Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ২ জন
আজকের পাঠক ৪৯ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৬৯৬ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৯২৪ বার
+ - R Print

সূরা রুম


সূরা রুম বা রোমান সম্রাজ্য - ৩০

৬০ আয়াত, ৬ রুকু , মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : পূর্বের ন্যায় এই সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে Ma'ad বা জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে , বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। পূর্বের সূরাতে বলা হয়েছে সময়ের পরিক্রমায় মানুষের জীবন কত দুর্বল। এই সূরাতে সময়ের পটভূমিতে মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ দুনীর্তির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে, আল্লাহ্‌ তা পরিশুদ্ধ করেন। আল্লাহ্‌র বিশ্বজনীন পরিকল্পনা পরলোকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। পরবর্তী দুইটি সূরাতে [ ৩১ ও ৩২ ] একই বিষয় বস্তুকে অন্য পটভূমিতে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতারাং এই চারটি সূরার [ ২৯, ৩০, ৩১ ও ৩২ ] প্রারম্ভে আলিফ, লাম, মিম কে স্থাপন করা হয়েছে।

এই সূরার সময়কাল গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। সূরাটি অবতীর্ণ হয় হিজরতের ৬ থেকে ৭ বৎসর পূর্বে। সম্ভবতঃ তা ছিলো ৬১৫ - ১৬ খৃষ্টাব্দ। সে সময়ে পারসিয়ানরা ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তারা রোম সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে। রোমের খৃষ্টান রাজা জেরুজালেমের অধিকার হারান এবং অগ্নিপূজক পারসিয়ানরা তা দখল করে। সে সময়ে এ কথা ধারণারও বাইরে ছিলো যে, শক্তিশালী পারসিয়ানদের কারও পক্ষে পরাজিত করা সম্ভব। মোশরেক কোরেশরা ছিলো পারসিয়ানদের সমর্থক , সুতারাং তারা পারসিয়ানদের বিজয়ে উল্লাসিত হয়ে ওঠে এবং রসুলুল্লাহ্‌র [ সা ] উপরে ব্যঙ্গ -বিদ্রূপ ও অপমানের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর কারণ ছিলো রসুলুল্লাহ্‌র [সা] প্রচারিত বাণী ছিলো হযরত ঈসার জেরুজালেমে প্রচারিত বাণীর পুণর্জীবিতকরণ। উভয় বাণীই এক আল্লাহ্‌র নিকট থেকে আগত।

পারসিয়ানদের যুদ্ধ জয়ের সময়ে এই আয়াতগুলি [ ৩০ : ১ - ৬] অবতীর্ণ হয় যাতে পারসিয়ানদের পরাজয়ের পূর্বাভাষ দেয়া হয়েছে ; যা ছিলো পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংসের পূর্বাভাস। এই ভবিষ্যত বাণী ছিলো স্বয়ং আল্লাহ্‌ কর্তৃক দেয়া। সুতারাং তা যে কার্যকর হবে-ই সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিলো না। তবুও মোশরেক কোরেশরা হযরত আবু বকরের সাথে এ ব্যাপারে বাজি রাখে এবং স্বাভাবিক ভাবেই বাজিতে হেরে যায়।

সময়ের বৃহত্তর পরিসরে ইসলামের সূচনা , প্রচার ও প্রসার। এর তুলনায়, শক্তিশালী রোমান ও পারসিয়ান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন ছিলো অত্যন্ত নগন্য ঘটনা মাত্র। হিজরতের ৬-৭ বৎসর পূর্ব থেকে হিজরতের ২ - ১ বৎসর পর পর্যন্ত ইসলামের অস্তিত্ব ছিলো অত্যন্ত দুর্বল ; তা ছিলো পৃথিবীর বুকে মানবতার টিকে থাকার সংগ্রাম। খুব কম লোকই তখন ইসলামকে অনুসরণ করতো। কিন্তু যখন ধীরে ধীরে ইসলাম সংগঠিত হয় এবং আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে থাকে তখনই তার অনুসারীদের উপরে অপমান, অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। তাদের প্রতি পদে অপমানিত , লাঞ্ছিত , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত করা হতো, এক কথায় সর্ব প্রকারে তাদের অবদমিত করা হয়।

অবশ্য তখনও রসুলুল্লাহ্‌ [ সা ] তায়েফের ঘটনার [ হিজরতের দু বৎসর পূর্বে ] নিদারুণ যন্ত্রণার সম্মুখীন হন নাই বা হিজরতের প্রাক্কালে তাঁকে হত্যার যে ষড়যন্ত্র করা হয় তা করা হয় নাই। কিন্তু শত অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেশনেও আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার নয়। বদরের যুদ্ধ [ ২য় হিজরী বা ৬২৪ খৃষ্টাব্দ ] ছিলো মুসলমানদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ যুগ সন্ধিক্ষণ। এখান থেকেই শুরু হয় বাইরের পৃথিবীর সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধন এবং ভারসাম্য রক্ষা করার সিদ্ধান্ত। এটা ছিলো বাইরের ঘটনা, বৃহত্তর ঘটনা ঘটে চলেছিলো মানুষের মনোজগতে। এক বিশাল আধ্যাত্মিক জগতের সৃষ্টি হতে চলেছে। এই আধ্যাত্মিক বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইসলাম মিথ্যা উপাস্য ও পৌরহিত্যকে ছুঁড়ে ফেলে, ধর্মের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে ধর্মীয় বিশ্বাসে সহজ সরল জীবন ধারণ পদ্ধতি চালু করে। পৃথিবীর জীবন পরলোকের জীবনের জন্য শিক্ষানবীশ কাল মাত্র। এই বিশ্বাস ইসলামের মূল বিষয়বস্তু ; অন্ধ , কুসংস্কার এবং ধর্মীয় অনুশাসনের সুক্ষ চুলচেরা বিশ্লেষণকে ইসলাম প্রত্যাখান করে সেখানে প্রকৃত বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন জ্ঞানের সন্ধান করে, এবং প্রচার করে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন কর্মকান্ড ধর্ম নয়, ধর্ম হচ্ছে জীবনকে পরিচালনার ঐশী নির্দ্দেশ সমূহ। অর্থাৎ জীবন ও ধর্ম এক। ইসলামের মূল কথা হচ্ছে চিন্তা - অনুভূতি - কথা - কর্ম , সব এক সুতোতে গাঁথা। ইসলামের এই বিশ্বাস, সংগ্রাম পৃথিবীব্যপী চলছেই এবং চলবেই। শতাব্দীর শেষে এ কথার সত্যতা পৃথিবী ব্যপী ইসলামের প্রসারের মাধ্যমে প্রমাণ করে।

সারসংক্ষেপ : ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীতে ক্ষমতার উত্থান পতন ঘটে, - যা পারসিয়ান ও রোম সাম্রাজ্যের উত্থানপতনকে প্রতীক হিসেবে এখানে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই বাহ্যিক ঘটনাগুলি বিবরণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে আল্লাহ্‌র অত্যাশ্চার্য কর্মপদ্ধতির গভীরতা বুঝানোর জন্য। দেখানো হয়েছে কি ভাবে ভালো ও মন্দ তাদের শেষ পরিণতি লাভ করে। [ ৩০ : ১ - ১৯ ]

আল্লাহ্‌র সৃষ্টিতে উত্থান পতন , শারীরিক , নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক যে কোনও পরিবর্তন সবই নির্দ্দেশ করে আল্লাহ্‌র একত্বের দিকে। মানব কখনও আল্লাহ্‌র একত্ব থেকে বিপথে যাবে না। বরং সে সেই বিশ্ব স্রষ্টার প্রশংসা করবে কারণ তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই। [ ৩০ : ২০ - ৪০ ]

মানুষ পৃথিবীতে দুর্নীতি দ্বারা বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে। আল্লাহ্‌ দূষিত প্রাকৃতিক পরিবেশ যে ভাবে পরিশুদ্ধ করেন, দুর্বলকে যে ভাবে সবল করেন, নির্দ্দিষ্ট সময়ের পরে শক্তিশালীকে যে ভাবে টেনে নামান, ঠিক সেই ভাবে আল্লাহ্‌ মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জগতকে পরিশুদ্ধ করেন। সুতারাং ধৈর্য, অধ্যাবসায় অবলম্বন কর, হতাশ হয়ো না। [ ৩০ : ৪১ - ৬০ ]।

সূরা রুম বা রোমান সম্রাজ্য - ৩০

৬০ আয়াত, ৬ রুকু , মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


০১। আলিফ্‌ - লাম্‌- মীম ।

০২। রোম সম্রাজ্য পরাজিত হয়েছে ৩৫০৫ , -

৩৫০৫। হেরাক্লিয়াসের অধীনে রোমান সম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমানদের শুধু যে এই একটি পতন ঘটে তাই-ই নয়, এশিয়ায় অবস্থিত তাদের বিস্তৃত ভূখন্ড তারা হারায়। প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের রাজধানী কনস্‌টান্টিনেপালের চতুপার্শ্বের সকল ভুখন্ড হারায়। " নিকটবর্তী অঞ্চল" বাক্যটি দ্বারা সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, জেরুজালেম কে বোঝানো হয়েছে যা রোমানরা ৬১৪ -১৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে হারায়। এই সূরাটি এই সময়ের কিছু পূর্বে অবতীর্ণ হয়।

০৩। নিকটবর্তী অঞ্চলে। কিন্তু উহারা উহাদের এই পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে; - ৩৫০৬

৩৫০৬। পারসিয়ানদের দ্বারা রোমানদের পরাজয় মোশরেক কোরেশদের আনন্দে উৎফুল্ল করেছিলো। কারণ তাদের ধারণা হয়েছিলো যে, এত শক্তিশালী রোমক সম্রাটের যদি অগ্নি উপাসক পারসিয়ানদের দ্বারা পরাজিত হতে হয়, তবে ইসলামের অনুসারী ক্ষুদ্র গোষ্ঠিকে তারা হত্যা, অত্যাচার, নির্যাতনের মাধ্যমে ধবংস করতে সক্ষম হবে না কেন ? কিন্তু তারা মহাকালের লিখন পড়তে অক্ষম ছিলো। এই সূরাতে তাদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, শীঘ্রই তাদের স্বপ্নভঙ্গ হবে, এবং তারা উপলব্ধি করবে তাদের হিসেবের ভুল। বাস্তবেও তাই ঘটেছিলো , ইসাসের যুদ্ধে [Battle of Issus ] ৬২২ খৃষ্টাব্দে [ যে বছর রসুলুল্লাহ্‌ হিজরত করেন ] পারসিয়ানদের পরাজয়ের মাধ্যমে। ৬২৪ খৃষ্টাব্দে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস পারস্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং ঠিক সেই সময়েই বদরের যুদ্ধে কোরেশরা নব্য মুলসমানদের নিকট পরাজয় বরণ করে।

০৪। কয়েক বৎসরের মধ্যেই ৩৫০৭। অতীত ও ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত আল্লাহ্‌র হাতে। সেদিন বিশ্বাসীগণ হর্ষোৎফুল্ল হবে , - ৩৫০৮

৩৫০৭। "Bidh'un" শব্দটির অর্থ স্বল্পকাল যা তিন থেকে নয় বৎসরকে বোঝায়। রোমানদের জেরুজালেম হারানোর ঘটনা ঘটেছিলো [ ৬১৪ - ১৫ ] খৃষ্টাব্দের মধ্যে এবং তা পুণরায় উদ্ধার করে ইসাসের [ Issus] যুদ্ধে জয় লাভ করে ৬২২ খৃষ্টাব্দে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ঘটনা ঘটে প্রায় সাত বৎসর সময়কালের মধ্যে। এবং হেরাক্লিয়াস পারস্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ লাভ করেন নয় বৎসর সময়ের মধ্যে। দেখুন উপরের টিকা।

৩৫০৮। দেখুন টিকা ৩৫০৬। বদরের যুদ্ধ [ হিজরী দ্বিতীয় বর্ষ = ৬২৪ খৃষ্টাব্দ ] মুমিনগণদের জন্য ছিলো প্রকৃত আনন্দের সময়। কোরেশরা মুসলমানদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার মানসে মদিনা আক্রমণ করে, তাদের ধারণা ছিলো তারা খুব সহজেই মুসলমানদের পরাজিত করবে এবং মদিনার ইসলামের জাগরণকে স্তব্ধ করে দেবে,যে ভাবে তারা মক্কাতে মুসলমানদের নির্যাতিত করতো। কিন্তু তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয় এবং তারা পরাজিত ও বিতাড়িত হয়।

০৫। আল্লাহ্‌র [ এই ] সাহায্যের কারণে। তিনি যাকে খুশী সাহায্য করেন এবং তিনি ক্ষমতায় পরাক্রমশালী, পরম করুণাময়।

৩৫০৯। " তিনি যাকে খুশী " - এই বাক্যটিকে বিভিন্ন জায়গাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা হচ্ছে বিচক্ষণ এবং সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মান্ড তার সুবৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। তিনি স্বেচ্ছাচারীর ন্যায় যখন যা খুশী তাই করেন না - তার পরিকল্পনাও যথেচ্ছ নয়। তাঁর পরিকল্পনা সর্বোচ্চ জ্ঞান সমৃদ্ধ। তাঁর পরিকল্পনায় সকল প্রাণী তাঁর দয়া ও করুণায় বিধৌত হয়। তিনি সৃষ্ট সকল প্রাণীর অধিকার ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করেন এবং স্বার্থপর ও অত্যাচারীদের থেকে সৃষ্ট সকল প্রাণীকে রক্ষা করেন। "যাকে খুশী " অর্থাৎ তাঁর বিচক্ষণ পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য যাকে যা [ ক্ষমতা, সম্পদ, শক্তি ইত্যাদি ] দেয়া প্রয়োজন তিনি তা দিয়ে থাকেন। যে কোনও অবস্থায় ও সময়ে আল্লাহ্‌ তাঁর পরিকল্পনা কার্যকর করতে সক্ষম। পৃথিবীতে এমন কোনও শক্তি নাই যে তার পরিকল্পনা প্রতিহত করতে পারে।

০৬। ইহা আল্লাহ্‌র অঙ্গীকার ৩৫১০। আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা অনুধাবন করে না।

৩৫১০। অঙ্গীকার অর্থ আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্ত এবং হুকুম। আল্লাহ্‌র সৃষ্ট এই বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি অণু পরমাণুর জন্য আল্লাহ্‌ নির্দ্দিষ্ট নিয়ম ও বিধান চালু করেছেন। এ সবই আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্ত। এই আয়াতগুলির মাধ্যমে আমাদের শুভ সংবাদ দেয়া হয়েছে যে, তিনি তার বিশ্বাসী মোমেন বান্দাদের পার্থিব জীবনের সকল বাধা, বিপত্তি দূর করে দেবেন, এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রামে মোমেন বান্দাদের সর্বদা জয়ী করবেন। যদিও এই আয়াতের মাধ্যমে বদরের যুদ্ধে জয়ী মোমেন বান্দাদের সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু এর আবেদন যুগ কাল অতিক্রান্ত। আল্লাহ্‌র এই আশ্বাস বাণী সকল সময়ের ও সকল পরিবেশের জন্য প্রযোজ্য। যারা মোমেন বান্দা, তারা দুঃসময়ে বিমর্ষ বা হতাশ হয়ে পড়বে না, কারণ তারা জানে তাদের জন্য আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রস্তুত। সাধারণ লোকেরা অন্যায় পথে সাফল্য লাভ করে ও গর্বে অহংকারে স্ফীত হয়ে ওঠে ; কারণ তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছাকে বাধা দান করার ক্ষমতা কারও নাই , তাদের অন্যায় আচরণ একদিন ধ্বংস হবেই। আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী ও পরম দয়ালু।

