+
-
R
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপ : এই সুন্দর মক্কী সূরাটি পূর্ববর্তী [ ৭৭ নং সূরা ] সূরার ন্যায় প্রাথমিক মক্কী সূরা নয়, আবার সূরা নং ৭৬ এর ন্যায় পরেও অবতীর্ণ হয় নাই, তবে এর সমসাময়িক।
এই সূরার আয়াতগুলির মাধ্যমে আল্লাহ্র সদয় তত্বাবধানের চিত্র অংকন করা হয়েছে যা সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতি ইঙ্গিত দান করে থাকে, যে সময়ে পাপ ও মন্দ ধ্বংস হয়ে যাবে ও ভালো ও পূণ্য স্থায়িত্ব লাভ করবে। সেই সাথে যারা আল্লাহ্র আশ্রয় কামনা করে, তাদের সকলকে সেই আশ্রয়ে আহ্বান করা হয়েছে।
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৫৮৮৯। 'মহা-সংবাদ ' - মহাসংবাদ দ্বারা বুঝানো হয়েছে কেয়ামত দিবস বা পুণরুত্থান দিবসকে। ইহুদী ও খৃষ্টানদের মাঝে পুণরুত্থান দিবস সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ চালু আছে। প্রকৃত পক্ষে ওল্ড টেস্টামেন্টে এ সম্বন্ধে কোনও কিছুই বিবৃত করা হয় নাই, এবং খৃষ্টের সময়েও পুণরুত্থানকে অস্বীকার করা হয়। মোশরেক আরবদের মাঝেও পরলোকের জীবন সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না। সুতারাং খৃষ্টান, ইহুদী ও মোশরেক আরবেরা পুণরুত্থান দিবস বা মহাসংবাদ সম্বন্ধে সংবাদ জানতে চেয়েছে।
সূরা [৩৮ : ৬৭ ] আয়াতে মহাসংবাদ দ্বারা বুঝানো হয়েছে সর্বশক্তিমানের প্রত্যাদেশ বা কোরাণ বা রাসুলের (সা) প্রচারিত, 'সত্য '। এই সত্য বা কোরাণের আবির্ভাব সম্বন্ধে সে সময়ে মোশরেকদের মাঝে সন্দেহ ও তর্কের সৃষ্টি করে। যেহেতু কোরাণের 'সত্য' পুনরুত্থান ও শেষ বিচারের উপরে অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে, সে জন্য সূরা ৭৮ নং এবং সূরা ৩৮ নং এ উল্লেখিত মহা সংবাদ দ্বারা একই বিষয়বস্তুকে বুঝানো হয়েছে।
৫৮৯০। দেখুন [ ১৬ : ১৫ ] আয়াতের টিকা ২০৩৮। আরও দেখুন [ ১৩ : ৩ ] এবং [ ১৫ : ১৯ ] আয়াত। এসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ ভূমন্ডলকে কার্পেটের ন্যায় বিস্তৃত করেছেন এবং কার্পেটকে স্বস্থানে রাখার জন্য যেরূপ পেরেকের প্রয়োজন হয় সেরূপ পর্বতকে সৃষ্টি করেছেন, যেনো ভূঅভ্যন্তরস্ত চলমান শিলারাশির কম্পন থেকে ভূপৃষ্ঠকে রক্ষা করে। এই সূরাতে আল্লাহ্র সৃষ্টির নিদর্শন সমূহকে একের পরে এক উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্যের বিশদ চিত্র অংকন করা হয়েছে [ ৬ - ৭ ] আয়াতে। এর পরে এসেছে মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টির বিষয়। তার পরে ধারাবাহিক ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের বিশ্রাম ও কাজকে যা সম্পৃক্ত করা হয়েছে রাত্রি ও দিনের সাথে [ ৮- ১১ ] আয়াত। অসীম নীল আকাশ যা বিন্যস্ত করা হয়েছে সপ্ত আকাশে এবং সুশোভিত করা হয়েছে অত্যুজ্জ্বল আলোকমালাতে [ ১২ - ১৩ ] আয়াত। মেঘ ও বৃষ্টি এবং ফসলের প্রাচুর্য। এভাবেই আকাশ, পৃথিবী ও মানুষকে এক সূত্রে গ্রথিত করা হয়েছে [ ১৪ - ১৬ ] আয়াত। সৃষ্টির বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং পরলোকের জীবনের প্রতি।
৫৮৯১। রাত্রির অন্ধকারকে এখানে আবরণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি একটি অপূর্ব সুন্দর উপমা। পোষাক বা আবরণ যেরূপ দেহকে শৈত্য ও অত্যাধিক গরম থেকে রক্ষা করে রাত্রির অন্ধকার সেরূপ, আত্মাকে কর্মব্যস্ত দিবসের সংগ্রাম থেকে সাময়িক মুক্তি দান করে থাকে। পার্থিব জগতের ক্লান্তিকর কর্মব্যস্ততা নিশিতের অন্ধকারের আবরণে সাময়িক অবসর লাভে সক্ষম হয়। ঘুম হচ্ছে বিশ্রামের প্রতীক। রাত্রির অন্ধকার মানুষকে সুপ্তির কোলে আশ্রয় দান করে বিশ্রামে সহায়তা করে।
৫৮৯২। Ma'ash - এই শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে জীবিকা। জীবিকা শব্দটি দ্বারা প্রকৃত শব্দের খুব সংঙ্কীর্ণ অর্থ করা হয়েছে। শব্দটি দ্বারা জীবনের ও জীবন ধারণের সকল কর্মকান্ডকে বুঝানো হয়েছে। দিবসকে স্রষ্টা আলোকময় করেছেন যেনো মানুষ তাঁর কর্মব্যস্ততা সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে পারে।
৫৮৯৩। দেখুন [ ৬৫ : ১২ ] আয়াতের টিকা ৫৫২৬ ; [ ২৩ : ১৭ ] আয়াতের টিকা ২৮৭৬; এবং [ ৩৭ : ৬] আয়াতের টিকা সমূহ।
৫৮৯৪। "উজ্জ্বল দীপ" - অর্থাৎ সূর্য। দেখুন সূরা [ ২৫ : ৬১ ] ; [ ৩৩ : ৪৬ ] ; [ যেখানে রাসুলকে (সা) রূপক অলংকারে এ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ] এবং আয়াত [ ৭১ : ১৬ ]।
৫৮৯৫। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সদয় তত্বাবধানকে চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ১) আমাদের চারিপার্শ্বের দৃশ্যমান জগত ও প্রকৃতির বিন্যাস [ আয়াত ৬-৭ ]। ২) মানুষের সৃষ্টি ; মানুষের দৈহিক, আধ্যাত্মিক ও মনোজগতের বৈশিষ্ট্য [ আয়াত ৮ - ১১ ]। ৩) নক্ষত্র খচিত আকাশ ও প্রদীপ্ত সূর্য [ আয়াত ১২ - ১৩ ]। ৪) আকাশ, পৃথিবী ও বায়ুর পরস্পর নির্ভরশীলতা যার প্রকাশ ঘটে পানি চক্রে যা মেঘ ও বৃষ্টির মাধ্যমে, পৃথিবীর উদ্ভিদ জগত ও শষ্য উৎপাদনের মাধ্যমে। এক কথায় বলতে হয় যে, আকাশ, পৃথিবী, বিশ্ব প্রকৃতি, সকল কিছুই আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে শৃঙ্খলার সাথে কাজ করে চলেছে।
যার মন আছে, যে দেখতে জানে সেই বুঝতে পারে সমগ্র সৃষ্টির মাঝে বিশ্ববিধাতার অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ, মঙ্গলময় হাতের স্পর্শ, সদয় তত্বাবধান বিদ্যমান। এর পরেও কি তারা বিশ্বাস করবে না যে, যে বিধাতা এত কিছু করতে সক্ষম, তিনি নির্দ্দিষ্ট দিনে বা কেয়ামত দিবসে ভালোকে মন্দ থেকে আলাদা করতেও সক্ষম এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম ?
