+
-
R
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপঃ এই সূরাটি মক্কাতে অবতীর্ণ প্রথম দশটি সূরার অন্যতম। সম্ভবতঃ সূরাটির সময়কাল ৮৯ নং এবং ৯৩নং সূরাদ্বয়ের অবতীর্ণ কালের সময়ের সমসাময়িক। লক্ষ্য করুণ এই তিনটি সূরাতেই রাত্রি ও দিনের অপূর্ব বৈশিষ্ট্য ও বৈষম্যকে তুলে ধরা হয়েছে শপথের মাধ্যমে এবং এই শপথের মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক আকাঙ্খা বা অতৃপ্তির সান্তনা দান করা হয়েছে। এই সূরাতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহকে পাওয়ার জন্য মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, তাহলেই আল্লাহ্ মানুষকে সকল প্রকার সাহায্য সহযোগীতা ও সন্তুষ্টি দান করবেন।
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৬১৫৯। তিনটি বিষয়ের শপথ এখানে করা হয়েছে যথা : রাত্রি,দিন এবং লিঙ্গের ; এবং শপথের বিষয়বস্তুর উল্লেখ করা হয়েছে ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে যে মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকার। ঠিক সেরূপ বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় প্রকৃতির মাঝে। রাত্রি ও দিনের বৈষম্যের থেকে বেশী বৈষম্য আর কিসে হতে পারে? রাত্রি যখন তার অন্ধকার চাদরে সারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলে, সূর্য তখন লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু হারিয়ে যায় না। সূর্য তার স্ব অস্তিত্বে সবর্দা বিরাজমান। সূর্য রাত্রির অন্ধকারে হারিয়ে গেলেই হারিয়ে যায় না। নির্দ্দিষ্ট সময়ে সূর্য তার উজ্জ্বলতা ও কিরণ সহ স্ব মহিমায় আবির্ভূত হবে। দেখুন [ ৯১ : ৩, ৪ ] আয়াত ও টিকা ৬১৪৯। এটি একটি রূপক বর্ণনা। পৃথিবীতে মানুষকে বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টাতে নিয়োজিত থাকতে হয় যার ফলে অনেক সময়েই সে পরলোকের কথা, আধ্যাত্মিক জীবনের উপস্থিতি তার মাঝে অনুভবে সক্ষম হয় না। ফলে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো তার আত্মার মাঝে অনুপ্রবেশ ঘটে না। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন প্রত্যেককে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে তাহলেই আত্মিক অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে সেখানে আল্লাহ্র নূরের অনুপ্রবেশ ঘটবে।
৬১৬১। প্রকৃতিতে যৌন জীবন স্রষ্টার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এখানে আল্লাহ্ মানুষের যৌন জীবনের উল্লখ করেছেন। স্রষ্টার সৃষ্টিকে আবাহমানকাল ধরে রাখার এ এক সুনিপুন কৌশল। এক নির্দ্দিষ্ট বয়েসে নারী ও পুরুষ পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, যার ফলে জন্ম নেয় প্রেম ও ভালোবাসা। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের স্ব-স্ব ভূমিকা, যা স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত, তা পালন করে থাকে। সন্তানের জন্ম,লালন -পালন, সন্তানকে পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হিসেবে সংসার জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার সকল দায়িত্ব মা ও বাবা হিসেবে মানুষ পালন করে থাকে। আর এই সংসার জীবনের মূল ভিত্তি হচ্ছে নারী -পুরুষের মিলিত যৌন জীবন।
কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষাতে তা নিম্নলিখিত ভাবে প্রকাশ করা যায় :
"তোমার গৃহে পালিছ স্নেহে,
তুমি ধন্য ধন্য হে !
পিতার বক্ষে, রেখেছ মোরে
জনম দিয়েছ জননী ক্রোড়ে
বেঁধেছ সখার প্রণয় ডোরে
তুমি ধন্য, ধন্য হে !
