সূরা ফাত্-হ
সূরা ফাত্-হ অথবা বিজয় - ৪৮
২৯ আয়াত, ৪ রুকু, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : ১) ৪৭ নং সূরার ভূমিকাতে মদিনাতে অবতীর্ণ সূরাগুলির যে শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে সেই শ্রেণীর এটি দ্বিতীয় সূরা। এই সূরাটির সময়কাল হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়কাল আর তা হচ্ছে ৬ই হিজরী জুল-কাদ মাস বা ৬২৮ খৃষ্টাব্দ ও ফেব্রুয়ারী মাস। [ দেখুন ৯ : ১৩ আয়াতের টিকা নং ১২৬১ ]।
২) রাসুলের (সা ) জীবদ্দশায় হুদায়বিয়ার সমতলভূমির অবস্থান ছিলো মক্কা থেকে মদীনা গামী রাস্তার সামান্য পশ্চিমে। মক্কা থেকে দূরত্ব ছিলো উত্তরে একদিনের রাস্তা। রাসুলের ( সা ) হিজরতের পরে ছয় বৎসর অতিবাহিত হয়ে পড়েছে। তার প্রিয় জন্মভূমি মোশরেক কোরাইশদের স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্বের অধীনে। কিন্তু এই ছয় বৎসরে মদীনায় ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে। ইতিমধ্যে মুসলমানদের কিব্লা নির্ধারিত হয়েছে পবিত্র কাবা অভিমুখে। সুতারাং মক্কা নগরী তথা কাবা মুসলমানদের অতি প্রাণপ্রিয় পবিত্র স্থানরূপে পরিগণিত হতো। সেই প্রাচীনকাল থেকে এই প্রথা চলে আসছিলো যে, আরবের প্রতিটি অধিবাসী নিরস্ত্র অবস্থায় পবিত্র কাবাঘর প্রদক্ষিণ করার অধিকার রাখে। এই পবিত্র স্থানে পবিত্র মাসে [ দেখুন ২ : ১৯৪ সূরার টিকা ২০৯ ] সকল প্রকার যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ। এই পবিত্র মাসগুলোর মধ্যে জুল-কাদ মাস অর্ন্তভূক্ত। সে কারণেই ৬ষ্ঠ হিজরীর জুল-কাদ মাসে রাসুলুল্লাহ্ (সা ) সংক্ষিপ্ত হজ্জ বা উমরা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। [ দেখুন ২ : ১৯৬ ] আয়াতের টিকা ২১২ ]। সে ভাবেই রাসুল (সা ) নিরস্ত্র অবস্থায় তাঁর অনুসারীদের সমভিব্যবহারে মদিনা থেকে মক্কার পথে যাত্রা করেন। চৌদ্দশ থেকে পনেরশ মুসলমানের বিশাল দল তাঁর সঙ্গী হন।
৩) মুসলামনদের এই তীর্থযাত্রা, মক্কার স্বেচ্ছাচারী মোশরেক কোরাইশদের মনঃপুত হলো না। তাদের পাপিষ্ঠ মন শঙ্কায় পরিপূর্ণ হলো। তারা নিরস্ত্র মুসলমান তীর্থযাত্রীদের বাধাদানে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলো। ফলে আল্লাহ্র রাসুল মক্কাতে প্রবেশ না করে মক্কা থেকে সামান্য পশ্চিমে যেয়ে হুদায়বিয়া নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন, যেখান থেকে তিনি কোরাইশদের সাথে সন্ধির আলোচনা করেন। রাসুল (সা ) যে কোনও মূল্যে পবিত্র স্থানে কোরাইশদের সংহিসতা প্রতিরোধ করতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। অপরপক্ষে বিগত ছয় বৎসরের অভিজ্ঞতা কোরাইশদের এই শিক্ষা দেয় যে, ইসলামকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়, বরং চর্তুদিক থেকে তাদের শক্তি সীমিত হয়ে আসছে এবং ইসলামের ব্যপক প্রসার লাভ ঘটছে। ইসলামের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ তারা বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিক ও প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছে। ফলে তারা রাসুলের (সা ) সাথে হুদায়বিয়ার নামক স্থানে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ইসলামকে এবং মুসলমানদের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার অধীনে সমগ্র মুসলিমরা হুদায়বিয়া নামক স্থানে বৃক্ষের নীচে [ ৪৮ : ১৮ ] চুক্তির স্বপক্ষে যে ভাবে একত্বতা প্রদর্শন করে থাকেন তা ভবিষ্যতের বিশাল শক্তিশালী জাতীয়বাদেরই ইঙ্গিত বহন করে।
৪) এ ভাবেই সন্ধির চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হয় যা হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে বিখ্যাত। চুক্তির শর্তসমূহ ছিলো নিম্নরূপ :
১) দুদলের মাঝে দশ বছরের জন্য শান্তির চুক্তি বলবৎ থাকবে।
২) যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি নিজ স্বাধীনতা অনুযায়ী যে দলে ইচ্ছা মিলিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
৩) মক্কার কোরাইশদের অধীনের কোনও কোরাইশ যদি কোরাইশদের অনুমতি ব্যতীত মদিনায় গমন করে ও মদিনায় রাসুলের (সা ) আনুগত্য স্বীকার করে, তবে তাঁকে মক্কাতে ফেরত দিতে মুসলমানেরা বাধ্য থাকবে। অপরপক্ষে, বিপরীত ক্ষেত্রে মুসলিমদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য থাকবে না।
৪) রাসুল (সা ) এবং তাঁর অনুসারীরা সে বছর মক্কাতে প্রবেশের অনুমতি লাভ করবেন না। পরবর্তী বছর থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় তাঁরা মক্কা নগরীতে প্রবেশের অধিকার লাভ করবেন।
৫। উপরিউক্ত চুক্তির তিন নম্বর ধারাটি সমতার ভিত্তিতে সম্পাদিত না হওয়াতে মুসলিম শিবিরে অসন্তোষের জন্ম দেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো না। কোনও মুসলিমকে মক্কাতে ফেরত পাঠানোর অর্থ এই নয় যে, তাঁকে স্বধর্ম ত্যাগ করতে হবে বা তিনি ইসলামের তথা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হবেন। প্রকৃতপক্ষে এমন প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধেও ইসলামকে যিনি নিজ জীবনে ধারণ করবেন, তিনি অবশ্যই তাঁর উদাহরণ দ্বারা অপরকেও ইসলাম গ্রহণে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবেন। মক্কাতে ইসলাম প্রচারের তিনিই হবেন মধ্যমণি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ঈমানের দৃঢ়তায় দৃঢ় এই সব মুসলিমদের মদিনাতে অবস্থান করা অপেক্ষা মক্কাতে অবস্থান করা ইসলাম প্রচারের জন্য সে সময়ে অধিক প্রয়োজন ছিলো। অপরপক্ষে যে মুসলিম স্বইচ্ছায় মদিনা ত্যাগ করে কোরাইশদের সাথে মিলিত হয়, সে মুসলিম সমাজের কলঙ্ক। তাকে ফেরৎ নেয়ার কোনও যৌক্তিকতা নাই।
৬। মুসলমানেরা বিশ্বস্ততার সাথে চুক্তির শর্তসমূহ মেনে চলে। পরবর্তী বছরে ৭ম হিজরীতে মুসলমানেরা তিনদিনের জন্য উমরা পালন করেন। পরবর্তীতে কোরাইশদের মিত্র শক্তি বানু বাকর্ গোষ্ঠি, মুসলমানদের মিত্র শক্তি বানু খুজাআ গোষ্ঠিকে আক্রমণ দ্বারা সন্ধির শান্তি চুক্তি লঙ্ঘন করে। ফলে মুসলমানেরা মক্কা আক্রমণ করে মক্কা বিজয় করেন। কোরাইশদের স্বৈরতন্ত্র চিরতরে মক্কা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ ভাবেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে হুদায়বিয়ার সন্ধি ছিলো মুসলমানদের জন্য বিজয়ের প্রতীক। এই প্রতীকি শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই সূরার মাধ্যমে, ঠিক যেমনভাবে [ ৮ : ৪২ - ৪৮ ] আয়াতে বদরের যুদ্ধের শিক্ষাকে এবং [ ৩ : ১২১ - ১২৯ ; ১৪৯ - ১৮০ ] আয়াত সমূহে ওহদের যুদ্ধের শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সার সংক্ষেপ : ঠান্ডা মাথায় উত্তেজনাহীন সাহস, আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, শৃঙ্খলা, বিশ্বাস এবং ধৈর্য্য এগুলিই হচ্ছে প্রকৃত বিজয় লাভের মাধ্যম যেমন হুদায়বিয়ার প্রান্তরে মুসলমানেরা প্রদর্শন করেন। সুতারাং বিজয়ের জন্য আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল হও এবং রাসুলের (সা ) আনুগত্য কর। [ ৪৮ : ১ - ২৯ ]।
সূরা ফাত্-হ অথবা বিজয় - ৪৮
২৯ আয়াত, ৪ রুকু, মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৪৮৬৬। অধিকাংশ তফসীরকারদের মতে হুদায়বিয়ারের সন্ধিকে আল্লাহ্ "সুস্পষ্ট বিজয়" রূপে ঘোষণা দান করেছেন। হুদায়বিয়ারের সন্ধির ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে এই সূরার ভূমিকাতে। এ কথা সত্য যে, বহু বছরের নির্যাতন, অত্যাচার ও সংঘর্ষের পরে মক্কার কোরাইশরা ইসলাম তথা মুসলমানদের সমকক্ষ শক্তিরূপে স্বীকৃতি দান করে - এই সন্ধির মাধ্যমে। এই স্বীকৃতি ছিলো প্রত্যক্ষ বিজয়। পরোক্ষভাবে এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বে ইসলামের বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, ফলে আরব তথা সমগ্র বিশ্বে ইসলাম প্রসারের সুযোগ লাভ করে।
৪৮৬৭। দেখুন [ ৪০ : ৫৫ ] আয়াতের টিকা নং ৪৪২৮ এবং [ ৪৭ : ১৯ ] আয়াত। এই আয়াতটিতে রাসুলকে (সা ) সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে রাসুলকে ( সা ) সরলপথে পরিচালনা অর্থাৎ হেদায়েতের কথা বলা হয়েছে। হেদায়েত একটি ব্যাপক শব্দ। এর অসংখ্য স্তর বিদ্যমান। পৃথিবীর, জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্র নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই নৈকট্য ও সন্তুষ্টির অসংখ্য স্তর বিদ্যমান। এক স্তর অর্জিত হওয়ার পরে দ্বিতীয় বা তৃতীয় এরূপ বহু স্তর অর্জনের আবশ্যকতা থাকে। কোন সর্বোত্তম ওলী এমন কি নবী রসুলও এই আবশ্যকতা থেকে মুক্ত হতে পারেন না। সরল পথের দোয়া করার শিক্ষা যেমন উম্মতকে দেয়া হয়েছে, তেমনি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ্ কেও ( সা ) দেয়া হয়েছে। এর সারমর্ম হচ্ছে 'সিরাতে মুস্তাকীমের হেদায়েত তথা আল্লাহ্ তায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টির স্তরসমূহে উন্নতি লাভ। এই প্রকাশ্য বিজয়ের কারণে আল্লাহ্ তায়ালা এই নৈকট্য ও সন্তুষ্টির একটি অত্যুচ্চ স্তর রসুলুল্লাহ্ কে ( সা ) দান করেছেন।
৪৮৬৮। আল্লাহ্র সন্তুষ্টির তিনটি বিষয়কে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে :
১) "অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটি সমূহ মার্জনা করেন" -অর্থাৎ আল্লাহ্র করুণা, অনুগ্রহ ও ক্ষমা লাভ করা
২) আরবে রসুলের অবস্থানকে সম্মান ও দৃঢ় অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে নবুয়তের সম্মান বৃদ্ধি করন। এভাবেই আল্লাহ্ নবীর প্রতি তাঁর "অনুগ্রহ পূর্ণ করেন।"
৩) নবীর জন্য ইসলাম প্রসারের পথ সরল ও সহজ করে দেন। পরবর্তীতে মক্কা তথা কাবা হচ্ছে ইসলামের প্রতীক স্বরূপ। আল্লাহ্র এই তিনটি অনুগ্রহকে সংক্ষিপ্ত আকারে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে : " আল্লাহ্ তোমাকে শক্তিশালী সাহায্য দান করেন।
৪৮৬৯। আল্লাহ্র অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে হুদায়বিয়া প্রান্তরে রাসুলের সহযোগী ১৪০০-১৫০০ তীর্থযাত্রীর মাঝে। তাঁরা তাদের অন্তরের মাঝে প্রগাঢ় শান্তি, ধীর-স্থির মনোভাব, নিরাপত্তা এবং দুর্জয় সাহসের অনুভূতি উপলব্ধি করেন যদিও তাঁরা ছিলেন নিরস্ত্র এবং বহিঃশত্রুর দ্বারা তাদের আক্রান্ত হওয়া কিছুমাত্র অসম্ভব ছিলো না। এই প্রশান্তি প্রদানের ফলেই প্রবল উস্কানি সত্ত্বেও মুসলিমগণ শান্ত ছিলেন এবং এমন সংকটময় মূহুর্তে ধীরস্থির ভাবে দৃঢ়তার সাথে জিহাদের বায়'আত [ ৪৮ : ১৮ ] গ্রহণ করেছিলেন। তা ছিলো তাদের সুদৃঢ় ঈমানের প্রতিদানে আল্লাহ্র অনুগ্রহ।
মন্তব্য : মানসিক প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি আল্লাহ্র অসীম অনুগ্রহের দান।
৪৮৭০। বিশ্বাস বা ঈমানের কি স্তর ভেদ আছে ? এরূপ প্রশ্ন শুধুমাত্র কূটতার্কিকরাই করতে পারে। বিশ্বাস বা ঈমান হচ্ছে অন্তরের ধন, বাইরে তা জনসমক্ষে প্রকাশ্য নয়। সুতারাং তর্কের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব নয়। যারা বিশ্বাসী তারা বিশ্বচরাচরে সর্বক্ষেত্রে সর্ববিষয়ে আল্লাহ্র নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে থাকে।এসব নিদর্শন সমূহ তাদের বিশ্বাস বা ঈমানকে প্রতিনিয়ত দৃঢ় থেকে দৃঢ়তার পথে, স্তর থেকে স্তরে উন্নত করতে সাহায্য করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামের অনুসারীর হত্যা, নির্যাতন, সংঘর্ষের শীকার হন। ইসলামের শত্রুরা যখন হুদায়বিয়া নামক স্থানে সন্ধির শর্তসমূহ আলোচনার জন্য অগ্রসর হয় তখন বিশ্বাসীদের অন্তর আল্লাহ্র অনুগ্রহ উপলব্ধিতে আপ্লুত হয়ে পড়ে। তাদের বিশ্বাস বা ঈমান সোনায় মোড়ানো হীরার ন্যায় উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে ওঠে। তাদের ' বিশ্বাস ' বা ঈমান হয় দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর, পরিপূর্ণ, নিশ্চিত - তা ন্যায্যতা প্রতিপাদিত হয়। অন্তরের এই উপলব্ধি, এই পাওয়া তাদের হৃদয়কে আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ করে তোলে।
৪৮৭২। কর্মের মাধ্যমে ঈমানের দৃঢ়তার পরিচয় যারা দান করেন পরলোকে তাদের জন্য কি পুরস্কার রয়েছে তা এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
৪৮৭৩। 'পাপের চক্র' অর্থাৎ তারা পাপের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়বে। এই আয়াতে মোনাফেক ও মোশরেক নর-নারীকে একই কাতারে সম্বোধন করা হয়েছে। সুতারাং যারা পার্থিব জীবনে অবিশ্বস্ততা ও মিথ্যার বেসাতী করে থাকে তারা মুখে যতই ধর্মের কথা আলোচনা করুক তা আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। পাপ তাদের সর্বসত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে।
৪৮৭৪। এসব মোনাফেক ও মোশরেকদের প্রতি আল্লাহ্ রুষ্ট হয়েছেন এবং " আল্লাহ্ তাদের অভিশপ্ত করেন।" অর্থাৎ তারা আল্লাহ্র সকল অনুগ্রহ বঞ্চিত হবে। আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের নূর বা আলো অপ্রবেশ্য। কি ভয়াবহ সে অবস্থা। তারা এ অবস্থা প্রাপ্ত হবে কারণ তারা " আল্লাহ্ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে।" এবং সর্বদা আল্লাহ্র হুকুম সমূহ অমান্য করে থাকে। যার ফলে তারা আল্লাহ্র করুণা ও রহমত বঞ্চিত হয়।
৪৮৭৫। আপতঃদৃষ্টিতে এই আয়াতটি ৪নং আয়াতের পুণঃরাবৃত্তি বলে ভ্রম হয়। পুণঃরাবৃত্তি অবশ্যই তবে সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল বক্তব্যকে জোরালোরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবীতে সুদক্ষ যোদ্ধাবাহিনী, সমরাস্ত্র প্রভৃতির প্রয়োজন সমরক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এটাই শেষ কথা নয়। এসব দৃশ্যমান সমরশক্তি ব্যতীতও আল্লাহ্র অদৃশ্য শক্তি সর্বত্র কর্তৃত্বশালী। শুধুমাত্র দৃশ্যমান শক্তির উপরে নির্ভর করেই আল্লাহ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না। আল্লাহ্র শক্তি জলে স্থলে, অন্তরীক্ষে, দ্যুলোকে, ভূলোকে, সর্বত্র অদৃশ্য থেকে পৃথিবীর প্রতিটি কার্য্যকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে এবং আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে তার নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি এগিয়ে নিয়ে চলে। ঠিক যেরূপটা ঘটেছিলো হুদায়বিয়ার প্রান্তরে। ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। পূর্বের আয়াতে আল্লাহ্র জ্ঞানের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো, এই আয়াতে আল্লাহ্র ক্ষমতার উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জ্ঞান ও বিচক্ষণতা পরিকল্পনা প্রণয়নে সাহায্য করে এবং ক্ষমতা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য করে।
৪৮৭৬। রাসুলের (সা ) আগমন পৃথিবীতে আল্লাহ্র একত্বের উপাসনা শিক্ষা দানের জন্য। মানুষকে ঈমানের রাস্তায় আহ্বানের জন্য। এই আয়াতে রাসুলের তিনটি বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে :
১) সাক্ষীরূপে তাঁকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে দুর্বল, ও নির্যাতিতের সাহায্যকারী ও শক্তিশালীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাধাদানকারী হিসেবে। তিনি ঘোষণাকারী বা সাক্ষ্যদাতা।
২) যারা অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধন করে এবং আল্লাহ্ নির্দ্দেশিত পবিত্র জীবন যাপন করে থাকে, রাসুল (সা) তাদের জন্য আল্লাহ্র ক্ষমা, দয়া ও করুণার সুসংবাদ প্রদানকারী।
পাপীদের পাপের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে সর্তককারী হিসেবে তাঁর আগমন।
১০। যারা তোমার হাতে বায়'আত করে তারা তো আল্লাহ্রই হাতে বায়'আত করে, ৪৮৭৭। এরপরে যে তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, সে তা করে নিজেরই আত্মার অকল্যাণের জন্য এবং যে আল্লাহ্র সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করে ; শীঘ্রই আল্লাহ্ তাকে মহাপুরষ্কার দান করবেন।
৪৮৭৭। হুদায়বিয়ার প্রান্তর থেকে মক্কার কোরাইশদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্য মুসলমান শিবির থেকে দূত প্রেরণ করা হয়। কোরাইশরা মুসলমানদের দুতকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করবে না, অসম্মানিত করবে এ ব্যাপারে সকলেই ছিলো অনিশ্চিত। মুসলমান শিবিরে চরম উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিলো - সে সময়ে ১৪০০-১৫০০ মুসলিম তীর্থযাত্রীর মাঝে আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের তীব্র আবেগ বিরাজ করছিলো। তাঁরা আরবের প্রথা অনুযায়ী, রাসুলের হাতের উপরে হস্ত স্থাপন পূর্বক সকল বিপদ বিপর্যয়ে রাসুলের (সা ) প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। [ দেখুন এই সূরার ভূমিকা ৩নং অনুচ্ছেদ ]। এই আনুগত্য ছিলো সকল নৈতিক সাহস ও পার্থিব শক্তির মূল ভিত্তি। এই আনুগত্যই হচ্ছে সকল বিজয়ের অদৃশ্য শক্তির উৎস। প্রকৃত বিজয় এই আনুগত্য প্রদর্শন ইসলামের ইতিহাসে "Bai'at ur Ridhwan" নামে বিখ্যাত। [Fealty of Allah's Good Pleasure ]। সাহাবীরা রাসুলের (সা) হাতের উপরে হস্ত স্থাপন পূর্বক আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, প্রকৃত পক্ষে তারা আল্লাহ্রই আনুগত্য গ্রহণ করেছে।
রুকু - ২
৪৮৭৮। নবীর মদিনা থেকে মক্কা যাত্রার প্রাক্কালে [যে যাত্রা হুদায়বিয়া নামক স্থানে স্থগিত হয়ে যায় ] প্রতিটি মুসলমানকে পবিত্র যাত্রা সম্পন্ন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেন। এ ব্যাপারে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিলো স্বতঃস্ফুর্ত ও উজ্জ্বল দীপ্তিমান ও আবেগপূর্ণ। কিন্তু কোনও কোনও মরুবাসী আরব গোষ্ঠি এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ না করে পিছনে থেকে যায়। তারা তীর্থযাত্রীদের সহযোগী না হওয়ার বিশেষ অজূহাত খাড়া করে। কারণ তাদের বিশ্বাস বা ঈমানের ভিত্তি ছিলো দুর্বল। সে কারণেই তারা সম্ভাব্য কোনওরূপ বিপদ বা বিপর্যয়ের মাঝে যেতে অনিচ্ছুক ছিলো। মক্কীগামী নিরস্ত্র মুসলিম তীর্থযাত্রীরা বিপদ বা অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে এই চিন্তা তাদের দুর্বল বিশ্বাসের ভিত্তিকে প্রকম্পিত করে। আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা হারায়। সে কারণে তারা মিথ্যা অজুহাতের উপস্থাপন করে। এই আয়াতে তারা ধন সম্পদ ও পরিবার পরিজনের রক্ষণাবেক্ষণের যে অজুহাত উত্থাপন করে তা ছিলো মদিনাবাসীদের হুদায়বিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে। হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মদিনাবাসী মুসলমানদের সম্মান বৃদ্ধি ঘটে। সুতারাং তারা সেই সম্মানের অংশীদার হওয়ার জন্য এই মিথ্যা অজুহাতের আশ্রয় গ্রহণ করে। এই আয়াতের মাধ্যমে সুযোগ সন্ধানীদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যা সর্বযুগে বিদ্যমান ছিলো এবং ভবিষ্যতেও থাকবে তা তুলে ধরা হয়েছে।
৪৮৭৯। ক্ষমা প্রার্থনার কথা ছিলো শুধুমাত্র কথার কথা। তা তাদের হৃদয়ের কথা ছিলো না। কারণ তাদের অন্তরে বা চিন্তায় কোনওরূপ ধর্মানুরাগ স্থান লাভ করে নাই।
৪৮৮০। তাদের মিথ্যা অজুহাতের একমাত্র কারণ হচ্ছে পার্থিব লাভ-লোকসানের হিসাব। এ সব লোকের নিকট আধ্যাত্মিক জগতের কোনও অস্তিত্ব নাই। বৃহত্তর ও মহত্তর কারণে আত্মত্যাগ আধ্যাত্মিক জগতকে করে সমুন্নত, উন্নত, আল্লাহ্র রহমত পাওয়ার যোগ্য। নিতান্ত পার্থিব, আত্ম স্বার্থ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যারা শুধু কাজ করে তাদের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতির এই পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বিপদের আশংকাকে উপেক্ষা করে, যারা রাসুলের (সা ) সাথে মদিনা থেকে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং হুদায়বিয়ার প্রান্তরে যারা নিজ জীবনকে আল্লাহ্র রাস্তায় উৎসর্গ করার জন্য রাসুলের হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তাদের ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ আল্লাহ্ বৃথা যেতে দেন না। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি তাদের আধ্যাত্মিক জগতকে স্বর্গীয় অনুভূতিতে ভরিয়ে দেয়। কল্যাণজনক কাজের এই স্বর্গীয় অনুভূতি সর্বকালের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। যারা শুধুমাত্র বৈষয়িক ব্যাপারে পার্থিব লাভলোকসানের হিসাবে জীবন অতিবাহিত করে থাকে, তারা অত্যন্ত নির্বোধ। কারণ তারা মনে করে থাকে যে, তাদের বৈষয়িক স্বার্থ বুদ্ধির খবর কেউ জানতে পারবে না। তারা নিতান্তই নির্বোধ কারণ আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।
৪৮৮১। স্বার্থপর ও বিয়ষবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির চিন্তাধারা এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। যা সর্বকালের সর্বযুগের মানব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। যাদের অন্তরে ঈমানের ভিত্তি দুর্বল, যারা সর্ব অবস্থায় আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল নয়, যারা শুধুমাত্র পার্থিব লাভ-লোকসানের দ্বারা পরিচালিত হয় তারাই শুধুমাত্র মহৎ কাজের পরিণতি সম্বন্ধে আশংকা প্রকাশ করে থাকে। এই আয়াতের মাধ্যমে মদিনার মোনাফেক সম্প্রদায়ের মনঃস্তাত্বিক বিশ্লেষণের দ্বারা পৃথিবীর সর্বকালের সর্বযুগের মোনাফেক ও সুযোগ সন্ধানীদের চরিত্র অঙ্কিত করা হয়েছে। মদিনার সুযোগ সন্ধানী মোনাফেকদের ধারণা হয়েছিলো যে, মক্কার কোরাইশরা রাসুল (সা ) ও তাঁর নিরস্ত্র সহযোগীদের ধ্বংস করে ফেলবে। প্রকৃতপক্ষে এ ধারণা তাদের মনে দুঃখের পরিবর্তে প্রীতিরই সঞ্চার করে থাকে। কারণ তারা ছিলো একগুঁয়ে, অবাধ্য, দুষ্ট সম্প্রদায় যারা অপরের দুঃখ কষ্টে আনন্দ লাভ করে থাকে। এ সব লোক বা সম্প্রদায় শেষ পর্যন্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায়রূপে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পরলোকে তাদের জন্য আছে জলন্ত অগ্নি।
১৪। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী আল্লাহ্রই অধীনে। তিনি যাকে খুশী ক্ষমা করেন ৪৮৮২, এবং যাকে খুশী শাস্তি দান করেন। আল্লাহ্ তো বারে বারে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
৪৮৮৩। যারা মোনাফেক, সুযোগ সন্ধানী, যারা মহৎ কাজে অংশ গ্রহণে অনিচ্ছুক, বিশ্লেষণে তাদের মনের আর এক ধরণের 'উদ্দেশ্যকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তীর্থযাত্রা প্রাক্কালে কোনরূপ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভের সুযোগ নাই। সুতারাং সে যাত্রাতে তাদের প্রচুর অনীহা লক্ষ্য করা যাবে। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি তাদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের প্রলোভন দান করা হয়, তবে তারা তৎক্ষণাত সহযাত্রী হতে সম্মত হবে। কিন্তু তাদের এই মানসিক অবস্থা জেহাদের প্রতি নিবেদিত ব্যক্তির মানসিক অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। 'জেহাদ' কোন ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়। আল্লাহ্র সন্তুষ্টির লাভের জন্য, সমাজ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য যে সংগ্রাম তাই-ই জেহাদ। সেখানে ব্যক্তিগত লাভ লোকসান ও স্বার্থ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এই-ই হচ্ছে স্বর্গীয় আইন বা হুকুম। এই দৃষ্টি কোণ থেকে 'জিহাদ' অর্থ শুধুমাত্র অস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধক্ষেত্র নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মানুষের কল্যাণের জন্য চেষ্টা সবই 'জেহাদ'। সুতারাং যুদ্ধ এবং শান্তি অবস্থায় সর্বদাই সমাজ জীবনে 'জেহাদ' হতে পারে। [ দেখুন ৮ নং সূরার ভূমিকার ২নং অনুচ্ছেদ ]।
৪৮৮৪। 'কিছুতেই ' অর্থাৎ তোমাদের মানসিক অবস্থা যদি জেহাদের উপযুক্ত না হয়ে শুধুমাত্র যুদ্ধলব্ধ ধন-সম্পদ লাভের উপযুক্ত হয় তবে তোমরা 'কিছুতেই ' সঙ্গী হতে পারবে না।
৪৮৮৫। দেখুন আয়াত [ ৮ : ১ ] ও টিকা ১১৭৯।
৪৮৮৬। মরুবাসী আরবরা লুঠতরাজ করার জন্য যুদ্ধ করতে ভালোবাসতো। বৃহত্তর ও মহত্তর কারণের জন্য যুদ্ধ করা সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই ছিলো না। তারা ছিলো ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ ব্যক্তির ন্যায়। তাদের সকল চিন্তা চেতনা আবর্তিত হতো ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারের চিন্তায়; ফলে লুট-তরাজের জন্য যুদ্ধ করাই ছিলো তাদের জন্য স্বাভাবিক কেউ যদি তাদের এরূপ যুদ্ধে অংশগ্রহণে বঞ্চিত করতো, তবে তারা হিংসা ও বিদ্বেষে উম্মত্ত হয়ে পড়তো। পরবর্তী আয়াতে এসব মরুবাসী আরবদের আত্মসংযম, আত্মোৎসর্গ ও মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করার অভ্যাস গঠনের শিক্ষা দান করা হয়েছে।
৪৮৮৭। নিরস্ত্র অবস্থায় হুদায়বিয়াতে গমন ছিলো বিপদসংকুল এবং সেখানে কোনওরূপ লুটের মাল অর্জনের সম্ভাবনা ছিলো না। সুতারাং যারা এই মিছিলে শরীক হতে অস্বীকার করেছিলো তাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়, এবং সেই সাথে তাদের জন্য শুভসংবাদও জ্ঞাপন করা হয়। যদি তারা ইসলামের ঝান্ডা উত্তোলন করার জন্য আত্মসংযম ও আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে এবং এ কারণে প্রকৃত জেহাদে অংশ গ্রহণে আগ্রহী হয়, তবে তাদের জন্য আছে " উত্তম পুরষ্কার "। পরবর্তীতে পারস্য এবং বাইজানটাইনের যুদ্ধে ঠিক তাই সংঘটিত হয়।
৪৮৮৮। দেখুন [ ২৭ : ৩৩ ] আয়াত।
৪৮৮৯। ধর্ম যুদ্ধ বা জেহাদ হবে আত্মসংযম ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে ধর্ম ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ। শুধুমাত্র যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য নয়। যদি শত্রু সেনা আত্মসমর্পন করে তবে সেখানে আর কোনও যুদ্ধ নয় ; আর কোন লুণ্ঠন নয়। এই হলো ইসলামের দৃষ্টিতে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ।
৪৮৯০। শুধুমাত্র যুদ্ধলব্ধ সম্পদের জন্য যুদ্ধ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ হচ্ছে জেহাদ যা আত্মসংযম ও শৃঙ্খলার সর্বোচ্চ প্রকাশ। জেহাদের আহ্বানে সাড়া দেওয়া প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তবে অন্ধ, খঞ্জ ও রুগ্নের জন্য তা অবশ্য করণীয় নয়। তবে তারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী দেশ ও জাতির সেবা করতে সক্ষম। এই আয়াতে এ সব ব্যক্তির নিয়ত ও উদ্দেশ্যের প্রতিও পরম করুণাময় আল্লাহ্ উদাসীন নন তাই ব্যক্ত করা হয়েছে। তারাও জেহাদের অংশগ্রহণকারীদের সমতুল্য ও পুরষ্কারের যোগ্য। পরলোকে তাদের সকলের জন্য আছে বেহেশতের সুখ ও শান্তি।
রুকু - ৩
৪৮৯১। হুদায়বিয়ায় যখন মুসলিমগণ অবস্থান করছিলেন, তখন মক্কার মোশরেকদের সাথে আলোচনার জন্য হযরত ওসমান (রা) কে মক্কায় প্রেরণ করা হয়। তাঁকে মক্কায় মুশরিকরা আটক করে রাখলে গুজব রটে যে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এ বার্তা শুনে মুসলমানগণ রাসুলুল্লাহ্ ( সা ) এর আহ্বানে জিহাদের বাইয়াত গ্রহণ করেন। এই বাইয়াত ইতিহাসে বায়আতে রিদওয়ান নামে খ্যাত। এই আয়াতে উক্ত বায়াতের উল্লেখ করা হয়েছে।
৪৮৯২। বাইয়াত গ্রহণকালে মহানবী হুদায়বিয়ার প্রান্তরে একটি বৃক্ষতলে উপবেশন করেছিলেন - এই আয়াতে তারই উল্লেখ করা হয়েছে।
৪৮৯৩। "তা তিনি জানতেন" যা পরীক্ষা করারই নামান্তর। দেখুন [ ৪৭ : ৩১ ] আয়াতের টিকা ৪৮৫৫।
৪৮৯৪। 'Sakina' - শান্তি, স্থিতি, স্থির, প্রশান্তি, নিরাপত্তা বোধ, স্নায়ু উত্তেজনা প্রশমনকারী ইত্যাদি। দেখুন উপরের আয়াত [ ৪৮ : ৪ ] ও টিকা নং ৪৮৬৯। এই একই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে হুনাইনের যুদ্ধের বর্ণনার সময়ে আয়াত নং [ ৯ : ২৬ ] এবং হিজরতের প্রাথমিক স্তরে 'Cave of Thaur' [ ৯ : ৪০ ]।
৪৮৯৫। 'হুদায়বিয়ার সন্ধি' ছিলো "আসন্ন বিজয়"। বাইয়াত গ্রহণের পর পরই এই সন্ধির চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হয়।
২০। আল্লাহ্ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদের, যার অধিকারী হবে তোমরা ৪৮৯৬। তিনি পূর্বেও তোমাদের তা দিয়েছেন ৪৮৯৭ ; এবং মানুষের হাতকে তোমাদের থেকে নিবৃত্ত করেছেন; যেনো মোমেনদের জন্য তা হয় এক নিদর্শন ৪৮৯৮ ; এবং তিনি যেনো তোমাদের সরল পথে পরিচালিত করতে পারেন।
৪৮৯৬। বাইয়াত গ্রহণের পরে আল্লাহ্ মুসলমানদের যে সম্পদ দান করেন তা "বিপুল সম্পদ" নামে অভিহিত করা হয়। যা পার্থিব সম্পদের পরিমাণে ধার্য করার নয়। তাদের মানসিক প্রশান্তি, স্নায়ুর উত্তেজনা প্রশমন, অগাধ নিরাপত্তাবোধ প্রভৃতি নৈতিক সাহসের চেতনা তাদের সর্বসত্তাকে আপ্লুত করে। এই পাওয়া পার্থিব ধন সম্পদ পাওয়া থেকে বহুগুণ শ্রেষ্ঠ। এর ফলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বিস্তৃতিলাভ করে এবং মক্কা বিজয়ের পথ সুগম হয় এবং পরিণামে পবিত্র কাবা ঘর পৌত্তলিক মুক্ত হয়। মক্কা বিজয়ের পরেই ধীরে ধীরে ইসলামের প্রসার সমস্ত আরব ভূখন্ডে ব্যপ্তি লাভ করে। "বিপুল সম্পদ" এখানে শুধুমাত্র পার্থিব সম্পদ নয়, তা ছিলো আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানসিক।
৪৮৯৭। বাইয়াতের প্রথম "ফসল " হচ্ছে 'হুদায়বিয়ার সন্ধি' যার ফলে কিছুদিনের জন্য মুসলমানেরা মক্কার কোরাইশদের আক্রমণ ও নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করে। এই মুক্তির বারতাকেই এভাবে এ ভাবে উত্থাপন করা হয়েছে " এবং মানুষের হাতকে তোমাদের থেকে নিবৃত্ত করেছেন।"
৪৮৯৮। হুদায়বিয়ার 'বাইয়াত' ও 'সন্ধি' এই উভয়ই ছিলো মুসলমানদের জন্য মাইলফলক স্বরূপ। মুসলমানদের একত্ব, অভিন্নতা ও সংহতি দর্শনে সমগ্র আরব বিশ্ব অভিভূত হয়ে পড়ে।
৪৮৯৯। মুসলমানদের জন্য ভবিষ্যতে আরও বহু বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এই বিজয়কে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সমরাস্ত্রের বিজয়, ও পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতা লাভের বিজয় রূপে মনে করার অবকাশ নাই। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে ইসলাম পৃথিবীতে অজেয় শক্তিরূপে আর্বিভূত হবে ভবিষ্যতের বিজয়ের মাধ্যমে সেই সুসংবাদই দান করা হয়েছে।
৪৯০০। মোশরেক কাফিরদের কোনও প্রকৃত নৈতিক মূল্যবোধ ছিলো না, ফলে তারা যুদ্ধের প্রকৃত মানসিক ও নৈতিক সাহস প্রদর্শনে অক্ষম হয়।
৪৯০১। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৩৩ : ৬২ ]। প্রকৃতিতে প্রাণী, বস্তু ও পরিবেশের জন্য আছে বিশ্বজনীন আইন যা স্রষ্টা করে দিয়েছেন। সেগুলিকে বলা হয় প্রাকৃতিক আইন। সমগ্র বিশ্ব জগৎ নভোমন্ডল প্রাকৃতিক আইনের অর্ন্তগত। ঠিক সেরূপ মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের জন্যও কতকগুলি নৈতিক আইন বর্তমান, যা যুগ যুগ ধরে বর্তমান আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। উপরের আয়াতগুলির মাধ্যমে ও হুদায়বিয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে যুদ্ধকালীন প্রতিটি সৈনিকের নৈতিক গুণাবলী যা আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত তারই বর্ণনা করা হয়েছে। এই সব গুণাবলী যেমন : বিশ্বস্ততা, একতা, সংহতি, শৃঙ্খলা, নেতার প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রভৃতি যে সব গুণাবলী হুদায়বিয়ার প্রান্তরে মুসলমানেরা আল্লাহ্র রাসুলের প্রতি প্রদর্শন করেছিলেন - তাই-ই হচ্ছে আল্লাহ্ কর্তৃক সর্বকালের সর্বযুগের জন্য সমরক্ষেত্রে মনোনীত গুণাবলী। এ সব গুণাবলী হচ্ছে সার্বজনীন।
৪৯০২। মোশরেকদের কয়েকটি দল হুদায়বিয়াতে এসে মুসলমানদের উত্যক্ত করে। এমনকি একজন মুসলিমকে শহীদও করে। সাহাবীগণ তাদের বন্দী করে রাসুলুল্লাহ্ (সা) সম্মুখে নীত করে। এই দুঘর্টনা মদিনার মুসলমান ও কোরাইশদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত করতে পারতো। কারণ একপক্ষে কোরাইশরা যে কোনও মূল্যে মুসলমানাদের মক্কা থেকে বিতাড়িত করতে বদ্ধ পরিকর - যদিও তাদের সে অধিকার নাই। কারণ কাবা ঘর বিশ্ব মানবের মহামিলন স্থান রূপে প্রাচীন কাল থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে। অপরপক্ষে মুসলমানরা নিরস্ত্র থাকা সত্ত্বেও প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়ে একতাবদ্ধ হয় যে, যদি তারা আক্রান্ত হন তবে তাঁরা কাবা ঘরে জোর করেই প্রবেশ করবেন। কিন্তু রাসুল দুর্বৃত্ত কোরাইশদের ক্ষমা করে দেন। এ ভাবেই আল্লাহ্ পবিত্র মক্কা ভূমিকে রক্তপাত থেকে রক্ষা করেন। এই আয়াতে এই ধরণের ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর দুপক্ষের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটে। এ সবই হচ্ছে আল্লাহ্র অদৃশ্য হস্তের ইঙ্গিত। আল্লাহ্র ইচ্ছা মানুষের মনের উপরে কার্যকর হয়।
৪৯০৩। মুসলমানেরা কোরবানীর উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে মক্কাতে পশু আনায়ন করেন। তাদের পরনে ছিলো এহরামের পোষাক [ দেখুন ২ : ১৯৭ ] আয়াতের টিকা ২১৭ ]। কোরাইশরা মুসলমানদের শুধুমাত্র যে, মক্কাতে প্রবেশে বাঁধা দান করে তাই-ই নয়, তারা কোরবানীর উদ্দেশ্যে আনীত পশুগুলিকেও মক্কার কোরবানী স্থলে প্রেরণে বাঁধা দান করে। সে কারণে হুদায়বিয়ার প্রান্তরে পশুগুলিকে আল্লাহ্র ওয়াস্তে কোরবানী করা হয়।
৪৯০৪। সে সময়ে মক্কা নগরীতে কিছু সংখ্যক মোমেন পুরুষ ও নারী ছিলেন যারা বাইরে নিজেদের মুসলিম বলে প্রকাশ করতেন না। ফলে তাদের পরিচয় মদিনার মুসলমানদের নিকটও অপ্রকাশ্য ছিলো। যদি মুসলমানেরা মক্কা নগরীতে প্রবেশ লাভ করতেন তবে সংঘর্ষ ছিলো অনিবার্য, যার ফলে এ সব মোমেন মুসলিম পুরুষ ও নারীর জীবন হানির আশঙ্কা ছিলো। মুসলমানেরা এই সংঘর্ষে বিজয়ী হলেও তাদের অজান্তেই মোমেন পুরুষ ও নারীর প্রাণহানি ঘটতো - যার পাপ মদিনার মুসলমানদের উপরে নিপতিত হতো। হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মোমেন মুসলিম পুরুষ ও নারীর রক্তপাত থেকে আল্লাহ্ মুসলমানদের রক্ষা করেন।
৪৯০৫। সমগ্র বিশ্ব জগত আল্লাহ্র পরিকল্পনার অংশ বিশেষ। পৃথিবী ও সমগ্র বিশ্ব জগৎ সেই পরিকল্পনার সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসরমান। আমাদের ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান, বুদ্ধিতে যা আজকে মনে হবে অসংলগ্ন, অকিঞ্চিতকর ও অপ্রয়োজনীয়, সময়ের বৃহত্তর পরিসরে তাই একদিন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এ অভিজ্ঞতা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের। হুদায়বিয়ার প্রান্তরে যুদ্ধ প্রতিরোধ দ্বারা আল্লাহ্ শুধুমাত্র মোমেন মুসলিমদের অমূল্য জীবনই রক্ষা করলেন না ; কোরাইশদের মধ্যে অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন যারা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আল্লাহ্ জানতেন যে, ভবিষ্যতে মক্কার কোরাইশদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন। তাদের প্রতি এবং মক্কায় আটক অনেক মুসলমানদের প্রতি রহমত করার জন্য এসব আয়োজন করা হয়েছে। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দয়া মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান অপেক্ষা বহুগুণ বিস্তৃত ও অসীম - সময়ের বৃহত্তর পরিসরেই যা শুধুমাত্র পরিমাপ করা সম্ভব। আল্লাহ্র অনুগ্রহ তার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে "আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন রহমতের মধ্যে অধিষ্ঠিত করেন।"
৪৯০৬। মক্কাতে সেই সময়ে বহু মোমেন মুসলিম অবস্থান করছিলেন। যদি তাঁদের কাফেরদের থেকে পার্থক্য করা সম্ভব হতো, তবে আল্লাহ্ মদিনার মুসলিমদের মক্কাতে প্রবশে করাতেন এবং কোরাইশদের গর্ব, অহংকার ও মক্কাতে সকলের প্রবেশের অধিকারের অলিখিত চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য মদিনার মুসলমানদের দ্বারা শাস্তি দান করতেন। এরূপ ক্ষেত্রে সে সময়ে হুদায়বিয়ার সন্ধি-ই ছিলো সর্বাপেক্ষা প্রকৃষ্ট পন্থা। যা সে সময়ে উপলব্ধি না করতে পারলেও সময়ের বৃহত্তর পরিসরে প্রমাণিত হয়েছে।
৪৯০৭। হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে কোরাইশদের আচরণ ছিলো উদ্ধত, অহংকারী, একগুঁয়ে। তারা চুক্তিপত্রের খুঁটিনাটি ব্যাপারেও হৈ-চৈ শুরু করেছিলো। তারা যখন চুক্তিপত্রের প্রারম্ভে "বিসমিল্লাহের রাহ্মানের রহিম" শব্দটি প্রয়োগে আপত্তি উত্থাপন করলো তখনও আল্লাহ্র রাসুল ছিলেন স্থির, আত্মসংযমী। আল্লাহ্র নামে প্রারম্ভের বাক্যটির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ না করে তিনি ধীর-স্থির ও ধৈর্য্য সহকারে চুক্তিপত্রের মূল বিষয়গুলির প্রতি মনোনিবেশ করেন, কারণ সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এর থেকে শ্রেষ্ঠ উপায় আর কিছু ছিলো না। এই সূরার ভূমিকাতে চুক্তি পত্রের সার-সংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে যা মুসলমানদের সে সময়ে অনেকেরই মনঃপূত ছিলো না। কিন্তু হযরতের (সা ) অনুসারীরা তাঁদের নেতার প্রতি আনুগত্যে ও বিশ্বাসে ছিলেন অটল। তাঁরা তাঁদের নেতার বিচার বিবেচনার প্রতি সম্পূর্ণরূপে ছিলেন আস্থাশীল। পরবর্তীতে তাঁদের এই আস্থা যথার্থ প্রমাণিত হয়।
উপদেশ : এই আয়াত সমূহের মাধ্যমে নেতার প্রকৃত গুণাবলী ও অনুসারীদের করণীয় কর্তব্য সমূহের প্রকৃত চিত্ররূপকে তুলে ধরা হয়েছে।
৪৯০৮। দেখুন উপরের [ ৪৮ : ১৮ ] আয়াতের টিকা ৪৮৯৪।
৪৯০৯। হুদায়বিয়ার প্রান্তরের সম্পূর্ণ ঘটনাপঞ্জী ছিলো মুসলমানদের জন্য উত্তেজনাপূর্ণ, ক্রোধাদ্দীপক ও প্ররোচনাপূর্ণ। কিন্তু এরূপ পরিবেশেও তাঁরা তাঁদের নেতার প্রতি যে আনুগত্য ও শৃঙ্খলা প্রদর্শন করেন, তার পুরষ্কার স্বরূপ আল্লাহ্ তাঁদের মনে প্রশান্তি দান করেন। ফলে এরূপ উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশেও তারা ছিলেন শান্ত ও ধীর-স্থির। আল্লাহ্র এই পুরষ্কার তাঁরা তাঁদের যোগ্যতার দ্বারা অর্জন করেন। তাঁরা ছিলেন এই পুরষ্কারের যোগ্য। আল্লাহ্র ক্ষমতা মানুষের অন্তরের উপরে কার্যকর।
রুকু - ৪
৪৯১০। মদিনা থেকে মক্কা যাত্রার প্রাক্কালে [ যে যাত্রা হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে শেষ হয় ] রাসুল (সা ) স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করছেন। সে বছর রাসুল ও তাঁর সাহাবীগণ মক্কাতে প্রবেশ লাভ করতে পারেন নাই সত্য, তবে পরের বছর তাঁর এই স্বপ্ন সফল হয়। তিনি ও তাঁর সাহাবীরা পরের বৎসর মক্কায় প্রবেশ লাভ করেন কোনওরূপ প্রতিরোধ ব্যতীত। সেবারেই তিনি ও তাঁর সাহাবীরা আনুষ্ঠানিকভাবে এহ্রাম পরিধান করে মস্তকমুন্ডিত করে আনুষ্ঠানিকভাবে হজ্বব্রত পালন করেন।
৪৯১১। দেখুন পূর্বের [ ৪৮ : ১৮ ] আয়াতের টিকা ৪৮৯৫।
৪৯১২। আল্লাহ্র রাসুল (সা ) ও ইসলামের ধরাতলে আগমন হচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যের আগমন। জীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নাই যার বিধান ইসলাম প্রচার করে নাই। দেখুন [ ৬১ : ৯ ] আয়াত ও টিকা ৫৪৪২।
৪৯১৩। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৯ : ১২৮ ]। রাসুলের সহচরগণ হচ্ছেন আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নিবেদিত মোমেন বান্দা। তাঁরা কাফেরদের প্রতি বা যারা আল্লাহ্র আইন অমান্যকারীদের প্রতি কঠোর, অপরপক্ষে নিজ সম্প্রদায় যারা মোমেন বা আল্লাহ্র অনুসারী, তাদের প্রতি ভ্রাতৃসম এবং দুর্বল ও অত্যাচারীতদের প্রতি ভাতৃসম সৌহার্দ্যপূর্ণ। তাঁদের সাহায্য ও সহযোগীতার জন্য এ সব আল্লাহ্ ভক্তদের হস্ত সর্বদা সম্প্রসারিত হয়। আল্লাহ্ ভক্তদের গুণাবলী সংক্ষেপে এই আয়াতের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে।
৪৯১৪। আল্লাহ্ ভক্তদের আরও গুণাবলী বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এরা হবেন বিনয়ী - আল্লাহ্ ও রাসুলের আনুগত্যে তারা সর্বদা বিনয়াবনত। তারা পার্থিব ক্ষমতা, জাঁকজমক, অথবা চাকচিক্যের নিকট অবনত হন না। তাদের আনুগত্য ও বিনয় হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য। জাগতিক কোনও সুযোগ, সুবিধা বা পার্থিব সম্মান তাঁদের কাম্য নয়। ''আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদের রুকু সেজদায় অবনত হতে দেখবে।"
৪৯১৫। আল্লাহ্র প্রতি তাঁদের এই ভালোবাসা তারা বাইরের পৃথিবীতে প্রদর্শন করতে না চাইলেও তাদের সমস্ত অবয়বে তা পরিষ্ফুট হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহ্র প্রতি এই ভালোবাসাতে তাদের হৃদয় মন হয়ে পড়ে আপ্লুত, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের মুখমন্ডলে। মুখমন্ডল হচ্ছে প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরের বহিঃপ্রকাশের অঙ্গ। "মুখমন্ডলে সিজ্দার চিহ্ন দেখিবে" এই বাক্যটিকে যদি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হয় তবে এর অর্থ দাঁড়ায় পুণঃপুণঃ সেজ্দা করার ফলে তাঁদের কপালে সেজদার চিহ্ন অঙ্কিত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে সেটাই শেষ কথা নয়। একজন ভালো, সৎ ও পূণ্যবান ব্যক্তির চেহারা, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, ইত্যাদির মাধ্যমে তার অন্তরের যে দীপ্তি, যা আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত তা প্রস্ফুটিত হয়ে পড়ে। তিনি হবেন ভদ্র, দয়ালু, ক্ষমাশীল, সাহায্যকারী, সৎ ও সর্বপরি সর্ববিষয়ে আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীল। এদের অন্তরে আল্লাহ্ প্রশান্তি প্রদান করেন। [ Sakina ৪৮ : ২৬ আয়াত ] যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের মুখমন্ডলে ও সর্ব অবয়বে। এই মানসিক প্রশান্তি একমাত্র আল্লাহ্ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোন শক্তি দান করার ক্ষমতা রাখে না।
৪৯১৬। 'তওরাত' হচ্ছে হযরত মুসার দেয় আল্লাহ্র কিতাব - যা বর্তমানে অবিকৃত অবস্থায় নাই। বর্তমান গ্রন্থ 'Pentatench' হচ্ছে হযরত মুসার কিতাবের বিকৃত অংশ বিশেষ। তওরাতে সিজ্দাকে বর্ণনা করা হয়েছে বিনয় প্রকাশের সর্বোচ্চ মাধ্যম হিসেবে। সেখানে বলা হয়েছে, "Moses and Aron fell upon their faces " [ Num xvi 22 ]।
৪৯১৭। "ইঞ্জিল " - খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ। এই গ্রন্থে বীজের উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। কি ভাবে ভালো বীজ থেকে ভালো ফসল উৎপন্ন হয় যা বপনকারীর ধারণারও বাইরে। বর্ণনাটি এরূপ,"The seed should spring and grow up, he knoweth not how; for the earth bringeth forth fruit of herself : first the blade, then the ear , after that the full corn in the ear ." [ Mark iv 27 -28 ] । রাসুল ( সা ) কর্তৃক ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছিলো ঠিক উপরের ঐ বর্ণনার ন্যায়। ক্ষুদ্র বীজ যখন বপন করা হয়; মনে হয় তা মাটির অভ্যন্তরে হারিয়ে গেছে। দৃষ্টিতে তা আর ভাস্বর হয় না। কিন্তু মাটির অভ্যন্তরে বীজ হয়ে ওঠে সজীব - একদিন তা অঙ্কুরিত হয়, ধীরে ধীরে বড় হয় ; শক্ত মজবুত হয়ে নিজ কান্ডের উপরে দৃঢ় ভিত্তিতে দাড়িয়ে পড়ে এবং একদিন মহীরূহুতে পরিণত হয়। তখন একজন অন্ধ ব্যক্তিও তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং মুমিনদের উপমা হচ্ছে মহীরূহু এর বীজের ন্যায়। কোরাণের বর্ণনায় উপমাটির খুঁটিনাটি জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বীজ বপনকারী চাষীর মানসিক আনন্দকে তুলে ধরা হয়েছে নিম্নের বাক্যটি দ্বারা : "তার পরে তা শক্ত হয়, এর পরে তা মজবুত হয় ও কান্ডের উপরে দাঁড়ায়, যা চাষীকে বিস্ময় ও আনন্দ বর্ষণ করে" সেরূপ সৎ কাজ বা ভালো কাজ সর্বদা আল্লাহ্র সাহায্যপুষ্ট হয় এবং খুব ক্ষুদ্র পরিসরে তার প্রথম প্রকাশ ঘটে ঐ বীজের অঙ্কুরোদগমের ন্যায় - অনেক সময়ে যা দৃষ্টিগোচর হয় না। যদি সৎ কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্য হয় আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য তবে তা আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হয়ে বিস্তার লাভ করবে এবং বীজ থেকে উদ্গত ছোট চারা গাছের মহীরূহুতে পরিণত হওয়ার ন্যায় একদিন তা বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে বাধ্য।
৪৯১৮। ইসলামের অপূর্ব প্রসার ও প্রচার এবং শক্তিশালী জাতি হিসেবে পৃথিবীতে অভ্যুত্থান কাফেরদের বিভ্রান্ত করে ফেলে এবং তাদের অন্তরে অন্তর্জালার সৃষ্টি করে। তারা দুর্দ্দান্ত ক্রোধে অন্ধ হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে, রাসুল ( সা ) ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের এই সাফল্যে ছিলেন পরিতৃপ্ত, আনন্দিত এবং বিস্মিত। এই আয়াতটির শেষ উপদেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে : যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ্ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন "ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার।" আল্লাহ্র এই প্রতিশ্রুতি সর্বকালের সর্বমানুষের জন্য প্রযোজ্য।