Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ১২ জন
আজকের পাঠক ১১৬ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৬৫৪৬০ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬২৩১০৬ বার
+ - R Print

সূরা আন্‌ফাল


সূরা আন্‌ফাল বা যুদ্ধের লুটের মাল - ৮

আয়াত ৭৫, রুকু ১০, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে]




ভূমিকা : পূর্বের সূরাগুলিতে দেখানো হয়েছে কিভাবে কোরানের শিক্ষার ধাপে ধাপে ক্রমবিকাশ ঘটেছে। প্রথম সাতটি সূরা কোরান শরীফের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এই অংশে দেখানো হয়েছে মানুষের ধর্মীয় ইতিহাস ও কিভাবে তার ধাপে ধাপে ক্রমবিকাশ ঘটেছে, কিভাবে রাসূলের (সাঃ) প্রভাবে এক নূতন সম্প্রদায় বা উম্মতের আবির্ভাব ঘটেছে। এই সূরাতে এই নূতন সম্প্রদায়ের ক্রমবিকাশের আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনা করা হয়েছে তাদের সমষ্টিগত অগ্রগতির বিভিন্ন ধাপ।

এই অধ্যায়ে বদরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে উপদেশ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে : (১) যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত গণিমতের বা লুটের মাল, (২) যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীর সৈনিকের যে সব গুণাবলীর প্রয়োজন, (৩) বাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে জয় লাভ করা, (৪) যুদ্ধ জয়ের মূহুর্তে দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন নিজের আত্ম উন্নতির জন্য ও অন্যের জন্য প্রয়োজন।

যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য গণিমতের মালের লোভ হওয়া উচিত নয়। গণিমতের মাল হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের এক বিশেষ সুবিধা, যা অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া, যা আমাদের যুদ্ধ জয়ের কোনও উদ্দেশ্য হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ কোনও সৈনিকের বা সেনাদলের জন্য গণিমতের মাল কোনও ন্যায় সঙ্গত অধিকারের বস্তু হতে পারে না। জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ হচ্ছে আল্লাহ্‌র পক্ষে যুদ্ধ, এই যুদ্ধ জয়ে যা লাভ সবই প্রাপ্য আল্লাহ্‌র। তৃতীয়তঃ গণিমতের মালের সুষ্ঠ বণ্টনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন, যেনো মানুষের স্বার্থপরতা ও লোভ লালসা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে না পারে। গণিমতের মালের এক পঞ্চমাংশ ইমাম বা ধর্মীয় নেতার প্রাপ্য। তিনি তা নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী, নিজ প্রয়োজনে বা গরীব, দুস্থ, বিপদগ্রস্থ, এতিম ও বিধবা নারীদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন [৮ : ৪১]। অবশিষ্ট চার পঞ্চমাংশ বিতরণ করতে হবে রাসূল যেভাবে করতেন তার অনুসরণে। রাসূল গণিমতের মাল শুধুমাত্র যারা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতো তাদের মধ্যেই বিতরণ করতেন তা নয়; যারা এই দুঃসাহসিক অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতার হস্ত প্রসারিত করেছে, স্ব-স্ব কর্তব্য ও দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে তাদেরও যুদ্ধে লব্ধ মালের অংশ দেওয়া হতো, চতুর্থতঃ নিজেদের মধ্যে কোন বিবাদ বা বিসংবাদ নয় - কারণ তা সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে।
সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে বদরের যুদ্ধ। আকাশ ছোঁয়া প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে বদরের যুদ্ধ। যারা মহত্বর কারণের জন্য যুদ্ধ করে, আল্লাহ্‌ স্বয়ং তাদের সাহায্য করেন, তাদের জয় সুনিশ্চিত। যুদ্ধ বন্দীদের সম্পর্কে নির্দেশ দান করা হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সংহতির নির্দেশ আছে এই সূরাতে।

বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসের ১৭ তারিখ শুক্রবারে। এই সূরা, বদরের যুদ্ধের অল্প কিছু পরে নাজেল হয়। যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে সূরা [৩ : ১৩] আয়াতে এবং টীকা ৩৫২।

সারসংক্ষেপ : সমস্ত গণিমতের মাল বিতরণের ভার আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুসারে আল্লাহ্‌র রাসূলের উপরে। বিশ্বাসী মোমেন বান্দারা প্রফুল্ল চিত্তে রাসূলের হুকুম মান্য করবে। যুদ্ধ জয় ও জয়ের পুরস্কার আল্লাহ্‌র নিকট থেকে পাওয়া, বদরের যুদ্ধ এই কথাই প্রমাণ করে [৮ ১-১৯]।

আনুগত্য, শৃঙ্খলা, উৎসাহ উদ্দীপনা, আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতা হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি ও পাপ থেকে আত্মরক্ষার উপায়। পাপ কাজ ক্রমান্বয়ে তার গতি ত্বরান্বিত করে, ফলে পাপের বোঝা একদিন পাপীকে ধ্বংস করে দেয় [৮ : ২০-৩৭]।

বদরের যুদ্ধ ছিল আল্লাহ্‌র পরীক্ষা, এই পরীক্ষা ছিল চারিত্রিক গুণাবলী ও শৌর্য-বীর্যের। বদরের যুদ্ধ এ কথাই প্রমাণ করে যে, চারিত্রিক গুণাবলী ও শৌর্য-বীর্য যে কোনও বাঁধাকে অতিক্রম করতে সক্ষম। আল্লাহ্‌র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, সাহস, অমিত তেজ, সঠিক প্রস্তুতি ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার বিপদকে অতিক্রম করতে পারে, কারণ আল্লাহ্‌র সাহায্য তাদের জন্যই [৮ : ৩৮-৬৪]।

সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ্‌র রাস্তায় যে যুদ্ধ করে, আল্লাহ্‌ তাদের সাহায্য করেন। এ সব সত্যের সৈনিকেরা দশ গুণ বাঁধাকেও অতিক্রম করতে সক্ষম। স্মরণ রাখতে হবে যে, জয়ের মূহুর্তে ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শন উত্তম [৮ : ৬৫-৭৫]।

সূরা আন্‌ফাল বা যুদ্ধের লুটের মাল - ৮

আয়াত ৭৫, রুকু ১০, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে]



০১। তারা তোমাকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে ১১৭৮। বল, "[এই] সম্পদ আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের নিয়ন্ত্রণে ১১৭৯। সুতরাং আল্লাহ্‌কে ভয় কর এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক সহজ সরল রাখ। যদি তোমরা বিশ্বাসী হও তবে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলকে মান্য কর।

১১৭৮। বদরের যুদ্ধ জয়ের পরে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বিলিবণ্টনের প্রশ্নটি আসে। দেখুন এই সূরার ভূমিকা।

১১৭৯। বদর যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের নিয়েই এই আয়াতের বিষয়বস্তু। সে ঘটনাটি ছিল এই যে, গণিমতের মালামাল বিলি বণ্টনের ব্যাপারে মুসলমানদের মাঝে সামান্য মতবিরোধ হয়। ফলে মুসলমানদের চরিত্রে অশুভ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আল্লাহ্‌ এই আয়াতের মাধ্যমে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বিলবণ্টনের নীতিনির্ধারণ করে দেন। সত্য ও ন্যায়ের যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সবই আল্লাহ্‌র। কারণ আল্লাহ্‌র সত্যকে রক্ষা করার জন্যই এই যুদ্ধ। তাঁর অনুগ্রহেই এই সম্পদ হস্তগত হয়, কারও বাহুবলে তা অর্জিত হয় নাই। রাসূল আল্লাহ্‌র ব্যবস্থাপক। আল্লাহ্‌র বিধান অনুযায়ী তা বণ্টন করবেন রাসূল। আল্লাহ্‌র রাস্তায় যুদ্ধের একটাই মানদন্ড, আর তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বস্ততা অর্থাৎ ঈমানের দাবীই হল আনুগত্য। এই বিশ্বস্ততাই সকল মোমেন বান্দাদের ঐক্যের ভিত্তি। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বিলিবণ্টনকে কেন্দ্র করে যে মনোমালিন্যের কারণ ছিল তাঁর আভ্যন্তরীণ সংস্কার ও পারস্পরিক সম্পর্ককে সুন্দর করার উপায় বলা হয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দু হল "তাকওয়া" বা পরহেযগারী বা খোদাভীতি। "নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক সহজ সরল রাখা।" অর্থাৎ অর্থলিন্সা, বা পার্থিব লাভ লোকসান যেনো মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি না করে। সে জন্য সর্বাগ্রে এ আয়াতে সাবধান করা হয়েছে, যাতে পূতঃ পবিত্র এবং নিষ্কলুষ সম্প্রদায়ের অন্তরের বিশ্বাস ও নিঃস্বার্থ মনোভাব এবং ঐক্য ও আত্মত্যাগের প্রেরণা ব্যতীত অন্য কোনও কিছু থাকতে না পারে।

০২। তারাই বিশ্বাসী যাদের হৃদয়, আল্লাহ্‌র নামের উল্লেখে কম্পিত হয়, যখন তারা আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহ আবৃত্তি করতে শোনে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তাদের [সকল] নির্ভরতা [শুধুই] তাদের প্রভুর উপরে স্থাপন করে।

০৩। যারা নিয়মিত সালাত কায়েম করে এবং তাদের জীবিকার জন্য আমি যা অনুগ্রহ প্রদান করেছি তা থেকে [মুক্ত হস্তে] ব্যয় করে; ১১৮০।

১১৮০। "যা অনুগ্রহ প্রদান করেছি" - অর্থাৎ আল্লাহ্‌ যে জীবিকা বা সম্পদ দান করেছেন। এই আয়াত দ্বারা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির বিরুদ্ধে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ মুমিন বান্দাদের জীবিকার ব্যাপারে উদার ও মহৎ।

০৪। এরাই প্রকৃত বিশ্বাসী। তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধাপের মর্যাদা, ক্ষমা এবং উদার জীবিকা।

০৫। ইহা এরূপ ১১৮১ যে তোমার প্রভু সত্যই তোমাকে তোমার বাড়ির বাইরে যেতে আদেশ দিয়েছিলেন, যদিও বিশ্বাসীদের একদল তা অপছন্দ করেছিলো।

১১৮১। বদরের যুদ্ধের পটভূমিতে আয়াতটি নাযেল হয়। আল্লাহ্‌ বিশ্বাসীদের ন্যায়ের যুদ্ধের জন্য গৃহত্যাগ করতে বলেন। 'Haqq' এই শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে "সত্যই", ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে 'Truth' ইত্যাদি। সত্যিকারের মোমেন বান্দা সত্যে বিশ্বাসী, এবং আল্লাহ্‌র আনুগত্যে সঠিক পথ অবলম্বন করে। আল্লাহ্‌ মোমেন বান্দাদের সত্যের পথে ন্যায়ের পথে শতবাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে আদেশ দান করেন - কারণ এই হচ্ছে মুক্তির পথ, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার পথ। আর এই সংগ্রামে বিশ্বাসীদের জয় অবশ্যাম্ভবী।

০৬। সত্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরও তারা তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। মনে হচ্ছিল তারা যেনো মৃত্যুর দিকে পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা যেনো [প্রকৃতই] তা প্রত্যক্ষ করছে ১১৮২।

১১৮২। "সত্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর।" অর্থাৎ মুসলমানদের একটি দল এই জেহাদকে কঠিন মনে করেছিল তারই উল্লেখ এখানে করা হয়েছে। "সত্য" অর্থাৎ জেহাদের ঘোষণা। তারা মনে করেছিলেন যে জেহাদের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। তাদের মনে "জেহাদ"-কে মৃত্যুর পরোয়ানারূপে মনে হয়েছিলো। "তারা যেন মৃত্যুর দিকে পরিচালিত হচ্ছে।"

০৭। দেখ ! আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, [শত্রুদের] দু'দলের একদল তোমাদের [আয়ত্ত্বাধীন] হবে। ১১৮৩ তোমরা চাচ্ছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের হোক, অথচ আল্লাহ্‌ চাচ্ছিলেন তাঁর বাণীকে সত্য দ্বারা সমর্থন করতে এবং অবিশ্বাসীদের [কাফেরদের] নির্মুল করতে;-

১১৮৩। বদরের যুদ্ধের পটভূমি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কোরেশদের এক বাণিজ্য বহর প্রচুর সম্পদসহ সিরিয়া থেকে মক্কাতে প্রত্যাবর্তন করছিলো। সিরিয়া থেকে মক্কা ফিরে যাওয়ার পথে ছিল মদিনায় অবস্থান। পূর্ব শত্রুতা বশতঃ আবু সুফিয়ানের ভয় ছিল মদিনার নব্য মুসলমানদের। এই অমূলক ভয়ের বশবর্তী হয়ে আবু সুফিয়ান মক্কার কোরেশদের নিকট সাহায্যের আবেদন জানায়। মুসলমানদের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় তাদের আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য বহরকে আক্রমণ করতে হবে নয়তো সাহায্যকারী কোরেশ বাহিনীর গতিরোধ করতে হবে। বাণিজ্য বহরকে আক্রমণ করে লুণ্ঠিত করার অর্থ হচ্ছে প্রভূত ধন সম্পদ হস্তগত করা। নিরস্ত্র বাণিজ্য বহরের সাথে যুদ্ধ করে তা লুণ্ঠিত করা অনেক নিরাপদ ও লাভজনক। কারণ এই বাণিজ্য বহর যদিও প্রচুর ধন সম্পদ বহন করেছিল, কিন্তু তার জনবল ছিল মাত্র ৪০ জন এবং তারা ছিল নিরস্ত্র। পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে এই নিরস্ত্র বাণিজ্য বহরকে আক্রমণ করা শুধু যে লাভজনক তাই-ই নয় নিরাপদ-ও। বিকল্প রাস্তাটি হচ্ছে এই লাভজনক ধন সম্পদের আশা ত্যাগ করে, অস্ত্র- শস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধ বিদ্যায় অভিজ্ঞ কোরেশ বাহিনীর মোকাবিল করা। কোরেশ বাহিনীতে যেমন ছিল সৈন্য সংখ্যার আধিক্য, তেমন তারা ছিল অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত। এই আয়াতে যে "দুই দলের" কথা বলা হয়েছে, তার একদল হচ্ছে আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলা, অন্যদল আবু জাহেলের নেতৃত্বে কাফেরদের সশস্ত্র বাহিনী। অপরপক্ষে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০ জন এবং তাঁদের সমরাস্ত্রও ছিল অপ্রতুল। স্বাভাবিকভাবে মুসলমানেরা "চাচ্ছিলো যে, নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তাধীন হোক।" অথচ "আল্লাহ্‌ চাচ্ছিলেন যে, তিনি সত্যকে তাঁর বাণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে এবং কাফিরদেরকে নির্মূল করতে।" মুসলমানেরা যদি সম্পদের লোভ না করে মক্কার কাফেরদের স্বার্থপর স্বৈরাচারী কর্তৃত্বকে পরাজিত করতে পারে, তবে আল্লাহ্‌র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাভাবিকভাবেই মুস্তফার (সাঃ) নেতৃত্বে মুসলমানেরা পার্থিব সম্পদের লোভ ত্যাগ করে মক্কার কোরেশদের মোকাবিলা করে। ফলে তাদের জনবল ও অস্ত্রবল কম থাকা সত্বেও আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রাপ্ত হয় এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে। এই জয় লাভ যেমন ছিল গৌরবময়, তেমন তা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে ছিল সহায়ক। এটাই ছিল সত্যের প্রতিষ্ঠার প্রথম বিজয়।

