সূরা আহ্যাব
সূরা আহ্যাব বা মিলিতশক্তি - ৩৩
৭৩ আয়াত, ৯ রুকু , মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : ২৬ নং সূরা দিয়ে যে শ্রেণীবদ্ধ সূরাগুলির শুরু হয়েছিলো পূর্বের সূরাটি [ ৩২ নং ] ছিলো শ্রেণীর শেষ সূরা। এখন থেকে শুরু হচ্ছে জীবনের কঠিন সত্যের বর্ণনা। এখানে দুটি ধাপে তা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন-
১) শক্তি প্রয়োগ ও প্রচন্ড আক্রোশে সত্যকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা এবং
২) কুৎসা এবং অশোভন আচরণ দ্বারা নারীর চরিত্রে কালিমা লেপন।
প্রথমটিকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয় আহ্যাব বা মৈত্রিবদ্ধ দুষ্কার্যে সহযোগীদের সাথে। যারা মদিনার মুসলিম সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জন্য গোপন ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়। এরা ছিলো, পৌত্তলিক আরব , ইহুদী [ বানু নাদের গোষ্ঠি ] সম্প্রদায়, যাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো তাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, , আভ্যন্তরীণ বেদুঈন আরব গোষ্ঠি [গাতাফান গোষ্ঠি ] , এবং মদিনার ইহুদী সম্প্রদায় [ বানু কোরাইজা ]। এই সম্প্রদায় গুলির মৈত্রিবদ্ধ হওয়ার কারণ ছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়া। যদিও তাদের সংঘবদ্ধ ক্ষমতা অবরুদ্ধ মুসলমানদের দুঃচিন্তা ও কষ্টের কারণ ছিলো , তবুও শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম এই পরীক্ষায় বিজয়ীরূপে স্থান লাভ করে এবং অবস্থানকে আরও সুসংহত ও দৃঢ় করতে সমর্থ হয়।
মক্কার কোরাইশরা মুসলমানদের উপরে অত্যাচারের বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে। তারা মুসলমানদের অবরোধ, অপমান, শারীরিক অত্যাচার এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, নব্য মুসলিমদের এক অংশ আবেসিনিয়াতে হিজরত করে। মূসলমানদের এই শত্রুদের সাথে প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে বদর প্রান্তে হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে , যেখানে কোরেশদের নিশ্চিত পরাজয় ঘটে। [ দেখুন আয়াত ৩: ১৩ এবং টিকা ৩৫২ ] পরের বছর হিজরতের তৃতীয় বর্ষে তারা প্রতিশোধ নেবার জন্য মদিনাতে আক্রমণ চালায়। ওহদ্ প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যদিও ওহদের যুদ্ধে মুসলমানদের প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি ঘটে , তবুও শেষ পর্যন্ত মদিনা রক্ষা পায় এবং কোরাইশরা বিক্ষুব্ধ ও নিরাশা নিয়ে মক্কাতে ফিরে যায়। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা তাদের মিত্রদের সহযোগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে এবং হিজরীর পঞ্চম বর্ষে সাওয়াল মাসে তাদের মিলিত সৈন্য সহযোগে যা প্রায় ১০,০০০ এর মত ছিলো , তারা মদিনা অবরোধ করে। শত্রুদের এই মিলিত অবরোধকেই উল্লেখ করা হয়েছে [ ৩৩ : ৯- ২৭ ] আয়াতের মাধ্যমে। এই অবরোধ দুসপ্তাহের উপরে স্থায়ী হয়। কেহ কেহ তা ২৭ দিন বলে উল্লেখ করেছেন। এই অবরোধের ফলে মূসলমানেরা ক্ষুধা ও শীতে প্রচন্ড কষ্ট পায়। উপরন্তু তাদের উপরে শত্রুপক্ষের অবিশ্রান্ত তীর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং সেই সাথে তীব্রভাবে গালিগালাজ , অপমানজনক বাক্যের স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে। দুষ্কর্মে সহযোগী এই মৈত্রিবদ্ধ শক্তি বা আহ্যাব শেষ পর্যন্ত ছত্রভঙ্গ অবস্থায় রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে যায় এবং ইসলামের অবস্থান আরও সুদৃঢ় ও সুসংহত হয়। এই মৈত্রিবদ্ধ শক্তির আক্রমণ ছিলো সুবিন্যস্ত ও সুসংগঠিত, সুপরিচালিত আক্রমণ। কিন্তু মুসলিমরা তা প্রতিহত করার জন্য ভালো প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিলো মদিনার চুতর্পাশ্বে পরিখা খনন [খন্দক ] করা যার নির্দ্দেশ দান করেছিলেন আল্লাহ্র রাসুল এবং কার্যে পরিণত হয় পারস্যের অধিবাসী সালমানের তত্বাবধানে। সেই কারণে এই অবরোধ এবং যুদ্ধ পরিখার যুদ্ধ নামে খ্যাত।
দ্বিতীয়ত : রসুলের [সা ] সহধর্মীনীদের সমাজে অবস্থান ও সম্মানের কথা আলোচনা করা হয়েছে এবং সেই সাথে মুসলিম নারীদের সম্পর্কে সাধারণ নীতিমালার অবতারণা করা হয়েছে যাতে তাদের সামাজিক সম্মান রক্ষা করা হয়। এবং কুৎসা ও অপমান থেকে সুরক্ষিত করা হয়। রসুলের সহধর্মীনিরা সমাজের সেবার জন্য নিবেদিত ছিলেন। তারা সমাজ সেবামূলক কাজে নিজেদের আত্মনিবেদন করেছিলেন। তাঁরা মুসলমান মহিলাদের এই কাজে আত্মনিয়োগের জন্য অনুপ্রাণীত করেন। মুসলমান মহিলাদের সামাজিক কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দান করা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন [দুই যয়নাব ] গরীবের সেবায় আত্ননিয়োগ করেন। সে যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের সেবা দান করা ছিলো এক জরুরী প্রয়োজনীয় ব্যাপার। রসুলের কন্যা বিবি ফাতেমা ওহদের যুদ্ধের সময়ে ছিলেন মাত্র ১৯-২০ বৎসরের তরুণী। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করেন এবং আহত পিতার সেবা শুশ্রূষা করেন। এমন কি সপ্তম হিজরীতে সংঘটিত খাইবার অভিযানে মুসলিম রমণীরা আহতদের সেবার জন্য মদিনার বাইরে গমন করেন।
এই সূরার কিছু অংশের সময়কাল হবে পরিখার যুদ্ধের [ সাওয়াল, পঞ্চম হিজরী ] পরে। কারণ এই সূরার পরিখার যুদ্ধের বর্ণনার মাধ্যমে উপদেশ প্রদান করা হয়েছে। বিবি জয়নাবের সাথে রসুলের [সা ] বিবাহের উল্লেখ আছে এই সূরার ৩৭ নং আয়াতে , যা ঐ বছরেই সংঘটিত হয়।
সারসংক্ষেপ : পৌত্তলিক আরবদের বিবাহ সংক্রান্ত পুরাণ প্রথা পরিত্যাগ করতে হবে। পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক হবে স্বাভাবিক সম্মানজনক। [ ৩৩ : ১ - ৮ ]।
পরিখার যুদ্ধ এবং এর থেকে প্রাপ্ত উপদেশ : মোনাফেক এবং তাদের ভয়ভীতি ; সত্য এবং মহৎ উদাহরণকে অনুসরণ করতে হবে। [ ৩৩ : ৯ - ২৭ ]।
রসুলের [ সা] স্ত্রীদের জন্য আছে উচ্চ সম্মান : মিথ্যা সংকোচে অসুখী বিবাহ চিরস্থায়ী করার প্রয়োজন নাই। রসুলের [সা ] স্ত্রীদের প্রতি ব্যবহার হবে সংবেদনশীল এবং ভদ্র। [৩৩ : ২৮- ৫২ ]।
রসুল [সা ] এবং তাঁর পরিবারের সম্মান প্রাপ্য : কুৎসা রটনা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ ; তোমাদের বাক্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হও। [৩৩ : ৫৩ - ৭৩ ]।
সূরা আহ্যাব বা মিলিত শক্তি - ৩৩
৭৩ আয়াত, ৯ রুকু , মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৩৬৬৬। ইসলামের ইতিহাসে হিজরী পঞ্চম বর্ষ ছিলো অত্যন্ত বিপদ-সংঙ্কুল। সে সময়টা ছিলো ইসলামের প্রথম যুগ। তখনও ইসলামের অবস্থান দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এরই পটভূমিতে এই সূরা অধ্যয়ন করতে হবে। ভূমিকাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, দুষ্কর্মে সহযোগীদের মৈত্রী মদিনা অবরোধ করে এবং বিফল হয়। এই মৈত্রীতে ছিলো মক্কার অবিশ্বাসী পৌত্তলিকরা, মধ্য আরবের মরুভূমির আরবেরা, বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মদিনা থেকে পূর্বে বহিষ্কৃত ইহুদীরা ,মদিনাতে অবস্থানকারী অবশিষ্ট ইহুদীরা, এবং আব্দুল্লা -ইবন- উবাই এর তত্বাবধানে মদিনার মোনাফেকরা যাদের কথা পূর্বের [ ৯ : ৪৩ - ১১০ ] সূরাতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিভিন্ন গোষ্ঠির একত্রে মিলিত হওয়ার প্রধান সুত্র ছিলো ইসলামের প্রতি তীব্র ঘৃণা। এখানে তিনটি বিষয় উল্লেখযোগ্য :
১) ইহুদীরা ইসলাম গ্রহণের শেষ সুযোগ নষ্ট করে ফেলে। তাদের মধ্যে যারা ভালো লোক ছিলো তারা পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করে। কারণ তারা মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলো যে, ইসলামে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে পুণরুজ্জীবিত করা হয়েছে।
২) হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা থেমে যাওয়ার পরে [ ২৪ : ১১ - ২৬ ] ,এই সূরাতে রসুলের [সা ] স্ত্রীদের বিশেষ মর্যদা দান করা হয়। তাদের বিশ্বাসীদের মাতারূপে পরিগণিত করা হয়।
৩) হযরত জয়নাবের কাহিনীর উপরে ভিত্তি করে যৌন জীবনের পবিত্রতাকে নূতন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়। হযরত জয়নাবের উপাধি ছিলো গরীবের মাতা।
এই বিষয়গুলি পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
৩৬৬৭। এই আয়াতের পটভূমি ছিলো রসুলের [সা ] জীবনের দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলি। দুষ্ট লোকদের অপমান ও প্রতিবন্ধকতা, বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র,মোনাফেকী ,মিথ্যা কুৎসা রটনা, মিথ্যা এবং অলঙ্ঘনীয় কুসংস্কার, রসুলের [সা ] জীবনকে সর্বদিক থেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। দুর্যোগময় সেই দিনগুলিতে আল্লাহ্র রসুল ধীর স্থির ভাবে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে তার কর্তব্য কর্ম করে যাবেন। পার্থিব কোনও ভয় তাঁকে গ্রাস করবে না - এই আল্লাহ্র হুকুম। হয়তো মানুষ তাঁকে ভুল বুঝতে পারে , কিন্তু প্রকৃত সত্য আল্লাহ্র নিকট সুষ্পষ্ট। মানুষ হয়তো সত্য ও ভালোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহ্র নিকট।
উপদেশ : প্রতিটি মোমেন বান্দার জন্য এই আয়াত ও রসুলের জীবন উদাহরণ স্বরূপ।
৩৬৬৮। মূসলমান জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে চলবে। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান এবং আমাদের প্রকৃত অভিভাবক। দেখুন আয়াত [ ৪ : ৮১ ] এবং টিকা ৬০০।
৩৬৬৯। "মানুষের শরীরে দুইটি হৃদয় স্থাপন করেন নাই।" দুইটি হৃদয় অর্থাৎ দুইটি অসঙ্গত আত্মবিরোধী আচরণ , যেমন : একই সাথে আল্লাহকে এবং অসদুপায়ে প্রাপ্ত ধনদৌলত বা দুর্নীতির আরাধনা করা সম্ভব নয়। অথবা একই সাথে সত্যের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং কুসংস্কারচ্ছন্ন হওয়া সম্ভব নয়। অথবা মোনাফেকদের ন্যায় একটি জিনিষের ভান করা এবং কিন্তু মনের উদ্দেশ্য বিপরীত থাকা ইত্যাদি। অর্থাৎ দুই বিপরীত আচরণ একই ব্যক্তির চরিত্রে থাকা কোনও প্রকারে সম্ভব নয়। যে দুর্নীতিপরায়ণ বা মোনাফেক বা কুসংস্কারচ্ছন্ন তার আত্মা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। সেখানে সত্যের আলো প্রবেশ লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ এই-ই হচ্ছে আল্লাহ্র আইন। জাগতিক প্রাকৃতিক আইনের ন্যায় আল্লাহ্ আমাদের জন্য আধ্যাত্মিক আইনের সৃষ্টি করেছেন। সেই আইনের অধীনে এরূপ বিপরীত কর্মধারা একই ব্যক্তির পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ সবই তখন মোনাফেকীর নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। এই আয়াতে অজ্ঞতার যুগের পৌত্তলিক আরবদের দুইটি খারাপ প্রথার উল্লেখ করা হয়েছে উদাহরণ হিসেবে এবং তাদের অন্যায় আচরণের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। দেখুন টিকা ৩৬৭০ এবং ৩৬৭১।
৩৬৭১। প্রাক্-ইসলাম যুগে পোষ্য পুত্রকে আপন পুত্রবৎ গণ্য করা হতো। এই আয়াতে বলা হয়েছে পোষ্য পুত্র আপন পুত্র নয়। শরীয়তে পিতা -পুত্রের যে সম্পর্ক নির্ধারিত হয়েছে তা পোষ্য পুত্রের জন্য প্রযোজ্য নয়। পোষ্য পুত্রের ধারণা পিতা-পুত্রের সাধারণ সম্পর্ককে জটিল করতে পারে। কারণ এ ধারণার সাথে রক্তের সম্পর্ক বিদ্যমান নয় -এগুলি শুধুমাত্র একটা ধারণা বা কথার কথা। এগুলি আক্ষরিক , প্রকৃত সত্য নয়। প্রকৃত সত্যকে মুখের কথায় পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মুখের কথায় জীববিজ্ঞানের বংশগতির ধারাকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মুসলিম আইনে পোষ্য পুত্রের ধারণা অমূলক। সেই কারণে তালাকপ্রাপ্ত নিজ পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা হারাম কিন্তু পোষ্য পুত্রের বেলাতে এই আইন প্রযোজ্য নয়। দেখুন আয়াত [ ৪ : ২৩ ]।
৩৬৭২। প্রাক্ -ইসলাম যুগে প্রচলন ছিলো যে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ক্রীতদাসকে তাঁর পূর্ব মনিবের সন্তান হিসেবে সম্বোধন করা হতো। সম্ভবতঃ এটা ঘটতো তাঁর পিতৃপরিচয় না জানার কারণে। আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে ; পিতৃপরিচয় জানা না থাকলে মাওলা বা উম্মতের নাম ধরে ডাকতে হবে। আরবীতে মাওলা শব্দটি গাঢ় বন্ধুত্বের বন্ধনকে বোঝায়। 'ভাই' বা ভাতৃত্ববোধ এগুলির ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু পিতৃত্ব শব্দটি কোনও অবস্থাতেই ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে না।
৩৬৭৩। মিথ্যা কুসংস্কার এবং মনগড়া সম্পর্ককে লালন-পালন করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পৃথিবীতে আল্লাহ্র নিকট রক্তের সম্পর্ক-ই একমাত্র সম্পর্ক বলে স্বীকৃত। মনগড়া সম্পর্ক এরূপ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে এরূপ সম্পর্ককে উত্থাপন না করে বা ভুলবশতঃ কাউকে অপরের পিতা বা সন্তান বলে সম্বোধন করে , তবে তার জন্য কোনও অপরাধ হবে না। এরূপ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে," আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। " অপরাধ তাদেরই হবে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সমাজ জীবনে ক্ষতি সাধন করার উদ্দেশ্যে এরূপ মনগড়া সম্পর্ককে উপস্থাপন করে থাকে। এই আয়াতে তাদেরই ভত্র্সনা করা হয়েছে তাদের বক্রোক্তি বা পরোক্ষ ইঙ্গিতের জন্য। উদ্দেশ্য যদি মন্দ না হয় সাধারণ ভুলের জন্য আল্লাহ্ অপরাধ নেবেন না।
৩৬৭৪। এই আয়াতের মাধ্যমে রসুলের [সা ] অবস্থানকে বর্ণনা করা হয়েছে। উপরের আয়াতের মাধ্যমে পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্ককে সর্বোচ্চ স্থান প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু রসুলের [সা ] প্রতি সম্মান ও জাগতিক সম্পর্ক সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার অধিকারী। কারণ এই সর্ম্পক শুধুমাত্র ইহকালের নয় - মৃত্যুর পরেও আমরা তার উম্মত হিসেবে আল্লাহ্র নিটক পরিচিতি লাভ করবো। সুতারাং মোমেন বান্দারা তাঁকে পিতা-মাতা বা ভাই সকলের উর্দ্ধে স্থাপন করবে, যখন তাদের সাথে কর্তব্য কর্মে সংঘাত দেখা দেবে। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্র রসুলের সাথে মোমেন বান্দার সম্পর্ক জাগতিক সম্পর্ক অপেক্ষা নিকটতর এবং দৃঢ় যা মৃত্যুর পরেও স্থায়িত্ব লাভ করবে। সে সম্পর্ক ইহকালের ও পরকালের; আত্মার সাথে সে বন্ধন। এমন কি রসুল [সা] আমাদের নিজস্ব সত্ত্বা অপেক্ষা নিকটতর। আমাদের নিজস্ব স্বার্থ বা ভালো মন্দের উর্দ্ধে আমাদের অস্তিত্বের অপেক্ষাও নিকটতম।
৩৬৭৫। দেখুন উপরের টিকা। এই সূরাতে সম্মানীয় রসুলের [সা] পত্নীগণের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে।সমাজে রসুলের [সা ] পত্নীগণের অবস্থান সাধারণ ছিলো না। আল্লাহ্ তাদের জন্যও বিশেষ কর্তব্য কর্ম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তাদের ভূমিকা ছিলো উম্মতের 'মা ' হিসেবে। তারা সাধারণ মহিলাদের ধর্মীয় ব্যাপারে উপদেশ দান করবেন। তাদের সাথে যোগাযোগ রাখবেন, অসুস্থ ও দুঃখী দুদ্দর্শাগ্রস্থদের পাশে দাঁড়াবেন। সেই সাথে নবীজির সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখবেন। সমাজ জীবনে তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিলো ব্যপক ও গভীর।
৩৬৭৬। হিজরতের প্রথম দিকে যখন মদিনার মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয় নাই, সেইসময়ে আনসার ও মোহজেরদের মধ্যে ভাতৃসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। সে হিসেবে আত্মীয়তা থাকুক বা না থাকুক মোহাজেররা আনসার ভাইদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব লাভ করতো। কিন্তু যখন মূসলিম উম্মত স্থায়িত্ব লাভ করলো, তখন এই ব্যবস্থা রহিত হয়ে গেলো এবং শুধুমাত্র রক্তের সম্পর্ককেই উত্তারাধীকারের নীতি বা ভিত্তি হিসেবে আল্লাহ্ নির্দ্দেশ দান করেন। এই আয়াত এবং সূরা ৮ এর ৭৫ নং আয়াত দ্বারা পূর্বের ব্যবস্থাকে রহিত করা হয়।
৩৬৭৭। দেখুন আয়াত [ ৩ : ৮১ ]। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল সৃষ্ট পদার্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আল্লাহ্র সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ যে তারা সকলেই আল্লাহ্র আইন মেনে চলবে। আল্লাহ্র আইন হচ্ছে তাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। জড় পদার্থ বা জীবন্ত প্রাণী সকলেই নির্ভূল ভাবে স্রষ্টার আইন বা ইচ্ছাকে মেনে চলে। না মানার স্বাধীনতা তাদের দেয়া হয় নাই। শুধুমাত্র মানুষকেই স্বাধীনত দান করা হয়েছে সীমিত আকারে। আর সে কারণেই তাদের তা মানতে নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। দেখুন [ ৫ : ১ ] আয়াত। কিন্তু নবী ও রসুলদের জন্য আছে বিশেষ কঠোর ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার যা তাদের পালন করতে হবে। তাঁদের কর্তব্য হচ্ছে নির্ভিকভাবে সত্যকে প্রচার করা, সকল অবস্থায় আল্লাহ্র সেবায় নিয়োজিত থাকা। সমাজে তাদের সম্মানজন অবস্থানকে আল্লাহ্ পূর্বের আয়াতে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাঁদের অনুসারীদের সঠিক পথ প্রদর্শকের বিশাল দায়িত্ব তাদের উপরে নিয়োজিত।
৩৬৭৮। আল্লাহ্র সত্যকে প্রচারের জন্য যাদের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে তাদের পরলোকে জিজ্ঞাসা করা হবে কিভাবে তাঁরা পৃথিবীতে তাদের কর্তব্য কর্মে অগ্রসর হয়েছেন, কি ভাবে মানুষ তা গ্রহণ করেছে , কি ভাবে তা প্রত্যাখান করেছে ,কারা সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে। এই মহান দায়িত্ব তাঁদের আমানত। আমানতদারদের মতই তাঁদের এর হিসাব দাখিল করতে হবে মহান আল্লাহ্র কাছে। আল্লাহ্ সবই জানেন তিনি সর্বজ্ঞ। এই হিসাব দাখিল আল্লাহ্র জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে না। কিন্তু এর দ্বারা যারা তাদের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের উপস্থাপন ঘটবে। ফলে যারা সত্য প্রচারে বিরোধিতা ও অসম্মান করেছিলো তাদের দায়িত্ব ও অপরাধ উপলব্ধিতে সাহায্য করবে। সত্যের বাণী প্রচারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নবী ও রসুলদের কিন্তু তাঁদের পরেও যাদের মাঝে আল্লাহ্র তত্বজ্ঞান বিকাশ লাভ করেছে তাদের উপরেও এই মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়।
রুকু - ২
৩৬৭৯। এই আয়াতের মাধ্যমে পঞ্চম হিজরীতে মদিনা অবরোধের সংগ্রামের শুরু এবং শেষ কে সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দুষ্কর্মে সহযোগীদের মৈত্রীবদ্ধ সংঘ একযোগে ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়, যার কথা ভূমিকাতে বলা হয়েছে। তাঁদের সৈন্যসংখ্যা ছিলো দশ থেকে বার হাজারের মত। এরূপ বিশাল সেনা বাহিনী সে যুগের জন্য ছিলো নজিরবিহীন ঘটনা। এই যুদ্ধ পরিখার যুদ্ধ নামে খ্যাত।
৩৬৮০। পরিখার যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ্ বিশ্ববাসীর নিকট তাঁর শক্তিকে উন্মোচন করেছেন। যারা সত্যের জন্য সংগ্রামী এবং আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল, আল্লাহ্ তাঁদের প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করে থাকেন। ঘটনাটি ছিলো এরূপ : বিরোধী দলের মৈত্রীরা যারা মদিনা অবরোধ করতে এসেছিলো তাঁরা ২ -৪ সপ্তাহ মদিনা অবরোধ করে রাখে। যারা সহজ বিজয়ের আশায় এসেছিলো এরূপ অকৃতকার্যতায় তারা হতাশ হয়ে পড়লো। সময়টা ছিলো ফেব্রুয়ারী মাস। মদিনাতে ফেব্রুয়ারী মাসে হাঁড় কাপানো শীতের আগমন ঘটে থাকে, কারণ মদিনা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফিট উচ্চে অবস্থিত।
একে তো যুদ্ধে জয়ী না হওয়ার জন্য হতাশা , তদুপরি হাঁড় কাপানো ঠান্ডা এর উপরে শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়। বাতাসের বেগে তাদের তাবু ছিড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় , আগুন নিভে যায় এবং বৃষ্টির ঠান্ডা ফোঁটা এবং বালি প্রচন্ড বেগে তাদের চোখে মুখে সূচের মত বিধঁতে থাকে। এসবই তাদের কাছে অশুভ লক্ষণ বলে প্রতিভাত হতে থাকে, তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে প্রকৃতির এই বৈরিতায়। ফলে তারা মানসিক দিক থেকে ভেঙ্গে পড়ে এবং রণে ভঙ্গ দিয়ে প্রস্থান করে। অপর পক্ষে মদিনাবাসীদের সৈন্যসংখ্যা ছিলো মাত্র ৩০০০ এর মত। তার উপরে ইহুদীদের বানু কুরাইজা গোত্র মদিনার অভ্যন্তরে থেকে ক্রমাগত মূসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে এবং মদিনার মোনাফেকেরা তাদের সাথে যুক্ত হয়। দেখুন টিকা ৩৬৬৬। এ সব হচ্ছে মুসমানদের মদিনার অভ্যন্তরের বিরুদ্ধ শক্তি। কিন্তু মুসলমানদের জন্য অদৃশ্য শক্তি কাজ করে - আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র সাহায্য। আল্লাহ্র হুকুমে প্রকৃতি তাদের হয়ে কাজ করে এবং ফেরেশতারা অদৃশ্যভাবে মুসলমানদের হয়ে কোরেশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
উপদেশ : সত্যের জন্য সংগ্রামে আল্লাহ্র সাহায্য অবধারিত। যারা ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম করে তারা কখনও একা নয়। স্বয়ং আল্লাহ্ তাদের রক্ষাকর্তা।
৩৬৮১। আল্লাহ্ সকল কিছুই দেখেন ও জানেন তিনি সম্যক দ্রষ্টা। মূসলমানদের নৈতিক মনোবল, বিপদের মাঝেও ঠান্ডা মাথায় শৃঙ্খলা রক্ষা করা , অপরপক্ষে শত্রু পক্ষের নিজেদের মাঝে বিশ্বাসহীনতা, দুর্বল মনোবল, ষড়যন্ত্র, এবং স্বর্গীয় শক্তি ব্যতীত শুধুমাত্র পশুশক্তির প্রয়োগ, এ সব কিছুই হচ্ছে আল্লাহ্র অদৃশ্য শক্তির প্রয়োগ যা যুদ্ধের গতিকে ফিরিয়ে দেয়। এ সব ঘটনাতে বহু ধরণের অদৃশ্য শক্তি কাজ করে এবং যুদ্ধ জয়ে সাহায্য করে থাকে। কোনও পক্ষই তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করত সক্ষম হয় না।
উপদেশ : আমাদের উপলব্ধির জগতের বাইরেও আল্লাহ্র শক্তি কার্যকর। সুতারাং সাফল্যে কখনও অহংকারে স্ফীত হওয়া উচিত নয়, বরং কৃতজ্ঞ অন্তরে আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা প্রয়োজন। কারণ তাঁরই অদৃশ্য সাহায্য সকল সাফল্যের মূল।
৩৬৮২। কোরাণ শরীফের এই আয়াতে যুদ্ধে নিয়োজিত মুসলমান সৈনিকের মানসিক অবস্থাকে সংক্ষেপে কিন্তু তুলনাহীনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শত্রুদের আক্রমণ ছিলো প্রচন্ড। পরিখাটি ছিলো আক্রমণাত্মক শত্রুসেনা ও মূসলমানদের মধ্যবর্তী স্থানে, শত্রুদের পিছনে ছিলো উচ্চ ভূমি যাতে মনে হচ্ছিলো যে তারা উচ্চ ভূমি থেকে আগত হচেছ। যখন তারা উপত্যকা অতিক্রম করছিলো বা পরিখা অতিক্রম করার চেষ্টা করছিলো তখন প্রতিভাত হয় যে, তারা নিম্ন অঞ্চল থেকে উপরে উঠে আসছে। অবশ্যই দুপক্ষ থেকে বৃষ্টির ন্যায় অবিরল ধারাতে তীর এবং পাথর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। যুদ্ধ ক্ষেত্রের এই বর্ণনা এবং মুসলমানদের মানসিক অবস্থার বর্ণনা সংক্ষিপ্ত কিন্তু অতুলনীয়।
১২। এবং স্মরণ কর ! মুনাফেক ও যাদের অন্তরে ছিলো ব্যাধি তারা বলেছিলো, " আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা প্রবঞ্চনা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। " ৩৬৮৩।
৩৬৮৩। কোরেশদের মদিনা আক্রমণের পূর্বে মুসলমানেরা উত্তরে সিরিয়ার সীমানা পর্যন্ত সাফল্যজনকভাবে উপণীত হয় এবং আশা প্রকাশ করা হয় যে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হবে। পূণ্যাত্মা রসুল [সা ] অন্তর্দৃষ্টিতে মুসলমানদের এসব বিজয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু অবস্থা এই দাঁড়ালো যে বিজয়ের পরিবর্তে মুসলমানের পরিখার মাঝে অবরুদ্ধ থাকতে হচ্ছে। এইরূপ অবস্থা যখন বিরাজমান ,সে সময়ে মোনাফেকরা বিদ্রূপ করে এই বলে যে নবীর প্রতিশ্রুতি প্রতারণা ব্যতীত কিছুই না। কিন্তু সময় ও ঘটনা পরবর্তীতে প্রমাণ করে যে, এগুলি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছিলো না। পরবর্তী কয়েক বছরে মুসলমানদের প্রাপ্তি তাদের আশা আকাঙ্খাকে অতিক্রম করে যায়।
৩৬৮৪। যুদ্ধে অংশগ্রহণে সক্ষম সকল মদিনাবাসীরা শহরের বাইরে এসে নগরী এবং পরিখার মধ্যবর্তী স্থানে তাবু স্থাপন করে। পরিখাটি খনন করা হয়েছিলো মদিনার চতুপার্শ্বে বেষ্টন করে। যদিও মদিনা ছিলো সুরক্ষিত। তবুও মোনাফেকেরা পরাজিত হওয়ার গুজব রটনা করে এবং ভান করে যে, তারা তাদের বাড়ীঘর রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তন করতে আগ্রহী। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে তাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত বা আক্রান্ত ছিলো না। সদা সর্বদা সর্তক প্রহরীরা পালাক্রমে পরিখার অভ্যন্তরে পাহারা দিতেছিলো। বাড়ী ঘর রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করার আগ্রহ প্রকাশ ছিলো মোনাফেকদের এক কৌশল মাত্র।
৩৬৮৫। যুদ্ধের আসল ধাক্কা ছিলো নগরীর উত্তর প্রান্তে। কিন্তু সম্পূর্ণ পরিখাকে প্রহরী দ্বারা সুরক্ষিত করে রাখা হয়। দুই এক স্থানে শত্রুপক্ষ মুসলমানদের বুহ্য ভেদ করে নগরীতে ঢোকার চেষ্টা করে , কিন্তু তাদের প্রতিহত করা হয়। হযরত আলী বহু যুদ্ধে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেন। আল্লাহ্র নবীর বর্ম ও তরবারী নিয়ে হযরত আলী এই যুদ্ধে অবতরণ করেন। সিংহের ন্যায় তিনি নগরীকে রক্ষা করেন, এই আয়াতে মোনাফেকদের ; অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও তারা পরিখা অবরোধের দ্বারা কোনও রূপ ক্ষতিগ্রস্থ হয় নাই, তবুও শত্রুরা যদি মুসলমানদের বুহ্য ভেদ করে নগরীতে ঢুকতে সক্ষম হতো , তবে তারাই হতো প্রথম ব্যক্তি যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাত অস্ত্র ধারণ করতো। এমন কি বর্ম পরিধান করতে যেটুকু সময়ের প্রয়োজন, সেটুকুও তারা নষ্ট করতো না।
৩৬৮৬। ওহদের যুদ্ধের সময়ে যারা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছিলো , যুদ্ধের পরে তাদের শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমা করা হয়। তারা প্রতিজ্ঞা করে যে পরবর্তীতে তার অবশ্যই ভালো কাজ প্রদর্শন করবে। তাদের এই প্রতিজ্ঞা ছিলো আল্লাহ্র নবীর সাথে , যা আল্লাহ্র সাথে প্রতিজ্ঞার নামান্তর। এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা শাস্তি ব্যতিরেকে অব্যহতি পাওয়া সম্ভব নয়।
৩৬৮৭। কাপুরুষতা কখনও মৃত্যুকে প্রতিহত বা এড়াতে পারে না। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়নের ফলে সে মিত্র ও শত্রু উভয়েরই রোষের পাত্রে পরিণতত হয়। মিত্ররা তার উপরে হয় ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত , শত্রুরা তাকে বিশ্বাস করে না। যদি সে মনে করে যে, কাপুরুষতা ও পলায়ন তাকে মৃত্যু থেকে রেহাই দেবে, তবে সে মহা মূর্খ। কারণ মৃত্যুকে কেহই এড়াতে পারে না। বরং তার জীবনে কাপুরুষতার উপাধি স্থায়ীভাবে আসন লাভ করে এবং সে স্বজনদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। কাপুরুষের জীবনের পরিণতি হচ্ছে কলঙ্ক। জীবনে সে কলঙ্ক মোচন করা অসাধ্য।
