Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ০ জন
আজকের পাঠক ৭২ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৬০৬ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৮৮২ বার
+ - R Print

সূরা হাশ্‌র


সূরা হাশ্‌র বা জনতা -৫৯

২৪ আয়াত, ৩ রুকু, মাদানী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : মদিনায় অবতীর্ণ ছোট সূরাগুলির মধ্যে দশটি সূরার যে শ্রেণীর উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে এটি তৃতীয় নম্বর। এই শ্রেণীর সূরাগুলিতে মুসলিম উম্মার জীবন বিধানের বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলির আলোচনা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দেখুন ৫৭ নং সূরার ভূমিকা। এই সূরার বিশেষ বিষয় হচ্ছে যে কিভাবে উম্মার বিরুদ্ধে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, তাদের বিশ্বাসঘাতকতা তাদেরই পরাজয়ের কারণ হয়েছিলো। অপরপক্ষে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে উম্মার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী বন্ধন দৃঢ় হয়। ইহুদী গোত্র বানু নাদিরের উদাহরণের সাহায্যে উপরের বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়েছে। ঘটনাটি সংঘটিত হয় ৪র্থ হিজরীর রবিউল মাসে।

এখান থেকে সূরাটির অবতীর্ণ কাল সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।

সার সংক্ষেপ : বিশ্বাসঘাতক ইহুদীদের বিতারণ প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। ইহুদীদের নিরাপদ দূর্গ ও মিত্র শক্তি তাদের রক্ষা করতে সক্ষম হয় নাই। সব কিছুই বৃথা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনা মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজেদের বন্ধনকে দৃঢ় করেছে। এ সকলই আল্লাহ্‌র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। যিনি সুন্দর নামের যোগ্য। [ ৫৯ : ১ - ২৪ ]।

সূরা হাশ্‌র বা জনতা -৫৯

২৪ আয়াত, ৩ রুকু, মাদানী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


১। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে; সকলেই আল্লাহ্‌র প্রশংসা এবং মহিমা ঘোষণা করে ৫৩৬৮। নিশ্চয়ই তিনি মহাশক্তিধর, প্রজ্ঞাময়।

৫৩৬৮। এই সূরাটির প্রারম্ভের আয়াত যা ৫৭ নং সূরার প্রারম্ভিক আয়াতের [ ৫৭ : ১ ] অনুরূপ। উভয় সূরার বিষয় বস্তু হচ্ছে আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ও বিচক্ষণ সদয় তত্বাবধান। পূর্বের সূরাটিতে মক্কা বিজয়ের উল্লেখের মাধ্যমে বিনয় ও নম্রতা শিক্ষাদান করা হয়েছে। এই সূরার ক্ষেত্রে বানু নাদের গোত্রের আলোচনা করা হয়েছে ; বিশ্বাসঘাতকতার জন্য যাদের মদিনার উপকন্ঠ থেকে বহিঃষ্কার করা হয়,কোনও রূপ সশস্ত্র সংঘর্ষ ব্যতীত।

২। তিনিই, কিতাবীদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসী ৫৩৬৯, তাদের প্রথম বার সমবেত ভাবে তাদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। তোমরা কল্পনাও কর নাই যে, তারা নির্বাসিত হবে ৫৩৭০, এবং তারা ধারণা করেছিলো যে, তাদের [ দুর্ভেদ্য ] দুর্গগুলি তাদের আল্লাহ্‌র [ আজাব ] থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহ্‌র [শাস্তি ] এমন এক দিক থেকে এলো, যা ছিলো তাদের ধারণাতীত ৫৩৭১ এবং যা তাদের অন্তরে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো। সুতারাং তারা তাদের নিজ হস্ত দ্বারা ও মোমেনদের হস্ত দ্বারা নিজেদের বাড়ী -ঘর ধ্বংস করে ফেললো ৫৩৭২। হে চক্ষুষ্মান ! এর থেকে উপদেশ গ্রহণ কর।

৫৩৬৯। হিজরত করে রাসুলুল্লাহ্‌ (সা) মদিনা পৌঁছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে সর্ব প্রথম মদিনা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকারী ইহুদী গোত্র সমূহের সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। এই চুক্তি ইতিহাসখ্যাত 'মদিনা চুক্তি ' যার দ্বারা ইহুদীরা মুসলমানদের সাথে শান্তিতে বসবাসের অঙ্গীকার দান করে। মদিনা থেকে তিন মাইল দক্ষিণে মদিনা শহরের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছিলো বানু নাদের নামক ইহুদী গোত্রের বাস, যদিও তারা মুসলিমদের সাথে শান্তিতে বসবাসের অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছিলো, কিন্তু তারা ৩য় হিজরী শাওয়াল মাসে সংঘটিত ওহদের যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এই ঘটনার চারমাস পরে ৪র্থ হিজরীর রবিউল মাসে এদের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। রাসুলুল্লাহ্‌ [সা ] প্রথমে তাদের মদিনা থেকে চলে যেতে নির্দ্দেশ দেন। এই আদেশ অমান্য করায় তিনি তাদের দুর্গ অবরোধ করেন [ হি : ৪/ খৃ ৬২৫ ]। প্রথমে ইহুদীরা ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দান করে নাই - কারণ তাদের দূর্গ ও মিত্র শক্তির উপরে উপরে তাদের ছিলো অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু মুসলমানেরা যখন ইহুদীদের দুর্গ অবরোধ করলো, ইহুদীদের মিত্র শক্তিরা কোনও সাহায্য বা সহযোগীতার হাত সম্প্রসারিত করলো না, ফলে তারা কিছুদিন পরে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় এবং মুসলমানেরা তাদের মদিনা ত্যাগে বাধ্য করেন। ইহুদীদের অধিকাংশ সিরিয়াতে তাদের আত্মীয় স্বজনের নিকট গমন করে, অবশিষ্ট অংশ খাইবারে গমন করে। দেখুন [ ৩৩ : ২৭ ] আয়াতের টিকা ৩৭০৫। বানু নাদেররা চুক্তি ভঙ্গের দ্বারা যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, মৃত্যুদন্ডই ছিলো তার উপযুক্ত জবাব। কিন্তু আল্লাহ্‌র নবী তাদের জীবন ভিক্ষা দেন এবং তাদের পশু সম্পদ ও অন্যান্য জিনিষসহ মদিনা ত্যাগের অনুমতি দান করেন।

৫৩৭০। "তোমরা কল্পনাও কর নাই যে, তারা নির্বাসিত হবে।" - অর্থাৎ পবিত্র মুসলিম রক্তপাত ব্যতীত, কোনরকম সংঘর্ষ ব্যতীত এরূপ বিজয় লাভ ঘটবে তা ছিলো মুসলমানদের কল্পনাতীত।