নারী ও পুরুষের মাঝে যে ভালোবাসার বন্ধন তা স্বর্গীয়, তা তুলনাহীন। নারী, পুরুষ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সম্পুরক। দুজনে আলাদা, তবে দুয়ে মিলে একজন। এই হলো নারী পুরুষের যৌন জীবনের স্বর্গীয় দৃষ্টি। কিন্তু যখন এই জীবনকে লালসার মাঝে অভিসিক্ত করা হয় তখনই তা পাপ ও নরকের দুয়ারে পরিণত হয়। সুতারাং জীবনের কল্যাণ ও সর্বোচ্চ মঙ্গলের জন্য মানুষ চেষ্টা করে যাবে।
৬১৬২। পৃথিবীর জীবনে মানুষের কর্ম প্রচেষ্টার মাঝে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। মানুষের সকল কর্মপ্রচেষ্টাকে সাধারণ ভাবে দুভাগে ভাগ করা যায় যথা : ভালো ও মন্দ। ভালো ও মন্দের প্রকৃতরূপকে সুন্দর উপমার সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। রাত্রির অন্ধকার দিনের আলোকে সাময়িক অপসারণ করে সত্যি, কিন্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে অক্ষম। ঠিক সেরূপ মানুষের মন্দ কাজ বা পাপ, সাময়িকভাবে ভালো বা মঙ্গলকে অন্ধকারময় করে দিতে সক্ষম কিন্তু সম্পূর্ণরূপে প্রকৃত মঙ্গলকে ধ্বংস করতে সক্ষম নয়। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, রাত্রির অন্ধকার মানুষের জন্য বিশ্রামের পরিবেশ সৃষ্টি করে, যার ফলে পরবর্তী দিনের প্রস্তুতি গ্রহণ সম্ভব হয়। ঠিক সেরূপ অমঙ্গল ও মন্দ অনেক সময়েই মানুষের শুভবুদ্ধি জাগরিত করতে সাহায্য করে। ফলে সে সব অমঙ্গল ও মন্দকে ছদ্মবেশে আর্শীবাদ স্বরূপ বলা যায়। সুতারাং কর্ম প্রচেষ্টা মানুষের বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য হবে একটাই আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র একত্বের ধারণা লাভ করা। মানুষের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যের মধ্যে বিভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সকলেরই মুল লক্ষ্য হবে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর সন্ধান লাভ করা।
৬১৬৩। কল্যাণ ও মঙ্গলের তিনটি মানদন্ড এখানে বর্ণনা করা হয়েছে।
১) 'দান ' অর্থাৎ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে আত্মত্যাগ করে। এ দানকে শুধুমাত্র অর্থের নিক্তিতে মাপার যৌক্তিকতা নাই। মানুষের সকল কর্মপ্রচেষ্টা যখন শুধুমাত্র আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগে প্রস্তুত হয় সে দানই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ দান।
২) মুত্তাকী অর্থাৎ যার হৃদয়ে তাকওয়া বা আল্লাহ্ ভীতি আছে। এই তাকওয়া তার প্রতিটি কর্মেই তার চরিত্রে প্রস্ফুটিত হবে ; দেখুন [২ : ২ ] আয়াতের টিকা নং ২৬। আত্মসংযম ও সততা হবে তাকওয়ার মানদন্ড।
৩) সত্যের ও সুন্দরের প্রতি আন্তরিক বিশ্বস্ততা। যা সত্য, তাই -ই সুন্দর আর তাই হচ্ছে নৈতিকতার মানদন্ড যা ব্যক্তির চরিত্রকে করে সুষমা মন্ডিত। Husn শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ভালো ও সুন্দর।
৬১৬৪। প্রকৃত সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন হয় সততা, আত্মত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলন। তবে যারা এই জীবনে একবার অভ্যস্ত হতে পারেন আল্লাহ্ সে সব মহৎ বান্দার অন্তর্জগতে বিরাট বিপ্লব সাধন করেন, ধীরে ধীরে সে পৃথিবীর কলুষতার বন্ধন মুক্ত হয়ে অনন্ত মুক্তির জগতে প্রবেশের যোগ্যতা লাভ করবে যা তাকে আনন্দলোকের সন্ধান দান করবে। সততা, আত্মত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমের জীবন তার নিকট সহজ থেকে সহজতর হবে এবং শেষ পর্যন্ত সে অনন্ত শান্তির রাজ্যে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়
" আনন্দ লোকে, মঙ্গলালোকে
বিরাজ সত্য সুন্দর।"
৬১৬৫। অমঙ্গল বা পাপের তিনটি মানদন্ড এখানে বর্ণনা করা হয়েছে : ১)সে ব্যক্তি হবে লোভী এবং স্বার্থপর। যার ফলে, অন্যের জন্য সে ব্যয় করতে হবে কুণ্ঠিত এবং লোভীর ন্যায় সব ভালো নিজের জন্য কুক্ষিগত করার প্রয়াস পায় এবং মানুষের অধিকারকে হরণ করতে দ্বিধা বোধ করে না। আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয়কে বা পরিশ্রমকে সে অর্থহীন মনে করে। ২) 'স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করে ' এর অর্থ হচ্ছে এসব ব্যক্তি জীবনের সর্ব সাফল্যের একক দাবীদার। আল্লাহ্র মহান দানকে সে নিজের কৃতিত্ব বলে জাহির করে। কখনও আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ হয় না। সে ভুলে যায় যে তার মেধা, মননশক্তি, সৃজনক্ষমতা, ধন-জন, সহায়-সম্পত্তি সবই সেই পরম করুণাময়ের দান। তার ধারণা হয় তার সাফল্যের সর্ব কৃতিত্ব তার একার। [ ৯৬ : ৬ - ৭]। ৩) এসব লোকেরা ইচ্ছাকৃত ভাবে যা ন্যায়, সত্য ও সুন্দর তা প্রত্যাখান করে। এরা সত্যকে ঘৃণা করে, সুন্দর কে এরা অসুন্দর ও কুৎসিতে রূপান্তর করে। এসব লোকের সম্বন্ধে বলা হয়েছে এদের পাপের পিচ্ছিল পথে যাত্রা যার নিম্ন গতি ক্রমান্বয়ে হবে ত্বরান্বিত। এদের শেষ পরিণতি ভয়াবহ। শেষের সে পরিণতির দিনে কোনও ধন সম্পদ বা লোকবল কিছুই সাহায্যে আসবে না।
৬১৬৬। পৃথিবীর জীবনে অর্থ বিত্ত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সত্য। কিন্তু শেষ বিচারের দিনে এ সবই হবে মূল্যহীন। পার্থিব কোনও সুযোগ সুবিধা পরলোকের সে জীবনে কোন কাজেই আসবে না। বিচার দিবসে যা সাহায্য করবে, তা হচ্ছে পূত পবিত্র জীবন যা সত্যের প্রতি ছিলো নিবেদিত এবং আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য যে জীবন ছিলো উৎসর্গিত।
৬১৬৭। মানুষ যাতে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে, সে কারণে আল্লাহ্ মানুষের জন্য সঠিক পথের নির্দ্দেশনা দান করেছেন। সৃষ্টির সকল কিছুর মাঝেই তিনি পথের নির্দ্দেশনা রেখেছেন, মানুষকে সাহায্য করেছেন সঠিক ও ভুল পথের নিশানা খুঁজে নিতে। মানুষকে তিনি দান করেছেন মানসিক দক্ষতা সমূহ, বিবেক, বিচার বুদ্ধি। এ সব কিছুর সমন্বয় ও সঠিক ব্যবহারেই সে খুঁজে পাবে সঠিক পথের ঠিকানা যা তাঁকে পৌঁছে দিবে আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির সোপানে। এর পরেও আল্লাহ্ মানুষের জন্য নবী ও রসুলদের প্রেরণ করেছেন যাদের শিক্ষা মানুষকে চলার পথের সন্ধান দান করে।
৬১৬৮। এই পৃথিবীর কর্মজীবনের শেষে প্রতিটি মানুষকে জবাবদিহিতার জন্য আল্লাহ্র সম্মুখীন হতে হবে। পৃথিবীর জীবনে আল্লাহ্র করুণা ও ভালোবাসা মানুষের জীবনকে আপ্লুত করে রাখে। আল্লাহ্ মানুষকে সীমিত স্বাধীনতা দিয়েছেন - ভালো ও মন্দকে বেছে নেয়ার জন্য। পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত 'শিক্ষানবীশকালে' সে যদি এই "সীমিত স্বাধীনতার 'অপব্যবহার না করে আল্লাহ্ ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পন করে; আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ইচ্ছার সাথে নিজেকে সমন্বিত করতে সক্ষম হয়, তবেই তাঁর মনুষ্য জীবন সার্থক। কারণ পরলোকে তার জন্য জবাবদিহিতা অপেক্ষা করে আছে, কিভাবে সে তার মেধা, মননশক্তি, সুযোগ সুবিধা, সহায় সম্পদকে পৃথিবীর জীবনে ব্যবহার করেছে। আল্লাহ্র এসব দানকে সে কি সঠিক ভাবে ব্যবহার করেছে। সীমিত স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথে আল্লাহ্র দেয়া নেয়ামতের ব্যবহার করেছে না অপব্যবহার করেছে, এটাই হবে তার জন্য জবাবদিহিতার বিষয়। যদি সে অপব্যবহার করে তবে তার পরিণতি তাকে ভোগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ্ ইহকাল ও পরকালের মালিক। তিনিই প্রথম ও তিনিই শেষ।
৬১৬৯। যে ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র সত্যকে প্রত্যাখান করে এবং বিবেকের বিরুদ্ধে পাপ কাজে লিপ্ত হয়, তাদের জন্য পরলোকে আগুনের লেলিহান শিখা অপেক্ষা করে আছে।
৬১৭০। 'Atqa' বা "আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নিবেদিত" বা মুত্তাকী দ্বারা বুঝানো হয়েছে তাদের যারা কলুষমুক্ত পূত পবিত্র জীবন যাপন করেন। এদের জীবনের একমাত্র কাম্য আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন এবং আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত থাকা।
