+
-
R
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : মক্কাতে অবতীর্ণ সাতটি সূরার শ্রেণীর এটি তৃতীয় সূরা। দেখুন শ্রেণীর ১ নম্বর সূরার ভূমিকা।
পূর্ববর্তী সূরার ন্যায় এটি মক্কাতে ইসলামের প্রথম আবির্ভাবের সময়ে অবতীর্ণ হয়। যে বিষয়গুলির উপরে এই সূরাতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ : প্রত্যাদেশ হচ্ছে আল্লাহ্র নিদর্শন, এর মধ্যে পূর্ববর্তী সময়ে যে সব প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে তাও অন্তর্গত। পারলৌকিক জীবন অবশ্য সত্য এবং আমাদের সে জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা অবশ্য কর্তব্য।
সার সংক্ষেপ : পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশসহ সকল প্রত্যাদেশ আল্লাহ্র নিদর্শন। ভালো কাজ ও মন্দ কাজের উপযুক্ত প্রতিফল বিদ্যমান। কিভাবে মানুষ প্রত্যাদেশের সত্যকে অস্বীকার করে ? [ ৫২ : ১ - ৪৯ ]।
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৫০৩৭। এখানে পাঁচটি জিনিষের শপথ করা হয়েছে। আয়াত ১ - ৬ পর্যন্ত পাঁচটি নিদর্শনের প্রতি আবেদন করা হয়েছে। আয়াত নং ৭ - ২৮ পর্যন্ত মৃত্যু পরবর্তী পারলৌকিক জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যা তিন ভাগে উপস্থাপন করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে এই চেনা জানা পৃথিবী অদৃশ্য হয়ে যাবে [ ৭-১০ আয়াত ] ; পাপীরা পাপের শাস্তি ভোগ করবে [ ১১ - ১৬ আয়াত ] ; পূণ্যাত্মারা ভবিষ্যতে আল্লাহ্র ক্ষমা ও ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করবে অপার শান্তির মাধ্যমে। [ ১৭- ২৮ ] আয়াত ]
৫০৩৮। দেখুন উপরেরর টিকা, যে পাঁচটি নিদর্শনের শপথ করা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে : ১) তূর পর্বতের [ আয়াত ১ ] ; ২) উম্মুক্ত পত্রে লিখিত কিতাবের [ আয়াত ২ - ৩ ] ; ৩) বায়তুল মামূরের [ আয়াত ৪ ] ; ৪) সমুন্নত আকাশের [ আয়াত ৫ ] ; এবং ৫) উদ্বেলিত সমুদ্রের [ আয়াত ৬ ]।
১) এগুলির ব্যাখ্যা নিম্নরূপ : প্রতিটি নিদর্শন আক্ষরিক অর্থের সাথে সংযুক্ত। তূর পর্বতে বা সিনাই পর্বতে হযরত মুসা তাঁর প্রতি আল্লাহ্র প্রেরিত প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন ; দেখুন [৯৫ : ২ ] আয়াত, যেখানে পবিত্র মক্কা নগরীর পাশাপাশি এর উল্লেখ আছে [ ৯৫ : ৩ ]। হযরত ঈসার ক্ষেত্রে যায়তুন বা জলপাই পাহাড়ের কথা বলা হয়েছে ; দেখুন [ ৯৫ :১ ] আয়াত। বাইবেলে বলা হয়েছে [ Mar xxiv . 3 – 51 ] যে এখান থেকেই হযরত ঈসা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের শেষ বিচারের ঘোষণা দান করেন। হযরত মুহম্মদের (সা ) বেলাতে তিনি প্রথম আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ লাভ করেন হেরা বা আলোর পাহাড়ে। সুতারাং কিতাবধারী জাতিদের জন্য পর্বতের শপথ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
২) "উম্মুক্ত পত্রে লিখিত কিতাব " অর্থাৎ যাতে আল্লাহ্র চিরন্তন বাণীসমূহ লিখিত থাকে। যখন প্রত্যাদেশসমূহ মানুষের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়, তখন তাকে বলা হয়েছে লিখিত কিতাব, যেনো তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য রূপে ধরা পড়ে। এই কিতাবের বর্ণনাতে বলা হয়েছে যে তা লিখিত আছে উম্মুক্ত পত্রে। এর আসল অর্থ প্রাচীন কালে লেখার জন্য কাগজের স্থলে ব্যবহৃত হতো, পাতলা চামড়া বা পার্চমেন্ট যা বেলনাকারে পাকিয়ে রাখা হতো। তাই এর অনুবাদ করা হয়েছে পত্র। এই পত্রকে যখন উম্মুক্ত করা হতো বা পাকানো অবস্থা মুক্ত করা হতো তখন যে কেউ তা দেখতে পেতো এবং তা থেকে হেদায়েত গ্রহণ করতে পারতো।
৫০৩৯। ৩) উপরের দুটি টিকা দেখুন। বায়তুন মামুরের শাব্দিক অর্থ এমন গৃহ যেখানে সর্বদা জনসমাগম হয়। কেউ কেউ মনে করেন এর দ্বারা ফেরেশতাদের এবাদত করবার স্থানকে বোঝায়। মওলানা ইউসুফ আলীর মতে বায়তুল মামুর দ্বারা কাবা ঘরকে বোঝানো হয়েছে যাকে আমাদের রাসুল (সা) পবিত্র করেন এবং আল্লাহ্র এবাদতের জন্য নিবেদন করেন।
৫০৪০। "সমুন্নত আকাশ " - আকাশকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এর ব্যপ্তি, সীমা মানুষের বর্ণনার বাইরে।
৫০৪১। "উদ্বেলিত সমুদ্রের " - অর্থাৎ আদিগন্ত বিস্তৃত, বিশাল, সীমাহীন জলরাশি হচ্ছে সমুদ্র। 'Masjur' শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে ফুলে ফেঁপে ওঠা শক্তিশালী সমুদ্রের বিশাল ঢেউ যা প্রচন্ড বেগে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে। দেখুন [ ৮১ : ৬ ] আয়াত যা এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর নিশ্চিহ্ন হওয়া এবং শেষ বিচারের দিনের প্রকৃত চিত্রকে তুলে ধরে।
৫০৪২। উপরের বর্ণিত পাঁচটি নিদর্শনের শপথের মাধ্যমে মানুষের জন্য মৃত্যু পরবর্তী শেষ বিচারের দিনের প্রতি ইঙ্গিত দান করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিন অবশ্যম্ভাবী সত্য। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই নিদর্শনগুলিকে ক্রম অনুযায়ী ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সর্বোচ্চ নিদর্শন যা মানুষের অনুভূতির সূদূর প্রান্তে থাকে তার উপস্থাপন করা হয়েছে সর্বাগ্রে এবং মানুষের অনুভূতির খুব কাছের জিনিষকে উপস্থাপন করা হয়েছে সর্বশেষে। উপস্থাপনের ধারাটি এরূপ : আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ যা সর্বোচ্চ নিদর্শন মানুষের ভাষাতে প্রকাশ লাভ করে রাসুলদের মাধ্যমে ; ঐশ্বরিক এবাদতের বিশ্বজনীন আবেদন ; উপরে নক্ষত্রশোভিত সমুন্নত আকাশ; নীচে পৃথিবী বেষ্টনকারী সমুদ্র যা জীবন ও গতিতে সমৃদ্ধ। এ সমস্তই নির্দ্দেশ করে আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্বন্ধে এবং আল্লাহ্র নিকট হিসাব - নিকাশের দিনকে। শেষ বিচারের দিনকে কেউই প্রতিহত করতে পারবে না।
৫০৪৩। শেষ বিচারের দিনকে দুভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১) " নভোমন্ডল মহাকম্পনে কাঁপতে থাকবে।" পার্থিব জীবনে আকাশের এইরূপ কল্পনা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ পৃথিবীর জীবনে আমরা আকাশকে দেখি মুক্ত প্রশান্ত, উদার স্থির নীলাকাশ যা মানুষের মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়। রাতের নক্ষত্র খচিত আকাশ মানুষের চেতনাকে সূদূরে মহাবিশ্বে বিলিন করে। প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র, তারকারাজি সকলেই আল্লাহ্ প্রদত্ত আইন নিভুর্লভাবে মেনে চলেছে বিরামহীন ভাবে। আকাশ মন্ডলীর কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা দৃষ্টিগোচর হয় না - সর্বত্র বিরাজ করে অপার শান্তি। শেষ বিচারের দিনে নভোমন্ডলের এই শান্তির রূপ পরিবর্তিত হয়ে যাবে ; নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয় বর্ণনার জন্য দেখুন পরবর্তী টিকা।
৫০৪৪। সুউচ্চ পর্বতমালাকে দৃঢ়তার প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা যায়। এ কথা বলা হয়েছে যে, পর্বত পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে চলমান শিলার কম্পন থেকে রোধ করে [ ১৩ : ৩ ] [ ১৫ : ১৯ ] [ ২১ : ৩১ ] [ ৩১ : ১০ ] [ ১৬ : ১৫ ] যার সত্যতা মেলে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়। পার্থিব জীবনে আমরা যাকে মনে করি দৃঢ়, অচঞ্চল, কাঠিন্যের প্রতিমূর্তি হাশরের দিনে তা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাবে। দৃঢ়তার প্রতীক যে পর্বত সকলই পরলোকে মরীচিকার ন্যায় মিথ্যা বলে প্রতিভাত হবে এবং অদৃশ্য হয়ে যাবে। [ ৭৮ : ২০ ]।
৫০৪৫। " মিথ্যাশ্রয়ী " বলতে তাদেরই বোঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্র সত্যকে অস্বীকার করে; ফলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে ক্রীড়াচ্ছলে,সত্য ভাষণ, সত্যের প্রকাশকে তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ; জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিককে তারা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে। এরা হচ্ছে মোনাফেক। অনেক সময়েই এরা প্রকাশ্যে সত্যকে অস্বীকার করার সাহস প্রদর্শন করে না ; কিন্তু গোপনে সত্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করে তা থেকে লাভবান হয়। এ সব লোকই জীবন ভরে সন্দেহের মাঝে দোদুল্যমান হয়ে জীবন কাটায়। প্রকাশ্যে বা গোপনে যে কোনও ভাবে সত্যকে অস্বীকার করা বা তার ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হচেছ সত্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করা। এর পরেও যদি কেউ অনুতপ্ত হয়ে আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করে তবে আল্লাহ্র ক্ষমার দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত।
সূরা তূর
সূরা তূর বা পর্বত - ৫২
৪৯ আয়াত, ২ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : মক্কাতে অবতীর্ণ সাতটি সূরার শ্রেণীর এটি তৃতীয় সূরা। দেখুন শ্রেণীর ১ নম্বর সূরার ভূমিকা।
পূর্ববর্তী সূরার ন্যায় এটি মক্কাতে ইসলামের প্রথম আবির্ভাবের সময়ে অবতীর্ণ হয়। যে বিষয়গুলির উপরে এই সূরাতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ : প্রত্যাদেশ হচ্ছে আল্লাহ্র নিদর্শন, এর মধ্যে পূর্ববর্তী সময়ে যে সব প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে তাও অন্তর্গত। পারলৌকিক জীবন অবশ্য সত্য এবং আমাদের সে জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা অবশ্য কর্তব্য।
সার সংক্ষেপ : পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশসহ সকল প্রত্যাদেশ আল্লাহ্র নিদর্শন। ভালো কাজ ও মন্দ কাজের উপযুক্ত প্রতিফল বিদ্যমান। কিভাবে মানুষ প্রত্যাদেশের সত্যকে অস্বীকার করে ? [ ৫২ : ১ - ৪৯ ]।
সূরা তূর বা পর্বত - ৫২
৪৯ আয়াত, ২ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
০১। শপথ তূর পর্বতের ৫০৩৭।
৫০৩৭। এখানে পাঁচটি জিনিষের শপথ করা হয়েছে। আয়াত ১ - ৬ পর্যন্ত পাঁচটি নিদর্শনের প্রতি আবেদন করা হয়েছে। আয়াত নং ৭ - ২৮ পর্যন্ত মৃত্যু পরবর্তী পারলৌকিক জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যা তিন ভাগে উপস্থাপন করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে এই চেনা জানা পৃথিবী অদৃশ্য হয়ে যাবে [ ৭-১০ আয়াত ] ; পাপীরা পাপের শাস্তি ভোগ করবে [ ১১ - ১৬ আয়াত ] ; পূণ্যাত্মারা ভবিষ্যতে আল্লাহ্র ক্ষমা ও ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করবে অপার শান্তির মাধ্যমে। [ ১৭- ২৮ ] আয়াত ]
০২। শপথ লিখিত বিধানের ৫০৩৮
০৩। যা আছে উম্মুক্ত পত্রে ;
০৩। যা আছে উম্মুক্ত পত্রে ;
৫০৩৮। দেখুন উপরেরর টিকা, যে পাঁচটি নিদর্শনের শপথ করা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে : ১) তূর পর্বতের [ আয়াত ১ ] ; ২) উম্মুক্ত পত্রে লিখিত কিতাবের [ আয়াত ২ - ৩ ] ; ৩) বায়তুল মামূরের [ আয়াত ৪ ] ; ৪) সমুন্নত আকাশের [ আয়াত ৫ ] ; এবং ৫) উদ্বেলিত সমুদ্রের [ আয়াত ৬ ]।
১) এগুলির ব্যাখ্যা নিম্নরূপ : প্রতিটি নিদর্শন আক্ষরিক অর্থের সাথে সংযুক্ত। তূর পর্বতে বা সিনাই পর্বতে হযরত মুসা তাঁর প্রতি আল্লাহ্র প্রেরিত প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন ; দেখুন [৯৫ : ২ ] আয়াত, যেখানে পবিত্র মক্কা নগরীর পাশাপাশি এর উল্লেখ আছে [ ৯৫ : ৩ ]। হযরত ঈসার ক্ষেত্রে যায়তুন বা জলপাই পাহাড়ের কথা বলা হয়েছে ; দেখুন [ ৯৫ :১ ] আয়াত। বাইবেলে বলা হয়েছে [ Mar xxiv . 3 – 51 ] যে এখান থেকেই হযরত ঈসা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের শেষ বিচারের ঘোষণা দান করেন। হযরত মুহম্মদের (সা ) বেলাতে তিনি প্রথম আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ লাভ করেন হেরা বা আলোর পাহাড়ে। সুতারাং কিতাবধারী জাতিদের জন্য পর্বতের শপথ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
২) "উম্মুক্ত পত্রে লিখিত কিতাব " অর্থাৎ যাতে আল্লাহ্র চিরন্তন বাণীসমূহ লিখিত থাকে। যখন প্রত্যাদেশসমূহ মানুষের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়, তখন তাকে বলা হয়েছে লিখিত কিতাব, যেনো তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য রূপে ধরা পড়ে। এই কিতাবের বর্ণনাতে বলা হয়েছে যে তা লিখিত আছে উম্মুক্ত পত্রে। এর আসল অর্থ প্রাচীন কালে লেখার জন্য কাগজের স্থলে ব্যবহৃত হতো, পাতলা চামড়া বা পার্চমেন্ট যা বেলনাকারে পাকিয়ে রাখা হতো। তাই এর অনুবাদ করা হয়েছে পত্র। এই পত্রকে যখন উম্মুক্ত করা হতো বা পাকানো অবস্থা মুক্ত করা হতো তখন যে কেউ তা দেখতে পেতো এবং তা থেকে হেদায়েত গ্রহণ করতে পারতো।
০৪। শপথ বায়তুল মামুরের,৫০৩৯
৫০৩৯। ৩) উপরের দুটি টিকা দেখুন। বায়তুন মামুরের শাব্দিক অর্থ এমন গৃহ যেখানে সর্বদা জনসমাগম হয়। কেউ কেউ মনে করেন এর দ্বারা ফেরেশতাদের এবাদত করবার স্থানকে বোঝায়। মওলানা ইউসুফ আলীর মতে বায়তুল মামুর দ্বারা কাবা ঘরকে বোঝানো হয়েছে যাকে আমাদের রাসুল (সা) পবিত্র করেন এবং আল্লাহ্র এবাদতের জন্য নিবেদন করেন।
০৫। শপথ সমুন্নত আকাশের ; ৫০৪০
৫০৪০। "সমুন্নত আকাশ " - আকাশকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এর ব্যপ্তি, সীমা মানুষের বর্ণনার বাইরে।
০৬। [ আরো ] শপথ উদ্বেলিত সমুদ্রের ; ৫০৪১, ৫০৪২
৫০৪১। "উদ্বেলিত সমুদ্রের " - অর্থাৎ আদিগন্ত বিস্তৃত, বিশাল, সীমাহীন জলরাশি হচ্ছে সমুদ্র। 'Masjur' শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে ফুলে ফেঁপে ওঠা শক্তিশালী সমুদ্রের বিশাল ঢেউ যা প্রচন্ড বেগে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে। দেখুন [ ৮১ : ৬ ] আয়াত যা এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর নিশ্চিহ্ন হওয়া এবং শেষ বিচারের দিনের প্রকৃত চিত্রকে তুলে ধরে।
৫০৪২। উপরের বর্ণিত পাঁচটি নিদর্শনের শপথের মাধ্যমে মানুষের জন্য মৃত্যু পরবর্তী শেষ বিচারের দিনের প্রতি ইঙ্গিত দান করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিন অবশ্যম্ভাবী সত্য। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই নিদর্শনগুলিকে ক্রম অনুযায়ী ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সর্বোচ্চ নিদর্শন যা মানুষের অনুভূতির সূদূর প্রান্তে থাকে তার উপস্থাপন করা হয়েছে সর্বাগ্রে এবং মানুষের অনুভূতির খুব কাছের জিনিষকে উপস্থাপন করা হয়েছে সর্বশেষে। উপস্থাপনের ধারাটি এরূপ : আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ যা সর্বোচ্চ নিদর্শন মানুষের ভাষাতে প্রকাশ লাভ করে রাসুলদের মাধ্যমে ; ঐশ্বরিক এবাদতের বিশ্বজনীন আবেদন ; উপরে নক্ষত্রশোভিত সমুন্নত আকাশ; নীচে পৃথিবী বেষ্টনকারী সমুদ্র যা জীবন ও গতিতে সমৃদ্ধ। এ সমস্তই নির্দ্দেশ করে আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্বন্ধে এবং আল্লাহ্র নিকট হিসাব - নিকাশের দিনকে। শেষ বিচারের দিনকে কেউই প্রতিহত করতে পারবে না।
০৭। নিশ্চয়ই তোমার প্রভুর শাস্তি অবশ্যই আসবে ; -
০৮। কেহই তা রোধ করতে পারবে না ; -
০৯। যেদিন নভোমন্ডল মহাকম্পনে কাঁপতে থাকবে ৫০৪৩
০৮। কেহই তা রোধ করতে পারবে না ; -
০৯। যেদিন নভোমন্ডল মহাকম্পনে কাঁপতে থাকবে ৫০৪৩
৫০৪৩। শেষ বিচারের দিনকে দুভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১) " নভোমন্ডল মহাকম্পনে কাঁপতে থাকবে।" পার্থিব জীবনে আকাশের এইরূপ কল্পনা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ পৃথিবীর জীবনে আমরা আকাশকে দেখি মুক্ত প্রশান্ত, উদার স্থির নীলাকাশ যা মানুষের মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়। রাতের নক্ষত্র খচিত আকাশ মানুষের চেতনাকে সূদূরে মহাবিশ্বে বিলিন করে। প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র, তারকারাজি সকলেই আল্লাহ্ প্রদত্ত আইন নিভুর্লভাবে মেনে চলেছে বিরামহীন ভাবে। আকাশ মন্ডলীর কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা দৃষ্টিগোচর হয় না - সর্বত্র বিরাজ করে অপার শান্তি। শেষ বিচারের দিনে নভোমন্ডলের এই শান্তির রূপ পরিবর্তিত হয়ে যাবে ; নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয় বর্ণনার জন্য দেখুন পরবর্তী টিকা।
১০। এবং পাহাড়-পর্বত দিগ-দিগন্তে [ ঝড়া পাতার ন্যায় ] উড়ে যাবে ৫০৪৪
৫০৪৪। সুউচ্চ পর্বতমালাকে দৃঢ়তার প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা যায়। এ কথা বলা হয়েছে যে, পর্বত পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে চলমান শিলার কম্পন থেকে রোধ করে [ ১৩ : ৩ ] [ ১৫ : ১৯ ] [ ২১ : ৩১ ] [ ৩১ : ১০ ] [ ১৬ : ১৫ ] যার সত্যতা মেলে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়। পার্থিব জীবনে আমরা যাকে মনে করি দৃঢ়, অচঞ্চল, কাঠিন্যের প্রতিমূর্তি হাশরের দিনে তা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাবে। দৃঢ়তার প্রতীক যে পর্বত সকলই পরলোকে মরীচিকার ন্যায় মিথ্যা বলে প্রতিভাত হবে এবং অদৃশ্য হয়ে যাবে। [ ৭৮ : ২০ ]।
১১। সেদিন তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা [ সত্যকে ] মিথ্যা বলে জেনেছে ; - ৫০৪৫
১২। যারা ক্রীড়াচ্ছলে অসার কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে।
১২। যারা ক্রীড়াচ্ছলে অসার কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে।
৫০৪৫। " মিথ্যাশ্রয়ী " বলতে তাদেরই বোঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্র সত্যকে অস্বীকার করে; ফলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে ক্রীড়াচ্ছলে,সত্য ভাষণ, সত্যের প্রকাশকে তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ; জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিককে তারা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে। এরা হচ্ছে মোনাফেক। অনেক সময়েই এরা প্রকাশ্যে সত্যকে অস্বীকার করার সাহস প্রদর্শন করে না ; কিন্তু গোপনে সত্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করে তা থেকে লাভবান হয়। এ সব লোকই জীবন ভরে সন্দেহের মাঝে দোদুল্যমান হয়ে জীবন কাটায়। প্রকাশ্যে বা গোপনে যে কোনও ভাবে সত্যকে অস্বীকার করা বা তার ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হচেছ সত্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করা। এর পরেও যদি কেউ অনুতপ্ত হয়ে আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করে তবে আল্লাহ্র ক্ষমার দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত।
১৩। সেদিন তাদের বাঁধাহীন ভাবে জাহান্নামের আগুনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে।
১৪। বলা হবে ৫০৪৬, " এই সেই আগুন যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে,
১৪। বলা হবে ৫০৪৬, " এই সেই আগুন যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে,
৫০৪৬। সেদিন প্রত্যেকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হবে। পাপীরা সেদিন বুঝতে পারবে তাদের মন্দ কাজের প্রতিফল। তাদের প্রতিটি মন্দ কাজ, মন্দ চিন্তা যা তাদের মনের গহনে ছিলো, যাকে তারা পৃথিবীর জীবনে সযত্নে লালিত করেছে এবং কখনও স্মরণে আনে নাই যে, প্রতিটি মন্দ চিন্তা, মন্দ কাজ বা উদ্দেশ্য জীবনের কোনও জিনিষই হারিয়ে যাবে না, মহাকালের খাতায় তা লেখা থাকে। সবকিছুরই প্রতিদান থাকে যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এই পরিণামই হচ্ছে " সেই অগ্নি যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে।"
৫০৪৭। যারা আল্লাহ্র সত্যকে স্বীকার করে না তাদের আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো প্রবেশ লাভ করে না। ফলে তাদের নিকট পরলোকের জীবনটাকে কখনও বাস্তব সত্য বলে প্রতিভাত হয় না। তারা পরকালকে প্রাচীন যুগের গল্প কাহিনী বা কুসংস্কারচ্ছন্নদের অন্ধ বিশ্বাস এবং নিজেদের প্রগতিশীলরূপে কল্পনা করে থাকে। কিন্তু যদি তারা আল্লাহ্র নিদর্শন বা সত্য সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করতো, তবে তারা খুব সহজেই প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে পারতো এবং আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব থেকে মুক্তি লাভ করতো। আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব মানুষকে প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধিতে বাঁধা দান করে। এরা নিজেদের দোষত্রুটি অনুধাবনে অক্ষম। ফলে তারা আল্লাহ্র নবীর প্রেরিত সত্যকে গ্রহণে অপারগ হয় এবং সত্য বিমুখ হয়।
উপদেশ : কোরাণ হচ্ছে আল্লাহ্র প্রেরিত 'সত্য' যা জীবনের সফলতার চাবিকাঠি। কিন্তু যারা তা গ্রহণ করতে না চায় তাদের আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে আল্লাহ্ অবগুণ্ঠন দ্বারা আবৃত করে দেন। ফলে তারা কোরাণ পড়েও তা বুঝতে বা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না। দেখুন [ ১৭ : ৪৬ ] আয়াত।
৫০৪৮। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে নূতনভাবে আর কোনও কিছু করার ক্ষমতা আমাদের থাকবে না। পৃথিবীর জীবন ছিলো মৃত্যুপরবর্তী জীবনের শিক্ষানবীশ কাল। এ জীবনের হিসাব নিকাশ দাখিল করতে হবে শেষ বিচারের দিনে এবং আমাদের পার্থিব জীবনের কৃতকর্ম অনুযায়ী আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে সেদিন। সেদিন অধৈর্য বা রাগের প্রকাশ কিছুই তাদের উপকারে আসবে না, অথবা অনুতাপ বা ধৈর্য্য ধারণ কিছুই তাদের শাস্তি থেকে অব্যহতি দান করবে না। কারণ পার্থিব জীবনে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র ক্ষমা ও করুণা এবং অনুগ্রহকে প্রত্যাখান করেছে। সুতারাং অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র ক্ষমালাভের যে সুযোগ ও সময় তাদের দেয়া হয়েছিলো তারা তা অবহেলায় নষ্ট করেছে। এখন তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
৫০৪৯। পূণ্যাত্মারা বেহেশতে যে সুখ ও শান্তি লাভ করবেন তা তুলনাহীন, তা তাদের ধারণারও বাইরে। পৃথিবীর জীবনে কেউই সর্ব পাপের উর্দ্ধে নয়। কিন্তু পরম করুণাময় তাঁদের এই ছোটখাট পাপ ও দোষত্রুটি মাপ করে দিয়ে তাদের আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভে ধন্য করবেন। পার্থিব জীবনে তারা পাপমুক্ত জীবন ধারনের যে চেষ্টা করেছেন তারই পুরষ্কার তাঁরা লাভ করবেন পারলৌকিক জীবনে ; দেখুন আয়াত নং ১৯। তবে তাদের পুরষ্কার তাদের যা প্রাপ্য তার থেকে বহু গুণ দেয়া হবে।
৫০৫০। উপরের আয়াতসমূহের বিপরীতে পূণ্যাত্মাদের সুখ শান্তির বিবরণ তিনটি ধাপে তুলে ধরা হয়েছেঃ
১) তাঁদের ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি ও আর্থিক প্রশান্তি ; দেখুন আয়াত নং [ ১৭- ২০ ] ; ২) তাঁদের সামাজিক সুখ শান্তির প্রকাশ, দেখুন আয়াত নং [ ২১ - ২৪ ] ; এবং ৩) তাঁরা পৃথিবীর জীবনের তুচ্ছ আমোদ প্রমোদ ও সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করে পরকালে আল্লাহ্র অনুগ্রহের পরিপূর্ণ রূপকে অনুধাবনে সক্ষম হবে। দেখুন আয়াত নং [ ২৫ - ২৮ ]।
৫০৫১। মোমেন বান্দাদের ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তিকে তিনটি বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। ১) পান ও আহার করা ২) সজ্জিত আসন, ৩) সাহচর্যের বিমল অনন্দ। পানাহারকে বলা হয়েছে তৃপ্তির সাথে আহার কর অর্থাৎ অতিভোজন বা পানীয়ের কোনও পরবর্তীতে কুফল থাকবে না। সেখানে রোগ ব্যাধি মুক্ত, দুঃশ্চিন্তাহীন জীবনের নিশ্চয়তা থাকবে। অন্য দুটির জন্য দেখুন পরবর্তী টিকা।
আরও দেখুন বেহেশতের বর্ণনা [ ৩৭ : ৪০- ৪৯ ] আয়াতে।
৫০৫২। বেহেশতবাসীদের প্রত্যেকের জন্য থাকবে সম্মানীয় আসন। প্রতিটি আসনই থাকবে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য মন্ডিত যদিও তারা থাকবে "শ্রেণীবদ্ধ"। অর্থাৎ প্রত্যেককে আল্লাহ্ পূত পবিত্র করে নেবেন কিন্তু সকলকে মিশ্রিত না করে প্রত্যেকেই স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর থাকবেন।
৫০৫৩। দেখুন [ ৪৪ : ৫৪ ] আয়াত এবং টিকা নং ৪৭২৮ ও ৪৭২৯ যেখানে হুর শব্দটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মানুষ সুখ -আনন্দ কখনও একা ভোগ করে আনন্দ পায় না। সম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আনন্দের শিখা আরও উজ্জ্বল ভাবে প্রজ্জ্বলিত হয়। এই সাহচর্যের সঙ্গীকে 'হুর' শব্দটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।
৫০৫৪। 'Zurriyat' অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম, সন্তান-সন্ততি, পরিবার ইত্যাদি যারা আপনজন তাদের সকলের জন্য শব্দটি প্রযোজ্য। ভালোবাসা সর্বদাই নিঃস্বার্থ হয়; ভালোবাসার জনের জন্য লোকে আত্মত্যাগ করে। এখানে বলা হয়েছে সৎকর্মপরায়ন পিতৃপুরুষ দ্বারা তাদের সন্তানেরা উপকৃত হবে, শর্ত হচ্ছে তারাও তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী ঈমানে বিশ্বস্ত থাকবে। তাদের আমল কিছু কম হওয়া সত্ত্বেও তাদের পিতৃপুরুষদের পূণ্যের দরুণ তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। আবার এর জন্য পূর্বপুরুষদের আমল কিছুমাত্র হ্রাস করা হবে না।
৫০৫৫। যারা নবীর উম্মত তাদের উপরে নবীর ভালোবাসা বা নেকবান পূর্বপুরূষদের দোয়া বা পরবর্তী বংশধরদের দোয়া বা নেক বান্দাদের দোয়া আল্লাহ্ কুবল করেন সত্য, তবে একের গোনাহ্র প্রতিক্রিয়া অন্যের উপরে প্রতিফলিত হবে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর আমলের জন্য দায়ী হবে। পরবর্তী বা পূর্ববর্তী প্রজন্মের উপরে দোয়া কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমান ও সৎ কাজ। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার স্ব-স্ব কৃতকর্মের জন্য দায়ী থাকবে। আল্লাহ্র রাজত্বে কোনও বংশ গৌরবের স্থান নাই বা পূর্বপুরুষের নেকীর বদৌলতে নিজ কৃতকর্মের জবাবদিহিতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে এমন বিধান নাই। তবে পূণ্যাত্মাদের জন্য এই সুসংবাদ দান করা হয়েছে যে, যদি তাদের পরবর্তী প্রজন্মে কোনও যোগ্য উত্তরসূরী জন্মলাভ করে, তবে সে তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে।
৫০৫৬। লক্ষ্য করুন এই আয়াতটি বেহেশতে সামাজিক শান্তির বর্ণনার মধ্যে স্থাপিত করা হয়েছে। বেহেশতের ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ ও শান্তির বর্ণনা আছে ১৯ নং আয়াতে। সামাজিক সুখ -শান্তির আরাম -আয়েশ বহু ধরণের হতে পারে তার মাঝে খাদ্য দ্রব্য অন্যতম। বেহেশতে প্রত্যেকের চাওয়া ও পাওয়া হবে পূত ও পবিত্র এবং তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী। এখানের বর্ণনাতে আঁকা হয়েছে সমষ্টিগত আরাম আয়েশের বর্ণনা।
৫০৫৭। পৃথিবীর জীবনে পান করার অর্থ হচ্ছে 'মদ' বা এই জাতীয় মাদক দ্রব্য পান করা বা পানপাত্র বন্ধু বান্ধবের নিকট থেকে গ্রহণ করা যা পানে দ্বিবিধ ক্রিয়া হয় : ১) অবসর সময়কে বাজে ও বৃথা ব্যয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়; অথবা ২) পানীয়টাকে উত্তেজক হিসেবে ব্যবহার করা হয় যেনো খারাপ চিন্তা, খারাপ ধারণা, খারাপ ইঙ্গিত, খারাপ কথাবার্তা বা পাপ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। বেহেশতের 'পানীয় ' হবে ঠিক এর বিপরীত।
৫০৫৮। 'Maknun' অর্থ সুরক্ষিত রাখা,বন্ধ রাখা, গুপ্ত রাখা, লুকিয়ে রাখা ইত্যাদি। কিশোরদের এক কথায় বর্ণনা করা হয়েছে সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ্য। শুক্তির মাঝে যে মুক্তা থাকে তার ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। কিন্তু দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে বা বাইরে আলো হাওয়াতে ফেলে রাখলে মুক্তার ঔজ্জ্বল্য কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। সুতারাং যখন ব্যবহার হয় না তখন মুক্তাকে সুরক্ষিত গহনার বাক্সে বন্দ করে রাখে যেনো তার ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য না হারায়।
৫০৫৯। বেহেশতের বর্ণনার তৃতীয় ধাপ এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। বেহেশতের সুখ শান্তির প্রথম ধাপ হচ্ছে ব্যক্তিগত সুখ ও শান্তি। দ্বিতীয় ধাপে আছে সমষ্টিগত বা সামাজিক সুখ ও শান্তি। তৃতীয় ধাপে বর্ণনা করা হয়েছে অতীতের স্মৃতি চারণের মাধ্যমে বর্তমানের সুখ, শান্তি ও আরাম, আয়েশকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহকে অনুভব করা। দেখুন টিকা ৫০৫০। এই অনুভবও হবে পরস্পর অন্তরঙ্গ কথোপকথনের মাধ্যমে ও একই বিশ্বাসের মূলসূত্র থেকে।
৫০৬০। পার্থিব জীবনের কেউই সম্পূর্ণ শঙ্কামুক্ত জীবন যাপন করতে পারে না। পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে সীমিত ধারণায় হলেও আধ্যাত্মিক দিক থেকে সে সফলতা লাভ করতে পারে সত্য। কিন্তু পৃথিবীর জীবন, কর্মক্ষেত্র, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী, পুত্র, পরিজন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তাদের চিন্তা ধারা ও মনকে সর্বদা ব্যপৃত রাখতো এবং শঙ্কায় পরিপূর্ণ করে ফেলতো। বেহেশতি শান্তির বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তাদের মন থেকে সকল ভয়, দুঃশ্চিন্তা, শঙ্কা, মুক্ত করে দেয়া হবে এবং এই ব্যাপারে তারা সমমনাদের সাথে আলোচনা করবে। কি অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সুখ, শান্তি, আনন্দ পরিতৃপ্তির বর্ণনা করা হয়েছে।
৫০৬১। এই আয়াতে "আমাদিগকে " শব্দটি দ্বারা বহুবচন বুঝানো হয়েছে যার দ্বারা পুরুষ ও নারী উভয়েই অন্তর্ভূক্ত, যাদের আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন।
৫০৬২। "আমরা পূর্ব থেকেই আল্লাহকে ডাকতাম " - অর্থাৎ পার্থিব জীবনেও মোমেন বান্দারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতো এবং বিশ্বাস করতো যে সকল ভালো ও কল্যাণের তিনিই একমাত্র প্রভু। এখন এই পরলোকের জীবনে তারা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করতে পারেন যে, আল্লাহ্ প্রকৃতই কল্যাণের মালিক ও অপার করুণার আধার। তাদের উপলব্ধির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় কৃতজ্ঞতায় তাঁদের অন্তর আপ্লুত হয়ে পড়ে। এই আয়াতটি বেহেশতের বর্ণনার সর্বোচ্চ প্রকাশ।
১৫। " তবে কি এটা নকল, ৫০৪৭, কিংবা তোমরাই তা দেখতে পাচ্ছ না ?
৫০৪৭। যারা আল্লাহ্র সত্যকে স্বীকার করে না তাদের আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো প্রবেশ লাভ করে না। ফলে তাদের নিকট পরলোকের জীবনটাকে কখনও বাস্তব সত্য বলে প্রতিভাত হয় না। তারা পরকালকে প্রাচীন যুগের গল্প কাহিনী বা কুসংস্কারচ্ছন্নদের অন্ধ বিশ্বাস এবং নিজেদের প্রগতিশীলরূপে কল্পনা করে থাকে। কিন্তু যদি তারা আল্লাহ্র নিদর্শন বা সত্য সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করতো, তবে তারা খুব সহজেই প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে পারতো এবং আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব থেকে মুক্তি লাভ করতো। আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব মানুষকে প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধিতে বাঁধা দান করে। এরা নিজেদের দোষত্রুটি অনুধাবনে অক্ষম। ফলে তারা আল্লাহ্র নবীর প্রেরিত সত্যকে গ্রহণে অপারগ হয় এবং সত্য বিমুখ হয়।
উপদেশ : কোরাণ হচ্ছে আল্লাহ্র প্রেরিত 'সত্য' যা জীবনের সফলতার চাবিকাঠি। কিন্তু যারা তা গ্রহণ করতে না চায় তাদের আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে আল্লাহ্ অবগুণ্ঠন দ্বারা আবৃত করে দেন। ফলে তারা কোরাণ পড়েও তা বুঝতে বা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না। দেখুন [ ১৭ : ৪৬ ] আয়াত।
১৬। " তোমরা সেখানে পুড়তে থাক : তোমরা তা ধৈর্যের সাথে সহ্য করবে বা করবে না, তোমাদের জন্য উভয়ই সমান ৫০৪৮। তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল তোমাদের দেয়া হচ্ছে।"
৫০৪৮। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে নূতনভাবে আর কোনও কিছু করার ক্ষমতা আমাদের থাকবে না। পৃথিবীর জীবন ছিলো মৃত্যুপরবর্তী জীবনের শিক্ষানবীশ কাল। এ জীবনের হিসাব নিকাশ দাখিল করতে হবে শেষ বিচারের দিনে এবং আমাদের পার্থিব জীবনের কৃতকর্ম অনুযায়ী আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে সেদিন। সেদিন অধৈর্য বা রাগের প্রকাশ কিছুই তাদের উপকারে আসবে না, অথবা অনুতাপ বা ধৈর্য্য ধারণ কিছুই তাদের শাস্তি থেকে অব্যহতি দান করবে না। কারণ পার্থিব জীবনে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র ক্ষমা ও করুণা এবং অনুগ্রহকে প্রত্যাখান করেছে। সুতারাং অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র ক্ষমালাভের যে সুযোগ ও সময় তাদের দেয়া হয়েছিলো তারা তা অবহেলায় নষ্ট করেছে। এখন তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
১৭। পূণ্যাত্মারা ৫০৪৯ থাকবে [ বেহেশতের ] বাগানে এবং সুখে সন্তুষ্টিতে;
১৮। তাদের প্রভু তাদের যে [ প্রশান্তি ] দান করেছেন তারা তা উপভোগ করতে থাকবে, এবং তাদের প্রভু তাদের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন।
১৮। তাদের প্রভু তাদের যে [ প্রশান্তি ] দান করেছেন তারা তা উপভোগ করতে থাকবে, এবং তাদের প্রভু তাদের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন।
৫০৪৯। পূণ্যাত্মারা বেহেশতে যে সুখ ও শান্তি লাভ করবেন তা তুলনাহীন, তা তাদের ধারণারও বাইরে। পৃথিবীর জীবনে কেউই সর্ব পাপের উর্দ্ধে নয়। কিন্তু পরম করুণাময় তাঁদের এই ছোটখাট পাপ ও দোষত্রুটি মাপ করে দিয়ে তাদের আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভে ধন্য করবেন। পার্থিব জীবনে তারা পাপমুক্ত জীবন ধারনের যে চেষ্টা করেছেন তারই পুরষ্কার তাঁরা লাভ করবেন পারলৌকিক জীবনে ; দেখুন আয়াত নং ১৯। তবে তাদের পুরষ্কার তাদের যা প্রাপ্য তার থেকে বহু গুণ দেয়া হবে।
১৯। [ তাদের বলা হবে ] ৫০৫০, " তোমাদের [ ভালো ] কাজের বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তির সাথে আহার কর, এবং পান কর। " ৫০৫১
৫০৫০। উপরের আয়াতসমূহের বিপরীতে পূণ্যাত্মাদের সুখ শান্তির বিবরণ তিনটি ধাপে তুলে ধরা হয়েছেঃ
১) তাঁদের ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি ও আর্থিক প্রশান্তি ; দেখুন আয়াত নং [ ১৭- ২০ ] ; ২) তাঁদের সামাজিক সুখ শান্তির প্রকাশ, দেখুন আয়াত নং [ ২১ - ২৪ ] ; এবং ৩) তাঁরা পৃথিবীর জীবনের তুচ্ছ আমোদ প্রমোদ ও সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করে পরকালে আল্লাহ্র অনুগ্রহের পরিপূর্ণ রূপকে অনুধাবনে সক্ষম হবে। দেখুন আয়াত নং [ ২৫ - ২৮ ]।
৫০৫১। মোমেন বান্দাদের ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তিকে তিনটি বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। ১) পান ও আহার করা ২) সজ্জিত আসন, ৩) সাহচর্যের বিমল অনন্দ। পানাহারকে বলা হয়েছে তৃপ্তির সাথে আহার কর অর্থাৎ অতিভোজন বা পানীয়ের কোনও পরবর্তীতে কুফল থাকবে না। সেখানে রোগ ব্যাধি মুক্ত, দুঃশ্চিন্তাহীন জীবনের নিশ্চয়তা থাকবে। অন্য দুটির জন্য দেখুন পরবর্তী টিকা।
আরও দেখুন বেহেশতের বর্ণনা [ ৩৭ : ৪০- ৪৯ ] আয়াতে।
২০। তারা সারি সারি [মর্যাদাপূর্ণ ] সিংহাসনে [ আরামের সাথে ] হেলান দিয়ে বসবে ৫০৫২। সুনয়না পরমা সুন্দরী হুরদের সাথে আমি তাদের মিলন ঘটাবো ৫০৫৩।
৫০৫২। বেহেশতবাসীদের প্রত্যেকের জন্য থাকবে সম্মানীয় আসন। প্রতিটি আসনই থাকবে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য মন্ডিত যদিও তারা থাকবে "শ্রেণীবদ্ধ"। অর্থাৎ প্রত্যেককে আল্লাহ্ পূত পবিত্র করে নেবেন কিন্তু সকলকে মিশ্রিত না করে প্রত্যেকেই স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর থাকবেন।
৫০৫৩। দেখুন [ ৪৪ : ৫৪ ] আয়াত এবং টিকা নং ৪৭২৮ ও ৪৭২৯ যেখানে হুর শব্দটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মানুষ সুখ -আনন্দ কখনও একা ভোগ করে আনন্দ পায় না। সম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আনন্দের শিখা আরও উজ্জ্বল ভাবে প্রজ্জ্বলিত হয়। এই সাহচর্যের সঙ্গীকে 'হুর' শব্দটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।
২১। এবং যারা বিশ্বাসী এবং যাদের পরিবারবর্গ তাদের বিশ্বাসের অনুগামী হয় ৫০৫৪,- তাদের সাথে তাদের পরিবারবর্গকে একত্রে মিলিত করাবো। তাদের কাজের জন্য [ পুরষ্কার থেকে ] কিছুই কমাবো না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ নিজ কর্মফলের সাথে আবদ্ধ রয়েছে ৫০৫৫।
৫০৫৪। 'Zurriyat' অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম, সন্তান-সন্ততি, পরিবার ইত্যাদি যারা আপনজন তাদের সকলের জন্য শব্দটি প্রযোজ্য। ভালোবাসা সর্বদাই নিঃস্বার্থ হয়; ভালোবাসার জনের জন্য লোকে আত্মত্যাগ করে। এখানে বলা হয়েছে সৎকর্মপরায়ন পিতৃপুরুষ দ্বারা তাদের সন্তানেরা উপকৃত হবে, শর্ত হচ্ছে তারাও তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী ঈমানে বিশ্বস্ত থাকবে। তাদের আমল কিছু কম হওয়া সত্ত্বেও তাদের পিতৃপুরুষদের পূণ্যের দরুণ তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। আবার এর জন্য পূর্বপুরুষদের আমল কিছুমাত্র হ্রাস করা হবে না।
৫০৫৫। যারা নবীর উম্মত তাদের উপরে নবীর ভালোবাসা বা নেকবান পূর্বপুরূষদের দোয়া বা পরবর্তী বংশধরদের দোয়া বা নেক বান্দাদের দোয়া আল্লাহ্ কুবল করেন সত্য, তবে একের গোনাহ্র প্রতিক্রিয়া অন্যের উপরে প্রতিফলিত হবে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর আমলের জন্য দায়ী হবে। পরবর্তী বা পূর্ববর্তী প্রজন্মের উপরে দোয়া কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমান ও সৎ কাজ। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার স্ব-স্ব কৃতকর্মের জন্য দায়ী থাকবে। আল্লাহ্র রাজত্বে কোনও বংশ গৌরবের স্থান নাই বা পূর্বপুরুষের নেকীর বদৌলতে নিজ কৃতকর্মের জবাবদিহিতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে এমন বিধান নাই। তবে পূণ্যাত্মাদের জন্য এই সুসংবাদ দান করা হয়েছে যে, যদি তাদের পরবর্তী প্রজন্মে কোনও যোগ্য উত্তরসূরী জন্মলাভ করে, তবে সে তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে।
২২। [ সেখানে ] তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেরূপ ফল ও গোশ্ত চাইবে আমি তাদের তাই-ই দেবো ৫০৫৬।
৫০৫৬। লক্ষ্য করুন এই আয়াতটি বেহেশতে সামাজিক শান্তির বর্ণনার মধ্যে স্থাপিত করা হয়েছে। বেহেশতের ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ ও শান্তির বর্ণনা আছে ১৯ নং আয়াতে। সামাজিক সুখ -শান্তির আরাম -আয়েশ বহু ধরণের হতে পারে তার মাঝে খাদ্য দ্রব্য অন্যতম। বেহেশতে প্রত্যেকের চাওয়া ও পাওয়া হবে পূত ও পবিত্র এবং তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী। এখানের বর্ণনাতে আঁকা হয়েছে সমষ্টিগত আরাম আয়েশের বর্ণনা।
২৩। সেখানে তারা পরস্পরের মধ্যে আদান প্রদান করবে [ ভালোবাসার ] পেয়ালা যা হবে চাপল্যমুক্ত ও সকল পাপ থেকে মুক্ত ৫০৫৭।
৫০৫৭। পৃথিবীর জীবনে পান করার অর্থ হচ্ছে 'মদ' বা এই জাতীয় মাদক দ্রব্য পান করা বা পানপাত্র বন্ধু বান্ধবের নিকট থেকে গ্রহণ করা যা পানে দ্বিবিধ ক্রিয়া হয় : ১) অবসর সময়কে বাজে ও বৃথা ব্যয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়; অথবা ২) পানীয়টাকে উত্তেজক হিসেবে ব্যবহার করা হয় যেনো খারাপ চিন্তা, খারাপ ধারণা, খারাপ ইঙ্গিত, খারাপ কথাবার্তা বা পাপ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। বেহেশতের 'পানীয় ' হবে ঠিক এর বিপরীত।
২৪। তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে সুরক্ষিত, মুক্তাসদৃশ কিশোরেরা ৫০৫৮।
৫০৫৮। 'Maknun' অর্থ সুরক্ষিত রাখা,বন্ধ রাখা, গুপ্ত রাখা, লুকিয়ে রাখা ইত্যাদি। কিশোরদের এক কথায় বর্ণনা করা হয়েছে সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ্য। শুক্তির মাঝে যে মুক্তা থাকে তার ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। কিন্তু দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে বা বাইরে আলো হাওয়াতে ফেলে রাখলে মুক্তার ঔজ্জ্বল্য কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। সুতারাং যখন ব্যবহার হয় না তখন মুক্তাকে সুরক্ষিত গহনার বাক্সে বন্দ করে রাখে যেনো তার ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য না হারায়।
২৫। এবং তারা একে অন্যের সম্মুখীন হয়ে পরস্পর জিজ্ঞাসা বাদ করবে ৫০৫৯।
৫০৫৯। বেহেশতের বর্ণনার তৃতীয় ধাপ এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। বেহেশতের সুখ শান্তির প্রথম ধাপ হচ্ছে ব্যক্তিগত সুখ ও শান্তি। দ্বিতীয় ধাপে আছে সমষ্টিগত বা সামাজিক সুখ ও শান্তি। তৃতীয় ধাপে বর্ণনা করা হয়েছে অতীতের স্মৃতি চারণের মাধ্যমে বর্তমানের সুখ, শান্তি ও আরাম, আয়েশকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহকে অনুভব করা। দেখুন টিকা ৫০৫০। এই অনুভবও হবে পরস্পর অন্তরঙ্গ কথোপকথনের মাধ্যমে ও একই বিশ্বাসের মূলসূত্র থেকে।
২৬। তারা বলবে, " আমরা পূর্বে পরিবার পরিজনের সম্বন্ধে ভীত ছিলাম ৫০৬০।
৫০৬০। পার্থিব জীবনের কেউই সম্পূর্ণ শঙ্কামুক্ত জীবন যাপন করতে পারে না। পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে সীমিত ধারণায় হলেও আধ্যাত্মিক দিক থেকে সে সফলতা লাভ করতে পারে সত্য। কিন্তু পৃথিবীর জীবন, কর্মক্ষেত্র, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী, পুত্র, পরিজন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তাদের চিন্তা ধারা ও মনকে সর্বদা ব্যপৃত রাখতো এবং শঙ্কায় পরিপূর্ণ করে ফেলতো। বেহেশতি শান্তির বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তাদের মন থেকে সকল ভয়, দুঃশ্চিন্তা, শঙ্কা, মুক্ত করে দেয়া হবে এবং এই ব্যাপারে তারা সমমনাদের সাথে আলোচনা করবে। কি অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সুখ, শান্তি, আনন্দ পরিতৃপ্তির বর্ণনা করা হয়েছে।
২৭। " কিন্তু আল্লাহ্ আমাদের অনুগ্রহ করেছেন এবং দগ্ধকারী বাতাসের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন ৫০৬১।
৫০৬১। এই আয়াতে "আমাদিগকে " শব্দটি দ্বারা বহুবচন বুঝানো হয়েছে যার দ্বারা পুরুষ ও নারী উভয়েই অন্তর্ভূক্ত, যাদের আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন।
২৮। "নিশ্চয়ই আমরা পূর্ব থেকেই আল্লাহকে ডাকতাম : তিনি তো উপকারী,পরম দয়ালু ৫০৬২।"
৫০৬২। "আমরা পূর্ব থেকেই আল্লাহকে ডাকতাম " - অর্থাৎ পার্থিব জীবনেও মোমেন বান্দারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতো এবং বিশ্বাস করতো যে সকল ভালো ও কল্যাণের তিনিই একমাত্র প্রভু। এখন এই পরলোকের জীবনে তারা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করতে পারেন যে, আল্লাহ্ প্রকৃতই কল্যাণের মালিক ও অপার করুণার আধার। তাদের উপলব্ধির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় কৃতজ্ঞতায় তাঁদের অন্তর আপ্লুত হয়ে পড়ে। এই আয়াতটি বেহেশতের বর্ণনার সর্বোচ্চ প্রকাশ।
রুকু - ২
৫০৬৩। কাফেররা মহানবীকে গণক বা উম্মাদ বলে বিদ্রূপ করতো। যুগে যুগে এ ভাবেই সত্যকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে বাঁধা দান করা হয়ে থাকে। আল্লাহ্র হুকুম মহানবীর উদাহরণের মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, সত্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেউ যেনো পিছিয়ে না যায়।
৫০৬৪। কাফেররা মহানবীকে কবি বলে বিদ্রূপ করতো কারণ কোরাণের আয়াতকে তারা মহানবীর রচিত কবিতা বলে অভিহিত করতো এবং বলতো যে তা মানুষের অকল্যাণের সংবাদ দেয়। কাফেররা মহানবীকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে পারে এবং তাঁর জন্য বিপর্যয় কামনা করতে পারে; কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ কখনও কল্যাণ বয়ে না এনে তার পরিণতি হবে বিপর্যয়। 'Raib' শব্দটি বহুবিধ অর্থ বিদ্যমান দেখুন [ ১৪ : ৯ ] আয়াতের টিকা ১৮৮৪ ] কোন কোন তফসীরকারের মতে, "মারাত্বক বিপদ" শব্দটি দ্বারা মৃত্যুকে বোঝানো হয়েছে।
৫০৬৫। দেখুন আয়াত [ ৯: ৫২ ] যদি দুষ্ট ও মন্দ লোকেরা মহানবীর বিপর্যয়ের প্রতীক্ষা করে থাকে, তবে মহানবীও আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের প্রতীক্ষা করবেন। তাঁর এবং তাঁর অত্যাচারীদের মধ্যে ন্যায় বিচারের মালিক একমাত্র আল্লাহ্। রাসুলের (সা ) সংগ্রাম ছিলো ন্যায় ও সত্যের জন্য। আল্লাহ্র সাহায্য সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে বিদ্যমান।
৫০৬৬। সত্যের নির্যাতনকারীরা সীমালঙ্ঘন করতে পারে কারণ সত্যকে অবদমিত করার ফলে তাদের সত্যকে অনুভব করা ও উপলব্ধির মাধ্যমে অন্তরে গ্রহণ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এ কথা সার্বজনীন সত্য ছিলো, অদ্যাবধিও তা আছে, এবং ভবিষ্যতেও ঠিক তেমনি থাকবে। এ সব সত্যত্যাগী লোকেরা হয় সীমালঙ্ঘনকারী, বিকৃত মনা ও আল্লাহ্র আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। এদের একমাত্র চেষ্টা থাকে নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধার। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দুর্বলকে নির্যাতন করা এবং মানুষের প্রতি ন্যায় বিচারে বাধার সৃষ্টি করা। এদের বিচার বুদ্ধি এদের ন্যায় ও সত্যের প্রতি প্ররোচিত করে না।
৫০৬৭। দেখুন আয়াত [ ৫১ : ৫৩]।
৫০৬৮। রাসুলের (সা) প্রতি বহুবিধ অভিযোগ যেমন গণক, উম্মাদ, বিদ্বেষপূর্ণ কবিতার রচয়িতা ইত্যাদি, অভিযোগের সাথে তারা আর একটি অভিযোগ যুক্ত করেছিলো তা হচেছ প্রতারণার অভিযোগ। তারা বলতো যে, কোরাণের আয়াত সমূহ আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ নয়, তা রাসুলের (সা ) স্বরচিত। তারা বলতে চেয়েছিলো যে, কোরাণ আসলে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ নয়। এই মানসিকতা রসুলের (সা) যুগেও যেমন অবিশ্বাসীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিলো, বর্তমানেও আছে। এই মানসিকতা ঘোর নাস্তিক ও অবিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য। এদের এ অবিশ্বাসের উত্তরেই আয়াত [ ১৭ : ৮৮] তে অবিশ্বাসীদের আল্লাহ্ আহ্বান করেছেন এরূপ একটি আয়াত রচনার জন্য। তারা অবশ্যই তা পারবে না। দেখুন টিকা নং ৩৭ - ৩৯।
৫০৭০। নিরাকার আল্লাহ্র বিশালত্ব, জ্ঞান, ক্ষমতা, ও প্রজ্ঞা তখনই অনুভব করা সম্ভব যখন সে সম্বন্ধে চিন্তা করা যায়। উর্দ্ধে সুর্যালোকিত সুনীল গগন, নক্ষত্রখচিত রাত্রির আকাশ, চন্দ্রালোকিত দূর নীলিমার স্নিগ্ধরূপ, নীচে নীল সমুদ্র বেষ্টিত ফল, ফুলে সুশোভিত সবুজ ধরাতল এ সবেরই সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহ্। এ সবের সৃষ্টি কর্তা যদি আল্লাহ্ না হন তবে কে ? এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর তাদের নিকট নাই। কারণ বিশ্বাসহীনতা তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে বিলুপ্ত করে দেয়।
৫০৭১। দেখুন [ ৬ : ৫০ ] আয়াত ও টিকা ৮৬৭। আল্লাহ্র জ্ঞানের ভান্ডার অসীম। বিশ্ব প্রকৃতির সর্বত্র আল্লাহ্র জ্ঞানের নিদর্শন ছড়ানো আছে। মানুষ বিজ্ঞান চর্চ্চার মাধ্যমে আল্লাহ্র জ্ঞানের অপার রহস্যকে উন্মোচন করতে চেষ্টা করে মাত্র। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী ও সন্দেহ বাতিক তারা এই জ্ঞানকে আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রূপে স্বীকার করে না। কারণ তাদের আত্মা অন্ধকারে আচ্ছাদিত। সেখানে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর প্রবেশ রুদ্ধ। সুতারাং পার্থিব জ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে অপার্থিব জগতে উত্তোরণের উপায় তাদের নিকট অনুপস্থিত। আল্লাহ্র অনুগ্রহ যে বিশ্বাসের আলোয় সিক্ত হয়ে অন্তরকে আলোকিত করে এ অনুভূতি লাভে তারা অক্ষম।
৫০৭২। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৬ : ৬৫ ]। মোশরেক আরবদের যে অন্ধ বিশ্বাস ছিলো যে, বস্তুগত সিঁড়ির মাধ্যমে আকাশে আরোহণ করে আল্লাহ্র রহস্য উদ্ঘাটিত করা সম্ভব ; তারই প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
৫০৭৩। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ৫৭ - ৫৯ ] ও টিকা ২০৮২। আল্লাহ্র একত্বের ধারণায় আল্লাহ্র ছেলে বা মেয়ে সন্তান অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু পৌত্তলিক আরবেরা বিশ্বাস করতো যে ফেরেশতারা আল্লাহ্র কন্যা সন্তান। কি অদ্ভুদ ব্যাপার, যে কন্যা সন্তানকে তারা ঘৃণা করতো এবং জীবন্ত কবর দিত তাকেই তারা আল্লাহ্র অংশরূপে কল্পনা করতো এবং নিজেদের জন্য পুত্র সন্তান ধারণা করতো।
৫০৭৪। মানুষকে সঠিক পথে চালিত করার জন্য আল্লাহ্র রাসুল (সা ) আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সমূহ প্রচার করতেন। মানুষের মঙ্গল কামনাই ছিলো তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। তবে কেন মানুষ তাঁকে অত্যাচার ও নির্যাতন করে ?
৫০৭৫। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের মাধ্যমে অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান মানুষকে দান করা হয়েছে। দৃষ্টি সীমার বাইরে যে আধ্যাত্মিক জগত, সে জগতের জ্ঞান চেষ্টার মাধ্যমে, অনুভবের মাধ্যমে আত্মার মাঝে উপলব্ধি করতে হয়। অন্যথায় তা চিরদিন মানুষের আওতার বাইরে থেকে যায়।
৫০৭৬। যাদের মাঝে প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুপস্থিত শুধু তারাই পারে প্রকৃত কল্যাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে। এরা হচ্ছে শয়তানের শিকার।
৫০৭৭। " আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের অন্য কোন ইলাহ্ আছে কি ? " উপরের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে যে প্রশ্নরাজিকে উপস্থাপন করা হয়েছে, এই প্রশ্নের মাধ্যমে সে সব প্রশ্নের সার সংক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হয়েছে না সূচক। আল্লাহ্র একত্বের উপদেশ, প্রত্যাদেশ এবং পরলোক সম্পর্কে জ্ঞান এভাবেই বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রচার করা হয়েছে। এভাবেই অবিশ্বাসীদের অবস্থানকে অনুসন্ধান ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই সূরাটি শেষ করা হয়েছে এই পরামর্শ দিয়ে যে যারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে ও একত্বে বিশ্বাসী নয়, তাদের ভাগ্য তাদের উপরে ছেড়ে দেয়ার জন্য। তারা কখনও ঈমান বা বিশ্বাস আনবে না। সময় তার জাল বুনে যাবে ও আল্লাহ্র পরিকল্পনা নির্দ্দিষ্ট গতিতে পরিপূর্ণতা লাভ করবে। অবিশ্বাসীদের অবিশ্বাসে কিছু ক্ষতি বা বৃদ্ধি হবে না।
৫০৭৮। দেখুন [ ২৬: ১৮৭ ] আয়াত। অবিশ্বাসী আইকাবাসীরা আল্লাহ্র নবী সুয়েবকে তার নবুয়তের প্রমাণ দাখিলের জন্য এরূপ প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করেছিলো। তারা বলেছিলো যে, " তুমি যদি সত্যিই আল্লাহ্র নবী হও, তবে একখন্ড আকাশকে মাটিতে আমাদের উপরে ফেলে দাও।" ঠিক এই বাক্য না হলেও এরূপ হঠকারী আহ্বান আল্লাহ্র সকল রসুলদেরই করা হয়েছিলো। এরূপ হঠকারীতা দ্বারা তারা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত রসুলদের প্রতি অবিশ্বাসকেই প্রমাণ করতে চেয়েছে। এরূপ হঠকারীতা অর্থহীন। কারণ আল্লাহ্ যদি তাদের উপরে একখন্ড আকাশকে ফেলেও দিতেন, তবুও তাদের আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস জন্মাতো না। প্রকৃত পক্ষে তখন তারা অন্য যুক্তির অবতারণা করতো যেমন : বলতো, " ইহা তো এক পুঞ্জীভূত মেঘ।" কারও যদি ঈমান বা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস আনার কোন ইচ্ছাই না থাকে তবে তাকে বিশ্বাস করানো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। আকাশ মাটিতে পতনের মত অসম্ভব ঘটনাও তার জ্ঞান চক্ষুকে উম্মীলিত করতে সাহায্য করতো না। আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য অত্যাচার্য অসম্ভব কোনও ঘটনা ঘটানোর প্রয়োজন নাই। কারণ আল্লাহ্র সৃষ্টির এত অপূর্ব সব নিদর্শন আমাদের চারিপার্শ্বে বিদ্যমান যে, যে দেখতে চায় সে দেখতে পায়।
৫০৭৯। "সেইদিন " অর্থাৎ শেষ বিচারের দিন। দেখুন [ ৩৯ : ৬৮] আয়াত ও টিকা ৪৩৪৩।
৫০৮০। শেষ বিচারের দিন প্রত্যেকের জন্য এক অবশ্যাম্ভবী সত্য। জালিমদের কোনও ষড়যন্ত্র সেদিন কোন কাজে আসবে না। এই শাস্তি ব্যতীতও জালিমদের জন্য আরও শাস্তি রয়েছে - সে শাস্তি হবে ইহকালেই - পার্থিব বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে।
৫০৮১। আল্লাহ্র রাসুল তাঁর প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন; এই আল্লাহ্র হুকুম। ফলাফল আল্লাহ্র হাতে। তিনি শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন। এ কথা স্মরণ রাখবেন যে, আল্লাহ্ ভুলে যান নাই। রাসুল (সা) সর্বদা আল্লাহ্র দৃষ্টির সম্মুখে, তাঁর সদয় তত্ত্বাবধানে এবং নিরাপত্তায় আছেন। এবং তিনি সর্বদা আল্লাহ্র পবিত্রতা ঘোঘণা করবেন।
উপদেশ : রাসুলের মাধ্যমে বিশ্বজনীন উপদেশ দান করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট বস্তু প্রতিটিরই হিসাব ও খবর রাখেন। প্রত্যেকেই স্ব স্ব কর্তব্য কর্ম নিষ্ঠার সাথে করে যাবে। ফলাফলের জন্য ধৈর্য্য ধারণ করবে। মানব জীবনে ধৈর্য্য হচ্ছে এক অমূল্য গুণাবলী।
৫০৮২। "যখন তুমি শয্যা ত্যাগ কর " এই লাইনটি ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে, "While thou standest forth" কারণ Taqumu শব্দটি অনেক অনুবাদকারক মনে করেন অর্থ হওয়া উচিত ঘুম থেকে ওঠা। বিভিন্ন সূরাতে কোরাণের ভাষার প্রয়োগের ধারা থেকে এর অনুবাদ করা হয়েছে "ÒWhile you standest forth" যেমন সূরা [ ২৬ : ২১৮ ] আয়াতে "La yaqum an-nasubil-qisit" দুটি শব্দ আছে "Hina Taquma" অর্থাৎ [ প্রার্থনায় ] দাড়ানো। সূরা [ ৫৭ : ২৫ ] আয়াতে শব্দটির অর্থ " মানুষ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে" অর্থাৎ মানুষ তাঁর দৈনন্দিক জীবনের সকল কাজ ন্যায়ের সাথে সম্পাদন করবে। আবার সূরা [ ৭৮: ৩৮] আয়াতের শব্দ "yaqumu" অর্থ ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়।
উপরের প্রয়োগের ধারা থেকে এই আয়াতের ইংরেজী অনুবাদে "দাঁড়ানো " শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এর সার্বিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ রাসুলের মাধ্যমে বিশ্বজনীন উপদেশ দিয়েছেন যে, দাঁড়িয়ে আল্লাহ্র প্রশংসা করা অথবা রাত্রির কিছু অংশ ও ঊষালগ্নে যখন জীবনের কোলাহল ক্ষণকালের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন আল্লাহ্র প্রশংসা করা।
৫০৮৩। এই আয়াতের অর্থ সার্বজনীন। কোন নির্দ্দিষ্ট ওয়াক্তের নামাজের কথা এখানে বলা হয় নাই। রাত্রির কিছু অংশ প্রার্থনায় ব্যয় করা কল্যাণকর ; দেখুন সূরা [ ৭৩ : ৬ ] আয়াত। প্রত্যুষ হচ্ছে দিনের পুণরাবৃত্তির সূচনা তবুও তা প্রতিদিনই নূতন, সতেজ এবং অত্যাচর্য ঘটনা, আধ্যাত্মিক উদ্দীপনাতে ভরপুর ; দেখুন সূরা [ ১৭ : ৭৮-৭৯ ] আয়াত।
৫০৮৪। "Idbar un-nujum" - অস্তগামী তারা। অর্থাৎ সুবে সাদেকের সময়, যখন তারকারাজি অস্ত যায় ; রাতের আঁধার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে দিনের সূচনা শুরু হয়, এ সময়েই প্রভাতের প্রভুর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। সূরা [ ১১ : ৩১ ] আয়াতে ও [১১৩:১] আয়াতে।
২৯। সুতারাং [ তোমার প্রভুর ] প্রশংসা ঘোষণা কর ৫০৬৩। তোমার প্রভুর অনুগ্রহে তুমি গণক নও, উম্মাদও নও।
৫০৬৩। কাফেররা মহানবীকে গণক বা উম্মাদ বলে বিদ্রূপ করতো। যুগে যুগে এ ভাবেই সত্যকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে বাঁধা দান করা হয়ে থাকে। আল্লাহ্র হুকুম মহানবীর উদাহরণের মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, সত্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেউ যেনো পিছিয়ে না যায়।
৩০। অথবা তারা কি [ একথাও ] বলে : - " এ তো একজন কবি মাত্র। আমরা তার মারাত্মক বিপদের [মৃত্যুর ] অপেক্ষা করছি।" ৫০৬৪।
৫০৬৪। কাফেররা মহানবীকে কবি বলে বিদ্রূপ করতো কারণ কোরাণের আয়াতকে তারা মহানবীর রচিত কবিতা বলে অভিহিত করতো এবং বলতো যে তা মানুষের অকল্যাণের সংবাদ দেয়। কাফেররা মহানবীকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে পারে এবং তাঁর জন্য বিপর্যয় কামনা করতে পারে; কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ কখনও কল্যাণ বয়ে না এনে তার পরিণতি হবে বিপর্যয়। 'Raib' শব্দটি বহুবিধ অর্থ বিদ্যমান দেখুন [ ১৪ : ৯ ] আয়াতের টিকা ১৮৮৪ ] কোন কোন তফসীরকারের মতে, "মারাত্বক বিপদ" শব্দটি দ্বারা মৃত্যুকে বোঝানো হয়েছে।
৩১। তুমি বল :, " তোমরা প্রতীক্ষা কর ! আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।" ৫০৬৫।
৫০৬৫। দেখুন আয়াত [ ৯: ৫২ ] যদি দুষ্ট ও মন্দ লোকেরা মহানবীর বিপর্যয়ের প্রতীক্ষা করে থাকে, তবে মহানবীও আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের প্রতীক্ষা করবেন। তাঁর এবং তাঁর অত্যাচারীদের মধ্যে ন্যায় বিচারের মালিক একমাত্র আল্লাহ্। রাসুলের (সা ) সংগ্রাম ছিলো ন্যায় ও সত্যের জন্য। আল্লাহ্র সাহায্য সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে বিদ্যমান।
৩২। তবে কি ওদের বুঝার ক্ষমতা ওদেরকে এই বিষয়ে প্ররোচিত করে ৫০৬৬, না কি তারা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায় ৫০৬৭?
৫০৬৬। সত্যের নির্যাতনকারীরা সীমালঙ্ঘন করতে পারে কারণ সত্যকে অবদমিত করার ফলে তাদের সত্যকে অনুভব করা ও উপলব্ধির মাধ্যমে অন্তরে গ্রহণ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এ কথা সার্বজনীন সত্য ছিলো, অদ্যাবধিও তা আছে, এবং ভবিষ্যতেও ঠিক তেমনি থাকবে। এ সব সত্যত্যাগী লোকেরা হয় সীমালঙ্ঘনকারী, বিকৃত মনা ও আল্লাহ্র আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। এদের একমাত্র চেষ্টা থাকে নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধার। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দুর্বলকে নির্যাতন করা এবং মানুষের প্রতি ন্যায় বিচারে বাধার সৃষ্টি করা। এদের বিচার বুদ্ধি এদের ন্যায় ও সত্যের প্রতি প্ররোচিত করে না।
৫০৬৭। দেখুন আয়াত [ ৫১ : ৫৩]।
৩৩। অথবা তারা কি বলে, " এই [ কুর-আনের ] বাণী তাঁর নিজ রচনা ৫০৬৮ ? " বরং তাদের কোন ঈমান নাই।
৩৪। ওরা যদি সত্যবাদী হয় তবে ইহার অনুরূপ কোন রচনা উপস্থিত করুক না !
৩৪। ওরা যদি সত্যবাদী হয় তবে ইহার অনুরূপ কোন রচনা উপস্থিত করুক না !
৫০৬৮। রাসুলের (সা) প্রতি বহুবিধ অভিযোগ যেমন গণক, উম্মাদ, বিদ্বেষপূর্ণ কবিতার রচয়িতা ইত্যাদি, অভিযোগের সাথে তারা আর একটি অভিযোগ যুক্ত করেছিলো তা হচেছ প্রতারণার অভিযোগ। তারা বলতো যে, কোরাণের আয়াত সমূহ আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ নয়, তা রাসুলের (সা ) স্বরচিত। তারা বলতে চেয়েছিলো যে, কোরাণ আসলে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ নয়। এই মানসিকতা রসুলের (সা) যুগেও যেমন অবিশ্বাসীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিলো, বর্তমানেও আছে। এই মানসিকতা ঘোর নাস্তিক ও অবিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য। এদের এ অবিশ্বাসের উত্তরেই আয়াত [ ১৭ : ৮৮] তে অবিশ্বাসীদের আল্লাহ্ আহ্বান করেছেন এরূপ একটি আয়াত রচনার জন্য। তারা অবশ্যই তা পারবে না। দেখুন টিকা নং ৩৭ - ৩৯।
৩৫। ওরা কি [ স্রষ্টা ব্যতীত ] শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে না কি তারা নিজেরাই স্রষ্টা ?
৩৬। অথবা তারা কি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে ? বরং তাদের কোন দৃঢ় বিশ্বাস নাই ৫০৭০।
৩৬। অথবা তারা কি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে ? বরং তাদের কোন দৃঢ় বিশ্বাস নাই ৫০৭০।
৫০৭০। নিরাকার আল্লাহ্র বিশালত্ব, জ্ঞান, ক্ষমতা, ও প্রজ্ঞা তখনই অনুভব করা সম্ভব যখন সে সম্বন্ধে চিন্তা করা যায়। উর্দ্ধে সুর্যালোকিত সুনীল গগন, নক্ষত্রখচিত রাত্রির আকাশ, চন্দ্রালোকিত দূর নীলিমার স্নিগ্ধরূপ, নীচে নীল সমুদ্র বেষ্টিত ফল, ফুলে সুশোভিত সবুজ ধরাতল এ সবেরই সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহ্। এ সবের সৃষ্টি কর্তা যদি আল্লাহ্ না হন তবে কে ? এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর তাদের নিকট নাই। কারণ বিশ্বাসহীনতা তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে বিলুপ্ত করে দেয়।
৩৭। অথবা তোমার প্রভুর ধনভান্ডার কি তাদের নিকট রয়েছে ৫০৭১, নাকি ওরা এই সমুদয়ের নিয়ন্তা ?
৫০৭১। দেখুন [ ৬ : ৫০ ] আয়াত ও টিকা ৮৬৭। আল্লাহ্র জ্ঞানের ভান্ডার অসীম। বিশ্ব প্রকৃতির সর্বত্র আল্লাহ্র জ্ঞানের নিদর্শন ছড়ানো আছে। মানুষ বিজ্ঞান চর্চ্চার মাধ্যমে আল্লাহ্র জ্ঞানের অপার রহস্যকে উন্মোচন করতে চেষ্টা করে মাত্র। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী ও সন্দেহ বাতিক তারা এই জ্ঞানকে আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রূপে স্বীকার করে না। কারণ তাদের আত্মা অন্ধকারে আচ্ছাদিত। সেখানে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর প্রবেশ রুদ্ধ। সুতারাং পার্থিব জ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে অপার্থিব জগতে উত্তোরণের উপায় তাদের নিকট অনুপস্থিত। আল্লাহ্র অনুগ্রহ যে বিশ্বাসের আলোয় সিক্ত হয়ে অন্তরকে আলোকিত করে এ অনুভূতি লাভে তারা অক্ষম।
৩৮। অথবা ওদের কি কোন সিড়ি রয়েছে ৫০৭২, যার সাহায্যে তারা আসমানে আরোহণ করে [ গোপন কথা ] শ্রবণ করতে পারে ? তাহলে তাদের [ এরূপ ] কোন শ্রবণকারীর সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করুক।
৫০৭২। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৬ : ৬৫ ]। মোশরেক আরবদের যে অন্ধ বিশ্বাস ছিলো যে, বস্তুগত সিঁড়ির মাধ্যমে আকাশে আরোহণ করে আল্লাহ্র রহস্য উদ্ঘাটিত করা সম্ভব ; তারই প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
৩৯। তবে কি কন্যা সন্তান তাঁর জন্য এবং পুত্র সন্তান তোমাদের জন্য ৫০৭৩?
৫০৭৩। দেখুন আয়াত [ ১৬ : ৫৭ - ৫৯ ] ও টিকা ২০৮২। আল্লাহ্র একত্বের ধারণায় আল্লাহ্র ছেলে বা মেয়ে সন্তান অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু পৌত্তলিক আরবেরা বিশ্বাস করতো যে ফেরেশতারা আল্লাহ্র কন্যা সন্তান। কি অদ্ভুদ ব্যাপার, যে কন্যা সন্তানকে তারা ঘৃণা করতো এবং জীবন্ত কবর দিত তাকেই তারা আল্লাহ্র অংশরূপে কল্পনা করতো এবং নিজেদের জন্য পুত্র সন্তান ধারণা করতো।
৪০। অথবা তুমি কি তাদের নিকট পারিশ্রমিক চাইছ, যার ফলে, তারা ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত ৫০৭৪ ?-
৫০৭৪। মানুষকে সঠিক পথে চালিত করার জন্য আল্লাহ্র রাসুল (সা ) আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সমূহ প্রচার করতেন। মানুষের মঙ্গল কামনাই ছিলো তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। তবে কেন মানুষ তাঁকে অত্যাচার ও নির্যাতন করে ?
৪১। অথবা তাদের নিকট কি অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান আছে এবং তারা তা লিখে নেয় ৫০৭৫ ?
৫০৭৫। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের মাধ্যমে অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান মানুষকে দান করা হয়েছে। দৃষ্টি সীমার বাইরে যে আধ্যাত্মিক জগত, সে জগতের জ্ঞান চেষ্টার মাধ্যমে, অনুভবের মাধ্যমে আত্মার মাঝে উপলব্ধি করতে হয়। অন্যথায় তা চিরদিন মানুষের আওতার বাইরে থেকে যায়।
৪২। অথবা তারা কি [ তোমার বিরুদ্ধে ] ষড়যন্ত্র করে ৫০৭৬ ? কিন্তু যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে, তারা নিজেরাই ষড়যন্ত্রের শিকার।
৫০৭৬। যাদের মাঝে প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুপস্থিত শুধু তারাই পারে প্রকৃত কল্যাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে। এরা হচ্ছে শয়তানের শিকার।
৪৩। আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের কি অন্য কোন উপাস্য আছে ৫০৭৭ ? তারা যাকে শরীক স্থির করে আল্লাহ্ তা থেকে পবিত্র।
৫০৭৭। " আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের অন্য কোন ইলাহ্ আছে কি ? " উপরের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে যে প্রশ্নরাজিকে উপস্থাপন করা হয়েছে, এই প্রশ্নের মাধ্যমে সে সব প্রশ্নের সার সংক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হয়েছে না সূচক। আল্লাহ্র একত্বের উপদেশ, প্রত্যাদেশ এবং পরলোক সম্পর্কে জ্ঞান এভাবেই বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রচার করা হয়েছে। এভাবেই অবিশ্বাসীদের অবস্থানকে অনুসন্ধান ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই সূরাটি শেষ করা হয়েছে এই পরামর্শ দিয়ে যে যারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে ও একত্বে বিশ্বাসী নয়, তাদের ভাগ্য তাদের উপরে ছেড়ে দেয়ার জন্য। তারা কখনও ঈমান বা বিশ্বাস আনবে না। সময় তার জাল বুনে যাবে ও আল্লাহ্র পরিকল্পনা নির্দ্দিষ্ট গতিতে পরিপূর্ণতা লাভ করবে। অবিশ্বাসীদের অবিশ্বাসে কিছু ক্ষতি বা বৃদ্ধি হবে না।
৪৪। ওরা আকাশের কোন খন্ড [ তাদের উপরে ] ভেঙ্গে পড়তে দেখলে তারা শুধুমাত্র বলবে ৫০৭৮ ; "ইহা তো এক পুঞ্জীভূত মেঘ।"
৫০৭৮। দেখুন [ ২৬: ১৮৭ ] আয়াত। অবিশ্বাসী আইকাবাসীরা আল্লাহ্র নবী সুয়েবকে তার নবুয়তের প্রমাণ দাখিলের জন্য এরূপ প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করেছিলো। তারা বলেছিলো যে, " তুমি যদি সত্যিই আল্লাহ্র নবী হও, তবে একখন্ড আকাশকে মাটিতে আমাদের উপরে ফেলে দাও।" ঠিক এই বাক্য না হলেও এরূপ হঠকারী আহ্বান আল্লাহ্র সকল রসুলদেরই করা হয়েছিলো। এরূপ হঠকারীতা দ্বারা তারা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত রসুলদের প্রতি অবিশ্বাসকেই প্রমাণ করতে চেয়েছে। এরূপ হঠকারীতা অর্থহীন। কারণ আল্লাহ্ যদি তাদের উপরে একখন্ড আকাশকে ফেলেও দিতেন, তবুও তাদের আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস জন্মাতো না। প্রকৃত পক্ষে তখন তারা অন্য যুক্তির অবতারণা করতো যেমন : বলতো, " ইহা তো এক পুঞ্জীভূত মেঘ।" কারও যদি ঈমান বা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস আনার কোন ইচ্ছাই না থাকে তবে তাকে বিশ্বাস করানো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। আকাশ মাটিতে পতনের মত অসম্ভব ঘটনাও তার জ্ঞান চক্ষুকে উম্মীলিত করতে সাহায্য করতো না। আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য অত্যাচার্য অসম্ভব কোনও ঘটনা ঘটানোর প্রয়োজন নাই। কারণ আল্লাহ্র সৃষ্টির এত অপূর্ব সব নিদর্শন আমাদের চারিপার্শ্বে বিদ্যমান যে, যে দেখতে চায় সে দেখতে পায়।
৪৫। সুতারাং তাদের সেদিন পর্যন্ত একা থাকতে দাও যেদিন তারা [ ভয়ে ] হতচেতন হতে [বাধ্য হবে ] ৫০৭৯,
৪৬। যেদিন তাদের শঠতা তাদের কোন কাজে আসবে না, এবং তাদের কোন সাহায্যও করা হবে না।
৪৬। যেদিন তাদের শঠতা তাদের কোন কাজে আসবে না, এবং তাদের কোন সাহায্যও করা হবে না।
৫০৭৯। "সেইদিন " অর্থাৎ শেষ বিচারের দিন। দেখুন [ ৩৯ : ৬৮] আয়াত ও টিকা ৪৩৪৩।
৪৭। যারা পাপ করে, অবশ্যই তাদের জন্য এ ছাড়া [ দুনিয়াতে ] আরও শাস্তি রয়েছে ৫০৮০। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বুঝতে পারে না।
৫০৮০। শেষ বিচারের দিন প্রত্যেকের জন্য এক অবশ্যাম্ভবী সত্য। জালিমদের কোনও ষড়যন্ত্র সেদিন কোন কাজে আসবে না। এই শাস্তি ব্যতীতও জালিমদের জন্য আরও শাস্তি রয়েছে - সে শাস্তি হবে ইহকালেই - পার্থিব বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে।
৪৮। ধৈর্য ধারণ কর তোমার প্রভুর নির্দ্দেশের অপেক্ষায় ; নিশ্চয়ই তুমি আমার চোখের সামনেই রয়েছ ৫০৮১। এবং যখন তুমি শয্য্ ত্যাগ কর, তুমি তোমার প্রভুর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। ৫০৮২
৫০৮১। আল্লাহ্র রাসুল তাঁর প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন; এই আল্লাহ্র হুকুম। ফলাফল আল্লাহ্র হাতে। তিনি শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন। এ কথা স্মরণ রাখবেন যে, আল্লাহ্ ভুলে যান নাই। রাসুল (সা) সর্বদা আল্লাহ্র দৃষ্টির সম্মুখে, তাঁর সদয় তত্ত্বাবধানে এবং নিরাপত্তায় আছেন। এবং তিনি সর্বদা আল্লাহ্র পবিত্রতা ঘোঘণা করবেন।
উপদেশ : রাসুলের মাধ্যমে বিশ্বজনীন উপদেশ দান করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট বস্তু প্রতিটিরই হিসাব ও খবর রাখেন। প্রত্যেকেই স্ব স্ব কর্তব্য কর্ম নিষ্ঠার সাথে করে যাবে। ফলাফলের জন্য ধৈর্য্য ধারণ করবে। মানব জীবনে ধৈর্য্য হচ্ছে এক অমূল্য গুণাবলী।
৫০৮২। "যখন তুমি শয্যা ত্যাগ কর " এই লাইনটি ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে, "While thou standest forth" কারণ Taqumu শব্দটি অনেক অনুবাদকারক মনে করেন অর্থ হওয়া উচিত ঘুম থেকে ওঠা। বিভিন্ন সূরাতে কোরাণের ভাষার প্রয়োগের ধারা থেকে এর অনুবাদ করা হয়েছে "ÒWhile you standest forth" যেমন সূরা [ ২৬ : ২১৮ ] আয়াতে "La yaqum an-nasubil-qisit" দুটি শব্দ আছে "Hina Taquma" অর্থাৎ [ প্রার্থনায় ] দাড়ানো। সূরা [ ৫৭ : ২৫ ] আয়াতে শব্দটির অর্থ " মানুষ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে" অর্থাৎ মানুষ তাঁর দৈনন্দিক জীবনের সকল কাজ ন্যায়ের সাথে সম্পাদন করবে। আবার সূরা [ ৭৮: ৩৮] আয়াতের শব্দ "yaqumu" অর্থ ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়।
উপরের প্রয়োগের ধারা থেকে এই আয়াতের ইংরেজী অনুবাদে "দাঁড়ানো " শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এর সার্বিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ রাসুলের মাধ্যমে বিশ্বজনীন উপদেশ দিয়েছেন যে, দাঁড়িয়ে আল্লাহ্র প্রশংসা করা অথবা রাত্রির কিছু অংশ ও ঊষালগ্নে যখন জীবনের কোলাহল ক্ষণকালের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন আল্লাহ্র প্রশংসা করা।
৪৯। এবং আল্লাহ্র প্রশংসা ঘোষণা কর রাত্রির কিয়দংশ এবং তারকাদের অস্তগমনের পর ৫০৮৩, ৫০৮৪।
৫০৮৩। এই আয়াতের অর্থ সার্বজনীন। কোন নির্দ্দিষ্ট ওয়াক্তের নামাজের কথা এখানে বলা হয় নাই। রাত্রির কিছু অংশ প্রার্থনায় ব্যয় করা কল্যাণকর ; দেখুন সূরা [ ৭৩ : ৬ ] আয়াত। প্রত্যুষ হচ্ছে দিনের পুণরাবৃত্তির সূচনা তবুও তা প্রতিদিনই নূতন, সতেজ এবং অত্যাচর্য ঘটনা, আধ্যাত্মিক উদ্দীপনাতে ভরপুর ; দেখুন সূরা [ ১৭ : ৭৮-৭৯ ] আয়াত।
৫০৮৪। "Idbar un-nujum" - অস্তগামী তারা। অর্থাৎ সুবে সাদেকের সময়, যখন তারকারাজি অস্ত যায় ; রাতের আঁধার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে দিনের সূচনা শুরু হয়, এ সময়েই প্রভাতের প্রভুর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। সূরা [ ১১ : ৩১ ] আয়াতে ও [১১৩:১] আয়াতে।