+
-
R
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : মক্কাতে অবতীর্ণ প্রাথমিক সূরাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম এবং সাতটি সূরার শ্রেণীর এটি চতুর্থ সূরা।
এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে, প্রত্যাদেশ কোন বিভ্রান্তি নয়। বিভ্রান্তি তাদের জন্য যারা একে অবিশ্বাস করে এবং আল্লাহ্র সম্বন্ধে মিথ্যা ধারণা পোষণ করে। সকল কিছুর উৎপত্তি আল্লাহ্ থেকে।
সার সংক্ষেপ : রাসুল (সা ) প্রত্যাদেশ লাভ করেন তা কোনও মিথ্যা বা প্রতারণা নয়, তিনি কোন ব্যক্তিগত স্বার্থের উদ্দেশ্যে তা প্রচার করেন না। এই প্রত্যাদেশ পরিষ্কারভাবে আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত। আল্লাহ্র অস্তিত্ব কোনও মিথ্যা কল্পনাপ্রসূত নয়। তিনি সর্বেসর্বা ; প্রথম এবং শেষ ; সকল কিছুর প্রভু; পরম ক্ষমাশীল। [ ৫৩ : ১-৩২ ]।
যারা আল্লাহ্র দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা অজ্ঞ ও ক্ষুদ্রমনা ; তারা জানে না যে এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর স্রষ্টা এক আল্লাহ্ ; মানুষ, বিশ্ব প্রকৃতি, অতীত, বর্তমান সকল কিছুর প্রভু তিনি। সুতারাং তারই এবাদত কর। [ ৫৩ : ৩৩ - ৬২ ]।
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৫০৮৫। "An-Najm" - এই শব্দটির সঠিক ব্যাখ্যা অতি দুরূহ কাজ। বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এর ব্যাখ্যাও বিভিন্ন হয়ে পড়ছে। অস্তমিত নক্ষত্রের অর্থ করতে যেয়ে অনেকে বলেছেন যে তা হলো নক্ষত্রের শেষ অবস্থা যেমন : আমাদের সূর্য একটি নক্ষত্র যা একদিন তার জ্বালানি শেষে অস্তমিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। নক্ষত্রের অস্তমিত হওয়া হচ্ছে আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে বিণীত হওয়া। বিনয়ের প্রতীক হিসেবে একে কল্পনা করা যেতে পারে। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ আল্লাহ্র সৌন্দর্য্য, ক্ষমতা ও জ্ঞানের সর্বোচ্চ প্রকাশ।
৫০৮৬। " তোমাদের সঙ্গী " এই বাক্যটি দ্বারা রাসুলুল্লাহ্ কে ( সা ) বোঝানো হয়েছে যিনি কোরাইশদের মাঝে অবস্থান করছিলেন। অবিশ্বাসীরা তাঁর বিরুদ্ধে যে তিন ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করেছিলো তারই জবাব এখানে প্রদান করা হয়। কোরাইশদের অভিযোগ সমূহ ছিলো নিম্নরূপ :
১) হয় তিনি বুদ্ধির দোষে বিভ্রান্ত কিংবা অমনোযোগী।
২) অথবা তিনি অশুভ শক্তির প্ররোচনায় বিপথগামী।
৩) অথবা তিনি উত্তেজনা বা আবেগ তাড়িত হয়ে মনগড়া কথা বলেন। অথবা নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, নিজ ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য মনগড়া কথা বলেন।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, এই অভিযোগ গুলির একটিও সত্য নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে তিনি সরাসরি আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত।
৫০৮৭। আয়াত নং [ ৫-৬] যে বর্ণনা আছে তফসীরকারগণ মনে করেন তার দ্বারা জিব্রাইল ফেরেশতাকে বোঝানো হয়েছে।
৫০৮৮। রাসুলুল্লাহ্ (সা) এর নবুয়তের প্রথম দিকে জিব্রাইল ( আ ) কে তাঁর পূর্ণ অবয়বে তিনি একবার দর্শন করেছিলেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।
৫০৮৯। "দুই ধনুকের " অর্থাৎ দুই ধনুকের পাল্লা [ ১০০-১৫০ গজ ] ব্যবধান ধরা হয়। অর্থাৎ সেই দূরত্ব যেখান থেকে পরিষ্কার দৃশ্যমান।
৫০৯০। জিব্রাইল (আ) ছিলেন আল্লাহ্র প্রেরিত দূত বিশেষ। তিনি শুধুমাত্র আল্লাহ্র বাণী বহন করে নিয়ে এসেছিলেন।
৫০৯১। এই আয়াতে 'সে ' দ্বারা রাসুলুল্লাহকে (সা ) বোঝানো হয়েছে। আরবীতে heart বা অন্তঃকরণ বলতে মানসিক দক্ষতা সমূহ যেমন বুদ্ধিমত্তা এবং আবেগ ও অনুভূতিকে বোঝানো হয়। এখানে বলা হয়েছে যে রাসুলুল্লাহ্ (সা ) যা দেখেছেন তা পবিত্র সত্য এর মাঝে কোন দৃষ্টি বিভ্রম বা বিভ্রান্তি নাই।
৫০৯২। রাসুলুল্লাহ্ (সা) হেরা পর্বতের গুহায় প্রথম বার জিব্রাইল (আ) কে দর্শন করেন, যখন তিনি প্রথম নবুয়তের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং তাঁর প্রতি প্রেরিত প্রথম শব্দটি ছিলো ইক্রা। দ্বিতীয় বার রাসুল (সা) জিব্রাইলের দর্শন লাভ করেন যখন তিনি মেরাজ গমন করেন। এ সম্বন্ধে দেখুন সূরা নং ১০ এর ভূমিকা।
৫০৯৩। "বদরী বৃক্ষ " বা"লোট বৃক্ষ " - দেখুন সূরা [ ৩৪ : ১৬ ] ও টিকা ৩৮১৪। বন্য লোট গাছ প্রচন্ড কাটাযুক্ত হয়। কিন্তু চাষাবাদ করলে তা সুস্বাদু ফল ও ছায়া উৎপাদন করে। একে বেহেশতের শান্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়েছে এখানে এবং সূরা [ ৫৬ : ২৮ ] আয়াতে।
৫০৯৪। "Jannat-al-Mawa" বেশেহত্, মুমিনদিগের বাসস্থান, তাই উহা বাসোদ্যান। অনেকের মতে মুমিনদের এই বাসস্থান লোট বৃক্ষের সন্নিকটে অবস্থিত।
৫০৯৫। উপরের আয়াত সমূহে ঐশ্বরিক মহিমা সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে অনুপম ভাষাতে। এই আয়াত থেকে বর্ণনা করা হয়েছে পার্থিব জীবনের গ্লানি সমূহ। পার্থিব জীবনের প্রধান কদর্য দিক হচ্ছে মূর্তির উপাসনা। প্রাচীন আরব মুশরিকদের তিনটি দেবীর নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবের লোকেরা বিশ্বাস করতো যে, এরা আল্লাহ্র কন্যা। এদের আকৃতিগত কাঠামো সম্বন্ধে ভিন্নমত আছে। একদলের মত হচ্ছে লাতের আকৃতি ছিলো মনুষ্যাকৃতি; উয্যা ছিলো পবিত্র গাছের আকৃতি এবং মানাত ছিলো সাদা পাথরের আকৃতি।
৫০৯৬। মুশরিক আরবেরা আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা মানুষের আকৃতির বাইরে কল্পনা করতে পারতো না। মানুষের ন্যায় রক্ত -মাংসের তৈরী, মানুষের ন্যায় সন্তানের পিতা ইত্যাদি। নিরাকার আল্লাহ্ -যার অস্তিত্ব সমগ্র বিশ্বচরাচরে পরিব্যপ্ত ; দ্যুলোকে, ভূলোকে যিনি সর্বদা বিদ্যমান, সমগ্র সৃষ্টির মাঝে যার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা বিরাজ করে সেই আল্লাহ্কে মনুষ্যরূরে কল্পনা করে মোশরেক আরবেরা আল্লাহ্র অবমাননা করতো। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যে আরবেরা কন্যা সন্তানকে অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখতো, তারা আল্লাহ্ যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সর্বশক্তিমান, তাঁর জন্য ঘৃণ্য কন্যা সন্তান কল্পনা করতো। দেখুন সূরা [ ১৬ : ৫৭ - ৫৯ ] ] আয়াত ও টিকা ২০৮২ এবং সূরা [ ৫২ : ৩৯] আয়াত ও টিকা ৫০৭৩।
৫০৯৭। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৭১] ; [ ১২ : ৪০ ] ও টিকা ১৬৯৩। পৌত্তলিকেরা তাদের সৃষ্ট পাথরের মূর্তি অথবা জাতীয় বীরশ্রেষ্ঠ তা জীবিত বা মৃত যাই হোক না কেন এমন কি আল্লাহ্র প্রেরিত রাসুল বা মুত্তাকী বান্দা যেই-ই হোক না কেন এ সবের উপাসনা করা বা উপাস্য রূপে গ্রহণ করা সবই হচ্ছে মানুষের নিজস্ব কল্পনার প্রকাশ মাত্র। তারা যেই-ই হোক না কেন, যাই-ই হোক না কেন এ কথা মনে রাখতে হবে যে, তারা সবাই আল্লাহ্র সৃষ্ট। কেউই স্রষ্টার ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না।
৫০৯৮। ধর্মীয় ব্যাপারে অনুমান করা এক অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু যুগে যুগে মানুষ তাই-ই করে থাকে। এ সবের পিছনে মানুষের নিজস্ব স্বার্থ ও হৃদয়ের প্রবৃত্তির অনুপ্রেরণা বিরাজ করে মাত্র। মানুষের নিজস্ব আকাঙ্খা ও প্রবৃত্তির প্রেরণার এ মনঃস্তত সর্বযুগে বিদ্যমান ছিলো এবং এখনও আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে। ধর্মের নামে মানুষের এই আত্মপ্রতারণার রূপ পৃথিবীর সর্বত্র বিদ্যমান - আর এ কারণেই ধর্মের নামে এত ভেদাভেদ এত সংঘর্ষ এত হানাহানি। মানুষের মনঃস্তত্বের এই চিত্র এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। দেখুন আয়াত [ ৬: ১১৬ ]।
