম হয়ে পড়া প্রভৃতি ঘটনাবলীতে মুসলমানদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলি যা আল্লাহ্ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন তা হচ্ছে : (১) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা রাখা ও তাঁর মাহাত্ম্য স্বীকার করা মুসলমানদের ঈমানের অংশ। কিন্তু সে ভালোবাসা হবে মানুষের জন্য মানুষের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা এবং সর্বোচ্চ ভালোবাসা। সে ভালোবাসা যেনো আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার উপরে স্থান না পায় যে রকম খৃষ্টানরা যীশুকে আল্লাহ্র অংশীদার হিসেবে পূঁজা করে। মুসলমানদের ধর্মের উপর অটল থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর যখন ইন্তেকাল হয় এবং প্রধান প্রধান সাহাবীগণ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন, তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) এই আয়াতটি তেলাওয়াত করে তাদের সম্বিত ফেরান। এই আয়াতের আর একটি সাধারণ উপদেশ : (২) জীবনে চলার পথে নানা বাধা-বিপত্তির মাঝে আমরা অনেক সময়ে বিষন্ন বোধ করি। আমরা ভুলে যাই আল্লাহ্র অস্তিত্ব - যে সত্ত্বা সর্বক্ষণ তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। যদি আমরা তা ভুলে যাই তবে তা আমাদেরই ক্ষতি। যদি আমরা তা স্মরণ করি তবে আমরা কৃতজ্ঞদিগের অন্তর্ভূক্ত হব এবং আল্লাহ্র কর্তৃক পুরষ্কৃত হব।
৪৬১। ওহুদের যুদ্ধে যেসব মুসলমান তীরন্দাজ গণিমতের মালের লোভে স্বস্থান ত্যাগ করে নিশ্চিত জয়কে বিপর্যয়ে পরিণত করেছিল তাদের এই আয়াতে সামান্য শ্লেষের সাথে সম্বোধন করা হয়েছে। সামান্য পার্থিব লোভের দরুন তারা তাদের আত্মাকে বিক্রী করে দিচ্ছিল। অপরপক্ষে যেসব সাহাবীগণ প্রচণ্ড বিপদের মুখে দৃঢ়ভাবে, অমিত সাহসের সাথে হযরত (সাঃ) এর পাশে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের মায়াকে উপেক্ষা করে ইসলামের ঝাণ্ডাকে বুলন্দ রাখার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন দুরদৃষ্টিসম্পন্ন, একনিষ্ঠ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ এক উন্নত মানবগোষ্ঠী। যাঁরা ছিলেন পৃথিবীর লোভ লালসার উর্ধ্বে। এঁদের জন্য আল্লাহ্র তরফ থেকে ইহকাল এবং পরকালে সব সময়েই পুরস্কার আছে। যদি তাঁরা মৃত্যুবরণ করতেন, যেমনটি করেছিলেন হযরত হামজা, তাঁরা জাতির নিকট শহীদের সম্মান পেতেন এবং যদি তাঁরা যুদ্ধে জয় লাভ করে ফিরে আসতেন তবে তারা জাতীয় বীরে পরিণত হতেন। এসব হচ্ছে ইহকালের পুরস্কার, পরকালের পুরস্কার আল্লাহ্র হেফাজতে।
[উপদেশঃ কোনও মহৎ কাজই আল্লাহ্ হারিয়ে যেতে দেন না। মহৎ ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুর পরও পৃথিবীর চোখে সম্মানের সাথে, শ্রদ্ধার সাথে বেঁচে থাকে। মৃত্যুর পরে আল্লাহ্ তাঁকে বেহেশতে সমাসীন করেন। এভাবেই তাঁকে ইহকাল এবং পরকালেও পুরষ্কৃত করা হয়। - অনুবাদক।]
১৪৭। তারা যা বলেছিলো তা হচ্ছে : "হে আমাদের প্রভু ! আমাদের পাপ এবং কোন কর্তব্য কাজে আমরা সীমালংঘন করলে তুমি ক্ষমা কর, আমাদের পদদ্বয়কে [অবস্থান] সুদৃঢ় কর এবং যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য কর।
১৪৮। অতঃপর আল্লাহ্ তাদের এই পৃথিবীতে পুরস্কার দেবেন এবং পরলোকে দেবেন পরমোৎকৃষ্ট পুরস্কার। কারণ আল্লাহ্ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন।
রুকু - ১৬
১৫০। বস্তুতঃ আল্লাহ্ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।
১৫১। শীঘ্রই আমি কাফিরদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করবো। কারণ তারা আল্লাহ্র সাথে শরীক করে থাকে; যার কোন অনুমতি তিনি পাঠান নাই। তাদের আবাস হবে আগুন, পাপীদের আবাস্থল কত নিকৃষ্ট।
১৫২। যখন তোমরা আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে শত্রুদের প্রায় বিনাশ করে ফেরেছিলে, [তখন] আল্লাহ্ তোমাদের সাথে তাঁর অঙ্গীকার অবশ্যই পূর্ণ করেছিলেন, যে পর্যন্ত না তোমরা ভয়ে পিছিয়ে এলে ও নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদের সৃষ্টি করলে ৪৬২ এবং যা [যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্য] তোমরা ভালোবাস তা তোমাদের দৃষ্টিগোচর করানোর পরে তোমরা অবাধ্য হলে। তোমাদের মাঝে কতক ইহকালের [আরাম আয়েশ] সম্বন্ধে লালায়িত ছিলে, কতক পরলোকের [জীবন] আকাঙ্খা করেছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, তোমাদেকে শত্রুদের থেকে ফিরিয়ে দিলেন ৪৬৩। কিন্তু তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দিলেন। যারা বিশ্বাসী আল্লাহ্ তাদের প্রতি করুণাময়।
৪৬২। "নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ করলে" - নির্দেশ ছিল কোনও অবস্থাতেই তীরন্দাজ বাহিনী গিরিপথে তাদের স্থান ত্যাগ করতে পারবে না। শৃঙ্খলাকে কঠোরভাবে রক্ষা করার হুকুম ছিল। ওহুদের যুদ্ধে প্রথম পর্যায়ে মুসলিমগণ জয়যুক্ত হয়েছিলেন এবং কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করছিল। পাহাড়ের গিরিপথে মোতায়েনকৃত মুসলিম সৈনিক দলের এক অংশ তখন হযরত (সাঃ) এর নির্দেশ ভুলে গিয়ে গণিমতের মালের লোভে অন্যান্যদের সাথে মিলিত হয়ে কুরাইশদের পেছনে ধাওয়া করে। তাদের ধারণা হয়েছিল জয়লাভের পর সেখানে অবস্থান নিরর্থক। কুরাইশ বাহিনীর একদল সুযোগ দেখে গিরিপথের ভিতর দিয়ে এসে পিছন দিক থেকে মুসলমানদের আক্রমণ করে। ফলে মুসলমানেরা সম্মুখে এবং পশ্চাতে দুদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ঘটনাটি উল্লেখ করে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা হচ্ছে। দেখুন টীকা ৪৪২।
৪৬৩। উপরে বর্ণিত অবাধ্যতা প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে সুখকর মনে হয়েছিল, তারা শত্রুসেনাদের পিছু ধাওয়া করছিলো, সংগ্রহ করছিলো গণিমতের মাল। যখন গিরিপথের প্রহরা শিথিল হলো তখন শত্রুসেনারা সেই পথে পিছন থেকে মুসলমানদের আক্রমণ করলো। আল্লাহর রহমত এবং রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণের অনমনীয় দৃঢ়তা ব্যতীত সেদিনই মুসলমানদের নাম-নিশানা পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যেতে পারতো।
[শিক্ষণীয়ঃ জীবনের যে কোনও উদ্দেশ্য সফল করতে হলে একাগ্রতা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন। লোভের বশবর্তী হয়ে লক্ষ্যচ্যূত হলে ধ্বংস অনিবার্য। বিপদে বা ব্যর্থতায় হতাশ না হয়ে এবং সাময়িক বিজয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কর্তব্যে শিথিলতা না এনে একাগ্রভাবে লক্ষ্যের প্রতি স্থির থাকাই প্রকৃত মু'মিনের লক্ষণ। - অনুবাদক।]
৪৬৪। ওহুদের যুদ্ধে বাধামুক্ত গিরিপথ দিয়ে এসে খালিদ-বিন-ওয়ালিদ মুসলমানদের পিছন থেকে আক্রমণ করেছিলেন। এই দেখে পলায়নপর কুরাইশ সেনারা ঘুরে সামনে থেকে মুসলমানদের আক্রমণ করে। ফলে মুসলমানেরা শত্রু দ্বারা সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত হয়। মুসলমানদের দু'রকমের ক্ষতি হয় : (১) তারা যে লুটের মালের জন্য হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছিল, তা তাদের সীমানার বাইরে থেকে যায়, (২) তাদের জীবন, এমনকি তাদের লোভের দরুন সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবন-আশাঙ্কা হয়। এই যুদ্ধে বহু মুসলিম সেনা শহীদ হন। এই ঘোর দুর্যোগের মধ্যে তারা তাদের বা তাদের হারানো স্বজনদের জন্য শোক করার সময় বা সুযোগ পায় নাই সত্য, কিন্তু এই বিপর্যয় তাদের সংঘবদ্ধভাবে দৃঢ়তার সাথে দুর্যোগ মুকাবিলা করার জন্য অনুপ্রেরণা জোগালো। মুসলিম সম্প্রদায় এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করে। হযরত (সাঃ) এর আদেশ অমান্য করায় এবং লোভের দরুন মুসলমানেরা সাময়িক দুঃখ পেয়েছে। এটা তাদেরই কর্মফল। এ কথা উপলব্ধি করার পর তাদের দুঃখিত হওয়ার কোনও কারণ নাই। কারণ ওহুদের যুদ্ধের যে বিপদ এসেছিল, তা ছিল আল্লাহ্র তরফ থেকে পরীক্ষা ও শিক্ষাস্বরূপ।
