Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ১৩ জন
আজকের পাঠক ৪২ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৬৫৩৮২ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬২৩০৪৪ বার
+ - R Print

সূরা কাফ্‌


সূরা কাফ্‌ - ৫০

৪৫ আয়াত, ৩ রুকু, মক্কী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : এখন থেকে শুরু হচ্ছে সাতটি সূরার [ ৫০ -৫৬ ] একটি গ্রুপ বা শ্রেণী। এই সূরাগুলি মক্কাতে অবতীর্ণ হয়। এই সূরাগুলির বিষয়বস্তু হচ্ছে : আকাশ- বাতাস, প্রকৃতি, পৃথিবীর অতীত ইতিহাস, রসুলদের মুখ নিঃসৃত বাণী সব কিছু আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশের স্বাক্ষর। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ পরলোকের সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ববর্তী শ্রেণীর সূরাগুলি [ ৪৭ - ৪৯ ] নূতন মুসলিম উম্মার বহিঃর্বিশ্বের ও নিজেদের মাঝে আচরণ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান গ্রুপের সূরাগুলিতে বিশেষ ভাবে পরলোকের সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

এই বিশেষ সূরাটি মক্কী সূরাগুলির প্রথম দিকে অবতীর্ণ হয়। বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি ও বিশ্ব ইতিহাসের পাপিষ্ঠদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অবগুণ্ঠন খোলার প্রয়াস করা হয়েছে [ দেখুন আয়াত ২২ ]।

সার সংক্ষেপ : যারা সন্দেহবাতিক, পরলোকে বিশ্বাস করে না তারা বিশ্বপ্রকৃতির দিকে, আকাশ ও নভোমন্ডলীর দিকে এবং ইতিহাস থেকে পাপীদের শেষ পরিণতির দিকে লক্ষ্য করুক। তাদের অন্তরের উপর থেকে অবগুণ্ঠন তুলে নেওয়ার পরেও কি তারা প্রত্যাদেশ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে ? [ ৫০ : ১ - ২৯ ]।

হিসাব নিকাশের দিন ও বাস্তবতার দিনই প্রকৃত সত্য। [ ৫ ০ : ৩০ - ৪৫ ]

সূরা কাফ্‌ - ৫০

৪৫ আয়াত, ৩ রুকু, মক্কী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


০১। কাফ্‌, সম্মানিত কুর-আনের শপথ [ নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহ্‌র রাসুল ] ৪৯৪০।

৪৯৪০। 'Majid' এই শব্দটি ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে 'Glorious' এবং শব্দটি বাংলাতে অনুবাদ করা হয়েছে "সম্মানিত" শব্দটি দ্বারা। অবশ্য 'মজিদ' একটি অত্যন্ত সুন্দর শব্দ, যার সঠিক সৌন্দর্য্য অনুবাদের মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব নয়। ; যার দ্বারা কোরাণকে ভূষিত করা হয়েছে। কোন ভাষার শব্দ দ্বারা কোরাণের দীপ্তিকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কোরাণের দীপ্তি উদিত সূর্যের ন্যায় ভাস্বর। সূর্য দিগন্তরেখা ত্যাগ করে যত উর্দ্ধে উদিত হতে থাকে ততই তার আলোর প্রখরতা ও দীপ্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কোরাণের বাণীও ঠিক তদ্রূপ ধীরে ধীরে মনের দিগন্তকে উদ্ভাসিত করে আধ্যাত্মিক তমসাকে দূর করে দেয়। কোরাণের বাণীর সৌন্দর্য্য যত হৃদয়ে ধারণ করা যায় তত এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধায় হৃদয় মন আপ্লুত হয়ে পড়ে। এর বাণীর অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট এবং চিরসত্য যা অক্ষয় এবং অবিনশ্বর। এই সত্যের সাথে যার একবার আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ঘটা সম্ভব হয়েছে, সে জানে যে, সে অভিজ্ঞতা ভোলার নয়, যা প্রকাশের ভাষা পৃথিবীর কোনও সাহিত্যিকের নাই। যত এই অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়, তত আধ্যাত্মিক চক্ষু উম্মীলিত হয় - হৃদয়ের অন্ধকার কোরাণের আলোর দীপ্তিতে ধীরে ধীরে বিদূরিত হতে থাকে। আত্মার মাঝে কোরাণের দীপ্তি ও সৌন্দর্যের বিরল অনুভূতি যার কখনও ঘটে নাই তার পক্ষে সে অনুভূতি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারও পক্ষেও সে অনুভূতি প্রকাশ করাও সম্ভব নয়। কোরাণ হচ্ছে রাসুলের (সা ) নবুয়তের উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

০২। তারা আশ্চর্য হয় যে ৪৯৪১, তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন সতর্ককারী এসেছে। সুতরাং অবিশ্বাসীরা বলে, " এটা তো বড় আশ্চর্য ব্যাপার !

৪৯৪১। কাফেরদের এই বিস্ময়বোধ করা ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার তাদেরই স্বগোত্রের একজন উদিত সূর্যের ন্যায় ভাস্বর, জোতির্ময় -এ কথা বিশ্বাস করা তাদের জন্য সত্যিই কষ্টকর। সূর্যের অস্তিত্বকে যেরূপ দিবাভাগে অস্বীকার করার উপায় নাই। অন্ধ ব্যতীত, কোনও চক্ষুষ্মান ব্যক্তি দিবাভাগে সূর্যের দীপ্তিকে যেরূপ অস্বীকার করতে পারে না, ঠিক সেরূপ কাফেররাও রাসুলের (সা ) স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্যাবলীকে অস্বীকার করতে পারছিলো না। ফলে তারা বিস্ময়ে ও অবিশ্বাসে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো।

উপদেশ : এ ভাবেই পৃথিবীতে যুগে যুগে সত্যের প্রকাশকে প্রথমেই বাঁধাপ্রাপ্ত হতে হয় তার স্বগোত্রের লোকদের দ্বারা এ ক্ষেত্রে বাংলা প্রবাদ বাক্যটি স্মরণীয় ; " গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।"

০৩। " সে কি ! আমরা যখন মরে যাব এবং ধূলিতে পরিণত হব, [ তারপর আবার পুণরায় জীবিত হব ] ? [ এ ধরণের ] প্রত্যাবর্তন আমাদের [ ধারণার ] বাইরে ৪৯৪২। "

৪৯৪২। দেখুন আয়াত [ ৩৭ : ১৬ ]।

০৪। আমি তো জানি মৃত্তিকা উহাদের কতটুকু ক্ষয় করে ৪৯৪৩। আমার নিকট সুরক্ষিত রয়েছে [ পূর্ণ হিসেবের ] নথি।

৪৯৪৩। এই নশ্বর দেহের মাঝে অমর আত্মার বাস যা পরমাত্মার অংশ। মৃত্যু পরবর্তীতে নশ্বর দেহের শুধুমাত্র ধ্বংস বা ক্ষয় ঘটে; আত্মা অমর, অবিনশ্বর। মৃত্তিকা শুধুমাত্র নশ্বর দেহকেই ধ্বংস করতে পারে। আত্মার উপরে এর কোনও ক্ষমতা বা একে ধ্বংস করার কোনও অধিকার নাই। আত্মার পার্থিব জীবনের সকল হিসাব আল্লাহ্‌র নিকট লওহে মাহ্‌ফুজে আমলনামায় রক্ষিত আছে।

০৫। তাদের নিকট সত্য আসার পরে তারা তা প্রত্যাখান করেছে। ফলে তারা রয়েছে সংশয়ে দোদুল্যমান ৪৯৪৪।

৪৯৪৪। প্রকৃত সত্যকে দেখার পরেও যদি কেউ তা অস্বীকার করে, তবে তাদের বুদ্ধি, বিবেক ও মন হয়ে পড়বে তমসাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত। বিশ্বভূবনের সকল কিছুতেই আল্লাহ্‌র মহিমা ছড়ানো। আল্লাহ্‌র কল্যাণ হস্তের স্পর্শে সকল কিছু ধন্য। প্রত্যাদেশ বা আল্লাহ্‌র প্রেরিত বাণীর মাধ্যমে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যক্ত করা হয়েছে। ইহজীবনের ভেদাভেদ, পার্থক্য, পরলোকে পূনঃর্বিন্যাস করা হবে ইহজীবনের কৃতকর্মের ভিত্তিতে। যদি কেউ আত্মার অমরত্বে ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে বুঝতে হবে সে মানব জীবন সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। তার স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারা বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। তারা চেনা জানা পার্থিব পৃথিবীর সাথে অচেনা ও অজানা পৃথিবীর সমন্বয় সাধনে অক্ষম। তাদের মন সর্বদা "সংশয়ে দোদুল্যমান " থাকবে, এই-ই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান।

০৬। তারা কি তাদের উর্দ্ধে অবস্থিত আকাশকে দেখে না ? - কিভাবে আমি তা নির্মাণ করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি। অথচ তার মধ্যে কোন ত্রুটি নাই ৪৯৪৫।

৪৯৪৫। আল্লাহ্‌র অস্তিত্বকে অনুভব করতে হবে আত্মার মাঝে। বিশ্ব প্রকৃতি ও নভোমন্ডলে সর্বত্র তাঁর হাতের কল্যাণ স্পর্শ বিদ্যমান। আল্লাহ্‌র অস্তিত্বকে আত্মার মাঝে অনুভবের জন্য অবিশ্বাসীদের সম্মুখে একটি উদাহরণ স্থাপন করা হয়েছে। তাদের লক্ষ্য করতে বলা হয়েছে কোটি কোটি তারকারাজি, ও গ্রহ নক্ষত্র শোভিত আকাশমন্ডলীর দিকে। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ও কোটি কোটি তারকারাজি ও নীহারীকাপুঞ্জ সকলকেই বিন্যস্ত করা হয়েছে এক সুনির্দ্দিষ্ট নিয়ম ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে। যার ফলে তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের গতি, শৃঙ্খলা ও নিয়মের মাঝে নিজ নিজ শৃঙ্খলা রক্ষা করে অসীম মহাশূন্যে ছুটে চলেছে। বিজ্ঞান বলে যে, এই নিয়ম ও শৃঙ্খলার মাঝে গণিত বিদ্যার সর্বোচ্চ নির্যাস বিদ্যমান যার প্রকৃত অনুধাবনে হৃদয় হয় এ সবের স্রষ্টার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধায় আপ্লুত। " তার মধ্যে কোনও ত্রুটি নাই" - বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে নভোমন্ডলের গাণিতিক বিন্যাসে আল্লাহ্‌র জ্ঞানের মাঝে কোনও রূপ বৈষম্য ও বিভাজন লক্ষ্য করা যায় না।

০৭। এবং পৃথিবী, আমি তাকে বিস্তৃত করেছি, এবং তাতে স্থাপন করেছি সুদৃঢ় পর্বতমালা ৪৯৪৬এবং তাতে সব রকমের সুন্দর সুন্দর জিনিষ উৎপন্ন করেছি [ জোড়ায় জোড়ায় ] ৪৯৪৭ -

৪৯৪৬। দেখুন [ ১৩ : ৩ ] আয়াত এবং [ ১৫ : ১৯ ] আয়াত ও টিকা ১৯৫৫। পৃথিবী যদিও গোল্‌ তবুও এর আয়তনের তুলনায় মানুষের অস্তিত্ব এত ক্ষুদ্র যে পৃথিবীর ভূমিকে মানুষের নিকট মনে হয় বিস্তৃত সমতল। কার্পেটকে যেরূপ পেরেকের মাধ্যমে স্বস্থানে সন্নিবেশিত করা হয়। পর্বতমালা ঠিক সেরূপ পৃথিবীর বিস্তৃত ভূমিকে স্বস্থানে রাখতে সাহায্য করে।

৪৯৪৭। দেখুন [ ২২ : ৫ ] ও টিকা ২৭৭৭। [ ১৩ : ৩ ] আয়াতের টিকা ১৮০৪ এ আভাষ দান করা হয়েছে উদ্ভিদ জগতের যৌনতা সম্বন্ধে।
০৮। আল্লাহ্‌র দিকে অভিমুখী প্রত্যেক ভক্ত বান্দার জন্য জ্ঞান ও উপদেশ স্বরূপ ৪৯৪৮।

৪৯৪৮। সৃষ্টির বিভিন্ন বস্তু " আল্লাহ্‌র অনুরাগী " দের আত্মার মাঝে; হৃদয়ের মাঝে গভীর " আল্লাহ্‌ প্রেম" ও ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে থাকে। তাঁরা এসব সৃষ্ট বস্তুর সম্বন্ধে চিন্তা করতে ভালোবাসে। প্রকৃতির সৃষ্ট বস্তুর সম্বন্ধে চিন্তা করা এবং তাদের প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করাই হচ্ছে "বিজ্ঞানের" জ্ঞান। সুতারাং যারা বিজ্ঞানের সাধনা করে এবং এই সাধনা লব্ধ জ্ঞানকে আল্লাহ্‌র অসীম ক্ষমতার ক্ষুদ্র প্রকাশরূপে অনুধাবন করে তারাই প্রকৃতরূপে আল্লাহ্‌র বিমূর্ত ধারণাকে আত্মার মাঝে অনুধাবন করে। সে ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যক্তির জন্য "উপদেশ স্বরূপ"।

মন্তব্য : অনেকেরই ধারণা বিজ্ঞানের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধ বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টার বিমূর্ত ধারণাকে হৃদয়ের মাঝে মূর্তরূপে উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই বিজ্ঞানের জ্ঞানকে জানতে হবে। তবেই স্রষ্টার বিশালত্ব, ক্ষমতা, শিল্পসত্তা প্রতিদিনের জীবনে তাঁর কল্যাণকে অনুধাবন করা সম্ভব। এই আয়াতের মাধ্যমে এই সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে।

০৯। এবং আমি আকাশ থেকে কল্যাণকর বৃষ্টি প্রেরণ করি, এবং তা দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান এবং পরিপক্ক শস্যরাজি ;

১০। এবং সুউচ্চ [ রাজকীয়] পাম বৃক্ষ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফলের বৃন্ত স্তরে স্তরে স্তুপিকৃত করা ; - ৪৯৪৯

১১। আল্লাহ্‌র বান্দাদের জন্য জীবিকা স্বরূপ। এই [ বৃষ্টি ] দ্বারা আমি মৃত ভূমিকে [ নূতন ] জীবন দান করি। এরূপই হবে [কেয়ামতের দিনের ] পুণরুত্থান।

৪৯৪৯। প্রাকৃতিক বর্ণনার কি অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে এই আয়াতগুলিতে। যে কখনও আরবের মরুদ্যানের গ্রীষ্মের ও বসন্তের রূপ দর্শন করেছে - সেই একমাত্র অনুধাবন করতে পারবে এই আয়াতগুলির অবিস্মরণীয় চিত্র লেখাকে।

১২। তাদের পূর্বে নূহের জাতি, রাস্‌স ও সামুদ সম্প্রদায় [ পরলোককে ] অস্বীকার করেছিলো ৪৯৫০,

৪৯৫০। আরবের সম্প্রদায়কে যাদের আল্লাহ্‌ তাদের পাপের দরুণ শাস্তি প্রদান করেছিলেন - শুধুমাত্র তাদের নামের উল্লেখ করা হয়েছে এই আয়াতগুলিতে। তাদের কাহিনীর উল্লেখ আছে অন্যান্য সূরাতে। নিম্নোক্ত সূরাগুলির মধ্যে : নূহের সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন [ ১১ : ২৫ - ৪৮ ] আয়াত এবং অন্যান্য আয়াত সমূহে। রাস্‌স সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন [ ২৫ : ৩৮ ] আয়াত ও টিকা ৩০৯৪। আ'দ ও সামুদ সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন [ ২৬ : ১২৩ - ১৫৮ ] আয়াত ও অন্যান্য আয়াত সমূহ। ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন [ ২ : ৪৯ - ৫০ ] আয়াত ও আয়াত সমূহ। লূতের সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন [ ৭ : ৮০ - ৮৪ ] আয়াত ও অন্যান্য আয়াতসমূহ। আয়কার অধিবাসীদের জন্য দেখুন [ ১৫, ৭৮ - ৭৯ ] আয়াত ও টিকা ২০০০। এবং তুব্বা সম্প্রদায়ের জন্য দেখুন [ ৪৪ : ৩৭ ] আয়াত ও টিকা ৪৭১৫।

১৩। আ'দ,ফেরাউন এবং লূতের ভাইগণও [ সেরূপ করেছিলো ],

১৪। অরণ্যের অধিবাসীরা এবং তুব্বার লোকেরা, [ তাদের ] প্রত্যেকেই রসুলদের প্রত্যাখান করেছিলো, ফলে তাদের প্রতি আমার প্রতিশ্রুতিও পূর্ণ হয়েছিলো।

১৫। তবে কি আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেই [ এতটাই ] ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে তারা নূতন সৃষ্টি সম্বন্ধে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে পতিত হয় ? ৪৯৫১
৪৯৫১। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৪৬ : ৩৬ ] ; ও টিকা ৪৯১২।

রুকু - ২

১৬। আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি, এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি ৪৯৫২। কেন না আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী [ Jagular vein ] অপেক্ষাও নিকটতর।

৪৯৫২। শরীরবৃত্তির দিক থেকে মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য খুব কম। পশুর সাথে মানুষের মূল পার্থক্য হচ্ছে, আল্লাহ্‌ মানুষকে বুদ্ধি দান করেছেন এবং সেই বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যবহারের জন্য সীমিত আকারে " স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি " দান করেছেন। এই ইচ্ছাশক্তি ব্যবহারের সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির মানসিক অবস্থা বিভিন্ন হয়ে থাকে। আল্লাহ্‌ মানুষের অন্তঃস্থলের অন্তরের খবর রাখেন। মানুষের চিন্তার জগতের কিছুই তাঁর নিকট অজ্ঞাত থাকে না। আল্লাহ্‌ মানুষের অন্তঃস্থলের অন্তরের খবর রাখেন। মানুষের মস্তিষ্ককে যদি এক বিরাট কম্পিউটারের সাথে তুলনা করা হয়, তবে কম্পিউটারের বিভিন্ন বোতামের মাধ্যমে যেমন বিশ্বব্যপী সংবাদের আদান প্রদান ও রক্ষণাবেক্ষণ ঘটে এক মূহুর্তের মধ্যে, ঠিক সেরূপ মানুষের মস্তিষ্করূপ কম্পিউটারের মাধ্যমে চিন্তা জগতের সকল তথ্য, তত্ব, উদ্দেশ্য সব কিছু মূহুর্তের মাধ্যমে লওহে মাহ্‌ফুজে রক্ষিত হয়ে চলেছে। সুন্দর উপমার সাহায্যে এই বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রীবাস্থিত ধমণীকে বলা হয়, " জাগুলার ধমনী" যা হৃদপিন্ড থেকে মস্তিষ্কে এবং মস্তিষ্ক থেকে হৃদপিন্ডে রক্ত বহনকারী প্রধান শিরা। রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে জীবনের প্রধান শর্ত যা মানুষকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা দান করে। মস্তিষ্ক হচ্ছে বুদ্ধিমত্তার প্রধান কেন্দ্র, যা মানুষকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণীতে পরিণত করেছে। জাগুলার ধমনী হচ্ছে মানুষের প্রাণের অস্তিত্বের অত্যন্ত কাছাকাছি। এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ্‌ মানুষের মনোজগতে গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটবর্তী। "গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটবর্তী " এই বাক্যটি দ্বারা এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে, মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থিত সকল সংবাদ আল্লাহ্‌ সর্বদা অবহিত। আমাদের অনুভূতি, চিন্তা -ধারা, বিবেক, আত্ম-গরিমা, অহংকার, সুক্ষ অনুভূতি যা অনেক সময়েই আমাদের চেতন মনে ধরা পড়ে না যা আমাদের অবচেতন মনেরই বহিঃপ্রকাশ, তাও আল্লাহ্‌র নিকট গোপন থাকে না।

১৭। স্মরণ রেখো, দুজন [ অভিভাবক ফেরেশতা ] হিসাব গ্রহণ করে, মানুষের সমস্ত পাপ পূণ্য লিখে নেয়; একজন বসে ডানদিকে, অন্যজন বামদিকে ৪৯৫৩।

৪৯৫৩। এরা হচ্ছেন দুই ফেরেশতা, মানুষের সংগে সংগে থাকেন। ডানে যিনি আছেন তিনি পূণ্যের এবং বামে যিনি আছেন তিনি পাপের কর্ম লিপিবদ্ধ করেন। দেখুন [ ৫৬ : ২৭ ; ৪১ ] আয়াতে এদের উল্লেখ করা হয়েছে " ডান দিকের দল" এবং " বাম দিকের দল" হিসেবে। এদের আরও উল্লেখ আছে [৮২ : ১০ - ১২ ]।

১৮। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা [ লিখার ] জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে ৪৯৫৪।

৪৯৫৪। মানুষ যাই উচ্চারণ করুক না কেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য আছে " তৎপর প্রহরী" [Raqib]। এর থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে এই প্রহরী শুধুমাত্র উচ্চারিত বাক্য সমূহই লিপিবদ্ধ করেন। গুপ্ত চিন্তা, বা যা ভাবা হয়েছে কিন্তু মুখে উচ্চারণ করা হয় নাই এরূপ চিন্তা ভাবনাকে তিনি লিপিবদ্ধ করেন না। যে চিন্তা ভাবনাকে প্রকাশ করা হয় নাই বা কার্যে পরিণত করা হয় নাই, তা হয়তো আল্লাহ্‌ ক্ষমা করে দেবেন। যখনই আমরা চিন্তাকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করি তখনই তা কিছুটা হলেও কার্যে পরিণত করে থাকি। উপরে উল্লেখিত   দুজন লিপিবদ্ধকারী এবং এই আয়াতের লিপিবদ্ধকারী এই তিনজনের নথি হচ্ছে মানুষের কর্মপদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ দলিল। এর মাধ্যমে মানুষের কর্ম, চিন্তার জগত, কর্মের নিয়ত সব কিছু সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করবে। পার্থিব জগতের সকল কর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য, চিন্তার ধারা, কৃত কর্মের সকল কিছুরও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ থাকবে এই তিনজনের লিপিবদ্ধ বিবরণের মাঝে। এই বিবরণ পরলোকের বিচারের নথি বা দলিল হিসেবে উত্থাপিত হবে। এই তিনজনই হচ্ছেন মানুষের কর্মজীবনের সম্পূর্ণ বিবরণ প্রদানকারী বা "Kiraman Katibin"।

১৯। এবং মৃত্যুর হতচেতন অবস্থা [তাদের চোখের সম্মুখে ] সত্যকে তুলে ধরে, " এটাই তা যা থেকে তোমরা পলায়ন করতে।" ৪৯৫৫

৪৯৫৫। এই পৃথিবীর শিক্ষানবীশ কালে মানুষের মাঝে পরলোকের অনুভূতি থাকে অসাড় ও অচৈতন্য। মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের সম্মুখে পরলোকের দ্বার উম্মুক্ত হয়ে যায়। পার্থিব জীবন থেকে পরলোকের জীবনে প্রবেশের দরজা হচ্ছে মৃত্যু। মৃত্যুর মাধ্যমেই একমাত্র ইহলোক থেকে পরলোকে প্রবেশের ক্ষমতা লাভ করা যায়। একবার এই দ্বার অতিক্রম করলে মানুষ বুঝতে পারবে যে পার্থিব জীবন কত তুচ্ছ ও মূল্যহীন। পৃথিবীতে অবস্থানকালে পরলোকের যে জীবনকে মনে হতো অবিশ্বাস্য ও যোজন দূরের কোন সংবাদ মুত্যুর সাথে সাথেই পরলোকের জীবনকেই প্রকৃত সত্য বলে অনুভূত হবে। পৃথিবীর যে জীবনকে মনে হতো গুরুত্বপূর্ণ তা হয়ে যাবে কায়াহীন ছায়ার ন্যায় এবং অস্তিত্ববিহীন ও তুচ্ছ। যে জীবন ও যে জীবনের অস্তিত্বের প্রতি কোন প্রকৃত বিশ্বাস ছিলো না, যে জীবনকে সে অস্বীকার করে এসেছে, মৃত্যুর সাথে সাথে সেই জীবনই হবে প্রকৃত জীবনের পরিধি। পার্থিব জীবনের ভালো ও মন্দ প্রকৃতরূপে ভাস্বর হবে; সত্যকে তীব্র ভাবে অনুভব করা সম্ভব হবে। পৃথিবীতে অবস্থান কালে মানুষ মৃত্যুর সত্য থেকেই অব্যাহতি চায়।

২০। এবং শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে। উহাই হবে সেই সতর্কিত দিন ৪৯৫৬।

৪৯৫৬। জীবনের ধাপগুলি একের পরে এক প্রত্যেককে অতিক্রম করতে হয়। পৃথিবীর জীবনের পরে আসে মৃত্যু পরবর্তী জীবন। তার পর আসে শেষ বিচারের দিন। সেদিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন প্রতিটি আত্মা বিচারের জন্য উপস্থিত হবে।

২১। আর প্রত্যেক আত্মাকে উপস্থিত হতে হবে [ কৈফিয়ত দেয়ার জন্য ] ; তার সাথে থাকবে একজন চালক [ ফেরেশতা ] ও একজন সাক্ষী [ ফেরেশতা ] ৪৯৫৭।

৪৯৫৭। এই আয়াতের কয়েক প্রকার তফসীর করা হয়েছে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেষ বিচারের দিনের প্রতি নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে পার্থিব জীবনের সকল প্রকার নথিপত্র উপস্থাপিত করা হবে। সৎ কাজ ও পাপ কাজ প্রত্যেকে সাক্ষ্য দান করবে। প্রত্যেকের প্রতি প্রকৃত ন্যায় বিচার করা হবে - প্রত্যেককে প্রত্যেকের কর্মফল দেয়া হবে।

১) "চালক " ও " সাক্ষী" এরা দুজন ফেরেশতা সম্ভবতঃ এর দ্বারা দক্ষিণে ও বামে বসে লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাদের বোঝানো হয়েছে [ দেখুন এই সূরার ১৭নং আয়াত ] একজন তাকে হাশরের ময়দানে পৌঁছাবে, অপরজন তার কর্মের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে।

২) সম্ভবতঃ এর দ্বারা ফেরেশতা বোঝানো হয় নাই ; ভালো কাজ ও মন্দ কাজকে বোঝানো হয়েছে। মন্দ কাজ 'চালকের ' ন্যায় আচরণ করবে এবং ভালো কাজ বিচারের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকবে। অথবা
৩) আল্লাহ্‌র দেয়া যে সব অঙ্গ ও মানসিক দক্ষতাকে সে খারাপ কাজে ব্যবহার করেছে তারা শেষ বিচারের দিনে তাকে তার ধ্বংসের দিকে বা শেষ পরিণতির দিকে চালিয়ে নিয়ে যাবে। এখানে এসব অঙ্গ ও মানসিক দক্ষতাকে "চালক" হিসেবে বলা হয়েছে। অপরপক্ষে সৎ কাজে ব্যবহৃত অঙ্গ ও মানসিক দক্ষতা সমূহ তার জন্য সৎকাজের সাক্ষী হবে।

২২। [ বলা হবে : ] " এ সম্বন্ধে তুমি অমনোযোগী ছিলে, এখন আমি তোমার থেকে আবরণ সরিয়ে নিয়েছি, সুতারাং এখন তোমার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়েছে ৪৯৫৮।"

৪৯৫৮। মানুষকে আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন এক নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত করে। এখানেই প্রাণী জগতের সাথে মানুষের পার্থক্য। মনুষ্য জীবনের জন্য পরলোকের জীবনই হচ্ছে প্রকৃত সত্য। ইহলোকের জীবন পরলোকের জীবনের জন্য প্রস্তুতি কাল মাত্র। কিন্তু পার্থিব জীবনে মানুষ এই সত্যকে অনুধাবন করে খুব কমই। পার্থিব জীবনের চাকচিক্য তার দৃষ্টিকে করে বিভ্রান্ত ফলে প্রকৃত সত্যকে সে দেখতে হয় অক্ষম। মনের চোখ বা উপলব্ধি ক্ষমতা হয়ে পড়ে অন্ধের ন্যায়। মৃত্যুর পরে, শেষ বিচারের দিনে তাদের সম্মুখ থেকে বিভ্রান্তির পর্দা উম্মোচন করা হবে, ফলে তারা প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধিতে সক্ষম হবে। দেখুন উপরের টিকা নং ৪৯৫৫।

২৩। এবং তার সঙ্গী [ ফেরেশতা ] বলবে ৪৯৫৯ : " এই তো [ আমলনামা ] যা আমার নিকট প্রস্তুত রয়েছে। "

৪৯৫৯। 'Qarin' অর্থাৎ সঙ্গী। যদি আমরা ৪৯৫৭ নং টিকার ১) নম্বর তফসীর গ্রহণ করি তবে এই আয়াতের "সঙ্গী" শব্দটি দ্বারা ২১ নং আয়াতে যে ফেরেশতাদের উল্লেখ আছে তাদের একজনকে বোঝানো হবে। সম্ভবতঃ যিনি তাদের হাশরের ময়দানে পরিচালিত করবেন তাকেই বোঝানো হয়েছে। অথবা এই সঙ্গী শব্দটি দ্বারা তৃতীয় আর একজন ফেরেশতা যার উল্লেখ আছে ১৮ নং আয়াতে, এবং যার কাছে 'আমলনামা ' প্রস্তুত আছে তাঁকে বোঝানো হয়েছে। ৪৯৫৭ নং টিকার ১) নম্বর তফসীর বাদে যদি আমরা অন্য তফসীর গ্রহণ করি তবে 'সঙ্গী' শব্দটি দ্বারা মন্দ বা পাপ কাজকেই বোঝানো হবে অথবা বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক দক্ষতা সমূহের অপব্যবহারকেই বোঝানো হবে। যে কোনও তফসীরকেই আমরা গ্রহণ করি না কেন এই 'সঙ্গী ' -ই হবেন হাশরের ময়দানের বিচারের প্রামাণিক সাক্ষ্য।

২৪। [ দণ্ডাদেশ হবে ] " নিক্ষেপ কর, নিক্ষেপ কর জাহান্নামে, প্রতিটি অবাধ্য প্রত্যাখানকারীকে, - ৪৯৬০

২৫। " যে ভালো কাজে বাঁধা দান করেছিলো,সকল সীমাকে লংঘন করেছিলো, [আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে ] সন্দেহ ও অবিশ্বাস পোষণ করেছিলো ;-

২৬। " যে আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করেছিলো। এখন তাকে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।"

৪৯৬০। "নিক্ষেপ কর " শব্দটি দুবার ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক তফসীরকারদের মতে এর দ্বারা বক্তব্যকে জোরালো ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আরবীতে ভাষার এরূপ ব্যবহার বিদ্যমান। অপরপক্ষে, অন্যভাবেও এর ব্যাখ্যা করা যায়। ১৭ নং ও ২১ নং আয়াতে যে দুজন ফেরেশতাদের উল্লেখ আছে তাদের যুগ্মভাবে সম্বোধন করার জন্য দুবার "নিক্ষেপ কর " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

২৭। তার সঙ্গী [শয়তান ] বলবে ৪৯৬১ : " হে আমাদের প্রভু ! ৪৯৬২ আমি তাকে সীমালংঘন করতে বলি নাই ৪৯৬৩। বরং সে নিজেই [নিজেকে ] বিপথে চালিত করেছে।"

৪৯৬১। "সঙ্গী শয়তান" দ্বারা পৃথিবীতে মন্দ সঙ্গীদের বোঝানো হয়েছে, যারা কাফির [ আয়াত নং ২৪ ]; কল্যাণকর কাজে বাধাদানকারী ; সীমালঙ্ঘনকারী; সন্দেহ পোষণকারী [ আয়াত নং ২৫ ] এবং আল্লাহ্‌র সাথে অন্য ইলাহ্‌ গ্রহণকারী [ আয়াত নং ২৬ ] এদেরই সহচর শয়তানরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এক কথায় যা কিছু মন্দ যা মানুষকে কুপথে বা পাপের পথে প্ররোচিত করে তাই-ই হচ্ছে শয়তান।

৪৯৬২। শয়তান এখানে " হে আমাদের প্রভু " বাক্যটি দ্বারা আল্লাহ্‌কে সম্বোধন করেছে যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে সে স্বীকার করে যে আল্লাহ্‌ বিচার প্রার্থী সকলের ও বিশ্বজগতের সকল কিছুর প্রতিপালক ও প্রভু এবং শয়তানেরও প্রভু।

৪৯৬৩। প্রতিটি মানুষ তার কৃতকর্মের ফলাফলের জন্য দায়ী। কারণ মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির " ব্যবহার মানুষের ইচ্ছাধীন। সে ভালোকে গ্রহণ করবে ও মন্দকে প্রত্যাখ্যান করবে, না মন্দকে গ্রহণ করবে ও ভালোকে প্রত্যাখ্যান করবে এটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। এই স্বাধীনতা আল্লাহ্‌ তাঁকে দান করেছেন - যার হিসাব তাকে স্রষ্টার নিকট পেশ করতে হবে। কোনও লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা বা অপব্যবহারকারী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা বিবেক বা অন্য কিছু কাউকেই সে তার কর্মের জন্য দায়ী করতে পারবে না। প্রত্যেকের প্রতিটি কাজ তার ব্যক্তিগত দায় দায়িত্ব।

২৮। আল্লাহ্‌ বলবেন, " আমার উপস্থিতিতে তোমরা পরস্পর বাক্‌ -বিতন্ডা করো না ৪৯৬৪। আমি তো পূর্বেই তোমাদের সর্তক করেছি ৪৯৬৫।

৪৯৬৪। শেষ বিচারের দিনে, যাদের কর্মের রেকর্ড হবে অন্ধকার বা পাপে আচ্ছন্ন, তারা যথারীতি তাদের কর্মের জন্য জাগতিক বহু ব্যাপারকে 'দায়ী করবে যেমন : লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মানসিক দক্ষতা সমূহ অথবা সুযোগ সুবিধা সমূহ, পরিবেশ অথবা সঙ্গী-সাথী ইত্যাদি যা তাদের পার্থিব জগতে বিদ্যমান ছিলো। এরূপ পাল্টা অভিযোগ ও বাক্‌ -বিতন্ডা সেই বিচার সভায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেয়া হবে।

৪৯৬৫। বাক্‌-বিতন্ডা নিষিদ্ধ করা ব্যতীত তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে, তাদের ব্যক্তিগত দায় -দায়িত্বের কথা। প্রত্যেকে তাদের স্ব স্ব কর্ম ফলের জন্য দায়ী থাকবে।

২৯। " আমার কথার রদবদল হয় না, এবং আমি আমার বান্দাদের প্রতি বিন্দু মাত্র অন্যায় করি না ৪৯৬৬।"

৪৯৬৬। হাশরের ময়দানে বিচারের রায় হবে সম্পূর্ণ ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। কারও প্রতি কোনও অবিচার করা হবে না। এর কোনও রদবদল হবে না পাপের শেষ পরিণতি অবশ্য ঘটবে। কারণ আল্লাহ্‌র করুণা লাভের সময় তখন অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।

রুকু - ৩

৩০। সেই দিন আমি জাহান্নামকে জিজ্ঞাসা করবো, " তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ ? " জাহান্নাম বলবে, " আরও বাকী আছে কি ? " ৪৯৬৭

৪৯৬৭। আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণা যেমন সীমাহীন, ঠিক তদ্রূপ হচ্ছে তাঁর শাস্তির পরিধি। শাস্তির প্রতীক হচ্ছে জাহান্নাম। জাহান্নামকে জিজ্ঞাসা করা হবে "তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ ? " জাহান্নাম বলবে, "আরও কি আছে, অর্থাৎ তা হলে তাদের আসতে দাও।" যেনো বলতে চায় যে "আমি এখনও পরিতৃপ্ত নই।"

৩১। আর পূণ্যাত্মাদের জন্য জান্নাতকে নিকটস্ত করা হবে, - কোন দূরত্ব থাকবে না ৪৯৬৮।

৪৯৬৮। পার্থিব জীবনের সাথে পারলৌকিক জীবনের চাওয়া পাওয়ার পার্থক্যকে এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পার্থিব জীবনে আমাদের কাঙ্খিত বস্তু, আশা- আকাঙ্খার পরিপূর্ণতা লাভ করতে বহু উদ্যোগ, উদ্দীপনা, উৎসাহ, পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। তার পরেও তা সব সময়ে সফলতা লাভ করে না। কিন্তু পরলোকে মুত্তাকীদের জীবন হবে ভিন্নরূপ। তাদের ঈমান ও পূণ্যকাজের ফল তারা সেখানে খুবই নিকটস্থ দেখতে পাবে, জান্নাত হচ্ছে সুখ-শান্তি, আনন্দ, আশা আকাঙ্খা পরিপূর্ণতার প্রতীক। মুত্তাকী ও এগুলির মধ্যে কোনও দূরত্ব থাকবে না।

৩২। [বলা হবে ] : " ইহারই প্রতিশ্রুতি তোমাদের প্রত্যেককে দেয়া হয়েছিলো, - যারা প্রকৃত অনুতাপের মাধ্যমে [আল্লাহ্‌র দিকে ] ফিরে আসে, তাঁর হুকুম পালন করে ৪৯৬৯ -

৪৯৬৯। পূণ্যাত্মা বা মুত্তাকী ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য চারটি দক্ষতাপূর্ণ উপবাক্য দ্বারা সুনিপুনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে :

১) যারা পাপ ও মন্দ থেকে নিজেকে রক্ষা করে এবং আন্তরিক অনুতাপের মাধ্যমে আত্ম সংশোধন করে থাকে।

২) যারা তাদের নূতন জীবনকে আল্লাহ্‌ অভিমুখী অর্থাৎ সৎভাবে নির্বাহ করে।

৩) যারা না দেখেও আল্লাহকে ভয় পায়, অর্থাৎ যারা সর্বদা অন্তরের মাঝে আল্লাহ্‌র উপস্থিতি অনুভব করে। তাঁদের সকল কর্ম প্রেরণার উৎস আল্লাহ্‌ প্রেম। তাঁদের আল্লাহ্‌ - ভীতি, আল্লাহ্‌ প্রেমেরই সমতুল্য। তাঁরা সর্বদা আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে করুণা ও দয়ার প্রতীকরূপে। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ স্মরণে তাঁদের হৃদয় মন আপ্লুত - আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাঁরা থাকে সর্বদা সচেষ্ট। [ ৫০ : ৩৩ ]

৪) "ভক্তিপ্লুত হৃদয়কে উপস্থাপন করে" - অর্থাৎ যারা তাঁদের হৃদয়, মন, এক কথায় সর্বসত্তা আল্লাহ্‌র নিকট সমর্পন করবে অর্থাৎ সম্পূর্ণ আত্মসমর্পনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হবে। [ ৫০ : ৩৩ ]

৩৩। " যে পরম করুণাময় [আল্লাহ্‌কে ] না দেখে ভয় করে এবং [ তাঁর নিকট ] ভক্তিপ্লুত হৃদয়কে উপস্থাপন করে ; ৪৯৭০ -

৪৯৭০। দেখুন [ ৩৬ : ১১ ] আয়াত ও টিকা ৩৯৫২ ; এবং [ ৩৫ : ১৮ ] আয়াত ও টিকা ৩৯০২।
৩৪। " তোমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে উহাতে প্রবেশ কর ৪৯৭১ ; এটাই অনন্ত জীবনের দিন।"

৪৯৭১। ইসলামের অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে এক কথায় এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে : শান্তি, নিরাপত্তা, প্রীতি সম্ভাষণ ও আল্লাহ্‌র ইচ্ছা বা পরিকল্পনার নিকট আত্মসমর্পন যা অনন্ত কাল ব্যপী বিরাজমান থাকবে।

৩৫। সেখানে তারা যা কামনা করবে তাই-ই পাবে, এবং আমার নিকটে [ তাদের জন্য ] আরও বেশী আছে ৪৯৭২।

৪৯৭২। পার্থিব জীবনে চাওয়া ও পাওয়ার আকাঙ্খা মানুষকে সারাটা জীবন তাড়না করে ফেরে। না পাওয়ার বেদনা, আশাভঙ্গের হতাশা জীবনকে করে তোলে বিক্ষিপ্ত,সুখহীন, তৃপ্তিহীন। মুত্তাকীদের বলা হয়েছে, বেহেশতে তাদের পবিত্র সকল আশা আকাঙ্খাকে তৃপ্তি দান করা হবে। সেখানে সকল চাওয়া-পাওয়ার পরিসমাপ্তির শেষে অনন্ত শান্তি লাভ করবে। সকল চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে হচ্ছে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভ করা। আল্লাহ্‌র নূরের আলোকে তাদের জগত হবে আলোকিত ধন্য। " আমার নিকট আরও বেশী আছে।"

৩৬। আমি তাদের পূর্বে আরও কত মানব গোষ্ঠিকে ধ্বংস করেছি [তাদের পাপের জন্য ], - যারা ছিলো তাদের অপেক্ষা অধিক ক্ষমতাবান ৪৯৭৩। তারা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াত। তারা পালাবার কোন স্থান পেয়েছিলো কি ?

৪৯৭৩। মুত্তাকী বা পূণ্যাত্মাদের বা গুণসম্পন্ন যারা তাদের পুরষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, দেখুন [২৬ : ৮৯], [ ৩৭ : ৮৪ ], [ ৫০: ৩৩ ] আয়াত সমূহ। অপর পক্ষে যারা পাপী ও শুধুমাত্র পার্থিব জীবনকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে তাদের শেষ পরিণতি কি ? তাদের পরিণতি পৃথিবীর অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলা হয়েছে। কবির ভাষায়, " হে অতীত তুমি কথা কও যুগে যুগে।" কত শক্তিশালী জাতি, জনপদ, সময়ের পরিক্রমায় বিলিন হয়ে যায় - শুধু রয়ে যায় তাদের গল্প কাহিনী। তাদের পতনের ইতিহাস একটাই - আর তা হচ্ছে তাদের পাপ কাজ। পাপের পরিণতিকে বাধা দিতে সক্ষম কেউ নয়। এ কথা পার্থিব জীবনের জন্য যেমন সত্য, ঠিক তদ্রূপ সত্য পারলৌকিক জীবনের জন্য। পরলোকের জীবনে পাপীদের পরিণতি ইহলোক অপেক্ষা আরও নিকৃষ্ট যার বর্ণনা করা হয়েছে ২৪ - ২৫ নং আয়াতে।

৩৭। অবশ্যই এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার [আন্তরিক ] হৃদয় এবং বোঝার ক্ষমতা আছে অথবা যে শ্রবণ করে নিবিষ্ট চিত্তে ৪৯৭৪।

৪৯৭৪। "যার আছে আন্তরিক হৃদয় এবং বোঝার ক্ষমতা" - এই বাক্যটি এক অত্যন্ত গূঢ় অর্থবোধক বাক্য, যা অত্যন্ত উচ্চ আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করে। যে অন্তঃকরণ বিশুদ্ধ, বিনীত এবং বোধশক্তিসম্পন্ন, একমাত্র সেই অন্তঃকরণ পারে আল্লাহ্‌র নিদর্শন সমূহ বিশ্বচরাচরে প্রত্যক্ষ করতে; সেই অন্তঃকরণ পারে আল্লাহ্‌র বাণীর প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে শিক্ষা গ্রহণ করতে। একমাত্র সেই পারে আল্লাহ্‌ তাঁর বাণীর মাধ্যমে যে শিক্ষা বা উপদেশ দিতে চান তা প্রকৃত ভাবে উপলব্ধি করতে ও চিন্তা করতে। এরা অত্যন্ত উচ্চ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি। আল্লাহ্‌র দেয়া উপদেশ দ্বারা সাধারণ ব্যক্তিও উপকৃত হতে পারে যদি তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্‌র বাণীর মর্মার্থ উপলব্ধি করার জন্য চেষ্টা করে; নিবিষ্ট চিত্তে তা শ্রবণ করে। শান্ত নির্জন পরিবেশে একা আয়াতসমূহ নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করা যায়। এই শ্রবণ হতে হবে আন্তরিক - অর্থ বুঝে এবং বোঝার চেষ্টা করে। অন্তরকে অনুপস্থিত রেখে বা না বুঝে কোরাণ তেলওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র বাণীর প্রকৃত মর্মার্থ আত্মার মাঝে ধারণ করা সম্ভব নয়।

উপদেশ : আরবীতে কোরাণ পড়ার সাথে সাথে মাতৃভাষাতে তার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করা আল্লাহ্‌র হুকুম ও অনুগ্রহ লাভের উপায়। আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের এই একমাত্র পন্থা।

৩৮। আমি আকাশমন্ডলী ৪৯৭৫ ও পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যবর্তী সকল কিছু সৃষ্টি করেছি ছয় দিনে ৪৯৭৬। আমাকে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করে নাই ৪৯৭৭।

৪৯৭৫। এ কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর দিন বা সূর্যদয় ও সূর্যাস্তই একমাত্র সময়ের মাপকাঠি নয়। এই বিশাল নভোমন্ডল, পৃথিবী ও এর অন্তর্বর্তী সকল কিছু ছয়টি ধাপে সম্পন্ন করা হয় যা আমাদের ধারণায় সুদীর্ঘ কাল। সময়ের সাথে সাথে সকল কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। সুতারাং পরবর্তী আয়াতে রাসুলকে উপদেশের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ বিশ্ব মানব শ্রেণীকে এই উপদেশ দান করেছেন যে, যদি কাঙ্খিত 'ভালো' কিছু আমাদের জীবনে না ঘটে, তবে আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভর করে আমরা যেনো ধৈর্য ধারণ করি কারণ বিশ্ব প্রকৃতির ন্যায়, প্রকৃত কল্যাণও সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় আগত হয়। সে সময়ে আমাদের সকল ইচ্ছাকে প্রতিপালকের ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করে তাঁরই সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করতে হবে। অন্তরে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, সকল কল্যাণের উৎস সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌।

৪৯৭৬। দেখুন [ ৭ : ৫৪ ] আয়াত ও টিকা ১০৩১ ; এবং [ ৪১ : ১২ ] আয়াত ও টিকা ৪৪৭৭।

৪৯৭৭। দেখুন [ ৩৫ : ৩৫ ] আয়াত।

৩৯। অতএব, তারা যা কিছু বলে, তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং তোমার প্রভুর প্রশংসা কীর্তন কর, সূর্যদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে, ৪৯৭৮

৪৯৭৮। শয়নে স্বপনে সর্বদা আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করতে হবে। আল্লাহ্‌র নাম স্মরণে অন্তরের অন্ধকার বিদূরিত হয়ে আত্মা কলুষমুক্ত হয়। তবে র্সবাপেক্ষা উত্তম সময় হচ্ছে সূর্যদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে বৈকাল বেলা এবং রাত্রির কিছু অংশ যখন বিশ্ব প্রকৃতি দিনের কোলাহল মুক্ত হয়ে নিঃশব্দ বিশ্রামের কোলে ঢলে পড়ে। এরূপ সময়ে আধ্যাত্মিক ভাবে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের উপযুক্ত সময়। পরবর্তীতে মদিনাতে এই সময়গুলিকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে রূপান্তরিত করা হয়। ফজর হচ্ছে সূর্যাস্তের পূর্বে, জোহর এবং আসর হচ্ছে সূর্য মধ্যাহ্ন অতিক্রম করার পরে সূর্যাস্তের পূর্বে ; মাগরিব ও এশা হচ্ছে রাত্রের এবাদত।

৪০। এবং তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর রাত্রির একাংশে এবং সালাতের পরেও ৪৯৭৯।

৪৯৭৯। "সালাতের পরেও " - বাক্যটির অর্থ ফরজ নামাজ বা সালাত আদায়ের পরেও আল্লাহ্‌র ধ্যানে নিমগ্ন হও। তফসীরকারগণ মনে করেন যে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায়ের পর অতিরিক্ত নামাজ আদায়ের প্রয়োজন আছে যা নফল নামাজ নামে অভিহিত করা হয়।

৪১। এবং শোন,যেদিন এক ঘোষণাকারী নিকটবর্তী স্থান থেকে আহ্বান করবে৪৯৮০, ৪৯৮১, -

৪০৮০। পুণরুত্থানের দিনকে এখানে " যেদিন " নামে অভিহিত করা হয়েছে। সেদিন প্রতিটি আত্মাকে পুনরুত্থানের জন্য আহ্বান করা হবে এবং বিচার সভায় তৎক্ষণাত উপস্থিত হওয়ার জন্য আদেশ দেয়া হবে। তৎক্ষণাত প্রতিটি আত্মা সে আদেশ মান্য করতে বাধ্য থাকবে। দেখুন আয়াত [ ৩৬ : ৪৯- ৫৩ ] ও টিকা ৩৯৯৭ এবং ৩৯৯৯।

৪৯৮১। মানুষ পার্থিব জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধে তার চিন্তা করারও অবসর নাই। পরলোকের জীবনকে তার কাছে মনে হয় সূদূর পরাহত। কিন্তু পুনরুত্থানের পর সে জীবনকে আর সূদূর পরাহত মনে হবে না। সে জীবনকে দূরে ভাবার মত স্থান বা সময় তারা আর পাবে না।

৪২। যেদিন মানুষ অবশ্যই [ প্রচন্ড ] বিষ্ফোরণ শুনতে পাবে ; সেদিনই হবে পুনরুত্থানের দিন ৪৯৮২।

৪৩। অবশ্যই আমিই জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই ; এবং আমার নিকট হচ্ছে শেষ প্রত্যাবর্তন -

৪৯৮২। 'Saihatun' শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে বিস্ফোরণ। এই শব্দটি দ্বারা এখানে পুনরুত্থানের সময়কে বোঝানো হয়েছে। অথবা [ ১১ : ৬৭ ] আয়াতে এই শব্দটি দ্বারা পৃথিবীর বুকের হঠাৎ শস্তিকে বোঝানো হয়েছে।

৪৪। যেদিন পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে যাবে ৪৯৮৩, এবং মানুষ ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করবে, এই সমবেত সমাবেশকরণ আমার জন্য সহজ ৪৯৮৪।

৪৯৮৩। পুনরুত্থান দিনের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, সেদিন প্রতিটি আত্মা পৃথিবীর সর্বপ্রান্ত থেকে দ্রুত বের হয়ে আসবে। পৃথিবী সেদিন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে পড়বে। দেখুন আয়াত [ ২৫ : ২৫ ] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আকাশ বিদির্ণ হয়ে যাবে; এবং ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে অগ্রসর হবে। দেখুন [ ৮৪ : ১- ৪ ] আয়াতের টিকা ৩০৮২।

৪৯৮৪। পৃথিবীর ধ্যান ধারণাতে অভ্যস্ত থাকার ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য যে কিভাবে এই সুবিশাল মানুষ জাতি - তাদের বিভিন্ন সময়ে মৃত্যু হওয়া এবং বিভিন্ন পরিবেশে ও সময়ে অবস্থান সত্বেও তাদের সকলকে মূহুর্তের মাঝে এক স্থানে, একই সময়ে সমবেত করা সম্ভব হবে। কিন্তু পরলোকের সে পৃথিবী হবে সম্পূর্ণ এক নূতন পৃথিবী, যার নিয়ম কানুন, সৃষ্টি, ধ্বংস সবই হবে সম্পূর্ণ নূতন আইনের বা নিয়মের অধীনে যার সম্বন্ধে আমাদের তিলমাত্র ধারণাও নাই, দেখুন আয়াত [১৪:৪৮]। আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান - তাঁর পক্ষে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত সহজ।

৪৫। ওরা যা বলে তা আমি ভালোভাবেই জানি ৪৯৮৫ ; তুমি ওদের উপরে জবরদস্তিকারী নও। সুতারাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কুর-আনের সাহায্যে উপদেশ দান কর।

৪৯৮৫। পার্থিব জগত সম্বন্ধে যারা অত্যন্ত বাস্তববাদী তারা অনেক সময়েই পরলোকের জীবন সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে থাকে। তারা বিশ্বাস করতে চায় না যে পৃথিবীর সকল কাজের হিসাব নিকাশের সময় হবে পরলোকে শেষ বিচারে দিনে। ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে অন্তরের ধন। উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে সে বিশ্বাস অর্জন করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ্‌ রাসুলকে ( সা ) সম্বোধন করে এই আয়াতে বলেছেন যে, ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নাই। রাসুলের ( সা ) দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী বা কোরাণের আয়াত সমূহ মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। যারা আল্লাহ্‌র হুকুম সমূহ শুনতে চায়; বিশ্বাস করার মত উপযুক্ত আধ্যাত্মিক অবস্থা যাদের বিদ্যমান তাদের কোরাণের বাণীর সাহায্যে আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করার জন্য রাসুলকে বলা হয়েছে। পৃথিবীর জীবনই শেষ কথা নয় - মানুষের জন্য আছে মহত্তর, উচ্চতর জীবনের সন্ধান - পরলোকে। কোরাণ আমাদের সেই জীবনের সন্ধান দান করে। কোরাণকে প্রকৃত অর্থে হৃদয়ঙ্গম করলেই ধর্মের পথ সহজ, মসৃণ ও সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে উপনীত হওয়া সম্ভব। সুতারাং কোরাণ শরীফকে অর্থ বুঝে আরবীর সাথে সাথে মাতৃভাষাতে পড়তে হবে ও গভীর ভাবে চিন্তার মাধ্যমে তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হবে - তবেই ধর্মের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ে হবে ভাস্বর। আল্লাহ্‌র বাণীর নূরে আত্মা হবে আলোকিত।