৫৮৯৬। দেখুন [ ৩৭ : ২১ ] আয়াত ও টিকা ৪০৪৭ এবং [ ৩৬ : ৫৯] আয়াত ও টিকা ৪০০৫। শেষ বিচারের দিনকে বলা যায় ভালো ও মন্দকে আলাদা ভাবে সনাক্ত করার দিন। এই দিনকেই বলা হয়েছে "বিচার দিবস" বা ভালো ও মন্দের ফয়সালা দিবস।
৫৮৯৭। ইস্রাফীল হচ্ছেন ফেরেশতা যাকে আল্লাহ্ শিঙ্গাতে ফুঁৎকারের জন্য নিযুক্ত করেছেন। শিঙ্গাতে ফুৎকার হচ্ছে বিচার দিবসের পূর্ব ঘোষণা। দেখুন [ ৩৯: ৬৮ ] আয়াত ও টিকা ৪৩৪৩ এবং [ ৬৯ : ১৩ ] আয়াত ও টিকা ৫৬৪৮।
৫৮৯৮। বিচার দিবসের ঘোষণার সাথে সাথে যে পরিবর্তন হবে তারই বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। পুরানো ও দৃশ্যমান বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সম্পূর্ণরূপে বদলে যাবে। এবং সেখানে নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে। শুধু পৃথিবীই নয় আকাশের দৃশ্যও সম্পূর্ণরূপে পরিবতির্ত হয়ে পড়বে। এই আয়াতে আকাশের এবং পরের আয়াতে পৃথিবীর পরিবর্তনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আকাশের রহস্যের দ্বার উম্মুক্ত করা হবে। সদৃঢ় পর্বতমালা মরীচিকার ন্যায় অদৃশ্য হয়ে যাবে।
৫৮৯৯। দোযখ হচ্ছে পাপীদের বাসস্থান বা পাপের প্রতিমূর্তি। দোযখকে বর্ণনা করা হয়েছে সেই সব প্রাণীর সাথে যারা শিকার ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। হিংস্র প্রাণী থেকে যেরূপ সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়, দোযখ থেকেও আমাদের সেরূপ সর্বদা সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যারা সীমালংঘনকারী,যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচারণ করে; তাদের জন্য দোযখের স্থান নির্ধারিত করা হয়েছে, যেখান থেকে আল্লাহ্র হুকুম ব্যতীত তাদের মুক্তি নাই। [ দেখুন ৬ : ১২৮ আয়াত ও টিকা ৯৫১ ]।
৫৯০০। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ১০ : ৪ ] ও টিকা ১৩৯০ ; আরও দেখুন [ ৩৮ : ৫৭ ] আয়াত ও টিকা ৪২১৩।
৫৯০১। আল্লাহ্র দেয়া সীমালংঘন করার প্রবণতা হচ্ছে একধরণের আধ্যাত্মিক ব্যাধি। এই ব্যাধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এসব ব্যাধিগ্রস্থ লোক অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র দিকে মুখ ফেরাতে অস্বীকার করে। সীমালংঘণকারীদের শেষ পরিণতির বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। দোযখের আগুন তাদের জন্য ক্রমান্বয়ে অধিক শাস্তিদায়ক হতে থাকবে। সে আগুনের তাপকে ঠান্ডা করার কোনও উপায় থাকবে না। তাঁদের খাদ্য ও পানীয় হবে পরস্পর বিরোধী বিশৃঙ্খল বস্তু যেমন : ফুটন্ত পানীয়, আবার ভয়াবহ ঠান্ডা,পূঁজের ন্যায় তরল পদার্থ। এই পরস্পর বিরোধী হওয়ার কারণ, তাদের আধ্যাত্মিক জীবনে পরস্পর বিরোধী বৈকল্য। সৃষ্টির আদিতে আত্মা থাকে পূত পবিত্র যার পবিত্রতা মানুষ নষ্ট করে পরস্পর বিরোধী বিশৃঙ্খল ও আত্মার অনুপযোগী চিন্তাধারা ও কর্মধারার মাধ্যমে। তাদের পরস্পর বিরোধী চিন্তার ও কর্মের পরিণতি হবে পরস্পর বিরোধী শাস্তি। আত্মার মাঝে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে পরিণতিতে তারা আত্মার শান্তি ও শৃঙ্খলা হারাবে এবং এদের জন্যই আছে পরস্পর বিরোধী উপযুক্ত শাস্তি।
৫৯০২। পৃথিবীতে সীমালংঘনকারীরা পরলোকে হিসাবের ভয়ে শংকিত হবে না। কারণ পাপের পথ অত্যন্ত পিচ্ছিল ও নিম্নগামী। এই পথে অবতরণে, গতি হয় ত্বরান্বিত এটা কোনও একক কর্মের পরিণতি নয়, বরং সমন্বিত পাপ কর্মের পরিণতি যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আল্লাহ্র প্রদত্ত নৈতিক মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করে থাকে। ফলে তাদের কোনও আধ্যাত্মিক দায় দায়িত্ব থাকে না। এরা অবজ্ঞা ভরে আল্লাহ্র সত্যকে মিথ্যা বলার মত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে। যেখানে বিশ্ব জুড়ে আল্লাহ্র নিদর্শন বর্তমান এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ বান্দার জন্য অবারিত সেখানে তারা আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহ ও অনুগ্রহকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করে। তাদের কর্মফল হারিয়ে যায় না, মহাকালের খাতায় তা অক্ষয়ভাবে রক্ষিত হয়, যেনো প্রতিটি কর্মকে বিচার দিবসে হিসাবের সম্মুখীন করা যেতে পারে।
৫৯০৩। যদি অনুতপ্ত না হয়, তবে পাপীদের অন্তরে পাপ করার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ফলে পাপীদের আধ্যাত্মিক জগত ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে অন্ধকার থেকে আরও গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। সুতারাং ধীরে ধীরে তাদের শাস্তির পরিণামও বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
রুকু - ২
৫৯০৪। "পরিতৃপ্তি" - এর অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রকৃত মুক্তিলাভ। আত্মার এই মুক্তিলাভকে ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। পৃথিবীতে আত্মার অভিব্যক্তি, ঘাত প্রতিঘাত, দুঃখ বেদনা,সফলতা, ব্যর্থতা, রোগ,শোক প্রভৃতি জীবনের বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিবেশ ও ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের রীপু সমূহ যথা : কাম, ক্রোধ, লোভ, অহংকার, আত্মগরিমা, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি; মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে অবদমিত করার প্রয়াস পায়। পরিবেশগত অবস্থা ও রীপুর দহন থেকে মুক্তি লাভ করার অর্থ শুধুমাত্র নিরাপত্তা ও শান্তি লাভ করা নয়। এর অর্থ অনেক ব্যপক। এর অর্থ নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে বা মঞ্জিলে পৌঁছানোর বা সর্বোচ্চ প্রাপ্তি লাভের সফলতার আনন্দ যা আত্মাকে স্বর্গীয় শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের পবিত্র অনুভূতি সীমাহীন তৃপ্তিতে হৃদয়কে আপ্লুত করে ফেলবে। আত্মার এই অনুভূতি ও মুক্তিই পারে মানুষকে স্বর্গীয় শান্তির পরশ দান করতে, যা হচ্ছে 'মুত্তাকীদের জন্য সাফল্য "। দেখুন [ ৪৪ : ৫৭ ] আয়াতের টিকা ৪৭৩৩।
৫৯০৫। আধ্যাত্মিক সাফল্যের যে তৃপ্তি, যে সাফল্যের উল্লেখ পূর্বের আয়াতে করা হয়েছে, তার প্রতীক ধর্মী আত্মিক পরিতৃপ্তির উদাহরণ দেয়া হয়েছে তিনটি আয়াতের মাধ্যমে [ ৩২ - ৩৪ ] আয়াত। এবং সেই সাথে ৩৫ নং আয়াতে দুইটি নাস্তিবাচক উক্তির উল্লেখ করা হয়েছে যা দূরীকরণ দ্বারা আত্মিক সুখ ও শান্তির বৃদ্ধি ঘটে। আত্মিক প্রশান্তির তিনটি উদাহরণের প্রথমটি হচ্ছে 'উদ্যান' যা 'দ্রাক্ষা' প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। বেহেশতের শান্তির বর্ণনায় অনেক সময়েই বাগানের উল্লেখ করা হয়েছে অথবা বলা চলে সুন্দর উদ্যান হচ্ছে বেহেশতি শান্তির প্রতীক। ফলের উদ্যানকে বিশেষ ভাবে পরিচর্যা ও রক্ষা করতে হয়। এই আয়াতে বিশেষ ভাবে যে ফলের উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে রসে পরিপূর্ণ অতীব সুমিষ্ট দ্রাক্ষা ফল।
৫৯০৬। দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে সমবয়স্ক কুমারী তরুণী। বেহেশতের বর্ণনায় সর্বদা প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান সুখ স্বাচ্ছন্দের উপমার সাহায্যে বেহেশতের আনন্দ, সুখকে অনুধাবন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান বর্ণনায় 'সমবয়স্ক ' শব্দটির উপরে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এই প্রতীকের সাহায্যে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, সমবেদনা,এবং পরস্পরকে বুঝতে পারার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে সমবয়স্ক সাথীদের দ্বারা। আধ্যাত্মিক 'সঙ্গের ' সর্বোচ্চ পরিণতির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে এই শব্দটির মাধ্যমে। বেহেশত্ যেরূপ সময়ের সীমাহীনতায় অনন্ত জীবনের প্রকাশ, সমবয়স্ক শব্দটি দ্বারা সেরূপ পরস্পরের জন্য অসীম ভালোবাসা, আবেগ,অনুভূতি,ভালো লাগার সর্বোচ্চ প্রকাশ ব্যক্ত করা হয়েছে প্রতীকের মাধ্যমে।
৫৯০৭। তৃতীয় উদাহরণ হচ্ছে পূর্ণ পান-পাত্র।
৫৯০৮। উপরের তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তির যে চিত্র আঁকা হয়েছে সেই ছবির পূর্ণতা বা গভীরতা দান করা হয়েছে দুটি নাস্তিবাচক শব্দ দ্বারা।
১) পার্থিব জীবন হচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবন, যে জীবনে জাগতিক সাফল্যই হচ্ছে সর্ব সাফল্যের মানদন্ড। আর এই কারণে সকলেই নিজ সাফল্য প্রদর্শনে সদা ব্যস্ত থাকে এবং আত্মম্ভরিতা ও আত্মগর্বই হচ্ছে মানুষের একমাত্র প্রচারের বিষয়বস্তু। মুত্তাকীরা কোনও অসাড় গর্ব বা অহংকারের বাক্য শুনবে না যা তাদের মানসিক শান্তিকে বিঘ্নিত করতে পারে।
২) সেখানে কোন মিথ্যা বা অসত্য থাকবে না। থাকবে না কোন অবিশ্বস্ততা বা প্রতারণা। ফলে মনের উপরে কোনও অশুভ প্রভাব বা চাপ ফেলবে না। সব কিছুই পরিস্ফুট হবে চরম সত্যের পটভূমিতে।
৫৯০৯। মুত্তাকীরা এ সব লাভ করবেন তাদের সৎকাজের তুল্য বিনিময়ে নয়, তাঁরা তা লাভ করবেন আল্লাহ্র বিশেষ করুণা ও দান হিসেবে যা তাদের জন্য পুরষ্কার স্বরূপ। কারণ তাঁদের যা প্রাপ্য তার থেকে বহুগুণ তাঁদের দেয়া হবে। বেহেশতের বাগানে মুত্তাকীদের সকল চাওয়া পাওয়ার অবসান ঘটে আত্মা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে অপার শান্তির পরশে - যা সর্বশক্তিমানের দান।
৫৯১০। আল্লাহ্র দান ও পুরষ্কারেরর জন্য আবেদন, নিবেদন বা যুক্তির্তক উত্থাপনের ক্ষমতা সেদিন কারও থাকবে না। কিংবা আল্লাহ্র ন্যায় বিচারে প্রাপ্ত শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যও পাপীদের আবেদন নিবেদন করার ক্ষমতা থাকবে না। ৩৮ নং আয়াতে দেখুন শুধুমাত্র যে সম্মানীয়কে আল্লাহ্ পাপীদের জন্য কথা বলার অনুমতি দেবেন শুধুমাত্র সেই -ই কথা বলতে পারবেন। অবশ্যই "সে ন্যায় কথা বলবে " - অর্থাৎ তিনি ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতেই শুধুমাত্র আবেদন করবেন।
৫৯১১। 'রূহু ' - শব্দটির জন্য দেখুন [ ৭০ : ৪ ] আয়াতের টিকা ৫৬৭৭। রূহু শব্দটি কোরাণের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ স্থলে রূহু শব্দটি দ্বারা ফেরেশতাদের মাঝে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও মর্যদা সম্পন্ন তাঁকেই বুঝানো হয়েছে। কোন কোন তফসীরকারের মতে এর দ্বারা জিব্রাইল ফেরেশতাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ তিনিই আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সমূহ রসুলদের নিকট বহন করে আনেন। দেখুন [ ২৬ : ১৯৩ ] আয়াত ও টিকা ৩২২৪। তবে শব্দটিকে ব্যপক অর্থে নিলে, তার দ্বারা সমস্ত আত্মাকে বুঝানো হয়, যাদের আল্লাহ্র বিচার সভায় সমবেত করা হবে।
৫৯১২। দেখুন উপরের টিকা নং ৫৯১০। বিচার দিবসে আল্লাহ্র সম্মুখে কথা বলার ক্ষমতা কারও থাকবে না। কিন্তু বলা হয়েছে আল্লাহ্র চোখে বিশেষ সম্মানীয় যারা তাদের পাপীদের জন্য আবেদন করার অনুমতি দেয়া হবে। সে সময়ে তাদের আবেদনের ধারা কিরূপ হবে তারও রূপরেখা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করবেন সত্য কিন্তু তা আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের ভিত্তিকে অস্বীকার করে নয়।
৫৯১৩। দেখুন [ ৬৯ : ১ ] আয়াত ও টিকা ৫৬৩৫। বিচার দিবস অবশ্যই আসবে সেদিন মিথ্যার সকল মোহজাল ছিন্ন হয়ে যাবে এবং সত্য তাঁর ঔজ্জ্বল্যে হবে ভাস্বর। প্রকৃত সত্যের রূপ সেদিন সকলেই অনুধাবনে সক্ষম হবে। তবে কেন মানুষ পৃথিবীর এই শিক্ষানবীশকালে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহ্র পানে মুখ ফেরায় না ? আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে না ?