৪৬৫। মুসলমান সেনারা প্রথমে দুদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। তারপর যখন তারা সম্বিত ফিরে পায়, তখন তারা যে অমিত বিক্রম ও সাহস দেখিয়েছিল তা কুরাইশ সেনাদের পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। যুদ্ধ শেষে দিনান্তে যোদ্ধাদের দু'চোখে শান্তির ঘুম নেমে আসে - এ আল্লাহ্রই দান। কারণ তারা যুদ্ধ করেছে ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য তাদের অন্তর সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত। তাই তাদের বিবেক স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ, তাদের মনে থাকে না কোনও দ্বন্দ্ব। ফলে তাদের চোখে নেমে আসে শান্তির ঘুম। কিন্তু যারা মুনাফিক তাদের সম্পর্কে পরবর্তী টীকায় বর্ণনা আছে।
৪৬৬। ওহুদের যুদ্ধের সময়ে মুনাফিকদের যে ভূমিকা ছিল তা-ই এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা কখনও যুদ্ধের ময়দানে যেতো না। শহরের ভিতরে বসে থেকে তারা এমন ভান করতো যে তারা মদিনা শহর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চিন্তা-ভাবনা করছে এবং যুক্তি পরামর্শ করছে। এর কারণ যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা ও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে তারা ভয় পেতো। কিন্তু তাদের এই কার্যকলাপ আর কেউ না জানুক, আল্লাহ্র কাছে তো তা আর অগোচরে থাকে না। তাই তাদের মানসিক শান্তি অন্তর্হিত হয়। ভয়, উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। ফলে তাদের চোখের ঘুম উধাও হয়ে যায়। যারা মুনাফিক, যারা বোকা শুধু তারাই নিজ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য ছলাকলার আশ্রয় নেয়। প্রকৃত জ্ঞানী যারা তারা দায়িত্ব না এড়িয়ে প্রয়োজনে বিপদের মুখোমুখি হয়।
৪৬৭। "পরীক্ষা করেন" - আল্লাহ্র পরীক্ষা আমাদের পার্থিব জীবনের পরীক্ষার মত নয়। পার্থিব জীবনে আমরা পরীক্ষা গ্রহণ করি যাতে আমাদের কোন ছাত্র বা ছাত্রী সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য জানতে পারি। জানতে পারি ঐ ছাত্র বা ছাত্রীর সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর জ্ঞান কতটুকু। কিন্তু আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তাঁর নূতন করে কিছু জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন নাই। তিনি আমাদের অন্তরের
অন্তঃস্থলের সব খবর জানেন। তাহলে পরীক্ষা কিসের ? বিপদ, বাধা, দুঃখ, দুর্দশার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে" পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্র সাহায্যের আশায় আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল করে গড়ে তুলবো - এই আল্লাহ্র ইচ্ছা। মানুষের স্বভাব হচ্ছে "সুখের দিনে ভুলে থাকি, বিপদে তোমায় স্মরি।" তাই বিপদ, দুঃখ, দুর্দশা মানুষের গর্ব, অহংকার ত্যাগ করতে সাহায্য করে এবং মানুষকে বিনয়ী, ধৈর্যশীল এবং আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পণকারীরূপে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। দুঃখের অমানিশাতে, বিপদের অশনি সংকেতের মাঝে যে বান্দা একমাত্র আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল হয়ে, দৃঢ়তার সাথে অবিচলভাবে, ধীরস্থিরভাবে বিপদকে অতিক্রম করতে পারে, সে-ই তো মু'মিন। আল্লাহ্ ঐসব মু'মিনদের বিপদের পরীক্ষার মাধ্যমে দেখে নিতে চান তার সীমিত ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার সে কিভাবে করে। দেখুন সূরা ৩, আয়াত ১৪১।
৪৬৮। আলোচ্য আয়াতটিও ওহুদ যুদ্ধের ঘটনাবলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। ওহুদের যুদ্ধ ছিল জিহাদ। সত্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করাও জিহাদ। ওহুদের যুদ্ধকে এখানে সর্বকালের সর্বযুগের জিহাদের প্রতীক হিসেবে ধরা যায়। সত্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করা প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য বা ফরজ। কিন্তু ওহুদের যুদ্ধে একদল যুদ্ধ করতে ভয় পেয়েছিল। কারণ হিসেবে এখানে আল্লাহ্ বলছেন যে তাদের কৃত কোন পাপ কাজই তাদের জিহাদের মর্যাদা অনুধাবনে ব্যর্থ করেছিল। শয়তান তাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তিনি আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলের চিন্তা-ভাবনা খোলা বই এর মত পাঠ করেন। আল্লাহ্ আমাদের কর্মকে বিচার করবেন কর্মসম্পাদনের সময়কার নিয়তের দ্বারা। তিনি পরম করুণাময় ও মহাজ্ঞানী। আমাদের দোষক্রুটি, অবহেলা আল্লাহ্ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ্ তাদের আরও সুযোগ দেন, সম্ভবতঃ তারা তাদের ভুল বুঝে নিজস্ব কর্তব্য করার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।
রুকু - ১৭
৪৬৯। চরিত্রের দৃঢ়তা নির্ভর করে ঈমানের উপরে। যার ঈমান যত দৃঢ় অর্থাৎ 'বিশ্বাসের' ভিত্তি যত মজবুত, তার চরিত্র তত মহৎ গুণাবলীতে ভূষিত হয়। সে হয় দৃঢ়চেতা, নির্ভিক, কর্তব্যে কঠোর, দয়ালু ইত্যাদি। যার বিশ্বাসের ভিত্তি দুর্বল সে-ই ; (১) মৃত্যুকে ভয় পায়। (২) কর্তব্যকর্মকে দৃঢ়ভাবে সম্পাদনের সাহস রাখে না। সৎভাবে উপার্জনের জন্য দেশের বাইরে যাওয়া বা সত্য ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করা এদের ভীত করে তোলে। ভীত আত্মায় দুশ্চিন্তার জন্ম হয়। ফলে চিত্ত হয় বিভ্রান্ত ও সন্ত্রস্ত। অন্তরের অস্থিরতা আল্লাহ্র তরফ থেকে পাওয়া শাস্তি; আবার অন্তরের শান্তি আল্লাহ্র তরফ থেকে পাওয়া পুরস্কার। অনেকের ধারণা পার্থিব বস্তু সামগ্রীই সুখের ও শান্তির আলয়ে পৌঁছে দিতে পারে। যার সব আছে বলে ধারণা, তার মত হাহাকারে ভরা মানুষ হয়তো দ্বিতীয় নাই। সুখ বা দুঃখকে আমরা নিজের নিজের পরিবেশ, মানসিকতা এবং অভিজ্ঞতা দিয়েই নিরূপণ করি, তাই নিজের সুখটাই অন্যের সুখ বলে মনে করি। ব্যক্তি বিশেষ, অবস্থা বিশেষ, পরিবেশ বিশেষে সুখের সংজ্ঞা যে কত পরিবর্তিত হয় তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার ক্ষমতা আমাদের অনেকেরই নাই। অন্তরের সুখ ও শান্তি সৃষ্টি, বস্তু দ্বারা সম্ভব নয়, এর একমাত্র মালিক আল্লাহ। যদি আল্লাহ্র উপর দৃঢ় বিশ্বাস থাকে, ঈমান থাকে নির্ভেজাল, তবে তার আত্মা কোনরূপ বিপদ আপদে বিচলিত হবে না। এমনকি সে মৃত্যুকেও ভয় করবে না। কারণ মৃত্যু তাকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করতে সাহায্য করবে, তার তো সারা জীবনের সাধনাই ছিল আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ। কোন বিপদ, বিপর্যয় তাকে ভীত করতে পারবে না, কারণ সে জানে জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই সংঘটিত হবে না। যদি আল্লাহ্র ইচ্ছা থাকে মৃত্যু, তবে বাড়ীতে পথে-ঘাটে যে কোন জায়গাতেই তা ঘটতে পারে। এমনকি সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে বাস করেও মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না। যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন তাকে জীবিত রাখবেন, তবে বিপদ ও বিপর্যয় তার জন্য আরও মহত্তর পুরষ্কার বয়ে আনে। হয়তো তার দৈহিক মৃত্যু ঘটে, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও তার যশ, বিজয় গৌরব, তাঁকে অমর করে রাখে। আল্লাহ্র রাস্তায় যদি কেউ সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ্ বলছেন তার কোন চিন্তা নাই, কারণ : (১) ন্যায় ও সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হচ্ছে জিহাদ। জিহাদে মৃত্যুবরণ করা হচ্ছে শাহাদাৎ বরণ করা। শাহাদাৎ লাভ আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। তাঁর ক্ষমা ও করুণা পাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ [৩ : ১৫৭]। (২) বিশ্বাসী বা ঈমানদার ব্যক্তি জানে যে মৃত্যুর পরে সে কোনও অচেনা অজানা দেশে যাচ্ছে না, যে দেশ সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নাই। সে জানে সে তার স্রষ্টা করুণাময় আল্লাহ্র কাছে নীত হচ্ছে [৩ : ১৫৮]। যাঁর করুণা ও ক্ষমা সে পাবে। (৩) বিশ্বাসী বা ঈমানদার ব্যক্তিদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, মৃত্যুর পর তারা আল্লাহ্র কাছে নীত হবেই - আল্লাহ্ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবে। সেখানে সব বিশ্বাসীদের একত্র করা হবে [৩ : ১৫৮]। কত শান্তিদায়ক এবং সুখের হবে সে মিলন। অপরপক্ষে যারা অবিশ্বাসী তাদের সুখ, শান্তি সবই পার্থিব। এই পার্থিব জীবন ত্যাগ করে অচেনা ভুবনে পাড়ি জমানোর চিন্তা তাদের ভীত করে তোলে। ফলে আল্লহ্ তা তাদের দীর্ঘশ্বাস ও মনস্তাপের কারণে পরিণত করেন। অপরপক্ষে ঈমানদার ব্যক্তিরা আল্লাহ্র সাথে মিলনের জন্য ব্যগ্র হয়ে থাকে।
৪৭০। "যা তারা জমা করে" - এই তারা হচ্ছে অবিশ্বাসীরা। আয়াতটি শুরু হয়েছে "তোমরা" দিয়ে। এই "তোমরা" হচ্ছে যারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে। যদি এদের কথা উল্লেখ করা থাকতো তাকে বলা হতো "তোমরা যা জমা করো"। অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা পার্থিব ধন সম্পদের পাহাড় গড়তে এবং এর সংরক্ষণ করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। এ সবই তাদের জীবন অপেক্ষা প্রিয়। কিন্তু আল্লাহ্ বলছেন যারা আল্লাহ্র পথে নিহত হয়, তাদের জন্য আছে আল্লাহ্র ক্ষমা ও দয়া - যা ঐসব ধন-দৌলতের অপেক্ষা শ্রেয়ঃ।
১৫৯। এটা আল্লাহ্র করুণার অংশ যে, তুমি তাদের সাথে কোমলতার সাথে ব্যবহার কর ৪৭১। যদি তুমি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতে, তবে তারা তোমার নিকট থেকে দূরে সরে যেতো। সুতরাং [তাদের দোষক্রুটি] উপেক্ষা কর এবং তাদের জন্য আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, এবং [সর্ব] কাজ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। তারপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করবে। যারা আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল আল্লাহ্ তাদের ভালোবাসেন।
৪৭১। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর চরিত্র ছিল অত্যন্ত কোমল, দয়ালু, শান্ত স্বভাবসম্পন্ন ও অমায়িক। এসব গুণ-বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) এর মধ্যে থাকা আল্লাহ্রই রহমতের ফলশ্রুত। রাসূল (সাঃ) এর আর একটি উপাধি ছিল, "তিনি বিশ্বজগতের জন্য আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ।" এই কোমলতা, সদ্ব্যবহার, ক্ষমা প্রদর্শন, দয়া, করুণা যদি তাঁর মধ্যে না থাকতো তবে মানুষের সংশোধনের যে গুরু দায়িত্ব তাঁর উপরে দেয়া হয়েছিল তা যথাযথরূপে সম্পাদিত হতো না। রাসূল (সাঃ) কঠোর প্রকৃতি হলে মানুষ তাঁর থেকে দূরে সরে যেতো। তাঁর কোমলতা, দয়া, মানুষের দুর্বলতার জন্য তাঁর যন্ত্রণা ভোগ করার উদাহরণ, বিশেষতঃ ওহুদের যুদ্ধের পরে, ইত্যাদি গুণাবলীই লক্ষ লক্ষ লোকের হৃদয় তাঁর দিকে আকৃষ্ট করে এবং তারা ইসলামে সত্যের সন্ধান পায়।
১৬১। কোন রাসূলের পক্ষে তাঁর নিকট রাখা গচ্ছিত মাল [কখনও] গোপন করা সম্ভব নয় ৪৭২। কোন ব্যক্তি যদি এ কাজ করে, শেষ বিচারের দিনে যা সে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করেছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অতঃপর প্রতিটি আত্মার যা কিছু সে [পৃথিবীতে] অর্জন করেছে তা পরিশোধ করতে হবে। কারও প্রতি অন্যায় আচরণ করা হবে না।
৪৭২। ওহুদের যুদ্ধে গণিমতের (যুদ্ধলব্ধ) মালের মধ্য হতে একটি চাদর পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন এক ব্যক্তি বলেছিল যে, হয়তো হযরত (সাঃ) তা নিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে আয়াতটি নাজিল হয়। হযরত (সাঃ) যে শুধুমাত্র কোমল হৃদয় ছিলেন তা-ই নয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও বিশ্বাসভাজন, যে কারণে তাঁকে নবুওয়াতের পূর্বেই আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু যারা নিজেরা নীচ এবং অবিশ্বস্ত, তারাই অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ নিজের নীচতা, হীনতা, অবিশ্বস্ততার উর্ধ্বে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব। মুনাফিকরা নিজেরা কোন কাজে বা কারও ব্যাপারে বিশ্বস্ত নয়, সুতরাং সে অন্য লোকদেরও তার সমকক্ষ মনে করে। তাই ওহুদের যুদ্ধে গণিমতের মাল নিয়ে মুনাফিকরা সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও বিভেদের বীজ বপন করার প্রয়াস পায়। যে ব্যক্তি সন্দেহ প্রবণ তার সন্দেহ থেকে আল্লাহ্র নবীও রেহাই পান না, তারা কাউকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু নীচ সন্দেহপ্রবণের সন্দেহ আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। এখানে এই আয়াতে আমাদের জন্য আল্লাহ্ কিছু শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরেছেন। (১) আল্লাহ্র নবীগণ কখনোই কোন কাজ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করেন না। (২) যারা এই ধরণের কাজ করে তারা অতি নিকৃষ্ট ধরণের মানুষ এবং তারা কখনোই লাভবান হতে পারে না। (৩) একজন লোভী মানুষকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, আল্লাহ্র নবীগণকে কখনোই সেভাবে বিচার করা যায় না। (৪) আল্লাহ্র বিচারে পৃথিবীতে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আছে। এবং আমাদেরকে অবশ্যই এই ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের চিনতে হবে ও এই শ্রেণীবিন্যাসকে বুঝতে হবে। যদি আমরা আমাদের নেতাকে বিশ্বাস করি, তবে কোন কারণ ছাড়া তাঁর সততাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা কখনোই আমাদের উচিত হবে না। অসৎ ব্যক্তি কখনোই নেতা হবার যোগ্যতা রাখে না।
১৬৩। আল্লাহ্র দৃষ্টিতে তারা বিভিন্ন স্তরে [বিভক্ত] তারা যা করে আল্লাহ্ তা সব দেখেন।
১৬৪। আল্লাহ্ মুমিনদের বিশেষ অনুগ্রহ প্রদান করেছেন ৪৭৩, যখন তিনি তাদের নিজেদের মধ্যে থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন, যে তাদের নিকট [কোরআনের] আয়াত সমূহ আবৃত্তি করে, তাদের পরিশোধন করে, এবং কিতাব [কোরআন] ও জ্ঞান [হিকমত] শিক্ষা দেয়, যদিও তার পূর্বে তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিলো।
