+
-
R
ভূমিকা : সূরা তাওবাহ্ (অনুতাপ) বা বারাত (রেহাই প্রাপ্ত) যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই সূরাকে পূর্ববর্তী সূরার (৮) ধারাবাহিকতারূপে পরিগণিত করা যায়। শুধু ধারাবাহিকতা নয়, পূর্ববর্তী সূরার অংশরূপে গণ্য করা যায়। যদিও পূর্ববর্তী সূরা (৮) এবং এই সূরার (৯) অবতীর্ণ হবার সময়ের মধ্যে প্রায় সাত বছরের ব্যবধান রয়েছে।
পূর্বের সূরাতে (৮) নূতন মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলমানদের সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে অভ্যুত্থান, যুদ্ধের ময়দানে প্রতিরক্ষার নিয়ম-কানুন, যুদ্ধ জয়ের পরে যুদ্ধলব্ধ মালের সুষ্ঠ বণ্টনের নিয়মাবলী, সম্মিলিতভাবে শত্রুসেনাদের পরাভূত করতে জাতীয় জীবনে যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন হয় এবং যুদ্ধ জয়ের প্রাক্কালে শত্রুদের প্রতি সদয় ব্যবহার, যা ব্যক্তির চরিত্রকে মহিমান্বিত করে প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে যে, যদি শত্রুরা তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং বিশ্বাস ঘাতকতা করে - তখনকার করণীয় কর্তব্য। এটা সর্বজন স্বীকৃত সত্য যে শত্রুপক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে তা মেনে চলার দায়িত্ব অন্য পক্ষের থাকে না। ইসলাম তবুও চুক্তিভঙ্গের পরে চারমাস সময় প্রদানের পক্ষে। এই মেয়াদ দেয়া হবে অনুতাপ করার জন্য। ভুল বুঝতে পেরে যদি কেউ মুসলমানদের কাছে ফিরে আসতে চায়, তাদের সে সুযোগ দান করার জন্য মুসলমানদের সখ্যতার হাত সদা-সম্প্রসারিত থাকবে। কিন্তু এর পরেও যদি কেউ অনুতপ্ত না হয় তবে সর্বশক্তি দ্বারা শত্রুদের আক্রমণ করতে হবে। এই-ই হচ্ছে এই সূরার সাধারণ নীতিমালা। পূর্ববর্তী সূরার সাথে ধারাবাহিকতার কারণে এই সূরাকে পূর্ববর্তী সূরার (সূরা আন্ফাল) ক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে।
আয়াত (১ - ২৯) পর্যন্ত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা (State Policy) সম্বন্ধে ঘোষণা করা হয়েছে। এই আয়াতগুলিতে যেসব কর্মপন্থা (Policy) ঘোষণা করা হয়েছে তার সময়কাল ছিল ৯ই হিজরী সন, সওয়াল মাস এবং তা সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন হযরত আলী (রাঃ)। এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ঘোষণার জন্য তিনি হজ্জ্বের ময়দানকে বেছে নেন। যদিও আয়াতগুলি অবতীর্ণ হওয়ার দু'মাস পরে তিনি তা করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পলিসিগুলি যাতে ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে সে কারণেই আয়াতগুলি অবতীর্ণ হওয়ার দু'মাস পরে হজ্জ্বের ময়দানে তা প্রচার ও প্রকাশ করা হয়। এই সূরার পরবর্তী অংশ অর্থাৎ আয়াত ৩০-১২৯ অবতীর্ণ হয় পূর্ববর্তী আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার কিছু পূর্বে। সম্ভবতঃ তা ছিল ৯ই হিজরী সনের রমজান মাস। এই আয়াতগুলিতে নবী করিমের (সাঃ) তাবুক অভিযানের শিক্ষণীয় বিষয়গুলিকে বর্ণনা করা হয়েছে। তাবুক অভিযান ছিল ৯ই হিজরী গ্রীষ্মের শেষ ভাগে [সম্ভবতঃ ৬৩০ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাস]।
তাবুক অভিযানের সূত্রপাতের কারণ নিম্নরূপ :
আরবের শেষ সীমায় তাবুকের অবস্থান। সে সময়ে তাবুক ছিল সিরিয়ার একটি প্রদেশ [প্যালেস্টাইন ছিল এর অন্তর্ভুক্ত] এবং বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এর অবস্থান ছিল মদিনা থেকে ৩৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে এবং মা'ন (Ma'an) থেকে ১৫০ মাইল দক্ষিণে। বর্তমানে এই স্থানের উপর দিয়ে হিজাজ রেললাইন (Hijaz Railway) গিয়েছে। তাবুকে একটি মিষ্টি পানির ঝরণা ও একটি দূর্গ ছিল। সেই সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্রমাগত একটি গুজব উদ্বিগ্ন করে তোলে। আর তা হচ্ছে : বাইজেনটাইন সম্রাট (পারস্য সম্রাট) আরব আক্রমণের প্রস্তুতির কারণে পারস্য সম্রাট স্বয়ং সীমান্তে অবস্থান করছেন। এরই প্রেক্ষিতে রাসূল (সাঃ) তাঁর সাধ্য অনুযায়ী বিরাট সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেন এবং তাবুকের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু পারস্য সম্রাট কর্তৃক আরব আক্রমণের গুজবটি ছিল ভিত্তিহীন। কিন্তু নবীজি (সাঃ) তাবুক থেকে শুধু হাতে ফিরে আসেন নাই। তিনি এই সুযোগ গ্রহণ করেন এবং মুসলমানদের সুসংহত করে অগ্রসর হন এবং 'আকাবা' উপসাগরের নিকট অবস্থিত খৃস্টান ও ইহুদী সম্প্রদায়ের সাথে "মিত্রচুক্তিতে" আবদ্ধ হয়ে মদিনাতে ফিরে আসেন। মদিনাতে ফিরে এসে তিনি পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা বিবেচনা করে দেখেন। তাঁর অবর্তমানে মদিনার মুনাফিকরা যথারীতি দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করে। তাদের এই দ্বিমুখী নীতির কারণে এই সময়ে মুসলমান ও মুশরিকদের জন্য নীতির পরিবর্তন ঘটে। কারণ মুনাফিক ও মুশরিকরা বারে বারে মুসলমানদের মহানুভবতার অপব্যবহার করেছিল।
সমগ্র কুরআন শরীফে এটাই একমাত্র সূরা যার প্রারম্ভে "বিসমিল্লাহ্" সংযুক্ত হয় নাই। যদিও এই সূরাটির প্রত্যাদেশের সময়কাল ছিল শেষের দিকে তবুও রাসূল (সাঃ) এই সূরাটিকে সূরা আন্ফাল (৮)-কে অনুসরণ করতে আদেশ দান করেন। তবে এই সূরাটি একটি আলাদা সূরা হবে না সূরা আন্ফাল এর বর্ধিত অংশ হবে সে সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ তিনি দেন নাই। বর্তমানে এই সূরাটিকে একটি আলাদা সূরা হিসেবে গণ্য করা হলেও এর পূর্বে প্রারম্ভিক হিসেবে "বিসমিল্লাহ্" সংযুক্ত করা হয় না। যদিও কেউ নিশ্চিত নয় যে, আমাদের রাসূল (সাঃ) কুরআনের এই সূরাটি আবৃত্তির পূর্বে "বিস্মিল্লাহ্" বলে আরম্ভ করতেন কিনা।
এই সূরাটিকে বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা হয়। সবচেয়ে বেশী প্রচলিত হচ্ছে : আত্-তাওবা (অনুতাপ)। এই নামকরণ হয়েছে এই সূরার ১০৪ নং আয়াত অনুযায়ী এবং (২) বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদ করা)। এই নামকরণ হয়েছে সূরার প্রারম্ভিক আয়াত অনুযায়ী।
সারসংক্ষেপ : মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের যে চুক্তি ছিল, তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সে চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা কার্যকর করার জন্য চার মাস সময় দেয়া হয় যাতে মুশরিকরা অনুতাপ করার সুযোগ পায় (৯ : ১-২৯)।
কিতাবধারী জাতিরা আল্লাহ্র নির্দেশসমূহকে দুর্বোধ্য করে তুলেছে। কিন্তু সত্য সবার উপরে ভাস্বর হবে। আমরা সর্বদা ধর্মের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকব। তা যদি না করি তবে আমরা আল্লাহ্র পতাকা বহনে অসমর্থ হব; এবং আল্লাহ্ আমাদের স্থলে অন্য আরেক দলকে এই দায়িত্ব অর্পন করবেন [৯ : ৩০-৪২]।
মুনাফিক ও তাদের দ্বিমুখী নীতি : তাদের দুরভিসন্ধি প্রকাশ করা হয়েছে। মু'মিন বান্দাদের জন্য আল্লাহ্র আশীর্বাদ যেমন সন্দেহাতীত, সেরূপ মুনাফিকদের জন্য আল্লাহ্র শাস্তিও অবধারিত [৯ : ৪৩-৭২]।
পাপীকে সবসময় প্রতিহত করতে হবে যদি না সে অনুতপ্ত হয়। মিথ্যাবাদীরা সত্যকে ভঙ্গ করেই সন্তুষ্ট থাকে না। বরং সমস্ত কল্যাণকেই সে উপহাস করে। মুনাফিকদের হিংসা না করে পরিহার করতে হবে [৯ : ৭৩-৯৯]।
আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট যারা আন্তরিকভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ করে। যারা মন্দ কাজের পরে অনুতাপ করে আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু যারা বিবাদ ঘটায় এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনৈক্যের জন্য প্ররোচিত করে তাদের আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন না। বিশ্বাসী বা মু'মিন বান্দারা আল্লাহ্র কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, ফলে আল্লাহ্ তাদের সীমাহীন সুখ-শান্তি দান করেন। যারা বিশ্বাসে দোদুল্যমান, এবং কর্তব্যকর্মে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তারাও যদি শেষ পর্যন্ত অনুতপ্ত হয় - দয়াময় আল্লাহ্ তা গ্রহণ করেন [৯ : ১০০-১১৮]।
যারা বিশ্বাসী বা মু'মিন বান্দা, তারা সর্বদা পূণ্যবান, সত্যবাদী ও কর্তব্য-কর্মপরায়ণদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে। যদি সম্প্রদায়ের সমস্ত লোক যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করে তবে এক অংশ নিজ অবস্থানে থাকবে, তা এই জন্য যে তারা অধ্যাবসায়ের সাথে ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনা করবে এবং তাদের ভাইরা যখন প্রত্যাবর্তন করবে তাদের ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষাদান করবে। যারা বিশ্বাসী, প্রতিটি সূরা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করে। যাদের অন্তঃকরণ ব্যাধিগ্রস্থ, তাদের বেলায় সন্দেহ ক্রমাগত আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। মহা আরশের অধিপতি আল্লাহ্তে বিশ্বাস স্থাপন কর [৯ : ১১৯-১২৯]।
১২৪৬। "Baraat" আরবী শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে "Immunity", বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "সম্পর্কচ্ছেদ"। মাওলানা ইউসুফ আলী মনে করেন আরবী এই শব্দটির সঠিক অনুবাদ সম্ভব নয়। মাওলানা ইউসুফ আলী চেষ্টা করেছেন যতটুকু সম্ভব আরবী শব্দটির মূল ভাবকে ইংরেজী ভাষায় রূপান্তরিত করতে। এই আরবী শব্দটির পূর্ণ অর্থকে সূরাটির ভূমিকাতে প্রকাশ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। আয়াত [৯ : ৩]-এ "Dissolve (treaty) obligation" লাইনটি দ্বারা এবং বাংলা "কোন সম্পর্ক রহিল না" লাইনটি দ্বারা মূল শব্দটির ভাবকে প্রকাশ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। মুশরিক ও ইসলামের শত্রুরা ঘন ঘন মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হ'ত। মুসলমানেরা চুক্তির শর্ত যথাযতভাবে পালন করত, কিন্তু মুশরিকরা চুক্তির শর্ত যখনই সুযোগ পেত তখনই ভঙ্গ করতো। এই কারণে কয়েক বছর পরে মুশরিকদের সাথে এই চুক্তি "বাতিল" ঘোষণা করা একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এই সূরাতে সে কথাই বলা হয়েছে যে শর্ত অনুযায়ী চার মাস সময় দান করে চুক্তি বাতিল ঘোষণা করতে হবে এবং যারা মৈত্রী-চুক্তির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাদের সুযোগ দান করতে হবে।
১২৪৭। "চারিমাস" - কোন কোন তফসীরকারের মতে, এই "চারিমাস" সময় হচ্ছে রজব, জিলক্কাদ, জিলহজ্জ্ব এবং মুহরম। কারণ, আরবদেশে প্রাচীনকাল থেকে এই চারটি মাসকে পবিত্র মাস বলে গণ্য করা হতো এবং এই মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ থাকে [দেখুন ২: ১৯৪ এবং এর টীকা]। "চারিমাস" - কে এভাবে গণনা না করে, চুক্তিভঙ্গের ঘোষণার পর থেকে গণনা করা শ্রেয়। এই সূরাটি অবতীর্ণ হয় সওয়াল মাসের প্রথমে (ভূমিকা দেখুন)। সূরা নাজিলের পরবর্তী চারটি মাস হবে সওয়াল, জিলক্কাদ, জিলহাজ্জ্ব এবং মুহররম। এক্ষেত্রে শেষের তিনটি মাস প্রাচীনকাল থেকেই নিষিদ্ধ মাস রূপে পরিচিত ছিল।
১২৪৮। "মহান হজ্জ্বের দিবস" - On the day of the great pilgrimage। সম্ভবতঃ দিনটি ছিল জিলহজ্জ্ব মাসের ৯ তারিখ [আরাফাত] অথবা ১০ তারিখ [কুরবাণী-Day of sacrifice]।
১২৬২। "মু'মিনদিগের চিত্ত প্রশান্ত করবেন।" মুশরিকদের বিদ্রূপাত্মক ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, অপমান ইত্যাদিতে মু'মিন বান্দাদের অন্তর ক্ষতবিক্ষত হতো। উপরের বাক্যটির দ্বারা তাদের আল্লাহ্ সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
১২৬৩। মুসলমানেরা মুশরিকদের দ্বারা বারে বারে অত্যাচারিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন, বিদ্রূপের কষাঘাতে তাদের হৃদয় হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু মুশরিকদের উপরে মুমিনদের বিজয়ে তাদের হৃদয়ের সেই যন্ত্রণার প্রশমন ঘটে। মু'মিনদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ফলে যে বিজয় তারা লাভ করবে, তা তাদের আত্মার সকল যন্ত্রণা দূরীভূত করে শান্তির প্রলেপ দিয়ে দেবে, এ আশ্বাস আল্লাহ্ তাদের দিয়েছেন। অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা এবং যুদ্ধ করা আল্লাহ্র সৈনিকদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের ফলে যে সাফল্য তারা লাভ করবে তা তাদের অন্তরকে শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। অন্তরের সকল গ্লানি অপমানের যন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে, অন্তরে বিরাজ করবে অপার শান্তি। এ হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান। সাধারণ উপদেশ হচ্ছে, সৎ কাজের জন্য সংগ্রাম করা হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করা। আর এই সংগ্রামের মধ্যে অপমান আছে, গ্লানি আছে, তবে আল্লাহ্ তাদের সাফল্য দান করবেন যা তাদের আত্মার সকল গ্লানি, অপমানের জ্বালা দূর করবে। আত্মাকে পৌঁছে দেবে বেহেশ্তি প্রশান্তির আলয়ে।
১২৬৪। আল্লাহ্ অসীম করুণার আঁধার। প্রতিটি সমাজে কিছু লোক থাকে যারা খুব সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। যখন সমাজে অন্যায় ও অশুভ শক্তি, ন্যায় ও সত্যের কাছে পরাভুত হয়, তখন এসব লোক খুব সহজে ন্যায় ও সত্যের শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং নিজেকে মু'মিন বান্দারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। যারা ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সৈনিক, যুদ্ধজয়ের পরে তাদের অন্তর বেহেশ্তি শান্তিতে ভরে যাবে। এই হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান। সত্যের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে সৈনিকেরা যুদ্ধের সাফল্যের পরে আল্লাহ্র অপার রহমত ও ক্ষমার পরশ তাদের অন্তরে লাভ করে। তাদের অন্তরের সকল ক্ষোভ ও অশান্তি দূরীভূত হয়ে যায়।
১২৬৫। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তিনি আমাদের দৃশ্য-অদৃশ্য, মনের গোপন-প্রকাশ্য সকল কিছুই অবগত আছেন। তবুও কুরআনের বহু স্থানে বলা আছে, আমাদেরকে আল্লাহ্ পরীক্ষা করে জেনে নেবেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কেও পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তিনি আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত। আল্লাহ্ সবই জানেন। এসব পরীক্ষা কোনরূপ অজ্ঞতা যাচাইয়ের জন্য নয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে : বিপদ আপদে ধৈর্য্য ও তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের দ্বারা বান্দার "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে" আধ্যাত্মিক জগতের পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে দেয়া। আল্লাহ্র কাছে শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞানের চাইতে চারিত্রিক দৃঢ়তার মূল্য অনেক বেশি। আল্লাহ্র দরবারে যে বিষয়ের মূল্য বেশি, তা শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞান নয়, বরং কার্যগত ও চরিত্রগত শ্রেষ্ঠত্ব। এই চরিত্রগত শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই আমরা আল্লাহ্র রহমত ও করুণা আশা করতে পারি। কে আল্লাহ্কে ভালবেসে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামে প্রস্তুত, কে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) ও বিশ্বাসীদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত - এই আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা ও সংগ্রামী মনোভাবই হচ্ছে আল্লাহ্র জানার বিষয়বস্তু।
১২৬৬। "Amara" - এই আরবী শব্দটি মসজিদের জন্য প্রযোজ্য করা হয়েছে। এই শব্দটি বিভিন্ন অর্থবোধক। তা নিম্নরূপ : (১) তৈরী করা বা পুনঃসংস্কার করা; (২) উপযুক্ত মান বজায় রাখা; (৩) শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে দর্শন করা; (৪) জীবন, আলো এবং কর্মব্যস্ততা। এই আয়াতে রক্ষণাবেক্ষণ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলাম প্রচারের পূর্বে আরবের মুশরিকরা ক্বা'বা শরীফের নির্মাণ, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। তারা এই মসজিদকে এক আল্লাহ্র উপাসনার জন্য পূত-পবিত্র রাখার পরিবর্তে সেখানে বহু দেবতার উপাসনা এবং অনৈসলামিক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পবিত্র ক্বা'বা শরীফকে তারা তাদের অর্থ আয়ের উৎস স্বরূপ ব্যবহার করতো। ইসলামের আগমন তাদের এসব কার্যক্রমের বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা নওমুসলিম ও তার নেতা হযরত মুহাম্মদকে (সাঃ) মক্কা থেকে বহিষ্কার করে দেয় এবং মুসলমানদের জন্য ক্বা'বা শরীফকে নিষিদ্ধ করে দেয়। মুসলমানেরা যখন আরবের বুকে সংঘবদ্ধ মুসলিম সম্প্রদায়রূপে আবির্ভূত হলো, তখন অষ্টম হিজরীতে তাঁরা মক্কা জয় করলেন। মক্কা জয়ের পরে মুসলমানেরা ক্বা'বা শরীফকে বিভিন্ন দেব-দেবী মুক্ত করে তা পবিত্র করেন এবং হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) ন্যায় ক্বা'বা শরীফে এক আল্লাহ্র ইবাদত প্রতিষ্ঠা করেন। আরবদের ভিতর যারা বহু দেবদেবীতে বিশ্বাসী এবং যারা ক্বা'বা শরীফে দেব-দেবীর অধিষ্ঠানে আগ্রহী তাদের জন্য ক্বা'বা শরীফে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই আয়াত দ্বারা। কারণ, ক্বা'বা শরীফ হযরত ইব্রাহীমের দ্বারা নির্মিত হয়, আল্লাহ্র হুকুমে। এটা হচ্ছে আল্লাহ্র ঘর। সেই ঘরে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারো উপাসনা হলে তা হবে আল্লাহ্র জন্য অপমানজনক, এবং ক্বা'বা শরীফের জন্য মানহানিকর। সুতরাং, এই পবিত্র ঘরে আর কারো উপাসনা হারাম। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
সাধারণ উপদেশ হচ্ছে : আল্লাহ্র মসজিদ সবসময় হবে আল্লাহ্র প্রেমিকদের জন্য ইবাদতের স্থান। আল্লাহ্র ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন আচার অনুষ্ঠান বা তা থেকে আয় রোজগার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ এটা হবে এমন এক স্থান যেখানে বান্দার আগমন ঘটবে আত্মিক উন্নতি লাভের জন্য, পার্থিব লাভের জন্য নয়। প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিকদের জন্য এর দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে। প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিকদের সংজ্ঞা পরবর্তী আয়াতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
১২৬৭। প্রকৃত আল্লাহ্ প্রেমিকদের বৈশিষ্ট্য এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। তারাই অকৃত্রিম বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিক যারা আল্লাহ্র একত্বের অস্তিত্বে বিশ্বাসী; পরকালে আল্লাহ্র কাছে ইহকালের কার্যক্রমের জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী, একান্তভাবে, একাগ্রভাবে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ্র সান্নিধ্য কামনা করে, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করে, এবং আল্লাহ্ ব্যতীত পৃথিবীর কোন শক্তির কাছে মাথা নত করে না, অর্থাৎ তাদের সকল কার্যকলাপ, তাদের সর্ব অবয়ব এক আল্লাহ্র কাছে নিবেদিত থাকে - তারাই প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিক।
১২৬৮। উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে বর্তমান, পৃথিবীর লোক তাদের খ্রিস্টান, ইহুদী যে নামেই ডাকুক না কেন, তারাই প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিক বা মুসলমান। আল্লাহ্র হেদায়েত তাদের জন্য অপেক্ষমান।
১২৬৯। আরব দেশ মরুভূমির দেশ। পানি সেখানে মহার্ঘ বস্তু। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশে বসে সেই সময়ের আরব দেশের পানির মহার্ঘতা কল্পনা করাও অসম্ভব। এ আয়াতে তীর্থযাত্রী বা হাজীদের পানি পান করানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ তাই-ই দাঁড়ায়, কিন্তু প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায় তীর্থযাত্রীদের সেবা করা। সেই সেবার মান হতে হবে মহার্ঘ, অর্থাৎ যা সহজলভ্য নয়। মসজিদের জন্য পার্থিব সম্পদ খরচ করা। এই পার্থিব সম্পদ শারীরিক হতে পারে, অর্থ সম্পদ হতে পারে। আল্লাহ্র রাস্তায় অর্থ সম্পদ ব্যয় করা অবশ্যই পূণ্যের কাজ। কিন্তু এ সমস্ত কাজই হচ্ছে বাহ্যিক যা অত্যন্ত সহজ। কারণ, যে কাজে মানুষের মেধা, মননশক্তি, পরিশ্রম, একাগ্রতা, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, আত্মোৎসর্গ থাকে না, অর্থাৎ যে কাজ আত্মাকে স্পর্শ করে না, তার মূল্য আল্লাহ্র চোখে সামান্য। কাজের পরিমাণ যাই-ই হোক না কেন যদি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কোন কাজ করা হয়, এবং সে কাজে নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করা হয়, তবে আল্লাহ্র চোখে তা-ই শ্রেষ্ঠ কাজ। এ আয়াতে বলা হয়েছে যারা বিশ্বাসী ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সংগ্রাম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে সৎ পথ প্রদর্শন করেন। অর্থাৎ তাদের আত্মা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়ে যায়। অর্থাৎ তাদের মধ্যে বিবেকের আলো জাগ্রত হয়। ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের পার্থক্য তাদের সামনে হয় ভাস্বর। চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে "সরল পথের" ঠিকানায় তাঁরা পৌঁছে যান। অপরপক্ষে যারা পৃথিবীতে সুনাম কুড়ানোর জন্য সৎ কাজ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে তাদের আল্লাহ্ হেদায়েত বা সৎ পথ প্রদর্শন করেন না। অর্থাৎ তাদের আত্মায় বিবেকের আলো বা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে না। ফলে তারা ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা লাভ করে না। দুর্লভ চারিত্রিক গুণাবলী - যা সৎ পথের সন্ধান দেয়, তা অর্জন করতে তারা অক্ষম।
১২৭১। যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা করে আল্লাহ্ তাদের সুসংবাদ দিচ্ছেন : (১) তারা আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হবে, (২) আল্লাহ্র সন্তুষ্টি তাদের জীবন সুখ-শান্তিতে ভরে দেবে; (৩) বেহেশ্তের সুখবর আছে তাদের জন্য; (৪) আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করবে আত্মার মাঝে যা স্থায়ী সুখ-শান্তিতে আত্মাকে ভরিয়ে দেবে - যা বান্দার জীবনের সর্বোচ্চ পুরস্কার। এই চারটি অবস্থা আত্মিক অগ্রগতির ক্রমমাত্রা বা ধাপ। ১ নম্বর হচ্ছে আল্লাহ্র স্বীয় মর্যাদা বা বিশেষ দয়া বা রহমত। ২ নম্বর হচ্ছে আল্লাহ্র সন্তোষ বা সন্তুষ্টি নিজ আত্মার ভিতরে অনুভব করার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা আত্মাকে পৃথিবীর মলিনতার উর্ধ্বে স্থাপন করে। আত্মাকে স্বর্গীয় শান্তিতে ভরিয়ে দেয়। ৩ নম্বর হচ্ছে "জান্নাতের" স্থায়ী সুখ-শান্তির আশ্বাস। পৃথিবীর কোনও অশান্তি বা বিপর্যয় এসব লোকদের বিচলিত করে না। ৪ নম্বর হচ্ছে আত্মার সর্বোচ্চ আশা-আকাঙ্ক্ষা বা সর্বোচ্চ শান্তি বা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ।
১৩৩৪। মুনাফিক সরদার "আবদুল্লাহ্ ইব্ন উবাঊ ইবন সালুল" - এর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) তার জানাযার নামাজ পড়ান ও তার জন্য দোয়া করেন। এই প্রসঙ্গে এই আয়াত ও পরবর্তী ৮৪ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। এইসব আয়াতে আল্লাহ্ কঠোর ভাষায় কাফের ও মুনাফিকদের সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়। তিনি তাঁর স্বভাব অনুযায়ী সবার জন্য মঙ্গল কামনা করতেন। তিনি ইসলামের শত্রুর মৃত্যুর পরেও আল্লাহ্র দরবারে তার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এই আয়াতে আল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ)'র প্রার্থনার জবাবে তা নাকচ করে দেন।
[বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের এ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে : ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বই হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। যেখানে পাপাচারীর জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) এর দোয়া আল্লাহ্ কবুল করেন নাই। এমনকি তিনি যদি পুনঃ পুনঃ (সত্তর বার কথাটি দ্বারা আল্লাহ্ পুনঃ পুনঃ ভাবকে প্রকাশ করেছেন) দোয়াও করতেন, তবুও তা আল্লাহ্র দরবারে কবুল হতো না। সেখানে আমাদের দেশের কিছু অজ্ঞ ব্যক্তি সমাজ জীবনে অন্যায় অত্যাচার করে প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করে প্রতি মূহুর্তে আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে চলেছে এবং এরা ধারণা করে মাজার পূঁজা করে এবং পীর ফকিরের সাহায্যে তাদের সব পাপ মোচন হয়ে যাবে। পাপ মোচনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে প্রকৃত অনুতাপ করা এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। প্রকৃত অনুতাপকারীকে আল্লাহ্ ক্ষমা করেন। তিনিই তো পরম ক্ষমাশীল, দয়ার আঁধার। এ কথা মনে রাখতে হবে ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বই হচ্ছে ইসলামের মূল মর্মবাণী।]
১৩৩৫। এই আয়াতটি তাবুকের প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে। তাবুক অভিযানের সময় ছিল গ্রীষ্মকালে। আরব দেশের দাবদাহ কল্পনা করা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অসম্ভব। বাইজেন্টাইন সম্রাট মুসলমানদের আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন, এই গুজবের ভিত্তিতেই রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ)-কে তাড়াহুড়ো করে তাবুক অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাবুক অভিযান ঘটে সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবর মাসে।
১৩৩৬। তাবুকের অভিযানে যারা অংশগ্রহণ করে নাই, এই আয়াতে তাদের সম্বোধন করা হয়েছে। তারা এখন অবজ্ঞা প্রদর্শন করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে পারে, কিন্তু তা হবে ক্ষণস্থায়ী। কারণ তাদের এই অপরিণামদর্শিতার ফল খুব খারাপ। চোখের পানিতে তাদের এই ঋণ শোধ করতে হবে।
[উপদেশ : যে কাজ মহৎ ও আমাদের জন্য মঙ্গলজনক, তা বর্তমানে সুখকর না-ও হতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তার ফল আনন্দদায়ক। বর্তমানের ক্ষণস্থায়ী সুখের আশায় যারা আল্লাহ্র আদেশকে লঙ্ঘন করে, ভবিষ্যতে তাদের পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাবুক অভিযান এখানে এই উপদেশের প্রতীকরূপে কল্পনা করা যায়। - অনুবাদক।]
১৩৩৭। মুসলমানের মৃত্যুর পরে, প্রত্যেক মুসলমানের পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য হচ্ছে তার জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ ও তার পাপ মোচনের জন্য, তার আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা। এই আয়াতে বলা হয়েছে যারা কাফের, যারা আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ) কে অস্বীকার করে, অর্থাৎ যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের ধর্মীয় লেবেল যা-ই হোক না কেন, তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা-প্রার্থনা বা জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করা নিষিদ্ধ।
১৩৩৮। এই আয়াতটি এই সূরার ৫৫ নং আয়াতের অনুরূপ। এই দু'টি আয়াতই দু'টি ভিন্ন প্রেক্ষাপটের সমাপ্তি স্বরূপ বলা হয়েছে। ৫৫ নং আয়াতের প্রেক্ষাপট ছিল মহৎ বা সৎ কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করা। ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদের সময়ে অর্থের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তবুও তা যদি শুধুমাত্র লোক দেখানো দান হয়, আল্লাহ্র কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই আয়াতের [৯ : ৮৫] প্রেক্ষাপট হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলো, তাদের অন্তোষ্টিক্রিয়া বা জানাযায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ।
১৩৩৯। "Khawalif", - একবচনে "Khalifa" - অর্থাৎ তারাই যারা যুদ্ধের সময়ে অন্তঃপুরে থাকে : মহিলা। এই আয়াতটি কাপুরুষদের জন্য বিদ্রূপাত্মক বিশেষণ। যারা ভীতু ও কাপুরুষ তারা যুদ্ধের ময়দান অপেক্ষা গৃহে অবস্থান পছন্দ করে। তারা যে শুধু কাপুরুষ তা-ই নয়, তারা বুদ্ধিহীনও। কারণ যুদ্ধের ময়দানে যাবার প্রয়োজন তাদের নিজেদের-ই স্বার্থে, নিজেদের নিরাপত্তার কারণে। এ কথা তারা ভুলে যায় যে, শত্রু সেনারা যদি তাদের ভূমি ও গৃহ দখল করে নেয়, তবে সে বা তার পরিজন কখনোই নিরাপদ নয়। এমনকি তার নিজ জীবন পর্যন্ত নিরাপদ নয়। কিন্তু এই সহজ সত্যটি তারা অনুধাবণে ব্যর্থ। "অন্তর মোহর করা হয়েছে"; ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, "Their hearts are sealed"। এই বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে - "মানুষ অভ্যাসের দাস।" এই সব লোকের চরিত্রে মুনাফেকী ও কাপুরুষোচিত ব্যবহার এমনভাবে শেকড় বিস্তার লাভ করেছে যে, এরা সমাজের অন্যান্য মূল্যবোধ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। আত্মোৎসর্গ, সাহসিকতা, সততা - প্রভৃতি গুণাবলী ও স্বর্গীয় আদেশের তাৎপর্য এরা অনুধাবন করতে পারে না। কারণ, এরা এদের মুনাফেকী ও কাপুরুষোচিত অভ্যাসের দরুণ তাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। এবং আত্মার বিকাশের অন্যান্য পথ এদের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন : যে লোক সর্বদা মিথ্যাতে অভ্যস্ত, তাঁর পক্ষে সত্যের আলো, ক্ষমতা ও শান্তি অনুধাবন করা অসম্ভব। এই অবস্থাকেই কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে, "অন্তরে মোহর"।
১৩৪০। "কল্যাণ" এবং "সফলকাম" এই শব্দ দুটি আক্ষরিক অর্থে এবং আত্মিক উন্নতির প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত।
১৩৪১। এই আয়াতটি সূরার ৭২ নং আয়াতটির অনুরূপ। এই আয়াতে এসে মদিনার মুনাফিকদের বর্ণনা শেষ হয়েছে। অধ্যায় ১২ থেকে শুরু হয়েছে বেদুঈন মুনাফিকদের বর্ণনা।
রুকু - ১২
১৩৪২। মুনাফিকদের অস্তিত্ব যে শুধুমাত্র মদিনাতেই ছিল তা-ই নয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের অস্তিত্ব বেদুঈন সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিরাজমান ছিল। এই আয়াতে বেদুঈন মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে "মরুবাসী" অর্থাৎ বেদুঈন। আরবদের বেদুঈন সম্প্রদায় অত্যন্ত সাহসী ও যুদ্ধপ্রিয় সম্প্রদায়রূপে পরিচিত। কিন্তু তাবুক অভিযানে যখন তাদের আহ্বান করা হলো, তারা সে আহ্বানে সাড়া দিল না। যখনই জিহাদের আহ্বান আসবে, মুসলিম হিসেবে প্রতিটি মুসলমানের সেই যুদ্ধে যোগদান করা অবশ্য কর্তব্য। যদিও বেদুঈনরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো, তবে তা তাদের আত্মাকে খাটি মু'মিন ব্যক্তিকে রূপান্তরিত করতে পারে নাই - তারা ছিলো মুনাফিকদেরই রূপান্তর। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের কষ্ট : সর্বোপরি পারস্য সম্রাটের সুশিক্ষিত বাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার ভয় তাদের তাবুক অভিযানে বিরত রাখে। অভিযানে অংশগ্রহণ না করার জন্য তারা মিথ্যা অযুহাতের অবতারণা করে। এর কারণ, তাদের ঈমান বা বিশ্বাসের অভাব। ঈমানের ভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারণেই, তারা মহত্বর কারণের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে ভয় পায়। মুনাফিকদের সম্বন্ধে দেখুন সূরা ৯, আয়াত ৪৬-৪৭ এবং সূরা ৯, আয়াত ৫৩-৫৪। বেদুঈনদের কেউ কেউ মিথ্যা অজুহাত প্রদর্শন করেছিলো, কেউ কেউ তাবুক অভিযানের আহ্বান উপেক্ষা করে বাড়ীতেই 'বসে রইল'।
১৩৪৩। নিজ মাতৃভূমি যখন শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা করে, তখন সারা দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। প্রতিটি মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য এই অবস্থায় যার যা আছে, তাই দিয়ে সাহায্য করা। শক্তি-সামর্থ, অর্থ-সম্পদ, সবকিছু যুদ্ধের জন্য উৎসর্গ করতে হবে।
১৩৪৪। "Hamala, Yahmilu"- এর অর্থ পরিবহনের ব্যবস্থা করা। এখানে এর অর্থ হবে যার উপরে আরোহণ করা যায়, অর্থাৎ ঘোড়া, উট ইত্যাদি। কারণ সে সময়ে বর্তমান যুগের মত অটোমোবাইলের চলন ছিল না। সে সময়ে যুদ্ধ যাত্রায়, রসদ এবং অস্ত্র-শস্ত্র পরিবহনের জন্য ভারবাহী পশু ব্যবহার করা হতো। বর্তমান যুগে পরিবহন ব্যবস্থা যুদ্ধের সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ। বিভিন্ন ধরণের অটোমোবাইলের ব্যবহার বর্তমানে প্রচলিত। কিন্তু আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে পশুই ছিল একমাত্র ভারবাহী প্রাণী। আর তাবুক অভিযান ছিল আত্মরক্ষার্থে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ; আর তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অভিযান। ইসলাম রক্ষার্থে তা ছিল জিহাদ। আর এই জিহাদ কোন পূর্ব পরিকল্পিত ব্যাপার ছিল না; ছিল না কোনও তহবিল, ছিল না কোনও পরিবহন ব্যবস্থা। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করে। ফলে যারা গরীব, যারা যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহে ব্যর্থ হলো তাদের অন্তর দুঃখে ভরে গেলো, "তারা অর্থ ব্যয়ে অসমর্থজনিত দুঃখে অশ্রুবিগলিত নেত্রে ফিরে গেল।" কারণ তারা আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদের জন্য আগ্রহী ছিল। কিন্তু তাদের সামর্থের অভাবে তারা আল্লাহ্র সেবা করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য হলো। তাদেরকেই এই আয়াতে আল্লাহ্ সান্ত্বনা দিয়েছেন।
[উপদেশ : আল্লাহ্র কাছে কাজ অপেক্ষা কাজের নিয়ত এবং নিয়তের আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা অধিক মূল্যবান। তবে যারা দুর্বল এবং অসুস্থ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ - একমাত্র এরাই যুদ্ধের আওতা থেকে অব্যাহতি পেতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত উপস্থিতির প্রশ্নই আসে না, তবে তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও, পরোক্ষভাবে অর্থ-সম্পদ সাহায্য দ্বারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। অবশ্য এক্ষেত্রে সামর্থের প্রশ্নটি বিবেচ্য। কিন্তু যদি কেউ শারীরিক দিক থেকে অসমর্থ এবং সেই সাথে গরীব হন, তবে তিনি যুদ্ধ করা থেকে অব্যাহতি লাভ করবেন। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, "আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি তারা [কর্তব্য] আন্তরিক থাকে" এবং তাদের "সৎ কর্ম" - যদি খাঁটি হয়, অর্থাৎ তাদের নিয়ত বা উদ্দেশ্য হবে জিহাদের জন্য একাত্মতা, আল্লাহ্র ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ও সৎ; তবেই তারা সম্মুখ যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারবে। প্রকৃত মুসলিমদের মধ্যেও কেউ কেউ বিশেষ অসুবিধার জন্য তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নাই, তাদের ওযর কবুল হওয়ার আশ্বাস এখানে দেয়া হয়েছে। উপদেশ হচ্ছে, যে কোনও কাজ, তা যদি সৎ নিয়তে বা উদ্দেশ্যে করা হয়, তার সফলতা বা অসফলতা, বৃহৎ বা ক্ষুদ্র, যে কোনও রূপেই তা করা হোক না কেন, তা হবে আল্লাহ্র সেবা বা আল্লাহ্র কাজ। কবি মিলটন তার কবিতায় এই ভাবকে এভাবে প্রকাশ করেছেন, "They also serve who only stand and wait"। কাজ করাটাই সংসারে বড় কথা নয়; কাজের নিয়ত বা কাজের পিছনের ব্যক্তির যে সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, বিরাজ করে - আত্মার এই পবিত্র অবস্থাই আল্লাহ্র কাছে কাম্য। যাদের কাজের পিছনে সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা ও সততা বিরাজ করে, তারাই আল্লাহ্র করুণা ও ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য।
১৩৪৫। সূরা ৯ আয়াত ৮৭-তে একই রকম ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে করা হয়েছে সেই সব শহরবাসীদের জন্য, যারা নিজ কর্তব্য এড়িয়ে যেতে চায়, এখানে সেই একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে মরুবাসীদের জন্য। এটাতো শুধুমাত্র কর্তব্যই ছিল না, এটা ছিলো মু'মিন বান্দাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ - নিজেকে আল্লাহ্র ভালোবাসা পাবার যোগ্য প্রমাণ করার সুযোগ। আত্মত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের সুযোগ। যারা একম সুযোগ হারায় তারা সত্যিই হতভাগ্য। তারা জানে না, জীবনে তারা কি হারালো।
[উপদেশ : দেশ ও জাতির দুর্যোগের সময়ে সকলেরই আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মানসিকতা থাকতে হবে - তবেই আল্লাহ্র রহমত তাদের উপরে বর্ষিত হবে। তা যারা করতে পারে না, তারা হতভাগ্য। আর্থিক লাভই পৃথিবীর শেষ কথা নয়। এই উপদেশ সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বস্থানের জন্য প্রযোজ্য।
১৩৫২। সংসারে সকল লোকের মনোবল সমান থাকে না। পৃথিবীতে বেশির ভাগ লোক দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়। তারা খুব সহজে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই সব লোকের কথাই এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের অনেকের চরিত্রেই অনেক ভালো গুণাবলী উপস্থিত, কিন্তু দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়ার জন্য, তারা খুব সহজেই মন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরে। এদের চরিত্রে অনেক ভালো এবং মন্দের মিশ্রণ দেখা যায়। এদের জন্য আল্লাহ্ এই আয়াতে ক্ষমার আশ্বাস দিয়েছেন। অবশ্য তা শর্ত সাপেক্ষ। নিজ অপরাধ সনাক্ত করে স্বীকার করতে হবে এবং অনুতাপ, সৎকর্মের মাধ্যমে আত্মাকে পূত পবিত্র করার চেষ্টা করবে। তবেই তারা আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়ালু । রাসূলকে (সাঃ) তাদের আত্মার পবিত্রার জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে, নীচের আয়াতে দেখুন।
[উপদেশ : রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) সময়ে যারা দুর্বল চরিত্রের লোক তাদের উদ্দেশ্যে এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এর উপদেশ সর্বজনীন-যুগ, কাল, দেশ অতিক্রান্ত -সকল মানব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য।]
১৩৫৩। যারা অনুতাপকারী তাদের এই আয়াতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। অনুতাপের পূর্বশর্তই হচ্ছে সেই পাপের আর পুনরাবৃত্তি না করা এবং নিজ চরিত্রকে সংশোধন করা যেনো পূর্বের ভুলের বা পাপের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এ ব্যাপারে মু'মিন বান্দাদের এসব দুর্বল লোকদের উৎসাহ প্রদান করতে বলা হয়েছে, যেনো এসব লোক তাদের চরিত্রে দুর্লভ গুণাবলীর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। চারিত্রিক গুণাবলীর-ই হচ্ছে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং অতীতের দোষ-ত্রুটি দূর করতে সাহায্য করে। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, যখন আত্মা এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে অনন্তলোকে যাত্রা শুরু করবে, তখন তারা বুঝতে পারে, তাদের অনুতাপের মাধুর্য্য, স্বর্গীয় ক্ষমার মহিমা, যা তাদের আত্মিক যন্ত্রণার উপশম করে দেবে। অপরপক্ষে যারা পাপী, মুত্যৃর পরে তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবে, সত্য মিথ্যার প্রভেদ বোঝার ক্ষমতা জন্মাবে - তাদের আত্মিক অবনতির ধারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে [দেখুন ৯ : ৯৪]। "তিনি তোমাদের জানাবেন" - বাক্যাংশটি দ্বারা এই ভাবেই প্রকাশ করা ঘটেছে।
১৩৫৪। এরা হলেন কা'ব ইবনে মালিক, মারারা; ইবনে রাবী (আঃ) ও হিলাল ইবন উমায়্যা (রাঃ), তাঁরা আলস্য করে তাবুক অভিযানে শরীক হন নাই। এ জন্য তাঁদেরকে একঘরে রাখা হয়েছিল; ৫০দিন এভাবে থাকার পর আল্লাহ্ তাঁদের তওবা কবুল করেন। যদিও আয়াতগুলি তাবুক অভিযানের পটভূমিতে নাজিল হয়, কিন্তু এর উপদেশ সর্বজনীন-যুগ কাল অতিক্রান্ত। উপরের আয়াতগুলিতে তিন ধরণের লোকের বর্ণনা করা হয়েছে। (১) প্রথম শ্রেণী : যারা সর্বান্তকরণে মুনাফিক, তারা তাদের মুনাফেকী কোন সময়ে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে না সর্বদা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে তাদের অপকর্মের স্বপক্ষে যুক্তির অবতারণা করবে, যেনো নিজেকে লোক চক্ষে হেয় প্রমাণিত হতে না হয়। এরা হলো একগুঁয়ে, অবাধ্য, ফলে অজ্ঞ। এদের আত্মিক মুক্তির কোন উপায় নাই। দেখুন আয়াত [৯ : ১০১]। (২) দ্বিতীয় শ্রেণী হলো : তারা খুব সহজে প্রভাবিত হয়। ফলে কুপ্রভাবের সংস্পর্শে তারাই সহজে প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তারা সর্বান্তকরণে মন্দ নয়, ভিতর বাহির সর্বৈব মুনাফিক নয়। এরা খুব সহজেই বুঝতে পারে এবং অনুতপ্ত হয় এবং এদের অনুতাপ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। দেখুন সূরা ৯, আয়াত ১০২-১০৫। এবং (৩) তৃতীয় শ্রেণী হচ্ছে : যেসব ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে (doubtful case)। কিন্তু এক্ষেত্রে বলা হয়েছে আল্লাহ্ এদের ভার গ্রহণ করবেন, "শাস্তি দেবেন, না ক্ষমা করবেন"। কারণ আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।
১৩৫৫। তিন ধরণের মুনাফিকের বর্ণনা পূর্বে করা হয়েছে। দেখুন টীকা নং ১৩৫৪। এখানে চতুর্থ ধরণের পাপচারীর উল্লেখ আছে। এর বর্ণনা হচ্ছে : Qubaa শহরে মসজিদ "Mosque of mischief (dhirar)" নির্মাণের কাহিনীর মাধ্যমে। কুবা স্থানটি মদিনার শহরতলীতে অবস্থিত এবং মদিনা থেকে তিন মাইল দক্ষিনে-পূর্বে এর অবস্থান। সুদীর্ঘ যাত্রা শেষে নবী করিম (সাঃ) হিজরত করে যখন মদিনাতে আসেন, মদিনা শহরে প্রবেশের পূর্বে তিনি এই স্থানে ৪ দিন বিশ্রাম গ্রহণ করেন। এখানেই প্রথম মসজিদ তৈরী হয়। মদিনাতে অবস্থান কালে হযরত (সাঃ) এই মসজিদে (Mosque of Piety) প্রায়ই নামাজ পড়তে আসতেন। বনি গানাম (Banu Ganam) গোত্রের কিছু মুনাফিক এই সুযোগ গ্রহণ করে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে (Qubaa) মসজিদের উল্টোদিকে আরও একটি মসজিদ তৈরী করে। কিন্তু এমন ভান করতে থাকে যে তারা ইসলামের প্রসারের জন্যই তা করেছে। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করে আবু আমির রাহিব খাযরাজী নামক এক ব্যক্তি। এই ব্যক্তি ওহুদের যুদ্ধে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই ব্যক্তি খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করে সংসারত্যাগী হয়েছিলো। মদিনার লোকেরা তাকে ইসলাম গ্রহণে আমন্ত্রণ জানালে সে তা অস্বীকার করে এবং হযরত (সাঃ) এর সাথে শত্রুতা করতে থাকে। এই ব্যক্তি মদিনার কিছু মুনাফিককে মসজিদ তৈরী করার পরামর্শ দেয়, যাতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায় এবং এই মসজিদে মিলিত হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যায়। তারা মসজিদ তৈরী করে এবং সেখানে সালাত আদায় করার জন্য হযরত (সাঃ) কে অনুরোধ জানায়। তিনিই হুনাইন যুদ্ধ শেষ করে ৯ম হিজরীতে মদিনাতে ফিরে এসে সেই মসজিদে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ মসজিদটি স্বরূপ প্রকাশ করেন। অতঃপর হযরত (সাঃ) মসজিদটি জ্বালিয়ে দিতে নির্দেশ দেন।
[উপদেশ : ধর্ম নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করা মুনাফিকদের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে সর্বসাধারণকে সাবধানতা অম্বলন করতে হবে, বিশেষভাবে নেতাকে কঠোর হস্তে তা দমন করতে হবে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে যে বিভেদ তা এরই ফলশ্রুতি।]
১৩৫৬। এই ব্যক্তির নাম আবু আমির যারা পদবী ছিল রাহিব (ভিক্ষু); কারণ সে (খ্রীষ্টান সাধুদের) মঠের সংস্পর্শে ছিল। দেখুন পূর্বের টীকা।
১৩৫৮। সত্যিকার মু'মিন বান্দার শরীর, মন, হৃদয়, আত্মা, সর্বক্ষেত্রে হতে হবে পূত পবিত্র, নির্মল। এই পবিত্রতা শুধুমাত্র বাহ্যিক বা শারীরিক নয়। তাঁর চিন্তা, ভাবনা, কর্মজগৎ, সব হবে পাপমুক্ত; পূত-পবিত্র। তাঁর হৃদয়, মন, আত্মা, সবই হবে পৃথিবীর মলিনতামুক্ত। ক্ষুদ্রস্বার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থের কলুষতা থেকে তাঁর আত্মা হবে নিষ্কলুষ। তাঁর ধর্ম, বা আল্লাহ্র কাছে তাঁর আত্মা-নিবেদন হবে আন্তরিক, বিশ্বস্ত। এঁরাই হচ্ছেন পবিত্রতা অর্জনকারী।
১৩৫৯। অপূর্ব উপমার সাহায্যে স্থায়ী সাফল্য ও ক্ষণস্থায়ী সাফল্যের রূপকে এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জীবনবোধ ও মূল্যবোধ 'তাক্ওয়া' বা আল্লাহ্-ভীতির উপরে অবস্থিত, তারাই সাফলকাম। তাক্ওয়া বা আল্লাহ্ - ভীতি অর্থাৎ যে ধর্মীয় বিশ্বাস বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা, সততা, এক আল্লাহ্ উপরে নির্ভরশীলতার উপরে প্রতিষ্ঠিত, তার ভিত্তি অত্যন্ত সুদৃঢ় ও মুজবুত। তা এত মুজবুত যে কঠিন পর্বতের ন্যায় দৃঢ়, যাতে কখনও সামান্য ফাটল পর্যন্ত ধরবে না। অপরপক্ষে যে বিশ্বাস আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বস্ততা, সততা, আন্তরিকতা ও নির্ভরশীলতার থেকে উৎপন্ন নয়, তার উপমা হচ্ছে চোরাবালির চূড়ায় প্রাসাদ নির্মাণের ন্যায়। সে জানে না তার প্রাসাদ ধ্বংসের প্রান্তসীমার দাঁড়িয়ে। কারণ চোরাবালির নিম্নেদেশের মাটি সর্বদাই সরে যায়। আর যখন তা ঘটে চোরাবালির চূড়ায় নির্মিত সুরম্য অট্টালিকা এক মূহুর্তে ধ্বংসে যায়। অবিশ্বস্ত, কপট, খল, ব্যক্তিদের সকল কাজের শেষ পরিণতিকে উপরের উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের কর্মফলের সাথে সাথে তাদেরও ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠে। এই উপমার আবেদন সর্বজনীয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কারণ মানুষের বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা, সততা,-সবকিছুই তার দৈনন্দিক জীবনে, কর্মজগতের সাথে সম্পৃক্ত। এ কথা কেউ দাবী করতে পারেবে না যে সে তার কর্মজগতে অসৎ, অবিশ্বস্ত, মুনাফিক হওয়া সত্বেও ধর্মীয় জগতে বিশ্বস্ত ও সৎ। মানুষের কর্মজগতেই তার চরিত্রের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। এই মূল্যবোধ যদি তাক্ওয়ার ভিত্তিতে গড়ে না ওঠে, তবে তার সকল কর্ম, ঈমান, ধর্ম-কর্ম সবকিছুই ঐ উপমার মত চোরাবালির উপরে প্রতিষ্ঠিত। এ কথা ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য, জাতির জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। এ-ই আল্লাহ্র বিধান।
[মন্তব্য : বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা ও বর্তমান মুসলিম সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য এই উপমার সাহায্যে অনুধাবনযোগ্য। - অনুবাদক।]
১৩৬০। "অন্তর ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে পড়ে", ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে : Their hearts cut ot pieces.। এই লাইনের অর্থ যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু ঘটে। পূর্বের আয়াতে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে রূপকের সাহায্যে সুন্দরভাবে উপস্থান করা হয়েছে। এই আয়াতে তারই ধারাবাহিকতার বর্ণনা আছে। "Heart" বা "অন্তর" এই শব্দটি কুরআনে শরীফে বহুস্থানে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের হৃদয় বা "অন্তর" হচ্ছে : প্রেম, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষার উৎপত্তিস্থল। হৃদয় হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক জীবনের মূল ভিত্তি। আর এই ভিত্তির মূল একক হচ্ছে বিশ্বস্ততা, সততা, আন্তরিকতা ও আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নির্ভশীলতা। যদি এই বিশ্বোসের মূল ভিত্তি দুর্বল হয়, তখন তার উপমা হচ্ছে চোরাবালির উপরে দাঁড়ানো প্রাসাদের ভিত্তির মতন। সেক্ষেত্রে তার প্রতিটি পদক্ষেপ, জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপে, সে হবে অবিশ্বস্ত, ফলে সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ। আল্লাহ্র প্রতি নির্ভশীলতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে তার চরিত্রের দৃঢ়তা হবে অন্তর্হিত। ফলে সে যে কোনও বিপদ বা বিপর্যয়ে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছু, যেমন রত্ন-পাথর, মাজারে মান্নত,পীরের দোয়া ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করতে ছুটে যাবে। তার আত্মা বাঁধা পড়ে যাবে কুসংস্কারের বেড়াজালে। সন্দেহ, কুসংস্কার অস্থিরতা, ভয় তার হৃদয়ের সকল সুপ্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে দেবে। এ যেনো চোরাবালির চূড়া যা প্রতি মূহুর্তে ধ্বংসে পড়ার জন্য প্রস্তুত। এর ফলে ঐ ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র যেমন ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, ঠিক ও সেরূপ তার আধ্যাত্মিক জীবন।
সূরা তাওবা
সূরা তাওবা (অনুতাপ) বা বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদ) - ৯
আয়াত ১২৯, রুকু ১৬, মাদানীভূমিকা : সূরা তাওবাহ্ (অনুতাপ) বা বারাত (রেহাই প্রাপ্ত) যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই সূরাকে পূর্ববর্তী সূরার (৮) ধারাবাহিকতারূপে পরিগণিত করা যায়। শুধু ধারাবাহিকতা নয়, পূর্ববর্তী সূরার অংশরূপে গণ্য করা যায়। যদিও পূর্ববর্তী সূরা (৮) এবং এই সূরার (৯) অবতীর্ণ হবার সময়ের মধ্যে প্রায় সাত বছরের ব্যবধান রয়েছে।
পূর্বের সূরাতে (৮) নূতন মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলমানদের সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে অভ্যুত্থান, যুদ্ধের ময়দানে প্রতিরক্ষার নিয়ম-কানুন, যুদ্ধ জয়ের পরে যুদ্ধলব্ধ মালের সুষ্ঠ বণ্টনের নিয়মাবলী, সম্মিলিতভাবে শত্রুসেনাদের পরাভূত করতে জাতীয় জীবনে যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন হয় এবং যুদ্ধ জয়ের প্রাক্কালে শত্রুদের প্রতি সদয় ব্যবহার, যা ব্যক্তির চরিত্রকে মহিমান্বিত করে প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে যে, যদি শত্রুরা তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং বিশ্বাস ঘাতকতা করে - তখনকার করণীয় কর্তব্য। এটা সর্বজন স্বীকৃত সত্য যে শত্রুপক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে তা মেনে চলার দায়িত্ব অন্য পক্ষের থাকে না। ইসলাম তবুও চুক্তিভঙ্গের পরে চারমাস সময় প্রদানের পক্ষে। এই মেয়াদ দেয়া হবে অনুতাপ করার জন্য। ভুল বুঝতে পেরে যদি কেউ মুসলমানদের কাছে ফিরে আসতে চায়, তাদের সে সুযোগ দান করার জন্য মুসলমানদের সখ্যতার হাত সদা-সম্প্রসারিত থাকবে। কিন্তু এর পরেও যদি কেউ অনুতপ্ত না হয় তবে সর্বশক্তি দ্বারা শত্রুদের আক্রমণ করতে হবে। এই-ই হচ্ছে এই সূরার সাধারণ নীতিমালা। পূর্ববর্তী সূরার সাথে ধারাবাহিকতার কারণে এই সূরাকে পূর্ববর্তী সূরার (সূরা আন্ফাল) ক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে।
আয়াত (১ - ২৯) পর্যন্ত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা (State Policy) সম্বন্ধে ঘোষণা করা হয়েছে। এই আয়াতগুলিতে যেসব কর্মপন্থা (Policy) ঘোষণা করা হয়েছে তার সময়কাল ছিল ৯ই হিজরী সন, সওয়াল মাস এবং তা সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন হযরত আলী (রাঃ)। এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ঘোষণার জন্য তিনি হজ্জ্বের ময়দানকে বেছে নেন। যদিও আয়াতগুলি অবতীর্ণ হওয়ার দু'মাস পরে তিনি তা করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পলিসিগুলি যাতে ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে সে কারণেই আয়াতগুলি অবতীর্ণ হওয়ার দু'মাস পরে হজ্জ্বের ময়দানে তা প্রচার ও প্রকাশ করা হয়। এই সূরার পরবর্তী অংশ অর্থাৎ আয়াত ৩০-১২৯ অবতীর্ণ হয় পূর্ববর্তী আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার কিছু পূর্বে। সম্ভবতঃ তা ছিল ৯ই হিজরী সনের রমজান মাস। এই আয়াতগুলিতে নবী করিমের (সাঃ) তাবুক অভিযানের শিক্ষণীয় বিষয়গুলিকে বর্ণনা করা হয়েছে। তাবুক অভিযান ছিল ৯ই হিজরী গ্রীষ্মের শেষ ভাগে [সম্ভবতঃ ৬৩০ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাস]।
তাবুক অভিযানের সূত্রপাতের কারণ নিম্নরূপ :
আরবের শেষ সীমায় তাবুকের অবস্থান। সে সময়ে তাবুক ছিল সিরিয়ার একটি প্রদেশ [প্যালেস্টাইন ছিল এর অন্তর্ভুক্ত] এবং বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এর অবস্থান ছিল মদিনা থেকে ৩৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে এবং মা'ন (Ma'an) থেকে ১৫০ মাইল দক্ষিণে। বর্তমানে এই স্থানের উপর দিয়ে হিজাজ রেললাইন (Hijaz Railway) গিয়েছে। তাবুকে একটি মিষ্টি পানির ঝরণা ও একটি দূর্গ ছিল। সেই সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্রমাগত একটি গুজব উদ্বিগ্ন করে তোলে। আর তা হচ্ছে : বাইজেনটাইন সম্রাট (পারস্য সম্রাট) আরব আক্রমণের প্রস্তুতির কারণে পারস্য সম্রাট স্বয়ং সীমান্তে অবস্থান করছেন। এরই প্রেক্ষিতে রাসূল (সাঃ) তাঁর সাধ্য অনুযায়ী বিরাট সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেন এবং তাবুকের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু পারস্য সম্রাট কর্তৃক আরব আক্রমণের গুজবটি ছিল ভিত্তিহীন। কিন্তু নবীজি (সাঃ) তাবুক থেকে শুধু হাতে ফিরে আসেন নাই। তিনি এই সুযোগ গ্রহণ করেন এবং মুসলমানদের সুসংহত করে অগ্রসর হন এবং 'আকাবা' উপসাগরের নিকট অবস্থিত খৃস্টান ও ইহুদী সম্প্রদায়ের সাথে "মিত্রচুক্তিতে" আবদ্ধ হয়ে মদিনাতে ফিরে আসেন। মদিনাতে ফিরে এসে তিনি পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা বিবেচনা করে দেখেন। তাঁর অবর্তমানে মদিনার মুনাফিকরা যথারীতি দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করে। তাদের এই দ্বিমুখী নীতির কারণে এই সময়ে মুসলমান ও মুশরিকদের জন্য নীতির পরিবর্তন ঘটে। কারণ মুনাফিক ও মুশরিকরা বারে বারে মুসলমানদের মহানুভবতার অপব্যবহার করেছিল।
সমগ্র কুরআন শরীফে এটাই একমাত্র সূরা যার প্রারম্ভে "বিসমিল্লাহ্" সংযুক্ত হয় নাই। যদিও এই সূরাটির প্রত্যাদেশের সময়কাল ছিল শেষের দিকে তবুও রাসূল (সাঃ) এই সূরাটিকে সূরা আন্ফাল (৮)-কে অনুসরণ করতে আদেশ দান করেন। তবে এই সূরাটি একটি আলাদা সূরা হবে না সূরা আন্ফাল এর বর্ধিত অংশ হবে সে সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ তিনি দেন নাই। বর্তমানে এই সূরাটিকে একটি আলাদা সূরা হিসেবে গণ্য করা হলেও এর পূর্বে প্রারম্ভিক হিসেবে "বিসমিল্লাহ্" সংযুক্ত করা হয় না। যদিও কেউ নিশ্চিত নয় যে, আমাদের রাসূল (সাঃ) কুরআনের এই সূরাটি আবৃত্তির পূর্বে "বিস্মিল্লাহ্" বলে আরম্ভ করতেন কিনা।
এই সূরাটিকে বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা হয়। সবচেয়ে বেশী প্রচলিত হচ্ছে : আত্-তাওবা (অনুতাপ)। এই নামকরণ হয়েছে এই সূরার ১০৪ নং আয়াত অনুযায়ী এবং (২) বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদ করা)। এই নামকরণ হয়েছে সূরার প্রারম্ভিক আয়াত অনুযায়ী।
সারসংক্ষেপ : মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের যে চুক্তি ছিল, তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সে চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা কার্যকর করার জন্য চার মাস সময় দেয়া হয় যাতে মুশরিকরা অনুতাপ করার সুযোগ পায় (৯ : ১-২৯)।
কিতাবধারী জাতিরা আল্লাহ্র নির্দেশসমূহকে দুর্বোধ্য করে তুলেছে। কিন্তু সত্য সবার উপরে ভাস্বর হবে। আমরা সর্বদা ধর্মের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকব। তা যদি না করি তবে আমরা আল্লাহ্র পতাকা বহনে অসমর্থ হব; এবং আল্লাহ্ আমাদের স্থলে অন্য আরেক দলকে এই দায়িত্ব অর্পন করবেন [৯ : ৩০-৪২]।
মুনাফিক ও তাদের দ্বিমুখী নীতি : তাদের দুরভিসন্ধি প্রকাশ করা হয়েছে। মু'মিন বান্দাদের জন্য আল্লাহ্র আশীর্বাদ যেমন সন্দেহাতীত, সেরূপ মুনাফিকদের জন্য আল্লাহ্র শাস্তিও অবধারিত [৯ : ৪৩-৭২]।
পাপীকে সবসময় প্রতিহত করতে হবে যদি না সে অনুতপ্ত হয়। মিথ্যাবাদীরা সত্যকে ভঙ্গ করেই সন্তুষ্ট থাকে না। বরং সমস্ত কল্যাণকেই সে উপহাস করে। মুনাফিকদের হিংসা না করে পরিহার করতে হবে [৯ : ৭৩-৯৯]।
আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট যারা আন্তরিকভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ করে। যারা মন্দ কাজের পরে অনুতাপ করে আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু যারা বিবাদ ঘটায় এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনৈক্যের জন্য প্ররোচিত করে তাদের আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন না। বিশ্বাসী বা মু'মিন বান্দারা আল্লাহ্র কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, ফলে আল্লাহ্ তাদের সীমাহীন সুখ-শান্তি দান করেন। যারা বিশ্বাসে দোদুল্যমান, এবং কর্তব্যকর্মে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তারাও যদি শেষ পর্যন্ত অনুতপ্ত হয় - দয়াময় আল্লাহ্ তা গ্রহণ করেন [৯ : ১০০-১১৮]।
যারা বিশ্বাসী বা মু'মিন বান্দা, তারা সর্বদা পূণ্যবান, সত্যবাদী ও কর্তব্য-কর্মপরায়ণদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে। যদি সম্প্রদায়ের সমস্ত লোক যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করে তবে এক অংশ নিজ অবস্থানে থাকবে, তা এই জন্য যে তারা অধ্যাবসায়ের সাথে ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনা করবে এবং তাদের ভাইরা যখন প্রত্যাবর্তন করবে তাদের ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষাদান করবে। যারা বিশ্বাসী, প্রতিটি সূরা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করে। যাদের অন্তঃকরণ ব্যাধিগ্রস্থ, তাদের বেলায় সন্দেহ ক্রমাগত আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। মহা আরশের অধিপতি আল্লাহ্তে বিশ্বাস স্থাপন কর [৯ : ১১৯-১২৯]।
সূরা তাওবা (অনুতাপ) বা বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদ) - ৯
আয়াত ১২৯, রুকু ১৬, মাদানী০১। আল্লাহ্র এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে দায়মুক্তির [ঘোষণা], ১২৪৬ সেই সব মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেঃ-
১২৪৬। "Baraat" আরবী শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে "Immunity", বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে "সম্পর্কচ্ছেদ"। মাওলানা ইউসুফ আলী মনে করেন আরবী এই শব্দটির সঠিক অনুবাদ সম্ভব নয়। মাওলানা ইউসুফ আলী চেষ্টা করেছেন যতটুকু সম্ভব আরবী শব্দটির মূল ভাবকে ইংরেজী ভাষায় রূপান্তরিত করতে। এই আরবী শব্দটির পূর্ণ অর্থকে সূরাটির ভূমিকাতে প্রকাশ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। আয়াত [৯ : ৩]-এ "Dissolve (treaty) obligation" লাইনটি দ্বারা এবং বাংলা "কোন সম্পর্ক রহিল না" লাইনটি দ্বারা মূল শব্দটির ভাবকে প্রকাশ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। মুশরিক ও ইসলামের শত্রুরা ঘন ঘন মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হ'ত। মুসলমানেরা চুক্তির শর্ত যথাযতভাবে পালন করত, কিন্তু মুশরিকরা চুক্তির শর্ত যখনই সুযোগ পেত তখনই ভঙ্গ করতো। এই কারণে কয়েক বছর পরে মুশরিকদের সাথে এই চুক্তি "বাতিল" ঘোষণা করা একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এই সূরাতে সে কথাই বলা হয়েছে যে শর্ত অনুযায়ী চার মাস সময় দান করে চুক্তি বাতিল ঘোষণা করতে হবে এবং যারা মৈত্রী-চুক্তির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাদের সুযোগ দান করতে হবে।
০২। সুতরাং তোমাদের [ইচ্ছা অনুযায়ী] দেশের মধ্যে চারিমাস ভ্রমণ কর ১২৪৭। কিন্তু জেনে রেখ যে [তোমাদের মিথ্যা দ্বারা] তোমরা আল্লাহ্কে পরাজিত করতে পারবে না। পক্ষান্তরে, যারা আল্লাহ্কে প্রত্যাখ্যান করে তাদের তিনি অপমানিত করবেন।
১২৪৭। "চারিমাস" - কোন কোন তফসীরকারের মতে, এই "চারিমাস" সময় হচ্ছে রজব, জিলক্কাদ, জিলহজ্জ্ব এবং মুহরম। কারণ, আরবদেশে প্রাচীনকাল থেকে এই চারটি মাসকে পবিত্র মাস বলে গণ্য করা হতো এবং এই মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ থাকে [দেখুন ২: ১৯৪ এবং এর টীকা]। "চারিমাস" - কে এভাবে গণনা না করে, চুক্তিভঙ্গের ঘোষণার পর থেকে গণনা করা শ্রেয়। এই সূরাটি অবতীর্ণ হয় সওয়াল মাসের প্রথমে (ভূমিকা দেখুন)। সূরা নাজিলের পরবর্তী চারটি মাস হবে সওয়াল, জিলক্কাদ, জিলহাজ্জ্ব এবং মুহররম। এক্ষেত্রে শেষের তিনটি মাস প্রাচীনকাল থেকেই নিষিদ্ধ মাস রূপে পরিচিত ছিল।
০৩। মহান হজ্জ্বের [মহাসমাবেশে] আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের জন্য ইহা এক ঘোষণা ১২৪৮, যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মুশরিকদের সাথে অঙ্গীকারের [চুক্তির] অবসান করা হলো। এরপর যদি তোমরা অনুতাপ কর তবে তা হবে তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ; কিন্তু যদি তোমরা মুখ ফিরাও তবে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহ্কে পরাজিত করতে পারবে না। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দাও।
১২৪৮। "মহান হজ্জ্বের দিবস" - On the day of the great pilgrimage। সম্ভবতঃ দিনটি ছিল জিলহজ্জ্ব মাসের ৯ তারিখ [আরাফাত] অথবা ১০ তারিখ [কুরবাণী-Day of sacrifice]।
০৪। তবে মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ও পরবর্তীতে যারা তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোন ত্রুটি করে নাই, এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করে নাই; তাদের সাথে [চুক্তির] অবসান হয় নাই। সুতরাং তাদের সাথে তোমাদের চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পূণ্যাত্মাদের ভালোবাসেন ১২৪৯।
১২৪৯। এই পৃথিবীতে মানবজীবন কর্তব্যের বেড়াজালে আবদ্ধ। পরিবারের প্রতি কর্তব্য, সমাজের প্রতি কর্তব্য, মানুষের প্রতি কর্তব্য, স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য, স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য ইত্যাদি হাজারো কর্তব্যের বেড়াজালে আমরা আবদ্ধ। আর তাই সমাজ জীবনে আমরা বিভিন্নভাবে একে অপরের কাছে অলিখিত অঙ্গীকার বা চুক্তিতে আবদ্ধ। এই অঙ্গীকার পালনের মধ্যে দিয়েই মানুষের মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায়। মানুষের পশুত্ব থেকে মানবিক গুণে উত্তরণ ঘটে এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। তাই অঙ্গীকার পালন-ই হচ্ছে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই আয়াতে অমুসলমানদের সাথে মুসলমানদের চুক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তির ক্ষেত্রে অমুসলমানেরা আশা করতো তারা চুক্তি ভঙ্গ করলেও মুসলমানেরা বিশ্বস্ততার সাথে তাদের অংশ পালন করবে। সেই ক্ষেত্রে মুসলমানদের কর্তব্য সম্পর্কে এই সূরার ৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে মুসলমান ও অমুসলমানদের সাথে চুক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা যায় না। কারণ, মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন কোন অমুসলমান গোষ্ঠী অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে চুক্তির শর্তসমূহ পালন করতো। তারা কোনরূপ বিশ্বাস ঘাতকতা করতো না বা চুক্তির শর্তসমূহ লঙ্ঘন করতো না। এই ক্ষেত্রেই আলোচ্য আয়াতটি প্রযোজ্য ছিল। এই আয়াতে মুসলমানদের কঠোরভাবে নির্দেশ দান করা হয়েছে সেসব অমুসলমান সম্বন্ধে যারা চুক্তি ভঙ্গ করে নাই, তাদের সাথে বিশ্বস্ততা ও সততার সাথে চুক্তির শর্তসমূহ পালন করার জন্য। কারণ, মুত্তাকী হওয়ার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে বিশ্বস্ততা ও সততা। মুত্তাকী বা মু'মিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে যে, মুসলমান, অমুসলমান, পরিবার বা সমাজ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে কোনও অঙ্গীকার বিশ্বস্ততা ও সততার সাথে পালন করা - আর তাই-ই আল্লাহ্ কর্তৃক আমাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব বা কর্তব্য।
১২৫০। "নিষিদ্ধ মাস" অর্থাৎ পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে চুক্তি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার পরে তা কার্যকর করার জন্য যে চারমাস সময় দেয়া হয়েছে, সেই চার মাসকে নিষিদ্ধ মাস রূপে অভিহিত করা হয়েছে। যদি এই বাড়তি সময়ের মধ্যে চুক্তি ভঙ্গকারী ভুল বুঝতে পেরে তার চরিত্রের সংশোধন না করে এবং বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার না করে তবে সেক্ষেত্রে মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে "সর্বাত্মক যুদ্ধাবস্থা" বলে পরিগণিত হবে।
১২৫১। যে ক্ষেত্রে শত্রুর সাথে সমঝোতা কোন প্রকারেই সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে সর্বাত্মক যুদ্ধাবস্থা। পূর্ণ উদ্যমে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধ করতে হবে। শিথিলভাবে আংশিক যুদ্ধাবস্থা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। শত্রুকে পরাভূত করার জন্য বিভিন্ন রণকৌশল অবলম্বনের আদেশ এ আয়াতে দেয়া হয়েছে। হত্যা, বন্দী, ওঁৎ পেতে থাকা, অবরোধ ইত্যাদি - যেক্ষেত্রে যেরূপ প্রয়োজন তা অবলম্বনের আদেশ এ আয়াতে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যখন যুদ্ধ করা হবে তা হবে সর্বাত্মক। এত কিছুর পরেও আল্লাহ্ অনুতাপকারীর জন্য অনুতাপের দরজা বন্ধ করে দেন নাই। অনুতাপ করা ও তদানুযায়ী চরিত্রের সংশোধন সর্বদা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য; আমাদের উপরে হুকুম হচ্ছে সেক্ষেত্রে শত্রুকে ক্ষমা করা।
১২৫২। অনুতাপ শুধুমাত্র মৌখিক হবে না, তা হতে হবে অনুতাপকারীর অন্তরের অন্তস্থল থেকে উত্থিত এবং আন্তরিক। অনুতাপ যদি আন্তরিক হয় তবে তার বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই অনুতাপকারীর চিন্তা ও কার্যপ্রণালীতে প্রকাশ পেতে বাধ্য। তখন সে সর্বান্তকরণে আল্লাহ্র হুকুম পালনে হবে নিবেদিত প্রাণ। অনুতাপের প্রকাশ ঘটবে আল্লাহ্র নিকটে তার আন্তরিক প্রার্থনা ও আল্লাহ্র জন্য দান বা জনগণের সেবার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে আমাদের উপরে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে : পাপী যখন অনুতপ্ত হয়, অনুতাপের আগুনে তার জীবনবোধ, চরিত্রের মাধুর্য্য হয় পরিশ্রুত, প্রস্ফুটিত - জীবনবোধ যায় বদলে, পাপী হয় আল্লাহ্র রাস্তায়, আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত প্রাণ, সেক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে ক্ষমা করা ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। কারণ আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
১২৫৪। "Maaman" - এই আরবী শব্দটির অর্থ সবরকম বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ স্থান বা তেমন নিরাপত্তার সুযোগ।
রুকু - ২
১২৫৫। এই রুকু বা অধ্যায়ে কারণ দর্শানো হয়েছে, কেন এবং কোন অবস্থায় মুসলমানেরা মুশরিকদের সাথে চুক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবে। এই আয়াতে বলা হয়েছে : "আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নিকট মুশরিকদের চুক্তি কি করে বলবৎ থাকবে ?" এই লাইনটির ধারাবাহিকতা হচ্ছে পরবর্তী আয়াত ৮। কারণ, আরবী "Kaifa" শব্দটি আয়াত ৭ এর শুরুতে এবং আয়াত ৮-এ পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে চুক্তিটি মুশরিকদের সাথে ভঙ্গ হবে না তার পূর্ণ বিবরণ এই আয়াতে আছে। যেসব গোত্র মুসলমানদের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করে নাই তারা হচ্ছে বনু হাম্জা এবং বনু-কাইনুকা। এই দুটো গোত্র পবিত্র মক্কা শরীফের নিকট মুসলমানদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং নিষ্ঠার সাথে চুক্তির শর্তাবলী পালন করে। সেক্ষেত্রে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে যদিও তারা মুশরিক এবং অন্যান্য মুশরিক গোষ্ঠীরা তাদের সহযোগী, তবুও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সকল সুযোগ সুবিধা তাদের দান করতে হবে।
১২৫৬। "অবাঞ্ছিত" ঘোষণার পরও যাদের জন্য চুক্তির শর্তসমূহ পালনযোগ্য তাদের বিবরণ আছে আয়াত ৭-এ। এই আয়াতে সংক্ষেপে, কিন্তু জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য; যে কারণে চুক্তির শর্তাবলী তাদের জন্য "অবাঞ্ছিত" ঘোষণা করা হয়েছে। কারণগুলি নিম্নরূপ : (১) যখনই তারা সামান্যতম সুযোগ পায়, তখনই মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এক্ষেত্রে তাদের পাপ দ্বিবিধ। প্রথমতঃ তারা আত্মীয়তার বন্ধন অস্বীকার করে, দ্বিতীয়তঃ তারা মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়, এবং সে কারণে তারা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে ইতস্ততঃ করে না। (২) তাদের মুখে মিষ্টি, কিন্তু অন্তরে বিষ। অর্থাৎ তারা কখনোই সত্য বলে না। যার ফলে তাদের স্বরূপ বোঝা যায় না। (৩) তাদের আচরণ ছিল চুক্তির শর্তাবলীর বিরুদ্ধে। কারণ "তাদের অধিকাংশ বিদ্রোহী ও সত্যত্যাগী"। সত্যত্যাগীরা কখনো সত্যের বা প্রতিশ্রুতির মর্যাদা দান করবে না। (৪) সামান্য বক্তিস্বার্থের জন্য তারা আল্লাহ্র আয়াতের অসম্মান করে [৯ : ৯]। (৫) তারা অন্য লোককেও আল্লাহ্র রাস্তায় আসতে বাঁধা দান করে [৯ : ১০]। আয়াত [৯ : ১০] প্রথম অংশকে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ, "তারা কখনো মু'মিনের সাথে আত্মীয়তার ও অঙ্গীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না।" লাইনটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কারণ, এক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার রূপ ছিল দ্বিবিধ এবং সে কারণে এর উপরে বিশেষভাবে গুরুত্ব দান করা হয়েছে।
১২৫৭। আত্মীয়তার মর্যাদা আরবগোষ্ঠীর মধ্যে অত্যন্ত প্রবল। তা এত প্রবল যে ধারণা করা হতো, তা অস্বীকার করা আরবদের জন্য সবচেয়ে অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মুশরিক আরবদের মধ্যে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা এত প্রবল ছিল যে তারা সে আত্মীয়তার বন্ধনকেও অস্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে নাই। উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের অনেকেই ছিল মুশরিক আরবদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। মুসলমানদের সাথে আরব মুশরিকদের আত্মীয়তার বন্ধন ব্যতীতও তারা "অঙ্গীকার" বা "চুক্তি" শপথে আবদ্ধ ছিল। মুশরিকদের মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা এত প্রবল ছিল যে, তারা শুধু আত্মীয়তার বন্ধনই অস্বীকার করে নাই, তারা সে পবিত্র অঙ্গীকারকেও লঙ্ঘন করে।
১২৫৮। এই আয়াতে আরব মুশরিকদের পাপের বর্ণনা করা হয়েছে। এ বর্ণনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, তারা অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
১২৫৯। আল্লাহ্ বারে বারে আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন যে, পরম এবং চরম শত্রুরও অনুতাপ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, কেউ যেন ভুল না বুঝে যে, যুদ্ধ একটি ছেলে-খেলা মাত্র। যুদ্ধ যে ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী, সে ক্ষেত্রগুলিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে পরবর্তী আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। যে কোন আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন মুসলমানের জন্য সেক্ষেত্রে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ব্যতীত গত্যন্তর নাই।
১২৬০। আরব মুশরিকরা শুধুমাত্র যে তাদের অঙ্গীকারই ভঙ্গ করতো তা-ই না। তারা নির্লজ্জভাবে মুসলমানদের তাদের ধর্ম সম্বন্ধে বিদ্রূপাত্মক কথা বলতো এবং মুসলমানদের বিশুদ্ধতা ও আন্তরিকতা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতো। যেহেতু মুসলমানেরা চুক্তির শর্তসমূহ বিশ্বস্ততার সাথে পালন করতো, মুশরিকদের ধারণা হতো যে, মুসলমানেরা যুদ্ধ করতে ভয় পায় তাই চুক্তি মানার ব্যাপারে তারা এতটা আন্তরিক।
১২৬১। এই আয়াতে নতুন যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। এই আয়াতে মুসলমানদের প্রতি বিভিন্নভাবে যে আবেদন করা হয়েছে, তা হচ্ছে : (১) শত্রু কর্তৃক নির্লজ্জভাবে চুক্তির শর্তসমূহ লঙ্ঘন; (২) আল্লাহ্র নবীর (সাঃ) বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং এই চেষ্টা যেন নবীকে (সাঃ) মদীনা থেকে বের করে দেওয়া যায়, যেমনভাবে মক্কা থেকে তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন; (৩) হুদায়বিয়ার সন্ধির পরও [ষষ্ঠ হিজরী জ্জিলক্কদ মাস, ৬২৮ খৃষ্টাব্দ ফেব্রুয়ারি মাস] মদীনায় অবস্থিত তাদের মিত্রদের সহযোগিতায় মুসলমানদের আক্রমণ করতে কুরাইশদের বারে বারে চেষ্টা; (৪) পুরুষোচিত সেই ঈমানী শক্তি যে পৃথিবীতে ভয় করতে হবে একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্কে, অন্য কাউকে নয় এবং (৫) আল্লাহ্র প্রতি মু'মিনের বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা ও নির্ভরতা হতে হবে প্রমাণ সাপেক্ষ, পরীক্ষা দিতে হবে দুর্যোগ বিপদের মাধ্যমে, আল্লাহ্র ভালবাসা পাওয়ার আশায় সর্বস্ব এমনকি জীবন ত্যাগেও হতে হবে অকুণ্ঠচিত্ত। [৯ : ১৬ আয়াত দেখুন]।
০৫। কিন্তু যখন নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হবে ১২৫০ তারপরে যুদ্ধ কর, এবং মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা কর ১২৫১, এবং তাদের বন্দী কর, তাদের অবরোধ কর শত্রুকে [যুদ্ধে] ফাঁকি দেয়ার জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা কর। কিন্তু যদি তারা অনুতপ্ত হয় ১২৫২; এবং নিয়মিত সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
১২৫০। "নিষিদ্ধ মাস" অর্থাৎ পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে চুক্তি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার পরে তা কার্যকর করার জন্য যে চারমাস সময় দেয়া হয়েছে, সেই চার মাসকে নিষিদ্ধ মাস রূপে অভিহিত করা হয়েছে। যদি এই বাড়তি সময়ের মধ্যে চুক্তি ভঙ্গকারী ভুল বুঝতে পেরে তার চরিত্রের সংশোধন না করে এবং বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার না করে তবে সেক্ষেত্রে মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে "সর্বাত্মক যুদ্ধাবস্থা" বলে পরিগণিত হবে।
১২৫১। যে ক্ষেত্রে শত্রুর সাথে সমঝোতা কোন প্রকারেই সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে সর্বাত্মক যুদ্ধাবস্থা। পূর্ণ উদ্যমে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধ করতে হবে। শিথিলভাবে আংশিক যুদ্ধাবস্থা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। শত্রুকে পরাভূত করার জন্য বিভিন্ন রণকৌশল অবলম্বনের আদেশ এ আয়াতে দেয়া হয়েছে। হত্যা, বন্দী, ওঁৎ পেতে থাকা, অবরোধ ইত্যাদি - যেক্ষেত্রে যেরূপ প্রয়োজন তা অবলম্বনের আদেশ এ আয়াতে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যখন যুদ্ধ করা হবে তা হবে সর্বাত্মক। এত কিছুর পরেও আল্লাহ্ অনুতাপকারীর জন্য অনুতাপের দরজা বন্ধ করে দেন নাই। অনুতাপ করা ও তদানুযায়ী চরিত্রের সংশোধন সর্বদা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য; আমাদের উপরে হুকুম হচ্ছে সেক্ষেত্রে শত্রুকে ক্ষমা করা।
১২৫২। অনুতাপ শুধুমাত্র মৌখিক হবে না, তা হতে হবে অনুতাপকারীর অন্তরের অন্তস্থল থেকে উত্থিত এবং আন্তরিক। অনুতাপ যদি আন্তরিক হয় তবে তার বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই অনুতাপকারীর চিন্তা ও কার্যপ্রণালীতে প্রকাশ পেতে বাধ্য। তখন সে সর্বান্তকরণে আল্লাহ্র হুকুম পালনে হবে নিবেদিত প্রাণ। অনুতাপের প্রকাশ ঘটবে আল্লাহ্র নিকটে তার আন্তরিক প্রার্থনা ও আল্লাহ্র জন্য দান বা জনগণের সেবার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে আমাদের উপরে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে : পাপী যখন অনুতপ্ত হয়, অনুতাপের আগুনে তার জীবনবোধ, চরিত্রের মাধুর্য্য হয় পরিশ্রুত, প্রস্ফুটিত - জীবনবোধ যায় বদলে, পাপী হয় আল্লাহ্র রাস্তায়, আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত প্রাণ, সেক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে ক্ষমা করা ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। কারণ আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
০৬। যদি মুশরিকদের ১২৫৩ মধ্যে কেহ তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাকে মঞ্জুর করবে যেনো সে আল্লাহ্র বাণী শুনতে পায়। অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দেবে ১২৫৪। কারণ তারা হচ্ছে অজ্ঞ লোক।
১২৫৩। ইসলাম এক মহানুভব ধর্ম। ইসলামে শত্রুদের মধ্যে কেউ যদি কোন কারণে ব্যক্তিগতভাবে মুসলমানদের কাছে নিরাপত্তা ও আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে মুসলমানদের উপরে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে তার জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা দান করা। ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণের ফলে সে আল্লাহ্র বাণী শোনার সুযোগ লাভ করবে। যদি মুশরিক বান্দা সে বাণী গ্রহণ করে, তবে সে পূর্ণ মুসলমান রূপে, মুসলমান ভ্রাতৃত্বের অংশীদার রূপে পরিগণিত হবে। আর যদি সে তা না করে মুশরিক রূপেই জীবন অতিবাহিত করতে চায়, ইসলামকে সে গ্রহণ না করে তবে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে তার জন্য দ্বিবিধ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। (১) প্রথমতঃ নিরাপত্তা দান করতে হবে মুসলমান সেনাবাহিনী থেকে যারা প্রত্যক্ষভাবে মুশরিক সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। (২) দ্বিতীয়তঃ মুশরিক সেনাবাহিনী থেকে অর্থাৎ তার নিজ গোষ্ঠীর লোকদের থেকে। এ দু'দল লোকদের থেকে তাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। এবং যেখানে সে নিরাপদে থাকবে, সেখানে তাকে স্থানান্তরিত করতে হবে। তার সম্বন্ধে আল্লাহ্ দ্বিবিধ নিরাপত্তা দান করতে হুকুম দান করেছেন। কারণ, তারা তাদের সত্যিকার কল্যাণ সম্পর্কে অজ্ঞ। আর সেই কারণেই তারা ভুল করে।১২৫৪। "Maaman" - এই আরবী শব্দটির অর্থ সবরকম বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ স্থান বা তেমন নিরাপত্তার সুযোগ।
রুকু - ২
০৭। যাদের সাথে তোমরা মসজিদুল হারামের নিকট পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলে তারা ব্যতীত, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নিকট মুশরিকদের সাথে চুক্তি কিরূপে বলবৎ থাকবে ? যতক্ষণ পর্যন্ত তারা বিশ্বস্ত থাকবে তোমারও তাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পূণ্যাত্মাদের ভালোবাসেন ১২৫৫।
১২৫৫। এই রুকু বা অধ্যায়ে কারণ দর্শানো হয়েছে, কেন এবং কোন অবস্থায় মুসলমানেরা মুশরিকদের সাথে চুক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবে। এই আয়াতে বলা হয়েছে : "আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নিকট মুশরিকদের চুক্তি কি করে বলবৎ থাকবে ?" এই লাইনটির ধারাবাহিকতা হচ্ছে পরবর্তী আয়াত ৮। কারণ, আরবী "Kaifa" শব্দটি আয়াত ৭ এর শুরুতে এবং আয়াত ৮-এ পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে চুক্তিটি মুশরিকদের সাথে ভঙ্গ হবে না তার পূর্ণ বিবরণ এই আয়াতে আছে। যেসব গোত্র মুসলমানদের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করে নাই তারা হচ্ছে বনু হাম্জা এবং বনু-কাইনুকা। এই দুটো গোত্র পবিত্র মক্কা শরীফের নিকট মুসলমানদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং নিষ্ঠার সাথে চুক্তির শর্তাবলী পালন করে। সেক্ষেত্রে আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে যদিও তারা মুশরিক এবং অন্যান্য মুশরিক গোষ্ঠীরা তাদের সহযোগী, তবুও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সকল সুযোগ সুবিধা তাদের দান করতে হবে।
০৮। [এরূপ চুক্তি] ১২৫৬ কিরূপে হতে পারে ? যখন তারা তোমাদের উপর সুবিধা লাভ করে তখন তারা তোমাদের আত্মীয়তার ও অংগীকারের কোন মর্যাদা দেয় না ১২৫৭। তাদের মুখের [মিষ্টি কথা] দ্বারা তারা তোমাকে বিপথে চালিত করে। কিন্তু তাদের হৃদয় থাকে বিমুখ। এবং উহাদের অধিকাংশ বিদ্রোহী এবং সত্যত্যাগী।
১২৫৬। "অবাঞ্ছিত" ঘোষণার পরও যাদের জন্য চুক্তির শর্তসমূহ পালনযোগ্য তাদের বিবরণ আছে আয়াত ৭-এ। এই আয়াতে সংক্ষেপে, কিন্তু জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য; যে কারণে চুক্তির শর্তাবলী তাদের জন্য "অবাঞ্ছিত" ঘোষণা করা হয়েছে। কারণগুলি নিম্নরূপ : (১) যখনই তারা সামান্যতম সুযোগ পায়, তখনই মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এক্ষেত্রে তাদের পাপ দ্বিবিধ। প্রথমতঃ তারা আত্মীয়তার বন্ধন অস্বীকার করে, দ্বিতীয়তঃ তারা মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়, এবং সে কারণে তারা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে ইতস্ততঃ করে না। (২) তাদের মুখে মিষ্টি, কিন্তু অন্তরে বিষ। অর্থাৎ তারা কখনোই সত্য বলে না। যার ফলে তাদের স্বরূপ বোঝা যায় না। (৩) তাদের আচরণ ছিল চুক্তির শর্তাবলীর বিরুদ্ধে। কারণ "তাদের অধিকাংশ বিদ্রোহী ও সত্যত্যাগী"। সত্যত্যাগীরা কখনো সত্যের বা প্রতিশ্রুতির মর্যাদা দান করবে না। (৪) সামান্য বক্তিস্বার্থের জন্য তারা আল্লাহ্র আয়াতের অসম্মান করে [৯ : ৯]। (৫) তারা অন্য লোককেও আল্লাহ্র রাস্তায় আসতে বাঁধা দান করে [৯ : ১০]। আয়াত [৯ : ১০] প্রথম অংশকে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ, "তারা কখনো মু'মিনের সাথে আত্মীয়তার ও অঙ্গীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না।" লাইনটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কারণ, এক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার রূপ ছিল দ্বিবিধ এবং সে কারণে এর উপরে বিশেষভাবে গুরুত্ব দান করা হয়েছে।
১২৫৭। আত্মীয়তার মর্যাদা আরবগোষ্ঠীর মধ্যে অত্যন্ত প্রবল। তা এত প্রবল যে ধারণা করা হতো, তা অস্বীকার করা আরবদের জন্য সবচেয়ে অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মুশরিক আরবদের মধ্যে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা এত প্রবল ছিল যে তারা সে আত্মীয়তার বন্ধনকেও অস্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে নাই। উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের অনেকেই ছিল মুশরিক আরবদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। মুসলমানদের সাথে আরব মুশরিকদের আত্মীয়তার বন্ধন ব্যতীতও তারা "অঙ্গীকার" বা "চুক্তি" শপথে আবদ্ধ ছিল। মুশরিকদের মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা এত প্রবল ছিল যে, তারা শুধু আত্মীয়তার বন্ধনই অস্বীকার করে নাই, তারা সে পবিত্র অঙ্গীকারকেও লঙ্ঘন করে।
০৯। তারা আল্লাহ্র আয়াতকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রী করে। এবং [অনেককে] তারা তাঁর [আল্লাহ্র] পথ থেকে নিবৃত্ত করে। প্রকৃতই তারা অতি মন্দ কাজ করে থাকে।
১০। বিশ্বাসীদের সাথে তারা আত্মীয়তার অথবা অংগীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না। এরাই তারা যারা সকল সীমা লংঘন করেছে ১২৫৮।
১০। বিশ্বাসীদের সাথে তারা আত্মীয়তার অথবা অংগীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না। এরাই তারা যারা সকল সীমা লংঘন করেছে ১২৫৮।
১২৫৮। এই আয়াতে আরব মুশরিকদের পাপের বর্ণনা করা হয়েছে। এ বর্ণনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, তারা অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
১১। কিন্তু [এর পরেও] যদি তারা অনুতপ্ত হয় ১২৫৯ নিয়মিত সালাত কায়েম করে, এবং যাকাত দেয়, [তবে] তারা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে ভাই। [এভাবেই] যারা বুঝতে পারে তাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি।
১২৫৯। আল্লাহ্ বারে বারে আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন যে, পরম এবং চরম শত্রুরও অনুতাপ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, কেউ যেন ভুল না বুঝে যে, যুদ্ধ একটি ছেলে-খেলা মাত্র। যুদ্ধ যে ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী, সে ক্ষেত্রগুলিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে পরবর্তী আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। যে কোন আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন মুসলমানের জন্য সেক্ষেত্রে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ব্যতীত গত্যন্তর নাই।
১২। কিন্তু যদি তারা চুক্তির পরে শপথ ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে বিদ্রূপ করে ১২৬০; [তবে] অবিশ্বাসীর প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ তাদের শপথের কোন মূল্য তাদের নিকট নাই। এভাবেই যেনো তারা নিবৃত্ত হয়।
১২৬০। আরব মুশরিকরা শুধুমাত্র যে তাদের অঙ্গীকারই ভঙ্গ করতো তা-ই না। তারা নির্লজ্জভাবে মুসলমানদের তাদের ধর্ম সম্বন্ধে বিদ্রূপাত্মক কথা বলতো এবং মুসলমানদের বিশুদ্ধতা ও আন্তরিকতা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতো। যেহেতু মুসলমানেরা চুক্তির শর্তসমূহ বিশ্বস্ততার সাথে পালন করতো, মুশরিকদের ধারণা হতো যে, মুসলমানেরা যুদ্ধ করতে ভয় পায় তাই চুক্তি মানার ব্যাপারে তারা এতটা আন্তরিক।
১৩। যারা নিজেদের শপথ ভঙ্গ করেছে, রাসূলকে বহিষ্কারের জন্য চক্রান্ত করেছে ১২৬১ এবং প্রথম তোমাদের বিরুদ্ধাচারণ [শুরু] করেছে, তোমরা কি সেই সম্প্রদায়কে ভয় পাও ? যদি তোমরা [প্রকৃতই] বিশ্বাসী হও, তবে আল্লাহ্-কে ভয় করাই তোমাদের পক্ষে অধিক সমীচিন।
১২৬১। এই আয়াতে নতুন যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। এই আয়াতে মুসলমানদের প্রতি বিভিন্নভাবে যে আবেদন করা হয়েছে, তা হচ্ছে : (১) শত্রু কর্তৃক নির্লজ্জভাবে চুক্তির শর্তসমূহ লঙ্ঘন; (২) আল্লাহ্র নবীর (সাঃ) বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং এই চেষ্টা যেন নবীকে (সাঃ) মদীনা থেকে বের করে দেওয়া যায়, যেমনভাবে মক্কা থেকে তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন; (৩) হুদায়বিয়ার সন্ধির পরও [ষষ্ঠ হিজরী জ্জিলক্কদ মাস, ৬২৮ খৃষ্টাব্দ ফেব্রুয়ারি মাস] মদীনায় অবস্থিত তাদের মিত্রদের সহযোগিতায় মুসলমানদের আক্রমণ করতে কুরাইশদের বারে বারে চেষ্টা; (৪) পুরুষোচিত সেই ঈমানী শক্তি যে পৃথিবীতে ভয় করতে হবে একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্কে, অন্য কাউকে নয় এবং (৫) আল্লাহ্র প্রতি মু'মিনের বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা ও নির্ভরতা হতে হবে প্রমাণ সাপেক্ষ, পরীক্ষা দিতে হবে দুর্যোগ বিপদের মাধ্যমে, আল্লাহ্র ভালবাসা পাওয়ার আশায় সর্বস্ব এমনকি জীবন ত্যাগেও হতে হবে অকুণ্ঠচিত্ত। [৯ : ১৬ আয়াত দেখুন]।
১৪। তাদের সাথে যুদ্ধ কর, এবং তোমাদের হস্ত দ্বারা আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দেবেন, তাদের লাঞ্ছিত করবেন, তোমাদের তাদের উপর [বিজয়ী] হতে সাহায্য করবেন, বিশ্বাসীদের চিত্তকে প্রশান্ত করবেন ১২৬২;-
১২৬২। "মু'মিনদিগের চিত্ত প্রশান্ত করবেন।" মুশরিকদের বিদ্রূপাত্মক ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, অপমান ইত্যাদিতে মু'মিন বান্দাদের অন্তর ক্ষতবিক্ষত হতো। উপরের বাক্যটির দ্বারা তাদের আল্লাহ্ সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
১৫। এবং তাদের অন্তরের ক্ষোভ দূর করবেন ১২৬৩। আল্লাহ্র যার প্রতি ইচ্ছা তার প্রতি [দয়া] প্রদর্শন করেন ১২৬৪। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।
১২৬৩। মুসলমানেরা মুশরিকদের দ্বারা বারে বারে অত্যাচারিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন, বিদ্রূপের কষাঘাতে তাদের হৃদয় হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু মুশরিকদের উপরে মুমিনদের বিজয়ে তাদের হৃদয়ের সেই যন্ত্রণার প্রশমন ঘটে। মু'মিনদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ফলে যে বিজয় তারা লাভ করবে, তা তাদের আত্মার সকল যন্ত্রণা দূরীভূত করে শান্তির প্রলেপ দিয়ে দেবে, এ আশ্বাস আল্লাহ্ তাদের দিয়েছেন। অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা এবং যুদ্ধ করা আল্লাহ্র সৈনিকদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের ফলে যে সাফল্য তারা লাভ করবে তা তাদের অন্তরকে শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। অন্তরের সকল গ্লানি অপমানের যন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে, অন্তরে বিরাজ করবে অপার শান্তি। এ হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান। সাধারণ উপদেশ হচ্ছে, সৎ কাজের জন্য সংগ্রাম করা হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করা। আর এই সংগ্রামের মধ্যে অপমান আছে, গ্লানি আছে, তবে আল্লাহ্ তাদের সাফল্য দান করবেন যা তাদের আত্মার সকল গ্লানি, অপমানের জ্বালা দূর করবে। আত্মাকে পৌঁছে দেবে বেহেশ্তি প্রশান্তির আলয়ে।
১২৬৪। আল্লাহ্ অসীম করুণার আঁধার। প্রতিটি সমাজে কিছু লোক থাকে যারা খুব সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। যখন সমাজে অন্যায় ও অশুভ শক্তি, ন্যায় ও সত্যের কাছে পরাভুত হয়, তখন এসব লোক খুব সহজে ন্যায় ও সত্যের শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং নিজেকে মু'মিন বান্দারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। যারা ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সৈনিক, যুদ্ধজয়ের পরে তাদের অন্তর বেহেশ্তি শান্তিতে ভরে যাবে। এই হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান। সত্যের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে সৈনিকেরা যুদ্ধের সাফল্যের পরে আল্লাহ্র অপার রহমত ও ক্ষমার পরশ তাদের অন্তরে লাভ করে। তাদের অন্তরের সকল ক্ষোভ ও অশান্তি দূরীভূত হয়ে যায়।
১৬। তোমাদের মধ্যে কারা সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রাম করে এবং আল্লাহ্ তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসী [সম্প্রদায়] ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে না, তোমরা কি মনে কর তা পরীক্ষা না করা পর্যন্ত আল্লাহ্ তোমাদের এমনি ছেড়ে দেবেন ? তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ্ সবিশেষ অবহিত ১২৬৫।
১২৬৫। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। তিনি আমাদের দৃশ্য-অদৃশ্য, মনের গোপন-প্রকাশ্য সকল কিছুই অবগত আছেন। তবুও কুরআনের বহু স্থানে বলা আছে, আমাদেরকে আল্লাহ্ পরীক্ষা করে জেনে নেবেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কেও পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তিনি আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সমর্পিত। আল্লাহ্ সবই জানেন। এসব পরীক্ষা কোনরূপ অজ্ঞতা যাচাইয়ের জন্য নয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে : বিপদ আপদে ধৈর্য্য ও তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের দ্বারা বান্দার "সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে" আধ্যাত্মিক জগতের পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে দেয়া। আল্লাহ্র কাছে শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞানের চাইতে চারিত্রিক দৃঢ়তার মূল্য অনেক বেশি। আল্লাহ্র দরবারে যে বিষয়ের মূল্য বেশি, তা শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞান নয়, বরং কার্যগত ও চরিত্রগত শ্রেষ্ঠত্ব। এই চরিত্রগত শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই আমরা আল্লাহ্র রহমত ও করুণা আশা করতে পারি। কে আল্লাহ্কে ভালবেসে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামে প্রস্তুত, কে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) ও বিশ্বাসীদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত - এই আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা ও সংগ্রামী মনোভাবই হচ্ছে আল্লাহ্র জানার বিষয়বস্তু।
১৭। যারা আল্লাহ্র সাথে অংশীদার করে, আল্লাহ্র মসজিদের পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ তাদের [কাজ] নয়, যখন তারা নিজেরাই নিজেদের আত্মার নাস্তিকতার সাক্ষী ১২৬৬। এদের সকল কার্য কোন সুফল বয়ে আনবে না; তারা আগুনে বসবাস করবে।
১২৬৬। "Amara" - এই আরবী শব্দটি মসজিদের জন্য প্রযোজ্য করা হয়েছে। এই শব্দটি বিভিন্ন অর্থবোধক। তা নিম্নরূপ : (১) তৈরী করা বা পুনঃসংস্কার করা; (২) উপযুক্ত মান বজায় রাখা; (৩) শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে দর্শন করা; (৪) জীবন, আলো এবং কর্মব্যস্ততা। এই আয়াতে রক্ষণাবেক্ষণ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলাম প্রচারের পূর্বে আরবের মুশরিকরা ক্বা'বা শরীফের নির্মাণ, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। তারা এই মসজিদকে এক আল্লাহ্র উপাসনার জন্য পূত-পবিত্র রাখার পরিবর্তে সেখানে বহু দেবতার উপাসনা এবং অনৈসলামিক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পবিত্র ক্বা'বা শরীফকে তারা তাদের অর্থ আয়ের উৎস স্বরূপ ব্যবহার করতো। ইসলামের আগমন তাদের এসব কার্যক্রমের বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা নওমুসলিম ও তার নেতা হযরত মুহাম্মদকে (সাঃ) মক্কা থেকে বহিষ্কার করে দেয় এবং মুসলমানদের জন্য ক্বা'বা শরীফকে নিষিদ্ধ করে দেয়। মুসলমানেরা যখন আরবের বুকে সংঘবদ্ধ মুসলিম সম্প্রদায়রূপে আবির্ভূত হলো, তখন অষ্টম হিজরীতে তাঁরা মক্কা জয় করলেন। মক্কা জয়ের পরে মুসলমানেরা ক্বা'বা শরীফকে বিভিন্ন দেব-দেবী মুক্ত করে তা পবিত্র করেন এবং হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) ন্যায় ক্বা'বা শরীফে এক আল্লাহ্র ইবাদত প্রতিষ্ঠা করেন। আরবদের ভিতর যারা বহু দেবদেবীতে বিশ্বাসী এবং যারা ক্বা'বা শরীফে দেব-দেবীর অধিষ্ঠানে আগ্রহী তাদের জন্য ক্বা'বা শরীফে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই আয়াত দ্বারা। কারণ, ক্বা'বা শরীফ হযরত ইব্রাহীমের দ্বারা নির্মিত হয়, আল্লাহ্র হুকুমে। এটা হচ্ছে আল্লাহ্র ঘর। সেই ঘরে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারো উপাসনা হলে তা হবে আল্লাহ্র জন্য অপমানজনক, এবং ক্বা'বা শরীফের জন্য মানহানিকর। সুতরাং, এই পবিত্র ঘরে আর কারো উপাসনা হারাম। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
সাধারণ উপদেশ হচ্ছে : আল্লাহ্র মসজিদ সবসময় হবে আল্লাহ্র প্রেমিকদের জন্য ইবাদতের স্থান। আল্লাহ্র ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন আচার অনুষ্ঠান বা তা থেকে আয় রোজগার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ এটা হবে এমন এক স্থান যেখানে বান্দার আগমন ঘটবে আত্মিক উন্নতি লাভের জন্য, পার্থিব লাভের জন্য নয়। প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিকদের জন্য এর দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে। প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিকদের সংজ্ঞা পরবর্তী আয়াতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
১৮। তারাই আল্লাহ্র মসজিদের পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যারা আল্লাহ্তে এবং আখিরাতে ঈমান আনে। নিয়মিত সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করে না ১২৬৭। এরাই তারা, আশা করা যায় তারা হবে সৎ পথে পরিচালিতদের অন্তর্ভুক্ত ১২৬৮।
১২৬৭। প্রকৃত আল্লাহ্ প্রেমিকদের বৈশিষ্ট্য এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। তারাই অকৃত্রিম বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিক যারা আল্লাহ্র একত্বের অস্তিত্বে বিশ্বাসী; পরকালে আল্লাহ্র কাছে ইহকালের কার্যক্রমের জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী, একান্তভাবে, একাগ্রভাবে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ্র সান্নিধ্য কামনা করে, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করে, এবং আল্লাহ্ ব্যতীত পৃথিবীর কোন শক্তির কাছে মাথা নত করে না, অর্থাৎ তাদের সকল কার্যকলাপ, তাদের সর্ব অবয়ব এক আল্লাহ্র কাছে নিবেদিত থাকে - তারাই প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিক।
১২৬৮। উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে বর্তমান, পৃথিবীর লোক তাদের খ্রিস্টান, ইহুদী যে নামেই ডাকুক না কেন, তারাই প্রকৃত বিশ্বাসী বা আল্লাহ্ প্রেমিক বা মুসলমান। আল্লাহ্র হেদায়েত তাদের জন্য অপেক্ষমান।
১৯। হাজীদের পানি সরবরাহ করা ১২৬৯, অথবা মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে তোমরা কি তাদের [পূণ্য কাজের] সমজ্ঞান কর, যারা আল্লাহ্ ও আখিরাতে ঈমান আনে এবং আল্লাহ্ রাস্তায় সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রাম করে ? আল্লাহ্র নিকট উহারা সমতুল্য নয়। যারা পাপ করে আল্লাহ্ তাদের সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।
১২৬৯। আরব দেশ মরুভূমির দেশ। পানি সেখানে মহার্ঘ বস্তু। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশে বসে সেই সময়ের আরব দেশের পানির মহার্ঘতা কল্পনা করাও অসম্ভব। এ আয়াতে তীর্থযাত্রী বা হাজীদের পানি পান করানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ তাই-ই দাঁড়ায়, কিন্তু প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায় তীর্থযাত্রীদের সেবা করা। সেই সেবার মান হতে হবে মহার্ঘ, অর্থাৎ যা সহজলভ্য নয়। মসজিদের জন্য পার্থিব সম্পদ খরচ করা। এই পার্থিব সম্পদ শারীরিক হতে পারে, অর্থ সম্পদ হতে পারে। আল্লাহ্র রাস্তায় অর্থ সম্পদ ব্যয় করা অবশ্যই পূণ্যের কাজ। কিন্তু এ সমস্ত কাজই হচ্ছে বাহ্যিক যা অত্যন্ত সহজ। কারণ, যে কাজে মানুষের মেধা, মননশক্তি, পরিশ্রম, একাগ্রতা, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, আত্মোৎসর্গ থাকে না, অর্থাৎ যে কাজ আত্মাকে স্পর্শ করে না, তার মূল্য আল্লাহ্র চোখে সামান্য। কাজের পরিমাণ যাই-ই হোক না কেন যদি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কোন কাজ করা হয়, এবং সে কাজে নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করা হয়, তবে আল্লাহ্র চোখে তা-ই শ্রেষ্ঠ কাজ। এ আয়াতে বলা হয়েছে যারা বিশ্বাসী ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য সংগ্রাম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে সৎ পথ প্রদর্শন করেন। অর্থাৎ তাদের আত্মা আল্লাহ্র নূরে আলোকিত হয়ে যায়। অর্থাৎ তাদের মধ্যে বিবেকের আলো জাগ্রত হয়। ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের পার্থক্য তাদের সামনে হয় ভাস্বর। চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে "সরল পথের" ঠিকানায় তাঁরা পৌঁছে যান। অপরপক্ষে যারা পৃথিবীতে সুনাম কুড়ানোর জন্য সৎ কাজ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে তাদের আল্লাহ্ হেদায়েত বা সৎ পথ প্রদর্শন করেন না। অর্থাৎ তাদের আত্মায় বিবেকের আলো বা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে না। ফলে তারা ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা লাভ করে না। দুর্লভ চারিত্রিক গুণাবলী - যা সৎ পথের সন্ধান দেয়, তা অর্জন করতে তারা অক্ষম।
২০। যারা ঈমান আনে এবং হিজরতের কষ্ট সহ্য করে, এবং সম্পদ ও জীবন দ্বারা সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করে ১২৭০ তারা আল্লাহ্র নিকট মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। এরাই তারা যারা [আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভে] সফলকাম।
