+
-
R
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : মদিনাতে অবতীর্ণ ছোট ছোট দশটি সূরা গুলিকে যে একটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়েছে তার মাঝে এই সূরার অবস্থান পঞ্চম। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এই শ্রেণীর প্রথম সূরাটি আরম্ভ হয়েছে ৫৭ নং সূরা থেকে। এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে শৃঙ্খলা, কর্মদক্ষতা এবং উম্মার জন্য আত্মত্যাগের মানসিকতা। এই সূরাটির অবতীর্ণ কাল সম্বন্ধে জানা যায় না, তবে সম্ভবতঃ তা হচ্ছে ওহদের যুদ্ধের পর পরই। ওহদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসে।
সার সংক্ষেপ : সমস্ত সৃষ্টিতে আল্লাহ্র মহিমা উজ্জ্বল ভাবে দৃশ্যমান। তোমার কথা ও কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য তুমি কিরূপে শৃঙ্খলা প্রদর্শন করবে ? হযরত মুসা ও ঈসার কাহিনীর শিক্ষণীয় বিয়ষ কি ? মহৎ কাজের সাহায্যে অগ্রবর্তী হও, আল্লাহ্র সাহায্য তোমার সাফল্যকে গৌরব মন্ডিত করবে। [৬১:১-১৪]
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৫৪৩১। এই আয়াতটি সূরা [ ৫৯ : ১ ] আয়াতের অনুরূপ। উক্ত আয়াতে শত্রুদের ছলনা ও কৌশলকে পরাজিত করার জন্য আল্লাহ্র অপূর্ব বিচক্ষণতার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতে সেই একই বিষয়কে উদাহরণের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে যে আল্লাহ্র সাহায্যে পাওয়ার জন্য দৃঢ় ও অটল শৃঙ্খলার প্রয়োজন।
৫৪৩২। ওহদের যুদ্ধে কিছু কিছু মুসলমানদের মাঝে অবাধ্যতা লক্ষ্য করা গিয়েছিলো এবং সে কারণেই যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ওহদের যুদ্ধের প্রাক্কালে মুসলমানেরা বহু আলোচনা করেছে, বহু যুক্তি তর্ক উত্থাপন করেছে, কিন্তু তাদের সিন্ধান্তকে তারা বাস্তবে রূপদান করতে পারে নাই। তাদের কাজ কথার মধ্যে সমন্বয় ছিলো না। ওহদের যুদ্ধের বিবরণের জন্য দেখুন [৩ : ২১ ] আয়াতের টিকা ৪৪২। ওহদের যুদ্ধের এই উদাহরণের মাধ্যমে বিশ্বমানবের জন্য আল্লাহ্র উপদেশ হচ্ছে যাদের কথা ও কাজের মাঝে সামঞ্জস্য থাকবে না, তারা আল্লাহ্র চোখে নিন্দনীয়। এই নিন্দনীয় আচরণ সত্বেও কেউ যদি বিপদ ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় তবে মনে রাখতে হবে সে শুধু আল্লাহ্রই করুণা ও দয়ার জন্যই সম্ভব হয়েছে। যেমনটি হয়েছিলো ওহদের যুদ্ধে।
৫৪৩৩। সারিবদ্ধভাবে সংগ্রাম, অর্থাৎ যুদ্ধে অনেক লোক সারিবদ্ধভাবে কুচকাওয়াজ করে যখন অগ্রসর হয়, - যে কোন বাধা বিপত্তির মুখে তারা অগ্রসর হয় যেনো তারা এক সুদৃঢ় প্রাচীর। "প্রাচীর " এই উপমার সাহায্যে বুঝানো হয়েছে যে, এসব দৃঢ়চেতা সংকল্পে অটল মানব শ্রেণী হচ্ছেন একতা, শৃঙ্খলা, সাহসে ও আনুগত্যের জ্বলন্ত উদাহরণ। এরা হলেন সিমেন্টে গাঁথা 'সুদৃঢ় প্রাচীরের ন্যায়"। যে কোন দেয়ালের মাঝে বিভিন্ন উপকরণ থাকে যথা ইট, বালু, লোহা, কাঠ ইত্যাদি। এসব যখন সিমেন্ট দ্বারা গাঁথা হয় তখন তা কঠিন দেয়ালে রূপান্তরিত হয় - যে কাঠিন্যে প্রত্যেকের অবদান বিদ্যমান থাকে। ঠিক সেরূপে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানব, বিভিন্ন গুণে ভূষিত থাকে, তাদের কর্মক্ষেত্র ও দক্ষতাও থাকে বিভিন্ন। এ সব বিভিন্ন মানব গোষ্ঠি ঈমানের সিমেন্টে আবদ্ধ হয়ে যখন আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করে, তখন তাদের বিভিন্নতা সত্বেও তারা একই সত্ত্বাতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। এদের কথাই আল্লাহ্ বলেছেন যে, আল্লাহ্ তাদের ভালোবাসেন। দেখুন [ ৩৭ : ১ ] আয়াত ও টিকা ৪০৩১।
৫৪৩৪। মুসার সম্প্রদায় প্রায়ই হযরত মুসার অবাধ্য হতো এবং তাঁর বিরক্তির কারণ ঘটাতো এবং তাঁকে অপমানিত করতে দ্বিধাবোধ করতো না। দেখুন ওল্ড টেস্টামেন্টের [ Num xii – 1 – 13]। তাঁরা এ সব বুঝে শুনেই করতো। তারা যে অজ্ঞ ছিলো তা নয়, তারা ছিলো স্বার্থপর, অবাধ্য, বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন, যে কারণে তারা আল্লাহ্র নিকট থেকে শাস্তি লাভ করে। এদের এই উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্ মুসলিম উম্মাকে সাবধান করেছেন, এবং তাদের এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন। সাবধান করা হয়েছে আল্লাহ্র আইন বা বিধান থেকে বিচ্যুত হয়ে কেউ যেনো বক্র পথ না ধরে। কারণ বক্রপথ বা বিপথ মানুষের মন, মানসিকতা ও চিন্তাধারাকেও বক্র বা বিপথে চালিত করবে। এই হচ্ছে আল্লাহ্র হুকুম বা আইন বা বিধান।