৬১৭১। 'সম্পদ' শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র পার্থিব ধন সম্পদকেই বুঝানো হয় নাই। শব্দটি এখানে ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্র যে কোনও নেয়ামতই বান্দার জন্য সম্পদ। এই সম্পদ হতে পারে মেধা, প্রতিভা, সৃজনক্ষমতা : প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি। দেখুন সূরা [ ২ : ৩ ] আয়াতের টিকা নং ২৭। এসব সৃষ্টির সেবার ব্যয় করাই হচ্ছে দান করা। ভালো কাজ করা যেমন : জ্ঞান, বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য কাজ করাও দান ইত্যাদি।
৬১৭২। আবরীতে "Zaka" শব্দটি বৃদ্ধি করা ও পবিত্র করা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এই আয়াতে এই দুটি অর্থেরই প্রয়োগ ঘটেছে। সম্পদের অর্থ আক্ষরিক বা প্রতীকধর্মী, যাই-ই হোক না কেন, আল্লাহ্র দেয়া যে কোন সম্পদ মানুষের জন্য আমানত স্বরূপ। সম্পদের জন্য দেখুন টিকা নং ২৭। এই সম্পদ যথেচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি আল্লাহ্ মানুষকে দেন নাই। আল্লাহ্র নেয়ামত মানুষের জন্য আমানত বা মানুষের জন্য তা পরীক্ষা স্বরূপ। সেই এই পরীক্ষাতে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হতে পারে যে এই সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে পারে। তারই জীবন পবিত্র ও কলূষমুক্ত যে আল্লাহ্র নেয়ামতে ধন্য হয়েও গর্বে অহংকারে স্ফীত হয় না। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে সম্পদের ভারকে যে হালকা করতে পারে। যে সঠিকভাবে তার সম্পদের ব্যবহার করতে পারে পৃথিবীতে মানুষের নিকট এবং আল্লাহ্র নিকট তার সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন হয় গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত।
৬১৭৩। দানের প্রকৃত সংজ্ঞা এখানে বিবৃত করা হয়েছে। প্রকৃত দাতা হচ্ছে সেই যে দান করে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য, দান গ্রহীতার নিকট তার কোন দাবী বা প্রতিদানের কোনও আকাঙ্খা থাকে না। কারও অনুগ্রহ, বা সুবিধা লাভ বা দানের মাধ্যমে কারও সেবা গ্রহণের মানসিকতা প্রকৃত দাতার মনে স্থান লাভ করে না। যে কোনও সৎকাজ যা প্রতিদানের বা অনুগ্রহের উদ্দেশ্য ব্যতীত শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য যা করা হয় তাই -ই হচ্ছে প্রকৃত দানের সংজ্ঞা।
৬১৭৪। যা সৎ কাজ, তাই দান বা আত্মত্যাগ। দানকে বা আত্মত্যাগকে জগতে সর্বোচ্চ সম্মান দান করা হয়েছে। " আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নিবেদিত " তারাই যারা স্বীয় ইচ্ছাকে আল্লাহ্র ইচ্ছার মাঝে বিলীন করে দিতে পেরেছেন। আল্লাহ্র জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ তাদের আনন্দ ও সন্তুষ্টির বিষয়। তাদের এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ্ তাদের হৃদয়ের মাঝে শান্তি ও সন্তোষ দান করেন। যে কোনও পূণ্যাত্মা লোকের অন্তর শান্তির পরশে আপ্লুত থাকে। তবে এই প্রশান্তির গভীরতা নির্ভর করে তাদের পূণ্য বা আত্মিক গুণাবলীর গভীরতার উপরে। সর্বোচ্চ প্রশান্তি হচ্ছে সর্বোচচ পূণ্য বা আত্মিক গুণাবলীর সর্বোচ্চ প্রকাশ। এই আয়াতে আল্লাহ্ সেভাবেই বলেছেন যে, পূণ্য কাজের বিনিময়ে আছে অন্তরের সন্তোষ বা প্রশান্তি। এ প্রশান্তি ঐশ্বর্যের উপরে নির্ভর করে না। মান-সম্মান বা সাফল্যের উপরেও নির্ভর করে না, যা সুর্যের কিরণের মত অকৃপণ, অপক্ষপাতী,উদার, ধনী দরিদ্র বিচার করে না, উপকরণের স্বল্পতা বা বাহুল্যের উপরে নির্ভর করে না। বিশ্ব জগতের প্রভুর এ এক অপূর্ব দান পূণ্য কাজের পরিবর্তে।
সূরা লায়ল
সূরা লায়ল বা রজনী - ৯২
২১ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপঃ এই সূরাটি মক্কাতে অবতীর্ণ প্রথম দশটি সূরার অন্যতম। সম্ভবতঃ সূরাটির সময়কাল ৮৯ নং এবং ৯৩নং সূরাদ্বয়ের অবতীর্ণ কালের সময়ের সমসাময়িক। লক্ষ্য করুণ এই তিনটি সূরাতেই রাত্রি ও দিনের অপূর্ব বৈশিষ্ট্য ও বৈষম্যকে তুলে ধরা হয়েছে শপথের মাধ্যমে এবং এই শপথের মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক আকাঙ্খা বা অতৃপ্তির সান্তনা দান করা হয়েছে। এই সূরাতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহকে পাওয়ার জন্য মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, তাহলেই আল্লাহ্ মানুষকে সকল প্রকার সাহায্য সহযোগীতা ও সন্তুষ্টি দান করবেন।
সূরা লায়ল বা রজনী - ৯২
২১ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