১২৭০। এ আয়াতে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদের বর্ণনা আছে। আল্লাহ্র রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ করার নামই হচ্ছে জিহাদ। সমাজ জীবনে আল্লাহ্র বিধানকে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করাই আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম। আল্লাহ্র বিধান সর্বদা ন্যায় ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ন্যায় ও সত্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার নামই হচ্ছে "জিহাদ"। এর সারমর্ম হচ্ছে : (১) যারা সত্যিকারের মু'মিন বান্দা তারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য এত নিবেদিত প্রাণ থাকবেন যে, পার্থিব আশা আকাঙ্ক্ষা, পার্থিব লাভ-লোকসান তাদের কাছে তুচ্ছ জ্ঞান হবে। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি-ই হবে তাদের কাছে একমাত্র লক্ষ্য। (২) তাঁরা হবেন আল্লাহ্র রাস্তায় নিবেদিত প্রাণ। তাঁদের সমস্ত কর্মপ্রণালী, অর্থ সম্পদ, পার্থিব সমস্ত কিছুই হবে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গীকৃত। প্রয়োজনে তাঁরা নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে হিজরত করতেও কুণ্ঠিত হন না, এমন কি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে তাঁরা থাকেন সদা প্রস্তুত। অর্থাৎ তাদের মেধা, মননশক্তি, পরিশ্রম, একাগ্রতা, আত্মোৎসর্গ, জীবন, ধন-মান, অর্থ সম্পদ, সব-ই আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত। জিহাদের মর্মবাণী হচ্ছে তা-ই। যদি কেউ মনে করে শক্তির দম্ভ প্রদর্শন করে যুদ্ধ করাই একমাত্র জিহাদ, তবে তা হবে ভুল। কারণ, সেক্ষেত্রে "জিহাদের" মূলনীতি [spirit] থাকে অনুপস্থিত। জ্ঞানী লোকের কলম, ধর্মপ্রচারকের বাণী, ধনবান লোকের সমাজের জন্য দান এসবও হতে পারে জিহাদ। যদি তার মধ্যে থাকে জিহাদের মূল চেতনা বা spirit।২১। উহাদের প্রতিপালক উহাদেরকে সুসংবাদ দিতেছেন তাঁর পক্ষ থেকে দয়া ও সন্তোষের এবং জান্নাতের, যেখানে তাদের জন্য আছে স্থায়ী সুখ-শান্তি।
২২। সেখানে তারা চিরস্থায়ীরূপে বসবাস করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট সর্বোচ্চ পুরস্কার রয়েছে ১২৭১।
২২। সেখানে তারা চিরস্থায়ীরূপে বসবাস করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট সর্বোচ্চ পুরস্কার রয়েছে ১২৭১।
১২৭১। যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা করে আল্লাহ্ তাদের সুসংবাদ দিচ্ছেন : (১) তারা আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হবে, (২) আল্লাহ্র সন্তুষ্টি তাদের জীবন সুখ-শান্তিতে ভরে দেবে; (৩) বেহেশ্তের সুখবর আছে তাদের জন্য; (৪) আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করবে আত্মার মাঝে যা স্থায়ী সুখ-শান্তিতে আত্মাকে ভরিয়ে দেবে - যা বান্দার জীবনের সর্বোচ্চ পুরস্কার। এই চারটি অবস্থা আত্মিক অগ্রগতির ক্রমমাত্রা বা ধাপ। ১ নম্বর হচ্ছে আল্লাহ্র স্বীয় মর্যাদা বা বিশেষ দয়া বা রহমত। ২ নম্বর হচ্ছে আল্লাহ্র সন্তোষ বা সন্তুষ্টি নিজ আত্মার ভিতরে অনুভব করার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা আত্মাকে পৃথিবীর মলিনতার উর্ধ্বে স্থাপন করে। আত্মাকে স্বর্গীয় শান্তিতে ভরিয়ে দেয়। ৩ নম্বর হচ্ছে "জান্নাতের" স্থায়ী সুখ-শান্তির আশ্বাস। পৃথিবীর কোনও অশান্তি বা বিপর্যয় এসব লোকদের বিচলিত করে না। ৪ নম্বর হচ্ছে আত্মার সর্বোচ্চ আশা-আকাঙ্ক্ষা বা সর্বোচ্চ শান্তি বা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ।
২৩। হে বিশ্বাসীগণ ! যদি তোমাদের পিতা ও ভ্রাতা ঈমান অপেক্ষা কুফরীকে ভালোবাসে, তবে তাদের রক্ষাকর্তা রূপে গ্রহণ করো না, তোমাদের মধ্যে যদি কেহ তা করে তবে সে পাপ করে।
২৪। বলঃ "যদি তাই হয় যে, তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের জ্ঞাতিবর্গ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দাপড়ার আশংকা কর; অথবা বাসস্থান যেখানে তোমরা পরমানন্দ লাভ কর, ১২৭২ [এগুলি তোমাদের নিকট] আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অথবা আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম অপেক্ষা বেশী প্রিয় হয়; তবে আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর ১২৭৩।" আল্লাহ্ বিদ্রোহী সম্প্রদায়কে সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।
২৪। বলঃ "যদি তাই হয় যে, তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের জ্ঞাতিবর্গ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দাপড়ার আশংকা কর; অথবা বাসস্থান যেখানে তোমরা পরমানন্দ লাভ কর, ১২৭২ [এগুলি তোমাদের নিকট] আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অথবা আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম অপেক্ষা বেশী প্রিয় হয়; তবে আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর ১২৭৩।" আল্লাহ্ বিদ্রোহী সম্প্রদায়কে সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।
১২৭২। সাধারণ মানুষ পরকালের জীবন অপেক্ষা ইহকালের পার্থিব জীবনকে অধিক মূল্যবান মনে করে। যার ফলে মানুষ পার্থিব জীবনে দৃঢ়ভাবে আসক্ত থাকে; (১) তার নিকট আত্মীয়, যেমন- পিতামাতা, সন্তান, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন তাদের শুভ-অশুভ চিন্তায়; (২) পার্থিব ধন সম্পদের চিন্তায়, অথবা (৩) ব্যবসা-বাণিজ্য, লাভ-লোকসানের চিন্তায়, অথবা (৪) সামাজিক সম্মান, অথবা আরাম-আয়েস বা বাসস্থান যা প্রাণের চেয়েও প্রিয় - এসবের চিন্তায়। যদি উপরে উল্লেখিত বস্তুসমূহ তার চিন্তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে আল্লাহ্র চিন্তা তার অন্তরে স্থান না পায়; আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করা থেকে তাকে নিবৃত্ত করে, তবে আল্লাহ্র আদেশ হচ্ছে ইহকাল ও অনন্ত পরকাল এই দুই পৃথিবীর মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে। আল্লাহ্র নির্দেশ হচ্ছে আল্লাহ্র ভালোবাসা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে আমরা পার্থিব সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবো।
১২৭৩। পৃথিবীর ভালোবাসার বন্ধন, আরাম-আয়েস, লাভ-লোকসান, আনন্দ-ফূর্তি - এসব যদি আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা থেকে বেশি হয়, যদি এসবের কারণে আমরা আল্লাহ্র হুকুম মানতে অপারগ হই, তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য প্রস্তুত না থাকি, তবে তাতে আল্লাহ্র কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। যা ক্ষতি তা হচ্ছে আমাদের আত্মার। আল্লাহ্র সামগ্রিক পরিকল্পনা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আমরা তাতে অংশগ্রহণ করি বা না করি তাতে আল্লাহ্র কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। আল্লাহ্র ডাকে সাড়া না দেয়ার ক্ষতি আমাদের নিজস্ব, আমাদের আত্মার। আমরা আল্লাহ্র রহমত, দয়া, হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হব : "আল্লাহ্ বিদ্রোহী সম্প্রদায়কে সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।"
এই আয়াতগুলির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে সেই সব সাহাবাদের জীবন, যাঁরা আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য, রাসূলের (সাঃ) প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য, তাঁদের সুখের আলয়, ধন সম্পদ ত্যাগ করে, জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। মদিনার নির্বাসিত জীবন বেছে নেওয়ার পূর্বে, তাঁরা তাঁদের প্রিয় বাসগৃহ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আরাম-আয়েস সবকিছু ত্যাগ করেন আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য। তাঁরা আল্লাহ্র জন্য "জিহাদ" ঘোষণা করেন, এমনকি নিজ গোত্র, আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই; কারণ, তারা ছিল ইসলামের শত্রু। যারা ইসলামের ইতিহাস পড়েছেন তাঁরা জানেন যে শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় লাভ ঘটে। যাঁরা সত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁদের অপারগতার জন্য ইসলামের বিজয় থেমে থাকে নাই। আল্লাহ্র উদ্দেশ্য অপূর্ণ থাকে নাই।
[উপরের আয়াতগুলির প্রয়োগ সর্বকালের সর্বযুগের জন্য। আল্লাহ্র পরিকল্পনা রোধের সাধ্য কারও নাই। সত্যের জয় অবধারিত। শুধু যারা সত্যকে, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে, তারাই লাভবান হয় শেষ পর্যন্ত।
রুকু - ৪
১২৭৪। মক্কা থেকে তায়েফ যাওয়ার পথে, মক্কার ১৪ মাইল পূর্বে, পর্বতময় মক্কা এবং তায়েফের উপত্যকার মধ্যবর্তী স্থানে পর্বতময় হুনায়নের অবস্থান। মক্কা বিজয়ের পর পরই (৮ম হিজরী) আরবের পৌত্তলিকেরা ইসলামের বিজয়ে যেমন বিস্মিত হয়, তেমনিই বিরক্ত হয়। তারা এক বিরাট সেনাবাহিনী সংগ্রহ করে এবং তায়েফের নিকট রাসূলকে (সাঃ) আক্রমণের পরিকল্পনা করে। হাওয়াযিন ও ছাকীফ গোত্রদ্বয় এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করে এবং মক্কা অভিযানের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। তারা তাদের সামরিক শক্তি ও দক্ষতা সম্বন্ধে অত্যন্ত গর্বিত ছিল। অপরপক্ষে মক্কার মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। দলে দলে নও-মুসলিমরা যুদ্ধে যোগদান করতে থাকে। তার ফলে মুসলমানদের দশ থেকে বার হাজারের একটি বিরাট বাহিনী গঠিত হয়। অপরপক্ষে শত্রুবাহিনীর সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র চার হাজারের মত। যুদ্ধ সংঘটিত হয় হুনাইন প্রদেশে। এ সম্বন্ধে বর্ণনা আছে পরবর্তী আয়াতে।
১২৭৫। হুনায়নেই মুসলমানদের প্রথম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তার কারণ নিহিত ছিল তাদের নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। মক্কা বিজয়ের পরে বহু নব্য মুসলমান ঈমান, বিশ্বাস ও জিহাদের মনোভাব অপেক্ষা অহংকার ও গর্বকে প্রাধান্য দেয়। ফলে তাদের চরিত্রে মু'মিনের ধীর স্থির মনোভাবের পরিবর্তে গর্ব, অহংকার, আবেগ-উচ্ছ্বাস ও উল্লাসের প্রকাশ পায়। যুদ্ধক্ষেত্র হুনায়ন উপত্যকা শত্রুদের পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিল। এই সুযোগ তারা ভালোভাবেই গ্রহণ করে। দেশটি পর্বতময়। পূর্ব পরিচিত থাকার দরুণ শত্রু সেনারা পাহাড়ের আড়ালে উপযুক্ত জায়গায় লুকিয়ে থাকে। পাহাড়ে অবস্থানের দরুণ তাদের এই লুকিয়ে ওঁৎ পেতে থাকার কাজটি অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিলো। যে মূহুর্তে মুসলিম সেনাবাহিনীর পুরোভাগ হুনায়ন উত্যকায় প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গে শত্রুসেনারা তাদের লুক্কায়িত স্থান থেকে তীর ধনুকের সাহায্যে মুসলিম সেনাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে বিপর্যয় ঘটিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সৈন্য সংখ্যা মুসলমানদের সুবিধার পরিবর্তে অসুবিধাই ঘটায় বেশি। বহু মুসলিম প্রাণ হারান, অনেকে পলায়ন করেন, অনেকে আক্রমণের আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। কিন্তু আমাদের নবী (সাঃ) চিরাচরিতভাবে সে বিপর্যয়ের মধ্যেও ছিলেন ধীর স্থির - আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে অবিচল। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতা মুসলমান সেনাদের সংগঠিত হতে সাহায্য করে এবং ফলশ্রুতিতে শত্রু সেনারা নির্মম পরাজয় বরণ করে।
১২৭৬। "Sakina": আরবী শব্দটির অর্থ ধীর-স্থির, শান্তি, নিরাপত্তা, চিত্ত-প্রশান্তি। দেখুন [২ : ২৪৮] আয়াত। আমাদের নবী (সাঃ) কখনও সম্পূর্ণরূপে আত্মবিশ্বাস বা মানুষের শক্তি সামর্থ বা সংখ্যাধিক্যের উপরে নির্ভর করতেন না। তার প্রমাণ আমরা তাঁর জীবন থেকেই দেখতে পাই। মহা দুর্যোগের সময়েও তাঁর চরিত্রে দেখা যায় অপূর্ব গুণাবলীর সমন্বয় : আল্লাহ্র প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে ধীর-স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাহসের সাথে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া, সর্বোপরি আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, চিত্তের প্রশান্তি, ধীর-স্থির মনোভাব, সর্বোপরি আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা মুসলিম সেনাদের জিহাদের মনোভাবে উদ্বুদ্ধ করে; বিশেষভাবে যাঁরা হতবুদ্ধি হয়ে বিশৃঙ্খলভাবে পলায়ন করেছিলেন। ফলে মুসলিম সৈন্যরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে শত্রুদের উপরে আক্রমণ করেন। এবং যুদ্ধে জয় লাভ করেন। আল্লাহ্র সাহায্যেই তাঁরা এই যুদ্ধে সফলতা লাভ করেন। মুসলমানগণ শত্রুসেনাদের ছত্রভঙ্গ করে তাদের পিছনে ধাওয়া করেন। তাদের বাড়ীঘর, পশু সম্পদ এবং পরিবার পরিজন হস্তগত করেন। তাঁরা মাথা উঁচু করে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
১২৭৮। "অপবিত্র" - মুশরিকদের থেকে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, মুসলমানেরা হবে অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। শুধু শারীরিকভাবেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হবে না, মানসিক ও আত্মিক দিকেও তারা হবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মানসিক বা আত্মিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অর্থ হচ্ছে - তারা হবে সত্যবাদী, কথা ও কাজের মধ্যে তাদের কোনও পার্থক্য থাকবে না। অর্থাৎ তারা মিথ্যাবাদী বা মুনাফিক বা ভণ্ড হবে না। তারা যেনো তাদের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে। এই-ই হচ্ছে আত্মিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। "পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংগ"। এই পরিচ্ছন্নতা হবে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক।
১২৭৯। "তাদের এই বৎসর" - এই বাক্যটির অর্থ দ্বিবিধ : (১) এখন মুসলমানদের দ্বারা মক্কা বিজয় হয়েছে, সুতরাং ক্বা'বা শরীফকে মূর্তি পূজার পাপ থেকে ও অপবিত্র কার্যকলাপ থেকে পবিত্র রাখার দায়িত্ব মুসলমানদের। তা এই বৎসর থেকেই কার্যকর। (২) মক্কা বিজয়ের বৎসর ছিল মুশরিকদের ক্ষমতা ও দম্ভ প্রকাশের শেষ বৎসর, ক্ষমতা অপব্যবহারের বৎসর, এখন তার অবসান হলো, এবং এই বৎসর থেকেই ক্বা'বা শরীফের দায়িত্ব শুধুমাত্র মুসলমানদের উপর অর্পিত হলো।
১২৮০। ক্বা'বা শরীফে তীর্থ যাত্রীদের আগমন মক্কার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হয়েছিলো ক্বা'বাকে মুশরিকদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, সেখানে লোকসমাগম হ্রাস পাবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেবে। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ মুসলমানদের আশ্বাস দিয়ে দরিদ্রতার ভয় পেতে নিষেধ করেছেন। মুসলমানদের বলা হয়েছে যে মুশরিকরা ক্ষয়িষ্ণু শক্তি; শেষ পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। মুসলমানরা পৃথিবীতে শক্তিশালী জাতি হিসাবে আবির্ভুত হবে। ফলে ক্বা'বা প্রাঙ্গনের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাময়িক মন্দা খুব শীঘ্রই তুল্য শক্তি সম্পন্ন বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হবে। আরও বলা হয়েছে যে, "আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাঁর নিজ অনুগ্রহ দ্বারা তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন।" অর্থাৎ আর্থিক সংগতির অন্যান্য সুবন্দোবস্ত করতে পারেন। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে আমরা দেখি, আরব থেকে মুশরিকরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা বৃহৎ শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হয়। এর ফলে ক্বা'বা শরীফে মুসলমান তীর্থযাত্রী বা হজ্জ্বযাত্রীর আগমন, মুশরিকদের সমবেত সংখ্যা অতিক্রম করে যায়। শুধু অতিক্রম বললে ভুল হবে, বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এখানেই আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। এ ব্যতীত আজ এই বিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখি, সমগ্র আরব দেশ তেলের সমুদ্রে ভেসে আছে। তাদের অর্থের প্রাচুর্য্য, বিত্তের অহংকার পৃথিবীর অন্যান্য জাতির ঈর্ষার বস্তু। আজ থেকে একশত বৎসর পূর্বেও আরবদের এই প্রাচুর্য ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু আল্লাহ্ সবই জানতেন, তিনি "সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।"
১২৮১। "Jizya"- আরবী শব্দটির মূল অর্থ ক্ষতি পূরণ দান করা। মুসলিম সমাজে এই শব্দটি একটি করের পরিভাষারূপে ব্যবহার করা হয়। মুসলমান রাজ্যে বাস করে যারা ইসলাম গ্রহণে অনিচ্ছুক, কিন্তু মুসলমানদের দ্বারা সুরক্ষিত জীবন যাপন করতে চায়, তাদের জন্য এই কর ধার্য্য করা হয়। অর্থাৎ মুসলিম রাজ্যে অমুসলমানেরা যেন সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে সে কারণে মুসলমানেরা তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বভার নেবে, বিনিময়ে তারা কর প্রদান করবে। এই কর দান ছিল অমুসলমানদের পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেয়া যে, তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে মুসলমানরা সহ্য করবে, কিন্তু বিনিময়ে তারা ইসলামের অগ্রগতি ও সংহতিতে কোন বাঁধার সৃষ্টি করবে না। অমুসলমানদের উপরে ধার্য এই করকে ধরা যায় তাদেরকে দেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া - কর দানের পরিবর্তে। জিজিয়া করের কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ কোরআন শরীফে ধার্য্য করা হয় নাই। ঈমান শাফিঈ মনে করেন যে, বৎসরে এর পরিমাণ হবে এক দিনার। অবশ্যই এই দিনার হবে আরবের স্বর্ণমুদ্রা। ট্যাক্স বা করের পরিমাণের তারতম্য হতে পারে। গরীব লোক, স্ত্রীলোক এবং শিশু, ক্রীতদাস, সাধু সন্ন্যাসীদের ক্ষেত্রে কর রহিত হতে পারে [আবু হানিফার মত অনুযায়ী]। প্রতীয়মান হয় যে, অমুসলমান যুবকদের দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে এই করের পরিবর্তে রেহাই দান করা হয় [পরবর্তী টীকাতে দেখুন]।
১২৮২। "An Yadin" - আরবী শব্দটির পরিভাষা হওয়া উচিৎ "হাত থেকে"। কিন্তু শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এখানে "হাত" শব্দটিকে ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। (মাওলানা ইউসুফ আলী সাহেব) ইংরেজীতে শব্দটিকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে - "In token of willing submission" বাংলা অনুবাদ হয়েছে, "তারা আত্মসমর্পণ করে।" অর্থাৎ জিজিয়া শব্দটিকে অমুসলমানদের দেশের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব থেকে রেহাই দেয়ার বিনিময় হিসাবে বিবেচনা করা যায়। যেহেতু বাৎসরিক করের পরিমাণ অতি সামান্য, এবং এই কর থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে অসংখ্য অমুসলিমকে, সুতরাং একে আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে এবং দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে রেহাই দেয়ার প্রতীক হিসেবে ধরা অধিক যুক্তিযুক্ত। [পূর্ববর্তী টীকাতে দেখুন]।
১২৭৩। পৃথিবীর ভালোবাসার বন্ধন, আরাম-আয়েস, লাভ-লোকসান, আনন্দ-ফূর্তি - এসব যদি আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা থেকে বেশি হয়, যদি এসবের কারণে আমরা আল্লাহ্র হুকুম মানতে অপারগ হই, তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য প্রস্তুত না থাকি, তবে তাতে আল্লাহ্র কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। যা ক্ষতি তা হচ্ছে আমাদের আত্মার। আল্লাহ্র সামগ্রিক পরিকল্পনা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আমরা তাতে অংশগ্রহণ করি বা না করি তাতে আল্লাহ্র কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। আল্লাহ্র ডাকে সাড়া না দেয়ার ক্ষতি আমাদের নিজস্ব, আমাদের আত্মার। আমরা আল্লাহ্র রহমত, দয়া, হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হব : "আল্লাহ্ বিদ্রোহী সম্প্রদায়কে সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।"
এই আয়াতগুলির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে সেই সব সাহাবাদের জীবন, যাঁরা আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য, রাসূলের (সাঃ) প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য, তাঁদের সুখের আলয়, ধন সম্পদ ত্যাগ করে, জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। মদিনার নির্বাসিত জীবন বেছে নেওয়ার পূর্বে, তাঁরা তাঁদের প্রিয় বাসগৃহ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আরাম-আয়েস সবকিছু ত্যাগ করেন আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য। তাঁরা আল্লাহ্র জন্য "জিহাদ" ঘোষণা করেন, এমনকি নিজ গোত্র, আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই; কারণ, তারা ছিল ইসলামের শত্রু। যারা ইসলামের ইতিহাস পড়েছেন তাঁরা জানেন যে শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় লাভ ঘটে। যাঁরা সত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁদের অপারগতার জন্য ইসলামের বিজয় থেমে থাকে নাই। আল্লাহ্র উদ্দেশ্য অপূর্ণ থাকে নাই।
[উপরের আয়াতগুলির প্রয়োগ সর্বকালের সর্বযুগের জন্য। আল্লাহ্র পরিকল্পনা রোধের সাধ্য কারও নাই। সত্যের জয় অবধারিত। শুধু যারা সত্যকে, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে, তারাই লাভবান হয় শেষ পর্যন্ত।
রুকু - ৪
২৫। নিশ্চিতরূপে আল্লাহ্ তোমাদের বহু যুদ্ধক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন এবং হুনায়নের যুদ্ধ ক্ষেত্র স্মরণ কর ১২৭৪। তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের উৎফুল্ল করেছিলো, কিন্তু উহা তোমাদের কোন কাজে আসে নাই। বিস্তৃত হওয়া সত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিলো, এবং তোমরা পশ্চাদপশরণ করে পলায়ন করেছিলে ১২৭৫।
১২৭৪। মক্কা থেকে তায়েফ যাওয়ার পথে, মক্কার ১৪ মাইল পূর্বে, পর্বতময় মক্কা এবং তায়েফের উপত্যকার মধ্যবর্তী স্থানে পর্বতময় হুনায়নের অবস্থান। মক্কা বিজয়ের পর পরই (৮ম হিজরী) আরবের পৌত্তলিকেরা ইসলামের বিজয়ে যেমন বিস্মিত হয়, তেমনিই বিরক্ত হয়। তারা এক বিরাট সেনাবাহিনী সংগ্রহ করে এবং তায়েফের নিকট রাসূলকে (সাঃ) আক্রমণের পরিকল্পনা করে। হাওয়াযিন ও ছাকীফ গোত্রদ্বয় এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করে এবং মক্কা অভিযানের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। তারা তাদের সামরিক শক্তি ও দক্ষতা সম্বন্ধে অত্যন্ত গর্বিত ছিল। অপরপক্ষে মক্কার মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। দলে দলে নও-মুসলিমরা যুদ্ধে যোগদান করতে থাকে। তার ফলে মুসলমানদের দশ থেকে বার হাজারের একটি বিরাট বাহিনী গঠিত হয়। অপরপক্ষে শত্রুবাহিনীর সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র চার হাজারের মত। যুদ্ধ সংঘটিত হয় হুনাইন প্রদেশে। এ সম্বন্ধে বর্ণনা আছে পরবর্তী আয়াতে।
১২৭৫। হুনায়নেই মুসলমানদের প্রথম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তার কারণ নিহিত ছিল তাদের নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। মক্কা বিজয়ের পরে বহু নব্য মুসলমান ঈমান, বিশ্বাস ও জিহাদের মনোভাব অপেক্ষা অহংকার ও গর্বকে প্রাধান্য দেয়। ফলে তাদের চরিত্রে মু'মিনের ধীর স্থির মনোভাবের পরিবর্তে গর্ব, অহংকার, আবেগ-উচ্ছ্বাস ও উল্লাসের প্রকাশ পায়। যুদ্ধক্ষেত্র হুনায়ন উপত্যকা শত্রুদের পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিল। এই সুযোগ তারা ভালোভাবেই গ্রহণ করে। দেশটি পর্বতময়। পূর্ব পরিচিত থাকার দরুণ শত্রু সেনারা পাহাড়ের আড়ালে উপযুক্ত জায়গায় লুকিয়ে থাকে। পাহাড়ে অবস্থানের দরুণ তাদের এই লুকিয়ে ওঁৎ পেতে থাকার কাজটি অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিলো। যে মূহুর্তে মুসলিম সেনাবাহিনীর পুরোভাগ হুনায়ন উত্যকায় প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গে শত্রুসেনারা তাদের লুক্কায়িত স্থান থেকে তীর ধনুকের সাহায্যে মুসলিম সেনাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে বিপর্যয় ঘটিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সৈন্য সংখ্যা মুসলমানদের সুবিধার পরিবর্তে অসুবিধাই ঘটায় বেশি। বহু মুসলিম প্রাণ হারান, অনেকে পলায়ন করেন, অনেকে আক্রমণের আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। কিন্তু আমাদের নবী (সাঃ) চিরাচরিতভাবে সে বিপর্যয়ের মধ্যেও ছিলেন ধীর স্থির - আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসে অবিচল। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতা মুসলমান সেনাদের সংগঠিত হতে সাহায্য করে এবং ফলশ্রুতিতে শত্রু সেনারা নির্মম পরাজয় বরণ করে।
২৬। কিন্তু রাসূল এবং বিশ্বাসীদের উপর আল্লাহ্ তাঁর প্রশান্তির ধারা বর্ষণ করেন ১২৭৬ এবং এমন এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন যা তোমরা দেখ নাই। তিনি অবিশ্বাসীদের শাস্তি দান করেন। এভাবেই তিনি ঈমানহীনদের পুরষ্কৃত করেন।
১২৭৬। "Sakina": আরবী শব্দটির অর্থ ধীর-স্থির, শান্তি, নিরাপত্তা, চিত্ত-প্রশান্তি। দেখুন [২ : ২৪৮] আয়াত। আমাদের নবী (সাঃ) কখনও সম্পূর্ণরূপে আত্মবিশ্বাস বা মানুষের শক্তি সামর্থ বা সংখ্যাধিক্যের উপরে নির্ভর করতেন না। তার প্রমাণ আমরা তাঁর জীবন থেকেই দেখতে পাই। মহা দুর্যোগের সময়েও তাঁর চরিত্রে দেখা যায় অপূর্ব গুণাবলীর সমন্বয় : আল্লাহ্র প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে ধীর-স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাহসের সাথে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া, সর্বোপরি আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, চিত্তের প্রশান্তি, ধীর-স্থির মনোভাব, সর্বোপরি আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা মুসলিম সেনাদের জিহাদের মনোভাবে উদ্বুদ্ধ করে; বিশেষভাবে যাঁরা হতবুদ্ধি হয়ে বিশৃঙ্খলভাবে পলায়ন করেছিলেন। ফলে মুসলিম সৈন্যরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে শত্রুদের উপরে আক্রমণ করেন। এবং যুদ্ধে জয় লাভ করেন। আল্লাহ্র সাহায্যেই তাঁরা এই যুদ্ধে সফলতা লাভ করেন। মুসলমানগণ শত্রুসেনাদের ছত্রভঙ্গ করে তাদের পিছনে ধাওয়া করেন। তাদের বাড়ীঘর, পশু সম্পদ এবং পরিবার পরিজন হস্তগত করেন। তাঁরা মাথা উঁচু করে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
২৭। এর পরও যার প্রতি ইচ্ছা আল্লাহ্ [অনুগ্রহশীল] হবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বার বার ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু ১২৭৭।
১২৭৭। বিপদের দিনে আল্লাহ্র করুণা ও দয়া যেরূপ অনুভব করা যায়, বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্র করুণা ও দয়া সেরূপ সর্বদা প্রবাহিত।২৮। হে বিশ্বাসীগণ ! মুশরিকরা অবশ্যই অপবিত্র ১২৭৮। সুতরাং এই বৎসরের পরে তারা যেনো মসজিদুল হারামের নিকট না আসে ১২৭৯ এবং যদি তোমরা দারিদ্রের আশংকা কর, [তবে] আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে, শীঘ্রই তিনি তোমাদের তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন ১২৮০। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
১২৭৮। "অপবিত্র" - মুশরিকদের থেকে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, মুসলমানেরা হবে অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। শুধু শারীরিকভাবেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হবে না, মানসিক ও আত্মিক দিকেও তারা হবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মানসিক বা আত্মিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অর্থ হচ্ছে - তারা হবে সত্যবাদী, কথা ও কাজের মধ্যে তাদের কোনও পার্থক্য থাকবে না। অর্থাৎ তারা মিথ্যাবাদী বা মুনাফিক বা ভণ্ড হবে না। তারা যেনো তাদের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে। এই-ই হচ্ছে আত্মিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। "পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংগ"। এই পরিচ্ছন্নতা হবে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক।
১২৭৯। "তাদের এই বৎসর" - এই বাক্যটির অর্থ দ্বিবিধ : (১) এখন মুসলমানদের দ্বারা মক্কা বিজয় হয়েছে, সুতরাং ক্বা'বা শরীফকে মূর্তি পূজার পাপ থেকে ও অপবিত্র কার্যকলাপ থেকে পবিত্র রাখার দায়িত্ব মুসলমানদের। তা এই বৎসর থেকেই কার্যকর। (২) মক্কা বিজয়ের বৎসর ছিল মুশরিকদের ক্ষমতা ও দম্ভ প্রকাশের শেষ বৎসর, ক্ষমতা অপব্যবহারের বৎসর, এখন তার অবসান হলো, এবং এই বৎসর থেকেই ক্বা'বা শরীফের দায়িত্ব শুধুমাত্র মুসলমানদের উপর অর্পিত হলো।
১২৮০। ক্বা'বা শরীফে তীর্থ যাত্রীদের আগমন মক্কার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হয়েছিলো ক্বা'বাকে মুশরিকদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, সেখানে লোকসমাগম হ্রাস পাবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেবে। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ মুসলমানদের আশ্বাস দিয়ে দরিদ্রতার ভয় পেতে নিষেধ করেছেন। মুসলমানদের বলা হয়েছে যে মুশরিকরা ক্ষয়িষ্ণু শক্তি; শেষ পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। মুসলমানরা পৃথিবীতে শক্তিশালী জাতি হিসাবে আবির্ভুত হবে। ফলে ক্বা'বা প্রাঙ্গনের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাময়িক মন্দা খুব শীঘ্রই তুল্য শক্তি সম্পন্ন বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হবে। আরও বলা হয়েছে যে, "আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাঁর নিজ অনুগ্রহ দ্বারা তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন।" অর্থাৎ আর্থিক সংগতির অন্যান্য সুবন্দোবস্ত করতে পারেন। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে আমরা দেখি, আরব থেকে মুশরিকরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা বৃহৎ শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হয়। এর ফলে ক্বা'বা শরীফে মুসলমান তীর্থযাত্রী বা হজ্জ্বযাত্রীর আগমন, মুশরিকদের সমবেত সংখ্যা অতিক্রম করে যায়। শুধু অতিক্রম বললে ভুল হবে, বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এখানেই আল্লাহ্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। এ ব্যতীত আজ এই বিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখি, সমগ্র আরব দেশ তেলের সমুদ্রে ভেসে আছে। তাদের অর্থের প্রাচুর্য্য, বিত্তের অহংকার পৃথিবীর অন্যান্য জাতির ঈর্ষার বস্তু। আজ থেকে একশত বৎসর পূর্বেও আরবদের এই প্রাচুর্য ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু আল্লাহ্ সবই জানতেন, তিনি "সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।"
২৯। যারা আল্লাহ্তেও ঈমান আনে না ও শেষ [বিচারের] দিনেও বিশ্বাস করে না, যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নিষিদ্ধ [ঘোষণা] করা হয়েছে, তা নিষিদ্ধ বলে গণ্য করে না, [যদিও তারা কিতাবধারী জাতি তবুও] তারা সত্য দ্বীনকে স্বীকার করে না; তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা স্ব-ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে জিজিয়া [কর] দেয় এবং নিজেদের পরাভূত মনে করে ১২৮১; ১২৮২।
১২৮১। "Jizya"- আরবী শব্দটির মূল অর্থ ক্ষতি পূরণ দান করা। মুসলিম সমাজে এই শব্দটি একটি করের পরিভাষারূপে ব্যবহার করা হয়। মুসলমান রাজ্যে বাস করে যারা ইসলাম গ্রহণে অনিচ্ছুক, কিন্তু মুসলমানদের দ্বারা সুরক্ষিত জীবন যাপন করতে চায়, তাদের জন্য এই কর ধার্য্য করা হয়। অর্থাৎ মুসলিম রাজ্যে অমুসলমানেরা যেন সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে সে কারণে মুসলমানেরা তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বভার নেবে, বিনিময়ে তারা কর প্রদান করবে। এই কর দান ছিল অমুসলমানদের পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেয়া যে, তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে মুসলমানরা সহ্য করবে, কিন্তু বিনিময়ে তারা ইসলামের অগ্রগতি ও সংহতিতে কোন বাঁধার সৃষ্টি করবে না। অমুসলমানদের উপরে ধার্য এই করকে ধরা যায় তাদেরকে দেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া - কর দানের পরিবর্তে। জিজিয়া করের কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ কোরআন শরীফে ধার্য্য করা হয় নাই। ঈমান শাফিঈ মনে করেন যে, বৎসরে এর পরিমাণ হবে এক দিনার। অবশ্যই এই দিনার হবে আরবের স্বর্ণমুদ্রা। ট্যাক্স বা করের পরিমাণের তারতম্য হতে পারে। গরীব লোক, স্ত্রীলোক এবং শিশু, ক্রীতদাস, সাধু সন্ন্যাসীদের ক্ষেত্রে কর রহিত হতে পারে [আবু হানিফার মত অনুযায়ী]। প্রতীয়মান হয় যে, অমুসলমান যুবকদের দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে এই করের পরিবর্তে রেহাই দান করা হয় [পরবর্তী টীকাতে দেখুন]।
১২৮২। "An Yadin" - আরবী শব্দটির পরিভাষা হওয়া উচিৎ "হাত থেকে"। কিন্তু শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এখানে "হাত" শব্দটিকে ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। (মাওলানা ইউসুফ আলী সাহেব) ইংরেজীতে শব্দটিকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে - "In token of willing submission" বাংলা অনুবাদ হয়েছে, "তারা আত্মসমর্পণ করে।" অর্থাৎ জিজিয়া শব্দটিকে অমুসলমানদের দেশের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব থেকে রেহাই দেয়ার বিনিময় হিসাবে বিবেচনা করা যায়। যেহেতু বাৎসরিক করের পরিমাণ অতি সামান্য, এবং এই কর থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে অসংখ্য অমুসলিমকে, সুতরাং একে আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে এবং দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে রেহাই দেয়ার প্রতীক হিসেবে ধরা অধিক যুক্তিযুক্ত। [পূর্ববর্তী টীকাতে দেখুন]।
রুকু - ৫
১২৮৩। সূরা ৫ এর ১৮ নং আয়াতে এবং এর টীকাতে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তাওরাত থেকে উদ্বৃতি দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, ইহুদীরা কত সহজভাবে " আল্লাহ্র পুত্র" কথাটি ব্যবহার করে। উযাইর [Ezra] শব্দটি ইহুদী সম্প্রদায়ের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। অপরপক্ষে খ্রীস্টানেরা যীশু খ্রীষ্টকে " আল্লাহ্র পুত্র" বলে ডাকে।
১২৮৪। আল্লাহ্র রাসূলকে " আল্লাহ্র পুত্র" সম্বোধন করা কোন নতুন কিছু নয়। সমস্ত পৌরাণিক কাহিনীতে এর বিস্তর উদাহরণ আছে। আল্লাহ্র সকল নবী/রাসূল পরিষ্কারভাবে নিজ অবস্থান ও অন্যান্য নবী রাসূলদের অবস্থান মানুষের নিকট বর্ণনা করেছেন। এর পরও পূর্ববর্তী যুগে যারা কুফরী করেছিল, তাদের মত ব্যবহার বা কথা আল্লাহ্কে অপমানেরই সামিল।
১২৮৫। দেখুন সূরা ৫, আয়াত ৭৫।
১২৮৬। "Ahbar" - এই আরবী শব্দটির অর্থ 'আইন বিশেষজ্ঞ, পুরোহিত, বিদ্বান ব্যক্তি'। সূরা ৫-এর ৪৪ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে সাধারণ লোক 'রাব্বী'কে ঐসব অর্থের সাথে সম্পৃক্ত করতো। "Ruhban" - অর্থ ভিক্ষু, কঠোর তপস্বী, সন্ন্যাসী, যারা সংসার ত্যাগ করেছে ইত্যাদি। এ শব্দটি সাধু সন্ন্যাসীদের বেলায় প্রয়োগ করে তাদেরকে দেবত্বে উন্নীত করা হয়। দেখা যায়, এইসব ব্যক্তির কাছে লোকেরা আত্মিক ও জাগতিক পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করে, যেমন দেখা যায়, রোমান ক্যাথলিক চার্চ-এ। মানুষকে দেবত্বের পর্যায়ে বা স্রষ্টার সমকক্ষ মনে করা ইসলামে নিষিদ্ধ। তবুও বাংলাদেশের লোকেরা দরগাহ্ শরীফ, ভন্ড পীরের দরবারে যায় ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য। এ কাজ শিরক - এরা "সত্যি বিমুখ"।
১২৮৭। যুগে যুগে মানুষের প্রবণতা হচ্ছে সাধু, সন্ন্যাসী, পুরোহিত, ধর্মযাজক, সংসারত্যাগী ও কঠোর তপস্বীদের আল্লাহ্র পরিবর্তে রক্ষকরূপে কল্পনা করে তার পূজা করা। বাংলাদেশেও বর্তমানে মাজারে মানত ও পীরের দরবারে যাতায়াত এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। তালমুদের কাহিনীতে ইহুদীদের কুসংস্কার, এবং খ্রীস্টানদের ধর্মযাজক পোপের পূঁজা, এবং খ্রীস্টান সন্ন্যাসীদের পূঁজা ঐ একই কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্র পরিবর্তে ধর্মযাজক বা পুরোহিত বা সন্ন্যাসী বা পীর বা মাজার পূজার একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করে তৃতীয় এক দলের অভ্যুত্থান, যারা দাবী করে তারা আল্লাহ্র বাণীর ধারক, বাহক ও রক্ষক এবং সরাসরি আল্লাহ্র আশীর্বাদপুষ্ট। একথা বলা বা বিশ্বাস করা আল্লাহ্কে অপমান করার সামিল। আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কাউকে অভিভাবক কল্পনা করা শুধুমাত্র আরব মুশরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, যুগে যুগে তা বিভিন্ন কিতাবধারী জাতির মধ্যেও প্রবেশ করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেরীকে দেবত্ব আরোপ ও পূঁজা করা যা আজো সভ্য জগতে বিরাজমান। পৃথিবীতে আজকে বহুলোক ধর্মের নামে আল্লাহ্র শরীক কল্পনা করে। বাংলাদেশী মুসলমান সমাজও এর বাইরে নয়।
১২৮৮। দেখুন [৬ : ১০০] আয়াত।
১২৮৯। "মুখের ফুৎকারে" - এর দু'রকম অর্থ : (১) প্রাচীনকালে যখন তেলের প্রদীপ ব্যবহার করা হতো, বা বর্তমানে যখন মোমবাতি জ্বালানো হয়, এটাকে নেভাবার সময় এক ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়া হয়। ঠিক সেভাবে মুশরিকরা আল্লাহ্র বাণীর যে আলো, তা নিভিয়ে দিতে চায়। কারণ, এ আলোর দীপ্তি তাদের নিকট অসহ্য। (২) অন্য অর্থ হচ্ছে তাদের জন্য যারা নিজেদেরকে আল্লাহ্র বাণীর ধারক, বাহক ও রক্ষকরূপে দাবী করে, কিন্তু বাস্তবে তারা আল্লাহ্র বাণীকে তাদের সুবিধামতে বিকৃত করে প্রচার করে। এটা করে তাদের মুখের সাহায্যে, একেই বলা হয়েছে "মুখের ফুৎকারে"। তাদের মনে একটাই উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হচ্ছে সত্যের আলোকে নির্বাপিত করে দেওয়া - কারণ তারা অন্ধকারের জীব, তাদের আত্মা অন্ধকারে নিমজ্জিত। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর আলোকে নির্বাপিত হতে দেবেন না। অর্থাৎ যারা সত্যের অনুসারী, তাদের চোখে আল্লাহ্র জ্যোতি উজ্জ্বলভাবে ভাস্বর করাবেন। আল্লাহ্র জ্যোতি স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং তা সত্যাদর্শীদের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করবে এবং তাদের অন্তরে "পূর্ণ উদ্ভাসন ব্যতীত অন্য কিছু" হবে না।
১২৯০। ধর্ম একটাই, আর তা হচ্ছে "ইসলাম" বা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। যুগে যুগে বিভিন্ন নবী ও রাসূলগণ এই বাণী-ই প্রচার করেছেন। হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত ইব্রাহীম, হযরত মুসা, হযরত ঈসা, এই এক ধর্মই প্রচার করেছেন, আর তা হচ্ছে " আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ" বা ইসলাম। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসব ধর্ম থেকে সত্যের আলো হারিয়ে যায়, এর পরেও সত্যের ফুলকী এসব ধর্মেও খুঁজে পাওয়া যায়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে আল্লাহ্র বাণীর পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ রূপে। সত্যের জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ঘটে এই ইসলামে। উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি যেরূপ নিষ্প্রভ আলোকে ঢেকে দেয়, যেমন বিদ্যুতের আলোর উপস্থিতি প্রদীপের আলোকে ঢেকে দেয়। ঠিক সেরূপ ইসলামের আলোর পূর্ণাঙ্গ জ্যোতি অন্যান্য ধর্মের আংশিক সত্যের জ্যোতিকে নিষ্প্রভ করে দেবে। এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে "অপর সমস্ত দ্বীনের উপরে জয়যুক্ত" কথাটি দ্বারা।
১২৯১। "Bil-batili" - ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে In falsehoood, বাংলায় অনুবাদ হয়েছে "অন্যায়ভাবে"। মধ্যযুগের ইউরোপের ধর্মযাজকদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করে যে, ধর্মের নামে এসব ধর্মযাজকেরা সাধারণ মানুষের সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করতো। ধর্মের নামে এই অন্যায় আচরণ পৃথিবীতে সর্বযুগে সর্বস্থানে সংঘটিত হয়েছে। এমনকি প্রাগৈতিহাসিক যুগে মিশরের ফেরাউনদের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মযাজকেরা ধর্মের দোহাই দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পার্থিব ক্ষমতা লাভের সোপানস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি মঠে বসবাসরত সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীরা - যারা পৃথিবীর সম্পদ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে বলে প্রতিজ্ঞা করতো, যদিও তারা ব্যক্তিগতভাবে কোনও সম্পদ গ্রহণ করতো না, কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠান ধর্মের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। ইউরোপের ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
১২৯২। অর্থ সম্পদ, বিষয় সম্পত্তি নিন্দার যোগ্য তিনটি কারণে : (১) যদি অন্যায়ভাবে অর্জন ও ভোগ করা হয়; (২) ধন সম্পদকে খরচ না করে পুঞ্ছিভূত করে রাখা হয়; (৩) এবং ধন সম্পদ আল্লাহ্র পথে, অর্থাৎ ভালো কাজে ব্যয় না করা হয়।
১২৯৩। স্বর্ণ ও রৌপ্য-কে এখানে ধন-সম্পদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ধন-সম্পদকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব দান করে। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, তাদের রক্ষিত ধন-সম্পদই হবে তাদের শাস্তির কারণ।
১২৯৪। "এটাই সেই [ধন-সম্পদ] যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জিভূত করতে।" - এই বাক্যটির মধ্যে সম্পূর্ণ আয়াতের নৈতিক উপদেশ নিহিত। উপদেশ হচ্ছে, "তোমরা যেসব অর্থ-সম্পদের অপব্যবহার করেছো, তা দ্বারা কি তোমরা তোমাদের আত্মার মুক্তি কামনা করো ? সাবধান, তা তোমাদের শাস্তির পরিমাণই বরং বাড়িয়ে দেবে।"
১২৯৫। এই আয়াতটি পরবর্তী আয়াতের সাথে সংযুক্ত করে পড়তে হবে। এখানে মুশরিক আরবদের অসংলগ্ন ও স্বার্থপর আচরণের নিন্দা করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই রাসূল (সাঃ)-এর আগমনের পূর্ব থেকেই আরবে নিয়ম প্রচলিত ছিল যে বার মাসের মধ্যে চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ। এই চারটি মাস ছিল - জ্বিলক্কদ, জ্বিলহজ্জ্ব, মুহররম ও রজব। প্রাচীন যুগ থেকেই এটা ছিল আল্লাহ্র বিধান। আরব মুশরিকরা নিজেদের সুবিধামতো, স্বার্থের খাতিরে যুদ্ধের প্রয়োজনে হারাম মাসকে হালাল মাস ঘোষণা করতো, যেমন এই বৎসর সফর মাস মুহররম মাসের পূর্বে আসবে ইত্যাদি। অর্থাৎ তারা তাদের সুবিধামতো নিষিদ্ধ মাসের পূর্বে ও পরে অন্যান্য মাসকে যোগ বিয়োগ করতো, যেন তারা তাদের যুদ্ধ বা শত্রুর বিরুদ্ধে অন্যায় সুবিধালাভ করতে পারে। যদি মনে করে তাদের সুবিধা হবে, তবে তারা নিষিদ্ধ মাসকে ভবিষ্যতের জন্য মূলতবী রাখতো। ফলে নিষিদ্ধ মাসটি সাধারণ অন্যান্য মাস হিসেবে পরিগণিত হতো। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় তাদের শত্রুরা নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে ইতস্তত করতো এবং সে সুযোগ মুশরিকরা পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করতো। আল্লাহ্ চারটি মাসকে (যুদ্ধ-বিগ্রহ) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন - মানবকূলের কল্যাণের জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য। আরব মুশরিকদের এই কার্যকলাপের জন্য নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা নষ্ট হতো এবং অনেক সময়ে হজ্জ্ব বা তীর্থযাত্রার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতো। নিষিদ্ধ মাসের লঙ্ঘনকে এই আয়াতে নিন্দা করা হয়েছে। ইসলামিক মাসগুলো হচ্ছে চান্দ্রমাস - ইসলাম পূর্ব আরবের চান্দ্রমাস, চান্দ্র-সৌর মাসরূপে অভিহিত করা যায়। যেমন বাংলা মাসগুলি ভারতে প্রচলিত। সে সময়ে চান্দ্র মাসকে প্রতি তিন বছর অন্তর সংশোধন করে সৌর মাসের সাথে সমন্বয় বিধান করা হতো। বিদায় হজ্জ্বের সময় [৮ই হিজরী] থেকে ইসলামী মাসকে চান্দ্র মাসের সাথে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। পূর্বে প্রতি তিন বছর অন্তর যে সংশোধন করা হতো, তা আর করা হবে না। অর্থাৎ চান্দ্র বৎসর গণনা করা হবে ৩৫৪ দিনে। প্রতিটি মাসকে গণনা করা হবে চাঁদের উদয়ের প্রথম দিন থেকে। বিদায় হজ্জ্বের পর থেকে চান্দ্র বৎসর সৌর-বৎসর থেকে প্রতি বৎসর ১১ দিন এগিয়ে শুরু হয়। এ কারণে ইসলামিক মাস বা চান্দ্র মাস চক্রাকারে সৌর-মাসকে অতিক্রম করে।
১২৯৬। অনেক সময়ে মুশরিকরা মুসলমানদের আক্রমণ করলেও সেটা নিষিদ্ধ মাস হলে - আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করা হবে এই ভয়ে - মুসলমানেরা ইতস্ততঃ করতো। এক্ষেত্রে মুসলমানদের ইতস্ততঃ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যদি আরব মুশরিকরা নিষিদ্ধ মাসে আক্রমণ করে তবে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করা মুসলমানদের জন্য বৈধ। তবে আত্মসংযমই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
[উপদেশ : ধর্মীয় সকল বিধি-বিধানই মানুষের কল্যাণের জন্য। উপরের আয়াতের উপদেশ হচ্ছে আত্মরক্ষার জন্য আল্লাহ্ তাঁর বিধানকে লঙ্ঘনের সুযোগ দেন। তবে আত্মসংযমই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। - অনুবাদক।]
১২৯৭। যুগ যুগ ধরে পালিত প্রথা ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সুযোগ লাভ করাই ছিল নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা লঙ্ঘনে মুশরিকদের একমাত্র উদ্দেশ্য। যুগে যুগে মুনাফিক ও মুশরিকরা বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের আন্তরিকতার সুযোগ এভাবেই গ্রহণ করে থাকে। তারা তাদের মনগড়া মতবাদ সুবিধা মত প্রচারে আগ্রহী হয়ে থাকে। এর ফলে সমাজ জীবনে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। কারণ, বিভিন্ন প্রথা ও ধর্মীয় বিধান শুধু যে অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধাবস্থাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম তা-ই নয়, তারা মানুষের আইনকে মানার প্রবণতাকেও বৃদ্ধি করে থাকে। সাধারণ মানুষ আইন মেনে চলতে চায়। কিন্তু যখন সে দেখে কিছু লোক প্রয়োজনে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে তা পরিবর্তন করে শুধুমাত্র সাময়িক লাভের জন্য, তখন তা সংক্রামক ব্যাধির মত সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তার লাভ করে এবং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে।
১২৯৮। দেখুন আয়াত [৬ : ১২২]। "মন্দ কাজগুলি তাদের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে।" এই বাক্যটি অত্যন্ত অর্থবোধক। সাধারণ মানুষ সে সমাজে থাকতে ভালবাসে যে সমাজে আইনের শাসন প্রচলিত। কিন্তু কিছু লোক থাকে যারা আইনের শাসন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত লাভের জন্য এবং তা মনে করে বাহাদুরী। কারণ, তারা আর দশজনের মত আইন মেনে চলে দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না। তারা নিজ প্রয়োজনে আইনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম - এই বোধ তাদের আত্মতৃপ্তি দেয়। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, যারা আইন ভঙ্গকারী, তাদের "মন্দ কাজগুলি তাদের চোখে মনোহর করা হবে।" তারা তা নিয়ে গর্ববোধ করবে, কারণ তারা কাফের সমতুল্য। তাদের আল্লাহ্ সৎ পথে হেদায়েত করবেন না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
৩০। ইহুদীরা 'উযাইর'কে আল্লাহ্র পুত্র বলে ডাকে এবং খৃষ্টানরা মসীহকে আল্লাহ্র পুত্র বলে ডাকে। এটা তাদের মুখের কথা ১২৮৩ এর দ্বারা তারা পূর্ববর্তী অবিশ্বাসীরা যা বলতো তার অনুকরণ করে মাত্র ১২৮৪। তাদের উপর আল্লাহ্র অভিশম্পাত [পতিত হোক]। কিভাবে তারা সত্য থেকে বিভ্রান্ত হয়ে ফিরে যায় ? ১২৮৫।
১২৮৩। সূরা ৫ এর ১৮ নং আয়াতে এবং এর টীকাতে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তাওরাত থেকে উদ্বৃতি দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, ইহুদীরা কত সহজভাবে " আল্লাহ্র পুত্র" কথাটি ব্যবহার করে। উযাইর [Ezra] শব্দটি ইহুদী সম্প্রদায়ের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। অপরপক্ষে খ্রীস্টানেরা যীশু খ্রীষ্টকে " আল্লাহ্র পুত্র" বলে ডাকে।
১২৮৪। আল্লাহ্র রাসূলকে " আল্লাহ্র পুত্র" সম্বোধন করা কোন নতুন কিছু নয়। সমস্ত পৌরাণিক কাহিনীতে এর বিস্তর উদাহরণ আছে। আল্লাহ্র সকল নবী/রাসূল পরিষ্কারভাবে নিজ অবস্থান ও অন্যান্য নবী রাসূলদের অবস্থান মানুষের নিকট বর্ণনা করেছেন। এর পরও পূর্ববর্তী যুগে যারা কুফরী করেছিল, তাদের মত ব্যবহার বা কথা আল্লাহ্কে অপমানেরই সামিল।
১২৮৫। দেখুন সূরা ৫, আয়াত ৭৫।
৩১। তারা আল্লাহ্কে খর্ব করে পুরোহিত ১২৮৬ ও সন্ন্যাসীদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে ১২৮৭, এবং মরিয়ম তনয় মসীহ্কেও [তাদের প্রভূরূপে গ্রহণ করেছে]। যদিও তাদেরকে এ যাবৎ এক আল্লাহ্র উপাসনা করতে বলা হয়েছিলো। তিনি ব্যতীত অন্য কোনও উপাস্য নাই। তাঁর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা কর। [আল্লাহ্র সাথে] যে অংশীদারিত্ব তারা আরোপ করে তিনি তার থেকে [বহু উর্ধ্বে] ১২৮৮।
১২৮৬। "Ahbar" - এই আরবী শব্দটির অর্থ 'আইন বিশেষজ্ঞ, পুরোহিত, বিদ্বান ব্যক্তি'। সূরা ৫-এর ৪৪ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে সাধারণ লোক 'রাব্বী'কে ঐসব অর্থের সাথে সম্পৃক্ত করতো। "Ruhban" - অর্থ ভিক্ষু, কঠোর তপস্বী, সন্ন্যাসী, যারা সংসার ত্যাগ করেছে ইত্যাদি। এ শব্দটি সাধু সন্ন্যাসীদের বেলায় প্রয়োগ করে তাদেরকে দেবত্বে উন্নীত করা হয়। দেখা যায়, এইসব ব্যক্তির কাছে লোকেরা আত্মিক ও জাগতিক পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করে, যেমন দেখা যায়, রোমান ক্যাথলিক চার্চ-এ। মানুষকে দেবত্বের পর্যায়ে বা স্রষ্টার সমকক্ষ মনে করা ইসলামে নিষিদ্ধ। তবুও বাংলাদেশের লোকেরা দরগাহ্ শরীফ, ভন্ড পীরের দরবারে যায় ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য। এ কাজ শিরক - এরা "সত্যি বিমুখ"।
১২৮৭। যুগে যুগে মানুষের প্রবণতা হচ্ছে সাধু, সন্ন্যাসী, পুরোহিত, ধর্মযাজক, সংসারত্যাগী ও কঠোর তপস্বীদের আল্লাহ্র পরিবর্তে রক্ষকরূপে কল্পনা করে তার পূজা করা। বাংলাদেশেও বর্তমানে মাজারে মানত ও পীরের দরবারে যাতায়াত এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। তালমুদের কাহিনীতে ইহুদীদের কুসংস্কার, এবং খ্রীস্টানদের ধর্মযাজক পোপের পূঁজা, এবং খ্রীস্টান সন্ন্যাসীদের পূঁজা ঐ একই কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্র পরিবর্তে ধর্মযাজক বা পুরোহিত বা সন্ন্যাসী বা পীর বা মাজার পূজার একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করে তৃতীয় এক দলের অভ্যুত্থান, যারা দাবী করে তারা আল্লাহ্র বাণীর ধারক, বাহক ও রক্ষক এবং সরাসরি আল্লাহ্র আশীর্বাদপুষ্ট। একথা বলা বা বিশ্বাস করা আল্লাহ্কে অপমান করার সামিল। আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কাউকে অভিভাবক কল্পনা করা শুধুমাত্র আরব মুশরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, যুগে যুগে তা বিভিন্ন কিতাবধারী জাতির মধ্যেও প্রবেশ করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেরীকে দেবত্ব আরোপ ও পূঁজা করা যা আজো সভ্য জগতে বিরাজমান। পৃথিবীতে আজকে বহুলোক ধর্মের নামে আল্লাহ্র শরীক কল্পনা করে। বাংলাদেশী মুসলমান সমাজও এর বাইরে নয়।
১২৮৮। দেখুন [৬ : ১০০] আয়াত।
৩২। তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহ্র জ্যোতি নির্বাপিত করতে ব্যগ্র ১২৮৯। অবিশ্বাসীরা অপ্রীতিকর মনে করলেও, আল্লাহ্ তাঁর জ্যোতির পূর্ণতা ব্যতীত অন্য কিছু চান না।
১২৮৯। "মুখের ফুৎকারে" - এর দু'রকম অর্থ : (১) প্রাচীনকালে যখন তেলের প্রদীপ ব্যবহার করা হতো, বা বর্তমানে যখন মোমবাতি জ্বালানো হয়, এটাকে নেভাবার সময় এক ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়া হয়। ঠিক সেভাবে মুশরিকরা আল্লাহ্র বাণীর যে আলো, তা নিভিয়ে দিতে চায়। কারণ, এ আলোর দীপ্তি তাদের নিকট অসহ্য। (২) অন্য অর্থ হচ্ছে তাদের জন্য যারা নিজেদেরকে আল্লাহ্র বাণীর ধারক, বাহক ও রক্ষকরূপে দাবী করে, কিন্তু বাস্তবে তারা আল্লাহ্র বাণীকে তাদের সুবিধামতে বিকৃত করে প্রচার করে। এটা করে তাদের মুখের সাহায্যে, একেই বলা হয়েছে "মুখের ফুৎকারে"। তাদের মনে একটাই উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হচ্ছে সত্যের আলোকে নির্বাপিত করে দেওয়া - কারণ তারা অন্ধকারের জীব, তাদের আত্মা অন্ধকারে নিমজ্জিত। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর আলোকে নির্বাপিত হতে দেবেন না। অর্থাৎ যারা সত্যের অনুসারী, তাদের চোখে আল্লাহ্র জ্যোতি উজ্জ্বলভাবে ভাস্বর করাবেন। আল্লাহ্র জ্যোতি স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং তা সত্যাদর্শীদের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করবে এবং তাদের অন্তরে "পূর্ণ উদ্ভাসন ব্যতীত অন্য কিছু" হবে না।
৩৩। তিনিই পথ নির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহ রাসূল প্রেরণ করেছেন অপর সকল দ্বীনের উপর ব্যাপকভাবে জয় লাভ করার জন্য, যদিও মুশরিকেরা [তা] অপছন্দ করে ১২৯০।
১২৯০। ধর্ম একটাই, আর তা হচ্ছে "ইসলাম" বা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। যুগে যুগে বিভিন্ন নবী ও রাসূলগণ এই বাণী-ই প্রচার করেছেন। হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত ইব্রাহীম, হযরত মুসা, হযরত ঈসা, এই এক ধর্মই প্রচার করেছেন, আর তা হচ্ছে " আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ" বা ইসলাম। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসব ধর্ম থেকে সত্যের আলো হারিয়ে যায়, এর পরেও সত্যের ফুলকী এসব ধর্মেও খুঁজে পাওয়া যায়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে আল্লাহ্র বাণীর পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ রূপে। সত্যের জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ঘটে এই ইসলামে। উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি যেরূপ নিষ্প্রভ আলোকে ঢেকে দেয়, যেমন বিদ্যুতের আলোর উপস্থিতি প্রদীপের আলোকে ঢেকে দেয়। ঠিক সেরূপ ইসলামের আলোর পূর্ণাঙ্গ জ্যোতি অন্যান্য ধর্মের আংশিক সত্যের জ্যোতিকে নিষ্প্রভ করে দেবে। এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে "অপর সমস্ত দ্বীনের উপরে জয়যুক্ত" কথাটি দ্বারা।
৩৪। হে বিশ্বাসীগণ " ধর্মযাজক ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা অন্যায়ভাবে অন্যের ধন সাগ্রহে ভোগ করে থাকে এবং লোকদের আল্লাহ্র পথ থেকে নিবৃত্ত করে থাকে ১২৯১। এবং যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত রাখে এবং আল্লাহ্র রাস্তায় তা ব্যয় করে না, তাদেরকে মহাশাস্তির ঘোষণা দাও ১২৯২।
১২৯১। "Bil-batili" - ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে In falsehoood, বাংলায় অনুবাদ হয়েছে "অন্যায়ভাবে"। মধ্যযুগের ইউরোপের ধর্মযাজকদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করে যে, ধর্মের নামে এসব ধর্মযাজকেরা সাধারণ মানুষের সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করতো। ধর্মের নামে এই অন্যায় আচরণ পৃথিবীতে সর্বযুগে সর্বস্থানে সংঘটিত হয়েছে। এমনকি প্রাগৈতিহাসিক যুগে মিশরের ফেরাউনদের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মযাজকেরা ধর্মের দোহাই দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পার্থিব ক্ষমতা লাভের সোপানস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি মঠে বসবাসরত সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীরা - যারা পৃথিবীর সম্পদ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে বলে প্রতিজ্ঞা করতো, যদিও তারা ব্যক্তিগতভাবে কোনও সম্পদ গ্রহণ করতো না, কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠান ধর্মের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। ইউরোপের ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
১২৯২। অর্থ সম্পদ, বিষয় সম্পত্তি নিন্দার যোগ্য তিনটি কারণে : (১) যদি অন্যায়ভাবে অর্জন ও ভোগ করা হয়; (২) ধন সম্পদকে খরচ না করে পুঞ্ছিভূত করে রাখা হয়; (৩) এবং ধন সম্পদ আল্লাহ্র পথে, অর্থাৎ ভালো কাজে ব্যয় না করা হয়।
৩৫। সেদিন জাহান্নামের আগুনে উহাকে [সম্পদকে] উত্তপ্ত করা হবে এবং উহা দ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশে ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে ১২৯৩। "এই সেই [সম্পদ] যা তোমরা তোমাদের জন্য পুঞ্জিভূত করে রেখেছিলে ১২৯৪। সুতরাং যা [সম্পদ] তোমরা পুঞ্ছিভূত রেখেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর।"
১২৯৩। স্বর্ণ ও রৌপ্য-কে এখানে ধন-সম্পদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ধন-সম্পদকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব দান করে। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, তাদের রক্ষিত ধন-সম্পদই হবে তাদের শাস্তির কারণ।
১২৯৪। "এটাই সেই [ধন-সম্পদ] যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জিভূত করতে।" - এই বাক্যটির মধ্যে সম্পূর্ণ আয়াতের নৈতিক উপদেশ নিহিত। উপদেশ হচ্ছে, "তোমরা যেসব অর্থ-সম্পদের অপব্যবহার করেছো, তা দ্বারা কি তোমরা তোমাদের আত্মার মুক্তি কামনা করো ? সাবধান, তা তোমাদের শাস্তির পরিমাণই বরং বাড়িয়ে দেবে।"
৩৬। আল্লাহ্র দৃষ্টিতে [বছরে] মাসের সংখ্যা বার ১২৯৫। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই তিনি এই ব্যবস্থা বিন্যস্ত করেছেন। তার মধ্যে চারটি পবিত্র [মাস] এটাই সহজ বিধান। সুতরাং নিজেদের [আত্মার] প্রতি পাপ করো না ১২৯৬; এবং তারা যেমন তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে। কিন্তু জেনে রাখ যারা পূণ্যাত্মা আল্লাহ্ তাদের সংগে থাকেন।
১২৯৫। এই আয়াতটি পরবর্তী আয়াতের সাথে সংযুক্ত করে পড়তে হবে। এখানে মুশরিক আরবদের অসংলগ্ন ও স্বার্থপর আচরণের নিন্দা করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই রাসূল (সাঃ)-এর আগমনের পূর্ব থেকেই আরবে নিয়ম প্রচলিত ছিল যে বার মাসের মধ্যে চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ। এই চারটি মাস ছিল - জ্বিলক্কদ, জ্বিলহজ্জ্ব, মুহররম ও রজব। প্রাচীন যুগ থেকেই এটা ছিল আল্লাহ্র বিধান। আরব মুশরিকরা নিজেদের সুবিধামতো, স্বার্থের খাতিরে যুদ্ধের প্রয়োজনে হারাম মাসকে হালাল মাস ঘোষণা করতো, যেমন এই বৎসর সফর মাস মুহররম মাসের পূর্বে আসবে ইত্যাদি। অর্থাৎ তারা তাদের সুবিধামতো নিষিদ্ধ মাসের পূর্বে ও পরে অন্যান্য মাসকে যোগ বিয়োগ করতো, যেন তারা তাদের যুদ্ধ বা শত্রুর বিরুদ্ধে অন্যায় সুবিধালাভ করতে পারে। যদি মনে করে তাদের সুবিধা হবে, তবে তারা নিষিদ্ধ মাসকে ভবিষ্যতের জন্য মূলতবী রাখতো। ফলে নিষিদ্ধ মাসটি সাধারণ অন্যান্য মাস হিসেবে পরিগণিত হতো। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় তাদের শত্রুরা নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে ইতস্তত করতো এবং সে সুযোগ মুশরিকরা পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করতো। আল্লাহ্ চারটি মাসকে (যুদ্ধ-বিগ্রহ) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন - মানবকূলের কল্যাণের জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য। আরব মুশরিকদের এই কার্যকলাপের জন্য নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা নষ্ট হতো এবং অনেক সময়ে হজ্জ্ব বা তীর্থযাত্রার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতো। নিষিদ্ধ মাসের লঙ্ঘনকে এই আয়াতে নিন্দা করা হয়েছে। ইসলামিক মাসগুলো হচ্ছে চান্দ্রমাস - ইসলাম পূর্ব আরবের চান্দ্রমাস, চান্দ্র-সৌর মাসরূপে অভিহিত করা যায়। যেমন বাংলা মাসগুলি ভারতে প্রচলিত। সে সময়ে চান্দ্র মাসকে প্রতি তিন বছর অন্তর সংশোধন করে সৌর মাসের সাথে সমন্বয় বিধান করা হতো। বিদায় হজ্জ্বের সময় [৮ই হিজরী] থেকে ইসলামী মাসকে চান্দ্র মাসের সাথে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। পূর্বে প্রতি তিন বছর অন্তর যে সংশোধন করা হতো, তা আর করা হবে না। অর্থাৎ চান্দ্র বৎসর গণনা করা হবে ৩৫৪ দিনে। প্রতিটি মাসকে গণনা করা হবে চাঁদের উদয়ের প্রথম দিন থেকে। বিদায় হজ্জ্বের পর থেকে চান্দ্র বৎসর সৌর-বৎসর থেকে প্রতি বৎসর ১১ দিন এগিয়ে শুরু হয়। এ কারণে ইসলামিক মাস বা চান্দ্র মাস চক্রাকারে সৌর-মাসকে অতিক্রম করে।
১২৯৬। অনেক সময়ে মুশরিকরা মুসলমানদের আক্রমণ করলেও সেটা নিষিদ্ধ মাস হলে - আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করা হবে এই ভয়ে - মুসলমানেরা ইতস্ততঃ করতো। এক্ষেত্রে মুসলমানদের ইতস্ততঃ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যদি আরব মুশরিকরা নিষিদ্ধ মাসে আক্রমণ করে তবে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করা মুসলমানদের জন্য বৈধ। তবে আত্মসংযমই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
[উপদেশ : ধর্মীয় সকল বিধি-বিধানই মানুষের কল্যাণের জন্য। উপরের আয়াতের উপদেশ হচ্ছে আত্মরক্ষার জন্য আল্লাহ্ তাঁর বিধানকে লঙ্ঘনের সুযোগ দেন। তবে আত্মসংযমই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। - অনুবাদক।]
৩৭। [নিষিদ্ধ মাসের] স্থান বিনিময় করা হচ্ছে কুফরীর বা অবিশ্বাসের বৃদ্ধি করা ১২৯৭। অবিশ্বাসীরা এর দ্বারা বিপথে চালিত হয়। তারা উহাকে কোন বছর বৈধ [ঘোষণা] করে, কোন বছর অবৈধ [ঘোষণা] করে, যেনো আল্লাহ্ কর্তৃক নিষিদ্ধ মাসগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে বৈধ করতে পারে। তাদের মন্দ কাজগুলি তাদের দৃষ্টিতে মনোরম করা হয়েছে ১২৯৮। যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ্ তাদের সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।
১২৯৭। যুগ যুগ ধরে পালিত প্রথা ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সুযোগ লাভ করাই ছিল নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা লঙ্ঘনে মুশরিকদের একমাত্র উদ্দেশ্য। যুগে যুগে মুনাফিক ও মুশরিকরা বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের আন্তরিকতার সুযোগ এভাবেই গ্রহণ করে থাকে। তারা তাদের মনগড়া মতবাদ সুবিধা মত প্রচারে আগ্রহী হয়ে থাকে। এর ফলে সমাজ জীবনে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। কারণ, বিভিন্ন প্রথা ও ধর্মীয় বিধান শুধু যে অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধাবস্থাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম তা-ই নয়, তারা মানুষের আইনকে মানার প্রবণতাকেও বৃদ্ধি করে থাকে। সাধারণ মানুষ আইন মেনে চলতে চায়। কিন্তু যখন সে দেখে কিছু লোক প্রয়োজনে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে তা পরিবর্তন করে শুধুমাত্র সাময়িক লাভের জন্য, তখন তা সংক্রামক ব্যাধির মত সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তার লাভ করে এবং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে।
১২৯৮। দেখুন আয়াত [৬ : ১২২]। "মন্দ কাজগুলি তাদের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে।" এই বাক্যটি অত্যন্ত অর্থবোধক। সাধারণ মানুষ সে সমাজে থাকতে ভালবাসে যে সমাজে আইনের শাসন প্রচলিত। কিন্তু কিছু লোক থাকে যারা আইনের শাসন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত লাভের জন্য এবং তা মনে করে বাহাদুরী। কারণ, তারা আর দশজনের মত আইন মেনে চলে দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না। তারা নিজ প্রয়োজনে আইনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম - এই বোধ তাদের আত্মতৃপ্তি দেয়। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, যারা আইন ভঙ্গকারী, তাদের "মন্দ কাজগুলি তাদের চোখে মনোহর করা হবে।" তারা তা নিয়ে গর্ববোধ করবে, কারণ তারা কাফের সমতুল্য। তাদের আল্লাহ্ সৎ পথে হেদায়েত করবেন না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
রুকু - ৬
১২৯৯। কুরআনের প্রতিটি আয়াতের অর্থ দ্বিবিধ। সমসাময়িক ঘটনার প্রেক্ষিতে যা নাজেল হয়েছে তারই প্রেক্ষিতে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সর্বযুগের ও কালের উপযোগী পৃথিবীর মানব সম্প্রদায়ের জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এই আয়াতের সাম্প্রতিক ঘটনা হচ্ছে তাবুকের যুদ্ধ [৯ই হিজরী]। দেখুন সূরাটির ভূমিকায়। কিন্তু এর উপদেশ হচ্ছে সর্বজনীন - যুগ-কাল অতিক্রান্ত। এই আয়াতে বলা হয়েছে, যখন মহত্তর ও বৃহত্তর কোন কাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন সেই ডাকে যারা সাড়া দেয়, সেই সুযোগ যারা গ্রহণ করে, তারাই ভাগ্যবান। যারা পার্থিব জীবনের ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে জীবনের সর্বসুখ খুঁজে পায়, তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তারা হতভাগ্য। তারা মহত্তর ও বৃহত্তর কাজের আহ্বানে সাড়া দিতে অক্ষম। কারণ সে ডাক শোনার মত মানসিকতা তাদের নাই। তারা বধিরের ন্যায়। মহত্তর জীবনের আবেদন তাদের কাছে পৌঁছায় না। কারণ তাদের আত্মা ব্যধিগ্রস্থ। " আল্লাহ্র পথে" কথাটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে নিজ স্বার্থের উর্ধ্বে মহত্তর কারণের জন্য সংগ্রামকে।
১৩০০। তাবুকের যুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্মুখে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় মহত্তর ও বৃহত্তর কারণের জন্য নবী (সাঃ)-কে অনুসরণ করে যুদ্ধে যোগদান করা, অথবা ক্ষুদ্র স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, পার্থিব লাভ লোকসানের জন্য যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা। তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইতস্ততঃ করার কারণ ছিল দুটো : (১) ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে সময়ে তাবুক অভিযানে বের হয়, তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। উত্তপ্ত সূর্যে মরুভূমির দাবদাহ প্রচণ্ড রূপ ধারণা করেছিলো। এই দাবদাহের ভয়ে অনেকেই তাবুক অভিযানে যেতে ইতস্ততঃ করেছিলেন। (২) সেটা ছিল ফসল তোলার সময়। সুপক্ক ফসল কিছুদিনের মধ্যেই ঘরে তোলা হবে। সুতরাং, যুদ্ধ অভিযানে গেলে, তারা আশংকা করেছিলো যে, হয়তো সেই ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই দুটো কারণই ছিল ক্ষুদ্র পার্থিব আরাম আয়েশ ও স্বার্থ সম্পর্কিত।
১৩০১। "Tanfiru" - শব্দটির অর্থ এগিয়ে যাওয়া, কুচকাওয়াজ করে অগ্রসর হওয়া, চেষ্টা করা ও কষ্ট করার জন্য প্রস্তুত থাকা। তাবুকের যুদ্ধের বর্ণনার মাধ্যমে কুরআনের এই আয়াতে মানুষের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও পার্থিব অগ্রগতির শর্তসমূহ বর্ণনা হয়েছে। জীবনের শিক্ষা হচ্ছে কোনও অগ্রগতিই প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম, কষ্ট স্বীকার করা ব্যতীত লাভ করা যায় না। ইংরেজীতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে, "God helps those, who help themselves"। কুরআনের সূরা [১৩ : ১১] আয়াতে আছে, "আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।"
পৃথিবীর পথ সংগ্রামময়। জীবন নৌকার বৈঠা এক মূহুর্তের জন্যও থামানো যায় না। মানুষকে পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়েছে সংগ্রামের জন্য [৯০ : ৪]। অলসতা ও কর্মবিমুখতা ধ্বংস ডেকে আনে। পৃথিবীর জীবন সংগ্রামে আদম সন্তানের আল্লাহ্র সাহায্য প্রয়োজন আছে, কিন্তু আল্লাহ্র আদম সন্তানের কাছে কোনও প্রয়োজন নাই। মানুষ আল্লাহ্কে ডাকে, ইবাদত করে তার নিজস্ব প্রয়োজনে। মানব সন্তানের আধ্যাত্মিক জীবন ও সংগ্রামী জীবনের সাফল্যের জন্যই আল্লাহ্র সাহায্য তার প্রয়োজন। তার এই ইবাদতে আল্লাহ্র কোনও প্রয়োজন নাই। যদি কোনও জাতি আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করে, তবে সে জাতির আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিৎ তাঁর নেয়ামতের যোগ্য হওয়ার জন্য। আল্লাহ্র নেয়ামতকে চেষ্টা ব্যতীত করায়ত্ব করা সম্ভব নয়। যদি কোনও জাতি আল্লাহ্র নেয়ামত পাওয়ার পরেও তার যোগ্য হওয়ার জন্য বা তার উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য সংগ্রাম না করে, তবে আল্লাহ্ এই আয়াতে বলেছেন, তাদের স্থলে নূতন জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করবেন। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের এই কথাই বলে। যুগে যুগে যখন কোনও জাতি আল্লাহ্র নেয়ামত পাওয়া সত্বেও আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে, তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এই আয়াতটি থেকে মুসলিম জাতির শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) সময়ে তাবুক অভিযানের কালে যে সাবধান বাণী আল্লাহ্ মুসলমানদের জন্য উচ্চারণ করেছেন, তা সর্বকালের, সর্বযুগের। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিম জাতিদের আল্লাহ্ প্রচুর নেয়ামত দান করেছেন [উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আরব দেশের মুসলমানরা], কিন্তু যদি তারা আল্লাহ্র এই নেয়ামতের যোগ্য ব্যবহারের জন্য সংগ্রাম না করে, তবে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। মুসলমান বলে তারা আল্লাহ্র রোষ থেকে রেহাই পাবে না। আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামের মাধ্যমে সাফল্যের জলন্ত উদাহরণ সর্বকালের সর্বযুগের জন্য আমাদের নবীর (সাঃ) জীবন ও তার সাফল্য।
১৩০২। যদিও অনেক মুসলিম তাবুক অভিযানে ইতস্ততঃ করেছিলো, কিন্তু তাবুক অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় নাই। মানুষের ক্ষমতায় কোনও বড় কাজে সাফল্য আসে না। আল্লাহ্র সাহায্য সকল বৃহৎ ও মহৎ কাজের সাফল্যের কারণ। তার জ্বলন্ত উদাহরণ রাসূল (সাঃ) এর জীবনের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন।
মক্কার কুরাইশরা যখন নবীর (সাঃ) জীবন নাশের জন্য ষড়যন্ত্র করে তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনাতে হিযরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কুরাইশদের বিভ্রান্ত করার জন্য হযরতের (সাঃ) বিছানায় হযরত আলীকে (রাঃ) রেখে রাসূল (সাঃ) শুধুমাত্র হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে রাতে মক্কা ত্যাগ করেন। কুরাইশরা প্রথমে রাসূল (সাঃ)-এর বিছানায় হযরত আলীর অস্তিত্ব অনুধাবণ করতে পারে নাই। তাদের ধারণা ছিল রাসূল (সাঃ) বিছানাতেই আছেন। সুতরাং, তারা নিশ্চিত ছিল যে রাসূল (সাঃ) মক্কা ত্যাগ করতে পারেন নাই। ইতোমধ্যে রাসূল (সাঃ) মক্কা ত্যাগ করে বহুদূর অতিক্রম করেন। কুরাইশরা যখন বুঝতে পারলো রাসূল (সাঃ) মক্কা ত্যাগ করেছেন, তখন তারা পাগলা কুকুরের ন্যায় রাসূল (সাঃ) এর পিছনে ধাওয়া করলো। রাসূল (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে সওর (Thaur) নামক পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করে থাকেন। মুশরিক কুরাইশরা পাগলের ন্যায় তাঁর অনুসন্ধান চালাতে লাগলো। তাদের উপস্থিতিতে সমস্ত পর্বত প্রকম্পিত হচ্ছিল। এ সময়ে হযরত আবু বকর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রাসূল (সাঃ) কে বলেন যে, "আমরা তো মাত্র দু'জন - ওরা তো সংখ্যায় অনেক।" রাসূল (সাঃ) উত্তর দিয়েছিলেন, "না, আমরা শুধু দু'জন নই, আমাদের সাথে আল্লাহ্ও আছেন।" আল্লাহ্র উপরে এই নির্ভরশীলতা তাঁদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে করেছিলো সুদৃঢ়। ফলে শত বিপদেও তাঁদের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট হয় নাই। আল্লাহ্-ই তাঁদের নিরাপত্তা দান করেন এবং তাঁরা অবশেষে নিরাপদে মদিনাতে পৌঁছান। এর পরেই শুরু হয় ইসলামের উজ্জ্বল অধ্যায়ের।
[উপদেশ : আল্লাহ্র সাহায্য চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর শক্তি অনুভব করা যায়। তাঁর শক্তি অপ্রতিরোধ্য। - অনুবাদক।]
১৩০৩। "একজন ব্যতীত তাঁর অন্য কোন সঙ্গী ছিলো না।" এই দ্বিতীয় জন ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ)। পরবর্তীতে "দ্বিতীয় জন" উপাধিতে তিনি ভূষিত হন।
১৩০৪। দেখুন [৯ : ২৬] আয়াত।
১৩০৫। ইসলামের শত্রুরা তাদের শক্তি ও ক্ষমতা সম্বন্ধে গর্ব করতো, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা নিজেদের জঘন্য ও হাস্যকর রূপে প্রমাণিত করলো।
১৩০৬। "হালকা অবস্থায় বা ভারী অবস্থায়" সজ্জিত। এখানে এই বাক্যটির দ্বারা লঘু রণসম্ভার ও গুরু রণসম্ভার বুঝানো হয়েছে। এই বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যদিও এর তাৎক্ষণিক শাব্দিক অর্থ আছে। এই আয়াতে যার যা সম্পদ আছে তা হালকাই হোক বা ভারীই হোক তাই নিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামের জন্য আহ্বান করা হয়েছে। হালকা অস্ত্র, ভারী অস্ত্র, পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে বা শকটে চড়ে, অর্থাৎ যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। অভিজ্ঞ লোক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকবে - যেনো তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে, অনভিজ্ঞ লোক তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্তব্যকর্মে নিয়োজিত থাকবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ক্ষমতা অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগীতা ও সংগ্রাম করবে। এমনকি যারা বৃদ্ধ এবং দুর্বল তারাও তাদের সাধ্য অনুযায়ী অর্থ ও সম্পদ দ্বারা এই সংগ্রামের অংশীদার হতে পারে। অর্থাৎ যে কোনও মহৎ কাজে সকলের সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য, সহযোগিতা ও সংগ্রামের হাত প্রসারিত করা উচিৎ।
১৩০৭। এই আয়াতে মুনাফিকদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। মুনাফিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যখন কোন কাজে বিপদের আশঙ্কা থাকে, তারা সেই বিপদজনক কাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এই বিরত থাকার জন্য তারা সুকৌশলে নিখুঁতভাবে কথার ধুম্রজালের সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে তাদের ওজর আপত্তি, কৌশল, অভিনয়, সবই সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়। তারা কোনও ব্যাপারে সামান্যতম ঝুঁকিও নিতে অপারগ। মুনাফিকদের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য সর্বযুগের এবং সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। এই আয়াতটি তাবুকের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়। যদি মুনাফিকরা জানতো যে যুদ্ধে গেলে যুদ্ধলব্ধ মাল লাভের সম্ভাবনা বেশি, এবং যুদ্ধে জয় লাভ করা খুবই সহজ ব্যাপার, তবে তারা অবশ্যই যুদ্ধে যোগদান করতো। জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে : ব্যক্তিগত লাভ ব্যতীত মুনাফিকরা কোন কাজেই, তা যত মহৎ বা প্রয়োজনীয় হোক না কেন, অগ্রসর হবে না। কিন্তু আল্লাহ্ আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন যে যারা শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ ব্যতীত অন্য কিছু দেখে না, যাদের চিন্তায় বা ধারণায় মহত্বর কিছুর জন্য সংগ্রাম করাকে নির্বুদ্ধিতার সামিল বলে মনে হবে, যারা শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ ও নিজের নিরাপত্তা ও লাভ-লোকসানের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে। তারা শুধু যে তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকেই (Spiritual life) ধ্বংস করে তা-ই নয়, তারা সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের জীবনও বিপন্ন করে তোলে। যদি শত্রুরা জয় লাভ করে, তবে সমাজের প্রতিটি নাগরিকই সমভাবে বিপন্ন হবে এবং দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে। তাবুকের যুদ্ধের উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্ সর্বযুগের মানব সম্প্রদায়ের জন্য মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। এই বৈশিষ্ট্য সে যুগেও যেমন বর্তমান ছিল, তেমনি আজও সমভাবে বর্তমান আছে।
৩৮। হে মুমিনগণ ! তোমাদের কি হয়েছে ১২৯৯, যখন তোমাদের আল্লাহ্র রাস্তায় [অভিযানে] বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা দৃঢ়ভাবে অনুরক্ত হয়ে থাক পৃথিবীর [জীবনে] ? তোমরা কি পরলোকের জীবনের পরিবর্তে পার্থিব জীবনকে অধিক পছন্দ কর ? কিন্তু পরলোকের জীবনের তুলনায় পার্থিব জীবনের আরাম - আয়েশ অকিঞ্চিতকর ১৩০০।
১২৯৯। কুরআনের প্রতিটি আয়াতের অর্থ দ্বিবিধ। সমসাময়িক ঘটনার প্রেক্ষিতে যা নাজেল হয়েছে তারই প্রেক্ষিতে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সর্বযুগের ও কালের উপযোগী পৃথিবীর মানব সম্প্রদায়ের জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এই আয়াতের সাম্প্রতিক ঘটনা হচ্ছে তাবুকের যুদ্ধ [৯ই হিজরী]। দেখুন সূরাটির ভূমিকায়। কিন্তু এর উপদেশ হচ্ছে সর্বজনীন - যুগ-কাল অতিক্রান্ত। এই আয়াতে বলা হয়েছে, যখন মহত্তর ও বৃহত্তর কোন কাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন সেই ডাকে যারা সাড়া দেয়, সেই সুযোগ যারা গ্রহণ করে, তারাই ভাগ্যবান। যারা পার্থিব জীবনের ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে জীবনের সর্বসুখ খুঁজে পায়, তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তারা হতভাগ্য। তারা মহত্তর ও বৃহত্তর কাজের আহ্বানে সাড়া দিতে অক্ষম। কারণ সে ডাক শোনার মত মানসিকতা তাদের নাই। তারা বধিরের ন্যায়। মহত্তর জীবনের আবেদন তাদের কাছে পৌঁছায় না। কারণ তাদের আত্মা ব্যধিগ্রস্থ। " আল্লাহ্র পথে" কথাটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে নিজ স্বার্থের উর্ধ্বে মহত্তর কারণের জন্য সংগ্রামকে।
১৩০০। তাবুকের যুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্মুখে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় মহত্তর ও বৃহত্তর কারণের জন্য নবী (সাঃ)-কে অনুসরণ করে যুদ্ধে যোগদান করা, অথবা ক্ষুদ্র স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, পার্থিব লাভ লোকসানের জন্য যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা। তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইতস্ততঃ করার কারণ ছিল দুটো : (১) ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে সময়ে তাবুক অভিযানে বের হয়, তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। উত্তপ্ত সূর্যে মরুভূমির দাবদাহ প্রচণ্ড রূপ ধারণা করেছিলো। এই দাবদাহের ভয়ে অনেকেই তাবুক অভিযানে যেতে ইতস্ততঃ করেছিলেন। (২) সেটা ছিল ফসল তোলার সময়। সুপক্ক ফসল কিছুদিনের মধ্যেই ঘরে তোলা হবে। সুতরাং, যুদ্ধ অভিযানে গেলে, তারা আশংকা করেছিলো যে, হয়তো সেই ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই দুটো কারণই ছিল ক্ষুদ্র পার্থিব আরাম আয়েশ ও স্বার্থ সম্পর্কিত।
৩৯। যদি তোমরা [অভিযানে] বের না হও, তিনি তোমাদের ভয়াবহ শাস্তি দেবেন এবং অপর [জাতিকে] তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। কিন্তু তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সকল বিষয়ের উপরে শক্তিমান ১৩০১।
১৩০১। "Tanfiru" - শব্দটির অর্থ এগিয়ে যাওয়া, কুচকাওয়াজ করে অগ্রসর হওয়া, চেষ্টা করা ও কষ্ট করার জন্য প্রস্তুত থাকা। তাবুকের যুদ্ধের বর্ণনার মাধ্যমে কুরআনের এই আয়াতে মানুষের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও পার্থিব অগ্রগতির শর্তসমূহ বর্ণনা হয়েছে। জীবনের শিক্ষা হচ্ছে কোনও অগ্রগতিই প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম, কষ্ট স্বীকার করা ব্যতীত লাভ করা যায় না। ইংরেজীতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে, "God helps those, who help themselves"। কুরআনের সূরা [১৩ : ১১] আয়াতে আছে, "আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।"
পৃথিবীর পথ সংগ্রামময়। জীবন নৌকার বৈঠা এক মূহুর্তের জন্যও থামানো যায় না। মানুষকে পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়েছে সংগ্রামের জন্য [৯০ : ৪]। অলসতা ও কর্মবিমুখতা ধ্বংস ডেকে আনে। পৃথিবীর জীবন সংগ্রামে আদম সন্তানের আল্লাহ্র সাহায্য প্রয়োজন আছে, কিন্তু আল্লাহ্র আদম সন্তানের কাছে কোনও প্রয়োজন নাই। মানুষ আল্লাহ্কে ডাকে, ইবাদত করে তার নিজস্ব প্রয়োজনে। মানব সন্তানের আধ্যাত্মিক জীবন ও সংগ্রামী জীবনের সাফল্যের জন্যই আল্লাহ্র সাহায্য তার প্রয়োজন। তার এই ইবাদতে আল্লাহ্র কোনও প্রয়োজন নাই। যদি কোনও জাতি আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করে, তবে সে জাতির আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিৎ তাঁর নেয়ামতের যোগ্য হওয়ার জন্য। আল্লাহ্র নেয়ামতকে চেষ্টা ব্যতীত করায়ত্ব করা সম্ভব নয়। যদি কোনও জাতি আল্লাহ্র নেয়ামত পাওয়ার পরেও তার যোগ্য হওয়ার জন্য বা তার উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য সংগ্রাম না করে, তবে আল্লাহ্ এই আয়াতে বলেছেন, তাদের স্থলে নূতন জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করবেন। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের এই কথাই বলে। যুগে যুগে যখন কোনও জাতি আল্লাহ্র নেয়ামত পাওয়া সত্বেও আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে, তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এই আয়াতটি থেকে মুসলিম জাতির শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) সময়ে তাবুক অভিযানের কালে যে সাবধান বাণী আল্লাহ্ মুসলমানদের জন্য উচ্চারণ করেছেন, তা সর্বকালের, সর্বযুগের। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিম জাতিদের আল্লাহ্ প্রচুর নেয়ামত দান করেছেন [উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আরব দেশের মুসলমানরা], কিন্তু যদি তারা আল্লাহ্র এই নেয়ামতের যোগ্য ব্যবহারের জন্য সংগ্রাম না করে, তবে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। মুসলমান বলে তারা আল্লাহ্র রোষ থেকে রেহাই পাবে না। আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামের মাধ্যমে সাফল্যের জলন্ত উদাহরণ সর্বকালের সর্বযুগের জন্য আমাদের নবীর (সাঃ) জীবন ও তার সাফল্য।
৪০। যদি তোমরা [তোমাদের নেতাকে] সাহায্য না কর, [তাতে কিছু যায় আসে না।] : যখন অবিশ্বাসীরা তাঁকে বহিঃষ্কার করেছিলো, আল্লাহ্ তাঁকে অবশ্যই সাহায্য করেছিলেন ১৩০২। একজন ব্যতীত তাঁর অন্য কোন সঙ্গী ছিলো না ১৩০৩। তারা দু'জনে গুহার মধ্যে ছিলো। সে তাঁর সঙ্গীকে বলেছিলো "ভয় পেয়ো না; আল্লাহ্ তো আমাদের সাথে আছেন।" অতঃপর আল্লাহ্ তাঁর প্রশান্তির ধারা তাঁর উপর বর্ষণ করেন ১৩০৪। এবং তাঁকে শক্তিশালী করেন সৈন্যবাহিনী [ফেরেশতা] দ্বারা যা তোমরা দেখ নাই এবং অবিশ্বাসীদের কথাকে হেয় [প্রতিপন্ন] করেন ১৩০৫। অপরপক্ষে আল্লাহ্র বাণী ছিলো সর্বোচ্চ। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।
১৩০২। যদিও অনেক মুসলিম তাবুক অভিযানে ইতস্ততঃ করেছিলো, কিন্তু তাবুক অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় নাই। মানুষের ক্ষমতায় কোনও বড় কাজে সাফল্য আসে না। আল্লাহ্র সাহায্য সকল বৃহৎ ও মহৎ কাজের সাফল্যের কারণ। তার জ্বলন্ত উদাহরণ রাসূল (সাঃ) এর জীবনের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন।
মক্কার কুরাইশরা যখন নবীর (সাঃ) জীবন নাশের জন্য ষড়যন্ত্র করে তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনাতে হিযরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কুরাইশদের বিভ্রান্ত করার জন্য হযরতের (সাঃ) বিছানায় হযরত আলীকে (রাঃ) রেখে রাসূল (সাঃ) শুধুমাত্র হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে রাতে মক্কা ত্যাগ করেন। কুরাইশরা প্রথমে রাসূল (সাঃ)-এর বিছানায় হযরত আলীর অস্তিত্ব অনুধাবণ করতে পারে নাই। তাদের ধারণা ছিল রাসূল (সাঃ) বিছানাতেই আছেন। সুতরাং, তারা নিশ্চিত ছিল যে রাসূল (সাঃ) মক্কা ত্যাগ করতে পারেন নাই। ইতোমধ্যে রাসূল (সাঃ) মক্কা ত্যাগ করে বহুদূর অতিক্রম করেন। কুরাইশরা যখন বুঝতে পারলো রাসূল (সাঃ) মক্কা ত্যাগ করেছেন, তখন তারা পাগলা কুকুরের ন্যায় রাসূল (সাঃ) এর পিছনে ধাওয়া করলো। রাসূল (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে সওর (Thaur) নামক পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করে থাকেন। মুশরিক কুরাইশরা পাগলের ন্যায় তাঁর অনুসন্ধান চালাতে লাগলো। তাদের উপস্থিতিতে সমস্ত পর্বত প্রকম্পিত হচ্ছিল। এ সময়ে হযরত আবু বকর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রাসূল (সাঃ) কে বলেন যে, "আমরা তো মাত্র দু'জন - ওরা তো সংখ্যায় অনেক।" রাসূল (সাঃ) উত্তর দিয়েছিলেন, "না, আমরা শুধু দু'জন নই, আমাদের সাথে আল্লাহ্ও আছেন।" আল্লাহ্র উপরে এই নির্ভরশীলতা তাঁদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে করেছিলো সুদৃঢ়। ফলে শত বিপদেও তাঁদের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট হয় নাই। আল্লাহ্-ই তাঁদের নিরাপত্তা দান করেন এবং তাঁরা অবশেষে নিরাপদে মদিনাতে পৌঁছান। এর পরেই শুরু হয় ইসলামের উজ্জ্বল অধ্যায়ের।
[উপদেশ : আল্লাহ্র সাহায্য চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর শক্তি অনুভব করা যায়। তাঁর শক্তি অপ্রতিরোধ্য। - অনুবাদক।]
১৩০৩। "একজন ব্যতীত তাঁর অন্য কোন সঙ্গী ছিলো না।" এই দ্বিতীয় জন ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ)। পরবর্তীতে "দ্বিতীয় জন" উপাধিতে তিনি ভূষিত হন।
১৩০৪। দেখুন [৯ : ২৬] আয়াত।
১৩০৫। ইসলামের শত্রুরা তাদের শক্তি ও ক্ষমতা সম্বন্ধে গর্ব করতো, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা নিজেদের জঘন্য ও হাস্যকর রূপে প্রমাণিত করলো।
৪১। [সমর সজ্জ্বা] হালকা অথবা ভারী [হোক] অভিযানে বের হও। আল্লাহ্র রাস্তায় তোমাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা সংগ্রাম কর ও কঠিন ভাবে চেষ্টা কর। এটাই তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো, যদি তোমরা তা জানতে ১৩০৬।
১৩০৬। "হালকা অবস্থায় বা ভারী অবস্থায়" সজ্জিত। এখানে এই বাক্যটির দ্বারা লঘু রণসম্ভার ও গুরু রণসম্ভার বুঝানো হয়েছে। এই বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যদিও এর তাৎক্ষণিক শাব্দিক অর্থ আছে। এই আয়াতে যার যা সম্পদ আছে তা হালকাই হোক বা ভারীই হোক তাই নিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামের জন্য আহ্বান করা হয়েছে। হালকা অস্ত্র, ভারী অস্ত্র, পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে বা শকটে চড়ে, অর্থাৎ যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। অভিজ্ঞ লোক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকবে - যেনো তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে, অনভিজ্ঞ লোক তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্তব্যকর্মে নিয়োজিত থাকবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ক্ষমতা অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগীতা ও সংগ্রাম করবে। এমনকি যারা বৃদ্ধ এবং দুর্বল তারাও তাদের সাধ্য অনুযায়ী অর্থ ও সম্পদ দ্বারা এই সংগ্রামের অংশীদার হতে পারে। অর্থাৎ যে কোনও মহৎ কাজে সকলের সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য, সহযোগিতা ও সংগ্রামের হাত প্রসারিত করা উচিৎ।
৪২। [তাদের দৃষ্টিতে] যদি তাৎক্ষণিক লাভের সম্ভাবনা থাকতো এবং যাত্রা পথ সহজ হতো, তবে তারা [সকলেই] নিঃসন্দেহে তোমার অনুসরণ করতো, কিন্তু তাদের নিকট [পথের] দূরত্ব অনেক সুদীর্ঘ [এবং কষ্টকর], মনে হয়। তারা অবশ্যই আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলবে, "যদি আমরা পারতাম, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে, বের হতাম।" [ফলে] তারা তাদের নিজেদের [আত্মাকেই] ধ্বংস করে ১৩০৭। আল্লাহ্ জানেন তারা অবশ্যই মিথ্যা বলে।
১৩০৭। এই আয়াতে মুনাফিকদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। মুনাফিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যখন কোন কাজে বিপদের আশঙ্কা থাকে, তারা সেই বিপদজনক কাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এই বিরত থাকার জন্য তারা সুকৌশলে নিখুঁতভাবে কথার ধুম্রজালের সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে তাদের ওজর আপত্তি, কৌশল, অভিনয়, সবই সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়। তারা কোনও ব্যাপারে সামান্যতম ঝুঁকিও নিতে অপারগ। মুনাফিকদের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য সর্বযুগের এবং সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। এই আয়াতটি তাবুকের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়। যদি মুনাফিকরা জানতো যে যুদ্ধে গেলে যুদ্ধলব্ধ মাল লাভের সম্ভাবনা বেশি, এবং যুদ্ধে জয় লাভ করা খুবই সহজ ব্যাপার, তবে তারা অবশ্যই যুদ্ধে যোগদান করতো। জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে : ব্যক্তিগত লাভ ব্যতীত মুনাফিকরা কোন কাজেই, তা যত মহৎ বা প্রয়োজনীয় হোক না কেন, অগ্রসর হবে না। কিন্তু আল্লাহ্ আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন যে যারা শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ ব্যতীত অন্য কিছু দেখে না, যাদের চিন্তায় বা ধারণায় মহত্বর কিছুর জন্য সংগ্রাম করাকে নির্বুদ্ধিতার সামিল বলে মনে হবে, যারা শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ ও নিজের নিরাপত্তা ও লাভ-লোকসানের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে। তারা শুধু যে তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকেই (Spiritual life) ধ্বংস করে তা-ই নয়, তারা সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের জীবনও বিপন্ন করে তোলে। যদি শত্রুরা জয় লাভ করে, তবে সমাজের প্রতিটি নাগরিকই সমভাবে বিপন্ন হবে এবং দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে। তাবুকের যুদ্ধের উদাহরণের মাধ্যমে আল্লাহ্ সর্বযুগের মানব সম্প্রদায়ের জন্য মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। এই বৈশিষ্ট্য সে যুগেও যেমন বর্তমান ছিল, তেমনি আজও সমভাবে বর্তমান আছে।
রুকু - ৭
তাবুকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মুনাফিকদের যুদ্ধ করা থেকে রেহাই দেন। সামরিক কৌশল এবং নীতির দিক থেকে তা ছিল বেশি নমনীয়। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নীতি ছিল একদিকে দয়া ও অপরদিকে সামরিক নীতির কৌশলের অবলম্বনের উপরে অবস্থিত। দয়া : কারণ তিনি মনে করতেন "জরুরী" অবস্থা কালে, সকলের জন্য যুদ্ধ অবশ্য করণীয় করে দিলে হয়তো বা যার সত্যিকারের যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি পাওয়া উচিত, তার প্রতি অন্যায় করা হবে। নীতি : এই জন্য যে, যদি কেউ স্ব-ইচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে, তবে তার পক্ষে বিপদের মুখে সাহসের সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। উপরন্তু সে যুদ্ধের অংশীদার সাহায্যকারী সৈনিক না হয়ে সকলের বোঝা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। তাবুকের যুদ্ধে সেনা সংখ্যার অভাব ছিল না। প্রায় ৩০ হাজারের বেশি লোক তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করে। সুতরাং, যারা অনিচ্ছুক তাদের নিয়ে দলভারী করে লাভ নাই। কারণ, তারা দলের জন্য শেষ পর্যন্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু তাই বলে যারা মুনাফিক ও যুদ্ধে না যাওয়ার পক্ষপাতি তাদের আচরণের ন্যায্যতা এ থেকে প্রতিপাদন করা যায় না। এই আয়াতে আল্লাহ্ সেই সব মুনাফিক ও যুদ্ধ ত্যাগকারীদের ধিক্কার দান করেছেন।
[উপদেশ : সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম ত্যাগকারী হচ্ছে আল্লাহ্র চোখে ঘৃণ্য ও ধিকৃত। - অনুবাদক।]
১৩১০। "Khilal" - এই আরবী শব্দটি বিভিন্নার্থক। কিন্তু মাওলানা ইউসুফ আলী জনাব রাগীবের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেছেন এবং অধিকাংশ তফসীরকারগণও তাঁকেই অনুসরণ করে "In your midst" বা "তোমাদের মধ্যে" বাক্যাংশটি ব্যবহার করেছেন।
১৩১১। যারা পাপী, যারা মন্দ কাজকে পছন্দ করে, তাদের সর্বদা চেষ্টা থাকে কোনও সৎ কাজকে বা ভালো কাজকে পণ্ড করে দেয়া। যদি তারা এই পণ্ড করে দেয়ার সুযোগটি ভিতর থেকে পায়, তবে তারা অত্যন্ত সুখী হয়। তারা বাইরের শত্রুদের সাথে একাত্ম হয়ে ষড়যন্ত্র করে, কিন্তু নিজ দলের ভিতর থেকে তাদেরই একজন হয়ে ষড়যন্ত্র কার্যকর করার পরিকল্পনা করে। মহত্বর উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য, সৎ কাজ করার জন্য, আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা কোনও রকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়, কোনও রকম আত্মত্যাগ করতে ইচ্ছুক নয়। তাদের কর্মপ্রণালীর ধারাই হচ্ছে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা, বিবাদ ও অমঙ্গলের সৃষ্টি করা। প্রতিটি জাতির মধ্যে, প্রতিটি সমাজেই এদের অস্তিত্ব বর্তমান। প্রাচীন যুগেও ছিল, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর যুগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। অর্থাৎ সর্বযুগে সর্বকালে এদের অস্তিত্ব বর্তমান। এ-ই হচ্ছে এই আয়াতের সতর্কবাণী। এদের সনাক্ত করে, এদের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকে, জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যিনি জাতীয় নেতা, তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সর্বোপরি আল্লাহ্র সাহায্য, যা আমাদের নবী (সাঃ)'র জীবনে ঘটেছিলো, সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় এসব ক্ষেত্রে। আল্লাহ্র সাহায্য ব্যতীত নেতার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, কিছুই প্রকৃত দূরদর্শিতায় রূপান্তরিত হতে পারে না।
১৩১২। "Fitnat" - এই আরবী শব্দটি সূরা [৮ : ২৫] আয়াতে আছে এবং টীকা ১১৯৮ নং টীকায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পরীক্ষা, প্রলোভন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিপর্যয় ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দ দ্বারা অনেকে এর ব্যাখ্যা করেছেন। এই আয়াতে তফসীরকারগণ ব্যাখ্যা করেছেন যে, মুনাফিকরা জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধকে ফিৎনা বা বিপর্যয় বলে উল্লেখ করেছে। তারা এই যুদ্ধ বা বিপর্যয় থেকে রেহাই চেয়েছে এই জন্য যে তারা যুদ্ধে গেলে সিরিয়ার সুন্দরী মহিলাদের আকর্ষণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং এ রকম ক্ষেত্রে তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে ঘরে থাকাই অধিক শ্রেয়। তাদের এই আবেদন ছিলো যুদ্ধের থেকে রেহাই পাবার ছল বা কৌশল মাত্র। এক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে : "তোমরা যা করছো বা বলছো তা হচ্ছে তোমরা আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে নিজেদের মিথ্যার প্রলোভনে আটকে গেছো।" তারা যুদ্ধের বিপর্যয় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চায়, কিন্তু তার থেকে বড় বিপর্যয় যা আত্মিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তারা। কারণ তারা এমন এক কুটিল আবেদন করেছে যা সত্যকে প্রতিহত করার ষড়যন্ত্র। এক্ষেত্রে তাদের আত্মিক অবনতি হতে বাধ্য। সুতরাং যারা জিহাদকে ফিৎনা কল্পনা করে তার থেকে অব্যাহতি চায়, তারা আত্মিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। "তারা কি ইতিপূর্বেই ফিতনাতে পড়ে নাই ?"- বাক্যাংশটি দ্বারা এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে। তাদেরকে জাহান্নামের আগুন বেষ্টন করে আছে।
[উপদেশ : যে কোন সৎ কাজ, মহৎ কাজ যা সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য নিবেদিত তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করা আল্লাহ্র হুকুম। যার যা সামর্থ্য সে তাই দিয়ে সাহায্য করবে। যদি কেউ তা না করে, তবে আল্লাহ্র হুকুমে তার মানসিক ও আত্মিক বিপর্যয় অবশ্যাম্ভাবী। - অনুবাদক।]
১৩১৩। "তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমরাও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।" মু'মিন বান্দাদের প্রতীক্ষা এবং কাফের ও মুনাফিকদের প্রতীক্ষা দু'টি দুই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কাফের মুনাফিকরা প্রতীক্ষা করে মু'মিন বা বিশ্বাসীদের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করার জন্য, অপরপক্ষে মু'মিন বান্দারা প্রতীক্ষা করে অবিশ্বাসী ও কাফেরদের উপরে জয় লাভ করে আল্লাহ্র দ্বীনকে প্রতিষ্টা করার লক্ষ্যে, অথবা যুদ্ধে মৃত্যুকে বরণ করে শাহাদাৎ লাভের আকাঙ্ক্ষায়। মু'মিন বান্দাদের যে কোনও "দু'টি মঙ্গলের একটির প্রতীক্ষা"র মধ্যেই আছে আল্লাহ্র জন্য আত্মোৎসর্গের আনন্দ। মু'মিন বান্দারা আশা করে মুনাফিকদের অবিশ্বস্ততার জন্য আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দেবেন। এই শাস্তি হবে তাদের কর্মফল - তাদের নিজ কর্মের প্রতিফলেই তাদের ধ্বংস ডেকে আনবে অথবা আল্লাহ্র পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, যা কাফের বা মুনাফিকরা পছন্দ করবে না। দেখুন সূরা ৬ আয়াত ১৫৮।
[উপদেশ : সর্বযুগে সর্বকালে যারা মুনাফিক বা কাফের তাদের ধ্বংস অনিবার্য তা ব্যক্তিগত হতে পারে বা জাতি হিসেবেও হতে পারে। - অনুবাদক।]
১৩১৪। মুনাফিকরা অধিকাংশ সময়ে তাদের অন্তরের ধ্যান ধারণাকে জনসমক্ষে প্রকাশ না করার জন্য ভনিতা বা ভানের আশ্রয় গ্রহণ করে। অনেক সময়ে দেখা যায়, কোন মহৎ কাজের জন্য যখন আপামর জনসাধারণ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, মুনাফিকরা সেই কাজের নীতিকে মনে মনে মেনে না নিলেও বাহ্যিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করে, এবং এই একাত্মতা প্রকাশের জন্য তারা সেই মহৎ কাজের আনুকুল্যে অর্থ সাহায্য করতেও কুণ্ঠিত হয় না। আসলে পুরো ব্যাপারটাই তাদের একটা ভনিতা বা ছলনা মাত্র। এই আয়াতে আল্লাহ্ এ ঘোষণা করেছেন যে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে ভাবেই তারা দান করুক না কেন, তাদের দান আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই দানের সাথে তাদের আত্মার যোগাযোগ নাই। আল্লাহ্ আমাদের অর্থ-সম্পদের মুখাপেক্ষী নন। তাঁর কাছে আমাদের আত্মার পবিত্রতা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা কাম্য। পরবর্তী আয়াতে তাদের প্রত্যাখানের কারণসমূহ নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে : (১) তারা আল্লাহ্র অনুগত বা বিশ্বাসী নয়; (২) তাদের প্রার্থনাও আন্তরিক নয়; তারা লোকসমক্ষে নিজেকে মু'মিন বান্দারূপে প্রমাণের জন্য, লোক দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে। এই নামাজের সাথে তাদের অন্তরের যোগাযোগ নাই; ফলে তাদের নামাজে বা প্রার্থনায় আল্লাহ্র কাছে আত্মিক নিবেদন বা ভক্তি প্রকাশ পায় না। (৩) তারা সৎ কাজে আল্লাহ্র রাস্তায় যে দান করে তার পিছনে তাদের কোনও আন্তরিকতা থাকে না বা তারা সেই কারণকে বিশ্বাসও করে না। যে কোনও কাজ তা দানই হোক বা প্রার্থনাই হোক; তা যদি আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা, ভয়, বা তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য বান্দার হৃদয় থেকে উৎসারিত না হয়, তবে আল্লাহ্র কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
৪৩। আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করেছেন ১৩০৮। কারা সত্য বলেছে তা তোমার নিকট স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এবং কারা মিথ্যাবাদী তা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কেন তাদের অব্যহতি দিলে ?
১৩০৮। "আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করেছেন।" - এ বাক্যটির দ্বারা কেউ যেন এমন না বোঝেন যে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) দোষ করেছিলেন এবং আল্লাহ্ তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমাদের রাসূল (সাঃ) এর দোষ করার প্রশ্ন এখানে আসতে পারে না। হযরত ঈমাম রাজীর মতে, এই লাইনটি শুধুমাত্র একটা ভাবের প্রকাশ বই আর কিছু নয়। যেমন- ইংরেজীতে বলে,"God bless you" বা "God save you" বা "আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন" বা "আল্লাহ্ তোমাকে রক্ষা করুন"। যদিও সেখানে কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই, তবুও আমরা এই ভাষা ব্যবহার করি আল্লাহ্র করুণা, কৃপা ও দয়ার ভাবকে প্রকাশ করার জন্য। একই বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে সূরা [৩ : ১৫২] আয়াতে। এখানে ক্ষমা শব্দটি আল্লাহ্র কৃপা বা দয়ার সমার্থক হবে।তাবুকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মুনাফিকদের যুদ্ধ করা থেকে রেহাই দেন। সামরিক কৌশল এবং নীতির দিক থেকে তা ছিল বেশি নমনীয়। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নীতি ছিল একদিকে দয়া ও অপরদিকে সামরিক নীতির কৌশলের অবলম্বনের উপরে অবস্থিত। দয়া : কারণ তিনি মনে করতেন "জরুরী" অবস্থা কালে, সকলের জন্য যুদ্ধ অবশ্য করণীয় করে দিলে হয়তো বা যার সত্যিকারের যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি পাওয়া উচিত, তার প্রতি অন্যায় করা হবে। নীতি : এই জন্য যে, যদি কেউ স্ব-ইচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে, তবে তার পক্ষে বিপদের মুখে সাহসের সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। উপরন্তু সে যুদ্ধের অংশীদার সাহায্যকারী সৈনিক না হয়ে সকলের বোঝা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। তাবুকের যুদ্ধে সেনা সংখ্যার অভাব ছিল না। প্রায় ৩০ হাজারের বেশি লোক তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করে। সুতরাং, যারা অনিচ্ছুক তাদের নিয়ে দলভারী করে লাভ নাই। কারণ, তারা দলের জন্য শেষ পর্যন্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু তাই বলে যারা মুনাফিক ও যুদ্ধে না যাওয়ার পক্ষপাতি তাদের আচরণের ন্যায্যতা এ থেকে প্রতিপাদন করা যায় না। এই আয়াতে আল্লাহ্ সেই সব মুনাফিক ও যুদ্ধ ত্যাগকারীদের ধিক্কার দান করেছেন।
[উপদেশ : সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম ত্যাগকারী হচ্ছে আল্লাহ্র চোখে ঘৃণ্য ও ধিকৃত। - অনুবাদক।]
৪৪। যারা আল্লাহ্ এবং শেষ [বিচারের] দিনে বিশ্বাস করে, তারা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া থেকে অব্যহতি পাবার জন্য তোমার নিকট প্রার্থনা করে না। আল্লাহ্ ভালোভাবেই জানেন কারা কর্তব্য পরায়ণ।
৪৫। তোমার নিকট অব্যহতি প্রার্থনা করে তারাই যারা আল্লাহ্তে এবং শেষ [বিচারের] দিনে বিশ্বাস করে না এবং যাদের হৃদয় সন্দেহ প্রবণ। ফলে তারা তাদের সন্দেহে দ্বিধাগ্রস্থ থাকে ১৩০৯।
১৩০৯। সন্দেহ, শঙ্কা, দ্বিধা, চিত্তের প্রশান্তি নষ্ট করে দেয়, নষ্ট করে দেয় চরিত্রের দৃঢ়তা। অপরপক্ষে যারা বিশ্বাসে আন্তরিক ও দৃঢ় তাদের চরিত্রেও সে দৃঢ়তা প্রকাশ পায়। তারা যে কোন কাজে হয় ধীর, স্থির, শান্ত, সংযত ও মানসিকভাবে দৃঢ়।৪৫। তোমার নিকট অব্যহতি প্রার্থনা করে তারাই যারা আল্লাহ্তে এবং শেষ [বিচারের] দিনে বিশ্বাস করে না এবং যাদের হৃদয় সন্দেহ প্রবণ। ফলে তারা তাদের সন্দেহে দ্বিধাগ্রস্থ থাকে ১৩০৯।
৪৬। যদি তাদের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকতো, তবে তারা অবশ্যই তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতো। কিন্তু উহাদের অভিযাত্রা আল্লাহ্র মনঃপূত ছিলো না। সুতরাং তিনি তাদের পশ্চাতে ফেলে রাখেন এবং তাদের বলা হয়, "যারা [অকর্মণ্যভাবে] বসে আছে তাদের সাথে বসে থাক।"
৪৭। যদি তারা তোমার সাথে বের হতো, তারা তোমার [শক্তি] বৃদ্ধি করতো না বরং কেবলমাত্র বিশৃঙ্খলাই [সৃষ্টি] করতো, তোমাদের মধ্যে সামনে পিছনে দৌড়াদৌড়ি করতো ১৩১০। এবং তোমাদের মাঝে গণবিক্ষোভের বীজ বপন করতো। তোমাদের মাঝে কিছু লোক আছে যারা তাদের কথা শুনতো। কিন্তু আল্লাহ্ ভালোভাবেই জানেন তাদের, যারা পাপ করে।
৪৭। যদি তারা তোমার সাথে বের হতো, তারা তোমার [শক্তি] বৃদ্ধি করতো না বরং কেবলমাত্র বিশৃঙ্খলাই [সৃষ্টি] করতো, তোমাদের মধ্যে সামনে পিছনে দৌড়াদৌড়ি করতো ১৩১০। এবং তোমাদের মাঝে গণবিক্ষোভের বীজ বপন করতো। তোমাদের মাঝে কিছু লোক আছে যারা তাদের কথা শুনতো। কিন্তু আল্লাহ্ ভালোভাবেই জানেন তাদের, যারা পাপ করে।
১৩১০। "Khilal" - এই আরবী শব্দটি বিভিন্নার্থক। কিন্তু মাওলানা ইউসুফ আলী জনাব রাগীবের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেছেন এবং অধিকাংশ তফসীরকারগণও তাঁকেই অনুসরণ করে "In your midst" বা "তোমাদের মধ্যে" বাক্যাংশটি ব্যবহার করেছেন।
৪৮। প্রকৃত পক্ষে পূর্বেও তারা গণবিক্ষোভের চক্রান্ত করেছিলো এবং তোমার জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলো - যে পর্যন্ত না সত্যের আগমন ঘটলো, এবং তাদের নিদারুণ বিরাগ সত্বেও আল্লাহ্র বিধানের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটলো ১৩১১।
১৩১১। যারা পাপী, যারা মন্দ কাজকে পছন্দ করে, তাদের সর্বদা চেষ্টা থাকে কোনও সৎ কাজকে বা ভালো কাজকে পণ্ড করে দেয়া। যদি তারা এই পণ্ড করে দেয়ার সুযোগটি ভিতর থেকে পায়, তবে তারা অত্যন্ত সুখী হয়। তারা বাইরের শত্রুদের সাথে একাত্ম হয়ে ষড়যন্ত্র করে, কিন্তু নিজ দলের ভিতর থেকে তাদেরই একজন হয়ে ষড়যন্ত্র কার্যকর করার পরিকল্পনা করে। মহত্বর উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য, সৎ কাজ করার জন্য, আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা কোনও রকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়, কোনও রকম আত্মত্যাগ করতে ইচ্ছুক নয়। তাদের কর্মপ্রণালীর ধারাই হচ্ছে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা, বিবাদ ও অমঙ্গলের সৃষ্টি করা। প্রতিটি জাতির মধ্যে, প্রতিটি সমাজেই এদের অস্তিত্ব বর্তমান। প্রাচীন যুগেও ছিল, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর যুগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। অর্থাৎ সর্বযুগে সর্বকালে এদের অস্তিত্ব বর্তমান। এ-ই হচ্ছে এই আয়াতের সতর্কবাণী। এদের সনাক্ত করে, এদের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকে, জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যিনি জাতীয় নেতা, তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সর্বোপরি আল্লাহ্র সাহায্য, যা আমাদের নবী (সাঃ)'র জীবনে ঘটেছিলো, সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় এসব ক্ষেত্রে। আল্লাহ্র সাহায্য ব্যতীত নেতার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, কিছুই প্রকৃত দূরদর্শিতায় রূপান্তরিত হতে পারে না।
৪৯। তাদের মধ্যে [অনেক] লোক আছে যারা বলে, "আমাকে অব্যহতি দাও এবং আমাকে বিপর্যয়ের [ফিতনা] মধ্যে ফেলো না ১৩১২।" তারা কি ইতিপূর্বেই বিপর্যয়ে [ফিতনা] পড়ে নাই ? প্রকৃত পক্ষে অবিশ্বাসীদের জাহান্নাম [চতুর্দিক থেকে] বেষ্টন করে থাকে।
১৩১২। "Fitnat" - এই আরবী শব্দটি সূরা [৮ : ২৫] আয়াতে আছে এবং টীকা ১১৯৮ নং টীকায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পরীক্ষা, প্রলোভন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিপর্যয় ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দ দ্বারা অনেকে এর ব্যাখ্যা করেছেন। এই আয়াতে তফসীরকারগণ ব্যাখ্যা করেছেন যে, মুনাফিকরা জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধকে ফিৎনা বা বিপর্যয় বলে উল্লেখ করেছে। তারা এই যুদ্ধ বা বিপর্যয় থেকে রেহাই চেয়েছে এই জন্য যে তারা যুদ্ধে গেলে সিরিয়ার সুন্দরী মহিলাদের আকর্ষণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং এ রকম ক্ষেত্রে তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে ঘরে থাকাই অধিক শ্রেয়। তাদের এই আবেদন ছিলো যুদ্ধের থেকে রেহাই পাবার ছল বা কৌশল মাত্র। এক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে : "তোমরা যা করছো বা বলছো তা হচ্ছে তোমরা আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে নিজেদের মিথ্যার প্রলোভনে আটকে গেছো।" তারা যুদ্ধের বিপর্যয় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চায়, কিন্তু তার থেকে বড় বিপর্যয় যা আত্মিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তারা। কারণ তারা এমন এক কুটিল আবেদন করেছে যা সত্যকে প্রতিহত করার ষড়যন্ত্র। এক্ষেত্রে তাদের আত্মিক অবনতি হতে বাধ্য। সুতরাং যারা জিহাদকে ফিৎনা কল্পনা করে তার থেকে অব্যাহতি চায়, তারা আত্মিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। "তারা কি ইতিপূর্বেই ফিতনাতে পড়ে নাই ?"- বাক্যাংশটি দ্বারা এই ভাবকেই প্রকাশ করা হয়েছে। তাদেরকে জাহান্নামের আগুন বেষ্টন করে আছে।
[উপদেশ : যে কোন সৎ কাজ, মহৎ কাজ যা সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য নিবেদিত তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করা আল্লাহ্র হুকুম। যার যা সামর্থ্য সে তাই দিয়ে সাহায্য করবে। যদি কেউ তা না করে, তবে আল্লাহ্র হুকুমে তার মানসিক ও আত্মিক বিপর্যয় অবশ্যাম্ভাবী। - অনুবাদক।]
৫০। যদি তোমার কোন কল্যাণ হয়, তবে তা তাদের কষ্ট দেয়; কিন্তু যদি তোমার কোন দুর্ভাগ্য হয় তবে তারা বলে, "আমরা পূর্বেই আমাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম", এবং তারা আনন্দের সাথে ফিরে যায়।
৫১। বল, "আল্লাহ্ আমাদের জন্য যা নির্দিষ্ট করেছেন তা বতীত আমাদের অন্য কিছু হবে না। তিনি আমাদের রক্ষাকর্তা এবং বিশ্বাসীরা তার উপরেই তাদের আনুগত্য স্থাপন করুক।"
৫২। বল, [শহীদ হওয়া অথবা বিজয় গৌরব অর্জন] এ দুটির যে কোন একটি ব্যতীত অন্য কোন [নিয়তি] কি আমাদের জন্য আশা করতে পার ? কিন্তু আমরা তোমাদের জন্য আশা করি, হয় আল্লাহ্ সরাসরি তার পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন, অথবা আমাদের হস্ত দ্বারা [শাস্তি দেবেন]। সুতরাং [প্রত্যাশীরা] অপেক্ষা কর; আমরাও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করবো" ১৩১৩।
৫১। বল, "আল্লাহ্ আমাদের জন্য যা নির্দিষ্ট করেছেন তা বতীত আমাদের অন্য কিছু হবে না। তিনি আমাদের রক্ষাকর্তা এবং বিশ্বাসীরা তার উপরেই তাদের আনুগত্য স্থাপন করুক।"
৫২। বল, [শহীদ হওয়া অথবা বিজয় গৌরব অর্জন] এ দুটির যে কোন একটি ব্যতীত অন্য কোন [নিয়তি] কি আমাদের জন্য আশা করতে পার ? কিন্তু আমরা তোমাদের জন্য আশা করি, হয় আল্লাহ্ সরাসরি তার পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন, অথবা আমাদের হস্ত দ্বারা [শাস্তি দেবেন]। সুতরাং [প্রত্যাশীরা] অপেক্ষা কর; আমরাও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করবো" ১৩১৩।
১৩১৩। "তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমরাও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।" মু'মিন বান্দাদের প্রতীক্ষা এবং কাফের ও মুনাফিকদের প্রতীক্ষা দু'টি দুই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কাফের মুনাফিকরা প্রতীক্ষা করে মু'মিন বা বিশ্বাসীদের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করার জন্য, অপরপক্ষে মু'মিন বান্দারা প্রতীক্ষা করে অবিশ্বাসী ও কাফেরদের উপরে জয় লাভ করে আল্লাহ্র দ্বীনকে প্রতিষ্টা করার লক্ষ্যে, অথবা যুদ্ধে মৃত্যুকে বরণ করে শাহাদাৎ লাভের আকাঙ্ক্ষায়। মু'মিন বান্দাদের যে কোনও "দু'টি মঙ্গলের একটির প্রতীক্ষা"র মধ্যেই আছে আল্লাহ্র জন্য আত্মোৎসর্গের আনন্দ। মু'মিন বান্দারা আশা করে মুনাফিকদের অবিশ্বস্ততার জন্য আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দেবেন। এই শাস্তি হবে তাদের কর্মফল - তাদের নিজ কর্মের প্রতিফলেই তাদের ধ্বংস ডেকে আনবে অথবা আল্লাহ্র পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, যা কাফের বা মুনাফিকরা পছন্দ করবে না। দেখুন সূরা ৬ আয়াত ১৫৮।
[উপদেশ : সর্বযুগে সর্বকালে যারা মুনাফিক বা কাফের তাদের ধ্বংস অনিবার্য তা ব্যক্তিগত হতে পারে বা জাতি হিসেবেও হতে পারে। - অনুবাদক।]
৫৩। বল, "ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যা [আল্লাহ্র রাস্তায়] ব্যয় কর তোমাদের নিকট থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। প্রকৃত পক্ষে তোমরা এক বিদ্রোহী এবং দুষ্ট সম্প্রদায়" ১৩১৪।
১৩১৪। মুনাফিকরা অধিকাংশ সময়ে তাদের অন্তরের ধ্যান ধারণাকে জনসমক্ষে প্রকাশ না করার জন্য ভনিতা বা ভানের আশ্রয় গ্রহণ করে। অনেক সময়ে দেখা যায়, কোন মহৎ কাজের জন্য যখন আপামর জনসাধারণ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, মুনাফিকরা সেই কাজের নীতিকে মনে মনে মেনে না নিলেও বাহ্যিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করে, এবং এই একাত্মতা প্রকাশের জন্য তারা সেই মহৎ কাজের আনুকুল্যে অর্থ সাহায্য করতেও কুণ্ঠিত হয় না। আসলে পুরো ব্যাপারটাই তাদের একটা ভনিতা বা ছলনা মাত্র। এই আয়াতে আল্লাহ্ এ ঘোষণা করেছেন যে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে ভাবেই তারা দান করুক না কেন, তাদের দান আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই দানের সাথে তাদের আত্মার যোগাযোগ নাই। আল্লাহ্ আমাদের অর্থ-সম্পদের মুখাপেক্ষী নন। তাঁর কাছে আমাদের আত্মার পবিত্রতা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা কাম্য। পরবর্তী আয়াতে তাদের প্রত্যাখানের কারণসমূহ নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে : (১) তারা আল্লাহ্র অনুগত বা বিশ্বাসী নয়; (২) তাদের প্রার্থনাও আন্তরিক নয়; তারা লোকসমক্ষে নিজেকে মু'মিন বান্দারূপে প্রমাণের জন্য, লোক দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে। এই নামাজের সাথে তাদের অন্তরের যোগাযোগ নাই; ফলে তাদের নামাজে বা প্রার্থনায় আল্লাহ্র কাছে আত্মিক নিবেদন বা ভক্তি প্রকাশ পায় না। (৩) তারা সৎ কাজে আল্লাহ্র রাস্তায় যে দান করে তার পিছনে তাদের কোনও আন্তরিকতা থাকে না বা তারা সেই কারণকে বিশ্বাসও করে না। যে কোনও কাজ তা দানই হোক বা প্রার্থনাই হোক; তা যদি আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা, ভয়, বা তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য বান্দার হৃদয় থেকে উৎসারিত না হয়, তবে আল্লাহ্র কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
৫৪। তাদের প্রদত্ত [দান] কেন গ্রহণ করা হবে না, তার একমাত্র কারণঃ তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করে, তারা আন্তরিক না হয়েও সালাতে অংশগ্রহণ করে এবং তারা অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাদের [নিবেদিত] অংশ দান করে।
৫৫। তাদের সম্পদ ও [অনুগত] পুত্রগণ যেনো তোমাকে বিমুগ্ধ না করে ১৩১৫ : প্রকৃত পক্ষে এ সবের দ্বারা পার্থিব জীবনে ওদের শাস্তি দান করাই হচ্ছে আল্লাহ্র পরিকল্পনা ১৩১৬। ওরা কাফির থাকা অবস্থায় ওদের আত্মা দেহ ত্যাগ করবে।
৫৫। তাদের সম্পদ ও [অনুগত] পুত্রগণ যেনো তোমাকে বিমুগ্ধ না করে ১৩১৫ : প্রকৃত পক্ষে এ সবের দ্বারা পার্থিব জীবনে ওদের শাস্তি দান করাই হচ্ছে আল্লাহ্র পরিকল্পনা ১৩১৬। ওরা কাফির থাকা অবস্থায় ওদের আত্মা দেহ ত্যাগ করবে।
১৩১৫। এই ভণ্ড অবিশ্বাসীদের পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় সফলকাম। তাদের অর্থ সম্পদ, লোকবল, ক্ষমতা, সমাজে অবস্থান অনেকের ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন, সেসব দেখে আমাদের অন্তরে যেনো ঈর্ষার উদয় না হয়। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে তাদের ধন-সম্পদ, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি, সবকিছু তাদের সত্যপথ হতে পদস্খলনে সাহায্য করে। এসবের মোহে সে সত্যপথকে পরিত্যাগ করে। এসব তার জন্য শয়তানের ফাঁদ হিসেবে কাজ করে। দেখুন সূরা ৮ আয়াত ২৮। রাসুলুল্লাহ্র (সাঃ) সময়ে আরব মুশরিকদের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে এই আয়াতকে সমর্থন করে। এই আয়াতে "সন্তান-সন্ততিকে" ক্ষমতা-প্রতিপত্তি ও লোকবলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি আরব মুশরিকদের অহংকার ও দম্ভে স্ফীত করে তোলে, ফলে তাদের মনের মাঝে অন্ধকার জমে যায়। অন্ধকার আত্মায় জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতার অভাব ঘটে, ফলে তার মধ্যে সত্যিকার মঙ্গল কিসে নিহিত তার অনুধাবন ক্ষমতা রহিত হয়ে যায়। অন্ধলোক যেমন দৃষ্টিশক্তির অভাবে পথ চলার সময়ে বুঝতে না পেরে ভুল জায়গায় পা ফেলে বিপদ ঘটায়। যেসব লোকের আত্মা অন্ধকারে আবৃত তারাও কোনটা কল্যাণের পথ, কোনটা অকল্যাণের পথ তা অনুধাবন করতে পারে না। ফলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। আরব মুশরিকরা যারা প্রাণপণে ইসলামের প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মক্কা বিজয়ের পরে তাদের সন্তান-সন্ততি ও অনুসারীরা ইসলাম গ্রহণ করে, ফলে তাদের ছত্রভঙ্গ অবস্থা হয়। তবে বাইরের এই ছত্রভঙ্গ অবস্থা যদিও করুণার যোগ্য, কিন্তু তাদের আত্মিক অবস্থা আরও ভয়াবহ। কারণ, তারা আত্মিক দিক থেকে মৃত। সে আত্মায় আর কোন দিন সত্যের আলো প্রবেশ লাভ করবে না। তারা কাফির থাকা অবস্থায় দেহত্যাগ করবে। এই-ই আল্লাহ্র বিধান।
১৩১৬। দেখুন সূরা ৩, আয়াত ১৭৬-১৭৮।
১৩১৭। "Jamaha"- অর্থ অনিয়ন্ত্রিত, পলায়নপর অশ্বের মত; পাগলের মত দৌড়ান এবং অনমনীয় একগুয়েভাবে হঠকারীতার সাথে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া।
১৩১৮। "Sadaqa" - আল্লাহ্র নামে যা দান করা হয়, বিশেষঃ অভাবগ্রস্থদের জন্য এবং এ ব্যতীত পরবর্তী আয়াতে যাদের উল্লেখ আছে তাদের জন্য। "সাদাকা" দু'রকম। এক রকম হচ্ছে "স্বতঃস্ফূর্ত", যাকে দান বলা হয়, অন্যটি বাধ্যতামূলক দান, যাকে "যাকাত" বলা হয়। যাকাত বাধ্যতামূলক। দু'টোই দান। একটি স্বতঃস্ফূর্ত, অন্যটি বাধ্যতামূলক। যাকাতের নিয়ম হচ্ছে : মুসলিম সম্প্রদায়কে তার বাৎসরিক সম্পদের শতকরা ২.৫% এবং ফসলের শতকরা ১০% বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রদান করতে হবে। যাকাতের উপরে প্রচুর গবেষণা এবং গবেষণালব্ধ লেখা আছে। "যাকাত" শব্দটি দানের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় - তবে তা সংকীণার্থে, "সদ্কা" শব্দটিও দানের পরিবর্তে ব্যবহার হয় - তবে তা ব্যাপকার্থে যার মধ্যে যাকাতও অন্তর্ভুক্ত।
১৩১৯। যারা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর তাদের নিকট দাতব্য ভাণ্ডার [যাকাত তহবিল] কোনও গুরুত্বপূর্ণ বস্তু মনে হয় না, তারা একে খেলাধূলার বস্তু হিসেবে কল্পনা করে। কিন্তু ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দানের সংজ্ঞা অতি মহৎ এবং এর অবস্থান অতি উচ্চে। ইসলামিক দানের যে দর্শন তার বাস্তব প্রয়োগ কখনই জনপ্রিয় হয় না। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে সে সংজ্ঞা ও সে দর্শন বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কেও বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, নিন্দাবাদ শুনতে হয়। কারণ, তিনি ছিলেন নীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর। এই আয়াতে আল্লাহ্ তাদেরকে সম্বোধন করেছেন যাদের দান পাওয়ার ক্ষেত্রে দাবীদার হিসেবে সন্দেহের অবকাশ ছিল। এসব ক্ষেত্রে দাবীদারেরা যেনো হতাশ হয়ে, মূলনীতির নিন্দা না করে বা যারা সেই নীতি প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের দোষারোপ না করে। তাদেরকে আল্লাহ্র উপরে সর্বান্তকরণে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলা হয়েছে - কারণ, আল্লাহ্ সকল সম্পদের মালিক, তাঁর নেয়ামত অফুরন্ত। তিনি যাকে খুশী তাঁর নেয়ামতে ধন্য করেন। ধনী দরিদ্র সকলেই তাঁর নেয়ামতের সমান হকদার। তিনি যাকে যোগ্য মনে করেন, তাকে তার প্রয়োজন অনুসারে দান করেন। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের জন্য সর্বাপেক্ষা ভালো উপদেশ হচ্ছে, "deserve before you desire", অর্থাৎ আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আল্লাহ্র কোনও বিশেষ নেয়ামত পাবার যোগ্যতা আমাদের আছে কি-না। পাবার আশা করার পূর্বে আল্লাহ্র নিকট যোগ্যতা প্রমাণের বিষয়টিই প্রধান। তখনই আমরা যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবো, যখন আমরা বলতে পারবো " আল্লাহ্র প্রতিই আমরা আমাদের সর্ব আশা আকাঙ্খা স্থাপন করলাম"।
[দ্রষ্টব্য : আল্লাহ্র নেয়ামতকে সঙ্কীর্ণার্থে ব্যবহার না করে একে বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা করা উচিৎ। দেখুন টীকা ২৭। - অনুবাদক।]
রুকু - ৮
১৩২০। ভিক্ষা বা দান-ধ্যান করতে হবে নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ ও যাকাত আদায়সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য। এদের সাহায্যের জন্য যে তহবিল তা অন্য খাতে ব্যবহার করা যাবে না। অভাবগ্রস্থ কারা ? সাধারণভাবে আমরা যাদের অভাবগ্রস্থরূপে মনে করি, তারা ব্যতীত অন্যান্য আরও যাদের কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা সাধারণ মানুষের ধারণায় "অভাবগ্রস্থ" না হলেও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের অভাবগ্রস্থরূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁরা হলেন : (১) যারা ভ্রান্তপথ ত্যাগ করে সৎ পথে জীবনকে পরিচালিত করার জন্য সংকল্প করে, কিন্তু তারা পূর্ববর্তী অসৎপথের সহযোগী দ্বারা আক্রান্ত ও অত্যাচারিত হওয়ার আশঙ্কা করে। এক্ষেত্রে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা মুসলমানদের কর্তব্য। (২) "দাসমুক্তির জন্য" - যারা দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ তাদের মুক্তির জন্য খরচ করতে হবে। এই "দাসত্ব বন্ধন" কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের যুগে ক্রীতদাস প্রথা নাই সত্য, তবে আজকের সভ্য সমাজে দাসত্ব প্রথা নানাভাবে বিরাজমান। "দাসত্ব প্রথা" - শব্দটির অর্থ অনেক ব্যাপক। এর অর্থ শুধুমাত্র আক্ষরিক নয়, এর অর্থ আক্ষরিক ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যেমন : যুদ্ধবন্দীকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করা, ক্রীতদাসকে অর্থের পরিবর্তে মুক্ত করা, এগুলিতে "দাসমুক্তি" কথাটি আক্ষরিক অর্থে নেওয়া যায়। এছাড়াও "দাসমুক্তি" কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। আজকের যুগে দাসপ্রথা প্রাচীন যুগের মত নাই, কিন্তু অন্যভাবে তা বর্তমান। যেমন, যারা অশিক্ষিত তারা অজ্ঞতার দাসত্বে আবদ্ধ, যারা কুসংস্কার সম্পন্ন তারা কুসংষ্কারের দাসত্বে আবদ্ধ, যারা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জীবন ধারণ করছে তারা প্রতিকূলতার দরুণ তাদের মেধা, মননশক্তি - যা আল্লাহ্ প্রেরিত তার সুস্থ বিকাশে অক্ষম - এরা প্রতিকূলতার দাসত্বে আবদ্ধ; অনুকূল পরিবেশে তাদের চরিত্রে এই গুণাবলী প্রকাশে সাহায্য করতো, তাদের প্রতিকূলতার দাসত্ব মুক্ত করতো। আজকের পৃথিবীর দাসত্ব হচ্ছে ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অত্যাচার, অবিচার ইত্যাদি। (৩) যারা ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ তাদের এই ঋণের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। (৪) যারা বিভিন্নভাবে আল্লাহ্র সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, যেমন- সত্য প্রচারের মাধ্যমে, জিহাদের মাধ্যমে, মুসলিম প্রজাতন্ত্র তার উপরে যে কর্তব্য ও দায়িত্ব ন্যস্ত করে তার সম্পন্ন করার মাধ্যমে - এসব ক্ষেত্রে নিজের জীবন ধারণের জন্য পরিশ্রম করতে যদি সে ব্যক্তি অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে এদেরকে সাহায্যের জন্য দান করতে হবে। (৫) বিদেশে যদি কেউ অর্থাভাবে অসহায় অবস্থায় পতিত হয়, তার সাহায্যার্থে দান করা। এদের ক্ষেত্রেই পথচারীদের সাহায্য করার কথাটি প্রয়োজ্য। উপরে যাদের কথা বলা হয়েছে তাদেরকেই সাহায্য করতে বলা হয়েছে। দানের মাধ্যমে তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে। এই দান ব্যক্তিগতভাবে করা যায়, বা সংঘবদ্ধভাবে করা যায়। কিন্তু তা করতে হবে দায়িত্বপূর্ণভাবে। যেনো সমাজ জীবনের চিত্র বদলে দেয়ার সংগ্রাম সফল হয়। এই আয়াতে "সাদাকাত" শব্দটি ব্যবহার হয়েছে "যাকাত" বা বাধ্যতামূলক দানের ক্ষেত্রে।
১৩২১। যারা নবীর (সাঃ) কুৎসা রটনাকারী তারা নবীর চরিত্রে দোষারোপ করার জন্য বলে যে, তিনি সকলের কথাই শোনেন, অর্থাৎ তিনি 'কান-কথা' শ্রবণকারী। এক্ষেত্রে আল্লাহ্ বলেছেন, "হ্যাঁ, তিনি যা শোনেন তা সকলের মঙ্গলের জন্যই শোনেন।" কারণ, তিনি হচ্ছেন সকলের জন্য আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ। এই আয়াতে বলা হয়েছে, "তার কান তোমাদের জন্য যা মঙ্গল তা-ই শোনে।" এই 'তোমাদের' শব্দটি বিশেষভাবে কুৎসা রটনাকারীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
১৩২২। বিশ্ব স্রষ্টা আমাদের সকলের স্রষ্টা। তিনি আমাদের ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমান, ভিতর, বাহির - সবকিছু অবগত। আমাদের মনের গোপন কথাটিও তাঁর কাছে অজানা থাকে না। কুরআনের বিভিন্ন সূরায় মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। এ কারণে মুনাফিকরা সদা শঙ্কিত থাকতো যে হয়তো বা তাদের বাইরের আবরণ পৃথিবীকে মুগ্ধ কররেও তাদের অন্তরের উদ্দেশ্য যা অত্যন্ত গ্লানিকর ও কুৎসিত, তা আল্লাহ্ পৃথিবীর সম্মুখে প্রকাশ করে দেবেন। কারণ, আল্লাহ্ তো সর্বজ্ঞ। তাদের শঙ্কার কারণ তাদের নীচ ও হীন মনোবৃত্তি। তারা চাইত পৃথিবীর যত কিছু শ্রেষ্ঠ তা তাদের করতলগত হবে এবং একই সময়ে তারা পরকালেও আল্লাহ্কে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে। ছলে বলে কৌশলে তারা ইহকাল পরকাল সব সময়েই নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে। তাদের চরিত্রে বিশ্বস্ততা আন্তরিকতার কোনও স্থান নাই। প্রকৃত মু'মিন বান্দাদের চরিত্রের বিশ্বস্ততা, সততা ও আন্তরিকতাকে তারা বোকামী মনে করতো। সুতরাং তারা তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করতো, সেই কারণে এই আয়াতে মুনাফিকদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে। বিশ্বস্ততা, সততা ও আন্তরিকতা ব্যক্তির চরিত্রের অমূল্য ধন। তা নিয়ে যারা হাসি-ঠাট্টা করে এবং নিজেদের শঠতা ও প্রতারণা পূর্ণ কাজ যা মুনাফিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তা নিয়ে গর্ববোধ করে তারা ধিক্।
[উপদেশ : আমাদের সমাজ জীবনে এ ধরণের লোক সর্বকালে সর্বযুগে বর্তমান। অতীতেও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র সময়েও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।]
[উপদেশ : এ থেকে মিথ্যাবাদী ও মুনাফিকদের উপদেশ গ্রহণ করা উচিৎ।
১৩১৬। দেখুন সূরা ৩, আয়াত ১৭৬-১৭৮।
৫৬। ওরা আল্লাহ্র নামে শপথ করে যে, ওরা তোমাদেরই একজন; কিন্তু ওরা তোমাদের একজন নয় তাছাড়াও তারা ভীত সন্ত্রস্ত থাকে [তাদের প্রকৃত পরিচয়ে উপস্থিত হতে]।
৫৭। যদি তারা পলায়নের কোন স্থান পেতো, অথবা কোন গিরি-গুহা, অথবা [লুকানোর কোন] গুপ্তস্থান, তারা তৎক্ষণাত সেদিকে অনমনীয় ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরে যেতো ১৩১৭।
৫৭। যদি তারা পলায়নের কোন স্থান পেতো, অথবা কোন গিরি-গুহা, অথবা [লুকানোর কোন] গুপ্তস্থান, তারা তৎক্ষণাত সেদিকে অনমনীয় ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরে যেতো ১৩১৭।
১৩১৭। "Jamaha"- অর্থ অনিয়ন্ত্রিত, পলায়নপর অশ্বের মত; পাগলের মত দৌড়ান এবং অনমনীয় একগুয়েভাবে হঠকারীতার সাথে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া।
৫৮। তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা সদ্কা [বণ্টন] সম্পর্কে তোমাকে মিথ্যা অপবাদ দেয় ১৩১৮। যদি তাদের এর কিছু অংশ প্রদান করা হয় তবে তারা সন্তুষ্ট হয়, যদি না দেয়া হয়, দেখ ! তারা ঘৃণায় ক্ষুব্ধ হয়।
১৩১৮। "Sadaqa" - আল্লাহ্র নামে যা দান করা হয়, বিশেষঃ অভাবগ্রস্থদের জন্য এবং এ ব্যতীত পরবর্তী আয়াতে যাদের উল্লেখ আছে তাদের জন্য। "সাদাকা" দু'রকম। এক রকম হচ্ছে "স্বতঃস্ফূর্ত", যাকে দান বলা হয়, অন্যটি বাধ্যতামূলক দান, যাকে "যাকাত" বলা হয়। যাকাত বাধ্যতামূলক। দু'টোই দান। একটি স্বতঃস্ফূর্ত, অন্যটি বাধ্যতামূলক। যাকাতের নিয়ম হচ্ছে : মুসলিম সম্প্রদায়কে তার বাৎসরিক সম্পদের শতকরা ২.৫% এবং ফসলের শতকরা ১০% বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রদান করতে হবে। যাকাতের উপরে প্রচুর গবেষণা এবং গবেষণালব্ধ লেখা আছে। "যাকাত" শব্দটি দানের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় - তবে তা সংকীণার্থে, "সদ্কা" শব্দটিও দানের পরিবর্তে ব্যবহার হয় - তবে তা ব্যাপকার্থে যার মধ্যে যাকাতও অন্তর্ভুক্ত।
৫৯। যদি তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকতো এবং বলতো, "আল্লাহ্-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল শীঘ্রই তাঁর [আল্লাহ্র] অনুগ্রহ দান করবেন। আল্লাহ্র প্রতিই আমরা আমাদের সব আশা আকাঙ্খা স্থাপন করলাম।" [এটাই হচ্ছে প্রকৃত জীবন যাত্রার পথ] ১৩১৯।
১৩১৯। যারা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর তাদের নিকট দাতব্য ভাণ্ডার [যাকাত তহবিল] কোনও গুরুত্বপূর্ণ বস্তু মনে হয় না, তারা একে খেলাধূলার বস্তু হিসেবে কল্পনা করে। কিন্তু ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দানের সংজ্ঞা অতি মহৎ এবং এর অবস্থান অতি উচ্চে। ইসলামিক দানের যে দর্শন তার বাস্তব প্রয়োগ কখনই জনপ্রিয় হয় না। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে সে সংজ্ঞা ও সে দর্শন বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কেও বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, নিন্দাবাদ শুনতে হয়। কারণ, তিনি ছিলেন নীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর। এই আয়াতে আল্লাহ্ তাদেরকে সম্বোধন করেছেন যাদের দান পাওয়ার ক্ষেত্রে দাবীদার হিসেবে সন্দেহের অবকাশ ছিল। এসব ক্ষেত্রে দাবীদারেরা যেনো হতাশ হয়ে, মূলনীতির নিন্দা না করে বা যারা সেই নীতি প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের দোষারোপ না করে। তাদেরকে আল্লাহ্র উপরে সর্বান্তকরণে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলা হয়েছে - কারণ, আল্লাহ্ সকল সম্পদের মালিক, তাঁর নেয়ামত অফুরন্ত। তিনি যাকে খুশী তাঁর নেয়ামতে ধন্য করেন। ধনী দরিদ্র সকলেই তাঁর নেয়ামতের সমান হকদার। তিনি যাকে যোগ্য মনে করেন, তাকে তার প্রয়োজন অনুসারে দান করেন। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের জন্য সর্বাপেক্ষা ভালো উপদেশ হচ্ছে, "deserve before you desire", অর্থাৎ আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আল্লাহ্র কোনও বিশেষ নেয়ামত পাবার যোগ্যতা আমাদের আছে কি-না। পাবার আশা করার পূর্বে আল্লাহ্র নিকট যোগ্যতা প্রমাণের বিষয়টিই প্রধান। তখনই আমরা যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবো, যখন আমরা বলতে পারবো " আল্লাহ্র প্রতিই আমরা আমাদের সর্ব আশা আকাঙ্খা স্থাপন করলাম"।
[দ্রষ্টব্য : আল্লাহ্র নেয়ামতকে সঙ্কীর্ণার্থে ব্যবহার না করে একে বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা করা উচিৎ। দেখুন টীকা ২৭। - অনুবাদক।]
রুকু - ৮
৬০। সদ্কা তো গরীব ও অভাবগ্রস্থদের জন্য, এবং যারা [সদ্কার ভান্ডার] পরিচালনার কাজে নিয়োজিত, তাদের জন্য। তাদের জন্য যাদের হৃদয় [সম্প্রতি] সত্যকে গ্রহণ করেছে। দাসমুক্তির জন্য ও ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য এবং পথচারীদের জন্য ১৩২০। [এভাবেই] আল্লাহ্ বিধান দিয়েছেন। আল্লাহ্ জ্ঞানে এবং প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ।
১৩২০। ভিক্ষা বা দান-ধ্যান করতে হবে নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ ও যাকাত আদায়সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য। এদের সাহায্যের জন্য যে তহবিল তা অন্য খাতে ব্যবহার করা যাবে না। অভাবগ্রস্থ কারা ? সাধারণভাবে আমরা যাদের অভাবগ্রস্থরূপে মনে করি, তারা ব্যতীত অন্যান্য আরও যাদের কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা সাধারণ মানুষের ধারণায় "অভাবগ্রস্থ" না হলেও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের অভাবগ্রস্থরূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁরা হলেন : (১) যারা ভ্রান্তপথ ত্যাগ করে সৎ পথে জীবনকে পরিচালিত করার জন্য সংকল্প করে, কিন্তু তারা পূর্ববর্তী অসৎপথের সহযোগী দ্বারা আক্রান্ত ও অত্যাচারিত হওয়ার আশঙ্কা করে। এক্ষেত্রে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা মুসলমানদের কর্তব্য। (২) "দাসমুক্তির জন্য" - যারা দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ তাদের মুক্তির জন্য খরচ করতে হবে। এই "দাসত্ব বন্ধন" কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের যুগে ক্রীতদাস প্রথা নাই সত্য, তবে আজকের সভ্য সমাজে দাসত্ব প্রথা নানাভাবে বিরাজমান। "দাসত্ব প্রথা" - শব্দটির অর্থ অনেক ব্যাপক। এর অর্থ শুধুমাত্র আক্ষরিক নয়, এর অর্থ আক্ষরিক ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যেমন : যুদ্ধবন্দীকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করা, ক্রীতদাসকে অর্থের পরিবর্তে মুক্ত করা, এগুলিতে "দাসমুক্তি" কথাটি আক্ষরিক অর্থে নেওয়া যায়। এছাড়াও "দাসমুক্তি" কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। আজকের যুগে দাসপ্রথা প্রাচীন যুগের মত নাই, কিন্তু অন্যভাবে তা বর্তমান। যেমন, যারা অশিক্ষিত তারা অজ্ঞতার দাসত্বে আবদ্ধ, যারা কুসংস্কার সম্পন্ন তারা কুসংষ্কারের দাসত্বে আবদ্ধ, যারা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জীবন ধারণ করছে তারা প্রতিকূলতার দরুণ তাদের মেধা, মননশক্তি - যা আল্লাহ্ প্রেরিত তার সুস্থ বিকাশে অক্ষম - এরা প্রতিকূলতার দাসত্বে আবদ্ধ; অনুকূল পরিবেশে তাদের চরিত্রে এই গুণাবলী প্রকাশে সাহায্য করতো, তাদের প্রতিকূলতার দাসত্ব মুক্ত করতো। আজকের পৃথিবীর দাসত্ব হচ্ছে ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অত্যাচার, অবিচার ইত্যাদি। (৩) যারা ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ তাদের এই ঋণের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। (৪) যারা বিভিন্নভাবে আল্লাহ্র সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, যেমন- সত্য প্রচারের মাধ্যমে, জিহাদের মাধ্যমে, মুসলিম প্রজাতন্ত্র তার উপরে যে কর্তব্য ও দায়িত্ব ন্যস্ত করে তার সম্পন্ন করার মাধ্যমে - এসব ক্ষেত্রে নিজের জীবন ধারণের জন্য পরিশ্রম করতে যদি সে ব্যক্তি অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে এদেরকে সাহায্যের জন্য দান করতে হবে। (৫) বিদেশে যদি কেউ অর্থাভাবে অসহায় অবস্থায় পতিত হয়, তার সাহায্যার্থে দান করা। এদের ক্ষেত্রেই পথচারীদের সাহায্য করার কথাটি প্রয়োজ্য। উপরে যাদের কথা বলা হয়েছে তাদেরকেই সাহায্য করতে বলা হয়েছে। দানের মাধ্যমে তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে। এই দান ব্যক্তিগতভাবে করা যায়, বা সংঘবদ্ধভাবে করা যায়। কিন্তু তা করতে হবে দায়িত্বপূর্ণভাবে। যেনো সমাজ জীবনের চিত্র বদলে দেয়ার সংগ্রাম সফল হয়। এই আয়াতে "সাদাকাত" শব্দটি ব্যবহার হয়েছে "যাকাত" বা বাধ্যতামূলক দানের ক্ষেত্রে।
৬১। তাদের মধ্যে এমন মানুষ আছে যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, "সে [সকলের] কান কথা [শোনে] ১৩২১।" বল, "তোমাদের জন্য যা মঙ্গল সে তাই-ই শোনে।" সে আল্লাহ্তে ঈমান আনে, বিশ্বাসীদের উপর আস্থা স্থাপন করে এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী তাদের জন্য [সে] রহমত। কিন্তু যারা নবীকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি।
১৩২১। যারা নবীর (সাঃ) কুৎসা রটনাকারী তারা নবীর চরিত্রে দোষারোপ করার জন্য বলে যে, তিনি সকলের কথাই শোনেন, অর্থাৎ তিনি 'কান-কথা' শ্রবণকারী। এক্ষেত্রে আল্লাহ্ বলেছেন, "হ্যাঁ, তিনি যা শোনেন তা সকলের মঙ্গলের জন্যই শোনেন।" কারণ, তিনি হচ্ছেন সকলের জন্য আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ। এই আয়াতে বলা হয়েছে, "তার কান তোমাদের জন্য যা মঙ্গল তা-ই শোনে।" এই 'তোমাদের' শব্দটি বিশেষভাবে কুৎসা রটনাকারীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
৬২। তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা তোমাদের নিকট আল্লাহ্র নামে শপথ করে। কিন্তু যদি তারা বিশ্বাসী হতো তবে তাদের জন্য আরও উপযুক্ত হতো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে সন্তুষ্ট করা।
৬৩। তারা কি জানে না, যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তাদের জন্য আছে জাহান্নামের আগুন ? যেখানে তারা বাস করবে। সেটাই হবে সর্বোচ্চ অপমান।
৬৪। মুনাফিকেরা ভয় পায় যে, তাদের সম্বন্ধে এমন এক সূরা না অবতীর্ণ হয় যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে। বল, "বিদ্রুপ করতে থাক ! তোমরা যা ভয় কর, আল্লাহ্ তা প্রকাশ করে দেবেন ১৩২২।"
৬৩। তারা কি জানে না, যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তাদের জন্য আছে জাহান্নামের আগুন ? যেখানে তারা বাস করবে। সেটাই হবে সর্বোচ্চ অপমান।
৬৪। মুনাফিকেরা ভয় পায় যে, তাদের সম্বন্ধে এমন এক সূরা না অবতীর্ণ হয় যা তাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করে দেবে। বল, "বিদ্রুপ করতে থাক ! তোমরা যা ভয় কর, আল্লাহ্ তা প্রকাশ করে দেবেন ১৩২২।"
১৩২২। বিশ্ব স্রষ্টা আমাদের সকলের স্রষ্টা। তিনি আমাদের ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমান, ভিতর, বাহির - সবকিছু অবগত। আমাদের মনের গোপন কথাটিও তাঁর কাছে অজানা থাকে না। কুরআনের বিভিন্ন সূরায় মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। এ কারণে মুনাফিকরা সদা শঙ্কিত থাকতো যে হয়তো বা তাদের বাইরের আবরণ পৃথিবীকে মুগ্ধ কররেও তাদের অন্তরের উদ্দেশ্য যা অত্যন্ত গ্লানিকর ও কুৎসিত, তা আল্লাহ্ পৃথিবীর সম্মুখে প্রকাশ করে দেবেন। কারণ, আল্লাহ্ তো সর্বজ্ঞ। তাদের শঙ্কার কারণ তাদের নীচ ও হীন মনোবৃত্তি। তারা চাইত পৃথিবীর যত কিছু শ্রেষ্ঠ তা তাদের করতলগত হবে এবং একই সময়ে তারা পরকালেও আল্লাহ্কে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে। ছলে বলে কৌশলে তারা ইহকাল পরকাল সব সময়েই নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে। তাদের চরিত্রে বিশ্বস্ততা আন্তরিকতার কোনও স্থান নাই। প্রকৃত মু'মিন বান্দাদের চরিত্রের বিশ্বস্ততা, সততা ও আন্তরিকতাকে তারা বোকামী মনে করতো। সুতরাং তারা তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করতো, সেই কারণে এই আয়াতে মুনাফিকদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে। বিশ্বস্ততা, সততা ও আন্তরিকতা ব্যক্তির চরিত্রের অমূল্য ধন। তা নিয়ে যারা হাসি-ঠাট্টা করে এবং নিজেদের শঠতা ও প্রতারণা পূর্ণ কাজ যা মুনাফিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তা নিয়ে গর্ববোধ করে তারা ধিক্।
[উপদেশ : আমাদের সমাজ জীবনে এ ধরণের লোক সর্বকালে সর্বযুগে বর্তমান। অতীতেও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র সময়েও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।]
৬৫। যদি তোমরা তাদের জিজ্ঞাসা কর, তারা [নিশ্চয়ই] বলবে, "আমরা তো আলাপ আলোচনা এবং ক্রিড়া-কৌতুক করছিলাম।" বল, "তোমরা কি আল্লাহ্, তাঁর নিদর্শন এবং তাঁর রাসূলকে বিদ্রুপ করেছিলে ?"
৬৬। "তোমরা কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করো না। তোমরা তো ঈমান আনার পরে তা প্রত্যাখ্যান করেছ। আমি তোমাদের কতককে ক্ষমা করলেও, তোমাদের মধ্যে অন্য দলকে শাস্তি দেবো, কারণ তারা পাপিষ্ঠ ১৩২৩।"
১৩২৩। মুনাফিকদের সম্বন্ধে পূর্ববর্তী টীকাতে আলোচনা করা হয়েছে। মুনাফেকী এক ধরণের অন্তরের ব্যধি। এর উৎপত্তি স্বার্থপরতা এবং মিথ্যা বলার অভ্যাস। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তারা উপর্যুপরি মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। এই মিথ্যা ভাষণ তাদের চরিত্রের বিশ্বস্ততা ও সাধুতাকে বিনষ্ট করে দেয়। এর ফলে তাদের চরিত্রের দৃঢ়তা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও দূরদর্শিতা হয়ে যায় রহিত। তারা ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। ফলে তারা সর্বদা ভালো ও মন্দের মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, যাদের ভালোর দিকে প্রবণতা অধিক তারা আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু যাদের মধ্যে মন্দের প্রবণতা বেশি, তারা আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়।৬৬। "তোমরা কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করো না। তোমরা তো ঈমান আনার পরে তা প্রত্যাখ্যান করেছ। আমি তোমাদের কতককে ক্ষমা করলেও, তোমাদের মধ্যে অন্য দলকে শাস্তি দেবো, কারণ তারা পাপিষ্ঠ ১৩২৩।"
[উপদেশ : এ থেকে মিথ্যাবাদী ও মুনাফিকদের উপদেশ গ্রহণ করা উচিৎ।
রুকু - ৯
১৩২৪। "মুনাফিক নর ও নারী একে অপরের অনুরূপ।" মুনাফিকীর ধরণ বিভিন্ন হতে পারে; বিভিন্নভাবে তারা সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে; যেমন : কেউ করে মানবতার নামে, কেউ করে সাম্যবাদের নামে, কেউ করে ধর্মের নামে, কেউ করে রাষ্ট্রের নামে ইত্যাদি। অর্থাৎ এদের বাহ্যিক উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু এদের অন্তরে নিজ স্বার্থ উদ্ধার ব্যতীত আর কোনও চিন্তা স্থান পায় না। বাইরের খোলস যা-ই হোক না কেন মুনাফিকরা সকলেই এক। একমাত্র তারাই একে অপরের মুনাফেকী খুব সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারে। তাই মুনাফিক পুরুষ মুনাফিক নারীর প্রকৃত সঙ্গী; আবার মুনাফিক নারী মুনাফিক পুরুষের প্রকৃত সাথী।
১৩২৫। "তারা হাত গুটিয়ে রাখে।" এখানে "হাতবদ্ধ" শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 'হাত' কথাটি এখানে প্রতীকধর্মী। হাত হচ্ছে ক্ষমতার প্রতীক, সাহায্যের প্রতীক, সহযোগিতার প্রতীক। সাহায্য-সহযোগিতা আর্থিকও হতে পারে বা ভিন্নভাবেও হতে পারে। মুনাফিকরা সর্বদা ভান করে যে তারা বিভিন্ন মতবাদের নামে, বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে সর্বদা মানবতাকে সাহায্য করতে উদগ্রীব, আসলে এ সমস্তই তাদের একটা ভান বা ছলনা ব্যতীত আর কিছুই না। তাদের দ্বারা সত্যিকারভাবে কারও কোনও উপকারই সম্ভব নয়।
১৩২৬। দেখুন সূরা ৭, আয়াত ৫১ ও টীকা নং ১০২৯। যেহেতু তারা আল্লাহ্কে ভয় করে না, আল্লাহ্র ভয়ে বা আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার অঙ্গীকারে তারা অসৎ বা মন্দ কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখে না, তারা তাদের এহেন কাজে আল্লাহ্কে ভুলে যায়, আল্লাহ্ও তাদের ভুলে যান। অর্থাৎ তাদের কোনও কাজেই আল্লাহ্র রহমত থাকে না, ফলে সে কাজের বরকত থাকে না।
১৩২৭। লা'নত বা Curse। লা'নতকে আল্লাহ্র রহমত, করুণা ও দয়ার বিপরীতধর্মী হিসেবে ধরা যেতে পারে। যারা আল্লাহ্কে বা তাঁর উপদেশকে বা তাঁর জীবন বিধানকে অস্বীকার করে, তাদেরকে আল্লাহ্ তাঁর রহমত, করুণা ও দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন। আর তাই হচ্ছে মানব সন্তানের জন্য আল্লাহ্র লা'নত বা Curse।
১৩২৮। নূহ্ নবী (আঃ)'র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সূরা ৭, আয়াত ৫৯-৬৪-তে। সামুদ সম্প্রদায়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সূরা ৭, আয়াত ৭৩-৭৯-তে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)'র কথা কুরআনের বহু স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে, বিশেষভাবে সূরা ৬, আয়াত ৭৪-৮২-তে। মিদিয়ানদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে সূরা ৭, আয়াত ৮৫-৯৩-তে। এবং লুত (আঃ) এর সম্প্রদায় ও তাঁর নগরীর ধ্বংসের বিবরণ আছে সূরা ৭, আয়াত ৮০-৮৪-তে।
১৩২৯। "qaum"- শব্দটিকে অনুবাদ করা হয়েছে সম্প্রদায়। যেমন : ইব্রাহীমের সম্প্রদায়, নূহ, আ'দ ও সামুদের সম্প্রদায় ইত্যাদি। এ সমস্ত সম্প্রদায় বিভিন্ন যুগে পৃথিবীতে বাস করে গেছে আর তাদের জন্য আল্লাহ্ যুগে যুগে এইসব নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। যেমন- আদ সম্প্রদায়ের জন্য হুদ (আঃ) নবীকে, সামুদ সম্প্রদায়ের জন্য সালেহ (আঃ) নবীকে। আরবী শব্দ "আসহাবী মাদইয়ান"-কে ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে,"men of midian" এবং বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে "মাদইয়ানবাসী।" মাদইয়ান সম্প্রদায় হচ্ছে বেদুঈন, এদের কোনও নির্দিষ্ট ভুখন্ড ছিল না। আকাবা উপসাগরের তীরে মাদইয়ান সম্প্রদায়ের যে শহরের উল্লেখ করা হয়েছে তা বহু পরে যখন তারা প্রায় একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত। দেখুন সূরা ৭, আয়াত ৮৫, টীকা ১০৫৩।
১৩৩০। "বিধ্বস্ত নগরী" বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে 'সদম' ও 'গোমরাহ' শহরকে। এই শহর দুটিতে লুত নবী (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে পাপ কাজ থেকে বিরত করতে বৃথাই চেষ্টা করেছিলেন। দেখুন সূরা ৭, আয়াত ৮০-৮৪।
১৩৩১। তাবুক যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনকালে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এক রাতে ঘটনাক্রমে মুসলিম বাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি নির্জন পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সংগে ছিলেন মাত্র দু'জন সাহাবী। মুনাফিকদের কয়েকজন এই সুযোগে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে একজন সাহাবী সাহস করে তাদেরকে প্রবলভাবে বাঁধা প্রদান করেন। আল্লাহ্র অনুগ্রহে মুনাফিকরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এখানে সেই ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আক্রমণকারীদের মধ্যে কয়েকজন ছিল মদীনার লোক। মদিনাতে তখন ইসলামী শাসন পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়ের শাসন বিরাজমান। সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি প্রতিটি নাগরিকের জন্য পূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে প্রদান করা হয়েছিলো। এর পরেও মদিনার এই কাপুরুষদের রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কে আক্রমণ করার উদ্দেশ্য একটাই - আর তা হচ্ছে ভালোর পরিবর্তে মন্দকে প্রতিস্থাপন করা। ইসলামিক শাসন ছিল ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ন্যায় ও সত্য এসব স্বার্থপরদরে কুমতলব হাসিলের বাঁধাস্বরূপ ছিল, যার যা প্রাপ্য তা থেকে তাকে বঞ্চিত করে শুধুমাত্র নিজ আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের জন্য ব্যয় করাই হচ্ছে এসব স্বার্থপরদের প্রধান উদ্দেশ্য। গরীবের স্বার্থ রক্ষা করা, দুঃস্থদের অধিকারের জন্য ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠিত করা, মানুষকে তার গুণাবলী ও যোগ্যতা দ্বারা মূল্যায়ন করা - তার বংশ পরিচয় বা প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা নয়, এসবই হচ্ছে ইসলামের মূলনীতি। এসব মূলনীতি ঐসব স্বার্থপরদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ফলে তাদের মনে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে - তারই পরিণতিতে মনিদার ঐসব কাপুরুষের দল রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর উপরে আক্রমণ করে।
১৩৩২। যদি মানুষ মিথ্যাবাদী হয়, যদি সে তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, এবং বিশ্বস্ততার সাথে অংগীকার রক্ষা না করে, তবে তাদের অন্তরে মুনাফেকী স্থায়ীভাবে আসন লাভ করবে। মিথ্যার সাথে মুনাফেকীর নিবিড় সম্পর্ক। মুনাফেকীর উৎস হচ্ছে মিথ্যা কথা। মিথ্যাকে ঢাকার জন্য তাদের এই মুনাফেকী আচরণ, এটি শেষ বিচার দিন পর্যন্ত তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকবে। এরা ভাবে এদের মিথ্যা বা মুনাফেকী দ্বারা অন্যকে প্রতারিত করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতে পারলেও তারা আল্লাহ্কে প্রতারিত করতে পারে নি, যিনি তাদের অন্তরের ক্ষুদ্রতম চিন্তা-ভাবনা, গোপন পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র, গোপন কথা বা কাজ - সবই সম্যকভাবে জানেন।
৬৭। মুনাফিক নর এবং নারী একে অপরের অনুরূপ [বোধ শক্তি সম্পন্ন] ১৩২৪। তারা অসৎ কাজের নির্দেশ দেয়, এবং যা ন্যায় কাজ তা নিষেধ করে, এবং হাত গুটিয়ে রাখে ১৩২৫। তারা আল্লাহ্কে বিস্মৃত হয়েছে, সুতরাং তিনিও তাদের ভুলে গেছেন ১৩২৬। নিশ্চয়ই মুনাফিকেরা বিদ্রোহী এবং বিপথগামী।
১৩২৪। "মুনাফিক নর ও নারী একে অপরের অনুরূপ।" মুনাফিকীর ধরণ বিভিন্ন হতে পারে; বিভিন্নভাবে তারা সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে; যেমন : কেউ করে মানবতার নামে, কেউ করে সাম্যবাদের নামে, কেউ করে ধর্মের নামে, কেউ করে রাষ্ট্রের নামে ইত্যাদি। অর্থাৎ এদের বাহ্যিক উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু এদের অন্তরে নিজ স্বার্থ উদ্ধার ব্যতীত আর কোনও চিন্তা স্থান পায় না। বাইরের খোলস যা-ই হোক না কেন মুনাফিকরা সকলেই এক। একমাত্র তারাই একে অপরের মুনাফেকী খুব সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারে। তাই মুনাফিক পুরুষ মুনাফিক নারীর প্রকৃত সঙ্গী; আবার মুনাফিক নারী মুনাফিক পুরুষের প্রকৃত সাথী।
১৩২৫। "তারা হাত গুটিয়ে রাখে।" এখানে "হাতবদ্ধ" শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 'হাত' কথাটি এখানে প্রতীকধর্মী। হাত হচ্ছে ক্ষমতার প্রতীক, সাহায্যের প্রতীক, সহযোগিতার প্রতীক। সাহায্য-সহযোগিতা আর্থিকও হতে পারে বা ভিন্নভাবেও হতে পারে। মুনাফিকরা সর্বদা ভান করে যে তারা বিভিন্ন মতবাদের নামে, বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে সর্বদা মানবতাকে সাহায্য করতে উদগ্রীব, আসলে এ সমস্তই তাদের একটা ভান বা ছলনা ব্যতীত আর কিছুই না। তাদের দ্বারা সত্যিকারভাবে কারও কোনও উপকারই সম্ভব নয়।
১৩২৬। দেখুন সূরা ৭, আয়াত ৫১ ও টীকা নং ১০২৯। যেহেতু তারা আল্লাহ্কে ভয় করে না, আল্লাহ্র ভয়ে বা আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার অঙ্গীকারে তারা অসৎ বা মন্দ কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখে না, তারা তাদের এহেন কাজে আল্লাহ্কে ভুলে যায়, আল্লাহ্ও তাদের ভুলে যান। অর্থাৎ তাদের কোনও কাজেই আল্লাহ্র রহমত থাকে না, ফলে সে কাজের বরকত থাকে না।
৬৮। মুনাফিক নর ও নারী এবং ঈমানকে অস্বীকারকারীদের আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন জাহান্নামের আগুনের। সেখানে তারা বাস করবে। এটা তাদের জন্য যথেষ্ট হবে। তাদের জন্য আল্লাহ্র অভিশাপ ১৩২৭; এবং স্থায়ী শাস্তি রয়েছে।
১৩২৭। লা'নত বা Curse। লা'নতকে আল্লাহ্র রহমত, করুণা ও দয়ার বিপরীতধর্মী হিসেবে ধরা যেতে পারে। যারা আল্লাহ্কে বা তাঁর উপদেশকে বা তাঁর জীবন বিধানকে অস্বীকার করে, তাদেরকে আল্লাহ্ তাঁর রহমত, করুণা ও দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন। আর তাই হচ্ছে মানব সন্তানের জন্য আল্লাহ্র লা'নত বা Curse।
৬৯। তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা এরূপঃ ক্ষমতায় তারা ছিলো তোমাদের থেকে শক্তিশালী এবং সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে ছিলো আরও সমৃদ্ধ। তারা তাদের [অতিবাহিত সময়ের] অংশ ভোগ করেছে। তোমরা তোমাদের [যাপিত সময়] ভোগ কর, যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীরা করেছিলো। তাদের মত তোমরাও অলস আলাপ আলোচনাতে মত্ত থাক। ওরাই তারা যাদের কর্ম ইহলোকে ও পরলোকে নিষ্ফল হবে এবং তারা [সকল আধ্যাত্মিক কল্যাণ] হারাবে।
৭০। তাদের পূর্ববর্তীদের কাহিনী কি তাদের নিকট পৌঁছায় নাই ? - নূহ্ এর সম্প্রদায়, আ'দ ১৩২৮, ও সামুদ; ইব্রাহিমের সম্প্রদায়, মাদইয়ানবাসী ১৩২৯ এবং বিধ্বস্ত নগরীর ১৩৩০ ? তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ রাসূলগণ এসেছিলো। আল্লাহ্ তাদের ক্ষতি করেন নাই বরং তারা নিজেরাই নিজেদের আত্মার ক্ষতি করেছে।
৭০। তাদের পূর্ববর্তীদের কাহিনী কি তাদের নিকট পৌঁছায় নাই ? - নূহ্ এর সম্প্রদায়, আ'দ ১৩২৮, ও সামুদ; ইব্রাহিমের সম্প্রদায়, মাদইয়ানবাসী ১৩২৯ এবং বিধ্বস্ত নগরীর ১৩৩০ ? তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ রাসূলগণ এসেছিলো। আল্লাহ্ তাদের ক্ষতি করেন নাই বরং তারা নিজেরাই নিজেদের আত্মার ক্ষতি করেছে।
১৩২৮। নূহ্ নবী (আঃ)'র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সূরা ৭, আয়াত ৫৯-৬৪-তে। সামুদ সম্প্রদায়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সূরা ৭, আয়াত ৭৩-৭৯-তে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)'র কথা কুরআনের বহু স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে, বিশেষভাবে সূরা ৬, আয়াত ৭৪-৮২-তে। মিদিয়ানদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে সূরা ৭, আয়াত ৮৫-৯৩-তে। এবং লুত (আঃ) এর সম্প্রদায় ও তাঁর নগরীর ধ্বংসের বিবরণ আছে সূরা ৭, আয়াত ৮০-৮৪-তে।
১৩২৯। "qaum"- শব্দটিকে অনুবাদ করা হয়েছে সম্প্রদায়। যেমন : ইব্রাহীমের সম্প্রদায়, নূহ, আ'দ ও সামুদের সম্প্রদায় ইত্যাদি। এ সমস্ত সম্প্রদায় বিভিন্ন যুগে পৃথিবীতে বাস করে গেছে আর তাদের জন্য আল্লাহ্ যুগে যুগে এইসব নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। যেমন- আদ সম্প্রদায়ের জন্য হুদ (আঃ) নবীকে, সামুদ সম্প্রদায়ের জন্য সালেহ (আঃ) নবীকে। আরবী শব্দ "আসহাবী মাদইয়ান"-কে ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে,"men of midian" এবং বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে "মাদইয়ানবাসী।" মাদইয়ান সম্প্রদায় হচ্ছে বেদুঈন, এদের কোনও নির্দিষ্ট ভুখন্ড ছিল না। আকাবা উপসাগরের তীরে মাদইয়ান সম্প্রদায়ের যে শহরের উল্লেখ করা হয়েছে তা বহু পরে যখন তারা প্রায় একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত। দেখুন সূরা ৭, আয়াত ৮৫, টীকা ১০৫৩।
১৩৩০। "বিধ্বস্ত নগরী" বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে 'সদম' ও 'গোমরাহ' শহরকে। এই শহর দুটিতে লুত নবী (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে পাপ কাজ থেকে বিরত করতে বৃথাই চেষ্টা করেছিলেন। দেখুন সূরা ৭, আয়াত ৮০-৮৪।
৭১। বিশ্বাসী পুরুষ ও নারী পরস্পর পরস্পরের রক্ষাকর্তা, তারা ন্যায় কাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কাজের নিষেধ করে, তারা নিয়মিত সালাত কায়েম করে, যাকাত দান করে, এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদের উপরেই আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
৭২। আল্লাহ্ বিশ্বাসী নর ও নারীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের - যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা বাস করবে, জান্নাতের চিরস্থায়ী শান্তির সুরম্য অট্টালিকায়। কিন্তু আল্লাহ্র সন্তুষ্টিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তি, সেটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ সুখ।
৭৩। হে নবী ! অবিশ্বাসী ও মোনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম [জিহাদ] কর, এবং তাদের প্রতি কঠোর হও। জাহান্নাম হবে তাদের বাসস্থান, উহা কত নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থান।
৭৪। তারা আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলেছিলো, তারা [মন্দ] কিছু বলে নাই। কিন্তু সত্যিই তারা আল্লাহ্র নিন্দা করেছিলো এবং তারা তা করেছিলো ইসলাম গ্রহণের পরে। এবং তারা ষড়যন্ত্রের কৌশল গভীররভাবে চিন্তা করেছিলো যা কার্যকর করতে তারা অক্ষম হয়েছিলো ১৩৩১। আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল অনুগ্রহ দ্বারা তাদের সমৃদ্ধ করেছিলেন বলেই তাদের একমাত্র প্রতিদান ছিলো এই প্রতিশোধ। যদি তারা অনুতাপ করে এটা তাদের জন্য হবে সর্বোৎকৃষ্ট। কিন্তু যদি তারা [তাদের মন্দ পথে] ফিরে যায়, আল্লাহ্ তাদের এই জীবনে এবং পরলোকের জীবনে ভয়াবহ শাস্তি দেবেন। পৃথিবীতে তাদের কোন রক্ষাকর্তা অথবা সাহায্যকারী থাকবে না।
৭২। আল্লাহ্ বিশ্বাসী নর ও নারীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের - যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা বাস করবে, জান্নাতের চিরস্থায়ী শান্তির সুরম্য অট্টালিকায়। কিন্তু আল্লাহ্র সন্তুষ্টিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তি, সেটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ সুখ।
৭৩। হে নবী ! অবিশ্বাসী ও মোনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম [জিহাদ] কর, এবং তাদের প্রতি কঠোর হও। জাহান্নাম হবে তাদের বাসস্থান, উহা কত নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থান।
৭৪। তারা আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলেছিলো, তারা [মন্দ] কিছু বলে নাই। কিন্তু সত্যিই তারা আল্লাহ্র নিন্দা করেছিলো এবং তারা তা করেছিলো ইসলাম গ্রহণের পরে। এবং তারা ষড়যন্ত্রের কৌশল গভীররভাবে চিন্তা করেছিলো যা কার্যকর করতে তারা অক্ষম হয়েছিলো ১৩৩১। আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল অনুগ্রহ দ্বারা তাদের সমৃদ্ধ করেছিলেন বলেই তাদের একমাত্র প্রতিদান ছিলো এই প্রতিশোধ। যদি তারা অনুতাপ করে এটা তাদের জন্য হবে সর্বোৎকৃষ্ট। কিন্তু যদি তারা [তাদের মন্দ পথে] ফিরে যায়, আল্লাহ্ তাদের এই জীবনে এবং পরলোকের জীবনে ভয়াবহ শাস্তি দেবেন। পৃথিবীতে তাদের কোন রক্ষাকর্তা অথবা সাহায্যকারী থাকবে না।
১৩৩১। তাবুক যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনকালে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এক রাতে ঘটনাক্রমে মুসলিম বাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি নির্জন পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সংগে ছিলেন মাত্র দু'জন সাহাবী। মুনাফিকদের কয়েকজন এই সুযোগে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে একজন সাহাবী সাহস করে তাদেরকে প্রবলভাবে বাঁধা প্রদান করেন। আল্লাহ্র অনুগ্রহে মুনাফিকরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এখানে সেই ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আক্রমণকারীদের মধ্যে কয়েকজন ছিল মদীনার লোক। মদিনাতে তখন ইসলামী শাসন পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়ের শাসন বিরাজমান। সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি প্রতিটি নাগরিকের জন্য পূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে প্রদান করা হয়েছিলো। এর পরেও মদিনার এই কাপুরুষদের রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কে আক্রমণ করার উদ্দেশ্য একটাই - আর তা হচ্ছে ভালোর পরিবর্তে মন্দকে প্রতিস্থাপন করা। ইসলামিক শাসন ছিল ন্যায় ও সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ন্যায় ও সত্য এসব স্বার্থপরদরে কুমতলব হাসিলের বাঁধাস্বরূপ ছিল, যার যা প্রাপ্য তা থেকে তাকে বঞ্চিত করে শুধুমাত্র নিজ আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের জন্য ব্যয় করাই হচ্ছে এসব স্বার্থপরদের প্রধান উদ্দেশ্য। গরীবের স্বার্থ রক্ষা করা, দুঃস্থদের অধিকারের জন্য ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠিত করা, মানুষকে তার গুণাবলী ও যোগ্যতা দ্বারা মূল্যায়ন করা - তার বংশ পরিচয় বা প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা নয়, এসবই হচ্ছে ইসলামের মূলনীতি। এসব মূলনীতি ঐসব স্বার্থপরদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ফলে তাদের মনে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে - তারই পরিণতিতে মনিদার ঐসব কাপুরুষের দল রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর উপরে আক্রমণ করে।
৭৫। তাদের মাঝে কিছু লোক আছে যারা আল্লাহ্র নিকট অংগীকার করেছিলো যে, যদি আল্লাহ্ তাদের তাঁর অনুগ্রহ প্রদান করেন, তবে তারা [বহু পরিমাণে] দান করবে এবং প্রকৃত পক্ষে তারা পূণ্যাত্মাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
৭৬। কিন্তু যখন তিনি [আল্লাহ্] তাদের তাঁর অনুগ্রহ প্রদান করলেন, তারা পরিণত হলো অর্থলোলুপে এবং [তাদের অংগীকার থেকে] মুখ ফিরিয়ে নিল, [অংগীকার কার্যকর করতে] বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হলো।
৭৭। সুতরাং পরিণামে তিনি তাদের হৃদয়ে মোনাফেকী স্থাপন করলেন তাঁর [আল্লাহ্র] সাথে সাক্ষাৎ দিবস পর্যন্ত। কারণ তারা আল্লাহ্র সাথে কৃত অংগীকার ভঙ্গ করেছিলো, এবং কারণ তারা মিথ্যা বলেছিলো [বারে বারে] ১৩৩২।
৭৬। কিন্তু যখন তিনি [আল্লাহ্] তাদের তাঁর অনুগ্রহ প্রদান করলেন, তারা পরিণত হলো অর্থলোলুপে এবং [তাদের অংগীকার থেকে] মুখ ফিরিয়ে নিল, [অংগীকার কার্যকর করতে] বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হলো।
৭৭। সুতরাং পরিণামে তিনি তাদের হৃদয়ে মোনাফেকী স্থাপন করলেন তাঁর [আল্লাহ্র] সাথে সাক্ষাৎ দিবস পর্যন্ত। কারণ তারা আল্লাহ্র সাথে কৃত অংগীকার ভঙ্গ করেছিলো, এবং কারণ তারা মিথ্যা বলেছিলো [বারে বারে] ১৩৩২।
১৩৩২। যদি মানুষ মিথ্যাবাদী হয়, যদি সে তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, এবং বিশ্বস্ততার সাথে অংগীকার রক্ষা না করে, তবে তাদের অন্তরে মুনাফেকী স্থায়ীভাবে আসন লাভ করবে। মিথ্যার সাথে মুনাফেকীর নিবিড় সম্পর্ক। মুনাফেকীর উৎস হচ্ছে মিথ্যা কথা। মিথ্যাকে ঢাকার জন্য তাদের এই মুনাফেকী আচরণ, এটি শেষ বিচার দিন পর্যন্ত তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকবে। এরা ভাবে এদের মিথ্যা বা মুনাফেকী দ্বারা অন্যকে প্রতারিত করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতে পারলেও তারা আল্লাহ্কে প্রতারিত করতে পারে নি, যিনি তাদের অন্তরের ক্ষুদ্রতম চিন্তা-ভাবনা, গোপন পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র, গোপন কথা বা কাজ - সবই সম্যকভাবে জানেন।
৭৮। তারা কি জানে না যে তাদের গোপন [চিন্তা ভাবনা] ও তাদের গোপন পরামর্শ আল্লাহ্ জানেন এবং যা দেখা যায় না সে সম্বন্ধেও আল্লাহ্ বিশেষভাবে অবহিত ?
৭৯। বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান [কার্য] করে থাকে এবং যারা তাদের শ্রম ব্যতীত অন্য কিছু দিতে পারে না, - তাদের যারা বিদ্রুপ করে ১৩৩৩, আল্লাহ্ তাদের বিদ্রুপ তাদের উপরে নিক্ষেপ করবেন, এবং তারা ভয়াবহ শাস্তি লাভ করবে।
১৩৩৩। "স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান" - এখানে স্বতঃস্ফূর্ত কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্বতঃস্ফূর্ত যে দান তা যাকাত না। অনেকে এই শব্দটিকেও যাকাত নামে অনুবাদ করেছেন - কিন্তু যাকাত হচ্ছে বাধ্যতামূলক দান - যার সাথে দাতার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনও সম্পর্ক নাই। এখানে "সাদাকা" অর্থ প্রয়োজনের সময়ে প্রতিটি মু'মিন বান্দার কর্তব্য সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করা। যারা ধনী, তারা প্রয়োজনে প্রচুর অর্থ দান করতে পারেন। কিন্তু যারা গরীব, "যারা নিজ শ্রম ব্যতিরেকে আর কিছুই দান করতে পারে না" - তারাও তাদের সেই ক্ষুদ্র আয় থেকে সামান্য অর্থ বা বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দান করতে পারেন। এখানেই দান ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য। যাকাত সব সময়ে অর্থের মাপকাঠিতে পরিশোধিত হবে, অপরপক্ষে দান হচ্ছে আল্লাহ্র যে কোনও নেয়ামতকে দান করা [আল্লাহ্র নেয়ামতের প্রকারভেদ দেখুন টীকা ২৭-এ]। ধনী ও গরীবের দানের মধ্যে পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের নিকট পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও, আল্লাহ্র নিকট সব দানই সমান মূল্যবান। কারণ আল্লাহ্ ধন-দৌলতের মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ্র কাছে দাতার নিয়ত ও আন্তরিক ইচ্ছাই হচ্ছে মূল্যায়নের মাপকাঠি। শুধুমাত্র যারা পার্থিব জীবনকে অত্যন্ত ভালোবাসে, যারা পরছিদ্রান্বেষী, শুধু তারাই দানের অন্তর্নিহিত গুরুত্বকে অনুধাবনে হবে ব্যর্থ। তাদের কাছে দানের পরিমাণটাই হবে দানের নিয়ত বা আন্তরিকতা থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই সব অপরিণামদর্শী ও অবিবেচক ব্যক্তিরাই দানের অল্প পরিমাণের জন্য পরিহাস করতে পারে। এদের অপরিণামদর্শিতা এতদূরে পৌঁছায় যে কখনও কখনও এরা দানের পরিমাণের উপরে নির্ভর করে দাতার সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে দ্বিধা বোধ করে না। এদের সম্পর্কেই এই আয়াতে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।৭৯। বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান [কার্য] করে থাকে এবং যারা তাদের শ্রম ব্যতীত অন্য কিছু দিতে পারে না, - তাদের যারা বিদ্রুপ করে ১৩৩৩, আল্লাহ্ তাদের বিদ্রুপ তাদের উপরে নিক্ষেপ করবেন, এবং তারা ভয়াবহ শাস্তি লাভ করবে।
৮০। তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর অথবা না কর [তাদের পাপ ক্ষমার অযোগ্য]। তুমি যদি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর, আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করবেন না ১৩৩৪। কারণ তারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এবং যারা বিপথগামী এবং বিদ্রোহী আল্লাহ্ তাদের পথ প্রদর্শন করেন না।
১৩৩৪। মুনাফিক সরদার "আবদুল্লাহ্ ইব্ন উবাঊ ইবন সালুল" - এর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) তার জানাযার নামাজ পড়ান ও তার জন্য দোয়া করেন। এই প্রসঙ্গে এই আয়াত ও পরবর্তী ৮৪ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। এইসব আয়াতে আল্লাহ্ কঠোর ভাষায় কাফের ও মুনাফিকদের সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়। তিনি তাঁর স্বভাব অনুযায়ী সবার জন্য মঙ্গল কামনা করতেন। তিনি ইসলামের শত্রুর মৃত্যুর পরেও আল্লাহ্র দরবারে তার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এই আয়াতে আল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ)'র প্রার্থনার জবাবে তা নাকচ করে দেন।
[বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের এ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে : ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বই হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। যেখানে পাপাচারীর জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) এর দোয়া আল্লাহ্ কবুল করেন নাই। এমনকি তিনি যদি পুনঃ পুনঃ (সত্তর বার কথাটি দ্বারা আল্লাহ্ পুনঃ পুনঃ ভাবকে প্রকাশ করেছেন) দোয়াও করতেন, তবুও তা আল্লাহ্র দরবারে কবুল হতো না। সেখানে আমাদের দেশের কিছু অজ্ঞ ব্যক্তি সমাজ জীবনে অন্যায় অত্যাচার করে প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করে প্রতি মূহুর্তে আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে চলেছে এবং এরা ধারণা করে মাজার পূঁজা করে এবং পীর ফকিরের সাহায্যে তাদের সব পাপ মোচন হয়ে যাবে। পাপ মোচনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে প্রকৃত অনুতাপ করা এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। প্রকৃত অনুতাপকারীকে আল্লাহ্ ক্ষমা করেন। তিনিই তো পরম ক্ষমাশীল, দয়ার আঁধার। এ কথা মনে রাখতে হবে ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বই হচ্ছে ইসলামের মূল মর্মবাণী।]
৮১। [তাবুক অভিযানে] যারা পিছনে থেকে গেলো, তারা আল্লাহ্র রাসূলের পিছনে বিরুদ্ধাচারণ করে আনন্দিত হলো। তারা আল্লাহ্র জন্য তাদের জীবন ও সম্পদ দ্বারা সংগ্রাম ও যুদ্ধ করাকে ঘৃণা করেছিলো। তারা বলেছিলো, "গরমের মধ্যে বের হয়ো না" ১৩৩৫। বল, "জাহান্নামের আগুন উত্তাপে প্রচন্ডতর।" যদি তারা [তা] বুঝতো।
১৩৩৫। এই আয়াতটি তাবুকের প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে। তাবুক অভিযানের সময় ছিল গ্রীষ্মকালে। আরব দেশের দাবদাহ কল্পনা করা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অসম্ভব। বাইজেন্টাইন সম্রাট মুসলমানদের আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন, এই গুজবের ভিত্তিতেই রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ)-কে তাড়াহুড়ো করে তাবুক অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাবুক অভিযান ঘটে সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবর মাসে।
৮২। তাদের সামান্য হাসতে দাও, তারা প্রচুর কাঁদবে : তারা যে [মন্দ] কাজ করে [এটা] তার প্রতিদান ১৩৩৬।
১৩৩৬। তাবুকের অভিযানে যারা অংশগ্রহণ করে নাই, এই আয়াতে তাদের সম্বোধন করা হয়েছে। তারা এখন অবজ্ঞা প্রদর্শন করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে পারে, কিন্তু তা হবে ক্ষণস্থায়ী। কারণ তাদের এই অপরিণামদর্শিতার ফল খুব খারাপ। চোখের পানিতে তাদের এই ঋণ শোধ করতে হবে।
[উপদেশ : যে কাজ মহৎ ও আমাদের জন্য মঙ্গলজনক, তা বর্তমানে সুখকর না-ও হতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তার ফল আনন্দদায়ক। বর্তমানের ক্ষণস্থায়ী সুখের আশায় যারা আল্লাহ্র আদেশকে লঙ্ঘন করে, ভবিষ্যতে তাদের পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাবুক অভিযান এখানে এই উপদেশের প্রতীকরূপে কল্পনা করা যায়। - অনুবাদক।]
৮৩। এরপরে, যদি আল্লাহ্ তোমাকে তাদের [মোনাফেকদের] কোন দলের নিকট ফেরত আনেন, এবং তারা যদি [তোমার সাথে অভিযানে] বের হওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে, বল, ! "তোমরা কখনও আমার সাথে [অভিযানে] বের হবে না, আমার সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। প্রথমবারে তোমরা অকর্মণ্যভাবে বসে থাকা পছন্দ করেছিলে। তাহলে যারা পিছনে থাকে তাদের সাথে [এখনও] বসে থাক।"
৮৪। তাদের মধ্যে কারও মৃত্যু হলে তুমি তাদের জন্য [জানাযায়] সালাত পড়বে না এবং তার কবরের পার্শ্বে দাঁড়াবে না ১৩৩৭। কারণ তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো এবং তারা বিপথগামী এবং বিদ্রোহী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলো।
৮৪। তাদের মধ্যে কারও মৃত্যু হলে তুমি তাদের জন্য [জানাযায়] সালাত পড়বে না এবং তার কবরের পার্শ্বে দাঁড়াবে না ১৩৩৭। কারণ তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো এবং তারা বিপথগামী এবং বিদ্রোহী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলো।
১৩৩৭। মুসলমানের মৃত্যুর পরে, প্রত্যেক মুসলমানের পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য হচ্ছে তার জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ ও তার পাপ মোচনের জন্য, তার আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা। এই আয়াতে বলা হয়েছে যারা কাফের, যারা আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ) কে অস্বীকার করে, অর্থাৎ যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের ধর্মীয় লেবেল যা-ই হোক না কেন, তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা-প্রার্থনা বা জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করা নিষিদ্ধ।
৮৫। তাদের সম্পদ এবং [অনুগত] পুত্রগণ যেনো তোমাকে বিমুগ্ধ না করে। আল্লাহ্র পরিকল্পনা হচ্ছে এ সব জিনিস দ্বারা তাদের এই পৃথিবীতে শাস্তি দেয়া। কাফির থাকা অবস্থায় তাদের আত্মা [দেহ] ত্যাগ করবে ১৩৩৮।
১৩৩৮। এই আয়াতটি এই সূরার ৫৫ নং আয়াতের অনুরূপ। এই দু'টি আয়াতই দু'টি ভিন্ন প্রেক্ষাপটের সমাপ্তি স্বরূপ বলা হয়েছে। ৫৫ নং আয়াতের প্রেক্ষাপট ছিল মহৎ বা সৎ কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করা। ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদের সময়ে অর্থের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তবুও তা যদি শুধুমাত্র লোক দেখানো দান হয়, আল্লাহ্র কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই আয়াতের [৯ : ৮৫] প্রেক্ষাপট হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলো, তাদের অন্তোষ্টিক্রিয়া বা জানাযায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ।
৮৬। আল্লাহ্তে বিশ্বাস স্থাপন কর এবং সংগ্রাম ও যুদ্ধ কর রাসূলের সংগী হয়ে এই আদেশ সহ যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তাদের মধ্যে যাদের সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে তারা তোমার নিকট অব্যহতি চায়, এবং বলে, "আমাদের রেহাই দাও। যারা [ঘরে] বসে থাকে আমরা তাদের সাথেই থাকবো।"
৮৭। তারা [মহিলাদের] পিছনে [বাড়ীতে] বসে থাকতে পছন্দ করে ১৩৩৯। তাদের অন্তঃকরণকে সীলমোহর করে দেয়া হয়েছে, সুতরাং তারা বুঝতে অক্ষম।
৮৭। তারা [মহিলাদের] পিছনে [বাড়ীতে] বসে থাকতে পছন্দ করে ১৩৩৯। তাদের অন্তঃকরণকে সীলমোহর করে দেয়া হয়েছে, সুতরাং তারা বুঝতে অক্ষম।
১৩৩৯। "Khawalif", - একবচনে "Khalifa" - অর্থাৎ তারাই যারা যুদ্ধের সময়ে অন্তঃপুরে থাকে : মহিলা। এই আয়াতটি কাপুরুষদের জন্য বিদ্রূপাত্মক বিশেষণ। যারা ভীতু ও কাপুরুষ তারা যুদ্ধের ময়দান অপেক্ষা গৃহে অবস্থান পছন্দ করে। তারা যে শুধু কাপুরুষ তা-ই নয়, তারা বুদ্ধিহীনও। কারণ যুদ্ধের ময়দানে যাবার প্রয়োজন তাদের নিজেদের-ই স্বার্থে, নিজেদের নিরাপত্তার কারণে। এ কথা তারা ভুলে যায় যে, শত্রু সেনারা যদি তাদের ভূমি ও গৃহ দখল করে নেয়, তবে সে বা তার পরিজন কখনোই নিরাপদ নয়। এমনকি তার নিজ জীবন পর্যন্ত নিরাপদ নয়। কিন্তু এই সহজ সত্যটি তারা অনুধাবণে ব্যর্থ। "অন্তর মোহর করা হয়েছে"; ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে, "Their hearts are sealed"। এই বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে - "মানুষ অভ্যাসের দাস।" এই সব লোকের চরিত্রে মুনাফেকী ও কাপুরুষোচিত ব্যবহার এমনভাবে শেকড় বিস্তার লাভ করেছে যে, এরা সমাজের অন্যান্য মূল্যবোধ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। আত্মোৎসর্গ, সাহসিকতা, সততা - প্রভৃতি গুণাবলী ও স্বর্গীয় আদেশের তাৎপর্য এরা অনুধাবন করতে পারে না। কারণ, এরা এদের মুনাফেকী ও কাপুরুষোচিত অভ্যাসের দরুণ তাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। এবং আত্মার বিকাশের অন্যান্য পথ এদের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন : যে লোক সর্বদা মিথ্যাতে অভ্যস্ত, তাঁর পক্ষে সত্যের আলো, ক্ষমতা ও শান্তি অনুধাবন করা অসম্ভব। এই অবস্থাকেই কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে, "অন্তরে মোহর"।
৮৮। কিন্তু নবী এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিলো তারা তাদের জীবন ও সম্পদ দ্বারা [আল্লাহ্র পথে] সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে। তাদের জন্য আছে [সর্ব] কল্যাণ ১৩৪০। এরাই তারা যারা [আধ্যাত্মিক] সফলতা লাভ করবে।
১৩৪০। "কল্যাণ" এবং "সফলকাম" এই শব্দ দুটি আক্ষরিক অর্থে এবং আত্মিক উন্নতির প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত।
৮৯। আল্লাহ্ তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন [বেহেশ্তের] বাগান যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা বাস করবে। এটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ সুখ ১৩৪১।
১৩৪১। এই আয়াতটি সূরার ৭২ নং আয়াতটির অনুরূপ। এই আয়াতে এসে মদিনার মুনাফিকদের বর্ণনা শেষ হয়েছে। অধ্যায় ১২ থেকে শুরু হয়েছে বেদুঈন মুনাফিকদের বর্ণনা।
রুকু - ১২
৯০। এবং মরুবাসী আরবদের মধ্যে এমন লোকও ছিলো যারা অব্যহতি পাওয়ার জন্য অযুহাত পেশ করেছিলো। এবং যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে মিথ্যা বলেছিলো, তারা অকর্মণ্যভাবে বসে থাকলো ১৩৪২। তাদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসী শীঘ্রই তারা এক ভয়াবহ শাস্তি দ্বারা আক্রান্ত হবে।
১৩৪২। মুনাফিকদের অস্তিত্ব যে শুধুমাত্র মদিনাতেই ছিল তা-ই নয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের অস্তিত্ব বেদুঈন সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিরাজমান ছিল। এই আয়াতে বেদুঈন মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে "মরুবাসী" অর্থাৎ বেদুঈন। আরবদের বেদুঈন সম্প্রদায় অত্যন্ত সাহসী ও যুদ্ধপ্রিয় সম্প্রদায়রূপে পরিচিত। কিন্তু তাবুক অভিযানে যখন তাদের আহ্বান করা হলো, তারা সে আহ্বানে সাড়া দিল না। যখনই জিহাদের আহ্বান আসবে, মুসলিম হিসেবে প্রতিটি মুসলমানের সেই যুদ্ধে যোগদান করা অবশ্য কর্তব্য। যদিও বেদুঈনরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো, তবে তা তাদের আত্মাকে খাটি মু'মিন ব্যক্তিকে রূপান্তরিত করতে পারে নাই - তারা ছিলো মুনাফিকদেরই রূপান্তর। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের কষ্ট : সর্বোপরি পারস্য সম্রাটের সুশিক্ষিত বাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার ভয় তাদের তাবুক অভিযানে বিরত রাখে। অভিযানে অংশগ্রহণ না করার জন্য তারা মিথ্যা অযুহাতের অবতারণা করে। এর কারণ, তাদের ঈমান বা বিশ্বাসের অভাব। ঈমানের ভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারণেই, তারা মহত্বর কারণের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে ভয় পায়। মুনাফিকদের সম্বন্ধে দেখুন সূরা ৯, আয়াত ৪৬-৪৭ এবং সূরা ৯, আয়াত ৫৩-৫৪। বেদুঈনদের কেউ কেউ মিথ্যা অজুহাত প্রদর্শন করেছিলো, কেউ কেউ তাবুক অভিযানের আহ্বান উপেক্ষা করে বাড়ীতেই 'বসে রইল'।
৯১। যারা দুর্বল অথবা অসুস্থ অথবা [আল্লাহ্র রাস্তায়] খরচ করার মত কোন সঙ্গতি নাই তাদের কোন অপরাধ নাই, যদি তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি [কর্তব্যে] আন্তরিক থাকে। যারা ন্যায়সম্মত ভাবে কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে [অভিযোগের] কোন কারণ নাই। এবং আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু ১৩৪৩।
১৩৪৩। নিজ মাতৃভূমি যখন শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা করে, তখন সারা দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। প্রতিটি মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য এই অবস্থায় যার যা আছে, তাই দিয়ে সাহায্য করা। শক্তি-সামর্থ, অর্থ-সম্পদ, সবকিছু যুদ্ধের জন্য উৎসর্গ করতে হবে।
৯২। যারা তোমার নিকট বাহনের জন্য এসেছিলো, তাদেরও [কোন অপরাধ] নাই, ১৩৪৪। এবং যখন তুমি বলেছিলে, "আমি তোমাদের জন্য কোন বাহন সরবরাহ করতে পারছি না," তারা ফিরে গেলো, দুঃখে তাদের চক্ষু অশ্রু প্লাবিত হয়েছিলো [এজন্য] যে তাদের [এমন কোন] সঙ্গতি নাই যার দ্বারা তারা খরচ বহন করতে পারে।
১৩৪৪। "Hamala, Yahmilu"- এর অর্থ পরিবহনের ব্যবস্থা করা। এখানে এর অর্থ হবে যার উপরে আরোহণ করা যায়, অর্থাৎ ঘোড়া, উট ইত্যাদি। কারণ সে সময়ে বর্তমান যুগের মত অটোমোবাইলের চলন ছিল না। সে সময়ে যুদ্ধ যাত্রায়, রসদ এবং অস্ত্র-শস্ত্র পরিবহনের জন্য ভারবাহী পশু ব্যবহার করা হতো। বর্তমান যুগে পরিবহন ব্যবস্থা যুদ্ধের সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ। বিভিন্ন ধরণের অটোমোবাইলের ব্যবহার বর্তমানে প্রচলিত। কিন্তু আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে পশুই ছিল একমাত্র ভারবাহী প্রাণী। আর তাবুক অভিযান ছিল আত্মরক্ষার্থে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ; আর তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অভিযান। ইসলাম রক্ষার্থে তা ছিল জিহাদ। আর এই জিহাদ কোন পূর্ব পরিকল্পিত ব্যাপার ছিল না; ছিল না কোনও তহবিল, ছিল না কোনও পরিবহন ব্যবস্থা। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করে। ফলে যারা গরীব, যারা যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহে ব্যর্থ হলো তাদের অন্তর দুঃখে ভরে গেলো, "তারা অর্থ ব্যয়ে অসমর্থজনিত দুঃখে অশ্রুবিগলিত নেত্রে ফিরে গেল।" কারণ তারা আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদের জন্য আগ্রহী ছিল। কিন্তু তাদের সামর্থের অভাবে তারা আল্লাহ্র সেবা করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য হলো। তাদেরকেই এই আয়াতে আল্লাহ্ সান্ত্বনা দিয়েছেন।
[উপদেশ : আল্লাহ্র কাছে কাজ অপেক্ষা কাজের নিয়ত এবং নিয়তের আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা অধিক মূল্যবান। তবে যারা দুর্বল এবং অসুস্থ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ - একমাত্র এরাই যুদ্ধের আওতা থেকে অব্যাহতি পেতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত উপস্থিতির প্রশ্নই আসে না, তবে তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও, পরোক্ষভাবে অর্থ-সম্পদ সাহায্য দ্বারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। অবশ্য এক্ষেত্রে সামর্থের প্রশ্নটি বিবেচ্য। কিন্তু যদি কেউ শারীরিক দিক থেকে অসমর্থ এবং সেই সাথে গরীব হন, তবে তিনি যুদ্ধ করা থেকে অব্যাহতি লাভ করবেন। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, "আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি তারা [কর্তব্য] আন্তরিক থাকে" এবং তাদের "সৎ কর্ম" - যদি খাঁটি হয়, অর্থাৎ তাদের নিয়ত বা উদ্দেশ্য হবে জিহাদের জন্য একাত্মতা, আল্লাহ্র ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ও সৎ; তবেই তারা সম্মুখ যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারবে। প্রকৃত মুসলিমদের মধ্যেও কেউ কেউ বিশেষ অসুবিধার জন্য তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নাই, তাদের ওযর কবুল হওয়ার আশ্বাস এখানে দেয়া হয়েছে। উপদেশ হচ্ছে, যে কোনও কাজ, তা যদি সৎ নিয়তে বা উদ্দেশ্যে করা হয়, তার সফলতা বা অসফলতা, বৃহৎ বা ক্ষুদ্র, যে কোনও রূপেই তা করা হোক না কেন, তা হবে আল্লাহ্র সেবা বা আল্লাহ্র কাজ। কবি মিলটন তার কবিতায় এই ভাবকে এভাবে প্রকাশ করেছেন, "They also serve who only stand and wait"। কাজ করাটাই সংসারে বড় কথা নয়; কাজের নিয়ত বা কাজের পিছনের ব্যক্তির যে সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, বিরাজ করে - আত্মার এই পবিত্র অবস্থাই আল্লাহ্র কাছে কাম্য। যাদের কাজের পিছনে সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা ও সততা বিরাজ করে, তারাই আল্লাহ্র করুণা ও ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য।
৯৩। সম্পদ থাকা সত্বেও যারা অব্যহতি প্রার্থনা করে, [অভিযোগ] তাদের বিরুদ্ধে। [অন্তঃপুর বাসিনী] যারা ঘরে বসে থাকে তাদের সাথে থাকাই ওরা পছন্দ করেছিলো। আল্লাহ্ তাদের হৃদয়কে সীল মোহর করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা বুঝতে পারে না [তারা কি হারাচ্ছে] ১৩৪৫।
১৩৪৫। সূরা ৯ আয়াত ৮৭-তে একই রকম ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে করা হয়েছে সেই সব শহরবাসীদের জন্য, যারা নিজ কর্তব্য এড়িয়ে যেতে চায়, এখানে সেই একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে মরুবাসীদের জন্য। এটাতো শুধুমাত্র কর্তব্যই ছিল না, এটা ছিলো মু'মিন বান্দাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ - নিজেকে আল্লাহ্র ভালোবাসা পাবার যোগ্য প্রমাণ করার সুযোগ। আত্মত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের সুযোগ। যারা একম সুযোগ হারায় তারা সত্যিই হতভাগ্য। তারা জানে না, জীবনে তারা কি হারালো।
[উপদেশ : দেশ ও জাতির দুর্যোগের সময়ে সকলেরই আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মানসিকতা থাকতে হবে - তবেই আল্লাহ্র রহমত তাদের উপরে বর্ষিত হবে। তা যারা করতে পারে না, তারা হতভাগ্য। আর্থিক লাভই পৃথিবীর শেষ কথা নয়। এই উপদেশ সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বস্থানের জন্য প্রযোজ্য।
একাদশ পারা
১৩৪৬। ইসলামে দানকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) বাধ্যতামূলক দান বা যাকাত- যার মাপকাঠি হচ্ছে অর্থের পরিমাণ, আর কিছু নয়। (২) স্বঃস্ফূর্ত দান - তা হচ্ছে যার যা আছে সতঃস্ফূর্তভাবে তা আল্লাহ্র রাস্তায় দান করা - এর কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। অর্থের মাপকাঠিতে এ দানকে মূল্যায়ন করা যায় না। আল্লাহ্ যাকে যে নেয়ামত [দেখুন টীকা ২৭] দান করেছেন, সেই নেয়ামতকে আন্তরিকতার সাথে, বিশ্বস্ত ও সততার সাথে আল্লাহ্র খুশির জন্য, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করাই দান। এর উদ্দেশ্য অনেক বড়, অনেক মহৎ। মাটির পৃথিবীর লাভ লোকসানের অনেক উর্ধ্বে। এই আয়াতে "অল্লাহ্র পথে" কথাটি উহ্য আছে, ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে, "Some of the Bedouine Arabs look upon their payments as a fine" এখানে এই "payments" শব্দটি বাংলা অনুবাদে "অর্থ প্রদান" বলা হয়েছে। এই অর্থ প্রদান বা দান হচ্ছে বাধ্যতামূলক দান। অর্থাৎ তা হবে যাকাত। ইসলামের যাকাত বাধ্যতামূলক। কোন মুসলমান যদি সামর্থ্য থাকা সত্বেও যাকাত না দেয়। এবং যাকাত দিতে বাধ্য হলে যদি তার মনে বিরাগের সৃষ্টি হয়, তবে তার সেই দানে আত্মার কোনও উন্নতি হবে না। ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, নিয়ম-নিষ্ঠা, আচার-অনুষ্ঠান, সবকিছুর মূলেই আছে আত্মার উন্নতির প্রচেষ্টা। মাটির পৃথিবী মলিনতা মুক্ত করে, আত্মার মাঝে বেহেশ্তি গুণাবলীর সৃষ্টির মাধ্যমে, আত্মিক উন্নতির লাভের আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে ধর্ম। আত্মিক উন্নতির লাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যতীত, ধর্মীয় নিয়ম, বিধি-নিষেধ সবই হবে যাবে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠানে পর্যবসিত। এ যেনো মুত্তোবিহীন, শ্বাসবিহীন ঝিনুকের খোসা। যার ঔজ্জ্বল্য আছে - কিন্তু প্রাণ নাই মূল্যও নাই। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগে যাকাতের দ্বারা সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হতো, যেমন- সমাজে যারা দুঃস্থ,তাদের জন্য সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করা, যেনো তারা সমাজে সুস্থ সুন্দর ও সম্মানজনক ভাবে বাঁচার সুযোগ পায়। সামাজিক উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখা, ভিক্ষাবৃত্তি ও দারিদ্র্যকে প্রতিরোধ করা , শিক্ষার প্রসার করা, ইত্যাদি। অর্থাৎ সমাজের মঙ্গলের জন্য, সুস্থ অগ্রগতি ও উন্নতির জন্য, সামাজিক সাহায্যমূলক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের জন্য বাধ্যতামূলক দানে যারা আনন্দিত , তারাই আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হয়। এর ফলে তাদের চরিত্রে বিভিন্ন গুণাবলীর বিকাশ ঘটে, যার মাধ্যমে তারা আত্মার মাঝে শান্তি খুঁজে পায়। কিন্তু কেউ যদি একে বিরক্তিজনক ন্যাক্কারজনক মনে করে, কিন্তু দিতে বাধ্য হয়, তবে এই দানের কোন সুফল সে ভোগ করতে পারবে না। কারণ ,তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। তার মূল্যবোধে মানুষের জন্য ভালবাসা, সমাজের জন্য ভালবাসা, আল্লাহ্র সৃষ্টির জন্য মঙ্গলাকাঙ্খা অনুপস্থিত। সুতরাং তার জন্য আল্লাহ্র রহমতও থাকবে না। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব অনটন দূর করে সমাজের মঙ্গলের জন্য, সমাজের উন্নতির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার জন্যই যাকাত তহবিলের সৃষ্টি। যাকাত দেওয়ার মর্মার্থই হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক বাধা বিপত্তি দূর করা। যারা তা সহাস্যে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে এগিয়ে আসে তাদের চরিত্র দুর্লভ গুণাবলীর জন্ম নেবে। এই গুণাবলীই হচ্ছে আল্লাহ্র রহমত। অর্থ-সম্পদের মাপকাঠিতে তা মাপা যায় না, কারণ তা অমূল্য। এই গুণাবলীর ফলে বান্দার চরিত্র স্বর্গীয় আনন্দ ও শান্তিতে ভরে যায়। বান্দা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা লাভ করে । সে যুগে এ ধরণের ব্যক্তিগণ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র আশীর্বাদে ধন্য হয়েছেন; আজও এসব ব্যক্তি আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হন।
১৩৪৭। আল্লাহ্ রহমানুর রাহীম। তাঁর রহমত বিশ্বব্যাপী। আকাশ, পৃথিবী, ভূতল-সমুদ্র সর্বত্রই রহমতের হাত প্রসারিত। যার ইচ্ছা সেই পারে তাঁর রহমতের ধারায় অবগাহন করতে। এর জন্য প্রয়োজন আত্মিক শুদ্ধি, আত্মিক পবিত্রতা, প্রয়োজনীয় গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি। যদি আমরা নিজেদের সেভাবে তৈরী করতে পারি তবে আমরা আল্লাহ্র রহমতের সাগরে অবগাহন করতে সমর্থ হবো। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যে তীব্র আনন্দ অনুভূতি, তা অনুভব করার যোগ্যতা অর্জন করবো। উপমা হচ্ছে : সূর্যালোক যেমন সমস্ত পৃথিবীকে বিধৌত করে। ধনী গরীব যে কেউ খুশী তার উষ্ণতা উপভোগ করতে পারে। শুধু ব্যক্তির চেষ্টা থাকতে হবে ছায়াময় ঠাণ্ডা স্থান থেকে নিজেকে বের করে সূর্যকিরণে নিজেকে স্থাপন করা। ঠিক সেইরূপে আল্লাহ্র রহমত আমাদের বিধৌত করতে সবর্দা ব্যাকুল। বান্দাকে শুধু স্ব-ইচ্ছায় চেষ্টার দ্বারা তাঁর যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
রুকু-১৩
১৩৪৮। ইসলামের পতাকা উত্তোলনকারী ও বহনকারী সেনাদলের পুরোধায় যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, তারা প্রতিকূল অবস্থা, বিপদ, দুর্যোগ, দুর্ভাগ্য কিছুতেই ভয় পান নাই। জীবনের পরিবর্তে তাঁরা ইসলামের পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। ইসলামের প্রথম অবস্থায় আত্মত্যাগের ইতিহাসের প্রথম সারিতে যারা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মুজাহির এবং আনসার। "মুহাজির" হচ্ছেন তাঁরাই যারা ধর্মের জন্য নিজ মাতৃভূমি মক্কা, সহায়, সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন - সব ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যদিও হিজরতকারীদের পূর্বাহ্নে প্রেরণ করে নিজে সবার শেষে বিপদ সঙ্কুল স্থান থেকে হিজরত করেন, তবুও "[ইসলামের] অগ্রদূত" শব্দটির সাহায্যে এখানে তাঁকেই বোঝানো হয়েছে। এর পরে বলা হয়েছে ''আনসার'' দের কথা। আনসার শব্দটির অর্থ সাহায্যকারী। মদীনাবাসীরা মুহাজিরদের সাদরে গ্রহণ করেন তাঁদের জন্য খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, সর্বপ্রকার সাহায্যের হস্ত তাঁরা প্রসারিত করেন। এভাবেই মদীনাতে নূতন মুসলিম সম্প্রদায়ের শুরু এবং আনসারদের সাহায্য সহযোগিতায় এই সম্প্রদায় বিকশিত হতে শুরু করে। এর পরে উল্লেখ করা হয়েছে "যারা নিষ্ঠার সাথে তাদেরকে অনুসরণ করে"।
[এই আয়াতটি ইংরেজী অনুবাদটি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কারণ, ইংরেজী অনুবাদে আয়াতটির অর্থ অনেক প্রাঞ্জল এবং হৃদয়গ্রাহী। - অনুবাদক।]
"The vanguard (of Islam) the First of those who forsook (their homes) and of those gave them aid and (also) those who follow them in (all) good deeds well pleased is Allah with them as are they with Him........."
মাওলনা ইউসুফ আলীর অনুবাদ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই "অনুসরণ" কথাটি শুধুমাত্র পরবর্তী হিযরতকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এঁরা হঁচ্ছেন তাঁরাই, যারা সৎ কাজে পূর্বোক্ত দলকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেন। অর্থাৎ সৎ কাজে প্রয়োজন পূর্বোক্ত দলের ন্যায় সর্বস্ব ত্যাগ করে আত্মোসৎর্গের জন্য প্রস্তুত। এই বাক্যটি শুধুমাত্র নবীর (সাঃ) সঙ্গী-সাথী, যারা তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন বা নবী (সাঃ)'র সমসাময়িক যারা, তাঁদের জন্য প্রযোজ্য তা-ই নয়, আল্লাহ্র এই বাণী সর্বযুগে সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ যারাই রাসূল (সাঃ)'র জীবনী অনুসরণ করে সৎ কাজে জীবন উৎসর্গ করবে, তাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট। সর্বকালের, সর্বযুগের, নারী-পুরুষ সকলের জন্য তা প্রযোজ্য। তাদের আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে আল্লাহ্ তাঁদের পুরষ্কৃত করবেন। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি তাদের আত্মাকে পৃথিবীর দুঃখ, কষ্ট,লোভ, লালসা, হিংসা, দ্বেষ, প্রভৃতি সকল মলিনতা থেকে মুক্তি দেবে। আত্মার মাঝে অপার শান্তি বিরাজ করবে। আর তা-হচ্ছে "জান্নাত"।
১৩৪৯। "জান্নাত" - আত্মার সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার শেষ আবাসস্থল। এই লাইনের আরও বহুবার কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সূরাতে আয়াত ৭২, ৮৯-এ উল্লেখ আছে। অংক শাস্ত্রে অংকের বহু ধাপকে এক লাইনের ফর্মুলার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, এখানেও সেই রকম পৃথিবীতে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার শেষে এক লাইনের উল্লেখ করা হয়েছে। তার অনন্ত গন্তব্যস্থলের ঠিকানাও সেরূপ।
১৩৫০। মরুবাসী আরবেরা খুব সহজ সরল প্রকৃতির নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ধূর্ত ও মুনাফিক। যারা মদিনার আশে পাশে ও মদিনাতে রাসূল (সাঃ)-এর সময়ে তাঁর সাহচর্যে বাস করতো এদের মাঝেও অনেকেই ছিলো ধূর্ত ও মুনাফিক।
[রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র চরিত্র ছিল পরশ পাথরের ন্যায়। লোহা যেরূপ পরশ পাথরের সংস্পর্শে সোনাতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, সেরূপ রাসূল (সাঃ)-এর সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন তাদের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে। তাঁরা ''সোনার'' মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন। সেই সময়ে নবী করীমের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শেও যাদের পরিবর্তন হয় নাই, যারা ধূর্ত ও মুনাফিক থেকে যায়, তাদের কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়। সে যুগেও নয়, এ যুগেও নয়। দেখুন এই সূরার ৯৭ নং আয়াত। এ থেকেই আরবদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবনযোগ্য।]
১৩৫১। এই আয়াতে বলা হয়েছে পৃথিবীতে মুনাফিকদের শাস্তি হবে দ্বিবিধ। বুদ্ধিমান লোকেরা বুঝতে পারবে যে ইসলামের অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু মুনাফিকরা ধূর্ত ও বুদ্ধিমান হওয়া সত্বেও তারা ইসলামের সৌন্দর্য্য, গুণরাজি, অগ্রযাত্রা বুঝতে হবে ব্যর্থ, ফলে তাদের অবস্থা হবে ছত্রভঙ্গ এবং তারা হবে পরাজিত। কারণ, মুনাফিকরা হবে অত্যন্ত অবাধ্য একগুঁয়ে ও অজ্ঞ। তাদের এই অজ্ঞতা, একগুঁয়েমী অবাধ্যতার জন্য পার্থিব জীবনে তাদের পরাজয়ের গ্লানি ও ছত্রভঙ্গ অবস্থা মেনে নিতে হবে। এই অপমান ও গ্লানিই শেষ কথা নয়, পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
৯৪। তুমি যখন তাদের নিকট প্রত্যবর্তন করবে, তারা তোমার নিকট কৈফিয়ত পেশ করবে। তুমি বল, : "কোন কৈফিয়ত দিও না। আমরা তোমাদের বিশ্বাস করবো না। আল্লাহ্ ইতিমধ্যেই তোমাদের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করেছেন। আল্লাহ্ এবং তার রাসূল তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন। যিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকট তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে তারপরে তোমরা যা করতে তার সত্যতা সম্বন্ধে তোমাদের অবহিত করা হবে।"
৯৫। যখন তুমি তাদের নিকট ফিরে আসবে, তারা আল্লাহ্র নামে তোমার নিকট শপথ করবে যেনো তুমি তাদের স্বেচ্ছামত থাকতে দাও। সুতরাং তাদের স্বেচ্ছমত থাকতে দাও। কারণ তারা অপবিত্র এবং তারা যে [মন্দ] করে তার উপযুক্ত তুল্য বিনিময় স্বরূপ জাহান্নাম হবে তাদের আবাসস্থল।
৯৬। তারা তোমার নিকট শপথ করবে যেনো তদের উপর সন্তুষ্ট হও। কিন্তু তোমরা তাদের উপর সন্তুষ্ট হলেও, যারা [আল্লাহ্র] অবাধ্য আল্লাহ্ তাদের উপর সন্তুষ্ট নন।
৯৭। মরুবাসী আরবরা অবিশ্বাস মোনাফেকীতে নিকৃষ্টতম। আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের প্রতি যে আদেশ প্রেরণ করেছেন সে সম্বন্ধে তারা অজ্ঞদের উপযুক্ত। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
৯৮। মরুবাসী আরবদের কেহ কেহ [আল্লাহ্র রাস্তায়] অর্থ প্রদানকে জরিমানা রূপে গণ্য করে ১৩৪৬, এবং তোমাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের প্রতীক্ষা করে, মন্দ ভাগ্য বিপর্যয় ওদেরই হোক। আল্লাহ্ সব কিছু শোনেন এবং জানেন।
৯৫। যখন তুমি তাদের নিকট ফিরে আসবে, তারা আল্লাহ্র নামে তোমার নিকট শপথ করবে যেনো তুমি তাদের স্বেচ্ছামত থাকতে দাও। সুতরাং তাদের স্বেচ্ছমত থাকতে দাও। কারণ তারা অপবিত্র এবং তারা যে [মন্দ] করে তার উপযুক্ত তুল্য বিনিময় স্বরূপ জাহান্নাম হবে তাদের আবাসস্থল।
৯৬। তারা তোমার নিকট শপথ করবে যেনো তদের উপর সন্তুষ্ট হও। কিন্তু তোমরা তাদের উপর সন্তুষ্ট হলেও, যারা [আল্লাহ্র] অবাধ্য আল্লাহ্ তাদের উপর সন্তুষ্ট নন।
৯৭। মরুবাসী আরবরা অবিশ্বাস মোনাফেকীতে নিকৃষ্টতম। আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের প্রতি যে আদেশ প্রেরণ করেছেন সে সম্বন্ধে তারা অজ্ঞদের উপযুক্ত। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
৯৮। মরুবাসী আরবদের কেহ কেহ [আল্লাহ্র রাস্তায়] অর্থ প্রদানকে জরিমানা রূপে গণ্য করে ১৩৪৬, এবং তোমাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের প্রতীক্ষা করে, মন্দ ভাগ্য বিপর্যয় ওদেরই হোক। আল্লাহ্ সব কিছু শোনেন এবং জানেন।
১৩৪৬। ইসলামে দানকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) বাধ্যতামূলক দান বা যাকাত- যার মাপকাঠি হচ্ছে অর্থের পরিমাণ, আর কিছু নয়। (২) স্বঃস্ফূর্ত দান - তা হচ্ছে যার যা আছে সতঃস্ফূর্তভাবে তা আল্লাহ্র রাস্তায় দান করা - এর কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। অর্থের মাপকাঠিতে এ দানকে মূল্যায়ন করা যায় না। আল্লাহ্ যাকে যে নেয়ামত [দেখুন টীকা ২৭] দান করেছেন, সেই নেয়ামতকে আন্তরিকতার সাথে, বিশ্বস্ত ও সততার সাথে আল্লাহ্র খুশির জন্য, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করাই দান। এর উদ্দেশ্য অনেক বড়, অনেক মহৎ। মাটির পৃথিবীর লাভ লোকসানের অনেক উর্ধ্বে। এই আয়াতে "অল্লাহ্র পথে" কথাটি উহ্য আছে, ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে, "Some of the Bedouine Arabs look upon their payments as a fine" এখানে এই "payments" শব্দটি বাংলা অনুবাদে "অর্থ প্রদান" বলা হয়েছে। এই অর্থ প্রদান বা দান হচ্ছে বাধ্যতামূলক দান। অর্থাৎ তা হবে যাকাত। ইসলামের যাকাত বাধ্যতামূলক। কোন মুসলমান যদি সামর্থ্য থাকা সত্বেও যাকাত না দেয়। এবং যাকাত দিতে বাধ্য হলে যদি তার মনে বিরাগের সৃষ্টি হয়, তবে তার সেই দানে আত্মার কোনও উন্নতি হবে না। ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, নিয়ম-নিষ্ঠা, আচার-অনুষ্ঠান, সবকিছুর মূলেই আছে আত্মার উন্নতির প্রচেষ্টা। মাটির পৃথিবী মলিনতা মুক্ত করে, আত্মার মাঝে বেহেশ্তি গুণাবলীর সৃষ্টির মাধ্যমে, আত্মিক উন্নতির লাভের আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে ধর্ম। আত্মিক উন্নতির লাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যতীত, ধর্মীয় নিয়ম, বিধি-নিষেধ সবই হবে যাবে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠানে পর্যবসিত। এ যেনো মুত্তোবিহীন, শ্বাসবিহীন ঝিনুকের খোসা। যার ঔজ্জ্বল্য আছে - কিন্তু প্রাণ নাই মূল্যও নাই। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগে যাকাতের দ্বারা সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হতো, যেমন- সমাজে যারা দুঃস্থ,তাদের জন্য সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করা, যেনো তারা সমাজে সুস্থ সুন্দর ও সম্মানজনক ভাবে বাঁচার সুযোগ পায়। সামাজিক উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখা, ভিক্ষাবৃত্তি ও দারিদ্র্যকে প্রতিরোধ করা , শিক্ষার প্রসার করা, ইত্যাদি। অর্থাৎ সমাজের মঙ্গলের জন্য, সুস্থ অগ্রগতি ও উন্নতির জন্য, সামাজিক সাহায্যমূলক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের জন্য বাধ্যতামূলক দানে যারা আনন্দিত , তারাই আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হয়। এর ফলে তাদের চরিত্রে বিভিন্ন গুণাবলীর বিকাশ ঘটে, যার মাধ্যমে তারা আত্মার মাঝে শান্তি খুঁজে পায়। কিন্তু কেউ যদি একে বিরক্তিজনক ন্যাক্কারজনক মনে করে, কিন্তু দিতে বাধ্য হয়, তবে এই দানের কোন সুফল সে ভোগ করতে পারবে না। কারণ ,তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। তার মূল্যবোধে মানুষের জন্য ভালবাসা, সমাজের জন্য ভালবাসা, আল্লাহ্র সৃষ্টির জন্য মঙ্গলাকাঙ্খা অনুপস্থিত। সুতরাং তার জন্য আল্লাহ্র রহমতও থাকবে না। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব অনটন দূর করে সমাজের মঙ্গলের জন্য, সমাজের উন্নতির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার জন্যই যাকাত তহবিলের সৃষ্টি। যাকাত দেওয়ার মর্মার্থই হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক বাধা বিপত্তি দূর করা। যারা তা সহাস্যে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে এগিয়ে আসে তাদের চরিত্র দুর্লভ গুণাবলীর জন্ম নেবে। এই গুণাবলীই হচ্ছে আল্লাহ্র রহমত। অর্থ-সম্পদের মাপকাঠিতে তা মাপা যায় না, কারণ তা অমূল্য। এই গুণাবলীর ফলে বান্দার চরিত্র স্বর্গীয় আনন্দ ও শান্তিতে ভরে যায়। বান্দা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা লাভ করে । সে যুগে এ ধরণের ব্যক্তিগণ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র আশীর্বাদে ধন্য হয়েছেন; আজও এসব ব্যক্তি আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হন।
৯৯। কিন্তু মরুবাসী আরবদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে এবং তাদের অর্থ প্রদানকে পূণ্য কাজ, যা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ ও রাসূলের দু'আ লাভের উপায় হিসাবে গণ্য করে, হ্যাঁ প্রকৃতই তা তাদের জন্য [আল্লাহ্র] সান্নিধ্য লাভের উপায়। শীঘ্রই আল্লাহ্ তাদের নিজ রহমতের অন্তর্ভুক্ত করবেন ১৩৪৭। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু।
১৩৪৭। আল্লাহ্ রহমানুর রাহীম। তাঁর রহমত বিশ্বব্যাপী। আকাশ, পৃথিবী, ভূতল-সমুদ্র সর্বত্রই রহমতের হাত প্রসারিত। যার ইচ্ছা সেই পারে তাঁর রহমতের ধারায় অবগাহন করতে। এর জন্য প্রয়োজন আত্মিক শুদ্ধি, আত্মিক পবিত্রতা, প্রয়োজনীয় গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি। যদি আমরা নিজেদের সেভাবে তৈরী করতে পারি তবে আমরা আল্লাহ্র রহমতের সাগরে অবগাহন করতে সমর্থ হবো। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যে তীব্র আনন্দ অনুভূতি, তা অনুভব করার যোগ্যতা অর্জন করবো। উপমা হচ্ছে : সূর্যালোক যেমন সমস্ত পৃথিবীকে বিধৌত করে। ধনী গরীব যে কেউ খুশী তার উষ্ণতা উপভোগ করতে পারে। শুধু ব্যক্তির চেষ্টা থাকতে হবে ছায়াময় ঠাণ্ডা স্থান থেকে নিজেকে বের করে সূর্যকিরণে নিজেকে স্থাপন করা। ঠিক সেইরূপে আল্লাহ্র রহমত আমাদের বিধৌত করতে সবর্দা ব্যাকুল। বান্দাকে শুধু স্ব-ইচ্ছায় চেষ্টার দ্বারা তাঁর যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
রুকু-১৩
১০০। [ইসলামের] অগ্রদূত, ১৩৪৮ যারা [মুহাজির] প্রথম তাদের [জন্মভূমি] পরিত্যাগ করেছিলো এবং যারা [আনসার] তাদের সাহায্য করেছিলো এবং [সকল] ভালো কাজে যারা তাদের নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করে - আল্লাহ্ তাদের প্রতি প্রসন্ন থাকেন যেরূপ তারা তাঁর [আল্লাহ্র] প্রতি [প্রসন্ন থাকে]। তাদের জন্য তিনি [বেহেশ্তের] বাগান প্রস্তুত রেখেছেন পাদদেশ যার প্রবাহিত নদী ১৩৪৯। যেখানে তারা চিরদিন বাস করবে। এটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ সুখ।
১৩৪৮। ইসলামের পতাকা উত্তোলনকারী ও বহনকারী সেনাদলের পুরোধায় যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, তারা প্রতিকূল অবস্থা, বিপদ, দুর্যোগ, দুর্ভাগ্য কিছুতেই ভয় পান নাই। জীবনের পরিবর্তে তাঁরা ইসলামের পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। ইসলামের প্রথম অবস্থায় আত্মত্যাগের ইতিহাসের প্রথম সারিতে যারা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মুজাহির এবং আনসার। "মুহাজির" হচ্ছেন তাঁরাই যারা ধর্মের জন্য নিজ মাতৃভূমি মক্কা, সহায়, সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন - সব ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যদিও হিজরতকারীদের পূর্বাহ্নে প্রেরণ করে নিজে সবার শেষে বিপদ সঙ্কুল স্থান থেকে হিজরত করেন, তবুও "[ইসলামের] অগ্রদূত" শব্দটির সাহায্যে এখানে তাঁকেই বোঝানো হয়েছে। এর পরে বলা হয়েছে ''আনসার'' দের কথা। আনসার শব্দটির অর্থ সাহায্যকারী। মদীনাবাসীরা মুহাজিরদের সাদরে গ্রহণ করেন তাঁদের জন্য খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, সর্বপ্রকার সাহায্যের হস্ত তাঁরা প্রসারিত করেন। এভাবেই মদীনাতে নূতন মুসলিম সম্প্রদায়ের শুরু এবং আনসারদের সাহায্য সহযোগিতায় এই সম্প্রদায় বিকশিত হতে শুরু করে। এর পরে উল্লেখ করা হয়েছে "যারা নিষ্ঠার সাথে তাদেরকে অনুসরণ করে"।
[এই আয়াতটি ইংরেজী অনুবাদটি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কারণ, ইংরেজী অনুবাদে আয়াতটির অর্থ অনেক প্রাঞ্জল এবং হৃদয়গ্রাহী। - অনুবাদক।]
"The vanguard (of Islam) the First of those who forsook (their homes) and of those gave them aid and (also) those who follow them in (all) good deeds well pleased is Allah with them as are they with Him........."
মাওলনা ইউসুফ আলীর অনুবাদ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই "অনুসরণ" কথাটি শুধুমাত্র পরবর্তী হিযরতকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এঁরা হঁচ্ছেন তাঁরাই, যারা সৎ কাজে পূর্বোক্ত দলকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেন। অর্থাৎ সৎ কাজে প্রয়োজন পূর্বোক্ত দলের ন্যায় সর্বস্ব ত্যাগ করে আত্মোসৎর্গের জন্য প্রস্তুত। এই বাক্যটি শুধুমাত্র নবীর (সাঃ) সঙ্গী-সাথী, যারা তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন বা নবী (সাঃ)'র সমসাময়িক যারা, তাঁদের জন্য প্রযোজ্য তা-ই নয়, আল্লাহ্র এই বাণী সর্বযুগে সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ যারাই রাসূল (সাঃ)'র জীবনী অনুসরণ করে সৎ কাজে জীবন উৎসর্গ করবে, তাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট। সর্বকালের, সর্বযুগের, নারী-পুরুষ সকলের জন্য তা প্রযোজ্য। তাদের আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে আল্লাহ্ তাঁদের পুরষ্কৃত করবেন। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি তাদের আত্মাকে পৃথিবীর দুঃখ, কষ্ট,লোভ, লালসা, হিংসা, দ্বেষ, প্রভৃতি সকল মলিনতা থেকে মুক্তি দেবে। আত্মার মাঝে অপার শান্তি বিরাজ করবে। আর তা-হচ্ছে "জান্নাত"।
১৩৪৯। "জান্নাত" - আত্মার সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার শেষ আবাসস্থল। এই লাইনের আরও বহুবার কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সূরাতে আয়াত ৭২, ৮৯-এ উল্লেখ আছে। অংক শাস্ত্রে অংকের বহু ধাপকে এক লাইনের ফর্মুলার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, এখানেও সেই রকম পৃথিবীতে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার শেষে এক লাইনের উল্লেখ করা হয়েছে। তার অনন্ত গন্তব্যস্থলের ঠিকানাও সেরূপ।
১০১। তোমার চারিপার্শ্বের মরুবাসী আরবদের মধ্যে, এবং মদিনাবাসীদের মধ্যেও, কেহ কেহ মোনাফেক আছে ১৩৫০। তারা মোনাফেকিতে একগুঁয়ে জেদী। তুমি তাদের জান না, আমি তাদের জানি। তাদের আমি দু'বার শাস্তি দেবো। এবং উপরন্তু তাদের ভয়াবহ শাস্তির দিকে প্রেরণ করা হবে ১৩৫১।
১৩৫০। মরুবাসী আরবেরা খুব সহজ সরল প্রকৃতির নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ধূর্ত ও মুনাফিক। যারা মদিনার আশে পাশে ও মদিনাতে রাসূল (সাঃ)-এর সময়ে তাঁর সাহচর্যে বাস করতো এদের মাঝেও অনেকেই ছিলো ধূর্ত ও মুনাফিক।
[রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র চরিত্র ছিল পরশ পাথরের ন্যায়। লোহা যেরূপ পরশ পাথরের সংস্পর্শে সোনাতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, সেরূপ রাসূল (সাঃ)-এর সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন তাদের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে। তাঁরা ''সোনার'' মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন। সেই সময়ে নবী করীমের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শেও যাদের পরিবর্তন হয় নাই, যারা ধূর্ত ও মুনাফিক থেকে যায়, তাদের কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়। সে যুগেও নয়, এ যুগেও নয়। দেখুন এই সূরার ৯৭ নং আয়াত। এ থেকেই আরবদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবনযোগ্য।]
১৩৫১। এই আয়াতে বলা হয়েছে পৃথিবীতে মুনাফিকদের শাস্তি হবে দ্বিবিধ। বুদ্ধিমান লোকেরা বুঝতে পারবে যে ইসলামের অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু মুনাফিকরা ধূর্ত ও বুদ্ধিমান হওয়া সত্বেও তারা ইসলামের সৌন্দর্য্য, গুণরাজি, অগ্রযাত্রা বুঝতে হবে ব্যর্থ, ফলে তাদের অবস্থা হবে ছত্রভঙ্গ এবং তারা হবে পরাজিত। কারণ, মুনাফিকরা হবে অত্যন্ত অবাধ্য একগুঁয়ে ও অজ্ঞ। তাদের এই অজ্ঞতা, একগুঁয়েমী অবাধ্যতার জন্য পার্থিব জীবনে তাদের পরাজয়ের গ্লানি ও ছত্রভঙ্গ অবস্থা মেনে নিতে হবে। এই অপমান ও গ্লানিই শেষ কথা নয়, পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
[উপদেশ : কুরআনের বাণী সর্বকালের, সর্বযুগের ও সর্বসাধারণের জন্য প্রযোজ্য। এই আয়াতে মুনাফিকদের দ্বিবিধ শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা শুধু যে মরুবাসী মুনাফিকদের জন্য প্রযোজ্য তা মনে করলে ভুল হবে। তা সকল দেশের সকল যুগে সকল মুনাফিকের জন্য প্রযোজ্য। প্রথমতঃ তারা যে কোনও ব্যাপারে সঠিক অবস্থান বুঝতে হবে ব্যর্থ, তাদের কারণে দূরদর্শিতার থাকবে অভাব, দ্বিতীয়তঃ মতানৈক্যের ফলে তাদের মধ্যে একতা থাকবে না, ফলে তারা খুব সহজেই শত্রু দ্বারা ছত্রভঙ্গ অবস্থায় পতিত হবে এবং পরাজয়ের গ্লানি বহন করবে। মন্থব্য : বাংলাদেশীদের অবস্থা। - অনুবাদক।]
১০২। [সেখানে] অপর কিছু লোক আছে যারা তাদের পাপকে স্বীকার করে। তারা একটি ভালো কাজের সাথে একটি মন্দ কাজ মিশিয়ে ফেলেছে সম্ভবতঃ আল্লাহ্ তাদের দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু ১৩৫২।
১৩৫২। সংসারে সকল লোকের মনোবল সমান থাকে না। পৃথিবীতে বেশির ভাগ লোক দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়। তারা খুব সহজে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই সব লোকের কথাই এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের অনেকের চরিত্রেই অনেক ভালো গুণাবলী উপস্থিত, কিন্তু দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়ার জন্য, তারা খুব সহজেই মন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরে। এদের চরিত্রে অনেক ভালো এবং মন্দের মিশ্রণ দেখা যায়। এদের জন্য আল্লাহ্ এই আয়াতে ক্ষমার আশ্বাস দিয়েছেন। অবশ্য তা শর্ত সাপেক্ষ। নিজ অপরাধ সনাক্ত করে স্বীকার করতে হবে এবং অনুতাপ, সৎকর্মের মাধ্যমে আত্মাকে পূত পবিত্র করার চেষ্টা করবে। তবেই তারা আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়ালু । রাসূলকে (সাঃ) তাদের আত্মার পবিত্রার জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে, নীচের আয়াতে দেখুন।
[উপদেশ : রাসূলুল্লাহ্র (সাঃ) সময়ে যারা দুর্বল চরিত্রের লোক তাদের উদ্দেশ্যে এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এর উপদেশ সর্বজনীন-যুগ, কাল, দেশ অতিক্রান্ত -সকল মানব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য।]
১০৩। তাদের সম্পদ থেকে সদ্কা গ্রহণ কর, যেনো তুমি তাদের পবিত্র ও পাপমুক্ত করতে পার। তাদের পক্ষ থেকে প্রার্থনা কর। অবশ্যই তোমরা প্রার্থনা তাদের জন্য নিরাপত্তার উৎস। এবং একমাত্র আল্লাহ্-ই সব শোনেন এবং সব জানেন।
১০৪। তারা কি জানে না যে আল্লাহ্ তাঁর উপাসনায় আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তির অনুতাপ ও দানের উপহার সামগ্রী গ্রহণ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বার বার তওবা গ্রহণকারী, পরম করুণাময়।
১০৫। এবং বলঃ, ''[পূণ্য] কাজ কর ১৩৫৩। শীঘ্রই আল্লাহ্ তোমাদের কাজ নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীগণও [করবে]। যা কিছু লুক্কায়িত এবং যা কিছু দৃশ্যমান এসবের পরিজ্ঞাতার নিকট তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে; তারপরে তোমরা যা করেছিলে তার সত্যতা সম্বন্ধে তিনি তোমাদের জানাবেন।''
১০৪। তারা কি জানে না যে আল্লাহ্ তাঁর উপাসনায় আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তির অনুতাপ ও দানের উপহার সামগ্রী গ্রহণ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বার বার তওবা গ্রহণকারী, পরম করুণাময়।
১০৫। এবং বলঃ, ''[পূণ্য] কাজ কর ১৩৫৩। শীঘ্রই আল্লাহ্ তোমাদের কাজ নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীগণও [করবে]। যা কিছু লুক্কায়িত এবং যা কিছু দৃশ্যমান এসবের পরিজ্ঞাতার নিকট তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে; তারপরে তোমরা যা করেছিলে তার সত্যতা সম্বন্ধে তিনি তোমাদের জানাবেন।''
১৩৫৩। যারা অনুতাপকারী তাদের এই আয়াতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। অনুতাপের পূর্বশর্তই হচ্ছে সেই পাপের আর পুনরাবৃত্তি না করা এবং নিজ চরিত্রকে সংশোধন করা যেনো পূর্বের ভুলের বা পাপের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এ ব্যাপারে মু'মিন বান্দাদের এসব দুর্বল লোকদের উৎসাহ প্রদান করতে বলা হয়েছে, যেনো এসব লোক তাদের চরিত্রে দুর্লভ গুণাবলীর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। চারিত্রিক গুণাবলীর-ই হচ্ছে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং অতীতের দোষ-ত্রুটি দূর করতে সাহায্য করে। এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, যখন আত্মা এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে অনন্তলোকে যাত্রা শুরু করবে, তখন তারা বুঝতে পারে, তাদের অনুতাপের মাধুর্য্য, স্বর্গীয় ক্ষমার মহিমা, যা তাদের আত্মিক যন্ত্রণার উপশম করে দেবে। অপরপক্ষে যারা পাপী, মুত্যৃর পরে তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবে, সত্য মিথ্যার প্রভেদ বোঝার ক্ষমতা জন্মাবে - তাদের আত্মিক অবনতির ধারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে [দেখুন ৯ : ৯৪]। "তিনি তোমাদের জানাবেন" - বাক্যাংশটি দ্বারা এই ভাবেই প্রকাশ করা ঘটেছে।
১০৬। [তদ্ব্যতীত] আরও কতক আছে, আল্লাহ্র আদেশের প্রতীক্ষায় যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রইল, তিনি [আল্লাহ্] কি তাদের শাস্তি দেবেন না ক্ষমা করবেন ? এবং আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময় ১৩৫৪।
১৩৫৪। এরা হলেন কা'ব ইবনে মালিক, মারারা; ইবনে রাবী (আঃ) ও হিলাল ইবন উমায়্যা (রাঃ), তাঁরা আলস্য করে তাবুক অভিযানে শরীক হন নাই। এ জন্য তাঁদেরকে একঘরে রাখা হয়েছিল; ৫০দিন এভাবে থাকার পর আল্লাহ্ তাঁদের তওবা কবুল করেন। যদিও আয়াতগুলি তাবুক অভিযানের পটভূমিতে নাজিল হয়, কিন্তু এর উপদেশ সর্বজনীন-যুগ কাল অতিক্রান্ত। উপরের আয়াতগুলিতে তিন ধরণের লোকের বর্ণনা করা হয়েছে। (১) প্রথম শ্রেণী : যারা সর্বান্তকরণে মুনাফিক, তারা তাদের মুনাফেকী কোন সময়ে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে না সর্বদা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে তাদের অপকর্মের স্বপক্ষে যুক্তির অবতারণা করবে, যেনো নিজেকে লোক চক্ষে হেয় প্রমাণিত হতে না হয়। এরা হলো একগুঁয়ে, অবাধ্য, ফলে অজ্ঞ। এদের আত্মিক মুক্তির কোন উপায় নাই। দেখুন আয়াত [৯ : ১০১]। (২) দ্বিতীয় শ্রেণী হলো : তারা খুব সহজে প্রভাবিত হয়। ফলে কুপ্রভাবের সংস্পর্শে তারাই সহজে প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তারা সর্বান্তকরণে মন্দ নয়, ভিতর বাহির সর্বৈব মুনাফিক নয়। এরা খুব সহজেই বুঝতে পারে এবং অনুতপ্ত হয় এবং এদের অনুতাপ আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। দেখুন সূরা ৯, আয়াত ১০২-১০৫। এবং (৩) তৃতীয় শ্রেণী হচ্ছে : যেসব ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে (doubtful case)। কিন্তু এক্ষেত্রে বলা হয়েছে আল্লাহ্ এদের ভার গ্রহণ করবেন, "শাস্তি দেবেন, না ক্ষমা করবেন"। কারণ আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।
১০৭। আরও একদল যারা মসজিদ স্থাপন করেছিলো অমঙ্গল, নাস্তিকার স্বরূপ ১৩৫৫ এবং মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য, এবং যে ব্যক্তি ইতিপূর্বে আল্লাহ্ তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তার ঘাঁটি স্বরূপ ১৩৫৬। তারা অবশ্যই শপথ করে বলবে, যে ভালো ব্যতীত মন্দ করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যে অবশ্যই তারা মিথ্যাবাদী।
১৩৫৫। তিন ধরণের মুনাফিকের বর্ণনা পূর্বে করা হয়েছে। দেখুন টীকা নং ১৩৫৪। এখানে চতুর্থ ধরণের পাপচারীর উল্লেখ আছে। এর বর্ণনা হচ্ছে : Qubaa শহরে মসজিদ "Mosque of mischief (dhirar)" নির্মাণের কাহিনীর মাধ্যমে। কুবা স্থানটি মদিনার শহরতলীতে অবস্থিত এবং মদিনা থেকে তিন মাইল দক্ষিনে-পূর্বে এর অবস্থান। সুদীর্ঘ যাত্রা শেষে নবী করিম (সাঃ) হিজরত করে যখন মদিনাতে আসেন, মদিনা শহরে প্রবেশের পূর্বে তিনি এই স্থানে ৪ দিন বিশ্রাম গ্রহণ করেন। এখানেই প্রথম মসজিদ তৈরী হয়। মদিনাতে অবস্থান কালে হযরত (সাঃ) এই মসজিদে (Mosque of Piety) প্রায়ই নামাজ পড়তে আসতেন। বনি গানাম (Banu Ganam) গোত্রের কিছু মুনাফিক এই সুযোগ গ্রহণ করে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে (Qubaa) মসজিদের উল্টোদিকে আরও একটি মসজিদ তৈরী করে। কিন্তু এমন ভান করতে থাকে যে তারা ইসলামের প্রসারের জন্যই তা করেছে। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করে আবু আমির রাহিব খাযরাজী নামক এক ব্যক্তি। এই ব্যক্তি ওহুদের যুদ্ধে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই ব্যক্তি খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করে সংসারত্যাগী হয়েছিলো। মদিনার লোকেরা তাকে ইসলাম গ্রহণে আমন্ত্রণ জানালে সে তা অস্বীকার করে এবং হযরত (সাঃ) এর সাথে শত্রুতা করতে থাকে। এই ব্যক্তি মদিনার কিছু মুনাফিককে মসজিদ তৈরী করার পরামর্শ দেয়, যাতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায় এবং এই মসজিদে মিলিত হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)'র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যায়। তারা মসজিদ তৈরী করে এবং সেখানে সালাত আদায় করার জন্য হযরত (সাঃ) কে অনুরোধ জানায়। তিনিই হুনাইন যুদ্ধ শেষ করে ৯ম হিজরীতে মদিনাতে ফিরে এসে সেই মসজিদে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ মসজিদটি স্বরূপ প্রকাশ করেন। অতঃপর হযরত (সাঃ) মসজিদটি জ্বালিয়ে দিতে নির্দেশ দেন।
[উপদেশ : ধর্ম নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করা মুনাফিকদের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে সর্বসাধারণকে সাবধানতা অম্বলন করতে হবে, বিশেষভাবে নেতাকে কঠোর হস্তে তা দমন করতে হবে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে যে বিভেদ তা এরই ফলশ্রুতি।]
১৩৫৬। এই ব্যক্তির নাম আবু আমির যারা পদবী ছিল রাহিব (ভিক্ষু); কারণ সে (খ্রীষ্টান সাধুদের) মঠের সংস্পর্শে ছিল। দেখুন পূর্বের টীকা।
১০৮। তুমি কখনও সেখানে দাঁড়াবে না। যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকে আল্লাহ্র ভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ১৩৫৭, সেটাই তোমার [প্রার্থনায়] দাঁড়ারাব জন্য অধিক উপযোগী। সেখানে এমন লোক আছে যারা পবিত্র হতে ভালোবাসে। এবং যারা নিজেদের পবিত্র করে আল্লাহ্ তাদের ভালোবাসেন ১৩৫৮।
১৩৫৭। "Mosque of piety" বা তাক্ওয়ার উপর ভিত্তি করে যা নির্মিত। মদিনার উপকণ্ঠে ক্কুবা নামক স্থানে প্রথম এই মসজিদটি স্থাপন করেন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজে।১৩৫৮। সত্যিকার মু'মিন বান্দার শরীর, মন, হৃদয়, আত্মা, সর্বক্ষেত্রে হতে হবে পূত পবিত্র, নির্মল। এই পবিত্রতা শুধুমাত্র বাহ্যিক বা শারীরিক নয়। তাঁর চিন্তা, ভাবনা, কর্মজগৎ, সব হবে পাপমুক্ত; পূত-পবিত্র। তাঁর হৃদয়, মন, আত্মা, সবই হবে পৃথিবীর মলিনতামুক্ত। ক্ষুদ্রস্বার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থের কলুষতা থেকে তাঁর আত্মা হবে নিষ্কলুষ। তাঁর ধর্ম, বা আল্লাহ্র কাছে তাঁর আত্মা-নিবেদন হবে আন্তরিক, বিশ্বস্ত। এঁরাই হচ্ছেন পবিত্রতা অর্জনকারী।
১০৯। তাহলে কোনটা উৎকৃষ্ট ? যে ব্যক্তি তার [জীবনের] ভিত্তি আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি এবং তাঁর সন্তুষ্টির উপর স্থাপন করেছে সে অথবা যে ব্যক্তি তাঁর [জীবনের] ভিত্তি ধংসোন্মুখ বালিয়াড়ির খাতের কিনারায় স্থাপন করে সে ? ফলে তাকে সহ উহা জাহান্নামের আগুনে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে পতিত হয়। যারা পাপ করে আল্লাহ্ তাদের পথ প্রর্দশন করেন না। ১৩৫৯।
১৩৫৯। অপূর্ব উপমার সাহায্যে স্থায়ী সাফল্য ও ক্ষণস্থায়ী সাফল্যের রূপকে এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জীবনবোধ ও মূল্যবোধ 'তাক্ওয়া' বা আল্লাহ্-ভীতির উপরে অবস্থিত, তারাই সাফলকাম। তাক্ওয়া বা আল্লাহ্ - ভীতি অর্থাৎ যে ধর্মীয় বিশ্বাস বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা, সততা, এক আল্লাহ্ উপরে নির্ভরশীলতার উপরে প্রতিষ্ঠিত, তার ভিত্তি অত্যন্ত সুদৃঢ় ও মুজবুত। তা এত মুজবুত যে কঠিন পর্বতের ন্যায় দৃঢ়, যাতে কখনও সামান্য ফাটল পর্যন্ত ধরবে না। অপরপক্ষে যে বিশ্বাস আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বস্ততা, সততা, আন্তরিকতা ও নির্ভরশীলতার থেকে উৎপন্ন নয়, তার উপমা হচ্ছে চোরাবালির চূড়ায় প্রাসাদ নির্মাণের ন্যায়। সে জানে না তার প্রাসাদ ধ্বংসের প্রান্তসীমার দাঁড়িয়ে। কারণ চোরাবালির নিম্নেদেশের মাটি সর্বদাই সরে যায়। আর যখন তা ঘটে চোরাবালির চূড়ায় নির্মিত সুরম্য অট্টালিকা এক মূহুর্তে ধ্বংসে যায়। অবিশ্বস্ত, কপট, খল, ব্যক্তিদের সকল কাজের শেষ পরিণতিকে উপরের উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের কর্মফলের সাথে সাথে তাদেরও ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠে। এই উপমার আবেদন সর্বজনীয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কারণ মানুষের বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা, সততা,-সবকিছুই তার দৈনন্দিক জীবনে, কর্মজগতের সাথে সম্পৃক্ত। এ কথা কেউ দাবী করতে পারেবে না যে সে তার কর্মজগতে অসৎ, অবিশ্বস্ত, মুনাফিক হওয়া সত্বেও ধর্মীয় জগতে বিশ্বস্ত ও সৎ। মানুষের কর্মজগতেই তার চরিত্রের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। এই মূল্যবোধ যদি তাক্ওয়ার ভিত্তিতে গড়ে না ওঠে, তবে তার সকল কর্ম, ঈমান, ধর্ম-কর্ম সবকিছুই ঐ উপমার মত চোরাবালির উপরে প্রতিষ্ঠিত। এ কথা ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য, জাতির জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। এ-ই আল্লাহ্র বিধান।
[মন্তব্য : বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা ও বর্তমান মুসলিম সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য এই উপমার সাহায্যে অনুধাবনযোগ্য। - অনুবাদক।]
১১০। এভাবে যারা [জীবনের ] ভিত্তি স্থাপন করে তাদের হৃদয় কখনও সন্দেহ ও দ্বিধামুক্ত হতে পারে না, যতক্ষণ না তাদের অন্তর ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে পড়ে। আল্লাহ ্সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময় ১৩৬০।
১৩৬০। "অন্তর ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে পড়ে", ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে : Their hearts cut ot pieces.। এই লাইনের অর্থ যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু ঘটে। পূর্বের আয়াতে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে রূপকের সাহায্যে সুন্দরভাবে উপস্থান করা হয়েছে। এই আয়াতে তারই ধারাবাহিকতার বর্ণনা আছে। "Heart" বা "অন্তর" এই শব্দটি কুরআনে শরীফে বহুস্থানে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের হৃদয় বা "অন্তর" হচ্ছে : প্রেম, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষার উৎপত্তিস্থল। হৃদয় হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক জীবনের মূল ভিত্তি। আর এই ভিত্তির মূল একক হচ্ছে বিশ্বস্ততা, সততা, আন্তরিকতা ও আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নির্ভশীলতা। যদি এই বিশ্বোসের মূল ভিত্তি দুর্বল হয়, তখন তার উপমা হচ্ছে চোরাবালির উপরে দাঁড়ানো প্রাসাদের ভিত্তির মতন। সেক্ষেত্রে তার প্রতিটি পদক্ষেপ, জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপে, সে হবে অবিশ্বস্ত, ফলে সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ। আল্লাহ্র প্রতি নির্ভশীলতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে তার চরিত্রের দৃঢ়তা হবে অন্তর্হিত। ফলে সে যে কোনও বিপদ বা বিপর্যয়ে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছু, যেমন রত্ন-পাথর, মাজারে মান্নত,পীরের দোয়া ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করতে ছুটে যাবে। তার আত্মা বাঁধা পড়ে যাবে কুসংস্কারের বেড়াজালে। সন্দেহ, কুসংস্কার অস্থিরতা, ভয় তার হৃদয়ের সকল সুপ্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে দেবে। এ যেনো চোরাবালির চূড়া যা প্রতি মূহুর্তে ধ্বংসে পড়ার জন্য প্রস্তুত। এর ফলে ঐ ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র যেমন ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, ঠিক ও সেরূপ তার আধ্যাত্মিক জীবন।
রুকু-১৪
১৩৬১। এই পৃথিবীতে সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় আদান-প্রদানের মাধ্যমে। পৃথিবীতে পিতামাতার স্নেহ-ভালোবাসা ব্যতীত আর সবই নিয়ন্ত্রিত হয় আদান-প্রদানের ভিত্তিতে। কিছু দিয়ে তবে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতে হয়। এই আয়াতে মানুষের সাথে আল্লাহ্র স্বর্গীয় আদান-প্রদানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ মানুষের নিকট জীবন অর্থাৎ মানুষের পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ দাবী করেন। প্রয়োজনে আল্লাহ্র রাস্তায় সে এই জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। অর্থাৎ বান্দার আত্মা, বেঁচে থাকা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই হবে সে পরম করুণাময়ের নিকট নিবেদিত। "সম্পদ" অর্থাৎ পার্থিক সম্পদ, যথা : অর্থ বিত্ত, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, মেধা, মননশক্তি, প্রতিভা, শক্তি, সাফল্য ইত্যাদি পৃথিবীর জীবনে যা কিছু বান্দাকে সম্পদশীল করে, সম্পদ কথাটি তারই প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এ থেকে এ কথা কেউ যেন না ভাবে যে, শুধুমাত্র অর্থের মাপকাঠিতেই এই সম্পদ মূল্যায়ণ করা যাবে। আল্লাহ্ বান্দার কাছে "জীবন" চেয়েছেন। এখানে জীবন ও সম্পদ দুটোই প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। জীবন ও সম্পদ দুটোই আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে নিবেদিত করতে হবে। বিনিময়ে আল্লাহ্ বান্দাকে দিয়েছেন অনন্ত শান্তির আশ্বাস। যে মানুষ আল্লাহ্র রাস্তার সংগ্রাম করে, এবং এই সংগ্রামের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তার পার্থিব সম্পদের ক্ষতি হয়, অনেক সময়ে জীবন পর্যন্ত হুমকীর সম্মুখীন হতে হয়। এই সংগ্রম হচ্ছে ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম-কারণ, পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠাই হচ্ছ আল্লাহ্র বিধান প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ্র বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় শ্রেষ্ঠ সংগ্রাম। এই সংগ্রামে তুচ্ছ ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জিনিসের পরিবর্তে বান্দা লাভ করবে আত্মার চিরস্থায়ী মুক্তি (salvation)। আমাদের জীবন পার্থিব আশা-আকাঙ্ক্ষায় বন্দী। ফলে আত্মা হয়ে পড়ে বিভিন্ন রিপুর দাস। রিপুতাড়িত ব্যক্তি বিভিন্ন রিপু দ্বারা সর্বদা মানসিক দিকে থেকে বিক্ষিপ্ত থাকে। যেমন- হিংসা-দ্বেষ লোভ-লালসা, ক্রোধ ইত্যাদি মানুষের আত্মার শান্তিকে বিভিন্নভাবে বিঘ্নিত করে। এসব রিপু থেকে যখন ব্যক্তি মুক্তিলাভ করতে পারে, তখনই কেবলমাত্র সে তার আত্মার মাঝে স্বর্গীয় পরশ অনুভব করতে পারে। স্বর্গীয় পরশ যে এক বার অনুভব করেছে, সে-ই জানে এর অনুভূতি। আত্মার মুক্তি বা salvation ঘটে। অনন্ত অপার শান্তি তার আত্মাকে ভরিয়ে দেয় - যা হচ্ছে সর্বোচ্চ সফলতা বা পাওয়া।
১৩৬২। যদি আমরা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে পারি [যার অর্থ ইসলাম বা শান্তি], তবেই আমাদের মুক্তি, আমাদের আত্মা রিপুর দহন থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে স্ব-ইচ্ছায় এই পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই হচ্ছে আত্মার মুক্তির একমাত্র পথ বা নির্দেশ। এই আয়াতে বিশেষ উপদেশের দিকে বিশ্ব মুসলিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এই বিশেষ উপদেশটি শুধুমাত্র যে কুরআনে আছে তা-ই নয়, এই উপদেশ হযরত মুসা (আঃ) এর কিতাব তাওরাত ও হযরত ঈসা (আঃ)-এর কিতাব ইঞ্জিলেরও মর্মবাণী। সময়ের ব্যবধানে আল্লাহর মূল বাণীকে ইহুদী ও খৃষ্টানেরা পরিবর্তন করে ফেলেছে। ফলে বর্তমানে তাওরাত ও ইঞ্জিলে যা লিখা রয়েছে কুরআন তার অধিকাংশই গ্রহণ করে না, কারণ তা হচ্ছে আল্লাহ্র বাণীর বিকৃত রূপ। যেমন : খৃষ্টানেরা বিশ্বাস করে হযরত ঈসা পৃথিবীতে রক্ত দান করেছেন, অর্থাৎ নিহত হয়েছেন পৃথিবীর পাপী লোকদের পাপ মোচনের জন্য। তাঁর রক্তের বিনিময়ে পাপীরা মুক্তি পাবে। পাপস্খলনের জন্য তাদের মধ্যবর্তী ধর্ম-যাজক শ্রেণীর প্রয়োজন হয়। পাপস্খলনের মধ্যবর্তী এই ব্যবস্থা মূল তাওরাত ও ইঞ্জিলেও [বিকৃত হওয়ার পূর্বে] নাই। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে বান্দার পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই হচ্ছ পাপস্খলনের একমাত্র উপায়। অপর কোন ব্যক্তির সহায়তায় তা হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে তারাই সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী যারা ''আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম করে, হত্যা করে, নিহত হয়।'' এই সংগ্রাম হবে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব উভয়ই। আমাদের দিক থেকে আল্লাহ্র জন্য আত্মত্যাগ অতি সামান্য, কিন্তু বিনিময়ের পাওনা অনেক-অনন্ত শান্তি, অপার প্রশান্তি, আত্মার মুক্তি (salvation), সুতরাং আমাদের জন্য তা সুসংবাদ বৈকি।
১৩৬৪। এই আয়াত মৃত ব্যক্তির জানাযা সংক্রান্ত। তাদের জন্য ক্ষমা বা প্রার্থনা বা তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ নিষেধ করা হয়েছে, যারা : (১) ইসলাম গ্রহণ না করেই, নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত না হয়েই মৃত্যুবরণ করে; (২) যারা সক্রিয়ভাবে শেষ পর্যন্ত ইসলামের প্রসারে বাঁধা সৃষ্টি করে।
১৩৬৫। হযরত ইব্রাহীম ও তাঁর কাফের পিতার কথা সূরা ৬, আয়াত ৭৪ এর বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম তাঁর কাফের পিতার আত্মার মুক্তির জন্য সর্বদা প্রার্থনা করতেন। কিন্তু উপরের আয়াতটিতে [১১৩ নং] যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা যখন তাঁর কাছে অবতীর্ণ হলো, তখন থেকে তিনি তাঁর পিতার জন্য আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বিরত হন। কারণ শর্তগুলি তাঁর পিতার জন্যও প্রযোজ্য ছিল। এর থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে আধ্যাত্মিক জীবন হচ্ছে স্থায়ী জীবনের ঠিকানা। ইহকালে পৃথিবীর নিকট বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও তা ক্ষণস্থায়ী। আধ্যাত্মিক দিক থেকে যদি তারা পরস্পরের বিপরীতধর্মী ও শত্রুভাবান্ন হয়, তবে মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের সে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। যেমন- হযরত ইব্রাহীমের দোয়া তাঁর পিতার জন্য প্রযোজ্য ছিল না যদিও তিনি ছিলেন ইব্রাহীমের পিতা। পিতার মঙ্গলের জন্য, আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার আশায় পিতার জন্য হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দোয়া করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন [দেখুন সূরা ১৯, আয়াত ৪৭]।
১৩৬৬। হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) ছিলেন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সাঃ)-এর মতই কোমল হৃদয়। তিনি সর্বদা তাঁর পিতার মঙ্গলের জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আল্লাহ্র নির্দেশ এলো যে কাফেরদের জন্য মু'মিন বান্দাদের দোয়া করা উচিৎ নয়। আল্লাহ্ রাহমানুর রাহীম। এই মহাবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তাঁর প্রণীত আইনের দ্বারা চলে। বিশ্ব ভুবন, আকাশ-পাতাল, তরু-লতা, পশু-পাখী, আলো-হাওয়া, সবকিছুই আল্লাহ্র প্রবর্তিত আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। যদি কেউ সামান্যতমও তাঁর আইনের বাইরে চলতো, তবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বোঝাতে চেষ্টা করবো। যেমন সূর্য্য পূর্ব দিকে ওঠে, আলো সরল রেখাতে চলে ইত্যাদি ভৌত বিজ্ঞানের আইন অনাদি-অনন্তকাল থেকে নির্ভুলভাবে চলে আসছে। ঠিক সেইরূপ আধ্যাত্মিক জগতেরও আইন আছে। যেমন : আল্লাহ্ প্রদত্ত নৈতিক নীতিমালা মেনে চললে আত্মিক উন্নতি লাভ ঘটবে। আর যারা মেনে চলে না, আল্লাহ্কে অস্বীকার করে, তাদের আধ্যাত্মিক জগত অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবে। সেসব আত্মার মুক্তি (salvation) নাই। যখন আল্লাহ্র নবীরা (আঃ) বা মু'মিন বান্দারা আল্লাহ্র দরবারে হাত তোলে আল্লাহ্ তাঁদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন-এও আধ্যাত্মিক জগতের একটা আইন। কিন্তু সেই প্রার্থনা যদি হয় কাফের আত্মার মুক্তির জন্য, তবে আল্লাহ্কে মু'মিন বান্দার আর্জি মঞ্জুর করার জন্য নিজের আইন ভঙ্গ করতে হয়। অর্থাৎ এক আইন রক্ষা করতে আর এক আইন ভঙ্গ করতে হয়। বিশ্ব ভুবনে আল্লাহ্র আইন অলঙ্ঘনীয়। যদিও কোমল-হৃদয় ও ধৈর্য্যশীল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর জন্য তাঁর পিতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে অত্যন্ত কষ্ট হয়েছিলো, কারণ তা ছিল তাঁর প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে, তবুও তিনি যখন আল্লাহ্র হুকুম অনুধাবন করতে পারলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। যারা কাফের, যারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে, আল্লাহ্র সাথে শরীক করে, তাদের জন্য আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চাওয়া আল্লাহ্র আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার শামিল, সুতরাং অন্যায়।
১৩৬৭। জীবন চলার পথে, পৃথিবীর সুদীর্ঘ পথ অতিক্রমকালে আমাদের জানতে হয় কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা পাপ, কোনটা পূণ্য। আল্লাহ্ কিতাবের মাধ্যমে এ সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশ দান করেছেন। সুতরাং যারা বিশ্বাসী তারা যেনো কখনও মানবিক দুর্বলতার জন্য আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ ত্যাগ করে ভুল পথে না যায়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে আল্লাহ্র দেয়া নৈতিক নীতিমালা যুগে যুগে অপরিবর্তণীয় রয়ে গেছে - হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত। সময়ের ব্যবধানে কুরআন ব্যতীত অন্যান্য কিতাব কলুষিত হয়ে গেছে। একমাত্র কুরআনই অবিকৃত রয়ে গেছে। "তাদেরকে পথভ্রান্ত করবেন না" - বাক্যাংশটি দ্বারা এই ভাবকেই বোঝানো হয়েছে।
১৩৬৯। "তাদের একদলের হৃদয় [কর্তব্য থেকে] ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।" ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে,"The hearts of a part them had nearly swerved (from duty);"। সাধারণ মানুষ মাত্রেই আরাম আয়েশের প্রত্যাশী। এটা তাদের চরিত্রগত দুর্বলতা। তাই দেখা যায় মানুষ সাধারণতঃ যেখানে শারীরিক কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে স্থানকে পরিহার করতে চায়। তাবুক অভিযানের সময়ে মুহাজিরদের অনেকের মানসিক অবস্থা এরূপ হয়েছিলো। কারণ সে সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল এবং স্থানটি মদিনা থেকে বেশ দূরে ছিল, আর পথ ছিল মরুভূমির মধ্য দিয়ে। মরুভূমির মাঝে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ পরিহার করার প্রবণতা সাধারণ মানুষের চরিত্রে জন্মলাভ করা স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত যারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, তারা আল্লাহ্র করুণায় তা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নিজ নিজ কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করেন। অর্থাৎ তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। জিহাদে তাদের যে প্রাথমিক দ্বিধা ঘটেছিলো, পরম করুণাময় তা ক্ষমা করে দেন।