৫৪৩৫। আল্লাহ্র বিধান বা আইন থেকে বিচ্যুত হওয়া পাপ। যারা এই পাপে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, অর্থাৎ প্রতি মূহুর্তে আল্লাহ্র হুকুমকে অমান্য করে তাদের চিন্তাধারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে তারা গভীর থেকে গভীরতর পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত হতে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়। অনুগ্রহ বঞ্চিত হওয়ার ফলেই তারা সত্য পথ ত্যাগ করে মিথ্যা পথকে গ্রহণ করে বিভ্রান্ত হয়। তাদের আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো অনুপ্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। " আল্লাহ্ উহাদের হৃদয়কে পথভ্রষ্ট করে দেন" পুনঃ পুনঃ পাপ ও অবাধ্যতার ফলে আল্লাহ্র নিরাপত্তা লাভেও তারা অক্ষম হয়। আল্লাহ্র করুণা, দয়া, মহানুভবতা, অনুগ্রহ লাভের সকল অর্গল তাদের হৃদয়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। " তাদের অন্তরে ব্যাধি। " [ ২ : ১০ ]। এই অন্তরই হচ্ছে সকল কিছুর মহৎ,ভালো বা মন্দের উৎপত্তিস্থল। পুনঃপুনঃ অবাধ্যতার ফলে তাদের আধ্যাত্মিক জগতের এই কেন্দ্রস্থল ধ্বংস হয়ে যায়। ভাঙ্গা আয়না যেরূপ আর কোন কিছুর সঠিক প্রতিবিম্বকে ধারণ করতে অক্ষম হয়, ঠিক সেরূপ হচ্ছে আত্মিক দিক থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের অবস্থা। তারা আল্লাহ্র হেদায়েতকে অন্তরে ধারণ করতে অক্ষম। একেই বলা হয়েছে ''যারা বিদ্রোহী সীমা লংঘনকারী আল্লাহ তাদের পথ প্রদর্শণ করেন না।"
৫৪৩৬। হযরত ঈসার আগমন ঘটেছিলো, তাঁর নিজ সম্প্রদায় ইহুদীদের হেদায়েতের জন্য। এ জন্য দেখুন Matt . x : 5 – 6 ও Matt xv 24 যেখানে বলা হয়েছে, "I am not sent but to the lost sheep of Israel"।
৫৪৩৭। দেখুন Matt v 17
৫৪৩৮। আহমদ বা মুহম্মদ যার উভয়েরই অর্থ যে প্রশংসিত।
৫৪৩৯। বিশ্বনবীর আগমন বার্তা পূর্বেই ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিলো। তার সারাটা জীবন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলো অলৌকিক। তিনি পাহাড় প্রমাণ প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হন যা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। তিনি কোনওরূপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীত জগতকে সর্বোচ্চ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দান করেন। আর মোশরেকদের ন্যায় কঠিন হৃদয়কেও তিনি দ্রবীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ফলে তারা নিঃশর্তভাবে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হন। তাঁর সকল উপদেশ, কথা ও কাজের মধ্যে আল্লাহ্র ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটতো যা উপলব্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুভবকে উদ্বেলিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। যে কোনও প্রজ্ঞা সম্পন্ন মানুষই "উম্মী" নবীর এই সাফল্যকে আল্লাহ্র অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ ব্যতীত অন্য কিছু ভাবতে পারতো না। কিন্তু অবিশ্বাসীরা একে "স্পষ্ট যাদু" বলে আখ্যায়িত করে। কারণ রাসুলের (সা) জীবন ও কর্ম সবই ছিলো,এত অবাস্তব কিন্তু অকাট্য সত্য যা অস্বীকার করার উপায় নাই, সুতারাং তারা তা ব্যাখ্যা করতো যাদুরূপে।
৫৪৪০। যারা ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেও মিথ্যা ও নিকৃষ্ট কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে তারা মুসলমান হয়েও পাপী। আর এই পাপ কাজ আরও গভীর পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত করে যদি তারা তাদের ভ্রান্ত ও মিথ্যা ধারণা ও কুসংস্কারকে আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যের প্রতিদ্বন্দী রূপে উপস্থাপন করার প্রয়াস পায়। আল্লাহ্র একত্বের বিশ্বাস পৃথিবীর বুকে শান্তি ও শৃঙ্খলার আলো বিকিরণ করে। যারা এই 'আলোকে' মিথ্যা ও কুসংস্কার দ্বারা প্রতিহত করে তাদেরই বলা হয়েছে 'যালিম'। আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো সকলের জন্য সমভাবে বিকিরীত হয়, তবে যারা যালেম অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্যায় ও পাপ করে আল্লাহ্ তাদের উপর থেকে তাঁর অনুগ্রহ তুলে নেন।" আল্লাহ্ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।" বাংলদেশীদের জন্য আয়াতটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বহন করে আনে।
৫৪৪১। আল্লাহ্র বাণীর সত্যের শিখা অণির্বান, চির অম্লান, চির ভাস্বর। যারা নির্বোধ এবং অজ্ঞ শুধু তারাই মনে করে যে তাদের কর্ম প্রচেষ্টা দ্বারা এই চির সত্যকে ধরা পৃষ্ঠ থেকে মুছে ফেলে দেবে। এদের এই প্রচেষ্টাকে সুন্দর একটি উপমার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মাটির প্রদীপ বা মোমের শিখা আলোকে আমরা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে থাকি। এসব ক্ষুদ্র দীপ শিখার আলোকে ফুঁ দিয়ে নেভানো যায় সত্য, কিন্তু বিদ্যুৎ বাতির আলো যার ব্যপ্তি বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে, তা কি ফুঁ দিয়ে নেভানো সম্ভব ? এ সব অজ্ঞ ও মূর্খরা মনে করে তারা তাদের কর্মপ্রচেষ্টা দ্বারা আল্লাহ্র বাণীর অণির্বাণ শিখাকে, যা চির সত্য, চির ভাস্তর, তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হবে। "ফুৎকারে নিভানো" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে উপমা হিসেবে। নির্বোধ ও অজ্ঞ ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও হৈ-চৈ কে এই শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে। এ সব নির্বোধেরা আল্লাহ্র প্রেরিত চির সত্যকে যত নির্বাপিত বা ধ্বংস করতে চেষ্টা করবে, আল্লাহ্ বলেছেন, " আল্লাহ্ তাঁর[প্রত্যাদেশের]আলো পূর্ণ করবেন। "
৫৪৪২। হযরত আদম ( আ) থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে একটাই ধর্ম যুগে যুগে নবী রসুলদের দ্বারা প্রচারিত হয়েছে আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন বা ইসলাম। হযরত নূহ, হযরত মুসা, হযরত ঈসা সকল পয়গম্বরগণ যে ধর্ম প্রচার করেছেন তা হচ্ছে হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম ইসলাম। তাদের প্রচারিত ধর্ম বিভিন্ন নামে ডাকা হয় সত্য। সুবিধার জন্য যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, বিভিন্ন পয়গম্বরদের প্রচারিত এ সব ধর্মের মূল সত্য যুগে যুগে একই আর তা হচ্ছে ইব্রাহীমের ধর্ম বা ইসলাম। যুগের ব্যবধানে এ সব সত্যের অনির্বাণ শিখা -ই শেষ পর্যন্ত স্থায়ীত্ব লাভ করবে দেখুন [ ৯: ৩৩ ] আয়াত ও টিকা ১২৯০ এবং [ ৫৮: ২৮ ] আয়াত ও টিকা ৪৯১২।
সূরা সাফ্ফ
সূরা সাফ্ফ বা সারিবদ্ধ যুদ্ধ - ৬১
১৪ আয়াত, ২ রুকু, মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : মদিনাতে অবতীর্ণ ছোট ছোট দশটি সূরা গুলিকে যে একটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়েছে তার মাঝে এই সূরার অবস্থান পঞ্চম। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এই শ্রেণীর প্রথম সূরাটি আরম্ভ হয়েছে ৫৭ নং সূরা থেকে। এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে শৃঙ্খলা, কর্মদক্ষতা এবং উম্মার জন্য আত্মত্যাগের মানসিকতা। এই সূরাটির অবতীর্ণ কাল সম্বন্ধে জানা যায় না, তবে সম্ভবতঃ তা হচ্ছে ওহদের যুদ্ধের পর পরই। ওহদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসে।
সার সংক্ষেপ : সমস্ত সৃষ্টিতে আল্লাহ্র মহিমা উজ্জ্বল ভাবে দৃশ্যমান। তোমার কথা ও কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য তুমি কিরূপে শৃঙ্খলা প্রদর্শন করবে ? হযরত মুসা ও ঈসার কাহিনীর শিক্ষণীয় বিয়ষ কি ? মহৎ কাজের সাহায্যে অগ্রবর্তী হও, আল্লাহ্র সাহায্য তোমার সাফল্যকে গৌরব মন্ডিত করবে। [৬১:১-১৪]
সূরা সাফ্ফ বা সারিবদ্ধ যুদ্ধ - ৬১
১৪ আয়াত, ২ রুকু, মাদানী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
১। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই আল্লাহ্র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনিই মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। ৫৪৩১
৫৪৩১। এই আয়াতটি সূরা [ ৫৯ : ১ ] আয়াতের অনুরূপ। উক্ত আয়াতে শত্রুদের ছলনা ও কৌশলকে পরাজিত করার জন্য আল্লাহ্র অপূর্ব বিচক্ষণতার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতে সেই একই বিষয়কে উদাহরণের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে যে আল্লাহ্র সাহায্যে পাওয়ার জন্য দৃঢ় ও অটল শৃঙ্খলার প্রয়োজন।
২। হে বিশ্বাসীগণ ! তোমরা যা কর না, তা তোমরা কেন বল ? ৫৪৩২
৫৪৩২। ওহদের যুদ্ধে কিছু কিছু মুসলমানদের মাঝে অবাধ্যতা লক্ষ্য করা গিয়েছিলো এবং সে কারণেই যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ওহদের যুদ্ধের প্রাক্কালে মুসলমানেরা বহু আলোচনা করেছে, বহু যুক্তি তর্ক উত্থাপন করেছে, কিন্তু তাদের সিন্ধান্তকে তারা বাস্তবে রূপদান করতে পারে নাই। তাদের কাজ কথার মধ্যে সমন্বয় ছিলো না। ওহদের যুদ্ধের বিবরণের জন্য দেখুন [৩ : ২১ ] আয়াতের টিকা ৪৪২। ওহদের যুদ্ধের এই উদাহরণের মাধ্যমে বিশ্বমানবের জন্য আল্লাহ্র উপদেশ হচ্ছে যাদের কথা ও কাজের মাঝে সামঞ্জস্য থাকবে না, তারা আল্লাহ্র চোখে নিন্দনীয়। এই নিন্দনীয় আচরণ সত্বেও কেউ যদি বিপদ ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় তবে মনে রাখতে হবে সে শুধু আল্লাহ্রই করুণা ও দয়ার জন্যই সম্ভব হয়েছে। যেমনটি হয়েছিলো ওহদের যুদ্ধে।
৩। আল্লাহ্র নিকট ইহা বড়ই অসন্তোষের কারণ যে, তোমরা যা কর না তা বল।
৪। নিশ্চয় আল্লাহ্ সেই সকল লোককে ভালোবাসেন যারা আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করে সারিবদ্ধভাবে - যেনো তারা সিমেন্টের কঠিন দেয়াল। ৫৪৩৩
৪। নিশ্চয় আল্লাহ্ সেই সকল লোককে ভালোবাসেন যারা আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করে সারিবদ্ধভাবে - যেনো তারা সিমেন্টের কঠিন দেয়াল। ৫৪৩৩
৫৪৩৩। সারিবদ্ধভাবে সংগ্রাম, অর্থাৎ যুদ্ধে অনেক লোক সারিবদ্ধভাবে কুচকাওয়াজ করে যখন অগ্রসর হয়, - যে কোন বাধা বিপত্তির মুখে তারা অগ্রসর হয় যেনো তারা এক সুদৃঢ় প্রাচীর। "প্রাচীর " এই উপমার সাহায্যে বুঝানো হয়েছে যে, এসব দৃঢ়চেতা সংকল্পে অটল মানব শ্রেণী হচ্ছেন একতা, শৃঙ্খলা, সাহসে ও আনুগত্যের জ্বলন্ত উদাহরণ। এরা হলেন সিমেন্টে গাঁথা 'সুদৃঢ় প্রাচীরের ন্যায়"। যে কোন দেয়ালের মাঝে বিভিন্ন উপকরণ থাকে যথা ইট, বালু, লোহা, কাঠ ইত্যাদি। এসব যখন সিমেন্ট দ্বারা গাঁথা হয় তখন তা কঠিন দেয়ালে রূপান্তরিত হয় - যে কাঠিন্যে প্রত্যেকের অবদান বিদ্যমান থাকে। ঠিক সেরূপে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানব, বিভিন্ন গুণে ভূষিত থাকে, তাদের কর্মক্ষেত্র ও দক্ষতাও থাকে বিভিন্ন। এ সব বিভিন্ন মানব গোষ্ঠি ঈমানের সিমেন্টে আবদ্ধ হয়ে যখন আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করে, তখন তাদের বিভিন্নতা সত্বেও তারা একই সত্ত্বাতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। এদের কথাই আল্লাহ্ বলেছেন যে, আল্লাহ্ তাদের ভালোবাসেন। দেখুন [ ৩৭ : ১ ] আয়াত ও টিকা ৪০৩১।
৫। এবং স্মরণ কর, মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিলো, ৫৪৩৪, " হে আমার সম্প্রদায় ! কেন তোমরা আমাকে বিরক্ত ও অপমান করছো ? অথচ তোমরা জান, আমি তোমাদের নিকট আল্লাহ্ [ প্রেরিত ] রসুল।" অতঃপর যখন তারা বিপথগামী হলো, আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে আরও পথভ্রষ্ট করে দিলেন ৫৪৩৫; কেন না যারা বিদ্রোহী সীমালংঘনকারী আল্লাহ্ তাদের পথ প্রদর্শন করেন না।
৫৪৩৪। মুসার সম্প্রদায় প্রায়ই হযরত মুসার অবাধ্য হতো এবং তাঁর বিরক্তির কারণ ঘটাতো এবং তাঁকে অপমানিত করতে দ্বিধাবোধ করতো না। দেখুন ওল্ড টেস্টামেন্টের [ Num xii – 1 – 13]। তাঁরা এ সব বুঝে শুনেই করতো। তারা যে অজ্ঞ ছিলো তা নয়, তারা ছিলো স্বার্থপর, অবাধ্য, বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন, যে কারণে তারা আল্লাহ্র নিকট থেকে শাস্তি লাভ করে। এদের এই উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্ মুসলিম উম্মাকে সাবধান করেছেন, এবং তাদের এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন। সাবধান করা হয়েছে আল্লাহ্র আইন বা বিধান থেকে বিচ্যুত হয়ে কেউ যেনো বক্র পথ না ধরে। কারণ বক্রপথ বা বিপথ মানুষের মন, মানসিকতা ও চিন্তাধারাকেও বক্র বা বিপথে চালিত করবে। এই হচ্ছে আল্লাহ্র হুকুম বা আইন বা বিধান।
৫৪৩৫। আল্লাহ্র বিধান বা আইন থেকে বিচ্যুত হওয়া পাপ। যারা এই পাপে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, অর্থাৎ প্রতি মূহুর্তে আল্লাহ্র হুকুমকে অমান্য করে তাদের চিন্তাধারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে তারা গভীর থেকে গভীরতর পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত হতে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে তারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়। অনুগ্রহ বঞ্চিত হওয়ার ফলেই তারা সত্য পথ ত্যাগ করে মিথ্যা পথকে গ্রহণ করে বিভ্রান্ত হয়। তাদের আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো অনুপ্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। " আল্লাহ্ উহাদের হৃদয়কে পথভ্রষ্ট করে দেন" পুনঃ পুনঃ পাপ ও অবাধ্যতার ফলে আল্লাহ্র নিরাপত্তা লাভেও তারা অক্ষম হয়। আল্লাহ্র করুণা, দয়া, মহানুভবতা, অনুগ্রহ লাভের সকল অর্গল তাদের হৃদয়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। " তাদের অন্তরে ব্যাধি। " [ ২ : ১০ ]। এই অন্তরই হচ্ছে সকল কিছুর মহৎ,ভালো বা মন্দের উৎপত্তিস্থল। পুনঃপুনঃ অবাধ্যতার ফলে তাদের আধ্যাত্মিক জগতের এই কেন্দ্রস্থল ধ্বংস হয়ে যায়। ভাঙ্গা আয়না যেরূপ আর কোন কিছুর সঠিক প্রতিবিম্বকে ধারণ করতে অক্ষম হয়, ঠিক সেরূপ হচ্ছে আত্মিক দিক থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের অবস্থা। তারা আল্লাহ্র হেদায়েতকে অন্তরে ধারণ করতে অক্ষম। একেই বলা হয়েছে ''যারা বিদ্রোহী সীমা লংঘনকারী আল্লাহ তাদের পথ প্রদর্শণ করেন না।"
৬। এবং স্মরণ কর, মরিয়ম পুত্র ঈসা বলেছিলো, " হে বণী ইসারাঈলী ! নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট আল্লাহ্ [ প্রেরিত ] রসুল ৫৪৩৬। আমার পূর্বে যে তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছিলো, আমি তা সত্যায়িত করছি ৫৪৩৭, এবং আমার পরে আহম্মদ [ মুহম্মদ ] নামে যে রসুল আসবে, তার [ আগমনের ] সুসংবাদ দিতেছি ৫৪৩৮। " কিন্তু যখন সে [ মুহম্মদ ] তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছিলো, ৫৪৩৯, তারা বলেছিলো, "এটা তো সুস্পষ্ট যাদু।"
৫৪৩৬। হযরত ঈসার আগমন ঘটেছিলো, তাঁর নিজ সম্প্রদায় ইহুদীদের হেদায়েতের জন্য। এ জন্য দেখুন Matt . x : 5 – 6 ও Matt xv 24 যেখানে বলা হয়েছে, "I am not sent but to the lost sheep of Israel"।
৫৪৩৭। দেখুন Matt v 17
৫৪৩৮। আহমদ বা মুহম্মদ যার উভয়েরই অর্থ যে প্রশংসিত।
৫৪৩৯। বিশ্বনবীর আগমন বার্তা পূর্বেই ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিলো। তার সারাটা জীবন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলো অলৌকিক। তিনি পাহাড় প্রমাণ প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হন যা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। তিনি কোনওরূপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীত জগতকে সর্বোচ্চ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দান করেন। আর মোশরেকদের ন্যায় কঠিন হৃদয়কেও তিনি দ্রবীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ফলে তারা নিঃশর্তভাবে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হন। তাঁর সকল উপদেশ, কথা ও কাজের মধ্যে আল্লাহ্র ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটতো যা উপলব্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুভবকে উদ্বেলিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। যে কোনও প্রজ্ঞা সম্পন্ন মানুষই "উম্মী" নবীর এই সাফল্যকে আল্লাহ্র অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ ব্যতীত অন্য কিছু ভাবতে পারতো না। কিন্তু অবিশ্বাসীরা একে "স্পষ্ট যাদু" বলে আখ্যায়িত করে। কারণ রাসুলের (সা) জীবন ও কর্ম সবই ছিলো,এত অবাস্তব কিন্তু অকাট্য সত্য যা অস্বীকার করার উপায় নাই, সুতারাং তারা তা ব্যাখ্যা করতো যাদুরূপে।
৭। তার থেকে বড় পাপী আর কে আছে, যে ইসলামের দিকে আমন্ত্রিত হয়েও, আল্লাহ্র বিরুদ্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করে ৫৪৪০ ? যারা পাপ করে আল্লাহ্ তাদের হেদায়েত করেন না।
৫৪৪০। যারা ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেও মিথ্যা ও নিকৃষ্ট কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে তারা মুসলমান হয়েও পাপী। আর এই পাপ কাজ আরও গভীর পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত করে যদি তারা তাদের ভ্রান্ত ও মিথ্যা ধারণা ও কুসংস্কারকে আল্লাহ্র প্রেরিত সত্যের প্রতিদ্বন্দী রূপে উপস্থাপন করার প্রয়াস পায়। আল্লাহ্র একত্বের বিশ্বাস পৃথিবীর বুকে শান্তি ও শৃঙ্খলার আলো বিকিরণ করে। যারা এই 'আলোকে' মিথ্যা ও কুসংস্কার দ্বারা প্রতিহত করে তাদেরই বলা হয়েছে 'যালিম'। আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো সকলের জন্য সমভাবে বিকিরীত হয়, তবে যারা যালেম অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্যায় ও পাপ করে আল্লাহ্ তাদের উপর থেকে তাঁর অনুগ্রহ তুলে নেন।" আল্লাহ্ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।" বাংলদেশীদের জন্য আয়াতটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বহন করে আনে।
৮। ওরা আল্লাহ্র নূর মুখের [ ফুৎকার ] দ্বারা নিভিয়ে দিতে চায় ৫৪৪১। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর [ প্রত্যাদেশের ] আলো পূর্ণ করবেন, যদিও অবিশ্বাসীরা [তা ] অপছন্দ করে থাকে।
৫৪৪১। আল্লাহ্র বাণীর সত্যের শিখা অণির্বান, চির অম্লান, চির ভাস্বর। যারা নির্বোধ এবং অজ্ঞ শুধু তারাই মনে করে যে তাদের কর্ম প্রচেষ্টা দ্বারা এই চির সত্যকে ধরা পৃষ্ঠ থেকে মুছে ফেলে দেবে। এদের এই প্রচেষ্টাকে সুন্দর একটি উপমার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মাটির প্রদীপ বা মোমের শিখা আলোকে আমরা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে থাকি। এসব ক্ষুদ্র দীপ শিখার আলোকে ফুঁ দিয়ে নেভানো যায় সত্য, কিন্তু বিদ্যুৎ বাতির আলো যার ব্যপ্তি বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে, তা কি ফুঁ দিয়ে নেভানো সম্ভব ? এ সব অজ্ঞ ও মূর্খরা মনে করে তারা তাদের কর্মপ্রচেষ্টা দ্বারা আল্লাহ্র বাণীর অণির্বাণ শিখাকে, যা চির সত্য, চির ভাস্তর, তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হবে। "ফুৎকারে নিভানো" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে উপমা হিসেবে। নির্বোধ ও অজ্ঞ ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও হৈ-চৈ কে এই শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে। এ সব নির্বোধেরা আল্লাহ্র প্রেরিত চির সত্যকে যত নির্বাপিত বা ধ্বংস করতে চেষ্টা করবে, আল্লাহ্ বলেছেন, " আল্লাহ্ তাঁর[প্রত্যাদেশের]আলো পূর্ণ করবেন। "
৯। তিনিই হেদায়েত ও সত্য ধর্ম সহ আপন রসুলকে প্রেরণ করেছেন, যেনো সে তা সকল ধর্মের উপরে বিজয় ঘোষণা করতে পারে ৫৪৪২ ; যদিও মুশরিকরা [ উহা ] অপছন্দ করে।
৫৪৪২। হযরত আদম ( আ) থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে একটাই ধর্ম যুগে যুগে নবী রসুলদের দ্বারা প্রচারিত হয়েছে আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন বা ইসলাম। হযরত নূহ, হযরত মুসা, হযরত ঈসা সকল পয়গম্বরগণ যে ধর্ম প্রচার করেছেন তা হচ্ছে হযরত ইব্রাহীমের ধর্ম ইসলাম। তাদের প্রচারিত ধর্ম বিভিন্ন নামে ডাকা হয় সত্য। সুবিধার জন্য যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, বিভিন্ন পয়গম্বরদের প্রচারিত এ সব ধর্মের মূল সত্য যুগে যুগে একই আর তা হচ্ছে ইব্রাহীমের ধর্ম বা ইসলাম। যুগের ব্যবধানে এ সব সত্যের অনির্বাণ শিখা -ই শেষ পর্যন্ত স্থায়ীত্ব লাভ করবে দেখুন [ ৯: ৩৩ ] আয়াত ও টিকা ১২৯০ এবং [ ৫৮: ২৮ ] আয়াত ও টিকা ৪৯১২।
রুকু - ২
৫৪৪৩। 'Tijarat' - দরাদরি করা, বাণিজ্য করা, লেনদেন করা ইত্যাদি। অর্থাৎ কোনও কিছু দিয়ে তৎপরিবর্তে কাঙ্খিত কিছু লাভ করা। পৃথিবীর এই জীবন ধারা বাণিজ্যে আল্লাহ্ আমাদের নিকট থেকে যা চান, তার বর্ণনা আছে, নিম্নের আয়াত নং ১১ তে এবং তার পরিবর্তে আমরা যা লাভ করবো তার বর্ণনা আছে আয়াত নং ১২ তে। প্রকৃতপক্ষ এই বাণিজ্য এক অপূর্ব বাণিজ্য। এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের খুব সামান্য জিনিষই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ আমাদের নিকট দাবী করেন। বিনিময়ে তিনি আমাদের যা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা চিরস্থায়ী। এ বাণিজ্য শুধু-মাত্র লাভের বাণিজ্য। এ বাণিজ্যের লভাংশ এই পৃথিবীতেই বান্দা পেতে শুরু করে যার ধারাবাহিকতায় পরলোকে সে প্রবেশ করে অনন্ত শান্তির আলয়ে। আল্লাহ্র নেয়ামত অসীম - তা পরিমাপযোগ্য নয়। যে আল্লাহ্র জন্য পার্থিব জীবনকে উৎসর্গ করে। তার জন্য শুধু পরলোকে নয়, ইহলোকেও সে আল্লাহ্র নেয়ামত স্বরূপ অশেষ চারিত্রিক গুণাবলীতে ধন্য হয়।
৫৪৪৪। এই আয়াতে [ ৬১ : ১১ ] আল্লাহ্র সাথে বাণিজ্যের দুটি মূল উপাদান তুলে ধরা হয়েছে। একটি হচ্ছে (১) আল্লাহ্ ও রাসুলে বিশ্বাস বা ঈমান, (২) অন্যটি হচ্ছে ঈমানের ব্যবহারিক প্রয়োগ যাকে বলা হয়ে থাকে সৎ কাজ বা আল্লাহ্র পথে জিহাদ। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনে এই সামান্য জিনিষের পরিবর্তে আমরা লাভ করবো বহুগুণ যার মূল্যমান বিচার করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। এই জীবনের সৎ কাজ ও আত্মত্যাগের পরিবর্তে আমরা লাভ করবো আল্লাহ্র ক্ষমা, দয়া, ভালোবাসা ও অনন্ত কালব্যপী অপার শান্তি ও প্রশান্তি।
৫৪৪৫। মানব জীবনের প্রাপ্তি হচ্ছে : বেহেশত এবং আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ। এ দুটোই পরকালে পাওয়া যাবে। যারা জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব ও প্রকৃত উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন একমাত্র তারাই পারবেন বেহেশতের বিলম্বিত প্রশান্তির আশায় ইহ কালকে বিসর্জন দিতে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, যারা আধ্যাত্মিক ভাবে ততটা অগ্রসরমান নন তাদের পক্ষে ইহকালকে পরলোকের সুখ ও শান্তির জন্য বিসর্জন দেয়া সম্ভব নয়। কারণ তাদের নিকট পরলোকের জীবনকে মনে হবে সূদূরের জীবন। আল্লাহ্ এই আয়াতে তাদেরকে [ ৬১ : ১৩ ] বলেছেন যে, " তোমাদের পছন্দের আরও একটি অনুগ্রহ" দান করবেন। অর্থাৎ আল্লাহ্র পূর্ববর্তী ঘোষণায় যারা উৎসাহ বোধ করে নাই,এই ঘোষণাকে তারা স্বাগত জানাবে। আল্লাহ্র এই অনুগ্রহ হবে ইহজগতের জন্য সাহায্য ও বিজয়। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সৎকাজে সংগ্রাম করবে। আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করবেন বিজয় দ্বারা। যত বাধা বিপত্তিই আসুক না কেন আল্লাহ্ আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, বিজয় আমাদের হবেই, কারণ আল্লাহ্ স্বয়ং আমাদের সাহায্য করবেন। মানুষের সমগ্র জীবনই হচ্ছে ভালোর জন্য সংগ্রামের জীবন, তবে পার্থিব জীবনে সংগ্রামের তুলনায় আধ্যাত্মিক জীবনের সংগ্রাম আরও কঠিন। আধ্যাত্মিক জীবনের শেষ বিজয় হচ্ছে বেহেশত লাভ।
৫৪৪৬। আল্লাহ্র সাহায্য লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে সৎ কাজ বা আল্লাহ্র রাস্তায় সাহায্য করা। এটাকেই আল্লাহ্ পূর্ববর্তী আয়াতে বাণিজ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় আত্মোৎসর্গ করবো - তবেই আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভে সক্ষম হব। এই আয়াতে [ ৬১ : ১৪ ] বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসার শিক্ষার নির্যাস ছিলো একই। নিউ টেস্টামেন্টে হযরত ঈসা বলছেন যে, Then said Jesus to his diciples , if any man will come after me, let him deny himself , and take up his cross and follow me.” [ Matt xvi 24 ]
৫৪৪৭। দেখুন সূরা [ ৩ : ৫২ ] আয়াত ও টিকা ৩৯২ ; বাইবেলের উল্লেখিত অংশের জন্য দেখুন উপরের টিকা। হযরত ঈসার ১২ জন্ শিষ্যের জন্য দেখুন [ Matt x 2- 4 ].
৫৪৪৮। ইহুদীদের একাংশ যারা প্রকৃতই সত্যে বিশ্বাসী ছিলো, তারা হযরত ঈসার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং তার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিলো নিতান্তই স্বল্প। বেশীর ভাগ ইহুদীরা ছিলো কঠিন হৃদয় বিশিষ্ট ; তাদের হৃদয় ছিলো সত্যের আলোর জন্য অপ্রতিরোধ্য। ফলে তারা তাদের আনুষ্ঠানিকতা ও জাতিগত অহংকারকেই ধর্ম হিসেবে আকরে থাকে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে ভালোবাসতো, কারণ তারা মনে করতো যে, তারা হযরত ঈসাকে হত্যা করেছে ফলে তারা সত্যের অপ্রতিহত গতিকে স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু শীঘ্র তাদের সে ভুল ভেঙ্গে গেলো। কারণ ৭০ খৃষ্টাব্দে টিটো জেরুজালেমকে ধ্বংস করে দেন এবং ইহুদীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পথভ্রষ্ট ইহুদীদের কাহিনী বহু পৌরাণিক সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। অপরপক্ষে যে সব ইহুদীরা হযরত ঈসার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন তারা রোমান সম্রাজ্যের সাথে পরিব্যপ্ত হয়ে যান। তাঁরা তাদের বিশ্বাসের আওতায় বহু নূতন জাতিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এর ফলে রোমান সাম্রাজ্যের মাধ্যমে খৃষ্টান ধর্মের প্রসার লাভ ঘটতে থাকে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত খৃষ্টান ধর্ম ছিলো পৃথিবীর প্রধান ধর্ম। ইসলামের অনুসারীদেরও আল্লাহ্ ঘোষণা দিয়েছেন যে, তারাও যদি সত্যকে অনুসরণ করে তবে তাদেরও বিজয় সুনিশ্চিত। নিম্নলিখিত ঘটনা সমূহ এর সত্যতা প্রমাণিত করে। মোশরেক আরবদের বিরুদ্ধে 'বদর' হচ্ছে বিজয়ের মাইলফলক [ ২য় হিজরী ]। এর পরে ধারাবাহিকভাবে এসেছে ' কুদসিয়া' [ ১৪ই হিজরী ] এবং 'মাদাইন' [ ১৬ইহিজরী ] এর যুদ্ধ যা ছিলো শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। ইয়ারমুকের যুদ্ধ ছিলো শক্তিশালী বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত সিরিয়ান খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে। একই সাম্রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত খৃষ্টান ধর্ম অবলম্বী মিশর ও আফ্রিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয় হেলিও পোলিসে ১৯ হিজরীতে। বহিঃর্বিশ্বের এই ঘটনাগুলি হচ্ছে বিজয়ের প্রতীক স্বরূপ। প্রকৃত বিজয় হচ্ছে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিজয় যা ধীরে ধীরে অর্জিত হয় বাস্তব সত্যরূপে। ইসলামের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, কিভাবে পুরোহিত তন্ত্র বা যাজক সম্প্রদায়ের ক্ষমতা, ঔদ্ধত্যকে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়, কিভাবে প্রতিটি মানুষ, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের স্বাধীনতা ও অধিকারকে সমন্বিত করা হয়, বিবাহের পবিত্রতা ও তালাকের মাধ্যমে। কিভাবে সমাজে নারীদের মর্যদা বৃদ্ধি করা হয়। মিতাচার ও সংযমকে ধর্মের অংগে পরিণত করা হয়। জ্ঞান আরোহণ ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সম্পদের সুষ্ঠূ বন্টনের মাধ্যমে কিভাবে অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শক্তিশালী করা হয়েছিলো ইত্যাদি অসংখ্য দিক্নিদ্দের্শনার মাধ্যমে পৃথিবীকে মধ্যযুগের বর্বরতাকে অতিক্রম করে সুশীল সভ্য জগতের দ্বার প্রান্তে নিয়ে আসে ইসলামের বিজয় নিকেতন।
১০। হে মুমিনগণ ! আমি কি তোমাদের এমন এক লাভজনক বাণিজ্যের সন্ধান দেবো ৫৪৪৩, যা তোমাদের ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা করবে ? -
৫৪৪৩। 'Tijarat' - দরাদরি করা, বাণিজ্য করা, লেনদেন করা ইত্যাদি। অর্থাৎ কোনও কিছু দিয়ে তৎপরিবর্তে কাঙ্খিত কিছু লাভ করা। পৃথিবীর এই জীবন ধারা বাণিজ্যে আল্লাহ্ আমাদের নিকট থেকে যা চান, তার বর্ণনা আছে, নিম্নের আয়াত নং ১১ তে এবং তার পরিবর্তে আমরা যা লাভ করবো তার বর্ণনা আছে আয়াত নং ১২ তে। প্রকৃতপক্ষ এই বাণিজ্য এক অপূর্ব বাণিজ্য। এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের খুব সামান্য জিনিষই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ আমাদের নিকট দাবী করেন। বিনিময়ে তিনি আমাদের যা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা চিরস্থায়ী। এ বাণিজ্য শুধু-মাত্র লাভের বাণিজ্য। এ বাণিজ্যের লভাংশ এই পৃথিবীতেই বান্দা পেতে শুরু করে যার ধারাবাহিকতায় পরলোকে সে প্রবেশ করে অনন্ত শান্তির আলয়ে। আল্লাহ্র নেয়ামত অসীম - তা পরিমাপযোগ্য নয়। যে আল্লাহ্র জন্য পার্থিব জীবনকে উৎসর্গ করে। তার জন্য শুধু পরলোকে নয়, ইহলোকেও সে আল্লাহ্র নেয়ামত স্বরূপ অশেষ চারিত্রিক গুণাবলীতে ধন্য হয়।
১১। উহা এই যে, তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলে বিশ্বাস স্থাপন করবে, এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহ্র পথে [প্রাণপণে ] সংগ্রাম করবে। সেটাই হবে তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পারতে ৫৪৪৪।
৫৪৪৪। এই আয়াতে [ ৬১ : ১১ ] আল্লাহ্র সাথে বাণিজ্যের দুটি মূল উপাদান তুলে ধরা হয়েছে। একটি হচ্ছে (১) আল্লাহ্ ও রাসুলে বিশ্বাস বা ঈমান, (২) অন্যটি হচ্ছে ঈমানের ব্যবহারিক প্রয়োগ যাকে বলা হয়ে থাকে সৎ কাজ বা আল্লাহ্র পথে জিহাদ। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনে এই সামান্য জিনিষের পরিবর্তে আমরা লাভ করবো বহুগুণ যার মূল্যমান বিচার করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। এই জীবনের সৎ কাজ ও আত্মত্যাগের পরিবর্তে আমরা লাভ করবো আল্লাহ্র ক্ষমা, দয়া, ভালোবাসা ও অনন্ত কালব্যপী অপার শান্তি ও প্রশান্তি।
১২। তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদের প্রবেশ করাইবেন বেহেশতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, অনন্ত বাগানের মাঝে সুরম্য অট্টালিকাতে। সেটাই হবে সর্বোচ্চ সফলতা
১৩। এবং আর একটি [ অনুগ্রহ ] তিনি দান করবেন, যা তোমরা পছন্দ করবে ৫৪৪৫। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সাহায্য এবং দ্রুত বিজয়। সুতারাং বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দাও।
১৩। এবং আর একটি [ অনুগ্রহ ] তিনি দান করবেন, যা তোমরা পছন্দ করবে ৫৪৪৫। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সাহায্য এবং দ্রুত বিজয়। সুতারাং বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দাও।
৫৪৪৫। মানব জীবনের প্রাপ্তি হচ্ছে : বেহেশত এবং আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ। এ দুটোই পরকালে পাওয়া যাবে। যারা জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব ও প্রকৃত উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন একমাত্র তারাই পারবেন বেহেশতের বিলম্বিত প্রশান্তির আশায় ইহ কালকে বিসর্জন দিতে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, যারা আধ্যাত্মিক ভাবে ততটা অগ্রসরমান নন তাদের পক্ষে ইহকালকে পরলোকের সুখ ও শান্তির জন্য বিসর্জন দেয়া সম্ভব নয়। কারণ তাদের নিকট পরলোকের জীবনকে মনে হবে সূদূরের জীবন। আল্লাহ্ এই আয়াতে তাদেরকে [ ৬১ : ১৩ ] বলেছেন যে, " তোমাদের পছন্দের আরও একটি অনুগ্রহ" দান করবেন। অর্থাৎ আল্লাহ্র পূর্ববর্তী ঘোষণায় যারা উৎসাহ বোধ করে নাই,এই ঘোষণাকে তারা স্বাগত জানাবে। আল্লাহ্র এই অনুগ্রহ হবে ইহজগতের জন্য সাহায্য ও বিজয়। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সৎকাজে সংগ্রাম করবে। আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করবেন বিজয় দ্বারা। যত বাধা বিপত্তিই আসুক না কেন আল্লাহ্ আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, বিজয় আমাদের হবেই, কারণ আল্লাহ্ স্বয়ং আমাদের সাহায্য করবেন। মানুষের সমগ্র জীবনই হচ্ছে ভালোর জন্য সংগ্রামের জীবন, তবে পার্থিব জীবনে সংগ্রামের তুলনায় আধ্যাত্মিক জীবনের সংগ্রাম আরও কঠিন। আধ্যাত্মিক জীবনের শেষ বিজয় হচ্ছে বেহেশত লাভ।
