সূরা আল্-আ'রাফ
সূরা আল্-আ'রাফ বা চূড়া বা শীর্ষ - ৭
আয়াত ২০৬, রুকু ২৪, মাক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে]
ভূমিকা : এই সূরাটির ধারাবাহিকতা ও যুক্তির দিক থেকে পূর্ববর্তী সূরার সমগোত্রীয়। এই সূরাতে বিভিন্ন নবী ও রাসূলদের জীবনীর মাধ্যমে ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ সমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। শুরু করা হয়েছে হযরত আদম (আঃ) থেকে এবং শেষ করা হয়েছে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত। এর মাঝে হযরত মুসার সংগ্রামের ইতিহাসকে বিশদ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
সারসংক্ষেপ : এই সূরাতে প্রথম থেকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; "অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাকে।" ভালোকে মন্দ সব সময়েই বাঁধা প্রদান করে থাকে, এ কথা সর্বকালের সর্বযুগের। এই বার্তাকেই হযরত আদম ও ইবলিসের কাহিনীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। উদ্ধতপনা ও একগুয়েমী - বিদ্রোহের জন্ম দেয়, আর বিদ্রোহীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা হবে হিংসূক ও সাধারণ মানুষকে তারা তাদের পথে চলার জন্য প্রলোভিত করবে। এদেরকেই এখানে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। [৭ : ১-৩১]
যদি কেউ আল্লাহ্র সাবধান বাণীতে কর্ণপাত না করে তাদের জন্য ভবিষ্যতে রয়েছে শাস্তি। পূণ্যাত্মাদের জন্য পরকালে রয়েছে সুখ ও শান্তির প্রতিশ্রুতি এবং ইহকালে আছে আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও করুণা [৭ : ৩২ - ৫৮]।
নূহ নবীর বন্যা, হুদ, সালেহ্, লুত এবং সুহেব নবীর কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে সর্বকালেই আল্লাহ্র নবীরা মন্দদের দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য জয়লাভ করেছে। অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটেছে। কারণ আল্লাহ্র পরিকল্পনা কখনও ব্যর্থ হয় না [৭ : ৫৯-৯৯]।
হযরত মুসার কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই কাহিনীতে ফেরাউনের সাথে হযরত মুসার সংগ্রামের কথাই যে শুধু বর্ণিত হয়েছে তাই-ই নয়, আরও বলা হয়েছে নবুওয়াতের (mission) জন্য কিভাবে আল্লাহ্ তাঁকে প্রস্তুত করেন এবং হযরত মুসা কিভাবে তার স্বগোত্রের লোকদের বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। এমনকি হযরত মুসার সময়েই নিরক্ষর নবীর আগমনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল [৭ : ১০০-১৫৭]।
হযরত মুসার লোকেরা ধর্মচ্যুত হয়ে আল্লাহ্র আইন, যা তাদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল, তা অমান্য করে। তারা আল্লাহ্র সাথে যে চুক্তি করেছিল, তা লঙ্ঘন করে। ফলে তারা সারা পৃথিবীতে আবাসচ্যুত অবস্থায় ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়ে। [৭ : ১৫৮-১৭১]
আদম সন্তান বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু তাদের অনেকেই সত্যকে অস্বীকার করার ফলে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়, কিন্তু তারা তা অনুধাবন করে না। পূণ্যাত্মারা আল্লাহ্র বাণীর তাৎপর্য বুঝতে পারে, এবং বিনয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্র সেবায় নিয়োজিত হয় [৭ : ১৭২-২০৬]।
সূরা আল্-আ'রাফ বা চূড়া বা শীর্ষ - ৭
আয়াত ২০৬, রুকু ২৪, মাক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে]
০২। তোমার নিকট কিতাব [কোরআন] অবতীর্ণ করা হয়েছে, সুতরাং ইহা দ্বারা [বিপথগামীদের] সতর্ক করা এবং মুমিনদের শিক্ষা দানের ব্যাপারে তোমার হৃদয়কে পীড়িত করো না ৯৯০।
৯৯০। এই আয়াতে রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, এ কোরান আল্লাহ্র গ্রন্থ, যা আপনার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। এ কারণে আপনার অন্তরে কোন সংকোচ থাকা উচিত নয়। অন্তরের সংকোচনের অর্থ হলো কোরানের নির্দেশাবলী প্রচারের ক্ষেত্রে কোনও ভয়ভীতি, অন্তরায় হওয়া উচিত নয়, যদিও মানুষ এর প্রতি মিথ্যারোপ করবে এবং আপনাকে কষ্ট দেবে।
৯৯১। "তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর।" এই লাইনটির ভাবার্থ হচ্ছে, পৃথিবীর অধিকাংশ লোক তাদের সামান্য বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অহংকারে স্ফীত হয়ে যায়। কিন্তু তারা জানে না আধ্যাত্মিক জগতের আরোহণের সিড়ির শেষ প্রান্ত বা চূড়া অনেক উঁচুতে।
০৫। [এরূপে] যখন আমার শাস্তি তাদের উপর আপতিত হয়েছিলো তারা শুধু বলতে পেরেছিলো "নিশ্চয়ই আমরা পাপ করেছিলাম" ৯৯২।
৯৯২। এই আয়াত ধর্মীয় উপকথার প্রারম্ভের ভূমিকা স্বরূপ। আল্লাহ্ কত শহর, জনপদ ও বহু জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন তাদের অন্যায়, অবিচার ও অপরাধের কারণে। আল্লাহ্ তাদের সংশোধনের জন্য সুযোগ দান করেছেন, রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। কিন্তু এসব লোকেরা তাঁদের সাবধান বাণীতে কর্ণপাত না করে একগুয়ে অবাধ্য ভাবে তাদের মন্দ কাজ চালিয়ে যেতেই থাকে যতক্ষণ না ভয়ংকর দূর্যোগে তারা নিঃশেষ হয়ে যায়। যখন এই বিপর্যয় তাদের উপরে পতিত হয়, তখন তারা বুঝতে পারে তাদের কৃত অন্যায়, অপরাধ। কিন্তু তখন তা বহু দেরী হয়ে যায়।
মন্তব্য : বর্তমান যুগে সুনামির ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আয়াতটির বক্তব্য অনুধাবন করা যায়।
৯৯৩। এই আয়াতটিতে শেষ বিচারের দিনের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই দিন নবী রাসূলেরা তাদের সত্য প্রচার সম্বন্ধে সাক্ষ্য দান করবেন এবং যারা অসৎ, যারা মন্দ তারা সেই দিন সত্যের প্রকৃত রূপকে অনুধাবন করতে পারবে। সমস্ত দৃশ্যটা যেনো একটা বিচার সভার দৃশ্য; যেখানে ঘটনার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে, কিন্তু যিনি বিচারক তিনি বর্ণনাকারী অপেক্ষাও ঘটনার প্রকৃতরূপ জানেন।
৯৯৪। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। পৃথিবীর কোন ক্ষুদ্রতম ঘটনাও তার অগোচরে থাকে না। সর্বস্থানে তার অবস্থান। সুতরাং শেষ বিচারের দিনে বর্ণনাকারী অপেক্ষা তিনি পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। কারণ তিনি সার্বভৌম ও অসীম।
০৯। যাদের [পূণ্যের] পাল্লা হাল্কা হবে, তারা তাদের আত্মাকে ধ্বংসের মাঝে দেখতে পাবে, যেহেতু তারা আমার নিদর্শন সমূহকে প্রত্যাখ্যান করতো।
১০। আমিই তো তোমাদের পৃথিবীতে কর্তৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তোমাদের [পৃথিবীর] জীবনকে পূর্ণতা দানের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি ৯৯৫। তোমরা খুব সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
৯৯৫। সুন্দর ও সংস্কৃতিবান জীবন ধারণের জন্য এই পৃথিবীতে আমাদের বহু জিনিসের প্রয়োজন হয়। আজ আমরা গর্ববোধ করি মানব সভ্যতার জন্য; এই সভ্যতার ক্রমবিকাশ হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন মানসিক ক্ষমতার প্রকাশ। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি বহুমুখী মানব প্রতিভা যা সভ্যতাকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা সবই যে সর্বশক্তিমানের দান, এই সহজ সত্যটা আমরা ভুলে যাই। আমরা অহংকারে স্ফীত হয়ে ভুলে যাই এসব বহুমুখী প্রতিভা বা ক্ষমতা যা আল্লাহ্র দান। আদম সন্তানকে তার মহত্তর বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই তা দান করা হয়েছে।
রুকু - ২
৯৯৬। আদমকে আল্লাহ্ জ্ঞান দান করার ফলে আদম ফেরেশতাদের দ্বারা সেজদার যোগ্য বলে বিবেচিত হন। আদম (আঃ) এখানে সমগ্র মানব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি স্বরূপ। আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাকে ফেরেশতাদের উপরে স্থান দান করেছে।
৯৯৭। ইব্লিশ শুধু যে আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করলো তাই-ই নয়, যে সব ফেরেশতারা সেজদা করেছিলো তারাও ছিল তার কাছে অবজ্ঞার পাত্র। এক কথায় ইব্লিশ তার উদ্ধত অহংকারে ফেরেশতাদের অবজ্ঞা করে এবং আল্লাহ্র হুকুম মানতে অস্বীকার করে। সে হয় বিদ্রোহী। উদ্ধত-অহংকার, হিংসা এবং বিদ্রোহ এই তিন কারণে ইব্লিশের পতন হয়।
[উপদেশ : আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এই তিন কারণের জন্যই আমাদের পতন হয়।]
৯৯৮। এই আয়াতে ইব্লিশের নিজেকে রক্ষা করার জন্য, নিজের কর্মের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের জন্য সূক্ষ্ণ কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়। আল্লাহ্র প্রশ্নের জবাবে সে বলে, যেহেতু সে অগ্নি দ্বারা সৃষ্ট এবং মানুষ মাটির সৃষ্টি, সুতরাং সে আদম সন্তান থেকে শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ কখনও নিকৃষ্টকে সেজদা করতে পারে না। ইব্লিশের আত্মমর্যাদা, গর্ব, অহংকার, তাকে সহজ সত্য অনুধাবনে বাঁধার সৃষ্টি করে। সহজ সত্য হচ্ছে এই যে, আদম সন্তানের দেহ অবশ্যই মাটির, যা নশ্বর, যা ভঙ্গুর। কিন্তু তার আত্মা, অবিনশ্বর, যা পরমাত্মার অংশ [১৫:২৯], যা জ্ঞান গরিমায় ফেরেশতাদের থেকেও শ্রেষ্ঠ। সেজদা করতে বলা হয়েছিল সেই আত্মাকে, যা পরমাত্মার অংশ, যা জ্ঞানে, ফেরেশতাদের থেকেও উন্নত। নশ্বর মাটির দেহকে নয়। ইব্লিশের অহংকার আত্মশ্লাঘা এই সহজ সত্যকে বুঝতে বাঁধার সৃষ্টি করেছিল।
উপদেশ : ইব্লিশের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের মত সাধারণ মানুষকে এই সত্য অনুধাবনের জন্য আহ্বান করেছেন যেনো আমরা কখনও গর্ব ও অহংকার না করি। যদি করি তবে আমাদের সম্মুখে সত্যের প্রকৃত রূপ ধরা দেবে না।
১৫। [আল্লাহ্] বললেন, "যাদের অবকাশ দেয়া হয়েছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে ১০০০।
১০০০। "যাদের অবকাশ দেওয়া হইয়াছে" - এর অর্থ কি এই যে ইব্লিশ ব্যতীত আরও অনেককে অবকাশ দেওয়া হয়েছে ? এর উত্তর হ্যাঁ। ইব্লিশের বিরাট সঙ্গী বাহিনী রয়েছে। এরা হচ্ছে মানুষের মধ্যে যারা মন্দ, অসৎ ও পাপী।
১০০১। এই আয়াত ইব্লিশের সুক্ষ্ম কৌশলপূর্ণ মিথ্যার আর একটি উদাহরণ। আল্লাহ্ তাকে অবকাশ দান করার পরে, সে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয় এবং আল্লাহ্র বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের উত্থাপন করে। আল্লাহ্ শয়তানকে বেহেশতে থেকে বহিষ্কার করে দেন তার উদ্ধত-অহংকার ও অবাধ্যতার জন্য। এর জন্য শয়তানের উক্তি ছিল "তুমি আমাকে শাস্তি দান করিলে, এই জন্য ------।" অর্থাৎ সে বলতে চাচ্ছে যে আল্লাহ্ তাকে 'মিথ্যা কারণে শাস্তি দান' করেছেন। এ কথা সর্বৈর মিথ্যা। কারণ শয়তানের আচরণই ছিল তার বেহেশত থেকে পতনের মূল কারণ। সে কারণে অনুতাপের পরিবর্তে তার মানুষকে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ থেকে বিপথে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা ছিল আল্লাহ্র সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।
১০২। পাপের বা শয়তানের ফাঁদ অত্যন্ত আপাতঃ মধুর। এই আপাতঃ মধুরের সন্ধানে মানব সন্তান দিগ্বিদিক্ জ্ঞান শূন্য হয়ে শয়তানের ফাঁদে পা দেয়। মানব সন্তানের সামান্যতম দুর্বলতাও শয়তান তাদের বিপথে নেওয়ার কাজে ব্যবহার করে। এই কথাকেই এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, "..... সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক থেকে .....।" যারা শয়তানের দ্বারা মোহবিষ্ট হয়, তারা আত্মসুখের জন্য, আল্লাহ্র সব নির্দেশ জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা বোধ করে না। কোনও ন্যায়-নীতি তাদের কাছে আর ন্যায়-নীতি থাকে না। আল্লাহ্র দয়া, করুণা, ভালোবাসার জন্য যে মানব সন্তানের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, তার পরিবর্তে তারা হয়ে ওঠে অকৃতজ্ঞ ও স্বেচ্ছাচারী।
১৯। "হে আদম ১০০৩, তুমি এবং তোমার স্ত্রী [জান্নাতের] বাগান [যেমন ভাবে খুশী] উপভোগ কর ১০০৪। কিন্তু এই গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। হলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ এবং সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।"
১০০৩। এখান থেকে হযরত আদমের কাহিনীর শুরু। আল্লাহ্ হযরত আদমকে বেহেশতে অধিষ্ঠিত করলেন এবং বেহেশতি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তিতে তাদের জীবন ভরিয়ে দিলেন। আল্লাহ্র পরিকল্পনা অনুযায়ী আল্লাহ্ আদমকে "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা-শক্তি" দান করেছিলেন এবং এই ইচ্ছা শক্তিকে ব্যবহারের সীমানাও নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ্ শুধু একটি গাছের নিকটবর্তী না হওয়ার জন্যই আদমকে নির্দেশ দেন। কিন্তু আদম শয়তানের প্রলোভনে, লোভের বশবর্তী হয়ে, আল্লাহ্র সে আদেশ লঙ্ঘন করে। ফলে তারও বেহেশ্ত থেকে পতন হয়।
উপদেশ : লোভ মানুষকে ধ্বংস করে। এ কথা আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত আদমের জন্য যেমন প্রযোজ্য ছিল - আজও সমভাবে প্রযোজ্য। লোভ হচ্ছে শয়তানের ফাঁদ, যাতে আদম সন্তান খুব সহজেই ধরা দেয় এবং পরিণতিতে নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে।
১০০৪। "যেমন ভাবে খুশী উপভোগ কর" এই কথাটির অর্থ হচ্ছে যাহা ইচ্ছা উপভোগ করা।
১০০৬। আমাদের প্রথম পিতা-মাতা আদম ও হাওয়াকে আল্লাহ্ নিষ্পাপ করে সৃষ্টি করেন। তারা জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় অর্থেই ছিলেন নিষ্পাপ। আদমকে আল্লাহ্ ফেরেশতাদের উপরে স্থান দিয়েছিলেন কারণ তাঁকে আল্লাহ্ জ্ঞান দান করেন এবং "সীমিত আকারে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দান করে। এই ইচ্ছা-শক্তির কারণে আদমের পাপ ও অসৎকে স্ব-ইচ্ছায় পরিত্যাগ করার ক্ষমতা ছিল এবং ভালোকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল। এই ক্ষমতা সম্বন্ধে তাদের পূর্বেই আল্লাহ্ সাবধান করে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্র উপদেশ ছিল তাঁর নির্দেশ মানার। আদম আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করে বুঝতে পারলেন তিনি অন্যায় করেছেন। আল্লাহ্ অপার করুণার আধার। তাই আল্লাহ্ তাদের পরিশুদ্ধ হওয়ার পুনরায় সুযোগ দান করেন। তারা যেনো পাপ মুক্ত হয়ে তাদের নিষ্পাপ জীবন ফিরে পান। ঠিক একই ভাবে, আমাদের আদি পিতা-মাতার মত মানব সন্তান নিষ্পাপ অবস্থায় পৃথিবীতে জন্ম লাভ করে। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় সে তার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অপব্যবহার করে এবং পাপে নিমজ্জিত হয়। কিন্তু আল্লাহ্ মানব সন্তানকে পাপ মুক্ত হওয়ার জন্য বারে বারে সুযোগ দান করেন।
২২। এভাবে প্রবঞ্চনার দ্বারা সে তাদের পতন ঘটালো। যখন তারা বৃক্ষের [ফলের] আস্বাদ গ্রহণ করলো, তখন লজ্জ্বাস্থান তাদের নিকট স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো এবং তারা তাদের শরীরের উপর বাগানের পাতা সেলাই করতে লাগলো। তখন তাদের প্রভু তাদের ডেকে বললেন, "আমি কি তোমাদের ঐ গাছ নিষিদ্ধ করি নাই এবং বলি নাই যে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু ?"
২৩। তারা বলেছিলো, "হে আমাদের প্রভু ! আমরা নিজেদের আত্মার প্রতি পাপ করেছি; যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না কর এবং আমাদের দয়া না কর তবে তো আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হব।
২৪। [আল্লাহ্] বললেন, "তোমরা পরস্পরের শত্রু হিসেবে এখান থেকে নেমে যাও। পৃথিবী তোমাদের কিছু কালের জন্য বাসস্থান ও জীবিকার উপায় হবে।"
২৫। [আল্লাহ্] বললেন, "সেখানেই তোমরা জীবন যাপন করবে এবং সেখানেই তোমরা মৃত্যুবরণ করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হবে ১০০৭।"
১০০১৭। দেখুন আদম সম্বন্ধে আয়াত [২ : ৩০-৩৯], এই আয়াত এবং পূর্ববর্তী আয়াতে আদমের কাহিনীতে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেলেও দুটিকে উপস্থাপনা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে। সূরা 'বাকারাতে' আদমের কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের উৎপত্তির সম্বন্ধে আলোকপাত করে। এই আয়াতে আদমের কাহিনী বর্ণনা করা হয় পৃথিবীতে মানুষের আগমনের ভূমিকা হিসেবে। সেই কারণে পরবর্তী অধ্যায় "আদম সন্তানদের" সম্বোধনের মাধ্যমে শুরু করা হয়েছে। এর পরে ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিক ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে বিভিন্ন নবী ও রাসূলদের কাহিনী যারা আদম সন্তানদের, আল্লাহ্র তরফ থেকে, পথ নির্দেশক হিসেবে পৃথিবীতে আসেন। যুগে যুগে তাদের প্রচারিত সত্য এক, কিন্তু সময় ও যুগের প্রেক্ষিতে তাদের উপস্থাপনা হয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
রুকু - ৩
১০০৮। পোষাক-পরিচ্ছদ, অলংকার সবকিছু ব্যবহার করা হয় লজ্জা নিবারণ ও দৈহিক সৌন্দর্য্যে বর্ধনের জন্য। মানুষের আত্মার ন্যায় তার দেহকেও আল্লাহ্ পূত ও পবিত্র করে সৃষ্টি করেছেন। দেহ পূত পবিত্র থাকে ততক্ষণ যতক্ষণ আমরা এই নশ্বর দেহ দ্বারা কোনও পাপ কাজ সংঘটিত না করি। দেহের সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য যে কোন পোষাক বা অলংকার আমরা ব্যবহার করি না কেন তা যদি কোন মন্দ উদ্দেশ্যে না হয়ে থাকে, তবে তা হবে সৌন্দর্য্য ও পবিত্রতার প্রতীক। কারণ পোষাকই মানুষের শালীনতা বাড়ায়, সৌন্দর্য্য বাড়ায়, দেহকে অপবিত্র, নোংরা জিনিস থেকে রক্ষা করে, প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে আরাম দেয়, তৃপ্তি দেয়। ঠিক সেইরূপ আত্মার সৌন্দর্য্য বিকাশের জন্য যে পোষাকের প্রয়োজন তা হচ্ছে আল্লাহ্ ভীতি এবং ভালো কাজ বা সৎ কাজ। পাপ কাজে আত্মার মাঝে যন্ত্রণা ও লজ্জ্বার উর্দ্রেক হয়। সৎ কাজ আত্মার সেই লজ্জা ও যন্ত্রণাকে ঢেকে দেয়। সৎ কাজ চরিত্রকে সৎ গুণে অলংকৃত করে। আর এই পৃথিবীতে মানবাত্মার জন্য সেটাই সর্বোচ্চ পোষাক ও সর্বাপেক্ষা সুন্দর অলংকার।
১০০৯। শয়তানের কাজ হচ্ছে প্রতারণাপূর্ণ কৌশল ও অসতর্ক মুহুর্তে মিথ্যা বলার অভ্যাস। এই সূরার আয়াত [৭ : ২০-২২] পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে আদমের স্বর্গ থেকে পতনের ইতিহাস যা বিশ্ব মানবেরই পতনের ইতিহাসের প্রতীক। স্বর্গের উদ্যানে হযরত আদামের জীবন ছিল পূত ও পবিত্র, গ্লানি ও লজ্জা মুক্ত। তিনি ছিলেন পবিত্রতা ও পূণ্যাত্মার প্রতীক। শয়তান তার এই পবিত্রতা ও পূণ্যের যে আভরণ তা থেকে তাঁকে অনাবৃত করে তাঁর ললাটে লজ্জা ও অপমানের তিলক এঁকে দেয়। এই পৃথিবীতে আমরা শয়তানের রূপকে প্রত্যক্ষে করি নানা ভাবে। নানা প্রলোভনের মাধ্যমে শয়তান পৃথিবীর মানব জাতিকে প্রতিনিয়ত পাপের পঙ্কে টেনে নামাচ্ছে। আমাদের আত্মার পবিত্রতা, পূণ্য, নৈতিক মূল্যবোধ তার প্রতারণার কাছে ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিক জীবনে এই প্রতারণা কখনও আসে নিঃস্বার্থ বন্ধুর ছদ্মবেশে, কখনও দেশাত্ববোধক অনুপ্রেরণার ছলে বা সমাজ সেবার নামে, আবার কখনও বা পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি বা সংস্কৃতি রক্ষার নাম। এসব কাজ যদি নিঃস্বার্থ ভাবে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে করা হয় তবে তা হবে পূণ্য কাজ, কিন্তু যদি লোকের চোখে ধূলা দিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য করা হয়; তবে তা পরিণত হয় শয়তানের অঙ্গীকারে।
উপদেশ : বাংলাদেশের প্রেক্ষিত এন.জি.ও-দের সৎ কাজ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশপ্রেমের স্বরূপ, বাঙ্গালী কৃষ্টির পূঁজা, এসবই ব্যক্তি স্বার্থের রূপান্তর মাত্র যা শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হওয়ারই রূপ।
২৯। বল, "আমার প্রভু ন্যায়পরায়ণতার আদেশ দিয়েছেন; প্রত্যেক সময়ে এবং স্থানে সালাতের সময়ে [আল্লাহ্র] নিকট [এমনভাবে] আত্মনিবেদন করবে যেনো তাঁর দৃষ্টিতে তোমার উপাসনা হয় আন্তরিক ১০১০। প্রথমে তিনি যেভাবে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, সেভাবে তোমরা [তাঁর নিকট] ফিরে আসবে ১০১১।
১০১০। আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি ও নিবেদন হতে হবে আন্তরিক। ধর্ম ও ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে অন্তরের ধন। এই বিশ্বাস হবে আন্তরিক ভাবে একমাত্র আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদিত। পূণ্যাত্মা লোকের হৃদয়, আত্মা, সর্বকাজ, সর্ব চেতনা, সবই সর্বশক্তিমানের কাছে থাকে নিবেদিত, এক আল্লাহ্কে খুশী করার জন্য তারা হয় সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত। লোকচক্ষুতে ধার্মিক হওয়ার জন্য কেউ ধর্ম-কর্ম করলে তা আল্লাহ্র দরবারে গৃহীত হয় না। আমাদের পাপের দরুন আমাদের আত্মা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে সময়ে আমাদের ইচ্ছা থাকা সত্বেও আমরা তাঁর কাছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করতে অপারগ হই। এজন্য আমরা সালাতের মাধ্যমে তাঁর কাছে আত্মার অন্ধকার দূর করে দেবার জন্য একান্ত ভাবে প্রার্থনা করবো যেনো আমরা তার কাছে আত্মনিবেদনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারি। অর্থাৎ নামাজে একান্তভাবে, একাগ্রচিত্তে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে।
১০১১। দেখুন আয়াত [৬ : ৯৪]। আল্লাহ্র ইবাদত হতে হবে আন্তরিক ও নিবেদিত প্রাণ। একনিষ্ঠ ভাবে একাগ্রচিত্তে, অন্তরের অন্তঃস্থল হতে আকুল ভাবে তাঁর কাছে আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতে হবে। সালাত বা নামাজের এটাই হচ্ছে পূর্ব শর্ত। লোক দেখানো বা নিজেকে ধার্মিক বলে প্রমাণিত বা প্রচারিত করার প্রবণতা আত্ম প্রবঞ্চনা বৈ আর কিছু নয়- আল্লাহ্র কাছে এই ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আন্তরিকতা ও শর্তহীন আত্মসমর্পণই একমাত্র আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। এই হচ্ছে সালাতের বা আল্লাহ্র ইবাদতের পূর্বশর্ত। আন্তরিকতা ব্যতীত যে ইবাদত তা ছল-চাতুরী ও আত্মপ্রবঞ্চনা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। পার্থিব জীবনের সাফল্যের আনন্দ যা আত্মাকে তৃপ্তিতে ভরিয়ে দিত তা সব কেড়ে নিয়ে সৃষ্টির প্রথমের যে নিরাভরণ নিঃস্ব, রিক্ত অবস্থা, সেই অবস্থায় আল্লাহ্র নিকট নীত করা হবে।
১০১২। আল্লাহ্র রহমত সবার জন্য সমভাবে প্রবাহিত। তার প্রেরিত জীবন পথের যে নির্দেশাবলী তা গ্রহণ করার জন্য সকলকেই সমভাবে আহ্বান করা হয়েছে। মানব
সন্তানকে আল্লাহ্ "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি" দান করেছেন। আল্লাহ্র নির্দেশিত জীবনাদর্শ গ্রহণ করার বা না করার পূর্ণ স্বাধীনতা স্রষ্টা তাকে দান করেছেন। যে স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে আল্লাহ্ তার আত্মাকে করেন ঐশ্বর্যমন্ডিত। এই কথাকেই এভাবে বলা হয়েছে "একদলকে সৎ পথে পরিচালিত করেছেন।" অর্থাৎ আত্মিক গুণাবলীতে তাদের আত্মাকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছেন। আর যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্ নির্দেশিত পথকে পরিহার করে, তারা শয়তানকেই প্রকারান্তে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। "সীমিত ইচ্ছাশক্তির" অপব্যবহারের কারণে তাদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা হবে বিলুপ্ত, ফলে তাদের পাপ কাজকেও তাদের চক্ষে মনোহর মনে হবে এবং নিজেদের পূণ্যাত্মা এবং সৎপথগামী ভেবে আত্ম প্রসাদ লাভ করবে।
১০১৩। 'Zinat' শব্দটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "সুন্দর পোষাক পরিচ্ছদ।" এ শব্দটির মূল ভাব হচ্ছে শুধুমাত্র পোষাক দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করা নয়, বরং বিভিন্ন উপকরণ দ্বারা সজ্জিত করা যথাঃ পরিষ্কার ভাবে নিজেকে ধৌত করা, সুন্দর পরিপাটিরূপে চুলের বিন্যাস করা, প্রসাধনী ব্যবহার করা ইত্যাদি। নামাজের পূর্বে প্রত্যেককে পরিপাটি সুন্দররূপে; পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সাথে স্রষ্টার সম্মুখে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিক জীবনে আমরা কোন সম্মানীয় ব্যক্তিত্বের সাক্ষাতের পূর্বে নিজেকে যথাসাধ্য শ্রেষ্ঠ পোষাক ও প্রসাধনীতে সাজিয়ে নিয়ে নিজেকে উপস্থাপনা করি। আর এখানে আমরা আমাদের দেহ, মন, আত্মাকে বিশ্ব স্রষ্টার কাছে নিবেদন করার জন্য প্রস্তুত হই সালাতের মাধ্যমে। সুতরাং এখানে সাধ্যমত সুন্দর পরিচ্ছদ ও পরিপাটিরূপে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হতে হবে। অবশ্য পুরুষদের জন্য সিল্ক ও মহিলাদের মত গহনা পরিধান করা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ "সুন্দর পরিচ্ছদের" ব্যাপারেও বাড়াবাড়ি ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামে নোংরা, জটাধারী, দুর্গন্ধযুক্ত বেশবাস পরিহিত "ফকির" বা আধ্যাত্মিক নেতার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। কারণ কোরানে আল্লাহ্র নির্দেশ হচ্ছে তাঁর সম্মুখে দন্ডায়মান হতে হবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে সুন্দর পোষাকে।
রুকু - ৪
১০১৪। অনেকে মনে করে যে ধার্মিক হওয়ার পূর্ব শর্ত-ই হচ্ছে কঠোর তপস্বীর মত জীবনকে সব সৌন্দর্য্য থেকে বঞ্চিত করা। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার মধ্যে কোনও ধর্ম নেই। বিখ্যাত শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত যেমন হাম্দ, নাত, মোজাহার্ট, বিটোফেন ইত্যাদি এ সব আত্মার মাঝে স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। মানুষের মাঝে এসবের প্রকাশ হচ্ছে আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামতের প্রকাশ। বিখ্যাত শিল্প বা সাহিত্য এসব যারা সৃষ্টি করেন তারা আল্লাহ্র হাতের ক্রীড়নক মাত্র। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ্র এইসব নেয়ামতের প্রকাশ পায় মাত্র। সুতরাং বান্দার জন্য এসব "বিশুদ্ধ পবিত্র বস্তু" নিষিদ্ধ নয়।
১০১৫। পৃথিবীর এসব সুন্দর জিনিস তাদেরই জন্য যারা ঈমান আনে, আল্লাহ্তে বিশ্বাস করে। তবে এই পৃথিবীতে অনেক সময়ে দেখা যায় এসব সুন্দর জিনিস তারাই ভোগ করছে যারা আল্লাহ্র এইসব নেয়ামত ভোগ করার যোগ্যতা রাখে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে পৃথিবীর জীবনই আমাদের শেষ কথা নয়। পৃথিবীর জীবন হচ্ছে আদম সন্তানের জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র। পরকালের অনন্ত জীবনে ঈমানদারদের জন্য আছে সুসংবাদ। "শেষ বিচারের দিনে এই সমস্ত তাদের জন্য যারা ঈমান আনে।"
১০১৬। আল্লাহ্ যে সব জিনিসকে নিষিদ্ধ করেছেন, তা চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। (১) যা কিছু লজ্জাজনক ও অসুন্দর। অনেক সমাজে দেখা যায় সামাজিক রীতি নীতিতে অনেক অসুন্দর এবং জঘন্য রীতিনীতি চালু থাকে, সমাজ যাকে পাপ বলে মনে করে না। যেমন হিন্দু ধর্মে 'সতীদাহ' প্রথা চালু ছিল। আফ্রিকার কোন কোন মুসলিম দেশে মেয়েদের লিঙ্গের ত্বকচ্ছেদের সামাজিক রীতি চালু আছে - যা ইসলাম অনুমোদন করে না। আবার বিবাহ বহির্ভূত যৌন জীবন ইসলামের চোখে অত্যন্ত গর্হিত ইত্যাদি। (২) নিজেকে পাপে নিমজ্জিত করা। কোনও কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে মানুষ সত্য থেকে বিচ্যুত এবং পাপে নিমজ্জিত হয়। যেমনঃ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করা, কারও প্রতি কর্তব্য দায়িত্ব না করা, আইন ভঙ্গ করা, নিজ স্বার্থের জন্য অন্যের অধিকারে বা প্রাপ্য জিনিসে হস্তক্ষেপ করা ইত্যাদি। "যুক্তির বিরুদ্ধে সীমালংঘন" যার ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, Tresspasses against truth and reason. অর্থাৎ যা সত্য এবং সঙ্গত তার বিরোধিতা করা। (৩) মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করা। মিথ্যা উপাস্যের সৃষ্টি হচ্ছে, আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করা। (৪) ধর্মের নামে কুসংস্কার চালু করা। যে সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নাই।
৩৬। কিন্তু যারা আমার নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখ্যান করবে এবং সে সম্বন্ধে অহংকার করবে, তারা হবে আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।
৩৭। তার থেকে বড় অন্যায়কারী কে আছে যে আল্লাহ্ সম্বন্ধে মিথ্যার উদ্ভাবন করে এবং তাঁর নিদর্শন সমূহ প্রত্যাখ্যান করে ? তাদের জন্য [পৃথিবীতে] বিধিলিপিতে যা ধার্য করা হয়েছে তা তাদের নিকট পৌঁছিবে ১০১৮ যতক্ষণ না আমার [মৃত্যুর] ফেরেশতাগণ উপস্থিত হবে এবং তাদের আত্মাকে হরণ করবে ও জিজ্ঞাসা করবে, "আল্লাহ্ ব্যতীত যাদের তোমরা ডাকতে তারা কোথায় ?" তারা উত্তর দিবে, "তারা আমাদের হতাশার মাঝে ত্যাগ করে গেছে," তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে যে তারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করেছিলো।
১০১৮। "বিধিলিপিতে যা ধার্য করা হয়েছে তা তাদের নিকট পৌঁছাবে" - যারা আল্লাহ্র অবাধ্য ও একগুয়ে তারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদের এই অবাধ্যতার জন্য আল্লাহ্ সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। তাদের এই পৃথিবীতে সময় ও সুযোগ দান করেন। সুযোগ দান করেন পৃথিবীকে উপভোগ করার জন্য, সময় দান করেন কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করার জন্য, নিজেকে সংশোধন করার জন্য যেনো "শিক্ষানবীশ কালের" মধ্যে নিজেকে পরকালের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে। পৃথিবীতে অবস্থানের জন্য যে সময়কাল নির্ধারিত করা হয়েছে আল্লাহ্ কারও পাপের জন্য সেই সময়কালকে সংক্ষিপ্ত করেন না। দেখুন সূরা [১৮ : ৫৮] যেখানে বলা হয়েছে, "তাদের জন্য রয়েছে এক প্রতিশ্রুত মূহুর্ত।" নির্ধারিত সময় শেষ হলে, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা প্রত্যেকে পৃথিবীর জীবনকে শেষ করে অন্য ভূবনে যাত্রা করি। আমাদের "শিক্ষানবীশ" কালের সমাপনান্তে হিসাব নিকাশের জন্য উপস্থিত হতে হয়। পৃথিবীর জীবন শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ভূমিকা অনুধাবন করতে পারবে, তারা তাদের পাপকে স্বীকার করবে।
১০১৯। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী সম্প্রদায় পরবর্তী সম্প্রদায় থেকে দ্বিগুণ পাপী। কারণঃ (১) তাদের নিজেদের পাপ ও (২) পরবর্তী সম্প্রদায়ের জন্য খারাপ উদাহরণ স্থাপন। আমরা শুধুমাত্র আমাদের পাপের জন্যই যে দায়ী তাই নয়, আমরা আমাদের পরবর্তী বংশধরদের সামনে যে মন্দ উদাহরণ স্থাপন করি তার জন্যও আমাদের জবাবদিহিতা থাকবে। সুতরাং আমাদের পাপের জন্য শাস্তি দ্বিবিধ।
১০২০। যারা পাপী ও অন্যায়কারী, তারা কখনও পরস্পর পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে পারে না। পৃথিবীর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি অন্যায়, অপরাধ ও পাপ, সর্বদা ঘৃণিত পরিবেশের সৃষ্টি করে। এ সব পাপিষ্ঠেরা দুষ্কর্মে পরস্পরের সঙ্গী, কিন্তু যখনই তারা বিচারের সম্মুখীন হয়, তারা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে তিক্ত অভিযোগে পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে।
রুক - ৫
৪১। তাদের জন্য জাহান্নামের [আগুন] হবে [নীচের] বিছানা এবং ভাজের উপর ভাজ করা [উপরের] আচ্ছাদন। যারা পাপ করে এই হবে তাদের জন্য আমার প্রতিদান।
৪২। [অপর দিকে] যারা আমার উপর ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, আমি [তাদের] কাকেও তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব ভার অর্পণ করি না। এরাই বেহেশতের অধিবাসী, সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী।
৪৩। আমি তাদের অন্তর থেকে অদৃশ্য কষ্টের অনুভূতি দূর করে দেব ১০২১। তাদের পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী; এবং তারা বলবে; "প্রশংসা আল্লাহ্র যিনি আমাদের এই [শান্তির] পথ প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ্ আমাদের পথ প্রদর্শন না করালে আমরা কখনও পথ খুঁজে পেতাম না। এই হচ্ছে প্রকৃত সত্য যা আমাদের প্রভুর রাসূলগণ আমাদের নিকট এনেছে।" এবং তারা উচ্চ স্বরে বলতে শুনবে, "দেখ ! তোমাদের সম্মুখে [বেহেশতের] বাগান ! তোমাদের [ভালো] কাজের জন্য তোমাদের এই [জান্নাতের] উত্তরাধিকারী করা হয়েছে ১০২২।"
১০২১। এই আয়াতে বেহেস্তের বর্ণনা উপলক্ষে বলা হয়েছে যে পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের অন্তর থেকে ঈর্ষা, ক্ষোভ, হতাশা কষ্ট দূর করে দেয়া হবে। একথাটির অর্থ হচ্ছে - পৃথিবীর সংঘাতময় জীবনে আমাদের প্রত্যেককেই অনেক সময়ে হতাশা, ব্যর্থতা, ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-ব্যথার সম্মুখীন হতে হয়। এসব অতীত স্মৃতি আমাদের হৃদয়কে সুখের সময়েও উদ্বেলিত করে তোলে। সুখের মাঝেও এই স্মৃতি আমাদের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করতে পারে। স্মৃতিই এখানে দুঃখ, সত্যিই টেনিসন বলেছেন যে, "A sorrows Crown of sorrow is remembering happier things." এ সবই হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর জীবনের জন্য প্রযোজ্য। কারণ পৃথিবীর জীবন - হচ্ছে অসম্পূর্ণ জীবন। এই জীবনে সুখের সাথে দুঃখ মিশে থাকবেই। অতীতের অভিজ্ঞতা, সম্পূর্ণ তৃপ্তি ও সুখের মাঝে বাঁধার সৃষ্টি করে। কিন্তু বেহেস্তের যে সুখ ও শান্তির কথা বলা হয়েছে সেখানে অতীতের কোনও দুঃখ-ব্যাথা, গ্লানি-অপমান, ব্যর্থতা, হতাশার কোনও স্মৃতিই মনকে পীড়িত করবে না। কারণ আল্লাহ্ আমাদের এসব দুঃখময় স্মৃতি থেকে রেহাই দেবেন - কোন ব্যাথার স্মৃতিই আর হৃদয়কে দুঃখ ভারাক্রান্ত করতে পারবে না, অতীতের স্মৃতির ভার যা হৃদয়ে পাষাণের মত চেপে থাকে তা বেহেস্তের শান্তির পরশে রৌদ্রালোকে বরফের ন্যায় গলে যাবে। হৃদয় ভরে যাবে উদ্বেগহীন, হতাশাহীন, দুঃখ-কষ্টহীন, অপার শান্তিতে। এ শান্তির যা পরশ তা পৃথিবীতে পাওয়া কোনও শান্তির সাথে তুলনীয় নয়। বেহেস্তের শান্তি হচ্ছে পরিপূর্ণ শান্তি। কোন ঈর্ষা, ক্ষোভ, গ্লানি, অপমান, ত্রুটি-বিচ্যুতি কিছুই বেহেস্তের শান্তিকে স্পর্শ করতে পারবে না। নিরুদ্বিগ্ন জীবন অপার শান্তিতে ভরে যাবে।
১০২২। "তোমাদের [ভালো] কাজের জন্য" এই বাক্যটি মওলানা ইউসুফ আলীদ সাহেব প্রকাশ করেছেন এ ভাবে,"Behold ! The Garden before you ! Ye have been made its inheritors, for your deeds Of righteousness" অর্থাৎ পূণ্য কাজ বা Righteous deeds খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আছে যে যীশু খৃষ্ট বলেছেন "Blessed are the meek, for they shall inherit the earth," [Mah V.5]পার্থক্য হচ্ছে ইসলাম পূণ্য কর্মের বা সৎ কর্মের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। সৎ কর্মই হবে আল্লাহ্র কাছে পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি। এই পুরষ্কার ইহকালে পাওয়া গেল কিনা সেটা শেষ কথা নয়, শেষ কথা হচ্ছে, এ পৃথিবীতে যাই-ই ঘটুক না কেন পরলোকে এসব, সৎ কাজের জন্য বিশেষ পুরষ্কার আছে। অর্থাৎ পূণ্য কাজ বা সৎ কাজই হচ্ছে বেহেস্তের চাবিকাঠি।
১০২৩। এই আয়াতটি থেকে অনুধাবন করা যায় যে যারা দোযখের আগুনে জ্বলতে থাকবে, তাদের দুঃখ দুর্দশার পরিমাণ এত বেশী হবে যে তা শুধুমাত্র 'হাঁ' এই কথাটি বলতে সক্ষম হবে, এর বেশী নয়। এমনকি এই সামান্য কথাটিও তাদের শেষ করতে দেওয়া হবে না, তার পূর্বেই একজন ঘোষণাকারী তাদের অবস্থা ঘোষণা করবে। তাদের অবস্থা হবে অভিশপ্ত আত্মা, যারা আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত। আল্লাহ্র করুণা বঞ্চিত আত্মাই সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্থ আত্মা।
১০২৪। যারা পাপিষ্ঠ, তারা পৃথিবীর জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে তারা আল্লাহ্র প্রদর্শিত জীবন পথকেও বাঁকা ভাবে দেখতে চায়, আর তা করে তাদের ক্ষুদ্র ও দলীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। আল্লাহ্ নির্দেশিত সহজ সরল পথ - যা ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত সে পথকে তারা পরিহার করে বাঁকা পথ বা অসৎ পথের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধার করে। সত্যি কথা বলতে কি, এসব লোকেরা পরকালে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি।
১০২৬। "তাদের দৃষ্টি" - উপরের টিকার ১০২৫ ব্যাখ্যা অনুসারে নম্বর (২)-এ "তাদের" দ্বারা তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে, যাদের ভাগ্য এখনও স্থির হয় নাই। এই আয়াতে প্রতিপালকের কাছে যে আবেদন তা ঐ "তাদের"। নম্বর (১) এবং (৩) "তাদের" কথাটি দ্বারা বেহেস্তবাসীদের বোঝানো হয়েছে, যারা দোযখের অগ্নিশিখার ভয়াবহতা হৃদয়ঙ্গম করে উপরের আবেদন করেছেন। মওলানা ইউসুফ আলী ব্যক্তিগত ভাবে শেষোক্তদের ব্যাখ্যার পক্ষপাতি। পরের আয়াতে [৭ : ৪৮] আরাফের লোকেরা যে দল লোকদের সম্ভাষণ করেছেন তারা হচ্ছে উপরের দল থেকে আলাদা।
রুকু - ৬
৪৯। দেখ ! এরাই কি তারা নয় যাদের সম্বন্ধে তোমরা প্রতিজ্ঞা করে বলতে যে আল্লাহ্ এদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন না ? "[এদেরই বলা হবে] তোমরা [বেহেশতের] বাগানে প্রবেশ কর, তোমাদের কোন ভয় নাই, তোমরা দুঃখিত হবে না।"
১০২৭। "আরাফের" লোকদের বক্তব্যকে এখানে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। (১) বিচার সভাতে বিচারক যে ভাবে অপরাধীদের সম্বোধন করেন, ঠিক সে ভাবে এই আয়াতের প্রথম অংশে দোযখবাসীদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, পৃথিবীতে লব্ধ তাদের ধন, সম্পদ, ক্ষমতা, দম্ভ, অহংকার সবকিছুই এখানে অর্থহীন। (২) আয়াত [৭ ৪৯]-তে বক্তব্যের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতের প্রথম অংশে বলা হয়েছে যে, কিভাবে এসব উদ্ধত অহংকারী লোকেরা ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদের দম্ভে পূণ্যাত্মা কিন্তু গরীবদেরকে অবহেলার চক্ষে দেখতো। তাদের ধারণা ছিল যে পৃথিবীতে তাদের ক্ষমতা ও অর্থ সম্পদ লাভ করার কারণ তারা আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহভাজন। কিন্তু আজ সে সব গরীব কিন্তু পূণ্যাত্মারাই বেহেস্তের যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং (৩) ৭ : ৪৯] আয়াতের শেষ ভাগে পূণ্যাত্মাদেরই সাদর সম্ভাষণ করা হয়েছে এই বলে যে, "তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর।"
১০২৮। দোযখের অধিবাসীরা বিভিন্ন যন্ত্রণার সম্মুখীন হবে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে তৃষ্ণা এবং ক্ষুধা। তৃষ্ণায় তাদের বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইবে, কিন্তু তৃষ্ণার পানি মিলবে না। ব্যাকুল হয়ে তারা জান্নাতবাসীদের কাছে পানি ও জীবিকার জন্য আবেদন জানাবে। কারণ জান্নাতবাসীরা ঠান্ডা সুপেয় পানি, সুখাদ্য ও আল্লাহ্র দান অপার শান্তি উপভোগ করবে। পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য হবে তাদের সর্বোচ্চ পাওয়া - তা তারা ভোগ করবে তাদের পৃথিবীর সুকর্মের দরুণ। দোযখবাসীরা এসবের অংশ ভিক্ষা করবে জান্নাতবাসীদের নিকট, কিন্তু পরলোকে এসব বস্তু হস্তান্তরযোগ্য নয়। দেখুন [৩৭ : ৪১-৪৭, ৬২-৬৭]।
৫৩। তারা কি শুধু ঘটনার শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করে ? সেদিন যখন ঘটনার শেষ পরিণতি ঘটবে ১০৩০, যারা পূর্বে তা অশ্রদ্ধা করতো তারা বলবে, "আমাদের প্রভুর রাসূলগণ অবশ্যই সত্য [বাণী] এনেছিলো। আমাদের কি এমন কোন সুপারিশকারী আছে যে আমাদের পক্ষে সুপারিশ করবে ? অথবা আমাদের [পৃথিবীতে] ফেরত পাঠানো হবে ? তাহলে আমরা পূর্বে যেভাবে আচরণ করতাম তা থেকে ভিন্নতর আচরণ করতাম ?" প্রকৃত পক্ষে তারা তাদের [নিজেদের] আত্মার ক্ষতি করেছে। তারা যে [মিথ্যার] উদ্ভাবন করেছে তা তাদের হতাশার মাঝে নিক্ষেপ করবে।
১০৩০। যাদের আল্লাহ্র উপরে ঈমান নাই তারা ইহকালে আল্লাহ্র হুকুমের অবাধ্যতা করে এবং পরকালের শাস্তির কথা বিশ্বাস করে না। তারা অপেক্ষা করে পরকালের শেষ পরিণতির জন্য। এ কথা সত্য যে তাদের শেষ পর্যন্ত "সত্যকে" প্রত্যক্ষ করতেই হবে, কিন্তু তখন তা হবে অনেক বিলম্ব। কারণ এই পৃথিবীতে যাদের তারা মনে করতো শক্তিমান, ক্ষমতাধর, রক্ষাকর্তা এবং সেই কারণে তাদের পূঁজা করতো; পরকালে তাদের কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই দিনে অন্য কারও মহত্ব বা বীরত্ব বা ক্ষমতা দ্বারা কেউই লাভবান হবে না। প্রত্যেকের কর্মফলের জন্য প্রত্যেকে দায়ী থাকবে। কেউই কারও কর্মফলের জন্য দায়ী হবে না। আত্মার মুক্তি লাভ ঘটবে শুধুমাত্র নিজস্ব সুকৃতি দ্বারা। অন্যের সুকৃতি দ্বারা কেউ লাভবান হবে না বা অন্যের দুষ্কৃতি দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্থও হবে না। সেদিন পাপিষ্ঠরা কতই না ব্যাকুল ভাবে কামনা করবে যেনো পৃথিবীতে আর একবার তাদের সুযোগ দান করা হউক। কিন্তু সে সুযোগ আর কখনও তারা পাবে না।
রুকু - ৭
১০৩২। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন। ইহুদীরা বিশ্বাস করে আল্লাহ্ ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। কিন্তু এই আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী "অতঃপর তিনি সিংহাসনে সমাসীন হন।" অর্থাৎ মুসলমান বিশ্বাস করে ছয় দিনে সৃষ্টি কর্মের বিবরণ হচ্ছে আল্লাহ্র বৃহত্তর কাজের ভূমিকা স্বরূপ। কারণ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পরেই স্রষ্টা বিশ্রামে চলে যান নাই। "সিংহাসনে সমাসীন হন" - অর্থাৎ এই সৃষ্টিকে পরিচালনার জন্য আইনের প্রবর্তন করেন। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত সৃষ্টি, দ্যুলোকে-ভূলোকে, তরুলতা, কীট-পতঙ্গ সকলেই এই আইনের অধীন। জীব জগতের জন্ম-মৃত্যু, পৃথিবীর প্রাকৃতিক ঘটনাবলী, গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচল সবই নিখুঁত ও নির্দিষ্টভাবে আল্লাহ্র আইন মেনে চলে। কারও আল্লাহ্র আইন ভাঙ্গার ক্ষমতা নাই। প্রকৃতির এই আইনকেই আমরা বিজ্ঞান নামে আখ্যা দিয়ে থাকি। সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য আল্লাহ্ তার আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর। এই আয়াতে সুন্দর উপমার সাহায্যে এই কথাকেই তুলে ধরা হয়েছে। দিন ও রাত্রি একে অপরকে অনুসরণ করে। কিন্তু কেউ কাউকে ধরতে পারে না। নক্ষত্ররাজি আকাশে সন্তরণ করে, কিন্তু কেউই তাদের নির্দিষ্ট গতিপথের বাইরে যায় না। অর্থাৎ পুরো আয়াতে এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে আল্লাহ্ সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টিকে রক্ষাকর্তা এবং সৃষ্টিকে পরিচালনার মালিক একমাত্র তিনিই।
১০৩৩। 'প্রার্থনা' বা আল্লাহ্কে 'ডাকা' - তা হতে হবে অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে, বিনীত ও নম্রভাবে এবং গোপনে। নামাজ হচ্ছে প্রার্থনারই একরূপ। প্রার্থনা হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদিত। অহংকার, বা উচ্চস্বর, বা অবাধ্যতা যখন প্রার্থনার সাথে যুক্ত হয় তখন তা হয় লোক দেখানো। সর্বশক্তিমানের কাছে নিবেদন হতে হবে গোপনে, শুধুমাত্র তাঁকেই খুশী করার জন্য।
মন্তব্য : এতে বোঝা যায় যে, আজকাল জনসাধারণ যে ভঙ্গীতে প্রার্থনা বা নামাজ পড়ে সাধারণতঃ প্রায়ই জানা থাকে না যে, মুখে যে সব আরবী শব্দ উচ্চারণ করা হচ্ছে তার অর্থ কি ? অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ং ইমামদেরও এসব শব্দের অর্থ জানা থাকে না। তাদের জানা থাকলেও যারা দোয়া বা প্রার্থনায় শরীক হন তাদের জানা থাকে না। তারা অর্থ না বুঝেই ইমামের আবৃত্তি করা বাক্যাবলীর সাথে 'আমীন' বলতে থাকেন। এর সাথে অন্তরের বা আন্তরিকতার কোনও যোগাযোগ থাকে না। দোয়া বা প্রার্থনার যে স্বরূপ, তা এ ক্ষেত্রে থাকে অনুপস্থিত।
১০৩৪। যে লোক বিনয় ও আন্তরিকভাবে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে আল্লাহ্ তাঁর ডাকে সাড়া দেন। তাঁর আধ্যাত্মিক উন্নতির এটাই হলো প্রথম ধাপ। জমিতে ফসল বোনার পূর্বে জমিকে যেমন চাষ করে আগাছা মুক্ত করতে হয়, তবেই তা ফসল বোনার উপযুক্ত হয়। সেইরূপ আল্লাহ্র হেদায়েত লাভের পূর্বে বিনয় ও আন্তরিক আত্মনিবেদনের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। "ভয় ও আশার" সাথে আল্লাহ্কে ডাকলে আল্লাহ্ তাদের নিটবর্তী। যারা মন্দ তারা সৎ কর্মপরায়ণদের, আল্লাহ্র জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি তা লন্ডভন্ড করে দিতে চায়। এদেরকেই এই আয়াতে নিষেধ করা হয়েছে।
১০৩৫। 'ভয় এবং আশা' - এখানে ভয় শব্দটি হচ্ছে সেই ভয় করা যা তাকওয়া বা আল্লাহ্কে ভালোবেসে ভয় করা। যা আল্লাহ্র অপছন্দ তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা। অর্থাৎ সৎ জীবন যাপন করা। এই ভয় আল্লাহ্ প্রীতির-ই অন্যরূপ।
১০৩৬। এই আয়াতে রূপকের সাহায্যে আল্লাহ্ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দান করেছেন। (১) এই পার্থিব দুনিয়ায় বৃষ্টিকে আমরা আল্লাহ্র রহমতরূপে তুলনা করতে পারি। সমুদ্রের পানি জলীয় বাষ্পরূপে ঘনকালো মেঘরূপে বায়ু তারিত হয়ে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হয়। বাতাসের আর্দ্রতাই আমাদের জানিয়ে দেয় বর্ষণের পূর্বাভাস। এই বাতাসই বৃষ্টির আগমনের শুভসংবাদ বহন করে আনে। আল্লাহ্র প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মেঘরাজি স্থলভাগে বারি বর্ষণ করে ফলশ্রুতিতে সমস্ত শুষ্ক মৃত মাটি সজীব হয়ে ওঠে এবং শস্য ও ফল-ফুলে ধরীত্রি সুশোভিত হয়ে যায়। এ কারণেই মেঘ ও বৃষ্টিকে আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ বলা হয়েছে। (২) এই রূপকটিকে ব্যবহার করা হয়েছে আধ্যাত্মিক জগতকে তুলনার মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য ও বোধগম্য করার জন্য। মেঘ বহনকারী বাতাসকে এখানে মানুষের "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির" সাথে তুলনা করা যায়। যদি কোন ব্যক্তি স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ্র হেদায়েতের জন্য ব্যগ্র হয় তবে, সুবাতাস যেরূপ মেঘের বার্তা ঘোষণা করে, ঠিক সেইরূপ ব্যক্তির ইচ্ছা হচ্ছে মৃত আত্মার জন্য সুবাতাস স্বরূপ যা আল্লাহ্র করুণা ও হেদায়েতের সুসংবাদ দান করে। শুষ্ক জমি যে ভাবে বৃষ্টির ফলে উজ্জীবিত হয়ে উর্বর হয়, ঠিক সেই ভাবে আধ্যাত্মিক ভাবে মৃত আত্মা আল্লাহ্র রহমতের বর্ষণে পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। (৩) পার্থিব পৃথিবীতে মৃত ও শুষ্ক পৃথিবীর মাটি বৃষ্টির ফলে যদি সজীব ও উর্বর রূপ ধারণ করতে পারে, তবে মানব সন্তানের মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে অবিশ্বাস থাকে কিরূপে ?
১০৩৭। উপরের রূপকের ধারাবাহিকতা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। (১) এই পৃথিবীতে বৃষ্টির পানি জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে একথা ঠিক তবে সব জমির জন্য একথা প্রযোজ্য নয়। যে জমির গুণগত মান উন্নত এবং পলিমাটি সমৃদ্ধ, সেই মাটি বৃষ্টি দ্বারা অধিক উপকৃত হয়। আবার যে মাটি পাথুরে এবং গুণগত মানে অনুর্বর, সে মাটি বৃষ্টি দ্বারা ধৌত হলেও ফসল ফলাতে সক্ষম হয় না। (২) আধ্যাত্মিক জগতেও যে আত্মা মন্দ কাজে অভ্যস্ত সেই অসৎ আত্মাতে আল্লাহ্র রহমত কোনও সুফল বয়ে আনতে পারে না। যে আত্মা সৎ কাজে অভ্যস্ত সেই সৎ আত্মা আল্লাহ্র রহমতের বৃষ্টিতে পরিপূর্ণতা লাভ করে মুক্তি পায়। (৩) শেষ বিচারের দিনে সকলের পুনরুত্থান ঘটবে যদিও সকলেই সেদিন মোক্ষ লাভে সমর্থ হবে না।
১০৩৮। "কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়" - আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা শুধুমাত্র কথার কথা নয়। এর ভাষা হচ্ছে ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলী (Conduct of life) এবং সৎ কাজ। সৎ ও পবিত্র জীবন যাপন প্রণালী এবং সৎ কাজের মাধ্যমেই আল্লাহ্র হুকুম পালন করা যায় এবং এই হচ্ছে সর্বশক্তিমানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা।
রুকু - ৮
৬১। সে বলেছিলো, "হে আমার সম্প্রদায় ! আমার [মনে] কোন বিভ্রান্তি নাই। বরং আমি জগত সমূহের প্রতিপালক প্রভুর রাসূল।
৬২। "তোমাদের প্রতি আমার প্রভু কর্তৃক নির্দিষ্ট কাজ আমি সম্পাদন করেছি। তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ আন্তরিক এবং আমি আল্লাহ্র নিকট থেকে এমন কিছু জানি যা তোমরা জান না।
৬৩। "তোমরা কি অবাক হচ্ছ এ জন্য যে, তোমাদের সম্প্রদায়ের একজনের মাধ্যমে, তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে উপদেশ এসেছে তোমাদের সাবধান করতে, যেনো তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং সম্ভবতঃ তাঁর অনুকম্পা লাভ কর ?"
৬৪। কিন্তু তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আমি তাকে এবং যারা তার সাথে নৌকাতে ছিলো তাদের উদ্ধার করি। কিন্তু যারা আমার নিদর্শন সমূহ প্রত্যাখ্যান করেছিলো তাদের আমি বন্যার [পানিতে] নিমজ্জিত করি। অবশ্যই তারা ছিলো এক অন্ধ সম্প্রদায়।
রুকু - ৯
১০৪০। 'আদ' প্রকৃতপক্ষে নূহ্ (আঃ) এর পঞ্চম পুরুষের মধ্যে এবং নূহের পুত্র সামের বংশধরদের মধ্যে এক ব্যক্তির নাম। অতঃপর তার বংশধর ও গোটা সম্প্রদায় 'আদ' নামে খ্যাত হয়ে গেছে। আদের দাদার নাম ছিল ইরাম। ইরামের এক পুত্র 'আওসের' বংশধররাই আদ সম্প্রদায়। এদেরকে প্রথম আদ বলা হয়। ইরামের দ্বিতীয় পুত্র হচ্ছে সামুদ। তার বংশধরকে বলা হয় দ্বিতীয় আদ বা সামুদ জাতি। অর্থাৎ আদ ও সামুদ উভয়েই ইরামের দু-শাখা।
আদ সম্প্রদায়ের তেরটি গোষ্ঠি ছিল। আম্মান থেকে শুরু করে হাদরামাওত ও ইয়েমেন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপুসম্পন্ন। তারা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী জাতি। আল্লাহ্ তাদের সামনে দুনিয়ার যাবতীয় নেয়ামতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। যে বিশ্বপালকের নেয়ামতের বৃষ্টি তাদের উপরে বর্ষিত হচ্ছিল, তারা তাঁকে পরিত্যাগ করে মূর্তি পূঁজায় আত্মনিয়োগ করে। হযরত 'হুদ' আদ জাতিকে মূর্তি পূঁজা ত্যাগ করে একত্ববাদের অনুসরণ করতে এবং অত্যাচার আবিচার ত্যাগ করে ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ করেন। কিন্তু তারা ধনৈশ্বর্যের মোহে মত্ত হয়ে তাঁর আদেশ অমান্য করে। এর পরিণতিতে তাদের উপরে প্রথম আযাব নাজিল হয় এবং তিন বছর পর্যন্ত উপর্যুপরি বৃষ্টি বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত্র শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। কিন্তু এতেও তাদের চৈতন্যদয় ঘটে নাই। ফলশ্রুতিতে আট দিন সাত রাত পর্যন্ত তাদের উপর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আযাব পাঠানো হয়। এভাবে তাদের দালান-কোঠা, ফসলের ক্ষেত, মানুষ, জীব-জন্তু সব ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু থেকে যায় দ্বিতীয় আদ বা সামুদ জাতি। পরবর্তীতে তাদের পাপের কারণে তাদের ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটে।
হুদ নবীর কবর এখনও হাদরামাওতে বিদ্যমান। হাযরামাওতের অবস্থান হচ্ছে, ১৬ ডিগ্রি উত্তর দ্রাঘিমাংশ এবং ৪৯.৫ ডিগ্রি পূর্ব অক্ষাংশে এবং মুকালা থেকে ৯০ মাইল উত্তরে। এখানে এখনও এই প্রাচীন সভ্যতার অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। দেখুন পুস্তক Hadhramaut; and some of its mysteries unveiled” by D. Van der Heulen and H. Von Wissmann, heyden 1932.
৬৭। সে বলেছিলো, "হে আমার সম্প্রদায় ! আমি মূর্খ নই বরং [আমি] জগতসমূহের প্রতিপালক প্রভুর রাসূল।
৬৮। "আমার প্রভু কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তোমাদের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করছি। আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা।
৬৯। "তোমরা কি আশ্চর্য্য হচ্ছ যে, তোমাদের সতর্ক করার জন্য তোমাদের মধ্যে একজনের মাধ্যমে আল্লাহ্র বাণী এসেছে ? স্মরণ কর, নূহ্ এর সম্প্রদায়ের পরে তিনি তোমাদের উত্তরাধীকার করেছিলেন এবং দৈহিক উচ্চতায় সকল জাতির মধ্যে লম্বা করেছিলেন। স্মরণ কর আল্লাহ্ প্রদত্ত সুবিধাসমূহ [যা তোমরা পেয়েছিলে] যেনো তোমরা সফলকাম হতে পার।"
৭০। তারা বলেছিলো, "তুমি কি আমাদের নিকট এ জন্য এসেছ যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে এক আল্লাহ্র ইবাদত করি ? তুমি যদি সত্য বলে থাক, তবে যার ভয় তুমি আমাদের দেখাচ্ছ তা আনায়ন কর।"
৭১। সে বললো, "তোমাদের প্রভুর শাস্তি এবং ক্রোধ ইতিপূর্বেই তোমাদের সম্মুখীন হয়েছে ১০৪১। তোমরা কি আমার সাথে কতকগুলি [দেব-দেবীর] নাম নিয়ে তর্ক কর যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষগণ উদ্ভাবন করেছে আল্লাহ্র অনুমতি ব্যতীত ১০৪২ ? তাহলে অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি।"
১০৪১। "তোমাদিগের প্রভুর শাস্তি ও ক্রোধ ইতিপূর্বেই তোমাদের সম্মুখীন হয়েছে" অর্থাৎ পূর্ব থেকেই তা প্রযোজ্য হয়ে আছে। এই বাক্যটির ব্যাখ্যা তিন ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় : (১) 'আদ' সম্প্রদায়ের উপরে চূড়ান্ত শাস্তিদানের পূর্বেই আল্লাহ্ তাদের জন্য দূর্ভিক্ষরূপ আযাব প্রেরণ করেন যেন তারা আল্লাহ্র রাস্তায় ফিরে আসে। এই দূর্ভিক্ষরূপ আযাবকেই এখানে বলা হয়েছে ইতিপূর্বেই তোমাদের সম্মুখীন হয়েছে (২) যে পাপ ও উদ্ধত্য তাদের ঘিরে ধরেছিল, তাই ছিল তাদের জন্য আত্মিক যন্ত্রণা বা আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তি, চূড়ান্ত শাস্তির পূর্বে। (৩) অথবা পয়গম্ববররা যেরূপ ভবিষ্যত দ্রষ্টা হিসেবে ভবিষ্যত দেখতে পান এবং বলেন যে "সাবধান ! আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাদের পাপ কাজ তোমাদের ঘিরে ধরেছে।"
১০৪২। এখানে আদ সম্প্রদায়ের জন্য হুদ নবীর উপদেশকে বর্ণনা করা হয়েছে। আদ্ সম্প্রদায় মিথ্যা দেব দেবীর উপাসনা করতো এক আল্লাহ্র পরিবর্তে - আর এ সম্বন্ধে মিথ্যা বিতর্কে লিপ্ত হতো। সেই প্রেক্ষিতে হুদ নবী বলেছেন মিথ্যা হচ্ছে তোমাদের অবাধ্যতা ও ঔদ্দত্যের ফল। নবীর এখানে করণীয় কিছু নেই। আল্লাহ্র শাস্তি অবশ্যাম্ভবী।
রুকু - ১০
১০৪৩। ইতিপূর্বে আদ জাতির বর্ণনায় বলা হয়েছে যে আদ ও সামুদ জাতি হযরত নূহের বংশধরদের থেকে উদ্ভুদ। সে হিসেবে সামুদ জাতি আদ জাতির জ্ঞাতি ভাই। তারা আরবের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় বাস করতো, যার অবস্থান ছিল মদিনা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে। তাদের প্রধান শহরের নাম ছিল 'হিজর' বা "পর্বতময় শহর।" পর্বতময় শহর ব্যতীতও তাদের ছিল উর্বর উপত্যকা ও সমতল ভূমি। শহর হিজর কে বর্তমানে "মাদায়েনে ছালেহ্" বলা হয়। আদ জাতির মত সামুদ জাতিও সম্পন্ন, শক্তিশালী ও বীর জাতি ছিল। তারা পাথর খোদাই ও স্থাপত্য শিল্পে খুবই পারদর্শী ছিল। সমতল ভূমিতে বিশালকায় অট্টালিকা নির্মাণ ছাড়াও পর্বত খোদাই করে নানা রকম প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করতো। ৯ম হিজরীতে নবী করিম 'তাবুক' অভিযানে যান (মদিনা থেকে ৪০০ মাইল উত্তরে)। রোমানেরা মদিনা আক্রমণ করতে আসছে এরকম একটি গুজবের ভিত্তিতে 'তাবুক' অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ সময়েই রাসূল ও তার সহচরবৃন্দ সামুদ জাতির ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ অতিক্রম করেন। তিনি তাঁর সাহাবাদের নির্দেশ দেন, কেউ যেন এই আযাব বিধ্বস্ত এলাকার ভিতরে প্রবেশ কিংবা এর কূপের পানি ব্যবহার না করে। পার্থিব বিত্ত, ধনৈশ্বর্যের পরিণতি প্রায়ই অশুভ হয়ে থাকে। বিত্তশালীরা আল্লাহ্ ও পরকাল ভুলে গিয়ে ভ্রান্ত পথে পা বাঁড়ায়। সামুদ জাতির বেলায়ও তাই হয়েছিল। তাদের নবী সালেহ্ তাদের সতর্ক করেন, কিন্তু তা ছিল বৃথা সতর্কীকরণ।
১০৪৪। এই আয়াতে যে আশ্চর্যজনক উষ্ট্রীর কথা বলা হয়েছে, তার সম্বন্ধে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী কাহিনীকে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত করা হয়েছে। কোরানের কাহিনী নিম্নরূপঃ (১) সামুদ জাতিও আদ জাতির মত বিত্ত এবং ক্ষমতার অহংকারে গরীবদের অত্যাচার ও শোষণ করতে দ্বিধা বোধ করতো না। সালেহ্ নবী বললেন যে, উষ্ট্রীটি আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রেরিত গরীব ও অত্যাচারিতদের প্রতিভূ স্বরূপ। (২) সে সময়ে পানির খুব কষ্ট চলছিল। যারা বিত্তবান ও ক্ষমতাবান তারা গরীবদের এবং তাদের পশুদের ঝরণা বা কূপের নিকটবর্তী হতে বাঁধা দান করতো। সালেহ নবী বিত্তবানদের এই কাজের প্রতিবাদ করেন এবং বলেন যে ধনী গরীব সবার পশুকে পালাক্রমে ঝরণার পানির অধিকার দিতে হবে এবং উষ্ট্রীটি হবে গরীবদের পশুর প্রতিনিধি স্বরূপ। দেখুন সূরা [২৬ : ১৫৫] আয়াতে এবং সূরা [৫৪ : ২৮] আয়াতে। (৩) পানির মত চারণভূমিও আল্লাহ্র অকৃপণ দান - যাতে ধনী গরীব উভয়েরই সম অধিকার [দেখুন সূরা (৭ : ৭৩) আয়াত]। কিন্তু যারা উদ্ধত ও অবাধ্য তারা সম্পদকে কুক্ষিগত করার প্রয়াস পায় এবং চারণ ভূমিকেও শুধুমাত্র বিত্তবান ও ক্ষমতাধরদের পশুদের চারণের জন্য ব্যবহার করে। (৪) এই বিশেষ উষ্ট্রীটি ছিল অত্যাচারী ও শোষকদের জন্য এক মহা পরীক্ষা। দেখুন সূরা [৫৪ : ২৭]। আল্লাহ্র উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষা করা অবাধ্য অবিশ্বাসীদের। (৫) কিন্তু যারা অত্যাচারী, অবাধ্য ও অবিশ্বাসী, তারা আল্লাহ্র এই মহা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে অসমর্থ হয়। গরীবের ন্যায্য অধিকার প্রদানের পরিবর্তে তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করে, সম্ভবতঃ গোপনে। দেখুন সূরা [৯১ : ১৪] আয়াতে এবং সূরা [৫৪ : ২৯] আয়াতে। এভাবেই তারা তাদের অন্যায়ের পাত্র পরিপূর্ণ করে। ফলে তারা আল্লাহ্র রোষানলে পতিত হয় এবং সামুদ জাতিরা ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাদের অহংকার ও গর্বের বস্তু তাদের সুউচ্চ ইমারত সব এক মূহুর্তে মাটির গর্ভে বিলিন হয়ে যায়।
৭৫। [সালেহ্ এর] সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানগণ, তাদের মধ্যে যাদের ক্ষমতাবিহীন বলে গণ্য করা হতো কিন্তু যারা ছিলো ঈমানে বিশ্বাসী, তাদের বলেছিলো ১০৪৫, "তোমরা কি নিশ্চিতই জান যে সালেহ্ তার প্রভু প্রেরিত রাসূল ?" তারা বলেছিলো, "তার মাধ্যমে যে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করা হয়েছে আমরা তাতে নিশ্চিত বিশ্বাসী" ১০৪৬।
১০৪৫। পৃথিবীতে সাধারণ ভাবে দেখা যায়, যারা পূণ্যাত্মা তারা হন নিরহঙ্কার এবং বিনয়ী। বিশেষতঃ এসব লোকেরা বিত্তশালী হন না। বিত্ত ও ক্ষমতা মানুষকে অহংকারী, উদ্ধত ও অবাধ্য করে তোলে সামুদ জাতিদের বেলাতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বিত্ত ও ক্ষমতা তাদের যে শুধু উদ্ধত ও অহংকারী করেছিল তাই-ই নয় - স্বাভাবিক ভাবেই তারা ছিল অত্যাচারী ও স্বার্থপর। আল্লাহ্ তাদের যে নেয়ামত দান করেছিলেন তারা তা কুক্ষিগত করে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। তাদের নিকট ন্যায় বা নীতি বলে কোনও কিছু ছিল না। সালেহ্ নবী, যারা বঞ্চিত, অত্যাচারিত তাদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং স্বার্থপর ও অত্যাচারিতদের উপদেশ দান করেন।
১০৪৬। এই আয়াতটিতে বিশ্বাসী মোমেনদের সাথে কাফেরদের কথোপকথনকে তুলে ধরা হয়েছে। এখানের কথোপকথন অনুধাবন যোগ্য। অবিশ্বাসী কাফেরেরা গরীব অত্যাচারিত মোমেনদের নিকট সুকৌশলে প্রশ্নের মাধ্যমে সালেহ্ নবীকে কলঙ্কিত করার দুরভিসন্ধি করে। তারা বলে যে, সালেহ্ নবী কি নিজেকে আল্লাহ্র প্রেরিত দূত হিসেবে বর্ণনা করে মিথ্যাচার করছে না ? মোমেন বান্দাদের উত্তর ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের। তারা কাফেরদের লক্ষ্য করতে বললো যে, "আমরা অবশ্যই হযরত সালেহ্কে আল্লাহ্র নবী বলে বিশ্বাস করি। কারণ তার মধ্যে আমরা ন্যায়ের প্রতিফলন লক্ষ্য করি।" গরীবদের এবং অত্যাচারীতদের পক্ষ অবলম্বন হচ্ছে ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করা। যারা অন্যায় করে তারা আল্লাহ্র কাজে বাঁধা দান করে। কিন্তু অবিশ্বাসী কাফেরেরা মোমেন বান্দাদের এই উত্তরে কর্ণপাত না করে উষ্ট্রীকে বধ করে এবং নিজেদের পাপের পাত্র পূর্ণ করে।
৭৭। এর পরে তারা সেই উষ্ট্রীকে বধ করে এবং উদ্ধতভাবে তাদের প্রভুর আদেশ অমান্য করে এবং বলে, "হে সালেহ্ ! যদি তুমি [আল্লাহ্র] রাসূল হও তবে যার ভয় তুমি দেখাচ্ছ তা আনায়ন কর।"
৭৮। সুতরাং যখন তারা অসাবধান ছিলো, তখন তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো ১০৪৭। [ফলে] তাদের প্রভাত হলো নিজগৃহে অধঃমুখ পতিত অবস্থায়।
১০৪৭। গরীবের অধিকার অস্বীকারের প্রতিবাদ স্বরূপ আল্লাহ্ প্রেরিত উষ্ট্রীকে বধ করার প্রতিফল পেতে সামুদ জাতির খুব দেরী হলো না। ভয়ংকর ভূমিকম্প তাদের ঘিরে ধরলো। তাদের গর্বের বস্তু তাদের উন্নত মানের সভ্যতা এক মূহুর্তে মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ লাভ করলো। এই ভূমিকম্পের তীব্রতা ও এর শব্দ এত বেশী ছিল যার বর্ণনা সূরা [৫৪ : ৩১] আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, "একটি মাত্র বিস্ফোরণ" যার ইংরেজী করা হয়েছে, "Single mighty blast"। যে কোন ভূমিকম্পেই শব্দের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু এই ভূমিকম্পের তীব্রতা এত বেশী ছিল যে, শব্দের তীব্রতাও ছিল "মহানাদ।"
মন্তব্য : বর্তমান কালে [সুনামি] নামক জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ আদ ও সামুদ জাতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।]
১০৪৮। সালেহ্ নবী এই ভয়ংকর ভূমিকম্প থেকে আল্লাহ্র করুণায় রক্ষা পেলেন; কারণ তিনি ছিলেন সৎ, পূণ্যবান ও ন্যায়পরায়ণ লোক। এই কথাগুলি সালেহ্ নবীর বিদায় ভাষণ হতে পারে তার মৃত স্বগোত্রের জন্য, অথবা তাঁর স্বগোক্তি আক্ষেপও হতে পারে।
উপদেশ : আল্লাহ্র করুণা সর্বদা ন্যায়পরায়ণ ও পূণ্যবানদের রক্ষা করে এবং অন্যায়কারী ও মন্দদের ধ্বংস করে।
১০৪৯। হযরত লুত ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের ভ্রাতুষ্পুত্র। আল্লাহ্ তাকে নবুওয়াত দান করেন এবং তিনি সদম ও গোমরাহ্ নামক শহরের লোকদের তাদের অশ্লীল কাজের জন্য আল্লাহ্র শাস্তির পরিণাম সম্বন্ধে সতর্ক করে দেন। লুতের সম্প্রদায় ছিল সমকামী। তারা লুতের কথায় কর্ণপাত করলো না। লুতের সম্প্রদায়ের আসন্ন শাস্তির খবর আল্লাহ্ দুজন ফেরেশতা মারফত লুতের কাছে পাঠান। এই দু'জন ফেরেশতা এসেছিলেন দু'জন কান্তিমান যুবকের রূপ ধারণ করে। সদমের লোকেরা এই দু'জন কান্তিমান যুবকের খবর শুনে লুতের বাড়ী আক্রমণ করে - তাদের অশ্লীল ও অবৈধ আকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য। দেখুন আয়াত [১৫ : ৬৭] এবং [১১ : ৭৮]। লুত তাদের এই অশ্লীল কাজ থেকে নিবৃত থাকতে উপদেশ দেন এবং যা আল্লাহ্ বৈধ করেছেন সেই অনুপাতে জীবন ধারণ করতে বলেন। এতে লুতের সম্প্রদায় ক্রুদ্ধ হয়ে জবাব দেয়, "তোমার কন্যাদিগের আমাদের কোনও প্রয়োজন নাই" [১১ : ৭৯]। এভাবেই লুতের সম্প্রদায়ে নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে আনে। ফেরেশতারা লুতকে সতর্ক করে দেন এবং পরিবারসহ প্রত্যুষে গৃহ ত্যাগ করে চলে যেতে বলেন [১১ : ৮১]। এর পর আল্লাহ্ সদম ও গোমরাহ্ শহর পাথর বর্ষণ দ্বারা ধ্বংস করে দেন।
সদম ও গোমরাহ্ এই দুটি শহরের নামের উল্লেখ বাইবেলে আছে। কিন্তু ঠিক কোথায় এর অবস্থান এ সম্বন্ধে জানা যায় না। তবে অনেকে মনে করেন এই শহরটির অবস্থান "মরু সাগর" বা Dead Sea-এর পার্শ্বের সমতল ভূমিতে। এই সাগরের পানিতে কোনও জীবিত প্রাণী বাস করতে পারে না, তাই এর নামকরণ হয়েছে "মরু সাগর।" বায়তুল মুকাদ্দাস ও জর্দ্দান নদীর মাঝখানে এই মরু সাগরের অবস্থান। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে আল্লাহ্ সালেহ্ ও সোহেব নবীকে পাঠিয়েছিলেন তাদের নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে, কিন্তু লুত এসেছিলেন বাহির থেকে।
৮২। উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলেছিলো, "তোমাদের শহর থেকে এদের বের করে দাও। সত্যিই এরা এমন লোক যারা পূত পবিত্র হতে চায় ১০৫০।
১০৫০। "এদের" অর্থাৎ লুত ও তাঁর অনুসারীগণকে এই আয়াতে "পূত পবিত্র" কথাটি কঠিন হৃদয় পাপী লোকদের মুখ থেকে উচ্চারিত। পুনঃপুনঃ পাপ কাজ তাদের হৃদয়কে পাথরের থেকেও শক্ত করে ফেলেছিল। তাই লুতের শুভাকাঙ্খার পরিবর্তে তাঁকে অসম্মান ও আঘাত করার জন্য ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ করে উপরের বাক্যটি উচ্চারণ করা হয়। এই সব পাপীরা লুতকে বাক্যবানে জর্জরিত করে, অন্যায় ও অত্যাচারের মাধ্যমে অপমানিত করে মনে করেছিল পূণ্যাত্মা লোকের অসম্মান করতে পেরেছে কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। শেষ পর্যন্ত পাপী ও মন্দ যারা তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে।
১০৫১। বাইবেলে লুতের কাহিনীর বর্ণনাতে বলা হয়েছে যে লুতের স্ত্রী পিছন ফিরে তাকায় এবং তার ফলে সে লবণের মূর্তিতে পরিণত হয়ে যায়। এই বর্ণনার মাঝে আধ্যাত্মিক জীবনের কোনও ইঙ্গিত নাই। এ যেনো রূপকথার কোনও কাহিনী - রাজপুত্র পিছন ফিরে তাকালো ও পাথরে পরিণত হলো। কিন্তু একই কাহিনী কোরানে বর্ণিত হয়েছে আধ্যাত্মিক জীবনের আলোর ইঙ্গিত বহন করে। এখানে বলা হয়েছে, "তাহার স্ত্রী ছিল পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভূক্ত।" অর্থাৎ তাঁর মানসিকতা ও নৈতিকতার অবস্থান ছিল পশ্চাতে অর্থাৎ অত্যন্ত নিম্নমানের। যদিও লুতের স্ত্রী অত্যন্ত সম্মানীয় ও পূণ্যবান লোকের সহধর্মীনি ছিলেন - কিন্তু নৈতিকতার মানদন্ডে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিম্নমানের। পূণ্যবানদের জীবনের একটাই উদ্দেশ্য আর তা হচ্ছে, আল্লাহ্র রাস্তায় জীবনকে পরিচালিত করা। যাদের জীবনের এই উদ্দেশ্য একবার স্থির হয়ে গেছে তাদের কখনও পিছনে, ডাইনে বা বায়ে তাকানোর প্রশ্নই ওঠে না। আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধানে যারা ব্যপৃত তাদের যাত্রা শুধুমাত্র সম্মুখের দিকে। যারা আধ্যাত্মিক জীবনের অনুসন্ধান করে না তারাই পশ্চাতে অবস্থানকারী।
১০৫২। সূরা [১১ : ৮২] আয়াতে লুতের কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে "উহাদের উপর ক্রমাগত গন্ধক বর্ষণ করলাম যা ছিলো ইটের ন্যায় শক্ত।" সূরা [১৫ : ৭৩-৭৪] আয়াতে বলা হয়েছে যে, "অতঃপর সূর্যোদয়ের সময়ে বিস্ফোরণ উহাদিগকে আঘাত করলো, এবং আমি জনপদকে উল্টিয়ে উপর নীচ করে দিলাম এবং তাদের উপরে প্রস্তর, কঙ্কর বর্ষণ করলাম।"
রুকু - ১১
১০৫৩। মাদইয়ানবাসী বা মিদিয়ানবাসীদের কথা তওরাতে বা ওল্ড টেষ্টামেন্টে বহুবার উল্লেখ আছে। মিদিয়ান বাসীরা ছিল এক আরব গোষ্ঠী। ক্যানন বাসীদের প্রতিবেশী হিসেবে বাস করার ফলে তাদের সাথে মিদিয়ানদের সংমিশ্রণ ঘটে। মিদিয়ানরা ছিল যাযাবর সম্প্রদায়। তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে বেড়াত। এই সেই মিদিয়ান সম্প্রদায়, যাদের বণিকরা ইউসুফ নবীকে কূপের মধ্যে থেকে উদ্ধার করে মিশরে নিয়ে যায় এবং ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে। হযরত মুসার সময়ে তাদের মূল ভূখন্ড ছিল সিনাই উপত্যকার উত্তর পূর্বে এবং আমেলাকাইটের (Amalekite) এর পূর্বে অবস্থিত। হযরত মুসার তত্ত্বাবধানে ইসরাঈলীরা তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা তাদের রাজাকে হত্যা করে, জনসাধারণের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে, তাদের পশু সম্পদ হস্তগত করে। [Num xxxi 7-11] আপতঃ দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল যে সেটাই বুঝি ছিল মিদিয়ানদের রোজ কেয়ামত বা পৃথিবীতে তাদের স্থায়িত্বকালের শেষ। কিন্তু কয়েক প্রজন্মের পরেই এই মিদিয়ানরা এত শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয় যে, তারা ইসরাঈলীরের যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দী করে এবং ইসরাঈলীদের প্রায় সাত বছর তাদের পরাধীন করে রাখে। মিদিয়ানদের সাথে ইসরাঈলীদের কয়েকবার সংঘর্ষের কথা তাদের ধর্মগ্রন্থে আছে। কিন্তু সে সব ক্ষেত্রে মাদিয়ান নামে কোনও শহরের উল্লেখ নাই। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় 'আকাবা' উপসাগরের পূর্বে মাদিয়ান নামে একটা শহরের উপস্থিতি। এই শহরটির উল্লেখ আছে Jesephus, Ensebins and Ptolemy দ্বারা। (Encyclopaedia of Islam)। তার পরে তা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায়। মুসলমানদের রাজত্বকালে এই শহরের পুণর্ভাব ঘটে; কিন্তু সে সময়ে তার অধিবাসীরা ছিল ভিন্ন। মিদিয়ানরা ইতিহাস থেকে চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায়।
১০৫৪। শোয়েব ইহুদী না আরব ছিলেন ? এ সম্বন্ধে মতভেদ আছে। অনেকেই হযরত মুসার শ্বশুর জেথ্রো [Jethro] ও শোয়েব নবীকে সমসাময়িক বলে সনাক্ত করেন। কিন্তু এর স্বপক্ষের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ জেথ্রোর বক্তব্যকে সমর্থন করতে হলে ঘটনার ধারাবাহিকতার সাথে ক্রমপঞ্জি মেলানো শক্ত দেখুন [টিকা-১০৬৪]। কারণ বহু তফসীরকারই মন্তব্য করেন যে, শোয়েব নবী ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের চতুর্থ অধঃস্তন বংশধর, শোয়েব ছিলেন মাদিয়ানের প্রপৌত্র। মাদিয়ান ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের পুত্র। হযরত ইব্রাহীম থেকে প্রায় শত বর্ষ পরে তাঁর জন্ম। হীব্রু বাইবেল হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মুসার মধ্যে ব্যবধান ছয়শত বৎসরের ইতিহাস বলে বর্ণনা করেছে। হযরত ইব্রাহীম ও শোয়েবের মধ্যে পার্থক্য একশত বৎসর এবং হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মুসার মধ্যে পার্থক্য ছয়শত বৎসর। সুতরাং জেথ্রো (যিনি হযরত মুসার শ্বশুর) ও শোয়েব সমসাময়িক হতে পারেন না। জেথ্রো ছিলেন একজন মিদিয়ান সম্প্রদায়ের লোক, যার অন্য আর এক নাম ছিল হোবাব [Hobab], যার উল্লেখ আছে হযরত মুসার শ্বশুর রূপে [Num x 29] মিদিয়ান হওয়ার কারণেই শোয়েবকে তার সাথে সমসাময়িকরূপে কল্পনা করা হয়। সুতরাং যেহেতু শোয়েব নবীর সময়ে যখন মিদিয়ানদের জনপদ ধ্বংস হয়, তখন একথা ভাবার অবকাশ নাই যে মিদিয়ানদের সকল সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মিদিয়ানদের যে সম্প্রদায় বিভিন্ন জায়গায় বিচরণশীল ছিল তারা ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়। শোয়েব মিদিয়ানদের যে সম্প্রদায়ের সাথে অবস্থান করতেন তারা তাদের পাপের দরুন সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হয় [৭ : ৯১]।
হযরত ইব্রাহীমের শত বর্ষ পরে মিদিয়ানেরা অবশ্যই বহু বৃদ্ধি পায় এবং বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। শতবর্ষ পরে শোয়েব নবীর আবির্ভাব ঘটে, তবে এ কথা অনুমান করা শক্ত নয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিদিয়ানেরা বংশ বৃদ্ধি লাভ করে বহু সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছিল। তাদেরই একটি সম্প্রদায় হযরত শোয়েবের সময়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। ধ্বংসের পরে যে সব গোত্র জীবিত ছিল তারা শোয়েবের চার-পাঁচশত বৎসর পরে হযরত মুসার সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে অবশ্যই সংখ্যায় কম থাকার কথা নয়। হযরত মুসার সময়ে তারা ছিল যাযাবর সম্প্রদায়, দেখুন [টিকা-১০৫৩], যাদের সাথে ইহুদীদের সংঘর্ষ হয়। সুতরাং আয়কাবাসী বা অরণ্যবাসী যারা শোয়েব নবীর সময়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, তারা ও হযরত মুসার সময়ের মিদিয়ানেরা সমসাময়িক ছিল না। শোয়েব যাদের মধ্যে আল্লাহ্র বাণী প্রচার করেন সে সম্প্রদায়ের একজনও হযরত মুসার সময়ে জীবিত ছিল না। যারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল মিদিয়ানদের সেই সম্প্রদায়কে কোরানে 'আইকা' বাসী বা অরণ্যবাসী বলে সম্বোধন করা হয়েছে [২৬ : ১৭৬] আয়াতে। ইয়েমেনের সর্বোচ্চ পাহাড়ের (উচ্চতা ১১,০০০ ফুট) নাম নবী শুয়েব। এর সাথে যাযাবর মিদিয়ানদের ভৌগলিক অবস্থানের কোনও সম্পর্ক নাই। সম্ভবতঃ এই যাযাবর সম্প্রদায়ের কোনও কোনও গোষ্ঠী নিজ বাসভূমি থেকে বহু দক্ষিণ পর্যন্ত বিচরণ করতো।
১৫০৪-ক। "তোমরা সঠিক মাপ ও ওজন ঠিক ভাবে দিবে। লোকদিগকে তাদের প্রাপ্ত বস্তু কম দিবে না।" এই বাক্যটি আক্ষরিক ও আলংকারিক দু'রকম অর্থ-ই বহন করে। সমাজ জীবনে আমরা প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের উপরে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা হচ্ছে একজনের আমানত ও অন্যজনের হক। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, উকিল, কৃষক-শ্রমিক, সমাজে যে যেখানে যে পেশায় নিয়োজিত আছে প্রত্যেকেরই স্ব-স্ব পেশা জনসাধারণের জন্য আমানত স্বরূপ। এই আমানত খেয়ানত করাই হচ্ছে "মাপে কম দেওয়া।" উদাহরণঃ ডাক্তার ও তার পেশাগত জ্ঞান আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রাপ্ত নেয়ামত স্বরূপ - ডাক্তার তার আমানতকারী। কারণ যে মেধার বলে সে ঐ জ্ঞান করায়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছে সে মেধা আল্লাহ্রই দান। যেহেতু এই মেধাকে ব্যবহার করে এই জ্ঞান নিজ সাধনার দ্বারা অর্জন করতে হয় সেই কারণে অনেকেই এই জ্ঞান আহরণের পুরো কৃতিত্ব নিজেরাই গ্রহণ করে। তারা ভুলে যায় তারা শুধু আল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত আমানতকারী। আল্লাহ্ প্রদত্ত মেধা না থাকলে এই জ্ঞান সে লাভ করতো না, ডাক্তারের কাছে আন্তরিক সুচিকিৎসার দাবী হচ্ছে সাধারণ মানুষের ন্যায্য হক্। এই উদাহরণের সাহায্যে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, কেউ যদি কারও ন্যায্য হক্ থেকে বঞ্চিত করে তবে তা লোকদিগকে প্রাপ্য বস্তু "মাপে কম দেওয়ার" সমতুল্য। সমাজ জীবনে স্ব-স্ব পেশা হচ্ছে তার আমানত। এর অপব্যবহারই হচ্ছে "মাপে বা ওজনে কম দেওয়া ও লোকদের প্রাপ্য বস্তু কম দেওয়ার সমতুল্য।"
মন্তব্য : এই আয়াত বাংলাদেশের জন্য অনুধাবনযোগ্য।
১০৫৫। মিদিয়ানদের বাসভূমি ছিল এশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য সড়কের পাশে। প্রাচীন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনবান, সুশৃঙ্খল দেশ মিশর থেকে শুরু করে মেসোপোটেমিয়ামের আসেরিয়ান ও বেবীলনীয় সভ্যতার দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই বাণিজ্য পথ (ম্যাপে দেখুন)। সুতরাং এই দুই ধনবান দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধানতঃ এ সড়কই নিয়ন্ত্রণ করতো আয়াত [৭:৮৫-৮৬]। মিদিয়ানবাসীর যে সব পাপের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে তা নিম্নরূপ : (১) লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করতো। "তারা ওজনে কম দিত" কথাটি দ্বারা এই কথাকেই প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা সততা অবলম্বন করতো না। (২) "লোকদিগকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিবে না," এই বাক্যটি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মিদিয়ান বাসীরা ছিল প্রতারক। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করতো। অন্যকে ঠকানো, কাউকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি সেই সাধারণ প্রতারণার অন্তর্গত। (৩) তারা সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা ঘটাতো এবং বিবাদ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতো। (৪) যে বাণিজ্য সড়কের উল্লেখ উপরে করা হয়েছে সেই সড়কে যাতায়াতকারী বাণিজ্য বহরের উপরে তারা ডাকাতি করতো ফলে বাণিজ্য পণ্য তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সমর্থ হতো না। "তাদের ভয় দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ্র রাস্তায় তাদের বাঁধা দেয়ার জন্য প্রতিটি পথে বসে থাকবে না।" একথাটির আক্ষরিক অর্থে যারা সৎ ব্যবসায়ে নিয়োজিত তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। (৫) রূপক অর্থে এর অর্থ হচ্ছে, তারা এত জালেম ছিল যে তারা পূণ্যাত্মাদের আল্লাহ্র পথে বাঁধার সৃষ্টি করতো, এবং ধর্মকে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতো। অর্থাৎ মিদিয়ানবাসীদের ধর্ম-ব্যবসায়ী বলা চলে। উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে- যদি কেউ মসজিদ নির্মাণ করে তার কোনও গোপন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য [যেমনঃ জমি দখলের উদ্দেশ্যে] : আবার অসৎ পথে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু সেই পাপের অর্থ দান করে, ধার্মিক বা দাতারূপে পরিচিত লাভ করার জন্য বা মানুষের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য, এই ধরণের কাজকে বাইরের আবরণে সৎ কাজ মনে হলেও তা হচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীদের - ধর্মকে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। এই আয়াতে মিদিয়ান বাসীদের এইসব পাপের তালিকা পেশ করার পরে নবী শোয়েবের আবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে। শোয়েব নবী দু'ভাবে মিদিয়ানবাসীর নিকট আবেদন করেন। তিনি তাদের স্মরণ করান : (১) মিদিয়ান বাসীরা অতীতে খুব নগন্য জাতি ছিল, আল্লাহ্র অনুগ্রহ তাদের সমৃদ্ধিশালী, বৃহৎ ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করেছে। আল্লাহ্র এই বিশেষ অনুগ্রহের জন্য আল্লাহ্র প্রতি তাদের যে কর্তব্য তা কি করা উচিত নয় ? আল্লাহ্র প্রতি মানুষের কি কর্তব্য ? আল্লাহ্র প্রতি মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তাঁর আইনকে মান্য করা তার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। (২) এই প্রসঙ্গে শোয়েব নবী মিদিয়ানবাসীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, অতীতে যে সব জাতি আল্লাহ্র আইন ভঙ্গ করে পাপে নিমজ্জিত হয়েছে তাদের কি পরিণতি হয়েছিল লক্ষ্য করতে। তিনি মিদিয়ান বাসীদের অতীতের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে উপদেশ দিয়েছেন। শোয়েব নবী তার বক্তব্য শুরু করেন আল্লাহ্র উপরে প্রগাঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে। আল্লাহ্র উপরে প্রগাঢ় বিশ্বাসই হচ্ছে সমস্ত চারিত্রিক গুণাবলীর ভিত্তি। তার বক্তব্য শেষ করেছেন সতর্কবাণী উচ্চারণ করে যে, পাপের শেষ পরিণতি হচ্ছে ধ্বংস। পরের আয়াতে নবী শোয়েব আবেদন করেছেন যে, তারা সমস্ত মত পার্থক্য ও পাপের পথ পরিহার করে আল্লাহ্র কাছে ফিরে আসুক।
অনুবাদকের মন্তব্য : মিদিয়ানবাসীরা যে সব পাপে অভিযুক্ত ছিল, তার সবই বর্তমানে বাংলাদেশীদের মধ্যে বর্তমান। যদি তারা এসব পাপ থেকে নিজেকে সংশোধন না করে, তবে ঐ মিদিয়ানবাসীদের মত বাংলাদেশীদেরও ধ্বংস অনিবার্য।
১০৫৬। এই বিশ্বব্রহ্মান্ড আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। একে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ্ প্রাকৃতিক আইন (physical law) ঘোষণা করেছেন। এই আইন জড় ও জীব সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কেউই এই আইন লঙ্ঘন করতে পারে না। পৃথিবীতে মানুষের নৈতিক শৃঙ্খলার জন্যও আল্লাহ্র আইন আছে। যারা তা মানে তারা আত্মিক দিকে গুণান্বিত হয় এবং পার্থিব দিকে সমৃদ্ধশালী হয়। যারা মানে না তারা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এক এক পাপের শাস্তি এক এক রকম। মিদিয়ানবাসীদের যে পাপ তার শাস্তি স্বরূপ তারা নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও হানাহানিতে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ প্রতারণা, জালিয়াতি, অশান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য এই পৃথিবীতে যে শাস্তি তা হচ্ছে নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও বিভেদ। মিদিয়ান জাতিরাও নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও বিভেদের ফলে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। শোয়েব নবী এসেছিলেন তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ তাকে বিশেষভাবে জ্ঞান, বিবেক, ন্যায় ও সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করেছিলেন। পরবর্তী আয়াতে মিদিয়ানবাসীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে তাদের প্রত্যেকটি পাপের মূল বা শেকড় ছিল তাদের স্বার্থপরতা, অবাধ্যতা, সন্ত্রাস, আইন না মানার প্রবণতা ও অন্যায় আচরণ। স্বার্থপরতা, অবাধ্যতা, সন্ত্রাস-আইন না মানায় প্ররোচিত করে। শোয়েব নবী মিদিয়ানবাসীদের বিবেকের কাছে আবেদন করেন ভালো হওয়ার জন্য। কিন্তু যারা পাপী, যারা মোমেন বান্দাদের প্রতি অত্যাচার করতে উন্মুখ, তারা শোয়েবের কথায় কর্ণপাত করবে না, কারণ তাদের আত্মার মাঝেই এই মুশরেকীর বীজ প্রেথিত। শোয়েবকে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা বলেছিল : "আপনি যদি সত্যপন্থী হন, তবে আপনার অনুসারীরা সমৃদ্ধ হত এবং অমান্যকারীদের উপর আযাব আসত। কিন্তু তা-না হয়ে উভয় দল স্ব-স্ব অবস্থানে দিন যাপন করছে। এমতাবস্থায় আমরা আপনাকে কিভাবে সত্যপন্থীরূপে মেনে নিতে পারি ?" উত্তরে শোয়েব বললেন যে, "তাড়াহুড়া কিসের অতি সত্বর আল্লাহ্ তোমাদের ও আমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন।" শোয়েবের উপদেশ ছিল ধৈর্য্য ধারণের জন্য। এই অভিজ্ঞতা শোয়েব নবী, হযরত নূহ, হুদ, সালেহ্, লুত সবার জন্যই অতীতে প্রযোজ্য ছিল এবং এত বছর পরে সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদের (সাঃ) বেলায়ও সমভাবে প্রযোজ্য ছিল।
অনুবাদকের মন্তব্য : স্বার্থপরতা, অবাধ্যতা, আইন না মানার প্রবণতা, জাল-জুয়াচুরি ও প্রতারণা, মাপে কম দেওয়া ইত্যাদি কাজ বাংলাদেশীদের সমাজ জীবনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে - ঠিক যেমন করেছিল মিদিয়ান বাসীদের। নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে মিদিয়ান বাসীরা ধ্বংস হয়। এসব পাপের ফলে বাংলাদেশীদের মধ্যেও হানাহানি শুরু হয়েছে, যা কোরানে বর্ণিত আছে, যা অবশ্যাম্ভাবী, পরিণামে ধ্বংস অনিবার্য।
১০৫৭। এই আয়াতে বলা হয়েছে যারা অন্যায়কারী তাদের মীমাংসা আল্লাহ্ করবেন। আল্লাহ্র মীমাংসা বা বিচার এই পৃথিবীতেও হতে পারে; আবার পরকালের জন্য বিলম্বিত হতে পারে। এই পৃথিবীতে যারা পাপ করে অনেক সময়ে পাপের শাস্তি তাদের ঘিরে ধরে, আবার অনেক সময়ে দেখা যায় পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ববর্তী প্রজন্মের পাপের শাস্তি ভোগ করে। এই পৃথিবীতে পাপীদের পাপের শাস্তি হোক বা না হোক, পরকালে তারা কখনও মুক্তি লাভ করবে না। পরকালে পূণ্যাত্মারা লাভ করবে শান্তি, আর পাপীরা তাদের যন্ত্রণা ভোগ করবে।
১০৫৮। শোয়েবের হৃদয়গ্রাহী আবেদনের প্রেক্ষিতে গর্বিত অহংকারী সর্দারদের উত্তর ছিল "বের করে দাও শোয়েব ও তার অনুসারীদের জনপদ থেকে।" যখন পাপ মানুষকে ঘিরে ধরে, তখন সেখানে সত্যের আবেদন হয় নিষ্ফল। অন্যায়, অসত্য, তাদের দৃষ্টিকে এমনভাবে আকৃষ্ট করে রাখে যে তারা তাদের গোড়ামীকে মনে করে উদারতা ও ধৈর্য্যের প্রতীক। তারা তখন এভাবে কথা বলে, "আমরা অনেক সহ্য করেছি, অনেক ধৈর্য্য ধারণ করেছি আর সহ্য করা হবে না, আমাদের বাপ পিতামহের ধর্মে ফিরে এসো - আমরা মহৎ, আমরা তাহলে তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবো।" বাপ-পিতামহের ধর্ম অর্থাৎ অন্যায়, অত্যাচার, গরীবের উপর জুলুমের পথ, ধর্মের নামে প্রতারণা, জাল-জুয়াচুরি ইত্যাদি। সম্ভবতঃ যারা শোয়েবের অনুসারী ছিলেন তারা ছিলেন গরীব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি হীন। কারণ দাম্ভিক ও অহংকারী প্রধানদের উক্তি ছিল হুমকি স্বরূপ আবার একই সাথে প্রলোভন বা ঘুষ স্বরূপ। যাদের সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি কম থাকে তাদেরই এভাবে হুমকী দেওয়া সম্ভব। আবার তারা যখন বলেঃ "তোমরা যদি শোয়েবকে অনুসরণ কর তবে নিশ্চিত তোমরা ধ্বংস হবে।" [৭:৯০]। এই বাক্যটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা এই বলে প্রলোভিত করতে চাচ্ছে যে তাদের অনুসরণ করলে শোয়েবের অনুসারীরা লাভবান হবে। যদি না করে তবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এটা এক ধরণের ঘুষ বৈকি।
১০৫৯। শোয়েবের অনুসারীরা ছিলেন মোমেন ও পূণ্যাত্মা। অহংকারী প্রধানদের বক্তব্যের উত্তরে মোমেন বান্দারা যা বললেন তা এই আয়াতে বলা হয়েছে। তাদের বক্তব্য তিন ভাগে ভাগ করা যায়। (১) তোমাদের ধর্মে ফিরে আসার অর্থ তোমাদের পাপের পথ অনুসরণ করা। (২) তোমাদের পাপের পথ অনুধাবন করার পরে, আবার সে পথে ফিরে যাওয়ার অর্থ নিজের বিবেককে হত্যা করা, আল্লাহ্র বিরুদ্ধে মিথ্যা বলা। (৩) কোন হুমকী বা কোনও প্রলোভন বা কোনও ঘুষ বা পূর্বপুরুষের ধর্মের নামে বা, দেশ প্রেমের নামে কোনও কিছুতেই আমাদের স্থানচ্যুত করতে পারবে না। আমরা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল। আমরা আল্লাহ্র হুকুম পালন করি, আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সব ত্যাগ করি। ধর্মবিচ্যুতিদের ভান ও বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ কিছুই আল্লাহ্র কাছে গোপন থাকে না। আমাদের প্রতিপালকের জ্ঞান প্রত্যেক বস্তুকে পরিবেষ্টন করে থাকে।
১০৬০। "আমাদের প্রভু আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা না হলে সেখানে কোন অবস্থাতেই ফিরে যাওয়া সমীচিন নয়।" - অবশ্যই আল্লাহ্ কখনও কারও জন্য পাপের পথ নির্বাচিত করবেন না। শোয়েবের উক্তিই ছিল যে, "তোমাদের পথ থেকে আল্লাহ্ আমাদের উদ্ধার করার পর।" অর্থাৎ পাপের পথ থেকে আল্লাহ্র করুণায় উদ্ধার পাওয়ার পরে।
১০৬১। এই আয়াতের শেষাংশে শোয়েব নবী আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করেছেন তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে মীমাংসার জন্য। যারা মোমেন, যারা পূণ্যাত্মা তাদের সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ। আধ্যাত্মিক জগত হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক। এ জগত পঞ্চ ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নয়। অপরপক্ষে যারা ধর্মবিচ্যুত - তাদের জগত পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ থাকে পৃথিবীর লাভ লোকসানের মধ্যে। তাই পূণ্যাত্মা ও পাপীদের ধর্মীয় বিভেদের মীমাংসা করা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার উর্ধ্বে। দু'পক্ষই আন্তরিকভাবে স্ব-স্ব যুক্তিতর্কে বিশ্বাসী হলেও তাদের কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয় প্রকৃত সত্য কি ? প্রকৃত সত্য একমাত্র আল্লাহ্ জ্ঞাত। তাই প্রকৃত সত্যের মীমাংসাকারী একমাত্র আল্লাহ্, যিনি মানুষের সব ভুলত্রুটির উর্ধ্বে, সব অসম্পূর্ণতার উর্ধ্বে। যারা আল্লাহ্ বিশ্বাসে আন্তরিক, তারা আল্লাহ্কে মীমাংসাকারীরূপে প্রার্থনা করতে ভয় পায় না।
১০৬২। যারা অবিশ্বাসী, যারা মুশরিক তাদের বৈশিষ্ট্য এই আয়াতে ফুটে উঠেছে। যেহেতু তারা এক স্রষ্টাতে বিশ্বাসী নয়, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে, তারা সর্বদা সচেষ্ট হবে বিশ্বাসী বা মোমেন বান্দাদের তাদের মতাবলম্বী করতে। এর জন্য তারা প্রথমে মিষ্টি কথা বা নানা ধরণের প্রলোভনের জাল বুনবে বিশ্বাসীদের সামনে, এতেও যদি কাজ না হয়, তবে তারা ভয় ভীতি প্রদর্শন করতেও কুণ্ঠিত বোধ করে না। তারা 'বিশ্বাসী' বা মোমেন বান্দাদের নির্যাতন, অসম্মান, গাল-মন্দ, একঘরে করা এমনকি সম্মানজনকভাবে জীবিকা অর্জনেও বাঁধার সৃষ্টি করে। এমনকি তাদের আত্মীয়-পরিজন, সন্তান-সন্ততিরা অপমানিত হয়, অত্যাচারিত হয়। তাদের বাড়ীঘর ভেঙ্গে দেওয়া হয়, তাদের নাম ঘৃণার সাথে উচ্চারিত হয়। তাদের লোকসমক্ষে হাস্যস্পদ করা হয়, অর্থাৎ মুশরিক বা অবিশ্বাসীরা পৃথিবীতে যতরকম অত্যাচার আছে, সব ধরণের নির্যাতন, বিশ্বাসী বা মোমেন বান্দাদের উপর করে।
কিন্তু আয়াত [৭ : ৯২]-এ মোমেন বান্দাদের জন্য সুখবর আছে, আল্লাহ্ অবিশ্বাসীদের শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করে দেবেন।
১০৬৩। এই আয়াতে মিদিয়ানবাসীদের শেষ পরিণতির বর্ণনা আছে, যা সামুদ জাতিদের সম্বন্ধে [৭ : ৭৮] আয়াতে বর্ণনা আছে, ঠিক সেই একই ভাষাতে। এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করে রাতের আঁধারে। এই দুর্যোগের অংশ বিশেষ বর্ণনা করা হয়েছে আয়াত [২৬ : ১৮৯]-এ। সেখানে বলা হয়েছে, "পরে উহাদিগকে মেঘাচ্ছন্ন দিবসের শাস্তি গ্রাস করলো।" সম্ভবতঃ এভাবে এই বাক্যটির ব্যাখ্যা করা যায়। এটা ছিল একটি অগ্নুৎপাতের দরুন ভূমিকম্প। অগ্নুৎপাতের পূর্বে দিনে আকাশ ছাই-ভস্মে ছেয়ে যায় - মনে হয়েছিল যে সূর্য্য মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এর ফলে মিদিয়ানবাসীরা ভয়ে স্ব-স্ব গৃহে গমন করে এবং রাতের আধারে ভয়ংকর ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করে। এক্ষেত্রে শোয়েব নবী রক্ষা পান। সালেহ্ নবী তার সম্প্রদায়ের ধ্বংসের পরে যেভাবে আক্ষেপ করেন [৭ : ৯৩]। এই আক্ষেপের ভাষা মোটামুটি এক হলেও দুটি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। (১) শোয়েবের সম্প্রদায় মিদিয়ানবাসীর পাপ ছিল বহুবিধ [দেখুন টিকা - ১০৫৫]। কিন্তু সালেহ্ নবীর সম্প্রদায়ের পাপ ছিল একটাই - তা ছিল স্বার্থপরতা, যার দরুন তারা ছিল উদ্ধত অহংকারী, ফলে গরীবদের স্বার্থের কথা তাদের মনেও স্থান পেতো না। (২) সামুদ জাতি ছিল অত্যন্ত উন্নত সভ্যতার অধিকারী এবং এই কারণে তারা ছিল অত্যন্ত অহংকারী। এই অহংকারই ছিল তাদের পতনের কারণ।
৯৩। সুতরাং শুয়েব তাদের পরিত্যাগ করলো, এই বলে যে, "হে আমার সম্প্রদায় ! আমি তো আমার প্রভুর বাণী তোমাদের নিকট অবশ্যই পৌঁছিয়ে দিয়েছি - যে উদ্দেশ্যে আমাকে আমার প্রভু প্রেরণ করেছিলেন। আমি তোমাদের ভালো উপদেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু কিভাবে আমি তাদের জন্য শোক প্রকাশ করি যারা ঈমান আনতে অস্বীকার করেছিলা ১০৬৪।
১০৬৪। মিদিয়ানবাসীরা ঠিক কোন সময়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, তার একটি অনুমান করার জন্য এখানে আলোচনা করা হলো। সূরা [৭ : ৮৫] আয়াতের টিকা - ১০৫৩-তে মিদিয়ানবাসীদের ভৌগলিক অবস্থানের বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করলে তাদের সময়কাল সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। (১) নূহ নবী, হুদ, সালেহ, লূত, শোয়েব নবী এরা এসেছেন ধারাবাহিক ভাবে। সুতরাং শোয়েব এসেছেন হযরত ইব্রাহীমের পরে। কারণ ধারাবাহিকতায় শোয়েব লূতের পরে। আর লূত ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের ভাইয়ের ছেলে এবং হযরত ইব্রাহীমের সমসাময়িক। (২) শোয়েব ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের চতুর্থ অধঃস্তন বংশধর। [দেখুন টীকা - ১৫৯০ এবং আয়াত [১১ : ৮৯]। সুতরাং তিনি হযরত মুসার সমসাময়িক হতে পারেন না। কারণ হযরত মুসার আগমন হযরত ইব্রাহীমের ছয় শত বৎসর পরে। এই অসুবিধা সমূহ ইবনে খাতিব সহ বহু তফসীরকারগণ অনুধাবন করেন। (৩) হযরত মুসার শ্বশুর জেথ্রো ও শোয়েব সমসাময়িক এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা চলে না। দেখুন টীকা ১০৫৪ এবং আয়াত [৭ : ৮৫]। (৪) শোয়েব অবশ্যই হযরত মুসার বহু পূর্বে ছিলেন। দেখুন [৭ : ১০৩]। (৫) মিদিয়ান সম্প্রদায়, যারা হযরত মুসা এবং গিডিয়ান (Giddeon) দ্বারা পরাজিত হয়, তারা ছিল মূল মিদিয়ানদের বংশধর। যারা শোয়েবের সময়ে ঐ মহা ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়, কিন্তু জাতি হিসেবে তাদের আবাসভূমি সহ তাদের মূল অংশ ধ্বংস প্রাপ্ত হয় হযরত মুসার বহু পূর্বে। এ কথাই কোরানে এভাবে বলা হয়েছে, "মনে হলো, শোয়েবকে যারা প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল, তারা যেন কখনও সেখানে বসবাস করে নাই।" দেখুন আয়াত [৭ : ৯২]। (৬) যোশেফাস, ইউসিবিয়াস, এবং টলেমি তাদের লেখায় মাদিয়ান শহরের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তা কোনও গুরুত্ব বহন করে নাই। (৭) খৃষ্টাব্দের প্রথম শতাব্দী অতিক্রমের পরে মাদিয়ান শহরের কোনও গুরুত্বই ছিল ন।
রুকু - ১২
১০৬৫। জন্মসূত্রে প্রতিটি মানুষের আত্মা পূত ও পবিত্র। পৃথিবীর প্রতিদিনের জীবন যাত্রা প্রণালীতে, লোভ, হিংসা প্রভৃতি তাকে দূর্নীতি, অন্যায় ও অসত্যের পথে চালিত করে। ফলে তার আত্মা হয় কলুষিত। এই কলুষকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহ্ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনপদে নবী ও রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। যারা এই সব নবী ও রাসূল ও তাঁদের অনুসারী, তারা আল্লাহ্র পথে, দূর্নীতি, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। যখন কোনও সম্প্রদায় আল্লাহ্র বিধান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তখন সেই সমাজে অন্যায় ও দূর্নীতি বিরাজ করে। সমাজের ভারসাম্য হয় নষ্ট, ফলে পুরো সমাজের অধিবাসীবৃন্দ অর্থ কষ্ট ও দুঃখ ক্লেশে নিপতিত হয়। যদি তারা তাদের পাপকে স্বীকার করে এবং তা সংশোধন করে বিনয়ের সাথে আল্লাহ্র ক্ষমা ভিক্ষা করে, তবেই তারা মুক্তি পেতে পারে।
মন্তব্য : মিদিয়ানবাসীরা যে সব পাপে অভিযুক্ত ছিলো আজকের বাংলাদেশের জনসাধারণ সেই পাপে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সুতরাং তাদেরও সংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করা উচিত।
১০৬৬। আল্লাহ্ পাপীদের অনুতাপের জন্য প্রচুর সুযোগ ও সময় দান করেন। কিন্তু যারা পাপী তারা এই সুযোগ গ্রহণ করে না। দুঃখ কষ্ট বা সমৃদ্ধি কোনও কিছুই তাদের পাপের পথ থেকে বিরত করতে পারে না। আল্লাহ্ তাদের দুঃখ কষ্ট বা প্রাচুর্য্যের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে চান, ধৈর্য্য, বিনয়, কৃতজ্ঞতা এবং জীবে দয়া। কিন্তু পাপীরা আল্লাহ্র শিক্ষাকে গ্রহণ করে না। তারা দুঃখ বেদনা, বা সমৃদ্ধি প্রাচুর্য সবই নিয়তি বা ঘটনাচক্রের ফল বলে মনে করে। তারা বিষয়টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করে, "আমাদের পূর্ব পুরুষগণও তো দুঃখ-সুখ ভোগ করেছে। আমাদের সন্তানেরাও এভাবেই জীবন যাপন করবে।" পৃথিবী এভাবেই সর্বদা আবর্তিত হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? তবে আল্লাহ্র অমোঘ শাস্তি কি ?
৯৭। জনপদের অধিবাসীরা কি নিরাপদ বোধ করে আমার ক্রোধ থেকে, যখন রাত্রিতে তারা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকবে ? ১০৬৭।
৯৯। তারা কি আল্লাহ্র পরিকল্পনার বিরুদ্ধে নিরাপদ বোধ করে ? কিন্তু ধ্বংসের জন্য [দণ্ডপ্রাপ্ত] ব্যতীত অন্য কেউ আল্লাহ্র কৌশল থেকে নিরাপদ মনে করে না ১০৬৮।
১০৬৮। এই আয়াতটির দ্বারা সেই সব নবীদের কাহিনী শেষ করা হয়েছে, যারা স্বজাতির দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা শত বাধা বিপদ সত্বেও আল্লাহ্র রাস্তা ত্যাগ করেন নাই, বরং দৃঢ়ভাবে আল্লাহ্র বাণী প্রচার করে গেছেন। এসব জাতিরা তাদের নবীদের প্রত্যাখ্যানের ফলে আল্লাহ্র ক্রোধে নিপতিত হন, কিন্তু নবীদের ক্ষুদ্র অনুসারী দল আল্লাহ্র ক্রোধ থেকে নিষ্কৃতি পান। কোরানের বর্ণনা অনুযায়ী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধ্বংসের কারণ ছিল তাদের বিভিন্ন পাপকার্য। হযরত নূহ্ এর সম্প্রদায় ধ্বংস হয়, কারণ তারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য উপাস্যের আরাধনা করতো, "আদ" জাতি ধ্বংস হয় কারণ তারা ছিল উদ্ধত অহংকারী ও শক্তি মদমত্ত। সামুদ জাতি ধ্বংস হয় কারণ তারা গরীবের উপরে অত্যাচার করতো, গরীবকে শোষণ করতো, গরীবদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো। লূতের সম্প্রদায় ধ্বংস হয় কারণ তারা ছিল সমকামী ও ব্যভিচারী। মিদিয়ানবাসীরা ধ্বংস হয় কারণ তারা ছিল প্রতারক, অন্যকে ঠকাতো, জাল-জুয়াচুরি করতো, সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতো। প্রত্যেক জাতির পাপের ধরণ ছিল আলাদা আলাদা কিন্তু তা সবই ছিল আল্লাহ্র বিধানের পরিপন্থি। জাতি যত শক্তিশালীই হোক না কেন আল্লাহ্র বিধান লঙ্ঘনকারীর ধ্বংস অনিবার্য। কারণ আল্লাহ্র পরিকল্পনা কার্যকর হবেই।
১০৬৯। পূর্ববর্তী আয়াতগুলিতে যে সব কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে, তা করা হয়েছে বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের সাবধান করার জন্য। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বংশধররা যেন অতীতের এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাদের সাবধান করা হয়েছে যে, যদি তারা ঐ একই পাপের পুনরাবৃত্তি করে, তবে তাদেরও ধ্বংসের পরিণতি হবে পুনরাবৃত্তি। অবশ্য যারা পাপে আসক্ত হয়, তাদের হৃদয়ে সাবধান বাণী বা ভালো উপদেশ গ্রহণের ক্ষমতা হয়ে যাবে লুপ্ত। তারা কোনও উপদেশেই কর্ণপাত করবে না।
১০৭০। সংসারে দু'ধরণের লোক থাকে। এক ধরণের লোক যারা সৎ পথের সন্ধান পায় না কারণ হয়তো পরিবেশগত। ফলে এসব লোকেরা ইচ্ছাকৃত ভাবে সৎ পথকে পরিহার করে না। আর এক ধরণের লোক থাকে যারা সত্য পথের সন্ধান জানে, কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থের অন্ধ মোহে বা অহংকার উদ্ধতপনার বশে অবাধ্য হয় এবং সত্যপথে চলতে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক, যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে সত্য পথকে ত্যাগ করে, তাদের অন্তরের উপরে আবরণ পড়ে যায়। কোনও অবস্থাতেই সেখানে সত্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। আল্লাহ্র বাণীর মাধুর্য্য তারা গ্রহণে হয় অক্ষম। কারণ পাপ কাজ তাদের অন্তরে আল্লাহ্র করুণা প্রবেশের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়। তাদের অন্তর হয়ে যায় কঠিন থেকে কঠিনতর। অন্তরের এই কঠিন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় আল্লাহ্র সাথে মানুষের যে অঙ্গীকার তা লঙ্ঘন করার মাধ্যমে। আল্লাহ্র সাথে মানুষের অঙ্গীকার হচ্ছে ঈমান ও নৈতিক মূল্যবোধের, মানুষ আল্লাহ্র বিধান সমূহ মেনে চলবে। কিন্তু যখন কেউ সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র বিধান বা আইন অমান্য করে তখন তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। প্রতিটি পদক্ষেপে সে ক্রমান্বয়ে পাপের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। ক্রমান্বয়ে পাপের আসক্তির ফলে শেষ পর্যন্ত তার হৃদয় ভালোকে গ্রহণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আত্মার এই অবস্থাকেই এখানে বলা হয়েছে যে, "আল্লাহ্ কাফিরদের হৃদয় মোহর করিয়া দেন।"
১০৩। তাদের পরে, ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের নিকট মুসাকে আমার নিদর্শনসহ প্রেরণ করি। কিন্তু তারা অন্যায়ভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং দেখ, যারা বিপর্যয় সৃষ্টি করে তাদের কি পরিণাম হয়।
১০৪। মুসা ১০৭১ বলেছিলো, "হে ফেরাউন ! আমি তো জগতসমূহের প্রভুর প্রেরিত দূত ১০৭২।
১০৭১। হযরত মুসার কাহিনী কোরানের বহু স্থানে বর্ণিত হয়েছে। আপতঃ দৃষ্টিতে মনে হবে হযরত মুসার কাহিনী বারে বারে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে বিভিন্ন সূরায় হযরত মুসার বর্ণনা প্রসঙ্গে তার কার্যকলাপের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন আয়াতে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছে। সূরা [২ : ৪৯-৭১] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে ইহুদীদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ, তাদের ঐতিহ্য, মানুষের ধর্মীয় ইতিহাসে তাদের স্থান, তাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ এবং কিভাবে তারা আল্লাহ্র সেই অনুগ্রহ হারায় সেই কাহিনী। এই সূরাতে হযরত মুসার কাহিনীর সমান্তরালভাবে হযরত মুহম্মদের (সাঃ) ধর্ম প্রচারের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এই দু'জন ধর্ম প্রচারক আল্লাহ্র আইনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিভাবে নিম্নলিখিত প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তার বর্ণনা আছে। তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, (১) বিদেশী শত্রু, যারা ছিল উদ্ধত, অত্যাচারী, কাফের এবং কুসংস্কারচ্ছন্ন এবং (২) স্বজাতির মধ্যে শত্রু। এই দু'জন ধর্ম প্রচারককে এই দু'ধরণের শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী হতে হয়। হযরত মুসার বেলায় বিদেশী ও দেশী শত্রু ছিল ফেরাউন এবং মিশরবাসীরা। এরা সর্বদা তাদের প্রাচীন এবং উন্নত সভ্যতার জন্য গর্বিত ও অহংকারী ছিল। হযরত মুহম্মদের (সাঃ) সময়ে বিদেশী শত্রু ছিল সমসাময়িক ইহুদী ও খৃষ্টানেরা। হযরত মুসা তার অনুসারীদের বিদ্রোহ সত্বেও তাদের মিশরের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন এবং আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত দেশে (land of promise) তাদের নিয়ে প্রায় পৌঁছেছিলেন। কিন্তু ইহুদীদের অবাধ্যতার কারণে শেষ পর্যন্ত তা সফল করতে পারেন নাই। অপর পক্ষে মুহম্মদ (সাঃ) তার প্রদত্ত কার্য সফলভাবে সমাপ্ত করতে সক্ষম হন। হযরত মুহম্মদের (সাঃ) চরিত্রের দৃঢ়তা, গুণাবলী এবং সর্বোপরি আল্লাহ্র সাহায্যে তিনি সকল বাধা-বন্ধন অতিক্রম করতে সক্ষম হন। এই সূরাটি নাজেল হয় মক্কায়। মুহম্মদ (সাঃ) তার জীবদ্দশাতেই তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সফলভাবে শেষ করে যেতে পারেন।
১০৭২। আরবী 'Fir aun' শব্দের পরিভাষা হচ্ছে ফারাও। এটা একটা রাজকীয় উপাধি। এটা কোনও নির্দিষ্ট মিশরের রাজার নাম নয়। প্রাচীন মিশরের সভ্যতার উষালগ্নে, মিশরে যে রাজারা রাজত্ব করতেন তাদেরকে ফারাও বা ফেরাউন বলা হতো। প্রশ্ন হলো, হযরত মুসার সময়ে মিশরের রাজসিংহাসনে কোন ফারাও রাজত্ব করতেন ? গবেষণালব্ধ ফলাফল হতে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে, হযরত মুসার সময়ে যে ফারাও ছিলেন তিনি ছিলেন ১৮শ ডাইনেষ্টি বা রাজবংশ। প্রাচীন মিশরে ত্রিশটি রাজবংশ রাজত্ব করেন। এদের রাজত্বকাল ছিল প্রায় তিন হাজার বছর। ১৮শ রাজবংশের যে ফারাও ছিলেন তার সময়ে মুসার আবির্ভাব সম্ভবতঃ তার নাম ছিল Thothmas ও (তুতমাস-১)। রাজত্বকাল ছিল ১৫৪০ খৃষ্টপূর্ব।
১০৭৩। লক্ষ্য করুণ, হযরত মুসা ফেরাউনকে সম্বোধন করেছিলেন এই বলে যে তিনি দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন "তোমাদের প্রভূর নিকট থেকে।" এখানে হযরত মুসা কিন্তু বলেন নাই শুধুমাত্র "তাঁর প্রভু" বা "তাঁর জনগণের প্রভু।" এই আয়াতটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন এই কারণে যে এই আহ্বানের মাধ্যমে হযরত মুসার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল। সারা জাহানের মালিক একমাত্র আল্লাহ্। কোরানের মূল মর্মবাণী এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। তাওরাতের বক্তব্যের (Old testament) সাথে কেরানের বক্তব্যের পার্থক্য এখানেই। তাওরাতে বলা হয়েছে "The Lord, God of the Hebrews" অর্থাৎ হিব্রুদের আল্লাহ্। ইহুদীরা ছিল হিব্রুভাষী সেই কারণে একচেটিয়া তাদের আল্লাহ্ বলে তাওরাতে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু জগত সংসারের প্রতিপালক ও স্রষ্টা একজনই - তিনি আস্তিক, নাস্তিক, ফেরাউন, হিব্রু ইত্যাদি সকলেরই স্রষ্টা, সকলেরই পালন কর্তা। এটাই হচ্ছে কোরানের মূল মর্মবাণী। কোরানের মূল মর্মবাণী বিভিন্ন কাহিনীর মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহীরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি কাহিনীতেই গল্পচ্ছলে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন- কিতাবী জাতিদের ধর্মগ্রন্থে ইউসুফ নবীর গল্পকে প্রেমের গল্পরূপে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু কোরানের গল্পে এর ব্যাখ্যা নিম্নরূপ : ইউসুফ নবীর কারাভোগের অবসান ও মিশরের প্রধান মন্ত্রীত্ব লাভের মাধ্যমে (১) তার অসৎ ও দুষ্ট ভাইরা যারা ইউসুফ নবীকে কূপের মধ্যে নিক্ষেপের মাধ্যমে দাসত্বের জীবনে বাধ্য করে, তাদের জন্য একটি শিক্ষণীয় অধ্যায় ছিল : "আল্লাহ্ যার রক্ষাকর্তা তার কোনও ভয় নাই।" (২) তাঁর স্বগোত্রের জন্য শিক্ষা ছিল, যখন তারা দূর্ভিক্ষ কবলিত হয়ে মিশরে আসে এবং ইউসুফ নবী কর্তৃক সম্বর্ধিত হয়। (৩) মিশর বাসী, যারা তাদের সভ্যতার গর্বে ছিল অহংকারী ও উদ্ধত, তাদের জন্য শিক্ষণীয় ছিল হযরত ইব্রাহীমের ধর্মের মাধুর্য্য। ইউসুফ নবীর পরে কয়েক শতাব্দী গত হয়ে যায়। ইসরাঈলীরা মিশরে অত্যন্ত সমৃদ্ধি লাভ করে, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মিশরবাসী ও ইসরাঈলীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাধে এবং মিশরবাসীরা আবার তাদের সমৃদ্ধি ফিরে পায় এবং ইসরাঈলীদের পদদলিত করে তাদের উপরে নির্যাতন শুরু করে। হযরত মুসার কাহিনীতে দেখি (ক) আল্লাহ্ হযরত মুসাকে ইসরাঈলী হওয়া সত্বেও মিশরবাসীদের সকল জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দান করেন। সে সময়ে ইসরাঈলীরা মিশরের ফেরাউনের অধীনে দাসত্বের জীবন যাপন করেছিল। সেখানে আল্লাহ্র কুদরতে হযরত মুসা ইহুদী হওয়া সত্বেও তাকে মিশরবাসীদের সর্বোচ্চ জ্ঞান আহরণের সুযোগ দেন। (খ) তিনি তার সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করেন। (গ) তাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন এবং মিশরের বাইরে স্বাধীন পৃথিবীতে তাদের অধিষ্ঠিত করেন। এখানে ইসরাঈলীরা তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি করে, যার চরম পরকাষ্ঠা ঘটে - দাউদ নবীর প্রার্থনা সঙ্গীতে এবং রাজা সোলায়মানের সুবর্ণ রাজত্বকালে। ইসলামিক গল্পের এই হচ্ছে সারমর্ম।
১০৭৪। এই আয়াতগুলিতে যে কথোপকথনের উল্লেখ আছে, তা থেকে ফেরাউন ও হযরত মুসার মানসিকতার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। ফেরাউন তার রাজ দরবারে পরিষদ বর্গ দ্বারা পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। ঐশ্বর্য্য, শক্তি ও দম্ভে পৃথিবীর সব কিছুই তার কাছে তুচ্ছ। ফেরাউন ও তার সঙ্গীরা দম্ভে ও অহংকারে এত উদ্ধত হয়েছিল যে, তারা হযরত মুসার আহ্বানকে ধৃষ্টতা ব্যতীত আর কিছুই কল্পনা করে নাই। তারা তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে মনে করতো তাদের নিজস্ব কৃতিত্ব, ধর্মের ব্যাপারে তারা যাদুবিদ্যার উপরে ছিল নির্ভরশীল। যাদের এত ঐশ্বর্য্য, শক্তি, লোকবল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেছে মাত্র দু'জন লোক। একজন হচ্ছেন মুসা নবী, যিনি আল্লাহ্র প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহ্ কর্তৃক দায়িত্ব প্রাপ্ত, অন্যজন তাঁর ভাই হারুন যে তাঁর সহকারী। তাঁদের না আছে ঐশ্বর্য্য, না আছে ক্ষমতা, না আছে লোকবল। কিন্তু তাঁরা কর্তব্যে অটল, কারণ তাঁরা জানেন তাঁদের ক্ষমতার উৎস ঐশ্বরিক। স্বয়ং আল্লাহ্-ই হচ্ছেন তাঁদের ক্ষমতার উৎস। হযরত মুসা প্রথমে মিশরবাসীদের মনের উপরে আল্লাহ্র ক্ষমতা সম্বন্ধে প্রভাব বিস্তার করেন। আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে যাদুকরদের যাদুবিদ্যা অত্যন্ত নগন্য।
১০৭৫। প্রাচীন মিশরে সাপের স্থান ছিল অত্যন্ত উচ্চে। প্রাচীন মিশরবাসীরা সাপকে পূঁজা করতো। সুতরাং মিশরের পৌরণিক কাহিনীতে 'সাপ' একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সূর্যদেব 'রা' (Ra) যুদ্ধ করে সর্পদেব অ্যাপোফিস (Apophis) এর উপরে জয় লাভ করে। সর্প হচ্ছে অন্ধকারের জীব এর অর্থ অন্ধকারের উপরে আলোর বিজয়। মিশরের পৌরণিক কাহিনীতে বর্ণনা আছে যে অনেক দেব-দেবী শত্রুর মনে ভয় সৃষ্টি করার জন্য সাপের মূর্তি ধারণ করতো। সাপের ব্যাপারে মিশরবাসীদের মানসিক প্রভাব পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। সুতরাং মুসা নবীর লাঠি যখন সাপে পরিণত হয়, তা তৎক্ষণাত মিশরবাসীদের মনে প্রভাব বিস্তার করে। এতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মনে যে আক্রোশ ও ঘৃণার ভাব বিরাজ করেছিল মুসা নবী সম্পর্কে, তা ভয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ভয় এই কারণে যে মুসা হচ্ছেন সে রকম এক ব্যক্তি যিনি তার লাঠিকে সর্প দেবতাকে পরিণত করতে পারেন, যাদের নিয়ন্ত্রণ করা তাদের সূর্যদেব 'রা' (Ra) এর পক্ষেও কষ্টকর।
১০৭৬। হযরত মুসা যে দ্বিতীয় মোজেজা প্রদর্শন করেন তা ছিল আরও চমকপ্রদ ও আশ্চর্যজনক। তিনি তার কাপড়ের মধ্যে থেকে তাঁর হাত বের করেন - সে হাত ছিল আশ্চর্যজনক শুভ্র উজ্জ্বল। আশ্চর্যজনক এই জন্য যে, সে হাত থেকে স্বর্গীয় আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। সাপ ছিল মিশরীয়দের অন্ধকার দেবীর প্রতীক - অর্থাৎ মন্দ বা কুপ্রভাবের মালিক। হযরত মুসার লাঠিকে সাপে রূপান্তর দ্বারা যদি কারও মন মন্দের শক্তি সম্বন্ধে প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং এ ধারণা পোষণ করে যে, মুসাই হচ্ছেন সেই শক্তির বাহক, এই মিথ্যা ভ্রান্ত ধারণা যেন কেউ পোষণ না করে সেই কারণে স্বর্গীয় জ্যোতি বিচ্ছুরিত হাত দ্বারা সেই ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করা হয়েছে। লাঠি সাপে রূপান্তর কোনও যাদু ছিল না, বা ছিল না কোনও অপকৌশল। জ্যোতির্ময় সাদা হাত কোনও যাদুর বিষয় ছিল না। কোনও যাদুকরের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, সুতরাং জ্যোতির্ময় হাতের যিনি অধিকারী তিনি যাদুকর হতে পারেন না। তার লাঠি সাপে রূপান্তরও যাদুর প্রভাবে হতে পারে না। মুসলিম সাহিত্যে "শুভ্র উজ্জ্বল হাত" একটি প্রবাদ বাক্যের মত চালু হয়ে গেছে - স্বর্গীয় উজ্জ্বল আলোককে প্রতীক অর্থে এই বাক্যকে ব্যবহার করা হয়।
১১০। "এর পরিকল্পনা হচ্ছে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করে দেয়া। এ ব্যাপারে তোমাদের পরামর্শ কি ?" ১০৭৭।
১১২। "[আমাদের] সকল সুদক্ষ যাদুকরদের এবং তাদের তোমার নিকট উপস্থিত করার জন্য" ১০৭৮।
১০৭৮। ফেরাউনের সভা পরিষদেরা হযরত মুসার অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের ভুল ব্যাখ্যা দান করে। যথারীতি পার্থিব জীবনের প্রতি যাদের আসক্তি প্রবল, সর্বক্ষণ হারাবার ভয়ে তারা থাকে শঙ্কিত। তারা মুসার স্বর্গীয় অলৌকিক কার্যাবলীতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের ক্ষমতার ভিত্তি ছিল পুরোহিত ও যাদুকরদের যাদু বিদ্যা। তাদের ভয় হলো হয়তো বা হযরত মুসা তাদের ক্ষমতার এই ভিত্তিতে আঘাত হেনে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। সুতরাং তারা ফেরাউনকে পরামর্শ দিল যে, রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী যাদুকরদের সমবেত করা হোক মুসাকে অপদস্ত করার জন্য। "নগরে নগরে লোক পাঠাও সংগ্রহ করার জন্য।"- এই লাইনটির অর্থ হচ্ছে যাদুকরদের সংগ্রহ করার জন্য লোক পাঠাও। তাহলে তারা তাদের ক্ষমতার ভিত্তি অটুট রাখতে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যে যে সময়টুকু পাওয়া যাবে সে সময় মুসা ও তাঁর ভাই হারুনকে "অবকাশ দাও।" তাঁদের নিকট আত্মসমর্পণও নয় বা তাদেরকে বাঁধাও না দেওয়া। অর্থাৎ ফেরাউন ও তাঁর লোকেরা তাদের কার্যপ্রণালী স্থির করার জন্য সময় নিচ্ছিল। আল্লাহ্র নবীর কোন উদ্বেগ ছিল না, কারণ তিনি জানেন সত্য প্রকাশের জন্য সর্বদা সময়ের প্রয়োজন। যা মিথ্যা - তা প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে দিলেও সময়ের ব্যবধানে সত্য তার নিজস্ব আলোয় উদ্ভাসিত হবেই, সত্য প্রকাশ হবেই।
১০৭৯। ফেরাউনের দরবারে বিশিষ্ট যাদুকরদের আগমন ঘটে। তাদের যাদুবিদ্যার প্রধান উপায় ছিল অপকৌশল ও প্রতারণা। যেহেতু তাদের জীবন, ধর্ম ও জীবনবোধ প্রতিষ্ঠিত ছিল প্রতারণা ও অসত্যের উপরে। তাই পার্থিব আকর্ষণ তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ছিল অত্যন্ত প্রবল। তাই কাজে নামার পূর্বেই তারা পুরষ্কারের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে চেয়েছে, "আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো ?" এ কথা সে যুগের প্রতারক অপকৌশলধারী যাদুকরদের জন্য যেরূপ প্রযোজ্য ছিল ঠিক সমভাবে এত বছর পরেও সকল প্রতারক ও অপকৌশলধারীদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এরা সর্বদা পার্থিব লাভের কথা চিন্তা করে। ফেরাউন যাদুকরদের শুধু যে আর্থিক পুরস্কারের আশ্বাস দিলেন তাই-ই নয়, তিনি বললেন যে, যদি এই অত্যাচার্য মানুষটিকে তারা অপদস্ত করতে পারে, তবে যাদুকরদের ফেরাউন সর্বোচ্চ সম্মান দান করবেন, তার একান্ত সভাষদরূপে তাদের গ্রহণ করা হবে।
১১৫। তারা বলেছিলো, "হে মুসা, তুমি কি [প্রথমে] নিক্ষেপ করবে, অথবা আমরা [প্রথমে] নিক্ষেপ করবো ?"
১১৬। মুসা বলেছিলো, "তোমরা [প্রথমে] নিক্ষেপ কর।" সুতরাং তারা যখন নিক্ষেপ করেছিলো তারা লোকের চক্ষুকে যাদুর দ্বারা বশ করলো, এবং তাদের মাঝে আতংকের সৃষ্টি করলো। তারা এক বিশাল [কৃতিত্বপূর্ণ] যাদু প্রদর্শন করলো ১০৮০।
১০৮০। মিশরের সর্বোচ্চ যাদুকরেরা মুসা ও হারুণকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেছিল। কিন্তু মুসা ও হারুন এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নাই। তারা ছিলেন ধীর, স্থির ও অবিচল। প্রথমে যাদুকরদের তাদের যাদু দেখাতে বলা হলো। যথারীতি যাদুকরদের যাদু উপস্থিত দর্শকের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটালো এবং তাদের মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করলো। কিন্তু হযরত মুসা যখন তাঁর লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করলেন, তখন সকলের দৃষ্টিভ্রম দূর হলো। হযরত মুসার লাঠি বড় সাপে রূপান্তরিত হয়ে, যাদুকরদের সাপগুলিকে গিলে খেয়ে ফেললো। অর্থাৎ তাদের প্রতারণা ও অপকৌশল সমূহ সত্য দ্বারা বিদূরিত হলো। তওরাতে কাহিনীটি একটু ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে [Exod vii. 10-12]। সেখানে সালংকারে বর্ণনা করা হয়েছে যে, লাঠি প্রথমে নিক্ষেপ করেন মুসার ভাই হারুন, পরে নিক্ষেপ করে যাদুকরেরা। হারুনের লাঠি যা সাপে রূপান্তরিত হয় তা যাদুকরদের সাপদের গিলে ফেলে। কোরানের গল্প একটু অন্যরকম। কোরানে বলা হয়েছে যে মুসা যাদুকরদের প্রথমে লাঠি ছুঁড়তে বলেন - অর্থাৎ কোরান শরীফে বলা হয়েছে যে মুসা যাদুকরদের প্রথমে তাদের অপকৌশল ও প্রতারণা প্রদর্শন করতে বললেন। পরবর্তীতে মুসার ধৃত সাধারণ লাঠি যা পশু চারণের জন্য ব্যবহৃত হতো তা সাপে পরিবর্তিত হয়ে যাদুকরদের সাপগুলিকে গিলে খায়। বুঝানো হয়েছে আল্লাহ্র করুণায় মুসা অসত্যকে দূর করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এটা হচ্ছে প্রতীক ধর্মী। যাদুকরদের যাদু ছিল অসত্য ও প্রতারণার প্রতীক আর মুসার লাঠি ছিল সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। অন্যায় ও অসত্য সর্বদা সত্য দ্বারা বিদূরিত হবেই। "এ ভাবেই সত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন হলো, এবং তারা যা করেছিলো, তার কোনই প্রভাব রইল না" [৭ : ১১৮]।
১১৮। এভাবেই সত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন হলো, এবং তারা যা করেছিলো তার কোনই প্রভাব রইল না।
১১৯। সুতরাং [যাদুকরের প্রধানগণ] তৎক্ষণাত পরাভূত হলো, এবং ক্ষুদ্র বলে প্রতিপন্ন হলো ১০৮১।
১০৮১। ফেরাউন ও তার সভাষদরা ছিল অত্যন্ত অহংকারী ও কঠিন হৃদয়। যাদুকরদের প্রতারণা ও অপকৌশল যখন সর্বসমক্ষে প্রকাশ পেয়ে গেলো তখন ফেরাউনের সঙ্গীরা লজ্জা পাওয়ার পরিবর্তে প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠলো। অপরপক্ষে যাদুকরেরা, যাদের ফেরাউন ও তার সঙ্গীরা দাবার গুটি স্বরূপ ব্যবহার করেছিল, তাদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা বুঝতে পেরেছিল যে মুসার অলৌকিক কর্মকান্ড কোনও প্রতারণা বা যাদু নয়। তাদের বিবেক হয়েছিল জাগ্রত, তারা সর্বশক্তিমানের অস্তিত্ব অনুধাবনে সক্ষম হয়েছিল। সুতরাং তারা সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রতি ঈমান এনে তাঁর প্রতি ভূলুণ্ঠিত হয়ে সেজাদারত হলো।
১২১। [তারা] বললো, "আমরা জগত সমূহের প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।
১২২। "যিনি মুসা ও হারুণের প্রভু।"
১২৩। ফেরাউন বলেছিলো, "আমি তোমাদের অনুমতি দেবার পূর্বেই তোমরা তাঁকে [আল্লাহ্কে] বিশ্বাস করলে ? অবশ্যই এটা এক ধরণের প্রতারণাপূর্ণ কৌশল যা তোমরা নগরবাসীদের বিতাড়িত করার জন্য পরিকল্পনা করেছ। কিন্তু শীঘ্রই তোমরা এর [পরিণতি] জানতে পারবে ১০৮২।
১০৮২। ফেরাউন ও তার সভাষদদের ক্রোধের কারণ ছিল দ্বিবিধ। প্রথমতঃ তাদের নিয়োজিত যাদুকরেরা সর্বসমক্ষে পরাজয় বরণ করায় প্রকারন্তে তা ছিল ফেরাউনেরই পরাজয়। দ্বিতীয়তঃ যাদের ফেরাউন মুসার আল্লাহ্কে পরাজিত করার জন্য অস্ত্র হিসেবে নিয়োজিত করেছিল, তারা সর্বসমক্ষে আল্লাহ্র নিদর্শনাবলীকে সনাক্ত করলো এবং পূর্বের কৃত জাল-জোয়াচুরি, প্রতারণা ও মিথ্যার জন্য অনুতপ্ত হয়ে পড়লো। তারা সর্বসমক্ষে আল্লাহ্র একত্বে ঈমান আনলো। যা সচারচর ঘটে থাকে এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। যারা জ্ঞান পাপী, তাদের হৃদয় পাথরের থেকেও শক্ত। ফেরাউনও ছিল ঠিক তাই। এসব লোকেরা কোনও অবস্থাতেই সৎ পথ নিজে তো অবলম্বন করেই না, অপরের সৎ পথ অবলম্বনে তারা বাঁধার সৃষ্টি করে। তারা নিজেদের মানসিকতা দ্বারা অন্যের কার্যাবলীর মূল্যায়ন করে। বিশেষতঃ দেখা যায়, এসব পাপিষ্ঠ লোকেরা যে কোনও সৎ কাজের মধ্যেও ছলনা-কপটতার সন্ধান পায়; এবং সর্বদা তারা তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে থাকে। ফেরাউনও ছিল সেই রকম জ্ঞান পাপী যার আত্মা পাপের দরুন পাথরের থেকেও শক্তরূপ ধারণ করে। যাদুকরদের আত্মসমর্পণ, ফেরাউনকে প্রতিহিংসায় অন্ধ করে তোলে। সে তাদের কঠোর শাস্তির ভয় দেখালো। কিন্তু যারা একবার আল্লাহ্র হেদায়েতের সন্ধান পায়, যাদের হৃদয় একবার আল্লাহ্র নূরে অলোকিত হয়েছে, তারা কি আর কখনও পৃথিবীর কোনও শাস্তিকে ভয় পায় ? শত অত্যাচার সত্বেও তারা আল্লাহ্র কাছে ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার জন্যে প্রার্থনা করেছিল। আল্লাহ্র প্রতি তাদের এই প্রকাশ্য অনুরাগ সাধারণ মানুষদেরও অনুপ্রাণীত করে।
১২৫। তারা বলেছিলো, "আমাদের জন্য [তা হবে] আমাদের প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তন।
১২৬। "কিন্তু তুমি তো আমাদের উপর তোমার প্রতিহিংসা গ্রহণ করছো শুধু এই জন্য যে আমরা আমাদের প্রভুর নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যখন তা আমাদের নিকট পৌঁছেছে। হে আমাদের প্রভু ! আমাদের ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা দান কর, এবং আমাদের আত্মাকে মুসলমান রূপে [যে তোমার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে] গ্রহণ কর ১০৮৩।"
১০৮৩। এই সব যাদুকর যারা, তারা ছিল মিশরবাসী। এই সব যাদুকর মিশরবাসীরা তাদের ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা দ্বারা প্রমাণ করেছিলেন যে, তাদের ঈমান ছিল সত্য। এভাবেই মুসার উপরে আল্লাহ্র অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণতা লাভ করে। এদের উদাহরণ দেখে অনেক মিশরবাসী অনুপ্রাণীত হয় - ফলে মুসার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এসব অনুসারীদের ঈমান ছিল খাঁটি সোনার মত, সত্য ও উজ্জ্বল। তারা তাদের বিশ্বাসের জন্য ফেরাউনের অত্যাচারে জীবন দিতেও কুণ্ঠিত বোধ করেন নাই। তারা ঈমানের জন্য শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁদের শাহাদাৎ বৃথা যায় নাই - তা দু'ভাবে সমস্ত জাতিকে প্রভাবিত করে। প্রথমতঃ যাদুকরেরা সে সময়ে মিশরের রাজনৈতিক জীবনে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। যাদুকরেরা যখন আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনলো তখন মিশরবাসীদের পুরাতন ধর্ম বিশ্বাসের উপরে তা ছিল এক আকস্মিক বিরাট আঘাত স্বরূপ। দ্বিতীয়তঃ এই ঘটনার প্ররোক্ষ প্রভাব ছিল আরও সূদূর প্রসারী। যাদুকরদের শাহাদাৎ মিশরের আপামর জনসাধারণের উপরে যে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা ছিল অপরিমেয়। পরোক্ষভাবে এক আল্লাহ্র পথের জয়যাত্রা নিঃশব্দে শুরু হলো যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে মিশরের ধর্মবিশ্বাসের আমূল পরিবর্তন ঘটায়। ফেরাউনদের দীর্ঘ তিন হাজার বছরের রাজত্বকালে তাদের ধর্ম বিশ্বাস সম্বন্ধে আলোচনা করলে দেখা যায়, বহু যুগ আগে, ফেরাউনদের রাজত্বের প্রথম কালে, সভ্যতার সেই ঊষালগ্নে মানুষ জীবজন্তুকে দেবতারূপে পূঁজা করতো। তার পরের অবস্থায় তারা সূর্যকে পূঁজা করতে শুরু করে, শক্তির প্রতীক স্বরূপ, এর পরে ফেরাউনকে পূঁজা করে দেবতা বা দেবতার প্রতিনিধি স্বরূপ, এর পরে ধীরে ধীরে তারা হৃদয়ঙ্গম করে বিমূর্ত আল্লাহ্র ধারণা এবং অনুধাবন করে আল্লাহ্র একত্ব, দয়া ও করুণা। অর্থাৎ মুসার ধর্মের পূর্বে মিশরবাসীদের ধর্মীয় ক্রমবিকাশ ঘটে ক্রমান্বয়ে। মুসার পরে ঈসা এবং সর্বশেষে হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এ এসে ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে মিশরবাসীদের ধর্মে পূর্ণতা লাভ করে।
১০৮৪। যাদুকরদের প্রতি ফেরাউনের আদেশ ছিল অত্যন্ত নির্মম ও নিষ্ঠুর। কিন্তু তার পরিষদবর্গ এতেও খুশী হতে পারলো না। তাদের কথা ছিল, তাহলে কি মুসা এবং ইসরাঈলীদের বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়া হবে ? যাতে তারা ফেরাউন ও তার উপাস্যদিগকে পরিহাস করতে পারে ? এখানে কৌশলে তারা কূটবুদ্ধির দ্বারা ফেরাউনের আত্মশ্লাঘাতে, তার ক্ষমতার দম্ভে আঘাত হানে, যেনো ফেরাউন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। এখানে ফেরাউনের উত্তর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ফেরাউন মুসার অলৌকিক ক্রিয়া কর্মে নিজের ভিতরে ভীতি অনুভব করে। কারণ সে প্রত্যক্ষভাবে মুসার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা বোধ করে। মুসার জন্মের পূর্ব থেকে তারা নিয়ম চালু করেছিল যে ইসরাঈলীদের পুরুষ বাচ্চাদের হত্যা করবে এবং মেয়ে শিশুদের জীবিত রাখবে, যেনো ইসরাঈলীরা পুরুষ শূন্য জাতিতে পরিণত হয়। নারীরা হবে তাদের সেবাদাসী, "তাদের উপর আমাদের ক্ষমতা হবে অপ্রতিহত।" এভাবে শেষ পর্যন্ত ইসরাঈল জাতি পৃথিবী থেকে মুছে যাবে। লক্ষ্যণীয় যে ফেরাউন, তার সম্প্রদায়ের জেরার মুখে পূর্বের জারিকৃত হুকুমের কথাই উল্লেখ করলো, কিন্তু মুসা বা হারুন সম্বন্ধে কোনও উল্লেখ করলো না। কারণ তার অবচেতন মনে মুসা সম্বন্ধে ভয়ের সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ইসরাঈলীদের নিশ্চিহ্ন করার এই ব্যর্থ পরিকল্পনা আল্লাহ্র পরিকল্পনার কাছে নিতান্ত তুচ্ছ। যাদের ঈমান আছে তাদের রক্ষাকর্তা স্বয়ং আল্লাহ্।
১০৮৫। এই আয়াতে মুসার উপদেশ ছিল (১) আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা ও (২) ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হওয়া। ফেরাউন ও মুসা উভয়েই তাদের স্ব-স্ব লোকদের সম্বোধন করেছেন - কিন্তু সম্বোধনের ভাষা লক্ষ্যণীয়। পার্থিব ধন সম্পদ ও ক্ষমতার দম্ভে ফেরাউন সম্বোধন করেছে উদ্ধত ও হুমকীর মাধ্যমে। অন্যদিকে মুসা তার লোকদের সম্বোধন করেছেন বিনয় এবং আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরতা শিক্ষা দিয়ে। আল্লাহ্র শিক্ষা হচ্ছে : পৃথিবীতে আত্মম্ভরিতা ও অহংকারের স্থায়িত্ব অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, অপরপক্ষে ঈমান ও বিনয়ের ভিত্তি স্থায়ী। লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে এই হচ্ছে সেই অমোঘ ব্যবস্থা। প্রার্থনা ও ধৈর্য্য যার অবলম্বন বিজয় তার সুনিশ্চিত। তবে এই প্রার্থনা হতে হবে একান্তই সত্যনিষ্ঠ ও আন্তরিক ও একনিষ্ঠার সাথে, শুধু কিছু শব্দের আবৃত্তি নয়।
১০৮৬। এই আয়াতে বনী ইসরাঈলীদের কুটিলতার ধরণই এখানে প্রকাশ পেয়েছে। তাদের অভিযোগের উত্তরে মুসা তাদের সাহস, সান্ত্বনা ও আশার বাণী শোনান।
১০৮৭। হযরত মুসার দ্বারা ইহুদীরা মিশরীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে কালক্রমে বর্তমান প্যালেষ্টাইনে তাদের সম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়। দাউদ ও সোলাইমান ছিলেন ইহুদীদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য রাজা। ইহুদীদের এই উত্থান ছিল শর্ত সাপেক্ষ : "যেনো তিনি তোমাদের কর্মের মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন।" এ উক্তি দ্বারা এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে তাদেরকে বিচার করা হবে তাদের কার্য দ্বারা। যতদিন তারা তাদের সদ্গুণ অক্ষুন্ন রাখতে পারবে, ততদিন তারা সম্মান ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে। যখন তাদের চরিত্রে আর গুণের মাধুর্য্য থাকবে না তখন তাদের এই সম্মান ও ক্ষমতা অন্য লোককে দান করা হবে। রাসূল হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) আগমনের পরে তা মুসলমানদের দান করা হয়। আল্লাহ্র নেয়ামত তাদের উপরেই বর্ষিত হয় যারা পূণ্যবান এবং আল্লাহ্র বিধান বা আইন সমূহ মেনে চলে।
১৩১। কিন্তু যখন [সুসময়] আসে তারা বলতো, "ইহা তো আমাদের প্রাপ্য।" যখন বিপদ-বিপর্যয় দ্বারা আক্রান্ত হতো, তারা এসব অশুভ লক্ষণকে আরোপ করতো মুসা এবং তাঁর সঙ্গীদের সাথে যুক্ত করে। দেখ ! প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তাদের অশুভ লক্ষণ [অকল্যাণ], আল্লাহ্র নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা অনুধাবন করে না ১০৮৮।
১০৮৮। ফেরাউনের সম্প্রদায়ের হটকারীতা ও দুরাচরণের ফলে দূর্ভিক্ষের আগমন ঘটে। যাতে তাদের ক্ষেতের ফসল ও বাগ-বাগিচার উৎপাদন চরমভাবে হ্রাস পায়। ফলে তারা অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত মুসা এর মাধ্যমে দূর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি লাভের জন্য দোয়া করেন। কিন্তু দূর্ভিক্ষ রহিত হয়ে গেলে পুনরায় তারা নিজেদের ঔদ্ধত্যে লিপ্ত হয় এবং বলতে শুরু করে যে, এ দূর্ভিক্ষতো মুসা (আঃ) - এর সঙ্গী সাথীদের অলুক্ষণের দরুণই আপতিত হয়েছিল। আর এখন যে দূর্ভিক্ষ রহিত হয়েছে তা হলো আমাদের সুকৃতির স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। তারা একথা অনুধাবনে ব্যর্থ হয় যে তাদের অবাধ্যতার কারণেই আল্লাহ্ তাদের এই শাস্তি দিয়েছেন। তারা তাদের নিজেদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করতে অক্ষম, অনুধাবনে অক্ষম। সর্বদোষ তারা মুসা (আঃ) ও তার অনুসারীদের উপরে চাপিয়ে দেয়। এ কথা যেমন মুসার (আঃ) যুগেও প্রযোজ্য ছিল আজও ঠিক সমভাবে প্রযোজ্য আছে। যারা দুষ্টলোক তাদের অভ্যাসই হচ্ছে নিজের দোষ, যারা ভালো লোক, যারা মোমেন বান্দা তাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া। পৃথিবীতে যারা অসৎ, অন্যায়কারী, তারা কোনও অবস্থাতেই আত্মানুসন্ধান করে না। তারা কখনও দোষত্রুটি বুঝতে পারে না। এই বুঝতে পারার মধ্যেই নিহিত থাকে সংশোধনের ইচ্ছা।
১০৮৯। এই আয়াতের উদ্বৃতি দ্বারা বোঝা যায় ফেরাউনের সম্প্রদায় কতটা অবাধ্য, একগুয়ে ছিল আল্লাহ্র বিধানের প্রতি। তারা যেহেতু যাদু বিদ্যায় বিশ্বাসী ছিল তাই তারা যে কোনও অস্বাভাবিক ক্রিয়া কর্মকেই যাদুবিদ্যা বলে মনে করত। মুসা (আঃ) এর অলৌকিক ক্রিয়া বা মোজেজা যা আল্লাহ্ কর্তৃক প্রাপ্ত তাকেও তারা ম্যাজিক বা যাদু বলে চিহ্নিত করে। কারণ তাদের হৃদয় পাপের আবরণে শক্ত কঠিনরূপ ধারণ করে, ফলে হৃদয় আল্লাহ্র ক্ষমতা বুঝতে অসমর্থ।
১০৯০। 'Tufan'এই আরবী শব্দটির অনেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন প্লাবন, ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে "Wholesale Death"। 'তুফান' - এই আরবী শব্দটির অর্থ : বহুবিধ দুর্যোগ যাতে ব্যাপক মৃত্যু ও ধ্বংস ঘটে। এই দুর্যোগ প্লাবন হতে পারে, সামুদ্রিক টাইফুন হতে পারে, মানুষ ও পশুর মধ্যে মড়ক ও মহামারী হতে পারে ইত্যাদি যাকিছু ব্যাপক ক্ষতি ও ধ্বংস সাধন করতে পারে।
১০৯১। সূরা [১৭:১০১] আয়াতে নয়টি মোজেজা যা আল্লাহ্ মুসাকে দান করেছিলেন তার উল্লেখ আছে। এগুলি হলো : (১) লাঠি [৭ : ১০৭] (২) জ্যোতির্ময় হাত [৭ : ১০৮] (৩) খরা এবং পানির স্বল্পতা [৭ : ১৩০] (৪) দূর্ভিক্ষ [৭ : ১৩০] এবং আর পাঁচটি মোজেজার উল্লেখ এখানে আছে। এগুলি হলো (৫) মানুষ ও পশুর মধ্যে মড়ক ও মহামারী (৬) পঙ্গপাল (৭) উকুন (৮) ব্যাং (৯) পানি রক্তে পরিবর্তিত হওয়া।
১০৯২। হযরত মুসার (আঃ) দাবী ছিল দুটো। (১) আল্লাহ্র রাস্তায় আসা ও ইসরাঈলীদের উপরে অত্যাচার বন্ধ করা এবং (২) ইসরাঈলীদের মিশরের দাসত্ব মুক্ত করে মিশরের বাইরে চলে যেতে দেওয়া। মুসার (আঃ) দাবী ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের কাছে এতই অযৌক্তিক মনে হয়েছিল যে তারা ব্যাপারটিকে হাস্যস্পদ মনে করেছিল। এর ফলে এক একবার এক এক গজব ফেরাউন সম্প্রদায়ের উপরে পতিত হয়। দূর্ভিক্ষ, খরা, পঙ্গপাল, প্লাবন, মহামারী ইত্যাদি বিভিন্ন আযাব তাদের উপরে পতিত হয়। এই আয়াতে [৭:১৩৩] প্লেগের উল্লেখ আছে। প্লেগ যখন মহামারী আকারে তাদের গ্রাস করলো, তখন তারা মুসার (আঃ) কাছে প্রার্থনা করলো এই আযাব থেকে তাদের রক্ষা করতে, বিনিময়ে তারা নিজেদের সংশোধন করার প্রতিজ্ঞা করে। মুসার প্রার্থনায় যখনই গজব থেকে রক্ষা পেত, তখনই তারা স্বমূর্তি ধারণ করতো। তারা কখনই তাদের প্রতিজ্ঞা রাখতো না। পাপীদের মানসিকতা সব সময়ে সব যুগে একই রকম থাকে। এটা সর্বকালের জন্য সত্য। এই আয়াত থেকে পাপীদের মানসিকতা অনুধাবন করা যায়।