৫০৯৯। যে আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো প্রবেশ লাভ করে নাই, সে আত্মা অন্ধকারে আবৃত্ত। সে আত্মার আশা আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়া সবই অশুভ শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; যার পরিণাম কখনও শুভ হয় না, যার পরিণামে তার জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। আল্লাহ্র কল্যাণ হস্ত মানুষের মঙ্গল কামনায় সর্বদা উম্মুখ। সে কারণেই অপবিত্র আত্মার চাওয়া-পাওয়া সকল সময়ে পূর্ণতা লাভ করে না। আত্মার পবিত্রতা আসে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো থেকে। পার্থিব জীবনের উদ্দেশ্য সর্ব শক্তিমানের সন্তুষ্টি - সৃষ্টির সকল কিছুই শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন করবে।
রুকু - ২
৫১০০। সাধারণ মানুষ ফেরেশতাদের ধারণা করে প্রভু ও ক্ষমতা ধর হিসেবে। তাঁরা ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী সন্দেহ নাই ; কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ পরিষ্কার ভাষাতে ঘোষণা করেছেন যে, ফেরেশতাদের সকল ক্ষমতা আল্লাহ্ প্রদত্ত এবং সীমিত। মানুষ আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির মাধ্যমে আল্লাহ্র ফেরেশতাদের থেকেও সম্মানিত হতে পারেন। হযরত আদমকে ফেরেশতাদের সেজদার মাধ্যমে [ ২ : ৩৪ ] এই চিরন্তন সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে এই বিশ্বজগতে সকল ক্ষমতা ও শক্তির মূল কেন্দ্র সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনও কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ্র একত্বের প্রতি এই আয়াতের দ্বারা দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে ; এবং কোরেশরা আল্লাহ্ ও মানুষের মধ্যে যে মধ্যস্তকারী শক্তি কল্পনা করতো তার নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। কোরাণের এই শক্তিশালী আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষ বিভিন্ন পীরের দরগা, বা মাজারের স্মরণাপন্ন হয়ে থাকে, আল্লাহ্র নিকট সুপারিশ করার জন্য, তা আল্লাহ্ অনুমোদন করেন না।
৫১০১। দেখুন সূরা [ ২০ : ১০৯] আয়াত এবং [ ২১ : ২৮ ] আয়াত। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, দ্যুলোকে, ভূলোকে সর্বত্র তারই হুকুম বা আইন বর্তমান। তাঁর বিনা অনুমতিতে কারও পক্ষে মধ্যস্তকারী বা সুপারিশ করা সম্ভব হবে না। শুধুমাত্র যিনি আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য হবেন, তিনিই সুপারিশ বা মধ্যস্ততা করার অনুমতি লাভ করবেন। বিভিন্ন অর্থবোধক তফসীরের জন্য দেখুন [ ২০ : ১০৯ ] আয়াতের টিকা ২৬৪৩।
৫১০২। দেখুন [ ৫৩ : ২১ ] আয়াত এবং টিকা ৫০৯৬। মোশরেক আরবদের পরলোকে বিশ্বাস ছিলো না। তাদের জীবন-ধর্ম,সকল চাওয়া, পাওয়া আবর্তিত ছিলো পার্থিব জীবনকে ঘিরে। পার্থিব জীবনে তাদের চোখে নারীকে মনে হতো মোহনীয় রূপে, সুতারাং ফেরেশতাদেরও তারা সেইরূপই কল্পনা করতে ভালোবাসতো। পৃথিবীতে যারাই আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাসী নয়, তারাই তাদের উপাস্যদের নারীমূর্তিতে কল্পনা করতে ভালোবাসে। তাদের অন্য আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের সকল চাওয়া পাওয়া আবর্তিত হয় শুধুমাত্র পার্থিব জীবনকে ঘিরে।
মন্তব্য : বাংলাদেশে মানুষ পীরের দরগায় এবং মাজারে গমন করে শুধুমাত্র পার্থিব বিপদ থেকে মুক্তি ও জাগতিক উন্নতির আশায়। এটা প্রকৃত ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না।
৫১০৩। দেখুন [ ৫৩ : ২৩ ] আয়াত ও টিকা ৫০৯৮। " সত্যের বিরুদ্ধে অনুমান কোন কাজেই আসবে না।" এই অবিস্মরণীয় উপদেশ যুগ কাল অতিক্রান্ত। শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে নয় কোরাণে এই উপদেশ দান করা হয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রের জন্য। সত্যকে তার প্রকৃতরূপে উদ্ঘাটিত করতে হবে। সত্যকে উদ্ঘাটিত করার অপর নামই হচ্ছে "বিজ্ঞান " যা আল্লাহ্র সৃষ্টি তত্বের প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটিত করে থাকে। মানুষের সামাজিক জীবনে যেমন : বিচার বিভাগ, প্রশাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটিত করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে " সত্যের মুকাবিলাতে অনুমানের কোনও মূল্য নাই।"
৫১০৪। কি অপূর্বভাবে জীবনের চিত্রকে এক কথায় অঙ্কন করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্র স্মরণে বিমুখ হয় তাদের মনঃস্তাত্বিক চিত্র অংকন করা হয়েছে এই একটি আয়াতের মাধ্যমে। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না তাদের সমগ্র সত্ত্বায় পরলোকের অস্তিত্বের কোনও স্থান নাই। তাদের মনঃজগত, চিন্তার ব্যপ্তি শুধুমাত্র এই পার্থিব জীবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে থাকে। এরা হয় প্রচন্ড ভোগবাদী ও বস্তুবাদী। এদের কেউ অর্থের, কেউ সম্মানের, কেউ খ্যাতির, কেউ ক্ষমতার, কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তির পিছনে জীবনের সকল অধ্যাবসায়,প্রচেষ্টা, মেধা, মননশক্তি, সৃজন ক্ষমতা ব্যয় করে থাকে। এদের জীবন আবর্তিত হয় পার্থিব আরাম-আয়েশ, ও যৌন সম্ভোগের আনন্দকে কেন্দ্র করে। সুতারাং তাদের চিন্তার জগতের ব্যাপ্তি পার্থিব জীবনের বাইরে সম্প্রসারিত হতে পারে না। এদের আত্মায় কোনও দিনও আধ্যাত্মিক জগতের আলো অনুভূত হতে পারে না। তাদের জ্ঞান শুধুমাত্র সীমিত পার্থিব জগতেই আবদ্ধ থাকবে। আধ্যাত্মিক জগতের দুয়ার তাদের সামনে কখনও উম্মোচিত হতে পারবে না। কারণ আধ্যাত্মিক জগতকে অনুভব করতে অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। বস্তু জগতের ভারী আবরণ তাদের অন্তর্দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবে। বৈদ্যুতিক আলোর চোখ ধাঁধানো দ্যুতি যেমন পূর্ণিমা চাঁদের আলোকেও দৃশ্যমান হতে বাঁধা দেয়। ঠিক সেরূপ বস্তু জগতের ঔজ্জ্বল্য আধ্যাত্মিক জগতকে আত্মার মাঝে অনুভবে বাধা দান করে। বৈদ্যুতিক আলো অপসারণ ব্যতীত পূর্ণিমার চাঁদের আলোর অপরূপ সৌন্দর্য যেমন প্রকাশ পায় না ; ঠিক সেরূপ পার্থিব জীবনের কামনা থেকে মুক্ত হতে না পারলে আধ্যাত্মিক জীবনের সৌন্দর্য্য, অপূর্ব শান্তি,কমনীয় রূপ, আত্মার মাঝে অনুভব করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্তে অবিশ্বাসী ও বস্তুবাদীদের ধরা ছোঁয়ার বহু দূরে থাকবে আধ্যাত্মিক জগতের রূপরেখা। অপরপক্ষে যারা আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাসী, যারা আধ্যাত্মিক জগতের আলোকে হৃদয়ের মাঝে অনুভব করতে সমর্থ হয়েছে তারা তাদের সকল ব্যর্থতা সত্বেও সঠিক পথে অবস্থান করছে। তাঁরা আল্লাহ্র হেদায়েতের জন্য উম্মুখ হয়ে থাকে; সুতারাং আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাদের সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
৫১০৫। পদার্থ বিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক নিউটনের সুত্র হচ্ছে "Every action there is an equal and opposite reaction" এই সুত্রটি শুধুমাত্র যে পদার্থের জন্য প্রযোজ্য তাই নয়, মানুষের জীবনেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। ভালো ও মন্দ প্রতিটি ঘটনার ফলাফল সমভাবে বিদ্যমান এ কথা সত্য, কিন্তু দয়াময় আল্লাহ্ মানুষকে এই আইনের আওতায় সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকেন না। আল্লাহ্র আইনের অধীনে সারা বিশ্ব ভূবন। ন্যায়বিচারক ও করুণাময় তাঁর উপাধি। মানুষের সকল কথা, কাজ, কাজের নিয়ত, মনের একান্তের চিন্তা ভাবনা কোনও কিছুই বৃথা যায় না। সবই সব কিছুর ফলাফল বহন করে। যে মন্দ কাজ করে, মন্দ কথা বলে, মন্দ চিন্তা করে তার ফলাফল তাকে বহন করতে হয়। কিন্তু মানুষের জন্য অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা আল্লাহ্র ক্ষমা লাভের ও মন্দের ফলাফল থেকে অব্যহতি লাভের সুযোগ আছে। অনুতাপ ও আত্মসংশোধন সকল পাপকে দূর করে দেয়; আল্লাহ্ তাদের পুরষ্কৃত করেন যা তাদের প্রাপ্য পুরষ্কারের থেকে বহুগুণ হয়।
৫১০৬। " তোমার প্রভু অবশ্যই অপরিসীম ক্ষমাশীল ", তাদের যোগ্যতা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে ছোটখাট অপরাধ করলেও আল্লাহ্ তাঁদের উত্তম পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করবেন না। কারণ আল্লাহ্র "ক্ষমা অপরিসীম"। তার ক্ষমার হস্ত সদা প্রসারিত। যখনই আমরা তাঁর ক্ষমাপ্রার্থী হই তিনি অকুণ্ঠভাবে ক্ষমা করেন। প্রার্থনা আত্মনিবেদন করতে সাহায্য করে। প্রার্থনার মাধ্যমে যে আত্মনিবেদন করে ক্ষমাপ্রার্থী হয় আল্লাহ্র করুণার ধারা তৎক্ষণাত প্রবাহিত হয়ে তাকে প্লাবিত করে। এই অনুভূতি প্রতিটি ক্ষমাপ্রার্থী ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে অবশ্যই অনুভব করে থাকবেন। আল্লাহ্র ক্ষমা লাভের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন, তা লাভ করা যায় প্রার্থনা ও আত্ম নিবেদনের মাধ্যমে। আল্লাহ্র নূতন করে কিছু জানার নাই। তিনি আমাদের সম্বন্ধে "সম্যক অবগত" ; তিনি সর্বজ্ঞ।
৫১০৭। দয়াময় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তিনি মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলের খবর প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল চিন্তাধারা খোলা বইয়ের ন্যায় পাঠ করতে পারেন। সুতারাং নিজেকে মুত্তাকী বা ভালো বা ন্যায়বান ইত্যাদি রূপে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হাস্যকর প্রচেষ্টা বই আর কিছু নয়। কারণ আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু মুত্তাকী অর্জন করেছি বা বিশুদ্ধ নিয়তে কতটুকু সৎকর্ম করেছি তা আল্লাহ্র নিকটে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। আমাদের প্রচারণা বা ওজর আপত্তি সেখানে অর্থহীন। "আত্ম প্রশংসা " সেখানে হাস্যষ্কর প্রচেষ্টা। আমাদের করণীয় কর্তব্য হচ্ছে আমরা আমাদের দোষত্রুটি সনাক্ত করে একান্ত বিনীতভাবে আল্লাহ্র কাছে আত্মনিবেদন করে ক্ষমাপ্রার্থী হতে পারি। আল্লাহ্র ক্ষমার হস্ত অবারিত। তাঁর করুণা ধারা আমাদের অপবিত্র আত্মাকে পবিত্র করে দেবে। আল্লাহকে ভালোবেসে, তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য যদি আমরা চেষ্টা করি এবং মন্দ থেকে দূরে থাকার প্রচেষ্টা গ্রহণ করি; আমাদের এই চেষ্টাই হবে আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। সৎ কাজ ও সৎ নিয়ত আল্লাহ্র কাম্য তাঁর বান্দার কাছে। কাজের সফলতা বা বিফলতা শেষ কথা নয়। নিয়ত ও চেষ্টা সেটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য।
৫১১৭। অষ্টম বাণী হচ্ছে পরলোকের পুণরুত্থান সম্পর্কে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা এখানে বলা হয়েছে।
৫১১৮। পৃথিবীর অধিকাংশ লোক অর্থ সম্পদ ও পার্থিব লাভের কাঙ্গাল। কারণ অধিকাংশ লোকেরই বিশ্বাস যে পার্থিব সম্পদ ক্ষমতা ইত্যাদি পার্থিব জিনিষ মানুষকে আনন্দ ও তৃপ্তি দানে সক্ষম। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। দৈহিক আনন্দ ও তৃপ্তি কখনও স্থায়ী প্রভাব বিস্তারে অক্ষম। এই আনন্দ খুবই ক্ষণস্থায়ী। স্থায়ী ও প্রকৃত আনন্দের সাথে আধ্যাত্মিক যোগসুত্র বর্তমান। মানুষ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উভয় পরিতৃপ্তির জন্য আল্লাহ্র অনুগ্রহের উপরে নির্ভরশীল। তিনিই মানুষকে অভাবমুক্ত করেন ও সন্তুষ্টি দান করেন। "অভাবমুক্ত" শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অভাব মানুষের মানসিক অবস্থার সাথে সম্পর্ক যুক্ত। যে মানুষ মানসিকভাবে অভাবগ্রস্থ সেই প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তি। পার্থিব জিনিষের অপর্যাপ্ততা কখনও অভাবের সৃষ্টি করে না ; অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। আল্লাহ্ মানুষের পরিবেশের ও মানসিক দুধরনের অভাবই দূর করে মানুষকে আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করেন, যা মানুষকে করে পরিতৃপ্ত।
৫১১৯। দশম বাণীটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক ব্যাপারের উপরে বলা হয়েছে। "শিরা" একটি নক্ষত্র যা সৌর বৎসরের প্রথমার্দ্ধে যেমন : জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আকাশে দৃশ্যমান হয়। আকাশে শিরা নক্ষত্রের উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল। এই গ্রহটি উজ্জ্বল নীলাভ আলো বিকিরণ করে থাকে, যা মোশরেক আরবদের মনে ভয় ও বিস্ময়ের উৎপাদন করতো। ফলে মোশরেক আরবেরা শিরা নক্ষত্রকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে পূঁজা করতো। কিন্তু এই উজ্জ্বল আলো বিকিরণকারী শিরা নক্ষত্রের স্রষ্টাও মহাশক্তিধর আল্লাহ্। সকল উপাসনা সেই মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র-ই প্রাপ্য।
৫১২০। এগার নম্বর বা শেষ বাণীটি প্রদান করা হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী আ'দ জাতির শাস্তির উল্লেখের মাধ্যমে। আ'দ জাতির জন্য দেখুন সূরা [ ৭ : ৬৫ ] আয়াতের টিকা ১০৪০ ; সামুদ জাতির জন্য দেখুন সূরা [ ৭ : ৭৩ ] আয়াতের টিকা ১০৪৩। এ সব জাতিরা সমকালীন পৃথিবীতে ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী জাতি। শুধু যে শক্তিশালী তাই-ই নয়,তারা ছিলো প্রতিভাধর এবং এক সৃজনশীল জাতি। কিন্তু তাদের শক্তি, প্রতিভা, এবং সৃজন ক্ষমতা কিছুই তাদের পাপের পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারে নাই। তারা তাদের পাপের পরিণতিতে ধ্বংস হয়ে যায়। একই ভাবে নূহ্ -এর সম্প্রদায়ও ধ্বংস হয়ে যায় বন্যার দ্বারা। কারণ তারা অন্ধের মত আল্লাহ্র নিদর্শনকে উপেক্ষা করেছিলো। দেখুন সূরা [ ৭: ৬৪ ] এবং [ ৭ : ৫৯ ] আয়াতের টিকা ১০৩৯ এবং সূরা [ ১১ : ২৫ - ৪৯ ]।
৫১২১। আয়াত ৫৩ - ৬০ পর্যন্ত উপদেশ বাণী সমূহের উদাহরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। হযরত লূত (আ) এর সম্প্রদায়ের জনপদ সদম ও গোমরাহ্ কে উল্টিয়ে দেয়া হয়েছিলো। লূত কে তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট সর্তককারী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিলো। দেখুন সূরা [ ১১ : ৭৪ - ৮০ ] আয়াত সমূহ এবং টিকা সমূহ।
৫১২২। সামান্য পরিবর্তন ব্যতীত এই লাইনটি সূরা আর-রাহমানের একটি লাইন যা সঙ্গীতের ধূয়ার মত বারে বারে বলা হয়েছে, প্রায় একই। জীবনের প্রতিটি সুযোগ, সুবিধা, সহজাত গুণরাজি সব কিছু আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দান। শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যুগে যুগে নবী, রসুল ও প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন সর্তককারী রূপে। এর পরেও কেন তোমরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ কর ?
৫১২৩। এই নবী অর্থাৎ মুহম্মদ (সা ) ছিলেন আল্লাহ্র রসুলদের ধারাবাহিকতায় শেষ নবী। বিশ্ব মানবদের আল্লাহ্র একত্ব এবং ন্যায় ও সত্য শিক্ষাদানের জন্য পৃথিবীতে তাঁর আগমন। আমরা কি তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করবো না ? প্রতিটি দিন মহাকালের গর্ভে বিলিন হয় এবং সেই সাথে আমাদের শেষ পরিণতি বা শেষ বিচারের দিন প্রতিক্ষণে এগিয়ে আসে। আসন্ন কেয়ামতের সঠিক ক্ষণ একমাত্র আল্লাহ্র এখতিয়ারের জ্ঞান। যদিও কেয়ামত অবশ্যাম্ভবী, তবুও মানুষ তার সঠিক সময় জানে না, এ এক রহস্যে ঘেরা অতি বাস্তব। একমাত্র আল্লাহ্-ই তা সঠিক ভাবে জানেন।
৫১২৪। কেয়ামতের কথায় বিস্ময় বোধ দ্বারা কেয়ামতের পরিণতি এড়ানো সম্ভব হবে না। প্রতিটি আত্মাকে কেয়ামত দিবসের শাস্তিকে এড়ানোর জন্য সৎ কাজের মাধ্যমে আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে। আল্লাহ্র ক্ষমা ও দয়া অতি নিকটেই।
৫১২৫। এই পৃথিবী বিশেষ ভাবে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক বিশেষ উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে। জীবন এই পৃথিবীতেই শেষ হয়ে যাবে না। মানব জীবন পরলোকের বৃহত্তর ও মহত্তর উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যায়। সুতারাং পৃথিবীতে আমরা যাই -ই করি না কেন সব কর্মই হবে পরলোকের মুক্তির জন্য। অর্থহীন ও তুচ্ছ কাজে সময় ব্যয় করার মত সময় মানুষের নাই। হাসি ঠাট্টার মাঝে সময় খেপনের মত সময় আমাদের হাতে নাই। যদি আমরা আমাদের দোষত্রুটি প্রকৃতপক্ষে অনুধাবন করতে পারতাম তবে হাসি তামাসার পরিবর্তে আমাদের হৃদয় শঙ্কা ও ভয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অশ্রুজলে আমরা আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করতাম। আমাদের উচিত আল্লাহ্র উপাসনার মাধ্যমে তাঁকে আত্মার মাঝে অনুধাবনের চেষ্টা করা। আল্লাহ্র নৈকট্য অন্বেষণের মাধ্যমেই মানব নিজেকে চিনতে পারে, মানুষকে ভালোবাসতে পারে ফলে আত্মার মুক্তি ঘটে।
৫১২৬। সুতারাং আমাদের আল্লাহকে সেজ্দা করার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। অর্থাৎ ভক্তি বিগলিত চিত্তে সেই সর্বশক্তিমানের পদতলে লুণ্ঠিত হয়ে নিজেকে আত্মসমর্পন করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের সর্বশেষ উপদেশ বা সত্য হচ্ছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন। যখন আমরা আমাদের হৃদয়ের মাঝে এই সত্যকে অনুভবে সক্ষম হব তখনই আমরা সৃষ্টির উদ্দেশ্য, বিশ্ব-প্রকৃতি,মানুষের ইতিহাস, মানব সৃষ্টিতে আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে আমাদের সত্তার মাঝে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব।
সূরা নাজ্ম
সূরা নাজ্ম বা নক্ষত্র - ৫৩
৬২ আয়াত, ৩ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : মক্কাতে অবতীর্ণ প্রাথমিক সূরাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম এবং সাতটি সূরার শ্রেণীর এটি চতুর্থ সূরা।
এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে, প্রত্যাদেশ কোন বিভ্রান্তি নয়। বিভ্রান্তি তাদের জন্য যারা একে অবিশ্বাস করে এবং আল্লাহ্র সম্বন্ধে মিথ্যা ধারণা পোষণ করে। সকল কিছুর উৎপত্তি আল্লাহ্ থেকে।
সার সংক্ষেপ : রাসুল (সা ) প্রত্যাদেশ লাভ করেন তা কোনও মিথ্যা বা প্রতারণা নয়, তিনি কোন ব্যক্তিগত স্বার্থের উদ্দেশ্যে তা প্রচার করেন না। এই প্রত্যাদেশ পরিষ্কারভাবে আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত। আল্লাহ্র অস্তিত্ব কোনও মিথ্যা কল্পনাপ্রসূত নয়। তিনি সর্বেসর্বা ; প্রথম এবং শেষ ; সকল কিছুর প্রভু; পরম ক্ষমাশীল। [ ৫৩ : ১-৩২ ]।
যারা আল্লাহ্র দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা অজ্ঞ ও ক্ষুদ্রমনা ; তারা জানে না যে এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর স্রষ্টা এক আল্লাহ্ ; মানুষ, বিশ্ব প্রকৃতি, অতীত, বর্তমান সকল কিছুর প্রভু তিনি। সুতারাং তারই এবাদত কর। [ ৫৩ : ৩৩ - ৬২ ]।
সূরা নাজ্ম বা নক্ষত্র - ৫৩
৬২ আয়াত, ৩ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
০১। শপথ নক্ষত্রের, যখন তা অস্তমিত হয়, ৫০৮৫
৫০৮৫। "An-Najm" - এই শব্দটির সঠিক ব্যাখ্যা অতি দুরূহ কাজ। বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এর ব্যাখ্যাও বিভিন্ন হয়ে পড়ছে। অস্তমিত নক্ষত্রের অর্থ করতে যেয়ে অনেকে বলেছেন যে তা হলো নক্ষত্রের শেষ অবস্থা যেমন : আমাদের সূর্য একটি নক্ষত্র যা একদিন তার জ্বালানি শেষে অস্তমিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। নক্ষত্রের অস্তমিত হওয়া হচ্ছে আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে বিণীত হওয়া। বিনয়ের প্রতীক হিসেবে একে কল্পনা করা যেতে পারে। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ আল্লাহ্র সৌন্দর্য্য, ক্ষমতা ও জ্ঞানের সর্বোচ্চ প্রকাশ।
০২। তোমাদের সংগী পথভ্রষ্টও হয় নাই, বিপথেও যায় নাই ৫০৮৬,
০৩। আর সে নিজের ইচ্ছামত কোন কথা বলে না।
০৩। আর সে নিজের ইচ্ছামত কোন কথা বলে না।
৫০৮৬। " তোমাদের সঙ্গী " এই বাক্যটি দ্বারা রাসুলুল্লাহ্ কে ( সা ) বোঝানো হয়েছে যিনি কোরাইশদের মাঝে অবস্থান করছিলেন। অবিশ্বাসীরা তাঁর বিরুদ্ধে যে তিন ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করেছিলো তারই জবাব এখানে প্রদান করা হয়। কোরাইশদের অভিযোগ সমূহ ছিলো নিম্নরূপ :
১) হয় তিনি বুদ্ধির দোষে বিভ্রান্ত কিংবা অমনোযোগী।
২) অথবা তিনি অশুভ শক্তির প্ররোচনায় বিপথগামী।
৩) অথবা তিনি উত্তেজনা বা আবেগ তাড়িত হয়ে মনগড়া কথা বলেন। অথবা নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, নিজ ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য মনগড়া কথা বলেন।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, এই অভিযোগ গুলির একটিও সত্য নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে তিনি সরাসরি আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত।
০৪। ইহা তো ওহী যা তার প্রতি প্রেরণ করা হয় ;
০৫। সে শিক্ষিত হয়েছে [ এমন ] একজন দ্বারা [ যে ] ক্ষমতায় মহাশক্তিশালী ৫০৮৭,
০৫। সে শিক্ষিত হয়েছে [ এমন ] একজন দ্বারা [ যে ] ক্ষমতায় মহাশক্তিশালী ৫০৮৭,
৫০৮৭। আয়াত নং [ ৫-৬] যে বর্ণনা আছে তফসীরকারগণ মনে করেন তার দ্বারা জিব্রাইল ফেরেশতাকে বোঝানো হয়েছে।
০৬। প্রজ্ঞাসম্পন্ন। যে আভির্ভূত হয়েছিলো [ নিজ আকৃতিতে ] :
০৭। যখন সে ছিলো দিগন্তরেখার সর্বোচ্চ প্রান্তে : ৫০৮৮
০৭। যখন সে ছিলো দিগন্তরেখার সর্বোচ্চ প্রান্তে : ৫০৮৮
৫০৮৮। রাসুলুল্লাহ্ (সা) এর নবুয়তের প্রথম দিকে জিব্রাইল ( আ ) কে তাঁর পূর্ণ অবয়বে তিনি একবার দর্শন করেছিলেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।
০৮। অতঃপর সে অগ্রসর হলো এবং আরও নিকটবর্তী হলো
০৯। ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল, অথবা তারও কম ৫০৮৯।
০৯। ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল, অথবা তারও কম ৫০৮৯।
৫০৮৯। "দুই ধনুকের " অর্থাৎ দুই ধনুকের পাল্লা [ ১০০-১৫০ গজ ] ব্যবধান ধরা হয়। অর্থাৎ সেই দূরত্ব যেখান থেকে পরিষ্কার দৃশ্যমান।
১০। এরূপেই [ আল্লাহ্ ] তাঁর বান্দাকে ওহী সমর্পন করেন ৫০৯০ ; তিনি যা জানাতে চেয়েছিলেন [ তা জানান ]।
৫০৯০। জিব্রাইল (আ) ছিলেন আল্লাহ্র প্রেরিত দূত বিশেষ। তিনি শুধুমাত্র আল্লাহ্র বাণী বহন করে নিয়ে এসেছিলেন।
১১। [ নবীর ] হৃদয় এবং মন, সে যা দেখেছে, তাতে ভুল করে নাই ৫০৯১।
৫০৯১। এই আয়াতে 'সে ' দ্বারা রাসুলুল্লাহকে (সা ) বোঝানো হয়েছে। আরবীতে heart বা অন্তঃকরণ বলতে মানসিক দক্ষতা সমূহ যেমন বুদ্ধিমত্তা এবং আবেগ ও অনুভূতিকে বোঝানো হয়। এখানে বলা হয়েছে যে রাসুলুল্লাহ্ (সা ) যা দেখেছেন তা পবিত্র সত্য এর মাঝে কোন দৃষ্টি বিভ্রম বা বিভ্রান্তি নাই।
১২। তবুও কি তোমরা সে যা দেখেছে সে সম্বন্ধে তার সাথে বির্তক করবে ?
১৩। এবং নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিলো ৫০৯২।
১৩। এবং নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিলো ৫০৯২।
৫০৯২। রাসুলুল্লাহ্ (সা) হেরা পর্বতের গুহায় প্রথম বার জিব্রাইল (আ) কে দর্শন করেন, যখন তিনি প্রথম নবুয়তের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং তাঁর প্রতি প্রেরিত প্রথম শব্দটি ছিলো ইক্রা। দ্বিতীয় বার রাসুল (সা) জিব্রাইলের দর্শন লাভ করেন যখন তিনি মেরাজ গমন করেন। এ সম্বন্ধে দেখুন সূরা নং ১০ এর ভূমিকা।
১৪। সীমান্তবর্তী লোট বৃক্ষের নিকটে, যার [ সীমাকে ] কেহ অতিক্রম করতে পারে না ৫০৯৩।
৫০৯৩। "বদরী বৃক্ষ " বা"লোট বৃক্ষ " - দেখুন সূরা [ ৩৪ : ১৬ ] ও টিকা ৩৮১৪। বন্য লোট গাছ প্রচন্ড কাটাযুক্ত হয়। কিন্তু চাষাবাদ করলে তা সুস্বাদু ফল ও ছায়া উৎপাদন করে। একে বেহেশতের শান্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়েছে এখানে এবং সূরা [ ৫৬ : ২৮ ] আয়াতে।
১৫। এর নিকটেই আছে জান্নাতুল মা-ওয়া [বেহেশত ] ৫০৯৪।
৫০৯৪। "Jannat-al-Mawa" বেশেহত্, মুমিনদিগের বাসস্থান, তাই উহা বাসোদ্যান। অনেকের মতে মুমিনদের এই বাসস্থান লোট বৃক্ষের সন্নিকটে অবস্থিত।
১৬। দেখো ! লোট গাছটি আচ্ছাদিত ছিলো [ অনির্বচনীয় রহস্য দ্বারা ]
১৭। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নাই, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুত হয় নাই।
১৮। সত্যিই সে তো তার প্রভুর মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিলো।
১৯। তুমি কি লাত ও উজ্জ্বাকে দেখেছ ৫০৯৫
২০। এবং তৃতীয় আর এক [ দেবী ] মান্নাত ?
১৭। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নাই, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুত হয় নাই।
১৮। সত্যিই সে তো তার প্রভুর মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিলো।
১৯। তুমি কি লাত ও উজ্জ্বাকে দেখেছ ৫০৯৫
২০। এবং তৃতীয় আর এক [ দেবী ] মান্নাত ?
৫০৯৫। উপরের আয়াত সমূহে ঐশ্বরিক মহিমা সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে অনুপম ভাষাতে। এই আয়াত থেকে বর্ণনা করা হয়েছে পার্থিব জীবনের গ্লানি সমূহ। পার্থিব জীবনের প্রধান কদর্য দিক হচ্ছে মূর্তির উপাসনা। প্রাচীন আরব মুশরিকদের তিনটি দেবীর নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবের লোকেরা বিশ্বাস করতো যে, এরা আল্লাহ্র কন্যা। এদের আকৃতিগত কাঠামো সম্বন্ধে ভিন্নমত আছে। একদলের মত হচ্ছে লাতের আকৃতি ছিলো মনুষ্যাকৃতি; উয্যা ছিলো পবিত্র গাছের আকৃতি এবং মানাত ছিলো সাদা পাথরের আকৃতি।
২১। সে কি ! তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান ও আল্লাহ্র জন্য কন্যা সন্তান ? ৫০৯৬
২২। দেখো, এ প্রকার বণ্টন তো অতিশয় অন্যায়।
২২। দেখো, এ প্রকার বণ্টন তো অতিশয় অন্যায়।
৫০৯৬। মুশরিক আরবেরা আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা মানুষের আকৃতির বাইরে কল্পনা করতে পারতো না। মানুষের ন্যায় রক্ত -মাংসের তৈরী, মানুষের ন্যায় সন্তানের পিতা ইত্যাদি। নিরাকার আল্লাহ্ -যার অস্তিত্ব সমগ্র বিশ্বচরাচরে পরিব্যপ্ত ; দ্যুলোকে, ভূলোকে যিনি সর্বদা বিদ্যমান, সমগ্র সৃষ্টির মাঝে যার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা বিরাজ করে সেই আল্লাহ্কে মনুষ্যরূরে কল্পনা করে মোশরেক আরবেরা আল্লাহ্র অবমাননা করতো। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যে আরবেরা কন্যা সন্তানকে অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখতো, তারা আল্লাহ্ যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সর্বশক্তিমান, তাঁর জন্য ঘৃণ্য কন্যা সন্তান কল্পনা করতো। দেখুন সূরা [ ১৬ : ৫৭ - ৫৯ ] ] আয়াত ও টিকা ২০৮২ এবং সূরা [ ৫২ : ৩৯] আয়াত ও টিকা ৫০৭৩।
২৩। এগুলি তো কতকগুলি নাম মাত্র, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষেরা উদ্ভাবন করেছে ৫০৯৭, - যার সমর্থনে আল্লাহ্ কোনরূপ বিধিসংগত ক্ষমতা প্রেরণ করেন নাই। তারা তো অনুমান ও নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ ব্যতীত অন্য কিছুর অনুসরণ করে না ; যদিও তাদের নিকট ইতিমধ্যে তাদের প্রভুর পথনির্দ্দেশ এসেছে ৫০৯৮।
৫০৯৭। দেখুন আয়াত [ ৭ : ৭১] ; [ ১২ : ৪০ ] ও টিকা ১৬৯৩। পৌত্তলিকেরা তাদের সৃষ্ট পাথরের মূর্তি অথবা জাতীয় বীরশ্রেষ্ঠ তা জীবিত বা মৃত যাই হোক না কেন এমন কি আল্লাহ্র প্রেরিত রাসুল বা মুত্তাকী বান্দা যেই-ই হোক না কেন এ সবের উপাসনা করা বা উপাস্য রূপে গ্রহণ করা সবই হচ্ছে মানুষের নিজস্ব কল্পনার প্রকাশ মাত্র। তারা যেই-ই হোক না কেন, যাই-ই হোক না কেন এ কথা মনে রাখতে হবে যে, তারা সবাই আল্লাহ্র সৃষ্ট। কেউই স্রষ্টার ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না।
৫০৯৮। ধর্মীয় ব্যাপারে অনুমান করা এক অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু যুগে যুগে মানুষ তাই-ই করে থাকে। এ সবের পিছনে মানুষের নিজস্ব স্বার্থ ও হৃদয়ের প্রবৃত্তির অনুপ্রেরণা বিরাজ করে মাত্র। মানুষের নিজস্ব আকাঙ্খা ও প্রবৃত্তির প্রেরণার এ মনঃস্তত সর্বযুগে বিদ্যমান ছিলো এবং এখনও আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে। ধর্মের নামে মানুষের এই আত্মপ্রতারণার রূপ পৃথিবীর সর্বত্র বিদ্যমান - আর এ কারণেই ধর্মের নামে এত ভেদাভেদ এত সংঘর্ষ এত হানাহানি। মানুষের মনঃস্তত্বের এই চিত্র এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। দেখুন আয়াত [ ৬: ১১৬ ]।
২৪। মানুষ যা চায় তাই-ই কি পায় ? ৫০৯৯
২৫। বস্তুতঃ ইহকাল ও পরকাল আল্লাহ্র অধীনে।
২৫। বস্তুতঃ ইহকাল ও পরকাল আল্লাহ্র অধীনে।
৫০৯৯। যে আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো প্রবেশ লাভ করে নাই, সে আত্মা অন্ধকারে আবৃত্ত। সে আত্মার আশা আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়া সবই অশুভ শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; যার পরিণাম কখনও শুভ হয় না, যার পরিণামে তার জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। আল্লাহ্র কল্যাণ হস্ত মানুষের মঙ্গল কামনায় সর্বদা উম্মুখ। সে কারণেই অপবিত্র আত্মার চাওয়া-পাওয়া সকল সময়ে পূর্ণতা লাভ করে না। আত্মার পবিত্রতা আসে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো থেকে। পার্থিব জীবনের উদ্দেশ্য সর্ব শক্তিমানের সন্তুষ্টি - সৃষ্টির সকল কিছুই শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন করবে।
রুকু - ২
২৬। আকাশে কত ফেরেশতা রয়েছে ৫১০০, তাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসু হবে না। তবে আল্লাহ্ অনুমতি দান করেন যাকে ইচ্ছা, ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট সে ব্যতীত ৫১০১।
৫১০০। সাধারণ মানুষ ফেরেশতাদের ধারণা করে প্রভু ও ক্ষমতা ধর হিসেবে। তাঁরা ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী সন্দেহ নাই ; কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ পরিষ্কার ভাষাতে ঘোষণা করেছেন যে, ফেরেশতাদের সকল ক্ষমতা আল্লাহ্ প্রদত্ত এবং সীমিত। মানুষ আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির মাধ্যমে আল্লাহ্র ফেরেশতাদের থেকেও সম্মানিত হতে পারেন। হযরত আদমকে ফেরেশতাদের সেজদার মাধ্যমে [ ২ : ৩৪ ] এই চিরন্তন সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে এই বিশ্বজগতে সকল ক্ষমতা ও শক্তির মূল কেন্দ্র সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনও কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ্র একত্বের প্রতি এই আয়াতের দ্বারা দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে ; এবং কোরেশরা আল্লাহ্ ও মানুষের মধ্যে যে মধ্যস্তকারী শক্তি কল্পনা করতো তার নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। কোরাণের এই শক্তিশালী আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষ বিভিন্ন পীরের দরগা, বা মাজারের স্মরণাপন্ন হয়ে থাকে, আল্লাহ্র নিকট সুপারিশ করার জন্য, তা আল্লাহ্ অনুমোদন করেন না।
৫১০১। দেখুন সূরা [ ২০ : ১০৯] আয়াত এবং [ ২১ : ২৮ ] আয়াত। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, দ্যুলোকে, ভূলোকে সর্বত্র তারই হুকুম বা আইন বর্তমান। তাঁর বিনা অনুমতিতে কারও পক্ষে মধ্যস্তকারী বা সুপারিশ করা সম্ভব হবে না। শুধুমাত্র যিনি আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য হবেন, তিনিই সুপারিশ বা মধ্যস্ততা করার অনুমতি লাভ করবেন। বিভিন্ন অর্থবোধক তফসীরের জন্য দেখুন [ ২০ : ১০৯ ] আয়াতের টিকা ২৬৪৩।
২৭। যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তারাই ফেরেশতাদের নারীবাচক নামে অভিহিত করে থাকে ৫১০২।
৫১০২। দেখুন [ ৫৩ : ২১ ] আয়াত এবং টিকা ৫০৯৬। মোশরেক আরবদের পরলোকে বিশ্বাস ছিলো না। তাদের জীবন-ধর্ম,সকল চাওয়া, পাওয়া আবর্তিত ছিলো পার্থিব জীবনকে ঘিরে। পার্থিব জীবনে তাদের চোখে নারীকে মনে হতো মোহনীয় রূপে, সুতারাং ফেরেশতাদেরও তারা সেইরূপই কল্পনা করতে ভালোবাসতো। পৃথিবীতে যারাই আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাসী নয়, তারাই তাদের উপাস্যদের নারীমূর্তিতে কল্পনা করতে ভালোবাসে। তাদের অন্য আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের সকল চাওয়া পাওয়া আবর্তিত হয় শুধুমাত্র পার্থিব জীবনকে ঘিরে।
মন্তব্য : বাংলাদেশে মানুষ পীরের দরগায় এবং মাজারে গমন করে শুধুমাত্র পার্থিব বিপদ থেকে মুক্তি ও জাগতিক উন্নতির আশায়। এটা প্রকৃত ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না।
২৮। কিন্তু সে সম্বন্ধে তাদের কোন জ্ঞান নাই। অনুমান ব্যতীত তারা অন্য কিছুর অনুসরণ করে না ; আর সত্যের বিরুদ্ধে অনুমান কোন কাজেই আসবে না ৫১০৩।
৫১০৩। দেখুন [ ৫৩ : ২৩ ] আয়াত ও টিকা ৫০৯৮। " সত্যের বিরুদ্ধে অনুমান কোন কাজেই আসবে না।" এই অবিস্মরণীয় উপদেশ যুগ কাল অতিক্রান্ত। শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে নয় কোরাণে এই উপদেশ দান করা হয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রের জন্য। সত্যকে তার প্রকৃতরূপে উদ্ঘাটিত করতে হবে। সত্যকে উদ্ঘাটিত করার অপর নামই হচ্ছে "বিজ্ঞান " যা আল্লাহ্র সৃষ্টি তত্বের প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটিত করে থাকে। মানুষের সামাজিক জীবনে যেমন : বিচার বিভাগ, প্রশাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটিত করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে " সত্যের মুকাবিলাতে অনুমানের কোনও মূল্য নাই।"
২৯। সুতারাং যারা আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং পৃথিবীর জীবন ব্যতীত অন্য কিছু চায় না, তুমিও তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।
৩০। তাদের জ্ঞানের [ সীমানা ] এ পর্যন্তই পৌঁছাবে ৫১০৪। আল্লাহ্ ভালোভাবেই তাদের জানেন, কারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়; এবং তাদের ভালোভাবেই জানেন কারা সৎপথ প্রাপ্ত হয়।
৩০। তাদের জ্ঞানের [ সীমানা ] এ পর্যন্তই পৌঁছাবে ৫১০৪। আল্লাহ্ ভালোভাবেই তাদের জানেন, কারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়; এবং তাদের ভালোভাবেই জানেন কারা সৎপথ প্রাপ্ত হয়।
৫১০৪। কি অপূর্বভাবে জীবনের চিত্রকে এক কথায় অঙ্কন করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্র স্মরণে বিমুখ হয় তাদের মনঃস্তাত্বিক চিত্র অংকন করা হয়েছে এই একটি আয়াতের মাধ্যমে। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না তাদের সমগ্র সত্ত্বায় পরলোকের অস্তিত্বের কোনও স্থান নাই। তাদের মনঃজগত, চিন্তার ব্যপ্তি শুধুমাত্র এই পার্থিব জীবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে থাকে। এরা হয় প্রচন্ড ভোগবাদী ও বস্তুবাদী। এদের কেউ অর্থের, কেউ সম্মানের, কেউ খ্যাতির, কেউ ক্ষমতার, কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তির পিছনে জীবনের সকল অধ্যাবসায়,প্রচেষ্টা, মেধা, মননশক্তি, সৃজন ক্ষমতা ব্যয় করে থাকে। এদের জীবন আবর্তিত হয় পার্থিব আরাম-আয়েশ, ও যৌন সম্ভোগের আনন্দকে কেন্দ্র করে। সুতারাং তাদের চিন্তার জগতের ব্যাপ্তি পার্থিব জীবনের বাইরে সম্প্রসারিত হতে পারে না। এদের আত্মায় কোনও দিনও আধ্যাত্মিক জগতের আলো অনুভূত হতে পারে না। তাদের জ্ঞান শুধুমাত্র সীমিত পার্থিব জগতেই আবদ্ধ থাকবে। আধ্যাত্মিক জগতের দুয়ার তাদের সামনে কখনও উম্মোচিত হতে পারবে না। কারণ আধ্যাত্মিক জগতকে অনুভব করতে অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। বস্তু জগতের ভারী আবরণ তাদের অন্তর্দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবে। বৈদ্যুতিক আলোর চোখ ধাঁধানো দ্যুতি যেমন পূর্ণিমা চাঁদের আলোকেও দৃশ্যমান হতে বাঁধা দেয়। ঠিক সেরূপ বস্তু জগতের ঔজ্জ্বল্য আধ্যাত্মিক জগতকে আত্মার মাঝে অনুভবে বাধা দান করে। বৈদ্যুতিক আলো অপসারণ ব্যতীত পূর্ণিমার চাঁদের আলোর অপরূপ সৌন্দর্য যেমন প্রকাশ পায় না ; ঠিক সেরূপ পার্থিব জীবনের কামনা থেকে মুক্ত হতে না পারলে আধ্যাত্মিক জীবনের সৌন্দর্য্য, অপূর্ব শান্তি,কমনীয় রূপ, আত্মার মাঝে অনুভব করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্তে অবিশ্বাসী ও বস্তুবাদীদের ধরা ছোঁয়ার বহু দূরে থাকবে আধ্যাত্মিক জগতের রূপরেখা। অপরপক্ষে যারা আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাসী, যারা আধ্যাত্মিক জগতের আলোকে হৃদয়ের মাঝে অনুভব করতে সমর্থ হয়েছে তারা তাদের সকল ব্যর্থতা সত্বেও সঠিক পথে অবস্থান করছে। তাঁরা আল্লাহ্র হেদায়েতের জন্য উম্মুখ হয়ে থাকে; সুতারাং আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাদের সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
৩১। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র অধিকারে ; ফলে যারা মন্দ কাজ করে তিনি তাদের কাজ অনুযায়ী প্রতিফল দিতে পারেন ৫১০৫ ; এবং যারা ভালো কাজ করে তাদের দিতে পারেন উত্তম পুরষ্কার।
৫১০৫। পদার্থ বিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক নিউটনের সুত্র হচ্ছে "Every action there is an equal and opposite reaction" এই সুত্রটি শুধুমাত্র যে পদার্থের জন্য প্রযোজ্য তাই নয়, মানুষের জীবনেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। ভালো ও মন্দ প্রতিটি ঘটনার ফলাফল সমভাবে বিদ্যমান এ কথা সত্য, কিন্তু দয়াময় আল্লাহ্ মানুষকে এই আইনের আওতায় সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকেন না। আল্লাহ্র আইনের অধীনে সারা বিশ্ব ভূবন। ন্যায়বিচারক ও করুণাময় তাঁর উপাধি। মানুষের সকল কথা, কাজ, কাজের নিয়ত, মনের একান্তের চিন্তা ভাবনা কোনও কিছুই বৃথা যায় না। সবই সব কিছুর ফলাফল বহন করে। যে মন্দ কাজ করে, মন্দ কথা বলে, মন্দ চিন্তা করে তার ফলাফল তাকে বহন করতে হয়। কিন্তু মানুষের জন্য অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা আল্লাহ্র ক্ষমা লাভের ও মন্দের ফলাফল থেকে অব্যহতি লাভের সুযোগ আছে। অনুতাপ ও আত্মসংশোধন সকল পাপকে দূর করে দেয়; আল্লাহ্ তাদের পুরষ্কৃত করেন যা তাদের প্রাপ্য পুরষ্কারের থেকে বহুগুণ হয়।
৩২। যারা ছোট খাট দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে; [ তাদের প্রতি ] তোমার প্রভু অবশ্যই অপরিসীম ক্ষমাশীল ৫১০৬। আল্লাহ্ তোমাদের [ তখন থেকেই ] ভালো ভাবে জানেন যখন তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং যখন তোমরা আপন মায়ের পেটে ভ্রূণের আকারে অবস্থান করছিলে। সুতারাং নিজেকে ন্যায়সঙ্গত বলে দাবী করো না ৫১০৭; আল্লাহ্ ভালোভাবে জানেন কে নিজেকে পাপ থেকে রক্ষা করে থাকে।
৫১০৬। " তোমার প্রভু অবশ্যই অপরিসীম ক্ষমাশীল ", তাদের যোগ্যতা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে ছোটখাট অপরাধ করলেও আল্লাহ্ তাঁদের উত্তম পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করবেন না। কারণ আল্লাহ্র "ক্ষমা অপরিসীম"। তার ক্ষমার হস্ত সদা প্রসারিত। যখনই আমরা তাঁর ক্ষমাপ্রার্থী হই তিনি অকুণ্ঠভাবে ক্ষমা করেন। প্রার্থনা আত্মনিবেদন করতে সাহায্য করে। প্রার্থনার মাধ্যমে যে আত্মনিবেদন করে ক্ষমাপ্রার্থী হয় আল্লাহ্র করুণার ধারা তৎক্ষণাত প্রবাহিত হয়ে তাকে প্লাবিত করে। এই অনুভূতি প্রতিটি ক্ষমাপ্রার্থী ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে অবশ্যই অনুভব করে থাকবেন। আল্লাহ্র ক্ষমা লাভের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন, তা লাভ করা যায় প্রার্থনা ও আত্ম নিবেদনের মাধ্যমে। আল্লাহ্র নূতন করে কিছু জানার নাই। তিনি আমাদের সম্বন্ধে "সম্যক অবগত" ; তিনি সর্বজ্ঞ।
৫১০৭। দয়াময় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তিনি মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলের খবর প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল চিন্তাধারা খোলা বইয়ের ন্যায় পাঠ করতে পারেন। সুতারাং নিজেকে মুত্তাকী বা ভালো বা ন্যায়বান ইত্যাদি রূপে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হাস্যকর প্রচেষ্টা বই আর কিছু নয়। কারণ আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু মুত্তাকী অর্জন করেছি বা বিশুদ্ধ নিয়তে কতটুকু সৎকর্ম করেছি তা আল্লাহ্র নিকটে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। আমাদের প্রচারণা বা ওজর আপত্তি সেখানে অর্থহীন। "আত্ম প্রশংসা " সেখানে হাস্যষ্কর প্রচেষ্টা। আমাদের করণীয় কর্তব্য হচ্ছে আমরা আমাদের দোষত্রুটি সনাক্ত করে একান্ত বিনীতভাবে আল্লাহ্র কাছে আত্মনিবেদন করে ক্ষমাপ্রার্থী হতে পারি। আল্লাহ্র ক্ষমার হস্ত অবারিত। তাঁর করুণা ধারা আমাদের অপবিত্র আত্মাকে পবিত্র করে দেবে। আল্লাহকে ভালোবেসে, তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য যদি আমরা চেষ্টা করি এবং মন্দ থেকে দূরে থাকার প্রচেষ্টা গ্রহণ করি; আমাদের এই চেষ্টাই হবে আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। সৎ কাজ ও সৎ নিয়ত আল্লাহ্র কাম্য তাঁর বান্দার কাছে। কাজের সফলতা বা বিফলতা শেষ কথা নয়। নিয়ত ও চেষ্টা সেটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য।
রুকু- ৩
৫১০৮। এই বিশেষ ঘটনাটি কুরাইশ সরদার ওলীদ ইবনে মুগীরার সম্বন্ধে। ওলীদ একসময়ে ইসলামের দিকে কিছুটা আকৃষ্ট হয়েছিলো স্বগোত্রের নিকট ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে আল্লাহ্র শাস্তির ভয়ের উল্লেখ করে। তখন একজন মোশরেক কুরাইশ অর্থের পরিবর্তে ওলীদের পাপের শাস্তি নিজ স্কন্ধে নিতে সম্মত হয়। ওলীদ তাকে আংশিক ভাবে অর্থ দান করে কিন্তু পরে তা বন্ধ করে দেয়। এই ছিলো এই আয়াতের পটভূমি। সাধারণ ভাবে আয়াত সমূহ থেকে তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে :
১) যদি আমরা ইসলাম গ্রহণ করি তবে তা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের সাথে পূর্বপুরুষদের প্রাচীন প্রথা সমূহের কুসংস্কারের মিশ্রণ ঘটানো ধর্মের অবমাননা করা।
২) ওয়াদা ভঙ্গ করা নিষিদ্ধ।
৩) আধ্যাত্মিক জগতে দরকষাকষির স্থান নাই। আল্লাহ্র প্রদত্ত নৈতিক নীতিমালা অনুযায়ী যারা পবিত্র জীবন যাপন না করে, তারা কেউই জানে না তাদের শেষ পরিণতি কি হবে।
৫১০৯। "অদৃশ্যের জ্ঞান " - অর্থাৎ সেই জ্ঞান যে জগত এই পার্থিব জীবনে দৃশ্যমান নয়। সে জগত হচ্ছে মৃত্যুপরবর্তী জীবন বা পরলোকের জীবন। যে জগত সম্বন্ধে কোনও জ্ঞানই নাই, কিভাবে সে জীবন সম্বন্ধে মূল্য ধার্য করে ?