৫৩৭১। ইহুদীদের ভূমিকা ছিলো দ্বৈত। তারা একদিকে মদিনার মুসলমানদের সাথে রাসুলের (সা) নেতৃত্বে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলো, অপরদিকে তারা গোপনে মক্কার প্যাগানদের সাথে আবু জহলের নেতৃত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো এবং তাদের সাথে মদিনার মোনাফেকরাও ষড়যন্ত্রে যোগদান করে। এমনকি আল্লাহ্‌র রাসুল (সা ) যখন একদিন তাদের মাঝে ছিলেন, তারা রাসুলুল্লাহ্‌ কে (সা ) হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এ ভাবেই তারা আতিথেয়তার অবমাননা ও তাদের কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে। তাদের ধারণা ছিলো বিপদে মক্কার কোরাইশরা ও মদিনার মোনাফেকরা তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু প্রকৃত বিপদের সময়ে ইহুদীদের মিত্র শক্তিরা সাহায্যের জন্য কোনও চেষ্টাও করলো না। মুসলমানরো তাদের দুর্গ অবরোধ করে ছিলো এগারো দিন। এই এগারো দিনে তাদের অসহায়ত্বের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য জিনিষের সরবরাহ বন্দ করে দেয়া হয়। অবরোধের প্রয়োজনীয় কৌশল হিসেবে মুসলমানেরা দুর্গের বাইরের সকল খেজুর গাছ সমূহ কর্তন করে ফেলেন। তাদের অসহায়ত্ব তাদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে। তাদের অন্তর শঙ্কায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং তারা শর্তাধীনে আত্ম সমর্পন করে। কিন্তু তারা তাদের দুর্গ ত্যাগের প্রাক্কালে, নিজ হস্তে তাদের বাড়ী ঘর ধ্বংস করে। দেখুন পরবর্তী টিকা।

৫৩৭২। ইহুদীদের আত্মসমর্পনের পরে তাদের দশদিন সময় দেয়া হয়, পরিবার পরিজনসহ সে স্থান ত্যাগ করার জন্য এবং তাদের অনুমতি দেয়া হয় বহনযোগ্য বস্তু যা তাদের সাধ্যে কুলায় তা তাদের সাথে বহন করার জন্য। মুসলমানেরা যাতে তাদের আবাসসমূহ ব্যবহার করতে না পারে সে কারণে তারা নিজ হস্তে তাদের আবাস সমূহ ধ্বংস করে ফেলে। অবরোধের পরিণতিতে মুসলমানদের দ্বারা যে ধ্বংস সংঘটিত হওয়ার কথা ছিলো, সে কাজকে ইহুদীরা নিজেরাই ত্বরান্বিত ও সমাপ্ত করলো। এ ভাবেই আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা কার্যকর হয়। যে জ্ঞানী, সেই শুধু পারে ঘটনার উর্দ্ধে উঠে হৃদয় দিয়ে অনুভবের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কৌশলী কার্যকে উপলব্ধি করতে। যার আছে অন্তর্দৃষ্টি বা মনের চোখ একমাত্র সেই পারে প্রকৃত ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে।

৩। এবং আল্লাহ্‌ যদি তাদের জন্য নির্বাসনের আদেশ না দিতেন ৫৩৭৩, তবে তিনি এই পৃথিবীতেই তাদের শাস্তি দান করতেন। এবং পরলোকে তাদের জন্য [ নিশ্চয়ই ] আগুনের শাস্তি রয়েছে।

৫৩৭৩। বানু নাদের গোত্র যে মন্দ কাজ করেছিলো তার পরিবর্তে তাদের অক্ষত অবস্থায় বিতারণ ছিলো প্রকৃতপক্ষে খুব কম শাস্তি। এ শাস্তি ছিলো আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত। আল্লাহ্‌ তাদের আর একবার সুযোগ দান করেছিলেন কিন্তু তাদেরই সমগোত্র বানু কোরাইজারা সেরূপ সুযোগ লাভ করে নাই। বানু নাদেরদের ঘটনার দুবছর পরে অনুরূপ ঘটনায় বানু কোরাইজাদের পরিণতি ঘটেছিলো অন্যরূপ। দেখুন [ ৩৩ : ২৬ ] আয়াত ও টিকা।

৪। তার কারণ তারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলো। এবং কেহ যদি আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধাচারণ করে ৫৩৭৪ ; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ কঠিন শাস্তিদাতা।

৫৩৭৪। বানু নাদেরদের প্রতি শাস্তির কারণ গুলি নিম্নরূপ : তারা আল্লাহ্‌র রাসুলের (সা) সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তারা আল্লাহ্‌র বাণীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করে এবং শত্রুদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ ভাবেই তারা আল্লাহ্‌র পবিত্র ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচারণ করে। আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করা এবং বিদ্রোহ করা ভয়াবহ অপরাধ। তবুও এক্ষেত্রে আল্লাহ্‌ তাদের জন্য নমনীয় শাস্তির ব্যবস্থা করেন।
৫। [ হে মুসলমানেরা ! ] তোমরা সতেজ খেজুর গাছগুলি কাট, অথবা তাদের মূলের উপরে স্থির রেখে দাও, তা ঘটে থাকে আল্লাহ্‌র অনুমতিক্রমে ৫৩৭৫, এবং তা এ জন্য যে, আল্লাহ্‌ বিদ্রোহী, সীমালংঘনকারীদের যেনো অপমানে আচ্ছাদিত করতে পারেন ৫৩৭৬।

৫৩৭৫। অপ্রয়োজনে ফলের গাছ কাটা বা শষ্যের ক্ষতি করা বা যে কোন ধ্বংসযজ্ঞ, যা বিশেষতঃ যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত হয়, এরূপ উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলামে বিনা প্রয়োজনে শত্রুদের সম্পদ, বৃক্ষ, শষ্যের কোন ক্ষতি করা নিষিদ্ধ তবে সমর কৌশলের প্রয়োজনে, শত্রুদের উপরে চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যতটুকু ক্ষতি করা প্রয়োজন তা করা বিধিসম্মত। তবে যতদূর সম্ভব বৃক্ষ ও শষ্যের ক্ষতি সাধন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এগুলি হচ্ছে আল্লাহ্‌ কর্তৃক মনোনীত আইন যা মুসলিমরা সমরক্ষেত্রে মেনে চলতেন।

মন্তব্য : এরই প্রেক্ষিতে ১১ই সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনাটি কতটুকু যুক্তি সঙ্গত ; বিবেকবান মুসলিমদের তা চিন্তা করতে হবে।

৫৩৭৬। ''বিদ্রোহী, সীমালংঘনকারী'' অর্থাৎ এখানে বানু নাদের গোত্রকে বুঝানো হয়েছে। এদের উদ্ধতপনা, অহংকারকে আল্লাহ্‌ লাঞ্ছনার মাধ্যমে বিনীত করেন। তাদের দুরভিসন্ধি করার ক্ষমতাকে আল্লাহ্‌ ধ্বংস করেন। যদিও এখানে 'সীমালংঘনকারী' শব্দটি দ্বারা নির্দ্দিষ্ট পাপাচারী গোষ্ঠিকে বুঝানো হয়েছে, তবে তা পৃথিবীর সর্বকালের পাপাচারীদের জন্য তা প্রযোজ্য।

৬। আল্লাহ্‌ তাঁর রসুলকে যে অনুগ্রহ দান করেছেন, [এবং যা কেড়ে নিয়েছেন] ইহুদীদের থেকে - তার জন্য তোমরা অশ্বে কিংবা উষ্ট্রে আরোহণ করে যুদ্ধ কর নাই ৫৩৭৭। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর রাসুলদের, যার উপরে খুশী ক্ষমতা দান করেন। সকল কিছুর উপরে আল্লাহ্‌ শক্তিমান ৫৩৭৮।

৫৩৭৭। এই অবরোধকালে কোন অশ্বারোহী বাহিনী বা উষ্ট্রবাহিনী ব্যবহার হয় নাই। 'ফায়' শব্দটির অর্থ যে সম্পদ যুদ্দ ব্যতীত হস্তগত হয় ও যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয় রাসুলের (সা ) তত্বাবধানে। প্রকৃত পক্ষে বানু নাদেররা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পন করে। এ তো আল্লাহ্‌রই কুদরত। আল্লাহ্‌ তাদের অন্তরের মাঝে ভয়, শঙ্কা ও ত্রাসের সঞ্চার করেন যার ফলে তারা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পন করে। দেখুন [ ৫৯ : ২ ] আয়াত।

৫৩৭৮। আল্লাহ্‌র পবিত্র পরিকল্পনা কত বিভিন্নভাবে বাস্তবায়িত হয় তা অনুধাবন করা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে অসাধ্য। কখনও তা বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন হয়, কখনও তা বিনা যুদ্ধে হয়। এতো আল্লাহ্‌রই ক্ষমতার প্রকাশ মাত্র।

৭। আল্লাহ্‌ তাঁর রসুলকে যে অনুগ্রহ দান করেছিলেন ৫৩৭৯ [ এবং যা কেড়ে নিয়েছিলেন ] জনপদবাসীদের নিকট থেকে ৫৩৮০, - তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র অধিকারভূক্ত ৫৩৮১- তাঁর রসুলের, তাঁর আত্মীয় স্বজনের, এবং এতিমদের, অভাবগ্রস্থ এবং পথচারীদের জন্য। এটা এ জন্য যে, তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই যেনো ঐশ্বর্য আবর্তন না করে। সুতারাং রসুল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর এবং তোমাদের যা দিতে অসম্মত হয় তা থেকে নিজেকে বিরত রাখ। এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় শাস্তি দানে আল্লাহ্‌ অত্যন্ত কঠোর।

৫৩৭৯। 'জনপদবাসী ' এই শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে ইহুদীদের বসতি যা ছিলো মদিনার উপকন্ঠে। সম্ভবতঃ এরে দ্বারা বানু নাদের বা অন্যান্য গোত্রকে বুঝানো হয়েছে। দেখুন জনপদের উল্লেখ করা হয়েছে নিম্নের আয়াতে [ ৫৯ : ১৪ ]।
৫৩৮০। ইহুদীরা আরবের মূল অধিবাসী ছিলো না। আরবের বাইরে থেকে তাদের আগমন ঘটে এবং তারা মদিনার উপকন্ঠের ভূমি দখল করে বসবাস করতো। তারা আরবের মূল অধিবাসীদের সংস্কৃতিক ধারার সাথে মিশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে মদিনাবাসীদের মাঝে তাদের অস্তিত্ব ছিলো বিষ ফোঁড়ার মত। সুতারাং মদিনা থেকে তাদের বিতারণ ছিলো মদিনার হৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের ন্যায়। এই আয়াতে 'Fai' শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে শত্রু সম্পত্তির অধিকার বিনা যুদ্ধে লাভ করা। এ ভাবেই এই শব্দটিকে 'Anjal' শব্দটি থেকে আলাদা করা হয়েছে যার অর্থ যুদ্ধ জয়ের শেষে গনিমতের বা লুটের মাল লাভ করা। দেখুন [ ৭ : ১; ৪ ] আয়াত।

৫৩৮১। "তা আল্লাহ্‌র অধিকারভুক্ত " অর্থাৎ আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করার জন্য। এর জন্য কোন অংশ বা ভাগ নির্দ্দিষ্ট করা হয় নাই। কতটুকু আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করা হবে তা নির্ভর করবে পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী যার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে নেতার। সূরা বাকারার [ ২ : ১৭৭ ] আয়াতে দান গ্রহীতাদের যে তালিকা আছে তার সাথে এই আয়াতটি তুলনা করা চলে, তবে এক্ষেত্রে দান গ্রহীতাদের যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে তার পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে কিছু কিছু দান গ্রহীতার উল্লেখ আছে যাদের উল্লেখ উভয় আয়াতেই করা হয়েছে।

জনহিতের জন্য অর্থ দান করা অপরিহার্য কারণ হিসেবে আল্লাহ্‌ বলেছেন, " তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে।" ইসলামের সমতার যে বিধান তারই দলিল এটি।

৮। এই সম্পদ অভাবগ্রস্থ মুহাজিরদের জন্য ৫৩৮২ যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও সম্পত্তি থেকে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলের সাহায্য করে। এরাই তো সত্যাশ্রয়ী।

৫৩৮২। 'মোহাজির ' দ্বারা তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে যারা তাদের বিষয় সম্পত্তি সব কিছু মক্কাতে ত্যাগ করে মদিনাতে রাসুলের (সা ) সাথে হিজরত করেন, রাসুলকে ( সা) সাহায্য করার জন্য। আল্লাহ্‌র প্রতি, রাসুলের ( সা) প্রতি তাদের যে আন্তরিকতা যে আনুগত্য, তা তুলনাহীন। আত্মোৎসর্গ দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে এ সত্যকে প্রমাণিত করেছেন। সুতারাং এখন তারা পুরষ্কারের যোগ্য।

৯। কিন্তু মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এই [ মদিনা ] নগরীতে যারা বসবাস করতো [ এ সম্পদে তাদেরও অংশ রয়েছে ] ৫৩৮৩, তারা ঈমান এনেছে, তাদের নিকট যে মুহাজিররা এসেছে তাদের তারা ভালোবাসে, এবং মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে তার জন্য তারা তাদের অন্তরে আকাঙ্খা পোষণ করে না; বরং দারিদ্রতা তাদের ভাগ্যলিখন হওয়া সত্বেও তারা নিজেদের উপর তাদের প্রাধান্য দেয়।এবং যারা নিজের আত্মাকে প্রলোভন থেকে রক্ষা করতে পেরেছে তারাই সফলকাম।

৫৩৮৩। যাদের কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা হচ্ছেন মদিনাবাসী আন্‌সার [ সাহায্যকারী ]। মক্কাতে যখন মুসলমানদের উপরে অত্যাচার নির্যাতন চলছিলো , সে সময়ে মদিনার লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসুলকে (সা) মদিনাতে এসে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য আহ্বান করেন। রাসুল (সা) এবং মক্কার অত্যাচারীত মুসলিমদের মদিনাতে হিজরত করা সম্ভব হয়েছিলো, মদিনাবাসীদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার কারণে। মদিনাবাসীরা নবী ও মোহাজেরদের সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাদের সাধ্যমত আদর যত্ন করেন। মোহাজের ও আনসারের মাঝে এক অপূর্ব ভাতৃবন্ধনের সৃষ্টি হয়। এবং যতদিন মদিনার মুসলিম উম্মা আত্মনির্ভরশীল হয়ে না ওঠে ততদিন আনসাররা মোহাজেরদের নিয়মিত সাহায্য করতেন। এ ব্যাপারে আনসারদের মনে কোন আত্মগরিমার স্থান ছিলো না। তারা এটাকে তাদের জন্য আল্লাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহ বলে বিবেচনা করতেন। এমন কি মদিনার গরীব আনসারটিও এ ব্যাপারে ধনীদের সাথে প্রতিযোগীতা করতেন। এই প্রতিযোগীতা অর্থ সম্পদের ছিলো না। ছিলো আত্মোৎসর্গের মহৎ উদ্দীপনার। বানু নাদের গোত্রের বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পরে, তার অধিকাংশ যখন মোহাজেরদের মধ্যে বন্টন করা হয়, তখন মদিনার আনসারদের মধ্যে ক্ষীণতমও ঈর্ষা বোধ লক্ষ্য করা যায় নাই। বরং তারা তাদের মোহাজের ভাইদের সৌভাগ্যে আনন্দিত হন। প্রকৃত পক্ষে তারা মোহাজেরদের জন্য আনসারের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

১০। এবং যারা তাদের পরে এসেছে ৫৩৮৪ তারা বলে, " হে আমাদের প্রভু! আমাদের ক্ষমা কর, এবং আমাদের পূর্বে যারা ঈমান এনেছে আমাদের সেই ভ্রাতাদেরও ক্ষমা কর। যারা ঈমান এনেছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ [ অথবা ক্ষোভ ] রেখো না ৫৩৮৫। নিশ্চয়ই তুমি দয়াময় ও পরম করুণাময়।

৫৩৮৪। "যারা তাদের পরে এসেছে " - এই লাইনটি তাৎক্ষণিক ভাবে যে সব মোহাজের রাসুলের পরে মদিনাতে আগমন করেন তাদের জন্য প্রযোজ্য ছিলো, তবে এই আয়াতটির তাৎপর্য সার্বজনীন। যুগ কাল অতিক্রান্ত। সাধারণভাবে তাদেরই বোঝানো হয়, যারা পরবর্তীতে ইসলামের পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতের মুসলিমগণ এরা শুধুমাত্র নিজেদের জন্যই প্রার্থনা করেন না, এরা তাদের পূর্ববর্তী সকল মুসলিম ভাইদের জন্য প্রার্থনা করেন। উপরন্তু তারা প্রার্থনা করেন আত্মশুদ্ধির জন্য।

মুসলিম ভ্রাতাদের গুণাবলী দর্শনে বা সৌভাগ্য দর্শনে তাদের আত্মার মাঝে যেনো কোনও রূপে বিদ্বেষ বা ঈর্ষার প্রকাশ না ঘটে সে কারণে স্রষ্টার নিকট তারা প্রার্থনা করে। ঈর্ষা ও বিদ্বেষ হচ্ছে আত্মার গুণাবলী ও প্রশান্তি বিনষ্টকারী শক্তি। এগুলি এমনই খারাপ রীপু যে, এর প্রভাবে মানুষের সকল গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়। আত্মার মাঝে যন্ত্রনার সৃষ্টি করে। সুতারাং মুসলিম মাত্রই আল্লাহ্‌র নিকট এ থেকে মুক্তি চাওয়া প্রয়োজন।

৫৩৮৫। দেখুন সূরা [ ৭ : ৪৩ ] আয়াত ও টিকা ১০২১। যেখানে বলা হয়েছে মোমেনদের আল্লাহ্‌ ঈর্ষা ও দ্বেষ থেকে মুক্তি দেবেন।

রুকু - ২

১১। তুমি কি মোনাফেকদের লক্ষ্য কর নাই, কিতাব প্রাপ্তদের ৫৩৮৬ মধ্যে যারা কাফের তারা তাদের বলে, " যদি তোমাদের দেশ [থেকে] বহিষ্কার করা হয় তবে আমরাও তোমাদের সাথে বের হয়ে যাব, এবং আমরা তোমাদের ব্যাপারে কখনও কারও কথা শুনবো না। এবং তোমরা যদি [যুদ্ধে ] আক্রান্ত হও, আমরা তোমাদের সাহায্য করবো ''। কিন্তু আল্লাহ্‌ সাক্ষী, তারা অবশ্যই মিথ্যাবাদী ৫৩৮৭।

৫৩৮৬। মদিনার মোনাফেকরা বানু নাদীর গোত্রের ইহুদীদের আশ্বাস দান করেছিলো যে, তারা সর্বদা ইহুদীদের সমর্থন জানাবে। তাদের ধারণা হয়েছিলো যে, তারা যদি নবীর পক্ষ ত্যাগ করে তবে মুসলমানদের দুর্বল করে ফেলবে, এবং এভাবেই তারা ইহুদীদের রক্ষা করতে সমর্থ হবে। কিন্তু এ কাজের জন্য যদি আত্মহত্যা ও আত্মোৎসর্গের প্রয়োজন হয়, মোনাফেকরা তা করতে রাজী নয়। যদি ইহুদীরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতো, বিজিত দল হতো, তবে অবশ্যই মোনাফেকরা তাদের সাথে থাকতো। কিন্তু কারও বিপদ ও বিপর্যয়ে মোনাফেকরা কখনও তাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে না। এটা তাদের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, যুদ্ধ করার মত সাহস, মনোবল বা উৎসাহ তাদের ছিলো না। মুসলিম সৈন্যদের শৃঙ্খলা, সাহসিকতা ও বিশ্বস্ততার নিকট তাদের আচরণ ছিলো ভীতু ও কাপুরুষের ন্যায়। মোনাফেকরা বানু নাদের গোত্রকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালন করে নাই।

৫৩৮৭। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ মোনাফেকদের মিথ্যাবাদী বলে সম্বোধন করেছেন। যখন বানু নাদের গোষ্ঠি বিপদে পতিত হলো, এ সব মোনাফেকরা প্রতিশ্রুতি সত্বেও ইহুদীদের সাহায্যের জন্য তাদের একটা অঙ্গুলিও উত্তোলন করলো না। তাদের তা করার কোন ইচ্ছাও ছিলো না। কারণ তারা তাদের প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে আন্তরিক ছিলো না। এটা মোনাফেকদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ্‌ সকলের অন্তরের চিন্তা ও ভাবনা খোলা বই এর ন্যায় পাঠ করতে পারেন। দেখুন সূরা [ ৪৭: ২৬ ] আয়াত ও টিকা ৪৮৫০। মোনাফেকের প্রধান বৈশিষ্ট্য তারা হবে মিথ্যাবাদী।

১২। যদি তারা বহিষ্কৃত হয়, তবে মোনাফেকরা কখনও তাদের সাথে বের হবে না। এবং তারা যদি [ যুদ্ধে ] আক্রান্ত হয়, মোনাফেকরা কখনও তাদের সাহায্য করবে না। আর যদি তারা তাদের সাহায্য করতেও চায়, তারা অবশ্যই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। সুতারাং তারা কোন সাহায্য পাবে না। ৫৩৮৮

৫৩৮৮। মোনাফেকরা মিথ্যা কথা বলে ও ওয়াদা ভঙ্গ করে। এটা মোনাফেকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এরা হয় সুবিধাবাদী। তাদের চরিত্রের এই বিশেষ দিককে তুলে ধরা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। যে আশা -আকাঙ্খা বা আশ্বাস ; অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতার উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে তার কোনও শক্ত ভীত নাই - শেষ পর্যন্ত তা মিথ্যা অলীক বলে প্রতিপন্ন হবে।

১৩। আল্লাহ্‌ কর্তৃক তাদের অন্তরে [ প্রেরিত ] প্রচন্ড ভয়ের দরুন, তোমরা [ মুসলমানেরা ] তাদের থেকে শক্তিশালী। এর কারণ তারা হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতাহীন এক সম্প্রদায় ৫৩৮৯।

৫৩৮৯। এই আয়াতটিকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যার অর্থ হবে : আল্লাহ্‌ মুসলিমদের বলছেন যে, "হে মুসলমানগণ যদিও তোমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নও, এবং তোমাদের শত্রুরা বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছে এ কথা সত্য, তবুও তোমরাই প্রকৃত পক্ষে শক্তিশালী দল - মোনাফেকরা নয়। তাদের অন্তর সর্বদা ভয় এবং শঙ্কাতে পূর্ণ থাকবে। কারণ পাপীদের অন্তর আল্লাহ্‌ এভাবেই ভয় ও শঙ্কাতে পূর্ণ করে তোলেন।" অপর ব্যাখ্যা হতে পারে নিম্নরূপ, " যেহেতু তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্‌র ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়, মোনাফেকরা আল্লাহ্‌ অপেক্ষা আপনাকেই [ রাসুলকেই (সা) ] বেশী ভয় করবে। কারণ আপনার সাহস, শৈর্য্য ও বীর্য তাদের দৃষ্টি গোচর, কিন্তু আল্লাহ্‌র ক্ষমতা তারা অনুধাবনে অক্ষম।"

১৪। সুরক্ষিত শহর সমূহ ভিন্ন কিংবা দেয়ালের পশ্চাৎ থেকে ব্যতীত তারা সংঘবদ্ধভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না ৫৩৯০। নিজেদের মধ্যে তাদের যুদ্ধ করার [সাহস ] প্রচন্ড। তোমার মনে হবে তারা একতাবদ্ধ,কিন্তু তাদের হৃদয় দ্বিধা বিভক্ত ৫৩৯১। তার কারণ এরা এক প্রজ্ঞাবিহীন সম্প্রদায়।

৫৩৯০। মোনাফেকদের অন্য আর একটি বৈশিষ্ট্য এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তারা কখনও একতাবদ্ধ হতে সক্ষম হবে না। তাদের কোনও আত্মবিশ্বাস থাকবে না। তারা শুধুমাত্র পার্থিব সুযোগ সুবিধার নিরাপত্তার মাঝে যুদ্ধ করতে আগ্রহী হবে কোনও বিপদের ঝুঁকি নিতে তারা হবে নারাজ। তারা যদি ধর্ম যুদ্ধে যোগদানও করে, তাদের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস তাদের যুদ্ধের যে প্রকৃত নৈতিক নীতিবল তা অর্জনে অক্ষম করবে। অর্থাৎ কোনও রূপ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে কোনও দিনই তারা অংশ গ্রহণ করবে না। এক কথায় তারা হবে সুবিধাবাদী ও পরস্পরকে প্রতি অবিশ্বাসী।

৫৩৯১। প্রকৃত পক্ষে মোনাফেকদের যুদ্ধ করার মত শৈর্য-বীর্য থাকে কিন্তু তাদের নিকট যুদ্ধ করার মত কোন মহত্তর ও বৃহত্তর কারণ থাকে অনুপস্থিত, যে কারণের জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে কুন্ঠা বোধ করে না। ফলে তাদের মাঝে কোনও একত্ব থাকে না। স্বার্থপরতা সর্বদা বিভেদের জন্ম দেয়। মক্কার প্যাগান বা মোশরেকরা তাদের অন্যায় ও স্বার্থপর স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখতে আগ্রহী ছিলো, মদিনার মোনাফেকরা তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে আগ্রহী, ইহুদীরা তাদের বংশ গৌরবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠাতে ছিলো আগ্রহী - এরা সকলেই ইসলামের ক্রমান্বয়ে প্রচার ও প্রসারে হিংসা ও বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে পড়ে। বাইরের লোক দেখানো মৈত্রী প্রকৃত জিহাদের ক্ষেত্রে যুদ্ধের নৈতিক মনোবল ধরে রাখতে অক্ষম। তাদের ভান করা মৈত্রী জয় বা পরাজয়ের কোনও কিছুরই সাথে একাত্বতা প্রকাশ করতে পারে না। মনের দিক থেকে, উপলব্ধির দিক থেকে এরা অজ্ঞ। এদের মাঝে স্বার্থবুদ্ধি ব্যতীত, কোনও জ্ঞান বা প্রজ্ঞা থাকে অনুপস্থিত। যদি তারা জ্ঞান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন হতো, তবে তারা ঈমান, সত্য ও আল্লাহ্‌র একত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে স্বাগত জানাতো।

১৫। এরা তাদের মত, যারা সম্প্রতি ৫৩৯২ তাদের অগ্রবর্তী ছিলো। তারা তাদের মন্দ কাজের ফল আস্বাদন করেছে। এবং [পরকালে ] তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।

৫৩৯২। এই আয়াতে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন ইহুদী গোত্র বানু কায়নূর। পেশায় এরা ছিলো কামার। এদেরও অবস্থান ছিলো মদিনার উপকন্ঠে এক নিরাপদ দুর্গে। বদরের যুদ্ধের এক মাস পরে এদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২য় হিজরীতে, যে যুদ্ধে কোরাইশদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। যারা অজ্ঞ তারা কখনও অন্যের উদাহরণ থেকে শিক্ষা লাভ করে না। বানু নাদের গোত্রও সেরূপ বানু কায়নূকা গোত্রের পরিণতি থেকে শিক্ষা লাভ করে নাই। এই আয়াতের সাধারণ উপদেশ হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা পাপ, আর তা থেকে নিজেদের রক্ষা করা সকলের কর্তব্য, অন্যথায় এর পরিণাম ভয়াবহ। নিরাপদ দূর্গ বা শক্তিশালী কিন্তু অন্যায়কারী মিত্র, কিছুই এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

১৬। তাদের মিত্রতা, শয়তানের মত [ তাদের প্রতারিত করে ] ; যখন সে লোকদের বলে, " আল্লাহকে অস্বীকার কর।" কিন্তু যখন [ লোকেরা ] আল্লাহকে অস্বীকার করে ৫৩৯৩ [ শয়তান বলে ], " তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। আমি জগত সমূহের প্রভু আল্লাহ্‌কে ভয় করি।"

৫৩৯৩। মোনাফেকদের বৈশিষ্ট্য একটি উপমার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে এরা হচ্ছে শয়তানের মত। শয়তান মানুষের সম্মুখে প্রলোভনের মায়াজাল বিস্তার করে। শয়তানের মিথ্যা প্রতিজ্ঞাতে সাধারণ মানুষ হয় বিভ্রান্ত ও সম্মোহীত। শয়তানের প্রতারণার শিকার সাধারণ মানুষ মনে করে শয়তান তাকে রক্ষা করতে পারবে, সকল বিপদ ও প্রতিবন্ধকতা থেকে। শয়তান তখন বলে, "আল্লাহকে অস্বীকার কর" একথার অর্থ এই নয় যে, শুধুমাত্র মৌখিক অস্বীকার করা। এর অর্থ কার্যতঃ প্রমাণ করা যে, সে আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী নয়। সে তখন তার প্রতিটি কর্মে আল্লাহ্‌র বিধানকে অস্বীকার করতে থাকে, পাপে নিমগ্ন থেকে আত্মসংশোধনের পথকে পরিহার করে। এভাবে পাপী যখন সম্পূর্ণরূপে পাপের বেড়াজালে আটকে পড়ে তখন শয়তান ব্যঙ্গভরে বলে, " তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই, আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।" শয়তানের বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে : " মোনাফেকের সকল মৈত্রী হচেছ চাঁদের আলোর মতো, চাঁদের আলো যেমন নিজস্ব নয়, ঠিক সেরূপ শয়তানের প্রতিশ্রুতিরও কোনও ভিত্তি নাই। সুতারাং শয়তান তাদের ব্যঙ্গ করে থাকে তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য।

১৭। ফলে উভয়ের পরিণাম হবে জাহান্নাম। সেথায় তারা স্থায়ী হবে। পাপীদের পুরষ্কার হবে এরূপই।

রুকু- ৩

১৮। হে মুমিনগণ ! আল্লাহ্‌কে ভয় কর ৫৩৯৪, এবং প্রতিটি আত্মা ভেবে দেখুক, আগামী দিনের জন্য কি [ সম্বল ] সে অগ্রিম পাঠিয়েছে ৫৩৯৫। হ্যাঁ, আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত আছেন।

৫৩৯৪। " আল্লাহকে ভয় কর। " এই ভয় করার অর্থ আল্লাহ্‌র ভালোবাসা হারাবার ভয়ে ভয় করা। যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্‌র ভালোবাসা হারাবার ভয়ে আল্লাহ্‌ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকা, যা করতে হুকুম দিয়েছেন তা আন্তরিক ও বিশ্বস্ততার সাথে পালন করতে চেষ্টা করা। এই হচ্ছে 'তাকওয়া' বা আল্লাহ্‌ ভীতি যার অর্থ আত্ম সংযম, নিজেকে সকল পাপ, অন্যায়, মন্দ থেকে বিরত রাখা, ভালো কাজে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য আত্মনিয়োগ করা। দেখুন সূরা [ ২ : ২ ] আয়াত ও টিকা নং ২৬।

৫৩৯৫। এই আয়াতে 'তাকওয়ার' প্রকৃত অর্থের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র ভীতি বা তাকওয়া শুধুমাত্র তত্বীয় নয় কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য এই আয়াতে নির্দ্দেশ দান করা হয়েছে বলা হয়েছে, "প্রতিটি আত্মা ভেবে দেখুন আগামী দিনের  জন্য সে কি অগ্রিম পাঠিয়েছে।" আগামী দিনের এই প্রস্তুতি অর্থাৎ পরলোকের প্রস্তুতি শুধুমাত্র মৌখিক বা আবেগ স্বর্বস্ব নয় -এই প্রস্তুতির ভিত্তি হতে হবে সৎকর্ম যা হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত,আত্মার মুক্তির জন্য, পরলোকে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের আশায়। পরলোকের জীবনকেই এখানে, " আগামী দিনের " জীবন এই উপমার মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে। আগামী দিন বা ভবিষ্যতের এই জীবনকে ইহলোকের বা পৃথিবীর জীবনের পটভূমিতে তুলে ধরা হয়েছে। "তোমরা যা কিছু কর " -তারই পটভূমিতে পরলোকের জীবনের মুক্তি, সুখ ও শান্তি নির্ধারিত হবে। আল্লাহ্‌ মানুষের কর্মের নিয়ত সম্বন্ধে সম্যক অবহিত। এই বিশ্ব ভূবনে প্রতিটি কর্মেরই পরিণতি বিদ্যমান। এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান।

১৯। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে যায় ৫৩৯৬ [ ফলে ] তিনি তাদের নিজ আত্মার [ অস্তিত্বের ] কথা ভুলিয়ে দেন। এরূপই হয় বিদ্রোহী সীমালংঘনকারীদের [ অবস্থা ]।

৫৩৯৬। আল্লাহ্‌কে ভুলে যাওয়ার অর্থ আত্মবিস্মৃত হওয়া। কারণ মানুষের আত্মা পরমাত্মারই অংশ বিশেষ। আল্লাহ্‌ মানুষের মাঝে তাঁর রুহুর অংশ ফুঁৎকার করে দিয়েছেন। সুতারাং আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার অর্থ নিজের আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। চাঁদের আলোর মূল উৎপত্তি যেরূপ সূর্যের আলো। সূর্যকে অস্বীকার করলে যেরূপ চাঁদের আলোর কোনও অস্তিত্ব নাই। সূর্যের প্রতিফলিত রশ্মিই হচ্ছে চাঁদের আলোর মূল বা উৎস। ঠিক সেরূপ মানবাত্মাও হচ্ছে সেই পরমাত্মার প্রতিফলিত রশ্মি বিশেষ। সুতারাং আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস ব্যতীত আমাদের মাঝে অর্ন্তদৃষ্টি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উন্মেষ ঘটতে পারে না। আল্লাহ্‌কে ভুলে গেলে আমরা আমাদের অস্তিত্বকেই ভুলে যাব। " ফলে তিনি তাদের নিজ আত্মার অস্তিত্বের কথা ভুলিয়ে দেন।" সুতারাং যারা এক স্রষ্টাতে বিশ্বাসী নয় তাদের মনে প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উন্মেষ ঘটে না। এরা হয় অন্তর্দৃষ্টি বিহীন এদেরই উপমা হচ্ছে মূক, বধির ও অন্ধ। [ ২ :১৮ ]।

২০। জাহান্নামের অধিবাসী এবং বেহেশতের অধিবাসীরা সম পর্যায়ভুক্ত নয়। বেহেশতের অধিবাসীরাই সফলতা লাভ করবে ৫৩৯৭।

৫৩৯৭। প্রতিটি জীবনেরই এক নির্দ্দিষ্ট পরিণাম বিদ্যমান। যারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে, তাদের জীবনের শেষ পরিণতি অর্থহীন, তাদের জীবন মূল্যহীন। তাদের সকল মানসিক দক্ষতাকে সেদিন স্তব্ধ করে দেয়া হবে, তাদের সকল ইচ্ছাকে সেদিন ব্যর্থতায় পর্যবসিত করা হবে।

২১। যদি আমি এই কুর-আন পর্বতের উপরে অবতীর্ণ করতাম ৫৩৯৮, তবে তুমি উহাকে আল্লাহ্‌র ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ হতে দেখতে ৫৩৯৯। এই সকল দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য বর্ণনা করছি যেনো তারা চিন্তা করে।

৫৩৯৮। সুউচ্চ পর্ব্বতমালা মানুষের হৃদয়ে যে অনুভূতির জন্ম দেয় তা দ্বিবিধ। প্রথমত : পর্বতের উচ্চতা যা মানুষের মনে সম্ভ্রম জাগায়। দ্বিতীয়ত : পর্বতের কাঠিন্য, সকল সুউচ্চ পর্বতই কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত হয়। পর্বতের উপমার সাহায্যে কোরাণের তুলনা করা হয়েছে এই আয়াতে। কোরানের প্রত্যাদেশ সমূহ এতই মহিমান্বিত, শ্রেষ্ঠ এবং ভয় ও শ্রদ্ধা উদ্রেককারী যে, সর্বোচ্চ পর্বতও শ্রদ্ধায়, ভয়ে বিনয়াবনত হয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত : প্রতাদেশ সমূহ এতটাই শক্তিশালী ও প্রত্যয় উৎপাদনকারী যে পবর্তও তার কাঠিন্য হারিয়ে ফেলবে। ভয়ে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে প্রত্যাদেশের ভারে। এর পরেও কি মানুষ নিজেকে আল্লাহ্‌র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করে। সে কি এতটাই কঠিন হৃদয় যে এই শক্তিশালী বাণী সমূহও তার হৃদয়ে কোনও প্রভাব ফেলতে অক্ষম ? পূণ্যাত্মা হৃদয়, যে হৃদয় পাপের দ্বারা কলুষিত হয় নাই, সে ক্ষেত্রে উত্তর হবে "না"। কিন্তু যে হৃদয় পাপ দ্বারা কলুষিত হয়েছে সেক্ষেত্রে উত্তর হবে "হ্যাঁ"।

৫৩৯৯। দেখুন সূরা [ ৭ : ১৪৩ ] ও টিকা ১১০৩ ; যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে হযরত মুসার কাহিনীর মাধ্যমে যে, আল্লাহ্‌র মহিমা পবর্তকে ধূলায় পরিণত করে দেয়। আরও দেখুন সূরা [ ৩৩ : ৭২ ] ও টিকা ৩৭৭৮। যেখানে পর্বতকে রূপক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পবর্ত হচ্ছে স্থায়ীত্বের প্রতীক, যা অটল ও অপরিবতর্নীয়। এই পর্বতকেই যখন আল্লাহ্‌ তার আমানত ধারণ করতে বললেন, " সে বিনীতভাবে অস্বীকার করেছিলো কারণ সে নিজেকে এই বিশাল দায়িত্বের উপযোগী মনে করে নাই; সে ছিলো এ ব্যাপারে বিনয়ী এবং নম্র।

২২। তিনিই আল্লাহ্‌, তিনি ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নাই ৫৪০০। যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সব জানেন। তিনি মহান এবং পরম করুণাময়।

৫৪০০। আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্ব ও মহত্বের বিবরণ পেশ করে এই আয়াত ও পরবর্তী আয়াতগুলিতে আল্লাহ্‌র গুণসূচক উপাধিগুলিকে বর্ণনা করে সূরাটির সামাপ্তি টানা হয়েছে। এই আয়াতে প্রথমতঃ বর্ণনা করা হয়েছে আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা দান করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে :

১) "তিনিই আল্লাহ্‌ " এই বাক্যটির অর্থ আল্লাহ্‌র বর্ণনা করা কোন ভাষাবিদের পক্ষেই সম্ভব নয়। কোনও ভাষার অলংকার এত সমৃদ্ধ নয় যে আল্লাহ্‌র বর্ণনা করতে পারে। তাঁর বর্ণনা হচ্ছে " তিনিই আল্লাহ্‌ " - তাঁর মত আর কিছু নাই এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে।

২) তিনি এক ও অদ্বিতীয়। প্রকৃতির বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী শক্তিসমূহ তাঁরই একক নিয়ন্ত্রনের অধীন। আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা পেতে হলে আমাদের আল্লাহ্‌র একত্বের ধারণাকে অনুধাবন করতে হবে।

৩) দৃশ্য-অদৃশ্য, বর্তমান -ভবিষ্যত, কাছে -দূরে, সর্ব অস্তিত্বে আল্লাহ্‌র জ্ঞান পরিব্যপ্ত;

৪) আল্লাহ্‌র করুণা ও

৫) দয়া সীমাহীন। দেখুন সূরা [ ১ :১ ] আয়াত ও টিকা ১৯। এই প্রাথমিক ধারণা গুলি উপলব্ধি ব্যতীত আমাদের পক্ষে তাঁর পবিত্র পরিকল্পনা ও কার্য প্রণালী অনুধাবন করা এবং সমগ্র ভূবনে তাঁর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মানুষের অবস্থানকে সনাক্ত করা কোনও প্রকারেই সম্ভব নয়।

২৩। তিনিই আল্লাহ্‌, তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই ৫৪০১; তিনিই সার্বভৌম, পবিত্র, শান্তি [ ও পূর্ণতার ] উৎস, ঈমানের বিধায়ক, নিরাপত্তার রক্ষক ৫৪০২, পরাক্রমশালী, অপ্রতিরোধ্য, সর্বশ্রেষ্ঠ ৫৪০৩। মহিমা আল্লাহ্‌র। তারা আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে যে শরীক আরোপ করে তিনি তার [ বহু ] উর্দ্ধে ৫৪০৪।

৫৪০১। " তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই।" এই বাক্যটি পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে আল্লাহ্‌র একত্বের ধারণাকে অন্তরের মাঝে অনুভবের মাঝে ধারণ করার প্রথম ধাপ হিসেবে টিকা নং ৫৪০০ তে বর্ণনা করা হয়েছে আল্লাহ্‌র একত্বকে অনুভবের প্রথম ধাপ। আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে এই প্রাথমিক অনুভূতি অন্তরে দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হওয়ার পরেই শুধু সম্ভব হবে আল্লাহ্‌র অন্যান্য গুণাবলীকে উপলব্ধি করা।

৫৪০২। সমৃদ্ধ আরবী ভাষাতে সংক্ষেপে আল্লাহ্‌র মহিমান্বিত গুণাবলীকে যে ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, তাকি কোন অনুবাদকের পক্ষে প্রকৃত ভাষান্তরিত করা সম্ভব ? কারণ এই সংক্ষিপ্ত ও অপূর্ব সুন্দর শব্দাবলী যে ভাবকে প্রকাশ করেছে তা যে কোন ভাষাতে ভাষান্তরিত করা অসম্ভব।

১) "তিনিই সার্বভৌম " অর্থাৎ আল্লাহ্‌ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিপতি। সার্বভৌম শব্দটির দ্বারা বোঝানো হয় যার অবিসংবাদী কর্তৃত্ব, যিনি আদেশ দিতে সক্ষম এবং প্রশ্নাতীত আনুগত্য লাভের অধিকারী। যিনি ন্যায় ও আইন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।

২) " তিনিই পবিত্র " - মানুষের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে অপব্যবহার করার প্রবণতা থাকে। কিন্তু একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ্‌ এ অপবাদ মুক্ত। তিনি সকল অপবিত্রতা থেকে মুক্ত এবং সর্বোচ্চ পবিত্র।

৩) "তিনিই শান্তি " - [ Salam] পরিপূর্ণ শান্তি, দ্বন্দ ও অশান্তি মুক্ত। পরিপূর্ণ শান্তিই শুধু নয়, এর দ্বারা দোষত্রুটি মুক্ত আত্মিক পরিপূর্ণতা বোঝায়। সে কারণে এ ভাবে বলা যায় যে, আল্লাহ্‌ হচেছন পূর্ণাঙ্গ প্রশান্তির উৎস।

৪) 'Mumin' - যিনি ঈমানকে অন্তরে ধারণ করেন, যিনি অন্যকে বিশ্বাস দান করেন, অন্যের ঈমান বা বিশ্বাসকে যিনি কখনও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন না। সে কারণেই বলা হয়েছে তিনিই ঈমানের বিধায়ক।

৫) " নিরাপত্তার রক্ষক " সকল অমঙ্গল, ক্ষতি, বিপদ ইত্যাদির তিনি একমাত্র রক্ষক। কোরানে [ ৫ : ৫১ ] আয়াতে এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলি সবই হচ্ছে আল্লাহ্‌র করুণা, দয়া ও সদয় তত্বাবধানকে বুঝানোর জন্য গুণবাচক উপাধি। পরের টিকাতে আল্লাহ্‌র ক্ষমতা ও পরাক্রম বুঝানোর জন্য যে সব গুণবাচক শব্দ সেগুলির উল্লেখ করা হয়েছে।

৫৪০৩। দেখুন উপরের টিকা।

৬ ) আল্লাহ্‌ শুধু মহান করুণাময়ই নন্‌, তিনিই পরাক্রমশালী। অর্থাৎ তিনি তার পরিকল্পনা কার্যকর করতে সক্ষম।

৭) যদি কোনও শক্তি আল্লাহ্‌র পথে বাঁধার সৃষ্টি করে, আল্লাহ্‌র ইচ্ছাই জয়যুক্ত হবে, কারণ "তিনিই অপ্রতিরোধ্য" ;

৮) আল্লাহ্‌ পৃথিবীর সকল বস্তু ও প্রাণের উপরে শ্রেষ্ঠ। "তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।" আল্লাহ্‌র এসব গুণবাচক উপাধি বর্ণনার পরে তাঁর একত্বের ঘোষণার দ্বারা আয়াতটি শেষ করা হয়েছে যে ভাবে ২২ নং আয়াত শুরু করা হয়েছিলো।

৫৪০৪। মহিমান্বিত আল্লাহ্‌ যিনি দয়া ও করুণার আঁধার, যিনি তার সৃষ্টিকে প্রগাঢ় মমতায় ঘিরে থাকেন, তারই মহত্ব ও ক্ষমতা অনুধাবনের পরেও যে অন্য কিছুকে আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করে সে নির্বোধ বই আর কিছু নয়। তার মহীমা ও গৌরব তুলনাহীন।

২৪। তিনিই আল্লাহ্‌ [ যিনি ] সৃষ্টিকর্তা ৫৪০৫, উদ্ভাবক, আকৃতি [ ও রং এর ] রূপকার ৫৪০৬, সকল উত্তম নাম তারই ৫৪০৭। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

৫৪০৫। আল্লাহ্‌ সকল কল্যাণ ও মঙ্গলের এবং ক্ষমতার অধিকারী। আল্লাহ্‌র এই বিশেষ গুণাবলী সমূহ বিবৃত করার পরে এই আয়াতে আল্লাহ্‌র সৃজন ক্ষমতার বর্ণনা করা হয়েছে। এই সৃজন ক্ষমতাকে তিনটি ধাপে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। পরবর্তী টিকাতে এ সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ শুধুমাত্র সৃষ্টিই করেন না, তিনি সে সবের রক্ষাকর্তা ও পালন কর্তাও। তাঁর সৃষ্ট পদার্থ প্রতি নিয়ত বিবর্তনের মাধ্যমে নূতন নূতন আঙ্গিকে পরিবর্তিত হচ্ছে ; নূতন রং এ রঞ্জিত হচ্ছে কারণ তিনি "উদ্ভাবন কর্তা ও রূপদাতা। " সৃষ্টি করেই তিনি থেমে যান নাই, অনাদি অনন্তকাল থেকে বিবর্তনের ধারা অব্যাহত গতিতে চলছে এবং নূতন সৃষ্টিকে তিনি তাঁর নিয়মের অধীনে সন্নিবেশিত করে তাদের পৃথিবীতে টিকে থাকার পথকে সুগম করে দেন।

৫৪০৬। সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বহু ধাপ বর্তমান। এই সুবিশাল ধাপগুলিকে সংক্ষেপে বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যেমন [ ২ : ১১৭] আয়াতের টিকা ১২০ তে বর্ণনা আছে যার আরও সম্পূর্ণতা আনা হয়েছে [ ৬ : ৯৪ ] আয়াতের টিকা ৯১৬ এবং [ ৬ : ৯৮] আয়াতের টিকা ৯২৩ এ। Khalaqa শব্দটি দ্বারা সাধারণ ভাবে সৃজন ক্ষমতাকে বুঝানো হয়, এবং সকল সৃজন ক্ষমতার কর্তৃত্বকে বুঝানো হয় 'Khaliq' 'Baraa' শব্দটি দ্বারা বিবর্তনের ধারাকে বোঝায় - যা পূর্ববর্তী সৃষ্ট পদার্থ থেকে উদ্ভুদ। এই ধারার কর্তৃত্বকে বুঝানো হয় 'Bari-u' শব্দটি দ্বারা যার অর্থ 'উদ্ভাবন কর্তা।" 'Sawwara' শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয় নির্দ্দিষ্ট রূপদাতা বা রংদাতা। অর্থাৎ কোনও বস্তুকে আকার, আকৃতি ও রংয়ের সাহায্যে নির্দ্দিষ্ট রূপে পরিণত করা যেনো তা সমগ্র পরিবেশে টিকে থাকার উপযোগী রূপ লাভ করে। সে কারণে আল্লাহ্‌র নাম 'Musawwir' বা রূপদাতা বা রংদাতা। যে কোনও সৃষ্ট পদার্থের এটাই হচ্ছে সর্বশেষ ধাপ।

৫৪০৭। দেখুন সূরা [ ৭ : ১৮০ ] ও টিকা ১১৫৪ এবং সূরা [ ১৭ : ১১০ ] ও টিকা ২৩২২।

৫৪০৮। সৃষ্টির প্রথম থেকে আবাহমান কাল এই বিশ্ব ভূবন, স্রষ্টার নির্দ্দিষ্ট নিয়মের অধীন। তিনি পৃথিবীর বিবর্তনের মাধ্যমে নূতন আঙ্গিকে নূতন রংএর রূপদান করেন, প্রতিপালন করেন, রক্ষা করেন। তাঁর ক্ষমতা, শক্তি, সৃজনশীলতার বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর গুণবাচক নামের মাধ্যমে। এই সূরাটিকে শেষ করা হয়েছে সঙ্গীতের ধূয়ার ন্যায় প্রথম চরণটির দ্বারা [ ৫৯ : ১ ]। প্রথম আয়াতটি ও শেষ আয়াতটি এই সূরাতে একই শুধুমাত্র ক্রিয়া পদ 'Sabbaha' ব্যতীত। সূরাটির প্রথম আয়াতে 'Sabbaha' ক্রিয়াপদটি কামনা সূচক ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ভাবটি হচেছ, " সকলেই আল্লাহ্‌র গুণগান করুক।" সূরাটিতে আল্লাহ্‌র পরাক্রম, ক্ষমতা, সৃজনশীলতা একত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন গুণবাচক উপাধির বর্ণনা শেষে 'yusabbihu' ক্রিয়াপদ যুক্ত হওয়ার ফলে আয়াতটি হয়েছে ঘোষণা স্বরূপ যার অর্থ হবে, "সকলেই আল্লাহ্‌র গুণগান করে।"