Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ৪ জন
আজকের পাঠক ৫৫ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৫৮৯ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৮৭৫ বার
+ - R Print

সূরা সাবা


সূরা সাবা অথবা সাবা শহর - ৩৪

৫৪ আয়াত, ৬ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

ভূমিকা : সূরা নং ৩৪ থেকে সূরা নং ৩৯ পর্যন্ত সূরাগুলিকে নূতন শ্রেণীতে বিন্যাস করা হয়েছে , যার বক্তব্য হচ্ছে আধ্যাত্মিক জগতের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি। এই শ্রেণীর সূরাগুলি শুরু হয়েছে আল্লাহ্‌র প্রশংসা দিয়ে। প্রথম সূরাটি শুরু হয়েছে আল্লাহ্‌র করুণা এবং ক্ষমতা এবং সত্যের উপরে গুরুত্ব আরোপ করে। এর পরে সূরা নং ৩৫ এ বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে ফেরেশতারা আল্লাহ্‌র অসীম ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকে এবং ভালো,মন্দ এবং সত্য -মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপন করে। ৩৬ নং সূরাটি, পূণ্যাত্মা রাসুলের প্রতি এবং তাঁর মাধ্যমে যে গ্রন্থ কোরাণ অবতীর্ণ হয়েছে ; তারই প্রতি নিবেদিত। সূরা নং ৩৭ এ আছে শয়তানের ফাঁদের বর্ণনা; সূরা নং ৩৮ এ দাউদ নবী ও সুলাইমানের উদাহারণের মাধ্যমে বলা হয়েছে মন্দকে কি ভাবে জ্ঞান ও ক্ষমতার দ্বারা পরাজিত করা যায় ; এবং ইয়াকুবের উদাহরণের মাধ্যমে বলা হয়েছে ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সাহায্যে মন্দকে দমন করা সম্ভব। সূরা ৩৯ এ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে শেষ বিচারের দিনের উপরে যখন বিশ্বাসীদের অবিশ্বাসী থেকে পৃথক করা হবে এবং প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে।

এই সূরা অবতীর্ণ হওয়ার সঠিক সময়কাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর অবতীর্ণ কাল হচ্ছে মক্কী সুরাগুলির প্রথম দিকে।

সার সংক্ষেপঃ সত্য এবং কোন ভালো কাজ হারিয়ে যায় না , মানুষের ক্ষমতা ও সম্পদ ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আল্লাহ্‌র ক্ষমতা, ন্যায় এবং সত্য চিরস্থায়ী যা শেষ বিচারের দিনে মানুষের ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বকে গুরুত্ব প্রদান করে থাকে [ ৩৪ : ১ - ৩০ ]।

বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীরা শেষ পর্যন্ত তাদের কর্মফলের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবে এবং নিজেদের সঠিক অবস্থানকে বুঝতে পারবে। [ ৩৪ : ৩১ - ৫৪ ]।


সূরা সাবা অথবা সাবা শহর - ৩৪

৫৪ আয়াত, ৬ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

০১। সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র ৩৭৮৫, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছু যার অধিকারে। পরকালেও সকল প্রশংসা তারই। এবং তিনি প্রজ্ঞাময় , সকল বিষয়ে অবহিত।

৩৭৮৫। আকাশ, পৃথিবী, বিশ্বব্রহ্মান্ড আল্লাহ্‌র প্রশংসায় মশ্‌গুল। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সৃষ্টি আল্লাহ্‌র করুণা ,দয়া , মহত্ব, ক্ষমতা , জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য্য আল্লাহ্‌র নামে আরোপিত [ ৭ : ১৮০ এবং ১৭ : ১১০ এবং টিকা সমূহ ]। আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে ধ্যান করার অর্থ হচ্ছে, তাঁর আরোপিত বিভিন্ন গুণবাচক নাম যা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য-ই আরোপ করা হয়েছে , তা আত্মার মাঝে উপলব্ধির চেষ্টা করা। এই চেষ্টা মানুষের আত্মার মাঝে মনঃজগতকে সত্যের আলোতে প্রত্যাদেশের ন্যায় উদ্ভাসিত করবে। আল্লাহ্‌কে মনের মাঝে, আত্মার মাঝে ধারণ করার চেষ্টা কে পাঁচটি সূরাতে সমানভাবে বন্টন করে দেয়া হয়েছে। সূরাগুলিতে প্রথমেই আল্লাহ্‌র প্রশংসা আত্মাকে মহিমান্বিত করার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরাগুলি হচ্ছে ১নং , ৬নং, ১৮নং, ৩৪নং এবং ৩৫নং সূরা। ৩৪ নং সূরাতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে আল্লাহ্‌র জ্ঞান, ও করুণার স্বাক্ষর যা সর্ব সৃষ্টির মাঝে বিদ্যমান , তা অনুধাবন করার উপরে। তিনি আকাশমন্ডলী অর্থাৎ আমাদের চেনা জানা আকাশের সীমানার বাইরে অনন্ত মহাশূন্যের এবং সীমাহীন সময়ের , এবং আমাদের চেনা জানা পৃথিবীর সকল কিছুর-ই স্রষ্টা ও মালিক। এগুলির অনুভবের মাধ্যমে আল্লাহ্‌কে আত্মার মাঝে অনুভব ও উপলব্ধি করতে হবে।

০২। তিনি জানেন, ভূমিতে যা কিছু প্রবেশ করে ৩৭৮৬ এবং যা কিছু উহা থেকে বের হয়; যা কিছু আকাশ থেকে পতিত হয় ৩৭৮৭ এবং যা কিছু উহাতে আরোহণ করে। এবং তিনি অতীব দয়াময় , ক্ষমাশীল।

৩৭৮৬। বিজ্ঞানে সুন্দর এক তত্ব রয়েছে , যা বিবৃত করে যে : বস্তুর ধ্বংস নাই ; তা শুধু এক রূপ থেকে অন্যরূপ ধারণ করে। শুধু অজ্ঞ লোকেরাই ধারণা করে যে, মাটি পানিকে শোষণ করে নিয়ে পানিকে অস্তিত্ব বিহীন করে ফেলে। অথবা বীজ মাটির নীচে হারিয়ে যায়। পৃথিবীতে কিছুই হারায় না। যে পানি মাটিতে প্রবেশ করে হারিয়ে যায়, সেই পানি-ই পরবর্তীতে নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-কূপ, প্রভৃতি পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করে, পৃথিবীর উদ্ভিদ জগতকে বাঁচিয়ে রাখে, নূতন উদ্ভিদের জন্ম দেয় এবং কোটি কোটি প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখে। সৃষ্টির আদি থেকে কোটি কোটি ধরণের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে বের হয়ে আসছে, এবং নির্দ্দিষ্ট সময় অন্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ; নূতন প্রাণের জন্ম হচ্ছে আবার তা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে - কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুন্যে কিছুই সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় না। জীবন ও মৃত্যু, ধ্বংস ও সৃষ্টি পাশাপাশি কাজ করে যায়। চক্রাকারে তা আবর্তিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। এ সবই হচ্ছে প্রতীক, যার মাধ্যমে পার্থিব জ্ঞানের পরিধি অপার্থিব জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। আমরা মানব সন্তানের জন্ম ও মৃত্যুকে অহরহ প্রত্যক্ষ করে থাকি। এই মৃত্যু হচ্ছে মানবের দৈহিক বা পার্থিব বা জান্তব অংশের মৃত্যু। যখন মৃত ব্যক্তিকে মাটির নীচে কবর দেয়া হয়, অজ্ঞ ব্যক্তিরা মনে করতে পারে যে মৃতের সব শেষ হয়ে গেলো বা সে অস্তিত্ব বিহীন হয়ে গেলো। কিন্তু আল্লাহ্‌র নিকট কিছুই হারায় না।

৩৭৮৭। সুন্দর উপমার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র করুণা ও দয়ার চিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে। পানি বাস্প হয়ে আকাশে উত্থিপ হয় এবং বৃষ্টিরূপ রহমত স্বরূপ মাটিতে ঝরে পড়ে মাটিকে সজীব করে থাকে। ঠিক সেরূপই হচ্ছে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও করুণা। দুঃখে-বিপদে, বিপর্যয়ে ,মানুষ যখন আন্তরিক ভাবে প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকে, আল্লাহ্‌র সাহায্য , পথনির্দ্দেশ প্রার্থনাকারীর সকল সত্তাকে বিধৌত করে দেয়। এ অভিজ্ঞতা প্রতিটি বিজ্ঞ জনেই জীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের সময়ে লাভ করেছেন। সুতারাং এ কথা আমরা যেনো ভুলে না যাই যে, আল্লাহ্‌ পরম করুণাময় ও দয়ালু আবার তিনি ন্যায়বিচারক ও শাস্তি দানেও সক্ষম।

০৩। অবিশ্বাসীরা বলে ৩৭৮৮, " আমাদের নিকট [ কেয়ামতের ] ক্ষণ আসবে না।" বল, " না , আমার প্রভুর শপথ ৩৭৮৯, নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট উহা আসবেই।" যিনি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন; যার নিকট আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ জিনিষও গোপন থাকে না। বরং তার থেকে ছোট অথবা বড় এমন কোন কিছুই নাই যা সুস্পষ্টরূপে কিতাবে লেখা নাই ৩৭৯০-

৩৭৮৮। উপরের আয়াত দুটি আমাদের এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মান্ডে কাফেরদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, আকাশ ও ভূমন্ডলে , আল্লাহ্‌র সকল সৃষ্টি পরস্পর সমন্বিত [Harmony] ভাবে সঙ্গতি রক্ষা করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে। প্রতিটি বস্তু বা প্রাণকে আল্লাহ্‌ এক বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। বস্তু বা প্রাণকে সেই বিশেষ উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত হওয়াই হচ্ছে তার চরম ও পরম পাওয়া , এবং তখনই প্রকৃতিতে সমন্বিত [Harmony] সঙ্গতি ও শান্তি রক্ষা পায়। যে বস্তু বা প্রাণ এই সঙ্গতি রক্ষা না করে, তার ধ্বংস অনিবার্য। কারণ প্রকৃতির সমন্বিত ক্ষমতার বাইরে কেউ যেতে অক্ষম। ঠিক সেই ভাবে আল্লাহ্‌ মানুষের আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্‌র নিকট প্রার্থনা করার জন্য ও আল্লাহ্‌র প্রশংসা করার জন্য। এটাই হচ্ছে আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম। আর এই প্রশংসা ও প্রার্থনা করতে হবে স্ব-ইচ্ছায়। কারণ একমাত্র মানুষকেই স্রষ্টা সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন - যা হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ্‌র আমানত। কাফের বা অবিশ্বাসীরা এই আমানতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে , তাদের অবিশ্বাসের দরুণ [ দেখুন ৩৩ : ৭২ আয়াত এবং টিকা সমূহ ]। অবশ্যই এর পরিণতিতে তাদের আত্মার ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ্‌ বলেছেন তাদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর মর্মন্তুদ শাস্তি দেখুন আয়াত নং ৫ ]। মানুষের কোনও শক্তিই প্রাকৃতিক আইনের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে না। জাগতিক , নৈতিক বা আধ্যাত্মিক সকল কর্মকান্ডই প্রাকৃতিক আইনের অধীন। আল্লাহ্‌ যাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন সেটাই হচ্ছে তার জন্য সেই প্রাকৃতিক আইন। প্রতিটি কাজেরই শেষ পরিণাম আছে। নিউটনের সেই বিখ্যাত সুত্র : Every action there is an equal and opposite reaction. আধ্যাত্মিক জগতের ক্ষেত্রেও এই সুত্র প্রযোজ্য যদিও আধ্যাত্মিক জগত আমাদের চোখে বস্তু জগতের ন্যায় দৃশ্যমান নয়।

৩৭৮৯। আল্লাহ্‌র শপথের মাধ্যমে কিয়ামতের অবশ্যম্ভবীতা সম্বন্ধে আল্লাহ্‌র কর্তৃত্বকে প্রকাশ করা হয়েছে এই আয়াতে; যিনি শেষ বিচারের মালিক।

৩৭৯০। "এমন কোন কিছুই নাই যা সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা নাই।" মানুষের অভিজ্ঞতাকে প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা জানি লিপিবদ্ধ বিবরণী, স্মরণ শক্তি থেকে অধিক নির্ভুল , বিশ্বাসযোগ্য এবং যদি তা সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা হয় তবে তা চিরস্থায়ী। যদি লিপিকা সঠিক ভাবে লেখা হয়; এতে যদি দুর্বোধ্য কিছু না থাকে, তবে সময়ের ব্যবধানেও তা সঠিকভাবে পাঠোদ্ধার হয় এবং বক্তব্য সঠিকভাবে অনুধাবণ করা সম্ভব হয়, যার সম্বন্ধে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না। মানুষের দোষত্রুটি মুক্ত করে আল্লাহ্‌র আইন এভাবেই লিপিবদ্ধ আছে সুস্পষ্ট কিতাবে। আর সে লেখা হচ্ছে নির্ভুল , যা অনন্তকাল স্থায়ী - কখনও মুছে যাবে না। ছোট-বড় , সব কিছু সেখানে স্থান লাভ করেছে এবং ভালো কাজের শেষ পরিণতি পুরষ্কার এবং মন্দ কাজের শাস্তি।

০৪। ইহা এজন্য যে, যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তিনি তাদের পুরষ্কৃত করতে পারেন। তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও উত্তম জীবনোপকরণ ৩৭৯১।

৩৭৯১। 'রিজিক ' - শব্দটির অর্থ ব্যপক। সাধারণ ভাবে রিজিক অর্থ সেই সব খাদ্য যা শরীরের পুষ্টি সাধন করে, তাই আমরা বুঝে থাকি। তবে এর অর্থ সীমাবদ্ধ নয়। রিজিক অর্থ সেই সব জাগতিক বস্তু যা শরীরের পুষ্টি সাধন করে, আধ্যাত্মিক বস্তু যা আত্মার কল্যাণ সাধন করে।

০৫। যারা আমার আয়াতসমূহকে ব্যর্থ করার জন্য সংগ্রাম করে ৩৭৯২, - তাদের জন্য আছে ভয়াবহ অপমানকর শাস্তি,

৩৭৯২। দেখুন আয়াত [ ২২ : ৫১ ]। আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ব্যর্থ করার ক্ষমতা পৃথিবীতে কোনও মানুষের নাই। যারা তা করতে চেষ্টা করবে তাদের পৃথিবী থেকে ধ্বংস করে দেয়া হবে।

০৬। যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে ৩৭৯৩, তারা জানে যে, তোমার প্রভুর নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে , তাই-ই হলো সত্য। ইহা পরাক্রমশালী সকল প্রশংসার যোগ্য আল্লাহ্‌র পথ নির্দ্দেশ।

৩৭৯৩। অবিশ্বাসী কাফেররা অজ্ঞ, তাই তারা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে। কিন্তু যারা জ্ঞানী তারা প্রকৃত পক্ষে জানে যে, আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ, আত্মাকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় আলোকিত করার পন্থা। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ-ই হচ্ছে প্রকৃত পথ-প্রদর্শক, যে পথে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভ করা যায়। একমাত্র আল্লাহ্‌-ই সকল প্রশংসার দাবীদার যিনি অসীম করুণাময় , পরাক্রমশালী। আল্লাহ্‌র শক্তির উদাহরণ দেয়া হয়েছে [ ৩৪ : ৩ ] আয়াতে , যেখানে বলা হয়েছে, " পৃথিবীতে কিছুই তার অগোচর নহে - অণু, পরিমাণ কিছু ..........।"

০৭। অবিশ্বাসীরা [ ব্যঙ্গ করে ] বলে যে, " আমরা কি এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দিব যে তোমাদের বলে যে, তোমরা [ মৃত্যুর পরে ] ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়লেও নূতন সৃষ্টিরূপে উত্থিত হবেই ? ৩৭৯৪

৩৭৯৪। এই আয়াতটিতে কাফেরদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যারা রাসুলকে [ সা ] উপহাস বিদ্রূপ করতো। তাদের ভাষ্য ছিলো নিম্নরূপ , " এটা কি ভাবে সম্ভব মৃত্যুর পরে দেহের ধ্বংসের পরে তা মাটিতে মিশে যাওয়ার পরেও মানুষকে পুণরুত্থিত করা হবে ; এবং নূতন সৃষ্টি করা হবে ? "এর সাথে তারা যোগ করে যে, এ সবই হচ্ছে বিকৃত মস্তিষ্ক উম্মাদের কল্পনা। এরূপ মন্তব্য আজও অবিশ্বাসী কাফেররা করে থাকে ধর্মের ব্যাপারে। কারণ অবিশ্বাস তাদের আত্মার স্বচ্ছতাকে ঢেকে দেয়; ফলে তারা হয় অন্তর্দৃষ্টিবিহীন। তারা আত্মার মাঝে স্রষ্টার উপস্থিতি ও পরলোকের অবস্থানকে অনুভবে অক্ষম।

০৮। " সে কি আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করেছে না সে ভূতে [ আক্রান্ত ] হয়েছে ৩৭৯৫? " না বরং যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না তারাই রয়েছে [ প্রকৃত ] শাস্তির মাঝে এবং সুদূর পথ ভ্রষ্টতাতে।

৩৭৯৫। যদি আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, তবে পরলোকের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে। কারণ ধর্মের মূল কথাই হচ্ছে আত্মা এবং আত্মিক উন্নতির মাধ্যমে পরলোকের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। মানুষের যদি আত্মা না থাকতো , তবে পশুপাখীর ন্যায় মৃত্যুর সাথে সাথেই তার অস্তিত্ব শেষ হযে যেতো। যেহেতু আত্মা অমর এবং নৈতিক জীবনের পবিত্রতা আত্মার উন্নতির মূলধন, সে কারণেই মানব সভ্যতার সূচনা এখানেই এবং পরলোকের জবাবদিহিতার প্রশ্নটিও এসে যায়। পরলোকের জীবন সর্বাপেক্ষা বড় সত্য, যার থেকে বড় সত্য আর কিছু নাই। যিনি এই সত্য শিক্ষা দেন তিনি উম্মাদ হতে পারেন না। যারা তা বলে, তারা প্রকৃত জ্ঞানের অভাবেই তা বলে থাকে এবং নিজ আত্মাকে ভবিষ্যত বিপদের মাঝে নিক্ষেপ করে থাকে। যারা সত্যকে অস্বীকার করে থাকে তাদের পরিণতি হচ্ছে বিপর্যয়। তারা ক্রমাগত প্রকৃত সত্য থেকে দূরে সরে যাবে, প্রকৃত সত্যকে তারা আত্মার মাঝে অনুধাবনে অক্ষম হবে। কারণ সত্য ধারণের অক্ষমতার ফলে আত্মা স্বচ্ছতা হারায় এবং বিভ্রান্ত আত্মা পরলোকের জীবনের প্রকৃত চিত্র উপলব্ধিতে অক্ষম হবে এবং তাদের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটবে।

০৯। ওরা কি তাদের সামনে ও পিছনে , আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার প্রতি লক্ষ্য করে না ? ৩৭৯৬ যদি আমি ইচ্ছা করতাম , তবে মাটি তাদের গ্রাস করে ফেলতো ৩৭৯৭, অথবা আকাশের একখন্ড তাদের উপরে পতিত হতো ৩৭৯৮। প্রত্যেক অনুগত বান্দা যারা [ অনুতাপের মাধ্যমে] আমার নিকট ফিরে আসে তাদের জন্য অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন।

৩৭৯৬। আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস আত্মাকে আলোর জগতে স্থাপন করে থাকে , যার ফলে আত্মার মাঝে ন্যায়-অন্যায়ের, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা উপলব্ধি ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি, অর্ন্তদৃষ্টি , জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্ম নেয়। যে আত্মা এক স্রষ্টায় বিশ্বাসী নয় সেতো আলোবিহীন অন্ধকারের যাত্রী। আধ্যাত্মিক অন্ধকার তার সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এরাই পরলোক সম্বন্ধে উপহাস করে। এদেরকেই বলা হয়েছে চারিপাশের প্রকৃতির মাঝে আল্লাহ্‌র ক্ষমতাকে উপলব্ধি করতে। যিনি নভোমন্ডল এবং ভূমন্ডলের স্রষ্টা। যিনি এদের সম্বন্ধে নির্দ্দিষ্ট আইন প্রবর্তন করেছেন এবং যিনি এই বিশাল ভূমন্ডলের সকল জীবের জীবনোপকরণ দিয়ে থাকেন। যার এত ক্ষমতা, তিনি কি আর এক নূতন পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারেন না ? অবিশ্বাসীরা তাকিয়ে দেখুক, নভোমন্ডলের মহাজাগতিক আইন কত কঠোর ভাবে অনুশীলিত হয়। স্রষ্টার আইন সর্বদা ন্যায় ও অবশ্যই তা প্রতিপালিত হয়ে থাকে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের এই উদাহরণও কি তাদের আল্লাহ্‌র হুকুমের প্রতি জ্ঞানচক্ষু উম্মীলিত করবে না ? আল্লাহ্‌র আইন প্রতিষ্ঠিত হবেই এবং সকল মিথ্যা ধ্যান ধারণা ও অন্যায়ের অবসান ঘটে প্রকৃত সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবেই।

৩৭৯৭। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ১৬ : ৪৫ ] এবং টিকা ২০৭১। এ সব নগন্য পুঁচকে জীব কারা , যারা আল্লাহ্‌র ক্ষমতা ও মহিমা সম্পর্কে প্রশ্ন করে ?

৩৭৯৮। দেখুন আয়াত [ ২৬ : ১৮৭ ] যেখানে এই বাক্যটি দ্বারা অবিশ্বাসীরা হযরত সুয়েব নবীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেছিলো। ফলশ্রুতিতে শুয়েবের সম্প্রদায়ের উপরে ছাই ও অঙ্গার বর্ষিত হয় এবং তারা তার নীচে সমাধিত হয়ে পড়ে।

রুকু - ২

১০। আমি আমার পক্ষ থেকে দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম ৩৭৯৯। "হে পর্বতমালা! তোমরা দাউদের সাথে আমার মহিমা কীর্তন কর; এবং বিহঙ্গকুলকেও [ তা বলি ] !" এবং তাঁর জন্য লৌহকে নমনীয় করে দিয়েছিলাম ৩৮০০; -

৩৭৯৯। দেখুন আয়াত [ ২১ : ৭৯ -৮০ ] এবং টিকা ২৭৩৩ - ৩৪। দাউদ নবীকে আল্লাহ্‌ গানের প্রতিভা দান করেছিলেন , তাঁর গান ছিলো আল্লাহ্‌র গুণগানে পরিপূর্ণ যেগুলি বাইবেলে প্রার্থনা সঙ্গীত নামে আজও পরিচিত। অবশ্য সময়ের ব্যবধানে যেগুলি সম্পূর্ণ অবিকৃত নাই। তিনি যখন প্রার্থনা গান গাইতেন বিশ্ব-প্রকৃতি, পর্বতমালা, বিহঙ্গকূল তাঁর গানের প্রতিধ্বনি করতো।

মন্তব্য : গানের প্রতিভাও আল্লাহ্‌র-ই দান। সুতারাং এই প্রতিভা যখন মানুষের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত হয় তখনই তার স্বার্থকতা।

৩৮০০। লৌহ একটি অত্যন্ত শক্ত ধাতু। কিন্তু কামারের হাতে সেই শক্ত লৌহ কোমল ও নমনীয় হয়ে যায় এবং কারিগর তাঁর ইচ্ছামত বাঁকিয়ে লৌহের যন্ত্রপাতি তৈরী করে থাকে। আল্লাহ্‌ দাউদ নবীকে লৌহের দ্বারা বর্ম তৈরীর পদ্ধতি শিক্ষা দেন যেনো সমরক্ষেত্রে পূণ্যাত্মা লোকেরা আত্মরক্ষা করতে পারে। লৌহের এই বিশেষ ব্যবহার দাউদ নবীর দান - যা আল্লাহ্‌ তাঁকে শিক্ষা দেন।

১১। [ আদেশ দিয়েছিলাম]: " তুমি বর্ম তৈরী কর বুননে পরিমাণ রক্ষা করে ৩৮০১ এবং তোমরা সৎকাজ কর।" ৩৮০২। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আমি তা [ সুস্পষ্ট ভাবে ] দেখে থাকি।

৩৮০১। লৌহের বর্ম বা কোট তৈরী অত্যন্ত কৌশলপূর্ণ শিল্পকলা। একটি লোহার আংটার সথে আর একটি লোহার আংটা জোড়া দিয়ে তা করা হয়, কিন্তু সম্পূর্ণ বর্মটি ব্যবহারের পূর্ণ মাপের হয় এবং আরামদায়ক হয়।

৩৮০২। লক্ষ্য করুন এই আয়াতটি শুরু হয়েছে এক বচন দিয়ে , " তুমি বর্ম তৈরী কর বুননে পরিমাণ রক্ষা করে।" এখানে তুমি একবচন ব্যবহার করা হয়েছে , যার দ্বারা শুধুমাত্র দাউদ নবীকে সম্বোধন বুঝায়। কারণ দাউদ নবী-ই ছিলেন বর্ম তৈরীর কারিগর। আল্লাহ্‌ তাকেই এই বিদ্যা শিক্ষা দেন। এর পরে দ্বিতীয় লাইনে বহু বচনে বলা হয়েছে : " তোমরা সৎ কর্ম কর, তোমরা যাহা কিছু কর আমি উহার সম্যক দ্রষ্টা।" এখানে বহুবচনে দাউদ নবী ও তাঁর সহযোগী যোদ্ধাদের সম্বোধন করা হয়েছে। দাউদ নবী বর্ম তৈরী করেছেন সত্য , কিন্তু তা ব্যবহার করবে সকল যোদ্ধারা। তাই আল্লাহ্‌ দাউদ নবী ও তাঁর সহযোগী যোদ্ধাদের সর্তক করেছেন যে তাঁরা যেনো কখনও অন্যায় যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করে। ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত না হয়। যুদ্ধ যেনো কোনও অবস্থাতেই হাঙ্গামা ও অত্যাচারের পর্যায়ে চলে না যায়। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ সর্তকবাণী প্রেরণ করেছেন এবং সর্তক করে দিয়েছেন যে, তিনি সকল কিছুরই সম্যক দ্রষ্টা। এখানে একবচন ব্যবহার করা হয়েছে , "আমি তা [ সুস্পষ্ট ভাবে ] দেখে থাকি।" বাক্যটি দ্বারা।

১২। এবং বায়ুকে সুলাইমানের আজ্ঞাবহ করেছিলাম ৩৮০৩। ইহা সকালে একমাসের [ পথ ] অতিক্রম করতো এবং সন্ধ্যায় এক মাসের [পথ ] অতিক্রম করতো। আমি তাঁর জন্য গলিত তামার প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছিলাম ৩৮০৪। তাঁর প্রভুর অনুমতিক্রমে জ্বিনদের কতক তাঁর সম্মুখে কাজ করতো ৩৮০৫। যদি কেউ আমার আদেশ অমান্য করে তাকে আমি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি আস্বাদন করাইব।

৩৮০৩। দেখুন আয়াত [ ২১ : ৮১ - ৮২ ] ও টিকা ২৭৩৬ এবং আয়াত [ ৩৮ : ৩৬- ৩৮ ]। মানুষের পায়ে হেটে বা গরুর গাড়ীতে এক মাসের পথ অতিক্রম করার মত দূরত্ব , সুলাইমান নবীর হুকুমে বাতাস একদিনে অতিক্রম করতো। বর্তমান যুগে প্লেনের দ্বারা এরূপ দূরত্ব অতিক্রম করা কোনও অসম্ভব ব্যাপার নয়।

৩৮০৪। ওল্ড টেস্টামেন্টের ক্রনিকাল্‌স এর ৩ এবং ৪ নং অধ্যায়ে মূল্যবান বস্তু সমূহের বর্ণনা আছে, যা সুলাইমান তাঁর মসজিদ তৈরীর জন্য ব্যবহার করেছিলেন। এই বর্ণনাতে বলা হয়, তিনি তা সজ্জিত করার জন্য সুন্দর পাত্র , দীপাধার ,প্রদীপ ইত্যাদি তৈরী করেন। "Solomon made all these vessels in great abundance : for the weight of the brass could not be found out." [ II chronicles , iv-18] ।

৩৮০৫। দেখুন আয়াত [ ২৭ : ১৭ ] এবং টিকা ৩২৫৭।

১৩। তারা সুলাইমানের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতো , [ তৈরী করতো ] খিলান, মূর্তি, পুকুরের ন্যায় বড় পাত্র, এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ ৩৮০৬। [ বলেছিলাম ] : " হে দাউদের পরিবার ৩৮০৭ , কৃতজ্ঞতার সাথে কাজ কর। কিন্তু আমার বান্দাদের মধ্যে অতি অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ।"

৩৮০৬। 'Mihrab' বহুবচনে 'Mahasib' বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে খিলান ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে 'arch' বা ধনুকাকৃতি খিলান বা ধনুকাকৃতি ছাদ বিশিষ্ট স্থাপত্য শিল্প। সম্ভবতঃ যে কোনও সুউচ্চ , প্রশস্ত সুন্দর স্থাপত্য শিল্পের জন্য শব্দটি প্রযোজ্য। যেহেতু শব্দটি সুলাইমানের তৈরী মসজিদের জন্য প্রযোজ্য সেহেতু 'arch' শব্দটি অধিক প্রযোজ্য। কারণ মসজিদের জন্য ধনুকাকৃতি খিলান ও ছাদ সৌন্দর্য বর্দ্ধিত করে, বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী মূর্তিগুলি হচ্ছে ডানাওয়ালা দেবশিশুর এবং ষাড়ের ছিলো এবং বড় বড় পাত্র নির্মান করা হয়েছিলো ; কিছু ছিলো বড় বড় থালা যাতে বহু লোক গোল হয়ে বসে খাবার গ্রহণ করতে পারে। এটা হচ্ছে মধ্য প্রাচ্যের এক সামাজিক নিয়ম। আর তৈরী করা হয়েছিলো রান্নার জন্য বড় বড় ডেকচি। [chronicles , iv-22, 16]।

৩৮০৭। সুলাইমানের তৈরী মসজিদটি ইহুদীদের জন্য এক গর্বের বস্তু। আল্লাহ্‌ এ কারণে ইহুদীদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে বলেছেন। দাউদ পরিবার দ্বারা ইহুদী গোষ্ঠিকেই বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্‌র রহমত ও অনুগ্রহ ব্যতীত কোনও মহৎ কাজই সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যতীত ক্ষমতা ও গৌরব স্থায়ী করা বা ধরে রাখা সম্ভব নয়। কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানেই ইহুদীরা এই সত্যকে ভুলে যায়।

১৪। অতঃপর ,যখন আমি সুলাইমানের মৃত্যুর হুকুম দিলাম ,মাটির ক্ষুদ্র এক পোকা ব্যতীত কেহই জ্বিনদের তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে অবগত করায় নাই ৩৮০৮; যে পোকা তার লাঠিকে খাচ্ছিল। সুতারাং যখন সে পড়ে গেলো, তখন জ্বিনেরা বুঝতে পারলো যে, তারা যদি অদৃশ্য বিষয় সম্বন্ধে অবগত থাকতো তাহলে তারা [ তাদের কাজের দরুণ ] অপমানকর শাস্তিতে আবদ্ধ থাকতো না ৩৮০৯।

৩৮০৮। হযরত সুলাইমান [ আ ] লাঠিতে ভর দিয়ে বায়তুল মুকাদ্দিসের নির্মাণ কার্য তদারক করছিলেন। সেই অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যু হয়। বায়তুল মুকাদ্দিসের নির্মাণ কার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর মৃত দেহটি, জীবিত অবস্থায় তিনি যেই ভাবে ছিলেন , সেই ভাবে স্থির থাকে। নির্মাণ কার্য যখন শেষ হয় তখন লাঠিটি ভেঙ্গে পড়ে এবং তিনিও মাটিতে পড়ে যান। সম্পূর্ণ আয়াতটির মর্মার্থ তিনটি শিরোনামে ভাগ করা যায়।

১) মানুষের ক্ষমতা ও জাঁকজমক যতই বেশী ও গৌরবময় হোক না কেন তা সবই ক্ষণস্থায়ী। মানুষ অনুধাবন করার পূর্বেই তার ক্ষয় শুরু হয়ে যায়।

২) পৃথিবীর অসাধারণ ঘটনাসমূহ সব সময়ে উচ্চনাদে ভেরীধ্বনির মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় না। সুলাইমানের মত অসাধারণ রাজন্যের মৃত্যু সংবাদ যখন কেহই জানতে পারে নাই; তা লোকচক্ষুর অগেচরে ছিলো ; তখন সর্ব সমক্ষে প্রকাশ পেলো, যখন লাঠিটি ভেঙ্গে গেলো।

৩৮০৯। জ্বিনেরা তাদের কাজকে শাস্তি হিসেবে মনে করতো। অপরপক্ষে , দাউদ নবীর লোকেরা এই কাজকে পবিত্র মনে করতো এবং অত্যন্ত যত্নসহকারে কার্য সম্পাদন করতো। ফলে তাদের কাজ পূণ্য কাজে রূপান্তরিত হয়। অপরপক্ষে জ্বিনেরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র শাস্তির ভয়ে কাজ করতো। সুতারাং তাদের কাজের মধ্যে কোনও পূণ্য ছিলো না যদিও মসজিদ তৈরীর কাজটি পূণ্য কাজ ছিলো। তারা অদৃশ্য বিষয়ে অবগত ছিলো না। সুতারাং তারা পোকার বিষয়ের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারে নাই।

উপদেশ : কাজের নিয়ত দ্বারাই কাজের প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয়। আল্লাহ্‌কে খুশী করার জন্য একান্ত আন্তরিকভাবে কাজ করা হয় তাই-ই পূণ্য।

১৫। পূর্ব থেকেই সাবা বাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে ছিলো এক নিদর্শন ৩৮১০ - দুই সারি বাগান একটি ডান দিকে , অপরটি বামদিকে। " তোমাদের প্রভু যে জীবনোপকরণ দান করেছেন তা থেকে আহার কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। সুখী ও সুন্দর নগরী এবং ক্ষমাশীল প্রভু।" ৩৮১১

৩৮১০। সূরা [ ২৭ : ২২ ] আয়াতে ইয়েমেনের অন্তর্গত যে শহরের উল্লেখ আছে এই‌ সাবা নগরী সেই একই নগরী। নগরীর অবস্থানের জন্য উক্ত আয়াতের টিকা দেখুন। উক্ত আয়াতের সময়কাল ছিলো সুলাইমান ও সাবার রাণী বিলকিসের সময়কাল। এই আয়াতে যে সময়কাল বর্ণনা করা হয়েছে, ,তা বিলকিসের সময়কাল থেকে শত বৎসর পরে। এই রাজ্য তখনও সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরপুর ছিলো। সাবাবাসীরা বাঁধ নির্মাণ করে জলসেচের সুবন্দোবস্ত করে। ফলে সারাদেশে প্রচুর শষ্য ও ফল-মূল উৎপন্ন হয়। সম্ভবতঃ সেচের খালের দুপাশে ছিলো তাদের উদ্যান গুলি যার বর্ণনাতে বলা হয়েছে "দুইটি উদ্যান, একটি ডানদিকে, অপরটি বামদিকে।" খালের যে কোন স্থান থেকেই উদ্যানের অবস্থান এরূপই হওয়া সম্ভব।

৩৮১১। দেশটি ছিলো মনোরম এবং এই শহরের বাসিন্দারা ছিলো সুখ ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ পরিপূর্ণ ভাবে লাভ করেছিলো। আল্লাহ্‌ মহান ও ক্ষমাশীল; তিনি মানুষের ছোটখাট দোষত্রুটি ক্ষমা করে দেন।

১৬। কিন্তু তারা [আল্লাহ্‌র দিক থেকে ] মুখ ফিরিয়ে নিল, ফলে আমি তাদের বিরুদ্ধে বাঁধ ভেঙ্গে বন্যা প্রেরণ করলাম ; ৩৮১২, ৩৮১৩। এবং আমি তাদের দুই সারি বাগানকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন বাগানে যা উৎপন্ন করে তিক্ত ফল এবং ঝাউগাছ ও [ক্ষুদ্রকায় ] কিছু কূল গাছ ৩৮১৪।

৩৮১২। সাবাবাসীদের সুখ ও সমৃদ্ধির বাগানে অবিশ্বাস ও পাপের কীট প্রবেশ করে তা ধবংস করে দেয়। যুগে যুগে পৃথিবীতে সভ্যতার পতন ঘটেছে তাদের পাপের দুরুণ। এই পাপ বিভিন্ন মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। সম্ভবতঃ সাবার লোকেরা তাদের সুখ ও সম্পদের গর্বে গর্বিত হয়ে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে ওঠে। বাঁধ তৈরীতে তারা যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রকাশ করেছে; উন্নত সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা যে সম্পদশালী দেশ গড়তে সক্ষম হয়েছে এ জন্য তারা আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে উদ্ধত অহংকারী হয়ে ওঠে। হয়তো তারা সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলো ; ধনী ও গরীবের প্রভেদ ছিলো আকাশচুম্বী। হয়তো সমাজে এক শ্রেণী সুবিধা ভোগ করতো অন্য শ্রেণী থাকতো বঞ্চিত ; উচ্চবর্ণ , নিম্ন বর্ণের ভেদাভেদ মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়নে বাঁধা দান করতো ইত্যাদি। আজ এত সময়ের ব্যবধানে তাদের সঠিক পাপটির কথা আমাদের জানা নাই , তবে এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে, তারা আল্লাহ্‌র আদেশ অমান্য করেছিলো। অর্থাৎ যে সম্পদ প্রাচুর্য আল্লাহ্‌ তাদের দান করেছিলেন , তারা ভুলে গিয়েছিলো , যে সম্পদ ও প্রাচুর্য কোন বিশেষ জনগোষ্ঠির জন্য নয়। আল্লাহ্‌র নেয়ামত সকলকেই সমভাবে ভোগ করতে হয়। তবেই সেই নেয়ামতের বরকত বা প্রাচুর্য বৃদ্ধি পায়। এই হচ্ছে পৃথিবীতে অন্যান্য প্রাকৃতিক আইনের মত, নৈতিক আইন। যে আইন আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করে দিয়েছেন যা অলঙ্ঘনীয়। সম্ভবতঃ তারা এই নৈতিক আইন ভঙ্গ করেছিলো। সুতারাং তাদের পাপ কাজের প্রতিক্রিয়া ঘটতে বাধ্য; প্রকৃতির প্রতিশোধ অবশ্যাম্ভবী। ইয়েমেনের পূর্ব প্রান্ত উচ্চ ভূমিতে বৃষ্টিপাতের ফলে বৃষ্টির পানি ভূমির ঢাল বেয়ে নিম্ন প্রান্তে চলে এসে তা জনজীবন বিপর্যস্ত করতো। এই পানিকে মাআরিব নামক স্থানে বাঁধের সাহায্যে প্রাকৃতিক হ্রদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং খাল কেটে এই পানি সেচের ব্যবস্থা করা হয়। যখন তাঁদের অবাধ্যতা ও পাপের পাত্র পূর্ণ হয়, তখন আল্লাহ্‌র শাস্তি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে নেমে আসে। প্রচন্ড বন্যা তাদের বাঁধকে ভেঙ্গে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং তা আর পুণঃনির্মাণ সম্ভব হয় নাই। তবে যে বাঁধ তাদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দের উপায় ছিলো , আল্লাহ্‌ তাকেই তাদের বিপদ ও মুসিবতের কারণ করে দিলেন। কারণ বাঁধ না থাকাতে তাদের সেচ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং ফলে তাদের সম্পূর্ণ বাগানও শুকিয়ে যায়।

৩৮১৩। "Arim" অর্থাৎ বাঁধ অথবা মাটি দ্বারা তৈরী ও পাথর দ্বারা আচ্ছাদিত বিশাল মাআরিব বাঁধের নামও হতে পারে। এই বাঁধের সামান্য অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান আছে। ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে ফরাসী পর্যটক T.J Arnand পুরাতন ভগ্ন মাআরিব বাঁধ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। তিনি এর বিশালত্ব ও শিলালিপি সম্বন্ধে বর্ণনা করেন Journal Asiatique for January 1874। সম্পূর্ণ বিবরণ ফরাসী ভাষাতে লেখা। দ্বিতীয় বিবরণের জন্য দেখুন H.B. Harris , Journey Through Yemen, Edinburgh 1893, ফরাসী পর্যটক 'Arnand' বাঁধটির বর্ণনাতে উল্লেখ করেন যে, তা দুই মাইল লম্বা এবং ১২০ ফুট উচ্চ। বাঁধটি সম্ভবতঃ ১২০ খৃষ্টাব্দে ধ্বংস হয়ে যায় - যদিও অনেকে মনে করেন আরও পরে তা ধ্বংস হয়ে যায়।

৩৮১৪। সমৃদ্ধিশালী বাগান অরণ্যে পরিণত হয়। রসালো ফল গাছের স্থানে তিক্ত স্বাদ যুক্ত ফল গাছ জন্মে । ঝাউগাছ অর্থাৎ এগুলি এমন গাছ যাতে ফুল বা ফল কিছুই জন্মে না। যেখানে ফুলের ঘ্রাণে বাতাস আমোদিত হতো, রসালো ফলভারে বৃক্ষ অবনত থাকতো সেখানে তিক্ত স্বাদ যুক্ত ফলের গাছ , ঝাউ গাছ যাতে ফল বা ফুল কিছু জন্মে না , এবং আগাছাতে ভর্তি হয়ে যায়। আরবী লোটগাছকে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে কূল গাছ, লোট গাছ এমন এক ধরণের গাছ যার ফল সুস্বাদু নয় বা তার ছায়াও কার্যকরী নয়। আঙ্গুর ও দাড়িম্ব ফলের স্থানে এসব বৃক্ষ জন্মে। অর্থাৎ এ এমন এক চিত্র যার সাহায্যে বোঝানো হয়েছে সুসজ্জিত ফল ও ফুলের বাগানের পরিবর্তে আগাছার অরণ্য।

১৭। আমি তাদের এই প্রতিদান দিয়েছিলাম , কারণ তারা অকৃতজ্ঞভাবে ঈমানকে প্রত্যাখান করেছিলো ৩৮১৫। অকৃতজ্ঞ প্রত্যাখানকারী ব্যতীত আমি [ এরূপ ] প্রতিদান কখনও দেই না।

৩৭১৫। 'Kafur' কুফরীর সর্বোচ্চ অবস্থা। যারা সর্বদা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং তাঁর দেয়া অনুগ্রহকে সনাক্ত করে তাঁর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে কৃতঘ্ন হয় - তাদের জন্য এই শব্দটি। এসব লোকেরা সর্বদা নিজেদের পাপে নিমগ্ন রাখে।

১৮। তাদের এবং যে সব জনপদকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলির মধ্যবর্তী স্থানে আমি বিখ্যাত শহর সমূহ স্থাপন করেছিলাম এবং তাদের মধ্যে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম ; " দিনে এবং রাত্রিতে তোমরা সেখানে নিরাপদে ভ্রমণ কর।" ৩৮১৬

৩৮১৬। লোভের শেষ পরিণাম ধ্বংস ; সাবাবাসীদের পৃথিবীর সম্মুখে এর জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছে। লোভের পরিণতিতে তারা নিজেদের কণ্ঠনালী নিজেরাই ছিঁড়ে ফেলে। প্রাচীনকালে ধূপ ধূনা অত্যন্ত মূল্যবান সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যে দেশ ধূপ উৎপন্ন করতে পারতো তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হতো। একদেশ থেকে অন্যদেশে ধূপ আমদানী রফতানীর যে বাণিজ্যিক রাস্তা তার বর্ণনা আছে [Imam Mubin xv. 79; Sabil Muqim xv. 76]। Frankinense rout বা ধূপের বাণিজ্যিক পথটি অবস্থিত ছিলো আরব ও সিরিয়ার মধ্যে। সিরিয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তাটি প্রসারিত ছিলো এক দিকে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর মধ্যবর্তী সমৃদ্ধশালী উপত্যকা পর্যন্ত , অন্যদিকে মিশর এবং ভূমধ্যসাগর বেষ্টন করে রোম সাম্রাজ্য পর্যন্ত। রাস্তাটির অন্য প্রান্ত সিরিয়া থেকে ইয়েমেনের সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত প্রসারিত ছিলো। সেখান থেকে সমুদ্র জাহাজের মাধ্যমে ভারত, মালয় এবং চীনের সাথে সংযোগ ছিলো। ইয়েমেন , সিরিয়া রাস্তাটি ছিলো বহুল ব্যবহৃত। এই রাস্তার পাশেই ছিলো সালেহ্‌ নবীর দেশ [ মাদইন সালেহ্‌ ] ,পরবর্তীতে যে রাস্তাটি তীর্থযাত্রীরা ব্যবহার করতো। সিরিয়ার উপরে আল্লাহ্‌র রহমত অকৃপণভাবে বর্ষিত হয়েছিলো। এই সেই সমৃদ্ধশালী উর্বর ভূমি যেখানে হযরত ইব্রাহীম বাস করতেন। পবিত্র প্যালেস্টাইন এর অন্তর্ভূক্ত। সমৃদ্ধির সেই দিনগুলিতে রাস্তার দুপাশে কাছাকাছি বহু সমৃদ্ধ নগরী গড়ে উঠেছিলো , যে সব স্থানে বণিকরা নির্ভয়ে , নিরাপদে তাদের বানিজ্য সম্ভার নিয়ে চলাচল করতে পারতো। নগরী গুলি কাছাকাছি থাকাতে বাণিজ্যপথে ডাকাতির সম্ভাবনা কম ছিলো। সম্পূর্ণ বাণিজ্য পথটি ছিলো নিরাপদ।

১৯। কিন্তু তারা বলেছিলো ৩৮১৭ , " হে আমাদের প্রভু! আমাদের ভ্রমণের বিশ্রাম স্থান দূরে দূরে স্থাপন কর ৩৮১৮।" কিন্তু [ এর দ্বারা ] তারা নিজেদেরই ক্ষতি করলো। অবশেষে আমি তাদের প্রবাদ কাহিনীতে পরিণত করলাম ৩৮১৯। এবং তাদের আমি ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয়ই এর মাঝে নিদর্শন রয়েছে প্রতিটি [আত্মার জন্য] যারা ধৈর্য্যশীল, দৃঢ় ও কৃতজ্ঞ।

৩৮১৭। 'তারা বলেছিলো ' কোরাণের ভাষায় এখানে " বলেছিলো" অর্থাৎ কার্যে পরিণত করার জন্য চিন্তা করলো। তফসীরকারগণ এই শব্দটিকে বলেন, "Language of actual facts" [Zaban hal] যার বিপরীত আছে "Language of words" [Zaban qal] ।

৩৮১৮। সাবা নগরীর অধিবাসীরা সম্পদ ভোগ করতে করতে আল্লাহ্‌র হুকুমকে ভুলে যায়। তারা ভুলে যায় আল্লাহ্‌র নেয়ামতকে একা ভোগ করা যায় না। সবার সাথে অংশদারিত্বে ভোগ করলে আল্লাহ্‌র নেয়ামতের বরকত বৃদ্ধি পায়। সাবা নগরীর অধিবাসীরা ন্যায় -অন্যায় পার্থক্য ভুলে স্বার্থপর ও লোভী হয়ে ওঠে। বণিকদের নিকট থেকে বিভিন্ন নগরী যে আয় করতো , সে আয় তারা একাই ভোগ করতে চায়। এ জন্য তারা বণিকদের থামার বহুস্থানকে নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে কেন্দ্রীভূত করে যেনো শুধু তাদের অধিকার একচেটিয়া হয়। এর জন্য তারা বড় বড় শহর বন্ধ করে দেয় ও বাণিজ্য পথে চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। স্বার্থপরতা ও লোভ মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে ধবংস করে দেয়। এটা আল্লাহ্‌র নৈতিক আইন। লোভী ও স্বার্থপর ব্যক্তি চক্ষু থাকতেও অন্ধ হয়, ফলে তারা লোভের ও স্বার্থপরতার বশবর্তী হয়ে নিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। সাবা বাসীদের বেলাতেও এই সত্য প্রযোজ্য ছিলো। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ইয়েমেনের পতনের সাথে সাথে আরবের প্রধান বাণিজ্য পথ ইয়েমেন - সিরিয়ার বাণিজ্য পথ ধীরে ধীরে প্রত্যাখাত হয় এবং মহাকালের গর্ভে একদিন তা হারিয়ে যায়। মহাকালের যাত্রা পথে জাতির উত্থান পতনকে আমরা খুব স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করি। এ কথা সত্য যে বাহ্যিক ভাবে বিভিন্ন জাতির পতনের বিভিন্ন কারণ থাকে, কিন্তু সব চেয়ে বড় কারণ যেটা সকল জাতির জন্য প্রযোজ্য তা হচ্ছে জাতির নৈতিক অধঃপতন। যখনই কোনও জাতি আল্লাহ্‌ প্রদত্ত নৈতিক নীতিমালা থেকে বিচ্যুত হয়ে ন্যায় -অন্যায়ের পার্থক্য ভুলে যায় তখনই সে জাতির পতন অবশ্যাম্ভবী হয়ে দাঁড়ায়।

৩৮১৯। আল্লাহ্‌ সাবা নগরীর অধিবাসীদের সকল রকম সুযোগ-সুবিধা দান করেছিলেন। তাদের যেমন ছিলো সম্পদ ,তেমনি ছিলো দক্ষতা ও ব্যবসা বাণিজ্য , সর্বপরি তাদের ছিলো সমৃদ্ধশালী ও সুন্দর একটি দেশ। জাতি হিসেবে তারা ছিলো অত্যন্ত গুণবান। যতদিন তারা তাদের এই গুণাবলী চরিত্রের মাঝে ধারণ করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো তারা ছিলো একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী জাতি। নৈতিক গুণাবলী হচ্ছে আল্লাহ্‌র আইন মানার প্রবণতা। যেমন : সততা , ন্যায়পরায়নতা, সত্যপরায়ণতা ইত্যাদি হচ্ছে আল্লাহ্‌র হুকুম বা নৈতিক আইন। যারা বা যে জাতি এই হুকুম মেনে চলে তাদের সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি অনিবার্য। আর যারা তার বিরোধিতা করে অর্থাৎ যে জাতি মিথ্যার দোষে নিমগ্ন। অন্যায় দুর্নীতিপরায়ণতা যাদের নৈতিক চরিত্র ,তাদের ধবংস অনিবার্য, এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র আইন। সাবাবাসীরা যখন অন্যায় লোভে স্বার্থপর হয়ে ওঠে এবং অন্যের সমৃদ্ধিতে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে একাই সব ভোগ করতে চায়, তখনই তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়ে পড়ে। সম্ভবতঃ তাদের পতনের কারণ সমূহের মধ্যে প্রথমত : ছিলো প্রাকৃতিক। হয়তো বা আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে দেশটিতে বৃষ্টিপাত কমে যায় ; যার কারণ হয়তো বা অধিক বৃক্ষকর্তনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। মানুষই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করার মূল কারণ। উপরন্তু বাণিজ্য রাস্তার পরিবর্তন ঘটার জন্য তাদের আয় কমে যায়। বানিজ্য সড়কের পরিবর্তনের কারণঃ পূর্বে এই সড়কের দুপার্শ্বে অজস্র জনপদ ছিলো, এবং এ সব জনপদে নিরাপত্তার অভাব ছিলো না। ফলে বণিকেরা তাদের বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে নির্ভয়ে এই রাস্তায় চলাচল করতো। এবং রাত্রিতে এ সব জনপদে আশ্রয় গ্রহণ করতো। কিন্তু সাবা বাসীরা লোভের বশবর্তী হয়ে অন্য সকলকে উচ্ছেদ করে বণিকদের থামার জন্য নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি স্থানকে কেন্দ্রীভূত করে। ফলে সমগ্র বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা রহিত হয়ে যায় কারণ ডাকাতির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পূর্বের জনবসতিগুলি এমন সুষম ও সমান দূরতে গড়ে উঠেছিলো যে বণিকেরা নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এক জনবসতি থেকে অন্য জনবসতিতে পৌঁছে যেতো - যেখানে তাদের জন্য ছিলো নিরাপত্তা, আশ্রয়, ও আহার, তারা দিন রাত্রি সর্বক্ষণ নিশ্চিন্তে সফর করতো। এখন জনবসতিগুলি বহুদূরে অবস্থানের ফলে বণিকদের পথিমধ্যে রাত্রি নেমে আসতো , এবং নির্জন সড়কে প্রায়ই তারা ডাকাতির সম্মুখীন হতো। এ সব কারণে প্রধান বাণিজ্য সড়কটি আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সুতারাং সাবাবাসীরা যখন চরিত্রের নৈতিক গুণাবলী হারিয়ে ফেলে তখনই তাদের বিপর্যয় শুরু হয়। চরিত্রের নৈতিক গুণাবলীই মানুষকে জনপ্রিয় করে তোলে। জাতির পতনের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অন্য যে কোনও কারণকেই দায়ী করা হোক না কেন এর মূল কারণ একটাই আর তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র হুকুমকে অমান্য করে মানুষ যখন শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ, লোভ, অর্থ -সম্পদ এককথায় জাগতিক বিষয় বস্তুর আরাধনা করে তখনই বিভিন্ন বিপর্যয় বিপদের আকারে নেমে আসে। সুক্ষভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় এসব বিপর্যয় অপ্রতিরোধ্য নয়। কিন্তু মানুষের লোভ ও স্বার্থপরতা যেখানে বড় হয়ে দেখা যায় , সেখানে এসব বিপর্যয় মোকাবিলার মত ক্ষমতা থাকে না। কারণ তাদের মাঝে প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুপস্থিত থাকে ফলে তারা শয়তানের ফাঁদে আটকে যায়। এ ভাবেই সাবাবাসীরা ধীরে ধীরে মহাকালের অতলগর্ভে হারিয়ে যায় এবং কাহিনীতে পরিণত হয়।

উপদেশ : মানুষের লোভ ও স্বার্থপরতা কখনও প্রকৃত সুখের সন্ধান দিতে পারে না। আল্লাহ্‌র করুণা ও অনুগ্রহ-ই হচ্ছে প্রকৃত সুখ ও সমৃদ্ধির ঠিকানা। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ সকলের সাথে অংশীদারিত্বে বৃদ্ধি পায়; সম্পদে , প্রাচুর্যে উপচে পড়ে। কিন্তু স্বার্থপরতা ও লোভ যদি প্রকট আকার ধারণ করে এবং একাই সব ভোগ করতে চায়, তবে সে শয়তানের ফাঁদে আটকে পড়ে। চরিত্রের নৈতিক গুণাবলীই ব্যক্তি বা জাতিকে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের যোগ্য করে তোলে।

অনুবাদকের মন্তব্য : এ সব কারণেই খৃষ্টান হওয়া সত্বেও পাশ্চাত্যে সমাজ আজ উন্নতির শিখরে।

২০। এবং তাদের সম্বন্ধে শয়তান তার ধারণা সত্য প্রমাণ করলো ৩৮২০, এবং বিশ্বাসীদের একদল ব্যতীত তারা সকলেই শয়তানের অনুসরণ করেছিল।

৩৮২০। দেখুন আয়াত [ ১৭ : ৬২ ]। যেখানে উদ্ধত শয়তান বলেছিলো, " যদি আপনি আমাকে কেয়ামত পর্যন্ত সময় দেন , তবে আমি সামান্য সংখ্যক ছাড়া তার [ আদম ] বংশধরদেরকে সমূলে নষ্ট করে দেব।" শয়তানের এই উক্তিটি সাবাবাসীদের জন্য সত্য হয়েছিলো। শয়তান মানুষকে জোর করে কিছু করাতে অক্ষম। মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি " যখন ভালোকে প্রত্যাখান করে মন্দকে গ্রহণ করে থাকে তখনই তারা শয়তানের ক্ষমতার অধীনে চলে যায়।

২১। তাদের উপরে তার [শয়তানের] কোন কর্তৃত্ব ছিলো না। কারা পরলোকে বিশ্বাসী এবং কারা খারাপ সন্দিহান তা প্রকাশ করে দেয়াই ছিলো আমার উদ্দেশ্য। এবং তোমার প্রভু সমস্ত জিনিসের উপরে নজর রাখেন। ৩৮২১

৩৮২১। "কারা পরলোকে বিশ্বাসী এবং কারা খারাপ সন্দিহান তা প্রকাশ করে দেওয়াই ছিলো আমার উদ্দেশ্য।" এখানে প্রশ্ন আসতে পারে আল্লাহ্‌ তো সর্বজ্ঞ ' প্রকাশ করে তাঁর লাভ কি ? আত্মসমালোচনা দ্বারা আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে আমরা যেনো প্রশিক্ষিত করতে পারি সে কারণেই আল্লাহ্‌ আমাদের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এই শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা যেনো সুনির্দ্দিষ্ট ভাবে নিজেকে এই প্রশ্ন করি, " তুমি কি শুধু আল্লাহকেই আরাধনা করবে না আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত করবে ? " দেখুন [ ৩ : ১৫৪ ] আয়াতের টিকা নং ৪৬৭। মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য এই ব্যবস্থা।

রুকু - ৩

২২। বল," আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের [উপাস্য] মনে কর তাদের ডাক ৩৮২২। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে তাদের অনু পরিমানও ক্ষমতা নাই ৩৮২৩। এই দুয়ের মধ্যে তাদের কোন অংশ নাই, তাদের কেউ আল্লাহ্‌র সাহায্যকারীও নয়।

৩৮২২। পৃথিবীর মানুষ জাগতিক জীবনকে এত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে, এত ভালোবাসে যে, জাগতিক জীবনের বাইরে আর কিছুই সে কল্পনা করতে পারে না। ফলে তার জীবনে ক্ষমতা ও অর্থই হয়ে পড়ে একমাত্র আরধ্য বিষয়বস্তু। মানুষ সেই সব জিনিষের পিছনে অন্ধের মত ছুটে বেড়ায় যা তার জন্য সম্পদ ও সৌভাগ্য বহন করে আনবে বলে মনে করে। মানুষ আল্লাহকে ভুলে দিবারাত্র এদেরই আরাধনা করে থাকে , এরাই তাদের আরাধ্য দেবতা।

৩৮২৩। আকাশ ও পৃথিবীতে কোন কিছুর উপরে মিথ্যা উপাস্য সমূহের কোনও ক্ষমতা নাই। আমাদের আধ্যাত্মিক ও দৈনন্দিক জীবনে এদের কোনও প্রভাব নাই। যদি কেউ মনে করে যে এ সব মিথ্যা উপাস্য সামান্য কিছু হলেও আল্লাহ্‌র ক্রিয়া কর্মে সাহায্য করে থাকে তবে তা সর্বৈব মিথ্যা এবং তা আল্লাহ্‌র প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করার মত জঘন্য কাজ। আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান তিনি তার ক্ষমতা কারও সাথে অংশীদারিত্ব করেন না। তাঁর কারও সাহায্যের প্রয়োজন নাই। তাঁর সমকক্ষ কেহ নাই।

মন্তব্য : বাংলাদেশে অনেকেই মাজারে যেয়ে সাহায্য প্রার্থী হয় বা বিপদ ও মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পীরের স্মরণাপন্ন হয়, এ সব অত্যন্ত গর্হিত কাজ।

২৩। যাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে সে ব্যতীত আল্লাহর নিকট কারও সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। ৩৮২৪। এমন কি [শেষ বিচারের দিনে] যখন তাদের মন থেকে ভয় দূর করা হবে ৩৮২৫, তখন তারা [পরস্পরের মধ্যে] বলবে, "তোমাদের প্রভু কি আদেশ করেছেন ?" ৩৮২৬ তারা বলবে ," যা সত্য ও ন্যায়। বস্তুতঃ তিনি সুউচ্চ সুমহান।"

৩৮২৪। দেখুন আয়াত [ ২০ : ১৯ ] এবং টিকা ৩৬৩৪ যেখানে দুধরণের তফসীরের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রতিটি আত্মা তার নিজস্ব কাজের জন্য জবাবদিহিতায় আবদ্ধ থাকবে। কেহ কারও জন্য সুপারিশ করার অধিকার পাবে না। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌ যাদের অনুমতি দেবেন তারাই পাবে। শেষের সে দিন বড়ই ভয়ংকর - যখন পূণ্যাত্মারাও ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যাবে আল্লাহ্‌র ক্ষমতা দেখে। দেখুন পরবর্তী টিকা।

৩৮২৫। " তাদের মন থেকে " এই "তাদের" দ্বারা আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী ফেরেশতাদের বোঝানো হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্‌র অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার প্রকাশ দেখে ফেরেশতারা পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যাবে। কি ঘটতে যাচ্ছে সেটুকু বোঝারও তাদের শক্তি থাকবে না। তারা পরস্পরকে প্রশ্ন করবে এবং তার ফলেই তাদের সাহস ফিরে পাবে। অথবা এই " তাদের " দ্বারা তাদেরই বোঝানো হয়েছে যারা সুপারিশের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছিলো।

৩৮২৬। তারা পরস্পর প্রশ্নের মাধ্যমে এই সত্যকে অনুধাবনে সক্ষম হবে যে আল্লাহ্‌র বিচার সর্বদা সত্য এবং ন্যায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে।

২৪। বল " কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে জীবনোপকরণ দান করে থাকেন?" ৩৮২৭ বল, " আল্লাহ! এবং এটা নিশ্চিত যে , হয় আমরা না হয় তোমরা সঠিক পথে অথবা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছ। " ৩৮২৮।

৩৮২৭। পরবর্তী ছয়টি আয়াতের বক্তব্য "বল' এই শব্দটি দ্বারা শুরু হয়েছে। আয়াতগুলি হচ্ছে ২২, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, এবং ৩০। ২২নং আয়াতে আল্লাহ্‌র একত্বের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ২৪নং আয়াতে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া , ২৫ নং আয়াতে মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ব , শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে বলা হয়েছে ২৬ নং আয়াতে, ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ্‌র ক্ষমতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, এবং ৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে মৃত্যুর পরে কেয়ামতের দিনের বিচার সম্বন্ধে , যা অবশ্যাম্ভবী এবং যেদিন ভালো, মন্দ, ন্যায়-অন্যায় প্রতিটি জিনিষের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে।

৩৮২৮। ভালো, মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য এক সাথে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে ভালোর সাথে মন্দের, ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের , পাপের সাথে পূণ্যের কোনও আপোষ হতে পারে না। তবে সংসারে অমিশ্র ভালো বা অমিশ্র মন্দ দেখা যায় না। সাধারণ মানুষের মাঝে ভালো ও মন্দের সংমিশ্রণ দেখা যায়। এবং আমাদের মানুষের এই দোষ ত্রুটি মেনে নিয়েই জীবনের পথ অতিক্রম করতে হয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, আমাদের একই সাথে আল্লাহ্‌ ও অপদেবতার এবাদত করতে হবে। জীবনের কোনও অবস্থাতেই আল্লাহ্‌র সাথে কোনও কিছুকেই শরীক করা চলবে না। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্যের অবস্থান পরস্পর বিপরীত মেরুতে। আলো যেরূপ অন্ধকারের বিপরীত অবস্থানে থাকে, ঠিক সেরূপ ন্যায়ের অবস্থান অন্যায়ের বিপরীত মেরুতে। আলো ও অন্ধকারের উপমা দেয়া হলো কারণ অন্ধকারের গভীরতা ও আলোর ঔজ্জ্বল্য সব সময়ে এক সাথে থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ বলে চলে যে মেঘে আবৃত তারাবিহীন কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অন্ধকার এবং মেঘশূন্য আকাশের তারার আলোতে উদ্ভাসিত রাত্রির অন্ধকার এক নয়। আবার সূর্যের প্রথম আলোর ঔজ্জ্বল্য ও মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তি এক নয়। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্‌র হেদায়েতের আলো সবার নিকট সমভাবে উদ্ভাসিত হয় না। যার আধ্যাত্মিক দৃষ্টি যত স্বচ্ছ সে তত বেশী গভীরভাবে এই আলোর দীপ্তি অনুভবে সক্ষম।

এই সব আয়াতে সুস্পষ্ট প্রমাণদির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ই স্রষ্টা, মালিক, এবং সর্বশক্তিমান। বর্ণনা করা হয়েছে পাপ ও পূণ্যের মধ্যে পার্থক্য। সুতারাং যে বিজ্ঞ সে নিজেই চিনে নেবে সে ভ্রান্ত পথে না সৎ পথে স্থিত হয়েছে।

২৫। বল," আমাদের পাপ সম্বন্ধে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে না এবং তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমাদেরও জবাবদিহি করতে হবে না ৩৮২৯। "

৩৮২৯। আল্লাহ্‌ প্রত্যেক মানুষকে বিবেক দান করেছেন। ভালো, মন্দ , পাপ-পূণ্য ও ন্যায়-অন্যায় কে সনাক্ত করার ক্ষমতা দান করেছেন। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন, সৎ বা অসৎ পথকে বেছে নেবার জন্য। সুতারাং প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভালো বা মন্দের জন্য দায়ী, কেউ কারও অপরাধের জন্য দায়ী থাকবে না।

২৬। বল, " আমাদের প্রভু আমাদের একত্র করবেন এবং সবশেষে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আমাদের [ ও তোমাদের ] মাঝে সকল বিষয়ের মীমাংসা করে দেবেন ৩৮৩০। তিনিই শ্রেষ্ঠ মীমাংসাকারী , তিনিই সব কিছু জানেন। "

৩৮৩০। পৃথিবীতে নানা মত নানা পথ। কোনটি ভুল কোনটি সঠিক নানা দ্বন্দ্বে মানুষ তা বুঝতে পারে না, ভুল সিদ্ধান্তে উপণীত হয়। যদি তুমি আল্লাহ্‌র একত্বে বিশ্বাসী হও, এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল হও তাহলে তোমরা এবং আমরা [ বিশ্বাসীরা ] একই ভাতৃত্বের অংশ। বাইরের গাত্রবর্ণ বা সংস্কৃতি বা সম্পদ কিছুই আমাদের এই ভাতৃত্বের বন্ধনকে ছিন্ন করতে পারবে না। শেষ বিচারের দিনে আমাদের সকলকেই আল্লাহ্‌ প্রকৃত সত্য অবগত করাবেন।

২৭। বল, " যাদের তোমরা আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করেছ, তাদেরকে আমাকে দেখাও। কোন ভাবেই [ তোমরা তা পারবে ] না। বরং আল্লাহ্‌ ক্ষমতায় পরাক্রমশালী , প্রজ্ঞাময় ৩৮৩১।"

৩৮৩১। সমস্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতার উৎস আল্লাহ্‌। যদি কেউ তার বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুর উপরে স্থাপন করে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত করে তবে তা বৃথা। কারণ আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কোনও কিছুই তাঁর সমকক্ষ নয় -ক্ষমতায় ও প্রজ্ঞায়। তিনি শ্রেষ্ঠ পরাক্রমশালী , প্রজ্ঞাময়।

২৮। আমি তো তোমাকে বিশ্বভূবনের মানুষের জন্য [ বার্তাবহ রূপে ] প্রেরণ করেছি - তাদের জন্য সুসংবাদদাতা ও [ পাপের বিরুদ্ধে ] সর্তককারী রূপে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা বুঝতে পারে না ৩৮৩২।

৩৮৩২। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ বসুলের [সা ] মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। এটা শুধুমাত্র কোনও পরিবার , বা কোন গোত্র বা কোন নির্দ্দিষ্ট জাতির জন্য নয়। এই প্রত্যাদেশ বিশ্বের সমগ্র মানব জতির জন্য রহমত স্বরূপ। যদি কেউ আল্লাহ্‌ দিকে মুখ ফেরায় , তাঁর নিকট আত্মসমর্পন করে - তাদের জন্য আছে আল্লাহ্‌র রহমত। আর কেউ যদি আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে অস্বীকার করে, তবে তাদের সর্তক করা হয়েছে তাদের পাপের জন্য যার অবশ্যম্ভবী পরিণাম আল্লাহ্‌র শাস্তি। এই শাস্তি তাৎক্ষণিক নয় ; কিন্তু তাই বলে সন্দেহের অবকাশ নাই। কারণ তাদের পাপের পরিণাম ঘোষণা করা হয়েছে দ্ব্যর্থহীন এবং পরিষ্কার ভাষায়। মানবাত্মার শেষ পরিণতি সম্বন্ধে কোনও সন্দেহের অবকাশ নাই। তবে কেন নির্বোধ মানুষ দেরী করে ? কেন মানুষ ছিদ্রান্বেষী হয় ? কেন মানুষ আল্লাহ্‌র প্রতি আত্মনিবেদন করে প্রত্যাদেশের সত্যকে জীবনে গ্রহণ করে না ; এবং অনুতাপের মাধ্যমে পূণ্যাত্মা হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে না ?

২৯। তারা জিজ্ঞাসা করে, " যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে বল কবে তোমাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে?"

৩০। বল, " তোমাদের [সাক্ষাতের ] জন্য রয়েছে এক নির্দ্দিষ্ট দিন , যা তোমরা মূহুর্তকাল বিলম্বিত অথবা ত্বরান্বিত করতে পারবে না।" ৩৮৩৩

৩৮৩৩। প্রতিটি মানব আত্মাকে পৃথিবীতে এক নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রাখা হবে। সেটাই হচ্ছে তার জন্য "শিক্ষানবীশকাল " - পৃথিবীর জীবনের মাধ্যমে আত্মাকে বিকশিত ও উন্নত করার জন্য। সেই সময়ের পরে আর কেউ অনুতাপ করার সুযোগ লাভ করবে না। সুতারাং সৎ কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়।

রুকু - ৪

৩১। অবিশ্বাসীরা বলবে, " আমরা এই কিতাবে [কুর-আন] অথবা যা এর পূর্বে এসেছে তার কোনটাই বিশ্বাস করি না ৩৮৩৪।" তুমি যদি দেখতে পেতে যখন এই পাপীদের তাদের প্রভুর সম্মুখে দাঁড় করানো হবে , তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি [দোষারোপ ] করতে থাকবে ৩৮৩৫। যারা ছিলো নগণ্য তারা ক্ষমতাদর্পীদের বলবে যে, ৩৮৩৬; " তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মোমেন হতাম।"

৩৮৩৪। কাফের যারা তারা আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করে না। যুগে যুগে এদের অবস্থানের কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই। রসুলের [ সা ] যুগে আরব মোশরেকরা কোরাণকে গ্রহণে অস্বীকার করে। এমন কি যারা কিতাবধারী জাতি তারাও আল্লাহ্‌ প্রেরিত শেষ এবং সার্বজনীন প্রত্যাদেশ কোরাণকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা তা করে তাদের উদ্ধত অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব থেকে।আরব মোশরেকরা এদের দ্বারা প্রভাবিত হতো। রসুলের [ সা ] যুগে গত হয়েছে , কিন্তু এ মানসিকতা সম্পন্ন্‌ দুধরণের লোক এখনও বিদ্যমান। একদল যারা পার্থিব জ্ঞানের গর্বে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং দুর্বল পক্ষকে প্রভাবিত করে , প্রতারিত করে থাকে।

৩৮৩৫। মূল কথা হচ্ছে দুর্বল ও প্রভাবশালী উভয়েরই বিশ্বাসের অভাব ছিলো অত্যন্ত বেশী। দুপক্ষই সমান দোষে দোষী। যখন শেষ বিচারের দিন উপস্থিত হবে এবং সকলের হিসাব গ্রহণ করা হবে, তখন একপক্ষ অন্যপক্ষকে দোষারোপ করতে থাকবে।

৩৮৩৬। অজ্ঞলোক যারা কিতাবধারী জাতিদের দ্বারা প্রতারিত হবে তারা বলবে, " তোমরা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছ ; তোমরা পূর্বে প্রত্যাদেশ লাভ করেছ ; সুতারাং তোমরা শেষ নবীর আগমন সম্বন্ধে অবগত ছিলে ; কিন্তু আমরা ছিলাম না। তোমাদের খারাপ উদাহরণ দ্বারা আমরা প্রভাবিত হয়ে আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশকে গ্রহণ করি নাই। তোমাদের খারাপ উদাহরণ না থাকলে আমরা বিশ্বাসীতে পরিণত হতাম।" অথবা যারা দুর্বল চিত্ত এবং সর্বদা তাদের নেতাকে অনুসরণ করে থাকে, অথবা যারা কম নেয়ামত প্রাপ্ত , তারা তাদের থেকে যারা শ্রেষ্ঠ তাদের অনুসরণ করে থাকে। এ সব লোকদেরই এখানে দুর্বল বলা হয়েছে। পৃথিবীতে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করতো এবং নিজেদের ভন্ডামিপূর্ণ কার্যকলাপ দ্বারা লাভবান হতো ; শেষ বিচারের দিনে তারা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে।

৩২। ক্ষমতাদর্পীরা, যারা ছিলো নগন্য তাদের বলবে, "সৎ পথের নির্দ্দেশ লাভ করার পরে আমরাই কি তোমাদের তা থেকে নিবৃত্ত করেছিলাম ? না , বরং তোমরাই সীমালঙ্ঘন করেছিলে।" ৩৮৩৭

৩৮৩৭। বিপথে চালনাকারী ও বিপথগামী উভয়েই উভয়কে দোষারোপ করবে। তবে উভয়ের মধ্যে সামান্য হলেও সত্য আছে। তবুও নিজেদের ব্যক্তিগত দায়িত্ব উপলব্ধি না করার জন্য উভয়েই সমভাবে দোষী।

৩৩। যারা ছিলো নগণ্য তারা ক্ষমতাদর্পীদের বলবে, " না বরং এটা ছিলো [তোমাদের ] দিনরাত্রির ষড়যন্ত্র ৩৮৩৮। স্মরণ কর ! তোমরা [ অবিরত ] আমাদের আদেশ দিতে যেনো আমরা আল্লাহ্‌র প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারি এবং তার সাথে সমান অংশীদারিত্ব আরোপ করি।" ৩৮৩৯। যখন তারা শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করবে, তারা [তাদের ] অনুতাপ ঘোষণা করবে ৩৮৪০। আমি অবিশ্বাসীদের গলায় বেড়ী পরাবো। এটা হবে শুধুমাত্র তাদের [মন্দ ] কর্মের প্রতিদান।

৩৮৩৮। যারা বুদ্ধিমান এবং প্রভাবশালী ছিলো , তারা দুর্বল চিত্তদের ও অজ্ঞদের নিজেদের অধীনে রাখার জন্য দিবা রাত্র চক্রান্ত করতো যেনো তারা কিছু জানতে না পারে এবং অজ্ঞ থাকে। তারা তাদের পাপের পথে পরিচালিত করে যেনো এ ভাবে দুর্বল ও অজ্ঞদের তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

৩৮৩৯। যদি মানুষ প্রকৃত ঈমানদার হয় এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপাসনা করে তবে তারা কখনও অন্যায় ও অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ করবে না। কারণ ঈমানের দৃঢ়তা শুধুমাত্র মৌখিক নয় - কাজের মাধ্যমেই প্রকৃত ঈমানের প্রকাশ ঘটে। আল্লাহ্‌ যে সব কাজকে নিষেধ করেছেন , যদি আল্লাহ্‌কে খুশী করার জন্য দৃঢ়ভাবে তা থেকে বিরত থাকতে পারে - তবেই সে প্রকৃত ঈমানদার। প্রকৃত ঈমানদার কখনও অন্যায় ও অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ করবে না। ঈমানদারদের পদ দলিত করা বা এদের উপর প্রভুত্ব করা সহজ নয়। কারণ তারা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র নিকট মাথা নত করে থাকে। সুতারাং ক্ষমতাদর্পীরা তাদের ক্ষমতার ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য আল্লাহ্‌র হুকুম সমূহ অমান্য করার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে। আর এই কাজের জন্য তারা প্রতারণা ও অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। মানুষকে তারা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার জন্য উদ্বুদ্ধ করে -যা অন্যায় ও অসত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত।

৩৮৪০। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৫৪ ] এবং টিকা ১৪৪৫। শেষ বিচারের দিনে পরস্পরের প্রতি অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে কোন সুফল বয়ে আনবে না। ভয়ঙ্কর সে দিনে সকলেই প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে পারবে। পৃথিবীতে যে সব ঘটনা তাদের চোখে মায়া অঞ্জন পরিয়েছিলো , পরলোকে সকল মিথ্যা, সকল প্রতারণা , সকল প্রচার, ভান, মিথ্যা জাহির সব কিছু বিদূরিত হয়ে সত্যের প্রকৃত রূপ উদ্ভাসিত হবে। সেদিন অন্যায়কারী ,পাপীর অন্তর অনুতাপে পূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু অনুতাপ করার জন্য তখন আর কোনও সময় থাকবে না। তাদের মন্দ বা পাপ কাজ তাদের গলদেশে জোয়ালের ন্যায় বেষ্টন করে থাকবে। একেই বলা হয়েছে , "গন্ডদেশে বেড়ী পরাইব।" মানুষ পৃথিবীতে যে যা করে - ভালো কাজ বা মন্দ কাজ - তার প্রতিক্রিয়া তার মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এ ভাবেই সে পৃথিবীর জীবনে প্রতিনিয়ত মন্দ কাজে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তার চিন্তা-ভাবনার জগত সেই কাজের পরিণতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যা ভালো , সুন্দর , পূণ্য তা বোঝার ক্ষমতা তার থাকে না। সে হিসেবে পৃথিবীতেই অন্যায়কারীর গলদেশে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে যা বাহ্যিক ভাবে দৃষ্টিগোচর হয় না। মৃত্যুর পরে পাপীদের কর্মফল জোয়ালের ন্যায় পাপীদের স্কন্ধে চেপে বসবে। পৃথিবীতে তারা তাদের আত্মাকে পাপ কাজের দাসে পরিণত করেছিলো , সেই দাসত্বের জোয়াল থেকে তাদের মুক্তি ঘটবে না। এটাই হবে তাদের জন্য আল্লাহ্‌র ন্যায় বিচার। তাদের পাপ কাজ-ই তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

৩৪। আর আমি যখনই কোন স্থানে সর্তককারীদের প্রেরণ করেছি, উহার ধনী অধিবাসীরা বলেছে, " তোমাদের যে বার্তাসহ প্রেরণ করা হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাস করি না।" ৩৮৪১

৩৮৪১। যুগে যুগে যখনই আল্লাহ্‌র বাণী মানুষকে সত্য পথে আহ্বান করেছে - একদল তার বিরোধিতা করে থাকে। তারা তা করে কারণ আল্লাহ্‌র বাণী তাদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত হানে , তারা তাদের কায়েমী স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ্‌র বিধানের বিরোধিতা করে থাকে। পার্থিব ক্ষমতা, তাদের উদ্ধত অহংকারী করে তোলে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতার জন্ম দেয়। অহংকার বোধ ও জাগতিক সুখ-সম্পদ, আরাম-আয়েশ তাদের সত্যকে ধারণ করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। প্রকৃত সত্য ও ন্যায়কে তারা বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ে। সুতারাং তারা আল্লাহ্‌র বাণী - যা প্রকৃত জীবন বিধান তা অস্বীকার করে থাকে। কারণ তা তাদের কয়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যায়।

৩৫। তারা বলেছিলো, " আমরা ধনে ও সন্তানে অনেক বেশী ৩৮৪২, এবং আমাদের শাস্তি দেয়া হবে না।"

৩৮৪২। ক্ষমতা ও ধন সম্পদ মানুষকে উদ্ধত, অহংকারী করে তোলে। প্রভাব প্রতিপত্তি তাদের শক্তিমদমত্ত করে তোলে। তাদের ধারণা যেহেতু পৃথিবীতে তারা শ্রেষ্ঠ, পরলোকেও তাদের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করা হবে। আয়াত ৩১-৩৩ পর্যন্ত এ সব উদ্ধত অহংকারী ও ক্ষমতাদর্পী তারা যাদের দুর্বল ও অবজ্ঞেয় মনে করতো তাদের তুলনা করা হয়েছে।

৩৬। বল, " অবশ্যই আমার প্রভু যার প্রতি ইচ্ছা রিয্‌ক বর্ধিত করেন, অথবা সীমিত করেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকে তা বুঝতে পারে না ৩৮৪৩। "

৩৮৪৩। 'রিয্‌ক' - Provision, sustenance বা জীবনোপকরণ। এই শব্দটির অর্থ - জীবন ধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই এর অর্ন্তগত। পার্থিব ধন-সম্পদ, ক্ষমতা , প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুযোগ-সুবিধা, মানসিক দক্ষতা, প্রতিভা ইত্যাদি। এ কথা চিন্তা করা ঠিক নয় যে, পৃথিবীতে যাকে জীবনোপকরণ বেশী দেয়া হয়েছে সে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ধন্য এবং যাকে কম দেয়া হয়েছে তার অর্থ এই নয় যে, সে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ বঞ্চিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপারটি বিপরীত। কারণ জাগতিক বিষয় বস্তু বেশী পাওয়ার ফলে অধিকাংশ লোক পরলোকের কথা ভুলে যায়। অন্ধ অহংকারে উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং পরকালের শাস্তিকে অস্বীকার করে পাপের অতলে তলিয়ে যায়। অপর পক্ষে বিপদে, দুর্যোগে, দুর্দ্দশায় লোকে বেশী করে সেই সর্বশক্তিমানের সাহায্য কামনা করে, যা তাদের জন্য প্রকৃত মঙ্গলজনক। পৃথিবীর সভ্যতার অগ্রগতির জন্য , মানুষের আত্মিক বিকাশের চরম উৎকর্ষতা লাভের জন্য আল্লাহ্‌ মানুষের "জীবনোপকরণ" এর বণ্টন করেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে - যা সাধারণ মানুষ অনুধাবনে অক্ষম। কেউ বেশী লাভ করে কেউ কম। কিন্তু এর প্রকৃত নিহিতার্থ অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ সাধারণ মানুষ অজ্ঞ।
রুকু - ৫

৩৭। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কেহই তোমাদের আমার সামান্যতম নিকটবর্তী করতে পারবে না ৩৮৪৪। কিন্তু যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে - এদের জন্যই রয়েছে তাদের কাজের দরুণ বহুগুণ পুরষ্কার ৩৮৪৫। তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে [ বসবাস ] করবে ৩৮৪৬।

৩৮৪৪। নশ্বর দেহের মাঝে যে আত্মা - তা পরমাত্মার অংশ। কারণ আল্লাহ্‌ তাঁর রুহুর অংশ মাটির নশ্বর দেহের অভ্যন্তরে ফুঁকে দিয়েছেন [ ৩২ : ৯ ; ১৫ : ২৯ ]। সুতারাং এই আত্মা সৃষ্টির আদিতে থাকে পূত ও পবিত্র। পৃথিবীতে এই আত্মার ক্রমবিকাশই প্রতিটি মানুষের ইহলোকের জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। পরলোকে যখন প্রতিটি আত্মাকে হিসেবের সম্মুখীন করা হবে, তখন পাথির্ব ধন-দৌলত হিসেবের বিবেচ্য বিষয় হবে না। যা বিবেচ্য হবে তা হচ্ছে আত্মিক উন্নতি। আর এই উন্নতির মানদন্ড পার্থিব ধন-দৌলত নয়। ঈমান ও সৎকর্ম -ই হবে সেদিন প্রধান মানদণ্ড। ঈমানের সর্বোচ্চ বিকাশ আত্মার মাঝে তখনই ঘটে যখন ব্যক্তি আত্মার মাঝে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য অনুভব করে থাকে।

৩৮৪৫। দেখুন আয়াত [ ৩০ : ৩৯ ]। পার্থিব অর্থ-সম্পদ , প্রভাব-প্রতিপত্তি , ক্ষমতা, সন্তান-সন্ততি কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সময়ের পরিক্রমায় তা একদিন শেষ হয়ে যায়। অনন্ত কালের পটভূমিতে তাদের স্থায়ীত্ব এতই কম যে এ সবের কোনও প্রকৃত মূল্যমান নাই। কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনে ও আল্লাহ্‌কে খুশী করার জন্য সৎ কাজ করে , তারাই প্রকৃত পক্ষে আত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রগামী। পার্থিব জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ধন-সম্পদ অর্জন নয়। আত্মিক বিকাশ ও উন্নতিই হচ্ছে এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। যে এই উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছে। সেই ধন্য ইহকালে ও পরকালে। তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ বলেছেন, তাদের জন্য অঢেল পুরষ্কার আছে যা তাদের কর্মগুণকেও অতিক্রম করে যাবে। তারা আল্লাহ্‌র সীমাহীন অনুগ্রহের অংশীদারিত্ব লাভ করবে।

৩৮৪৬। এসব পূণ্যাত্মাদের পুরষ্কারের বর্ণনা এভাবে করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে তারা সুখের সাগরে নিমজ্জিত হবে। পার্থিব সকল সুখের থেকে প্রকৃত পক্ষে তা হবে বহুগুণ [ বহুগুণ পুরষ্কার ] ; এবং তাদের এই পুরষ্কার হবে মহিমান্বিত , সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ [ "প্রাসাদে থাকিবে " ]। পাথরের সুউচ্চ প্রাসাদের ন্যায় তা মহিমান্বিত ও সুউচ্চ। তাদের সুখ -শান্তি হবে অনন্তকাল স্থায়ী [ নিরাপদে থাকিবে ]। তা পার্থিব সুখ শান্তির মত সময়ের আবর্তনে হারিয়ে যাবে না।

৩৮। যারা আমার আয়াত সকলকে ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে উহার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে , তারা শাস্তি ভোগ করতে থাকবে ৩৮৪৭।

৩৮৪৭। দেখুন আয়াত [ ৩৪ : ৫ ] ; যেখানে বলা হয়েছে যারা আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ব্যর্থ করার প্রয়াস পায়, তাদের জন্য আছে চরম পরাজয় এবং তাদের জীবনে আছে অপমান,লাঞ্ছনা। পার্থিব পরাজয় ও অপমানের পরেও এ সব লোকের শেষ পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। তারা নিক্ষিপ্ত হবে শাস্তির অতল গহ্বরে ; যা "নিরাপদ প্রাসাদের" বিপরীত অবস্থানকে বোঝায়।

৩৯। বলঃ " অবশ্যই আমার প্রভু তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা জীবনোপকরণ বৃদ্ধি করেন অথবা সংকুচিত করেন। ৩৮৪৮। তোমরা যা কিছু [আল্লাহ্‌র রাস্তায় ] ব্যয় কর , তিনি তা প্রতিস্থাপন করেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ রিযিক্দাতা ৩৮৪৯।

৩৮৪৮। দেখুন [ ৩৪ : ৩৬ ] আয়াত এবং টিকা ৩৮৪৩।

৩৮৪৯। পৃথিবীতে জাগতিক বিষয়বস্তু , অর্থ-সম্পদ ,ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ,এগুলির বণ্টন সমভাবে হয় না। কেউ বেশী কেউ কম পায়। এগুলির বণ্টন হয় আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা অনুযায়ী - যা আল্লাহ্‌র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। কোনও কিছুই সর্বশক্তিমানের পরিকল্পনার বাইরে নয় বা কোনও কিছুই হঠাৎ করে ঘটে না। যা আমাদের জন্য এখন বা চিরকালের জন্য মঙ্গলজনক আল্লাহ্‌ তাই-ই আমাদের জন্য করে থাকেন। যে আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করে আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতিদান দান করে থাকেন।

৪০। একদিন তিনি তাদের সকলকে একত্র করবেন, এবং ফেরেশতাদের বলবেন, ৩৮৫০, " এই লোকেরা কি তোমাদের এবাদত করতো ? "


৩৮৫০। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে এক আল্লাহ্‌র পরিবর্তে অন্যান্য জিনিষের এবাদত করা যেমন আল্লাহ্‌র শক্তির প্রতিভূরূপে ফেরেশতারা বা মহৎ ব্যক্তি, বা পীর পূঁজা , মাজার পূঁজা প্রভৃতি করে থাকে। প্রকৃত পক্ষে এগুলি সবই হচ্ছে মিথ্যা ,উপাস্যের উপাসনা করা। যারা তা করে তারা প্রকৃত কল্যাণ অপেক্ষা পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়। এরা বিপথগামী।

 

৪১। তারা বলবে, " সব মহিমা তোমার ! রক্ষাকর্তা হিসেবে আমাদের [ বন্ধন ] তোমার সাথে ৩৮৫১ - তাদের সাথে নয়। বরং ওরা জ্বিনদের পূঁজা করতো। ওদের অধিকাংশই তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো ৩৮৫২।"

 

৩৮৫১। "Wali" -এই আরবী শব্দটির অর্থ বন্ধু অর্থাৎ যে রক্ষা করে , অথবা উপকার করে অথবা যে অতিশয় প্রিয়। অর্থাৎ বদ্যানতা,বিশ্বাস,ও বন্ধুত্বের বন্ধন যেখানে বর্তমান। ফেরেশতারা মিথ্যা উপাস্যের পূঁজারীদের সাথে সম্পর্ককে অস্বীকার করবে এবং তাদের নির্ভরশীলতা যে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপরে সেই ঘোষণা দেবে। তারা বলবে যে, তারা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র নিরাপত্তার উপরে নির্ভরশীল। তারা অন্য কারও নিরাপত্তার জন্য দায়ী নয় বা তারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কাউকে এবাদত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে নাই। তারা আরও বলবে যে, তারা যখন ভান করতো যে, তারা ফেরেশতাদের পূঁজা করছে, আসলে তারা জ্বিনের পূঁজা করে থাকে। দেখুন পরবর্তী টিকা।

৩৮৫২। জ্বিন দেখুন [ ৬ : ১০০ ] এবং টিকা ৯২৯। যাদের ঈমান দুর্বল তারা এক আল্লাহ্‌র পরির্বতে বিভিন্ন জিনিষকে এবাদতের বস্তুতে পরিণত করে; যেমন : উজ্জ্বল ফেরেশতাদের মূর্তি ,পীর , মাজার , নবী-রাসুল, শক্তিশালী নেতা ইত্যাদি। এরা বিপদ-আপদে আল্লাহ্‌র পরির্বতে এদের সাহায্য কামনা করে থাকে। তারা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এদের দাসত্ব করে - যা হচ্ছে শয়তানের লুক্কায়িত শক্তি। এরা শয়তানের শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করে এবং এই শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করে - যদিও আল্লাহ্‌র শক্তির নিকট এ সব শক্তি অত্যন্ত তুচ্ছ।

মন্তব্য : বাংলাদেশে বর্তমানে আল্লাহ্‌ ব্যতীতও বিভিন্ন জিনিষের প্রতি এবাদতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন : পীর পূঁজা,মাজার পূঁজা,রত্ন পাথর ধারণ, মাদুলী ধারণ ইত্যাদি।

৪২। সুতারাং সেই দিন তাদের পরস্পরের উপকার বা অপকার করার কোনও ক্ষমতাই থাকবে না। এবং আমি পাপীদের বলবো , "আগুনের শাস্তিকে আস্বাদন কর - যাকে তোমরা অস্বীকার করতে।" ৩৮৫৩।

৩৮৫৩। মানুষ যাদের আল্লাহ্‌র কাল্পনিক প্রতিদ্বন্দ্বি কল্পনা করে যাদের উপরে নিজেদের আশা -আকাঙ্খা ,ও বিপদ-বিপর্যয়ে নির্ভর করতো - শেষ বিচারের দিনে তাদের নিকট প্রকৃত অবস্থাকে উদ্ঘাটিত করা হবে। তারা তাদের কাজের প্রকৃত মূল্যমান অনুধাবনে সক্ষম হবে। পৃথিবীতে তারা দোযখের আগুন ও শাস্তিকে বিশ্বাস করতো না - এ ব্যাপারে তারা সন্দেহ পোষণ করতে ও উপহাস করতো - পরলোকে যখন তারা প্রকৃত অবস্থাকে উপলব্ধি করতে পারবে তখন সেটাই হবে তাদের প্রকৃত অনুধাবন যার থেকে তাদের কোনও নিষ্কৃতি নাই।

৪৩। যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করা হয়, তারা বলে, " এতো একজন [সাধারণ ] মানুষ মাত্র, যার মনঃষ্কামনা হচ্ছে তোমাদের পূর্বপুরুষ যাদের এবাদত করতো তা থেকে তোমাদের নিবৃত্ত রাখা ৩৮৫৪।" এবং তারা বলে, " ইহা [কুর-আন ] তো কেবলমাত্র মিথ্যার উদ্ভাবন।" এবং অবিশ্বাসীদের নিকট যখন সত্য আসে , তখন তারা বলে, " ইহা তো সুস্পষ্ট যাদু ব্যতীত অন্য কিছু নয়।"

৩৮৫৪। মানুষ শক্তির পূঁজারী। বহু লোক আল্লাহ্‌র পরিবর্তে বিভিন্ন জিনিষ যেমন : অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি,নেতা , পীর , মাজার , রত্নপাথর ইত্যাদি জিনিষের এবাদত করে থাকে নিজস্ব জাগতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। এ সব লোকের কাছে পরলোকের জীবন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর এক ধরণের মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা মানুষ করে থাকে আর তা হচ্ছে পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির চর্চ্চা। তারা বলে, "কেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা করেছে তা আমরা করবো না কেন ? " তারা তাদের মাঝে রসুলের [ সা ] আগমনকে প্রত্যাখান করে। তাঁর প্রচারিত সত্য থেকে বিমুখ হয় - কারণ তা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে স্বীকার করে না। এর উত্তর দেয়া হয়েছে নীচের ৪৪ নং আয়াতে। প্রত্যাখানকারীদের প্রত্যাখানের কারণ তিনটি শিরোনামে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলবে :

১) আমাদের পূর্বপুরুষ নূতন প্রচারিত সত্য সম্বন্ধে কিছুই জানতো না ;

২) প্রত্যাদেশ পাওয়ার কথা সত্য নয়, এটা এক কাহিনী মাত্র এবং মিথ্যার উদ্ভাবন। সুতারাং আমরা প্রত্যাদেশে বিশ্বাস স্থাপন করি না।

৩) যখন তারা দেখে নূতন প্রচারিত সত্য কোন কোন মানুষের হৃদয় ও বিশ্বাসকে আমূল পরিবর্তন করে দেয় তখন তারা বলে যে এই প্রত্যাদেশ এক ধরণের ম্যাজিক বা যাদু বিদ্যা।

ম্যাজিক মানুষকে ধোঁকা দেয় এবং প্রতারণা করে। কিন্তু 'সত্য ' এ সবের বহু উর্দ্ধে। 'সত্য' হৃদয়কে আলোকিত করে। দ্বিতীয় আপত্তি সম্বন্ধে বলা চলে , রসুলের আগমন আধ্যাত্মিক জগতের বিকাশ লাভের জন্য। যারা সত্য-সন্ধানী, তারা রাসুলের [ সা ] প্রচারিত প্রকৃত সত্যের আলো সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলো। যে সত্যকে প্রচারিত করার ফলে নবীকে দুঃখ এবং নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে ,যা প্রচারের মাধ্যমে তাঁর কোনও ব্যক্তিগত লাভ নাই , সেখানে তিনি কেন মিথ্যা প্রচার করবেন ? পূর্ব পুরুষদের ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে দেখুন পরবর্তী টিকা।

৪৪। কিন্তু আমি তাদের পূর্বে কোন কিতাব দেই নাই যা তারা পাঠ করতে পারতো অথবা তোমার পূর্বে সর্তককারী রূপে কোন রাসুলও তাদের নিকট প্রেরণ করা হয় নাই ৩৮৫৫।

৩৮৫৫। আরবদের পূর্বপুরুষরা রসুলের [ সা ] আগমনের পূর্বে অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত। কিতাবধারী জাতিদের মত আল্লাহ্‌ তাদের কোনও রসুল বা কিতাব প্রেরণ করেন নাই। সেই কারণে যখন তাদের মাঝে সত্যসহ রসুলের [ সা ] আগমন ঘটলো তাদের উচিত ছিলো তা সাদরে গ্রহণ করা। নূতন সত্যকে প্রত্যাখান করা তাদের উচিত হয় নাই।

৪৫। তাদের পূর্বপুরুষেরাও [ সত্যকে ] প্রত্যাখান করেছিলো। ওদের আমি যা দান করেছিলাম এরা তার একদশমাংশও পায় নাই। তবুও তারা যখন আমার রাসুলদের প্রত্যাখান করলো। তখন কত ভয়ংকর হয়েছিলো আমার প্রত্যাখান ৩৮৫৬।

৩৮৫৬। আরববাসীদের প্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষদের [ কোরেশরা ] পূর্বে যারা ছিলো, যেমন সাবা, আদ, সামুদ প্রভৃতি জাতির নিকট আল্লাহ্‌ সত্য প্রেরণ করেন, তাঁর অনুগ্রহ বিতরণ করেন - তাদের যে পরিমাণ ক্ষমতা ,সম্পদ দান করেন তা ছিলো মোশরেক কোরেশদের থেকে দশগুণ বেশী। পার্থিব প্রচুর ক্ষমতা ও সম্পদ থাকা সত্বেও তারা যখন আল্লাহ্‌র সত্য বা প্রত্যাদেশ থেকে বিমুখ হয় , আল্লাহ্‌ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, এবং তাঁর অনুগ্রহ বঞ্চিত করেন। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ বঞ্চিত অবস্থা কি ভয়াবহ অবস্থা এগুলি হচ্ছে তার উদাহরণ যার সাহায্যে পরবর্তী প্রজন্মদের , হযরত মুহম্মদের [সা ] উত্তর পুরুষদের বিনয়ী হতে আদেশ দান করা হয়েছে।

উপদেশ হচ্ছে , কেউ যদি আল্লাহ্‌র প্রেরিত সত্যকে অস্বীকার করে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তার পরিণতি ভয়াবহ।

রুকু - ৬

৪৬। বল, " আমি তোমাদের একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি যে, তোমরা আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে জোড়ায় জোড়ায় ৩৮৫৭ অথবা একা একা দাঁড়াও এবং [ নিজের মনের মাঝে ] চিন্তা করে দেখ, তোমাদের সংগী পাগল নয় ৩৮৫৮। এক আসন্ন কঠিন শাস্তি আসার পূর্বে সে তোমাদের জন্য একজন সর্তককারী মাত্র।

৩৮৫৭। এই আয়াতে সত্যকে অনুসন্ধানের জন্য রসুলের [ সা ] মাধ্যমে একটি সংক্ষিপ্ত পথ বলে দেয়া হয়েছে। সদলবলে ও সমবেত ভাবে সত্যের অনুসন্ধান সম্ভব নয়। আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে দাঁড়ানোর অর্থ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দাঁড়ানো নয় যে, বসা , শোয়া অথবা দাঁড়ানো। আল্লাহ্‌ উদ্দেশ্যে শব্দটি যোগ করার উদ্দেশ্য এই যে, একান্তভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিগত ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাস মুক্ত হয়ে সত্যান্বেষণে প্রবৃত্ত হও। যাতে অতীত ধারণা ও কর্ম সত্য গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধক না হয়। দু'দু'জন এবং এক একজন বলার মধ্যে কোনও নির্দ্দিষ্ট সংখ্যা উদ্দেশ্য নয় , বরং এর অর্থ এই যে :

১) একান্তে নির্জনতায় প্রতিটি আত্মা আল্লাহ্‌র সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। আর এই চেষ্টা হবে একান্ত আন্তরিক ও বিশ্বস্ত ভাবে।

২) যদি তার পক্ষে সম্পূর্ণ একা এই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব না হয় তাহলে একজন শিক্ষকের সাহায্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। অথবা তার অন্তরের বিশ্বাসের ভিত্তিকে দৃঢ় করার জন্য বন্ধু বা সহানুভূতিশীল , চিন্তাশীল মুরুব্বীর সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। সত্যকে অনুসন্ধান একাই করা বা অন্যান্যদের সাথে পরামর্শক্রমেই কর, একটা বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে - চিন্তা করতে হবে মুক্তমনে , পূর্বোক্ত সকল সংস্কার মুক্ত হয়ে সত্যানুসন্ধান করতে হবে। কারণ একমাত্র স্বচ্ছ ও মুক্ত আত্মাতেই সত্যের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে।

৩৮৫৮। লক্ষ্য করুণ আয়াত ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯ এবং ৫০ এ রসুলের [ সা ] বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে যে যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, তা যে কোন স্বচ্ছ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিকে সত্য সম্পর্কে সঠিক চিন্তাধারাতে অনুপ্রাণীত করতে বাধ্য। এখানে যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছে যে, মুহম্মদ [ সা ] কোনও পাগল বা উম্মাদ ছিলেন না। তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি , বিবেচনা ও আচার আচরণ সম্পর্কে সমগ্র মক্কা ও গোটা কোরাইশ সম্প্রদায় সম্যক অবগত। তাঁর জীবনের চল্লিশটি বছর স্বজাতির মাঝেই অতিবাহিত হয়েছে। শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত কার্যকলাপ তাদের সামনে সংঘটিত হয়েছে। কখনও কেউ তাঁর কথা ও কর্মকে জ্ঞানবুদ্ধি , গাম্ভীর্য ও শালীনতা পরিপন্থি পায়নি। এখন তিনি অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে আচরণ করছেন , কারণ তাঁকে আল্লাহ্‌ মানুষের আধ্যাত্মিক বিপদের মহাসংকেত প্রেরণ করেছেন। তাঁর ভালোবাসার জনদের মহাবিপদের থেকে উদ্ধারের উপায় তিনি প্রচার করছেন - যা আল্লাহ্‌র বাণী বা শ্বাসত সত্য।

৪৭। বল, " আমি তোমাদের নিকট কোন পুরষ্কার চাই না। এর [ সবই] তো তোমাদেরই [ কল্যাণ ]। আমার পুরষ্কার তো আল্লাহ্‌র কাছে প্রাপ্য। এবং তিনি সকল কিছুর সাক্ষী ৩৮৫৯। "

৩৮৫৯। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৭২ ]। দ্বিতীয় যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছে এভাবে সত্যকে প্রচারের মাধ্যমে তাঁর কোনও স্বার্থ নাই । তাঁর কোনও ব্যক্তিগত লাভ নাই। সত্যের বাণী তিনি প্রচার করে থাকেন যাতে সাধারণ মানুষ পরলোকের ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা পায়। সত্যকে প্রচারের জন্য তিনি অত্যাচার , নির্যাতন, অপমান সহ্য করতে প্রস্তুত। তাঁর জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তিনি আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পূর্ণ করতে চান।

৪৮। বল, " অবশ্যই আমার প্রভু [ তাঁর বান্দার উপরে ] সত্যের [ উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা ] নিক্ষেপ করেন ৩৮৬০, যা কিছু লুকানো আছে তিনি তার পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। "

৩৮৬০। আল্লাহ্‌র জ্ঞান ও বাণী এত গভীর ও বিস্তৃত যে কোনও মানুষের পক্ষেই তা সম্পূর্ণ করায়ত্ব করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্‌ তাঁর কোন কোন বান্দার উপরে বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করে থাকেন তাঁর প্রতি সত্যকে প্রেরণ করেন ; সত্যের আবরণে তাঁকে ঢেকে দেন। এরাই আল্লাহ্‌র প্রেরিত দূত পৃথিবীর লোককে সত্য শিক্ষা দেয়ার জন্য। সত্যের অবস্থান মিথ্যার বহু উর্দ্ধে। এই অবস্থান থেকেই তারা মানুষকে সত্যের পথে ডাক দেন। এটা হচ্ছে তৃতীয় যুক্তি।

৪৯। বল, " সত্য এসেছে , মিথ্যা নূতন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না ৩৮৬১, বা পুণঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে না ৩৮৬১।

৩৮৬১। চতুর্থ যুক্তি হচ্ছে : সত্যের প্রকাশ ও স্থায়ীত্ব হচ্ছে সব কিছুর শেষ পরিণতি। সত্যের কখনও ধ্বংস নাই। কখনও যদি সত্যের পরাজয় ঘটে, তবে সে পরাজয় কখনও চিরস্থায়ী হয় না। সময়ের ব্যবধানে প্রকৃত সত্য তার স্থান করে নেবেই। সত্যের প্রকৃত মূল্যায়ন ঘটবেই। মিথ্যা শেষ পর্যন্ত সত্যের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। [ দেখুন আয়াত ১৭ : ৮১ ]। আল্লাহ্‌র নবীর মাধ্যমে সত্যের আগমন , যা সময়ের পরিক্রমায় তা আরও উজ্জ্বল আরও ভাস্বর - তা যুগ কাল অতিক্রান্ত। এই সূরাটি অবতীর্ণ হয় মক্কায় - পরবর্তীতে ইসলামের প্রচার,প্রসার ও ইতিহাস এই সূরার বক্তব্যকে প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করে।

৫০। বল, " যদি আমি পথভ্রষ্ট হই তবে বিপথগামীতা হবে আমার [ আত্মার ] ক্ষতির কারণ। কিন্তু যদি আমি পথ নির্দ্দেশ গ্রহণ করি , তবে তার কারণ হচ্ছে আমার প্রতি আমার প্রভুর ওহীর প্রেরণ ৩৮৬২।তিনিই সব কিছু শোনেন এবং [ সবচেয়ে ] সন্নিকটে। "

৩৮৬২। পঞ্চম যুক্তি হচ্ছে নিম্নরূপ : যদি নবী আল্লাহ্‌র নামে আত্মপ্রতারণা করতেন , তবে তা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতো। যার ফলে তাঁর কার্যের পরিণাম শুধু তাকেই ভোগ করতে হতো। কিন্তু তিনি ছিলেন তাঁর বিশ্বাসে দৃঢ় ,অবিচল এবং সকল মিথ্যা ও বিভ্রান্তির উর্দ্ধে। তাঁর জীবনী বিশ্লেষনে দেখা যায় তিনি ধীরে ধীরে মিথ্যার উপরে সত্যকে শক্তিশালী করেছেন। শুধু তাই-ই নয়, তিনি তাঁর অনুসারীদের প্রাণ প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যারাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরা তাঁর বিশ্বাস , ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তায় অভিভূত হয়ে পড়তেন এবং ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতেন। কি ভাবে তা সম্ভব ছিলো ? যদি না আল্লাহ্‌ তাঁকে ওহী বা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করতেন ? এই আয়াতটি-ই ছিলো শেষ যুক্তি।

৫১। যদি তুমি দেখতে পেতে , [ কেয়ামতের দিনে ] যখন তারা ভয়ে কাঁপতে থাকবে; কিন্তু তখন তাদের পালানোর কোন পথ থাকবে না ৩৮৬৩, এবং [ খুব] নিকটবর্তী স্থান থেকে তাদের গ্রেফতার করা হবে।

৩৮৬৩। সত্যের বাস্তবতা এবং সত্যের বিজয় সম্বন্ধে যুক্তি উপস্থাপন পূর্বক এই আয়াতে যারা সত্যের বিরোধিতা করেছিলো , তাদের অবস্থা সম্বন্ধে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সকলের সব ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। সেদিন সত্যের আলোর ঔজ্জ্বলে মিথ্যা দূরীভূত হয়ে যাবে। যারা মিথ্যাশ্রয়ে পৃথিবীর জীবনকে অতিবাহিত করেছে , তারা ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়বে। এ সব লোক তখন প্রাণপণে চেষ্টা করবে সেই অবস্থা থেকে পলায়ন করতে এবং অব্যহতি পেতে। কিন্তু তখন তা করা সম্ভব হবে না। তাদের পূর্বের অবস্থান পরিবর্তন করা হবে এক অসম্ভব ব্যাপার। তাদের পূর্ব জীবনের কৃতকর্ম-ই তাদের শক্তভাবে আটকে রাখবে তাদের অবস্থানে। কেউ পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে না।

পৃথিবীতে মানুষ যে জীবন যাপন করে - তার মনোজগত ও চিন্তাজগত সেই অনুযায়ী গড়ে ওঠে। তার মূল্যবোধ , আগ্রহ , চেষ্টা , কর্ম, সবই সেই মনোজগত ঘিরে আবর্তিত হয়। এর বাইরে বের হয়ে আসা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে মিথ্যার কলুষতায় জীবনকে অতিবাহিত করে - পৃথিবীতে সে মিথ্যা ও কলুষতার মাঝেই সৌন্দর্য ও আনন্দ খুঁজে পায়। মৃত্যুর পরেও সে এই কলুষতা ও বিকৃত আনন্দ অনুভূতি থেকে মুক্তি পায় না। বরং তা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে তারা নিকটস্থ স্থান থেকেই ধৃত হয়।

৫২। এবং তারা বলবে, " আমরা [এখন সত্যকে ] বিশ্বাস করলাম।" কিন্তু কি ভাবে তারা এত দূরবর্তী স্থান থেকে [সত্যকে ] পেতে পারে , ৩৮৬৪ -

৩৮৬৪। এই সেই অবস্থা যখন মানুষের নিজস্ব কিছু করার আর কোনও ক্ষমতা দান করা হবে না। মিথ্যাশ্রয়ী এসব লোকেরা পরলোকে সত্যের জ্যোতিতে আতঙ্কিত হয়ে সত্যকে গ্রহণ করার জন্য প্রতিজ্ঞা করবে। কিন্তু তখন আর সে অনুতাপ ও প্রতিজ্ঞার কোনও মূল্য থাকবে না। বিশ্বাস হচ্ছে পরলোক সম্বন্ধে বিশ্বাস যা ইহকালে দেখা সম্ভব নয়; তা না দেখেও বিশ্বাস করা ও আত্মার মাঝে তার অস্তিত্ব ও উপস্থিতি অনুভব করা। কিন্তু পরলোকে অদৃশ্য বা কোনও আড়াল থাকবে না। সব কিছুই প্রকাশ্য ও উম্মুক্ত হবে। সুতারাং সেখানে না দেখে বিশ্বাসের কোনও স্থান নাই। ফলে বিশ্বাস তাদের থেকে বহুদূরে চলে যাবে। পৃথিবীতে যখন সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে , সাহায্য কামনা করে ,আশ্রয় প্রার্থনা করে, মিথ্যাশ্রয়ীরা নিষ্ঠুর ভাবে, উদ্ধত অহংকারে সত্যকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে। সুতারাং মৃত্যুর পরেও তারা তাদের এই মানসিক অবস্থান থেকে সরে যেতে পারবে না। সত্য তাদের নাগালের বহু দূরেই থেকে যায়। ঈমানের স্থান বহুদূরে চলে গেছে। কেননা পার্থিব জীবনের ঈমান ও কর্মজগতের ফলাফলই পরলোকে সকলে বহন করে নিয়ে যাবে। পরকাল কোনও কর্মজগত নয়। সেখানের কোন কিছু কর্ম হিসেবে ধরা যাবে না।

৫৩। যখন তারা পূর্বেই ঈমানকে [ সম্পূর্ণ ] প্রত্যাখান করেছিলো,এবং তারা বহুদূর থেকে ক্রমাগত [ অপবাদ ] ছুঁড়ে মারতো ? ৩৮৬৫

৩৮৬৫। যদি মানুষ আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, তবে পরলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনও সন্দেহের অবকাশ নাই। অদৃশ্যে বিশ্বাসই হচ্ছে ঈমানের মূল ভিত্তি যা প্রকৃত সত্য। এর থেকে বড় সত্য আর কিছু নাই। যারা এই সত্যকে অস্বীকার করে, তাদের আত্মার মাঝে সত্যের প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রোশের জন্ম লাভ করে। ফলে তারা সত্য প্রচারকদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষে বক্রোক্তি করে থাকে। তারা সত্যের প্রচারকদের অসৎ , মিথ্যাবাদী, মোনাফেক ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় অপমানিত করে থাকে। যেহেতু তাদের বিদ্বেষ মিথ্যার উপরে প্রতিষ্ঠিত, সুতারাং তারা সর্বদা অলক্ষিতে , গোপনে সত্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। এ যেনো দূর থেকে তীরন্দাজের লক্ষ্যভেদের মত অথবা গোপন স্থান থেকে বন্দুকের গুলি ছোঁড়া। ঠিক সেই ভাবে "তারা বহুদূর থেকে ক্রমাগত [ অপবাদ ] ছুঁড়ে মারতো।"

৫৪। তাদের ও তাদের কামনা বাসনার মধ্যে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হয়েছে ৩৮৬৬ , যেরূপ করা হয়েছিলো তাদের পূর্বের সমপন্থী লোকদের ৩৮৬৭। নিশ্চয়ই এরা দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও [ অনিষ্টকারী ] সন্দেহের মধ্যে ছিলো ৩৮৬৮।

৩৮৬৬। প্রতিবন্ধক অর্থাৎ বাঁধার প্রাচীর। সত্যকে অবদমিত করা এবং পাপ ,মন্দ ও স্বার্থ উদ্ধার করাই মোশরেকদের একান্ত ইচ্ছা। তাদের ও তাদের উদ্দেশ্যের মাঝে প্রাচীরের অন্তরাল সৃষ্টি করা হবে। অর্থাৎ কখনও তাদের পাপ উদ্দেশ্যে তারা সফলতা লাভ করবে না। এই বিফলতা তাদের মনে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করবে আর এই হচ্ছে তাদের শাস্তি। বিশ্ব বিধাতার সমগ্র সৃষ্টির মাঝে পাপ ও পূণ্যের অনন্ত সংগ্রামের মাঝে এ এক অলিখিত আইন। পাপের সকল অনুসারীদের একই পরিণতি।

৩৮৬৭। লক্ষ্য করুন সত্য ও মিথ্যার মধ্যে দ্বন্দ্বকে শক্তিশালী বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে [ ৫১ - ৫৪ ] আয়াত সমূহের মাধ্যমে। এই বর্ণনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায় :

১) এই বর্ণনা প্রযোজ্য হতে পারে বর্তমান জীবনের পটভূমিতে পরলোকের জীবনের শেষ পরিণতি।

২) এই বর্ণনা প্রযোজ্য হতে পারে ইসলামের প্রথম যুগে মক্কাবাসীদের নব্য মুসলমানদের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের পটভূমিতে মদিনাতে ইসলামের প্রসার এবং পরবর্তীতে পৃথিবীতে ইসলামের বিজয়।

৩) প্রযোজ্য হতে পারে যুগে যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে ন্যায় ,অন্যায়ের এবং পূণ্য ও পাপের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও তার শেষ পরিণতি হিসেবে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।

৪) প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাস।

পৃথিবীতে ন্যায়-অন্যায়ের , সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব যুগে যুগে সংঘটিত হয়েছে , তবে অন্যায় এবং পাপ বাসনা সম্পৃক্ত যারা তারা শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করে নাই। 'সমপন্থী বা অনুগামী' বলতে এদের সকলকেই বোঝানো হয়েছে।

৩৮৬৮। দেখুন আয়াত [ ১৪ : ৯ ] এবং টিকা ১৮৮৪। যেখানে পূর্ববর্তীদের কাহিনী যারা পাপের অনুসরণ করতো , তাদের বর্ণনা করা হয়েছে।