[উপদেশ : সাধারণ মানুষের দুর্বলতা আল্লাহ্ ক্ষমা করে দেন, যদি সে তার ভুলকে সংশোধন করে নেয়। এ কথা সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য।]
১১১। আল্লাহ্ বিশ্বাসীদের নিকট থেকে তাদের জীবনে ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছে। [বিনিময়ে] তাদের জন্য রয়েছে [বেহেশ্তের] বাগান ১৩৬১। তারা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করে, হত্যা করে এবং নিহত হয়। তাওরাত ইঞ্জিল এবং কুরআনে তিনি [আল্লাহ্] সত্য সহ এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ১৩৬২। আল্লাহ্ ব্যতীত নিজ অঙ্গীকার পালনে কে বেশী বিশ্বস্ত ? সুতরাং যে লাভজনক আদান-প্রদান তোমরা করেছ তার জন্য আনন্দ কর। সেটাই তো মহাসাফল্য।
১৩৬১। এই পৃথিবীতে সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় আদান-প্রদানের মাধ্যমে। পৃথিবীতে পিতামাতার স্নেহ-ভালোবাসা ব্যতীত আর সবই নিয়ন্ত্রিত হয় আদান-প্রদানের ভিত্তিতে। কিছু দিয়ে তবে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতে হয়। এই আয়াতে মানুষের সাথে আল্লাহ্র স্বর্গীয় আদান-প্রদানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ মানুষের নিকট জীবন অর্থাৎ মানুষের পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ দাবী করেন। প্রয়োজনে আল্লাহ্র রাস্তায় সে এই জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। অর্থাৎ বান্দার আত্মা, বেঁচে থাকা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই হবে সে পরম করুণাময়ের নিকট নিবেদিত। "সম্পদ" অর্থাৎ পার্থিক সম্পদ, যথা : অর্থ বিত্ত, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, মেধা, মননশক্তি, প্রতিভা, শক্তি, সাফল্য ইত্যাদি পৃথিবীর জীবনে যা কিছু বান্দাকে সম্পদশীল করে, সম্পদ কথাটি তারই প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এ থেকে এ কথা কেউ যেন না ভাবে যে, শুধুমাত্র অর্থের মাপকাঠিতেই এই সম্পদ মূল্যায়ণ করা যাবে। আল্লাহ্ বান্দার কাছে "জীবন" চেয়েছেন। এখানে জীবন ও সম্পদ দুটোই প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত। জীবন ও সম্পদ দুটোই আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে নিবেদিত করতে হবে। বিনিময়ে আল্লাহ্ বান্দাকে দিয়েছেন অনন্ত শান্তির আশ্বাস। যে মানুষ আল্লাহ্র রাস্তার সংগ্রাম করে, এবং এই সংগ্রামের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তার পার্থিব সম্পদের ক্ষতি হয়, অনেক সময়ে জীবন পর্যন্ত হুমকীর সম্মুখীন হতে হয়। এই সংগ্রম হচ্ছে ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম-কারণ, পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠাই হচ্ছ আল্লাহ্র বিধান প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ্র বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় শ্রেষ্ঠ সংগ্রাম। এই সংগ্রামে তুচ্ছ ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জিনিসের পরিবর্তে বান্দা লাভ করবে আত্মার চিরস্থায়ী মুক্তি (salvation)। আমাদের জীবন পার্থিব আশা-আকাঙ্ক্ষায় বন্দী। ফলে আত্মা হয়ে পড়ে বিভিন্ন রিপুর দাস। রিপুতাড়িত ব্যক্তি বিভিন্ন রিপু দ্বারা সর্বদা মানসিক দিকে থেকে বিক্ষিপ্ত থাকে। যেমন- হিংসা-দ্বেষ লোভ-লালসা, ক্রোধ ইত্যাদি মানুষের আত্মার শান্তিকে বিভিন্নভাবে বিঘ্নিত করে। এসব রিপু থেকে যখন ব্যক্তি মুক্তিলাভ করতে পারে, তখনই কেবলমাত্র সে তার আত্মার মাঝে স্বর্গীয় পরশ অনুভব করতে পারে। স্বর্গীয় পরশ যে এক বার অনুভব করেছে, সে-ই জানে এর অনুভূতি। আত্মার মুক্তি বা salvation ঘটে। অনন্ত অপার শান্তি তার আত্মাকে ভরিয়ে দেয় - যা হচ্ছে সর্বোচ্চ সফলতা বা পাওয়া।
১৩৬২। যদি আমরা আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে পারি [যার অর্থ ইসলাম বা শান্তি], তবেই আমাদের মুক্তি, আমাদের আত্মা রিপুর দহন থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে স্ব-ইচ্ছায় এই পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই হচ্ছে আত্মার মুক্তির একমাত্র পথ বা নির্দেশ। এই আয়াতে বিশেষ উপদেশের দিকে বিশ্ব মুসলিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এই বিশেষ উপদেশটি শুধুমাত্র যে কুরআনে আছে তা-ই নয়, এই উপদেশ হযরত মুসা (আঃ) এর কিতাব তাওরাত ও হযরত ঈসা (আঃ)-এর কিতাব ইঞ্জিলেরও মর্মবাণী। সময়ের ব্যবধানে আল্লাহর মূল বাণীকে ইহুদী ও খৃষ্টানেরা পরিবর্তন করে ফেলেছে। ফলে বর্তমানে তাওরাত ও ইঞ্জিলে যা লিখা রয়েছে কুরআন তার অধিকাংশই গ্রহণ করে না, কারণ তা হচ্ছে আল্লাহ্র বাণীর বিকৃত রূপ। যেমন : খৃষ্টানেরা বিশ্বাস করে হযরত ঈসা পৃথিবীতে রক্ত দান করেছেন, অর্থাৎ নিহত হয়েছেন পৃথিবীর পাপী লোকদের পাপ মোচনের জন্য। তাঁর রক্তের বিনিময়ে পাপীরা মুক্তি পাবে। পাপস্খলনের জন্য তাদের মধ্যবর্তী ধর্ম-যাজক শ্রেণীর প্রয়োজন হয়। পাপস্খলনের মধ্যবর্তী এই ব্যবস্থা মূল তাওরাত ও ইঞ্জিলেও [বিকৃত হওয়ার পূর্বে] নাই। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে বান্দার পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই হচ্ছ পাপস্খলনের একমাত্র উপায়। অপর কোন ব্যক্তির সহায়তায় তা হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে তারাই সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী যারা ''আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম করে, হত্যা করে, নিহত হয়।'' এই সংগ্রাম হবে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব উভয়ই। আমাদের দিক থেকে আল্লাহ্র জন্য আত্মত্যাগ অতি সামান্য, কিন্তু বিনিময়ের পাওনা অনেক-অনন্ত শান্তি, অপার প্রশান্তি, আত্মার মুক্তি (salvation), সুতরাং আমাদের জন্য তা সুসংবাদ বৈকি।
১১২। যারা অনুতাপের মাধ্যমে [আল্লাহ্র দিকে] ফিরে যায়, ১৩৬৩ তাঁর আনুগত্য করে এবং তাঁর প্রসংশা করে, যারা একান্ত আনুগত্যের সাথে আল্লাহ্র রাস্তায় পর্যটন করে; যারা সালাতে রুকু করে, এবং সেজদায় লুটিয়ে পড়ে; যারা ভালো কাজে নির্দ্দেশ দেয় ও মন্দ কাজে নিষেধ করে এবং আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলে; [তারাই আনন্দ করুক]। সুতরাং বিশ্বাসীদের শুভ সংবাদে ঘোষণা দাও।
১৩৬৩। এই আয়াতে মু'মিন বান্দাদের কর্তব্য কাজগুলির তালিকা প্রদান করা হয়েছে। যারা এই কাজগুলি করে তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। ১১৩। আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং বিশ্বাসীদের জন্য সংগত নয় - যখন তা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী ১৩৬৪।
১৩৬৪। এই আয়াত মৃত ব্যক্তির জানাযা সংক্রান্ত। তাদের জন্য ক্ষমা বা প্রার্থনা বা তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ নিষেধ করা হয়েছে, যারা : (১) ইসলাম গ্রহণ না করেই, নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত না হয়েই মৃত্যুবরণ করে; (২) যারা সক্রিয়ভাবে শেষ পর্যন্ত ইসলামের প্রসারে বাঁধা সৃষ্টি করে।
১১৪। এবং ইব্রাহিম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলো, তার একমাত্র কারণ ছিলো, সে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ১৩৬৫। কিন্তু যখন এ কথা তাঁর নিকট স্পষ্ট হলো যে সে আল্লাহ্র শত্রু, তখন ইব্রাহিম তার সাথে সম্পর্ক ছেদ করলো। ইব্রাহিম তো কোমল হৃদয় ও সহনশীল ছিলো ১৩৬৬।
১৩৬৫। হযরত ইব্রাহীম ও তাঁর কাফের পিতার কথা সূরা ৬, আয়াত ৭৪ এর বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম তাঁর কাফের পিতার আত্মার মুক্তির জন্য সর্বদা প্রার্থনা করতেন। কিন্তু উপরের আয়াতটিতে [১১৩ নং] যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা যখন তাঁর কাছে অবতীর্ণ হলো, তখন থেকে তিনি তাঁর পিতার জন্য আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বিরত হন। কারণ শর্তগুলি তাঁর পিতার জন্যও প্রযোজ্য ছিল। এর থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে আধ্যাত্মিক জীবন হচ্ছে স্থায়ী জীবনের ঠিকানা। ইহকালে পৃথিবীর নিকট বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও তা ক্ষণস্থায়ী। আধ্যাত্মিক দিক থেকে যদি তারা পরস্পরের বিপরীতধর্মী ও শত্রুভাবান্ন হয়, তবে মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের সে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। যেমন- হযরত ইব্রাহীমের দোয়া তাঁর পিতার জন্য প্রযোজ্য ছিল না যদিও তিনি ছিলেন ইব্রাহীমের পিতা। পিতার মঙ্গলের জন্য, আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার আশায় পিতার জন্য হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দোয়া করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন [দেখুন সূরা ১৯, আয়াত ৪৭]।
১৩৬৬। হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) ছিলেন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সাঃ)-এর মতই কোমল হৃদয়। তিনি সর্বদা তাঁর পিতার মঙ্গলের জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আল্লাহ্র নির্দেশ এলো যে কাফেরদের জন্য মু'মিন বান্দাদের দোয়া করা উচিৎ নয়। আল্লাহ্ রাহমানুর রাহীম। এই মহাবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তাঁর প্রণীত আইনের দ্বারা চলে। বিশ্ব ভুবন, আকাশ-পাতাল, তরু-লতা, পশু-পাখী, আলো-হাওয়া, সবকিছুই আল্লাহ্র প্রবর্তিত আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। যদি কেউ সামান্যতমও তাঁর আইনের বাইরে চলতো, তবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বোঝাতে চেষ্টা করবো। যেমন সূর্য্য পূর্ব দিকে ওঠে, আলো সরল রেখাতে চলে ইত্যাদি ভৌত বিজ্ঞানের আইন অনাদি-অনন্তকাল থেকে নির্ভুলভাবে চলে আসছে। ঠিক সেইরূপ আধ্যাত্মিক জগতেরও আইন আছে। যেমন : আল্লাহ্ প্রদত্ত নৈতিক নীতিমালা মেনে চললে আত্মিক উন্নতি লাভ ঘটবে। আর যারা মেনে চলে না, আল্লাহ্কে অস্বীকার করে, তাদের আধ্যাত্মিক জগত অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবে। সেসব আত্মার মুক্তি (salvation) নাই। যখন আল্লাহ্র নবীরা (আঃ) বা মু'মিন বান্দারা আল্লাহ্র দরবারে হাত তোলে আল্লাহ্ তাঁদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন-এও আধ্যাত্মিক জগতের একটা আইন। কিন্তু সেই প্রার্থনা যদি হয় কাফের আত্মার মুক্তির জন্য, তবে আল্লাহ্কে মু'মিন বান্দার আর্জি মঞ্জুর করার জন্য নিজের আইন ভঙ্গ করতে হয়। অর্থাৎ এক আইন রক্ষা করতে আর এক আইন ভঙ্গ করতে হয়। বিশ্ব ভুবনে আল্লাহ্র আইন অলঙ্ঘনীয়। যদিও কোমল-হৃদয় ও ধৈর্য্যশীল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর জন্য তাঁর পিতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে অত্যন্ত কষ্ট হয়েছিলো, কারণ তা ছিল তাঁর প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে, তবুও তিনি যখন আল্লাহ্র হুকুম অনুধাবন করতে পারলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। যারা কাফের, যারা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে, আল্লাহ্র সাথে শরীক করে, তাদের জন্য আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চাওয়া আল্লাহ্র আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার শামিল, সুতরাং অন্যায়।
১১৫। কি বিষয়ে [আল্লাহ্কে] ভয় করে বিরত থাকতে হবে তা সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়কে পথ প্রর্দশনের পরে তাদের পথভ্রান্ত করেন না। আল্লাহ্ সকল বিষয়ে সবিশেষ অবহিত ১৩৬৭।
১৩৬৭। জীবন চলার পথে, পৃথিবীর সুদীর্ঘ পথ অতিক্রমকালে আমাদের জানতে হয় কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা পাপ, কোনটা পূণ্য। আল্লাহ্ কিতাবের মাধ্যমে এ সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশ দান করেছেন। সুতরাং যারা বিশ্বাসী তারা যেনো কখনও মানবিক দুর্বলতার জন্য আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ ত্যাগ করে ভুল পথে না যায়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে আল্লাহ্র দেয়া নৈতিক নীতিমালা যুগে যুগে অপরিবর্তণীয় রয়ে গেছে - হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত। সময়ের ব্যবধানে কুরআন ব্যতীত অন্যান্য কিতাব কলুষিত হয়ে গেছে। একমাত্র কুরআনই অবিকৃত রয়ে গেছে। "তাদেরকে পথভ্রান্ত করবেন না" - বাক্যাংশটি দ্বারা এই ভাবকেই বোঝানো হয়েছে।
১১৬। নভোমন্ডল ও পৃথিবী আল্লাহ্রই অধিকারভূক্ত। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই তা হরণ করেন। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন রক্ষাকর্তা বা সাহায্যকারী নাই।
১১৭। আল্লাহ্ অনুগ্রহ করলেন নবীর প্রতি এবং মুহাজিরদের এবং আনসারদের প্রতি-যারা সংকটকালে তাঁকে অনুসরণ করেছিলো ১৩৬৮। এরপরে তাদের একদলের হৃদয় [কর্তব্য থেকে] ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো কিন্তু তাদের প্রতিও তিনি অনুগ্রহ করলেন। তিনি তো তাদের প্রতি অতি দয়ালু এবং পরম করুণাময় ১৩৬৯।
১৩৬৮। দেখুন সূরা ৯ আয়াত ১০০। ইসলামের প্রথম যুগে যেসব মুসলিম ধর্মের জন্য তাদের বাড়ী-ঘর বিষয়-সম্পত্তি সব ত্যাগ করে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে অনুসরণ করে মক্কা থেকে মদিনাতে আশ্রয় গ্রহণ করেন তাদের মুহাজির বলে; এবং মদিনাতে যেসব মুসলিম তাদের ভ্রাতৃসম জ্ঞান করে বুকে টেনে নেন, তাদের আনসার নাতে অভিহিত করা হয়। মুজাহির এবং আনসার এই দু'দলই ছিলেন ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক। তাঁদের ঈমানের পরীক্ষা তাঁরা বিভিন্ন আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ করে গেছেন। কিন্তু তাবুক অভিযান কালে এই সব সাচ্চা ও খাঁটি মুসলমানদের একদল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুগামী হতে দ্বিধা প্রর্দশন করে। এই দ্বিধার কারণ তাদের ঈমানের দুর্বলতা ছিল না, তা ছিল কিছুটা আলসেমী, কিছুটা মানবিক দুর্বলতা। আল্লাহ্ তাদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁরা আগ্রহভরে ইসলামের খেদমত করেছেন। ১১৭। আল্লাহ্ অনুগ্রহ করলেন নবীর প্রতি এবং মুহাজিরদের এবং আনসারদের প্রতি-যারা সংকটকালে তাঁকে অনুসরণ করেছিলো ১৩৬৮। এরপরে তাদের একদলের হৃদয় [কর্তব্য থেকে] ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো কিন্তু তাদের প্রতিও তিনি অনুগ্রহ করলেন। তিনি তো তাদের প্রতি অতি দয়ালু এবং পরম করুণাময় ১৩৬৯।
১৩৬৯। "তাদের একদলের হৃদয় [কর্তব্য থেকে] ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।" ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে,"The hearts of a part them had nearly swerved (from duty);"। সাধারণ মানুষ মাত্রেই আরাম আয়েশের প্রত্যাশী। এটা তাদের চরিত্রগত দুর্বলতা। তাই দেখা যায় মানুষ সাধারণতঃ যেখানে শারীরিক কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে স্থানকে পরিহার করতে চায়। তাবুক অভিযানের সময়ে মুহাজিরদের অনেকের মানসিক অবস্থা এরূপ হয়েছিলো। কারণ সে সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল এবং স্থানটি মদিনা থেকে বেশ দূরে ছিল, আর পথ ছিল মরুভূমির মধ্য দিয়ে। মরুভূমির মাঝে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ পরিহার করার প্রবণতা সাধারণ মানুষের চরিত্রে জন্মলাভ করা স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত যারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, তারা আল্লাহ্র করুণায় তা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নিজ নিজ কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করেন। অর্থাৎ তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। জিহাদে তাদের যে প্রাথমিক দ্বিধা ঘটেছিলো, পরম করুণাময় তা ক্ষমা করে দেন।
[উপদেশ : সাধারণ মানুষের দুর্বলতা আল্লাহ্ ক্ষমা করে দেন, যদি সে তার ভুলকে সংশোধন করে নেয়। এ কথা সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য।]
১১৮। যে তিনজন পিছনে পরিত্যক্ত হয়েছিলো তিনিই তাদেরও ক্ষমা করলেন]। [তারা অপরাধ বোধ করেছিলো] এতটাই যে পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্বেও তারা সংকুচিত বোধ করেছিলো ১৩৭০। তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিসহ হয়েছিলো, - তারা উপলব্ধি করেছিলেন যে আল্লাহ্র নিকট থেকে পালিয়ে যাওয়ার উপায় নাই । এবং তিনি ব্যতীত [কোন আশ্রয়স্থল নাই]। তারপরে তিনি তাদের ক্ষমা করেন যাতে তারা অনুতাপ করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বার বার ক্ষমাশীল এবং পরম করুণাময়।
১৩৭০। এই আয়াতটি তাবুক অভিযানের প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ। রাসূল (সাঃ) এর আহবানে যারা তাবুক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো তাদেরকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে প্রথম শ্রেণীতে আছেন তাঁরাই যাঁরা আল্লাহ্র নবীর (সাঃ) আহ্বানে সব কিছু ত্যাগ করে সাথে সাথে তাবুক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তাঁদের অন্তরে স্থান পায় নাই। এঁরা খাঁটি মু'মিন বান্দা। দ্বিতীয় শ্রেণী : যারা অবশ্যই ঈমানদার, কিন্তু পথের কষ্ট ও বিপদের আশঙ্কা তাদের দ্বিধা- দ্বন্দ্বের মধ্যে নিপতিত করে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তারা এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে মনস্থির করতে সক্ষম হন। আল্লাহ্র ক্ষমা ও করুণা এদের জন্যও। এর পরে খুব অল্প সংখ্যক লোকের উল্লেখ করা হয়েছে, এঁরা তাবুক অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন নাই। এর কারণ তাঁদের অবাধ্যতা বা দুরভিসন্ধি ছিল না - তা ছিল তাঁদের চরিত্রের দুর্বলতা। তাঁরা ছিলেন দুর্বল চরিত্রের ও অপরিণামদর্শী লোক - সুতরাং তাঁরা বুঝতেই পারেন নাই যে জীবনের থেকে, জীবনের আরাম-আয়েশ থেকে, কর্তব্য কর্ম করা অনেক বড় কথা। তাদের এই চারিত্রিক দুর্বলতার জন্য তারা তাবুক অভিযানে অংশ গ্রহণের জন্য রাসূল (সাঃ) এর আহ্বানে সাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তাবুক অভিযানের শেষে এদের ডাকা হয় এবং অংশ গ্রহণ না করার জন্য কৈফিয়ত চাওয়া হয়। সন্তোষজনক কৈফিয়ত না দিতে পারায় শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে সামাজিকভাবে বর্জন বা একঘরে করা হয়। এই সময়ে তাদের যে মানসিক অবস্থা তারই চিত্র আঁকা হয়েছে এই আয়াতে। যদিও পৃথিবী অনেক বড়, কিন্তু তাদের মানসিক অবস্থার জন্য তাদের মনে হতো পৃথিবী বোধ হয় সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। কারণ তাদের আত্মার মাঝে তারা বন্দীদশা অনুভব করতো। বাহ্যিকভাবে তারা বন্দী না থাকলেও এই অনুভূতি তাদের মানসিকভাবে কারাকক্ষে বন্দী থাকার অনুভূতি দিত। পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-কিছুই তাদের আত্মাকে তৃপ্ত করতো না। পৃথিবী ঐশ্বর্যময় হওয়া সত্বেও তারা তা ভোগ করতে পারতো না। কারণ, আত্মার বন্দীত্ব তাদের এসব ভোগ করতে বাঁধা সৃষ্টি করতো। আত্মার আনন্দেই আমরা আনন্দিত হই , আত্মার প্রশান্তিতেই আমরা আমাদের জীবনে শান্তি খুঁজে পাই - আত্মা আমাদের সকল সুখ, দুঃখের মূল উৎস। যখন তারা এই সত্য অনুধাবন করতে পারলো, তারা তাদের আত্মার মুক্তির জন্য,শান্তির জন্য আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করলো। তারা অনুতপ্ত হলো এবং তাদের অনুতাপের বহিঃপ্রকাশ তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করলো। আল্লাহ্ ব্যতীত কোনও আশ্রয়স্থল নাই- এই উপলব্ধি তাদেরকে আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য করেছিলো। "আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করলেন"। যদিও তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে এই তিনজন ছিলেন-ক্ক'ব, মারারাহ্ এবং হিলাল। তবে এর দ্বারা আল্লাহ্ আমাদের সর্বজনীন উপদেশ দিয়েছেন। (১) আইনের প্রয়োগ হতে হবে কঠোরভাবে। আইন শুধু প্রণয়ন করলেই চলবে না [যেমন বাংলাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়, কিন্তু প্রয়োগ নাই। -অনুবাদক।] তার কঠোর প্রয়োগ হওয়া প্রয়াজন। না হলে বহুলোক সেই উদাহরণ অনুসরণ করবে, ফলে সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। যদিও মাত্র তিনজন হযরত (সাঃ)-এর আহ্বানকে উপেক্ষা করেছিলো, কিন্তু আইনের দণ্ড কঠিনভবে তাদের উপরে প্রযোজ্য হয়েছিলো। সংখ্যার স্বল্পতার জন্য তা উপেক্ষা করা হয় নাই। সামাজিক জীবনের শান্তি ও শৃঙ্খলা (Peace & harmony) রক্ষার এ এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। (২) কর্তব্য কঠিন বা অপ্রীতিকর যা-ই হোক না কেন তা অবশ্যই করণীয় এবং এর থেকে রেহাই চাওয়া অন্যায়।
১৩৭১। এই আয়াতটিও তাবুক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেয়া উপদেশ। কিন্তু এর আবেদন সর্বজনীন - যুগকাল অতিক্রান্ত। কোন জাতির জীবনে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে, সে সময়ে প্রত্যেকের কর্তব্য হচ্ছে নেতাকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়া, তার নির্দেশিত পথ অবিচলিতভাবে অনুসরণ করা। কোনও অবস্থাতেই নিজের সুখ-সুবিধা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নেতাকে পরিত্যাগ করা উচিত নয়, বা দ্বিমত পোষণ করা উচিত নয়। আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা, আরাম-আয়েশ কখনও যেনো নেতৃত্বের উর্ধ্বে না হয়। এই আয়াতে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) এর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে মদিনাবাসী ও মরুবাসীদের আল্লাহ্ এই উপদেশ দান করেছেন যা যুগ কাল অতিক্রান্ত।
যারা আন্তরিক ও বিশ্বস্ততার সাথে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করে, তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, কষ্ট-ক্লান্তি, আঘাত-যন্ত্রণা, যে কোন প্রকার কষ্ট, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, যে কোন প্রকার প্রচেষ্টা, যে কোনও প্রকার ব্যয়, সবই আল্লাহ্ গ্রহণ করেন। বিনিময়ে তাঁদের আত্মার অন্ধকার কেটে যায়, তারা আত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হয় - অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে হয় তাদের অগ্রযাত্রা। এই আয়াতে আল্লাহ্ আশ্বাস দিয়েছেন আন্তরিক আত্মত্যাগ, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন তা কখনও আল্লাহ্র কাছে হারিয়ে যাবে না। আমরা ক্ষুদ্র মানুষ। সেই মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য আন্তরিকভাবে আমরা যা-ই ব্যয় করি না কেন তা যত ক্ষুদ্রই হোক, তিনি তা অপেক্ষা অনেক গুণ বেশি পুরস্কার আমাদের জন্য তৈরী রেখেছেন। দুঃখের সমুদ্র মন্থন করেই তো অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। আত্মত্যাগ ব্যতীত সেই মহান স্রষ্টার পুরস্কার লাভের যোগ্যতা অর্জন করা যায় না।
১১৯। হে বিশ্বাসীগণ ! আল্লাহ্কে ভয় কর এবং যারা [কথায় ও কাজে] সত্যবাদী তাদের অন্তর্ভুক্ত হও।
১২০। মদিনাবাসী ও উহার পার্শ্ববর্তী আরব বেদুঈনদের, আল্লাহ্র রাসূলকে অনুসরণ করতে অস্বীকার করা এবং তাঁর জীবন অপেক্ষা তাদের নিজের জীবনকে অধিক গুরুত্ব দেয়া সঙ্গত নয়। কারণ তারা যে কষ্ট ভোগ করুক বা যাই-ই করুক তা সৎ কাজ রূপে তাদের জমার খাতায় গণ্য করা হবে - হতে পারে তা আল্লাহ্র রাস্তায় তৃষ্ণার কষ্ট, অথবা ক্লান্তি, অথবা ক্ষুধার যন্ত্রণা, অথবা কাফিরদের ক্রোধ উৎপন্ন করে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অথবা শত্রুদের নিকট থেকে আঘাত পাওয়া। নিশ্চয়ই যারা ভালো কাজ করে আল্লাহ্ তাদের পুরষ্কার নষ্ট করেন না; - ১৩৭১।
১২০। মদিনাবাসী ও উহার পার্শ্ববর্তী আরব বেদুঈনদের, আল্লাহ্র রাসূলকে অনুসরণ করতে অস্বীকার করা এবং তাঁর জীবন অপেক্ষা তাদের নিজের জীবনকে অধিক গুরুত্ব দেয়া সঙ্গত নয়। কারণ তারা যে কষ্ট ভোগ করুক বা যাই-ই করুক তা সৎ কাজ রূপে তাদের জমার খাতায় গণ্য করা হবে - হতে পারে তা আল্লাহ্র রাস্তায় তৃষ্ণার কষ্ট, অথবা ক্লান্তি, অথবা ক্ষুধার যন্ত্রণা, অথবা কাফিরদের ক্রোধ উৎপন্ন করে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অথবা শত্রুদের নিকট থেকে আঘাত পাওয়া। নিশ্চয়ই যারা ভালো কাজ করে আল্লাহ্ তাদের পুরষ্কার নষ্ট করেন না; - ১৩৭১।
১৩৭১। এই আয়াতটিও তাবুক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেয়া উপদেশ। কিন্তু এর আবেদন সর্বজনীন - যুগকাল অতিক্রান্ত। কোন জাতির জীবনে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে, সে সময়ে প্রত্যেকের কর্তব্য হচ্ছে নেতাকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়া, তার নির্দেশিত পথ অবিচলিতভাবে অনুসরণ করা। কোনও অবস্থাতেই নিজের সুখ-সুবিধা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নেতাকে পরিত্যাগ করা উচিত নয়, বা দ্বিমত পোষণ করা উচিত নয়। আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা, আরাম-আয়েশ কখনও যেনো নেতৃত্বের উর্ধ্বে না হয়। এই আয়াতে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) এর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে মদিনাবাসী ও মরুবাসীদের আল্লাহ্ এই উপদেশ দান করেছেন যা যুগ কাল অতিক্রান্ত।
যারা আন্তরিক ও বিশ্বস্ততার সাথে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করে, তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, কষ্ট-ক্লান্তি, আঘাত-যন্ত্রণা, যে কোন প্রকার কষ্ট, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, যে কোন প্রকার প্রচেষ্টা, যে কোনও প্রকার ব্যয়, সবই আল্লাহ্ গ্রহণ করেন। বিনিময়ে তাঁদের আত্মার অন্ধকার কেটে যায়, তারা আত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হয় - অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে হয় তাদের অগ্রযাত্রা। এই আয়াতে আল্লাহ্ আশ্বাস দিয়েছেন আন্তরিক আত্মত্যাগ, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন তা কখনও আল্লাহ্র কাছে হারিয়ে যাবে না। আমরা ক্ষুদ্র মানুষ। সেই মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য আন্তরিকভাবে আমরা যা-ই ব্যয় করি না কেন তা যত ক্ষুদ্রই হোক, তিনি তা অপেক্ষা অনেক গুণ বেশি পুরস্কার আমাদের জন্য তৈরী রেখেছেন। দুঃখের সমুদ্র মন্থন করেই তো অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। আত্মত্যাগ ব্যতীত সেই মহান স্রষ্টার পুরস্কার লাভের যোগ্যতা অর্জন করা যায় না।
১২১। [আল্লাহ্র রাস্তায়] ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ যাই ব্যয় করতে পারুক, যে কোন প্রান্তর অতিক্রম করুক ১৩৭২, সব কাজ তাদের জমার খাতায় লেখা হয়। যেনো তারা যা করে আল্লাহ্ তা [সম্ভাব্য] সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার দ্বারা পরিশোধ করতে পারেন।
১৩৭২। "Cut across a valley"- বঙ্গানুবাদ "যে কোন প্রান্তর অতিক্রম করে।" এই বাক্যটি রূপকধর্মী। "যে কোনও প্রান্তর" - অর্থাৎ জীবনের যে কোনও প্রান্তর বা অবস্থা। ব্যক্তিগত বীরত্ব, সাহস, উৎসাহ-উদ্দীপনা, অর্থাৎ ব্যক্তিগত যে কোন প্রচেষ্টাকেই এখানে valley বা প্রান্তরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কারণ জীবনের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন অবস্থার সাথে আমাদের মোকাবেলা করতে হয়, কখনও প্রতিকূল - কখনও অনুকূল। এই অবস্থা অতিক্রম করাকে এখানে প্রান্তর অতিক্রম করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই প্রান্তর দুর্গম, দুস্তর হতে পারে আবার সুশোভন ও আরামদায়কও হতে পারে। জীবনের কর্মক্ষেত্রে যখন কোনও দুর্গম ও দুস্তর প্রান্তরকে অতিক্রম করতে হয় - তা যুদ্ধক্ষেত্রেও হতে পারে, বা জাতীয় দুর্যোগও হতে পারে, ব্যক্তিগত হতে পারে বা সমষ্টিগত হতে পারে - সেক্ষেত্রে দলগতভাবে বা সৈন্যদলের সাথে এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অতিক্রম করা অনেক সহজ। এই আয়াতের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে পূর্ববর্তী আয়াতে আত্মত্যাগের উল্লেখ আছে দলগতভাবে [মদিনাবাসী ও মরুবাসী], এই আয়াতে আছে ব্যক্তিগতভাবে আত্মত্যাগের কথা। দলগতভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করা প্রশংসনীয় সন্দেহ নাই, কিন্তু তা অনেক সহজ। কিন্তু আল্লাহ্র সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যখন একা সংগ্রাম করতে হয়, জীবনের সেই দুর্গম দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে আল্লাহ্র বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় - একা একা; সেই সংগ্রাম অনেক কঠিন, অনেক দুরূহ।১২২। সকল বিশ্বাসীরা এক সাথে অভিযানে বের হবে না। যদি প্রত্যেক অভিযানে সেনাবাহিনীর এক অংশ পিছনে থাকে, [তবে] তারা দ্বীনের চর্চাতে আত্মনিয়োগ করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারবে যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসে - যেনো এভাবে তারা [শিখতে পারে এবং] নিজেদের [মন্দ থেকে] সতর্ক রাখতে পারে ১৩৭৩।
১৩৭৩। ইসলামিক রাষ্ট্রে যখন ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জিহাদের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের তাতে অংশগ্রহণ করা ফরজ। এই আয়াতে জিহাদ সময়কালে আর একটি কাজকে জিহাদের সমতুল্য ঘোষণা করা হয়েছে। সক্ষম ব্যক্তি যারা যুদ্ধের উপযুক্ত, তাদের একদলকে দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলনের জন্য গৃহে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। কারণ যখন যোদ্ধারা যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরে আসবেন, তাদের মন ও চিন্তা সাধারণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, যাতে তারা আল্লাহ্র ইবাদতে একান্তভাবে নিজেকে নিবেদন করতে পারে। শিক্ষকের উপযুক্ত নির্দেশে যাতে তারা তাদের স্বাভাবিক ধর্মীয় জীবন ও পরিবেশ ফিরে পায় সেই কারণে এক দলকে গৃহে উপযুক্তভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই কাজটি জিহাদ বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা অপেক্ষা কোনও অংশে কম নয়। এক্ষেত্রে ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়েই জিহাদের সৈনিক, কারণ একজন সংগ্রাম করে অস্তিত্ব রক্ষা এবং আল্লাহ্র বিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, আর এক দল সংগ্রাম করে সমাজ জীবনের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে। উভয় দলই সম গুরুত্বপূর্ণ।
১৩৭৪। "কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের বেষ্টন করে আছে" - এই আয়াতে "বেষ্টন" শব্দটি বিশেষ অর্থবোধক। এই আয়াতে কাফির বা অবিশ্বাসী শব্দটি রূপক অর্থে ব্যাপক ভাবকে প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যা কিছু পাপ বা অন্যায়, তাকেই কাফেরদের প্রতীক স্বরূপ বলা যায়। যখন কাফেরদের সাথে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে, মু'মিন বান্দাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাঁর চারিদিকের পরিবেশকে মন্দ, খারাপ ও পাপমুক্ত করা। পাপের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সর্বদা কঠোর ও নির্মমভাবে বাঁধা দান করা কর্তব্য। জীবনের কোনও অবস্থাতেই যা পাপ, যা অন্যায় ও অশুভ তার সাথে সমঝোতা করা - যারা সত্যের পূজারী, ন্যায়ের সৈনিক, তাদের জন্য উচিত নয়। যদি কেউ কঠোরতার পরিবর্তে মধুর ব্যবহার বা কথার দ্বারা অশুভ শক্তির মন জয় করতে চেষ্টা করে, তবে বুঝতে হবে সে সত্যের নির্ভীক সৈনিক নয় - কাপুরুষতা, ভয়, ক্লান্তি, সর্বোপরি দুর্নীতি ও লোভ তাকে গ্রাস করেছে। পৃথিবীতে কোনও দিন ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে, সত্য ও অসত্যের মাঝে, ভালো ও মন্দের মাঝে সন্ধি হতে পারে না। সেই কারণে এই আয়াতে সত্যের সৈনিক বা মু'মিনগণকে অশুভ ও অকল্যাণকর যে শক্তি বা যাকে অবিশ্বাসী বা কাফির শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবাপন্ন হওয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে, এবং সর্বোপরি নিজ পরিবেশকে সর্বপ্রথম এই কলুষতামুক্ত করতে বলা হয়েছে।
১৩৭৫। ঈমান হচ্ছে বিশ্বাসের দৃঢ়তা। বিশ্বাস বা ঈমান এমন বস্তু যার উপস্থিতি ব্যক্তির চরিত্রে, ব্যবহারে, আচার-আচরণে প্রকাশ পায়। কিন্তু তা বস্তুগতভাবে উপস্থাপনযোগ্য নয়। ঠিক একইভাবে যাদের বিশ্বাস বা ঈমান নাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাদের সনাক্ত করে। এই আয়াতে ঈমানদার ব্যক্তি ও ঈমানহীন ব্যক্তির মধ্যে যে অসামঞ্জস্য তাকেই তুলে ধরা হয়েছে, নতুন কোন আয়াত বা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর শিক্ষার আলোকে। যখন কোন নতুন আয়াত বা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয় পৃথিবীতে, যারা অবিশ্বাসী তারা বিদ্রূপাত্মকভাবে বলে, "এটি তোমাদের মধ্যে কার ঈমান বৃদ্ধি করলো ?" অপরপক্ষে, প্রতিটি নতুন নতুন প্রত্যাদেশ মু'মিনদের ঈমানকে আরও সুদৃঢ় করে। তারা ভক্তি ও কৃতজ্ঞতায় আল্লাহ্র দরবারে শোকর-গুজারী করে। তাদের অন্তরের দিগন্তে সত্যের আলো আরও প্রসারিত হয়, উদ্ভাসিত হয়, উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়। ফলে সত্যের আলোতে তার ঈমানের দৃঢ়তা আরও বৃদ্ধি পায়, তাঁর সাধনার সফলতায় তাঁর অন্তর উৎফুল্ল হয়, শান্তিতে ভরে ওঠে।
১৩৭৬। দেখুন সূরা ২, আয়াত ১০। কুরআন শরীফের বহুস্থানে এরূপ ভাবের প্রকাশ ঘটেছে বহু আয়াতে। এই আয়াতের বক্তব্যকে উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। যেরূপ, যাদের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক ও সুস্থ, আলো তাদের দৃষ্টিশক্তিকে দেখতে সাহায্য করে, কিন্তু যাদের চোখ রোগ দ্বারা আক্রান্ত, আলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা কালো চশমা ব্যবহার করে থাকে, কারণ আলোর ফলে তাদের চোখের ক্ষতি হয় এবং চোখ থেকে ক্রমাগত দূষিত পানি পড়ে, যে পানি নোংরা ও কলুষতায় ভরা। এই উপমাকে ব্যবহার করা যায়, আত্মার উপরে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের প্রভাবকে। যাদের আত্মা পাপে নিমগ্ন, যারা বিশ্বাসী নয়, তাদের আত্মায় আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে না। বরং তাদের সন্দেহের ভিত্তি আরও প্রসারিত হয়। এ এক ধরণের অন্তরের ব্যাধি যা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশে নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে আরও শিকড় বিস্তার করে। এই ভাবকেই বলা হয়েছে, "সন্দেহের সাথে আরও সন্দেহ যুক্ত করে।" অর্থাৎ তাদের অন্তরের ব্যাধির বিস্তার বা ব্যপ্তিলাভ ঘটে। শেষ পর্যন্ত তাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। "আত্মিক মৃত্যু" অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে তারা সাধারণ মানুষের মতই জীবিত থাকবে। কিন্তু তাদের আত্মার কোনও সত্যকেই গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকবে না। রূপকের সাহায্যে এই ভাবকে প্রকাশ করা হয়েছে।
১৩৭৭। যদিও তারা ঈমানহীন এবং অবিশ্বাসী, তবুও আল্লাহ্ তাদের বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার জন্য বারে বারে সুযোগ দান করেন। দুর্যোগ, বিপদ-আপদের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার মনোভাব সৃষ্টি করা হয়, ধৈর্য্যের পরীক্ষা করা হয়, সত্যকে চিনে ঈমানের রাস্তায় পরিচালিত করার প্রয়াস হয়। প্রত্যেক বছর ২/১ বার বিপদ, বিপর্যয়, দুর্যোগ, দুঃখ-কষ্ট, শোক-তাপের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাদের সুযোগ দেন তাঁর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য। কিন্তু যাদের অন্তর কলুষিত এবং এই কলুষতার ব্যপ্তি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে তারা কোনও উপদেশ, সতর্কবাণী বা আহ্বানে কর্ণপাত করবে না। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে, আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে অস্বীকার করবে।
১৩৭৯। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ছিলেন কোমল-হৃদয়, দয়া ও মায়ার প্রতীক স্বরূপ। অবিশ্বাসীদের শেষ পরিণাম ধ্বংস। এই পরিণামের কথা চিন্তা করে নবীর (সাঃ) হৃদয় ব্যথায় ভরে যেতো, এই চিন্তা তাঁর জন্য ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে তাঁর সংস্পর্শে যারা আসতো তাদের লক্ষ্য করতেন এবং যখনই তাদের মধ্যে সামান্য পরিমাণও ঈমানের লক্ষণ দেখতে পেতেন, তাঁর হৃদয় আনন্দ এবং দয়ায় উৎফুল্ল হয়ে উঠতো।
১৩৮০। যদি তারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তা নবীর (সাঃ) হৃদয়ে কোনও চিহ্নই আঁকতে সক্ষম হবে না। জ্বলন্ত সত্যের আলোয় তাঁর হৃদয়ের দিগন্ত উদ্ভাসিত। কারও সাধ্যি নাই সেই আলোকে নির্বাপিত করে। কারণ বিশ্বাসীদের জন্য এক আল্লাহ্ই যথেষ্ট। আল্লাহ্তে দৃঢ় বিশ্বাস - আত্মাকে মুক্তির (salvation) বা মোক্ষলাভের সন্ধান দান করে। যে এই পথের সন্ধান লাভ করেছে, তার আত্মা পরিতৃপ্ত, স্বর্গীয় শান্তির সন্ধান সে লাভ করে। আল্লাহ্র রূপকে বর্ণনার জন্য যে রূপকের ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে, "[মহিমান্বিত] সিংহাসনের অধিপতি।" অর্থাৎ জাঁকজমকে যার আসন মহিমান্বিত।
১২৩। হে বিশ্বাসীগণ ! অবিশ্বাসীরা যারা তোমাদের বেষ্টন করেছে তাদের সাথে যুদ্ধ কর; ১৩৭৪। এবং তারা যেনো তোমাদের মাঝে দৃঢ়তা দেখতে পায়। জেনে রেখো যারা আল্লাহ্কে ভয় করে তিনি তাদের সাথে থাকেন।
১৩৭৪। "কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের বেষ্টন করে আছে" - এই আয়াতে "বেষ্টন" শব্দটি বিশেষ অর্থবোধক। এই আয়াতে কাফির বা অবিশ্বাসী শব্দটি রূপক অর্থে ব্যাপক ভাবকে প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যা কিছু পাপ বা অন্যায়, তাকেই কাফেরদের প্রতীক স্বরূপ বলা যায়। যখন কাফেরদের সাথে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে, মু'মিন বান্দাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাঁর চারিদিকের পরিবেশকে মন্দ, খারাপ ও পাপমুক্ত করা। পাপের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সর্বদা কঠোর ও নির্মমভাবে বাঁধা দান করা কর্তব্য। জীবনের কোনও অবস্থাতেই যা পাপ, যা অন্যায় ও অশুভ তার সাথে সমঝোতা করা - যারা সত্যের পূজারী, ন্যায়ের সৈনিক, তাদের জন্য উচিত নয়। যদি কেউ কঠোরতার পরিবর্তে মধুর ব্যবহার বা কথার দ্বারা অশুভ শক্তির মন জয় করতে চেষ্টা করে, তবে বুঝতে হবে সে সত্যের নির্ভীক সৈনিক নয় - কাপুরুষতা, ভয়, ক্লান্তি, সর্বোপরি দুর্নীতি ও লোভ তাকে গ্রাস করেছে। পৃথিবীতে কোনও দিন ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে, সত্য ও অসত্যের মাঝে, ভালো ও মন্দের মাঝে সন্ধি হতে পারে না। সেই কারণে এই আয়াতে সত্যের সৈনিক বা মু'মিনগণকে অশুভ ও অকল্যাণকর যে শক্তি বা যাকে অবিশ্বাসী বা কাফির শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবাপন্ন হওয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে, এবং সর্বোপরি নিজ পরিবেশকে সর্বপ্রথম এই কলুষতামুক্ত করতে বলা হয়েছে।
১২৪। যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয় ১৩৭৫, তাদের কিছু সংখ্যক বলে, "এর দ্বারা তোমাদের কার ঈমান বৃদ্ধি করেছিলো ?" হ্যাঁ, যারা বিশ্বাসী তাদেরই ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারাই আনন্দিত হয়।
১৩৭৫। ঈমান হচ্ছে বিশ্বাসের দৃঢ়তা। বিশ্বাস বা ঈমান এমন বস্তু যার উপস্থিতি ব্যক্তির চরিত্রে, ব্যবহারে, আচার-আচরণে প্রকাশ পায়। কিন্তু তা বস্তুগতভাবে উপস্থাপনযোগ্য নয়। ঠিক একইভাবে যাদের বিশ্বাস বা ঈমান নাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাদের সনাক্ত করে। এই আয়াতে ঈমানদার ব্যক্তি ও ঈমানহীন ব্যক্তির মধ্যে যে অসামঞ্জস্য তাকেই তুলে ধরা হয়েছে, নতুন কোন আয়াত বা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর শিক্ষার আলোকে। যখন কোন নতুন আয়াত বা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয় পৃথিবীতে, যারা অবিশ্বাসী তারা বিদ্রূপাত্মকভাবে বলে, "এটি তোমাদের মধ্যে কার ঈমান বৃদ্ধি করলো ?" অপরপক্ষে, প্রতিটি নতুন নতুন প্রত্যাদেশ মু'মিনদের ঈমানকে আরও সুদৃঢ় করে। তারা ভক্তি ও কৃতজ্ঞতায় আল্লাহ্র দরবারে শোকর-গুজারী করে। তাদের অন্তরের দিগন্তে সত্যের আলো আরও প্রসারিত হয়, উদ্ভাসিত হয়, উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়। ফলে সত্যের আলোতে তার ঈমানের দৃঢ়তা আরও বৃদ্ধি পায়, তাঁর সাধনার সফলতায় তাঁর অন্তর উৎফুল্ল হয়, শান্তিতে ভরে ওঠে।
১২৫। কিন্তু যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে - এটা তাদের সন্দেহের সাথে আরও সন্দেহ যুক্ত করবে। এবং তাদের মৃত্যু হবে অবিশ্বাসী অবস্থায় ১৩৭৬।
১৩৭৬। দেখুন সূরা ২, আয়াত ১০। কুরআন শরীফের বহুস্থানে এরূপ ভাবের প্রকাশ ঘটেছে বহু আয়াতে। এই আয়াতের বক্তব্যকে উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। যেরূপ, যাদের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক ও সুস্থ, আলো তাদের দৃষ্টিশক্তিকে দেখতে সাহায্য করে, কিন্তু যাদের চোখ রোগ দ্বারা আক্রান্ত, আলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা কালো চশমা ব্যবহার করে থাকে, কারণ আলোর ফলে তাদের চোখের ক্ষতি হয় এবং চোখ থেকে ক্রমাগত দূষিত পানি পড়ে, যে পানি নোংরা ও কলুষতায় ভরা। এই উপমাকে ব্যবহার করা যায়, আত্মার উপরে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশের প্রভাবকে। যাদের আত্মা পাপে নিমগ্ন, যারা বিশ্বাসী নয়, তাদের আত্মায় আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে না। বরং তাদের সন্দেহের ভিত্তি আরও প্রসারিত হয়। এ এক ধরণের অন্তরের ব্যাধি যা আল্লাহ্র প্রত্যাদেশে নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে আরও শিকড় বিস্তার করে। এই ভাবকেই বলা হয়েছে, "সন্দেহের সাথে আরও সন্দেহ যুক্ত করে।" অর্থাৎ তাদের অন্তরের ব্যাধির বিস্তার বা ব্যপ্তিলাভ ঘটে। শেষ পর্যন্ত তাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। "আত্মিক মৃত্যু" অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে তারা সাধারণ মানুষের মতই জীবিত থাকবে। কিন্তু তাদের আত্মার কোনও সত্যকেই গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকবে না। রূপকের সাহায্যে এই ভাবকে প্রকাশ করা হয়েছে।
১২৬। তারা কি দেখে না প্রতি বছর তাদের একবার কি দু'বার [বিপর্যয় দ্বারা] পরীক্ষা করা হয় ১২৩৭৭ ? তথাপি তারা অনুতাপের [মাধ্যমে] ফিরে আসে না, এবং কোন সতর্কতা অবলম্বন করে না।
১৩৭৭। যদিও তারা ঈমানহীন এবং অবিশ্বাসী, তবুও আল্লাহ্ তাদের বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার জন্য বারে বারে সুযোগ দান করেন। দুর্যোগ, বিপদ-আপদের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার মনোভাব সৃষ্টি করা হয়, ধৈর্য্যের পরীক্ষা করা হয়, সত্যকে চিনে ঈমানের রাস্তায় পরিচালিত করার প্রয়াস হয়। প্রত্যেক বছর ২/১ বার বিপদ, বিপর্যয়, দুর্যোগ, দুঃখ-কষ্ট, শোক-তাপের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাদের সুযোগ দেন তাঁর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য। কিন্তু যাদের অন্তর কলুষিত এবং এই কলুষতার ব্যপ্তি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে তারা কোনও উপদেশ, সতর্কবাণী বা আহ্বানে কর্ণপাত করবে না। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে, আল্লাহ্র প্রত্যাদেশকে অস্বীকার করবে।
১২৭। যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে [বলে] : "কেউ কি তোমাদের দেখেছে ?" তারপরে তারা সরে পড়ে। আল্লাহ্ তাদের হৃদয়কে [সত্যের আলো থেকে] বিমুখ করেছেন। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা কিছু বুঝে না ১৩৭৮।
১৩৭৮। সত্যের আলো ও দীপ্তি এত তীব্র ও ভাস্বর যে অবিশ্বাসী পর্যন্ত তাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করতে অস্বস্তি বোধ করে। তাদের হৃদয়, বিবেক - সচেতনে নয়, অবচেতনভাবে তাদের মাঝে অপরাধ বোধ জাগায়। "একে অপরের দিকে তাকায়" বাক্যটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে তারা চোরা-গোপ্তা ভাবে একে অপরের দিকে লক্ষ্য করে। রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশায়, মুনাফিকরা তাঁর সভায় নিজেদের মধ্যে এই আচরণই করতো, যেনো প্রকৃত রূপ লোকসমক্ষে প্রকাশ না হয়। তারা চোরের মত নিজের মুনাফেকী, অবিশ্বাস ও মনের ভাব গুপ্ত রাখতো, এবং এর ফলে নিজেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে আত্মপ্রসাদ লাভ করতো। কিন্তু তারা হতভাগ্য, তারা জানে না, তাদের এই অবাধ্যতা ও একগুঁয়েমী তাদের আল্লাহ্র রহমত ও করুণা থেকে বঞ্চিত করেছে; আল্লাহ্র সত্যকে হৃদয়ে অনুধাবনে বাঁধার সৃষ্টি করছে। আল্লাহ্র রহমত ও করুণা তাদের অতি নিকটে, কিন্তু নির্বোধের মত তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। যখন আল্লাহ্ তাদের উপর থেকে তার রহমত প্রত্যাহার করে নেবেন - তখন তাদের ধ্বংস অনিবার্য।১২৮। এখন তোমাদের মধ্যে থেকেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছে। তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে [এ চিন্তা] তাঁকে দুঃখ দেয়। তোমাদের জন্য সে অতিশয় চিন্তিত। বিশ্বাসীদের জন্য সে অতিশয় দয়ালু এবং করুণাময় ১৩৭৯।
১৩৭৯। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ছিলেন কোমল-হৃদয়, দয়া ও মায়ার প্রতীক স্বরূপ। অবিশ্বাসীদের শেষ পরিণাম ধ্বংস। এই পরিণামের কথা চিন্তা করে নবীর (সাঃ) হৃদয় ব্যথায় ভরে যেতো, এই চিন্তা তাঁর জন্য ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে তাঁর সংস্পর্শে যারা আসতো তাদের লক্ষ্য করতেন এবং যখনই তাদের মধ্যে সামান্য পরিমাণও ঈমানের লক্ষণ দেখতে পেতেন, তাঁর হৃদয় আনন্দ এবং দয়ায় উৎফুল্ল হয়ে উঠতো।
১২৯। কিন্তু যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, বলঃ "আমার জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তাঁর প্রতিই আমার সকল বিশ্বাস। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ [মহিমান্বিত] সিংহাসনের অধিপতি" ১৩৮০।
১৩৮০। যদি তারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তা নবীর (সাঃ) হৃদয়ে কোনও চিহ্নই আঁকতে সক্ষম হবে না। জ্বলন্ত সত্যের আলোয় তাঁর হৃদয়ের দিগন্ত উদ্ভাসিত। কারও সাধ্যি নাই সেই আলোকে নির্বাপিত করে। কারণ বিশ্বাসীদের জন্য এক আল্লাহ্ই যথেষ্ট। আল্লাহ্তে দৃঢ় বিশ্বাস - আত্মাকে মুক্তির (salvation) বা মোক্ষলাভের সন্ধান দান করে। যে এই পথের সন্ধান লাভ করেছে, তার আত্মা পরিতৃপ্ত, স্বর্গীয় শান্তির সন্ধান সে লাভ করে। আল্লাহ্র রূপকে বর্ণনার জন্য যে রূপকের ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে, "[মহিমান্বিত] সিংহাসনের অধিপতি।" অর্থাৎ জাঁকজমকে যার আসন মহিমান্বিত।