+
-
R
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : সূরা নং ৩৪ থেকে যে ছয়টি সূরার একটি শ্রেণীগুচ্ছ শুরু হয়েছিলো, তা এই [৩৯ নং সূরা ] সূরাটির মাধ্যমে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শ্রেণীগুচ্ছের সূরাগুলির বিষয়বস্তু আধ্যাত্মিক জগত এবং Ma'ad বা শেষ বিচারের দিন। দেখুন সূরাগুচ্ছের প্রথম সূরা ৩৪ নং সূরার ভূমিকা।
এই সূরাটির বিষয় বস্তু হচ্ছে : সৃষ্টির বৈচিত্র সত্বেও সৃষ্টির সকল বিষয়বস্তু বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এ সকল বস্তুকে, বৈচিত্র সত্বেও সকলকেই আল্লাহ্ প্রতিপালন করে থাকেন। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ ভালোকে মন্দ থেকে আলাদা করে নেবেন। 'Zumar' শব্দটি ৭১ এবং ৭৩ নং আয়াতে আছে।
এই সূরাটি মক্কান সূরা।
সার সংক্ষেপঃ যদিও সৃষ্টির মাঝে বহু বৈচিত্র বিদ্যমান, কিন্তু তবুও তা সবই একই সুত্রে গ্রথিত যা এক স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে। আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সকল উপাসনার যোগ্য এবং ন্যায় এবং করুণার আঁধার তিনিই। [ ৩৯ : ১- ২১ ]
সকল প্রত্যাদেশে আল্লাহ্র একত্ব প্রকাশ পায়। একমাত্র আল্লাহ্-ই মানুষকে পথ প্রদর্শন করতে পারেন। একমাত্র তাঁরই এবাদত কর আর সবই মিথ্যা। [ ৩৯ : ২২-৫২ ]
আল্লাহ্র করুণা সৃষ্টির সকল কিছুকে পরিবৃত্ত করে থাকে। হতাশ হওয়ার কারণ নাই। বেশী দেরী হওয়ার পূর্বেই তাঁর করুণা ভিক্ষা কর। অবশ্য প্রত্যেককেই আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
[ ৩৯ : ৫৩-৭৫ ]
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৪২৪২। প্রত্যাদেশের সাথে আল্লাহ্র দুটি গুণাবলীর উল্লেখ এই আয়াতে করা হয়েছে :
১) আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান , পরাক্রমশালী। সকল বাঁধা সত্বেও তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবেই।
২) তিনি অসীম জ্ঞানের আঁধার ও প্রজ্ঞাময়।
যারা জিজ্ঞাসা করে যে আল্লাহ্ কিভাবে তাঁর বাণী পৃথিবীতে প্রেরণ করেন ? তাদের প্রশ্নের উত্তর আছে ১নং এর বক্তব্যে এবং ২নং বক্তব্য ব্যাখ্যা করে যে প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করা সম্ভব , আল্লাহ্ যা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন তার অনুসরণ দ্বারা।
৪২৪৩। বিশ্ব ভূবনের সর্বত্র স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুন্য ছড়িয়ে আছে। সকালের ঝড়ে পড়া শিউলীফুলের পেলবতা থেকে সুউচ্চ পর্বতমালার কাঠিন্য গাম্ভীর্য সর্ব স্থানে স্রষ্টার হাতের স্পর্শ বিদ্যমান। বিশ্বভূবনের সকলেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি ; তাই পৃথিবীর সকলেই বিজ্ঞানের একই সুত্রের আওতাধীন। সূদূর মঙ্গলে জড় পদার্থের যে ধর্ম ,এই মাটির পৃথিবীর জড় পদার্থের একই ধর্ম। জীব জগতেরও জৈবিক ধর্ম সকল প্রাণীর মাঝে এক। স্রষ্টা এক ও অদ্বিতীয় - এ সত্যকেই প্রত্যক্ষ করা যায় সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণের দ্বারা। বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্-ই একমাত্র উপাসনার যোগ্য। আর সে উপাসনা হতে হবে একান্ত আন্তরিক।
৪২৪৪। মানুষ জ্ঞানতঃ বা অজ্ঞানত বশতঃ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্যের উপাসনা করে থাকে। এ সবের মধ্যে পীর পূঁজা ও মাজার পূঁজা অন্যতম। এদের বক্তব্য হচ্ছে যে, তারা নিরাকার আল্লাহ্র নিকট পৌঁছানোর জন্য এসব মাধ্যমের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। তাহলে খৃষ্টান ও ইহুদীদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কোথায়?
আবার আর একদল আছে যারা জাগতিক বিষয়বস্তুকে জীবনের চরম ও পরম পাওয়া বলে সাব্যস্ত করে। এরা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবী করে। এদের কেউ সম্পদের , কেউ বিজ্ঞানের , কেউ শিল্পকলার , আবার কেউ নিজস্ব স্বার্থের চিন্তায় দিবারাত্র বিভোর থাকে। তারা দাবী করে যে এগুলির মাধ্যমে তারা আত্মোন্নতি করার ক্ষমতা রাখে এবং জীবনের সর্বশেষ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম।এবং এরই মাধ্যমে তারা স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার আশা রাখে। এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, এরা সকলেই ভুল পথে আল্লাহ্র অন্বেষণ করছে। কোনও মাধ্যম নয়, মানুষের চিন্তার জগত, মনোজগত, আধ্যাত্মিক জগত শুধুমাত্র স্রষ্টার চিন্তায় আপ্লুত থাকলেই স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।
৪২৪৫। আল্লাহ্র প্রকৃত উপাসনা ত্যাগ করে, সঠিক পথকে পরিহার করে, মানুষ যখন মিথ্যা উপাস্যের উপাসনায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে , তখন তাদের মাঝে সীমাহীন বিভেদের ও দলের সৃষ্টি হয়। এ সব ফয়সালার মালিক একমাত্র আল্লাহ্। কিন্তু কেউ যদি সত্যকে পরিহার করে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আল্লাহ্র প্রতি করণীয় কর্তব্য ও আল্লাহ্র কাজে অনীহা প্রকাশ করে, আল্লাহ্র প্রতি প্রতিদিনের এই জীবনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলে যায় , তাহলে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্ প্রদর্শিত পথকে ত্যাগ করে। এরাই তারা যারা মিথ্যাবাদী ও কাফের, আল্লাহ্ তাদের হেদায়েত করেন না।
৪২৪৬। আল্লাহ্র সন্তান রয়েছে এ কথা চিন্তা করাও পাপ এবং ঈশ্বর নিন্দা। যদি সত্যিই আল্লাহ্ সন্তান গ্রহণ করতেন তবে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর একজন স্ত্রী বিদ্যমান থাকতো [৬ : ১০১ ] ,এবং তাঁর পুত্র তাঁরই মত গুণসম্পন্ন হতো। কিন্তু সূরা [ ১১২ : ৪ ] আয়াতে বলা হয়েছে, " তাহার সমতুল্য কেহ নাই।" সন্তান জন্ম দান করা একটি জৈব প্রক্রিয়া যা প্রাণী জগতে বিদ্যমান , যা একটি যৌন প্রক্রিয়া। আল্লাহ্র সম্বন্ধে এরূপ চিন্তা বা ধারণা কিভাবে করা সম্ভব , যেখানে আল্লাহ্র অস্তিত্ব বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর উর্দ্ধে। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কোনও সাহায্যকারীর প্রয়োজন নাই - তিনি সর্বশক্তিমান। যদি সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতো , তবে তার জন্য তাকে প্রাণীজগতের যৌন প্রক্রিয়ার মত নিম্নস্তরে নামার প্রয়োজন ছিলো না। আল্লাহ্ এসবের বহু উর্দ্ধে ,তিনি মহান ও পবিত্র। নিরাকার আল্লাহ্র একত্ব আত্মার মাঝে অনুভব করা , উপলব্ধি করা যে তিনি এক ও অদ্বিতীয়, এই-ই হচ্ছে ঈমানের প্রথম ধাপ। তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং সর্বশক্তিমান। তাঁর কোনও সাহায্যকারীর প্রয়োজন নাই।
৪২৪৭। দেখুন সূরা [ ৬ : ৭৩ ] আয়াত ও টিকা ৪৯৬।
৪২৪৮। আল্লাহ্র করুণা ও দয়া তাঁর ক্ষমতার মতই অসীম। তাঁর সমকক্ষ কেহ নাই।
৪২৪৯। দেখুন সূরা [ ৪ : ১ ] ও টিকা ৫০৪।
৪২৫০। দেখুন সূরা [ ৬ : ১৪৩ - ৪৪ ] আয়াতে আরবদের কুসংস্কারের উল্লেখ আছে উল্লেখিত চার ধরণের পশুদের জোড়া সম্বন্ধে। পূর্বের ঐ আয়াতে এই চার জোড়া পশুদের সম্বন্ধে কুসংস্কারের নিন্দা করা হয়েছে। সেই চার জোড়া গৃহপালিত পশুর উল্লেখ করা হয়েছে এখানে ; যাদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য। এগুলি হলো ; ভেড়া, ছাগল,উট ও গরু। আরবদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ঘোড়াকে তারা গৃহপালিত পশু হিসেবে পরিগণিত করে না।
আল্লাহ্র অসীম করুণা যে, আল্লাহ্ মানুষকে পশুদের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন দেখুন [৩৬ : ৭১- ৭৩ ]।
৪২৫১। "ত্রিবিধ অন্ধকার " শিশু মাতৃগর্ভে ত্রিবিধ পর্দ্দায় আচ্ছাদিত থাকে ; ঝিল্লির আচ্ছাদন ,জরায়ু ও মাতৃজঠর।
৪২৫২। দেখুন সূরা [ ২২ : ৫ ] আয়াতে, যেখানে মানুষ সৃষ্টির বিভিন্ন ধাপগুলিকে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র সৃষ্টি নৈপুন্যের এবং সদয় প্রতিপালকের নিদর্শন স্বরূপ।
৪২৫৩। এ কথা সত্য যে, মানুষের জীবনোপকরণ, শারীরিক বৃদ্ধি ও অস্তিত্বের জন্য সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্র করুণার উপরে নির্ভরশীল। সুতারাং সেই মানুষ কিভাবে আল্লাহ্র প্রতি বিমুখ হয়?
৪২৫৪। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত। সুতারাং মানুষের অকৃতজ্ঞতা আল্লাহ্র কোনও ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ্ মানুষের মঙ্গল কামনা করেন। সে কারণে মানুষের আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আল্লাহ্ পছন্দ করেন এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা আল্লাহ্র করুণা অর্জন ও যোগ্যতা অর্জন করার উপায়।
। সে কারণে দেখা যায় কৃতজ্ঞ ব্যক্তির চিত্ত প্রশান্তিতে ভরপুর থাকে। অপরপক্ষে অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির অন্তরে অশান্তির দাবনলে ভরে যায় কারণ তারা আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত।
উপদেশ : কৃতজ্ঞতা গুণটির কথা কোরাণ শরীফে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে ,কারণ কৃতজ্ঞ অন্তর আল্লাহ্র রহমত প্রাপ্ত প্রশান্তিতে ভরা। অপরপক্ষে তার মত হতভাগ্য কে আছে ,যার অন্তর হাহাকার ভরা। অকৃতজ্ঞ অন্তরে না পাওয়ার দাবানলে দোযখের অগ্নি সৃষ্টি করে।
৪২৫৫। দেখুন অনুরূপ সূরা [ ৬ : ১৬৪ ] আয়াত। প্রতিটি মানুষকেই তার কর্মের হিসাব তার প্রতিপালকের নিকট দান করতে হবে। কেউই কারও কৃতকর্মের বোঝা বহন করবে না। ইসলামে কোনও প্রতিনিধিত্ব নাই। সকলেই স্ব-স্ব কর্মের জন্য দায়ী। সেখানে কোনও মধ্যস্থতার অবসর নাই। মৃত্যুর পরে প্রত্যেককে আল্লাহ্র নিকট নীত করা হবে। সেখানে প্রত্যেকের যাবতীয় কর্ম যা সে পৃথিবীতে করেছে, সব সংরক্ষিত থাকবে। এমনকি মনের অগোচরে যে চিন্তা ভাবনা, নিয়ত সবই আল্লাহ্র নিকট নীত হবে। আল্লাহ্ প্রত্যেককে তার কর্মফল অবগত করাবেন - তাঁর নিকট কোনও কিছুই গোপন থাকে না।
৪২৫৬। দেখুন সূরা [ ১০ : ১২ ] আয়াত। মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ জীব, যখন দুঃখ , বিপর্যয়ের অমানিশা তার সর্বসত্তাকে গ্রাসে উদ্যোক্ত হয় ,তখন নিরূপায় মানুষ ঐকান্তিক ভাবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করে। কিন্তু যে মূহুর্তে আল্লাহ্ তাকে অনুগ্রহ করেন সে আল্লাহকে বিস্মৃত হয়। সে অনুধাবনে অক্ষম হয় জীবনের সেই শিক্ষা যা আল্লাহ্ তাকে বিপদ বিপর্যয়ের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। ফলে সে আল্লাহকে ভুলে যায়। ভুলে যায় বিপদ বিপর্যয় দূর করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্র হাতে। ফলে সে আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কিছুকে তার ত্রাণকর্তারূপে অভিহিত করে। সেগুলি বিশেষতঃ নিম্নরূপ : নিজস্ব কৃতিত্ব অথবা মাজার, তাবিজ, কবজ অথবা প্রাকৃতিক শক্তি অথবা পীরবাবা যাকে সে আল্লাহ্র ন্যায় শক্তিশালী মনে করে। এ কথা সে ভুলে যায় যে, সকল শক্তির উৎস আল্লাহ্। আল্লাহ্র শক্তির সাথে অন্য যে কোনও কিছুর অংশীদারিত্ব মহাপাপ। এই পাপ শুধু যে তারই ক্ষতি করে তাই নয় , লক্ষ লক্ষ অজ্ঞ লোক তার দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়। যার ফলে দেখা যায় ভন্ডপীরের প্রভাব ও প্রতিপত্তি।
৪২৫৭। দেখা যায় যারা পাপ করে এবং অন্যকে পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করে তাদের পার্থিব জীবন হয় অর্থসম্পদে, খ্যাতি ও যশে সমৃদ্ধ। তাদের এই সফলতা খুবই ক্ষণস্থায়ী।কারণ পৃথিবীর জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত জীবন। তাদের পাপ তাদের পরলোকের জীবনে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে।
৪২৫৮। দেখুন আয়াত [ ৩ : ১১৩ - ১১৭ ]। পার্থিব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত বিনয়ের সাথে ভক্তিভরে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। মোমেন বান্দাদের জন্য পরলোকের জীবনের জন্য পার্থিব জীবন। পরলোকের অনন্ত জীবনই তাদের নিকট প্রকৃত সত্য। সেই জীবনের জন্য মোমেন বান্দারা ইহকালে প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকেন। তাঁদের মূলধন হচ্ছে আল্লাহ্র করুণা ও দয়ার প্রত্যাশা। সে কারণে তারা হয় সিজ্দায় অবনত , বিনয়ী ও অনুগত। পার্থিব অহংকার বা দম্ভকে তারা ত্যাগ করে। এরাই হচ্ছেন সেই বান্দা যারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভ করেন, ফলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্ম লাভ ঘটে এবং তারা উৎসাহ ও তৎপরতার সাথে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে গ্রহণ করে থাকেন। যারা অবিশ্বাসী কাফের তারা এসব মোমেন বান্দাদের সাথে তুলনা যোগ্য বলে আল্লাহ্র চোখে বিবেচিত নয়।
৪২৫৯। দেখুন সূরা [ ৩ :১৯ ] আয়াত , যেখানে মোমেন বান্দা ও কাফেরদের তুলনা করা হয়েছে।
রুকু - ২
৪২৬০। আল্লাহ্ ভীতি বা তাক্ওয়া সম্বন্ধে বলা হয়েছে সূরা [ ২ : ২ ] আয়াতে এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছে টিকা নং ২৬। আরও দেখুন সূরা [ ২৩ : ৬০ ] আয়াত ও টিকা ২৯১২। এই আল্লাহ্ ভীতির উৎপত্তি হচ্ছে অন্তরের অকুণ্ঠ ভালোবাসা যার অর্থ হচ্ছে তাঁদের অন্তরে একটাই ভয় বিরাজ করে যে, তারা যেনো আল্লাহ্র ভালোবাসা থেকে বিচ্যুত না হন। আল্লাহ্কে তারা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার জনের ভালোবাসা হারানো ও অসন্তুষ্টির ভয়েই তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকেন।
৪২৬১। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২৯ : ৫৬ ] ও টিকা ৩৪৮৯। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উপায় এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। ১) আল্লাহ্কে ভয় করা ও ২) কল্যাণকর কাজ করা। সমাজের কল্যাণের জন্য , সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য কাজ সব সময়ে খুব সহজ হয় না। কিন্তু যা কল্যাণকর তা করে যাওয়ার নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে। এ আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় যে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করতে অক্ষম হয়েছি; বা আমাদের নিষ্ক্রীয়তা বা পাপের আসক্তি সমাজের অস্থিরতার ফল। এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থা আল্লাহ্র হুকুম অনুযায়ী কল্যাণকর কাজের অনুপযুক্ত হয় তবে আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হবে প্রয়োজনে স্বদেশ জন্মভূমি ত্যাগ করে হিজরত করতে হবে যেখানে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের মর্যদা রাখা সম্ভব। আল্লাহ্র পৃথিবী প্রশস্ত। "
৪২৬২। দেখুন সূরা [ ৬ : ১৪ ] আয়াত। "প্রথম হই" - অর্থাৎ যারা উৎসাহ , উদ্দীপনা এবং ধর্মের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে সর্বাগ্রে এগিয়ে প্রথম সারিতে থাকেন।
৪২৬৩। দেখুন সূরা [ ৬ : ২৫ ] আয়াত। আধ্যাত্মিক জগতে সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি হচ্ছে আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি। এর বিপরীত হচ্ছে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করা , যার পরিণতি হচ্ছে আত্মার মাঝে স্রষ্টার সান্নিধ্য অনুভব করা , আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ অর্জন করা। আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত আত্মায় আল্লাহ্র নূর প্রবেশে বাঁধা পায় ফলে সে হয় অন্ধকারে নিমজ্জিত যার শেষ পরিণতি দোযখের আগুন।
৪২৬৪। "যাকে ইচ্ছা এবাদত কর " - এই লাইনটি দ্বারা আদেশ বা অনুমতি বোঝানো হয় নাই। এই লাইনটি ভৎর্সনা ছলে বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তাঁর নবীকে সম্বোধন করে যা বলেছেন তা সহজতর ভাবে প্রকাশ করলে নিম্নরূপ হয়। নবী বলছেন, " যাই ঘটুক না কেন আমি আল্লাহ্র হুকুম মান্য করে চলবো। তিনি আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন। আমি জানি তিনি এক ও অদ্বিতীয় , সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশীল। একমাত্র আল্লাহ্ই এবাদতের যোগ্য। এমন কি কেউ অজ্ঞ আছে যে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত করে? তবে সে তা করুক এবং দেখুক তার শেষ পরিণতি কি ঘটে। ক্ষতি তারই ব্যক্তিগত। কারণ একমাত্র সেই আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হবে। ফলে সে পাপের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। "
৪২৬৫। পাপের পথ বড়ই পিচ্ছিল। এর শুরু হয় স্রষ্টা ব্যতীত অন্য উপাস্যের উপাসনার মাধ্যমে। কারণ চারিত্রিক গুণাবলীর উন্মেষ ঘটে স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পনের মাধ্যমে। স্রষ্টাকে না মানার প্রবণতা মানবকে ধীরে ধীরে পাপের পথে পরিচালিত করে। পাপে আসক্ত ব্যক্তির চারিত্রিক সকল গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়। এমন কি তার চরিত্র থেকে পরিবার পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব সকলের জন্য ভালোবাসার বন্ধন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। যে সব গুণাবলী মানুষকে স্রষ্টার সান্নিধ্যে পৌঁছানোর যোগ্যতা দান করে থাকে, পাপে আসক্তির ফলে সে সব গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়। পাপের অতল, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। "যারা নিজের আত্মার ও তাদের পরিবারবর্গের ক্ষতি সাধন করে।"
৪২৬৬। শেষ বিচারের পাপের শাস্তিকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। শাস্তিকে বর্ণনা করা হয়েছে আচ্ছাদন বা পোষাকের ন্যায় যা সর্বঅঙ্গকে আচ্ছাদিত করে থাকবে - উর্দ্ধোদিক এবং নিম্নদিকে। যদিও আগুন তাদের ঘিরে থাকবে , কিন্তু পাপের অন্ধকার তাদের আত্মার মাঝে যন্ত্রণার সৃষ্টি করবে।
৪২৬৭। পরলোকের বিপদ সম্বন্ধে আল্লাহ্ বারে বারে তাঁর বান্দাদের সর্তক করেছেন। আদম সন্তানকে তিনি সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন সত্য তবে এই ইচ্ছাশক্তির সঠিক ব্যবহারের জন্যও বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছেন। আদম সন্তানের সাহায্যের জন্য যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন। সঠিক পথে না চললে তার পরিণতির কথা পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করেছেন। যারা যুক্তিবাদী তাদের যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তার নিকট আবেদন করা হয়েছে। যারা আবেগ ও ভালোবাসার দ্বারা নিয়ন্ত্রীত হয় তাদের নিকট আল্লাহ্র ভালোবাসার মাধ্যমে আবেদন করা হয়েছে। যারা ভীতি প্রদর্শন ব্যতীত অন্য কিছুই হৃদয়ঙ্গম করে না, তাদের নিকট পাপের ভয়াবহ পরিণতির উল্লেখের মাধ্যমে আবেদন করা হয়েছে।
৪২৬৮। পাপের ফাঁদ পাতা ভূবনে ভূবনে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে। তাই কৌতুহলবশতঃ যদি কেউ তাগুতের অর্থাৎ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদতে অগ্রসর হয়, তাদের শেষ পরিণতি হয় তাগূতের দাসত্ব। যেমন দেখা যায় সংস্কৃতিবান ও প্রগতিশীল হওয়ার জন্য অনেকে নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে ফলে শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি খুব একটা সুখের হয় না। যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা এ সব থেকে দূরে থাকেন এবং একমাত্র আল্লাহ্র দাস হিসেবেই নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফলে এরাই আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করে ধন্য হয়।
৪২৬৯। এই আয়াতটি সম্বন্ধে দুধরণের তফসীর দেখা যায়। ১) ' কথা' শব্দটি যদি সাধারণ অর্থে ব্যবহার হয় ,তবে আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় যে, পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরা সত্য মিথ্যা , ভালো-মন্দ নির্বিশেষে মনোযোগ সহকারে সকল কথাই শোনে, এবং তা থেকে যা সত্য ও উত্তম তারই অনুসরণ করে থাকে। ২) যদি 'কথা ' শব্দটি আল্লাহ্র 'বাণী' ধরা হয় তবে তার অর্থ দাঁড়ায় পূণ্যাত্মারা আল্লাহ্র বাণী ভক্তিসহকারে শোনে এবং তার মাঝে যা উত্তম তারই অনুসরণ করে। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা দুর্বলদের পক্ষে অবলম্বন করা সম্ভব হয় না যারা বোধ-শক্তি সম্পন্ন শুধু তারাই পারে সর্বোত্তম পন্থার অনুসরণ করতে। উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করবো : কেহ আঘাত করলে বা ক্ষতি করলে তাকে ততটুকু আঘাত বা ক্ষতি ফিরিয়ে দেয়া আল্লাহ্ আমাদের জন্য সিদ্ধ করেছেন , কিন্তু সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে পাপকে পূণ্য দ্বারা , মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করা [ ২৩ : ৯৬ ]। আমাদের উপরে আল্লাহ্র নির্দ্দেশ হচ্ছে আমরা যেনো উত্তম পন্থা অনুসরণ করতে চেষ্টা করি।
৪২৭০। পাপে যে আসক্ত , সে এরই মাঝে বিকৃত আনন্দ খুঁজে পায়। পাপ কাজকে তার চোখে শোভন মনে হয়। পাপের মাঝে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকার ফলে এ সব আত্মা আল্লাহ্র রহমত ও অনুগ্রহ ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এসব আত্মার বর্ণনা আছে সূরা [ ৬ : ২৫, ২৬, ৩৯ ] ও আরও বহু আয়াতে। ফলে তাদের পক্ষে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাদের আত্মায় আল্লাহ্র নূর প্রবেশের ক্ষমতা হারায়। এদের কথাই এই আয়াতে বলা হয়েছে।
৪২৭১। দেখুন সূরা [ ২৯ : ৫৮ ] আয়াত এবং [ ৩৪ : ৩৭ ] আয়াত। এই আয়াতে বেহেশতের ধারণা দান করা হয়েছে। পৃথিবীর বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বর্ণনা করা হয়েছে তা হবে ছবির মত মনোরম সুউচ্চ প্রাসাদগুলি একের উপরে একটি বিন্যস্ত , যার পাদদেশে ছোট নদী বয়ে যাবে।
৪২৭২। 'Ma'ad' অর্থ আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার সময় , স্থান ও উপায়। আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি পালিত হবেই আমাদের ধারণার থেকেও উত্তমরূপে তা পালিত হবে।
৪২৭৩। পৃথিবীতে পানিচক্রকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টির পানি ভূমি শোষণ করে উর্ব্বর হয়, নদী -নালা ভরে ওঠে ,ভূমির পানির স্তর পরিপূর্ণতা লাভ করে ও প্রবাহিত হয় নির্ঝর রূপে। ভূমিস্থ পানির প্রবাহিত ধারা নির্ঝররূপে, নদীরূপে সমুদ্রে পতিত হয় এবং সমুদ্রের পানি পুণরায় বাস্পরূপে মেঘের সৃষ্টি করে। পানি চক্রের বিবরণ আছে সূরা [ ২৫ : ৫৩ ] আয়াতে এবং টিকা ৩১১১ - ৩১১২। এই আয়াতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে পানি চক্রের পরিণতির উপরে। বৃষ্টি ভূমিকে সজীব ও উর্বর করে, ফলে বিভিন্ন ফসল ও ফল ও ফুল উৎপন্ন হয়। ফসল পরিপক্কতা লাভের পরে ঘরে ওঠে এবং গাছগুলি শুকিয়ে পশুখাদ্যে পরিণত হয়। আবার পরের বছরে ফসলের জন্য সেই একই চক্রের পুণরাবৃত্তি ঘটে। মানুষকে প্রকৃতির এই নিয়ম ও ধারার মাঝে আল্লাহ্র করুণা ও কল্যাণ স্পর্শ উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে। যারা বোধশক্তি সম্পন্ন তাদের নিকট আল্লাহকে আত্মার মাঝে উপলব্ধি করার এ এক উপায়।
উপদেশ : আল্লাহ্ নিরাকার। তাঁকে আত্মার মাঝে তখনই অনুভব করা যাবে, যখন মানুষ বিশ্ব প্রকৃতি সৃষ্টির মাঝে তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কল্যাণ স্পর্শ অনুভবে সক্ষম। সে কারণেই জ্ঞান লাভ করা মুসলমান নারী ও পুরুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
রুকু - ৩
