+
-
R
১৯ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপ : ৪০ বৎসর বয়সে হেরা পর্বতের গুহায় সর্বপ্রথম তাঁর এই সূরার [ ১ - ৫ ] পাঁচটি আয়াত রাসুলের নিকট সরাসরি অবতীর্ণ হয় এটাই ছিলো প্রথম ওহী। এর পরে কয়েক মাস বা সম্ভবতঃ এক বছরের বিরতি [Fatra] ছিলো। সূরা নং ৬৮ কে বলা হয় এই পাঁচটি আয়াতের পরে অবতীর্ণ দ্বিতীয় ওহী। কিন্তু এই সূরার পরবর্তী অংশ [ ৯৬ : ৬ - ১৯] দীর্ঘ বিরতির পরে অবতীর্ণ হয়,এবং এই অংশকে পূর্বের পাঁচটি আয়াতের সাথে যুক্ত করা হয়, যেখানে আদেশ দান করা হয়েছে সত্য জ্ঞান প্রচারের জন্য। পরবর্তী অংশ সংযুক্ত করার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, এই সত্য ও জ্ঞানকে প্রচারের প্রধান বাঁধা হচ্ছে মানুষের একগুঁয়েমী,অহংকার এবং উদ্ধতপনা। দেখুন সূরা মুজাম্মিলের [ ৭৩ নং ] ভূমিকা।
১৯ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
৬২০৩। 'Iqraa' অর্থ পড় বা আবৃত্তি করা, অথবা ঘোষণা কর। এখানে আল্লাহ্র বাণী। পৃথিবীর দৃষ্টিকোণ থেকে রাসুল (সা) ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তাঁর হৃদয় ছিলো পরিপূর্ণ। এখন সময় হয়েছে সেই জ্ঞানের বাণী পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য প্রচার করার।
৬২০৪। কোরাণের সর্বপ্রথম আয়াত হচ্ছে এই আয়াতটি যার মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় আল্লাহ্র নাম। এই ঘোষণা রাসুলের (সা) জন্য কোন ব্যক্তিগত লাভ ছিলো না বরং আল্লাহ্র বাণী প্রচারের জন্য তাঁকে অমানুষিক অত্যাচার,নির্যাতন, দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আল্লাহ্র বাণী পৃথিবীতে প্রেরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথের সন্ধান দান করা। কোরাণের এই প্রথম আয়াতটিতে আল্লাহ্র উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের 'প্রতিপালক' রূপে। যার ফলে আল্লাহ্র সাথে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ ঘটে থাকে। মানুষের প্রতি আল্লাহ্র বাণী কোন বির্মূত ধ্যান ধারণা বা দার্শনিক তত্ব নয়। এ বাণী হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা ও প্রতিপালকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তাঁর সৃষ্টির সাথে, যে সৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন এবং প্রতিপালন করেন। "তোমার " শব্দটিকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায় :
১) শব্দটি রাসুলের (সা ) জন্য প্রযোজ্য হয়েছে। জিবরাইল ফেরেশতার সাথে তার সরাসরি যোগাযোগ ঘটে ; যাকে আল্লাহ্ রাসুলের (সা) নিকট প্রেরণ করেন। অথবা
২) তোমার শব্দটি দ্বারা সম্পূর্ণ মানব জাতিকে বুঝানো হয়েছে।
৬২০৫। দেখুন [ ২৩ : ১৪ ] আয়াত। মানুষের জন্ম ইতিহাস অন্যান্য প্রাণীর জন্ম ইতিহাসের সমতুল্য যা অতি তুচ্ছ। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার বুদ্ধিমত্তা, নৈতিক মূল্যবোধ, ও আত্মিক বিকাশের মাধ্যমে উচ্চতর ও মহত্তর পরিণতি। মানুষকে আল্লাহ্ জ্ঞান দান করেছেন যার সাহায্যে সে উত্তোরতর উন্নতির পথে আরোহণ করে।
৬২০৬। দেখুন [ ৬৮ : ১ ] আয়াতের টিকা নং ৫৫৯৩। এই সূরাতে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। 'পড়া ' 'কলম' ও 'জ্ঞান'। 'জ্ঞান' শব্দটিকে এ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ''শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যাহা সে জানিত না।" কারণ "শিক্ষা দান করা " ও "জ্ঞান" এই শব্দ দুটির মূল শব্দ একটাই। 'কলম' শব্দটি বই, লেখা, অধ্যয়ন,গবেষণা ইত্যাদির প্রতীক। 'জ্ঞান ' শব্দটি 'বিজ্ঞান', প্রজ্ঞা, সাধারণ জ্ঞান, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতীক এবং পড় বা 'ঘোষণা কর' শব্দটির অপর অর্থ নিজে পড়া ও অন্যকে জানানো। প্রকৃত পক্ষে শব্দগুলি এতটাই গভীর অর্থবোধক এবং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যে এগুলির সঠিক অনুবাদ এক কথায় করা প্রায় অসম্ভব। পড়া, শিক্ষা দান করা, কলম জ্ঞান ঘোষণা করা এই শব্দগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত শব্দ যা অর্কেষ্ট্রার ঐক্যতানের মত; আলাদা করে দেখার অবসর নাই।
