Logo

খোঁজ করুন

পাঠক

অনলাইনে আছেন ৫ জন
আজকের পাঠক ৬৪ জন
সর্বমোট পাঠক ১৩৬৫৪০৭ জন
সূরা পাঠ হয়েছে ৬২৩০৬৮ বার
+ - R Print

সূরা বাইয়ানা


সূরা বাইয়ানা বা সুস্পষ্ট প্রমাণ - ৯৮

৮ আয়াত, ১ রুকু, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

ভূমিকা ও সার সংক্ষেপ : এই সূরাটি সম্ভবতঃ প্রাথমিক মাদানী সূরা অথবা শেষদিকে অবতীর্ণ মক্কী সূরা।

এই সূরার বিষয়বস্তু পূর্বের সূরার ধারাবাহিকতা স্বরূপ। কদরের রাত্রি প্রকৃতপক্ষেই মানুষের জন্য রহমত স্বরূপ। কিন্তু যারা সত্যকে প্রত্যাখান করে ; আল্লাহ্‌র বাণী তাদের হৃদয়ে কোন রেখাপাত করতে পারে না। এ বাণীর স্বপক্ষে যত যুক্তিই থাকুক না কেন, বক্তব্য যত সুষ্পষ্টই হোক না কেন তা সত্য প্রত্যাখানকারীদের হৃদয়ে রেখাপাত করে না ; সত্যের আলোর প্রবেশ ঘটে না।


সূরা বাইয়ানা বা সুস্পষ্ট প্রমাণ - ৯৮

৮ আয়াত, ১ রুকু, মাদানী
[দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে ]

১। কিতাবীদের ৬২২১ মধ্যে এবং মুশরিকদের মধ্যে ৬২২২ যারা [ সত্যকে] অস্বীকার করেছিলো, তারা [তাদের পথ ] পরিত্যাগ করবে না,যতক্ষণ না তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসবে ৬২২৩

৬২২১। কিতাবী জাতি দ্বারা ইহুদী ও খৃশ্চিয়ানদের বুঝানো হয়েছে। এই দুই জাতিই আল্লাহ্‌র কিতাব লাভ করে এবং তাঁদের নবুয়তের ধারাতেই শেষ নবীর আগমন ঘটে। তাদের শেষ নবীর আগমন বার্তা পূর্বাহ্নেই দান করা হয়েছে। ইহুদীদের কিতাবে বলা হয়েছে, " যে হযরত মুসার ন্যায় রাসুল প্রেরণ করা হবে। "The Lord thy God will raise up unto thee a prophet from the midst of thee , of thy brethren, like unto me, unto ye shall hearken." [Deut xviii : 15]। হযরত ঈসা শেষ নবীর আগমন উল্লেখ করে তাঁর নাম পর্যন্ত বলেছেন। [John xiv : 16 ; xv : 26 and xv : 7]। দেখুন কোরাণের [ ৬১ : ৬ ] আয়াতের টিকা ৫৪৩৮। কিতাবী জাতিরা তাদের কিতাবের শিক্ষাকে ভুলে গিয়েছিলো ফলে তারা ধর্মের সাধারণ সত্যগুলি থেকে দূরে সরে যায় এবং বিভ্রান্তির বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে। তারা তাদের ভ্রান্ত পথকে ত্যাগ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কিতাবে বর্ণিত অঙ্গীকারের রাসুল তাদের মাঝে আবির্ভূত হন। কিন্তু যখন প্রতিশ্রুত নবী হযরত মুহম্মদ (সা) এর আগমন ঘটলো পৃথিবীতে, তারা তাঁকে প্রত্যাখান করলো। কারণ তারা কখনও প্রকৃত সত্যের অন্বেষণ করে নাই। তারা নিজেদের মনগড়া, তত্ব ও তথ্য নিয়েই খুশী ছিলো।

মন্তুব্যঃ নৈতিক অবক্ষয় ও সত্য বিচ্যুতির কবল থেকে রক্ষা কল্পে মানুষের চারিদিকে যে আবেস্টন সৃষ্টি বা প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে, তাকেই ধর্ম বলা হয়। কিন্তু যারা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, তারা ধর্মের মূল বিষয়কে ত্যাগ করে সংস্কার ও আনুষ্ঠানিকতার উপরে অধিক গুরুত্ব আরোপ করে এবং একেই ধর্ম বলে মনে করে। কারণ তা তাদের নিজস্ব ইচ্ছা এবং প্রাধান্যকে স্বীকৃতি দেয়।

৬২২২। প্যাগান আরবদের মুশরিক বলা হয়েছে। এরা পূর্বাহ্নে কোনরূপ কিতাব প্রাপ্ত হয় নাই। কিন্তু তাদের নিকট যখন সুস্পষ্ট প্রমাণ উত্থাপন করা হলো, তাদের উচিত ছিলো বিশ্বাস করা। কিন্তু তা না করে তারা মহানবীকে ও তাঁর শিক্ষাকে প্রত্যাখান করে। কারণ তারাও প্রকৃত সত্যের সন্ধানী ছিলো না। তারাও ছিলো নিজস্ব ধ্যান ধারণার পূঁজারী।

৬২২৩। সুস্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা পবিত্র মহানবীকে বুঝানো হয়েছে। শেষ নবীর ব্যক্তিত্ব,চরিত্র, শিক্ষা কর্মজীবন সব কিছুই হচ্ছে তাঁর নবুয়তের সুস্পষ্ট প্রমাণ।

২। আল্লাহ্‌র নিকট থেকে এক রাসুল, যে আবৃত্তি করে, পূত পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। ৬২২৪, ৬২২৫

৬২২৪। দেখুন [ ২ : ১৫১ ] আয়াত।

৬২২৫। দেখুন [ ৮০ : ১৩ - ১৬ ] আয়াত।

৩। সেখানে আছে সঠিক বিধান। ৬২২৬

৬২২৬। 'Qaiyim' এই শব্দটি যে ভাবের প্রকাশ করে তা হলো : বক্রতার বিপরীতে সোজা, নিয়মবর্হিভূতের বিপরীত ভাব হলো আদর্শ, অস্থায়ী ও সাময়িকের বিপরীত ভাব চিরস্থায়ী ইত্যাদি। দেখুন সূরা [ ৯ : ৩৬ ] ; [ ১২ : ৪০ ] ইত্যাদি আয়াত সমূহ।

৪। যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিলো, তারা তো [ ধর্মে ] বিভক্ত হলো তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর। ৬২২৭

৬২২৭। মোশরেক আরবদের অপেক্ষা কিতাবী জাতিদের দায়িত্ব অনেক বেশী। কারণ আল্লাহ্‌ তাদের পূর্বাহ্নেই প্রত্যাদেশ বা কিতাবের দ্বারা সহজ সরল পথের নির্দ্দেশনা দান করেছেন এবং আদর্শ ধর্মের প্রতি আহ্বান করেছেন এবং সেই ধর্মের উপযুক্ত হওয়ার শিক্ষা দান করেছেন। কিন্তু তবুও যখন সুস্পষ্ট প্রমাণ এলো অর্থাৎ বিশ্বনবীর মাধ্যমে ইসলামের আবির্ভাব ঘটলো,এ সব কিতাবী জাতিরাই অধিক বাঁধার সৃষ্টি করেছিলো। এই সহজ, সরল এবং আদর্শ ধর্ম কি যা সকল অস্পষ্টতা, অসাড় আনুষ্ঠানিকতা দূর করেছিলো ? এই ধর্মের মূল বিষয়কে তিনটি মুল নীতির মাধ্যমে পরবর্তী আয়াতে উপস্থাপন করা হয়েছে যা শ্বাসত সত্য। দেখুন পরবর্তী টিকা।

৫। তাদের এ ব্যতীত আর কিছু আদেশ দেয়া হয় নাই ৬২২৮, যে তারা একান্ত অনুগত ভাবে সত্য [ বিশ্বাসে ] ৬২২৯ আল্লাহ্‌র এবাদত করবে; নিয়মিত নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দেবে এবং এটাই হলো সঠিক ও সরল দ্বীন। ৬২৩০

৬২২৮। ইসলামের তিনটি শ্বাসত মূলনীতি হলো :

১) বিশুদ্ধ চিত্তে বিশ্বস্ততার সাথে একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহ্‌র 'এবাদত ' করা।

২) সালাত কায়েম করা ও

৩) যাকাত দান করা।

উপরের তিনটি দিক নির্দ্দেশনা ইসলামের মূল ভিত্তি। ১) প্রথমটিতে বলা হয়েছে 'এবাদত ' করতে আনুগত্যের সাথে বিশুদ্ধ চিত্তে। এবাদত শব্দের অর্থ অনেক ব্যপক। এবাদত অর্থাৎ আল্লাহ্‌ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা, যা করতে আদেশ দিয়েছেন তা পালন করা। অর্থাৎ আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। আত্মার বিশুদ্ধতার জন্য দেখুন [ ৮০ : ৩ ] ; [৯১ : ৯-১০] আয়াত সমূহ। রোজা হচ্ছে আত্মসংযমের অন্যতম প্রধান উপায়। আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি সম্ভব। সুতারাং ইসলামের অন্যতম পিলার হচ্ছে রোজা।

সালাতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নৈকট্য অন্বেষণ করা হয়, যাকে বলা হয় ইসলামের অন্যতম পিলার।

যাকাত হচ্ছে বাধ্যতামূলক দান বা সৎ কাজ ইসলামের অন্যতম পিলার। যাকাত ছাড়াও ইসলাম সৎকাজে উৎসাহিত করে থাকে। ঈমানের আলো ব্যক্তির চরিত্রে ও ব্যক্তিত্বে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে উপরের তিনটি প্রধান নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে।

ইসলাম ৫ টি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত যথা : ১) ঈমান বা আল্লাহ্‌র একত্বের প্রতি অটল বিশ্বাস, ২) সালাত, ৩) রোজা,৪) যাকাত ৫) হজ্ব [ সামর্থ অনুযায়ী ]।

রোজা - আত্মশুদ্ধির প্রতীক [৯১ : ৫ - ৭ ] ; [ ৮০ : ৩ ]। আত্মসংযম ও সততা হবে তাকওয়ার মানদন্ড। দেখুন [৮৭: ১৪] ও টিকা ৬০৯২।

সালাত - আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভের উপায়।

যাকাত - সৎ কাজের প্রতীক।

হজ্ব - বিশ্ব মুসলিম ভাতৃত্বের বা উম্মার প্রতীক যা সামর্থের উপরে নির্ভরশীল।

এই -ই হচ্ছে সহজ, সরল ধর্ম।

৬২২৯। 'Hanif' দেখুন [ ২ : ১৩৫ ] আয়াতের টিকা ১৩৪।

৬২৩০। দেখুন উপরের টিকা ৬২২৬।

৬। কিতাবধারী ও মুশরেকদের মধ্যে যারা [ সত্যকে ] প্রত্যাখান করে, এরাই জাহান্নামের অগ্নিতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করবে। সৃষ্টির মাঝে ওরা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব। ৬২৩১

৬২৩১। আল্লাহ্‌র মানুষকে ভালো -মন্দ, সত্য মিথ্যা, ন্যায় -অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা দান করেছেন। এই ক্ষমতা থাকা সত্বেও যদি কেউ ন্যায় ও সত্যকে প্রত্যাখান করে এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অপব্যবহার করে, তবে সে পশুরও অধম। প্রতিটি কাজেরই কর্মফল বিদ্যমান। তাদেরও এই স্বেচ্ছাচারিতার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে হোক না তারা ইব্রাহীমের অনুসারী বা পোপ বা যাজক শ্রেণীকে অর্থ দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া ব্যক্তি, বা নাস্তিক বা মোশরেক আরব। আল্লাহ্‌র চোখে বংশ বা কূল বা জাতির বা বর্ণের কোন পক্ষপাতিত্ব নাই। আল্লাহ্‌ নিকট সেই সর্বাপেক্ষা সম্মানীয় যে সৎ চরিত্রের অধিকারী ও সৎগুণসম্পন্ন ব্যক্তি।

৭। যাদের ঈমান আছে ও সৎ কাজ করে, সৃষ্টির মধ্যে তারা সর্বোৎকৃষ্ট জীব। ৬২৩২

৬২৩২। এই আয়াতটি পূর্বের আয়াতের বিপরীত ভাবকে প্রকাশ করে। মানুষের মধ্যে যারা আল্লাহ্‌র একত্বে বিশ্বাসী এবং সৎ কর্মশীল, তারাই তাদের পৃথিবীর শিক্ষানবীশকালকে সফলতার সাথে অতিক্রম করতে পারে। তাদের মনুষ্য জীবন সার্থক।

৮। তাদের পুরষ্কার আছে আল্লাহ্‌র নিকটে - অনন্ত জান্নাত, পাদদেশে যার নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরদিন বাস করবে। আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও তাঁর প্রতি ৬২৩৩। এগুলি তাদেরই জন্য যারা তাদের আপন প্রভু ও প্রতিপালককে ভয় করে ৬২৩৪।

৬২৩৩। মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে এই সন্তুষ্টি পারস্পরিক। সেই সর্বাপেক্ষা ভাগ্যবান এবং তারই আত্মা পার্থিব চাওয়া পাওয়ার উপরে উঠে মুক্তি লাভে সক্ষম হবে যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন করবে।

৬২৩৪। আল্লাহকে ভয় করার অর্থ, আল্লাহ্‌র আইন ভংগ করে আল্লাহ্‌কে অসন্তুষ্ট করার ভয় এবং এমন কিছু করা যা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় এবং আল্লাহ্‌র ক্রোধের ভয় বা আল্লাহ্‌র ভালোবাসা হারানোর ভয়। এরূপ ভয় হচ্ছে ভালোবাসারই প্রতিরূপ। কারণ প্রিয়জনের মনঃকষ্ট ও ভালোবাসা হারানোর ভয়ে তারা থাকেন ব্যকুল, শাস্তির ভয়ে নয়। এ ভাবেই তাদের হৃদয়ে আল্লাহ্‌র কল্যাণ ও মঙ্গল স্পর্শের সচেতনতা সৃষ্টি হয় যা বান্দার জন্য অমূল্য সম্পদ।