৩৬৮৮। এই আয়াতগুলিতে পরিখার যুদ্ধের বর্ণনার মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম হচ্ছে ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম। যে ন্যায় ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, তাঁর পুরষ্কার আল্লাহ্র কাছে রক্ষিত। আর যে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম থেকে পলায়ন করে সেকি আল্লাহ্র শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে ? ঠিক সেই ভাবে অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভ করা যায় যা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা সম্ভব নয়। মানুষ মাত্রেই দুর্বল। যদি কেউ বিপথে পরিচালিত হয় তবে অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভের পথ তার জন্য উন্মুক্ত। দেখুন পরবর্তী আয়াত [ ৩৩ : ২৪ ] ও টিকা ৩৬৯৮।
১৯। তোমাদের সাথে [ গণীমতের ভাগের ] লোভের বশবর্তী হয়ে ৩৬৮৯। তারপরে যখন ভয় আসে, তুমি তাদের দেখবে , মৃত্যুর ভয়ে মুর্চ্ছাতুর ব্যক্তির ন্যায় চক্ষু উল্টিয়ে তোমার দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু যখন ভীতি দুর হয়ে যাবে, তারা [গনিমতের ] ধনের লোভে তোমাদের তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করবে ৩৬৯০। এসব লোকের কোন ঈমান নাই , এবং সে কারণে আল্লাহ্ তাদের কর্ম নিষ্ফল করেছেন ৩৬৯১। এবং আল্লাহ্র জন্য তা সহজ ৩৬৯২।
৩৬৮৯। "Ashihhatan" অর্থ লোলুপ, আকড়াইয়া ধরার জন্য ব্যগ্র, কৃপণ। এখানের অর্থ দ্বিবিধ।
১) মোনাফেকেরা যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে তোমাদের তুলনায়; তারা মুসলিম বাহিনীর সাহায্য করার ব্যাপারে কৃপণতা প্রকাশ করে; তারা তাদের উদ্যম, ব্যক্তিগত উদ্যম, বা অর্থ সম্পদ খরচের ব্যাপারে কৃপণ। এবং
২) মোনাফেকরা অর্থলোলুপ -যুদ্ধে লুটের মাল হস্তগত করার ব্যাপারে তারা আগ্রহী তবে যুদ্ধ করার ব্যাপারে নয়।
৩৬৯০। এ সব মোনাফেকদের বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, এরা আরাম আয়েসের জীবন ত্যাগ করে যুদ্ধের বা সংগ্রামের মাঝে কখনও যাবে না বরং যুদ্ধের মাঝে সংগ্রামের পরিবর্তে তারা ব্যাকুলভাবে রসুলের [ সা ] মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, রক্ষা পাওয়ার আশায়। কিন্তু যেই বিপদ তিরোহিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে তাদের আস্ফালন ,দম্ভ, লাফালাফি ও ঝগড়া করার প্রবণতা ফিরে আসে এবং ধন-সম্পদের প্রতি তীব্র লোলুপতা প্রকাশ করে।
উপদেশ : মোনাফেকদের চরিত্রের এই বহিঃপ্রকাশ সে যুগের জন্য যেমন প্রযোজ্য ছিলো ; আজও তা সমভাবে প্রযোজ্য এ হচ্ছে সর্বযুগে মোনাফেকদের চরিত্রের সাধারণ ধর্ম।
৩৬৯১। মোনাফেকদের সকল র্কম নিষ্ফল। এমন কি তাদের কোনও ভালো কাজও আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তাদের ভালো কাজের নিয়ত ভালো হয় না। তাদের কাজের নিয়ত হয় হিংসা, দ্বেষ, লোভ-লালসা এবং এরা আচরণে হয় কাপুরুষ। আল্লাহ্র কাছে কাজের সাফল্য বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে কাজের নিয়ত। যে কাজ নিঃস্বার্থ ভাবে শুধু মাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত - তাই-ই আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য। মোনাফেকদের কার্যে তা অনুপস্থিত। এ কারণেই আল্লাহ্ তাদের কার্যাবলী "নিষ্ফল করেন।" মহাকালের বিশাল পটভূমিতে কাজের সাফল্য হারিয়ে যায়, কিন্তু কাজের নিয়ত মহাকালের খাতায় লেখা থাকে।
৩৬৯২। মোনাফেকদের কার্যের নিয়ত বা উদ্দেশ্য কখনও সৎ ও নির্মল হয় না। তাই তাদের কাজ আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না। মানুষের পক্ষে মনের অভ্যন্তরের নিয়ত অনুসন্ধান করা অসাধ্য কাজ। কিন্তু আল্লাহ্র জন্য তা অত্যন্ত সহজ। কারণ অন্তরের মোনাফেকী ,ও মিথ্যা লোক দেখানো কাজ ও প্রতারণা - মনের সকল ভাবই আল্লাহ্র নিকট দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট।
৩৬৯৩। মোনাফেকদের চরিত্রের এবং মানসিকতার বর্ণনা শুরু হয়েছে ১২নং আয়াত থেকে। আসুন আমরা তা বিশ্লেষণ করি।
১) মোনাফেকরা হয় সুবিধাবাদী , সুতারাং যুদ্ধের রণদামামা তাদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে , কারণ তাদের মধ্যে পরাজয়ের মানসিকতা কাজ করছিলো [ ১২ নং আয়াত ]
২) তারা হয় অবিশ্বস্ত ও আনুগত্যহীন। তারা তাদের আনুগত্যহীনতায় সন্তুষ্ট এবং তারা তা অন্যের অন্তরে সংক্রামিত করতে প্রয়াস পায়। [ ১৩ নং আয়াত ]।
৩) যদি শত্রুরা নগরীতে প্রবেশ লাভ করতো তবে মোনাফেকরা সর্বপ্রথম বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুদের সাথে যোগদান করতো। [ ১৪ নং আয়াত ]।
৪) তারা বিশ্বস্ততার যে অংগীকার পূর্বে করেছিলো তা ভুলে যায়। তাদের নিকট অংগীকার বা বিশ্বস্ততার কোন মূল্য নাই। [ ১৫ নং আয়াত ]।
৫) তাদের হিসাব নিকাশ সবই বিষয় বুদ্ধি সম্পন্ন অত্যন্ত তুচ্ছ ও নগন্য। তাদের এই তুচ্ছ হিসেব নিকেশে তারা অনুধাবনে অসমর্থ যে যুদ্ধে পলায়ন ও কাপুরুষতা প্রদর্শন কখনও ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। [১৬ - ১৭ ] নং আয়াত ]।
৬। মোনাফেকরা প্রকৃত সংগ্রামে অংশ গ্রহণে বিরত থাকে ; বরং তারা সহজ ও মধুর কথা ও উপদেশ বিতরণে আগ্রহী এবং বিপদ বা যুদ্ধ শেষে সাফল্য ও যুদ্ধ জয়ের লভ্যাংশ লাভের পুরোধায় অংশ গ্রহণে আগ্রহী। [ ১৮- ১৯ নং আয়াত ]।
৭। এরা এত ভীতু ও কাপুরুষ হয় যে, যুদ্ধ শেষে শত্রুরা চলে যাওয়ার পরও তারা শত্রুদের প্রত্যাবর্তনের ভয়ে প্রকম্পিত হতে থাকে এবং তখন তারা কি করবে সেই কল্পনায় আত্মনিয়োগ করে। তাদের চিন্তায় স্থান পায় যে, তারা মরুভূমিতে বেদুঈনদের সাথে অবস্থান করবে বা নিরাপদ দূরত্বে থেকে মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি অবম্বলন করবে। যদি মদিনা শত্রুদের অধিকারে চলে যায়, তবে তারা মদিনাবসীদের মাঝে থাকলেও খুব সামান্যই যুদ্ধ করতো। [ ২০ নং আয়াত ]।
[ ১২ - ২০ ] নং আয়াত সমূহে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ও অশুভ তৎপরতার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তবে এ বর্ণনার ভাষা সার্বজনীন যুগকাল অতিক্রান্ত। মোনাফেকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সে যুগের যা ছিলো , আজও তা সমভাবে বিদ্যমান। মদিনাবাসীদের মধ্যে এরূপ মোনাফেকদের অবস্থান সত্বেও রসুল [সা ] ও তাঁর অনুসারীরা অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেন এটা একটা অলৌকিক কর্মকান্ড বটে। আল্লাহ্ যাকে সাহায্য করেন তার জয় অবধারিত। রসুলের জীবনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছেন।
৩৬৯৪। এতক্ষণ মোনাফেকদের মানসিকতা বর্ণনা করা হয়েছে , এবারে মোমেন ব্যক্তিদের মানসিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্ ও আখিরাতের ভয় করে, রসুলের [ সা ] জীবন তাদের জন্য অনুসরণীয়।
৩৬৯৫। দেখুন [ ২৬ : ২২৭ ] আয়াত। বিশেষভাবে এই মক্কান সূরার উপবাক্য "And defend themselves after ..................................... their affairs will take" যা আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি তা মদিনাতে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
৩৬৯৬। বিশ্বাসীদের এই উক্তি ১২ নং আয়াতে বর্ণিত মোনাফেকদের উক্তির বিপরীত। স্বর্গীয় সাহায্যের আশ্বাস ও সফলতা কোন আকস্মিক ঘটনা বা অলৌকিক কর্মকান্ড নয়। আল্লাহ্ বলেছেন যে, তা হবে বিশ্বাস বা ঈমান এবং আন্তরিক চেষ্টার সাথে সম্পর্কযুক্ত বা শর্ত সাপেক্ষে। বিপদ এবং পাপী ও মোশরেকদের সাথে সংঘর্ষের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে এবং উপদেশ দান করা হয়েছে তা বীরত্বের সাথে ও সাহসের সাথে মোকাবিলার জন্য
৩৬৯৭। সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে যারা অংশীদার , তাঁরা তাঁদের অর্থ সম্পদ , মেধা মননশক্তি, জ্ঞান , সহায় সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি এমন কি জীবন দান করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। তারা সত্যের জন্য, ন্যায়ের সংগ্রামে কখনও বিচলিত বা প্রকম্পিত হন না। যদি তারা মৃত্যু বরণ করেন তবে তা তাদের জন্য শাহাদাতের সম্মান বহন করে আনে। সাদ্-ইবনে- মু'আজ ; যিনি অউস গোত্রের প্রধান ছিলেন, পরিখার যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করে বিশ্বমানবের মাঝে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন ইসলামের একজন নির্ভিক সৈনিক। তিনি পরিখার যুদ্ধে আহত হন এবং পরে মৃত্যু বরণ করেন। সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামীরা হয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন অথবা সংগ্রামের জন্য তারা সদা সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকেন। উভয় দল সত্য ও ন্যায়ের সমর্থনে অবিচল, শঙ্কাহীন, নির্ভয়। তারা কখনও বিচলিত হন না। সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামীদের বৈশিষ্ট্যকে এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে।
৩৬৯৮। আল্লাহ্র করুণার হস্ত পাপী ও অপরাধী সকলের জন্য সর্বদা প্রসারিত। যে কেহ অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের চেষ্টা দ্বারা আল্লাহ্র ক্ষমা লাভের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এমন কি বিশ্বাসঘাতক ও দুষ্কিতিকারী অপরাধীও এই যোগ্যতা লাভে সক্ষম। কিন্তু আল্লাহ্র ক্ষমা আল্লাহ্র পরিকল্পনা ও ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে। আল্লাহ্ অনুতাপকারীর আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, এবং ভালো হওয়ার ক্ষমতাকে বিচার করবেন। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৩৩ : ১৭ ]।
৩৬৯৯। মক্কাবাসী, মধ্য আরবের বেদুঈন, অতৃপ্ত ইহুদী এবং মদিনার বিশ্বাসঘাতক ইহুদীদের মিলিত শক্তি প্রবল আক্রোশে মদিনা অবরোধ করে। কিন্তু তাদের এই মিলিত শক্তিও মদিনা জয়ে অসমর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তাদের অন্ধ আক্রোশ তাদের সাফল্য লাভে সহায়তা হয় নাই। তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। কারণ মুমিনদের জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট। এরপর থেকে শুরু হয় ইসলামের বিজয়।
৩৭০০। "Aziz" শব্দটির অর্থের জন্য দেখুন টিকা ২৮১৮ ও আয়াত [ ২২ : ৪০ ]।
৩৭০১। এই আয়াতে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে তারা ইহুদীদের 'বানু কোরাইজা' গোত্র। এরা ছিলো মদিনার অধিবাসী এবং নাগরিক হিসেবে তারা মদিনাবাসীদের সাথে নগরীর নিরাপত্তার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলো। কিন্তু পরিখার যুদ্ধে যখন নগরীর নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত হলো, তখন তারা মুসলমানদের সাহায্যের পরিবর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং কোরাইশদের মিত্র শক্তির সাথে লিপ্ত হয়, যাতে শত্রুপক্ষ সহজে মদিনা দখল করতে পারে। কিন্তু শত্রুদের মিলিত শক্তিও মদিনা দখলে সমর্থ হয় নাই এবং শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত শত্রুরা মদিনার অবরোধ ত্যাগ করে দ্রুত ফিরে যায়। অবরোধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে রসুলুল্লাহ্ [সা] এই বিশ্বাসঘাতক ইহুদী গোত্রের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন - যারা ঘোর বিপদের দিনে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো।
৩৭০২। মদিনা অবরোধ শেষে বানু কোরাইজা গোত্র ভয়ে এবং হতাশায় নিমজ্জিত হয়, - কারণ তারা তাদের বিশ্বাসঘাতক কর্মকান্ডের জন্য শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মদিনা থেকে ৩/৪ মাইল পূর্বে [ বা উত্তর পূর্বে ] অবস্থিত দুর্গে তারা পলায়ন করে এবং নিজেদের অবরুদ্ধ করে রাখে। মুসলমানরা দুর্গকে অবরোধ করে রাখে। এই অবরুদ্ধ অবস্থায় ইহুদীরা ২৫ দিন পর্যন্ত থাকে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পন করে এই শর্তে যে, আউস গোত্র প্রধান সা'দ -ইবনে- মুয়াজেরের বিচার ও রায়কে তারা মেনে নেবে। সা'দ -ইব্নে- মুয়াজের গোত্রের সাথে বানু কোরাইশ গোত্র মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো।
৩৭০৩। সা'দ ইব্নে মুয়াজ , বানু কোরাইজা গোত্রের জন্য ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। [ Deut xx. 10 – 18 ] বর্ণিত আছে সেই নগরীর কথা যা "Which is very far off from thee" যার জন্য এরূপ ক্ষেত্রে কম শাস্তির ব্যবস্থা প্রযোজ্য। অপর পক্ষে "Of those people, which the lord thy God does give thee for an inheritance" অর্থাৎ যে নগরী এত নিকটে যা ইহুদী ধর্মকে কলুষিত করতে পারে তাদের জন্য বর্ণিত শাস্তি হচ্ছে সম্পূর্ণ ধবংস, "Thou Shalt save nothing that breatheth" [ Deut . xx : 16 ] দূরবর্তী নগরীর জন্য কম শাস্তির ব্যবস্থার বিবরণ আছে পরবর্তী টিকাতে। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থের বিধান অনুযায়ী বানু কোরাইজা গোত্রের সকল পুরুষ , নারী , শিশু , সকলকেই হত্যা করা উচিত - কারণ তারা মদিনার সীমানার মধ্যে বসবাস করতো এবং তারা ঘোর বিপদের দিনে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। তারা মুসলমানদের সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে।
৩৭০৪। যদিও ইহুদীদের অবস্থান ছিলো মদিনার অভ্যন্তরে,কিন্তু সা'দ তাদের দূরবর্তী নগরীর জন্য প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করেন। ইহুদী ধর্ম গ্রন্থ অনুযায়ী দূরবর্তী নগরীর অধিবাসীদের প্রাপ্য শাস্তি হচ্ছে , Thou shalt smite every male there of with the edge of the sword : but the women and the little ones, and the cattle, and all that is in the city, even all the spoil there of , shalt thou take unto thyself, and thou shalt eat the spoil of thine enemies, which the lord thy God hath given theee [ Deut . xx. 13 – 14 ] . ইহুদী ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী কুরাইজা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করা হয়, নারীদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে বিক্রী করা হয়, এবং তাদের ভূমি এবং সম্পত্তি মোহাজেরদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
৩৭০৫। " এমন দেশের যাতে তোমরা পূর্বে কখনও যাতায়াত কর নাই।" আয়াতটির এই অংশ হচ্ছে ভবিষ্যদ্বাণী। এই অংশে খাইবারের বিজয় সম্বন্ধে ইঙ্গিত করা হয়েছে। খাইবার হচ্ছে আগ্নেয়গিরির উপত্যকা। এই অঞ্চল আগ্নেয় শিলার অভ্যন্তর থেকে নির্গত বহু প্রস্রবন দ্বারা বিধৌত। ভালো জলসেচন পদ্ধতির ফলে এই অঞ্চল উর্বর উপত্যকাতে রূপান্তরিত হয়। এখানে প্রচুর শষ্য ও ফলমূল উৎপন্ন হয়। এই শষ্য শ্যামল উচ্চ ভূমিতে বহু দূর্গ নির্মিত হয় এবং তা ইহুদীদের জন্য এক বিশাল নিরাপদ ঘাটিরূপে বিবেচিত হয়। রসুলুল্লাহ্র [সা ] সময়ে যে ইহুদী সম্প্রদায় এখানে বাস করতো, পরিখার যুদ্ধ শেষে তারা মুসলমানদের জন্য অবিরাম অস্থিরতা, শত্রুতা ও সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই স্থান তখন শত্রুভাবাপন্ন ইহুদীদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে যে সব ইহুদীরা তাদের বিশ্বাসঘাতক আচরণের জন্য বিতাড়িত হতে থাকে, তারা এখানে এসে আশ্রয় লাভ করে এবং নিজেদের জন্য শক্ত ঘাটি প্রস্তুত করে। এই স্থানের রাজধানী ছিলো 'খাইবার '। এর অবস্থান ছিলো মদিনা থেকে ৯০ মাইল উত্তরে। মদিনার মুসলমানদের জন্য এই স্থান বিপদসঙ্কুল হয়ে দাঁড়ায় যার ফলে ইসলামের নির্ভিক সেনা শৈর্যের প্রতীক হযরত আলী, যদিও তিনি সবেমাত্র অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করেন, এই স্থান জয় করেন। আত্মসমর্পনের পরে এই স্থানের ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে উপনিবেশ গড়ে তোলা হয়। কৃষকদের অধীনে তাদের নিজ ভূমিকে প্রত্যার্পন করা হয়, কিন্তু তাদের মুসলমানদের অধীনে রাখা হয় যেনো ভবিষ্যতে তারা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে কোনও শত্রুতা করতে না পারে।
৩৭০৬ এখান থেকে শুরু হয়েছে রসুলুল্লাহ্র [সা] পূণ্যবতী স্ত্রীদের বিষয়বস্তু [ Azwaj mutahharat ]। সমাজে তাদের অবস্থান আর দশজন স্ত্রীলোকদের মত ছিলো না। আল্লাহ্ তাঁদের জন্য বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত করেন। রসুলের [ সা ] জীবনের সর্বপেক্ষা আনন্দময় ও সুখী দাম্পত্য জীবন ছিলো বিবি খাদিজার সাথে পরিণয়। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ২৫ বৎসর স্থায়ী হয়। তাঁদের পরস্পরের প্রতি আনুগত্য ছিলো স্বর্গীয়। আধ্যাত্মিক ও সামাজিক দিক থেকেও তা ছিলো অতুলনীয়। বিবি খাদিজা জীবিত অবস্থায় নবীজি অন্য কোনও স্ত্রী গ্রহণ করেন নাই। যা কি না তার সমসাময়িক সামাজিক অবস্থায় এক বিশেষ ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত। যখন বিবি খাদিজা পরলোকে গমন করেন, রসুলের [সা ] বয়স ছিলো ৫০ বৎসর। হয়তো বা রসুল [সা] জীবনে আর বিবাহ-ই করতেন না কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সংযমী পুরুষ, কিন্তু শুধুমাত্র দ্বিবিধ কারণে তিনি পুণঃবিবাহ করেন।
১) অসহায় দুঃখী বিধবাদের পুণঃর্বাসনের এক জলন্ত উদাহরণ স্থাপনের জন্য তিনি তা করেন। এসব বিধবারা নিজেদের এবং তাদের সন্তানদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে অক্ষম ছিলো। যেমন 'সউদা' সন্তানসহ বিধবা হয় এবং সন্তানের লালন পালনের জন্য তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো।
২) রসুলের [সা ] দায়িত্ব ও কর্তব্য কর্মে সাহায্য সহযোগীতার জন্য। ইসলাম পুরুষ ও নারীর যুগল জীবনে বিশ্বাসী। নারীরও পুরুষের ন্যায় সামাজিক জীবনে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সে হিসেবে রসুলের [সা] স্ত্রীদের ভূমিকা চিরজীবন বিশ্ব মুসলিম নারীদের জন্য অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকা প্রয়োজন। এখানে রসুলের [সা] স্ত্রীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তা শুধুমাত্র স্বামী সেবার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। সমাজের বিভিন্ন কর্মকান্ডে তাঁরা ভূমিকা রেখে গেছেন। হযরত আবু বকরের কন্যা হযরত আয়েশা ছিলেন বুদ্ধিমতী এবং বিদ্বান। হাদিসের তিনি ছিলেন একজন প্রধান প্রবক্তা। হযরত খুজাইসার কন্যা বিবি জয়নাব গরীব দুঃখীদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন, তাঁকে "গরীবের মাতা " উপাধি দান করা হয়। অন্য আর এক জয়নাব ছিলেন হযরত জাহসের কন্যা। তিনিও গরীবের দুঃখ মোচনের জন্য কাজ করতেন। শারীরিক পরিশ্রম দ্বারা তিনি এই কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন। তিনি চামড়া শিল্পে একজন দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে নবীজির স্ত্রীগণের সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত সম্মানীয় হওয়া সত্বেও শারীরিক পরিশ্রম থেকে রেহাই দেয়া হয় নাই। মুসলিম উম্মতের মাতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। অলসতা বা বিলাসী জীবনযাত্রা তাদের জন্য ছিলো না। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য বা কাজে সাহায্যের জন্য কোনও দাসী বাদী ছিলো না। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, যদি তারা শুধুমাত্র পার্থিব আরাম আয়েশ ও চাকচিক্য কামনা করে, তবে রসুলের [সা ] পবিত্র গৃহে তাদের স্থান নাই। যদি তারা তাই-ই করে তবে তারা তালাক গ্রহণ করতে পারে এবং আল্লাহ্ তাদের জন্য ব্যবস্থা করবেন। খায়বরের যুদ্ধ জয়ের পরে রসুলুল্লাহ্ [সা ] এর স্ত্রীগণ তাঁদের ভরণপোষণের জন্য কিছু অধিক অর্থ বরাদ্দের অনুরোধ করেন। এই আয়াতগুলিতে সেই ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।
৩৭০৭। রসুলের [সা ] স্ত্রীগণ সকলেই পূণ্যবতী ছিলেন। কিন্তু সমাজে তাদের বিশেষ সম্মানীয় স্থানের জন্য তাদের উপরে মুসলিম উম্মতের মাতা হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব অর্পন করা হয় , এবং তা সম্পাদনের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যারা তা করবেন তাঁদের জন্য আল্লাহ্ মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। কর্ম যত মহৎ হবে আত্মিক তৃপ্তি হবে তত তীব্র এবং স্থায়ী। যদিও তাদের প্রতিদিনের জীবনের জাগতিক আরাম আয়েশের কোনও স্থান বা ব্যবস্থা ছিলো না , কিন্তু আল্লাহ্র তাদের জন্য ইহকালে আধ্যাত্মিক তৃপ্তি এবং পরলোকে সুউচ্চ সম্মানের প্রতিশ্রুতি দান করেছেন।
এ সব আয়াত থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র রসুলের [সা ] স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্যের গুণেই তারা আল্লাহ্র পুরষ্কারের যোগ্য হবেন না। বা শুধু মাত্র স্বামী এবং সংসারের সেবাতে নিজেকে নিয়োজিত করেই আল্লাহ্র পুরষ্কারের যোগ্যতা অর্জন করবেন না। তাঁদের হতে হবে সামাজিক ক্রিয়া কর্মে সক্রিয় এবং সৎকর্মশীল। তবেই তারা আল্লাহ্র পুরষ্কারের যোগ্যতা অর্জন করবেন। এখানে লক্ষণীয় যে, রসুলের [ সা ] স্ত্রীগণের দায়িত্ব কর্তব্য নির্দ্দেশের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম নারীর দায়িত্ব কর্তব্যের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আজ মুসলিম নারীরা যে শুধুমাত্র স্বামী ও সংসারের মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে - তা অবশ্যই আল্লাহ্র বিধান নয়। রসুলের [সা ] স্ত্রীগণের সামাজিক ভূমিকা ও এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ বহিঃবিশ্বে মুসলিম নারীর ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত দান করেছেন।
৩৭০৮। "স্পষ্টত অশ্লীল " - এখানে স্পষ্টতঃ শব্দটি দ্বারা বলা হয়েছে সেই সব কাজ যা কিছু আচরণগত ভাবে নিন্দনীয়। মিথ্যা কলঙ্ক এর মধ্যে অন্তর্গত নয়। এই বাক্যটি দ্বারা মিথ্যা কলঙ্ক ও নিন্দাকে উপেক্ষা করার দিকে ইঙ্গিত দান করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেহ যদি প্রকৃত পক্ষে নিন্দনীয় কাজ করে থাকেন সাধারণ নারীদের অপেক্ষা তা হবে অধিক নিন্দনীয়। কারণ তাঁরা হচ্ছেন বিশ্ব -নারীকূলের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁদের আল্লাহ্ সমাজে বিশেষ সম্মানীয় স্থান দান করেছেন , রসুলের [সা ] স্ত্রী হিসেবে যা যুগ কাল অতিক্রান্ত। যুগে যুগে সমগ্র মুসলিম সমাজের অন্তরে যাদের স্থান হবে অম্লান। অবশ্য তাঁরা সকলেই তা রাখতে সক্ষম ছিলেন।
৩৭০৯। দেখুন আয়াত [ ৩৩ : ১৯ ] এবং টিকা ৩৬৯২। বিবাহিত মেয়েদের অসতী হওয়া গর্হিত অপরাধ এবং পৃথিবীতে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি : অবিবাহিত অবস্থায় যৌন আচরণের জন্য শাস্তি হচ্ছে প্রকাশ্যে ১০০ বেত্রাঘাত [ ২৪ : ২ ] ; অথবা সমকামিতার জন্য অন্তরীণ আবদ্ধ [ ৪ : ১৫ ] ; অথবা ব্যভিচারের জন্য প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যু , অবশ্য এই শাস্তিটি কোরাণ শরীফের কোথাও উল্লেখ নাই , তবে বাইবেলে বর্ণিত এই আইনটি ইসলামের প্রথম যুগেও প্রয়োগ করা হতো। যেহেতু এই আয়াতটি রসুলের [ সা ] পত্নীদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ , সুতারাং এরূপ জঘন্য অশ্লীল পাপের কথা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে যেহেতু তাঁরা সমস্ত মুসলিম রমণীদের অনুকরণীয় এবং তাদের বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়, এবং তাদের প্রতি মুসলিম উম্মার মাতা হিসেবে বিশেষ কর্তব্য অর্পিত ; সুতারাং সামান্য ভুল ভ্রান্তিও তাদের জন্য নিন্দনীয়। শুধু ইহজগতেই নয় তাদের জন্য পরলোকের শাস্তিও দ্বিগুণ করা হবে।
দ্বাবিংশতি পারা
৩৭১০। 'দুইবার' অর্থাৎ তাঁদের সৎকর্যের জন্য তারা দুবার পুরষ্কৃত হবেন। একবার পূণ্যবতী রমণী হিসেবে এবং পুণরায় মুসলমান উম্মার মাতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য। এভাবেই তাঁরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে।
৩৭১১। 'রিয্ক ' - এই শব্দটি ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত। জীবনের সুখ ও স্বাচছন্দের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই আল্লাহ্র দেয়া রিয্ক। রিয্ক অর্থ শুধুমাত্র আহার্য বোঝায় না।
৩৭১২। "হে নবী পত্নীগণ ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও " - এই লাইনটি সব আয়াতগুলির সারমর্ম। নবী পত্নীরা অন্য সাধারণ রমণীদের মত নন। তাঁদের বিবাহও সাধারণ রমণীদের ন্যায় সাধারণ ছিলো না। সাধারণ রমণীদের বিবাহ হচ্ছে সামাজিক ও ব্যক্তিগত অঙ্গীকার মাত্র। কিন্তু নবী পত্নীদের বিবাহ সাধারণ বিবাহের যে ধারণা তার থেকে বহু উর্দ্ধে। কারণ তারা হচ্ছেন মুসলিম উম্মার মাতা। তাঁদের জন্য আছে সমাজে বিশেষ সম্মান এবং সমাজের প্রতি তাঁদের রয়েছে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব। স্ত্রীর কর্তব্য ব্যতীতও তাঁরা সাধারণ রমণী, যারা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে চায়, তাদের নির্দ্দেশনা দান ও ইসলামের পথে চলতে সাহায্য করার মত দায়িত্ব তাদের উপরে অর্পিত হয়। ইসলাম ধর্ম হচ্ছে এক সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা এবং সকল মুসলমান এক পরিবারের সদস্য। নারী , পুরুষের মিলিত প্রচেষ্টায় এই পরিবার গঠিত হয়ে থাকে। ইসলামে নারীরও পুরুষের ন্যায় সামাজিক অবস্থানে, বিশেষ স্থান আছে, এবং সে কারণেই নারীর জীবন ব্যবস্থায় একান্ত গোপন ব্যাপারগুলির নির্দ্দেশনা নারীরা নবী পত্নীদের নিকট থেকে গ্রহণ করতেন। আল্লাহ্র হুকুম সমূহ নবী পত্নীদের মাধ্যমে সাধারণ রমণীরা অবগত হতো। কারণ এ সব গোপন ব্যাপার সমূহ পুরুষের প্রকাশ্য মজলিসে আলোচনার বিষয় বস্তু নয়।
৩৭১৩। নবী পত্নীদের উপরে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে তাঁরা সকলের প্রতি দয়ালু এবং ভদ্র হবে। কিন্তু সকল অবস্থাতেই তারা তাদের সামাজিক সম্মান ও দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধে সর্তক থাকবে, যেনো লোকে তাদের ভুল না বোঝে এবং সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা না করে। অন্ধকারময় যুগের সংস্কৃতি অনুযায়ী নিজেকে প্রদর্শিত করা থেকে বিরত থাকার নির্দ্দেশ দান করা হয় নবী পত্নীগণকে।
৩৭১৪। আল্লাহ্র প্রতি কর্তব্যসমূহকে এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে সালাত বা প্রার্থনা [ যার সাহায্যে মানুষ আল্লাহ্র নৈকট্য অনুসন্ধান করে আত্মার মাঝে ] এবং যাকাত দান করা [ সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করা ]। ইসলামের এই দুটি স্তম্ভকে এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩৭১৫। "Ahl-al- Bail" - অর্থাৎ নবী পরিবার। এর মধ্যে নবী পত্নীগণ, নবী কন্যা হযরত ফাতেমা ,নবী জামাতা হযরত আলী, পৌত্র হাসান ও হোসেন এরা সকলেই সাধারণ বর্ণনা অনুযায়ী মুসলিম উম্মার সম্মানের পাত্র।
৩৭১৬। "UzKurna" - অর্থ শুধুমাত্র স্মরণ করা নয়, আরও অর্থ হচ্ছে আবৃত্তি করা , শিক্ষাদান করা , প্রচার করা , জনসাধারণ্যে প্রকাশ করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ রাসুলের [ সা ] নিকট থেকে নবী পত্নীরা যে জ্ঞান আহরণ করবেন তারা তা প্রকাশ বা প্রচার বা শিক্ষাদান বা আবৃত্তি করবেন। রসুল [ সা ] হচ্ছেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ঝরণা ধারা বা মূলধারা। কোরাণের আয়াতসমূহ হচ্ছে আল্লাহ্র বিশেষ নিদর্শন সমূহ যা মানুষকে করে বিবেকবান , অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন ও জ্ঞানী।
৩৭১৭। দেখুন আয়াত [২২ : ৬৩ ] ও টিকা ২৮৪৪। আল্লাহ্র গুণবাচক নামসমূহের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রতিটি বিষয়ের জ্ঞান অত্যন্ত নির্ভুল এবং তা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বর্ণিত। সুতারাং আল্লাহ্র প্রেরিত প্রত্যাদেশ সমূহ অত্যন্ত বিশদ এবং সেখানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
৩৭১৮। এই আয়াতে 'ইসলাম ' বা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্ম সমর্পনকারীর ধর্মসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে যার সার সংক্ষেপ করা হয়েছে টিকা ৩৭২০।
৩৭১৯। মোমেন নারী ও পুরুষের গুণসমূহ এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে মোমেন হতে হলে নারী পুরুষ নির্বিশেষ সকলকেই সমভাবে আল্লাহ্ নির্দ্দেশিত গুণে গুণান্বিত হতে হবে। নারী পুরুষ উভয়েরই আধ্যাত্মিক অধিকার এবং মানবিক অধিকার এই আয়াতে সমভাবে স্বীকৃত হয়েছে। এই আয়াত নারীর সম -অধিকারের এক জলন্ত দলিল। নারীকেও আল্লাহ্ পরকালে তাঁর কর্তব্য কর্মের জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখীন করবেন এবং তাঁকে শাস্তি বা পুরষ্কার প্রদান করবেন। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষ উভয়কে সম্বোধনের মাধ্যমে নারীর অধিকার, দায়িত্ব কর্তব্যকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং নারীকে পুরুষের সম-মর্যদা দান করা হয়েছে। সুতারাং যারা বলে ইসলামে নারীকে মর্যদা দান করে নাই - তারা অজ্ঞতা থেকেই তা বলে।
৩৭২০। মোমেন নারী ও পুরুষকে যে সব নৈতিক গুণে গুণান্বিত হতে হবে সেগুলি নিম্নরূপ :
১) আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পনকারী অর্থাৎ বিশ্বাসে, আনুগত্যে এবং পার্থিব চাওয়া-পাওয়া, বিপদ -বিপর্যয় জীবনের সব ক্ষেত্রে তারা আল্লাহ্র ইচ্ছাকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া বলে বিবেচনা করে থাকে।
২) মোমেন অর্থাৎ যার মধ্যে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও ভয় একান্ত আন্তরিক। দেখুন টিকা ২৬।
৩) অনুগত অর্থাৎ যারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে আন্তরিক ভাবে।
৪) সত্যবাদী অর্থাৎ যারা চিন্তায়, নিয়তে, কথায় ও কাজে সত্যের প্রতি নিবেদিত।
৫) ধৈর্য্যশীল ; অর্থাৎ বিপদে যারা দৃঢ়, অধ্যাবসায়ী , ধৈর্য্যশীল এবং সঠিক পথে কখনও উৎসাহ না হারিয়ে প্রবল ভাবে চেষ্টাশীল। দেখুন টিকা ৬১।
৬) বিনয়ী অর্থাৎ দম্ভ ও অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্ব বোধকে ত্যাগ করা।
৭) দানশীল : অপরকে সাহায্য করার মানসিকতা। এটা একটা বিশেষ গুণ যা আল্লাহ্র প্রতি কর্তব্য বোধ থেকে জাগরিত হয়। ২নং এ যে কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে।
৮) সওম পালনকারী বা রোজাদার : এখানে সওম অর্থাৎ আত্মসংযমী - এই সংযম শুধুমাত্র খাদ্যবস্তুতে নয়, রীপু সকল ও জীবনের সকল চাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য।
৯)। যৌন অংগ হিফাজত কারী , যৌন পবিত্রতা পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। এই সংযম দৈহিক ভাবে যেমন প্রযোজ্য , ঠিক সমভাবে প্রযোজ্য যৌন চিন্তার ক্ষেত্রে, তার নিয়ত , চিন্তা , কথা ,এবং পরিশেষে কাজ। কুদৃষ্টি, কুচিন্তা , কু-উদ্দেশ্য এ সকল ব্যাপারেই সংযমী হওয়ার নির্দ্দেশের অর্ন্তগত।
১০। আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী : অর্থাৎ যারা সর্বদা আল্লাহ্র প্রেরিত বার্তা বা শিক্ষাকে অনুধাবনের চেষ্টা করে এবং ঐকান্তিক ভাবে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের জন্য চেষ্টা করে থাকে।
উপরিউক্ত গুণাবলী হচ্ছে মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম নারীদেরও মুসলিম পুরুষদের সাথে সমভাবে এক কাতারে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানেই ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষের সমতা, এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য।
৩৭২১। মানুষ তার ক্ষুদ্র জ্ঞান, বুদ্ধি নিয়ে অনেক সময়েই দম্ভে , অহংকারে নিজেকে আল্লাহ্র থেকে শ্রেষ্ঠ কল্পনা করে থাকে। মানুষের পক্ষে তা করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ - কারণ আল্লাহ্র সাথে প্রতিযোগীতা করা অত্যন্ত হটকারীতা ও অন্যায়। আল্লাহ্র হুকুম আন্তরিক আনুগত্যের সাথে পালন করা উচিত। আমাদের ইচ্ছাকে আল্লাহ্র ইচ্ছার অনুগত করে দেয়া আল্লাহ্র হুকুম।
৩৭২২। ইনি হলেন জায়েদ ইব্ন হারিছা [রা ] যাঁকে রাসুলুল্লাহ্ [ সা ] পোষ্য পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ইনি ছিলেন , প্রথম যারা ইসলাম গ্রহণ করেন তাদের একজন। রাসুল [ সা ] তাঁকে ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি দেন এবং পোষ্যপুত্র রূপে গ্রহণ করেন। তাঁর সাথে রাসুল [ সা ] তাঁর ফুপাতো বোন জয়নাবের বিবাহ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এই বিয়ে সুখের হয় নাই। দেখুন পরবর্তী টিকা।
৩৭২৩। যায়েদের সাথে রাসুলের ফুপাতো বোন জাহ্সের কন্যা জয়নাবের বিবাহ হয়। এই বিবাহ সুখের হয় নাই, জয়নাব ছিলেন উচ্চ বংশজাত। অপরপক্ষে যায়েদ ছিলেন ক্রীতদাস, যাকে রাসুল [ সা ] মুক্ত করেন এবং বিবাহ দেন। জয়নাব কখনও তাঁর বংশের গৌরব ভুলতে পারেন নাই , তিনি যায়েদকে নীচু দৃষ্টিতে দেখতেন। এখানেই ছিলো তাদের দাম্পত্য জীবনের সংঘর্ষের সূচনা। ব্যক্তিগত ভাবে যায়েদ এবং জয়নাব প্রত্যেকেই ছিলেন একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ। তারা উভয়েই নবীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তারা পরস্পর পরস্পরকে বুঝতে পারতেন না, পরস্পরের সাথে খাপ খাওয়াতে পারতেন না। ফলে তাদের দাম্পত্য জীবন সংঘর্ষে পরিণত হয়। যায়েদ জয়নাবকে তালাক দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু রসুল [সা ] তাঁকে নিবৃত্ত করেন। জয়নাব ছিলেন রাসুলের [সা ] নিকট আত্মীয় এবং যায়েদের সাথে পরিণয় ছিলো রাসুলের [ সা ] একান্ত ইচ্ছানুযায়ী। এই বিয়েতে রাসুল [ সা ] দম্পত্তি যুগলকে উদার হাতে উপহার প্রদান করেন। এরূপ ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে লোকে মন্দ বলবে এই ভয় রাসুলের [ সা ] অন্তরে স্থান লাভ করে। মুসলিম বিয়ে হচ্ছে একটি সামাজিক চুক্তি। হিন্দুদের মত এর সাথে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক নাই। আল্লাহ্ মানুষকে অসুখী করতে চান না। তিনি মানুষকে সুখী দেখতে চান। বিবাহ বন্ধন হচ্ছে সেই সুখের চাবিকাঠি যা নারী ও পুরুষের পৃথিবীকে বেহেশতে পরিণত করে। সুতারাং এই বন্ধন যেনো দুঃখের কারণ না হয় এই আল্লাহ্র ইচ্ছা। সুতারাং আল্লাহ্র ইচ্ছায় এবং যায়েদ ও জয়নাবের ইচ্ছানুযায়ী বিবাহ বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়। আল্লাহ্র ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হবে।
৩৭২৪। আল্লাহ্ পৃথিবীতে নারী ও পুরুষকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন সুখ ও শান্তিতে পৃথিবীর জীবনকে অতিবাহিত করার জন্য। কিন্তু যদি এই বন্ধন সুখের না, হয় তবে আল্লাহ্ তা অনুমোদন করেন না। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অসুখী বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ , তা টিকে রাখা অপেক্ষা। তবে এই বন্ধন ছিন্ন করতে হবে উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা করে , যাতে কেউ কোনও ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। জয়নাবের একান্ত ইচ্ছা ছিলো যে তিনি মুসলিম উম্মতের মাতা হিসেবে সম্মানিত হবেন, এবং নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্মানের সহিত পালন করবেন। আল্লাহ্ তাঁর মনঃস্কামনা পূর্ণ করেন। দেখুন [ ৩৩ : ২৮ ] আয়াত এবং টিকা ৩৭০৬। এই আয়াতের উপদেশ হচ্ছে লোকলজ্জ্বাকে কোনও অবস্থাতেই আল্লাহ্র হুকুমের উপরে স্থান দেয়া চলবে না। আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে ন্যায় ও সত্যের প্রতীক। জীবনের সর্বাবস্থায়, সব কিছুর উপর তাঁর স্থান।
৩৭২৫। "প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা " এক্ষেত্রে 'ইদ্দতের ' সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে বিবাহের কথা বলা হয়েছে। দেখুন [ ২ : ২৮ ] এবং টিকা ২৫৪।
৩৭২৬। এই ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ্ পৌত্তলিক আরবদের যুগ যুগান্তরের কুসংস্কারকে ধ্বংস করেন। দেখুন আয়াত [ ৩৩ : ৪ - ৫ ] এবং টিকা ৩৬৭১-৩৬৭২ যেখানে মোশরেক আরবদের আরও কিছু কুসংস্কারের বর্ণনা আছে।
৩৭২৮। "পূর্বে যারা [ নবীরা ] গত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও ইহাই ছিলো আল্লাহ্র বিধান।" এই বাক্যটি পরবর্তী আয়াত [ ৩৯ নং ] এর সাথে সংযুক্ত। কিতাবধারী জাতিসমূহের মধ্যে পোষ্য পুত্রের সম্বন্ধে কোনওরূপ নিষিদ্ধ প্রথা ছিলো না। এই প্রথা চালু ছিলো শুধু মোশরেক আরবদের মধ্যে।
৩৭২৯। মানুষের পার্থিব জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ্ যে সব বিধান দান করেছেন তা মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁর জ্ঞান অসীম ও প্রজ্ঞাময়। অনেক সময়েই সাময়িক দুঃখ কষ্ট আমাদের বিভ্রান্ত করে। দুঃখের অনলে আমরা তাঁর কল্যাণ স্পর্শকে অনুভবে ব্যর্থ হই। কিন্তু দুঃখ , কষ্ট , সংগ্রাম অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য হতাশার কারণ না হয়ে আর্শীবাদ স্বরূপ হয়। সুতারাং ব্যর্থতার জন্য হাহাকার না করে বা অসন্তুষ্ট না হয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পুণরায় চেষ্টা করা উচিত। আর এই চেষ্টা হবে আল্লাহ্ নির্ধারিত সুনির্দ্দিষ্ট জীবন বিধান এবং কর্তব্য অনুযায়ী। কারণ আল্লাহ্ আমাদের জন্য যে সুনির্দ্দিষ্ট নীতি বা বিধান দান করেছেন তা বিশ্বজনীন কল্যাণের জন্য , তা পরিবর্তন করা মানুষের পক্ষে অসাধ্য।
৩৭৩০। পার্থিব জীবনে মানুষের দায়িত্ব কর্তব্য হচ্ছে শুধুমাত্র আল্লাহ্র প্রতি। তিনি যে ভাবে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে হুকুম দান করেছেন। সে ভাবে পরিচালনা করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। জাগতিক হুকুম বা ভয়ে বা সংস্কারের বশে তা ত্যাগ করা উচিত নয়। মানুষ সভ্যতার দোহাই দিয়ে বা নিজস্ব মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে , যখনই এরূপ বিভ্রান্তির উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ্র প্রতি কর্তব্যকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে, মানুষকে নয়। শুধুমাত্র আল্লাহকেই ভয় করতে হবে মানুষকে নয়।
৩৭৩১। কোনও দলিল বা ফরমান শেষ হওয়ার পরে তা সীলমোহর করা হয়। আর একবার সীলমোহর করার পরে তাতে আর নূতন কিছু সংযুক্ত করা হয় না - এই -ই নিয়ম। ঠিক সেরূপ পৃথিবীর আদি যুগ থেকে মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে যুগে যুগে আল্লাহ্ পৃথিবীতে রসুলদের প্রেরণ করেছেন। তাঁরা আল্লাহ্র বাণী শিক্ষা দিয়েছেন এবং মানব সভ্যতাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে অগ্রসর করেছেন। সভ্যতার ধারাবাহিকতায়, মানুষের মানসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ ভাবে আল্লাহ্র শিক্ষা ধারাবাহিক ভাবে যুগে যুগে নবী রসুলদের মাধ্যমে ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণ করা হয়। এই সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতাতে হযরত মুহম্মদ [ সা ] শেষ নবী। মানুষের পৃথিবীতে প্রথম আগমন থেকে শুরু করে আল্লাহ্র শিক্ষা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। কিন্তু হযরত মুহম্মদের [ সা ] পরে আর কোনও রসুলের আগমন হবে না। রসুলদের আগমনের সীলমোহর এখানেই। এর পরে আল্লাহ্ যাদের প্রেরণ করবেন তাঁরা হবেন চিন্তাবিদ , এবং সংস্কারক , কিন্তু কোনও রসুল নয়। আল্লাহ্র এই হুকুম কোনও খামখেয়ালি নয়। এ হচ্ছে আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রকাশ। আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।
৪২। এবং সকাল ও সন্ধ্যায় তার মহিমা কীর্তন কর।
৪৩। তিনি তোমাদের প্রতি শুভাশীষ প্রেরণ করেন ৩৭৩২, তার ফেরেশতাগণও তা করে থাকে, যেনো তিনি তোমাদের অন্ধকারের অতল থেকে আলোতে বের করে নিয়ে আসতে পারেন। এবং তিনি বিশ্বাসীদের প্রতি দয়াতে পরিপূর্ণ ৩৭৩৩।
৩৭৩২। ''শুভাশীষ" - অর্থাৎ আল্লাহ্র করুণা , দয়া এবং কল্যাণ কামনা। আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট জীবের জন্য কল্যাণ কামনা করেন এবং ফেরেশতারা তা কার্যে পরিণত করে। ফেরেশতাদের কার্য হচেছ আল্লাহ্র ইচ্ছার প্রতিফলন। কারণ ফেরেশতাদের কোনও নিজস্ব ইচ্ছা নাই। সে ক্ষমতা তাদের দান করা হয় নাই। মানুষের মাঝে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রকাশ হচ্ছে আল্লাহ্র করুণা ও কল্যাণের সর্বোচ্চ প্রকাশ। এই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কারণেই মানুষ প্রাণীকূলে শ্রেষ্ঠ প্রাণী।
৩৭৩৩। সৃষ্টির জন্য আল্লাহ্র করুণা ও দয়া তুলনাহীন এবং তা সকল সৃষ্ট জীবের জন্য সমভাবে বহমান। কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে ,যারা মোমেন বা বিশ্বাসী , যারা শুধু আল্লাহ্র অনুগ্রহের উপরে নির্ভরশীল তাদের জন্য আছে আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহের শুভ সংবাদ যার উল্লেখ করা হয়েছে পরের আয়াতে।
৪৫। হে নবী ! আমি তো তোমাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, একজন সুসংবাদদাতা এবং সর্তককারী রূপে ৩৭৩৪।
৩৭৩৪। আল্লাহ্র রাসুল হযরত মুহম্মদকে [ সা ] আল্লাহ্ পাঁচটি বিশেষ যোগ্যতা দান করেছেন। এই আয়াতে তিনটির উল্লেখ আছে এবং পরবর্তী আয়াতে দুটির উল্লেখ আছে।
১) রাসুলের [ সা ] আগমন সকল মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের "সাক্ষীরূপে।" রসুলদের মাধ্যমে যুগে যুগে সত্যকে প্রেরণ করা হয়েছে। সময়ের আবর্তনে সে সব শিক্ষা অস্পষ্ট বা অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে যায়। কারণ মানুষ তা করে থাকে অজ্ঞতার কারণে বা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে অথবা ধর্ম সম্বন্ধে মতভেদের কারণে নিজেদের মধ্যে বিভক্তির দ্বারা। নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য রসুলকে প্রেরণ করা হয় নাই। তাঁর আগমন পুরাতন ইব্রাহীমের ধর্মকে কলুষমুক্ত করা। মানুষ কি ভাবে এই সত্যকে গ্রহণ করেছে তিনি আল্লাহ্র নিকট তার সাক্ষী হবেন, দেখুন আয়াত [ ৪ : ৪১ ] এবং টিকা ৫৬০।
২) সুসংবাদদাতা রূপে : আল্লাহ্র করুণা ও অনুগ্রহের সুসংবাদদাতা রূপে তাঁকে প্রেরণ করা হয়। মানুষ যতদূর সীমা লঙ্ঘন করুক না কেন, যত পাপই করুক না কেন, অনুতাপ, আত্মসংশোধন ও পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে আল্লাহ্র রহমত লাভের শুভ সংবাদদাতা রূপে তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে।
৩) সর্তককারীরূপে : যারা আল্লাহ্র বাণীর প্রতি অমনোযোগী তাদের জন্য সর্তককারীরূপে রাসুলের [ সা ] আগমন। এই পার্থিব জীবনই শেষ কথা নয় , এর পরেও মৃত্যুর পরে অনন্ত জীবন বিদ্যমান। আর সেই জীবনই হচ্ছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পরের টিকা লক্ষ্য করুন।
৩৭৩৫। পূর্বের টিকা দেখুন। এই আয়াতে রাসুলের [ সা ] আর দুটি বিশেষ যোগ্যতার উল্লেখ করা হয়েছে।
৪) অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র ক্ষমা লাভের জন্য আহ্বানকারীরূপে তাঁকে আল্লাহ্ প্রেরণ করেছেন। এই কাজ তিনি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী করার ক্ষমতা লাভ করেন নাই। আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং হুকুম অনুযায়ী তিনি তা করার ক্ষমতা লাভ করেন। অন্যান্য রসুলদের মত মানুষ তাঁকে অস্বীকার করতে পারে, তবে একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, একমাত্র রসুলই [ সা ] সঠিক পথ নির্দ্দেশ করে সঠিক পথে আহ্বান করার ক্ষমতা রাখেন। কেউ যদি তাঁকে অস্বীকার করে তবে তা হবে তার ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব। তার কাজের জবাবদিহিতার জন্য সেই একমাত্র দায়ী।
৫) নবীকে এখানে উজ্জ্বল প্রদীপ [ Siraj ] হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। উজ্জ্বল অর্থাৎ যা অন্ধকার বিদূরিত করে আলো বিচ্ছুরিত করে। সমস্ত পৃথিবীর মানবের আত্মাকে আলোকিত করার জন্য তাঁর আগমন। আয়াত [ ৭১ : ১৬ ] আয়াতে এবং অন্যান্য বহুস্থানে [ Siraj ] শব্দটি সূর্যের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। সূর্যের উদয়ে শুধু যে অন্ধকার বিদূরিত হয় তাই-ই নয়, নিশিত রাতের সবচেয়ে শক্তিশালী ও উজ্জ্বল আলোও ম্লান ও দীপ্তিহীন হয়ে পড়ে। ঠিক সে রকমই ইসলামের বাণী হচ্ছে বিশ্বজনীন। ইসলামের আলো অন্যান্য সকল ধর্মের আলোকে নিষ্প্রভ করে দেয়।
৩৭৩৬। ইসলামের বাণী হচ্ছে আল্লাহ্র মহা অনুগ্রহ। যদি মানুষ তা সঠিকভাবে অনুধাবন করে তবে সে তার মহিমা কীর্তন করতে বাধ্য।
৩৭৩৭। কাফের ও মোনাফেকরা রসুলকে [সা ] অত্যাচার ও নির্যাতনের দ্বারা যে উপেক্ষা প্রদর্শন করতো এখানে তারই উল্লেখ আছে। এ কথা রসুলের জন্য যেমন প্রযোজ্য ছিলো , অদ্যাবধি যারা কাফের ও মোনাফেক তারা ঈমানদার এবং সত্য ও ন্যায়ের অনুসারীকে বিদ্রূপ ব্যঙ্গ দ্বারা নির্যাতিত করতে দ্বিধা বোধ করে না। আল্লাহ্ মোমেন ব্যক্তিদের তাঁর উপরেই নির্ভর করতে আদেশ দান করেছেন , কারণ কর্মবিধায়করূপে আল্লাহ্ই যথেষ্ট।
৩৭৩৮। দেখুন টিকা ২৫৪ এবং আয়াত [ ২ : ২২৮ ]। ইদ্দতের সময়কাল তিনমাস বা তিনরজঃস্রাব। দেখুন [৬৫ : ৪ ] আয়াত।
৩৭৩৯। এই উপহার সামগ্রী সম্বন্ধে অনেকে এই মত পোষণ করেন যে, আয়াতে [ ২ : ২৩৭ ] যে অর্দ্ধেক দেন-মোহরের উল্লেখ আছে তাহা ব্যতীতও এই উপহার সামগ্রী প্রাপ্য। যদি দেন-মোহর ধার্য না হয়ে থাকে , তবে এই উপহার সামগ্রী হবে প্রচুর পরিমাণে এবং আয়াতে [ ২ : ২৩৬ ] এই উপহারের কথা বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে।
৩৭৪০। " সৌজন্যের সাথে বিদায় দিবে।" অর্থাৎ উপহার সামগ্রী দিতে হবে সহৃদয়তার এবং স্বাভাবিক মাধুর্যের সাথে। কোনও অবস্থাতেই নারীদের স্বাধীনতা খর্ব করা চলবে না। যদি সে তৎক্ষণাত বিয়ে করতে চায়, তালাকের পরে তার কোনও বাধা থাকবে না। অর্থাৎ উপহারের সাথে নারীর স্বাধীনতার কোনও যোগসূত্র নাই। উপহার দান দ্বারা এ কথা যেনো মনে করা না হয় যে, সে কোনও ভাবে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকবে।
৩৭৪১। এখান থেকে নূতন ব্যতিক্রম বা সুবিধার উল্লেখ আছে। আয়াত ৫ ০ -৫২ পর্যন্ত বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে বর্ণনা আছে রসুলের বিবাহ সম্বন্ধে। রসুলের বিবাহকে সাধারণ মুসলমানদের বিবাহ থেকে বিশেষীকরণ ও স্পষ্ট করা হয়েছে। রসুলের স্ত্রীদের সম্পর্কে দেখুন টিকা ৩৭০৬। এই চারটি বৈশিষ্ট্য নিম্নোক্ত চারটি টিকার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
৩৭৪২। প্রথম শিরোনাম বা আল্লাহ্র হুকুম : দেন-মোহর সহ বিবাহ [ ৪ : ৪ ] : দেনমোহর প্রথা মুসলিম বিবাহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং তা দেশ-কাল জাতি নির্বিশেষে মুসলমানের সকলের জন্য প্রযোজ্য এবং রসুলের [ সা ] জন্যও তা প্রযোজ্য। রসুলের বিবাহের প্রথম হুকুম : তা শুধুমাত্র চারটি বিবাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় নাই , যা অন্যান্য মুসলমানদের জন্য শর্ত সাপেক্ষে বিবাহে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে [ ৪ : ৩ ]। এ ব্যতীত হুকুম হচ্ছে রসুলের [ সা ] স্ত্রীগণকে হতে হবে মুসলমান , শুধুমাত্র কিতাবধারী হলেই যথেষ্ট হবে না। যেখানে সাধারণ মুসলমানদের কিতাবধারী মহিলাদের সাথে বিবাহকে বৈধ করা হয়েছে [ ৫ : ৫ ]। সেখানে রসুলের জন্য তা বৈধ করা হয় নাই। অবশ্যই যারা মুসলিম উম্মার মাতা হবেন তাদের মুসলমান হতে হবে।
৩৭৪৩। দ্বিতীয় শিরোনাম [ ২ ] মহিলা যুদ্ধবন্দী : উপরের টিকা সর্ম্পকে যা বলা হয়েছে তা এখানেও প্রযোজ্য।
৩৭৪৪। তৃতীয় শিরোনাম [ ৩ ] : রসুলের [ সা ] জন্য চাচা, ফুপু এবং মামা ও খালার কন্যার সাথে বিবাহ বৈধ। বিবাহ নিষিদ্ধ এর তালিকার জন্য দেখুন আয়াত [ ৪ : ২৩ - ২৪ ]। এই বৈধতা শুধুমাত্র রসুলুল্লাহ্ [ সা ] জন্য নয় সকল মুসলমানদের জন্য বৈধ। কিন্তু "তারা রসুলুল্লাহ্র [ সা ] সাথে হিজরত করেছে " - এ কথাটি শুধু রসুলুল্লাহ্র [ সা ] জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ পিতৃ [ চাচা, ফুপু ] ও মাতৃ [ খালা , মামা ] কূলের কন্যাদের সাথে মুসলমানদের জন্য বিবাহ বৈধ। কিন্তু রসুলের [ সা] জন্য শুধু তারাই বৈধ যারা হিজরত করেছে।
৩৭৪৫। চতুর্থ শিরোনাম [ ৪ ] : " কোন মুমিন নারী নবীর নিকট নিজেকে নিবেদন করলে " - অর্থাৎ পূর্বের ন্যায় এই নিয়মটি শুধুমাত্র রসুলের [ সা ] জন্য প্রযোজ্য। এই নিয়মটিকেও শর্ত সাপেক্ষে সুরক্ষিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে নারী চাইলেই নবীকে বিবাহ করতে হবে সেটা ঠিক নয়। শর্ত হচ্ছে যদি নবীও তাঁকে বিবাহের উপযুক্ত মনে করেন তবেই তা হওয়া সম্ভব।
৩৭৪৬। " এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র তোমার জন্য " - এই বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে শুধুমাত্র রসুলের জন্য যে সব বৈধ করা হয়েছে।
৩৭৪৭। মুসলিম বিবাহের নিয়মের জন্য দেখুন [ ২ : ২২১- ২৩৫ ] ; [৪ : ১৯ - ২৫ ] ; এবং [ ৫ : ৫ ] আয়াত।
৩৭৪৮। সামাজিক জীবনে বিবাহের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ শুধুমাত্র দৈহিক আরাম আয়েশের বস্তু নয় - বিবাহ মানুষের জীবনে সামাজিক জীবনের মাধ্যমে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জগতে উত্তরণের পন্থা। সুশীল, সৎ ও শান্তিপূর্ণ গৃহকোণ সুনাগরিক সৃষ্টি করে। বিবাহের ফসল সন্তান আমাদের ভবিষ্যত বংশধর। সুসন্তান শুধুমাত্র পিতামাতার জন্য শান্তিদায়ক নয় , তারা দেশের জন্য সম্পদ বটে। এ ভাবেই বিয়ের সূদূর প্রসারী প্রভাব শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয় তার প্রভাব ব্যক্তিজীবনের গন্ডি অতিক্রম করে সমাজ জীবনে প্রসারিত হয়। সুতরাং বিয়েকে লঘুভাবে দেখার কোন সুযোগ নাই। দাম্পত্য জীবনে অনেক সময়েই বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। নারী ও পুরুষ উভয়েই সে সমস্যাকে গুরুত্ব ও আন্তরিকভাবে বিবেচনা করবে। চেষ্টা করবে আবেগের বশবর্তী না হয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। এ ব্যাপারে সর্বদা সে মহান স্রষ্টার সাহায্য কামনা করবে। আল্লাহ্ সকলের জন্যই জীবনের পথ সহজ , সুন্দর করতে চান - কারণ আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
৩৭৪৯। আয়াতে [ ৪ : ৩ ] বলা হয়েছে যে "If ye fear that ye shall not be able to deal justly with them", তাহলে একের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা বৈধ নয়। মুসলমানদের জন্য পত্নীদের মধ্যে একজন অধিক প্রিয় পত্নী এরূপ কেহ থাকতে পারে না। সাধারণ উম্মতের জন্য একাধিক পত্নী থাকলে সকলের জন্য সমতা বিধান জরুরী , বৈষম্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ। এই সমতা শুধু মাত্র জাগতিক বিষয়বস্তুই নয়, স্ত্রীর সাথে সমান সংখ্যক রাত্রি যাপন করতে হবে।
বিশেষ অবস্থার কারণে রসুলুল্লাহ্র [ সা ] একের অধিক পত্নী বিদ্যমান ছিলো। তিনি সর্বদা সকল পত্নীর জন্য সকল ব্যাপারে সমতার আইন মেনে চলতেন। কিন্তু নবুয়ত পাওয়ার ফলে রসুলের [ সা ] ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন অপেক্ষা নবুয়তের কার্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ানোর ফলে, সব সময়ে রাত্রি যাপনের সমতা রাখা সম্ভব ছিলো না ,দেখুন টিকা ৩৭০৬ , আয়াত [ ৩০: ২৮ ]। এই আয়াতে রসুলকে [ সা ] রাত্রিযাপনের সমতা থেকে অব্যহতি দান করা হয়, কিন্তু রসুলুল্লাহ্র [ সা ] এই ব্যতিক্রম ও অনুমতি সত্বেও কার্যতঃ সর্বদাই সমতা বজায় রেখেছেন।
৩৭৫১। " এতে তাদের সন্তুষ্টি সহজতর হবে " - সাধারণ মানুষের মনঃস্ততঃকে এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে জিনিষে মানুষের অধিকার নাই , তা হঠাৎ করে করতলগত হলে , মানুষ আনন্দ ও সুখে আত্মহারা হয়ে পড়ে। অধিকারভুক্ত জিনিষ পেলে সে সুখ ও আনন্দ পাওয়া যায় না। রসুলের [ সা ] জীবন ও তাঁর পত্নীদের জীবনকে শান্তিময় করার জন্যই আল্লাহ্র এ বিধান।
৩৭৫২। রসুলের [ সা ] এমন কোনও জাগতিক অর্থ সম্পদ ছিলো না যা তিনি তাঁর পত্নীদের দিতে পারতেন। [ পত্নীদের জন্য দেখুন আয়াত ৩০ : ২৮ ] কিন্তু তার চরিত্রের গুণাবলী তাঁকে করেছিলো সমৃদ্ধ , পরিবারের তথা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবরূপে, দয়া-মায়া, ন্যায় এবং সত্যের বিকাশ তাঁর চরিত্রকে করেছিলো মহিমান্বিত - যার আলোয় সহধর্মীনিরা আপ্লুত থাকতেন।
৩৭৫৩। সাধারণ মানুষ যত মহৎ বা উন্নত হোক না কেন, তার অন্তরের উদ্দেশ্য বা চিন্তা সর্বদা স্বচ্ছ ও মহৎ হয় না। মনের গোপন কন্দরে কত ভাব , চিন্তা ,আসা যাওয়া করে। তার কিছু ভালো কিছু মন্দ, কিছু কল্পনা , কিছু বাস্তব। সাধারণ লোকে তা অনুধাবন না করতে পারলেও বিশ্বস্রষ্টার বিশাল কম্পিউটারে তা তাৎক্ষণিক ধরা পড়ে যায় এবং সংরক্ষিত হয়ে যায়। কোনও মানুষই ,পুরুষ বা নারী কেহই কুচিন্তা থেকে রেহাই পায় না। বিশ্বস্রষ্টা মানুষের এই দুর্বলতা জানেন। তাই তিনি তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। তাই তো তাঁর উপাধি "Halim' বা ক্ষমাশীল। যারা আল্লাহ্র প্রতি অনুরক্ত তাদের জন্য এটা একটা সংকেতপূর্ণ র্বাতা যে, যিনি আমাদের এত দোষ ত্রুটি জানা সত্বেও ক্ষমা করতে পারেন, আমরা তাঁর পূঁজারী ও অনুসারী হয়ে আমাদের প্রতিবেশী বা অন্যান্য লোকের দোষত্রুটি ক্ষমা করতে পারবো না কেন ?
৩৭৫৪। এই আয়াতটি ৭ম হিজরীতে অবতীর্ণ হয়। এর পরে রসুল [ সা ] আর বিবাহ করেন নাই। তবে মিশরের খৃষ্টান শাসনকর্তা রসুলকে [ সা ] একজন পরিচারিকা উপহার দেন, যার নাম ছিলো মেরী। মেরীর গর্ভে রসুলের [ সা ] ছেলে ইব্রাহীমের জন্ম হয় যে শৈশবে মৃত্যু বরণ করে ?
রুকু - ৭
৩৭৫৫। এই আয়াতটির মাধ্যমে সুশীল, ও সুরুচীশীল সামাজিক সংস্কৃতি শিক্ষা দান করা হয়েছে। রসুলের [সা ] যুগে দুর্বিনীত ও অভদ্র আরবদের যে সামাজিক আদব কায়দা শিক্ষা দান করা হয়েছে অদ্যাবধি যে কোনও সুশীল ও সংস্কৃতিবান সমাজের জন্য তা প্রযোজ্য। এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলি সংক্ষেপে নীচে তুলে ধরা হলো।
১) বন্ধুর গৃহে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করো না।
২) যদি কোথাও নিমন্ত্রিত হও, তবে সময়ের বেশী পূর্বে গমন করবে না, যেনো খাদ্য প্রস্তুত করার জন্য অপেক্ষা করতে না হয়।
৩) যে সময়ে দাওয়াত সেই সময়কে রক্ষা করতে চেষ্টা করবে যেনো তোমার উপস্থিতি হয় প্রত্যাশিত সময়ে।
৪) খাবার পরে নিমন্ত্রণ কর্তার সাথে বেশী আন্তরিক হতে চেষ্টা করো না , বিশেষ করে তার সাথে তোমার যদি সামাজিক দূরত্ব বেশী থাকে।
৫) খাবার পরে তার সাথে আজে বাজে গল্পে সময় নষ্ট করো না , কারণ তা অনেক সময়েই গৃহকর্তার বিরক্তি উৎপাদন করে থাকে।
৬) তোমার প্রকৃত আচরণ কি হওয়া উচিত উপলব্ধি করতে চেষ্টা করো। কারণ তোমার গৃহকর্তা হয়তো ভদ্রতার খাতিরে তোমাকে তোমার আচরণের উল্লেখ নাও করতে পারে। এসব সামাজিক রীতি নীতি সামাজিক মূল্যবোধ ও গুণের বিকাশ করে।
৩৭৫৬। মহিলাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বিভিন্ন সমাজে সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু একটি সভ্য সমাজের সকল মহিলাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রাপ্য। সুশীল সমাজের এ এক সুনীতি। রসুল পত্নী, যারা মুসলিম 'উম্মার মাতা' তারা সাধারণ নারীদের অপেক্ষা অধিক সম্মানের যোগ্য। এই আয়াতে নবী পত্নীদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ্ তাদের জন্য "Hijab" বা পর্দ্দার নির্দ্দেশ দান করেন। এ ভাবেই তাদের সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে রূপান্তর করা হয়। যাতে তাঁরা সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। এই হিজাব শুধুমাত্র রসুল পত্নীদের জন্য প্রযোজ্য, পরপুরুষের সাথে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলা শুধু তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য। সাধারণ মুসলিম মহিলাদের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। মুসলিম মহিলাদের জন্য নির্দ্দেশ আছে [ ৩৩ : ৫৯ ] আয়াতে।
৩৭৫৭। রসুল [ সা ] হচ্ছেন সারা বিশ্ব জাহানের রহমত স্বরূপ। পৃথিবীতে তাঁর যে অবস্থান, সে হিসেবে তিনি বিশ্ব মুসলিমের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। এমন কিছু করা উচিত নয় যা তাঁর জন্য বিরক্তিকর। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন শুধুমাত্র যে তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রাপ্য তা নয় - তা পৃথিবীতে সর্ব যুগে সকল মুসলমানের করণীয় কর্তব্য। সে যুগেও তা যেমন প্রযোজ্য ছিলো আজও তা সমভাবে প্রযোজ্য এবং ভবিষ্যতেও তা সমভাবে থাকবে। কারণ তাঁর শিক্ষা ও ব্যক্তিত্ব আমাদের মাঝে আজও জীবন্ত। আজও তা সমভাবে প্রেরণা যোগায়। সুতারাং রসুলের [ সা ] মৃত্যুর পরে তাঁর বিধবা পত্নীদের বিবাহ করা অন্যদের জন্য হারাম করা হয়েছে। কারণ সমাজে তাদের রসুলের পত্নী হিসেবে বিশেষ সম্মানজনক অবস্থানের জন্য এবং রসুলের [ সা ] সম্মানের জন্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় রসুলের [ সা ] প্রতি এই সম্মান যোগ্য ভাবেই নিবেদন করা হয়েছিলো।
৩৭৫৮। "Aza" বা পীড়া দেওয়া , বিরক্ত করা , আঘাত দেয়া , অপমান করা, খারাপ ব্যবহার করা , কলঙ্ক লেপন করা ,খারাপ আচরণ করা , অনুভূতিতে আঘাত দান করা ইত্যাদি। পৃথিবীতে হযরত মুহম্মদ মুস্তফার [সা] আগমন ঐশি দায়িত্ব পালনের জন্য। পৃথিবীকে পাপের পথ থেকে বিরত করে আত্মিক মুক্তির পথ দেখানো ছিলো তাঁর ঐশি দায়িত্ব। এই গুরু দায়িত্ব যিনি সফলভাবে পালন করেছেন; অবশ্যই পৃথিবীর সকল লোকের নিকট তাঁর যোগ্য সম্মান প্রাপ্য। তিনি আজ আমাদের মাঝে নাই, কিন্তু তাঁর শিক্ষা প্রতিনিয়ত আমাদের আত্মিক শক্তি যোগায়, আত্মিক মুক্তির পথ দেখায়। সে হিসেবে তাঁর পত্নীরা যারা মুসলিম উম্মার মাতা হিসেবে পরিগণিত তারাও সম্মানের যোগ্য তবে অবশ্যই তা রসুলের [সা ] সমকক্ষ হবে না।
৩৭৫৯। সংসার জীবনে মানুষ নিজ মনের অনুভূতিকে অনেক সময়েই প্রকাশ করে না। ব্যক্তি জীবনে অনেকেই বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, চাটুকারিতার আশ্রয় নেয়। আবার অনেকেই প্রতারণার উদ্দেশ্যে ভালোকে প্রতিহত করে। বাইরের থেকে আমরা এ সব প্রতারকদের বুঝতে না পারলেও মহান আল্লাহ্র নিকট কারও মনের ভাব গোপন থাকে না। ব্যক্ত , অব্যক্ত সকল চিন্তাধারাই আল্লাহ্র নিকট সুস্পষ্ট। তিনি তো সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।
৩৭৬০। পূর্বের আয়াতে [ ৫৩ নং ] রসুলের [সা ] স্ত্রীদের যে হিজাবের [ পর্দ্দা ] কথা বলা হয়েছে ,এই আয়াতটি তারই ধারাবাহিকতা। নবী পত্নীরা হিজাব ব্যতীত যাদের সামনে বের হতে পারবেন, - তাদের তালিকা এই আয়াতে প্রকাশ করা হয়েছে। এরা হলেন : পিতা, পুত্র, ভাই অথবা বোনের ছেলে, দাসী ,ক্রীতদাস [ অধিকারভুক্ত দাস দাসী ]। তফসীরকারগণ এই সাথে চাচা ও মামাকে অর্ন্তভুক্ত করেছেন পিতার শিরোনামে। সেবিকাগণ শব্দটি দ্বারা সকল মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মহিলাদের বোঝানো হয়েছে। মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য স্ত্রীলোকদের তাঁরা আগন্তুক হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং হিজাবের আড়াল থেকে কথা বলবেন। নবী পত্নীদের জন্য প্রযোজ্য তালিকার সাথে সূরা নুরের [ ২৪ : ৩১] আয়াতের তুলনা করলে দেখা যাবে যে সূরা নূরের আয়াতের [ ২৪ : ৩১ ] তালিকাটি সকল মুসলিম মহিলাদের জন্য প্রযোজ্য। লক্ষ্য করুন সূরা আহ্যাবের এই আয়াতে [ ৩৩ : ৫৫ ] স্বামীর আত্মীয় স্বজনের উল্লেখ নাই যা পূর্বোক্ত সূরা নূরের [ ২৪ : ৩১ ] আয়াতে উল্লেখ আছে। কারণ সূরা আহ্যাবের এই আয়াতটি [ ৩৩ : ৫৫ ] অবতীর্ণ হয়েছে শুধুমাত্র নবী পরিবারের জন্য যে পরিবার সমগ্র মুসলিম জাহানের কেন্দ্র বিন্দু। সে কারণে পূর্বের আয়াতে [ ২৪ : ৩১ ] গৃহভৃত্য ও ছোট শিশুর উল্লেখ আছে , যা এখানে [ ৩৩ : ৫৫ ] নাই।
সূরা আহ্যাব ও সূরা নূরের এই দুটি আয়াতের ভাষার দিকে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, সাধারণ মুসলিম মহিলাদের জন্য "Hijab" বা পর্দ্দার উল্লেখ নাই। শুধুমাত্র বলা হয়েছে তাদের দেহসৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখার জন্য, তাঁরা চাঁদরের সাহায্যে অবগুণ্ঠন দেবে ও দেহকে ঢেকে রাখবে এবং শালীনভাবে পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করবে। যাতে তাদের সৌন্দর্যের প্রদর্শনী না হয়। "Hijab" বা পর্দ্দা নবী পত্নীদের জন্য বিশেষ সম্মানের প্রতীক। এই আয়াতটি রসুলের [সা ] মৃত্যুর ৫/৬ বৎসর পূর্বে অবতীর্ণ হয়।
৩৭৬১। আল্লাহ্ স্বয়ং এবং ফেরেশতাগণ নবীর [ সা ] প্রতি সম্মান ও আশীর্বাদ বর্ষণ করেন। কারণ তিনি হচ্ছেন পৃথিবীর সকল মানবকূলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এই আয়াতে আমাদেরও বলা হয়েছে নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে - কারণ তিনি পৃথিবীর মানুষকে আত্মিক দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি দানের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর জীবনের দুঃখ কষ্ট, অত্যাচার-নির্যাতনের পরিবর্তে তিনি আমাদের আল্লাহ্র করুণা লাভের পথ, শান্তির পথ এবং লোভ লালসা ভরা পৃথিবীর আত্মিক যন্ত্রণা থেকে ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন। আত্মিক বিকাশের সর্বোচ্চ পথ তিনি আমাদের প্রদর্শন করেছেন।
৩৭৬২। দেখুন টিকা নং ৩৭৫৮।
৩৭৬৩। দেখুন আয়াত [ ৪ : ১১২ ] যেখানে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ অপরাধ করে এবং সেই অপরাধের বোঝা অন্যের উপরে চাপাতে চেষ্টা করে , তবে সে পরলোকে দ্বিবিধ শাস্তির সম্মুখীন হবে। প্রথমত : তাঁর নিজস্ব পাপের যে শাস্তি তার জন্য ,দ্বিতীয়ত : অপর ব্যক্তিকে মিথ্যা পাপের কলঙ্কে অভিযু্ক্ত করার জন্য। এই আয়াতে [ ৩৩ : ৫৮ ] সার্বজনীন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে , ব্যক্তিগতভাবে দুটি ব্যক্তির উল্লেখ না করে, দুই শ্রেণী লোকের বর্ণনা করা হয়েছে। মোমেন পুরুষ ও নারী [ যদি সত্যিকারের মুমিন হয় ] - যারা আল্লাহ্র জন্য মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে থাকে, যদি তারা অবিশ্বাসী ও পাপীদের দ্বারা অপমানিত হয়, আঘাত প্রাপ্ত হয়, অথবা বিরক্তির কারণ হয়; সেক্ষেত্রে অপরাধীদের অপরাধ হবে দ্বিবিধ যথা : 'স্পষ্ট পাপ ' অর্থাৎ যে অন্যায় কাজ তারা করে তার ফলাফল এবং 'অপবাদ' অর্থাৎ মিথ্যা অভিযোগের দ্বারা যে ক্ষতি ও মনঃকষ্ট তারা মুমিন বান্দাদের দিয়ে থাকে তার ফলাফল।
৩৭৬৪। এই আয়াতটি সার্বজনীন। সকল মুসলিম নারীদের জন্য তা প্রযোজ্য হবে। আয়াতের বক্তব্য নবীপত্নী ও অন্যান্য মুসলিম নারী সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। তাদের বলা হয়েছে যখন তারা রাস্তায় বের হবেন তখন একটি বহিরাবরণ পরিধান করবেন।
৩৭৬৫। "Jilbad" বহুবচনে "Jalabib" অর্থ বহিরাবরণ। লম্বা গাউন যা সর্বশরীরকে ঢেকে দেয় অথবা পোষাক যা ঘাড় , গলা ও বুক ঢেকে ফেলে।
৩৭৬৬। এই আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে মহিলাদের বহিরাবরণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এর দ্বারা মহিলাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করতে চাওয়া হয় নাই বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মহিলাদের কুদৃষ্টি ও উক্ত্যক্ত করার হাত থেকে রক্ষা করা। পাপাসক্ত পুরুষ যাতে সহজে নারীর সৌন্দর্য্যে আকর্ষিত না হয় সেই কারণে এই ব্যবস্থা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সকল স্থানেই প্রাচীন যুগ থেকে সম্মানীয় নারী ও পুরুষেরা বহিরাগমনের সময়ে বিশেষ পোষাক পরিধান করে থাকেন। পোষাক আভিজাত্য প্রকাশের এক বিশেষ মাধ্যম বিশেষ। পোষাকের এই বিশেষ দিকটি সর্ব যুগে বিদ্যমান ছিলো। এমন কি প্রাচীন আসেরিয়ান [ Assyrian ] সভ্যতার সময়ে , আসেরিয়ান আইন ছিলো যে বিবাহিত মহিলারা রাস্তায় বের হতে অবগুণ্ঠনের ব্যবহার করবেন, যা ছিলো সম্মানের প্রতীক স্বরূপ। কারণ উক্ত অবগুণ্ঠন ক্রীতদাসী এবং চরিত্রহীনাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো। দেখুন Cambridge Ancient History III 107 সুতারাং মুসলিম মহিলাদের অবগুণ্ঠণের দ্বারা নিজেকে আবৃত করে রাস্তায় বের হওয়ার অর্থ এই নয় যে , তাদের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ। আল্লাহ্ পরিষ্কার ভাবে এই আয়াতের মাধ্যমে বলেছেন যে, বহিরাবরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে " উহাদিগকে উত্ত্যক্ত করা হইবে না।" এখানে লক্ষ্যণীয় যে বহিরাবরণে মুখ ঢাকার উল্লেখ নাই, কারণ এই আবরণটি এমন হবে যেনো মহিলাদের "সহজে চেনা যায়।" রাস্তায় বের হলে মহিলাদের " চেনা সহজতর " এবং " উত্ত্যক্ত হওয়ার " হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য-ই ইসলাম নারীদের জন্য বহিরাবরণের সুবন্দোবস্ত করেছে। সেই কারণে নারী যখন যৌবন ও সৌন্দর্য্য হারায় তখন আর বহিরাবরণের প্রয়োজন নাই। দেখুন সূরা নূরে আয়াত [ ২৪ : ৬ ০ ] এ বর্ণনা করা হয়েছে , "বৃদ্ধা নারী, যারা বিবাহের আশা রাখে না , যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের বহিরাবরণ খুলে রাখে, তাদের জন্য দোষ নাই।" এই আয়াত থেকে এই ধারণাই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে মহিলাদের গৃহে বন্দী করার জন্যই পর্দ্দার বন্দোবস্ত করা হয় নাই। বর্তমান বিশ্বে মুসলমান নারীদের পর্দ্দার দোহাই দিয়ে তাদের বহিঃবির্শ্বের সাথে সংযোগ স্থাপনে বাধা দান করা হয় যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। ইসলামের প্রথম যুগের বিভিন্ন মহিয়সী মহিলাদের জীবনই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দৈহিক শালীনতা রক্ষা করে চলবে এই হচ্ছে ইসলামিক জীবন বিধান।
৩৭৬৭। " আল্লাহ্ ক্ষমাশীল , পরম দয়ালু।" এই আয়াতে মুসলিম মহিলাদের জন্য যে বিধানের প্রচলন করা হয়েছে, তা মহিলারা আন্তরিক ভাবে ও বিশ্বস্তভাবে মেনে চলতে চেষ্টা করবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ মনের দিক থেকে দুর্বল। যদি কেউ মানবিক দুর্বলতার কারণে তা মানতে অক্ষম হয়, তবে আল্লাহ্ আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি " ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।"
৩৭৬৮। রসুলের [ সা ] নগরীতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুজব রটানো হারাম বা নিষিদ্ধ। এরূপ কাজ যারা করবে তাদের জন্য এই আয়াতে কঠোরভাবে সর্তকবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। এরূপ কাজ শুধুমাত্র মোনাফেকদের দ্বারাই করা সম্ভব, কারণ মোনাফেকরা মুখে নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করলেও, অন্তরে তারা মুসলিম বিরোধী। মোনাফেকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা চিন্তায় - কথায় ও কাজে পরস্পর বিরোধী। তারা এরূপ করে কারণ তাদের অন্তর অর্থাৎ মানসিক অবস্থা ব্যধিগ্রস্থ। সেখানে আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার কোনও স্থান নাই। যারা মোনাফেক অর্থাৎ " অন্তরে ব্যধিগ্রস্থ " তারাই
১) নিরীহ ও নিদোর্ষ মহিলাদের উৎপীড়ন করতে ভালোবাসে
২) এরাই মিথ্যা গুজব দ্বারা নগরীতে গণ বিদ্রোহের সূচনার প্রয়াস পায়।
অনুবাদকের মন্তব্য : মোনাফেকদের এই বৈশিষ্ট্য আজও আমাদের সমাজে প্রকটভাবে বিদ্যমান। ধর্মের নামে নারী নির্যাতন ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টির প্রয়াস এসব মোনাফেকদের আজও প্রধান বৈশিষ্ট্য।
৩৭৬৯। মোনাফেকরা আল্লাহ্র অভিশপ্ত। তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও পথ নির্দ্দেশ ধারণে অক্ষম হবে। এরা পৃথিবীতে সংঘাত ও নৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টিতে পারঙ্গম। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, বিপর্যয়ও সংঘাত দ্বারা মোনাফেকরা আল্লাহ্র সৃষ্টিকে ধবংস করতে পারবে না। বরং তারাই তাদের কৃতকর্মের দরুণ ধবংস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে যারা আইনকে অমান্য করে, অপরাধ করে, তারা দেশের প্রচলিত আইন দ্বারাই শাস্তি লাভ করে থাকে।
৩৭৭০। ইহুদীদের এ ব্যাপারে আইন আরও কঠোর। দেখুন [ ৩৩ : ২৬ ] আয়াত ও টিকা ৩৭০৩ এবং ৩৭০৪। ইসলামে এই শাস্তিকে লঘু করা হয়। যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে গোপনে বা প্রকাশ্যে সমাজের শৃঙ্খলা ও শান্তিকে ধ্বংস করতে চায়; সমাজের প্রচলিত আইনকে অস্বীকার করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি , তাদের দমন করা এবং শাস্তি দান করা পৃথিবীর যে কোনও সভ্য সমাজের রীতি। কারণ এ ব্যতীত সুসভ্য নাগরিক ও সামাজিক জীবন কল্পনাও করা যায় না। নাগরিক ও সামাজিক জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্যই তা প্রয়োজন। অপরাধী ও অন্যায়কারী , যারা সমাজের শান্তি শৃঙ্খলার বিরোধী তাদের কঠোর শাস্তি দান ব্যতীত দমন করা সম্ভব নয়।
৩৭৭১। কেয়ামতের ধারণা সম্বন্ধে দেখুন আয়াত [ ৭ : ১৮৭ ]। পৃথিবীর শেষ দিন বা কেয়ামতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্র নিকট। কিন্তু শেষ দিবস বা কেয়ামত অবশ্যাম্ভবী ঘটনা। কেয়ামত ঘটার সঠিক সময় আমরা কেউই জানি না। আল্লাহ্ তা আমাদের নিকট প্রকাশ করেন নাই। যদি স্রষ্টা পূর্বাহ্নে-ই আমাদের তা জানিয়ে দিতেন , তবে বিশ্ব মানব কূলের জন্য তা অশান্তির কারণ হতো। মানুষের চিন্তা, কর্ম, জীবনকে তা প্রভাবিত করতো। ফলে মানব সভ্যতার অগ্রগতি ব্যহত হতো। "Heavy were its burden through the heavens and the earth" তবে পৃথিবীর শেষ দিন বা কেয়ামত যে কোনও মূহুর্তে ঘটে যেতে পারে- হয়তো তা বেশী দূর নয়। ধর্মীয় ভাষায় তা এ ভাবে প্রকাশ করা যায় : ব্যক্তির মৃত্যুক্ষণই হচ্ছে তার জন্য শেষ সময় বা কেয়ামত বা Qiyamat Sugra। সে ভাবে বিচার করলে সকল ব্যক্তির নিকট মৃত্যু সম অভিজ্ঞতা বহন করবে না। অবশ্য মৃত্যু যে কোনও লোকের যে কোনও সময়ে ঘটতে পারে।
৬৫। সেখানে চিরদিন বাস করার জন্য। [সেখানে ] তারা কোন রক্ষাকর্তা বা সাহায্যকারী পাবে না।
৬৬। সেদিন আগুনের মাঝে তাদের মুখমন্ডল উলট-পালট করা হবে ৩৭৭২, এবং তারা বলবে, " আমাদের দুর্ভাগ্য ! আমরা যদি আল্লাহ্কে মানতাম ও রাসুলকে মানতাম।"
৩৭৭২। 'মুখমন্ডল ' শব্দটি দ্বারা ব্যক্তির সমগ্র ব্যক্তিসত্ত্বাকে বোঝানো হয়েছে; এবং উলটপালট শব্দটি দ্বারা সম্মান হানিকর এবং কলঙ্কিত ও অপমানকর অবস্থা বোঝানো হয়েছে। যখন পাপীদের কাজের সমুচিত প্রতিদান দেয়া হবে , তাদের অপমানিত করা হবে। তারা তখন আফসোস করবে পৃথিবীতে সঠিক পথ অবলম্বন না করার জন্য। এ সময়ে তারা পৃথিবীতে অতিবাহিত সময়ের জন্য আক্ষেপ করবে এবং তাদের নেতাদের অভিযুক্ত করবে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত না করার জন্য , তাদের ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করার জন্য। কিন্তু তারা ভুলে যায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব দায় দায়িত্ব রয়েছে তাদের কর্মের জন্য।
৬৮। " হে আমাদের প্রভু ! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দাও ৩৭৭৩ ; এবং তাদের অভিশপ্ত কর মহা অভিশাপ দ্বারা।"
৩৭৭৩। দেখুন অনুরূপ আয়াতের জন্য [ ২৫ : ৬৯ ] আয়াত ও টিকা ৩১২৯ এবং আয়াত [ ১১ : ২০ ] ও টিকা ১৫১৫। শাস্তি দ্বিগুণ করার কারণ :
১) তারা সুপথের পরিবর্তে পাপের পথে বা ভ্রান্ত পথে ছিলো।
২) নিজেরা পাপের পথ অবলম্বন ব্যতীতও তারা অপরকে এই পথে পরিচালিত করে।
৩৭৭৪। ইহুদীরা হযরত মুসার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং আল্লাহ্র আইন ভঙ্গ করে এবং বিভিন্ন বাক্যবাণে তাঁর বিরক্ত উৎপাদন করে। বাইবেলে বর্ণিত মুসার কাহিনী নিম্নরূপঃ [Num. xii 1- 13 ] : মুসার ভগ্নী মিরিয়াম এবং ভাই হারূন মুসাকে বিদেশী ইথিওপিয়ান মহিলাকে বিবাহ করার জন্য সর্বদা দোষারোপ করতো। কিন্তু আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যে মুসা পাপমুক্ত।"My servant Moses is not , so , who is faithful in all mine house" মিরিয়াম শাস্তি হিসেবে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়। সাতদিন রোগাক্রান্ত থাকার পরে আল্লাহ্ তাঁকে ক্ষমা করেন এবং সে আরোগ্য লাভ করে এবং হারুণও আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করে। এই ছিলো ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্য। হযরত মুসার মত, পূণ্যাত্মা রসুলকেও [ সা ] আক্রমণ করা হয়, জাহাসের কন্যা জয়নবকে বিবাহ করার জন্য। অবশ্য এক্ষেত্রে রসুলের [ সা ] নিকট জনেরা তা করেন নাই। আয়াতটির এরই প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়।
৩৭৭৫। " আল্লাহকে ভয় কর ও ন্যায়ের অভিমুখে কথা বল " - এই উপদেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মিথ্যা রটনা ও মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। শুধু যে সত্য কথা বলতে হবে তাই-ই নয়, সর্বদা সঠিক ভাবে -সত্য- বক্তব্যকে উপস্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ সত্য মিথ্যার মিশ্রণ বা সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। সত্যকে সর্বদা সহজ সরল ভাবে , নির্দ্দিষ্ট ভাবে, কথায় ও কাজে সমভাবে উপস্থাপন করতে হবে। আয়াতে [ ২ : ৪২ ] বলা হয়েছে , " তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না।" আমরা যদি সর্বদা সত্যাশ্রয়ীরূপে জীবন অতিবাহিত করতে পারি , তবে আল্লাহ্ আমাদের চরিত্র থেকে দোষত্রুটি দূর করে দেবেন এবং আমাদের আত্মার মাঝে জ্ঞান , প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির জন্ম দেবেন। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য , তিনি আমাদের চরিত্রের দোষত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি , পূর্বের কৃত পাপ ক্ষমা করে দেবেন।
উপদেশ : মিথ্যা আমাদের চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়, আত্মার গুণাবলী অর্জনে বাঁধার সৃষ্টি করে। চরিত্রের সকল নৈতিক গুণাবলীর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সত্যের সাধনা।
৩৭৭৬। এই আয়াতটি পূর্বের আয়াতের ধারাবাহিকতা। সত্য বলা ,সত্য চিন্তা করা , সততার পূর্ব প্রস্তুতি। সততা এমন একটি গুণ যা সত্য থেকে উৎসারিত। জীবনের প্রতিটি কাজে যারা সৎ এবং সততার মাধ্যমে যারা জীবনকে পরিচালিত করেন তাদের জন্য আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হবে। আল্লাহ্ তাদের ত্রুটিমুক্ত ও ক্ষমা করবেন- অর্থাৎ তাঁরা নিজস্ব চারিত্রিক দোষত্রুটি উপলব্ধিতে সক্ষম হবে এবং তা সংশোধন করে সঠিক পথে পরিচালিত হবে। এই উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন অর্ন্তদৃষ্টি , বিবেক ও প্রজ্ঞা। আল্লাহ্ এ সবই তাদের দান করবেন ও তাদের পূর্বের সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। এটাই হচ্ছে আত্মার মোক্ষলাভ বা মুক্তি। আত্মা পৃথিবীর ক্লেদাক্ত পরিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করে পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। পৃথিবীতে মানব জীবনের এটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ চাওয়া ও পাওয়া বা মহাসাফল্য অর্জন।
৩৭৭৭। 'আমানত ' যা ইংরেজীতে বলা হয় "Trust" শব্দটির অর্থ হচ্ছে কোনও ব্যক্তিকে কিছু দেয়া যার বিলি বন্দোবস্ত বা বিন্যাস বা ব্যবস্থা করার অধিকার তার থাকবে। আমানতকারী আমানতের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, এবং মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী বা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করবে। আমানত প্রদত্ত বিষয় বস্তু এমন হবে যে, তা যেনো নষ্ট না হয়ে বরং উত্তোরোত্তর উন্নতি লাভ করে। এখানেই আমানতকারীর সাফল্য নিহিত। যদি আমানতকারীর এ সব কোনও ক্ষমতা না থাকে, তবে প্রকৃতপক্ষে তা আমানত নয়। প্রকৃত পক্ষে যিনি আমানতকারী নিযুক্ত করেন তিনি তা করেন নিজ শর্ত সাপেক্ষে যা আমানতকারী [Trustee] মেনে চলবে।
৩৭৭৮। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৫৯ : ২১ ] ; যেখানে উপমা হিসেবে কোরাণকে পর্বতের উপরে অবতীর্ণ করার উল্লেখ আছে। এই উপমার সাহায্যে মানুষের মানসিক চেতনাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।
৩৭৭৯। আসমান , যমীন ও পর্বতমালা অর্থাৎ মানুষ ব্যতীত বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল সৃষ্ট পদার্থ ; আল্লাহ্র আমানত বা দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করলো। এই অস্বীকার করার অর্থ এই যে তারা "নিজস্ব কোন স্বাধীন ইচ্ছাকে" ধারণ করতে অস্বীকার করলো। তাদের মাঝে ভালোকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ও মন্দকে প্রতিহত করার ক্ষমতা তারা ধারণ করতে অস্বীকার করলো এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যতিরেকেই তারা তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকলো। মানুষ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোন সৃষ্ট পদার্থের বা প্রাণীজগতের ; ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে প্রতিহত করার ক্ষমতা বা ভালোকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ত্যাগ করে মন্দকে গ্রহণ করার ক্ষমতা নাই। এই ক্ষমতার বলেই মানুষ পৃথিবীতে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ ব্যতীত বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত। অর্থাৎ প্রাণী ও জড় ,যার মাঝে আল্লাহ্ যে ধর্ম দান করেছেন সে তাতেই তৃপ্ত এবং তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তার নাই। যেমন : পানির ধর্ম পানির, আলোর ধর্ম আলোর। অনুরূপ ভাবে প্রাণীজগতও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর , যা আল্লাহ্র দেয়া প্রাকৃতিক ধর্ম , যার বাইরে তারা যেতে অক্ষম। তাদের অসম্পূর্ণ জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার থেকে আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হওয়াকে বেছে নেয়। মানুষ অজ্ঞ, তাই সে এই গুরু দায়িত্ব স্ব-স্কন্ধে তুলে নেয়ার স্পর্ধা ও দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে। যার ফলে মানুষ সঠিক পথ থেকে বারে বারে বিচ্যুত হয়। পাপীরা আল্লাহ্র এই আমানতকে খেয়ানত করে এবং তার ফলে তারা আল্লাহ্র শাস্তির যোগ্য হয়। অবশ্য যারা পূণ্যাত্মা তারা পৃথিবীর কালিমা মুক্ত হয়ে জীবনকে পূণ্যময় ভূবনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এরাই হচ্ছেন "Muqarrabin" বা আল্লাহ্র নিকটবর্তী। দেখুন [ ৫৬ : ১১, ৮৮ ] আয়াত। এই-ই হচ্ছে সর্বোচ্চ চাওয়া ও পাওয়া।
এই আয়াত থেকে এ কথাই সুস্পষ্ট যে, এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবী মানুষ সৃষ্টির বহু পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছিলো - যা বর্তমান বিজ্ঞানের তত্বকে সমর্থন করে। পৃথিবীতে মানুষের আগমন আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির অনেক পরে।
৩৭৮০। "Hamala": দায়িত্ব বা ভার গ্রহণ করা, বহন করা , পৌছাইয়া দেয়া [ আমানত বা দায়িত্ব ] ইত্যাদি। অধিকাংশ তফসীরকারগণ এই অর্থ গুলিই গ্রহণ করে থাকেন। তবে অনেকে মনে করেন এই শব্দটি দ্বারা [ সঙ্গে করে ] চলে যাওয়া; পলায়ন করা ; আত্মসাৎ করা ইত্যাদি বোঝায়। অর্থাৎ আল্লাহ্র আমানতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। সেক্ষেত্রে [ ৭২- ৭৩ ] আয়াত পর্যন্ত অর্থ হবে, আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট সকল বস্তু ও প্রাণীকে তাঁর দায়িত্ব অর্পণ করতে চাইলেন। মানুষ ব্যতীত সকল সৃষ্ট বস্তু ও প্রাণী সে দায়িত্ব নিতে ভয় পেলো , এই জন্য যে হয়তো বা তারা তা সঠিক ভাবে পালন করতে পারবে না। কিন্তু মানুষ নির্ভিকভাবে সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলো কারণ মানুষ অজ্ঞ। পরিণতিতে মানুষ সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অক্ষম হয় এবং আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলশ্রুতিতে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়; কেউ হয় মোনাফেক,কেউ অবিশ্বাসী। এদেরকে আল্লাহ্ শাস্তি দান করবেন। অপরপক্ষে যারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বস্ত এবং বিশ্বাসী , তারা আল্লাহ্র কৃপা লাভে সমর্থ হয়। উভয় ক্ষেত্রে মানুষের শেষ পরিণতি একই।
৩৭৮১। দেখুন [ ২ : ৩০ - ৩৪] এবং এর টিকাসমূহ। আল্লাহ্ মানুষের জন্য অত্যন্ত উচ্চ সম্মানীয় স্থান নির্ধারিত করেন। মানুষ যখন পূত পবিত্র থাকে, সে তার আত্মাকে দুর্নিতি দ্বারা কলুষ করে না, তখন তার অবস্থান ফেরেশতাদেরও উপরে। সে অবস্থায় ফেরেশতারা তাঁকে সেজদা করে। কিন্তু মানুষ তাঁর মন্দ কাজের দরুণ নিজেকে কলুষতায় আচ্ছন্ন করে ফেলে যখন তার অবস্থান পশুর থেকেও অধম হয়ে যায়। তাহলে একই মানুষ কখনও ফেরেশতাদের থেকে পবিত্র ও মহৎ আবার কখনও পশুরও থেকে অধম হয় কি ভাবে যে গুণটির জন্য মানুষ ফেরেশতাদের থেকেও সম্মানীয় তা হচ্ছে আল্লাহ্ তাঁর রুহুর অংশ মানুষের মাঝে ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করিয়েছেন [ দেখুন আয়াত [৩২ : ৯] ও [১৫ : ২৯] [৩৮:৭২] এবং টিকা ১৯৬৮ ; অন্যান্য অংশে বিদ্যমান ]। রুহুর অনুপ্রবেশের অর্থ হচ্ছে মানুষের মাঝে ঐশ্বরিক গুণের জন্মলাভ এবং তাঁর সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি - যার সাহায্যে সে ভালো বা মন্দকে গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে। ফলে মানুষের মাঝেই আল্লাহ্র গুণাবলীর ক্ষুদ্র প্রকাশ ঘটে - আবার সেই আত্মাকে কলুষ করার দরুণ পশুশক্তির প্রকাশ ঘটে থাকে।
৩৭৮২। "Zalum" ইংরেজীতে অনুবাদ হয়েছে "unjust" বা অন্যায় এবং "Jahul " এর অর্থ অনুবাদ করা হয়েছে অজ্ঞ। এই শব্দগুলির আরবীতে ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও গভীর ও তীব্র যার দ্বারা মানুষের চরম অজ্ঞতা এবং অন্যায় প্রবণতা বোঝানো হয়েছে। মানুষ তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে অক্ষম। একমাত্র আল্লাহ্র করুণাই তার এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। ভালো ও মন্দের মাপকাঠি হচ্ছে তুলনামূলক। মানুষের দৃষ্টিতে যা সর্বোচ্চ ভালোর প্রতীক হয়তো বা তা খুবই সাধারণ।
এই সীমাবদ্ধ জ্ঞানের মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে আল্লাহ্র প্রতিনিধি [ ২ : ৩০ ] হওয়ার মত এত বড় দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নেয় ? ; এখানেই আদম সন্তান আল্লাহ্র সাথে মানবিক দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য, পৃথিবীকে সুন্দর করার মহৎ প্রচেষ্টার লিখিত ও অলিখিত অঙ্গীকারে আবদ্ধ। দেখুন [ ৭ : ১৭২- ১৭৩] ও টিকা ১১৪৬ - ৪৮ ; এবং [ ৫ : ১ ] ও টিকা ৬৮২। চুক্তি বা অঙ্গীকার [ Mithaq ] প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য যাই-ই হোক না কেন তা হচ্ছে আমানত। এই চুক্তি বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করার অর্থ হচ্ছে আমানত খেয়ানত করা ,যার অবশ্যাম্ভবী পরিণাম হচ্ছে শাস্তি।
৩৭৮৪। যারা আল্লাহ্র উপরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে এবং অঙ্গীকার পূরণে আন্তরিক [ দেখুন টিকা ৩৭৮১ - ৮২ ] ; তারা আল্লাহ্র সাহায্য ও করুণা লাভ করবে। পৃথিবীতে মানুষের দুঃখের কারণ হচ্ছে তার দোষত্রুটি , লোভ লালসা, হিংসা দ্বেষ ইত্যাদি। যদি মানুষ তার চরিত্রের এসব দোষ ত্রুটি দূর করতে সক্ষম হয়, তবেই সে এই পৃথিবীতেই বেহেশতের শান্তির স্বাদ লাভ করবে। এই আয়াতে আল্লাহ্ আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে মুমিন পুরুষ ও নারী , যারা আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহ্ যে সব মানবিক গুণ অর্জনের হুকুম দিয়েছেন তা অর্জনে আন্তরিক , আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করবেন। অর্থাৎ তাদের চরিত্রের দোষ ত্রুটি দূর করে দেবেন। ফলে তারা মহিমান্বিত ও উন্নত জীবনের যোগ্যতা অর্জন করবে। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
পৃথিবীতে আদম সন্তানের জীবনের দুঃখ কষ্ট জটিলতা , বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যমে জীবনের সর্বোচ্চ পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে এই সূরাটি এখানেই শেষ হয়েছে।