১৪। হে বিশ্বাসীগণ ! তোমরা আল্লাহ্র [ কাজে ] সাহায্যকারী হও ৫৪৪৬। মারইয়ামের পুত্র ঈসা যেরূপে তার শিষ্যদের বলেছিলো ৫৪৪৭, " কে [আল্লাহ্র কাজে ] আমার সাহায্যকারী হবে ? " শিষ্যরা বলেছিলো, " আমরা আল্লাহ্র কাজে সাহায্যকারী।" অতঃপর বণী ইসরাঈলের একদল ঈমান আনলো, এবং একদল অবিশ্বাস করলো। কিন্তু যারা ঈমান এনেছিলো, আমি তাদের শত্রুদের উপরে শক্তিশালী করেছিলাম, ফলে তারা বিজয়ী হলো ৫৪৪৮।
৫৪৪৬। আল্লাহ্র সাহায্য লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে সৎ কাজ বা আল্লাহ্র রাস্তায় সাহায্য করা। এটাকেই আল্লাহ্ পূর্ববর্তী আয়াতে বাণিজ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় আত্মোৎসর্গ করবো - তবেই আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভে সক্ষম হব। এই আয়াতে [ ৬১ : ১৪ ] বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসার শিক্ষার নির্যাস ছিলো একই। নিউ টেস্টামেন্টে হযরত ঈসা বলছেন যে, Then said Jesus to his diciples , if any man will come after me, let him deny himself , and take up his cross and follow me.” [ Matt xvi 24 ]
৫৪৪৭। দেখুন সূরা [ ৩ : ৫২ ] আয়াত ও টিকা ৩৯২ ; বাইবেলের উল্লেখিত অংশের জন্য দেখুন উপরের টিকা। হযরত ঈসার ১২ জন্ শিষ্যের জন্য দেখুন [ Matt x 2- 4 ].
৫৪৪৮। ইহুদীদের একাংশ যারা প্রকৃতই সত্যে বিশ্বাসী ছিলো, তারা হযরত ঈসার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং তার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিলো নিতান্তই স্বল্প। বেশীর ভাগ ইহুদীরা ছিলো কঠিন হৃদয় বিশিষ্ট ; তাদের হৃদয় ছিলো সত্যের আলোর জন্য অপ্রতিরোধ্য। ফলে তারা তাদের আনুষ্ঠানিকতা ও জাতিগত অহংকারকেই ধর্ম হিসেবে আকরে থাকে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে ভালোবাসতো, কারণ তারা মনে করতো যে, তারা হযরত ঈসাকে হত্যা করেছে ফলে তারা সত্যের অপ্রতিহত গতিকে স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু শীঘ্র তাদের সে ভুল ভেঙ্গে গেলো। কারণ ৭০ খৃষ্টাব্দে টিটো জেরুজালেমকে ধ্বংস করে দেন এবং ইহুদীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পথভ্রষ্ট ইহুদীদের কাহিনী বহু পৌরাণিক সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। অপরপক্ষে যে সব ইহুদীরা হযরত ঈসার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন তারা রোমান সম্রাজ্যের সাথে পরিব্যপ্ত হয়ে যান। তাঁরা তাদের বিশ্বাসের আওতায় বহু নূতন জাতিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এর ফলে রোমান সাম্রাজ্যের মাধ্যমে খৃষ্টান ধর্মের প্রসার লাভ ঘটতে থাকে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত খৃষ্টান ধর্ম ছিলো পৃথিবীর প্রধান ধর্ম। ইসলামের অনুসারীদেরও আল্লাহ্ ঘোষণা দিয়েছেন যে, তারাও যদি সত্যকে অনুসরণ করে তবে তাদেরও বিজয় সুনিশ্চিত। নিম্নলিখিত ঘটনা সমূহ এর সত্যতা প্রমাণিত করে। মোশরেক আরবদের বিরুদ্ধে 'বদর' হচ্ছে বিজয়ের মাইলফলক [ ২য় হিজরী ]। এর পরে ধারাবাহিকভাবে এসেছে ' কুদসিয়া' [ ১৪ই হিজরী ] এবং 'মাদাইন' [ ১৬ইহিজরী ] এর যুদ্ধ যা ছিলো শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। ইয়ারমুকের যুদ্ধ ছিলো শক্তিশালী বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত সিরিয়ান খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে। একই সাম্রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত খৃষ্টান ধর্ম অবলম্বী মিশর ও আফ্রিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয় হেলিও পোলিসে ১৯ হিজরীতে। বহিঃর্বিশ্বের এই ঘটনাগুলি হচ্ছে বিজয়ের প্রতীক স্বরূপ। প্রকৃত বিজয় হচ্ছে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিজয় যা ধীরে ধীরে অর্জিত হয় বাস্তব সত্যরূপে। ইসলামের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, কিভাবে পুরোহিত তন্ত্র বা যাজক সম্প্রদায়ের ক্ষমতা, ঔদ্ধত্যকে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়, কিভাবে প্রতিটি মানুষ, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের স্বাধীনতা ও অধিকারকে সমন্বিত করা হয়, বিবাহের পবিত্রতা ও তালাকের মাধ্যমে। কিভাবে সমাজে নারীদের মর্যদা বৃদ্ধি করা হয়। মিতাচার ও সংযমকে ধর্মের অংগে পরিণত করা হয়। জ্ঞান আরোহণ ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সম্পদের সুষ্ঠূ বন্টনের মাধ্যমে কিভাবে অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শক্তিশালী করা হয়েছিলো ইত্যাদি অসংখ্য দিক্নিদ্দের্শনার মাধ্যমে পৃথিবীকে মধ্যযুগের বর্বরতাকে অতিক্রম করে সুশীল সভ্য জগতের দ্বার প্রান্তে নিয়ে আসে ইসলামের বিজয় নিকেতন।