১০৯৩। মুসার মধ্যস্থতায় তারা প্রত্যেকবার আল্লাহ্র গজব থেকে রক্ষা পেত। আল্লাহ্র গজব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাদের উপরে পতিত হয়েছিল, এই আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা মুসার স্মরণাপন্ন হয়। মুসার মধ্যস্থতায় নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে গজব শেষ হয়ে যায়। এখানে মধ্যস্থতা অর্থাৎ মুসার প্রার্থনায়। এই মধ্যস্থতার দুটি দিক বিদ্যমান : (১) মধ্যস্থতার অর্থ মুসার মাধ্যমে একান্ত আন্তরিক ভাবে পাপীরা আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করবে এবং পাপীরা সর্বান্তকরণে তাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে; মহান আল্লাহ্র কাছে। (২) পাপীদের প্রার্থনা মঞ্জুর করা হবে এ জন্য যে তারা আবার পাপমুক্ত হয়ে পবিত্র জীবন যাপন করার সুযোগ পাবে। আল্লাহ্র এই অমোঘ আইন শ্বাসত সত্য। সর্বকালের সর্ব যুগের জন্য প্রযোজ্য।
১০৯৫। ফেরাউন সম্প্রদায় আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার বারে বারে ভঙ্গ করে, ফলে বারে বারে তারা আল্লাহ্র গজবে পতিত হয়। শেষ পর্যন্ত ফেরাউন ইসরাঈলীদের মিশর ত্যাগের অনুমতি দান করে। সেই সময়ে ভূমধ্যসাগরের উপকূল বরাবর গাজা প্রদেশের মধ্যে দিয়ে মিশর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যানন পর্যন্ত বাণিজ্য পথ চালু ছিল। হযরত মুসার অধিনায়কত্বে ইহুদীরা সে পথে না যেয়ে জনবসতিহীন ঊষর নির্জন সিনাই মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পথ চলে। কারণ তারা ছিল নিরস্ত্র, বাণিজ্য পথে যাত্রা হয়তো সহজ হতো, কিন্তু ইসরাঈলীরা শত্রুর ভয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করে পথ চলে।
১০৯৫। ফেরাউন ও মুসার সভা কোথায় অনুষ্ঠিত হয় ? ইসরাঈলরা বাস করতো বদ্বীপের কাছে। 'মেম্ফীস' ছিল ফেরাউন রাজত্বের অন্যতম প্রধান শহর। মেমফীসের অবস্থান বদ্বীপের শীর্ষ বিন্দুর কাছে, বর্তমান কায়রো শহরের সামান্য দক্ষিণে। এই মেমফীস শহর থেকে ১০০ মাইল দূরত্বে ইসরাঈলীদের অবস্থান ছিল। ভৌগলিক অবস্থান থেকে মনে হয় ফেরাউন ও হযরত মুসার কথোপকথন হয়েছিল গোসেনে (Goshen) অবস্থিত প্রাসাদে। গোসেনে ইহুদীরা বাস করতো, অথবা জোয়ান নামক (Zoan অথবা Tanis) বদ্বীপের রাজধানীতে। অবশ্য এই শহরটি নির্মাণ করেছিল পূর্ববর্তী রাজবংশের রাজারা যা সেই সময়ে যারা রাজত্ব করতো তাদের দখলে ছিল। এই শহরগুলিও ইসরাঈলীদের অবস্থান থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। সম্ভবতঃ এই শহরগুলির কোনও একটিতে হযরত মুসার সাথে ফেরাউনের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১০৯৬। এই আয়াতে ইসরাঈলীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ইসরাঈলীরা দাসত্বের বন্ধনে সকলের ঘৃণার পাত্র ছিল, তারাই হযরত সোলাইমানের নেতৃত্বে এক বৃহৎ, অত্যুচ্চ ও যশ গৌরবে পৃথিবী খ্যাত জাতিতে পরিণত হয়। তাঁর রাজত্ব ছিল ধন-ধান্য ও সমৃদ্ধিতে ভরপুর। তিনি ছিলেন আল্লাহ্র বিশেষ নেয়ামতে ধন্য। জ্ঞান ও বিচক্ষণতার প্রতীক। তাঁর রাজত্ব ও যশগাঁথা পূর্ব ও পশ্চিমে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এভাবেই আল্লাহ্ ইহুদীদের সাথে তাঁর কৃত অঙ্গীকার পূরণ করেন। ফেরাউনদের যে সাম্রাজ্য একদিন সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তা সময়ের ব্যবধানে ধ্বংস হয়ে যায়। সুউচ্চ ভবন, তোরণ, স্মৃতিসৌধ সব ধূলিতে মিশে যায়। তাদের প্রধান প্রধান শহর, থিব্স, মেমফীস ইত্যাদি যা একদিন বিশ্ববাসীর চোখে চমকের সৃষ্টি করতো, তা এখন কোনও অস্তিত্বই বহন করে না। পুরাতত্ত্ববিদরা খনন কার্য দ্বারা এসব নগরী এবং এর সভ্যতাকে মাটির নীচ থেকে উদ্ধার করে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন। স্মৃতিসৌধ, মন্দির, প্রাসাদ, কবর, মূর্তি, স্তম্ভ, রাজকীয় ভবন সমূহ ইত্যাদি অত্যাচার্য্য ভাস্কর্য সমূহ সব সময়ের সাথে সাথে মাটির নীচে তলিয়ে যায়। এমন কি স্ফিংকসের মত বিশাল স্মৃতিসৌধ যা সময়ের শাসনকে উপেক্ষা করে আজও টিকে আছে, তা বালির নীচে আংশিকভাবে প্রোরিত হয়ে গিয়েছিল। স্ফিংকসের উদ্ধার কার্য পুরাতত্ত্ববিদের সমসাময়িক কাজ। ১৭৪৩ সালে রিচার্ড পোকক্ (Richard Pococke) 'Travels in Egypt' বইতে লিখেছেন যে, "Most of the Pyramids are very much ruined" (পৃষ্ঠা নং-৪১)। অর্থাৎ ফেরাউনদের শৈর্য্য, বীর্য, ধন-সম্পদ, ক্ষমতা অহংকার, দম্ভ কোনও কিছুই পৃথিবীতে স্থায়ী হতে পারে নাই। পৃথিবীর কিছুই স্থায়ী নয়।
১০৯৭। এই আয়াতটিতে সিনাই উপত্যকার পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। ইসরাঈলীরা লোহিত সাগর পার হয়ে সিনাই মরুভূমিতে প্রবেশ লাভ করে। সেখানের জনসাধারণ ছিল পৌত্তলিক। তারা ছিল কারা ? সম্ভবতঃ তারা ছিল (১) আমালেকাইট সম্প্রদায়, যাদের সাথে ইসরাঈলীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এরা ছিল পৌত্তলিক সম্প্রদায়। তবে এদের সম্বন্ধে খুব কমই জানা যায়। (২) মিশরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, খুব প্রাচীন কাল থেকেই মিশরের নৃপতিরা সিনাই উপত্যকাতে কপার ধাতু উত্তোলন করতো। এসব খনিতে প্রচুর মজুররা কাজ করতো। সুতরাং সেখানে মিশরবাসীরা তাদের অস্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তোলে। এসব আবাসস্থলকে খনি শহররূপে পরিগণিত করা যায়। তারপরে সময়ের সাথে সাথে যখন এসব খনিগুলি নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন রাজানুকূল্য ও সেখানের প্রশাসন অপসারিত হয়। কিন্তু সম্ভবতঃ দরিদ্র মজুর সম্প্রদায়, যারা সেখানে বসতি গড়ে তুলেছিল, তারা সে স্থান ত্যাগ না করে সেখানে রয়ে যায়। পরবর্তীতে অনগ্রসর সম্প্রদায়, আরও অনগ্রসর জাতিতে পরিণত হয়। কারণ তারা সভ্যতা ও শিক্ষা-দীক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করে। সভ্যতা, সংস্কৃতির স্পর্শ ব্যতীত এরা এক গোড়া, অন্ধ-বিশ্বাসী, পৌত্তলিক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে ইসরাঈলীরা বললো, "তাদের দেবতার ন্যায় আমাদের জন্যও দেবতা গড়ে দাও।" এটা ছিল ইসরাঈলীদের জন্য শয়তানের ফাঁদ। শতাব্দীকালের দাসত্বের শৃঙ্খল তাদের আত্মাকে কুসংস্কার এবং অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তাই অবাস্তব ও হাস্যস্কর প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রয়াস পায়।
১০৯৮। যদি উপরের টিকার দ্বিতীয় (২) অনুমানটি সঠিক হয়, তবে বলতে হয় যে মূর্তি পূজক যারা ছিল, তারা ছিল মিশরবাসীদেরই এক ভগ্নাংশ। মুসার ভর্ৎসনা এক্ষেত্রে ছিল অত্যন্ত তীব্র।
১৪১। এবং স্মরণ কর আমি তোমাদের ফেরাউনের সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার করেছিলাম, যারা তোমাদের চরম শাস্তি প্রদান করতো। যারা তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করতো এবং কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখতো। তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ইহাতে [নিহিত] ছিলো তোমাদের জন্য এক মহা পরীক্ষা ১০৯৯।
১০৯৯। হযরত মুসার বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহ্ ইসরাঈলী সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ইসরাঈলীদের জন্য মিশরের দাসত্ব ছিল পরীক্ষা স্বরূপ, আর তা ছিল দ্বিবিধ : (১) যখন তারা দাসত্বের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত ছিল, তখন তাদের ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা অবলম্বনের জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছিল এবং (২) যখন তারা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে উদ্ধার প্রাপ্ত হলো, তাদের বিনয়, ন্যায়পরায়ণতা এবং সৎ কাজের জন্য আহ্বান করা হলো।
রুকু - ১৭
১১০০। হযরত মুসাকে তাওরাত প্রাপ্তির জন্য প্রথমে ৩০ দিন পরে আরও ১০ দিন বৃদ্ধি করে মোট ৪০ দিন সিয়াম সহ ইতিকাফের ন্যায় একই স্থানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। মুসা (আঃ) এর এই নির্জন বাসকে হযরত ঈসা (আঃ) এর ধর্ম প্রচারের পূর্বে ৪০ দিন নির্জনবাস ও সিয়ামের সাথে তুলনা করা চলে [Matt iv 2]। উভয় ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব রাসূলেরা আল্লাহ্র কাছ থেকে তাদের পূর্ণ দায়িত্ব ও মর্যাদা পাওয়ার পূর্বে দীর্ঘ সিয়াম ও নির্জনবাস করেন।
উপদেশ : গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য একটা বিশেষ সময় নির্ধারণ করে নেয়া এবং তা ধীর স্থির ভাবে পর্যায়ক্রমিকভাবে সমাধা করা আল্লাহ্র রীতি।
১১০১। যদি কোনও কারণে আল্লাহ্র রাসূলকে তার সম্প্রদায় থেকে দূরে থাকতে হয়, তবে সে দায়িত্ব তার ভাই নেবে। এখানে ভাই এর অর্থ, রক্তের সম্পর্কে ভাই হতে হবে এমন কথা নাই, তার সম্প্রদায়ের এমন একজন যার সাথে তিনি মূল্যবোধে ভাতৃস্থানীয়। প্রতিনিধির দায়িত্ব কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে বিনয়ের সাথে। মুসা এখানে তিনটি নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। (১) প্রতিনিধির কার্যকলাপ সর্বদা প্রধানের নীতি ও উপদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হবে। "আমার অনুপস্থিতিতে আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তুমি আমার প্রতিনিধিত্ব করবে।" (২) "সঠিক কাজ করবে" এই বাক্যটি ইংরেজীতে প্রকাশ করা হয়েছে, "Do right" অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বা উৎস হবে "সত্য ও ন্যায়।" এবং (৩) প্রধান বা মূল ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা বিপর্যয় সৃষ্টির প্রয়াস পায়। এক্ষেত্রে মুসার উপদেশ হচ্ছে "বিপর্যয়কারীদিগের পথ অনুসরণ করবে না।" অর্থাৎ প্রতিনিধি সর্বদা সতর্ক থাকবে যে, মূল ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিপর্যয়কারীরা তাঁর জন্য প্রতারণার ফাঁদ পেতে রাখতে পারে।
উপদেশ : যদি কোনও ব্যক্তি কোন কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত হন তবে প্রয়োজনবোধে কোথাও যেতে হলে সে কাজের ব্যবস্থাপনার জন্য লোক নিয়োগ করা কর্তব্য। হযরত মুসার উপদেশ ছিল ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীকে সাহায্য না করা। এই উপদেশ থেকে সে সব লোকের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
১১০২। হযরত মুসাকে আল্লাহ্ নয়টি মোজেজা দান করেন, তার মধ্যে তার জ্যোতির্ময় হাত যা আল্লাহ্র মহিমাতে উজ্জ্বল ভাস্বর হতো [৭ : ১০৮ ও টীকা ১০৭৬ দেখুন]। তাঁর সাথে আল্লাহ্ কথা বলেছেন, এর পরেও তিনি আল্লাহ্কে চাক্ষুস দেখার জন্য আবদার করেছিলেন। কিন্তু রক্ত মাংসের শরীর অবলম্বন করে আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব নয়। এখানে উপদেশ হচ্ছে : আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতিতে অনেকেই অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের সীমাবদ্ধতা ভুলে যায়। সে যা নয় তাই-ই কল্পনা করে বা করতে ভালোবাসে - এ রকম উদাহরণ অহরহই আমাদের চারিপাশে ঘটে।
১১০৩। হযরত মুসা আল্লাহ্কে চাক্ষুস দেখার কৌতুহল প্রকাশ করেন। কিন্তু এই নশ্বর দেহ ধারণ করা অবস্থায় কারো পক্ষেই চর্মচক্ষুতে আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব নয়, কিন্তু আল্লাহ্ দয়াময় এবং সকলকে সস্নেহে লালন-পালন করেন। তিনি হযরত মুসার এই অযৌক্তিক আকাঙ্খাকেও সস্নেহে গ্রহণ করেন। আল্লাহ্র নূরের যে ক্ষমতা তা সহ্য করা রক্ত মাংসের মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এমন কি আল্লাহ্র নূরের প্রতিফলিত রশ্মিও পার্থিব কোনও জিনিসের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। তাই আল্লাহ্র বিকিরিত জ্যোতির প্রভাবে পর্বত চূড়াও বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং হযরত মুসা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে, তিনি তাঁর ক্ষুদ্রতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হন। আমরা মরণশীল মানুষ - যার অবলম্বন হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী রক্ত মাংসের দেহ, মানুষ আল্লাহ্র ক্ষমতার কাছে এত অকিঞ্চিতকর যে আল্লাহ্র প্রতিফলিত নূরের ক্ষমতাও সহ্য করতে অক্ষম। এই বোধদয় হযরত মুসাকে অনুতাপ ও বিশ্বাসের গভীরতায় আপ্লুত করে।
১১০৪। "মুমিনদের মধ্যে আমিই প্রথম" - এই বাক্যটি ও সূরা [৬ : ১৪, ১৬৩] এর উদ্বৃতি "আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম ব্যক্তি" এই দুটি সমার্থক। অর্থাৎ এর অর্থ এই নয় যে তিনিই প্রথম মুসলমান বা ইসলাম গ্রহণকারী। এত অর্থ হচ্ছে, ঈমানের একগ্রতায় ও অগ্রসরতায় সর্বোচ্চ স্থানের দাবীদার। এই লাইনের অর্থ যেন কেউ তুলনামূলক ভাবে বিচার না করেন।
১১০৫। 'রিসালাত' - অর্থাৎ রাসূলের মর্যাদা ও দায়িত্ব। "তোমাকে সকল মানুষের উপর মনোনীত করেছি", অর্থাৎ হযরত মুসার সমসাময়িক যারা তাদের মধ্যে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। তাঁকে আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব দান করেন এবং তিনিই একমাত্র যার সাথে আল্লাহ্ কথা বলেন।
১১০৬। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সমূহ মানুষের জন্য করুণা ও রহমত স্বরূপ। যারা এই প্রত্যাদেশসমূহ নিজের জীবনে গ্রহণ করে, তারা ধন্য। তারা হয় আল্লাহ্র বাণীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অবনত মস্তক ও কৃতজ্ঞ। সিনাই পর্বতে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের আলোকে হযরত মুসার আধ্যাত্মিক জীবন যখন আলোকিত হয়, তখন নীচে অকৃতজ্ঞ মুসার সম্প্রদায় আলোহ্কে ভুলে সোনার গোবৎস পূঁজাতে ব্যপৃত হয় [দেখুন ৭ : ১৪৭]।
১১০৯। "দুর্বৃত্তদের বাসস্থান" - এই বাক্যটি ব্যক্তিগত ও জাতিগত ভাবে প্রযোজ্য। যেমন দুর্বৃত্ত ছিল মিশরবাসীরা, আদ ও সামুদ জাতিরা।
১১১০। এই আয়াতটির বক্তব্যকে সহজ ভাবে প্রকাশ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে : পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবেই - কারণ এই হচ্ছে পৃথিবীর আদিরূপ, পৃথিবীর প্রকৃতি, গাছপালা, জীব-জন্তু প্রত্যেকেই কঠোর ভাবে আল্লাহ্র আইন মেনে চলে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তার সৃষ্টির প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুর জন্য তা জীবন্তই হোক বা জড়ই হোক, তার জন্য কতকগুলি আইন বা খধি ধার্য করে দিয়েছেন। এগুলিকে অনেকে বলে প্রাকৃতিক আইন। যেমন সূর্য সর্বদা পূর্বদিকেই উঠবেই এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যাবে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ঋতুর পরিবর্তন ঘটবে। বীজ উপযুক্ত পরিবেশে অঙ্কুরোদগম ঘটাবে ও বৃক্ষ পরিণত বয়েসে ফুল ও ফলে সুশোভিত হবে। জীব-জন্তু নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাতৃগর্ভে থাকবে। জন্মের পরে মা তাকে আপত্য স্নেহে পালন করবে। এর কোনওটা আমরা বলি প্রাকৃতিক নিয়ম কোনওটাকে আমরা প্রাণীর সহজাত প্রেরণারূপে অভিহিত করি। এরূপ হাজারো নিদর্শন আমাদের চারিদিকে ছড়ানো আছে, যা নির্দেশ করে বিশ্ব প্রকৃতির আল্লাহ্ আইন মানার বিশ্বস্ততা। এই আইন ভঙ্গ করার ক্ষমতা বিশ্ব প্রকৃতির কারও নাই। বিশ্ব প্রকৃতি কঠোর ভাবে আল্লাহ্র আইন মেনে চলতে বাধ্য, কারণ তাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নাই। প্রতিটি সৃষ্ট জীব বা পদার্থের জন্য আল্লাহ্র আইনকে নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। কেউই তা অমান্য করে না। একমাত্র মানুষই তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অপব্যবহারের ফলে আল্লাহ্র আইনকে অমান্য করে। আল্লাহ্ চান আমরা আমাদের এই নশ্বর দেহকে অবলম্বন করে চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নতি লাভ করি। এই উন্নতি লাভের জন্য আল্লাহ্ তাঁর নবী রাসূলদের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন, পথ প্রদর্শন করেছেন। তারা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ জীব। তারা অন্ধ অহংকারে ও দম্ভে, একগুয়ে অন্যায় ও অবাধ্যভাবে আল্লাহ্র হুকুম সমূহ অমান্য করে। এই অমান্য করার ক্ষমতা সে লাভ করে তার "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির" অপব্যবহারের মাধ্যমে। এই অবাধ্যতার মূল শেকড় হচ্ছে অহংকার ও দম্ভ যা ছিল ইবলিসের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ্র হাতের পরশ, তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, তাঁর সৃষ্টিতে বিদ্যমান। বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টার উপস্থিতি বর্তমান। যারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে, তারা বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে আল্লাহ্র অস্তিত্ব অনুভব করতে ব্যর্থ হয়। আল্লাহ্ এদেরকে তাঁর অনুগ্রহ বঞ্চিত করেন যার ফলে পাপীদের আত্মার মাঝে ক্রমান্বয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর রূপান্তর ঘটবে। সেই কঠিন আত্মাতে আল্লাহ্র নূর প্রবেশে বাঁধা পায়। ফলে এসব পাপীরা সত্যকে ও ন্যায়কে অনুধাবনে হবে অক্ষম। এরা সত্য ও অসত্যের মধ্যে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। কারণ আল্লাহ্র প্রতি অবিশ্বাস তাঁদের আত্মার মধ্যে অন্ধকারের জন্ম দেয় যা তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনে বাঁধার সৃষ্টি করে। তারা চক্ষুস্মান হয়েও অন্তর্দৃষ্টিহীন। আধ্যাত্মিক জগতে এরা অন্ধ, মূক ও বধীর [দেখুন সূরা ২ : ১৮]।
উপদেশ : নিজেকে নিজে অন্যান্যদের চাইতে বড় ও উত্তম মনে করা এমনই দূষণীয় ও জঘন্য অভ্যাস যে, এতে যে পতিত হয়, তার সুষ্ঠুবুদ্ধি ও জ্ঞান থাকে না। অহংকার ও গর্ব-দম্ভ এমন এক মন্দ অভ্যাস, যা ঐশী জ্ঞান লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আল্লাহ্র জ্ঞান লাভ হতে পারে একমাত্র আল্লাহ্রই রহমতে। আল্লাহ্র রহমত পাওয়া যায় একমাত্র বিনম্রতার মাধ্যমে।
রুকু - ১৮
১১১৩। "গো বৎসের এক মূর্তি" Jasad এই আরবী শব্দটির বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে মূর্তি। মূর্তি অর্থাৎ আত্মাহীন বা প্রাণহীন শুধু এক শরীর। এই আয়াতে। "মূর্তি" এর অর্থ নিম্নলিখিত ভাবে চিন্তা করা যায় : (১) গো-বৎসের মূর্তি ছিল প্রাণহীন শুধু এক শরীর (২) পরবর্তীতে বলা হয়েছে তা হাম্বা বলে ডাকতো। কিন্তু যেহেতু তা ছিল প্রাণহীন সুতরাং স্বর্ণ গো-বৎসের হাম্বা ডাকটি ছিল প্রতারণা।
১১১৪। স্বর্ণ নির্মিত গো-বৎসের হাম্বা রব অবশ্যই ছিল প্রতারণা। ইটালীর পাম্পই নগরী অগ্নুৎপাতে ধ্বংস হয়ে যায়। সমস্ত শহর আগ্নেয়গিরির লাভার নীচে চাপা পড়ে যায় - যা বর্তমানে প্রত্নতত্ববিদেরা খুঁড়ে বের করেছেন। Lytton রচিত "Last Day of Pompei" গ্রন্থে তিনি প্রকাশ করেছেন কিভাবে পুরোহিত সম্প্রদায় দেবী "আইসিস (Isis)চ্ এর মুখ দিয়ে ভবিষ্যত বাণী করাতো। একজন লোক মূর্তির পিছনের লুকায়িত স্থান থেকে কথা বলতো এবং এভাবেই তারা সাধারণ মানুষদের প্রতারণা করতো। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও গোবৎসের মূর্তির হাম্বা রব অবশ্যই ছিল প্রতারণা।
১৫০। যখন মুসা ক্রুদ্ধ এবং দুঃখিত হয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলো, সে বলেছিলো, "আমার অনুপস্থিতিতে আমার স্থানে তোমরা প্রকৃতই মন্দ কাজ করেছ। তোমাদের প্রভুর আদেশ [পাওয়ার] পূর্বেই তোমরা ত্বরান্বিত করলে ?" ১১১৫। সে ফলকগুলি নামিয়ে রাখলো ১১১৬, এবং স্বীয় ভ্রাতার মাথার [চুল] টেনে ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করলো ১১১৭। হারুন বলেছিলো, "হে আমার সহোদর ! লোকেরা তো আমাকে মূল্যহীন মনে করে আমাকে প্রায় হত্যা করেই ফেলেছিলো। আমার দুর্ভাগ্যে শত্রুদের আনন্দিত হতে দিও না। আমাকে তুমি পাপিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত করো না ১১১৮।
১১১৫। "তোমাদের প্রভুর আদেশের পূর্বে তোমরা ত্বরান্বিত করলে।" এই বাক্যটি হযরত মুসার। এখানে হযরত মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছেন যে আমি তো তোমাদের জন্য আল্লাহ্র নির্দেশ সমূহ লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গিয়েছি, তোমরা আমার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা না করে এরূপ ঘৃণ্য কাজ করে ফেললে এর ফলে তোমরা আল্লাহ্র ক্রোধ ও লাঞ্ছনা ত্বরান্বিত করে ফেললে। এখানে 'ত্বরান্বিত' কথাটি আল্লাহ্র বিচারের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে।
১১১৬। অনেক বাংলা অনুবাদে বলা হয়েছে, "সে ফলকগুলি ফেলিয়া দিল" অথচ ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে He put down the Tables ফেলিয়া দিলেন কথাটির মধ্যে অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। কিন্তু ফলকগুলি ছিল পবিত্র - আল্লাহ্র নির্দেশ সম্বলিত। সুতরাং আল্লাহ্র রাসূল তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন তা হতেই পারে না। কারণ তাতে আল্লাহ্র প্রতিই অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। তাওরাতে উল্লেখ আছে যে ফলকগুলি ভেঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু কোরানে [আয়াত ৭ : ১৫৪]-এ উল্লেখ আছে যে, সেগুলি অক্ষতই ছিল। কারণ কোরানের ভাষ্য অনুযায়ী "মুসার ক্রোধ যখন প্রশমিত হলো, তখন সে ফলকগুলি তুলে নিল।" তাওরাতের বর্ণনা নিম্নরূপ : "Moses's anger waxed hot, and he cast the tablets out of his hands, and brake them beneath the Mount". [Exod. xxxii 10]। তাওরাতে আরও উল্লেখ আছে যে, হারুণ স্বর্ণ গোবৎসের জন্য বেদী তৈরীতে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু কোরানের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। হারুণকে আল্লাহ্ মনোনীত করেছেন হযরত মুসাকে সাহায্য করার জন্য। আল্লাহ্র মনোনীত ব্যক্তি কিভাবে মূর্তি পূঁজার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে ? সুতরাং তাওরাতের বক্তব্য সম্পূর্ণ আল্লাহ্র বক্তব্য নয়।
১১১৭। আল্লাহ্র নবী ও রাসূল সবাই ছিলেন রক্ত মাংসের মানুষ। কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতির ফলে তারা সাধারণ মানুষ হওয়া সত্বেও ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলীতে পৃথিবীকে আলোকিত করে গেছেন। তবুও মানুষের আবেগ অনুভূতি তাদের চরিত্রে বিদ্যমান ছিল। হযরত মুসার চরিত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর অবর্তমানে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকের পুনরায় পৌত্তলিকতায় প্রত্যাবর্তন, তাঁকে ক্রোধে আত্মহারা করে ফেলেছিল। হারুণকে তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করে তিনি তূর পর্বতে চল্লিশ দিনের জন্য গমন করেন [দেখুন ৭ : ১৪২]। স্বভাবতই হারুণের অক্ষমতা তাকে রাগে অগ্নিশর্মা করে তোলে এবং হারুণকে তিনি "চুলে ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করলেন।" কিন্তু যত রাগই হোক আল্লাহ্র রাসূল কখনই আল্লাহ্র নির্দেশ সম্বলিত ফলক ভেঙ্গে ফেলতে পারেন না। তাঁর ক্রোধের প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর ভাই হারুণের উপরে এবং হারুণ তার ব্যাখ্যাও দান করেছিলেন। সুতরাং বাক্যটি হওয়া উচিত "ফলকগুলি নামিয়ে দিল।"
১১১৮। হারুণের উক্তি এখানে আবেগ ও দুঃখপূর্ণ ছিল। তিনি হযরত মুসাকে সম্বোধন করেছিলেন 'সহোদর' ভাই বলে - যা ছিল ভালোবাসার এক অনাবিল সুন্দর প্রকাশ। এখানে তিনি ব্যাখ্যা করেন তাদের বাঁধা দানের ফলে কিভাবে দূর্নীতি পরায়ণ, বিদ্রোহী ও অবাধ্য লোকেরা তাঁকে প্রায় হত্যাই করে ফেলেছিল। তিনি পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করেন তাঁর স্বর্ণ গোবৎস পূঁজার সাথে কোনও সংশ্রব নাই। সূরা [২০ : ৮৫] আয়াতে বলা হয়েছে সামীরী নামে এক দুষ্ট লোক ইসরাঈলীদের গো-পূঁজাতে উদ্বুদ্ধ করে এবং বিপথে চালিত করে। এ সম্বন্ধে পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ে আলোচনা করা হবে।
১১১৯। হারুণের নির্দোষিতা সম্বন্ধে হযরত মুসার যখন সন্দেহাতীত ভাবে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপন্ন হলো তখন তার প্রচন্ড ক্রোধ প্রশমিত হয়। তিনি তাঁর নিজের জন্য ও তাঁর ভাই হারুণের জন্য আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করেন। তিনি নিজের জন্য প্রার্থনা করেন। কারণ তিনি তাঁর প্রচন্ড ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নাই, তাঁর ভাই হারুণের জন্য প্রার্থনা করেন, কারণ হারুণ তাঁর উপরে অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালনে অক্ষম হয়েছিল। এখানে হযরত মুসার চরিত্রে শ্রেষ্ঠ নেতাদের গুণাবলী ভাস্বর। কারণ সাধারণ লোকেরা নিজেদের অক্ষমতা অন্যের উপরে ন্যস্ত করতে উদগ্রীব থাকে। হযরত মুসা নেতাসুলভ গুণের দ্বারা পরিচালিত, তাই তিনি তাঁর সহকর্মীর অক্ষমতার সাথে নিজেকেও সম্পৃক্ত করে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। শুধু তাই-ই নয় দোয়া করেছেন [৭ : ১৫৫]। ঠিক একই গুণাবলীর পরিচয় আমরা পাই আমাদের নবী হযরত মুহম্মদের (সাঃ) চরিত্রে।
১৫৪। যখন মুসার ক্রোধ প্রশমিত হলো, তখন সে ফলকগুলি তুলে নিল। যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে তাদের জন্য উহাতে পথ নির্দেশ ও রহমত লেখা ছিলো।
১৫৫। মুসা আমাদের সাক্ষাতের স্থানে সমবেত হওয়ার জন্য সত্তরজনকে মনোনীত করলো ১১২১। যখন তারা প্রচন্ড ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো ১১২২, তখন মুসা প্রার্থনা করলো : "হে আমার প্রভু ! এই যদি তোমার ইচ্ছা ছিলো তবে তুমি তা পূর্বেই এদের এবং আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারতে। আমাদের মধ্যে যারা নির্বোধ তাদের কাজের জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করবে ? এ তো শুধু তোমার পরীক্ষা ১১২৩। এর দ্বারা যাকে ইচ্ছা তুমি বিপথগামী ১১২৪ কর এবং যাকে ইচ্ছা তুমি সঠিক পথে পরিচালিত কর। তুমিই আমাদের রক্ষাকর্তা। সুতরাং আমাদের ক্ষমা কর এবং তোমার অনুগ্রহ দান কর। কারণ যারা ক্ষমা করে, তাদের মধ্যে তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
১১২১। এই আয়াতে এক বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। হযরত মুসা আল্লাহ্র কিতাব তাওরাত নিয়ে এসে বনী ইসরাঈলীদের দিলেন। তারা নিজেদের বক্রতা ও ছলছুতার দরুণ বলতে লাগলো যে, আমরা এ কথা কেমন করে বিশ্বাস করবো যে, এটা আল্লাহ্রই কালাম ? এমনও তো হতে পারে যে, আপনি নিজেই এগুলো নিয়ে এসেছেন। মুসা (আঃ) তখন এ বিষয়ে তাদের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করলেন। তারই প্রেক্ষিতে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বলা হলো যে, আপনি এ সম্প্রদায়ের নির্বাচিত ব্যক্তিদের তূরে নিয়ে আসুন। মুসা তাদের মধ্যে থেকে সত্তর জনকে নির্বাচিত করে তূরে নিয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে এবং হযরত মুসা যেখানে আল্লাহ্র সাথে কথা বলবেন, তার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রাখা হলো। কারণ তারা হবে হযরত মুসা ও আল্লাহ্র কথোপকথনের নিরব সাক্ষী। তারা নিজ কানে আল্লাহ্ ও হযরত মুসার কথোপকথন শোনার পরেও বলতে শুরু করলো, কে জানে এ শব্দ আল্লাহ্রই না অন্য কারও। আমরা তো তখনই আল্লাহ্কে বিশ্বাস করবো যখন প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তাদের এ দাবী যেহেতু একান্তই হটকারিতা ও মূর্খতার ভিত্তিতে ছিল, তাই তাদের উপর ঐশী রোষানল বর্ষিত হল। বজ্র ও বিদ্যুৎ তাদের ঘিরে ধরলো। এক্ষেত্রে যদি না হযরত মুসা মধ্যস্থতা করতেন তবে তারা সকলেই ধ্বংস হয়ে যেতেন।
১১২২। 'Rajfat' এই আরবী শব্দটির অর্থ ভূকম্পন। এক্ষেত্রে সূরা [২ : ৫৫] আয়াতে 'Saiqat' আরবী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। 'সায়েকা' অর্থ বজ্র গর্জন। 'রাজফাহ্' অর্থ ভুকম্পন। বজ্র ও বিদ্যুৎ সমস্ত তূর পর্বতকে প্রকম্পিত করেছিল।
১১২৩। হযরত মুসা ছিলেন নিষ্পাপ। তবুও নেতাসুলভ গুণাবলীর জন্য তিনি নিজেকে তার সম্প্রদায়দের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আল্লাহ্র অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য এটা ছিল ঈমানের পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তারা অকৃতকার্য হয়। তাদের অকৃতকার্যতা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ মানুষ সাধারণ ভাবেই অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু যখন সে ইবলীসের মত দম্ভ ও অহংকারে একগুয়ে ও অবাধ্যভাবে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে তখন তা হয় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধে অপরাধী হওয়া সত্বেও হযরত মুসা তাদের জন্য আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
১১২৪। দেখুন আয়াত [২ : ২৬]।
১১২৫। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছুই আল্লাহ্র রহমতে আপ্লুত। সবকিছুই সৃষ্টি করা হয়েছে মহত্তর মঙ্গলের জন্য বৃহত্তর কল্যাণের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্র মঙ্গল ও কল্যাণের স্পর্শ সর্বদা তাঁর সৃষ্টিকে ঘিরে থাকে। আমাদের মানসিক দক্ষতা (faculties of mind) জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভা, শক্তি সবই তারই দান। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে তাঁর সৃষ্টি জগতে, আমরা কেহই স্বয়ং সম্পূর্ণ নই। আমাদের দক্ষতা, কর্মশক্তি, জ্ঞান, বিচার-বুদ্ধি সবই একে অপরের সম্পূরক। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই দাতা আবার প্রত্যেকেই গ্রহীতা। এভাবেই আল্লাহ্র করুণা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়। আল্লাহ্র করুণা পূণ্যবান ও পাপীর জন্য সমভাবে বহমান। পাপীরাও তার করুণা থেকে বঞ্চিত নয়। তারা বঞ্চিত হয় স্ব-ইচ্ছায়। আল্লাহ্র ন্যায় বিচার অত্যন্ত সূক্ষ্ণ। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে তাদের শাস্তি হবে সূক্ষ্ণ ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে; যতটুকু পাপ সেই অনুযায়ী। কিন্তু পূণ্যাত্মাদের জন্য আছে অশেষ রহমতের আশ্বাস। পূণ্যাত্মা তারাই যারা 'তাকওয়া' অবলম্বন করে। 'তাকওয়া' অর্থাৎ (১) আল্লাহ্র ভালোবাসা হারাবার ভয়ে, তার ভালোবাসা লাভের জন্য ন্যায় ও সত্যের পথ অবলম্বন করে, (২) যাকাত দেয় ও (৩) আল্লাহ্র নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে।
১১২৭। এই আয়াতে হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে বলা হয়েছে উম্মী নবী। অর্থাৎ অক্ষর জ্ঞানহীন। তাই কোরান হচ্ছে আমাদের নবীর জন্য মোজেজা স্বরূপ নবুওয়াতের প্রমাণ। শেষ নবী হযরত মুহম্মদের (সাঃ) আগমন বার্তা হযরত মুসা ও হযরত ঈসার কিতাবে বর্তমান। এই আয়াতে সে সম্পর্কেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থ তাওরাত ও খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ ইনজিল এর বক্তব্য এ সম্বন্ধে অত্যন্ত স্পষ্ট। তাওরাতে মুসা বলেছেন, "The Lord the God will raise up unto thee a prophet from the midst of thee, of thy brethren like unto me" [Deutt xviii 15]| । মুহম্মদই (সাঃ) একমাত্র রাসূল যিনি মুসার (আঃ) মত "সারিয়া" বা জীবনের চলার পথের দিক্ নির্দেশনা সম্বলিত কিতাবের অধিকারী হন। আবার মুহম্মদ (সাঃ) ছিলেন হযরত ঈসমাইলের অধঃস্থন পুরুষ। ঈসমাইল ছিলেন হযরত ইসহাকের ভাই। ইসহাক ছিলেন ইসরাঈলের পিতা - যে বংশে হযরত মুসার জন্ম।
১১২৮। "Aglal" বহুবচনে "gullun"এর অর্থ হচ্ছে জোয়াল বা কণ্ঠ বেষ্টনকারী লোহার কলার। ইহুদীরা অত্যন্ত কঠোর স্বভাবের - তাই হযরত মুসার গ্রন্থ তাওরাতে যে সব বিধানাবলী বা শরীয়ত তা ছিল অত্যন্ত কঠিন। ফলে ইহুদী ধর্মে আনুষ্ঠানিকতা ও স্বকীয়তার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইসলামে আনুষ্ঠানিকতার কোনও স্থান নাই। ইহুদী ধর্মের এই কঠোর শরীয়তের বিধানকে ইসলাম পরিত্যাগ করে সহজ জীবন ধর্মী ব্যবস্থা চালু করে। ইসলাম এমনই এক ধর্ম যা আনুষ্ঠানিকতা নয়, ঈমানের বিশ্বস্ততাকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে, ফলে ইসলাম দেশ, জাতি, বর্ণ, ভাষা, আচার-আচরণ সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে ঈমানের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভব হয়েছে। তাই ইসলাম হচ্ছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ধর্ম, বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। এটা সম্ভব হয়েছে শরীয়তের যে "গুরুভার ও শৃঙ্খল" যা পূর্ববর্তী কিতাবধারীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল তা থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার ফলে। "সে তাদের গুরুভার থেকে এবং শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দান করে, যা তাদের উপর [চাপানো] ছিলো।"
১১২৯। "যে আলো তার সাথে প্রেরণ করা হয়েছে।" এই বাক্যটির প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বলা হয়েছে "তাহার সাথে", "তার প্রতি" কথাটি ব্যবহার করা হয় নাই। "সাথে" কথাটির দ্বারা বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যে নূর নবীজী সাথে করে এনেছেন তার আলোয় আলোকিত হওয়ার অধিকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ভেদে সকলের সমান। "তাঁর প্রতি" কথাটি ব্যবহার করলে তা হতো একবচনে শুধুমাত্র রাসূলের প্রতি। এই নূর হচ্ছে ঈমানের নূর যার উৎপত্তি বা কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা বা তাকওয়া। এই তাকওয়া বা ভালোবাসাকে কর্মের মাধ্যমে, চারিত্রিক গুণাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। কর্মের মাধ্যমে নিম্নরূপ : তাদের সৎ কার্যের নির্দেশ দেয় ও অসৎ কার্যে বাধা দেয়। পবিত্র বস্তু বৈধ ও অপবিত্র বস্তু অবৈধ করে। কর্মের মাধ্যমে আত্মার মাঝে আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে, যার ফলে আত্মার মাঝে আল্লাহ্র নূরের স্ফুরণ ঘটে। একেই বলা হয়েছে, "যে নূর বা আলো তাহার সাথে প্রেরণ করা হয়েছে, উহার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম।" "সফলকাম" অর্থাৎ ইহকাল ও পরকালের উন্নতিতে সফলকাম, কারণ তারা আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি লাভ করবে।
১১৩০। 'Falah' - এই আরবী শব্দটির ইংরেজী অর্থ করা হয়েছে Prosperity এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "সফলকাম।" চৎড়ংঢ়বৎরঃুচ্ এর বাংলা অনুবাদ হয় শ্রীবৃদ্ধি লাভ করা বা উন্নতি লাভ করা। এখানে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করা বা সফলকাম হওয়া হচ্ছে এই পৃথিবীর জীবনে ও পরকালের জীবনে। ইহকাল ও পরকালের সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে, সঠিকভাবে জীবনকে পরিচালনা করা। আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে চরিত্রকে সুষমামন্ডিত করলেই একমাত্র সাফল্যের চাবিকাঠি হস্তগত করা সম্ভব। যে ব্যক্তি বা জাতি চরিত্রবান তারা অবশ্যই আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে অর্থাৎ ন্যায় ও সত্যের পথে জীবনকে পরিচালিত করবে। যখন কোনও ব্যক্তি বা জাতি ন্যায় ও সত্যের পথে পরিচালিত হয়, তখন সেই ব্যক্তির ও জাতির শ্রীবৃদ্ধি লাভ ও সফলকাম অবশ্যম্ভাবী। এই শ্রীবৃদ্ধি লাভ বা সফলকাম উভয় অর্থে - ইহলৌকিক ও পারলৌকিক। পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক অর্থে, বিশ্বাস বা ঈমান এমন বস্তু যা ব্যক্তির চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটায়। ঈমানদার ব্যক্তি অবশ্যই আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালিত করবে, ফলে তার চরিত্র দুর্লভ গুণরাজিতে অলঙ্কৃত হয়ে উঠবে। চরিত্রের এই গুণরাজি-ই (Right Conduct) হচ্ছে আত্মার মোহ মুক্তির পথ বা বেহেস্তের চাবিকাঠি।
১১৩২। 'উম্মী' অর্থাৎ নিরক্ষর। আমাদের নবী সম্পর্কে এই শব্দটি কোরানে পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে আয়াতে [৭ : ১৫৭]। 'উম্মী' শব্দটির মর্মার্থ তিনভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। (১) আমাদের নবী পৃথিবীর কারও কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন নাই। মরণশীল কোনও মানুষই তার শিক্ষক ছিল না। সুতরাং তিনি ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু তাঁর শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ্ - তাই তিনি ছিলেন বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বোচ্চ জ্ঞানে সমৃদ্ধ। পূর্ববর্তী সকল কিতাবধারীদের কিতাব সম্বন্ধে তিনি ছিলেন ওয়াকিবহাল - যদিও তিনি আক্ষরিক ভাবে কোনও লেখাপড়াই জানতেন না। তার এই জ্ঞান তিনি লাভ করেন প্রত্যাদেশের মাধ্যমে। একজন নিরক্ষর ব্যক্তির এরূপ জ্ঞান, কোরানের মত এরূপ গ্রন্থ লাভ এই হচ্ছে আমাদের রাসূলের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেজা। কোরান এমন এক গ্রন্থ, যার বাণী সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করা সারা জীবনের চেষ্টার ফলেও সম্ভব হয় না। কিভাবে একজন অক্ষর জ্ঞানহীন লোকের পক্ষে এরূপ গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব - আল্লাহ্র মোজেজা ব্যতীত ? অক্ষর জ্ঞানহীন নবীর কোরানের মত গ্রন্থ লাভই হচ্ছে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেজা। (২) মানুষের দার্শনিক জ্ঞান কখনও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে পারে না। কোনও না কোনও চিন্তাবিদের (School of thought) দ্বারা তা হয় প্রভাবিত। আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও শিক্ষক। তিনি তো কারও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন না। বিশ্বব্রহ্মান্ডের মালিক আল্লাহ্র বাণী নিখুঁতভাবে, প্রভাবমুক্ত ভাবে হৃদয়ে ধারণের জন্য হযরত মুহম্মদের (সাঃ) মানসিক বিকাশ, চিন্তাধারাকে নূতন শ্লেটের মত আচরবিহীন রাখা প্রয়োজন ছিল, যেনো প্রথম লেখাটি হয় আল্লাহ্র দ্বারা। তাই তিনি ছিলেন নিরক্ষর। (৩) সূরা [৩ : ২০] এবং [৬২ : ২] আয়াতে যে, নিরক্ষর "উম্মীর" উল্লেখ আছে, তা সমসাময়িক আরব মোশরেকদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তারা ছিল অজ্ঞ।
১৬০। আমি তাদের বারটি গোত্র বা জাতিতে বিভক্ত করেছি ১১৩৩। যখন মুসার সম্প্রদায় [পিপাসার্ত হয়ে] তাঁর নিকট পানি প্রার্থনা করলো, আমি প্রত্যাদেশ দ্বারা তাঁকে নির্দেশ দান করলাম, "তোমার লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত কর।" [ফলে] সেখান থেকে বারটি ঝরণাধারা প্রবলবেগে উৎসারিত হলো। প্রত্যেক গোত্র তাদের নিজ নিজ পানির স্থান জেনে নিল। আমি তাদের মেঘের ছায়া দান করেছিলাম, তাদের জন্য মান্না ও কোয়েল [তিতির জাতীয় পাখি] প্রেরণ করেছিলাম, [বলেছিলাম] : "তোমাদের জন্য যে সব ভালো জিনিস সরবরাহ করেছি তা থেকে আহার কর।" [কিন্তু তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলো]। [ফলে] তারা আমার কোন ক্ষতি করে নাই বরং তারা তাদের নিজের আত্মার প্রতি ক্ষতি সাধন করেছিলো ১১৩৪।
১১৩৩। ইহুদীদের ইতিহাসের কিছু ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে এর পরবর্তী আয়াতসমূহে। এ সম্বন্ধে সূরা [২ : ৫৭-৬০] আয়াতে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ইহুদীদের বারটি গোত্র এবং তাদের উপমা সম্বন্ধে বিশদভাবে বলা হয়েছে সূরা [২ : ৬০] আয়াতে এবং এর টীকা ৭৩।
১১৩৪। দেখুন সূরা [২ : ৫৭] আয়াতে এবং টীকা ৭১।
১১৩৫। যেরূপ আয়াত [৭ : ১৯]-এ 'উপভোগ' কথাটির উল্লেখ আছে। এখানে 'আহার' শব্দটি আক্ষরিক ও আলংকারিক উভয় অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আলংকারিক অর্থে কোনও ভালো জিনিসকে উপভোগ করা বোঝানো হয়েছে। সেটা সর্বদা খাদ্য বস্তু নাও হতে পারে।
১১৩৬। এই আয়াতটি সূরা [২ : ৫৮-৫৯] আয়াতের সমতুল্য। এই আয়াতে [৭ : ১৬১] সামান্য ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এখানে "এই জনপদে প্রবেশ কর" এই বাক্যটির পরিবর্তে "এই শহরে বাস কর" এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে ইত্যাদি।
রুকু - ২১
১১৩৭। দেখুন সূরা [২ : ৬৫] আয়াত এবং টীকা ৭৯। ইহুদীদের জন্য সাবাত দিন বা শনিবার দিনটি ছিল কর্মবিরতি দিন। অন্যান্য কাজের মত মাছ ধরাও নিষেধ ছিল এই দিনে যেহেতু শনিবারে কেউ কোন কাজ করতো না, মাছেরা জলাশয়ের তীরবর্তী হয়ে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত। কারণ তারা জানতো যে এ দিনটি তাদের জন্য আছে আল্লাহ্র তরফ থেকে নিরাপত্তা। সপ্তাহের অন্য দিন মাছেরা এরূপ আচরণ করতো না। কারণ সে সব দিনে মাছ ধরার উপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এটা ছিল আইন অমান্যকারীদের জন্য বিরাট প্রলোভন, যা ছিল আল্লাহ্র তরফ থেকে পরীক্ষা। যদিও ইহুদীদের মধ্যে যারা ধর্মভীরু তারা শনিবারে মৎস্য স্বীকারে আপত্তি উত্থাপন করে। কিন্তু যারা অন্যায়কারী, লোভী, তাদের আক্রমণাত্মক ভূমিকার কাছে ধর্মভীরুদের আপত্তি ভেসে যায়। তারা সীমা লঙ্ঘনকারীরূপে বিবেচিত হয়। সম্ভবতঃ কারণ ছিল যে, তারা একের পরে এক এই ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন করে। সুতরাং অলঙ্ঘনীয়ভাবে আল্লাহ্র শাস্তি তাদের উপরে নেমে আসে।
১১৩৮। একদল লোক আছে যারা সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করে যে দুষ্ট ও মন্দ লোকের জন্য সদুপদেশের প্রয়োজনীয়তা নাই। এর উত্তর নিম্নলিখিত ভাবে দেওয়া হয়েছে। (১) মন্দ, বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রতিটি লোকেরই নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য, "দায়িত্ব মুক্তির জন্য" বাক্যটি এই অর্থে ব্যবহৃত। (২) মন্দ বা দুষ্ট যারা হয়তো সময়ের ব্যবধানে তাদের মনোজগতে পরিবর্তন আসতে পারে। পাপী অনুতপ্ত হয়ে ধর্মভীরুতে পরিণত হতে পারে। এভাবেই হয়তো অনুতপ্ত আত্মা রক্ষা পেয়ে যেতে পারে "সম্ভবতঃ তারা আল্লাহ্কে ভয় করবে" এই বাক্যটি এই অর্থে ব্যবহৃত। এই আয়াতটি বিশেষ ভাবে রাসূলের জন্য প্রযোজ্য ছিল, রাসূলের হিজরতের পূর্বে যখন তার আবেদন সত্বেও মক্কাবাসীরা তাঁর উপদেশে কর্ণপাত করতো না, কিন্তু তাই বলে তিনি তাঁর কর্তব্য কর্ম থেকে বিচ্যুত হন নাই। এই উপদেশ রাসূলের সময়ে যেমন প্রযোজ্য ছিল সর্বকালে, সর্বযুগে সকলের জন্য তা সমভাবে প্রযোজ্য।
১৬৬। যখন তাদের ঔদ্ধত্য [সকল] নিষেধের সীমা অতিক্রম করে গেলো, আমি তাদের বলেছিলাম, "ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত বানর হয়ে যাও" ১১৩৯।
১১৩৯। দেখুন সূরা [২ : ৬৫] ও টীকা ৭৯।
১১৪০। তাওরাতের বহু স্থানে এই শাস্তির বর্ণনা আছে।[Deut xxviii 49], "The Lord shall bring a nation against thee from afar, from the end of the earth, as swift as the eagle flieth; a nation whose tongue thon shalt not understand." ইত্যাদি।
১১৪১। পৃথিবী জুড়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে ইহুদী জাতির অবস্থান। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যুগে যুগে ইহুদী জাতি পৃথিবীতে নিগৃহীত হয়েছে। তাদের এই শাস্তি আজও শেষ হয় নাই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে জার্মানদের দ্বারা ইহুদী নিধন যদিও মনে হয় বর্বরোচিত, অমানবিক, তবুও এতবড় দুর্ঘটনা আল্লাহ্র হুকুম ব্যতীত ঘটা অসম্ভব।
১১৪২। কিতাব প্রাপ্ত জাতি মানেই ধার্মিক নয় বা বেহেস্তের অধিকারী নয়, বা আনুষ্ঠানিক ভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা ধার্মিকের লক্ষণ নয়। আনুষ্ঠানিকতা বা কিতাবধারী জাতিরূপে স্বীকৃতি পূণ্যাত্মার মাপকাঠি নয়। যদি কোনও ব্যক্তি বা জাতি পৃথিবীর ভোগ বিলাসকে নৈতিক মূল্যবোধের উর্ধ্বে স্থান দেয়, তবে অবশ্যই পৃথিবীর অন্যায় কাজ বা মোনাফেকী তাদের চোখে অত্যন্ত মনোহর মনে হবে। যে সব প্রলোভনের দ্বারা তারা প্রতারিত হবে তার মধ্যে অপচয় ও উচ্চ জীবন যাত্রার মান বজায় রাখার জন্য প্রতিযোগীতা হবে অন্যতম (যেমন- বাংলাদেশীদের মধ্যে)। "পৃথিবীর অসার আনন্দ সামগ্রী পছন্দ করে" বাক্যটি উপরের অর্থ বহন করে। এসব পাপীরা পরকালের জীবন সম্বন্ধে মিথ্যা ধারণা করে এবং নিজেদের সম্বন্ধে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করে। সূরা [২ : ৮০] আয়াতে বলা হয়েছে যে তারা বলে, "দিন কতক ব্যতীত অগ্নি আমাদের কখনও স্পর্শ করবে না।" আবার সূরা [২ : ৮৮] আয়াতে বলা হয়েছে যে তারা বলে, "আমাদের হৃদয় (আল্লাহ্র বাণী দ্বারা) আচ্ছাদিত।" এই সূরাতে [৭ : ১৬৯] বলা হয়েছে তারা বলে "আমাদিগকে ক্ষমা করা হবে।" - এগুলি সবই উদ্ধত্ত অহংকারে আল্লাহ্কে অস্বীকার করার সামিল। কারণ এই বক্তব্যগুলি স্বপ্রণোদিত, আল্লাহ্র নামে মিথ্যাচার।
১১৪৩। তাওরাতে অঙ্গীকারের কথা এখানে বলা হয়েছে। দেখুন তাওরাতে Exod xix. 5-8; xxiv 3; xxxiv 27 এবং আরও অনেক স্থানে।
১৭১। যখন আমি পর্বতকে চাঁদোয়ার মত তাদের উর্ধ্বে স্থাপন করেছিলাম,. এবং তারা ধারণা করেছিলো যে উহা তাদের উপর পড়ে যাবে। [আমি বলেছিলাম] "আমি তোমাদের যা দিলাম তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর ১১৪৪। এবং উহাতে যা আছে তা স্মরণ কর ১১৪৫ যেনো তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করতে পার।"
১১৪৪। দেখুন সূরা [২ : ৬৩] আয়াতে এবং এর টীকা।
১১৪৫। "উহাতে যা আছে" - অর্থাৎ প্রত্যাদেশ পাওয়া কিতাবে।
১১৪৬। এই আয়াতটির ব্যাখ্যার ব্যাপারে তফসীরকারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যে মতবাদ প্রাধান্য বিস্তার করে তা হচ্ছে : আদম সন্তানদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় হযরত আদমের সময়েই নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এই আয়াতে "পৃষ্ঠদেশ দেশ থেকে বংশধরদের বের করেন" কথাটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে, আদমের পশ্চাতে থেকে তাঁর সন্তানদিগকে। অতঃপর এই সন্তানদের থেকে তাদের সন্তানদিগকে আনুক্রমিকভাবে সৃষ্টি করা হয়। এই ধারাবাহিকতাকেই উপরের বাক্যটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে। আদম সন্তান কথাটির অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত মানব জাতি। মানব জাতির মধ্যে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা, যারা এখনও জন্মগ্রহণ করেন নাই তারা সকলেই অন্তর্ভুক্ত। আলোচ্য আয়াতে সেই বিশ্বজনীন প্রতিশ্রুতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যা সমস্ত আদম সন্তানের কাছ থেকে দুনিয়ায় আসারও পূর্বে সৃষ্টি লগ্নে নেয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই অঙ্গীকার প্রত্যেকটি মানুষের মনে আল্লাহ্ পরিচিতির বীজ বপন করে দিয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে লালিত হচ্ছে, সে ব্যাপারে কারও জানা থাক কিংবা না থাক। আর এই বীজেরই ফুল-ফসল এই যে, প্রতিটি মানুষের মনেই ঐশী প্রেম ও মহত্বের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে স্বতন্ত্র, কারণ আল্লাহ্ তাকে বিশেষ মানসিক ক্ষমতায় (faculties of mind) ভূষিত করেছেন। এই বিশেষ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করার জন্য সে আল্লাহ্র সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ, বিশেষতঃ আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সে অঙ্গীকারবদ্ধ। দেখুন সূরা [৫ : ১] আয়াত এবং টীকা ৬৮২। এই অঙ্গীকারের মধ্যে কিছু থাকে প্রকাশ্য, কিছু অপ্রকাশ্য। কিছু সামাজিক কিছু আধ্যাত্মিক - এই সবই নিয়ে আদম সন্তানের ঐশ্বরিক অঙ্গীকার। এই সূরা [৭ : ১৭১] আয়াতে শুধুমাত্র ইহুদীদের সাথে ঐশ্বরিক চুক্তি বা অঙ্গীকারের উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতে [৭ : ১৭২] যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্রষ্টার সাথে এই অঙ্গীকার সারা জাহানের মানব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। ইসলামের মাধ্যমে, আমাদের নবীর মাধ্যমে সেই অঙ্গীকারকে বিশ্ব মানবের সামনে উত্থাপন করা হয়েছে। বিশ্ব মানবের জন্য আমাদের নবীর জীবন ছিল ঐশ্বরিক অর্পিত দায়িত্ব।
১১৪৭। মানব সন্তান স্রষ্টার সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিভাবে সে সেই অঙ্গীকার পূরণ করে ? সৃষ্টির প্রথমে প্রতিটি আত্মা থাকে পূত ও পবিত্র। মানব আত্মা সেই পরমাত্মারই অংশ বিশেষ [১৫:২৯], যিনি অসমান যমীনের মালিক। সুতরাং পূত ও পবিত্র হওয়া তার স্বাভাবিক ধর্ম কিন্তু কালের আবর্তনে পৃথিবীর মোহে, শয়তানের কুমন্ত্রণার কাছে মানুষ হয় পরাজিত, ফলে সে তার আত্মার পবিত্রতা হারায়। আত্মাকে করে ফেলে কলুষিত। আমরা ভুলে যাই মহান সৃষ্টি কর্তার মহত্ব, তাঁর অস্তিত্ব। ভুলে যাই আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা। ভুলে যাই আল্লাহ্র প্রতি আমাদের কর্তব্য ও অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার পালন তখনই সম্ভব যখন আমাদের আত্মাকে পূত পবিত্র রাখতে সক্ষম হব।
১১৪৮। মানব সন্তান "আশরাফুল মাখলুকাত" - কারণ আল্লাহ্ মানব সন্তানের মধ্যে তাঁর রুহুর অংশ বিশেষ ফুৎকার করে দিয়েছেন - যাকে আমরা আত্মা বলি, সূরা [৩৮ : ৭২] আয়াত। এ ব্যতীত আল্লাহ্ মানুষকে দান করেছেন বিশেষ মানসিক দক্ষতা [Faculties of mind]। এই দক্ষতার বলেই সে পশু থেকে উন্নত। আল্লাহ্ মানুষকে দান করেছেন বিবেক। ফলে মানব সন্তান ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা রাখে। সৃষ্টির আদিতে মানব আত্মা থাকে পূত ও পবিত্র। কর্মক্ষেত্রে অন্যায়, অসত্যের দ্বারা আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যের মাধ্যমে সে তার আত্মার পবিত্রতা হারায়। কিন্তু তাঁর জাগ্রত বিবেক সর্ব অবস্থায় তাকে সুপথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত আত্মা বিবেকের এই আহ্বান শুনতে পায় না। পূত ও পবিত্র আত্মা বিবেকের আহ্বানে সাড়া দেয়। সত্যকে অনুধাবন করতে ও সনাক্ত করতে সক্ষম। সুতরাং এ কথা বলার কোনও অবকাশ নাই যে (১) সে অমনোযোগী ছিল, তাকে কেউ সতর্ক করে নাই কারণ তার জাগ্রত বিবেক সদা সতর্ককারী। (২) তার পূর্বপুরুষের পাপের কারণে তার শাস্তি পাওয়া উচিত নয়। কারণ সেতো পূর্বপুরুষদেরই অনুসরণ করেছে মাত্র। মানুষ ভুলে যায় সৃষ্টিকর্তার সাথে তার অঙ্গীকার। ভুলে যায় প্রত্যেক কাজের দায়-দায়িত্ব তার নিজস্ব। কেহ কারও পাপের ভার বহন করবে না। [৩৫ : ১৮, ৩৯ : ৭, ৩৯ : ৭০, ২ : ১৩৯]।
১৭৫। তাদের ঐ ব্যক্তির কাহিনী ১১৪৯ বিবৃত কর যাকে আমি আমার নিদর্শন প্রেরণ করেছিলাম, কিন্তু সে তা বর্জন করেছিলো। সুতরাং শয়তান তাকে অনুসরণ করে, ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।
১১৪৯। তফসীরকারগণ এই আয়াতের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে একমত নন। অনেকে মনে করেন বনী ইসরাঈলের জনৈক বড় আলেম ও অনুসরণীয় ব্যক্তির জ্ঞান ও দর্শনের সুউচ্চ স্তরে পৌঁছার পরে সহসা অভিশপ্ত হয়ে যাওয়ার একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা এবং তার কারণসমূহ বিবৃত হয়েছে [Num xxii, xxiii, xxiv]। এক্ষেত্রে এই আয়াতটিকে বৃহত্তর পরিসরে সার্বজনীন ভাবে চিন্তা করার অবকাশ আছে। এখানে ব্যক্তিকে প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়। সমাজে বহুলোক আছেন যারা আল্লাহ্র নেয়ামতে ধন্য। তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন শাখায় প্রতিভাধর। তাদের প্রতিভা, তাদের অবস্থান, তাদের আধ্যাত্মিক জগতে উচ্চতর আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারতো যদি তারা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত হতো। কিন্তু তারা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পণের বদলে শয়তানের অনুসরণ করে। অর্থাৎ তাদের মেধা, মননশীলতা, সৃজনক্ষমতা, প্রতিভা আল্লাহ্র ওয়াস্তে, মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত না করে স্বার্থপরতা ও অন্যায় অসত্যের পথে নিয়োজিত করে। ফলে আল্লাহ্র যে নেয়ামত ব্যবহারের ফলে, তারা আধ্যাত্মিক উন্নতির সুবর্ণ শিখরে পৌঁছাতে পারতো তার পরিবর্তে তাদের স্বার্থপরতা, পার্থিব ধন সম্পদের জন্য তীব্র আকাঙ্খা তাদের শয়তানের ফাঁদে আকৃষ্ট করে এবং পরিণতিতে ধ্বংসের অতলে তলিয়ে যায়।