৫১১০। 'মুসার কিতাব' দ্বারা বুঝানো হয়েছে মুসার প্রতি অবতীর্ণ মূল কিতাব 'তাওরাত' কে। বর্তমান Peutatench মূল কিতাবের অপভ্রংশ মাত্র। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় "The Book of the Wars of Jehova" যার উল্লেখ আছে Old Testament [ Num xxi 14 ] তা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। বর্তমান Peutatench এ পরলোকের জীবন সম্বন্ধে কোন স্বচ্ছ ধারণা দান করে না।
৫১১১। "ইব্রাহীমের কিতাব" বর্তমানে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু "The Testament of Abraham" নামে মূল হিব্রু ভাষার একটি বই গ্রীক ভাষাতে অনুদিত আছে। দেখুন সূরা [ ৮৭ : ১৯] আয়াতের ৬০৯৪ নম্বর টিকা যেখানে মুসার কিতাব ও ইব্রাহীমের কিতাবের উল্লেখ একই সাথে আছে।
৫১১২। হযরত ইব্রাহীম একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন যে কারণে তাঁর উপাধি ছিলো "হানিফ" বা "বিশ্বাসে বিশ্বস্ত"। দেখুন সূরা [ ১৬ : ১২০, ১২৩ ]।
৫১১৩। এই আয়াত থেকে শুরু হয়েছে এগারোটি অমর বাণীর ধারাবাহিকতা। প্রথম বাণীটি হচ্ছে : প্রত্যেককে প্রত্যেকের স্ব স্ব পাপের বোঝা বহন করতে হবে। কেহ কারও পাপের বোঝা বহন করবে না। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৬ : ১৬৪ ]। পৃথিবীতে কেউই কারও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে না।
৫১১৪। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাণী হচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্য সাধন করার জন্য মানুষকে চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা ব্যতীত সে কিছুই লাভ করতে সক্ষম হবে না। যদি সে আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করে তবে তার চেষ্টার ফলাফল শীঘ্রই দৃশ্যমান হবে। এবং শেষ পর্যন্ত তার চেষ্টার পুরষ্কার সে লাভ করবে এবং তার অভীষ্ট সাধন হবে।
৫১১৫। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বাণী সমূহ হচ্ছে পার্থিব সকল কিছুই আল্লাহ্র নিকট প্রত্যানীত হবে। সুতারাং আমাদের সকল আশা-আকাঙ্খা আল্লাহ্র পরে প্রত্যার্পন করতে হবে। আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করবো না। আল্লাহ্-ই জীবন ও মৃত্যুর একমাত্র মালিক।
৫১১৬। সপ্তম বাণী হচ্ছে যৌনতা প্রসঙ্গে। পৃথিবীর সকল জীবনকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে। জোড়ায় পুরুষ ও স্ত্রী তাদের স্ব স্ব কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে আল্লাহ্র সৃষ্টিকে অনাদি অনন্তকাল ব্যপী ধরে রেখেছে এক অত্যাচার্য উপায়ে। এ ভাবেই আল্লাহ্ বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম ঘটান যে বীজ ডি, এন, এর মাধ্যমে তাঁর পূর্বপুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে রাখে - যুগ যুগ ধরে অবিকৃত অবস্থায়। এ ভাবেই পুরানো ধ্বংস নূতনের জন্ম লাভ ঘটে - সৃষ্টি রয়ে যায় অবিকৃত অবস্থায়।
৩৩। তুমি কি দেখেছ সেই ব্যক্তিকে, যে মুখ ফিরিয়ে নেয় ৫১০৮,
৩৪। এবং যৎসামান্য দান করে, পরে [হৃদয়কে] শক্ত করে ফেলে ?
৩৪। এবং যৎসামান্য দান করে, পরে [হৃদয়কে] শক্ত করে ফেলে ?
৫১০৮। এই বিশেষ ঘটনাটি কুরাইশ সরদার ওলীদ ইবনে মুগীরার সম্বন্ধে। ওলীদ একসময়ে ইসলামের দিকে কিছুটা আকৃষ্ট হয়েছিলো স্বগোত্রের নিকট ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে আল্লাহ্র শাস্তির ভয়ের উল্লেখ করে। তখন একজন মোশরেক কুরাইশ অর্থের পরিবর্তে ওলীদের পাপের শাস্তি নিজ স্কন্ধে নিতে সম্মত হয়। ওলীদ তাকে আংশিক ভাবে অর্থ দান করে কিন্তু পরে তা বন্ধ করে দেয়। এই ছিলো এই আয়াতের পটভূমি। সাধারণ ভাবে আয়াত সমূহ থেকে তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে :
১) যদি আমরা ইসলাম গ্রহণ করি তবে তা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের সাথে পূর্বপুরুষদের প্রাচীন প্রথা সমূহের কুসংস্কারের মিশ্রণ ঘটানো ধর্মের অবমাননা করা।
২) ওয়াদা ভঙ্গ করা নিষিদ্ধ।
৩) আধ্যাত্মিক জগতে দরকষাকষির স্থান নাই। আল্লাহ্র প্রদত্ত নৈতিক নীতিমালা অনুযায়ী যারা পবিত্র জীবন যাপন না করে, তারা কেউই জানে না তাদের শেষ পরিণতি কি হবে।
৩৫। সে কি ! তার নিকট কি অদৃশ্যের জ্ঞান আছে যে, সে [ পরিণাম ] দেখতে পায় ৫১০৯ ?
৫১০৯। "অদৃশ্যের জ্ঞান " - অর্থাৎ সেই জ্ঞান যে জগত এই পার্থিব জীবনে দৃশ্যমান নয়। সে জগত হচ্ছে মৃত্যুপরবর্তী জীবন বা পরলোকের জীবন। যে জগত সম্বন্ধে কোনও জ্ঞানই নাই, কিভাবে সে জীবন সম্বন্ধে মূল্য ধার্য করে ?
৩৬। তবে কি সে মুসার কিতাবে যা আছে তা অবগত নয়, ৫১১০
৫১১০। 'মুসার কিতাব' দ্বারা বুঝানো হয়েছে মুসার প্রতি অবতীর্ণ মূল কিতাব 'তাওরাত' কে। বর্তমান Peutatench মূল কিতাবের অপভ্রংশ মাত্র। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় "The Book of the Wars of Jehova" যার উল্লেখ আছে Old Testament [ Num xxi 14 ] তা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। বর্তমান Peutatench এ পরলোকের জীবন সম্বন্ধে কোন স্বচ্ছ ধারণা দান করে না।
৩৭। এবং অঙ্গীকার পালনকারী ইব্রাহীমের [ কিতাবের ] ৫১১১, ৫১১২।
৫১১১। "ইব্রাহীমের কিতাব" বর্তমানে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু "The Testament of Abraham" নামে মূল হিব্রু ভাষার একটি বই গ্রীক ভাষাতে অনুদিত আছে। দেখুন সূরা [ ৮৭ : ১৯] আয়াতের ৬০৯৪ নম্বর টিকা যেখানে মুসার কিতাব ও ইব্রাহীমের কিতাবের উল্লেখ একই সাথে আছে।
৫১১২। হযরত ইব্রাহীম একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন যে কারণে তাঁর উপাধি ছিলো "হানিফ" বা "বিশ্বাসে বিশ্বস্ত"। দেখুন সূরা [ ১৬ : ১২০, ১২৩ ]।
৩৮। উহা এই যে, কোন বহনকারী অপরের [ পাপের ] বোঝা বহন করবে না ; ৫১১৩
৫১১৩। এই আয়াত থেকে শুরু হয়েছে এগারোটি অমর বাণীর ধারাবাহিকতা। প্রথম বাণীটি হচ্ছে : প্রত্যেককে প্রত্যেকের স্ব স্ব পাপের বোঝা বহন করতে হবে। কেহ কারও পাপের বোঝা বহন করবে না। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৬ : ১৬৪ ]। পৃথিবীতে কেউই কারও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে না।
৩৯। মানুষ যার জন্য চেষ্টা করে, শুধু তাই-ই পায়;
৪০। তার চেষ্টার ফল শীঘ্রই দৃশ্যমান হবে ; ৫১১৪
৪১। তারপরে তাকে ইহার পুরোপুরি পুরষ্কার দেয়া হবে ;
৪০। তার চেষ্টার ফল শীঘ্রই দৃশ্যমান হবে ; ৫১১৪
৪১। তারপরে তাকে ইহার পুরোপুরি পুরষ্কার দেয়া হবে ;
৫১১৪। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাণী হচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্য সাধন করার জন্য মানুষকে চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা ব্যতীত সে কিছুই লাভ করতে সক্ষম হবে না। যদি সে আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করে তবে তার চেষ্টার ফলাফল শীঘ্রই দৃশ্যমান হবে। এবং শেষ পর্যন্ত তার চেষ্টার পুরষ্কার সে লাভ করবে এবং তার অভীষ্ট সাধন হবে।
৪২। আর তোমার প্রভুর নিকটে সকল কিছুর সমাপ্তি ; ৫১১৫
৪৩। আর তিনিই হাসান, তিনিই কাঁদান ;
৪৪। আর তিনিই মারেন, তিনিই বাঁচান ;
৪৩। আর তিনিই হাসান, তিনিই কাঁদান ;
৪৪। আর তিনিই মারেন, তিনিই বাঁচান ;
৫১১৫। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বাণী সমূহ হচ্ছে পার্থিব সকল কিছুই আল্লাহ্র নিকট প্রত্যানীত হবে। সুতারাং আমাদের সকল আশা-আকাঙ্খা আল্লাহ্র পরে প্রত্যার্পন করতে হবে। আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করবো না। আল্লাহ্-ই জীবন ও মৃত্যুর একমাত্র মালিক।
৪৫। আর তিনিই সৃষ্টি করেন জোড়া পুরুষ ও নারী ; ৫১১৬
৪৬। বীজ থেকে যখন তা [ প্রকৃত স্থানে ] স্থাপন করা হয় ;
৪৬। বীজ থেকে যখন তা [ প্রকৃত স্থানে ] স্থাপন করা হয় ;
৫১১৬। সপ্তম বাণী হচ্ছে যৌনতা প্রসঙ্গে। পৃথিবীর সকল জীবনকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে। জোড়ায় পুরুষ ও স্ত্রী তাদের স্ব স্ব কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে আল্লাহ্র সৃষ্টিকে অনাদি অনন্তকাল ব্যপী ধরে রেখেছে এক অত্যাচার্য উপায়ে। এ ভাবেই আল্লাহ্ বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম ঘটান যে বীজ ডি, এন, এর মাধ্যমে তাঁর পূর্বপুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে রাখে - যুগ যুগ ধরে অবিকৃত অবস্থায়। এ ভাবেই পুরানো ধ্বংস নূতনের জন্ম লাভ ঘটে - সৃষ্টি রয়ে যায় অবিকৃত অবস্থায়।
৪৭। আর তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দ্বিতীয় সৃষ্টির [ মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের ] ; ৫১১৭
৫১১৭। অষ্টম বাণী হচ্ছে পরলোকের পুণরুত্থান সম্পর্কে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা এখানে বলা হয়েছে।
৪৮। আর, তিনিই দান করেন সম্পদ ও সন্তুষ্টি ; ৫১১৮
৫১১৮। পৃথিবীর অধিকাংশ লোক অর্থ সম্পদ ও পার্থিব লাভের কাঙ্গাল। কারণ অধিকাংশ লোকেরই বিশ্বাস যে পার্থিব সম্পদ ক্ষমতা ইত্যাদি পার্থিব জিনিষ মানুষকে আনন্দ ও তৃপ্তি দানে সক্ষম। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। দৈহিক আনন্দ ও তৃপ্তি কখনও স্থায়ী প্রভাব বিস্তারে অক্ষম। এই আনন্দ খুবই ক্ষণস্থায়ী। স্থায়ী ও প্রকৃত আনন্দের সাথে আধ্যাত্মিক যোগসুত্র বর্তমান। মানুষ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উভয় পরিতৃপ্তির জন্য আল্লাহ্র অনুগ্রহের উপরে নির্ভরশীল। তিনিই মানুষকে অভাবমুক্ত করেন ও সন্তুষ্টি দান করেন। "অভাবমুক্ত" শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অভাব মানুষের মানসিক অবস্থার সাথে সম্পর্ক যুক্ত। যে মানুষ মানসিকভাবে অভাবগ্রস্থ সেই প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তি। পার্থিব জিনিষের অপর্যাপ্ততা কখনও অভাবের সৃষ্টি করে না ; অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। আল্লাহ্ মানুষের পরিবেশের ও মানসিক দুধরনের অভাবই দূর করে মানুষকে আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করেন, যা মানুষকে করে পরিতৃপ্ত।
৪৯। আর, তিনিই [ শক্তিশালী ] সিরিয়াস নক্ষত্রের প্রভু ৫১১৯ ;
৫১১৯। দশম বাণীটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক ব্যাপারের উপরে বলা হয়েছে। "শিরা" একটি নক্ষত্র যা সৌর বৎসরের প্রথমার্দ্ধে যেমন : জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আকাশে দৃশ্যমান হয়। আকাশে শিরা নক্ষত্রের উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল। এই গ্রহটি উজ্জ্বল নীলাভ আলো বিকিরণ করে থাকে, যা মোশরেক আরবদের মনে ভয় ও বিস্ময়ের উৎপাদন করতো। ফলে মোশরেক আরবেরা শিরা নক্ষত্রকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে পূঁজা করতো। কিন্তু এই উজ্জ্বল আলো বিকিরণকারী শিরা নক্ষত্রের স্রষ্টাও মহাশক্তিধর আল্লাহ্। সকল উপাসনা সেই মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র-ই প্রাপ্য।
৫০। এবং তিনিই [ শক্তিশালী ] প্রাচীন আদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছিলেন ৫১২০।
৫১২০। এগার নম্বর বা শেষ বাণীটি প্রদান করা হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী আ'দ জাতির শাস্তির উল্লেখের মাধ্যমে। আ'দ জাতির জন্য দেখুন সূরা [ ৭ : ৬৫ ] আয়াতের টিকা ১০৪০ ; সামুদ জাতির জন্য দেখুন সূরা [ ৭ : ৭৩ ] আয়াতের টিকা ১০৪৩। এ সব জাতিরা সমকালীন পৃথিবীতে ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী জাতি। শুধু যে শক্তিশালী তাই-ই নয়,তারা ছিলো প্রতিভাধর এবং এক সৃজনশীল জাতি। কিন্তু তাদের শক্তি, প্রতিভা, এবং সৃজন ক্ষমতা কিছুই তাদের পাপের পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারে নাই। তারা তাদের পাপের পরিণতিতে ধ্বংস হয়ে যায়। একই ভাবে নূহ্ -এর সম্প্রদায়ও ধ্বংস হয়ে যায় বন্যার দ্বারা। কারণ তারা অন্ধের মত আল্লাহ্র নিদর্শনকে উপেক্ষা করেছিলো। দেখুন সূরা [ ৭: ৬৪ ] এবং [ ৭ : ৫৯ ] আয়াতের টিকা ১০৩৯ এবং সূরা [ ১১ : ২৫ - ৪৯ ]।
৫১। এবং সামুদ সম্প্রদায়কে; তাদেরকে চিরস্থায়ী জীবনের ইজারা দেন নাই।
৫২। এবং তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে [ ধবংস করেন ] কেননা তারা [ সকলে ] ছিলো ভয়ঙ্কর অন্যায়কারী ও প্রচন্ড উদ্ধত সীমালংঘনকারী ;
৫৩। এবং তিনি [ সদম ও গোমরাহ্ ] নগরীকে ধ্বংস ও উৎপাটিত করেছিলেন ; ৫১২১
৫৪। সুতারাং [অজানা ধ্বংস স্তুপ ] তাদের আচ্ছাদিত করেছিলো।
৫২। এবং তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে [ ধবংস করেন ] কেননা তারা [ সকলে ] ছিলো ভয়ঙ্কর অন্যায়কারী ও প্রচন্ড উদ্ধত সীমালংঘনকারী ;
৫৩। এবং তিনি [ সদম ও গোমরাহ্ ] নগরীকে ধ্বংস ও উৎপাটিত করেছিলেন ; ৫১২১
৫৪। সুতারাং [অজানা ধ্বংস স্তুপ ] তাদের আচ্ছাদিত করেছিলো।
৫১২১। আয়াত ৫৩ - ৬০ পর্যন্ত উপদেশ বাণী সমূহের উদাহরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। হযরত লূত (আ) এর সম্প্রদায়ের জনপদ সদম ও গোমরাহ্ কে উল্টিয়ে দেয়া হয়েছিলো। লূত কে তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট সর্তককারী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিলো। দেখুন সূরা [ ১১ : ৭৪ - ৮০ ] আয়াত সমূহ এবং টিকা সমূহ।
৫৫। তাহলে [ হে মানবকূল ] তোমার প্রভুর কোন অনুগ্রহ সম্বন্ধে বির্তক করবে ৫১২২?
৫১২২। সামান্য পরিবর্তন ব্যতীত এই লাইনটি সূরা আর-রাহমানের একটি লাইন যা সঙ্গীতের ধূয়ার মত বারে বারে বলা হয়েছে, প্রায় একই। জীবনের প্রতিটি সুযোগ, সুবিধা, সহজাত গুণরাজি সব কিছু আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দান। শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যুগে যুগে নবী, রসুল ও প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন সর্তককারী রূপে। এর পরেও কেন তোমরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ কর ?
৫৬। প্রাচীন কালের [ ধারাবাহিক ] সর্তককারীদের ন্যায় [এই নবীও ] এক সর্তককারী মাত্র ৫১২৩।
৫৭। ক্রমাগত অগ্রসরমান [বিচার দিবস ] নিকটবর্তী হচ্ছে;
৫৮। আল্লাহ্ ব্যতীত কেহই তা ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়,
৫৭। ক্রমাগত অগ্রসরমান [বিচার দিবস ] নিকটবর্তী হচ্ছে;
৫৮। আল্লাহ্ ব্যতীত কেহই তা ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়,
৫১২৩। এই নবী অর্থাৎ মুহম্মদ (সা ) ছিলেন আল্লাহ্র রসুলদের ধারাবাহিকতায় শেষ নবী। বিশ্ব মানবদের আল্লাহ্র একত্ব এবং ন্যায় ও সত্য শিক্ষাদানের জন্য পৃথিবীতে তাঁর আগমন। আমরা কি তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করবো না ? প্রতিটি দিন মহাকালের গর্ভে বিলিন হয় এবং সেই সাথে আমাদের শেষ পরিণতি বা শেষ বিচারের দিন প্রতিক্ষণে এগিয়ে আসে। আসন্ন কেয়ামতের সঠিক ক্ষণ একমাত্র আল্লাহ্র এখতিয়ারের জ্ঞান। যদিও কেয়ামত অবশ্যাম্ভবী, তবুও মানুষ তার সঠিক সময় জানে না, এ এক রহস্যে ঘেরা অতি বাস্তব। একমাত্র আল্লাহ্-ই তা সঠিক ভাবে জানেন।
৫৯। তবে কি তোমরা এই কথায় বিস্ময় বোধ করছো ? ৫১২৪
৫১২৪। কেয়ামতের কথায় বিস্ময় বোধ দ্বারা কেয়ামতের পরিণতি এড়ানো সম্ভব হবে না। প্রতিটি আত্মাকে কেয়ামত দিবসের শাস্তিকে এড়ানোর জন্য সৎ কাজের মাধ্যমে আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে। আল্লাহ্র ক্ষমা ও দয়া অতি নিকটেই।
৬০। এবং [ তবুও কি ] তোমরা হাসবে, এবং কাঁদবে না, ৫১২৫
৬১। এবং অহংকারে [ মত্ত ] থেকে সময় নষ্ট করবে ?
৬১। এবং অহংকারে [ মত্ত ] থেকে সময় নষ্ট করবে ?
৫১২৫। এই পৃথিবী বিশেষ ভাবে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক বিশেষ উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে। জীবন এই পৃথিবীতেই শেষ হয়ে যাবে না। মানব জীবন পরলোকের বৃহত্তর ও মহত্তর উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যায়। সুতারাং পৃথিবীতে আমরা যাই -ই করি না কেন সব কর্মই হবে পরলোকের মুক্তির জন্য। অর্থহীন ও তুচ্ছ কাজে সময় ব্যয় করার মত সময় মানুষের নাই। হাসি ঠাট্টার মাঝে সময় খেপনের মত সময় আমাদের হাতে নাই। যদি আমরা আমাদের দোষত্রুটি প্রকৃতপক্ষে অনুধাবন করতে পারতাম তবে হাসি তামাসার পরিবর্তে আমাদের হৃদয় শঙ্কা ও ভয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অশ্রুজলে আমরা আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করতাম। আমাদের উচিত আল্লাহ্র উপাসনার মাধ্যমে তাঁকে আত্মার মাঝে অনুধাবনের চেষ্টা করা। আল্লাহ্র নৈকট্য অন্বেষণের মাধ্যমেই মানব নিজেকে চিনতে পারে, মানুষকে ভালোবাসতে পারে ফলে আত্মার মুক্তি ঘটে।
৬২। বরং আল্লাহকে সিজ্দা কর এবং [তাঁর ] এবাদত কর ৫১২৬।
৫১২৬। সুতারাং আমাদের আল্লাহকে সেজ্দা করার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। অর্থাৎ ভক্তি বিগলিত চিত্তে সেই সর্বশক্তিমানের পদতলে লুণ্ঠিত হয়ে নিজেকে আত্মসমর্পন করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের সর্বশেষ উপদেশ বা সত্য হচ্ছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন। যখন আমরা আমাদের হৃদয়ের মাঝে এই সত্যকে অনুভবে সক্ষম হব তখনই আমরা সৃষ্টির উদ্দেশ্য, বিশ্ব-প্রকৃতি,মানুষের ইতিহাস, মানব সৃষ্টিতে আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে আমাদের সত্তার মাঝে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব।