Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ৮ জন
আজকের পাঠক ৩৪ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৬৫৩৭৪ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬২৩০৩৭ বার
+ - R Print

সূরা মুনাফিকুন্‌


সূরা মুনাফিকুন্‌ অথবা মোনাফেক - ৬৩

১১ আয়াত, ২ রুকু, মাদানী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা : মদিনায় অবতীর্ণ দশটি সংক্ষিপ্ত সূরার মধ্যে এই সূরাটি ৭ম সূরা। এই সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে মুসলিম ভাতৃত্বের সামাজিক বিকাশের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে আছে সমাজে মোনাফেকদের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের বিবরণ যার মাধ্যমে তারা সমাজে অনৈক্য ও বিবাদ -বিসংবাদ ঘটানোর কৌশলের অবতারণা করে থাকে। বিশ্বাসীদের সামনে তারা যে প্রলোভনের জাল বিস্তার করে তা থেকে বিশ্বাসী বা মোমেন বান্দাদের আত্মরক্ষা করতে বলা হয়েছে।

ওহদের যুদ্ধ [ ৩য় হিজরী শাওয়াল মাস ] মদিনার মোনাফেকদের মুখোশ উম্মোচন করে ; দেখুন আয়াত [ ৩ : ১৬৭ ] ও টিকা ৪৭৬। এই সূরা ওহদের যুদ্ধের কিছু পরে অবতীর্ণ হয় ; সম্ভবতঃ ৪র্থ বা ৫ম হিজরীতে বানু মুসতালিক গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ে অবতীর্ণ [ দেখুন টিকা ৫৪৭৫ ]।

সার সংক্ষেপ : মোনাফেকদের প্রতিজ্ঞা মূল্যহীন। তারা শুধুমাত্র নিজস্ব স্বার্থের সন্ধানে ব্যস্ত। বিশ্বাসী বা মোমেন বান্দারা তাদের কৌশল সম্বন্ধে সাবধান হবে এবং আন্তরিকভাবে আল্লাহ্‌র রাস্তায় কাজ করবে। [ ৬৩ : ১ - ১১ ]।


সূরা মুনাফিকন্‌ অথবা মোনাফেক - ৬৩

১১ আয়াত, ২ রুকু, মাদানী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


১। যখন মোনাফেকেরা ৫৪৬৬, তোমার নিকট আসে, তারা বলে, "আমরা সাক্ষ্য দিতেছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র রসুল।" হ্যাঁ, অবশ্যই আল্লাহ্‌ জানেন যে, তুমি অবশ্যই আল্লাহ্‌র রসুল, এবং আল্লাহ্‌ সাক্ষ্য দিতেছেন যে, মোনাফেকেরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।

৫৪৬৬। যে কোন সমাজের জন্য মোনাফেকেরা হচ্ছে সমাজের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য দুর্বলতা ও বিপদজনক ও হুমকি স্বরূপ। যখন মহানবী হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনাতে আগমন করেন, মদিনার সকল দেশপ্রেমিক নাগরিক তাঁকে স্বাগত সম্ভাষণ জানান। মহানবীর আগমন শুধু যে তাদের একতাবদ্ধ করতেই সক্ষম হয়েছিলো তাই-ই নয়। এর ফলে তাদের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে যে পার্থক্য ও শ্রেণী বিভক্তি বিরাজ করতো তা মুছে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। তাদের মাঝে মহানবী বা জগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের উপস্থিতি তাদের সম্মান ও আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতি বিধান করেছিলো যা ছিলো তাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। ফুলের গাছেও যেরূপ কাঁটার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে ঠিক সেরূপ মদিনার পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের মাঝেও কিছু নিম্ন মানসিকতা সম্পন্ন মোনাফেক ব্যক্তি বিরাজ করতো যারা মহানবীর আগমনে আনন্দিত না হয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। কারণ তাদের মনে ছিলো ক্ষমতা ও নেতৃত্বের লোভ। তারা বুঝতে পারলো যে, মহানবীর উপস্থিতিতে তাদের আজন্ম লালিত সেই নেতৃত্বের ও ক্ষমতা লাভের স্বপ্ন কোনও দিনও বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়। সুতারাং তারা গোপনে রাসুলুল্লাহ্‌র (সা) বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে। গোপনে এই কারণে যে নূতন মুসলিম সম্প্রদায় ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং হযরতের একান্ত অনুগত। সুতারাং প্রকাশ্যে কিছু করার সাহস তাদের ছিলো না। তারা গোপনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নূতন মুসলিম সমাজকে ধ্বংস করতে অগ্রসর হলো কিন্তু তারা হযরতের (সা) নিকট আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা করলো। এই সব মোনাফেকদের আল্লাহ্‌ ওহদের যুদ্ধে তাদের পরিচয় প্রকাশ করে দেন। দেখুন [ ৩ : ১৬৭ ] ও টিকা ৪৭৬।

২। তারা তাদের শপথগুলিকে ৫৪৬৭, [ তাদের মন্দ কাজের ] পর্দারূপে ব্যবহার করে। এভাবেই তারা [ মানুষকে ] আল্লাহ্‌র পথে নিবৃত্ত করে। সত্যিই তাদের কাজগুলি মন্দ।

৫৪৬৭। এ সব মোনাফেকরা প্রকাশ্যে হযরতকে আল্লাহ্‌র রাসুল (সা) রূপে স্বীকার করে। এই স্বীকারোক্তি এই জন্য যে কেউ যেনো তাদের মনের দুরভিসন্ধি বুঝতে না পারে। এই স্বীকারোক্তি তাদের অন্তরের অভিব্যক্তির ঢাল স্বরূপ। কেউ যেনো তা বুঝতে না পারে। এই স্বীকারোক্তি মিথ্যা বই আর কিছু নয়।

মন্তব্য : মোনাফেকদের এই বৈশিষ্ট্য সর্বকালের ও সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য।

৩। তার কারণ তারা ঈমান আনে, তারপরে তারা ঈমানকে প্রত্যাখান করে। সুতারাং তাদের হৃদয়ের উপরে মোহর করে দেয়া হয়েছে ৫৪৬৮। ফলে তারা [ কিছুই ] বুঝতে পারবে না।

৫৪৬৮। দেখুন [ ২ : ৭ ]। দুনৌকায় পা দিয়ে যেরূপ চলা যায় না। এরূপ ব্যক্তির নিরাপত্তা যেরূপ হুমকির মুখে; আধ্যাত্মিক জগতে ঠিক সেরূপ অবস্থা হচ্ছে মোনাফেকদের। তাদের দ্বিবিধ নীতির ফলে তাদের অন্তর সর্বদা থাকে দোদুল্যমান। এই দোদুল্যমান হৃদয় তাদের সত্য অনুধাবনে বাঁধা স্বরূপ। কুয়াশা যেরূপ চেনা পৃথিবীর অস্তিত্বকে মুছে দেয়, মোনাফেকীর ফলে এসব ব্যক্তির হৃদয়েও সেরূপ সত্যের প্রকৃত রূপ আড়াল হয়ে যায়। আরবীতে, 'হৃদয় ' শব্দটি দ্বারা অনুভূতি ও উপলব্ধির ক্ষমতাকে বোঝানো হয়। মোনাফেকরা সত্যকে বোঝার ও উপলব্ধির করার ক্ষমতা হৃদয়ের মাঝে হারিয়ে ফেলবে এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র অমোঘ নীতি।

৪। যখন তুমি তাদের দিকে তাকাও, তাদের বাহিরে [ দেহ ] সৌষ্ঠব তোমাদের প্রীতিকর মনে হয় ৫৪৬৯, এবং তারা যখন কথা বলে, তুমি তাদের কথা [ মনোযোগ দিয়ে ] শোন। তারা [ ঘুনে ধরা ] দেয়ালে হেলানো কাঠের খুটির ন্যায় [ মূল্যহীন ] ৫৪৭০। যে কোন শোরগোলকে তারা মনে করে তাদের বিরুদ্ধে ৫৪৭১। এরাই শত্রু, অতএব তাদের সম্বন্ধে সর্তক হও। আল্লাহ্‌র অভিশাপ তাদের উপরে পতিত হোক। কিভাবে তারা [ সত্য থেকে ] বিভ্রান্ত হয়ে চলেছে।

৫৪৬৯। মোনাফেকদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহ এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। ১) এদের সাজ-সজ্জা এবং দেহাকৃতি মনে হবে সুসভ্য সংস্কৃতি সম্পন্ন যা মানুষকে আকর্ষণ করবে। ২) এদের বাক্‌চাতুর্য মানুষের নিকট মনোহর মনে হবে। মদিনার মোনাফেকরাও ছিলো এসব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাদের বাইরের চাকচিক্য, পোষাক পরিচ্ছদ, সাজসজ্জা ও অনুচরবৃন্দ পরিবৃত্ত অবস্থা সাধারণ মানুষকে আকর্ষিত করতো ও মনে সম্ভ্রম জাগাতো। তারা তাদের বক্তব্যকে মনোহররূপে উপস্থাপন করতো যাতে তা সাধারণ মানুষের নিকট হৃদয় গ্রাহী হয়। যেহেতু মিথ্যাভাষণ তাদের মনোজগতে কোনও রূপ বৈকল্য সৃষ্টি করতো না সুতারাং তারা সত্যকে বিকৃত করে সকলের সাথে একত্বতা প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করতো না। তাদের বক্তব্য ছিলো মনোহর ও আকর্ষণীয় কারণ সত্য ভাষণ তাদের বক্তব্য বা জিহ্বাকে সংযত করতে সক্ষম ছিলো না। মিথ্যা ও অতিভাষণ মানুষকে সহজেই আকর্ষণ করে কারণ তা সর্বদা সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক লাভের দিকেই আকর্ষণ করে। তাদের তোষামোদ ও প্রতারণা ছিলো অসীম যা অনুমান করাও অসাধ্য। তবে এসবই আল্লাহ্‌র নিকট অর্থহীন। কারণ এসবই ছিলো মিথ্যার উপরে প্রতিষ্ঠিত সুতারাং তারা যা বলে বা করে সবই মুল্যহীন।

৫৪৭০। ভালো ও উন্নতমানের কাঠ হয় মজবুত ও শক্ত যা বাসস্থান তৈরীর প্রাক্কালে ঘরের কাঠামো তৈরীতে ব্যবহার করা হয়, যা ঘরকে মজবুত ও শক্তভাবে ধারণ করে ও উন্নত ও ঋজুভাবে দাড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু যে কাঠ ঘুণদ্বারা আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে সেসব কাঠ হয়ে পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য। কারণ পচা কাঠ তখন কোনও কিছুর ভার বহনে অক্ষম। তখন এসব কাঠ নিজ কাঠিন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না - এসব কাঠের কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ঠেকার প্রয়োজন হয়। এই উপমার সাহায্যে আল্লাহ্‌ মোনাফেকদের আধ্যাত্মিক ও মানসিক অবস্থাকে তুলে ধরেছেন যাতে সাধারণ মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারে। মোনাফেকরা ঐ পচা কাঠের ন্যায়। তাদের চরিত্রে কোন নীতিবোধ নাই ফলে তাদের চরিত্রের কোনও রূপ দৃঢ়তা থাকে না। এ সব দুর্বল চরিত্রের লোকেরা অন্যের ভার বহনে অক্ষম এবং পচা কাঠের মতনই তাদের পরে নির্ভর করা নিরাপদ নয়।

৫৪৭১। মিথ্যার বিষবাস্পে মোনাফেকদের বিবেক আচ্ছাদিত হওয়ার ফলে মোনাফেকরা প্রকৃত সত্যকে দেখতে পায় না। মিথ্যা ভাষণ মিথ্যা কর্ম তাদের বিবেককে করে অবরুদ্ধ যা তাদের মধ্যে দ্বন্দের সৃষ্টি করে থাকে। যে কোনও নূতন পদক্ষেপ তাদের উৎকণ্ঠিত করে এবং তাদের ধারণা হয় যে তা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করবে। কারণ মোনাফেকরা সর্বদা নিজস্ব স্বার্থের বিপরীতে কোনও ধ্যান ধারণা অনুধাবনে অক্ষম। এরূপ লোকেরা প্রকাশ্য শত্রু থেকেও নিকৃষ্ট।

৫। এবং যখন তাদের বলা হয়, " এসো, আল্লাহ্‌র রসুল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন ৫৪৭২", তখন তারা তাদের মাথা ঘুরিয়ে নেয়, এবং তুমি দেখতে পাবে তারা উদ্ধত অহংকারে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

৫৪৭২। "তারা তাদের মাথা ঘুরিয়ে নেয়" এটা একটা আরবী বাগ্‌ধারা যার অর্থ "মুখ ফিরিয়ে নেয়"। মোনাফেকী যদিও একটি জঘন্য পাপ কিন্তু ক্ষমার অযোগ্য নয়। যদি প্রকৃত অনুতাপের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের দ্বারা কেউ ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে সে অবশ্যই ঐশ্বরিক ক্ষমা ও করুণা লাভে সক্ষম। তবে এর জন্য প্রয়োজন ঐকান্তিক আন্তরিকতা এবং পাপ থেকে বিরত থাকার একান্ত ইচ্ছা ও আল্লাহ্‌র ক্ষমা লাভের আকাঙ্খা। এই আয়াতে দেখা যায় মদিনার মোনাফেকদের তা ছিলো না। ঔদ্ধত্য ও এতগুয়েমী হচ্ছে মোনাফেকদের বিশ্বজনীন আর একটি বৈশিষ্ট্য যা সর্বযুগে সর্বকালে বিদ্যমান।

৬। তাদের জন্য তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর অথবা না কর উভয়ই তাদের জন্য সমান ৫৪৭৩। আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ বিদ্রোহী সীমালংঘনকারীকে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।

৫৪৭৩। যারা অবাধ্য একগুঁয়েভাবে আল্লাহ্‌র সত্যকে প্রত্যাখান করে তাদের আধ্যাত্মিক জগত ঐশ্বরিক করুণা থেকে বহুদূরে সরে যায়। আল্লাহ্‌র রহমত ও তাদের মাঝে সৃষ্টি হয় দুস্তর ব্যবধান। মোনাফেকদের অন্তর ক্রমান্বয়ে মিথ্যা ভাষণে বিকৃতরূপ ধারণ করে যার উপমা হচ্ছে পচা কাঠ - যা পুনরুদ্ধার অসম্ভব। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন, কোনও প্রার্থনাই এমনকি রাসুলের (সা) প্রার্থনাও তাদের সাহায্য করতে অক্ষম। তাদের অবাধ্যতা ও সীমালংঘনের জন্য তারা আল্লাহ্‌র করুণা লাভে অক্ষম।

মন্তব্য : মিথ্যাভাষণ ও মিথ্যা বলার প্রবণতা যে কতটা ক্ষতিকর তা এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মহানবীর প্রার্থনাও তাদের এই দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত করতে অক্ষম, সুতারাং প্রতিটি পিতামাতা নিজেরা সত্য বলবেন ও সন্তানকে সত্য ভাষণে অভ্যস্ত করবেন। কারণ " আল্লাহ্‌ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।"

৭। এরাই তারা যারা বলে, " আল্লাহ্‌র রসুলের সাথে যারা রয়েছে তাদের জন্য ব্যয় করো না ৫৪৭৪। তাহলে, শেষ পর্যন্ত তারা সব সরে পড়বে [ এবং মদিনা ত্যাগ করবে ]।" কিন্তু আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ধন-ভান্ডার আল্লাহ্‌র অধিকারভূক্ত। কিন্তু মোনাফেকরা তা বুঝতে পারে না।

৫৪৭৪। 'Muhajirin' যারা মহানবীর সাথে মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেন। এদের মদিনাতে যারা সাদর সম্ভাষণ করেন তাদের বলা হয় 'আনসার' বা সাহায্যকারী। হিজরতকারীদের জন্য মদিনাবাসীদের এই সাহায্যকারীর ভূমিকা মোনাফেকদের পছন্দ ছিলো না। 'মুরাইসী ' যুদ্ধ জয় করে মদিনাতে ফেরার পথে একজন মুহাজির ও একজন আনসারের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয় পরবর্তীতে যা মোহাজের ও আনসারের মধ্যে গোষ্ঠিগত সংঘর্ষে ব্যপ্তি লাভ করে এবং মহানবীর হস্তক্ষেপে তা শান্ত হয়। এরই পটভূমিতে মোনাফেক সর্দার আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উবাই, আনসারদের মোহাজেরদের বিরুদ্ধে উত্তোজিত করতে চেষ্টা করে। তার ভাষ্য ছিলো যে, "হিজরতকারীদের জন্য বৃথা ধন সম্পদ ব্যয় করো না, কারণ তারা তোমাদের মঙ্গল কামনা করে না। যদি তোমরা ব্যয় না কর তবে তারা আপনা আপনি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে।" কিন্তু তাদের এই হীন অপকৌশল কার্যকরী হলো না। মদিনার ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় প্রতি দিন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে শক্তিশালী এক বৃহৎ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়, যারা সম্পদেই শুধু স্বনির্ভর হলো না, তারা তাদের সাহায্যকারী বন্ধু আনসারদেরও সহায় সম্পদ বাড়াতে সাহায্য করেন। এই আয়াতের উপদেশ হচ্ছে সমাজে ভালো ও পূণ্যকাজই সমাজের শক্তিকে সুসংহত করে এবং সমাজকে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করে - এই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বিধান। এবং মানুষের সর্বকল্যাণ তো আল্লাহ্‌রই হাতে। আল্লাহ্‌র শত্রুদের হাতে তো আল্লাহ্‌র ধনভান্ডার বিতরণের বা আটকিয়ে রাখার অধিকার দান করা হয় নাই।

৮। তারা বলে, "যদি আমরা মদিনায় প্রত্যাবর্তন করি ৫৪৭৫, তবে অবশ্য সম্মানীয় লোকেরা সেখান থেকে অধমদের [ মুসলমানদের ] বিতাড়িত করবে।" কিন্তু সম্মান তো আল্লাহ্‌, তাঁর রসুল, এবং মোমেনদের অধিকারভূক্ত। কিন্তু মোনাফেকরা তা বুঝতে পারে না।

৫৪৭৫। এই বাক্যটি মদিনার মোনাফেক সর্দার আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উবাইএর মুখনিঃসৃত। চতুর্থ অথবা পঞ্চম হিজরীতে বানু মুসতালিকের বিরুদ্ধে অভিযানে মুসলমানেরা যখন মদিনার বাহিরে যায় তখন সে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ সব কথা বলে, এ স্থলে 'সম্মানীয়' শব্দটি দ্বারা মুনাফিক এবং অধম দ্বারা 'মুমিনকে' বুঝানো হয়েছে। তার বক্তব্য ছিলো, এই যে, মদিনায় ফিরে যেয়ে সম্মানীরা [ আনসাররেরা ] বহিরাগত [ অর্থাৎ মোহাজের ] সব বাজে লোকদের বহিষ্কার করে দেবে। এ সব কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে তার মনে ছিলো নেতৃত্বের লোভ। সে রাসুলুল্লাহ্‌র (সা) নেতৃত্বে মনের মাঝে হিংসা অনুভব করতো এবং মুসলমানদের মদিনাতে আগমন এবং মহানবীর নেতৃত্বের সাংগঠনিক ক্ষমতাকে স্বীকার করা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সে কারণে সে অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে যেনো মদিনাবাসীদের বিভ্রান্ত করতে পারে।

রুকু - ২

৯। হে মুমিনগণ! তোমাদের ঐশ্বর্য তোমাদের সন্তান -সন্ততি যেনো তোমাদের আল্লাহ্‌র স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। যদি কেউ এরূপ করে, তবে ক্ষতি তার নিজেদের ৫৪৭৬।

