+
-
R
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : এই ছোট্ট সূরাটি দ্বারা আলিফ্,লাম, মিম সিরিজ বা ধারাবাহিকতা শ্রেণীকে শেষ করা হলো। এই ধারাবাহিক শ্রেণীর প্রথম সূরাটি হচ্ছে ২৯তম সূরা এবং শ্রেণীতে মোট চারটি সূরা আছে। এর বিষয়বস্তু হচ্ছে সময় ও Ma'ad বা শেষ বিচারের দিন। মানুষ যদি তার শেষ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করে , তবে অবশ্যই সে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসাতে আপ্লুত হবে। সময়ের ক্রমপঞ্জি অনুযায়ী এই সূরাটি মধ্য মক্কীন সূরা। সুতারাং এই সূরাটি পূর্ববর্তী সূরার কিছু পূর্বে অবতীর্ণ। অবশ্য অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের ব্যাপারে বিশেষ কোনও বিশেষত্ব নাই
সারসংক্ষেপ : সৃষ্টির ব্যাপারে সময় এবং সকল বস্তুর শেষ পরিণতি সম্বন্ধে মানুষ ধারণা লাভ করে বাইরের প্রতীক দ্বারা। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ মানুষের মনে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা উৎপন্ন করে ঠিক সেরূপ ভাবে, বৃষ্টি যেরূপ শুষ্ক মাটিকে সিক্ত করে সজীব করে তোলে [ ৩২ : ১ - ৩০ ]।
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৩৬২৯। আমাদের রাসুলের আগমনের পূর্বে ,পূর্ববর্তী নবী রসুলদের ঐশী গ্রন্থসমূহ মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিকৃত রূপ ধারণ করে। এর কারণ ছিলো, মানুষের অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা, প্রতারণা এবং ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা। এভাবে প্রত্যাদেশের অনেক অংশ সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে যায় এবং সেখানে মানুষের মনগড়া বিষয়বস্তু স্থান লাভ করে। নিজস্ব মনগড়া ব্যাখ্যা দ্বারা ধর্মীয় প্রত্যাদেশকে প্রকাশ করতে প্রয়াস পায়। ফলে এ সব ধর্মের মাঝে বহু বিভক্তির সৃষ্টি হয়, এবং তারা পরস্পরের মাঝে ধর্মীয় ব্যাখ্যার ব্যাপারে কূট তর্কে জড়িয়ে পড়ে। কোরাণের অবতীর্ণ দ্বারা এ সব কূট তর্ক ও বিভেদের অবসান ঘটে। কোরাণের আয়াতসমূহ সরাসরি আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত। আল্লাহ্ হচ্ছেন সার্বভৌম এবং জগতসমূহের প্রতিপালক। মানুষের তৈরী দর্শনে সর্বদাই সন্দেহ ও তর্কের অবকাশ থাকে।
৩৬৩০। ' তবে কি ' বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে অবিশ্বাসীরা কোরাণকে ঐশী গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করার পরিবর্তে রসুলের [ সা ] নিজস্ব রচনা হিসেবে মনে করে যা প্রতারণার সামিল। কিন্তু তাদের অনুমান সর্বৈব মিথ্যা : কারণ-
১) তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রধান সমালোচক ছিলো কোরেশরা - যারা তাঁকে সর্বদা সৎ ও সত্যবাদী বলে জানতো ;
২) তিনি ছিলেন নিরক্ষর। সুতারাং তাঁর পক্ষে পূর্ববর্তী কোন কিতাব পড়া সম্ভব নয়। সুতারাং তাঁর সকল জ্ঞানের উৎস হবে আল্লাহ্ কর্তৃক সরাসরি প্রদান; এবং
৩) প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার অবশ্যই কোনও সুনির্দ্দিষ্ট কারণ থাকবে। কারণ রসুলের [সা ] পূর্বে আরবে কোনও নবীর আগমন ঘটে নাই।
৩৬৩১। একজন পথ প্রদর্শকের প্রকৃত অভাব ছিলো আরবদের মাঝে। তাদের মাঝে বিশ্ব নবীর আভির্ভাব আল্লাহ্র পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশ সমূহের প্রত্যাশা অনুযায়ী -ই ঘটেছিলো।
৩৬৩২। "ছয়দিন" - দেখুন আয়াত [ ৭ : ৫৪ ] ও টিকা ১০৩১। আমাদের পৃথিবীর দিন ও রাত্রির সমতুল্য এই 'দিন' নয়। সময়ের ধারণা হচ্ছে আপেক্ষিক। পৃথিবীর বাসিন্দারা পৃথিবীর চর্তুদিকে সূর্যের আবর্তন দ্বারা দিন ও রাত্রিকে নির্ধারিত করে সময়ের ধারণা লাভ করে। কিন্তু এখানে যে 'দিনের ' কথা বলা হয়েছে, সে 'দিন' বা দিনের ধারণা সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী সৃষ্টির বহু পূর্বের অবস্থা। সুতারাং আমাদের 'দিন' ও কোরাণ শরীফে বর্ণিত দিন এক নয়। নীচের আয়াত ৫ এ বলা হয়েছে এক একটি দিন আমাদের দিনের তুলনায় হাজার বছরের মত। আবার [ ৭০ : ৪ ] আয়াতে বলা হয়েছে ৫০,০০০ [ পঞ্চাশ ] হাজার বছরের সমান। এর থেকে এই সত্যকে বোঝানো হয়েছে যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ সময় ব্যপী এবং তা সৃষ্টি হয়েছে ছয়টি বিভিন্ন স্তরে বা যুগে যা সমর্থন করে আজকের বিজ্ঞান। আরও দেখুন [ ৪১ : ৯ -১২ ] আয়াত এবং টিকা।
৩৬৩৩। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৩ ] এবং এর টিকা ১৩৮৬। আল্লাহ্ আকাশ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ছয়টি ধাপে। প্রাথমিক সৃষ্টির পরেও তিনি এ সকল কিছুরই সার্বভৌম কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই তিনি পরিচালনা করেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর কোনও অংশীদার নাই। কাউকে তিনি তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তর করেন নাই। এ ব্যাপারে তিনি কখনও ক্লান্তি অনুভব করেন না। আরও দেখুন আয়াত [ ৭ :৫৪]।
৩৬৩৪। সময় একটি আপেক্ষিক ধারণা মাত্র। সময়ের এই বিশাল রহস্যকে আমাদের ধারণাতে অনুভবের জন্য এই আয়াতে সময়ের ধারণাকে আপেক্ষিক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র সৃষ্টির এক একটি দিন আমাদের ধারণার এক হাজার বা পঞ্চাশ হাজার দিনের সমান। সূদূর অতীতে স্রষ্টা সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু করেন যা আজও সমভাবে বর্তমান। তিনি সকল কিছু পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন। সৃষ্টির সকল কিছুই তার আইন মেনে চলতে বাধ্য। ভবিষ্যতে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই তাঁর কাছে নীত হবে বিচারের জন্য। তিনি হবেন বিচারপতি। সেদিন তিনি সকল ভ্রান্তির অবসান ঘটাবেন, সকল কিছুরই প্রকৃত মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আর এসব কিছুই ঘটবে এক দিনের মধ্যে বা এক ঘন্টার মধ্যে বা এক মূহুর্তের মধ্যে বা চোখের পলকে। কিন্তু আমাদের ধারণায় তা মনে হবে হাজার বছরের সমান।
৩৬৩৫। আল্লাহ্র প্রতি আরোপিত নাম সমূহকে সার সংক্ষেপ করা হয়েছে এই আয়াতে এবং তা হচ্ছে তিনি -
১) সর্বজ্ঞ,
২) অসীম ক্ষমতার অধিকারী, এবং
৩) পরম দয়ালু।
সর্বজ্ঞ : অর্থাৎ তিনি দৃশ্য অদৃশ্য সকল জ্ঞানের অধিকারী, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কোনও কিছুই তাঁর অজ্ঞাত নয়। আল্লাহ্র পরিপূর্ণ ও সঠিক জ্ঞানের পটভূমিতে মানুষের জ্ঞান আংশিক, অকিঞ্চিতকর এবং অনিশ্চিত।
ক্ষমতা : আমাদের ক্ষমতা অনেক সময়েই আমাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। কারণ আমাদের ক্ষমতার পরিধি অত্যন্ত সীমিত। অনেক সময়েই ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করতে আমাদের সময় ও অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আল্লাহ্ হচ্ছেন মহা পরাক্রমশালী, তাঁর কারও সাহায্যের প্রয়োজন নাই। তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়নে তিনি একাই সক্ষম।
করুণা ও দয়া : আমাদের করুণা ও দয়া শর্ত সাপেক্ষ ; কারণ আমরা পাপী ও দুষ্কৃতিকারীকে করুণা করতে অপারগ। কিন্তু তাঁর করুণা ও দয়া শর্তহীন , অসীম। ধনী, দরিদ্র , পাপী ,পূণ্যাত্মা সকলেই তা সমভাবে লাভ করে থাকে। তিনি পরম দয়ালু।
৩৬৩৬। আল্লাহ্র সৃষ্টির প্রতিটি জিনিষই "উত্তম " : বিশ্বকর্মার প্রতিটি জিনিষই সুন্দর , যথাযথ, সুক্ষ এবং নির্দ্দিষ্ট কাজের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টিতে কোনও অসুন্দর নাই, কোন অসামঞ্জস্য বা বিশৃঙ্খলা নাই। পৃথিবীতে যা কিছু অসুন্দর ও বিশৃঙ্খলা সবই মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট। আর তার পিছনে থাকে মানুষকে দেয় স্রষ্টার "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি।" আধ্যাত্মিক শিক্ষা মানুষের এই "সীমিত ইচ্ছাশক্তিকে" উপদেশ ও অনুশীলনের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত এবং স্রষ্টার ইচ্ছার সাথে সমন্বিত করে।
৩৬৩৭। প্রথমতঃ মানুষ সৃষ্টির তুচ্ছ ও অকিঞ্চিতকর বিষয়গুলি সম্বন্ধে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। মানুষের শরীরকে [ আত্মা নয় ] গঠন করা হয়েছে তুচ্ছ কর্দ্দম থেকে, যা পৃথিবীর মূল উপাদান। সুতারাং মানুষের অস্তিত্বের প্রথম অংশ জড়িত থাকে তুচ্ছ জড় পদার্থের সাথে। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে জড় পদার্থও নিজে সৃষ্টি হতে পারে না। তা সবই আল্লাহ্ কর্তৃক সৃষ্ট।
৩৬৩৮। এর পরে উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের বংশ বিস্তার সম্বন্ধে। যদিও মানুষের বংশ বিস্তার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ শারীরিক, এবং জান্তব বা পশুপ্রকৃতি , তবুও তা প্রাণহীন বা জড় নয়। এভাবেই মানুষের বংশ বিস্তারকে জড় পদার্থ থেকে একধাপ উন্নত করা হয়েছে। মানুষের বংশ বিস্তার প্রক্রিয়া শুরু হয় 'তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস' বীর্য থেকে। যদিও তা তুচ্ছ, তবুও তা মানব দেহের কেন্দ্রীভূত বিশুদ্ধ সারাংশ। আর জীবদেহ গঠনকারী এই অতিরিক্ত অপরিহার্য অংশ থাকে শরীরের সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য স্থানে যেখান দিয়ে মুত্র নিঃসৃত হয়। সে কারণে বীর্য বা শুক্রকেও ঘৃণ্যভাবে অনুমান করা হয়। শুক্র বা বীর্য জীবন্ত জীবকোষ যার মাধ্যমে স্রষ্টা পূর্বপুরুষদের জীবন ইতিহাসকে বংশ পরস্পরায় প্রবাহিত করেন। দেখুন [ ২৩ : ১২ ] আয়াত এবং টিকা ২৮৭২।
৩৬৩৯। এর পরে মানুষের সৃষ্টির তৃতীয় ধাপকে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ মানুষের অবয়বকে সুঠাম, সৌন্দর্যমন্ডিত এবং যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ২৯ ]। সৃষ্টির প্রাথমিক ক্রিয়ায় শুক্র ডিম্ব কোষকে নিষিক্ত করার ফলে প্রাণের অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এই নিষিক্ত ডিম্ব ধীরে ধীরে মনুষ্য সৃষ্টির পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সৃষ্টি হয় , জীবনের বিকাশ আরম্ভ হয়। এই প্রক্রিয়ায় অভিজোযিত বস্তু শুধু যে প্রয়োজন মেটায় তাই-ই নয়, তা সৌন্দর্য বৃদ্ধিরও সহায়ক। এ পর্যন্ত মানব সৃষ্টির বর্ণনায় জান্তব বা পশুপ্রকৃতির দিকটি বর্ণনা করা হয়েছে। এ বারে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা যার কারণে মানব দেহে আল্লাহ্র "রূহ কে ফুঁকিয়া " দেয়া হয়। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষ সাধারণ প্রাণীকূল থেকে আলাদা।
৩৬৪০। আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহের কারণে মানুষ বিশেষ মানসিক দক্ষতা প্রাপ্ত হয়। ইউসুফ আলী সাহেবের মতে প্রাণীদেহের পাচঁটি ইন্দ্রিয় লাভ হচ্ছে মানব গঠনের তৃতীয় ধাপ - যা মানুষ ও প্রাণী উভয়ের বেলাতে প্রযোজ্য। কিন্তু চতুর্থ ধাপে মানুষকে প্রাণীদের থেকে উর্দ্ধে উত্তোলন করা হয়েছে। সে কারণে তৃতীয় ধাপে সম্বোধনের ভাষা হচ্ছে 'উহাকে' যা তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হয়। এবং চতুর্থ ধাপে সম্বোধনের ভাষা হচ্ছে দ্বিতীয় পুরুষ "তোমাদিগকে" - এমন কি তৃতীয় পুরুষ 'তাহাকে' শব্দও ব্যবহার করা হয় নাই। কারণ আল্লাহ্র রূহ গ্রহণের ফলে তার মাঝে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার জন্মলাভ ঘটেছে। সে আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ গ্রহণে সক্ষম। অর্থাৎ সে প্রকৃত সত্যের বাণী শুনতে পারে, তার শোনার ক্ষমতা থাকে। তার দেখার ক্ষমতা জন্মে , অর্থাৎ প্রকৃত সত্যকে সে দেখতে পারে, তার সে অন্তর্দৃষ্টি থাকে। তার মাঝে ভালোবাসার ক্ষমতা, সত্য ও সুন্দর কে অনুভব করার ক্ষমতা জন্মে। যে মানুষকে স্রষ্টা আকারে চেহারায়, অবয়বে, মানসিক দক্ষতায় , সৌন্দর্য্যে সুষম ও শ্রেষ্ঠ রূপে গড়েছেন , মানুষ কি তার জন্য স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ?
৩৬৪১। দেখুন আয়াত [১৩ : ৫ ]। 'তারা ' শব্দটি দ্বারা তাদেরই বোঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্র অনুগ্রহের জন্য 'সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।" এরা হচ্ছে বস্তুবাদী এবং সন্দেহবাতিক - যারা পৃথিবীর জীবনশেষে মৃত্যু পরবর্তী আর কোনও জীবনই স্বীকার করতে চায় না। তারা তাদের জীবনের সীমানাকে পৃথিবীর জীবনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী। এই আয়াতে তাদের বক্তব্য থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে এই যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিলো যে, যদি স্রষ্টা প্রথমে এত সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টিতে সক্ষম হন, তবে পরলোকে মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় বারেই বা তা করতে সক্ষম হবেন না কেন? বস্তুত পক্ষে এ সব লোক পরলোককে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকেই এরূপ কথা বলে যে, 'আমাদের আবার কি নূতন করে সৃষ্টি করা হবে ?' প্রতিপালকের সাক্ষাৎকার অস্বীকার করার ফলেই তাদের অন্তরে এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস জন্মে। অপরপক্ষে পরলোকের জীবন সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস এবং সেই জীবনের আশা আকাঙ্খার সাথে আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নির্ভরশীলতাই হচ্ছে আমাদের ঈমানের বা বিশ্বাসের মজবুত ভিত্তি।
৩৬৪২। কবি বলেছেন যে, 'জন্মিলে মরিতে হয়'। পৃথিবীতে এর থেকে বড় সত্য আর কিছু নাই। যদি পরলোকের অনন্ত জীবন এবং সেই জীবনের সুখ শান্তির জন্য পৃথিবীর জীবনকে নির্ধারিত করা না হতো , তবে মানুষের জন্য পৃথিবীর জীবন অর্থহীন হয়ে যেতো। মৃত্যুর সাথে সাথে যে জীবন শেষ হয়ে যায় সে জীবন তো পশু তুল্য। পশুর ন্যায় সে জীবনের কোনও মহত্বর বা উচ্চতর পরিপূর্ণতার দিক নাই। কারণ পশুদের কোনও আত্মা নাই। এ বিশাল বিশ্বভূবনে একমাত্র মানুষেরই জীবনের সাথে আত্মার অস্তিত্ব বিদ্যমান। মৃত্যুর মাঝে মৃত্যুদূত সেই আত্মাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং আমাদের আত্মাকে অন্য এক নূতন পৃথিবীতে নীত করে। যদি আমরা আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করি, তাহলে আমাদের ধর্মকে স্বীকার করতে হয়। কারণ আত্মার অস্তিত্বই হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল ভিত্তি স্বরূপ। আর ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনের অস্তিত্বে বিশ্বাস। সুতারাং অবিনশ্বর আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাস হচ্ছে নাস্তিকতার ভিত্তি।
রুকু - ২
৩৬৪৩। মৃত্যু পরবর্তী যে জীবন আরম্ভ হবে সে জীবনে প্রতারণা ও আত্ম প্রবঞ্চনার কোনও সুযোগ থাকবে না। মানুষের চিন্তা, ভাবনা, কাজের উদ্দেশ্য বা নিয়ত , কর্ম সকল কিছুই পাপীদের নিকট দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হবে। সত্য উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হবে। সেদিন পাপীরা আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের ভয়ে প্রকম্পিত হবে। তারা অনুতপ্ত চিত্তে পূণঃরায় পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। কিন্তু তাদের সে সময়ের অনুতাপ কোনও কাজে আসবে না, কারণ তা অনেক দেরী হয়ে যাবে। কারণ আমাদের চেনা জানা পৃথিবীর কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। নূতন পৃথিবী সৃষ্টি হবে যেখানে পৃথিবীর জীবনের পুণরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া হবে না।
৩৬৪৪। পৃথিবী কি পাপী শূন্য হওয়া সম্ভব ছিলো ? অবশ্য আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করতেন তা হতো। আমাদের এই চেনা জানা পৃথিবীতে উদ্ভিদ জগত ও প্রাণীজগতকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন প্রাণ দিয়ে, কিন্তু তাদের নিজস্ব কোনও ইচ্ছাশক্তি নাই। সুতারাং তারা আল্লাহ্ কর্তৃক দেয় নির্দ্দিষ্ট সীমারেখা কখনই অতিক্রম করতে পারে না। তারা আল্লাহ্র হুকুম বা বিধান অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সুতারাং তাদের কোনও পাপ নাই। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে মানুষকেও সেভাবেই সৃষ্টি করতে পারতেন। মানুষের কোন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকতো না। ফলে তাদের কোন কাজেই পাপ বা পূণ্য বলে কিছু থাকতো না। কিন্তু আল্লাহ্র তা ইচ্ছা নয়। পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ্ সীমিত আকারে " স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়ে প্রেরণ করেছেন। সে ইচ্ছা করলে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করার ক্ষমতা রাখে। যা অন্য কোনও প্রাণীর মাঝে নাই। সে কারণেই তিনি মানুষের জন্য জীবন -বিধান দিয়েছেন, যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন যেন মানুষের 'স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি' পবিত্র থাকে এবং মানুষ 'সরল পথের ' সন্ধান লাভ করে। যুগে যুগে নবী রসুলদের মাধ্যমে আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা আল্লাহ্র আইনকে লঙ্ঘন করবে পরলোকে তাদের শাস্তি অনিবার্য। পাপীদের শাস্তি হবেই কারণ আল্লাহ্র 'কথা অবশ্যই সত্য।'
৩৬৪৫। দেখুন আয়াত [ ১১ : ১১৯ ] ও টিকা ১৬২৩ এবং আয়াত [৭ : ১৮ ] এবং উপরের টিকা। শয়তান মানুষকে পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে যারা শয়তানের প্ররোচনার কাছে আত্মসমর্পন করে তারাই পরলোকে আল্লাহ্র শাস্তি ভোগ করবে।
৩৬৪৬। "বিস্মৃত হইয়াছিলে" শব্দটি আছে [ ৭ : ৫১ ] আয়াত ও টিকা ১০২৯। এই দুই আয়াতেই 'বিস্মৃত হওয়া ' বা ভুলে যাওয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ইচ্ছাকৃত ভাবে ও নিদারুণ ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করা বোঝানোর জন্য। " আমিও তোমাদিগকে বিস্মৃত হব " - এই বাক্যটির অর্থ এই নয় যে জ্ঞানের অভাবে বা অজ্ঞতার জন্য বা স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য তা ঘটেছে। কারণ সূরা [ ২০ : ৫২ ] আয়াতে বলা হয়েছে : " আল্লাহ্ ভ্রান্ত হন না, এবং বিস্মৃতও হন না।" আল্লাহ্র কাছে কোনও কিছুই হারিয়ে যায় না।
৩৬৪৭। "Sujjadan" - সিজ্দা - সিজদা হচ্ছে দেহকে এক নির্দ্দিষ্ট ভঙ্গীতে বিন্যস্ত করা যার দ্বারা আল্লাহ্র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা , ভালোবাসা ও বিনয় প্রকাশ করা হয়। সূরাটির নাম সিজ্দা হয়েছে এই আয়াতটির অনুসরণে। পৃথিবীতে আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহ চতুর্দ্দিকে ছড়ানো আছে, সৃষ্টির জন্য তাঁর সযত্ন তত্বাবধান আমাদের পৃথিবীর জীবনকে করেছে ঐশ্বর্যমন্ডিত সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ। জীবনের প্রতি মুহূর্ত, প্রতিপল স্রষ্টার স্নেহময় অনুভবকে যে উপলব্ধি করতে পারে সেই তো কৃতজ্ঞ অন্তরে তাঁর প্রতি সেজদাতে লুণ্ঠিত হতে পারে। এই আয়াতটি পড়ার সময়ে সেজ্দা দান করা নিয়ম।
৩৬৪৮। আল্লাহ্র প্রতি সশ্রদ্ধ ভক্তি জানানোর সর্বোচ্চ সময় হচ্ছে নিশুতি রাত। সে সময় বিশ্ব প্রকৃতি থাকে সুপ্তিতে নিমগ্ন। বিশ্ব চরাচর থাকে শব্দহীন। রাত্রির নৈশব্দ ভক্তের একগ্রতা বৃদ্ধি করে, আল্লাহ্র স্নেহময় স্পর্শ,নৈকট্য অনুভব করা হয় অনেক সহজ। এ কারণেই নারী ও পুরুষ নরম আরামদায়ক, সুখময় শয্যা, নিদ্রার বিলাস ত্যাগ করে আল্লাহ্র এবাদতে মগ্ন হয়। তাদের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গভীর অনুরাগে প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি নিবেদন করে নিশীত রাতের নির্জনতায়। তফসীরকারগণ এই সময়ের প্রার্থনার নাম দিয়েছেন তাহাজ্জুতের নামাজ - যা মধ্যরাতের পরে ফজরের নামাজের কিছু পূর্বে যে নামাজ পড়া হয়।
৩৬৪৯। 'প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও আশার সাথে।' আশংকা এই কারণে যে , মোমেন বান্দার অন্তরে সর্বদা এই ভয় বিরাজ করে যে, হয়তো বা তাঁর এবাদত আল্লাহ্র প্রতি যোগ্য হচ্ছে না,হয়তো বা তা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। আবার 'আশা' হচ্ছে এই জন্য যে আল্লাহ্ পরম করুণাময়, তিনি বান্দার দোষত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিচার করবেন। প্রকৃত মোমেন বান্দার মানসিক অবস্থাকে এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা শুধুমাত্র প্রার্থনার মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায় না তার বাস্তব প্রকাশ থাকতে হবে তাদের কাজের মাধ্যমে। মোমেন বান্দারা , আল্লাহ্ তাদের যাকে যে নেয়ামত দান করেছেন তাই থেকে আল্লাহ্র কাজে ব্যয় করে। আল্লাহ্র নেয়ামতসমূহের বিবরণের জন্য দেখুন টিকা ২৭।
৩৬৫০। 'নয়ন মুগ্ধকর' এটা একটা বাগ্ধারা যার দ্বারা বোঝানো হয় যে তৃপ্তিদায়ক, সুখকর ও আরামদায়ক পরিস্থিতি। বর্তমান জীবনে অবস্থান করে পারলৌকিক জীবনের সুখ ও শান্তি কল্পনা করাও মানুষের দুঃসাধ্য।
৩৬৫১। এখানে দু শ্রেণীর ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। এক শ্রেণী মুমিন ব্যক্তি , অন্য শ্রেণী পাপাচারী। এদের বর্ণনা আছে [ ১৯ - ২২ ] আয়াত পর্যন্ত।
৩৬৫২। 'বাসস্থান' - অর্থাৎ বাসভবন। গৃহ বা বাসভবন মানেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুখ ও শান্তির এক মনোরম ছবি যেখানে স্নেহ-ভালোবাসা , নিরাপত্তা , জীবনকে করে আরামদায়ক। যদি তার সাথে যুক্ত হয় সম্মান ও আদর আপ্যায়ন তাহলে তা সুখ ও শান্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
৩৬৫৩। দেখুন আয়াত [ ২২ : ২২ ]। মনোরম বাগান যেমন শান্তির প্রতীক, ঠিক সেরূপ আগুন হচ্ছে শাস্তি ও যন্ত্রণার প্রতীক। এই প্রতীকের মাধ্যমে বেহেশতের সুখশান্তি ও দোযখের শাস্তিকে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে পাপীদের দোযখের শাস্তি থেকে রেহাই নাই। যারা তাদের পাপের মাধ্যমে এই শাস্তি অর্জন করে থাকে তাদের মানসিক অবস্থা তখন কি হবে ? সে সময়ে তারা বলবে যে, "অনল উদ্গীরণকারী দোযখের শাস্তিকে আমরা মিথ্যা ও অলীক কল্পনা করেছিলাম, এখন তা সত্যে পরিণত হয়েছে।" পাপীরা সে অবস্থাকে কি ভাবে গ্রহণ করবে ?
৩৬৫৪। পরলোকের শাস্তি হচ্ছে পাপীদের জীবনের শেষ পরিণতি। পাপের শেষ পরিণতি দোযখ - এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। তবে শেষ পরিণতির পূর্বে করুণাময় আল্লাহ্ তাদের পৃথিবীতে ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পান। পৃথিবীতে দুর্ভাগ্য , দুঘর্টনা , দুঃখ-দুর্দ্দশা, প্রভৃতি শাস্তির মাধ্যমে স্রষ্টা তাদের বিপথ থেকে ফিরিয়ে, স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পনের প্রয়াস পান। পৃথিবীর এই লঘু শাস্তির রকমফের আছে। হতে পারে তা আর্থিক বা বিবেকের দংশন বা গোপন দুঃখ যা হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। যখন এ সব দুর্ঘটনা হৃদয়কে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পন করে থাকে। সুতারাং পৃথিবীর এ সব দুঃখ দুর্দ্দশা বান্দার জন্য শাস্তি স্বরূপ না হয়ে, প্রকৃত সুখ- ও শান্তির কারণ হতে পারে। কারণ এর ফলে হয়তো পাপীরা পাপ থেকে নিবৃত হয়ে অনুতাপের মাধ্যমে সঠিক পথে প্রত্যার্পন করবে। যার ফলে পরলোকের জীবনে সে দোযখের শাস্তির পরিবর্তে বেহেশতের সুখের আস্বাদন করতে সমর্থ হবে।
৩৬৫৫। সর্বাপেক্ষা মন্দ ও কঠিন হৃদয় বিশিষ্ট সেই পাপী যে আল্লাহ্র নিদর্শন বা আয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যে আল্লাহ্র আয়াতের শিক্ষাকে প্রত্যাখান করে এবং পাপের পথে ধাওয়া করে। আল্লাহ্র শিক্ষা - হতে পারে তা কোরাণের বাণীর মাধ্যমে বা মহান শিক্ষকদের পথ প্রদর্শনের মাধ্যমে, অথবা জাগতিক জীবনে ছোটখাট বিপদ বিপর্যয় ও দুঃখ দুর্দ্দশার মাধ্যমে। পাপে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, তারা আল্লাহ্র এসব শিক্ষা থেকে শিক্ষা লাভ না করে ঔদ্ধত্যতার সাথে মুখ ফিরিয়ে রাখে। অনেক সময়ে সর্বনাশা বিপদ তাদের সর্ব অস্তিত্বকে ঘিরে ধরে - এসব ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞানচক্ষু উম্মীলিত হওয়া উচিত ছিলো যে, আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও রহমত তাদের জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজন, ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র শিক্ষাকে প্রত্যাখানের ফলে তাদের বিবেক মৃত হয়ে যায়। তারা লাভের পরিবর্তে লোকসান ক্রয় করে। তাদের অবধারিত শাস্তি তাদেরই কর্মের ফল।
রুকু - ৩
৩৬৫৬। যুগে যুগে আল্লাহ্ মানুষের হেদায়েতের জন্য নবী রসুলদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন। একমাত্র হযরত মুহম্মদের [সা] নিকট প্রেরিত গ্রন্থ ব্যতীত কোনও গ্রন্থই সম্পূর্ণ নয়। হযরত মুসার কিতাবে আছে শুধুমাত্র 'সারিয়া' আইন বা জীবন বিধান। এই আইন হচ্ছে জীবন ধারণের পথ নির্দ্দেশ। মুসার পরে হযরত ঈসা আল্লাহ্র নিকট থেকে ঐশি গ্রন্থ প্রাপ্ত হন। তাঁর প্রাপ্ত কিতাব 'ইন্জিলে' শুধুমাত্র নৈতিক নীতিমালার সাধারণ বর্ণনা আছে, কোন 'সারিয়া' আইন বা জীবন বিধানের বর্ণনা নাই। হযরত ঈসার পরে বিশ্ব নবীর [ সা ] আগমন। তাঁর কাছে ঐশি গ্রন্থ কোরাণ প্রেরণ করা হয়। কোরাণের বিশেষত্ব হচ্ছে কোরাণ একটি সম্পূর্ণ ধর্মগ্রন্থ। এখানে 'সারিয়া' আইন বা জীবন বিধান [ code of life ] ও নৈতিক নীতিমালার সমন্বয় ঘটেছে। একই সাথে এই সূরাটি মক্কান সূরা। মক্কান সূরাগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে কোন জীবন বিধানের উল্লেখ নাই। জীবন বিধান বা 'সারিয়া' আইন সম্বলিত সূরা অবতীর্ণ হয় মদিনাতে। এই সূরাতে রসুলকে [সা] আশ্বাস দান করা হয়েছে যে রসুলকেও [সা ] মুসার ন্যায় অর্থাৎ সারিয়া আইন সমৃদ্ধ কিতাব প্রেরণ করা হবে। পরবর্তীতে মদিনায় প্রেরিত সূরাগুলির মাধ্যমে 'সারিয়া ' আইন বা জীবন বিধান প্রেরণ করা হয়। নবীর [সা] নিকট প্রেরিত মুসলিম জীবন বিধানে পূর্ববর্তীদের হযরত মুসার নিকট প্রেরিত অনেক জীবন বিধানকে বাতিল করা হয় এবং যুগোপযোগী জীবন বিধানের অবতারণা করা হয়। এ ভাবেই কোরাণ হচ্ছে এক পূণার্ঙ্গ ঐশি গ্রন্থ বা প্রত্যাদেশ।
৩৬৫৭। এই আয়াতটি সম্বন্ধে মতদ্বৈত আছে। "Liqa-i-hi" - এই বাক্যটির অর্থ সম্বন্ধে অনুবাদকদের মতদ্বৈতের কারণ ঘটেছে। এখানে সর্বনাম 'hi' কেহ কেহ অনুবাদ করেছেন 'ইহা' শব্দ দ্বারা আবার কেহ কেহ 'তাহার' শব্দ দ্বারা। মওলানা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন 'ইহা' শব্দ দ্বারা। এখানে 'ইহা' অর্থাৎ 'কোরাণ' বা ঐশি গ্রন্থকে বোঝানো হয়েছে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রণীত মারেফুল কোরাণেও অনুবাদ করা হয়েছে এভাবে " আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছি, অতএব আপনি কোরাণ প্রাপ্তির বিষয়ে কোন সন্দেহ করবেন না। আমি একে বনী ইসরাঈলীদের জন্য পথ প্রদর্শক করেছিলাম।" অনুবাদে এই অর্থটিই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। 'hi' শব্দটিকে 'তাহার ' শব্দ দ্বারা অনুবাদ করলে অর্থ দাড়ায় হযরত মুসার সাথে সাক্ষাৎকারের ব্যাপার, যা পরবর্তী লাইন থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।
৩৬৫৮। বনী ইসরাঈলীদের মধ্যে আল্লাহ্ বহু নেতা, নবী এবং রাজা প্রেরণ করেন, যারা ইসরাঈলীদের সঠিক পথের নির্দ্দেশ দান করেন এবং সমাজ জীবনে আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠিত করেন। আল্লাহ্র এই বিশেষ অনুগ্রহ ততদিনই ইসরাঈলীরা ভোগ করে, যতদিন তারা ছিলো আল্লাহ্র নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং ধৈর্য্যশীল। অর্থাৎ তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবন বিধান মেনে চলতো এবং বিপদ বিপর্যয়ে আল্লাহ্র প্রতি নির্ভর করে ধৈর্যের সাথে বিপদকে মোকাবিলা করতো। যখন ইসরাঈলীদের মাঝে থেকে এই অবস্থা অন্তর্হিত হয়, তখন থেকে তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়। ফলে জাতি হিসেবে তারা বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে, আত্মকলহে নিমগ্ন হয়, এবং কার্যতঃ তারা পৃথিবী থেকে উচ্ছেদের পর্যায়ে পড়ে যায়। তাদের জাতীয় বিপর্যয়, অপমান, অবমাননা , বিশ্বে সকলেই জ্ঞাত। এই আয়াতের উপদেশ হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথে যে ব্যক্তি বা জাতি তার জীবন পরিচালনা করে, তাদের জন্য আছে ঐশ্বর্যময় ভবিষ্যত - কারণ আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাদের উপরে বর্ষিত হয়। তারা সুযোগ্য নেতা লাভে সক্ষম হয় জাতীয় জীবনে।
৩৬৫৯। ইসরাঈলীদের নিজেদের মধ্যে যে তর্কবিতর্ক এবং ঝগড়াঝাটি বিদ্যমান তার ফয়সালা পৃথিবীতে সম্ভব নয়। তা চলতেই থাকবে, যতদিন না রোজকেয়ামত সংঘটিত হয়। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে নূতন উম্মতের [ইসলাম] আভির্ভাব ঘটেছে যার আগমন বিশ্ব মানবতার শুভ সংবাদ। যারা বিশ্বকে একই ভাতৃবন্ধনে এই নূতন উম্মত আহ্বান করে।
৩৬৬০। পৃথিবীতে যদি কোনও জাতি বিপথগামী হয়, তবে তাদের চৈতন্যদয় ঘটতে পারে অন্য ধবংসপ্রাপ্ত জাতির উদাহরণ দেখে। যুগে যুগে পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে পাপের পথ অবলম্বনের জন্য। পাপ ধ্বংসের পথ , পূণ্য সমৃদ্ধির পথ। প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পৃথিবীতে এই সত্য বিদ্যমান। মোশরেক আরবদের মাঝে আদ ও সামুদ ইত্যাদি জাতির উদাহরণ থেকেও ইসরাঈলীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো।