' পাঠ কর ' বা 'ঘোষণা কর ' এই বাক্যটির অর্থ সার্বজনীন। যদিও রাসুলের (সা) প্রতি আয়াতটি সর্বপ্রথমে অবতীর্ণ করা হয়, কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে যে কোরাণের উপদেশ বিশ্বজনীন -স্থান-কাল ও সময়ের উর্দ্ধে। সুতারাং আল্লাহ্র বাণী সমূহ প্রচারের মহান দায়িত্ব শুধুমাত্র তার নবী ও রসুলদের এ কথা ঠিক নয়। এ দায়িত্ব তাদের সকলের যারা এই বাণীর মর্মার্থ ও গুঢ় অর্থ অনুধাবনে সক্ষম। কারণ Iqraa শব্দটি দ্বারা ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে বুঝানো হয় না। এর অর্থ সামগ্রিক, বিশ্বজনীন, কোরাণের বহু স্থানে এরূপ গভীর অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায় যা জ্ঞানীদের উপলব্ধির বিষয় বস্তু। প্রকৃত পক্ষে এই একটি 'পড়' শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ঘোষণা হচ্ছে তাঁর কালামকে পড়তে হবে উপলব্ধির মাধ্যমে এবং সেই উপলব্ধি শুধুমাত্র নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ করে রাখলেই চলবে না ; তা করতে হবে বিশ্বজনীন প্রচার। রাসুলের (সা) মাধ্যমে এই-ই হচ্ছে সার্বজনীন উপদেশ।
৬২০৭। জন্মলগ্ন থেকে মানব শিশুর জ্ঞান আহরণের যাত্রা শুরু হয়। জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে আল্লাহ্ আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নূতন নূতন জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এই শেখার কোনও শেষ নাই। প্রত্যেক ব্যক্তি ব্যক্তিগত ভাবে, জাতি, জাতিগত ভাবে, মানুষের সভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রতি মূহুর্তে নূতন নূতন জ্ঞানকে অন্তরে শিক্ষা লাভ ও ধারণ করে থাকে। এ কথা পার্থিব জ্ঞানের পক্ষে যেরূপ সত্য, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পক্ষেও সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষের আত্মিক বিকাশও ধাপে ধাপে ক্রমোন্নতির পথে পরিচালিত হয়। সুতারাং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্ধতার স্থান নাই। মানুষ জ্ঞানের রাজ্যে কোথাও স্থবির হয়ে থাকবে আল্লাহ্র তা কাম্য নয়, কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, " শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতো না " ক্রমান্বয়ে।
৬২০৮। মানুষের সকল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মানসিক দক্ষতা সমূহ সকল কিছুই আল্লাহ্র দান। কারণ মানসিক দক্ষতা সমূহ, সৃজন ক্ষমতা, প্রতিভা এবং অন্যান্য নেয়ামত যা সে জন্মসূত্রে লাভ করে তা আল্লাহ্র দান। কিন্তু মানুষ এ সব নেয়ামত লাভ করার ফলে এতটাই অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে পড়ে যে, সে ভুলে যায় যে, তাঁর প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য, সম্পদ, ক্ষমতা, সৃজনক্ষমতা, ইত্যাদি বিভিন্ন নেয়ামত এ সব কিছুই তাকে দান করেছেন বিশ্বস্র্ষ্টা। এ সব অবদানের স্রষ্টা সে নিজে নয়। কিন্তু মানুষ আল্লাহকে ভুলে নিজেকেই সর্ব কৃতিত্বের দাবীদার মনে করে। আল্লাহ্র নেয়ামতকে মানুষ সনাক্ত করতে পারে না, ফলে সে হয়ে পড়ে সীমালংঘনকারী।
৬২০৯। উপরে বর্ণিত সীমালংঘনকারীরা নিজেকে সর্বেসর্বা অভাবমুক্ত মনে করে। তারা মনে করে তাদের সাফল্য তাদের একক বা দলগত ক্ষমতার ও কৃতিত্বের প্রকাশ। তারা এর পিছনে আল্লাহ্র কল্যাণকর হস্তের স্পর্শ উপলব্ধিতে অক্ষম। এ সব উদ্ধত অহংকারীকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মানুষকে আল্লাহ্ অত্যন্ত হীন বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন [ আলাক অর্থাৎ জমাট রক্ত পিন্ড থেকে ]। এটা হলো তার জীবনের পিছনের ইতিহাস, আর সামনের কাহিনী হচ্ছে তার কর্তব্য দায়িত্ব সম্বন্ধে আল্লাহ্র নিকট জবাবদিহিতা।
৬২১০। 'যে বাধা দেয়' সে ছিলো আবু জাহল। আবু জাহল ছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রু। সে দিনের শুরু করতো রাসুলের (সা) বিরুদ্ধে অত্যাচার ও নির্যাতনের পরিকল্পনা নিয়ে। শুধু রাসুল নয় তার এই নির্যাতনের খড়গ রাসুলের অনুসারীদের বিরুদ্ধেও নির্মমভাবে পরিচালিত হতো। সে রাসুল ও তাঁর অনুসারীদের কাবা প্রাঙ্গণে এবাদত করার পথে জঘণ্যতম বাঁধার সৃষ্টি করতো, যাতে তারা কাবা ঘরে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে না পারে। সে ছিলো অত্যন্ত একগুঁয়ে, অবাধ্য, উদ্ধত, অহংকারী, যার শেষ পরিণতি ঘটেছিলো বদর প্রাঙ্গণে।
এই আয়াতটির প্রেক্ষাপট উপরে বর্ণনা করা হলো, তবে এর উপদেশ সার্বজনীন। সর্ব কালে সর্বযুগের সত্যের প্রচারকদের জন্য এরূপ বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোকের সন্ধান পাওয়া যায় - যারা শুধু যে ব্যক্তিগত ভাবে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্র্রোহ করে তাই -ই নয়। তারা অন্যকেও আল্লাহ্র পথে যেতে বাঁধা প্রদান করে।
৬২১১। সীমালংঘনের প্রভাব বিবিধ। সীমালংঘন দ্বারা ১)- আত্মপ্রতারণার মাধ্যমে তারা নিজের আত্মাকেই ধ্বংস করে। ২) অপরের জন্য তারা মিথ্যা উদাহরণ স্থাপন করে থাকে। সুতারাং মোমেন বান্দাদের উপদেশ দান করা হয়েছে কোনও মানুষের উদাহরণকে অনুসরণ করার পূর্বে দুটি প্রশ্নের উত্তর সে পূর্বে লাভ করবে। প্রথম প্রশ্ন হবে, ১) সে কি সৎ পথ বা আল্লাহ্র পথ অবলম্বনকারী ? আল্লাহ্র প্রদর্শিত ন্যায় ও সত্যের পথই হচ্ছে সৎ পথ বা আল্লাহ্র পথ। যদি দেখা যায় তারা আল্লাহ্ প্রদর্শিত ন্যায় ও সত্যের পথকে অবহেলা ও ব্যঙ্গ করে তবে প্রথম প্রশ্নের উত্তর হবে ''না''। ২) দ্বিতীয় প্রশ্ন হবে, " সে কি ধর্ম প্রাণ ? " অর্থাৎ তাঁর জীবন তাকওয়া বা সৎকর্মের প্রতি নিবেদিত কি না। যদি তার চরিত্রে শ্বাসত সত্যের এই প্রতিফলন না ঘটে তবে তারা অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব নয়। মানুষ যুগে যুগে ব্যক্তিগত ভাবে, জাতিগত ভাবে ভুল ব্যক্তিত্বের উদাহরণ অনুসরণ করে থাকে। জাতিগত উদাহরণ দেয়া যেতে পারে বর্তমানকালে সোভিয়েত রাশিয়াতে লেনিনের আবির্ভাব। আবার ব্যক্তিগত ভাবে যুব সম্প্রদায় অনেক সময়েই মানবতার নামে, প্রগতিশীলতার নামে বা ধর্মের নামে নিবেদিত ভন্ডদের দ্বারা প্রতারিত হয়।উপরে দুটি প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমেই মানুষ খুঁজে পেতে পারে শ্বাসত সত্যের সন্ধান। যদি কেউ শুধু ধর্মের অনুশাসন পালন করে, কিন্তু সৎকর্মশীল না হয়, যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয় না সে প্রকৃত ধার্মিক নয়। আবার যে সৎ পথ বা ন্যায় ও সত্যের পথে নিবেদিত নয়, তার দ্বারা আল্লাহ্র প্রতি আন্তরিক নিবেদন সম্ভব নয়। তাঁর দ্বারা কৃত সৎ কাজ হবে আত্মপ্রচারের সামিল। যার দ্বারা মানবতার প্রকৃত উপকার সাধিত হবে না।
৬২১২। আল্লাহ্র প্রতি অবিশ্বাসী যারা তাদের বৈশিষ্ট্য হবে তারা সত্যকে অস্বীকার করবে এবং সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
৬২১৩। দেখুন [ ১১ : ৫৬ ] আয়াত ও টিকা ১৫৫১। "সম্মুখ ভাগের কেশগুচ্ছ " বাক্যটি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের সম্মান,এবং ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ মুকুট বা চুড়ান্ত প্রতীকার্থে বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেই মুকুট ধরে টেনে নেবার অর্থ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা অপমানিত করা।
৬২১৪। মোশরেক কোরাইশরা যারা কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত ছিলো, তারা আবু জহলের কাজের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলো। যদিও তারা আবু জহলের ন্যায় হযরতের প্রতি অত্যাচারে লাগাম ছাড়া ছিলো না। এই আয়াতে তাদের সকলকে আল্লাহ্ প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করেছেন যে তারা তাদের সমগ্র শক্তি দিয়ে আল্লাহ্র সত্যের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করুক, যদি তাদের ক্ষমতা থাকে।
৬২১৫। পাপের বা শয়তানের শক্তিকে পৃথিবীতে মনে হতে পারে অপারাজেয়। তবে পাপিষ্ঠদের এই সাফল্য ক্ষণস্থায়ী। তাদের সম্মিলিত শক্তি আল্লাহ্র শক্তির নিকট তৃণবৎ। আল্লাহ্র হুকুম পাওয়া মাত্র 'জাহান্নামের প্রহরীরা শয়তানের শক্তিকে দমন করবে এবং আল্লাহ্র অনুগতদের রক্ষা করবে ; এবং আল্লাহ্র রাস্তায় যারা অত্যাচারিত হবে, তাদের সমর্থন করবে।
৬২১৬। আল্লাহ্র প্রতি অনুগত যারা তাঁদের কোন ভয় নাই। তাঁর সম্মুখে শয়তান বাঁধার প্রাচীর সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু মোমেন বান্দা সে বাঁধাকে ভয় করে না, কারণ সে জানে স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর রক্ষাকর্তা। মোমেন বান্দার সর্বাপেক্ষা বড় প্রতিরক্ষা বুহ্য হচ্ছে তাঁর বিনয়। সে বিনয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পন করবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের জন্য সে অশ্রু বিগলিত বিনয়ে নিজেকে আত্মনিবেদন করবে। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের জন্য সে প্রাণপণে চেষ্টা করবে। মহাপ্রভু আল্লাহ্ মহাশক্তিধর। আল্লাহ্র শক্তি ও সত্ত্বা তাঁর সকল সৃষ্টিকে সর্বদা ঘিরে আছে। আল্লাহ্ আমাদের রক্তসঞ্চালনকারী ধমনীর থেকেও নিকটবর্তী। [ ৫০ : ১৬ ]। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ, নশ্বর দেহের আচরণে আবদ্ধ থাকার ফলে তা অনুভবে অসমর্থ। মানুষের পাপ কর্ম, রীপুর অসংযত আচরণ আমাদের আল্লাহ্র নৈকট্য অনুভবে বাঁধা দান করে। বিনয় এবং আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশের দ্বারা মানুষ উদ্ধত ও অহংকারী হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় একদিকে অপরপক্ষে, এর ফলে সে আল্লাহ্র অস্তিত্বের অনুভূতি আত্মার মাঝে উপলব্ধিতে সক্ষম হয়। যা তাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যোগ্য করে তুলবে। 'সিজ্দা কর' অর্থাৎ বিনয়ে বিগলিত হয়ে আল্লাহ্র নিকট মাথা নত করা। আল্লাহ্ বিশ্বজনীন উপদেশের মাধ্যমে এ কথাই ঘোষণা করেছেন যে মোমেন বান্দার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে বিনয়, যে বিনয় তাঁর জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিভাত হবে এবং শেষ পর্যন্ত তা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করবে।
সূরা ইক্রা
সূরা ইক্রা বা পড় অথবা ঘোষণা কর - ৯৬
অথবা আলাক্ বা জমাট রক্ত পিন্ড -৯৬১৯ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা ও সার সংক্ষেপ : ৪০ বৎসর বয়সে হেরা পর্বতের গুহায় সর্বপ্রথম তাঁর এই সূরার [ ১ - ৫ ] পাঁচটি আয়াত রাসুলের নিকট সরাসরি অবতীর্ণ হয় এটাই ছিলো প্রথম ওহী। এর পরে কয়েক মাস বা সম্ভবতঃ এক বছরের বিরতি [Fatra] ছিলো। সূরা নং ৬৮ কে বলা হয় এই পাঁচটি আয়াতের পরে অবতীর্ণ দ্বিতীয় ওহী। কিন্তু এই সূরার পরবর্তী অংশ [ ৯৬ : ৬ - ১৯] দীর্ঘ বিরতির পরে অবতীর্ণ হয়,এবং এই অংশকে পূর্বের পাঁচটি আয়াতের সাথে যুক্ত করা হয়, যেখানে আদেশ দান করা হয়েছে সত্য জ্ঞান প্রচারের জন্য। পরবর্তী অংশ সংযুক্ত করার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, এই সত্য ও জ্ঞানকে প্রচারের প্রধান বাঁধা হচ্ছে মানুষের একগুঁয়েমী,অহংকার এবং উদ্ধতপনা। দেখুন সূরা মুজাম্মিলের [ ৭৩ নং ] ভূমিকা।
সূরা ইক্রা বা পড় অথবা ঘোষণা কর - ৯৬
অথবা আলাক্ বা জমাট রক্ত পিন্ড -৯৬১৯ আয়াত, ১ রুকু, মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
১। পড় ! ৬২০৩। তোমার প্রভু এবং প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, ৬২০৪
৬২০৩। 'Iqraa' অর্থ পড় বা আবৃত্তি করা, অথবা ঘোষণা কর। এখানে আল্লাহ্র বাণী। পৃথিবীর দৃষ্টিকোণ থেকে রাসুল (সা) ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তাঁর হৃদয় ছিলো পরিপূর্ণ। এখন সময় হয়েছে সেই জ্ঞানের বাণী পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য প্রচার করার।
৬২০৪। কোরাণের সর্বপ্রথম আয়াত হচ্ছে এই আয়াতটি যার মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় আল্লাহ্র নাম। এই ঘোষণা রাসুলের (সা) জন্য কোন ব্যক্তিগত লাভ ছিলো না বরং আল্লাহ্র বাণী প্রচারের জন্য তাঁকে অমানুষিক অত্যাচার,নির্যাতন, দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আল্লাহ্র বাণী পৃথিবীতে প্রেরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথের সন্ধান দান করা। কোরাণের এই প্রথম আয়াতটিতে আল্লাহ্র উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের 'প্রতিপালক' রূপে। যার ফলে আল্লাহ্র সাথে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ ঘটে থাকে। মানুষের প্রতি আল্লাহ্র বাণী কোন বির্মূত ধ্যান ধারণা বা দার্শনিক তত্ব নয়। এ বাণী হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা ও প্রতিপালকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তাঁর সৃষ্টির সাথে, যে সৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন এবং প্রতিপালন করেন। "তোমার " শব্দটিকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায় :
১) শব্দটি রাসুলের (সা ) জন্য প্রযোজ্য হয়েছে। জিবরাইল ফেরেশতার সাথে তার সরাসরি যোগাযোগ ঘটে ; যাকে আল্লাহ্ রাসুলের (সা) নিকট প্রেরণ করেন। অথবা
২) তোমার শব্দটি দ্বারা সম্পূর্ণ মানব জাতিকে বুঝানো হয়েছে।
২। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত পিন্ড হতে ৬২০৫
৬২০৫। দেখুন [ ২৩ : ১৪ ] আয়াত। মানুষের জন্ম ইতিহাস অন্যান্য প্রাণীর জন্ম ইতিহাসের সমতুল্য যা অতি তুচ্ছ। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার বুদ্ধিমত্তা, নৈতিক মূল্যবোধ, ও আত্মিক বিকাশের মাধ্যমে উচ্চতর ও মহত্তর পরিণতি। মানুষকে আল্লাহ্ জ্ঞান দান করেছেন যার সাহায্যে সে উত্তোরতর উন্নতির পথে আরোহণ করে।
৩। পড় ! এবং তোমার প্রভু সুন্দরতম, -
৪। যিনি কলমের [ব্যবহার ] শিক্ষা দিয়েছেন, ৬২০৬
৪। যিনি কলমের [ব্যবহার ] শিক্ষা দিয়েছেন, ৬২০৬
৬২০৬। দেখুন [ ৬৮ : ১ ] আয়াতের টিকা নং ৫৫৯৩। এই সূরাতে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। 'পড়া ' 'কলম' ও 'জ্ঞান'। 'জ্ঞান' শব্দটিকে এ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ''শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যাহা সে জানিত না।" কারণ "শিক্ষা দান করা " ও "জ্ঞান" এই শব্দ দুটির মূল শব্দ একটাই। 'কলম' শব্দটি বই, লেখা, অধ্যয়ন,গবেষণা ইত্যাদির প্রতীক। 'জ্ঞান ' শব্দটি 'বিজ্ঞান', প্রজ্ঞা, সাধারণ জ্ঞান, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতীক এবং পড় বা 'ঘোষণা কর' শব্দটির অপর অর্থ নিজে পড়া ও অন্যকে জানানো। প্রকৃত পক্ষে শব্দগুলি এতটাই গভীর অর্থবোধক এবং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যে এগুলির সঠিক অনুবাদ এক কথায় করা প্রায় অসম্ভব। পড়া, শিক্ষা দান করা, কলম জ্ঞান ঘোষণা করা এই শব্দগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত শব্দ যা অর্কেষ্ট্রার ঐক্যতানের মত; আলাদা করে দেখার অবসর নাই।
' পাঠ কর ' বা 'ঘোষণা কর ' এই বাক্যটির অর্থ সার্বজনীন। যদিও রাসুলের (সা) প্রতি আয়াতটি সর্বপ্রথমে অবতীর্ণ করা হয়, কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে যে কোরাণের উপদেশ বিশ্বজনীন -স্থান-কাল ও সময়ের উর্দ্ধে। সুতারাং আল্লাহ্র বাণী সমূহ প্রচারের মহান দায়িত্ব শুধুমাত্র তার নবী ও রসুলদের এ কথা ঠিক নয়। এ দায়িত্ব তাদের সকলের যারা এই বাণীর মর্মার্থ ও গুঢ় অর্থ অনুধাবনে সক্ষম। কারণ Iqraa শব্দটি দ্বারা ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে বুঝানো হয় না। এর অর্থ সামগ্রিক, বিশ্বজনীন, কোরাণের বহু স্থানে এরূপ গভীর অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায় যা জ্ঞানীদের উপলব্ধির বিষয় বস্তু। প্রকৃত পক্ষে এই একটি 'পড়' শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ্র বিশ্বজনীন ঘোষণা হচ্ছে তাঁর কালামকে পড়তে হবে উপলব্ধির মাধ্যমে এবং সেই উপলব্ধি শুধুমাত্র নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ করে রাখলেই চলবে না ; তা করতে হবে বিশ্বজনীন প্রচার। রাসুলের (সা) মাধ্যমে এই-ই হচ্ছে সার্বজনীন উপদেশ।
৫। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না ৬২০৭।
৬২০৭। জন্মলগ্ন থেকে মানব শিশুর জ্ঞান আহরণের যাত্রা শুরু হয়। জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে আল্লাহ্ আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নূতন নূতন জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এই শেখার কোনও শেষ নাই। প্রত্যেক ব্যক্তি ব্যক্তিগত ভাবে, জাতি, জাতিগত ভাবে, মানুষের সভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রতি মূহুর্তে নূতন নূতন জ্ঞানকে অন্তরে শিক্ষা লাভ ও ধারণ করে থাকে। এ কথা পার্থিব জ্ঞানের পক্ষে যেরূপ সত্য, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পক্ষেও সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষের আত্মিক বিকাশও ধাপে ধাপে ক্রমোন্নতির পথে পরিচালিত হয়। সুতারাং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্ধতার স্থান নাই। মানুষ জ্ঞানের রাজ্যে কোথাও স্থবির হয়ে থাকবে আল্লাহ্র তা কাম্য নয়, কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, " শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতো না " ক্রমান্বয়ে।
৬। না, মানুষ তো সকল সীমা লংঘন করে থাকে, ৬২০৮
৭। কারণ সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে।
৭। কারণ সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে।
৬২০৮। মানুষের সকল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মানসিক দক্ষতা সমূহ সকল কিছুই আল্লাহ্র দান। কারণ মানসিক দক্ষতা সমূহ, সৃজন ক্ষমতা, প্রতিভা এবং অন্যান্য নেয়ামত যা সে জন্মসূত্রে লাভ করে তা আল্লাহ্র দান। কিন্তু মানুষ এ সব নেয়ামত লাভ করার ফলে এতটাই অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে পড়ে যে, সে ভুলে যায় যে, তাঁর প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য, সম্পদ, ক্ষমতা, সৃজনক্ষমতা, ইত্যাদি বিভিন্ন নেয়ামত এ সব কিছুই তাকে দান করেছেন বিশ্বস্র্ষ্টা। এ সব অবদানের স্রষ্টা সে নিজে নয়। কিন্তু মানুষ আল্লাহকে ভুলে নিজেকেই সর্ব কৃতিত্বের দাবীদার মনে করে। আল্লাহ্র নেয়ামতকে মানুষ সনাক্ত করতে পারে না, ফলে সে হয়ে পড়ে সীমালংঘনকারী।
৮। তোমার প্রভুর নিকট [ সকলের ] প্রত্যাবর্তন হবে সুনিশ্চিত। ৬২০৯
৬২০৯। উপরে বর্ণিত সীমালংঘনকারীরা নিজেকে সর্বেসর্বা অভাবমুক্ত মনে করে। তারা মনে করে তাদের সাফল্য তাদের একক বা দলগত ক্ষমতার ও কৃতিত্বের প্রকাশ। তারা এর পিছনে আল্লাহ্র কল্যাণকর হস্তের স্পর্শ উপলব্ধিতে অক্ষম। এ সব উদ্ধত অহংকারীকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মানুষকে আল্লাহ্ অত্যন্ত হীন বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন [ আলাক অর্থাৎ জমাট রক্ত পিন্ড থেকে ]। এটা হলো তার জীবনের পিছনের ইতিহাস, আর সামনের কাহিনী হচ্ছে তার কর্তব্য দায়িত্ব সম্বন্ধে আল্লাহ্র নিকট জবাবদিহিতা।
৯। তুমি কি তাকে দেখেছ, যে বাঁধা দেয় ৬২১০
১০। এক বান্দাকে, বাঁধা দেয় যখন সে সালাত আদায় করে ?
১০। এক বান্দাকে, বাঁধা দেয় যখন সে সালাত আদায় করে ?
৬২১০। 'যে বাধা দেয়' সে ছিলো আবু জাহল। আবু জাহল ছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রু। সে দিনের শুরু করতো রাসুলের (সা) বিরুদ্ধে অত্যাচার ও নির্যাতনের পরিকল্পনা নিয়ে। শুধু রাসুল নয় তার এই নির্যাতনের খড়গ রাসুলের অনুসারীদের বিরুদ্ধেও নির্মমভাবে পরিচালিত হতো। সে রাসুল ও তাঁর অনুসারীদের কাবা প্রাঙ্গণে এবাদত করার পথে জঘণ্যতম বাঁধার সৃষ্টি করতো, যাতে তারা কাবা ঘরে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে না পারে। সে ছিলো অত্যন্ত একগুঁয়ে, অবাধ্য, উদ্ধত, অহংকারী, যার শেষ পরিণতি ঘটেছিলো বদর প্রাঙ্গণে।
এই আয়াতটির প্রেক্ষাপট উপরে বর্ণনা করা হলো, তবে এর উপদেশ সার্বজনীন। সর্ব কালে সর্বযুগের সত্যের প্রচারকদের জন্য এরূপ বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোকের সন্ধান পাওয়া যায় - যারা শুধু যে ব্যক্তিগত ভাবে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্র্রোহ করে তাই -ই নয়। তারা অন্যকেও আল্লাহ্র পথে যেতে বাঁধা প্রদান করে।
১১। তুমি লক্ষ্য করেছ কি ৬২১১ যদি সে সৎপথে থাকে ? -
১২। অথবা ধর্মপ্রাণ হতে নির্দ্দেশ দেয় ?
১২। অথবা ধর্মপ্রাণ হতে নির্দ্দেশ দেয় ?
৬২১১। সীমালংঘনের প্রভাব বিবিধ। সীমালংঘন দ্বারা ১)- আত্মপ্রতারণার মাধ্যমে তারা নিজের আত্মাকেই ধ্বংস করে। ২) অপরের জন্য তারা মিথ্যা উদাহরণ স্থাপন করে থাকে। সুতারাং মোমেন বান্দাদের উপদেশ দান করা হয়েছে কোনও মানুষের উদাহরণকে অনুসরণ করার পূর্বে দুটি প্রশ্নের উত্তর সে পূর্বে লাভ করবে। প্রথম প্রশ্ন হবে, ১) সে কি সৎ পথ বা আল্লাহ্র পথ অবলম্বনকারী ? আল্লাহ্র প্রদর্শিত ন্যায় ও সত্যের পথই হচ্ছে সৎ পথ বা আল্লাহ্র পথ। যদি দেখা যায় তারা আল্লাহ্ প্রদর্শিত ন্যায় ও সত্যের পথকে অবহেলা ও ব্যঙ্গ করে তবে প্রথম প্রশ্নের উত্তর হবে ''না''। ২) দ্বিতীয় প্রশ্ন হবে, " সে কি ধর্ম প্রাণ ? " অর্থাৎ তাঁর জীবন তাকওয়া বা সৎকর্মের প্রতি নিবেদিত কি না। যদি তার চরিত্রে শ্বাসত সত্যের এই প্রতিফলন না ঘটে তবে তারা অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব নয়। মানুষ যুগে যুগে ব্যক্তিগত ভাবে, জাতিগত ভাবে ভুল ব্যক্তিত্বের উদাহরণ অনুসরণ করে থাকে। জাতিগত উদাহরণ দেয়া যেতে পারে বর্তমানকালে সোভিয়েত রাশিয়াতে লেনিনের আবির্ভাব। আবার ব্যক্তিগত ভাবে যুব সম্প্রদায় অনেক সময়েই মানবতার নামে, প্রগতিশীলতার নামে বা ধর্মের নামে নিবেদিত ভন্ডদের দ্বারা প্রতারিত হয়।উপরে দুটি প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমেই মানুষ খুঁজে পেতে পারে শ্বাসত সত্যের সন্ধান। যদি কেউ শুধু ধর্মের অনুশাসন পালন করে, কিন্তু সৎকর্মশীল না হয়, যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয় না সে প্রকৃত ধার্মিক নয়। আবার যে সৎ পথ বা ন্যায় ও সত্যের পথে নিবেদিত নয়, তার দ্বারা আল্লাহ্র প্রতি আন্তরিক নিবেদন সম্ভব নয়। তাঁর দ্বারা কৃত সৎ কাজ হবে আত্মপ্রচারের সামিল। যার দ্বারা মানবতার প্রকৃত উপকার সাধিত হবে না।
১৩। তুমি লক্ষ্য করেছ কি,যদি সে [ সত্যকে ] অস্বীকার করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয় ? ৬২১২
৬২১২। আল্লাহ্র প্রতি অবিশ্বাসী যারা তাদের বৈশিষ্ট্য হবে তারা সত্যকে অস্বীকার করবে এবং সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
১৪। তবে সে কি জানে না যে, আল্লাহ্ [ সব ] দেখেন ?
১৫। সাবধান ! সে যদি বিরত না হয়, আমি তাকে কপালের কেশগুচ্ছ ধরে অবশ্যই টেনে নিয়ে যাব, ৬১১৩
১৬। মিথ্যাবাদী, পাপিষ্ঠের কপালের কেশগুচ্ছ !
১৫। সাবধান ! সে যদি বিরত না হয়, আমি তাকে কপালের কেশগুচ্ছ ধরে অবশ্যই টেনে নিয়ে যাব, ৬১১৩
১৬। মিথ্যাবাদী, পাপিষ্ঠের কপালের কেশগুচ্ছ !
৬২১৩। দেখুন [ ১১ : ৫৬ ] আয়াত ও টিকা ১৫৫১। "সম্মুখ ভাগের কেশগুচ্ছ " বাক্যটি প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের সম্মান,এবং ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ মুকুট বা চুড়ান্ত প্রতীকার্থে বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেই মুকুট ধরে টেনে নেবার অর্থ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা অপমানিত করা।
১৭। অতএব, [ সাহায্যের ] জন্য সে যেনো তার পরামর্শদাতাদের ডেকে আনে ৬২১৪
৬২১৪। মোশরেক কোরাইশরা যারা কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত ছিলো, তারা আবু জহলের কাজের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলো। যদিও তারা আবু জহলের ন্যায় হযরতের প্রতি অত্যাচারে লাগাম ছাড়া ছিলো না। এই আয়াতে তাদের সকলকে আল্লাহ্ প্রতিদ্বন্দিতায় আহ্বান করেছেন যে তারা তাদের সমগ্র শক্তি দিয়ে আল্লাহ্র সত্যের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করুক, যদি তাদের ক্ষমতা থাকে।
১৮। আমিও আহ্বান করবো জাহান্নামের ফেরেশতাদের [ তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য ] ৬২১৫।
৬২১৫। পাপের বা শয়তানের শক্তিকে পৃথিবীতে মনে হতে পারে অপারাজেয়। তবে পাপিষ্ঠদের এই সাফল্য ক্ষণস্থায়ী। তাদের সম্মিলিত শক্তি আল্লাহ্র শক্তির নিকট তৃণবৎ। আল্লাহ্র হুকুম পাওয়া মাত্র 'জাহান্নামের প্রহরীরা শয়তানের শক্তিকে দমন করবে এবং আল্লাহ্র অনুগতদের রক্ষা করবে ; এবং আল্লাহ্র রাস্তায় যারা অত্যাচারিত হবে, তাদের সমর্থন করবে।
১৯। না, তুমি তার অনুসরণ করো না ; বরং ভক্তিভরে সিজ্দা কর এবং [আল্লাহ্র ] নিকটবর্তী হতে চেষ্টা কর। ৬২১৬
৬২১৬। আল্লাহ্র প্রতি অনুগত যারা তাঁদের কোন ভয় নাই। তাঁর সম্মুখে শয়তান বাঁধার প্রাচীর সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু মোমেন বান্দা সে বাঁধাকে ভয় করে না, কারণ সে জানে স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর রক্ষাকর্তা। মোমেন বান্দার সর্বাপেক্ষা বড় প্রতিরক্ষা বুহ্য হচ্ছে তাঁর বিনয়। সে বিনয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পন করবে। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের জন্য সে অশ্রু বিগলিত বিনয়ে নিজেকে আত্মনিবেদন করবে। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের জন্য সে প্রাণপণে চেষ্টা করবে। মহাপ্রভু আল্লাহ্ মহাশক্তিধর। আল্লাহ্র শক্তি ও সত্ত্বা তাঁর সকল সৃষ্টিকে সর্বদা ঘিরে আছে। আল্লাহ্ আমাদের রক্তসঞ্চালনকারী ধমনীর থেকেও নিকটবর্তী। [ ৫০ : ১৬ ]। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ, নশ্বর দেহের আচরণে আবদ্ধ থাকার ফলে তা অনুভবে অসমর্থ। মানুষের পাপ কর্ম, রীপুর অসংযত আচরণ আমাদের আল্লাহ্র নৈকট্য অনুভবে বাঁধা দান করে। বিনয় এবং আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশের দ্বারা মানুষ উদ্ধত ও অহংকারী হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় একদিকে অপরপক্ষে, এর ফলে সে আল্লাহ্র অস্তিত্বের অনুভূতি আত্মার মাঝে উপলব্ধিতে সক্ষম হয়। যা তাকে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের যোগ্য করে তুলবে। 'সিজ্দা কর' অর্থাৎ বিনয়ে বিগলিত হয়ে আল্লাহ্র নিকট মাথা নত করা। আল্লাহ্ বিশ্বজনীন উপদেশের মাধ্যমে এ কথাই ঘোষণা করেছেন যে মোমেন বান্দার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে বিনয়, যে বিনয় তাঁর জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিভাত হবে এবং শেষ পর্যন্ত তা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের যোগ্যতা অর্জন করবে।