৫৪৭৬। ঐশ্বর্য -সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা সব কিছুই অস্থায়ী - কোনও কিছুই চির জীবনের জন্য স্থায়ী নয়। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে বিপদ বিপর্যয়ে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং সুসময়ে, প্রাচুর্যে, সুখে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ মোমেন বান্দাদের সম্বোধন করেছেন যে, সুখের দিনে, প্রাচুর্যের দিনে, আনন্দের দিনে তারা যেনো আল্লাহকে স্মরণ করতে ভুলে না যায়। আল্লাহকে স্মরণ শুধুমাত্র কথার কথা নয় - জীবনের প্রতিটি কাজ, সব কল্যাণ, মঙ্গল, কাজের নিয়ত, মনের সকল চিন্তা বা অনুভূতি, সব কিছু হবে আল্লাহ্‌ উদ্দেশ্য উৎসর্গীকৃত। সকল চিন্তা, কার্য, এক কথায় জীবনের সকল প্রকাশ হবে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে নিবেদিত। আল্লাহ্‌ বান্দার নিকট এই পরিপূর্ণ আত্মসর্মপন যাঞা করেন। যদি পার্থিব জীবনের চাকচিক্যে আমাদের আল্লাহ্‌র নিকটে আত্মসমর্পনে, তাঁর রাস্তায় আত্মনিবেদনে বাঁধার সৃষ্টি করে এবং আমরা পার্থিব জীবনে নিমগ্ন হয়ে পড়ি, তাহলে আধ্যাত্মিক জীবনে আমাদের যে ক্ষতি হবে তা হবে শুধু আমদেরই। কেউই তার অংশ গ্রহণ করবে না। কারণ পার্থিব জীবনের চাকচিক্যের কাছে আত্মসমর্পনের অর্থ আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির পথকে রুদ্ধ করে দেয়া।

১০। তোমাদের কারও মৃত্যু আসার পূর্বে আমি তোমাদের যে অনুগ্রহ দান করেছি, তা থেকে [ দানে ] ব্যয় কর ৫৪৭৭। [ অন্যথায় ] সে তখন বলবে, " হে আমার প্রভু ! কেন তুমি আমাকে আর কিছুকালের জন্য অবকাশ দাও না ? তাহলে আমি দানে [ প্রচুর ] ব্যয় করবো, এবং আমি সৎ কর্মশীলদের অন্তর্গত হব।"

৫৪৭৭। 'রিযক' বা জীবনোপকরণ। অর্থাৎ জীবনকে ধারণ করার জন্য যা প্রয়োজন। এই জীবনোপকরণ শুধু মাত্র অর্থ ও বিত্তের নিক্তিতে পরিমাপ্য নয়। মানুষকে আল্লাহ্‌ যে সব নেয়ামত বা মানসিক দক্ষতা দান করেছেন সবই তার জীবনোপকরণ। বস্তুগত দান যথা, অর্থ, সম্পদ, ইত্যাদি, স্পর্শাতীত দান যথা মেধা, মননশক্তি, সৃজন ক্ষমতা ইত্যাদি। যাকে আল্লাহ্‌ যে নেয়ামতই দান করুন না কেন তিনি তা জনগণের সেবায় আল্লাহকে খুশী করার জন্য ব্যয় করবেন। এই ব্যয় 'যাকাত' নয়। যাকাতের পরিমাণ নির্দ্দিষ্ট এবং তা অর্থের মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য। আর 'ব্যয়' করা বা দান করা শুধুমাত্র অর্থের মাপকাঠিতে তা পরিশোধ যোগ্য নয়। এ হচ্ছে সেই দান যা পৃথিবীকে এবং পৃথিবীর সভ্যতাকে বৃহত্তর কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। দেখুন টিকা নং ২৭।

১১। কিন্তু যখন কারও নির্ধারিত কাল উপস্থিত হবে, আল্লাহ্‌ কোনও আত্মার জন্য অবকাশ মঞ্জুর করবেন না ৫৪৭৮। তোমরা যা কর আল্লাহ্‌ সে [ সব ] সম্বন্ধে ভালোভাবেই জানেন।

৫৪৭৮। যখন পৃথিবীর "শিক্ষানবীশকাল " শেষ হয়ে যাবে আমাদের জন্য আর এক মূহুর্ত সময়ও মঞ্জুর করা হবে না। জীবনের এই স্বল্প সময়কে বৃথা ব্যয় না করে সঠিক ভাবে ব্যয় করা প্রত্যেকের কর্তব্য। মানুষের চিন্তার জগত বা মনোজগত আল্লাহ্‌র নখদর্পনে। আল্লাহ্‌ মানুষের গোপন চিন্তা ভাবনা, প্রতিটি কাজের অন্তর্নিহিত নিয়ত সব সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞাত।