+
-
R
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপঃ একটি প্রাথমিক মক্কী সূরা। এই সূরাতে মক্কা নগরীর সাথে রাসুলের (সা) সর্ম্পকের উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কা নগরী রাসুলের (সা) জন্মের বহু পূর্ব থেকে পবিত্র নগরী হিসেবে পরিচিত। এই পবিত্র নগরীতে বিশ্বনবীর জন্ম হয়। তিনি এই নগরীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যে পরিবারের হাতে পবিত্র কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলো। বিশ্ব নবী খুব অল্প বয়েসেই পিতা ও মাতা হারা এতিম শিশুতে পরিণত হন। শিশু বয়েস থেকেই তাঁর হৃদয় মন এক স্রষ্টার এবাদতে নিমগ্ন থাকতো। পরিণত বয়েসে তিনি পৌত্তলিক এবাদতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ফলে তাঁর জন্মস্থানের অধিবাসীরা তাঁর প্রতি নির্যাতনের খড়গ চালনা করে। যার ফলে জন্মভূমি থেকে বিতারিত হয়ে ইয়াথরিব শহরে গমন করেন এবং সেখান থেকে ধর্ম প্রচার করেন। পরবর্তীতে এই শহরের নাম হয় 'মদিনাত্ -উন-নবী ' বা নবীর শহর। সেই থেকে বর্তমানেও এই শহরকে বলা হয় মদিনা। মদিনাকে রাসুলের শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু রাসুলের (সা ) হৃদয় সর্বদা তাঁর মাতৃভূমির জন্য আকুতি করতো এবং তাঁর দায়িত্ব কর্তব্য সমাপন অন্তে তিনি পূণরায় তার মাতৃভূমিতে প্রত্যার্পন করেন বিজয়ী রূপে। তিনি কাবা শরীফকে পৌত্তলিক মুক্ত করেন এবং এক আল্লাহ্র উপাসনা চালু করেন। তিনি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বিশ্বে ন্যায়বান ও যোগ্য ব্যক্তির শাসন চালু করেন, সেই সাথে দাস মুক্তি, গরীবের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেন। অনুধাবন করার বিষয় হচ্ছে পবিত্র মক্কাকে কেন্দ্র করে কি অপূর্ব ন্যায়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ইতিহাসে কাবা হচ্ছে আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রতীক স্বরূপ।
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৬১৩০। এখানে শপথ করা হয়েছে রাসুলের (সা) মাতৃভূমি মক্কা নগরী ও রাসুলের (সা) সম্পর্কের মধ্যে। মক্কা নগরীর পটভূমি এই সূরার ভূমিকাতে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের মুক্তির প্রতীক হচ্ছে এই শহর। মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে কঠোর শ্রমের মাধ্যমে সংগ্রাম করার জন্য। এটাই হচ্ছে শপথের বিষয়বস্তু [ আয়াত ৯০ : ৪ ]।
৬১৩১। 'Hillum' অর্থ : অধিবাসী, যার আইনগত অধিকার আছে, ইত্যাদি। জন্মসূত্রে রাসুল মক্কা নগরীর অধিবাসী, সুতারাং অধিবাসীদের উচিত ছিলো তাঁকে সম্মান করা। তার পরিবর্তে মক্কাবাসীরা তাঁকে নির্যাতিত করে, তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের হত্যার পরিকল্পনা করে। তিনি মদিনাতে নির্বাসিত হন। তবে সময়ের পরিক্রমায় তিনি বিজয়ী বেশে মক্কাতে প্রত্যার্পন করেন, কিন্তু মদিনা শহর পৃথিবীর বুকে রাসুলের (সা) কর্মস্থল এবং জীবন যাপনের পবিত্র স্থান হিসেবে চিরদিনের জন্য পৃথিবীতে অম্লান হয়ে রইল।
৬১৩২। পিতা মাতা সন্তানকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। পিতা সন্তানের সাফল্যে গর্বিত হয়। মাতা প্রচন্ড শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে সন্তান লাভ করে সত্য, তবে সন্তানকে বক্ষে ধারণ করার যে আনন্দ তার নিকট শারীরিক যন্ত্রণা তুচ্ছ। পিতা -মাতা ও সন্তানের মধ্যে যে বন্ধন সে বন্ধন পবিত্র ও স্নেহ ভালোবাসায় ধন্য। তবে অস্বাভাবিক ক্ষেত্রে অনেক সময়ে বিপরীত অবস্থাও বিরাজ করতে পারে,যখন পিতা মাতা ও সন্তানের মাঝে ভালোবাসার বন্ধনের পরির্বতে ঘৃণার সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। রাসুলের বেলাতে এরূপ অস্বাভাবিক ব্যাপারই ঘটেছিলো। মক্কার সবচেয়ে গৌরবান্বিত সন্তানকে মক্কা নগরী থেকে বের করে দেয় অত্যাচার, নির্যাতন করে। তবে তা ছিলো স্বল্প কালের জন্য। অন্যায়কারী, স্বৈরাচার, যারা অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দখল করে ছিলো তাদের অপসারণের পরে মক্কা আবার তার গৌরবান্বিত সন্তানকে ফিরে পায়, তাঁকে স্বাগত জানায়। এর পর থেকে,মক্কা নগরী ইসলামের কেন্দ্র ভূমিরূপে তার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে।