০৮। যেনো তিনি সত্যের ন্যায্যতা ও অসত্যের মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারেন। যদিও অপরাধীগণের কাছে তা অপছন্দ হয়।

০৯। স্মরণ কর তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে সাহায্যের জন্য মিনতি করেছিলে। এবং তিনি তোমাদের উত্তর দিয়েছিলেন : "অবশ্যই আমি তোমাদের এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবো যারা সারির পর সারিতে আসবে" ১১৮৪।

১১৮৪। দেখুন সূরা [৩ : ১২৩, ১২৫, ১২৬] আয়াতে। বদরের যুদ্ধে আল্লাহ্‌ এক হাজার ফেরেস্তা দ্বারা সাহায্য করেন এবং ওহুদের যুদ্ধে তিন হাজার এবং পাঁচ হাজার ফেরেস্তা দ্বারা সাহায্য করেন।
১০। আল্লাহ্‌ ইহা করেন শুধুমাত্র তোমাদের চিত্তে আশার বাণী এবং [নিরাপত্তার] প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য। [যে কোন ক্ষেত্রে] আল্লাহ্‌র সাহায্য ব্যতীত অন্য কোন সাহায্য নাই ১১৮৫। এবং আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।

১১৮৫। বিপদের দিনে, দুঃখের দিনে আল্লাহ্‌র সাহায্যই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সব সাহায্য ও সহযোগিতা আল্লাহ্‌রই দান। আমাদের পরিবেশ, প্রয়োজন, মানসিকতার সবকিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আল্লাহ্‌ আমাদের তার সাহায্য সহযোগীতার কল্যাণকর হাতকে প্রসারিত করেন। বদরের যুদ্ধ সৎ মানুষের বিপদ ও দুঃখের প্রতীক স্বরূপ। ফেরেস্তা দ্বারা সাহায্য হচ্ছে আল্লাহ্‌র রহমতের প্রতীক সাহায্যের প্রতীক। "তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে সাহায্যের জন্য মিনতি করেছিলে।" এই বাক্যটি জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্ব অবস্থায় প্রযোজ্য। বিপদে আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। এ কথাও বলা হয়েছে, প্রার্থনার জবাব দ্বার প্রান্তে "সারির পরে সারি" কথাটির দ্বারা তাই বোঝানো হয়েছে।

রুকু - ২

১১। স্মরণ কর, তিনি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের [হৃদয়ে] প্রশান্তি দান করার জন্য তোমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন ১১৮৬। এবং তোমাদের পরিষ্কার করার জন্য, শয়তানের স্পর্শ দূর করার জন্য, তোমাদের হৃদয়কে দৃঢ় করার জন্য এবং তোমাদের পদযুগলকে [মাটিতে] স্থির রাখার জন্য, তিনি আকাশ থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন; ১১৮৭, ১১৮৮।

১১৮৬। দেখুন সূরা [৩ : ১৫৪] আয়াত। এই আয়াতের "প্রশান্তি" কথাটি ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে 'Calm' যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় প্রশান্তি। যে কোনও বিপদে, তা ছোটই হোক বা বড়ই হোক চিত্তের প্রশান্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। চিত্তের প্রশান্তি ছাড়া বিপদে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। যখন আমাদের মন উত্তেজিত থাকে তখন আমরা কোনও কাজে সঠিক এবং সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নিতে হই অক্ষম। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন মুসলমানদের অন্তরের প্রশান্তি বজায় রাখার জন্য বদরের যুদ্ধের ময়দানে এক সময়ে ক্ষণিকের জন্য মুসলিম বাহিনীকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করেন। অর্থাৎ যে কোনও বিপদে, বিপদকে মোকাবিলা করার জন্য, অন্তরের প্রশান্তি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী এবং ঘুম অন্তরের প্রশান্তি রক্ষার জন্য ও ক্লান্তি দূর করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

১১৮৭। বদরের যুদ্ধের প্রক্কালে বৃষ্টি হয়, এই বৃষ্টি ছিল আল্লাহ্‌র তরফ থেকে রহমত স্বরূপ। কারণ : (১) যুদ্ধক্ষেত্রে পানির অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। খাবার পানি এবং ওজু ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব আল্লাহ্‌র সৈনিকদের অসুবিধায় ফেলেছিলো। বৃষ্টির পানি তাদের এই অসুবিধা দূর করে পবিত্র করে। (২) মুসলমানেরা যুদ্ধের ময়দানে ছিলো অত্যান্ত দীনহীনভাবে সজ্জিত। তাঁদের না ছিল প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র না ছিল আরাম আয়েশের নিম্নতম উপকরণ। ফলে তারা ক্ষুধা-পিপাসা এবং ক্লান্তিতে কাতর হয়ে পড়েন। বৃষ্টি তাদের এই ক্লান্তি দূর করে। (৩) বৃষ্টির পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রের বালু ছিল ঝুরঝুরে। ফলে ক্লান্ত মুসলমান সৈনিকেরা আলগা বালিতে শক্তভাবে পা রাখতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। বৃষ্টির ফলে মাটি শক্ত হয় এবং তারা দৃঢ় পদক্ষেপে চলতে সক্ষম হন।

১১৮৮। "Stain of Satan" বা "শয়তানের স্পর্শ", ধূলো, বালি, ময়লা হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর এবং অপবিত্রতার প্রতীক। মুসলমানেরা প্রার্থনার পূর্বে ধৌত করে নিজেকে পবিত্র করে। বদরের যুদ্ধে, যেখানে পানির তীব্র অভাব বিরাজ করেছিলো, সেখানে বৃষ্টির পরিষ্কার পানি দ্বারা যুদ্ধক্ষেত্রের সকল আবর্জনা, ময়লা, ধূলোবালি শরীর থেকে ধূয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো মুসলমানেরা। অপবিত্র বস্তু হচ্ছে শয়তানের প্রতীক। সে সব থেকে মুক্ত হওয়ার দরুণ মুসলমানদের মনে জয় সম্বন্ধে সুনিশ্চিত ধারণা জন্মে। কারণ ক্ষুধা-পিপাসায় ক্লান্ত, পানির অভাবে অপবিত্র, অপরিচ্ছন্ন থাকার ফলে অপরিসীম ক্লান্তি তাদের গ্রাস করেছিলো। মনে হয়েছিলো, 'বিজয়' অনেক দূরের পথ। কিন্তু বৃষ্টির ময়লা শুধু যে তাদের বাহ্যিক ময়লার আবরণ দূর করে দিয়েছিলো তাই-ই নয় তাদের অন্তরেও আল্লাহ্‌র রহমতের ভরসা সঞ্জীবিত করেছিলো। পূর্বের হতাশা, সন্দেহ, যা ছিলো শয়তানের কুমন্ত্রণা, তা হয়েছিলো দূরীভূত। সত্যাশ্রয়ীদের জন্য আল্লাহ্‌ সাহায্য বিভিন্নভাবে প্রেরণ করেন।

১২। স্মরণ কর; তোমার প্রভু ফেরেশতাদের [মনে] অনুপ্রাণীত করেন [এই বার্তা দ্বারা] "আমি তোমাদের সাথে আছি; সুতরাং বিশ্বাসীদের অবিচলিত রাখ। আমি অবিশ্বাসীদের মনে ধীরে ধীরে ভীতির সঞ্চার করবো। তোমরা তাদের ঘারের উপরে আঘাত কর এবং তাদের প্রত্যেক আঙ্গুলের অগ্রভাগে আঘাত কর" ১১৮৯।

১১৮৯। আল্লাহ্‌ যে সব ফেরেশতাকে মুসলমানদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছিলেন তাদের সম্বোধন করে এই আয়াতে বলা হয়েছে। বাংলা অনুবাদে এই আয়াতে কাফেরদের "স্কন্ধে ও সর্বাঙ্গে" আঘাত করার কথা বলা হয়েছে। ইংরেজী অনুবাদটি এখানে উল্লেখযোগ্য "Smite ye above their necks, and smite all their finger tips off them" "অর্থাৎ" স্কন্ধে ও আঙ্গুলের জোড়ায় জোড়ায় আঘাত হান।" ইংরেজী অনুবাদের "সর্বাংগের" পরিবর্তে "আঙ্গুলের জোড়ায় জোড়ায়" কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সেনার ঘাড়ে, মুখে বা মাথাতে আঘাত করতে পারলে তাকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সে যুগে সকল যোদ্ধা লোহার শিরাস্ত্রন ও বর্ম পরিধান করে থাকে, সুতরাং এসব জায়গায় আঘাত হানা খুব সহজ নয়। কিন্তু যদি যোদ্ধার হাত দুটি অকেজো করা যায়, তাহলে সে অস্ত্র ধরতে হবে অপারগ, তাকে পরাজিত করা ও বন্দী করা তখন অনেক সহজ।

১৩। এর কারণ তারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করে। যদি তারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তবে আল্লাহ্‌ তো শাস্তি দানে কঠোর।

১৪। তখন [এ কথা বলা হবে] : "তাহলে [শাস্তির] আস্বাদ গ্রহণ কর। যারা আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, তাদের জন্য আছে আগুনের শাস্তি।"

১৫। হে বিশ্বাসীগণ ! যখন তোমরা শত্রুদের সুশৃঙ্খল বাহিনীর সম্মুখীন হবে ১১৯০ তখন কখনও তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না।

১১৯০। বর্তমান বিশ্বে রণকৌশলের যে সব আইন বলবৎ আছে, চৌদ্দশ বৎসর পূর্বে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের আইনও ঠিক একইরূপ। জেহাদের আইন এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ শত্রুসেনাদের সুশৃঙ্খল ভাবে চতুর্দিক বেষ্টন করে আক্রমণ করতে বলা হয়েছে। 'Zahfan' এই আরবী শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে meeting in hostile array এবং বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে সম্মুখীন হইবে। এই আরবী শব্দটির দ্বারা প্রকাশ করা হয়ঃ ধীর-স্থির ভাবে, সুপরিকল্পিতভাবে শত্রুসেনাদের আক্রমণ করতে হবে। একবার আক্রমণ বা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, আর পশ্চাদপসরনের কোনও অবকাশ নাই। জেহাদের দুটোই উদ্দেশ্য। হয় যুদ্ধে জয় লাভ, নতুবা যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। এই হবে প্রতিটি যোদ্ধার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, এখানে পিছু হটা বা পলায়ন করার বা দ্বিতীয় চিন্তা করার কোনও অবকাশ নাই। ধর্ম যুদ্ধ বা জেহাদে ব্যক্তিগতভাবে কারও মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু মৃত্যু বা জয় লাভ যাই-ই ঘটুক না কেন ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদের জয় শেষ পর্যন্ত অবধারিত। এখানে জয় অর্থাৎ যে কারণে বা যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল, তা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হবেই। জেহাদে দুটি ক্ষেত্রে পশ্চাৎপসরণের নীতিকে সমর্থন করা হয় : (১) যুদ্ধের রণকৌশল হিসেবে পিছু হটে আসা যেনো দুর্বার বেগে শত্রুসেনার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। (২) যদি কোনও ক্ষুদ্র দল বা ব্যক্তিগতভাবে একক ব্যক্তি মূল সেনাদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তবে তারা পিছু হটে মূল দলের সাথে সংযুক্ত হতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে একা একা যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে কোনও গৌরব নাই। বরং পিছু হটে মূল দলের শক্তি বৃদ্ধির মধ্যে যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত। প্রত্যেক ব্যক্তিকে, প্রত্যেক দলকে, তার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে যুদ্ধে জয় লাভের জন্য।

১৬। সেদিন যুদ্ধ কৌশল ব্যতীত অথবা নিজ সৈন্যদলের পশ্চাদপসরণ ব্যতীত কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে তো আল্লাহ্‌র ক্রোধের পাত্র হবে এবং তার আবাস হবে জাহান্নাম, আর উহা [প্রকৃতই] নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল।

১৭। তোমরা তাদের হত্যা কর নাই; আল্লাহ্‌ করেছেন যখন তুমি [হাত ভর্তি ধূলা] নিক্ষেপ করেছিলে; ১১৯১ সেটা তোমার কাজ ছিলো না, প্রকৃতপক্ষে [তা ছিলো] আল্লাহ্‌র; ইহা এ জন্য যে আল্লাহ্‌ যেনো বিশ্বাসীদের উত্তমরূপে পরীক্ষা করতে পারেন ১১৯২। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ [সব] শোনেন এবং সব জানেন।

১১৯১। যখন যুদ্ধ শুরু হয়, নবী (সাঃ) মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য, তাদের জয়ের জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে প্রার্থনা করেন, এবং একমুঠো ধূলো শত্রুদের প্রতি নিক্ষেপ করেন। আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় এই ধূলো শত্রুদের চক্ষে পতিত হয়। এই ঘটনা শত্রুদের মনো জগতে ভয়ের সঞ্চার করে। ফলে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরাজিত হয়।

১১৯২। বদরের যুদ্ধে মুসলমান ও কোরেশদের মধ্যে যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ। সৈন্য সংখ্যায় কোরেশরা ছিল মুসলমানদের তিন গুণ। শুধু যে সৈন্য সংখ্যা তাই-ই নয়, সমরাস্ত্র, সুযোগ-সুবিধা, সবই ছিল কোরেশদের তুলনায় অপ্রতুল। মুসলমান সেনারা কেহই দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন না, অপর পক্ষে কোরেশদের মধ্যে সে সময়ের নামকরা অনেক যোদ্ধা ছিল, এবং কোরেশ বাহিনী ছিল যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষিত বাহিনী, এরূপ ক্ষেত্রে মুসলমানদের পক্ষে পরাজয় বরণ করাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এই যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য ঈমানের পরীক্ষা। আল্লাহ্‌ পরীক্ষা করতে চেয়েছেন কারা আল্লাহ্‌র জন্য, আল্লাহ্‌র বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নির্ভীকভাবে, মৃত্যুকে ভয় না করে, জীবনকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। মুসলমানদের সমর নায়ক হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) স্বয়ং, যিনি আল্লাহ্‌র প্রেরিত দূত। তার প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও ভালবাসার জন্য যারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত, তাদের জন্য আছে আল্লাহ্‌র অপরিসীম নেয়ামত ও করুণা। এই আয়াতগুলি থেকে আমরা দেখি আল্লাহ্‌র সাহায্য বৃষ্টিরূপে, তন্দ্রারূপে, শত্রুসেনার চোখে ধূলিরূপে, মোমেনদের অন্তরে সাহসরূপে ও শত্রুসেনার অন্তরে ভীতিরূপে, যুদ্ধ জয়ে সাহায্য করে। এভাবেই আল্লাহ্‌র পরীক্ষা বান্দার জীবনে আশীর্বাদরূপে নেমে আসে।

উপদেশ : যা ন্যায় ও সত্য তা প্রতিষ্ঠার জন্য বিপক্ষ দলের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতপত্তিকে ভয় করার কারণ নাই। কারণ সত্যের বা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার সৈনিকের সাহায্যকারী স্বয়ং আল্লাহ্‌।

১৮। [প্রকৃত ঘটনা] ইহাই এবং আরও কারণ হচ্ছে আল্লাহ্‌-ই অবিশ্বাসীদের পরিকল্পনা ও যুদ্ধকৌশল দুর্বল করে দেন।

১৯। [ওহে অবিশ্বাসীরা] তোমরা যদি বিজয় এবং মীমাংসার জন্য প্রার্থনা করে থাক ১১৯৩, এখন তো তোমাদের মধ্যে মীমাংসা হয়েছে। যদি তোমরা [ভুল করা থেকে] বিরত থাক, তবে তা হবে তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ। যদি তোমরা পুনরায় [আক্রমণ কর], আমিও পুনরায় করবো। তোমাদের সেনাবাহিনী [সংখ্যায়] অধিক হলেও তারা তোমাদের ন্যূনতম ভালো করতে পারবে না। নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী আল্লাহ্‌ তাদের সাথে থাকেন।

১১৯৩। 'Fath' - এ আরবী শব্দটির অর্থ জয় লাভ করা, মীমাংসা করা, বিচার করা। এই আয়াতটির অর্থ- মক্কার কোরেশরা সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করেছিলো তাদের জয় লাভের জন্য। তারা তা আশাও করেছিলো, কারণ তাদের ছিল অধিক সুদক্ষ সৈন্য সংখ্যা ও অস্ত্র-শস্ত্রের সম্ভার। কিন্তু এসব তাদের কোনও কাজে আসে নাই। কারণ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ব্যতীত কোনও জিনিসই সফলতা লাভ করতে পারে না।

রুকু - ৩

২০। হে বিশ্বাসীগণ ! আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। তোমরা যখন [তাঁকে কথা বলতে] শুনবে তাঁর থেকে ফিরে চলে যেও না।

২১। তাদের মত হয়ো না যারা বলে, "আমরা শুনলাম," কিন্তু তারা শোনে না ১১৯৪।

১১৯৪। দেখুন সূরা [২ : ৯৩] আয়াত।

২২। আল্লাহ্‌র চোখে নিকৃষ্টতম জীব হচ্ছে বধির এবং মূক, যারা কিছুই বোঝে না ১১৯৫।

১১৯৫। দেখুন সূরা [২ : ১৮] আয়াত।

২৩। আল্লাহ্‌ যদি তাদের মাঝে ভালো কিছু দেখতেন, তবে তিনি অবশ্যই তাদের শোনার [ক্ষমতা] দিতেন। [যথারীতি] যদি তিনি শোনার [ক্ষমতা] দিতেন, তবুও তারা [উপেক্ষা করে] মুখ ফিরাতো এবং [ঈমানকে] অস্বীকার করতো।

২৪। হে বিশ্বাসীগণ ! আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আহ্বানে সাড়া দাও, যখন সে তোমাদের এমন কিছুর জন্য ডাকে যা তোমাদের প্রাণবন্ত করে ১১৯৬। এবং জেনে রাখ আল্লাহ্‌ মানব [সত্ত্বা] ও তাঁর হৃদয়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করেন ১১৯৭। এবং তারই নিকট তোমাদের [সকলকে] একত্রিত করতে হবে।

১১৯৬। এই আয়াতে দুইটা প্রসঙ্গের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে : (১) আল্লাহ্‌র দূত যা কিছু প্রচার করেন, তা আল্লাহ্‌র বাণী বা ইচ্ছা। আল্লাহ্‌র নবী হচ্ছেন আল্লাহ্‌র বাণী প্রচারের মাধ্যম স্বরূপ। সে জন্য এই আয়াতে রাসূল যা প্রচার করেন, তা "আল্লাহ্‌ ও রাসূলের আহ্বান" এই বাক্যদ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। (২) আমাদের উপরে হুকুম হচ্ছে, এই আহ্বানে সাড়া দেওয়া। এই সাড়া হবে আমাদের নৈতিক চরিত্র, কর্ম ও বিবেকের মাধ্যমে। অনেক সময়ে এই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার অর্থ হচ্ছে পার্থিব অনেক কিছুই হারানো এমনকি জীবনকেও বাজি রাখতে হয়। তবুও এই আহ্বান পালনের মধ্যেই নিহিত আছে বৃহত্তর কল্যাণ - মানব সন্তানের জন্য। মানুষের নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন, মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা, সত্য ও ন্যায়ের জন্য ভালোবাসা, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকা, বৃহত্তর কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এ সবই আল্লাহ্‌র রাস্তায় জেহাদ। জেহাদ অর্থ এ যেনো কেউ না বোঝে - যে শুধুমাত্র অস্ত্রের সাহায্যে সম্মুখ সমর করা। সমাজে যুদ্ধাবস্থা সব সময়ে চলতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ্‌র রাস্তায় জেহাদ প্রতিটি সমাজে প্রতিক্ষণে বিরাজমান। কারণ খুব সভ্য ও উন্নত সমাজেও মানুষের মধ্যে অন্যায় করার প্রবণতা ও সত্যকে বিকৃত করার প্রবণতা দেখা যায়। আর অনুন্নত জাতি বা সমাজের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব ক্ষেত্রে এই সব অনাচার, অত্যাচার, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও সংগ্রাম করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জেহাদ। যারা তার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করে। সুতরাং "জেহাদ" কথাটি আক্ষরিক ও আলংকারিক উভয় অর্থে ব্যবহৃত।

১১৯৭। প্রবৃত্তি মানুষকে অনেক সময়েই কুপথে চালনা করে। মানুষের অন্তরের চিন্তা ভাবনার খবর বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। এই প্রবৃত্তির কারণেই মানুষ পাপের পথে পা বাড়ায়। এ সম্বন্ধে সে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করতে পারে, পৃথিবীর চোখে সে ধূলা দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে তাঁর অবস্থান "মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী স্থানে"। অর্থাৎ অন্তরের অন্তঃস্থলে। আল্লাহ্‌ মানুষের অতি নিকটে আছেন। মানুষের মনের উপরে আল্লাহ্‌র পূর্ণ কর্তৃত্ব বিদ্যমান।

২৫। দাঙ্গা এবং নীপিড়নকে ভয় কর ১১৯৮। ইহা যে [কেবলমাত্র] যারা তোমাদের মধ্যে যালেম নির্দিষ্টভাবে তাদেরই কষ্ট দেবে তা নয়, এবং জেনে রাখ শাস্তি প্রদানে আল্লাহ্‌ অত্যন্ত কঠোর।

১১৯৮। ফিত্‌না শব্দের অর্থ পরীক্ষাও হয়, আবার আঘাতও হয় তাছাড়া এমন সব বিষয়কেও ফিত্‌না বলা হয়, যেমন- গৃহযুদ্ধ যা আযাবের কারণ হয়ে থাকে। কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে এই তিন অর্থেই ফিত্‌না শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যখন কোন দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের মধ্যে বিরোধ, বিক্ষোভ দানা বেধে ওঠে, পরিণতিতে দাংগা হাংগামার সৃষ্টি হয়। গৃহযুদ্ধের ফলে শুধু যে, যারা হাংগামাকারী তাদেরই ক্ষতি হয় তা নয়, এর ফলে বহু নিরপরাধ ও নিরীহ লোকের জান ও মালের ক্ষতি সাধন হয়। সে কারণে বলা হয়েছে, "যারা যালিম কেবল তাদেরকেই ক্লিষ্ট করবে না।" বরং যারা সাধারণ লোক, নিরীহ ও নিরাপরাধ, তাদেরও ক্লিষ্ট করবে। সেই কারণে এই আয়াতে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। একথা ইসলামের প্রথম যুগে যেমন প্রযোজ্য ছিল আজও সমভাবে প্রযোজ্য আছে। গৃহযুদ্ধে এক একটা জাতি ধ্বংস হয়ে যায়, যেমন বর্তমানে দেখা যায় আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম দেশে।

২৬। মনে কর, যখন তোমরা ছিলে ছোট [একটি দল], পৃথিবীতে ছিলে অবজ্ঞেয় এবং [সর্বদা] ভয় করতে যে, লোকেরা তোমাদের লুণ্ঠন এবং হরণ করবে ১১৯৯। কিন্তু তিনি তোমাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন, স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদের শক্তিশালী করেন এবং তোমাদের জীবিকার জন্য উত্তম বস্তু দান করেন, যেনো তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার।

১১৯৯। এই আয়াতে মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, যখন তারা ছিল এক ক্ষুদ্র সম্প্রদায় যাদের সকলেই অবহেলা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত। ফলে তারা সকলের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হোত। মুসলমানদের এই অবস্থা ছিলো ইসলাম প্রচারের প্রথম অবস্থায় মদীনাতে হিজরতের পূর্বে। সে সময়ে ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় মক্কার কোরেশদের অত্যাচার, নিপিড়নের শিকার হতো, তাদের জান ও মালের কোনও নিরাপত্তা ছিলো না, তাদের আত্মীয়-স্বজন ও সন্তান সন্ততিরাও কোরেশদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতো না। আল্লাহ্‌র অসীম রহমতে এই ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় মদীনায় নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে। শুধু যে আশ্রয় লাভ করে তাই নয় সেই সাথে তারা পায় নিরাপত্তা, বন্ধুত্ব, সাহায্য, সহযোগীতা, স্নেহ-মায়ার বন্ধন। ফলে সময়ের সাথে সাথে মুসলমানেরা শক্তি সঞ্চয় করে এবং বিশাল এক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়, যারা শেষ পর্যন্ত মক্কা জয়ে সমর্থ হয়। কাবা শরীফ থেকে পৌত্তলিক পূঁজা এবং সেই সাথে সামাজিক অনাচার, দুর্নীতি ও অত্যাচার ও অবিচার দূর করতে সমর্থ হয়।

[উপদেশ : যে কোনও মহৎ ও বৃহৎ কাজের সূচনা হয় অতি ক্ষুদ্রভাবে এবং তারা সে সময়ে সমসাময়িক লোকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও অত্যাচারিত হয়। এই হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। কিন্তু আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা রেখে যে অবিচলভাবে সঠিক পথ অবলম্বন করে অগ্রসর হয় আল্লাহ্‌র সাহায্য তার দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছায় এবং তার এই মহৎ প্রচেষ্টা আল্লাহ্‌র রহমতে জয়যুক্ত হয়।]

২৭। হে বিশ্বাসীগণ ! আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আমানতের বিশ্বাস ভঙ্গ করো না। তোমাদের উপর যে আমানত অর্পণ করা হয়েছে, জেনে শুনে তা আত্মসাৎ করো না ১২০০।

১২০০। এই আয়াতে আমানতের কথা বলা হয়েছে। অনেকের ধারণা আমানত অর্থ শুধুমাত্র টাকা পয়সা ও বিষয়সম্পত্তি। আমানত বহুবিধ। জীবনের সর্বক্ষেত্রই আমানত। আমানতকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : (১) বিষয় সম্পত্তি, জিনিসপত্র, গচ্ছিত মাল ইত্যাদি। (২) গোপন পরিকল্পনা, গোপন কথা, বিশ্বাস ইত্যাদি। (৩) জ্ঞান, প্রতিভা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি যা কিছু আমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে প্রাপ্ত, যা আমাদের জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে বলা হয়েছে। যেমন : অফিসে যিনি যে পদে অধিষ্ঠিত সেই পদটি তার আমানত স্বরূপ। কারণ তাকে ঐ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে জনগণের খেদমত করার জন্য। উপরে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেগুলি সবই আমানত স্বরূপ আল্লাহ্‌র তরফ থেকে পাওয়া। আল্লাহ্‌র প্রদত্ত এই সব আমানত মানুষ খেয়ানত বা ভঙ্গ করতে পারে, (১) টাকা পয়সা, বিষয়-সম্পত্তির আত্মসাতের মাধ্যমে, (২) বা বিশ্বাস বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, (৩) বা ক্ষমতার বা জ্ঞানের বা প্রতিভার অপব্যবহার করে। ইসলাম প্রচারের প্রথম যুগে যখন কোরেশরা মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল, এই আয়াতে বলা হয়েছে মোমেন বান্দারা যেনো আল্লাহ্‌ ও রাসূলের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা না করে। আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য হচ্ছে তাদের আমানত। আমাদের দৈনন্দিক কর্মক্ষেত্রে, অফিসে, আদালতে হাসপাতালে, ব্যাংকে স্কুল-কলেজে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা আল্লাহ্‌র তরফ থেকে আমানত প্রাপ্ত। যার যার কর্তব্য কর্মই হচ্ছে তার জন্য আল্লাহ্‌র তরফ থেকে প্রাপ্ত আমানত। কেউ যদি তার কর্তব্য কর্মে অবহেলা করে তবে তা আমানত খেয়ানত বা ভঙ্গ করার সামিল। আমাদের মত সাধারণ মানুষের সামনে আমাদের নবীর চারিত্রিক উদাহরণ এ ব্যাপারে সর্বকালের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ। আরবের সেই অন্ধকারময় যুগেও তাঁকে "আল-আমীন" বা "বিশ্বাসী" নামে ডাকা হতো।

২৮। এবং জেনে রাখ যে. তোমাদের ধন সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি [আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে] পরীক্ষা ব্যতীত অন্য কিছু নয় ১২০১। এবং আল্লাহ্‌রই নিকটে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার।

১২০১। প্রাচীন কালে যখন যান্ত্রিক সভ্যতা পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে নাই, তখন মানুষকে শক্তির জন্য নির্ভর করতে হতো নিজ বাহুবলের উপরে। আজকের পৃথিবীতে উন্নত সমরাস্ত্র [যেমন- পারমাণবিক বোমা] হচ্ছে শক্তির মানদন্ড। সেইরূপ প্রাচীন পৃথিবীতে ব্যক্তিগত ও জাতিগত ভাবে শক্তির মানদন্ড ছিল জনবল। সেই কারণে বড় পরিবারকে যা সন্তান দ্বারা পরিপূর্ণ, কল্পনা করা হতো শক্তির উৎস। সেই সময়ে সন্তানের প্রাচুর্যে সকলেই গর্ববোধ করতো, ঠিক বর্তমানে যেভাবে আমরা অর্থ সম্পদের জন্য গর্ববোধ করি। তাই সন্তান সন্ততি ও অর্থ সম্পদকে কোরান শরীফে ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতীক স্বরূপ বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই পৃথিবীতে ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি সবই আল্লাহ্‌র তরফ থেকে পাওয়া নেয়ামত ও আমানত যা বান্দার জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। সঠিকভাবে যে তার হেফাজত করতে পারে তার জন্যই আছে মহা পুরস্কার।