০৭। তারা তো শুধু পার্থিব জীবনের বাহ্যিক বিষয় সম্বন্ধে জানে ৩৫১১। কিন্তু [ জীবনের ] শেষ বিষয় সম্বন্ধে তারা অমনোযোগী ৩৫১২।

৩৫১১। বাইরের পৃথিবীর চাকচিক্য সাধারণ মানবকে অভিভূত করে ফেলে, - ফলে সে জীবনের প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে অক্ষম হয়। অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন মানব বুঝতে পারে যে, আপাতঃ নিপতিত বিপদ, দুর্যোগ ও দুঃসময় , সূদূর ভবিষ্যতকে স্বর্ণমন্ডিত করে তোলে। কারণ বিপদ বিপর্যয়ের অতিক্রমের মাধ্যমেই চরিত্রের গুণাবলী যথা ধৈর্য্য, অধ্যবসায়, সহনশীলতা, কর্মক্ষমতা, আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীলতা প্রভৃতি গুণের বিকাশ লাভ করে থাকে; যা পরবর্তী জীবনে সাফল্যের স্বর্ণদুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়।

৩৫১২। "A Khirat" - কোন কিছুর শেষ অথবা ঐতিহাসিক কোনও ঘটনার শেষ , এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর অর্থ হচ্ছে পরলোক বা মানব জীবনের শেষ অধ্যায়।

০৮। তারা কি নিজেদের অন্তরে [ গভীর ভাবে ] ভেবে দেখে না ? আল্লাহ্‌ আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং উহাদের মধ্যবর্তী যা কিছু আছে তা যথাযথ ভাবে এবং এক নির্দ্দিষ্টকালের জন্যই সৃষ্টি করেছেন ৩৫১৩। তবুও মানুষের মধ্যে অনেকেই তাদের প্রভুর সাথে [ পুনরুত্থানের দিনের ] সাক্ষাতকে অস্বীকার করে থাকে ৩৫১৪।

৩৫১৩। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ৮৫ ]। ক্ষমতা, পার্থিব সম্পদ, সকল কিছুই ক্ষণস্থায়ী। এখানে মানবকে উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে যে, " পার্থিব জীবনের বাহ্য দিক" ; এমন কি ক্ষমতা সম্পদ সবই জোয়ার ভাঁটার ন্যায় - যার উত্থান ও পতন ঘটে থাকে। এখানে আরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, এই উত্থান ও পতন ঘটে থাকে " এক নির্দ্দিষ্ট কালের জন্য"। কোনও জাতি বা ব্যক্তি আল্লাহ্‌র করুণা লাভে ক্ষমতাশালী হয়; আবার "নির্দ্দিষ্ট সময়" অতিক্রান্ত হলে যখন আল্লাহ্‌র আর্শিবাদ প্রাপ্ত জাতি বা ব্যক্তি আল্লাহ্‌র বিধানকে ভুলে যায় , তখন পরাক্রমশালী জাতি বা ব্যক্তি বিশেষ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র আইন বা বিধান। যাকে আল্লাহ্‌ ক্ষমতা ও প্রভাব, প্রতিপত্তি , সুযোগ সুবিধা দ্বারা অনুগ্রীহিত করেছেন সে যেনো ভুলে না যায় যে আল্লাহ্‌র এই অনুগ্রহ তাকে অনন্ত কালের জন্য দেয়া হয় নাই। আল্লাহ্‌ তাঁর পরিকল্পনাকে , তাঁর সৃষ্টিকে এক নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাউকে কাউকে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে ধন্য করেন। আল্লাহ্‌র পরিকল্পনার মহত্তর , উচ্চতর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদের বিশেষ অনুগ্রহে ধন্য করা হয়। যেমন কালজয়ী লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ইত্যাদি। এরা পৃথিবীতে এক একটি যুগের সৃষ্টি করে থাকেন, এবং পৃথিবীর সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ যাকে যে নেয়ামত দিয়ে থাকেন তার চুলচেরা হিসাব তাকে আল্লাহ্‌র নিকট দাখিল করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের অধীন। " যথাযথ " শব্দটি দ্বারা উপরের বক্তব্যকেই বোঝানো হয়েছে।

৩৫১৪। উপরের বক্তব্যের সুত্র ধরে বলা হয়েছে যে, আশ্চর্য্য ঘটনা হচ্ছে মানুষ প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনে অক্ষম। শুধু যে অক্ষম হয় তাই-ই নয় আল্লাহ্‌র নেয়ামত প্রাপ্ত ব্যক্তিরা পরলোককেও অস্বীকার করে থাকে। তারা শেষ বিচারের দিন ও আল্লাহ্‌র সাথে মৃত্যুর পরে সাক্ষাৎকারকেও অস্বীকার করে থাকে। পৃথিবীর "শিক্ষানবীশকালে" যে সত্যকে অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে ব্যবহার করা উচিত ছিলো ; আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভে তারা গর্বে অহংকারে স্ফীত হয়ে তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী আয়াতে তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলা হয়েছে।

০৯। তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না এবং দেখে না তাদের পূর্ববর্তীদের কি পরিণাম হয়েছিলো ? শক্তিতে তারা ছিলো তাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তারা জমি চাষ করতো, এবং ভূমিতে তারা জনবসতি করেছিলো, ইহাদের [ প্যাগান ] অপেক্ষা অধিক [সংখ্যায় ]। তাদের নিকট স্পষ্ট [ নিদর্শনসহ] রাসুলগণ এসেছিলো ৩৫১৫, [ [যাদের তারা প্রত্যাখান করে নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছিলো ]। আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি অত্যাচার করেন নাই, তারা নিজেরাই নিজেদের আত্মার প্রতি অত্যাচার করেছিলো।

৩৫১৫। এ কথা যেনো পরবর্তী প্রজন্মের মনে উদয় না হয়, যে তারা পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে জ্ঞান , বিজ্ঞান ও সভ্যতায় উন্নত। হতে পারে বর্তমান প্রজন্ম অতীত প্রজন্মের উত্তরাধীকারী ,অতীত প্রজন্মের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্তরাধীকারী হওয়ার ফলে সময়ের নথিতে সে সর্বোচ্চ স্থানে বর্তমানে অবস্থান করছে। সে কারণে গর্ব ও অহংকার হওয়ার কিছুই নাই। অপরপক্ষে সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্তরাধীকারী হওয়ার ফলে তার দায়িত্ব বহূগুণে বৃদ্ধি পায়। এই সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের দেশ ভ্রমণ করতে আদেশ দিয়েছেন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন, কত সমৃদ্ধ জনপদ, উন্নত সভ্যতা পৃথিবীতে বিরাজ করেছে। যতদিন তারা তাদের রাজ্য শাসন করেছে আল্লাহ্‌র বিধান বা ন্যায়ের ও সত্যের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, ততদিন তাদের সমৃদ্ধি উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যখনই তারা আল্লাহ্‌র আইন বা বিধানকে লঙ্ঘন করেছে, অন্যায় ও অত্যাচারের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে ও আল্লাহ্‌র বিধানের বিরোধিতা করেছে, তখনই তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইতিহাস থেকে এ সত্যকে উপলব্ধি করা যায় যে, আল্লাহ্‌র বিধানের প্রতি বিদ্রোহ -ই ছিলো তাদের পতনের কারণ। আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি জুলুম করেন নাই। তিনি অপার করুণার আঁধার ও ন্যায়ের প্রতীক। মানুষ নিজেই নিজের কর্মফলের দরুন ধ্বংস হয়ে যায়। এই সত্য ব্যক্তির বেলাতে যেমন প্রযোজ্য , জাতির বলোতেও সমভাবে প্রযোজ্য।

১০। যারা মন্দ কাজ করে শেষ পর্যন্ত তাদের পরিণাম হবে মন্দ ৩৫১৬। কারণ তারা আল্লাহ্‌র আয়াত অস্বীকার করতো এবং তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো।

৩৫১৬। পৃথিবীর এই জীবনে ভালো ও মন্দ ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে , ঠিক যেমন থাকে আলো ও অন্ধকার। অনেক সময়েই দেখা যায় , যা মন্দ বা যারা মন্দ তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করে ধন্য ; অপরপক্ষে , ভালো বা যারা ভালো, তারা নির্যাতিত ও বঞ্চিত। এ কথা মনে রাখতে হবে যে মন্দের এই সমৃদ্ধি স্থায়ী সমৃদ্ধি নয়। এই সমৃদ্ধি খুবই স্বল্পকালীন স্থায়ী। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে মন্দ তাঁর প্রতিফল পাবে। তাদের মন্দ কর্মফল ধীরে ধীরে মহাকালের গর্ভে সঞ্চিত হয় এবং একদিন তার বিস্ফোরণ ঘটে। তাদের দম্ভ, শক্তি, ক্ষমতা , সমৃদ্ধি কালের পরিক্রমায় ,তাদের কর্মফলের দরুন তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তা হচ্ছে তারা আল্লাহ্‌র আয়াতকে প্রত্যাখান করেছিলো , ভালোকে পরিত্যাগ করে মন্দকে গ্রহণ করেছিলো। আল্লাহ্‌র এই সাবধান বাণী সর্বকাল ও সর্ব যুগের জন্য। পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত ন্যায় , সত্য ও ভালো স্থায়ীত্ব লাভ করবে এবং অন্যায় , অসত্য ও মন্দ ধ্বংস হয়ে যাবে।

রুকু - ২

১১। আল্লাহ্‌-ই প্রথম সৃষ্টি [ প্রক্রিয়া ] শুরু করেন ৩৫১৭। অতঃপর তিনি তা পুণরাবৃত্তি করেন। তারপরে তাঁরই নিকটে তোমাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে।

৩৫১৭। পৃথিবীতে কোনও কিছুই স্বয়ম্ভু নয়। কোনও কিছু পৃথিবীতে টিকে থাকা, তার স্ব-ইচ্ছা, বা কোন দৈব-ঘটনা নয়। সকল সৃষ্টির এবং পৃথিবীতে তা টিকে থাকার মূল হচ্ছে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা। তিনি প্রথম সৃষ্টি করেন এবং পুণরাবৃত্তি করেন। মৃত্যু নামে আমরা যাকে অভিহিত করি, তার অর্থ ধ্বংস বা শেষ নয় , তার অর্থ রূপান্তরিত হওয়া। আল্লাহ্‌ পুণঃসৃষ্টি করতে সক্ষম। তাঁর সৃষ্টির ক্ষমতা কখনও থেমে থাকে না, অনাদি অনন্ত কাল থেকে তা চলে আসছে , ভবিষ্যতেও চলবে। আমাদের মৃত্যুও এক বাহ্যিক ক্রিয়া মাত্র। আপতঃদৃষ্টিতে যা সবশেষ মনে হবে, বাস্তবে তা শেষ নয় , তা পুণঃ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার শুরু মাত্র। আল্লাহ্‌ সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু ও লক্ষ্য। যখন মৃত্যুর পরে আমরা তাঁর কাছে প্রত্যানীত হব, সেখানেই আমাদের জবাবদিহি করতে হবে , পৃথিবীর জীবনের সকল কর্মকান্ডের।

১২। যে দিন [ শেষ বিচারের ] সময়কে প্রতিষ্ঠিত করা হবে ৩৫১৮ ; অপরাধীরা হতাশায় বোবা হয়ে যাবে।

৩৫১৮। "যেই দিন শেষ বিচারের সময়কে প্রতিষ্ঠিত করা হবে " - অর্থাৎ যেদিন পৃথিবী ধবংস হয়ে যাবে এবং শেষ বিচারের দিন প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন পৃথিবীর সকল মূল্যবোধকে প্রকৃত সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। তার ফলে যারা ভালো তারা আনন্দে উল্লাসিত হবে, এবং অপরাধিগণ প্রকৃত অবস্থার মুখোমুখি হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হবে।

১৩। তাদের শরীকদের মধ্য থেকে কেহ মধ্যস্থকারী হবে না ৩৫১৯; এবং তারা [ নিজেরাও ] তাদের শরীকদের প্রত্যাখান করবে।

৩৫১৯। শেষ বিচারের দিনে মিথ্যা উপাসনার প্রকৃত রূপ প্রতিভাত হবে। এই পৃথিবীতে আল্লাহ্‌ ব্যতীত , আর যা কিছুরই আমরা বন্দনা করি না কেন, শেষ বিচারের দিনে তাদের আর কোনও অস্তিত্বই থাকবে না; তারা কোনও সাহায্যেই আসবে না। পৃথিবীতে যারা মিথ্যা উপাসনা দ্বারা নিজেদের বিভ্রান্ত করেছিলো, শেষ বিচারের দিনে তাদের জ্ঞানচক্ষু উম্মীলিত হবে, তারা তাদের মিথ্যাকে অনুধাবনে সক্ষম হবে। কারণ চারিদিকে সত্যের প্রকৃত রূপ ও মূল্যবোধ সমুজ্জ্বল থাকবে।

১৪। যে দিন [ শেষ বিচারের ] সময়কে প্রতিষ্ঠিত করা হবে, সে দিন [ সকল মানুষকে ] বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে ৩৫২০।

৩৫২০। কেয়ামতের দিনে ভালো ও মন্দ - কে আলাদা করে শ্রেণীভুক্ত করা হবে। পরবর্তী আয়াতে বর্ণনা আছে এই দুই শ্রেণীর শেষ পরিণতির। যারা পৃথিবীতে ঈমান এনেছিলো অর্থাৎ আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে সৎ কাজ বা ভালো কাজে নিয়োজিত ছিলো , তাদের জন্য পরলোকে বেহেশতের শুভ সংবাদ আছে। বিভিন্ন আয়াতে বেহেশতের যে বর্ণনা আছে, তা হচ্ছে : সর্বোচ্চ শান্তিময় স্থান, স্বচ্ছ সলিল প্রবাহিত ক্ষুদ্র নদী ঘেরা সবুজ প্রান্তর। এই বর্ণনাগুলি রূপক যার মাধ্যমে সুখ ও শান্তির প্রতীক বর্ণনাকে তুলে ধরা হয়েছে। অপর পক্ষে , যারা আল্লাহ্‌কে ও পরলোককে এই পৃথিবীতে অস্বীকার করেছিলো, তাদের জন্য পরলোকে আছে ভয়াবহ শাস্তি। পৃথিবীর সুখ-সম্পদ পরলোকে অর্ন্তহিত হবে; কারণ তাদের পরীক্ষার সময় অতিক্রান্ত ; তখন তারা প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হবে।

১৫। তখন, যারা ঈমান এনেছিলো এবং সৎকাজ করেছিলো তাদের পরম আনন্দধারায় সুখী করা হবে।

১৬। এবং যারা ঈমানকে প্রত্যাখান করেছিলো এবং মিথ্যাচারে আমার আয়াতসমূহ এবং পরকালের সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছিলো , - তারাই শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।