৪৭৩। দেখুন সূরা ২, আয়াত ১৫১।
৪৭৪। ওহুদের যুদ্ধে 'মুসলমানদের যা ক্ষতি হয়েছিল, বদরের যুদ্ধে মক্কাবাসীদের তার দ্বিগুণ ক্ষতি হয়েছিল; এই আয়াতে সেই কথারই উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয় মুসলমান তীরন্দাজদের লোভের কারণেই বিপর্যয় ঘটেছিল, কিন্তু সামগ্রিক পরিকল্পনাই ছিল আল্লাহ্র। কারণ আল্লাহ্ তাঁর প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা যাচাই করতে চেয়েছিলেন। এই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছিল, তাদের ঈমানের দৃঢ়তা, আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা, বিশ্বাসের পবিত্রতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই বিপর্যয়ের মধ্যে মুসলমানদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় ছিল আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সাহায্য পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে জীবন দিয়েও সংগ্রাম করতে হয়। হুকুম অমান্য করে এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে যে বিপর্যয় তারা ঘটিয়েছিল তার জন্য তারাই দায়ী, তাদের লোভ দায়ী। তাদের এই লোভের শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ্ খালিদ-বিন-ওয়ালিদকে বিপর্যয় স্বরূপ প্রেরণ করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ পরীক্ষা করে নিলেন সত্যিকারের কারা মৃত্যুর মুখেও আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত, ঈমানে অটল। আর কারা সুযোগ সন্ধানী।
৪৭৫। "মু'মিনগণের পরীক্ষার জন্য"- অর্থাৎ পরীক্ষা করবার জন্য। দেখুন টীকা ৪৬৭, সূরা ৩, আয়াত ১৫৪।
৪৭৬। "মুনাফিকদের জানার জন্য" - মুনাফিকদের পরীক্ষা অর্থাৎ তাদের নিয়ত বা উদ্দেশ্য জানা। আল্লাহ্ মুনাফিকদের অন্তরের উদ্দেশ্য জানেন। আল্লাহ্র কাছে কারও মনের ক্ষুদ্রতম কথাও গোপন থাকে না। কিন্তু এই ঘটনার মাধ্যমে মুনাফিকদের বলা হয়েছে আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করতে, নিদেনপক্ষে শত্রুদের শহরে প্রবেশে বাধা দিতে। এতে মুনাফিকরা মুসলমানদের সে আহবান এড়িয়ে যায়। মুসলমান সম্প্রদায়ের মঙ্গল তাদের কাম্য নয়। বরং তাদের অন্তর মুসলমানদের জন্য অমঙ্গলই কামনা করে। কারণ তারা মুনাফিক। তাদের কথা ও অন্তরে মিল নাই। এরা মুখের ভাষায় মুসলমান, এরা ভান করে, কিন্তু ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। এরা আত্মসুখ-সর্বস্ব, সর্বদা নিজের সুখ-সুবিধা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। নিজের জ্ঞাতি বা সমাজের অসম্মান বা বিপর্যয়ে এদের কিছু যায় বা আসে না। সুতরাং তারা যুদ্ধের আহবান এড়িয়ে যায়, যুদ্ধ না জানার ভান করে। আল্লাহ্ বলছেন, এদের অন্তর কাফেরদেরই সমতুল্য। ধর্মের কারণে তারা জীবন ত্যাগ করতে রাজী না হলেও, নিজের মাতৃভূমি রক্ষার জন্যও যুদ্ধ করা উচিৎ। কারণ ভালো নাগরিকের তা-ই দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু এ কষ্টও তারা করতে নারাজ। এরা মুনাফিক। এরা শুধু সুবিধা চায়।
১৬৯। যারা আল্লাহ্র পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনও মৃত মনে করো না। বরং তারা জীবিত ৪৭৭। তারা তাদের প্রভুর সান্নিধ্যে জীবনোপকরণ লাভ করছে।
৪৭৭। সত্যের জন্য জীবনদানকারী শহীদদের সম্বন্ধে একটি চমৎকার বর্ণনা আছে এই আয়াতে। বলা হয়েছে এরা জীবিত। 'জীবিত' কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে বৃহত্তর, মহত্তর অর্থে। অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মের মনে ও স্মৃতিতে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে এই কথা বলে। অমর আত্মার জীবন এই পৃথিবীতে এবং পরকালেও। কিন্তু অমর শব্দটির প্রয়োগ হয়তো এখানে ঠিক নয়। কারণ, নাস্তিকেরা বিশ্বাস করে দেহের সাথে সাথে সব শেষ। তারা আত্মার অমর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু মু'মিন ব্যক্তি আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করে। পৃথিবীর অস্থায়ী যাত্রাপথের শেষে মৃত্যুর দুয়ার পেরিয়ে আত্মা প্রবেশ করে অনন্ত জীবনে, তার স্বীয় স্থায়ী আবাসস্থলে।
১৭১। আল্লাহ্র নিয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং ঈমানদারদের শ্রমফল আল্লাহ্ বিন্দুমাত্র হারিয়ে যেতে দেন না।
৪৭৮। যারা শাহাদাৎ বরণ করবেন, তাঁরা শুধু যে আল্লাহ্র নেয়ামত ও অপার শান্তি লাভ করবে ও বেহেশতে বাস করবে তা-ই নয়, তাদের এই আনন্দ শান্তি আরও বৃদ্ধি পাবে এই ভেবে যে, তারা তাদের ভালোবাসার জনদের দুঃখ, বিপর্যয় ও অপমান থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। "তাদের কোনও ভয় নাই, তারা দুঃখিতও হবে না।" এ বাক্যটির অন্য আরেকটি অর্থও হতে পারে। শহীদদের মৃত্যুর জন্য তাদের প্রিয়জনদের কোন দুঃখ প্রকাশের কোন কারণই থাকবে না, বরং তারা সেই মহৎ মৃত্যুর জন্য গর্ববোধ করবে।
রুকু - ১৮
৪৭৯। ওহুদের যুদ্ধের প্রাথমিক বিপর্যয়ের পরে মুসলমানদের সম্বিৎ ফিরে এলো, তারা দ্রুত আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) কে রক্ষা করার জন্য তাঁর চারিপাশে সমবেত হলেন। যদিও তাঁরা প্রত্যেকে আহত হয়েছিলেন, তবুও তাঁরা আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) কে রক্ষা করার জন্য নিজেদের শারীরিক যন্ত্রণাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, হযরতের জীবন রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হন। তাঁরা আহত অবস্থায়ই কুরাইশ বাহিনীর পশ্চাৎধাবণ করেন। তাঁদের অমিত বিক্রম দেখে আবু সুফিয়ান তার দলবল নিয়ে প্রস্থান করে। কিন্তু যাবার আগে মুসলমানদের শাসিয়ে দিয়ে যায় যে পরের বছর "বদর সুগ্রা" নামক স্থানে তারা আবার মুসলমানদের ধ্বংসের জন্য ফিরে আসবে। তাদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহবান মুসলমানেরা গ্রহণ করেন এবং পরের বছর যথাস্থানে মুসলমানেরা সমবেত হয়। কিন্তু, কুরাইশরা সেখানে অনুপস্থিত থাকে। মুসলমানেরা অক্ষত অবস্থায় এবং সম্মানের সাথে ফিরে আসেন। ফিরে আসার সময়ে তারা সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন এবং প্রভুত ধন-সম্পদ লাভ করেন। এতে শুধু যে তাদের পার্থিব লাভ হয় তা-ই নয়, আত্মসম্মান রক্ষার্থে, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকল্পে, আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করার সঙ্কল্পের দরুন তাদের মানসিক বল বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
১৭৪। এবং তারা আল্লাহ্ নিকট থেকে প্রাপ্ত ঐশ্বরিক করুণা ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিলো। কোন অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করে নাই। কারণ তারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অনুসরণ করেছিলো। এবং আল্লাহ্ সীমাহীন অনুগ্রহের মালিক।
১৭৫। এরাই মন্দ [শয়তান] লোক যারা তোমাদের তাদের বন্ধুদের ভয় দেখায়। তাদের থেকে ভয় পেয়ো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে [শুধু] আমাকেই ভয় কর।