রুকু - ৪

২৯। হে বিশ্বাসীগণ ! যদি তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর, তবে আল্লাহ্‌ তোমাদের [ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করবার] শক্তি দান করবেন ১২০২। তোমাদের সকল মন্দ দূর করে দেবেন [যা তোমাদের কষ্ট দিত] এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। অবশ্যই আল্লাহ্‌ অসীম কল্যাণের আঁধার।

১২০২। দেখুন সূরা [২ : ৫৩] এবং সূরা [২ : ১৮৫] বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে "ফুরকান" বা পরীক্ষার মানদন্ড নামে পরিচিত, এই ছিল মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ যা ছিল কাফেরদের বিরুদ্ধে শক্তির পরীক্ষা, ক্ষমতার পরীক্ষা এবং ভালো ও মন্দের পরীক্ষা। এই যুদ্ধে কাফেরদের পরাজয় ঘটে, যারা বিশ্বাসী তাদের ঈমানের পরীক্ষা ছিল এই যুদ্ধ। সত্যিকারের বিশ্বাসীদের মোনাফেকদের থেকে আলাদা করার সুযোগ ঘটে এখানে। আরও দেখুন সূরা [৮ : ৪১] এবং টীকা ১২১০।

৩০। স্মরণ কর, কিভাবে অবিশ্বাসীরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলো, যেনো তারা তোমাকে বন্দী করতে, অথবা হত্যা করতে এবং তোমাকে [তোমার জন্মভূমি থেকে] নির্বাসিত করতে পারে ১২০৩। তারা ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করে, এবং আল্লাহ্‌ও পরিকল্পনা করেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী হচ্ছেন আল্লাহ্‌ ১২০৩-ক।

১২০৩। মক্কার কোরেশরা আল্‌-মুস্তফার (সাঃ) বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। এই চক্রান্তের কথাই এই আয়াতে বলা হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন যে কৌশলে আল্লাহ্‌ সর্বশ্রেষ্ঠ। তাদের ষড়যন্ত্র শুধু যে নস্যাৎ হয়েছিলো, তাই-ই নয়, আল্লাহ্‌ তাদের ষড়যন্ত্র আল-মুস্তফার (সাঃ) জন্য রহমতে পরিণত করে দেন। তাদের ষড়যন্ত্র ছিলো : (১) তারা নবীর চাচা আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছিলো, নবীকে বন্দী করার জন্য। কিন্তু এর ফলে যত তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের উপরে তাদের অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়েছে, তত মুসলমানদের ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন নতুন লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। (২) তারা নবীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু নবীর চরিত্রের বিনয়, অধ্যবসায়, নির্ভীকতা, বিশ্বাসের দৃঢ়তা, নতুন নতুন লোকদের ইসলাম গ্রহণে অণুপ্রাণীত করে। (৩) মক্কার কোরেশরা নবী (সাঃ) ও তার অনুসারীদের আশ্রয়হীন করতে চেয়েছিল। পরিণামে আল্লাহ্‌ তাদের জন্য মদীনাতে নতুন বাসস্থানের বন্দোবস্ত করেন। এই নতুন বাসস্থান ছিল ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র বিন্দু এবং শেষ পর্যন্ত এখান থেকেই মক্কা জয় করা হয় এবং আরবের বাইরেও ইসলামের প্রসার ঘটে।

১২০৩-ক। দেখুন সূরা [৩ : ৫৪] আয়াত।

৩১। যখন তাদের নিকট আমার আয়াত সমূহ আবৃত্তি করা হয়, তখন তারা বলে, "আমরা [পূর্বেই] এগুলি শুনেছি; যদি আমরা ইচ্ছা করতাম তবে আমরা অনুরূপ [কথা] বলতে পারতাম। এগুলি প্রাচীন কালের কাহিনী ব্যতীত অন্য কিছু নয় ১২০৪।

১২০৪। দেখুন সূরা [৬ : ২৫] আয়াত।

৩২। স্মরণ কর কিভাবে তারা বলেছিলো, "হে আল্লাহ্‌ ! ইহা যদি প্রকৃতই তোমার পক্ষ থেকে সত্য হয়, তবে আমাদের উপর আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর, অথবা আমাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি প্রেরণ কর ১২০৫।

৩৩। কিন্তু যখন তুমি তাদের মাঝে অবস্থান করছো তখন আল্লাহ্‌ তাদের জন্য শাস্তি প্রেরণ করবেন না। যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তখনও তিনি তাদের ইহা [শাস্তি] প্রেরণ করবেন না।

১২০৫। আলোচ্য আয়াতটি হচ্ছে মক্কার কাফেরদের এক ধরণের বিদ্রূপ। আবু জাহেল এই উপহাসটি করেছিল প্রার্থনার ভঙ্গীতে। এর উত্তর পরবর্তী দুটি আয়াতে দেয়া হয়েছে। একমাত্র নির্বোধরাই ভাবতে পারে যে আল্লাহ্‌ তাদের হুকুম মত চলবেন বা তাদের উপহাস, বিদ্রূপের জবাব দেবেন। মক্কার মুশরিকরা নিজেদের কুফরী ও অস্বীকৃতির দরুণ যদিও আসমানী আযাব প্রাপ্তিরই যোগ্য, কিন্তু মক্কায় রাসূলে করীম (সাঃ) এর উপস্থিতি ব্যাপক আযাবের পথে অন্তরায় হয়ে ছিল। মহানবীর মদিনায় হিজরতের পরে যদিও ব্যাপক আযাব এর অন্তরায় দূর হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও অনেক দুর্বল মুসলমান যারা হিজরত করতে পারছিলেন না, তাঁরা আল্লাহ্‌র দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে যাচ্ছিলেন। সুতরাং ব্যাপক আযাবের প্রশ্নই আসে না। উপরন্তু আল্লাহ্‌র দ্বার ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত। কিন্তু যদি কোন নাস্তিক হটকারী ব্যক্তি অহংকারে অন্ধ হয়ে আল্লাহ্‌র করুণাকে মনে করে অক্ষমতা, তবে তাদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। আবু জাহেলের ও তার অনুসারীদের কি পরিণতি হয়েছিল তা সকলেরই জানা। বদরের যুদ্ধে আবু জাহেল ও আরবের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা মুসলমানদের হাতে নিহত হন। এই ছিল তাদের উদ্ধতপনার শাস্তি। মক্কার কাফেররা মুসলমানদের কাবা শরীফে প্রবেশে বাঁধা দান করেছিল - তার শাস্তিও তারা ভোগ করেছিল। কোরেশরা দাবী করতো তারাই কাবা শরীফের অভিভাবক। কাবা শরীফের অভিভাবক তারাই হতে পারে, যারা পূণ্যাত্মা - কারণ কাবা ঘর শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র উপাসনার জন্য নির্মিত হয়েছিল। সেখানে কোরেশরা কাবা ঘরে বিভিন্ন মূর্তির উপাসনা করে কাবা ঘরের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়। কোরেশদের দেব-দেবীর উপাসনার ধরণও ছিল অতি বিচিত্র ও অপবিত্র ও হাস্যষ্কর অনুষ্ঠান। তারা পূজার আনুষ্ঠানিকতায় তালি দিত, শিশ দিত এবং অনেক সময়ে উলঙ্গ অবস্থায় কাবা ঘরকে প্রদক্ষিণ করতো। তাহলে কিভাবে তারা কাবা ঘর যা এক আল্লাহ্‌র পবিত্র উপাসনার জন্য তৈরী, তার অভিভাবকত্ব দাবী করতে পারে ?

৩৪। যখন তারা [মসজিদুল হারামের] তত্বাবধায়ক না হওয়া সত্বেও [লোকদের] পবিত্র মসজিদে 'যাওয়া থেকে বিরত রাখে, তখন তাদের [আত্ম পক্ষ সমর্থনে] কি কৈফিয়ৎ থাকতে পারে যে, কেন আল্লাহ্‌ তাদের শাস্তি দেবেন না ? একমাত্র পূণ্যাত্মা ব্যতীত আর কেহ এর তত্বাবধায়ক হতে পারে না। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা বুঝতে পারে না।

৩৫। আল্লাহ্‌র ঘরে তাদের ইবাদত হচ্ছে শুধু শিস্‌ দেয়া এবং করতালি দেয়া। [এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে] 'কুফরীর জন্য শাস্তি ভোগ কর।"

৩৬। [মানুষদের] আল্লাহ্‌র পথে বিরত রাখার জন্য অবিশ্বাসীরা ধন-সম্পদ ব্যয় করে, এবং এভাবেই তারা ব্যয় করতে থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা তাদের মনঃস্তাপের কারণ হবে [মাত্র]। অবশেষে তারা পরাস্ত হবে; এবং অবিশ্বাসীদের জাহান্নামে প্রকত্রিত করা হবে।

৩৭। ইহা এ জন্য যে, আল্লাহ্‌ যেনো অপবিত্রকে পবিত্র থেকে পৃথক করে নিতে পারেন। অপবিত্রদের একের উপরে অন্যকে রেখে স্তুপিকৃত করবেন এবং তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এরাই তারা যারা [প্রকৃত পক্ষে] ক্ষতিগ্রস্থ ১২০৬।

১২০৬। এই আয়াতে ভালো এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, খারাপ সব সময়ই মন্দ সঙ্গী খুঁজবে। মন্দ লোক হবে মন্দ লোকের একান্ত সঙ্গী, একে অপরের সঙ্গ ও সহচার্য তাদের জন্য হয় উপভোগ্য। অপর পক্ষে ভালো এবং পূণ্যাত্মা সব সময়েই পূণ্যাত্মার সঙ্গ উপভোগ করে। এই আয়াতে বলা হয়েছে শেষ বিচারের দিনে মন্দদের এক স্থানে স্তুপীকৃত করা হবে। মন্দ লোকেরা সর্বদা ভালো লোকদের এবং তাদের ভালো কাজকে একতাবদ্ধভাবে প্রতিহত করে। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে একতার অভাব হয় না। প্রয়োজনে তারা তাদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে অকৃপণ হস্তে, ভালোকে প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু যারা ভালো, যারা পূণ্যাত্মা, যারা ভালো কাজের অগ্রযাত্রার পথিক, তারা অবশ্যই মন্দলোকের প্রতিরোধকে ভয় পাবে না, বা নিরাশ হবে না। কারণ একদিন যখন পাপীদের পাপের পাত্র পূর্ণ হবে আল্লাহ্‌র শাস্তি বজ্রের মত তাদের উপরে নেমে আসবে।

রুকু - ৫

৩৮। অবিশ্বাসীদের বল, [এখনও] যদি তারা [অবিশ্বাস থেকে] বিরত হয়, তবে তাদের অতীতে যা হয়েছে তা ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যদি তারা অটল থাকে, তবে পূর্ববর্তীদের শাস্তির [দৃষ্টান্ত] তো রয়েছে [তাদের জন্য সতর্কবাণী রূপে]।

৩৯। এবং তাদের সাথে সংগ্রাম কর যতক্ষণ না দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নীপিড়ন দূর হয় এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান ও ন্যায় বিচার সামগ্রিকভাবে এবং সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১২০৭। কিন্তু যদি তারা বিরত হয়, নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ্‌ সব দেখেন ১২০৮।

১২০৭। দেখুন সূরা [২ : ১৯৩] এবং এর টীকা।

১২০৮। যদি কাফেরেরা সত্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিরূদ্ধাচারণ থেকে ক্ষান্ত হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে আর হয়রাণী বা শত্রুতা পূর্ণ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ। তিনি সম্যক জ্ঞাত আছেন কাফেরদের কার্যাবলী ও তাদের কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কিন্তু কাফেররা যদি মোমেনদের সাথে কোন শান্তি চুক্তিতে আসতে অস্বীকার করে, তবুও মোমেন বান্দাদের কোনও ভয় নাই। কারণ আল্লাহ্‌ স্বয়ং মোমেন বান্দাদের রক্ষা করবেন।

৪০। যদি তারা অস্বীকার করে, তবে নিশ্চিত থাক যে আল্লাহ্‌ তোমাদের রক্ষাকর্তা, সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ রক্ষাকর্তা এবং সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।


দশম পারা

৪১। এবং জেনে রাখ যে, [যুদ্ধে] তোমরা যে সব যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী সংগ্রহ কর তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্‌র ১২০৯ এবং রাসূলের এবং [রাসূলের] স্বজনদের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্থদের, এবং পথিকদের জন্য [বরাদ্দ] যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহ্‌র প্রতি এবং [সেই] প্রত্যাদেশের প্রতি যা আমি প্রেরণ করেছি আমার বান্দার নিকট ফুরকান [ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড] বা মীমাংসার দিনে ১২১০ - যেদিন দুই সৈন্যদল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলো [বদর প্রান্তরে]। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ের উপর সর্বশক্তিমান ১২১১।

১২০৯। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বিলিবণ্টনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যে, সম্পদের এক পঞ্চমাংশ ইমাম বা সেনাপতির প্রাপ্য এবং অবশিষ্ট সম্পদ সেনাবাহিনীর মধ্যে বিতরণ করা হবে। যে এক পঞ্চমাংশ ইমামের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র রাসূলের এবং গরীব দুঃখীদের জন্য বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য। এই এক পঞ্চমাংশের বিতরণের পূর্ণ ক্ষমতাবান হচ্ছে ইমাম। রাসূলের জীবদ্দশায় এখান থেকে কিছু অংশ তাঁর এবং তাঁর আত্মীয়দের ব্যবহারের জন্য থাকতো।

১২১০। "ফুরকান" শব্দটি এখানে অনুবাদ করা হয়েছে মীমাংসার দিন। অর্থাৎ ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে মীমাংসা, বা বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে মীমাংসা। বদরের যুদ্ধকে এই নামে বলা হতো, কারণ, মুমীন ও কাফির উভয় দলের ভাগ্যের মীমাংসা সেই দিন হয়েছিল। দেখুন সূরা [৮ : ২৯] আয়াত এবং টীকা ১২০২।

১২১১। পরবর্তী [৮ : ৪২-৪৪] তিনটি আয়াতে বদরের যুদ্ধে আল্লাহ্‌র ক্ষমতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে। আল্লাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহের ফলে এ রকম অসম যুদ্ধে কোরেশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জয় লাভ সম্ভব হয়েছিল।

