Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ২ জন
আজকের পাঠক ৮৬ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৩১৭৩৮ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬০৬৯৪১ বার
+ - R Print

সূরা বুরূজ


সূরা বুরূজ বা রাশিচক্র - ৮৫

২২ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


ভূমিকা ও সার সংক্ষেপ : প্রাথমিক মক্কী সূরাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এই সূরাটি ৯১ নং সূরাটির সমসাময়িক।

পূণ্যাত্মাদের উপরে নির্যাতনের বিষয় এই সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ শত্রুদের মোকাবিলা করেছেন এখনও তিনি তা করবেন।

সূরা বুরূজ বা রাশিচক্র - ৮৫

২২ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]


১। শপথ, সেই আকাশের ৬০৫১, যা [ প্রদর্শন করে ] রাশিচক্র [ তারকারাশি ] ৬০৫২ ;

৬০৫১। 'বুরূজ' অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্র। দেখুন [ ১৫ : ১৬ ] আয়াতের টিকা ১৯৫০। তারকাখচিত আকাশ এবং নক্ষত্র মন্ডলী রাতের নেত্র বা চক্ষু স্বরূপ। সুতারাং কেউ যেনো মনে না করে যে, অন্ধকার রাতের অপরাধের জন্য কেউ সাক্ষী থাকবে না। লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র মন্ডলীকে সাক্ষী করা হয়েছে শপথের উচ্চারণের দ্বারা।

৬০৫২। আয়াত [ ১ - ৩ ] তিনটি নিদর্শনের প্রতি আবেদন করা হয়েছে এবং এরই প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র বিবৃতি দান করা হয়েছে [৪ - ৮] আয়াতে। অন্যায় অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নিন্দা ঘোষণা করা হয়েছে, যে ব্যক্তি মোমেন ব্যক্তিদের ঈমানের জন্য তাদের পুড়িয়ে মেরেছিলো। তিনটি নিদর্শন নিম্নরূপ : ১) রাতের নক্ষত্র খচিত আকাশ যেখানে ছায়াপথ ও রাশিচক্র দৃশ্যমান। ২) বিচার দিবস, যেদিন সকল পাপীদের শাস্তি প্রদান করা হবে। এবং ৩) কিছু লোক যাদের সাক্ষীস্বরূপ করা হয়েছে।

২। শপথ, প্রতিশ্রুত [ শেষ বিচার ] দিবসের ; ৬০৫৩

৬০৫৩। 'প্রতিশ্রুত দিবস ' -অর্থাৎ বিচার দিবস; যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে পৃথিবীতে তাদের কৃত প্রতিটি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কাজের হিসাব সৃষ্টিকর্তার নিকট দাখিল করতে হবে। এটা কোনও ধারণা নয় এ হচ্ছে অকাট্য সত্য যা মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত। এই সত্যকে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে, এবং এই বিচার দিবস অবশ্যই সংঘটিত হবে। সেদিন হবে পাপীদের করুণ পরিণতি সেদিন হবে তাদের জন্য প্রকৃত দুঃখের দিন।

৩। শপথ, যে সাক্ষ্য দেয় এবং যার সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেয়া হয়; ৬০৫৪

৬০৫৪। এই আয়াতের আক্ষরিক অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বিভিন্ন তফসীরকারগণ বিভিন্ন ভাবে এই আয়াতকে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। সংক্ষিপ্ত এই বাক্যটি রূপকধর্মী যা নিম্নোক্ত ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মওলানা ইউসুফ আলী সাহেবের মতে বাক্যটি শেষ বিচারের সাথে সম্পৃক্ত। দ্রষ্টা বা সাক্ষী বিভিন্ন প্রকার হতে পারে যথা : ১) রসুলগণ [ ৩ : ৮১ ] ; আল্লাহ্‌ স্বয়ং [ ৩ : ৮১ এবং ১০ : ৬১ ] ; হিসাব লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাগণ [ ৫০: ২১ ] ; পাপীরা কুকর্মের জন্য তাদের যে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার করেছিলো সে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমূহ [ ২৪ : ২৪ ] ; প্রত্যেকের 'আমলনামা' [ ১৭ : ১৪ ] ; অথবা পাপী ব্যক্তি নিজে [ ১৭ : ১৪ ]। " যার সন্বন্ধে সাক্ষ্য দেয়া হয়।" বা যাকে উপস্থিত করা হয় যথা : পাপ কার্য, অথবা পাপী, যার বিরুদ্ধে প্রামাণিক সাক্ষ্য উপস্থিত করা হয়। এগুলির শপথ গ্রহণের মাধ্যমে এই সাবধান বাণী প্রেরণ করা হয়েছে যে, পাপীরা কোনভাবেই বিচার দিবসে নিস্কৃতি লাভ করতে পারবে না তাদের পাপ কাজের পরিণাম থেকে। একমাত্র অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমেই সে পরিত্রাণ পেতে পারে ও আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করতে সক্ষম হবে।

৪। দুভার্গ্য কুন্ডের অধিপতির, ৬০৫৫

৫। জ্বালানিপূর্ণ যে কুন্ডে ছিলো [ অফুরন্ত ] অগ্নি

৬০৫৫। কে এই ব্যক্তি ছিলো যে মুমিনদের কেবল ঈমানের কারণে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিলো ? এই ব্যক্তির পরিচয়ের জন্য আমাদের খুব বেশী সন্ধান করার প্রয়োজন নাই, কারণ মধ্য যুগে এরূপ বহু ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস বলে যে, মধ্যযুগে ইউরোপে বহু লোককে পুড়িয়ে মারা হয় কারণ তাদের প্রচলিত ধর্মীয় মতের সাথে ঐ সব হতভাগ্যের ধর্মীয় মতবাদের মিল ছিলো না। কোরাণে বর্ণিত আছে যে, প্রাচীন আরবে নমরূদ বাদশা হযরত ইব্রাহীমকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। কারণ প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ আগুনকে আদেশ দিয়েছিলেন," হে অগ্নি,তুমি ইব্রাহীমের উপরে শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।" [ ২১ : ৬৯ ] আয়াত ও টিকা ২৭২৫। আর একটি উদাহরণ হচ্ছে 'ইয়েমেনের শেষ হিমাইরাইট [ Himayarite] রাজা, যিনি ধর্মীয় বিশ্বাসে ছিলো ইহুদী। এই রাজা নাজরানার খৃষ্টানদের পুড়িয়ে মারার নির্দ্দেশ দান করেন। সম্ভবতঃ তার সময়কাল ছিলো ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগ অর্থাৎ ৫৭০ খৃষ্টাব্দে রাসুল হযরত মুহম্মদ মুস্তফার (সা) আবির্ভাবের পূর্ববর্তী সময়ে। এই আয়াতের আবেদন কোনও নির্দ্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য নয়, এর আবেদন সার্বজনীন। মোশরেক আরবদের নও মুসলিমদের উপরে যে অত্যাচার তাও এর সাথে তুলনীয়। যেমন তারা নওমুসলিমদের নগ্ন করে উম্মুক্ত প্রান্তরে গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরেরর মরুসূর্যের প্রচন্ড তাপের মাঝে বেঁধে রেখে দিত। এই অত্যাচার অগ্নিকুন্ডে পুড়িয়ে মারার থেকে কম যন্ত্রণাদায়ক নয়।

৬। দেখো ! যখন তারা [ আগুনের ] পার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলো ; ৬০৫৬

৭। বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে তারা যা করেছিলো, [সব কিছুর ] তারা সাক্ষী ছিলো

৬০৫৬। এখানে অত্যাচারীর মনোভাবকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডের পার্শ্বে বসে তারা তৃপ্তির সাথে হতভাগ্যদের [যারা অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবে ] মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

৮। এবং তারা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছিলো শুধু এই কারণে যে, তারা ছিলো আল্লাহ্‌র [ একত্বে ] বিশ্বাসী,যিনি ক্ষমতায় মহাপরাক্রমশালী, সকল প্রশংসার যোগ্য ; -

৯। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী যার অধীনে। এবং আল্লাহ্‌ সকল কিছুর সাক্ষী। ৬০৫৭

৬০৫৭। যারা অন্য কোনও অপরাধে নয়, শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌তে বিশ্বাসের দরুণ মোমেন বান্দাদের উপরে অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়, তাদের জন্য অনন্ত দোযখের আগুনের আশ্বাস দান করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ের দ্রষ্টা।

১০। নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী নর ও নারীদের উপরে অত্যাচার করেছে এবং পরে অনুতপ্ত হয় নাই, তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রনা।৬০৫৮

৬০৫৮। 'দহন যন্ত্রণা ' - এই শাস্তিটি জাহান্নামের শাস্তির উপরেও থাকবে। ধারণা করা হয়, এই শব্দটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। দোযখের শাস্তি ছাড়াও এই বিশেষ শাস্তিটি তাদেরই প্রদান করা হবে যারা মোমেন বান্দাদের জন্য অগ্নিকুন্ড প্রজ্জ্বলিত করেছিলো। সুতারাং এ সব অপরাধীদের জন্য বিশেষ ধরণের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

১১। যারা বিশ্বাসী এবং সৎকর্মশীল, তাদের জন্য আছে বেহেশত ৬০৫৯, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেটাই হবে [ তাদের ] মহামুক্তি [ সকল আকাঙ্খার পরিপূর্ণতা ] ৬০৬০

৬০৫৯। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৫ : ১১৯ ] ; [ ৯ : ৭২ ] এবং [ ২২ : ১৯] আয়াত।

৬০৬০। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৫ : ১১৯ ] ও টিকা ৮৩৩।

১২। অবশ্যই তোমার প্রভুর দৃঢ়মুষ্ঠি [ এবং ক্ষমতা ] অত্যন্ত শক্তিশালী।

১৩। তিনিই প্রথম সৃষ্টি করেন এবং [ জীবনকে ] পূণঃস্থাপন করতে পারেন। ৬০৬১

৬০৬১। 'প্রথম সৃষ্টি করেন' বাক্যটির ব্যাখ্যার জন্য দেখুন [ ২ : ১১৭ ] আয়াতের টিকা ১২০।

১৪। এবং তিনি বারে বারে ক্ষমাশীল এবং স্নেহপরায়ণ,

১৫। মহিমান্বিত আরশের প্রভু,

১৬। যা ইচ্ছা করেন তাই করেন। ৬০৬২

৬০৬২। আল্লাহ্‌র 'ইচ্ছাই' হচ্ছে তাঁর হুকুমসমূহ এবং সৃষ্ট কর্ম,তাঁর বিধানসমূহ। এই তিনের মাঝে কোনও পার্থক্য নাই। কোনও অবস্থাতেই তার ইচ্ছার কোনও পরিবর্তন ঘটে না। কোনও পরিবেশই তাঁর ইচ্ছার প্রতিপালনে বাঁধার সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি সর্বশক্তিমান ও সম্মানীত। আল্লাহ্‌র এই মহিমান্বিত রূপের সাথে পরবর্তী দুটি আয়াতে মানুষের শক্তির তুলনা করা হয়েছে।

১৭। তোমার নিকট কি পৌঁছেছে সৈন্যবাহিনীর কাহিনী ? ৬০৬৩

১৮। ফেরাউন ও সামুদের ?
৬০৬৩। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র ক্ষমতা, যা অসীম ও সার্বভৌম তার সাথে মানুষের সর্বোচ্চ শক্তিমানের তুলনা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দুটি উদাহরণ স্থাপন করা হয়েছে। ১) বিশাল সাম্রাজ্য,শক্তিশালী সেনাবাহিনী, অঢেল পার্থিব সম্পদ এবং সমসাময়িক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা পরিবৃত্ত অঢেল ক্ষমতার অধিকারী ফেরাউনের ধ্বংসের কাহিনী, দেখুন [ ৭৯ : ১৫ - ২৬ ]। ২) সামুদ জাতির কথা। সামুদরা ছিলো স্থাপত্য শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট স্থানে। পার্থিব সম্পদের অধিকারী সামুদ জাতি ছিলো বস্তুগত সভ্যতার অধিকারী। ফলে তারা আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্য করেছিলো, ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। দেখুন [ ৭ : ৭৩ - ৭৯ ] আয়াত ও টিকা ১০৪৩।

১৯। তবুও অবিশ্বাসীরা [ সত্যকে ] প্রত্যাখান করতে [ অনমনীয় ] ৬০৬৪

৬০৬৪। যুগে যুগে পৃথিবীর শক্তিশালী জাতিসমূহ যারা আল্লাহ্‌র বিধানসমূহকে প্রত্যাখান করেছে, তারা পৃথিবীর বুকে ধ্বংস হয়ে গেছে। এ সব উদাহরণ দেখার পরেও অবিশ্বাসীদের চেতনা ফিরে আসে না। একমাত্র আল্লাহ্‌ জানেন তাদের পরিণতি।

২০। এবং আল্লাহ্‌ ওদের অলক্ষ্যে পরিবেষ্টন করে আছেন ৬০৬৫

৬০৬৫। সৃষ্টির সকল কিছুই আল্লাহ্‌র ক্ষমতার অধীন। সৃষ্টির সকল কিছুই আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব দ্বারা পরিবেষ্টিত। পাপীরা মনে করতে পারে যে, তারা তাদের জ্ঞান ও বিচক্ষণতা দ্বারা নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারবে। কিন্তু তাদের অলক্ষ্যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়। ফলে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে তাদের পরাজয় আসে।

২১। না, না ইহা তো গৌরবময় কুর-আন,

২২। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ ৬০৬৬।

৬০৬৬। 'সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ ' - আল্লাহ্‌র বাণী কোনও ক্ষণস্থায়ী বস্তু নয়। এই বাণীর শিক্ষা শ্বাসত, চিরস্থায়ী সত্য। মানুষের জীবনে চলার পথে এই বাণীর হিত বা মঙ্গল সর্বযুগের সর্ব কালের মানুষের জন্য সমভাবে কার্যকর ছিলো, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সমাজ জীবন ও ব্যক্তিজীবন তখনই সুখ শান্তিতে উজ্জ্বল ও পরিতৃপ্ত হয়ে ওঠে যখন ব্যক্তি বা সমাজ আল্লাহ্‌র বিধান অনুযায়ী ন্যায় ও সত্যের দ্বারা পরিচালিত হয়। "সংরক্ষিত ফলক" দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাহ্‌র এই অমোঘ বিধান সমূহ কখনও কোনও যুগেই বিকৃত হয়ে যায় নাই। প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি ধর্মের যে নৈতিক নীতিমালা তা রয়েছে অক্ষয় ও শ্বাসত সত্য যা চিরস্থায়ী থাকবে ভবিষ্যতেও। দেখুন [ ১৫ : ৯ ] আয়াত যেখানে বলা হয়েছে এই বাণী অবিকৃত অবস্থায় রক্ষা করা হবে। আল্লাহ্‌র এ বাণীর মুল গ্রন্থ হচ্ছে পবিত্র কোরাণ। দেখুন [ ৩ : ৭ ] আয়াতের টিকা ৩৪৭।