১৭৬। যারা অবিশ্বাসে [কুফরীতে] হটকারী ও ত্বরিতগতি, তাদের আচরণ যেনো তোমাকে দুঃখিত না করে। তারা আল্লাহ্র সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারবে না। আল্লাহ্র পরিকল্পনায় পরলোকে তারা [শান্তির] সামান্যতম অংশ লাভ করবে না; শুধুমাত্র দুঃসহ শাস্তি ছাড়া।
১৭৭। যারা ঈমানের মূল্যে অবিশ্বাস ক্রয় করে, তারা আল্লাহ্র সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারবে না। তাদের জন্য দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অপেক্ষা করছে।
১৭৮। অবিশ্বাসীরা যেনো মনে না করে যে, আমার দেয়া অবকাশ তাদের জন্য মঙ্গলজনক। আমি তাদের অবকাশ [শাস্তি স্থগিত] দেই যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়। তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে ৪৮০।
৪৮০। যদি কেউ অনুতপ্ত না হয়ে পাপ করে যেতেই থাকে, তবে তার পাপের পাত্র একদিন পূর্ণ হবেই। পাপীর পাপের ক্ষুধা ক্রমাগত বেড়েই চলে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। একটি পাপ আর একটি পাপকে আকর্ষণ করে। যেমন- একটি পূণ্য আর একটি পূণ্যকে। যেহেতু আল্লাহ্ মানুষকে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দান করেছেন, পাপীদের কখনই আল্লাহ্র রহমত পেয়ে ধন্য হতে ইচ্ছা করবে না। আল্লাহ্ পাপীদের পৃথিবীতে আরাম আয়েশের উপকরণ প্রভুত পরিমানে দান করেন যাতে তারা নিজেদের অপরাধ প্রবণতায় অধিকতর এগিয়ে যায়। কারণ আল্লাহ্র করুণা পাওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সে যোগ্যতা গ্রহণে অস্বীকার করে। আল্লাহ্র করুণা পাওয়ার পূর্ব শর্তই হলো পাপ ও অন্যায় থেকে দূরে থাকা। আর যে এই পূর্বশর্তকে অস্বীকার করে তার পক্ষে আল্লাহ্র করুণা পাওয়া সম্ভব নয়। যারা আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত, তাদের কাছে অন্যায়, পাপ, লোভ-লালসা অর্থাৎ পৃথিবীর যাবতীয় ভোগবিলাসকে রমণীয় মনে হবে। তারা দ্রুত পাপের কর্দমাক্ত পথে তলিয়ে যাবে। এ-ই আল্লাহ্র আইন এই পৃথিবীর জন্য। আইন কথাটি এমনভাবে প্রয়োগ হয় যা অলঙ্ঘনীয়। যেমন- আলো সরল রেখায় চলে- পানির গতি নিম্নমুখী ইত্যাদি। এগুলি বস্তু জগতের জন্য আল্লাহ্ প্রণীত আইন। যাকে আমরা বলি ভৌত বিজ্ঞানের আইন (Laws of physical science) । ঠিক সেই একইভাবে আধ্যাত্মিক জগতের জন্যও আল্লাহ্র আইন আছে যার কথা পূর্বে বলা হয়েছে। সে আইন হচ্ছে যারা ন্যায় ও সত্য পথে চলে তারা আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হবে। যারা ন্যায় ও সত্য পথকে পরিহার করে অন্যায় ও পাপের পথে ধাবিত হয়, তারা আল্লাহ্র রহমত পাওয়ার অযোগ্য। সূর্য্যকিরণের সাথে আল্লাহ্র রহমতকে তুলনা করা যায়। আল্লাহ্র রহমত সকলের জন্যই সমভাবে বিচ্ছুরিত। সুউচ্চ প্রাচীর যেমন সূর্য কিরণের গতিপথে বাঁধা সৃষ্টি করে আলোর রাজ্যকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়। ঠিক সেইরূপ পাপ ও অন্যায় পাপীর হৃদয়ে আল্লাহ্র করুণার বোধ পৌঁছুতে বাঁধা সৃষ্টি করে।
৪৮১। সৎ কর্মপরায়ণ ব্যক্তিকে আল্লাহ্ বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে পরীক্ষা করে নেন। বিপদে, দুঃখে, 'সবর' ধারণ করা এবং হতাশ না হয়ে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করা এবং তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করাই হচ্ছে মু'মিন বান্দার লক্ষণ। "মু'মিনগণকে সেই অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না" - কথাটির অর্থ পরীক্ষার মাধ্যমে মু'মিনদের আত্মা খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত হয় আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা নির্ভর করে মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি"র প্রয়োগের উপর। এই ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগে সে ইচ্ছা করলে দুঃখে বিপদে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে ধৈর্য্য ধারণা করতে পারে, আল্লাহকে খুশী করার জন্য সত্য ও ন্যায়ের জন্য আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদে আত্মত্যাগ করতে পারে। এখানেই তার পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে মু'মিন বান্দার চরিত্রের দৃঢ়তা, বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
৪৮২। "অদৃশ্য লোকের রহস্য তিনি তোমাদের নিকট প্রকাশ করবেন না।" কারণ মানুষ খুব দুর্বল। ভবিষ্যতের অতল গহবরে আমাদের জন্য কি লুকিয়ে আছে তা আমরা জানি না। হয়তো আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আমাদের জন্য মৃত্যু নির্ধারিত আছে, কিন্তু যেহেতু তা আমরা জানি না, আমরা নিশ্চিন্তভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে পারি। জানা থাকলে আমাদের পক্ষে নিশ্চিন্তে কাজ করা সম্ভব হতো না, প্রতিটি মূহুর্ত আমাদের জন্য হয়ে উঠতো বিষময়। কিন্তু আল্লাহ্ নবীদের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে, আমাদের মৃত্যুর পরবর্তী ভবিষ্যত জীবন সম্বন্ধে জ্ঞান দান করেছেন। সেই জীবন হবে অমর। সেই অমর জীবনের সুখ-শান্তির চাবি-কাঠি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ) উপরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সৎকর্মপরায়ণ হওয়া।
৪৮৩। "Of the gifts which Allah hath given them of His Grace" বাংলায় বলা যায় "সেইসব দান যা আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে দিয়েছেন"। আল্লাহ্র নেয়ামত হচ্ছে আল্লাহ্র অনুগ্রহ। বহু বাংলা অনুবাদে এই অনুগ্রহকে টাকা পয়সার নিরিখে অনুবাদ করা হয়েছে। আল্লাহ্র নেয়ামত বা অনুগ্রহ শুধুমাত্র টাকা পয়সা হতে পারে না। বিশ্বজগতের যা কিছু সবই তাঁর নেয়ামত বা দান। এটা হতে পারে অর্থ-সম্পদ, বিষয়-সম্পত্তি, খাদ্য-পানীয়, পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি বস্তুগত দান যা আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে স্পর্শ করতে পারি। আবার আল্লাহ্র অনেক নেয়ামত আছে যা স্পর্শাতীত, যেমন - ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, জনবল, প্রভাবশালী বংশে জন্ম, বুদ্ধি, বিশেষ দক্ষতা, স্বাস্থ্য, দৈহিক সৌন্দর্য্য, প্রতিভা ইত্যাদি। আর এক ধরণের আল্লাহ্র নেয়ামত আছে, তা হচ্ছে বিবেক (spiritual gift)। আল্লাহ্র নেয়ামতের মধ্যে বান্দার চরিত্রে যে কোন ধরণের নেয়ামতের প্রকাশ ঘটুক না কেন তা শুধু কুক্ষিগত করে রাখা পাপ। আমাদের নিজ প্রয়োজনের পরে এই নেয়ামত কেউ যদি সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত না করে কুক্ষিগত করে রাখে তবে আল্লাহ্র চোখে তা অত্যন্ত গর্হিত। একে আল্লাহ্ তীব্রভাবে নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। দেখুন টীকা নং-২৭।