৪২। স্মরণ কর, তোমরা ছিলে উপত্যকার নিকট প্রান্তে আর তারা ছিলো দূর প্রান্তে। এবং উষ্ট্রারোহীর দল ছিলো তোমাদের অপেক্ষা নিম্নভূমিতে ১২১২। যদি তোমরা পরস্পরের মধ্যে [যুদ্ধে] সম্মুখীন হওয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইতে, তবে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তোমাদের মতভেদ ঘটতো ১২১৩। কিন্তু যে ভাবে আল্লাহ্‌ ইতিপূর্বেই বিষয়টির সম্পাদন বিধিবদ্ধ করেছিলেন সেভাবেই [তারা যুদ্ধে সম্মুখীন] হয়েছিলো; যারা মারা যায় তারা যেনো স্পষ্ট প্রমাণ [উপস্থাপনের] পরে মারা যায় এবং যারা বেঁচে থাকে তারা যেনো স্পষ্ট প্রমাণ [উপস্থাপনের] পরে বেঁচে থাকে। তিনিই আল্লাহ্‌ যিনি সব শোনেন এবং সব জানেন।

১২১২। মদীনার মুসলমানদের ক্ষুদ্র দলটি মক্কার কোরেশদের সুসজ্জিত ও বৃহৎ দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যেখানে মিলিত হয়, তা ছিল একটি উপত্যকা। বদর উপত্যকার যে প্রান্তটি মদীনার নিকটবর্তী তাকে নিকট প্রান্ত বলা হয়েছে। আর বিপরীত দিক যেদিকে কাফির দল ছিল তাকে দূর প্রান্ত বলা হয়েছে। অন্যদিকে "নিম্নভূমি" অর্থাৎ লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী পথ দিয়ে মক্কার বিধর্মীদের বাণিজ্যিক কাফেলা অগ্রসর হচ্ছিল। এই পথটি বদর প্রান্তর থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে ছিল।

১২১৩। আদম সন্তানকে স্রষ্টা "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি" দান করেছেন সত্যি, কিন্তু কালের পরিবর্তনে নূতন যুগের সৃষ্টিতে যে সব বৃহৎ ঘটনার সমাবেশ ঘটে যা পৃথিবীর ইতিহাস ও মানচিত্রকে পরিবর্তন করে দেয়, তার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ এক আল্লাহ্‌র অধীন। সেখানে আদম সন্তানের ইচ্ছাশক্তির প্রভাব খুবই কম। যে কোনও বৃহৎ ঘটনা আল্লাহ্‌র ইচ্ছারই প্রতিফলন। ঠিক এরকমটিই ঘটেছিল বদরের যুদ্ধের সময়ে। বদরের যুদ্ধের বিভিন্ন দলের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন। কোরেশদের বাণিজ্য সমৃদ্ধ বহরের গন্তব্য ঠিকানা ছিল মক্কা। যেহেতু তাদের যাত্রা পথ ছিল মদীনার পাশ দিয়ে, সেই কারণে তাদের অমূলক আশংকা ছিল যে মুসলমানরা তাদের আক্রমণ করে সর্বস্ব লুট করে নেবে। কোরেশ বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল দুটো। প্রথমতঃ বাণিজ্য বহরকে রক্ষা করা দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের শক্তিকে ধ্বংস করা। অপর পক্ষে মুসলমানেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে তারা বাণিজ্য বহরকে আক্রমণ না করে কোরেশদের আক্রমণ করবে। এ কারণেই আল্লাহ্‌ বলেছেন যে, "যদি তোমরা পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত করতে চাইতে তবে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটতো।" কিন্তু আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা সময়ের বৃহত্তর পরিসরে, তাই "যে ভাবে আল্লাহ্‌ ইতিপূর্বেই বিষয়টির সম্পাদন বিধিবদ্ধ করেছিলেন সেভাবেই [তারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে সমবেত] হয়েছিলো" কথাটির দ্বারা একথাই বোঝানো হয়েছে যে সামগ্রিক পরিকল্পনা আল্লাহ্‌র। পৃথিবীর সকল বৃহৎ ঘটনাই আল্লাহ্‌র পরিকল্পনার অধীন। মানুষের "সীমিত ইচ্ছা শক্তি" সেখানে কোনও কাজ করে না; সে কথাই এভাবে বলা হয়েছে, "তবে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তোমাদিগের মধ্যে মতভেদ ঘটিত।" মতভেদ ঘটিত এই কারণে যে কোরেশদের সৈন্য সংখ্যা ছিল বেশী অপর পক্ষে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্রের সম্ভার সবই ছিল অপ্রতুল। তবুও আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় দু'পক্ষই নির্ভুল ভাবে নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়। যদি দু'পক্ষ নিজেদের ইচ্ছামত পরিকল্পনা করতো, তবুও এর থেকে সঠিক ও নির্ভুল সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারতো না।

বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে যারা শহীদ হন তারা জেনে যান যে মুসলমানেরা জয়ী হয়েছে এবং তাদের এই মৃত্যু সার্থক। অপরপক্ষে মুসলমানদের মধ্যে যারা যুদ্ধ জয়ের পরে জীবিত থাকলেন, তারা যুদ্ধ জয়ের আনন্দ ও সুফল ভোগ করতে পেরেছেন। কোরেশদের বেলায় যারা নিহত হলো তারা এবং যারা পরাজিত হয়ে পলায়ন করলো; দু'পক্ষই ভালোভাবে জানতে পারলো তাদের অবস্থান সম্পর্কে। স্ব-স্ব অবস্থান সম্পর্কে এবং এই অবস্থানকে কার্যে পরিণত করার ব্যাপারে মুসলমান ও কোরেশরা প্রত্যেকেই ছিল অনমনীয় দৃঢ়। বদরের যুদ্ধ ইসলামের যাত্রাপথের ইতিহাসের এক মাইল ফলক। এই ফলক থেকেই শুরু হয় মুসলমানদের জয়যাত্রা।

৪৩। স্মরণ কর, তোমার স্বপ্নে আল্লাহ্‌ তোমাকে দেখিয়েছিলেন যে, তারা সংখ্যায় স্বল্প সংখ্যক। যদি তিনি তোমাকে দেখাতেন যে তারা সংখ্যায় অধিক, তবে তোমরা নিশ্চয়ই সাহস হারাতে এবং অবশ্যই তোমরা [যুদ্ধ বিষয়ে তোমাদের] সিদ্ধান্তে বির্তকে লিপ্ত হতে। কিন্তু আল্লাহ্‌ [তোমাদের] রক্ষা করেছিলেন যেহেতু তিনি [সকল] হৃদয়ের [গোপন] কথা বিশেষভাবে অবহিত।

৪৪। এবং স্মরণ কর, যখন তোমরা [যুদ্ধের জন্য] পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলে, তখন তিনি তাদের [কুরাইশদের] তোমাদের দৃষ্টিতে স্বল্প সংখ্যক দেখিয়েছিলেন এবং তাদের দৃষ্টিতে তোমাদের উপস্থাপন করেছিলেন নগন্য হিসেবে ১২১৪; যেনো আল্লাহ্‌ বিষয়টি পূর্বে যে ভাবে বিধিবদ্ধ করেছিলেন সে ভাবে সম্পাদন করতে পারেন। যেহেতু [সিদ্ধান্তের জন্য] সকল বিষয় আল্লাহ্‌র দিকেই ফিরে যায়।

১২১৪। মুসলমান সেনারা, যদিও তাদের সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্রের সম্ভার ইত্যাদির ব্যাপারে তাদের সীমাবদ্ধতার সম্বন্ধে সম্যক অবগত ছিল, তবুও প্রকৃত অসমতা কতটুকু সে সম্বন্ধে তাদের কোনও সঠিক ধারণা ছিল না। মক্কার কোরেশরা নিজেদের সেনা সংখ্যা, অস্ত্রের সম্ভার, যুদ্ধের দক্ষতা ইত্যাদি সম্বন্ধে এত আস্থাবান ছিল যে, তাদের ধারণা ছিল স্বল্প সংখ্যক মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের জয় সুনিশ্চিত। যদিও তাদের চক্ষে মুসলমানদের সেনা সংখ্যা আল্লাহ্‌র রহমতে দ্বিগুণ দেখানো হয়েছিল [দেখুন ৩ : ১৩ আয়াত], তবুও মক্কার কোরেশরা অন্ধ অহংকারে, মুসলমানদের তুচ্ছ জ্ঞান করে, কারণ মুসলমান সেনা সংখ্যা ও অস্ত্র সজ্জা তাদের নিকট নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয়েছিল। কোরেশদের এই মনস্তাত্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা হয়েছিল উদ্ধত ও অহংকারী সেটাই ছিল তাদের পতনের অন্যতম কারণ।

"তোমাদিগকে তাহাদের দৃষ্টিতে নগন্য দেখাইয়াছিলেন।" কথাটির অর্থ সংখ্যা ও অস্ত্র সজ্জায় তারা এতটা গর্বিত ছিল যে মুসলমানদের তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে নাই। আবার পরাজয়ের প্রাক্কালে কোরেশদের মনে হলো মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ। এসবই করা হয়েছিল আল্লাহ্‌র বৃহত্তর পরিকল্পনার অন্তর্গত ইসলামের অগ্রগতির জন্য। পৃথিবীতে কাফেরদের অত্যাচার মুসলমানদের উপরে অব্যাহত থাকবে না। পৃথিবীতে ইসলামের অগ্রযাত্রা প্রতিষ্ঠিত হবে, বদরের যুদ্ধের মাধ্যমেই আল্লাহ্‌ তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত নিরূপণ করে দেন। সিদ্ধান্ত আল্লাহ্‌র "যেনো আল্লাহ্‌ বিষয়টি পূর্বে যে ভাবে বিধিবদ্ধ করেছিলেন সে ভাবে সম্পাদন করতে পারেন।" কারণ মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ছিল আল্লাহ্‌ সিদ্ধান্ত। সুতরাং "সমস্ত বিষয় আল্লাহ্‌র দিকেই ফিরে যায়।"

রুকু - ৬

৪৫। হে বিশ্বাসীগণ ! যখন তোমরা কোন [বিরুদ্ধ] শক্তির সম্মুখীন হবে, তখন [অবিচলিত] দৃঢ় থাকবে এবং আল্লাহ্‌কে অধিক [এবং ঘন ঘন] স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলতা লাভ কর।

৪৬। এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং [নিজেদের মধ্যে] বির্তকে লিপ্ত হয়ো না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। এবং তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর এবং অধ্যাবসী হও। যারা ধৈর্য্যের সাথে অধ্যবসায়ী হয়, আল্লাহ্‌ তাদের সাথে থাকেন ১২১৫।

১২১৫। এই আয়াত দুটিতে প্রকৃত মুসলমানদের চারিত্রিক গুণাবলীর বর্ণনা আছে। এখানে যে সব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে মুসলমানরা যদি তা অনুশীলন করে তবে পৃথিবীতে তারা হবে অপরাজেয়। আর যদি তারা এই বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুত হয়, তবে তাদের বিশ্ব সভায় পরাজয় ও অপমান অবধারিত। আজকের বিশ্ব সভায় মুসলমানদের পরাজয় ও অপমান এই আয়াতের আলোকে খুঁজতে হবে। বাংলাদেশীদের জন্য এই আয়াতের মর্মার্থ অনুধাবনযোগ্য।

৪৭। তাদের মত হয়ো না যারা বাড়ী থেকে দম্ভভরে বের হয়েছিলো লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ্‌র পথ থেকে [লোকদের] বিরত রাখার জন্য ১২১৬। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তারা যা করে তা পরিবেষ্টন করে আছেন।

১২১৬। এই আয়াতে যে সব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবই বিদ্যমান ছিল মক্কার কোরেশদের মধ্যে, যারা বদরের যুদ্ধে মদীনা আক্রমণ করতে এসেছিল। আর এসব দোষের কারণেই আল্লাহ্‌ তাদের ধ্বংস করে দেন।
[মন্তব্য : এই আয়াত সমূহ সে যুগে যেমন কোরেশদের জন্য প্রযোজ্য ছিল ঠিক সমভাবে প্রযোজ্য আছে অদ্যাবধি। যারা উদ্ধত ও অহংকারী এবং যারা আল্লাহ্‌র আইন নিজে অস্বীকার করে এবং অপরকেও অস্বীকার করতে প্ররোচিত করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।]

৪৮। স্মরণ রেখো, শয়তান তাদের [পাপ] কার্য তাদের দৃষ্টিতে মনোমুগ্ধকর করেছিলো, এবং বলেছিলো "আজ মানুষের মধ্যে কেহই তোমাদের উপরে বিজয়ী হতে পারবে না, আমি যখন তোমাদের পাশে আছি।" কিন্তু যখন দুই দল পরস্পরের সম্মুখীন হলো, সে পিছনে সরে পড়লো এবং বললো, "দেখ ! আমি তোমাদের থেকে মুক্ত; দেখ ! তোমরা যা দেখ না আমি তা দেখি। দেখ ! আমি আল্লাহ্‌কে ভয় করি; কারণ আল্লাহ্‌ শাস্তিদানে কঠোর ১২১৭।"

১২১৭। দুষ্ট ও মন্দ যারা তাদের নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা যখন দেখে যে পরাজয় অবশ্যাম্ভাবী, তখন তার অনুসারীদের প্রতি নিজেদের দায় দায়িত্ব অস্বীকার করে। ফলে তার অনুসারীরা হতাশায় ডুবে যায়। কথিত আছে বদর যুদ্ধে কোরেশদের উৎসাহ ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য শয়তান বনী-কিনাসা গোত্রের নেতা সুরাকা-ইবনে মালিকের রূপ ধরে সদলবলে উপস্থিত হয়েছিল। আসমান থেকে অবতীর্ণ জিবরাঈল ও অন্যান্য ফেরেশতা দেখে পরাজয় অবশ্যাম্ভবী জেনে পলায়নোদ্যত হলে আবু জহলের নিষেধাজ্ঞার উত্তরে শয়তান এই কথা বলেছিল। তবে এর আবেদন সর্বকালের সর্বযুগের। শয়তান হচ্ছে মন্দ ও দুষ্টের প্রতীক। তারা বোকা বা মোটা বুদ্ধিসম্পন্ন নয়। দুষ্ট বা শয়তান বা পাপী যারা তারাও আল্লাহ্‌র ক্রোধকে ভয় পায়। মোমেন বান্দাও আল্লাহ্‌কে ভয় পায়। দু'জনের ভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, পাপী লোক আল্লাহ্‌কে ভয় পায় ঠিকই, তবে তার সাথে আল্লাহ্‌র প্রতি থাকে তার অসীম ঘৃণা। কিন্তু মোমেন বান্দাও আল্লাহ্‌কে ভয় পায় - তবে সে ভয়ের সাথে জড়িত থাকে আল্লাহ্‌র প্রতি অসীম ভালোবাসা শ্রদ্ধা। প্রিয়জনের অসন্তুষ্টির বা মনোবেদনার কারণ হওয়ার ভয় বা প্রিয়জনের ভালোবাসা হারানোর ভয়।


রুকু - ৭

৪৯। দেখ ! মোনাফেক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ১২১৮ রয়েছে তারা বলে, "[এরাই] এই সম্প্রদায় যাদের দ্বীন তাদের পথভ্রান্ত করেছে।" কিন্তু কেউ যদি আল্লাহ্‌র উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে; দেখ ! আল্লাহ্‌ তো শক্তিতে ও জ্ঞানে মহিমান্বিত।

১২১৮। দেখুন সূরা [২ : ১০] আয়াত, "তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে"। এরা হলো মোনাফেক। আল্লাহ্‌র প্রতি নির্ভরশীলতা, বিশ্বস্ততা - আমাদের হৃদয়কে করে কালিমামুক্ত ফলে আমাদের জ্ঞান চক্ষু হয় উন্মীলিত, আমাদের হৃদয়ে অন্তর্দৃষ্টির জন্মলাভ করে। আমরা সৃষ্টিকর্তার মহত্ব বিশালত্ব অনুভব করতে পারি। তাঁর দয়া, রহমত, জ্ঞান, প্রজ্ঞা অনুধাবন করতে সক্ষম হই। যারা মোনাফেক তারা এসব মোমেন বান্দাদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতে পারে। কারণ তাদের নিকট পার্থিব দুনিয়াই সব কিছু। কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভরশীল মোনাফেকদের ঘৃণা বা অবজ্ঞায় তাদের কিছু যায় বা আসে না। কারণ আল্লাহ্‌র করুণা তাদের হৃদয়, মন আত্মাকে করে বিধৌত ও সঞ্জিবীত।

৫০। তুমি যদি দেখতে পেতে অবিশ্বাসীদের [মৃত্যুর সময়ে] যখন ফেরেশতারা তাদের আত্মাকে হরণ করেছে ১২১৯। [কিভাবে] তারা তাদের মুখে এবং পিঠে আঘাত করে [এবং বলে]; "তোমরা আগুনের দহন যন্ত্রণার স্বাদ আস্বাদন কর।"

১২১৯। মোমেনদের প্রতি মোনাফেকদের ব্যঙ্গক্তি ছিল, "যাদের দ্বীন তাদের পথভ্রান্ত করেছে।" কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে, মৃত্যু কালে এবং মৃত্যুর পরে এসব মোনাফেকদের আছে অশেষ যন্ত্রণা।

৫১। এর কারণ এ জন্য যে, তোমাদের হাত পূর্বেই যা [কর্ম ও কর্মফল] প্রেরণ করেছে ১২২০। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তার বান্দাদের প্রতি অত্যাচারী নন।

১২২০। কাফির ও মোনাফেকদের এই শাস্তির কারণ তাদের নিজ কর্মফল। আল্লাহ্‌ ন্যায়বান বিচারক। প্রত্যেককে তার কর্মের ফল অনুযায়ী বিচার করবেন।

৫২। ফেরাউনের সম্প্রদায় ও তার পূর্ববর্তীদের [আচরণের] ন্যায় এরা আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। এবং তাদের অপরাধের জন্য আল্লাহ্‌ তাদের শাস্তি দান করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ শক্তিমান এবং শাস্তিদানে কঠোর।

৫৩। এর কারণ আল্লাহ্‌ কোন সম্প্রদায়কে যে অনুগ্রহ দান করেছেন তার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা তাদের [নিজ] আত্মার অবস্থার পরিবর্তন করে ১২২১ এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সব শোনেন এবং সব জানেন।

১২২১। আল্লাহ্‌র নেয়ামত কোনও শর্তাধীন নয়। আল্লাহ্‌র নেয়ামতের ভান্ডার অশেষ ও অফুরন্ত। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, যে জাতিকে আল্লাহ্‌ তায়ালা কোনও নেয়ামত দান করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তা তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লাহ্‌ তায়ালার আযাবকে আমন্ত্রণ জানায়। অর্থাৎ যে জাতির লোকদের মাঝে খোদাদ্রোহীতার জন্ম নেয় - যার পরিণতিতে তাদের উপরে আযাব নিপতিত হয়।

৫৪। ফেরাউনের সম্প্রদায় ও তার পূর্ববর্তীদের [আচরণের ন্যায়] ১২২২ তারা তাদের প্রভুর নিদর্শনকে মিথ্যা হিসেবে প্রতিপন্ন করেছিলো; সুতরাং আমি তাদের অপরাধের জন্য তাদের ধ্বংস করেছিলাম। এবং আমি ফেরাউনের সম্প্রদায়কে [পানিতে] নিমজ্জিত করেছিলাম। কারণ তারা সকলেই ছিলো অত্যাচারী এবং পাপী।

১২২২। আয়াত [৮ : ৫২]-এ বলা হয়েছে যারা আল্লাহ্‌র নিদর্শনকে "প্রত্যাখ্যান" করে তাদের আল্লাহ্‌ "শাস্তি" দান করেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে যারা প্রতিপালকের নিদর্শনকে "মিথ্যা" মনে করে আল্লাহ্‌ তাদের "ধ্বংস" করেন। অর্থাৎ অস্বীকার করা বা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করা প্রত্যাখ্যানের থেকেও অধিক পাপ। তাই শাস্তির পরিমাণও বেশী।

৫৫। আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে তারাই নিকৃষ্টতম প্রাণী ১২২৩, যারা তাঁকে [আল্লাহ্‌কে] প্রত্যাখ্যান করে; তারা [কখনও] ঈমান আনবে না।

১২২৩। আয়াত [৮ : ২২]-এ বলা হয়েছে যে আল্লাহ্‌র চোখে তারাই নিকৃষ্ট জীব যারা মূক ও বধির। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্‌ প্রদত্ত তাদের বিভিন্ন মানসিক দক্ষতার সদ্ব্যবহার করে না। মানসিক দক্ষতা অর্থাৎ শোনার ক্ষমতা, বলার ক্ষমতা, বোঝার ক্ষমতা, অনুধাবন ক্ষমতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা প্রতিভা ইত্যাদি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করে না আল্লাহ্‌র সেবায় অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সৃষ্টির সেবার নিয়োজিত করে না। প্রকৃত পক্ষে এ সব লোক তাদের এই প্রতিভা, মেধা, জ্ঞান, সবই নিয়োজিত করে মন্দ কাজে, পার্থিব সম্পদ লাভের আশায়। সুতরাং তারা প্রকারান্তে আল্লাহ্‌র-ই বিরোধিতা করে। এদেরকেই বলা হয়েছে মূক, কারণ তারা আল্লাহ্‌র নিদর্শন বিবৃত করতে অপারগ, বলা হয়েছে বধির, কারণ তারা আল্লাহ্‌র বাণী শুনতে বা হৃদয়ঙ্গম করতে অপারগ। এই আয়াতে এদের কথাই বলা হয়েছে অন্য আঙ্গিকে। এরা কাফের ও ঈমানহীন যারা, "আল্লাহ্‌কে প্রত্যাখ্যান করে।"

৫৬। এরাই তারা যাদের সাথে তুমি চুক্তিতে আবদ্ধ ১২২৪। কিন্তু তারা প্রত্যেকবার তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তাদের [আল্লাহ্‌র জন্য] ভয় নাই।

১২২৪। যারা আল্লাহ্‌র নিদর্শনে বিশ্বাসী নয়, প্রতিমূহুর্তে আল্লাহ্‌র হুকুমকে অস্বীকারের মাধ্যমে বেঈমানী করে তারা কাফের ও ঈমানহীন, তাদের সাথে কোনও চুক্তি করা বা না করা সমান কথা। কারণ তারা চুক্তি লঙ্ঘন করবেই। এই আয়াতের সমসাময়িক ঘটনা ছিল বানু কোরাইজা গোত্রের সাথে মুসলমানদের চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা। যারা বিশ্বাস ঘাতক তাদের প্রতি মুসলমানদের আচরণের বর্ণনা আছে পরবর্তী দুইটা আয়াতে। যুদ্ধের সময়ে দেশ ও জাতি সমূহ ঘোরতর বিপদে পতিত হয়। এই দূর্যোগের সময়ে যারা দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে তাদের অপরাধ দ্বিবিধ। তারা যে শুধু যোদ্ধাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে তাই-ই নয়; তারা দেশের নিরপরাধ লোকের জীবন ও সম্পদের আশঙ্কার কারণ হয়। এইসব ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এসব বিশ্বাস ঘাকতদের এমনভাবে শাস্তি দান করতে হবে, যেনো ভবিষ্যতের জন্যও তা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে আর কেউ বিশ্বাস ঘাকতা করতে ভয় পায়। শুধুমাত্র যারা বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য অপরাধী তারাই শাস্তি পাবে তাই-ই নয়, যারা তার অনুসারী বা সমর্থক তাদেরও করতে হবে বিচার ও ক্ষমতাহীন। যদি চুক্তির দ্বিতীয় পক্ষের দিক থেকে বিশ্বাসঘাতকতা অর্থাৎ চুক্তি লঙ্ঘনের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তবে চুক্তির বাধ্যবাধকতাকে অক্ষুন্ন রাখা অপরিহার্য নয়। তাদের সাথে সমস্ত চুক্তি বাতিল ঘোষণা করতে হবে, যেনো নিরপরাধ ও নির্দোষ ব্যক্তিরা চুক্তি দ্বারা প্রতারিত না হয়। ঘোষণা অর্থাৎ জানিয়ে দিতে হবে যে মুসলমানেরা চুক্তি পত্রের আওতায় আর নাই।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্রের চুক্তিপত্রের অঙ্গীকারের মাধ্যমে; আধ্যাত্মিক জীবনের যুদ্ধ ক্ষেত্রের নীতিমালা শিক্ষা দান করেছেন। আধ্যাত্মিক জীবন দৃশ্যমান নয়, কিন্তু সেই অদৃশ্য জগতও কতক নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। যে সেই নীতিমালা অনুসরণ করে, সেই-ই সাফল্য লাভ করে। আমাদের দৈনন্দিক জীবনে তারাই অঙ্গীকার রক্ষা করবে যারা আদর্শের বিশ্বাসী এবং নৈতিকতার সাধারণ নীতিসমূহ মেনে চলে। এদের সাথেই যে কোনও ব্যাপারে সমঝোতা সম্ভব, এদের সাথেই চুক্তিপত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা সম্ভব। যাদের কোনও নীতি নাই, তারা কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করে না। তারা নিজস্ব স্বার্থ ব্যতীত কিছুতেই বিশ্বাসী নয় - ফলে এসব স্বার্থপর লোক হয় অত্যাচারী ও পাপী।

নীতিজ্ঞানহীন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে, শাস্তির ভয় না থাকলে তারা সে কাজ করতে ভয় পায় না। বিবেকবান বা ন্যায়নীতির অনুসারীরা শাস্তির ভয়ে নয়, বিবেকের ভয়ে অন্যায় ও অসত্য থেকে দূরে থাকে। সুতরাং যারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে বা জীবনের কোনও ক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গকারী, তাদের কঠোর এবং দৃঢ় হস্তে শাস্তি দানের মাধ্যমে নিবৃত্ত করতে হবে। কঠোর ও দৃঢ় হতে হবে এই জন্য যে যারা ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু তারা যেন ভবিষ্যতে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে ভয় পায়। এই নীতি শুধু যে তখনকার জন্যই প্রযোজ্য হবে তা নয় এই নীতি সর্বকালের, সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য।

৫৭। যদি তুমি যুদ্ধে উহাদের আয়ত্তে পাও [তবে] তাদের এবং তাদের যারা অনুসরণ করে [সকলকে] বিধ্বস্ত কর, যেনো তারা শিক্ষা লাভ করে।

৫৮। যদি তুমি কোন দলের বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা কর তাহলে তুমিও তাদের সাথে চুক্তি বাতিল করবে সমতার ভিত্তি। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ বিশ্বাসঘাতকদের পছন্দ করেন না।

রুকু - ৮

৫৯। অবিশ্বাসীরা যেনো মনে না করে যে, তারা [ধর্মপরায়ণদের] পরাজিত করতে পারবে। তারা কখনও [তাদের] ব্যর্থ করতে পারবে না।

৬০। তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের শক্তিকে যথাসাধ্য সুসংহত করবে, অশ্ব-বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করবে ১২২৫, যেনো তোমরা আল্লাহ্‌র শত্রু, তোমাদের শত্রু এবং এ ছাড়াও অন্যদের যাদের তোমরা জান না কিন্তু আল্লাহ্‌ যাদের জানেন, তাদের [হৃদয়ে] ভীতির সঞ্চার করতে পার ১২২৬। আল্লাহ্‌র রাস্তায় যা কিছু ব্যয় করবে, তোমাদের তার পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি, কোন অন্যায় করা হবে না ১২২৭।

১২২৫। এই আয়াতে ইসলামের শত্রুকে প্রতিরোধ ও কাফেরদের মোকাবেলা করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির নির্দেশ দান করা হয়েছে। কিন্তু এই আয়াতের আবেদন সর্বকালের সর্বযুগের। যে কোন সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি অপরিহার্য। দৈহিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, যে কোন সংগ্রাম যা সত্যের ও ন্যায়ের জন্য সংঘটিত হয়, তার প্রস্তুতি হতে হবে সর্বাত্মক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে। এই আয়াতে "শক্তি" কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে যা ব্যাপক অর্থবোধক। "শক্তি" প্রত্যেক যুগ, দেশ ও স্থান অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হতে পারে। "শক্তি" সংগ্রামের আদর্শ অনুযায়ী শক্তির ধারাও আলাদা হতে পারে। সে হিসেবে লেখনীও অনেক সময়ে "শক্তির" প্রতীক হতে পারে।

১২২৬। জেহাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রস্তুতির নির্দেশ প্রসঙ্গে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, প্রতিটি সমাজেই কিছু বর্ণচোরা ব্যক্তি থাকে। যাদের প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে সনাক্ত করা সম্ভব হয় না, কিন্তু তারা সংগ্রামের বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্তু আল্লাহ্‌র অগোচরে কিছুই থাকে না। এখানে আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিয়েছেন, এই সব প্রতিকূলতাকেও সংগ্রামের প্রস্তুতির মধ্যে বিবেচনা করতে। আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রামে সব বাঁধা বিপত্তির জন্য প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে মোমেন বান্দার কর্তব্য।

১২২৭। মহত্তর কারণের জন্য, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য, মজলুমের অধিকার রক্ষার জন্য যে সংগ্রাম তাই-ই হচ্ছে আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম। মহত্তর কারণের জন্য যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামে মোমেন বান্দাদের সর্বস্ব নিয়োগ করতে এখানে নির্দেশ দান করা হয়েছে। এই "সর্বস্ব" ব্যয় শুধুমাত্র অর্থ বা অস্ত্রের মাপকাঠিতেই হবে না। এই "সর্বস্ব" ব্যয় হবে মেধা, মনন শক্তি, প্রতিভা, পরিশ্রম, আন্তরিকতা, একনিষ্ঠতা এক কথায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে। আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় কখনও বৃথা যাবে না। আল্লাহ্‌ অঙ্গীকার করেছেন তিনি ব্যয়কারীদের প্রতিদান দেবেন। এই প্রতিদান বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আল্লাহ্‌র পুরস্কার বান্দার জন্য তার আশারও অতিরিক্ত হবে, "পূর্ণ প্রতিদান" কথাটির দ্বারা তারই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

৬১। কিন্তু যদি শত্রুরা শান্তির [সন্ধির] দিকে ঝুঁকে পড়ে, তুমিও শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়বে, এবং আল্লাহ্‌র উপরে আস্থা রাখবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ [সকল কিছু] শোনেন এবং জানেন ১২২৮।

১২২৮। যে কোন যুদ্ধে যদি শত্রুপক্ষ শান্তির জন্য সন্ধির দিকে অগ্রসর হয়; তবে আল্লাহ্‌র নির্দেশ হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হওয়া। জীবনের উদ্দেশ্য হবে সুখ, শান্তি ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা। যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ করা বা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধ করার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নাই। পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র বিধান বা আইন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করাই হবে যুদ্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য। এটা হচ্ছে সর্বকাল ও সর্বযুগের উপদেশ।

৬২। যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় - তোমার জন্য আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট। তিনিই তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও বিশ্বাসীদের [দল] দ্বারা শক্তিশালী করেছেন; ১২২৯-

১২২৯। এই আয়াতটি যদিও রাসূলকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, এর আবেদন যুগ কাল অতিক্রান্ত। শান্তির জন্য কাজ করার সময়ে সর্বদা বিশ্বাসঘাতকদের গোপন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বর্তমান থাকে। আল্লাহ্‌র হুকুম হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সে ঝুঁকি মোমেন বান্দারা গ্রহণ করবে যেমন করেছিলেন আল্লাহ্‌র নবী। কারণ মোমেনদের সাথে থাকবে আল্লাহ্‌র সাহায্য।

৬৩। এবং [উপরন্তু] তাদের হৃদয়ের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় [সম্পদ] ব্যয় করলেও তুমি অনুরূপ ভালোবাসার [বন্ধন] সৃষ্টি করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ্‌ তা করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মহাশক্তিধর এবং প্রজ্ঞাময় ১২৩০।

১২৩০। এই আয়াতের বিষয়বস্তু হচ্ছে রাসূলের (সাঃ) সমসাময়িক আরবদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে। মহানবী এমন এক জাতির মধ্যে থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন, যারা পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্যে উগ্রতম, যারা মরুভূমির সূর্যের মত উত্তপ্ত স্বভাব সম্পন্ন। যে জাতি নিকৃষ্টতম পৌত্তলিকতার গ্রন্থিতে বাঁধা পড়েছিল, যে জাতির দ্বিতীয় স্বভাব ছিল রক্তমোক্ষণ; মুহম্মদ (সাঃ) সেই জাতিকে শিখিয়েছিলেন পবিত্রতা, সত্যনিষ্ঠা, আত্মসংযম, উদারতা, দেশপ্রেম ও আত্মোৎসর্গের অভ্যাস। এ সবই ছিল আল্লাহ্‌র প্রদত্ত নেয়ামত। এই আয়াতের উপদেশ হচ্ছে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে, সর্ব অবস্থায় আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করতে হবে। তবেই আমাদের মধ্যে বিভেদ দূর হয়ে একতা, বিভ্রান্তি দূর হয়ে স্থির লক্ষ্য অর্জনের একাগ্রতা এবং পরস্পরের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন বা সেতু রচিত হবে। ভালোবাসার বন্ধনের যে শক্তি, সে শক্তি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। যে কাজ পরস্পর ভালোবাসার বন্ধনে সম্পন্ন করা হয়, সে কাজ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সফল কাজ। কারণ ভালোবাসার বন্ধন আল্লাহ্‌র দান। অপরপক্ষে পেশীশক্তি দ্বারা যে কাজ করানো হয় তা হচ্ছে দাসত্ব, অপমান, নৈতিক অধঃপতনের স্বরূপ। একটি সমাজে অনেক মত ও পথ থাকতে পারে। সেই মতের ও পথের পার্থক্যের কারণে যে কোনও সমাজে সংঘাত ও সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটতে পারে [যেমনটি ঘটেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে]। একমাত্র আল্লাহ্‌র রহমত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই পারে সেই সংঘাতের পথকে মিলনের সেতুবন্ধনে রূপান্তরিত করতে।

৬৪। হে নবী ! তোমার জন্য এবং তোমার অনুসারী মোমেন বান্দাদের জন্য আল্লাহ্‌-ই যথেষ্ট ১২৩১।

১২৩১। বিশ্বাসী বা মোমেন বান্দা বলতে কি বোঝায় ? নাম সর্বস্ব মুসলমান তারাই, যারা শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও মৌখিক দোয়া, কলেমা ও না বুঝে কোরান শরীফ আবৃত্তির (Lip service) মধ্যে ধর্মকে আবদ্ধ করেছে; যাদের কর্মে বা জীবন, চরিত্রে বা নৈতিকতায় ইসলামের কোনও প্রতিফলন নাই। তাদের বিশ্বাসী বা মোমেন বান্দা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। তারাই মোমেন যাদের আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাসের আন্তরিকতা সকল যুক্তি তর্কের উর্ধ্বে। যারা আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসার দরুণ আল্লাহ্‌র বিধান বা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, আল্লাহ্‌র রাস্তায় নির্ভীক সৈনিক। পৃথিবীর লাভ লোকসানে তারা ভীত নয় বা তাদের আল্লাহ্‌র রাস্তা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। এরাই মোমেন বান্দা। আল্লাহ্‌র রহমত বা মঙ্গলময় সান্নিধ্য তাদের জন্যই। "মুমিনদের জন্য আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট।"

রুকু - ৯

৬৫। হে নবী ! বিশ্বাসীদের যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ কর। তোমাদের বিশ জন ধৈর্য্যশীল ও অধ্যাবসায়ী [সৈনিক] দুইশত জনকে পরাভূত করতে পারবে; যদি একশত জন হয়, তারা এক হাজার কাফেরকে পরাভূত করতে পারবে। কারণ তারা [কাফেররা] বোধশক্তি রহিত এক সম্প্রদায় ১২৩২।

১২৩২। যুদ্ধ জয়ের জন্য সেনা সংখ্যা ও অস্ত্র-সম্ভার-ই শেষ কথা নয় [বর্তমান বিশ্বে আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণ-এ কথাই প্রমাণ করে]। যুদ্ধ জয়ের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে যোদ্ধার নৈতিক মনোবল। বিপক্ষদলের দশগুণ সৈন্যসংখ্যা অবশ্যই আতঙ্কজনক। কিন্তু যারা মোমেন এই সেনাধিক্য তাদের ভীত করে তুলতে পারে না। কারণ তারা জানে যদি তাদের মৃত্যু হয়, তবে সে মৃত্যু হবে মহৎ মৃত্যু, বৃহত্তর কল্যাণের জন্য সে মৃত্যু হবে নিবেদিত। সুতরাং শেষ পর্যন্ত এই মৃত্যু বৃথা যাবে না। মৃত্যু তাদের ব্যথিত, দুঃখিত বা ভীত করবে না, কারণ : (১) তারা জানে তাদের সাহায্যকর্তা স্বয়ং আল্লাহ্‌ এবং (২) যারা সত্য ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে তারা মূর্খ ব্যতীত আর কিছুই নয়, কারণ তাদের জনবল, বাহুবল ও অস্ত্রবল কিছুই নির্ভরযোগ্য নয়।

৬৬। বর্তমানের জন্য আল্লাহ্‌ তোমাদের [উপর অর্পিত কর্মভার] লাঘব করলেন। কারণ তিনি তোমাদের দুর্বলতা সম্বন্ধে জানেন ১২৩৩। কিন্তু [তারপরেও] যদি তোমাদের একশত জন ধৈর্য্যশীল এবং অধ্যাবসায়ী [সৈনিক] থাকে, তবে আল্লাহ্‌র অনুজ্ঞাক্রমে তারা দুইশত জনকে পরাভূত করবে; এবং যদি এক হাজার জন থাকে, তারা দু'হাজার জনকে পরাভূত করবে। নিশ্চয়ই যারা ধৈর্য্যের সাথে অধ্যাবসায়ী হয় আল্লাহ্‌ তাদের সাথে থাকেন।

১২৩৩। ঈমানের দৃঢ়তা মুসলমানদের নৈতিক মনোবল বৃদ্ধি করে। ফলে তাদের একজনের ক্ষমতা কাফের প্রতিপক্ষের দশজনের সমান। পূর্বের আয়াতে এ কথারই উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে, "কুড়িজন ধৈর্য্যশীল থাকলে, তাহারা দুইশত জনের উপরে বিজয়ী হবে।" অর্থাৎ একজন দশজনের সমান। কিন্তু বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের যে শুধুমাত্র জনবলই কম ছিল তাই নয়, তাদের অস্ত্র-শস্ত্র, প্রশিক্ষণ প্রতিটি ব্যাপারেই তারা কোরেশদের থেকে দুর্বল ছিল। এ কথাকেই বলা হয়েছে "তিনি অবগত আছেন যে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে।" সেই কারণে মুসলমানদের কর্তব্য আল্লাহ্‌ অনেক হাল্‌কা করে দিয়েছেন। বদরের যুদ্ধে প্রতি একজন মুসলমানকে মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে দুইজন কাফেরকে। প্রকৃত পক্ষে বদরের যুদ্ধে মুসলমানেরা প্রতি তিনজন কাফেরকে একজন মোমেন মুসলমান প্রতিহত করেন ও যুদ্ধে জয় লাভ করেন।

৬৭। ব্যাপকভাবে বল প্রয়োগ দ্বারা শত্রু ভূমিকে অধীনে না আনা পর্যন্ত কোন নবীর জন্য [মুক্তিপণের জন্য] যুদ্ধ বন্দীদের [জীবিত] রাখা সংগত নয় ১২৩৪। তোমরা এই পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী সম্পদ কামনা কর; কিন্তু আল্লাহ্‌ চান পরলোকের [কল্যাণ]। এবং আল্লাহ্‌ মহাপরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়।

১২৩৪। সাধাণতঃ যুদ্ধ সংঘটিত হয় রাজ্য দখল, বাণিজ্য দখল, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা বা সমরক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। এই সমস্ত কারণই হচ্ছে পার্থিব লাভের জন্য করা। যে যুদ্ধ শুধুমাত্র পার্থিব লাভের জন্য করা হয়, যার পিছনে কোনওরূপ মহৎ উদ্দেশ্য কাজ করে না, সে যুদ্ধকে নিন্দা করা হয়েছে। মহত্তর উদ্দেশ্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে যুদ্ধ তাকেই বলা হয় "জেহাদ", কারণ সেই যুদ্ধই হচ্ছে আল্লাহ্‌র রাস্তায় যুদ্ধ। যে যুদ্ধের নিয়ত মহৎ সেখানে ক্ষুদ্র স্বার্থ, উদ্দেশ্য বা পার্থিব লাভ লোকসানের ব্যাপার প্রশ্নাতীত। তাই যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তিপণ দ্বারা লাভবান হওয়ার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। বদরের যুদ্ধে কোরেশদের সত্তর জনকে যুদ্ধ বন্দী হিসাবে আনা হয়। এসব যুদ্ধ বন্দীদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার ভার ছিল যুদ্ধের নেতা বা ইমাম বা নবীর উপরে। বদরের যুদ্ধবন্দী কোরেশদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া বা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া, উভয় পন্থার যে কোনও একটি গ্রহণের অনুমতি ছিল। পরামর্শক্রমে মুক্তিপণ নেওয়াই স্বীকৃত হয়, কিন্তু হত্যা করাই ছিল শ্রেয় - যা নবীজির মত কোমল প্রাণার পক্ষে ছিল কঠিন কাজ। তা না করায় এই আয়াতে মৃদু ভৎর্সনা বাক্য নাযেল হয়। তাদের হত্যা করা ছিল শ্রেষ্ঠ এই কারণে যে, তারা সত্যকে অবদমিত করতে চেয়েছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা, মুসলমানদের কষ্ট দিতে, মারতে, এবং হত্যা করতে কখনই কোন ত্রুটি করেনি। যখনই কোন রকম সুযোগ পেয়েছে একান্ত নির্দয়ভাবে অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছে। এহেন শত্রুকে বশে পাওয়ার পরেও তাদের শক্তি ও দম্ভকে চূর্ণ করে না দিয়ে অনিষ্টকর শত্রুকে ছেড়ে দিয়ে মুসলমানদের জন্য বিপদ স্থায়ী করিয়ে দেয়া কোন নবীর পক্ষেই শোভন নয়। উল্লেখিত আয়াতে মুক্তিপণের অর্থ ও গণিমতের মালামাল সংগ্রহের জন্য ভৎর্সনা নাযিল করা হয়েছে এবং পরে তা ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এ সম্বন্ধে পরবর্তী নির্দেশ আছে [৬৮-৭১] আয়াতে।

৬৮। যদি আল্লাহ্‌র পূর্ব পরিকল্পিত বিধান না থাকতো তবে তোমরা যে [মুক্তিপণ] গ্রহণ করেছ, তার জন্য তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হতো ১২৩৫।

১২৩৫। "জেহাদ" বা ধর্মযুদ্ধের জন্য যেখানে সর্বস্ব ত্যাগ করা হচ্ছে পূর্বশর্ত, সেখানে পার্থিব লোভ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হয়তো এই লোভের কারণে তাদের উপরে শাস্তির খরগ নেমে আসতো, যদি না ব্যাপারটির সাথে আল্লাহ্‌র পূর্ব পরিকল্পনা সমন্বিত হয়ে যেতো। যে সব যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল, হযরত মুহম্মদের (সাঃ) চাচা আব্বাস এবং হযরত আলীর ভাই আকিল। এরা দু'জনেই পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইনিই সেই আব্বাস যিনি আব্বাসীয় রাজবংশের পত্তন করেন। যে রাজবংশের রাজত্বকালে ইসলাম ধর্ম, শৈর্য্য বীর্যে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে। বন্দীদের মধ্যে কেহ কেহ প্রকাশ করেছিল যে, তারা অন্তরে মুসলিম, যদিও পরিস্থিতির চাপে তাদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয়েছে, যেমন আব্বাস (রাঃ)। এদের সম্পর্কেই ৭০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, তাঁরা সত্য বলে থাকলে মুক্তিপণ হিসেবে প্রদত্ত অর্থের বিনিময়ে আল্লাহ্‌ তাহাদের আরও উত্তম বস্তু দেবেন ও ক্ষমা করবেন। আব্বাসীয় রাজবংশে ইসলামের উত্থানের মধ্যে দিয়ে একথারই সত্যতা প্রমাণিত হয়। এই আয়াতগুলির মাধ্যমে উপদেশ দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা সময়ের বৃহত্তর পরিসরে - এবং সে পরিকল্পনা বিস্ময়কর ভাবে কার্যকর হয়, মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান বা দৃষ্টিশক্তি সেই মূহুর্তে তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ।

৬৯। কিন্তু [এখন] তোমরা যুদ্ধে যা লাভ করেছ তা বৈধ এবং উত্তম বলে ভোগ কর ১২৩৬। কিন্তু আল্লাহ্‌কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।

১২৩৬। মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ায় ৬৭ নং আয়াতে যে মৃদু ভৎর্সনা নাযিল হয়েছিল তাতে গণীমতের মাল ও মুক্তিপণের অর্থ তাঁদের জন্য হালাল কিনা এ বিষয়ে সাহাবীগণ সন্দিহান ছিলেন। এই সন্দেহ নিরসনের জন্য এই আয়াত নাযেল হয়। "ভোগ কর" কথাটির প্রকৃত অর্থের জন্য দেখুন [৭ : ১৯] আয়াত এবং টীকা নং ১০০৪ ও [৫ : ৬৬] এবং টীকা নং ৭৭৬।

রুকু - ১০

৭০। হে নবী ! তোমাদের করায়ত্ত যে সব যুদ্ধ বন্দী আছে তাদের বল; "যদি আল্লাহ্‌ তোমাদের হৃদয়ে ভালো কিছু দেখেন, তবে তোমাদের নিকট থেকে যা নেয়া হয়েছে তা অপেক্ষা ভালো কিছু তিনি তোমাদের দান করবেন এবং তিনি তোমাদের ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, অসীম দয়াময় ১২৩৭।

১২৩৭। এই আয়াতটিতে যুদ্ধ বন্দীদের সান্ত্বনা দান করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ অসীম রহমতের আঁধার। যুদ্ধবন্দীরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তাদের ইসলামের প্রতি পূর্বের শত্রুতা সত্বেও আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষমা করে দেবেন এবং অনুগ্রহ প্রদান করবেন, যদি তাদের চরিত্রে কোনও মহৎ কিছু গুণাবলী থাকে, ভালো কিছু থাকে। এই আয়াতে বলা হয়েছে তারা যা হারিয়েছে, তার থেকেও অনেকগুণ বেশী নেয়ামত তারা পাবে। মুক্তিপণের সাধারণ অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে যে কষ্ট তাদের করতে হয়, তাও তিনি দূর করে দেবেন, যদি তাদের মন-মানসিকতায় কোন কল্যাণ তিনি দেখতে পান। অর্থাৎ মুক্তি লাভের পর যুদ্ধ বন্দীদের মধ্যে যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে ঈমান ও ইসলাম গ্রহণ করবেন, তারা যে মুক্তিপণ দিয়েছে তার চাইতে অধিক ও উত্তম বস্তু তাদের দেয়া হবে ইহকালে ও পরকালেও। এখানে আল্লাহ্‌র ব্যাপক করুণাধারার বর্ণনা আছে এই আয়াতগুলিতে। এই আয়াতগুলির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধিতে অর্থাৎ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণে উৎসাহিত করেছেন, আবার মদিনার মুসলমানদের অর্থ সম্পদের লোভের মত নিকৃষ্ট মনোভাবের ভৎর্সনা করেছেন। পৃথিবীতে যত অন্যায় ও অসৎ কাজ সংঘটিত হয় তার সবই শুরু হয় "লোভ" নামক রীপুটির মাধ্যমে। তাই ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরের প্রান্তরে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে সাহাবীদের মধ্যে যখন লোভের ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ প্রকাশ পেলো, তখন আল্লাহ্‌র তরফ থেকে তাকে ভৎর্সনা করা হলো। অর্থাৎ অন্তরের কোনও ক্ষুদ্র কালিমাও আল্লাহ্‌র অগোচরে নয়। আবার যুদ্ধবন্দীদের বলা হয়েছে, যদি তাদের অন্তরে কোনও মহৎ ও ভালো কিছু থাকে, তবে আল্লাহ্‌ তাদের অবশ্যই পুরস্কৃত করবেন।

৭১। যদি তাদের মাঝে তোমার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার মনোবৃত্তি থাকে, [হে নবী !] তারা তো পূর্বেও আল্লাহ্‌র সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ১২৩৮। সুতরাং তিনি [তোমাকে] তাদের উপরে ক্ষমতা দিয়েছেন এবং আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।

১২৩৮। যুদ্ধবন্দীদের যে দয়া তোমরা দেখিয়েছিলে, যদি মুক্তি লাভের পরে তারা তার অপব্যবহার করে, তবে তা যেনো যারা দয়া প্রদর্শন করেছে তাদের হতাশ না করে। এরূপ ব্যক্তিরা তো তাদের বিশ্বাসঘাতকতার নমুনা স্বরূপ পূর্বেই আল্লাহ্‌র নবীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, এবং আল্লাহ্‌র ইবাদতকে ধ্বংসের মাধ্যমে তা দেখিয়েছে। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে তাদের অনেক সহচরের জ্ঞান চক্ষু খুলে গিয়েছিলো, কিন্তু তাদের অনেকের জ্ঞান চক্ষুর উম্মীলিন ঘটে নাই। কিন্তু আল্লাহ্‌ সব জানেন।

৭২। যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় তাদের ঈমানকে [রক্ষার] জন্য সম্পদ ও জীবন দ্বারা যুদ্ধ করেছে, আর যারা [তাদের] আশ্রয় দান করেছে ও সাহায্য করেছে - এরা [সকলেই] পরস্পরের বন্ধু ও রক্ষাকর্তা ১২৩৯। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করে নাই, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা হিজরত না করে, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার নয় ১২৪০। কিন্তু যদি তারা ধর্মের ব্যাপারে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করে, তবে তাদের সাহায্য করা তোমার কর্তব্য। [অবশ্য] যে সম্প্রদায়ের সাথে তোমাদের পরস্পরের মিত্রতার চুক্তি রয়েছে তারা ব্যতীত ১২৪১। এবং [স্মরণ রেখো] তোমরা যা কর আল্লাহ্‌ তা সব দেখেন।

১২৩৯। এই আয়াতে মোহাজের ও আনসারদের কথা বলা হয়েছে। মোহাজের অর্থাৎ যারা হিজরত করেছে, আনসার অর্থাৎ যারা আশ্রয় দান করেছেন। মোহাজেররা নিজেদের বাড়ী-ঘর, বিষয়, সম্পত্তি, স্বদেশ, জন্মভূমি, আত্মীয় পরিজন সব ত্যাগ করে প্রিয় নবীর সাথে স্ব-ইচ্ছায় অচেনা দেশে হিজরত করেন। কেউ তাদের বাধ্য করে নাই, অন্তরের ডাকে, আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসাতে তারা এই কাজ করেন। অপরপক্ষে মদীনাবাসীরা এদের ভ্রাতৃবন্ধনে, বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের আশ্রয় ও সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগীতা দান করেন। মহানবীর চরিত্রের মাধুর্য্য ও ব্যক্তিত্ব এই দু'দল লোকদের ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। বাস্তবে আমাদের চারিপাশে অহরহই দেখতে পাই রক্তের সম্পর্কও বিষয় সম্পত্তির লোভে ফাটল ধরে যায়। সেখানে মদীনার আনসাররা, মোহাজের ভাইদের তাদের বিষয় সম্পত্তির অংশ দান করেন স্ব-ইচ্ছায়। যেহেতু মোহাজেররা মক্কা থেকে হিজরতের সময়ে প্রায় কপর্দকশূন্যভাবে, আত্মীয়-স্বজনহীন ভাবে মদীনায় পৌঁছেন - তাদের সাহাযার্থে আনসাররা তাদের সহায় সম্পত্তির অংশ আপন ভাই এর মত তাদের সাথে ভাগ করে নেয়। এ এক অভূতপূর্ব উদাহরণ।

১২৪০। এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভ্রাতৃ স্বরূপ। একে অপরের সাহায্য সহযোগীতার বন্ধনে আবদ্ধ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এই আয়াতে মক্কার সেই সব মুসলমানদের কথা বলা হয়েছে যারা মহানবীর সাথে হিজরত করেন নাই। মহানবীর সাথে যারা হিজরত করেন, তাদের কাছে তাদের ব্যক্তিগত আরাম, আয়েশ, বিষয়-সম্পত্তি অপেক্ষা ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল্য ছিল অনেক বেশী। সে কারণে তারা স্ব-ইচ্ছায় নির্বাসিত জীবন বেছে নেন। অপরপক্ষে মক্কার মুসলমান, যারা সেই পরিমাণ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, স্বাভাবিকভাবেই তারা হিজরতকারী শিশু মুসলিম উম্মার কাছে সাহায্য কামনা করতে পারেন না।
১২৪১। ধর্মের জন্য যারা নির্বাসনকে শ্রেয় মনে করে এবং নির্বাসনকে বেছে নেয় তাদেরকে এখানে সম্বোধন করা হয়েছে। মক্কার মুসলমানেরা অত্যাচার ও নীপিড়নের শিকার হয় তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য। ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁদের একদল মক্কা থেকে মদীনাতে হিজরত করেন। তাদের এই নির্বাসন ছিল স্বেচ্ছায়। যারা দুর্বল ছিল তারা মক্কাতেই রয়ে যান। এই আয়াতে মদীনায় অবস্থানকারী মোহাজের মুসলমানদের বলা হয়েছে ধর্ম রক্ষার জন্য তাদের কর্তব্য রয়েছে তাদের দুর্বল ভাইদের জন্য। যদি তাদের ধর্ম বিপন্ন হয়, তবে নির্বাসিত মুসলমান ভাইদের কর্তব্য হচ্ছে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে জেহাদ করা। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে যাদের সাথে মদীনার মুসলমানদের শান্তি চুক্তি আছে তাদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করা চলবে না; চুক্তি মুসলমান বা অমুসলমান যাই-ই হোক না কেন সবার জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ মিত্রদের আক্রমণ করা চলবে না।

৭৩। অবিশ্বাসীরা পরস্পরের রক্ষাকর্তা। যতক্ষণ তোমরা তা [পরস্পরকে রক্ষা] না করবে, পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নীপিড়ন এবং বিপর্যয় দেখা দেবে ১২৪২।

১২৪২। যারা পাপী ও মন্দ তারা সব সময়েই একতাবদ্ধ। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। এই আয়াতে "তা" অর্থে মুমিনদের পরস্পরের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করা, মিত্রশক্তির সাথে শান্তি চুক্তি করা ও কাফিরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে বোঝানো হয়েছে। এই আয়াতে যারা ভালো তাদেরকে বলা হয়েছে যে শুধুমাত্র নিজেরা সুখ-শান্তির সাথে বাস করলেই হবে না, ভালোদের পরস্পর-পরস্পরকে বিপদে-আপদে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে, অন্যায়কারীর প্রতিরোধে বিবেকবানদের একতাবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় পৃথিবী অত্যাচারী, বিবেক বর্জিত লোকের অত্যাচারে ভরে যাবে। পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র বিধান বা আইন বলবৎ থাকবে না। ফলে পৃথিবীতে সৎ, ভালো ও বিবেকবান লোকদের নিরাপত্তা হবে বিঘ্নিত। আল্লাহ্‌র নির্দেশ প্রতি পদে হবে লঙ্ঘিত। পৃথিবী শয়তানের আয়ত্বে চলে যাবে। অর্থাৎ ভালো ও বিবেকবান লোকদের কর্তব্য ও দায়িত্ব হচ্ছে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের একতাবদ্ধভাবে অন্যায় ও অসত্যের প্রতিরোধ করা।

৭৪। যারা ঈমান আনে ও হিজরত করে এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় তাদের ঈমানের [রক্ষার] জন্য যুদ্ধ করে; এবং যারা [তাদের] আশ্রয় দান করে ও সাহায্য করে, এরা [সকলেই] প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাসী। তাদের জন্য আছে পাপের ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা ১২৪৩।

১২৪৩। এখানে মোহাজের ও আনসার উভয় মুসলমানদের কথা বলা হয়েছে। মোহাজেররা তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখার জন্য। আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নিজ জন্মভূমি, আত্মীয়-স্বজন, সব ত্যাগ করে। অপরপক্ষে মদীনার আনসাররা শুধু যে ইসলাম গ্রহণ করে তাই-ই নয়, মক্কাবাসী ভাইদের সাদরে গ্রহণ করে। এমনকি কপর্দকশূন্য মোহাজেরদের তাদের বিষয় সম্পত্তির অংশীদার করে নেয়, আল্লাহ্‌র জন্য। আল্লাহ্‌র সত্যের জন্য এত বড় ত্যাগ সত্যিই বিরল। আল্লাহ্‌র প্রতি তাদের এই আত্মত্যাগ আর্থিক ও পার্থিব ভাবে মূল্যায়ন করলে তার প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এই আত্মত্যাগের পিছনে তাঁদের আল্লাহ্‌র প্রতি যে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছিল তা ছিল তুলনাহীন, অমূল্য। আল্লাহ্‌র তরফ থেকে তাদের জন্য যে পুরস্কার তা হচ্ছে অনন্ত ক্ষমা ইহকাল ও পরকালের জন্য ও সম্মানজনক জীবিকা।

৭৫। এবং যারা পরে ঈমান এনেছে ১২৪৪, এবং হিজরত করেছে, এবং ঈমানের [রক্ষার] জন্য তোমাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করেছে, - তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্‌র বিধানে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়রা অন্যের অপেক্ষা অধিক নিকটবর্তী এবং [উত্তরাধীকারের] অধিকার অধিক। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত ১২৪৫।

১২৪৪। এই আয়াতে মোহাজেরদের বিভিন্ন শ্রেণীর নির্দেশাবলী বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, যদিও তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রয়েছেন প্রাথমিক পর্যায়ের মোহাজের, যারা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তির পূর্বে হিজরত করেছেন এবং কেউ কেউ রয়েছেন দ্বিতীয় পর্যায়ের মোহাজের, যাঁরা হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে হিজরত করেছেন। কিন্তু পূর্ববর্তী মোহাজেরদের মর্যাদা পরবর্তীদের অপেক্ষা অধিক।

১২৪৫। "আল্লাহ্‌র বিধান"-যা হচ্ছে চির অম্লান - যুগ কাল অতিক্রান্ত, "সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ" [৮৫ : ২২]। রক্তের সম্পর্ক ও এর অধিকার ও কর্তব্য চির অম্লান। তা কোনও বিশেষ অবস্থা বা পরিবেশের উপরে নির্ভর করে না। "আত্মীয়গণ আল্লাহ্‌র বিধানে একে অন্য অপেক্ষা অধিক হক্‌দার।" এই আয়াতটি সূরা আনফালের সর্বশেষ আয়াত এর শেষাংশে উত্তরাধীকার আইনের একটি ব্যাপক মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। এরই মাধ্যমে সেই সাময়িক বিধানটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে [দেখুন টীকা ১২৩৯], যেটি হিজরতের প্রথম পর্বের মোহাজের ও আনসারের মাঝে পারস্পরিক ভ্রাতৃবন্ধন স্থাপনের মাধ্যমে একে অপরের উত্তরাধীকারী হওয়ার ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল।