+
-
R
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : সূরাগুলি অবতীর্ণ হওয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে এগুলির বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সূরাগুলির বিন্যাসের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী ব্যাখ্যাও অনুসরণ করা হয়েছে। বিন্যস্তের এই ধারাবাহিকতায় এক অপূর্ব যুক্তিসম্মত ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। এ পর্যন্ত আমরা কোরাণের পাঁচ ষষ্ঠাংশ শেষ করতে পেরেছি। অবশিষ্ট এক ষষ্ঠাংশ ছোট ছোট সূরাগুলির সমষ্টি। এই ছোট ছোট সূরাগুলি আবার বিষয়বস্তু অনুযায়ী ছোট ছোট শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।
এরূপ প্রথম শ্রেণীটি গঠিত হয়েছে তিনটি সূরার [ ৪৭ থেকে ৪৯ ] সমন্বয়ে। এই শ্রেণীটিতে মুসলিম উম্মার বা সম্প্রদায়ের গঠন, বাইরের শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান সূরাটিতে আলোচনা করা হয়েছে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন সাহস এবং তেজঃপূর্ণ মনোবল। এই সূরার সময়কাল প্রথম হিজরী যে সময় মুসলমানদের অস্তিত্ব ছিলো মক্কাবাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হুমকির মুখে।
সার সংক্ষেপ : বিশ্বাসীদের উপরে আক্রমণ ও শত্রুতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে হবে তাহলেই আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করবেন। [ ৪৭ : ১ - ১৯]।
দুর্বল চিত্তদের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। যারা দৃঢ়ভাবে সত্যের জন্য সংগ্রাম করে এবং যারা করে না তাদের আলাদা ভাবে সনাক্ত করা হবে। [ ৪৭ : ২০ - ৩৮ ]।
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৪৮১৭। যারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না এবং অন্যকেও তাদের পথে প্রভাবিত করে ; তাদের সম্বন্ধেই এই আয়াতে বলা হয়েছে। তাদের কর্মপ্রচেষ্টা কখনই সফলতা লাভ করবে না। কারণ সকল শক্তির মূল উৎস আল্লাহ্। পৃথিবীর কোনও কিছুই তাঁকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। যদি মন্দ লোক সত্যের বিরোধিতা করে এবং অন্যকে সত্য গ্রহণ না করতে প্রভাবিত করার প্রয়াস পায় তবে তাদের কৃতকর্মের ফল তাদের প্রত্যাশার বিপরীতই ঘটবে।
৪৮১৮। 'Bal' শব্দটির দ্বারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মানসিক অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। এখানে উভয়বিধ অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। প্রথম অর্থে আল্লাহ্ মোমেন বান্দাদের ইহকাল ও পরকালের সকল অবস্থাকে কল্যাণে ভরিয়ে দেন। দ্বিতীয় অর্থে আল্লাহ্ মোমেন বান্দাদের মানসিক অবস্থান পরিবর্তন করে দেন। ফলে মোমেন বান্দার পক্ষে আল্লাহ্র সত্যকে অনুধাবন করা ও তার অনুসরণ করা অনেক সহজ হয়।
৪৮১৯। এই আয়াতটির মাধ্যমে জীবনের মূল্যবান নৈতিক শিক্ষা দান করা হয়েছে। আল্লাহ্ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক সত্য শিক্ষাদান করে থাকেন। যারা আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যকে প্রত্যাখান বা কুফরী করে তারা মিথ্যার অনুসরণ করে। তাদের অবস্থা এরূপ যেনো তারা মিথ্যা মরিচীকার পিছনে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটে চলেছে। যার প্রকৃত কোনও অস্তিত্ব নাই। ফলে কোনও দিনও সে তার প্রকৃত লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হবে না। অপর পক্ষে যরা ঈমান আনে তারা মানুষ সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে অনুধাবনে সক্ষম হবে ফলে তাদের মনঃজগত সুখ ও শান্তিতে ভরে উঠবে। তারা হবে মানসিক দিক থেকে সুখী,শান্তিপূর্ণ, ধীর স্থির, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ তারা দৃঢ়তার সাথে,স্বীয় লক্ষ্যের দিকে একাগ্রভাবে অগ্রসর হতে সক্ষম। তাদের মন্দ কর্মগুলি আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিবেন।
৪৮২০। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে জেহাদ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যখন কেউ তা করবে তা সর্ব শক্তি দ্বারা করার আদেশ দান করা হয়েছে। "গর্দ্দানে আঘাত কর " এই বাক্যটির আক্ষরিক ও আলংকারিক উভয় অর্থ বিদ্যমান। গর্দ্দান হচ্ছে শরীরের এমন স্থান যেখানে অস্ত্রের এক আঘাতে শরীরকে মস্তকচ্যুত করা যায়। অর্থাৎ শত্রুর নিধনের উপযুক্ত স্থান। আলংকারিক অর্থে ব্যপকভাবে সেইরূপ আঘাত যা হবে প্রাণঘাতি - মৃত্যুসমতুল্য। যুদ্ধকে ছেলেখেলা হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
৪৮২১। এই আয়াতটি, [ ৮ : ৬৭ ] আয়াত ও টিকা ১২৩৪ সহিত তুলনাযোগ্য। যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় শত্রুকে নিধন করতে হবে যতক্ষণ না তাদের শক্তি ক্ষয় হয়ে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপরের হুকুম হচ্ছে পরাভূত শত্রুদের বন্দী করতে হবে।
৪৮২২। যখন শত্রুদের পরাভূত করে বন্দী করা হবে, তখন হয় তাদের প্রতি দয়া [ মুক্তিপণ ব্যতীত মুক্তি ] অথবা মুক্তিপণ ধার্য করতে হবে।
৪৮২৩। আল্লাহ্ মানুষকে দুঃখ, ব্যাথা, বিপদ, বিপর্যয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন, মানুষের ধৈর্য্যের ও আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীলতার ও আত্মত্যাগের। জেহাদ হচ্ছে মোমেন বান্দাদের জন্য আত্মত্যাগ,নির্ভরশীলতার, একটি পরীক্ষা বিশেষ। মোমেন বান্দাদের পরীক্ষা করা হয় তাঁরা আল্লাহ্র রাস্তায় কতটুকু আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তাঁরা কি আল্লাহ্র রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ? জেহাদ হচ্ছে মোমেন বান্দাদের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরীক্ষা। অপরপক্ষে শত্রুদের জন্য তা হচ্ছে নিজের ভুলকে উপলব্ধির পরীক্ষা। বিপদের মাঝে তাদের উপলব্ধির করার সুযোগ দান করা হয় যে, তারা যেনো অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে সঠিক পথে ফিরে আসে।
৪৮২৪। এই পংক্তিটি দুভাবে পড়া যায়। ১) 'Qatalu' অর্থাৎ যারা যুদ্ধ করে ; ২) ' Qutilu' অর্থ যারা নিহত হয়। প্রথম অর্থটি ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে যার অন্তর্ভূক্ত হবে দ্বিতীয় অর্থটি তবে Royal Egyptian Edition এ দ্বিতীয় অর্থটি ব্যবহার করা হয়েছে সেই বিধায় এখানে দ্বিতীয় অর্থটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৪৮২৫। ৪নং আয়াতের শেষ পক্তিটিতে আছে, " যাহারা আল্লাহ্র পথে নিহত হয়।" এখানে ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে তাদের আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করবেন। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে মৃত্যু পরবর্তী যে পথ সেই পথ অতিক্রমের সময়।
৪৮২৬। " যার কথা তিনি তাদের জন্য পূর্বেই ঘোষণা করেছেন।" আয়াত [ ২ : ২৫ ] এ এই সুসংবাদ দান করা হয়েছে।
৪৮২৭। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৪৭ : ১ ] ও টিকা ৪৮১৭।
৪৮২৮। যারা আল্লাহ্র বিধানে বিশ্বাসী নয়, আল্লাহ্ তাদের "কর্ম ব্যর্থ করে দেবেন।" এই জন্য যে তাদের কর্ম আল্লাহ্র নিকট মূল্যহীন। ফলে তারা যা করতে চায় সে অনুযায়ী সফলতা লাভ করবে না। কারণ তাদের মন্দ কাজের পরিণতি মন্দ হতে বাধ্য। তাদের মন্দ কাজ তাদের আত্মিক শক্তিকে ক্ষয় করে ফেলবে। ক্ষয়িষ্ণু আত্মা কখনও মহৎ বা উন্নত কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম। এ ভাবেই মন্দ কাজের পরিণতিতে আত্মার অবনতি ঘটে।
৪৮২৯। একটি পাপ আর একটি পাপকে টেনে আনে। মন্দ কাজের পরিণতি সর্বদা মন্দ হতে বাধ্য। পৃথিবীর অতীত ইতিহাস ও প্রথা এই সাক্ষ্য দেয় যে মন্দ কাজের শেষ পরিণতি ধ্বংস। এ থেকেও কি ভবিষ্যত প্রজন্মের মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করবে না? আল্লাহ্র করুণার হস্ত তাঁর অনুগত বান্দার জন্য সর্বদা প্রসারিত কিন্তু যে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আল্লাহ্ তাকে সাহায্য করেন না।
সূরা মুহম্মদ
সূরা মুহম্মদ [ নবী ] - ৪৭
৩৮ আয়াত, ৪ রুকু, মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : সূরাগুলি অবতীর্ণ হওয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে এগুলির বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সূরাগুলির বিন্যাসের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী ব্যাখ্যাও অনুসরণ করা হয়েছে। বিন্যস্তের এই ধারাবাহিকতায় এক অপূর্ব যুক্তিসম্মত ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। এ পর্যন্ত আমরা কোরাণের পাঁচ ষষ্ঠাংশ শেষ করতে পেরেছি। অবশিষ্ট এক ষষ্ঠাংশ ছোট ছোট সূরাগুলির সমষ্টি। এই ছোট ছোট সূরাগুলি আবার বিষয়বস্তু অনুযায়ী ছোট ছোট শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।
এরূপ প্রথম শ্রেণীটি গঠিত হয়েছে তিনটি সূরার [ ৪৭ থেকে ৪৯ ] সমন্বয়ে। এই শ্রেণীটিতে মুসলিম উম্মার বা সম্প্রদায়ের গঠন, বাইরের শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান সূরাটিতে আলোচনা করা হয়েছে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন সাহস এবং তেজঃপূর্ণ মনোবল। এই সূরার সময়কাল প্রথম হিজরী যে সময় মুসলমানদের অস্তিত্ব ছিলো মক্কাবাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হুমকির মুখে।
সার সংক্ষেপ : বিশ্বাসীদের উপরে আক্রমণ ও শত্রুতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে হবে তাহলেই আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করবেন। [ ৪৭ : ১ - ১৯]।
দুর্বল চিত্তদের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। যারা দৃঢ়ভাবে সত্যের জন্য সংগ্রাম করে এবং যারা করে না তাদের আলাদা ভাবে সনাক্ত করা হবে। [ ৪৭ : ২০ - ৩৮ ]।
সূরা মুহম্মদ [ নবী ] - ৪৭
৩৮ আয়াত, ৪ রুকু, মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
০১। যারা আল্লাহ্কে প্রত্যাখান করে এবং আল্লাহ্র রাস্তা থেকে [ লোকদের ] নিবৃত্ত করে, - তিনি তাদের সকল কাজ ব্যর্থ করে দেবেন ৪৮১৭।
৪৮১৭। যারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না এবং অন্যকেও তাদের পথে প্রভাবিত করে ; তাদের সম্বন্ধেই এই আয়াতে বলা হয়েছে। তাদের কর্মপ্রচেষ্টা কখনই সফলতা লাভ করবে না। কারণ সকল শক্তির মূল উৎস আল্লাহ্। পৃথিবীর কোনও কিছুই তাঁকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। যদি মন্দ লোক সত্যের বিরোধিতা করে এবং অন্যকে সত্য গ্রহণ না করতে প্রভাবিত করার প্রয়াস পায় তবে তাদের কৃতকর্মের ফল তাদের প্রত্যাশার বিপরীতই ঘটবে।
০২। কিন্তু যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, এবং মুহাম্মদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা বিশ্বাস করে - যেহেতু তা তাদের প্রভুর নিকট থেকে [আগত ] সত্য, - তিনি তাদের মন্দগুলি দূর করে দেবেন এবং তাদের অবস্থার উন্নতি করবেন ৪৮১৮।
৪৮১৮। 'Bal' শব্দটির দ্বারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মানসিক অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। এখানে উভয়বিধ অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। প্রথম অর্থে আল্লাহ্ মোমেন বান্দাদের ইহকাল ও পরকালের সকল অবস্থাকে কল্যাণে ভরিয়ে দেন। দ্বিতীয় অর্থে আল্লাহ্ মোমেন বান্দাদের মানসিক অবস্থান পরিবর্তন করে দেন। ফলে মোমেন বান্দার পক্ষে আল্লাহ্র সত্যকে অনুধাবন করা ও তার অনুসরণ করা অনেক সহজ হয়।
০৩। এর কারণ যারা আল্লাহ্কে প্রত্যাখান করে, তারা [অন্তঃসারশূন্য ] অহংকারের অনুসরণ করে, [অপরপক্ষে] যারা বিশ্বাসী তারা তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে [ আগত ] সত্যের অনুসরণ করে। এ ভাবেই আল্লাহ্ মানুষের জন্য তাদের দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন উপমার মাধ্যমে ৪৮১৯।
৪৮১৯। এই আয়াতটির মাধ্যমে জীবনের মূল্যবান নৈতিক শিক্ষা দান করা হয়েছে। আল্লাহ্ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক সত্য শিক্ষাদান করে থাকেন। যারা আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যকে প্রত্যাখান বা কুফরী করে তারা মিথ্যার অনুসরণ করে। তাদের অবস্থা এরূপ যেনো তারা মিথ্যা মরিচীকার পিছনে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটে চলেছে। যার প্রকৃত কোনও অস্তিত্ব নাই। ফলে কোনও দিনও সে তার প্রকৃত লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হবে না। অপর পক্ষে যরা ঈমান আনে তারা মানুষ সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে অনুধাবনে সক্ষম হবে ফলে তাদের মনঃজগত সুখ ও শান্তিতে ভরে উঠবে। তারা হবে মানসিক দিক থেকে সুখী,শান্তিপূর্ণ, ধীর স্থির, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ তারা দৃঢ়তার সাথে,স্বীয় লক্ষ্যের দিকে একাগ্রভাবে অগ্রসর হতে সক্ষম। তাদের মন্দ কর্মগুলি আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিবেন।
০৪। সুতারাং যখন [ যুদ্ধক্ষেত্রে ] তোমরা অবিশ্বাসীদের সাথে মিলিত হও ৪৮২০; তখন তাদের গর্দানে আঘাত করবে, পরিশেষে যখন তোমরা উহাদের সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করবে, তখন [ উহাদের ] মজবুত করে বাঁধবে ৪৮২১। অতঃপর হয় অনুকম্পা, নয় মুক্তিপণ ৪৮২২। যতক্ষণ না শত্রুপক্ষ অস্ত্র ত্যাগ করে [ জিহাদ চালিয়ে যাবে ] এটাই বিধান। আর যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, অবশ্য তাদের উপরে নিজেই প্রতিশোধ নিতে পারেন, কিন্তু তিনি চান [ যুদ্ধের মাধ্যমে ] এককে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করার জন্য ৪৮২৩। কিন্তু যারা আল্লাহ্র রাস্তায় মারা যায় ৪৮২৪, তিনি কখনও তাদের কর্ম বিনষ্ট হতে দেন না।
৪৮২০। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে জেহাদ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যখন কেউ তা করবে তা সর্ব শক্তি দ্বারা করার আদেশ দান করা হয়েছে। "গর্দ্দানে আঘাত কর " এই বাক্যটির আক্ষরিক ও আলংকারিক উভয় অর্থ বিদ্যমান। গর্দ্দান হচ্ছে শরীরের এমন স্থান যেখানে অস্ত্রের এক আঘাতে শরীরকে মস্তকচ্যুত করা যায়। অর্থাৎ শত্রুর নিধনের উপযুক্ত স্থান। আলংকারিক অর্থে ব্যপকভাবে সেইরূপ আঘাত যা হবে প্রাণঘাতি - মৃত্যুসমতুল্য। যুদ্ধকে ছেলেখেলা হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
৪৮২১। এই আয়াতটি, [ ৮ : ৬৭ ] আয়াত ও টিকা ১২৩৪ সহিত তুলনাযোগ্য। যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় শত্রুকে নিধন করতে হবে যতক্ষণ না তাদের শক্তি ক্ষয় হয়ে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপরের হুকুম হচ্ছে পরাভূত শত্রুদের বন্দী করতে হবে।
৪৮২২। যখন শত্রুদের পরাভূত করে বন্দী করা হবে, তখন হয় তাদের প্রতি দয়া [ মুক্তিপণ ব্যতীত মুক্তি ] অথবা মুক্তিপণ ধার্য করতে হবে।
৪৮২৩। আল্লাহ্ মানুষকে দুঃখ, ব্যাথা, বিপদ, বিপর্যয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন, মানুষের ধৈর্য্যের ও আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীলতার ও আত্মত্যাগের। জেহাদ হচ্ছে মোমেন বান্দাদের জন্য আত্মত্যাগ,নির্ভরশীলতার, একটি পরীক্ষা বিশেষ। মোমেন বান্দাদের পরীক্ষা করা হয় তাঁরা আল্লাহ্র রাস্তায় কতটুকু আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তাঁরা কি আল্লাহ্র রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ? জেহাদ হচ্ছে মোমেন বান্দাদের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরীক্ষা। অপরপক্ষে শত্রুদের জন্য তা হচ্ছে নিজের ভুলকে উপলব্ধির পরীক্ষা। বিপদের মাঝে তাদের উপলব্ধির করার সুযোগ দান করা হয় যে, তারা যেনো অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে সঠিক পথে ফিরে আসে।
৪৮২৪। এই পংক্তিটি দুভাবে পড়া যায়। ১) 'Qatalu' অর্থাৎ যারা যুদ্ধ করে ; ২) ' Qutilu' অর্থ যারা নিহত হয়। প্রথম অর্থটি ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে যার অন্তর্ভূক্ত হবে দ্বিতীয় অর্থটি তবে Royal Egyptian Edition এ দ্বিতীয় অর্থটি ব্যবহার করা হয়েছে সেই বিধায় এখানে দ্বিতীয় অর্থটি ব্যবহার করা হয়েছে।
০৫। শীঘ্রই তিনি তাদের পথ প্রদর্শন করবেন এবং তাদের অবস্থার উন্নতি করবেন ৪৮২৫।
৪৮২৫। ৪নং আয়াতের শেষ পক্তিটিতে আছে, " যাহারা আল্লাহ্র পথে নিহত হয়।" এখানে ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে তাদের আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করবেন। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে মৃত্যু পরবর্তী যে পথ সেই পথ অতিক্রমের সময়।
০৬। এবং তাদের বেহেশতে দাখিল করবেন, যার কথা তিনি তাদের জন্য [পূর্বেই ] ঘোষণা করেছেন ৪৮২৬।
৪৮২৬। " যার কথা তিনি তাদের জন্য পূর্বেই ঘোষণা করেছেন।" আয়াত [ ২ : ২৫ ] এ এই সুসংবাদ দান করা হয়েছে।
০৭। হে বিশ্বাসীগণ ! যদি তোমরা আল্লাহ্র [ রাস্তায় ] সাহায্য কর, তবে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়ভাবে অবিচল রাখবেন।
০৮। কিন্তু যারা আল্লাহকে প্রত্যাখান করে, - তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংস এবং তিনি তাদের কর্মসমূহ ব্যর্থ করে দেবেন ৪৮২৭।
০৮। কিন্তু যারা আল্লাহকে প্রত্যাখান করে, - তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংস এবং তিনি তাদের কর্মসমূহ ব্যর্থ করে দেবেন ৪৮২৭।
৪৮২৭। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৪৭ : ১ ] ও টিকা ৪৮১৭।
০৯। কারণ তারা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে ঘৃণা করে ; সুতারাং তিনি তাদের কর্মসমূহ নিষ্ফল করে দেন। ৪৮২৮
৪৮২৮। যারা আল্লাহ্র বিধানে বিশ্বাসী নয়, আল্লাহ্ তাদের "কর্ম ব্যর্থ করে দেবেন।" এই জন্য যে তাদের কর্ম আল্লাহ্র নিকট মূল্যহীন। ফলে তারা যা করতে চায় সে অনুযায়ী সফলতা লাভ করবে না। কারণ তাদের মন্দ কাজের পরিণতি মন্দ হতে বাধ্য। তাদের মন্দ কাজ তাদের আত্মিক শক্তিকে ক্ষয় করে ফেলবে। ক্ষয়িষ্ণু আত্মা কখনও মহৎ বা উন্নত কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম। এ ভাবেই মন্দ কাজের পরিণতিতে আত্মার অবনতি ঘটে।
১০। তারা কি পৃথিবী ভ্রমণ করে না এবং দেখে না যে, উহাদের পূর্ববর্তীরা [ যারা পাপে আসক্ত ছিলো ], তাদের কি পরিণাম হয়েছে? আল্লাহ্ তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছেন এবং যারা আল্লাহকে প্রত্যাখান করে তাদের জন্য অনুরূপ পরিণাম [ অপেক্ষা করছে ]। ৪৮২৯
৪৮২৯। একটি পাপ আর একটি পাপকে টেনে আনে। মন্দ কাজের পরিণতি সর্বদা মন্দ হতে বাধ্য। পৃথিবীর অতীত ইতিহাস ও প্রথা এই সাক্ষ্য দেয় যে মন্দ কাজের শেষ পরিণতি ধ্বংস। এ থেকেও কি ভবিষ্যত প্রজন্মের মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করবে না? আল্লাহ্র করুণার হস্ত তাঁর অনুগত বান্দার জন্য সর্বদা প্রসারিত কিন্তু যে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আল্লাহ্ তাকে সাহায্য করেন না।
১১। এর কারণ যারা বিশ্বাসী আল্লাহ্ তাদের রক্ষাকর্তা, কিন্তু যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের কোন রক্ষাকর্তা নাই।
রুকু - ২
৪৮৩০। উপযুক্ত উপমার সাহায্যে পাপীদের জীবনকে সুন্দররূপে চিত্রিত করা হয়েছে। জন্তু জানোয়ারের প্রাণ আছে, ক্ষুধা,তৃষ্ণা আছে,যৌন প্রয়োজন আছে। তারা আহার গ্রহণ করে পেটপূর্তি করে। আহারের সন্ধানেই তারা সারাটা জীবন ব্যয় করে এবং নিজেদের বংশধর পৃথিবীতে রেখে এই ধরাধাম ত্যাগ করে এবং সেখানেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদের জীবনের কোনও উচ্চতর ও মহত্তর উদ্দেশ্য নাই। মৃত্যু পরপারের কোনও জীবন নাই। যে সব লোক শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের জন্য জীবনপাত করে তাদের জীবন ঐ পশুদের অপেক্ষা কোনও অংশেই উন্নত নয়। তাদের জীবনের আনন্দ ফুর্তি সবই জাগতিক। ধন -সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করা ও পেটপূর্তি আহার,যৌনক্ষুধা নিবৃত্তি করা ব্যতীত তাদের বাঁচার অন্য কোনও উদ্দেশ্য তাদের উপলব্ধির অগোচরে। আধ্যাত্মিক জগতের আনন্দ, তৃপ্তি, সুখ, সম্বন্ধে তাদের ক্ষীণমাত্র ধারণাও নাই। যেহেতু আল্লাহ্ তাদের আত্মিক শক্তি দান করেই এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন ; যা এসব পাপীরা উপযুক্ত ব্যবহারের পরিবর্তে পাপের পঙ্কে নিক্ষেপ করেছে - সুতারাং তাদের পাপের পরিণতি হবে জাহান্নাম।
৪৮৩১। এখানে যে জনপদের উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে পৌত্তলিক কোরাইশ অধ্যূষিত মক্কা নগরী। মোশরেক কোরাইশরা আল্লাহ্র রাসুলকে [ সা ] মক্কা নগরী থেকে বিতাড়িত করে তার একমাত্র কারণ রাসুলের [ সা ] পূত পবিত্র চারিত্রিক গুণাবলী ও আল্লাহ্র প্রতি কোরাইশদের আহ্বান। সে কারণে প্রতীয়মান হয় যে, এই সূরার সময়কাল হবে হিজরতের পরে।
৪৮৩২। "সুস্পষ্ট প্রমাণ " - এই শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে সেই পথ যা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত।
৪৮৩৩। বেহেশতের এই বর্ণনায় চার রকম পানীয় ও সকল প্রকার ফলের বর্ণনা আছে। এবং সকল সুখ ও সর্বোচ্চ শান্তির প্রতীককে বর্ণনা করা হয়েছে। " প্রতিপালকের অনুগ্রহ " বাক্যটির দ্বারা। চার রকমের পানীয় হচ্ছে নিম্নরূপ :
১ ) "নির্মল পানির নহর " - যা সুস্বাদু, শীতল, পরিষ্কার। যা পার্থিব জগতের পানির ন্যায় অপরিষ্কার হয়ে পড়ে না।
২ ) দুধ যার স্বাদ অপরিবর্তনীয় যা কখনও টক্ হয়ে নষ্ট হয়ে যায় না। যার স্বাদ সর্বদা গরুর স্তন থেকে নির্গত টাট্কা দুধের স্বাদ।
৩) 'সুরা' যা পৃথিবীতে প্রাপ্য কোনও সুরার ন্যায় নয়। কারণ এই সুরা পার্থিব সুরার ন্যায় মাথার যন্ত্রণা সৃষ্টি করে না, মাতলামির জন্ম দেয় না, কিন্তু এ পানে সর্বদা মানসিক আনন্দ দান করবে।
৪) পরিশোধিত মধু - যা স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও খাঁটি যার সাথে কোনও ভেঁজাল মিশ্রিত নাই।
এই সব পানীয় পানে আত্মার মাঝে শান্তির অনুভূতি অনুভূত হবে, হৃদয়, মন পরিতৃপ্ত হবে, অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ স্নেহ ভালোবাসা স্বতঃস্ফুর্তভাবে হৃদয় মনকে আপ্লুত করে ফেলবে।
৪৮৩৪ দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৪৩ : ৭৩ ] ও টিকা ৪৬৭১। বেহেশতের বর্ণনায় প্রতিটি জিনিষই প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, কারণ বেহেশতের সুখ ও শান্তির প্রকৃত রূপ অনুধাবন করা এই পৃথিবীতে কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
৪৮৩৫। "প্রতিপালকের অনুগ্রহ " - পরলোকের সুখ ও শান্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটবে প্রতিপালকের অনুগ্রহ লাভের মাধ্যমে। যার ফলে পার্থিব জীবনের দুঃখ, ব্যাথা, অতৃপ্তির অনুভূতি দূর হয়ে আত্মা স্বর্গীয় আনন্দে ভরপুর হয়ে যাবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের মাধ্যমে মানব জীবনের চরম ও পরম প্রাপ্তি ঘটবে।
৪৮৩৬। দেখুন [ ৩৭ : ৬৬ - ৬৭ ] আয়াত ও টিকা ৪০৭৪। এই বর্ণনার মাধ্যমে এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে, বেহেশতের সুখ ও শান্তি যেরূপ আত্মার অন্তঃস্থলকে উজ্জ্বীবিত করে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলবে, ঠিক তদ্রূপ দোযখের শাস্তি ও উৎকণ্ঠা তাদের সর্ব সত্ত্বাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে। যার অনুধাবন করা এ পৃথিবীতে কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। একমাত্র প্রতীকের মাধ্যমেই তা কিছু কল্পনায় উপলব্ধি করা সম্ভব।
৪৮৩৭। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৪২ ] ও টিকা ১৪৩৪ এবং আয়াত [ ৬ : ২৫, ৩৬ ] ও টিকা ৮৫৭। এই আয়াতে মদীনার মোনাফেকদের মানসিক অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে যা সর্বকালে সর্বযুগের মোনাফেকদের জন্য প্রযোজ্য। মদীনার এ সব মোনাফেকরা রাসুলের [ সা ] দরবারে আগমন করতো এবং এমন ভান করতো যে তারা গভীর মনোযোগের সাথে রাসুলের [ সা ] শিক্ষাকে গ্রহণ করছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তারা তাদের অন্তরে কোনও সত্যকেই গ্রহণ করে না, বরং তারা যা শোনে ও দেখে তার দোষত্রুটি বের করার জন্য উম্মুখ থাকে। যখন তারা রাসুলের [সা ] দরবার থেকে বের হয়, তার সত্যের প্রকৃত শিক্ষা সম্বন্ধে কিছুই জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয় না। অপরপক্ষে তাদের ব্যবহার হয়ে পড়ে নির্বোধের ন্যায় । তারা এমন সব অসংলগ্ন প্রশ্ন করে যা সাধারণ জনগণের মনে বিভ্রান্তি ও সন্দেহের জন্ম দেয়। মোনাফেকদের এই বৈশিষ্ট্য অদ্যাবধি বিদ্যমান।
৪৮৩৮। আধ্যাত্মিক উন্নতি একদিনে ঘটে না। তা ঘটে ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে তা অগ্রসর হয়। প্রতিটি ধাপ পরবর্তী ধাপে আরোহণের পথকে সুগম ও দৃঢ় করে দেয় ও আত্মিক সম্পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করে। এভাবেই আল্লাহ্ সৎ পথের পথিকদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন। "তাদের জন্য পথের (আলো) বৃদ্ধি করেন।"
৪৮৩৯। দেখুন [ ৪৩ : ৬৬ ] ও টিকা ৪৬৬৫।
৪৮৪০। "সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।" যখন কেউ কোনও পাপ করে তাঁর পরিণাম তার জন্য অবশ্যাম্ভবী, প্রতি মূহুর্তে প্রতি ক্ষণে সে শাস্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তার পাপ কাজই হচ্ছে তার শেষ পরিণাম, বা কেয়ামত। সুতারাং কারও শেষ পরিণাম বা কেয়ামত আসার পূর্বেই অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন করা উচিত এবং এখনই তা শুরু করা প্রয়োজন। যখন শাস্তি বা শেষ পরিণাম বা কেয়ামত সংঘটিত হবে তখন আর অনুতাপের সময় থাকবে না। জাগতিক সকল সতর্কবাণী তখন বৃথা হয়ে যাবে।
এই সূরাটির অবতীর্ণ কালের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এর অবতীর্ণ সময় হচ্ছে হিজরতের এক বছর পর। ইতিমধ্যেই কোরাইশদের বিপর্যয়ের সকল লক্ষণ সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হতে শুরু করেছে। হিজরত এক মাইলফলক ইসলামের ইতিহাসে। 'হিজরত' প্রমাণ করে মদিনাবাসীদের কতটা শুভেচ্ছা ও আন্তরিকতা বিদ্যমান ছিলো ইসলামের জন্য ও রাসুলের [ সা ] জন্য। অপরপক্ষে মক্কাবাসীদের মধ্যে যারা রাসুলের [ সা ] সাথে হিজরত করেন ঈমানের প্রতি আন্তরিকতার তারা হলেন জ্বলন্ত উদাহরণ। বদরের যুদ্ধ ইসলামের শক্তি ও তেজঃস্বীতা দৃঢ়তার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন মুসলিম সেনা তিনজন কাফেরকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম। কাফেরদের শেষ পরিণামই হচ্ছে কাফেরদের কেয়ামত।
৪৮৪১। দেখুন আয়াত [ ৪০ : ৫৫ ] ও টিকা ৪৪২৮।
৪৮৪২। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ আমাদের বিচার করবেন আমাদের জাগতিক কর্মকান্ডের মানদন্ডে। আমাদের গতিবিধি, আমাদের প্রতিদিনের জীবন, রুজী রিজিকের অন্বেষণ, নিয়ত, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ইত্যাদির পটভূমিতেই আমাদের চরিত্রকে এবং চারিত্রিক গুণাবলী ও দোষত্রুটির মূল্যায়ন করা হবে। আল্লাহ্ আমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন ? সুতারাং আধ্যাত্মিক জগতের অতি সুক্ষ তারতম্যের জন্যও আমাদের উচিত সেই সর্বশক্তিমানের সাহায্য ও হেদায়েত প্রার্থনা করা।
১২। যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ্ তাদের বেহেশতে দাখিল করবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত হয়। অপরপক্ষে যারা আল্লাহকে প্রত্যাখান করে, তারা [ এই পৃথিবীর জীবন ] উপভোগ করবে; এবং গবাদি পশুর ন্যায় উদর পূর্তি করবে ; তাদেরই আবাস হবে আগুন ৪৮৩০।
৪৮৩০। উপযুক্ত উপমার সাহায্যে পাপীদের জীবনকে সুন্দররূপে চিত্রিত করা হয়েছে। জন্তু জানোয়ারের প্রাণ আছে, ক্ষুধা,তৃষ্ণা আছে,যৌন প্রয়োজন আছে। তারা আহার গ্রহণ করে পেটপূর্তি করে। আহারের সন্ধানেই তারা সারাটা জীবন ব্যয় করে এবং নিজেদের বংশধর পৃথিবীতে রেখে এই ধরাধাম ত্যাগ করে এবং সেখানেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদের জীবনের কোনও উচ্চতর ও মহত্তর উদ্দেশ্য নাই। মৃত্যু পরপারের কোনও জীবন নাই। যে সব লোক শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের জন্য জীবনপাত করে তাদের জীবন ঐ পশুদের অপেক্ষা কোনও অংশেই উন্নত নয়। তাদের জীবনের আনন্দ ফুর্তি সবই জাগতিক। ধন -সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করা ও পেটপূর্তি আহার,যৌনক্ষুধা নিবৃত্তি করা ব্যতীত তাদের বাঁচার অন্য কোনও উদ্দেশ্য তাদের উপলব্ধির অগোচরে। আধ্যাত্মিক জগতের আনন্দ, তৃপ্তি, সুখ, সম্বন্ধে তাদের ক্ষীণমাত্র ধারণাও নাই। যেহেতু আল্লাহ্ তাদের আত্মিক শক্তি দান করেই এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন ; যা এসব পাপীরা উপযুক্ত ব্যবহারের পরিবর্তে পাপের পঙ্কে নিক্ষেপ করেছে - সুতারাং তাদের পাপের পরিণতি হবে জাহান্নাম।
১৩। আর যে জনপদ তোমাকে বিতাড়িত করেছে ৪৮৩১, তার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কত জনপদ আমি ধ্বংস করেছি [ তাদের পাপের দরুণ ]। এবং তাদের সাহায্যের জন্য সেখানে কেহ ছিলো না।
৪৮৩১। এখানে যে জনপদের উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে পৌত্তলিক কোরাইশ অধ্যূষিত মক্কা নগরী। মোশরেক কোরাইশরা আল্লাহ্র রাসুলকে [ সা ] মক্কা নগরী থেকে বিতাড়িত করে তার একমাত্র কারণ রাসুলের [ সা ] পূত পবিত্র চারিত্রিক গুণাবলী ও আল্লাহ্র প্রতি কোরাইশদের আহ্বান। সে কারণে প্রতীয়মান হয় যে, এই সূরার সময়কাল হবে হিজরতের পরে।
১৪। যে ব্যক্তি তার প্রভুর প্রেরিত সুস্পষ্ট [ প্রমাণের ] ৪৮৩২, উপরে প্রতিষ্ঠিত, সে কি তার মত, যার নিকট তার চরিত্রের মন্দ কর্মগুলিকে সুশোভিত করা হয়েছে ? এবং যারা তাদের আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করে ?
৪৮৩২। "সুস্পষ্ট প্রমাণ " - এই শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে সেই পথ যা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত।
১৫। পূণ্যাত্মাদের যে বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার উপমা হচ্ছে [ এরূপ ] : সেখানে বিশুদ্ধ পানির নহর সমূহ ৪৮৩৩; দুধের নহর সমূহ, যার স্বাদ কখনও পরিবর্তন হয় না ; আছে সূরার নহর সমূহ, যা পানকারীদের জন্য দেবে আনন্দ ; এবং মধুর নহর সমূহ যা খাঁটি ও স্বচ্ছ। সেখানে তাদের জন্য থাকবে সকল প্রকার ফলমূল ৪৮৩৪। এবং তাদের প্রভুর নিকট থেকে অনুগ্রহ ৪৮৩৫। [ যারা এরূপ প্রশান্তিতে থাকে ] তাদের কি ওদের সাথে তুলনা করা চলে যারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে এবং পান করার জন্য দেয়া হবে ফুটন্ত পানি, যেনো তা তাদের নাড়ীভূড়ি ছিন্ন-বিছিন্ন করে দেয় ? ৪৮৩৬
৪৮৩৩। বেহেশতের এই বর্ণনায় চার রকম পানীয় ও সকল প্রকার ফলের বর্ণনা আছে। এবং সকল সুখ ও সর্বোচ্চ শান্তির প্রতীককে বর্ণনা করা হয়েছে। " প্রতিপালকের অনুগ্রহ " বাক্যটির দ্বারা। চার রকমের পানীয় হচ্ছে নিম্নরূপ :
১ ) "নির্মল পানির নহর " - যা সুস্বাদু, শীতল, পরিষ্কার। যা পার্থিব জগতের পানির ন্যায় অপরিষ্কার হয়ে পড়ে না।
২ ) দুধ যার স্বাদ অপরিবর্তনীয় যা কখনও টক্ হয়ে নষ্ট হয়ে যায় না। যার স্বাদ সর্বদা গরুর স্তন থেকে নির্গত টাট্কা দুধের স্বাদ।
৩) 'সুরা' যা পৃথিবীতে প্রাপ্য কোনও সুরার ন্যায় নয়। কারণ এই সুরা পার্থিব সুরার ন্যায় মাথার যন্ত্রণা সৃষ্টি করে না, মাতলামির জন্ম দেয় না, কিন্তু এ পানে সর্বদা মানসিক আনন্দ দান করবে।
৪) পরিশোধিত মধু - যা স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও খাঁটি যার সাথে কোনও ভেঁজাল মিশ্রিত নাই।
এই সব পানীয় পানে আত্মার মাঝে শান্তির অনুভূতি অনুভূত হবে, হৃদয়, মন পরিতৃপ্ত হবে, অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ স্নেহ ভালোবাসা স্বতঃস্ফুর্তভাবে হৃদয় মনকে আপ্লুত করে ফেলবে।
৪৮৩৪ দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৪৩ : ৭৩ ] ও টিকা ৪৬৭১। বেহেশতের বর্ণনায় প্রতিটি জিনিষই প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, কারণ বেহেশতের সুখ ও শান্তির প্রকৃত রূপ অনুধাবন করা এই পৃথিবীতে কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
৪৮৩৫। "প্রতিপালকের অনুগ্রহ " - পরলোকের সুখ ও শান্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটবে প্রতিপালকের অনুগ্রহ লাভের মাধ্যমে। যার ফলে পার্থিব জীবনের দুঃখ, ব্যাথা, অতৃপ্তির অনুভূতি দূর হয়ে আত্মা স্বর্গীয় আনন্দে ভরপুর হয়ে যাবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের মাধ্যমে মানব জীবনের চরম ও পরম প্রাপ্তি ঘটবে।
৪৮৩৬। দেখুন [ ৩৭ : ৬৬ - ৬৭ ] আয়াত ও টিকা ৪০৭৪। এই বর্ণনার মাধ্যমে এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে, বেহেশতের সুখ ও শান্তি যেরূপ আত্মার অন্তঃস্থলকে উজ্জ্বীবিত করে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলবে, ঠিক তদ্রূপ দোযখের শাস্তি ও উৎকণ্ঠা তাদের সর্ব সত্ত্বাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে। যার অনুধাবন করা এ পৃথিবীতে কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। একমাত্র প্রতীকের মাধ্যমেই তা কিছু কল্পনায় উপলব্ধি করা সম্ভব।
১৬। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে যারা তোমার কথা শোনে, কিন্তু পরিশেষে তারা যখন তোমার নিকট থেকে বের হয়ে যায় ৪৮৩৭ ; [ তখন উপহাস করে ] যারা জ্ঞান লাভ করেছে তাদের বলে, " এই মাত্র সে কি বললো ? " এরাই তারা যাদের হৃদয় আল্লাহ্ মোহর করে দিয়েছেন, এবং যারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে।
৪৮৩৭। দেখুন আয়াত [ ১০ : ৪২ ] ও টিকা ১৪৩৪ এবং আয়াত [ ৬ : ২৫, ৩৬ ] ও টিকা ৮৫৭। এই আয়াতে মদীনার মোনাফেকদের মানসিক অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে যা সর্বকালে সর্বযুগের মোনাফেকদের জন্য প্রযোজ্য। মদীনার এ সব মোনাফেকরা রাসুলের [ সা ] দরবারে আগমন করতো এবং এমন ভান করতো যে তারা গভীর মনোযোগের সাথে রাসুলের [ সা ] শিক্ষাকে গ্রহণ করছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তারা তাদের অন্তরে কোনও সত্যকেই গ্রহণ করে না, বরং তারা যা শোনে ও দেখে তার দোষত্রুটি বের করার জন্য উম্মুখ থাকে। যখন তারা রাসুলের [সা ] দরবার থেকে বের হয়, তার সত্যের প্রকৃত শিক্ষা সম্বন্ধে কিছুই জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয় না। অপরপক্ষে তাদের ব্যবহার হয়ে পড়ে নির্বোধের ন্যায় । তারা এমন সব অসংলগ্ন প্রশ্ন করে যা সাধারণ জনগণের মনে বিভ্রান্তি ও সন্দেহের জন্ম দেয়। মোনাফেকদের এই বৈশিষ্ট্য অদ্যাবধি বিদ্যমান।
১৭। কিন্তু যারা পথ নির্দ্দেশ গ্রহণ করে ৪৮৩৮, আল্লাহ্ তাদের জন্য পথের [ আলো ] বৃদ্ধি করেন এবং ধর্মানুরাগ দান করেন ও [ মন্দ থেকে ] বিরত রাখেন।
৪৮৩৮। আধ্যাত্মিক উন্নতি একদিনে ঘটে না। তা ঘটে ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে তা অগ্রসর হয়। প্রতিটি ধাপ পরবর্তী ধাপে আরোহণের পথকে সুগম ও দৃঢ় করে দেয় ও আত্মিক সম্পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করে। এভাবেই আল্লাহ্ সৎ পথের পথিকদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন। "তাদের জন্য পথের (আলো) বৃদ্ধি করেন।"
১৮। তবে কি তারা কেবলমাত্র কেয়ামতের অপেক্ষা করে ৪৮৩৯- যেনো তা হঠাৎ করেই তাদের উপরে আপতিত হয় ? কেয়ামতের সামান্য লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে। তবে যখন তাদের উপরে কেয়ামত [ সত্যিই ] উপস্থিত হবে, তখন তারা কিভাবে সাবধান বাণী দ্বারা উপকৃত হবে ? ৪৮৪০
৪৮৩৯। দেখুন [ ৪৩ : ৬৬ ] ও টিকা ৪৬৬৫।
৪৮৪০। "সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।" যখন কেউ কোনও পাপ করে তাঁর পরিণাম তার জন্য অবশ্যাম্ভবী, প্রতি মূহুর্তে প্রতি ক্ষণে সে শাস্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তার পাপ কাজই হচ্ছে তার শেষ পরিণাম, বা কেয়ামত। সুতারাং কারও শেষ পরিণাম বা কেয়ামত আসার পূর্বেই অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন করা উচিত এবং এখনই তা শুরু করা প্রয়োজন। যখন শাস্তি বা শেষ পরিণাম বা কেয়ামত সংঘটিত হবে তখন আর অনুতাপের সময় থাকবে না। জাগতিক সকল সতর্কবাণী তখন বৃথা হয়ে যাবে।
এই সূরাটির অবতীর্ণ কালের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এর অবতীর্ণ সময় হচ্ছে হিজরতের এক বছর পর। ইতিমধ্যেই কোরাইশদের বিপর্যয়ের সকল লক্ষণ সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হতে শুরু করেছে। হিজরত এক মাইলফলক ইসলামের ইতিহাসে। 'হিজরত' প্রমাণ করে মদিনাবাসীদের কতটা শুভেচ্ছা ও আন্তরিকতা বিদ্যমান ছিলো ইসলামের জন্য ও রাসুলের [ সা ] জন্য। অপরপক্ষে মক্কাবাসীদের মধ্যে যারা রাসুলের [ সা ] সাথে হিজরত করেন ঈমানের প্রতি আন্তরিকতার তারা হলেন জ্বলন্ত উদাহরণ। বদরের যুদ্ধ ইসলামের শক্তি ও তেজঃস্বীতা দৃঢ়তার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন মুসলিম সেনা তিনজন কাফেরকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম। কাফেরদের শেষ পরিণামই হচ্ছে কাফেরদের কেয়ামত।
১৯। সুতারাং জেনে রাখ, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই, এবং তোমার ও বিশ্বাসী পুরুষ ও মহিলাদের ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর ৪৮৪১। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন ৪৮৪২।
৪৮৪১। দেখুন আয়াত [ ৪০ : ৫৫ ] ও টিকা ৪৪২৮।
৪৮৪২। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ আমাদের বিচার করবেন আমাদের জাগতিক কর্মকান্ডের মানদন্ডে। আমাদের গতিবিধি, আমাদের প্রতিদিনের জীবন, রুজী রিজিকের অন্বেষণ, নিয়ত, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ইত্যাদির পটভূমিতেই আমাদের চরিত্রকে এবং চারিত্রিক গুণাবলী ও দোষত্রুটির মূল্যায়ন করা হবে। আল্লাহ্ আমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন ? সুতারাং আধ্যাত্মিক জগতের অতি সুক্ষ তারতম্যের জন্যও আমাদের উচিত সেই সর্বশক্তিমানের সাহায্য ও হেদায়েত প্রার্থনা করা।
রুকু - ৩
৪৮৪৩। যারা মোমেন বান্দা বা বিশ্বাসে আন্তরিক তারা আল্লাহ্র সেবা করার জন্য সর্বদা ব্যগ্র ও উদ্গ্রীব। আল্লাহ্র রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করতেও তারা সদা প্রস্তুত। কিন্তু মোনাফেকরা সেরূপ নয়। কারণ প্রতারণার ব্যাধি তাদের অন্তরে। সুতারাং তারা সর্বদা মৃত্যু ভয়ে ভীত থাকবে।
৪৮৪৪। সত্য ও ন্যায় কে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার হুকুম করা হয়েছে। ইসলামীক রাষ্ট্র্রের কর্ণধারেরা যখন এরূপ হুকুম দান করেন তখন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা প্রতিটি মোমেন বান্দার থাকা অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করার এটা হচ্ছে প্রধান শর্ত। সব কিছু বিচারের ও শেষ পরিণতির মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে : আল্লাহ্র প্রতি আমাদের আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, আগ্রহ ও উদ্দীপনা হবে নিঃশর্ত। কারণ কর্মের মাধ্যমেই আল্লাহ্ আমাদের আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, আগ্রহ ও উদ্দীপনার মূল্যায়ন করে নেবেন। যেমন বর্ণনা করা হয়েছে ৪ নং আয়াতে। এই সুবিশাল পৃথিবীর কর্ম ক্ষেত্রে আল্লাহ্ মানুষকেই তার অনুমোদিত প্রতিনিধিরূপে প্রেরণ করে থাকেন। সুতারাং আল্লাহ্র হুকুম তার প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই প্রেরিত হবে। এবং রাষ্ট্রের, ও ধর্মের প্রতিরক্ষার জন্য তা আন্তরিকভাবে মান্য করা প্রতিটি মোমেন বান্দার অবশ্য কর্তব্য।
৪৮৪৫। দেখুন [২ : ১০ ] আয়াত। ঈমানের উৎস হচ্ছে আত্মা বা অন্তর। আবার মোনাফেকীর উৎসও হচ্ছে আত্মা বা অন্তর। যখন আত্মা তার পবিত্রতা হারায় তখনই তা ব্যাধিগ্রস্থ অন্তরে পরিণত হয়। এই ব্যধির উপসর্গ হচ্ছে : মোনাফেকী, অবিশ্বস্ততা, কাপুরুষতা, মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি ত্যাগ স্বীকারে বিমুখতা আল্লাহ্র হুকুমের যথার্থতা অনুধাবনে অক্ষমতা ইত্যাদি।
৪৮৪৬। কোনও মঙ্গলজনক সিদ্ধান্তই আল্লাহ্র হুকুম ব্যতীত হয় না। সুতারাং আল্লাহ্র সিদ্ধান্তকে পূর্ণরূপ দানের সংগ্রামে কেউ যখন নিজস্ব চেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকারে ব্যর্থ হয়, তারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে আন্তরিক নয়। বিশ্বাসে যারা আন্তরিক তারা নিজ জীবনকে আত্মোৎসর্গ করতেও দ্বিধা বোধ করে না। মোনাফেকদের এই অবিশ্বস্ততা ও ভীরুতা ও পশ্চাদপদতা তাদের কোনও কল্যাণেই আসে না - না জাগতিক না পারলৌকিক জীবনের প্রেক্ষাপটে। জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা মোনাফেকরূপে চিহ্নিত হওয়ার ফলে সমাজে তাদের অবস্থান হারায় ও নিন্দনীয় ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হয়। পরলোকের অবস্থান আল্লাহ্র ন্যায় বিচার।
৪৮৪৭। কোরাইশরা সাধারণভাবে বলতো যে আত্মীয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উপযুক্ত কাজ নয়। তবে একথার কোনও যৌক্তিকতা নাই, কারণ পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সর্বদাই রক্তক্ষয়ী হতে বাধ্য। তা কখনই শান্তিপূর্ণ হতে পারে না। কারণ পাপ ও পাপী সর্বদা শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর। সুতারাং জেহাদের ব্যাপারে আত্মীয়তার দোহাই সঠিক নয়। কারণ মোমেন বান্দার সম্মুখে দুটি পথ খোলা থাকে। হয় পাপকে দমন করা অথবা পাপের বশবর্তী হওয়া। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, যদি পাপীরা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ লাভ করে,তবে যে আত্মীয়তার দোহাই তারা দিচ্ছে, তারা তা মান্য করবে না। সর্বাগ্রে তারাই আত্মীয়তার বন্ধনকে অসম্মান করবে এবং অস্বীকার করবে। সুতারাং এরূপ অবস্থা আল্লাহ্র রাসুল ও তাঁর অনুসারীদের কাম্য হতে পারে না। অবশ্যই শান্তি রক্ষার জন্য তারা সত্যকে অবদমিত করতে পারেন না। আল্লাহ্র এই হুকুম বিশ্বজনীন কালোত্তীর্ণ।
৪৮৪৮। "অভিশপ্ত " - অর্থাৎ আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত। কারণ তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র সত্যকে প্রত্যাখান করেছে। আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত আত্মার অবস্থানকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তারা হবে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন। এই বধিরতা ও দৃষ্টিশক্তিহীনতা শারীরিক নয়। তা হবে আত্মিক। ফলশ্রুতিতে তারা যা শোনে তার প্রকৃত মর্ম অনুধাবনে অক্ষম হয়। তারা যা দেখে তার সঠিক চিত্র উপলব্ধি করতে পারে না। এই " শোনা " ও " দেখা " হচ্ছে আধ্যাত্মিক ভাবে অনুধাবন ক্ষমতা। তারা দেখেও দেখে না শুনেও শোনে না। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে অনুধাবন করার কোনও ইচ্ছাই তাদের মাঝে জন্মাবে না। ফলে এসব লোক পার্থিব জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলেও প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতা লাভ করবে না। তারা প্রকৃত সত্যের রূপকে অনুধাবনে অক্ষম হবে ফলে তারা সত্য মিথ্যা, ন্যায় অন্যায় ও ভালো -মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম হবে। তারা হবে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণহীন অন্যায়কারী। কারণ ন্যায় ও সত্যের বাণীর প্রতি তারা তাদের হৃদয়ের দুয়ারকে তালাবদ্ধ করে ফেলেছে। এরাই হচ্ছে অভিশপ্ত আত্মা।
৪৮৪৯। আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত আত্মা সম্পূর্ণ শয়তানের করায়ত্ব হয়ে পড়ে। তারা সর্বদা শয়তানের কুমন্ত্রণায় বশীভূত হয় এবং শয়তানের দ্বারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতারিত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের মন্দ কাজ তাদের চোখে শোভনরূপে পরিগণিত হয়।
৪৮৫০। সত্যের আলো মোনাফেকের আত্মায় কখনও প্রবেশ লাভ করবে না। সত্যের বা আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর জন্য এসব আত্মা অভেদ্য। প্রকাশ্যে আল্লাহ্র পথে সংগ্রামে বিরুদ্ধাচারণের সাহস এদের থাকে না। এরাই হয় বিশ্বাসঘাতক। তারা গোপনে আল্লাহ্র শত্রুদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং দুপক্ষেই তাদের কার্যক্রম চালায়। মুনাফেকরা নিজেদের মুসলমান দাবী করতো এবং বাহ্যতঃ রাসুলুল্লাহ্র [সা ] প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতো কিন্তু অন্তরে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে শত্রুদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতো। তারা ছিলো বিশ্বাসঘাতক, শত্রুর চর এবং সন্দেহবাতিক, মোনাফেকের এইরূপ বৈশিষ্ট্য অদ্যাবধি পৃথিবীতে বর্তমান আছে। আল্লাহ্র শ্বাসত সর্তকবাণী এই আয়াতের মাধ্যমে উচ্চারণ করা হয়েছে। মোনাফেকরা যদি মনে করে যে, তারা অবিশ্বস্ততা ও দ্বিমুখী নীতির দ্বারা জীবনে সাফল্য লাভ করবে, তবে তারা ভীষণ ভুলের মাঝে বাস করছে। কারণ আল্লাহ্ তাদের গোপন অভিসন্ধি,উদ্দেশ্য, সবই অবগত আছেন। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৫৯ : ১১ ]।
৪৮৫১। "মুখমন্ডল ও পৃষ্ঠদেশ " বাক্যটি এখানে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মুখমন্ডল হচ্ছে শরীরের সেই অংশ যা সম্মুখে অবস্থান করে এবং দৃশ্যমান। এখানে 'মুখমন্ডল ' এর উপমা দ্বারা মোনাফেকদের সেই সকল কাজ বা আচরণকে বোঝানো হয়েছে যা প্রকাশ্য এবং সর্বলোক গোচর। "পৃষ্ঠদেশ" হচ্ছে দেহের সেই অংশ যা পিছনে থাকে এবং সম্মুখের অগ্রযাত্রায় দৃশ্যমান হয় না। অথবা বলা চলে সম্মুখবর্তী সকল কিছু থেকে লুক্কায়িত থাকে। এই আয়াতে দেহের অংশের উপমার উল্লেখ দ্বারা এই সত্যকে প্রকাশ করা হয়েছে যে, মৃত্যুকালীন সময়ে তাদের 'মুখমন্ডল ' অর্থাৎ প্রকাশ্য সকল কাজ ও 'পৃষ্ঠদেশ' অর্থাৎ গোপনীয় সকল কাজ সবই প্রকাশ করা হবে আঘাতের মাধ্যমে। অথবা অন্যভাবেও আয়াতের বক্তব্যকে প্রকাশ করা যায়। মুখমন্ডল অর্থাৎ সেই সব জিনিষ যা সম্বন্ধে মোনাফেকেরা গর্ব প্রকাশ করতো এবং পৃথিবীর সম্মুখে প্রকাশ করার জন্য উন্মুখ থাকতো। 'পৃষ্ঠদেশ' অর্থাৎ তাদের মন্দ কাজ বা চিন্তা যা তারা গোপন রাখতো, লোক সম্মুখে প্রকাশ করতে সাহস করতো না। অর্থাৎ মোনাফেকদের সর্বসত্তাতে মৃত্যুকালীন সময়ে আঘাত হানা হবে। প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কিছুই হবে আঘাতের বস্তু। দেখুন আয়াত [ ৮: ৫০ ]।
৪৮৫২। মোনাফেকেরা তাদের মোনফেকী দ্বারা জীবনে সাফল্য ও সমৃদ্ধি লাভ করে সত্য, তবে জীবনের শেষ শুধুমাত্র এই পৃথিবীতেই হয়ে যায় না। পৃথিবী ত্যাগের কালে জীবন মৃত্যুর সন্ধি ক্ষণে মোনাফেকদের অবস্থা এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। দেহত্যাগের সময়ে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, তাদের কোন কাজ বা চিন্তা সর্বশক্তিমানের নিকট গোপন থাকে নাই। ফেরেশতারা তাদের সর্ব গোপনীয়তাকে স্পর্শ করবে। পার্থিব জীবনের সর্ব গোপনীয়তা পরলোকে প্রকাশ্যরূপ লাভ করবে," তখন উহাদের দশা কেমন হবে। "
২০। যারা বিশ্বাসী, তারা বলে, ৪৮৪৩, " [ আমাদের জন্য ] একটি সূরা অবতীর্ণ হয় না কেন ? " অতঃপর যখন মৌলিক ও দ্ব্যর্থহীন ৪৮৪৪ কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, এবং উহাতে যুদ্ধের কোন নির্দ্দেশ থাকে, যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে ৪৮৪৫, তুমি দেখবে তারা মৃত্যুভয়ে বিহ্বল মানুষের মত তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের জন্য সমীচিন হতো, -
৪৮৪৩। যারা মোমেন বান্দা বা বিশ্বাসে আন্তরিক তারা আল্লাহ্র সেবা করার জন্য সর্বদা ব্যগ্র ও উদ্গ্রীব। আল্লাহ্র রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করতেও তারা সদা প্রস্তুত। কিন্তু মোনাফেকরা সেরূপ নয়। কারণ প্রতারণার ব্যাধি তাদের অন্তরে। সুতারাং তারা সর্বদা মৃত্যু ভয়ে ভীত থাকবে।
৪৮৪৪। সত্য ও ন্যায় কে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার হুকুম করা হয়েছে। ইসলামীক রাষ্ট্র্রের কর্ণধারেরা যখন এরূপ হুকুম দান করেন তখন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা প্রতিটি মোমেন বান্দার থাকা অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করার এটা হচ্ছে প্রধান শর্ত। সব কিছু বিচারের ও শেষ পরিণতির মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে : আল্লাহ্র প্রতি আমাদের আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, আগ্রহ ও উদ্দীপনা হবে নিঃশর্ত। কারণ কর্মের মাধ্যমেই আল্লাহ্ আমাদের আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, আগ্রহ ও উদ্দীপনার মূল্যায়ন করে নেবেন। যেমন বর্ণনা করা হয়েছে ৪ নং আয়াতে। এই সুবিশাল পৃথিবীর কর্ম ক্ষেত্রে আল্লাহ্ মানুষকেই তার অনুমোদিত প্রতিনিধিরূপে প্রেরণ করে থাকেন। সুতারাং আল্লাহ্র হুকুম তার প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই প্রেরিত হবে। এবং রাষ্ট্রের, ও ধর্মের প্রতিরক্ষার জন্য তা আন্তরিকভাবে মান্য করা প্রতিটি মোমেন বান্দার অবশ্য কর্তব্য।
৪৮৪৫। দেখুন [২ : ১০ ] আয়াত। ঈমানের উৎস হচ্ছে আত্মা বা অন্তর। আবার মোনাফেকীর উৎসও হচ্ছে আত্মা বা অন্তর। যখন আত্মা তার পবিত্রতা হারায় তখনই তা ব্যাধিগ্রস্থ অন্তরে পরিণত হয়। এই ব্যধির উপসর্গ হচ্ছে : মোনাফেকী, অবিশ্বস্ততা, কাপুরুষতা, মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি ত্যাগ স্বীকারে বিমুখতা আল্লাহ্র হুকুমের যথার্থতা অনুধাবনে অক্ষমতা ইত্যাদি।
২১। উহাকে মান্য করা এবং যা ন্যায়সংগত তা বলা। বিষয়টির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পরে যদি তারা আল্লাহ্র প্রতি [ অঙ্গীকার পূরণে ] সত্য হতো, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য হতো সর্বোত্তম ৪৮৪৬।
৪৮৪৬। কোনও মঙ্গলজনক সিদ্ধান্তই আল্লাহ্র হুকুম ব্যতীত হয় না। সুতারাং আল্লাহ্র সিদ্ধান্তকে পূর্ণরূপ দানের সংগ্রামে কেউ যখন নিজস্ব চেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকারে ব্যর্থ হয়, তারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে আন্তরিক নয়। বিশ্বাসে যারা আন্তরিক তারা নিজ জীবনকে আত্মোৎসর্গ করতেও দ্বিধা বোধ করে না। মোনাফেকদের এই অবিশ্বস্ততা ও ভীরুতা ও পশ্চাদপদতা তাদের কোনও কল্যাণেই আসে না - না জাগতিক না পারলৌকিক জীবনের প্রেক্ষাপটে। জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা মোনাফেকরূপে চিহ্নিত হওয়ার ফলে সমাজে তাদের অবস্থান হারায় ও নিন্দনীয় ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হয়। পরলোকের অবস্থান আল্লাহ্র ন্যায় বিচার।
২২। তবে কি তোমাদের থেকে এই আশা করবো যে ৪৮৪৭, যদি তোমাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করি, তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে ৪৮৪৭।
৪৮৪৭। কোরাইশরা সাধারণভাবে বলতো যে আত্মীয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উপযুক্ত কাজ নয়। তবে একথার কোনও যৌক্তিকতা নাই, কারণ পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সর্বদাই রক্তক্ষয়ী হতে বাধ্য। তা কখনই শান্তিপূর্ণ হতে পারে না। কারণ পাপ ও পাপী সর্বদা শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর। সুতারাং জেহাদের ব্যাপারে আত্মীয়তার দোহাই সঠিক নয়। কারণ মোমেন বান্দার সম্মুখে দুটি পথ খোলা থাকে। হয় পাপকে দমন করা অথবা পাপের বশবর্তী হওয়া। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, যদি পাপীরা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ লাভ করে,তবে যে আত্মীয়তার দোহাই তারা দিচ্ছে, তারা তা মান্য করবে না। সর্বাগ্রে তারাই আত্মীয়তার বন্ধনকে অসম্মান করবে এবং অস্বীকার করবে। সুতারাং এরূপ অবস্থা আল্লাহ্র রাসুল ও তাঁর অনুসারীদের কাম্য হতে পারে না। অবশ্যই শান্তি রক্ষার জন্য তারা সত্যকে অবদমিত করতে পারেন না। আল্লাহ্র এই হুকুম বিশ্বজনীন কালোত্তীর্ণ।
২৩। এরাই তারা যাদের আল্লাহ্ অভিশপ্ত করেছেন ৪৮৪৮। নিশ্চয়ই তিনি তাদের করেছেন বধির এবং চক্ষুকে করেছেন অন্ধ।
৪৮৪৮। "অভিশপ্ত " - অর্থাৎ আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত। কারণ তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র সত্যকে প্রত্যাখান করেছে। আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত আত্মার অবস্থানকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তারা হবে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন। এই বধিরতা ও দৃষ্টিশক্তিহীনতা শারীরিক নয়। তা হবে আত্মিক। ফলশ্রুতিতে তারা যা শোনে তার প্রকৃত মর্ম অনুধাবনে অক্ষম হয়। তারা যা দেখে তার সঠিক চিত্র উপলব্ধি করতে পারে না। এই " শোনা " ও " দেখা " হচ্ছে আধ্যাত্মিক ভাবে অনুধাবন ক্ষমতা। তারা দেখেও দেখে না শুনেও শোনে না। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে অনুধাবন করার কোনও ইচ্ছাই তাদের মাঝে জন্মাবে না। ফলে এসব লোক পার্থিব জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলেও প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতা লাভ করবে না। তারা প্রকৃত সত্যের রূপকে অনুধাবনে অক্ষম হবে ফলে তারা সত্য মিথ্যা, ন্যায় অন্যায় ও ভালো -মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম হবে। তারা হবে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণহীন অন্যায়কারী। কারণ ন্যায় ও সত্যের বাণীর প্রতি তারা তাদের হৃদয়ের দুয়ারকে তালাবদ্ধ করে ফেলেছে। এরাই হচ্ছে অভিশপ্ত আত্মা।
২৪। তবে কি তারা একান্তভাবে কুর-আনকে বুঝতে চেষ্টা করে না, অথবা উহাদের অন্তর তালাবদ্ধ ?
২৫। যারা পথের নির্দ্দেশ স্পষ্ট প্রকাশিত হওয়ার পর স্বধর্ম ত্যাগ করে, - শয়তান তাদের উৎসাহিত করে এবং তাদের মিথ্যা আশায় উদ্বেলিত করে। ৪৮৪৯
২৬। এর কারণ, আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন, তাতে যারা ঘৃণা প্রকাশ করতো, তাদের উহারা বলে যে, " [এই ব্যাপারে] কোন কোন বিষয়ে আমরা অবশ্য তোমাদের কথা মানবো।" কিন্তু আল্লাহ্ তাদের গোপন অভিসন্ধি অবগত আছেন। ৪৮৫০
২৫। যারা পথের নির্দ্দেশ স্পষ্ট প্রকাশিত হওয়ার পর স্বধর্ম ত্যাগ করে, - শয়তান তাদের উৎসাহিত করে এবং তাদের মিথ্যা আশায় উদ্বেলিত করে। ৪৮৪৯
২৬। এর কারণ, আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন, তাতে যারা ঘৃণা প্রকাশ করতো, তাদের উহারা বলে যে, " [এই ব্যাপারে] কোন কোন বিষয়ে আমরা অবশ্য তোমাদের কথা মানবো।" কিন্তু আল্লাহ্ তাদের গোপন অভিসন্ধি অবগত আছেন। ৪৮৫০
৪৮৪৯। আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত আত্মা সম্পূর্ণ শয়তানের করায়ত্ব হয়ে পড়ে। তারা সর্বদা শয়তানের কুমন্ত্রণায় বশীভূত হয় এবং শয়তানের দ্বারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতারিত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের মন্দ কাজ তাদের চোখে শোভনরূপে পরিগণিত হয়।
৪৮৫০। সত্যের আলো মোনাফেকের আত্মায় কখনও প্রবেশ লাভ করবে না। সত্যের বা আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর জন্য এসব আত্মা অভেদ্য। প্রকাশ্যে আল্লাহ্র পথে সংগ্রামে বিরুদ্ধাচারণের সাহস এদের থাকে না। এরাই হয় বিশ্বাসঘাতক। তারা গোপনে আল্লাহ্র শত্রুদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং দুপক্ষেই তাদের কার্যক্রম চালায়। মুনাফেকরা নিজেদের মুসলমান দাবী করতো এবং বাহ্যতঃ রাসুলুল্লাহ্র [সা ] প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতো কিন্তু অন্তরে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে শত্রুদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতো। তারা ছিলো বিশ্বাসঘাতক, শত্রুর চর এবং সন্দেহবাতিক, মোনাফেকের এইরূপ বৈশিষ্ট্য অদ্যাবধি পৃথিবীতে বর্তমান আছে। আল্লাহ্র শ্বাসত সর্তকবাণী এই আয়াতের মাধ্যমে উচ্চারণ করা হয়েছে। মোনাফেকরা যদি মনে করে যে, তারা অবিশ্বস্ততা ও দ্বিমুখী নীতির দ্বারা জীবনে সাফল্য লাভ করবে, তবে তারা ভীষণ ভুলের মাঝে বাস করছে। কারণ আল্লাহ্ তাদের গোপন অভিসন্ধি,উদ্দেশ্য, সবই অবগত আছেন। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৫৯ : ১১ ]।
২৭। ফেরেশতারা যখন তাদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে মৃত্যুর মাধ্যমে আত্মা হরণ করবে, তখন উহাদের দশা কেমন হবে ? ৪৮৫১, ৪৮৫২
৪৮৫১। "মুখমন্ডল ও পৃষ্ঠদেশ " বাক্যটি এখানে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মুখমন্ডল হচ্ছে শরীরের সেই অংশ যা সম্মুখে অবস্থান করে এবং দৃশ্যমান। এখানে 'মুখমন্ডল ' এর উপমা দ্বারা মোনাফেকদের সেই সকল কাজ বা আচরণকে বোঝানো হয়েছে যা প্রকাশ্য এবং সর্বলোক গোচর। "পৃষ্ঠদেশ" হচ্ছে দেহের সেই অংশ যা পিছনে থাকে এবং সম্মুখের অগ্রযাত্রায় দৃশ্যমান হয় না। অথবা বলা চলে সম্মুখবর্তী সকল কিছু থেকে লুক্কায়িত থাকে। এই আয়াতে দেহের অংশের উপমার উল্লেখ দ্বারা এই সত্যকে প্রকাশ করা হয়েছে যে, মৃত্যুকালীন সময়ে তাদের 'মুখমন্ডল ' অর্থাৎ প্রকাশ্য সকল কাজ ও 'পৃষ্ঠদেশ' অর্থাৎ গোপনীয় সকল কাজ সবই প্রকাশ করা হবে আঘাতের মাধ্যমে। অথবা অন্যভাবেও আয়াতের বক্তব্যকে প্রকাশ করা যায়। মুখমন্ডল অর্থাৎ সেই সব জিনিষ যা সম্বন্ধে মোনাফেকেরা গর্ব প্রকাশ করতো এবং পৃথিবীর সম্মুখে প্রকাশ করার জন্য উন্মুখ থাকতো। 'পৃষ্ঠদেশ' অর্থাৎ তাদের মন্দ কাজ বা চিন্তা যা তারা গোপন রাখতো, লোক সম্মুখে প্রকাশ করতে সাহস করতো না। অর্থাৎ মোনাফেকদের সর্বসত্তাতে মৃত্যুকালীন সময়ে আঘাত হানা হবে। প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কিছুই হবে আঘাতের বস্তু। দেখুন আয়াত [ ৮: ৫০ ]।
৪৮৫২। মোনাফেকেরা তাদের মোনফেকী দ্বারা জীবনে সাফল্য ও সমৃদ্ধি লাভ করে সত্য, তবে জীবনের শেষ শুধুমাত্র এই পৃথিবীতেই হয়ে যায় না। পৃথিবী ত্যাগের কালে জীবন মৃত্যুর সন্ধি ক্ষণে মোনাফেকদের অবস্থা এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। দেহত্যাগের সময়ে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, তাদের কোন কাজ বা চিন্তা সর্বশক্তিমানের নিকট গোপন থাকে নাই। ফেরেশতারা তাদের সর্ব গোপনীয়তাকে স্পর্শ করবে। পার্থিব জীবনের সর্ব গোপনীয়তা পরলোকে প্রকাশ্যরূপ লাভ করবে," তখন উহাদের দশা কেমন হবে। "
২৮। ইহা এই হেতু যে, তারা সেই বস্তুর অনুসরণ করে যা আল্লাহ্র ক্রোধকে ডেকে আনে, এবং তারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টিকে ঘৃণা করে। সুতারাং তিনি তাদের কর্মকে নিষ্ফল করে দেন।
রুকু - ৪
৪৮৫৩। দেখুন এই সূরার পূর্বের আয়াত ২০ এবং টিকা ৪৮৪৫। যে আত্মা হেদায়েতের আলো লাভ করে নাই, যে হৃদয় অন্ধকারে নিমজ্জিত। যার অন্তরে আল্লাহ্র নূর প্রবেশ লাভে অভেদ্দ্য সেই আত্মা ব্যাধিগ্রস্থ। এ ব্যাধি শারীরিক নয় অন্তরের। ফলে এরা আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে সামান্য পরিমাণ ধারণা করতেও অক্ষম হয়। ন্যায় -অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা সবই এদের মাঝে একাকার হয়ে মিশে যায় - এদের মাঝে তারা পার্থক্য করতে অপারগ।
৪৮৫৪। এ কথা সত্য যে, পাপী এবং মন্দ ব্যক্তিরা সর্বদা সমাজে চিহ্নিত হয়ে থাকে না। সমাজ জীবনে বহু পাপিষ্ঠ ভালো মানুষরূপে সমাজের বুকে বিচরণ করে - কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের সনাক্ত করতে অক্ষম। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলেই তাদের সমাজের বুকে সনাক্তকরণ চিহ্নে চিহ্নিত করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের সুযোগ দান করেন এই পৃথিবীতে। কিন্তু যে উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখে সে পাপিষ্ঠ ও মোনাফেকদের কথার ভংগি ও আচরণ থেকে তাদের সনাক্ত করতে সক্ষম হবে। কারণ পাপীদের অন্তরে গরল। সে গরল তাদের বাক্যে ও আচরণে পরিস্ফুট হয়ে পড়ে।
৪৮৫৫। দেখুন [ ৩৪ : ২১ ] এবং টিকা ৩৮২১। মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণের মাধ্যমে স্রষ্টা মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির " প্রয়োগের পরীক্ষা করতে চান। কে স্রষ্টার দেয়া এই 'দানকে' স্রষ্টার মনঃতুষ্টির জন্য ব্যয় করে আর কে এই দানকে নিজস্ব রীপুর পরিতৃপ্তির জন্য ব্যয় করে - এই হচ্ছে স্রষ্টার পরীক্ষার বিষয়। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন আত্মিক উন্নতির দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। এ পরীক্ষা হবে মানসিক ইচ্ছার পরীক্ষা। ধৈর্য্যের পরীক্ষা, কে ধৈর্য ও অধ্যাবসায় সহকারে আল্লাহ্র রাস্তায় অটল থাকতে চায়।
৪৮৫৬। 'Akhbar'- অর্থাৎ যা তোমার নিকট প্রকাশ করা হয়েছে। " পরীক্ষা করে নেব" - অর্থাৎ আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামে যে সব গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে তারই পরীক্ষা। এই গুণাবলীকে এই আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। " প্রাণপনে সংগ্রাম করে, " এবং "ধৈর্য্যের সাথে অধ্যাবসায়ী হয়" অর্থাৎ যারা তাদের কৃতকর্মের সাফল্যের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে প্রস্তুত এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে এবং সাফল্য ও ব্যর্থতা যারা সমভাবে গ্রহণ করে ও আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার মাধ্যমে ধৈর্য ধারণ করে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ মহৎ কাজের সাফল্যের চাবিকাঠি বর্ণনা করেছেন। যে কোনও মহৎ কাজের সাফল্য নির্ভর করবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য জেহাদের মনোভাব ও ধৈর্য। প্রকৃত কার্যক্ষেত্র ব্যতীত ধৈর্য, অধ্যাবসায়, জেহাদী মনোভাব বা সাহস এবং আত্মোৎসর্গের প্রকৃত মনোভাব মহত্ব,সত্যের প্রতি আত্ম নিবেদন প্রভৃতি চারিত্রিক গুণাবলী ধরা পরে না। প্রকৃত কর্মক্ষেত্রেই বোঝা যায় কে প্রকৃত ত্যাগী, সাহসী, ধৈর্যশীল,সত্যের পূঁজারী। সুতারাং পার্থিব বিপদ বিপর্যয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এ সব গুণাবলীর পরীক্ষা নিতে চান - কে "ইচ্ছাশক্তি" প্রয়োগের মাধ্যমে উপরোক্ত গুণাবলী প্রকৃতপক্ষে অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হয়।
৪৮৫৭। দেখুন এই সূরার পূর্বের আয়াত নং ২৫ এবং নীচের আয়াত নং ৩৪। ২৫ নং আয়াতে সকল পাপ ও মন্দের উৎস যে শয়তান তারই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে শয়তানের প্ররোচণা তাদের সকল পাপ কাজকে তাদের চোখে শোভন করে দেখায়। এখানে পাপীদের মনঃস্তত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে তাদের পরিণতির কথা যারা পাপের নিকট আত্মসমর্পন করে থাকে। তাদের কোনও কর্মই সফল পরিণতি লাভ করবে না। ৩৪ নং আয়াতে এদের কথা বলা হয়েছে যে, তাদের শেষ পরিণতি অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ পরলোকের অনন্ত জীবনে তারা আল্লাহ্র করুণা, দয়া ও ক্ষমা লাভে অক্ষম হবে। অর্থাৎ এই আয়াত তিনটির মাধ্যমে অবিশ্বাসী তারাই যারা আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে পাপের অতলে তলিয়ে যায় তাদের মনঃস্তত্ব, পার্থিব কর্মফল ও শেষ পরিণতির বর্ণনা করা হয়েছে।
৪৮৫৮। দেখুন উপরের টিকা।
৪৮৫৯। যাদের উপরে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের ভার অর্পিত তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে এই আয়াতে নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। দুষ্টের সাথে সন্ধি বা শান্তি বা শুধুমাত্র সংঘর্ষই শেষ কথা নয়। শেষ কথা হচ্ছে হয় সত্য ও ন্যায় বিজয় লাভ করবে অথবা অন্যায় ও অসত্যের জয় হবে। এ দুয়ের মাঝে কোন সন্ধি হতে পারে না। আল্লাহ্ তাঁর সৈনিকদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, তারা যেনো সত্যের সংগ্রামে হীনবল না হয়ে পড়ে ; কারণ শেষ পর্যন্ত যা ন্যায়, সত্য ও কল্যাণকর তার বিজয় অবধারিত। কারণ আল্লাহ্ তাদের আশ্বাস দিচ্ছেন যে আল্লাহ্র সৈনিকরা যারা আল্লাহ্র বিশ্বজনীন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সংগ্রাম করে থাকে তাদের জন্য আল্লাহ্র সাহায্য দ্বার প্রান্তে।
৪৮৬০। দেখুন [ ৬ : ৩২ ] ও টিকা ৮৫৫ ; এবং [ ২৯ : ৬৪ ] ও টিকা ৩৪৯৭। পৃথিবীর কর্মব্যস্ত জীবনে খেলাধূলার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সংসার সংগ্রামের উপযুক্ত ব্যক্তিরূপে গড়ে তোলে। সে ভাবে জীবনের ক্ষেত্রে খেলাধূলার উপযুক্ত মূল্যমান বর্তমান। কিন্তু কর্মক্ষেত্র পরিত্যাগ পূর্বক কেউ যদি শুধুমাত্র খেলাধূলাতে জীবনের সমস্ত সময় ব্যয় করে তবে তা ব্যক্তির জীবনকে বিপর্যস্ত ও দুঃখময় করতে বাধ্য। ঠিক সেরূপ হচ্ছে আমাদের পার্থিব জীবন ও পারলৌকিক জীবন। পার্থিব জীবনের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই খেলাধূলার ন্যায়। এ সব আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বা ও আত্মিক উন্নতির মাধ্যম মাত্র। পার্থিব জীবনের মাধ্যমেই আমরা পারলৌকিক জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু আমরা যদি পারলৌকিক জীবনকে গুরুত্বের মধ্যে না এনে সকল মনোযোগ শুধুমাত্র ইহলৌকিক আয়-উন্নতি ও সুখের পিছনে ব্যয় করি তবে জীবনের শেষ যোগফলে আমরা সফলতা লাভ করবো না। একথা স্মরণ রাখতে হবে যে ইহকাল হচ্ছে পরলোকের সুখ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্র বিশেষ।
৪৮৬১। তারাই আল্লাহ্র পুরষ্কার লাভের যোগ্যতা অর্জন করে যারা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে। ঈমান আনার অর্থ শুধুমাত্র মুখে কলেমার উচ্চারণ নয়। এর অর্থ অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আল্লাহ্র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা এবং বিশ্বাসকে কার্যে পরিণত করা। কার্যে পরিণত করার অর্থ হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন করা অর্থাৎ আল্লাহ্ যে সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ্ যে সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তাই-ই হচ্ছে পাপ। পাপ থেকে বিরত থাকার নামই হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন করা। আল্লাহ্ মানুষের নিকট তার ধনসম্পদের প্রার্থী নন, তিনি মানুষের নিকট আত্মোৎসর্গ কামনা করেন। এই-ই হচ্ছে ঈমান ও তাকওয়া অর্জনের পথ। স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পন অতি মহৎ কাজ। কারণ এর অর্থ হচ্ছে ব্যক্তির আত্ম নিবেদন সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এরূপ আত্মিক নিবেদন আইন করে, নিয়ম করে করা সম্ভব নয়। আবার কোনও মহৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত আত্মোৎসর্গ বা জীবন দান করাও কোনও পূণ্যের কাজ নয়। যখন কেউ মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য করে পরিশ্রম ও চেষ্টা করে এবং প্রয়োজনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতেও দ্বিধা বোধ করে না, তখনই তা পূণ্যের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার মেধা, মননশক্তি,অর্থ, সম্পদ সব কিছু মহৎ উদ্দেশ্যে বা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকে। যদি আইন করে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করতে বাধ্য করা হয় তবে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে ধন সম্পদচ্যুত অবস্থায় গরীব হয়ে যাওয়ার ভয়ে মানুষ মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে। সেখানে আল্লাহ্র প্রতি যে আত্ম নিবেদনের স্পৃহা, মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যে নিবিষ্ট আত্মোৎসর্গ তা অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। ফলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি শুধুমাত্র শুষ্ক আনুষ্ঠানিকতাতে পরিণত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ব্যাপারটি তিক্ততা ও বিদ্রোহে পরিসমাপ্তি লাভ করে। যেরূপ দেখা যায় বহু দেশ ইসলামের নামে মানুষের উপরে অত্যাচার ও নির্যতন করে থাকে।
৪৮৬২। দেখুন আয়াত [ ৩ : ১৮০ ]।
৪৮৬৩। দেখুন এই সূরার ২৯ নং আয়াত। আইনের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য দাবী করলে সে আইন কখনও জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন আইন হতে পারে না। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ সাবধান করে দিচ্ছেন যে তাতে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে ব্যক্তি মনে বিদ্বেষের জন্ম দেবে। পৃথিবীর ইতিহাস যুগে যুগে এই আয়াতের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
৪৮৬৪। সাধারণ মানুষ ও প্রকৃত মোমেন বান্দার যে পার্থক্য তা এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই দুর্বলচিত্ত। ফলে সে বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্র রাস্তায় অর্থাৎ মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ানের জন্য মুক্তহস্তে ব্যয় করতে অপারগ। তাঁর এই ব্যয়কুণ্ঠ স্বভাব তার মানবিক দুর্বলতা। এটা কোনও গুণ নয়। কারণ কৃপণতা ব্যক্তির সুক্ষ মানবিক অনুভূতিকে নষ্ট করে দেয়। এ ক্ষতি কৃপণের ; আল্লাহ্ অভাবমুক্ত, স্বাধীন - কারও দানের উপরে তিনি নির্ভরশীল নন। তবে আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় মানুষের মাধ্যমেই। যে বা যারা তা বাস্তবায়িত করেন তারা হন চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত। এই অর্জিত গুণই হচ্ছে পার্থিব জগতে আল্লাহ্র বিশেষ দান। আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করা, মানুষের নিজস্ব কল্যাণের জন্য প্রয়োজন। আল্লাহ্র সেবার মাধ্যমেই আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব। আমরা তাঁর করুণাপ্রার্থী।
৪৮৬৫। এই পৃথিবীর জীবন মঞ্চে মানুষ অভিনয় করে চলে কোন অদৃশ্য সূতার করাঙ্গুলে। মানব সভ্যতার সুনির্দ্দিষ্ট অগ্রগতি সেই অদৃশ্য অঙ্গুলির সংকেত মাত্র। এ অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করার ক্ষমতা কারও নাই। মানুষ এই অগ্রযাত্রার নিমিত্ত মাত্র। যে এই অগ্রযাত্রায় আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত হয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় নিজস্ব মেধা, মননশক্তি, অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-ক্ষমতা ব্যয় করে সেই ধন্য। যদি কেউ না করে তবে তার দরুণ আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার নয়। অন্য আর এক দল আল্লাহ্র বিজয় পতাকা উর্দ্ধে উত্তোলিত করে ধরবে। পৃথিবীর অগ্রযাত্রা থেমে থাকবে না। থেমে যাবে সেই পথিক বা জাতি যে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয়কুণ্ঠ। সে যাবে পিছনে পড়ে,অন্য আর এক দল তার স্থান দখল করে নেবে - যারা ভীরু নয়, যারা আল্লাহ্র কাজে অবিশ্বস্ত নয়। কবি 'Wordsworth' এর ভাষায় 'High Heaven rejects the lore of nicely calculated less or more'.
২৯। অথবা যাদের অন্তরে [ অবিশ্বাসের ] ব্যাধি আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ্ তাদের মনের বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দেবেন না ? ৪৮৫৩
৪৮৫৩। দেখুন এই সূরার পূর্বের আয়াত ২০ এবং টিকা ৪৮৪৫। যে আত্মা হেদায়েতের আলো লাভ করে নাই, যে হৃদয় অন্ধকারে নিমজ্জিত। যার অন্তরে আল্লাহ্র নূর প্রবেশ লাভে অভেদ্দ্য সেই আত্মা ব্যাধিগ্রস্থ। এ ব্যাধি শারীরিক নয় অন্তরের। ফলে এরা আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে সামান্য পরিমাণ ধারণা করতেও অক্ষম হয়। ন্যায় -অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা সবই এদের মাঝে একাকার হয়ে মিশে যায় - এদের মাঝে তারা পার্থক্য করতে অপারগ।
৩০। যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তবে অবশ্যই তোমাকে তাদেরকে দেখিয়ে দিতাম। ফলে তুমি লক্ষণ দেখে তাদের চিনতে পারবে ৪৮৫৪। কিন্তু নিশ্চয়ই তুমি তাদের কথার সুরেই তাদের চিনে নিতে পারবে। এবং যা কিছু তোমরা কর না কেন আল্লাহ্ তা অবশ্য জানেন।
৪৮৫৪। এ কথা সত্য যে, পাপী এবং মন্দ ব্যক্তিরা সর্বদা সমাজে চিহ্নিত হয়ে থাকে না। সমাজ জীবনে বহু পাপিষ্ঠ ভালো মানুষরূপে সমাজের বুকে বিচরণ করে - কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের সনাক্ত করতে অক্ষম। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলেই তাদের সমাজের বুকে সনাক্তকরণ চিহ্নে চিহ্নিত করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের সুযোগ দান করেন এই পৃথিবীতে। কিন্তু যে উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখে সে পাপিষ্ঠ ও মোনাফেকদের কথার ভংগি ও আচরণ থেকে তাদের সনাক্ত করতে সক্ষম হবে। কারণ পাপীদের অন্তরে গরল। সে গরল তাদের বাক্যে ও আচরণে পরিস্ফুট হয়ে পড়ে।
৩১। আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করবো ৪৮৫৫, যতক্ষণ না আমি জেনে নেই তোমাদের মধ্যে কে প্রাণপণে সংগ্রাম করে এবং ধৈর্যের সাথে অধ্যাবসায়ী হয়। তোমাদের বর্ণিত [ তেজস্বিতা ] আমি পরীক্ষা করে নেব ৪৮৫৬।
৪৮৫৫। দেখুন [ ৩৪ : ২১ ] এবং টিকা ৩৮২১। মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণের মাধ্যমে স্রষ্টা মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির " প্রয়োগের পরীক্ষা করতে চান। কে স্রষ্টার দেয়া এই 'দানকে' স্রষ্টার মনঃতুষ্টির জন্য ব্যয় করে আর কে এই দানকে নিজস্ব রীপুর পরিতৃপ্তির জন্য ব্যয় করে - এই হচ্ছে স্রষ্টার পরীক্ষার বিষয়। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন আত্মিক উন্নতির দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। এ পরীক্ষা হবে মানসিক ইচ্ছার পরীক্ষা। ধৈর্য্যের পরীক্ষা, কে ধৈর্য ও অধ্যাবসায় সহকারে আল্লাহ্র রাস্তায় অটল থাকতে চায়।
৪৮৫৬। 'Akhbar'- অর্থাৎ যা তোমার নিকট প্রকাশ করা হয়েছে। " পরীক্ষা করে নেব" - অর্থাৎ আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামে যে সব গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে তারই পরীক্ষা। এই গুণাবলীকে এই আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। " প্রাণপনে সংগ্রাম করে, " এবং "ধৈর্য্যের সাথে অধ্যাবসায়ী হয়" অর্থাৎ যারা তাদের কৃতকর্মের সাফল্যের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে প্রস্তুত এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে এবং সাফল্য ও ব্যর্থতা যারা সমভাবে গ্রহণ করে ও আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার মাধ্যমে ধৈর্য ধারণ করে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ মহৎ কাজের সাফল্যের চাবিকাঠি বর্ণনা করেছেন। যে কোনও মহৎ কাজের সাফল্য নির্ভর করবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য জেহাদের মনোভাব ও ধৈর্য। প্রকৃত কার্যক্ষেত্র ব্যতীত ধৈর্য, অধ্যাবসায়, জেহাদী মনোভাব বা সাহস এবং আত্মোৎসর্গের প্রকৃত মনোভাব মহত্ব,সত্যের প্রতি আত্ম নিবেদন প্রভৃতি চারিত্রিক গুণাবলী ধরা পরে না। প্রকৃত কর্মক্ষেত্রেই বোঝা যায় কে প্রকৃত ত্যাগী, সাহসী, ধৈর্যশীল,সত্যের পূঁজারী। সুতারাং পার্থিব বিপদ বিপর্যয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের এ সব গুণাবলীর পরীক্ষা নিতে চান - কে "ইচ্ছাশক্তি" প্রয়োগের মাধ্যমে উপরোক্ত গুণাবলী প্রকৃতপক্ষে অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হয়।
৩২। যারা আল্লাহকে প্রত্যাখান করে, আল্লাহ্র রাস্তা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করে এবং তাদের নিকট পথনির্দ্দেশ সুস্পষ্ট হওয়ার পরেও রসুলের বিরুদ্ধাচারণ করে ৪৮৫৭, তারা আল্লাহ্র বিন্দুমাত্র ক্ষতিও করতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের সকল কাজ -নিষ্ফল করে দেবেন।
৪৮৫৭। দেখুন এই সূরার পূর্বের আয়াত নং ২৫ এবং নীচের আয়াত নং ৩৪। ২৫ নং আয়াতে সকল পাপ ও মন্দের উৎস যে শয়তান তারই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে শয়তানের প্ররোচণা তাদের সকল পাপ কাজকে তাদের চোখে শোভন করে দেখায়। এখানে পাপীদের মনঃস্তত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে তাদের পরিণতির কথা যারা পাপের নিকট আত্মসমর্পন করে থাকে। তাদের কোনও কর্মই সফল পরিণতি লাভ করবে না। ৩৪ নং আয়াতে এদের কথা বলা হয়েছে যে, তাদের শেষ পরিণতি অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ পরলোকের অনন্ত জীবনে তারা আল্লাহ্র করুণা, দয়া ও ক্ষমা লাভে অক্ষম হবে। অর্থাৎ এই আয়াত তিনটির মাধ্যমে অবিশ্বাসী তারাই যারা আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে পাপের অতলে তলিয়ে যায় তাদের মনঃস্তত্ব, পার্থিব কর্মফল ও শেষ পরিণতির বর্ণনা করা হয়েছে।
৩৩। হে বিশ্বাসীগণ ! আল্লাহ্র আনুগত্য কর এবং রাসুলের আনুগত্য কর, এবং তোমাদের কর্মকে নিষ্ফল করো না।
৩৪। যারা আল্লাহকে প্রত্যাখান করে ৪৮৫৮, এবং [ মানুষদের ] আল্লাহ্র রাস্তা থেকে নিবৃত্ত করে অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করবেন না।
৩৪। যারা আল্লাহকে প্রত্যাখান করে ৪৮৫৮, এবং [ মানুষদের ] আল্লাহ্র রাস্তা থেকে নিবৃত্ত করে অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করবেন না।
৪৮৫৮। দেখুন উপরের টিকা।
৩৫। ক্লান্ত হয়ো না এবং দুর্বল চিত্ত হয়ে সন্ধির জন্য আর্তনাদ করো না ; যখন তোমরাই হবে প্রবল ৪৮৫৯। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের সাথে আছেন, এবং তিনি তোমাদের [ ভালো ] কাজকে কখনও ক্ষতিগ্রস্থ করবেন না।
৪৮৫৯। যাদের উপরে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের ভার অর্পিত তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে এই আয়াতে নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। দুষ্টের সাথে সন্ধি বা শান্তি বা শুধুমাত্র সংঘর্ষই শেষ কথা নয়। শেষ কথা হচ্ছে হয় সত্য ও ন্যায় বিজয় লাভ করবে অথবা অন্যায় ও অসত্যের জয় হবে। এ দুয়ের মাঝে কোন সন্ধি হতে পারে না। আল্লাহ্ তাঁর সৈনিকদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, তারা যেনো সত্যের সংগ্রামে হীনবল না হয়ে পড়ে ; কারণ শেষ পর্যন্ত যা ন্যায়, সত্য ও কল্যাণকর তার বিজয় অবধারিত। কারণ আল্লাহ্ তাদের আশ্বাস দিচ্ছেন যে আল্লাহ্র সৈনিকরা যারা আল্লাহ্র বিশ্বজনীন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সংগ্রাম করে থাকে তাদের জন্য আল্লাহ্র সাহায্য দ্বার প্রান্তে।
৩৬। এই পার্থিব জীবন তো কেবল ক্রীড়া কৌতুক ৪৮৬০ এবং যদি তোমরা ঈমান আন, এবং পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা কর, আল্লাহ্ তোমাদের পুরষ্কার দিবেন এবং তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ চান না ৪৮৬১।
৪৮৬০। দেখুন [ ৬ : ৩২ ] ও টিকা ৮৫৫ ; এবং [ ২৯ : ৬৪ ] ও টিকা ৩৪৯৭। পৃথিবীর কর্মব্যস্ত জীবনে খেলাধূলার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সংসার সংগ্রামের উপযুক্ত ব্যক্তিরূপে গড়ে তোলে। সে ভাবে জীবনের ক্ষেত্রে খেলাধূলার উপযুক্ত মূল্যমান বর্তমান। কিন্তু কর্মক্ষেত্র পরিত্যাগ পূর্বক কেউ যদি শুধুমাত্র খেলাধূলাতে জীবনের সমস্ত সময় ব্যয় করে তবে তা ব্যক্তির জীবনকে বিপর্যস্ত ও দুঃখময় করতে বাধ্য। ঠিক সেরূপ হচ্ছে আমাদের পার্থিব জীবন ও পারলৌকিক জীবন। পার্থিব জীবনের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই খেলাধূলার ন্যায়। এ সব আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বা ও আত্মিক উন্নতির মাধ্যম মাত্র। পার্থিব জীবনের মাধ্যমেই আমরা পারলৌকিক জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু আমরা যদি পারলৌকিক জীবনকে গুরুত্বের মধ্যে না এনে সকল মনোযোগ শুধুমাত্র ইহলৌকিক আয়-উন্নতি ও সুখের পিছনে ব্যয় করি তবে জীবনের শেষ যোগফলে আমরা সফলতা লাভ করবো না। একথা স্মরণ রাখতে হবে যে ইহকাল হচ্ছে পরলোকের সুখ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্র বিশেষ।
৪৮৬১। তারাই আল্লাহ্র পুরষ্কার লাভের যোগ্যতা অর্জন করে যারা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে। ঈমান আনার অর্থ শুধুমাত্র মুখে কলেমার উচ্চারণ নয়। এর অর্থ অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আল্লাহ্র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা এবং বিশ্বাসকে কার্যে পরিণত করা। কার্যে পরিণত করার অর্থ হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন করা অর্থাৎ আল্লাহ্ যে সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ্ যে সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তাই-ই হচ্ছে পাপ। পাপ থেকে বিরত থাকার নামই হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন করা। আল্লাহ্ মানুষের নিকট তার ধনসম্পদের প্রার্থী নন, তিনি মানুষের নিকট আত্মোৎসর্গ কামনা করেন। এই-ই হচ্ছে ঈমান ও তাকওয়া অর্জনের পথ। স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্র ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পন অতি মহৎ কাজ। কারণ এর অর্থ হচ্ছে ব্যক্তির আত্ম নিবেদন সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এরূপ আত্মিক নিবেদন আইন করে, নিয়ম করে করা সম্ভব নয়। আবার কোনও মহৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত আত্মোৎসর্গ বা জীবন দান করাও কোনও পূণ্যের কাজ নয়। যখন কেউ মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য করে পরিশ্রম ও চেষ্টা করে এবং প্রয়োজনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতেও দ্বিধা বোধ করে না, তখনই তা পূণ্যের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার মেধা, মননশক্তি,অর্থ, সম্পদ সব কিছু মহৎ উদ্দেশ্যে বা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকে। যদি আইন করে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করতে বাধ্য করা হয় তবে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে ধন সম্পদচ্যুত অবস্থায় গরীব হয়ে যাওয়ার ভয়ে মানুষ মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে। সেখানে আল্লাহ্র প্রতি যে আত্ম নিবেদনের স্পৃহা, মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যে নিবিষ্ট আত্মোৎসর্গ তা অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। ফলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি শুধুমাত্র শুষ্ক আনুষ্ঠানিকতাতে পরিণত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ব্যাপারটি তিক্ততা ও বিদ্রোহে পরিসমাপ্তি লাভ করে। যেরূপ দেখা যায় বহু দেশ ইসলামের নামে মানুষের উপরে অত্যাচার ও নির্যতন করে থাকে।
৩৭। তোমাদের নিকট থেকে তিনি তা চাইলে ও তার জন্য তোমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করলেও, তোমরা তো লোভীর মত তা আকঁড়ে ধরে রাখতে ৪৮৬২। এবং তখন তিনি তোমাদের বিদ্বেষ ভাবকে প্রকাশ করে দিতেন ৪৮৬৩।
৪৮৬২। দেখুন আয়াত [ ৩ : ১৮০ ]।
৪৮৬৩। দেখুন এই সূরার ২৯ নং আয়াত। আইনের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য দাবী করলে সে আইন কখনও জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন আইন হতে পারে না। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ সাবধান করে দিচ্ছেন যে তাতে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে ব্যক্তি মনে বিদ্বেষের জন্ম দেবে। পৃথিবীর ইতিহাস যুগে যুগে এই আয়াতের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
৩৮। দেখ, তোমরাই তো তারা যাদের আল্লাহ্র পথে ব্যয় করতে বলা হয়েছে ৪৮৬৪। কিন্তু তোমাদের মধ্যে অনেকেই [ এ ব্যাপারে ] কার্পণ্য করে। অথচ যারা কার্পণ্য করে তারা তা করে নিজের আত্মার ক্ষতির পরিবর্তে। আল্লাহ্ তো অভাবমুক্ত বরং তোমরাই তো অভাবগ্রস্থ। তোমরা যদি [ সৎ পথ ] থেকে ফিরে যাও ৪৮৬৫, তবে তিনি তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে প্রতিস্থাপন করবেন। তারা তোমাদের মত হবে না।
৪৮৬৪। সাধারণ মানুষ ও প্রকৃত মোমেন বান্দার যে পার্থক্য তা এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই দুর্বলচিত্ত। ফলে সে বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্র রাস্তায় অর্থাৎ মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ানের জন্য মুক্তহস্তে ব্যয় করতে অপারগ। তাঁর এই ব্যয়কুণ্ঠ স্বভাব তার মানবিক দুর্বলতা। এটা কোনও গুণ নয়। কারণ কৃপণতা ব্যক্তির সুক্ষ মানবিক অনুভূতিকে নষ্ট করে দেয়। এ ক্ষতি কৃপণের ; আল্লাহ্ অভাবমুক্ত, স্বাধীন - কারও দানের উপরে তিনি নির্ভরশীল নন। তবে আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় মানুষের মাধ্যমেই। যে বা যারা তা বাস্তবায়িত করেন তারা হন চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত। এই অর্জিত গুণই হচ্ছে পার্থিব জগতে আল্লাহ্র বিশেষ দান। আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করা, মানুষের নিজস্ব কল্যাণের জন্য প্রয়োজন। আল্লাহ্র সেবার মাধ্যমেই আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব। আমরা তাঁর করুণাপ্রার্থী।
৪৮৬৫। এই পৃথিবীর জীবন মঞ্চে মানুষ অভিনয় করে চলে কোন অদৃশ্য সূতার করাঙ্গুলে। মানব সভ্যতার সুনির্দ্দিষ্ট অগ্রগতি সেই অদৃশ্য অঙ্গুলির সংকেত মাত্র। এ অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করার ক্ষমতা কারও নাই। মানুষ এই অগ্রযাত্রার নিমিত্ত মাত্র। যে এই অগ্রযাত্রায় আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত হয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় নিজস্ব মেধা, মননশক্তি, অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-ক্ষমতা ব্যয় করে সেই ধন্য। যদি কেউ না করে তবে তার দরুণ আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার নয়। অন্য আর এক দল আল্লাহ্র বিজয় পতাকা উর্দ্ধে উত্তোলিত করে ধরবে। পৃথিবীর অগ্রযাত্রা থেমে থাকবে না। থেমে যাবে সেই পথিক বা জাতি যে আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয়কুণ্ঠ। সে যাবে পিছনে পড়ে,অন্য আর এক দল তার স্থান দখল করে নেবে - যারা ভীরু নয়, যারা আল্লাহ্র কাজে অবিশ্বস্ত নয়। কবি 'Wordsworth' এর ভাষায় 'High Heaven rejects the lore of nicely calculated less or more'.