৫৯১৪। পাপের শাস্তি কি আসন্ন ? অবশ্যই হ্যাঁ। পাপের বিচার তিন ভাবে হতে পারে।
১) এই পৃথিবীতেই অনেক সময়ে বাহ্যিকভাবে এই শাস্তি প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু বিবেকের যন্ত্রণা আত্মাকে ক্ষয় করে ফেলে যা লোক চক্ষুতে দৃশ্যমান হয় না। সুতারাং আমরা কেন আল্লাহ্র ক্ষমা ভিক্ষা করি না ?
২) অনেক সময়ে পাপের শাস্তি পৃথিবীর জীবনে অনুভূত হয় না। সেক্ষেত্রে প্রতিটি আত্মার জন্য মৃত্যু হচ্ছে শেষ বিচারের পূর্বের ছোট বিচার বা কেয়ামত বা কবর আযাব প্রাপ্ত অবস্থা। দেখুন [ ৭৫ : ২২ ] আয়াতের টিকা ৫৮২ ২। মৃত্যু যে কোন মূহুর্তে আমাদের দুয়ারে হানা দিতে পারে। সুতারাং আমাদের সে জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত।
৩) সর্বশেষ সংঘটিত হবে শেষ বিচার দিবস। সেদিন এই চেনা পৃথিবীর রূপ যাবে পাল্টে। নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে। সময়ের ধারণা থাকবে না। সময় হয়ে যাবে সীমাহীন যেমন [ ৭০ : ৪] আয়াতে বলা হয়েছে সেদিনের একদিন হবে আমাদের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। সে ভাবে হিসাব করলে শেষ বিচারের দিন আসতে খুব বেশী দেরী নাই। আমাদের তার জন্য এখনই নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত। না হলে পরে আর অনুতাপ করার সময় পাওয়া যাবে না।
৫৯১৫। অবিশ্বাসী কাফেররা সেদিন নির্মম সত্যের মুখোমুখি হবে। সেদিন তার জন্য কোন আশ্রয় থাকবে না। সে বেঁচেও থাকবে না বা মরেও যাবে না। সে থাকবে জীবনমৃত [ ২০ : ৭৪ ]। সেদিন তার আকাঙ্খা হবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন তা সম্ভব হবে না।
সূরা নাবা'
সূরা নাবা' অথবা মহা সংবাদ -৭৮
৪০ আয়াত, ২ রুকু, মক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপ : এই সুন্দর মক্কী সূরাটি পূর্ববর্তী [ ৭৭ নং সূরা ] সূরার ন্যায় প্রাথমিক মক্কী সূরা নয়, আবার সূরা নং ৭৬ এর ন্যায় পরেও অবতীর্ণ হয় নাই, তবে এর সমসাময়িক।
এই সূরার আয়াতগুলির মাধ্যমে আল্লাহ্র সদয় তত্বাবধানের চিত্র অংকন করা হয়েছে যা সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতি ইঙ্গিত দান করে থাকে, যে সময়ে পাপ ও মন্দ ধ্বংস হয়ে যাবে ও ভালো ও পূণ্য স্থায়িত্ব লাভ করবে। সেই সাথে যারা আল্লাহ্র আশ্রয় কামনা করে, তাদের সকলকে সেই আশ্রয়ে আহ্বান করা হয়েছে।
সূরা নাবা' অথবা মহা সংবাদ -৭৮
৪০ আয়াত, ২ রুকু, মক্কী[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
১। তারা কি বিষয়ে বিতর্ক করছে ?
২। মহা -সংবাদ সম্বন্ধে ৫৮৮৯।
২। মহা -সংবাদ সম্বন্ধে ৫৮৮৯।
৫৮৮৯। 'মহা-সংবাদ ' - মহাসংবাদ দ্বারা বুঝানো হয়েছে কেয়ামত দিবস বা পুণরুত্থান দিবসকে। ইহুদী ও খৃষ্টানদের মাঝে পুণরুত্থান দিবস সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ চালু আছে। প্রকৃত পক্ষে ওল্ড টেস্টামেন্টে এ সম্বন্ধে কোনও কিছুই বিবৃত করা হয় নাই, এবং খৃষ্টের সময়েও পুণরুত্থানকে অস্বীকার করা হয়। মোশরেক আরবদের মাঝেও পরলোকের জীবন সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না। সুতারাং খৃষ্টান, ইহুদী ও মোশরেক আরবেরা পুণরুত্থান দিবস বা মহাসংবাদ সম্বন্ধে সংবাদ জানতে চেয়েছে।
সূরা [৩৮ : ৬৭ ] আয়াতে মহাসংবাদ দ্বারা বুঝানো হয়েছে সর্বশক্তিমানের প্রত্যাদেশ বা কোরাণ বা রাসুলের (সা) প্রচারিত, 'সত্য '। এই সত্য বা কোরাণের আবির্ভাব সম্বন্ধে সে সময়ে মোশরেকদের মাঝে সন্দেহ ও তর্কের সৃষ্টি করে। যেহেতু কোরাণের 'সত্য' পুনরুত্থান ও শেষ বিচারের উপরে অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে, সে জন্য সূরা ৭৮ নং এবং সূরা ৩৮ নং এ উল্লেখিত মহা সংবাদ দ্বারা একই বিষয়বস্তুকে বুঝানো হয়েছে।
৩। যে বিষয়ে তাদের মতৈক্য নাই।
৪। সত্য-সত্যই শীঘ্রই তারা জানতে পারবে,
৫। সত্য-সত্যই শীঘ্রই তারা জানতে পারবে,
৬। আমি কি ভূমিকে বিস্তৃত স্থান করি নাই, ৫৮৯০।
৭। এবং পর্বত সমূহকে পেরেক ?
৪। সত্য-সত্যই শীঘ্রই তারা জানতে পারবে,
৫। সত্য-সত্যই শীঘ্রই তারা জানতে পারবে,
৬। আমি কি ভূমিকে বিস্তৃত স্থান করি নাই, ৫৮৯০।
৭। এবং পর্বত সমূহকে পেরেক ?
৫৮৯০। দেখুন [ ১৬ : ১৫ ] আয়াতের টিকা ২০৩৮। আরও দেখুন [ ১৩ : ৩ ] এবং [ ১৫ : ১৯ ] আয়াত। এসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ ভূমন্ডলকে কার্পেটের ন্যায় বিস্তৃত করেছেন এবং কার্পেটকে স্বস্থানে রাখার জন্য যেরূপ পেরেকের প্রয়োজন হয় সেরূপ পর্বতকে সৃষ্টি করেছেন, যেনো ভূঅভ্যন্তরস্ত চলমান শিলারাশির কম্পন থেকে ভূপৃষ্ঠকে রক্ষা করে। এই সূরাতে আল্লাহ্র সৃষ্টির নিদর্শন সমূহকে একের পরে এক উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্যের বিশদ চিত্র অংকন করা হয়েছে [ ৬ - ৭ ] আয়াতে। এর পরে এসেছে মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টির বিষয়। তার পরে ধারাবাহিক ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের বিশ্রাম ও কাজকে যা সম্পৃক্ত করা হয়েছে রাত্রি ও দিনের সাথে [ ৮- ১১ ] আয়াত। অসীম নীল আকাশ যা বিন্যস্ত করা হয়েছে সপ্ত আকাশে এবং সুশোভিত করা হয়েছে অত্যুজ্জ্বল আলোকমালাতে [ ১২ - ১৩ ] আয়াত। মেঘ ও বৃষ্টি এবং ফসলের প্রাচুর্য। এভাবেই আকাশ, পৃথিবী ও মানুষকে এক সূত্রে গ্রথিত করা হয়েছে [ ১৪ - ১৬ ] আয়াত। সৃষ্টির বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং পরলোকের জীবনের প্রতি।
৮। এবং তোমাদের কি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করি নাই,
৯। এবং বিশ্রামের জন্য নিদ্রা,
১০। এবং রাত্রিকে আবরণ স্বরূপ ৫৮৯১
৯। এবং বিশ্রামের জন্য নিদ্রা,
১০। এবং রাত্রিকে আবরণ স্বরূপ ৫৮৯১
৫৮৯১। রাত্রির অন্ধকারকে এখানে আবরণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি একটি অপূর্ব সুন্দর উপমা। পোষাক বা আবরণ যেরূপ দেহকে শৈত্য ও অত্যাধিক গরম থেকে রক্ষা করে রাত্রির অন্ধকার সেরূপ, আত্মাকে কর্মব্যস্ত দিবসের সংগ্রাম থেকে সাময়িক মুক্তি দান করে থাকে। পার্থিব জগতের ক্লান্তিকর কর্মব্যস্ততা নিশিতের অন্ধকারের আবরণে সাময়িক অবসর লাভে সক্ষম হয়। ঘুম হচ্ছে বিশ্রামের প্রতীক। রাত্রির অন্ধকার মানুষকে সুপ্তির কোলে আশ্রয় দান করে বিশ্রামে সহায়তা করে।
১১। এবং জীবিকা আরহণের জন্য দিন ? ৫৮৯২
৫৮৯২। Ma'ash - এই শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে জীবিকা। জীবিকা শব্দটি দ্বারা প্রকৃত শব্দের খুব সংঙ্কীর্ণ অর্থ করা হয়েছে। শব্দটি দ্বারা জীবনের ও জীবন ধারণের সকল কর্মকান্ডকে বুঝানো হয়েছে। দিবসকে স্রষ্টা আলোকময় করেছেন যেনো মানুষ তাঁর কর্মব্যস্ততা সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে পারে।
১২। এবং [ আমি কি ] তোমাদের উপরে সপ্ত আকাশকে তৈরী করি নাই ? ৫৮৯৩
৫৮৯৩। দেখুন [ ৬৫ : ১২ ] আয়াতের টিকা ৫৫২৬ ; [ ২৩ : ১৭ ] আয়াতের টিকা ২৮৭৬; এবং [ ৩৭ : ৬] আয়াতের টিকা সমূহ।
১৩। এবং সেখানে কি স্থাপন করি নাই উজ্জ্বল প্রদীপ ? ৫৮৯৪
৫৮৯৪। "উজ্জ্বল দীপ" - অর্থাৎ সূর্য। দেখুন সূরা [ ২৫ : ৬১ ] ; [ ৩৩ : ৪৬ ] ; [ যেখানে রাসুলকে (সা) রূপক অলংকারে এ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ] এবং আয়াত [ ৭১ : ১৬ ]।
১৪। এবং আকাশ থেকে কি প্রচুর বারি বর্ষণ করি নাই, ৫৮৯৫
৫৮৯৫। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সদয় তত্বাবধানকে চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ১) আমাদের চারিপার্শ্বের দৃশ্যমান জগত ও প্রকৃতির বিন্যাস [ আয়াত ৬-৭ ]। ২) মানুষের সৃষ্টি ; মানুষের দৈহিক, আধ্যাত্মিক ও মনোজগতের বৈশিষ্ট্য [ আয়াত ৮ - ১১ ]। ৩) নক্ষত্র খচিত আকাশ ও প্রদীপ্ত সূর্য [ আয়াত ১২ - ১৩ ]। ৪) আকাশ, পৃথিবী ও বায়ুর পরস্পর নির্ভরশীলতা যার প্রকাশ ঘটে পানি চক্রে যা মেঘ ও বৃষ্টির মাধ্যমে, পৃথিবীর উদ্ভিদ জগত ও শষ্য উৎপাদনের মাধ্যমে। এক কথায় বলতে হয় যে, আকাশ, পৃথিবী, বিশ্ব প্রকৃতি, সকল কিছুই আল্লাহ্র পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে শৃঙ্খলার সাথে কাজ করে চলেছে।
যার মন আছে, যে দেখতে জানে সেই বুঝতে পারে সমগ্র সৃষ্টির মাঝে বিশ্ববিধাতার অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ, মঙ্গলময় হাতের স্পর্শ, সদয় তত্বাবধান বিদ্যমান। এর পরেও কি তারা বিশ্বাস করবে না যে, যে বিধাতা এত কিছু করতে সক্ষম, তিনি নির্দ্দিষ্ট দিনে বা কেয়ামত দিবসে ভালোকে মন্দ থেকে আলাদা করতেও সক্ষম এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম ?
১৫। যার দ্বারা আমি উৎপন্ন করতে পারি শষ্য ও তরি-তরকারী,
১৬। ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্যান ?
১৭। নিশ্চয়ই নির্ধারিত করা আছে বাছাই করার দিন ? ৫৮৯৬
১৬। ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্যান ?
১৭। নিশ্চয়ই নির্ধারিত করা আছে বাছাই করার দিন ? ৫৮৯৬
৫৮৯৬। দেখুন [ ৩৭ : ২১ ] আয়াত ও টিকা ৪০৪৭ এবং [ ৩৬ : ৫৯] আয়াত ও টিকা ৪০০৫। শেষ বিচারের দিনকে বলা যায় ভালো ও মন্দকে আলাদা ভাবে সনাক্ত করার দিন। এই দিনকেই বলা হয়েছে "বিচার দিবস" বা ভালো ও মন্দের ফয়সালা দিবস।
১৮। যে দিন সিঙ্গাতে ফুঁ দেয়া হবে, এবং তোমরা দলে দলে সমাগত হবে। ৫৮৯৭,
৫৮৯৭। ইস্রাফীল হচ্ছেন ফেরেশতা যাকে আল্লাহ্ শিঙ্গাতে ফুঁৎকারের জন্য নিযুক্ত করেছেন। শিঙ্গাতে ফুৎকার হচ্ছে বিচার দিবসের পূর্ব ঘোষণা। দেখুন [ ৩৯: ৬৮ ] আয়াত ও টিকা ৪৩৪৩ এবং [ ৬৯ : ১৩ ] আয়াত ও টিকা ৫৬৪৮।
১৯। এবং আকাশকে উম্মুক্ত করে দেয়া হবে, মনে হবে সেখানে বহু দরজা বিদ্যমান, ৫৮৯৮
৫৮৯৮। বিচার দিবসের ঘোষণার সাথে সাথে যে পরিবর্তন হবে তারই বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। পুরানো ও দৃশ্যমান বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সম্পূর্ণরূপে বদলে যাবে। এবং সেখানে নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে। শুধু পৃথিবীই নয় আকাশের দৃশ্যও সম্পূর্ণরূপে পরিবতির্ত হয়ে পড়বে। এই আয়াতে আকাশের এবং পরের আয়াতে পৃথিবীর পরিবর্তনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আকাশের রহস্যের দ্বার উম্মুক্ত করা হবে। সদৃঢ় পর্বতমালা মরীচিকার ন্যায় অদৃশ্য হয়ে যাবে।
২০। এবং পর্বত সমূহ অদৃশ্য হয়ে যাবে, যেনো তারা ছিলো মরিচীকা।
২১। নিশ্চয় জাহান্নাম অর্তকির্তে আক্রমণের জন্য ওঁৎ পেতে থাকবে, ৫৮৯৯
২২। সীমালংঘনকারীদের জন্য [ যা হবে ] গন্তব্যস্থল।
২১। নিশ্চয় জাহান্নাম অর্তকির্তে আক্রমণের জন্য ওঁৎ পেতে থাকবে, ৫৮৯৯
২২। সীমালংঘনকারীদের জন্য [ যা হবে ] গন্তব্যস্থল।
৫৮৯৯। দোযখ হচ্ছে পাপীদের বাসস্থান বা পাপের প্রতিমূর্তি। দোযখকে বর্ণনা করা হয়েছে সেই সব প্রাণীর সাথে যারা শিকার ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। হিংস্র প্রাণী থেকে যেরূপ সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়, দোযখ থেকেও আমাদের সেরূপ সর্বদা সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যারা সীমালংঘনকারী,যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচারণ করে; তাদের জন্য দোযখের স্থান নির্ধারিত করা হয়েছে, যেখান থেকে আল্লাহ্র হুকুম ব্যতীত তাদের মুক্তি নাই। [ দেখুন ৬ : ১২৮ আয়াত ও টিকা ৯৫১ ]।
২৩। সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে।
২৪। কোনরকম শীতলতা তারা আস্বাদন করবে না অন্য কোন পানীয় নয়,
২৫। ফুটন্ত তরল, এবং প্রচন্ড ঠান্ডা ঘোলা, কালো তরল ব্যতীত - ৫৯০০
২৪। কোনরকম শীতলতা তারা আস্বাদন করবে না অন্য কোন পানীয় নয়,
২৫। ফুটন্ত তরল, এবং প্রচন্ড ঠান্ডা ঘোলা, কালো তরল ব্যতীত - ৫৯০০
৫৯০০। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ১০ : ৪ ] ও টিকা ১৩৯০ ; আরও দেখুন [ ৩৮ : ৫৭ ] আয়াত ও টিকা ৪২১৩।
২৬। [ যা তাদের ] উপযুক্ত তুল্য বিনিময়। ৫৯০১
৫৯০১। আল্লাহ্র দেয়া সীমালংঘন করার প্রবণতা হচ্ছে একধরণের আধ্যাত্মিক ব্যাধি। এই ব্যাধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এসব ব্যাধিগ্রস্থ লোক অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহ্র দিকে মুখ ফেরাতে অস্বীকার করে। সীমালংঘণকারীদের শেষ পরিণতির বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। দোযখের আগুন তাদের জন্য ক্রমান্বয়ে অধিক শাস্তিদায়ক হতে থাকবে। সে আগুনের তাপকে ঠান্ডা করার কোনও উপায় থাকবে না। তাঁদের খাদ্য ও পানীয় হবে পরস্পর বিরোধী বিশৃঙ্খল বস্তু যেমন : ফুটন্ত পানীয়, আবার ভয়াবহ ঠান্ডা,পূঁজের ন্যায় তরল পদার্থ। এই পরস্পর বিরোধী হওয়ার কারণ, তাদের আধ্যাত্মিক জীবনে পরস্পর বিরোধী বৈকল্য। সৃষ্টির আদিতে আত্মা থাকে পূত পবিত্র যার পবিত্রতা মানুষ নষ্ট করে পরস্পর বিরোধী বিশৃঙ্খল ও আত্মার অনুপযোগী চিন্তাধারা ও কর্মধারার মাধ্যমে। তাদের পরস্পর বিরোধী চিন্তার ও কর্মের পরিণতি হবে পরস্পর বিরোধী শাস্তি। আত্মার মাঝে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে পরিণতিতে তারা আত্মার শান্তি ও শৃঙ্খলা হারাবে এবং এদের জন্যই আছে পরস্পর বিরোধী উপযুক্ত শাস্তি।
২৭। কারণ, তারা কখনও [ তাদের কাজের জন্য ] হিসাবের আশংকা করে নাই। ৫৯০২
২৮। তারা [ ধৃষ্টতার সাথে ] আমার নিদর্শন সমূহকে মিথ্যা বলতো।
২৯। এবং আমি সব কিছু নথিতে সংরক্ষিত করেছি।
২৮। তারা [ ধৃষ্টতার সাথে ] আমার নিদর্শন সমূহকে মিথ্যা বলতো।
২৯। এবং আমি সব কিছু নথিতে সংরক্ষিত করেছি।
৫৯০২। পৃথিবীতে সীমালংঘনকারীরা পরলোকে হিসাবের ভয়ে শংকিত হবে না। কারণ পাপের পথ অত্যন্ত পিচ্ছিল ও নিম্নগামী। এই পথে অবতরণে, গতি হয় ত্বরান্বিত এটা কোনও একক কর্মের পরিণতি নয়, বরং সমন্বিত পাপ কর্মের পরিণতি যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আল্লাহ্র প্রদত্ত নৈতিক মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করে থাকে। ফলে তাদের কোনও আধ্যাত্মিক দায় দায়িত্ব থাকে না। এরা অবজ্ঞা ভরে আল্লাহ্র সত্যকে মিথ্যা বলার মত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে। যেখানে বিশ্ব জুড়ে আল্লাহ্র নিদর্শন বর্তমান এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ বান্দার জন্য অবারিত সেখানে তারা আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহ ও অনুগ্রহকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করে। তাদের কর্মফল হারিয়ে যায় না, মহাকালের খাতায় তা অক্ষয়ভাবে রক্ষিত হয়, যেনো প্রতিটি কর্মকে বিচার দিবসে হিসাবের সম্মুখীন করা যেতে পারে।
৩০। " সুতারাং [ তোমাদের কর্মের ফল ] আস্বাদন কর। শাস্তি বৃদ্ধি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কিছু অনুমোদন করবো না। ৫৯০৩
৫৯০৩। যদি অনুতপ্ত না হয়, তবে পাপীদের অন্তরে পাপ করার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ফলে পাপীদের আধ্যাত্মিক জগত ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে অন্ধকার থেকে আরও গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। সুতারাং ধীরে ধীরে তাদের শাস্তির পরিণামও বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
রুকু - ২
৩১। পূণ্যাত্মাদের জন্য আছে [ হৃদয়ের ] ইচ্ছার পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি ৫৯০৪ ; -
৫৯০৪। "পরিতৃপ্তি" - এর অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রকৃত মুক্তিলাভ। আত্মার এই মুক্তিলাভকে ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। পৃথিবীতে আত্মার অভিব্যক্তি, ঘাত প্রতিঘাত, দুঃখ বেদনা,সফলতা, ব্যর্থতা, রোগ,শোক প্রভৃতি জীবনের বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিবেশ ও ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের রীপু সমূহ যথা : কাম, ক্রোধ, লোভ, অহংকার, আত্মগরিমা, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি; মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে অবদমিত করার প্রয়াস পায়। পরিবেশগত অবস্থা ও রীপুর দহন থেকে মুক্তি লাভ করার অর্থ শুধুমাত্র নিরাপত্তা ও শান্তি লাভ করা নয়। এর অর্থ অনেক ব্যপক। এর অর্থ নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে বা মঞ্জিলে পৌঁছানোর বা সর্বোচ্চ প্রাপ্তি লাভের সফলতার আনন্দ যা আত্মাকে স্বর্গীয় শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের পবিত্র অনুভূতি সীমাহীন তৃপ্তিতে হৃদয়কে আপ্লুত করে ফেলবে। আত্মার এই অনুভূতি ও মুক্তিই পারে মানুষকে স্বর্গীয় শান্তির পরশ দান করতে, যা হচ্ছে 'মুত্তাকীদের জন্য সাফল্য "। দেখুন [ ৪৪ : ৫৭ ] আয়াতের টিকা ৪৭৩৩।
৩২। সুরক্ষিত উদ্যান এবং দ্রাক্ষা-লতা ৫৯০৫ ;
৫৯০৫। আধ্যাত্মিক সাফল্যের যে তৃপ্তি, যে সাফল্যের উল্লেখ পূর্বের আয়াতে করা হয়েছে, তার প্রতীক ধর্মী আত্মিক পরিতৃপ্তির উদাহরণ দেয়া হয়েছে তিনটি আয়াতের মাধ্যমে [ ৩২ - ৩৪ ] আয়াত। এবং সেই সাথে ৩৫ নং আয়াতে দুইটি নাস্তিবাচক উক্তির উল্লেখ করা হয়েছে যা দূরীকরণ দ্বারা আত্মিক সুখ ও শান্তির বৃদ্ধি ঘটে। আত্মিক প্রশান্তির তিনটি উদাহরণের প্রথমটি হচ্ছে 'উদ্যান' যা 'দ্রাক্ষা' প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। বেহেশতের শান্তির বর্ণনায় অনেক সময়েই বাগানের উল্লেখ করা হয়েছে অথবা বলা চলে সুন্দর উদ্যান হচ্ছে বেহেশতি শান্তির প্রতীক। ফলের উদ্যানকে বিশেষ ভাবে পরিচর্যা ও রক্ষা করতে হয়। এই আয়াতে বিশেষ ভাবে যে ফলের উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে রসে পরিপূর্ণ অতীব সুমিষ্ট দ্রাক্ষা ফল।
৩৩। সমবয়সী সাথী, ৫৯০৬
৫৯০৬। দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে সমবয়স্ক কুমারী তরুণী। বেহেশতের বর্ণনায় সর্বদা প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান সুখ স্বাচ্ছন্দের উপমার সাহায্যে বেহেশতের আনন্দ, সুখকে অনুধাবন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান বর্ণনায় 'সমবয়স্ক ' শব্দটির উপরে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এই প্রতীকের সাহায্যে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, সমবেদনা,এবং পরস্পরকে বুঝতে পারার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে সমবয়স্ক সাথীদের দ্বারা। আধ্যাত্মিক 'সঙ্গের ' সর্বোচ্চ পরিণতির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে এই শব্দটির মাধ্যমে। বেহেশত্ যেরূপ সময়ের সীমাহীনতায় অনন্ত জীবনের প্রকাশ, সমবয়স্ক শব্দটি দ্বারা সেরূপ পরস্পরের জন্য অসীম ভালোবাসা, আবেগ,অনুভূতি,ভালো লাগার সর্বোচ্চ প্রকাশ ব্যক্ত করা হয়েছে প্রতীকের মাধ্যমে।
৩৪। এবং [ কানায় কানায় ] পূর্ণ পানপাত্র। ৫৯০৭
৫৯০৭। তৃতীয় উদাহরণ হচ্ছে পূর্ণ পান-পাত্র।
৩৫। সেখানে তারা শুনবে না কোন অহংকারের কথা বা মিথ্যা ভাষণ ; ৫৯০৮
৫৯০৮। উপরের তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তির যে চিত্র আঁকা হয়েছে সেই ছবির পূর্ণতা বা গভীরতা দান করা হয়েছে দুটি নাস্তিবাচক শব্দ দ্বারা।
১) পার্থিব জীবন হচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবন, যে জীবনে জাগতিক সাফল্যই হচ্ছে সর্ব সাফল্যের মানদন্ড। আর এই কারণে সকলেই নিজ সাফল্য প্রদর্শনে সদা ব্যস্ত থাকে এবং আত্মম্ভরিতা ও আত্মগর্বই হচ্ছে মানুষের একমাত্র প্রচারের বিষয়বস্তু। মুত্তাকীরা কোনও অসাড় গর্ব বা অহংকারের বাক্য শুনবে না যা তাদের মানসিক শান্তিকে বিঘ্নিত করতে পারে।
২) সেখানে কোন মিথ্যা বা অসত্য থাকবে না। থাকবে না কোন অবিশ্বস্ততা বা প্রতারণা। ফলে মনের উপরে কোনও অশুভ প্রভাব বা চাপ ফেলবে না। সব কিছুই পরিস্ফুট হবে চরম সত্যের পটভূমিতে।
৩৬। ইহা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পুরষ্কার ও উপহার ; ৫৯০৯
৫৯০৯। মুত্তাকীরা এ সব লাভ করবেন তাদের সৎকাজের তুল্য বিনিময়ে নয়, তাঁরা তা লাভ করবেন আল্লাহ্র বিশেষ করুণা ও দান হিসেবে যা তাদের জন্য পুরষ্কার স্বরূপ। কারণ তাঁদের যা প্রাপ্য তার থেকে বহুগুণ তাঁদের দেয়া হবে। বেহেশতের বাগানে মুত্তাকীদের সকল চাওয়া পাওয়ার অবসান ঘটে আত্মা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে অপার শান্তির পরশে - যা সর্বশক্তিমানের দান।
৩৭। যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এই দুই এর মধ্যবর্তী সকল কিছুর প্রভু, যিনি অসীম করুণাময় ; তাঁর সম্মুখে যুক্তি তর্ক করার কারও ক্ষমতা থাকবে না। ৫৯১০
৫৯১০। আল্লাহ্র দান ও পুরষ্কারেরর জন্য আবেদন, নিবেদন বা যুক্তির্তক উত্থাপনের ক্ষমতা সেদিন কারও থাকবে না। কিংবা আল্লাহ্র ন্যায় বিচারে প্রাপ্ত শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যও পাপীদের আবেদন নিবেদন করার ক্ষমতা থাকবে না। ৩৮ নং আয়াতে দেখুন শুধুমাত্র যে সম্মানীয়কে আল্লাহ্ পাপীদের জন্য কথা বলার অনুমতি দেবেন শুধুমাত্র সেই -ই কথা বলতে পারবেন। অবশ্যই "সে ন্যায় কথা বলবে " - অর্থাৎ তিনি ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতেই শুধুমাত্র আবেদন করবেন।
৩৮। সেদিন রূহু ৫৯১১ ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাড়াবে, পরম করুণাময় [আল্লাহ্ ] যাকে অনুমতি দেবেন সে ব্যতীত আর কারও কথা বলার অধিকার থাকবে না, এবং সে ন্যায় কথা বলবে। ৫৯১২
৫৯১১। 'রূহু ' - শব্দটির জন্য দেখুন [ ৭০ : ৪ ] আয়াতের টিকা ৫৬৭৭। রূহু শব্দটি কোরাণের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ স্থলে রূহু শব্দটি দ্বারা ফেরেশতাদের মাঝে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও মর্যদা সম্পন্ন তাঁকেই বুঝানো হয়েছে। কোন কোন তফসীরকারের মতে এর দ্বারা জিব্রাইল ফেরেশতাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ তিনিই আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ সমূহ রসুলদের নিকট বহন করে আনেন। দেখুন [ ২৬ : ১৯৩ ] আয়াত ও টিকা ৩২২৪। তবে শব্দটিকে ব্যপক অর্থে নিলে, তার দ্বারা সমস্ত আত্মাকে বুঝানো হয়, যাদের আল্লাহ্র বিচার সভায় সমবেত করা হবে।
৫৯১২। দেখুন উপরের টিকা নং ৫৯১০। বিচার দিবসে আল্লাহ্র সম্মুখে কথা বলার ক্ষমতা কারও থাকবে না। কিন্তু বলা হয়েছে আল্লাহ্র চোখে বিশেষ সম্মানীয় যারা তাদের পাপীদের জন্য আবেদন করার অনুমতি দেয়া হবে। সে সময়ে তাদের আবেদনের ধারা কিরূপ হবে তারও রূপরেখা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করবেন সত্য কিন্তু তা আল্লাহ্র ন্যায় বিচারের ভিত্তিকে অস্বীকার করে নয়।
৩৯। এই দিন হবে নিশ্চিত বাস্তবতা ৫৯১৩। সুতারাং যার ইচ্ছা হয় সে, এখনো [ সোজাসুজি ] তার প্রভুর নিকট শরণাপন্ন হোক।
৫৯১৩। দেখুন [ ৬৯ : ১ ] আয়াত ও টিকা ৫৬৩৫। বিচার দিবস অবশ্যই আসবে সেদিন মিথ্যার সকল মোহজাল ছিন্ন হয়ে যাবে এবং সত্য তাঁর ঔজ্জ্বল্যে হবে ভাস্বর। প্রকৃত সত্যের রূপ সেদিন সকলেই অনুধাবনে সক্ষম হবে। তবে কেন মানুষ পৃথিবীর এই শিক্ষানবীশকালে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহ্র পানে মুখ ফেরায় না ? আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করে না ?
৪০। সত্যিই তোমাদের আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সাবধান করলাম ৫৯১৪, সেদিন মানুষ [ যে কর্ম ] তার হাত [ মৃত্যুর ] পূর্বে প্রেরণ করেছে, তা প্রত্যক্ষ করবে, তখন অবিশ্বাসীরা বলবে, " দুর্ভাগ্য আমার ! আমি যদি ধূলি [ কণা ] হয়ে যেতাম। " ৫৯১৫
৫৯১৪। পাপের শাস্তি কি আসন্ন ? অবশ্যই হ্যাঁ। পাপের বিচার তিন ভাবে হতে পারে।
১) এই পৃথিবীতেই অনেক সময়ে বাহ্যিকভাবে এই শাস্তি প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু বিবেকের যন্ত্রণা আত্মাকে ক্ষয় করে ফেলে যা লোক চক্ষুতে দৃশ্যমান হয় না। সুতারাং আমরা কেন আল্লাহ্র ক্ষমা ভিক্ষা করি না ?
২) অনেক সময়ে পাপের শাস্তি পৃথিবীর জীবনে অনুভূত হয় না। সেক্ষেত্রে প্রতিটি আত্মার জন্য মৃত্যু হচ্ছে শেষ বিচারের পূর্বের ছোট বিচার বা কেয়ামত বা কবর আযাব প্রাপ্ত অবস্থা। দেখুন [ ৭৫ : ২২ ] আয়াতের টিকা ৫৮২ ২। মৃত্যু যে কোন মূহুর্তে আমাদের দুয়ারে হানা দিতে পারে। সুতারাং আমাদের সে জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত।
৩) সর্বশেষ সংঘটিত হবে শেষ বিচার দিবস। সেদিন এই চেনা পৃথিবীর রূপ যাবে পাল্টে। নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে। সময়ের ধারণা থাকবে না। সময় হয়ে যাবে সীমাহীন যেমন [ ৭০ : ৪] আয়াতে বলা হয়েছে সেদিনের একদিন হবে আমাদের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। সে ভাবে হিসাব করলে শেষ বিচারের দিন আসতে খুব বেশী দেরী নাই। আমাদের তার জন্য এখনই নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত। না হলে পরে আর অনুতাপ করার সময় পাওয়া যাবে না।
৫৯১৫। অবিশ্বাসী কাফেররা সেদিন নির্মম সত্যের মুখোমুখি হবে। সেদিন তার জন্য কোন আশ্রয় থাকবে না। সে বেঁচেও থাকবে না বা মরেও যাবে না। সে থাকবে জীবনমৃত [ ২০ : ৭৪ ]। সেদিন তার আকাঙ্খা হবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন তা সম্ভব হবে না।