৪৮৪। যারা আল্লাহ্র নেয়ামতকে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় না করে কুক্ষিগত করে রাখে তাদের অবস্থা সুন্দর রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এই পৃথিবীতে আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতে যে ব্যক্তি অন্য কাউকে অংশীদার করে নাই, কৃপণের মতো তা নিজের অধিকারে কুক্ষিগত করে রেখেছে সেই নেয়ামত কিয়ামতের দিনে তার গলায় বেড়ীর মত বেষ্টন করে রাখবে। সে প্রাণপণে চাইবে সেই বেড়ী ভেঙ্গে ফেলতে, কিন্তু সে তা করতে সক্ষম হবে না। বাইবেলে বর্ণিত আছে "They will hang like a millstone round his neck"। অর্থাৎ যাঁতার পাথরের মত গলার চারিপাশে ঝুলে থাকবে। ব্যক্তি তার ধন-সম্পদ বা অন্যান্য নেয়ামত অর্থাৎ মেধা, বুদ্ধি, প্রতিভা ইত্যাদি আল্লাহ্ তাকে যা দিয়েছেন তার অংশে সে কাউকে শরীক করে নাই। সে কৃপণের মত তার নেয়ামতকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। এই নেয়ামত যে আল্লাহ্র বিশেষ দান এ কথা সে ভুলে যায়। সে ভুলে যায় কেয়ামতের দিনে আল্লাহ্র এই বিশেষ দানের হিসেবে দিতে হবে। সে এই বিশেষ দানকে তার নিজস্ব সম্পদ মনে করে। ফলে মৃত্যুর পরও তার এই মানসিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় না। রূপকের সাহায্যে বলা হচ্ছে ঐ বিশেষ নেয়ামতের দাসত্ব দুনিয়াতে করেছে, মৃত্যুর পরও সে তারই দাসত্বের পরিচয় বহন করবে। কিন্তু পৃথিবীতে এই দাসত্ব আরামদায়ক মনে হলেও মৃত্যুর পরে এই দাসত্ব প্রচণ্ড কষ্ট দেবে। তার স্বার্থপরতা তার গলার চারিপাশে শক্তভাবে পেঁচিয়ে থেকে তার ভিতরে যন্ত্রণার সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ আত্মার যন্ত্রণা এমন রূপ ধারণ করবে তা যেনো ফাঁসির কষ্টের সমতুল্য।
৪৮৫। এখানে আর একটি সুন্দর রূপকের অবতারণা করা হয়েছে। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে অর্থ-সম্পদ, বিষয়-সম্পত্তি অথবা প্রতিভা, যথা- মেধা, কাব্য, সঙ্গীত, শিল্প, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিভা, সব কিছুকেই আমরা মনে করি ব্যক্তিগত। এগুলি আমাদের নিজস্ব কৃতিত্বের পরিচয় বলে সমাজে স্বীকৃত এবং আমরাও আমৃত্যু সেই ধারণাই বহন করে থাকি। কিন্তু আল্লাহ্ বলছেন "আসমান যমীনের স্বত্বাধিকারী একমাত্র আল্লাহ।" এই পৃথিবীতে মানবমন্ডলী যে বিশেষ বিশেষ গুণে গুণান্বিত তা আল্লাহ্রই দান। আমরা শুধুমাত্র এসবের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে, মানবতার জন্য, সৃষ্টির সেবার জন্য এই নেয়ামতসমূহের সঠিক ব্যবহার করা। কারণ এর হিসেব আল্লাহকে দিতে হবে, একমাত্র আল্লাহই এসবের মালিক। আমরা শুধুমাত্র এর পাহারাদার। সুতরাং কোনও বিশেষ নেয়ামতে ধন্য হলে তা নিয়ে আমাদের গর্ব বা অহংকার করার কিছুই নাই। কারণ তা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।
৪৮৬। "কে আল্লাহ্কে উত্তম ঋণ দেবে ?" - এই আয়াত [২ : ২৪৫] অবতীর্ণ হওয়ায় ইহুদীরা ঠাট্টা করে বলেছিল, "তোমাদের আল্লাহ্ অভাবগ্রস্থ তাই তিনি ঋণ চান।" দান বা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করাকে রূপকের সাহায্যে বলা হয় 'আল্লাহকে ঋণ দেওয়া'। আল্লাহ্র নবী (সাঃ) প্রায়ই জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে উপরের [২ : ২৪৫] আয়াতটি বলতেন। ইহুদীরা ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে বলতো, 'আল্লাহ্ অভাবগ্রস্থ, আমরা অভাবমুক্ত'। আল্লাহ্র প্রতি অবমাননাকর কথা বলা তাদের চরিত্রের অংশ - ইতিহাসই তার প্রমাণ দেয়। কারণ আল্লাহ্র নবী ও রাসূলগণকে হত্যা করে তারা এ কথাই যুগে যুগে প্রমাণ করেছে।
৪৮৭। "অন্যায়ভাবে হত্যা" - এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করা হয়েছে সূরা ৩, আয়াত ২১ ও ১১২ তে।
৪৮৮। দেখুন সূরা ২, আয়াত ৯৫ এবং তার টীকা ১০০।
৪৮৯। এই আয়াতে ইহুহীদের অপবাদ ও মিথ্যারোপের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে কোন কোন নবী এ ধরণের মু'জিজা দেখাতেন। কুরবাণী দিয়ে তাঁরা অপেক্ষা করতেন। আকাশ থেকে আগুন এসে যদি কুরবাণীর পশুকে ভস্মীভূত করে দিত, তাহলে বোঝা যেতো যে কুরবাণী আল্লাহ্ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। হযরত আদম (আঃ) এর পুত্র হাবীলের কুরবাণী কবুল হওয়া [২ : ২৭] সম্পর্কেও এইরূপ বলা হয়েছে। কিন্তু হযরত মুসা সম্বন্ধে ইহুদীরা এই দাবী করতো - তা সত্য নয়। কারণ হযরত মুসা (আঃ) সম্বন্ধে এরূপ মু'জিজা কুরআন সমর্থন করে না। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ Leviticus ix-24 এর বর্ণনা অনুযায়ী "And there came a fire out from before the Lord, and consumed upon the alter the brunt offering and the fat"। হযরত মুসা (আঃ) এর ৯টি মু'জিজা ছিল, কিন্তু এরপরেও ইহুদীরা কি হযরত মুসা (আঃ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নাই ? সেরূপ মহানবী (সাঃ) এর মাধ্যমে যদি মু'জিজা প্রকাশ পেতো তবুও ইহুদীরা ঈমান আনতো না।
৪৯০। এই আয়াতে তিনটি জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে। (১) সুস্পষ্ট নিদর্শন (baiyinat), (২) যুবুর (Zubur), (৩) কিতাব-ইল-মুনীর (Kitab-il-Munir) ১নং কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ৩নং সূরার ৬২ নং আয়াতের টীকাতে। সেখানে হযরত ঈসার প্রেক্ষিতে এই নিদর্শনের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই নিদর্শনকে যদি সর্বজনীনভাবে বর্ণনা করা হয় তবে বলা যায় আল্লাহ্র নবীদের আল্লাহ্র দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন বা মু'জিজা দান করা হয়েছিল। ফেরাউনকে প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্ন নিদর্শনসমূহ হযরত মুসাকে দান করেছিলেন। ২নং 'যুবুর' কথাটির ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে 'Scriptures' এবং বাংলায় "অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থ।" এই শব্দটি এসেছে মূল শব্দ 'যাবারা' থেকে, যার অর্থ কঠিন। এর অর্থ এই দাঁড়াতে পারে যে, সে সময়ের সাধারণ লোকদের পক্ষে নবীদের পাওয়া ধর্মগ্রন্থ অনুধাবন করা অত্যন্ত দুরূহ ছিল। এই ধারণা থেকেই উপরোক্ত শব্দটির উৎপত্তি। তবে অনুবাদকগণ এ ধারণায় সকলেই একমত নন। ডেভিড বা দাউদ নবীর রচিত প্রার্থনাসঙ্গীত এরই অন্তর্গত। ৩নং এর আক্ষরিক অর্থ সম্বন্ধে কোনরূপ দ্ব্যর্থতাবোধক মতামত থাকার কথা নয়। "The book of enlightenment" বা দীপ্তিমান কিতাব। দীপ্তিমান কিতাব অর্থ হচ্ছে নৈকিত মূল্যবোধ পরিচালনার ভিত্তিস্বরূপ যে কিতাব। কুরআন হচ্ছে সেই মহাগ্রন্থ যার মধ্যে আছে চরিত্রের মাধুর্য্য ও গুণের উৎকর্ষ সাধন করে সুন্দর জীবন যাপন প্রণালীর পথনির্দেশিকা। কুরআনের মূল নির্দেশ হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করার উপায়, যার মাধ্যমে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ সম্ভব। পাপে নিমজ্জিত আত্মা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভে বঞ্চিত হয়। যে আত্মা গুণান্বিত ও আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করেছে সে আত্মা আলোকিত আত্মা। সেই দিক থেকে দীপ্তিমান কিতাব কথাটি সঠিকভাবেই প্রযোজ্য।
৪৯১। "Every soul shall have a taste of death" - অনেক বাংলা অনুবাদ হয়েছে, "জীব মাত্রেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।" আত্মা অমর। তার সুদীর্ঘ যাত্রাপথে পঙ্কিলতা ভরা পৃথিবীকে সে অতিক্রম করে নশ্বর দেহ তরণীকে আশ্রয় করে। তারপর একদিন এই দেহরূপ তরণীকে পুরনো কাপড়ের মত ত্যাগ করে আত্মার যাত্রা শুরু হয় পরলোকে - অন্য ভুবনে, অন্য জগতে। কিন্তু দেহের মৃত্যু হবে, যে দেহ এত সুদীর্ঘকাল আত্মার সাথীরূপে বিরাজ করেছে। যার মাধ্যমে সে পৃথিবীর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, ভোগ করেছে পৃথিবীর রূপ, রস ও গন্ধকে। দেহের মৃত্যুর যে অভিজ্ঞতা সে অভিজ্ঞতাও আত্মাকে ধারণ করতে হয়। তাই বলা হয়েছেঃ taste of death বা মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ করবে। কিন্তু মৃত্যু নয় - কারণ আত্মা অমর। এই পৃথিবীর জীবন ছিল আত্মার জন্য শিক্ষানবীশকাল। এই শিক্ষানবীশকালের হিসাব তাকে দাখিল করতে হবে আল্লাহ্র কাছে পরকালে এবং এই সময়ের দক্ষতার উপরেই নির্ধারিত হবে পরকালে তার সম্মান বা অবস্থান। অনুবাদ হিসেবে "জীবমাত্রই" কথাটির পরিবর্তে "আত্মামাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে" কথাটি অধিক প্রযোজ্য। কারণ জীবমাত্রই তার আত্মা নাই, জীবন আছে। যেমন পশু, পাখী, প্রাণী, বৃক্ষ - এদের জীবন আছে, কিন্তু আত্মা নাই।
৪৯২। লংফেলোর একটি প্রার্থনা সঙ্গীত আছে যা এরূপ "All this world's a fleeting show. For Man's illusion given"। একমাত্র সত্য হচ্ছে যখন আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। পৃথিবীর জীবন হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী - পরকালের জীবনই হচ্ছে স্থায়ী জীবন। পার্থিব জীবনের জাগতিক সাফল্য কোন সাফল্যই নয়, পরকালের জীবনের সাফল্যই হচ্ছে আসল সাফল্য।
৪৯৩। এ কথা কেউ যেনো মনে না করে যে, ধন দৌলত ও বিষয় সম্পত্তিই হবে পরকালে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতার একমাত্র বিষয়বস্তু। আল্লাহ্ আমাদের মধ্যে যাকে যে নেয়ামত দিয়েছেন [টীকা ২৭] যেমন- প্রতিভা, মেধা, জ্ঞান, সুযোগ-সুবিধা সব কিছুরই হিসাব দিতে হবে পরকালে। এমনকি জীবনে চলার পথের বাধা-বিপত্তি, তা অতিক্রম করার প্রচেষ্টা সাহস, দৃঢ়তা, ধৈর্য্য ইত্যাদি সব - সবকিছুরই হিসাব দাখিল করতে হবে পরকালে। অর্থাৎ এই পৃথিবীর জীবনে আমাদের বৃহৎ কাজ আবার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ আমাদের আচরণ, আমাদের মূল্যবোধ, এক কথায় আমাদের ব্যক্তিত্বের বা চরিত্রের প্রকাশই হবে আমাদের জবাবদিহিতার বিষয়বস্তু। এই কথাকেই প্রকাশ করা হয়েছে "জীবন সম্বন্ধে" বাক্যাংশ দ্বারা এগুলির মাধ্যমেই আমাদের বিশ্বাসেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে। আমাদের ঈমান বা বিশ্বাস হতে হবে লৌহের মত দৃঢ় পাহাড়ের মত অটল।
৪৯৪। 'সত্য' বা আল্লাহ্র আইন হচ্ছে যে কোনও মানুষের বা জাতির জন্য পবিত্র আমানত। এই আমানত যাদের কাছে তারা তা রক্ষা করবে, প্রচার করবে, প্রকাশ করবে এবং অন্যকে পরিস্কারভাবে আল্লাহ্র আইন শিক্ষা দিবে। আল্লাহ্র এই বাণী সবার জন্য, সর্বকালের সর্বযুগের। সুবিধাভোগী পাদ্রী বা পুরোহিত শ্রেণী এই আদেশের বিরোধীতা করে। কারণ তারা দাবী করে তারাই মানুষের সাথে আল্লাহ্র যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। সবচেয়ে জঘন্য যা এই সুবিধাভোগী শ্রেণী করতো তা হচ্ছে, তারা সত্যকে পদদলিত করে যা তাদের জন্য সুবিধাজনক শুধুমাত্র তা-ই গ্রহণ করতো। তারা স্থায়ী লাভের পরিবর্তে ক্ষণস্থায়ী লাভ ক্রয় করে। তাদের জন্য পরকালে মহাশাস্তি।
৪৯৫। দেখুন সূরা ২, আয়াত ১০১।
৪৯৬। এই আয়াতটি ইহুদীদের সম্বন্ধে নাজিল হয়। ইহুদীরা (১) ধর্মীয় জ্ঞান গোপন করতো। (২) তারা আশা করতো সৎকর্ম না করা সত্বেও তাদের প্রশংসা করা হোক। যদিও এই আয়াতটি ইহুদীদের প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েছে, তবে এর আবেদন সর্বজনীন। ইহুদীদের মতই, মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা সর্বদা নিজেকে জ্ঞানী ও প্রশংসার পাত্র বলে জাহির করতে ব্যস্ত। ইহুদীরা জিহাদ সমাগত হলে ছলচাতুরী করে ঘরে বসে থাকতো এবং এভাবে জিহাদ থেকে অব্যাহতি লাভের আনন্দ উদযাপন করতো এবং রাসূলে করীম (সাঃ) যখন ফিরে আসতেন, তাঁর সামনে মিথ্যা কসম খেয়ে নানা অজুহাত বর্ণনা করতো এবং আশা করতো যে, তাদের এহেন কাজের জন্য প্রশংসা করা হোক। সেইরূপ আজকের যুগেও কুরআনের এই উপদেশ প্রযোজ্য। মুনাফিক যারা তারা আত্মপ্রশংসার জন্য লালায়িত। তারা সমাজে দুঃখ-দুর্দশার, কষ্ট-ঝামেলার সৃষ্টি করবে, কিন্তু আশা করবে সবাই তাদের প্রশংসা করুক। তারা হয়তো আল্লাহ্র বিধান বা আইনকে পদদলিত করে, হয়তো বা তাদের কাছে আল্লাহ্র দেয়া বিধান অপেক্ষা মিথ্যা গর্ব ও জাঁকজমক অধিক প্রিয়, তারা তাদের অন্যায় কাজকেও প্রশংসার দাবীদার মনে করে। এদের জন্য আল্লাহ্র শাস্তি অবধারিত।
৪৯৭। দেখুন সূরা ২, আয়াত ১৬৪। এই আয়াতটি পূর্বোক্ত [২ : ১৬৪] আয়াতেরই অনুরূপ। এখানে দু'টি উপমার ব্যবহার করা হয়েছে। যেখানে পূর্বোক্ত আয়াতে ছয়টি বা সাতটি উপমা ব্যবহার হয়েছে। দু'টির কারণ এই নয় যে, এই দু'টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দু'টির কারণ তা আমাদের পূর্ববর্তী সাতটি আয়াতের স্মরণ করিয়ে দেবে। কারণ এ সবগুলি উপমাই মহিমান্বিত আল্লাহ্র রহমতের বর্ণনা করে।
৪৯৮। এখানে বলা হয়েছে, "দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে"। এই কথাটির অর্থ প্রতীকধর্মী। অর্থাৎ জীবনের চলার পথে সকল অবস্থায়ই আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। উপরোক্ত শব্দগুলির সাহায্যে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে আমাদের জীবনের সকল অবস্থায়, যথা - ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় যে কোনও স্থানে যে কোনও অবস্থায় আমাদের অন্তর যেনো এক মূহুর্তের জন্যও আল্লাহকে ভুলে না যায়, প্রত্যেকটি কাজে আল্লাহ্র সম্মতি আছে কি-না বা আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান তা অনুমোদন করে কি-না তা যাচাই করে, সর্বদা তাঁকে স্মরণ করে, তাঁর কাছে সাহায্য কামান করে, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এসব প্রকাশ যে সরবে হতে হবে তা নয়। হতে পারে অন্তরেও। কারণ আমাদের অন্তরের সাথে আল্লাহ্র প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিন্তা বা ভাবনা সবই আল্লাহ্ সব সময়ই জানতে পারেন। সুতরাং জীবনের সর্বাবস্থায় তাঁকে স্মরণ করতে বলা হয়েছে। জীবনের সাফল্য, ব্যর্থতা, জয়, পরাজয়, সুখে-দুঃখে, সর্বদা নিজেকে আল্লাহ্র চিন্তায় ব্যপৃত রাখতে বলা হয়েছে।
৪৯৯। আল্লাহ্ তা'আলার সীমাহীন মাহাত্ম্য ও রহমত অবগত হওয়া একটি উচ্চ পর্যায়ের ইবাদত। সীমাহীন সৃষ্টির উপর যে লোক চিন্তা-ভাবনা করে সে অবশ্যই অনুধাবন করবে যে এসব সৃষ্টি নিরর্থক নয়। এ সবের সৃষ্টির পিছনে হাজারো তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। সে সমস্তকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়ে মানুষকে চিন্তা-ভাবনা করার আমন্ত্রণ জানানোতে তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। সে সমস্তকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়ে মানুষকে চিন্তা-ভাবনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবী তাদের কল্যাণের জন্য তৈরী। একমাত্র নিঃস্বার্থ সৃষ্টির সেবার মধ্যে দিয়ে পার্থিব দাসত্ব থেকে আত্মা মুক্তি লাভ করতে পারে। পার্থিব জিনিসের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ আত্মাকে আল্লাহ্র চিন্তা-ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, ফলে আত্মার ভিতরে যন্ত্রণার জন্ম লাভ করে। মৃত্যুর পরে এই যন্ত্রণা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে দোযখের আগুনের রূপ নেবে। অপরপক্ষে আল্লাহর স্মরণে, সৃষ্টির সেবায়, সৎকর্মের দ্বারা আত্মা প্রশান্তি লাভ করে। আত্মায় এক অনাবিল সুখ ও শান্তির সৃষ্টি হয়। এই প্রশান্তি বেহেশতি হওয়ার পূর্বাভাস। এ-ই হচ্ছে আত্মার মুক্তি বা দোযখের আগুন থেকে মুক্তি।
১৯৩। "হে আমাদের প্রভু ! আমরা এক আহবানকারীকে [আমাদের] ঈমানের দিকে আহবান করতে শুনেছি, 'তোমরা প্রভুর দিকে ঈমান আন ?' এবং আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের প্রভু ! আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা কর, আমাদের দোষত্রুটি দূর করে দাও এবং সৎকর্মপরায়ণদের সহগামী করে তুমি আমাদের আত্মাসমূহ গ্রহণ কর।
১৯৪। "হে আমাদের প্রভু ! তোমার রাসূলগণের মাধ্যমে যা তুমি আমাদের দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা দান কর, এবং শেষ বিচারের দিনের অপমান থেকে আমাদের রক্ষা কর। নিশ্চয়ই তুমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কর না।"
১৯৫। এবং তাদের প্রভু তাদের [প্রার্থনা] গ্রহণ করেন এবং সাড়া দিয়ে বলেন, "পুরুষ বা নারী কারও কর্ম আমি কখনও হারিয়ে যেতে দেবো না। তোমরা একে অপরের অংশ ৫০০। যারা তাদের নিজ গৃহ ত্যাগ করেছ, এবং সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছ এবং আমার কারণে নির্যাতিত হয়েছ এবং যুদ্ধ করেছ এবং নিহত হয়েছ, অবশ্যই আমি তাদের দোষত্রুটিগুলি দূর করে দেব, এবং তাদের বেহেশতের বাগানে স্থান করে দেবো যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। ইহা আল্লাহ্র নিকট থেকে পুরস্কার ৫০১। এবং আল্লাহ্র নিকট থেকেই আসে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার।
৫০০। "কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ।" ইসলাম পুরুষ ও নারীর সমতায় বিশ্বাসী। আল্লাহ্র চোখে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামে নারী পুরুষের সমতায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে যা অন্যান্য আরও আয়াতে আছে। তবে প্রকৃতিতে লিঙ্গের ভেদাভেদ লক্ষ্য করা যায়। আর এই ভেদাভেদ, সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু আধ্যাত্মিক জগতে, আল্লাহ্র চোখের নারী ও পুরুষের মাঝে কোনও ভেদাভেদ নাই। সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি সবই বাহ্যিক বা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। ধর্মের ব্যাপারে নারীর আত্মা ও পুরুষের আত্মাকে আল্লাহ্র কাছে একইভাবে নীত করা হবে।
৫০১। এই আয়াত এবং ১৯৮ আয়াতে এবং আরও অনেক আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে যে সমস্ত কল্যাণ ও প্রাচুর্য্যরে উৎস আল্লাহ্। এখানে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে যে সুখ, শান্তির বা যে কোনও নেয়ামতের কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহ্। মু'মিন বান্দার আত্মিক সুখ তার সর্ব অস্তিত্বকে ঘিরে রাখে। আর এই সুখ ও শান্তি আল্লাহ্রই দান। রূপকের মাধ্যমে বেহেশতের নেয়ামত বলা হয়েছে। মু'মিন বান্দাদের জন্য আল্লাহ্র সান্নিধ্য অপেক্ষা আর কোনও বড় পুরস্কার নাই। তাঁর জন্য আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ হচ্ছে- জীবনের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
১৯৭। ইহা স্বল্পকালীন ভোগ মাত্র। তাদের সর্বশেষ বাসস্থান হচ্ছে জাহান্নাম। আর উহা কত নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল [শোবার জন্য]।
১৯৮। অপরপক্ষে, যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে, তাদের জন্য আছে [বেহেশতের] বাগান, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা [চিরস্থায়ী রূপে] বাস করবে। ইহা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। আল্লাহ্র নিকট থেকে যা আসে তা পূণ্যাত্মাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট [স্বর্গসুখ]।
১৯৯। এবং কিতাবীদের মধ্যে অবশ্যই এমন লোক আছে যারা আল্লাহ্র প্রতি বিনয়ে অবনত হয়ে আল্লাহ্র [একত্বে] বিশ্বাসী, তোমাদের প্রতি প্রেরিত প্রত্যাদেশে এবং তাদের প্রতি প্রেরিত প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী। এবং তারা আল্লাহ্র আয়াতসমূহ তুচ্ছ মূল্যে বিক্রী করে না। এদের জন্য তাঁদের প্রভুর নিকট পুরস্কার রয়েছে। এবং আল্লাহ্ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।
২০০। হে ঈমানদারগণ ! ধৈর্য্যরে ৫০২ সাথে অধ্যাবসায়ী এবং দৃঢ় হও। এরূপ অধ্যাবসায়ের জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতা কর; [ফলে] পরস্পরকে শক্তিশালী কর। এবং আল্লাহকে ভয় কর যেনো তোমরা সফলকাম হতে পার ৫০৩।
৫০২। সবর কথাটির পূর্ণ অর্থ এখানে প্রকাশ করা হয়েছে। এর পূর্বের আয়াতেও [২ : ৪৫ এবং টীকা ৬১] সবর সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। সবরের পূর্ণ অর্থ হচ্ছেঃ বিপদে বা ব্যর্থতায় ধৈর্য্য ধারণ, হতাশ না হয়ে অধ্যবসায়ের সাথে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া এবং প্রতিযোগী মনোভাব রাখা, দৃঢ়তার সাথে বিপদের মুকাবিলা করা, লোভ-লালসা থেকে আত্মসংযম করা, অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করা ইত্যাদি। এই ধরণের সকল গুণাবলীকেই সবর নামে একটি আরবী শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা যায়। এই সব গুণাবলী চরিত্রে সৃষ্টি করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য ও দায়িত্ব। কারণ তা আল্লাহ্র হুকুম, কুরআনের আইন। যদি আমরা তা করতে পারি তবে তা হবে আল্লাহ্র হুকুম মানা। আর যে আল্লাহ্র হুকুম মানে তার প্রতি আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। ফলে ব্যক্তির চরিত্রে ঐসব গুণাবলীর প্রকাশ অন্য আর দশজনের জন্য উৎসাহ ও উদ্দীপনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হয়। তারা একে অপরের সাথে এসব গুণাবলী অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা করে। এ প্রতিযোগিতা হবে সুষ্ঠু ও সুন্দর। যদি কেউ এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে, তবে তার সাথীরা তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, ফলে সমাজ হয়ে ওঠে সুষ্ঠু ও সুন্দর। এভাবে এসব গুণাবলীপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সমষ্টিগতভাবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করার ইচ্ছা উদ্দীপনা বোধ করে। আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করার ইচ্ছা হবে তাদের সকলেরই মূল লক্ষ্য। এভাবেই একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সুন্দর, সুখী সমাজ গঠন সম্ভব।
৫০৩। 'ফালাহ্' আরবী শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে 'Prosper' এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "সফলকাম"। এই শব্দটির অর্থ অনেক ব্যাপক। আমরা যদি আমাদের চরিত্রে উপরোল্লিখিত গুণাবলী অর্জন করি, তবে আমরা পার্থিব জগতে এবং আধ্যাত্মিক জগতেও উন্নতি লাভ করতে পারবো। পৃথিবীতে সুখ-শান্তিতে বাঁচতে হলে আমাদের পার্থিক সম্পদের যেমন দরকার, ঠিক সমভাবে প্রয়োজন আত্মিক সম্পদের। সুতরাং সফলকাম কথাটির দ্বারা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে, আল্লাহ্র ভালোবাসা পাওয়ার আশায় যারা চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করে, তারা এই পৃথিবীতেই সুখী হয়, অর্জন করে পার্থিব উন্নতি এবং আত্মিক সমৃদ্ধি। সমাজ হয় সমৃদ্ধিশালী।