১। শপথ রাত্রির, যখন তা [ আলোকে ] লুকিয়ে ফেলে ৬১৫৯ ;
২। শপথ দিনের, যখন তা উদ্ভাসিত হয়।
২। শপথ দিনের, যখন তা উদ্ভাসিত হয়।
৬১৫৯। তিনটি বিষয়ের শপথ এখানে করা হয়েছে যথা : রাত্রি,দিন এবং লিঙ্গের ; এবং শপথের বিষয়বস্তুর উল্লেখ করা হয়েছে ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে যে মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকার। ঠিক সেরূপ বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় প্রকৃতির মাঝে। রাত্রি ও দিনের বৈষম্যের থেকে বেশী বৈষম্য আর কিসে হতে পারে? রাত্রি যখন তার অন্ধকার চাদরে সারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলে, সূর্য তখন লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু হারিয়ে যায় না। সূর্য তার স্ব অস্তিত্বে সবর্দা বিরাজমান। সূর্য রাত্রির অন্ধকারে হারিয়ে গেলেই হারিয়ে যায় না। নির্দ্দিষ্ট সময়ে সূর্য তার উজ্জ্বলতা ও কিরণ সহ স্ব মহিমায় আবির্ভূত হবে। দেখুন [ ৯১ : ৩, ৪ ] আয়াত ও টিকা ৬১৪৯। এটি একটি রূপক বর্ণনা। পৃথিবীতে মানুষকে বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টাতে নিয়োজিত থাকতে হয় যার ফলে অনেক সময়েই সে পরলোকের কথা, আধ্যাত্মিক জীবনের উপস্থিতি তার মাঝে অনুভবে সক্ষম হয় না। ফলে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো তার আত্মার মাঝে অনুপ্রবেশ ঘটে না। কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন প্রত্যেককে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে তাহলেই আত্মিক অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে সেখানে আল্লাহ্র নূরের অনুপ্রবেশ ঘটবে।
৩। শপথ পুরুষ ও নারীর সৃষ্টি [ রহস্যের ] ৬১৬১
৬১৬১। প্রকৃতিতে যৌন জীবন স্রষ্টার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এখানে আল্লাহ্ মানুষের যৌন জীবনের উল্লখ করেছেন। স্রষ্টার সৃষ্টিকে আবাহমানকাল ধরে রাখার এ এক সুনিপুন কৌশল। এক নির্দ্দিষ্ট বয়েসে নারী ও পুরুষ পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, যার ফলে জন্ম নেয় প্রেম ও ভালোবাসা। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের স্ব-স্ব ভূমিকা, যা স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত, তা পালন করে থাকে। সন্তানের জন্ম,লালন -পালন, সন্তানকে পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হিসেবে সংসার জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার সকল দায়িত্ব মা ও বাবা হিসেবে মানুষ পালন করে থাকে। আর এই সংসার জীবনের মূল ভিত্তি হচ্ছে নারী -পুরুষের মিলিত যৌন জীবন।
কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষাতে তা নিম্নলিখিত ভাবে প্রকাশ করা যায় :
"তোমার গৃহে পালিছ স্নেহে,
তুমি ধন্য ধন্য হে !
পিতার বক্ষে, রেখেছ মোরে
জনম দিয়েছ জননী ক্রোড়ে
বেঁধেছ সখার প্রণয় ডোরে
তুমি ধন্য, ধন্য হে !
নারী ও পুরুষের মাঝে যে ভালোবাসার বন্ধন তা স্বর্গীয়, তা তুলনাহীন। নারী, পুরুষ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সম্পুরক। দুজনে আলাদা, তবে দুয়ে মিলে একজন। এই হলো নারী পুরুষের যৌন জীবনের স্বর্গীয় দৃষ্টি। কিন্তু যখন এই জীবনকে লালসার মাঝে অভিসিক্ত করা হয় তখনই তা পাপ ও নরকের দুয়ারে পরিণত হয়। সুতারাং জীবনের কল্যাণ ও সর্বোচ্চ মঙ্গলের জন্য মানুষ চেষ্টা করে যাবে।
৪। অবশ্যই তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা হবে বিভিন্ন প্রকৃতির। ৬১৬২
৬১৬২। পৃথিবীর জীবনে মানুষের কর্ম প্রচেষ্টার মাঝে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। মানুষের সকল কর্মপ্রচেষ্টাকে সাধারণ ভাবে দুভাগে ভাগ করা যায় যথা : ভালো ও মন্দ। ভালো ও মন্দের প্রকৃতরূপকে সুন্দর উপমার সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। রাত্রির অন্ধকার দিনের আলোকে সাময়িক অপসারণ করে সত্যি, কিন্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে অক্ষম। ঠিক সেরূপ মানুষের মন্দ কাজ বা পাপ, সাময়িকভাবে ভালো বা মঙ্গলকে অন্ধকারময় করে দিতে সক্ষম কিন্তু সম্পূর্ণরূপে প্রকৃত মঙ্গলকে ধ্বংস করতে সক্ষম নয়। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, রাত্রির অন্ধকার মানুষের জন্য বিশ্রামের পরিবেশ সৃষ্টি করে, যার ফলে পরবর্তী দিনের প্রস্তুতি গ্রহণ সম্ভব হয়। ঠিক সেরূপ অমঙ্গল ও মন্দ অনেক সময়েই মানুষের শুভবুদ্ধি জাগরিত করতে সাহায্য করে। ফলে সে সব অমঙ্গল ও মন্দকে ছদ্মবেশে আর্শীবাদ স্বরূপ বলা যায়। সুতারাং কর্ম প্রচেষ্টা মানুষের বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য হবে একটাই আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র একত্বের ধারণা লাভ করা। মানুষের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যের মধ্যে বিভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সকলেরই মুল লক্ষ্য হবে আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর সন্ধান লাভ করা।
৫। কিন্তু যে, দান করে, এবং [আল্লাহকে ] ভয় করে,
৬। এবং যে [ আন্তরিক ] দৃঢ় ভাবে সর্বোত্তম [ সত্যকে] সমর্থন করে, ৬১৬৩ ;
৬। এবং যে [ আন্তরিক ] দৃঢ় ভাবে সর্বোত্তম [ সত্যকে] সমর্থন করে, ৬১৬৩ ;
৬১৬৩। কল্যাণ ও মঙ্গলের তিনটি মানদন্ড এখানে বর্ণনা করা হয়েছে।
১) 'দান ' অর্থাৎ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে আত্মত্যাগ করে। এ দানকে শুধুমাত্র অর্থের নিক্তিতে মাপার যৌক্তিকতা নাই। মানুষের সকল কর্মপ্রচেষ্টা যখন শুধুমাত্র আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগে প্রস্তুত হয় সে দানই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ দান।
২) মুত্তাকী অর্থাৎ যার হৃদয়ে তাকওয়া বা আল্লাহ্ ভীতি আছে। এই তাকওয়া তার প্রতিটি কর্মেই তার চরিত্রে প্রস্ফুটিত হবে ; দেখুন [২ : ২ ] আয়াতের টিকা নং ২৬। আত্মসংযম ও সততা হবে তাকওয়ার মানদন্ড।
৩) সত্যের ও সুন্দরের প্রতি আন্তরিক বিশ্বস্ততা। যা সত্য, তাই -ই সুন্দর আর তাই হচ্ছে নৈতিকতার মানদন্ড যা ব্যক্তির চরিত্রকে করে সুষমা মন্ডিত। Husn শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ভালো ও সুন্দর।
৭। আমি অবশ্যই তার জন্য পরম সুখ ও শান্তির পথ মসৃণ করে দেবো ৬১৬৪
৬১৬৪। প্রকৃত সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন হয় সততা, আত্মত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলন। তবে যারা এই জীবনে একবার অভ্যস্ত হতে পারেন আল্লাহ্ সে সব মহৎ বান্দার অন্তর্জগতে বিরাট বিপ্লব সাধন করেন, ধীরে ধীরে সে পৃথিবীর কলুষতার বন্ধন মুক্ত হয়ে অনন্ত মুক্তির জগতে প্রবেশের যোগ্যতা লাভ করবে যা তাকে আনন্দলোকের সন্ধান দান করবে। সততা, আত্মত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমের জীবন তার নিকট সহজ থেকে সহজতর হবে এবং শেষ পর্যন্ত সে অনন্ত শান্তির রাজ্যে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়
" আনন্দ লোকে, মঙ্গলালোকে
বিরাজ সত্য সুন্দর।"
৮। কিন্তু যে লোভী এবং কৃপণ হবে এবং নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করবে,
৯। এবং সর্বোত্তম [ সত্যকে ] মিথ্যা বলে মনে করবে, ৬১৬৫
৯। এবং সর্বোত্তম [ সত্যকে ] মিথ্যা বলে মনে করবে, ৬১৬৫
৬১৬৫। অমঙ্গল বা পাপের তিনটি মানদন্ড এখানে বর্ণনা করা হয়েছে : ১)সে ব্যক্তি হবে লোভী এবং স্বার্থপর। যার ফলে, অন্যের জন্য সে ব্যয় করতে হবে কুণ্ঠিত এবং লোভীর ন্যায় সব ভালো নিজের জন্য কুক্ষিগত করার প্রয়াস পায় এবং মানুষের অধিকারকে হরণ করতে দ্বিধা বোধ করে না। আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয়কে বা পরিশ্রমকে সে অর্থহীন মনে করে। ২) 'স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করে ' এর অর্থ হচ্ছে এসব ব্যক্তি জীবনের সর্ব সাফল্যের একক দাবীদার। আল্লাহ্র মহান দানকে সে নিজের কৃতিত্ব বলে জাহির করে। কখনও আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ হয় না। সে ভুলে যায় যে তার মেধা, মননশক্তি, সৃজনক্ষমতা, ধন-জন, সহায়-সম্পত্তি সবই সেই পরম করুণাময়ের দান। তার ধারণা হয় তার সাফল্যের সর্ব কৃতিত্ব তার একার। [ ৯৬ : ৬ - ৭]। ৩) এসব লোকেরা ইচ্ছাকৃত ভাবে যা ন্যায়, সত্য ও সুন্দর তা প্রত্যাখান করে। এরা সত্যকে ঘৃণা করে, সুন্দর কে এরা অসুন্দর ও কুৎসিতে রূপান্তর করে। এসব লোকের সম্বন্ধে বলা হয়েছে এদের পাপের পিচ্ছিল পথে যাত্রা যার নিম্ন গতি ক্রমান্বয়ে হবে ত্বরান্বিত। এদের শেষ পরিণতি ভয়াবহ। শেষের সে পরিণতির দিনে কোনও ধন সম্পদ বা লোকবল কিছুই সাহায্যে আসবে না।
১০। আমি অবশ্যই তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক পথকে মসৃণ করে দেবো।
১১। তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে [ সোজাসুজি ] দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। ৬১৬৬
১১। তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে [ সোজাসুজি ] দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। ৬১৬৬
৬১৬৬। পৃথিবীর জীবনে অর্থ বিত্ত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সত্য। কিন্তু শেষ বিচারের দিনে এ সবই হবে মূল্যহীন। পার্থিব কোনও সুযোগ সুবিধা পরলোকের সে জীবনে কোন কাজেই আসবে না। বিচার দিবসে যা সাহায্য করবে, তা হচ্ছে পূত পবিত্র জীবন যা সত্যের প্রতি ছিলো নিবেদিত এবং আল্লাহ্র সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য যে জীবন ছিলো উৎসর্গিত।
১২। অবশ্যই আমি নিজে [ মানুষকে] পথ প্রদর্শনের ভার নিয়েছি ৬১৬৭।
৬১৬৭। মানুষ যাতে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে, সে কারণে আল্লাহ্ মানুষের জন্য সঠিক পথের নির্দ্দেশনা দান করেছেন। সৃষ্টির সকল কিছুর মাঝেই তিনি পথের নির্দ্দেশনা রেখেছেন, মানুষকে সাহায্য করেছেন সঠিক ও ভুল পথের নিশানা খুঁজে নিতে। মানুষকে তিনি দান করেছেন মানসিক দক্ষতা সমূহ, বিবেক, বিচার বুদ্ধি। এ সব কিছুর সমন্বয় ও সঠিক ব্যবহারেই সে খুঁজে পাবে সঠিক পথের ঠিকানা যা তাঁকে পৌঁছে দিবে আধ্যাত্মিক জগতের উন্নতির সোপানে। এর পরেও আল্লাহ্ মানুষের জন্য নবী ও রসুলদের প্রেরণ করেছেন যাদের শিক্ষা মানুষকে চলার পথের সন্ধান দান করে।
১৩। এবং আমি তো মালিক শেষ ও শুরুর। ৬১৬৮
৬১৬৮। এই পৃথিবীর কর্মজীবনের শেষে প্রতিটি মানুষকে জবাবদিহিতার জন্য আল্লাহ্র সম্মুখীন হতে হবে। পৃথিবীর জীবনে আল্লাহ্র করুণা ও ভালোবাসা মানুষের জীবনকে আপ্লুত করে রাখে। আল্লাহ্ মানুষকে সীমিত স্বাধীনতা দিয়েছেন - ভালো ও মন্দকে বেছে নেয়ার জন্য। পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত 'শিক্ষানবীশকালে' সে যদি এই "সীমিত স্বাধীনতার 'অপব্যবহার না করে আল্লাহ্ ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পন করে; আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ইচ্ছার সাথে নিজেকে সমন্বিত করতে সক্ষম হয়, তবেই তাঁর মনুষ্য জীবন সার্থক। কারণ পরলোকে তার জন্য জবাবদিহিতা অপেক্ষা করে আছে, কিভাবে সে তার মেধা, মননশক্তি, সুযোগ সুবিধা, সহায় সম্পদকে পৃথিবীর জীবনে ব্যবহার করেছে। আল্লাহ্র এসব দানকে সে কি সঠিক ভাবে ব্যবহার করেছে। সীমিত স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে আল্লাহ্র নির্দ্দেশিত পথে আল্লাহ্র দেয়া নেয়ামতের ব্যবহার করেছে না অপব্যবহার করেছে, এটাই হবে তার জন্য জবাবদিহিতার বিষয়। যদি সে অপব্যবহার করে তবে তার পরিণতি তাকে ভোগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ্ ইহকাল ও পরকালের মালিক। তিনিই প্রথম ও তিনিই শেষ।
১৪। অতএব, তোমাদের লেলিহান প্রচন্ড অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি ;
১৫। চরম হতভাগ্য ব্যতীত সেখানে কেহ প্রবেশ করবে না ৬১৬৯
১৬। যে সত্যকে মিথ্যা বলে, মুখ ফিরিয়ে নেয়।
১৫। চরম হতভাগ্য ব্যতীত সেখানে কেহ প্রবেশ করবে না ৬১৬৯
১৬। যে সত্যকে মিথ্যা বলে, মুখ ফিরিয়ে নেয়।
৬১৬৯। যে ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্র সত্যকে প্রত্যাখান করে এবং বিবেকের বিরুদ্ধে পাপ কাজে লিপ্ত হয়, তাদের জন্য পরলোকে আগুনের লেলিহান শিখা অপেক্ষা করে আছে।
১৭। কিন্তু তাদের তা থেকে বহু দূরে রাখা হবে, যারা আল্লাহ্র প্রতি একান্ত অনুগত, ৬১৭০
৬১৭০। 'Atqa' বা "আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নিবেদিত" বা মুত্তাকী দ্বারা বুঝানো হয়েছে তাদের যারা কলুষমুক্ত পূত পবিত্র জীবন যাপন করেন। এদের জীবনের একমাত্র কাম্য আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন এবং আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত থাকা।
১৮। যারা আত্মশুদ্ধির জন্য স্বীয় সম্পদ ব্যয় করে ৬১৭১, ৬১৭২
৬১৭১। 'সম্পদ' শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র পার্থিব ধন সম্পদকেই বুঝানো হয় নাই। শব্দটি এখানে ব্যপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্র যে কোনও নেয়ামতই বান্দার জন্য সম্পদ। এই সম্পদ হতে পারে মেধা, প্রতিভা, সৃজনক্ষমতা : প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি। দেখুন সূরা [ ২ : ৩ ] আয়াতের টিকা নং ২৭। এসব সৃষ্টির সেবার ব্যয় করাই হচ্ছে দান করা। ভালো কাজ করা যেমন : জ্ঞান, বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য কাজ করাও দান ইত্যাদি।
৬১৭২। আবরীতে "Zaka" শব্দটি বৃদ্ধি করা ও পবিত্র করা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এই আয়াতে এই দুটি অর্থেরই প্রয়োগ ঘটেছে। সম্পদের অর্থ আক্ষরিক বা প্রতীকধর্মী, যাই-ই হোক না কেন, আল্লাহ্র দেয়া যে কোন সম্পদ মানুষের জন্য আমানত স্বরূপ। সম্পদের জন্য দেখুন টিকা নং ২৭। এই সম্পদ যথেচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি আল্লাহ্ মানুষকে দেন নাই। আল্লাহ্র নেয়ামত মানুষের জন্য আমানত বা মানুষের জন্য তা পরীক্ষা স্বরূপ। সেই এই পরীক্ষাতে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হতে পারে যে এই সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে পারে। তারই জীবন পবিত্র ও কলূষমুক্ত যে আল্লাহ্র নেয়ামতে ধন্য হয়েও গর্বে অহংকারে স্ফীত হয় না। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে সম্পদের ভারকে যে হালকা করতে পারে। যে সঠিকভাবে তার সম্পদের ব্যবহার করতে পারে পৃথিবীতে মানুষের নিকট এবং আল্লাহ্র নিকট তার সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন হয় গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত।
১৯। তারা প্রতিদানে কারও অনুগ্রহের অথবা পুরষ্কারের আশা মনে রাখে না। ৬১৭৩
৬১৭৩। দানের প্রকৃত সংজ্ঞা এখানে বিবৃত করা হয়েছে। প্রকৃত দাতা হচ্ছে সেই যে দান করে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য, দান গ্রহীতার নিকট তার কোন দাবী বা প্রতিদানের কোনও আকাঙ্খা থাকে না। কারও অনুগ্রহ, বা সুবিধা লাভ বা দানের মাধ্যমে কারও সেবা গ্রহণের মানসিকতা প্রকৃত দাতার মনে স্থান লাভ করে না। যে কোনও সৎকাজ যা প্রতিদানের বা অনুগ্রহের উদ্দেশ্য ব্যতীত শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য যা করা হয় তাই -ই হচ্ছে প্রকৃত দানের সংজ্ঞা।
২০। শুধু তাদের আকাঙ্খা হবে মহাপ্রভুর সন্তুষ্টি। ৬১৭৪
২১। এবং শীঘ্রই তারা [ সম্পূর্ণ ] সন্তুষ্টি লাভ করবে।
২১। এবং শীঘ্রই তারা [ সম্পূর্ণ ] সন্তুষ্টি লাভ করবে।
৬১৭৪। যা সৎ কাজ, তাই দান বা আত্মত্যাগ। দানকে বা আত্মত্যাগকে জগতে সর্বোচ্চ সম্মান দান করা হয়েছে। " আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নিবেদিত " তারাই যারা স্বীয় ইচ্ছাকে আল্লাহ্র ইচ্ছার মাঝে বিলীন করে দিতে পেরেছেন। আল্লাহ্র জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ তাদের আনন্দ ও সন্তুষ্টির বিষয়। তাদের এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ্ তাদের হৃদয়ের মাঝে শান্তি ও সন্তোষ দান করেন। যে কোনও পূণ্যাত্মা লোকের অন্তর শান্তির পরশে আপ্লুত থাকে। তবে এই প্রশান্তির গভীরতা নির্ভর করে তাদের পূণ্য বা আত্মিক গুণাবলীর গভীরতার উপরে। সর্বোচ্চ প্রশান্তি হচ্ছে সর্বোচচ পূণ্য বা আত্মিক গুণাবলীর সর্বোচ্চ প্রকাশ। এই আয়াতে আল্লাহ্ সেভাবেই বলেছেন যে, পূণ্য কাজের বিনিময়ে আছে অন্তরের সন্তোষ বা প্রশান্তি। এ প্রশান্তি ঐশ্বর্যের উপরে নির্ভর করে না। মান-সম্মান বা সাফল্যের উপরেও নির্ভর করে না, যা সুর্যের কিরণের মত অকৃপণ, অপক্ষপাতী,উদার, ধনী দরিদ্র বিচার করে না, উপকরণের স্বল্পতা বা বাহুল্যের উপরে নির্ভর করে না। বিশ্ব জগতের প্রভুর এ এক অপূর্ব দান পূণ্য কাজের পরিবর্তে।