১৭। সুতারাং যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হবে এবং প্রভাতে জাগরিত হবে আল্লাহকে মহিমান্বিত কর ৩৫২১।

১৮। হ্যাঁ , আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে সমস্ত প্রশংসা তারই এবং [ মহিমা ঘোষণা কর ] শেষ বিকেলে এবং দিন যখন শেষ হতে শুরু করে

৩৫২১। আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার বা নামাজ পড়ার বিশেষ সময়গুলির কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। সারাদিনের সকল কর্মের মাঝে-ই তাঁকে স্মরণ করতে হবে। নামাজের ওয়াক্তগুলি ঠিক সে ভাবেই নির্ধারিত করা হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, সূর্যের অবস্থানের সাথে আমাদের দৈনন্দিক জীবন প্রবাহ পরিচালিত হয়, আর সেই জীবন প্রবাহের সাথে সমন্বিত করে সূর্যের অবস্থানকে মানদণ্ড হিসেবে পরিগণিত করে নামাজের সময়কে ধার্য করা হয়েছে। এই আয়াতের নির্দ্দেশ অনুযায়ী মদিনাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ ঘোষণা করা হয়; যথা :

১) প্রভাতে সূর্য দিগন্তে ওঠার পূর্বে ফজরের নামাজ ;

২) যখন সূর্য মধ্যাহ্ন গগন অতিক্রম করে, পশ্চিম দিকে হেলে যায়, অর্থাৎ জুহরের নামাজ;

৩) অপরাহ্ন অর্থাৎ সূর্যের ঠিক মধ্যগগনে অবস্থান থেকে সূর্যাস্তের মধ্যবর্তী সময়ের মাঝামাঝি হচ্ছে আছরের সময় এবং

৪) ও ৫) হচ্ছে সন্ধ্যার নামাজ। একটি হচ্ছে সূর্য ডোবার সাথে সাথে অর্থাৎ মাগরিবের নামাজ; অন্যটি হচ্ছে দিকচক্রবাল থেকে গোধূলি অতিক্রান্ত হওয়ার পরে রাতের শুরুতে অর্থাৎ এশার নামাজ।

এর পরেই মানুষের কর্মময় দিনের সমাপ্তি ঘটে এবং মানুষ বিশ্রামের জন্য সুপ্তির কোলে আশ্রয় গ্রহণ করে। দেখুন আয়াত [ ১১ : ১১৪ ] ও টিকা ১৬১৬ - ১৭ ; আয়াত [ ১৭ : ৭৮-৭৯ ] ও টিকা ২২৭৫ ; আয়াত [২০ : ১৩০ ] ও টিকা ২৬৫৫।

১৯। তিনিই মৃত থেকে জীবন্তকে বের করে আনেন ও জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন ৩৫২২ এবং যিনি মৃত্যুর পরে ভূমিকে জীবন দান করেন। এবং এভাবেই তোমাদের বের করে আনা হবে [ মৃত্যুর পরে ] ৩৫২৩।

৩৫২২। দেখুন আয়াত[ ১০ : ৩১ ]। আল্লাহ্‌র কৌশলে মৃত বস্তু জীবন্ত রূপ ধারণ করে। যথাঃ মরুভূমির ন্যায় মৃত ভূমি বৃষ্টির পানির স্পর্শে সজীবতা লাভ করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। গাছের বীজ নির্জিব ঘুমন্ত অবস্থায় মনে হয় মৃত। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশে জীবন্তরূপ ধারণ করে পরিপূর্ণ বৃক্ষে রূপান্তর হয়। মৃত্যু ও জীবন এক সুক্ষ রেখা দ্বারা বিভক্ত। জীবনের এই রহস্য বিজ্ঞানও সমাধান করতে পারে না - মৃত্যু এবং জীবনের সংঙ্গা আজও মানুষের কাছে অজ্ঞাত। জীবন শুরু হয়, পরিপূর্ণতা লাভ করে, আবার এক সময়ে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যায় - এই তো জীবনের খেলা। এই পার্থিব জীবনের কোন কিছুই স্থায়ী নয়। কিন্তু আল্লাহ্‌র সৃষ্টি নৈপুন্যে এক অদৃশ্য কৌশল বিদ্যমান যার ফলে মৃত্যুর মাঝেও কোনও সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যায় না। তাঁর সৃষ্টিধর্মী কাজ অবিচ্ছিন্ন অবিরল ধারাতে চলতে থাকে, জীবন ও মৃত্যু চক্রাকারে আবর্তিত হয়। জীবন মৃত্যুর মাঝে শেষ হয়ে যায়। আবার মৃত্যুর মধ্যেই নূতন জীবনের আভির্ভাব ঘটে।

৩৫২৩। দেখুন [ ২ : ১৬৪] আয়াত। শুষ্ক , ঊষর মরুভূমিকে মৃত ও জীবন শূন্য মনে হয়, কিন্তু ভারী এক পশলা বৃষ্টি সেই মৃত মাটিকে সজীবতা ফিরিয়ে দেয়, এবং পৃথিবী ফুল ও ফসলে ভরে ওঠে , প্রাণীকূলের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সাধারণতঃ শীতকালে ও খরার সময়ে , যখন বৃষ্টিপাত খুব সামান্য হয়, বৃক্ষ তরুলতা সবই মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে , - আবার বসন্তের আগমনের সাথে সাথে সকল তরু-লতা সজীবতা ফিরে পায়; পৃথিবী আবার জীবন্ত রূপ ধারণ করে। "মৃত থেকে জীবন্তের ও জীবন্ত থেকে মৃতের আভির্ভাব" - বাক্যটি রূপলঙ্কার স্বরূপ। প্রতিদিনের জীবনের বহু ঘটনা , আন্দোলন, বহু প্রতিষ্ঠান, সংগঠিত দল, আইন সময়ের আবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে যায় ; আবার নূতন রূপে তা জন্মগ্রহণ করে। সব কিছুই ঘটে আল্লাহ্‌র বিচক্ষণ বিধান অনুযায়ী। সুতারাং পার্থিব জীবনের সকল কিছুরই মৃত্যু ঘটে বা ধবংস হয়ে যায়। আবার পুণরাভির্ভাব ঘটে। " এই ভাবে তোমাদের বের করে আনা হবে " - অর্থাৎ মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই আমাদের বিনাশ ঘটবে না। মৃত্যুর মাঝে নশ্বর দেহের ধবংস হবে। কিন্তু আমাদের আত্মা বা আমিত্ব বা ব্যক্তিসত্ত্বার মৃত্যু ঘটবে না। তা আবার পূণর্জীবিত করা হবে এবং পার্থিব জীবনের কর্মফল ভোগ করতে হবে।

রুকু - ৩

২০। তাঁর অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে এই যে, তিনি ধূলা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন ৩৫২৪। এবং তার পরে দেখো, এখন তোমরা মানুষ [ হিসেবে দূর দূরান্তরে ] ছড়িয়ে পড়েছ।

৩৫২৪। দেখুন [ ১৮ : ৩৭ ] ও টিকা ২৩৭৯। যদিও মানুষের সৃষ্টি মাটির ন্যায় অত্যন্ত নগন্য বস্তু থেকে। কিন্তু এই নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে আল্লাহ্‌ তাকে আত্মা ও মন দান করেছেন; যা স্রষ্টা তাঁর আর কোনও সৃষ্টিকে দান করেন নাই। এর ফলে মানুষ স্থান, কাল ও পাত্রের উর্দ্ধে নিজেকে স্থাপন করতে সক্ষম। ধূলির মানুষ তার নিজস্ব অস্তিত্বের উর্দ্ধে ফেরেশতা সমতুল্য হতে পারে। এও কি স্রষ্টার এক অত্যাচার্য নিদর্শন নয় ? জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধূলির মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে সকলের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে, কিভাবে সে পৃথিবী জয় করে এবং পৃথিবীর সূদূর প্রান্ত পর্যন্ত নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে এও কি আল্লাহ্‌র নিদর্শন নয় ?

২১। তাঁর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য সাথী সৃষ্টি করেছেন ৩৫২৫, যেনো তোমরা তাদের সাথে পরস্পর শান্তিতে বসবাস করতে পার ৩৫২৬। এবং তিনি তোমাদের [ হৃদয়ের] মাঝে ভালোবাসার [বন্ধন ] দিয়েছেন। যারা চিন্তাশীল অবশ্যই এ সবের মাঝে তাদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।

৩৫২৫। এই আয়াত নির্দ্দেশ করে নারী ও পুরুষের যৌন আকর্ষণের রহস্যের প্রতি। এই আকর্ষণ থেকেই জন্ম নেয় নারী ও পুরুষের মধ্যে পরস্পরের জন্য ভালোবাসা, ফলে সংসার যাত্রা নির্বাহের তীব্র আকর্ষণ যা পৃথিবীর অন্যান্য কোনও প্রাণীর মাঝেই নাই। নারী ও পুরুষের মিলনের ফলেই সন্তানের জন্ম হয়। মানব শিশু পৃথিবীতে অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, যার পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে কমপক্ষে বিশ বৎসরের প্রয়োজন হয়। একটি শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য জন্মের পরবর্তী বিশ বৎসর পর্যন্ত প্রয়োজন হয় খাদ্য, পানীয় , স্নেহ-ভালোবাসা, নিরাপত্তা। পিতা -মাতা উভয়েই এই দীর্ঘ সময়ে তাদের সে প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। নারী ও পুরুষের মিলিত সংসার যাত্রা হচ্ছে সন্তান প্রতিপালন , তাদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা ইত্যাদির ভিত্তি। একটি সংসার, সমাজ জীবনের একক স্বরূপ। মানব সমাজ ও সভ্যতার মূল ভিত্তি হচ্ছে নারী ও পুরুষের মিলিত সংসার জীবন, যেখানে থাকে প্রেম-প্রীতি , স্নেহ-ভালোবাসা। আবার নারী ও পুরুষের মিলিত জীবনের মূল ভিত্তি হচ্ছে পরস্পরের প্রতি যৌন আকর্ষণ। সুতারাং চিন্তা করে দেখলে অনুধাবন করা যায় সৃষ্টিকে রক্ষা করা এবং একে ভবিষ্যতের পানে গতিশীল করতে স্রষ্টার কি অপূর্ব কলা কৌশল ও রহস্য।

৩৫২৬। দেখুন [ ৭ : ১৮৯ ]। মানুষের মাঝে এই যৌন আকর্ষণ স্রষ্টা সৃষ্টি করে দিয়েছেন যেনো পৃথিবীতে তারা সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে। যে সংসারে স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে প্রেম ও প্রীতির সম্পর্ক বিরাজ করে সেই সংসারই প্রকৃত শান্তির নীড় , সেখানেই সন্তান লাভ করে স্নেহময় মাতা ও পিতা, স্ত্রী লাভ করে প্রেমময় স্বামী, আবার স্বামী লাভ করে অনুগত ও যত্নশীল স্ত্রী। কি মধুর এই সংসারের চিত্র। পুরুষের নারীর নিকট পৌরুষ প্রদর্শন এক স্বাভাবিক ধর্ম। যার ফলে নারী পুরুষের ভালোবাসার মধ্যে থাকে পুরুষের নারীর জন্য ভালোবাসা যা হয় সহানুভূতি পূর্ণ এবং দরদী মনোভাবে সিক্ত। কারণ নারী পুরুষের তুলনায় শারীরিকভাবে দুর্বল আবার সেই সাথে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও আবেগপূর্ণ। সুতারাং যে সবল তার দায়িত্ব ও কর্তব্য এই আবেগ ও অনুভূতিকে দরদী মন দিয়ে রক্ষা করা - এখানেই পুরুষের পৌরুষ প্রকাশ পায়। স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতনের; মাধ্যমে নয়। যা আমাদের দেশে প্রকাশ হয়।

সংসার জীবনে নারী পুরুষের সম্পর্ক সমতার ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে কোরাণের ভাষ্য , " যেনো তোমরা তাদের সাথে পরস্পর শান্তিতে বসবাস করতে পার"। এখানে লক্ষণীয় "পরস্পর " শব্দটি স্বামী স্ত্রীর প্রভু নয়। স্বামী ও স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, সহযোগী ও সহকর্মী। কেউ কারও প্রভুও নয় বা অধিকারভুক্ত নয়। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে পুরুষ ও নারীর দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্য মনের শান্তি। এটা তখনই সম্ভব, যখন উভয় পক্ষ একে অপরের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয় এবং তা আদায় করে নেয়। নতুবা প্রভু -ভৃত্যের সম্পর্কের মাঝে প্রেম-প্রীতিপূর্ণ বন্ধুত্ব স্থান পেতে পারে না। সুতারাং সে সব সংসারে পরিপূর্ণ শান্তি বা শৃঙ্খলাও সম্ভব নয়। স্বামী-স্ত্রীর মিলিত সংসার জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অনুধাবনের জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের এই আয়াতের শেষে বলেছেন, " চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য ইহাতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।" বৈবাহিক সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার জন্য শুধু নিদর্শন না বলে, "বহু নিদর্শন " বলা হয়েছে, এই সম্পর্কের বিভিন্ন দিক ও তা থেকে অর্জিত পার্থিব ও ধর্মীয় উপকারিতার প্রতি লক্ষ্য করে।

২২। তাঁর নিদর্শনসমূহের মাঝে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি ৩৫২৭ এবং তোমাদের ভাষার বিভিন্নতা এবং বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।

৩৫২৭। আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের নিদর্শন সকল সৃষ্টিব্যপী পরিব্যপ্ত। বিশ্ব চরাচরে সকল কিছুই তারই জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও শিল্প নৈপুন্যের স্বাক্ষর। এই আয়াতে দুইটি বিশেষ উদাহরণকে তুলে ধরা হয়েছে আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে উপস্থাপনার জন্য। মানুষের ভাষার বিভিন্নতা ও রং এর বৈচিত্রতার প্রতি এখানে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ভৌগলিক বিভিন্নতার জন্য দেশে দেশে ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন ধারা, প্রভৃতির কতই না পার্থক্য। এসব বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে স্রষ্টার ইচ্ছা অনুযায়ী। সুতারাং কেউ যেনো মনে না করে যে ,কোনও ব্যাপারে তারাই শ্রেষ্ঠ। আবার আকাশ, পৃথিবী ও ভূমন্ডলে কত না রং এর বৈচিত্র ছড়ানো। নীল আকাশে সূর্যদয় ও সূর্যাস্তে মেঘের রং এর খেলা থেকে শুরু করে বৃক্ষ তরুলতা, ফুল, ফল, ফসল, প্রাণী মানুষের মাঝে সর্বত্রই রংএর বৈচিত্র। সকল মানুষের আদি পিতা মাতা আদম ও হাওয়া সত্বেও যুগের পরিক্রমায় এই একক পিতা-মাতার পরবর্তী বংশধরেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে - ফলে পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থানের বিভিন্নতার কারণে তারা বিভিন্ন গাত্রবর্ণ ও ভাষার অধিকারী হয়। কিন্তু উপলব্ধি করার বিষয় হচ্ছে, জাতিতে-জাতিতে, গোত্রে-গোত্রে, ভাষাতে-ভাষাতে যত বিভিন্নতাই থাকুক না কেন তাদের মূল ঐতিহ্য একই রয়ে গেছে। তাদের আবেগ ও অনুভূতি একই ধারাতে প্রবাহিত - সুখ ও দুঃখের সংজ্ঞা এক, সুখ ও শান্তির উপলব্ধি অভিন্ন। কারণ সকলেই তারা এক আল্লাহ্‌র বান্দা। এ কথাই কবি বলেছে, " জগত জুড়িয়া আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মানুষ জাতি।"

পৃথিবীর বিবর্তনের ধারায় পুরানো ভাষার অবলুপ্তি ঘটে। আবার নূতন ভাষার সৃষ্টি হয় - নূতন শব্দে সমৃদ্ধ হয়ে নূতন প্রকাশ ভঙ্গীতে, নূতন আঙ্গিকে বিকশিত হয়। পৃথিবী সর্বদা পরিবর্তনশীল , এই-ই আল্লাহ্‌র নিয়ম। যারা জ্ঞানী অর্থাৎ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন তারা আল্লাহ্‌র এ সকল নিদর্শনকে আত্মার মাঝে উপলব্ধিতে সক্ষম। আবার এ সকল নিদর্শন উপলব্ধির মাধ্যমে আত্মার মাঝে জ্ঞানের বা অন্তর্দৃষ্টি বা দিব্যজ্ঞানের উদ্ভব ঘটে।

২৩। তাঁর নিদশর্নসমূহের মাঝে আর একটি এই যে, রাত্রিতে তোমাদের নিদ্রা এবং দিনে তাঁর অনুগ্রহ থেকে তোমাদের [ জীবিকার ] অন্বেষণ ৩৫২৮। নিশ্চয়ই এতে [ উপদেশ ] শ্রবণকারীদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে ৩৫২৯।

৩৫২৮। আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব আত্মার মাঝে অনুভব করার জন্য, আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে উপলব্ধির জন্য আরও কয়েকটি উদাহরণের উল্লেখ করা হয়েছে এই আয়াতে। যদি আমরা গভীর ঘুমের ব্যাপারটি গভীরভাবে চিন্তা করি , তবে দেখবো ক্লান্তির পরে ঘুম ক্লান্তি দূর করে এবং দেহ ও মনে সতেজতা আনায়ন করে। ঘুমের ফলে আমাদের চিন্তার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়, আমাদের অনুভূতি তীক্ষ্ণ হয়। ঘুমের অনুভূতি এবং ঘুমের পরবর্তী দেহ ও মনের সজীবতা সত্যিই অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও রহস্যজনক। সাধারণতঃ আমরা রাতে ঘুমাই এবং দিনে আমরা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ বা জীবিকার অন্বেষণ করি।

বিভিন্ন উপায়ে আমরা জীবিকার অন্বেষণ করে থাকি। কিন্তু এই উপায়াদির অন্বেষণের চেষ্টায় প্রকৃত সত্যকে যেনো কেউ বিস্মৃত না হয়। বুদ্ধিমানের কাজ হবে এ কথা বিস্মৃত না হওয়া যে, ইহকাল শুধুমাত্র পরলোকের "শিক্ষানবীশকাল " মাত্র।

আমাদের শারীরিক ও আত্মিক বিকাশের সাথে দিনের আলো ও রাত্রির অন্ধকারকে সমন্বিত করে দেয়া হয়েছে কর্ম ও বিশ্রামের জন্য। দিনে আমাদের কর্মক্ষমতা বিকশিত হয়, রাতে সুপ্তির কোলে আমাদের সকল ক্লান্তি দূরীভূত করার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। এও কি স্রষ্টার এক অপূর্ব নিদর্শন নয় কি ? আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যারা উপদেশ শ্রবণ করে তাদের জন্য অনেক নিদর্শন আছে। এতে শ্রবণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে এই কারণে যে দিনের জীবিকার অন্বেষণের চিন্তা যেনো মনোযোগকে শুধুমাত্র পার্থিব বস্তুতে সম্পৃক্ত করে না রাখে। প্রকৃত সত্যকে অনুধাবনের জন্য আল্লাহ্‌র নিদর্শনের প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

৩৫২৯। ২০ থেকে ২৫ আয়াত পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে আল্লাহ্‌র অত্যাচার্য নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে - যার সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করলে,অনুধাবনের চেষ্টা করলে আত্মার মাঝে আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটে।

১) মানুষের উৎপত্তি ও শেষ পরিণতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে ; অবশ্য তাই-ই প্রারম্ভিক হওয়া উচিত [ ৩০ : ২০ ]।

২) ধারাবাহিকতায় তারপরে এসেছে মানুষের সামাজিক জীবনের কথা। সামাজিক জীবনের সুত্রপাত ঘটে যৌন-জীবনের মাধ্যমে, নারী পুরুষের ভালোবাসার মাধ্যমে। দেখুন [ ৪ : ১ ] আয়াত ও টিকা ৫০৬।

৩) পরবর্তী আলোচ্য বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষকে উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে মানব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বৈচিত্র। ভৌগলিক পার্থক্যের কারণে মানুষের বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, পার্থক্য ঘটে, কিন্তু এ সব পার্থক্য সত্বেও সকল মানবের অন্তর্নিহিত ভাবধারা এক সূতোতে গাঁথা। হাসি -কান্না, আবেগ-অনুভূতি, দুঃখ-ব্যথা,সব কিছুর অনুভূতি পৃথিবীর সকল মানুষের মাঝে একই ভাবে বিরাজ করে যা মানুষ গভীরভাবে চিন্তা করলেই উপলব্ধি করতে পারবে [ ৩০ : ২২ ]।

৪) পরর্বতীতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে মানুষের মনঃস্তাত্বিক অবস্থার প্রতি যথাঃ ঘুম, বিশ্রাম, অন্তরের উপলব্ধি ইত্যাদির প্রতি ; যারা মনোযোগ সহকারে পথের নিদর্শন উপলব্ধি করতে চায় এবং উপদেশ শ্রবণ করে তাদের জন্যই এগুলি আল্লাহ্‌র নিদর্শন স্বরূপ [ ৩০ : ২৩ ]।

৫) পরর্বতী আয়াতে , উচ্চতর আধ্যাত্মিক আশা আকাঙ্খার এবং ভয়ের প্রতি আমাদের আহ্বান করা হয়েছে। এগুলি প্রকাশের জন্য সুক্ষভাবে প্রতীক হিসেবে বজ্র ও বিদ্যুতকে ব্যবহার করা হয়েছে। বজ্র ও বিদ্যুতের পতিত হওয়ার ফলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে এবং এর পশ্চাতে বৃষ্টির আশাবাদও সঞ্চার হয়। তিনি এই বৃষ্টি দ্বারা শুষ্ক ও মৃত মৃত্তিকাকে জীবিত ও সতেজ করে তাকে ফুল, ফল, ও ফসলে ভরিয়ে দেন। আধ্যাত্মিক জগতের পরিপূর্ণতা লাভের আশা আকাঙ্খা এবং না পাওয়ার ভয়কে এভাবে বজ্র -বিদ্যুত এবং বৃষ্টির প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে - এ কথা বুদ্ধি, ও প্রজ্ঞা দ্বারাই বোঝা যেতে পারে [ ৩০ : ২৪ ]।

৬) যষ্ঠ নিদর্শন এই যে, আকাশ ও পৃথিবী আল্লাহ্‌র-ই আদেশে স্থায়ী হয়ে আছে। কোটি কোটি বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এগুলোর কোথাও কোনও ত্রুটি দেখা যায় না। আল্লাহ্‌ যখন এই ব্যবস্থাপনাকে ভেঙ্গে দেয়ার আদেশ দেবেন, তখন এই অটুট ব্যবস্থাপনা নিমেষের মধ্যে ভেঙ্গে চুরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অতঃপর তাঁর আদেশে সব মৃত পুণরুজ্জীবিত হয়ে হাশরের মাঠে সমবেত হবে [ ৩০: ২৫-২৭ ]। এই ষষ্ঠ নিদর্শনটি প্রকৃতপক্ষে পূর্বোক্ত পাঁচটি নিদর্শনের পরিসমাপ্তি। মানুষের উৎপত্তি থেকে শুরু করে তার বিভিন্ন বিকাশের মাধ্যম ও পরিসমাপ্তি গুলিকে বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

২৪। তাঁর নিদর্শনসমুহের মধ্যে আর একটি এই যে, তিনি তোমাদের বিদ্যুৎকে দেখান ভয় ও ভরসা হিসেবে ৩৫৩০, এবং তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি প্রেরণ করেন এবং তার দ্বারা ভূমির মৃত্যুর পরে তা [ পুণরায় ] জীবিত করেন। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা প্রজ্ঞাসম্পন্ন।

৩৫৩০। দেখুন উপরের টিকার (৫) নম্বর , আরও দেখুন আয়াত [ ১৩ : ১২ ]। "ভয় ও ভরসা সঞ্চারকরূপে" - বজ্র ও বিদ্যুত প্রাকৃতিক শক্তি। বজ্র ও বিদ্যুতকে যদি বিদ্যুত প্রতিরোধক দ্বারা বাধা দান করা না হতো , তবে সুউচ্চ অট্টালিকা সমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হতো এবং জীবন নাশের আশঙ্কা হতো। এ কারণেই লোকে বজ্রের শব্দে ভীত হয়। কিন্তু বজ্র ও বিদ্যুত শুষ্ক মাটির জন্য বৃষ্টির সুসংবাদ দান করে, যা মাটিকে সতেজ ও সজীবতা দান করে। বজ্র ও বিদ্যুতের এই দ্বিবিধ কার্যক্ষমতাকে প্রতীক স্বরূপ ব্যবহার করা হয়েছে , আধ্যাত্মিক আশঙ্কা ও আশাকে প্রকাশ করার জন্য। ভয় এই কারণে যে, আমরা হয়তো আল্লাহ্‌র অপ্রতিরোধ্য বাণী গ্রহণের উপযুক্ত হতে পারবো না, এবং আশা এই কারণে যে, হয়তো আমরা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভে ধন্য হব এবং তাঁর শক্তিশালী স্পর্শে আমাদের আধ্যাত্মিক জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে। লক্ষ্য করুন এই লাইনটি "তার দ্বারা ভূমিকে উহার মৃত্যুর পরে পুণর্জীর্বিত করেন" পুণরাবৃত্তি করা হয়েছে [ ৩০ : ১৯ ] নম্বর আয়াতে। এই প্রতীকধর্মী বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ দ্বারা আমাদের আধ্যাত্মিক জগতের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে সঞ্জীবিত করা হয়।

আমাদের পরকালের জীবনের নিরাপত্তার জন্য আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারা হৃদয়ঙ্গমের চেষ্টা করা উচিত। একমাত্র জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমেই আল্লাহ্‌র ক্ষমতা ও দয়াকে আত্মার মাঝে অনুভব করা যায়। "ইহাতে অবশ্যই নিদর্শন রয়োছে প্রজ্ঞাসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য।" লাইনটি দ্বারা এ কথাকেই বোঝানো হয়েছে।

২৫। তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে আর একটি এই যে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবী স্থিতি থাকে ৩৫৩১। তারপরে তিনি যখন তোমাদের একবার ডাক দেবেন, তখন তোমরা ভূমি থেকে [ অবিলম্বে ] বের হয়ে আসবে।

৩৫৩১। দৃশ্যমান জগতে আকাশ ও পৃথিবী উভয়েই তার নিজস্ব পরিমন্ডলে আত্মনির্ভরশীল। আল্লাহ্‌র শিল্প নৈপুন্যে আকাশ ও পৃথিবী পরস্পরের সাহায্য ব্যতীরেকেই দাড়িয়ে আছে। তারা আল্লাহ্‌র ক্ষমতার সাক্ষী। আমাদের পার্থিব জীবন আকাশ ও পৃথিবীর উপরে নির্ভরশীল। ভূমি আমাদের খাদ্য জোগায় ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটায় , আকাশ আমাদের বৃষ্টি দেয়, সূর্যের আলো ও তাপ দান করে - এ ভাবেই আল্লাহ্‌র ক্ষমতা আমাদের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন। এ কথা বোঝার পরেও কি ভাবে আমরা Ma'ad বা শেষ বিচারের দিনকে অস্বীকার করি ? যে দিন আমরা সকলে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র করুণার প্রার্থী হব?

২৬। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর অধীনে। সকলেই একান্তভাবে তারই অনুগত ৩৫৩২।

৩৫৩২। এই আকাশ, পৃথিবী ও সারা বিশ্ব ভূমন্ডল আল্লাহ্‌র হুকুম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জড় জগত ও জীব জগত সকলেই একান্ত অনুগতভাবে আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করে থাকে। কারণ তাদের আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্য করার সাধ্য নাই। সে ক্ষমতা তাদের দেয়া হয় নাই। আল্লাহ্‌ যে নির্দ্দিষ্ট ধর্ম তাদের জন্য স্থির করে দিয়েছেন, যে প্রাকৃতিক আইনের অর্ন্তভূক্ত করেছেন তার বাইরে তারা কখনও যায় না। অর্থাৎ যে জীবনকে স্রষ্টা কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন , তাকে সেই উদ্দেশ্যের প্রতি পথ প্রদর্শনও করেছেন। যেমন : মৌমাছির মধ্যে ফুল চেনা মৌচাক তৈরী করা ইত্যাদি। সেই হিসেবে তারা সর্বদা আল্লাহ্‌র আইন মানার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র মাহাত্ম্য ঘোষণা করছে এবং আনুগত্য প্রকাশ করছে। একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ্‌ "সীমিত" আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন। যার ফলে সে ইচ্ছা করলে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করতে পারে অথবা মন্দকে গ্রহণ ও ভালোকে বর্জন করতে পারে। আল্লাহ্‌ প্রদত্ত যোগ্যতাকে মানুষ নিজ ইচ্ছায় ব্যবহার করতে পারে। প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহ্‌ প্রতিটি আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন পূত ও পবিত্র রূপে। প্রতিটি আত্মার স্বভাবগত ধর্ম হচ্ছে স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভ করার আকাঙ্খা। একমাত্র পূত পবিত্র আত্মাই স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভে সক্ষম। পৃথিবীর সকল সৃষ্টিই "তাঁর আজ্ঞাবহ"।

সুতারাং আত্মা তার স্বভাবগত ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকতে চাইবে , এবং সৃষ্টির অন্যান্য বস্তু ও প্রাণীর মত, আল্লাহ্‌র আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে; আত্মা প্রকৃতিগত ভাবে বিকাশ ও সমৃদ্ধি লাভ করবে।

২৭। তিনিই সৃষ্টি [ প্রক্রিয়া ] শুরু করেন ৩৫৩৩। তারপরে তার পুনরাবৃত্তি ঘটান। তাঁর জন্য এটা অতি সহজ। আকাশ ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ মর্যদা তাঁহারই। তিনি মহাশক্তিশালী ও পরম জ্ঞানী ৩৫৩৪।

৩৫৩৩। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৩০ : ১১ ]। পূর্বের আয়াতে এই একই বক্তব্য দ্বারা শুরু করা হয়েছে যে, সকল জিনিষই সৃষ্টির আদিতে এবং অন্তে আল্লাহ্‌ হুকুম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর পরে অনেক উদাহরণ দ্বারা এই কথাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এবং এই আয়াতে সেই একই লাইনের পুণরুল্লেখ দ্বারা বক্তব্যের ইতি টানা হয়েছে।

৩৫৩৪। আল্লাহ্‌র মাহাত্ম্য ও মহিমা ভাষাতে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা যে কোনও মানুষের সাধ্যের বাইরে। ভাষা যখন ভাব প্রকাশে অপারগ ; উপমা ও রূপকের মাধ্যমে তার কিছুটা প্রকাশ করা সম্ভব। কিন্তু তার পরেও আমাদের চিন্তা ভাবনা বা কল্পনা প্রকৃত সত্য থেকে বহু দূরে থাকে। কারণ আল্লাহ্‌ আমাদের ধারণার সীমানা থেকে বহু উর্দ্ধে বিরাজমান, যার ধারণা করা পৃথিবীর সর্বোচ্চ জ্ঞানীর পক্ষেও সম্ভব নয়।

রুকু - ৪

২৮। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের [ অভিজ্ঞতা ] থেকে দৃষ্টান্ত , বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছেন ৩৫৩৫। তোমাদের আমি যে ধন-সম্পদ দিয়েছি , তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস-দাসীগণের কেহ কি তাতে সমান অংশীদার ৩৫৩৬ ? তোমরা কি তাদের সেরূপ ভয় কর যেরূপ তোমরা পরস্পর পরস্পরকে কর ৩৫৩৭ ? এরূপেই আমি যারা বুঝতে পারে তাদের জন্য নিদর্শন সমূহ বিশবদভাবে ব্যাখ্যা করে থাকি ৩৫৩৮।

৩৫৩৫। এই আয়াতের রূপকের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের অন্তরে নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রার উর্দ্ধে অবস্থিত শক্তির অনুধাবনের চেষ্টা করতে বলেছেন। আল্লাহ্‌র অবস্থান এবং শক্তি আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষের এতই উর্দ্ধে যে, আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমরা তা সম্পূর্ণ অনুধাবনে সক্ষম হব না। কারণ তা আমাদের সকল অনুমান ও বোধশক্তিকে অতিক্রম করে যায়। আমাদের চিন্তার সর্বোচ্চ অধিষ্ঠানের বহু উর্দ্ধে তাঁর অবস্থান , সর্বোচ্চ জ্ঞানের বহুগুণ তাঁর জ্ঞান।

৩৫৩৬। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ - যার জ্ঞান, ক্ষমতা আমাদের উপলব্ধি করা কখনও সম্ভব নয় - কারণ তাঁর অবস্থান আমাদের অবস্থানের বহু উর্দ্ধে। এখানে যে উপমার সাহায্যে তার অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে - তা হচ্ছে প্রভু কি কখনও নিজেকে তার ক্রীতদাস দাসীদের সমকক্ষ মনে করে ? তার ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার সামান্যতম অংশীদরিত্বের অধিকার দান করে ? যদিও তার সকল ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা তার নিজস্ব নয়, সবই আল্লাহ্‌ তাকে দান করেছেন। কেউ ধনী কেউ গরীব বা ক্রীতদাস এ সকলই দৈব ঘটনা, এটা কারও ইচ্ছাধীন নয়। তবুও মানব সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ করে। অতএব চিন্তা কর ফেরেশতা , মানব ও জ্বিনসহ সমগ্র সৃষ্ট জগত আল্লাহ্‌র সৃজিত ও তাঁরই দাস বা গোলাম। সুতারাং আল্লাহ্‌র সৃজিত জিনিষ আল্লাহ্‌র সমকক্ষ অথবা তাঁর শরীক কিরূপে বিশ্বাস করে ?

৩৫৩৭। মানুষ সমাজ বদ্ধ জীব। কিন্তু এই সমাজে যে মানুষ সবল সে সর্বদা দুর্বলের উপরে অত্যাচার করতে উদ্যত। যদি সমাজে এদের দমনের কোনও বন্দোবস্ত না থাকতো তবে সমাজ মনুষ্য বাসের অযোগ্যরূপ ধারণ করতো। সমাজের শৃঙ্খলা ও শান্তিকে সঠিক রাখার জন্য মানুষ সামাজিক কাঠামোকে এভাবে বিন্যস্ত করেছে যে, রাজা বা প্রজাতন্ত্র প্রধান, সমাজে অত্যাচারী ও অন্যায়কারীর প্রতিরোধ করেন এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীকে শ্রদ্ধা করবে, মেনে চলবে, এবং শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য তাঁর কর্তৃত্বের উপরে নির্ভরশীল হবে। সমাজে মানুষ শুধু যে ক্ষমতা ও কতৃর্ত্বর অধিকারীকে ভয় পায় তাই নয়, সে তার সমকক্ষদেরও সম্মান করে, তাদের মতামত ও বদনামের ভয় করে। কিন্তু তারা তাদের ক্রীতদাস-দাসীদের বা নির্ভরশীলদের মতামতকে গ্রাহ্য করে না বা ভয়ও পায় না। এই উপমার সাহায্যে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, মানুষ তো সর্বোতভাবে সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল। এই বিশাল বিশ্ব ভূবনের মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌ তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তিনি কারও উপরে নির্ভরশীল নন। সুতারাং কিভাবে মানুষ মহান আল্লাহ্‌র সঙ্গে তাঁর কোনও সৃষ্টির কোন ব্যাপারে শরীকানা করে ? যেখানে সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই আল্লাহ্‌র সৃষ্টি, তাঁর অধীনে এবং একমাত্র তাঁরই উপরে নির্ভরশীল ? আমাদের উচিত আল্লাহ্‌র বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা ও তা মেনে চলা। কারণ আল্লাহ্‌ ভীতিই হচ্ছে সকল জ্ঞানের প্রারম্ভ বা উৎস এবং "যারা বুঝতে পারে তাদের জন্য নিদর্শনাবলী। "

৩৫৩৮। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৭ : ৩২, ১৭৪ ] প্রভৃতি।

২৯। বরং পাপীরা জ্ঞানবর্জিত হয়ে [ শুধুমাত্র ] তাদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে থাকে। আল্লাহ্‌ যাকে বিপথে ত্যাগ করেন কে তাকে সৎ পথ দেখাবে ? ৩৫৩৯। তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নাই।

৩৫৩৯। তারাই 'সীমালঙ্ঘনকারী' যারা জেনে শুনে সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্‌র পথ নির্দ্দেশকে প্রত্যাখান করে এবং আল্লাহ্‌র আইন বা বিধানকে অস্বীকার করে। ফলে তারা আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণা থেকে বিচ্যুত হয়। এভাবেই তারা আত্মিক উন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ একমাত্র আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া-ই আমাদের আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান দেয় ও সাফল্য আনায়ন করে এবং ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে ধন্য করে। আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান একমাত্র পরম করুণাময়ের সাহায্য ব্যতীত লাভ করা সম্ভব নয়। যারা পাপী ও সীমালঙ্ঘনকারী, তাদের জন্য আল্লাহ্‌র এই রহমতের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ তাদের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " যা মানুষকে আল্লাহ্‌ দান করেছেন, তার অপব্যবহারের ফলে তারা আল্লাহ্‌র করুণার পথ স্বহস্তে বন্ধ করে দেয়। ফলে তাদের আত্মিক উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এরূপ ক্ষেত্রে , " কে তাকে সৎপথে পরিচালিত করবে ? "

৩০। সুতারাং তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজের মুখকে ধর্মের দিকে প্রতিষ্ঠিত কর ৩৫৪০। তোমরা আল্লাহ্‌র প্রকৃতিকে [ প্রতিষ্ঠিত ] কর, যে নক্‌শা অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্‌র সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নাই ৩৫৪১। এটাই আদর্শ ধর্ম ৩৫৪২। কিন্তু মানুষের মধ্যে অধিকাংশই তা বুঝতে পারে না।

৩৫৪০। "Hanif" অর্থ ঋজু বা সরল। এই শব্দটি আয়াতে [ ২ : ১৩৫ ] ব্যবহৃত হয়েছে।। চুম্বক শলাকা যেরূপ উত্তর দক্ষিণে দিকে 'ঋজু' - 'সরল ' বা 'ঋজু' বা 'সত্য' বলতে ব্যক্তির সেরূপ মানসিকতাকেই বোঝানো হয়েছে যা সর্বদা এক আল্লাহ্‌র প্রতি ঐকান্তিক ভাবে নিবেদিত থাকবে। যারা আল্লাহ্‌র সত্যকে লাভ করে ঐশিজ্ঞানের অধিকারী তারা কখনও জীবনের কোনও অবস্থাতেই তা থেকে সরে যেতে পারে না। চুম্বক শলাকা যেরূপ সর্বাবস্থায় উত্তর দক্ষিণ মুখ করে থাকে, এরাও সেরূপ জীবনের সর্বাবস্থায় ঋজু ভাবে আল্লাহ্‌র সত্যের প্রতি নিবেদিত থাকে।

৩৫৪১। প্রতিটি মানব শিশু জন্ম গ্রহণ করে নিষ্পাপ, পবিত্র , ন্যায় ও সত্যের প্রতি অনুগত, গুণের প্রতি আসক্ত, এবং বিশ্বভূবনে তার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নিয়ে। নিষ্পাপ আত্মায় সে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে আল্লাহ্‌র মহানুভবতা, বিচক্ষণতা,জ্ঞান ও ক্ষমতাকে। এটাই হচ্ছে আত্মার প্রকৃতিগত ধর্ম বা যোগ্যতা। আল্লাহ্‌ প্রত্যেক জীবের জন্য তার নির্দ্দিষ্ট ধর্মকে এবং যোগ্যতাকে স্থির করে দিয়েছেন। অর্থাৎ যে জীবনকে স্রষ্টা যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন তাকে সে উদ্দেশ্যের প্রতি পথও প্রদর্শন করেছেন, যেমনঃ মৌমাছির মধ্যে ফুল ও মধু চেনার যোগ্যতা এবং মৌচাক ও মধু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ঠিক সে রকমই মানুষের আত্মাকে এক বিশেষ প্রকৃতি বা ধর্ম দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে , যাতে সে খুব সহজেই নিজ স্রষ্টাকে চিনতে পারে , তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশ করতে পারে। এটাই হচ্ছে আত্মার স্বভাবগত প্রকৃতি বা ধর্ম যে ভাবে স্রষ্টা তাকে সৃষ্টি করেছেন , যেমন ভেড়ার প্রকৃতি শান্ত , অশ্বের প্রকৃতি দ্রুত ধাবমান ইত্যাদি। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে পাওয়া আত্মার এই সহজ, সরল, নিষ্পাপ পবিত্র, সত্যের ও ন্যায়ের প্রতি নিবেদিত রূপকে নষ্ট করে ফেলে। কারণ সমাজ জীবনে সে রীতি-নীতি, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা, ভুল শিক্ষার শিকার হয়ে , এ সবের নাগপাশে নিজেকে আবদ্ধ করার ফলে আত্মার স্বাধীনতা ও পবিত্রতা হারায়। এ সবের ফলে তার মাঝে শান্ত সমাহিত ভাবের পরিবর্তে সে হয় লড়াই প্রিয়, অপবিত্র, মিথ্যুক, দাসসুলভ মনোভাব , যা কিছু নিষিদ্ধ এবং মিথ্যা তার দ্বারা আকর্ষিত হওয়া ইত্যাদি মনোভাব সম্পন্ন। এই মনোভাব সম্পন্ন হওয়ার ফলে সে মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতা হারায় - কারণ তার অন্ধ স্বার্থপরতা এবং পাপের প্রতি আসক্তির ফলে তার আত্মার এই পরিণতি ঘটে যার শেষ পরিণাম হচ্ছে এক স্রষ্টার এবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। মানুষকে আল্লাহ্‌ সৃষ্টিই করেছেন আল্লাহ্‌র এবাদতের জন্য- এটাই তার স্বভাব ধর্ম (৫১:৫৬), চুম্বকের যেরূপ উত্তর দক্ষিণে মুখ করে রাখা স্বভাবধর্ম। রসুলের [ সা ] সম্মুখে যে সমস্যা ছিলো, তা হচ্ছে এ সব অসাধু ও বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন সম্প্রদায়কে সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন করা , যা আত্মার আদি ধর্ম তাতে প্রতিষ্ঠিত করা - কারণ মানুষ সৃষ্টির সেটাই হচ্ছে স্রষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য।

৩৫৪২। "Qaiyim" দ্বীন বা ধর্ম। এই শব্দটি অত্যন্ত ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত। মানুষের সমগ্র জীবনই হচ্ছে 'দ্বীন'। জীবন ব্যবস্থার মাধ্যমে আত্মাকে তার স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত করার নামই হচ্ছে দ্বীন বা ধর্ম পালন করা। যা আত্মার স্বভাব ধর্মের পরিপন্থি নয়, তাই-ই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম বা "Standard Religion" বা সরল পথ যা যুগে যুগে মানুষের বিভিন্ন বিকৃত মতভেদ দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয় এবং ধর্মের মাঝে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি করে [ দেখুন নীচের ৩২ নং আয়াত ]। আল্লাহ্‌র ধর্ম সর্বযুগে একটাই , যা হচ্ছে- আল্লাহ্‌ এক এবং অদ্বিতীয়, যা "অধিকাংশ মানুষ তা বুঝতে পারে না।"

৩১। অনুতাপের মাধ্যমে তাঁর দিকে ফিরে এসো এবং তাঁকে ভয় কর। নিয়মিত সালাত প্রতিষ্ঠা কর; এবং যারা আল্লাহ্‌র সাথে অন্য উপাস্য গ্রহণ করে তাদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না ৩৫৪৩।

৩৫৪৩। "অনুতাপের মাধ্যমে তাঁর দিকে ফিরে এসো এবং তাঁকে ভয় কর। " - অনুতাপের মাধ্যমে, ভয় করার অর্থ এই নয় যে শরীরে ছাই মেখে ছিন্ন বস্ত্র পরিধান করে হতাশভাবে জীবন অতিবাহিত করা। এই ভয় করার অর্থ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য আত্মাকে বিশুদ্ধকরণ , সৃষ্টির আদিতে স্রষ্টা তাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে, আত্মার রোগমুক্তি; যথাঃ অসাধুতা [ যা আত্মার জন্য অস্বাভাবিক ] থেকে মুক্তি লাভ করে সরল পথে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যা আত্মার স্বভাব ধর্ম। সৃষ্টির আদিতে আল্লাহ্‌ যে স্বভাব ধর্মে আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন। আত্মার এই পবিত্রতা পাপের প্রলোভনে মানুষ নষ্ট করে ফেলে। চুম্বক শলাকার উপমাতে আবার ফিরে আসা যাক [ টিকা ৩৫৪০ ]। চুম্বক শলাকার ধর্মই হচ্ছে মুক্ত অবস্থায় সে সর্বদা উত্তর-দক্ষিণ মেরু অভিমুখী হয়ে থাকবে , একমাত্র কৃত্রিমভাবে কোনও বাধা দানের ফলে চুম্বক শলাকার এই মেরু অভিমুখী প্রবণতা বাধা দান করা সম্ভব। কিন্তু এই বাধা সরিয়ে নিলে , মুক্তভাবে চুম্বক শলাকাকে অবস্থান করতে দিলে, সে আবার তার পূর্বাবস্থা উত্তর-দক্ষিণে অবস্থান করবে। ঠিক সেরূপ পাপের ফলে আত্মা অপবিত্র হয় এবং তার স্বভাব ধর্ম হারিয়ে ফেলে। পাপের প্রলোভন থেকে মুক্ত হতে পারলেই , আত্মা আবার তার স্বভাব ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হবে - অর্থাৎ স্রষ্টার দিকে হবে একমাত্র আনুগত্য।

৩২। যারা তাদের ধর্মকে বিভক্ত করেছে এবং [ শুধুমাত্র ] ধর্মীয় দলে পরিণত হয়েছে, - তাদের প্রত্যেক দল তাদের নিকট যা আছে তাতেই আনন্দিত ৩৫৪৪।

৩৫৪৪। এই আয়াতটিতে যারা ধর্মে মতভেদের সৃষ্টি করে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে। যারা স্বভাব ধর্ম থেকে বিচ্যুত তারা সত্য ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করে থাকে। তাই বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন মাযহাবের সৃষ্টি। প্রত্যেকে নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে হর্ষোৎফুল্ল এবং অপরের মতবাদকে ভ্রান্ত আখ্যা দেয়, অথচ তারা সকলেই ভ্রান্ত পথে পরিচালিত। আল্লাহ্‌ এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর ধর্মও একটাই তা হচ্ছে আত্মার স্বভাব ধর্ম বা ইসলাম বা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন।

৩৩। মানুষকে যখন দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করে তারা তাদের প্রভুকে ডাকে ৩৫৪৫, অনুতপ্ত হয়ে তাঁর নিকট ফিরে আসে। কিন্তু যখন তিনি নিজের পক্ষ থেকে তাদের অনুগ্রহ আস্বাদন করান, দেখো, তাদের অনেকে আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য উপাস্যকে অংশীদার করে, -

৩৫৪৫। দেখুন আয়াত [ ১০ : ১২ ]। যখন মানুষের জীবনে দুঃখ-দৈন্য ,বিপর্যয়-দুর্দ্দশা স্পর্শ করে, তখন মানুষ হৃদয়ঙ্গম করে তার অসহায়ত্ব। শুধু তখনই মানুষ এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্রষ্টার সাহায্য কামনা করে একাগ্রচিত্তে ,সে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, সকল কল্যাণের এবং সুখ-শান্তির উৎস সেই পরম করুণাময় আল্লাহ্‌। কিন্তু মানুষকে স্রষ্টা যখন তাঁর অনুগ্রহ দান করেন এবং সে সেই বিপদ-বিপর্যয় থেকে উদ্ধার লাভ করে, তখন অধিকাংশ মানুষের যে মানসিকতা হয় তাই-ই এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে নিজের বুদ্ধিমত্তা বা রত্ন-পাথরের গুণ বা, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবমুক্তি বা মাজারে নিয়ত বা এরূপ বহু মিথ্যা উপাস্যকে অন্তর্ভূক্ত করে থাকে। এ ভাবেই তারা আল্লাহ্‌র সাথে অংশীদারিত্ব করে থাকে যদিও তারা মুখে আল্লাহ্‌র কথা বলে থাকে। তাদের এই মনোভাব তাদের আল্লাহ্‌র প্রতি অকৃতজ্ঞতারই স্বাক্ষর। কারণ তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল বলে বিশ্বাস করে না।

৩৪। [ এই উদ্দেশ্যে ] আমি যে [ অনুগ্রহ ] দান করেছি তার প্রতি যেনো অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। সুতারাং [ তোমাদের সংক্ষিপ্ত সময়কে ] ভোগ করে নাও। কিন্তু শীঘ্রই [ তোমাদের বোকামী ] জানতে পারবে ৩৫৪৬।

৩৫৪৬। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ৫৪ ]। যারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে শেরেক বা অংশীদার কল্পনা করে; তারা তা করে কারণ তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে স্বীকার করতে চায় না। তারা তাদের মনগড়া উপাস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। এদের পার্থিব জীবনকে ভোগ করে নিতে বলা হয়েছে , কারণ এদের জন্য পরকালে আছে শাস্তি। পরলোকে তারা তাদের কর্মের প্রকৃত রূপ অনুধাবনে সক্ষম হবে। তারা যা অস্বীকার করেছিলো এবং মনগড়া যা সৃষ্টি করেছিলো প্রতিটি কাজেরই প্রকৃত মূল্যবোধ তাদের সামনে তখন ভাস্বর হবে।

৩৫। আমি কি উহাদের নিকট এমন কোন দলিল অবতীর্ণ করেছি যা ওদের শরীক করতে বলে ? ৩৫৪৭

৩৫৪৭। যারা আল্লাহ্‌র সাথে অংশীদার করে তাদের মনগড়া উপাস্য বা ধনদৌলতের অধিদেবতার উপাসনা করে , তাদের ব্যবহারে মনে হয় তারা যেনো এ কাজ করার জন্য আল্লাহ্‌র তরফ থেকে অনুমতি লাভ করেছে। যদিও তারা এ কাজে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকে, তবুও সম্পূর্ণ ব্যাপারটি তাদের একান্তই মনগড়া।

৩৬। যখন আমি মানুষকে অনুগ্রহের আস্বাদ দেই ওরা উল্লাসিত হয়ে ওঠে ৩৫৪৮। কিন্তু ওদের কৃতকর্মের ফলে যদি বিপদে কষ্ট পায় , দেখো, তারা হতাশ হয়ে পড়ে।

৩৫৪৮। আয়াত [৩০ : ৩৩ ] এ বলা হয়েছে দুঃখ-দুর্দ্দশায় এবং সুখ ও প্রাচুর্যে মানুষের আল্লাহ্‌র প্রতি অযৌক্তিক আচরণ সম্বন্ধে। দুঃখের অমানিশা যখন তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, তারা সর্বান্তঃকরণে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করে , কিন্তু বিপদের কালো মেঘ সরে গেলে সুখের দিনে তারা আল্লাহ্‌কে ভুলে অন্য জিনিষের এবাদত করে। এই আয়াতে এই দুধরণের অবস্থায় মানুষের চিন্তাধারার মনঃস্তাত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুখের দিনে, প্রাচুর্যের দিনে মানুষ অহংকারে স্ফীত হয়ে গর্বে ঊল্লসিত হয়ে পড়ে, কিন্তু অপরপক্ষে দুঃখ-বিপদে সে হতাশ হয়ে পড়ে। এই দুধরণের মানসিকতাই নিন্দনীয়। প্রাচুর্যের দিনে তার মনে রাখা উচিত যে এ জন্য গর্ব করার কিছুই নাই। এ সকলই আল্লাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহ যা তাকে দান করা হয়েছে। এখানে তার নিজস্ব কোনও কৃতিত্ব নাই। অপর পক্ষে মানুষের দুঃখ দুর্দ্দশা, তার কৃতকর্মেরই ফল, এ কথা অধিকাংশ লোকই ভুলে যেয়ে হতাশগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের উচিত বিনয়ের সাথে, ধৈর্যের সাথে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করা যেনো তারা সেই দুঃখ দুর্দ্দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে। পরের আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র নেয়ামত বা অনুগ্রহ , যথা সম্পদ, প্রাচুর্য, মেধা, প্রতিভা, ক্ষমতা, প্রভৃতি সকলকে সমভাবে দান করেন না। পৃথিবী সৃষ্টিতে আল্লাহ্‌র বৃহত্তম ও সূদূর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাঁর দেয়া সুযোগ সুবিধা, সম্পদ-প্রাচুর্য ইত্যাদি তিনি কাউকে বেশী, কাউকে কম দান করেন। এ সবই তাঁর সর্ব কল্যাণময়, বিচক্ষণ পরিকল্পনার অংশ বিশেষ - আমরা তা বুঝতে পারি বা নাই পারি।

৩৭। তারা কি দেখে না যে, আল্লাহ্‌ যার প্রতি ইচ্ছা রুজী বৃদ্ধি করে দেন এবং সীমিত করে দেন ? ৩৫৪৯ অবশ্যই এর মাঝে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।

৩৫৪৯। দেখুন আয়াত [ ২৮ : ৮২ ] এবং টিকা ৩৪১২। আরও দেখুন পূর্বের টিকাটি। আল্লাহ্‌ তার অনুগ্রহ সকলকে সমভাবে বণ্টন করেন না। এটা আল্লাহ্‌র বৃহত্তর ও বিচক্ষণ পরিকল্পনার অংশ মাত্র। সকলেই সমান গুণের বা সম্পদের অধিকারী হলে পৃথিবীর সভ্যতার গতি স্তব্ধ হয়ে যেতো। বিশ্বাসী ও বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য এও আল্লাহ্‌র এক নিদর্শন।

৩৮। সুতারাং আত্মীয়কে, অভাবগ্রস্থকে এবং পর্যটককে তাদের প্রাপ্য দেবে। যারা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে তাদের জন্য এটাই উত্তম ৩৫৫০। এরাই তারা যারা হবে সফলকাম। ৩৫৫১

৩৫৫০। "Wajh" অর্থাৎ মুখমন্ডল,অনুগ্রহ বা প্রসন্নতা। দেখুন টিকা ১১৪ এবং আয়াত [ ২ : ১১২ ]। আরও দেখুন আয়াত [ ৬ : ৫২ ]।

৩৫৫১। এই জীবনে এবং পরকালেও সফলকাম। দেখুন টিকা ২৯ এবং আয়াত [ ২ : ৫ ]।

৩৯। [ অন্য ] লোকের সম্পত্তির মাধ্যমে বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা যা ব্যয় কর; আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে তা বৃদ্ধি বলে পরিগণিত নয় ৩৫৫২। কিন্তু আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যা তোমরা দান হিসেবে ব্যয় কর [ তা বৃদ্ধি পাবে ] ৩৫৫৩। এরাই তারা যাদের বহুগুণে পুরষ্কৃত করা হবে।

৩৫৫২। "Riba" হচ্ছে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন যেমন, সুদ, ঘুষ, প্রতারণাপূর্ণ ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি। দেখুন আয়াত [ ২ : ২৭৫ - ২৭৭ ] এবং টিকা ৩২৪ -৩২৭। অন্যায়ভাবে অপরের রক্ত শোষণ করে সম্পদ অর্জন করা হারাম। বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যা ব্যক্তি স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় হতে পারে তা ব্যক্তিগত , জাতীয় বা আর্ন্তজাতিক এ সকল কিছুই "Riba" শব্দটির আওতায় পড়ে। মূলনীতি হচ্ছে বিনা পরিশ্রমে অন্যের উপর দিয়ে, অপরের পরিশ্রমে, অপরকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ধন সম্পদ অর্জন করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগীতায়, অপরকে শোষণ করার উপায়গুলি, ভাষার মারপ্যাচে, রচনা শৈলীকে দুর্বোধ্য করে তাকে আইনগত অধিকার দান করলেও তা ইসলামে তা নিষিদ্ধ। এই আয়াতে এরূপ কর্মকান্ডকে নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। এই আয়াতে অন্যকে শোষণ করে অর্থ উপার্জন শুধু যে নিন্দা করা হয়েছে তাই-ই নয় এই অন্যায় কাজের বিপরীত প্রতিশোধকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য , সহায়, সম্পদ, দিয়ে অভাবগ্রস্থদের সাহায্য করতে। যদি আমরা তা করতে পারি আল্লাহ্‌ আমাদের আশ্বাস দান করেছেন যে, আমাদের প্রাপ্য অপেক্ষা বহুগুণ বেশী পুরষ্কৃত করা হবে। তফসীরকারদের মতে এই আয়াতটিতে তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে যারা ভালো কাজের প্রতিদান গ্রহীতার নিকট থেকে আশা করে থাকে। যেহেতু তাদের প্রত্যাশা পৃথিবীর মানুষের কাছে, তাদের কাজ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত নয়, সুতারাং তাদের ভালো কাজের পুরষ্কার ঐশ্বরিক হবে না, এ সব 'ভালো কাজ' আল্লাহ্‌র নিকট মূল্যহীন। কারণ আল্লাহ্‌ প্রত্যেকের কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জ্ঞাত, তিনি তাদের লোক দেখানো ভালো কাজের কোনও মূল্য দেন না।

৩৫৫৩। " আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ " - অর্থাৎ কাজের নিয়ত হবে সর্বশক্তিমানের সন্তুষ্টি লাভের জন্য। দেখুন টিকা ৩৫৫০।

৪০। আল্লাহ্‌-ই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। উপরন্তু তিনি তোমাদের জীবনোপকরণ যোগান দিয়েছেন। তারপরে তিনি তোমাদের মৃত্যু দেবেন। এবং পুণরায় তিনি তোমাদের জীবনে ফিরিয়ে আনবেন। তোমাদের [ মিথ্যা ] শরীকদের মধ্যে এমন কেহ আছে কি যে এ সমস্তের কিছুমাত্র করতে পারবে ? মহিমা তারই। তারা [আল্লাহ্‌ প্রতি ] যে শরীক আরোপ করে তিনি তা থেকে বহু উর্দ্ধে ৩৫৫৫।

৩৫৫৪। মানুষ বহু সময়েই আল্লাহ্‌র সাথে অংশীদারিত্বে অংশ গ্রহণ করে। ব্যক্তিপূঁজা,বা বীর পূঁজা, বা মাজার পূঁজা ইত্যাদিও এর অন্তর্ভূক্ত। এ সব অংশীদারদের থেকে আল্লাহ্‌ বহু উর্দ্ধে। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বের জন্য আমরা কি আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কারও উপরে নির্ভরশীল হতে পারি ? এ সব দেব-দেবীরা ক্ষমতাহীন। তারা কি আমাদের জীবনোপকরণ দিতে পারে ? তারা কি পারে আমাদের প্রাণ নিতে এবং তা আবার ফিরিয়ে দিতে ? অবশ্যই তারা তা পারে না। তাহলে কি এ সব ক্ষমতাহীনদের আল্লাহ্‌র সাথে ক্ষমতার অংশীদার কল্পনা করে নির্বোধ লোকেরা আল্লাহ্‌র অসম্মান করে না ?

