সূরা হা- মীম
সূরা হা- মীম বা সংক্ষিপ্ত অক্ষর অথবা আস্ - সাজ্দা অথবা ফুসিলত -৪১
৫৪ আয়াত , ৬ রুকু
[ দয়াময় , পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : " হা-মিম " দিয়ে শুরু হয়েছে যে সব সূরা সেই শ্রেণীর সাতটি সূরার এটি দ্বিতীয় সূরা। এ সূরার শিরোনাম হা-মিম্। এই শিরোনাম যাতে হা-মিম শ্রেণীর সূরাগুলির নামকরণের সাথে বিভ্রান্তি না ঘটায় সে জন্য সূরাটির নাম হা-মিমের সাথে আস্ সাজদা যোগ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ সূরাটির নাম হয়েছে হা-মিম ,আস্ সাজদা। দুটো নামকে এক সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে কারণ সাজ্দা নামে আর একটি সূরা আছে [ সূরা নং ৩২ ]। দুটি শিরোনামের অসুবিধা দূর করণের জন্য অনেক সময়ে এই সূরার তিন নম্বর আয়াতে দ্রষ্টব্য "ফুসিলত" শব্দটি অনুযায়ী "ফুসিলত" নামকরণ করা হয়।
সুরা ৪০ নং এর ভূমিকায় হা-মিম শ্রেণীর সময় কাল সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছেঃ বিশ্বাসের এবং প্রত্যাদেশের ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ্র ক্ষমতা ও করুণা , যার ফল হচ্ছে মুত্তাকী অর্জন ও আধ্যাত্মিক শান্তি।
সার সংক্ষেপ : প্রত্যাদেশ ও বিশ্বাস কি ? এই দুয়ের প্রতি মানুষের মনোভাব কি ? এবং এই মনোভাবের পরিণতি কি ? [ ৪১ : ১ - ৩২ ]।
বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এবং সত্য ও মিথ্যার ফলাফল কি ? [ ৪১ : ৩৩ - ৫৪ ]।
সূরা হা- মীম বা সংক্ষিপ্ত অক্ষর অথবা আস্- সাজ্দা অথবা ফুসিলত - ৪১
৫৪ আয়াত , ৬ রুকু
[ দয়াময় , পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
০২। দয়াময় পরম করুণাময় আল্লাহ্র নিকট থেকে ৪৪৬৩, -
৪৪৬৩। পূর্বের সূরাতে [ ৪০ নং ] বলা হয়েছে যে কোরাণ এসেছে মহাপরাক্রমশালী ও সর্বজ্ঞ আল্লাহ্র নিকট থেকে। সেখানে কোরাণের উল্লেখের সাথে আল্লাহ্র গুণাবলীর উল্লেখ আছে। এই সূরার আয়াতে কেরাণের বিষয় বস্তুর উল্লেখ করা হয়েছে।
১) কোরাণ হচ্ছে সুসংবাদ দাতা ও সর্তককারী।
২) এই কিতাবে কোন কিছু অস্পষ্টরূপে বলা হয় নাই , এখানে সকল কিছু সুস্পষ্টরূপে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
৩) এই কিতাব আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ হয়েছে , এর একমাত্র কারণ এই ঐশী বাণী প্রথম যাদের মাঝে প্রচারিত হবে তারা সকলে আরবী ভাষী। সুতারাং মাতৃভাষাতে আল্লাহ্র বাণীর নূর, বক্তব্য, অনুধাবন করা তাদের পক্ষে অনেক সহজ হবে।যদি তারা তা করতে চায়।
৪) এই কিতাব অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতার কথা বলে এবং আধ্যাত্মিক জগতের বিপদ সম্বন্ধে সর্তক করে।
০৪। সুসংবাদদাতা এবং সর্তককারী স্বরূপ, তথাপি অধিকাংশ লোক মুখ ফিরিয়ে নেয়, সুতারাং তারা [ কিছুই] শোনে না ৪৪৬৪।
৪৪৬৪। যদি কেউ আন্তরিক ভাবে কোরাণের বাণী অনুধাবন করার ইচ্ছা রাখে তবে কোরাণ পাঠ তার আধ্যাত্মিক জগতের প্রভূত উপকার সাধিত করবে। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছা পোষণ না করে তবে কোরাণ পাঠের দ্বারা সে কোন আত্মিক উপকার লাভ করবে না। কোরাণ পাঠের দ্বারা আধ্যাত্মিক জগতে আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভ না করার কারণ তাদের ইচ্ছার অভাব। ফলে তারা আত্মার মাঝে আল্লাহ্র হেদায়েত অনুভবে অক্ষম হয়।
৪৪৬৫। ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে প্রত্যাখান করার ফলে আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ ও প্রত্যাখানকারীর মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয় ; বাঁধার প্রাচীর তৈরী হয়। সে বাধার প্রাচীর অতিক্রম করে, দূরত্বকে অতিক্রম করে আল্লাহ্র বাণী তাদের আত্মার মাঝে স্থান করে নিতে পারে না। তাদের আত্মিক জগত ধীরে ধীরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।তাদের কান থাকতেও সত্যের আহ্বান শুনতে পাবে না। তারা হবে বধিরের ন্যায় - সত্যের আহ্বান তাদের শ্রবণে ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাবে। তারা আল্লাহ্র প্রেরিত রাসুলের সাথে নিজেদের দুস্তর ব্যবধানের সৃষ্টি করবে। কারণ আল্লাহ্ " সীমালঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।" [ ৪০ : ২৮ ] ও টিকা ৪৩৯৮।
৪৪৬৬। সম্পূর্ণ আয়াতটির বক্তব্য সম্ভবতঃ অবিশ্বাসীদের বিদ্রূপাত্মক ব্যঙ্গক্তি, অথবা আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতি অনীহার প্রকাশ। এই মানসিকতার প্রেক্ষিতেই তারা রাসুলকে [ সা ] বলেছিলো , " আমাদের হৃদয় ও মন তোমার মহৎ বাণী শোনার বা বোঝার উপযুক্ত নয়; তোমার ব্যাখ্যা শোনার জন্য আমাদের শ্রবণ শক্তি এতটা তীক্ষ্ণ নয় ; তুমি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ; তোমার সাথে আমাদের দুস্তর ব্যবধান। আমাদের জন্য তোমার চিন্তার কোনও কারণ নাই। তুমি তোমার পথে যাও আমরা আমাদের পথে যাব।"
উপরের বক্তব্য হচ্ছে আধ্যাত্মিক অন্ধত্বের প্রকাশ। এই প্রকাশ রাসুলের সময়ে যেরূপ বিদ্যমান ছিলো , অদ্যাবধি সমভাবে বিদ্যমান আছে অবিশ্বাসী ও অংশীবাদীদের মাঝে।
০৭। তারা যাকাত দেয় না এবং তারা পরকালকে অস্বীকার করে।
৪৪৬৭। অবিশ্বাসী ও অংশীবাদীদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপের উত্তরে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্র প্রেরিত রাসুল [ সা ] কোনও ফেরেশতা বা অতিমানব নন। তিনি আর দশজনের মতই সাধারণ মানুষ। সেক্ষেত্রে তাঁর ও অন্যের মধ্যে কোনও ব্যবধান নাই। আল্লাহ্ তাঁকে মনোনীত করেছেন সত্যকে প্রচারের জন্য এবং নিরাশ হৃদয়ে আশার বাণী শোনানোর জন্য। সুতারাং তাদের উচিত আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা আল্লাহ্র করুণা ও ক্ষমালাভ করা।
৪৪৬৮। যারা আল্লাহ্র সত্যকে অস্বীকার করে এবং মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে তাদের জন্য করুণা প্রকাশ ব্যতীত আর কিছু করার থাকে না। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে , এরা অংশীবাদী হয়, অর্থাৎ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর উপরে নির্ভরশীল। নিজ সম্প্রদায়ের জন্য এদের কোনও সহানুভূতি থাকে না ফলে তারা যাকাত দেয় না বা দান করে না। এমন কি এরা পরকালেও বিশ্বাসী নয়।
৪৪৬৯। ইসলাম ধর্মের মর্মার্থকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রতি ঈমান ও অন্তরের বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে সৎকর্মে যারা আত্মনিবেদিত তারাই ধন্য। তাদের জন্য রয়েছে " নিরবচ্ছিন্ন পুরষ্কার "।
রুকু - ২
৪৪৭০। ব্যাখ্যাদানকারীদের জন্য এই আয়াতটি ব্যাখ্যা করা কঠিন। কারণ এই আয়াতে মহাকাশ ও আমাদের চারিপাশের দৃশ্যমান পৃথিবীর সৃষ্টির বিবরণ আছে। এই আয়াতে [ ৯ নং ] পৃথিবী সৃষ্টির সময়কাল বলা হয়েছে দুইদিন, পরের আয়াতে [১০ নং ] উল্লেখ করা হয়েছে চার দিনের এবং ১২ নং আয়াতে উল্লেখ আছে দুই দিনের। তাহলে মোট দিনের সংখ্যা দাঁড়ায় আট দিন। কিন্তু কোরাণশরীফের বহুস্থানে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির সময় কালকে বলা হয়েছে ছয় দিন। দেখুন নিম্নোক্ত আয়াত সমূহ যেখানে ছয়দিনের উল্লেখ আছে ; [ ৭ : ৫৪ ] ও টিকা ১০৩১, [ ৩২ : ৪ ] ও টিকা ৩৬৩২ ; [ ১০ : ৩ ] ; [১১ : ৭] ; [ ২৫ : ৫৯ ] ; [ ৫৭ : ৪ ]। তফসীরকারদের মতে [ ৪১ : ১০ ] আয়াতে যে চারদিনেরউল্লেখ আছে, এই চারদিনের মধ্যে [ ৪১ : ৯ ] আয়াতেরদুই দিন অর্ন্তভূক্ত। তাহলেই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়াবে ছয়দিন। এই বিবরণ যুক্তিগ্রাহ্য, কারণ , প্রকৃত পক্ষে ১০ নং আয়াতটি ৯নং আয়াতের ধারাবাহিকতা। পৃথিবী সৃষ্টির চারদিনের মধ্যে দুদিন [ ৯ নং আয়াত ] ছিলো পৃথিবীর উপকরণ সৃষ্টি, পরবর্তীতে বিবর্তনের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের সৃজন যথাঃ পর্বত , সমুদ্র এবং এর প্রাণী ও উদ্ভিদ জগত এবং সেই সাথে তাদের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ সৃষ্টি। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ১৯ - ২০]।
৪৪৭১। দেখুন আয়াত [ ১৩ : ৩ ] এবং [ ১৬ : ১৫ ] ও টিকা ২০৩৮। এই আয়াতটি ইংরেজী ও বিভিন্ন বাংলা অনুবাদে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে "He set on [ earth ] mountains standings firm , high above" ইংরেজী সুউচ্চ শব্দটির স্থলে বাংলা "অটল " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৯০০০ ফিট এবং সমুদ্রের সর্বোচ্চ গভীরতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩১,০০০ ফিট। সুতারাং সর্বোচ্চ স্থান ও সর্বনিম্ন স্থানের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে ১১১/২ মাইল। পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা দেখতে পাই যে, নদী সমূহের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে পর্বতসমূহ। নদী হচ্ছে পৃথিবীর সকল প্রাণী জগত ও উদ্ভিদ জগতের পানীয় জলের এবং সর্বপ্রকার জীবন ধারণের পানির উৎস।সুতারাং পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের পানির সুচারুরূপে বিতরণের জন্য পর্বতের কার্যকারিতা অপরিসীম। আবার সুউচ্চ পর্বতসমূহ পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ চলমান শিলাস্তরকে স্থির রাখে ফলে ভূপৃষ্ঠে অহরহ ভূকম্পনের হাত থেকে রক্ষা পায়। এভাবেই আল্লাহ্ পর্বতসমূহে মানুষের জন্য "কল্যাণ রেখেছেন।"
৪৪৭৩। 'Sa-ilin' সম্ভাব্য অর্থ ; ১) যারা যাঞ্চা করে ; ২) যারা অনুসন্ধান করে। যদি ১নং অর্থটিকে প্রয়োগ করা হয় তবে অর্থ দাঁড়ায় ; আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট জীব জগতের জন্য যারা যাঞ্চা করে তাদের প্রয়োজনীয় ও উপযোগী খাদ্যের সৃষ্টি করেছেন। ৩) যদি ২নং অর্থটিকে প্রয়োগ করা হয়, তবে অর্থ দাঁড়ায় অনুসন্ধানকারীদের প্রয়োজন পর্যাপ্তভাবে মেটানো হয়।
৪৪৭৪। 'Istawa' শব্দটির জন্য দেখুন [ ১০: ৩ ] আয়াতের টিকা ১৩৮৬ এবং আয়াত [ ২ : ২৯ ]।
৪৪৭৫। [ ৭৯ : ২৭ - ৩০ ] আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী , প্রথমে আকাশমন্ডল সৃষ্টি করা হয়, তৎপর পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়। বর্তমান সূরাতে পৃথিবীর সৃষ্টি ও তৎপর পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনকে প্রথমে বর্ণনা করা হয় ; অতঃপর আসমানকে সপ্তস্তরে বিন্যস্ত করার বর্ণনা করা হয়। কেউ যেনো এই দুই বর্ণনাকে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে না করে। কারণ বর্তমান আয়াতের [ ৪১ : ১১ ] বর্ণনা অনুযায়ী আকাশকে সপ্ত আকাশে বিন্যস্ত করার পূর্বেও এর অবস্থান ছিলো তবে তা ছিলো ধূম্রকুন্ডের ন্যায় বা বাষ্পের ন্যায় কুয়াশাচ্ছন্ন। বিভিন্ন আয়াতে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির বর্ণনাকে একত্রীকরণ করলে এই সিন্ধান্তে আসা যায় যে , আল্লাহ্ প্রথমে বস্তুর আদি অবস্থা সৃষ্টি করেন যা তখনওনির্দ্দিষ্ট আকার বা সামঞ্জস্য বা শৃঙ্খলার জন্য বিন্যস্ত করা হয় নাই। নিখিল বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বের বিশৃঙ্খল অবস্থা যা পরবর্তীতে সুশৃঙ্খল সৃষ্টি রহস্যে পর্যবসিত করা হয়। বিশৃঙ্খল অবস্থার পরে পরবর্তী ধাপে ধীরে ধীরে স্থিতি লাভ করে এবং ঠান্ডা হয়ে আদি বস্তু সমূহে পরিণত হয় যেমন : গ্যাস, তরলপদার্থ, কঠিন পদার্থ ইত্যাদি। পৃথিবী সৃষ্টি সম্বন্ধে বলা হয়েছে চারটি ধাপ বা দিন এবং আকাশ সৃষ্টি সম্বন্ধে বলা হয়েছে দুইটি ধাপ বা দিন। এখানে দিনের ধারণা আমাদের দিন ও রাত্রির ধারণার মত নয়। সে কারণেই দিনকে ধাপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সময়ের ধারণা হচ্ছে একটি আপেক্ষিক ধারণা মাত্র। দেখুন টিকা ৪৪৭৭। বর্তমান বিজ্ঞান এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম।
৪৪৭৬। এই আয়াতটি মওলানা ইউসুফ আলী সাহেব এ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নিখিল বিশ্ব সৃষ্টির পরিকল্পনাতে আল্লাহ্র ইচ্ছা ছিলো যে, পৃথিবী ও নভোমন্ডল আলাদা অবস্থান করবে না। বরং তারা পৃথিবী ও আকাশ এক সাথে অবস্থান করবে। অবশ্যই পৃথিবী সৌর জগতের ও মহাবিশ্বের একটি অংশ হবে। অনন্ত মহাকাশে পৃথিবীসহ সৌরমন্ডল সাঁতরে চলেছে , অতিক্রম করে চলেছে ধুমকেতুদের গতিপথ। মহাকাশের যাবতীয় সৃষ্ট পদার্থ স্ব-ইচ্ছায় স্রষ্টার নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে থাকে।
৪৪৭৭। 'দিনের বা সময়ের ধারণা হচ্ছে আপেক্ষিক। কোরাণের বর্ণিত "দিন" আমাদের দিন-রাত্রির ধারণাতে সহস্র সহস্র বৎসরের সমান। [ ৭০ : ৪ ] আয়াতে বলা হয়েছে আমাদের পঞ্চাশ হাজার [ ৫০,০০০ ] বৎসরের সমান একদিন। বাইবেলের সৃষ্টিতত্বের সাথে [ Gen :i and ii, 1-7 ] প্রাচীন ব্যবিলন সভ্যতার সৃষ্টিতত্বের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে দিনকে আক্ষরিক ভাবেই দিন গণনা করা হয়েছে। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম দিন ঈশ্বর আলোর সৃষ্টি করেন, দ্বিতীয় দিনে আকাশের স্তর, তৃতীয় দিনে পৃথিবী ও পৃথিবীর উদ্ভিদ, চর্তুথ দিনে তারা ও গ্রহ , নক্ষত্র ; পঞ্চম দিনে সমুদ্র থেকে মাছ ও পক্ষীকূল ;ষষ্ঠদিনে পশু ; প্রাণী ইত্যাদি এবং মানুষ ; সপ্তম দিনে ঈশ্বর তাঁর কর্ম শেষে বিশ্রামে যান। মুসলিম দর্শনে কোরাণের বর্ণনা সম্পূর্ণ আলাদা। ১) আল্লাহ্ এই বিশাল নভোমন্ডল , বিশ্ব-ভূবন ,বিশ্ব চরাচরের সকল সৃষ্টিকে সর্বদা পরিবেষ্টন করে আছেন। এবং সর্বদা সেখানে সৃষ্টি প্রক্রিয়া অব্যাহত গতিতে চলে আসছে। এক মূহুর্তের জন্যও তা থেমে থাকে না। এই অবিরাম সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় তিনি কখনও ক্লান্ত বোধ করেন না বা তাঁর কোনও বিশ্রামের প্রয়োজন হয় নাই। আল্লাহ্ অতন্দ্র ভাবে তার সৃষ্টিকে রক্ষা করে চলেছেন। [ আয়াতল কুরশীতে আল্লাহ্র এই গুণবাচক বর্ণনাটি তুলে ধরা হয়েছে ]। ২) আল্লাহ্র সৃষ্টি শেষ হয়ে যায় নাই। প্রতিনিয়ত তা অব্যাহত গতিতে চলছে। নভোমন্ডল থেকে মাটির পৃথিবী সর্বত্রই একই গতিতে নূতন সৃষ্টি প্রক্রিয়া অব্যাহত গতিতে চলে আসছে সেই অনাদি কাল থেকে, ভবিষ্যতেও চলবে। [৩২ : ৫ ; ৭: ৫৪ ] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এই সমুদয় বিষয় আল্লাহ্র আয়ত্বাধীন। ৩) মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের সাথে একই সময়ে পৃথিবীতে আগমন করে নাই। তার আগমন প্রাণীদের আগমনের বহু পরে। ৪) বাইবেলের বর্ণনার মাঝে বহু অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায় যেমন : চর্তুথদিনের গ্রহ নক্ষত্রের সৃষ্টি হলে প্রথম তিন দিনের হিসাব মেলানো কঠিন। কঠিন হয়ে পড়ে উদ্ভিদের সৃষ্টিতত্ব। এ ব্যাপারে মরিস বুকাইলির বিখ্যাত গ্রন্থে আলোকপাত করা হয়েছে। কোরাণের সৃষ্টিতত্বের যে ছয়টি ধাপ বর্ণনা করা হয়েছে তা অবাধ ও উন্মুক্ত সেগুলি হলো : ১) আমাদের ও অন্যান্য গ্রহের সৃষ্টি 'Cosmic Matter' বা পদার্থের আদিরূপের বিষ্ফোরণ থেকে ; ২) ধীরে ধীরে ঠান্ডা হওয়া থেকে ৩) ও ৪) উদ্ভিদের উৎপত্তি ও প্রাণীর সৃষ্টি ; ৫) এবং ৬) সমান্তরাল ভাবে সপ্ত আকাশের সৃষ্টি। কোরাণের সৃষ্টিতত্বের এই বর্ণনা বিজ্ঞানের তত্বের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ।
৪৪৭৮। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ১৭ ] ও টিকা ১৯৫১ এবং আয়াত [ ৩৭ : ৬-৯ ]। লক্ষ্য করুন আয়াত সমূহে যতক্ষণ সৃষ্টিতত্বের বর্ণনা করা হয়েছে, ততক্ষণ 'তিনি ' বা তৃতীয় পুরুষ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এই বাক্যে তৃতীয় পুরুষ 'তিনি' র স্থলে প্রথম পুরুষ 'আমি ' ব্যবহার করা হয়েছে। সৃষ্টি প্রক্রিয়া নৈবর্ত্তিক বা অব্যক্তিগত। কিন্তু সুশোভিত ও সুরক্ষিত করা হচ্ছে ব্যক্তিগত কাজ। সৃষ্টিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্র করুণার সাক্ষর হিসেবে সৃষ্ট পদার্থ ও প্রাণের জন্য আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ বর্ণনা করা হয়েছে। সেই কারণে ভাষাকে সৌন্দর্যমন্ডিত ও গুরুত্ব আরোপ করার জন্য তৃতীয় পুরুষ থেকে প্রথম পুরুষে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
৪৪৭৯। দেখুন আয়াত নং ১৭।
৪৪৮০। "সম্মুখ ও পশ্চাৎ দিক থেকে " অর্থাৎ সকল দিক থেকে জীবনের চলার পথের প্রতিটি দিক্ থেকে তাদের সর্তক করা হয়েছিলো সেই কথাকেই এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
৪৪৮১। দেখুন আয়াত [ ১৫ : ৭ ] ও টিকা ১৯৪১ ; আয়াত [ ৬: ৮-৯ ] ও টিকা ৮৪১ - ৪২। রাসুলের [ সা ] সমসাময়িক আরব মোশরেকদের তুলনায় আদ্ জাতি, সম্পদ , ক্ষমতা ও শক্তিতে ছিলো শ্রেষ্ঠ। বলা চলে তুলনাহীন। জাগতিক সম্পদের যত প্রাচুর্য ঘটে, তত মানুষের মাঝে দম্ভ , অহংকার উদ্ধতপনার জন্ম হয়।
৪৪৮২। "দম্ভ প্রকাশ করত " ; দেখুন আয়াত [৭ : ৩৩ ]। পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সম্পদ , ক্ষমতা, শক্তির দম্ভ হয়তো যুক্তিসঙ্গত ছিলো। কিন্তু তাদের সকল ক্ষমতা ও শক্তিকে একত্রীভূত করলেও কি তা আল্লাহ্র শক্তির সাথে তুলনীয় ?
উপদেশ : পার্থিব ধন সম্পদ ও ক্ষমতা এভাবেই মানুষকে উদ্ধত ও একগুয়ে পরিণত করে। দম্ভ , অহংকার তার সর্ব সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফলে তার চরিত্র থেকে বিনয় ও আনুগত্য লোপ পায় এবং সে এক আল্লাহ্র এবাদতে বিমুখ হয়।
৪৪৮৩। আদ জাতি ও তাদের পাপের পূর্ণ বিবরণ এবং তাদের নিকট আল্লাহ্র বাণী প্রচার করেছিলেন যে হুদ নবী তার বিবরণ আছে [ ২৬ : ১২৩ -১৪০ ] ; ৭ : ৬৫-৭২ ] আয়াত ও টিকা ১০৪০। "ঝঞ্ঝাবায়ু" এর জন্য দেখুন [ ৫৪ : ১৯ ] আয়াত।
৪৪৮৪। সাধারণতঃ কোরাণ শরীফে সর্বদা সামুদ জাতির কাহিনী আ'দ জাতির সাথেই বর্ণনা করা হয়েছে। দেখুন সূরা [ ২৬ : ১৪০ - ৫৯ ] আয়াত এবং সূরা [ ৭ : ৭৩ -৭৯ ] আয়াত ও টিকা ১০৪৩।
৪৪৮৫। এই আয়াতে শাস্তির বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে তা ছিলো "লাঞ্ছনাদায়ক " - ইংরেজী অনুবাদে অনুবাদ করা হয়েছে "Thunderbolt of the Chastisement"। সামুদ জাতির ধ্বংস হয়েছিলো কর্ণ বিদায়ক শব্দ সহ বজ্র ও বিদ্যুৎ অথবা ভূমিকম্পের বিকট শব্দ সহ শাস্তি। সূরা [ ৭ : ৭৮ ] এর বর্ণনা অনুযায়ী তা ছিলো ভূমিকম্প দেখুন আয়াতের টিকা ১০৪৭।
৪৪৮৬। " তারা সারিবদ্ধভাবে অগ্রসর হবে " - বর্ণনার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে পাপীদের অবমাননাকর শাস্তির চিত্র। বন্দীদের যেরূপ শাস্তির জন্য সারিবদ্ধভাবে লওয়া হয় এ যেনো তারই প্রতিচ্ছবি।
৪৪৮৭। তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ ও মনের বিভিন্ন দক্ষতা , আল্লাহ্ যা তাদের দান করেছিলেন -সব তাদের অপব্যবহারের জন্য পাপীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে। একই ভাষ্য লক্ষ্য করা যায় সূরা [ ৩৬: ৬৫ ] আয়াতে যেখানে বলা হয়েছে , তাদের হস্তদ্বয় ও পদদ্বয় তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দান করবে।ত্বক অপব্যবহারের বিভিন্ন ধরণ আছে তার মাঝে প্রধান হচ্ছে স্পর্শ যা যৌন আবেদন ও যৌন অপকর্মের সময়ে প্রধানতঃ ব্যবহার হয়। এ ব্যতীত জিহ্বার স্বাদ, ঘ্রাণের অনুভূতি, এগুলিকেও স্পর্শের অনুভূতির পর্যায়ে একই শ্রেণীভুক্ত বলা চলে। এক কথায় বলা চলে , তাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শরীরের সকল অংশ, বুদ্ধিমত্তার সকল দক্ষতা , আবেগ ও অনুভূতির সকল দরজা , সব কিছুই সেদিন আল্লাহ্র দরবারে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবেন। পৃথিবীতে এ সব আল্লাহ্র দান, ব্যক্তি তার নিজস্ব সম্পদরূপে পরিগণিত করতো। তার পার্থিব উন্নতির জন্য সে এসব অহরহ ব্যবহার করেছে। এই ব্যবহারের সময়ে সে পাপ বা পূণ্য কোনও কিছুরই বিচার করে নাই। পৃথিবীতে যার সাহায্যে সে জাগতিক উন্নতি সাধন করে থাকে শেষ বিচারের দিনে, হিসাব গ্রহণের দিনে সে সব সম্পদের সঠিক হিসাব দাখিল করতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে অপব্যবহারের।
৪৪৮৮। হাশরের ময়দানে পাপীরা নূতন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবে। পৃথিবীতে তাদের ধারণা ছিলো যে যদি তারা তাদের কুকর্মকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে সক্ষম হয়, তবে পৃথিবীর কেউ তাদের পাপের বিবরণ জানতে পারবে না।ফলে তারা কোনওরূপ ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। তারা আল্লাহ্র ক্ষমতার কথা ভুলে গিয়েছিলো। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে বৃক্ষের জবান দিতে পারেন। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। মানুষের জীবনের জানা ও অজানা সকল তথ্য আল্লাহ্র নিকট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগ্রীহিত হয়ে থাকে। আমাদের শরীর , মন , আত্মা, সব কিছুই আমাদের কর্মের সাথী হয়ে অনন্তের মাঝে সংরক্ষিত হয়। আর এই সাক্ষীই সত্যকে তুলে ধরে ন্যায় বিচারকে স্পষ্ট করবে। যখন আমরা পাপের নিকট আত্মসমর্পন করি, আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ , আমাদের বুদ্ধিমত্তা , কর্মদক্ষতা, স্রষ্টা প্রদত্ত সকল অনুগ্রহ পাপে সহায়তা করতে বাধ্য হয় কিন্তু শেষ বিচারের দিনে এরাই সাক্ষী হিসেবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
৪৪৮৯। আয়াতের এই বক্তব্যটি পাপীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মানসিক দক্ষতা সমূহের। তারা বলবে, " তোমরা তোমাদের পাপসমূহ আমাদের নিকট থেকে গোপন কর নাই। প্রকৃতপক্ষে তোমরা আমাদের ব্যবহার করেছ, তোমাদের পাপ কার্য সিদ্ধির জন্য। আমরা ছিলাম তোমাদের অধীনে। তোমাদের বিশ্বাস ছিলো আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিব না , তোমরা কি জানতে না যে, আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ তিনি সব জানেন এবং আমাদের জ্ঞান তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে কাজ করবে ? "
৪৪৯০। উপরের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা এই আয়াত। বক্তব্য হচ্ছে : " এখন দেখ অবস্থা কিরূপ ? আমাদের তোমাদের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছিলো আমাদের ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মিক সমৃদ্ধি লাভ করা ও আত্মিক মুক্তির অনুসন্ধান করার জন্য। কিন্তু তোমরা আমাদের অপব্যবহার করেছ। ফলে তোমরা তোমাদের ধ্বংস ডেকে এনেছ।"
৪৪৯১। " যদি তারাধৈর্য্য ধারণ করে তবুও " - এই বাক্যটি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ অর্থে ব্যক্ত করা হয়েছে , যার অর্থ " এখন আর অধৈর্য হয়ে লাভ নাই। কারণ শীঘ্রই তারা তাদের শেষ নিবাস জাহান্নামের আগুন দেখতে পাবে। তারা যদি তখন আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও করুণা ভিক্ষা করে , তবে তা পাবে না , কারণ অনুগ্রহ লাভের জন্য তা হবে অনেক দেরী।
৪৪৯২। বেহেশতের বর্ণনায় সঙ্গীর কথা উল্লেখ আছে। সুখ-শান্তি একা ভোগ করে তৃপ্তি লাভ করা যায় না। তাই বেহেশতের বর্ণনায় অন্যান্য জিনিষের সাথে সাথীর উল্লেখও আছে। কারণ মানুষ সামাজিক জীব সগোত্র সমাজে বাসে তার সুখ শান্তির অনুভূতি আরও তীব্র করবে। অপরপক্ষে দোযখের শাস্তি আরও তীব্র ভাবে অনুভূত হবে মন্দ সঙ্গীর অবস্থানে। মন্দ সেখানে মন্দের সঙ্গ লাভ করবে। পৃথিবীর জীবনে যারা পাপ কার্যকে তাদের চোখে মনোহর করেছিলো ; পরলোকে জাহান্নামে তারাই হবে তাদের সাথী - যারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে দুঃখের বোঝাকে আরও ভারী করে তুলবে। প্রকৃত পক্ষে "হা-মিম" শ্রেণীর সূরাগুলিতে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, পূণ্যাত্মার জন্য আছে ভালো সঙ্গ এবং পাপীদের জন্য তাদের কৃতকর্মের দোসর ; যা প্রতিটি সূরার বক্তব্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
৪৪৯৩। পৃথিবীতে পাপীদের সহচররা পাপ কাজকে মনোহর করে চিত্রিত করেছিলো এবং ভবিষ্যতকেও তারা আশা আকাঙ্খা ; সুখ ও শান্তির প্রতীকরূপে উপস্থাপন করে। এভাবেই তাদের সহচররা বর্তমান ও ভবিষ্যত উভয়কে পাপের পথে প্রতারিত করে। পরলোকে এই সব প্রতারণা তাদের চোখে ভাস্বর হবে। "সম্মুখ ও পশ্চাত" অর্থ ভবিষ্যত ও অতীতের কার্য।
৪৪৯৪। "জ্বিন" সম্পর্কে দেখুন আয়াত [৬ : ১০০ ] ও টিকা ৯২৯। সকল মন্দ ও দুষ্ট আত্মা , অতীতে যারা পাপের নিকট আত্মসমর্পন করেছিলো এবং বর্তমানের লোকেরা , সকলেই সমভাবে শাস্তি ভোগ করবে। এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের যারা পাপের পথ অবলম্বন করবে, তাদেরও ঐ একই পরিণতি।
৪৪৯৫। এই লাইনটি ২৩নং আয়াতের ন্যায়। এখানে যুক্তিকে শেষ করা হয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
রুকু - ৪
৪৪৯৬। যারা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে অস্বীকার করে , তাদের একটি প্রধান কূটকৌশল ছিলো যে, তারা কোরাণ আবৃত্তি শুনতো না। শুধু তাই-ই নয় , অন্য কেউ যাতে শুনতে না পারে সে জন্য সে সময়ে তারা উচ্চস্বরে কথা বলতো এবং উদ্ধতভাবে গন্ডগোলের সৃষ্টি করে, যেনো যারা প্রকৃত শ্রোতা তারা কোরাণ আবৃত্তি বুঝতে না পারে। এবং কোরাণ থেকে কোনও শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারে। তারা মনে করতো এভাবে তারা আল্লাহ্র বাণীর মাহত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে সক্ষম হবে। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্র বাণীকে স্তব্ধ করার ক্ষমতা কারও নাই। অপর পক্ষে এসব ব্যক্তিরা নিজের দুঃখ কষ্টের বোঝা নিজেই বৃদ্ধি করে।
মন্তব্য :মাইকে সর্বক্ষণ কোরাণ আবৃত্তির যে রেওয়াজ আমাদের দেশে চালু আছে তা কোরাণের প্রতি অবমাননাকর।
২৮। আগুন ! - এই-ই হবে আল্লাহ্র শত্রুদের জন্য পরিশোধ। সেখানে তাদের জন্য থাকবে অনন্ত কালের আবাস। [ উপযুক্ত ] পরিশোধ , কারণ তারা অভ্যস্ত ছিলো আমার নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখান করতে।
৪৪৯৭। পাপীদের শেষ পরিণাম ভয়াবহ। সেদিন কোন কিছুই তাদের আল্লাহ্র শাস্তি থেকে অব্যহতি দান করতে পারবে না। কারণ পৃথিবীতে তারা আল্লাহ্র নিদর্শনকে প্রত্যাখান করেছিলো , যার পরিণতিতে তাদের জন্য আল্লাহ্র সকল করুণা , দয়া ও অনুগ্রহের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
৪৪৯৮। দুষ্ট ও পাপীদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্যকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। দুষ্ট ও পাপীরা যখন দুঃখ বিপর্যয়ে নিপতিত হয়, তখন তার মনে উদগ্র আকাঙ্খা থাকে অপরেও তাদের পর্যায়ে নিপতিত হোক।অন্যের অবমাননা ও অপমান তাদের চিত্তকে উৎফুল্ল করে। মন্দ ও দুষ্ট লোকদের মানসিক এই প্রতিক্রিয়া যে, শুধুমাত্র পরলোকেই ঘটবে তাই নয়, তাদের মানসিকএই প্রতিক্রিয়া ইহলোকেও সমভাবে বিদ্যমান। এ সব মন্দ লোক পৃথিবীতে সাধারণতঃ খুবই পরশ্রীকাতর হয়। অপরপক্ষে , যারা ভালো লোক , পূণ্যাত্মা লোক, তারা অন্যকে সাহায্য করে আনন্দ লাভ করে এবং অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারলে তারা সুখী হন। দেখুন আয়াত [ ৬ : ১১২ - ১১৩ ]।
৪৪৯৯। যারা পরলোকের অনন্ত জীবনে সাফল্য লাভে আগ্রহী , তারা এই শ্বাসত সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করে যে আল্লাহ্-ই একমাত্র চিরন্তন সত্য। সুতারাং তারা তাদের পৃথিবীর শিক্ষানবীশ কালকে দৃঢ়তার সাথে ও অধ্যবসায়ের সাথে আল্লাহ্র আইনকে তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে। এরাই মোমেন ব্যক্তি। এদের সম্বন্ধে এই আয়াতে সুসংবাদ দান করা হয়েছে।মোমেন ব্যক্তিদের সাথে থাকবে ফেরেশতা যারা তাদের বন্ধুরূপে রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। চিত্রটি পাপীদের চিত্রের ঠিক বিপরীত।পাপীরা সেদিন শয়তানের ভর্ৎসনা ব্যতীত আর কোন সাহায্যকারী বন্ধু বা রক্ষাকারী লাভ করবে না।
৪৫০০। 'বন্ধু' - দেখুন আয়াত নং [ ৪১ : ২৫ ] যেখানে "সহচর" শব্দটি বলা হয়েছে ও টিকা ৪৪৯২। আরও দেখুন নীচের আয়াত [ ৪১ : ৩৪ ] ও টিকা ৪৫০৫।
৪৫০১। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২১ : ১০২ ] ; [ ৪৩ : ৭১ ] ; [ ৫২ : ২২ ]।
৪৫০২। দেখুন আয়াত [ ৩ : ১৯৮ ]। আল্লাহ্র অসীম করুণা ও অনুগ্রহের ফলে মোমেন বান্দারা আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করবে। পরলোকে তাদেরই অবস্থান এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাদের সম্মানীয় অতিথিরূপে আপ্যায়ন করা হবে।
৪৫০৩। এখানে আয়াটিতে পূণ্যাত্মা রাসুলের [ সা ] জীবনাদর্শের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। রাসুলের [ সা ]জীবনের তিনটি প্রধান দিককে বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
১) তিনি আল্লাহ্র সত্যের প্রতি মানুষকে আহ্বান করেন। তাঁর চিন্তা ও বাক্য মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নিয়োজিত এই সত্যকেই তাঁর প্রচারিত বাণীতে প্রকাশ পায়।
২) তাঁর জীবন, কর্ম, সবই সৎকর্ম , মানুষের সেবায় নিয়োজিত। এই তথ্য এ কথাই প্রমাণ করে যে, তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে কোনও ব্যবধান নাই।
৩) তিনি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত ছিলেন। উপরের তিনটি বিশেষণের মাধ্যমে রাসুলের [সা] জীবনকে চিত্রিত করা হয়েছে, যা ছিলো ইসলামের মূর্ত প্রকাশ। যে প্রকাশ হচ্ছে মানুষের অনুধাবন ক্ষমতার সর্বোচ্চ অনুভূতি।
উপদেশ : সাধারণ মানুষ তাদের জীবনে এই সর্বোচ্চ অনুভূত প্রকাশের জন্য চেষ্টা করে যাবে।
৪৫০৪। ভালো মন্দের মধ্যে কোনও তুলনা হতে পারে না। কারণ দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা তখনই হয়, যখন তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। ভালো ও মন্দ দুটির অবস্থান দুই মেরুতে। মন্দকে ভালে দ্বারা প্রতিহত করতে বলা হয়েছে ; তা হবে অতি উত্তম যেমন উত্তম হচ্ছে বিষের প্রতিষেধক দ্রব্য উত্তম বিষের থেকে। ভালো দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করার ফলে , বিদ্বেষ ভালোবাসাতে রূপান্তরিত হবে। শত্রু হয়ে যাবে বন্ধু। জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞানতাকে দূর করতে, দুষ্ট ও পাপীকে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ দ্বারা সংশোধন করতে বলা হয়েছে।যে মানুষ পাপের দাসত্বে আবদ্ধ তাকে সেই দাসত্ব থেকে মুক্ত করলে সে রূপান্তরিত হবে সর্বশ্রেষ্ট বন্ধু রূপে। আল্লাহ্র রাস্তায় সে হবে শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী। এভাবেই আল্লাহ্র বাণীর মাহত্ব্য যুগে যুগে মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন ঘটায়।
৪৫০৫। 'হা-মিম'দেখুন ৪০নং সূরাটির ভূমিকা।
৪৫০৬। উপরের আয়াত সমূহে যে নৈতিক গুণের বর্ণনা করা হয়েছে ,তা যারা আয়ত্ব করবেন তাদের বৈশিষ্ট্য এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। এ সব নৈতিক গুণাবলী তারাই অজর্ন করবেন যারা হবেন ধৈর্যশীল ও আত্মসংযমী। অর্থাৎ ধৈর্য ও আত্মসংযম গুণ দুটি পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদিগের চরিত্রের মাইলফলক। মানুষের সকল চারিত্রিক দুর্বলতা, জ্ঞানের আবরণে মিথ্যা জ্ঞান, আত্ম সম্মানের আবরণে আত্মগরিমা, মানুষের আত্মোপলব্ধি ও আধ্যাত্মিক বিকাশের বাধাস্বরূপ। এগুলি হচ্ছে শয়তানের পরামর্শ স্বরূপ [ দেখুন পরের আয়াত ]। আল্লাহ্র সাহায্যে এগুলিকে প্রতিহত করতে হবে। যদি কেউ আধ্যাত্মিক জগতে আল্লাহ্ নির্ধারিত এই মানদন্ডে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, তবে সে মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। আধ্যাত্মিক জগতে সে মুক্তি লাভ করবে।আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ তার আধ্যাত্মিক জগতকে আলোকিত করবে।
৪৫০৭। "Nazaga" এই শব্দটির ধারণা হচ্ছে বিবাদ বা বিদ্বেষ , সমন্বয়হীনতা ইত্যাদি। যখন হিংসা , বিবাদ, বিদ্বেষ , আত্মাকে দহন করে - এসবের ফলে যখন আত্মার মাঝে অশান্তি বিরাজ করে - এসবের ফলে যখন আত্মার সুস্থতা নষ্ট হয়ে যায় , বলা হয়েছে এসবই শয়তানের প্ররোচনা। মানসিক এরূপ অবস্থাতে আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করতে বলা হয়েছে।
৪৫০৮। রাত্রি ও দিন একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত। তবুও আল্লাহ্র সৃষ্টি রহস্যের এ এক অপূর্ব সৃষ্টি। বিপরীত হওয়া সত্বেও রাত্রি ও দিন সমভাবে মানুষের মঙ্গল সাধন করে থাকে। রাত্রি মানুষের সারাদিনের ক্লান্তি বিনোদনের জন্য সৃষ্টি ; দিন মানুষের কর্মক্ষেত্র।রাত্রির বিশ্রাম ব্যতীত দিনের কর্মক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ সম্ভব নয়, আবার দিনের কর্ম ব্যতীত নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় নিশীতের বিশ্রাম অসম্ভব। সুতারাং দিন ও রাত্রি মানুষের জীবনে পরস্পর পরস্পরের সম্পূরক। ঠিক সেই একই ভাবে চন্দ্র ও সূর্য মানুষের জীবন ক্ষেত্রে একে অপরের সম্পূরক। মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনেও ঠিক সেই একইভাবে পরস্পর বিরোধী ঘটনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ; আল্লাহ্র সৃষ্টি নৈপুন্য ও বিচক্ষণতার সূদূর প্রসারী প্রভাবে যার শেষ পরিণতি সুফল বয়ে আনে। এগুলি সবই আল্লাহ্র পরিকল্পনা কার্যকর করার বাহকমাত্র। সব কিছুর মূল চালিকা শক্তি ও কারণ হচ্ছেন আল্লাহ্। সুতারাং আল্লাহ্কে পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র সৃষ্ট পদার্থের উপাসনা যেনো কেউ না করে - মনে রাখতে হবে আল্লাহ্ সব কিছুর স্রষ্টা। এই আয়াতের উপদেশ হচ্ছে আল্লাহ্র সৃষ্ট পদার্থের গুণাগুণ থেকে তা ব্যবহারের মাধ্যমে পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের কল্যাণ সাধন কর , কিন্তু তার উপাসনা করো না। আল্লাহ্র একত্বের ধারণা হৃদয়ে ধারণ করাই হচ্ছে প্রকৃত পূণ্যাত্মার লক্ষণ।
৪৫০৯। যদি কেউ পার্থিব সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তির দম্ভে আল্লাহ্কে প্রত্যাখান করে ,তবে তা আল্লাহ্র কোন ক্ষতি করতে পারে না। কারণ যে আল্লাহকে প্রত্যাখান করে তার আধ্যাত্মিক জগতের সকল দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগের ও আল্লাহ্র রহমতে প্রবেশের সকল দুয়ার বন্ধ হওয়ার ফলে তার আধ্যাত্মিক জগতে ঘন অন্ধকারের ব্যপ্তি ঘটে। আধ্যাত্মিক জগতের অবস্থানের জন্যই মানুষ পশু থেকে উন্নত। আত্মা হচ্ছে আল্লাহ্র রূহুর অংশ। আল্লাহ্র অনুগ্রহের দ্বারা সে সরাসরি আল্লাহ্র রহমতে সিক্ত হয়ে আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়। আল্লাহ্র নূরে আলোকিত আত্মা হয় বিবেকসম্পন্ন , বিচক্ষণ ও ন্যায়বান। যদি কেউ আত্মার মাঝে আল্লাহ্র নূর প্রবেশে বাধা দান করে তবে সে নিজেই নিজের ক্ষতিসাধন করে। আল্লাহ্র মাহত্ম্য এই বিশ্ব প্রকৃতিতে ফেরেশতারা দিবারাত্র ঘোষণা করছে; সেই সাথে যারা পূণ্যাত্মা তারাও যোগদান করে। তাদের নিকট আল্লাহ্র যিকির অত্যন্ত আনন্দদায়ক ; কারণ তারা আল্লাহ্র নূরের আলোকে বিধৌত হয়ে সত্যকে আলিঙ্গনের আনন্দে বিভোর থাকে।
৪৫১০। অপূর্ব সুন্দর উপমার সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের অবস্থানকে।পাপে আসক্ত আত্মা হচ্ছে শুষ্ক মাটির ন্যায়। যে মাটি খরার কবলে আক্রান্ত ; বৃষ্টি অভাবে, ছায়াহীন মাটি প্রখর রৌদ্রলোকে বৃক্ষতরুলতা শূন্য হয়ে মরুভূমির ন্যায় রূপ ধারণ করে। যে আত্মা পাপে আসক্ত , সে আত্মা আল্লাহ্র অনুগ্রহ শূন্য হওয়ার ফলে ঐ মাটির ন্যায় রূপ ধারণ করে। মাটি হয় মরুভূমি সদৃশ্য,
বৃক্ষ তরুলতাশূন্য ; আত্মা হয় গুণরাজিশূন্য পশু প্রবৃত্তিতে পরিপূর্ণ। মানব জীবনের সৌন্দর্য বঞ্চিত এবং মনুষ্য জীবনের স্বার্থকতাহীন জীবন তারা যাপন করে। যারা আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোতে ধন্য , যারা আল্লাহ্র রাস্তায় জীবন যাপন করেন, যারা মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করেন, তাদের সাথে এই সব পাপে আসক্ত পশু প্রবৃত্তির লোকের পার্থক্য বাহ্যিক ভাবেই দৃষ্টিগোচর হয়। এসব লোকের আত্মা মৃত, ফলে তা ঘৃণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ থাকে। বারিবর্ষণে যেরূপ মরুভূমি সদৃশ্য ভূমি উর্বরতা লাভ করে সজীব শষ্য শ্যামল রূপ ধারণ করে, ঠিক সেরূপ এ সব মৃত আত্মাও আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের আলোতে জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশে সক্ষম হয়। স্রষ্টার মানুষ সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে সফল করতে সক্ষম হয়।
৪৫১১। আল্লাহ্র বাণীর শক্তি সম্বন্ধে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। ইহলোকে অথবা পরলোকে আল্লাহ্র ক্ষমতা সমভাবে বিদ্যমান।
৪৫১২। "যারা আমার আয়াতসমূহ বিকৃত করে " - এই বিকৃতি বিভিন্ন ভাবে হতে পারে যেমন : অনেকে আল্লাহ্র কিতাবকে বিকৃত করে অথবা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য আয়াতসমূহের অর্থকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে ও উপস্থাপন করে। অথবা এরা তাদের চারিদিকে প্রকৃতির মাঝে আল্লাহ্র যে সব নিদর্শন বিদ্যমান তা তারা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করে, অথবা তারা তাদের বিবেকের মাঝে ধ্বনিত আল্লাহ্র বাণীকে স্তব্ধ করে দেয়। অর্থাৎ বিশ্বপ্রকৃতিতে সত্য, সুন্দর ,ন্যায় ও সত্যের মাঝে আল্লাহ্র যে বাণী অনুরণিত হয় তা তারা অবজ্ঞা করে। মানুষ যে ভাবেই আল্লাহ্র মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করুক না কেন আল্লাহ্র নিকট তা জ্ঞাত। সুতারাংএই সত্যকে জানার পরেও নির্বোধ মানুষ কেন ইহলোকে ও পরলোকে আত্মার মুক্তির জন্য চেষ্টা করে না ?
৪৫১৩। মানুষের প্রত্যাখান আল্লাহ্র বাণী স্তব্ধ করতে অক্ষম। আল্লাহ্র পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হবেই।
৪৫১৪। এই আয়াতে আল্লাহ্র প্রেরিত কোর্আনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কোর্আন হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী যা আল্লাহ্র তরফ থেকে সংরক্ষিত। কারও পক্ষে কোরাণের পরিবর্তন পরিবর্ধন করা সম্ভব নয়। কোর্আন আল্লাহ্র নিকট সম্মানীত ও সম্ভ্রান্ত। এর ভাষায় পরিবর্তন বা পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করার শক্তি যেমন কারও নাই , তেমনি এর অর্থ সম্ভার বিকৃত করে বিধানবলীর পরিবর্তন করার সাধ্যও কারও নাই। চৌদ্দশ বছর ব্যাপী কোরাণের ভাষা অটুট রয়ে গেছে। কারও সাধ্য নাই প্রকাশ্যে এ কিতাবের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা। এমনি ভাবে পেছন দিক থেকে অর্থাৎ গোপনে এসে এর অর্থ বিকৃত করার সাধ্য কারও নাই।
৪৫১৫। আল্লাহ্র বাণীর মর্মার্থ যুগে যুগে একই থেকে গেছে। এবং একই ভাবে কাফের ও অবিশ্বাসীরা যুগে যুগে আল্লাহ্র রাসুলদের প্রত্যাখান করেছে নির্যাতন করেছে। ঠিক সেই একই ভাবে তারা হযরত মুহম্মদ মুস্তফা [সা ] কেও প্রত্যাখান করে। আল্লাহ্র বাণীর সারমর্ম হচ্ছে বিপথগামী অনুতপ্তদের জন্য আল্লাহ্র ক্ষমা ও করুণা এবং সত্যকে ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রত্যাখানকারীদের জন্য ন্যায় বিচার ও শাস্তি।
৪৫১৬। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ১০৩ - ১০৫ ] ; [ ১২ : ২ ] ইত্যাদি। এটা খুবই স্বাভাবিক ও যুক্তিপূর্ণ যে, যেহেতু ইসলামের আবির্ভাব আরবে , রাসুল আরবের অধিবাসী , সুতারাং কোরাণ নাজেলের ভাষা হবে আরবী। 'আজমী' শব্দটির অর্থ আরবী ভাষা ব্যতীত অন্য যে কোনও ভাষাকে 'আজমী' ভাষা বলে। আরবীতে কোরাণ নাজেল হওয়ার দরুণ রাসুলের [ সা ] পক্ষে কোরাণকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা সহজতর হয়েছে। কারণ মানুষের মাতৃভাষার উপরে দখল, বাকপটুতা ও অলংকারের ক্ষমতা অনেক বেশী ও গভীর হয়। যদিও ইসলামের আবির্ভাব সারা দুনিয়ার জন্য তবুও প্রাথমিক উন্মেষ ও বিকাশের জন্য তা আরবী ভাষাতে হওয়া প্রয়োজন ছিলো। আরবের সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার জন্যই কোরাণকে আরবীতে নাজেল করা হয়েছে। যাদের আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের প্রতি বিশ্বাস নাই, তারা আত্মিকভাবে মৃত। মৃত ব্যক্তি যেরূপ কিছু শুনতে বা দেখতে পারে না ,এরাও সেরূপ সত্যের বাণীর আবেদন শুনতে বা বুঝতে পারবে না , কান থাকতেও এরা বধির , চোখ থাকতেও এরা অন্ধ, কারণ এরা অন্তর্দৃষ্টি বিহীন। ফলে তারা ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য দেখতে পারে না।কারণ তারা হবে প্রজ্ঞাবিহীন। এ সব লোকের কাছে যে ভাষাতেই কোরাণ অবতীর্ণ হোক না কেন কোরাণের বাণীর আবেদন তাদের অন্তরে পৌঁছাবে না। এখানে কোরাণের দুটি গুণ ব্যক্ত করা হয়েছে।
১) কোর্আনের হেদায়েত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে কল্যাণের পথ প্রদর্শন করে;
২) কোরাণ আত্মার ব্যধির প্রতিকার অর্থাৎ মানসিক ব্যাধি যথাঃ কুফর , শিরক, অহংকার , হিংসা লোভ-লালসা ইত্যাদি আত্মিক রোগের মহা ঔষধ, মহা গ্রন্থ কোরাণ। সে কারণে মুমিনদের জন্য কোরাণ হচ্ছে আত্মিক ব্যাধির প্রতিকার স্বরূপ।
৪৫১৭। দেখুন [ ৪১ : ৫ ] ও [ ৬ : ২৫ ] আয়াত। কাফেরদের উপরে আল্লাহ্র আয়াতের প্রতিক্রিয়াকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ মোমেনদের জন্য পথ নির্দ্দেশ ; সেখানে কাফেরদের অন্তরে তার কোনও প্রতিক্রিয়াই লক্ষ্য করা যায় না। তার কারণ তাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার ফলে, তারা প্রকৃত সত্যকে অন্তরে ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সত্যের আহ্বান বা বিবেকের আহ্বানকে তাদের নিকট মনে হবে সূদূরের আহ্বান ; যার কোনও অর্থই তাদের কাছে নাই। প্রকৃত সত্যের বাণী তাদের নিকট মনে হবে অভিনব ও অপরিচিত।
মন্তব্য : যারা বিশ্বাস করতে চায় না , তাদের নিজস্ব ধ্যান ধারণা তাদের মনের উপরে শ্রেষ্ঠত্বের পর্দ্দা বিছিয়ে দেয়, ফলে তারা কখনও প্রকৃত সত্যের আহ্বান শুনতে পায় না।
৪৫১৮। আল্লাহ্ হযরত মুসাকে কিতাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে প্রকৃত সত্যকে বিকৃত করে ফেলা হয়। মানুষ যখন ধর্মের ব্যাপারে মৌলবাদী হয়ে পড়ে , মানুষের অন্তরের কোমলতা তখন অন্তর্হিত হয়ে যায়; নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণা করার প্রবণতা জন্মে। ফলে ধর্মের নামে বিভিন্ন উপদলের সৃষ্টি হয়, যেমন হয়েছে ইহুদীদের মধ্যে , ফারিসী [ বা প্রাচীন ইহুদী জাতির অন্তর্ভূক্ত ধার্মিক ও আচারনিষ্ঠ বলে খ্যাত সম্প্রদায় ] ও সাদিউসী [বা ইহুদী নাস্তিক সম্প্রদায় ]। মানুষের অহমিকা ও অন্ধ শ্রেষ্ঠত্ব থেকে যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয় তা কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। কিন্তু যদি সত্যিকার ভাবে, সত্যকে জানার জন্য পার্থক্যের উদ্ভব ঘটে, তবে মহান আল্লাহ্র পরিকল্পনায়, তা মহত্তর পরিণতির দিকে অগ্রসর হবে। তবে যারা ভুল পথে অগ্রসর হয়, তাদের জন্য অনুতাপের দরজা সর্বদা খোলা আছে।আল্লাহ্র বাণী বা হুকুম মানুষের কল্যাণের জন্য সর্ব যুগে প্রেরণ করা হয়েছে, মানুষের বিশ্বাসের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য নয়। পবিত্র জীবন ও সত্যের বাণীর প্রতি বিশ্বাস, আমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য এবং সত্যের প্রতি অবিশ্বাস আমাদের অকল্যাণ করে। আল্লাহ্ কখনও তাঁর বান্দাদের প্রতি অন্যায় করেন না।
পঞ্চবিংশতম পারা
৪৫১৯। স্রষ্টার জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান অতি অকিঞ্চিতকর। আল্লাহ্র জ্ঞানকে ধারণ করা দূরে থাকুক , তা অনুমান করাও মানুষের সাধ্যের বাইরে। সেই সীমাহীন জ্ঞানের এক নিগুঢ় রহস্য হচ্ছে কেয়ামতের জ্ঞান। একমাত্র আল্লাহ্র নিকটই সেই জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত। কারণ আল্লাহ্-ই সকল কিছুর পরিচালনা করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন। কেয়ামতের জ্ঞান হচ্ছে সেরূপ একটি জ্ঞান যা শুধু আল্লাহ্রই নিয়ন্ত্রণে এবং কখন তা ঘটবে তা শুধুমাত্র আল্লাহ্-ই জানেন। যে জ্ঞানের সীমানা মানুষের আয়ত্বের বাইরে; তার সম্বন্ধে মানুষের বৃথা তর্কে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ কেয়ামতের ব্যাপারে মানুষের জ্ঞান শুধুমাত্র অনুমান ভিত্তিক বুদ্ধিমত্তা। ধর্মের ব্যাপারে এরূপ অনুমান হযরত মুসার সম্প্রদায়কে বিপথে চালিত করে এবং তারা সন্দেহ এবং বিতর্কের ঊষর , অনূর্বর মনোজগতে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে হারিয়ে ফেলে। যে জ্ঞানের জগত মানুষের সীমানার বাইরে তার সম্বন্ধে মিথ্যা তর্ক-বির্তক বিপথে চালিত করে।সুতারাং ধর্ম সম্বন্ধে মিথ্যা কুট তর্কে নিজেকে জড়িত না করে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি কর্তব্যে অবিচল থাকা এবং আল্লাহকে ও মানুষকে ভালোবাসা [ আয়াত নং ৪৫ও ৪৬ লক্ষ্য করুন ]। যা তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।দেখুন আয়াত [ ২১ : ৪ ]।
৪৫২০। কিয়ামত দিবসে প্রতিটি কর্মের মূল্যবোধের , সত্য রূপকে প্রকাশ করা হবে। সমস্ত মিথ্যা প্রচার ও ভান সেদিন তিরোহিত হবে এবং তাদের প্রকৃতরূপকে সর্বসমক্ষে উদ্ঘাটিত করা হবে। সেদিন মিথ্যা উপাস্যদের প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়ে পড়বে , তারা সব সেদিন অদৃশ্য হয়ে যাবে। মিথ্যা উপাস্যের উপাসনাকারীদের সেদিন বোধদয় ঘটবে। কিন্তু সে চৈতন্যলাভ তাদের কোন উপকারে আসবে না। কারণ তা হয়ে যাবে বহু দূর।
৪৯। ভালো [জিনিষ পাওয়ার ] জন্য প্রার্থনা করতে মানুষ কখনও ক্লান্ত বোধ করে না। কিন্তু যদি তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে সকল আশা ত্যাগ করে ও হতাশ হয়ে পড়ে৪৫২১।
৪৫২১। যারা আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে উদাসীন, তারা তাদের চেনা, শুনা ও দেখা জগতের বাইরের আর কিছু অনুধাবনে অক্ষম। ফলে তারা তাদের জ্ঞানের সীমার বাইরের জগত সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে থাকে, অথবা মনগড়া কোনও শিরকের উপাসনায় লিপ্ত হয়। কারণ তাদের আত্মার মাঝে আল্লাহ্র হেদায়েতের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এদেরই বিশেষত্ব এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের সকল চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র জাগতিক চাওয়া - পাওয়াকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। অর্থ, সম্পদ , ক্ষমতা , নিরাপত্তা প্রভাব, প্রতিপত্তি ইত্যাদি জাগতিক বিষয়বস্তুই এদের একমাত্র কাম্য বিষয়বস্তু। কোনটা তার জন্য ভালো , কোনটা মন্দ সে বোধ বা পার্থক্য করার ক্ষমতা এদের থাকে না। জাগতিক সকল বিষয় তাদের জন্য ভবিষ্যতে কল্যাণ বয়ে আনতে নাও পারে।যতক্ষণ তারা এসব জাগতিক নেয়ামত লাভ করে ততক্ষণ তাতে তারা মগ্ন ও বিভোর হয়ে থাকে ও তাদের অহংকার ও উদাসীনতা আরও বেড়ে যায়। যদি তাদের মঙ্গলার্থে তাদের সামন্যও দুঃখ দৈন্য স্পর্শ করে, তৎক্ষণাত তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। কারণ তাদের চরিত্রে ধৈর্য্যের মাধ্যমে আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পনের দ্বারা নিজের দোষত্রুটির অনুসন্ধান করার ক্ষমতা জন্মে না। ফলে তারা তাদের চারিত্রিক দোষত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমে জীবনের মহত্তর ও উচ্চতর দিকের সন্ধান লাভে অক্ষম হয়, হতাশা তাদের ঘিরে ধরে।
৪৫২২। মানুষকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন এক নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত করে। সেই উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বিত হয় তার জীবনবোধ , মূল্যবোধ। কিন্তু যখন মানুষ পার্থিব জীবনের মোহে পড়ে মনুষ্য জন্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে যায়, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যা প্রহেলিকায় ভুলে থাকে; তাদেরই মন মানসিকতা ও চিন্তা ভাবনাকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এ সব লোকেরা দুই বা তিন ধরণের মনোভাব প্রকাশ করে থাকে যখন তারা জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়।
প্রথমতঃ জাগতিক ভোগ বিলাসের দ্রব্যের প্রতি অত্যধিক মোহ এদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর থেকে যদি তাদের সামান্যও বঞ্চিত করা হয় তবে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।[ দেখুন উপরে টিকা ]।
দ্বিতীয়তঃ যদি তারা তাদের মনমত পার্থিব বস্তু লাভ করে তারা তখন অহংকারে ও দম্ভে স্ফীত হয়ে সব কৃতিত্ব নিজেদের বলে দাবী করে এবং আল্লাহ্ যে তাদের এই নেয়ামতে ধন্য করেছেন এই সাধারণ সত্যটি তারা ভুলে যায়। শুধু তাই-ই নয়, এ সব সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা তখন আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং কিয়ামত দিবসের ও পরলোকের সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে থাকে। এদের মধ্যে যদি বা কেউ কেয়ামত দিবসের সম্বন্ধে সামান্যতম বিশ্বাস পোষণ করে থাকে , তবে তারা ইহজগতের আল্লাহ্র আনুকূল্যের পটভূমিতে পরলোককেও বিচার করে থাকে এবং বলে যে পরলোকেও আল্লাহ্ তাদের প্রতি বিশেষ আনুকূল্য প্রদর্শন করবেন।কারণ পৃথিবীর জীবনে তারা আল্লাহ্র দেয়া জাগতিক নেয়ামতে ধন্য হয়েছে। সে উপলব্ধি করতে অক্ষম যে, এসব তাকে দেয়া হয়েছে পরীক্ষা স্বরূপ। এভাবেই তারা আল্লাহ্র নেয়ামতের সদ্ব্যবহার দ্বারা পরলোকের জীবনে সফলতার পরিবর্তে আত্মধ্বংসের পথে পরিচালিত হয়। কারণ তারা আল্লাহ্র প্রতি আত্মসমর্পনের পরিবর্তে মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পন করেছিলো।
৪৫২৩। পূর্বের আয়াতে ও টিকাতে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের মূল্যবোধের বিকৃতি সম্বন্ধে। এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের অকৃতজ্ঞতা ও মোনাফেকী সম্বন্ধে ।এসব লোক যখন জাগতিক সুখ সমৃদ্ধি লাভ করে থাকে, তখন তাদের মানসিক অবস্থা হচ্ছে, তারা তা ভোগে এত মগ্ন থাকে যে তারা ধীরে ধীরে আল্লাহ্র স্মরণে বিস্মৃত হয়। তারা ভুলে যায় যে, এই জাগতিক নেয়ামত মহান আল্লাহ্র দান। এর জন্য আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে তারা আল্লাহ্কে ভুলে যায়।অকৃতজ্ঞতার চরম নিদর্শন তারা প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু যখন তারা বিপদ বিপর্যয় , দুঃখ দুর্দ্দশায় নিপতিত হয়, তখন তারা আল্লাহকে গভীর মনোযোগের সাথে ডাকে, বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। তাদের এই আচরণ মোনাফেকীরই নামান্তর। কারণ তারা আন্তরিক ভাবে আল্লাহ্র প্রতি আত্মনিবেদিত নয়।
৪৫২৪। দেখুন আয়াত [ ১৭ : ৮৩ ] ও টিকা।
৪৫২৪-ক। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ মানুষকে আহ্বান করেছেন আত্ম অনুসন্ধানের জন্য। "কোরাণ পাঠ করে উপলব্ধির চেষ্টা কর; দেখ এর মাঝে অসাধারণ কিছু লক্ষ্য করতে পার কি না।" আন্তরিক ভাবে অর্থ বুঝে কোরাণ পাঠ করলে অবশ্যই আত্মার মাঝে কোরাণের বাণীর তাৎপর্যের উপলব্ধি ঘটবে। আত্মার মাঝে অনুসন্ধানের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের সত্যকে উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে। যদি এর পরেও কেউ প্রত্যাদেশের সত্যকে প্রত্যাখান করে, চিন্তা করে দেখ কি ভয়ঙ্কর দায়িত্ব সে নিজ স্কন্ধে বহন করছে। কারণ নভোমন্ডল ও পৃথিবীতে কেউই আল্লাহ্র আইনের চুলমাত্র বিরোধিতা করে না। আল্লাহ্র সৃষ্টির প্রতিটি ধূলিকণা আল্লাহ্র আইনের প্রতি একান্ত আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। একমাত্র মানুষই এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ্ তাকে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দান করেছেন, ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করার জন্য। যদি সে এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে , তবে সে গুরুদায়িত্ব তার একারই। এই দায়িত্বের বোঝা তার একাই বহন করতে হবে। সৃষ্টির কেউই যখন স্রষ্টার আইন লঙ্ঘন করে না তখন যে মানুষ ইচ্ছাকৃত ভাবে বিপথে গমন করে তার মত নির্বোধ আর কে আছে ?
৪৫২৪-খ। কোরাণের বাণী বিশ্বজনীন। পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য তা অবতীর্ণ। যদি কেউ আল্লাহ্র এই বিশ্বজনীন বাণীকে অমান্য করে এবং সার্বজনীন বিশ্বাস বা প্রত্যয়ের বিরুদ্ধাচারণ করে তাহলে সে নিজের কবর নিজে খুঁড়ছে। কারণ সে এক অন্ধকারময় ক্ষুদ্র ধর্মগোষ্ঠির অনুসারী হবে যারা হবে উদ্দেশ্যবিহীন। যারা ধর্মের আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবীতে বাসের যোগ্যতা হারাবে। তাদের মত বিভ্রান্ত আর কে আছে ?
৪৫২৪-গ। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ করা হয়েছে সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করার জন্য। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের দ্বারা এই সত্যই প্রমাণিত হয়। তবে প্রত্যাদেশ বা আল্লাহ্র সত্য মানুষের হৃদয় ও আত্মাকে কিভাবে পরিবর্তন করতে পারে তা অত্যাচার্য ব্যাপার ; যা ইসলামের প্রসার অপেক্ষাও অধিক বিস্ময়কর। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইসলামের প্রথম যুগের ব্যক্তিগণ। চার খলিফার জীবন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধু তাই-ই নয় ইসলামের ইতিহাসে এরূপ বহু ব্যক্তির সন্ধান মেলে যারা ইসলাম বিরোধী থেকে কোরাণের বাণীর যাদুস্পর্শে পরিবর্তিত মানুষ হয়ে যান এবং শৈর্য্যে বীর্যে পৃথিবীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হন।ইসলামের প্রাথমিক যুগে মদিনা ছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠিতে বিভক্ত ,পরস্পর হানাহানিতে মগ্ন। ইসলামের স্পর্শে সেই মদিনা রূপান্তরিত হয় সংঘবদ্ধ বীরের জাতিরূপে, যারা পৃথিবীর সম্মুখে শৈর্য্যে বীর্যে , সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে ভাস্বর হয়েছিলেন। বিরোধীরা যাই-ই করুক বা ভাবুক না কেন,আল্লাহ্র সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই। বর্তমান যুগেওপৃথিবী ব্যপী ইসলামের প্রসার এই সত্যেরই সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ্ই ভালো জানেন কে তার সত্য প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এবং কে সাহায্য করে। "তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত। "
৪৫২৫। যারা কাফের , যাদের আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস নাই তারা ধারণা করে যে, পৃথিবীর জীবন শেষ হওয়ার সাথে সাথে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। শেষ বিচার বলে কিছু নাই। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন যে, শেষ বিচারের দিন অবশ্যাম্ভবী। কেহই তা থেকে রেহাই পাবে না। আল্লাহ্ সকল কিছু পরিবেষ্টন করে আছেন।