৪২৭৪। "বক্ষ উন্মুক্ত করা " বাক্যটি আক্ষরিক অর্থে নয়, প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। অন্তরে আল্লাহ্র নূর প্রবেশ করলে বক্ষ উন্মুক্ত হয়। যারা আল্লাহ্র বাণী অনুধাবনের চেষ্টা করে তারা অন্তরের মাঝে অনুভব করে যে, তাদের আধ্যাত্মিক চিন্তা , অনুভব ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে। সেই প্রসারিত আধ্যাত্মিক জগত ধীরে ধীরে আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে সে বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র কল্যাণ স্পর্শ , পৃথিবীর অস্থায়ী জীবনে আল্লাহ্র বাণীর মাহত্ব্য অনুভবে সক্ষম হয়। তাঁর আধ্যাত্মিক জগতের যাত্রা তখন ধাপে ধাপে নির্দ্দিষ্ট পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। আধ্যাত্মিক জগতের দ্বার তাঁর নিকট উম্মুক্ত হয়ে যায়। বক্ষ উম্মোচনের অর্থ অন্তরের প্রশস্ততা। এর উদ্দেশ্য অন্তরে এরূপ যোগ্যতা থাকা যে, আল্লাহ্র সৃষ্টিগত নির্দ্দেশাবলী ,আকাশ ও বিশ্ব প্রকৃতির উপরে চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে আল্লাহ্র অনুভব অন্তরে লাভ করতে সক্ষম হয়। একেই বলা হয়েছে " ইসলামের জন্য বক্ষ উম্মুক্ত করা।" এরূপ ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে তাদের যারা আল্লাহ্র স্মরণে পরামুখ অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র নূর হৃদয়ে প্রবেশে বাধা দান করে।
৪২৭৫। যারা আল্লাহ্র করুণা অনুসন্ধান করে তাদের জন্য যেরূপ আধ্যাত্মিক প্রগতির সুসংবাদ আছে , ঠিক তার বিপরীত অবস্থা হচ্ছে যারা আল্লাহ্র কথা স্মরণে আনে না। যারা আল্লাহ্র নূরকে আত্মার মাঝে প্রবেশে বাঁধা দেয়, তাদের আধ্যাত্মিক প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদের আত্মা ধীরে ধীরে তার কমনীয়তা ,পেলবতা ও স্বচ্ছতা হারিয়ে কঠিন রূপ ধারণ করে, ফলে তাদের আত্মায় আর আল্লাহ্র হেদায়েত বা নূর প্রবেশ লাভ করে না। এসব লোকদের চারিত্রিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে এরা বিভ্রান্ত। এরা মানসিক দিক থেকে সর্বদা দোদুল্যমান অবস্থায় অবস্থান করবে। চারিত্রিক দুর্বলতা হবে এদের নিত্য দিনের সঙ্গী। অপরপক্ষে আল্লাহ্র সান্নিধ্য ধন্য ব্যক্তিদের চারিত্রিক দৃঢ়তা হবে অনমনীয়।
৪২৭৬। 'Mutashabih' শব্দটি এই আয়াতে যে অর্থে ব্যবহার হয়েছে , [৩ : ৭ ] আয়াতেও কি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ? এ ব্যাপারে টিকা নং ৩৪৭ দেখুন। বিজ্ঞ মতামত হচ্ছে এখানে সামান্য ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ ঘটেছে। 'Mathani' এই শব্দটির মূল অর্থ : একই ধর্ম বিশিষ্ট ; রূপক বা উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা ; বিভিন্ন অংশ পরস্পর সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সম্পর্কযুক্ত। শেষ অর্থটি গ্রহণ করলে পংক্তিটির অর্থ দাঁড়ায় যে, কোরাণের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে অবতীর্ণ হয়েছে ,কিন্তু সমগ্র কোরাণ এক সমন্বিত,সুসামঞ্জস্যপূর্ণ , ও সম্পর্কযুক্ত গ্রন্থ বিশেষ। এত বড় গ্রন্থের কোনও অংশে কোনও পরস্পর বিরোধিতা বা অসঙ্গতি নাই।
৪২৭৭।
৪২৭৮। শরীরের সর্ববহিঃস্থ স্তরে চর্মের অবস্থান। বাহিরের যে কোন অস্বাভাবিকতা সর্বপ্রথম চর্মের মাধ্যমে আমরা অনুভব করে থাকি। এই অনুভতির প্রথম প্রকাশ ঘটে থাকে , এভাবে : শরীর কেঁপে ওঠে এবং শরীরের লোম শিউরে ওঠে। অর্থাৎ যেকোনও অস্বাভাবিক অবস্থা প্রথমতঃ শরীরের বাহ্যিক আবরণে তা অনুভূত হয় , ঠিক সেরূপ আধ্যাত্মিক জগতেও আল্লাহ্র বাণীর প্রথম অনুভূতি হবে বাহ্যিক। যারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তারা প্রথমে সর্ব অবয়বে কম্পন অনুভব করবে। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে কম্পনের এই অনুভূতি বাহ্যিক অবয়বকে অতিক্রম করে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আত্মার মাঝে প্রবেশ লাভ করবে। আল্লাহ্র বাণীর মাহত্বে তাদের সমস্ত সত্ত্বা পেলবতা লাভ করে ফুলের ন্যায় সৌরভযুক্ত ও নরম হয়ে পড়ে এবং তাদের সমস্ত সত্ত্বার আমূল পরিবর্তন ঘটে থাকে।
৪২৭৯। "যাকে খুশী পথ প্রদর্শন করেন " এবং " যাকে ত্যাগ করেন" এই বাক্য দুটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে [ ১৬ : ৯৩ ] আয়াতে ও টিকা ২১৩৩ এবং [ ১৪ : ৪ ] আয়াতে ও টিকা ১৮৭৫।
৪২৮০। পৃথিবীতে যারা কোনও দিনও তাদের কৃত পাপের জন্য অনুতাপ করে নাই, শেষ বিচারের দিন তাদের জন্য হবে ভয়াবহ। সেদিন তারা তাদের কৃত পাপের পূর্ণ প্রতিফল লাভ করবে। সেদিনের শাস্তি তাদের সর্ব অবয়বকে ঘিরে মুখকেও পূর্ণ করে দেবে। অর্থাৎ শাস্তির আগুনে তারা পরিপূর্ণভাবে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে মানুষের অভ্যাস যে কোনও শারীরিক আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য হাত ও পাকে ঢালরূপে ব্যবহার করে থাকে। শেষ বিচারের দিনে এদের হাত ও পা থাকবে অকর্মণ্য। সুতারাং আগুনের শাস্তিকে প্রতিহত করার জন্য তারা হাত ও পাকে ব্যবহারের সুযোগ না পেয়ে তারা তা মুখ দিয়ে প্রতিহতের চেষ্টা করবে। শাস্তি প্রাপ্ত এই সব অসহায় পাপী লোকেরা কি পূণ্যবান ও আল্লাহ্র রহমত প্রাপ্ত বান্দাদের সাথে এক শ্রেণীতে তুলনাযোগ্য। অবশ্যই নয়। পাপী তার কর্মের শাস্তি ভোগ করবে এবং পূণ্যাত্মা আল্লাহ্র রহমত ভোগ করবে।
৪২৮১। "যা অর্জন করতে" - অর্থাৎ পৃথিবীকে কৃত তাদের সকল মন্দ কাজ ও পাপ যা তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে অর্জন করেছে।
৪২৮২। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ২৬ ]। পাপীরা এমনভাবে হঠাৎ করে শাস্তি লাভ করবে যা তারা কল্পনাও করে নাই। আল্লাহ্র বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও বিদ্রোহের দ্বারা তারা হয়তো পার্থিব জীবনে ক্ষণস্থায়ী সুযোগ সুবিধা লাভ করতে পারবে সত্য , কিন্তু তাদের এই পার্থিব জীবন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যাবে, পরে থাকবে শুধু পরলোকের অনন্ত জীবন। যে জীবনে তাদের জন্য থাকবে শুধু লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা।
৪২৮৩। দেখুন আয়াত [ ২ : ১১৪] পাপ কাজ কখনই জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনতে পারে না। পাপের শেষ পরিণতি সর্বদাই লাঞ্ছনা ও অপমানের মাধ্যমে শেষ হয়। কিন্তু পাপের সর্বশেষ পরিণতি অপেক্ষা করে থাকে পরকালে। কিন্তু যারা পরকালে অবিশ্বাসী তারা পরকালের জীবনের দুঃখ দুর্দ্দশা ও লাঞ্ছনার সংবাদ পার্থিব জীবনে বিশ্বাস করে না। এর মাঝে যদি কেহ পাপের দ্বারা পৃথিবীতে অগাধ বিত্ত ও ঐশ্বর্য অর্জনে সক্ষম হয়, তবে সে ধারণা করে তার বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরকালের পরিণতিকেও ইহাকালের ন্যায় অতিক্রম করতে পারবে। আর যদিও সে পাপের পরিণতিতে পৃথিবীতে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে , তবে তার ধারণা জন্মে যে, তার পাপক্ষয় হয়ে গেলো ,তাকে পরলোকে আর শাস্তি ভোগ করতে হবে না। এই উভয়বিধ ধারণাই হচ্ছে ভ্রান্ত ধারণা।
৪২৮৪। আধ্যাত্মিক জীবনকে চোখে দেখা যায় না। একে আত্মার মাঝে অনুভবের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। মানুষ যাতে উপলব্ধি করতে পারে , সে কারণে কোরাণ শরীফে বহু উদাহরণ উপমা ও রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে মানুষের বোধগম্যতাকে স্বচ্ছ করার জন্য। এ সব বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ যাতে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। কোরাণের কাহিনী শুধুমাত্র কোনও গল্পের ধারা বিবরণী নয়। কাহিনীর মাধ্যমে উদাহরণের মাধ্যমে উপমা, ও রূপকের দ্বারা মানুষকে শিক্ষা দান করা হয়েছে আধ্যাত্মিক জীবনের সত্যতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে।
৪২৮৫। পূর্ববর্তী কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে অন্য ভাষায়। কুর-আন অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষাতে যা সেই দেশের মাতৃভাষা এবং সাধারণ লোকেরা তা বুঝতে সক্ষম হয়। আরবী এক সমৃদ্ধ ভাষা যার প্রকাশভঙ্গী ও রচনাশৈলী অপূর্ব ; ফলে আল্লাহ্র বাণীর প্রকৃত মাধুর্য সেই ভাষাতে প্রকাশ সম্ভব।
৪২৮৬। দেখুন আয়াত [ ১৮ : ১ ] ও টিকা ২৩২৬ ; আয়াত [ ৭ : ৪৫ ] ও টিকা ১০২৪ এবং [ ১৯ : ৩৬ ] আয়াত ও টিকা ২৪৮৮।
৪২৮৭। যারা বহু উপাস্যের উপাসনা করে তাদের সাথে যারা শুধুমাত্র এক আল্লাহ্র উপাসনা করে তাদের মধ্যে পার্থক্য উপমার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বহু উপাস্যের উপাসনাকারীর অবস্থা হচ্ছে সেই লোকের ন্যায় যার প্রভু অনেক জন। এই প্রভুরা পরস্পর পরস্পররের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাভাবাপন্ন। সুতারাং ভৃত্যের পক্ষে তাদের কাউকেই সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। প্রভুদের কলহের ফলে ভৃত্যের চরম দণ্ড দিতে হয়। অপরপক্ষে যার শুধু একজনই প্রভু ; সে তো মনপ্রাণ দিয়ে সেই একজন প্রভুর সেবা যত্ন করতে সক্ষম। তাঁর সেই প্রভু হচ্ছে দয়াময়; ভৃত্যের আরাম আয়েশের জন্য যিনি সর্বদা ব্যকুল।এরূপ প্রভুর সেবা করা যে কোনও ভৃত্যের জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক কাজ। সে তার কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে , ফলে সে তার কাজে সাফল্যের সাথে ও পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। এ ব্যাপারে কি কোনও সন্দেহ থাকে যে ১) দুধরণের প্রভুর মধ্যে কোনটি কাঙ্খিত ? এবং ২) কোন প্রভুর কাজ বেশী আনন্দদায়ক এবং স্বাভাবিক ?
উপদেশ : মানুষকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন এ ভাবে যে, সে একই সাথে বিভিন্ন উপাস্যের উপাসনা করতে অক্ষম। বহু উপাস্যের উপাসনা আধ্যাত্মিক জগতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে ফলে আত্মার স্বচ্ছতা , পবিত্রতা , একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এসব লোকের চরিত্রে দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হয়।
৪২৮৮। আমরা আল্লাহ্র নিকট কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাদের বহু প্রভুর দাসে পরিণত করেন নাই। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্র তিনি দয়াময় , আল্লাহ্ অনুগ্রহ করে আমাদের সরাসরি তাঁর উপাসনা করার হুকুম দিয়েছেন - আমাদের কারও মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। তিনি এক ও অদ্বিতীয় ও অসীম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র।
৪২৮৯। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যে, মানুষ মাত্রই মরণশীল এমন কি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদও [ সা ] এর উর্দ্ধে নন। এর উর্দ্ধে নয় সকল পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরাও। পাপী ও পূণ্যাত্মা সকলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। কিন্তু যারা পূণ্যাত্মা তারা মৃত্যুর পর, পার্থিব জীবন শেষেও পৃথিবীতে রেখে যান তাদের পূণ্যকর্ম সমূহ পৃথিবীর কল্যাণার্থে। তাদের কর্মের মাধ্যমেই তাদের স্মৃতি পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে থাকে। মৃত্যুর পরপারে যে জীবন সে জীবন পৃথিবীর মানুষের কাছে অজ্ঞাত , অপরিচিত। এই জীবন সম্বন্ধে পৃথিবীতে অবিশ্বাসীরা বহু যুক্তি তর্ক , বাক্-বিতন্ডা করে থাকে। পরের আয়াতে আল্লাহ্ আমাদের বলেছেন যে, কেয়ামত দিবসে প্রত্যেকের বাক্-বিতন্ডার অবসান ঘটবে আল্লাহ্র উপস্থিতিতে।
৪২৯০। দেখুন উপরের টিকা।
চতুর্বিংশতিতম পারা
রুকু - ৪
৪২৯১। আল্লাহ্ আমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তাঁর কল্যাণস্পর্শ জীবনের প্রতিটি স্তরে পরিব্যপ্ত। কিন্তু যদি কোনও অকৃতজ্ঞ জীব আল্লাহ্র এই করুণাকে অস্বীকার করে ; আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যকে মিথ্যা বলে অভিহিত করে তবে তার থেকে বড় জালিম আর কে আছে ?
৪২৯২। দেখুন আয়াত [ ৩ : ১৫১ ] ; [ ১৬ : ২৯]।
৪২৯৩। প্রকৃত সত্য বা আল্লাহ্র বাণী সকল যুগেই এক, তা যুগ , কাল অতিক্রান্ত। যারা এই সত্যকে পৃথিবীতে প্রচার করেন তারা হলেন নবী,রসুল ও মোমেন বা পূণ্যাত্মা বান্দারা। যারাই সত্যকে নিজের অন্তরে ধারণ করেন এবং অপরের জন্য তা প্রচার করে থাকেন ,তারাই তো পৃথিবীর মহত্তর কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এ ভাবেই প্রতিটি মোমেন বান্দা পূর্ববর্তী রসুলদের প্রচারিত সত্যকে সত্যায়ন করেন। রসুলুল্লাহ্র [ সা ] আনীত শিক্ষাসমূহ অন্যান্য রসুলদের আনীত সত্যকে দৃঢ়ভাবে সত্যায়ন করে। যারা আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যকে মানে তারাই সঠিক পথ অবলম্বনকারী এবং কর্তব্যপরায়ন। এদেরকেই মুত্তাকী বলা হয়েছে।
৪২৯৪। সঠিক পথ অবলম্বনের ফলে মুত্তাকী ব্যক্তিরা আল্লাহ্র নিকট পুরষ্কারের যোগ্য বলে বিবেচিত। পৃথিবীতে রাজ্য বা প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি দ্বারা পুরষ্কৃত হলে আমরা ধন্য হয়ে যাই। সেখানে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের যিনি অধিপতি , তিনি মোমেন বান্দাদের বাঞ্ছিত সকল কিছু দ্বারা পুরষ্কৃত করার কথা এই আয়াতে ঘোষণা করেছেন।
৪২৯৫। "Lam" আরবী শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে "এই হেতু" বাংলা শব্দটি দ্বারা, যার দ্বারা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে মুত্তাকীদের কাজের ফলাফল। আল্লাহ্র পুরষ্কার সীমাহীন। যদি কেহ নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে,তবে আল্লাহ্ শুধু যে তার ছোট খাট দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন তাই নয়, তার পাপ বা মন্দ কর্মকেও ক্ষমা করে দেবেন। এবং তাকে বিচার করবেন তার সৎকর্ম বা পূণ্য কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে।
৪২৯৬। যারা মুত্তাকী বা আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট সমর্পিত , তাদের নিকট পার্থিব নিরাপত্তার জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট। পৃথিবীতে সুখ শান্তি ,নিরাপত্তা , বিশ্রাম , যার জন্য মানুষ আকাঙ্খা প্রকাশ করে থাকে , সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আল্লাহ্-ই এ সকলের জন্য যথেষ্ট , শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভয় দেখায় যে, শয়তানের নির্দ্দেশিত পথ ব্যতীত এসব সুখ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। শয়তানের নির্দ্দেশিত পথ হচ্ছে মিথ্যা কুসংস্কার ও মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা। মূর্তি পূঁজার অর্থেই শুধুমাত্র মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করা হয় না। পৃথিবীতে সাধারণ মানুষ অহরহ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য অনেক শক্তির নিকট মাথা নত করে। আপতঃদৃষ্টিতে তাদের নিকট এসব শক্তিকে আল্লাহ্র থেকে বেশী শক্তিশালী মনে হয়। যেমন মানুষ সম্পদ , ক্ষমতা, শাসক , বিজ্ঞান , আত্মসুখ বা নিজ স্বার্থ ইত্যাদিকে সর্বোচ্চ করে দেখতে অভ্যস্ত। নিজস্ব স্বার্থ ও আত্মসুখের জন্য তারা আল্লাহ্র আদেশের বিপরীতে কাজ করে থাকে। তাদের মানসিক অবস্থা এরূপ : " আমি সঠিক পথটি অবলম্বন করলে সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হব। অথবা যদি আমি পাপ কাজ করতে অস্বীকার করি, তবে আমি জাগতিক উন্নতি লাভে অসমর্থ হব এবং আমার জীবনে পার্থিব উন্নতি লাভের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে ইত্যাদি "। আজকের বাংলাদেশে অধিকাংশ চাকুরীর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অর্থাৎ জীবিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষ এই টানা পোড়েনের সম্মুখীন । তারা আল্লাহকে সর্বোচ্চ ও সর্বশক্তিমান মনে না করে বিভিন্ন শক্তির সাহায্য প্রার্থনা করে , এবং অন্যায় , দূর্নীতি, ও কুসংস্কারের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এগুলিই তাদের মিথ্যা উপাস্য। প্রকৃত পক্ষে এ সব মিথ্যা উপাস্য জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ ও উন্নতির সন্ধান দান করে যার শেষ পরিণতিতে এসবের উপাসনাকারীরা হতাশা ও দুর্দ্দশাতে নিমজ্জিত হয়। কারণ তারা পরম করুণাময় আল্লাহ্র করুণা ও দয়া থেকে বঞ্চিত হয়। আর যে আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত তাকে কে সঠিক পথের সন্ধান দেবে ? কে তাকে বিপদ বিপর্যয়ে সান্তনা ও সাহস দান করবে ? আল্লাহ্-ই তাঁহার বান্দার জন্য যথেষ্ট।"
উপদেশ : জীবিকার অন্বেষণে মানুষকে পৃথিবীর বিপদ সঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে হয়। এ পথে লোভ , প্রলোভন , ভয়, নিরাপত্তার অভাব, প্রভৃতি বহু ধরণের শক্তি কাজ করে যা আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। এ সবের উপরে নির্ভরশীলতাকেই বলা হয়েছে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা। মোমেন বান্দার পথ একটাই তা হচ্ছে আল্লাহ্র পথ, নির্ভরতা একটাই তা আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পন। কারণ সে জানে আল্লাহ্র শক্তিই সর্বোচ্চ এবং আল্লাহ্র ইচ্ছাই সর্বশেষ পরিণতি।
৪২৯৭। যারা আল্লাহ্র প্রেরিত পথ নির্দ্দেশকে দৃঢ়ভাবে জীবনের সত্য বলে গ্রহণ করে তাদের পৃথিবীর পথে পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয় নাই। কোন ভয় , প্রলোভন, বিপদ বা বিপর্যয় তাদের বিপথগামী বা প্রতারিত করতে পারবে না।
৪২৯৮। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী। তাঁর ক্ষমতা সকল দূরভিসন্ধি ও আল্লাহ্র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে জয়ী হবেই । পাপীর ক্ষমতা যখন সীমালংঘন করে যায়, তখন আল্লাহ্র ক্ষমতা তাকে ধ্বংস করে ফেলে। তিনি দন্ডবিধায়ক - তার শাস্তি থেকে কোনও ষড়যন্ত্রকারী রেহাই পাবে না।
৪২৯৯। দেখুন আয়াত [ ২৯ : ৬১ ] এবং আয়াত [ ২৩ : ৮৫] ও টিকা ২৯২৭। এই আয়াতে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনাকারীদের রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে। এ সব লোকেরা নাস্তিক বা সন্দেহবাতিক নয়। এরা বিশ্বাস করে যে এই বিশাল মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ্ , তবে তাদের সে বিশ্বাস তাদের আত্মার মাঝে দৃঢ়ভাবে সুসংবদ্ধ নয়। যার ফলে তাদের আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের প্রতিফলন তাদের কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায় না। তাদের জীবন প্রবাহিত হয় মিথ্যা ধারণার কালোস্রোতে। এরাই আল্লাহ্র পরিবর্তে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে থাকে। কখনও তা হয় পূর্বপুরুষদের মিথ্যা কুসংস্কার , কখনও তা হয় তাদের অনুভূতি হীনতার কারণে, বা দুষিত দূর্নীতিপরায়ণ পরিবেশের কারণে বা স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে অথবা সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণে। বিভিন্ন কারণে এরা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে অবিচল হতে পারে না। কখনও এরা মাজারে যেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে, কখনও বা ভন্ড পীর ফকির ও জ্যোতিষের স্মরণাপন্ন হয় তাবিজ মাদুলী বা রত্ন পাথরের জন্য। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এরা কখনও ক্ষমতাবানদের তোষামোদ করে, বা কখনও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এদের মাঝে ন্যায় ও অন্যায় বোধের সীমারেখা খুবই অস্পষ্ট। এদেরকেই আল্লাহ্ সম্বোধন করে বলেছেন যে, " তোমাদের মিথ্যা উপাস্য শেষ পর্যন্ত তোমাদের কোনও উপকারই করতে পারবে না ; তবে কেন তোমরা এক আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা কর না? কেন শুধুমাত্র তাঁর উপরে নির্ভর কর না ? একমাত্র আল্লাহ্-ই সকল কল্যাণের প্রভু এবং ন্যায় বিচার এবং শাস্তি দানের ক্ষমতা রাখেন। "
৪৩০০। দেখুন আয়াত [ ৩৩ : ১৭ ]।
৪৩০১। দেখুন আয়াত [ ১২ : ৬৭ ] এবং [ ১৪ : ১২ ] আয়াত। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। তিনি একাই সকল দায়িত্ব বহন করতে সক্ষম। যে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে সে প্রকৃত শক্তির সন্ধান লাভ করে। সুতারাং "নির্ভরকারীগণ আল্লাহ্র উপর নির্ভর করে।"
৪৩০২। দেখুন [ ১১ : ১২১ ] ও টিকা ১৬২৪ -ক।
৪৩০৩। দেখুন [ ১১ : ৯৩ ] আয়াত। এই আয়াতে শাস্তির বর্ণনার জন্য দুধরণের বর্ণনা ব্যবহার করা হয়েছে। একটি হচ্ছে লাঞ্ছনাদায়ক বা অপমানজনক শাস্তি , অপরটি হচ্ছে স্থায়ী শাস্তি। সম্ভবতঃ শাস্তি প্রাপ্ত লোকের দুধরণের অবস্থাকে এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে। তার অবস্থা হবে নিম্নরূপ : ১) তা হবে লাঞ্ছলাদায়ক এবং ২) তা হবে চিরস্থায়ী।
৪৩০৪। আল্লাহ্ রসুলদের মাধ্যমে তাঁর প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন সকল মানুষের জন্য। এই প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আল্লাহ্ পৃথিবীতে জীবন ধারণের পথ নির্দ্দেশ প্রেরণ করেছেন। পুরুষ নারী সকলের জন্য আছে সৎ পথের সন্ধান। প্রত্যাদেশের বাণী অমোঘ সত্য , সেখানে কোনও রহস্যময়তা বা অস্পষ্টতা নাই। যে তা অনুসরণ করে সে তা করে নিজের কল্যাণের জন্য। যদি কেউ তা প্রত্যাখান করে , তবে সে শয়তানের অনুসরণ করে যা তার নিজের আত্মার জন্য হবে ক্ষতিকর। নিজের ধ্বংস সে নিজে ডেকে আনে।
৪৩০৫। আল্লাহ্র প্রেরিত নবী ও রসুলেরা মানুষের শিক্ষার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারেন সত্য , কিন্তু তাদেরও ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। তারা মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " যা স্রষ্টার বিশেষ দান , সেই মানসিক শক্তিকে কোনও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন না। যদি কেহ তাদের শিক্ষাকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তবে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতার জন্য সেই শুধুমাত্র দায়ী হবে আর কেহ নয়। দেখুন [৬ : ১০৭ ] আয়াত ও টিকা ৯৩৫।
রুকু - ৫
৪৩০৬। ঘুম , স্বপ্ন ও মৃত্যুর রহস্য আজও মানুষের অজ্ঞাত। এ এক আকর্ষণীয় প্রহেলিকা। সম্ভবতঃ এই রহস্যের সমাধান মানুষের জ্ঞান , বিজ্ঞানের বাইরে। ঘুম , স্বপ্ন ও মৃত্যুর সম্বন্ধে বহু ধরণের কুসংস্কার , কাল্পনিক ধারণা এবং মনঃস্তাত্বিক গবেষণা বিদ্যমান। কিন্তু তা কোনটাই সম্পূর্ণ ঘটনাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। এই আয়াতে সামান্য কয়েকটি ছত্রে ঘুম ও মৃত্যুর ধর্মীয় মতবাদকে তুলে ধরা হয়েছে। দৈহিক সকল ক্রিয়া কর্মের সমাপ্তির মাধ্যমে মৃত্যু ঘটে অর্থাৎ দৈহিক মৃত্যু ঘটে, কিন্তু আমাদের আত্মার মৃত্যু ঘটে না ; তা অমর। তার অবস্থান তখন হয় পরলোকে বা আধ্যাত্মিক জগতে। আল্লাহ্ আমাদের আত্মাকে গ্রহণ করেন, যা আর পৃথিবীতে ফিরে আসে না।
৪৩০৭। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৬০ ]। ঘুম কি ? এ প্রশ্ন বহু যুগ থেকে মানুষ করে আসছে। মানুষ , জীব-জন্তু , কীট পতঙ্গ সকলেই ঘুমায়। মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীর ঘুমকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ঘুমকে বলা যায় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যবিরতি বিশেষ। কারণ ঘুমের সময়ে মানুষ বা প্রাণী কোনও কিছুই উপলব্ধি করতে পারে না , এই দৃশ্যমান পৃথিবী তাদের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ ও প্রাণীকুলের দৈহিক অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম যেমন : রক্ত সঞ্চালন , পরিপাক ক্রিয়া, শারীরিক বর্দ্ধন , নিশ্বাস প্রশ্বাস ইত্যাদি জৈবিক ক্রিয়াকর্ম স্বাভাবিক ভাবেই সম্পন্ন হতে থাকে , যদিও তা ঘটে অত্যন্ত ধীর গতিতে। ঘুমের সময়ে শুধুমাত্র স্নায়ুতন্ত্রের বিশ্রাম ঘটে। এই একটি ব্যাপারই মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে সার্বজনীন যা উভয় শ্রেণীর মধ্যেই ঘটে থাকে। সম্ভবতঃ এ সত্য বৃক্ষরাজির জন্যও প্রযোজ্য, কারণ, ধারণা করা হয় বৃক্ষরাজিরও স্নায়ুতন্ত্র বিদ্যমান। মানুষের বেলায় স্নায়ুতন্ত্রের বিশ্রামের সাথে সাথে মানসিক দক্ষতারও বিশ্রাম ঘটে। যে কোনও প্রকার মানসিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে যায় সত্য কিন্তু এ সময়েই মানুষ সাধারণতঃ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন সাধারণতঃ দুধরণের হয়। এক ধরণের স্বপ্নে প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন কার্যের প্রতিফলন ঘটে। অবচেতন মনের প্রতিফলন এসব স্বপ্নে ঘটে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় সাধারণ বিবেক বুদ্ধিতে যে সব ঘটনা অবাস্তব মনে হয়। চেতনায় যা অবাস্তব ,অবচেতন মন তাকেই ধারণ করে স্বপ্নে। সাধারণ মানুষ এ রকম স্বপ্নই দেখে থাকে সাধারণতঃ। তবে কখনও কখনও কদাচিৎ মানুষ অন্য আর এক ধরণের স্বপ্ন দেখে থাকে - যার কোনও ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। এ সব স্বপ্নে হয় ভবিষ্যতকে দেখা যায় নতুবা যা মানুষের অগোচরে তার দেখা মেলে। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানেন বৈজ্ঞানিক কেকুল বহু সাধনা ও গবেষণা করেছিলেন জৈব রসায়নের মূল পদার্থ বেন্জিনের রাসায়নিক সুত্র আবিষ্কারের জন্য। দিন রাত্রের পরিশ্রমও যখন সফল হলো না ,তখন একদিন তিনি স্বপ্নে বেনজিনের সুত্রটি দেখতে পান এবং এই আবিষ্কারের ফলে তিনি রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান। এর ব্যাখ্যা কি ? মানুষের প্রাণ বা আত্মা বা ব্যক্তিত্ব যাই বলা হোক না কেন - তা আমাদের এই নশ্বর দেহের উর্দ্ধে অবস্থান করে। নশ্বর দেহ সে তো পশুতুল্য। পশুর যা কাম্য আমাদের দেহেরও সেই একই কাম্য। মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব তা তার দেহের জন্য নয়। তা হচ্ছে তার এই নশ্বর দেহের মাঝে পরমাত্মার অংশ আত্মার অবস্থানের জন্য। ঘুমের মাঝে আত্মা দেহকে ত্যাগ করে অন্য জগতে চলে যায় - এই আয়াতে সেই কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের সকলের প্রাণ বা আত্মাকে হরণ করে থাকেন। সে হিসেবে ঘুমন্ত ব্যক্তি ও মৃত ব্যক্তির অবস্থান একই - কারণ উভয়ের আত্মাই আল্লাহ্র সন্নিকটে যায়। কবিতার ভাষাতে ঘুমকে বলা হয়েছে "Twin brother of Death." অতিপ্রাকৃত যে সব স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যা করা তখনই সম্ভব যদি ঘুমের এই ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা হয়।
৪৩০৮। ঘুমকে মৃত্যুর যমজ ভাই রূপে সম্বোধন করা হয়েছে। ঘুমের মাঝে আমাদের আত্মাকে অস্থায়ীভাবে নশ্বর দেহের রক্তমাংসের বন্ধন মুক্ত করা হয়। আল্লাহ্ তাদের আত্মাকে হরণ করেন। যারা ঘুমের মাঝে পরম শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন, তাদের আত্মা আর তাদের দেহের মাঝে ফিরে আসে না। পরিণতিতে তারা মৃত্যুবরণ করে। তাদের নশ্বর দেহ ধ্বংস হয়ে যায়। যাদের পৃথিবীর জন্য আরও সময় বাকী থাকে, তাদের আত্মাকে পুণরায় দেহের মাঝে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই তারা তাদের পৃথিবীর মেয়াদকাল পূর্ণ করে থাকে।
৪৩০৯। ঘুম ,মৃত্যু ইত্যাদি সম্বন্ধে যদি মানুষ গভীর ভাবে চিন্তা করে, তবে তার সম্মুখে আধ্যাত্মিক বা পারলৌকিক জীবনের অনেক সত্যের রূপ উদ্ভাসিত হবে। যেমনঃ
১) পৃথিবীর জীবনে জীবন ও মৃত্যু যা আমরা সর্বদা প্রত্যক্ষ করে থাকি তাই-ই জীবনের শেষ কথা নয়।
২) পৃথিবীর সংজ্ঞা অনুযায়ী দৈহিক ভাবে জীবিত ব্যক্তিও আধ্যাত্মিক ভাবে মৃত হতে পারে। আবার দৈহিক মৃত্যু আধ্যাত্মিক জগতের নিদ্রাত্থান হতে পারে।
৩) নিদ্রা শুধুমাত্র শারীরিক বিশ্রাম নয়। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে ঘুমকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা যায়। ঘুম যেরূপ জীবনের শেষ নয় , মৃত্যুও সেরূপ জীবনের শেষ নয়।
৪) কেয়ামত দিবসের পুণরুত্থান ,প্রতিটি প্রত্যুষে নিদ্রা থেকে জাগরণের ন্যায় ঘটনা যাকে কবির ভাষাতে বলা যায় ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর যমজ ভাই।
স্বপ্ন, ঘুম ইত্যাদি মানুষকে আত্মার অমরত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আত্মার অমরত্বের বিশ্বাসই হচ্ছে ধর্মের মূল ভিত্তি। সুতারাং ঘুম, মৃত্যু ,স্বপ্ন ইত্যাদি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ্ নিদর্শন - যা চিন্তার মাধ্যমে আত্মার মাঝে অনুধাবন করতে হয়।
৪৩১০। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর ক্ষমতার উপরে মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করবে না। কারণ আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও সাহায্য করার ক্ষমতা নাই। যদি তারা প্রতিমা বা মূর্তির পূঁজা করে তবে তারা হচ্ছে প্রাণহীন। তাদের কোন ক্ষমতাই নাই , এমন কি নবী রসুল এবং পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরাও সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখেন না, যদি না আল্লাহ্ তাদের সে ক্ষমতা দান করেন। দেখুন পরবর্তী টিকা।
৪৩১১। Shafa'at - অর্থ সুপারিশকারী , মধ্যাস্থতাকারী। দেখুন আয়াত সমূহ [২ : ২৫৫ ] ; [ ১০: ৩ ] ; ও টিকা ২৬৩৪ এবং [ ২১ : ২৮ ] ও টিকা ২৬৮৮। হাশরের ময়দানে , শেষ বিচারের দিনে , কেহই আল্লাহ্ নিকট কারও জন্য মধ্যাস্থতাকারীরূপে পরিগণিত হতে পারবে না। একমাত্র তারাই পারবেন ১) যাদের আল্লাহ্ অনুমতি দান করবেন ; ২) যারা অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা নিজেকে আল্লাহ্র সম্মুখে উপস্থিতির যোগ্য করে তুলবেন। পৃথিবীর বিচারালয়েও কেহ কারও জন্য বিচারকের নিকট সুপারিশ করতে পারে না , একমাত্র যোগ্য উকিল ব্যতীত। এমন কি পৃথিবীতে ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতেই একমাত্র বিচারকের নিকট করুণা ও ক্ষমা ভিক্ষা করা যায়।
৪৩১২। সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্র। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আমাদের বর্তমান পৃথিবীর জীবন শেষে ,আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট নীত হব। দেখুন আয়াত [১০ : ৪ ]।
৪৩১৩। আল্লাহ্র সেবা বা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার অর্থ হচ্ছে পৃথিবীতে ভালো কাজে বা সৎকাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। যারা মন্দ বা পাপী তাদের নিকট সৎকাজ সব সময়েই ঘৃণার বিষয়বস্তু। সৎকাজের নামে তাদের অন্তরে বিতৃষ্ণার উদ্রেক হবে। তারা তখনই উল্লসিত হবে, যখন তাদের আরধ্য কাজগুলির জন্য আহ্বান করা হবে। এই আরধ্য কাজগুলিই তাদের দেবতা স্বরূপ। এগুলি বিভিন্ন ধরণের হতে পারে যেমন : ব্যক্তিগত স্বার্থ বা পূর্বপুরুষদের মিথ্যা সংস্কার এবং বহুবিধ বস্তু যা আল্লাহ্র আইন বা হুকুমের বিরোধিতা করে থাকে।
শিক্ষণীয় বিষয় : যান্ত্রিকভাবে নামাজ পড়া ও রোজা করার মাধ্যমে কাউকে ধার্মিকরূপে পরিগণিত করা যায় না। প্রত্যেককে বিচার করতে হবে তার কাজের দ্বারা। যে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সৎকাজ করে সেই ধার্মিক।
৪৩১৪। জীবন, মৃত্যু ,ইহকাল -পরকাল , আধ্যাত্মিক জীবন , সবই আমাদের নিকট প্রহেলিকাময়। আমরা জানি না কেন আমাদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন সৃষ্টি স্রষ্টার কোন উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য। এই নশ্বর দেহকে জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবন একদিন শেষ হয়ে যায়। বৈচিত্রে ভরা এই জীবন , সময়ের বিশাল ব্যাপ্তিতে বুদবুদের ন্যায় চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। তার শেষ পরিণতি কি ? তার সঠিক চিত্র অনুধাবন করা এই পৃথিবীর জীবনে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে বৃথা বাদানুবাদ বা যুক্তিতর্ক অর্থহীন। কারণ মৃত্যুর পরপারের জীবনকে আল্লাহ্ আমাদের জন্য আড়াল করে রেখেছেন। মৃত্যুর দুয়ার অতিক্রম না করে তা দৃষ্টিগোচর হওয়া সম্ভব নয়। মৃত্যুর কালো পর্দ্দাকে কেহই অতিক্রম করতে পারবে না পৃথিবীতে অবস্থান করে। সে চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। আমাদের জন্য যা করণীয় তার সঠিক পথ নির্দ্দেশ করা হয়েছে এই আয়াতে। একান্ত আন্তরিক ভাবে, বিনয়ের সাথে আমরা আল্লাহ্র নিকট আমাদের বিশ্বাসে পরিশুদ্ধ আত্মাকে নিবেদন করতে পারি। এ বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে পোষণ করতে হবে যে আজ আমাদের নিকট যা অস্পষ্ট ,পরলোকে তা আমাদের নিকট সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পাবে। আল্লাহ্র কাছে সর্বদা প্রার্থনা করতে হবে তার পথনির্দ্দেশকে যেনো আমরা অন্তরের মাঝে উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর করুণা ও দয়া ভিক্ষা করতে হবে অবনত চিত্তে।
৪৩১৫। দেখুন আয়াত [ ১৩ : ১৮ ]। যারা এই পৃথিবীতে আল্লাহ্র বাণীকে অস্বীকার করে মৃত্যুর পরপারে যেয়ে তারা উপলব্ধি করতে পারবে সত্যকে প্রত্যাখান করার প্রতিফল। সেদিন তারা সত্যকে গ্রহণ করে পূণ্যাত্মারূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সকল সম্পদ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু তখন তা বহু দেরী হয়ে যাবে। তবে কেন এখনই তারা সাবধান হচ্ছে না এবং আল্লাহ্র পথ নির্দ্দেশকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করছে না ?
৪৩১৬। " এমন সব বিষয় " - হচ্ছে এমন ঘটনা যা অবিশ্বাসীরা পৃথিবীতে কল্পনাও করতে অক্ষম। পার্থিব জীবনে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। বেহেশতের সুখ ও শান্তি যেরূপ পূণ্যাত্মাদের কল্পনাকে অতিক্রম করে যাবে, ঠিক সেরূপ পরলোকের দোযখের যন্ত্রণা পাপীরা এ পৃথিবীতে বসে কল্পনাও করতে পারবে না। দেখুন পরবর্তী টিকা।
৪৩১৭। যে ব্যাপারে অবিশ্বাসীরা সর্বদা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো মৃত্যু পরপারের জীবনে তাদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে অপমানকর ভাবে বেঁধে ফেলবে। সেদিন তাদের বোধদয় ঘটবে যে তারা যার অনুসরণ করেছে তা ছিলো শুধুমাত্র মিথ্যা গর্ব ও অহংকার।
৪৩১৮। দেখুন [৩০ : ৩৩ ] আয়াত ও টিকা ৩৫৪৫।
৪৩১৯। দেখুন আয়াত [ ৩৯ : ৮ ]।
৪৩২০। দেখুন [২৮ : ৭৮ ] ও টিকা ৩৪০৮। পার্থিব সমৃদ্ধি নাম-যশঃ ,প্রভাব -প্রতিপত্তি , খ্যাতি ,প্রতিভা সব কিছুই আল্লাহ্র তরফ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ ঠিক যেরূপ দুঃখ , দুর্দ্দশা , বিপদ -বিপর্যয় ইত্যাদি। যারা আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহে ধন্য তাদের সে বিষয়ে দায় দায়িত্ব থাকে; জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। আবার বিপদ বিপর্যয়ে ধৈর্য্য ও আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার পরীক্ষা করা হয়।
৪৩২১। দেখুন [ ১৬ : ৩৪ ]।
৪৩২২। যুগ যুগ ধরে অবিশ্বাসীদের কাহিনী একই রয়ে গেছে।তারা সত্যকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে, সত্যকে প্রতিহত করে, নির্যাতন করে, ধ্বংস করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে অসমর্থ হয়। আল্লাহ্র পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবেই। শুধুমাত্র সত্যের যারা শত্রু তারাই তাদের মন্দ কর্মের ফল লাভ করবে। রাসুলের [ সা ] জীবনে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে এই সত্যের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। রাসুলের [সা ] সময়ে আরবে যা ঘটেছিলো - সেই একই ঘটনার বার বার পুণরাবৃত্তি ঘটেছে অতীতে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। পৃথিবীতে কোনও সৎ কাজ বিপদ-বাঁধা ব্যতীত অতিক্রম করতে পারে নাই। আমাদের চারিদিকেই এরূপ বহু উদাহরণ দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য ও সৎ কাজ জয় লাভ করে ও স্থায়ীত্ব পায়।
৪৩২৩। দেখুন [ ২৮ : ৮২ ] আয়াত। আল্লাহ্র অনুগ্রহ সবার জন্য সমভাবে বন্টিত হয় না। তাই যদি হতো তবে পৃথিবীতে আদম সন্তানের জন্যে পরীক্ষার স্থল বলে পরিগণিত হতো না। পৃথিবীতে মেধা, মননশক্তি , সম্পদ ,প্রতিভা , ক্ষমতা ও শক্তি ,প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ সমূহ সকলে সমভাবে লাভ করে না। আল্লাহ্ এ সব মানব সন্তানের মাঝে বণ্টন করে থাকেন তাঁর দূরদৃষ্টি ও জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী যেনো তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে ; যেনো আল্লাহ্র কল্যাণ হস্ত সকল কিছুকে স্পর্শ করে থাকে। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে যাদের আল্লাহ্ বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেছেন তাদের সেই নেয়ামতের দায়িত্ব বহন করতে হবে। সেই নেয়ামতকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী আল্লাহ্র রাস্তায় খরচ করতে হবে। পরলোকে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুতারাং কেউ যেনো প্রাচুর্যে অহংকারী না হয় , আবার মন্দ অবস্থাতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ না করে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্র বৃহত্তর পরিকল্পনার এক ক্ষুদ্র অংশ আমরা বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে অতিবাহিত করে চলেছি -অনন্তের পানে। এই ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা শুধু আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহ অবলোকন করে থাকি। পৃথিবীর অগ্রযাত্রার সামগ্রিক পরিকল্পনা দেখার ক্ষমতা আমাদের নাই। এখানে 'রিযিক' শব্দটি দ্বারা উপরে বর্ণিত আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামত সমূহকে বুঝানো হয়েছে যার ব্যবহার মানুষ পার্থিব সম্পদ লাভে সমর্থ হয়।
সূরা যুমার
সূরা যুমার বা জনতা - ৩৯
৭৫ আয়াত , ৮ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : সূরা নং ৩৪ থেকে যে ছয়টি সূরার একটি শ্রেণীগুচ্ছ শুরু হয়েছিলো, তা এই [৩৯ নং সূরা ] সূরাটির মাধ্যমে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শ্রেণীগুচ্ছের সূরাগুলির বিষয়বস্তু আধ্যাত্মিক জগত এবং Ma'ad বা শেষ বিচারের দিন। দেখুন সূরাগুচ্ছের প্রথম সূরা ৩৪ নং সূরার ভূমিকা।
এই সূরাটির বিষয় বস্তু হচ্ছে : সৃষ্টির বৈচিত্র সত্বেও সৃষ্টির সকল বিষয়বস্তু বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এ সকল বস্তুকে, বৈচিত্র সত্বেও সকলকেই আল্লাহ্ প্রতিপালন করে থাকেন। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ ভালোকে মন্দ থেকে আলাদা করে নেবেন। 'Zumar' শব্দটি ৭১ এবং ৭৩ নং আয়াতে আছে।
এই সূরাটি মক্কান সূরা।
সার সংক্ষেপঃ যদিও সৃষ্টির মাঝে বহু বৈচিত্র বিদ্যমান, কিন্তু তবুও তা সবই একই সুত্রে গ্রথিত যা এক স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে। আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সকল উপাসনার যোগ্য এবং ন্যায় এবং করুণার আঁধার তিনিই। [ ৩৯ : ১- ২১ ]
সকল প্রত্যাদেশে আল্লাহ্র একত্ব প্রকাশ পায়। একমাত্র আল্লাহ্-ই মানুষকে পথ প্রদর্শন করতে পারেন। একমাত্র তাঁরই এবাদত কর আর সবই মিথ্যা। [ ৩৯ : ২২-৫২ ]
আল্লাহ্র করুণা সৃষ্টির সকল কিছুকে পরিবৃত্ত করে থাকে। হতাশ হওয়ার কারণ নাই। বেশী দেরী হওয়ার পূর্বেই তাঁর করুণা ভিক্ষা কর। অবশ্য প্রত্যেককেই আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
[ ৩৯ : ৫৩-৭৫ ]
সূরা যুমার বা জনতা - ৩৯
৭৫ আয়াত , ৮ রুকু , মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
০১। এই প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহ্র নিকট থেকে , ৪২৪২ [ যিনি ] ক্ষমতায় পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাতে পরিপূর্ণ।
৪২৪২। প্রত্যাদেশের সাথে আল্লাহ্র দুটি গুণাবলীর উল্লেখ এই আয়াতে করা হয়েছে :
১) আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান , পরাক্রমশালী। সকল বাঁধা সত্বেও তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবেই।
২) তিনি অসীম জ্ঞানের আঁধার ও প্রজ্ঞাময়।
যারা জিজ্ঞাসা করে যে আল্লাহ্ কিভাবে তাঁর বাণী পৃথিবীতে প্রেরণ করেন ? তাদের প্রশ্নের উত্তর আছে ১নং এর বক্তব্যে এবং ২নং বক্তব্য ব্যাখ্যা করে যে প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করা সম্ভব , আল্লাহ্ যা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন তার অনুসরণ দ্বারা।
০২। আমিই তোমার নিকট সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি। সুতারাং একান্ত অনুগতভাবে তার এবাদত কর।
০৩। একান্ত আনুগত্য কি আল্লাহ্র প্রাপ্য নয় ? ৪২৪৩ কিন্তু যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে রক্ষাকর্তা রূপে গ্রহণ করে [ তারা বলে ] : " আমরা তো তাদের পূঁজা করি কেবলমাত্র এজন্য যে, তারা হয়তো আমাদের আল্লাহ্র সান্নিধ্যে নিয়ে আসবে।" ৪২৪৪। ওরা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে সত্যিই আল্লাহ্ তার বিচার মীমাংসা করে দেবেন। কিন্তু যারা মিথ্যাবাদী ও অকৃতজ্ঞ আল্লাহ্ তাদের পথ প্রদর্শন করেন না। ৪২৪৫।
০৩। একান্ত আনুগত্য কি আল্লাহ্র প্রাপ্য নয় ? ৪২৪৩ কিন্তু যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে রক্ষাকর্তা রূপে গ্রহণ করে [ তারা বলে ] : " আমরা তো তাদের পূঁজা করি কেবলমাত্র এজন্য যে, তারা হয়তো আমাদের আল্লাহ্র সান্নিধ্যে নিয়ে আসবে।" ৪২৪৪। ওরা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে সত্যিই আল্লাহ্ তার বিচার মীমাংসা করে দেবেন। কিন্তু যারা মিথ্যাবাদী ও অকৃতজ্ঞ আল্লাহ্ তাদের পথ প্রদর্শন করেন না। ৪২৪৫।
৪২৪৩। বিশ্ব ভূবনের সর্বত্র স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুন্য ছড়িয়ে আছে। সকালের ঝড়ে পড়া শিউলীফুলের পেলবতা থেকে সুউচ্চ পর্বতমালার কাঠিন্য গাম্ভীর্য সর্ব স্থানে স্রষ্টার হাতের স্পর্শ বিদ্যমান। বিশ্বভূবনের সকলেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি ; তাই পৃথিবীর সকলেই বিজ্ঞানের একই সুত্রের আওতাধীন। সূদূর মঙ্গলে জড় পদার্থের যে ধর্ম ,এই মাটির পৃথিবীর জড় পদার্থের একই ধর্ম। জীব জগতেরও জৈবিক ধর্ম সকল প্রাণীর মাঝে এক। স্রষ্টা এক ও অদ্বিতীয় - এ সত্যকেই প্রত্যক্ষ করা যায় সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণের দ্বারা। বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্-ই একমাত্র উপাসনার যোগ্য। আর সে উপাসনা হতে হবে একান্ত আন্তরিক।
৪২৪৪। মানুষ জ্ঞানতঃ বা অজ্ঞানত বশতঃ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্যের উপাসনা করে থাকে। এ সবের মধ্যে পীর পূঁজা ও মাজার পূঁজা অন্যতম। এদের বক্তব্য হচ্ছে যে, তারা নিরাকার আল্লাহ্র নিকট পৌঁছানোর জন্য এসব মাধ্যমের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। তাহলে খৃষ্টান ও ইহুদীদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কোথায়?
আবার আর একদল আছে যারা জাগতিক বিষয়বস্তুকে জীবনের চরম ও পরম পাওয়া বলে সাব্যস্ত করে। এরা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবী করে। এদের কেউ সম্পদের , কেউ বিজ্ঞানের , কেউ শিল্পকলার , আবার কেউ নিজস্ব স্বার্থের চিন্তায় দিবারাত্র বিভোর থাকে। তারা দাবী করে যে এগুলির মাধ্যমে তারা আত্মোন্নতি করার ক্ষমতা রাখে এবং জীবনের সর্বশেষ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম।এবং এরই মাধ্যমে তারা স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার আশা রাখে। এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, এরা সকলেই ভুল পথে আল্লাহ্র অন্বেষণ করছে। কোনও মাধ্যম নয়, মানুষের চিন্তার জগত, মনোজগত, আধ্যাত্মিক জগত শুধুমাত্র স্রষ্টার চিন্তায় আপ্লুত থাকলেই স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।
৪২৪৫। আল্লাহ্র প্রকৃত উপাসনা ত্যাগ করে, সঠিক পথকে পরিহার করে, মানুষ যখন মিথ্যা উপাস্যের উপাসনায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে , তখন তাদের মাঝে সীমাহীন বিভেদের ও দলের সৃষ্টি হয়। এ সব ফয়সালার মালিক একমাত্র আল্লাহ্। কিন্তু কেউ যদি সত্যকে পরিহার করে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আল্লাহ্র প্রতি করণীয় কর্তব্য ও আল্লাহ্র কাজে অনীহা প্রকাশ করে, আল্লাহ্র প্রতি প্রতিদিনের এই জীবনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলে যায় , তাহলে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্ প্রদর্শিত পথকে ত্যাগ করে। এরাই তারা যারা মিথ্যাবাদী ও কাফের, আল্লাহ্ তাদের হেদায়েত করেন না।
০৪। যদি আল্লাহ্ পুত্র গ্রহণ করতে চাইতেন , তবে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা বেছে নিতে পারতেন ৪২৪৬। কিন্তু তিনি মহিমান্বিত। [ তিনি এ সবের উর্দ্ধে ]। তিনি আল্লাহ্, এক অদ্বিতীয় , অপ্রতিরোধ্য।
৪২৪৬। আল্লাহ্র সন্তান রয়েছে এ কথা চিন্তা করাও পাপ এবং ঈশ্বর নিন্দা। যদি সত্যিই আল্লাহ্ সন্তান গ্রহণ করতেন তবে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর একজন স্ত্রী বিদ্যমান থাকতো [৬ : ১০১ ] ,এবং তাঁর পুত্র তাঁরই মত গুণসম্পন্ন হতো। কিন্তু সূরা [ ১১২ : ৪ ] আয়াতে বলা হয়েছে, " তাহার সমতুল্য কেহ নাই।" সন্তান জন্ম দান করা একটি জৈব প্রক্রিয়া যা প্রাণী জগতে বিদ্যমান , যা একটি যৌন প্রক্রিয়া। আল্লাহ্র সম্বন্ধে এরূপ চিন্তা বা ধারণা কিভাবে করা সম্ভব , যেখানে আল্লাহ্র অস্তিত্ব বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর উর্দ্ধে। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কোনও সাহায্যকারীর প্রয়োজন নাই - তিনি সর্বশক্তিমান। যদি সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতো , তবে তার জন্য তাকে প্রাণীজগতের যৌন প্রক্রিয়ার মত নিম্নস্তরে নামার প্রয়োজন ছিলো না। আল্লাহ্ এসবের বহু উর্দ্ধে ,তিনি মহান ও পবিত্র। নিরাকার আল্লাহ্র একত্ব আত্মার মাঝে অনুভব করা , উপলব্ধি করা যে তিনি এক ও অদ্বিতীয়, এই-ই হচ্ছে ঈমানের প্রথম ধাপ। তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং সর্বশক্তিমান। তাঁর কোনও সাহায্যকারীর প্রয়োজন নাই।
০৫। তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে ৪২৪৭। তিনি রাত্রি দ্বারা দিনের প্রান্তদেশকে আচ্ছাদিত করেন এবং দিন দ্বারা রাত্রির প্রান্তকোনকে আচ্ছাদিত করেন। তিনি সূর্য এবং চন্দ্রকে করেছেন [ তার আইনের ] নিয়মাধীন। প্রত্যেকেই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত একটি গতিপথ অনুসরণ করছে। তিনি কি ক্ষমতায় মহাপরাক্রমশালী নন যিনি বারে বারে ক্ষমা করেন ? ৪২৪৮
৪২৪৭। দেখুন সূরা [ ৬ : ৭৩ ] আয়াত ও টিকা ৪৯৬।
৪২৪৮। আল্লাহ্র করুণা ও দয়া তাঁর ক্ষমতার মতই অসীম। তাঁর সমকক্ষ কেহ নাই।
০৬। তিনি তোমাদের [ সকলকে ] সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে ৪২৪৯ ; অতঃপর তিনি একই প্রকৃতি বিশিষ্ট তার সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য জোড়ায় জোড়ায় [ নর-মাদী] আটটি গৃহপালিত পশু প্রেরণ করেছেন ৪২৫০। তিনি তোমাদের মায়ের গর্ভে সৃষ্টি করেছেন একের পরে এক বিভিন্ন ধাপে ৪২৫১; অন্ধকারের তিনটি আবরণের মধ্যে ৪২৫২। ইনিই আল্লাহ্ , তোমাদের প্রভু এবং প্রতিপালক। [ সকল ] রাজত্ব তারই অধীনে। তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তাহলে কি ভাবে তোমরা [ তোমাদের প্রকৃত কেন্দ্রবিন্দু থেকে ] মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ ? ৪২৫৩
৪২৪৯। দেখুন সূরা [ ৪ : ১ ] ও টিকা ৫০৪।
৪২৫০। দেখুন সূরা [ ৬ : ১৪৩ - ৪৪ ] আয়াতে আরবদের কুসংস্কারের উল্লেখ আছে উল্লেখিত চার ধরণের পশুদের জোড়া সম্বন্ধে। পূর্বের ঐ আয়াতে এই চার জোড়া পশুদের সম্বন্ধে কুসংস্কারের নিন্দা করা হয়েছে। সেই চার জোড়া গৃহপালিত পশুর উল্লেখ করা হয়েছে এখানে ; যাদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য। এগুলি হলো ; ভেড়া, ছাগল,উট ও গরু। আরবদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ঘোড়াকে তারা গৃহপালিত পশু হিসেবে পরিগণিত করে না।
আল্লাহ্র অসীম করুণা যে, আল্লাহ্ মানুষকে পশুদের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন দেখুন [৩৬ : ৭১- ৭৩ ]।
৪২৫১। "ত্রিবিধ অন্ধকার " শিশু মাতৃগর্ভে ত্রিবিধ পর্দ্দায় আচ্ছাদিত থাকে ; ঝিল্লির আচ্ছাদন ,জরায়ু ও মাতৃজঠর।
৪২৫২। দেখুন সূরা [ ২২ : ৫ ] আয়াতে, যেখানে মানুষ সৃষ্টির বিভিন্ন ধাপগুলিকে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র সৃষ্টি নৈপুন্যের এবং সদয় প্রতিপালকের নিদর্শন স্বরূপ।
৪২৫৩। এ কথা সত্য যে, মানুষের জীবনোপকরণ, শারীরিক বৃদ্ধি ও অস্তিত্বের জন্য সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্র করুণার উপরে নির্ভরশীল। সুতারাং সেই মানুষ কিভাবে আল্লাহ্র প্রতি বিমুখ হয়?
০৭। যদি তোমরা [আল্লাহকে ] প্রত্যাখান কর , প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্র তোমাদেরকে প্রয়োজন নাই। কিন্তু তিনি তাঁর বান্দার নিকট থেকে অকৃতজ্ঞতা পছন্দ করেন না ৪২৫৪। যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তবে তিনি তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। একের [ পাপের ] বোঝা অন্যে বহন করবে না ৪২৫৫। সবশেষে তোমাদের প্রভুর নিকট হবে তোমাদের প্রত্যাবর্তন , যখন তিনি তোমরা [ পৃথিবীর জীবনে ] যা করতে , তার [ প্রকৃত ] সত্যতা তোমাদের জানিয়ে দেবেন ; [ মানুষের] অন্তরে যা আছে নিশ্চয়ই তিনি তা ভালোভাবে জানেন।
৪২৫৪। আল্লাহ্ অভাবমুক্ত। সুতারাং মানুষের অকৃতজ্ঞতা আল্লাহ্র কোনও ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ্ মানুষের মঙ্গল কামনা করেন। সে কারণে মানুষের আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আল্লাহ্ পছন্দ করেন এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা আল্লাহ্র করুণা অর্জন ও যোগ্যতা অর্জন করার উপায়।
। সে কারণে দেখা যায় কৃতজ্ঞ ব্যক্তির চিত্ত প্রশান্তিতে ভরপুর থাকে। অপরপক্ষে অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির অন্তরে অশান্তির দাবনলে ভরে যায় কারণ তারা আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত।
উপদেশ : কৃতজ্ঞতা গুণটির কথা কোরাণ শরীফে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে ,কারণ কৃতজ্ঞ অন্তর আল্লাহ্র রহমত প্রাপ্ত প্রশান্তিতে ভরা। অপরপক্ষে তার মত হতভাগ্য কে আছে ,যার অন্তর হাহাকার ভরা। অকৃতজ্ঞ অন্তরে না পাওয়ার দাবানলে দোযখের অগ্নি সৃষ্টি করে।
৪২৫৫। দেখুন অনুরূপ সূরা [ ৬ : ১৬৪ ] আয়াত। প্রতিটি মানুষকেই তার কর্মের হিসাব তার প্রতিপালকের নিকট দান করতে হবে। কেউই কারও কৃতকর্মের বোঝা বহন করবে না। ইসলামে কোনও প্রতিনিধিত্ব নাই। সকলেই স্ব-স্ব কর্মের জন্য দায়ী। সেখানে কোনও মধ্যস্থতার অবসর নাই। মৃত্যুর পরে প্রত্যেককে আল্লাহ্র নিকট নীত করা হবে। সেখানে প্রত্যেকের যাবতীয় কর্ম যা সে পৃথিবীতে করেছে, সব সংরক্ষিত থাকবে। এমনকি মনের অগোচরে যে চিন্তা ভাবনা, নিয়ত সবই আল্লাহ্র নিকট নীত হবে। আল্লাহ্ প্রত্যেককে তার কর্মফল অবগত করাবেন - তাঁর নিকট কোনও কিছুই গোপন থাকে না।
০৮। যখন কোন বির্পযয় মানুষকে স্পর্শ করে ৪২৫৬ তখন সে একনিষ্ঠভাবে অনুতপ্ত হৃদয়ে তার প্রভুকে আহ্বান করে। কিন্তু যখন তিনি তার প্রতি অনুগ্রহ দান করেন , তখন পূর্বে যে জন্য তাঁর নিকট কাঁদাকাটি করেছিলো এবং প্রার্থনা করেছিলো [ মানুষ ] তা ভুলে যায়। এবং সে আল্লাহ্র প্রতিন্দ্বন্দী দাঁড় করায়। এভাবেই সে অন্যকে আল্লাহ্র রাস্তা থেকে বিপথগামী করে। বল : " কুফরীর জীবন ক্ষণকাল উপভোগ কর। বস্তুত তুমি জাহান্নামীদের অন্যতম।" ৪২৫৭
৪২৫৬। দেখুন সূরা [ ১০ : ১২ ] আয়াত। মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ জীব, যখন দুঃখ , বিপর্যয়ের অমানিশা তার সর্বসত্তাকে গ্রাসে উদ্যোক্ত হয় ,তখন নিরূপায় মানুষ ঐকান্তিক ভাবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করে। কিন্তু যে মূহুর্তে আল্লাহ্ তাকে অনুগ্রহ করেন সে আল্লাহকে বিস্মৃত হয়। সে অনুধাবনে অক্ষম হয় জীবনের সেই শিক্ষা যা আল্লাহ্ তাকে বিপদ বিপর্যয়ের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। ফলে সে আল্লাহকে ভুলে যায়। ভুলে যায় বিপদ বিপর্যয় দূর করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্র হাতে। ফলে সে আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কিছুকে তার ত্রাণকর্তারূপে অভিহিত করে। সেগুলি বিশেষতঃ নিম্নরূপ : নিজস্ব কৃতিত্ব অথবা মাজার, তাবিজ, কবজ অথবা প্রাকৃতিক শক্তি অথবা পীরবাবা যাকে সে আল্লাহ্র ন্যায় শক্তিশালী মনে করে। এ কথা সে ভুলে যায় যে, সকল শক্তির উৎস আল্লাহ্। আল্লাহ্র শক্তির সাথে অন্য যে কোনও কিছুর অংশীদারিত্ব মহাপাপ। এই পাপ শুধু যে তারই ক্ষতি করে তাই নয় , লক্ষ লক্ষ অজ্ঞ লোক তার দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়। যার ফলে দেখা যায় ভন্ডপীরের প্রভাব ও প্রতিপত্তি।
৪২৫৭। দেখা যায় যারা পাপ করে এবং অন্যকে পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করে তাদের পার্থিব জীবন হয় অর্থসম্পদে, খ্যাতি ও যশে সমৃদ্ধ। তাদের এই সফলতা খুবই ক্ষণস্থায়ী।কারণ পৃথিবীর জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত জীবন। তাদের পাপ তাদের পরলোকের জীবনে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে।
০৯। যে ব্যক্তি রাত্রির বিভিন্ন যামে সিজ্দাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে ৪২৫৮ যে পরলোককে ভয় করে , এবং যার আশা- আকাঙ্খা তার প্রভুর অনুগ্রহের উপরে নির্ভরশীল [ সে কি তার সমান যে নির্ভর করে না ] ? বল : " যারা জানে এবং যারা জানে না , তারা উভয়েই কি সমান ? বোধশক্তি সম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে ৪২৫৯।"
৪২৫৮। দেখুন আয়াত [ ৩ : ১১৩ - ১১৭ ]। পার্থিব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত বিনয়ের সাথে ভক্তিভরে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। মোমেন বান্দাদের জন্য পরলোকের জীবনের জন্য পার্থিব জীবন। পরলোকের অনন্ত জীবনই তাদের নিকট প্রকৃত সত্য। সেই জীবনের জন্য মোমেন বান্দারা ইহকালে প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকেন। তাঁদের মূলধন হচ্ছে আল্লাহ্র করুণা ও দয়ার প্রত্যাশা। সে কারণে তারা হয় সিজ্দায় অবনত , বিনয়ী ও অনুগত। পার্থিব অহংকার বা দম্ভকে তারা ত্যাগ করে। এরাই হচ্ছেন সেই বান্দা যারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভ করেন, ফলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্ম লাভ ঘটে এবং তারা উৎসাহ ও তৎপরতার সাথে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে গ্রহণ করে থাকেন। যারা অবিশ্বাসী কাফের তারা এসব মোমেন বান্দাদের সাথে তুলনা যোগ্য বলে আল্লাহ্র চোখে বিবেচিত নয়।
৪২৫৯। দেখুন সূরা [ ৩ :১৯ ] আয়াত , যেখানে মোমেন বান্দা ও কাফেরদের তুলনা করা হয়েছে।
রুকু - ২
১০। বল, " হে আমার বিশ্বাসী বান্দারা , তোমার প্রভুকে ভয় কর। যারা এই পৃথিবীতে কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য আছে কল্যাণকর [ পুরষ্কার ] ৪২৬০। আল্লাহ্র পৃথিবী প্রশস্ত ৪২৬১। যারা ধৈর্যের সাথে অধ্যাবসায়ী হয়, তারা সত্যিই সীমাহীন পুরষ্কার লাভ করবে।"
৪২৬০। আল্লাহ্ ভীতি বা তাক্ওয়া সম্বন্ধে বলা হয়েছে সূরা [ ২ : ২ ] আয়াতে এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছে টিকা নং ২৬। আরও দেখুন সূরা [ ২৩ : ৬০ ] আয়াত ও টিকা ২৯১২। এই আল্লাহ্ ভীতির উৎপত্তি হচ্ছে অন্তরের অকুণ্ঠ ভালোবাসা যার অর্থ হচ্ছে তাঁদের অন্তরে একটাই ভয় বিরাজ করে যে, তারা যেনো আল্লাহ্র ভালোবাসা থেকে বিচ্যুত না হন। আল্লাহ্কে তারা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার জনের ভালোবাসা হারানো ও অসন্তুষ্টির ভয়েই তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকেন।
৪২৬১। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২৯ : ৫৬ ] ও টিকা ৩৪৮৯। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উপায় এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। ১) আল্লাহ্কে ভয় করা ও ২) কল্যাণকর কাজ করা। সমাজের কল্যাণের জন্য , সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য কাজ সব সময়ে খুব সহজ হয় না। কিন্তু যা কল্যাণকর তা করে যাওয়ার নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে। এ আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় যে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করতে অক্ষম হয়েছি; বা আমাদের নিষ্ক্রীয়তা বা পাপের আসক্তি সমাজের অস্থিরতার ফল। এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থা আল্লাহ্র হুকুম অনুযায়ী কল্যাণকর কাজের অনুপযুক্ত হয় তবে আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হবে প্রয়োজনে স্বদেশ জন্মভূমি ত্যাগ করে হিজরত করতে হবে যেখানে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের মর্যদা রাখা সম্ভব। আল্লাহ্র পৃথিবী প্রশস্ত। "
১১। বল, " অবশ্যই আমাকে আদেশ করা হয়েছে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র এবাদত করার জন্য;
১২। "এবং আমাকে আদেশ করা হয়েছে আমি যেনো আত্মসমর্পনকারীদের মধ্যে প্রথম হই ৪২৬২।"
১২। "এবং আমাকে আদেশ করা হয়েছে আমি যেনো আত্মসমর্পনকারীদের মধ্যে প্রথম হই ৪২৬২।"
৪২৬২। দেখুন সূরা [ ৬ : ১৪ ] আয়াত। "প্রথম হই" - অর্থাৎ যারা উৎসাহ , উদ্দীপনা এবং ধর্মের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে সর্বাগ্রে এগিয়ে প্রথম সারিতে থাকেন।
১৩। বল, " যদি আমি আমার প্রভুকে অমান্য করি ,তবে নিশ্চয় আমি মহাদিনের শাস্তির ভয় করি ৪২৬৩।"
৪২৬৩। দেখুন সূরা [ ৬ : ২৫ ] আয়াত। আধ্যাত্মিক জগতে সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি হচ্ছে আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি। এর বিপরীত হচ্ছে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করা , যার পরিণতি হচ্ছে আত্মার মাঝে স্রষ্টার সান্নিধ্য অনুভব করা , আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ অর্জন করা। আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত আত্মায় আল্লাহ্র নূর প্রবেশে বাঁধা পায় ফলে সে হয় অন্ধকারে নিমজ্জিত যার শেষ পরিণতি দোযখের আগুন।
১৪। বল, " একনিষ্ঠ আনুগত্যে আমি শুধু আল্লাহ্রই ইবাদত করি ;
১৫। "আর তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যাকে ইচ্ছা তাকে এবাদত কর।" ৪২৬৪। বলঃ " শেষ বিচারের দিনে তারাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ যারা নিজের আত্মার এবং তাদের পরিজনবর্গের ক্ষতি করে ৪২৬৫। আঃ ! সেটাই হবে [ প্রকৃত এবং ] সুস্পষ্ট ক্ষতি।"
১৫। "আর তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যাকে ইচ্ছা তাকে এবাদত কর।" ৪২৬৪। বলঃ " শেষ বিচারের দিনে তারাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ যারা নিজের আত্মার এবং তাদের পরিজনবর্গের ক্ষতি করে ৪২৬৫। আঃ ! সেটাই হবে [ প্রকৃত এবং ] সুস্পষ্ট ক্ষতি।"
৪২৬৪। "যাকে ইচ্ছা এবাদত কর " - এই লাইনটি দ্বারা আদেশ বা অনুমতি বোঝানো হয় নাই। এই লাইনটি ভৎর্সনা ছলে বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তাঁর নবীকে সম্বোধন করে যা বলেছেন তা সহজতর ভাবে প্রকাশ করলে নিম্নরূপ হয়। নবী বলছেন, " যাই ঘটুক না কেন আমি আল্লাহ্র হুকুম মান্য করে চলবো। তিনি আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন। আমি জানি তিনি এক ও অদ্বিতীয় , সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশীল। একমাত্র আল্লাহ্ই এবাদতের যোগ্য। এমন কি কেউ অজ্ঞ আছে যে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত করে? তবে সে তা করুক এবং দেখুক তার শেষ পরিণতি কি ঘটে। ক্ষতি তারই ব্যক্তিগত। কারণ একমাত্র সেই আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হবে। ফলে সে পাপের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। "
৪২৬৫। পাপের পথ বড়ই পিচ্ছিল। এর শুরু হয় স্রষ্টা ব্যতীত অন্য উপাস্যের উপাসনার মাধ্যমে। কারণ চারিত্রিক গুণাবলীর উন্মেষ ঘটে স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পনের মাধ্যমে। স্রষ্টাকে না মানার প্রবণতা মানবকে ধীরে ধীরে পাপের পথে পরিচালিত করে। পাপে আসক্ত ব্যক্তির চারিত্রিক সকল গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়। এমন কি তার চরিত্র থেকে পরিবার পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব সকলের জন্য ভালোবাসার বন্ধন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। যে সব গুণাবলী মানুষকে স্রষ্টার সান্নিধ্যে পৌঁছানোর যোগ্যতা দান করে থাকে, পাপে আসক্তির ফলে সে সব গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়। পাপের অতল, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। "যারা নিজের আত্মার ও তাদের পরিবারবর্গের ক্ষতি সাধন করে।"
১৬। তাদের উপরে থাকবে স্তরে, স্তরে আগুন এবং নীচে থাকবে [ আগুনের ] স্তর ৪২৬৬। এর দ্বারা আল্লাহ্ তার বান্দাদের সর্তক করে থাকেন ৪২৬৭; " হে আমার বান্দারা। আমাকেই ভয় কর। "
৪২৬৬। শেষ বিচারের পাপের শাস্তিকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। শাস্তিকে বর্ণনা করা হয়েছে আচ্ছাদন বা পোষাকের ন্যায় যা সর্বঅঙ্গকে আচ্ছাদিত করে থাকবে - উর্দ্ধোদিক এবং নিম্নদিকে। যদিও আগুন তাদের ঘিরে থাকবে , কিন্তু পাপের অন্ধকার তাদের আত্মার মাঝে যন্ত্রণার সৃষ্টি করবে।
৪২৬৭। পরলোকের বিপদ সম্বন্ধে আল্লাহ্ বারে বারে তাঁর বান্দাদের সর্তক করেছেন। আদম সন্তানকে তিনি সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন সত্য তবে এই ইচ্ছাশক্তির সঠিক ব্যবহারের জন্যও বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছেন। আদম সন্তানের সাহায্যের জন্য যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন। সঠিক পথে না চললে তার পরিণতির কথা পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করেছেন। যারা যুক্তিবাদী তাদের যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তার নিকট আবেদন করা হয়েছে। যারা আবেগ ও ভালোবাসার দ্বারা নিয়ন্ত্রীত হয় তাদের নিকট আল্লাহ্র ভালোবাসার মাধ্যমে আবেদন করা হয়েছে। যারা ভীতি প্রদর্শন ব্যতীত অন্য কিছুই হৃদয়ঙ্গম করে না, তাদের নিকট পাপের ভয়াবহ পরিণতির উল্লেখের মাধ্যমে আবেদন করা হয়েছে।
১৭। যারা পাপ থেকে দূরে থাকে, - এবং ইহার পূঁজাতে মগ্ন হয় না ৪২৬৮ -এবং [ অনুতাপের মাধ্যমে ] আল্লাহ্র অভিমুখী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। সুতারাং আমার বান্দাদের জন্য সুসংবাদ ঘোষণা কর;-
৪২৬৮। পাপের ফাঁদ পাতা ভূবনে ভূবনে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে। তাই কৌতুহলবশতঃ যদি কেউ তাগুতের অর্থাৎ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদতে অগ্রসর হয়, তাদের শেষ পরিণতি হয় তাগূতের দাসত্ব। যেমন দেখা যায় সংস্কৃতিবান ও প্রগতিশীল হওয়ার জন্য অনেকে নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে ফলে শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি খুব একটা সুখের হয় না। যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা এ সব থেকে দূরে থাকেন এবং একমাত্র আল্লাহ্র দাস হিসেবেই নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফলে এরাই আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করে ধন্য হয়।
১৮। যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং উহার মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে ৪২৬৯ এরাই তারা যাদের আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং যারা জ্ঞানে সমৃদ্ধ।
৪২৬৯। এই আয়াতটি সম্বন্ধে দুধরণের তফসীর দেখা যায়। ১) ' কথা' শব্দটি যদি সাধারণ অর্থে ব্যবহার হয় ,তবে আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় যে, পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরা সত্য মিথ্যা , ভালো-মন্দ নির্বিশেষে মনোযোগ সহকারে সকল কথাই শোনে, এবং তা থেকে যা সত্য ও উত্তম তারই অনুসরণ করে থাকে। ২) যদি 'কথা ' শব্দটি আল্লাহ্র 'বাণী' ধরা হয় তবে তার অর্থ দাঁড়ায় পূণ্যাত্মারা আল্লাহ্র বাণী ভক্তিসহকারে শোনে এবং তার মাঝে যা উত্তম তারই অনুসরণ করে। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা দুর্বলদের পক্ষে অবলম্বন করা সম্ভব হয় না যারা বোধ-শক্তি সম্পন্ন শুধু তারাই পারে সর্বোত্তম পন্থার অনুসরণ করতে। উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করবো : কেহ আঘাত করলে বা ক্ষতি করলে তাকে ততটুকু আঘাত বা ক্ষতি ফিরিয়ে দেয়া আল্লাহ্ আমাদের জন্য সিদ্ধ করেছেন , কিন্তু সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে পাপকে পূণ্য দ্বারা , মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করা [ ২৩ : ৯৬ ]। আমাদের উপরে আল্লাহ্র নির্দ্দেশ হচ্ছে আমরা যেনো উত্তম পন্থা অনুসরণ করতে চেষ্টা করি।
১৯। যার প্রতি শাস্তির হুকুম অবধারিত হয়ে গেছে [ সে কি তার সমান যে মন্দ থেকে বিরত থাকে ] ? ৪২৭০। যে ব্যক্তি [ জাহান্নামের ] আগুনে রয়েছে তুমি কি তাকে রক্ষা করতে পার ?
৪২৭০। পাপে যে আসক্ত , সে এরই মাঝে বিকৃত আনন্দ খুঁজে পায়। পাপ কাজকে তার চোখে শোভন মনে হয়। পাপের মাঝে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকার ফলে এ সব আত্মা আল্লাহ্র রহমত ও অনুগ্রহ ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এসব আত্মার বর্ণনা আছে সূরা [ ৬ : ২৫, ২৬, ৩৯ ] ও আরও বহু আয়াতে। ফলে তাদের পক্ষে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাদের আত্মায় আল্লাহ্র নূর প্রবেশের ক্ষমতা হারায়। এদের কথাই এই আয়াতে বলা হয়েছে।
২০। যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে , তাদের জন্য রয়েছে একের উপরে এক নির্মিত আড়ম্বরপূর্ণ প্রাসাদ ৪২৭১। তাদের নীচে প্রবাহিত হচ্ছে [ আনন্দের ] ফল্গুধারা। এটাই আল্লাহ্র অঙ্গীকার। আল্লাহ্ কখনও তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন না ৪২৭২।
৪২৭১। দেখুন সূরা [ ২৯ : ৫৮ ] আয়াত এবং [ ৩৪ : ৩৭ ] আয়াত। এই আয়াতে বেহেশতের ধারণা দান করা হয়েছে। পৃথিবীর বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বর্ণনা করা হয়েছে তা হবে ছবির মত মনোরম সুউচ্চ প্রাসাদগুলি একের উপরে একটি বিন্যস্ত , যার পাদদেশে ছোট নদী বয়ে যাবে।
৪২৭২। 'Ma'ad' অর্থ আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার সময় , স্থান ও উপায়। আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি পালিত হবেই আমাদের ধারণার থেকেও উত্তমরূপে তা পালিত হবে।
২১। তোমরা কি দেখ না আল্লাহ্ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তা পৃথিবীর বুকে ঝরণা হিসেবে প্রবাহিত হয় ? ৪২৭৩। এরপরে তিনি তার দ্বারা বিভিন্ন বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন। এর পরে তা শুকিয়ে ম্লান হয়ে যায়। ফলে তোমরা তা হলুদ বর্ণে পরিণত হতে দেখো। অবশেষে তিনি তা শুকিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করেন। অবশ্যই এর মাঝে জ্ঞানী লোকদের জন্য স্মরণীয় উপদেশ রয়েছে।
৪২৭৩। পৃথিবীতে পানিচক্রকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টির পানি ভূমি শোষণ করে উর্ব্বর হয়, নদী -নালা ভরে ওঠে ,ভূমির পানির স্তর পরিপূর্ণতা লাভ করে ও প্রবাহিত হয় নির্ঝর রূপে। ভূমিস্থ পানির প্রবাহিত ধারা নির্ঝররূপে, নদীরূপে সমুদ্রে পতিত হয় এবং সমুদ্রের পানি পুণরায় বাস্পরূপে মেঘের সৃষ্টি করে। পানি চক্রের বিবরণ আছে সূরা [ ২৫ : ৫৩ ] আয়াতে এবং টিকা ৩১১১ - ৩১১২। এই আয়াতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে পানি চক্রের পরিণতির উপরে। বৃষ্টি ভূমিকে সজীব ও উর্বর করে, ফলে বিভিন্ন ফসল ও ফল ও ফুল উৎপন্ন হয়। ফসল পরিপক্কতা লাভের পরে ঘরে ওঠে এবং গাছগুলি শুকিয়ে পশুখাদ্যে পরিণত হয়। আবার পরের বছরে ফসলের জন্য সেই একই চক্রের পুণরাবৃত্তি ঘটে। মানুষকে প্রকৃতির এই নিয়ম ও ধারার মাঝে আল্লাহ্র করুণা ও কল্যাণ স্পর্শ উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে। যারা বোধশক্তি সম্পন্ন তাদের নিকট আল্লাহকে আত্মার মাঝে উপলব্ধি করার এ এক উপায়।
উপদেশ : আল্লাহ্ নিরাকার। তাঁকে আত্মার মাঝে তখনই অনুভব করা যাবে, যখন মানুষ বিশ্ব প্রকৃতি সৃষ্টির মাঝে তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কল্যাণ স্পর্শ অনুভবে সক্ষম। সে কারণেই জ্ঞান লাভ করা মুসলমান নারী ও পুরুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
রুকু - ৩
২২। আল্লাহ্ যার বক্ষ ইসলামের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছেন ৪২৭৪ , ফলে সে আল্লাহ্র নিকট থেকে আলোকসম্পাত লাভ করেছে [ সে কি কঠিন হৃদয় থেকে উত্তম নয় ] ? দুর্ভাগ্য তাদের জন্য যাদের অন্তর আল্লাহ্র স্মরণ থেকে কঠিন হয়ে পড়েছে ৪২৭৫। উহারা স্পষ্ট [ ভুলের মাঝে ] উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়।
৪২৭৪। "বক্ষ উন্মুক্ত করা " বাক্যটি আক্ষরিক অর্থে নয়, প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। অন্তরে আল্লাহ্র নূর প্রবেশ করলে বক্ষ উন্মুক্ত হয়। যারা আল্লাহ্র বাণী অনুধাবনের চেষ্টা করে তারা অন্তরের মাঝে অনুভব করে যে, তাদের আধ্যাত্মিক চিন্তা , অনুভব ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে। সেই প্রসারিত আধ্যাত্মিক জগত ধীরে ধীরে আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে সে বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র কল্যাণ স্পর্শ , পৃথিবীর অস্থায়ী জীবনে আল্লাহ্র বাণীর মাহত্ব্য অনুভবে সক্ষম হয়। তাঁর আধ্যাত্মিক জগতের যাত্রা তখন ধাপে ধাপে নির্দ্দিষ্ট পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। আধ্যাত্মিক জগতের দ্বার তাঁর নিকট উম্মুক্ত হয়ে যায়। বক্ষ উম্মোচনের অর্থ অন্তরের প্রশস্ততা। এর উদ্দেশ্য অন্তরে এরূপ যোগ্যতা থাকা যে, আল্লাহ্র সৃষ্টিগত নির্দ্দেশাবলী ,আকাশ ও বিশ্ব প্রকৃতির উপরে চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে আল্লাহ্র অনুভব অন্তরে লাভ করতে সক্ষম হয়। একেই বলা হয়েছে " ইসলামের জন্য বক্ষ উম্মুক্ত করা।" এরূপ ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে তাদের যারা আল্লাহ্র স্মরণে পরামুখ অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র নূর হৃদয়ে প্রবেশে বাধা দান করে।
৪২৭৫। যারা আল্লাহ্র করুণা অনুসন্ধান করে তাদের জন্য যেরূপ আধ্যাত্মিক প্রগতির সুসংবাদ আছে , ঠিক তার বিপরীত অবস্থা হচ্ছে যারা আল্লাহ্র কথা স্মরণে আনে না। যারা আল্লাহ্র নূরকে আত্মার মাঝে প্রবেশে বাঁধা দেয়, তাদের আধ্যাত্মিক প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদের আত্মা ধীরে ধীরে তার কমনীয়তা ,পেলবতা ও স্বচ্ছতা হারিয়ে কঠিন রূপ ধারণ করে, ফলে তাদের আত্মায় আর আল্লাহ্র হেদায়েত বা নূর প্রবেশ লাভ করে না। এসব লোকদের চারিত্রিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে এরা বিভ্রান্ত। এরা মানসিক দিক থেকে সর্বদা দোদুল্যমান অবস্থায় অবস্থান করবে। চারিত্রিক দুর্বলতা হবে এদের নিত্য দিনের সঙ্গী। অপরপক্ষে আল্লাহ্র সান্নিধ্য ধন্য ব্যক্তিদের চারিত্রিক দৃঢ়তা হবে অনমনীয়।
২৩। [ সময়ে সময়ে ] আল্লাহ্ অপূর্ব সুন্দর উপদেশাবলী একটি বইএর আকারে প্রকাশ করেছেন যা সামঞ্জস্যপূর্ণ ৪২৭৬, [যদিও এর উপদেশের বিভিন্ন দিক নানাভাবে ] বারে বারে বলা হয়েছে ৪২৭৭। যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে, এতে তাদের শরীর কম্পিত হয় ৪২৭৮ , এবং তাদের দেহ -মন আল্লাহ্র স্মরণে বিনম্র হয়ে ঝুঁকে পড়ে। এরূপই হচ্ছে আল্লাহ্র পথ-নির্দ্দেশ। এর দ্বারা তিনি যাকে খুশী পথ-প্রদর্শন করেন ৪২৭৯। কিন্তু যাকে ত্যাগ করেন তার জন্য কোন পথ -প্রদর্শক নাই।
৪২৭৬। 'Mutashabih' শব্দটি এই আয়াতে যে অর্থে ব্যবহার হয়েছে , [৩ : ৭ ] আয়াতেও কি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ? এ ব্যাপারে টিকা নং ৩৪৭ দেখুন। বিজ্ঞ মতামত হচ্ছে এখানে সামান্য ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ ঘটেছে। 'Mathani' এই শব্দটির মূল অর্থ : একই ধর্ম বিশিষ্ট ; রূপক বা উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা ; বিভিন্ন অংশ পরস্পর সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সম্পর্কযুক্ত। শেষ অর্থটি গ্রহণ করলে পংক্তিটির অর্থ দাঁড়ায় যে, কোরাণের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে অবতীর্ণ হয়েছে ,কিন্তু সমগ্র কোরাণ এক সমন্বিত,সুসামঞ্জস্যপূর্ণ , ও সম্পর্কযুক্ত গ্রন্থ বিশেষ। এত বড় গ্রন্থের কোনও অংশে কোনও পরস্পর বিরোধিতা বা অসঙ্গতি নাই।
৪২৭৭।
৪২৭৮। শরীরের সর্ববহিঃস্থ স্তরে চর্মের অবস্থান। বাহিরের যে কোন অস্বাভাবিকতা সর্বপ্রথম চর্মের মাধ্যমে আমরা অনুভব করে থাকি। এই অনুভতির প্রথম প্রকাশ ঘটে থাকে , এভাবে : শরীর কেঁপে ওঠে এবং শরীরের লোম শিউরে ওঠে। অর্থাৎ যেকোনও অস্বাভাবিক অবস্থা প্রথমতঃ শরীরের বাহ্যিক আবরণে তা অনুভূত হয় , ঠিক সেরূপ আধ্যাত্মিক জগতেও আল্লাহ্র বাণীর প্রথম অনুভূতি হবে বাহ্যিক। যারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তারা প্রথমে সর্ব অবয়বে কম্পন অনুভব করবে। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে কম্পনের এই অনুভূতি বাহ্যিক অবয়বকে অতিক্রম করে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আত্মার মাঝে প্রবেশ লাভ করবে। আল্লাহ্র বাণীর মাহত্বে তাদের সমস্ত সত্ত্বা পেলবতা লাভ করে ফুলের ন্যায় সৌরভযুক্ত ও নরম হয়ে পড়ে এবং তাদের সমস্ত সত্ত্বার আমূল পরিবর্তন ঘটে থাকে।
৪২৭৯। "যাকে খুশী পথ প্রদর্শন করেন " এবং " যাকে ত্যাগ করেন" এই বাক্য দুটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে [ ১৬ : ৯৩ ] আয়াতে ও টিকা ২১৩৩ এবং [ ১৪ : ৪ ] আয়াতে ও টিকা ১৮৭৫।
২৪। যে ব্যক্তিকে শেষ বিচারের দিনে শাস্তির আক্রমণের প্রচন্ডতা ভয় করতে হবে [ এবং তা গ্রহণ করতে হবে] তার মুখমন্ডলে [ সে কি তার মত যে নিরাপদ ] ? ৪২৮০ পাপীদের বলা হবে , " তোমরা যা অর্জন করেছ [তার ফল ] আস্বাদন কর।" ৪২৮১
৪২৮০। পৃথিবীতে যারা কোনও দিনও তাদের কৃত পাপের জন্য অনুতাপ করে নাই, শেষ বিচারের দিন তাদের জন্য হবে ভয়াবহ। সেদিন তারা তাদের কৃত পাপের পূর্ণ প্রতিফল লাভ করবে। সেদিনের শাস্তি তাদের সর্ব অবয়বকে ঘিরে মুখকেও পূর্ণ করে দেবে। অর্থাৎ শাস্তির আগুনে তারা পরিপূর্ণভাবে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে মানুষের অভ্যাস যে কোনও শারীরিক আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য হাত ও পাকে ঢালরূপে ব্যবহার করে থাকে। শেষ বিচারের দিনে এদের হাত ও পা থাকবে অকর্মণ্য। সুতারাং আগুনের শাস্তিকে প্রতিহত করার জন্য তারা হাত ও পাকে ব্যবহারের সুযোগ না পেয়ে তারা তা মুখ দিয়ে প্রতিহতের চেষ্টা করবে। শাস্তি প্রাপ্ত এই সব অসহায় পাপী লোকেরা কি পূণ্যবান ও আল্লাহ্র রহমত প্রাপ্ত বান্দাদের সাথে এক শ্রেণীতে তুলনাযোগ্য। অবশ্যই নয়। পাপী তার কর্মের শাস্তি ভোগ করবে এবং পূণ্যাত্মা আল্লাহ্র রহমত ভোগ করবে।
৪২৮১। "যা অর্জন করতে" - অর্থাৎ পৃথিবীকে কৃত তাদের সকল মন্দ কাজ ও পাপ যা তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে অর্জন করেছে।
২৫। তাদের পূর্বেও যারা [ প্রত্যাদেশকে ] প্রত্যাখান করেছিলো , ফলে তাদের উপর এমনভাবে শাস্তি এসেছিলো যে, সে সম্বন্ধে তারা ধারণাও করতে পারে নাই ৪২৮২।
৪২৮২। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ২৬ ]। পাপীরা এমনভাবে হঠাৎ করে শাস্তি লাভ করবে যা তারা কল্পনাও করে নাই। আল্লাহ্র বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও বিদ্রোহের দ্বারা তারা হয়তো পার্থিব জীবনে ক্ষণস্থায়ী সুযোগ সুবিধা লাভ করতে পারবে সত্য , কিন্তু তাদের এই পার্থিব জীবন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যাবে, পরে থাকবে শুধু পরলোকের অনন্ত জীবন। যে জীবনে তাদের জন্য থাকবে শুধু লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা।
২৬। সুতারাং পার্থিব জীবনে আল্লাহ্ তাদের লাঞ্ছনা আস্বাদন করিয়েছিলেন ৪২৮৩, কিন্তু পরকালের শাস্তি তো আরও ভীষণ, যদি তারা তা জানতো।
৪২৮৩। দেখুন আয়াত [ ২ : ১১৪] পাপ কাজ কখনই জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনতে পারে না। পাপের শেষ পরিণতি সর্বদাই লাঞ্ছনা ও অপমানের মাধ্যমে শেষ হয়। কিন্তু পাপের সর্বশেষ পরিণতি অপেক্ষা করে থাকে পরকালে। কিন্তু যারা পরকালে অবিশ্বাসী তারা পরকালের জীবনের দুঃখ দুর্দ্দশা ও লাঞ্ছনার সংবাদ পার্থিব জীবনে বিশ্বাস করে না। এর মাঝে যদি কেহ পাপের দ্বারা পৃথিবীতে অগাধ বিত্ত ও ঐশ্বর্য অর্জনে সক্ষম হয়, তবে সে ধারণা করে তার বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরকালের পরিণতিকেও ইহাকালের ন্যায় অতিক্রম করতে পারবে। আর যদিও সে পাপের পরিণতিতে পৃথিবীতে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে , তবে তার ধারণা জন্মে যে, তার পাপক্ষয় হয়ে গেলো ,তাকে পরলোকে আর শাস্তি ভোগ করতে হবে না। এই উভয়বিধ ধারণাই হচ্ছে ভ্রান্ত ধারণা।
২৭। আমি এই কুর-আনে মানুষের জন্য সর্ব প্রকার উপমা উপস্থাপন করেছি , যেনো তারা উপদেশ গ্রহণ করে। ৪২৮৪
৪২৮৪। আধ্যাত্মিক জীবনকে চোখে দেখা যায় না। একে আত্মার মাঝে অনুভবের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। মানুষ যাতে উপলব্ধি করতে পারে , সে কারণে কোরাণ শরীফে বহু উদাহরণ উপমা ও রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে মানুষের বোধগম্যতাকে স্বচ্ছ করার জন্য। এ সব বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ যাতে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। কোরাণের কাহিনী শুধুমাত্র কোনও গল্পের ধারা বিবরণী নয়। কাহিনীর মাধ্যমে উদাহরণের মাধ্যমে উপমা, ও রূপকের দ্বারা মানুষকে শিক্ষা দান করা হয়েছে আধ্যাত্মিক জীবনের সত্যতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে।
২৮। আরবী ভাষার [ এই ] কুর-আনে ৪২৮৫ , কোন রকম বক্রতা নাই ৪২৮৬ , যেনো মানুষ মন্দ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
৪২৮৫। পূর্ববর্তী কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে অন্য ভাষায়। কুর-আন অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষাতে যা সেই দেশের মাতৃভাষা এবং সাধারণ লোকেরা তা বুঝতে সক্ষম হয়। আরবী এক সমৃদ্ধ ভাষা যার প্রকাশভঙ্গী ও রচনাশৈলী অপূর্ব ; ফলে আল্লাহ্র বাণীর প্রকৃত মাধুর্য সেই ভাষাতে প্রকাশ সম্ভব।
৪২৮৬। দেখুন আয়াত [ ১৮ : ১ ] ও টিকা ২৩২৬ ; আয়াত [ ৭ : ৪৫ ] ও টিকা ১০২৪ এবং [ ১৯ : ৩৬ ] আয়াত ও টিকা ২৪৮৮।
২৯। আল্লাহ্ একটি উপমা উপস্থাপন করছেনঃ এক ব্যক্তি বিভিন্ন মতাবলম্বী অনেক প্রভুর অধীনে ৪২৮৭ এবং একজন কেবল একই মনিবের অধীনে। এরা দুজন কি তুলনায় সমান হতে পারে ? প্রশংসা আল্লাহ্রই ৪২৮৮। কিন্তু ওদের অধিকাংশের কোন ধারণা নাই।
৪২৮৭। যারা বহু উপাস্যের উপাসনা করে তাদের সাথে যারা শুধুমাত্র এক আল্লাহ্র উপাসনা করে তাদের মধ্যে পার্থক্য উপমার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বহু উপাস্যের উপাসনাকারীর অবস্থা হচ্ছে সেই লোকের ন্যায় যার প্রভু অনেক জন। এই প্রভুরা পরস্পর পরস্পররের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাভাবাপন্ন। সুতারাং ভৃত্যের পক্ষে তাদের কাউকেই সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। প্রভুদের কলহের ফলে ভৃত্যের চরম দণ্ড দিতে হয়। অপরপক্ষে যার শুধু একজনই প্রভু ; সে তো মনপ্রাণ দিয়ে সেই একজন প্রভুর সেবা যত্ন করতে সক্ষম। তাঁর সেই প্রভু হচ্ছে দয়াময়; ভৃত্যের আরাম আয়েশের জন্য যিনি সর্বদা ব্যকুল।এরূপ প্রভুর সেবা করা যে কোনও ভৃত্যের জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক কাজ। সে তার কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে , ফলে সে তার কাজে সাফল্যের সাথে ও পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। এ ব্যাপারে কি কোনও সন্দেহ থাকে যে ১) দুধরণের প্রভুর মধ্যে কোনটি কাঙ্খিত ? এবং ২) কোন প্রভুর কাজ বেশী আনন্দদায়ক এবং স্বাভাবিক ?
উপদেশ : মানুষকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন এ ভাবে যে, সে একই সাথে বিভিন্ন উপাস্যের উপাসনা করতে অক্ষম। বহু উপাস্যের উপাসনা আধ্যাত্মিক জগতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে ফলে আত্মার স্বচ্ছতা , পবিত্রতা , একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এসব লোকের চরিত্রে দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হয়।
৪২৮৮। আমরা আল্লাহ্র নিকট কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাদের বহু প্রভুর দাসে পরিণত করেন নাই। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্র তিনি দয়াময় , আল্লাহ্ অনুগ্রহ করে আমাদের সরাসরি তাঁর উপাসনা করার হুকুম দিয়েছেন - আমাদের কারও মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। তিনি এক ও অদ্বিতীয় ও অসীম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র।
৩০। নিশ্চয়ই তুমিও [ একদিন ] মারা যাবে , এবং নিশ্চয়ই তারাও [ একদিন ] মারা যাবে ৪২৮৯।
৪২৮৯। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যে, মানুষ মাত্রই মরণশীল এমন কি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদও [ সা ] এর উর্দ্ধে নন। এর উর্দ্ধে নয় সকল পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরাও। পাপী ও পূণ্যাত্মা সকলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। কিন্তু যারা পূণ্যাত্মা তারা মৃত্যুর পর, পার্থিব জীবন শেষেও পৃথিবীতে রেখে যান তাদের পূণ্যকর্ম সমূহ পৃথিবীর কল্যাণার্থে। তাদের কর্মের মাধ্যমেই তাদের স্মৃতি পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে থাকে। মৃত্যুর পরপারে যে জীবন সে জীবন পৃথিবীর মানুষের কাছে অজ্ঞাত , অপরিচিত। এই জীবন সম্বন্ধে পৃথিবীতে অবিশ্বাসীরা বহু যুক্তি তর্ক , বাক্-বিতন্ডা করে থাকে। পরের আয়াতে আল্লাহ্ আমাদের বলেছেন যে, কেয়ামত দিবসে প্রত্যেকের বাক্-বিতন্ডার অবসান ঘটবে আল্লাহ্র উপস্থিতিতে।
৩১। অবশেষে শেষ বিচারের দিনে তোমাদের প্রভুর সম্মুখে তোমরা তোমাদের বাক-বিতন্ডার মীমাংসা করবে ৪২৯০।
৪২৯০। দেখুন উপরের টিকা।
চতুর্বিংশতিতম পারা
রুকু - ৪
৩২। তার থেকে বেশী পাপ কে করে যে আল্লাহ্র সম্বন্ধে মিথ্যা উচ্চারণ করে ৪২৯১ , এবং সত্য আসার পরে তা অস্বীকার করে ? কাফেরদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয় ? ৪২৯২
৪২৯১। আল্লাহ্ আমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তাঁর কল্যাণস্পর্শ জীবনের প্রতিটি স্তরে পরিব্যপ্ত। কিন্তু যদি কোনও অকৃতজ্ঞ জীব আল্লাহ্র এই করুণাকে অস্বীকার করে ; আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যকে মিথ্যা বলে অভিহিত করে তবে তার থেকে বড় জালিম আর কে আছে ?
৪২৯২। দেখুন আয়াত [ ৩ : ১৫১ ] ; [ ১৬ : ২৯]।
৩৩। যারা সত্য এনেছে এবং যারা তা অনুমোদন [ ও সমর্থন ] করে ৪২৯৩ , এরাই তারা যারা সঠিক কাজ করে।
৪২৯৩। প্রকৃত সত্য বা আল্লাহ্র বাণী সকল যুগেই এক, তা যুগ , কাল অতিক্রান্ত। যারা এই সত্যকে পৃথিবীতে প্রচার করেন তারা হলেন নবী,রসুল ও মোমেন বা পূণ্যাত্মা বান্দারা। যারাই সত্যকে নিজের অন্তরে ধারণ করেন এবং অপরের জন্য তা প্রচার করে থাকেন ,তারাই তো পৃথিবীর মহত্তর কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এ ভাবেই প্রতিটি মোমেন বান্দা পূর্ববর্তী রসুলদের প্রচারিত সত্যকে সত্যায়ন করেন। রসুলুল্লাহ্র [ সা ] আনীত শিক্ষাসমূহ অন্যান্য রসুলদের আনীত সত্যকে দৃঢ়ভাবে সত্যায়ন করে। যারা আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যকে মানে তারাই সঠিক পথ অবলম্বনকারী এবং কর্তব্যপরায়ন। এদেরকেই মুত্তাকী বলা হয়েছে।
৩৪। তাদের প্রভুর উপস্থিতিতে তারা যে ইচ্ছা প্রকাশ করবে তাই-ই লাভ করবে ৪২৯৪। যারা ভালো কাজ করে এরূপই হবে তাদের পুরষ্কার।
৪২৯৪। সঠিক পথ অবলম্বনের ফলে মুত্তাকী ব্যক্তিরা আল্লাহ্র নিকট পুরষ্কারের যোগ্য বলে বিবেচিত। পৃথিবীতে রাজ্য বা প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি দ্বারা পুরষ্কৃত হলে আমরা ধন্য হয়ে যাই। সেখানে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের যিনি অধিপতি , তিনি মোমেন বান্দাদের বাঞ্ছিত সকল কিছু দ্বারা পুরষ্কৃত করার কথা এই আয়াতে ঘোষণা করেছেন।
৩৫। এই হেতু যে, আল্লাহ্ তাদের মন্দ কর্মগুলিও ক্ষমা করে দেবেন ৪২৯৫। এবং তারা যে সৎ কাজ করেছে সেই অনুযায়ী পুরষ্কার দান করবেন।
৪২৯৫। "Lam" আরবী শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে "এই হেতু" বাংলা শব্দটি দ্বারা, যার দ্বারা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে মুত্তাকীদের কাজের ফলাফল। আল্লাহ্র পুরষ্কার সীমাহীন। যদি কেহ নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে,তবে আল্লাহ্ শুধু যে তার ছোট খাট দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন তাই নয়, তার পাপ বা মন্দ কর্মকেও ক্ষমা করে দেবেন। এবং তাকে বিচার করবেন তার সৎকর্ম বা পূণ্য কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে।
৩৬। তাঁর বান্দাদের জন্য আল্লাহ্-ই কি যথেষ্ট নন ? ৪২৯৬ কিন্তু তারা তোমাকে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য [দেবতাদের ] ভয় দেখাতে চেষ্টা করে। আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন পথপ্রদর্শক নাই।
৪২৯৬। যারা মুত্তাকী বা আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট সমর্পিত , তাদের নিকট পার্থিব নিরাপত্তার জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট। পৃথিবীতে সুখ শান্তি ,নিরাপত্তা , বিশ্রাম , যার জন্য মানুষ আকাঙ্খা প্রকাশ করে থাকে , সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আল্লাহ্-ই এ সকলের জন্য যথেষ্ট , শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভয় দেখায় যে, শয়তানের নির্দ্দেশিত পথ ব্যতীত এসব সুখ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। শয়তানের নির্দ্দেশিত পথ হচ্ছে মিথ্যা কুসংস্কার ও মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা। মূর্তি পূঁজার অর্থেই শুধুমাত্র মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করা হয় না। পৃথিবীতে সাধারণ মানুষ অহরহ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য অনেক শক্তির নিকট মাথা নত করে। আপতঃদৃষ্টিতে তাদের নিকট এসব শক্তিকে আল্লাহ্র থেকে বেশী শক্তিশালী মনে হয়। যেমন মানুষ সম্পদ , ক্ষমতা, শাসক , বিজ্ঞান , আত্মসুখ বা নিজ স্বার্থ ইত্যাদিকে সর্বোচ্চ করে দেখতে অভ্যস্ত। নিজস্ব স্বার্থ ও আত্মসুখের জন্য তারা আল্লাহ্র আদেশের বিপরীতে কাজ করে থাকে। তাদের মানসিক অবস্থা এরূপ : " আমি সঠিক পথটি অবলম্বন করলে সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হব। অথবা যদি আমি পাপ কাজ করতে অস্বীকার করি, তবে আমি জাগতিক উন্নতি লাভে অসমর্থ হব এবং আমার জীবনে পার্থিব উন্নতি লাভের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে ইত্যাদি "। আজকের বাংলাদেশে অধিকাংশ চাকুরীর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অর্থাৎ জীবিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষ এই টানা পোড়েনের সম্মুখীন । তারা আল্লাহকে সর্বোচ্চ ও সর্বশক্তিমান মনে না করে বিভিন্ন শক্তির সাহায্য প্রার্থনা করে , এবং অন্যায় , দূর্নীতি, ও কুসংস্কারের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এগুলিই তাদের মিথ্যা উপাস্য। প্রকৃত পক্ষে এ সব মিথ্যা উপাস্য জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ ও উন্নতির সন্ধান দান করে যার শেষ পরিণতিতে এসবের উপাসনাকারীরা হতাশা ও দুর্দ্দশাতে নিমজ্জিত হয়। কারণ তারা পরম করুণাময় আল্লাহ্র করুণা ও দয়া থেকে বঞ্চিত হয়। আর যে আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত তাকে কে সঠিক পথের সন্ধান দেবে ? কে তাকে বিপদ বিপর্যয়ে সান্তনা ও সাহস দান করবে ? আল্লাহ্-ই তাঁহার বান্দার জন্য যথেষ্ট।"
উপদেশ : জীবিকার অন্বেষণে মানুষকে পৃথিবীর বিপদ সঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে হয়। এ পথে লোভ , প্রলোভন , ভয়, নিরাপত্তার অভাব, প্রভৃতি বহু ধরণের শক্তি কাজ করে যা আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। এ সবের উপরে নির্ভরশীলতাকেই বলা হয়েছে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা। মোমেন বান্দার পথ একটাই তা হচ্ছে আল্লাহ্র পথ, নির্ভরতা একটাই তা আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পন। কারণ সে জানে আল্লাহ্র শক্তিই সর্বোচ্চ এবং আল্লাহ্র ইচ্ছাই সর্বশেষ পরিণতি।
৩৭। এবং আল্লাহ্ যাকে পথ প্রদর্শন করেন,কেউই তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না ৪২৯৭। আল্লাহ্ কি শক্তিতে পরাক্রমশালী জবরদস্ত প্রতিশোধ গ্রহণকারী নন ? ৪২৯৮
৪২৯৭। যারা আল্লাহ্র প্রেরিত পথ নির্দ্দেশকে দৃঢ়ভাবে জীবনের সত্য বলে গ্রহণ করে তাদের পৃথিবীর পথে পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয় নাই। কোন ভয় , প্রলোভন, বিপদ বা বিপর্যয় তাদের বিপথগামী বা প্রতারিত করতে পারবে না।
৪২৯৮। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী। তাঁর ক্ষমতা সকল দূরভিসন্ধি ও আল্লাহ্র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে জয়ী হবেই । পাপীর ক্ষমতা যখন সীমালংঘন করে যায়, তখন আল্লাহ্র ক্ষমতা তাকে ধ্বংস করে ফেলে। তিনি দন্ডবিধায়ক - তার শাস্তি থেকে কোনও ষড়যন্ত্রকারী রেহাই পাবে না।
৩৮। যদি তুমি তাদের জিজ্ঞাসা কর আকাশ মন্ডলী এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন কে ? ৪২৯৯। অবশ্যই তারা বলবে " আল্লাহ্।" বল, " তাহলে ভেবে দেখো , আল্লাহ্ যদি আমাকে শাস্তি দিতে চান , তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যাদের আহ্বান কর তারা কি সেই শাস্তি দূর করতে পারবে?" অথবা যদি তিনি আমাকে কোন অনুগ্রহ করতে চান , তারা কি সেই অনুগ্রহ ফিরিয়ে দিতে পারবে ?" ৪৩০০। বল, " আমার জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট ! নির্ভরকারীগণ আল্লাহ্রই উপরে নির্ভর করে ৪৩০১। "
৪২৯৯। দেখুন আয়াত [ ২৯ : ৬১ ] এবং আয়াত [ ২৩ : ৮৫] ও টিকা ২৯২৭। এই আয়াতে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনাকারীদের রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে। এ সব লোকেরা নাস্তিক বা সন্দেহবাতিক নয়। এরা বিশ্বাস করে যে এই বিশাল মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ্ , তবে তাদের সে বিশ্বাস তাদের আত্মার মাঝে দৃঢ়ভাবে সুসংবদ্ধ নয়। যার ফলে তাদের আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের প্রতিফলন তাদের কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায় না। তাদের জীবন প্রবাহিত হয় মিথ্যা ধারণার কালোস্রোতে। এরাই আল্লাহ্র পরিবর্তে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে থাকে। কখনও তা হয় পূর্বপুরুষদের মিথ্যা কুসংস্কার , কখনও তা হয় তাদের অনুভূতি হীনতার কারণে, বা দুষিত দূর্নীতিপরায়ণ পরিবেশের কারণে বা স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে অথবা সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণে। বিভিন্ন কারণে এরা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে অবিচল হতে পারে না। কখনও এরা মাজারে যেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে, কখনও বা ভন্ড পীর ফকির ও জ্যোতিষের স্মরণাপন্ন হয় তাবিজ মাদুলী বা রত্ন পাথরের জন্য। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এরা কখনও ক্ষমতাবানদের তোষামোদ করে, বা কখনও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এদের মাঝে ন্যায় ও অন্যায় বোধের সীমারেখা খুবই অস্পষ্ট। এদেরকেই আল্লাহ্ সম্বোধন করে বলেছেন যে, " তোমাদের মিথ্যা উপাস্য শেষ পর্যন্ত তোমাদের কোনও উপকারই করতে পারবে না ; তবে কেন তোমরা এক আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা কর না? কেন শুধুমাত্র তাঁর উপরে নির্ভর কর না ? একমাত্র আল্লাহ্-ই সকল কল্যাণের প্রভু এবং ন্যায় বিচার এবং শাস্তি দানের ক্ষমতা রাখেন। "
৪৩০০। দেখুন আয়াত [ ৩৩ : ১৭ ]।
৪৩০১। দেখুন আয়াত [ ১২ : ৬৭ ] এবং [ ১৪ : ১২ ] আয়াত। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। তিনি একাই সকল দায়িত্ব বহন করতে সক্ষম। যে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে সে প্রকৃত শক্তির সন্ধান লাভ করে। সুতারাং "নির্ভরকারীগণ আল্লাহ্র উপর নির্ভর করে।"
৩৯। বল, " হে আমার সম্প্রদায় ! তোমরা যা পার কর; আমিও আমার কাজ করে যাচ্ছি ৪৩০২। কিন্তু শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, -
৪৩০২। দেখুন [ ১১ : ১২১ ] ও টিকা ১৬২৪ -ক।
৪০। "কার উপরে পতিত হবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি ৪৩০৩ এবং [ আখেরাতে ] আপাতিত হবে তার উপরে স্থায়ী শাস্তি। "
৪৩০৩। দেখুন [ ১১ : ৯৩ ] আয়াত। এই আয়াতে শাস্তির বর্ণনার জন্য দুধরণের বর্ণনা ব্যবহার করা হয়েছে। একটি হচ্ছে লাঞ্ছনাদায়ক বা অপমানজনক শাস্তি , অপরটি হচ্ছে স্থায়ী শাস্তি। সম্ভবতঃ শাস্তি প্রাপ্ত লোকের দুধরণের অবস্থাকে এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে। তার অবস্থা হবে নিম্নরূপ : ১) তা হবে লাঞ্ছলাদায়ক এবং ২) তা হবে চিরস্থায়ী।
৪১। অবশ্যই আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি , মানুষের [ নির্দ্দেশনার ] জন্য ৪৩০৪। অতঃপর যে পথ-নির্দ্দেশ গ্রহণ করে সে তা করে নিজেরই আত্মার কল্যাণের জন্য। কিন্তু যে বিপথে গমন করে সে তার নিজের আত্মারই ক্ষতি করে। আর তুমি তাদের কাজের জন্য দায়ী নও ৪৩০৫।
৪৩০৪। আল্লাহ্ রসুলদের মাধ্যমে তাঁর প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন সকল মানুষের জন্য। এই প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আল্লাহ্ পৃথিবীতে জীবন ধারণের পথ নির্দ্দেশ প্রেরণ করেছেন। পুরুষ নারী সকলের জন্য আছে সৎ পথের সন্ধান। প্রত্যাদেশের বাণী অমোঘ সত্য , সেখানে কোনও রহস্যময়তা বা অস্পষ্টতা নাই। যে তা অনুসরণ করে সে তা করে নিজের কল্যাণের জন্য। যদি কেউ তা প্রত্যাখান করে , তবে সে শয়তানের অনুসরণ করে যা তার নিজের আত্মার জন্য হবে ক্ষতিকর। নিজের ধ্বংস সে নিজে ডেকে আনে।
৪৩০৫। আল্লাহ্র প্রেরিত নবী ও রসুলেরা মানুষের শিক্ষার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারেন সত্য , কিন্তু তাদেরও ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। তারা মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " যা স্রষ্টার বিশেষ দান , সেই মানসিক শক্তিকে কোনও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন না। যদি কেহ তাদের শিক্ষাকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তবে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতার জন্য সেই শুধুমাত্র দায়ী হবে আর কেহ নয়। দেখুন [৬ : ১০৭ ] আয়াত ও টিকা ৯৩৫।
রুকু - ৫
৪২। আল্লাহ্ই [ মানুষের ] আত্মাকে হরণ করেন মৃত্যুর মাধ্যমে ৪৩০৬; এবং যাদের মৃত্যু আসে নাই,তাদেরটাও হরণ করেন নিদ্রার সময়ে ৪৩০৭। যাদের উপরে মৃত্যুর হুকুম হয়ে যায়, তিনি তাদের [পুণরায় জীবনে ফিরে যাওয়া থেকে ] বিরত রাখেন ৪৩০৮। কিন্তু অপর সকলকে [ তাদের দেহের মাঝে ] ফিরিয়ে দেন , নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তাশীল ৪৩০৯।
৪৩০৬। ঘুম , স্বপ্ন ও মৃত্যুর রহস্য আজও মানুষের অজ্ঞাত। এ এক আকর্ষণীয় প্রহেলিকা। সম্ভবতঃ এই রহস্যের সমাধান মানুষের জ্ঞান , বিজ্ঞানের বাইরে। ঘুম , স্বপ্ন ও মৃত্যুর সম্বন্ধে বহু ধরণের কুসংস্কার , কাল্পনিক ধারণা এবং মনঃস্তাত্বিক গবেষণা বিদ্যমান। কিন্তু তা কোনটাই সম্পূর্ণ ঘটনাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। এই আয়াতে সামান্য কয়েকটি ছত্রে ঘুম ও মৃত্যুর ধর্মীয় মতবাদকে তুলে ধরা হয়েছে। দৈহিক সকল ক্রিয়া কর্মের সমাপ্তির মাধ্যমে মৃত্যু ঘটে অর্থাৎ দৈহিক মৃত্যু ঘটে, কিন্তু আমাদের আত্মার মৃত্যু ঘটে না ; তা অমর। তার অবস্থান তখন হয় পরলোকে বা আধ্যাত্মিক জগতে। আল্লাহ্ আমাদের আত্মাকে গ্রহণ করেন, যা আর পৃথিবীতে ফিরে আসে না।
৪৩০৭। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৬০ ]। ঘুম কি ? এ প্রশ্ন বহু যুগ থেকে মানুষ করে আসছে। মানুষ , জীব-জন্তু , কীট পতঙ্গ সকলেই ঘুমায়। মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীর ঘুমকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ঘুমকে বলা যায় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যবিরতি বিশেষ। কারণ ঘুমের সময়ে মানুষ বা প্রাণী কোনও কিছুই উপলব্ধি করতে পারে না , এই দৃশ্যমান পৃথিবী তাদের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ ও প্রাণীকুলের দৈহিক অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম যেমন : রক্ত সঞ্চালন , পরিপাক ক্রিয়া, শারীরিক বর্দ্ধন , নিশ্বাস প্রশ্বাস ইত্যাদি জৈবিক ক্রিয়াকর্ম স্বাভাবিক ভাবেই সম্পন্ন হতে থাকে , যদিও তা ঘটে অত্যন্ত ধীর গতিতে। ঘুমের সময়ে শুধুমাত্র স্নায়ুতন্ত্রের বিশ্রাম ঘটে। এই একটি ব্যাপারই মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে সার্বজনীন যা উভয় শ্রেণীর মধ্যেই ঘটে থাকে। সম্ভবতঃ এ সত্য বৃক্ষরাজির জন্যও প্রযোজ্য, কারণ, ধারণা করা হয় বৃক্ষরাজিরও স্নায়ুতন্ত্র বিদ্যমান। মানুষের বেলায় স্নায়ুতন্ত্রের বিশ্রামের সাথে সাথে মানসিক দক্ষতারও বিশ্রাম ঘটে। যে কোনও প্রকার মানসিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে যায় সত্য কিন্তু এ সময়েই মানুষ সাধারণতঃ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন সাধারণতঃ দুধরণের হয়। এক ধরণের স্বপ্নে প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন কার্যের প্রতিফলন ঘটে। অবচেতন মনের প্রতিফলন এসব স্বপ্নে ঘটে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় সাধারণ বিবেক বুদ্ধিতে যে সব ঘটনা অবাস্তব মনে হয়। চেতনায় যা অবাস্তব ,অবচেতন মন তাকেই ধারণ করে স্বপ্নে। সাধারণ মানুষ এ রকম স্বপ্নই দেখে থাকে সাধারণতঃ। তবে কখনও কখনও কদাচিৎ মানুষ অন্য আর এক ধরণের স্বপ্ন দেখে থাকে - যার কোনও ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। এ সব স্বপ্নে হয় ভবিষ্যতকে দেখা যায় নতুবা যা মানুষের অগোচরে তার দেখা মেলে। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানেন বৈজ্ঞানিক কেকুল বহু সাধনা ও গবেষণা করেছিলেন জৈব রসায়নের মূল পদার্থ বেন্জিনের রাসায়নিক সুত্র আবিষ্কারের জন্য। দিন রাত্রের পরিশ্রমও যখন সফল হলো না ,তখন একদিন তিনি স্বপ্নে বেনজিনের সুত্রটি দেখতে পান এবং এই আবিষ্কারের ফলে তিনি রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান। এর ব্যাখ্যা কি ? মানুষের প্রাণ বা আত্মা বা ব্যক্তিত্ব যাই বলা হোক না কেন - তা আমাদের এই নশ্বর দেহের উর্দ্ধে অবস্থান করে। নশ্বর দেহ সে তো পশুতুল্য। পশুর যা কাম্য আমাদের দেহেরও সেই একই কাম্য। মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব তা তার দেহের জন্য নয়। তা হচ্ছে তার এই নশ্বর দেহের মাঝে পরমাত্মার অংশ আত্মার অবস্থানের জন্য। ঘুমের মাঝে আত্মা দেহকে ত্যাগ করে অন্য জগতে চলে যায় - এই আয়াতে সেই কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের সকলের প্রাণ বা আত্মাকে হরণ করে থাকেন। সে হিসেবে ঘুমন্ত ব্যক্তি ও মৃত ব্যক্তির অবস্থান একই - কারণ উভয়ের আত্মাই আল্লাহ্র সন্নিকটে যায়। কবিতার ভাষাতে ঘুমকে বলা হয়েছে "Twin brother of Death." অতিপ্রাকৃত যে সব স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যা করা তখনই সম্ভব যদি ঘুমের এই ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা হয়।
৪৩০৮। ঘুমকে মৃত্যুর যমজ ভাই রূপে সম্বোধন করা হয়েছে। ঘুমের মাঝে আমাদের আত্মাকে অস্থায়ীভাবে নশ্বর দেহের রক্তমাংসের বন্ধন মুক্ত করা হয়। আল্লাহ্ তাদের আত্মাকে হরণ করেন। যারা ঘুমের মাঝে পরম শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন, তাদের আত্মা আর তাদের দেহের মাঝে ফিরে আসে না। পরিণতিতে তারা মৃত্যুবরণ করে। তাদের নশ্বর দেহ ধ্বংস হয়ে যায়। যাদের পৃথিবীর জন্য আরও সময় বাকী থাকে, তাদের আত্মাকে পুণরায় দেহের মাঝে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই তারা তাদের পৃথিবীর মেয়াদকাল পূর্ণ করে থাকে।
৪৩০৯। ঘুম ,মৃত্যু ইত্যাদি সম্বন্ধে যদি মানুষ গভীর ভাবে চিন্তা করে, তবে তার সম্মুখে আধ্যাত্মিক বা পারলৌকিক জীবনের অনেক সত্যের রূপ উদ্ভাসিত হবে। যেমনঃ
১) পৃথিবীর জীবনে জীবন ও মৃত্যু যা আমরা সর্বদা প্রত্যক্ষ করে থাকি তাই-ই জীবনের শেষ কথা নয়।
২) পৃথিবীর সংজ্ঞা অনুযায়ী দৈহিক ভাবে জীবিত ব্যক্তিও আধ্যাত্মিক ভাবে মৃত হতে পারে। আবার দৈহিক মৃত্যু আধ্যাত্মিক জগতের নিদ্রাত্থান হতে পারে।
৩) নিদ্রা শুধুমাত্র শারীরিক বিশ্রাম নয়। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে ঘুমকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা যায়। ঘুম যেরূপ জীবনের শেষ নয় , মৃত্যুও সেরূপ জীবনের শেষ নয়।
৪) কেয়ামত দিবসের পুণরুত্থান ,প্রতিটি প্রত্যুষে নিদ্রা থেকে জাগরণের ন্যায় ঘটনা যাকে কবির ভাষাতে বলা যায় ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর যমজ ভাই।
স্বপ্ন, ঘুম ইত্যাদি মানুষকে আত্মার অমরত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আত্মার অমরত্বের বিশ্বাসই হচ্ছে ধর্মের মূল ভিত্তি। সুতারাং ঘুম, মৃত্যু ,স্বপ্ন ইত্যাদি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ্ নিদর্শন - যা চিন্তার মাধ্যমে আত্মার মাঝে অনুধাবন করতে হয়।
৪৩। তবে কি ওরা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সুপারিশকারী ধরেছে ? ৪৩১০। বল, " ওদের কোন ক্ষমতা না থাকলেও এবং কোন বুদ্ধি না থাকলেও ? "
৪৩১০। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর ক্ষমতার উপরে মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করবে না। কারণ আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও সাহায্য করার ক্ষমতা নাই। যদি তারা প্রতিমা বা মূর্তির পূঁজা করে তবে তারা হচ্ছে প্রাণহীন। তাদের কোন ক্ষমতাই নাই , এমন কি নবী রসুল এবং পূণ্যাত্মা ব্যক্তিরাও সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখেন না, যদি না আল্লাহ্ তাদের সে ক্ষমতা দান করেন। দেখুন পরবর্তী টিকা।
৪৪। বল, " সুপারিশ করার [ অধিকার দেয়া ] কেবল আল্লাহ্র জন্য সংরক্ষিত ৪৩১১। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব তাহারই অধীনে। সবশেষে তাহারই নিকট তোমরা প্রত্যানীত হবে।" ৪৩১২
৪৩১১। Shafa'at - অর্থ সুপারিশকারী , মধ্যাস্থতাকারী। দেখুন আয়াত সমূহ [২ : ২৫৫ ] ; [ ১০: ৩ ] ; ও টিকা ২৬৩৪ এবং [ ২১ : ২৮ ] ও টিকা ২৬৮৮। হাশরের ময়দানে , শেষ বিচারের দিনে , কেহই আল্লাহ্ নিকট কারও জন্য মধ্যাস্থতাকারীরূপে পরিগণিত হতে পারবে না। একমাত্র তারাই পারবেন ১) যাদের আল্লাহ্ অনুমতি দান করবেন ; ২) যারা অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা নিজেকে আল্লাহ্র সম্মুখে উপস্থিতির যোগ্য করে তুলবেন। পৃথিবীর বিচারালয়েও কেহ কারও জন্য বিচারকের নিকট সুপারিশ করতে পারে না , একমাত্র যোগ্য উকিল ব্যতীত। এমন কি পৃথিবীতে ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতেই একমাত্র বিচারকের নিকট করুণা ও ক্ষমা ভিক্ষা করা যায়।
৪৩১২। সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্র। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আমাদের বর্তমান পৃথিবীর জীবন শেষে ,আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট নীত হব। দেখুন আয়াত [১০ : ৪ ]।
৪৫। যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, যখন তাদের নিকট আল্লাহ্র একত্বের কথা উল্লেখ করা হয়, তাদের অন্তর তীব্র ঘৃণা ও বিষম ভয়ে পূর্ণ হয়ে যায় ৪৩১৩। কিন্তু যখন আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য উপাস্যগুলির উল্লেখ করা হয়, দেখো, তারা আনন্দে উল্লাসিত হয়।
৪৩১৩। আল্লাহ্র সেবা বা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার অর্থ হচ্ছে পৃথিবীতে ভালো কাজে বা সৎকাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। যারা মন্দ বা পাপী তাদের নিকট সৎকাজ সব সময়েই ঘৃণার বিষয়বস্তু। সৎকাজের নামে তাদের অন্তরে বিতৃষ্ণার উদ্রেক হবে। তারা তখনই উল্লসিত হবে, যখন তাদের আরধ্য কাজগুলির জন্য আহ্বান করা হবে। এই আরধ্য কাজগুলিই তাদের দেবতা স্বরূপ। এগুলি বিভিন্ন ধরণের হতে পারে যেমন : ব্যক্তিগত স্বার্থ বা পূর্বপুরুষদের মিথ্যা সংস্কার এবং বহুবিধ বস্তু যা আল্লাহ্র আইন বা হুকুমের বিরোধিতা করে থাকে।
শিক্ষণীয় বিষয় : যান্ত্রিকভাবে নামাজ পড়া ও রোজা করার মাধ্যমে কাউকে ধার্মিকরূপে পরিগণিত করা যায় না। প্রত্যেককে বিচার করতে হবে তার কাজের দ্বারা। যে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সৎকাজ করে সেই ধার্মিক।
৪৬। বল," হে আল্লাহ্ , আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ,গোপন ও প্রকাশ্য সকল জ্ঞানের অধিকারী ৪৩১৪। তোমার বান্দাগণ যে বিষয়ে মতবিরোধ করে, তুমি তার বিচার মীমাংসা করে দেবে।"
৪৩১৪। জীবন, মৃত্যু ,ইহকাল -পরকাল , আধ্যাত্মিক জীবন , সবই আমাদের নিকট প্রহেলিকাময়। আমরা জানি না কেন আমাদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন সৃষ্টি স্রষ্টার কোন উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য। এই নশ্বর দেহকে জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবন একদিন শেষ হয়ে যায়। বৈচিত্রে ভরা এই জীবন , সময়ের বিশাল ব্যাপ্তিতে বুদবুদের ন্যায় চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। তার শেষ পরিণতি কি ? তার সঠিক চিত্র অনুধাবন করা এই পৃথিবীর জীবনে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে বৃথা বাদানুবাদ বা যুক্তিতর্ক অর্থহীন। কারণ মৃত্যুর পরপারের জীবনকে আল্লাহ্ আমাদের জন্য আড়াল করে রেখেছেন। মৃত্যুর দুয়ার অতিক্রম না করে তা দৃষ্টিগোচর হওয়া সম্ভব নয়। মৃত্যুর কালো পর্দ্দাকে কেহই অতিক্রম করতে পারবে না পৃথিবীতে অবস্থান করে। সে চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। আমাদের জন্য যা করণীয় তার সঠিক পথ নির্দ্দেশ করা হয়েছে এই আয়াতে। একান্ত আন্তরিক ভাবে, বিনয়ের সাথে আমরা আল্লাহ্র নিকট আমাদের বিশ্বাসে পরিশুদ্ধ আত্মাকে নিবেদন করতে পারি। এ বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে পোষণ করতে হবে যে আজ আমাদের নিকট যা অস্পষ্ট ,পরলোকে তা আমাদের নিকট সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পাবে। আল্লাহ্র কাছে সর্বদা প্রার্থনা করতে হবে তার পথনির্দ্দেশকে যেনো আমরা অন্তরের মাঝে উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর করুণা ও দয়া ভিক্ষা করতে হবে অবনত চিত্তে।
৪৭। যদি পাপীদের পৃথিবীর সমুদয় [সম্পদও] থাকে, এবং তার সাথে ইহার সমপরিমাণ [ সম্পদও ] যুক্ত হয়; ৪৩১৫ শেষ বিচারের দিনের শাস্তির পরিবর্তে তারা মুক্তিপণ হিসেবে [ বৃথাই ] তা দিতে চাইবে। কিন্তু আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাদের জন্য এমন সব বিষয় প্রকাশ পাবে যা তারা ভাবতেই পারে নাই ৪৩১৬।
৪৩১৫। দেখুন আয়াত [ ১৩ : ১৮ ]। যারা এই পৃথিবীতে আল্লাহ্র বাণীকে অস্বীকার করে মৃত্যুর পরপারে যেয়ে তারা উপলব্ধি করতে পারবে সত্যকে প্রত্যাখান করার প্রতিফল। সেদিন তারা সত্যকে গ্রহণ করে পূণ্যাত্মারূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সকল সম্পদ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু তখন তা বহু দেরী হয়ে যাবে। তবে কেন এখনই তারা সাবধান হচ্ছে না এবং আল্লাহ্র পথ নির্দ্দেশকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করছে না ?
৪৩১৬। " এমন সব বিষয় " - হচ্ছে এমন ঘটনা যা অবিশ্বাসীরা পৃথিবীতে কল্পনাও করতে অক্ষম। পার্থিব জীবনে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। বেহেশতের সুখ ও শান্তি যেরূপ পূণ্যাত্মাদের কল্পনাকে অতিক্রম করে যাবে, ঠিক সেরূপ পরলোকের দোযখের যন্ত্রণা পাপীরা এ পৃথিবীতে বসে কল্পনাও করতে পারবে না। দেখুন পরবর্তী টিকা।
৪৮। নিশ্চয়ই তাদের কৃতকর্মের মন্দ পরিণাম প্রকাশ হয়ে পড়বে , এবং তারা যা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো তা তাদের [ সম্পূর্ণরূপে ] পরিবেষ্টন করে ফেলবে ৪৩১৭।
৪৩১৭। যে ব্যাপারে অবিশ্বাসীরা সর্বদা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো মৃত্যু পরপারের জীবনে তাদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে অপমানকর ভাবে বেঁধে ফেলবে। সেদিন তাদের বোধদয় ঘটবে যে তারা যার অনুসরণ করেছে তা ছিলো শুধুমাত্র মিথ্যা গর্ব ও অহংকার।
৪৯। এখন, যখন মানুষকে বিপর্যয় স্পর্শ করে সে আমাকে আর্তনাদ করে [ ডাকে ] ৪৩১৮। কিন্তু যখন আমি আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ দান করি ৪৩১৯ সে বলে, " এটা আমাকে দেয়া হয়েছে কারণ আমার বিশেষ জ্ঞান রয়েছে।" ৪৩২০ বস্তুত এটা একটা পরীক্ষা ,কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বুঝতে পারে না।
৪৩১৮। দেখুন [৩০ : ৩৩ ] আয়াত ও টিকা ৩৫৪৫।
৪৩১৯। দেখুন আয়াত [ ৩৯ : ৮ ]।
৪৩২০। দেখুন [২৮ : ৭৮ ] ও টিকা ৩৪০৮। পার্থিব সমৃদ্ধি নাম-যশঃ ,প্রভাব -প্রতিপত্তি , খ্যাতি ,প্রতিভা সব কিছুই আল্লাহ্র তরফ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ ঠিক যেরূপ দুঃখ , দুর্দ্দশা , বিপদ -বিপর্যয় ইত্যাদি। যারা আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহে ধন্য তাদের সে বিষয়ে দায় দায়িত্ব থাকে; জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। আবার বিপদ বিপর্যয়ে ধৈর্য্য ও আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার পরীক্ষা করা হয়।
৫০। এদের পূর্ববর্তী [ প্রজন্মও ] এরূপ বলতো। কিন্তু তারা যা করেছিলো তা তাদের জন্য লাভজনক হয় নাই।
৫১। বস্তুতঃ তাদের মন্দ কাজের পরিণাম তাদের ঢেকে ফেলেছিলো, ৪৩২১ এবং [ এই প্রজন্মের ] যারা পাপ করে তাদের মন্দ কাজের পরিণাম তাদের-ও ঢেকে ফেলবে ৪৩২২ এবং তারা কখনও আমার পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করতে পারবে না।
৫১। বস্তুতঃ তাদের মন্দ কাজের পরিণাম তাদের ঢেকে ফেলেছিলো, ৪৩২১ এবং [ এই প্রজন্মের ] যারা পাপ করে তাদের মন্দ কাজের পরিণাম তাদের-ও ঢেকে ফেলবে ৪৩২২ এবং তারা কখনও আমার পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করতে পারবে না।
৪৩২১। দেখুন [ ১৬ : ৩৪ ]।
৪৩২২। যুগ যুগ ধরে অবিশ্বাসীদের কাহিনী একই রয়ে গেছে।তারা সত্যকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে, সত্যকে প্রতিহত করে, নির্যাতন করে, ধ্বংস করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে অসমর্থ হয়। আল্লাহ্র পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবেই। শুধুমাত্র সত্যের যারা শত্রু তারাই তাদের মন্দ কর্মের ফল লাভ করবে। রাসুলের [ সা ] জীবনে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে এই সত্যের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। রাসুলের [সা ] সময়ে আরবে যা ঘটেছিলো - সেই একই ঘটনার বার বার পুণরাবৃত্তি ঘটেছে অতীতে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। পৃথিবীতে কোনও সৎ কাজ বিপদ-বাঁধা ব্যতীত অতিক্রম করতে পারে নাই। আমাদের চারিদিকেই এরূপ বহু উদাহরণ দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য ও সৎ কাজ জয় লাভ করে ও স্থায়ীত্ব পায়।
৫২। তারা কি জানে না যে, আল্লাহ্ যার জন্য ইচ্ছা করেন, জীবনোপকরণ প্রশস্ত করে দেন, অথবা সঙ্কুচিত করে দেন ৪৩২৩? যারা বিশ্বাস করে অবশ্যই এগুলি তাদের জন্য নিদর্শন।
৪৩২৩। দেখুন [ ২৮ : ৮২ ] আয়াত। আল্লাহ্র অনুগ্রহ সবার জন্য সমভাবে বন্টিত হয় না। তাই যদি হতো তবে পৃথিবীতে আদম সন্তানের জন্যে পরীক্ষার স্থল বলে পরিগণিত হতো না। পৃথিবীতে মেধা, মননশক্তি , সম্পদ ,প্রতিভা , ক্ষমতা ও শক্তি ,প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ সমূহ সকলে সমভাবে লাভ করে না। আল্লাহ্ এ সব মানব সন্তানের মাঝে বণ্টন করে থাকেন তাঁর দূরদৃষ্টি ও জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী যেনো তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে ; যেনো আল্লাহ্র কল্যাণ হস্ত সকল কিছুকে স্পর্শ করে থাকে। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে যাদের আল্লাহ্ বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেছেন তাদের সেই নেয়ামতের দায়িত্ব বহন করতে হবে। সেই নেয়ামতকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী আল্লাহ্র রাস্তায় খরচ করতে হবে। পরলোকে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুতারাং কেউ যেনো প্রাচুর্যে অহংকারী না হয় , আবার মন্দ অবস্থাতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ না করে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্র বৃহত্তর পরিকল্পনার এক ক্ষুদ্র অংশ আমরা বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে অতিবাহিত করে চলেছি -অনন্তের পানে। এই ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা শুধু আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহ অবলোকন করে থাকি। পৃথিবীর অগ্রযাত্রার সামগ্রিক পরিকল্পনা দেখার ক্ষমতা আমাদের নাই। এখানে 'রিযিক' শব্দটি দ্বারা উপরে বর্ণিত আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামত সমূহকে বুঝানো হয়েছে যার ব্যবহার মানুষ পার্থিব সম্পদ লাভে সমর্থ হয়।
রুকু - ৬
৪৩২৪। "আল্লাহ্ সকল পাপ ক্ষমা করে থাকেন।" আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যে কোনও পাপ যদি আন্তরিক অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা ক্ষমা চাওয়া যায়, তবে আল্লাহ্ তা ক্ষমা করে দেন।
৪৩২৫। সংক্ষেপে যে পরামর্শের মাধ্যমে প্রেরণা দান করা হয়েছে তা এই : অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন কর। বেশী দেরী হলে সে সুযোগ নাও আসতে পারে। " শাস্তি আসার পূর্বে " অর্থাৎ শেষ বিচারের পূর্বে অর্থাৎ মৃত্যু এসে দুয়ারে হানা দেওয়ার পূর্বেই নিজেকে অনুতাপের মাধ্যমে সংশোধন করে নিতে হবে। কারণ এই নশ্বর দেহ ত্যাগের পরে পৃথিবীর কোনও কাজ করার ক্ষমতা অমর আত্মার থাকবে না। শুধু সঙ্গে থেকে যাবে ভালো বা মন্দ কাজের অভিজ্ঞতা। সুতারাং আল্লাহ্র সম্মুখে দাঁড়াবার পূর্বেই পৃথিবীর জীবনটাকে সৎকাজে ব্যয় করার পরামর্শ এখানে দেয়া হয়েছে।
৪৩২৬। দেখুন আয়াত [ ৩৯ : ১৮ ] ও টিকা ৪২৬৯। আল্লাহ্র হুকুম সমূহ, সবল দুর্বল সকলের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পন দাবী করেন। তারা যেনো তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে থাকে। আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ইচ্ছার বাস্তব রূপ দানে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে আল্লাহ্ তাঁর করুণায় বিধৌত করবেন। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সর্বান্তকরণে চেষ্টা করে যাবো আল্লাহ্র হুকুম মানার জন্য। হয়তো তাতে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়ে যাবে , কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য যেনো হয় আল্লাহ্র ইচ্ছার অনুসরণ , তা হলেই আল্লাহ্র মঙ্গল হস্ত আমাদের ঘিরে থাকবে। আল্লাহ্র সাহায্য আমরা লাভ করবো। এ কথা মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ্র হুকুম অনুযায়ী কাজ করতে হবে এই পৃথিবীর জীবনেই। এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করার পূর্বেই। কারণ মৃত্যু যখন নশ্বর দেহকে ধ্বংস করে , তখন পার্থিব কোনও কাজের ক্ষমতা আত্মার থাকবে না। আত্মা তখন ভালো মন্দ সকল কাজের উর্দ্ধে চলে যাবে। সুতরাং মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহ্র হুকুম সমূহ বুঝে নিতে চেষ্টা করতে হবে ; হৃদয় , মন দিয়ে আন্তরিকভাবে অনুভব করতে হবে। এ ব্যাপারে এক মূহুর্তও দেরী করা উচিত নয়। কারণ হয়তো বা মৃত্যু অতি সন্নিকটে। " সেই উত্তম কিতাব " কথাটি দ্বারা কোরাণকে বোঝানো হয়েছে। সমগ্র কোরাণই উত্তম।
৪৩২৭। হাশরের ময়দানে শেষ বিচারের দিনে প্রত্যেকেই পৃথিবীতে তার পাপ-পূণ্য , ভালো -মন্দ , ন্যায়-অন্যায় সকল কৃতকর্মকেই স্মরণ করতে সক্ষম হবে। হাশরের ময়দান আক্ষেপ , দীর্ঘশ্বাস ও দুঃখের বাতাসে পরিপূর্ণ হয়ে পড়বে, কারণ প্রত্যেকেই তার নিজস্ব দোষত্রুটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। তাদের অন্তর দুঃখ ভারাক্রান্ত হবে, সেদিনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তারা বলবে যে, " পৃথিবীতে আমরা বিশ্বাসে আন্তরিক থাকার পরিবর্তে অবহেলাতে সময় নষ্ট করেছি। প্রকৃত সত্যকে বুঝতে পারার চেষ্টার পরিবর্তে , আমরা তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেছি। হায়! এখন আর সংশোধনের সময় নাই।"
৪৩২৮। দ্বিতীয়তঃ শেষ বিচারের দিনে পাপীদের একদল এ কথা বলার সুযোগ যেনো না পায় যে, " আল্লাহ্ আমাকে পথ প্রদর্শন করলে আমি তো অবশ্যই মুত্তাকীদিগের অন্তর্ভূক্ত হতাম। আল্লাহ্ পথ প্রদর্শন না করলে আমি কি করবো ইত্যাদি" এটা হবে মিথ্যা অজুহাত। কারণ পূর্বাহ্নেই আল্লাহ্ তাদের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে সঠিক পথের পথ নির্দ্দেশ প্রেরণ করেছেন। সুতারাং এ সব অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না।
৪৩২৯। তৃতীয়তঃ সেদিন শাস্তি প্রত্যক্ষ করে একদল বাসনা প্রকাশ করবে যে, " আহা যদি একবার পৃথিবীতে আমার প্রত্যাবর্তন ঘটতো, তবে আমি সৎকর্মপরায়ণ হতাম।" কিন্তু পৃথিবীতে তাদের বহুবার সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের বলা হয়েছে ," আল্লাহ্র অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না, আল্লাহ্ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।" [৫৩ নং আয়াত ]। সুতারাং তদের এই বাহানার কোনও সুযোগ থাকা উচিত নয়। পৃথিবীতে বারে বারে ক্ষমার সুযোগ থাকা সত্বেও তারা সে সুযোগ গ্রহণ করে নাই। এখন শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করার পরে তারা মিথ্যা বাহানার অজুহাত গ্রহণ করেছে।
৪৩৩০। কেয়ামতের দিনে অবিশ্বাসী পাপীরা কিভাবে নিজেদের উপস্থাপন করবে তারই বর্ণনা পূর্বাহ্নেই এই আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে তারা প্রত্যাখান করেছিলো ইচ্ছাকৃত ভাবে। সুতারাং তাদের কৃতকর্মের ফলভোগ তাদের করতে হবে। এই আয়াতের শেষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে পাপে আসক্ত ব্যক্তিদের মনঃস্ততঃ। পাপের মূল উৎপত্তি হচ্ছে অহংকার , যার থেকে উদ্ধতপনার জন্ম হয়। শয়তানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে ছিলো অহংকারী ও উদ্ধত। পৃথিবীতেও দেখা যায় যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তারা হয় আত্ম-অহংকারে অন্ধ।
৪৩৩১। শয়তানের কারণেই আদমের পৃথিবীতে আগমন। আর শয়তান-ই হচ্ছে পৃথিবীর সকল পাপীদের প্রধান বা নেতা। আর শয়তানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে [ ২ : ৩৪] আয়াতে। এই বৈশিষ্ট্য তার সকল অনুসারীদের মধ্যেও বিদ্যমান থাকে। সকল পাপীই হয় আত্মগর্বে গর্বিত ও উদ্ধত।
৪৩৩২। নিষ্কলঙ্ক তুষার শুভ্রতা হচ্ছে পবিত্রতা ,সম্মান , এবং সত্যের প্রতীক। ঠিক তার বিপরীত কালো হচ্ছে পাপ , অসম্মান এবং মিথ্যার প্রতীক। সম্ভবতঃ জাহান্নামের আগুনের সঙ্গে কালো রংটি সম্পর্কিত।
৪৩৩৩। দেখুন আয়াত [ ৩৯: ৩২ ] ও টিকা ৪২৯২। যেখানে এই বাক্যটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
৪৩৩৪। 'Mafazat' অর্থ স্থান বা নিরাপদ আশ্রয়স্থল , উদ্ধার পাওয়া ,বিজয়ের স্থান অথবা সিদ্ধিলাভ করা বা ইচ্ছার পরিপূর্ণতা লাভ করা। এই আয়াতটি জাহান্নামবাসীদের অকৃতকার্যতা ও হতাশার বিপরীতে জান্নাতবাসীদের চিত্রকে অংকন করা হয়েছে।
৪৩৩৫। এই মহাবিশ্ব ও নিখিল বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্। তিনি শুধু যে সৃষ্টি করেছেন তাই-ই নয়, তিনি তা রক্ষণাবেক্ষণ করেন, প্রতিপালন করেন এবং যত্ন করেন। তিনি তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে উদাসীন নন। সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই তাঁর উপরে নির্ভরশীল।
৪৩৩৬। যারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, আল্লাহকে অস্বীকার করে এতে আল্লাহ্র কোনও ক্ষতি নাই, ক্ষতি তাদেরই যারা বিদ্রোহী। কারণ প্রতিটি বস্তুকে আল্লাহ্ বিশেষ ধর্ম সম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। আলোর ধর্ম আলোর , পানির ধর্ম পানির , লোহার ধর্ম লোহার। প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব ধর্ম আছে। প্রতিটি উদ্ভিদের নিজস্ব ধর্ম আছে। সেরূপ আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টির পরে মানুষের আত্মার জন্য এক বিশেষ ধর্ম বা গুণ সৃষ্টি করেন। আত্মার এই বিশেষ ধর্ম হচ্ছে স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পন ও স্রষ্টার গুণগান করা। এখানেই নির্ভর করে আত্মার সাফল্য বা সমৃদ্ধি বা সিদ্ধি। যে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সে আল্লাহ্ প্রদত্ত প্রকৃতি দত্ত ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করে। ফলে সে তার নিজের বিরুদ্ধেই কাজ করে এবং নিজেই নিজের ক্ষতি করে থাকে।
৫৩। বল [আমার পক্ষ থেকে ] ; " হে আমার বান্দাগণ ! যারা নিজের আত্মার বিরুদ্ধে পাপ করেছো , তারা আল্লাহ্র করুণা থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সকল পাপ ক্ষমা করে থাকেন ৪৩২৪। নিশ্চয়ই তিনি বারে বারে ক্ষমাশীল , পরম করুণাময়। "
৪৩২৪। "আল্লাহ্ সকল পাপ ক্ষমা করে থাকেন।" আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যে কোনও পাপ যদি আন্তরিক অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা ক্ষমা চাওয়া যায়, তবে আল্লাহ্ তা ক্ষমা করে দেন।
৫৪। [ অনুতাপের মাধ্যমে ] তোমার প্রভুর দিকে মুখ ফিরাও, এবং পাপের শাস্তি আসার পূর্বেই তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন কর। এর পরে আর তোমাদের সাহায্য করা হবে না ৪৩২৫।
৪৩২৫। সংক্ষেপে যে পরামর্শের মাধ্যমে প্রেরণা দান করা হয়েছে তা এই : অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন কর। বেশী দেরী হলে সে সুযোগ নাও আসতে পারে। " শাস্তি আসার পূর্বে " অর্থাৎ শেষ বিচারের পূর্বে অর্থাৎ মৃত্যু এসে দুয়ারে হানা দেওয়ার পূর্বেই নিজেকে অনুতাপের মাধ্যমে সংশোধন করে নিতে হবে। কারণ এই নশ্বর দেহ ত্যাগের পরে পৃথিবীর কোনও কাজ করার ক্ষমতা অমর আত্মার থাকবে না। শুধু সঙ্গে থেকে যাবে ভালো বা মন্দ কাজের অভিজ্ঞতা। সুতারাং আল্লাহ্র সম্মুখে দাঁড়াবার পূর্বেই পৃথিবীর জীবনটাকে সৎকাজে ব্যয় করার পরামর্শ এখানে দেয়া হয়েছে।
৫৫। আর হঠাৎ তোমাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদের উপর শাস্তি পতিত হওয়ার পূর্বেই তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে সেই উত্তম [ কিতাবের ] অনুসরণ কর ৪৩২৬।
৪৩২৬। দেখুন আয়াত [ ৩৯ : ১৮ ] ও টিকা ৪২৬৯। আল্লাহ্র হুকুম সমূহ, সবল দুর্বল সকলের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পন দাবী করেন। তারা যেনো তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে থাকে। আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ইচ্ছার বাস্তব রূপ দানে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে আল্লাহ্ তাঁর করুণায় বিধৌত করবেন। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সর্বান্তকরণে চেষ্টা করে যাবো আল্লাহ্র হুকুম মানার জন্য। হয়তো তাতে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়ে যাবে , কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য যেনো হয় আল্লাহ্র ইচ্ছার অনুসরণ , তা হলেই আল্লাহ্র মঙ্গল হস্ত আমাদের ঘিরে থাকবে। আল্লাহ্র সাহায্য আমরা লাভ করবো। এ কথা মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ্র হুকুম অনুযায়ী কাজ করতে হবে এই পৃথিবীর জীবনেই। এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করার পূর্বেই। কারণ মৃত্যু যখন নশ্বর দেহকে ধ্বংস করে , তখন পার্থিব কোনও কাজের ক্ষমতা আত্মার থাকবে না। আত্মা তখন ভালো মন্দ সকল কাজের উর্দ্ধে চলে যাবে। সুতরাং মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহ্র হুকুম সমূহ বুঝে নিতে চেষ্টা করতে হবে ; হৃদয় , মন দিয়ে আন্তরিকভাবে অনুভব করতে হবে। এ ব্যাপারে এক মূহুর্তও দেরী করা উচিত নয়। কারণ হয়তো বা মৃত্যু অতি সন্নিকটে। " সেই উত্তম কিতাব " কথাটি দ্বারা কোরাণকে বোঝানো হয়েছে। সমগ্র কোরাণই উত্তম।
৫৬। যাতে কাউকে তখন বলতে না হয় , " হায়! আল্লাহ্র প্রতি [ আমার কর্তব্যে ] আমি যে , অবহেলা করেছি সে জন্য আফসোস ৪৩২৭। এবং আমি তো [আল্লাহ্র আদেশ ] বিদ্রূপকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম।"
৪৩২৭। হাশরের ময়দানে শেষ বিচারের দিনে প্রত্যেকেই পৃথিবীতে তার পাপ-পূণ্য , ভালো -মন্দ , ন্যায়-অন্যায় সকল কৃতকর্মকেই স্মরণ করতে সক্ষম হবে। হাশরের ময়দান আক্ষেপ , দীর্ঘশ্বাস ও দুঃখের বাতাসে পরিপূর্ণ হয়ে পড়বে, কারণ প্রত্যেকেই তার নিজস্ব দোষত্রুটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। তাদের অন্তর দুঃখ ভারাক্রান্ত হবে, সেদিনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তারা বলবে যে, " পৃথিবীতে আমরা বিশ্বাসে আন্তরিক থাকার পরিবর্তে অবহেলাতে সময় নষ্ট করেছি। প্রকৃত সত্যকে বুঝতে পারার চেষ্টার পরিবর্তে , আমরা তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেছি। হায়! এখন আর সংশোধনের সময় নাই।"
৫৭। অথবা কেহ যেনো না বলে , "যদি আল্লাহ্ আমাকে পথ প্রদর্শন করতেন , তবে আমি নিশ্চয়ই পূণ্যাত্মাদের অন্তর্ভূক্ত হতাম ৪৩২৮। "
৪৩২৮। দ্বিতীয়তঃ শেষ বিচারের দিনে পাপীদের একদল এ কথা বলার সুযোগ যেনো না পায় যে, " আল্লাহ্ আমাকে পথ প্রদর্শন করলে আমি তো অবশ্যই মুত্তাকীদিগের অন্তর্ভূক্ত হতাম। আল্লাহ্ পথ প্রদর্শন না করলে আমি কি করবো ইত্যাদি" এটা হবে মিথ্যা অজুহাত। কারণ পূর্বাহ্নেই আল্লাহ্ তাদের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে সঠিক পথের পথ নির্দ্দেশ প্রেরণ করেছেন। সুতারাং এ সব অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না।
৫৮। অথবা [ প্রকৃত ] শাস্তি প্রত্যক্ষ করলে কাউকে যেনো বলতে না হয়, ৪৩২৯। " আমাকে যদি আর একবার সুযোগ দেয়া হতো , তাহলে অবশ্যই আমি সৎকর্মশীলদের অন্তর্গত হতাম।"
৪৩২৯। তৃতীয়তঃ সেদিন শাস্তি প্রত্যক্ষ করে একদল বাসনা প্রকাশ করবে যে, " আহা যদি একবার পৃথিবীতে আমার প্রত্যাবর্তন ঘটতো, তবে আমি সৎকর্মপরায়ণ হতাম।" কিন্তু পৃথিবীতে তাদের বহুবার সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের বলা হয়েছে ," আল্লাহ্র অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না, আল্লাহ্ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।" [৫৩ নং আয়াত ]। সুতারাং তদের এই বাহানার কোনও সুযোগ থাকা উচিত নয়। পৃথিবীতে বারে বারে ক্ষমার সুযোগ থাকা সত্বেও তারা সে সুযোগ গ্রহণ করে নাই। এখন শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করার পরে তারা মিথ্যা বাহানার অজুহাত গ্রহণ করেছে।
৫৯। [ উত্তর হবে ] , " হ্যাঁ, তোমার নিকট আমার নিদর্শন সকল এসেছিলো , ৪৩৩০ এবং তুমি তাদের প্রত্যাখান করেছিলে। তুমি উদ্ধত হয়েছিলে এবং যারা ঈমানকে প্রত্যাখান করে তাদের দলভূক্ত হয়েছিলে" ৪৩৩১।
৪৩৩০। কেয়ামতের দিনে অবিশ্বাসী পাপীরা কিভাবে নিজেদের উপস্থাপন করবে তারই বর্ণনা পূর্বাহ্নেই এই আয়াতগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে তারা প্রত্যাখান করেছিলো ইচ্ছাকৃত ভাবে। সুতারাং তাদের কৃতকর্মের ফলভোগ তাদের করতে হবে। এই আয়াতের শেষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে পাপে আসক্ত ব্যক্তিদের মনঃস্ততঃ। পাপের মূল উৎপত্তি হচ্ছে অহংকার , যার থেকে উদ্ধতপনার জন্ম হয়। শয়তানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে ছিলো অহংকারী ও উদ্ধত। পৃথিবীতেও দেখা যায় যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তারা হয় আত্ম-অহংকারে অন্ধ।
৪৩৩১। শয়তানের কারণেই আদমের পৃথিবীতে আগমন। আর শয়তান-ই হচ্ছে পৃথিবীর সকল পাপীদের প্রধান বা নেতা। আর শয়তানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে [ ২ : ৩৪] আয়াতে। এই বৈশিষ্ট্য তার সকল অনুসারীদের মধ্যেও বিদ্যমান থাকে। সকল পাপীই হয় আত্মগর্বে গর্বিত ও উদ্ধত।
৬০। যারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে, শেষ বিচারের দিনে তুমি তাদের মুখ মন্ডল কালো বর্ণে পরিবতির্ত হতে দেখবে ৪৩৩২। উদ্ধতদের বাসস্থান কি জাহান্নাম নয় ? ৪৩৩৩
৪৩৩২। নিষ্কলঙ্ক তুষার শুভ্রতা হচ্ছে পবিত্রতা ,সম্মান , এবং সত্যের প্রতীক। ঠিক তার বিপরীত কালো হচ্ছে পাপ , অসম্মান এবং মিথ্যার প্রতীক। সম্ভবতঃ জাহান্নামের আগুনের সঙ্গে কালো রংটি সম্পর্কিত।
৪৩৩৩। দেখুন আয়াত [ ৩৯: ৩২ ] ও টিকা ৪২৯২। যেখানে এই বাক্যটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
৬১। কিন্তু যারা পূণ্যাত্মা আল্লাহ্ তাদের মুক্তির স্থানে পৌঁছিয়ে দেবেন ৪৩৩৪। কোন অকল্যাণ তাদের স্পর্শ করবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
৪৩৩৪। 'Mafazat' অর্থ স্থান বা নিরাপদ আশ্রয়স্থল , উদ্ধার পাওয়া ,বিজয়ের স্থান অথবা সিদ্ধিলাভ করা বা ইচ্ছার পরিপূর্ণতা লাভ করা। এই আয়াতটি জাহান্নামবাসীদের অকৃতকার্যতা ও হতাশার বিপরীতে জান্নাতবাসীদের চিত্রকে অংকন করা হয়েছে।
৬২। আল্লাহ্ সকল কিছুর স্রষ্টা এবং সকল কাজের অভিভাবক ও পরিচালক ৪৩৩৫।
৪৩৩৫। এই মহাবিশ্ব ও নিখিল বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্। তিনি শুধু যে সৃষ্টি করেছেন তাই-ই নয়, তিনি তা রক্ষণাবেক্ষণ করেন, প্রতিপালন করেন এবং যত্ন করেন। তিনি তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে উদাসীন নন। সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই তাঁর উপরে নির্ভরশীল।
৬৩। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চাবী সমূহ তাহারই অধীনে, এবং যে আল্লাহ্র নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখান করে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্থ ৪৩৩৬।
৪৩৩৬। যারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, আল্লাহকে অস্বীকার করে এতে আল্লাহ্র কোনও ক্ষতি নাই, ক্ষতি তাদেরই যারা বিদ্রোহী। কারণ প্রতিটি বস্তুকে আল্লাহ্ বিশেষ ধর্ম সম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। আলোর ধর্ম আলোর , পানির ধর্ম পানির , লোহার ধর্ম লোহার। প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব ধর্ম আছে। প্রতিটি উদ্ভিদের নিজস্ব ধর্ম আছে। সেরূপ আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টির পরে মানুষের আত্মার জন্য এক বিশেষ ধর্ম বা গুণ সৃষ্টি করেন। আত্মার এই বিশেষ ধর্ম হচ্ছে স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পন ও স্রষ্টার গুণগান করা। এখানেই নির্ভর করে আত্মার সাফল্য বা সমৃদ্ধি বা সিদ্ধি। যে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সে আল্লাহ্ প্রদত্ত প্রকৃতি দত্ত ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করে। ফলে সে তার নিজের বিরুদ্ধেই কাজ করে এবং নিজেই নিজের ক্ষতি করে থাকে।
রুকু - ৭
৪৩৩৭। আল্লাহ্ তাঁর নবীকে, নবীর সমালোচকদের প্রতি এই উক্তি করার হুকুম দেন। আয়াতগুরি শ্লেষাচ্ছলে ব্যক্ত করা হয়েছে। আয়াতগুলির সারমর্ম হচ্ছেঃ " হে অবিশ্বাসীরা তোমরা বিদ্রোহী ও উদ্ধত , তোমরা আমাকে হুকুম কর কার এবাদত করতে হবে ? কিন্তু তোমরা কে ? তোমাদের তো প্রকৃত কোনও জ্ঞানই নাই। তোমরা তো অজ্ঞ। আমি তো সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত। ঠিক একই ভাবে পূর্ববর্তী রসুলরাও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁদেরও দায়িত্ব ছিলো প্রচার করা যে, ১) আল্লাহ্র একত্বের ঘোষণাই হচ্ছে প্রকৃত সত্য ; এবং ২) যদি তুমি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত কর, তবে তোমাকে সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে জীবনকালে তোমার কোনও কাজই আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তোমার পৃথিবীর জীবনের শিক্ষানবীশকালের কোনও মূল্যই আল্লাহ্র কাছে থাকবে না।"
৪৩৩৮। আল্লাহ্র একত্বের ঘোষণা সব নবী ও রসুলগণ যুগে যুগে করে এসেছেন। পৃথিবী সৃষ্টিলগ্ন থেকে এই এক সত্যকেই পুনঃপুনঃ পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। ইসলাম কোনও নূতন ধর্ম নয়। সেই পুরানো সত্যকেই যুগোপযোগী করে প্রচার করা হয়েছে।
৪৩৩৯। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনার অর্থই হচ্ছে অর্থহীন বস্তুর প্রতি সময় নষ্ট করা। কারণ মানুষের আত্মার সৃষ্টি শুধুমাত্র আল্লাহ্র এবাদতের জন্য। এখানেই তার পরিপূর্ণতা , এখানেই তার সিদ্ধিলাভ এখানেই তার মুক্তি। যদি কেউ তা না করে তবে সে স্বধর্মচ্যুত হয় এবং জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে উপলব্ধিতে অক্ষম। সেতো ক্ষতিগ্রস্থ।
৪৩৪০। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার অর্থই হচ্ছে কারও প্রতি তার দানের জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা ও ধন্যবাদ দান করা। আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ অনুগ্রহকে আত্মার মাঝে উপলব্ধি করা এবং এর মূল্যায়ন করা। আল্লাহ্র অনুগ্রহরাজিকে শুধু ব্যক্তিগত আরাম আয়েশের জন্য ব্যয় না করে তা আল্লাহ্র রাস্তায় আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করার মাধ্যমেই আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
৪৩৪১। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৯১ ] ও টিকা ৯০৯ ; এবং আয়াত [ ২২ : ৭৪ ]। যথোচিত সম্মান অর্থ আল্লাহ্র বিশালত্ব , মহত্ব , ক্ষমতাকে যারা আত্মার মাঝে উপলব্ধি করতে পারে না তারাই মিথ্যা উপাস্যের বা প্রাকৃতিক শক্তির কাছে মাথা অবনত করে। তারা ভুলে যায় যে, আল্লাহ্র শক্তির নিকট সৃষ্টির সকল পদার্থই তুচ্ছ।
৪৩৪২। দেখুন পূর্ববর্তী টিকা। আল্লাহ্র শক্তিকে উপমার সাহায্যে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ক্ষুদ্র বস্তুকে মানুষ তার হাতের তালুতে, মুষ্ঠির মাঝে আবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। ঠিক অনুরূপভাবে স্রষ্টা এই বিশাল বিশ্বভূবনকে তাঁর হাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করতে সক্ষম। স্রষ্টার বিশালত্বকে অনুভবের জন্য এই উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় উপমা ব্যবহার করা হয়েছে গোটানো কাগজ [Scroll]। গোটানো কাগজকে মানুষ যেমন তার ডান হাতে ধরে রাখতে সক্ষম, স্রষ্টাও ঠিক সেরূপে এই বিশাল মহাবিশ্বকে তার সম্প্রসারণশীল কোটি কোটি গ্রহ, নক্ষত্র ও নীহারিকা ছায়াপথ সহ গুটিয়ে তার করায়ত্ব করতে পারেন। এই উদাহরণের মাধ্যমে মানুষের চেতনাতে , উপলব্ধিতে আঘাত হানা হয়েছে স্রষ্টার বিশালত্ব ও ক্ষমতাকে অনুভব করার জন্য। করায়ত্ব বা মুষ্ঠিবদ্ধ শব্দগুলি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। কর বা হাত হচ্ছে ক্ষমতা ও কার্যক্ষমতার প্রতীক। দেখুন আয়াত [২১ : ১০৪ ] এবং আয়াত [ ৮১ : ১ ]।
৪৩৪৩। [Sa'iqa] মুর্চ্ছিত হইয়া পড়া, অথবা জ্ঞান হারানো ; এর অর্থ জীবনের প্রকাশ থাকা সত্বেও মানুষের সাধারণ অনুভূতি , কার্যক্ষমতা ও শক্তি লোপ পাওয়া। শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সাথে সকল সৃষ্ট জীব মৃত্যু বরণ করবে। অর্থাৎ আমরা যাকে জীবন বলে থাকি তা স্তব্ধ হয়ে যাবে। নূতন ভাবে নূতন মাত্রায় নূতন পৃথিবীকে সৃষ্টি করা হবে। [ দেখুন ১৪ : ৪৮ ও টিকা ১৯২৫ ]। শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সাথে সাথে প্রতিটি আত্মা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে, সে হবে স্মৃতিভ্রংশ অথবা সময়, স্থান ও নিজের অস্তিত্বের জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। শিঙ্গায় দ্বিতীয় বার ফুৎকারের সাথে সাথে সকল মানুষ দণ্ডায়মান হয়ে যাবে। "তাকিয়ে থাকবে " - অর্থাৎ এ সময়ে তাদের দৃষ্টি হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং পূর্বে যা তাদের দৃষ্টির অগোচরে ছিলো তাও দৃষ্টি গোচর হবে। এ সময়েই বিচার কার্য আরম্ভ হবে।
৪৩৪৪। কেয়ামতের পর নূতন পৃথিবী সৃষ্টি করা হবে নূতন মাত্রাতে। যার সব কিছু সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে এই পৃথিবী থেকে। সেখানে কোনও অন্যায়, অবিচার ,পাপের অন্ধকার থাকবে না। নিখিল-বিশ্ব আল্লাহ্র একত্বের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আল্লাহ্ মহামান্বিত। আল্লাহ্র সত্বা সর্ব কিছুকে বেষ্টন করে থাকবে - সত্যের আলোয় জগৎ সংসার উদ্ভাসিত হবে। যত মিথ্যা , পাপ , মিথ্যা ভনিতা, দৃষ্টিবিভ্রম সব কিছু অদৃশ্য হয়ে যাবে। সব কিছুর প্রকৃত রূপ প্রতিভাত হবে।
৪৩৪৫। শেষ বিচার দিবসের পটভূমির দৃশ্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র সিংহাসনের সামনে সকল মানুষ সমবেত হবে। প্রত্যেকের সম্মুখে তাদের আমলনামা খোলা থাকবে - যা পৃথিবীতে তাদের খুঁটিনাটি কার্যবিবরণ। কাজের উদ্দেশ্য বা নিয়ত , পরিবেশ, সকল কিছুর খুঁটিনাটি বিবরণ সেখানে প্রতিভাত হবে। নবী , রসুল ,সত্যের প্রচারক , শহীদগণ যারা সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন সকলকে সেই বিচার সভায় উপস্থিত করা হবে সাক্ষী হিসেবে। বিচারের রায় হবে সর্বোচ্চ ন্যায়। কারণ যিনি বিচারক তিনি শুধু যে ন্যায় বিচারক তাই-ই নয়, তিনি সকলের কাজের উদ্দেশ্য ,পরিবেশ ,সকল খুঁটিনাটি ঘটনা জ্ঞাত, যা সাধারণ মানুষ ভুলে যায়। আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, ছোট , বড় সকল কিছুকেই মূল্যায়ন করবে।
৪৩৪৬। পৃথিবীর বিচারালয়ে অনেক সময়েই ন্যায় বিচারের নামে প্রহসন সংঘটিত হয়। কারণ বিচারকের পক্ষে সকল সময়ে ঘটনার পটভূমি , উদ্দেশ্য , প্রভৃতি জানা সম্ভব হয় না। অনেক সময়েই বাক্ পটিয়সী উকিল প্রকৃত ঘটনাকে কৌশলে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয় , সেক্ষেত্রে বিচারকের বিচার ন্যায় বিচার হয় না। কিন্তু কেয়ামতের পরে শেষ বিচারের বিচার সভা হবে ভিন্ন প্রকৃতির। কোনও প্রতারণা বা ভুল ভ্রান্তির স্থান সেখানে থাকবে না। কারণ আল্লাহ্র নিকট অতীত, বর্তমান , ভূত ভবিষ্যত কিছুই গোপন থাকবে না। তিনি সর্বজ্ঞাত এবং সকলের থেকে সব চেয়ে বেশী ওয়াকিবহাল।
রুকু - ৮
৪৩৪৭। দলে দলে বা যুমার এই শব্দটি থেকে সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। আত্মার গহীনে ডুব দিয়ে প্রতিটি আত্মাকে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে প্রকৃত সত্যের। যদি কেউ প্রকৃত সত্যের সন্ধান লাভ না করে, আত্মার মাঝে সত্যের বন্ধনকে দৃঢ় না করে ; আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপন্ন না করে , তবে সে আত্মা হবে বিভ্রান্ত দিগ্ভ্রান্ত। এদেরকে শেষ বিচারের দিনে জনসাধারণের ভীড় বা দলে দলে জনসাধারণ বলা হয়েছে।
৪৩৪৮। "জাহান্নামের রক্ষীরা " - সম্ভবতঃ এরা হচ্ছেন ফেরেশতা যারা পৃথিবীতে মানুষের অন্যায় ও পাপ কাজ সম্বন্ধে কোনও ধারণাই রাখেন না। সুতারাং তারা এই বিশাল জনগোষ্ঠির জাহান্নামের দিকে আগমন দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়বেন।
৪৩৪৯। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৩৩ ]। সম্ভবতঃ উত্তরটি ছিলো অপর ফেরেশতার। হ্যাঁ ; তাদের নিকটও আল্লাহ্ তাঁর দূতদের প্রেরণ করেছিলেন। নবী রসুলেরা তাদের সাবধান করেছেন , তাদের মাঝে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে প্রচার করেছেন ; অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র ক্ষমা প্রার্থনার উপদেশ দিয়েছেন। যেহেতু তারা এ সবের কিছুতেই কর্ণপাত করে নাই সুতারাং এখন পূর্বনির্ধারিত শাস্তি তাদের উপরে নিপতিত হয়েছে। কারণ তারা ছিলো বিদ্রোহী এবং উদ্ধত। তারা সত্যকে প্রতিহত করেছে , বিশ্বাসকে অবিশ্বাস দ্বারা দমিত করেছে এবং আল্লাহ্র করুণাকে অবহেলা করেছে।"
৪৩৫০। "কত নিকৃষ্ট উদ্ধতদিগের আবাসস্থল " - উদ্ধতপনা হচ্ছে আত্ম অহংকারের সর্বোচ্চ রূপ এবং তা হচ্ছে সকল পাপের শিকড় বা মূল। শয়তানের উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই সত্যকে শিক্ষা দিয়েছেন। দেখুন [ ২ :৩৪ ] আয়াত এবং আরও অনেক আয়াত।
৪৩৫১। পূণ্যাত্মারাও দলে দলে জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে। অর্থাৎ শেষ বিচারের দিনে পূণ্যাত্মা ও পাপীদের সম্পূর্ণরূপে দু শ্রেণীতে বাছাই করা হবে। আয়াত [৭৩ -৭৫ ] কে আয়াত [ ৭১-৭২ ] এর পটভূমিতে তুলনা করলে এ কথার সত্যতা মেলে।
৪৩৫২। বেহেশতের ফেরেশতারা দলে দলে পূণ্যাত্মাদের আগমনে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য বোধ করবে না। তারা সন্তুষ্টি লাভ করবে তারা পূণ্যাত্মাদের শান্তির সম্ভাষণ দ্বারা শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবে ,অভিনন্দন জ্ঞাপন করবে, সাদরে তাদের মাঝে আহ্বান করবে।
৪৩৫৩। যারা বেহেশতে প্রথম প্রবেশ লাভ করবে এটা হবে তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা। প্রারম্ভে আল্লাহ্র প্রশংসা কীর্তনের মাধ্যমে তারা তাদের বক্তব্য শুরু করবে যা তাদের জন্য উপযুক্ত। তারা সর্বান্তকরণে আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করবে।
৪৩৫৪। "অধিকারী " - এর অর্থ এই নয় যে, তারা বেহেশতে কিছু সম্পত্তির অধিকার লাভ করেছেন। তারা তাদের জীবনের শেষ পরিণতিতে বেহেশতের অনন্ত সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করার অধিকার লাভ করবে এবং পরম করুণাময়ের সান্নিধ্যে জীবনকে ধন্য করবে।
৪৩৫৫। " সব প্রশংসা আল্লাহ্র , যিনি জাহান সমূহের প্রভু " - এই বাক্যটি দ্বারা কোরাণ শরীফের প্রথম সূরার আরম্ভ করা হয়। এই আয়াতে বেহেশতের সর্বোচ্চ শান্তির রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। জগত সমূহের প্রতিপালকের মহিমা , প্রশংসা ও পবিত্রতা ও তাঁর সান্নিধ্যের উপলব্ধি আত্মাকে পরিপূর্ণ শান্তির মাঝে নিমজ্জিত করবে।
৬৪। তুমি বল, " হে মূর্খগণ ! তবুও কি তোমরা আমাকে আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কাউকে উপাসনা করতে আদেশ করছ ?" ৪৩৩৭
৪৩৩৭। আল্লাহ্ তাঁর নবীকে, নবীর সমালোচকদের প্রতি এই উক্তি করার হুকুম দেন। আয়াতগুরি শ্লেষাচ্ছলে ব্যক্ত করা হয়েছে। আয়াতগুলির সারমর্ম হচ্ছেঃ " হে অবিশ্বাসীরা তোমরা বিদ্রোহী ও উদ্ধত , তোমরা আমাকে হুকুম কর কার এবাদত করতে হবে ? কিন্তু তোমরা কে ? তোমাদের তো প্রকৃত কোনও জ্ঞানই নাই। তোমরা তো অজ্ঞ। আমি তো সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত। ঠিক একই ভাবে পূর্ববর্তী রসুলরাও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁদেরও দায়িত্ব ছিলো প্রচার করা যে, ১) আল্লাহ্র একত্বের ঘোষণাই হচ্ছে প্রকৃত সত্য ; এবং ২) যদি তুমি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর এবাদত কর, তবে তোমাকে সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে জীবনকালে তোমার কোনও কাজই আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তোমার পৃথিবীর জীবনের শিক্ষানবীশকালের কোনও মূল্যই আল্লাহ্র কাছে থাকবে না।"
৬৫। কিন্তু তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ পাঠানো হয়েছে যে, ৪৩৩৮ , " যদি তুমি আল্লাহ্র সাথে শরীক কর তবে, তোমার [ জীবনের ] সব কাজ অবশ্যই বৃথা যাবে ৪৩৩৯ , এবং যারা [আধ্যাত্মিক ভাবে ] ক্ষতিগ্রস্থ তুমি অবশ্যই তাদের শ্রেণীভূক্ত হবে। "
৪৩৩৮। আল্লাহ্র একত্বের ঘোষণা সব নবী ও রসুলগণ যুগে যুগে করে এসেছেন। পৃথিবী সৃষ্টিলগ্ন থেকে এই এক সত্যকেই পুনঃপুনঃ পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। ইসলাম কোনও নূতন ধর্ম নয়। সেই পুরানো সত্যকেই যুগোপযোগী করে প্রচার করা হয়েছে।
৪৩৩৯। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনার অর্থই হচ্ছে অর্থহীন বস্তুর প্রতি সময় নষ্ট করা। কারণ মানুষের আত্মার সৃষ্টি শুধুমাত্র আল্লাহ্র এবাদতের জন্য। এখানেই তার পরিপূর্ণতা , এখানেই তার সিদ্ধিলাভ এখানেই তার মুক্তি। যদি কেউ তা না করে তবে সে স্বধর্মচ্যুত হয় এবং জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে উপলব্ধিতে অক্ষম। সেতো ক্ষতিগ্রস্থ।
৬৬। অতএব, আল্লাহ্র উপাসনা কর এবং কৃতজ্ঞদের অর্ন্তভূক্ত হও ৪৩৪০।
৪৩৪০। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার অর্থই হচ্ছে কারও প্রতি তার দানের জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা ও ধন্যবাদ দান করা। আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ অনুগ্রহকে আত্মার মাঝে উপলব্ধি করা এবং এর মূল্যায়ন করা। আল্লাহ্র অনুগ্রহরাজিকে শুধু ব্যক্তিগত আরাম আয়েশের জন্য ব্যয় না করে তা আল্লাহ্র রাস্তায় আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করার মাধ্যমেই আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
৬৭। তারা আল্লাহ্র সম্বন্ধে যথোচিত প্রাপ্য সম্মান করে নাই ৪৩৪১। শেষ বিচারের দিনে সমস্ত পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে ৪৩৪২ , এবং আকাশমন্ডলী তাঁর ডান হাতে গুটানো থাকবে। পবিত্র মহান তিনি। তারা তাঁর প্রতি যে অংশীদারিত্ব আরোপ করে তিনি তা থেকে বহু উর্দ্ধে।
৪৩৪১। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৯১ ] ও টিকা ৯০৯ ; এবং আয়াত [ ২২ : ৭৪ ]। যথোচিত সম্মান অর্থ আল্লাহ্র বিশালত্ব , মহত্ব , ক্ষমতাকে যারা আত্মার মাঝে উপলব্ধি করতে পারে না তারাই মিথ্যা উপাস্যের বা প্রাকৃতিক শক্তির কাছে মাথা অবনত করে। তারা ভুলে যায় যে, আল্লাহ্র শক্তির নিকট সৃষ্টির সকল পদার্থই তুচ্ছ।
৪৩৪২। দেখুন পূর্ববর্তী টিকা। আল্লাহ্র শক্তিকে উপমার সাহায্যে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ক্ষুদ্র বস্তুকে মানুষ তার হাতের তালুতে, মুষ্ঠির মাঝে আবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। ঠিক অনুরূপভাবে স্রষ্টা এই বিশাল বিশ্বভূবনকে তাঁর হাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করতে সক্ষম। স্রষ্টার বিশালত্বকে অনুভবের জন্য এই উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় উপমা ব্যবহার করা হয়েছে গোটানো কাগজ [Scroll]। গোটানো কাগজকে মানুষ যেমন তার ডান হাতে ধরে রাখতে সক্ষম, স্রষ্টাও ঠিক সেরূপে এই বিশাল মহাবিশ্বকে তার সম্প্রসারণশীল কোটি কোটি গ্রহ, নক্ষত্র ও নীহারিকা ছায়াপথ সহ গুটিয়ে তার করায়ত্ব করতে পারেন। এই উদাহরণের মাধ্যমে মানুষের চেতনাতে , উপলব্ধিতে আঘাত হানা হয়েছে স্রষ্টার বিশালত্ব ও ক্ষমতাকে অনুভব করার জন্য। করায়ত্ব বা মুষ্ঠিবদ্ধ শব্দগুলি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। কর বা হাত হচ্ছে ক্ষমতা ও কার্যক্ষমতার প্রতীক। দেখুন আয়াত [২১ : ১০৪ ] এবং আয়াত [ ৮১ : ১ ]।
৬৮। এবং শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহ্ যাদের [ অবকাশ দিতে ] ইচ্ছা করেন তারা ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকলে মুর্ছিত হয়ে পড়বে ৪৩৪৩। অতঃপর যখন দ্বিতীয়টি বাজানো হবে, তৎক্ষণাত ওরা দাড়িয়ে যাবে ও তাকিয়ে থাকবে।
৪৩৪৩। [Sa'iqa] মুর্চ্ছিত হইয়া পড়া, অথবা জ্ঞান হারানো ; এর অর্থ জীবনের প্রকাশ থাকা সত্বেও মানুষের সাধারণ অনুভূতি , কার্যক্ষমতা ও শক্তি লোপ পাওয়া। শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সাথে সকল সৃষ্ট জীব মৃত্যু বরণ করবে। অর্থাৎ আমরা যাকে জীবন বলে থাকি তা স্তব্ধ হয়ে যাবে। নূতন ভাবে নূতন মাত্রায় নূতন পৃথিবীকে সৃষ্টি করা হবে। [ দেখুন ১৪ : ৪৮ ও টিকা ১৯২৫ ]। শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সাথে সাথে প্রতিটি আত্মা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে, সে হবে স্মৃতিভ্রংশ অথবা সময়, স্থান ও নিজের অস্তিত্বের জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। শিঙ্গায় দ্বিতীয় বার ফুৎকারের সাথে সাথে সকল মানুষ দণ্ডায়মান হয়ে যাবে। "তাকিয়ে থাকবে " - অর্থাৎ এ সময়ে তাদের দৃষ্টি হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং পূর্বে যা তাদের দৃষ্টির অগোচরে ছিলো তাও দৃষ্টি গোচর হবে। এ সময়েই বিচার কার্য আরম্ভ হবে।
৬৯। এবং বিশ্বভূবন উহার প্রতিপালকের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে, ৪৩৪৪। আমলনামা খুলে রাখা হবে। নবীদের ও সাক্ষীদের উপস্থিত করা হবে, এবং সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে ৪৩৪৫। এবং তাদের প্রতি সামান্য [ পরিমাণও ] অন্যায় করা হবে না।
৪৩৪৪। কেয়ামতের পর নূতন পৃথিবী সৃষ্টি করা হবে নূতন মাত্রাতে। যার সব কিছু সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে এই পৃথিবী থেকে। সেখানে কোনও অন্যায়, অবিচার ,পাপের অন্ধকার থাকবে না। নিখিল-বিশ্ব আল্লাহ্র একত্বের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আল্লাহ্ মহামান্বিত। আল্লাহ্র সত্বা সর্ব কিছুকে বেষ্টন করে থাকবে - সত্যের আলোয় জগৎ সংসার উদ্ভাসিত হবে। যত মিথ্যা , পাপ , মিথ্যা ভনিতা, দৃষ্টিবিভ্রম সব কিছু অদৃশ্য হয়ে যাবে। সব কিছুর প্রকৃত রূপ প্রতিভাত হবে।
৪৩৪৫। শেষ বিচার দিবসের পটভূমির দৃশ্য এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র সিংহাসনের সামনে সকল মানুষ সমবেত হবে। প্রত্যেকের সম্মুখে তাদের আমলনামা খোলা থাকবে - যা পৃথিবীতে তাদের খুঁটিনাটি কার্যবিবরণ। কাজের উদ্দেশ্য বা নিয়ত , পরিবেশ, সকল কিছুর খুঁটিনাটি বিবরণ সেখানে প্রতিভাত হবে। নবী , রসুল ,সত্যের প্রচারক , শহীদগণ যারা সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন সকলকে সেই বিচার সভায় উপস্থিত করা হবে সাক্ষী হিসেবে। বিচারের রায় হবে সর্বোচ্চ ন্যায়। কারণ যিনি বিচারক তিনি শুধু যে ন্যায় বিচারক তাই-ই নয়, তিনি সকলের কাজের উদ্দেশ্য ,পরিবেশ ,সকল খুঁটিনাটি ঘটনা জ্ঞাত, যা সাধারণ মানুষ ভুলে যায়। আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, ছোট , বড় সকল কিছুকেই মূল্যায়ন করবে।
৭০। প্রতিটি আত্মাকে তার কাজের পূর্ণ [ ফল ] দেয়া হবে। এবং তারা যা করে [আল্লাহ্ ] তা ভালোভাবেই জানেন ৪৩৪৬।
৪৩৪৬। পৃথিবীর বিচারালয়ে অনেক সময়েই ন্যায় বিচারের নামে প্রহসন সংঘটিত হয়। কারণ বিচারকের পক্ষে সকল সময়ে ঘটনার পটভূমি , উদ্দেশ্য , প্রভৃতি জানা সম্ভব হয় না। অনেক সময়েই বাক্ পটিয়সী উকিল প্রকৃত ঘটনাকে কৌশলে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয় , সেক্ষেত্রে বিচারকের বিচার ন্যায় বিচার হয় না। কিন্তু কেয়ামতের পরে শেষ বিচারের বিচার সভা হবে ভিন্ন প্রকৃতির। কোনও প্রতারণা বা ভুল ভ্রান্তির স্থান সেখানে থাকবে না। কারণ আল্লাহ্র নিকট অতীত, বর্তমান , ভূত ভবিষ্যত কিছুই গোপন থাকবে না। তিনি সর্বজ্ঞাত এবং সকলের থেকে সব চেয়ে বেশী ওয়াকিবহাল।
রুকু - ৮
৭১। অবিশ্বাসীদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করা হবে ৪৩৪৭। যতক্ষণ না তারা উহার নিকটে উপস্থিত হবে, [ তখন ] উহার প্রবেশদ্বারগুলি খুলে দেয়া হবে। এবং উহার রক্ষীরা বলবে ৪৩৪৮ , " তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট কি রাসুল আসে নাই , যারা তোমাদের নিকট তোমাদের প্রভুর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করতো , এবং এই দিনের সাক্ষাত সম্বন্ধে তোমাদের সর্তক করে দিত ? " উত্তর হবে, "হ্যাঁ, [ এসেছিলো ]" ; বস্তুত অবিশ্বাসীদের প্রতি শাস্তির কথা বাস্তবায়িত হয়েছে। " ৪৩৪৯
৪৩৪৭। দলে দলে বা যুমার এই শব্দটি থেকে সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। আত্মার গহীনে ডুব দিয়ে প্রতিটি আত্মাকে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে প্রকৃত সত্যের। যদি কেউ প্রকৃত সত্যের সন্ধান লাভ না করে, আত্মার মাঝে সত্যের বন্ধনকে দৃঢ় না করে ; আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপন্ন না করে , তবে সে আত্মা হবে বিভ্রান্ত দিগ্ভ্রান্ত। এদেরকে শেষ বিচারের দিনে জনসাধারণের ভীড় বা দলে দলে জনসাধারণ বলা হয়েছে।
৪৩৪৮। "জাহান্নামের রক্ষীরা " - সম্ভবতঃ এরা হচ্ছেন ফেরেশতা যারা পৃথিবীতে মানুষের অন্যায় ও পাপ কাজ সম্বন্ধে কোনও ধারণাই রাখেন না। সুতারাং তারা এই বিশাল জনগোষ্ঠির জাহান্নামের দিকে আগমন দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়বেন।
৪৩৪৯। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৩৩ ]। সম্ভবতঃ উত্তরটি ছিলো অপর ফেরেশতার। হ্যাঁ ; তাদের নিকটও আল্লাহ্ তাঁর দূতদের প্রেরণ করেছিলেন। নবী রসুলেরা তাদের সাবধান করেছেন , তাদের মাঝে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে প্রচার করেছেন ; অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র ক্ষমা প্রার্থনার উপদেশ দিয়েছেন। যেহেতু তারা এ সবের কিছুতেই কর্ণপাত করে নাই সুতারাং এখন পূর্বনির্ধারিত শাস্তি তাদের উপরে নিপতিত হয়েছে। কারণ তারা ছিলো বিদ্রোহী এবং উদ্ধত। তারা সত্যকে প্রতিহত করেছে , বিশ্বাসকে অবিশ্বাস দ্বারা দমিত করেছে এবং আল্লাহ্র করুণাকে অবহেলা করেছে।"
৭২। [ তাদের ] বলা হবে , " জাহান্নামের দ্বারাসমূহে প্রবেশ কর, সেখানে বসবাস করার জন্য। উদ্ধতদের জন্য [ তা ] কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল ! " ৪৩৫০
৪৩৫০। "কত নিকৃষ্ট উদ্ধতদিগের আবাসস্থল " - উদ্ধতপনা হচ্ছে আত্ম অহংকারের সর্বোচ্চ রূপ এবং তা হচ্ছে সকল পাপের শিকড় বা মূল। শয়তানের উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এই সত্যকে শিক্ষা দিয়েছেন। দেখুন [ ২ :৩৪ ] আয়াত এবং আরও অনেক আয়াত।
৭৩। যারা তাদের প্রভুকে ভয় করতো তাদেরকে দলে দলে [ বেহেশতের ] বাগানে পরিচালিত করা হবে ৪৩৫১ , যতক্ষণ না তারা উহার নিকটে পৌঁছাবে, [ তখন ] উহার দ্বারাসমূহ খুলে দেয়া হবে। এবং উহার রক্ষীরা বলবে, " তোমাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক ! তোমরা খুব ভাল কাজ করেছ ৪৩৫২। তোমরা এখানে প্রবেশ কর বসবাস করার জন্য।"
৪৩৫১। পূণ্যাত্মারাও দলে দলে জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে। অর্থাৎ শেষ বিচারের দিনে পূণ্যাত্মা ও পাপীদের সম্পূর্ণরূপে দু শ্রেণীতে বাছাই করা হবে। আয়াত [৭৩ -৭৫ ] কে আয়াত [ ৭১-৭২ ] এর পটভূমিতে তুলনা করলে এ কথার সত্যতা মেলে।
৪৩৫২। বেহেশতের ফেরেশতারা দলে দলে পূণ্যাত্মাদের আগমনে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য বোধ করবে না। তারা সন্তুষ্টি লাভ করবে তারা পূণ্যাত্মাদের শান্তির সম্ভাষণ দ্বারা শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবে ,অভিনন্দন জ্ঞাপন করবে, সাদরে তাদের মাঝে আহ্বান করবে।
৭৪। তারা বলবে, " সকল প্রশংসা আল্লাহ্র ৪৩৫৩ , যিনি আমাদের সাথে তার অঙ্গীকার সত্যিই পূরণ করেছেন এবং আমাদের [ এই ] দেশের অধিকারী করেছেন ৪৩৫৪। আমরা এই উদ্যানে যেখানে যেভাবে ইচ্ছা বাস করতে পারি। যারা [ সৎ ] কাজ করে তাদের জন্য পুরষ্কার কত উত্তম।"
৪৩৫৩। যারা বেহেশতে প্রথম প্রবেশ লাভ করবে এটা হবে তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা। প্রারম্ভে আল্লাহ্র প্রশংসা কীর্তনের মাধ্যমে তারা তাদের বক্তব্য শুরু করবে যা তাদের জন্য উপযুক্ত। তারা সর্বান্তকরণে আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করবে।
৪৩৫৪। "অধিকারী " - এর অর্থ এই নয় যে, তারা বেহেশতে কিছু সম্পত্তির অধিকার লাভ করেছেন। তারা তাদের জীবনের শেষ পরিণতিতে বেহেশতের অনন্ত সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করার অধিকার লাভ করবে এবং পরম করুণাময়ের সান্নিধ্যে জীবনকে ধন্য করবে।
৭৫। আর তুমি ফেরেশতাদের দেখবে [ স্বর্গীয় ] আরশের চারিদিকে ঘিরে তাদের প্রভুর প্রশংসা এবং মহিমা সংগীত করছে। এবং তাদের মধ্যে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করা হবে, এবং [ সকল দিক ] থেকে বলা হবে, " সব প্রশংসা আল্লাহ্র, যিনি জাহান সমূহের প্রভু।" ৪৩৫৫
৪৩৫৫। " সব প্রশংসা আল্লাহ্র , যিনি জাহান সমূহের প্রভু " - এই বাক্যটি দ্বারা কোরাণ শরীফের প্রথম সূরার আরম্ভ করা হয়। এই আয়াতে বেহেশতের সর্বোচ্চ শান্তির রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। জগত সমূহের প্রতিপালকের মহিমা , প্রশংসা ও পবিত্রতা ও তাঁর সান্নিধ্যের উপলব্ধি আত্মাকে পরিপূর্ণ শান্তির মাঝে নিমজ্জিত করবে।