১১৫১। কুকুরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গরমের সময়ে সে সর্বদা তার জিহ্বা বের করে হাঁপাতে থাকে। তাকে আক্রমণ করা হোক বা তাড়া করা হোক বা সে পরিশ্রান্ত হোক বা একা একা বিশ্রাম করুক - সব অবস্থাতেই সে তার লোল সর্বস্ব জিহ্বা বের করে হাঁপায়। এভাবে সে অপ্রয়োজনেও তার মুখের লালা নিঃস্মরণ করে। কুকুরের এই স্বভাবের সাথে তুলনা করা হয়েছে সেই সব ব্যক্তির যারা স্রষ্টাকে ও তাঁর নেয়ামতকে অস্বীকার করে। এসব লোকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সর্বদা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিষোদগার করবে। তাদের সাবধান করা হোক বা না হোক, অথবা তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হোক বা না হোক কোনও অবস্থাতেই তারা ঐ কুকুরের মত তাদের বিষাক্ত লালার নিঃস্বরণ বন্ধ করে না। তারা সর্বদা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে তাদের বিষোদগার করবেই। এই উপমার সাহায্যে এসব ঘৃণ্য ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। এসব ঘৃণ্য ব্যক্তিরা তাদের ক্রীড়াকর্মের ফলে, শুধুমাত্র তার নিজেরই আত্মাকে বিষাক্ত করে তাই-ই নয়; এর ফলে তার বিষাক্ত লালা যেখানে পড়ে সেই স্থানকেও বিষাক্ত করে তোলে। অর্থাৎ তার মন্দ কার্যকলাপ দ্বারা অনেকেই প্রভাবান্বিত হয় এবং পরিবেশ নষ্ট হয়। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে, অন্যদের এদের প্রভাব থেকে রক্ষার্থে এগিয়ে আসা। এমনকি ঐ সব বিপথগামী ব্যক্তির মুক্তির জন্যও চেষ্টা করতে হবে।
১৭৮। আল্লাহ্ যাকে পথ প্রদর্শন করেন সেই সঠিক পথে থাকে। যাকে তিনি পথ নির্দেশ প্রত্যাহার করেন এরাই তারা যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১১৫২।
১১৫২। যারা স্রষ্টাকে অস্বীকার করে, তারা স্রষ্টার করুণা ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু যারা আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত তাদের জন্য আল্লাহ্র দয়া ও করুণার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত। যারা স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তারা স্রষ্টার করুণা থেকে বঞ্চিত হয়, ফলে তারা আল্লাহ্র হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়, অর্থাৎ "যাকে তিনি পথ নির্দেশ প্রত্যাহার করেন।" এই বাক্যটি দ্বারা এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে, তারা বিপথগামী কারণ তারা আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত। আর পাপের পথ অতি পিচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপ তার পতনের গতিকে ত্বরান্বিত করে। শেষ পর্যন্ত ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
১১৫৩। এই আয়াতে যারা দোযখের জন্য নির্বাচিত হবে, তাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। মানব সন্তান "আশরাফুল মাখলুকাত," কারণ আল্লাহ্ তাকে বিশেষ মানসিক দক্ষতা (Faculties of mind) দান করেছেন। যারা আল্লাহ্র রাস্তায় চলে না তারা পাপী। পাপীদের মানসিক দক্ষতাসমূহ সঠিকভাবে কার্যকর থাকবে না। কারণ তারা তাদের পাপের দরুণ আল্লাহ্র রহমত বঞ্চিত হয়েছে। ফলে তারা চোখ থাকতেও দেখতে পাবে না, অর্থাৎ তারা হবে অন্তর্দৃষ্টি ও দূর দৃষ্টিহীন ব্যক্তি। কান থাকতেও শুনতে পাবে না, অর্থাৎ আল্লাহ্র বাণী বা মঙ্গলজনক বার্তা যা তাদের জন্য উপকারী তা তাদের হৃদয়ে পৌঁছাবে না। তাদের আত্মা থাকলেও, পাপের দরুণ সে আত্মা হবে অনুভূতি শূন্য। তারা ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারবে না। অর্থাৎ তাদের কোনও মানসিক দক্ষতাই (Faculties of mind) কার্যকর থাকবে না। এসব ব্যক্তি পশুতুল্য। এদের আবাসস্থল- দোযখ।
১১৫৪। আল্লাহ্র নেয়ামতসমূহ যদি আমরা প্রশান্তচিত্তে চিন্তা করি, তবে আমাদের হৃদয়ে তাঁর করুণাসমূহ, তাঁর রহমতের ছবি অাঁকা হতে বাধ্য। যে নিরানব্বই নামে আল্লাহ্কে আমরা স্মরণ করি প্রতিটি নাম স্রষ্টার প্রতি আরোপিত বিশেষণ, গুণাবলী বা বান্দার প্রতি আল্লাহ্র নেয়ামতের নাম যেমন- সূরা ফাতেহায় আল্লাহ্কে আমরা সম্বোধন করেছি। 'রহমান' নামে [পরম করুণাময়], রহিম নামে [পরম দয়াময়], রাব্বুল-আলামীন নামে [সস্নেহে লালনকারী এবং পৃথিবীর সকলের জীবিকা দানকারী]। প্রত্যেকটি নাম আল্লাহ্র এক একটি নেয়ামতের প্রতীক। আল্লাহ্ নিরাকার। তাঁকে স্মরণ করতে হবে তার নেয়ামতকে স্মরণ করে। অন্তরের মাঝে তাঁর নেয়ামত সমূহকে অনুভবের মাধ্যমে আমরা তাঁকে অনুভব করতে পারবো। এই নাম সমূহ হচ্ছে সেই সুন্দর অনুভবের প্রতীক। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে প্রার্থনা ও প্রশংসার মাধ্যমে আল্লাহ্র নাম সমূহের স্মরণ করা। যারা আল্লাহ্র নাম অবজ্ঞা ও ঘৃণার সাথে উচ্চারণ করে, তাদের সংসর্গ ত্যাগ করা উচিত। দেখুন সূরা [১৭ : ১১০] আয়াত।
১৮৩। আমি তাদের সময় প্রদান করবো : আমার পরিকল্পনা অত্যন্ত শক্তিশালী [এব অব্যর্থ]।
১১৫৪-ক। দেখুন সূরা [৬৮ : ৪৪] এবং টীকা ৫৬২৬।
১১৫৫। "তাদের সহচর" - অর্থাৎ আল্লাহ্র নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) যিনি আরবদের মধ্যে বাস করতেন তার কথা এখানে বলা হয়েছে। মক্কার লোকেরা তাকে পাগল বলে সাব্যস্ত করে, কারণ তিনি মক্কাবাসীদের গতানুগতিক জীবন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কিন্তু তার এই আচরণ কোন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ছিল না - তিনি ছিলেন একাধারে কথায়, কাজে, চিন্তায় সত্যবাদী, সৎ, দয়ালু, দুর্বল ও অসহায়ের বন্ধু। পৃথিবীর ধন সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ তাঁর ছিল না। কর্তব্য কার্যে তিনি ছিলেন অবিচল, শক্তিধরের শক্তি বা নিন্দুকের নিন্দা অপমান কিছুই তাঁকে তাঁর কর্তব্য কর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারতো না। দুষ্ট লোকের অনিষ্ট বা তাঁর উপদেশের প্রতি অনীহা বা অবজ্ঞা প্রকাশ করা বা গুরুত্ব না দেয়া কোনও কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতো না। অর্থাৎ এই কামনা বাসনা ভরা পৃথিবীর কোনও কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নাই। কর্তব্য কর্মে, সত্য প্রচারে তিনি ছিলেন অটল, অবিচল, নির্ভীক এক সৈনিক। অন্যায় ও পাপকে তিনি সাহসের সাথে মোকাবিলা করতেন এবং কঠোর ভাষায় এর প্রতিবাদ করতেন। নবীর চরিত্রের এইসব বৈশিষ্ট্য সমকালীন আরবদের চোখে অন্যরকম মনে হতো।
১১৫৬। 'Mubin' বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "স্পষ্ট" এবং ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে perspicuous, আল্ মুস্তাফার (সাঃ) সত্যের প্রচার ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট; সুবিধাবাদী, শক্তিধর বা ক্ষমতাবানদের খুশী করার মত কোনও চাটুকারিতা সেখানে ছিল না। তিনি সমকালীন সমাজের প্রতিটি অন্যায় ও পাপকে অগ্নিঝরা ভাষায় পৃথিবীর সম্মুখে উপস্থাপন করেন। সেখানে কোনও সমঝোতাই স্থান পায় নাই। 'মুবিন' শব্দটি দ্বারা এ কথারই প্রকাশ ঘটেছে।
১১৫৭। এই আয়াতে চিন্তাশীলদের প্রতি আবেদন করা হয়েছে, বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকে অনুধাবনের মাধ্যমে স্রষ্টাকে, স্রষ্টার সৃজনশীল ক্ষমতা, মহিমা এবং করুণাকে অনুধাবনের জন্য। এই বিরাট বিশাল সৃষ্টির তুলনায় মানুষ কত নগন্য, কত তুচ্ছ, কত ক্ষুদ্র এই বোধ তাকে স্রষ্টার বিশালত্বের, তার সার্বভৌমত্বের এবং সবকিছুর উপরে তাঁর কর্তৃত্ব সম্পর্কে অবহিত করে তোলে। এই পৃথিবীতে মানুষের স্থায়িত্ব কাল খুবই ক্ষণস্থায়ী। বুদবুদের ন্যায়ই ক্ষণস্থায়ী, সম্ভবতঃ "নির্ধারিত কাল নিকটবর্তী।" যদি মানুষ এই সব বিশেষ নিদর্শনে দৃষ্টিপাত না করে এবং আল্লাহ্র প্রেরিত দূতদের প্রত্যাদেশে কর্ণপাত না করে তাহলে "তাহারা আর কোন কথায় বিশ্বাস করিবে ?"
১১৫৮। দেখুন সূরা [২ : ১৫] আয়াতে। মানুষের কৃতকর্মের দরুণই মানুষের আত্মা আল্লাহ্র হেদায়েত বা পথ লাভ করে; আবার তার কৃতকর্মের দরুণই তার আত্মা আল্লাহ্র হেদায়েত বিচ্যুত হয়। হেদায়েত বিচ্ছিন্ন আত্মা আল্লাহ্র নূর বঞ্চিত। সে আত্মায় বিরাজ করে নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার। ফলে এসব লোক উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
১১৫৯। এখানে রোজকেয়ামতের উল্লেখ করা হয়েছে। ঠিক কখন শেষের সে দিন আসবে সে ব্যাপারে কেহই কিছু জানে না - জানেন একমাত্র আল্লাহ্। সেই প্রলয়ঙ্কর দিনের ঘটনা সহসাই ঘটবে। কেহ চিন্তা বা ভাবনার অবকাশ পর্যন্ত পাবে না। শেষের সে দিনের ভার অত্যন্ত ভারী। কেহই এমন কি নবী রাসূলেরা পর্যন্ত এ দিন সম্পর্কে সঠিক নন। তাই আমাদের প্রত্যেককে প্রতিমূহুর্তে এইদিন সম্পর্কে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ আছে। বাইবেলে হযরত ঈসা এই দিন সম্পর্কে বলেছেন যে, এই দিনের সঠিক সময় সম্পর্কে তিনি অজ্ঞাত, তবে শেষ প্রলয়ের দিন বা রোজকেয়ামতের দিন হঠাৎ করেই একদিন আসবে। But of that day and that hour knoweth no man, no, not the angles which are in heaven, neither the son, but the Father, Take ye heed, watch and pray for ye know not when the time is (Mark xiii 32-33).
১১৬১। মুহম্মদ মুস্তফা (সাঃ) ছিলেন একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদ বহনকারী, তাদের জন্যই যাদের আছে ঈমান বা বিশ্বাস। কারণ এই সতর্কবাণী দ্বারা এসব ঈমানদার ব্যক্তিরাই লাভবান হবেন। সারা বিশ্ব জাহানের সকলকেই ইসলামের পতাকাতলে আহ্বান করা হয়েছে, কিন্তু সকলে তা গ্রহণ করে না।
রুকু - ২৪
১১৬২। দেখুন সূরা [৪ : ১] এবং টীকা ৫০৪।
১১৬৩। মানব সন্তানের জন্ম রহস্য সৃষ্টির এক অপূর্ব রহস্য। সন্তানের আগমন যখন আগত প্রায়, পিতা-মাতার সর্ব চিন্তা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে নবাগতের চিন্তায়, তার কল্যাণের আকাঙ্খায়। পিতা-মাতা তখন ব্যাকুল ভাবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র দরবারে অনাগত সন্তানের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করে, প্রার্থনা করে সন্তানের নিরাপদ ভূমিষ্ট, নিরাপদ জীবনের জন্য। কিন্তু তাদের এ মানসিকতা যদি সন্তানের জন্মের পরেও রক্ষা করতো, তবে ভবিষ্যতে বংশধরদের জন্য তা হতো কল্যাণকর। পরবর্তী আয়াতে দেখুন।
১১৬৪। 'Salih' যার ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে 'Goodly' এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে, "পূর্ণাঙ্গ সন্তান।" একথাটির অন্তর্নিহিত ভাব হচ্ছে, শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ, স্বাস্থ্যবান, চরিত্রবান ও নৈতিক গুণে গুণান্বিত সন্তান।
১১৬৫। পরিবারে নবজাতকের আগমন আল্লাহ্র তরফ থেকে পাওয়া মূল্যবান উপহার বিশেষ। একটি শিশুর জন্ম, সৃষ্টির এক অত্যাচার্য রহস্য। পিতা-মাতার পক্ষে সুস্থ, সবল, পূর্ণাঙ্গ একটি শিশুর আগমন অপেক্ষা আর বেশী আনন্দের কি আছে। এর ফলে তাদের পক্ষে স্রষ্টার নিকট আরও বেশী কৃতজ্ঞ, আরও বেশী নিবেদিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি এর চিত্র আলাদা। সাধারণতঃ তারা তাদের এই নূতন অতিথির আগমনে আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে শিশুর মঙ্গলার্থে নানা ধরণের কুসংস্কার, আচার অনুষ্ঠান ও পালা-পার্বনাদির আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন- অনেকে মাজারে মানত করে, মাধুলী ধারণ করে ইত্যাদি। আল্লাহ্র আশ্রয়ের পরিবর্তে তারা বিভিন্ন শক্তির আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে তারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে। তারা আল্লাহ্র নামে বিভিন্ন উপাস্যের স্মরণাপন্ন হয়।
১৯২। ওরা না পারে তাদের সাহায্য করতে না পারে নিজেদের সাহায্য করতে।
১৯৩। তোমরা যদি তাদের পথ নির্দেশ দান কর তারা তা মান্য করবে না। তোমরা তাদের আহ্বান কর অথবা চুপ করে থাক, তোমাদের জন্য উভয়ই সমান ১১৬৬।
১১৬৬। যখন কেউ এক আল্লাহ্র উপাসনা ত্যাগ করে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করে, তাদের কাছে সত্যের আহ্বান পৌঁছায় না, তবুও সত্যের প্রচারক যিনি তিনি নিরলসভাবে সত্য প্রচার করে থাকনে। আয়াত [৭ : ১৯৯]-এ যে ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেভাবে।
১১৬৭। মিথ্যা উপাস্যের বহু প্রকার ভেদ আছে। অনেকের ধারণা মিথ্যা উপাস্য মানেই হচ্ছে মূর্তি পূঁজা। উপাস্য নানা ধরণের হতে পারে। হতে পারে তা মূর্তি বা দেবতুল্য ব্যক্তিত্ব, বা নূতন কোনও ধারণা বা কুসংস্কার - যার সাথে মহান স্রষ্টার কোনও সংস্রব নাই। সাধারণ মানুষ এসবে বিশ্বাস করে বিশেষ শক্তিধর হিসেবে। তখন তার ধারণায় স্রষ্টার কাছে নিবেদনের ইচ্ছা অন্তর্হিত হয়। একথা তারা ভুলে যায় যে এসব জিনিস আল্লাহ্ কর্তৃক সৃষ্ট - তাঁর ভৃত্যের মত, তার আইন মানতে বাধ্য। যাদের নিজস্ব শক্তি নাই, যারা নিজস্ব শক্তির জন্য আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল, তারা কিভাবে অন্যের সাহায্যে আসতে পারে ?
১১৬৮। এই আয়াতে ঐ সব মিথ্যা উপাস্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করা হয়েছে। যদি ঐ সব মিথ্যা উপাস্যের নিজস্ব কোনও ক্ষমতা থাকে, তাদের বলা হয়েছে তারা যেনো আল্লাহ্র রাসূলের সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধন করে - তাদের সাধ্যে যতদূর কুলায়। তারা তা পারবে না, কারণ সম্পূর্ণ জিনিসই কুসংস্কারের এবং মিথ্যা ভিত্তির উপরে অবস্থিত।
মন্তব্য : ইসলামে কুসংস্কারকে মিথ্যা উপাস্যেক সমগোত্রিয় বলা হয়েছে।
১৯৭। কিন্তু তাঁকে [আল্লাহ্কে] ব্যতীত তোমরা যাদের আহ্বান কর, [তারা] তোমাদের সাহায্য করতে অক্ষম, এবং সত্যিকার ভাবে নিজেদেরও।
১৯৮। যদি তুমি তাদের সৎ পথে আহ্বান কর, তারা শুনবে না। তুমি দেখবে যে তারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু [প্রকৃত পক্ষে] তারা দেখে না ১১৬৯।
১১৬৯। আল মুস্তফার (সাঃ) চারিত্রিক গুণাবলী, তাঁর সততা, সত্যবাদিতা, পূণ্য কার্যাবলী, সমসাময়িক আরব সমাজে সুনাম অর্জন করে। যে মুস্তফাকে (সাঃ) তারা এক কথায় বিশ্বাস করতো, আল-আমিন রূপে ভূষিত করেছিলো, নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে তাদের সেই আচরণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। কারণ ইসলামের প্রচার ছিল তাদের বহু উপাস্য ও অন্যায় ও অসৎ কাজের বিরুদ্ধে। সুতরাং আরব সমাজের মুশরিকেরা, নবীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। অন্যায়, অসত্য, মন্দ সমষ্টিগতভাবে ন্যায়, সত্য ও ভালোর বিরুদ্ধে বাঁধার প্রাচীর সৃষ্টি করে। ফলে ন্যায়, সত্য ও ভালো সমাজ জীবনে অনুপ্রবেশ লাভে ব্যর্থ হয়। এসব অন্যায়কারীদের আত্মায় আল্লাহ্র নূর প্রবেশে লাভ করে না। হৃদয় হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন। ফলে তারা কান থাকলেও শুনবে না, চোখ থাকলেও দেখবে না, বুদ্ধি থাকতেও অনুধাবনের সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তারা আল-মুস্তফার চারিত্রিক মাধুর্য্য, তার কর্তব্যকর্ম বুঝতে হয় অক্ষম তারা তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে। একথা আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেও যেমন সত্য ছিল, আজও ঠিক সমভাবে প্রযোজ্য। নবীর চরিত্রের পবিত্রতা, ধার্মিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, এবং সৎ জীবন যাপন যা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত ভাস্বর সেই চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য চৌদ্দশ বৎসর পূর্বে যেমন চেষ্টা ছিল, এখনও সমভাবে কাফেররা সচেষ্ট। "তারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছ। কিন্তু তারা দেখে না।"
১১৭০। এই আয়াতে আল্লাহ্ রাসূলকে সান্ত্বনা দান করেছেন। এই আয়াতে রাসূলকে তিনটি নির্দেশ দান করা হয়েছে : (১) তাঁর প্রতি যারা অত্যাচার, অপমান ও ক্ষতি করেছে, তাদের ক্ষমা করার জন্য। (২) সত্যের প্রচার ও প্রসার অব্যাহত রাখা। শুধু প্রচার নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সৎ কাজের প্রয়োগ যথাযথ করতে ও শত্রু-মিত্র সকলের সাথে ন্যায়ের ভিত্তিতে, সমতার ভিত্তিতে সকল কাজ সম্পন্ন করতে নির্দেশ দান করা হয়েছে। (৩) অজ্ঞ ও নির্বোধ লোক, যারা রাসূলের নবুওয়াত সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে, রাসূলের উপরে অন্যায় অত্যাচার করে, গালাগালি, ভর্ৎসনা করে, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, যেনো সত্যকে প্রতিহত করতে পারে, এদেরকে অগ্রাহ্য বা উপেক্ষা করার জন্য নির্দেশ দান করা হয়েছে। এদের সাথে নিষ্ফল বিবাদ বিসংবাদ বা সমঝোতা কিছুরই প্রয়োজন নাই। এই আয়াতের মর্মার্থ এই যে, আপনি অত্যাচারের প্রতিশোধ না দিয়ে তাদের সাথে কল্যাণকর ও সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার করুন। একান্ত কোমলতার সাথে তাদের সত্য ও ন্যায়ের বিষয় বাতলে দিন। কিন্তু বহু মূর্খ এমনও থাকে যারা এহেন ভদ্র আচরণে প্রভাবিত হয় না, বরং এ অবস্থা দর্শনেও তারা মূর্খের মত রূঢ় ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়। এমন ধরণের লোকদের সাথে আপনার আচরণ হবে এই যে, তাদের হৃদয়বিদারক মূর্খ-জনোচিত কথা বার্তায় দুঃখিত হয়ে তাদেরই মত ব্যবহার আপনিও করবেন না, বরং তাদের থেকে দূরে সরে থাকবেন।
১১৭১। আল্লাহ্র রাসূলও ছিলেন রক্তমাংসের মানুষ। সাধারণ মানুষের মত তার মধ্যে সকল রীপুর অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। যেহেতু তিনি ছিলেন মহামানব, তাই এসব রীপুকে তিনি সফলভাবে দমন করে আয়ত্বে আনতে পেরেছিলেন, যা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে এ আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের উপসংহার। কারণ এতে রাসূলকে হেদায়েত করা হয়েছে যে, যারা অত্যাচার উৎপীড়ন করে এবং মূর্খের মত ব্যবহার করে, তাদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন। তাদের মন্দের উত্তর মন্দ দ্বারা দেবেন না। বিষয়টি মানব প্রকৃতির পক্ষে বড়ই কঠিন। রাসূলের মনেও ক্ষণেকের তরে হলেও প্রতিশোধের আকাঙ্খা, বা সামান্য চাতুর্য্য অবলম্বন দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করার বাসনা, সফলতা লাভের জন্য অন্যায়ের সাথে সামান্য সমঝোতার আশ্রয় গ্রহণের লোভ হওয়া ছিল স্বাভাবিক। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সাহায্যে প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে।
মন্তব্য : ওহুদের যুদ্ধে হযরতের (সাঃ) চাচা হযরত হামযা নিহত হলে, কোরেশরা তার লাশের প্রতি অমানবিক ও অবমাননাকর এবং অসম্মান জনক ব্যবহার করে। তখন মহানবী (সাঃ) লাশটির এই অবস্থা দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং প্রতিশোধ স্পৃহা প্রকাশ করেন। এরই প্রেক্ষিতে উপরের আয়াতগুলি নাজেল হয়। এতে রাসূলকে (সাঃ) বলা হয় যে, এটা আপনার মর্যাদা সম্পন্ন নয়। আপনার মর্যাদার উপযোগী হলো ক্ষমা ও অব্যহতি দান করা ও আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করা। সাধারণ মানুষের জন্য উপদেশ হচ্ছে এরূপ ক্ষেত্রে একান্তভাবে আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করে তার হেদায়েত চাওয়া।
১১৭২। আল্লাহ্ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ রক্ষাকারী। যারা ধর্মভীরু বা তাকওয়ার অধিকারী তাদের জীবনে আল্লাহ্ই একমাত্র রক্ষাকারী। আল্লাহ্র আশ্রয় শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। পৃথিবীর প্রতিদিনের জীবন ধারণ অনেক সময়ে আমাদের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি স্থাপন করে। এ সময়ে আমরা কখনও ক্রোধ, কখনও হিংসা, বা দ্বেষ বা প্রতিশোধ গ্রহণে উন্মত্ত হয়ে উঠি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের হিত-অহিত জ্ঞান থাকে না। স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধির বিলোপ ঘটে। আমরা পুরোপুরি শয়তানের আয়ত্বে, শয়তান দ্বারা পরিচালিত হই। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নির্দেশ হচ্ছে প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহ্র আশ্রয় কামনা করা। কেউ যদি তা করে তবে আল্লাহ্ তার জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত করেন এবং তাকে হেদায়েত করেন। অর্থাৎ "তারা [সঠিক] পথ দেখতে পায়।" ভালো-মন্দ, ন্যায় অন্যায় বোঝার ক্ষমতাকে অনুভব করে। অর্থাৎ পুরো আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, যদি কোনও কারণে ক্রোধে, বা প্রতিহিংসায় বা হিংসা দ্বেষে স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি লোপ পায়, তবে নির্দেশ হচ্ছে আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করা তাহলে তার জ্ঞান চক্ষু উন্নীলিত হবে বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হবে এবং সে শয়তানের রাজ্য মুক্ত হবে।
১১৭৩। এই আয়াতে তাদের কথা বলা হয়েছে যারা শয়তানের দ্বারা পরিচালিত হয়। এদের কথা আয়াতে [৭ : ১৯৮]-এ আলোচনা করা হয়েছে। শয়তানের শক্তি সর্বদা সক্রিয়। কখনও তার ক্ষমতার হাত নিস্ক্রিয় থাকে না। যারা শয়তানের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়েছে তাদেরকে এই আয়াতে শয়তানের "সঙ্গী সাথী" রূপে অভিহিত করা হয়েছে। এরা শয়তানের "পরিবার" রূপে চিহ্নিত। এদের শয়তান ক্রমান্বয়ে পাপের পথে গভীর থেকে গভীরে টেনে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে শয়তান নিরলস। শেষ পর্যন্ত শয়তানের অনুসারীদের ধ্বংস অনিবার্য।
১১৭৪। এখানে যে নিদর্শনের উল্লেখ করা হয়েছে, তা কোরানের আয়াত। যারা অবিশ্বাসী তারা কোরানের আয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করে না। তারা কোরানের আয়াতের ব্যাপারে রাসূলকে (সাঃ) এই আয়াতে ব্যঙ্গক্তি করেছে। তারা এমন কথাও বলে যে কোরানের আয়াতগুলি কোন ঐশী বাণী নয়। এগুলি রাসূলের (সাঃ) স্বরচিত। এর উত্তরে বলা যায় কোরানের আয়াতের ভাষার সৌন্দর্য্য, আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি, বর্ণনার মাধুর্য্য যুগ কাল অতিক্রান্ত, কোনও মানুষের পক্ষে যার সমকক্ষ একটি আয়াতও রচনা করা সম্ভব নয়। সেখানে রাসূলের (সাঃ) মত একজন অক্ষর জ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে, যার কোনও পুঁথিগত জ্ঞান বা দার্শনিক জ্ঞান ছিল না, তিনি কিভাবে তা রচনা করলেন ?
১১৭৫। "প্রভুর প্রেরিত আলো" - ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে Light from your lord। আল্লাহ্র "নিদর্শন" বা কোরান হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য আলোক বর্তিকা স্বরূপ, যা আত্মাকে করে উন্নত, আলোকিত। আত্মার অন্তর্দৃষ্টিকে করে উন্মীলিত। সুতরাং এই নিদর্শনকে ইংরেজীতে 'Light' বা আলো বলা হয়েছে, যা আত্মার চক্ষু স্বরূপ। আল্লাহ্র নিদর্শন বা কোরানের শিক্ষা ব্যতীত আত্মা থাকে অন্ধকারে বিভ্রান্ত। এই নিদর্শনের অনুসরণের ফলে সে হয় চক্ষুস্মান। আল্লাহ্র নিদর্শন বা প্রত্যাদেশকে এখানে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে : (১) কোরান বা আল্লাহ্র নিদর্শন হচ্ছে আধ্যাত্মিক দৃষ্টি শক্তি স্বরূপ। (২) নিদর্শন হচ্ছে জীবন পথের পথ নির্দেশিকা স্বরূপ ও (৩) তাঁর দয়া। এর মধ্যে নম্বর (১) হচ্ছে সর্বোচ্চ। কারণ এ যেনো অন্ধজনে দৃষ্টি দান করা। অন্ধ ব্যক্তির অন্ধত্ব মোচনের সাথে সাথে তার পরিচিত পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে যায়। পৃথিবীর রূপ, রস, বর্ণ, সব তার চোখে সম্পূর্ণ নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি করে। ঠিক সেইরূপ যাদের আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব মোচন হয়েছে, তাদের কাছে আধ্যাত্মিক জগতের রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ ধরা পরে। সে তখন আধ্যাত্মিক জগতের সদস্যপদ লাভ করে। এর পরে আসে নম্বর (২) এর স্থান : কোরান হচ্ছে আধ্যাত্মিক জগতের ঠিকানায় পৌঁছানোর পথের নির্দেশিকা, যে পথ অবলম্বন করলে সে পরকালের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে। নম্বর (৩) হচ্ছে আল্লাহ্র অনুগ্রহ বা দয়া যা পাপী পূণ্যাত্মা সবার জন্য সমভাবে প্রবাহিত। যে দৃঢ়ভাবে আল্লাহ্র নিদর্শন-কে অবলম্বন করতে পারে, আন্তরিকভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে, সে আল্লাহ্র করুণা লাভে সক্ষম।
২০৬। যারা তোমার প্রভুর সান্নিধ্যে রয়েছে তারা তাঁর ইবাদত করাকে অবজ্ঞা জ্ঞান করে না ১১৭৬। তারা তাঁর প্রশংসা করে এবং তাঁর সম্মুখে সেজ্দায় অবনত হয় ১১৭৭।
১১৭৬। আধ্যাত্মিক জগতের পথে যত উন্নতি লাভ ঘটবে, তত মোমেন বান্দার চরিত্রে আল্লাহ্র ইবাদতের আকাঙ্খা বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ্ বিশ্ব জগতের প্রভু এবং প্রতিপালক।
১১৭৭। এই সূরাটি শেষ করা হয়েছে 'সিজ্দাবনত হয়' কথাটি দ্বারা। সিজ্দা হচ্ছে বিনয় প্রকাশের সর্বোচ্চ প্রতীক। আল্লাহ্র কাছে বিনয়াবনত ভাবে নিজেকে সমর্পণ করার প্রতীক। আল্লাহ্র নবীর জীবন, প্রত্যাদেশের অর্থ এবং প্রত্যাদেশের সাথে নৈতিক চরিত্রের সম্পর্ক ও আধ্যাত্মিক জীবনের অগ্রগতি এসব সম্পর্কে সুন্দরভাবে আলোচনার পরে, সূরাটি শেষ করা হয়েছে 'সিজ্দা' প্রতীক বা আল্লাহ্র কাছে বিনয়াবনত ভাবে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক জগতে যা১রা উন্নত, তাদের সর্ব অস্তিত্ব, সর্ব চিন্তা, ধ্যান-ধারণা সবই নিবেদিত সেই বিশ্ব প্রভুর মহান দরবারে।