Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ১ জন
আজকের পাঠক ৬০ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৫৯৪ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৮৭৮ বার
+ - R Print

সূরা আহ্‌কাফ


ষষ্ঠবিংশতি পারা

সূরা আহ্‌কাফ বা ঘুর্ণায়মান বালুকাময় অঞ্চল - ৪৬

৩৫ আয়াত, ৪ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : হা-মিম্‌ সিরিজের এটা হচ্ছে শেষ এবং সপ্তম সূরা। এর সময়কাল ও সাধারণ বিষয় বস্তুর জন্য দেখুন ৪০ নং সূরার ভূমিকা।

২১ নং আয়াতে আহ্‌কাফ [ Ahqaf ] শব্দটির উল্লেখ আছে। আহ্‌কাফ অর্থ হচ্ছে আকাঁবাকাঁ বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি বা বালির পাহাড় সমূহ। আ'দ জাতির আবাসস্থলের বৈশিষ্ট্য আহ্‌কাফ শব্দের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। স্থানটি হাদরামাউত এবং ইয়েমেনের সন্নিকটবর্তী : দেখুন [ ৭: ৬৫ ] আয়াত ও টিকা ১০৪০। তাদের দেশটি ছিলো উর্বর ভূমি। সম্ভবতঃ তা ছিলো তাদের উন্নত সেচপ্রণালীর ফল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তারা পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে ফলে তাদের উপরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পতিত হয় যার উল্লেখ আছে [ ৪৬ : ২৪-২৫] আয়াতে। এই সূরার উপদেশ হচ্ছে যদি কেউ সত্যকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে তবে তার হঠকারীতার উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে এবং সত্যের যর্থাততা প্রতিপন্ন হবে।

সার সংক্ষেপ : সমগ্র সৃষ্টির পিছনে স্রষ্টার নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্য বিদ্যমান। সত্য এবং আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবেই। যারা তার বিরোধিতা করবে তারা তাদের কৃতকর্মের দরুনই ধ্বংস হয়ে যাবে। মোমেন বান্দার বৈশিষ্ট্য হবে তার ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তার সাথে অপেক্ষা করা। [ ৪৬ : ১-৩৫ ]।

সূরা আহ্‌কাফ বা ঘুর্ণায়মান বালুকাময় অঞ্চল - ৪৬

৩৫ আয়াত, ৪ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

০১। হা - মীম।

০২। এই কিতাবের প্রত্যাদেশ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্‌র নিকট থেকে আগত ৪৭৭৫।

৪৭৭৫। এই আয়াতটি পূর্ববর্তী সূরার দ্বিতীয় আয়াতের অনুরূপ। কিন্তু দুইটি সূরার বিষয়বস্তুতে বিভিন্নতা আছে। ৪৫ নং সূরাতে বিবৃত করা হয়েছে যে, কিভাবে সত্য ও প্রত্যাদেশের প্রত্যাখানকারীরা শেষ পর্যন্ত নতজানু হয়ে বশ্যতা স্বীকার করে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা প্রত্যাদেশের সত্য ও ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে পারে না। এই সূরাতে বিবৃত করা হয়েছে যে সত্য এবং প্রত্যাদেশ শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হবেই, তবে তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তা। [ ৪৬ : ৩৫ ]।

০৩। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুই আমি নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে এবং নির্দ্দিষ্ট কালের জন্য সৃষ্টি করেছি ৪৭৭৬। কিন্তু যারা কাফের তারা, তাদের যে বিষয়ে সর্তক করা হয়েছে, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

৪৭৭৬। দেখুন [ ৪৫ : ২২ ] আয়াত। মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞানে সৃষ্টির বহু জিনিষকে মনে হয় অপ্রয়োজনীয়,অদ্ভুদ ও ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু এই বিশাল বিশ্ব ভূবনের প্রতিটি জিনিষই স্রষ্টা এক নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত করে সৃষ্টি করেছেন। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানে তা উপলব্ধি করতে পারি বা না পারি কিন্তু স্রষ্টার নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্য পরিপূর্ণতা লাভ করবেই। কারণ স্রষ্টার প্রতিটি সৃষ্টিই 'যথাযথ' এবং তা এক নির্দ্দিষ্ট কালের মেয়াদে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই আয়াতে এই কথাই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর কিছুই চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি জিনিষকেই এক নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যে এবং নির্দ্দিষ্ট কালের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। নির্দ্দিষ্ট সময় অন্তে প্রতিটি জিনিষ ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে জাতির উত্থান পতনও সেরূপ। নির্দ্দিষ্ট সময় অন্তে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভূমিকা শেষ করে চলে যায়। কোনও কিছুই এই পৃথিবীতে স্থায়ী নয়। চিরস্থায়ী শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র বাণী। জীবনের এই সত্যকে কাফেররা উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়। ফলে তারা তাদের প্রতি প্রেরিত সর্তকবাণীকে উপেক্ষা করে।

০৪। বল : " আল্লাহ্‌র পরিবর্তে তোমরা যাদের আহ্বান কর তাদের কথা ভেবে দেখেছ কি ? ৪৭৭৭ পৃথিবীতে তারা কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও অথবা আকাশমন্ডলীতে উহাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি ? যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে ইহার পূবর্তন কোন কিতাব কিংবা [ ঐশী ] জ্ঞানের অবশিষ্টাংশ আমার নিকট নিয়ে এসো ৪৭৭৮।

৪৭৭৭। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করা। এই মিথ্যা উপাস্য সর্বদা মূর্তি হতে হবে এমন কোনও কথা নাই। কখনও তা বীর পূঁজা, কখনও ব্যক্তিপূঁজা, কখনও পীর পূঁজা, কখনও তা কোন মতবাদের পূঁজা, কখনও পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির পূঁজা, কখনও বিজ্ঞানের জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ ধারণা করা, আবার কখনও নিজস্ব আত্মগরিমার লালন পালন ইত্যাদি বহুরূপে মানুষ আল্লাহ্‌র পরিবর্তে অন্য কিছুর উপাসনা করে থাকে। এই মানব সম্প্রদায়কেই এই আয়াতে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, একবার স্থিরভাবে চিন্তা করে দেখ, এসব মিথ্যা উপাস্যেরা কি কোনও কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে ? অথবা আকাশমন্ডলী অথবা মানুষের আধ্যাত্মিক জগতে এসব মিথ্যা উপাস্যদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি ?

৪৭৭৮। আরও বলা হয়েছে যে এ সব লোকের কাছে কি পূর্ববর্তী কোনও প্রত্যাদেশ রয়েছে যার ফলে তারা বর্তমান প্রত্যাদেশকে অস্বীকার করছে ? তাদের আহ্বান করা হয়েছে তাদের জ্ঞানের সত্যতাকে প্রমাণিত করতে। অবশ্যই তারা তা পারবে না।

০৫। এবং তার থেকে বেশী বিভ্রান্ত আর কে আছে যে আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত সাড়া দিবে না ৪৭৭৯। বস্তুতঃ তারা তাদের ডাক সম্বন্ধে কোন খবরই রাখে না।

৪৭৭৯। আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনার প্রকৃত পক্ষে কোনও যৌক্তিকতা নাই। কোনও জ্ঞান ও প্রজ্ঞাশীল লোক তা করতে পারে না। মূর্তিরূপ মিথ্যা উপাস্যগুলি নিষ্প্রাণ পাথরের স্তুপ মাত্র। তাদের কোনও কিছুতেই সাড়া দেয়ার ক্ষমতা নাই - কারণ তাদের কোনও বোধশক্তি নাই। শেষ বিচারের দিনে এসব উপাস্যরা উপাসনাকারীদের অস্বীকার করবে। অথবা যারা নিজস্ব কৃতিত্বে অহংকারে স্ফীত হয়ে আত্মপূঁজাতে নিমগ্ন হয়, শেষ বিচারের দিনে তাদের নিজস্ব মন, মেধা, কর্মকুশলতা এক কথায় বিভিন্ন চারিত্রিক দক্ষতা তাদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে [ ৪১ : ২০ - ২৩ ]। যদি পৃথিবীতে কেউ মহৎ ব্যক্তিত্বের পূঁজা করে এমন কি নবী রসুলদেরও যেমন খৃষ্টানেরা যীশু খৃষ্টের পূঁজা করে, সে ক্ষেত্রেও শেষ বিচারের দিনে তারা তাদের পূঁজারীদের অস্বীকার করবেন [ ৫ : ১১৬ ]। সেরূপ কেউ যদি ফেরেশতাদের উপাসনা করে, তারাও সেদিন তা অস্বীকার করবে [ ৩৪ : ৪০- ৪১ ]। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কিছুর উপরে নির্ভরশীলতা মানব জীবনের শেষ সাফল্য আনতে ব্যর্থ

০৬। [ পুরুত্থানের দিনে ] যখন মানব জাতিকে একত্র করা হবে, তখন, উহারা [ দেব-দেবীরা ] তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হবে এবং তাদের পূঁজাকে [সম্পূর্ণ ] অস্বীকার করবে।

০৭। যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ উহাদের নিকট আবৃত্তি করা হয়, সত্য তাদের নিকট উপস্থিত হলেও তারা বলে, " ইহা তো স্পষ্ট যাদু।" ৪৭৮০

৪৭৮০। পৃথিবীতে এ সব নির্বোধ কাফেরদের সম্মুখে যখন প্রকৃত সত্যকে উপস্থিত করা হয়,তারা তাকে 'যাদু' বলে আখ্যায়িত করে থাকে। দেখুন [ ২৭ : ১২ - ৪৫ ] ও টিকা ৪০৪২।

০৮। অথবা তারা কি বলে, " সে ইহা নকল করেছে ? " বল : " যদি আমি ইহা নিজে রচনা করে থাকি,তাহলে তোমরা তো আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে আমাকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারবে না ৪৭৮১। তোমরা যে বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত আছ, সে সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ সবিশেষ অবহিত। আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে তিনিই যথেষ্ট। এবং তিনি বারে বারে ক্ষমাশীল এবং পরম করুণাময়। "

৪৭৮১। ইবনে কাসীরের মতে এই আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, যদি রসুলুল্লাহ্‌র [ সা ] নবুয়তের দাবী তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন হতো; তিনি যদি প্রকৃত আল্লাহ্‌র প্রেরিত রাসুল না হতেন ; তবে তাঁর এই মিথ্যা দাবীর জন্য চরম শাস্তি ভোগ করতে হতো। সেক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে তাঁকে কেউই রক্ষা করতে পারতো না। এই আয়াতে 'সে' শব্দটি দ্বারা রাসুলুল্লাহকে [ সা ] বোঝানো হয়েছে।

০৯। বল : " আমি তো কোন অভিনব রসুল হয়ে আসি নাই ৪৭৮২। আমি তো জানি না যে, আমার সম্বন্ধে ও তোমাদের সম্বন্ধে কি করা হবে ? আমার প্রতি যে ওহী প্রেরণ করা হয়েছে, আমি শুধু তার-ই অনুসরণ করি। আমি তো একজন প্রকাশ্য এবং সুস্পষ্ট সর্তককারী মাত্র।

৪৭৮২। প্রকৃত পক্ষে রাসুলের [ সা ] শিক্ষাকে পর্যালোচনা করলে এই সত্যের সন্ধান মেলে যে প্রতিটি নবী রসুলের প্রচারিত সত্য এক ও অভিন্ন। তাঁরা সকলেই আল্লাহ্‌র একত্বের শিক্ষা দান করেছেন এবং সেই সাথে মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। এই আয়াতটির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ রাসুলকে নির্দ্দেশ দান করেছেন বলতে যে, তাঁর প্রতি প্রেরিত প্রত্যাদেশ কোন মিথ্যা উদ্ভাবন নয়। তিনি কোন নূতন বার্তা বহন করে আনেন নাই। তাঁর নিকট প্রেরিত বার্তা হচ্ছে শ্বাসত সত্য যা যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছে। যারা তা অস্বীকার করে তাদের শেষ পরিণতি আল্লাহ্‌র হাতে। রাসুলের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রেরিত সত্যকে সঠিক ভাবে প্রচার করা।

১০। বল : " আচ্ছা,তোমরা কি ভেবে দেখেছ ? ৪৭৮৩ যদি ইহা [ কুর-আন ] আল্লাহ্‌র নিকট থেকে হয় ও তোমরা ইহাকে অমান্য কর, আর বনী ইসরাঈলের মধ্য থেকে একজন ইহার, [ পূর্ববর্তী কিতাবের ] সাথে সাদৃশ্য সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেয়, এবং বিশ্বাস স্থাপন করে ৪৭৮৪, সেখানে তোমরা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে ; [তাহলে কতটা অন্যায়কারী তোমরা !]। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ অন্যায়কারীদের সুপথ প্রদর্শন করেন না।"

৪৭৮৩। এই আয়াতের মাধ্যমে মোশরেক আরবদের সাবধান করা হয়েছে, " হে মোশরেক আরব ! যদিও তোমরা অজ্ঞ জাতি, তবুও তোমরা মিথ্যা গর্বে স্ফীত হয়ে থাক। ইসরাঈলীদের মধ্যে অনেক লোক আছে যারা পূর্ববর্তী কিতাব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ; যারা জানে যে কোরাণ পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থকে সত্যায়িত করে মাত্র। তারা ইসলামকে হযরত মুসার নিকট প্রেরিত প্রত্যাদেশের ধারাবাহিকতার ও পরিপূর্ণতা বলে বিশ্বাস করে [দেখুন Deut. xviii . 18- 19 ]। তোমাদের বুঝার সুবিধার্থে কোরাণ আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তোমরা তা অস্বীকার কর। কি অন্যায় ও লজ্জ্বাজনক তোমাদের আচরণ। সেক্ষেত্রে কিভাবে তোমরা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও পথ নির্দ্দেশ পেতে পার ? "

৪৭৮৪। সে সময়ে জ্ঞানী ইহুদী ও খৃষ্টান ব্যক্তিরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, হযরত মুহম্মদ [ সা ] আল্লাহ্‌র প্রেরিত নবী এবং তাঁর প্রচারিত প্রত্যাদেশ পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থকে সত্যায়ন করে থাকে। সুতারাং তারা সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করে থাকেন। অনেকে মনে করেন আয়াতটিতে বিশিষ্ট ইহুদী আলেম আবদুল্লা-ইবনে সালাম সর্ম্পকে বলা হয়েছে। ইবনে সালাম ইসলাম গ্রহণ করেন মদীনায় রসুলের মৃত্যুর দুবছর পূর্বে। কিন্তু আয়াতটি অবতীর্ণ হয় মক্কায়। ইবনে সালামের ইসলাম গ্রহণের সাথে আয়াতটিকে সর্ম্পকিত করতে হলে আয়াতটিকে ভবিষ্যত বাণী হিসেবে ধরতে হয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জ্ঞানী ও প্রকৃত ধর্মে বিশ্বাসী ইহুদীরা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন যে, রাসুলের নিকট প্রেরিত প্রত্যাদেশ তাদের ধর্মগ্রন্থের ধারাবাহিকতা মাত্র।

রুকু - ২

১১। অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদের বলে, " যদি [ এই ধর্ম ] ভালো হতো, তবে নিশ্চয় [ এই সকল সাধারণ লোকের] বহু পূর্বেই আমরা ইহার দিকে যেতাম ৪৭৮৫। " এবং যখন তারা ইহা [ কুর-আন ] দ্বারা সৎপথে পরিচালিত হয় নাই, তখন তারা অবশ্য বলবে, " ইহা তো এক পুরাতন মিথ্যা।"

৪৭৮৫। ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে যারা মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তাদের অধিকাংশ ছিলেন গরীব, সুতারাং গর্বিত কোরাইশ নেতাগণ তাদের অসম্মানের সাথে ব্যবহার করতো। তাদের বক্তব্য ছিলো, যে যদি ইসলাম ধর্মে কোনও শ্রেষ্ঠত্বই থাকতো তবে তাদের মত নেতারাই সর্বাগ্রে তা দেখতে পেতো, ঐ গরীব সম্প্রদায় নয়। এবং তারাই সর্বাগ্রে তা গ্রহণ করতো, কারণ তারা জনসাধারণের নেতা। প্রকৃত সত্য হচ্ছে তারা ইসলামের মাঝে কোনও সৌন্দর্য বা শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজে পাবে না, কারণ আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব তাদের সমগ্র চেতনাকে গ্রাস করে ফেলেছে। অন্ধ অহংকার ও একগুয়েমি তাদের বিবেক ও বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সুতারাং তাদের পক্ষে প্রকৃত সত্যের আলোকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অন্ধজনে যেরূপ আলোর সত্ত্বাকে উপলব্ধিতে অক্ষম, তারাও সেরূপ আধ্যাত্মিক অন্ধত্বের শীকার। যেহেতু ইসলাম, পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থকে সত্যায়িত করে, সুতারাং এর ঐতিহাসিক ভিত্তি বর্তমান। কোরাইশরা যখন তা অস্বীকার করতে পারে না, তখন তারা একগুয়ে ভাবে বলে, " ইহা তো এক পুরাতন মিথ্যা। "

১২। এর পূর্বে মুসার কিতাব ছিলো [ মানুষের জন্য ] পথপ্রদর্শক ও করুণা স্বরূপ। এবং এই কিতাব [কুর-আন ] ইহাকে সত্যায়িত করে, আরবী ভাষাতে ৪৭৮৬ ; অন্যায়কারীকে সাবধান করার জন্য ও ন্যায় কর্মশীলকে সুসংবাদ দান করার জন্য।

৪৭৮৬। পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ যা আল্লাহ্‌র নিকট থেকে প্রেরিত জীবন বিধান স্বরূপ [ Shariat] তা প্রেরিত হয়েছিলো হযরত মুসার নিকট থেকে। হযরত ঈসার নিকট প্রেরিত এরূপ কোন ধর্মগ্রন্থ নাই, ফলে তাঁর প্রচারিত নৈতিক ধর্মানুশাসনে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রকৃত পক্ষে হযরত ঈসার, পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশ সম্পর্কে যে মনোভাব ছিলো কোরাণও ঠিক সেই একই মনোভাবের প্রচার করে। হযরত ঈসার বক্তব্য ছিলো, [ Matt. v. 17 ] : "Think not that I am come to destroy the law or the Prophets : I am not come to destroy , but to fulfill". কিন্তু হযরত ঈসার তিরোধানের পরে সময়ের আবর্তনে খৃষ্টান ধর্মে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটে, ফলে পৃথিবীতে জীবন বিধানের পুনঃসংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পরে। ইসলামের আবির্ভাব সেই অভাব পূরণে সক্ষম হয়, যা হচ্ছে হযরত মুসার কিতাবের সমর্থক।

১৩। নিশ্চয় যারা বলে, " আল্লাহ্‌ আমাদের প্রভু " এবং [ তাতেই ] অটল থাকে ; তাদের কোন ভয় নাই, তারা দুঃখিতও হবে না ৪৭৮৭, ৪৭৮৮।

৪৭৮৭। " আল্লাহ্‌ আমাদের প্রভু " - এই বাক্যটি গভীর ব্যঞ্জনাময় ভাবের প্রকাশ ঘটায়। এর অর্থ আমরা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করি যে আমাদের সকল কর্ম শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত। " এই বিশ্বাসে অবিচলিত থাকার " প্রধান শর্ত হচ্ছে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি আচরণে এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটানো। কর্মের মাধ্যমে, চরিত্রের মাধ্যমে, আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে,আমরা আল্লাহ্‌র প্রতি কর্তব্য ও ভালোবাসায় অটল।

৪৭৮৮। দেখুন আয়াত [ ২ : ৩৮]। "তাদের কোন ভয় নাই, এবং তারা দুঃখিতও হবে না।" এই লাইনটি কোরাণ শরীফের বহু সূরার আয়াতে বিদ্যমান, অবশ্য প্রতিটি স্থানে প্রয়োগ ঘটেছে নূতন নূতন ঘটনার পটভূমিতে। এখানের প্রয়োগের পটভূমি হচ্ছে যে, যদি আমরা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি যে, "আমাদের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ্‌ " - তাহলে আমাদের আর ভয় কিসের ? কোনও দুর্যোগই আমাদের আর দুঃখিত বা ভীত করতে পারবে না। কারণ এই বিশ্বাস যে একমাত্র আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতিপালক, রক্ষাকর্তা, সাহায্যকারী। আমাদের আশা ও আকাঙ্খা, যদি অন্তরে দৃঢ়ভাবে থাকে, তবে সে অন্তর জীবনের কোন ক্ষেত্রেই বা মৃত্যুর পরেও কোনও হতাশা বা ভয় বা দুঃখে আক্রান্ত হবে না।

১৪। এরাই হবে বেহেশতের অধিবাসী ; সেখানে তারা স্থায়ী হবে ; তাদের [ ভালো ] কাজের পুরষ্কার স্বরূপ।

১৫। আমি মানুষকে তার পিতা -মাতার সাথে সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি ৪৭৮৯। তার মা দৈহিক যন্ত্রণার মাধ্যমে তাকে গর্ভে ধারণ করে, দৈহিক যন্ত্রণার সাথে তাকে প্রসব করে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে এবং তার দুধ ছাড়ানোতে ত্রিশ মাস [ সময় ] লাগে ৪৭৯০। অবশেষে, সে যখন পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে, ৪৭৯১, এবং চল্লিশ বৎসরে উপণীত হয়, তখন সে বলে, " হে আমার প্রভু ! তুমি আমাকে এই ক্ষমতা দান কর যেনো আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি যে অনুগ্রহ দান করেছ, তার জন্য, এবং যেনো আমি সৎকাজ করতে পারি যা তুমি অনুমোদন কর। সন্তান সন্তানাদিদের ব্যাপারে আমার প্রতি অনুগ্রহশীল হও। নিশ্চয়ই আমি তোমার অভিমুখী হলাম এবং নিশ্চয়ই আমি আত্মসমর্পনকারীদের অন্তর্গত। "

৪৭৮৯। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২৯ : ৮ ] এবং [ ৩১ : ১৪ ]।

৪৭৯০। সূরা [ ৩১ : ১৪ ] আয়াতে স্তন্যদানের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে দুবৎসর অর্থাৎ ২৪ মাস। সূরা [ ২ : ২৩ ] আয়াতেও দু বৎসর সময়ের উল্লেখ আছে। এই আয়াতে গর্ভধারণ ও স্তন্যদান উভয়ের সময়কাল বর্ণিত হয়েছে ত্রিশ মাস। অতএব স্তন্যদানের দুবছর অর্থাৎ চব্বিশ মাস বাদ দিলে গর্ভধারণের জন্য ছয় মাস অবশিষ্ট থাকে। সুতারাং এটাই হবে গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময়কাল, যে সময় অতিক্রম করলে ভূমিষ্ট শিশু জীবিত থাকতে পারে। বর্তমানে বিজ্ঞান এ কথা স্বীকার করে যে গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময়কাল ছয় মাস হওয়া সম্ভবপর। এর কম সময়ে সন্তান সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ জন্মগ্রহণ করতে পারে না। গর্ভধারণের সর্বোচ্চ সময়সীমা ২৮০ দিন। অবশ্য সে ক্ষেত্রে স্তন্যদানের সময়সীমা দুবছরের কম হয়ে যাবে। দুবছর নির্ধারিত হয়েছে শিশুর 'দুধ দাঁত' ওঠা সম্পূর্ণ হয়ে যায়। ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে নীচের দুটো দাঁত ওঠে তারপরে ধীরে ধীরে অন্যান্য দাঁত উঠতে শুরু করে যতদিন না সমস্ত ওঠা শেষ হয়। মাড়ির দাঁত ওঠতে শুরু করে দুবছর বয়েসে। এভাবেই দুধ দাঁতের সারি পরিপূর্ণ হয় এবং শিশু মাতৃদুগ্ধ ব্যতীত অন্যন্য খাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, কারণ এখন সে চিবুতে সক্ষম। ছয় বৎসর বয়েসে দুধ দাঁত পড়ে যেয়ে স্থায়ী দাঁত ওঠে এবং ১৮- ২০ বৎসর বয়েসে আক্কেল দাঁত ওঠে।

৪৭৯১। "পূর্ণ শক্তি প্রাপ্ত হয় [ ashudd ] " - এই বয়েস হচ্ছে কৈশর শেষে যৌবনে প্রাপ্ত হওয়ার বয়েস। অর্থাৎ ১৮ থেকে ৩০/৩২ বৎসরের মধ্যে। ৩০ থেকে ৪০ বৎসরের মধ্যে মানুষ পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত হয় - জীবনের সকল ক্ষেত্রে সে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। এর পরে তার ক্ষয় শুরু হয়। ইতিমধ্যে পরবর্তী বংশধরগণ দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা অর্জন করে। অপরপক্ষে ৪০ বৎসর পরেই মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের দিগন্ত উম্মোচিত হতে শুরু করে।

১৬। আমি ইহাদেরই সৎ কর্মগুলি গ্রহণ করে থাকি ৪৭৯২ এবং মন্দ কর্মগুলি ক্ষমা করি ; তারা হবে বেহেশতবাসীদের অন্তর্ভূক্ত ; [ এই জীবনে ] তাদের যে সত্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার খাতিরে।

৪৭৯২। দেখুন [ ২৯ : ৭ ] আয়াত ও টিকা ৩৪২৯।

১৭। আর, যে ব্যক্তি আপন মাতা-পিতাকে বলে, ৪৭৯৩ " ধিক্কার তোমাদের ! তোমরা কি আমাকে এই ভয় দেখাতে চাও যে, আমি পুনরুত্থিত হব, যদিও আমার পূর্বে বহু পুরুষ গত হয়েছে [ পুনরুত্থান ব্যতীত ]? " তখন তারা দুজনে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করে [ এবং পুত্রকে ভর্ৎসনা করে ] ; " দুর্ভাগ্য তোমার! ঈমান আন ! আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সত্য।" কিন্তু সে বলে, " এগুলি প্রাচীন কালের গল্প কাহিনী ব্যতীত অন্য কিছু নয়।"

৪৭৯৩। আমাদের চারিপার্শ্বের এরূপ ঘটনা অহরহই ঘটে যে পূণ্যাত্মা ব্যক্তির সন্তান হয়ে পড়ে মন্দ প্রকৃতির। উপরের আয়াতে [ ১৫ নং ] বর্ণিত আছে সৎ সন্তানের বৈশিষ্ট্য। তারা নিজের জন্য ও পিতামাতার মঙ্গলের জন্য সর্বদা স্রষ্টার দরবারে প্রার্থনা করে থাকে। তারই বিপরীতে তুলে ধরা হয়েছে অসৎ সন্তানের বা মন্দ ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এ সব ব্যক্তি পূণ্যাত্মা পিতা মাতাকে শ্রদ্ধার পরিবর্তে অবজ্ঞা করে এবং পিতা মাতার পূণ্য কর্মকে তারা প্রাচীনপন্থী ক্রিয়াকর্ম ও শ্রদ্ধার অযোগ্য বলে পরিগণিত করে। প্রগতিশীলতার নামে এরা শ্বাসত সত্যকে অনুধাবনে অক্ষম হয় ও মন্দের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এ সত্য পরিবারের জন্য যেমন প্রযোজ্য পৃথিবীতে মানুষের সভ্যতার বিবর্তনে, জাতির জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। জাতির উত্থান পতনের ইতিহাস এই 'সত্যের ' মাঝে নিহিত। আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে এই যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক ও সত্যপথে পরিচালিত করা এবং নূতন প্রজন্মের উপলব্ধি করা উচিত যে পূর্বপুরুষদের বয়স ও অভিজ্ঞতা এক মূল্যবান সম্পদ ; বিশেষভাবে আধ্যাত্মিক জগতের জ্ঞান।

১৮। এদের পূর্বে যে জ্বিন ও মানব সম্প্রদায় গত হয়েছে তাদের মত এদের প্রতিও আল্লাহ্‌র শাস্তি সাব্যস্ত হয়ে গেছে। অবশ্যই তারা হবে [ সম্পূর্ণরূপে ] বিনাশ প্রাপ্ত ৪৭৯৪।

৪৭৯৪। দেখুন [ ৪১ : ২৫ ] আয়াত ও টিকা ৪৪৯৪। প্রতিটি লোক ব্যক্তিগত ভাবে এবং প্রত্যেক প্রজন্ম তাদের কাজের জন্য আল্লাহ্‌র সম্মুখে কৃতকর্মের জবাবদিহিতার জন্য দায়ী থাকবে। ভালো কাজের জন্য যেমন পুরষ্কার,মন্দ কাজের জন্য থাকবে শাস্তি। প্রত্যেকেই স্ব স্ব কার্যের জন্য দায়ী থাকবে। প্রতিটি কাজের প্রতিফল বিদ্যমান। কারও কাজের জন্য অন্য কেহ দায়ী থাকবে না ; কেউ কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও করুণা ভিক্ষা করা। শুধু নিজের জন্যই নয় অন্যের জন্যও।

এই আয়াতটি উপরের ১৬ নং আয়াতের বিপরীত। যার ফলে প্রকৃত ভারসাম্য রক্ষিত হয়।

১৯। প্রত্যেকের মর্যদা তাদের কর্মফল অনুযায়ী [দেয়া হয় ], ইহা এ জন্য যে, আল্লাহ্‌ প্রত্যেকের কর্মের পূর্ণ পুরষ্কার পুরোপুরি দিতে পারেন। এবং তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না ৪৭৯৫।

৪৭৯৫। পরলোকে প্রত্যেককে বিন্যাস করা হবে তাদের কৃতকার্যের পরিণাম অনুযায়ী। এই বিন্যাস হবে অতি সুক্ষ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। প্রতিটি ভালো ও মন্দ কাজকে বিচার করা হবে সুক্ষভাবে। কাজের উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, প্রেরণা, সাফল্য,ব্যর্থতা, পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিত সমস্ত কিছু চুলচেরা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতিটি মন্দ বা ভালো কাজকে মূল্যায়ন করা হবে। আপতঃ ভালো বা আপাতঃ মন্দ শেষ কথা নয়। ভালো ও মন্দের এই শ্রেণী বিভাগ মোটামুটি বা স্থূল নয়। তা হবে অত্যন্ত চুলচেরা সুক্ষদর্শী - বিচার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। মন্দ কাজের পরিণাম ততটুকুই হবে যতটুকু মন্দ সে করে। কিন্তু অন্যান্য আয়াতে [ ২৮ : ৮৪ ] উল্লেখ আছে যে, ভালো কাজের পুরষ্কার যা প্রাপ্য, সেই প্রাপ্যতাকে অতিক্রম করে যাবে। কারণ আল্লাহ্‌ অসীম করুণাময়।

২০। এবং যেদিন অবিশ্বাসীদের [ জাহান্নামের ] আগুনের সন্নিকটে উপস্থিত করা হবে [ তখন তাদের বলা হবে ] : " পার্থিব জীবনে তোমরা ভালো ভালো জিনিষ পেয়েছ এবং তা থেকে আনন্দ উপভোগ করেছ ৪৭৯৬। কিন্তু আজ তোমাদের লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি পুরষ্কার হিসেবে দেয়া হবে। কারণ পৃথিবীতে তোমরা অন্যায়ভাবে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিলে এবং তোমরা [ সর্বদা ] সীমালংঘন করে চলতে "৪৭৯৭।

৪৭৯৬। " পার্থিব জীবনে তোমরা ভালো ভালো জিনিষ পেয়েছ এবং আনন্দ উপভোগ করেছ।" অর্থাৎ তোমরা লোভী ছিলে, সস্তা আনন্দের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলে ; জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে বিশ্বাস না করে। আধ্যাত্মিক জীবনকে পার্থিব আনন্দের জন্য পরিত্যাগ করেছিলে।

৪৭৯৭। যারা পার্থিব জীবনের পরিবর্তে আধ্যাত্মিক জীবনকে উৎসর্গ করেছিলো তাদের বলা হবে, " তোমরা তোমাদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করেছ ; এখন তোমরা তোমাদের কাজের মূল্য গ্রহণ কর, তোমরা অন্যায় করেছ, পাপ করেছ এবং সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছ ; এবং নিজেদের পাপ কাজের দরুণ অন্যায়ভাবে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিলে। সত্যের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ পৃথিবীর জীবনে তোমরা সর্বদা করেছ এবং তা করেছ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে। এখন তোমাদের দেয়া হবে অবমাননাকর শাস্তি।"

রুকু - ৩

২১। আ'দ সম্প্রদায়ের ভ্রাতা [ হুদের ] উল্লেখ স্মরণ কর, ৪৭৯৮ যখন সে তাঁর সম্প্রদায়কে ঘুর্ণায়মান বালুকাময় প্রান্তর [ আহকাফ ] সম্বন্ধে সর্তক করেছিলো ৪৭৯৯। যদিও তাঁর পূর্বে এবং পরেও সর্তককারীরা এসেছিলো। [ সে বলেছিলো ] : " তোমরা আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কারও ইবাদত করো না। নিশ্চয় আমি তোমাদের উপরে এক ভয়ংকর মহাদিনের আজাবের ভয় করছি।"

৪৭৯৮। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৬৫ ] ও টিকা ১০৪০। " আ'দ সম্প্রদায়ের ভ্রাতা " অর্থাৎ হুদ্‌ নবীর কথা বলা হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হুদ নবী আদ্‌ সম্প্রদায়েরই লোক ছিলেন এবং তাদের মাঝেই প্রতিপালিত হন, তিনি বহিরাগত কোনও আগন্তুক ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাদেরই জ্ঞাতি ভাই। ঠিক যেরূপ হচ্ছে রাসুলের অবস্থান কোরাইশদের মাঝে।

৪৭৯৯। "আহকাফ " বাসীদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে এই সূরার ভূমিকাতে। আল্লাহ্‌র করুণায় তারা উন্নত সেচ প্রণালী উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছিলো। ফলে তারা পরিণত হয়েছিলো এক উন্নত সমৃদ্ধশালী জাতিতে। তাদের সমৃদ্ধি ও ক্ষমতা তাদের আল্লাহ্‌র রাস্তা থেকে বিচ্যুত করে দেয় - তারা আল্লাহ্‌র বিধানের বিরোধিতা করে। ফলে তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়। দেখুন নীচের [ ২৪ - ২৬ ] আয়াত সমূহ।

২২। তারা বলেছিলো," তুমি কি আমাদেরকে আমাদের দেব-দেবীগুলির পূঁজা থেকে নিবৃত্ত করতে এসেছ ? যদি তুমি সত্যবাদী হও তবে আমাদের যে [ শাস্তির ] ভয় দেখাচ্ছ তা আনায়ন কর ৪৮০০।

৪৮০০। পাপের পথ সত্যের আলো প্রবেশের পথকে অবরুদ্ধ করে দেয়। আদ্‌ জাতিও এর ব্যতিক্রম ছিলো না, আল্লাহ্‌র বিধানকে অস্বীকার করে তারা তাদের সৃষ্ট বিধানে এতটাই নিমগ্ন হয়ে পড়ে যে, তারা আল্লাহ্‌ প্রেরিত রাসুলকে সনাক্ত করতে অক্ষম হয় এবং তার প্রচারিত আল্লাহ্‌র বাণী গ্রহণে অস্বীকার করে। তারা আল্লাহকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে এবং আল্লাহ্‌র শাস্তিকে আহ্বান করে। এই আহ্বানের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি অবিশ্বাসই প্রকাশ করা হয়।

২৩। সে বলেছিলো : "[ কখন আজাব আসবে ] সে জ্ঞান তো কেবল আল্লাহ্‌রই নিকট আছে ৪৮০১। আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে, কেবল তাই-ই আমি তোমাদের নিকট প্রচার করি। কিন্তু আমি দেখছি তোমরা এক মূঢ় সম্প্রদায়। "

৪৮০১। পাপের শেষ পরিণতি কখনও শুভ হতে পারে না। পাপের শাস্তি অবশ্যই পতিত হবে। সে শাস্তি ঠিক কখন প্রেরিত হবে তা কেউ জানে না। এমন কি আল্লাহ্‌র প্রেরিত রসুলদের নিকটও তা দৃশ্যমান নয়। কারণ শাস্তিদাতা কোনও রসুল নয় ; শাস্তিদাতা স্বয়ং আল্লাহ্‌। পাপে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তির নিকট সত্যের আবেদন কোনও প্রতিক্রিয়া জাগাতে অক্ষম - এই চিরন্তন সত্যকে এই আয়াত সমূহের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে
২৪। অতঃপর, যখন তারা [ শাস্তিকে ] মেঘের [ আকারে ] আকাশকে অতিক্রম করে তাদের উপত্যকার দিকে আসতে দেখলো ৪৮০২। তারা বলেছিলো, " এই মেঘ আমাদের বৃষ্টি দেবে।" " না ; এই সেই [শাস্তি ], যা তোমরা ত্বরান্বিত করতে চাইছিলে। - একটি বাতাস, যাতে রয়েছে দুঃখদায়ক শাস্তি।

৪৮০২। আদ জাতির শাস্তির বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। তাদের শাস্তি এসেছিলো অকস্মাৎ - যখন তাদের মনে শাস্তি সম্বন্ধে ক্ষীণমাত্র শঙ্কা ছিলো না। তারা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলো। সুতারাং মেঘের দর্শনে তারা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ঘন কালো মেঘ যখন তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো তারা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো এই ভেবে যে বৃষ্টির পানি তাদের সেচ প্রণালীকে পরিপূর্ণ করে তুলবে। উপযুক্ত সেচের ফলে তাদের শষ্য ক্ষেত্র শষ্যের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু না, এটা কোনও সাধারণ মেঘ ছিলো না, এটা ছিলো টর্নেডো এর পূর্বাভাষ। প্রচন্ড বাতাস, ঘুর্ণিঝড়, ধূলা, বালি তাদের সৃষ্ট সকল কিছুকে এক লহমায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত করে দেয়। জীবন ধবংস হয়, শষ্য ক্ষেত্র পাথর ও বালিতে পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে। একদা সমৃদ্ধ নগরী, জনশূন্য, ঊষর স্থানে পরিণত হয়ে পড়ে। যারা একদিন নিজেদের উৎকর্ষতায় অহংকারে মত্ত ছিলো। যে সভ্যতাকে তারা দীর্ঘদিন তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলো তা একমূহুর্তের মধ্যে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। তাদের সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ অতীতের সাক্ষর হয়ে পড়ে মাত্র।

২৫। " ইহার প্রভুর নির্দেশে ইহা সব কিছুকে ধ্বংস করে দেবে।" তারপর সকালে তাদের পরিণাম এরূপ হলো যে, তাদের বসতির [ ধবংসাবশেষ ] ব্যতীত আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না। এরূপেই আমি পাপীদের প্রতিফল দিয়ে থাকি ৪৮০৩।

৪৮০৩। এই আয়াতটির মাধ্যমে আল্লাহ্‌র শাস্তির ক্ষীপ্রতা ও সম্পূর্ণতাকে তুলে ধরা হয়েছে। আদ্‌ জাতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের মধ্যে স্বল্প কিছু সংখ্যক বেঁচে থাকে তারা সে স্থান ত্যাগ করে [ দেখুন আয়াত ৭:৬৫ ও টিকা ১০৪০ ]। তাদের গৌরবজ্জ্বল সভ্যতার আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না।

২৬। [ হে কুরাইশরা ] নিশ্চয়ই আমি তাদের এমন দৃঢ়ভাবে [ সাফল্য এবং ] ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যা আমি তোমাদের করি নাই। এবং শোনার ক্ষমতা, দেখার ক্ষমতা, হৃদয় বৃত্তি এবং বুদ্ধি বৃত্তি দ্বারা আমি তাদের বিভূষিত করেছিলাম ৪৮০৪। কিন্তু তাদের শোনার ও দেখার ক্ষমতা এবং হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধি বৃত্তি তাদের কোন উপকারেই এলো না, যখন তারা আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে যেতে লাগলো ৪৮০৫। এবং তারা [ সম্পূর্ণভাবে ] [ সেই শাস্তি ] দ্বারা পরিবৃত হয়ে পড়লো, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো ৪৮০৬।

৪৮০৪। আদ্‌ জাতি ও তাদের পরবর্তী বংশধর যারা সেই প্রচন্ড ঘুর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পায়, সেই সামুদ জাতি - এদেরকে আল্লাহ্‌ বিশেষ নেয়ামতে ধন্য করেছিলেন। বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে তাদের উন্নতি ইসলাম পূর্বে কোরাইশদের অপেক্ষা ছিলো বহুগুণ। এই উন্নতির মূলে ছিলো তাদের মানসিক দক্ষতা সমূহ, যা, শুধুমাত্র আল্লাহ্‌ প্রদত্ত ক্ষমতা। " শোনার ক্ষমতা ও দেখার ক্ষমতা " দ্বারা বুঝানো হয়েছে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার মাধ্যমে শোনা ও দেখা বা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সত্যকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা। 'হৃদয়' শব্দটি আরবীতে 'বুদ্ধি', যুক্তিসংক্রান্ত বিচার ক্ষমতা এবং আবেগ, অনুভূতি, ও সৌন্দর্য বোধ এবং শিল্পী মনকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ মানসিক বিভিন্ন দক্ষতাকে "কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়" শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে।

৪৮০৫। আল্লাহ্‌ প্রদত্ত বিভিন্ন মানসিক দক্ষতা সমূহ সকলকে সমভাবে দান করা হয় না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রতিভাধর ব্যক্তিও যদি আল্লাহ্‌র বিধান সমূহ বা আল্লাহকে অস্বীকার করে তবে তার জন্যও পরলোকের শাস্তি অবধারিত। তার প্রতিভার স্বীকৃতি সে ইহলোকেই লাভ করবে পরলোকে তার জন্য কোনও স্বীকৃতি নাই। আল্লাহকে অস্বীকারের দরুণ সে আল্লাহ্‌র নিকট হবে অপরাধী।

৪৮০৬। দেখুন [ ৪৫ : ৩৩ ] আয়াত ও টিকা ৪৭৭০। যারা আল্লাহ্‌ ও আল্লাহ্‌র বিধান সমূহের প্রতি ঠাট্টা প্রদর্শন করে থাকে, তাতে আল্লাহ্‌র কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি ঘটে না। তাদের কৃতকর্ম তাদের সুস্থ বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফলে তারা আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠত্ব ; ক্ষমতা, মহানুভবতা, দয়া, ক্ষমাকে তাদের অন্তরের মাঝে অনুভবে ব্যর্থ হয়। তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বে ক্ষমতায়, বিমোহিত হয়ে পড়ে। এ ভাবেই তাদের কৃতকর্ম তাদের পরিবেষ্টন করে থাকে।

রুকু - ৪

২৭। আমি তো তোমাদের চারিপার্শ্বের জনপদসমূহ ধ্বংস করেছিলাম ; আমি তাদের বিভিন্নভাবে নিদর্শনসমূহ দেখিয়েছিলাম যেনো তারা [ আমার দিকে ] ফিরে আসে ৪৮০৭।

৪৮০৭। আরবের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী সাক্ষ্য দেয় যে, যুগে যুগে যারাই আল্লাহ্‌র বিধানকে অস্বীকার করে পাপে লিপ্ত হয়েছে তাদের জন্য শাস্তি ছিলো অবধারিত। পরবর্তী প্রজন্ম কি এর থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করবে না ?

২৮। [আল্লাহ্‌র ] নিকটবর্তী হওয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্‌র পরিবর্তে তারা যাদের উপাস্যরূপে পূঁজা করতো, তবে তারা কেন পূর্বেই তাদের সাহায্য করলো না? বরং তারা [ উপাস্যরা ] তাদের হতাশার মাঝে ত্যাগ করে গিয়েছিলো। এটা ছিলো তাদের মিথ্যা এবং [ অলীক ] উদ্ভাবন ৪৮০৮।

৪৮০৮। যারা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে তারা অলীক বস্তুরই উপাসনা করে। যেমনঃ আজকের যুগে অনেকেই 'বিজ্ঞান' কে আল্লাহ্‌র নেয়ামত ভাবার পরিবর্তে মনে করে বিজ্ঞান তাদের রক্ষাকর্তা। এরূপ বহু উদাহরণ বিদ্যমান যারা প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে তাদের রক্ষাকর্তারূপে কল্পনা করে। এ সমস্তই তাদের কল্পনা থেকে উদ্ভাবিত। প্রকৃত সত্য হচ্ছে যে আল্লাহ্‌ -ই একমাত্র রক্ষাকর্তা ও সর্বশক্তিমান।

২৯। স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জ্বিনকে, যারা [ নিঃশব্দে ] কুর -আন পাঠ শুনছিলো ৪৮০৯। যখন তারা উহার [ পাঠের ] নিকটে উপস্থিত হলো, তারা [ একে অন্যকে ] বলল, " চুপ করে শোন।" যখন [ পাঠ ] সমাপ্ত হলো তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেলো, সর্তক করার জন্য [তাদের পাপ থেকে ]।

৪৮০৯। 'Nafar' শব্দটি দ্বারা তিন থেকে দশজনের সমষ্টির একটি দলকে বোঝানো হয়েছে। জ্বিন শব্দটির অর্থের জন্য দেখুন [ ৬ : ১০০ ] আয়াত ও টিকা ৯২৯। জ্বিনের এই দলটি মনোযোগ ও ভক্তি সহকারে কোরাণ পাঠ শ্রবণ করে। পরবর্তী আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা হযরত মুসার কিতাব সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলো। তারা ইহুদীদের ধর্ম সম্বন্ধে পূর্বেই জ্ঞাত হলেও তারা ইসলাম ধর্মের রূপরেখাতে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে যায় এবং সকলকে ইসলামের দিকে আহ্বান করে।

৩০। তারা বলেছিলো, " হে আমাদের সম্প্রদায় ! আমরা এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি যা অবতীর্ণ হয়েছে মুসার পরে, যা সত্যায়িত করে উহার পূর্ববর্তী কিতাবকে। ইহা [ মানুষকে ] পরিচালিত করে সত্য এবং সরল পথের দিকে।

৩১। " হে আমার সম্প্রদায়, আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বানকারীর দিকে মনোযোগ দাও এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। আল্লাহ্‌ তোমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করবেন এবং ভয়াবহ শাস্তি থেকে তোমাদের উদ্ধার করবেন ৪৮১০।

৪৮১০। যিনি আল্লাহ্‌র একত্বের প্রতি বিশ্বমানবকে আহ্বান করেন তিনি আমাদের মহানবী [ সা ]। যদি আমরা আল্লাহ্‌র একত্বে ও মহানবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি, তবে আল্লাহ্‌ আমাদের গুণাহ্‌ সমূহ ক্ষমা করে দেবেন। কারণ সাধারণ মানুষ কেহই পাপের উর্দ্ধে নয়। অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন দ্বারাই একমাত্র আল্লাহ্‌র ক্ষমা লাভের যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ্‌র ক্ষমাই পরলোকের মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়।

৩২। " যদি কেউ আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া না দেয়, সে পৃথিবীতে [আল্লাহ্‌র পরিকল্পনাকে ] ব্যর্থ করতে পারবে না ৪৮১১। এবং আল্লাহ্‌ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। এরূপ লোকেরাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে [ ঘুরে বেড়ায় ]। " ৪৮১১

৪৮১১। যদি কেউ প্রকৃত সত্যকে অর্থাৎ আল্লাহ্‌র অস্তিত্বতে অস্বীকার করে, অথবা সত্য প্রচারে বাঁধার সৃষ্টি করে তার দ্বারা সে আল্লাহ্‌র পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করতে অক্ষম। কারণ আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবেই। পার্থিব কোন বাধাই তা অবরুদ্ধ করতে পারবে না। তবে অবিশ্বাসী ও বাধানদানকারীরা আল্লাহ্‌র করুণা ও অনুগ্রহ বঞ্চিত হবে। ফলে আল্লাহ্‌র দেয়া নিরাপত্তা বন্ধনী তাদের বেষ্টন করে থাকবে না। যার ফলে তাদের আত্মা কোনও নিরাপদ আশ্রয় লাভে অক্ষম হবে। এরা হবে বিভ্রান্ত, উদ্দেশ্যবিহীন অসহায় -যেনো হাল ভাঙ্গা তরণী [ A ship without rader ], এরাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। পৃথিবীতে যারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে ধন্য হয় তাদের জীবন বিশ্বাসের নিরাপত্তায় পরিপূর্ণতা লাভ করে। তারা হয় ধীর স্থির,সংযমী, ধৈর্য্যশীল, প্রভৃতি বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত। অপরপক্ষে যারা অবিশ্বাসী তাদের চিত্ত হয় উদ্‌ভ্রান্ত, অস্থিরতা তাদের সর্বসত্ত্বাকে গ্রাস করে মানসিক শান্তিকে বিঘ্নিত করে। এদের কথাই বলা হয়েছে যে, এরা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।

৩৩। তারা কি অনুধাবন করে না যে, আল্লাহ্‌, যিনি আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এ সকল সৃষ্টিতে কোনরূপ ক্লান্তিবোধ করেন না, এবং তিনি মৃতকে জীবন দান করতেও সক্ষম ? হ্যাঁ অবশ্যই তিনি সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাবান ৪৮১২।

৪৮১২। দেখুন [ ২ : ২৫৫ ] আয়াত [ আয়তাল কুরশী ] ; যেখানে বলা হয়েছে, " তাঁর আসন আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যপ্ত ; ইহাদের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না।" এই আয়াতে পূর্বোক্ত আয়াতেরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে। এই বিশাল বিশ্বভূবন সৃষ্টি ও রক্ষণাবেণে স্রষ্টার কোনও ক্লান্তি নাই। যিনি এই বিশাল বিশ্ব ভূবনের সৃষ্টি ও রক্ষনাবেক্ষণে সক্ষম, তিনি অবশ্যই মৃতের জীবন দান করতেও সক্ষম। তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। বিশ্বাসের এই ভিত্তি-ই হচ্ছে ঈমান।

৩৪। যেদিন অবিশ্বাসীদের [ জাহান্নামের ] আগুনের সম্মুখে উপস্থিত করা হবে ৪৮১৩ ; ও [ তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে ], " এটা কি সত্য নয় ? " তারা বলবে, " হ্যাঁ, আমাদের প্রভুর শপথ !" [ তখন বলা হবেঃ ] " তাহলে শাস্তি আস্বাদন কর, কারণ তোমরা ছিলে [ সত্য ] প্রত্যাখানে অভ্যস্ত।" ৪৮১৪

৪৮১৩।। দেখুন আয়াত [ ৪৬ : ২০ ] যেখানে ঈমানদার পিতামাতার পাপিষ্ঠ সন্তানের উদাহরণ দ্বারা অবিশ্বাসীদের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। এই আয়াতেও আদ্‌ জাতি ও ঈমানদার জ্বিন্‌ সম্প্রদায়ের উদাহরণের মাধ্যমে একই ভাবে কাফিরদের শেষ পরিণতির পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে।
৪৮১৪। যারা অবিশ্বাসী তাদের নিকট পরলোকের জীবনের প্রকৃত চিত্ররূপ থাকে অবগুণ্ঠিত। তারা চেষ্টা করেও এই পৃথিবীতে তা অনুধাবনে অক্ষম। বস্তুগত জগত তাদের এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে, তার বাইরে তারা কিছুই উপলব্ধি করে না। তাদের আধ্যাত্মিক জগত থাকে অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। মৃত্যুর পরপারে তাদের এই আচ্ছন্নতা বিদূরীত হয়। তারা তখন প্রকৃত সত্যের রূপ দেখতে সক্ষম হয়। কিন্তু তারা তখন সত্যের আলো ও আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়। পরলোকের জীবন হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবন। সে জীবনের সর্বোচ্চ কল্যাণ ও পাওয়া হচ্ছে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভ করা ও তাঁর নূরে আত্মাকে আলোকিত করা। যে তা বঞ্চিত হয় সে হয় দোযখের অধিবাসী।

৩৫। সুতারাং তুমি ধৈর্য্যের সাথে অধ্যাবসায়ী হও, যেরূপ [ অন্যসব ] রাসুলেরা উদ্দেশ্যের প্রতি ছিলেন অনমনীয়; এবং [ অবিশ্বাসীদের ] ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না। সেদিন যখন তারা প্রতিশ্রুত [ শাস্তিকে ] প্রত্যক্ষ করবে, [ তাদের মনে হবে ], ওরা যেনো দিনের একদন্ডের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করে নাই ৪৮১৫। আল্লাহ্‌র বাণী ঘোষণাই [ তোমার কাজ ] ৪৮১৬। সীমালংঘণকারী ব্যতীত আর কেহ কি ধ্বংস প্রাপ্ত হবে?

৪৮১৫। এ কথা বারে বারে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে কোনও সৎকাজই হারিয়ে যাবে না। তবে অনেক সময়ে তা বহু বাঁধার সম্মুখীন হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হতে সময়ের প্রয়োজন হয়। রসুলকে [ সা ] সম্বোধনের মাধ্যমে এই সত্যকেই বিশ্বজনীন করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। সুতারাং মোমেন বান্দারা যেনো অধৈর্য না হয়ে ধৈর্য ধারণ করে। সৎ কাজের সাফল্য অবশ্যাম্ভাবী এবং যারা সৎকাজে বাধা দান করে তাদের শাস্তিও সেরূপ অবশ্যাম্ভবী। এই অবশ্যাম্ভবী শাস্তিকে "প্রতিশ্রুত শাস্তি"- বাক্যটি দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই শাস্তি তাদের উপরে এমন হঠাৎ আসবে যে, তাদের মনে হবে যেন,তারা পৃথিবীতে একদিন বা একদন্ডের বেশী অবস্থান করে নাই। এখানে সময়ের আপেক্ষিক তত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীতে জীবনের সময়ের পরিক্রমা এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সময়ের গুরুত্বপূর্ণ এই ধারণা পরলোকের অনন্ত সময়ের ধারণার প্রেক্ষিতে বলবৎ থাকবে না। এখানে সময়ের ধারণার আপেক্ষিক তত্বকেই তুলে ধরা হয়েছে।

৪৮১৬। আল্লাহ্‌ রাসুলের [ সা ] মাধ্যমে যে বিশ্বজনীন ঘোষণা করেছেন, তা সর্বকালে, সর্বযুগের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ্‌ প্রেরিত সত্য জীবন বিধানই হচ্ছে আল্লাহ্‌ প্রেরিত সত্য। যদি কেউ এই সত্যকে বাধা দান করে তাদেরই বলা হয়েছে সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। এরাই হচ্ছে আল্লাহ্‌র সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বা সীমালঙ্ঘনকারী। এদের ধ্বংস অনিবার্য। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আল্লাহ্‌ প্রেরিত জীবন বিধান বা সত্য, সর্বদা ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত। মানুষের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত। সুতারাং এই ন্যায় ও সত্যকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার সাথে এক করে দেখার অবকাশ নাই। আনুষ্ঠানিকতা ধর্ম নয় - প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে সত্য ও ন্যায়। সীমালঙ্ঘনকারীরা তাদের কৃতকর্মের দরুণই ধ্বংস হয়ে যাবে