৩৬৬১। 'শুনবে না ? ' - শোনা অর্থাৎ আল্লাহ্র সাবধান বাণী শোনা বা অনুধাবন করা। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে কি অপূর্ব স্বাভাবিকভাবে ইন্দ্রিয়গত 'শোনা' কে উপলব্ধি বা অনুধাবন ক্ষমতার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে। উদাহরণ স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবীর উত্থান পতনের ইতিহাসের সাথে। প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাপের পরিণতি অনুধাবনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। জাগতিক বিষয় বস্তুকে আধ্যাত্মিক জগতের শিক্ষার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে। এই আয়াতে শুনতে পারার মানসিক দক্ষতাকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে। পরর্বতী আয়াতে 'দেখা' বা 'দেখতে পারা' -মানসিক দক্ষতাকেও এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৩৬৬২। এই আয়াতেও পূর্বের আয়াতের মত জাগতিক বিষয় বস্তুকে আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু অনুধাবনের উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কত সহজে এবং কত সুন্দরভাবে তা উত্থাপন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টিহীন বায়ু ভূমিকে ঊষর এবং মরুভূমি সদৃশ্য করে তোলে। ফলে মাটিতে জীবনের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে মৃতের রূপ ধারণ করে। আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্বরূপ বৃষ্টিপাতের ফলে মরুসদৃশ্য ভূমি সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামল ভূমিতে পরিণত হয়। এ সব উর্বর ভূমি তখন পশু এবং মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে থাকে। ঠিক সেরূপ হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক ভূবনের অবস্থা। আধ্যাত্মিক দিক থেকে মৃত ব্যক্তি আল্লাহ্র করুণা লাভে আত্মিক ভাবে পুণঃর্জীবন লাভ করে। আর আল্লাহ্র করুণা লাভের প্রধান উপায় হচ্ছে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অনুধাবনের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করা। যদি সে তা পারে তবে সে ব্যক্তির উপমা হচ্ছে ঐ মরুভূমি সদৃশ্য শুষ্ক মাটির ন্যায় যা বৃষ্টি সঞ্জীবিত হয়ে সুজলা সুফলা রূপ ধারণ করে। সে ব্যক্তি তখন শুধু নিজের জন্যই সম্পদ নয়, সে তখন তার উপরে যারা নির্ভরশীল তাদের জন্যও এক বিরাট সম্পদরূপে পরিগণিত হবে। কারণ তাঁর চরিত্র মাধুর্য্য তাকে সাধারণ মানুষের উর্দ্ধে স্থাপন করবে।
৩৬৬৩। এই আয়াতটি [ ৩২ : ২৭ ] ইংরেজীতে অনুবাদের সময়ে প্রথমে শুরু করা হয়েছে "Do they not see ? [ A wa lam yarau ] " বাক্যটি দ্বারা এবং শেষ করা হয়েছে "Have they not the vision ? [Afa La yubsirun ] "। বাংলা অনুবাদে উভয় স্থানে "লক্ষ্য করা " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু দেখা ও লক্ষ্য করার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। দেখা শুধুমাত্র পার্থিব ইন্দ্রিয়গত ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু "লক্ষ্য করা " চক্ষুর স্বাভাবিক ব্যবহারের বাইরেও মনোজগতে ঘটে থাকে। 'Vision' বা লক্ষ্য করা হচ্ছে স্বাভাবিক দৃষ্টির বাইরে অর্ন্তদৃষ্টি বা সচেতনতা। ইন্দ্রিয়গত জাগতিক দেখার মাধ্যমে ইন্দ্রিয় বর্হিভূত আধ্যাত্মিক জগতকে অনুধাবন করার ক্ষমতাকে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যেরূপ পূর্বের টিকা ৩৬৬১ এ বর্ণনা করা হয়েছে।
৩৬৬৪। অবিশ্বাসীরা জিজ্ঞাসা করে কখন সত্য মিথ্যার মধ্যে ফয়সালা করা হবে ? উত্তর হচ্ছে , " যদি তোমরা মনে কর শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত তোমরা অনুতাপ করা থেকে বিরত থাকবে এবং তখন তোমরা অনুতাপ করবে; তবে তা হবে মহা মূর্খের কাজ। কারণ শেষ বিচারের দিনের অনুতাপ গ্রহণযোগ্য হবে না। অনুতাপ করার জন্য তা অনেক দেরী হয়ে যাবে। সে সময়ে অনুতাপের জন্য কোনও সময় দেয়া হবে না। তোমাদের এখন সময় দেয়া হয়েছে এবং এ সুযোগ তোমরা গ্রহণ কর।"
৩৬৬৫। পড়ুন আয়াত [ ৬ : ১৫৮ ] এবং টিকা ৯৮৪ এই আয়াতের আলোচনা হিসেবে। সেখানে অবিশ্বাসীদের বলা হয়েছে : "Wait ye; we too are waiting" এই আয়াতে বিশ্বাসীদের সম্বোধন করা হয়েছে , "Wait [ then] they too are waiting."এই আয়াতের ক্ষেত্রে সম্বোধন করা হয়েছে বিপরীত ভাবে। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৭১ ]।
সূরা সাজদা
সূরা সাজদা বা আরাধনা - ৩২
৩০ আয়াত, ৩ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : এই ছোট্ট সূরাটি দ্বারা আলিফ্,লাম, মিম সিরিজ বা ধারাবাহিকতা শ্রেণীকে শেষ করা হলো। এই ধারাবাহিক শ্রেণীর প্রথম সূরাটি হচ্ছে ২৯তম সূরা এবং শ্রেণীতে মোট চারটি সূরা আছে। এর বিষয়বস্তু হচ্ছে সময় ও Ma'ad বা শেষ বিচারের দিন। মানুষ যদি তার শেষ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করে , তবে অবশ্যই সে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসাতে আপ্লুত হবে। সময়ের ক্রমপঞ্জি অনুযায়ী এই সূরাটি মধ্য মক্কীন সূরা। সুতারাং এই সূরাটি পূর্ববর্তী সূরার কিছু পূর্বে অবতীর্ণ। অবশ্য অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের ব্যাপারে বিশেষ কোনও বিশেষত্ব নাই
সারসংক্ষেপ : সৃষ্টির ব্যাপারে সময় এবং সকল বস্তুর শেষ পরিণতি সম্বন্ধে মানুষ ধারণা লাভ করে বাইরের প্রতীক দ্বারা। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ মানুষের মনে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা উৎপন্ন করে ঠিক সেরূপ ভাবে, বৃষ্টি যেরূপ শুষ্ক মাটিকে সিক্ত করে সজীব করে তোলে [ ৩২ : ১ - ৩০ ]।
সূরা সাজদা বা আরাধনা - ৩২
৩০ আয়াত, ৩ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
০১। আলিফ্ -লাম-মীম ,
০২। এই কিতাব জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নাই ৩৬২৯।
০২। এই কিতাব জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নাই ৩৬২৯।
৩৬২৯। আমাদের রাসুলের আগমনের পূর্বে ,পূর্ববর্তী নবী রসুলদের ঐশী গ্রন্থসমূহ মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিকৃত রূপ ধারণ করে। এর কারণ ছিলো, মানুষের অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা, প্রতারণা এবং ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা। এভাবে প্রত্যাদেশের অনেক অংশ সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে যায় এবং সেখানে মানুষের মনগড়া বিষয়বস্তু স্থান লাভ করে। নিজস্ব মনগড়া ব্যাখ্যা দ্বারা ধর্মীয় প্রত্যাদেশকে প্রকাশ করতে প্রয়াস পায়। ফলে এ সব ধর্মের মাঝে বহু বিভক্তির সৃষ্টি হয়, এবং তারা পরস্পরের মাঝে ধর্মীয় ব্যাখ্যার ব্যাপারে কূট তর্কে জড়িয়ে পড়ে। কোরাণের অবতীর্ণ দ্বারা এ সব কূট তর্ক ও বিভেদের অবসান ঘটে। কোরাণের আয়াতসমূহ সরাসরি আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত। আল্লাহ্ হচ্ছেন সার্বভৌম এবং জগতসমূহের প্রতিপালক। মানুষের তৈরী দর্শনে সর্বদাই সন্দেহ ও তর্কের অবকাশ থাকে।
০৩। তবে ৩৬৩০ তারা কি বলে, " সে [ মুহম্মদ ] ইহা জাল করেছে ? " কখনও না, ইহা তোমার প্রভুর নিকট থেকে আগত সত্য,- যেনো তুমি সেই জাতিকে সর্তক করতে পার, যাদের নিকট তোমার পূর্বে কোন সর্তককারী আসে নাই , হয়তো তারা সৎপথ গ্রহণ করবে ৩৬৩১।
৩৬৩০। ' তবে কি ' বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে অবিশ্বাসীরা কোরাণকে ঐশী গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করার পরিবর্তে রসুলের [ সা ] নিজস্ব রচনা হিসেবে মনে করে যা প্রতারণার সামিল। কিন্তু তাদের অনুমান সর্বৈব মিথ্যা : কারণ-
১) তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রধান সমালোচক ছিলো কোরেশরা - যারা তাঁকে সর্বদা সৎ ও সত্যবাদী বলে জানতো ;
২) তিনি ছিলেন নিরক্ষর। সুতারাং তাঁর পক্ষে পূর্ববর্তী কোন কিতাব পড়া সম্ভব নয়। সুতারাং তাঁর সকল জ্ঞানের উৎস হবে আল্লাহ্ কর্তৃক সরাসরি প্রদান; এবং
৩) প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার অবশ্যই কোনও সুনির্দ্দিষ্ট কারণ থাকবে। কারণ রসুলের [সা ] পূর্বে আরবে কোনও নবীর আগমন ঘটে নাই।
৩৬৩১। একজন পথ প্রদর্শকের প্রকৃত অভাব ছিলো আরবদের মাঝে। তাদের মাঝে বিশ্ব নবীর আভির্ভাব আল্লাহ্র পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশ সমূহের প্রত্যাশা অনুযায়ী -ই ঘটেছিলো।
০৪। আল্লাহ্-ই ছয়দিনে আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবী ও ইহার অন্তর্বর্তী সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন ৩৬৩২। অতঃপর তিনি [কর্তৃত্বের ] সিংহাসনে দৃঢ়ভাবে সমাসীন হন ৩৬৩৩। তোমাদের কোন রক্ষাকারী অথবা সুপারিশকারী নাই। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না ?