৬১৩৩। "Man is born unto troubles as the sparks fly upward” [ Job. V. 7] ; “ For all his days are sorrows , and his travail grief" [Ecclesiastes , ii 23 ] । উপরের ধর্মগ্রন্থসমূহের বক্তব্য থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মানুষের সমগ্র জীবন হচ্ছে দুঃখ ও কষ্টের। কিন্তু ইসলামের বক্তব্য ভিন্নধর্মী। এই আয়াতে আল্লাহ্ সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছে শ্রমের মাধ্যমে জীবন সংগ্রামের জন্য। জীবনে চলার পথে যদি তাকে কষ্টকর পথকে অতিক্রম করতে হয়,তবে সে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা প্রদর্শন করে ধৈর্য্য ধারণ করবে। ফলে আল্লাহ্ তার জীবনে চলার পথকে মসৃণ করে দেবেন [ ৬৫ : ৭ ; ৯৪ : ৫- ৬ ]। ধৈর্য্য ও নির্ভরশীলতাই হচ্ছে সংগ্রামের কষ্ট থেকে অব্যহতি লাভের উপায়। নীচের আয়াত নং [ ৫ - ৭] উপদেশ দান করা হয়েছে যে মানুষ যেনো পর্থিব সম্পদের অহংকার বা গর্ব না করে কারণ তার দ্বারা আত্মিক মুক্তি লাভ সম্ভব নয়।
৬১৩৪। দেখুন পূর্বের টিকার শেষাংশ। আল্লাহ্ যদি কাউকে অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি দান করেন, সে যেনো কখনও মনে না করে যে এসব অনন্ত কালের জন্য তাকে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং এসব সম্পদ তার নিজস্ব এ সবের জন্য তার কোন দায় দায়িত্ব নাই। সুতারাং এসব সম্পদ দ্বারা সে যা খুশী তা করার অধিকার রাখে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ্ তাঁর নেয়ামত বিভিন্ন বান্দার জন্য বিভিন্ন ভাবে বন্টন করে থাকেন। এ সব নেয়ামতের সুষ্ঠু ব্যবহারই হবে তার জন্য মহা পরীক্ষা। যিনি এসব দান করেন, কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা তারই। যদি ব্যক্তি বা জাতি আল্লাহ্র এই পরীক্ষায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারে, তবে অবশ্যই আল্লাহ্ সেই ব্যক্তি বা জাতির নিকট থেকে তাঁর নেয়ামত সমূহ কেড়ে নেবেন। আল্লাহ্ সবার উপরে ক্ষমতাবান।
৬১৩৫। মক্কার কোরাইশ সরদারগণ ইসলাম ও মুসলিমকে ধ্বংস করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতো। আর তা নিয়ে গর্ব করতো। তবে এই আয়াতের আবেদন বিশ্বজনীন সর্বকালের, সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। যারা অজ্ঞ তারাই আল্লাহ্র দেয়া নেয়ামত সমূহের যোগ্য হতে পারে না। তারা মনে করে এ সব নেয়ামত তার নিজস্ব এবং সে এর দ্বারা যা খুশী করার ক্ষমতা রাখে। এ সম্বন্ধে তার কোনও জবাবদিহিতা নাই। সে তার সম্পদের জন্য গর্ব করে,তা সে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এবং মনে করে এভাবেই সে পৃথিবীতে তার প্রভাব প্রতিপত্তি ও সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবে। হয়তো তার এই ধারণা স্বল্পকালের জন্য স্থায়ী হতে পারে। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে তাকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ প্রকৃত সত্যের উপরে ভিত্তি না করে সে মিথ্যার উপরে তার কর্ম প্রচেষ্টার ভিত্তি স্থাপন করেছিলো। সে তার নেয়ামত সমূহ ও সম্পদকে শুধুমাত্র নিজস্ব ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য ব্যয় করেছে, তার ফলে নিজের মাঝে সংযমের যে পরিশুদ্ধতার ছাঁকনী তা সে নষ্ট করে ফেলেছে। কারণ আত্ম সংযমই মানুষকে প্রবৃত্তির ফাঁদ থেকে অব্যহতি দান করতে সক্ষম এবং পরিণতিতে আত্মা মুক্তি লাভ করে। যে এই আত্মসংযমের ক্ষমতা রাখে না সে হতভাগ্য। কারণ এর ফলে তার চরিত্র ধীরে ধীরে উচ্ছৃঙ্খল ও সংযমহীন হয়ে ওঠে এবং জীবনের সর্ব প্রচেষ্টা শুধুমাত্র আত্মসুখের পিছনে ব্যয় করে যা হচ্ছে পৃথিবীতে শয়তানের ফাঁদ। আর একবার যে শয়তানের ফাঁদে পড়ে সে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। মানুষের মনঃস্তাত্বিক বিশ্লেষণ এই আয়াতে করা হয়েছে।
