সূরা আস্ সাফ্ফাত
সূরা আস্ সাফ্ফাত বা যারা শ্রেণীতে সারিবদ্ধ - ৩৭
১৮২ আয়াত, ৫ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : সূরা নং ৩৪ এর ভূমিকাতে যে শ্রেণীর সম্বন্ধে বলা হয়েছিলো। এই সূরাটি সেই শ্রেণীর চতুর্থ সূরা। পূর্বের ন্যায় এই সূরাতেও মন্দের পরাজয়কে প্রত্যাদেশের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। বেহেশতের ফেরেশতা এবং রসুলদের প্রসঙ্গ উল্লেখ দ্বারা প্রাচীন ইতিহাসের সারিবদ্ধ সংগ্রামের বিবরণ পেশ করা হয়েছে ; যে সংগ্রামের ইতিহাসে নূহ্ নবী থেকে ইউনুস নবী পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এই সূরার সময়কাল সম্বন্ধে বলা হয় মধ্য - মক্কার সময়।
সার সংক্ষেপ : স্বর্গ ও মর্তে সর্বত্র ভালোকে মন্দের বিপরীতে পৃথকীকরণ করা হয়। তাদের প্রত্যেকের শেষ পরিণতি তুলনামূলক বৈষম্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। [ ৩৭: ১-৭৪ ]।
নূহ্ , ইব্রাহীম , মুসা , হারুণ , ইলিয়াস , এবং লূতের বিজয় এবং শান্তি এসেছিলো তাদের পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষে। [ ৩৭ : ৭৫-১৩৮ ]।
ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিলো ইউনুস নবীর বেলাতে তিনি যখন আল্লাহ্র গুণগানে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু স্বভাবতই মানুষ আল্লাহ্র বিরুদ্ধে তাই -ই আরোপ করে থাকে যা তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ্র নবীরা আল্লাহ্র মাহাত্ম্য প্রকাশের জন্য সংগ্রাম করে থাকেন এবং অবশ্যই তারা জয়ী হবেন। [ ৩৭ : ১৩৯- ১৮২ ]।
সূরা আস্ সাফ্ফাত বা যারা শ্রেণীতে সারিবদ্ধ - ৩৭
১৮২ আয়াত, ৫ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৪০৩০। লক্ষ্য করুণ পূর্বের সূরাতে [ ইয়া-সীন ] শপথ করা হয়েছে "জ্ঞানগর্ভ কোরাণের " গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে প্রত্যাদেশের উপরে , যার সাহায্যে মানুষ আধ্যাত্মিক জগতের সর্বোচ্চ জ্ঞান আহরণ করতে পারে। এই সূরাতে শপথের মাধ্যমে তিনটি মনোভাব বা আচরণকে প্রকাশ কর হয়েছে পরবর্তী তিনটি আয়াতে যা হচ্ছে মন্দের উপরে ভালোকে প্রতিষ্ঠিত করার উপায়। দেখুন পরবর্তী টিকা সমূহ।
৪০৩১। এই আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাতে মতদ্বৈত আছে। এখানে দুধরণের মতবাদ আছে :
১) আয়াত [ ১- ৩ ] পর্যন্ত যাদের উল্লেখ আছে তারা সকলেই একই ব্যক্তি। একই ব্যক্তির মাঝে উপরে তিন ধরণের গুণের প্রকাশ ঘটেছে। অথবা এরা হলেন তিন বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তি ;
২) উভয়ক্ষেত্রেই প্রশ্ন হলো এরা কারা ? মতবাদের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী মতবাদ হচ্ছে : ১) যে তিনটি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে তা একজনের জন্য প্রযোজ্য - জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলীর বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। অপরপক্ষে ২) অন্যদল মনে করেন সারিবদ্ধ ভাবে যারা দন্ডায়মান তারা ফেরেশতা এবং তাদের গুণাবলীই এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যরা মনে করেন এরা হলেন ক) ভালো লোক, খ) আল্লাহ্র রসুলগণ , ৩) যারা আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করে। কোরাণে এই তিন প্রকার লোকের সুস্পষ্ট কোন বর্ণনা নাই। তবে মওলানা ইউসুফ আলীর মতে এই তিন প্রকার গুণাবলীর প্রয়োগ সার্বজনীন উভয় দলের জন্য প্রযোজ্য।
৪০৩২। তিনটি আয়াতের মাধ্যমে [ ১- ৩ ] যে তিনটি কর্মপদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে ধারাবাহিকতা এবং এই ধারাবাহিকতা প্রকাশের জন্য ফা [Fa ] শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। মওলানা ইউসুফ আলীর মতে - ফেরেশতা ও পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের উভয়ের কর্মপদ্ধতি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এই উভয় সম্প্রদায় -
১) আল্লাহ্র এবাদত ও পূণ্য কাজের জন্য শৃঙ্খলা , নিয়মানুবর্তিতা ও নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে থাকেন।
২) তারা সর্বদা পাপ ও মন্দকে প্রতিহত করে থাকেন। এ কাজে তারা অত্যন্ত কঠোরতার পরিচয় দান করেন। প্রতিটি কর্মকে পাপমুক্ত ভাবে আল্লাহ্র বিধানমতে সম্পন্ন করার জন্য তারা শৃঙ্খলা ,নিয়মানুবর্তিতা ও একতাবদ্ধ ভাবে পরিচালিত হন। তারা "কঠোর পরিচালক "।
৩) আল্লাহ্র রাজত্বের উন্নতি বিধানের জন্যই তাদের পরিশ্রম। তাঁরা আল্লাহ্র বাণী ও মহিমা প্রচারে মগ্ন থাকেন।
০৪। অবশ্যই অবশ্যই তোমাদের আল্লাহ্ অদ্বিতীয় ৪০৩৩ -
নিয়ম ও শৃঙ্খলা আল্লাহ্র আইনের আওতাভূক্ত ; এবং আল্লাহ্র পছন্দীয়। আল্লাহ্র এবাদত , তা যে কোনও প্রকারেরই হোক না কেন তা বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে হতে হবে সারিবদ্ধ শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে। উত্তম গুণাবলীর মধ্যে সর্বাগ্রে এ গুণটির উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্র এবাদত ও সৎ কাজ করার নির্দ্দেশনা হচ্ছে : বিশৃঙ্খল না হয়ে , সারিবদ্ধ থাকা, মন্দকে প্রতিরোধ করা এবং আল্লাহ্র উপদেশাবলী নিজে পাঠ করা এবং অপরের কাছে পৌঁছানো - আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য।
উপদেশ : এই আয়াতগুলির [ ১-৪ ] উপদেশ সার্বজনীন এবং শ্রেষ্ঠ কাজের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন সর্বকালে ; এগুলি হচ্ছে : ১) শৃঙ্খলা [ সারিবদ্ধ ভাবে ] ; ২) ন্যায়নীতি [ মন্দকে প্রতিহত ও ভালোকে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কঠোর পরিচালকের ভূমিকা ] ; ৩) সৎ কাজ [আল্লাহ্র রাজত্বের মঙ্গলের জন্য কাজ করা ও সর্বদা আল্লাহ্র নির্দ্দেশবলী স্মরণ রাখে যিক্র ও কোরাণ আবৃত্তির দ্বারা ]।
৪০৩৪। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদের অর্ন্তর্বতী সকল কিছুর প্রভু এক আল্লাহ্। তিনি 'Mashariq' সূর্যোদয়ের উদয়স্থলের প্রভু। তফসীরকারগণের মতে বছরে শুধুমাত্র দুদিন সূর্য বিষুবরেখার উপরে ঠিক পূর্ব প্রান্তে উদিত হয়। বৎসরের অন্যান্য সময়ে সূর্য প্রতিদিন ধীরে ধীরে দক্ষিণে অথবা উত্তরে সরে যায়। সুতারাং বৎসরে দুদিন ব্যতীত সূর্যকে ঠিক একই স্থানে উদিত হয় না। অর্থাৎ সূর্য কোনও নির্দ্দিষ্ট স্থানে সারা বৎসর উদিত হয় না। আমরা দেখি দীপ্ত সূর্য সারা বৎসর তার উদয়স্থানের পরিবর্তন করে থাকে; কিন্তু তা সত্বেও সূর্য সকল আকাশ ও পৃথিবীকে সমভাবে আলোকিত করে থাকে। এ সবই আল্লাহ্র একত্বের নিদর্শন।
৪০৩৫। অনুরূপ আয়াত দেখুন [ ৬৭ : ৫ ] এবং [ ৭২ : ৮-৯ ]। " নিম্নতম আকাশ " - বাক্যটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে আকাশের বিভিন্ন স্তরকে। মহাশূন্যে আকাশের সীমানা মানুষের জ্ঞানের সীমার বাইরে। বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা 'হাবেল' টেলিস্কোপ স্থাপন করেছেন পৃথিবীর বাইরে,যার সাহায্যে তারা নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন সপ্ত আকাশের সীমা রেখা নির্ধারণের। অসীম আকাশের পৃথিবীর নিকটবর্তী যে অংশ তারই বর্ণনা দেয়া হয়েছে এই আয়াতে।
এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে কোরাণ অবতীর্ণ হয়েছে আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে যখন মহাশূন্য সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ছিলো খুবই সীমাবদ্ধ। এমন কি সৌর মন্ডল সম্বন্ধেও মানুষের প্রকৃত ধারণা ছিলো না।
৪০৩৬। তারকাশোভিত রাতের অনন্ত আকাশ প্রতিটি মানুষকে মুগ্ধ করে। এই তারকারাজির মধ্যে শ্রেণীবিভাগ বর্তমান। নক্ষত্ররাজি শব্দটি দ্বারা গ্রহ, নক্ষত্র , ধূমকেতু , উল্কাপিন্ড, ইত্যাদি , রাতের আকাশের সকল বস্তুকে নির্দ্দেশ করা হয়েছে। নির্মেঘ রাতের আকাশের এ সব বস্তুর সৌন্দর্য্য প্রবাদতুল্য। এই আয়াতে দুইটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে :
১) নক্ষত্র রাজির অপূর্ব সৌন্দর্য এবং তাদের সমষ্টিগত ভাবে ছায়াপথে অবস্থান ও পৃথিবী থেকে দ্রষ্টব্য তাদের চলমান গতি প্রভৃতি সব কিছুই নির্দ্দেশ করে স্রষ্টা এক এবং এসব বস্তু তাঁর প্রণীত একই আইনের আওতায় সমন্বিত শৃঙ্খলার সাথে অনন্ত আকাশে অবস্থান করছে।
এখানে শুধু এটুকুই বলা উদ্দেশ্য যে, এই তারকাশোভিত আকাশ সাক্ষ্য দেয় যে , এগুলি আপনা আপনি অস্তিত্ব লাভ করে নাই , বরং একজন স্রষ্টা এগুলি সৃষ্টি করেছেন ; যে সত্ত্বা এ সব বস্তুকে অস্তিত্ব দান করতে সক্ষম তার কোন শরীক বা অংশীদার প্রয়োজন নাই। অর্থাৎ নভোমন্ডলের সকল কিছু স্রষ্টার একত্ব ঘোষণা করে তাঁর সমন্বিত আইন দ্বারা শৃঙ্খলার দ্বারা পরিচালিত হয়ে। এবং এ সকল নক্ষত্ররাজির অলক্ষ্যে যে শক্তি ও মহিমা কাজ করে তা শয়তানের প্রবল আক্রমণ থেকে প্রহরী স্বরূপ পৃথিবীকে রক্ষা করে। [দেখুন পরবর্তী আয়াত নং ৭ ]।
৪০৩৭। [ ৭ - ১১ ] আয়াত সমূহ জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডের নির্দ্দেশ দান করে। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ১৭ - ১৮ ] এবং টিকা ১৯৫১- ৫৩। অনন্ত নভোমন্ডল যে শুধুমাত্র আল্লাহ্র ক্ষমতা ও শিল্পসত্ত্বার সাক্ষর বহন করে তাই নয় ; পৃথিবীকে শয়তানের প্রবল আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সকল দিক থেকে তাকে সুরক্ষিত করেছেন নভোমন্ডল সৃষ্টির মাধ্যমে। শয়তান কোনও স্বর্গীয় বস্তু নয়। সে আইন অমান্যকারী , অবাধ্য, বিদ্রোহী - সুতারাং আল্লাহ্র বলেছেন, " রক্ষা করেছি প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান থেকে" এবং " তাদের বিতারণের জন্য আছে চিরস্থায়ী শাস্তি।" [ আয়াত ৭-৯ ]
আকাশ মন্ডলী , তারকারাজি ও উল্কাপিন্ডের আলোচনার উদ্দেশ্য আল্লাহ্র একত্ববাদ প্রমাণ করা। যে সত্ত্বা এই সুবিশাল নক্ষত্ররাজি প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনিই এবাদত ও উপাসনার যোগ্য। দ্বিতীয়ত : শয়তানের শক্তিকে উপাস্য ধারণা করার কোনও কারণ নাই , কারণ শয়তান বিতাড়িত ও পরাভূত সৃষ্ট জীব।
০৯। [ তাদের ] বিতাড়নের জন্য এবং তাদের জন্য আছে চিরস্থায়ী শাস্তি ,
৪০৩৮।কল্পনা করুণ মহাপরাক্রমশালী নৃপতির দরবার সভার দৃশ্য। যার ঐশ্বর্য ও জাঁকজমক অতুলনীয়। মানুষের সর্বোচ্চ কল্পনাকেও অতিক্রম করে যাবে মহান আল্লাহ্র দরবার সভার দৃশ্য। তিনি শুধু যে মহাশক্তিধর তাই-ই নয় , তিনি সকল জিনিষের স্রষ্টা ও রক্ষাকর্তা। সুতারাং তাঁর দরবার সভা আমাদের সর্বোচ্চ সুন্দর, পবিত্র এবং জাঁকজমকের যে ধারণা তা অতিক্রম করে যাবে। এই দরবার সভাতে ফেরেশতাদের আল্লাহ্র ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও ইচ্ছার সামান্য জ্ঞান দান করা হয়, যা শয়তান জানতে পারে না। শয়তান এ দরবার থেকে বহিষ্কৃত আর সে কারণেই তার পাপিষ্ঠ মনে এই দরবার সভার খবর জানার জন্য কৌতুহল হবে এবং যেহেতু তাকে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয় নাই, সে কারণে হিংসা হবে। শয়তান চুরি করে এই দরবারে ঢুকতে চাইবে এবং আড়ি পেতে মহান দরবারের কিছু সংবাদ শুনতে চেষ্টা করবে। এই শয়তানকেই জ্বলন্ত আগুন দ্বারা বিতাড়িত ও অনুসরণ করা হয় - যার কিছুটা ধারণা আমরা করতে পারি রাতের আকাশে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডের ছুটে চলা থেকে।
৪০৩৯। দেখুন উপরের টিকা এবং আয়াত [ ১৫ : ১৮ ] ও টিকা ১৯৫৩ - ৫৪।
৪০৪০। "ওদের " শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কাফেরদের, পাপীদের জন্য এবং যারা আল্লাহ্র করুণা ও অনুগ্রহকে অস্বীকার করে। এবং পরলোকে অবিশ্বাস করে তাদেরকেও বোঝানো হয়েছে " ওদের " শব্দটি দ্বারা। এ সব ব্যক্তিরা নিজেদের সর্বদা অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকে - এদের অবস্থা "কলুর বলদের " মত। নির্দ্দিষ্ট সীমার বাইরে দেখতে অক্ষম। নইলে বিশ্বের সকল সৃষ্ট পর্দাথের সৃষ্টি নৈপুন্য তার অনুভবে রেখাপাত করতো। বিশাল বিশ্ব ভূবনের পটভূমিতে নিজের নগন্যতা অনুভবে সক্ষম হতো। সামান্য মাটি থেকে সৃষ্ট হয়ে সে অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রকাশ করতে সাহস পেতো না।
৪০৪১। দেখুন [ ৬ : ২ ] ; [ ৭ : ১২ ] ; [ ৩২ : ৭ ] প্রভৃতি।
৪০৪২। রসুল [ সা ] এ সব অবিমৃষ্যকারী কাফেরদের আচরণে বিস্ময়বোধ করতেন। প্রকৃত পক্ষে এ সব অবিশ্বাসীদের আচরণ প্রকৃত পক্ষেই বিস্ময়কর কারণ তারা ভুলে যায় তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে নগন্য মৃত্তিকা থেকে। যদিও তাদের সৃষ্টি নগন্য বস্তু থেকে, কিন্তু আল্লাহ্ তাদের শেষ পরিণতির জন্য নির্ধারিত করেছেন মহত্তর উচ্চতর নিয়তি। এই আয়াতে এবং পরবর্তী আয়াতসমূহে এসব অবিশ্বাসী কাফেরদের মানসিক চিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে :
১) তারা সত্যের শিক্ষাকে গ্রহণের পরিবর্তে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে থাকে। [ ৩৭ : ১২ ]
২) সর্তকবাণী থেকে তারা শিক্ষালাভের পরিবর্তে , তারা এতে কর্ণপাত করে না। [৩৭ : ১৩ ]
৩) তারা যখন আল্লাহ্র নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে তাদের নিকট তা উপহাসের সামগ্রীতে পরিণত হয়। [ ৩৭ : ১৪
৪) যখন তাদের অপ্রতিরোধ্য সত্যের দিকে অঙ্গলি নির্দ্দেশ করা হয় , এবং তারা তাকে অস্বীকার করতে পারে না ফলে তারা তাকে "যাদু" আখ্যা দিয়ে থাকে। [ ৩৭ : ১৫ ] প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, যে সত্য সম্বন্ধে তারা অবহিত নয়, যা তারা অনুধাবনে অক্ষম তাকেই তারা 'যাদু ' আখ্যা দান করে। যদিও সত্যের শিক্ষা মানুষের আধ্যাত্মিক জগতকে জাগরিত, প্রস্ফুটিত , এবং বিকশিত করে থাকে কিন্তু এ সব লোক তা উপলব্ধিতে অক্ষম।
১৪। এবং যখন তারা কোন নিদর্শন দেখে , তারা তা নিয়ে উপহাস করে।
১৫। এবং বলে, " এটা তো সুস্পষ্ট যাদু ব্যতীত কিছু নয়।"
১৬। " কি ! যখন আমরা মরে যাব এবং ধূলি ও অস্থিতে রূপান্তরিত হব, [ তখনও ] কি আমাদের [পুণরায় ] উত্থিত করা হবে ?
১৭। " এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরও ? " ৪০৪৩
৪০৪৩। অবিশ্বাসীদের মানসিক অবস্থাকে এই আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষকে আল্লাহ্ পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্ট পদার্থ থেকে ভিন্ন প্রকৃতির করে সৃষ্টি করেছেন। দৈহিক উপাদানে যদিও সে অন্যান্য সৃষ্ট পদার্থ থেকে আলাদা নয় , কিন্তু বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিক জগতে, সে সকল সৃষ্ট পদার্থ থেকে শ্রেষ্ঠ। একমাত্র তাঁর জন্যই মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নির্ধারিত। মানুষের ভিতরে দুটো পরস্পর বিরোধী শক্তি কাজ করে। মাটির তৈরী নশ্বর দেহ পার্থিব বিষয়বস্তু , আরাম আয়েশের কাঙ্গাল। অপরপক্ষে মানুষের আত্মা যা পরমাত্মার অংশ, তা আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য ব্যগ্র। যখন জাগতিক বিষয়বস্তু প্রাধান্য বিস্তার করে, আত্মার বিকাশ ব্যহত হয়। সে কারণেই যারা অত্যন্ত বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন তারা পরলোকের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে থাকে। তারা অনুভবে অক্ষম যে দৈহিক মৃত্যুর পরেও তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে। বহু পূর্বে তাদের যে সব পূর্ব পুরুষ গত হয়েছে তাদের আবার পুণরুজ্জীবিত করা হবে। কি ভাবে তা সম্ভব ?
৪০৪৪। অবিশ্বাসীদের নিশ্চিত করা হয়েছে ভবিষ্যত জীবনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে। সে জীবন হবে নূতন পৃথিবীতে নূতন মাত্রিকে যা পৃথিবীর জীবনে অনুভব করা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে তারা ছিলো উদ্ধত, অহংকারী , একগুঁয়ে। তাদের স্বভাবের এই উদ্ধতপনা সেদিন ধূলিতে মিশে যাবে। সেই নূতন মাত্রিকের পৃথিবীতে প্রতিটি আত্মার অভিজ্ঞতা হবে নূতন , যার সাথে পৃথিবীর শিক্ষানবীশকালের অভিজ্ঞতার কোনও সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যক্তি শিক্ষানবীশকালে যে সব গুণাবলী অর্জন করেছে পরলোকের নূতন পৃথিবীতে শুধুমাত্র সেই সব গুণাবলীকেই সনাক্ত করে মূল্যায়ন করা হবে। অপরপক্ষে এই ধূলার পৃথিবীতে যারা অহংকারে , দাম্ভিকাতায় ধরণী প্রকম্পিত করতো ,তাদের লাঞ্ছিত করা হবে - মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হবে।
৪০৪৫। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৩৬: ২৯, ৪৯,ও ৫৩ ]।
৪০৪৬। পাপীরা পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যকে অনুধাবন করতে অক্ষম। কারণ পাপ তাদের আত্মার স্বচ্ছতাকে নষ্ট করে দেয়, ফলে তাদের মাঝে আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব বিরাজ করে। পরলোকে তাদের আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব ঘুচে যাবে -ফলে তারা ন্যায় -অন্যায় ,পাপ-পূণ্য , ভালো-মন্দ ,সত্য-মিথ্যার পার্থক্য হঠাৎ করে অনুভব করতে সক্ষম হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়বে।
২১। [ বলা হবে ] , " এটা হচ্ছে বাছাই করার দিন ৪০৪৭ , যে সত্যকে তোমরা [ একদিন ] অস্বীকার করেছিলে। "
৪০৪৭। এই আয়াতটি ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে এভাবে "This is the Day of sorting out " বাংলা অনুবাদে হয়েছে "বাছাই করার দিন" বা শেষ বিচারের দিন। অবশ্য উভয়েই একই অর্থ বহন করে। কারণ শেষ বিচারের দিনই হবে পাপী পূণ্যাত্মাদের পৃথকীকরনের দিন। দেখুন আয়াত [ ৩৬ : ৫৯] ও টিকা ৪০০৫। শেষ বিচার দিবসে পূণ্যাত্মা ও পাপীদের আলাদা করা হবে। পৃথিবীর জীবনে পাপী ও পূণ্যাত্মা পাশাপাশি বিরাজ করে এবং তাদের বুঝতে পারা ও পৃথক করা কোনও প্রকারেই সম্ভব নয়। কিন্তু পরলোকের অবস্থা হবে ভিন্ন।
রুকু - ২
২৩। " আল্লাহ্র পরিবর্তে , এবং তাদের দোযখের পথে নিয়ে যাও।
৪০৪৮। যদি পাপীদের স্ত্রীরা স্বামীদের সহযোগী হয়, তবে তাদের সকলকে একত্র করা হবে। প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব থাকবে। স্বামী বা স্ত্রী কেহই কারও পাপের বোঝা বহন করবে না। কেহ কারও উপরে দোষ চাপাতে পারবে না।
৪০৪৯। এখানের দৃশ্যটি হচ্ছে বিচার শেষের দৃশ্য। পৃথিবীতে বিচার কার্যের সময়ে অপরাধীকে বা অপরাধীর উকিলকে 'কারণ দর্শাও ' মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করা হয় যে কেন তাকে শাস্তি দান করা হবে না। এখানেও শেষ বিচারের দিনে যারা অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবে, তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে যে তারা কারও কাছ থেকে শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সাহায্যের অনুরোধ করতে পারে কি না। যারা পাপের পথকে প্রদর্শন করেছিলো তাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হবে।
৪০৫০। কেয়ামতের দিন হবে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের দিন। কারও অপরাধের বোঝা অন্য কেহ গ্রহণ করবে না ; সে যত নিকটজন বা প্রিয় হোক না কেন। কেউ কাউকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসবে না। কেউ কারও জন্য মধ্যস্ততা করার সাহস পাবে না। কেউ কাউকে সাহায্য করবে না।
৪০৫১। পৃথিবীর জীবনে মানুষ অর্থ সম্পদ , ধন - ঐশ্বর্য্য , বিদ্যা-বুদ্ধি, প্রভাব-প্রতিপত্তি , ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর গর্বে , অহংকারী , দাম্ভিক ও একগুঁয়ে হয়ে ওঠে। ফলে সে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে। কেয়ামত দিবসে যখন সে প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হবে তখন তার সে ঔদ্ধত্যপনা , দাম্ভিকতা ও অহংকার অন্তর্হিত হয়ে যাবে। সে সময়ে , যারা পৃথিবীতে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিলো সেই সব নেতাদের, তাদের অনুসারীরা অভিযুক্ত করবে। এ সব ভুল পথের নেতাদের চিত্র ফেরাউনের উদাহরণের মাধ্যমে আয়াত [ ২০ : ৭৯ ] তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুত সেদিন সকলেই আল্লাহ্র শক্তির নিকট আত্মসমর্পন করবে।
২৮। এবং বলবে ," তোমরা তো [ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ] ডান হাত থেকে আমাদের নিকট আসতে ৪০৫২।
৪০৫২। এখানে আয়াত [ ৩৭ : ২৭ ] পর্যন্ত দুদল লোকের মধ্যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এরা দুদলই পৃথিবীতে ছিলো অবিশ্বাসী ও পাপী। একদল ছিলো নেতা। অন্যদল ছিলো যারা দুর্বল শ্রেণীর তারা তাদের অনুসরণ করতো। পৃথিবীতে এসব ভ্রান্ত পথের নেতারা তাদের ক্ষমতা ,শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যবহার করতো মানুষকে প্রভাবিত করে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য। আল্লাহ্র দেয়া এসব প্রভাব, প্রতিপত্তি, ক্ষমতাকে তারা সঠিক পথে ব্যবহারের পরিবর্তে মন্দ কাজে , পাপের পথে ব্যবহার করতো। মানুষকে বিপথে পরিচালিত করতো। এটা তারা করতো, কারণ এর দ্বারা তারা জাগতিক ভাবে সুবিধা লাভে সক্ষম হতো। তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তারা সাধারণ মানুষকে অমঙ্গলের রাস্তায় , অকল্যাণের পথে পরিচালিত করতো।
৪০৫৩। 'তারা ' অর্থাৎ পৃথিবীর জীবনের শক্তিশালী নেতাদের বক্তব্য এই আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যের খারাপ উদাহরণ অনুসরণে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ পাপের পথে পা বাড়িয়েছে এ যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস এবং তাঁর প্রদর্শিত পথের অনুসরণ যা যুগে যুগে নবী রসুলদের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। বিশ্বাস হচ্ছে অন্তরের ধন। কিন্তু যদি আমাদের অন্তরে ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা , সত্যের প্রতি বিশ্বাস , পরলোকের জীবনকে সত্য বলে জানা, আল্লাহ্র আইনের প্রতি সম্মানবোধ না থাকে - তবে আমাদের অন্তরের এই ঈমানের অভাবের জন্য আমরা কেমন করে অপরকে দায়ী করবো? ন্যায়-অন্যায়, ভালো -মন্দ , পাপ-পূণ্য এসব মূল্যবোধ ধর্মীয় প্রত্যাদেশের মাধ্যমে যুগে যুগে আমাদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। এর পরেও যারা বিশ্বাস করে নাই ও ঈমান আনে নাই ; কাফের নেতারা যর্থাথই তাদের অনুসারীদের সেদিন বলবে, " তোমরা তো বিশ্বাসীই ছিলে না। তোমাদের কৃতকর্মের শাস্তি তোমাদেরই ভোগ করতে হবে।" কারণ প্রতিটি মানুষই তার ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বের নিকট আবদ্ধ। একের পাপ বা পূণ্য অন্যকে স্থানান্তর করা চলবে না। নেতাদের শাস্তি হবে দ্বিবিধ - প্রথমতঃ নিজস্ব কৃতকর্মের জন্য, দ্বিতীয়তঃ অন্যকে প্রভাবিত করে পাপের পথে পরিচালিত করার জন্য। কিন্তু তাই বলে দুর্বল শ্রেণীরা তাদের কৃতকর্মের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি লাভ করবে না। কারণ পাপ কার্যের অর্থই হচ্ছে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ভাবে বিদ্রোহ করা। কারণ পাপ কাজের দ্বারা আল্লাহ্র প্রদত্ত অমূল্য সম্পদ পরমাত্মার অংশ আত্মাকে অপবিত্র করা হয়। কেউ যখন পাপ করে, তখন সে তা করে ব্যক্তিগত দায়িত্বে। ফলে তা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ বলেই পরিগণিত হয়। সুতারাং সে কাজের দায়-দায়িত্ব্ ব্যক্তিগত। এ কথা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে মন্দ বা পাপ বা শয়তানের আমাদের উপরে কোনও ক্ষমতা নাই , যতক্ষণ না আমরা ইচ্ছাকৃত ভাবে তার কাছে অনুগত হই।
৩১। " সুতারাং এখন আমাদের বিরুদ্ধে আমার প্রভুর কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের সকলকেই অবশ্যই [ পাপের শাস্তি ] আস্বাদন করতে হবে ৪০৫৪।
৪০৫৪। পৃথিবীর সব কিছুই আল্লাহ্র আইনের অধীনে। জড় পদার্থ,জীবিত প্রাণীকূল সকলেই আল্লাহ্র আইনের আওতাভূক্ত। শারীরিক পরিবতর্নও বিশ্বস্রষ্টার আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। মানুষের নৈতিক চরিত্রও নৈতিক নীতিমালার অধীনে - তবে তা ভঙ্গ করার বা গ্রহণ করার স্বাধীনতা মানুষের আছে। যদি কেউ আল্লাহ্ প্রদত্ত নৈতিক নীতিমালা গ্রহণ না করে তবে তার ফলাফল তাকে ভোগ করতেই হবে। আল্লাহ্র ন্যায়নীতি অনুযায়ী প্রতিটি আত্মাকে তাঁর পাপের শাস্তি ভোগ করতেই হবে -এই আল্লাহ্র ন্যায়-নীতি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজের জন্য দায়ী থাকবে। এ ব্যাপারে কোনও ওজর বা আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারও সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। শুধুমাত্র আল্লাহ্র করুণা ও ক্ষমা-ই সেই মহাবিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে।
৪০৫৫। পৃথিবীতে যারা পাপকে জীবনের উন্নতির সোপান হিসেবে গ্রহণ করেছিলো - আল্লাহ্ ও পরকালের জীবনকে বিশ্বাস করে নাই ; এ সব লোক পরকালে শাস্তি দর্শনে তাদের নেতাদের ভৎর্সনা করবে। পথভ্রষ্টদের নেতা তার অনুসারীদের সেদিন বলবে, " তোমরা আমাদের কাছ থেকে ভালো কিছু কি ভাবে আশা কর ? কারণ আমরা নিজেরাও বিভ্রান্ত ছিলাম। আমরা আল্লাহ্র প্রেরিত সর্তকবাণীকে গ্রহণ না করার ফলে আমরা ছিলাম বিপথগামী। "
৩৪। পাপীদের সাথে আমি এভাবেই ব্যবহার করবো।
৩৫। কারণ,তাদের যখন বলা হয়েছিলো , আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই , তখন তারা অহংকারে স্ফীত হয়ে পড়েছিলো ৪০৫৬।
৪০৫৬। স্বার্থপরতা ও অহংকার এই দুটো অত্যন্ত খারাপ দোষ যা মানুষকে পথভ্রান্ত করে ও শেষ পরিণতিতে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। স্বার্থপরতা ও অহংকার সকল পাপের ও খোদাদ্রোহীতার মূল বা উৎপত্তিস্থল। শয়তান [ ২ : ৩৪ ] ও ফেরাউন [ ২৮ : ৩৯ ] প্রভৃতির উদাহরণের মাধ্যমে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের এই পৃথিবীর জীবনেও সাধারণ মানুষ পাপের অতলে নিজজ্জিত হয় শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থের কারণে। আর অহংকার থেকে উৎপন্ন হয় উদ্ধত-গর্বিত আচরণ , যা মানুষকে চারিত্রিক দোষত্রুটি অনুধাবনে বাঁধার সৃষ্টি করে ; ফলে সে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকে।
মানুষের এই অহংকারের প্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটে থাকে। যেমন : বংশগৌরব বা পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য সম্বন্ধে গর্ব ; বা নিজেকে জনগণের নেতা মনে করা, জাতিগত অহংকার অথবা নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা ইত্যাদি। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতার অনেক প্রকারভেদ আছে - কিন্তু বাংলাদেশীদের জাতীয় জীবনে সাধারণ ভাবে যে অহংবোধ কাজ করে থাকে তা হচ্ছে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবার প্রবণতা। বুদ্ধিমান ভাবার মধ্যে দোষের কিছু নাই, কিন্তু তখনই তা পাপে পরিণত হয় ,যখন সে কৌশলের মাধ্যমে অন্যের প্রতি অবিচার করে এবং সে সম্বন্ধে গর্ব ও আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করে থাকে। অহংকারের এই বিকৃত প্রকাশ মানুষকে উদ্ধত ও গর্বিত করে ফেলে এবং চরিত্র থেকে 'বিনয়' অপসারিত হয়। যার ফলে আল্লাহ্র ও ব্যক্তির আত্মার মাঝে দুস্তর ব্যবধান রচিত হয়। যদি মানুষ আল্লাহ্র একত্ব আত্মার মাঝে অনুভব করতো , এবং উপলব্ধি করতো যে সকল সফলতা আল্লাহ্র দান, সেখানে নিজস্ব কৃতিত্বের কোনও স্থান নাই, এই অনুভব তাকে অহংকার ও স্বার্থপরতা থেকে বিরত রাখতো। ক্ষণস্থায়ী এই পার্থিব জীবনে আল্লাহ্-ই একমাত্র সত্য, এই অনুধাবন পাপ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু যখন মানুষ আল্লাহ্র একত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে ,বিভিন্ন উপাস্য যেমন - রত্ন পাথর , পীর , মাজার , রাশি চক্র ইত্যাদির সাহায্য গ্রহণ করে, তখন তার আধ্যাত্মিক জীবন পাপের অন্ধকারে ঢেকে যায়। কারণ এ সব মিথ্যা উপাস্য পাপের প্রতিনিধি স্বরূপ, যা ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের পক্ষে তখন এসব উপাস্য ত্যাগ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা এদের পক্ষে সম্ভব হয় না এবং তা নিয়ে তারা গর্ব প্রকাশ করে থাকে, এরূপ ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ্র করুণা ও দয়া তাদের রক্ষা করতে পারে , আর কেউ না।
৪০৫৭। রাসুলের [ সা ] জীবনের মাধ্যমে এ সব উদ্ধত অহংকারী লোকেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলাম প্রচারের প্রথম যুগে, বহু উপাস্যের উপাসনাকারী এ সব পাপিষ্ঠরা রসুলকে [ সা] উম্মাদ কবিরূপে আখ্যায়িত করতো। সত্যের আবেদন তাদের নিকট ছিলো অরুচিকর , কারণ তা ছিলো তাদের ব্যক্তি স্বার্থের বিরোধী। আজও এত যুগ পরে , স্বার্থপর ও অহংকারী ব্যক্তিদের এই মানসিকতার কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই।
৪০৫৮। ইসলামের বাণী কোন পাগলের প্রলাপ নয় ; বরং তা সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত , যা জীবনের খুব কাছাকাছি। আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টিতে যে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন , ইসলামের শিক্ষা সেই সত্যকেই প্রকাশ করে থাকে। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে জীবনের সর্বোচ্চ সত্য। পবিত্রতার প্রতীক , যা বিভিন্ন যুগে আল্লাহ্র প্রেরিত রসুলদের প্রচারিত সত্যকে সত্যায়ন করে থাকে।
৩৯। এবং তোমরা [ যে মন্দ কাজ ] করতে তাহারই প্রতিফল পাবে; - ৪০৫৯
৪০৫৯। যে যার কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে, এই হচ্ছে ন্যায় বিচার । যে পাপ করে সে তার ফল ভোগ করবে, যে সৎকাজ করবে সেও উপযুক্ত প্রতিদান লাভ করবে। পাপীদের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে - যা তাদেরই কর্মফল। এটা কারও প্রতিরোধ বা বিদ্বেষবশতঃ করা নয়। কারণ প্রকৃতির ধর্ম-ই হচ্ছে "Every action there is an equal and opposite reaction"। বিশ্ব প্রকৃতিকে স্রষ্টা এই প্রাকৃতিক আইনের অধীন করে দিয়েছেন। পাপী ও পূণ্যাত্মা সকলেই এই আইনের অধীন।
৪১। তাদের জন্য নির্ধারিত আছে জীবনোপকরণ হিসেবে ৪০৬০, ৪০৬১
৪০৬০। "Ma'lum" - নির্ধারিত। এই নির্ধারিত শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, পূণ্যাত্মা ও আল্লাহ্র আর্শীবাদ পুষ্টদের জন্য যে পুরষ্কার নির্ধারিত তা কোন দৈবাৎ ঘটনা নয়। পূণ্যাত্মাদের কাজের পুরষ্কারের ঘোষণা হচ্ছে আল্লাহ্র দৃঢ় অংগীকার।
৪০৬১। 'রিযিক' বা "জীবনোপকরণ"- এখানে রিযিক শব্দটি দ্বারা বেহেশতের ফলমূলকে বোঝানো হয়েছে।
৪০৬২। "ফলমূল" ; দেখুন আয়াত [ ৩৬ : ৫৭ ] এবং টিকা ৪০০৩। এই আয়াত থেকে পরবর্তী আয়াতসমূহের বর্ণনা করা হয়েছে পূণ্যাত্মাদের পুরষ্কারের বর্ণনা। ধাপে ধাপে তা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ খাদ্য যথা ফলমূল, তারপর মনোরম ছবির মত বাগান [ যথাঃ নৈসর্গিক দৃশ্য, শোভা, পাখীর গান, ফুলের গন্ধ, ঝরণা ইত্যাদি ] ; সুখ ও সম্মানের বাসগৃহ ; সমমনোভাবাসম্পন্ন সঙ্গী সহযোগে সিংহাসনে সমাসীন , উপাদেয় পানীয় ; সামাজিক আনন্দ ; অপর লিঙ্গের সঙ্গের আনন্দ এখানে অপর লিঙ্গের সঙ্গীদের সৌন্দর্য মনোহারিত্ব হবে তুলনাহীন।
৪৪। [ মর্যাদার ] সিংহাসনে মুখোমুখি সমাসীন হয়ে।
৪৫। প্রবাহমান স্বচ্ছ ঝরণা থেকে [ পানীয় ] পেয়ালা তাদের নিকট ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে।
৪৬। উহা স্ফটিক শুভ্র , পানকারীদের জন্য তা হবে সুস্বাদু।
৪৭। তার মধ্যে [ ক্ষতিকর ] মাথা ব্যথার কারণ নাই, এবং উহাতে তারা মাতালও হবে না ৪০৬৩।
৪০৬৩। বেহেশতে যে সামাজিক সমাবেশ হবে তারই বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। সেখানে যে পানীয় পরিবেশন করা হবে তা হবে পবিত্র, কোনও ক্ষতিকর প্রভাব এতে থাকবে না। পৃথিবীতে এরূপ সামাজিক সমাবেশ পাপের জন্ম দেয়। কিন্তু বেহেশতে তা হবে পূত এবং পবিত্র।
৪০৬৪। এই আয়াতে বিশুদ্ধ নারীত্বের সর্বোচ্চ সৌন্দর্যকে প্রকাশ করা হয়েছে প্রতীকের মাধ্যমে। তারা হবে পূত পবিত্র , পৃথিবীতে কোন পাপ বা অপূর্ণতা তাদের স্পর্শ করবে না। তারা হবে নম্র দৃষ্টি হবে আনত। চক্ষুর সৌন্দর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তাদের সুন্দর চক্ষুদ্বয় শিশুর বিস্ময়ের ন্যায় মাধুর্যে পরিপূর্ণ।
৪০৬৫। এখানে হুরীদের সৌন্দর্যের বর্ণনা করা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তাদের গাত্রবর্ণ হবে কমনীয় যাকে ডিমের স্বচ্ছ ভঙ্গুর খোসার সাথে তুলনা করা যায়। আয়াত [ ৫৫ : ৫৮ ] তুলনা করা হয়েছে রুবী ও কোরালের সাথে অর্থাৎ গাত্রবর্ণ হবে গোলাপের মত সৌন্দর্যমন্ডিত গোলাপী।
৪০৬৬। একই বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে আয়াত[ ৩৭ : ২৭ ] এ। এখানে বক্তব্য হচ্ছে পূণ্যাত্মাদের , সেখানে ছিলো ঠিক তার বিপরীত যারা জাহান্নামী তাদের। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তারা পৃথিবীর স্মৃতিচারণ করেছে। তারা পৃথিবীর অভিজ্ঞতাকেই পরলোকে বহন করে নিয়েছে।
৪০৬৭। এই আয়াতে পূণ্যাত্মা ব্যক্তিটি যে সঙ্গীর কথা উল্লেখ করেছে, সে সন্দেহ প্রবণ ব্যক্তি ছিলো, ধর্ম ছিলো তার নিকট হাসির বস্তু। পরকাল অলীক কল্পনা মাত্র। মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি হয়ে যাবে সম্পূর্ণ উল্টো। যারা পৃথিবীতে আল্লাহ্র প্রতি একান্ত ভালোবাসার দরুণ আল্লাহ্ প্রদশির্ত সৎ জীবন যাপন করেছে - তারা পরলোকের জীবনে অনন্ত সুখ ও শান্তির আস্বাদন করবে। অপর পক্ষে যারা ছিলো সন্দেহ বাতিক তারা তাদের আত্মাকে এই পৃথিবীতেই অপবিত্র করার ফলে ইহকাল ও পরলোক উভয় কালেই দোযখের যন্ত্রণা ভোগ করবে।
৫৩। "যখন আমরা মৃত্যু বরণ করবো এবং ধূলা ও অস্থিতে পরিণত হব, তখন কি [ সত্যিই ] আমাদের পুরষ্কার এবং শাস্তি দেয়া হবে ?
৫৪। [তখন একটি স্বর ] বলেছিলো , " তুমি কি নীচের দিকে তাকাতে চাও ? "
৫৫। সে নীচের দিকে তাকালো এবং তাকে [ জাহান্নামের ] আগুনের মধ্যস্থলে দেখতে পেলো ৪০৬৮।
৪০৬৮। বেহেশতবাসীকে তাঁর সঙ্গীর অবস্থা উঁকি মেরে দেখার অনুমতি দেয়া হবে। সঙ্গীর অবস্থান দোযখে দেখে তার উপলব্ধি ঘটবে কি সাংঘাতিক পরিণতির হাত থেকে সে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। এ সবই আল্লাহ্র অসীম করুণার স্বাক্ষর।
৫৭। " আল্লাহ্র অনুগ্রহ না থাকলে ৪০৬৯ , আমি [ জাহান্নামে ] উপস্থিত করা লোকদের দলে পড়ে যেতাম।
৪০৬৯। বেহেশতবাসী কৃতজ্ঞতার সাথে আল্লাহ্ দয়া ও করুণাকে স্মরণ করবে। সে উপলব্ধি করবে যে, আল্লাহ্র রহমত ব্যতীত সে তার দোষত্রুটির উর্দ্ধে উঠতে সক্ষম হতো না। সে নিজেও একজন জাহান্নামীতে পরিণত হতো। সে অনুধাবনে সক্ষম হবে যে, পরলোকের জীবনে প্রত্যেকে প্রত্যেকের কর্মের জন্য দায়বদ্ধ। অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হওয়া কোনও শাস্তি থেকে অব্যহতি পাওয়ার শর্ত সে জগতে অচল। তাঁর আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস তাঁকে সৎপথে পরিচালিত করে যার ফলে সে এই ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা পায়।
৫৯। "প্রথম মৃত্যুর পরে, এবং আমাদের শাস্তিও দেয়া হবে না ? " ৪০৭০
৪০৭০। যে ভয়াবহ বিপদ থেকে সে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে এই অনুভব তাঁকে এতটাই আপ্লুত করবে যে সে বিশ্বাস-ই করতে চাইবে না - আনন্দে আত্মহারা পড়বে ; সত্যিই কি সে বিপদমুক্ত ? পুণরায় মৃত্যুর দ্বার কি সত্যিই তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ? সত্যিই কি সে পাপের প্রলোভন থেকে মুক্ত, শাস্তির ভয় তিরোহিত ?
৪০৭১। এখানে উত্তর দান হয়েছে ; হ্যাঁ। "Beyond the flight of time . Beyond the realm of Death . There surely is some blessed clime ." বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় " যে জীবন হবে অসীম, মৃত্যুর উর্দ্ধে। নিশ্চয়ই আর্শীবাদ ধন্যরাই সেখানে পৌঁছাতে পারে - যেখানে জীবন শুধুমাত্র একটি ফুৎকার নয়। Longfellow এই লাইনটির মাধ্যমে মৃত্যুপরবর্তী জীবনের যে চিত্র একেছেন তা আমাদের পৃথিবীবাসীদের জন্য আশা ও আকাঙ্খা। পরলোকের বিশ্বাসের মাধ্যমেই এই জীবনে প্রবেশ লাভ ঘটে।
কোন কোন তফ্সীরকার এর মতে আয়াত ৬০-৬২ হচ্ছে ধারাবাহিক বর্ণনা , যা একজন বেহেশতবাসীর উক্তি। সে ক্ষেত্রেও অর্থের কোনও তারতম্য হবে না।
৬২। আপ্যায়নের জন্য এটাই কি উত্তম , না যাক্কুম বৃক্ষ ৪০৭২।
৪০৭২। দেখুন [ ১৭ : ৬০ ] ও টিকা ২২৫০। বেহেশতের মনোরম বাগান ও সুস্বাদু ফলের পটভূমিতে দোযখের তিক্ত স্বাদ যুক্ত যাক্কুম বৃক্ষের বর্ণনা করা হয়েছে।
৪০৭৩। দোযখের তিক্ত বৃক্ষ পাপীদের জন্য সত্যিই এক মহাপরীক্ষা। এই বৃক্ষের বর্ণনা এরূপ : ১) বৃক্ষটি দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে উৎপন্ন হয়, ২) যে কোন বৃক্ষের বৃন্ত এবং ফল হয় নরম, কিন্তু এই বৃক্ষের ফল ও বৃন্ত সবই হবে শয়তানের মাথার মত। ৩) পাপীরা এই গাছের ফল গোগ্রাসে ভক্ষণ করবে; ৪) তদুপরি তাদের ফুটন্ত পানির মিশ্রণ পান করতে হবে যা তাদের অন্ত্র গলিয়ে দেবে [ দেখুন পরবর্তী টিকা ] ; ৫) পাপীরা এই প্রক্রিয়া শেষ করা মাত্র বারে বারে তা একই ভাবে পুণরাবৃত্তি করবে। এর কোনও শেষ থাকবে না। কি ভয়ানক বীভৎস দৃশ্য। এই পৃথিবীতে পাপীদের বাস্তব রূপকে দোযখের বর্ণনার প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ১) সর্বাপেক্ষা দূর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির আত্মার যে অপবিত্রতা সে স্থানই হচ্ছে দোযখের সর্বনিম্ন স্থানের ন্যায় ; যেখান থেকে এই বৃক্ষটি জন্ম লাভ করে। অর্থাৎ দুষিত বিকৃত আধ্যাত্মিক অবস্থাই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ফল উৎপন্ন করে সমাজে। ২) এ সব আত্মায় সুকুমার বৃত্তি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা অন্তর্হিত হয় ; ৩) পাপীর পাপের ক্ষুধা সীমাহীন , ক্রমাগত বাড়তে থাকে; ৪) পাপীদের পাপকার্য স্বল্পকালীন সময়ের জন্য নিবৃত্ত থাকতে পারে ; কিন্তু আবার তার পুণরাবৃত্তি ঘটবে ; ৫) পাপের ধারাবাহিকতা অসীম ,একটি পাপ আর একটি পাপকে আকর্ষণ করে - ধাপে ধাপে তা ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে।
৬৫। যার নূতন উদ্গত ফলের বৃন্ত [ মোচা ] যেনো শয়তানের মাথা।
৬৬। সেটাই তারা খাবে এবং তার দ্বারা তাদের উদর পূর্ণ করবে ৪০৭৪।
৪০৭৪। বেহেশতের বর্ণনায় বাগান ফল ও পানীয় হচ্ছে সুখ -স্বাচ্ছন্দ সৌভাগ্যের প্রতীক যার বিপরীতে দোযখের ভয়াবহত বর্ণনা করা হয়েছে। তা বিশদ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে [ ৪৭ : ১৫ ] আয়াতে -যেখানে বলা হয়েছে ফুটন্ত পানি পাপীদের অন্ত্রকে গলিয়ে দেবে।
৬৮। অতঃপর তাদের প্রত্যাবর্তন ঘটবে [ জ্বলন্ত ] অগ্নিকুন্ডে ৪০৭৫।
৪০৭৫। যখন তারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর থেকে 'জাক্কুম ' ভক্ষণ করবে তাদের নিয়ে আসা হবে ফুটন্ত পানীয় পান করার জন্য; শাস্তিকে আরও তীব্র করার জন্য। এর পরে তাদের জন্য আবার শাস্তিকে পুণঃরাবৃত্ত করা হবে। 'জাক্কুম ' ভক্ষণ ও ফুটন্ত পানীয় পান এ চক্রাকারে চলতেই থাকবে। পাপীরা ইচ্ছা করলেই ভক্ষণ ও পান থেকে বিরত থাকতে পারবে না। শাস্তির যন্ত্রণা তাদের চক্রাকারে অবিরল চলতেই থাকবে। মনে রাখতে হবে পরলোকে কোন ধবংস নাই। পাপীদের গলিত অন্ত্র ও ছিড়ে যাওয়া যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীর শাস্তির পুণরাবৃত্তির পূর্বে আবার পূর্বরূপ ধারণ করবে যেনো যন্ত্রণার তীব্রতা পুরোপুরি সে ভোগ করতে পারে। অনন্তকাল ব্যপী এ যন্ত্রণা চলবে।
৭০। সুতারাং তারাও তাদের পদচিহ্ন অনুসরণে ধাবিত হয়েছিলো ৪০৭৬।
৪০৭৬। পাপীদের এখানে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। "তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষদের পাপের পথে বিচরণ করতে দেখেছো এবং চিন্তা ভাবনা না করে তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছ।"
৭২। কিন্তু পূর্বেও আমি তাদের মধ্যে [ রাসুল ] প্রেরণ করেছিলাম , তাদের সর্তক করার জন্য ; - ৪০৭৭
৪০৭৭। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে ভুল করা। মহান আল্লাহ্ মানুষের ভুল-ভ্রান্তি , দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে দেন, যদি পাপী ব্যক্তি অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন করে থাকে। এই আয়াতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, যুগে যুগে আল্লাহ্ মানুষের কল্যাণের জন্য নবী রসুলদের প্রেরণ করেছে মানুষকে সর্তক করে দেবার জন্য। তারা মানুষকে আল্লাহ্র বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, সর্তক করেছেন , শিক্ষা দিয়েছেন ন্যায়-অন্যায় , সত্য-মিথ্যা , ভালো -মন্দের মধ্যে পার্থক্য। কিন্তু মানুষ ইচ্ছাকৃত ভাবে তা প্রত্যাখান করেছে।
৪০৭৮। পৃথিবীতে সৎ ও ন্যায়বান জীবন যাপন করা ও এক আল্লাহতে সর্ব নির্ভরতা স্থাপন করার মধ্যেই সকল সুখ ও শান্তি নিহিত। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ গ্রহণ এবং আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে জীবন ধারণই হবে শেষ বিচারের দিনের জবাবদিহিতা। তবে পরলোকের বিচারের পূর্বেই এই পৃথিবীতেই তার নমুনা অবলোকন করা যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অন্যায়কারী ও পাপী , তা সে ব্যক্তিই হোক বা জাতিই হোক, তাদের শেষ পরিণতি কখনও সুখের হয় না , এমনকি এই পৃথিবীতেই। জীবনের হিসাব হয় জীবনের শেষ যোগফলে জীবনের পরিণতিতে। অন্যায়কারী ও পাপীরা শেষ পরিণতিতে কখনও সাফল্য লাভ করে না। ইতিহাস থেকে এই শিক্ষাই নিতে বলা হয়েছে। "তাদের কি পরিণতি হয়। "
৪০৭৯। পৃথিবী যখন ঘোর পাপের মাঝে নিমজ্জিত হয়, তখনও একদল লোক থাকে যারা প্রকৃত আল্লাহ্র বান্দা। তারা বিশ্বাসে আন্তরিক ও বিশ্বস্ত, যারা আল্লাহ্র রাস্তায় , আল্লাহ্র সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে। "তাদের কথা স্বতন্ত্র।" তাদের জন্য উন্নততর জীবন অপেক্ষামান।
লক্ষ্য করুণ আয়াত [ ৩৭ : ৪০ ] এ এই লাইনটির পুণরাবৃত্তি করা হয়েছে ; যেখানে পূণ্যাত্মা ও পাপীর শেষ পরিণতির মধ্যে তুলনা করতে যেয়ে উপরের আয়াতটি বলা হয়েছে। এখানে এই আয়াতটির মাধ্যমে বক্তব্যের ইতি টানা হয়েছে যেখানে ইতিহাস থেকে ও পূর্বের নবী রসুলদের জীবনী থেকে উদাহরণ উত্থাপিত করা হয়েছে।
রুকু - ৩
৪০৮০। দেখুন আয়াত [ ৭৬ - ৭৭ ]। নূহ্ নবীর কাহিনী কোরাণের বহু স্থানে বিবৃত করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে কাহিনীকে উপস্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট শিক্ষাদানের জন্য। এখানের প্রেক্ষাপট হচ্ছে , ন্যায় ও সৎ পথের যারা সন্ধানী , আল্লাহ্ তাদের সকল পাপ থেকে রক্ষা করতে প্রয়াস পান। আল্লাহ্ তাদের রক্ষাকর্তা - পাপ কখনও ন্যায় ও সত্যকে পরাভূত করতে পারবে না। আল্লাহ্র পরিকল্পনা কখনও ব্যর্থ হবার নয়। নূহ্ নবীর কাহিনীর উল্লেখের মাধ্যমে এই সত্যকেই প্রকাশ করা হয়েছে।
৪০৮১। এই আয়াত নূহ্ নবীর মহাপ্লাবন সম্বন্ধে ইঙ্গিত করা হয়েছে মহা বিপর্যয় দ্বারা। মূল কাহিনী আছে আয়াত [ ১১ : ২৫ - ২৮ ]।
৪০৮২। একমাত্র নূহ্ নবীর বংশধরেরাই এই মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পায়, বাকী সকলেই ধ্বংস হয়ে যায়।
৪০৮৩। যতদিন পৃথিবীতে মানুষ থাকবে - ততদিন তারা নূহ্ নবীর নাম স্মরণ করবে। ধর্মীয় ইতিহাসের প্রথমে তাঁর নাম , শেষ পর্যন্তও তিনি স্মরণে থাকবেন - এই-ই আল্লাহ্র বিধান।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে আয়াত [ ৭৮ - ৮১ ] আয়াত সমূহ [ সামান্য পরিবর্তনসহ ] সঙ্গীতের ধূয়ার মত বারে বারে বিভিন্ন সূরাতে পুণরাবৃত্তি করা হয়েছে হযরত ইব্রাহীমের জন্য, মুসার জন্য, ইলিয়াসের জন্য। কিন্তু লূত ও হযরত ইউনুসের জন্য তা করা হয় নাই। লূত ছিলেন ইব্রাহীমের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং তাঁর উল্লেখ হযরত ইব্রাহীমের কাহিনীর সাথেই করা হয়েছে। ইউনুস নবীর নবুয়তের ধারা লোকেরা পায় যখন তারা ধ্বংসের পথে গিয়েছিলো , কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকেরা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে [ ৩৭ : ৪৮ ]। লূত যখন তারা এবং ইউনুস নবী উভয়েই আঞ্চলিক স্থানে কাজ করেন যা খুবই সীমিত।
৪০৮৪। প্লাবনের কাহিনী কোনও না কোনওভাবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে দেখা যায়। এই কাহিনী যে শুধুমাত্র মুসার ধর্মগ্রন্থে বিদ্যমান তা নয়, মুসার ধর্মের অনুসারী ব্যতীত অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও প্লাবনের কাহিনী প্রচার করে থাকে - কোন না কোন ভাবে। যেমন গ্রীক জাতি ঐতিহ্যগত ভাবে যে প্লাবনের কাহিনী বর্ণনা করে থাকে তার নায়ক হচ্ছে Deukalion এবং তার স্ত্রী হচ্ছেন Pyrrha। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীতে [ সপ্তপথ ব্রাহ্মণ এবং মহাভারত ] মহাজ্ঞানী মনু ও মাছের উল্লেখ আছে। চীনা পৌরাণিক কাহিনীতে মহাপ্লাবনের কাহিনী আছে Shu-king এ। আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের অনেক গোত্রের মাঝেই প্লাবনের কাহিনী খুবই সাধারণ ঘটনা।
এভাবেই সমগ্র বিশ্ব কোনও না কোনও ভাবে মহাপ্লাবনের ঘটনা স্মরণ করে থাকে।
৮১। নিশ্চয়ই সে ছিলো মোমেন বান্দাদের অন্তর্গত।
৮২। অন্য সকলকে আমি বন্যাতে নিমজ্জিত করেছিলাম।
৮৩। যারা তাঁকে অনুসরণ করেছিলো , ইব্রাহীম ছিলো তাদের অন্তর্গত ৪০৮৫।
৪০৮৫। " ইব্রাহীম ছিলো তাদের অন্তর্গত।" এখানে "তাঁকে" সর্বনাম দ্বারা হযরত নূহকে বোঝানো হয়েছে ; কারণ আয়াত ৮১ তে বলা হয়েছে " সে ছিলো মুমিন বান্দাদিগের অন্যতম।" এই "সে " সর্বনামটি হযরত নূহ্ এর পরিবর্তে ব্যবহৃত ।
হযরত ইব্রাহীমের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সূরা [ ২১ : ৫১-৭৩ ] আয়াতে। কিন্তু হযরত ইব্রাহীমের এবং তাঁর পুত্রের আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সর্বান্তকরণে আত্মসমর্পনের অধ্যায়কে বর্ণনা করা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। আয়াত নং [ ১০২ -১০৭ ] এ, বর্ণনা করা হয়েছে পিতার কর্ম সম্পাদনের আন্তরিকতা ও পুত্রের সর্বোচ্চ আত্মসমর্পনের চমৎকার কাহিনী যা ছিলো তাদের জন্য এক মহা পরীক্ষা। এই সূরার মূল বিষয়বস্তু-ই হচ্ছে " আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন।
৪০৮৬। 'Qalb Salim'- বিশুদ্ধ চিত্ত বা হৃদয়। অর্থাৎ পূত পবিত্র আত্মা , যে আত্মা পৃথিবীর কলুষতা থেকে মুক্ত। আরবীতে চিত্ত বা হৃদয় শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র আবেগ অনুভূতি এবং ভালোবাসার আধাঁর বা স্থানকেই চিহ্নিত করে না [ যা বাংলা ভাষাতে করা হয় ] ; হৃদয় শব্দটি দ্বারা এ সব ব্যতীত , বুদ্ধিমত্তা এবং তার প্রতিক্রিয়া, এক কথায় ব্যক্তির সমগ্র চরিত্র বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়। দেখুন সূরা [ ২৬ : ৮৯ ] তে বলা হয়েছে " সেই সফলকাম যে বিশুদ্ধ চিত্ত নিয়ে উপস্থিত হবে।"
৮৬। " তোমরা কি আল্লাহকে ত্যাগ করে মিথ্যা উপাস্য কামনা করছো ? ৪০৮৭
৪০৮৭। মিথ্যা উপাস্যের অনেক ধরণ আছে , যেমন মূর্তি, গ্রহ নক্ষত্র , উপদেবতা, আত্মপূঁজা, অথবা আল্লাহ্র সম্বন্ধে বিকৃত ধারণা বা অতীন্দ্রিয় কোন কিছুকে কল্পনার সাহায্যে বিশ্বাস করা। এ সব ক্ষেত্রেই উপাস্য সম্বন্ধে যে ধারণা করা হয় তা অলীক বা কল্পনাপ্রসূত যা জ্ঞান ও বিবেকের সমর্থন করে না। হযরত ইব্রাহীম তাঁর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
৪০৮৮। এই আয়াতটি হযরত ইব্রাহীমের বক্তব্য : " তোমরা কি প্রকৃত স্রষ্টাকে হৃদয়ে অনুভবে অক্ষম ? প্রকৃত স্রষ্টা এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি বিভিন্ন আকৃতি বা রূপের উর্দ্ধে। তোমরা তাঁর সম্বন্ধে যে সব কুসংস্কার প্রয়োগ কর তিনি তার বহু উর্দ্ধে অবস্থান করেন।
৮৯। এবং বললো , " আমি [ অন্তরে ] অসুস্থ। " ৪০৮৯
৪০৮৯। ধর্ম বিষয়ে হযরত ইব্র্রাহীমের সম্প্রদায়ের কর্মকান্ড তাঁকে বিচলিত করে তুললো - তাঁর সম্প্রদায়ের বিভ্রান্তিতে তার অন্তর ব্যথিত হয়ে পড়লো। বিশেষত : তাঁর পিতা ছিলেন সম্প্রদায়ের প্রধান এবং সম্প্রদায়ের লোকেরা মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার ক্ষেত্রে তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতো। হযরত ইব্রাহীমের পক্ষে ধর্ম বিষয়ের এ সব হাস্যস্কর অনুষ্ঠান অনুসরণ করা ছিলো অসম্ভব ব্যাপার ; যা তাঁর হৃদয় ও আত্মাকে ব্যথিত করতো। হৃদয়ে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করতো। সূরা [ ২১: ৫৬ - ৬৪ ] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে কিভাবে হযরত ইব্রাহীম এসবের প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
৯১। তারপরে সে তাদের উপাস্যদের দিকে ফিরলো এবং বললো , " [ তোমাদের সম্মুখের নৈবেদ্য ] তোমরা আহার করবে না ?
৯২। " তোমাদের ব্যাপার কি যে তোমরা [ বুদ্ধিমানের মত ] কথা বল না ? "
৯৩। তারপরে সে উহাদের ডানহাত দিয়ে সবলে আঘাত করলো ৪০৯০, ৪০৯১।
৪০৯০। উপরের টিকাতে বিষয়বস্তুর বিবরণ সম্বন্ধে যে আয়াতসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে তা দেখুন।
৪০৯১। "সবলে" - অর্থাৎ তিনি তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মূর্তিগুলিকে আঘাত হানেন।
৯৫। সে বলেছিলো , " তোমরা যাকে [ আপন হাতে ] খোদাই করে নির্মাণ করেছ , তোমরা কি তারই পূঁজা কর ৪০৯২ ?
৪০৯২। তিনি এই কাজ করেন তার সম্প্রদায়ের সাথে উপাস্য বিষয়ে উদাহরণের মাধ্যমে মীমাংসার নিমিত্তে।যেনো যুক্তি তর্কের ভিত্তিতে মিথ্যা উপাস্যের অসারতা তারা অনুধাবন করতে পারে। তাঁর বক্তব্য ছিলো , "তোমরা কি তোমাদের নিজের সৃষ্ট পদার্থের পূঁজা কর ? কিন্তু নিশ্চয়ই জেনো সমস্ত উপাসনা একমাত্র বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্র প্রাপ্য - কারণ তিনি তোমাদের এবং তোমাদের তৈরী উপাস্য সকলেরই সৃষ্টিকর্তা। "
৯৭। তারা বলেছিলো , " তার জন্য অগ্নিকুন্ড তৈরী কর, এবং তাকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ কর ৪০৯৩। "
৪০৯৩। হযরত ইব্রাহীমের যুক্তি ছিলো অখন্ডনীয় - সুতারাং তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তা যুক্তি তর্ক দ্বারা খন্ডন করতে সক্ষম হলো না। এরূপ ক্ষেত্রে মন্দ ব্যক্তিরা সত্যকে গ্রহণের পরিবর্তে বিপথের আশ্রয় গ্রহণ করে। হয় তারা সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ করে, আর যদি সে ক্ষমতা না থাকে তবে গোপন ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। হযরত ইব্রাহীমের ক্ষেত্রে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্র দুধরণের কৌশলেরই আশ্রয় গ্রহণ করে। সন্ত্রাস ও শক্তি প্রদর্শিত হয় তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ দ্বারা , কিন্তু আগুন যখন তাঁর কোন ক্ষতি করতে অক্ষম হলো [ ২১ : ৬৯ ] তখন তারা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করলো যার উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে [ ৩৭ : ৯৮ ]। কিন্তু তাদের এই ষড়যন্ত্র সফল না হয়ে বুমেরাং-এর ন্যায় তাদেরই পুণরায় আঘাত হানে। আল্লাহ্ তাদের -"লাঞ্ছিত করেন।"
হযরত ইব্রাহীমের এই উদাহরণ আজও বিদ্যামন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিবাদমান দলের নীতি হচ্ছে সন্ত্রাস ও চক্রান্ত। অসৎ ও মন্দ লোকের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যকেই এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
৪০৯৪।দেখুন আয়াত [ ২১ : ৭১ ]। পূণ্যাত্মা ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে যায়। ইব্রাহীম দেশ ত্যাগ করেন এবং সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপন করে সাফল্য ও সমৃদ্ধি লাভ করেন। তাঁর সাফল্যে তাঁর বিরুদ্ধে যারা চক্রান্ত করেছিলো , তারা বিশ্বের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হয়।
উপদেশ : আল্লাহ্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের আল্লাহ্ কি ভাবে সাফল্য দান করবেন তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব ব্যাপার।
৪০৯৫। সে অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীম। হযরত ইব্রাহীমের হিজরতের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে। ইব্রাহীম তাঁর শৈশবের লালিত জন্মভূমি , প্রিয়জন সব কিছু ত্যাগ করে অচেনা অজানা পৃথিবীর পথে পা বাড়ান সত্যকে রক্ষা করার প্রয়াসে। পূর্ব পুরুষদের মিথ্যাচারে জীবনকে পরিচালিত করা অপেক্ষা সত্যের প্রতি আনুগত্য তাঁর নিকটে অধিক প্রিয় বলে বিবেচিত হয়। এ ব্যাপারে তাঁর একমাত্র ভরসা ছিলো সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। পরবর্তীতে আল্লাহ্র অনুগ্রহে তিনি সত্যের অনুসারীদের ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হন যা পরবর্তীতে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়।
উপদেশ : ইব্রাহীমের কাহিনীর মাধ্যমে এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্র রাস্তায় প্রকৃত সংগ্রাম কখনও বৃথা যেতে পারে না। এ সত্য নবী রসুলদের জন্য যেমন প্রযোজ্য ঠিক সমভাবে সাধারণ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য।
১০১। সুতারাং আমরা তাকে এক কষ্ট সহ্যকারী ও ধৈর্য্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম ৪০৯৬, ৪০৯৭।
৪০৯৬। পুত্র সন্তান লাভের সুসংবাদ দান করা হয় সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনের উর্বর ভূমিতে যখন হযরত ইব্রাহীম সেখানে অবস্থান করছিলেন। মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই পুত্র হচ্ছেন হযরত ইসমাঈলের আগমনের সংবাদ। ইসমাঈল নামটি sami'a এই শব্দটি থেকে উত্থিত। sami'a অর্থাৎ শোনা, কারণ আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীমের প্রার্থনা কবুল করেন [ ৩৭ - ১০০ ]। ইসমাঈল যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন হযরত ইব্রাহীমের বয়স ছিলো ৮৬ বৎসর [ Gen XVI 16 ] ।
৪০৯৭। হযরত ইব্রাহীমের অনাগত পুত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে ; স্থির বুদ্ধি সম্পন্ন বা হালিম শব্দটি দ্বারা। হালিম শব্দটি হযরত ইব্রাহীমের উপাধিরূপে বর্ণনা করা হয় [ দেখুন আয়াত ৯ : ১১৪ ও ১১ :৭৫ ]। এই শব্দটি প্রকৃত ধৈর্য্যশীল বা সবরকারীদের জন্য প্রযোজ্য। সবর্ শব্দটির প্রকৃত তাৎপর্য সম্বন্ধে দেখুন টিকা ৬১। হযরত ইব্রাহীম ও তাঁর পুত্র আল্লাহ্র হুকুম অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতেও কুণ্ঠিত হন নাই। দেখুন পরবর্তী আয়াত।
৪০৯৮। প্রশ্ন হলো কোথায় হযরত ইব্রাহীম এই অলৌকিক স্বপ্ন দৃশ্য অবলোকন করেন ? মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী তা হচ্ছে মক্কার নিকটবর্তী স্থান। কেহ কেহ তা মক্কার ৬ [ ছয় ] মাইল উত্তরে মীনার উপত্যকারূপে চিহ্নিত করে থাকেন। এখানে প্রতি বছর হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা স্বরূপ জুলহজ্জ্ মাসের দশ [১০] তারিখে হযরত ইব্রাহীমের ও ইসমাঈলের আত্মত্যাগের অনুসরণে কোরবানী দান করা হয় যা ঈদ-উল-আযহা নামে পরিচিত [ দেখুন টিকা ২১৭ ও আয়াত ২ : ১৯৭ ]।
আর এক দল বলেন যে, হযরত ইব্রাহীম কর্তৃক ইসমাঈলকে প্রকৃত কোরবানীর স্থান ছিলো "মারওয়া পাহাড়ের নিকট সাফা পর্বতের নিকটবর্তী। সাফা ও মারওয়া পর্বতের জন্য দেখুন [ ২ : ১৫৮]।
৪০৯৯। এই ঘটনা হযরত ইব্রাহীমের জীবনে কখন সংঘটিত হয় ? দেখুন টিকা ২৭২৫ এবং আয়াত [ ২১ : ৬৯ ]। এ কথা নিশ্চিত যে, ইব্রাহীমের জন্মভূমি ত্যাগ করে ক্যানন দেশে আগমনের পরে ঘটনাটি সংঘটিত হয়। কারণ যে সময়ে ঘটনার সুত্রপাত হয়, তখন হযরত ইসমাঈল বিচক্ষণ ও আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট সমর্পিত ব্যক্তি হিসেবে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার মত বড় হয়েছেন। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় ঘটনাটি কি কাবা শরীফ নির্মাণের পূর্বে অথবা পরে সংঘটিত হয় ? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর লাভের মত প্রকৃত তথ্য হাতে নাই। তবে অনুমান করা হয় ঘটনার পূর্বে কাবা শরীফ নির্মান করা হয় এবং এখানে কোরবানীর মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীমের ও ইসমাঈলের আত্মত্যাগ ও আত্মসমপর্নকে যুগ কাল অতিক্রান্ত স্মৃতিরক্ষামূলক স্মারক হিসেবে স্থাপন করা হয়।
৪১০০। "উভয়েই [ আল্লাহ্র নিকট ] আত্মসমর্পন করলো " - এই বাক্যটির অর্থ হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করিলেন। হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈলের জন্য এই আনুগত্য ছিলো পরীক্ষা স্বরূপ। পিতার জন্য পরীক্ষাটি ছিলো স্বপ্নাদেশ পালন করা। স্নেহময় পিতা পিতৃস্নেহের উর্দ্ধে আল্লাহ্র আদেশকে স্থান দান করেন এবং পুত্রের নিকট স্বপ্নের আদেশ বর্ণনা করেন। পুত্র ইসমাঈল কোনওরূপ ইতঃস্ততঃ না করে নিজ জীবনকে কোরাবানী করার জন্য সম্মতি দান করেন। যদি আল্লাহ্ তাঁর নিকট এই আত্মত্যাগ দাবী করেন তবে তিনি তা করার জন্য প্রস্তুত। স্নেহময় পিতার নিকট পুত্রের জীবন কোরবানী দাবী এ সবই হচ্ছে আল্লাহ্র পরীক্ষা। কোরবানীর সম্পূর্ণ বিষয়বস্তুই হচ্ছে প্রতীকধর্মী। আল্লাহ্র নিকট রক্ত ও মাংসের কোনও মূল্য নাই [ ২২ : ৩৭ ]। কিন্তু আল্লাহ্ আমাদের নিকট আনুগত্য ও আত্মসমর্পনকে দাবী করেন যা বাহ্যিকভাবে প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পশু কোরবানী হচ্ছে প্রতীক যার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে যে প্রয়োজনে আল্লাহ্র প্রতি কর্তব্য কর্মে যদি প্রয়োজন হয়, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেও আমরা কুণ্ঠা বোধ করবো না।
৪১০১। মুসলিম ও ইহুদী , খৃষ্টানদের মধ্যে কোরবানীর তথ্য ও বিবরণে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ইহুদী খৃষ্টানেরা কোরবানীর মাহত্ম্য ও আত্মত্যাগকে ইসাহাকের জন্য আরোপ করতে প্রয়াসী [ Gen 22 : 1-18]। কিন্তু তাদের ধর্মগ্রন্থ বর্ণনা করে যে, ইব্রাহীমের বয়স যখন ১০০ বৎসর তখন ইসাহাকের জন্ম হয় [Gen 21: 5 ] । এবং ইব্রাহীমের বয়স যখন ৮৬ বৎসর তখন ইসমাঈলের জন্ম হয় [ 16 : 16 ] । তাদের বর্ণনা অনুযায়ী ইসমাঈল , ইসাহাক অপেক্ষা চৌদ্দ [ ১৪ ] বৎসরের বড়। সুতারাং হযরত ইসমাঈলের জীবনের প্রথম চৌদ্দ বৎসর তিনি ছিলেন ইব্রাহীমের একমাত্র সন্তান। এ কথা স্বীকার করার পরেও ওল্ড টেস্টামেন্ট কোরবানীর আত্মত্যাগকে নিম্নলিখিত ভাবে বর্ণনা করে থাকে। [ Gen 22 : 2 ] "And He said , Take now thy son, there only son Issac, whom thou lovest , and get thee into the land of Moriah : and offer him there for a burnt offering ..." ধর্ম বিকৃত করে নিজস্ব গোষ্ঠিভূত করার এ এক অপচেষ্টা। একদিকে তারা স্বীকার করছে যে ইব্রাহীম যে সন্তানকে কোরবানী দেন তিনি ছিলেন তার একমাত্র সন্তান। অপরদিকে তারা কোরবানীর পাত্র হিসেবে হযরত ইব্রাহীমের ছোট সন্তান হযরত ইসাহাককে সনাক্ত করে কারণ ইহুদী -খৃষ্টানেরা ইসাহাকের বংশধর। 'Land of Moriah' মরিয়ার অবস্থান সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। মরিয়ার অবস্থান সম্পর্কে বলা হয় তা হচ্ছে হযরত ইব্রাহীম যেখানে অবস্থান করতেন সেস্থান থেকে তিন দিনের পথ [ Gen 22: 8 ] । ইহুদীদের দাবী অনুযায়ী জেরুজালেম শহর যা পরবর্তীতে মরিয়া পাহাড়ের উপরে নির্মিত হয় যেখানে ইসাহাককে কোরবানী করা হয়। সুমলমানদের বিশ্বাস হযরত ইসমাঈলকে কোরবানী দেয়া হয় 'মারওয়া ' পাহাড়ের নিকট। এবং সেটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ বিবি হাজেরা সহ ইসমাঈলকে সেখানেই নির্বাসন দেয়া হয়। ইহুদীদের বর্ণিত মরিয়া পাহাড়ে যাওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই।
৪১০২। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বাইবেলের বর্ণনা ও কোরাণের বর্ণনার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী কোরবানীর জন্য ইসাহাকের কোনও অনুমতি গ্রহণ করা হয় নাই। কারণ ইসাহাক পিতাকে প্রশ্ন করে "Where is the lamb for sacrifice ?"তার পিতা উত্তর দেন, "God would provide it" তাহলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি দাড়ালো পৌত্তলিকদের বলিদানের মত। পাত্র বা পাত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার মত। কিন্তু কোরাণের বর্ণনার মূল দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন । এখানে বলা হয়েছে পিতা ইব্রাহীম ও পুত্র ইসমাঈল উভয়েই স্ব ইচ্ছায় আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পন করেন। আরবদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে হযরত ইসমাঈল। যিনি শেষ নবী হযরত মুহম্মদের [ সা ] পূর্বপুরুষ। শেষ নবী যার বংশে জন্ম গ্রহণ করবেন , তার উপযুক্ত মানসিকতাই ছিলো ইসমাঈলের চরিত্রে।
১০৬। নিশ্চয়ই এটা ছিলো এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
১০৭। আমি তাকে গুরুত্বপূর্ণ কোরবাণী মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করলাম ৪১০৩।
৪১০৩। 'Azim'- মহান, মহৎ, অতি গুরুত্বপূর্ণ ইত্যাদি। কোরবানীর পূর্বে এই বিশেষণটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর আক্ষরিক ও আলংকারিক উভয় অর্থই এখানে প্রযোজ্য। আক্ষরিক অর্থে তা হবে সুন্দর একটি ভেড়া বা ছাগল দ্বারা ইসমাঈলকে মুক্ত করা হয়। আলংকারিক বা গভীর অর্থ আরও গুরুত্বপূর্ণ ও দার্শনিক ভাবধারায় সমৃদ্ধ। আল্লাহ্ তার দুই পূণ্যাত্মা বান্দাকে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদনের জন্য তাদের একই সুরের ঐকতানে আবদ্ধ করে দেন। কোরবানীর আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তারা দুজনে একশ্রেণীভুক্ত হন - যারা শুধুমাত্র আল্লাহ্র সেবায় নিজেদের আত্মত্যাগ করেন। তাদের জীবনে আল্লাহ্র অবস্থান সর্বোচ্চ।
৪১০৪। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৩৭ : ৭৮-৮১ ] ও টিকা ৩০৮৩। ঈদ-উল- আযহাতে কুরবানী করার রীতি প্রবর্তন করে।
১১০। যারা সৎকাজ করে তাদের আমি এভাবেই পুরষ্কৃত করে থাকি;
১১১। কারণ সে ছিলো আমার মোমেন বান্দাদের একজন।
১১২। এবং আমি তাঁকে ইস্হাকের শুভ সংবাদ দিলাম যে হবে নবী ও পূণ্যাত্মাদের একজন ৪১০৫।
৪১০৫। ইসাহাক ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের দ্বিতীয় সন্তান সারার গর্ভে তাঁর জন্ম। সে সময়ে ইব্রাহীমের বয়স ছিলো ১০০ বৎসর। দেখুন টিকা ৪১০১। ইসাহাকও ছিলেন আল্লাহ্র আর্শীবাদ ধন্য - তারই বংশধরেরা হচ্ছে ইহুদীরা দেখুন পরবর্তী টিকা।
৪১০৬। যতদিন ইসরাঈলী বা ইহুদীরা আল্লাহ্র পতাকা ধারণ করে ছিলো অর্থাৎ আল্লাহ্র প্রদত্ত বিধানে জীবন যাপন করতো ততদিন তারা আল্লাহ্র আর্শীবাদ লাভ করেছে, ইসরাঈলীদের ইতিহাস এ কথার সাক্ষ্য দেয়। যখন তারা আল্লাহ্র রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয় ফলে তাদের পতন ঘটে। তাদের পতন আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যহত করতে পারে নাই। বিভিন্ন ভাবে আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবেই। তারা শুধু তাদের আত্মাকেই ধ্বংস করে পরিণামে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে।
উপদেশ : পৃথিবীর সকল জাতির জন্য এ এক অমূল্য উপদেশ।
রুকু - ৪
৪১০৭। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কোরাণ শরীফে হযরত মুসার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান সূরার প্রেক্ষাপট বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে [ ২৮ : ৪ ] আয়াতে , যেখানে বর্ণনার বিষয়বস্তু হচ্ছে মিশরে ইসরাঈলীদের উপরে অত্যাচারের কাহিনী। এবং [ ২০ : ৭৭-৭৯ ] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে ইসরাঈলীদের শত্রুদের উপরে বিজয়ের কাহিনী যখন তাদের শত্রুরা লোহিত সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
৪১০৮। মিশরে ইসরাঈলীদের উপরে যে নিমর্ম অত্যাচার চলছিলো তা বর্ণনাতীত। দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা ছিলো আবদ্ধ ; তাদের ছেলে সন্তানদের হত্যা করা হতো , এবং মিশরবাসীদের ভোগের জন্য তাদের মেয়ে সন্তানকে জীবিত রাখা হতো।
৪১০৯। ইসরাঈলীদের মুক্তির তিনটি ধাপকে সংক্ষেপে ১১৪, ১১৫, এবং ১১৬ আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আয়াত [ ১১৭ - ১১৮ ] তে বর্ণনা করা হয়েছে তাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ পরিপূর্ণ করার বিবরণ। তাদের আল্লাহ্ প্রত্যাদেশ বা কিতাব দান করেন ; যার সাহায্যে তারা সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। ততদিনই তারা সঠিক সরল পথে থাকবে যতদিন তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত কর্মবিধি মেনে চলবে। যে তিনটি ধাপের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে সেগুলি হলো : ১) হযরত মুসা ও হারুনকে ঐশ্বরিক দায়িত্ব প্রদান, ২) ইসরাঈলীদের মিশরের দাসত্ব থেকে মুক্তি দান; ৩) এবং তাঁদের লোহিত সাগর অতিক্রম করতে সাহায্য করা ও ফেরাউনের সেনাবাহিনীর সাথে ফেরাউনের ধ্বংসের মাধ্যমে।
৪১১০। এই আয়াতটি ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে এভাবে [ ৩৭ : ১১৭ ] "And We gave them the Book which helps to make things clear" মওলানা ইউসুফ আলী সাহেব অনুবাদ করেছেন। "Mustabin"শব্দটি "Mubin"শব্দ থেকে আলাদা ভাবে অনুবাদ করেছেন। "Mustabin"শব্দটি অনুবাদ করা হয়েছে, "Which helps to make things clear" অপর পক্ষে "Mubin"শব্দটি অনুবাদ করেছেন "which makes things clear" যে বিবরণটি তওরাত ও কোরাণের প্রতি প্রযোজ্য হয়েছে।
১১৯। এবং আমি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্য তাঁদের জন্য [ এই কল্যাণ ] রেখেছি ; ৪১১১
৪১১১। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৩৭ : ৭৮-৮১] এবং টিকা ৪০৮৩।
১২১। যারা সৎকাজ করে থাকে তাদের আমি এ ভাবেই পুরষ্কৃত করে থাকি।
১২২। নিশ্চয় তারা আমার মোমেন বান্দাদের অন্তর্গত ছিলো।
১২৩। আমার প্রেরিত [ রাসুলদের ] মধ্যে ইলিয়াসও ছিলো একজন ৪১১২।
৪১১২। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৮৬ ] এবং টিকা ৯০৫। ইলিয়াস ও ইলাইজাহ্ একই ব্যক্তি। ওল্ড টেস্টামেন্টে [1Kings xvii –xix , এবং 2 King i-ii ] বর্ণনা করা হয়েছে ইলাইজাহ্ [Elijah] এর কাহিনী। Ahab [BC 896-874 ] ও Ahaziah [BC 874-872] নামক রাজন্যদ্বয় ইসরাঈলীদের [ উত্তর] রাজত্বের রাজা ছিলেন। ইলিয়াস বা ইলাইজাহ্ এদের রাজত্বকালের বাস করতেন। তিনি জন দ্য বাপটিষ্ঠের মতো মরুভূমির অধিবাসীদের নবী ছিলেন। আহাব এবং আজারিয়া উভয়েই স্বধর্মচ্যুত হওয়া আশংকা ছিলো , কারণ সেখানের অধিবাসীরা ধর্মচ্যুত হয়ে বা'আলের পুঁজা করতো এবং এই পূঁজার দেবতা ছিলো সূর্য দেবতা। তাদের আরও উপাসনার পাত্র ছিলো প্রকৃতির শক্তির এবং প্রজনন শক্তির উপাসনা যেমন হিন্দুরা শিবলিঙ্গের পূঁজা করে থাকে। যার ফলে নানা ধরণের অপব্যবহার ও অন্যায় সংঘটিত হতো। রাজা আহাব সিত্নের রাজকুমারী জেজেবেলকে বিবাহ করেন। সে ছিলো এক দুষ্ট প্রকৃতির রমণী, যে তার স্বামীকে কুপথে পরিচালনা করে এবং আল্লাহ্র পরিবর্তে বা'আলের উপাসনাতে অনুপ্রাণীত করে। ইলাইজা বা ইলিয়াস আহাব এবং আহাজিয়ার পাপ উপাস্যদের অস্বীকার করেন। ফলে তাকে প্রাণভয়ে পলায়ন করতে হয়। ওল্ড টেস্টামেন্ট এর ভাষ্য মতে তাঁকে আগুনের রথে স্বর্গে তুলে নেয়া হয়।
১২৫। " তোমরা কি বা'আলকে ডাকবে এবং পরিত্যাগ করবে শ্রেষ্ঠ স্রষ্টাকে, - ৪১১৩
৪১১৩। বা'আলের সম্বন্ধে দেখুন পূর্বের টিকা।
১২৭। কিন্তু তারা তাকে প্রত্যাখান করলো ৪১১৪ , কাজেই তাদের অবশ্যই [ শাস্তির জন্য ] উপস্থিত করা হবে। -
৪১১৪। অবিশ্বাসীরা ইলিয়াসকে মিথ্যাবাদী বলেছিলো এবং তার প্রতি অত্যাচার ও নির্যাতন আরম্ভ করে। শেষ পর্যন্ত তিনি রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যান। দেখুন টিকা ৪১১২।
১২৯। এবং আমি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্য তাঁর জন্য [ এই কল্যাণ ] রেখেছি ৪১১৫
৪১১৫। দেখুন পূর্বোক্ত আয়াত [ ৩৭ : ৭৮ - ৮১ ] ও টিকা ৪০৮৩।
৪১১৫-ক। হযরত ইলিয়াসের আর একটি নাম ইল্য়াসীন।অন্যমতে ইলিয়াসের বহুবচন ইল্য়াসীন অর্থাৎ ইলিয়াস ও তাঁর অনুসারীগণ।
১৩২। সে ছিলো আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম।
১৩৩। সেরূপ আমার প্রেরিত [ রাসুলদের ] মধ্যে লূত ছিলো অন্যতম ৪১১৬।
৪১১৬। হযরত লূত সম্বন্ধে পূর্ণ বিবরণ দেয়া হয়েছে আয়াতে [ ৭ : ৮০- ৮৪ ]। মরু সাগর পার্শ্বে সমতল ভূমির শহর সদম ও গোমরাহ্ নগরীতে তাঁকে রাসুলরূপে প্রেরণ করা হয়। সেখানের অধিবাসীদের জঘন্য পাপের বিরুদ্ধে তিনি সর্তক করেন। ফলে অধিবাসীরা তাঁকে অপমান করে এবং নগর থেকে বহিষ্কার করার ভয় দেখায়। কিন্তু আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে রক্ষা করে [ একজন ব্যতীত ]। এর পরে নগরদ্বয়কে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
১৩৫। একজন বৃদ্ধা ব্যতীত , সে ছিলো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অর্ন্তভূক্ত ৪১১৭।
৪১১৭। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৮৩ ] এবং টিকা ১০৫১। হযরত লূতের পত্নীর তার স্বামীর হেদায়েতে কোনও আস্থা ছিলো না। ফলে সেও অন্যদের সাথে ধ্বংস হয়ে যায়।
১৩৭। তোমরা তো তাদের [ সেই স্থানের ] পাশ দিয়ে যাতায়াত কর কখনও সকালে ,৪১১৮
১৩৮। এবং কখনও রাত্রে ; তোমরা কি তবুও অনুধাবন করবে না ?
৪১১৮। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ৭৬ ] ও টিকা ১৯৯৮। লূত নবীর সম্প্রদায় যে স্থানে বাস করতো তা সিরিয়ার প্রধান বাণিজ্য পথের ধারে অবস্থিত যেখান দিয়ে রাত্রি ও দিনে অহরহ বাণিজ্য বহর যাতায়াত করে থাকে। চোখের সম্মুখে এরূপ উদাহরণ থাকা সত্বেও কি পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা পাপের পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করবে না।
রুকু - ৫
৪১১৯। ইউনুস নবীর বিশদ বিবরণের জন্য দেখুন [ ২১ : ৮৭-৮৮ ] আয়াত ও টিকা ২৭৪৪ এবং [ ৬৮ : ৪৮- ৫০ ] আয়াত। ইউনুস নবীকে প্রেরণ করা হয় নিনেভা নগরীতে, যার অধিবাসীরা ছিলো দুষ্টের শিরোমণি। তারা ইউনুস নবীর ধর্মোপদেশ গ্রহণে অস্বীকার করে ফলে তিনি ক্রুদ্ধভাবে তাদের উপরে আল্লাহ্র শাস্তিকে আহ্বান করেন। ফলে ইউনুস নবী ক্রুদ্ধ ভাবে সে স্থান ত্যাগ করেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাকারী ও দয়ালু। আল্লাহ্র করুণা ও ক্ষমা পাপী ও পূণ্যাত্মা সবার জন্য সমভাবে প্রবাহমান। দেখুন পরবর্তী টিকা ও আয়াত [১০ :৯৮ ] ও টিকা ১৪৭৮।
৪১২০। ইউনুস নবীর উম্মতগণ তাঁর ধর্মোপদেশ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে তিনি মর্মাহত হন এবং আল্লাহ্র আযাব আসতে কিছুটা বিলম্ব হওয়াতে ক্ষুব্ধ হন এবং কাউকে কিছু না বলে দেশ ত্যাগ করেন। ক্রীতদাসেরা যে ভাবে মনিবের নিকট থেকে পলায়ন করেন, তিনি সেভাবেই পলায়ন করেছিলেন। তাঁর উচিত ছিলো অকৃতকার্যতা সত্বেও আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত থাকা। কিন্তু তিনি তা না করে তাড়াহুড়ো করে নৌযানে আরোহণ করেন। তাঁর এই মনোভাবকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যেনো তিনি আল্লাহ্র পরিকল্পনার বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন এবং শাস্তিকে এড়িয়ে যাবেন।
উপদেশ : আল্লাহ্ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষকে কিছু না কিছু কর্তব্য কর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন। এই কর্তব্য সুষ্ঠ ভাবে পালন করাই তার ধর্ম। মেধা, মননশক্তি , প্রতিভা, সৃজন ক্ষমতা সবই এই কর্তব্যকে সঠিকভাবে অনুশীলনের জন্য দান করা হয়। সাফল্য বা ব্যর্থতা আসতে পারে কিন্তু কোনও অবস্থাতেই কর্তব্য কর্ম থেকে চ্যুত হওয়া চলবে না। ইউনুস নবীর জীবনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করার ক্ষমতা কারও নাই।
৪১২১। যাত্রী এবং বাণিজ্য সম্ভারে পরিপূর্ণ নৌযানটি যাত্রাপথে প্রতিকূল আবহাওয়ার সম্মুখীন হয়। জাহাজের নাবিকেরা তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের দরুন বিশ্বাস করতো কোনও পালতক ব্যক্তির কারণে তারা দুযোর্গের সম্মুখীন হয়েছে। নাবিকেরা তাকে খুঁজে বের করার জন্য লটারীর সাহায্য নেয়।লটারীতে ইউনুস নবীর নাম উঠলে তারা তাকে পানিতে নিক্ষেপ করে।
৪১২২। মেসোপটেমিয়ার নদীতে বিশাল বিশাল মাছ থাকে। এখানে 'Hut' যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তার শাব্দিক অর্থ সম্ভবতঃ মাছ অথবা কুমীর। যদি তা নদীর মোহনার উম্মুক্ত সমুদ্র হয়ে থাকে তবে তা হবে তিমি মাছ। প্রকৃত স্থান কোরাণ শরীফে উল্লেখ নাই। ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী ইউনুস নবী সদুদ্রগামী জাহাজে আরোহণ করেন Joppa [ now Jaffa ] বন্দর থেকে , যার অবস্থান হচ্ছে ভূমধ্যসাগরের কূলে [Jonah i : 3 ]। বন্দরটি নিনেভা শহর থেকে কমপক্ষে ৬০০ মাইল দূরে অবস্থিত। কোন কোনও তফসীরকারের মতে জলপথটি ছিলো তাইগ্রীস নদী কারণ তাইগ্রীস নদীতে বিশাল বিশাল মাছের অস্তিত্ব বিরাজ করে।
৪১২৩। দেখুন টিকা ৪১২০। আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করার ক্ষমতা কারও নাই।
৪১২৪। ইউনুস নবী মাছের পেটের মধ্যে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে , প্রতিকূল অবস্থানে অনুধাবনে সক্ষম হলো যে, আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করার ক্ষমতা কারও নাই। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান।তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন, " আল্লাহ্র ব্যতীত উপাস্য নাই , তুমি মহান ,আমি গুনাহ্গার।" [২১ : ৮৭।
৪১২৫। এই লাইনটির অর্থ ইউনুস নবীর কবর হতো মাছের পেট। সাধারণ মানুষের কবর হয়ে থাকে মাটির অভ্যন্তরে কিন্তু ইউনুস নবীকে যেহেতু মাছ গিলে ফেলেছিলো , সুতারাং পুনরুত্থান না ঘটা পর্যন্ত তার অবস্থান সেখানেই ঘটতো।
৪১২৬। মাছের পেটে আলো বাতাসহীন অন্ধকারে পাচকরসের সংস্পর্শে সম্ভবতঃ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি আকুলভাবে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চান - একটু বাতাস একটু নির্জনতা তার অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অনুতাপের মাধ্যমে তিনি আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করেন এবং মাছ তাকে উগরে দেবার পরে আল্লাহ্ তাকে নির্জন মুক্ত প্রান্তরে আনায়ন করেন। সেখানে তিনি মৃতবৎ পড়ে থাকেন এবং আল্লাহ্র করুণায় তার উপরে কুমড়া গাছের বিস্তৃতি ঘটে। লাউ ও কুমড়ো জাতীয় গাছ খুব সহজেই কোনও কিছুর উপরে ছড়িয়ে যেতে পারে। সম্ভবতঃ সেখানে ছিলো ছায়াঘেরা স্বাদু ফলের গাছ যা তাকে ছায়া ও খাদ্য উভয়ই সরবারহ করে থাকে।
১৪৭। তাকে আমি একলক্ষ বা ততোধিক লোকের [ প্রচারের ] কাজে প্রেরণ করি ৪১২৭।
৪১২৭। আল্লাহ্ তাকে পুণরায় নিনেভা নগরীতে প্রেরণ করেন। নিনেভা নগরী ছিলো এক বিশাল নগরী। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী "Nineva was an exceeding great city of three days ' journey" [ Jonah iii 3 ] ; "Wherein are more than six score thousand person" [ Jonah iv 11 ] । নিনেভা নগরীর পরিধি বলা হয়ে থাকে ৪৫ মাইল এবং লোক সংখ্যা ছিলো এক লক্ষ বিশ হাজারের উপরে।
৪১২৮। নিনেভাবাসী অনুতপ্ত হয়েছিলো এবং আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো , ফলে আল্লাহ্ তাদের নূতনভাবে বাঁচার অধিকার দান করেন। ইউনুস নবীর সময়কাল ও নিনেভা নগরীর উত্থানপতনের সময় খুব সম্ভব আসেরিয়ান সম্রাটদের সময়কাল। দেখুন টিকা [ ১৪৭৮ - ৭৯ ] এবং আয়াত [১০ : ৯৮ ]। ইউনুস নবীর কাহিনীর মাধ্যমে আমাদের নিম্নলিখিত বিষয় গুলি শিক্ষাদান করা হয়েছে : ১) আল্লাহ্র বিচার করার ক্ষমতা কারও নাই। তিনি যাকে খুশী অনুগ্রহ করেন যাকে খুশী শাস্তি দান করেন। তিনি সর্বশক্তিমান। সুতারাং আল্লাহ্র রহমত ও শাস্তির বিচার করা কোনও মানুষের উচিত নয়। ২) প্রকৃত অনুতাপকারীকে আল্লাহ্ সর্বদা ক্ষমা করে দেন , যেমন তিনি পাপে পুর্ণ নিনেভা নগরবাসীকে করেছিলেন। এবং ৩) আল্লাহ্ পরিকল্পনা ব্যর্থ করার ক্ষমতা কারও নাই , শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হবেই।
৪১২৯। এই আয়াত থেকে নূতন যুক্তি তর্কের অবতারণা করা হয়। পৌত্তলিক আরবের বিশ্বাস করতো যে, ফেরেশতাদের নারীরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু নিজেদের জন্য তারা পুত্র সন্তানকে অধিক পছন্দ করতো ,কারণ পুত্র ছিলো ক্ষমতা , ও সম্মানের প্রতীক। দেখুন [ ১৬ : ৫৭-৫৯ ] এবং টিকা ২০৮২। তা সত্ত্বেও তারা আল্লাহ্র জন্য কন্যা বরাদ্দ করতো।
১৫১। এটা কি ঠিক নয় যে, তারা নিজেদের মনগড়া কথা বলে যে,
১৫২। " আল্লাহ্ সন্তান জন্ম দিয়েছেন।" ওরা মিথ্যাবাদী ৪১৩০।
৪১৩০। আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতি স্রষ্টার একত্ব ঘোষণা করে। মানুষের আত্মার মাঝে আল্লাহ্র একত্বের ধারণাই হচ্ছে প্রকৃত ঈমান। আল্লাহ্ সম্বন্ধে পুত্র বা কন্যার ধারণা আত্মার মাঝে বিভ্রান্তি ঘটায় -ঈমানকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ফলে মানুষ সৃষ্টির তথা বিশ্ব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হয় ব্যহত। সে কারণেই আল্লাহ্র সাথে অংশদারিত্ব কঠোর ভাবে নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে।
৪১৩১। এই আয়াতটিতে আল্লাহ্ ব্যঙ্গ বিদ্রূপাত্মক ভাবে মোশরেক আরবদের সম্বোধন করেছেন।
১৫৫। তোমরা কি তা হলে উপদেশ গ্রহণ করবে না ?
১৫৬। নাকি তোমাদের সুস্পষ্ট কর্তৃত্ব রয়েছে ?
১৫৭। তাহলে তোমাদের [ কর্তৃত্বের ] দলিল নিয়ে এসো , যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
১৫৮। এবং তারা আল্লাহ্ ও জ্বিনদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক আবিষ্কার করে ৪১৩২। কিন্তু জ্বিনেরা [ভালোভাবেই] জানে যে , তাদেরকেও অবশ্যই [ বিচারের জন্য ] উপস্থিত করা হবে।
৪১৩২। ফেরেশতারা পূত ও পবিত্র যারা সর্বদা আল্লাহ্র সেবায় নিয়োজিত।কিন্তু পৌত্তলিক আরবেরা এ সব ফেরেশতাদের সাথে আল্লাহ্র কন্যা সম্পর্ক স্থাপন করে। শুধু তাই-ই নয়, তারা অন্যান্য আদিভৌতিক জিনিষ যেমন জ্বিনদের সাথেও আল্লাহ্র আত্মীয়তার সম্পর্ক কল্পনা করে। এরূপ অলীক কল্পনাকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
জ্বিনের জন্য দেখুন আয়াত [ ৬ : ১০০ ] ও টিকা ৯২৯।
১৬০। আল্লাহ্র একনিষ্ঠ ও অনুগত বান্দারা এরূপ করে না ৪১৩৩।
৪১৩৩। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র একনিষ্ঠ মোমেন বান্দা তারা আল্লাহ্ সম্বন্ধে এরূপ অসম্মানজনক মন্তব্য ও ধারণা থেকে বিরত থাকে।
১৬২। তোমরা কাউকেও আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করতে পারবে না ৪১৩৪।
১৬৩। কেবল তারা ব্যতীত যারা প্রজ্জ্বলিত আগুনে প্রবেশকারী।
৪১৩৪। ''কাউকেও'' অর্থাৎ মোমেন বান্দাদের আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। যাদের চরিত্রে বিশ্বাস বা ঈমান থাকে। যারা সত্যের পূজারী ও সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত এদের উপরে শয়তান বা মন্দের কোনও প্রভাব নাই। শয়তান তাদেরই প্রভাবিত করতে পারে যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে সত্যকে অস্বীকার করে এবং আত্মধ্বংসের পথ বেছে নেয়। তাদের ইচ্ছাই তাদের বিপথে চালিত করে। তারা যদি বিশ্বাস ,ধৈর্য্য এবং অধ্যবসায় সহকারে শয়তান বা পাপকে প্রতিহত করতো তবে মন্দ বা শয়তানের কোনও ক্ষমতাই থাকতো না তাদের প্রভাবিত করার। স্বয়ং আল্লাহ্ তাদের রক্ষা করতেন।
১৬৫। "এবং আমরা তো [ কাজের জন্য ] , সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান।
১৬৬। " এবং আমরা অবশ্যই আল্লাহ্র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণাকারী।"
৪১৩৫। আয়াত ১৬৪- ১৬৬ পর্যন্ত ফেরেশতাদের উক্তি। সূরার যুক্তি শেষ করার পূর্বে শুরু করার সময়ের যুক্তির উপস্থাপন ঘটেছে। এরাই তারা যাদের আল্লাহ্র কাজের জন্য সারিবদ্ধ করা হয়েছিলো দেখুন আয়াত [ ৩৭ : ১ ও টিকা ৪০৩১ ]। তারা ফেরেশতাই হোক বা পূণ্যাত্মা মোমেন বান্দাই হোক তারা তাদের নির্ধারিত স্থানে অবস্থান করতে পরিতৃপ্ত। তাদের জন্য আল্লাহ্ যে কাজ বা দায়িত্ব নির্ধারিত করেছেন তারা তা করতে কৃতসংকল্প। তারা কখনও আল্লাহ্র পরিকল্পনা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন না। তারা তাদের আত্মার মাঝে উপলব্ধি করেন যে, আল্লাহ্র দেয় দায়িত্ব তাদের জন্য কল্যাণকর এবং বিপদ বাধার শেষে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র পরিকল্পনা কার্যকর হবেই। তাৎক্ষনিক দৃশ্যমান বিপর্যয় বা বাধা তাদের উদ্বিগ্ন করে না। কোনও অবস্থায়ই তারা তাদের সারি বা অবস্থান ত্যাগ করেন না।
১৬৮। " যদি আমরা প্রাচীন লোকদের কিতাবের মত কোন কিতাব লাভ করতাম ,
১৬৯। " আমরা অবশ্যই আল্লাহ্র একনিষ্ঠ [ এবং অনুগত ] বান্দা হতাম।" ৪২৩৭
৪১৩৬। এখানে 'উহারা বলতে প্রাথমিকভাবে মোশরেক আরবদের বোঝানো হয়েছে তবে সামগ্রিকভাবে সকল কাফেরদের বোঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্ধিহান এবং আল্লাহ্র প্রত্যাদেশে বিশ্বাস স্থাপন করে না।
৪১৩৭। এ সব অবিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য এই আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এরা সব সময়ে পূর্বপুরুষদের প্রথার দোহাই দিয়ে থাকে। তারা বলে, " আমাদের পূর্বপুরুষদের যদি লিখিত কোনও প্রত্যাদেশ বা কিতাব থাকতো এবং আমাদের যদি সে ভাবেই উপাসনা শিক্ষা দান করা হতো তবে আমরা অবশ্যই তা পালন করতাম।" কিন্তু এখন তাদের মাতৃভাষাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে যা দৃঢ় প্রত্যয়ন উৎপন্ন করে, তবুও তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না। তারা কুর-আন সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে এবং তা প্রত্যাখান করে।
৪১৩৮। আল্লাহ্র প্রেরিত সত্য সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে একদিন সন্দেহতীত ভাবে প্রতীয়মান হবে এবং সমস্ত পৃথিবীতে তা ভাস্বর হবে।
১৭২। অবশ্যই তারা সাহায্য প্রাপ্ত হবে।
১৭৩। এবং আমার বাহিনীই বিজয়ী হবে ৪১৩৯।
৪১৩৯। এই বিজয় আল্লাহ্র সত্যের বিজয়, আল্লাহ্র বাহিনীর বিজয়। এই বিজয়ে আল্লাহ্র সৈনিকেরা ,যারা অবিচলিতভাবে স্ব স্ব কর্তব্য করে গেছেন , তারা সকলেই এই বিজয়ের অংশীদার। সকলেই আল্লাহ্র বাহিনী।
৪১৪০। প্রাথমিক ভাবে এই আয়াতে রাসুলকে [ সা ] সম্বোধন করা হয়েছে, তবে তা সার্বজনীন যুগ কাল অতিক্রান্ত। রসুলকে [সা ] তাঁর প্রাথমিক অকৃতকার্যের জন্য হতোদ্দম হতে নিষেধ করা হয়েছে। শীঘ্রই আল্লাহ্ তাঁকে বিজয় দান করবেন। এই র্বাতা পৃথিবীর সর্বযুগের মানব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। কারণ সত্য এবং সৎকাজ সংগ্রামের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগ্রামে ক্ষণস্থায়ী ব্যর্থতা আসতে পারে সন্দেহ নাই, কিন্তু মোমেন বান্দারা , সৎকাজের কর্মীরা তা উপেক্ষা করতে পারে ; কারণ আল্লাহ্র করুনা ও অনুগ্রহ তাদের অন্তরকে শক্তিশালী করে। তারা জানে যে বিজয় তাদের অবধারিত।
৪১৪১। " অপেক্ষা কর এবং পর্যবেক্ষণ কর ;সত্যের জয় অবশ্যম্ভবী।" এই হচ্ছে আল্লাহ্র আশ্বাস শ্বাসতকালব্যপী।
৪১৪২। উপরের আয়াতসমূহের দুষ্টের আক্রমনের বিরুদ্ধে ধৈর্য ধারণ করতে উপদেশ দান করা হয়েছে। আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত শয়তান ও দুষ্ট পরাভূত হবেই। পাপিষ্ঠরা উপহাস ও ব্যঙ্গ করে এ কথা বলে যে , "শাস্তি যদি দেয়াই হবে , তবে তৎক্ষণাত দেয়া হচ্ছে না কেন ? " তাদের এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে যে,যখন তা আসবে তখন তার গতি হবে প্রচন্ড অপ্রতিহত। যখন দুষ্ট ও পাপীরা নিজেদের গৃহে সর্বাপেক্ষা নিরাপদ বোধ করবে, রাতের আঁধারে তাদের সেই নিরাপদ গৃহকোণ আল্লাহ্র শাস্তির দ্বারা মূহুর্তে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে ও শত্রুদের পরাজিত করে ফেলবে যে সময়ে তারা সর্বাপেক্ষা নিরাপদ বোধ করবে সেটাই হবে তাদের শাস্তির প্রকৃত সময়। প্রভাতের সূর্যদয়ে তারা নিজেদের দুঃখ দুর্দ্দশার মাঝে আবিষ্কার করবে।
৪১৪৩। এই আয়াতটিতে উপমার মাধ্যমে পাপীদের শাস্তির বিবরণ দান করা হয়েছে। উপমাটি এরূপ শত্রুদের বাসস্থান যেনো পাহাড়ের পাদদেশে সমতল ভূমিতে। রাতের আধারে পাহাড় থেকে আল্লাহ্র সেনাদের অতর্কিতে আক্রমণে শত্রুদের বাসস্থান ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। উচ্চ স্থান থেকে নিম্নভূমিতে যখন বন্যার পানি ধেয়ে আসে তার গতি যেরূপ প্রচন্ড ও অপ্রতিহত হয়ে থাকে , পাপীদের উপরে আল্লাহ্র শাস্তি- ও ঠিক সেরূপ প্রচন্ড গতিতে নেমে আসবে। এর পরেও যারা জীবিত থাকবে তাদের দুঃখ দুর্দ্দশার অন্ত থাকবে না। উপরন্তু সঠিক সময়ে সাবধানবাণী না শোনার জন্য তাদের অনুতাপের ও কষ্টের সীমা থাকবে না। প্রভাত হবে তাদের জন্য কতই না মন্দ।
১৭৯। এবং তাদের পর্যবেক্ষণ কর [ তাদের কি হয় ] এবং তারাও শীঘ্র দেখবে [ তোমার কি ঘটে ]।
৪১৪৪। এই আয়াতটি ও পরবর্তী আয়াতটি সামান্য পরিবর্তন ব্যতীত ১৭৪-১৭৫ আয়াতের পুণঃরাবৃত্তি। [১৭৪- ৭৫] আয়াতে নূতন বিষয়ের উপস্থাপনা করা হয়েছে। যখন তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন পুণরাবৃত্তির মাধ্যমে মূল বিষয়বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং সূরাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে।
৪১৪৫। এই আয়াতটি ও পরবর্তী দুটি আয়াত পুনঃরায় স্মরণ করিয়ে দেয় : ১) মহত্ব, ক্ষমতা ও সম্মান সবই আল্লাহ্র জন্য প্রযোজ্য; ২) কেহই তার সককক্ষ হওয়ার যোগ্য নয় ; ৩) তিনি নবী রসুলদের এবং প্রত্যাদেশ প্রেরণ করে থাকেন এবং আল্লাহ্র সাহায্য সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে বিজয় এনে দেবে; ৪) আল্লাহ্ তার সৃষ্টির সকলকে ভালোবাসেন ও প্রতিপালন করেন।
১৮২। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র , যিনি জগতসমূহের প্রভু এবং প্রতিপালক।