৩৬৩২। "ছয়দিন" - দেখুন আয়াত [ ৭ : ৫৪ ] ও টিকা ১০৩১। আমাদের পৃথিবীর দিন ও রাত্রির সমতুল্য এই 'দিন' নয়। সময়ের ধারণা হচ্ছে আপেক্ষিক। পৃথিবীর বাসিন্দারা পৃথিবীর চর্তুদিকে সূর্যের আবর্তন দ্বারা দিন ও রাত্রিকে নির্ধারিত করে সময়ের ধারণা লাভ করে। কিন্তু এখানে যে 'দিনের ' কথা বলা হয়েছে, সে 'দিন' বা দিনের ধারণা সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী সৃষ্টির বহু পূর্বের অবস্থা। সুতারাং আমাদের 'দিন' ও কোরাণ শরীফে বর্ণিত দিন এক নয়। নীচের আয়াত ৫ এ বলা হয়েছে এক একটি দিন আমাদের দিনের তুলনায় হাজার বছরের মত। আবার [ ৭০ : ৪ ] আয়াতে বলা হয়েছে ৫০,০০০ [ পঞ্চাশ ] হাজার বছরের সমান। এর থেকে এই সত্যকে বোঝানো হয়েছে যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ সময় ব্যপী এবং তা সৃষ্টি হয়েছে ছয়টি বিভিন্ন স্তরে বা যুগে যা সমর্থন করে আজকের বিজ্ঞান। আরও দেখুন [ ৪১ : ৯ -১২ ] আয়াত এবং টিকা।
৩৬৩৩। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৩ ] এবং এর টিকা ১৩৮৬। আল্লাহ্ আকাশ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ছয়টি ধাপে। প্রাথমিক সৃষ্টির পরেও তিনি এ সকল কিছুরই সার্বভৌম কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই তিনি পরিচালনা করেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর কোনও অংশীদার নাই। কাউকে তিনি তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তর করেন নাই। এ ব্যাপারে তিনি কখনও ক্লান্তি অনুভব করেন না। আরও দেখুন আয়াত [ ৭ :৫৪]।
০৫। তিনি আকাশমন্ডলী থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমুদয় বিষয় পরিচালনা করেন। সব শেষে [সকল বিষয়] তাঁর নিকট পৌঁছায় এমন এক দিনে, যার পরিমাণ তোমাদের গণনায় এক হাজার বৎসর হয় ৩৬৩৪।
৩৬৩৪। সময় একটি আপেক্ষিক ধারণা মাত্র। সময়ের এই বিশাল রহস্যকে আমাদের ধারণাতে অনুভবের জন্য এই আয়াতে সময়ের ধারণাকে আপেক্ষিক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র সৃষ্টির এক একটি দিন আমাদের ধারণার এক হাজার বা পঞ্চাশ হাজার দিনের সমান। সূদূর অতীতে স্রষ্টা সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু করেন যা আজও সমভাবে বর্তমান। তিনি সকল কিছু পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন। সৃষ্টির সকল কিছুই তার আইন মেনে চলতে বাধ্য। ভবিষ্যতে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই তাঁর কাছে নীত হবে বিচারের জন্য। তিনি হবেন বিচারপতি। সেদিন তিনি সকল ভ্রান্তির অবসান ঘটাবেন, সকল কিছুরই প্রকৃত মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আর এসব কিছুই ঘটবে এক দিনের মধ্যে বা এক ঘন্টার মধ্যে বা এক মূহুর্তের মধ্যে বা চোখের পলকে। কিন্তু আমাদের ধারণায় তা মনে হবে হাজার বছরের সমান।
০৬। তিনি এরূপই , যিনি অদৃশ্য ও দৃশ্য সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত, [ ক্ষমতায় ] পরাক্রমশালী, এবং দয়ালু ৩৬৩৫।
৩৬৩৫। আল্লাহ্র প্রতি আরোপিত নাম সমূহকে সার সংক্ষেপ করা হয়েছে এই আয়াতে এবং তা হচ্ছে তিনি -
১) সর্বজ্ঞ,
২) অসীম ক্ষমতার অধিকারী, এবং
৩) পরম দয়ালু।
সর্বজ্ঞ : অর্থাৎ তিনি দৃশ্য অদৃশ্য সকল জ্ঞানের অধিকারী, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কোনও কিছুই তাঁর অজ্ঞাত নয়। আল্লাহ্র পরিপূর্ণ ও সঠিক জ্ঞানের পটভূমিতে মানুষের জ্ঞান আংশিক, অকিঞ্চিতকর এবং অনিশ্চিত।
ক্ষমতা : আমাদের ক্ষমতা অনেক সময়েই আমাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। কারণ আমাদের ক্ষমতার পরিধি অত্যন্ত সীমিত। অনেক সময়েই ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করতে আমাদের সময় ও অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আল্লাহ্ হচ্ছেন মহা পরাক্রমশালী, তাঁর কারও সাহায্যের প্রয়োজন নাই। তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়নে তিনি একাই সক্ষম।
করুণা ও দয়া : আমাদের করুণা ও দয়া শর্ত সাপেক্ষ ; কারণ আমরা পাপী ও দুষ্কৃতিকারীকে করুণা করতে অপারগ। কিন্তু তাঁর করুণা ও দয়া শর্তহীন , অসীম। ধনী, দরিদ্র , পাপী ,পূণ্যাত্মা সকলেই তা সমভাবে লাভ করে থাকে। তিনি পরম দয়ালু।
০৭। তিনিই প্রত্যেকটি সৃষ্ট বস্তুকে উত্তমরূপে সৃজন করেছেন ৩৬৩৬। এবং কাদা দ্বারা মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন ৩৬৩৭।
৩৬৩৬। আল্লাহ্র সৃষ্টির প্রতিটি জিনিষই "উত্তম " : বিশ্বকর্মার প্রতিটি জিনিষই সুন্দর , যথাযথ, সুক্ষ এবং নির্দ্দিষ্ট কাজের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টিতে কোনও অসুন্দর নাই, কোন অসামঞ্জস্য বা বিশৃঙ্খলা নাই। পৃথিবীতে যা কিছু অসুন্দর ও বিশৃঙ্খলা সবই মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট। আর তার পিছনে থাকে মানুষকে দেয় স্রষ্টার "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি।" আধ্যাত্মিক শিক্ষা মানুষের এই "সীমিত ইচ্ছাশক্তিকে" উপদেশ ও অনুশীলনের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত এবং স্রষ্টার ইচ্ছার সাথে সমন্বিত করে।
৩৬৩৭। প্রথমতঃ মানুষ সৃষ্টির তুচ্ছ ও অকিঞ্চিতকর বিষয়গুলি সম্বন্ধে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। মানুষের শরীরকে [ আত্মা নয় ] গঠন করা হয়েছে তুচ্ছ কর্দ্দম থেকে, যা পৃথিবীর মূল উপাদান। সুতারাং মানুষের অস্তিত্বের প্রথম অংশ জড়িত থাকে তুচ্ছ জড় পদার্থের সাথে। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে জড় পদার্থও নিজে সৃষ্টি হতে পারে না। তা সবই আল্লাহ্ কর্তৃক সৃষ্ট।
০৮। অতঃপর তিনি তার বংশ তৈরী করেন ঘৃণ্য তরল পদার্থের নির্যাস থেকে ৩৬৩৮।
৩৬৩৮। এর পরে উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের বংশ বিস্তার সম্বন্ধে। যদিও মানুষের বংশ বিস্তার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ শারীরিক, এবং জান্তব বা পশুপ্রকৃতি , তবুও তা প্রাণহীন বা জড় নয়। এভাবেই মানুষের বংশ বিস্তারকে জড় পদার্থ থেকে একধাপ উন্নত করা হয়েছে। মানুষের বংশ বিস্তার প্রক্রিয়া শুরু হয় 'তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস' বীর্য থেকে। যদিও তা তুচ্ছ, তবুও তা মানব দেহের কেন্দ্রীভূত বিশুদ্ধ সারাংশ। আর জীবদেহ গঠনকারী এই অতিরিক্ত অপরিহার্য অংশ থাকে শরীরের সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য স্থানে যেখান দিয়ে মুত্র নিঃসৃত হয়। সে কারণে বীর্য বা শুক্রকেও ঘৃণ্যভাবে অনুমান করা হয়। শুক্র বা বীর্য জীবন্ত জীবকোষ যার মাধ্যমে স্রষ্টা পূর্বপুরুষদের জীবন ইতিহাসকে বংশ পরস্পরায় প্রবাহিত করেন। দেখুন [ ২৩ : ১২ ] আয়াত এবং টিকা ২৮৭২।
০৯। কিন্তু তিনি উহাকে সঠিক অনুপাতে গঠন করেছেন এবং উহাতে ফুঁকে দিয়েছেন তাঁর রূহু থেকে ৩৬৩৯। এবং তিনি তোমাদের দিয়েছেন শোনার, দেখার ও অনুভবের [ বুঝতে পারার ] ক্ষমতা ৩৬৪০। তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক।
৩৬৩৯। এর পরে মানুষের সৃষ্টির তৃতীয় ধাপকে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ মানুষের অবয়বকে সুঠাম, সৌন্দর্যমন্ডিত এবং যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ২৯ ]। সৃষ্টির প্রাথমিক ক্রিয়ায় শুক্র ডিম্ব কোষকে নিষিক্ত করার ফলে প্রাণের অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এই নিষিক্ত ডিম্ব ধীরে ধীরে মনুষ্য সৃষ্টির পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সৃষ্টি হয় , জীবনের বিকাশ আরম্ভ হয়। এই প্রক্রিয়ায় অভিজোযিত বস্তু শুধু যে প্রয়োজন মেটায় তাই-ই নয়, তা সৌন্দর্য বৃদ্ধিরও সহায়ক। এ পর্যন্ত মানব সৃষ্টির বর্ণনায় জান্তব বা পশুপ্রকৃতির দিকটি বর্ণনা করা হয়েছে। এ বারে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা যার কারণে মানব দেহে আল্লাহ্র "রূহ কে ফুঁকিয়া " দেয়া হয়। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষ সাধারণ প্রাণীকূল থেকে আলাদা।
৩৬৪০। আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহের কারণে মানুষ বিশেষ মানসিক দক্ষতা প্রাপ্ত হয়। ইউসুফ আলী সাহেবের মতে প্রাণীদেহের পাচঁটি ইন্দ্রিয় লাভ হচ্ছে মানব গঠনের তৃতীয় ধাপ - যা মানুষ ও প্রাণী উভয়ের বেলাতে প্রযোজ্য। কিন্তু চতুর্থ ধাপে মানুষকে প্রাণীদের থেকে উর্দ্ধে উত্তোলন করা হয়েছে। সে কারণে তৃতীয় ধাপে সম্বোধনের ভাষা হচ্ছে 'উহাকে' যা তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হয়। এবং চতুর্থ ধাপে সম্বোধনের ভাষা হচ্ছে দ্বিতীয় পুরুষ "তোমাদিগকে" - এমন কি তৃতীয় পুরুষ 'তাহাকে' শব্দও ব্যবহার করা হয় নাই। কারণ আল্লাহ্র রূহ গ্রহণের ফলে তার মাঝে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার জন্মলাভ ঘটেছে। সে আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ গ্রহণে সক্ষম। অর্থাৎ সে প্রকৃত সত্যের বাণী শুনতে পারে, তার শোনার ক্ষমতা থাকে। তার দেখার ক্ষমতা জন্মে , অর্থাৎ প্রকৃত সত্যকে সে দেখতে পারে, তার সে অন্তর্দৃষ্টি থাকে। তার মাঝে ভালোবাসার ক্ষমতা, সত্য ও সুন্দর কে অনুভব করার ক্ষমতা জন্মে। যে মানুষকে স্রষ্টা আকারে চেহারায়, অবয়বে, মানসিক দক্ষতায় , সৌন্দর্য্যে সুষম ও শ্রেষ্ঠ রূপে গড়েছেন , মানুষ কি তার জন্য স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ?
১০। এবং তারা বলে, " সে কি ! যখন আমরা মাটির [ নীচে ] শুয়ে থাকবো, লুক্কায়িত থাকবো এবং হারিয়ে যাব, তখন আবার কি আমরা নূতন ভাবে সৃষ্টি হব ৩৬৪১?" বরং তারা তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধেই অস্বীকার করে।
৩৬৪১। দেখুন আয়াত [১৩ : ৫ ]। 'তারা ' শব্দটি দ্বারা তাদেরই বোঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্র অনুগ্রহের জন্য 'সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।" এরা হচ্ছে বস্তুবাদী এবং সন্দেহবাতিক - যারা পৃথিবীর জীবনশেষে মৃত্যু পরবর্তী আর কোনও জীবনই স্বীকার করতে চায় না। তারা তাদের জীবনের সীমানাকে পৃথিবীর জীবনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী। এই আয়াতে তাদের বক্তব্য থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে এই যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিলো যে, যদি স্রষ্টা প্রথমে এত সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টিতে সক্ষম হন, তবে পরলোকে মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় বারেই বা তা করতে সক্ষম হবেন না কেন? বস্তুত পক্ষে এ সব লোক পরলোককে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকেই এরূপ কথা বলে যে, 'আমাদের আবার কি নূতন করে সৃষ্টি করা হবে ?' প্রতিপালকের সাক্ষাৎকার অস্বীকার করার ফলেই তাদের অন্তরে এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস জন্মে। অপরপক্ষে পরলোকের জীবন সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস এবং সেই জীবনের আশা আকাঙ্খার সাথে আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নির্ভরশীলতাই হচ্ছে আমাদের ঈমানের বা বিশ্বাসের মজবুত ভিত্তি।
১১। বল : " তোমাদের জন্য নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা [ ঠিক সময়ে ] তোমাদের আত্মাকে হরণ করবে ৩৬৪২। অতঃপর তোমাদের সকলকে তোমাদের প্রভুর নিকট ফিরিয়ে আনা হবে।"
৩৬৪২। কবি বলেছেন যে, 'জন্মিলে মরিতে হয়'। পৃথিবীতে এর থেকে বড় সত্য আর কিছু নাই। যদি পরলোকের অনন্ত জীবন এবং সেই জীবনের সুখ শান্তির জন্য পৃথিবীর জীবনকে নির্ধারিত করা না হতো , তবে মানুষের জন্য পৃথিবীর জীবন অর্থহীন হয়ে যেতো। মৃত্যুর সাথে সাথে যে জীবন শেষ হয়ে যায় সে জীবন তো পশু তুল্য। পশুর ন্যায় সে জীবনের কোনও মহত্বর বা উচ্চতর পরিপূর্ণতার দিক নাই। কারণ পশুদের কোনও আত্মা নাই। এ বিশাল বিশ্বভূবনে একমাত্র মানুষেরই জীবনের সাথে আত্মার অস্তিত্ব বিদ্যমান। মৃত্যুর মাঝে মৃত্যুদূত সেই আত্মাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং আমাদের আত্মাকে অন্য এক নূতন পৃথিবীতে নীত করে। যদি আমরা আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করি, তাহলে আমাদের ধর্মকে স্বীকার করতে হয়। কারণ আত্মার অস্তিত্বই হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল ভিত্তি স্বরূপ। আর ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনের অস্তিত্বে বিশ্বাস। সুতারাং অবিনশ্বর আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাস হচ্ছে নাস্তিকতার ভিত্তি।
রুকু - ২
১২। যদি তুমি দেখতে পেতে, যখন অপরাধীরা তাদের প্রভুর সামনে মাথা নীচু করে [ বলবে ] : " হে আমাদের প্রভু ! আমরা দেখলাম এবং আমরা শুনলাম ৩৬৪৩; এখন তুমি আমাদের পুণরায় [ পৃথিবীতে ] প্রেরণ কর। আমরা সৎ কাজ করবো। কারণ [ এখন ] আমরা প্রকৃতই বিশ্বাস করি।"
৩৬৪৩। মৃত্যু পরবর্তী যে জীবন আরম্ভ হবে সে জীবনে প্রতারণা ও আত্ম প্রবঞ্চনার কোনও সুযোগ থাকবে না। মানুষের চিন্তা, ভাবনা, কাজের উদ্দেশ্য বা নিয়ত , কর্ম সকল কিছুই পাপীদের নিকট দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হবে। সত্য উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হবে। সেদিন পাপীরা আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের ভয়ে প্রকম্পিত হবে। তারা অনুতপ্ত চিত্তে পূণঃরায় পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। কিন্তু তাদের সে সময়ের অনুতাপ কোনও কাজে আসবে না, কারণ তা অনেক দেরী হয়ে যাবে। কারণ আমাদের চেনা জানা পৃথিবীর কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। নূতন পৃথিবী সৃষ্টি হবে যেখানে পৃথিবীর জীবনের পুণরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া হবে না।
১৩। যদি আমি ইচ্ছা করতাম ৩৬৪৪; তবে আমি প্রতিটি আত্মাকে সত্যপথে পরিচালিত করতে পারতাম। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে এ কথা সাব্যস্ত হয়েছে যে, নিশ্চয়ই আমি জ্বিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবো। ৩৬৪৫
৩৬৪৪। পৃথিবী কি পাপী শূন্য হওয়া সম্ভব ছিলো ? অবশ্য আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করতেন তা হতো। আমাদের এই চেনা জানা পৃথিবীতে উদ্ভিদ জগত ও প্রাণীজগতকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন প্রাণ দিয়ে, কিন্তু তাদের নিজস্ব কোনও ইচ্ছাশক্তি নাই। সুতারাং তারা আল্লাহ্ কর্তৃক দেয় নির্দ্দিষ্ট সীমারেখা কখনই অতিক্রম করতে পারে না। তারা আল্লাহ্র হুকুম বা বিধান অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সুতারাং তাদের কোনও পাপ নাই। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে মানুষকেও সেভাবেই সৃষ্টি করতে পারতেন। মানুষের কোন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকতো না। ফলে তাদের কোন কাজেই পাপ বা পূণ্য বলে কিছু থাকতো না। কিন্তু আল্লাহ্র তা ইচ্ছা নয়। পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ্ সীমিত আকারে " স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দিয়ে প্রেরণ করেছেন। সে ইচ্ছা করলে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করার ক্ষমতা রাখে। যা অন্য কোনও প্রাণীর মাঝে নাই। সে কারণেই তিনি মানুষের জন্য জীবন -বিধান দিয়েছেন, যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন যেন মানুষের 'স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি' পবিত্র থাকে এবং মানুষ 'সরল পথের ' সন্ধান লাভ করে। যুগে যুগে নবী রসুলদের মাধ্যমে আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা আল্লাহ্র আইনকে লঙ্ঘন করবে পরলোকে তাদের শাস্তি অনিবার্য। পাপীদের শাস্তি হবেই কারণ আল্লাহ্র 'কথা অবশ্যই সত্য।'
৩৬৪৫। দেখুন আয়াত [ ১১ : ১১৯ ] ও টিকা ১৬২৩ এবং আয়াত [৭ : ১৮ ] এবং উপরের টিকা। শয়তান মানুষকে পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে যারা শয়তানের প্ররোচনার কাছে আত্মসমর্পন করে তারাই পরলোকে আল্লাহ্র শাস্তি ভোগ করবে।
১৪। " সুতারাং [ শাস্তি ] আস্বাদন কর - কারণ আজকের এই সাক্ষাতের কথা তোমরা বিস্মৃত হয়েছিলে, এবং আমিও তোমাদের কথা বিস্মৃত হব। তোমাদের [ মন্দ ] কাজের জন্য অনন্ত শাস্তির স্বাদ আস্বাদন কর।" ৩৬৪৬
৩৬৪৬। "বিস্মৃত হইয়াছিলে" শব্দটি আছে [ ৭ : ৫১ ] আয়াত ও টিকা ১০২৯। এই দুই আয়াতেই 'বিস্মৃত হওয়া ' বা ভুলে যাওয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ইচ্ছাকৃত ভাবে ও নিদারুণ ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করা বোঝানোর জন্য। " আমিও তোমাদিগকে বিস্মৃত হব " - এই বাক্যটির অর্থ এই নয় যে জ্ঞানের অভাবে বা অজ্ঞতার জন্য বা স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য তা ঘটেছে। কারণ সূরা [ ২০ : ৫২ ] আয়াতে বলা হয়েছে : " আল্লাহ্ ভ্রান্ত হন না, এবং বিস্মৃতও হন না।" আল্লাহ্র কাছে কোনও কিছুই হারিয়ে যায় না।
১৫। কেবলমাত্র তারাই আমার আয়াতসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে, যারা ইহার দ্বারা উপদেশ প্রাপ্ত হলে, ভক্তিভরে সেজ্দায় লুটিয়ে পড়ে ৩৬৪৭, এবং তাদের প্রভুর মহিমা প্রশংসার সাথে বর্ণনা করে এবং তারা [কখনও] অহংকারে স্ফীত হয় না।
৩৬৪৭। "Sujjadan" - সিজ্দা - সিজদা হচ্ছে দেহকে এক নির্দ্দিষ্ট ভঙ্গীতে বিন্যস্ত করা যার দ্বারা আল্লাহ্র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা , ভালোবাসা ও বিনয় প্রকাশ করা হয়। সূরাটির নাম সিজ্দা হয়েছে এই আয়াতটির অনুসরণে। পৃথিবীতে আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহ চতুর্দ্দিকে ছড়ানো আছে, সৃষ্টির জন্য তাঁর সযত্ন তত্বাবধান আমাদের পৃথিবীর জীবনকে করেছে ঐশ্বর্যমন্ডিত সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ। জীবনের প্রতি মুহূর্ত, প্রতিপল স্রষ্টার স্নেহময় অনুভবকে যে উপলব্ধি করতে পারে সেই তো কৃতজ্ঞ অন্তরে তাঁর প্রতি সেজদাতে লুণ্ঠিত হতে পারে। এই আয়াতটি পড়ার সময়ে সেজ্দা দান করা নিয়ম।
১৬। তাদের অংগপ্রত্যঙ্গ [ আরামের ] নিদ্রা ত্যাগ করে ৩৬৪৮ তাদের প্রভুকে ডাকে, ভয় এবং আশার সাথে ৩৬৪৯। আমি তদের যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা থেকে তারা [ দানে ] ব্যয় করে।
৩৬৪৮। আল্লাহ্র প্রতি সশ্রদ্ধ ভক্তি জানানোর সর্বোচ্চ সময় হচ্ছে নিশুতি রাত। সে সময় বিশ্ব প্রকৃতি থাকে সুপ্তিতে নিমগ্ন। বিশ্ব চরাচর থাকে শব্দহীন। রাত্রির নৈশব্দ ভক্তের একগ্রতা বৃদ্ধি করে, আল্লাহ্র স্নেহময় স্পর্শ,নৈকট্য অনুভব করা হয় অনেক সহজ। এ কারণেই নারী ও পুরুষ নরম আরামদায়ক, সুখময় শয্যা, নিদ্রার বিলাস ত্যাগ করে আল্লাহ্র এবাদতে মগ্ন হয়। তাদের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গভীর অনুরাগে প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি নিবেদন করে নিশীত রাতের নির্জনতায়। তফসীরকারগণ এই সময়ের প্রার্থনার নাম দিয়েছেন তাহাজ্জুতের নামাজ - যা মধ্যরাতের পরে ফজরের নামাজের কিছু পূর্বে যে নামাজ পড়া হয়।
৩৬৪৯। 'প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও আশার সাথে।' আশংকা এই কারণে যে , মোমেন বান্দার অন্তরে সর্বদা এই ভয় বিরাজ করে যে, হয়তো বা তাঁর এবাদত আল্লাহ্র প্রতি যোগ্য হচ্ছে না,হয়তো বা তা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। আবার 'আশা' হচ্ছে এই জন্য যে আল্লাহ্ পরম করুণাময়, তিনি বান্দার দোষত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিচার করবেন। প্রকৃত মোমেন বান্দার মানসিক অবস্থাকে এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা শুধুমাত্র প্রার্থনার মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায় না তার বাস্তব প্রকাশ থাকতে হবে তাদের কাজের মাধ্যমে। মোমেন বান্দারা , আল্লাহ্ তাদের যাকে যে নেয়ামত দান করেছেন তাই থেকে আল্লাহ্র কাজে ব্যয় করে। আল্লাহ্র নেয়ামতসমূহের বিবরণের জন্য দেখুন টিকা ২৭।
১৭। এখন কেহই জানে না তাদের জন্য নয়ন মুগ্ধকর কি জিনিষ লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাদের [ ভালো ] কাজের পুরষ্কার স্বরূপ ৩৬৫০।
৩৬৫০। 'নয়ন মুগ্ধকর' এটা একটা বাগ্ধারা যার দ্বারা বোঝানো হয় যে তৃপ্তিদায়ক, সুখকর ও আরামদায়ক পরিস্থিতি। বর্তমান জীবনে অবস্থান করে পারলৌকিক জীবনের সুখ ও শান্তি কল্পনা করাও মানুষের দুঃসাধ্য।
১৮। তাহলে কি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে সে কি ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে বিদ্রোহী ও দুষ্ট ৩৬৫১? তারা সমান নয়।
৩৬৫১। এখানে দু শ্রেণীর ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। এক শ্রেণী মুমিন ব্যক্তি , অন্য শ্রেণী পাপাচারী। এদের বর্ণনা আছে [ ১৯ - ২২ ] আয়াত পর্যন্ত।
১৯। যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, [ভালো ] কাজের জন্য তাদের আপ্যায়ন করা হবে চিরস্থায়ী বাসস্থান বেহেশতে ৩৬৫২।
৩৬৫২। 'বাসস্থান' - অর্থাৎ বাসভবন। গৃহ বা বাসভবন মানেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুখ ও শান্তির এক মনোরম ছবি যেখানে স্নেহ-ভালোবাসা , নিরাপত্তা , জীবনকে করে আরামদায়ক। যদি তার সাথে যুক্ত হয় সম্মান ও আদর আপ্যায়ন তাহলে তা সুখ ও শান্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
২০। এবং যারা বিদ্রোহী ও দুষ্ট তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। যখনই তারা তা থেকে বের হতে চাইবে তখনই তাদের জোরপূর্বক সেখানে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের বলা হবে, " এখন আগুনের সেই শাস্তিকে আস্বাদন কর যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে। " ৩৬৫৩
৩৬৫৩। দেখুন আয়াত [ ২২ : ২২ ]। মনোরম বাগান যেমন শান্তির প্রতীক, ঠিক সেরূপ আগুন হচ্ছে শাস্তি ও যন্ত্রণার প্রতীক। এই প্রতীকের মাধ্যমে বেহেশতের সুখশান্তি ও দোযখের শাস্তিকে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে পাপীদের দোযখের শাস্তি থেকে রেহাই নাই। যারা তাদের পাপের মাধ্যমে এই শাস্তি অর্জন করে থাকে তাদের মানসিক অবস্থা তখন কি হবে ? সে সময়ে তারা বলবে যে, "অনল উদ্গীরণকারী দোযখের শাস্তিকে আমরা মিথ্যা ও অলীক কল্পনা করেছিলাম, এখন তা সত্যে পরিণত হয়েছে।" পাপীরা সে অবস্থাকে কি ভাবে গ্রহণ করবে ?
২১। মহাশাস্তির পূর্বে [ দুনিয়াতে ] ওদের আমি অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যেনো ওরা [ অনুতপ্ত হয়ে ] ফিরে আসে ৩৬৫৪।
৩৬৫৪। পরলোকের শাস্তি হচ্ছে পাপীদের জীবনের শেষ পরিণতি। পাপের শেষ পরিণতি দোযখ - এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। তবে শেষ পরিণতির পূর্বে করুণাময় আল্লাহ্ তাদের পৃথিবীতে ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পান। পৃথিবীতে দুর্ভাগ্য , দুঘর্টনা , দুঃখ-দুর্দ্দশা, প্রভৃতি শাস্তির মাধ্যমে স্রষ্টা তাদের বিপথ থেকে ফিরিয়ে, স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পনের প্রয়াস পান। পৃথিবীর এই লঘু শাস্তির রকমফের আছে। হতে পারে তা আর্থিক বা বিবেকের দংশন বা গোপন দুঃখ যা হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। যখন এ সব দুর্ঘটনা হৃদয়কে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পন করে থাকে। সুতারাং পৃথিবীর এ সব দুঃখ দুর্দ্দশা বান্দার জন্য শাস্তি স্বরূপ না হয়ে, প্রকৃত সুখ- ও শান্তির কারণ হতে পারে। কারণ এর ফলে হয়তো পাপীরা পাপ থেকে নিবৃত হয়ে অনুতাপের মাধ্যমে সঠিক পথে প্রত্যার্পন করবে। যার ফলে পরলোকের জীবনে সে দোযখের শাস্তির পরিবর্তে বেহেশতের সুখের আস্বাদন করতে সমর্থ হবে।
২২। তার থেকে বেশী পাপ কে করে, যার নিকট তার প্রভুর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করার পরেও, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ? ৩৬৫৫ যারা সীমালংঘন করে আমি অবশ্যই তাদের নিকট [ উপযুক্ত ] প্রতিশোধ দাবী করবো।
৩৬৫৫। সর্বাপেক্ষা মন্দ ও কঠিন হৃদয় বিশিষ্ট সেই পাপী যে আল্লাহ্র নিদর্শন বা আয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যে আল্লাহ্র আয়াতের শিক্ষাকে প্রত্যাখান করে এবং পাপের পথে ধাওয়া করে। আল্লাহ্র শিক্ষা - হতে পারে তা কোরাণের বাণীর মাধ্যমে বা মহান শিক্ষকদের পথ প্রদর্শনের মাধ্যমে, অথবা জাগতিক জীবনে ছোটখাট বিপদ বিপর্যয় ও দুঃখ দুর্দ্দশার মাধ্যমে। পাপে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, তারা আল্লাহ্র এসব শিক্ষা থেকে শিক্ষা লাভ না করে ঔদ্ধত্যতার সাথে মুখ ফিরিয়ে রাখে। অনেক সময়ে সর্বনাশা বিপদ তাদের সর্ব অস্তিত্বকে ঘিরে ধরে - এসব ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞানচক্ষু উম্মীলিত হওয়া উচিত ছিলো যে, আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও রহমত তাদের জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজন, ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র শিক্ষাকে প্রত্যাখানের ফলে তাদের বিবেক মৃত হয়ে যায়। তারা লাভের পরিবর্তে লোকসান ক্রয় করে। তাদের অবধারিত শাস্তি তাদেরই কর্মের ফল।
রুকু - ৩
২৩। আমি তো পূর্বে মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম ৩৬৫৬। সুতারাং [তোমার নিকট ] ইহার প্রাপ্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহের মধ্যে থেকো না ৩৬৫৭। বণী ইসরাঈলীদের জন্য আমি উহাকে পথ প্রদর্শক করেছিলাম।
৩৬৫৬। যুগে যুগে আল্লাহ্ মানুষের হেদায়েতের জন্য নবী রসুলদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন। একমাত্র হযরত মুহম্মদের [সা] নিকট প্রেরিত গ্রন্থ ব্যতীত কোনও গ্রন্থই সম্পূর্ণ নয়। হযরত মুসার কিতাবে আছে শুধুমাত্র 'সারিয়া' আইন বা জীবন বিধান। এই আইন হচ্ছে জীবন ধারণের পথ নির্দ্দেশ। মুসার পরে হযরত ঈসা আল্লাহ্র নিকট থেকে ঐশি গ্রন্থ প্রাপ্ত হন। তাঁর প্রাপ্ত কিতাব 'ইন্জিলে' শুধুমাত্র নৈতিক নীতিমালার সাধারণ বর্ণনা আছে, কোন 'সারিয়া' আইন বা জীবন বিধানের বর্ণনা নাই। হযরত ঈসার পরে বিশ্ব নবীর [ সা ] আগমন। তাঁর কাছে ঐশি গ্রন্থ কোরাণ প্রেরণ করা হয়। কোরাণের বিশেষত্ব হচ্ছে কোরাণ একটি সম্পূর্ণ ধর্মগ্রন্থ। এখানে 'সারিয়া' আইন বা জীবন বিধান [ code of life ] ও নৈতিক নীতিমালার সমন্বয় ঘটেছে। একই সাথে এই সূরাটি মক্কান সূরা। মক্কান সূরাগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে কোন জীবন বিধানের উল্লেখ নাই। জীবন বিধান বা 'সারিয়া' আইন সম্বলিত সূরা অবতীর্ণ হয় মদিনাতে। এই সূরাতে রসুলকে [সা] আশ্বাস দান করা হয়েছে যে রসুলকেও [সা ] মুসার ন্যায় অর্থাৎ সারিয়া আইন সমৃদ্ধ কিতাব প্রেরণ করা হবে। পরবর্তীতে মদিনায় প্রেরিত সূরাগুলির মাধ্যমে 'সারিয়া ' আইন বা জীবন বিধান প্রেরণ করা হয়। নবীর [সা] নিকট প্রেরিত মুসলিম জীবন বিধানে পূর্ববর্তীদের হযরত মুসার নিকট প্রেরিত অনেক জীবন বিধানকে বাতিল করা হয় এবং যুগোপযোগী জীবন বিধানের অবতারণা করা হয়। এ ভাবেই কোরাণ হচ্ছে এক পূণার্ঙ্গ ঐশি গ্রন্থ বা প্রত্যাদেশ।
৩৬৫৭। এই আয়াতটি সম্বন্ধে মতদ্বৈত আছে। "Liqa-i-hi" - এই বাক্যটির অর্থ সম্বন্ধে অনুবাদকদের মতদ্বৈতের কারণ ঘটেছে। এখানে সর্বনাম 'hi' কেহ কেহ অনুবাদ করেছেন 'ইহা' শব্দ দ্বারা আবার কেহ কেহ 'তাহার' শব্দ দ্বারা। মওলানা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন 'ইহা' শব্দ দ্বারা। এখানে 'ইহা' অর্থাৎ 'কোরাণ' বা ঐশি গ্রন্থকে বোঝানো হয়েছে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রণীত মারেফুল কোরাণেও অনুবাদ করা হয়েছে এভাবে " আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছি, অতএব আপনি কোরাণ প্রাপ্তির বিষয়ে কোন সন্দেহ করবেন না। আমি একে বনী ইসরাঈলীদের জন্য পথ প্রদর্শক করেছিলাম।" অনুবাদে এই অর্থটিই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। 'hi' শব্দটিকে 'তাহার ' শব্দ দ্বারা অনুবাদ করলে অর্থ দাড়ায় হযরত মুসার সাথে সাক্ষাৎকারের ব্যাপার, যা পরবর্তী লাইন থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।
২৪। এবং আমি তাদের মধ্যে থেকে বহু নেতা নিযুক্ত করেছিলাম যারা আমার আদেশ অনুযায়ী হেদায়েত করতো; ততদিন পর্যন্ত যতদিন তারা অধ্যাবসায়ের সাথে ধৈর্য অবলম্বন করতো এবং আমার আয়াতসমূহে বিশ্বাস রেখেছিলো ৩৬৫৮।
৩৬৫৮। বনী ইসরাঈলীদের মধ্যে আল্লাহ্ বহু নেতা, নবী এবং রাজা প্রেরণ করেন, যারা ইসরাঈলীদের সঠিক পথের নির্দ্দেশ দান করেন এবং সমাজ জীবনে আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠিত করেন। আল্লাহ্র এই বিশেষ অনুগ্রহ ততদিনই ইসরাঈলীরা ভোগ করে, যতদিন তারা ছিলো আল্লাহ্র নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং ধৈর্য্যশীল। অর্থাৎ তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবন বিধান মেনে চলতো এবং বিপদ বিপর্যয়ে আল্লাহ্র প্রতি নির্ভর করে ধৈর্যের সাথে বিপদকে মোকাবিলা করতো। যখন ইসরাঈলীদের মাঝে থেকে এই অবস্থা অন্তর্হিত হয়, তখন থেকে তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়। ফলে জাতি হিসেবে তারা বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে, আত্মকলহে নিমগ্ন হয়, এবং কার্যতঃ তারা পৃথিবী থেকে উচ্ছেদের পর্যায়ে পড়ে যায়। তাদের জাতীয় বিপর্যয়, অপমান, অবমাননা , বিশ্বে সকলেই জ্ঞাত। এই আয়াতের উপদেশ হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথে যে ব্যক্তি বা জাতি তার জীবন পরিচালনা করে, তাদের জন্য আছে ঐশ্বর্যময় ভবিষ্যত - কারণ আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাদের উপরে বর্ষিত হয়। তারা সুযোগ্য নেতা লাভে সক্ষম হয় জাতীয় জীবনে।
২৫। অবশ্যই তোমার প্রভু শেষ বিচারের দিনে, তারা [নিজেদের মধ্যে ] যে বিষয়ে মতবিরোধ করছে সে বিষয়ে মীমাংসা করে দেবেন ৩৬৫৯।
৩৬৫৯। ইসরাঈলীদের নিজেদের মধ্যে যে তর্কবিতর্ক এবং ঝগড়াঝাটি বিদ্যমান তার ফয়সালা পৃথিবীতে সম্ভব নয়। তা চলতেই থাকবে, যতদিন না রোজকেয়ামত সংঘটিত হয়। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে নূতন উম্মতের [ইসলাম] আভির্ভাব ঘটেছে যার আগমন বিশ্ব মানবতার শুভ সংবাদ। যারা বিশ্বকে একই ভাতৃবন্ধনে এই নূতন উম্মত আহ্বান করে।
২৬। আমি ইহাদের পূর্বে কত জাতিকে ধবংস করেছি, যাদের [ পরিত্যক্ত ] বাসভূমির মধ্য দিয়ে ওরা যাতায়াত করে, এ থেকেও কি তারা শিক্ষা নেয় না ? ৩৬৬০। অবশ্যই এর মাঝে রয়েছে [আল্লাহ্র ] নিদর্শনসমূহ। তবুও কি তারা শুনবে না ? ৩৬৬১
৩৬৬০। পৃথিবীতে যদি কোনও জাতি বিপথগামী হয়, তবে তাদের চৈতন্যদয় ঘটতে পারে অন্য ধবংসপ্রাপ্ত জাতির উদাহরণ দেখে। যুগে যুগে পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে পাপের পথ অবলম্বনের জন্য। পাপ ধ্বংসের পথ , পূণ্য সমৃদ্ধির পথ। প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পৃথিবীতে এই সত্য বিদ্যমান। মোশরেক আরবদের মাঝে আদ ও সামুদ ইত্যাদি জাতির উদাহরণ থেকেও ইসরাঈলীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো।
৩৬৬১। 'শুনবে না ? ' - শোনা অর্থাৎ আল্লাহ্র সাবধান বাণী শোনা বা অনুধাবন করা। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে কি অপূর্ব স্বাভাবিকভাবে ইন্দ্রিয়গত 'শোনা' কে উপলব্ধি বা অনুধাবন ক্ষমতার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে। উদাহরণ স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবীর উত্থান পতনের ইতিহাসের সাথে। প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাপের পরিণতি অনুধাবনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। জাগতিক বিষয় বস্তুকে আধ্যাত্মিক জগতের শিক্ষার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে। এই আয়াতে শুনতে পারার মানসিক দক্ষতাকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে। পরর্বতী আয়াতে 'দেখা' বা 'দেখতে পারা' -মানসিক দক্ষতাকেও এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
২৭। তারা কি লক্ষ্য করে না যে আমি বৃষ্টিকে তাড়িত করি শুষ্ক [ উদ্ভিদ শূন্য ] জমিতে ৩৬৬২, এবং তার ফলে শস্য উৎপন্ন করি, যা তাদের পশুদের এবং তাদের খাদ্য হয়? তাদের কি দূরদৃষ্টি নাই ? ৩৬৬৩
৩৬৬২। এই আয়াতেও পূর্বের আয়াতের মত জাগতিক বিষয় বস্তুকে আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু অনুধাবনের উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কত সহজে এবং কত সুন্দরভাবে তা উত্থাপন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টিহীন বায়ু ভূমিকে ঊষর এবং মরুভূমি সদৃশ্য করে তোলে। ফলে মাটিতে জীবনের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে মৃতের রূপ ধারণ করে। আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্বরূপ বৃষ্টিপাতের ফলে মরুসদৃশ্য ভূমি সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামল ভূমিতে পরিণত হয়। এ সব উর্বর ভূমি তখন পশু এবং মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে থাকে। ঠিক সেরূপ হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক ভূবনের অবস্থা। আধ্যাত্মিক দিক থেকে মৃত ব্যক্তি আল্লাহ্র করুণা লাভে আত্মিক ভাবে পুণঃর্জীবন লাভ করে। আর আল্লাহ্র করুণা লাভের প্রধান উপায় হচ্ছে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অনুধাবনের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করা। যদি সে তা পারে তবে সে ব্যক্তির উপমা হচ্ছে ঐ মরুভূমি সদৃশ্য শুষ্ক মাটির ন্যায় যা বৃষ্টি সঞ্জীবিত হয়ে সুজলা সুফলা রূপ ধারণ করে। সে ব্যক্তি তখন শুধু নিজের জন্যই সম্পদ নয়, সে তখন তার উপরে যারা নির্ভরশীল তাদের জন্যও এক বিরাট সম্পদরূপে পরিগণিত হবে। কারণ তাঁর চরিত্র মাধুর্য্য তাকে সাধারণ মানুষের উর্দ্ধে স্থাপন করবে।
৩৬৬৩। এই আয়াতটি [ ৩২ : ২৭ ] ইংরেজীতে অনুবাদের সময়ে প্রথমে শুরু করা হয়েছে "Do they not see ? [ A wa lam yarau ] " বাক্যটি দ্বারা এবং শেষ করা হয়েছে "Have they not the vision ? [Afa La yubsirun ] "। বাংলা অনুবাদে উভয় স্থানে "লক্ষ্য করা " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু দেখা ও লক্ষ্য করার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। দেখা শুধুমাত্র পার্থিব ইন্দ্রিয়গত ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু "লক্ষ্য করা " চক্ষুর স্বাভাবিক ব্যবহারের বাইরেও মনোজগতে ঘটে থাকে। 'Vision' বা লক্ষ্য করা হচ্ছে স্বাভাবিক দৃষ্টির বাইরে অর্ন্তদৃষ্টি বা সচেতনতা। ইন্দ্রিয়গত জাগতিক দেখার মাধ্যমে ইন্দ্রিয় বর্হিভূত আধ্যাত্মিক জগতকে অনুধাবন করার ক্ষমতাকে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যেরূপ পূর্বের টিকা ৩৬৬১ এ বর্ণনা করা হয়েছে।
২৮। তারা বলে, : " যদি তুমি সত্যি বলে থাক তবে কখন সে সিদ্ধান্ত হবে ? " ৩৬৬৪
৩৬৬৪। অবিশ্বাসীরা জিজ্ঞাসা করে কখন সত্য মিথ্যার মধ্যে ফয়সালা করা হবে ? উত্তর হচ্ছে , " যদি তোমরা মনে কর শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত তোমরা অনুতাপ করা থেকে বিরত থাকবে এবং তখন তোমরা অনুতাপ করবে; তবে তা হবে মহা মূর্খের কাজ। কারণ শেষ বিচারের দিনের অনুতাপ গ্রহণযোগ্য হবে না। অনুতাপ করার জন্য তা অনেক দেরী হয়ে যাবে। সে সময়ে অনুতাপের জন্য কোনও সময় দেয়া হবে না। তোমাদের এখন সময় দেয়া হয়েছে এবং এ সুযোগ তোমরা গ্রহণ কর।"
২৯। বল : " [শেষ বিচারের ] সিদ্ধান্তের দিনে অবিশ্বাসীদের [ সে সময়ের ] ঈমান আনায়ন কোন উপকারেই আসবে না। তাদের কোন অবকাশও দেয়া হবে না।"
৩০। সুতারাং তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং অপেক্ষা কর; [ অবশ্য] তারাও অপেক্ষা করছে ৩৬৬৫।
৩০। সুতারাং তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং অপেক্ষা কর; [ অবশ্য] তারাও অপেক্ষা করছে ৩৬৬৫।
৩৬৬৫। পড়ুন আয়াত [ ৬ : ১৫৮ ] এবং টিকা ৯৮৪ এই আয়াতের আলোচনা হিসেবে। সেখানে অবিশ্বাসীদের বলা হয়েছে : "Wait ye; we too are waiting" এই আয়াতে বিশ্বাসীদের সম্বোধন করা হয়েছে , "Wait [ then] they too are waiting."এই আয়াতের ক্ষেত্রে সম্বোধন করা হয়েছে বিপরীত ভাবে। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৭১ ]।