৬১৩৭। কেন মানুষ আত্মার মাঝে মহাশক্তিধর প্রভুর ক্ষমতাকে উপলব্ধি করবে না ? এই উপলব্ধির জন্য আল্লাহ্ আমাদের মাঝে যে সব মানসিক দক্ষতা সমূহ দিয়েছেন তার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। চক্ষুদ্বারা আমরা পৃথিবীর আলো দর্শন করি। দৈহিক ভাবে দেখা ব্যতীতও আল্লাহ্ মানুষকে আর এক ভাবে চক্ষুর ব্যবহার দান করেছেন - অন্তর্জগতে। মনের সে চোখ প্রকৃত সত্যের আলোকে সনাক্ত করতে পারে। বিশ্ব জগতের সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ্র হাতের শিল্প নৈপুন্যকে অনুধাবন করতে পারে। বিশ্ব ভূবন ও বিশাল নভোমন্ডলের মাঝে স্রষ্টার সৃষ্টির যে সমন্বিত শৃঙ্খলা যা সঙ্গীতের ন্যায় নিজস্ব লয়ে গতিময় তা অর্ন্তজগতের চক্ষু দ্বারা উপলব্ধির মাধ্যমে দেখতে পায়। একই ভাবে জিহ্বা ও ওষ্ঠ যা হচ্ছে কথা বলার ও খাবারের স্বাদ গ্রহণের মাধ্যম। এই মাধ্যমকে জৈবিক ভাবে ব্যবহার করা যায় আবার মহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও ব্যবহার করা যায়। এর দ্বারা সত্য পথের সন্ধান করা যায় এবং সত্যকে অনুভব করা যায়, জীবনের দিক্ নির্দ্দেশনার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা যায়। মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করা যায়। আল্লাহ্র গুণগান করা যায় ইত্যাদি। এই দুটি মানসিক দক্ষতার উল্লেখের মাধ্যমে এ সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে, মানসিক দক্ষতা সমূহ জৈবিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করা যায়,আবার জীবনের মহত্তর পরিণতির জন্যও ব্যবহার করা যায়। এটি একটি রূপক বর্ণনা যার দ্বারা আল্লাহ্র সৃষ্টি নৈপূণ্যকে তুলে ধরা হয়েছে।
৬১৩৮। মানব জীবনের প্রধান দুটি পথ হচ্ছে : ১ ) চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের পথ। এই পথকে বলা হয়েছে 'বন্ধুর গিরিপথ ' অর্থাৎ সুউচ্চ খাড়া পর্বতে আরোহণের ন্যায় কষ্ট সাধ্য, অর্থাৎ কষ্ট সাধ্য পথ। যার বর্ণনা নিম্নের আয়াতে করা হয়েছে। ২) পাপের পথ এবং আল্লাহ্র বিধানকে প্রত্যাখান করার প্রবণতা যা অত্যন্ত সহজ ও সাময়িক আরামদায়ক। আল্লাহ্ আমাদের ন্যায় অন্যায়, ভালো -মন্দ, পাপ -পূণ্য, সত্য -মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করার মত বিবেক, বুদ্ধি ও মানসিক দক্ষতা সমূহ দান করেছেন। আমাদের 'স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ' প্রয়োগের মাধ্যমে এই দুটি পথের যে কোন একটি পথকে আমরা নিজেদের জন্য পছন্দ করতে পারি। আমাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য আল্লাহ্ আমাদের জন্য যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন, প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ করেছেন যেনো আমরা সঠিক পথের সন্ধান লাভ করতে পারি।
৬১৩৯। মানুষকে আল্লাহ্ বিবেক, বুদ্ধি, মানসিক দক্ষতা সমূহ দান করা সত্বেও সাধারণ মানুষ সঠিক পথ অবলম্বনের প্রতি অমনোযোগী। সে কোনও অবস্থাতেই বন্ধুর গিরিপথ বা কষ্টসাধ্য পথ অবলম্বনে আগ্রহী হয় না যদিও এই পথ তার আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক কল্যাণ বয়ে আনবে। বাইবেলে আছে, "Strait is the gate, and narrow is the way, which leadeth unto life, and few there be that find it." [ Matt vii 14 ] ।
৬১৪০। চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের পথ হচ্ছে সৎকর্ম সম্পাদন করা যা সব সময়েই খুব কষ্টকর পথ। এ পথের একটাই মানদন্ড আর তা হচ্ছে মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও এই ভালোবাসা প্রকাশের জন্য দান করা। এই মানদন্ডকে তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১) দাস মুক্তি, ২) এতিমকে আহার্য দান ও ৩) দরিদ্র নিষ্পেষিত ব্যক্তিকে আহার্য দান করা। এই মানদন্ড প্রতিটিই প্রতীকধর্মী, যার আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থই বিদ্যমান। যদিও পৃথিবীতে ক্রীতদাস প্রথা বিদ্যমান নাই, তবুও তা সমাজে অন্যভাবে বর্তমান। যেখানেই মানবতা লাঞ্ছিত হয় সেখানেই তা ক্রীতদাস প্রথায় পর্যবেসিত হয়। যেমন বাংলাদেশে নারীদের অবস্থানকে ক্রীতদাসের সাথে তুলনা করা চলে। ঠিক সেভাবেই বসনিয়াতে বা অন্যান্য স্থানে যেখানে মানবতা লুণ্ঠিত হয় সে সকলই ক্রীতদাস প্রথার প্রতীক। দাস মুক্তি দ্বারা মানবতার মুক্তি বুঝানো হয়। এ ব্যতীত ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ লোভের দাস, অজ্ঞতার দাস, সম্পদের মোহে সম্পদের দাস, কুসংস্কারের দাস, তীব্র আবেগের দাস, ক্ষমতার দাস ইত্যাদি বিভিন্ন দাসের পরিণতিতে আত্মার স্বচ্ছতা হারায়। যারা পূণ্যাত্মা, তাদের দায়িত্ব হচেছ মানুষের এসব আত্মার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা - যদিও কাজটি তার জন্য সুখকর নয়, বরং কঠিন ও বিপদজনক। তবে তখনই সে এ কাজ করতে সক্ষম হবে যখন সে নিজেকে বা নিজের আত্মাকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে।
৬১৪১। এখানে আহার্য দান বাক্যটি প্রতীক ধর্মী। আহার্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা যার প্রতি সামর্থবান প্রতিটি মানুষের সাহায্যের হস্ত সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। এখানে দুর্ভিক্ষের দিনে শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্য সাহায্য যেরূপ অতীব প্রয়োজনীয় সেরূপ যে কোন মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষা, অসুখে চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার সময়েও সাহায্য করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য। যার খাদ্যের প্রয়োজন তাকেই দান করতে বলা হয়েছে। এই বাক্যটি প্রতীক ধর্মী যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থই বিদ্যমান। বিশেষ ভাবে আহার্য দান করতে বলা হয়েছে দুর্ভিক্ষের দিনে। অর্থাৎ যখন দেশব্যপী খাদ্য শষ্যের অপ্রতুলতা বিরাজ করে; অর্থাৎ যে কোন মৌলিক প্রয়োজনে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করতে হবে।
৬১৪২। যে কোন এতিমকে আহার্য দান করা অবশ্য কর্তব্য। এখানে আহার্য্য শব্দটি প্রতীক ধর্মী। যার সাহায্যে সাহায্য করাকে বুঝানো হয়েছে। সমাজে এতিমদের সুষ্ঠূ ও সম্মান জনক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে সাহায্যই করা হোক না কেন তা এর আওতায় অন্তর্ভূক্ত। তবে এখানে বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে নিজ আত্মীয়ের মাঝে এরূপ এতিমদের সর্বাগ্রে সাহায্য করতে হবে। ইংরেজীতে প্রবাদ আছে Charity begins at home . সে ভাবেই এখানে আল্লাহ্ আদেশ দান করেছেন।
৬১৪৩। সমাজে যারা দারিদ্র নিষ্পেষিত নিঃস্ব তাদের উন্নতির জন্য আন্তরিক চেষ্টা করার অপর নাম দারিদ্র নিষ্পেষিতদের আহার্য দান করা। এখানে প্রশংসা বা প্রতিদানের আকাঙ্খা করে না। এরূপ দানের প্রতিদান একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট চাওয়া হবে। এরূপ সাহায্যই প্রকৃত সাহায্য যার সাহায্যে সমাজ উপকৃত হয়, সমাজ থেকে দারিদ্রের অভিশাপ একমাত্র এরূপ সাহায্য দ্বারাই দূরীভূত হতে পারে। 'আহার্য ' প্রতীক শব্দটি যে কোন প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
৬১৪৪। উপরের আয়াত সমূহে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যে বর্ণনা দান করা হয়েছে তা হচ্ছে ঈমানের এসিড পরীক্ষা। খাঁটি সোনা যেরূপ কষ্টিপাথরে ঘষে পরীক্ষা করা হয়, প্রকৃত সৎ কাজও সেরূপ ঈমানের এসিড পরীক্ষা যা চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। বিশেষ চারিত্রিক গুণাবলীকে সারসংক্ষেপ করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাবে। ১) ধৈর্য বা সবর আরবীতে যার অর্থ ব্যপক [ সংযম, অধ্যাবসায় যার অর্ন্তভূক্ত দেখুন টিকা নং ৬১ ] ২) দয়া সহানুভূতি ও আন্তরিকতার সাথে কাউকে সাহায্য করার ইচ্ছা বা দয়া, শুধু মাত্র তাদের বিশ্বাসের আন্তরিকতাই বিচার করা হবে না ; তাদের কর্মের পরিণামও বিচার করা হবে।
৬১৪৫। উপরে বর্ণিত মোমেন বান্দাদের কথাই বলা হয়েছে যে, তারাই সৌভাগ্যশালী। দেখুন [৫৬ : ৩ ] ও টিকা ৫২২৩। এরাই তারা যারা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভ করবেন।
৬১৪৬। দেখুন সূরা [৫৬ : ৪১ - ৫৬ ] ও টিকা ৫২২৩। যারা আল্লাহ্র বর্ণিত নির্দ্দেশাবলীকে প্রত্যাখান করে দুভার্গ্য তাদের। তারা অগ্নি কুন্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়বে।
সূরা বালাদ
সূরা বালাদ বা নগর - ৯০
২০ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপঃ একটি প্রাথমিক মক্কী সূরা। এই সূরাতে মক্কা নগরীর সাথে রাসুলের (সা) সর্ম্পকের উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কা নগরী রাসুলের (সা) জন্মের বহু পূর্ব থেকে পবিত্র নগরী হিসেবে পরিচিত। এই পবিত্র নগরীতে বিশ্বনবীর জন্ম হয়। তিনি এই নগরীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যে পরিবারের হাতে পবিত্র কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলো। বিশ্ব নবী খুব অল্প বয়েসেই পিতা ও মাতা হারা এতিম শিশুতে পরিণত হন। শিশু বয়েস থেকেই তাঁর হৃদয় মন এক স্রষ্টার এবাদতে নিমগ্ন থাকতো। পরিণত বয়েসে তিনি পৌত্তলিক এবাদতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ফলে তাঁর জন্মস্থানের অধিবাসীরা তাঁর প্রতি নির্যাতনের খড়গ চালনা করে। যার ফলে জন্মভূমি থেকে বিতারিত হয়ে ইয়াথরিব শহরে গমন করেন এবং সেখান থেকে ধর্ম প্রচার করেন। পরবর্তীতে এই শহরের নাম হয় 'মদিনাত্ -উন-নবী ' বা নবীর শহর। সেই থেকে বর্তমানেও এই শহরকে বলা হয় মদিনা। মদিনাকে রাসুলের শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু রাসুলের (সা ) হৃদয় সর্বদা তাঁর মাতৃভূমির জন্য আকুতি করতো এবং তাঁর দায়িত্ব কর্তব্য সমাপন অন্তে তিনি পূণরায় তার মাতৃভূমিতে প্রত্যার্পন করেন বিজয়ী রূপে। তিনি কাবা শরীফকে পৌত্তলিক মুক্ত করেন এবং এক আল্লাহ্র উপাসনা চালু করেন। তিনি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বিশ্বে ন্যায়বান ও যোগ্য ব্যক্তির শাসন চালু করেন, সেই সাথে দাস মুক্তি, গরীবের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেন। অনুধাবন করার বিষয় হচ্ছে পবিত্র মক্কাকে কেন্দ্র করে কি অপূর্ব ন্যায়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ইতিহাসে কাবা হচ্ছে আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রতীক স্বরূপ।
সূরা বালাদ বা নগর - ৯০
২০ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
১। শপথ করছি এই নগরের ৬১৩০।
৬১৩০। এখানে শপথ করা হয়েছে রাসুলের (সা) মাতৃভূমি মক্কা নগরী ও রাসুলের (সা) সম্পর্কের মধ্যে। মক্কা নগরীর পটভূমি এই সূরার ভূমিকাতে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের মুক্তির প্রতীক হচ্ছে এই শহর। মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে কঠোর শ্রমের মাধ্যমে সংগ্রাম করার জন্য। এটাই হচ্ছে শপথের বিষয়বস্তু [ আয়াত ৯০ : ৪ ]।
২। এবং [ শপথ ] তুমি এই নগরীর স্বাধীন অধিবাসী ৬১৩১।
৬১৩১। 'Hillum' অর্থ : অধিবাসী, যার আইনগত অধিকার আছে, ইত্যাদি। জন্মসূত্রে রাসুল মক্কা নগরীর অধিবাসী, সুতারাং অধিবাসীদের উচিত ছিলো তাঁকে সম্মান করা। তার পরিবর্তে মক্কাবাসীরা তাঁকে নির্যাতিত করে, তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের হত্যার পরিকল্পনা করে। তিনি মদিনাতে নির্বাসিত হন। তবে সময়ের পরিক্রমায় তিনি বিজয়ী বেশে মক্কাতে প্রত্যার্পন করেন, কিন্তু মদিনা শহর পৃথিবীর বুকে রাসুলের (সা) কর্মস্থল এবং জীবন যাপনের পবিত্র স্থান হিসেবে চিরদিনের জন্য পৃথিবীতে অম্লান হয়ে রইল।
৩। এবং [ শপথ ] পিতা-মাতা ও সন্তানের [ রহস্যময় বন্ধনের ] ৬১৩২
৬১৩২। পিতা মাতা সন্তানকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। পিতা সন্তানের সাফল্যে গর্বিত হয়। মাতা প্রচন্ড শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে সন্তান লাভ করে সত্য, তবে সন্তানকে বক্ষে ধারণ করার যে আনন্দ তার নিকট শারীরিক যন্ত্রণা তুচ্ছ। পিতা -মাতা ও সন্তানের মধ্যে যে বন্ধন সে বন্ধন পবিত্র ও স্নেহ ভালোবাসায় ধন্য। তবে অস্বাভাবিক ক্ষেত্রে অনেক সময়ে বিপরীত অবস্থাও বিরাজ করতে পারে,যখন পিতা মাতা ও সন্তানের মাঝে ভালোবাসার বন্ধনের পরির্বতে ঘৃণার সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। রাসুলের বেলাতে এরূপ অস্বাভাবিক ব্যাপারই ঘটেছিলো। মক্কার সবচেয়ে গৌরবান্বিত সন্তানকে মক্কা নগরী থেকে বের করে দেয় অত্যাচার, নির্যাতন করে। তবে তা ছিলো স্বল্প কালের জন্য। অন্যায়কারী, স্বৈরাচার, যারা অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দখল করে ছিলো তাদের অপসারণের পরে মক্কা আবার তার গৌরবান্বিত সন্তানকে ফিরে পায়, তাঁকে স্বাগত জানায়। এর পর থেকে,মক্কা নগরী ইসলামের কেন্দ্র ভূমিরূপে তার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে।
৪। মানুষকে আমি সৃষ্টি করেছি কষ্ট ও সংগ্রামের জন্য ৬১৩৩
৬১৩৩। "Man is born unto troubles as the sparks fly upward” [ Job. V. 7] ; “ For all his days are sorrows , and his travail grief" [Ecclesiastes , ii 23 ] । উপরের ধর্মগ্রন্থসমূহের বক্তব্য থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মানুষের সমগ্র জীবন হচ্ছে দুঃখ ও কষ্টের। কিন্তু ইসলামের বক্তব্য ভিন্নধর্মী। এই আয়াতে আল্লাহ্ সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছে শ্রমের মাধ্যমে জীবন সংগ্রামের জন্য। জীবনে চলার পথে যদি তাকে কষ্টকর পথকে অতিক্রম করতে হয়,তবে সে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতা প্রদর্শন করে ধৈর্য্য ধারণ করবে। ফলে আল্লাহ্ তার জীবনে চলার পথকে মসৃণ করে দেবেন [ ৬৫ : ৭ ; ৯৪ : ৫- ৬ ]। ধৈর্য্য ও নির্ভরশীলতাই হচ্ছে সংগ্রামের কষ্ট থেকে অব্যহতি লাভের উপায়। নীচের আয়াত নং [ ৫ - ৭] উপদেশ দান করা হয়েছে যে মানুষ যেনো পর্থিব সম্পদের অহংকার বা গর্ব না করে কারণ তার দ্বারা আত্মিক মুক্তি লাভ সম্ভব নয়।
৫। সে কি মনে করে, তার উপরে কারও ক্ষমতা নাই ? ৬১৩৪
৬১৩৪। দেখুন পূর্বের টিকার শেষাংশ। আল্লাহ্ যদি কাউকে অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি দান করেন, সে যেনো কখনও মনে না করে যে এসব অনন্ত কালের জন্য তাকে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং এসব সম্পদ তার নিজস্ব এ সবের জন্য তার কোন দায় দায়িত্ব নাই। সুতারাং এসব সম্পদ দ্বারা সে যা খুশী তা করার অধিকার রাখে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ্ তাঁর নেয়ামত বিভিন্ন বান্দার জন্য বিভিন্ন ভাবে বন্টন করে থাকেন। এ সব নেয়ামতের সুষ্ঠু ব্যবহারই হবে তার জন্য মহা পরীক্ষা। যিনি এসব দান করেন, কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা তারই। যদি ব্যক্তি বা জাতি আল্লাহ্র এই পরীক্ষায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারে, তবে অবশ্যই আল্লাহ্ সেই ব্যক্তি বা জাতির নিকট থেকে তাঁর নেয়ামত সমূহ কেড়ে নেবেন। আল্লাহ্ সবার উপরে ক্ষমতাবান।
৬। সে [ অহংকার করে ] বলতে পারে, " আমি তো রাশি রাশি ধন ব্যয় করেছি।" ৬১৩৫
৬১৩৫। মক্কার কোরাইশ সরদারগণ ইসলাম ও মুসলিমকে ধ্বংস করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতো। আর তা নিয়ে গর্ব করতো। তবে এই আয়াতের আবেদন বিশ্বজনীন সর্বকালের, সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। যারা অজ্ঞ তারাই আল্লাহ্র দেয়া নেয়ামত সমূহের যোগ্য হতে পারে না। তারা মনে করে এ সব নেয়ামত তার নিজস্ব এবং সে এর দ্বারা যা খুশী করার ক্ষমতা রাখে। এ সম্বন্ধে তার কোনও জবাবদিহিতা নাই। সে তার সম্পদের জন্য গর্ব করে,তা সে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এবং মনে করে এভাবেই সে পৃথিবীতে তার প্রভাব প্রতিপত্তি ও সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবে। হয়তো তার এই ধারণা স্বল্পকালের জন্য স্থায়ী হতে পারে। সময়ের বৃহত্তর পরিসরে তাকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ প্রকৃত সত্যের উপরে ভিত্তি না করে সে মিথ্যার উপরে তার কর্ম প্রচেষ্টার ভিত্তি স্থাপন করেছিলো। সে তার নেয়ামত সমূহ ও সম্পদকে শুধুমাত্র নিজস্ব ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য ব্যয় করেছে, তার ফলে নিজের মাঝে সংযমের যে পরিশুদ্ধতার ছাঁকনী তা সে নষ্ট করে ফেলেছে। কারণ আত্ম সংযমই মানুষকে প্রবৃত্তির ফাঁদ থেকে অব্যহতি দান করতে সক্ষম এবং পরিণতিতে আত্মা মুক্তি লাভ করে। যে এই আত্মসংযমের ক্ষমতা রাখে না সে হতভাগ্য। কারণ এর ফলে তার চরিত্র ধীরে ধীরে উচ্ছৃঙ্খল ও সংযমহীন হয়ে ওঠে এবং জীবনের সর্ব প্রচেষ্টা শুধুমাত্র আত্মসুখের পিছনে ব্যয় করে যা হচ্ছে পৃথিবীতে শয়তানের ফাঁদ। আর একবার যে শয়তানের ফাঁদে পড়ে সে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। মানুষের মনঃস্তাত্বিক বিশ্লেষণ এই আয়াতে করা হয়েছে।
৭। সে কি মনে করে যে, তাকে কেহ দেখে নাই ? ৬১৩৬
৬১৩৬। উপরে বর্ণিত লোকেরা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয় এবং মনে করে তারা খুব বুদ্ধিমান। তাদের ধারণা এই ধোঁকা কেউ সনাক্ত করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে অলক্ষ্যে থেকে আল্লাহ্ আমাদের সকল কর্ম, সকল কর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য, গোপন চিন্তা ভাবনা, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল কথা সব কিছু রেকর্ড করে রাখছেন। তাঁর অজ্ঞাত কিছুই নাই। যদি সে সামান্য পরিমাণও বোধশক্তি সম্পন্ন হয় তবে বুঝতে সক্ষম হতো যে সেই মহাশক্তিধর প্রভুর অস্তিত্ব সর্বত্র বিদ্যমান।৮। আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করি নাই দুইটি চক্ষু ?
৯। এবং একটি জিহ্বা ৬১৩৭, এবং দুইটি ওষ্ঠ ?
৯। এবং একটি জিহ্বা ৬১৩৭, এবং দুইটি ওষ্ঠ ?
৬১৩৭। কেন মানুষ আত্মার মাঝে মহাশক্তিধর প্রভুর ক্ষমতাকে উপলব্ধি করবে না ? এই উপলব্ধির জন্য আল্লাহ্ আমাদের মাঝে যে সব মানসিক দক্ষতা সমূহ দিয়েছেন তার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। চক্ষুদ্বারা আমরা পৃথিবীর আলো দর্শন করি। দৈহিক ভাবে দেখা ব্যতীতও আল্লাহ্ মানুষকে আর এক ভাবে চক্ষুর ব্যবহার দান করেছেন - অন্তর্জগতে। মনের সে চোখ প্রকৃত সত্যের আলোকে সনাক্ত করতে পারে। বিশ্ব জগতের সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ্র হাতের শিল্প নৈপুন্যকে অনুধাবন করতে পারে। বিশ্ব ভূবন ও বিশাল নভোমন্ডলের মাঝে স্রষ্টার সৃষ্টির যে সমন্বিত শৃঙ্খলা যা সঙ্গীতের ন্যায় নিজস্ব লয়ে গতিময় তা অর্ন্তজগতের চক্ষু দ্বারা উপলব্ধির মাধ্যমে দেখতে পায়। একই ভাবে জিহ্বা ও ওষ্ঠ যা হচ্ছে কথা বলার ও খাবারের স্বাদ গ্রহণের মাধ্যম। এই মাধ্যমকে জৈবিক ভাবে ব্যবহার করা যায় আবার মহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও ব্যবহার করা যায়। এর দ্বারা সত্য পথের সন্ধান করা যায় এবং সত্যকে অনুভব করা যায়, জীবনের দিক্ নির্দ্দেশনার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা যায়। মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করা যায়। আল্লাহ্র গুণগান করা যায় ইত্যাদি। এই দুটি মানসিক দক্ষতার উল্লেখের মাধ্যমে এ সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছে যে, মানসিক দক্ষতা সমূহ জৈবিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করা যায়,আবার জীবনের মহত্তর পরিণতির জন্যও ব্যবহার করা যায়। এটি একটি রূপক বর্ণনা যার দ্বারা আল্লাহ্র সৃষ্টি নৈপূণ্যকে তুলে ধরা হয়েছে।
১০। এবং দেখাইনি কি দুটি পথ ? ৬১৩৮
৬১৩৮। মানব জীবনের প্রধান দুটি পথ হচ্ছে : ১ ) চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের পথ। এই পথকে বলা হয়েছে 'বন্ধুর গিরিপথ ' অর্থাৎ সুউচ্চ খাড়া পর্বতে আরোহণের ন্যায় কষ্ট সাধ্য, অর্থাৎ কষ্ট সাধ্য পথ। যার বর্ণনা নিম্নের আয়াতে করা হয়েছে। ২) পাপের পথ এবং আল্লাহ্র বিধানকে প্রত্যাখান করার প্রবণতা যা অত্যন্ত সহজ ও সাময়িক আরামদায়ক। আল্লাহ্ আমাদের ন্যায় অন্যায়, ভালো -মন্দ, পাপ -পূণ্য, সত্য -মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করার মত বিবেক, বুদ্ধি ও মানসিক দক্ষতা সমূহ দান করেছেন। আমাদের 'স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ' প্রয়োগের মাধ্যমে এই দুটি পথের যে কোন একটি পথকে আমরা নিজেদের জন্য পছন্দ করতে পারি। আমাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য আল্লাহ্ আমাদের জন্য যুগে যুগে নবী রসুলদের প্রেরণ করেছেন, প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ করেছেন যেনো আমরা সঠিক পথের সন্ধান লাভ করতে পারি।
১১। কিন্তু সে তো দুর্গম [ গিরি ] পথে প্রবেশে ত্বরা করে নাই ৬১৩৯
৬১৩৯। মানুষকে আল্লাহ্ বিবেক, বুদ্ধি, মানসিক দক্ষতা সমূহ দান করা সত্বেও সাধারণ মানুষ সঠিক পথ অবলম্বনের প্রতি অমনোযোগী। সে কোনও অবস্থাতেই বন্ধুর গিরিপথ বা কষ্টসাধ্য পথ অবলম্বনে আগ্রহী হয় না যদিও এই পথ তার আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক কল্যাণ বয়ে আনবে। বাইবেলে আছে, "Strait is the gate, and narrow is the way, which leadeth unto life, and few there be that find it." [ Matt vii 14 ] ।
১২। তুমি কি জান দুর্গম [গিরি ] পথ কি ?
১৩। [ তা হচ্ছে ] ; দাসমুক্তি ৬১৪০ ;
১৩। [ তা হচ্ছে ] ; দাসমুক্তি ৬১৪০ ;
৬১৪০। চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের পথ হচ্ছে সৎকর্ম সম্পাদন করা যা সব সময়েই খুব কষ্টকর পথ। এ পথের একটাই মানদন্ড আর তা হচ্ছে মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও এই ভালোবাসা প্রকাশের জন্য দান করা। এই মানদন্ডকে তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১) দাস মুক্তি, ২) এতিমকে আহার্য দান ও ৩) দরিদ্র নিষ্পেষিত ব্যক্তিকে আহার্য দান করা। এই মানদন্ড প্রতিটিই প্রতীকধর্মী, যার আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থই বিদ্যমান। যদিও পৃথিবীতে ক্রীতদাস প্রথা বিদ্যমান নাই, তবুও তা সমাজে অন্যভাবে বর্তমান। যেখানেই মানবতা লাঞ্ছিত হয় সেখানেই তা ক্রীতদাস প্রথায় পর্যবেসিত হয়। যেমন বাংলাদেশে নারীদের অবস্থানকে ক্রীতদাসের সাথে তুলনা করা চলে। ঠিক সেভাবেই বসনিয়াতে বা অন্যান্য স্থানে যেখানে মানবতা লুণ্ঠিত হয় সে সকলই ক্রীতদাস প্রথার প্রতীক। দাস মুক্তি দ্বারা মানবতার মুক্তি বুঝানো হয়। এ ব্যতীত ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ লোভের দাস, অজ্ঞতার দাস, সম্পদের মোহে সম্পদের দাস, কুসংস্কারের দাস, তীব্র আবেগের দাস, ক্ষমতার দাস ইত্যাদি বিভিন্ন দাসের পরিণতিতে আত্মার স্বচ্ছতা হারায়। যারা পূণ্যাত্মা, তাদের দায়িত্ব হচেছ মানুষের এসব আত্মার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা - যদিও কাজটি তার জন্য সুখকর নয়, বরং কঠিন ও বিপদজনক। তবে তখনই সে এ কাজ করতে সক্ষম হবে যখন সে নিজেকে বা নিজের আত্মাকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে।
১৪। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার্যদান ৬১৪১,
৬১৪১। এখানে আহার্য দান বাক্যটি প্রতীক ধর্মী। আহার্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা যার প্রতি সামর্থবান প্রতিটি মানুষের সাহায্যের হস্ত সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। এখানে দুর্ভিক্ষের দিনে শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্য সাহায্য যেরূপ অতীব প্রয়োজনীয় সেরূপ যে কোন মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষা, অসুখে চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার সময়েও সাহায্য করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য। যার খাদ্যের প্রয়োজন তাকেই দান করতে বলা হয়েছে। এই বাক্যটি প্রতীক ধর্মী যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থই বিদ্যমান। বিশেষ ভাবে আহার্য দান করতে বলা হয়েছে দুর্ভিক্ষের দিনে। অর্থাৎ যখন দেশব্যপী খাদ্য শষ্যের অপ্রতুলতা বিরাজ করে; অর্থাৎ যে কোন মৌলিক প্রয়োজনে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করতে হবে।
১৫। ইয়াতীম, আত্মীয়কে, ৬১৪২,
৬১৪২। যে কোন এতিমকে আহার্য দান করা অবশ্য কর্তব্য। এখানে আহার্য্য শব্দটি প্রতীক ধর্মী। যার সাহায্যে সাহায্য করাকে বুঝানো হয়েছে। সমাজে এতিমদের সুষ্ঠূ ও সম্মান জনক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে সাহায্যই করা হোক না কেন তা এর আওতায় অন্তর্ভূক্ত। তবে এখানে বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে নিজ আত্মীয়ের মাঝে এরূপ এতিমদের সর্বাগ্রে সাহায্য করতে হবে। ইংরেজীতে প্রবাদ আছে Charity begins at home . সে ভাবেই এখানে আল্লাহ্ আদেশ দান করেছেন।
১৬। অথবা পথের ধূলায় যে কাঙ্গাল থাকে তাকে, ৬১৪৩
৬১৪৩। সমাজে যারা দারিদ্র নিষ্পেষিত নিঃস্ব তাদের উন্নতির জন্য আন্তরিক চেষ্টা করার অপর নাম দারিদ্র নিষ্পেষিতদের আহার্য দান করা। এখানে প্রশংসা বা প্রতিদানের আকাঙ্খা করে না। এরূপ দানের প্রতিদান একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট চাওয়া হবে। এরূপ সাহায্যই প্রকৃত সাহায্য যার সাহায্যে সমাজ উপকৃত হয়, সমাজ থেকে দারিদ্রের অভিশাপ একমাত্র এরূপ সাহায্য দ্বারাই দূরীভূত হতে পারে। 'আহার্য ' প্রতীক শব্দটি যে কোন প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
১৭। এরপরে সে সেই সব লোকের দলভূক্ত হতে পারে ৬১৪৪ যারা ঈমান আনে; এবং ধৈর্য্য [ দৃঢ়তা ও আত্ম সংযম ] এবং দয়া ও সহানুভূতির উপদেশ দেয়।
৬১৪৪। উপরের আয়াত সমূহে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যে বর্ণনা দান করা হয়েছে তা হচ্ছে ঈমানের এসিড পরীক্ষা। খাঁটি সোনা যেরূপ কষ্টিপাথরে ঘষে পরীক্ষা করা হয়, প্রকৃত সৎ কাজও সেরূপ ঈমানের এসিড পরীক্ষা যা চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। বিশেষ চারিত্রিক গুণাবলীকে সারসংক্ষেপ করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাবে। ১) ধৈর্য বা সবর আরবীতে যার অর্থ ব্যপক [ সংযম, অধ্যাবসায় যার অর্ন্তভূক্ত দেখুন টিকা নং ৬১ ] ২) দয়া সহানুভূতি ও আন্তরিকতার সাথে কাউকে সাহায্য করার ইচ্ছা বা দয়া, শুধু মাত্র তাদের বিশ্বাসের আন্তরিকতাই বিচার করা হবে না ; তাদের কর্মের পরিণামও বিচার করা হবে।
১৮। এরাই হলো ডানদিকের [ সৌভাগ্যবান ] লোক ৬১৪৫।
৬১৪৫। উপরে বর্ণিত মোমেন বান্দাদের কথাই বলা হয়েছে যে, তারাই সৌভাগ্যশালী। দেখুন [৫৬ : ৩ ] ও টিকা ৫২২৩। এরাই তারা যারা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভ করবেন।
১৯। কিন্তু যারা আমার নিদর্শন সমূহ প্রত্যাখান করেছে, তারা হচ্ছে [ হতভাগ্য ] বা দিকের লোক ৬১৪৬।
৬১৪৬। দেখুন সূরা [৫৬ : ৪১ - ৫৬ ] ও টিকা ৫২২৩। যারা আল্লাহ্র বর্ণিত নির্দ্দেশাবলীকে প্রত্যাখান করে দুভার্গ্য তাদের। তারা অগ্নি কুন্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়বে।
২০। তাদের জন্য রয়েছে [ চারিদিক থেকে ] কুন্ডলীকৃত আগুনের ব্যবস্থা।