৩৫৫৫। অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন [ ১০ : ১৮ ] আয়াত।

রুকু - ৫

৪১। মানুষের হাত যা অর্জন করেছে [ কৃতকর্ম ] , তার দরুণ স্থলে ও সমুদ্রে অশান্তি দৃষ্টিগোচর হয় ৩৫৫৬। এজন্য যে [আল্লাহ্‌ ] যেনো তাদেরকে তাদের কোন কোন কাজের জন্য [ শাস্তির ] আস্বাদ দিতে পারেন ; যেনো তারা [ মন্দ থেকে ] ফিরে আসে ৩৫৫৭।

৩৫৫৬। আল্লাহ্‌র সৃষ্টি সর্বদা সুন্দর ও পবিত্র। সমাজ জীবনে দূর্নীতি এবং প্রকৃতির মাঝে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হচ্ছে মানুষের পাপ কর্ম, যে পাপ কর্মের উৎস হচ্ছে মানুষের স্বার্থপরতা এবং উদ্ধত অহংকার [ দেখুন টিকা ৩৫৪১ এবং আয়াত ৩০ : ৩০ ]। সমাজ জীবনেই হোক বা বিশ্ব প্রকৃতিতেই হোক যখনই মানুষের পাপে কোনও বিপর্যয় ঘটে থাকে আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়া তা প্রতিরোধ করে থাকে। যদিও মন্দ কাজের শেষ পরিণতি মন্দ তবুও মানুষ যতটুকু পাপ করে সে অনুপাতে তাকে শাস্তি দান করা হয় না ; কারণ তাকে আবার সৎপথে ফিরে আসার সুযোগ দান করার জন্য আংশিক ভাবে "কোন কোন কর্মের শাস্তি" আস্বাদন করানো হয়।

৩৫৫৭। আল্লাহ্‌র বিচক্ষণ বিচার এবং শাস্তি সবই মানুষকে পাপ পথ থেকে ফিরিয়ে এনে তাকে পূত পবিত্র রূপে , যেমন সে ছিলো পৃথিবীতে প্রথম আগমনের সময়ে, প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা। পৃথিবীতে মানব শিশু জন্মগ্রহণ করে পূত পবিত্র রূপে। পাপের প্ররোচনা ও প্রভাবে সে তার সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অপব্যবহার করে থাকে। আল্লাহ্‌র সীমিত শাস্তির দ্বারা এই "স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে" পাপের প্রভাবমুক্ত করে সুপথে ফিরিয়ে আনতে চান।

৪২। বল, " পৃথিবী ভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীদের কি পরিণাম হয়েছে। এদের অধিকাংশই আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত করতো ৩৫৫৮। "

৩৫৫৮। দেশ ভ্রমণ করে পৃথিবীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সভ্যতাকে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, পাপ এবং দূর্নীতি দ্বারা মানুষ নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। কারণ তাদের সকল কর্ম-ই মিথ্যার উপরে প্রতিষ্ঠিত। তারা মিথ্যা উপাস্যের উপসনা করে, জীবন ধারণের যে বিধান তা মিথ্যা মূল্যবোধের উপরে প্রতিষ্ঠিত, আশা -আকাঙ্খা মিথ্যা উদ্দেশ্যের প্রতি ধাবিত। এগুলি হচ্ছে মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। এ সব থেকে উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে প্রকৃত সত্যকে।

৪৩। অতএব, সঠিক ধর্মের দিকে তোমার লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত কর, আল্লাহ্‌র নিকট থেকে সে দিন আসার পূর্বেই যাকে ফেরানোর কোন সম্ভাবনা নাই ৩৫৫৯। সেদিন মানুষ [ দুদলে ] বিভক্ত হয়ে পড়বে ৩৫৬০।

৩৫৫৯। ইসলাম হচ্ছে সহজ সরল দ্বীন। মিথ্যা ও পাপ মানুষকে দ্বীনের সহজ সরল পথ থেকে বিচ্যূত করে দেয়। ফলে জীবনের ভারসাম্য বিচ্যুত হয়ে যায়, মানুষ মিথ্যামূল্য-বোধ ও আনুষ্ঠানিকতাকে ধর্ম বলে মনে করতে থাকে। খুব বেশী দেরী হয়ে যাওয়ার পূর্বেই আমাদের ভুল পথকে পরিহার করা উচিত। রোজ-কেয়ামত বা "সেই অনিবার্য দিন" - যা অবশ্যই আসবে যেদিন ব্যক্তির প্রতিটি কাজের প্রকৃত মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং সকল মিথ্যা এবং পাপকে ধ্বংস করা হবে। বর্তমান জীবনে পাপকে অনুধাবনের মাধ্যমে ,পাপকে পরিহার করা এবং অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনই হচ্ছে শেষ বিচারের দিনের ভয়াবহ পরিণতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ। যখন কেয়ামত সংঘটিত হবে, তখন অনেক দেরী হয়ে যাবে , আর অনুতাপ করার সময় পাওয়া যাবে না। কারণ তখন পাপ ও পূণ্য ; ভালো ও মন্দের মধ্যে এক অপ্রতিরোধ্য বাঁধার সৃষ্টি করা হবে, যার ফলে আল্লাহ্‌র নির্দ্দেশিত পথে তখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না।

৩৫৬০। শেষ বিচারের দিন বা কেয়ামত দিবসে মানুষ দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়বে। তারাই হতভাগ্য, যারা পার্থিব জীবনে সত্যকে প্রত্যাখান করেছিলো, ধর্মীয় বিশ্বাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলো , পরলোকে তারা নির্মম যন্ত্রণার সম্মুখীন হবে। আর অন্যদল হচ্ছে যারা পূণ্যাত্মা তারা লাভ করবে শান্তি এবং তাদের আত্মা সকল কামনা-বাসনা থেকে মুক্তি লাভ করবে [নীচের আয়াত দেখুন ]। পৃথিবীতে তাদের কৃতকর্মের দ্বারা তারা আল্লাহ্‌র আর্শীবাদে ধন্য হয় এবং তাদের জীবন সুখ ও শান্তিতে ভরে ওঠে ,ইহকালে ও পরকালেও।

৪৪। যারা ঈমানকে প্রত্যাখান করে তারা প্রত্যাখানের শাস্তি ভোগ করবে। এবং যারা সৎ কাজ করে তারা তাদের [ বিশ্রামের ] শয্যা স্বর্গ পর্যন্ত [ বিস্তৃত করবে ]।

৪৫। যেনো, যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকাজ করে তিনি নিজ অনুগ্রহে তাদের পুরষ্কৃত করতে পারেন ৩৫৬১। যারা ঈমানকে প্রত্যাখান করে তিনি তাদের ভালোবাসেন না ৩৫৬২।

৩৫৬১। যদিও পূণ্যাত্মা লোকেরা ইহকাল ও পরলোকের সুখ ও শান্তি অর্জন করে থাকে নিজস্ব চেষ্টা ও কর্মফলের মাধ্যমে , তবে এ কথা ভাবা ঠিক নয় যে তারা যা লাভ করে তা তাদের কাজের সমতুল্য পুরষ্কার। কারণ মহান আল্লাহ্‌ বহুবার আমাদের বলেছেন, যে তার দেয় পুরষ্কার ব্যক্তির যা প্রাপ্য তার থেকে বহুগুণ বেশী হবে এবং পাপের শাস্তি হবে ন্যায় বিচার অনুযায়ী যতটুকু প্রাপ্য ঠিক ততটুকুই। সুতারাং পূণ্যাত্মাদের জন্য এক বিরাট সুখবর বই কি। আল্লাহ্‌র রহমত ও অনুগ্রহ অপরিসীম।
৩৫৬২। " তিনি কাফেরদের পছন্দ করেন না" - অর্থাৎ যারা আল্লাহ্‌র সত্যকে প্রত্যাখান করে। আল্লাহ্‌র বিধানকে জীবনে গ্রহণ করে না তারা আল্লাহ্‌র করুণা ও রহমত বঞ্চিত হয়, " আল্লাহ্‌ তাদের ভালোবাসেন না।" প্রকৃত অর্থে এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তাদেরকেই ভালোবাসেন যারা আল্লাহ্‌র সত্যে বিশ্বাসী , তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনকারী। তাদের তিনি সীমাহীন অনুগ্রহে ধন্য করেছেন।

৪৬। তার নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে, তিনি সুসংবাদবাহী বায়ু প্রেরণ করেন ৩৫৬৩ এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি [ তার দ্বারা ] তোমাদের তাঁর [ অনুগ্রহ এবং ] দয়া আস্বাদন করাবেন ৩৫৬৪, যেনো জাহাজ সকল তাঁর আদেশে [ রাজকীয় ভাবে ] সমুদ্র যাত্রা করতে পারে ; এবং তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার ; যেনো তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার ৩৫৬৫।

৪৭। অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে বহু রসুলকে তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিকট পাঠিয়েছিলাম , এবং তাঁরা সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের কাছে গিয়েছিলো। অতঃপর যারা সীমালংঘন করেছিলো ,আমি তাদের প্রতিশোধ নিয়েছিলাম। যারা বিশ্বাস করে তাদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য।

৩৫৬৩। মানুষের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবনে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ সমূহকে অপূর্ব শিল্পিজনোচিত ভাবে পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে আয়াতে [ ৩০ :২০ - ২৭ ]। তারপরের আয়াতে [ ৩০ : ২৮ - ৪০ ] এ বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ মানুষ ও প্রকৃতিকে সৃষ্টির আদিতে পূত পবিত্র রূপে সৃষ্টি করেন, এবং আল্লাহ্‌র ইচ্ছা মানুষ আত্মার এই পবিত্রতা রক্ষা করুক, কিন্তু আমরা তার কতটুকু করি ? এখান থেকে শুরু হয়েছে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জগতকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ্‌ তাঁর যে সব প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন তাদের বর্ণনা।

৩৫৬৪। দেখুন অনুরূপ আয়াত [৭ :৫৭ ] ও টিকা ১০৩৬ এবং [২৫ : ৪৮ ] আয়াত ও টিকা ৩১০৪।

৩৫৬৫। জড় জগতে আমরা দেখি, গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহের পরে, বর্ষণ ধারা প্রকৃতিকে ঠান্ডা করে দেয় এবং বাতাসকে ধূলিমুক্ত করে পরিষ্কার করে ফেলে। শুধু তাই নয় বৃষ্টির ফলে শুষ্ক মাটি সিক্ত হয়, ফলে জমি ঊর্বরতা লাভ করে , নদী সমূহ নাব্যতা লাভ করে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এর ফলে আন্তঃমহাদেশীয় , সামাজিক মেলামেশা সম্ভব হয়েছে নৌযানে বা এরোপ্লেনে। এগুলি সবই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের স্বাক্ষর। যারা আল্লাহ্‌র এসব অনুগ্রহকে ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করে, তারা সমৃদ্ধি লাভ করে এবং আনন্দিত হয় - যেমন উন্নত দেশ সমূহ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ সমূহকে ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। অপর পক্ষে যারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ সমূহকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয় না তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ হচ্ছে জাগতিক বা জড় জগতের নিয়ম। আধ্যাত্মিক জগতের জন্যও আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতিনিধি নবী, রসুল প্রেরণ করেছেন , সুসংবাদ দানের জন্য। যারা তা গ্রহণ করে তাঁরা আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি দ্বারা ধন্য হয়, যারা তা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করে তাদের আধ্যাত্মিক জগত ধ্বংস হয়ে যায়। পরের আয়াত দেখুন।

৪৮। আল্লাহ্‌-ই বাতাসকে প্রেরণ করেন , যা মেঘমালাকে আনায়ন করে, ৩৫৬৬ তারপরে তিনি যে ভাবে ইচ্ছা করেন তা আকাশে বিছিয়ে দেন, এবং ছোট ছোট টুকরাতে ভেঙ্গে দেন, যতক্ষণ না তুমি তাদের মধ্য থেকে বৃষ্টির ফোঁটা বের হতে দেখ। তারপরে তিনি তাঁর বান্দাদের যার প্রতি ইচ্ছা করেন উহা বর্ষণ করেন ৩৫৬৭। দেখ ! [ তারা ] আনন্দ প্রকাশ করে, -

৩৫৬৬। এই আয়াতে পুণরায় বাতাসের উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে তবে তা ভিন্ন দৃষ্টি কোণ থেকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য। পৃথিবীতে আমরা দেখি বাতাস মেঘকে নিয়ে খেলা করে। বাতাস পৃথিবীর উপরিভাগের পানি শোষণ করে নিয়ে কালো মেঘকে পৌঁছে দেয় - যা পরবর্তীতে বৃষ্টিরূপে পৃথিবীর শুষ্ক মাটিকে সিক্ত করে। বাতাস ব্যতীত মেঘের বিস্তার সম্ভব ছিলো না। ধরাতলে সুষম বৃষ্টির দ্বারা মাটি সুষমভাবে উর্বরতা লাভ করতো না। এও তো আল্লাহ্‌র এক বিরাট অনুগ্রহ তাঁর বান্দাদের জন্য। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্‌র বাণী মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের আশা আকাঙ্খাকে জাগরিত করে। যখন তা ঘটে মানুষের হৃদয় মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়।

৩৫৬৭। দেখুন উপরের টিকা।

৪৯। যদিও [ বৃষ্টি ] লাভের পূর্বে - [ আনন্দিত ] হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা ছিলো হতাশায় বোবা।

৫০। সুতারাং [ হে মানব সম্প্রদায় ] ! আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের স্মারক সমূহ সম্বন্ধে ধ্যান কর। কি ভাবে তিনি মৃত পৃথিবীকে জীবন দান করেন ৩৫৬৮। নিশ্চয়ই এ ভাবেই মৃত মানুষকে জীবন দান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সকল কিছুর উপরে শক্তিমান।

৩৫৬৮। বাতাস ও মেঘের উপমার পরে এবারে তৃতীয় উপমার অবতারণা করা হয়েছে। শীতের আগমনে অথবা খরার ফলে পৃথিবী সজীবতা হারায়; মাটি শুষ্ক হয়ে যায় ,সবুজ তরুলতা সজীবতা হারিয়ে শুষ্ক ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। শীতের শেষে বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে নব যৌবনের সঞ্চার ঘটে। প্রকৃতি নূতন পত্র-পুষ্পে মঞ্জুরিত হযে ওঠে, নব জাগরণ ঘটে। খরার ফলে শুষ্ক মাটি বৃষ্টির আগমনে আবার পুণর্জীবিত হয়ে ওঠে। আবার মৃত মাটি পত্র পুষ্পে সুশোভিত হয়। ঠিক সেরূপ মানুষের আধ্যাত্মিক জগত। জাগতিক ক্রিয়াকর্মে অত্যাধিক ব্যস্ত থাকার ফলে মানুষের আধ্যাত্মিক জগত অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মা প্রায় মৃতরূপ ধারণ করে। আল্লাহ্‌র করুণার কণা তার মৃত প্রায় আত্মাকে পুণঃর্জীবিত করতে সক্ষম। 'মৃতকে জীবিত করেন ' বাক্যটি ইহকালে মানুষের আধ্যাত্মিক পুণঃজাগরণ এবং পরলোকের পুণঃরুত্থানকে বোঝানো হয়েছে।

৫১। কিন্তু যদি আমি এমন বাতাস পাঠাই যার ফলে তাদের [ শষ্য ক্ষেতকে ] হলুদ বর্ণে পরিবর্তিত হতে দেখবে, - দেখো, তার ফলে তারা অকৃতজ্ঞতে রূপান্তরিত হয় ৩৫৬৯।

৩৫৬৯। এই আয়াতে আর একটি উপমার অবতারণা করা হয়েছে। পূর্বের উপমা গুলিতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, বাতাস কিভাবে মেঘের সঞ্চালন দ্বারা প্রকৃতির মাঝে জীবন সঞ্চার করে, এবং যারা তার সঠিক ব্যবহারে সক্ষম তারা তার দ্বারা উপকৃত হয়। কিন্তু কখনও কখনও বাতাস শষ্যের জন্য ক্ষতিকর হয় - যেমন শীত প্রধান দেশে তুষার পীড়িত বায়ু শষ্য ক্ষেতকে ধ্বংস করে ফেলে। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও করুণা আধ্যাত্মিক জগতকে উজ্জীবিত করে , সমৃদ্ধ করে সত্য , কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র বিধানের প্রতিবন্ধকতা করে, প্রত্যাখান করে, আল্লাহ্‌র নিন্দা করে, তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের সঠিক ব্যবহারে অক্ষম। আল্লাহ্‌র বিধান ও অনুগ্রহ প্রত্যাখানের ফলে তারা তাদের সমগ্র জীবনের কর্মফলের দ্বারা কোনও সমৃদ্ধি লাভ করতে সক্ষম হয় না। তারা শাস্তির সম্মুখীন হয়। মোমেন বান্দারা জাগতিক শাস্তিকে সঠিক মানসিকতাতে গ্রহণে সক্ষম। বিশ্বাসীরা জানে সাময়িক বিপদ-বিপর্যয় তাদের কর্মেরই ফল। বিপদ-বিপর্যয় আল্লাহ্‌ প্রেরণ করেন আমাদের আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য। যারা মোমেন বান্দা তারা বিপদ-বিপর্যয় মাঝে ধৈর্য্য ধারণ করেন এবং খুঁজে দেখেন তাদের দোষ-ত্রুটি এবং আত্মসংশোধনের চেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র করুণা ও অনুগ্রহ লাভ করেন। অপরপক্ষে অবিশ্বাসীরা বিপদ বিপর্যয়ে ধৈর্য্য ও আত্মসংশোধনের পরিবর্তে আল্লাহ্‌র করুণার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় এবং তাদের পাপের পাত্র পূর্ণ করে।

৫২। সুতারাং নিশ্চয়ই তুমি মৃতকে শোনাতে পারবে না ৩৫৭০। বধিরকেও আহ্বান শোনাতে পারবে না যখন তারা পিছন ফিরে চলে যায়।

৩৫৭০। আল্লাহ্‌র সৃষ্টি নৈপুন্যের বিস্ময়কর দিক যে কেউ অনুধাবন করতে পারে যদি সে ঐকান্তিক ভাবে তা করতে চায়। কারণ আল্লাহ্‌ প্রতিটি মানুষের আত্মাকে সেই স্বাভাবিক প্রবণতা দ্বারা সৃষ্টি করেছেন যার সাহায্যে এই জ্ঞান খুব সহজেই তার অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে। কিন্তু যদি কেউ বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন হয় এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত মানসিক দক্ষতার স্বাভাবিক প্রবণতার পথ রুদ্ধ করে দেয়, তাহলে ধীরে ধীরে তার মানসিক দক্ষতা সমূহের [ Faculties of mind ] স্বাভাবিক প্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং একদিন সকল আধ্যাত্মিক জ্ঞান উপলব্ধির ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের আত্মা মৃত হয়ে যায় - তাহলে কি ভাবে তারা হেদায়েতের জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে পারবে ? " তুমিতো মৃতকে শুনাতে পারবে না।" দৈহিক মৃত ব্যক্তি যেমন পার্থিব কোনও কিছুই উপলব্ধিতে অক্ষম , ঠিক সেরূপ যাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটেছে তারা কোনও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কথা বুঝতে অক্ষম। এরা কান থাকতেও বধির অর্থাৎ সত্যের ডাক শুনতে পারে না। অনেক সময়ে বধির লোকেরা শুনতে না পেলেও দৃষ্টি শক্তি দ্বারা তারা জাগতিক জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু কোন বধির ব্যক্তি, যে কানে শুনতে পারে না, কিন্তু চক্ষুতে দেখতে পেলেও চোখের ব্যবহার না করে বিপরীত দিকে ফিরে থাকে, তবে তার পক্ষে যেমন জাগতিক কোনও প্রকার জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব নয়। ঠিক যেরূপ হচ্ছে যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে সত্যের আহ্বানকে অস্বীকার করে। মৃত আত্মাও আল্লাহ্‌র রহমতের বর্ষণে জীবন লাভ করতে পারে, যদি তার ঐকান্তিক আগ্রহ থাকে। কিন্তু যে ইচ্ছাকৃত ভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকে তাকে সত্যের আহ্বান শোনানো অসম্ভব।

৫৩। আর তুমি অন্ধদেরও বিপথ থেকে পথে আনতে পারবে না ৩৫৭১। শুধুমাত্র তাদেরকেই শোনাতে পারবে, যারা আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে এবং [ ইসলামে ] আত্মসমর্পন করে।

৩৫৭১। উপরের টিকা দেখুন। যে চক্ষুহীন , অন্ধ, তার পক্ষে প্রকৃতির অপূর্ব দৃশ্যাবলী অবলোকন করা যেরূপ অসম্ভব ব্যাপার, ঠিক সেরূপ হচ্ছে তাদের অবস্থা যারা পাপ কাজের মাঝে আনন্দ খুঁজে পায়। এ সব ব্যক্তির শারীরিক চক্ষু বিদ্যমান। কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে এরা অন্ধ , কারণ তাদের পাপ কাজ তাদের মনের চোখ বা অন্তর্দৃষ্টির উপরে পর্দ্দা ফেলে দেয়। তারা স্বর্গীয় নিদর্শন বুঝতে অক্ষম। কিভাবে তাদের হেদায়েত করা সম্ভব? তখনই আধ্যাত্মিক জগতে একজন হেদায়েত লাভ করতে পারে , যখন সে ঐকান্তিক ভাবে তা লাভ করতে চায়। যে বিশ্বাস করে আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহে এবং আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে, তারাই তো আধ্যাত্মিক শিক্ষা বা হেদায়েত থেকে লাভবান হতে পারে। যারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনকারী, তারাই মুসলমান।

রুকু - ৬

৫৪। আল্লাহ্‌-ই তোমাদের [অসহায় ] শক্তিহীন অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর শক্তিহীনতার পরে তিনি [তোমাদের ] শক্তি দান করেছেন। তারপরে শক্তির পরে দেন দুর্বলতা ও শুভ্র মস্তিষ্ক [ বার্ধক্য হেতু ] ৩৫৭২। তিনি যে ভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। সকল জ্ঞান ও ক্ষমতা তারই।

৩৫৭২। পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে, তাদের কথা যারা আল্লাহ্‌র শিক্ষাকে প্রতিহত করে থাকে। এর অর্থ এই নয় যে, মন্দ বা পাপী আল্লাহ্‌র শক্তির উপরে ক্ষমতাবান। এই আয়াতে আল্লাহ্‌র শক্তি ও জ্ঞানকে অনুধাবন ও চিন্তা করার জন্য উপমার ব্যবহার করা হয়েছে। জাগতিক পৃথিবীতে মানুষের জন্ম ও মৃত্যুকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে - দেখানো হয়েছে শক্তির প্রকাশকে হীনশক্তি বা দুর্বল থেকে, আবার শক্তির শেষ পরিণতি হীনশক্তিতে বা অসহায়ত্বে। মানব জন্মগ্রহণ করে অসহায় শিশুরূপে, পরিণত বয়সে যৌবনে সে শৌর্য -বীর্যের প্রতীক, আবার যৌবন বিদায়ে সে অসহায় বৃদ্ধ রূপে রূপান্তরিত হয়। একই মানুষের এই বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে স্রষ্টা তাঁর জ্ঞানকে প্রকাশ করেছেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ তাঁর বিচক্ষণ পরিকল্পনায় "যাহা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন।" তা বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারও নাই। তা বিপর্যয় করারও ক্ষমতা কেউ রাখে না।

৫৫। যে দিন [ হিসাব -নিকাশের ] সময় প্রতিষ্ঠিত হবে ৩৫৭৩; সীমালংঘনকারীরা শপথ করে বলবে যে তারা এক ঘণ্টার বেশী অবস্থান করে নাই। এ ভাবেই তারা সত্য ভ্রষ্ট হতো।

৩৫৭৩। বর্তমান পৃথিবীতে নানাধরণের অসমতা ও পার্থক্য চোখে পড়ে। এখানে ভালোরা দুর্বল, এবং নির্যাতিত, অপরপক্ষে, অত্যাচারী পার্থিব উন্নতি করে ইত্যাদি। কিন্তু শেষ বিচারের দিনে এসব বৈষম্য দূর করে দেয়া হবে এবং সমতা আনায়ন করে প্রকৃত মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। সেই সময় এতটাই হঠাৎ করে আসবে যে অপরাধীরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়বে। তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, কারণ যে সময়কে তারা মনে করতো তাদের বিজয় হয়েছে, অথবা তারা মনে করতো তারা যা খুশী করতে পারে, সে সময় অনন্ত কাল স্থায়ী নয়। আল্লাহ্‌ তাদের কিছুটা অবসর দান করেছিলেন তাদের সংশোধনের জন্য এবং আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও করুণা লাভের জন্য। যারা তা না পারে শাস্তি তাদের জন্য। অর্থাৎ যারা অপরাধী তারা এই পার্থিব জীবন নিয়ে এত মগ্ন থাকবে যে, তাদের ধ্যান ধারণায় পরলোকের জীবনের কোনও চিন্তাই স্থান পাবে না। তাদের ধারণা হবে, পৃথিবীর জীবনে শঠতা ও অন্যায় দ্বারা তারা যেরূপ সর্ব কাজে সাফল্য লাভ করতো, পরলোকের জীবনেও তারা সেরূপ আল্লাহ্‌র শাস্তিকে কৌশলে এড়ানোর জন্য সক্ষম হবে।

৫৬। কিন্তু যারা জ্ঞান ও ঈমানে ভূষিত ছিলো, তারা বলবে, " অবশ্যই তোমরা আল্লাহ্‌র নির্ধারিত সময় পুণরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবস্থান করেছ। এবং এটাই হচ্ছে পুণরুত্থান দিবস ৩৫৭৪। কিন্তু তোমরা সর্তক ছিলে না।"

৩৫৭৪। পূর্বের আয়াতে পাপী ও অপরাধীদের মনঃস্তত্বকে তুলে ধরা হয়েছে, এই আয়াতে বিশ্বাসী ও মোমেন বান্দাদের মনঃস্তত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। যারা বিশ্বাসী ও জ্ঞানী তারা পৃথিবীর জীবনের সর্বাবস্থায় জীবনের প্রকৃত মূল্যবোধ সম্বন্ধে সজাগ এবং জ্ঞাত। তারা জানেন যে পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং পরলোকের জীবনের শিক্ষানবীশ কাল মাত্র। পরলোকের জীবন হচ্ছে অনন্ত এবং স্থায়ী জীবন। পাপী এবং অজ্ঞ ব্যক্তিরা ইহকালের জীবনের মিথ্যা ও প্রতারণা নিয়ে পরিতৃপ্ত ও সুখী , তারা পরলোকের জীবন নিয়ে চিন্তাও করেন না। ফলে তারা পরলোকে যখন প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করে, তারা আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়ে। কারণ তারা এই জীবনের কোনও প্রস্তুতিই গ্রহণ করে নাই। কিন্তু জ্ঞানী ও বিশ্বাসীরা পরলোকের জীবনের সর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন , সুতারাং তাঁরা আশ্চর্যান্বিত হয় না।

৫৭। সুতারাং সেদিন সীমালংঘনকারীদের ওযর আপত্তি উহাদের কোন কাজে আসবে না ৩৫৭৫। এবং ওদের [ অনুতাপের মাধ্যমে ] আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের সুযোগও দেয়া হবে না।

৩৫৭৫। যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্‌র নিদর্শন প্রত্যাখান করে, তারা সীমালঙ্ঘনকারী। সীমালঙ্ঘনকারীরা ওজর আপত্তি তুলবে যে, " আমরা পূর্বে বুঝতে পারি নাই।" কিন্তু তাদের এই সব ওজর আপত্তি মিথ্যা ভান মাত্র। সুতারাং এ কথা চিন্তা করাও বাতুলতা যে, তাদের সে সময়ে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও ক্ষমা লাভের জন্য চেষ্টা করার সুযোগ দান করা হবে। তখন তা অনেক দেরী হয়ে যাবে, তারা আর সে সুযোগ পাবে না।

৫৮। অবশ্যই আমি এই কুর-আনে মানুষের বিবেচনার জন্য সব রকমের উপমা দিয়েছি। কিন্তু তুমি যদি তাদের নিকট কোন নিদর্শন আনায়ন কর,অবিশ্বাসীরা অবশ্যই বলবে, " তোমরা মিথ্যা ব্যতীত আর কিছু বল না।" ৩৫৭৬

৩৫৭৬। জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে বোঝানোর জন্য কোরাণে বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। এই সূরাতে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতিদিনের সাধারণ জীবনকে উপমা ও রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে , জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বোঝানোর জন্য। এ সব উপমা ও রূপক বিশ্বাসীদের জন্য যতই দৃঢ়বিশ্বাস উৎপাদক হোক না কেন, অবিশ্বাসীরা তার মাঝে প্রত্যয় উৎপাদনকারী কোনও কিছুই উপলব্ধি করতে পারে না। তাদের নিকট সত্যের আহ্বানকে মনে হবে " মিথ্যার প্রতি আহ্বান , যা মূল্যহীন। "

৫৯। যারা বুঝতে চায় না , এভাবেই আল্লাহ্‌ তাদের হৃদয়ে মোহর করে দেন ৩৫৭৭।

৩৫৭৭। যখন সত্যকে ইচ্ছাকৃত ভাবে এবং একগুঁয়ে ভাবে প্রত্যাখান করা হয়, তখন তার স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে তাদের মন এবং আত্মা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যাবে - এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র আইন। প্রতিটি পাপের পরিণতিতে আত্মার উপরে ধীরে ধীরে আবরণ জমতে থাকে - শেষে একদিন সে আবরণ এত পুরু ও শক্ত হয়ে যায় যে - তা ভেদ করে আল্লাহ্‌র নূর বা সত্যের আলো তাদের হৃদয়ে বা আত্মাতে পৌঁছাতে পারে না। খামের মুখ বন্ধ করে দিলে তা যেমন আর কিছু গ্রহণ করতে পারে না , ঠিক সেরূপ এ সব শক্ত আবরণে ঢাকা আত্মার কোন সত্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে না। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২ : ৭ ] এবং টিকা ৩১।

৬০। সুতারাং ধৈর্যের সাথে অধ্যাবসায়ী হও। অবশ্যই আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা ঈমানে বিশ্বস্ত নয়, তারা যেনো তোমাকে বিচলিত না করে ৩৫৭৮।

৩৫৭৮। অবিশ্বাসী কাফেরদের নির্যাতন , অত্যাচার, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও সত্যকে প্রত্যাখানে আল্লাহ্‌র নবী তার কর্ম প্রচেষ্টা শিথিল বা অবহেলা করবেন না বা বিচলিত হবেন না। এ বিশ্বাস তাঁর আছে যে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই। যে ঐশ্বরিক দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হয়েছে আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে, তিনি তা ধৈর্য্য, অধ্যবসায় সহকারে তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করবেন - অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে। বিজয় তাঁর হবেই এই -ই আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি।